What's new
Nirjonmela Desi Forum

Talk about the things that matter to you! Wanting to join the rest of our members? Feel free to sign up today and gain full access!

Collected কালবেলা- সমরেশ মজুমদার (1 Viewer)

গ্র্যাণ্ড হোটেলে সে কখনও আসেনি কিংবা সে সুযোগই হয়নি। চৌরঙ্গী দিয়ে যেতে যেতে অনেক দিন সে ওদিকে তাকিয়েছে। একজন দীর্ঘদেহী পাঞ্জাবী দারোয়ান দরজায় দাঁড়িয়ে থাকে তার পাশের গালচে বিছানো আলো ঝলমল প্যাসেজ দিয়ে।

সুবেশ মানুষরা যাতায়াত করেন। মধ্যবিত্ত বাঙ্গালীদের মতন ওরও মনে হতো ভেতরটা নিশ্চয়ই রহস্যময়। আজ সেই প্যাসেজ দিয়ে হাটবার সময় সে অকারণেই স্মার্ট হতে চাইল। ড্রাইভারই তাকে বলে দিয়েছে ছোট কাকার স্যুট নম্বর। কয়েকজন বিদেশী নারী পুরুষ হাসতে হাসতে তার পাশ দিয়ে চলে গেল। রিসেপসনে হদিস নিয়ে অনিমেষ ওপরে উঠে এল।

এই কলকাতা শহরের বুকেই এমন টিপটপ সাহেবী পরিবেশ অনিমেষের জানা ছিল না। মিছিল শ্লোগান অভাব দৈন্যতার বাইরে ইংরেজী ছবির মত ছিমছাম আবহাওয়ায় হাঁটতে হাঁটতে অনিমেষ নির্দিষ্ট নম্বরের সামনে এসে কপালের ঘাম মুছল। ঘর নয়, একটা পুরো স্যুট নিয়ে আছেন ছোট কাকা। নিশ্চয়ই প্রচুর অর্থ লাগছে এ জন্যে। অথচ দাদু জলপাইগুড়িতে, ব্যাপারটা মনে পড়তেই শক্ত হয়ে গেল অনিমেষ। না, আজকে এসব চিন্তা করবে না সে। দেখা করতে এসেছে দেখা করেই চলে যাবে।

বেল টিপতেই দরজা খুলে গেল। খুব সামান্য সময়, কিন্তু ছোট কাকাকে চিনতে পারল অনিমেষ। প্রচুর পরিবর্তন হয়ে গেছে চেহারার। একটু রোগাটে অথচ ছিমছাম শরীর। ঠোঁটের ওপর বেশ ঝোলা গোঁফ, মাথার চুল পাতলা কিন্তু যথেষ্ট লম্বাটে। চিনতে দেরী হওয়ার কারণ গোঁফ এবং চুলের রঙ লালচে আর গায়ের রঙ এত ফরসা যে চট করে বিদেশী বলে ভুল হতে পারে। সুন্দর একটা গন্ধ আসছে ওর শরীর থেকে। অনিমেষ প্রণাম করবে কিনা বুঝতে না পেরে বলল, কেমন আছেন?

ছোট কাকার মুখ এতক্ষণ অপরিচয়ের আড়াল সরাবার চেষ্টায় ছিল। কিন্তু তার কণ্ঠস্বর শোনা মাত্রই দু হাতে ওর কাধ ধরে চেঁচিয়ে উঠলেন আরিব্বাস অনি, তুই কত বড় হয়ে গেছিস। একদম অ্যাডালটা? আরে রাস্তায় দেখলে তো আমি চিনতেই পারতাম না। আয় আয় ভেতরে আয়। দুহাতে জড়িয়ে ধরে তাকে ঘরে ঢোকালেন ছোট কাকা।

ওঁর স্পর্শে অনিমেষ একটু আড়ষ্ট হল; এভাবে অনেকদিন তাকে কেউ জড়িয়ে ধরেনি এবং ছোট কাকার শরীর থেকে এমন মূল্যবান গন্ধ বের হচ্ছে যাতে সে অভ্যস্ত নয়।

ঘরটা বেশ বড়। সুন্দর করে সাজানো। একটি মানুষ যত রকমের আরামের উপকরণ না পেলে বিরক্ত হবে তার সবগুলিই আছে। অনিমেষ ঘরে আর তিনজন মানুষকে দেখতে পেল। একবার তাকানোতেই মনে হচ্ছিল তাদের মধ্যে একজনকে খুব চেনা চেনা মনে হচ্ছে। কিন্তু ছোট কাকার উচ্ছাস তাকে এত বিব্রত করছিল যে কিছু ভাবার সুযোগই পাচ্ছিল না। ছোট কাকা এখন ওর পাশে দাঁড়িয়ে বলছেন, আরে অনি তুই আমাকে ছাড়িয়ে গেছিস লম্বায়? এই সেদিন জন্মালি, আঃ সময়টা এত দ্রুত চলে যাচ্ছে যে তাল রাখা মুশকিল। দেখি তোর চেহারাটা কেমন হয়েছে। হুম, গুড, দাড়ি রেখেছিস কেন? কারণ শুধু রাখলেই হল না, ওটার একটু যত্ন আত্তিও দরকার। এখন কি পড়ছিস যেন!

এবার এম. এ. দেব। অনিমেষ কথাটা বলতেই প্রিয়তোষের চোখ কপালে উঠে গেল যেন এ্যা এম.এ.? নো দেন য়ু আর কোয়াইট এ্যাডালট। নাঃ তোকে দেখে মনে হচ্ছে আমি এবার বুড়ো হয়ে যাবো।

ছোট কাকা শিশুর মত ওর হাত ধরে কথা বলছিলেন। অনিমেষ ইচ্ছের বিরুদ্ধেই ওর সম্পর্কে নরম হতে লাগল। এই আচরণ, যদি আন্তরিক না হয় তাহলে মানুষ সম্পর্কে কখনোই কারো বিশ্বাস করার কারণ নেই। হঠাৎ ছোট কাকা অপেক্ষারত তিনজনের দিকে তাকিয়ে বললেন, আমাকে ক্ষমা করবেন। এ হল আমার ভাইপো। দীর্ঘকাল বাদে ওকে আমি দেখলাম। ন্যাচারালি।
 
সঙ্গে সঙ্গে তিনজন মানুষ প্রায় একই সঙ্গে বলে উঠলেন, ঠিক আছে ঠিক আছে। ছোট কাকা বললেন, আপনারা আমাকে মিনিট দশকে সময় দেবেন? আমি ওর সঙ্গে কয়েকটা কথা সেরে নিচ্ছি।

না, আপনাদের উঠতে হবে না, আমরা পাশের ঘরে যাচ্ছি। ততক্ষণ কিছু ড্রিংক বলছি আপনাদের জন্যে। টেলিফোন তুলে রুমসার্ভিসকে নির্দেশ দিয়ে ছোট কাকা ওকে নিয়ে পাশের ঘরে ঢুকলেন। ওকে এখন খুব স্বচ্ছন্দ দেখাচ্ছে।

এটি শোওয়ার ঘর। অমন লোভনীয় বিছানা অনিমেষ কখনো দ্যাখেনি। এক পাশে সুন্দর বেঁটে খাটো সোফাসেট। ছোট কাকার সঙ্গে সেখানে বসল অনিমেষ। অনিমেষ দেখল ছোট কাকা ওর দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছেন। চোখাচোখি হতেই বললেন, একদিন আমি তোর মতন ছিলাম!

খুবই স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বলা কিন্তু অনিমেষের অস্বস্তি হল। সে বলল, আপনি কবে এসেছেন কলকাতায়?

