What's new
Nirjonmela Desi Forum

Talk about the things that matter to you! Wanting to join the rest of our members? Feel free to sign up today and gain full access!

Collected মোহিনী- সমরেশ মজুমদার (4 Viewers)

মিস্টার আয়ার খুশি হলেন। এসব নিজে বুঝে নিলে পরে ব্যাখ্যা দিতে হয় না। কিন্তু ততক্ষণে রটে গিয়েছে খবরটা। ভিড় জমতে শুরু করেছে। সবাই আশা রাওকে দেখতে চায়। এই পথে সেই কিশোরী যখন কাকার হাত ধরে প্রথম পাণ্ডানুল্লুরে গিয়েছিল, তখন কেউ ভুলেও মুখ তুলে তাকায়নি। হঠাৎ আশার খুব ভাল লাগল। একজন বৃদ্ধকে ডেকে তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, আপনি এখানে কতদিন আছেন? বৃদ্ধ বললেন, আমি এখানেই জন্মেছি মা।

আশা বললেন, তাহলে আপনার নিশ্চয়ই মনে আছে এখান থেকে এককালে গরুর গাড়ি ছাড়তো।

সে তো অনেক আগের কথা। বৃদ্ধ হাসলেন।

অনেক আগের! ফিসফিসিয়ে বললেন আশা। এই সময় মিস্টার আয়ার মৃদু গলায় মনে করিয়ে দিলেন যে দেরি হয়ে যাচ্ছে। আশা গাড়িতে উঠে বসলেন। ভিড় কাটিয়ে দুটো গাড়ি ছুটল পাণ্ডানুল্লুরের পথে। এখন রাস্তা চমৎকার। সন্ধের অন্ধকার নেমে আসছে পৃথিবীর পথে। এই সময়টা বড় বিষণ্ণতা ছড়িয়ে দেয়। চোখ বন্ধ করে বসেছিলেন তিনি। অনেক আগের দিনগুলো কেন যে মানুষের মনে এমন জীবন্ত হয়ে থাকে! আজ যদি তীর্থকে না দেখতেন তাহলে একটি উজ্জ্বল পুরুষের ছবি চোখের সামনে ধরা থাকত যে তাকে প্রথম ভালবাসার কথা বলেছিল। পরবর্তীকালে সফল পেশাদারী শিল্পী হবার পর মাঝেমাঝেই তো অনুতাপ হয়েছে। আর সব কিছু সেই উজ্জ্বল পুরুষকে ঘিরে। যে কারণে মোহিনী আট্টম নাচতে গিয়েও নটরাজের বদলে সেই পুরুষকে কল্পনা করতেন নিজেকে উজাড় করে দেওয়ার মুহূর্তে অথচ আজ মনে হচ্ছে সব নিঃশেষ হয়ে গেল।

হঠাৎ যেন একটা নাড়া খেয়ে সোজা হয়ে বসলেন আশা। এ গাড়িতে তিনি আর কমলা। সামনের গাড়িতে ওরা যাচ্ছে তিনি ড্রাইভারকে জিজ্ঞাসা করলেন, পাণ্ডানুল্লুর আর কতদূর?

ড্রাইভার বলল, আর মিনিট পাঁচেক।

মাত্র সাতটা পনেরো ঘড়িতে। সময় ঠিক আছে। আজ তাতার জন্মশতবার্ষিকী হচ্ছে এখানে অনাড়ম্বরভাবে। সেই অনুষ্ঠান নিশ্চয়ই আটটার মধ্যে শেষ হয়ে যেতে পারে না। আশা মন স্থির করে নিলেন। যখন ড্রাইভার বলল, আমরা এসে গেছি, ওইটে বাসস্ট্যান্ড, তখন তিনি থামাতে বললেন ট্যাক্সি। ওঁদের থেমে যেতে দেখে সামনের গাড়িটাও দাঁড়িয়ে গেল। মিস্টার আয়ার এগিয়ে এলে তিনি বললেন, একটু খোঁজ নিয়ে দেখুন তো তাতার জন্মশতবার্ষিকী অনুষ্ঠানটি কোথায় হচ্ছে?

