What's new
Nirjonmela Desi Forum

Talk about the things that matter to you! Wanting to join the rest of our members? Feel free to sign up today and gain full access!

Collected তেরো পার্বন -সমরেশ মজুমদার (3 Viewers)

Kaptan Jacksparoow

Community Team
Elite Leader
Joined
Apr 6, 2019
Threads
325
Messages
5,984
Credits
44,713
T-Shirt
Profile Music
Recipe sushi
Rocket
Euro Banknote
Butterfly
তেরো পার্বন
লেখক - সমরেশ মজুমদার


images-2.jpeg
 
দিল্লিতে প্যান অ্যাম নেমেছিল মাঝরাত্রে। সারাটা রাত চেয়ারে বসে কাটিয়ে দশটার ফ্লাইট ধরতে হয়েছে গৌরবকে। ইন্ডিয়ান এয়ারলাইন্সের প্লেনে বসে তার ক্লান্তিটুকু চলে গেল। আর কিছুক্ষণ মাত্র, তার পরেই কলকাতার মাটিতে পা রাখবে। এই তিরিশ ঘন্টার পাড়ি কোনো সমস্যাই নয় এখন। বারো বছর পর সে দেশে ফিরছে। এক যুগ।

গৌরব জানলা দিয়ে বাইরে তাকাল। নিচে মেঘ। পৃথিবীর সব আকাশের চেহারাই তো এক। কিন্তু এই মেঘগুলোকেও কেমন চেনা চেনা মনে হচ্ছে। দীর্ঘ পথে যা শোনেনি, এয়ারলাইন্সের এই প্লেনে ওঠার পর বাংলা শব্দ অনর্গল শুনছে। আসলে শব্দগুলোই মেঘগুলোকে পরিচিত চেহারা দিচ্ছে। বারোটা বছর কি দ্রুত কেটে গেল। একটা শক্ত প্রতিজ্ঞা ছিল তার। যতদিন না আর পাঁচজনের চেয়ে মাথাটা উঁচুতে না উঠবে তদ্দিন দেশে ফিরবে না। তাকে অবশ্যই প্রয়োজনীয় মানুষ হতে হবে। কাজের ক্ষেত্রে তার বিকল্প খুঁজতে হিমশিম খেতে হবে। সেই জায়গায় পৌঁছেছে আজ। প্রেসিডেন্সি থেকে ফার্স্ট ক্লাস পেয়ে বারো বছর দাঁতে দাঁত চেপে ন্যুয়র্কে পড়ে থেকে একটা জায়গা দখল করার পর কলকাতায় ফিরছে সে। উত্তেজনাটা শুরু হয়েছে ন্যুয়র্ক থেকেই। দিল্লি থেকে দমদমের যাত্রা শুরু করার পর সেটা তুঙ্গে উঠল।

একটু আগেই এয়ারহোস্টেস সিগারেট নিবোতে এবং সিটবেল্ট বাঁধতে বলেছে। সিগারেট খায় গৌরব। আমেরিকায় ওই নেশাটি এখন প্রায় অচল হতে চলেছে। কুইন্সের যে পাড়ায় গৌরব থাকে সেখানে দোকান নেই। কিনতে হলে কোনো পেট্রলপাম্পে যেতে হবে। তাছাড়া বেশিরভাগ বাড়ির বাচ্চারাই সিগারেট খেতে দেখলে চেঁচামেচি করে। ফলে ওই নেশাটা করা হয়ে উঠল না তার। সেইসঙ্গে মদ্যপানও। কারণ তাকে গাড়ি চালাতে হয়। রোজ সত্তর মাইল যাওয়া আসা করতে হয়। মদ খেয়ে গাড়ি চালানো শাস্তিযোগ্য অপরাধ ওখানে। তাছাড়া বস্তুটা গৌরবকে আদৌ টানে না।

বারো বছর কলকাতার সঙ্গে নিবিড় যোগাযোগ রাখতে চেয়েছে। প্রতি মাসে সে বাড়িতে চিঠি লিখেছে। এবং ধাপে ধাপে দাদার উন্নতির খবর জেনেছে। মায়ের চিঠিতে টুকিটাকি খবর পাওয়া যেত। কিন্তু গত তিন মাস কোনো চিঠিপত্র নেই। না মায়ের না দাদার। এমন কি সে যে অ্যাদ্দিন বাদে কলকাতায় ফিরছে এই খবরটার প্রতিক্রিয়াও জানা যায়নি ওদের চিঠিতে। এই সময় আর একটি মুখের আদল চোখের সামনে ভেসে এল। তিনমাস নয়, তার সঙ্গে যোগাযোগ প্রায় চার বছর ধরে নেই। কী অবস্থায় আছে সে তা বোধহয় জানে না। যার মুখ মনে পড়লে শুধু নিশ্বাস আচমকা কেঁপে ওঠে। চার বছর গৌরব তাকে চিঠি লেখেনি, সেও না। হুহু করে প্লেনটা নিচে নামছে। কলকাতার মাটি ছোঁয়ার মুহূর্তে যে ঝাঁকুনি তা যে কি আরামের ওই মুহূর্তে বুঝতে পারল গৌরব।

