What's new
Nirjonmela Desi Forum

Talk about the things that matter to you! Wanting to join the rest of our members? Feel free to sign up today and gain full access!

Collected কালবেলা- সমরেশ মজুমদার (2 Viewers)

মানিকতলার মোড়ে নেমে রামানন্দ চ্যাটার্জী স্ট্রীটে হেঁটে এল অনিমেষ। এটা ওর পুরোন পাড়া। কলকাতায় এসে এখানকার হস্টেলে উঠেছিল স্কটিশে পড়ার সময়। অনেকগুলো বছর কেটেছে এখানে। এই পাড়াটা সেই রকমই রয়ে গেছে শুধু হস্টেলের সেই ছেলেরা আর নেই। লাহা বাড়ি ছাড়িয়ে বা দিকের দোতলা বাড়ির দরজায় টোকা দিল সে। রাস্তাটা এখন খালি। সবে সন্ধ্যা হয়েছে কিন্তু কোন কারণে পথের আরো জ্বলেনি। অনিমেষ দেখল দরজার ডান দিকে একটা কষ্যি বেলের বোতাম রয়েছে। কিন্তু সেটা ব্যবহার করতে নিষেধ করা হয়েছে। বর্ণনা অনুযায়ী যে সে ঠিক বাড়িতেই এসেছে থেকে তাতে কোন ভুল নেই। কয়েক মুহূর্ত অপেক্ষা করেই সে আবার শব্দ করতে ওপরের ব্যালকনি থেকে একজন ঝাঁঝিয়ে উঠল, কাকে চাই?

আমি অনিমেষ।

ওপরে তাকিয়ে পরিচয় দিতেই ভদ্রলোক মিলিয়ে গেলেন। তার কয়েক মুহূর্ত বাদেই সেই মানুষটি দরজা খুলে ওকে ভেরতে আসতে ইঙ্গিত করলেন। একতলার পেছন দিকের ঘরে মহাদেবদারা বসে আছেন। সুবাসদাও রয়েছে। সেই পোস্টার মারার রাতের ঘটনার পর সুবাসদার সঙ্গে তার দেখা হয়নি। অনিমেষ সে প্রসঙ্গ তুলবে ভাবতেই মহাদেবদা চাপা গলায় জিজ্ঞাসা করলেন, একা এলে?

একাই তো। কেন বলুন তো?

কাউকে দ্যাখোনি পেছনে আসতে?

অনিমেষ অন্যমনস্ক ছিল কিন্তু পেছনে পেছনে কেউ এলে নিশ্চয়ই টের পেত সে। একটু তো কোন উপায় ছিল না। ঠিক আছে বেলঘরিয়াতে কেমন কাজ হল আজ? মহাদেবদা চিন্তিত গলায় জিজ্ঞাসা করলেন।

ভাল। খুব সিরিয়াস ছেলে সব। হুলিগানদের দলে নেবে কিনা প্রশ্ন করেছিল। অনিমেষ জানালো। নিতেই হবে। রিস্ক থাকছে বটে এ ছাড়া অন্য কোন উপায় নেই। আর হুলিগান কারা? যারা বোম মারছে, ছিনতাই করছে, তারই আবার কৌন গরীব বৃদ্ধার জন্য প্রাণ দিয়ে লড়ে যাচ্ছে। তাই এখন আর ওসব নিয়ে কিছু চিন্তা করা উচিত নয়।

মহাদেবতা কথা শেষ করে সুবাসদার দিকে তাকালেন। সুবাসদ একটু নড়েচড়ে বসে বলল, অনিমেষে, আমাদের কাছে খবর এসেছে তুমি ব্ল্যাক লিস্টেড হয়েছ। সাম হাউ পুলিশ তোমার খবর জেনে গিয়েছে। তোমার আর ওই হোস্টেলে থাকা উচিত নয়। যে কোন মুহূর্তেই তোমাকে অ্যারেস্ট করতে পারে।

আপনাদের খবর ঠিক আছে?

মহাদেবদা বললেন, আমাদের খবর যেমন ওরা পেয়ে যাচ্ছে ঠিক ওদের কিছু কিছু খবরও আমরা পাচ্ছি।

খবর ফাঁস হয়ে যাচ্ছে একথা সত্যি। দেশজুড়ে যে একটা আন্দোলনের প্রস্তুতি চলছে এ খবর এখন সরকারের জানা। সাধারণ মানুষও যে এ ব্যাপারে অজ্ঞ তা বলা চলে না। যেহেতু কংগ্রেসী সরকার নানান ঝামেলায় বিব্রত তাই অনিমেষদের সুবিধে হচ্ছে। একজন বিখ্যাত গান্ধীবাদী নেতাকে দল থেকে বিতাড়িত করেছে প্রদেশ কংগ্রেস। মুখ্যমন্ত্রীর খাদ্যনীতি অনুযায়ীই সারাদেশের জোতদাররা এখন কংগ্রেসেও প্রতি বিরূপ মনোভাব পোষণ করছেন। তারা ভীড় করছেন। তারা ভীড় করেছেন দলচ্যুত গান্ধীবাদী নেতার চারপাশের। নতুন দল গড়ে উঠেছে তার নেতৃত্বে। তবু পুলিশ নিষ্ক্রিয় হয়ে রয়েছে একথা বলা যাবে না। খবরের কাগজে পুলিশ কর্তৃক উগ্রপন্থীদের ডেরা আবিষ্কার। এসব খবর প্রায়ই ছাপা হচ্ছে। পরিস্থিতি অবশ্যই নিশ্চিন্তের নয়।

অনিমেষ হাসল, আপনাদের সাজেশন কি?

সুবাসদা বলল, তোমার থাকা বিকল্প ব্যবস্থা আছে?

না। দু-একজন বন্ধুর মুখ মনে পড়ছে অবশ্য।

তাদের কারো কাছে আজ রাত্রে থেকে যাও। হস্টেলে ফিরো না।

কিন্তু আমার জিনিসপত্র তো ওখানে পড়ে আছে।

ওগুলোর কথা পরে চিন্তা করা যাবে।
 
মহাদেবদা বললেন, অনিমেষ, তোমার এখন কোলকাতা থেকে চলে যাওয়া দরকার। ব্যাপারটা নিয়ে আমরা আগে থেকেই চিন্তা করছিলাম। এটাই মনে হয় উপযুক্ত সময়। তুমি উত্তর বাংলায় চল যাও। ওখানে টেনশন কম থাকবে, মনের মত কাজ করতে পারবে আর পুলিশের ঝামেলা থেকে অনেকটা নিশ্চিন্তে থাকতে পারবে।

অনিমেষ জিজ্ঞাসা করল, সমস্ত ব্যবস্থা হয়ে গেছে?