গতকাল। তোর হোস্টেলে গিয়েছিলাম। কত রাতে ফিরিস?

কাল একটু দেরী হয়েছিল।

নো নো আমি কিছু মনে করছি না এ জন্যে, দেরী করে ফেরার বয়স তো এটাই। এবার কলকাতায় এসে আমার একটাই অভিজ্ঞতা হল তুই বড় হয়ে গেছিস। প্রেম করছিস?

আচমকা প্রশ্নটা শুনে অনিমেষ লাল হয়ে গেল কোন রকমে বলল, কি যে বলেন! ছোট কাকা তখনও হাসছেন দেখে কথা ঘোরাতে জিজ্ঞাসা করল, আমার ঠিকানা কোত্থেকে পেলেন?

ছোট কাকা হাত নাড়লেন সেটাও বেশ কাকতালীয়। অনেকদিন আগে জলপাইগুড়ি থেকে বাবার চিঠি পেয়েছিলাম। দ্যাট ওয়াজ লাস্ট ওয়ান। তাতে জেনেছিলাম তুই কলকাতায় স্কটিশে ভরতি হয়েছিস। এখানে এসে সে কথা মনে পড়তেই স্কটিশ কলেজে ফোন করলাম। ওরা কিছুই বলতে পারল না। তখন খেয়াল হল তুই কলকাতায় এলে নিশ্চয়ই হোষ্টেলে উঠবি। কলেজ থেকে নাম্বার নিয়ে পর পর হোস্টেলগুলোতে রিং করতে লাগলাম। আলটিমেটলি তোকে পেয়ে গেলাম। আমার যদি খেয়াল হতো তুই কলেজ ছেড়ে দিয়েছিস অনেক আগেই তাহলে এ বুদ্ধি মাথায় আসত না এবং দেখাও হতো না।

আপনি কি মস্কোয় আছেন?

হ্যাঁ। এখন ওখানেই সেটলড। তারপর গলা পালটে জিজ্ঞাসা করলেন। বাবার খবর কি? কেমন আছেন?

সঙ্গে সঙ্গে অনিমেষের মাথায় আগুন জ্বলে উঠল। এই বিলাসবহুল হোটেলে বসে দাদুর কথা জিজ্ঞাসা না করে ছোট কাকা তো সরাসরি জলপাইগুড়িতে চলে যেতে পারেন। কি উত্তর দেবে ঠিক করার আগেই ছোট কাকা একটা হাত বাড়িয়ে ওর কাধ ধরলেন, বুঝতে পারছি প্রশ্নটা শুনে তুই ডিস্টাবড তাই তো?

অনিমেষ খুব দ্রুত নিজেকে সামলে নিল, না, তা কেন হবে! আপনি নিশ্চয়ই প্রশ্নটা করতে পারেন। দাদুর শরীর ভাল নেই। উত্তরটা দিতে পেরে অনিমেষ স্বস্তি পেল। এখানে এই হোটেলে বসে ছোট কাকাকে রূঢ় কথা বলে সে দাদুর সমস্যার কোন সমাধান যখন করতে পারবে না তখন বলে লাভ কি।

তুই সত্যিই বুদ্ধিমান। ছোট কাকা উঠে টেবিলের কাছে গিয়ে একটা সাদা বোতল থেকে গ্লাসে পানীয় ঢেলে জিজ্ঞাসা করলেন, তুই ভদকা খাবি?

ভদকা? না, না।

ঠিক আছে। গ্লাসে ঠোঁট ঠেকিয়ে ছোট কাকা বিছানার ওপর বসলেন এবার, তুই জানিস কিনা জানি না জলপাইগুড়ি ছাড়ার পর আমি বাবার সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রেখেছিলাম। লাস্ট যেবার ওখানে যাই সে খবর তো তুই জানিস। তারপর নানান ঝামেলায় আমাকে ব্যস্ত থাকতে হয়। ওই সময় বড়দার চিঠি পাই বাবা চলে গেছেন। তখন আমার বাইরে যাওয়া ঠিকঠাক। সেদিনই দিল্লি যাব। ভাবলাম বাবা যখন নেই তখন আর জলপাইগুড়িতে ফিরে কি হবে। বড়দা টাকা চেয়েছিল তাই পাঠিয়ে দিলাম। মস্কোতে গিয়ে তোর বাবাকে চিঠি দিলাম। মেজদা যে আমার ওপর চটেছে তা উত্তর পেয়ে বুঝলাম আর সেই সঙ্গে জানলাম বড়দা আমাকে ব্লাফ দিয়েছে, বাবা বেঁচে আছেন। তুই বোঝ ব্যাপারটা। বাবাকে চিঠি দিয়েছি তারপর উত্তর পাইনি। দিল্লী থেকে এক বন্ধুকে দিয়ে টাকা পাঠিয়েছিলাম উনি রিফুজ করেছেন। নাউ আই হ্যাভ নাথিং টু সে। কেউ যদি আমাকে এ জন্য দোষী করতে চায় করতে পারে এবং তাতে আমার কিছু এসে যায় না। বাবা ভাল নেই বললি, কি হয়েছে? অনিমেষ বুঝতে পারছিল ছোট কাকা নিজেও জানেন তার কথাগুলোর পেছনে খুব জোরালো যুক্তি নেই। তাই স্রেফ জেদের বশে কথাগুলো বলে যাওয়া এবং ঘুরে ফিরে দাদুর কথা জানতে চাওয়ার মধ্যেই সেই দুর্বলতা প্রকাশিত।

অনিমেষ বলল, বয়স হয়েছে টাকা পয়সা হাতে নেই, খুব কষ্টে চলতে হচ্ছে।

ছোট কাকা বললেন, খুলে বল, ইন ডিটেইলস।
 
অনিমেষ তাকাল, আপনার ভাল লাগবে না। এখন ওই বাড়িটুকু ছাড়া দাদুর কোন সম্বল নেই। তাই পাবার জন্য আত্মীয়রা যাওয়া আসা করছে বলে দাদু সবাইকে বলেছেন ওঁর লেপ্রসি হয়েছে।

হয়নি। কিন্তু হয়েছে বলে বেড়ালে ভীড় এড়ানো হয় তা জানেন দাদু। আমি এবার গিয়ে দাদুকে চিনতে পারিনি। খুব বেশিদিন মনে হয় বাঁচবেন না।

বড়দি?

শরীর ভাল নেই। এক বেলা খান। শুকিয়ে গেছেন।

ছোট কাকা হাতের গ্লাসটটা একচুমুকে শেষ করলেন। তারপর আচমকা প্রশ্ন করলেন, শুনলাম তুই রাজনীতি করিস। এস. এফ.?

বিস্মিত অনিমেষ কাকার মুখে হাসি দেখতে পেল, হ্যাঁ।

তুই সি. পি. এম.-এর কাজকারবারে বিশ্বাস করিস?

খানিকটা।

হোয়াই?

