What's new
Nirjonmela Desi Forum

Talk about the things that matter to you! Wanting to join the rest of our members? Feel free to sign up today and gain full access!

Collected বাসভূমি -সমরেশ মজুমদার 🌎 (1 Viewer)

Kaptan Jacksparoow

Community Team
Elite Leader
Joined
Apr 6, 2019
Threads
325
Messages
5,984
Credits
44,713
T-Shirt
Profile Music
Recipe sushi
Rocket
Euro Banknote
Butterfly
images.jpeg
 
চোখ খুললেই যেন নিজের বুকটাকে দেখতে পায় শুকরা। একচিলতে মাঠ পেরিয়েই চায়ের গাছগুলো ঠাসাঠাসি দাঁড়িয়ে। যেন আকাশ ছুঁয়েছে দিগন্তে গিয়ে সবুজ জমাট ঢেউটা। আরো দূরে মাথাপোঁছা জঙ্গলে হাতছানি। দেখলেই বুক জুড়িয়ে যায়। চায়ের বাগান না বুকের কলিজা।

কিন্তু আজকাল বেশিক্ষণ চোখ চাইতে কষ্ট হয় শুকরার। যত দিন যাচ্ছে তত শরীরটা একটু একটু করে আর নিজের বশে থাকছে না। এই যে হাতের চামড়া ঢলঢলে, পা দুটো কাঠির মত সরু–এগুলো কি নিজের? মাঝে মাঝে বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলে চোখের সামনে ঝাপসা পর্দা ভাসে, কিছুতেই কাটতে চায় না। তখন, গাছ মাটি আকাশ সব একাকার। চোখ যখন বন্ধ হয় তখন মন কাজ করে যায়। মন দিয়ে দেখা শুরু হয়। সারাজীবন ধরে এই চোখদুটো যা দেখেছে তা বুকের মধ্যে সাজানো আছে। দৃষ্টি অচল হলেই সেগুলো মনের সামনে চলে আসে। নেড়ে চেড়ে দেখতে থাকে সে।

কুলি লাইনের সামনে এই জায়গাটা বেশ উঁচু। মোটকা একটা কাঁঠাল গাছের তলায় বাঁশ কেটে মাচা বেঁধে ছিল লাইনের লোক আড্ডা মারার জন্যে। সন্ধে হলেই আধবুড়োগুলো এখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে গপ্পো করে আর হাঁড়িয়া খায়। এখনও নীচে তাকালে শালপাতা ছড়ানো, ছিটানো চোখে পড়বে। কিন্তু দিনের বেলায় কেউ নেই এখানে একমাত্র শুকনো বুড়ো ছাড়া। সাতসকালে কাজে যাবার সময় ওকে বসিয়ে যাওয়া হয় এখানে। ওই চা বাগানের ঢেউ-এর দিকে মুখ করে বসিয়ে দিলে আর কিছু চায় না শুকরা। অবশ্য সঙ্গে একটা কঞ্চিও আছে। এমনি এমনি বসে থাকলে চলবে না। মাঝে মাঝে শাসন করতে হবে ওই কুচোগুলোকে। হাড়ে হাড়ে বজ্জাত সব। কালো সাপের মতো ছটফটে। লাইনের তাবৎ পরিবার বাচ্চাগুলোকে এখানে ছেড়ে দিয়ে যায় শুকরা বুড়োর জিম্মায়। কিন্তু ওরা বুঝে গেছে যে তার কিছু করার ক্ষমতা নেই। ঝিমুনি কাটিয়ে মাঝে মাঝে হেই বলে চিৎকার করে কঞ্চিটা মাচায় আছাড় মারা ছাড়া অন্য কোনো শাস্তি বুড়ো ওদের দিতে পারবে না। কুঁজো হয়ে আসা শরীরটা নিয়ে কোনোরকমে যে হেঁটে আসে, সে কী করে পাল্লা দেবে ওদের সঙ্গে। কিন্তু জিভ আছে বুড়োর। বিকেলে বাপ মা ফিরলে ক্যাটস ক্যাটস করে সব কিছু লাগিয়ে দিলে আর দেখতে হবে না। তাই বাচ্চাগুলো কঞ্চির আওয়াজ শুনলেই চুপ করে যায় কিছুক্ষণের জন্যে। পিট পিট করে বুড়োকে লক্ষ্য করে। তারপর কেউ একজন কাছে ঘেঁষে বলে, একটা গল্প বলো আমাদের।

সকালে এখানে এসে ইস্তক মনে মনে হাঁ করে বসে থাকে শুকরা বুড়ো এই অনুরোধটার জন্যে। কথা বলার মানুষ পাওয়া যায় না আজকাল। যে যার কাজে ব্যস্ত। এত কাজ যে কি আছে ছাই মাথায় ঢোকে না ওর। এমন কি ওর বুড়ো ছেলেটা যার বয়স পর্যন্ত সে কাছে আসে না। সূর্য উঠলেই দেখা মেলে না। নাতিটা মাঝে মাঝে এসে দাঁড়ায় কিন্তু শালাকে দেখলেই গা জ্বলে যায় শুকরার। কালো প্যান্ট লাল গেঞ্জি চওড়া বেল্ট আবার মেয়েদের মুখ আঁকা গেঞ্জির পিঠসাহেব হয়ে গেছেন তিনি। অবশ্য দু-তিনটে বিড়ি বা সিগ্রেট কখনো সখনো তার সামনে ফেলে দিয়ে যায়। হ্যা হ্যা করে হাসে আর খারাপ খারাপ হিন্দি গান গায় পাছা নাচিয়ে। যখন বাড়িতে থাকে তখন এক মিনিট কান পাতা যায় না হাতে ঝোলানো রেডিওর জ্বালায়। কেমন সব গোলমাল হয়ে যাচ্ছে আজকাল। অনেকদিন আগে যখন বড় সাহেবের কুঠিতে প্রথম রেডিও এল তখন চা-বাগানের মানুষরা তাজ্জব হয়ে গিয়েছিল। লম্বা তারের মধ্যে দিয়ে গান বাজিয়েছিল সাহেব গাছের মাথায় চোঙ বেঁধে। কুলি-কামিন বাবুরা কুঠির সামনে দাঁড়িয়ে হাঁ করে শুনেছিল সেই গান। শুকরা শুনেছিল গাড়ির ব্যাটারি দিয়ে নাকি সেই রেডিও চলে। আর এখন কুলি লাইনের ঘরে ঘরে হাতে হাতে ঘুরছে। ব্যাটারিটা নাকি ওর মধ্যেই ঢোকানো। যে সারাক্ষণ বাজনা বাজাবে সে আর কথা বলবে কেন শুকরা বুড়োর সঙ্গে।
 
ছেলেমেয়েগুলো এখন ভিড় করে দাঁড়িয়ে আছে তাকে ঘিরে। ওদের মধ্যে সবচেয়ে যে বড় তার পরনে একটা ইজের আর ময়লা ফ্রক। এটি তার নাতনি। বছর সাতেক বয়স। শুকরা মুখখানাকে খানিকক্ষণ খুঁটিয়ে দেখল। অনেকটা আদল আসে তার সঙ্গে। ওই চিবুকের কাছটায় আর চোখের চাহনিতে। মেয়েটাকে দেখলেই বুকের মধ্যে তির করে উঠতে থাকে। হিসেব নেই কবে চলে গেছে সে। সময় মনে করতে পারে না কিন্তু চোখ বুজলেই তাকে দেখতে পায় শুকরা। ত্রাইস পেরিয়ে ঢালু জমিটার পাশে ওদের কবরখানার একদম দক্ষিণ কোণটায় শুয়ে আছে সে তিনহাত মাটির তলায়। মেয়েছেলেটা মার খেয়েও কোনোদিন একটা কথা বলেনি। বেঁচে থাকতে যে চুপচাপ ছিল মরে গিয়ে বুক থেকে জল তুলে দুচোখে ছুঁড়ে মারছে।

