What's new
Nirjonmela Desi Forum

Talk about the things that matter to you! Wanting to join the rest of our members? Feel free to sign up today and gain full access!

Collected কালবেলা- সমরেশ মজুমদার (1 Viewer)

অনিমেষদের পার্টি থেকে যে ভদ্রলোক প্রার্থী হয়েছেন তিনি মুসলমান। জনসংখ্যার হিসেবে ত্রিশ শতাংশ হিন্দু হলেও উভয়পক্ষই হিন্দু প্রার্থী দিতে সাহস করেননি। কংগ্রেসের ক্ষেত্রে সে প্রশ্ন ওঠে না। মালদার একজন সম্ভ্রান্ত বংশীয় মুসলমান দীর্ঘকাল পশ্চিম দিনাজপুরের এই প্রান্তদেশ থেকে সম্মানের সঙ্গে নির্বাচিত হয়ে আসছিলেন। এবার তার ছেলে দাঁড়িয়েছেন। গতবার কম্যুনিস্ট পার্টি থেকে যিনি দাঁড়িয়েছিলেন তিনি হিন্দু ছিলেন বলেই কম ভোট পেয়েছিলেন–এমন কথা শোনা যায়। ব্যাপারটা চিন্তা করতেই ধাক্কা খেল অনিমেষ। তার মানে কোন মতবাদ বা আদর্শ এখানে কাজ করছে না? মানুষগুলোর ধর্মান্ধতার সুযোগ নিয়ে প্রার্থী নির্বাচন করা হচ্ছে। তাহলে কংগ্রেসের সঙ্গে কমুনিস্ট পার্টির কি পার্থক্য থাকল? কথাটা সৌমেনবাবুকে বলতেই তিনি কিছুক্ষণ অনিমেষের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলেন, মাও সে তুং–এর একটা থিওরী হল, দুপা এগিয়ে যেতে মাঝে মাঝে এক পা পিছিয়েও যেতে হয়।

এখন বর্সার চলে যাওয়ার সময়। তবু উত্তর বাংলায় বর্ষা কি সহজে যেতে চায়। হুড়মুড় করে কিছুক্ষণ জল ঝরিয়ে আকাশ বেশ কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে বসে থাকে। ভোর হতেই দাসপাড়া থেকে ওরা বেরিয়ে পড়ে গ্রামগুলোতে চলে যেত। তখন মাঠের কাজ ছিল না। গ্রামগুলোতে সকাল হতো দেরীতে, অদ্ভুত ঢিমে চালে ওরা দিন শুরু করে। এভাবে প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতায় গ্রামের মানুষ দেখা অনিমেমের একটা নেশার মত হয়ে গেল। এক–একটা গ্রাম যেন একটি বাড়িকে কেন্দ্র করেই বেঁচে আছে। জমিদাররা আর বাংলাদেশে নেই, কথাটা কলকাতায় বসে শোনা ছিল। কিন্তু এখানে এসে মনে হল কথাটা একদম মিথ্যে। জমিদারের চেহারা পালটে গেছে কিন্তু চরিত্র একই রকম আছে। জোতদারের সঙ্গে তার মৌলিক পার্থক্য নেই। সেই জোতদারের বাড়িতে আগে যেতে হত ওদের।

মোটামুটি পাকা বাড়ি, টিনের চাল। জোতদার ওদের দেখলে ব্যস্ত হয়ে বেরিয়ে আসতেন, আসনে আসেন বাবুরা, কি সৌভাগ্য, এ গ্রামের কি সৌভাগ্য যে আপনাদের পদধূলি পড়ল। বসতে আজ্ঞা হোক, বসতে আজ্ঞা হোক।

তিন-চারটে মাদুর পাতাই থাকে বোধ হয় সবসময় তাঁর দাওয়ায়। অনিমেষরা বসতেই ভদ্রলোক বললেন, বলুন, কি সেবা করতে পারি?

অনিমেষরা তিনজন এই দলে ছিল। সৌমেনবাবুরা অন্য গ্রামে গেছেন। ভদ্রলোকের মুখের ভাবভঙ্গি অনিমেষের ভালো লাগছিল না। এর একটা কারণ এখানে আসতে যে ঘরগুলো ওর চোখে পড়েছিল তার জরাজীর্ণ দশার তুলনায় এই গৃহটি প্রাসাদ বলে মনে হচ্ছে। শোষক এবং শোষিতের পার্থক্যটা বড় স্পষ্ট। গ্রামে এসে বক্তৃতা করার আগে এই ভদ্রলোকের সঙ্গে ভাব জমালে অধিকতর কাজ হবে বলা হয়েছিল।

অনিমেষ বলল, আপনি তো জানেন, নির্বাচন এসে পড়েছে। আমরা নির্বাচনের কাজেই এই গ্রামে এসেছি।

ভদ্রলোক বললেন, শহরে গিয়ে শুনেছিলাম বটে। তা কোন পার্টির মানুষ আপনারা? আগে তো কখনো দেখিনি

অনিমেষ বলল, আমরা মহম্মদ চৌধুরীর পক্ষে প্রচার করতে এসেছি।

চৌধুরী? অ! তাহলে আপনারা গিয়ে হলেন কম্যুনিস্ট। হুম্। এবার কম্যুনিস্টরা খুব চাল দিয়েছে, ভাল ভাল। চৌধুরীকে দাঁড় করিয়ে নবাব সাহেবের ছেলেকে বিপদে ফেলেছে জব্বর। তা আপনাদের পরিচয় জানলাম না তো। শহরেও মনে হয় দেখিনি।
 
অনিমেষের সঙ্গী বলল, আমরা কলকাতা থেকে নির্বাচনের কাজে এখানে এসেছি। এখন যদি আপনি সহযোগিতা করেন তাহলে খুশি হব।

হাঁ হয়ে গেলেন ভদ্রলোক, কলকাতা থেকে এসেছে? অতদূর থেকে এই গ্রামে! তাহলে তো বলতে হবে খুব জব্বার ব্যাপার হবে এবার। একদম রাজধানীতেও সাড়া পড়ে গেছে আমাদের নিয়ে। কি আশ্চর্য!

অনিমেষ বলল, এতদিন আপনাদের এলাকা থেকে কংগ্রেসের প্রার্থী নির্বাচিত হয়ে আসছেন। ব্যক্তিগতভাব তার বিরুদ্ধে কিছু বলতে চাই না কিন্তু কংগ্রেসের এতদিনের শাসন আমাদের কোথায় নিয়ে যাচ্ছে এটা ভাববার সময় এসেছে। এবং সেটা ভেবেই যেন গ্রামের ভাইরা ভোট দেন।

ভদ্রলোক পিটপিট করে অনিমেষকে দেখলেন। তারপর মাথা নেড়ে বললেন, বুঝলাম না। গ্রামের মানুষ ভোট দেবে তা আমার কি করার আছে। আপনি আমাকে নিজের কথা বলতে পারেন, অন্যের কথা আমাকে বলে লাভ কি!