ভারতবর্ষে কমুনিস্ট পার্টি বলতে তো সি. পি. এম-ই। কিন্তু এই দলের কাজকর্ম আমার ভাল লাগে না, অথচ উপায় নেই।

ও। তা ভাল না লাগলে রাজনীতি করতে কে বলেছে! এম. এ. পাস করে চাকরি যোগাড় করে সংসার কর।

এটা আমার ব্যক্তিগত ব্যাপার।

ছোট কাকা ওর মুখের দিকে সকৌতুকে তাকালেন, তারপর হো হো করে হাসতে লাগলেন। শেষে খুব ধীর গলায় বললেন, অনি এই রাজনীতি করতে এসে কোন আদর্শ বা ফর্মুলা সামনে রেখে এগোয় বোকারা। যখন যা তখন তা যে হতে পারে সেই ভাল পলিটিসিয়ান। গতকাল তোর হোস্টেলের একটি ছেলের সঙ্গে গল্প করতে করতে তোর সম্পর্কে জানতে পারলাম। তোকে দেখে আমি আমার অতীতকে দেখতে পাচ্ছি। পার্টি যখন নিষিদ্ধ হল তখন ওই একই আদর্শ নিয়ে আমরা বেঁচেছিলাম। কিন্তু তাই যদি আঁকড়ে থাকতাম তাহলে আমাকে আজ খুঁজে পাওয়া যেত না। রাজনীতি করবি একটা মজবুত সিঁড়ির কাছে পৌঁছাবার জন্য। যেই সেই সিঁড়িটা পেয়ে যাবি আর পেছন দিকে তাকাবি না। তোদের এখানে যারা বড় নেতা তাদের অনেকের ব্যক্তিগত চরিত্র আমি জানি। সেসব জানলে তুই শিউরে উঠবি। যারা বাইরের ঘরে বসে আছে তাদের তুই চিনিস?

অনিমেষ ঘাড় নাড়ল, না।

এরা এসেছে আমার মন গলাতে মস্কো যাওয়ার প্রবেশ পত্র পাওয়া ওদের উদ্দেশ্য, না এরা সিপিআই নয়। আজ সারাদিন আমি দফায় দফায় মিটিং করব তোদের নানা নেতাদের সঙ্গে। তুই যেমন করেই হোক একটু সামনের সারিতে চলে আয় তারপর তোর ব্যাপারটা আমার ওপর ছেড়ে দে।

অনিমেষ আর পারছিল না। ছোট কাকা যেসব কথা বলে যাচ্ছে তা হয়তো সত্যি কিন্তু এ কি রকম চিন্তা ভাবনা। চোখের সামনে জলপাইগুড়ির বাড়ির সামনে সেই বিক্ষোভটার ছবি ভেসে উঠল। ছোট কাকা যেটা এড়াতে বিরাম করের বাড়িতে গিয়ে বসেছিলেন। সে স্পষ্ট গলায় জিজ্ঞাসা করল, আপনি কি কেজিবির এজেন্ট?

এ্যা, গুড! এখন কি সি. আই এ-র সঙ্গে কে.জি. বির এজেন্ট বলা আপ টু ডেট গালাগালি? আরে বোকা সি.আই.এ.কিংবা কে.জি.বি. অনেক বুদ্ধিমান সংগঠন। তারা এমন লোককে কাজ করতে পাঠায় না যাকে দেখে তুইও বুঝতে পারবি। তোর উদ্দেশ্য কি?

কি ব্যাপার?

কেন রাজনীতি করছিস?

এদেশের মানুষ যাতে শোষিত না হয় কোন ধাপ্পায় না ভোলো।

ওর কথা থামিয়ে ছোট কাকা জিঞ্জাসা করল, এটা তো সি.পি. এম.ও বলছে।

বলছে। কিন্তু এই সংবিধানের মধ্যে সেটা করা সম্ভব নয় তা ওরা জানে।

দেন ইউ আর থিংকিং, সাম আদার ওয়ে। সেটা কি?

জানি না।

পাগলামি করিস না। এদেশের মানুষের মনে লোভের পোকা থিকথিক করছে। এদের নিয়ে কোন কাজ করা সম্ভব নয়। আমি যা বললাম তাই কর।

অনিমেষ উঠে দাঁড়াল, আপনি ওদের দশ মিনিট অপেক্ষা করতে বলেছিলেন।

হাসল ছোট কাকা, দরকার হলে ওরা দশ ঘন্টা অপেক্ষা করবে।

আমি চলি।

যাবি?

হ্যাঁ।

ছোট কাকা একটা ব্যাগ থেকে নিজের কার্ড বের করে ওর হাতে দিলেন। আমি আজ রাত্রেই ফিরে যাব। তোর যদি কখনো দরকার হয় এই ঠিকানায় আমাকে চিঠি দিবি। এটা অন্য ধরনের কার্ড, গতকালের মত নয়। এক সঙ্গে ইংরেজী এবং সম্ভবত রাশিয়ান, যা অনিমেষ বুঝতে পারল না, লেখা আছে। অনিমেষ ওটা পকেটে রেখে বেরিয়ে আসছে, ছোট কাকা আবার ডাকলেন, অনি, আমার একটা উপকার করবি?

বলুন।

তোকে প্রমিস করতে হবে।

এক মুহূর্ত দ্বিধা করে অনিমেষ সেটাকে ঝেড়ে ফেলল, বলুন।

আমি তোকে দুটো প্যাকেট দেব তুই দুজনকে ওদুটো পৌঁছে দিবি?

কাদের?

ছোট কাকা একটা স্যুটকেস খুলে দুটো সুদৃশ্য প্যাকেট বের করে অনিমেষের সামনে ধরে বললেন, উপরে নাম লেখা আছে।
 
খুব বেশী ওজন নয়, অনিমেষ প্যাকেট দুটোর নাম পড়তে গিয়ে খুব কষ্টে নিজেকে সংযত করল। একটাতে সরিৎশেখর মিত্র, অন্যটায় ছোট করে লেখা তপু মানে তপু পিসী। অনিমেষ বিহ্বলচোখে ছোট কাকাকে দেখল। এতগুলো বছর চলে গেছে অথচ ছোট কাকা এখনও তপুপিসীকে মনে রেখেছেন? এক সময় ছোট কাকার ওপর সে রেগে গিয়েছিল তপুপিসীকে অবহেলা করার জন্য অথচ একটা মানুষ যে গোপনে গোপনে আর একজনকে মনে রেখে দেয় চিরকাল, এটা জেনে সব গোলমাল হয়ে গেল তার। রুপশ্রী সিনেমার সামনে বচ্চাদের নিয়ে তপুপিসীকে যেদিন পথের পাঁচালী দেখাতে যাচ্ছিল সেদিনই বোধ হয় ছোট কাকার সঙ্গে তার শেষ দেখা। কি নির্লিপ্ত হয়ে তপুপিসী ছোট কাকাকে এড়িয়ে গিয়েছিল। আর নীল কাগজে ছোট কাকাকে লেখা তপুপিসীর সেই চিঠিটা যেটাকে সে বাড়ি সার্চ করার আগে পুলিশের চোখ থেকে সরিয়ে রেখেছিল, যা কিনা পরে ছোট কাকার হাতেই টুকরো টুকরো হয়ে গেল তার কথা মনে পড়ল। সেই লাইন দুটো কখনোই ভুলবে না অনিমেষ, তোমার রাজনীতিই এখন সব, আমি আর কেউ নই। তাই তুমি যত ইচ্ছে রাজনীতি কর, আমি দায় তুলে নিলাম।

তপুর সঙ্গে তোর যোগাযোগ আছে?

প্রশ্নটা শুনেই ঘাড় নেড়ে না বলল অনিমেষ।

তপুপিসী কি এখনও জলপাইগুড়ি গার্লস স্কুলে আছে?

কি জানি।

ওর কোন খবর জানিস না তুই?

না।

তাহলে।

যদি দায়িত্ব দেন তাহলে খুঁজে বের করে দিয়ে দিতে পারি।

এটুকু অন্তত কর।

হঠাৎ অনিমেষের মাথায় চিন্তাটা চলকে উঠল, কিন্তু তপুপিসী যদি না নেয়?