ধীরে ধীরে অন্য যাত্রীদের পিছু পিছু বাইরে আসতেই এয়ারপোর্ট বিল্ডিং নজরে এল। এই আকাশ কলকাতার। দূরে কোথাও বোধহয় মাইকে হিন্দি গান বাজছে। ওইটে ছাড়া এয়ারপোর্টের আবহাওয়ার করাচি কিংবা দিল্লির সঙ্গে কোনো ফারাক নেই। নিচে নেমে খুব ভাবপ্রবণ হয়ে যাচ্ছিল সে। হাতব্যাগটা সঙ্গে নিয়ে সে দূরের গ্যালারির দিকে তাকাল। অনেক মানুষ সেখানে দাঁড়িয়ে হাত নেড়ে যাচ্ছেন নবাগত যাত্রীদের উদ্দেশে। তার নিজের জন্যে কি কেউ এসেছে? তার দেশে ফেরার খবরটা নিশ্চয়ই জানবে না।
 
কাস্টমসের বেড়া ডিঙিয়ে প্লেনের পেট থেকে আনা মালপত্তরের পাহাড় থেকে নিজের সুটকেশ দুটো বের করে গৌরব কয়েক পা হাঁটতেই চিৎকার শুনতে পেল, হা-ই, গ্যারি। গৌরব প্রথমে বুঝতে পারেনি তারপর খানিক দূরে একজন সুন্দরী মহিলাকে হাত নাড়তে দেখে থমকে গেল। সুটকেশ দুটো নামিয়ে রেখে সে ভালো করে তাকিয়ে চিৎকার করে উঠল, আরে, বউদি, তুমি?

ততক্ষণে মলি ছুটে এসেছে কাছে। দুহাতে আঁকড়ে ধরেছে গৌরবের হাত, কি ভালো লাগছে তোমাকে দেখে গ্যারি, দেশে ফেরার জন্যে আমার কনগ্রাচুলেশন নাও।

গৌরবের কপালে ভাঁজ পড়ল, সে হেসে বলল, তোমাকে প্রথমটায় আমি চিনতেই পারিনি।

ওঃ, নো, আমি কি এমন বদলেছি! তোমার নিজের চেহারা কী হয়েছে?

কেন? আমাকে তো সহজেই চিনতে পারলে।

তা পারব না কেন? কিন্তু কি হ্যান্ডসাম হয়েছ তুমি। ওখানে রক্ষাকবচ বেঁধে এসেছ নাকি, নইলে এখানকার মেয়েরা তোমাকে ছিঁড়ে খাবে। খিলখিলিয়ে হেসে উঠল মলি।

তুমি বড্ড বাড়িয়ে বলছ বউদি। সত্যি অবাক করে দিয়েছ। আমি যখন বিদেশে গেলাম তখন তুমি আর এই তুমির মধ্যে আকাশ আর পাতাল ফারাক।

সঙ্গে সঙ্গে ইস্ত্রি করা চুলের রাশি এক ঝাঁকুনিতে কিছুটা সরিয়ে মলি কপট অভিমানে জিজ্ঞাসা করল, কেন এখন কি আমাকে খুব খারাপ দেখাচ্ছে?

না, না, আমি কি সেটা বলেছি? তোমাকে দারুণ দেখাচ্ছে। আর সব কোথায়? মা, দাদা–। এবার চারপাশে তাকাল গৌরব। সঙ্গে সঙ্গে ঠোঁট ফোলাল মলি, ও গ্যারি! তোমার দাদাটা না যাচ্ছেতাই! এমন একটা চাকরি করে যে নিজের বলতে কিছুই থাকে না। বিলেত থেকে কয়েকজন শেয়ারহোল্ডার এসেছে তাদের নিয়েই আজ এত ব্যস্ত যে বেচারা ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও আসতে পারে নি।

মা?

উফ? উনি, মানে, ইউ আর স্টিল এ মাদারস বেবি, গ্যারি। চলো, বাড়িতে চলো। টনি বনিরা গাড়িতে বসে আছে। মলি মুখ ঘুরিয়ে চিৎকার করল, পোর্টার, পোর্টার! সঙ্গে সঙ্গে সুটকেশ দুটো তুলে গৌরব জিজ্ঞাসা করল, আরে, খামকা কুলিকে ডাকছ কেন?

তুমি এই লাগেজ বইবে?

কেন নয়? এমন কিছু ভারী নয়, তাছাড়া আমার শরীর অসুস্থও নয়।

হাঁটতে হাঁটতে গৌরব জিজ্ঞাসা করল, টনি বনিকে গাড়িতে রেখে এলে কেন?

টনিকে তো জানো না, তোমার সঙ্গে ভালো করে কথাই বলতে দিত না গ্যারি।

কি আশ্চর্য! তুমি আমায় আজ থেকে গ্যারি বলছ কেন বলোতো? আমি গোরা, গৌরব।

ডোন্ট বি সিলি! তুমি গোরা মায়ের কাছে, আমাদের গ্যারি! ইউ নিড এ রাইট নেম, ইজন্ট ইট?
 
