আজকাল এটা খুব হচ্ছে। আর কারও হচ্ছে কি না জানি না, আমার হচ্ছে। কারও সঙ্গে কথা বলতে গেলেই গা গুলিয়ে ওঠে, বমি পায়। নিজের পাছায় লাথি মারা যায় না বলে সেই বমিটা গিলে ফেলি। আমি তাই চেষ্টা করি কম কথা বলতে, একদম যদি না বলতে পারতাম তাহলে মন্দ হত না।
আমি যে বাড়িটায় থাকি সেটা তৈরি হয়েছিল আমার জন্মানোর বহুবছর আগে। একতলার কোণের ঘরটা আমার জন্যে বরাদ্দ। ঘরটায় সুবিধে হল রাস্তা দিয়ে ঢোকা যায় আবার ভেতরে যাওয়ার দরজাও আছে। ওই ঘরেই আমি থাকি আর আমি কথা বলতে ভালবাসি না। সেটা বাড়ির সবাই জেনে গেছে বলে আমায় কেউ বিরক্ত করে না। আমার বয়স এখন আঠাশ।
আমার বার্থ সার্টিফিকেটে যে জন্ম-তারিখ লেখা রয়েছে সেটা ধরলে আমার বয়স এখন সাতাশও হয়নি। স্কুলে ভর্তি করার সময় কর্পোরেশনকে ম্যানেজ করে বাবা একটা বার্থ সার্টিফিকেট জোগাড় করে ভেবেছিল, ছেলের আয়ু এক-দেড় বছর বাড়িয়ে দিলাম। এটা শুধু আমার ক্ষেত্রেই নয়, আমার সঙ্গে পড়ত এমন অনেক ছেলের দেখেছি দু’নম্বরি বয়স করে দিয়েছে বাপ মা। জিজ্ঞাসা করলে তেনারা বলবেন, যা চাকরির বাজার, হাতে দেড় এক বছর থাকলে খোঁজাখুজির সুবিধে হবে। অর্থাৎ ধরেই নেওয়া হয়েছিল আমরা চাকরি পাব না ঠিক সময়ে, দরজায় দরজায় খুব ঘুরতে হবে এবং সেই ফাঁকে সময়সীমা ফুরিয়ে যেতে পারে, তাই ওই বাড়তি সময়টুকু দিলে আমাদেরই উপকার হবে। বার্থ সার্টিফিকেটের কথা কিন্তু মা-বাবার মনে নেই। আমার পনেরো বছর বয়স পর্যন্ত এ বাড়িতে পায়েস হত ঠিকঠাক জন্মদিনে। পনেরো বছর বয়সে মা মারা যান।
আমার একটা এম. এ. ডিগ্রি আছে। বঙ্গসন্তান স্কুল থেকে বেরিয়ে কলেজে ভর্তি হয়। কলেজ থেকে ইউনিভার্সিটিতে। কেন ভর্তি হচ্ছে, যেটা পড়ছে সেটা পড়ে পরে কী উপকারে লাগবে। এ নিয়ে কেউ ভাবে না। তুমি এম.এ. পাশ করেছ, টাকাপয়সা খরচ করে পড়িয়েছি এতদিন, এবার চাকরি করে সংসারের উপকারে এসো। কিন্তু ইতিহাস, বাংলা অথবা ফিলজফি নিয়ে পঞ্চাশ বাহান্ন পেয়ে পাশ করে হাত পাতলে যে চাকরি পাওয়া যায় না, এ কথাটা ওঁরা যখন বিশ্বাস করবেন তখন ওঁদের কাছে আমরা ঘি শুকিয়ে যাওয়া ছাই-এর গাদা ছাড়া আর কিছু নই।
এই এক গ্যাঁড়াকল। পশ্চিমবাংলার প্রতিটি কলেজে প্রতিবছর হাজার হাজার ছেলেমেয়ে ভর্তি হচ্ছে। তাদের কাছ থেকে টাকা নিয়ে তিনবছর ধরে হিউমানিটিজ গ্রুপের বিষয়গুলো পড়ানোর অভিনয় করা হয়। ছেলেমেয়েগুলো সেই বৈতরণী পার হবার পর দ্যাখে অর্জিত বিদ্যা কোনো কাজে লাগছে না। স্কুলে মাস্টারি করতে গেলেও এম.এ. ক্লাশে ভর্তি হতে হবে। আবার দু’বছর। তারপর সমস্ত রাজ্যে ছড়িয়ে থাকা স্কুলগুলোর একজন বাংলা বা ফিলজফির মাস্টার মশাই কবে অবসর নেবে আর তার সেই চেয়ারটির দিকে শকুনের মতো তাকিয়ে থাকবে হাজার হাজার বাংলা অথবা ফিলজফির এম.এ. প্রতিবছর যাদের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। দু-চারজনের কপালে শিকে ছিঁড়তে পারে, বাকিরা ঢুকে যায় কেরানির চাকরিতে তাও ভাগ্য সহায় থাকলে। ভারতচন্দ্রের বিদ্যাসুন্দর অথবা ভাষার ইতিবৃত্ত পড়ে কী লাভ হল ছেলেটির? প্রশ্ন করলে উত্তর একটাই, জ্ঞানার্জনের জন্যে পড়াশুনা। নিজেকে শিক্ষিত করতে, ঐতিহ্য বহন করতে এই শিক্ষানবিশি। পেটে যার ভাত নেই তাকে দিনরাত রবীন্দ্রসংগীত গাইতে বলার মতো ব্যাপার। আসলে স্কুলের পর পাঁচবছর এত হাজার হাজার ছেলেকে ভুলিয়ে রাখা গেল, এটাকে যারা লাভ বলে মনে করেন তাঁদের কাছে মুরগি আর কুকুরের মাংসের কোনো পার্থক্য নেই। বিকেলবেলায় চমৎকার চপ কাটলেট ভেজে হাসিমুখে খদ্দেরের প্লেটে ধরে দিতে অসুবিধে হয় না।
দেখে শুনে মনে হয় আমরা শালা কুত্তার থেকেও অধম। রাস্তার ঘেয়ো কুত্তার কথা বলছি না। বাড়িতে বাড়িতে যেসব কুত্তা আদরে মানুষ হয় তারা আমাদের থেকে ঢের ভাল আছে। আমার এক মাসতুতো বোন তার কুকুরকে কাঁটামাছ খেতে দেয় না, গলায় কাঁটা ফুটে যাবে বলে। বমি বা পায়খানা করলে আদুরে গলায় ধমক দেয়, নো কিটি নো। তোমাকে কতবার বলেছি এসব পেলে টয়লেটে যাবে। লোকে দেখলে বলবে তোমাকে আমি কিছুই শেখাইনি। এইসব বলতে বলতে সে যখন বস্তুগুলো পরিষ্কার করছে তখন তার কিটি পাশে বসে লেজ নাড়ছে কান ঝুলিয়ে প্রসন্ন মুখে।
এই যে আমি কুত্তার সঙ্গে নিজেদের তুলনা করলাম, এটা আমার ভাল লাগল না। মুশকিল হল, কারও সঙ্গে যে কথা বলে না তার মনে সবসময় কথার খই ফোটে। আমি কেন বেঁচে আছি এ প্রশ্নের উত্তর আমার জানা নেই। কিন্তু উত্তরটা আমি সবসময় খোঁজার চেষ্টা করি। আর এই চেষ্টার জন্যে মনে হরেক রকম ভাবনা চুলকে ওঠে। কুত্তা-ভাবনাটা সেই কারণেই।
আমি এম.এ. পাশ করেছিলাম বাংলা নিয়ে। বাংলাদশের মানুষ একুশে ফেব্রুয়ারিকে শহিদ দিবস হিসেবে শ্রদ্ধা করে। তাদের চেষ্টায় বাংলা ভাষা আজ পৃথিবীর অন্যতম স্বীকৃত ভাষা। ওরা যে ভাষার জন্যে জীবন দিয়ে হাততালি পায় আমি সেই ভাষায় এম.এ. পাশ করে জুতোর শুকতলা ক্ষইয়েছি এতদিন। এটাকে কী বলব? কলকাতায় যখন কেউ কেউ একুশে ফেব্রুয়ারি পালন করে তখন তাদের ভণ্ডামি দেখে পিত্তি জ্বলে যায়!
