What's new
Nirjonmela Desi Forum

Talk about the things that matter to you! Wanting to join the rest of our members? Feel free to sign up today and gain full access!

Collected মোহিনী- সমরেশ মজুমদার (2 Viewers)

এইরকম ভাষায় কথা বলতে পারে আশা তা ধারণাতেই ছিল না। কাকা বুঝলেন ব্যাপারটা আর সাধারণ পর্যায়ে নেই। এতদিন যে ছিল পাহাড়ের ঘেরের মধ্যে আটকে থাকা ছোট্ট পুকুর, সেই এখন মুখ খুঁজে নিয়ে ঝরনায় রূপান্তরিত হয়ে নদী হওয়ার স্বপ্ন দেখছে। এখন আর অন্য কোনো পথ নেই। অনিচ্ছা থাকলেও তার কর্তব্য হচ্ছে একে সঠিক পথে চালিত করা।

প্রধানাধ্যক্ষের সঙ্গে দেখা করলেন তিনি। পরিষ্কার বললেন তার নিজের তেমন কোনো ধারণা নেই। কিন্তু মেয়ে কথাকলি নাচের গণ্ডিতে আটকে থাকতে চাইছে না। সে আরও বড় জায়গায় পৌঁছাতে চাইছে। এক্ষেত্রে তাঁর কী করা উচিত। প্রধানাধ্যক্ষ প্রথমে বেশ বিরক্ত হয়েছিলেন। কথাকলি নৃত্যনাট্যের একনিষ্ঠ সেবক হিসেবে তিনি কখনই বরদাস্ত করতে পারেন না সেই ছাত্রীকে, যে এতে সন্তুষ্ট নয়। পরিচিত পৌরাণিক গল্প, অভ্যস্ত সঙ্গীত, প্রতীকধর্মী মেকআপ, স্টাইলাইজড পোশাক কথাকলি নৃত্যনাট্যের দর্শককে একটা আকাঙ্ক্ষিত জগতে সহজেই নিয়ে যেতে পারে। একমাত্র কথাকলি নৃত্যনাট্যেই সেই প্রাচীন ঐতিহ্য এখনও রয়েছে, যেখানে নাট্যগুণ রসসৃষ্টিতে সক্ষম। এই নৈপুণ্য অন্য ভারতীয় নাট্যশালায় প্রায় লোপ পেতে বসেছে। প্রধানাধ্যক্ষ আশাকে ডেকে পাঠালেন।

ঘরে ঢুকে আশা গুরুজনদের প্রণাম সেরে মাথা নিচু করে দাঁড়াল। প্রধানাধ্যক্ষ মেয়েটিকে ভাল করে লক্ষ্য করলেন। তার হঠাৎ খেয়াল হল কোনো শিক্ষকই আশা সম্পর্কে কখনও অভিযোগ করেনি বরং তার পরিশ্রম করার ক্ষমতা এবং গ্রহণ করার জন্যে উৎসাহ দেখে সবাই প্রশংসাই করেছে। তিনি জিজ্ঞাসা করলেন,

তোমার এখানে ভাল লাগছে না?

মাথা নিচু করেই আশা জবাব দিল, ভাল লাগছে।

তাহলে এখান থেকে চলে যেতে চাইছ কেন?

আমার তো মায়ের কাছে থাকতে খুব ভাল লাগত। তবু তো এত দূরে এসেছিলাম।

প্রধানাধ্যক্ষ কথাগুলো শুনে অবাক হলেন। এমন ইঙ্গিতে রূঢ় কথা সরল গলায় যে জানিয়ে দিতে পারে সে সহজ মেয়ে নয়। তিনি আর শাসনের ভাষা খুঁজে পাচ্ছিলেন না। তবু খানিকটা পরীক্ষা করার গলায় জিজ্ঞাসা করলেন, কথাকলির প্রাথমিক পাঠ তোমার নেওয়া হয়ে গিয়েছে। তোমার কি মনে হচ্ছে এখানে আর কিছু শেখার নেই?

আমার একথা বলার মতো স্পর্ধা যেন কখনও না হয়। কিন্তু আমি একক নৃত্যের মাধ্যমে নিজের কথা বলতে চাই।

কেন? পৌরাণিক চরিত্ররা কী আমাদের কথাই বলে না? দলগত অভিনয়ের মাধ্যমে সেই জীবন কী স্পষ্ট হয় না?

আপনার প্রথম প্রশ্নের উত্তর, হ্যাঁ, বলে। কিন্তু তাদের দশটা কথার একটা কথা আমার। যে পাখি খোলা আকাশে উড়তে চায় তার কী বড় খাঁচায় ডানা মেলতে ভাল লাগে? আপনার দ্বিতীয় প্রশ্নের উত্তর দলগত অভিনয় দর্শকের কাছে অর্থবহ এবং দৃষ্টিনন্দন। তাতে নাট্যরস বেড়ে যায়। কিন্তু আমি একজন অভিনেত্রী হিসেবে অন্যের জীবন পরিস্ফুট করে যাচ্ছি। কিন্তু সেই সুখটা তো নকল সুখ।

প্রধানাধ্যক্ষ আচমকা প্রশ্ন করলেন, তুমি কি ভরতনাট্যম শিখতে চাও?

এবার চোখ তুলল আশা, আপনারা যদি সুযোগ করে দেন।

প্রধানাধ্যক্ষ হাসলেন, বেশ। তোমার ইচ্ছেই পূর্ণ হোক। যে অধ্যবসায় এবং মানসিকতা তোমার লক্ষ্য করছি তাতে এইটুকু বলতে পারি সাধনা থেকে যদি তুমি ভ্রষ্ট না হও তাহলে একদিন তুমি ভারতবর্ষের শ্রেষ্ঠ নৃত্যশিল্পীর স্বীকৃতি পাবে। এখন তুমি যাও, আমি তোমার অভিভাবকের সঙ্গে আলোচনা করব।
 
শিক্ষার্থীদের মধ্যে প্রচারিত হয়ে গেল আশা কথাকলি নৃত্যনাট্যে আর আগ্রহী নয়। কারণ সে মনে করে কথাকলি তাকে তেমন কিছু দিতে পারছে না। ফলে এই নিয়ে রসিকতা যা রীতিমতো আক্রমণের পর্যায়ে উত্তীর্ণ হল। ছাত্ররা তাদের একমাত্র সহ-শিক্ষার্থিনীকে হারাবার আশঙ্কায় বিমর্ষ এবং ক্রুদ্ধ হল। শেষের দলটিকে ইন্ধন জোগালেন সেই সব শিক্ষক, যাঁরা কথাকলিকেই শ্রেষ্ঠ নৃত্য মনে করেন। এখনও এই বয়সে পৌঁছে কোনো কোনো সাংবাদিক অতীতের সেই ঘটনার কথা উল্লেখ করে মাঝে মাঝে প্রশ্ন তোলেন। কথাকলিকে তুচ্ছ করার মতো দুঃসাহস এবং হীনমানসিকতা তার কোনোকালেই ছিল না একথা আর কতবার বলবেন তিনি। সবাই সব কিছুর জন্যে তৈরি হয় না। নদীর মতো তাকে নিজের খাত খুঁজে নিতে হয়। সেই খোঁজার চেষ্টাই সেই সময় বিকৃতভাবে ব্যাখ্যা করেছিলেন সবাই। মাঝে মাঝে মনে হয়েছে আবার তালিম নিয়ে তিনি কথাকলি নৃত্যনাট্যে অংশ নেবেন। অন্তত ওই নাচের প্রতি তিনি যে অশ্রদ্ধা পোষণ করেন না, এতে প্রমাণিত হবে। কিন্তু এখন যেভাবে সময় নিয়ন্ত্রিত, তাতে বাড়তি সময় বের করা সম্ভব নয়।