সেই গল্পটা বলো।

নাতনির মুখের ওপর থেকে চোখ সরিয়ে নিল শুকরা। দুটো পাতা কিছুক্ষণ বন্ধ রেখে দৃষ্টি সইয়ে নিল। এখন সকালের শেষ। রোদের তেজ নেই। হিম বাতাস আসছে ভুটানের পাহাড় থেকে। শীত আসছে শীগগির। এই শীতটা বোধহয় আর কাটবে না। প্রতিবছর যেন হাওয়ার দাঁত আরো ধারালো হচ্ছে। এবার আর সহ্য হবে না। বাচ্চাগুলো ওকে চুপচাপ দেখে উশখুশ করছে। শুকরা ফোকলা মুখে হাসল এবার। তারপর সামান্য নড়েচড়ে দেখে কানের পেছনে খুঁজে রাখা বিড়িটাকে বের করে ঘুরিয়ে মচমচে করে নিল। বাঁ হাতে কোমরটাকে বৃথা হাতড়াল সে। এটা গল্প বলার একটা ভূমিকা তা বাচ্চারা জেনে গেছে। এরই ফাঁকে তার হাত থেকে বিড়িটা নিয়ে মেয়েটা ছুটে গেছে পেছনের লাইনের দিকে। মিনিট খানেকও লাগল না, জ্বলন্ত বিড়িটা ফিরে এল শুকরার হাতে। আগুনটা বাঁচাতে দুতিনবার টান দিয়েছে মেয়েটা কিন্তু বেশি যাতে না পোড়ে সেদিকে খেয়াল ছিল। এখনও তার হাঁ করা মুখে আবছা ধোঁয়া–সেদিকে জ্বলজ্বলে চোখে চেয়ে আছে বাচ্ছাগুলো। মেয়েটা জানে ওরা ওকে এখন হিংসে করছে। ওদের চেয়ে যে সে বড় এটা দেখাবার সুযোগ ছাড়তে চাইলে না।

চোখ বন্ধ করে তিনবার ধোঁয়া টানতেই গলা ঘড় ঘড় করে উঠল। আর তারপরেই কাশির দমকে বুক চুরমার। বাচ্চাগুলো শুকরাকে চুপচাপ দুমড়ে মুচড়ে কাশতে দেখল বেশ কিছুক্ষণ। শেষে হাঁ হাঁ করে বুকের হাপরটা থামতেই জ্বলন্ত বিড়িটা নিভিয়ে আবার কানে খুঁজে রাখল সে। এই বিড়ি খাওয়া, কাশি, নিঃশ্বাসের কষ্ট, বিড়ি নিভিয়ে রাখা একটা রুটিনের মত হয়ে গেছে। এইবার বুড়ো একটু কেশে গলা পরিষ্কার করে নেবে তারপর বলবে, সেই কথাটাকে ভাল লাগে। তাদের বাপ বলে ব্যাপারটা নাকি একটু একটু সত্যি।

এই জায়গাটা, এই চা বাগান, জঙ্গল আর এই মাটি–এটা আমাদের দেশ নয়। আমাদের দেশটা একদম অন্যরকম। এই দ্যাখ না, আমরা মদেশিয়া, ওঁরাও, মুন্ডা, আমাদের গায়ের রঙ কালো পাথরের মত আর ওই নেপালি ভুটিয়া লেপচা ওদের গায়ের রঙ হলদে সাদা সাদা। আমরা এই বাঙালিবাবুরা কেউ ফর্সা কেউ শ্যামলা কেউ আবার অন্যরকম। এটা নাকি দেশটার মানুষ হই তাহলে এক এক রকম হবে কেন? আবার দেখ, ওই নাকি ওদের দেশ। তাই কখনও হয়! এক মায়ের তিনছেলের মধ্যে এক রক্ত বইবে না?

ঠিক এই সময় যে প্রশ্নটা অবধারিত উঠবে সেটা হল, এটা আমাদের দেশ না? আমরা তো এখানেই থাকি?

ধাইবুড়ি কি করে? অ্যাঁ? মায়ের পেট থেকে পড়লি আর সে বুড়ি তোকে কোলে তুলে নিলে, মুখে জল দেওয়ালো, ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে টা টা করালো তাই বলে কি সে তোর মা হয়ে গেল? এই রকম। এ জায়গাটা আমাদের দেশ নয়। আমাদের দেশ অনেক দুরে। যেতে যেতে দিন যায় রাত যায় দিন আসে রাত আসে। গেল বছর একটা লোক এসেছিল, সে বলেছিল, চল্লিশ টাকা ভাড়া রেলের গাড়িতে। এ বছর নাকি আবার ভাড়া বাড়বে। আমার কাছে তো আর চল্লিশ টাকা নেই। কথাটা বলতে বুড়ো অন্যমনস্ক হয়ে যাচ্ছিল।

সেটা টের পেয়ে নাতনি ওর হাঁটুতে হাত রাখল, তারপর? গল্পটা বলো না?

উত্তরের বাতাসে বুড়োর ঘিয়েসাদা চুল উড়ছিল। প্রকৃতির সুন্দর সুন্দর সৃষ্টিগুলোকে এখন মাঝে মাঝে শত্রু বলে মনে হয়, যেমন এই হাওয়াটা। এককালে এরকম কেন প্রচন্ড ঝড়ো বাতাসে শরীর ভাসিয়ে ছুটতে কি আরাম হত। আর এখন এই সামান্য ঝাপটা অসহ্য লাগে। বুড়ো আবার কাশল, এই দেশটা আমাদের দেশ নয়। লোকে যেমন কোথাও বেড়াতে যায় দুদিন থাকে, আমরাও তেমনি এখানে আছি। বলতে পারিস একটু বেশি দিন আছি। আমি আছি চারকুড়ির ওপর, তখন এখানে বাঘ হাঁটত দিন দুপুরে। মাত্তর তিরিশজন কুলি ছিলাম এই বাগানে আর ছিল একজন বাঙালি বাবু। কিন্তু আর থাকব না আমি, এবার আমি যাব। বিনাগুড়িতে গিয়ে রেলগাড়িতে চড়ব আর ঝিক ঝিক করে চলে যাব আমার দেশে।

সে দেশটা কোথায়?

নাতনির প্রশ্নটা শুনে মেয়েটাকে আর একবার দেখল বুড়ো। ঠিক ঠাকুমার মুখ পেয়েছে মালা। নামটা দিয়েছে ওর দাদা। যে ছিল এতোয়ারি সে এখন মালা। বাঙালি নাম। অনেক আপত্তি করেছিল বুড়ো কেউ শুনল না। মদেসিয়া মেয়ের নাম বাঙালি হল।
 
নাতি খিঁচিয়ে উঠেছিল, আরে এই নাম বাঙালির বাপকা সম্পত্তি হ্যায়? ইয়ে নাম বোম্বাইকা ফিলিম স্টারসে লিয়া হামনে। এখন ওদের দুঘরের কোয়ার্টার ছবিতে ছবিতে ছয়লাপ। সব শালা বড় বড় মেয়েছেলের ছবি। সিনেমার। নাতিটা ওগুলো এখানে ওখানে থেকে আনে আর ঘরে দেওয়ালে সাঁটে। তবে এই মেয়েটা ভাল, বড় বাধ্য বুড়োর। মাথা নেড়ে বুড়ো শুরু করল, অনেক দূর সে দেশ। আগে তিনদিন লাগত রেলগাড়িতে এখন কম লাগে বোধহয়। অনেক ভাড়া হয়ে গেছে। সেই যে গেলবার তোর বাপের শালার শ্বশুর এসেছিল, সে বলে গেল কমসে কম পঞ্চাশ টাকা হয়ে যাবে। আমাকে কে দেবে অত টাকা! তোর বাপ দেয় না, মা দেয় না, ভাই দেয় না। দুবেলা খেতে দেয় বাপ বলে। এমন কি হঠাৎ খেয়াল হলে তবে হাঁড়িয়া দেয়। আমার কাছে যে টাকা আছে তাতে যে হবে না নইলে চলেই যেতাম।

মালা বলল, তোমার টাকা আছে?