অনিমেষ বলল, শুনলাম, আপনার অনুমতি ছাড়া

মিথ্যে কথা, অপপ্রচার। আপনার যেমন খুশি তেমন বোঝন, আমি এর মধ্যে আসি কি করে। লোকটি প্রতিবাদ করে উঠল।

ভদ্রলোককে অনেক ধন্যবাদ দিয়ে ওরা বেরিয়ে পড়ল। চাষ–নির্ভর গ্রাম। মানুষগুলো এত দরিদ্র যে সোজা হয়ে দাঁড়াবার কথাও অনেকে ভুলে গেছে। এই মানুষগুলোকে সচেতন করতে হবে, শ্ৰেণীসগ্রামে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। মইদুল শেখের উঠোনে বসে কথা বলছিল অনিমেষ। রোগা, পাঁজর বের করা চেহারা। মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি। পরনের লুঙ্গি শতছিদ্র। মাইদুল উবু হয়ে বসে অনিমেষের কথা শুনছিল। মাটির দাওয়ায় অনিমেষ বসে, মাথার ওপর জলো মেঘ অনেকটা নেমে এসেছে। উঠোনময় ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে কতগুলো ন্যাংটো বাচ্চা। মইদুলের বউ দাওয়ার খুঁটি ধরে একমাথা ঘোমটায় মুখ ঢেকে দাঁড়িয়ে আছে। মাংসমেদহীন লিকলিকে শরীরটা ঘিরে কাপড়টায় অনেক সেলাই।

অনিমেষ জিজ্ঞাসা করল, আচ্ছা মইদুলভাই তোমার জমিতে বছরে ফসল হয় কটা?

জমি? জমি তো আমার নয় বাবু।

যে জমিটা তুমি চাষ করে সেটা তোমার নয়? তবে কার ওটা?

বড়কত্তার।

সে আবার কে?

যার ঘসে বসে এতক্ষণ কথা বলছিলেন তার!

অনিমেষ লোকটার মুখ স্মরণ করল, কেমন তেল–চকচকে চেহারা। এই গ্রামে ঢুকতে গেলে ওর সঙ্গে কথা বললে সহজ হবে একথা শুনেছিল অনিমেষ। যেন এই গ্রামের মানুষেরা সব ওঁর তাবেদার। দুপা এগোতে হলে এক পা পিছোতে হবে–তাই বুঝি এই লোকটির সঙ্গে সমঝোতা করতে হল।

তার মানে তুমি ভাগচাষী?

মাথা নাড়ল মইদুল, ফসল হয় তিনবার। জমি যার তার, পরিশ্রম আমার–দুভাগ তিনি নেবেন একভাগ আমি।

অনিমেষ বলল, ওতে চলে সারা বছর?

সাদা চেখে অনিমেষের দিকে তাকালো মইদুল। এমন ফ্যাকাশে চোখ কখনো দ্যাখেনি অনিমেষ। ওই দৃষ্টি যেন বুকের ভেতরটা নড়বড়ে করে দেয়। কোন শব্দ দিয়ে বোধ হয় এমন উত্তরটা দেওয়া যেন না।

অনিমেষ উসখুস করে জিজ্ঞাসা করল, এর আগে কখনো ভোট দিয়েছ?

ঘাড় নাড়ল মইদুল, তা দেব না কেন না দিলে চলে!

কাকে ভোট দিয়েছ?

বড়কত্তার পার্টিকে?

সেটা কি?

ওই যে বাবু, জোড়া বলদ, তাতে ছাপ দিয়েছি আমরা।

কিন্তু কেন দিলে তাতে?

ভারী মজার কথা! দেব না কেন? বড়কত্তা বলল তাই দিলাম।

যাদের দিলে তারা ভাল লোক না মন্দ তা না জেনেই দিলে?

সে খবরে আমাদের দরকার কি! আর যেসব ছবি ছিল এই যেমন কাস্তে, ধানের শিষ, সিংহ, ওদের দিয়েই বা কি লাভ হতো? এ তবু চেনা ছবিতে ছাপ দেওয়া। বড়কা বোদে খাওয়ালেন সেদিন, সেটাই লাভ। মইদুল হাসল, এবার বউ–এর দিকে তাকিয়ে। কিন্তু সেখানে কোন প্রতিক্রিয়া হল না। অনিমেষ অন্তরঙ্গ হবার চেষ্টা করল, শোন ভাই মইদুল, তুমি যেমন একজন মানুষ, যে দেশের জন্য খাবার উৎপাদন করে ঘাম ঝরিয়ে –এই অবধি বলেই অনিমেষের মনে হল যে সে ঠিক ভাষায় কথা বলছে না। এই ভাবে কথা বললে মইদুলের কাছে পৌঁছানোই যাবে না। সে আবার শুরু করল, শোন ভাই মইদুল, তুমি নিশ্চয়ই চাও তোমার নিজের জমি হোক, ছেলেমেয়েরা ভরপেট খাক, ভাল জামাকাপড় পরুক, যে ফসল তুমি তৈরী করবে তার ন্যায্য দাম পাও, ঠিক কিনা!
 
মইদুল কথা না বলে তার সাদা চোখে তাকিয়ে থাকল ওর দিকে।

অনিমেষ আবার বোঝাতে লাগল, কিন্তু এতদিন তুমি কি পেয়েছ! জমিটাও নিজের নয়, অন্যের দয়ায় কোনরকমে বেঁচে আছ। কেন এই অবসস্থা? তুমি ভেবেছ কখনো?

আঙুলটা কপালে ঠুকল মইদুল, ঠুকে হাসল।

অনিমেষ বলল, মিথ্যে কথা! ভাগ্যে কিছু লেখা থাকে না। মানুষ নিজেই তার ভাগ্য তৈরী করে। দেশের মানুষকে সুস্থ সবল রাখার দায়িত্ব হল তার সরকারের। আমাদের এই দেশ একদিন ইংরেজের অধীনে ছিল। তারা ছিল বিদেশী। এখন থেকে শোষণ করে নিয়ে যাওয়াই ছিল একমাত্র উদ্দেশ্য। সেটা বোঝা যায়। কিন্তু স্বাধীনতার পর ক্ষমতা হাতে নিল যারা তারা এতগুলো বছর ধরে কি করল? তারা গরীবের রক্তে নিজেদের সম্পদ আরা বাড়িয়েছে। কিন্তু দেশের কথা ভাবেনি, দেশের মানুষের জন্যে কোন চিন্তা করেনি। যার জন্যে আজ তোমার জমি নেই, খাবার নেই। তুমি এদের সঙ্গে একা। লড়তে পারবে না। এদের শক্তি অনেক। আর এদের মদত দিচ্ছে তোমার বড়কত্তার মত ছারপোকারা। কিন্তু এদের শাস্তি দেওয়ার আর একটা উপায় আছে। এই হল সুযোগ। তুমি এবং তোমার ইচ্ছে করলে এদের ছুঁড়ে ফেলে দিতে পার রাস্তায়। কি করে? তোমরা যদি সামনের নির্বাচনে ভোট না দাও ওদের তাহলে ওরা নির্বাচিত হতে পারবে না। মন্ত্রী না হতে পারলে দেখবে ওরা সব কেঁচো হয়ে যাবে।