গৌরব হতভম্ব হয়ে যাচ্ছিল। বারো বছর আগে সে যখন এয়ারপোর্ট দিয়ে বিদেশে গিয়েছিল সেইদিন এখানে মা দাদা বউদি এসেছিল। বউদির কোলে তখন তিন বছরের বনানী। আর পাঁচটা মধ্যবিত্ত বাড়ির বউ যেমন হয়, বেথুনে পড়া মলি সেইভাবেই মায়ের পাশে দাঁড়িয়েছিল সজল চোখে। তখন পারতপক্ষে ওর গলায় ইংরেজি শব্দ শোনা যেত না। পায়ে দাগ হলে আলতা পরত। বিয়ের পর চিনে দোকানে খেতে গিয়ে খুব আড়ষ্ট হয়ে বসেছিল। তাই নিয়ে দাদা ঠাট্টা করত মনে আছে। আসলে দাদাও তখন সামান্যই চাকরি করত। উত্তর কলকাতার যে বাড়িতে ওরা থাকত তার ভাড়াও কম ছিল। গৌরবের বিদেশে পড়তে যাওয়া ওই পরিবারের পটভূমিকায় বিশ্বাস্য নয়। কিন্তু মেধা এবং চেষ্টার সঙ্গে যোগাযোগ মিলে গেলে কোনো কিছুই অসম্ভবের পর্যায়ে পড়ে না। আর এই বারো বছরে ধাপে ধাপে উঠে গেছে দাদা। এখন দক্ষিণের সবচেয়ে অভিজাত এলাকায় ওঁদের ফ্ল্যাট। কিন্তু বউদি? গৌরব আড়চোখে তাকাল। পাঁচফুট সাড়ে তিন ইঞ্চি লম্বা, মেদহীনা, রোদ-চশমা পরা এই মহিলাটি যেভাবে তরতরিয়ে হাঁটছেন তার সঙ্গে সেই বউদির কোনো মিল নেই। এখন নাভিমূলের চারইঞ্চি অবহেলায় উন্মুক্ত, সাদা ব্লাউজ বাহুমূল পর্যন্ত নামেনি। সবচেয়ে বিস্ময়ের, শাড়ি পরার ধরনটাই পাল্টে গেছে তার। এত দ্রুত কি করে মানুষের বদল হয় তা ভাবতে পারছিল না গৌরব।

এয়ারপোর্ট থেকে বেরিয়ে আসার পর প্রচুর গাড়ি দেখতে পেল সে। এবং ওই গাড়িগুলো বেশ নিয়ম মেনে রাখা হয়েছে। অনেক দূরে লম্বা একটা গাড়ি নজরে পড়ল। মলি একটি গাড়ির দিকে এগিয়ে যেতে যেতে ডাকলেন, ড্রাইভার, ড্রাইভার। সঙ্গে সঙ্গে একজন প্রৌঢ় ছুটে এল। মলির ইঙ্গিত বুঝে সে চলে এল গৌরবের কাছে। তারপর দিন স্যার নইলে চাকরি যাবে গোছের মুখ করে সুটকেশ দুটো ছিনিয়ে গাড়ির পেছন দিকে চলে গেল। গৌরব দেখল ড্রাইভারের পাশের আসনে একটি কিশোরী বসে তন্ময় হয়ে বই পড়ছে। তার রোদ-চশমা মাথায় তোলা। পেছনের আসনে দাঁড়িয়ে একটি চার পাঁচবছরের ছেলে প্রবল নৃত্য করছে বাজনার তালে। টেপে বাজনা বাজছে সজোরে। মলি মেয়ের দিকে তাকাল, বনি, লুক, কে এসেছে!

বনির পড়ায় বিঘ্ন হলো, ঈষৎ বিরক্ত কিন্তু গৌরবকে দেখে বলল, হা-ই। ওর উচ্চারণ, হাসির মাত্রা অত্যন্ত শিক্ষিতা মহিলার মতো। শব্দটা উচ্চারণ করার সময় বইটা বন্ধ করেছিল, গৌরব লক্ষ্য করল, গডফাদার। কই গডফাদার? মেরুদণ্ড চিনচিন করে উঠলেও সে হাসল, আরে বনানী না? কত বড় হয়ে গেছিস তুই। হাত বাড়িয়ে বনানীর চিবুক স্পর্শ করতেই মেয়েটি ঈষৎ লজ্জিত হয়ে কাঁধ নাচাল।

মলি বলল, আর ওই বিচ্ছুটা টনি। তুমি যাওয়ার অনেক পরে ও এসেছে। গৌরব নৃত্যরত বালকটির দিকে তাকাতেই সে ওই অবস্থায় জিভ ভ্যাংচালো, মলি দরজা খুলে পেছনে উঠে গৌরবকে পাশে জায়গা করে দেওয়ার সময়েও টনির নাচ থামছিল না। ড্রাইভার সুটকেশ পেছনে তুলে দিয়ে স্টিয়ারিং-এ এসে বাজনা কমিয়ে দিতেই টনি চিৎকার করে উঠল, ওঃ নো! আই ওয়ান্ট টু ডান্স!

বনি মুখ ফিরিয়ে বলল, ওঃ টনি, বিহেভ ইওরসেলফ!

টনি তীব্র প্রতিবাদ করল, নো, মিউজিক বাড়িয়ে দাও!

মলি মৃদু বকল, ওঃ টনি, আচ্ছা ড্রাইভার, একদম বন্ধ কোরো না, আর একটু জোরে করো। বুঝলে গ্যারি, আজকালকার বাচ্চারা এমন হয়েছে, হটট্র্যাক ছাড়া একদম থাকতে চায় না।

গাড়ি তখন ভি আই পি রোড ধরে ছুটছে। দুহাতে কান ঢাকল গৌরব। এই কলকাতাকে সে যাওয়ার আগে দেখে যায়নি।
 