সঙ্গে সঙ্গে বুড়ো সচকিত হল।

বেফাঁস হয়ে গেল। আজকাল জিভের ওপর নিজের ক্ষমতা কমে গেছে। বলে ফেলার পর বুঝতে পারে কী বলেছে। সজোরে ঘাড় নাড়তে লাগল সে, দূর দূর আমি টাকা পাব কোথায়? এই দ্যাখ লেংটি পরে আছি। তোর বাপের মত হাফ প্যান্ট পরি যে দুটো পকেটে টাকা রাখব? কুড়ি সাল আগে কাজ ছেড়েছি এখন আমাকে টাকা দেবে কে বল? নাতনিকে বিশ্বাস করাবার জন্যে গায়ে হাত বুলিয়ে দিল বুড়ো।

হ্যাঁ যে কথা বলছিলাম, চক্রধরপুর আর রাঁচি তার মাঝখানে একটা গ্রাম যার নাম টেবুয়া, সেইখানে আমি জন্মেছিলাম। আমার বাপ জন্মেছিল, তার বাপও! ওই মাটি আমার মাটি! আমাদের শরীরের যে রঙ সেটা ওই মাটির রঙ। অনেক অনেকদিন আগে একটা দেবতা আর একজন দেবীর সঙ্গে আকাশে উড়ে যাচ্ছিলেন। দেবীর কোলে ছিল একটা ফুটফুটে বাচ্চা। হঠাৎ হাত ফসকে সেই বাচ্চাটা পড়ে গেল পৃথিবীতে। দেবী কান্নাকাটি করে মাটিতে নেমে ছেলেকে কিন্তু চিনতে পারল না। মাটিতে নেমে বাচ্চাটা জীবনে প্রথম মাটির গন্ধ পেয়েছিল। এর আগে তো ওরা শুধু আকশেই উড়ত, মাটি কি জানবে কী করে। তাই আনন্দে ওই মিষ্টি মাটিতে গড়াগড়ি দিতেই মাটি তাকে আপন করে নিল। সে তার নিজের রঙ বাচ্চাটার শরীরে মাখিয়ে দিল। দেবী নিজের ছেলেকে চিনতে পারলেন না রঙ কালো হয়ে যাওয়ায়। সেই ছেলে বড় হল আর তার থেকে আমরা হলাম। বুড়ো চোখ বন্ধ করে বিড় বিড় করল।

মালা অস্থির হয়ে বলল, আ, থামলে কেন? টেবুয়া কেমন জায়গা!

আঃ সে যদি কোনোদিন দেখতিস দিদি। দেখবি দেখবি ওটাই তো তোর আসল জায়গা। গরমকালে যেমন গরম শীতকালে তেমনি ঠাণ্ডা। মাঠ আর মাঠ যেন আকাশে উঠে গেছে। পাহাড়ের রেখা দেখা যায় তবে এরকম মোটকা মোটকা পাহাড় নয়। বিকেলে গরম কমে যায় ঠাণ্ডা বাতাস বইলেই। সে কি মিষ্টি বাতাস তা কি করে বোঝাই! ছোট ছোট বন আছে সেখানে খরগোশ পাওয়া যায়, হরিণও আছে। আমাদের জমি ছিল। জলের জন্য চাষ হতো কম কিন্তু লোকে খুব খাটত। আমি মোষের পিঠে চড়ে মাঠে ঘুরতাম আর গরু চরাতাম। একটা নদী ছিল। গরমকালে সেটায় শুকনো বালি আর বর্ষার সময় কি ফোঁসফোঁসানি। যেন চোখের সামনে সেই স্বপ্নের দেশ টলছে, বুড়ো তাকে হাত বাড়িয়ে সামাল দিচ্ছে।

মালা বলল, ওখান থেকে চলে এলে কেন?

এলাম নিজের ইচ্ছায়। পেটের জন্য। জমিটা এমন কোনোরকমে খাবার জিনিস মেলে। আর গায়ে খেটে কাজ করে পয়সা পাবে তার কোনো সুযোগ নেই। সেই সময় কন্ট্রাক্টরের লোক এল। তারা লোভ দেখাল চায়ের চাষ হচ্ছে। গেলেই মুঠো মুঠো টাকা পাওয়া যাবে। যত ইচ্ছে রোজগার করো, খাও দাও, মজা মারো। যখন খুশি হুট করে সেই টাকা নিয়ে দেশে ফিরে এসো। সামান্যই পথ। ওই যে আকাশটা যেখানে শেষ হয়েছে তার একটু ওদিকে।

লোকে প্রথমে ঠিক বিশ্বাস করল না। চা গাছ আবার কী জিনিস? যদি গিয়ে আর ফিরে আসা যায়? এক টাকায় তখন একমণ চাল পাওয়া যেত। ওরা বলল তিন টাকা মাইনে দেবে। বুকের মধ্যে লোভ জন্ম নিল। ভাল খাওয়ার লোভ। মা বাপকে খাওয়ানোর লোভ।
 
এক এক করে কুড়ি পঁচিশ জন নাম লেখালাম। নাম লিখলেই একমণ চাল এমনি এমনি দিয়ে দিল। বুড়োদের চলবে না। জোয়ান মেয়ে ছেলে। আমাদের বাড়িতে জোয়ান কেউ নেই। আমার আগে তিন ভাই মরেছে ছেলেবেলায়। বাপের বেশি বয়সের ছেলে আমি। কিন্তু পনেরো বছরের ছেলেকে নেবে কেন ওরা। অবশ্য স্বাস্থ্য দেখে কুড়ি বলে মনে হয়। কি বুক কি হাত পা। আমার তখনও বিয়ে হয়নি। কিন্তু যাকে বিয়ে করব বলে মনে লেগেছে সেও যে চলে যাচ্ছে। তোদের ঠাকুমা তখন এইটুকু। কিন্তু ওর বাপ মা জোয়ান বলে নাম লিখিয়েছে আর ওরা গেলে মেয়েকে তো ফেলে যাবে না। তাই কোনোরকমে দলে ভিড়ে গেলাম। যেদিন আমরা চলে এলাম সেদিন গ্রামের লোক দল বেঁধে চারক্রোশ পথ সঙ্গে হেঁটে এল; সেদিন যদি জানতাম ওই আমাদের শেষ আসা, আর কোনদিন আমি ফিরবে পারব না!

এই অবধি বলেই বুড়ো ভেউ ভেউ করে কাঁদবে তা সবাই জানত। বাচ্চাগুলো ঠোঁট টিপে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকল বুড়োর দিকে। ওরা জানে অনেক চেষ্টা করলেও আর বুড়োর পক্ষে এখনি কথা বলা সম্ভব নয়। একটা একটা করে সরে পড়তে লাগল সামনে থেকে। শেষ পর্যন্ত গাছতলা একদম ফাঁকা হয়ে গেল। বুড়ো তখনও হাঁটুতে মুখ গুঁজে ফুঁপিয়ে চলেছে আর তার একটা হাত ধরে মালা চুপচাপ বসে আছে।

খাঁ খাঁ রোদ হঠাৎ চোখ ঝলসে দিয়েই আবার মিলিয়ে যায়। সামনের চায়ের গাছে সারাদিন রোদছায়ায় খেলা চলে। কুলি লাইনে দিনভর মুরগি আর গরুর হাঁকাহাঁকি, মাথার ওপরে গাছের ডালে ঘুঘুর গলায় দুপুরটা ধুঁকতে থাকে। এইসময় লাইনে যারা আছে তারা আশক্ত, হয় শিশু, বালক নয় বৃদ্ধ। শুকরা বুড়োর ছেলে ছেলের বউ আর নাতি এখন এই বাগানের নানান জায়গায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে কাজ করছে। জোয়ান মানুষ ঘরে বসে থাকবে এমন চলবে না। ভোরে উঠে ছেলের বউ রুটি আর গুড় রেখে গেছে তাই দুপুরে বসে নাতনির সঙ্গে খায় শুকরা বুড়ো। বিকেল নাগাদ ছুটি হলে কামিনরা আসতে শুরু করবে পিঠে খালি ঝুলি নিয়ে। পুরুষগুলো পয়সা পেলেই চলে যায় ভাটিখানায়। যাদের বয়স হয়েছে এমন মেয়েও বাদ যায়না। হপ্তার টাকা পাওয়ার দিন মাঝে মাঝে রাতে তাই খাওয়া জোটে না।

.

