What's new
Nirjonmela Desi Forum

Talk about the things that matter to you! Wanting to join the rest of our members? Feel free to sign up today and gain full access!

Collected বুকের ঘরে বন্দী আগুন♨️ (4 Viewers)

Kaptan Jacksparoow

Community Team
Elite Leader
Joined
Apr 6, 2019
Threads
325
Messages
5,984
Credits
44,713
T-Shirt
Profile Music
Recipe sushi
Rocket
Euro Banknote
Butterfly
বুকের ঘর বন্দী আগুন
সমরেশ মজুমদার
images-1bf245cba527fd2da.jpeg
 
কুচি কুচি করে ঢেঁকির শাক কেটে তাতে পেঁয়াজ আর রসুন দিয়ে অল্প তেলে ভেজে নিলে এক থালা ভাত গোগ্রাসে খেয়ে নেওয়া যায়। কোম্পানি রেশনে যে-চাল দেয়, তা পেঁয়াজ রসুনের কল্যাণে খেতে মন্দ লাগে না। আকাশ ফরসা হলেই ঝোলা নিয়ে কুলিলাইন থেকে বেরিয়ে নদীর ধারে চলে যেতে কার ভাল লাগে! এতোয়ারিরও লাগে না। কিন্তু নদীর ধারে পৌঁছলেই প্রথম যে-হাওয়ার ঢেউটা মুখে বুকে আলতো ছুঁয়ে যায়, তাতেই মনে ভাল লাগাটা ঝটপট এসে যায়। ছোট্ট নদী, চওড়ায় বড়জোর ষাট কি সত্তর ফুট, তরতরিয়ে ছুটে যাচ্ছে ডুডুয়া নদীর বুকে মিশে যেতে। সেই নদীর দুই পাড়ে ঢেঁকিশাকের গাছ দঙ্গল বেঁধে রয়েছে। পাতা ছিঁড়ে ছেঁড়া ঝোলায় ভরে ফেলতে হয় ঝটপট। তারপর চারধারে নজর বুলিয়ে নিঃসন্দেহ হয়ে প্রাতঃকৃত্য সেরে জলে ডুব দেয়। এক দুই করে পাঁচবার। এখন সাবান নয়। সাবান মেখে স্নান হয় বিকেলেশেষে। সারা দিনের ক্লান্তি-ঘাম ধুতে সাবানের দরকার হয়। ভেজা কাপড় ঠিকঠাক শরীরে জড়িয়ে এক ঝোলা ঢেঁকি শাক নিয়ে এতোয়ারি যখন ঘরে ফিরে আসে, তখন লাইনের দু’-চারজন মেয়েছেলে আর আধরাত জাগা কিছু বুড়ো ছাড়া কেউ আশপাশে নেই। ঝটপট শাড়ি পালটে চুলে চিরুনি বুলিয়ে শাক কাটতে বসে সে। খাওয়ার মানুষ তিনজন। বাবা আমগাছ থেকে পড়ে সেই যে পা ভেঙেছিল, তারপর থেকে ঘরে বসে আছে। হাতে লাঠি নিয়ে চায়ের কারখানায় কাজ করা যায় না। একটু সুস্থ হয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছিল, খানিকটা হাঁটতেই মাথা ঘুরেছিল, শরীর ঝিমঝিম। মা এখনও কাজ করে যাচ্ছে। চা-বাগানে দলের সঙ্গে পাতা তোলার কাজ। শরীর বেশ দুর্বল। প্রতিদিনের বরাদ্দ চায়ের পাতা তুলতে পারছে না। ঝুড়িতে পাতা নিয়ে যখন ফ্যাক্টরির সামনে ওজন করাতে হয়, তখনই দেখা যায় যা হুকুম, তার চেয়ে অনেক কম পাতা তুলতে পেরেছে এতোয়ারির মা। বরাদ্দ পাতা না-তুলতে পারলে মজুরির টাকা কমে যায়। পরপর তিনদিন একই অবস্থা হলে পাতিবাবু দু’দিন বসিয়ে দেন। অপরাধীর গলায় এতোয়ারির মা বলে, “খুব মাথা ঘোরে যে…”

এতোয়ারি একদিন জোর করে চা-বাগানের হাসপাতালে নিয়ে গিয়ে ডাক্তারবাবুকে দেখিয়েছিল। নতুন আসা যুবক ডাক্তারবাবু প্রেশার দেখে, বুকে পিঠে স্টেথো চেপে দেখে বলেছিলেন, “ওষুধ দিচ্ছি। সাতদিন বাড়িতে বিশ্রাম করতে হবে। ওষুধ শেষ করে সাতদিন পরে এসো।”

এতোয়ারি বলেছিল, “একদিন দু’দিন বিশ্রাম নিলে হয় না?”