আজ পথে জ্যাম ছিল না। ভি আই পি রোডের মতন অমন চমৎকার পথ, বাইপাসের মতো চওড়া রাস্তার দুপাশে চাষের মাঠ, খোলা জমি, আদিগন্ত আকাশ কখনও কলকাতার শরীরের পাশে দেখবে বলে ভাবেনি গৌরব। আর রাস্তাটা কয়েক মিনিটের মধ্যে যখন বাঁক নিয়ে পার্কসার্কাসের পেটে চলে এল তখন সে আরও তাজ্জব। এবং তখনি পরিচিত কলকাতাকে পেয়ে মন খুশিতে ভরে গেল। একটা আদুরে আলস্য বাড়িগুলোর শরীরে মাখানো, রাস্তায় অলস মানুষের চলাফেরা। ট্রামগুলো আজন্ম একই চেহারায় রয়ে গেছে। কিছু রঙিন এস মার্কা বাস চোখে পড়ল।

দক্ষিণখোলা ছতলা বাড়ির লিফট তাদের নিয়ে এল চারতলায়। নিচে দাঁড়িয়েই গৌরব লক্ষ্য করেছিল এই বাড়ির বাসিন্দাদের অধিকাংশই অবাঙালি। অন্তত লেটার বক্সগুলো সেই কথাই বলছে। নাম লেখা দরজার বোতাম টিপল মলি। মলি মিত্র আর সৌরভ মিত্র। বনি স্থির হয়ে পাশে দাঁড়িয়ে, টনি তখনও নাচের ভঙ্গি চালিয়ে যাচ্ছে। এই ছেলে বড় হয়ে মাইকেল জ্যাকসন না হয়ে যায় না। দরজা খুলতেই মোক্ষদাকে চিনতে অসুবিধে হলো না। তাকে দেখেও একটু ঘোমটা টানল মোক্ষদা। যাক, তাহলে বাল্যকালের মানুষকেও দাদা সঙ্গে করে বাড়িতে এনেছে। গৌরব সহজ গলায় জিজ্ঞাসা করল, কেমন আছ মোক্ষদা? মাথা নেড়ে সসঙ্কোচে মোক্ষদা নীরবে জবাব দিল, ভালো। তারপর চলে গেল ভেতরে।

মলি সোফায় বসে বলল, বসো, কাল নিশ্চয় সারারাত ঘুমাওনি। একটু জিরিয়ে স্নান করলে ফ্রেশ লাগবে। কেমন দেখছ ফ্ল্যাটটা?

চমৎকার। সত্যি সুন্দর সাজানো হয়েছে হলঘরটা। উত্তর কলকাতার বাড়িতে এসব স্বপ্নের বিষয় ছিল। সে বলল, কটা ঘর আছে এই ফ্ল্যাটে?

পাঁচটা। তোমার ঘরটা আমি নিজে হাতে সাজিয়েছি। আফটার অল আমেরিকা থেকে আসছ, হাজার হাজার ডলার আর্ন করছ, তোমার জন্যে দক্ষিণের ঘরটা ছেড়ে দিয়েছি। মোক্ষদা, ড্রাইভারকে ছোটবাবুর ঘরটা দেখিয়ে দাও, সুটকেশগুলো রেখে আসুক। মলি শেষ কথাগুলো চেঁচিয়ে বলল।

গৌরব জিজ্ঞাসা করল, কোথায়? মাকে দেখছি না তো!

একটু মেঘ জমতে না জমতেই সরিয়ে ফেলল মলি, উনি আসবেন, ব্যস্ত হচ্ছ কেন! চা না কফি?

কিছু না। আসবেন মানে? মা বাড়িতে নেই? গৌরব খুব অবাক।

না, মানে, এই মুহূর্তে নেই। তবে তিনি এসে পড়বেন যে কোনো মুহূর্তেই।

মা কোথায় গিয়েছেন?

তোমার মামার বাড়িতে, যিনি রাণাঘাটে থাকেন। তুমি এত ভাবছ কেন এই নিয়ে?

বাঃ এতকাল পরে দেশে ফিরলাম আর সেই সময় মা বাড়িতে নেই, আমি ভাবব না? কী ব্যাপার? হঠাৎ রাণাঘাটে কেন? কোনো অনুষ্ঠান ছিল নাকি ওখানে?

তোমার দাদা হয়তো নিয়ে আসবে রাণাঘাট থেকে। উনি জানেন তুমি আজ আসছ। অত ব্যস্ত হয়ো না, আমরা আছি তোমার অযত্ন হবে না এই ভেবে মা নিশ্চিন্তে আছেন। দুপুরে কী খাবে? চাইনিজ না ইংলিশ?

মানে? গৌরব হতভম্ব।

বাঃ, বারো বছর ওখানে থেকে নিশ্চয়ই তোমার ফুড হ্যাবিট পাল্টে গেছে। আমাদের মোক্ষদা এখন সব রান্না করতে পারে। চাইনিজটা তো দুর্দান্ত।

বউদি। শুধু মাছের ঝোল আর ভাত।

ন্যাকা।

.
 