এখনকার ছেলেমেয়েগুলোকে দেখে খুব ভয় হয় শুকরা বুড়োর। এই তো চোখের সামনে নাতিটা আছে। সিরিল কথা বলে অর্ধেক ওদের ভাষায় অর্ধেক হিন্দিতে। ঘোরে ফেরে যেন ডোন্ট কেয়ার ভাব। হাঁড়িয়া খাক, বয়স হলে মানুষ খাবেই কিন্তু ওতে রুচি নেই ছেলের। ভুটানে নাকি ছয় সাত টাকার মদের বোতল বিক্রি হয়। তাই খেয়ে মাতাল হয় ছোকরা। নিজে কোনো দিন সে জিনিস খায়নি শুকরা বুড়ো। এখানে তাকে দেবে কে যে জিভে ঢালবে? অথচ একটা দিনও সে হাঁড়িয়া না খেয়ে থেকেছে এমন হয়নি। এই নিয়ে কি ঝগড়া হত ঘরে। হপ্তার টাকা হাতে পেলেই রামচন্দ্রের ভাটিখানায় জমা দিয়ে আসত। সারাদিন চা বাগানে খেটে ওইটুকুই যা শান্তি। ধারাটা বজায় রেখেছে ওর ছেলে মাংরা। নাতিকে না বুঝলেও শুকরা বুড়ো ছেলেকে বুঝতে পারে। ওরই মত হাবভাব তবে একটু সন্দেহ করে। সন্দেহটা সাহেববাবুদের নিয়ে। ছেলেকে ডেকে বোঝায় বুড়ো ওসব বলিস না মাংরা। ওরা হলেন দেবতা আর তার বাহন। আমাদের অন্ন দেয়।

এখান তো সাহেবরা কত ভাল হয়ে গেছে।

আগে একদম সাদা চামড়ার সাহেবে চারধার গমগম করত। কাজে গোলমাল হলেই সপাং সপাং চাবুক। কেউ মুখ ফুটে কিন্তু বলবে এমন হিম্মত ছিল?

দোকানপাট ছিল না, গাড়িঘোড়া নেই তেমন, রাস্তায় বেরুলে মানুষের মুখ দেখা যেত না। জ্বর হতো খুব, কাঁপুনি দিয়ে জ্বর আসতো। ম্যালেরিয়া। কত কুলি মরে গেছিল কিন্তু এখান থেকে পালাতে গেলে জান রেখে যেতে হতো। এখানে আসার পর ওরা দিন-রাত কাঁদত। যে টাকা দেবে বলেছিল তার সিকিটাও হাতে আসত না।
 
চা গাছ সেই প্রথম দেখল ওরা। এই চায়ের পাতা নিংড়ে শুকিয়ে পিষে চা বানানো হোত। এখন তো আট ঘণ্টা হয়ে গেলেই ছুটি। তখন সে সব বালাই ছিল না। পাতি তুলে গুদামে কাজ করে আবার সাহেবের কুঠিতে যেতে হতো ফরমাস খাটতে। একটু ডবকা বয়সের ছেলেমেয়ে হলে ওদের সাহেবের কুঠিতে যেতে হবেই এরকম নিয়ম বাঁধা ছিল। মন খারাপ লাগলেও কেউ কিছু বলতে সাহস পেত না। এখান থেকে পালাবার কথা মাঝে মাঝে শুকরা ভাবত কিন্তু এসেই যে বিয়েটা হয়ে গেল সেই মেয়ের সঙ্গে। আর তারই টানে টানে এতগুলো বছর পার হয়ে গেল। মেয়েটা ছিল খুব রোগা কিন্তু মুখটা ভারী ঢলে ঢলো। রোগা বলেই সাহেবের নজরে পড়েনি। মা মেরীর কাছে প্রার্থনা করত শুকরা, ওকে একটুও মোটা করো না–রোগা থাক, হাড়জিড়জিড়ে রোগা থাক।

মা মেরী! সেই সব সাহেবগুলো আর এখন নেই। সেই যে পাদ্রীসাহেবের দল। সাদা চোপকান পরে থাকত যারা আর মুখে মিশে থাকত হাসি। চা বাগানের বড়াসাহেবের হুকুমে ওদের এক রবিবারে যেতে হয়েছিল লাইন দিয়ে সাত মাইল দূরে গির্জায়। পাদ্রীসাহেব বলেছিলেন, ঈশ্বর তোমাদের মঙ্গল করুন। তাহার কাছে নিজেকে সমর্পণ করো, দেখিবে আর কোনো অভাব থাকিবে না।

ওদের আগে যারা এসেছিল সেই দলের একজন সর্দার, যার নাম চার্লস ওঁরাও, বলেছিল, পাদ্রীসাহেব তোদের জ্ঞানের আলো দিতে চান। এতদিন তোরা অন্ধকারে ছিলি। আজ থেকে পরমপিতার পুত্র হলি।

লাইন দিয়ে সবাই খ্রিস্টান হয়ে গিয়েছিল। প্রত্যেকের নামের আগে একটা সাহেবি নাম দিয়ে দিয়েছিল পাদ্রীসাহেব। শুকরারও একটা নামকরণ হয়েছিল বটে কিন্তু সেটা কোনোদিন ব্যবহার হয়নি। তা তখন প্রতি রবিবারে সর্চে যেতে হতো। পাদ্রী সাহেব যখন সাদা চামড়ার সাহেবদের নিয়ে চার্চের ভেতরে ভগবানের কাছে প্রার্থনা করতেন তখন ওরা বাইরের লনে হাত জোড় করে বসে থাকত। তারপর প্রার্থনা শেষ হয়ে গেলে রুটি আর গুড় আসত প্রত্যেকের জন্যে। ওইটেই ছিল সবচেয়ে আনন্দের।

সে সময় যে নতুন বড়সাহেব এল সে ছিল ভারি জবরদস্ত। একা মুখোমুখি দাঁড়িয়ে একটা বিরাট বাঘকে মেরেছিল। মেরে চামড়া ছাড়িয়ে মাংসটা খেতে দিয়েছিল কুলিদের। এখন তো সিরিলদের অনেক বাছবিচার হয়েছে, এটা খাব না সেটা খাব না করে। তখন যা পেত তাই সই। পেট ভরলেই হলো। ইঁদুর পেঁচা কিংবা সাপ চোখে পড়লেই দিনটা ভালভাবে কেটে যেত! সিরিল শুনে বলে, সব জংলিকা কারবার। তা তো বলবিই। তখন এক সের চাল কিনতে আট মাইল তো যেতে হতো আর সেটা কেনার পয়সাও থাকতো না সবসময়। তা বাঘের মাংস বিলিয়ে সেই সাহেব চলে এল সন্ধ্যাবেলায় কুলি লাইনে। সাহেবকে দেখে সবাই জড়োসড়ো। মেয়েরা ঘর থেকে বের হতেই চায় না। সাহেব বলল, মাংস পাকাও আউর শরাব পিও।