“ডাক্তারিটা করছে কে, আমি না তুমি?” ডাক্তারবাবু রেগে গিয়েছিলেন।’

“আপনি।”

“তা হলে আমি যা বলছি তাই করো।”

মুখ নিচু করে ওষুধ নিয়ে চলে এসেছিল এতোয়ারি, মায়ের সঙ্গে।

মা কিছু বলে না কিন্তু বাবাকে মাঝে মাঝে সহ্য করতে পারে না এতোয়ারি। পঙ্গু হয়ে যাওয়ার পর থেকে একটু একটু করে বাবার কথাবার্তা অন্যরকম হয়ে গিয়েছিল। মায়ের সঙ্গে সবসময় ঝগড়া তো করতই, তাকেও অভিশাপ দেওয়া শুরু করল। মেজাজ যখন খুব খারাপ হত, তখন যা মুখে আসে তাই বলা শুরু করল।
 
আজ যখন ঢেঁকির শাকপাতা কাটা সবে শেষ হয়েছে, তখন বাবার গলা কানে এল।

“তোর ছেলেবেলায় আমি কত কী কিনে এনে খাইয়েছি। তুই তার বদলে আমাকে মাগনায় তোলা ঢেঁকি শাক খাওয়াচ্ছিস রোজ। ছ্যা ছ্যা ছ্যা। খরচ করে বিয়ে দিলাম। এমন মেয়েছেলে তুই যে, বছর না-ঘুরতেই বর দূর দূর করে তাড়িয়ে দিল। হায় ভগবান! তুমি কেন যে আমাকে এই মেয়ে না-দিয়ে একটা ছেলে দিলে না!”

বাবার দিকে না-তাকিয়ে জবাব দিয়েছিল এতোয়ারি, “পয়সার লোভ দেখিয়েছিলে তাকে, তাই সে বিয়ে করেছিল। টাকা দাওনি তাই মাতালটার মার থেকে বাঁচতে আমি পালিয়ে এসেছি। আমি না-ফিরে এলে তো এতদিনে না-খেয়ে শুকিয়ে মরতে।”

পাশ ফিরে শুয়ে মা চোখ বন্ধ করে ছিল। এবার চিনচিনে গলায় বলল, “দোহাই তোমাদের, চুপ করো। তুই কি পাগল হয়ে গেলি?”

“আমি পাগল হলাম? বাবা কী বলছে শুনতে পাওনি?” খেঁকিয়ে উঠল এতোয়ারি।

মা উঠে বসল, “আমার আর ভাল লাগে না। এত মানুষ চটপট মরে যায়, আমার কেন মরণ হয় না! ও ও ভগবান, তুমি কী নিষ্ঠুর!”

“জানি জানি, সব জানি,” বাবার গলা ওপরে উঠল, “নিজের নয়, তুমি আমার মৃত্যু চাইছ! এত লোক মরে যাচ্ছে, আমি কেন বেঁচে আছি, তাই না? ঠিক আছে, আমি এবার সব বলে দেব, এতদিন মুখ বন্ধ করে ছিলাম, এবার মুখ খুলব।”

পাশের বারান্দা ঘিরে রান্নার জায়গায় চলে এল এতোয়ারি। একটু কেরোসিন ঢেলে উনুনের কাঠ জ্বেলে ঢেঁকিশাক রাঁধতে শুরু করল। তারপর ভাত ডাল রান্না করে সেগুলো পেটে দিতে হবে। দিয়ে রাতের রুটি আর গুড় ঠোঙায় নিয়ে শাড়ি পালটে ছুটতে হবে কাজে।

কাজটা পাইয়ে দিয়েছিলেন ডাক্তারবাবুর বউ। কপাল ছাড়া আর কী বলবে! নদীতে বাসন মাজতে গিয়েছিল সে দুপুর পার করে। তখনও রোদ ছিল চড়া। হঠাৎ বাচ্চার গলা কানে আসতেই চোখ তুলে দেখতে পেয়েছিল ওপারে মায়ের হাত ধরে দাঁড়িয়ে আছে বছর আড়াইয়ের শিশু। চোখাচোখি হতেই মা মিষ্টি হাসলেন। নদীর ওপারে জঙ্গলের শেষে, কোয়ার্টার্সের চা-বাগানে যেসব বাবু কাজ করেন, তাঁরা থাকেন। তাঁদের একপাশে ডাক্তারবাবুরও কোয়ার্টার্স, ওই মহিলাকে ডাক্তারবাবুর কোয়ার্টার্সের বারান্দায় কয়েকবার দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছে সে। তাই আজ বুঝতে অসুবিধে হল না যে উনি ডাক্তারবাবুর বউ।
 
বাসন মাজা থামিয়ে বাচ্চাটাকে যখন কিছু বলতে যাচ্ছিল এতোয়ারি, তখন চিলটা দ্রুত নেমে এল নদীর ওপর। কিছু বোঝার আগেই দুই পা দিয়ে একটা ছোট মাছ তুলে নিয়ে উড়ে গেল ওদিকের গাছের ডালে। আর তাকে দেখে বাচ্চাটা এমন উত্তেজিত হল যে, সে মায়ের হাত ছাড়িয়ে এগিয়ে যেতে চাইল। এতোয়ারি দেখল টাল সামলাতে না-পেরে ছোট্ট শরীরটা ঝুপ করে জলে পড়ে গিয়ে হাবুডুবু খেতে লাগল। বাচ্চার মা চিৎকার করে জলে নামার চেষ্টা করলেও ছেলের শরীরকে তখন নদীর স্রোত নাগালের বাইরে নিয়ে গিয়েছে। আর দেরি না-করে লাফিয়ে, জলে শরীর ভাসিয়ে, বাচ্চাটাকে ধরতে পারল এতোয়ারি। এর মধ্যে পেটে জল ঢুকে যাওয়ায় বাচ্চাটা হাঁসফাঁস করছে। তাড়াতাড়ি নদীর পাড়ে উঠে ওকে নিজের কোলের ওপর উপুড় করে শুইয়ে দিয়ে পিঠে আস্তে আস্তে চাপ দিতেই মুখ থেকে বেশ খানিকটা জল বেরিয়ে এল। তখন বাচ্চাটাকে সোজা করে বসাতেই তার গলা থেকে কান্না বের হল। ততক্ষণে ওর মা কাঁদতে কাঁদতে ছুটে এসে বাচ্চাকে কোলে তুলে নিয়েছেন।