স্নান করে বেশ তাজা লাগছিল। মাছের ঝোল আর ভাত খেয়ে লম্বা ঘুমিয়ে নিল গৌরব। চোখ মেলে দেখল কলকাতায় বিকেল নেমেছে। তড়াক করে উঠে বসতেই বিয়ারের বোতলগুলো চোখে পড়ল। খাওয়ার আগে বউদি ফ্রিজ থেকে কনকনে বিয়ার বের করে দিয়েছিল খিদে বাড়াবার জন্যে। বাড়িটার হাল কি পাল্টে গেছে। উত্তর কলকাতায় বাড়িতে বসে বিয়ার খাওয়ার কথা কেউ কল্পনাও করতে পারত না।

সামনে ছোট্ট ব্যালকনিতে দাঁড়াতেই চোখ জুড়িয়ে গেল। সামনেই লেক। সেখানে মেলা বসে গেছে যেন। চারতলা থেকেই নিচের পৃথিবীটা অন্যরকম দেখাচ্ছে। কিন্তু ওই আকাশ, গাছের পাতা ন্যুয়র্কের স্মৃতিটাকে চট করে আড়াল করে দেয়। এ চেহারা একদম আলাদা, একদম। বেশ কিছুক্ষণ দাঁড়াবার পর গৌরব পিছন ফিরল। সাধ্যের মধ্যে যা সম্ভব তাই এই ঘরে রাখা হয়েছে। নিশ্চয়ই বউদি তাকে সেরা আরাম দিচ্ছেন। সে দেখল মোক্ষদা চা নিয়ে ঢুকছে। এগিয়ে নিয়ে কাপটা নিল গৌরব, মা এসেছে?

মাথা নাড়ল মোক্ষদা। গৌরব জিজ্ঞাসা করল, তুমি বোবা হয়ে গেলে নাকি? মাথা নেড়ে জবাব দিচ্ছ কথা বলছ না কেন?

মোক্ষদা এবার মুখ তুলল, তুমি নাকি সাহেবদের ভাষায় কথা বলো এখন।

হো হো করে হেসে উঠল গৌরব, একথা কে বলেছে তোমাকে! বাঃ কি মনে হচ্ছে তোমার? আমার কথা বুঝতে পারছ না? যত সব! হ্যাঁ, মা কবে রাণাঘাটে গিয়েছে বলো তো?

এসব কথা আমাকে জিজ্ঞাসা কোরো না দাদাবাবু।

কেন?

ছোট মুখে বড় কথা বলতে নেই।

কবে গেছে সেই কথাটা তো বলতে পারবে?

তিন মাস।

তিন মাস? কি আশ্চর্য! তিন মাস মা রাণাঘাটে কী করছে? দাদা বাড়িতে ফিরেছে?

না।

আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। যাক, তোমার খবর কি বলো? দেশে যাও না?

আমি গেলে বউদির অসুবিধে হয়! মা নেই, তাই! মেয়েটারও বিয়ে দিয়ে দিয়েছি। সে ছাড়া তো কোনো পিছুটান নেই। মেদিনীপুরে থাকে তারা। শুনেছি বাচ্চা হবে। সেই সময় যাব।

মোক্ষদা চলে গেলে কিছুক্ষণ গুম হয়ে বসে থাকল সে। মা কেন অ্যাদ্দিন বাইরে রয়েছে তা মাথায় ঢুকছিল না। বউদির সঙ্গে কি কোনো ঝামেলা হয়েছে। বিয়ের পর তো বউদি মাকে খুব সমীহ করত! দাদা মায়ের সঙ্গে ঝগড়া করবে তাও ভাবা যায় না। জ্ঞান হবার পর মাকে এতদিন রাণাঘাটে সে কখনও থাকতে দ্যাখেনি। বাবা মারা যাওয়ার পরও নয়। রাণাঘাটে একটা ফোন করলে কেমন হয়? ওখানে তো ফোন আছে।
 
গৌরব হলঘরে বেরিয়ে এল। বনি একটা গল্পের বই নিয়ে বসে আছে সোফায় হেলান দিয়ে। তাকে দেখে সোজা হয়ে হাসল, কী খবর সব! কোন ক্লাসে পড়িস তুই?

নাইন।

তাহলে তো লেডি হয়ে গেছিস। হ্যাঁরে রাণাঘাটের মামাদের ফোন নম্বর কত?

গাইডেই লেখা আছে। বনি উঠে গাইডটা এনে পাতা খুলে দেখাল। সেখানে অনেকের টেলিফোন নম্বর পর পর লেখা। মিনিট পাঁচেক নষ্ট হলো গৌরবের। কিছুতেই এক্সচেঞ্জকে ধরতে পারছে না। শেষের দিকে ক্রশ কানেকশন হয়ে গেল। আর এক ভদ্রলোক চেঁচাচ্ছেন, তারও রাণাঘাট দরকার। শেষ পর্যন্ত হাল ছেড়ে দিল সে। বনি এক দৃষ্টিতে দেখছিল। সে রিসিভার ছাড়তে জিজ্ঞাসা করল, আমেরিকায় এইরকম হয়?

মাথা খারাপ। সত্যি যদি কেউ কথা বলে তো অন্য কথা। কিন্তু তা নাহলে লাইন পেতে পাঁচ সেকেন্ডও লাগে না। এরকম হলে ওখানে টেলিফোন কোম্পানি উঠে যেত। গৌরব বিরক্তিতে কথাগুলো বলল। বনি বলল, কি ভালো, না! আচ্ছা আঙ্কল–

দাঁড়া। গৌরব থামিয়ে দিলো আমাকে আঙ্কল বলবি না, কাকু বলবি।

হেসে ফেলল বনি, তোমাকে অনেকদিন কেউ কাকু বলে ডাকেনি, না?

থতমত হয়ে গেল গৌরব। তারপর হেসে বলল, ধরে নে, তাই। কি বলছিলি বল।

তুমি মাইকেল জ্যাকসনকে দেখেছ?

মাইকেল? না।

ডাস্টিন হফম্যান?