তখন তো মদ পাওয়া যেত না এ তল্লাটে। ওদের কেউ কেউ ভাত পচিয়ে হাঁড়িয়া বানাত কিন্তু সেটা হতো খুবই অল্প। কারণ ভাত পেলে তো সেটা পেট ভরাতেই লেগে যেত। সাহেব সব শুনেটুনে মাসখানেকের মধ্যে ছোটখাটো ভাটিখানা খুলিয়ে দিল বাগানের বাইরে। ব্যস, হয়ে গেল। রবিবারে পাদ্রীসাহেবের কাছে রুটিগুড় খাওয়া আর হর-সন্ধ্যায় ভাটিখানায় পড়ে থাকা নিয়ম হয়ে গেল ওদের। তখন ভাটিখানায় রোজ পয়সা দিতে হতো না। হপ্তার দিন মালিক এসে দাঁড়িয়ে থাকত। হিসেব মত পয়সা গুনে নিত। অনেকেই খালি হাতে ঘরে ফিরত তখন। শুকরা বুড়োর মনে আছে সে যখন সাহেবের কুঠিতে কাজ পেল তখন লাইনের মানুষ কি রকম হিংসে করত তাকে। দুবেলা পেট ভরে খাবার জুটত আবার তা থেকে বাঁচিয়ে বউএর জন্যে নিয়ে আসত রাত্রে। হ্যাঁ, সেটা একটা সুখের সময় গিয়েছে বটে।

.

কিন্তু সত্যি কি সবটাই সুখের ছিল! রোজ সন্ধেবেলায় মেয়েগুলোর চিৎকার শুনতে শুনতে বুকের ভেতর একটা পাথর জমে গিয়েছিল না? তখন কোনো সাহেবই মেমসাহেবদের নিয়ে আসত না চাবাগানে। তার ফলে মাঝেমাঝেই দেখা যেত কোনো কুলি মেয়ে সাদা ধবধবে বাচ্চা বিইয়েছে। সে রকম বাচ্চা হলে পাদ্রীসাহেব এসে নিয়ে যেত। অনেক সময় মায়েরা দিতে চাইত না, কান্নাকাটি করত কিন্তু শেষ পর্যন্ত রাজি হতেই হতো। তার বাপ-মাই তাকে রাজি হতে বাধ্য করত। ওরকম একটা সাদা চামড়ার মানুষকে কেউ নিজের জাতের লোক বলে কোনোদিন মানতে পারবে না এটা শেষ পর্যন্ত মায়েরা বুঝত।
 
একটা চা বাগানের রাজা ছিল তার ম্যানেজার। হাফপ্যান্ট শার্ট বুট পরা লোকটাকে দেখে তামাম বাগান কাঁপত। পাতি তুলতে গিয়ে কেউ সর্দারের চোখের আড়ালে থেকে জিরিয়ে নিচ্ছে খানিক এমন সময় ম্যানেজারের নজরে পড়ে গেল। এমন এক একজন ম্যানেজারকে দেখেছে শুকরা যে ওই অবস্থায় পিঠের চামড়া খুলে নিতে বাকি রেখেছে। আবার এই সাহেবই দরাজ হলে ভগবানকে ছাড়িয়ে যেতে পারে। সেই রাতটার কথা মনে থাকবে ওর।

কুঠিতে কাজ করছে শুকরা। কাজ মানে বাগান কোপানো, ঘর ঝাঁট দেওয়া আর ফুলদানিতে ফুল রাখা। এগুলো গুদামের ডিউটি সেরে তবেই করতে হতো। বদলে ম্যানেজারের কুঠিতে খাবার মিলত। সেদিন সন্ধে থেকেই বৃষ্টি। এই চা বাগানে ওটা শুরু হলে মনে হয় আর কখনো শেষ হবে না। মেঘ যেন মাথার ওপরে নেমে এসে চুপ করে বসে থাকে। রাত্রে খাবার না নিয়ে শুকরা যেতে পারত না। তখন বয়স ওর এককুড়ি দশ হবে। অতরাতে ঘরে ফিরতে হত চোখ বন্ধ করে। তখন রাস্তাগুলো এমন চওড়া আর পরিষ্কার হয়নি। চা বাগানের মধ্যে দিয়ে পায়ে চলার যে পথ ছিল সেটায় সন্ধের পরই জন্তু জানোয়ারের রাজত্ব হয়ে যেত। শুকরা ফিরত মশাল জ্বালিয়ে চিৎকার করতে করতে। ঘরে তখন বউ আর বাচ্চা গুটিসুটি মেরে বসে থাকত। তার গলার আওয়াজ পাওয়ার আশায়। তখন কুলি লাইনেও চিতাগুলো স্বচ্ছন্দে রাত্রে ঘুরে বেড়াত যদি কোনো গরু বাছুরকে অসতর্ক অবস্থায় পায়।

সন্ধে থেকে বৃষ্টি শুরু হলে শুকরার বুক হিম হয়ে গেল। এর আগে বিকেল থেকেই মেঘ জমলে সাহেবের কাছে গিয়ে কাকুতি-মিনতি করলে ছেড়ে দিত তাকে। বৃষ্টির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে দিনের আলো থাকতেই ছুটে যেত সে তাদের লাইনে। সে রাতে খাবার না জুটলেও প্রাণ তো বেঁচে যেত। কিন্তু আজ সাহেবের ফেরার নাম নেই অথচ জল ঝরছে বেশ এবং বাইরে ঘন অন্ধকার। কাঠের বাংলোর এক কোণে চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিল শুকরা। শালা, আজকের রাতটা এখানেই থেকে যেতে হবে মনে হচ্ছে। এই বৃষ্টিতে মশাল জ্বলবে না। জন্তুগুলোকে যদি ভয় দেখানো না যায় তো হয়ে গেল। কুঠিতে সাহেবের যে আর্দালি আছে সেই রান্না করে। তার আস্তানা এইখানেই। বয়স হয়েছে আর মদেসিয়া নয় বলে ওর সঙ্গে ঠিক পাত্তা দিয়ে কথা বলে না। বাড়ি না ফিরলে বউটা সারারাত কান্নাকাটি করবে এটা বুঝতে পেরে শুকরার অবস্থা আরো খারাপ হচ্ছিল।

এমন সময় বৃষ্টির শব্দ ছাপিয়ে গাড়ির আওয়াজ শুনতে পেল। সাহেব আসছে। বৃষ্টিতে ঝাপসা আলো ফেলে গাড়িটা নীচে এসে থামল। শুকরা এমনভাবে সরে দাঁড়াল যাতে সাহব ওকে দেখতে না পায়। এখন কী মেজাজ আছে কে জানে, শুধু দেখার অপরাধেই চাবুক খাওয়া অসম্ভব নয়। চিৎকার করে গান গাইছে সাহেব ভাষা বোঝা শুকরার পক্ষে সম্ভব নয়। সাহেব রাতে একা ফেরে না। একটা মেয়েকে জুটিয়ে আনে। সে মেয়ে কাঁদুক কিংবা হাসুক তাতে কিছু যায় আসে না। শুকরা দেখল সাহেবের জামা কাপড় আধভেজা আর চিৎকার করে যাকে নামতে বলছে। সেই মেয়েছেলেটার নামার কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। দুবার ডাকার পর সাহেবের মেজাজ বোধহয় বিগড়ে গেল। হাত বাড়িয়ে যাকে টেনে হিঁচড়ে নামাল তাকে দেখে অবাক হয়ে গেল শুকরা। মেয়েটা মোটেই কালো চামড়ার নয়। দস্তুরমতো ফর্সা এবং এরকম মেয়েকে এ তল্লাটে দেখা যায় না। মেয়েটা সমানে প্রতিবাদ করছিল। একসময় প্রায় মারামারি পর্যায়ে চলে গেল ব্যাপারটা। সাহেব বোধহয় খুব নেশা করেছিল কারণ মেয়েটা সাহেবকে মাটিতে ফেলে দিল। অতবড় শরীরটাকে কুঠির সিঁড়ির ওপর দড়াম করে পড়তে দেখে হাঁ হয়ে গিয়েছিল শুকরা। কেউ যে সাহেবের গায়ে হাত তুলতে পারে, এভাবে ফেলে দিতে পারে তা কল্পনাতেও ছিল না।

