আমি তো দিনে একবার খাই। আর এখন তো শোওয়া ছাড়া আমার কোনো কাজ নেই। এরা?
এঁর জন্যেই আপনাকে বিরক্ত করলাম। আমরা কি এখানে বসব?
হ্যাঁ। মহিলা একটি ছোট মোড়া টেনে নিয়ে নিজে বসলেন, ঘরে এবাড়ির তিনটে বাচ্চা শুয়ে আছে। এখন তো আমার বেশি ঘরের দরকার নেই। কিন্তু আমি বুঝতে পারছি না চারপাশের এত ঝরনা, নদী ছেড়ে আপনারা একটা মজা ডোবার কাছে কেন এলেন?
রঈস মানুষটি হাসলেন, ধরুন, আপনার সঙ্গে গল্প করতে।
তা ভাল। বাঙালিদের একটা খুব মজার অভ্যেস।
আপনিও তো বাঙালি হয়ে গিয়েছেন।
না না। আমি পাক্কা হিন্দুস্থানী। যা দিলাম তার থেকে বেশি নিলাম।
কী দিয়েছেন তা জানি, কী নিয়েছেন?
বিষ। মনে, শরীরে। বলেই হাসলেন, আপনি, না তুমিই বলছি, অনেক ছোট, তুমি কিছু মনে কর না। কী করো তুমি? ওঁর সঙ্গে এখানে কেন? তুমি যদি ভদ্রঘরের মেয়ে হও তাহলে বলি এখানে তোমাদের কেউ আসে না। মহিলার কথায় কোনো ঝাঁঝ নেই।
আশা প্রথম কথা বললেন, আপনাকে দেখতে।
মীনাজী সজোরে হেসে উঠলেন, ওমা! আমার মতো একটা বুড়িকে দেখার কী আছে।
আশা বললেন, ওর সঙ্গে আমার আজকেই পরিচয়। উনি হঠাৎ আপনার কথা বলতে আমরা এখানে চলে এলাম।
আমার কথা? একজন বৃদ্ধা বাঈ-এর আর কী কথা থাকতে পারে?
রঈস মানুষ এবার কথা বললেন, মীনাজী, ওঁর পরিচয় দিচ্ছি। উনি আজ কলকাতায় এসেছেন সারা বাংলা সঙ্গীত সম্মেলনে নিমন্ত্রিত হয়ে। আপনি তো জানেন আমি কোনো সম্মেলনে রস উপভোগ করতে পারি না। তাই ওঁকে নিয়ে গিয়েছিলাম আমার বাগানবাড়িতে। কোনোরকম অসম্মান করিনি তবু উনি আমাকে নাচ দেখাতে অস্বীকার করেছেন। কোনো ব্যক্তিমানুষের সামনে উনি নাচেন না! ঈশ্বরকে দর্শক হিসেবে কল্পনা করে উনি খুশি হন। তখনই আপনার প্রসঙ্গ উঠল।
তুমি নাচো? বাঃ। মীনাজী কথার মাঝখানে বাধা দিল, কোন্ নাচ?
ভরতনাট্যম। আশা নিচু গলায় জানালেন।
কার কাছে শিখেছ?
আমি শেখা শুরু করেছিলাম তাতার কাছে।
তাতা? পাণ্ডানুল্লুরের তাতা? প্রায় চিৎকার করে উঠলেন মীনাজী।
আজ্ঞে হ্যাঁ। তিনি চলে যাওয়ার পর আরও দুজনকে গুরু হিসেবে পেয়েছি।
মীনাজী উত্তেজিত ভঙ্গিতে মোড়া থেকে উঠে কাছে এলেন, তুমি তাতার কাছে শিখেছ! আহা কী ভাগ্যবতী তুমি। কী নাম তোমার?
আশা দেখলেন, তাঁর কাছে এগিয়ে আসা মানুষটির বেশ বয়স হয়েছে। মুখে অজস্র ভাঁজ। কোনোভাবেই সত্তরের নীচে নয়। তিনি নিজের নাম বললেন। তাতে বিন্দুমাত্র প্রতিক্রিয়া হল না। কারণ তখন মীনাজী যেন তাতার কথাতেই বিভোর। মীনাজী বললেন, মানুষটিকে আমি শুধু চোখে দেখেছি, তুমি কী ভাগ্যবতী। তারপরেই গুনগুনিয়ে উঠলেন একটি পদ, যা আশার খুব চেনা। নিজের অগোচরেই আশা তাতে গলা মেলালেন। খুবই নিচু গলায় একটু সুরের সেতু তৈরি হতেই মীনাজীর পায়ে তাল ফুটল। হঠাৎ থেমে গিয়ে মীনাজী বলে উঠলেন, এই মেয়ে, তোমার গল্প শুনি।
আশা হেসে উঠলেন, আমার কোনো গল্প নেই।
তুমি কি শুধু নাচ নিয়েই থাকো?
