What's new
Nirjonmela Desi Forum

Talk about the things that matter to you! Wanting to join the rest of our members? Feel free to sign up today and gain full access!

Collected উত্তরাধিকার - সমরেশ মজুমদার (1 Viewer)

Kaptan Jacksparoow

Community Team
Elite Leader
Joined
Apr 6, 2019
Threads
330
Messages
6,279
Credits
48,462
T-Shirt
Profile Music
Recipe sushi
Rocket
Euro Banknote
Butterfly
উত্তরাধিকার
লেখক- সমরেশ মজুমদার

029ef92418bae1ef4a6fb98bbfde1321.jpg
 
শেষবিকেলটা অন্ধকারে ভরে আসছিল। যেন কাছাকাছি কোথাও বৃষ্টি হয়ে গেছে, বাতাসে একটা ঠাণ্ডা আমেজ টের পাওয়া যাচ্ছিল। অবশ্য কদিন থেকেই আকাশের চেহারাটা দেখার মতো ছিল। চাপ-চাপ কুয়াশার দঙ্গল বাদশাহি মেজাজে গড়িয়ে যাচ্ছিল সবুজ গালচের মতো বিছানো চা-গাছের ওপর দিয়ে খুঁটিমারীর জঙ্গলের দিকে। বিচ্ছিরি, মন-খারাপ করে-দেওয়া দুপুরগুলো গোটানো সুতোর মতো টেনে টেনে নিয়ে আসছিল স্যাঁতসেঁতে বিকেল-ঘষা সেলেটের মতো হয়েছিল সারাদিনের আকাশ। বৃষ্টির আশঙ্কায় প্রত্যেকটা দিন যেন সুচের ডগায় বসে থাকত এই পাহাড়ি জায়গাটায়, কেবল বৃষ্টিই যা হচ্ছিল না।

কিন্তু কাছাকাছি কোথাও বৃষ্টি হয়েছে। হয়তো ভুটানোর পাহাড়ে বৃষ্টি নেমেছে। ঠাণ্ডা হাওয়া বইছে। পুরো হাতওয়ালা হলুদ পুলওভার পরে অনি দেখল দিনটা ফুরিয়ে যাচ্ছে। বাড়ির সামনে পাতাবাহারের গাছগুলোর ওপর নেতিয়ে-পড়া হলুদ বরোদটা কোথায় হারিয়ে গেল টুক করে। আরও দূরে, আঙরাভাসা নদী জড়িয়ে বিরাট খুঁটিমারীর জঙ্গলের মাথায় লাল বলের মতো যে-সূর্যটা হঠাৎ উঁকি দিয়েছিল একবার, যাকে সকাল থেকে বুকের মধ্যে আঁকড়ে রাখতে চেয়েছিল ও, কেমন করে, ব্যাডমিন্টনের কর্কের মতো ঝুলে পড়ল ওপাশে, একরাশ ছায়া ছড়িয়ে দিল চারধারে। অনির খুব কান্না পাচ্ছিল।

খালিপায়ে বাড়ির পেছনে চলে এল অনি। ঘাসগুলো কেমন ঠাণ্ডা, ন্যাতাননা। পায়ের তলায় শিরশির করে। চটি না পরে বেরুলে মা রাগ করবেন, কিন্তু অনি জানে এখন ওদের কাউকে পাওয়া, যাবে না। এই বিরাট কোয়ার্টারটার ঠিক মধ্যখানের ঘরে এখন সবাই বসে গোছগাছ করছে। এদিকে নজর দেবার সময় নেই কারও।

এই বাড়িটার চারপাশে শুধু গাছপালা। দাদু এখানে এসেছিলেন প্রায় পঁয়তাল্লিশ বছর আগে। সবকটা গাছের আলাদা আলাদা গল্প আছে, মন ভালো থাকলে দাদু সেগুলো বলেন। এই যে বিরাট ঝাপড়া.কাঁঠাল গাছ ওদের উঠানের ওপর সারাদিন ছায়া ফেলে রাখে, যার গোড়া অবধি রসালো মিষ্টি কাঠাল থোকা থোকা হয়ে ঝুলে থাকে, সেটা বড় ঠাকুমা লাগিয়েছিলেন। প্রায় চল্লিশ বছর বয়স হয়ে গেছে গাছটার। প্রথমদিকে নাকি মাটির নিচে কাঁঠাল হত, পেকে গেলে ওপরের মাটি ফেটে যেত, গঙ্কে চারদিক ম-ম করত তখন। রাত্রির বেলায় শেয়াল, আসত দল বেঁধে সেই কাঁঠাল খেতে। বড় ঠাকুমা শুয়ে শুয়ে চিৎকার করতেন তখন। শেষ পর্যন্ত দাদু কাঁঠাল গাছের ওপরে একটা টিনের ঘোট ড্রাম বেঁধে দিয়েছিলেন। সেই ড্রামের মধ্যে একটা ঘণ্টা দড়িতে বাঁধা থাকত। দড়িটা টিনের ছাদের নিচ দিয়ে ঘরে ঢুকিয়ে খাটের সঙ্গে বাঁধা ছিল। ভালো থাকলে দাদু হেসে বলেন, রাতদুপুরে ঘুম ভেঙে গেলে দেখতাম তোমার ঠাকুমা শুয়ে সেই দড়ি টানছেন আর বাইরে প্রচণ্ড শব্দ করে ড্রামটা বাজছে। শেয়ালের সাধ্য কী এর পরে আসে!

উঠানের শেষে গোয়ালঘর যাবার খিড়কিদরজার গায়ে যে-তালগাছটা, যার ফল কোনদিন পাকে না, ছোট ঠাকুমা লাগিয়েছিলেন। মেজোপিসিকে তিনদিনের রেখে বড় ঠাকুমা মারা যান। হোট ঠাকুমা বড় ঠাকুমার বোন। এই তাল গাছটা কোনো কর্মের নয়। পিসিমা বলেন, ব্যাটাছেলে গাছ। বাবা কাটতে দেন না ছোটমা লাগিয়েছিল বলে, ছায়া-ফায়া সব বাজে কথা। ছোটমাকে তো বাবা খুব ভালোবাসতেন। গাছটাকে অনেকবার কেটে ফেলার কথা হয়েছিল। বাবুই পাখিরা সারা গাছে বাসা, করে আছে। সারাদিন রঙিন পাখির কিচিরমিচির, দেখতেও ভালো লাগে। তা ছাড়া ছায়া হয় উঠানে এইসব বলে দাদু কাটতে দেননি। তাই পিসিমা বলেন, ছায়া-ফায়া সব বাজে কথা। সত্যিই বাবুই পাখি বাসা করে বটে। এক-একদিন সকালে সারারাত ঝড়ের পরে অনি. দেখেছে মাটিতে পড়া বাসাগুলো হাতে নিয়ে, কী নরম! অথচ পাখিগুলোর ক্ষেপ নেই, আবার বাসা করতে লেগে গেছে। ঝাড়িকাকু একদিন ওকে বলেছিল, কত্তামশাই-এর দুই বউ, কাঠালগাছ আর তালগাছ। বেশ মজা লেগেছিল অনির।

খিড়কিদরজা দিয়ে বেরুতেই ও কালীগাই-এর হাম্বা ডাক শুনতে পেল। এমন মানুষের মতে ডাকে গরুটা, বুকের মধ্যে কেমন করে ওঠে। কালী দাঁড়িয়ে আছে গোয়ালঘরের সামনে। ওর ছেলেমেয়েরা কোথায়? বেশি গরু বাড়তে দেন না মা। চারটে বেশি হয়ে গেলে লাইন থেকে পাতরাস আসে, হাটে গিয়ে বিক্রি করে দেয়। সে টাকা মায়ের কাছে জমা থাকে-গরুগুলো সব মায়ের। কালীকে বিক্রি করা হবে না কখনো । দুধ দিক বা না-দিক, ও এখন বাড়ির লোক হয়ে গিয়েছে। অনি দেখল কালী বড় বড় চোখে ওর দিকে তাকিয়ে আছে। ওর চোখ দুটো আজ এত গম্ভীর কেন? বুকের মধ্যে কেমন করে উঠল অনির। ও কি কিছু বুঝতে পেরেছে গরুরা কি টের পায়? হাত বাড়াল অনি, সঙ্গে সঙ্গে মুখটা ওপরে তুলে ধরল কালী। গলার কম্বলে হাত বোলাল অনি অনেকক্ষণ। নাক দিয়ে শব্দ করছে কালী। রোজ যেরকম আদর করে খাবার মুখে নেয়, আজ সেরকমটা না। যেন ও সত্যিই বুঝতে পারছে অনি। বড় বড় মাথা সমান আকন্দ গাছগুলো ঘোয়ালঘরের চারপাশে বেড়া দিয়ে লাগানো হয়েছে। অনি সেগুলো পেরিয়ে আসতে আসতে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখল, কালী ঘুরে দাঁড়িয়ে ওকে একদৃষ্টে দেখছে। অনি দৌড় লাগাল।
 
