What's new
Nirjonmela Desi Forum

Talk about the things that matter to you! Wanting to join the rest of our members? Feel free to sign up today and gain full access!

Collected তনু অতনু সংবাদ (1 Viewer)

Kaptan Jacksparoow

Community Team
Elite Leader
Joined
Apr 6, 2019
Threads
329
Messages
6,255
Credits
48,358
T-Shirt
Profile Music
Recipe sushi
Rocket
Euro Banknote
Butterfly
images-21ef86b7e1609c2af.jpeg
 
Last edited:
ডুডুয়া একটি নদীর নাম। পাহাড়ি ঝরনাগুলো মিলে মিশে সমতলে পৌঁছে নদীর চেহারা নেয়, এ নদীও নিয়েছিল। নিয়ে মাইল তিরিশেক গিয়ে সব জল ঢেলেছে জলঢাকার পেটে। অতএব নদীর দৈর্ঘ্য বেশি নয়। তবে এর জল শীত গ্রীষ্মে কমে গেলেও একেবারে শুকোয় না। তখন বেশ শান্ত বালিকার মতো তিরতিরিয়ে বয়ে যায়। ওইটুকু যাওয়ার পথে তাকে একবারই মাথার ওপর। সেতুকে মেনে নিতে হয়েছে। কারণ ন্যাশনাল হাইওয়ে ওখান দিয়ে চলে গেছে আসামে। নদীর নাম বহুকাল আগে কেউ দিয়েছিল ডুডুয়া। তাই ন্যাশনাল হাইওয়ের পাশে বছর আশি আগে যে জনপদ গড়ে উঠেছিল তার নামকরণ হয়েছিল নদীর নামে, ডুডুয়া।

জনপদ, তবে সেখানকার মানুষের সংখ্যা মেরে কেটে হাজার তিনেক। একটা পোস্ট-অফিস, ব্লক অফিস, কয়েকটা মুদির দোকান, একটা প্রাইমারি স্কুল ছাড়া কয়েক বছর হল সরকারি চিকিৎসালয় তৈরি হয়েছে এখানে। একটা ভাটিখানাও গজিয়ে উঠেছে গ্রামের শেষপ্রান্তে জঙ্গলের গায়ে।

জঙ্গল কেটে বসতি। আর কে না জানে এসব সম্ভব হয়েছে একটা লোকের জন্যে। সতীশ রায়। কিন্তু ওর কথা বলতে গেলেই লোকে বলে ডুডুয়ার সতীশ রায়। এই জায়গার নাম, নদীর নাম আর মানুষটির নাম একসঙ্গে জুড়ে গেছে। ডুডুয়ার একমাত্র কাঠচেরাই-এর কারখানার মালিক সতীশ রায়ের বয়স এখন বাহান্ন। বছর পনেরো আগে ম্যালেরিয়ায় ভুগে ওঁর স্ত্রী মারা যান। তাকে জলপাইগুড়ির হাসপাতালে ভর্তি করিয়েও বাঁচাতে পারেননি তিনি। ডাক্তাররা বলেছিল, বড্ড দেরি করে নিয়ে এসেছেন। ম্যালিগন্যান্ট ম্যালেরিয়া হয়ে গেছে। একমাত্র ছেলে সত্য তখন সাত বছরের। স্ত্রীর চলে যাওয়ার আঘাত সতীশ রায় মুখ বুজে সহ্য করেছিলেন শুধু ছেলের দিকে তাকিয়ে। আত্মীয়স্বজন, স্তাবকেরা বলেছিল আবার বিয়ে করতে। অন্তত ছেলেকে মানুষ করার জন্যে আর একজন মহিলার প্রয়োজন। কানে তোলেননি সতীশ রায়। বাড়ির পুরোনো কাজের মহিলা মতির মাকে ডেকে দায়িত্ব দিয়েছিলেন সত্যর দেখাশোনা করার। কিন্তু স্ত্রীর মৃত্যুর আড়াই বছরের মধ্যে অনেক লেখালেখি, তদ্বির করে সরকারি স্বাস্থ্যকেন্দ্র খুলিয়ে ছিলেন ডুডুয়াতে। যাতে ম্যালেরিয়া হলেই ঠিকঠাক ওষুধ এলাকার মানুষ পায় সেই চেষ্টা করেছেন। নদীতে মশা জন্মায় খুব কম। মশার ডিম তো মাছেরাই খেয়ে ফেলে। সতীশ রায়ের উদ্যোগে ডুডুয়া গ্রামের কোথাও কোন ভাঙা পাত্রে, গর্তে জল জমে যাতে মশা ডিম না পাড়তে পারে তার ব্যবস্থা হয়েছে।

এই ডুডুয়া গ্রামের বেশির ভাগ মানুষ কৃষিজীবী। হাইওয়ের এপাশে গ্রাম, ওপাশে চাষের জমি। আর কিছু মানুষ কাঠের কারখানায় কাজ করে। এছাড়া পোস্ট অফিস, স্বাস্থ্যকেন্দ্র অথবা দোকানগুলোর কর্মচারীরা আছে। কিন্তু সবাই জানে, বিপদে আপদে মাথার ওপর সতীশ রায় আছেন। ডুডুয়ার সতীশ রায়কে চেনে না এমন লোক জেলার এই তল্লাটে নেই।

স্ত্রীর চলে যাওয়ার পর একটি অভ্যেসে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছেন সতীশ রায়। সন্ধের মুখে তার দুই স্তাবক চলে আসেন। সতীশেরই সমান বয়সি। একজন গোরক্ষনাথ, অন্যজন নাগেশ্বর। দুজনেই খুব শীর্ণ চেহারার, বেঁটে। কিন্তু দুজনের মুখের হাসি কখনই বন্ধ হয় না। এরা নিঃশব্দে হাসতে জানেন।
 
গোধূলির একটু পরেই ওরা চলে এল। গোরক্ষনাথ আকাশের দিকে মুখ তুলে বলল, আমি বলছি, আজ বৃষ্টি হবে না। কাল পূর্ণিমা বলে কথা।

নাগেশ্বর মাথা নাড়ল, ঠিক হল না। কথাটা হবে, পূর্ণিমার আগের দিন বৃষ্টি হয় না। চক্ষুলজ্জা বলে তো একটা কথা আছে।

নদীর গায়ে বাগান। বাগানের শেষে বাড়ি। সতীশ রায় বাড়ি থেকে বেরিয়ে বাগানে এসে দাঁড়ালেন। পরনে পাঞ্জাবি আর পাজামা। হাতে বার্মা চুরুট। দুই স্তাবকের দিকে তাকিয়ে ভু কোঁচকালেন, নাগেশ্বর, আজ দুপুরে কিছু খাওনি?