অনিমেষ একটু থেমে মইদুলকে জরিপ করল। চোখের দৃষ্টি একটুও পালটায়নি। সেই একইভাবে উবু হয়ে বসে আছে সে। অনিমেষ আবার শুরু করল, বলদ চিহ্নে নয়, তোমাদের উচিত কাস্তে হাতুড়িতে ছাপ দেওয়া। আমরা চাই সমস্ত সমাজব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন। আমরা চাই যার জমি নেই সে নিজের চাষের জমি পাবে, যে ফসল সে উৎপাদন করবে তার উপযুক্ত দাম পাবে, যে কোন কৃষকের সন্তান শিক্ষার পর্যাপ্ত সুযোগ পাবে। দেশের মানুষ না খেয়ে মরবে না। এই সব সম্ভব হবে যদি তুমি আমাদের নির্বাচিত করো।

বড় ভাল লাগে বাবু এসব কথা শুনতে। মইদুল দুলছিল।

তাহলে বোঝ, জীবনটা তোমরা স্বচ্ছন্দে এরকম করে ফেলতে পারো।

কিন্তু সেবার ওনারাও তো এসব কথা শুনিয়েছিলেন, কিন্তু

ভ্রূকুঁচকে গেল অনিমেষের, কারা?

বড়কত্তার দল, জোড়াবলদে যাদের ছাপ দিলাম সবাই, তারা। আপনি যেসব কথা শোনালেন তারাও এইসব খোয়াব আমাদের দেখালেন। আর তাই শুনে শুনে বড়কত্তা আমাদের কত উৎসাহ দিলেন। কিন্তু কি হল, আমাদের কোন উন্নতি হল? মইদুল ঘাড় নাড়লো।

অনিমেষ ভেবে পাচ্ছিল না কংগ্রেসীরা কি করে এইসব কথা বুঝিয়েছে। ওরাও সমাজব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন চাইছে নাকি! এই মানুষটি যদি একই কথা ওদের মুখে শুনে থাকে তাহলে কোনরকমেই অনিমেষের কথায় আস্থা রাখতে পারে না। খানিকটা চিন্তা করে সে আবার বোঝাতে চাইল, তাহলে ওরা মিথ্যে বলেছে এটা নিশ্চয়ই তুমি বুঝতে পেরছ। তোমার বড়কত্তা নিজের সম্পত্তি বাড়িয়ে যাচ্ছেন তোমাদের শোষণ করে।

মইদুল হেসে উঠল আচমকা, যেন অনিমেষ খুব মজার কথা বলেছে, একি কথা বললেন, সবাই তো চায় নিজের অবস্থা ভাল হোক, নতুন কি!

অনিমেষ বলল, কিন্তু দশজনের সম্পত্তি একজনের ঘরে গিয়ে জমা হবে কেন? আমরা চাই সবাই সমান অবস্থায় থাকুক। লাঙ্গল যার জমি তার। তোমরা আমাদের সঙ্গে হাত মেলাও দেখবে দিন পালটাবেই।

মইদুল বলল, এসব একদম বাসি কথা। ভোটের আগে আপনি গায়ে এসে আমাকে শোনালেন, আর পাঁচ বছর আপনার মুখই দেখতে পাব না। তখন আমাকে কে বাঁচাবো? না ওই বড়কাই। তাই খামোকা তাকে চটিয়ে লাভ কিছু নেই।
 
অনিমেষ হতাশ হচ্ছিল। এই লোকগুলোকে কি ভাবে বোঝানো যায়? নিজেদের স্থবির পরিবেশ থেকে মুক্ত হবার আকাক্ষাটাই ওযন মরে গেছে। আচ্ছা, লোকটাকে আহত করলে কেমন হয়? ওর মনে ঘা দিল যদি নড়েচড়ে বসে।

অনিমেষ বলল, দেখুন কেউ কাউকে বাঁচাতে পারে না যদি সে নিজে বাঁচতে না চায়। তোমরা, এই গ্রামের মানুষরা যদি এক হয়ে শোষণের বিরুদ্ধে না দাঁড়াও তাহলে চিরকাল এভাবেই পড়ে পড়ে মার খাবে। বড়লোকের সেবা করে তোমাদের কি লাভ? তোমরা এত ভীরু কেন?

খুব আস্তে মইদুল বলল, কি করতে বলেন!

উৎসাহিত অনিমেষ জানালো, তোমরা নিজেদের শক্তি প্রয়োগ কর। এই গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে আমাদের একমাত্র অস্ত্র হল নির্বাচন। ভোটের মাধ্যমে আমরা একটা সরকারকে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে জনদরদী সরকার প্রতিষ্ঠা করতে পারি, যারা সাধারণ মানুষের কথা ভাবছে। ভোট হল ওদের সঙ্গে যুদ্ধ করার প্রধান অস্ত্র।

হঠাৎ মইদুল খেপে গেল। তার কপালে ভাঁজ পড়ল, গলার স্বর উঁচুতে উঠল, তখন থেকে এক কথা ঘ্যানর ঘ্যানর করবেন না তো। ভোট–ফোট সব বুজরুকি। ও দিলেও যা না দিলেও তা। যে জেতার সে ঠিক জিতবেই। আর জিতে গেলে নীচের দিকে তাকাবে না। যতক্ষণ সবার পা খালি ততক্ষণ কাদা লাগুক কেউ কিছু ভাবি না। কিন্তু যেই জুতো দিলাম পায়ে সঙ্গে সঙ্গে হাঁটা চলা টিপুস টিস হয়ে গেল, হবেই। কিসব কথা বলছিলেন, সবাই সমান হবে, পেট ভরে খেতে পাবে, বলছিলেন না! ছাই হবে, যত্ত বুকুনি। ভোট–ফোট না, যদি সবাই জোট করে গিয়ে কেড়েকুড়ে নিতে পারি তবেই অবস্থা ফিরবে। ফালতু খোয়াব দেখাবেন না।

শক্ত হয়ে গেল অনিমেষ। এই জীর্ণ শরীর থেকে এরকম কথা বেরিয়ে আসবে কল্পনাও করেনি সে। কোনরকমে বলল, তবে সেটাই করছ না কেন?

মাথা নামাল মইদুল, করলে কি আর আপনাকে এত কথা বলতে দিতাম ওটা একটা মুখের কথা, সাহস নেই, শক্তিও নেই, আল্লাই বা মানবেন কেন!