মহাদেবদা বললেন, হ্যাঁ।

কবে যাব?

আজ নয় কাল। শিলিগুড়ির স্টেশন পাড়ায় একজনের সঙ্গে দেখা করবে। তাকে সব খবর দেওয়া হয়ে গেছে। হি উইল টেল ইড এভরিথিং।

আজ রাত্রে রওনা হওয়ার একটু অসুবিধে আছে! কথাটা বলার সময় মাধবীলতা মুখ মনে পড়ল অনিমেষের। ওকে একটুও না জানিয়ে হুট করে চলে যাওয়াটা অন্যন্ত অন্যায় হবে।

কালই যেও। এই সময়টা বাইরে বেশি ঘুরে বেড়িও না। উত্তর বাংলায় তোমার চেনা এলাকায় কাজ করতে নিশ্চয়ই সুবিধে হবে। তাছাড়া কলকাতা ক্রমশ গরম হয়ে উঠছে। আমাদের এখান থেকে বেরিয়ে যেতে হবে।

আমাদের যোগাযোগ থাকবে কি করে?

সে ব্যবস্থা করা হচ্ছে। সুবাস যাচ্ছে বীরভূমে, আগামী মাসে বোলপুরে একটা গোপন মিটিং আছে। খবর পাবে তখন দেখা হবে। আচ্ছা আজ আর রাত করো না। মহাদেবদা ঘর থেকে বেরিয়ে কাউকে রাস্তাটা দেখতে বললেন।

অনিমেষ বলল, সুবাসদা, আমায় যদি কালই চলে যেতে হয় তাহলে হস্টেলের জিনিসপত্রগুলোর কি হবে? আমি তো আজ–।

একটা ঠিকানা দাও, পৌঁছে দেওয়া হবে।

অনিমেষ এক মুহূর্ত চিন্তা করে মাধবীলতার ঠিকানাটা দিল। সুবাসদা বলল, ওটা তো গার্লস হস্টেল তাই না?

হ্যাঁ। অনিমেষ সুবাসদার মুখে চোখ রাখল, কোন ভাবান্তর দেখতে পেল না। রামানন্দ চ্যাটার্জী স্ট্রীট এখন ফাঁকা। কোথাও রেডিও বাজছে তারস্বরে। অনিমেষ ওর পুরোন হস্টেলের সামনে দিয়ে হেঁটে আসছিল। আমনে পেছনে তাকিয়ে সন্দেহজনক কাউকে দেখতে পেল না। মহাদেবদার খবার কতটা সত্যি কে জানে। নাকি তাড়াতাড়ি যাতে সে উত্তর বাংলায় যায় তার এসব কথা বললেন? সঙ্গে সঙ্গে মনে হল না এ রকম ছেলে মানুষী মহাদেবদা করবেন না। আজ রাত্রে কোথায় থাকবে ভাবতে লাগল অনিমেষে। পরমহংসের মুখ মনে পড়ল। ওর বাড়িতে গিয়ে পড়লে নিশ্চয়ই না বলবে না। কিন্তু হস্টেলে ফেরা যে দরকার ছিল। খাটে তোষকের থলায় কিছু টাকা রয়েছে ওগুলোর প্রয়োজন। অনিমেষ ঠিক করল পরমহংসকে রাজী করাবে তার হস্টেলে গিয়ে সেগুলো নিয়ে আসতে। তামালকে একটা চিঠি লিখে দিলে সেই ব্যবস্থা করে দেবে। হস্টেলের সামনে পুলিশ থাকবে পারে কিন্তু তার ঘরের সামনে নিশ্চয়ই কেউ পাহারা দিচ্ছে না। এখন ঘটনা কি দ্রুত মোড় নিচ্ছে অথচ আজ হস্টেল থেকে বেরুবার সময় এসব সে টেরই পায়নি।

আমহার্স্ট স্ট্রীটে এসে অনিমেষ ডান দিকে মোড় নিল। বিবেকানন্দ রোড ধরে কর্ণওয়ালিস স্ট্রীটে গিয়ে ট্রাম ধরে পরমহংসের বাড়িতে যাবে। রাত হয়েছে। নিশ্চয়ই এতক্ষণে ওর টিউশণি শেষ হয়েছে।
 
অনিমেষ সাবধানে পথ হাঁটছিল। হঠাৎ ওর অস্বস্তি শুরু হল। মনে হল কেউ ওর পেছন পেছন হাঁটছে। ঘাড় ঘুরিয়ে কোন সন্দেহজনক কাউকে দেখতে পেল না সে। হাসল অনিমেষ, মানসিক প্রতিক্রিয়া থেকে এই রকম গোলমেলে চিন্তা আসে। তবু নিশ্চিন্ত হতে সে ফুটপাথ পালটালো। একটা পানের দোকনের সামনে গিয়ে পয়সা দিয়ে সিগারেট কিনলো কিনেই চট কর ঘুরে দাঁড়ালো। খুব দ্রুত উলটা ফুটপাথের মানুষগুলোকে লক্ষ্য করতে গিয়ে অনিমেষের চোখ একটি মুখের ওপর স্থির হল। লোকটা চোখে চোখ পড়তেই মুখ ঘুরিয়ে নিল। অনিমেষ দৃষ্টি সরাচ্ছিল না। লম্বা রোগা লোকটা যে একটু অস্বস্তিতে পড়েছে বুঝতে অসুবিধে হচ্ছিল না। এমনিতে খুব নিরীহ দেখাচ্ছিল তাকে, শুধু কিছুতেই আর এদিকে চোখ ফেরাচ্ছিল না। অনিমেষের তবু সন্দেহ ছিল যে মহাদেবদার কথা মতন এই লোকই সেই কিনা। সে হঠাৎ এগিয়ে পাশের কালোয়ারের গলিতে ঢুকে পড়ল। এখানকার হস্টেলে থাকার সময় এই গলি দিয়ে ওরা শর্টকার্ট করতে কলেজে যেতে। দুপাশে লোহালড়ের দোকান, গলিটাও সরু। দ্রুত পায়ে বেশ কিছুটা গিয়ে ডান দিকে মোড় ঘুরতেই অনিমেষ পেছনে তাকালো। লোকটি হন্তদন্ত হয়ে ফুটপাত পেরিয়ে গলিতে পৌঁছে গেছে। ওর একটা হাত কোমরের কাছে সতর্কভঙ্গীতে রাখা।