গোয়ালঘরের পেছনদিকে কোনো বাড়িঘর নেই। বড় বড় জঙ্গলে গাছের সঙ্গে আম কুল ছড়িয়ে আছে। এখন আলো প্রায় নেই বললেই চলে। দৌড়ে আসতে আসতে অনিত সেই ডাহুকটার গলা শুনতে পেল। রোজকার মতো কেমন নিঃসঙ্গ গলায় ঝাকড়া কুলগাছটার তলায় বসে একটানা ডেকে যাচ্ছে। ডাহুকটার গলার কাছটা সাদা থালার মতো। অনেকদিন দেখেছে অনি। ঝাড়িকাকু বলে ডাহুকের মাংস খেতে নাকি খুব ভালো। গুলতি দিয়ে মারার চেষ্টা করেও পারেনি ঝাড়িকাকু। ভীষণ চালাক ডাহুকটা। এখন প্রায়-সন্ধে-হওয়া সময়টায় ডাহুকটার গলার শব্দে কোন বিষণ লাগছিল চারপাশ। অনি আঙরাভাসা নদীর গায়ে-রাখা কাপড়কাচার পাথরটার ওপরে এসে দাঁড়াল। চকচকে ঢেউগুলো যেন ওদের স্কুলে নতুন-আসা গম্ভীর-দিদিমণির মতো দ্রুত হেঁটে যাচ্ছে কোনোদিন না তাকিয়ে। ঝুঁকে পড়ে নিজের ছায়া দেখল ও আঙরাভাসার কালো জলে। মাকে লুকিয়ে ওরা প্রায়ই এই নদীতে স্নান করে। ছোট ছোট নুড়ি-বিছানো হাঁটুজলের নদী। এর নিচে লাল লাল চিড়িগুলো গুড়ি মেরে পড়ে থাকে, হাত বাড়ালেই হল, রোজকার মতো অনি আর ধরতে পারবে না। যাবার বাকি দিনগুলো কেমন দ্রুত, মুখের ভিতর নরম চকোলেটের মতো দ্রুত মিলিয়ে যাচ্ছে। অনির ভীষণ খারাপ লাগছে, ভীষণ।

এখন এখানে কেউ নেই। আঙরাভাসার দুধারে বড় বড় আমগাছগুলোতে ফিরে-আসা পাখিরা জোরালো গলায় চ্যাঁচামেচি করে নিচ্ছে শেষবার। অদ্ভুত একটা আঁষটে গন্ধ উঠছে নদীর গা থেকে। চওড়ায় পনেরো ফুট, তীব্র স্রোতের এই নদী চলে গেছে নিচে চা-ফ্যাক্টরির ভিতর দিয়ে। ফ্যাক্টরির বিরাট হুইলটা চলছে এর স্রোতে। বলতে গেলে স্বৰ্গছেঁড়া হৃৎস্পন্দনের মতো এই নদীর ঢেউগুলো। অথচ ওরা, পায়ের তলায় নড়বড়ে পাথর রেখে কতবার পার হয়ে যায়। ওপাশের লাইনের মদেসিয়া মেয়ের দল যখন নদী পেরিয়ে এপারে আসে তখন ওদের হাঁটু অবধি নামা কালো পাহাড়ের ঘেরটা পদ্মপাতার মতো স্রোতে ভাসে। কাপড়টাকে ওরা বলে আঙরা। নদীর নাম তাই আঙরাভাসা। স্রোত আর জল কম তাই বড় মাছেরা এদিকে আসে না। তবু একটা জলজ আঁষটে গন্ধ বেরোয় নদীর গা থেকে। চোখ বন্ধ করলে জলের শব্দ খনির মতো বেজে যায়।

পুলওভার গুটিয়ে উবু হয়ে চট করে কাপড়কাচা পাথরটা তুলে ধরল অনি। হালকা চ্যাপটা পাথর। সামান্য ঘোলা জল সরে গেলে অনি দেখল একটা বিরাট দাড়াওয়ালা কালো কাঁকড়া, গোল গোল চোখ তুলে জলের তলায় বসে ওকে দেখল সেটা। তারপর নাচের মতো পা ফেলে ফেলে সরে যেতে লাগল সেটা নদীর ভিতরে। একগাছা চুনোমাছের বাচ্চা খলবলিয়ে চলে গেল। ছোট সাদা পাথরের ফাক দিয়ে লম্বা শুড়ওয়ালা একটা লাল চিংড়িকে দেখতে পেল অনি। হঠাৎ মাথার ওপর থেকে পাথরের ছাদটা উঠে যেতে বেচারা বুঝতে পারছিল না কী করবে। বাঁ হাতে পাথরটাকে দাঁড় করিয়ে রেখে ডান হাতে খপ করে ধরে ফেলল ও মাছটাকে। পাথরটাকে নামিয়ে দিয়ে আবার উঠে বসল তার ওপর। হাতের মুঠোয় চিংড়িটা ছটফট করছে। পেটের তলায় অজস্র পায়ের মতো শুড়গুলো নাচাচ্ছে এখন। নাকের কাছে নিয়ে এল অনি, চমৎকার জলের গন্ধ। কী ভীষণ কষ্ট হচ্ছে বুকের মধ্যে, এই চিড়িটাকে আর কোনোদিন সে দেখতে পাবে না। হাতের মুঠোটাকে জলের মধ্যে রান নি। আঙুলের ফাক গলে জল ঢুকছে। চিড়িটা মোচড় দিয়ে খুব। হাত ওপরে তুলতেই জল বেরিয়ে যেতেই চিংড়িটা লাফ দিল হঠাৎ। আর সেই সময় গলার শব্দ পেল ও। চোখ তুলে তাকাতেই নি দেখল ওপারে জঙ্গলের রাস্তা দিয়ে টুকরি-কাঁধে দুটো মদেসিয়া মেয়ে ঘাটে আসছে। ফ্যামির বোধহয় ছুটি হল। মেয়ে দুটো মা-মেয়েও হতে পারে। তপূপিসির মতো ছোটটার বয়স। টুকরিটা পাড়ে রেখে ওরা চট করে ঠাণ্ডা জলে নেমে পড়ল। জল ছিটিয়ে মুখ ভেজাল। তারপর উঠে দাঁড়িয়ে অনিকে দেখল। ছোট মেয়েটাকে বড়কে আঙুল দিয়ে অনিকে দেখাল, বুড়ো বাবাকে লাথি।

বড়জন বিরাট খোপাসমেত মাথাটা ঘুরিয়ে অনিকে দেখে হাসল, কর-লে, ও ছোউয়া গো নাই হলেক। অনি বুঝল, ওর গোঁফ হয়নি এখনও, বাচ্চা ছেলে। বড়টা ছোটকে কিছু করে নিতে বলছে। কথাটা শুনে ছোটটা পেছন ফিরে কাপড় আভরা গুটিয়ে জলের মধ্যে প্রায় হাঁটু ভেঙে বসে পড়ল। এই প্রাকৃতিক শব্দ, যার সঙ্গে এই নির্জন আরাভাসা নদীর কোনো সম্পর্ক নেই, কানে যেতেই অনি ঘুরে দাঁড়াল আর তারপর কোনোদিকে না তাকিয়ে অন্ধকার নেমে-যাওয়া মাঠের মধ্যে দিয়ে প্রাণপণে ছুটতে লাগল বাড়ির দিকে। পেছনে হঠাৎ মেয়ে দুটো হেসে উঠলা খুলে, সরমাতিস রে-এ ছোউয়া-হি-হি-হি। ওদের গলার শব্দেরই কি না বোঝা গেল, একদম চুপ।
 