মইদুল তবু মুখ ফুটে এত কথা বলেছিল। গ্রামের অন্য মানুষের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে অন্যরকম অভিজ্ঞতা হল। কেউ মুখ খোলে না। সবাই মরা মাছের মত চোখ চেয়ে থাকে। সারা দিন গ্রাম ঘুরে বিকেলে একটা জমায়েত করল ওরা। কম্যুনিস্ট পার্টির প্রার্থীর পক্ষে জোরালো বক্তৃতা করে আবেদন জানালো ভোটের জন্য। কিন্তু অনিমেষ অনুভব করছিল এসব কথা কাউকেই স্পর্শ করছে না। যাত্রা দেখার মত ওরা ওদের দেখছে। প্রতি মুহূর্তেই সে মনে করছিল তাদের এই বলার ধরন ও বিষয়ের সঙ্গে কংগ্রেস বক্তব্যের বোধহয় কোন গরমিল নেই। কম্যুনিজম কি এভাবে বাইরে থেকে চাপিয়ে দেওয়া যায়?

মিটিং–এর শেষে ওরা যখন ফিরে আসছে তখন গ্রামের বড়কত্তা ওদের সাদরে আমন্ত্রণ করলেন জলপানের জন্য। সারাদিন ঘুরে ঘুরে খাওয়া–দাওয়া হয়নি। খিদেও পেয়েছিল খুব। তবু অনিচ্ছা সত্ত্বেও অনুরোধ এড়াতে পারল না ওরা।

মুড়ি নারকোল আর বাতাসা খেতে খেতে ভদ্রলোকের কথা শুনল অনিমেষরা, আজ সারাদিন তো ঘুরলেন আপনারা দেখলেন কেমন?

অনিমেষ বলল, এভাবে মানুষ বেঁচে থাকে কল্পনাও করা যায় না।

ভদ্রলোক বলল, মানুষ বলেই বেঁচে আছে। আপনারা যারা শহরে থাকেন তাঁরা তো এদের চেনেন। এই গ্রামে, ধরেন, আটশো ভোট আছে। প্রতিবার জোড়বলদ পায় সেগুলো। আগে যিনি দাঁড়াতেন তিনি আমাকে অতীব স্নেহ করতেন। তার ছেলেকে শুনেছি লোক ভাল নয়। তাই আমরাও পছন্দ নয়। এখন কি করবেন ঠিক করুন।
 
অনিমেষ জিজ্ঞাসা করল, কথাটা বুঝতে পারলাম না।

সরল কথা। আটশো ভোটের যারা ন্যায্য দাম দেবে তারাই এগুলো পাবে। যিনি এম. এল. এ. হবেন তিনি পাঁচ বছর ধরে কত পাবেন ভাবুন তো। হাজার রাস্তায় তার পকেটে টাকা ঢুকবে। তাই হবার আগে আমাদের একটু মূল্য দিলে ক্ষতিটা কি, বরং নিশ্চিন্ত। একশ গুণ হয়ে টাকাটা ঘুরে আসবে তার ঘরে। হাসলেন বড়কত্তা।

অসম্ভব। কি যা–তা কথা বলছেন আপনি? গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে আপনি ভোট বিক্রি করার প্রস্তাব দিচ্ছেন? আপনাকে তো জেলে পোরা উচিত। অনিমেষের এক সঙ্গী চিৎকার করে উঠল।

গণতন্ত্র! হা হা করে হাসলেন বড়কত্তা, মজার কথা বললেন। ওসব তো বইয়ে থাকে। আরে মশাই কংগ্রেস আর কমুনিস্ট, যারা ভোটে দাঁড়ায় তারা একই টাকার এপিঠ ওপিঠ। ক্ষমতা পাবে বলে, পার্টির ফান্ড বাড়াবে বলে, ক্যাডারদের চাকরি দেবে বলে আর নিজের পকেট ভারী করবে বলে এই তো মতলব। তা যারা তাদের ভোটে দিয়ে এসব পেতে সাহায্য করবে তারা আঙুল চুষবে?

অনিমেষরা আর কথা না বলে বেরিয়ে এল। মাঠ ভেঙ্গে দাসপাড়ায় ফেরার সময় অনিমেষের খুব ক্লান্ত লাগছিল। মনে হচ্ছিল সারাদিনের পরিশ্রম কোন কাজেই লাগল না। স্বাধীনতার পর থেকে আমাদের দেশে যেভাবে নির্বাচন করা হয়ে থাকে তাতে দেশের মানুষের মানসিকতার প্রতিফলন কতটা ঘটেছে সে বিষয়ে যথেষ্ট সন্দেহ আছে। মইদুলের মত মানুষেরা তাই ভোটের ওপর কোন আস্থা রাখে না। কেড়ে নেওয়ার কথা বলে। কিন্তু সেটা তো স্রেফ ডাকাতি, অরাজকতা। রাত্রের শুয়ে শুয়ে অনিমেষ আর একটি কথা ভাবছিল। নির্বাচনী প্রচার করতে এসে তারা জনসাধারণকে বোঝাচ্ছে আমাদের ভোট দিন, আমরা আপনাদের সুখের রাজ্যে নিয়ে যাব। কংগ্রেসীরাও নিশ্চয়ই একই কথা বলছে। এ যেন তিন–চারটে সাবানের কোম্পানি দরজায় দরজায় নিজের প্রোডাক্টের গুণাগুণ বলে বেরাচ্ছে বিক্রি বাড়াবার জন্যে। যেসব প্রার্থী দলের হয়ে দাঁড়াচ্ছে তাদের সঙ্গে জনসাধারণের যোগ নেই। তারা, কর্মীরা, কয়েকদিনের জন্যে মধ্যস্থতা করছে মাত্র। কোনরকম বিশ্বাস থেকে এদের ভোট দেবে না। যদি দেয় তাহলে কথার চটকে ভুলে কিংবা কোন প্রাপ্তির আশায়। দেশে নতুন সরকার গঠিত হলে তার সঙ্গে মইদুলের কি সম্পর্ক থাকবে? তাছাড়া কম্যুনিস্ট পার্টি যদি একটি সংগঠিত আদর্শের ধারক হয় তাহলে এই নির্বাচনের ব্যবস্থায় তার সঙ্গে কংগ্রেসের পার্থক্যটা কি থাকছে? এদেশের মানুষকে যে বিষাক্ত রাস্তায় হাঁটানো হয়েছে এতদিন তাতে কিছু না পেলে বা পাইয়ে না দিলে তাদের সমর্থন পাওয়া যাবে না। এই দেওয়া–নেওয়া পদ্ধতিতে কি কখনো কম্যুনিজমের প্রতিষ্ঠা সম্ভব?