এই প্রশ্নটির উত্তর দিতে দিলেন না রঈস মানুষটি। তিনি বললেন, মীনাজী, আপনার স্মরণশক্তি বেশ দুর্বল হয়ে পড়েছে। আপনার কী মনে পড়ছে না আশার কথা? আপনিই তো একদিন বলেছিলেন ওর কথা। আপনার স্বামী–! হঠাৎ মাথা নিচু হয়ে গেল মীনাজীর। সেটা লক্ষ্য করে রঈস মানুষ বললেন, তিন বছর আগে আশাদেবী যখন এই শহরে নাচ দেখাতে এসেছিলেন তখন খবরের কাগজে ওর ছবি বেরিয়েছিল। সেটা দেখার পর আপনি ওর কথা আমাকে বলেছিলেন। আপনার কি মনে পড়ছে না?
হঠাৎ চেহারা পাল্টে গেল বৃদ্ধার। কঠোর স্বরে জিজ্ঞাসা করলেন, কেন নিয়ে এসেছেন ওকে?
রঈস মানুষটি শান্ত গলায় জবাব দিলেন, আপনার সঙ্গে ওঁর পরিচয় হওয়া দরকার।
এবার আশা প্রশ্ন না করে পারলেন না, একথা কি সত্যি, যিনি আমাকে প্রথম নাচ সম্পর্কে আগ্রহী করেছিলেন তিনি আপনার স্বামী? ওঁর কথাটা শোনার পর আমি বিশ্বাস করতে পারছি না।
মীনাজী মুখ তুললেন, কেন?
কারণ আমি খুব ছোটবেলা থেকে আমার শিক্ষককে দেখেছি। তিনি ছিলেন বাউণ্ডুলে প্রকৃতির। গ্রামের বাচ্চাদের নাচ শেখাতেন ইচ্ছেমতন। তাঁর পরিবারের কাউকেই আমি দেখিনি। গ্রামের মানুষরা তাঁকে বলত পাগলা মাস্টার। সত্যি বলতে কী তিনি সব সময় স্বাভাবিক ছিলেন না।
এঁর জন্যেই আপনাকে বিরক্ত করলাম। আমরা কি এখানে বসব?
হ্যাঁ। মহিলা একটি ছোট মোড়া টেনে নিয়ে নিজে বসলেন, ঘরে এবাড়ির তিনটে বাচ্চা শুয়ে আছে। এখন তো আমার বেশি ঘরের দরকার নেই। কিন্তু আমি বুঝতে পারছি না চারপাশের এত ঝরনা, নদী ছেড়ে আপনারা একটা মজা ডোবার কাছে কেন এলেন?
রঈস মানুষটি হাসলেন, ধরুন, আপনার সঙ্গে গল্প করতে।
তা ভাল। বাঙালিদের একটা খুব মজার অভ্যেস।
আপনিও তো বাঙালি হয়ে গিয়েছেন।
না না। আমি পাক্কা হিন্দুস্থানী। যা দিলাম তার থেকে বেশি নিলাম।
কী দিয়েছেন তা জানি, কী নিয়েছেন?
বিষ। মনে, শরীরে। বলেই হাসলেন, আপনি, না তুমিই বলছি, অনেক ছোট, তুমি কিছু মনে কর না। কী করো তুমি? ওঁর সঙ্গে এখানে কেন? তুমি যদি ভদ্রঘরের মেয়ে হও তাহলে বলি এখানে তোমাদের কেউ আসে না। মহিলার কথায় কোনো ঝাঁঝ নেই।
আশা প্রথম কথা বললেন, আপনাকে দেখতে।
মীনাজী সজোরে হেসে উঠলেন, ওমা! আমার মতো একটা বুড়িকে দেখার কী আছে।
আশা বললেন, ওর সঙ্গে আমার আজকেই পরিচয়। উনি হঠাৎ আপনার কথা বলতে আমরা এখানে চলে এলাম।
আমার কথা? একজন বৃদ্ধা বাঈ-এর আর কী কথা থাকতে পারে?