দূর থেকে দেখেছি। ব্রডওয়েতে ডেথ অফ এ সেলসম্যান নাটকে উনি অভিনয় করেন। সেটা দেখতে গিয়ে দেখেছি। কেন বল তো?

তোমার কি মজা না!

মোটেই নয়। এদের দেখতে পাওয়া মোটেই জীবন ধন্য হওয়ার মতো ব্যাপার নয়।

বনির মুখ গম্ভীর হয়ে গেল। সেটা দেখে গৌরব তার পাশে এসে বসল, ওদের চেয়ে আমার ঢের বেশি ভালো লাগছে তোদের দেখে।

ইউ আর সামথিং। বনি কাঁধ নাচাল।

কেন?

আমার এক বন্ধুর দাদা দুবছর আমেরিকায় ছিল। ফিরে এসে একদম বাংলা বলে না।

তিনি জিনিয়াস। আমি নিজের রান্না নিজে করি, মেসিনে কাপড় কাচি, গাড়ি চালিয়ে অফিসে যাই, বাজার করি, ঘরদোর নিজেকেই পরিষ্কার করতে হয়। আর রবীন্দ্রসঙ্গীত শুনি। একদম সাদামাঠা বাঙালি যাকে বলে তাই।

তোমার আমেরিকান বন্ধু নেই?

প্রচুর। তারা আমার হাতের রান্না খেতে খুব ভালবাসে। শুধু মশলাটা কম দিতে হয়।

অফিসের পরে তুমি কী করো?

আড্ডা মারি, নিজের সঙ্গে।

নিজের সঙ্গে মানে?

শুক্র এবং শনি রবি ছাড়া কেউ অফিসের পর বাড়ি থেকে বের হয় না। আমাদের যখন ছুটি হয় তখনও সূর্য বেশ গনগনে তবু বাঙালিরা বাড়ি ছোটে এই বলে যে কাল অফিস আছে। হাজার নিমন্ত্রণ করলেও আসবে না। ওদের আড্ডা ওই তিনদিন। আমি ম্যানহাটনে টাইম স্কোয়ারে হাঁটি। নিজের সঙ্গে কথা বলি। কয়েকটা পাঙ্ক ছেলে-মেয়ের সঙ্গে আমার চমৎকার বন্ধুত্ব হয়ে গেছে।

পাঙ্ক মানে?
 
বাউণ্ডুলে কিন্তু হিপিদের মতো ভালোমানুষ নয়। ওদের গল্প পরে একদিন বলব। তাছাড়া আমার পাশের বাড়িতে মিসেস ডেভিস আছেন। ঠিক তোমার ঠাকুমার মতন। ওর ছেলে-মেয়েরা আর কাছে আসার সময় পায় না। বুড়ি আমার সঙ্গে গল্প করতে খুব ভালবাসে।

তোমার কোন গার্ল ফ্রেন্ড নেই?

গৌরব চট করে বনির মুখ দেখে নিল। এবং বুঝল প্রশ্নটিতে কোনো জটিলতা নেই। তার মনে হলো ছেলেবেলায় তারা কখনও কোনো বয়স্ক মানুষকে এই প্রশ্ন করার কথা ভাবতেও পারত না। ভারতবর্ষেও তাহলে যুগের হাওয়াটা পৌঁছেছে। সে স্বাভাবিক গলায় বলল, থাকবে না কেন? প্রচুর আছে। সব মেয়েই তো আমার বন্ধু। তুইও আমার বন্ধু হয়ে যেতে পারিস।

সত্যি? বনির মুখে একটা আলো পড়ল যেন।

সত্যি। গৌরব হাত বাড়াল। বনি ওর হাতটা খুশির সঙ্গে ধরল। গৌরব বলল, আচ্ছা, তোর বাবা কখন আসবে কিছু বলেছে?

মাথা নেড়ে না বলল বনি। তারপর চারপাশে একবার নজর বুলিয়ে গলা নামাল, আজ সকালে তোমাকে নিয়ে মা আর বাবা খুব ঝগড়া করছিল। তারপর খুব রেগে নিয়ে বাবা বাড়ি থেকে চলে যায়। কাল রাত্রে পার্টি থেকে ফেরার পরই বাবার মেজাজ খুব খারাপ ছিল।

আমাকে নিয়ে ঝগড়া, কেন? গৌরব বিস্মিত।

বাবা মাকে বলেছিল তোমাকে আনতে যেতে এয়ারপোর্টে। মা বাবাকেও যেতে বলেছিল। কিন্তু। বাবা যেতে চাইছিল না। বলছিল, তোমার সামনে দাঁড়াতে পারবে না।

কেন?

তুমি যখন জিজ্ঞাসা করবে গ্রামি কোথায় তখন বাবা কি জবাব দেবে, তাই।

গ্রামি মানে?

উঃ, তুমি কিস্যু জানো না। গ্রামি মানে গ্র্যান্ডমাদার। ওটা টনি বানিয়েছে।

ও। নিজেকে কোনো রকমে সামলে নিল গৌরব। যথেষ্ট হয়েছে। ওইটুকুনি বাচ্চা মেয়েকে আর প্রশ্ন করা অনুচিত হবে। তার খারাপ লাগছিল। বড়রা যখন ঝগড়া করে তখন ছোটদের অস্তিত্ব উপেক্ষা করে কেন! বনি কথার সূত্র ধরে রাখতে চাইছিল, মা বাবার অফিসে ফোন করেছিল তুমি আসার পর। কিন্তু বাবা নাকি আজ সারাদিন অফিসেই যায়নি।

বোধহয় রাণাঘাটে গিয়েছে ঠাকুমাকে আনতে। গৌরব প্রসঙ্গ ঘোরাতে চাইল।

.