হাত কচলাল নাগেশ্বর, একেই বলে দিব্যদৃষ্টি। দেখলে গোরক্ষনাথ, ঠিক ধরে ফেলেছেন। ঈশ্বরের আশীর্বাদ না থাকলে এরকম হয় না।

গোরক্ষনাথ বলল, আজ ওর স্ত্রীর মঙ্গলচণ্ডীর উপোস।

তাই বলো। তাই তোমাকে রোগা দেখাচ্ছে। সতীশ রায় বললেন, তা আজ কোথায় আসন পাতবে?

গোরক্ষনাথ বলল, বলছিলাম কী, আজ বৃষ্টি হবে না। ভালো বাতাসও বইছে। নদীর ধারে টেবিল চেয়ার পেতে বসলে কেমন হয়।

একটু বাদেই চাঁদ উঠবে। আপনি তো জ্যোৎস্না খুব পছন্দ করেন। নাগেশ্বর সবিনয়ে মনে করিয়ে দিল।

করতাম। পনেরো বছর আগে। যাকগে। সতীশ রায় গলা তুলে ডাকলেন, হরিপদ, হরিপদ!

সঙ্গে সঙ্গে একজন প্রৌঢ় কাজের লোক সামনে এসে দাঁড়াল।

সতীশ রায় জিজ্ঞাসা করলেন, খোকা কোথায়?

তার ঘরে। হরিপদ জবাব দিল।

কী করছে এখন?

আজ্ঞে, লেখালেখি করছে।

লেখালেখি? কী লেখে?

তা জানি না। লেখে আর কাটে। নিজের মনেই থাকে।

হুঁ। মতির মাকে বলল কী লেখে তা জিজ্ঞাসা করতে। আর হ্যাঁ, নদীর ধারে টেবিল আর চারটে চেয়ার লাগাও। জলদি। সতীশ রায় এগিয়ে গিয়ে ডুডুয়ার পাড়ে দাঁড়ালেন। মনে হল, ওখানে বসলে জল, আকাশ এবং জলে আকাশ সবই দেখা যাবে।

গোরক্ষনাথ বলল, আজ একটা চেয়ার বেশি বললেন?

ভয় নেই। তাতে তোমাদের ভাগ কম হবে না। বলতে বলতে জলে। মাছের ঘাই-এর শব্দ শুনতে পেলেন সতীশ রায়। তার মুখে হাসি ফুটল। বললেন, দ্যাখো, কাজ হয়েছে। বলেছিলাম বছরে ছয়মাস কেউ নদীতে ছিপ বা জাল ফেলবে না। লোকে কথা শুনেছে বলেই মাছগুলো গায়ে গতরে বেড়েছে।

নাগেশ্বর বলল, কার ঘাড়ে কটা মাথা যে আপনার কথা শুনবে না।

হরিপদ টেবিল চেয়ার এনে সাজিয়ে দিল। দুটো বোতল এল। একটা দামি হুইস্কি অন্যটা অতি সাধারণ। সতীশ রায়ের জন্যে কাজুবাদাম আর ওদের জন্যে চিনে বাদাম! সতীশ রায়ের জন্যে ফোঁটানো জল আর বরফ, অন্যদের জন্যে কুয়োর জল। সতীশ রায় বসলেন সেই চেয়ারে যেখানে বসলে চাঁদের মুখ দেখতে পাবেন। অন্য দু-জন তার উলটো দিকে। হরিপদ পরিবেশন করে চলে গেল।

চীয়ার্স। সতীশ রায় গ্লাসে ঠোঁট রাখলেন।

চীয়ার্স, চীয়ার্স। দু-জন বলতেই জলে ভালো শব্দ হল। প্রথম ঢোঁক গিলে সতীশ রায় বললেন, কাতলা। দেড় কেজি ওজন। পেটে ডিম নেই।

গোরক্ষনাথ বলল, তার মানে পেট পাতলা হয়নি। আহা।

সতীশ রায় বললেন, আমার এই ডুডুয়ায় কত রকমের মাছ আছে জানো? আমি তো আট রকমের খোঁজ পেয়েছি। রুই, কাতলা, পারশে, ট্যাংরা, খলসে, পুঁটি, বান, শোল।

নাগেশ্বর মাথা নাড়ল, আর একটা মাছ নদীতে এলে ষোলকলা পূর্ণ হত।

গোরক্ষনাথ মুখ তুলল, ভেটকি?

দূর! নাগেশ্বর সতীশ রায়ের দিকে তাকাল, ইলিশ ডুডুয়ায় পেলে কী ভালো হত।
 
গোরক্ষনাথ হাসল। তার টাক মাথার চামড়ায় ঢেউ খেলে গেল। শুনলেন বড়বাবু? ডুডুয়াতে ইলিশ এলে ছিপে ধরবেন নাগেশ্বর। আরে ইলিশ হল সমুদ্রের মাছ। এ কথা তো বাচ্চারাও জানে। নদীতে পাওয়া যাবে কী করে?

খুব রেগে গেল নাগেশ্বর, নাঃ! সঙ্গ ত্যাগ না করলে চরিত্র নিম্নমুখী হয়। বড়বাবু স্নেহ করেন বলে না এসে পারি না। আচ্ছা, গঙ্গা, পদ্ম, রূপনারায়ণ এরা কী নদী নয়? এদের জলে কি ইলিশ পাওয়া যায় না?