হ্যাঁ, শব্দটা এতক্ষণে মাথায় এল। আমি আমার চারপাশে শুধু একের পর এক ভণ্ড দেখে। যাচ্ছি। এত ভণ্ড একসঙ্গে বাস করে কী করে? এখন মনে হয় এই প্রশ্নটা করাও বোকামি। অন্ধদের দেশে তাঁরা তাঁদের মতো করে বেঁচে ছিলেন। একজন চক্ষুষ্মান সেখানে হাজির হয়ে নানা অসঙ্গতি দেখে মানিয়ে উঠতে পারছিল না। শেষ পর্যন্ত সে চোখ বন্ধ করে ফেলতেই সব কিছু সহজ হয়ে গেল তার কাছে।
এদেশে বাস করতে হলে সবাইকে ভণ্ড হয়ে থাকতে হবে। মুখে এক কথা, মনে আর এক, কাজ করব যা ভাবব অন্য। এ না হলে তোমার টায়ার পাংচার। আমার বাবা রাজনীতি করেন। গত কুড়ি বছর শাসকদলের হয়ে কাজ করছেন। নিচের দিকের কমিটি ডিঙিয়ে পার্টির ওপর দিকের কমিটিতে পৌঁছে গিয়েছেন। এখন তাঁর হাতে দলের অনেক কিছু দায়িত্ব। কিন্তু তিনি কখনও নির্বাচনে দাঁড়াবেন না। একটা ভেজা কাককেও দলের নমিনেশন পেলে তিনি নির্বাচনে জিতিয়ে আনতে পারেন তবু নিজে দাঁড়াতে চাইছেন না। এই ব্যাপারটাকে লোকে বেশ শ্রদ্ধার সঙ্গে দ্যাখে। পার্টির জন্যে নিজেকে উৎসর্গ করতে ক’জন পারে?
এই ভদ্রলোক চাকরি করতেন কর্পোরেশনে। কুড়িবছর আগে যখন দল ক্ষমতায় আসেনি তখন উনি এগারোটার মধ্যে অফিসে যেতেন। দল ক্ষমতায় এলেন তার উপর এত চাপ পড়ল যে তিনি একটার আগে সেখানে পৌঁছতে পারতেন না। কোন কোনোদিন সেটাও সম্ভব হত না। অথচ মাইনেপত্তর ঠিকঠাকই পেতেন। সেসময় বাড়িতে আর একধরনের লোক আসত। তাদের কেউ কেউ কর্পোরেশনের কর্মচারী, বাকিরা কর্পোরেশনের অনুগ্রহ পেতে আগ্রহী। আড়াল থেকে কথাবার্তা শুনে মনে হত, বাবার হাতে একটা বিশেষ চাবি আছে যা দিয়ে তিনি যে কোনো ইচ্ছার দরজা খুলে দিতে পারেন। তা এই করতে করতে বাবা যখন আরও ওপরতলায় উঠে এলেন তখন নিজের যা প্রাপ্য বুঝে নিয়ে চাকরি ছেড়ে দিলেন। অবশ্য আমার একভাই একবোন কর্পোরেশনে চাকরি করছে। সল্টলেকে দু-দুটো ফ্ল্যাট ভাড়া খাটছে। হ্যান্ডলুমের পাজামাপাঞ্জাবি বাবা শরীর থেকে নামাননি, আমাদের সংসারের খরচ যেমন চলছিল তেমনই চলছে। এখন শুধু সকাল হলেই বাইরের ঘরে ভিড়। এলাকার ভাড়াটে বাড়িওয়ালা, কারখানার মালিক শ্রমিক থেকে রাজ্যের গোলমাল ঢেউ-এর মতো বাবার পায়ে এসে আছড়ে পড়ছে এবং তিনি সেগুলোর সুরাহা করে দিচ্ছেন।
বছর তিনেক আগে কাগজে খবর পড়ে কৌতূহল হয়েছিল। বিখ্যাত এক গুরুদেব এসেছিলেন কলকাতার উপকণ্ঠে। দেখতে গিয়েছিলাম। তখন বিকেলবেলা। বাস থেকে নেমে জিজ্ঞাসা করতেই লোকে উৎসাহ নিয়ে দেখিয়ে দিল। বাড়ির সামনে খুব ভিড়। পাগলের মতো লোকে ঢুকতে চাইছে। স্বেচ্ছাসেবক ও পুলিশ সেই ভিড় সামলাচ্ছে। শেষ পর্যন্ত লাইন করে দেওয়া হলো। অতবড় লাইন আমি ইডেন গার্ডেনেও দেখিনি। লাইনে দাঁড়িয়ে ক্রমাগত শুনে গেলাম বাবার অযৌক্তিক কাহিনিগুলো। ক্যানসার তো বটেই এখন নাকি উনি এইডসও সারিয়ে দিচ্ছেন স্পর্শ করে। বুঝতে পারলাম লাইনের বেশিরভাগ মানুষ কঠিন অসুখে ভুগছেন অথবা অসুস্থদের প্রতিনিধি হয়ে এসেছেন। তিনঘণ্টার অপেক্ষা আমাকে পৌঁছে দিল যে ঘরে সেখানে ষণ্ডামার্কা স্বেচ্ছাসেবকরা রয়েছে। বাড়ির ভেতর থেকে একটা দড়ি দরজা গলে ওঘরে ঢুকে টেবিলের ওপর রয়েছে। আমার আগের মানুষটি সেই দড়ি ধরে তার প্রার্থনা নিবেদন করছে করুণ গলায়। তিরিশ সেকেন্ড হওয়া মাত্র জোর করে তাকে বের করে দিয়ে স্বেচ্ছাসেবক বলল, তিরিশ সেকেন্ড! তিরিশ সেকেন্ডে যা বলার বাবাকে বলে দিন।
তিনি কোথায়? আমি অবাক!
আরে! ওই দড়িটা দেখছেন না?
কিন্তু এটা তো বাবা নন?
যাচ্ছলে। কোথায় থাকো তুমি। দ্বিতীয়জন বলল, ওই দড়ির প্রান্ত বাবা দোতলার ঘরে বসে বাঁ পায়ে ছুঁয়ে আছেন। ওটা ধরলেই বাবা তোমাকে টের পেয়ে যাবেন।
টেলিফোনের লাইনের মতো কথা বলা যাবে?