কিন্তু রাত আটটা বেজে গেল তবু কারও দেখা নেই। এর মধ্যে যতবার বেল বেজেছে গৌরব বেরিয়ে এসেছে। হয় টনির টিচার নয় অন্য কেউ। রাণাঘাটের টেলিফোন লাইনটাও পাওয়া যাচ্ছে না। গৌরব ঠিক করল সে রাণাঘাটেই যাবে। আজ রাত্রেই। দাদা বউদির সঙ্গে মায়ের যাই হোক না কেন সে আসছে জেনেও মা কি করে রাণাঘাটে থাকল। যদি তেমন কিছু এই বাড়িতে হয়ে থাকে তাহলে তো এয়ারপোর্টেই যেতে পারত। বিকেল থেকে বউদিও যেন অত্যন্ত অস্বস্তিতে রয়েছে। সকালের সেই স্বাভাবিক ব্যবহারটা করছে না। বলতে কি সামনেই আসতে চাইছে না যেন। খানিক আগে গৌরব ঘরে উঁকি দিয়েছিল। মলি বিছানায় উপুড় হয়ে শুয়েছিল। সেই অবস্থায় ডাকা উচিত মনে হয় নি গৌরবের। ওর মনে হয়েছিল সকাল থেকে যেটা আড়ালে রাখতে চেয়েছিল মলি সেটা ক্রমশ প্রকাশিত হয়ে যাচ্ছে বলে কুণ্ঠিত হয়ে পড়েছে। এই অবস্থায় কোনো প্রশ্ন করা মানে আরও বিব্রত করা হবে। কিন্তু রাণাঘাটে যাওয়ার সিদ্ধান্ত তো জানাতে হয়।
 
এই সময় দরজার বেল বাজল। গৌরব এগিয়ে এসে সেটা খুলতেই জমে গেল। মা দাঁড়িয়ে আছেন। হাতে একটা ব্যাগ। কয়েক লহমা, যেন কয়েক হাজার মাইল পরিক্রমার মতো, পরস্পর পরস্পরের দিকে তাকাল। শেষে পর্যন্ত গৌরব উচ্চারণ করল, মা! এবং তখনই সে আবিষ্কার করল তার বুকের সব জল বাষ্প হয়ে গলায় আটকেছে। সরলা এগিয়ে এলেন। বারো বছর তাঁর শরীরে অনেক কিছু চাপিয়ে দিয়েছে। কিন্তু তাঁর চোখ তীব্রভাবে ছেলের মুখ দেখছিল। তারপর দুহাতে ছেলেকে জড়িয়ে ধরে কাঁপতে শুরু করলেন তিনি। ঠিক কান্না নয় সমস্ত শরীরে একটা কাঁপুনি যা এই মুহূর্তে ছড়িয়ে পড়েছিল ছেলের শরীরের চাপে। মায়ের চুলে মুখ রেখে নিজেকে সংবরণ করার চেষ্টা করছিল গৌরব। কিন্তু চোখের জল মনের নিষেধ কখনো মানে না। প্রায় মিনিটখানেক লাগল স্থির হতে। সরলা শেষ পর্যন্ত জিজ্ঞাসা করতে পারলেন, কখন এলি?

সকালে। খুব কষ্ট হচ্ছিল শব্দটা উচ্চারণ করতে গৌরবের।

ও।

তুমি কেমন আছ মা? তখন ছেলের দুহাতের বাঁধনে বাঁধা সরলা। কোনো রকমে ভালো বলতে গিয়ে চোখের কোণ থেকে জল গড়িয়ে এল। গৌরব সেই অবস্থায় তাঁকে বলল, চলো, ঘরে গিয়ে কথা বলি আমরা।

ওই যতটুকু, দুয়ার থেকে অন্দর, যেতে যেতে নিজেকে পাল্টে ফেলতে পারলেন সরলা। ঘরে ঢুকে ছেলের হাত থেকে নিজেকে মুক্ত করে বললেন, এতদিনে বাবুর সময় হলো! উচ্চারণে একটু অভিমান, একটু স্নেহের ধমক। গৌরব নিশ্বাস ফেলল। তারপর বলল, না এলেই তো ভালো ছিল।

কেন? সরলা মুখ ঘুরিয়ে চারপাশে তাকাচ্ছিলেন। যেমন রেখে গিয়েছিলেন তেমনই রয়েছে। তবে মনে হয় মোক্ষদা রোজ ঝাড়ামোছ করে। ছেলের কথা শুনে মুখ ফেরালেন।

বাঃ। আমি অ্যাদ্দিন বাদে বাড়িতে ফিরলাম আর তুমি রাণাঘাটে গিয়ে বসে আছে। কী হয়েছিল মা? এ বাড়ির কেউ তোমার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করেছিল?

ওমা, কে আবার খারাপ ব্যবহার করবে? তুই একটা পাগল।

তাহলে তুমি তিন মাস রাণাঘাটে বসে রইলে কেন? উঁহু, তুমি চেপে যাচ্ছ।

ওরে বাবা, না। মনে হলো অনেকদিন দাদার বাড়িতে যাই না, তাই থেকে এলাম। এবার বল, তুই কেমন আছিস? গায়ে গতরে একটুও লাগেনি, শুধু ঢ্যাঙাই হয়েছিস। খাওয়া দাওয়া করতিস না বোধহয়। সরলা ছেলের চিবুকে হাত দিলেন।

তোমার চোখেই আমি রোগা। চশমাটা পালটাও। কিন্তু তোমার খবর কী?