সতীশ রায়ের মজা লাগছিল। বললেন, ঠিক কথা। তবে ওসব নদীতে ইলিশ ঢুকে পড়ে সমুদ্র থেকে ডিম পাড়তে। তখনই ধরা পড়ে।

সেকথাই তো বলছি। গঙ্গায় যেমন ঢোকে ডুডুয়াতেও যদি ঢুকত?

গোরক্ষনাথ বলল, ঢুকবে কী করে? ডুডুয়া গিয়ে মিশেছে জলঢাকায়। জলঢাকা পড়েছে তোৰ্যায়, তোৰ্ষা ব্ৰহ্মপুত্রে, ব্ৰহ্মপুত্ৰ সমুদ্রে। ব্রহ্মপুত্রে ইলিশ ঢোকে।

সেকথাই তো বলছি। ইলিশগুলো তো নদী বেয়ে বেয়ে এখানে চলে আসতে পারত। কি বড়বাবু, পারত না? নাগেশ্বর তাকাল।

সতীশ রায় মুখ তুললেন, সঙ্গে সঙ্গে দূরের গাছগাছালির ওপর প্রায়-গোল একটা আলোর বল লাফিয়ে উঠে বসল। মুগ্ধ হয়ে গেলেন তিনি। এখনই চরাচর জ্যোৎস্নায় ছেয়ে যাবে। চাঁদের শরীরের কলঙ্ক স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। তিনি বললেন, মন ভালো হয়ে গেল। তিনি গ্লাসে বড় চুমুক দিলেন।

আজ্ঞে, ইলিশের কথা উঠলে আমারও মন ভালো হয়ে যায়।

তাহলে তুমি পেছনে তাকিয়ো না।

পেছনে? কী আছে পেছনে? নাগেশ্বর তাকাতে গিয়েও তাকাল না।

চাঁদ উঠেছে। বিশাল চাঁদ। আহা, চক্ষু সার্থক হল।

এই কথা! চাঁদের মুখে সূর্যের আলো পড়েছে বলেই চাঁদ সুন্দর। আবার সেই চাঁদের আলো আপনার মুখে পড়ায় আমি ধন্য হয়ে গিয়েছি।

কেন? সতীশ রায় চোখ ছোট করলেন।

আপনাকে এখন পরমসুন্দর দেখাচ্ছে।

সতীশ রায় কিছু বলতে যাচ্ছিলেন কিন্তু হরিপদকে আসতে দেখে থমকে গেলেন। হরিপদ কাছে এসে নিচু গলায় বলল, তরুণ সংঘের ছেলেরা আপনার সঙ্গে দেখা করতে এসেছে। কাল আসতে বলব?

গোরক্ষনাথ বলল, হ্যাঁ হ্যাঁ তাই বলো। এখন বড়বাবুকে বিরক্ত কেন করবে?

সতীশ রায় উঠে দাঁড়ালেন, আমি যাচ্ছি।

বাগানের ভেতর দিয়ে জ্যোৎস্নায় হাঁটতে অসুবিধে হল না। গেটের ওপাশে ছেলেগুলো দাঁড়িয়ে। কুড়ি থেকে পঁচিশের মধ্যে বয়স। তরুণ সংঘ নাম দিয়ে ক্লাব করেছে। আশেপাশের গঞ্জে ফুটবল খেলে বেড়ায়। সতীশ রায় প্রেসিডেন্ট। প্রতিবছর বল কিনে দিতে হয়, খেলতে যাওয়ার সময় গাড়ি ভাড়াও তাঁকেই জোগাতে হয়। ছেলেগুলো বেকার। চাযের সময় বাপ কাকাকে সাহায্য করতে মাঠে যায় বটে, বাকি সময়টা নিষ্কর্মা হয়ে থাকে।

হ্যাঁ। বলল, কী ব্যাপার? সতীশ রায় গেটের সামনে চলে এলেন।

পরশু খেলা আছে। বানারহাটের সঙ্গে। যেতে হবে। একজন বলল।

নিশ্চয়ই যাবো। কিন্তু তোমাদের সঙ্গে আমার কিছু কথা আছে। সতীশ রায় বললেন।

ওরা নিজেদের দিকে তাকাল। একজন বলল, কেউ কি কোনও অন্যায় করেছে।

না না, এক কাজ করো। আমি কাল সকাল সাড়ে নটায় বেরুব। তোমরা ঠিক নটায় এখানে চলে আসবে। তোমাদের ক্যাপ্টেন কে?

এক এক ম্যাচে এক একজন হয়।

হুঁ, কিন্তু কাল আসার আগে একজনকে নেতা ঠিক করে আসবে। যাও।

ওরা চলে গেলে ফিরে এসে তিনি দেখলেন দু-জনেই গ্লাস ভরে নিয়েছে। তাকে বলতে হল না, ওরাই তার গ্লাস ভরে দিতেই পাশের নদীর জলে আবার ঘাই মারল মাছ।

খেলতে যাবে বুঝি? নাগেশ্বর জিজ্ঞাসা করল।

হ্যাঁ, তবে কাল ওদের আসতে বলেছি অন্য কারণে। এই ছেলেগুলোকে একটা রোজগারের মধ্যে ঢুকিয়ে দিতে চাই। সতীশ রায় বললেন।

কী রকম?

ডুডুয়ায় এখন প্রচুর মাছ। আওয়াজ তো শুনছ। তরুণ সংঘের ছেলেরা ছয় মাস ধরে এই মাছ ধরবে। ধরে হাটে গিয়ে মাছওয়ালাদের কাছে বিক্রি করবে। খরচ বাদ দিয়ে যা লাভ হবে তা নিজেরা সমান ভাগ করে নেবে। যে ছয়মাস মাছ ধরা হবে না সেই ছয়মাস ওরাই নদী পাহারা দেবে। কী? আইডিয়াটা কেমন লাগছে? সতীশ রায় জিজ্ঞাসা করলেন।

অপূর্ব। চমৎকার। অবস্থা ফিরে যাবে ওদের। গোরক্ষনাথ বলল।

একটা কথা। শুধু ছেলে কেন, মেয়েদেরও যদি জুড়ে দিতেন। নাগেশ্বর বলতে বলতে আড়চোখে গোরক্ষনাথকে দেখল।