আরে, বলবে তো বলো নইলে কেটে পড়।
আমি দড়িটা ধরে জোরে টান মারলাম কিন্তু ওটা বেশ শক্ত আর নাড়ানো গেল না। মনে হল ওই দড়ির প্রান্ত ওপাশে, চোখের আড়ালে কোনো শক্ত খুঁটিতে বাঁধা রয়েছে। ততক্ষণে আমাকে ঠেলে সরিয়ে দেওয়া হলো। আমার পরের লোকটি হামলে পড়ল দড়ির ওপর।
গুরুদেব সে-সময় কী করছেন কেউ জানে না, শুধু ওই দড়ি ধরে বৈতরণী পার হবার জন্যে যে আকুলতা ভক্তদের মধ্যে দেখেছি তাতে নিজেকে জুতোতে ইচ্ছে করছিল। এঁরাই আমাদের বাবা কাকা দাদা জেঠা। এঁদের সঙ্গেই আমরা বাড়িতে বাড়িতে বাস করি শ্রদ্ধা নিয়ে। চমৎকার।
ইদানীং আমার বাবা সেইরকম গুরুদেবের ভূমিকা নিয়ে ফেলেছেন। ওপরতলায় উঠলেই ক্ষমতা আসে হাতে, আর ক্ষমতা এলেই চামচে জুটে যায়। বাবারও জুটেছে। তারা পার্টিরই কর্মী। ওপরে ওঠার ইচ্ছে যতটা গুছিয়ে নেবার সাধ তার চেয়ে ঢের বেশি। লোকজন জেনে গেছে বাবা প্রসন্ন হলে এম.এল.এ. হতে বাধ্য, রাইটার্স থেকে ফাইল নড়বে দূরের কথা, যাকে বলে ছুটবে, ঠিক তাই। কিন্তু ইদানীং তাঁরা আমার বাবার দর্শন পাচ্ছেন না। এত লোকের সঙ্গে জনে জনে কথা বলার মতো সময় তাঁর নেই। অতএব চামচেরা স্ক্রুটিনি করে। স্তোক দেয় অথবা কাটায়। যাঁর ভাগ্য খুব ভাল তিনি বাবার দর্শন পান। আগে বাবা বসতেন আমাদের বাইরের ঘরে। এখন আর একটি ভেতরের ঘরের দরকার হয়েছে আশীর্বাদধন্যদের সঙ্গে কথাবার্তা বলার জন্যে। কিন্তু এসব চলে ভোর থেকে সকাল পর্যন্ত। তারপরেই বাবা বেরিয়ে যান গণতান্ত্রিক কর্মধারা রূপায়ণের জন্যে।
এম.এ. পাশ করার পর বাবা আমাকে ডেকে কথা বলেছিলেন। ভদ্রলোক এত ব্যস্ত যে আমার সঙ্গে আলাদা কথা বলার সময় তাঁর ছিল না। ভাই-বোনের সঙ্গেও একই অবস্থা। ডাক পড়েছিল মধ্যরাত্রে। বাড়ি ফিরে স্নান করে উনি আহ্নিকে বসেন। শব্দটা বাবাই ব্যবহার করেন। রাত এগারোটার পরে কেউ ডাকতে এলে চাকরকে বলে দেন, এখন আমি ব্যস্ত, আহ্নিকে বসেছি, কাল আসতে বল। বাবা আহ্নিক সারেন দু পেগ শীভাস রিগ্যাল আর আটটা কাজুবাদামে। সেই কর্পোরেশনে চাকরি করার সময় থেকেই এই পরিমিতিবোধ বাবার ছিল। তখন দু’পেগ ডি.এস. খেতেন। একটু একটু করে ডি.এস. থেকে প্রিমিয়ামে উঠলেন। এখন ইন্ডিয়ান প্রিমিয়াম হুইস্কি বাতিল করে স্কটল্যান্ডের প্রিমিয়ামে অবস্থান করছেন। তবে কখনই দু’পেগের বেশি নয়। সারাদিন খাটাখাটনি, টেনসনের পর দু’পেগ হুইস্কি খেলে নার্ভ ভাল থাকে। হার্টও সক্রিয় হয়। এবং তাদের মহান নেতারও নাকি ওই অভ্যেস আছে। সত্যি কথা, তিরাশিচুরাশিতেও ভদ্রলোকের ছবি দেখলে মনে হয় সত্তর পার হননি। ওই বয়সে ভদ্রলোক যেরকম পরিশ্রম করেন তা একটা তিরিশ বছরের ছেলে করলে ক’দিনেই হাঁপিয়ে উঠবে। বাবা তার এই মহান নেতাকে অনুসরণ করছেন অন্ধভাবে। ইদানীং বাবার কথাবার্তাও ওই ভদ্রলোকের মতো হয়ে গিয়েছে।
আমার তখন ঘুম পাচ্ছিল। ভাবলাম বলে দিই এখন যেতে পারব না। তারপরই মনে হল অনেককাল বাবার সঙ্গে কথা বলিনি, উনিও ডাকেননি। তাছাড়া এরকম একটা ডাকের জন্যে দর্শনপ্রার্থী জনগণ যখন হাঁ করে বসে থাকে তখন আমি কি এমন হরিদাস যে ফিরিয়ে দেব?
গেলাম। বালিশে হেলান দিয়ে লুঙ্গি পরে খালি গায়ে বাবা বসেছিলেন। অনেককাল পরে বাবাকে খালি গায়ে দেখলাম। একটু রোগা রোগা মনে হল। লোকটাকে খুব খাটতে হচ্ছে।
এসো। বসো, উঠে বসো। হ্যাঁ, বিছানাতেই বসো। বাবা সামান্য সরলেন।
না। ঠিক আছে। আমার মুখ থেকে বেরিয়ে এল।
তুমি তো এম.এ. পাস করলে। এবার কী করবে ঠিক করেছ?
কিছুই ঠিক করিনি।
কেন?
আমি ঠিক করলেই সেটা করা যাবে কি না তা তো জানি না।
আঃ, বড্ড পেঁচিয়ে কথা বল। তোমার মায়ের স্বভাব ছিল এইরকম।
আমি তো মায়েরই ছেলে।
মায়ের ছেলেরা কখনও বড় হয় না। হ্যাঁ। কলেজ সার্ভিস কমিশনে নাম লিখিয়েছ?
এখনও ওরা নাম চায়নি।
তোমার কলেজে পড়ানোর ইচ্ছে আছে তো?
আমি ঠিক বুঝতে পারছি না।
স্ট্রেঞ্জ! তাহলে বাংলা নিয়ে এম.এ. পাস করলে কেন?
চাকরি করব বলে পড়িনি।
বাঃ। তা যখন পড়েই ফেলেছ তখন বিদ্যেটাকে কাজে লাগাও। ছেলেমেয়েদের শেখাও।
এই বিদ্যে শেখাবার জন্যে এম.এ. পড়ার দরকার হয় না। বাড়িতেই পড়া যায়।
বাবা আমার দিকে তাকালেন। আমি তখনও দাঁড়িয়ে ছিলাম। তিনি গ্লাস শেষ করে তাঁর কোটা অনুযায়ী দ্বিতীয়বার ঢাললেন। জল মেশাবার সময় লক্ষ্য করলাম তাঁর চোখ খুব সতর্ক। ঠিক পরিমাণ মতো জল ঢেলে জগটা ট্রের ওপর রেখে একটা কাজু মুখে পুরলেন, তোমার কথা শুনে আমি একটুও রাগ করিনি। এসো, এখানে বসো। কাম।
অগত্যা বসতে হলো। মায়ের সঙ্গে আমার সম্পর্ক খুব ভাল ছিল। ছেলেবেলায় দেখেছি মা বাবার জন্যে রাত জেগে বসে থাকতেন। তখন বোধহয় সংসারে খুব টানাটানি ছিল। দেশ-উদ্ধার করে এসে বাবা খেতে বসতেন চোরের মতো। প্রায়ই দেখেছি মায়ের খাবার কিছুই থাকত না। আর তখন মনে হত ওই লোকটা মায়ের খাবার খেয়ে নিয়েছে বলে মা খেতে পেল না। তখনও বাবার নিয়মিত রাতের আহ্নিক শুরু হয়নি। কর্পোরেশনের অ্যাসেসমেন্ট সেলে বদলি হবার পর থেকেই বাড়ির হালচাল পাল্টাল। দু’বেলা আমিষ পড়তে লাগল পাতে। এবং বাবা তার আহ্নিক শুরু করলেন। কিন্তু মা হয়ে গেলেন আরও চুপচাপ।
বিছানায় বসার পর বাবা গ্লাসে চুমুক দিয়ে বললেন, কাল থেকে তুমি পার্টি অফিসে যাবে। তোমাকে সবাই চেনে, তুমি এবার চেনাজানা করে নাও।
কেন?