এতোয়ারি হেসে বলল, “আর ভয় নেই। জল বেরিয়ে গিয়েছে।”

মায়ের কোলে গিয়ে শান্ত হতে বাচ্চাটা সময় নিল। আর-একবার জল তোলার পর সে মায়ের কাঁধে মুখ লুকোল।

এতোয়ারি বলল, “আর ভয় নেই। ও এখন ভাল আছে।”

ছেলের মাথায় পিঠে হাত বুলিয়ে ডাক্তারের স্ত্রী বললেন, “তোমাকে কী বলে ধন্যবাদ দেব জানি না। তুমি আমার ছেলের জীবন বাঁচিয়ে দিলে, আমি সারা জীবন তোমার কাছে ঋণী হয়ে থাকলাম।”

“ছি ছি, এ কী বলছেন! আমি যা করেছি তা যে-‌কোনও মানুষ করত। আপনি এভাবে বলবেন না,” হাতজোড় করল এতোয়ারি।

বাচ্চা এবার মুখ তুলল। এতোয়ারি বলল, “ওর জামাপ্যান্ট ভিজে গিয়েছে, ওগুলো খুলে তাড়াতাড়ি বাড়ি নিয়ে যান।”

“তোমার নাম কী”

“আমার নাম এতোয়ারি।”

“এতোয়ারি, তুমি একটু পরে আমার বাড়িতে আসতে পারবে? ওর বাবা হলেন ডাক্তারবাবু।”

“বুঝতে পেরেছি। আপনি যখন বলছেন তখন নিশ্চয়ই যাব,” এতোয়ারি বলতেই মহিলা শিশুকে নিয়ে দ্রুত তাঁদের কোয়ার্টার্সের দিকে চলে গেলেন জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে।

বিকেল বিকেল এতোয়ারি চলে এসেছিল। জিজ্ঞাসা করে ডাক্তারবাবুর কোয়ার্টার্সে পৌঁছতে কোনও অসুবিধে হল না। গেটের সামনে দাঁড়াতেই বারান্দার দরজায় এসে দাঁড়ালেন ডাক্তারবাবুর বউ, “এসো এতোয়ারি। এখানে এসে বসো।”

এতোয়ারির এবার বেশ সংকোচ হচ্ছিল। বারান্দায় উঠে সে জিজ্ঞাসা করল, “ছেলে কোথায়?”

“কাজের লোকের সঙ্গে বেড়াতে গিয়েছে। এতোয়ারি, তুমি আজ যে-উপকার করেছ, তা আমি জীবনে ভুলতে পারব না। আমার ছেলেটাকে তুমি আজ বাঁচিয়ে দিয়েছ,” ডাক্তারবাবুর বউ বলল।

“না না, একটা বাচ্চা ডুবে যাচ্ছে, তাকে বাঁচাবার চেষ্টা করব না?” এতোয়ারি বারান্দায় রাখা একটা মোড়ায় বসল।

সামনের চেয়ারে বসে ডাক্তারবাবুর স্ত্রী ওকে জিজ্ঞাসা করলেন, “তুমি নিশ্চয়ই চা-বাগানের চাকরিতে আছ! কোথায় কাজ করো, বাগানে না ফ্যাক্টরিতে?”

মাথা নাড়ল এতোয়ারি, “না মেমসাব, আমি চাকরি করি না।”

“ওমা, কেন?” ডাক্তারবাবুর স্ত্রী অবাক হলেন।

“আমার মা পাতি তোলে। এক ফ্যামিলি থেকে একজনই পাতি তোলার কাজ করতে পারে। ফ্যাক্টরিতে নাকি কোনও কাজ খালি নেই।”

“তোমার বিয়ে হয়নি?”

একটু চুপ করে এতোয়ারি বলল, “হ্যাঁ, হয়েছিল।”

“হয়েছিল মানে? তোমার স্বামী নেই?”

“আছে।”

“থাক ওসব কথা,” এইসময় সাইকেলের বেল শোনা গেল। ডাক্তারবাবুর স্ত্রী বললেন, “ওই যে, ডাক্তারবাবু এসে গিয়েছেন।”
 
কথাটা কানে যেতেই এতোয়ারি উঠে দাঁড়াল। সাইকেল ভেতরে ঢুকিয়ে ডাক্তারবাবু সিঁড়িতে পা দিতেই তাঁর স্ত্রী বললেন, “এর কথা তোমাকে তখন বলেছিলাম। ওর নাম এতোয়ারি। আমি ওকে আসতে বলেছিলাম।”

“আচ্ছা,” ডাক্তারবাবু বললেন, “কোন লাইনে থাকো তুমি?”

“দু’নম্বর লাইন।”

“তুমি আমাদের খুব বিপদ থেকে রক্ষা করেছ।”

“বেচারার কোনও চাকরি নেই। তুমি একটু দ্যাখো না!” বেশ আন্তরিক গলায় বললেন ডাক্তারবাবুর স্ত্রী।

ডাক্তারবাবু সব খবর নিলেন। বাবা কী করে, স্বামী এই বাগানে কাজ করে কি না, মা বাগানের কাজে আছে— এইসব। যেই শুনলেন, বিয়ে হয়েছিল, স্বামী তেলিপাড়া চা-বাগানে চাকরি করে কিন্তু তিন হাজার টাকা পণ চেয়ে না-পেয়ে মেরে তাড়িয়ে দিয়েছিল বউকে, অমনি গম্ভীর হয়ে গেলেন। বললেন, “থানায় গিয়ে ডায়েরি করেছ?”