গোরক্ষনাথ ফিক ফিক করে হাসি শুরু করেছে।
 
নাগেশ্বর হজম করল। গোরক্ষর মেয়ে নেই। সংসারে আইবুড়ো মেয়ে বসে থাকলে যে জ্বালা বাবার মনে ধরে তা ও কী করে বুঝবে।

মাস্টারনি থেকে মেছো, ভাবাটাই অন্যায়। গোরক্ষ বলল।

কার কথা বলছ? সতীশ রায় তাকালেন।

আজ্ঞে নাগেশ্বরের মেয়ে। আপনি বলে দেওয়ায় সে পাঠশালার মাস্টারের কাছে পড়ানো শিখেছে। মাস্টারের চাকরি তো এই চৈত্রেই শেষ হবে। তারপর পাঠশালার যে কী হাল হবে! গোরক্ষ হতাশ।

কেন? আমার মেয়ে কি খারাপ পড়াচ্ছে? মাস্টারকে জিজ্ঞাসা করেছি। তিনি তো একটাও কুকথা বললেন না। তবে পোস্ট-অফিসের অবস্থা খুব খারাপ। কথা ঘোরাল নাগেশ্বর।

কেন? দ্বিতীয় গ্লাস শেষ করলেন সতীশ রায়। এটাই তাঁর কোটা। কালেভদ্রে তৃতীয় গ্লাস চলতে পারে, রোজ কখনই নয়। মদ আর মস্তিষ্ক কখনই বন্ধু হতে পারে না। যতক্ষণ মদকে মস্তিষ্ক দাবিয়ে রাখতে পারে ততক্ষণ পান করাই বুদ্ধিমানের কাজ।

পোস্টমাস্টার ফ্যামিলি নিয়ে কলকাতায় গিয়েছে। ব্যাস, কর্মচারীদের পোয়াবারো। ঠিক সময়ে পোস্ট-অফিস খুলল না, খুললেও ডিউটিতে থাকছে না। নাগেশ্বর জানাল।

এই সময় হরিপদ কাছে এসে দাঁড়াল, এক ভদ্রলোক দেখা করতে চান।

কে? সতীশ রায় সোজা হয়ে বসলেন।

বললেন উনি ঘটকমশাই। হরিপদ বলল।

নাগেশ্বর হাসল, তুমি এই খবর দিতে এলে হরিপদ! বড়বাবুর যদি ইচ্ছে থাকত তাহলে কয়েক বছর আগেই বিয়ে করতে পারত। কাটিয়ে দাও।

আঃ! বড্ড বেশি কথা বলো তুমি! ধমকালেন সতীশ রায়। তারপর মাথা নাড়লেন, নিয়ে এসো এখানে।

হরিপদ চলে গেল।

গোরক্ষ বলল, কথাই আছে, যে বেশি বকে সে বাজে কথা বলে।

হরিপদ যাকে নিয়ে এল তার বয়স ষাট পেরিয়েছে। পরনে ধুতি আর বাবু শার্ট। কাঁধে কাপড়ের ঝোলা। সামনে এসে দুহাত কপালে ঠেকিয়ে ঝুঁকে নমস্কার জানিয়ে টেবিলের দিকে তাকিয়ে বলে উঠলেন। এ হে হে, বড় অসময়ে এসে পড়লাম।

সতীশ রায় বললেন, বসো।

বসব? আপনাদের এখন সেবার সময়।

শোনো ঘটকবাবু, ন্যাকামি আমি সহ্য করতে পারি না।

চেয়ার টেনে দ্রুত বসে পড়লেন ঘটকবাবু। বসে তাকালেন দুজনের দিকে।

গোরক্ষ বলল, আমি গোরক্ষ, ইনি নাগেশ্বর। বড়বাবুর স্নেহধন্য।

আমার দুই সাপ। তবে বিষ নেই। তেঁড়া বা হেলে বলতে পারো। সতীশ রায় হাসলেন, তা, এখন কটা বাজে?

আজ্ঞে সাতটা। নাগেশ্বর বলল।

তোমার শেষ বাস কখন?

এখান দিয়ে সাড়ে সাতটায় যায়। ঘটকবাবু বললেন।

তাহলে একদম সময় নেই। এক গ্লাস চলবে?

না না। শরীর নাড়ালেন ঘটকবাবু, সন্ধান পেয়েছি বড়বাবু।

বাঃ! গুড। বাড়ি কোথায়?

আলিপুরদুয়ারের কাছে।

বয়স?

আজ্ঞে বলছে কুড়ি। দু-বছর জল মেশালে বাইশ ধরতে পারেন।

চলবে। বৃত্তান্ত বলল।
 
পরমাসুন্দরী, যেমন নাক, তেমন চোখ, তেমন গড়ন, গায়ের রঙ ওই জ্যোৎস্নার চেয়েও সুন্দর। মানে যাকে বলে–।

আঃ! অন্য গুণ বলো!

হ্যাঁ। গৃহকর্মনিপুণা, রন্ধনে দ্রৌপদী, সূচিশিল্পে দক্ষ, মৃদুভাষিণী, এরকম পাত্রী ভুভারতে পাওয়া যাবে না।

তুমি ওঠো! সতীশ রায় গম্ভীর গলায় বললেন।

অ্যাঁ? চমকে উঠলেন ঘটকবাবু।

তোমাকে সেদিন বলেছিলাম আমার প্রতিমার দরকার নেই।

তাহলে?

কান খুলে শোনো, আমার ছেলে সত্যচরণের জন্যে আমি একটি সুশ্রী পাত্রী চাই, যার দিকে তাকালে মন বিরূপ হবে না। ডানাকাটা সুন্দরীর কোনও দরকার নেই। কিন্তু আমার একটাই শর্ত আছে। মাথা নাড়লেন সতীশ রায়।

আদেশ করুন। ঝোলা থেকে খাতা বের করলেন ঘটকমশাই।

সেই মেয়ের স্বভাবে একটু নষ্টামির ঝোঁক থাকতে হবে।

সেকি! আঁতকে উঠলেন ঘটকমশাই।

আর দেরি করলে বাস পাবে না।

কিন্তু, কোনও বাপ বলবে যে তার মেয়ের স্বভাবে নষ্টামি আছে? ঘটকমশাই খাতা ব্যাগে ঢোকালেন।

ওঃ! আমি নষ্টামি বলিনি। বলেছি নষ্টামির ঝোঁক। বোঝনি?