এখন রাস্তায় লোক নেই বললেই চলে। বাসস্ট্যান্ড বলেই কিছু দোকানপাট খোলা। মিস্টার আয়ার সেখান থেকে ঘুরে এসে বললেন, ওরা বলল, তাতার বাড়ির সামনেই স্টেজ বেঁধে হচ্ছে।

মুখ ঘুরিয়ে জায়গাটাকে দেখলেন তিনি। এ কেমন ব্যাপার! কিছুই যেন পরিচিত মনে হচ্ছে না। এখান থেকে তাতার বাড়িতে পৌঁছে যেতে তিনি কি একা পারবেন না? আশা বললেন, আপনি ওঁদের নিয়ে সোজা চলে যান মঞ্চের কাছে। কাউকে বলবেন না আমি এসেছি।

আপনি? মিস্টার আয়ার না জিজ্ঞাসা করে পারলেন না।

আমি কমলাকে নিয়ে একটু ঘুরে আসছি ওখানে।

কিন্তু এই রাত্রে কি আপনি পথ চিনতে পারবেন?

এই গ্রাম আমার হাতের রেখার মতো চেনা।

অত্যন্ত অনিচ্ছা নিয়ে মিস্টার আয়ার, শাস্ত্রীজী এবং শ্রীমতী বিজয়লক্ষ্মীকে নিয়ে চলে গেলেন। আন্দাজে রাস্তা চিনে বেশ নির্জন অন্ধকারে পৌঁছে গেলেন আশা। কমলাকে বললেন, সাজসজ্জার জিনিসপত্র নামাতে। তারপর ড্রাইভারকে নির্দেশ দিলেন তাতার বাড়ি খুঁজে নিয়ে যেখানে অনুষ্ঠান হচ্ছে সেই মঞ্চের কাছাকাছি থাকতে যাতে ডাকলেই পাওয়া যায়।

পাহাড়ের এই দিকটায় মানুষজন নেই। কিংবা যারা ছিল তারা অনুষ্ঠান দেখতে চলে গিয়েছে। নানা তার ঠাকুর্দার জন্মশতবার্ষিকীতে ঠিক কী ধরনের অনুষ্ঠান করছে তা জানা নেই। হঠাৎ মনে হল জায়গাটা তার খুব চেনা। বড় ভূমিকম্প না হলে পাহাড় বড় একটা বদলায় না। সেই পাথরটা এখনও যেন স্তব্ধ হয়ে রয়ে গেছে, অন্ধকারেও চিনতে পারলেন আশা। এইখানে তাকে নিয়ে এসেছিলেন তাতা। বলেছিলেন পাথরের যে জড়ত্ব তারও একটা অভিব্যক্তি আছে। ঠোঁট কামড়ালেন তিনি। তাহলে সময় সব কিছু পাল্টে দিতে পারে না। কোথাও না কোথাও প্রত্যেকের নিজের জায়গা থেকে যায়।

সেই পাথরের আড়ালে পোশাক পরিবর্তন করলেন ভারতবর্ষের অন্যতম শ্রেষ্ঠ শিল্পী। পৃথিবীর খুব বড় প্রেক্ষাগৃহের ড্রেসিংরুমের আরাম যাঁর জানা তিনি কিন্তু একটুও অস্বাচ্ছন্দ্য অনুভব করলেন না খোলা আকাশের নিচে তারার আলোয় দাঁড়িয়ে। তারপর সেই অন্ধকারেই কমলাকে বললেন, এবার আমাকে সাজিয়ে দিতে হবে যে! কমলা বিব্রত গলায় জিজ্ঞাসা করল, বড় অন্ধকার। দেখব কী করে?

আশা বললেন, দেখার দরকার নেই।
 
রাতের কোনো বিস্মিত পাখি মাথার ওপরে পাক দিয়ে ফিরে এসে বসল কাছের একটি পাথরে। মৃদুমন্দ বাতাস বইতে শুরু করল। আকাশ হয়ে উঠল নীল, মেঘ শূন্য। কমলা বলল, আমি জানি না কীরকম সাজ হল!

আশা উত্তর দিলেন না। কারণ একটু একটু করে তার হৃদয় নৃত্যের জন্যে প্রস্তুত হয়ে পড়েছে। কমলা তার জিনিসপত্র গুছিয়ে নিলে তিনি পা বাড়ালেন। সেই গাছটা নজরে এল। যে সামান্য বাতাসে পাতা নাড়াত, ঝড় উঠলে ডাল দোলাত। শরীরের ওই দোলার হেরফেরে দুরকম ভাব ফুটিয়ে তোলা যায়–এই শিক্ষা তো তিনি এখানেই পেয়েছিলেন। তারপরেই তিনি জেনেছিলেন দেখা এবং অদেখার বাইরে আর একটা জগৎ আছে, যা সৃষ্টি করতে জানলেই শিল্পী হয়ে ওঠা যায়। ওই গাছ যা কখনই পারবে না। কিন্তু পথ চিনিয়ে দেবার জন্য তো ওর কাছে তার চিরজীবনের কৃতজ্ঞতা।