মাথা নেড়ে না বলল এতোয়ারি।

ডাক্তাবাবুর স্ত্রী ভেতরে চলে গেলেন। ফিরে এসে কয়েকটা দশ টাকার নোট এগিয়ে ধরলেন, “কিছু মনে কোরো না, এই টাকা রাখো, মিষ্টি কিনে খেয়ো।”

দ্রুত মাথা নাড়ল এতোয়ারি, “না না। ওইটুকু বাচ্চাকে জল থেকে তুলেছি বলে আমি যদি টাকা নিই, তা হলে আমার নরকেও জায়গা হবে না। আচ্ছা, আমি আসছি।”

মাথা নিচু করে বেরিয়ে এসেছিল এতোয়ারি।

কিন্তু তার ঠিক তিনদিন পরে একটা লোক এসে বলল, “তোমাকে ডাক্তারবাবু আজই হাসপাতালে গিয়ে দেখা করতে বলেছেন।”

সে অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করেছিল, “কেন?”

লোকটা জবাব দিতে পারেনি। কিন্তু ঘরে বসে বাবা চেঁচিয়েছিল, “যা যা, গিয়ে আমার জন্যে ওষুধ নিয়ে আয়। আমার সারা শরীরে ব্যথা, তোর মাকে বললে তো সে শুনতেই চায় না।”

যাব না যাব না করেও হাসপাতালে গিয়েছিল এতোয়ারি। ডাক্তারবাবু তখন হাসপাতালে ছিলেন না। তাকে দেখে বড় নার্স বললেন, “তোর কপাল ভাল।’’

“কীরকম ভাল তা আমি জানি,” এতোয়ারি বলেছিল।

“তার মানে? কী জানিস?”

“বিয়ের পর যদি তোমার স্বামী টাকার জন্যে মেরে বাপের বাড়ি পাঠিয়ে দিত, তা হলে বুঝতে কপাল কীরকম ভাল।”

বড় নার্স কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলেছিলেন, “রাত তো চিরকাল থাকে না, একসময় ভোর হয়, অন্ধকার সরিয়ে আলো ফোটে। বুঝলি!” বলে অন্যদিকে চলে গেলেন।

ডাক্তারবাবু এলেন ঘণ্টাখানেক পরে। তার ডাক পড়ল ঘরে। বেশ ভয় লাগছিল, সেইসঙ্গে কৌতূহলও। তাকে দেখে ডাক্তারবাবু বললেন, “তুমি কাজ করবে?”

এতোয়ারি হতভম্ব হয়ে তাকাল। এরকম প্রশ্ন সে কল্পনাতেও ভাবতে পারেনি। চট করে হ্যাঁ বা না বলার হুঁশ তার হল না।

ডাক্তারবাবু বললেন, “আমি বড়সাহেবের সঙ্গে কথা বলেছি। যে-মেয়েটি এখানে কাজ করত, সে বিয়ের পর অসমের বাগানে চলে গিয়েছে। আমার ওর জায়গায় একজনকে দরকার।”

ততক্ষণে সাহস ফিরে পেয়েছে, সেইসঙ্গে আনন্দ, এতোয়ারি বলল, “আপনি আমাকে যা করতে বলবেন আমি তাই করব।”
 
“তোমাকে বড় নার্সদিদি বুঝিয়ে দেবে কী করতে হবে,” ডাক্তারবাবু কথা বলার মধ্যেই বড় নার্স ঘরে ঢুকলেন। ডাক্তারবাবু বললেন, “দেবী, তুমি ওকে কী কী কাজ করতে হবে তা দেখিয়ে দাও। একদিনে নয়, দু’-তিনদিনে ও কাজগুলো যদি ঠিকঠাক বুঝে নিতে পারে, তা হলে ওকেই রাখতে চাই।”

“আপনি যেমন বলবেন,” বড় নার্স নিজে নেপালি হলেও ভাল বাংলা বলেন।

ডাক্তারবাবু বললেন, “ঠিক আছে, তুমি বাইরে গিয়ে অপেক্ষা করো। ইনি যেমন বলবেন, ঠিক সেইমতো কাজ করবে। যাও।”

এতোয়ারি ডাক্তারবাবুর ঘর থেকে বেরিয়ে এসেছিল।

কাজটা শুরু হয়েছিল নার্সদের সাহায্যকারী হিসেবে। সেইসঙ্গে এই ছোট্ট হাসপাতালের পাঁচখানা বেডের চাদর পালটানো থেকে রোগীদের যাবতীয় সেবার কাজ করা। সকাল সাতটায় হাসপাতালে আসতে হত, ছুটি পেত সন্ধে সাতটায়। বারো ঘণ্টার কাজ কিন্তু একটুও খারাপ লাগত না এতোয়ারির। উলটে মনে হত, হাসপাতালের কাজ পেয়ে সে বেঁচে গেছে।