না।

বাতাস জোরে বইলে কী বলি আমরা?

আজ্ঞে ঝড়।

যদি খুব ধীরে বয়?

মধুর হাওয়া।

ঠিক তাই।

কিন্তু বড়বাবু, কোনও বাপ স্বীকার করবে না।

বাপ না করুক মা করবে। সতীশ রায় বললেন।

মা না করুক প্রতিবেশিরা করবে। নাগেশ্বর বলল।

উঠে দাঁড়ালেন ঘটকমশাই। তাঁর মুখ চুপসে গিয়েছে।

আচ্ছা, চলি।

ঘটকমশাই চলে গেলে গোরক্ষ বলল, আহা, বেচারির মুখ দেখে মনে হল পাঁচ কেজি মাছ বঁড়শি থেকে ছিটকে গেল।

নাগেশ্বরের গলা জড়িয়ে এল, বড়বাবু।

সতীশ রায় উঠে দাঁড়ালেন, আমার খাওয়ার সময় হয়ে গিয়েছে।

একটা কথা! নাগেশ্বর উঠে দাঁড়াতে পা টলল।

চটপট বলল। মাতালদের অসহ্য লাগে আমার।

খোকার জন্য ওরকম পাত্রী চাইছেন কেন? নাগেশ্বর জিজ্ঞাসা করল।

সতীশ রায় একটা আঙুল তুললেন, এভাবে সোজা করে আঙুল বোতলে ঢোকালে ঘি উঠবে? তার জন্যে আঙুলটা একটু বাঁকাতে হয়। বাড়ির দিকে চলে গেলেন সতীশ রায়।

হরিপদ প্রায় লাফিয়ে এল সামনে, বাড়ি যান।

এখনও গ্লাসে রয়েছে যে–। গোরক্ষ বলল।

গ্লাসের তরল পদার্থ ঘাসের ওপর ফেলে দিয়ে হরিপদ বলল, আর নেই, বাবুকে খেতে দিতে হবে, দেরি করিয়ে দেবেন না।

জ্যোৎস্নায় গোরক্ষ আর নাগেশ্বর বাড়ির দিকে পা বাড়াল হাত ধরাধরি করে।

*
 
ভোর ভোর সময়টায় ঘুম ভেঙে যায় ডুডুয়ার সতীশ রায়ের। মুখ ধুয়ে তিনি চলে আসেন বাগানের এপাশে, ডুডুয়া নদীর ধারে। বড়সড় নদী নয়, তবু এই কালো ছায়ামাখা নদীর দিকে তাকালে মন ভরে যায়। সতীশ রায়ের পিতৃদেবের ইচ্ছেয় জায়গার নাম ডুডুয়া হয়েছে বলে কথিত আছে। তখনও এখানে ধানের চাষ হত, এপাশে ছিল জঙ্গল। ধূপগুড়ির উপকণ্ঠে বাড়ি ছিল তাদের। যাতায়াতে অসুবিধে হত, জায়গাতেও কুলাচ্ছিল না, তাই বন কেটে জমির গায়ে বাড়ি তৈরি করা হয়েছিল। লোকে বলে তাঁদের পরিবারের জন্যেই এখানকার সবাই ভাল আছে। বাবার কাছে শুনেছেন সতীশ রায়, পাকিস্তান হওয়ার পর পূর্ববঙ্গ থেকে চলে আসা উদ্বাস্তুদের বেশ বড় দুটো দল এখানেও আশ্রয় নিয়েছে। তখন নিজেদের সংখ্যা কম হওয়ায় তারা সাগ্রহে ওদের সাহায্য করেছেন। বেশির ভাগই জলপাইগুড়ি কুচবিহার সীমান্তের ওপারের মানুষ। ভাষা, সংস্কৃতিতে কোনও পার্থক্য না থাকায় মিশে যেতে অসুবিধে হয়নি। এখন আর ডুডুয়াতে খালি জমি নেই। যা আছে তা সরকারি খাস জমি অথবা বনবিভাগের সম্পত্তি। ভালই হয়েছে তাতে, জনসংখ্যা আর না বাড়াই ভালো।

একটা ছিপ নৌকো দেখতে পেলেন সতীশ রায়। চিৎকার করলেন, কে যায়?

আঙে আমি তারিণী। লগি নৌকোয় তুলে হাতজোড় করল লোকটা।

ও। তা এই সাতসকালে চললে কোথায়? মাছ ধরতে নাকি?

ছি ছি ছি। আপনি নিষেধ করেছেন, অমান্য করতে পারি?

তোমার ছেলে তরুণ সংঘে খেলে, তাই তো?

আর বলবেন না। এক পয়সা রোজগার নেই, শুধু খেলা আর খেলা। বড়বাবু ওর একটা ব্যবস্থা করে দিন না। তারিণী কাতর গলায় বলল।

হবে, শিগগির হবে। তা তুমি নদীতে কী করছ?

মেয়ের বাড়ি যাচ্ছি। নাতির শরীর খারাপ খবর এসেছে।

মেয়ের বাড়ি কোথায়?