উঠোনে ঢুকে অনি দেখল হারিকেন জ্বালানো হয়ে গেছে। স্বৰ্গছেঁড়া চা-বাগানে এখনও ইলেকট্রিক আসেনি। শুধু ফ্যাক্টরিতে ডায়নামো চালিয়ে বাতি জ্বালানো হয়। মহীতোষ বাড়ির পেছনে সম্প্রতি একটা ছোট টিনের চালাঘর করেছেন। বড় শৌখিন মানুষ মহীতোষ, কলকাতা থেকে ডায়নামো আনার ব্যবস্থা করেছেন। এখন যে-কোনো দিনই সেটা এসে যেতে পারে। অয়ারিং হয়নি, এমনি তার ঝুলিয়ে ঘরে-ঘরে বাতি জ্বালাবার ব্যবস্থা পাকা। এই রাত্তিবেলায় তালগাছের মাথায় জমে থাকা অন্ধকার, কাঠালগাছের ডালে-ডালে যে অদ্ভুত রহস্যের ভূতটা দলা পাকিয়ে বসে থাকে-অনির ভীষণ ইচ্ছে করে ইলেকট্রিক জ্বললে সেগুলোকে কেমন দেখবে। মহীতোষ ডায়নামো বসালে এটাই হবে এই তল্লাটের প্রথম ইলেকট্রিক আসেনি। কিন্তু মুশকিল হল, কবে আসবে ডায়নামোটা? ওরা চলে বাবার পর এলে অনির কী লাভ হবে! বাবা কেন কলকাতায় তাগাদা দিয়ে চিঠি লিখছে না! এই তো কিছুদিন আগে ওদের বাড়িতে প্রথম রেডিও এল। ওদের বাড়ি মানে স্বৰ্গছেঁড়ায় প্রথম রেডিও এল। মহীতোষ নিজে দুটিতে গিয়েছিলেন কলকাতায় বেড়াতে। ফেরার সময় বড়সড় রেডিও সেটটা কিনে নিয়ে এলেন। শুধু রেডিও সেট নয়, সঙ্গে একটা আলাদা স্পিকার। বাইরের ঘরে রেডিও বাজত, সেই রেডিও শুনতে ভিড় করে আসতেন বাবুরা। মহীতোষ ওর সঙ্গে একটা তার জুড়ে শিকারটাকে টেনে নিয়ে গিয়েছিলেন পঞ্চাশ গজ দূরে-আসাম রোডের কাছে। বড় কৃষ্ণচূড়া গাছের ডালে বেঁধে স্পিকারটা ঝুলিয়ে দিয়েছিলেন। আর রাস্তা জুড়ে বসে যত মদেসিয়া কুলিকামিন ভিড় করে শুনত, অল ইণ্ডিয়া রেডিও, কলকাতা।

রেডিও আসার পর বাড়িটার চেহারাই যেন বদলে গেল । সরিৎশেখর সকাল-বিকেল রেডিওর পাশে বসে থাকেন একগাদা বুড়ো নিয়ে, খবর শুনবেন। ছোট কাকু আধুনিক গান শুনবে চুপিচুপি, কেউ না থাকলে।রাত্তিরবেলা নাটক হলে স্পিকারটা ভিতরবাড়িতে চালান করে দিয়ে মহীতোষ উচ্চঘামে রেডিও বাজিয়ে দেন। সেদিন সন্ধের মধ্যে রান্না শেষ করার তাড়া দেখা দেয় মা-পিসিদের মধ্যে আটটা বাজলেই সব হাত-পা গুটিয়ে বাবু হয়ে ভিতরের বারান্দায় সতরঞ্জি পেতে বসেন নাটক শুনতে। তখন বলা নিষেধ-অনি নাটক শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পড়ে এক-একদিন। এখন অবশ্য শুধু এ-বাড়ি নয়-নাটক শুনতে আশেপাশের সব কোয়ার্টারের মেয়েরা সন্ধের মধ্যে চলে আসে অনিদের বাড়ি। একটা সতরঞ্জিতে আর কুলোয় না এখন। সঙ্গের বাচ্চা র একজোট করে মা বলেন, অনি, যাও, এদের সঙ্গে খেলা কর। বিচ্ছিরি লাগে তখন। বরং বাই র ঘুটঘুটি অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে চুপচাপ বসে নাটক শুনতে শুনতে, রেডিও ফাটিয়ে একটা গল যখন চিৎকার করে কাঁদে-আমার সাজানো বাগান শুকিয়ে গেল তখন বুকের মধ্যে কেমন করে ওঠে। মাকে আচলে চোখ মুছতে দেখে নিজেরই কান্না পেয়ে যায়।

এখন বাইরের ঘরে রেডিও বাজছে না। সরিৎশেখর বা মহীতোষ ফেরেননি এখনও তুলসীগাছের নিচে প্রদীপ জ্বালা হয়ে গিয়েছে। ভিতরের বারান্দায় উঠতেই মা বললেন, হ্যাঁরে–কোথায় ছিলি এতক্ষণ? অনি কোনো কথা বলল না। দৌড়ে আসার জন্য ওর ফরসা মুখ লাল-লাল দেখাচ্ছিল। রান্নাঘরে যেতে যেতে আমায় আবার বললেন, খিদে পেয়েছে। অনি ঘাড় নাড়ল, তারপর বাইরে চলে এল। বাইরের ঘরে বিরাট হারিকেন জ্বেলে দেওয়া হয়েছে। সামনে পাতাবাহার গাছের পাশে ওযেক্লাবঘর, তার দরজা খুলে ঝাটফাট দিয়ে ঝাড়িকাকু হ্যাজাক জ্বালাচ্ছে উবু হয়ে বসে। ওপাশে অন্ধকারে ডুবে-থাকা আসাম রোড দিয়ে হুশহুশ করে একটার পর একটা গাড়ি ঝুলিয়ে দিল ঝাড়িকাকু সঙ্গে সঙ্গে সমস্ত চত্বরটা দিনের মতো পরিষ্কার হয়ে গেল। হ্যাজাকের তলায় ঝাড়িকাকুকে কেমন বেঁটে লাগছে। হাঁটু অবধি ঢালা হাফপ্যান্ট আর ফতুয়া গায়ে দিয়ে মুখ উঁচু করে ঝাড়িকাকু হ্যাজাকটা দেখছে।

ঠিক এই সময় অনি সাইকেলের ঘন্টিগুলো শুনতে পেল। চা-বাগানের ভিতর দিয়ে সাদা নুড়ি-বিছানো যে-রাস্তাটা ফ্যাক্টরির মুখে গিয়ে পড়েছে, সাইকেলগুলো সেই রাস্তা দিয়ে আসছিল। অন্ধকার হয়ে-যাওয়া চরাচরে এখন সবে জ্বলে ওঠা-তারার আলো একটা আবছা ফিকে ভাব এনেছে, যার জন্য এতদূরে ওদের বারান্দায় দাড়িয়েও অনি-চা-গাছগুলোর মধ্যে মধ্যে বসানো শেডট্রিগুলোকে বুঝতে পারল। দশ-বারোটা সাইকেলের পরপর আসছে ঘন্টি বাজাতে বাজাতে মাঝে-মাঝে টর্চ জ্বেলে রাস্তা দেখে নিচ্ছে ওরা। প্রায় দেড় মাইল লম্বা এই রাস্তার দুধারে ঘন চা-গাছ আর শেডট্রি । সন্ধের পর একা বরং একা কেউ যায় না।
 