প্রধানাধ্যক্ষের পরামর্শে কাকা দুদিন পরে তাকে নিয়ে যাত্রা করলেন। যাত্রা করার সময় কয়েকজন বন্ধু তাকে বিদায় জানাতে এসেছিল, তাদের মধ্যে একজন, শ্রীনিবাসন, কেঁদেই ফেলেছিল সবার সামনে। তখন তাদের বয়স পনেরো ছোঁয়নি। কিন্তু শ্রীনিবাসন যে অমন করবে সে ভাবেনি। কিন্তু আশার চোখে জল আসেনি। এই ব্যাপারটা নিয়ে পরে অনেক ভেবেছে। যখনই কোনো নতুন সাধনার উদ্দেশ্যে আগের মাটি থেকে শেকড় তুলতে হয়েছে তখন কোনো পিছুটান অনুভব করেনি সে। সব সময় তার আগামীদিনের আকাঙ্ক্ষা বড় হয়ে দেখা দিয়েছে।

প্রধানাধ্যক্ষের সঙ্গে কাকার কী কথা হয়েছিল আশা জানে না কিন্তু যেতে যেতে তিনি তাকে। বলেছিলেন, মনে রাখবে তুমি একটি তীর্থক্ষেত্রে যাচ্ছ। একজন তীর্থযাত্রীর সঙ্গে তোমার কোনো পার্থক্য নেই। তীর্থযাত্রী যেমন তীর্থক্ষেত্রে পৌঁছে জাগতিক সুখের সন্ধান করে না, তার লক্ষ্য থাকে ঈশ্বরের আশীর্বাদে ধন্য হওয়া তেমনি তুমিও সেইমত আচরণ করবে। হয়তো প্রধানাধ্যক্ষ কাকাকে বলেছিলেন তার মন প্রস্তুত করে দিতে। এসব বলার পরেও কাকা নিচু স্বরে বলেছিলেন, তবে আমার মনে হয় এত কষ্টের মধ্যে না গিয়ে বাড়ি ফিরে যাওয়াই ভাল। তোমার মায়ের তো তুমি ছাড়া কেউ নেই। ঈশ্বরের আশীর্বাদে যখন এই দুই বছরে অসুখবিসুখ আর ফিরে আসেনি তখন সংসারধর্ম করার ব্যাপারে অসুবিধে হবেনা। আশা অন্যদিকে তাকিয়েছিল, কথা শেষ হতে সে নিজের অজান্তেই এমনভাবে কাকার দিকে মুখ ফিরিয়েছিল যে তিনি আর প্রসঙ্গ টানতে চাননি। এই মানুষটিকে তার এক সময় খুব কড়া প্রকৃতির বলে মনে হত। কিন্তু যত তার সঙ্গে দূরত্ব বাড়তে লাগল তত মনে হচ্ছিল মানুষটির চারপাশের দেওয়ালগুলো একটু একটু করে ভেঙে পড়ছে।

সারারাত জেগে ওরা যখন পাণ্ডানুল্লুর গ্রামে পৌঁছেছিল তখন সবে ভোর হয়েছে। তবু প্রচণ্ড উত্তেজনায় আশার শরীরে এক ফোঁটা ক্লান্তি নেই। তখনও গ্রামের মানুষের ঘুম ভাল করে ভাঙেনি। শক্ত মাটির পথ দিয়ে ওর হেঁটে আসছিল আধফোঁটা রোদ্দুরে। সেই সাতসকালে এক প্রৌঢ় তার কাজে যাচ্ছিলেন, কাকা নাম বলতেই তিনি নিজের কাজ ছেড়ে দিয়ে ওদের পথ দেখাতে দেখাতে নিয়ে এলেন একটি ছোট্ট ঘরের সামনে। দেখিয়ে দিয়ে চলে গেলেন। ঘরটিকে কুঁড়েঘর বললে ঠিক বলা হবে। দরজা বন্ধ।
 
ভোরের প্রথম আলো এসে পড়েছে দরজার গায়ে। কাকা তাকেই ইশারা করলেন দরজায় আঘাত করতে। সেই বন্ধ দরজায় শীর্ণা মেয়েটি মৃদু আঘাত করল। কোনো শব্দ এল না ভেতর থেকে। আশা কী করবে বুঝতে না পেরে কাকার দিকে তাকাল। কাকা খানিকটা দূরে দাঁড়িয়ে ছিলেন উদ্বিগ্ন মুখে। আশা আবার দরজার দিকে ফিরল। এমন কিছু মজবুত নয়। সে এবার শব্দ করল বেশ জোরে। এই ঘরের ভেতরে যিনি আছেন তিনি ভরতনাট্যম নাচকে নিজের মধ্যে যেভাবে সঞ্চয় করেছেন সেভাবে আর কেউ এই মুহূর্তে পারেননি। সেই তাঞ্জোর রাজাদের সময় থেকে এই শাস্ত্রে যেসব পণ্ডিত পাণ্ডিত্য দেখিয়েছেন ইনি তাদের যোগ্যতম উত্তরাধিকারী। এসব কাকা তাকে বলেছেন আসবার সময়।

দরজা খুলল। ঘরের অন্ধকারে বাইরের আলো ছড়িয়ে পড়তেই বৃদ্ধ দেখা দিলেন। প্রথমে বিস্ময়, তারপর শীর্ণ মেয়েটিকে দেখে তার মুখে হাসি ফুটে উঠল। আশা দেখল তার সামনে যে কালো জীর্ণ শরীর এসে দাঁড়িয়েছে তার লজ্জা নিবারণ হয়েছে একটি লেংটির মাধ্যমে, মুখে অজস্র বলিরেখা এবং একটি চোখ অন্ধ। কোনো পরিচয় জিজ্ঞাসা না করে বৃদ্ধ বললেন, এসো, ভেতরে এসে বসো তোমরা। কথাগুলো বলেই তিনি চোখের আড়ালে চলে গেলেন।

দৃশ্যটি আশাকে বাকরহিত করে তুলেছিল। তার সমস্ত চেতনা এক সঙ্গে জানান দিয়েছিল যে সে প্রকৃত গুরুর সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। সমস্ত শরীরে যেন বিদ্যুৎ প্রবাহিত হয়ে গেল। এই সময় কাকা পেছন থেকে এগিয়ে বসে তার পিঠে হাত রাখলেন, চলো। আমরা তাঁর দেখা পেয়েছি।

ঘরের ভেতরে ঢুকে একটা চওড়া মাদুর দেখতে পেল ওরা। প্রায় সমস্ত ঘর জুড়ে সেটি পাতা। পাশেই আর একটা দরজা। বোধহয় সেখানেই তিনি শুয়েছিলেন। কাকা বসলেন মাদুরের ওপর। সে দাঁড়িয়ে দেখল ঘরের এক পাশে মৃদঙ্গ রয়েছে। আর কোনো আসবাব নেই এখানে। খানিকবাদে তিনি আবার বেরিয়ে এলেন পাশের ঘর থেকে। এবার তাঁর কোমর থেকে সাদা কাপড় জড়ানো। খানিকটা ভদ্র হবার চেষ্টা আর কী। তিনি এসে দাঁড়ানো মাত্র আশা এগিয়ে গিয়ে তার দুই পা স্পর্শ করে বসে পড়ল। এক মুহূর্ত পরে মাথার ঠিক মাঝখানে হাতের স্পর্শ পেল সে। এটা সেই ধরনের স্পর্শ যার মাধ্যমে আশীর্বাদ অনুভব করা যায়। তারপর প্রশ্ন করলেন, ইনি আপনার মেয়ে?

কাকা নমস্কার করলেন অর্ধনত হয়ে, আজ্ঞে না, আমার দাদার মেয়ে। দাদা নেই।

ওহো। একটা বিষাদের স্বর ফুটে উঠল গলায়। একটু সময় নিলেন এবং সেই সময় বোঝা গেল তার কথা বলার ভঙ্গি স্বাভাবিক নয়। তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, কোত্থেকে আসছেন আপনারা?