আমার ছেলে হয়ে তোমার সঙ্গে পার্টির কোনো সংযোগ নেই এটা ভাল দেখায় না, তাই।
সেটা কি অন্যায়?
ন্যায়-অন্যায় জানি না। আমি যখন সমস্ত গণতান্ত্রিক মানুষকে আমাদের পতাকার নিচে শামিল হতে উদ্বুদ্ধ করছি তখন প্রশ্ন উঠতে পারে, নিজের ছেলের ক্ষেত্রে কেন পারিনি?
এর উত্তর তো আপনার জানা আছে।
জানা আছে? নাঃ, আমি জানি না!
যিনি আপনার আদর্শ বলে শুনি তিনি তো তার ছেলেকে পার্টিতে নিয়ে যেতে পারেননি। নিশ্চয়ই তাকেও এ ব্যাপারে কৈফিয়ত দিতে হয়েছে। সেই কৈফিয়তই কোট করবেন।
মাই গড! বাবা চমকে উঠলেন।
আমি ভুল বললে বলুন সংশোধন করে নেব।
তুমি কার সঙ্গে নিজের তুলনা করছ জানো? ওঁর মতো কর্মক্ষমতা থাকলে তুমি এম.এ. পাশ করে বেকার বসে থাকতে না। বাবা হঠাৎ রেগে গেলেন।
আমি কারও সঙ্গে নিজের তুলনা করছি না। কৈফিয়ত দেবার কথা উঠল বলে বললাম।
কয়েক সেকেন্ড লাগল বাবার, নিজেকে আগের জায়গায় ফিরিয়ে আনতে। বললেন, তোমাকে নিয়ে আমার অনেক পরিকল্পনা আছে। দ্যাখো, এতকাল রাজনীতি করছি। রাজনীতির জন্য চাকরি ছাড়লাম। এখন পার্টির কর্মী হিসেবে কাজ করে যাচ্ছি। তুমি হয়তো জানো আমাকে অনেকবার ইলেকশনে দাঁড়াতে বলা হয়েছে কিন্তু আমি আড়ালেই থাকতে চাই। তবে সততার তো একটা মূল্য আছেই। সেই কারণেই পার্টিসূত্রে কিছু ক্ষমতা আমি পেয়েছি। এখন দেখছি মাঝারি শ্রেণির নেতাদের ছেলেরা ঝটপট মাথা উঁচু করে দাঁড়াচ্ছে। তুমি বেলগাছিয়ায় যাও অথবা টালিগঞ্জে, শুনবে অমুক নেতা বা মন্ত্রীর ছেলে যা বলবে তাই হবে। এইসব ছেলের সঙ্গে পার্টির যোগ কিন্তু খুব কম। যেদিন বাবা থাকবে না সেদিন তাদেরও দিন শেষ। এই ভুলটা আমি তোমার ক্ষেত্রে করতে চাই না। তাছাড়া আমি তোমাকে একেবারে তৃণমূল থেকে উঠতে বলছি না। তার প্রয়োজনও নেই। তোমার ভূমি তৈরি আছে। এম.এ. ডিগ্রিটা কাজে লাগবে। ওটা তুমি চাকরি করার জন্যে অর্জন করোনি। পার্টিতে তোমার স্ট্যাটাস বাড়াবার জন্যে ব্যবহার করো। আমাদের বেশিরভাগই তো অশিক্ষিত। কয়েকজন শিক্ষিত মানুষ তাই লাঠি ঘোরাতে পারে সহজেই।
আপনি কী বলতে চাইছেন বুঝতে পারছি না।
খুব সহজে। পার্টির সঙ্গে সংযোগ রাখলে তোমাকে ওপরের দিকের কোনো সেলে প্লেস করতে আমার অসুবিধা হবে না। অধ্যাপনা করতে চাইলে কলেজ সার্ভিস কমিশনের প্যানেলের প্রথম দিকে তোমার নাম থাকবে।
আর না চাইলে?
হ্যাঁ। এটাই আমি চাইছি। অধ্যাপনা করলে জীবন একটা জায়গায় আটকে থাকবে। অর্থ, বল, সম্মান সব একই জায়গায় পাক খাবে। আমি সেটা চাই না। দ্যাখো, আমাকে কেউ কখনও সাহায্য করেনি। আমি যা করেছি নিজের চেষ্টায় করেছি। কিন্তু এই করাটা এত সামান্য যে, যাক গে, আমি চাই, তুমি আমার থেকে শুরু করো।
কী রকম?
দু’জন নন রেসিডেন্ট ইন্ডিয়ান আমাকে ব্যক্তিগতভাবে অ্যাপ্রোচ করেছেন। তারা ইনভেস্টমেন্ট করতে চান। একজন মাছের বিভিন্ন আইটেম টিনে প্যাক করে বিদেশে পাঠাবেন আর একজন টেক্সটাইলের কারখানা করবেন। কিন্তু ওঁদের কোনো এস্টাব্লিশমেন্ট এদেশে নেই। তুমি ওয়ার্কিং পার্টনার হয়ে এঁদের সঙ্গে যোগ দেবে। প্ল্যান, প্রোগ্রাম যা কিছু ইঞ্জিনিয়াররাই করবে, তুমি শুধু সেটা এক্সিকিউট করবে। ব্যাপারটা রপ্ত করতে তোমার বেশি সময় লাগবে না। কিন্তু তার আগে তোমাকে পার্টির লোক হতে হবে। কয়েক মাস যাওয়া আসা, মিছিল করা, স্লোগান দেওয়ার ব্যাকগ্রাউন্ড থাকলে তোমাকে পুশ করতে আমার অসুবিধে হবে না। এদেশে ব্যবসা করতে গেলে প্রথম সমস্যা হল শ্রমিক সমস্যা। তুমি যদি শ্রমিকদের একজন বলে নিজেকে আগেই চিহ্নিত করতে পারো, তাহলে ওই সমস্যা মাথা চাড়া দেবে না। দ্বিতীয়ত, সরকারি লালফিতের ব্যাপার। ওর জন্যে আমি আছি। তাই তোমাকে নিলে যারা টাকা ঢালবে তারা বিস্তর উপকৃত যেমন হবে, তেমনি তোমারও ওপরে ওঠার দরজা একটার পর একটা খুলে যাবে।
আমি কথা বলতে পারছিলাম না। ইশারায় ওঁকে অপেক্ষা করতে বলে প্রায় দৌড়ে পাশের টয়লেটে ঢুকে পড়লাম। আলো জ্বেলে বেসিনের ওপর ঝুঁকে পড়তেই হড়হড় করে বমি বেরিয়ে এল। বেশ কিছুক্ষণ ধরে পাক খাচ্ছিল এগুলো, এখন মুখে তেতো স্বাদ নিয়ে হাঁপাতে লাগলাম। কল খুলে জল মুখে নিয়ে স্বস্তি ফিরছিল না। আজকাল এটা হচ্ছে। কেন হচ্ছে বুঝতে পারি না। যখন হয় তখন আচম্বিতেই হয়। মুখ মুছে ঘরে ফিরে আসতেই প্রশ্ন হল, কী হয়েছে?