অনিমেষ পা চালালো। আর সন্দেহ করার কিছু বাকী থাকলো না। পুলিশ তার পেছনে লেগে গেছে। এখন এই লোকটাকে কোনভাবে না কাটাতে পারলে পরমহংসের বাড়িতে যাওয়া যাবে না। কি করা যায় ভাবতে ভাবতে সে বিবেকানন্দ রোড এসে পড়ল। রাস্তাটা পার হয়ে স্কটিশের গলিতে ঢুকে পেছনে ফিরতেই সে লোকটাকে দেখতে পেল। কালোয়ারের গলি থেকে রেরিয়ে এপাশ-ওপাশ দেখছে। অনিমেষ একটা থামের পাশে নিজেকে গুটিয়ে লক্ষ্য করতে লাগল। লোকটা দুদিকের ফুটপাথ ভাল করে যাচাই করে রাস্তা পার হচ্ছে। আর এখানে দাঁড়িয়ে থাকা উচিত নয়। অনিমেষ থামটা ছেড়ে পা বাড়াবার আগেই দেখতে পেল রাস্তার এধারে দাঁড়ানো একটা জীপের পাশে গিয়ে লোকটা হাত পা নেড়ে কথা বলছে। ওটা যে পুলিশের গাড়ি তা বুঝতে সময় লাগল না। কারণ চার পাঁচটা পুলিশ গাড়ি থেকে লাফিয়ে নামল। অনিমেষ আর অপেক্ষা করল না। ফুটপাথ ধরে সোজা ছুটতে লাগল স্টটিশের দিকে আর তখনই পেছনে হইচই শুরু হল। পুলিশগুলো ছুটছে এবার।

রাস্তাটা বাঁক নিতেই চোখের সামনে লাল বাড়িটা যেন ছিটকে চলে এল। অনিমেষের মনে পড়ল সেই সন্ধ্যের কথা। স্কটিশ হস্টেলের সেই আফ্রিকান ছেলেটির সঙ্গে ট্যাক্সিতে ওরা একজন মহিলাকে এখানে নামিয়ে দিয়েছিল। এই মুহূর্তে মহিলার নামটা কিছুতেই মনে পড়ছে না। কিন্তু পঁয়ত্রিশ আর চারটে শুন্য টেলিফোনের এই নম্বরটা মনে করতে একটুও অসুবিধা হল না। একটুও ইতস্তত করল না অনিমেষ। চিৎকার চেঁচামেচিটা এগিয়ে আসছে। এখনই রাস্তায় ভীড় জমে যাবে। সামনে এগুলে লুকোবার কোন জায়গা নেই। অনিমেষ গম্ভীর মুখে খোলা জায়গাটা পেরিয়ে লাল বাড়িটার ভেতরে ঢুকে আড়ালে দাঁড়ালো। পুলিশগুলো সামনের রাস্তা দিয়ে ছুটে গেল খানিক, তারপর দাঁড়িয়ে পড়ে চারপাশে তাকাতে লাগল। ঠিক এমন সময় পেছনে একটা গলা আচমকা কথা বলে ওঠায় অনিমেষ চমকে উঠল। কাকে চাই?
 
অনিমেষ দেখল একজন বৃদ্ধ ধুতি ফতুয়া পরে তার দিকে সতর্ক চোখে তাকিয়ে আছেন। কিছুতেই নামটা মনে করতে পারল না অনিমেষ। থম্বোটোর নাম মনে পড়ছে। এমনকি ভদ্র মহিলার হাসিও, কিন্তু। অথচ আর বেশী ইতস্তত করলে এখানে দাঁড়িয়ে থাকা চলবে না। বাইরে বেরুলে আর রক্ষে থাকবে না এ তো স্পষ্ট।

কুলকুল করে ঘামতে লাগল সে। তার কোন রকমে নিজেকে সামলে জিজ্ঞাসা করল, এ বাড়িতে থ্রি ফাইভ ফোর জিরো ফোন কোন ফ্লাটে জানেন?

টেলিফোন? কি দরকার? বুড়োর গলায় সন্দেহ।

আমি টেলিফোন অফিস থেকে আসছি।

মিথ্যে কথাটা খুব দ্রুত অনিমেষের জিভে এসে গেল।

অ। দোতলায় বা দিকে। ওই একটিই টেলিফোন আছে এ বাড়িতে। নাম্বার ফাম্বার জানি না। ভদ্রলোক ঘাড় নাড়লেন।

অনিমেষ আর দাঁড়ালো না। সামনের সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় উঠে এল। বাঁ দিকের ফ্ল্যাটের দরজা বন্ধ। কলিং বেল হাত রাখল সে। জলতরঙ্গ বাজল। অনিমেষের মনে হল বুড়োটা যদি এখন বাইরে বের হয় আর পুলিম যদি জিজ্ঞাসাবাদ করে তাহলে তো আর উপায় থাকবে না। ব্যস্ত হয়ে আবার সে কলিং বেল টিপতেই দরজা খুলে একজন বৃদ্ধা উঁকি মালল, কি চাই?

আর কি আশ্চর্য ব্যাপার মুখ খুলতেই নামটা জিভে এসে গেল। অনিমেষ জিজ্ঞাসা করল, শীলা সেন আছেন?

আপনার নাম?

অনিমেষ মিত্র। পরিচয় দিয়েই অনিমেষের মনে হল শীলা সেন হয়তো বুঝতেই পারবেন না সে কে। এত বছরের অদর্শন সেই সামান্য পরিচয়কে ভুলিয়ে দেওয়ার পক্ষে যথেষ্ট। তাই সে আর একটু জুড়ে দিল, স্কটিশ কলেজের হোস্টেলে আমি থাকতাম।

মিনিট তিনেক অপেক্ষা করতে হল অনিমেষকে। এখন এক সেকেন্ড এক ঘন্টার মত দীর্ঘ মনে হচ্ছে। পুলিশগুলো যদি নীচের সেই বৃদ্ধের সঙ্গে কথা বলে তাহলে এখানে চলে আসতে পারে। আর শীলা মে এত দেরীই বা করছেন কেন? যদি ভদ্র মহিলা তাকে চিনতে না পারেন তো হয়ে গেল। তখন রাস্তায় যে এগিয়ে গেয়ে লুকোবার উপায় নেই আর মাথার শীরা সেনের কথাটাও আচমকা এসে গেল।

আধখোলা দরজার সামনে অনিমেষ যখন প্রায়ই অসহিষ্ণু তখনই আহ্বান এল। মহিলা তাকে ভেতরে আসতে বলল। সাজানো টেবিল বেয়ার দেখে বোঝা যায় এটাই বসবার ঘর। অনিমেষ তার একটায় বসতে গিয়ে দেখল সেখানে ধুলো পুরু হয়ে আছে। অনেক দিন কারো হাত পড়েনি এখানে। বৃদ্ধা বলল, দিদিমণি এখানে আসতে পারবে না। তারপর একটু উদাসী গলায় জানালো, তেনার শরীর খারাপ।

অনিমেষের নজর বাইরের দরজার দিকে ছিল, শেষ কথাটা শুনে হতাশ হল সে। শীলা সেন যদি অসুস্থ হন তাহলে ভেতরে আসতে অনুমতি দিলেন কেন? এই বাড়িতে কি আর লোকজন নেই? কেমন চুপচাপ চারধার। অনিমেষ বলল, আমি কে ওকে দেখতে যেতে পারি?