কাকা তাঁকে সব কথা খুলে বললেন। তিনি তার ভাল চোখটি বন্ধ করে সব শুনলেন। তারপর আশার দিকে তাকালেন, দু’বছর শিক্ষা নেওয়ার পর তোমার মতি পাল্টালো। কিন্তু তুমি কী শিখেছ তা তো আমাকে দেখাতে হবে মা।

প্রায় এক ঘন্টা পরে তিনি ইঙ্গিত করলেন আশাকে মাদুরের ওপর বসতে। কোনো যন্ত্র নেই, সঙ্গীতের সহযোগিতা নেই, নিজের মুখে শব্দ উচ্চারণ করে শরীর সঞ্চালন করতে করতে আশার মনে আকাঙ্ক্ষা তীব্রতর হচ্ছিল, সে কিছুতেই ফিরে যাবে না। বৃদ্ধ জিজ্ঞাসা করলেন, এবার তুমি বলো ঠিক কী চাও তুমি? কত কষ্ট সহ্য করতে পারবে?

আপনি যা আদেশ করবেন, সে তড়িঘড়ি বলে উঠল, আমি আজ থেকে আপনার কাছে শিখতে চাই।

তিনি হেসে মাথা নাড়লেন, তা সম্ভব নয়।

কেন? প্রায় আর্তনাদ করে উঠল আশা।

নিজের জীর্ণ বুকের খাঁচার ওপর হাত রাখলেন তিনি, এই শরীর বাদ সেধেছে। নিঃশ্বাসের কষ্ট হয়। বিশেষ করে বছরের এই সময়। শরীরও আর আগের মতো মনের কথা শোনে না। সেই কারণেই নতুন ছাত্র-ছাত্রীদের আমি শিক্ষা দিতে পারি না।

হঠাৎ সোজা হয়ে বসল আশা, কিন্তু আমি আপনার কাছ থেকে ফিরে যাব না।

সেই এক চোখে বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে বৃদ্ধ বললেন, তুমি খুব জেদী, না?

আশা মাথা নিচু করল। এর জবাবে কী বলতে পারে সে। হঠাৎ তার কানে গেল, তেই ইয়া তেই ইয়ে। সঙ্গে সঙ্গে আশা সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে দু’বার ডান পা মাটিতে ঠুকল। ডান, ডান, বাঁ, বাঁ বা ডান।
 
এই প্রথম পর্যায়ে তার পায়ের দিকে তাকিয়ে বৃদ্ধ ছেলেমানুষের খুশিতে উজ্জ্বল হয়ে উঠলেন। ইশারায় তিনি কাছে ডাকলেন। আশা কম্পিত পায়ে সামনে এসে দাঁড়াতেই মুখ দুলিয়ে বসতে বললেন। আশা পা মুড়ে বসতেই তার এক চোখ দীর্ঘক্ষণ তার চোখের দিকে চেয়ে রইল। তারপর হঠাৎই প্রশ্নটা ছিটকে এল, তুই পারবি? সমস্ত শরীর নড়ে উঠল আশার, চোখের পলক না ফেলে বলল, পারব।

পাণ্ডানুল্লুর গ্রামটি খুব বড় নয়। কিন্তু এ গ্রামের মানুষেরা তাদের জীবনযাত্রার মধ্যে সঙ্গীত এবং নৃত্যকে এমনভাবে জড়িয়ে রেখেছেন যে আশার দিনগুলো চমৎকার কেটে যাচ্ছিল। যতক্ষণ আবহাওয়ার পরিবর্তন না ঘটছে ততক্ষণ গুরুদেব সক্রিয়ভাবে তাকে শিক্ষা দেবেন না। তার শরীর সেটা দিতে তাকে সাহায্য করবে না। প্রথমে কথাটা শোনার পর মন ভীষণ ভেঙে পড়েছিল। অপেক্ষা করার ধৈর্য তার ছিল না। প্রতিদিন গুরুদেবের সামনে বসে কথা শুনতে হবে অথচ নাচ শিখতে পারবে না এ কেমন কথা।

কিন্তু দিন গড়াতে আশা ধৈর্য ধরতে শিখল। কাকা চলে গেছেন সেইদিনই। যাওয়ার আগে তার এখানে থাকার ব্যবস্থা করে গেছেন গুরুদেবের ছেলের সঙ্গে কথা বলে। গুরুদেব এই বাড়িতে থাকেন একা। কিন্তু পাশেই তাঁর পরিবারের লোকজনেরা থাকেন। গুরুদেবের তিন ছেলে এবং অনেক নাতি নাতনি। ছেলেরাও ভাল নাচেন কিন্তু নাচ নিয়ে সর্বক্ষণ থাকেন না। পিতার প্রতিভা তাঁরা পাননি কিন্তু পিতার প্রতি শ্রদ্ধায় সব সময় নিবেদিত প্রাণ। গুরুদেবের নাতি নানা পিল্লাই কিন্তু নাচ নিয়ে আদৌ মাথা ঘামাত না। ওই ঘরে ঢুকে শরীর সঞ্চালনের বদলে মাঠে ঘুরে বেড়ানো, টিলায় ওঠা, নদীর জলে ডুব দিতে তার বেশি ভাল লাগত। আর এই কারণে নাচের ঘরে তার প্রবেশ নিষিদ্ধ ছিল। কিন্তু তাতে তার কোনো ক্ষতিবৃদ্ধি হত না। সে থাকত নিজের মনে। আশা তারই সমবয়সী। ফলে আশার সঙ্গে ভাব জমাতে চেষ্টা করত। সেটা এমন একটা সময় যে সমবয়সী ছেলের সম্পর্কে মেয়েদের কৌতূহল জাগবেই। কিন্তু সেই কালো দামাল ছেলেটা তাকে খুব একটা টানত না। বরং একা একা টিলায় টিলায় ঘুরে বেড়াবার সময় নাচের মুদ্রায় নিজেকে ছড়িয়ে দিতে অনেক বেশি আরাম লাগত। কীভাবে মেঘেরা শরীর ভাসায় দেখার পর সে ভাসতে চেষ্টা করত, গাছেরা হাওয়ার দোলায় যেভাবে ডাল দোলায় তার অনুকরণ করার চেষ্টা করত। একদিন একটি বিরাট পাথর দেখে সে থমকে দাঁড়িয়ে ছিল। পাথরটি কুঁজো হয়ে যেন সমস্ত ছন্দ বন্ধ করে মহাকালের মতো স্থির হয়ে বসে রয়েছে। সারাটা দুপুর কেটে গিয়েছিল সেই পাথরের মতো স্থির হয়ে শরীরটাকে অর্থবহ করতে। এবং এই একাকী ঘুরে বেড়ানো তাকে একটি আবিষ্কারের দিকে নিয়ে গেল। প্রকৃতির বাইরের চেহারাটা চোখের আরাম দেয় কিন্তু তাকে ঘিরে মনের আবর্ত তৈরি হলে নতুন অর্থ তৈরি হয়ে আসে। আর সেই বেরিয়ে আসা অর্থটি সমস্ত চেতনাকে আচ্ছন্ন করে রাখে।

আশার থাকার ব্যবস্থা হয়েছিল নানা পিল্লাইদের বাড়িতে। কিন্তু সেখানে সে থাকত হাতে গোনা সময়ে। ভোর হলেই সে চলে যেত তাতার কাছে। গ্রামের সমস্ত মানুষ গুরুদেবকে ওই নামেই ডাকত। বৃদ্ধ ঘুম থেকে উঠে তাকে বসতে বলতেন হাসিমুখে। যেদিন তার নিঃশ্বাসের কষ্ট হত সেদিন কথা বলতে পারতেন না। যেদিন শরীর একটু ভাল থাকত সেদিন গল্প করতেন।

তেই ইয়াম দাত তা তেই ইয়াম তা হা। পায়ের গোড়ালির ওপর শরীরের ভর রেখে পাতা ওপরে রাখতে হবে। তারপর এক পা সামনের দিকে প্রসারিত করতে হবে ডান বা বাঁদিকে। তারপর সেই পা ফিরিয়ে আনতে হবে, পেছনের পায়ের পাশে।