দূর থেকে মৃদঙ্গের আওয়াজ ভেসে আসছিল। অনুষ্ঠানমঞ্চের আলো চারপাশে ছড়িয়ে পড়েছে। ফলে কয়েক হাজার মানুষকে দেখা যাচ্ছে নিমগ্ন হয়ে বসে থাকতে। আশা সন্তর্পণে জনতার শেষে এসে দাঁড়ালেন। মঞ্চের পেছনে তাতার একটি ছবি রাখা আছে। মঞ্চ জুড়ে লেখা গুরুর গুরু। এই মাত্র কোনো শিল্পীর নাচ শেষ হল। দর্শকরা হাততালি সম্বর্ধনা জানাচ্ছে। আশা চাপা গলায় বললেন, ওরা কোথায়?

কমলা বিব্রত হয়ে উত্তর দিল, এই ভিড়ে খুঁজে পাওয়া যাবে না।

ট্যাক্সি দুটোকে ওপাশে দেখেছি। যদি সেখানে থাকে তাহলে মঞ্চে আসতে বল।

ততক্ষণে এক প্রৌঢ় মঞ্চে এসেছেন। মাইকের সামনে দাঁড়িয়ে বিনীত গলায় বলছেন, ভরতনাট্যমের মহাগুরুর আজ জন্মশতবার্ষিকী। রক্তসূত্রে তিনি আমার পিতামহ। এখনও এই গ্রামে তাঁর নৃত্যধারা যে বজায় আছে তার প্রমাণ আপনারা পেলেন। এই অনুষ্ঠানে আপনারা যে এসেছেন তাতে আমার পিতামহের আত্মাই সম্মানিত হয়েছে। আপনাদের মধ্যে যাঁরা আমার পিতামহকে চিনতেন তাঁরা যদি ওঁর সম্পর্কে কিছু বলতে চান তাহলে মঞ্চে আসতে পারেন। সঙ্গে সঙ্গে গুঞ্জন শুরু হল।

নানা! আশা চমকে উঠলেন। সেই জেদী কিশোর আজ শান্ত প্রৌঢ়। নৃত্য সম্পর্কে আগ্রহ না থাকায় তাতা একে তেমন পছন্দ করতেন না। কিন্তু সবচেয়ে বড় প্রণাম তো ওই জানাল! ভিড়ের পাশ দিয়ে যতটা সম্ভব নজর এড়িয়ে আশা মঞ্চের দিকে এগিয়ে গেলেন। শেষ দিকে তার সাজ দেখে কেউ কেউ বিস্মিত হয়ে পথ ছেড়ে দিচ্ছিল। দুপাশে উইংসের ধার ঘেঁষে যেমন মঞ্চে পৌঁছনো যায়, তেমনি সামনের দিকে একটি ছোট সিঁড়ি রাখা আছে ওপরে ওঠার জন্যে। আশা সেইটে ব্যবহার করতেই সমস্ত গুঞ্জন একসঙ্গে নিস্তব্ধ হয়ে গেল। নানা চমকে তাকালেন এগিয়ে আসা মূর্তিটির দিকে। মঞ্চে সোজা এগিয়ে গেলেন আশা ছবিটির দিকে। দর্শকরা এখন বাকরহিত। তারপর নতজানু হয়ে শ্রদ্ধা জানালেন আশা তাতার ছবিকে। অপ্রস্তুত নানা কয়েক পা এগিয়ে থেমে গেলেন। তিনি লক্ষ করলেন প্রণামটি সাষ্টাঙ্গে নয়। কিন্তু এই অচেনা রমণীকে চিনতে চেষ্টা করেছিলেন তিনি। এই সময় আশা ঘুরে দাঁড়িয়ে তাঁকে নমস্কার করতেই তিনি বিস্ময়ে বলে উঠলেন, আশা!