দুপুরের খাবার হাসপাতাল থেকেই পাওয়া যেত। সবাই বলত, খুব খারাপ রান্না কিন্তু এতোয়ারির তা মনে হত না। ভাত ডাল আর আলুর তরকারি তো খেতে পাচ্ছে, স্বাদ যত পানসে হোক, বিনা পয়সায় কে দিচ্ছে তাকে। বিকেলে বিনা পয়সায় এক গ্লাস চা আর একটা বিস্কুট। সন্ধে সাতটায় লাইনে ফিরেই উনুন ধরিয়ে ভাত আলুসেদ্ধ রাঁধতে হত। কোনও কোনওদিন মা রেঁধে রাখত বলে জামাকাপ়ড় নিয়ে চলে যেতে হয় নদীতে। ঘাটে বসে চারপাশে অন্ধকার সইয়ে নিতে, দৃষ্টি ঠিক করতে সময় লাগত। আর চাঁদের রাত হলে মন কী ভালই না হয়ে যেত! আকাশ থেকে যেন রুপোর স্রোত নেমে আসছে পৃথিবীতে। সমস্ত চরাচর যেন ভাতের ফ্যানের মতো রূপের গমকে ফুলে-ফেঁপে উঠছে। ছোট্ট নদীর দুরন্ত ঢেউগুলোয় সেই আলো এমনভাবে মাখামাখি হয়ে গিয়েছে যে, চোখ ফেরানো মুশকিল হয়ে ওঠে।

কিন্তু কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলে বুক টনটন করে ওঠে এতোয়ারির। আঙুল চলে যায় বাঁ চোখের ওপরে। ভ্রূ ঘেঁষে আধ ইঞ্চি উঁচু হয়ে থাকা আব তার শত্রু। এই শত্রুটাকে কপালে বয়ে বেড়াতে হচ্ছে। তার বর বলেছিল, “তোর বাপ বলেছিল ওই আব সমেত বিয়ে করলে যে-টাকা দেবে, তার অর্ধেকও দেয়নি। এতদিন চুলের মুঠো ধরেছি। পিঠে লাঠি মেরেছি এবার তোর ওই আব ফাটিয়ে দেব। তোর বাপ যদি ওই আবের দাম না-দিতে পারে, তা হলে আবের সঙ্গে সঙ্গে তুইও খতম হয়ে যাবি। সাতদিনের মধ্যে তোর বাপ যদি আব বাঁচাতে টাকা না দেয়, তা হলে আমাকে দোষ দিবি না।”

চোখ খোলা, বাইরে ঝিলিক দেওয়া জ্যোৎস্না, কিন্তু এতোয়ারির কোনও হুঁশ নেই। ঘাটে বসে আছে পাথর হয়ে। জল ছেড়ে কাঁকড়ার দল যখন খাবার খুঁজতে পাড়ে উঠে এল, তখনও তার হুঁশ নেই।

হঠাৎ শরীরে ঝাঁকুনি লাগল। ধড়মড়িয়ে উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে সে চাঁদের আলোয় মাকে দেখতে পেল। দেখামাত্র দু’হাতে মায়ের জীর্ণ শরীরকে জড়িয়ে ধরে হাউ হাউ করে কেঁদে উঠল এতোয়ারি। সেই কান্নার শব্দ কানে যেতেই কাঁকড়াগুলো দৌড়োতে লাগল নদীর জলের দিকে। একটা রাতপাখি চিৎকার করে উড়ে গেল সামনের গাছের ডাল থেকে।

মেয়ের কাঁপতে থাকা শরীর দু’হাতে জড়িয়ে ধরে শেষপর্যন্ত মা নিজেকে আর সামলাতে পারল না। তার গলা থেকেও কান্না বের হল। চতুর্দশীর চাঁদ তখন একফালি সাদা মেঘের আড়ালে ছটফট করছে।
 
মাইনে পাওয়ার আগেই ঘটনাটা ঘটে গেল। জলপাইগুড়ি শহর থেকে সিভিল সার্জেন সাহেব এসেছিলেন বানারহাটে, যাওয়ার সময় এই চা-বাগানের হাসপাতালে ম্যানেজারের আমন্ত্রণে কিছুক্ষণের জন্যে এসেছিলেন।

ডাক্তারবাবু আর ম্যানেজারের সঙ্গে ভদ্রলোক হাসপাতালটা ঘুরে দেখলেন। তখন সকাল দশটা। হাসপাতালের আউটডোরে ততক্ষণ জনা তিরিশেক মানুষ তাদের নানা রকমের অসুখ নিয়ে হাজির হয়েছে। ওইসময় সিভিল সার্জেনের চোখ গেল এতোয়ারির দিকে। ছোট নার্স একটি মেয়ের পায়ে ব্যান্ডেজ বেঁধে দিচ্ছিল। তাকে সাহায্য করছিল এতোয়ারি। সিভিল সার্জেন ম্যানেজারকে ইংরেজিতে জিজ্ঞাসা করলেন, “ওই মেয়েটি কি এখানে কাজ করে?”

ম্যানেজার সাহেব ডাক্তারবাবুর দিকে তাকালেন। ডাক্তারবাবু মাথা নাড়লেন, “হ্যাঁ, ওই মেয়েটি কিছুদিন আগে হেল্পার হিসেবে কাজ শুরু করেছে। খুব কাজের মেয়ে।”

সিভিল সার্জেন বললেন, “মেয়েটিকে এখানে আসতে বলুন তো।”

ডাক্তারবাবু কাছে গিয়ে এতোয়ারিকে সঙ্গে নিয়ে এলেন। এতোয়ারি কপালে হাত ছুঁইয়ে সবাইকে নমস্কার করল।

ভাঙা হিন্দিতে সিভিল সার্জেন জিজ্ঞাসা করলেন, “তোমার কপালে এটা কবে থেকে হয়েছে?”