তৃতীয় পর্যায়ে আসছে তাত্ তেই তাম্। সমান পাতায় শরীরের ভর রেখে আঙুলের ওপর সামান্য এগোনো। পায়ের আঙুল থেকে গোড়ালির মধ্যে সঞ্চালন শুরু হল।
 
একটু একটু করে নবম পর্যায়ের বিশদ বিবরণ তাতার মুখে শুনতে পেল আশা। সে মনে মনে গেঁথে নিল বোলগুলো, তেই ইয়াম্ দাত, তা তেই ইয়াম্ তা হা, তাত্ তেই তা তেই হাত তেই হি, তাত তেই তা হা, তেই তেই তা, ডি ডি তাই। অষ্টম পর্যায়ে নিঃশব্দে শরীরের ভঙ্গি পরিবর্তন এবং নবম পর্যায়ে তা ডিট ডিট তাই। এসবের শুরুতে প্রথম বোল তেই ইয়া তেই ইয়ে তো রয়েছেই। কিন্তু ভরতনাট্যমের বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে এই নবম পর্যায়ের বিস্তারে পার্থক্য আছে। কিন্তু মূল অংশটি নিয়ে কোনো মতভেদ নেই। সাহিত্য ও স্থাপত্য বলছে ভরতনাট্যম পরিবেশিত হত একক এবং দলগতভাবে। উনিশ শতকে তাঞ্জোরের চার ভাই, চিন্নার্য, পন্না, ভাদিভেলু এবং শিবানন্দন দলগত নৃত্যের বদলে একক নৃত্যে পুরোপুরি ভরতনাট্যমকে নিয়ে আসেন। এ কথা স্বীকার করে নেওয়া হয়েছে, ভরতনাট্যম নাচ সাধারণত মন্দিরে ঈশ্বরের সামনে পরিবেশিত হত কিন্তু রাজদরবারের নৃত্যের সঙ্গে এর পার্থক্য প্রমাণ করে দুটো নাচের শুধু অভিব্যক্তিতে।

দুমাস কাটানোর পর আশার মনে হল তাদের গ্রামের শিক্ষক যে কথা গল্প করে বলতেন সেই সব কথার সঙ্গে তার কথার কোনো পার্থক্য নেই। শুধু সেই মানুষটি কখনই এক বিষয়ে স্থির। থাকতেন না। কিন্তু তাতা সেই বিষয়ের গভীরে তাকে নিয়ে যেতেন। সক্রিয় শিক্ষা শুরু হবার আগে তাতা তাকে নির্দেশ দিলেন মাকে দর্শন করে আসতে, কারণ তিনি মনে করেন মায়ের আশীর্বাদ না পেলে শিক্ষা সম্পূর্ণ হয় না। তাতার এক ছেলে আশাকে পৌঁছে দিয়ে এল বাড়িতে।

সেই প্রথমবার আশার মনে হল সময় যেন কিছুতেই কাটতে চাইছে না পরিচিত পরিবেশে। যেখানে সে জন্মেছে, যে চৌহদ্দিতে তার শৈশব কেটেছে সেখানে কোনো কিছু নতুন করে পাওয়ার নেই। এমন কী খুড়তুতো ভাই বোনেদের জীবনযাত্রার সঙ্গে তার কোনো মিল নেই। শুধু মায়ের পাশে শোওয়ার পর তিনি যখন তার গায়ে হাত রাখেন তখন সমস্ত শরীর-মনে একটা শান্তির প্রলেপ ছড়িয়ে পড়ে। গ্রামে ফিরে আশা যে দুঃসংবাদটি পেয়েছিল তা সে বাকি জীবনে ভুলতে পারেনি। তার সেই শিক্ষক, যিনি নাচ ভালবেসেছিলেন নিজের মতো করে, একটি দুর্ঘটনায় মারা গিয়েছেন। মাঝ রাতে একটি কুয়োর মধ্যে পড়ে গিয়েছিলেন তিনি এমন আশঙ্কা করা হয়েছে। হঠাৎ পরিচিত পৃথিবী থেকে একটি বিশেষ মানুষ উধাও হয়ে গেছে, সমস্ত চেষ্টাতেও যার হদিস পাওয়া সম্ভব নয়, আশাকে নাড়িয়ে দিল। নিজের পিতৃদেবের মৃত্যু তাকে এই বোধ দেয়নি। কারণ তখন তার নিজস্ব অনুভূতির জন্ম হয়নি। সে চোখ বন্ধ করলেই দেখতে পায় সেই খেয়ালি মানুষটিকে যিনি বর্তমান কিংবা ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করতেন না। তাকে তো অনেকেই আধ পাগল বলত। সাংসারিক নিয়মের বাঁধাপথে মানুষটি কখনও চলেননি। কিন্তু আশাকে নৃত্য সম্পর্কে প্রথম অবহিত করেছিলেন এই মানুষটি। নিজে উদ্যোগী হয়ে তাকে পৌঁছে দিয়েছিলেন স্বপ্নের দরজায়। এখনও মাঝে মাঝে আশার গোলমাল হয়ে যায় ঠিক কাকে তার গুরুদেব বলা উচিত? তাতা না সেই শিক্ষককে।

তাতার কাছে ফেরার তাগিদ আশাকে বেশিদিন শোকভিভূত রাখতে পারেনি। কিন্তু ফেরার সময় এবার একটা কাণ্ড হল। কাকার শরীর খারাপ তাই কাকার এক ছেলে তাকে পৌঁছে দিতে চলেছিল। কিন্তু হঠাৎ মা ঘোষণা করলেন তিনি সঙ্গে যাবেন। তিনি নিজের চোখে দেখে আসতে চান তাঁর মেয়ে কীরকম পরিবেশে থাকছে। দূরত্বটা অনেক কিন্তু প্রৌঢ়া কিছুতেই নিরস্ত হলেন না। শেষ পর্যন্ত কাকাও বললেন, তোমার মায়ের যাওয়া দরকার। কারণ আমি তো পিল্লাই পরিবারের মেয়েদের সঙ্গে কথা বলার সুযোগ পাইনি; তিনি গেলে সেটা সম্ভব হবে এবং আমরাও নিশ্চিন্ত হব। অতএব মা চললেন সঙ্গে। বাড়ি থেকে বের হবার পর কিন্তু আশার খুব ভাল লাগল মায়ের সঙ্গ। পথের সব কিছুতেই মায়ের কৌতূহল, আশারও।
 
মায়ের জন্যেই স্টেশনে নেমে গরুর গাড়ি নেওয়া হল। অবশ্য দূরত্বটা কম নয়। এখানে পাঁচ সাত ক্রোশ মানুষ অক্লেশে হেঁটে যায়। পাণ্ডানুল্লুরের কাছ দিয়ে অবশ্য রাস্তা গিয়েছে বাসের, হাঁটতেও হয় না বেশি, কিন্তু গরুর গাড়িতে চেপে আশারও ভাল লাগল। বেশ হেলতে দুলতে প্রকৃতিকে একটু একটু করে আবিষ্কার করা যাচ্ছিল।

গ্রামে যখন পৌঁছাল ওরা, তখন সূর্য মাথার ওপরে। আশার বার তর সইছিল না। ওকে দেখে যারা এগিয়ে এসেছিল তাদের দিকে তাকিয়ে হেসে মাথা দুলিয়ে সে মায়ের হাত ধরে চলল তার কাছে। তার ঘরের দরজা খোলা। তিনি বসেছিলেন দেওয়ালের সামনে। কয়েকজন শিল্পী তাঁর কাছে সম্ভবত তালিম নিচ্ছিল। মৃদঙ্গে বোল উঠছিল। দরজায় তাদের দেখে তাতা মুখ তুলে চাইলেন। এবং তারপরই ওঁর মুখ হাসিতে ভরে উঠল। দ্রুত ব্যবধান ঘুচিয়ে তার পায়ে মাথা ঠেকাল আশা। বৃদ্ধের শীর্ণ আঙুল তার মাথায়, তিনি বললেন, বাঃ তুমি এসে গেছ! যেন তার আসার পথ চেয়েছিলেন তাতা। খুশিতে মন ভরে গেল আশার। সে মুখ তুলে বলল, আপনার সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন আমার মা।