আশা ততক্ষণে মাইকের সামনে এসে বিনীত গলায় উচ্চারণ করলেন, আমি আশা রাও।

সঙ্গে সঙ্গে সমুদ্র-গর্জনের আওয়াজও হার মানল। বিস্ময় এবং আনন্দ ছিটকে উঠল দর্শকদের গলা থেকে। সেটাকে কিছুটা কমে আসতে দিয়ে আশা বললেন, তাতা আমার গুরু। তাতা আমার সমস্ত বোধ, ভাবনার জন্মদাতা। তাতা যদি গুরু তবে মহাগুরু নটরাজ। আমি বলি পরম গুরু। আমার স্বামী।

এই সময় নানা এগিয়ে এলেন, আমি ভাবতে পারছি না, নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছি না যে আপনি এসেছেন। আজই কাগজে পড়লাম আপনি গৌহাটিতে। আর আপনি অত বড় সরকারি খেতাব প্রত্যাখান করেছেন।

বাঁ হাত তুলে তাকে শান্ত করল আশা, বিচলিত হবেন না। যা ছিল আমাদের কর্তব্য তা আপনি করেছেন। ফলে কোনো অপরাধ আপনাকে স্পর্শ করবে না। আজ তাতার জন্মশতবার্ষিকী, আমি যদি না আসতাম তাহলে সমস্ত শরীরে বিষরক্ত বয়ে যেত এরপর। চোখ বন্ধ করলেন আশা। তাঁর শরীরে কাঁপুনি ছড়িয়ে পড়ল। মাইকের সামনে পৌঁছে নানা বললেন, আমি আপনাদের কাছে ক্ষমাপ্রার্থী। আমার ঠাকুরদার কাছে ভারতবর্ষের শ্রেষ্ঠ ভরতনাট্টম শিল্পী এককালে দীক্ষা নিয়েছিলেন। তাঁকে আমি আমন্ত্রণ জানিয়ে চিঠি লিখেছিলাম। তিনি জবাবে আমাকে চিনতে পারছিলেন না বলে লিখলেও আসবেন বলে সম্মতি দিয়েছিলেন। অপমানিত বোধ করায় আমি আর যোগাযোগ করিনি। কিন্তু তিনি এসেছেন। সমস্ত প্রতিবন্ধকতা সরিয়ে ঠিক সময়ে পৌঁছেছেন। আমি কৃতজ্ঞ।
 
মাথা নাড়লেন আশা। বড় সাজানো কথা বলা হচ্ছে আমার সঙ্গে। এই গ্রাম এই মাটি আমাকে নবীন জন্ম দিয়েছে। ওই বৃদ্ধ অশক্ত শরীরে আমাকে জাগ্রত করেছিলেন। আজ সমস্ত আত্মীয়স্বজন যখন হারিয়ে গিয়েছে তখন তাঁর দেওয়া নাচ আমাকে ঘিরে রেখেছে। তিনি আমার স্বামী হিসেবে নির্বাচিত করেছিলেন নটরাজকে। স্বীকার করছি, কখনই ওই সিদ্ধান্ত আমি অন্তরে গ্রহণ করতে পারিনি যদিও অবজ্ঞা করিনি। যখন আমি মঞ্চে নাচি আমার শরীর সেই নৃত্য পরিবেশন করে। যখন আমি মঞ্চ থেকে বেরিয়ে আসি তখন আমার হৃদয়ে নাচ শুরু হয়। আমি নিজেকে হারিয়ে ফেলি। এসবই তাতারই দান। এখন আপনাদের অনুমতি নিয়ে আমি আমার গুরুপ্রণাম শুরু করছি।

এই সময় মঞ্চের একধারে এসে বসলেন শাস্ত্রীজী সঙ্গে শ্রীমতী বিজয়লক্ষ্মী। আশা তাদের দিকে তাকাতেই যেন ইশারা লক্ষ্য করলেন। তিনি এগিয়ে গেলেন মঞ্চের ধারে। বিনীত গলায় বিজয়লক্ষ্মী বললেন, আপনার মেকআপ ঠিকঠাক নেই।

না-ই থাক। আপনি সেই গানটি ধরুন। ভরণম-এ ঈশ্বরের প্রতি যে আর্তি ফুটেছে—

আপনি কি প্রথম থেকে শুরু করবেন না?