বমি।
সেকি। কী খেয়েছিলে? বদহজম হয়েছে নাকি?
না। তার জন্যে নয়।
তাহলে?
আজকাল এমন হয়।
তাই নাকি। কালই হরেন ডাক্তারের কাছে যেও, লিভারে কিছু হল নাকি।
শরীর ঠিক আছে।
আজকাল এমন হয় বলছ আবার শরীর ঠিক আছে, সম্ভব নাকি?
বেশি কথা বললে বা শুনলে এমন হয়।
কথা বললে বা শুনলে বমি হয় আমি বাপের জন্মে শুনিনি।
কেমন ঘেন্না লাগে, গা গুলিয়ে ওঠে আর তারপরই বমি বেরিয়ে আসে। আমি চেষ্টা করেছি কিন্তু কিছুতেই কন্ট্রোল করতে পারিনি।
বাবার মুখ এবার শক্ত হয়ে গেল, আমার কোন্ কথা শুনে তোমার ঘেন্না হল? গা গুলিয়ে উঠল? উত্তর দাও?
আমি লোকটার দিকে তাকালাম। এই লোকটা আমার বাবা। সেই পুরনো গপ্পোটা তুলে যদি প্রশ্ন করি, উত্তরটা দিচ্ছি। কিন্তু তার আগে প্রমাণ করুন আপনি আমার বাবা! তাহলে কি জবাব দেবেন?
তাকিয়ে আছ কেন? কী জিজ্ঞাসা করলাম শুনতে পাওনি?
পেয়েছি। কিন্তু আমার উত্তর দিতে ইচ্ছে করছে না।
ইচ্ছে করছে না? তুমি এত বড় উদ্ধত?
আমাকে ভুল বুঝবেন না। আমি এ বিষয়ে কথা বললে আবার বমি করে ফেলব।
স্ট্রেঞ্জ। বাবার চোখমুখ দেখবার মত। হাতের গ্লাসের দিকে তাকালেন, এর গন্ধ সহ্য হচ্ছে না, এমন তো হতে পারে। তোমার মায়ের হতো না।
মায়ের সব অভ্যেস আমি পাইনি।
সেটা তো দেখতেই পাচ্ছি।
আসলে, আপনার আলমারির সব বই আমি পড়েছি।
বই? কোন্ বই?
আমি আলমারিটা দেখালাম। ওটা বই-এ ঠাসা। মার্কস সাহেব থেকে আরম্ভ করে অশোক মিত্র, বাবার সংগ্রহ চমৎকার। কোনো কোনো বই পড়ার সময় বুঝেছি আমার আগে কেউ তার পাতা উল্টে দ্যাখেনি। বাবা চোখ ছোট করলেন, তো?
ওগুলো পড়লে যে ধারণা তৈরি হয় তার সঙ্গে আপনাদের কাজের কোনো মিল নেই। অথচ ওগুলো থেকে কিছু শব্দ নিয়ে বাক্য তৈরি করে আপনারা এমন একটা বাতাবরণ তৈরি করেছেন যে–আমার আর কথা বলতে ভাল লাগছে না।
না। পালিয়ে যেতে দেব না তোমাকে। বলো, কী বলতে চাও?
আপনি আমাকে পার্টি করতে বলছেন সুবিধে আদায় করার জন্য। আপনাদের দলের বেশিরভাগ নেতার ছেলে বেআইনি পথে টাকা রোজগার করে বড়লোক হয়েছে। বাবার ইনফ্লুয়েন্স আর সেই সুবাদে সঙ্গে মাস্তান রেখে চললে টাকা আপনি আসে। আর আপনার নেতার ছেলে পার্টি থেকে বহু দূরে থেকেও এদেশে যা ইচ্ছে তাই করতে পারে। এমন কি তার কোম্পানিতে কেন লকআউট ক্লোজার হয়, তা নিয়ে আপনাদের শ্রমিকদরদী নেতারা কোনো প্রশ্নও করে না। আপনি সেই ভুলটা করতে চান না বলে আমার ওপর পার্টির সাইনবোর্ডটা টাঙিয়ে রাখতে চান? আপনারা পার্টি করেন টাকা রোজগারের ধান্দায়। ওপরের তলার নব্বইভাগ নেতার বেআইনি সম্পত্তি আছে। এই, আপনি দু-দুটো বেআইনি ফ্ল্যাটের মালিক। ওইসব বই-এর লাইন আপনাদের দেখে এখন লজ্জা ভয়ে কুঁকড়ে থাকে। আপনার উপদেশ শুনলে তাই আমার বমি আসে।
যত বড় মুখ নয় তত বড় কথা। এক পয়সার মুরোদ নেই অথচ জ্ঞান দিচ্ছ আমাকে। শুয়োরের বাচ্চা! চিৎকার করে উঠলেন তিনি।
কয়েকজন, খুব অল্প কয়েকটা মানুষ দলে আছে যারা আদর্শে বিশ্বাস করে। মানুষের জন্যে কাজ করতে চায়। দলের অবস্থা দেখে তাদের কেউ কেউ মন্ত্রীত্ব থেকে বেরিয়ে এসেও শেষপর্যন্ত সামান্য কিছু করতে পারবে বলে আপোস করে। এরা আছে বলে এখনও আপনারা সর্বহারা গণতান্ত্রিক ইত্যাদির সাইনবোর্ডটা বহন করতে পারছেন। নইলে আপনাদের সঙ্গে আপনাদের বিরোধীদের কোনো পার্থক্য নেই। বলতে বলতে আবার বমি পেয়ে গেল। আমি টয়লেটে ছুটলাম। শরীর হালকা হতেই মুখে জল দিয়ে আয়নায় নিজেকে দেখলাম। এই আমি, আমার নাম মা রেখেছিলেন বিপ্লব। মা যে কি বোকা ছিলেন!
এই পরিবারের কর্তা যখন বাবা তখন তার ছেলের নাম বিপ্লব? কানাছেলের নাম পদ্মলোচন এর চেয়ে কম হাস্যকর। মায়ের কেন এমন মতিভ্রম হয়েছিল তা তিনিই জানেন।
টয়লেট থেকে বেরিয়ে নিজের ঘরের দিকে যাচ্ছিলাম, এইসময় হুঙ্কার উঠল, যাচ্ছ কোথায়? আগে কথা কমপ্লিট কর।
আমার কোনো কথা নেই।
নেই?
হ্যাঁ। কারণ আপনি আমাকে শুয়োরের বাচ্চা বলেছেন।
তুমি আমার সঙ্গে ইয়ার্কি মারছ?
একদম নয়। বলে ভাল করেছেন।
ভাল করেছি?