তাই? কোথায় তিনি? সচকিত হয়ে দরজার দিকে তাকালেন তাতা। তারপরেই দুটো হাত মাথার ওপরে তুলে নমস্কারের ভঙ্গি করে বললেন, আসুন। আমি ভাল দেখতে পাই না। মা ধীরে ধীরে এগিয়ে এলেন। তারপর নতজানু হয়ে তার পা স্পর্শ করতে করতে সবাইকে অবাক করে সশব্দে কান্নায় ভেঙে পড়লেন। ব্যাপারটা এমন আচমকা ঘটল যে আশা পর্যন্ত হতভম্ব হয়ে গেল। হাত বাড়াতে গিয়েও তাতা থেমে গেলেন। ঘরের অন্য মানুষেরা চুপচাপ দৃশ্যটি দেখছেন। শেষ পর্যন্ত তাতা বললেন, মা আপনি শান্ত হন।

আমি পারছি না, আমি আর সইতে পারছি না। মা মুখে আঁচল চাপা দিলেন।

আমাকে যদি একটু খুলে বলেন–। তার গলায় মমতা।

ওকে ছেড়ে আমি আর থাকতে পারছি না। পৃথিবীতে ওই মেয়ে ছাড়া আমার আর কেউ নেই। আপনি ওকে বুঝিয়ে বলুন। মায়ের কান্না জড়ানো শব্দগুলো কানে আসামাত্র আশা কাঠ হয়ে দাঁড়াল। এ কী বলছেন মা? এতটা পথ আসবার সময় সে বুঝতেই পারেনি এখানে মায়ের আসার উদ্দেশ্য কী! সে তীব্র গলায় প্রতিবাদ করতে গিয়ে কেঁদে ফেলল। মা তখন বলেই চলেছেন আশা তার জীবনের কতখানি। অল্প-স্বল্প নাচ শেখাতে তার আপত্তি ছিল না। কিন্তু গ্রামের যে শিক্ষক প্রথম আশাকে নাচ শিখিয়েছিলেন তিনি মারা যাওয়ার আগে একদিন তাকে বলেছিলেন, আশা যদি সত্যিকারের শিল্পী হয়ে ওঠে তবে তার জগৎ হবে আলাদা, সেখানে মা দাদা বোনের কোনো অস্তিত্ব নেই। এই কথা শোনার পর তিনি আর চান না মেয়ে পর হয়ে যাক।

ততক্ষণে শক্তি ফিরে পেয়েছে আশা। এগিয়ে এসে মায়ের বাজু ধরে বলল, তুমি ওঠো।

মা সেই কথায় কান দিলেন না, আমার বুকে জমে থাকা কষ্ট আমি কাউকে বলিনি। এমনকী ওই মেয়েকেও নয়। কিন্তু আপনাকে দেখার পর মনে হল আপনি আমাকে বুঝতে পারবেন।

আশা কেঁপে উঠল। তার ভবিষ্যতের ওপর একটা কালো পর্দা নেমে আসছে। মায়ের কথা শুনে তাতা তাকে এইবার বলবেন চলে যেতে। এবং তা যদি হয় তাহলে সে গ্রামে ফিরে গিয়েই কুয়োয় ঝাঁপিয়ে পড়বে। এখন যদি কোনোমতে মাকে তাতার সামনে থেকে সরিয়ে নেওয়া যেত! চুপচাপ শুনছিলেন তাতা, এবার কথা বললেন, মা, আমি আপনার কষ্ট বুঝতে পারছি। কিন্তু আপনি বলুন তো, আপনার সন্তান যখন বিবাহের পর স্বামীর ঘরে চলে যাবে তখন আপনি কী করবেন? সেই একাকিত্ব সহ্য করবেন কী করে?

মা একটু থমকে গেলেন। তারপর দৃঢ় গলায় বললেন, তখন আমার সান্ত্বনা থাকবে এই ভেবে যে আমার মেয়েকে যত্ন করার মানুষ এসেছে। তার ভবিষ্যৎ আর অনিশ্চিত নয়।

ও, তাহলে আপনার মেয়ের মঙ্গল হলে আপনি এই একাকিত্ব সহ্য করতে পারবেন?

মা মুখে কিছু না বলে ধীরে ধীরে মাথা নেড়ে স্বীকৃতি জানালেন। তার মুখে হাসি ফুটে উঠল, বেশ। আমি আপনার মেয়ের বিবাহের আয়োজন করছি।

শুধু মা নন, আশাও চমকে উঠল। এ কী কথা বলছেন তাতা।

মা মুখ ফিরিয়ে তার মুখ একবার দেখে নিয়ে বললেন, আমি, আমি ঠিক প্রস্তুত নই।

এই বিবাহে প্রস্তুতির প্রয়োজন হয় না মা!

পাত্র কে?

জগদীশ্বর। শিব। নটরাজ। সুরের দেবতা। শিল্পের জনক। তাঁর সঙ্গে বিবাহ হলে যে যত্ন এবং নিরাপত্তা আপনার মেয়ে পাবে তা পৃথিবীর কোনো মানুষ ওকে দিতে পারবে?

হঠাৎ মা দ্রুত মাথা নাড়তে নাড়তে উঠে দাঁড়ালেন, না।

না মানে? তাতার গলার স্বর চড়া।

দরকার নেই। ও এখানে থাকুক, ওর যেমন ইচ্ছে তেমন শিখুক। আমি চেষ্টা করব আমার কষ্ট অতিক্রম করতে। না, আমি আর ওর এগিয়ে যাওয়ার পথে বাধা দেব না।
 
ইন্দিরা মার্গের এই বাড়ির সেই বিশেষ ভাবে তৈরি বারান্দায় চেয়ারে শরীর এলিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে তিনি মায়ের মুখ কল্পনা করছিলেন। আজকাল প্রায়ই মুখগুলো ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে। মা চলে গেছেন অনেককাল আগে। কিন্তু এখনও তার বোধগম্য হল না কেন মা তাতার কথা শোনার পর অমন আঁতকে উঠেছিলেন। এবং তারপরেই নিজের সমস্ত ইচ্ছা বিসর্জন দিয়ে আশাকে অনুমতি দিয়েছিলেন এগিয়ে যেতে? তারপরে কখনই তিনি তাকে সংসারী করার চেষ্টা করেননি। তাতা তাকে প্রায়ই রসিকতা করে বলতেন, তোমার সঙ্গে নটরাজের বিবাহ হয়ে গিয়েছে, মনে রেখ।

প্রায় সেইরকম বিশ্বাস করে নিয়েছিলেন তিনি। আশা চেয়ার ছেড়ে ওঠার কথা ভাবলেন। এক গ্লাস জল চাই। কমলা কিংবা শ্রীনিবাসকে ডাকলেই ছুটে আসবে। কিন্তু আজ আশার কোনো শব্দ উচ্চারণ করতে ইচ্ছে করছিল না। রাতের আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে নিজের প্রয়োজন অতিক্রম করা যায়। ওই মেঘেরা যেভাবে শরীর পরিবর্তন করে সারা আকাশ জুড়ে নেচে বেড়ায় তা দুচোখ ভরে দেখে যেতে বড় ভাল লাগে তার।

তাতার কাছে তার হাতে-কলমে নাচ শেখা শুরু হল। এ এক অপূর্ব আনন্দ। বৃদ্ধের জীর্ণ শরীর যেন শুধু তার জন্যেই কথা বলতে শুরু করল। অত্যন্ত ভাগ্যবতী না হলে ওই প্রতিভাবান মানুষের সংস্পর্শে সে আসতে পারত না। নিঃস্বার্থভাবে জ্ঞানের ভাণ্ডার তিনি উন্মুক্ত করে দিচ্ছিলেন তার কাছে। মনে হচ্ছিল এক জীবনে এসব শিখে ওঠা যাবে না। তাতা তার অন্য শিষ্যদের কথা বলতেন। যারা শিষ্যত্ব গ্রহণ করেছিল। সেই সব দেবদাসীর গল্প বলতেন যারা নৃত্যকেই জীবনে বাঁচার একমাত্র পথ বলে মনে করত। তাতা যাদের কাছে শিক্ষা পেয়েছেন সেই সব পূর্বসূরীর কথাও বলতেন। প্রতিটি শব্দ, নৃত্যের প্রতিটি ব্যাখ্যা আশা মনের মধ্যে গেঁথে নিচ্ছিল। আর প্রতি রাত্রে খাতায় লিখে রাখত। সেসব খাতা এখনও রয়েছে কিন্তু পৃথিবী থেকে সেই ভাল মানুষেরা কখন যেন উধাও হয়ে গেছে!