সে কথাই তো বলল। আমার সঙ্গে আসুন।

মাঝখানে একটা অবিন্যস্ত ঘর। কিছু পুরোন দিনের আসবাব। ঘরটা পেরিয়ে যাওয়ার মুহূর্তে অনিমেষের মনে হল কেউ যেন কোণার ইজিচেয়ারে শুয়ে আছে। কিন্তু তার শরীর এত ক্ষীণ যে অস্তিত্ব বোঝার আগেই সে তৃতীয় ঘরে প্রবেশ করল।
 
এমন ঝকঝকে তকতকে ঘর অনিমেষ কখনো দেখেনি। এই বাড়ি চরিত্রের সঙ্গে এই ঘর একদম মানায় না। বৃদ্ধা একটা সোফা দেখিয়ে বসতে বলে অন্য ঘরে চলে গেল। ঘরে কেউ নেই। কোণার দিকে সুন্দর সাজানো বিছানা। বিছানার পাশে এটা স্ট্যান্ডে টেলিফোন। ঘরের সমস্ত দেওয়াল এবং ছাদ প্লাস্টিক রঙ করা। দেওয়ালের গায়ে লম্বা রঙিন কাবার্ড। এমন কি ঘরের মেঝেতেও রঙিন টাইল সাজানো। এই ঘরের মালিকের সৌখিন মেজাজ এক পলকেই ধরা পড়ে যাচ্ছে। অনিমেষ সোফায় বসতে যাচ্ছিল উঠল অনিমেষ। সামান্য কয়েকটা বছরের ব্যবধানে একটি পরে যিনি ঢুকলেন তাকে দেখে চমকে উঠল অনিমেষ। সামান্য কয়েকটা বছরের ব্যবধানে একটি মানুষের চেহারা কি এত দ্রুত পালটে যেতে পারে? অনিমেষ কথা খুঁজে পাচ্ছিল না।

কি খবর! এতদিনে মনে পড়ল? ওমা! এ যে দেখছি সোমত্থ পুরুষ হয়ে গেছে। শীলা সেন হাসলেন। অনিমেষ খুব খোলা রাখছিল। এ কাকে দেখছে সে! হাউসকোটের আড়ালে যে বিশাল শরীরটা পায়ে পায়ে হেঁটে খাটের দিকে এগোচ্ছে তার সঙ্গে থম্বোটার বন্ধু শীলা সেনের কোন মিল নেই। মাথায় একটা কালো রুমলা বাধা চোখে গগলস। মুখে যেন থোকা থোকা মাংস কেউ ছুঁড়ে মেরেছে। বীভৎস একটা মাংসের পিন্ড হয়ে শীলা সেন খাটে বসলেন। বসে আবার হাসলেন, আমাকে দেখে নিশ্চয়ই মচকে উঠছে? মুখের উপর বাড়তি মাংসের মাঝে পোড়া ভাজ হাসিটাকে করুণ করে তুলছিল।

এই সামান্য বয়সে অনিমেষ মানুষের অনেক রকম মুখ দেখেছে। তিস্তার বুকে নৌকোয় বসে অথবা সেই বন্যার সময় রিলিফ দিতে কুষ্ঠরোগীদের গ্রামে গিয়ে অনেক গলিত বিকৃত মুখ তাকে দেখতে হয়েছে। সে সব স্মৃতি এখন আর বুকের মধ্যে কোন ভয়ংকর ছাপ নিয়ে বেঁচে নেই। কিন্তু এই মুখ তাকে এমন নাড়া দিল যে অনিমেষ চোখ বন্ধ করতে পারলে বড় আরাম পেত। কি হয়েছে আপনার? নিজের কণ্ঠস্বর অচেনা ঠেকল অনিমেষের।

ও কিছু না। তুমি কেমন আছ?

আমি ভালই। কিন্তু

হঠাৎ কি মনে করে?

এদিক দিয়ে যাচ্ছিলাম, ভাবলাম।

কি করছ এখন? পড়াশুনা শেষ হয়েছে।

না। বোধ হয় শেষ হবে না।

সেকি! কেন?

সে অনেক কথা। কিন্তু আপনার এ অবস্থা কেন?

সেও অনেক কথা। বলে হাসলেন শীলা সেন। ঠিক সেই সময় বাইরের দরজার শব্দ হতেই অনিমেষ চমকে উঠল। শীলা সেন বললে, আবার কে এল!

কয়েক মুহূর্ত বাদেই সেই মহিলা দরজায় এল। ঘরে ঢুকে সোজা শীলা সেনের কানের কাছে মুখ রেখে কিছু বলল। ওই বিকট শরীর নিয়ে সঙ্গে সঙ্গে সোজা হয়ে বসলেন শীলা সেন সেকি! এখন পুলিশ কেন? দরজা খুলেছিস?

না, ফুটো দিয়ে দেখলাম। বৃদ্ধার কথা শেষ না হতেই বাইরে শব্দ হল। এক মুহূর্ত চিন্তা করে আবার উঠে দাঁড়ালেন শীলা সেন। অনিমেষ তখন মাথা নামিয়ে দাঁতে ঠোঁট কামড়ে ধরেছে। সেদিকে থাকিয়ে শীলা সেন বললেন, আমাকে নিয়ে চল, আমি কথা বলব।

তুমি আবার যাবে কেন।

আঃ, যা বলছি তাই কর। শীলা সেন ধমক দিলেন।

মহিলা ওর হাত ধরলে শীলা সেন পায়ে পায়ে হাঁটতে লাগলেন বাইরের ঘরের উদ্দেশ্য কিন্তু হাঁটতে যে ওর কষ্ট হচ্ছে তা বুঝতে অসুবিধা হয় না। ওঁরা ঘরের বাইরে যাওয়া মাত্র অনিমেষ চট করে উঠে দাঁড়াল।