মাথা নিচু করে ভাবল এতোয়ারি। তারপর মাথা নেড়ে বলল, “জানি না, মনে নেই।”

ভদ্রলোক হাত বাড়িয়ে এতোয়ারির ভ্রূ-র ওপরের আবটাকে পরীক্ষা করলেন। তারপর গম্ভীর মুখে ডাক্তারবাবুকে ইংরেজিতে বললেন, “তোমার কি মনে হয়নি এটা বেশিদিন রেখে দিলে এই বেচারার প্রাণসংশয় হতে পারে?”

“হ্যাঁ স্যার, মনে হয়েছিল। কিন্তু আমাদের এখানে ওটা অপারেশন করা সম্ভব নয়। এরা এত গরিব যে, শহরে গিয়ে নিজেদের উদ্যোগে অপারেশন করাতেও পারবে না,” ডাক্তারবাবু বললেন।

“ওর বাবা মা আছে?” সিভিল সার্জেন জিজ্ঞাসা করলেন।

উত্তরটা এতোয়ারির কাছ থেকে জেনে নিয়ে জানালেন ডাক্তারবাবু।

“আমার মনে হচ্ছে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ওটা অপারেশন করে বাদ দেওয়া দরকার। কিছুদিন পরে আর অপারেশন করাও যাবে না। আপনারা যদি মেয়েটিকে বাঁচাতে চান, তা হলে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব জলপাইগুড়ির হাসপাতালে পাঠিয়ে দিন,” সিভিল সার্জেন বললেন।
 
ভদ্রলোক চলে যাওয়ার পর ম্যানেজার সাহেব ডাক্তারবাবুকে ডেকে বললেন, “আমি স্থির করেছি, মেয়েটির অপারেশনের ব্যাপারে কোম্পানিকে অনুরোধ করব সাহায্য করতে। এটা প্রচার হলে সবাই জানবে, আমরা শ্রমিকদের সঙ্গে মানবিক ব্যবহার করি। আপনি ওর বাবা-মায়ের সঙ্গে কথা বলুন। ওরা অনুমতি দিতে ওকে জলপাইগুড়িতে পাঠিয়ে দিন।’’

“ঠিক আছে। কিন্তু আমি লক্ষ করেছি বেশির ভাগ শ্রমিক অপারেশনে ভয় পায়। যদি ওর বাবা মা রাজি না হয়,” ডাক্তারবাবু বললেন।

“ওরা রাজি না-হলেও মেয়েটি যদি রাজি থাকে, তা হলে ওকে জলপাইগুড়িতে সিভিল সার্জেনের অফিসে পাঠিয়ে দিন। কেউ কিছু বললে তাকে বলবেন আমার সঙ্গে কথা বলতে,” ম্যানেজার গম্ভীর হয়ে বললেন।

বাবা আসেনি। বাবার পক্ষে আসা সম্ভবও ছিল না। মা এসেছিল। ডাক্তারবাবুর প্রস্তাব শুনে জিজ্ঞাসা করেছিল, “অপারেশন হলে ও কি মাইনে পাবে?”

অবাক হয়ে তাকিয়েছিলেন ডাক্তারবাবু। তারপর মাথা নেড়েছিলেন, “আমি ম্যানেজার সাহেবের সঙ্গে কথা বলব যাতে ওকে টাকা দেওয়া হয়!”

ম্যানেজার সাহেবের নির্দেশে পাতিবাবু এতোয়ারি আর তার মাকে নিয়ে জলপাইগুড়ি শহরে চলে গেলেন। যাওয়ার আগে এতোয়ারির বাবাকে হাসপাতালে নিয়ে আসা হল। মেয়ে সুস্থ হয়ে ফিরে না-আসা পর্যন্ত পঙ্গু মানুষটা হাসপাতালের এক কোণে থাকবে। এই ব্যবস্থা না করলে এতোয়ারির মা মেয়ের সঙ্গে যেতে চাইছিল না।

তিনদিন পরে অপারেশন হল। এই তিনদিন এতোয়ারিকে যখন ওষুধপত্র অথবা ইনজেকশন দেওয়া হত, তখন ওর মা পাশে থাকত। কিন্তু এতোয়ারি লক্ষ করছিল, দ্বিতীয় দিন থেকেই মায়ের চালচলনে একটু একটু করে পরিবর্তন আসছে। কথাবার্তাতেও। হাসপাতালের খাবার খাওয়া, হাসপাতালেই মেয়ের খাটের পাশে মেঝের ওপর চাদর পেতে শোওয়া, হাসপাতালের বাথরুম ব্যবহার করে মা বাকি সময়টা, প্রাথমিক আড়ষ্টতা কাটানোর পর ঘুরে ঘুরে বেড়াত। কোন মহিলা কী অসুখ নিয়ে হাসপাতালে ভরতি হয়েছে, তা যেমন তার একদিনেই জানা হয়ে গিয়েছিল, তেমনই তার মেয়েকে সবচেয়ে বড় ডাক্তার নিজে অপারেশন করতে হাসপাতালে নিয়ে এসেছেন, এই খবর সবাইকে জানিয়ে দিয়ে সে খুব তৃপ্তি পেয়েছিল।