মাঝে মাঝে তাতার ইচ্ছে হলে আশাকে নিয়ে বাইরে বের হতেন। মাঠে দাঁড়িয়ে মায়ের ডাক শুনে ছুটে আসা বাছুরের শরীরের ছন্দ লক্ষ্য করতে বলতেন। লজ্জাবতী গাছের ডালে আঙুল রেখে ওদের কুঁকড়ে যাওয়া এবং শেষে ডালগুলোর মাথা নুইয়ে নেওয়া দেখিয়ে নকল করতে বলতেন। এ এক অপূর্ব অভিজ্ঞতা। তাতা বলতেন আমাদের চারপাশের যে জগত সেখানেই নৃত্যের সব উপকরণ ছড়ানো আছে। যে শিল্পী সে ওই জীবন দেখে নিজেকে তৈরি করে নেয়।

একদিন তাতা তাকে পুঁটুলি বেঁধে নিতে বললেন। তাতার ছেলেদের আপত্তি ছিল। কিন্তু বৃদ্ধ একবার যা সিদ্ধান্ত নিতেন তা বদল করতেন না। অতএব গরুর গাড়ি ডেকে আনা হল। ছেলেরা চেয়েছিল সঙ্গে পরিবারের কেউ যাক। অন্তত নাতি নানা গেলেও নিশ্চিন্ত হতে পারে তারা। কিন্তু তাতা কাউকেই সঙ্গে নিতে চাননি। কেন চাননি তা পরে বুঝতে পেরেছিল আশা। দুজনে গরুর গাড়ির ছই-এর মধ্যে বসে দীর্ঘ পথ অতিক্রম করে কুম্বাকোনামে পৌঁছেছিল। সমস্ত পথ তাতা চোখ বন্ধ করে শুয়েছিল। আর তার পায়ে হাত বুলিয়ে দিচ্ছিল আশা। পৌঁছাবার মুখে তিনি উঠে বসলেন, আমরা এখন যার কাছে যাচ্ছি সে ঈশ্বরের দাসী। নাচ আছে তার রক্তে। কিন্তু ঈশ্বর ছাড়া অন্য কারো সামনে সে কখনো নাচেনি। মনে রেখ প্রকৃত গুণীর সান্নিধ্যে সব সময় তোমার অন্তরকে শক্তিমান করবে। তা তিনি যদি কিছু না দিতে চান তবুও তুমি কিছু পাবে।

আশা অবাক হয়ে দেখল এত কষ্ট করে তাতা যাঁর কাছে এলেন তার বয়স পঁচাত্তর তো হবেই। শরীর বেশ ভারী, চুলে কালো ছোপও নেই। কিন্তু তিনি তাতাকে গাড়ি থেকে নামতে দেখে ছুটে এলেন বাইরে। তাতা মাটিতে দাঁড়ানো মাত্র হাঁটু মুড়ে বসে দুটো হাত বুকে জড়ো করে নমস্কার জানালেন। পরে, অনেক পরে আশা জেনেছে মহিলা একমাত্র ঈশ্বরকেই মাটিতে কপাল ঠেকিয়ে প্রণাম করেন। অভিবাদন সেরে উঠে দাঁড়িয়ে বৃদ্ধা বললেন, আমার কি সৌভাগ্য!

কেমন আছ পুষ্প? তাতা জিজ্ঞাসা করলেন সস্নেহে।

তাঁর আশীর্বাদে এখনও বেঁচে আছি তাতা। আসুন ভেতরে আসুন।
 
বাড়িটা ছোট। কিন্তু ভেতরে ঝকঝকে বাঁধানো উঠোন রয়েছে। হাত-পা ধাওয়ার পর তাতা পরিচয় করিয়ে দিলেন, এর কথাই তোমায় বলেছিলাম। আর পুষ্প, এর নাম আশা। এই বয়সে ওই মেয়ে আবার নাচ শেখাতে বাধ্য করেছে।

আপনাকে কেউ বাধ্য করতে পারে না তাতা। নিশ্চয়ই এই মেয়ের ক্ষমতা আছে যার জন্যে আপনি রাজি হয়েছেন। বৃদ্ধা সস্নেহে আশার মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন।

জলযোগ শেষ হলে তাতা বললেন, আমরা এত দূরে এলাম তোমার নাচ দেখতে পুষ্প!

আমার? চমকে উঠলো পুষ্প।

হ্যাঁ। এই মেয়েকে আমি আমার যা কিছু অভিজ্ঞতা দিয়ে যেতে চাই। কিন্তু যেটা আমি নিজে কখনও পারব না সেটা ও তোমার মধ্যে দেখুক। তাতা মাথা দোলাতে দোলাতে বললেন।

লজ্জায় যেন কুঁকড়ে গেলেন বৃদ্ধা, না-না, এ আদেশ করবেন না।

উঁহু, তোমার অভিনয়, ভঙ্গি আর অভিব্যক্তি আর কারো মধ্যে আমি দেখিনি।

কিন্তু এখন যে আমার বয়স হয়ে গেছে। পুষ্প প্রতিবাদ করার চেষ্টা করলেন।

যে তিনটি বিষয়ের কথা বললাম তা কোনো সময় থামিয়ে দিতে পারে না পুষ্প।

বেশ কাতর চোখে বৃদ্ধা তাতার দিকে তাকালেন। বোঝা যাচ্ছিল তিনি আর অমান্য করতে পারবেন না। পুষ্প মন্থর ভঙ্গিতে চলে গেলেন ঘরের ভেতর। তারপর আসন সুষ্ঠু ভেঙ্কটেশ্বরের ছোট্ট একটা মূর্তি সযত্নে বা নিয়ে এলেন বারান্দায়। একটু সময় নিলেন নিজেকে তৈরি করতে। তারপর আভূমি নত হয়ে দেবতাকে প্রণাম জানালেন। আজ্ঞা নিলেন তাতার কাছ থেকে। তারপর শুরু করলেন।

ওই শরীর, যার সর্বাঙ্গে বয়স জেঁকে বসেছে, আশার কল্পনা কিছুতেই কাজ করছিল না তিনি কীভাবে সক্ষম হবেন। পুষ্প সেই পদ শুরু করলেন যেখানে কৃষ্ণের জন্যে বিরহিণী রাধার আর্তি ফুটে উঠেছে। সেদিন আশা যা দেখেছিল তা এক মুহূর্তের জন্যেও মন থেকে মুছে যায়নি। এখনও চোখ বন্ধ করলে বৃদ্ধার সেই নাচ ভেসে ওঠে। সমস্ত শরীরে শিহরন বয়ে গিয়েছিল তার। দ্যাখো, দেখে শেখো, এই দেখার জন্যেই তোমার জন্ম হয়েছিল। নিজেকে প্রায়ই এই কথা বলতেন তিনি যখনই পুষ্পর কথা মনে পড়ত। নাচের একটি অংশের কথা বিশেষ করে মনে পড়ে যেখানে রাধা এক সহচরীর জন্যে অপেক্ষা করছেন যে কৃষ্ণের বার্তা বহন করে আনছে। শুধু নাকছাবির ওঠা নামা এবং চাহনিতে সেই আর্তি এবং উদ্বেগ ফুটিয়ে তুললেন পুষ্প। কোথাও কোনো মাসল নড়ল না। এই হল প্রকৃত শিল্পীর কাজ। তাতা বলতেন, সবাই নাচে কিন্তু কেউ কেউ শুধু নাচের মাধ্যমে নিজের জগৎ তৈরি করে নিতে পারে।