না। অভিনয় অংশই আমার শরীরে-মনে আসুক।

শ্ৰীমতী বিজয়লক্ষ্মী খুশি হলেন না। শাস্ত্রীজিও। মুখ দেখে বুঝতে পারলেন আশা। তারপর বললেন, থাক। শুরু থেকেই হোক। আদি থেকে অন্ত।

তাতার মুখ মনে করলেন আশা। ধীরে নিজেকে অতিক্রম করলেন। শরীরে স্পন্দন এল। এবং জীবনের শ্রেষ্ঠ নাচটি তিনি শুরু করলেন। একে একে ভরতনাট্যমের একটির পর একটি দরজা অতিক্রম করতে লাগলেন তিনি। পঞ্চাশ পেরিয়ে যাওয়া এই শরীরটা যেন তাতার বয়ে-আনা মশালের দায়িত্ব নিয়ে এখন অনন্তের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।

অভিনয় পর্বে এসে তিনি কী একটু থমকে দাঁড়িয়েছিলেন; ভরতনাট্যমের শিল্পী হয়ে ঐ মুহূর্তে মোহিনী আট্টমের সেই রাজকুমারীর মতো তাঁর নজরের মধ্যে আর এক নবীন দৃষ্টির উদয় হয়েছিল কি? কার দিকে তিনি অমন সম্মোহিতের মতো তাকিয়ে নেচে চলেছিলেন? ডান কিংবা বাম নয়, মুখোমুখি কী কারো দর্শন পেয়ে আপ্লুত হয়েছিলেন? ভরণমের বিখ্যাত গান যখন বিজয়লক্ষ্মীর গলায় গীত হল, তখন তিনি আত্মহারা। সমস্ত শরীরে তখন ভূমিকম্প। অনেক হয়েছে তোমার লীলাখেলা। আর কতকাল এভাবে অপেক্ষায় রাখবে তুমি হে বধির সুন্দর, হে আমার প্রভু। তোমার স্পর্শ পাওয়ার জন্যে আর বিলম্ব সইতে পারি না। তোমার প্রতি বিশ্বস্ত এই হৃদয়কে যন্ত্রণা দিয়ে কী সুখ পাচ্ছ? হে প্রভু, হে আমার প্রাণ, কেন এগিয়ে আসতে এত দ্বিধা? কেন নিজেকে এমন আড়ালে রাখা? এই বিরহযন্ত্রণা আর সহ্য করতে পারি না যে।

হঠাৎ সমস্ত শরীরে উত্তাল কান্না ছড়িয়ে পড়ল। তার প্রকাশ এল মুখ-চোখে। দর্শকরা শঙ্কায়িত হলেন। আবেগের সংক্রমণ বড় মারাত্মক। তারা এক অদ্বিতীয় শিল্পীকে দেখতে পেলেন। আর শিল্পীর চোখের সামনে তখন নটরাজ নয়, তাতা নয়, সবাইকে সরিয়ে একটি উজ্জ্বল সহাস্যমুখ বলছে, আমি তোমাকে ভালবাসি। যেন নিজেকে শক্ত ডাল থেকে ছিঁড়ে নেবার মতো নাচ থামিয়ে ভেঙে পড়লেন তিনি। দর্শকরা ভাবল আশা মিশে গিয়েছিলেন আরাধনায়।

.

ইন্দিরা মার্গের সমস্ত যানবাহন এখন নীরব। কোথাও কোনো শব্দ নেই। ব্যালকনির চেয়ারে বসেছিলেন আশা। সেই রাত্রে অনেক অনুরোধ এড়িয়ে তিনি চলে এসেছিলেন তাতার গ্রাম থেকে। নিজেকে সেদিন অপবিত্র মনে হয়েছিল বলে নাচ থামিয়ে দিয়েছিলেন। যদিও সেই অনুভূতির কথা কেউ জানতে পারেনি।

আজ এই মধ্যরাত্রে নিদ্রাহীন আকাশের তলায় বসে দুই সন্তানের পিতা শীর্ণ মানুষটির মুখ মনে করলেন আশা। দেবতার মন্দিরে যে নাচ পরিবেশন করতে হয় সেখানে কেন মানুষের মুখ আসে মনের সামনে? সে কোন মানুষ? একা নিঃসঙ্গ মহিলা এ প্রশ্নের উত্তর খোঁজেন প্রহরের পর প্রহর। সামনে বহু পথ পড়ে আছে কার ছায়া নিয়ে তিনি হাঁটবেন? ঈশ্বর না মানুষের!

[কপিলা বাৎস্যায়নের ইন্ডিয়ান ক্লাসিকাল ড্যান্স, মার্গ পত্রিকা এবং অশোক চ্যাটার্জির ড্যান্স অফ দি গোল্ডেন হল বই তিনটির কাছে আমি ঋণী। বস্তুত আশা রাও একজন জীবন্ত শিল্পীর ছায়ায় গড়া, কিন্তু কোনোমতেই তাঁর জীবনী নয়।]
 

Users who are viewing this thread

Back
Top