দ্বিতীয়দিনের বিকেলে এতোয়ারির মনে হচ্ছিল মাকে একটু অন্যরকম দেখাচ্ছে। ঠোঁটে হাসি ফুটিয়ে কথা বলছে, একটু যেন ছটফটে। কয়েকবার একই কথা বলল, “তুই একদম ভয় পাবি না। ডাক্তারবাবু তোকে ঠিক করে দেবে। আর কেউ তোকে খারাপ দেখতে বলতে পারবে না।”

অপারেশনের দিন একটুও ভয় পাচ্ছিল না এতোয়ারি। সবাই বলত যদি তার কপালের এই ঢিবিটা আচমকা ফেটে যায়, তা হলে সঙ্গে সঙ্গে সে মরে যাবে। ডাক্তারবাবুরা যদি আবটাকে যত্ন করে সরিয়ে দিতে পারে, তা হলে আর সেই ভয় থাকবে না। বাড়িতে যে-ঘষা আয়না আছে, তাতে নিজের যে-মুখ দেখতে সে অভ্যস্ত, তাতে আব চোখ সওয়া হয়ে গিয়েছে। ওই আব অপারেশনের পর সে মারা গেল না, এমন হলে তার মুখটা কীরকম দেখাবে? সে কল্পনা করতে চেয়েও নাগাল পায়নি।
 
অপারেশনের আগে অনেক ওষুধ, কয়েকটা ইনজেকশনের যন্ত্রণা দাঁতে দাঁত চেপে সহ্য করেছিল এতোয়ারি। পাশে দাঁড়িয়ে মা বারবার বলছিল, ‘সব ঠিক হয়ে যাবে, সব ঠিক হয়ে যাবে।’

অপারেশনের পর কতক্ষণ বাদে তার জ্ঞান ফিরে এসেছিল সে জানে না। মুখে মাথায় ব্যথা। চোখ খুলে তাকাতেই নার্সের ঝাপসা মুখ দেখতে পেল। নার্সের গলা কানে এল, “শরীর খারাপ লাগছে? ব্যথা হচ্ছে?”

কথা না বলে মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলল এতোয়ারি।

মিনিটখানেক বাদে বাঁ হাতের কবজির কিছুটা ওপরে সুচ ফোটানোর ব্যথা অনুভব করল সে। মুখ থেকে যন্ত্রণার শব্দ ছিটকে বেরিয়ে এল। কিন্তু নার্স ব্যথার জায়গাটা মালিশ করে দিতে না-দিতেই কীরকম ঘোর লাগল। আর কিছু মনে নেই।

যখন চেতনা এল তখন মায়ের গলা শুনতে পেল, “বাব্বা, কতক্ষণ ধরে তুই ঘুমালি! এখন কীরকম লাগছে?”

বড় শ্বাস নিল এতোয়ারি, “ভাল,” তারপর মনে পড়তেই হাত তুলে কপাল স্পর্শ করে বুঝতে পারল তার কপাল ঢেকে রাখা হয়েছে। নার্স এগিয়ে এল, “হাত দিয়ো না। তোমার যে-জায়গায় অপারেশন হয়েছে, সেটা ব্যান্ডেজে ঢাকা আছে।”

সেই বিকেলে মা দুঃখী দুঃখী মুখ করে বলল, “এরা আমাকে চলে যেতে বলছে।”

“মানে?” অবাক হল এতোয়ারি।

“এরা বলছে তোর অপারেশন ভালভাবে হয়ে গেছে, তাই আর আমার এখানে থাকার দরকার নেই। তোকে আরও সাতদিন এখানে রেখে বাগানে পাঠিয়ে দেবে এরাই। কিন্তু আমি এখন যেতে চাই না, আমি তোর সঙ্গে ফিরে যেতে চাই,” মা কাঁদো কাঁদো গলায় বলল।

কী বলবে বুঝতে পারছিল না এতোয়ারি।

মা বলল, “জীবনে এত আরাম, এত আনন্দে আমি কখনও থাকিনি রে। তোর বাবা আমাকে কোনওদিন এত শান্তি দেওয়ার কথা ভাবেওনি। আমি যদি আরও ক’টা দিন এখানে থেকে তোকে নিয়ে ফিরে যাই, তা হলে এদের কত ক্ষতি হবে!”

“তুমি ওদের বলেছ?”

“কেউ শুনতেও চাইছে না,” মা কেঁদে ফেলল।

এইসময় নার্স প্রায় দৌড়ে কাছে এসে বলল, “যাও, যাও, বাইরে যাও। সিভিল সার্জেন সাহেব আসছেন। এখন এখানে থেকো না।”

মা কিছু বলার আগেই একজন আয়া তাকে ধরে বাইরে নিয়ে গেল। একটু পরে সিভিল সার্জেন এলেন, সঙ্গে কয়েকজন ডাক্তার এবং হেড নার্স। ইশারায় এতোয়ারিকে দেখিয়ে দিলে, সিভিল সার্জেন খাটের পাশে এসে ভাঙা হিন্দিতে জিজ্ঞাসা করলেন, “এখন কেমন আছ?”