ভোর ছটার বেজে গেলে বাবুরা দল বেঁধে সাইকেলে চেপে বাড়ি ফেরেন। এখন একটু একটু হাওয়া দিচ্ছে। সামনে মাঠে একা দাড়িয়ে-থাকা লম্বাটে কাঠালিচাপা গাছে একদল ঝিঝি করাত চালানোর মতো শব্দ করে যাচ্ছে। সাইকেলের ঘটিগুলো আরও জোর হল। তারপর একসময় ওরা মোড় ঘুরে চা-বাগানের গেট পেরোতেই অনি ওদের দেখতে পেল। পরপর সাজানো কোয়ার্টারের সামনে পড়ে-থাকা বিরাট মাঠের মধ্যে ঢুকে সাইকেলগুলো এবার আলাদা হয়ে যাচ্ছে। এক-একটা টর্চের আলো ধারালো তলোয়ারের মতো লম্বা হয়ে এক-একটা কোয়ার্টারের দিকে চলে যাচ্ছে। শেষ পর্যন্ত বাবাকে দেখতে পেল অনি। আবছা আবছা বাবার জামা-প্যান্ট দেখা যাচ্ছে। সাইকেলের গতি কমিয়ে টর্চের আলো নিবিয়ে দিলেন মহীতোষ। তারপর বাড়ির সামনে লম্বা বেঞ্চিতে সাইকেলটাকে খাড়া করে বারান্দায় উঠে এলেন। বছর বত্রিশের যুবক মহীতোষ প্যান্ট পরেন, ফুলপ্যান্ট। এই চাবাগানের কেউ তা পরে না। হাঁটু অবধি মোজা গার্টারে বাঁধা, খাকি হাফপ্যান্ট আর হাফহাতা বুশশার্ট-এই হল এখানকার বাবুদের পোশাক। পাতিবাবু মশাবাবু-যাদের কাজ রোদুরে ঘুরে ঘুরে, তারা অবশ্য মাথায় একটা সোলার হ্যাট ঝুলেন।-কিন্তু মহীতোষ এই বয়সে হাফপ্যান্ট পরতে রাজি নন। ফুলপ্যান্টের পায়ের কাছটা ক্লিপ দিয়ে গুটিয়ে রাখেন সাইকেল চড়ার সময়। সারামুখে নিটোল করে দাড়িগোঁফ কামানো মহীতোষের মাথার চুল নিগ্রোদের মতন কোঁকড়া। হাসতে গেলে গজদাঁত দেখা যায়। বারান্দায় উঠে মহীতোয ছেলেকে দেখে বললেন, আজ রাত্রে নদী বন্ধ হবে, বুঝলি! বলে

অনির মাথায় হাত বুলিয়ে ভিতরে চলে গেলেন।

হাঁ করে তাকিয়ে থাকল অনি। নদী বন্ধ হবে মানে আঙরাভাসা আজ বন্ধ করে দেওয়া হবে। এর আগে গত বছর, তখন অনি অনেক ছোট ছিল, আঙরাভাসাকে বন্ধ করা হয়েছিল। সেটা হয়েছিল শেষরাতে। অনিরা সবাই ঘুমিয়ে ছিল। শুধু পরদিন সকালে ঝাড়িকাকু এক ড্রাম ভতি চিংড়ি আর কাঁকড়া এনে দেখিয়ে যখন বলল যে নদী বন্ধ হয়ে গিয়েছিল বলে ওগুলো ধরা গে. তখন একদৌড়ে আঙরাভাসার কাছে গিয়ে দাঁড়িয়ে ভীষণ আফসোস হয়েছিল অনির। খটখট করছে নদী, কোথাও এক ফোঁটা জল নেই। ভিজে শ্যাওলা আর নুড়িপাথরের ওপর কয়েকটা কুকুর কী শুকছিল। পায়ে পায়ে নদীর ঠিক মধ্যিখানে দাঁড়িয়ে ছিল অনি। চারদিকে শুকনো পাথর, ছবিতে দেখা কঙ্কালের মতো লাগছিল নদীটাকে। এমন সময় পায়ের তলায় কী সুড়সুড় করতে অনি দেখল একটা ছোট্ট লাল কাঁকড়া গর্ত থেকে মুখ বের করছে। অনিকে দেখেই সেটা সুড়ৎ করে ভিতরে ঢুকে গেল। এখানে-ওখানে কিছু চুনোমাছ, গেঁড়ি শুকিয়ে পড়ে আছে। অনির খুব আফসোস হচ্ছিল তখন, যদি সে দেখতে পেত হঠাৎ জল শেষ হয়ে যাওয়াটা! মাছগুলো তখন কী করছিল। তারপর আবার রাত্তির হলে জল ছাড়া হয়েছিল নদীতে। সেটাও অনি দেখতে পায়নি। পরদিন সকালে গিয়ে দেখল ঠিক আগের মতো যে-কে সে-ই। কুলকুল করে স্রোত বইছে। ওধু কাপড়কাচার পাথরের নিচে কোনো মাছ ছিল না এই যা। বছরে একবার এইরকম হয়। শ্মশানের কালীবাড়ির পাশ দিয়ে বয়ে-আসা আঙরাভাসা নদীটাকে ওয়োরকটা মাঠের পাশে দুভাগ করে দেওয়া হয়েছে। এক ভাগ গেছে নিচেধানের জমির গা দিয়ে দুনম্বর কুলিলাইনের পাড় ঘেঁষে ডুডুয়া নদীতে। আর অন্য বাঁকটার মুখে সিমেন্টের বাঁধমতো করে তার তলা দিয়ে জল আনা হয়েছে ফ্যাক্টরিতে। স্রোতটা এদিকেই বেশি। ফ্যাক্টরির সেই বিরাট হইলটায় যখন আবর্জনা জমে জমে পাহাড় হয়ে যায় তখন বাঁধের মুখটা বন্ধ করে দেওয়া হয়। জল তখন ওপাশে চলে যায়-এদিকটা খটখটে। ফ্যাক্টরিতে তখন হইল পরিষ্কার করবার কাজ চলে। আজ আবার নদী বন্ধ হবে। কখন? উত্তেজনায় পায়ের তলা শিরশির করে উঠল অনির। আজ দেখতেই হবে। অনি ঘুরে দাঁড়াতে গিয়ে আর-একটা টর্চের আলো দেখতে পেল। মহীতোষ বাড়িতে এসে রেডিও চালিয়ে দিয়েছেন। কী একটা আসর হচ্ছে এখন। অনি দেখল একটা টর্চের আলো লাফাতে লাফাতে এগিয়ে আসছে। এই আলোটাকে অনি চেনে। অন্ধকারে নেমে পড়ল অনি। পায়ের তলায় ভিজে-থাকা শিশির আর ঠান্ডা বাতাসে ওর শীত করছিল। এগিয়ে-আসা টর্চের দিকে ও দৌড়াতে লাগল। ক্রমশ অনি অন্ধকার কুঁড়ে এগিয়ে-আসা একটা বিরাট লম্বাচওড়া শরীর দেখতে পেল। হাঁটুর নিচ অবধি ধুতি, ঢোলা পাঞ্জাবি, হাতে লাঠি-সরিৎশেখর আসছেন। পেছনে ওঁর ব্যাগহাতে বকু সর্দার। সরিৎশেখর হাঁটতে দাঁড়িয়ে পড়লেন হঠাৎ। তারপর পাঁচ-ব্যাটারির টর্চ জ্বেলে সোজা করে ধরলেন সামনে। লম্ব আঁকশির মতো আলোটা ছুটন্তু অনিকে টেনে নিয়ে আসছিল। যেন এক লাফে দূরত্বটা অতিক্রম করে অনি দাদুর বুকের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। সঙ্গে সঙ্গে টর্চ বিনিয়ে অনিকে দুহাতে জড়িয়ে ধরে সরিৎশেখর বললেন, কী হয়েছে দাদু?