এই কদিন নির্বাচনী প্রচার অনিমেষকে আর একটি জিনিস শেখানো। কম্যুনিস্ট নেতাদের বিখ্যাত উক্তিগুলো মানুষ নিজের প্রয়োজনে প্রয়োগ করতে পারে। সংসদীয় গণতন্ত্রে নির্বাচন হল একমাত্র অস্ত্র। এবং তার ব্যবহার করতে গেলে কোনরকম সুন্ঠা রাখা বোকামি। শ্রীকৃষ্ণ বলেছিলেন যুদ্ধে কোন কাজই অসঙ্গত নয়। নির্বাচনে জিততে হলে সবসময় থিওরি আঁকড়ে বসে থাকলে চলবে না। বড় শত্রুর সঙ্গে লড়াই করতে গেলে ছোট শক্রর সঙ্গেও সাময়িক বন্ধুত্ব করতে বাধা নেই। নির্বাচনে জেতার ব্যাপারে গৃতীত পথ যদি কংগ্রেসের থেকে ভিন্ন না হয় তো ক্ষতি কি। কারণ। দুপা এগোতে হলে এক পা পিছিয়ে যেতে আপত্তি নেই। অস্থির অনিমেষ দাসপাড়া থেকে এক সকালে জলপাইগুড়ি রওনা হয়ে গেল, কাউকে কিছু না বলেই।
 
কদমতলায় বাস থেকে নামতেই রিকশার হর্ন আর মানুষের চিৎকারে কান ঝালাপালা হয়ে গেল। সঙ্গে একটি কাঁদে ঝোলানো ব্যাগ, অনিমেষ চুপচাপ হেঁটে রূপমায়া সিনেমার সামনে এসে দাঁড়ায়। প্রতি বছর শহরটা একটু একটু করে চেহারা পালটাচ্ছে। নতুন নতুন দোকান এবং তাদের সাজানোর ঢং এর অভিনবত্ব চোখে পড়ছে। রূপমায়ার আগে নাম ছিল আলোছায়া। জীবনের প্রথম সিনেমা দেখেছিল সে এখানে, ছবিটার নাম দস্যু মোহন। হলটাকে ভালভাবে দেখল অনিমেষ। এতগুলো বছরেও একই রকম আছে। তবে আগে হিন্দী ছবি হতো না, এখন তাই চলছে।

খুব চেনা রাস্তায় দীর্ঘদিন পরে হাঁটলে এক ধরনের অনুভূতি হয়। অনিমেষ খুশি খুশি মেজাজে চারপাশে তাকাচ্ছিল। চৌধুরী মেডিক্যালের কাউন্টারে রামদা বসে আছেন। অনিমেষকে দেখে হাত তুলে ডাকলেন। ভদ্রলোকের হাসিটা খুব সুন্দর। কখনো চুলে তেল দেন না বলে সব সময় ফেঁপে থাকে সেগুলো। ওঁর ওষুধের দোকানের সামনে এলেই অদ্ভুত একটা অনুভূতি হয় অনিমেষের। নানান ট্যাবলেট ক্যাপসুল এবং ওষুধের বোতল দেখতে দেখতে একধরনের নিরাপত্তা আসে। এখানে বসে থাকলে কোন অসুখ আক্রমণ করতে পারবে না। দোকানের মধ্যে ঢুকলে যে ওষুধ–মার্কা গন্ধটা নাকে আসে তা বেশ আরামদায়ক মনে হয় তখন।

রামদা হাসলেন, কবে আসা হল?

এই মাত্র। কাঁধের ব্যাগটা দেখালো অনিমেষ।

এইভাবে, শুধু একটা ব্যাগ নিয়ে? রামদা বিস্মিত।

কাজে এসেছিলাম এদিকে, হঠাৎ চলে এলাম। তা আপনাদের খবর কী?

আমি সব সময় ভাল। ও হ্যাঁ, কে যেন বলছিল তুমি এখন খুব পার্টি করছ?

বাঃ, এখানেও খবর এসেছে? খুব না, একটু একটু।

এইটেই খারাপ লাগে। যখন কিছু করবে তখন হয় পুরোদমে করবে নয় একদম ধারে কাছে যাবে। মাঝামাঝি থাকাটা মারাত্মক। জানো তো, অখিলদা মারা গেছেন!

অখিলদা, মানে কংগ্রেসের–।

হ্যাঁ, তবে ওঁকে তোমার জন্য পরিচয়ে চেনা উচিত ছিল। জলপাইগুড়ি শহরের খেলাধুলোর উন্নতি যে লোকটা না থাকলে হতো না।

অনিমেষের মনে পড়ল মানুষটাকে যে কোন স্পোর্টস বা খেলায় এ লোকটিকে না হলে চলত না। অর্থবান মানুষ, খেলার জন্যে দুহাতে অর্থ বিলিয়েছেন। এমন কি বৃদ্ধ বয়সেও নিজে ফুটবল খেলতে নামতেন। হাফপ্যান্ট পরা ফর্সা হাসিখুশি সেই মানুষটি লেফট আউটে দাঁড়িয়ে এই বয়সেও এমন কিক করতেন যেটা রামধনু হয়ে গোলে গিয়ে ঢুকতো। অনিমেষ জিজ্ঞাসা করল, কী হয়েছিল?

মার্ডার! রাত্রে খেলার মাঠ থেকে ফেরার পথে–। রামদা গম্ভীর হলেন।

কেন?

সেটাই বোঝা যাচ্ছে না। ওরকম হাসিখুশি মানুষকে কি সুস্থ মাথায় মারা যায়? পুলিশ কোন হদিস পাচ্ছে না। শহরটা কেমন পালটে যাচ্ছে। এখন কেউ কাউকে পছন্দ না করলে সহজেই সরিয়ে দিতে পারে।

অনিমেষ রামদাকে দেখল। ওঁর সুর মুখটা এখন বিমর্ষ। যতদূর জানা আছে রামদা কোন রাজনীতিতে নেই। বাবুপাড়া পাঠাগারের সূত্রে গল্প–উপন্যাস পত্রিকা নিয়ে ডুবে থাকেন। তাহলে শহরটা ভেতরে ভেতরে পালটে যাচ্ছে! এটা কি রাজনীতির কুপ্রভাব? প্রসঙ্গটা এড়াতে রামদা একটা কাশির লজেন্স বের করে এগিয়ে দিয়ে বললেন, কদিন থাকছ?

ঠিক নেই বলে লজেন্সটা কাগজ থেকে ছাড়িয়ে মুখে ফেলল অনিমেষ।
 
রামদা তখনই একজন খদ্দেরকে ওষুধ দিতে ব্যস্ত হয়ে পড়ায় অনিমেষ বলল, চলি, ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানিয়েই রামদা আবার হাত তুলে তাকে দাঁড়াতে বললেন। গলায় ঝাঁজ লাগছিল অনিমেষের। ওর মন পড়ে গেল আগে যখনই এখানে আড্ডা মাতে আসতো তখন এই লজেন্সটা তার বরাদ্দ থাকতো। কথাটা তার খেয়ালে ছিল না কিন্তু রামদা সেটা মনে রেখেছেন। তার নিজের মনের অবচেতনায় ব্যাপারটা থেকে গিয়েছিল বলেই ওটা নেওয়ার সময় সে অন্যমনস্ক-স্বচ্ছন্দতায় নিয়েছিল। রামদাকে আজ নতুন করে ভাল লাগল তার।

কাজ শেষ করে রামদা ওর সামনে এসে কাউন্টারের ওপর দুহাত রেখে বললেন, তোমার দাদু এসেছিলেন।

দাদু?