জোড়াপানিতে, বাসে গেলে দুবার পালটাতে হয়, পয়সাও লাগে। নদী বেয়ে গেলে এক ঘণ্টায় পৌঁছে যাব মাগনায়। নদীর পাশেই বাড়ি।

বাঃ! বেশ ভালো। যাও।

তারিণীর ছিপ নৌকো অদৃশ্য হওয়ামাত্র একটা কাতলা মাছ লাফিয়ে জলের ওপর উঠেই নেমে গেল। এক লহমায় তার চকচকে শরীর দেখতে পেয়ে খুব খুশি হলেন সতীশ রায়। বেশ ভালো স্বাস্থ্য মাছটার।

তখনই তার মাথায় বুদ্ধিটা এল। এই যে ছেলেগুলো খেলা-পাগল, খেলেই চলেছে কিন্তু কী করে ভালো খেলতে হয় তা শেখানোর কোনও লোক নেই। নিজেরাই যা পারছে খেলছে। শহর থেকে কোচ আনলে কী রকম খরচ পড়ে? জলপাইগুড়ির টাউন ক্লাবের অবনীদার সঙ্গে তাঁর এককালে পরিচয় ছিল। ওঁকে জিজ্ঞাসা করলে কেমন হয়? আজ শহরে যেতে হবে ডিসি অফিসে। তখন যদি সময় পান তাহলে অবনীদার সঙ্গে দেখা করবেন।

সকাল নটায় ভাত খেয়ে নিলেন সতীশ রায়। খাওয়া শেষ হতে মতির মাকে ডেকে পাঠালেন। বৃদ্ধা এসে দরজার পাশে দাঁড়াল মাথায় ঘোমটা দিয়ে। চেয়ারে বসে পান চিবোচ্ছিলেন সতীশ রায়। জিজ্ঞাসা করলেন, এখন এই বাড়িতে কে রাঁধছে মতির মা?

আজ্ঞে আমি।

লোক দ্যাখো। ভালো রান্না জানা এমন কাউকে আনন। যত বয়স হচ্ছে। তোমার হাতের রান্না তত খারাপ হচ্ছে। রান্নায় যে ঝাল দিতে হয় তাও ভুলে গেছ।

খোকা ঝাল একদম খেতে পারে না। কষ্ট হয়। মতির মা বলল।

মাথা নাড়লেন সতীশ রায়। তারপর বললেন, তোমার ওই খোকার রান্না তুমি বেঁধে, আমার জন্যে ভালো রাঁধুনি খুঁজে আনো। কথাটা বলেই খেয়াল হল, তাঁর, সত্যকে এখানে আসতে বলে।

মতির মা যেন আঁতকে উঠল, ওকে বকবেন না বড়বাবু।

বকব? আমি তাকে বকবো বলে কেন মনে হল! যত্ত সব! যাও, পাঠিয়ে দাও।
 
মতির মা চলে গেল। সিগারেট শেষ করলেন তিনি। সারাদিনে এক প্যাকেট সিগারেট, সন্ধের পর একটা দামি চুরুট। ডাক্তাররা বলে নেশাটা খারাপ, কিন্তু কিছু করার নেই। সত্যর মা বলত, তুমি সিগারেট খেলে গন্ধটা বেশ লাগে, কিন্তু চুরুটের গন্ধ সহ্য করতে পারি না। তখন সন্ধের পরে মদ্যপান করতেন না, তাই চুরুট খাওয়া বন্ধ রেখেছিলেন। হঠাৎ দরজার দিকে তাকাতেই দেখলেন, সত্যচরণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে।

তুমি ওখানে ভূতের মতো দাঁড়িয়ে আছ কেন? জিজ্ঞাসা করলেন সতীশ রায়।

আপনি ডেকেছেন! মাথা নিচু করে জবাব দিল সত্যচরণ।

তাতে সাড়া দিয়ে তুমি এঘরে এসেছ সেটা জানান দেবে তো!

সত্যচরণ কথা বলল না। মেঝের দিকে তাকিয়ে থাকল।

কি করছিলে?

পড়ছিলাম।

কী বই?

শরৎচন্দ্রের পশ্লীসমাজ।

পাও কোথায়?

হরিপদদা এনে দেয় লাইব্রেরি থেকে।

শোনো, অনেক হয়েছে। কাল থেকে তুমি আমার সঙ্গে বেরুবে। অনেক বয়স হয়েছে। ঘরে বসে বই পড়ে সময় নষ্ট করা চলবে না। আমার ব্যবসাগুলো কীভাবে চলছে শিখে নাও। কানে ঢুকল? ছেলের দিকে তাকালেন সতীশ রায়।

কাল থেকে যেতে বলবেন না। মুখ তুলল না সত্যচরণ।

কেন? কী রাজকাজ আছে তোমার?

এই মাসটায় আমি খুব কষ্টে থাকি।

কষ্টে থাকো? কেন?

এই মাসেই মা স্বর্গে গিয়েছিল।

থমকে গেলেন সতীশ রায়। হ্যাঁ, কথাটা ঠিক। তবে পনেরো বছর বাদে ওটা মনে রাখার বিষয় নয়। এমন মাতৃভক্ত ছেলে যে অনেক বছর পরেও মায়ের মৃত্যুমাসে কষ্টে থাকে! ভাবা যায়?

হুম, ঠিকু আছে। মনে রেখো আমার সঙ্গে ছলচাতুরি করে তুমি পার পাবে না। ও হ্যাঁ, শুনলাম ঘরে বসে তুমি নাকি কিছু লেখো আর কাটো। কী ব্যাপার?

চুপ করে থাকল সত্যচরণ।

দ্যাখো, তোমার কোনও বন্ধু নেই, কোথাও গল্প করতে যাও না। তরুণ সংঘের ছেলেরা খেলাধুলা করে, তাদের সঙ্গেও তোমার সম্পর্ক নেই, একদম ঘরকুনো হয়ে থাকলে চলবে? যাও।

বলমাত্র সত্যচরণ যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। কিন্তু হরিপদ এল, ক্লাবের ছেলেরা এসেছে দেখা করতে। বলল, আপনি আসতে বলেছেন।

হুঁ, শোনো হরিপদ। সত্য কী লেখে আর কাটে তা আমি দেখতে চাই।

আমাকে মতির মা খোকার ঘরে ঢুকতে দেয় না।

তাহলে তাকেই বলে একটা পাতা জোগাড় করে আনতে।

বলবো, এই একটু আগে খোকা একটা পাতা ছিঁড়ে পাকিয়ে মেঝেয় ফেলে দিতেই মতির মা সেটা যত্ন করে কুড়িয়ে নিয়েছে।

বাঃ, ওই পাতাটা মতির মায়ের কাছ থেকে নিয়ে এসো। আমার হুকুম।

বাইরে বেরিয়ে এলেন সতীশ রায়।

ছেলেগুলো দাঁড়িয়ে আছে বাগানে। একটু অস্বস্তিতে। এদের মধ্যে তারিণীর ছেলে শেনটা? বুঝতে পারলেন না। জিজ্ঞাসা করলেন, তোমাদের দলে কজন আছে?