ছোট কাকা স্থির হয়ে গেলেন। এতক্ষণ যে মানুষটা প্রচন্ড প্রতাপে নানান কথা বলছিল এই সময় তাকে কি নিঃসহায় দেখাচ্ছে। মৃদু গলায় বললেন, যদি না নিতে চায় তাহলে তিস্তায় ফেলে দিস। তারপর বেশ কিছুক্ষণ চুপচাপ থেকে বললেন, আমার ভাগ্যটাই এমন। কোন সম্পর্ককেই আমি সহজ স্বাভাবিক রাখতে পারলাম না অনি, তোকে দেখে আমার এই ভয়টাই হচ্ছে। আমি যে ভুল করেছি। তুই তা করিস না।

অনিমেষ প্যাকেট দুটো হাতে নিয়ে বলল, যাচ্ছি।

তুই কি আজকে আবার আসবি?

কখন?

কখন বলি! সারাদিন ঝামেলা লেগেই থাকবে। এয়ারপোর্টে আসতে পারবি ছটা নাগাদ?

এয়ারপোর্ট?

তখন কিছুক্ষণ কথা বলা যাবে।

দেখি।

তুই সিগারেট খাস অনি?

দ্বিধা না করে উত্তর দিল অনিমেষ, মাঝে মাঝে।

দেন ওয়েট। ছোট কাকা ঘরের কোণায় ফিরে গিয়ে একটা সুদৃশ্য প্যাকেট আর ছোট্ট অথচ সুন্দর লাইটার এনে ওর হাতে গুঁজে দিলেন। অনিমেষ প্যাকেটটা দেখল। রাশিয়ান সিগারেট। বিদেশী সিগারেট সম্পর্কে তার কোন ধারণা নেই। বন্ধুদের দেখেছে খুব লালায়িত হতে। লাইটারের বোতামে চাপ দিতেই একটা নীল হলকা বেরিয়ে এল। খুব দামী নিশ্চয়ই এটা। ছোট কাকা বললেন, গ্যাসের, ফুরিয়ে গেলে কিনে নিস।

আমার অত পয়সা নেই। এটা রেখে দিন। আমার কাজে লাগবে না।

কেনার দরকার নেই। ওটার গ্যাস শেষ হয়ে গেলে কাউকে দিয়ে দিস।
 
বাইরের ঘরে বেরিয়ে আসতেই লোক তিনটে উঠে দাঁড়াল। তাদের মুখ দেখে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে এতক্ষণ বসিয়ে রাখার জন্য তারা একটুও অসন্তুষ্ট হয়নি। বরং বেশ নেশা হয়ে গেছে এরই মধ্যে। একজন অকারণেই হাসছিল। লোকটাকে চেনা চেনা মনে হচ্ছে অথচ ছোট কাকা বললেন, সরি দেরী করিয়ে দিলাম আপনাদের। বসুন বসুন। কি খাচ্ছেন? সিভাস রিগ্যাল? আমার আবার ভদকা না হলে চলে না। অনিমেষ বেরিয়ে যাচ্ছিল, ছোট কাকা ওকে দাঁড়াতে বললেন, আমার ভাইপো অনিমেষ মিত্র; খুব ইনটেলিজেন্ট ছেলে, লোক তিনটে তাকে নমস্কার করছে দেখে অনিমেষ প্যাকেট হাতেই সেটা ফিরিয়ে দেবার চেষ্টা করল। ছোট কাকা তখন বলছেন, এম. এ. পড়েছে ছাত্র ফেডারেশন করে। খুব অ্যাকটিভ।

আচ্ছা। সেই চেনা চেনা লোকটি বলল, বিমানকে চেন?

হ্যাঁ। অনিমেষ জবাব দিল।

কি নাম যেন? অনিমেষ মিত্র।

ঠিক আছে মিত্র সাহেব, মনে থাকবে। লোকটি ছোট কাকার দিকে তাকিয়ে হাসল তবে ওকে মানে, বুঝতেই পারছেন?

অফ কোর্স। ছোট কাকা অনিমেষকে দরজা অবধি এগিয়ে দিয়ে বললেন, এদের যে তুই এখানে দেখলি কাউকে বলার দরকার নেই।

কেন? চাপা গলায় বলল অনিমেষ।

রাজনীতিতে সাফল্য পাওয়ার সবচেয়ে বড় চাবিকাঠি হল চোখ খোলা আর মুখ বন্ধ রাখা। এটার সঙ্গে যে মস্তিষ্ক ব্যবহার করতে পারে তাকে কেউ ঠেকাতে পারবে না। ছোট কাকা হাসলেন।

অনিমেষ খুব শান্ত গলায় জিজ্ঞেস করল, আর হৃদয়।

ওটার ব্যবহার নির্বোধরাই করে। ইমোশনাল ফুলদের জায়গা রাজনীতিতে নেই। ওকে চেষ্টা করিস এয়ারপোর্ট আসতে আর ইন কেশ অফ অনি ডেঞ্জার চিঠি লিখবি। এই ভারতবর্ষের যে কোন অসাধ্য সাধন মস্কোয় বসে করা যায়। দরজা বন্ধ করলেন ছোট কাকা।

সেদিন দুপুরে ইয়ুনিয়ন অফিসে গেল অনিমেষ। ইদানিং এই ঘরটাকে সে এড়িয়ে যাচ্ছে। বিমান, সুদীপ এবং অনেকে কথা বলছিল। ওকে দেখে সুদীপ বলল, তোমার কি হয়েছে? আজকাল অন্য রকম লাগছে।

কি হবে। অনিমেষ হাসল, খুব ব্যস্ত ছিলাম।

কি ব্যাপার? বিমান জিজ্ঞাসা করল।

আমার কাকা এসেছেন মস্কো থেকে। এখানে পলিটিক্যাল কনফারেন্স আছে। ওঁর সঙ্গে থাকতে হয়েছিল। অনিমেষ বলল।

বিমান বিজ্ঞাসা করল কি নাম বল তো?

প্রিয়তোষ মিত্র।

আচ্ছা। আমি ঠিক জানি না। তুমিও তো কখনো বলনি।

এমন কি ব্যাপার যে বলব! তবে দেখলাম নেতারা জানেন। অনিমেষ দেখল ওদের খুব পাজলড দেখাচ্ছে। সে পকেট থেকে সিগারেটর প্যাকেট বের করে সুদীপের সামনে রাখল, কাকা দিয়েছেন তোমাদের খেতে।

নির্লিপ্তের মত প্যাকেটটা তুলেই চেঁচিয়ে উঠল সুদীপ, আরে রাশিয়ান সিগারেট! এ প্যাকেট ফ্রম দ্য ল্যান্ড অফ কন্যুনিজম। সবাই হুমড়ি খেয়ে প্যাকেটটাকে দেখতে লাগল। সুদীপ সন্তর্পণে প্যকেটটা খুলে সিগারেট বের করে ঠোঁটে গুঁজে বলল, থ্যাংকু অনিমেষ আমি যেন মস্কোর গন্ধ পাচ্ছি। চারপাশ থেকে আরো কতগুলো আগ্রহী হাত এগিয়ে এল সিগারেটের জন্য।

প্রচণ্ড একটা জ্বলুনি অনিমেষকে এয়ারপোর্টে নিয়ে এল। তিরিশের বি বাসে চেপে এই প্রথম দমদমে যেতে যেতে অনিমেষ আজ সকাল থেকে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো যত ভাবছিল ততই জ্বলুনিটা বাড়ছিল। ছোট কাকা হঠাৎ মস্কো থেকে উড়ে এলেন কেন? ওঁর ঘরে যারা বসেছিলেন কিংবা যাদের সঙ্গে মিটিং করেছেন তাদের সঙ্গে ওর কি সম্পর্ক? সকাল বেলায় তার মস্তিষ্ক ঠিক কাজ না করায় ছোট কাকা একতরফা কতগুলো কথা বলে গেছেন। হয়তো তিনিই সঠিক, আজকাল যে সুবিধেবাদী রাজনীতির শিকার সবাই তাতে ওই পথে চলাই লোভনীয়। কিন্তু অনিমেষের মনে হল ছোট কাকাকে কিছু কথা স্পষ্ট বলা দরকার।
 
এয়ারপোর্টে এসে চোখ ধাধিয়ে গেল অনিমেষের। স্টেশনের যাত্রীদের থেকে এখনকার মানুষগুলোর হাবভাব আলাদা। কিছুক্ষণ সময় কাটানোর পর সে ছোট কাকাকে দেখতে পেল। সেই তিনটে লোক এখনও সঙ্গে আছে।

ওকে দেখে ছোট কাকা এগিয়ে এলেন, এসেছিস।

হ্যাঁ।

খুব দেরী হয়ে গেছে আমার। তোকে যা বললাম তা করিস।

কি ব্যাপারে?