সাহেব উঠল। একবার মেয়েটাকে দেখে চিৎকার করে গালাগালি শুরু করে এক পা এক পা করে এগিয়ে এমন একটা চড় মারল যে শুকরার মনে হলো মেয়েটার মুখের হাড় বোধহয় গুঁড়িয়ে গেছে। কাটা কলাগাছের মত পড়ে গেল মেয়েটা। সাহেবের গালাগালি কিন্তু তখনো চলছিল। মেয়েটা পড়ার পর আর নড়েনি। শুকরার মনে হল মেয়েটা নির্ঘাৎ মরে গেছে। মরে না গেলে কেউ অমন করে পড়ে থাকতে পারে? সাহেবেরও বোধহয় হঠাৎ সে সন্দেহ হয়েছিল। কারণ তার মুখে আর গালাগালি শোনা যাচ্ছিল না। হাত বাড়িয়ে গাড়ি থেকে একটা বোতল বের করে ঢকঢক করে গলায় ঢালল খানিকটা। তারপর মেয়েটাকে জরিপ করতে গলায় মুখে হাত দিল। শরীর টলছে, বোতলটা নিয়ে লাথি মেরে দরজা খুলে ভেতরে চলে এল সাহেব। মেয়েটা পড়ে রইল তেমনি।
 
শুকরা তখন থরথর করে কাঁপছে। চোখের সামনে খুন হতে সে এই প্রথম দেখল। খুন অবশ্য তখন চা বাগানে আকছারই হতো। এখনকার মত থানা পুলিস ছিল না চা বাগানে। সাহেব যা বলত তাই শেষ কথা। শুকরা পায়ে পায়ে সরে আসছিল এমন সময় সাহেবের গলা পাওয়া গেল। চিৎকার করে ডাকছে, কৌন হ্যায়? কৌন হ্যায়?

শুকরা জানত আর্দালি নিশ্চয় ছুটে যাবে। কিন্তু কয়েক মুহূর্ত বাদেই সে আর্দালিকে দেখল, ইঙ্গিতে সাহেবের ঘরে যেতে বলছে শুকরাকে। হাত পা জমে গেল যেন। এখন যদি রাগের মাথায় তাকেও খুন করে ফেলে সাহেব তাহলেও কিছু বলার নেই। আবার বাঘের ডাকের মত চিৎকার ভেসে আসতেই শুকরা প্রায় দৌড়ে সাহেবের ঘরের দরজায় গিয়ে দাঁড়াল। সাহেব চিত হয়ে বিছানায় শুয়ে আছে। শুকরা কোনোরকমে বলেছিল, হজৌর। ইশারায় কাছে ডাকল সাহেব। ভয়ে প্রাণ গলার কাছে এসে ঠেকেছে! শুকরা মাথার নিচু করে কাছাকাছি হলে সাহেব জিভে একটা শব্দ করল। শব্দটার মানে কি তা আজও বুঝতে পারে না সে। তারপর বোতলটা বাড়িয়ে দিল তার দিকে, ড্রিঙ্ক ড্রিঙ্ক এনজয় ইট। এমন হতভম্ব হয়ে গিয়েছিল শুকরা যে আর একটু হলেই অজ্ঞান হয়ে যেত। সাহেব তাকে মদের বোতল দিচ্ছে। নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিল না সে। এই বোতলগুলোকে আলমারিতে দেখেছে, থরে থরে সাজানো। আর্দালি বলেছে ওসব নাকি সাহেবের দেশ থেকে আনানো। তার এক ফোঁটা জিভে পড়লে নাকি জীবন সার্থক হয়ে যায়। ভয়ে শ্রদ্ধায় জুলজুল করে এতদিন বোতলগুলোকে দেখে এসেছে। এখন সাহেব সেই বোতলের ভাগ নিতে বলছে ওকে। একি সম্ভব?

পাথরের মত দাঁড়িয়েছিল শুকরা। সাহেবের ধৈর্যচ্যুতি হল। এমন একটা চিৎকার গলা থেকে বের হলে যে শুকরা প্রায় দৌড়ে গিয়ে বোতলটা ধরল। বোতল দিয়ে দেবার পরও সাহেবের গালাগাল কমল না। শেষে একটু থিতিয়ে এলে আসল কথাটা বলল। বাইরে যে মেয়েটা পড়ে আছে তাকে চা বাগানের ওপাশে গাড়ির রাস্তায় ফেলে দিয়ে আসতে হবে। এখুনি এই রাত্তিরেই। আর এই খবরটা যেন কেউ জানতে না পারে। এর জন্যে সামনের মাস থেকে এক টাকা মাইনে বাড়বে শুকরার। কথাটা শেষ করে সাহেব বালিশ জড়িয়ে কাত হয়ে শুয়ে পড়ল। হুকুম শোনার পর নিজের বুদ্ধি প্রয়োগ করা তখন অসম্ভব ব্যাপার ছিল। এখন নাতি তো বটেই মাঝে মাঝে ছেলেকেও গাঁইগুঁই করতে শোনে। কিন্তু তখন সাহেব যদি বলে জান দাও তো জান দিয়ে দিতে হত। চোখের আড়ালে এসে চৈতন্য হল শুকরার। বৃষ্টিটা কমেছে। দূরে শেয়াল ডাকছে। আর্দালিটার দেখা নেই আশেপাশে। এই জলে মশাল কিছুতেই জ্বলবে না। বাইরে বেরুনো মানে প্রাণটা দিয়ে দেওয়া। তার ওপর এই মেয়েমানুষটা কাঁধে থাকবে। নিশ্চয়ই টেনে হিঁচড়ে আধমাইল নিয়ে যাওয়া যাবে না। কাঁধে নিয়ে হাঁটা এমন কিছু শক্ত ব্যাপার নয়। ত্রিশ বছরের শুকরার তখন টগবগে স্বাস্থ্য। একবার মনে হল যে চুপচাপ রাতটা কাটিয়ে দিয়ে ভোর ভোর মেয়েটাকে নিয়ে বেরিয়ে যাবে। কিন্তু সাহেব যদি একবার দেখতে ঘর থেকে বের হয় তাহলে ওরও মেয়েটার অবস্থা হবে। এই মরাটার কোনো অনিশ্চয়তা নেই। বরং জঙ্গলে চা গাছের বাগানে বাঘা চিতা যদি ঝাঁপিয়ে পড়ে তাহলে বাঁচা যেতেও পারে। তারপরেই হাতের বোতলটার দিকে নজর পড়ল তার অর্ধেকটায় টলটল করছে, চেহারা দেখে চোখ জুড়িয়ে যায়। খুব লোভ হল বোতলের মুখটা খুলে একটু চেখে দ্যাখে। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে নিজেকে সংযত করল সে। এ জিনিস ওদের লাইনের কেউ দ্যাখেনি চোখে। এটাকে নিয়ে গেলে সবার কাছে ওর খাতির যে কীরকম বেড়ে যাবে তা ভাবা যায় না। তাছাড়া এই মদ সাহেবরা খেয়ে সহ্য করে। সে যদি না পারে, যদি নেশা হয়ে পড়ে যায়? বোতলটাকে নেংটির কাপড়ে ভাল করে বেঁধে বাইরে এল শুকরা।