ফিসফিস গলায় বুকে মুখ রেখে অনি বলল, আজ আমি নদীর বন্ধু হাওয়া দেখব।
 
পঁয়তাল্লিশ বছর চাকুরি করার পর আর ছদিন বাদে সরিৎশেখর অবসর নেবেন। এই তো আজ বিকেলে সাহেবের সঙ্গে ওর বাংলায় বসে কথা হচ্ছিল। একটা ফাইল সই করাতে নিয়ে গিয়েছিলেন সরিৎশেখর। কাজকর্ম মিটে গেলে হে সাহেব জিজ্ঞাসা করলেন, রিটায়ার করে কী করবে ঠিক করেছ বড়বাবু? সরিৎশেখর হেসেছিলেন, দেখি। সঙ্গে সঙ্গে ওঁর মনে পড়ে গিয়েছিল বছর পাঁচেক আগেকার কথা। এই চেয়ারে বসে ম্যাকফার্সন সাহেবকে সেদিন এই প্রশ্ন করেছিলেন সরিৎশেখর। প্রায় বাইশ বছর একসঙ্গে কাজ করেছিলেন ওঁরা। ম্যাকফার্সনের ছেলে ডেমন্ডকে জন্মাতে দেখেছেন উনি। বিলিতি কোম্পানির এই চা-বাগানে চিরকাল স্কচ নাহেবরাই ম্যানেজারি করেছে। ম্যাকফার্সনের মতে এত বেশিদিন কেউ স্বৰ্গছেঁড়ায় থাকেননি। সরিৎশেখরের দেখা ম্যানেজারদের মধ্যে ম্যাকফার্সন সবচেয়ে মাই-ডিয়ার লোক। এই তো সেদিন অনি জন্মাতে মিসেস ম্যাকফার্সন একগাদা প্রেজেন্টশন নিয়ে ওঁর নাতির মুখ দেখে এলেন। চা-বাগানের ম্যানেজারদে যেসব নিয়মকানুন মানতে হয় সেগুলো প্রায়ই মানতেন না মিসেস ম্যাকফার্সন। বাবুদের সঙ্গে ওঁদের বেশি মেলামেশা বারণ। কেউ তা করলেই তেলিপাড়া ক্লাবে কথা উঠবে। তারপর সেটা চলে যাবে কলকাতার সদর দপ্তরে। নির্দিষ্ট ম্যানেজারের নামের পাশে লাল টেড়া পড়বে। সরিৎশেখরের প্রশ্ন শুনে ম্যাকফার্সন চটপট বলেছিলেন, রিটায়ার মানে একদম বিশ্রাম। কোনো কাজকর্ম করব না। ডেসমন্ড অস্ট্রেলিয়া থেকে লিখেছে একটা মাঝারি ফার্ম করেছে ক্যাটলের-ওটাই দুজনে দেখাশোনা করব। ছেলেকে সেই ছোটবেলায় শালীর কাছে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন সাহেব অস্ট্রেলিয়ায়। মিসেস ম্যাকফার্সন বলেছিলেন, চিঠি লিখব কিন্তু আমি-তুমি উত্তর দেবে বাবু। আই ওয়ান্ট এভরি ডিটেল। তা যাবার দুদিন আগেও বউমাকে কীসব সেলাই শিখিয়ে গিয়েছেন মিসেস ম্যাকফার্সন। আর গিয়ে অবধি প্রত্যেক মাসে একটা করে চিঠি লেখেন উনি। সবকিছু লিখতে হয় সরিৎশেখরকে। এমনকি সাহেবের বাংলোর গেটের পাশে যেবাতাবিলেবু গাছটা-সেটার কথাও। ওদিকে মেমসাহেব এখন একা। ছেলের বিয়ে দিয়েছেন। সাহেব মাছ ধরতে গিয়ে নদীতে ডুবে মারা গেছেন। এইসব ব্যাপার। বছর কুড়ি আগে তোলা মেমসাহেবের যুবতী অবস্থার একটা ছবি আছে সরিৎশেখরের কাছে। ভুড়ুয়া থেকে একটা বিরাট কালবোস মাছ ধরে উপহার দিয়েছিলেন তিনি সাহেবকে। মেমসাহেব সেই মাছটা দুহাতে সামনে ধরে ছবি তুলিয়ে সরিৎশেখরকে প্রেজেন্ট করেছিলেন। কী সুন্দর দেখতে ছিলেন মেমসাহেব–পায়ের পাতা অবধি গাউন-পরতেন তখন। সেই মাছ ধরতে গিয়েই সাহেব মারা গেলেন।

আজ বিকেলে হে সাহেব আফসোস করলেন, তুমি চলে গেলে আমি কী করে চালাব জানি না। কোম্পানি আর এক্সটেন্ড করতে চাইছে না–তোমার বয়স কত হল বাবু?

বাষট্টি। উত্তর দিয়েছিলেন সরিৎশেখর।

জানি, তোমারও ছেড়ে যেতে কষ্ট হচ্ছে, কী করা যাবে বলে। ওয়েল, তোমার জলপাইগুড়ির বাড়ি বানাতে যা যা দরকার তুমি বাগান থেকে নিয়ে যেও। হে সাহেব বলছেন।

ছেড়ে যেতে কষ্ট হচ্ছে? হ্যাঁ, তা হচ্ছে বইকী। এমন তো হয়নি যখন বড়বউ চলে গেল! ছোটবউ যাবার সময় খুব কষ্ট হয়েছিল এখন মনে পড়ে। শোক জীবনে কম পাননি তো। বড় মেয়ে বিধবা হল তেরো বছর বয়সে। এই তিন মাস আগে মেজো মেয়ে মরে গেল দুম করে বাচ্চাকাচ্চা রেখে। বড় ছেলে পরিতোষ বখাটে হয়ে কোথায় চলে গেছে-ওকে শুধরোতে পারলেন না উনি। কিন্তু এইসব দুখ পাওয়া কেমন সহ্যের মধ্যে ছিল। অন্য কাউকে টের পেতে দেননি। এমনিতেই সকলে বলে লোকটা পাষাণ! দয়ামায়া নেই একবিন্দু। ঠিক বুঝতে পারেন না নিজেকে উনি। কিন্তু চলে যাবার সময় যত এগিয়ে আসছে বুকের ভিতরটা তত ভার বোধ হচ্ছে কেন?
 
পঁয়তাল্লিশ বছর আগে উনি যখন স্বৰ্গছেঁড়া চা-বাগানে ছোটবাবুর চাকরি নিয়ে এসেছিলেন তখন আসাম রোডে সন্দে হলেই বাঘ ডাকত। সাকুল্যে দুজন বাবু ছিল এই চা-বাগানে। চা-বাগান বললে ভুল বলা হবে, তখন তো সবে চা-গাছ লাগানো হচ্ছে। তিনকড়ি মণ্ডল কুলি চালান নিয়ে আসছে রাচি থেকে। স্বৰ্গছেঁড়ার তিন রাস্তার মোড়ে চা-বিড়ি-সিগারেটের কোনো দোকান ছিল না তখন। আর আজ বেশ রমরমে চারধার। তিন তিল করে জায়গাটা শহরে শহুরে হয়ে গেল। চা-বাগানে বাবুদের সংখ্যা বেড়েছে, তাই ছুটির তো বাজলেই কেউ আর সিটে থাকতে চায় না। আজ ভীষণ বিরক্ত হয়েছেন নতুন ছোরাটার ওপর। গ্রাজুয়েট ছেলে। হে সাহেব অফিসারের ঘরে আলো জ্বলছে। কে আছে-কৌতুহল হল দেখার। নিজের ঘর থেকে বেরিয়ে সরিৎশেখর উকি দিলেন। নতুন হোকরা মনোজ হালদার মাথা ঝুকিয়ে ডিকশনারি দেখছে। ওঁকে দেখে সন্ত্রস্ত হয়ে পড়েছিল ছেলেটি।

কী ব্যাপার, এখন বাড়ি যাওনি? সরিৎশেখর জিজ্ঞাসা করেছিলেন। তো-ততা করেছিল মনোজ, এই, মানে চিঠিটা শেষ করে। হাত বাড়িয়ে বাংলায় লেখা একটা চিঠি তুলে ধরেছিলেন উনি। চিঠিটা পড়ে মাথার ভিতর দপদপ করতে লাগল। আজ দুপুরে উনি ছোকরাকে বলেছিলেন, ফয়ারউড সাপ্লাই দেয় যে-কন্ট্রাক্টর, তাকে চিঠি লিখে সাবধান করে দিতে যে ওর লোকজন ঠিকমতো সাপ্লাই দিচ্ছে না। মনোজ বাংলায় লিখেছে সেটা।

বাংলায় কেন? কোনোরকমে বললেন তিনি।

এই, ইংরেজিতে ট্রানস্লেশন করে নিচ্ছিলাম। হাসল মনোজ।

রাগে গা গরম হয়ে গেল সরিৎশেখরের। কী অবস্থা! একটা চিঠি লিখতে এদের কলম ভেঙে যায়, আবার গ্রাজুয়েট বলে ঢুকেছে! তিন মিনিটের কাজ তিন ঘন্টায় হয় না-এই হল ইয়ংম্যান! অথচ তিনি তো মাত্র ফাস্ট ক্লাস অবিধি পড়া বিদ্যা নিয়ে এসেছিলেন। বাবা মারা যেতে পরীক্ষার ফি যোগাড় করতে পারেননি। আজ অবধি তার ইংরেজির ভুল কোনো সাহেব-ম্যানেজার ধরতে পারেননি। মাত্র আট টাকা মাইনেতে ঢুকেছিলেন তিনি। এরা তো ঢুকেই আড়াইশো টাকা হাতে পায়।