এখান থেকে অবিলম্বে পালানো দরকার। পুলিশ নিশ্চয়ই এই ফ্লাট সার্চ করবে এখন। সে সাজানো ঘরটার চার পাশে চোখ বোলালো। এই ফ্ল্যাট থেকে বাইরে বের হবার আর কোন দরজা আছে কিনা বোঝা যাচ্ছে না। বাথরুমের দরজা খুলে সে তার ভেতরে একটা ছোট জানলা দেখতে পেল। জানলাতে কোন গরাদ নেই কিন্তু এখান থেকে লাফিয়ে নীচে নামা তার পক্ষে অসম্ভব। ফাঁদে পড়া ইঁদুরের মত অসহায় লাগছিল অনিমেষের। এ রকম বোকার মত ধরা দেওয়ার চেয়ে ওই জানাল দিয়ে একবার চেষ্টা করলে কেমন হয়! সে জানলা দিয়ে ঝুঁকে নীচের দিকটা জরিপ করল। জানলার অনেক নীচে একটা পাইপ দেওয়াল বের নেমে গেছে। সেটা হাতের নাগালে পেলে একটু চেষ্টা করা যায়। তাবে তার আগে বাথরুমের ছিটকিনি ভেতর থেকে বন্ধ করে দিতে হবে কিছুটা সময় পাওয়ার জন্যে। দরজাটা বন্ধ করতে গিয়ে ভেতরে গলা পেল অনিমেষ। শীলা সেন বেশ যন্ত্রণার গলায় কথা বলছেন। সামান্য অপেক্ষা করইে সে বুঝতে পারল পুলিশ এই ঘরে আসেনি এখনও। বাড়ি সার্চ করলে তারা শীলা সেনকে ছেড়ে দিত না। খুব সম্পূর্ন দরজাটা খুলতেই চোখে পড়ল বিছানায় বসে শীলা সেন হাঁপাচ্ছেন। তার মুখ অনিমেষের দিকে ফেরানো।
 
খুব ভয় পাইয়ে দিয়েছিলে তুমি! এলে তো একেবারে পুলিশ টেনে নিয়ে এলে। শীলা সেনের কণ্ঠস্বরে তারল্য নেই।

উপায় ছিল না। তারা আছেন?

না, ভয় নেই। নিশ্চিন্তে বসো।

অনিমেষ স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। শীলা সেন কিভাবে পুলিশকে কাটালেন সে জানে না, কিন্তু বীভৎস চেহারার মানুষটির কাছে সে ভীষণ কৃতজ্ঞ হয়ে রইল। সোফায় বসলে শীলা সেন জিজ্ঞাসা করলেন, কি হয়েছে বল তো? মোতার পেছনে পুলিশ কেন?

সে অনেক কথাব। অনিমেষ ঠিক কি বলা উচিত ভাবছিল।

তা তো বুঝলাম। মুতি চুরি ডাকাতি করেছ এটা তো আর ভাবতে পারছি না। কিন্তু ওদের কথাবার্তা শুনে বুঝলাম তুমি খুব ভয়ংকর লোক। শুনে আমি হেসে বাঁচি না। নাক টিপলে দুধ বের হবে যার তাকে ভয়ংকর বলা হচ্ছে! শীলা সেন হাসতে চেষ্টা করতেই মুখটা আরো বীভৎস হয়ে গেল। এতক্ষণে এই দৃশ্য অনিমেষের সয়ে গেছে। অনিমেষ বলল, আমার কিন্তু যথেষ্ট বয়স হয়েছে।

তাই নাকি। সত্যি?

ওঁর বলার ধরনে অনিমেষ এবার মজা পেল। আগের শীলা সেনের সুন্দর মুখের এই ধরনের রসিকতা চমৎকার মানিয়ে যেত। এখন কণ্ঠস্বর একই থাকলেও মুখ বিশ্বাসঘাতকতা করছে। এই মুহূর্তে শীলা সেন নিশ্বয়ই সেই কথা ভুলে গেছেন। অনিমেষ এমন ভাব করল যেন মুখের এই বিকৃতি তারও খোয়ালে নেই।

সত্যি কথাটা বলো তো এবার। পুলিশ খুঁজছে কেন?

বলছি। কিন্তু কি বলে ওদের বিদায় করলেন?

বললাম আমার বাড়িতে কেউ আসেনি। আমি অসুস্থ বিছানায় শুয়ে থাকি। খামোকা আমার কাছে কেউ আসতেই বা যাবে কেন? যে অফিসার এসেছিলেন তিনি বোধ হয় এককালে আমার খবর রাখতেন। তাই তোমার সম্পর্কে অনেক সতর্ক করে বিদায় হলেন। কি হয়েছে?

শীলা সেনের শরীর থেকে চোখ সরিয়ে নিল অনিমেষ। কিভাবে এই মহিলাকে ওসব কথা বলা যায়। বললে ইনি কিছু বুঝবেন বলে তার ভরসা হচ্ছে না। অথচ না বলে সরে থাকা শোচনীয় নয়। সঙ্গে সঙ্গে মনে হল একজন সাধারণ মানুষকে যদি তাদের উদ্দেশ্যের কথা সে না বোঝাতে পারে তাহলে।। আমরা এদেশের রাজনৈতিক সামাজিক ব্যবস্থাটা মানতে পারছি না। ভেতরে ভেতরে আমরা প্রস্তুত হচ্ছি দেশ জুড়ে বিপ্লবের জন্যে। বুঝতেই পারছেন যারা এখন ক্ষমতায় আছে তারা আমাদের যেমন শত্রু আমরাও তাদের। আমাদের থামিয়ে দেওয়ার জন্যেই পুলিশ পেছন নিয়েছে। অনিমেষ কথাগুলো বলার সময় মহিলার মুখের দিকে সতর্ক নজর রেখে ছিল। মুখের বিকৃতির জন্যে সেখানে কি প্রতিক্রিয়া হল বোঝা গেল না।

কাগজে তাহলে তোমাদের কথাই লিখেছে?

কি লিখেছে?

আমি তো পড়ি না, আমাকে পড়ে শোনায়। কি যেন কথাটা, হ্যাঁ, উগ্রপন্থী, তোমরা তাই?

উগ্রপন্থী! অনিমেষ হেসে ফেলল, না, কথাটা হওয়া উচিত সঠিক পন্থী।

কিন্তু কিভাবে তোমরা দেশটাকে পালটাবে?

এদের হাত থেকে অধিকার ছিনিয়ে নিয়ে।

কি যে হাসির কথা বলছ!

কেন?