ওঃ ওই প্যাকেট দুটোর কথা বলছি।

আচ্ছা।

আর, হা, এদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখিস, আখেরে কাজ দেবে। ইঙ্গিতে পেছনে দাঁড়ানো লোকগুলোকে দেখিয়ে দিলেন উনি, মনে রাখিস, প্রত্যেকটা স্টেপ সামনে এগিয়ে যাবার জন্যেই ফেলতে হয়। কথাটা বলে ছোট কাকা ঘুরে স্যুটকেস হাতে নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছিলেন, অনিমেষ পেছন থেকে ডাকল।

কি হল?

এই লোকগুলোকে কি আপনি লোভ দেখিয়ে গেলেন?

কথাটা শোনামাত্র ছোট কাকার মুখ বিস্ময়ে চুরমার। অবাক চোখে দেখছেন তিনি অনিমেষকে। তারপর কয়েক পা ফিরে এসে জিজ্ঞাসা করলেন,

কি বলছিস?

আপনি যে রাশিয়ান সিগারেটের প্যাকেটটা দিয়েছিলেন সেটা খাওয়ার জন্যে আমার কমরেড বন্ধুরা লালায়িত হয়েছে। এরা নিশ্চয়ই আরো বড় কিছু প্রাপ্তির আশায় আপনার পেছনে ছুটছে। এঁদের নষ্ট করে আপনার কি লাভ হচ্ছে? অনিমেষ খুব স্পষ্ট গলায় জিজ্ঞাসা করল।

উত্তরটা তোকে দেব না। তোকে অন্য রকম দেখাচ্ছে। তোরা কি চাস?

এই করাপসন থেকে দেশটাকে বাঁচাতে চাই। শুনুন যে সব লোকদের আপনি দেখে এসেছেন কিংবা নিজের মত মনে করেন তার বাইরেও কেউ কেউ আছে। অনিমেষ দৃঢ় প্রত্যয়ে জানাল।

গুড। একই ভ্রান্ত আবেগ। অনি, ভারতবর্ষের এই সিস্টেমে তোর ওই কেউ কেউ লোকগুলো হয় না খেয়ে মরবে নয় একদিন দালাল হয়ে যাবে। অতএব ভেবে দ্যাখ। আই ফিল পিটি ফর য়ু।

ছোট কাকা আর দাঁড়ালেন না। সঙ্গীদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ভেতরে চলে গেলেন। অনিমেষের প্রতিবাদ করতে ইচ্ছে হয়েছিল কিন্তু হঠাৎ সে টের পেয়ে গেল তার কোন জোর নেই। কিসের ওপর ভিত্তি করে এই সব লোভী মানুষগুলোর বিরুদ্ধে লড়াইয়ের কথা বলবে? সামনে যে কোন পথ খোলা নেই। চুপচাপ রাজনীতি থেকে সরে যাওয়া সেও তো এক রকম এসকেপিজম। তাহলে এই ঘোলাজলে পাক খাওয়া যেখানে অবধারিত সেখানে ছোট কাকাকে মুখের উপর জবাব দেবার কোন উপায় নেই। এয়ার পোর্ট থেকে বাস স্ট্যান্ড অনেকটা দুর। অনিমেষ হেঁটে যাচ্ছিল। ঠিক সেই সময় পেছনে গাড়ির শব্দ হওয়ায় সে ঘাড় ঘোরাল। গাড়িটা ওর পাশে এসে দাঁড়িয়ে গেল। সেই তিনজন। ছোট কাকাকে সি অফ করে ফিরছেন। একজন জিজ্ঞাসা করলেন, কলকাতায় যাবেতো? অনিমেষ ঘাড় নাড়ল। উঠে এসো। কথার মধ্যে একটা নকল ভালবাসা টের পাওয়া যাচ্ছে। অনিমেষ একমুহূর্ত চিন্তা করল।

তারপরই হাসল, না। আপনারা যান। আমার এখানে একটু দরকার আছে। দেরী হবে। তিনটে লোক স্বাভাবিক হয়ে গেল। চলে যাওয়ার আগে সেই ভদ্র লোক বললেন, তোমার কাকার সঙ্গে কথা হয়েছে। একদিন সকালে আমার সঙ্গে দেখা করো। কোন চিন্তা নেই। ছুটন্ত গাড়ির পশ্চাদ্দেশ দেখতে দেখতে অনিমেষ দাঁতে দাঁত চাপল, শালা।

অনেক রাত্রে হোস্টেলে ফিরল অনিমেষ। উলটোডাঙ্গা থেকে সোজা হেঁটে এসেছে। ভীষণ ক্লান্তি শরীরে। আশেপাশের দোকান বন্ধ এখন। হোস্টেলের গেট আধভেজানো। হঠাৎ পাশের ল্যামপোস্টের ছায়া থেকে কেউ দ্রুত সরে এল ওর কাছে। চমকে অনিমেষ তাকাতে হতভম্ব হয়ে গেল। সুবাসদা। ঝড়ো কাকের মত চেহারা। চাপা গলায় ডাকল সুবাসদা, অনিমেষ।

সুবাসদা! আপনি? যতটা না দেখে তার চেয়ে ওর হাবভাবে অবাক হল সে।

অনিমেষ তুমি কি আমাকে একটা রাত থাকতে দিতে পার?

অনিমেষ একটু দ্বিধা না করে বলল, নিশ্চয়ই, আসুন।
 
দারোয়ানকে ম্যানেজ করে সুবাসকে নিজের ঘরে আনতে কোন অসুবিধে হল না অনিমেষের। হোস্টেলের সবার খাওয়া হয়ে গেছে। রাত বেশি হওয়ায় দু একটা ছাড়া প্রায় সব ঘরের আলো নিভে গেছে। অনিমেষ খাবার ঘর থেকে ঢাকা দেওয়া নিজের খাবারটা ওপরে নিয়ে এল। রুটিগুলো এরই মধ্যে শক্ত হয়ে গেছে, ঝোলে সেই বিদিকিচ্ছিরি গন্ধ। জোর করে সুবাসকে রাজী করিয়ে ওই খাবার ভাগ করে খেয়ে অনিমেষ বলল, আপনি খাটে শুয়ে পড়ুন আমি নিচে শুচ্ছি।

তোমার তক্তপোশটায় দিব্যি দুজনের কুলিয়ে যাবে, ব্যস্ত হয়ো না। সুবাস একটা চারমিনারের প্যাকেট বের করে বলল, আচ্ছা অনিমেষ, আমরা দুজনেই তুমি বলব এরকম পরিস্থিতি আগে হয়েছিল না? আপনি বলাটা বন্ধ করো, ওতে দূরত্ব বেড়ে যায়।

চারধার নিঃশব্দ, ট্রাম-লাইন ঘুমিয়ে পড়লে কলকাতা যুবতী বিধবার মত মাথা নীচু করে থাকে খানিকক্ষণ। আশেপাশের বাড়িগুলোর আলো নিভে গেলে দূরে একটা চার তলার ঘরের জানালার কাঁচ ঝকঝক করছে। অনিমেষ চেয়ারে বসে সেদিকে তাকিয়েছিল। এতক্ষণ সে সুবাসকে কোন প্রশ্ন করেনি। এত রাতে হঠাৎ কী বিপদ হল তা জানতে কৌতূহল হচ্ছে কিন্তু নিজে থেকে না বললে প্রশ্ন করতে খারাপ লাগছিল।

হঠাৎ সুবাস বলল, তোমার কোন অস্বস্তি হচ্ছে না তো?