হুঁ। এখন তোমাদের ওঁকে একা রাখা উচিত নয়।

কেন, কি হয়েছে?

তুমি কিছু জানো না?

না।

সত্যি?

বিশ্বাস করুন। অনিমেষ খুব নার্ভাস হয়ে পড়েছিল। দাদু তো এই সেদিন গয়া থৈকে ওর কাছে ঘুরে ফিরে এসেছেন। চিঠিতেও তো কিছু লেখেননি।

কিছুদিন হল ওঁর কানে একটা ঘা মত হয়েছিল।

কানের ভেতরে?

না, লতিতে। কিছুতেই সারছিল না বলে ডক্টর সেনের কাছে যান। তিনি সাসপেক্ট করছেন। অনিমেষের দিকে তাকালেন রামদা। তারপর মুখ ফিরিয়ে নিয়ে একটু ভাবলেন। অনিমেষ বুঝল যে রামদা কোন অপ্রিয় কথা বলতে দ্বিধা করছেন। সে একটা হাত বাড়িয়ে রামদার হাতে রাখল, বলুন, এখন আমি আর বালক নই।

ডক্টর সেন এটাকে এক ধরনের লেপ্রসি বলে সন্দেহ করছেন। কিন্তু, শোন শোন, আপসেট হয়ো না, এটা জাস্ট সন্দেহ। তোমার দাদুকে উনি যে সব পরীক্ষা করাতে বলেছিলেন তার একটাও করতে চাননি। সামান্য কয়েকট টেস্টে একটা ধরা যাবে। আর আজকাল তার প্রচুর ওষুধ আছে, কোন সমস্যাই নয়। আমার কাছে উনি এসেছিলেন কয়েকটা ওষুধ কিনতে আর ইঞ্জেকসন নিতে। ওঁকে অনেক বোঝাতে চাইলাম কিছুতেই শুনলেন না। বললাম, ডক্টর সেন ভুল করতে পারেন, আপনি আর একজনকে দিয়ে যাচাই করান, স্কিন টেস্ট করুন। বাট হি ইজ টোটালি এ চেঞ্জড ম্যান। তুমি যখন এসে পড়েছ ওঁকে ভাল করে বোঝাও।

অনিমেষের মাথায় আর কিছু ঢুকছিল না। দাদুর কুষ্ঠ হয়েছে? থেকে থেকে শরীরে একটা কাঁপুনি আসছিল। কাউন্টারের ওপর দুহাতের ভর রেখে নিজেকে সামলে নিল সে। তারপর খুব নীচু গলায় বলল, কিন্তু রামদা, ব্যাপারটা কি ঠিক?

রামদা দ্রুত হাত নাড়লেন, এটা একটা অনুমানমাত্র। অনেক সময় শুধু ভিটামিনের অভাবে শরীরের ঘা শুকোতে চায় না, ডায়েবেটিস থাকলেও হতে পারে। ব্যাপারটা আসলে কি তা পরীক্ষা না করলে কি করে বোঝা যাবে। কিন্তু তার আগেই তিনি সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছেন। শুনছি আজকাল বাড়ি থেকে বেরও হচ্ছেন না! তুমি ওকে বোঝাও।

রামদার দোকান থেকে বেরিয়ে একটা রিকশা নেবে কিনা ভাবল অনিমেষ। খবরটা শোনামাত্র শরীর কেমন অবসন্ন হয়ে গেছে। দাদুর যদি সত্যি কুষ্ঠ হয়ে থাকে তাহলে–কোন হিসাব মেলাতে পারছিল না অনিমেষ। সে দ্রুত হাঁটা শুরু করল নিজেকে শক্ত করতে। রূপশ্রী সিনেমার সামনে দিয়ে থানার পাশ ঘুরে করলা নদীর ধারে হন হন করে হেঁটে আসার পথে একটাও চেনা মুখ পড়ল না। অনিমেষ এই মুহূর্তে পরিচিত কাউকে দেখতেই চাইছিল না। কারো সঙ্গে কোন খেজুরে কথা বলার মত মেজাজাও নেই।
 
বাড়িটাকে রং করা হয়েছিল অনেকদিন আগে কিন্তু এখনও বেশ ঝকঝকে দেখাচ্ছে। সরু গলি দিয়ে হেঁটে এসে বাড়ির সামনের গেটটায় হাত রাখল অনিমেষ। কোথাও কোন শব্দ নেই। ঝিম মেরে আছে চারধার। এখন দুপুর। বাইরের সব দরজা জানলা বন্ধ। গেটের সামনে দাঁড়িয়ে মনে হয় অতবড় এলাকা জুড়ে তৈরি বাগান এবং বাড়িতে কোন মানুষ নেই। সামনের অংশে আগে ভাড়াটেরা থাকত। এখন সেগুলোও যে ফাঁকা তা বুঝতে অসুবিধে হয় না। অনিমেষ ভেতরে ঢুকে দরজায় শব্দ করল।

বেশ কিছুক্ষণ সাড়া নেই, তারপরই একটা সরু কণ্ঠস্বর শুনতে পেল সে, কে এল আবার, ও হেম, দ্যাখো না একবার। অনেক কষ্টে বোঝা যায় এই গলা সরিৎশেখরের। অনিমেষের মেরুদণ্ডে কেউ যেন বরফ ঘষে দিল। একি গলা হয়েছে ওঁর! শ্লেষ্মজড়ানো অথচ ভাঙ্গা কাঁসির মত বিরক্তি মাখানো এরকম সরু স্বর সরিৎশেখরের কণ্ঠ থেকে বেরুবে চিন্তাও করা যায় না।

পিসীমার গলা শুনল অনিমেষ, আপনি দেখুন না, আমার সময় নেই।

কেন কি রাজকার্য করছ তুমি, আঁ?

আমার পিন্ডি চটকাচ্ছি। এগুলো না রাঁধলে গিলবেন কি?

যে রাঁধে সে কি চুল বাঁধে না? রান্না শেখাচ্ছ আমাকে?

সকাল থেকে রাত পর্যন্ত আপনার চাকরানী হয়ে জীবনটা গেল আমার। কেন, ওখান থেকে একটু উঠে গিয়ে দেখতে পারছেন না?