হ্যাঁ প্রশ্নটা আমার মধ্যে পাক খাচ্ছিল। নিজেকে জিজ্ঞাসা করছিলাম আমি কেন শুয়োরের বাচ্চা হতে পারছি না। কেন আমার এসব দেখলে শুনলে বমি আসে। শুয়োরের বাচ্চাদের তো বমি পায় না। তারা ঘোঁত ঘোঁত করে কাদায় খাবার খোঁজে, কোনো প্রতিবাদ করে না। মানুষের অবস্থা তো একই রকম। বাসে-ট্রামে ওঠার জায়গা নেই তবু ওঠে। আগে এক পয়সা ভাড়া বাড়ানোয় যারা আগুন জ্বেলেছিল প্রতিবাদে, তারাই এখন বিভিন্ন নাম দিয়ে সরকারি বাস বের করে তিনগুণ বেশি ভাড়া নিচ্ছে বেসরকারি বাসের চেয়ে, অথচ কেউ প্রতিবাদ করে না। আলুর দাম মন্ত্রীর কৃপায় হু হু করে বেড়ে গেলেও মুখ বুজে লোকে কেনে। পাঁঠার মাংসের দাম একশ’ টাকা ছাড়িয়ে গেলে ভাবে তার নিজের মাংস কি ওই দামে বিক্রি হবে? নিউ মার্কেটে শুয়োরের বাচ্চার মাংস বেশ দামি। অথচ মানুষের মাংস কলকাতায় বিক্রি হয় না। হলে তবু! যাকগে। আপনি আমাকে শুয়োরের বাচ্চা বলে কিছুটা সম্মান দিলেন।
সম্মান দিলাম? তুমি কী বলতে চাইছ আমি বুঝতে পারছি না ভেবেছ? যেহেতু তোমাকে শুয়োরের বাচ্চা রাগের মাথায় বলে ফেলেছি তাই বার বার বলে বোঝাতে চাইছ আমি শুয়োর। স্কাউন্ডেল।
উনি সত্যি সত্যি খেপে গেলেন।
আমি শুয়োরের বাচ্চা হলে আপনাকে শুয়োর ভাবব কেন?
যেহেতু আমি তোমার বাবা!
এইটে গোলমেলে ব্যাপার।
তার মানে? ওনার চোয়াল আবার ঝুলে গেল।
আচ্ছা, আপনাকে যদি বলা হয় প্রমাণ করুন, আপনি আমার বাবা তাহলে সেটা প্রমাণ করতে পারবেন? গোলমেলে ব্যাপার নয়?
আমাকে প্রমাণ করতে হবে যে আমি তোমার বাবা?
যদি বলা হয়! না, পারবেন না। দেখুন, আপনার চেহারার সঙ্গে আমার কোনো মিল নেই। মা বলত আমি মামারবাড়ির ধাত পেয়েছি। আপনার স্বভাবের সঙ্গে আমার কোনো সাদৃশ্য নেই। আপনি যা ভাবেন আমি তার উল্টো। আমাদের দেখলে পাবলিক কখনই বলবে না আমরা বাপ ছেলে। মায়ের পেট থেকে পৃথিবীতে এসেছি। সেটা মা তো বটেই, ডাক্তার নার্স সাক্ষী হিসেবে আছে। অতএব আমি মায়ের ছেলে। এ নিয়ে কোনো ডিসপুট নেই। কিন্তু কে বাবা তা মা বলে দেয় বলেই তিনি বাবা হন।
বাঃ। তোমার বার্থ সার্টিফিকেটে আমার নাম আছে বাবা হিসেবে।
ওখানে আপনার বদলে মায়ের কোনো বয়ফ্রেন্ডের নাম বললে ওরা সেটাই লিখত।
আপনি একটু ভেবে দেখলে বুঝতে পারবেন আমি সত্যি বলছি বলে আর দাঁড়ালাম না আমি। একটু ভাল লাগছিল গা গুলানো ভাবটা কমে যাচ্ছিল বলে। নিজের ঘরে চলে এলাম। নিজের ঘরের জানলায় দাঁড়াতেই ঠাণ্ডা বাতাস গায়ে লাগল। রাত বাড়লে বাতাসের চরিত্র খারাপ হয়? ওই ভদ্রলোক আমাকে ব্যবহার করতে চাইছেন। নিজে দু’হাতে কামিয়ে চলছে না, আমাকে এন. আর, আইয়ের সঙ্গে ভিড়িয়ে মাল খিঁচতে চান। ওই ওঁর নেতার সম্পর্কে পাবলিক একই কথা বলে। ছেলেকে হরেক রকম কোম্পানি করে দিচ্ছেন ভদ্রলোক বিদেশিদের সঙ্গে কোলাবরেশনে, তার এক একটার নাভিশ্বাস অল্প কয়েক বছরেই উঠে যাচ্ছে। কিন্তু, লোকে বলে, ছেলে তার অর্জিত কালো টাকা সুইস ব্যাঙ্কে রেখে আসছে। আর উনি বছরে দু’বার এন. আর. আই. খোঁজার নাম করে ব্যাঙ্কের অ্যাকাউন্ট চেক করে আসেন।
আজ আমার ঘুম আসছিল না। হঠাৎ চোখে পড়ল মহিলাটিকে। ঠিক উল্টোদিকের ফ্ল্যাট। আমার দিকে তাকিয়ে হাসছে। আমি দেখতে পেয়েছি বুঝে হাত নেড়ে বললেন, ঘুম আসছে না?
আমি না বুঝে মাথা নাড়লাম। হ্যাঁ। তিনি গলা তুললেন, আমারও।
আমি ঝটপট সরে এলাম। এরকম কেস জীবনে শুনিনি। ওই বাড়িটা নতুন হয়েছে। সবকটা ফ্ল্যাট বিক্রি হয়ে গেছে তৈরি হবার আগেই। ওই মহিলাকে কখনও দেখিনি। ভদ্রমহিলা কারো দিকে তাকিয়ে কি হাত নাড়ছেন? নাকি এদিকে অন্য কেউ আছে। আমি একতলায় আর উনি দোতলায়। তাকিয়ে আছেন এদিকেই। অতএব আমিই ওঁর লক্ষ্য। আমার ঘুম আসছে কি আসছে না জেনে উনি কী করবেন? কী লাভ?
সরে এলাম জানলা থেকে।
আজ আমার খুব ভাল লাগছে। যাঁকে বাবা বলি, জ্ঞান হবার পর থেকে বলে এসেছি বলেই বলি, তাঁকে কথাগুলো বলতে পেরে আনন্দ লাগছে। আচ্ছা, মানুষ কত সহজে আনন্দিত হয়, না? অথচ ওই ভদ্রলোকের আহ্নিকের আরাম আজ ঘুচল। এখন উনি কি করতে পারেন? আমাকে, বড়জোর এ বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিতে পারেন। আমার মাসিক আয় এখন আটশো টাকা। দিব্যি চলে যায়। কলেজ স্ট্রিটের এক প্রকাশকের নতুন বই-এর প্রুফ দেখি আমি। এই হল বিপ্লবকুমারের বিপ্লব। আটশো টাকায় থাকা-খাওয়া যায়?