কেন?

এই যে হঠাৎ এসে জুড়ে বসলাম।

যাঃ তা কেন হবে।

তোমার বন্ধুরা, আমি বিমানদের কথা বলছি, তারা কৈফিয়ত চাইবেই।

কেন? এটা আমার ব্যক্তিগত ব্যাপার। তাছাড়া এখন আর কৈফিয়ত দিতে আমি বাধ্য নই। কথাটা বলে অনিমেষ সুবাসের দিকে তাকিয়ে হাসল।

কেন?

আমার আর ভাল লাগছে না। আসলে আমি পার্টির কাজকর্ম আর মানতে পারছি না। এত স্বার্থান্বেষী মানুষ পার্টির ওপর তলায় ছেয়ে গেছে যে এই দলের কাছ থেকে নতুন কিছু আশা করা যাবে না। প্রতি মুহূর্তে বিবেকের সঙ্গে লড়াই করার চাইতে নিষ্ক্রিয় হয়ে থাকা অনেক ভাল। অনিমেষ বলল।

সুবাস ওকে ভাল করে দেখল। তারপর বলল, আলো নিভিয়ে শুয়ে পড় অনেক রাত হয়েছে। আলোচনাটাকে হঠাৎ এভাবে থামিয়ে দেওয়ায় অনিমেষ অবাক হল। সুবাস কি ওর কথা বিশ্বাস করছে না?

ঘরের আলো নেভালেও একটা পাতলা আলো অন্ধকারে মাখামাখি হয়ে থাকে। অনিমেষ সুবাসের পাশে চুপচাপ শুয়েছিল। সে বুঝতে পারছিল তার ঘুম আসবে না। এতকাল একা শুয়ে শুয়ে এমন একটা অভ্যেস তৈরি হয়ে গেছে যে এখন পাশে কেউ শুয়ে থাকলেই অস্বস্তি হয়। শুয়ে শুয়ে সে সুবাসের ব্যাপারটা চিন্তা করছিল। পার্টির সক্রিয় কর্মী হিসেবে সুবাস খাদ্য আন্দোলন করেছে, অ্যাকসনে নেমেছে। এ রকম একটা মুহূর্তে ও তাকে শিয়ালদের গলি থেকে গুলীবিদ্ধ অবস্থায় তুলে নিয়ে গিয়েছিল। তারপর পার্টির হয়ে বীরভূমের গ্রামে গ্রামে ঘুরে সংগঠনের কাজ করেছে দীর্ঘদিন। সুবাসই তাকে বিমানদের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিয়েছে। আবার এই সুবাসকেই পার্টি থেকে দল বিরোধী কাজের জন্য তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। সুবাসের সঙ্গে দেখা হয়েছিল বলে বিমানরা তার প্রতি অসন্তুষ্ট হয়েছিল। দল থেকে বেরিয়ে সুবাসদা এখন কি করছে! কিছু কিছু কথা আবছা আবছা তার কানে আসছে। সেগুলো বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়। সুবাস কি সেই দলে আছে। আর আজ রাত্রে যেভাবে সুবাস তার কাছে এসে আশ্রয় নিল তাতে বোঝা যায় কেউ বা কারা তার ক্ষতি করতে চাইছে অথচ এক হাতের মধ্যে শুয়ে আছে সুবাস, তাকে জিজ্ঞাসা করা যাচ্ছে না। কেউ যদি নিজে থেকে উন্মোচন করে তাহলে খোঁচাতে সংকোচ হয়। সুবাস যে ঘুমিয়ে পড়েছে এটা বুঝতে কোন অসুবিধে হচ্ছে না এখন। অনিমেষ ঘুমুতে পারছিল না।
 
এখন পার্টির মধ্যে হাজারটা ফাটল। পাশাপাশি কংগ্রেসও স্বাভাবিক অবস্থায় নেই। বর্তমান সরকারের খাদ্য নীতি একদল মানুষকে বেদম চটিয়েছে। লেভি ব্যবস্থার শিকার হয়েছে জোতদারেরা যারা এতকাল কংগ্রেসের খুঁটি ছিল। বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী বৃহত্তর কলকাতায় রেশন ব্যবস্থা চালু করেছেন লেভির মাধ্যমে রেকর্ড পরিমাণ খাদ্য শস্য সংগ্রহ করে। আর এর ফলে সারা বাংলার জোতদারেরা ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেছে। বামপন্থীরা বিক্ষিপ্ত আন্দোলন শুরু করেছিল কয়েকটি জায়গায়। কৃষ্ণনগর এবং বর্ধমানে দুটো তাজা ছেলে পুলিশের গুলীতে প্রাণ হারিয়ে সারা বাংলার মানুষের মনে কংগ্রেস সম্পর্কে অস্বস্তি এনে দিয়েছে। কেন্দ্রে প্রধানমন্ত্রীর অকাল মৃত্যুতে কংগ্রেস যে দ্বিধায় পড়েছিল তা এখনও কাটেনি। নেহরু পরিবারকে আবার আঁকড়ে ধরা হয়েছে। দেশের প্রধানমন্ত্রী এখন একজন মহিলা যাকে মন্ত্রীসভার বংস্ক সদস্যরা একদা স্নেহ করতেন বা বাধ্য হতেন স্নেহ করতে। কংগ্রেসের বর্তমান অন্তর্ঘ যত তাড়াতাড়ি জনসাধারণ জানতে পারে তার ছিটেফোঁটাও মার্কসবাদী পার্টি সম্পর্কে জানা যায় না। মেদিনীপুরের বিখ্যাত কংগ্রেসী নেতা আজ কংগ্রেস থেকে বিতাড়িত। তাকে ঘিরে জোতদাররা সংগঠিত হচ্ছে আগামী নির্বাচনে লড়বার জন্য। নতুন নামকরণে তিনি কংগ্রেসের গন্ধ ছাড়তে পারেননি। তার একমাত্র লক্ষ্য কংগ্রেসকে ক্ষমতাচ্যুত করে প্রকৃত কংগ্রেসীদল প্রতিষ্ঠা করা। তার সঙ্গে বিরোধীদের সুবিধেবাদী অংশ হাত মেলাচ্ছে। তা সত্ত্বেও কোন গোড়া পার্টি ক্যাডার স্বপ্নেও ভাবতে পারে না আগামী নির্বাচনে কংগ্রেস পরাজিত হবে। তবু লড়ে যাওয়া, গণতন্ত্রে পড়ে যেতে হয়। একটা পার্টির অস্তিত্ব প্রমান করার সুবর্ণ সুযোগ হল নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা। পার্লামেন্ট হল শুয়োরের খোয়াড়–কথাটা মনে পড়তেই অনিমেষ হেসে ফেলল। সারাদেশ উৎসুক হয়ে আছে ওই খোয়াড়ে ঢুকে কাদা পাঁকে মুখ গুঁজে পড়ে থাকতো। এই পরিস্থিতিতে সুবাসরা কি ভাবছে? কি করতে চাইছে ওরা?