এদের কত পুলিশ, মিলিটারী। কত বন্দুক কামান। তোমরা যতই দল গড় এদের সঙ্গে কখনো পারো! অসম্ভব। এদের বিরুদ্ধে লড়াই করা আর অত্মহত্যা করতে যাওয়া একই ব্যাপার।
 
যে কোন বিপ্লবের আগে একথাই মনে হয়। কিন্তু মানুষের মনের ভেতর যদি আগুন থাকে তাহলে বাইরের কোন শক্তিই তাকে নিভিয়ে দিতে পারে না। জনসাধারণ পরিবর্তন চাইলে তা হতে বাধ্য।

কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থাকলেন শীলা সেন। তারপর নীচু গলায় বললেন, তার মানে তোমার একটা ভাল কাজ করতে চাইছ। বেশ, করো।

আপনি আমার খুব উপকার করলেন, আজ।

না জেনে করেছি। আমার কোন কৃতিত্ব নেই। ওমা, দেখো তখন থেকে শুধু বকবক করছি। অথচ। খাটের পাশে রাখা একটা বোতামে চাপ দিতেই ভেতরে কোথাও আওয়াজ উঠল। অনিমেষ দেখল সেই মহিলা দরজায় এসে দাঁড়িয়েছেন, হারে, তোরও কি বোধবুদ্ধি লোপ পেল! চা খাবার নিয়ে আয়।

অনিমেষ বাধা দিল, না না, এখন কিছু খাবো না। অনেক রাত হয়ে গেছে, এবার চলি।

যাবে, কোথায় যাবে?

মানে?

আজ রাত্রে তোমার এখান থেকে বের হওয়া উচিত নয়। পুলিশ যে সামনের রাস্তায় নেই তা কে বলতে পারে।

কিন্তু।

কিন্তু আবার কি। এখন তো আর হোস্টেলেও ফিরে যাওয়া চলবে না। কোথায় আছ এখন?

এতদিন হোস্টেলেই ছিলাম, আজ রাত থেকে অনিশ্চিত।

তোমার বাড়ির লোক জানে?

জানি না।

তোমাদের তো চা-বাগান ছিল।

কম্মিন কালেও নয়। আমার বাবা চা বাগানে কাজ করেন। ওঁরা তো কেউ কোলকাতায় নেই!

না। তাহলে আর ওঠার জন্যে ছটফট করছ কেন? কাউকে যদি খবর দেবার থাকে কিছু তাহলে টেলিফোনে দিয়ে দাও। খাটের উলটো দিকটা ইঙ্গিতে দেখিয়ে দিলেন শীলা সেন। টেলিফোনটা এতক্ষণ নির্জীব ছিল কিংবা কাঠের বাক্সবন্দী থাকায় অনিমেষের চোখে পড়েনি। এখন সেটা নরে আসতেই হুড়মুড় করে নানা চিন্তা মাথায় ঢুকে পড়ল। কাল যদি উত্তর বাংলায় চলে যেতেই হয় তাহলে আজই মাধবীলতার সঙ্গে কথা বলা দরকার। কিন্তু এত রাত্রে ওর হোস্টেলে গিয়ে দেখা পাওয়ার বোধ হয় সম্ভাবনা নেই। হয়তো জরুরী বললে টেলিফোনে ডেকে দিতে পারে। অনিমেষ উঠে শীলা সেনের খাটটা ঘুরে টেলিফোনের পাশে এসে দাঁড়াল।

ওপাশে রিং হচ্ছিল। অনিমেষ রিসিভারটা কানে ঠেকিয়ে শীলা সেনের দিকে আড় চোখে তাকাল। একটা সাদা পাথর কেটে কুটে মানুষের আদল আনা হয়েছে মাত্র এখনও মুখ নাক চোখ স্পষ্ট হয়নি এ রকম একটা ছবি মনে পড়ল। এতক্ষণে সে স্থির নিশ্চিত মহিলা চোখে দেখতে পান না বা পেলেও তা অতি সামান্য।

হ্যালো! ওপাশে গলা শুনতে পেল সে। মনে হয় সেই সুপারের গলা ঈষৎ চিন্তিত এবং কিছুটা বিরক্ত।

হ্যালো। নিজেকে জানান দিয়ে নম্বরটা মিলিয়ে নিল অনিমেষ।

কে বলছেন?

আমি অনিমেষ মিত্র। আপনার একজন বোর্ডার মাধবীলতা সঙ্গে কথা চাইছি। অনিমেষ নামটা বলবার সময় শীলা সেনের দিকে তাকাল। না, সেখানে কোন রকম কৌতূহলের প্রকাশ নেই।

মাপ করবেন, এত রাত্রে কাউকে ডেকে দেয়া সম্ভব নয়। আপনি কাল সকাল সাতটার পর টেলিফোন করবেন। আচ্ছা। ভদ্র মহিলার কাঠ কাঠ গলা শেষের দিকে নীচে নেমে এল। উনি বোধ হয় রিসিভার নামিয়ে রাখছেন ভেবে অনিমেষ তড়িঘড়ি অনুনয় করল শুনুন, প্লিজ, আমি জানি এত রাত্রে টেলিফোন করা উচিত নয় কিন্তু নিতান্ত বাধ্য হয়ে আমাকে করতে হচ্ছে। বিষয়টা অত্যন্ত জরুরী। এখন না জানালে খুব ক্ষতি হয়ে যাবে।

কয়েক পলক নীরবতা, তারপর মহিলা জিজ্ঞাসা করলেন, আপনার নাম আর একবার বলুন।

অনিমেষ মিত্র।

একটু ধরুন। ওপাশে রিসিভার টেবিলের ওপর নামিয়ে রাখার শব্দ হল। মিনিট দুয়েক অপেক্ষার যন্ত্রণায় কাটল অনিমেষের। এ ঘরেও কোন শব্দ নেই। শীলা সেনের শরীর একই ভঙ্গিমায় খাটের উপর বসে রয়েছে।

ওপাশে গলা বাজল, দেখুন, এত রাত্রে আমরা টেলিফোন অ্যাটেন্ড করতে চাই না। তবে আপনার নাম ওর ফর্মে আছে বলে, আর একটু ধরুন আমি খবর পাঠাচ্ছি।
 
স্বস্তির নিঃশ্বাস পড়ল অনিমেষের। যাক, ফাড়া তাহলে কাটল। আজব মহিলা বটে। ফর্ম ভেরিফিকেশন করে তবে কথা বলার অনুমতি দিলেন।

একটু বাদেই মাধবীলতার গলা শুনল। গলায় প্রচণ্ড উদ্বেগ, হ্যালো।

আমি বলছি। অনিমেষ মৃদু হাসল।

কি ব্যাপার? মাধবীলতা আরো অবাক।

খুব জরুরী বলে করতে হলো। তোমার অসুবিধে হল না তো?

সে ঠিক আছে, কি হয়েছে?

আমাকে নর্থ বেঙ্গলে চলে যেতে হচ্ছে।

নর্থ বেঙ্গল?

তোমাকে সম্ভাবনার কথা বলেছিলাম।

ও। কিন্তু এখনই।

কোলকাতায় থাকা আমার পক্ষে আর নিরাপদ নয়।

কোত্থেকে বলছ?

অনিমেষ আর একবার শীলা সেনের দিকে তাকাল। প্রতিক্রিয়া কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। অনিমেষ জবাব দিল, একজনের বাড়ি থেকে। আজ এখানে থাকতে হবে, বাইরে পুলিশ ঘুরছে।

কখন যাবে?