আলোটা নিবিয়ে বাড়ি চলে যাও। বলে বেরিয়ে এসেছিলেন তিনি। ইচ্ছে হচ্ছিল সোজা বাংলোয় গিয়ে সাহেবকে বলে সাসপেন্ড করেন ওকে। কিন্তু অনেক কষ্টে সামলে নিয়েছিলেন নিজেকে। আর তো কটা দিন আছেন এখানে, মিছিমিছি এই ছেলেটার ভবিষ্যৎ নষ্ট করার দায়ভোগ করবেন কেন? অবশ্য ভবিষ্যৎ যা নষ্ট হবার তা তো হয়েই গেছে ওর। শুধু লোকে বলবে, বুড়োটা যাবার আগে চাকরি খেয়ে গেল। বড় বড় ঝোলা সাদা গোঁফে হাত রাখলেন উনি। কোনোকিছু অস্বাভাবিক ব্যাপার ঘটলেই উনি আশু মুখুজ্যের মতো ঠোটের দুপাশে ঝোলা গোঁফে অজান্তেই হাত বোলান।

অফিস থেকে বেরিয়ে আঙরাভাসার ওপর পাতা ছোট্ট পুল পেরিয়ে ফ্যাক্টরির সামনে এলেন উনি, পেছনে বকু সর্দার। বকু প্রায় তিরিশ বছর আগে ওঁর সঙ্গে। বকুর ছেলে এবার বিনাগুড়ির মিশনারি স্কুল থেকে পরীক্ষা দেবে। কী নেশা হয়েছিল সরিৎশেখরের, জোর করে বকুর ছেলে মাংরাকে স্কুলে ভর্তি করিয়ে দিয়েছিলেন। মিশনারিরা নাম রেখেছে জুলিয়েন। মদেসিয়া ছেলের সাহেব নামে বকু সর্দার কিন্তু আপত্তি করেনি। অবশ্য স্বৰ্গছেঁড়ায় এলে সবাই ওকে মা বলেই ডাকে। তা এই ছেলে পাশ করলে বাবুদের চাকরিতে নেবার জন্য বন্ধু ওকে সম্প্রতি ধরেছে। ব্যাপারটা অন্য কুলিসর্দাররা কেমন চোখে দেখছে তা জানেন না সরিৎশেখর। এখন অবধি এই বাগানে কোনো নেবার-ট্রাবল হয়নি কখনো-কিন্তু কু যেভাবে ছেলে ব্যাপারে কথা বলছে। ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনে তাকালেন উনি। মাথায় সাদা কাপড় পাগড়ির মতো বাধা, হাঁটুর ওপর গুটিয়ে পরা খাটো ধুতি, খালিগায়ে বন্ধু একটা লাঠির ডগায় সরিৎশেখরের ব্যাগটা বুলিয়ে কাঁধে নিয়ে হাঁটছে। সাহেবের কানে বকুর ছেলের কথা পৌছেছে। ইঙ্গিতে আকারে বোঝা যায়, জুলিয়েনের চাকরি প্রায় হয়ে গেছে বললেই হয়। কেমন অস্বস্তি হতে লাগল তার। ভাগ্যিস উনি কদিন পরেই রিটায়ার করে যাচ্ছেন। মহীতোষরা বুঝবে পরে। বাগানের বাবুদের পোষ্টে স্থানীয় ছেলে থাকলে বাইরে থেকে লোক নেওয়া চলবে না-মোটামুটি এই প্রস্তাব এতদিনে কার্যকর করেছেন সরিৎশেখর। এতে সুবিধা হল, নতুন যারা ঢেকে তাদের জন্মাতে দেখেছেন, উনি, ফলে কোনোদিন মাথা তুলে কেউ প্রতিবাদ করার সাহস পায়নি। এই প্রস্তাবটাকেই আঁকড়ে ধরেছে অন্যান্য চা-বাগানের কুলিরা তারাও তাদের ছেলেমেয়েদের আগে সুযোগ দেবার দাবি জানাচ্ছে। লাঠি দিয়ে সামনের পাথরের নুড়ি সরিয়ে সরিৎশেখর হাসলেন, স্বাধীনতা এসে যাচ্ছে। ওঁর রিটায়ার করার দিন পনেরোই আগস্ট।
 
ফ্যাক্টরির সামনে আসতেই ননু চায়ের গন্ধ পেলেন উনি। নিজে পঁয়তাল্লিশ বছর এখানে কাজ করে গেলেন, কিন্তু চায়ের অভ্যেস কখনো হল না তার। তবে এই ফ্যাক্টরির সামনে দিয়ে যেতে তার খুব ভালো লাগে। নতুন পাতার রস নিংড়ে যখন চা বাক্সবন্দি হবার চেহারা নিয়ে ফ্যাক্টরিতে লুপ হয়ে থাকে তখন হেঁটে যেতে যেতে নাক ভারী হয়ে ওঠ মিষ্টি গন্ধে। প্রচণ্ড একটা টানা আওয়াজ আসছে ফ্যাক্টরি থেকে। আঙরাভাসার জলে ফ্যাক্টরির হইলটা ঘুরছে। ডায়নামো ফিট করে ইলেকট্রিক আলে জেলে দেওয়ায় জায়গাটা কেমন ম্যাড়মেড়ে দেখাচ্ছে। ফ্যাক্টরির সামনে ডিসপেনসারি। হলুদ রঙ-করা একতলা বাড়ির সামনে আলো জ্বলছে। ডিসপেনসারির খোলা দরজা দিয়ে ডাক্তার ঘোসালকে দেখতে পেলেন উনি। একটা বাচ্চা ছেলের হাতে ব্যান্ডেজ বেঁধে দিচ্ছেন। মাথা-ভরতি পাকা চুল এই লোকটির ডাক্তারি ডিগ্রি থাকুক বা না-থাকুক, ওঁর দিনরাত খেটে যাবার ক্ষমতাকে শ্রদ্ধা করেন সরিৎশেখর।

বাড়ি যাবে নাকি হে ডাক্তার? গলাখাকারি দিলেন উনি।

চকিতে মুখটা ঘুরিয়ে ডাক্তার ঘোষাল বাইরের দিকে তাকালেন, তারপর দুটো হাত জোড় করে কপালে ঠেকালেন, নমস্কার, স্যার।

কী হে, উঠবে?

এই হয়ে এল, আপনি এগোন, আমি আসছি। ডাক্তার হাসলেন।

পা বাড়ালেন সরিৎশেখর, কিন্তু এগানো হলো না তার। ডিসপেনসারির পাশের অন্ধকারে ঘাপটি মেরে কোথায় বসেছিল, ছিলা-ছাড়া তীরের মতো ছিটকে এসে পড়ল সরিৎশেখরের পায়ে। এসে দুহাতে পায়ের পাতা জড়িয়ে ধরে ঢুকরে উঠল, তুই কিনো চলি যাবি রে-এ-এ।

হাহা করে উঠলেন সরিৎশেখর, কিন্তু ছাড়াতে পারলেন না। দুহাতে শক্ত করে ওর হাঁটু জড়িয়ে ধরেছে, মাথাটা ঠুকছে এক-একবার। লাঠিতে ভর রেখে নিজেকে সামলালেন একবার। তারপর অসহায় চোখে পেছনে দাঁড়ানো বকুর দিকে তাকালেন। হলদে দাঁত বের করে বন্ধু হাসল। তারপর মাথা দোলাল।

এই ওঠ, ওঠ বলছি! হেঁকে ওঠেন সরিৎশখর।

তু কাঁহা যাহাতিস রে-এ-এ-এ। মুখ তুলল কামিনটা। একমুখ ভাঙাচোরা খো, মাথায় কাঁচাপাকা প্রায় নুড়ি-হয়ে-আসা চুল, খালিগায়ে কোনোরকমে জড়ানো শাড়ি কুচকুচে কালো কামিনটার তেঁতুলের খোসার মতো আঙুল সরিৎশেখরের পায়ে চেপে বসেছিল। শেষ পর্যন্ত বকু সর্দার এগিয়ে এসে মেয়েটাকে ছাড়িয়ে নিল। সরিৎশেখর দেখলেন, কোনোরকমে উঠে দাড়াল ও, দাড়িয়ে টলতে লাগল। চিনতে পারলেন এবার, তিন নম্বর কুলি-লাইনের এককালের সাড়াজাগানো কামিন সেরা। হাড়িয়া টেনেছে খুব। মদেসিয়া মেয়ের নাম সেরা বিশ্বাস করতে পারেননি উনি তিরিশ বছর আগে। হপ্তা নিতে এসেছিলে এক শনিবার। টিপসই নিয়ে টাকা দিচ্ছিল ক্যাশিয়ার ব্রজেনবাবু অফিসের বারান্দায় বসে। আগের শনিবার পেমেন্টের একটা গোলমাল হয়েছিল বলে সরিৎশেখর সামনে দাড়িয়ে ছিলেন। মাথায় ফুলগোজা আঁটোসাটো শরীরের লম্বা এই মেয়েটাকে চোখে পড়েছিল ভিড়ের মধ্যে। ডুরে শাড়ি, লাল ব্লাউজ, আর শাড়ির ওপর হাঁটু অবধি নামা আঙরা-জড়ানো শরীরটা নিয়ে রঙচঙ করছিল মেয়েটা। অন্য সবাই যখন সরিৎশেখরকে দেখে চুপচাপ টাকা নিয়ে যাচ্ছিল তখন এই মেয়েটা চোখ ঘুরিয়ে তিন-চারবার দাঁত দিয়ে ঠোঁট কামড়েছিল ওর দিকে তাকিয়ে। ব্ৰজেনবাবু যখন নাম, ডাকলেন তখন বুঝতে পারেননি সরিৎশেখর প্রথমটায়। মেয়েটা যখন তিন দুলিয়ে শালিকপাখির মতো হেঁটে এল, তখন বুঝতে পারেননি সরিৎশেখর ব্রজেনবাবুকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, কী নাম বললেন?
 