কখন ঘুমিয়ে পড়েছিল অনিমেষ তা জানে না। উঠে দেখল সুবাস চেয়ারে বসে আছে, বাইরে এখনও তেমন রোদ ওঠেনি। সুবাস হাসল, ঘুম হল?

অনিমেষ চট করে উঠে বসে দেখল সুবাস যাওয়ার জন্য তৈরী। সে আচমকা জিজ্ঞাসা করল, আপনি এখন কি করছেন?

কি করছি মানে?

রাজনীতির কথা বলছি।

রাজনীতি কথাটা আবর্জনার চেয়ে নিকৃষ্ট হয়ে গেছে, ওতে সারও হয় না।

আপনি কি আমাকে স্পষ্ট কিছু বলতে চাইছেন না?

তুমি কিন্তু এখনও আপনি ছাড়তে পারলে না।

ঠিক আছে, সুবাসদা। আমি একটা রাস্তা খুঁজতে চাই। এভাবে ভাল লাগছে না। পার্টির সঙ্গে কাজ করা আমার পোষাবে না। ভেবেছিলাম এসে পড়াশুনা করব, ওসব মাথায় রাখব না। কিন্তু–।

সুবাস কিছুক্ষণ চিন্তা করল। তারপর একটা সিগারেট ধরিয়ে বলল, তোমার যা অবস্থা তা আমাদের অনেকেরই। এক সময় আমি ডেডিকেটেড ছিলাম, কম্যুনিস্ট পার্টির কর্মী হিসেবে আমি একমুখী ছিলাম। কিন্তু সংসদীয় গণতন্ত্রের দোহাই দিয়ে এই দেশের পার্টির কর্তারা এক ধরনের গজকচ্ছপ কম্যুনিজম জন্ম দিচ্ছেন। তোমার সঙ্গে একদিন চায়ের দোকানে এ ব্যাপারে কথা বলেছিলাম। হ্যাঁ আমরা অন্য রকম চিন্তা ভাবনা করেছি, কাজ শুরু হয়ে গেছে। আমরা বিশ্বাস করি ভারতবর্ষের স্বাধীনতা চীনের পথেই সম্ভব। আমরা সেটা অর্জন করতে চাই। এই মেরুদন্ডহীন মানুষগুলো কিন্তু আমাদের হাতে স্বাধীনতা তুলে দেবে না। আমাদের আদায় করতে হবে। আমরা মনে করি বন্দুকের নলই হল মানুষের প্রকৃত শক্তির উৎস। অনিমেষ আমরা একটা আগুন জ্বালাতে চাই। যে আগুনে আমাদের নকল চামড়ার খোলস পুড়ে ছাই হয়ে যাবে, একটা নতুন ভারতবর্ষ নিজের পায়ে দাঁড়াবে শ্রেণীহীন সমাজ ব্যবস্থা নিয়ে।

অনিমেষ জিঞ্জাসা করল, এটা কি এখনই সম্ভব?

সুবাস বলল, এ সম্পর্কে মাও সে তুং-এর দেওয়া একটা চমৎকার উপমা মনে পড়ছে। আমরা এক থালা ভাত কি একবারে খেতে পারি? থালার ভাত তো ধীরে ধীরে গ্রাস করে করে খেতে হয়। তাই না?
 
অনিমেষ ভেতরে ভেতরে অত্যন্ত উত্তেজিত হয়ে পড়ছিল। সে উজ্জ্বল মুখে সুবাসের দিকে তাকিয়ে বলল, সুবাসদা, আমাকে একটু বিশদ করে বলুন।

সুবাস বলল, এখন আমার সময় নেই ভাই, আটটার মধ্যে আমাকে একটা জায়গায় পৌঁছাতে হবে। তুমি এক কাজ করো, আমি তোমাকে একটা কাগজ দিয়ে যাচ্ছি। পড়লেই মোটামুটি বুঝতে পারবে আমরা কি চাইছি। যদি কোথাও অস্পষ্টতা থাকে আলোচনা করতে পার।

সুবাস ব্যাগ থেকে কিছু কাগজপত্র বের করে তার থেকে একটা লিফলেট জাতীয় জিনিস তুলে অনিমেষের হাতে দিল।

অনিমেষ সেটার উপর চোখ রাখতেই সুবাস উঠে দাঁড়াল, বিমানদের সঙ্গে তোমার সম্পর্ক ছিন্ন করেছ?

মাথা নাড়ল অনিমেষ না। মানে মৌখিকভাবে কিছু হয়নি।

সুবাস বলল, আমি জানতাম তোমাকে সরে আসতেই হবে। সিদ্ধান্ত নেবার পর আশা করব তুমি সম্পর্ক রাখবে না। তাতে ভুল বোঝাবুঝি বাড়ে। আর একটা কথা এখন থেকে যা করবে সাবধানে করবে। এই কাগজটা প্রকাশ্যে রাখার দরকার নেই।

অনিমেষ বলল, আপনি কি আজ সন্ধ্যা বেলায় আসছেন? মানে এখানে থাকবেন তো?

সুবাস বলল, না ভাই, আমাকে আজই বর্ধমান যেতে হবে।

অনিমেষ একটু ভাবল, তাহলে আপনার সঙ্গে আমার কবে দেখা হচ্ছে?

দরজায় দাঁড়িয়ে সুবাস বলল, তুমি নিজের মন পরিস্কার করো আমি সময় হলেই যোগাযোগ করব।

ঝড়ের মত নেমে গেল সুবাস। অনিমেষ চুপচাপ বসে থাকল বেশ কিছুক্ষণ। তারপর উঠে দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে এসে আবার বিছানায় শরীর এলিয়ে দিল। লিফলেটটা কয়েকটা পাতার।

‘ভারতবর্ষের বর্তমান কমিউনিস্ট পার্টিগুলো বৈপ্লবিক পরিবর্তনের অতীত প্রতিশ্রুতিগুলো বিস্তৃত হয়ে ঔপনিবেশিক সংসদীয় কাঠামোয় নিজের মানানসই করে নিয়ে রাজ্য সরকার পাওয়ার জন্য বেশি মন দিয়েছেন। এর প্রতিক্রিয়া হয়েছে তরুণ কমিউনিস্টদের মধ্যে। আমরা ভারতবর্ষের অতীত বিল্পবী পর্বের (তেভাগা সংগ্রাম ও তেলেঙ্গানার সশস্ত্র আন্দোলন) উৎস থেকে প্রেরণা নিয়ে নতুনভাবে বিপ্লব পরিচালনা করতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞা। যেহেতু তৃতীয় বিশ্বে জনগণের মধ্যে সবচেয়ে শোষিত ও পীড়িত অংশ কৃষক সমাজ এবং যেহেতু এ অঞ্চলে অতীতে সমাজ পরিবর্তনের আন্দোলনে এই কৃষক সাধারণেরই ছিল সর্বাধিক অগ্রণী ভূমিকা, তাই আমাদের এই নতুন বিপ্লব এই অবহেলিত শ্রেণীর পাশে দাঁড়াব আমরা।

তৃতীয় বিশ্বে বিল্পবের কেন্দ্রস্থল গ্রাম। এই তত্ত্বকে আরও একধাপ এগিয়ে লিনপ্রিয়াও সিদ্ধান্তে এসেছিলেন য়ুরোপ ও আমেরিকা শহরের মত, আর আফ্রিকা, এশিয়া ও লাতিন আমেরিকা এই পৃথিবীর গ্রামাঞ্চল। গ্রাম দিয়ে শহর ঘেরার তত্ত্ব প্রয়োগ করে তিনি গণমুক্তির সংগ্রামকে জোরদার করতে যে আহ্বান জানিয়েছেন আমরা সর্বান্তঃকরণে তা সমর্থন করি।