অনিমেষ চুপচাপ সংলাপগুলো শুনছিল। দাদু এবং পিসীমার সম্পর্ক প্রায় আগের মত থাকলেও মনে হচ্ছে কোথাও যেন সুর কেটে গেছে। অনিমেষ আর একবার দরজায় টোকা দিল। গনগনে আঁচের মত মেজাজ এগিয়ে আসছে বোঝা গেল। দুপদাপ পায়ের আওয়াজ হচ্ছে। শব্দ করে দরজা খোলার সময় হেমলতা বিড়বিড় করছিলেন, আসার আর সময় পায় না, ভরদুপুরেও–।

দরজা খুলে যেতে ও হাসতে চেষ্টা করল। কিন্তু একি হয়েছে পিসীমার চেহারা! শুকিয়ে প্রায় দড়ি পাকিয়ে গেছে শরীর। গায়ে সেমিজ নেই, সাদা ফিতে পাড় ধুতিটা গোড়ালি ঢাকেনি। গাল ভেঙে গেছে। বাইরের কড়া রোদ চোখে পড়তে দৃষ্টি অস্বচ্ছ হয়েছিল একটু, পরক্ষণেই চিৎকার করে উঠলেন, বাবা দেখুন কে এসেছে!

অনিমেষ নীচু হয়ে প্রণাম করতেই উনি দুহাতে ওকে জড়িয়ে ধরলেন। হেমলতার মুখ অনিমেষের বুকে এবং তখনই ফোঁপানি শুরু হল। কান্নাটাকে আর ধরে রাখতে পারছেন না হেমলতা, দমবন্ধ গলায় শুধু উচ্চারণ করছেন, অনিবাবা, অনিবাবা!

অনিমেষ স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকল। সেই স্বৰ্গছেঁড়া থেকে শৈশবে এই মহিলার সঙ্গে চলে আসার পর থেকে অনেক মান-অভিমান এবং সুখের স্পর্শ পেয়ে সে যৌবনে পৌঁছেছিল। কিন্তু কখনও এমন করে হেমলতা ব্যক্তিগত আড়াল সরিয়ে তার বুকে মাথা ঠোকেননি। নিজের মাকে এখন আর স্পষ্ট মনে পড়ে না। মায়ের স্নেহ-ভালবাসা দুএকটা সুখ এবং দুঃখের স্মৃতিতে আধো আলোছায়ায় মুখ বুজে আছে। কিন্তু একদিকে সরিৎশেখরের ব্যক্তিত্ব অন্যদিকে হেমলতার স্নেহের প্রশ্রয় তার বালককাল ও কৈশোর জুড়ে ছড়ানো–এ তো অস্বীকার করা যায় না। আজ হেমলতা তার বুকে এমন করে ভেঙ্গে পড়তে অনিমেষের নিজেকে সামলানো মুশকিল হচ্ছিল।

কয়েক মুহূর্ত এই অবস্থায় থাকতেই ভেতর থেকে একটা আর্তনাদ ভেসে এল, কে এল, ও হেম, কে এল এখন?
 
হেমলতা ফিসফিস করে অনিমেষকে বললেন, অনেক কথা আছে অনিবাবা, তোকে পরে বলব। তারপর নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে গলা তুললেন, আপনার নাতি এসেছে, অনিবাবা। কি কালো হয়ে গেছে দেখুন। কথাটা বলতে বলতেই হেমলতা ভেতরে ঢুকলেন। এই মুহূর্তে তাকে অন্যরকম দেখাচ্ছিল। যেন বিশ্বজয় করে এসেছেন এমন ভঙ্গিতে হেলেদুলে এগোচ্ছিলেন। একটু আগের কান্নাটাকে আর খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। যেন অনিমেষ এ বাড়িতে আসতেই তাঁর সব সমস্যার সমাধান হয়ে গেছে, আর কোন কিছু নিয়ে তাকে দুশ্চিন্তা করতে হবে না।

অনিমেষ আড়ষ্ট পায়ে ভেতরে ঢুকে দরজা বন্ধ করল। এই ঘরের আসবাব, চেহারা এমনকি গন্ধটা অবিকল একই রকম রয়েছে। স্বৰ্গছেঁড়া থেকে জলপাইগুড়িতে এসে সরিৎশেখর এই ছ’কামরার বাড়িটা প্রথমে তৈরি করেছিলেন মাথা গোঁজার জন্যে। তারপর বড় বাড়ি হল, অনেক যত্নে সেটাকে তৈরি করলেন সরিৎশেখর। কিন্তু কি আশ্চর্য, ওখানে গিয়ে থাকার ইচ্ছে হল না তাঁর। এখনও সেই পুরোন ঘরেই রয়ে গেছেন। অনিমেষ বাড়ির ভেতরে ঢুকেই চমকে গেল।

ভেতরে উঠোনজুড়ে যে কাঁঠালগাছটা ছিল সেটা আর নেই। অনেকটা জায়গা ন্যাড়া দেখাচ্ছেন এখন। আর তার ঠিকমাঝখানে বেতের রঙওঠা চেয়ারে আপাদমস্তক ঢেকে এই রোদে বসে আছেন সরিৎশেখর। একটা নস্যিরঙা চাদরে ওঁর মাথা ঢাকা, শুধু চোখ আর নাক বেরিয়ে আছে বাইরে। বারান্দার কোণে এসে দাঁড়াতেই চোখাচোখি হল। অনিমেষের মনে হল একটা শীতল হাওয়া যেন তার শরীরে কনকনানি ছড়াচ্ছে। এই মাত্র সামান্য কদিনের ব্যবধানে একটা মানুষের চেহারায় এতখানি পরিবর্তন ঘটতে পারে চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না। কাঁধের ব্যাগটাকে বারান্দার টুলের ওপর রেখে অনিমেষ উঠোনে নামল, কি হয়েছে আপনার?

সরিৎশেখর চিৎকার করে উঠলেন। সেই গম্ভীর স্বর নেই, বাচনভঙ্গীতে যে ব্যক্তিত্ব অনেকের সাহস হরণ করত তা উধাও, চিনচিনে গলায় শব্দটা ছিটকে বের হল, কাছে এসো না, কাছে এসো না, দূর থেকে কথা বলো!

অনিমেষ ভাল করে দাদুকে দেখল। নাক চোখ তো স্বাভাবিকই আছে। সে খুব শান্ত গলায় জিজ্ঞাসা করল আবার, কেন, কী হয়েছে?

কেন, শোননি কিছু? এখানে আসার পথে কেউ তোমায় বলেনি?

না। মিথ্যে কথাটা শক্ত গলায় বলল অনিমেষ।

সেকি। লোকে আমায় আজকাল দেখলেই সরে দাঁড়ায়। পাড়ায় একটা কম্পাউন্ডার পাই না যে আমাকে ইঞ্জেকশন দেবে আর তোমাকে কেউ কিছু বলল না! কেন, তোমার পিসীমা তো দরজা খুলে অনেকটা সময় নিল, সে কিছু বলেনি?