আলো নিবিয়ে শুয়ে পড়লাম। একটা জিনিস লক্ষ্য করেছি। অনেকেই ঘর অন্ধকার হলে চমৎকার ঘুমিয়ে পড়েন। আমার আবার উল্টো। অন্ধকার আমার মনে হাজারটা সমস্যা স্প্রে করে। সেগুলো মুছতে রীতিমত লড়াই করতে হয়।
আজকাল কিছুতেই ভোরবেলায় আমার ঘুম ভাঙে না। ওদিকে রাত হয় বলেই হয়তো আজও সাড়ে আটটায় বিছানা ছাড়লাম। ব্রাশে পেস্ট নিয়ে কেন জানি না জানলার সামনে এগিয়ে গিয়ে দাঁড়ালাম। চোখ পড়ল সামনের দোতলায়। কেউ নেই সেখানে। কিন্তু এদিকে বাড়ির সামনে ভিড় জমেছে। বাবার দর্শন পেতে আগ্রহীরা ইতিমধ্যেই জড়ো হয়ে গেছে। আচ্ছা, ভদ্রলোক কি গতরাত্রে ঘুমিয়েছিল? ওঁর মনে কি একবারও মায়ের চরিত্র সম্পর্কে সন্দেহ এসেছিল? আমার মায়ের চরিত্র কিরকম ছিল? মায়ের মুখ মনে পড়ল। সাধারণ আটপৌরে সহজ সরল বাঙালি মেয়ের মুখ। যাদের জীবনে স্বামীপুত্রকন্যা ছাড়া আর কোনো চিন্তা নেই, পরপুরুষের সঙ্গে দূরকথা, নিজের স্বামীর সঙ্গেই যাঁদের প্রেম করা হয়ে ওঠে না। হয়তো শারীরিক আনন্দও একটা অভ্যেসের মধ্যে সীমিত। আমার মায়ের চরিত্র এতই আটপৌরে যে ওই ভদ্রলোকের সন্দেহ লবণের লাড্ডু হয়ে যাবে এবং সেটা তাকেই গিলতে হবে। আচ্ছা, কেন বেঁচেছিলেন? যদি জন্ডিসে মারা না যেতেন তাহলে এতকাল কি কারণে বেঁচে থাকতেন? শুধু স্বামীর সঙ্গে সহবাসে পাওয়া সন্তানগুলোকে বড় করার জন্যে? দু’বেলা রান্নাঘরে কাটিয়ে প্রত্যেকের মুখে আহার তুলে দেবার জন্যে? একে তো একধরনের মানুষ সেবা বলে থাকেন। তা সেই সেবা করে জীবন ফুরিয়ে দিতে যারা উৎসাহ যোগান, মহীয়সী আখ্যা দেন, তাদের মতো ক্রিমিনালদের গুলি করে মারা যায় না? আর এই সব নির্বোধ রমণীদের যাদের জ্ঞানচক্ষু ফোটালেও ফুটবে না, জন্মমাত্র কেন জন্ডিস হয় না? ম্যালিগন্যান্ট জন্ডিস!
পিতৃদেবের ঘরের গায়ে তাঁর নিজস্ব টয়লেট বাথরুম রয়েছে। কিন্তু আমাদের সবার জন্যে বাথরুম কমন। টয়লেট তার মধ্যেই। বাড়িটা যেহেতু পুরনো ধরনের তাই এই ব্যবস্থা। এখনও এ বাড়ির কলঘরে চৌবাচ্চা আছে। চৌবাচ্চার বিলাসিতা দক্ষিণ কলকাতার ফ্ল্যাট বাড়িতে আজকাল ভাবা যায় না।
কলঘরের সামনে পৌঁছে দেখলাম ওটার দরজা বন্ধ। এই এক জ্বালা, একটু অপেক্ষা করে গলা তুললাম, ভেতরে কে? তাড়াতাড়ি কর।
দেরি হবে। মেজভাই-এর গলা।
কেন?
এইমাত্র ঢুকেছি। অফিস যেতে হবে।
অতএব অপেক্ষা করা ছাড়া কোনো উপায় নেই। নেই কেন? মনে পড়তেই দোতলায় উঠে এলাম। ভদ্রলোক ঘরে নেই। এখন তিনি নিচের দরবারে আসীন। ওর বাথরুমে গিয়ে পরিষ্কার হলাম। এখানে আসা আমাদের অভ্যেস নেই, বোধহয় এক্তিয়ারেও। কিন্তু আজ মনে হলো, কেন আসব না? এই বাথরুম টয়লেট তো বাড়ির বাইরে নয়।
সকালে এক কাপ চা আর দুটো টোস্ট আমার বরাদ্দ। সকালে এর চেয়ে বেশি খেতেও ইচ্ছে করে না। এখন আমাদের রান্নাঘর ঠাকুর সামলায়। লোকটা রোজ ফুলে ফেঁপে উঠছে। কিন্তু কিছু করার নেই। কেন জানি না, ঠাকুর আমাকে একটু সমীহ করে চলে। চলুক।
সেজেগুজে পথে নামলাম। সাজগোজ বলতে জিনস আর টি শার্ট। পায়ে চপ্পল। দরজায় তালা দিয়ে দেখলাম তখনও দুতিনজন পাবলিক বাবার চামচাদের সঙ্গে কথা বলে যাচ্ছে। মানুষের কতরকমের ধান্দা থাকে তা মানুষই জানে না।
রাস্তায় নামবার আগে দোতলায় নজর চলে গেল কোনো কারণ ছাড়াই। তখন তাঁকে দেখতে পেলাম। কাল রাত্রের সেই মহিলা। বয়স কত হবে? আমারই বয়সী। কিন্তু কি আশ্চর্য, চোখাচোখি হতে চোখ সরিয়ে নিল। যেন আমাকে কখনও দ্যাখেনি। উদাস হয়ে তাকিয়ে রইল দূরের বাড়ির দিকে। অথচ গতরাত্রে ইনিই আমাকে হাত নেড়ে প্রশ্ন করেছিলেন। একেই হয়তো নকশা করা বলে। মেয়েদের পক্ষে এমনটা করাই সম্ভব। নিকুচি করেছে।
আমার হাসি পেল। হাঁটতে-হাঁটতেই হাসলাম। আমাদের বাংলা ভাষায় চমৎকার কিছু শব্দ আছে। যেমন এই নিকুচি। আহা। কী শব্দ। যেমন, ন্যাকামি। করো অনুবাদ। পারবে না। কিন্তু ওই শব্দদুটো কত শত মানে কী স্বচ্ছন্দে বুঝিয়ে দেয়। মোড়ের মাথায় আসতেই হঠাৎ কানে শব্দগুলো ঢুকল। দুটো বছর বাইশের ছেলে কথা বলছে। ভারতীয় ক্রিকেট টিম কেন একের পর এক ম্যাচ হেরে যাচ্ছে তাই নিয়ে আলোচনা। কিন্তু প্রতি তিনটি শব্দের পর দু অক্ষরের পুরুষাঙ্গ অথবা চার অক্ষরের শব্দ অকাতরে ব্যবহার করে চলেছে জোর গলায়। রাস্তা দিয়ে ছেলেমেয়ে, মহিলা, বৃদ্ধরা যাচ্ছেন কিন্তু ওরা অসাড়। আর যাঁরা যাচ্ছেন তারা ওসব শুনেও যেন শুনতে পাননি এমন ভান করছেন।
আমার মাথাটা ঝিমঝিম করে উঠল। আমি সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম, এই যে ভাই, কাজটা কি ঠিক করছেন?
ওরা হকচকিয়ে গেল। একজন জিজ্ঞাসা করল, কেন? অন্যায় কিছু করেছি?
আপনারা এতক্ষণ কী বলেছিলেন?
ক্রিকেট নিয়ে আলোচনা করছি।
করছিলেন। কিন্তু সেই সঙ্গে অশ্লীল শব্দ বলেছিলেন কেন?
অশ্লীল শব্দ? যাঃ বাঁআ। অশ্লীল শব্দ কখন বললাম?
এইমাত্র কী বললেন? আপনার লজ্জা করছে না, নিজেই জানেন না কি বললেন। আপনার মা-বোনেদের সামনে বসে ওই কথা যদি কেউ বলত আপনার ভাল লাগত?