কালই।

যাওয়ার আগে দেখা হবে না?

জানি না, হয়তো নয়। তোমার কাছে আমার জিনিসপত্র কেউ পৌঁছে দিয়ে আসবে, সেগুলো রেখে দিও।

আচ্ছা।

আর শোন, পুলিশ যদি তোমাকে আমার ব্যাপারে জিজ্ঞাসাবাদ করে স্রেফ অস্বীকার করবে। ওরা যে যাবেই তা বলছি না, তবে যদি যায়।

ওসব চিন্তা করতে হবে না। কিন্তু এত তাড়াতাড়ি কি করে হয়ে গেল?

হয়ে গেল, কেন হল জানি না।

আমি কি তোমার কাছে যাব?

কখন?

এখন।

এত রাত্রে?

এমন কিছু রাত হয়নি। তোমায় দেখতে ইচ্ছে করছে।

উঁহু। এখন এলে পুলিশ তোমাকে সন্দেহ করবে। তাছাড়া হোস্টেলে তোমাকে থাকতে হবে। হঠাৎ শীলা সেনের গলা কানে এল, ওকে কাল ভোরে আসতে বল। তাহলে তোমার পক্ষে এখান থেকে বেরুনো সহজ হবে।

অনিমেষ চমকে ওঁর দিকে তাকাল। উনি যে এতক্ষণ তার কথা শুনছিলেন বোঝা যায়নি। কার সঙ্গে সে টেলিফোনে কথা বলছে অনিমেষ না জানালো সত্ত্বেও কি করে অনুমান করলেন?

ওপাশে মাধবীলতা চুপ করে ছিল। অনিমেষ বলল, অবশ্য তুমি যদি ঝুঁকি নিতে পারো তাহলে কাল যত তাড়াতাড়ি পারো ভোরেই চলে এস।

সঙ্গে সঙ্গে রাজী হয়ে গেল মাধবীলতা। অনিমেষ তাকে শীলা সেনের বাড়ির ঠিকানা এমন করে বুঝিয়ে দিল যাতে পথে কাউকে জিজ্ঞাসা করতে না হয়। টেলিফোন ছেড়ে দিয়ে সামনে আসতেই শীলা সেন বললেন, এখানে উঠে বসো আরাম করে। হাত দিয়ে খাটের একটা ধার দেখিয়ে দিলেন। সেই সময় পেছনে পায়ের শব্দ হল। অনিমেষ তাকিয়ে দেখল একটা ট্রেতে ওমলেট আর চা নিয়ে এসেছে সেই মহিলাটি। ছোট একটা টেবিলের ওপর সেগুলো নামিয়ে রাখতেই শীলা সেন বললেন, খাবার এনেছিস? কি দিলি?

ওমলেট।

শুধু ওমলেট? একটু মিষ্টি আনতে পারলি না?

আপনি এত ব্যস্ত হচ্ছেন কেন? অনিমেষ প্রতিবাদ করল।

ওগুলো খেয়ে নাও।

ক্ষিদে পেয়েছিল খুব। অনিমেষ ইতস্তত করল না।

খাওয়া হয়ে গেলে শীলা সেন হাসলেন, মেয়েটি কে?

আমার সহপাঠিনী।

উঁহু।

তাহলে?

আরো বেশি, অনেক বেশি। তা না হলে এই রাত্রে সে আসতে চাইতে না।

অনিমেষ কথা বলল না। অবাক হয়ে মহিলার বীভৎস মুখের দিকে তাকিয়ে থাকল। এমন করে দেখতে বোধ হয় একমাত্র মেয়েরাই পারে।

শীলা সেন আবার বললেন, তোমার এসব কথা সে পরিষ্কার জানে?

নিশ্চয়ই।

তবু সে ভালবেসেছে, না? দীর্ঘশ্বাস স্পষ্ট টের পেল অনিমেষ। শীলা সেনের মুখ এখন সামান্য ঝুলে পড়েছে। কিছুক্ষণ কেউ কোন কথা বলল না। শেস পর্যন্ত অনিমেষ আর পারল না। খুব নরম গলায় জিজ্ঞাসা করল, আপনার এ রকম অবস্থা কি করে হল?
 
দ্রুত মাথা তুললেন শীলা সেন, কি রকম অবস্থা। খুব খারাপ লাগছে দেখতে, তাই না? শুনেছি আমাকে একবারে দেখলে অনেকে রাত্রে ঘুমুতে পারে না। তোমারও সে রকম হতে পারে।

আপনি আমার কথা এড়িয়ে যাচ্ছেন।

হঠাৎ খুব ক্লান্ত দেখালো শীলা সেনকে। ধীরে ধীরে বালিশে মাথা রেখে শুয়ে পড়লেন। তারপর কেমন অসাড় গলায় বললেন, পাশের ঘরে যে লোকটা রয়েছে তাকে দেখেছ?

অনিমেষ স্মরণ করতে লাগল। অত্যন্ত রোগা একটি মানুষকে এক পলকের জন্যে দেখে ছিল সে। মুখ মনে নেই, লক্ষ্যও করেনি।

হা একজন ছিলেন। কে উনি?

আমার স্বামী, পতিদেবতা।

ও। আমার শরীরের এই কারুকার্য ওঁরই কীর্তি।

সেকি। আঁতকে উঠল অনিমেষ।

অবাক হচ্ছ কেন? উনি স্বচ্ছন্দে এক বোল ডিস আমার ওপর ঢেলে দিয়েছিলেন, একটুও হাত কাঁপেনি। এখনও স্বচ্ছন্দে ওই ঘরে বসে দিন কাটান।

কিন্তু কেন?

পুরুষ মানুষ তাই।

একি বলছেন?

কিছু মনে করো না, তোমরা চাও মেয়েরা তোমাদের জন্য প্রাণ ঢেলে সব কিছু করবে কিন্তু তাদের যদি সামান্য বিচ্যুতি ঘটে তোমরা সহ্য করতে পারো না।

তাই বলে সবাইকে এক রকম ভাবা ঠিক নয়।

আমি তো দেখলাম না। যারা আমাকে পয়সা দিত, জানতো শুধু পয়সার সম্পর্ক, তারাও দেখতাম ধিক্কারের থাবা বসাতো। ঘেন্না ধরে গেছে।

তাহলে আমাকে আশ্রয় দিলেন কেন?

চমকে উঠলেন শীলা সেন, তুমি? কি বলছ?

আমিও তো পুরুষ মানুষ!

হয়তো কিন্তু আমার কাছে তুমি ছোট ভাই। যেদিন তোমাকে প্রথম ট্যাক্সিতে দেখি সেদিনই মনটা কেমন করে উঠেছিল। তোমাকে অমি পুরুষ মানুষ বলে ভাবব কি করে। ভাববো যে যাকে ফোন করেছ দেখছ না তার দুরবস্থা!