সঙ্গে সঙ্গে কপট শব্দ করেছিল গলায় মেয়েটা, হাত নেড়ে ব্ৰজেনবাবুকে নাম বলতে নিষেধ করেছিল। তারপর আচমকা হেসে উঠে বলেছিল, সেরা-সেরা ওঁয়াও। ফাস্টো কেলাস।

এখন কী বলবেন এই মাতালপ্রায় বুড়ি-হয়ে-যাওয়া সেরাকে। দুটো পায়ে শরীরের ভর ঠিক রাখতে পারছে না। টলতে টলতে বাঁ হাত ঘুরিয়ে সেরা কী বলতে চেষ্টা করল আর একবার। তারপর হঠাৎ থমকে দাঁড়িয়ে যেন এই প্রথম বকু সর্দারকে দেখতে পেল। সঙ্গে সঙ্গে ঠোঁট বেঁকিয়ে মুখ-ভরতি থুতু মাটিতে ছিটকে ছিটকে ফেলল সেরা। সরিৎশেখর বুঝলেন, ও এখন হঠাৎ রেগে গেচে। বোধহয় এখন সরিৎশেখর ওর মাথায় নেই। রেগে যাওয়ায় সেরার জরাজীর্ণ মুখ-চোখ আরও কদাকার দেখাচ্ছে। কিন্তু হঠাৎ সেই দৃশ্যটা চোখের মধ্যে চমকে উঠল তার। বকু সর্দার হয়নি। অফিসে পিয়নের চাকরি করে বলে অন্য কুলিদের থেকে মর্যাদা বেশি এই যা। সেরা সম্পর্কে তখন অনেক গল্প জেনে গেছেন। দুএকজন অ্যাসিস্টেন্ট ম্যানেজারের বাংলোয় রাতে ওকে দেখা গেছে; যারা একটু লাজুক তারা, সন্ধের পর অন্ধকারে রাস্তায় দাঁড়ানো সেরাকে জিপে তুলে নিয়ে খুঁটিমারী ফরেস্টে ঘণ্টাখানেক কাটিয়ে আসে-এইসব। কিন্তু মাংরার মা যখন ওঁর কাছে কেঁদে পড়ল বাড়িতে এসে তখন ছোটবউ বলেছিল, দূর করে দাও-না মেয়েছেলেটাতে! বিশ্বাস নেই কিছু–।

কী বিশ্বাস নেই সেটা আর জিজ্ঞাসা করেননি তিনি। চা-পাতি তুলতে গিয়ে সারাদিন সেরা গাছের তলায় পা ছড়িয়ে বসে পাতিবাবুর সঙ্গে গল্প করে এ-খবর ছোটবউ-এর কানে এসেছিল। ইঙ্গিতটা যে এবার তার দিকে সেটা বুঝতে অসুবিধা হয়নি। বকুকে ধমক দিয়েছিলেন সেদিনই-কিন্তু চুপচাপ মাথা গুঁজে দাড়িয়ে ছিল মাংরার বাবা। শেষ পর্যন্ত ব্ৰজেনবাবুকে এক শনিবার বলে রেখেছিলেন, সেরা টাকা নিতে এলে যেন ওর সঙ্গে দেখা করে।

সেদিন সন্ধেবেলায় তার অফিস-ঘরে বসে তিনি অবাক হয়ে সেরাকে দেখলেন। কথাটা শুনেই নাকের পাটার পেতলের ফুলটা নেচে উঠল সেবার। কোমরে দুহাত রেখে মুখভর্তি থুতু ছড়িয়েছিল অফিস-ঘরের মেঝেতে। চিৎকার করে বলেছিল, বকুর প্রতি ওর কোনো লাভ নেই। কী জন্য থাকবে–ওটা তো মেড় য়া-না আছে টাকপয়সা, না তাগদ। তা ছাড়া কত বড় বড় রইস আদমি ওর চারপাশে ঘুরঘুর করছে, বন্ধুর মতো তেলাপোকার দিকে নজর দেবার সময় কোথায়? এই এখন, সেরার কোরের হাত রেখে দাঁড়ানো দড়ি-পাকানো চেহারাটা দেখে চট করে সেই ছবিটা মনে পড়ে গেল ওঁর। মেয়েদের এক-একটা ভঙ্গি আছে সময় যাকে কেড়ে নিতে পারে না। বিশেষ বিশেষ মুহূর্তে এবং সম্পূর্ণ নিজের অজান্তে সেগুলো তাদের শরীরে ফিরে আসে আচমকা। প্রত্যেক মেয়ের মধ্যে অভিমান এত দীর্ঘ সময় ধরে একইভাবে গোপনে গোপনে কী আশ্চর্য সততায় বেঁচে থাকে যা কোনো পুরুষমানুষ লালন করতে পারে না। কবে কোন যৌবনে বকুর প্রতি ওর যে অভিমান ঘৃণা বা অহংকারে মিলেমিশে একাকার হয়ে গিয়েছিল, এখন এতদিন পরে নেশার চুড়ান্ত মুহূর্তে সেগুলো ফিরে পেল সেরা-পেয়ে বোধহয় আজ সারারাত বুদ হয়ে থাকবে। ভরবিকেলে আচমকা ঘুম ভেঙে গেলে মনে হয় না এই সবে সকাল হয়েছে।



নিজের মনে হেসে আবার হাঁটতে লাগলেন সরিৎশেখর। পেছনে বকু সর্দার। সেরা তখনও টলছে। ওরা যে চলে যাচ্ছে সেদিকে তার খেয়াল নেই। সাদা নুড়ি-বিছানো বাগানের পথ দিয়ে ওরা হাঁটতে লাগল। ফ্যাক্টরির আলো ফুরিয়ে যেতেই টর্চ জ্বাললেন তিনি। পাঁচ-ব্যাটারির জোরালো আলো। ঘুটঘুটে অন্ধকার চমকে চমকে সামনের পথটা পরিষ্কার করে দিচ্ছে। দুপাশে ছোট শুকনো নালার ধারে থরে থরে চা-গাছ। রাস্তাটার বাকে দাড়িয়ে পেছনে তাকালেন উনি। দূরে ঝিম হয়ে থাকা ফ্যাক্টরির হলদে-মেরে-যাওয়া আলোয় ডিসপেনসারি-বাড়িটা আনাড়ি হাতের তোলা ছবির মতো মনে হচ্ছে। আর তার সামনে একা রোগাটে শাড়ি জড়ানো শরীর একই জায়গায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে টলছে। সরিৎশেখর লক্ষ করলেন, বকু পেছন ফিরে দেখল না। মাথা নিচু করে পেছন পেছন আসছে তাঁর। দুপাশের চা-গাছের মধ্যে দিয়ে চলে-যাওয়া অন্ধকার রাস্তায় টর্চ জ্বেলে যেতে-যেতে সরিৎশেখর লক্ষ করলেন, বকু পেছন ফিরে দেখল না। মাথা নিচু করে যেতে-যেতে সরিৎশেখর হঠাৎ এক অদ্ভুত ঘ্রাণ পেলেন। ছোটবউ কবে চলে গেছে। তখন তো তার মধ্যযৌবন। এই এতদিন ধরে তিনি কী ভীষণ একা! আর আশ্চর্য, কথাটা এমন করে কই কখনো মনে পড়েনি তাঁর। এই স্বৰ্গছেঁড়া চা-বাগানে তার শিকড়গুলো কত গভীরে নেমে গেছে-নিজের কথা মনে পড়ার সুযোগই দেয়নি। এখন ছেলেরা বড় হয়ে গিয়েছে। দুটো সরল কথা বলার মতো সম্পর্ক নেই আর। বড় মেয়ে বিধবা হয়ে তার কাছেই আছে। ওঁর দেখাশুনা সেই করে। কিন্তু তাকেও তো সহজ হয়ে কিছু বলতে পারেন না তিনি। এই বয়সে নিজের চারদিকে এত রকমের দেওয়াল নিজেই খাড়া করে রেখেছেন দিনদিন-আজ বর কষ্ট হল সরিৎশেখরের। ভারী পা টেনে টেনে চা-বাগানের রাস্তা ছেড়ে কোয়ার্টারের সামনে মাঠে এলেন উনি। টর্চের আলো ফেলতে ফেলতে হঠাৎ চেয়ে দেখলেন, এটা ছোট্ট শরীর সারা গায়ে তার টর্চের আলো মেখে দুর্গাঠাকুরের পায়ে ছুঁড়ে দেওয়া অঞ্জলির মতো ছুটে আসছে। হঠাৎ আলো নিবিয়ে ফেললেন এবার। এই ঘন অন্ধকারে দাড়িয়ে তার শরীরে লক্ষ কদম ফুটে আসছে। হঠাৎ আলো নিবিয়ে ফেললেন তার শীত বোধ হল যেন। দুহাত বাড়িয়ে নিজের বিশাল দেহে নরম শরীরটাকে প্রায় লুফে নিয়ে কী গাঢ় মমতায় তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, কী হয়েছে দাদু?

