শেষবিকেলটা অন্ধকারে ভরে আসছিল। যেন কাছাকাছি কোথাও বৃষ্টি হয়ে গেছে, বাতাসে একটা ঠাণ্ডা আমেজ টের পাওয়া যাচ্ছিল। অবশ্য কদিন থেকেই আকাশের চেহারাটা দেখার মতো ছিল। চাপ-চাপ কুয়াশার দঙ্গল বাদশাহি মেজাজে গড়িয়ে যাচ্ছিল সবুজ গালচের মতো বিছানো চা-গাছের ওপর দিয়ে খুঁটিমারীর জঙ্গলের দিকে। বিচ্ছিরি, মন-খারাপ করে-দেওয়া দুপুরগুলো গোটানো সুতোর মতো টেনে টেনে নিয়ে আসছিল স্যাঁতসেঁতে বিকেল-ঘষা সেলেটের মতো হয়েছিল সারাদিনের আকাশ। বৃষ্টির আশঙ্কায় প্রত্যেকটা দিন যেন সুচের ডগায় বসে থাকত এই পাহাড়ি জায়গাটায়, কেবল বৃষ্টিই যা হচ্ছিল না।
কিন্তু কাছাকাছি কোথাও বৃষ্টি হয়েছে। হয়তো ভুটানোর পাহাড়ে বৃষ্টি নেমেছে। ঠাণ্ডা হাওয়া বইছে। পুরো হাতওয়ালা হলুদ পুলওভার পরে অনি দেখল দিনটা ফুরিয়ে যাচ্ছে। বাড়ির সামনে পাতাবাহারের গাছগুলোর ওপর নেতিয়ে-পড়া হলুদ বরোদটা কোথায় হারিয়ে গেল টুক করে। আরও দূরে, আঙরাভাসা নদী জড়িয়ে বিরাট খুঁটিমারীর জঙ্গলের মাথায় লাল বলের মতো যে-সূর্যটা হঠাৎ উঁকি দিয়েছিল একবার, যাকে সকাল থেকে বুকের মধ্যে আঁকড়ে রাখতে চেয়েছিল ও, কেমন করে, ব্যাডমিন্টনের কর্কের মতো ঝুলে পড়ল ওপাশে, একরাশ ছায়া ছড়িয়ে দিল চারধারে। অনির খুব কান্না পাচ্ছিল।
খালিপায়ে বাড়ির পেছনে চলে এল অনি। ঘাসগুলো কেমন ঠাণ্ডা, ন্যাতাননা। পায়ের তলায় শিরশির করে। চটি না পরে বেরুলে মা রাগ করবেন, কিন্তু অনি জানে এখন ওদের কাউকে পাওয়া, যাবে না। এই বিরাট কোয়ার্টারটার ঠিক মধ্যখানের ঘরে এখন সবাই বসে গোছগাছ করছে। এদিকে নজর দেবার সময় নেই কারও।
এই বাড়িটার চারপাশে শুধু গাছপালা। দাদু এখানে এসেছিলেন প্রায় পঁয়তাল্লিশ বছর আগে। সবকটা গাছের আলাদা আলাদা গল্প আছে, মন ভালো থাকলে দাদু সেগুলো বলেন। এই যে বিরাট ঝাপড়া.কাঁঠাল গাছ ওদের উঠানের ওপর সারাদিন ছায়া ফেলে রাখে, যার গোড়া অবধি রসালো মিষ্টি কাঠাল থোকা থোকা হয়ে ঝুলে থাকে, সেটা বড় ঠাকুমা লাগিয়েছিলেন। প্রায় চল্লিশ বছর বয়স হয়ে গেছে গাছটার। প্রথমদিকে নাকি মাটির নিচে কাঁঠাল হত, পেকে গেলে ওপরের মাটি ফেটে যেত, গঙ্কে চারদিক ম-ম করত তখন। রাত্রির বেলায় শেয়াল, আসত দল বেঁধে সেই কাঁঠাল খেতে। বড় ঠাকুমা শুয়ে শুয়ে চিৎকার করতেন তখন। শেষ পর্যন্ত দাদু কাঁঠাল গাছের ওপরে একটা টিনের ঘোট ড্রাম বেঁধে দিয়েছিলেন। সেই ড্রামের মধ্যে একটা ঘণ্টা দড়িতে বাঁধা থাকত। দড়িটা টিনের ছাদের নিচ দিয়ে ঘরে ঢুকিয়ে খাটের সঙ্গে বাঁধা ছিল। ভালো থাকলে দাদু হেসে বলেন, রাতদুপুরে ঘুম ভেঙে গেলে দেখতাম তোমার ঠাকুমা শুয়ে সেই দড়ি টানছেন আর বাইরে প্রচণ্ড শব্দ করে ড্রামটা বাজছে। শেয়ালের সাধ্য কী এর পরে আসে!