পাণ্ডানুল্লুর ফিরে আসার পর প্রতিটি দিন শেষ হত আর আশার মনে হত সে ঢেউ-এর ওপরে ভেসে বেড়াচ্ছে। দিনে পনের ঘন্টা অনুশীলন আর ব্যাখ্যা শোনা। সে টের পেত বিশাল কলসির তলায় যেন একটু একটু করে জল জমছে। আর তখনই ঈশ্বর তাকে ভাগ্যহীনা করলেন। এক প্রত্যুষে সে বিছানা ছেড়ে মাটিতে পা দিতেই খবর পেল মা চলে গেছেন। গ্রাম থেকে খবর আসতে, সময় লেগেছে। কিন্তু কাকা তার জন্যে মায়ের দেহ রেখে দিয়েছেন। চিৎকার করে কাঁদতে কাঁদতে সে ছুটে গিয়েছিল তাতার দরজায়। বৃদ্ধ সংবাদটা সম্ভবত আগেই জেনেছিলেন। দুহাতে আশার মাথা বুকে টেনে নিয়েছিলেন। শুধুই কান্না। অনেকক্ষণ কেউ কোনো কথা বলেনি। বৃদ্ধের শুকনো খাঁচার মতো বুকে মুখ রেখে যে শান্তি খুঁজেছিল আশা তার স্মৃতি আজও স্পষ্ট। নিজের বাবাকে খুব অল্প বয়সে হারিয়েছিল সে। কিন্তু তার মধ্যে সে সত্যিকারের পিতাকে খুঁজে পেয়েছিল।

তাতা বলেছিলেন, মন শক্ত রেখো। তোমার মায়ের শরীর তোমার জন্যে অপেক্ষা করছে। যদি পৌঁছে তাঁকে দেখতে না পাও তবু ভেঙে পড় না। পৃথিবীতে সব সময় কষ্ট সইবার জন্যে তৈরি থাকতে হয়। যত তোমার বয়স বাড়বে তত তোমার চেয়ে বয়স্করা বয়স্কতর হবে।

কিন্তু আমার যে কেউ রইল না! ডুকরে উঠেছিল আশা।

সে কী! তোমার নাচ রইল। তোমার নটরাজ রইল। নাচ আর নটরাজের বয়স কখনও বাড়ে না। একদিন তুমি তাদের ছাড়িয়ে যাবে কিন্তু তারা নয়।
 
সেই সকালেই পাণ্ডানুল্লুর থেকে রওনা হয়েছিল আশা। কিন্তু মায়ের শরীর দেখার সুযোগ পায়নি আর। সেই গ্রাম, সেই বাড়ি একই আছে শুধু তার জন্যে সব সময় ভাবত যে মানুষটা তাকে আজ খুঁজে পাওয়া যাবে না। মৃতদেহ সংরক্ষিত রাখার কোনো বৈজ্ঞানিক সাহায্য না পাওয়ায় কাকা মুখাগ্নি করেছেন। মায়ের খাট, জামাকাপড়, পুরনো ছবি আর তখনও ঘরময় ভেসে বেড়ানো মা গন্ধ নিয়ে কয়েকদিন অঝোরে কেঁদে গেল আশা। তাকে কাঁদতে দিয়েছিলেন কাকা। মায়ের কাজ শেষ হয়ে যাওয়ার পর সে যখন আবার তাতার কাছে ফিরে যেতে প্রস্তুত তখন কাকা কথাটা বললেন। মারা যাওয়ার কয়েকদিন আগে মা নাকি আবার ব্যস্ত হয়ে উঠেছিলেন আশার বিয়ে নিয়ে। একে ওকে ডেকে বলতেন। এবং সেই সুবাদে একটি সুপাত্রের সন্ধান পেয়েছিলেন। ছেলেটি শিক্ষিত। এম. এ পাশ করে স্কুলে শিক্ষকতা করছে। সুদর্শনও। মায়ের এই শেষ ইচ্ছার মূল্য নিশ্চয়ই আশার দেওয়া উচিত। কী জবাব দেবে বুঝতে পারেনি আশা। তখনও চারপাশে মায়ের স্মৃতি এত প্রকট এবং এত বেদনাময় যে চট করে মায়ের বিরোধিতা করতে পারল না সে। কিন্তু কাকা যে তার নীরবতাকেই সম্মতির লক্ষণ ধরে নিয়ে পাত্রপক্ষকে খবর পাঠাবেন তা কে জানত!

সেটা জানতে পেরেই ফুঁসে উঠল সে। কিন্তু তখন ব্যাপারটা এত দূরে এগিয়ে গেছে যে কাকা নিজের এবং পারিবারিক সম্মানহানির ভয়ে খেপে উঠলেন। গৃহস্থের মেয়ে হিসেবে যতটা নাচ শেখা দরকার তার অনেক বেশি শেখা হয়ে গেছে। তাছাড়া নাচ ওকে ভবিষ্যতে কী দেবে? একমাত্র দেবদাসীরাই যৌবনে এই বৃত্তি বাঁচিয়ে রাখে। দেবদাসী লোপ করার বিল যখন উনিশশো দশ সালে পাশ হয়ে গেল তখনই ভরতনাট্যম বিরাট ধাক্কা খেল। সেই উকিল, যার নাম কৃষ্ণ আয়ার, তিনি এগিয়ে না এলে কী হত বলা যায় না। তার মুখে আশা আয়ারের কথা শুনেছে। ভদ্রলোক নাকি মেয়েদের সাজে সেজে মঞ্চে ভরতনাট্যম পরিবেশন করতেন যাতে এই নাচ সম্পর্কে সাধারণ মানুষের ধারণা স্পষ্ট হয়। দেবদাসী নৃত্য মানেই একধরনের পতিতাদের দ্বারা মনোরঞ্জনের নাচ নয়, তাই প্রমাণ করতে উঠে পড়ে লেগে গেলেন ভদ্রলোক। ভরতনাট্যমকে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করার জন্যে মানুষটি নিজেকে উৎসর্গ করেছিলেন। পাত্রপক্ষ কাকাকে জানিয়েছেন, পুত্রবধূ করতে তারা সম্মত কিন্তু পাত্রীকে ওই নাচ বাদ দিতে হবে।

আর এই শর্ত আরও খেপিয়ে তুলল আশাকে। এরা ভাবে কী! কে বলেছে সময় পাল্টে গেছে? কৃষ্ণ আয়ারজীকে তখন যে বিরোধিতার সামনে দাঁড়াতে হয়েছিল তার নিদর্শন তো আজকেও। লন্ডনের মিস টেনান্ট যদি এগিয়ে এসে জনমত তৈরি করতে সাহায্য না করতেন এবং উনিশশো সাতাশ সালে মাদ্রাজে সর্বভারতীয় কংগ্রেস সম্মেলনে সমাজ সংস্কারকদের সামনে সঙ্গীত সম্মেলনের ব্যবস্থা যদি আয়ার না করতেন তাহলে কী হত কে জানে। উনিশশো বত্রিশ সালের ডিসেম্বর মাদ্রাজের মুখ্যমন্ত্রীর সম্মানে একজন দেবদাসীর দ্বারা ভরতনাট্যমের ব্যবস্থা হল। খবরের কাগজে এই নিয়ে প্রচুর বিতর্ক হয়। এর এক বছর আগে আয়ার সাহেব কল্যাণী কন্যাদের দিয়ে প্রথম মঞ্চে নাচিয়েছিলেন। এক বছর বাদে তার পুনরাবৃত্তি করেন। এবং সেই থেকে সমস্ত বিরোধিতাকে নস্যাৎ করে ভরতনাট্যম তার স্বমহিমায় প্রতিষ্ঠিত হল। তাতা এসব কথা তাকে বলেছিলেন। কিন্তু জীবনে এর বিপরীত ছবি দেখতে পাচ্ছে সে।
 
