গোধূলির একটু পরেই ওরা চলে এল। গোরক্ষনাথ আকাশের দিকে মুখ তুলে বলল, আমি বলছি, আজ বৃষ্টি হবে না। কাল পূর্ণিমা বলে কথা।
নাগেশ্বর মাথা নাড়ল, ঠিক হল না। কথাটা হবে, পূর্ণিমার আগের দিন বৃষ্টি হয় না। চক্ষুলজ্জা বলে তো একটা কথা আছে।
নদীর গায়ে বাগান। বাগানের শেষে বাড়ি। সতীশ রায় বাড়ি থেকে বেরিয়ে বাগানে এসে দাঁড়ালেন। পরনে পাঞ্জাবি আর পাজামা। হাতে বার্মা চুরুট। দুই স্তাবকের দিকে তাকিয়ে ভু কোঁচকালেন, নাগেশ্বর, আজ দুপুরে কিছু খাওনি?
হাত কচলাল নাগেশ্বর, একেই বলে দিব্যদৃষ্টি। দেখলে গোরক্ষনাথ, ঠিক ধরে ফেলেছেন। ঈশ্বরের আশীর্বাদ না থাকলে এরকম হয় না।
গোরক্ষনাথ বলল, আজ ওর স্ত্রীর মঙ্গলচণ্ডীর উপোস।
তাই বলো। তাই তোমাকে রোগা দেখাচ্ছে। সতীশ রায় বললেন, তা আজ কোথায় আসন পাতবে?
গোরক্ষনাথ বলল, বলছিলাম কী, আজ বৃষ্টি হবে না। ভালো বাতাসও বইছে। নদীর ধারে টেবিল চেয়ার পেতে বসলে কেমন হয়।
একটু বাদেই চাঁদ উঠবে। আপনি তো জ্যোৎস্না খুব পছন্দ করেন। নাগেশ্বর সবিনয়ে মনে করিয়ে দিল।
করতাম। পনেরো বছর আগে। যাকগে। সতীশ রায় গলা তুলে ডাকলেন, হরিপদ, হরিপদ!
সঙ্গে সঙ্গে একজন প্রৌঢ় কাজের লোক সামনে এসে দাঁড়াল।
সতীশ রায় জিজ্ঞাসা করলেন, খোকা কোথায়?
তার ঘরে। হরিপদ জবাব দিল।
কী করছে এখন?
আজ্ঞে, লেখালেখি করছে।
লেখালেখি? কী লেখে?
তা জানি না। লেখে আর কাটে। নিজের মনেই থাকে।
হুঁ। মতির মাকে বলল কী লেখে তা জিজ্ঞাসা করতে। আর হ্যাঁ, নদীর ধারে টেবিল আর চারটে চেয়ার লাগাও। জলদি। সতীশ রায় এগিয়ে গিয়ে ডুডুয়ার পাড়ে দাঁড়ালেন। মনে হল, ওখানে বসলে জল, আকাশ এবং জলে আকাশ সবই দেখা যাবে।
গোরক্ষনাথ বলল, আজ একটা চেয়ার বেশি বললেন?
ভয় নেই। তাতে তোমাদের ভাগ কম হবে না। বলতে বলতে জলে। মাছের ঘাই-এর শব্দ শুনতে পেলেন সতীশ রায়। তার মুখে হাসি ফুটল। বললেন, দ্যাখো, কাজ হয়েছে। বলেছিলাম বছরে ছয়মাস কেউ নদীতে ছিপ বা জাল ফেলবে না। লোকে কথা শুনেছে বলেই মাছগুলো গায়ে গতরে বেড়েছে।
নাগেশ্বর বলল, কার ঘাড়ে কটা মাথা যে আপনার কথা শুনবে না।
হরিপদ টেবিল চেয়ার এনে সাজিয়ে দিল। দুটো বোতল এল। একটা দামি হুইস্কি অন্যটা অতি সাধারণ। সতীশ রায়ের জন্যে কাজুবাদাম আর ওদের জন্যে চিনে বাদাম! সতীশ রায়ের জন্যে ফোঁটানো জল আর বরফ, অন্যদের জন্যে কুয়োর জল। সতীশ রায় বসলেন সেই চেয়ারে যেখানে বসলে চাঁদের মুখ দেখতে পাবেন। অন্য দু-জন তার উলটো দিকে। হরিপদ পরিবেশন করে চলে গেল।
চীয়ার্স। সতীশ রায় গ্লাসে ঠোঁট রাখলেন।
চীয়ার্স, চীয়ার্স। দু-জন বলতেই জলে ভালো শব্দ হল। প্রথম ঢোঁক গিলে সতীশ রায় বললেন, কাতলা। দেড় কেজি ওজন। পেটে ডিম নেই।
গোরক্ষনাথ বলল, তার মানে পেট পাতলা হয়নি। আহা।
সতীশ রায় বললেন, আমার এই ডুডুয়ায় কত রকমের মাছ আছে জানো? আমি তো আট রকমের খোঁজ পেয়েছি। রুই, কাতলা, পারশে, ট্যাংরা, খলসে, পুঁটি, বান, শোল।
নাগেশ্বর মাথা নাড়ল, আর একটা মাছ নদীতে এলে ষোলকলা পূর্ণ হত।
গোরক্ষনাথ মুখ তুলল, ভেটকি?
দূর! নাগেশ্বর সতীশ রায়ের দিকে তাকাল, ইলিশ ডুডুয়ায় পেলে কী ভালো হত।