আমাদের দেশের ইতিহাস হচ্ছে বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদ ও সামান্তবাদী শোষণের বিরুদ্ধে ভারত–বর্ষের বীর কৃষক শ্রেণীর বিরামহীন সংগ্রামের ইতিহাস। ভারতবর্ষের মোট জনসংখ্যার শতকরা পঁচাত্তর ভাগই হলেন কৃষক এবং এরাই সবচেয়ে বেশি শোষিত। তাই সশস্ত্র কৃষক গেরিলা দল সংগঠিত করে গ্রামে গ্রামে অঞ্চলভিত্তিক ক্ষমতা দখল করতে হবে। গত দুই শতকে কৃষক আন্দোলনের অনুপ্রেরণা আমরা কাজে লাগাবো। সাঁওতাল বিদ্রোহের নেতা সিধু-কানু এই কৃষক বিদ্রোহের পূর্বসূরী।
 
সংগঠন পর্যায় সম্পূর্ণ হলে কৃষক গেরিলার দল সশস্ত্র সংগ্রামের ছোট ছোট ঘাটি গুলোকে বিস্তৃত করে জনযুদ্ধের প্রচণ্ড ঢেউ সৃষ্টি করতে পারবেন, গড়ে তুলবেন গণফৌজ, যে গণফৌজ দ্বারা গ্রামাঞ্চলে চার পাহাড়ের প্রতিক্রিয়াশীল শাসনকে উচ্ছেদ করবে, শহরগুলোকে ঘিরে ফেলে দখল করে নেওয়া হবে এবং সমগ্র দেশে গণতান্ত্রিক একানয়কত্ব কায়েম করে দৃঢ়তার সঙ্গে তাকে সর্বহারের এই শ্রেণীর কমীদের শ্রেণীচ্যুত হয়ে ভুমিহীন ও গরীব কৃষকের পাশে গিয়ে লড়াই করতে আহ্বান জানানো হচ্ছে’।

অনিমেষ বাকী লিফলেটটা শেষ করল। একবার নয়, বেশ কয়েকবার সে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে আগাগোড়া পড়ে নিল। পড়তে পড়তে ও শীরের শিরায় শিরায় যেন নতুন পায়ের শব্দ পাচ্ছিল। একটা নতুন ভারতবর্ষ সৃষ্টি করার পরিকল্পনা শুরু হয়ে গেছে। এতদিন যে বিক্ষিপ্ত মানসিকতায় একই ঘোলাজলে সে পাক খাচ্ছিল তা থেকে ছিটকে বেরিয়ে এল সে। তার অজ্ঞাতে আরো কিছু মানুষ যে একই রকম চিন্তাভাবনা করছে এবং পরিষ্কার একটা পথের সন্ধান করে নিচ্ছে তা সে এতদিন জানতোই না!

এই ক্লীব সমাজ ব্যবস্থা এবং মেরুদণ্ডহীন লোভী রাষ্ট্রব্যবস্থাকে চুরমার করে দেওয়ার জন্য একটা সংগঠিত শক্তি দরকার। গ্রামের কৃষকদের সংগঠিত করেই সেটা সম্ভব। এই স্বার্থপর মানুষগুলো যারা বিভিন্ন পার্টির চুড়োয় কায়েম হয়ে আছেন দিনের পর দিন, তাঁদের ছুঁড়ে ফেলে না দিতে পারলে এই দেশে কখনই মানুষের স্বাধীনতা আসবে না। উনিশশো সাতচল্লিশ আমাদের মুক্তির বছর নয়। সুবাসদারা যে পথে যাচ্ছেন মনে হচ্ছে সেটাই আসল মুক্তির পথ। কিছু পেতে হলে অবশ্যই দিতে হয়। অধিকার কেউ হাতে তুলে দেয় না। বিদেশী রাষ্ট্র যখন মাথার ওপর জুতো চাপিয়ে দেয় তখন তার বিরুদ্ধে লড়াই করে মুক্তি পাওয়া অনেক সহজ। প্রতিপক্ষকে চিহ্নিত করতে একটুও অসুবিধে হয় না। কিন্তু এ লড়াই নিজেদের সঙ্গে নিজেদের লড়াই। শোষকের বিরুদ্ধে শোষিতের সংগ্রাম।

অনিমেষের হঠাৎ মনে হল প্রাকৃবিপ্লব চীনের সঙ্গে ভারতবর্ষের বর্তমান শাসনব্যবস্থার হুবহু মিল আছে। লিফলেট-এ মাও সে তুং-এর লং মার্চের কথা বলা আছে। অনিমেষ আগেও সেই সংগ্রামী যাত্রার কাহিনী পড়েছে। কুও মিনতাং-এর নেতারা যখন ধারণা করেছেন চীনের মাটি থেকে কম্যুনিস্টরা মুছে যাচ্ছে তখন উনিশশো চৌত্রিশ সালের মোলই অক্টোবর নব্বই হাজার লোকের মুক্তিফৌজ রাতের অন্ধকারে শুরু করেছিল সেই মহাযাত্রা। পনে বছর বাদে উনিশশো উনপঞ্চাশে যা চীনকে মুক্ত করে নুতন ইতিহাস সৃষ্টি করল। নব্বই হাজার কৃষক শ্রমিককে সংগঠিত করেছিলেন মাও সে তুং। মার্চ হতো রাতের বেলায়। মুক্তিবাহিনী দুভাগে ভাগ হয়ে দক্ষিণ ও পশ্চিম দিকে চলতে শুরু করলো। যাত্রার চতুর্থ দিনে তারা আচমকা আক্রমণ করে চিয়াং কাইশেকের বাহিনীকে হঠিয়ে দিয়ে পথ পরিষ্কার করে নিল। মুক্তিফৌজের প্রধান বাহিনীর সঙ্গী ছিল যুবক, বৃদ্ধ, নারী, শিশুরা। ছিল খচ্চরের পিঠে চাপানো কারখানার মেশিন, অস্ত্রশস্ত্র, সাংসারিক জিনিস। প্রচুর ক্ষতি স্বীকার করতে হয়েছে মুক্তিবাহিনীকে। গতি ধীর হওয়ায় চিয়াং কাইশেক বারংবার আঘাত হেনে চলেছেন ওদের ওপর। দুদিক থেকে মিছিলকে তার সৈন্যরা আক্রমণ করছে আর মাথার ওপরে মার্কিন সাহায্যপ্রাপ্ত বিমান থেকে বোমা বর্ষণ চলছে। কিন্তু কিছুতেই দমল না মুক্তিবাহিনী। মানুষ যখন উদ্বুদ্ধ হয় দেশপ্রেমে তখন কোন প্রতিরোধ তার সামনে মাথা তুলতে পারে না। দেশের এপিঠ থেকে ওপিঠ মিছিলটা এগোচ্ছে। কোন বক্তৃতা দিয়ে মানুষকে বোঝানো বা শিক্ষিত করার চেয়ে জনসাধারণকে একত্রিত করার, উদ্বুদ্ধ করার এমন কার্যকরী উপায় কেউ ভাবতে পারেনি। এ মিছিল আমাদের মুক্তি, এই বোধ মানুষকে উৎসাহিত করেছিল। নইলে তাতু নদীর ওপর সেদিন অমন ঘটনা ঘটতে পারত না।
 

Users who are viewing this thread

Back
Top