সঙ্গে সঙ্গে হেমলতা রান্নাঘরের বারান্দা থেকে চিৎকার করে উঠলেন, আমি বলতে যাব কেন? আপনার দুর্গতির কথা আপনি বলুন। আমার তো আর ভীমরতি হয়নি আপনার মত।

অ। চাদরে মোড়া মাথাটা একটু দুলল। তারপর অনিমেষকে খুব স্বাভাবিক ভঙ্গীতে জানালেন, শোন, আমার কুষ্ঠ হয়েছে। জানি, সব কুষ্ঠ সংক্রামক নয়। তবু আমি ঝুঁকি নিতে চাই না। তাই কেউ এখানে আসুক আমি পছন্দ করি না। তোমার বাবাকে আমি জানিয়েছি, কিন্তু সে কথা শুনতে চায় না। সপ্তাহে একদিন এসে তোমার পিসীমার কাছে খবর নিয়ে যায়।

হেমলতা চেঁচিয়ে উঠলেন, শুনলি অনিবাবা, শুনলি। অন্য কাউকে উনি রোগ ধরাবেন না কিন্তু আমার বেলায় সে কথা একদম মনে পড়ল না। স্বার্থপর কিরকম দ্যাখ তুই। সেই যে ছেলেবেলা থেকে গু-মুত ফেলাচ্ছেন তা থেকে আর নিস্তার নেই।

সরিৎশেখর মাথা নাড়লেন, নিজের শরীর তো আর আয়নায় দ্যাখো না, হয় তুমি নয় আমি যে কেউ আগে যেতে পারি। আমি ছাড়া তোমার আর কেউ নেই। এই বয়সে তোমার যদি আমার রোগ হয় তাহলে কি এমন বেশি হবে। আমার তো এই শরীরের পর কোন মায়া নেই। গয়ায় গিয়ে মুক্তপুরুষ হয়ে এসেছি। কিন্তু আমার ওপর তো তোমার খুব মায়া আছে। তাই তোমাকে দূরে যেতে বলছি না। আর তা বললে যে কদিন বেঁচে আছি খাব কি?
 
হেমলতার গলাটা আচমকা পালটে গেল, ওই আর এক ন্যাকাপনা হয়েছে, বাবা নিজে নিজের শ্রাদ্ধ করে এসেছেন। আর তাই জগতের ওপর শরীরের ওপর ওঁর কোন মায়া নেই! তাই যদি হবে তো রোগ হয়েছে বলে মানুষের সামনে যাচ্ছেন না কেন? ভাত একটু শক্ত থাকলে খাবার সময় আমার পিন্ডি চটকান কেন? এর নাম মুক্তপুরুষ, না? আপনার দুটো বউ যে আগেভাগে মরে গেছে সেটা তারা কপাল করে এসেছিল বলেই, বুঝলেন?

অনিমেষ একটু কড়া গলায় বলল, পিসীমা, আপনি একটু চুপ করুন। তারপর দাদুর পাশে গিয়ে দাঁড়াতেই সরিৎশেখর চোখ বন্ধ করলেন। এখন ওঁর চামড়া কুঁচকে মুখের আদল দুমড়ে দিয়েছে। সময় বড় নির্মম। অনিমেষ আদেশের গলায় বলল, চাদরটা সরান, আমি দেখব।

কুষ্ঠ, কুষ্ঠ, অনেক পাপ করেছি সারাজীবন, তার ফল। চাদর সরাবার চেষ্টা না করে সরিৎশেখর বিড়বিড় করলেন।

আপনি অশিক্ষিতের মত কথা বলছেন। সামান্য কদিন আগেও আপনি এরকম কথা বলতেন না। চাদরটা সরান। সরিৎশেখর বুঝলেন আর প্রতিরোধ করে লাভ নেই। একান্ত অনিচ্ছায় তিনি মাথা। থেকে চাদর সালেন। সাদা কদমফুল দেখল অনিমেষ। আধ ইঞ্চি কাঁচা পাকা চুলে ছাওয়া মাথাটা অদ্ভুত দেখাচ্ছে। সরিৎশেখরকে চেনা যেত না আচমকা দেখলে। অনিমেষ সতর্ক চোখে সরিৎশেখরের কানের দিকে তাকাল। বাঁ কানটা সামান্য ফুলেছে। লতির পেছ দিকটা ঘা হয়েছে বেশ। বোধহয় কানের ভাজ থেকে চটচটে রস জড়ানো ক্ষত ছড়িয়েছে। একটা লালচে ওষুধ বোধহয় লাগানো হয়েছে সকালে অন্য কানটা একদম স্বাভাবিক। কানের লতিতে, নাকের পাটায় লালচে ভাব বা ফোলা নেই। গলা, কপালের ওপরের চামড়ায় বয়সের জন্যে যেটু বিধ্বস্ত তার অতিরিক্ত কিছু দেখা যাচ্ছে না। অনিমেষ এই অল্প বয়সে অনেক কুষ্ঠরোগী দেখেছে। জীবনের প্রথমবার সেই তিস্তার ওপরে নৌকায় বসে থেকে শুরু করে কংগ্রেসের হয়ে বন্যার সাহায্য দেওয়ার সময় পর্যন্ত ওদের কাছ থেকে লক্ষ্য করেছে। আজ সেই সামান্য অভিজ্ঞতা নিয়ে বুঝতে পারল রোগটা কুষ্ঠ নয়। কিন্তু ডাক্তারের সন্দেহ এবং দাদুর এই আচরণ শুধু অনুমানের ওপর তা কি করে হয়? অনিমেষ জিজ্ঞাসা করল, আপনার রক্তে চিনি আছে?

চিনি?

ব্লাড সুগার! অনিমেষ জোর করে রসিকতার চেষ্টা করছিল।

জানি না। থাকলেও থাকতে পারে।

পরীক্ষা করিয়ে দেখবেন?

পয়সা নষ্ট করে লাভ কি?

যদি রোগটা সেই কারণেই বেড়ে থাকে তাহলে স্বস্তি পাবেন। ঠিক চিকিৎসা হবে।

লাভ কি?

মানে?

এই শরীরটা নিয়ে আমি এক ফোঁটা চিন্তা করি না।

কিন্তু অন্যলোককে বিব্ৰত করছেন।

বিব্রত না হলেই হয়।

আপনি কানের কাছে ওই রোগ হয়েছে বলে চেঁচাবেন আর লোকে তা শুনবে না? শুনলাম ইঞ্জেকশন নিতে গিয়েছিলেন।

কে বলল?

একটু আগে আপনিই তো কম্পাউন্ডারের কথা বললেন।

অ। হ্যাঁ, ডাক্তার সেন অনুমান করছিলেন। যদি হয় তাহলে লেপ্রসির প্রাথমিক ওষুধপত্র এবং ইঞ্জেকশন লিখে দিতে বলেছিলাম।

ব্যাস। নিজে নিশ্চিত না হয়ে সেগুলো ব্যবহার করতে লাগলেন! দাদু, আপনি তো এরকম অবৈজ্ঞানিক চিন্তা কখনো করতে না?
 

Users who are viewing this thread

Back
Top