রঈস মানুষ এবার কথা বললেন, মীনাজী, ওঁর পরিচয় দিচ্ছি। উনি আজ কলকাতায় এসেছেন সারা বাংলা সঙ্গীত সম্মেলনে নিমন্ত্রিত হয়ে। আপনি তো জানেন আমি কোনো সম্মেলনে রস উপভোগ করতে পারি না। তাই ওঁকে নিয়ে গিয়েছিলাম আমার বাগানবাড়িতে। কোনোরকম অসম্মান করিনি তবু উনি আমাকে নাচ দেখাতে অস্বীকার করেছেন। কোনো ব্যক্তিমানুষের সামনে উনি নাচেন না! ঈশ্বরকে দর্শক হিসেবে কল্পনা করে উনি খুশি হন। তখনই আপনার প্রসঙ্গ উঠল।
তুমি নাচো? বাঃ। মীনাজী কথার মাঝখানে বাধা দিল, কোন্ নাচ?
ভরতনাট্যম। আশা নিচু গলায় জানালেন।
কার কাছে শিখেছ?
আমি শেখা শুরু করেছিলাম তাতার কাছে।
তাতা? পাণ্ডানুল্লুরের তাতা? প্রায় চিৎকার করে উঠলেন মীনাজী।
আজ্ঞে হ্যাঁ। তিনি চলে যাওয়ার পর আরও দুজনকে গুরু হিসেবে পেয়েছি।
মীনাজী উত্তেজিত ভঙ্গিতে মোড়া থেকে উঠে কাছে এলেন, তুমি তাতার কাছে শিখেছ! আহা কী ভাগ্যবতী তুমি। কী নাম তোমার?
আশা দেখলেন, তাঁর কাছে এগিয়ে আসা মানুষটির বেশ বয়স হয়েছে। মুখে অজস্র ভাঁজ। কোনোভাবেই সত্তরের নীচে নয়। তিনি নিজের নাম বললেন। তাতে বিন্দুমাত্র প্রতিক্রিয়া হল না। কারণ তখন মীনাজী যেন তাতার কথাতেই বিভোর। মীনাজী বললেন, মানুষটিকে আমি শুধু চোখে দেখেছি, তুমি কী ভাগ্যবতী। তারপরেই গুনগুনিয়ে উঠলেন একটি পদ, যা আশার খুব চেনা। নিজের অগোচরেই আশা তাতে গলা মেলালেন। খুবই নিচু গলায় একটু সুরের সেতু তৈরি হতেই মীনাজীর পায়ে তাল ফুটল। হঠাৎ থেমে গিয়ে মীনাজী বলে উঠলেন, এই মেয়ে, তোমার গল্প শুনি।
আশা হেসে উঠলেন, আমার কোনো গল্প নেই।
তুমি কি শুধু নাচ নিয়েই থাকো?
এই প্রশ্নটির উত্তর দিতে দিলেন না রঈস মানুষটি। তিনি বললেন, মীনাজী, আপনার স্মরণশক্তি বেশ দুর্বল হয়ে পড়েছে। আপনার কী মনে পড়ছে না আশার কথা? আপনিই তো একদিন বলেছিলেন ওর কথা। আপনার স্বামী–! হঠাৎ মাথা নিচু হয়ে গেল মীনাজীর। সেটা লক্ষ্য করে রঈস মানুষ বললেন, তিন বছর আগে আশাদেবী যখন এই শহরে নাচ দেখাতে এসেছিলেন তখন খবরের কাগজে ওর ছবি বেরিয়েছিল। সেটা দেখার পর আপনি ওর কথা আমাকে বলেছিলেন। আপনার কি মনে পড়ছে না?
হঠাৎ চেহারা পাল্টে গেল বৃদ্ধার। কঠোর স্বরে জিজ্ঞাসা করলেন, কেন নিয়ে এসেছেন ওকে?
রঈস মানুষটি শান্ত গলায় জবাব দিলেন, আপনার সঙ্গে ওঁর পরিচয় হওয়া দরকার।
এবার আশা প্রশ্ন না করে পারলেন না, একথা কি সত্যি, যিনি আমাকে প্রথম নাচ সম্পর্কে আগ্রহী করেছিলেন তিনি আপনার স্বামী? ওঁর কথাটা শোনার পর আমি বিশ্বাস করতে পারছি না।
মীনাজী মুখ তুললেন, কেন?
কারণ আমি খুব ছোটবেলা থেকে আমার শিক্ষককে দেখেছি। তিনি ছিলেন বাউণ্ডুলে প্রকৃতির। গ্রামের বাচ্চাদের নাচ শেখাতেন ইচ্ছেমতন। তাঁর পরিবারের কাউকেই আমি দেখিনি। গ্রামের মানুষরা তাঁকে বলত পাগলা মাস্টার। সত্যি বলতে কী তিনি সব সময় স্বাভাবিক ছিলেন না।