আশা স্পষ্ট জানিয়ে দিল সে কিছুতেই নাচ ছাড়বে না। বস্তুত মায়ের কাজ শেষ হয়ে যাওয়ার পর সে নিয়মিত অনুশীলন করে যাচ্ছিল। বিরোধ যখন তুঙ্গে তখন কাকা এলেন তার ঘরে। আশা তখন অনুশীলন করছে। দরজায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে শেষ পর্যন্ত চলে গেলেন তিনি। ওই প্রথম তাঁর মনে হল কোনো আত্মমগ্ন মানুষকে বিরক্ত করা ঠিক নয়। কিন্তু সেদিন তিনি নৃত্যরত আশার মধ্যে কী দেখেছিলেন তিনিই জানেন, কারণ বাড়ির সবাইকে উদ্বিগ্ন রেখে কাকা ফিরে এসেছিলেন পরের দিন। এসে জানিয়েছিলেন বিবাহ বাতিল করে দিয়ে এসেছেন তিনি। পাত্রপক্ষকে কী কারণ দেখিয়েছিলেন তা কোনোদিন জানা হয়নি আশার।

পাণ্ডানুল্লুরে ফিরে যাওয়ার দিন ঠিক করতে করতে বেশ সময় চলে গিয়েছিলেন। কাকা যখন তাকে নিয়ে পাণ্ডানুল্লুরে পৌঁছালেন তখন আশা জানত না তার জন্যে কী অপেক্ষা করছে। সেই ভোরেই সমস্ত গ্রাম যেন প্রাণহীন। রাস্তায় লোক নেই। ঘরদোর বন্ধ। এমন কী মাঠে গরুগুলোও ডাকছে না। তার বাড়ির সামনে পৌঁছাতে হল না। দূর থেকেই ওরা দেখতে পেল সমস্ত গ্রামের মানুষ বাড়ির সামনে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রয়েছে। কাকা দাঁড়িয়ে পড়লেন সহসা, আর বুঝতে একটুও অসুবিধে হল না আশার। সে ছুটে গেল মানুষের ভিড় বাঁচিয়ে দরজায়।

তাতা শুয়ে আছেন মাদুরে। তাঁর ছেলেরা কাঁদতে কাঁদতে শবযাত্রার আয়োজন করছে। মেয়েরা কাঁদছে সুর করে। নানা পিল্লাই বসে আছে তার ঠাকুর্দার মাথার পাশে। তার চোখ বন্ধ। দরজায় দাঁড়িয়ে সেই মুখের দিকে তাকিয়ে অবশ হয়ে গেল আশা। পৃথিবীর সব কিছু বিস্মরিত হয়ে শুধু মনের পর্দা জুড়ে ওই মুখ। সে তার মায়ের মৃতদেহ দ্যাখেনি। বস্তুত পিতার মৃত্যুর সময় তার বোধ পরিস্ফুট হয়নি। এখন তাতার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে তার মনে হল প্রকৃত সন্ন্যাসীর অভিব্যক্তি এই রকম হওয়া উচিত। কোথাও কোনো সঙ্কোচন নেই। একটি মাসলও নড়ছে না। জীবনের সমস্ত আসক্তি ত্যাগ করে নিজেকে সবকিছুর উর্ধ্বে তুলে নেওয়ার সক্ষমতা এখন তাতার মুখে। কোনো সুখ অথবা দুঃখ হাজার চেষ্টা করলেও তাকে স্পর্শ করতে পারবে না।

মাঝে মাঝে শহরেও অদ্ভুত কাণ্ড ঘটে। জ্যোৎস্নার রাত্রে একজোড়া সাদা লক্ষ্মীপ্যাঁচা উড়ে আসে কোনো গোপন আস্তানা থেকে। এসে বসে ব্যালকনির রেলিঙে। বসে থাকে চুপচাপ। ওরা সম্ভবত এখন আশাকে ভয় পায় না। এই এখনই ওরা এল। দুটো পাখি যাদের দেখতে কখনই তার খারাপ লাগে না। সাদা রঙের আভিজাত্য এবং সারল্য সমস্ত খুঁত ঢেকে দিতে পারে। আশা নড়ে বসলেন। এখনও তাতার সেই মুখ সামনে। সারা জীবন ধরে চেষ্টা করে গেছেন নাচের বিশেষ মুহূর্তে ওই অভিব্যক্তি ফুটিয়ে তুলতে। কিন্তু না তার নাকে স্পন্দন শূন্য হয়েছে, না গালের কাঁপুনি। কীভাবে মুখের সমস্ত বোধ অসাড় করে আর একটি অর্থ ফুটিয়ে তোলা যায় তা তিনি আজও বুঝে উঠতে পারলেন না।

তাতার মৃত্যু তার জেদ আরও বাড়িয়ে দিয়েছিল। পর পর দুজন গুরুর কাছে শিক্ষা নিলেন তিনি। এবং তারপর মাদ্রাজের মিউজিয়াম থিয়েটারে তাঁর প্রথম নৃত্যপ্রদর্শনীর আয়োজন হল। আর সেই সূত্রেই তীর্থনারায়ণের সঙ্গে তার আলাপ। মাদ্রাজে তীর্থের নাচের স্কুল ছিল। এক কালে সে তাতার কাছে কিছুদিন নাচ শিখেছিল। আশার কথা কানে এসেছিল। সে এগিয়ে এসে প্রস্তাব দিয়েছিল একক নৃত্যের অনুষ্ঠান করার জন্যে। প্রতিটি শিক্ষার শেষে একটা সময় আসে, যখন শিক্ষার্থী নিজেকে প্রকাশ করতে চায়, তীর্থের প্রস্তাব এল আশার সেই সময়ে। অন্তত দশ বছরের বড় ছিল তীর্থ। কিন্তু মেদহীন শরীরে একটা তকতকে ভাব থাকত সব সময়। কাকার আশীর্বাদ নিয়ে সম্মতি জানাল সে। জীবনে প্রথমবার দর্শকের সামনে নিজের নাচ দেখাতে যাওয়ার আগে খুব নার্ভাস হয়ে গিয়েছিল আশা। তীর্থ তাকে সান্ত্বনা দিত। মাত্র মাসখানেকের আলাপেই তীর্থ তার সঙ্গে এমন ব্যবহার করতে আরম্ভ করল যেন সে অনেক দিনের চেনা। উৎসাহ দেখাবার উৎসাহে সে আশাকে অনেক কথা বলত। সমবয়স্ক মানুষের সান্নিধ্যে এত পুলকিত সে কখনও হয়নি। এবং এই প্রথম মনে হয়েছিল পৃথিবীতে তার নিকট কোনো আত্মীয় নেই। বয়সের কারণে কাকাকে সব জায়গায় সে পায় না। তাছাড়া যেসব জায়গায় প্রিয়স্মৃতি জড়ানো সেখানে প্রিয়মানুষটির মৃত্যুর পরে ফিরে যাওয়ার কথা চিন্তা করত না সে। ফলে তীর্থের ওপর তার নির্ভরতা বাড়ল। তীর্থ যখন বলল, তোমার মতো মেয়ের সন্ধানে ছিলাম আমি যে ভরতনাট্যমকে ভারতবর্ষের সব প্রান্তে ছড়িয়ে দেবে। তখন কী ভালই না লেগেছিল।
 

Users who are viewing this thread

Back
Top