এখন তাঁর চারপাশে কোনো দেওয়াল নেই। আকাশ হাতের কাছে, বুকের ওপরে।
 
ক্লাবঘরে মাঝে-মাঝে শোরগোল উঠছে। পটাপট তাস ফেলার শব্দ, এর ওর ভুল বুঝিয়ে দেবার চেষ্টায় কান পাতা দায় ওখানে। যাজাকে পূর্ণ আলো দরজা-জানালা দিয়ে ঠিকরে পড়েছে বাইরের অন্ধকারে। মহীতোষ ওখানে আছেন। তাস-পাগল লোক। ব্রিজ টুর্নামেন্টে আশেপাশের চা-বাগান থেকে অনেক ট্রফি জিতে এনেছেন মালবাবুকে পার্টনার করে। সরিৎশেখরের যৌবনকালে কোনো ক্লাবঘর ছিল না স্বৰ্গছেঁড়ায়। মহীতোষরা খালি-পড়ে-থাকা খড়ের ছাদ দেওয়া ঘরটাকে ক্লাবঘর বানিয়ে নিয়েছেন মেরামত করে। অবশ্য স্বৰ্গছেঁড়া বাজারে এখন বিরাট ক্লাবঘর হয়েছে। টিম্বার মার্টেন্টস আর কন্ট্রাক্টররা এসে আঁকিয়ে বসেছে চা-বাগানের পাশে স্বৰ্গছেঁড়া বাজারে। ওটা খাসমহলের এলাকা। মাঝে-মাঝে মহীতোষরা ঐ ক্লাবে তাস খেলতে যান। শুধু ব্রিজ নয়, পয়সা বাজি রেখে রামি, এমনকি কালীপূজার রাত্রে তিনতাস খেলাও হয়ে থাকে ওখানে। সরিৎশেখর ব্যাপারটা একদম পছন্দ করেন না। ফলে মাঝে-মাঝে ইচ্ছে হলেও রামি বা তিনতাস নিজেদের ক্লাবে খেলেন না মহীতোষরা।

অনি বারান্দায় দাঁড়িয়ে ক্লাবঘরের দিকে একবার তাকাল। বাবার গলা শোনা যাচ্ছে, মালবাবুকে কল ভুল দেবার জন্য বকছেন। এখন যদি অনিকে দেখতে পান, চিৎকার করে উঠবেন, কী চাই এখানে-যাও! অথচ মহীতোযকে বলার দরকার ছিল। সরিৎশেখর অনুমতি দিয়েছেন শুনে মা বলেছেন, বেশ যাও, বাবাকে বলে যেও। আনন্দে লাফিয়ে উঠতে ইচ্ছে করেছিল কিন্তু বাবাকে বলার ব্যাপারটা ভালো লাগেনি অনির। ক্লাবঘরে যাওয়া নিষেধ ওর। ও আবার ভিতরের ঘরে ফিরে এল। এটা সরিৎশেখরের ঘর। একপাশে খাটে বিছানা সাজানো। লম্বা ইজিচেয়ারে উনি বসে আছে। বিরাট পেটমোটা হারিকেনটা একটা স্ট্যান্ডের ওপর জ্বলছে। সামনে-রাখা টিপয়ের ওপর একটা দাবার বোর্ড।কালো গুটি খুব পছন্দ সরিৎশেখরের। বা হাতের তালুতে মুখ রেখে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছেন বোর্ডের দিকে। হঠাৎ দেখলে মনে হবে খেলা চলতে চলতে ওর প্রতিদ্বন্দী একটু উঠে গেছে। কিন্তু অনি জানে এটা দাদুর অভ্যেস। এই একা একা দাবা খেলা। হোটবাবু মারা যাবার পর থেকে দাদু একাই দাবা খেলেন। আগে ফিস থেকে ফিরে হাতমুখ ধুয়ে ছোটবাবু চলে আসতেন এখানে। জখাবার খেতে দাদুর সঙ্গে। তারপর দাবাখেলার বোর্ড পাতা হত। প্রায় দাদুর বয়সি মানুষ মাথা জুড়ে টাক, সন্ধের পর আর বাঁধানো দাঁত পরতেন না বলে মুখটা বিশ্রী দেখাত। দাদুর সঙ্গে অনেকদিন এই চা-বাগানে কাটিয়েছিলেন উনি। বলতে গেলে দাদুর বন্ধু বলতে উনিই ছিলেন। খেলতে খেলতে কাশি হত ওর, আর চট করে উঠে-আসা কফ গিলে ফেলে দাদুর দিকে অপরাধীর ভঙ্গিতে তাকাতেন ছোটবাবু। সঙ্গে সঙ্গে ঝের্ড থেকে হাত সরিয়ে নিয়ে মাথা নাড়তেন সরিৎশেখর, নিজেই নিজের মৃত্যু ডাকছ হে, আমার , শুধু সন্ধের পর এই খেলাটা বন্ধ হবে এই যা। যেদিন ছোৰু মারা গেলেন অনির মনে পড়েছিল ঐ কফগেলার কথাটা। নিশ্চয়ই কক্ষগুলো জমে জমে ছোটবাবুর পেটটা ভরতি হয়ে গিয়েছিল। সেদিন চা-বাগানের লোকজন ছোটবার বাড়িতে ভেঙে পড়েছিল। অনেকদিনের মানুষ। কিন্তু সরিৎশেখর যাননি। অনিদের বাড়িতে নিয়ে এসেছিলেন হোটবাবুকে কাঁধে করে মহীতোষরা। মা ঘোমটা টেনে এসে বলেছিলেন, উনি তো নেই। তারপর সন্ধে পেয়ে গেলে ছোটবাবুকে নিয়ে ওরা অনেকক্ষণ চলে যাবার পর চোরের মতো বাড়ি ফিরেছিলেন সরিৎশেখর। এক হাতে অনিকে জড়িয়ে ধরে দাবার বোর্ড পাততে পাততে সেই সবে রাত-হওয়া হারিকেনের আলোয় ফিসফিস করে বলেছিলেন, ব্যাটা চলে গেল। বুঝলে!

তুমি এলে না কেন? অনি জিজ্ঞাসা করেছিল।

মাথা-খারাপ! যদি ডাক দেয়, বলে চলো, বিশ্বাস আছে কিছু! গুটি সাজাতে সাজাতে বলরেন সরিৎশেখর। আর হঠাৎ সমস্ত শরীরে কাঁটা দিয়ে উঠেছিল অনির। ঝাড়িকাকু বলেছিল, মানুষ মরে গেলে ভূত হয়।
 

Users who are viewing this thread

Back
Top