ভালো। আমি খুব ভালো আছি।

তাহলে আমার চিঠির উত্তর দাওনি কেন গত তিন মাস। আর আগে আমার এত বড় চিঠির উত্তরে এই এতটুকু। তোমার ভাগ্যে কি জায়গা জুটত না?
 
রাণাঘাটে তোর খটমট ঠিকানাটা কিছুতেই মনে পড়ছিল না। লিখে নিয়ে যেতে ভুলে গিয়েছিলাম। আর সবাই এখানে এত লিখত যে আমি–। চিঠি তো পেতিস তা হলেই হলো। কতদিনের ছুটি তোর?

তিন মাস।

তিন মাস পরে চলে যাবি?

সেইটাই ভাবছি। যদি এখানে একটা ভালো কাজ জোটাতে পারি–দেখি।

তোর মতো বিদ্বান ছেলে এখানে চাকরি পাবে না? হতেই পারে না।

তুমি কিন্তু আসল কথাটা এড়িয়ে যাচ্ছ?

ও কথা বাদ দে। বউমা কোথায়? তোর দাদা? বাচ্চাদের দেখছি না কেন?

আছে সবাই। দাদার সঙ্গে আমার এখনও দেখা হয়নি। মা, তোমার কী হয়েছে?

কি আর হবে।

ঠিক এই সময় বাইরে পায়ের শব্দ পাওয়া গেল। সরলা বিছানায় বসলেন। পাশে গৌরব। দরজায় এসে দাঁড়াল সৌরভ। গৌরবের চেয়ে বছর দশেকের বড় সে। পরনে পাজামা পাঞ্জাবি। মাথার চুল এলোমেলো। উদভ্রান্ত চেহারা দেখলেই বোঝা যায় সে মদ্যপান করেছে। একটা হাত দরজায় রেখে অন্য হাত বুকের কাছে নিয়ে সৌরভ বলল, গোরা, আমি বলছি তোকে। আমি দোষী। আমি ছেলে হয়ে মাকে রাখতে পারিনি।

দাদা! গৌরব চাপা গলায় বলে উঠল।

ইয়েস আমি। যে ছেলে মাকে নিজের কাছে রাখতে পারে না, ভাইকে এয়ারপোর্টে বারো বছর পর রিসিভ করতে যেতে পারে না তার–! কথাটা শেষ না করে বিকৃত মুখে মাথা নাড়ল সৌরভ। তারপর সেই জড়ানো গলা যতটা সম্ভব স্বাভাবিক করতে চেষ্টা করে বলল, মা, তুমি আমাকে ক্ষমা করো।

আঃ, খোকা, কি যা তা বলছিস! সরলা ধমকে উঠলেন।

না। আমি তোমাকে আনতে রাণাঘাটে গিয়েছিলাম। ওরা বলল, তুমি সকাল বেলায় বেরিয়ে গেছ। আমি ক্ষমা চাইছি মা।

গৌরব চমকে উঠল, সকালে রাণাঘাট থেকে বেরিয়ে এতক্ষণ কোথায় ছিলে মা?

সরলা মাথা নিচু করে বললেন, দক্ষিণেশ্বরে।

হঠাৎ সব শব্দ যেন মরে গেল। কিছুক্ষণ চুপচাপ। সৌরভ শেষ পর্যন্ত জড়ানো গলায় কথা বলল, সত্যি বলছি মা, তুমি এই বাড়ি থেকে চলে যাওয়ার পর আমি এক মুহূর্ত ভালো ছিলাম না। কিন্তু আমি জানতাম তোমাকে আনতে গেলে তুমি কিছুতেই আসবে না। মলি না, দোষ আমার, আমাকে ক্ষমা করো।

সরলা ডাকলেন, এখানে আয়, আমার পাশে বোস।

সৌরভ নিজেকে কোনোরকমে সামলে সরলার আর এক পাশে গিয়ে বসল। দুই পুত্র দুই দিকে। সরলা বললেন, আমারই দোষ। আমিই যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে পারিনি। তোদের যে জীবন না মানলে চলে না আমার তাই নিয়ে রাগারাগি করা উচিত ছিল না। শুধু আমার বাচ্চা দুটোর জন্যে ভয় হয়, খুব ভয় হয়।

গৌরব মুখ তুলল, বউদি কোথায় দাদা!

সৌরভ মাথা নাড়ল। ইঙ্গিতে বোঝাল সে দ্যাখেনি। সরলা উঠলেন, তোরা বোস, আমি দেখছি বউমা কোথায়। রাতও হয়েছে, ওরা তোদের খাবার দিচ্ছে না কেন?

কথা বলতে বলতে সরলা যেন ঘরের বাইরে যেতে পেরে স্বস্তি পেলেন। দুই ভাই একটু পাশাপাশি বসুক। ওদের মধ্যে তো ঝগড়াবিবাদ নেই। তিনি বউমার স্বামীর সঙ্গে পাল্লা দেওয়া পছন্দ করেন নি বলেই তো সংঘর্ষ। এবার তিনি মানিয়ে নেবেন। তিন মাসে তিনি বুঝতে পেরেছেন মানিয়ে না নিলে শুধু দুঃখই বাড়ে, ব্যবধান ঘোচে না।
 

Users who are viewing this thread

Back
Top