উঠানের শেষে গোয়ালঘর যাবার খিড়কিদরজার গায়ে যে-তালগাছটা, যার ফল কোনদিন পাকে না, ছোট ঠাকুমা লাগিয়েছিলেন। মেজোপিসিকে তিনদিনের রেখে বড় ঠাকুমা মারা যান। হোট ঠাকুমা বড় ঠাকুমার বোন। এই তাল গাছটা কোনো কর্মের নয়। পিসিমা বলেন, ব্যাটাছেলে গাছ। বাবা কাটতে দেন না ছোটমা লাগিয়েছিল বলে, ছায়া-ফায়া সব বাজে কথা। ছোটমাকে তো বাবা খুব ভালোবাসতেন। গাছটাকে অনেকবার কেটে ফেলার কথা হয়েছিল। বাবুই পাখিরা সারা গাছে বাসা, করে আছে। সারাদিন রঙিন পাখির কিচিরমিচির, দেখতেও ভালো লাগে। তা ছাড়া ছায়া হয় উঠানে এইসব বলে দাদু কাটতে দেননি। তাই পিসিমা বলেন, ছায়া-ফায়া সব বাজে কথা। সত্যিই বাবুই পাখি বাসা করে বটে। এক-একদিন সকালে সারারাত ঝড়ের পরে অনি. দেখেছে মাটিতে পড়া বাসাগুলো হাতে নিয়ে, কী নরম! অথচ পাখিগুলোর ক্ষেপ নেই, আবার বাসা করতে লেগে গেছে। ঝাড়িকাকু একদিন ওকে বলেছিল, কত্তামশাই-এর দুই বউ, কাঠালগাছ আর তালগাছ। বেশ মজা লেগেছিল অনির।
খিড়কিদরজা দিয়ে বেরুতেই ও কালীগাই-এর হাম্বা ডাক শুনতে পেল। এমন মানুষের মতে ডাকে গরুটা, বুকের মধ্যে কেমন করে ওঠে। কালী দাঁড়িয়ে আছে গোয়ালঘরের সামনে। ওর ছেলেমেয়েরা কোথায়? বেশি গরু বাড়তে দেন না মা। চারটে বেশি হয়ে গেলে লাইন থেকে পাতরাস আসে, হাটে গিয়ে বিক্রি করে দেয়। সে টাকা মায়ের কাছে জমা থাকে-গরুগুলো সব মায়ের। কালীকে বিক্রি করা হবে না কখনো । দুধ দিক বা না-দিক, ও এখন বাড়ির লোক হয়ে গিয়েছে। অনি দেখল কালী বড় বড় চোখে ওর দিকে তাকিয়ে আছে। ওর চোখ দুটো আজ এত গম্ভীর কেন? বুকের মধ্যে কেমন করে উঠল অনির। ও কি কিছু বুঝতে পেরেছে গরুরা কি টের পায়? হাত বাড়াল অনি, সঙ্গে সঙ্গে মুখটা ওপরে তুলে ধরল কালী। গলার কম্বলে হাত বোলাল অনি অনেকক্ষণ। নাক দিয়ে শব্দ করছে কালী। রোজ যেরকম আদর করে খাবার মুখে নেয়, আজ সেরকমটা না। যেন ও সত্যিই বুঝতে পারছে অনি। বড় বড় মাথা সমান আকন্দ গাছগুলো ঘোয়ালঘরের চারপাশে বেড়া দিয়ে লাগানো হয়েছে। অনি সেগুলো পেরিয়ে আসতে আসতে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখল, কালী ঘুরে দাঁড়িয়ে ওকে একদৃষ্টে দেখছে। অনি দৌড় লাগাল।