তখন ঝিরঝিরে বৃষ্টির পড়ছে। ভিজতে হবেই। বাইরের দিকে তাকালে একটুও দৃষ্টি চলে না এমন কালো চারধার। মেয়েটা চিত হয়ে পড়ে আছে। না এ তল্লাটের মেয়ে নয়, এমন কি পোশাকও আলাদা। বেয়াদপির শাস্তি পেল বেচারা। শালা মাথা ঠাণ্ডা রাখলেই দুনিয়ার সব কিছু দেখা যায়।

এক হ্যাঁচকায় মেয়েটাকে কাঁধে তুলে নিল শুকরা। এখনও এই বয়সে সেই নরম নরম শরীরটার কথা মনে পড়ে, যৌবন ছিল বটে মেয়েছেলেটার। কিন্তু তখন সেসব হুঁশ ছিল না তার। ওই অন্ধকারে চা বাগানের মধ্যে দিয়ে অতটা পথ যেতে হবে ভাবতেই গায়ে কাঁটা দিচ্ছিল।
 
প্রায় দৌড় শুরু করল সে। টিপটিকে বৃষ্টি মাথায় লাগছে। শরীরটা অনেকখানি মেয়েটার আড়ালে। পথ জানা কিন্তু তবু হোঁচট খেতে খেতে বেঁচে গেল সে দুবার। ফ্যাক্টরির পাশ দিয়ে যেতে গিয়ে হঠাৎ হঠাৎ শেয়ালটা এমন আচমকা ডেকে উঠল যে শুকরা হোঁচট খেল। আর এবার নিজের তাল রাখতে না পেরে মেয়েটি সমেত মাটিতে লুটোতে হল। আর এক সঙ্গে দুটোর বিপরীত বিস্ময় যেন ওকে অসাড় করে দিল। মাটিতে পড়া মাত্রই মেয়েটা একটা কাতরোক্তি করে উঠল। অস্ফুট কিন্তু স্পষ্ট। তার মানে ও বেঁচে আছে। সাহেবের মারে ওর প্রাণ বের হয়নি। এতক্ষণ একটা জ্ঞানহীন শরীরকেই সে বয়ে আনছিল। কিন্তু সেদিকে নজর দেবার সময় পাচ্ছে না শুকরা। কারণ বাঁ দিকে এক জোড়া লাল চোখ স্থির হয়ে আছে। ও দুটো চোখের মালিক যদি বাঘ হয় তাহলে আর কিছু করার নেই। এখন যদি দৌড়াবার চেষ্টা করে সে তাহলে বেশিদূর যেতে হবে না। শরীর জমে যাচ্ছে তবুও চোখদুটোর কোনো নড়াচড়া নেই। হঠাৎ কি হল শুকরা এখনো ভেবে পায় না। আচম্বিতে মাটি থেকে একটা বড় পাথর তুলে নিয়ে চোখ দুটো লক্ষ্য করে ছুঁড়ে মেরেছিল সে। পলকেই লাল বল মিলিয়ে গেল অন্ধকারে। নিশ্চিন্তে নিঃশ্বাস ফেলার আগেই শুকরার শরীর হিম হয়ে গেল কান ফাটা চিৎকারে। মৃত্যুর সঙ্গে নিষ্ফল লড়াইটা থেমে যেতেই শুকরা প্রাণপণে দৌড়তে লাগল। কখন এল কীভাবে এল সে বুঝতে পারেনি। শুধু দেখেছে মেয়েটার শরীরটা শূন্যে উঠে গেল। ওরকম দৌড় সে জীবনে দৌড়ায়নি। একেবারে লাইনে পৌঁছে নিজের ঘরের দরজায় প্রাণপণে লাথি মেরে সে হাঁপাতে লাগল। বাঘের কথা বউ এবং পড়শিদের বলেছিল শুকরা কিন্তু বাঘটা আর কী করেছিল বলতে পারেনি। মেয়েছেলেটার কথা লাইনে জানাজানি হলে সাহেব চামড়া খুলে নেবে। কদিন বাদে অবশ্য চা বাগানের ভেতরে অচেনা মেয়ের জামাকাপড় পেয়েছিল কুলিরা। চেনাশোনা কেউ মরেনি বলে কেউ মাথা ঘামায়নি। কিন্তু মনে মনে শুকরা জানে ওর জীবনটা সেই মেয়েই দিয়ে গেছে। সাহেব একটা টাকা মাইনে বাড়িয়েছিল পরের মাসেই। কিন্তু প্রাণে ধরে মদের বোতলটা শেষ করতে পারেনি অনেক দিন। পড়শিরা যারা এক ঢোক খেয়েছে তারা নাকি তৃপ্তি পায়নি। ওটার চেয়ে নাকি হাঁড়িয়াতে নেশা জমে বেশি। কিন্তু শুকরার মনে হতো সেটা হিংসেতে বলত ওরা। সাহেবের ভালবাসা পায়নি বলে জ্বলত। এসব ঘটনা ঘটলেও সাহেবকে বুঝতে কোনো অসুবিধে হত না শুকরার। সাহেব আলাদা জাতের মানুষ তারা আলাদা জাতের। যে যার নিজের মত থাকলেই কোনো সমস্যা হয় না।

ছোট্ট এইটুকুন চা বাগান ছিল। প্রত্যেকের নাড়িনক্ষত্র প্রত্যেকের জানা। সেই বাগান আজ এত বড় হয়েছে যে চেনা লোকের চেয়ে অচেনার সংখ্যাই বেশি। এইখানেই প্রায় চারকুড়ি বছর পার হয়ে গেল তবু সেই গ্রামটাকেই নিজের গ্রাম বলে মনে হয়। এখানে কেউ জোর করে ধরে এনেছিল–একি কখনো নিজের হয়? চাকরি শেষ হয়ে যাওয়ার পর শুকরা ঠিক করেছিল এবারে চলে যাবেই। ছেলে তখন সর্দার হয়েছে তার যাওয়ার মন নেই। সে বলে, যাও কিন্তু ঘুরে এসো। ওখানে এখন কোনো আত্মীয়স্বজন নেই যে তোমাকে দুদিন দেখবে। কথাটা শুনে হাসবে না কাঁদবে শুকরা ভেবে পায় না। যে মাটিতে সে জন্মেছে, শৈশব কেটেছে যার মাঠে ঘাটে সেখানে গেলেই তো শান্তিতে বুক জুড়িয়ে যাবে। এই কথাটা ছেলেকে যদিও বোঝানো যায় নাতি বোঝে না। সিরিল বলে, উ শালা ভুখা আদমিকো জিলা।

মোরগটা আচমকা এমন চিৎকার করে উঠল কানের কাছে যে শুকরা ধড়মড়িয়ে উঠে বসল। এখন দুপুর না বিকেল বোঝা যাচ্ছে না। হাওয়া নেই, রোদ নেই।

মাচার ওপর সে এতক্ষণ একাই শুয়ে ছিল। নাতনিটা ধারেকাছে নেই। চোখের জোর কমে। এলেও গলা এখনো ঠিক আছে, শুকনো আধবসা হয়ে চিৎকার করল, ও মালা-মা-অ-আ। কোনো সাড়া নেই বেটির। শুকরা মাচার ওপর পা ঝুলিয়ে সামনের দিকে তাকাল। এক মাপে ছাঁটা চায়ের গাছগুলো যেন ঢেউ খেলানো মাঠের মতো চলে গেছে আকাশের দিকে। আর এখন ভূটানের পাহাড় থেকে চুপিচুপি নেমে এসেছে এক দঙ্গল কুয়াশা। ছোট ছোট বল হয়ে সেগুলো গড়িয়ে যাচ্ছে সেই মাঠের ওপর দিয়ে। এই কুয়াশা যত গড়াবে পাতার স্বাদ তত জমবে। একটু একটু করে সুগন্ধ জন্ম নেবে। হাসল শুকরা, এই যে চায়ের গাছগুলো যাদের নিয়ে এত যত্নআত্তি তাদের যা কিছু মূল্য পাতার জন্যেই। আর কোনো টান নেই গাছটার জন্যে। থাকবে কী করে? যে গাছ ফল দেয় না সে গাছের জন্য কোনো মায়া হয়? এই জায়গায় চারকুড়ি বছর থেকেও তাই একে নিজের বলে ভাবা গেল না কিছুতেই।
 