কুড়ি-জন।

কিন্তু এখানে তো বারোজনকে দেখতে পাচ্ছি।

বাকি আটজন বয়সে ছোট। মোল সতেরো। তাই নিয়ে আসিনি।

যে ছেলেটি কথা বলছিল তার দিকে তাকালেন। ওর নাম মঙ্গল। ব্যাক। খেলে। ভালোই খেলে।

তমাদের জন্যে একটা পরিকল্পনা করেছি। তোমরা সবাই জানো গত ছয়মাস ধরে চূড়ুয়া নদীর এই এলাকায় মাছ ধরা বন্ধ আছে। আগামী ছয়মাস মাছ ধরা যাবে এবং সেটা ধরবে তোমরা ঘোষণার ভঙ্গিতে বললেন সতীশ রায়।

গুঞ্জন উঠল।

সতীশ রায় বললেন, তার আগে তোমাদের একটা কো-অপারেটিভ তৈরি করতে হবে। এই বারোজন হবে সেই কো-অপারেটিভের মেম্বার। আমি গতরাতে বলে দিয়েছিলাম আজ এখানে আসার আগে একজনকে নেতা নির্বাচন করে আসবে। কাকে নির্বাচন করেছ?

মঙ্গলকে। সবাই কথা বলল, একসঙ্গে।

বেশ। মঙ্গল হবে কো-অপারেটিভের সেক্রেটারি। এই কো-অপারেটিভ ছাড়া আর কেউ ডুডুয়াতে মাছ ধরতে পারবে না। মাছ ধরতে যা যা লাগে সেসব খরচ আমার। এখান থেকে তিরিশ মাইলের মধ্যে সপ্তাহে চারটে হাটি হয়। প্রতি ভোরে মাছ ধরবে, সকাল নটা পর্যন্ত। তারপর সেই মাছ হাটে নিয়ে গিয়ে মাছওয়াদের কাছে বিক্রি করে দেবে। খরচ বাদ দিয়ে যা লাভ থাকবে তার অর্ধেক ব্যাঙ্কে রাখবে কো-অপারেটিভের অ্যাকাউন্টে। বাকিটা বারোজন সমান ভাগ করে নেবে। এই ছয়মাসে যা রোজগার করবে তাতে তোমাদের পরিবারের বারোমাসের খরচ মেটাতে পারবে। ব্যাঙ্কে যা জমবে তার বারোভাগের একভাগ প্রত্যেকে আপদে বিপদে খরচ করতে পারবে। ধীরে ধীরে বুঝিয়ে বললেন সতীশ রায়।
 
ছেলেগুলোর মুখ চকচক করল। একজন বলল, কিন্তু আমরা কী দিয়ে মাছ ধরব? ছিপ দিয়ে?

ছিপ দিয়ে তিনচার ঘণ্টায় কটা মাছ ধরতে পারবে? জাল ফেলতে হবে। এটা শিখে নাও অন্য জায়গার জেলেদের কাছে। শিখতে চাইলে সব কিছু শেখা যায়। কো-অপারেটিভের নাম হবে ডুডুয়া ইয়ং মেন ফিশারিস। সতীশ রায় বললেন, আমি আজ শহরে যাচিছ। কত তাড়াতাড়ি কো-অপারেটিভ, তৈরি করা যায় খবরাখবর নেব। তোমরা ময়নাগুড়িতে গিয়ে দাশরখি উকিলের সঙ্গে দেখা করে আমার কথা বলবে। তিনি কাগজপত্র তৈরি করে দেবেন।

মঙ্গল বলল, রোজ কত মাছ ধরব?

রোজ নয়, সপ্তাহে চারদিন। চারদিনের ভোর থেকে চার ঘণ্টায় যা ওঠে। তার বেশি নয়। আর হ্যাঁ। এখন মাছ বেশ বড় হয়ে গেছে। তোমাদের লক্ষ রাখতে হবে যেন চুরি করে কেউ মাছ না ধরে।

তাহলে কি তরুণ সংঘ উঠে যাবে? একজন জিজ্ঞাসা করল।

মুর্খের মতো কথা বলছ! ছয়মাস সপ্তাহে চারদিনের অর্ধেক বেলা। তারপর কী করবে? তরুশ সংঘ থাকবে। ভালোভাবে থাকবে। আর বাকি ছয়মাস তো তোমরা একদম বেকার। তখন তো আরও সময় পাবে। এ ব্যাপারেও আমি ভেবেছি। তোমরা এখন ফুটবল খেলো নিজেদের মতো করে। কিন্তু ভালো খেলতে হলে একজন কোচ দরকার। এই কোচ তোমাদের ঠিকঠাক খেলা শেখাবেন।

সতীশ রায়ের কথায় হাসি ফুটল প্রত্যেকটা মুখে। সতীশ রায় লক্ষ করলেন মাছ ধরার প্রস্তাবেও এই হাসি ওদের মুখে দেখা যায়নি।

পকেট থেকে আড়াইশো টাকা বের করে মঙ্গলের হাতে দিলেন তিনি, বানারহাটে খেলতে যাচ্ছ, জিতে ফিরতে হবে।

আমরা চেষ্টা করব। মঙ্গল বলল।

ওরা ফিরে যেতে যেতে দাঁড়াল। নিজেদের মধ্যে পরামর্শ করল নিচু গলায়। তারপর মঙ্গল ফিরে এল, কাকা, সত্যদাকে আমাদের মধ্যে পাওয়া যাবে না।

কী ব্যাপারে?

ওই কো-অপারেটিভ।

তার সঙ্গে তোমাদের কথা হয়?

না।

তাকে দেখতে পাও?