আমি চিৎকার করে উঠতেই ভিড় জমে গেল। কয়েকজন আমাকে টানতে লাগল। একজন বলল, ছেড়ে দিন দাদা। এদের বলে কিছু লাভ হবে না।
আমি অসহায় চোখে লোকটির দিকে তাকালাম। তারপর হাঁটা শুরু করলাম কানে এল, প্রথম ছেলেটি তখনও বিস্মিত গলায় বলে চলেছে, কী মাল মাইরি। আমাকে কেন টকরালো তাই বুঝতে পারছি না এখনও। আফসোস হচ্ছিল। আমি কাদের বোঝাতে যাচ্ছিলাম। জননীদেবী যত ভালবাসা নিয়ে আমার নাম বিপ্লব রাখুন না কেন, আমার ক্ষমতা একটা মাথা নাড়া পুতুলের চেয়ে বেশি নয়। শরীর গুলিয়ে উঠছিল। ট্রাম রাস্তায় গিয়ে দাঁড়ালাম। যদি কোন অলৌকিক উপায়ে ক্ষমতা পেতাম তাহলে এইসব বঙ্গ যুবকদের জিভ কেটে ফেলতাম। হয়তো আশি শতাংশ যুবক বোবা হয়ে যেত কিন্তু তাতে কানের আরাম হত।
তারপরেই মনে হল, আমি অকারণে রেগে যাচ্ছি। এককালে শালা বলাটাও অশ্লীল ছিল, এখন তো নেই। তাহলে?
ট্রামে চেপে কলেজ স্ট্রিট যেতে কতক্ষণ। তারমধ্যেই চোখে পড়ল দুটো মধ্যবয়সী লোক টিকিট না নিয়ে এক টাকা কন্ডাক্টরের হাতে গুঁজে নেমে পড়ল। দু’টাকা কুড়ির বদলে এক টাকা। কন্ডাক্টরের মুখের দিকের তাকালাম। একেবারে বুদ্ধদেবের মুখ। দাড়ি কদিন না কামানো সত্ত্বেও ওই মুখে পৃথিবীর কোনো পাপ স্পর্শ করেনি।
আমি দাঁড়িয়েছিলাম ভেতরের দিকে। সেখান থেকেই চেঁচিয়ে উঠলাম, এই যে দাদা, আপনাকে আট আনা দিলে বিনা টিকিটে যাওয়া যায় বুঝি!
লোকটি আমার দিকে তাকাল না। নির্বিকার হয়ে দাঁড়িয়ে থাকল।
এক বৃদ্ধ বললেন, এই তো চলে আসছে ভাই। আজ তো নতুন দেখছি না। পঞ্চাশ সালেও এই কাণ্ড হত। এই করে করে বাস-ট্রাম লোকসানে চলছে। যাও প্রাইভেট বাসে। অনেক কম ভাড়া, কই তাদের তো তবু লোকসান হয় না!
আর একজন প্রৌঢ় খিঁচিয়ে উঠলেন, লোকসান কোথায় নেই বলুন তো? বড় বড় মন্ত্রীরা ঘুষ নিচ্ছে, হাওলা কেস, বোফর্স কেস-এ কত ট্রানজেকশন হয়েছে জানেন? তা এমনি এমনি ও হয়েছে নাকি? পাবলিককে ঠকিয়ে হয়েছে। দেশের এক নম্বর যদি ঘুষ নেয় তো এই বেচারারা কী দোষ করল!
আমি জিজ্ঞাসা করলাম, তাহলে আপনি ওকে সমর্থন করছেন?
আলবাত করছি। ক’টাকা মাইনে পায়? ভাড়া বাড়িতে থেকে বাজার করে খেতে গেলে ওর মাইনেতে কদিন চলবে? অ্যাঁ! এই যে বাজারে দ্যাখেন, একশ’ টাকা মাংস, দেড়শো টাকা ইলিশ হু হু করে পাবলিকের ব্যাগে ঢুকে যাচ্ছে কোন রোজগারে? নিশ্চয়ই মাইনের টাকায় নয়। দেখছেন না, চারপাশের সব কিছুর দাম বেড়ে গেছে অথচ লোকে প্রতিবাদ না করে দিব্যি ম্যানেজ করে যাচ্ছে। ও বেচারাকে একটাকা আট আনার জন্যে দোষ দিয়ে কী লাভ?
কথাগুলো শোনামাত্র আমার গা-গুলানি ভাবটা উধাও হয়ে গেল। মনে হল ভদ্রলোকের প্রত্যেকটা কথাই সত্যি। বাড়তি রোজগার তো খেটেখুটে হয় না আর বাড়তি রোজগার না করলে মানুষ ছেলেমেয়েদের নিয়ে বাঁচবে কী করে? এদেশে শ্রেণিহীন সমাজ ব্যবস্থা, অর্থনৈতিক সমবন্টন, ইত্যাদি ইত্যাদি ব্যাপারগুলো চালু করা আর সোনার পাথরবাটি কিনে আনা যে একই ব্যাপার। তা গণতান্ত্রিক দলের নেতারা বুঝে গিয়েছেন বলেই তারা আর ও পথে এগোচ্ছেন না। যে যা পারো লুটেপুটে খাও, বেঁচে থাকো কিন্তু খবরদার দলের শৃঙ্খলা ভেঙো না। ওটা ভাঙলেই তোমাকে দলবিরোধী কাজের জন্যে বহিষ্কার করা হবে।
কলেজ স্ট্রিটে নেমে বাবার কথা মনে এল। ওই লোকটির উপদেশ বাবার কাছে নিশ্চয়ই কথামৃত। শুনলে খুশি হতেন। আচ্ছা, এসব সত্য জানা সত্ত্বেও আমি মেনে নিতে পারি না কেন? কেন মনের ভেতর খচখচ্ করে? আহা, এই খচখচ্ শব্দটাও তো দারুণ।
প্রকাশনা সংস্থাটি বেশ বড়। এদেশে তো বটেই, বাংলাদেশেও এদের বিশাল কারবার। আমি এখানে চাকরি করি না। চাকরি এঁরা আমাকে অফার করেননি। কিন্তু একটা টেবিল চেয়ার দিয়েছেন। প্রুফ এলে টেবিলে পাঠিয়ে দেন। দু’ঘণ্টা অন্তর চা খাওয়ান এবং দুপুরে রুটি এবং আলুরদমের ব্যবস্থা থাকে। এতেই আমার চলে যায়।
টেবিলে বসামাত্র বেয়ারা প্রুফ দিয়ে গেল। আমার একপাশে চলন্তিকা এবং সংসদ। বাংলাভাষার প্রহরী। খুব জনপ্রিয় একজন ঔপন্যাসিকের উপন্যাস। বছরে চার-পাঁচটা সংস্করণ চোখ বন্ধ করে বিক্রি হয়। অবশ্য এঁর জনপ্রিয়তা বাংলাদেশেই বেশি। তিনলাইন পড়তেই আমার গা গুলিয়ে উঠল। ভুল বানান যদি দীর্ঘ-উ কেউ লেখে তাহলে তার লেখা ভুলে যাওয়া উচিত। উপন্যাসের শুরু হয়েছে এইভাবে। তোমাকে ভীষণ ভালবাসি। দয়া করে তুমি আমাকে ভুল বুঝো না প্রিয়া। উনিশশো ছিয়ানব্বইতে এই রকম লেখা যাঁরা লেখেন তাঁরা কী তা আমি জানি, কিন্তু যাঁরা পড়েন, পয়সা দিয়ে বই কিনে পড়েন তারা কোন গ্রহের মানুষ? এছাড়া নায়ক ধুতি পরে বাড়ি থেকে বের হলো এবং একটু বাদেই রাস্তায় জল জমা থাকায় প্যান্টের পা গোটাল। নায়িকার নাম প্রিয়া, পিয়া, তিয়া এক এক পাতায় এক এক রকম। বাক্য মাঝে মাঝেই অসম্পূর্ণ! আমি টেবিল থেকে উঠলাম।