শুকরা বুড়ো ঘাড় ঘুরিয়ে দেখল আশেপাশে কেউ নেই। কোনোরকমে লাঠিটাকে জড়িয়ে ধরে নীচে নেমে দাঁড়াল সে। এখন মাথাটা কিছুতেই সোজা হয় না। পা ফেললেই থরথরিয়ে শরীর কাঁপে। কিন্তু তবু মনটা টানতে লাগল শরীরটাকে। এক পা এক পা করে সে এগোতে লাগল পেছনের কুলি লাইনের দিকে। ওই যে ঝুপরি বটগাছটার বয়স ওর চেয়েও বেশি তার তলায় যেতে হবে ওকে।

এখনও সম্ভব। শুকরা বুড়ো বলল নিজের মনে। এখনও কোনরকমে বিনাগুড়িতে গিয়ে ট্রেনে চেপে বসলেই হল। শুয়ে ঘুমিয়ে একদিন না একদিন পৌঁছে যাবেই সেখানে। রেলের বাবু যদি কিছু বলে তো কেঁদে পায়ে পড়ে বলবে আমার কাছে এই আছে বাবা, তুমি এই নিয়ে আমাকে পৌঁছে দাও। আমি তোমার ভাড়া জানি না। কেউ আমাকে পয়সা দেয়নি অথচ আমাকে যেতে হবে। যেবার ওকে নিয়ে ফিরে যাব ঠিকঠাক, সেবার এই টাকায় হয়ে যেত। কিন্তু তখনই একদিনের ব্যারামে মেয়েছেলেটা চলে গেল। যাওয়ার মনটা ভেঙে গিয়েছিল তখন। খুব ইচ্ছে ছিল যে তারও। আমরা দুজন এই পরদেশ ছেড়ে নিজের মাটিতে শেষ কটা দিন কাটাই। সে বলতো আগে আমি মরব তুই গোর দিবি ওই মাটিতে। আমি বলতাম, না আমি আগে যাব। হেরে গেলাম। সে চলে গেছে আমাকে হারিয়ে। চা বাগানের মাটিতে শুয়ে সে ছটফট করে, রাত হলেই বলে কই তুমি গেলে না। আমার ঘুম আসে না আর। তাই বলি রেলের বাবু, তুমি এই টাকাটা রাখো আর আমাকে পৌঁছে দাও। এককুড়ি বছরের ওপর আমি এই টাকাটাকে বটগাছের নীচে যত্ন করে পুঁতে রেখেছিলাম। কেউ জানতো না। মাংরা না সিরিল না। আমার কাছে যে একটা পয়সা আছে তাই কেউ জানে না। সে যখন চলে গেল তখন তার নাকের নথটাকে পুঁতেছিলাম টাকার সঙ্গে। ওর ভারি শখ ছিল গাঁয়ের মাটিতে শোবার, হল না, তাই ওর নথটাকে নিয়ে যাচ্ছি সঙ্গে। আমি যখন শোব তখন এই নথটাও শোবে আমার সঙ্গে। ও খুশি হবে খুব। রেলের বাবু, দয়া করো। এতদিন পরদেশে ছিলাম, এবার দেশে যেতে দাও।

বটগাছের বাঁ দিকের গুঁড়ির মোটা শেকড়টার পাশে বসতেই বুক জুড়িয়ে গেল। ঠিক এখানে হাত খুঁড়লেই সেই টাকা আর নথটাকে পাওয়া যাবে! আর দেরি নয় এবার যেতেই হবে। নথটা পরলে সেই রোগা মুখটাকে যে কি সুন্দর লাগত। বুকের কান্নাটা সমস্ত শরীর নিংড়ে গলায় এসে জমল। কিন্তু একটা ঘড়ঘড়ে শব্দ ছাড়া আর কিছুই হল না। আজকাল আর কান্নাতেও সুখ মেলে না।

.

টিপিস টিপিস বৃষ্টি পড়ছে! চট করে মনে হয় গায়ে লাগছে না কিন্তু একসময় পাতলা সরের মত জল জমে যায় শরীরে। তিন নম্বর ব্লকটার এ বছর প্রথম পাতি তোলা হচ্ছে। আশিজন মেয়ে পুরুষ টুকরি কাঁধে চা গাছগুলোর সামনে দাঁড়িয়ে হাত চালাচ্ছে। বেশির ভাগই মাথাই একটা করে বোরা এমন ভাবে ভাঁজ করে রেখেছে যে ঘোমটার মতো মনে হচ্ছে। বৃষ্টির ছোট্ট কণাগুলো থেকে আত্মরক্ষার সব চেয়ে সহজ উপায়। সকালের এই সময়টার বাতাসে একটা শীত শীত ভাব আছে কিন্তু এটা শীতকাল নয়। বরং সারা বছর ছড়িয়ে জমিয়ে থাকা বর্ষার এটা খুব মন্দা সময় বলা যেতে পারে। হাতে লাঠি নিয়ে মাংরা শেডট্রির নিচে দাঁড়িয়েছিল। ওর চোখ ঘুরছে এখন মানুষগুলোর হাতের দিকে। ঠিকমতন পাতি তোলা হচ্ছে কি না এইটে দেখাই ওর কাজ। নির্দিষ্ট পরিমাণের নিচে হলেই কৈফিয়ত দিতে হবে। জন্মইস্তক এই কাজ করছে সে। এখন কুলিকামিনদের হাতঘোরা দেখেই বলে দিতে পারে কে কতটা ফাঁকি দিচ্ছে। দুইকুড়ি দশ বয়স হয়ে গেল তার। চুল এর মধ্যেই সাদা। পায়ের গোছগুলো গুটিয়ে দড়ি হয়ে আসছে। কিন্তু এখনও খাটতে একটুও অনিচ্ছা নেই। দিনভর খাটা আর সন্ধেবেলায় রামচন্দ্রের ভাটিখানায় গিয়ে বুকভরা মাল খাওয়া–এই তো জীবন।

কেয়া করতিস রে? তুহার বাপকো বাগান? পাতিবাবুর চিৎকারটা কানে আসতেই ছটফটিয়ে উঠল মাংরা। যে দিক দিয়ে আওয়াজটা এল সেদিকে পা চালাল। দ্রুত যেতে চাইলেই যাওয়া যায় না। ঘন চা গাছগুলোকে অনেকদিন ইচ্ছেমতন বাড়তে দেওয়ায় এখন রাস্তা করে নিতে হয়। অন্য লোকের পক্ষে যা কষ্টকর মাংরার কাছে তা জলের মত সহজ। এই চা গাছের গন্ধ, ডালগুলোর ভঙ্গি তার মত আর কজন চেনে। বুড়োর বাপটার সঙ্গে সে তুলনা করছে না অবশ্য কারণ সে তাকে জন্ম দিয়েছে। এই বাগানের অনেক গাছের জন্মও এই বুড়োর হাতে। কিন্তু শুকরা বুড়োদের সময় এই সার দেওয়া গাছ সাজানো আর নতুন নতুন আইন কানুন তো এমন ছিল না। তার ওপর কুড়ি বছর বসে গিয়ে সব স্মৃতি এখন ঝাপসা হয়ে গেছে বাপের। দিনরাত শালা টেবুয়া টেবুয়া করবে। কবে কখন কোথায় ছিল এখনও তার টান গেল না। মাংরা বোঝে বাপ বেশি দিন নেই। মারা যাওয়ার আগেই এইসব লক্ষণ প্রকাশ পায়। কিন্তু এটা তো ঠিক, কাজ জানত লোকটা।
 

Users who are viewing this thread

Back
Top