না।

কো-অপারেটিভের প্রত্যেক সদস্যকে কাজ করতে হবে। অকাজের লোককে রেখে লাভ কী! তোমরা পরে এসে ওকে জিজ্ঞাসা কোরো সে কাজ করতে ইচ্ছুক কিনা।

ছেলেরা চলে গেল।

দেরি হয়ে গিয়েছে বেশ। সতীশ রায় ঘরে এসে তৈরি হলেন। এই সময় মতির মা দরজায় এল, বাবু।

বলো।

খোকাবাবু তো নিজের মনে লেখে, ওকে কিছু বলবেন না।

কী লেখে?

একটা দলা পাকানো কাগজ এগিয়ে দিল মতির মা।

সেটা নিয়ে খুললেন সতীশ রায়। টান টান করে দেখলেন তিনটে লাইন লেখা হয়েছে। লেখার পর লাইন। তিনটে কেটে দিয়েছে সত্য। প্রথম লাইন, এখানকার সব পাখি বোবা হয়ে গেছে। লাইনটা দুবার কেটে দ্বিতীয় লাইন লিখেছে, এখানে পাখিরা আর কথা বলে না। এটাও দুবার কেটেছে ছোকরা। তৃতীয় লাইন, পাখিরা এখন মূক, পাখি নেই বলে। এটা একবার কাটা।



চোখ বিস্ফারিত হয়ে গেল সতীশ রায়ের। কবিতা লিখছে নাকি ছোকরা? কী সর্বনাশ! দিনরাত ঘরে বসে কবিতা লিখছে আর কাটছে? মেজাজ টঙে উঠল তাঁর। ইচ্ছে হল ওর ঘরে গিয়ে কবিতার ভূত ভাগাতে। মতির মা তার মুখ দেখে বলে উঠল, বড়বাবু!

আঃ। যাও দূর হও এখান থেকে। চিৎকার করতেই মতির মা অদৃশ্য হল। অনেক কষ্টে নিজেকে সামলালেন সতীশ রায়। খুব দেরি হয়ে যাওয়ার আগে একটা বিহিত করা দরকার।

*
 
গাড়িটা অ্যাম্বাসাডার। পা ছড়িয়ে বসতে বেশ আরাম লাগে। দুপাশে বাড়িঘর, মুদির দোকান,একটা পুকুর পেরিয়ে পাঠশালার সামনে গাড়ি দাঁড় করাতে বললেন ড্রাইভারকে। পাঠশালার দুটো ঘর। বাইরের সাইনবোর্ডে লেখা, পাঠশালা। ভেতর থেকে পড়ুয়াদের গলা ভেসে আসছে।

গাড়ির শব্দ শুনে দ্রুত বেরিয়ে এলেন মাস্টার মশাই নিতাই দাস। হাতজোড় করে বললেন, আপনি এখানে কেন কষ্ট করে এলেন। আমায় ডেকে–।

কথা শেষ করতে দিলেন না সতীশ রায়, পাঠশালা কেমন চলছে?

ভালো। এবছর যারা ক্লাস ওয়ানে ভর্তির পরীক্ষা দিয়েছিল সবাই পাশ করেছে।

বাঃ। মাথা নাড়লেন সতীশ রায়। কোন অসুবিধে?

বড়বাবু, অসুবিধে তো থাকবেই। কিন্তু তার সঙ্গে মানিয়ে চলতে হয়।

হুম। আপনার চাকরি আর কতদিন?

হয়ে এল। ষাট বছরের পর তো আর চাকরি থাকে না।

তখন কী করবেন?

আমি জানি না। ভাবলেই চোখে সরষে ফুল দেখি, তাই ভাবি না।

আপনার জায়গায় কে পড়াবে?

পাঠশালা কমিটি ঠিক করবেন।

কেউ কি এখন সাহায্য করছে আপনাকে?

সাহায্য? ঠিক সাহায্য নয়। নাগেশ্বরবাবুর মেয়ে পার্বতী রোজ আসে। কী করে পড়াতে হয় তাই শেখাচ্ছি তাকে।

একটু ডাকুন তো ওকে।

নিতাই মাস্টার দরজার কাছে গিয়ে ডাকতেই পার্বতী বেরিয়ে এল। বাপের উচ্চতা পেয়েছে মেয়ে। পাঁচ ফুট। কিন্তু প্রস্থে প্রায় এক দরজার সমান। এইটুকু হেঁটে আসতেই সময় লাগল, জ্যেঠু!

কেমন পড়াচ্ছ?

আমার ভাল্লাগে না।

তাহলে আসছ কেন?

বাবা রাগ করে। বলে নিজের পায়ে দাঁড়া। পার্বতী বলল, এই সকাল দশটা থেকে তিনটে পর্যন্ত নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কোমরে ব্যথা হয়ে গেছে জ্যেই।

ভেতরে যাও।

পার্বতী চলে গেলে সতীশ রায় জিজ্ঞাসা করলেন, ওখানে বসার ব্যবস্থা নেই? চেয়ার টেয়ার।

না। শিশুরা সতরঞ্চির ওপর বসে পড়ে। আমরাও মাটিতে আসন পেতে বসে পড়াই। এতে দূরত্ব কমে যায়।

তাহলে পার্বতী বসে পড়ায় না কেন?

আজ্ঞে, ওর যা শরীর পা মুড়ে বসতে পারে না। প্রথমদিন চেষ্টা করে। বসেছিল কিন্তু দুটো পা এত অবশ হয়ে গিয়েছিল যে অনেক কষ্টে ওকে ভোলা হয়েছিল। নিতাই মাস্টার বললেন।

অনেক চেষ্টায় হাসি সামলালেন সতীশ রায়। তারপর বললেন, একটা অ্যাপ্লিকেশন দিন। কমিটি যাতে আপনার চাকরি আরও কয়েক বছর বাড়িয়ে দেয় তার চেষ্টা করব। সতীশ রায় গাড়িতে উঠলেন।

একটু এগিয়ে দাঁড়িয়ে গেলেন নিতাই মাস্টার। তার চোখ উপচে জল বেরিয়ে আসছে। সহানুভূতির কথা শুনলে আজকাল শরীরটা আর বশে থাকে না।
 

Users who are viewing this thread

Back
Top