আপনি যার কথা বলছেন সে আমাকে ভালবাসে।

তাই তো মরেছে! মেয়েদের কাছে ভালবাসার চেয়ে বড় মরণ আর কিছু নেই ভাই। সব চলে যাচ্ছে জেনেও অন্ধ হয়ে থাকতে হয়।

কথাগুলো অনিমেষের ভাল লাগছিল না। এসব শরৎচন্দ্রীয় কথাবার্তা এযুগে অচল হয়ে গেছে। এখন মেয়েরা অনেক স্বাবলম্বী। কিন্তু এ নিয়ে শীলা সেনের সঙ্গে তর্ক করা বৃথা। সে প্রসঙ্গে ফিরে এল, ওর আক্রোশের কারণ কি?

জলে নামো ক্ষতি নেই, খবরদার চুল ভিজিও না। আচ্ছা, আমাকে যখন প্রথম দেখলে তোমার খারাপ লাগেনি তখন?

ঠিক খারাপ নয়।

লজ্জা করছ কেন? সত্যি কথা বল। একটা বাঙ্গালী মেয়ে অচেনা নিগ্রো ছেলের সঙ্গে এক ট্যাক্সিতে ফিরছে আমাদের সমাজে তা কখনো সম্ভব? হ্যাঁ, অভাবে পড়ে আমি ঘরের বাইরে গিয়েছিলাম। ওঁরই বন্ধু ট্রাভেল এজেন্সিতে চাকরি দিয়ে নিয়ে গিয়েছিল। নিজে কোনদিন চাকরি-বাকরি করেননি, ব্যবসা ছিল, সেটা ডুবে গেলে আমাকে পাঠালেন বন্ধুর সঙ্গে। চেহারা ছাড়া আমার কোন গুণ ছিল না। তা লোকেই বা ছাড়বে কেন? এই চেহারাটাকে ভাঙ্গিয়ে ভাঙ্গিয়ে পয়সা পাচ্ছিলাম। একটু ছোঁয়া একটু হাসিতেই কাজ হতো প্রথম। কিন্তু সব কিছুর তো সীমা আছে। লোভ বড় খারাপ জিনিস। একবার মাথা তুললে আকাশ ছোঁয়া হয়। আমার এই পাশ কাটানো লোকে শুনবে কেন? শরীর দিতে হল। উনি সব জেনেশুনে ন্যাকা সেজে বসেছিলেন। টাকায় ভেসে যেতে লাগল। কোন দিন জিজ্ঞাসা করেনেনি, নিষেধ করেননি। কিন্তু এসব করতে করতে আমি ডুবলাম। প্রেমে পড়ে গেলাম একজনের। সে সব জেনে শুনে আমায় নিলো। প্রায় পাগল হয়ে যাওয়ার অবস্থা আমার তখন। আর একবার যখন প্রেমে পড়েছি তখন আর অন্য পাক ঘাটতে ইচ্ছে করে?
 
হাসলেন শীলা সেন, তোমার জাতভাই এতদিন কিন্তু কিছু বলেননি। যেই দেখলেন আমার মন অন্য রকম হয়েছে তখনই শাসন শুরু করলেন। কিন্তু তখন আমি নিষেধ শুনব কেন? পরিণতি তো চোখের ওপর দেখছ।

এ তো খুন করার চেষ্টা!

তাই তো।

পুলিশ কিছু বলেনি?

বলতে চেয়েছিল, আমি দিইনি।

কেন?

আমার জীবনে এত নোংরা ছড়ানো যে পুলিশ আমাকে খারাপ বলে প্রচার করতেই পারত। জ্ঞান হলে, এই চেহারায় ফিরলে যখন কেস উঠল তখন মাথাটাকে ঠান্ডা রাখতে পেরেছিলাম। কোর্টে গেলে সত্যি কথাটা বলে লোকটাকে জেলে পাঠাতে পারতাম। কিন্তু আমার কি হতো? এই অবস্থায় যখন সারাজীবন বেঁচে থাকতে হবে তখন একটা আশ্রয় চাই। নিজের হাতে কেউ নিজের সর্বনাশ করে?

কিন্তু এত বড় অন্যায় করে উনি শাস্তি পাবেন না?

কে বলল পাবে না। কেঁচোর মত কুঁকড়ে আছে সারাক্ষণ। হাসপাতালে আমার পা ধরে প্রাণ ভিক্ষে চেয়েছে। এ বাড়ি থেকে ওর বেরুনো নিষেধ। মজা কি জানো, আমার শরীরের পোড়া ঘা যত শুকিয়ে এল তত ওর শরীর ভয়ে ভাবনায় শুকিয়ে যেতে লাগল। এখন ওই ইজিচেয়ার আর বাথরুমেটুকু হাঁটতেই ওঁর প্রাণ বেরিয়ে যায়।

আপনার দৃষ্টিশক্তি

একটায় নেই, অন্যটায় এত কম যে দেখতে ইচ্ছে করে না। চোখ বুঝেই থাকি।

অপারেশন করার কথা ভাবছেন না?

শিশির জানে সে সব। আমাকে নাকি অনেকবার অপারেশন টেবিল গিয়ে শুতে হবে। পাস্টিক সার্জারী না কি যেন বলে। তারপর চোখ।

শিশির কে?

হাসলেন শীলা সেন, তুমি এখনও ছেলে মানুষ। রুপ চলে যাওয়া সে এক রকম। কিন্তু এ রকম বীভৎস চেহারার মেয়ের কাছে যে পুরুষ আসে, চিন্তা কর। সে আমার কে হতে পারে? শিশিরের জন্যেই তো উনি এ্যাসিড ঢেলেছিলেন। আমি অনেক আপত্তি করেছি কিন্তু কিছুতেই শুনছে না শিশির। আবার আমাকে কেটে সুন্দর করতে চায়। কি জ্বালা বল!

কথা বলার ভঙ্গিতে এমন আদুরেপনা ছিল যে অনিমেষ হেসে ফেলল শব্দ করে।

শীলা সেন বললেন, কি হল?

একটু আগে মেয়েদের কথা বলছিলেন, না ভালবাসার চেয়ে বড় মরণ তাদের আর কিছুতেই নেই, কিন্তু এখন দেখছি কোন কোন ছেলেও…

মাংস পিন্ড বিকৃত হয়ে সারা মুখে ছড়ানো, তবু শীলা সেনের লজ্জা অনিমেষের চোখ এড়াল না। নীচু গলায় বললেন, তাই তো মরণে এত সুখ অনিমেষ।
 

Users who are viewing this thread

Back
Top