এত লোক দেখে ভয়ে গলা শুকিয়ে গিয়েছিল এতোয়ারির। তার গলা দিয়ে স্বর বের হল না। সিভিল সার্জেন ইশারা করলে, হেড নার্স ব্যান্ডেজ খুলে দিলেন। জায়গাটা ভাল করে পরীক্ষা করে মাথা নাড়লেন সিভিল সার্জেন। তাঁর ঠোঁটে হাসি ফুটল। বললেন, “গুড,” যে-ডাক্তারের অধীনে এতোয়ারির চিকিৎসা হচ্ছে, তিনি প্রেসক্রিপশন দেখালেন। কী কী ওষুধ দেওয়া হচ্ছে দেখে খানিকটা কথা বলে সিভিল সার্জেনের নির্দেশে আবার ব্যান্ডেজ বেঁধে দেওয়া হল। ভদ্রলোক ভাঙা হিন্দিতে বললেন, “আর সাতদিন পরে বাড়িতে যেতে পারবে।”

এতোয়ারির গলা থেকে শেষপর্যন্ত শব্দ বের হল।

সিভিল সার্জেন জিজ্ঞাসা করলেন, “ইয়েস, কিছু বলবে?”

“আমার মা, মা যদি আমার সঙ্গে থাকে…” কথা শেষ করতে পারল না সে।

বড় ডাক্তারের সঙ্গে আলোচনা করে ঘাড় লাড়লেন সিভিল সার্জেন, “ওয়েল, ঠিক আছে, তোমার মা থাকতে পারে।”
 
দলটা চলে যাওয়ার পরেই মা ছুটে এল। হাঁটু গেড়ে বসে দু’হাতে মেয়েকে জড়িয়ে ধরে বলল, “আমাকে যেতে হবে না রে, ওরা আমাকে থাকতে দেবে। ওঃ, আরও কয়েকটা দিন এখানে থাকতে পারব রে।”

চা-বাগানের গাড়ি ওদের হাসপাতালে পৌঁছে দিয়েছিল অপারেশনের জন্যে। এখন কয়েকটা দিন কী কী ওষুধ খেতে হবে, তা বুঝে নিয়ে বাগানে ফিরে যাওয়ার জন্যে বাইরে বেরিয়ে কোনও গাড়ি দেখতে পেল না। পাতিবাবু তাদের পৌঁছে দিতে এসেছিলেন, তিনিও আসেননি। এই সময় যে-ডাক্তারবাবু দু’বেলা তার দেখাশোনা করছিলেন, তিনি ওদের দেখতে পেয়ে সমস্যার সমাধান করলেন। জলপাইগুড়ি থেকে চা-বাগানের বাজারে যে-বাস যায়, তার ভাড়ার পয়সা হাতে গুঁজে দিলেন।

চা-বাগানের বাজারে বাস পৌঁছল ভরদুপুরে। চেনা জায়গা, চেনা পথ। এতোয়ারিরা প্রথমে চা-বাগানের ভেতরে হাসপাতালের দিকে এগোল। বাগানের মুখেই বঙ্কু সর্দারের সঙ্গে দেখা। বঙ্কু সর্দার মাকে জিজ্ঞাসা করল, “আরে! মেয়ে কেমন আছে?”

মা হেসে বলল, “এই তো, পাশেই আছে, ওকেই জিজ্ঞাসা করো।”

বঙ্কু সর্দারের চোখ বড় হয়ে গেল, “কী আশ্চর্য! ওর মুখ যে একদম পালটে গিয়েছে!”

মা বলল, “হ্যাঁ, অপারেশনের পরে এরকম দেখাচ্ছে। ওই টিউমারটা সব ঢেকে রেখেছিল।”

মাথা নাড়ল বঙ্কু সর্দার, “ঠিক ঠিক। কিন্তু শুধু মেয়ে না, মায়েরও পরিবর্তন হয়েছে নাকি!”

মা ঠোঁট ওলটাল, “কী যে বলো, আমার পরিবর্তন হবে কেন?”

“উঁহু! তোমাকে একটু অন্যরকম দেখাচ্ছে।”

“কীরকম?” হাসল এতোয়ারির মা।

কথার জবাব না-দিয়ে মাথা নাড়তে নাড়তে চলে গেল বঙ্কু সর্দার।

এইসময় চা-বাগান ঝিমিয়ে থাকে। বাগানের ভেতর নুড়ি বিছানো রাস্তাগুলো চুপচাপ ঘুঘুর ডাক শোনে। মা এবং মেয়ে পথটা হেঁটে চলে আসে ছোট্ট হাসপাতালের সামনে। এখন ডাক্তার দেখাতে আসা রোগীদের ভিড় নেই, কিন্তু বারান্দায় পা দিতেই ছোট নার্স চোখ বড় করে এগিয়ে এল, “ও মা! তুই তো একদম অন্যরকম হয়ে গিয়েছিস রে,” ছোট নার্স কাছে এসে এতোয়ারির চিবুক তুলে ধরে ভ্রূ-র দিকে তাকাল। পাতলা তুলোর ওপর একটা ব্যান্ডেজ বাঁধা রয়েছে।

ছোট নার্স বলল, “বাঃ, তোর আবটা একদম চলে গেছে। ব্যান্ডেজ খোলার পর তোকে খুব সুন্দর দেখাবে রে।”

ভিড় জমে গেল এতোয়ারিকে ঘিরে। বড় নার্স বললেন, “তোমরা এখন বাড়িতে চলে যাও। কাল সকালে এসে ডাক্তারবাবুর সঙ্গে দেখা করবে।”

কিন্তু বেঁকে বসেছিল এতোয়ারির বাবা। মাথা নাড়তে নাড়তে বলে উঠল, “দূর! এ আমার মেয়ে না। বউ কোথা থেকে কাকে ধরে এনেছে।”

ছোট নার্স হাসি চাপতে চাপতে জিজ্ঞাসা করেছিল, “ভাল করে তাকিয়ে দ্যাখো, পাশে যে দাঁড়িয়ে আছে সে তোমার বউ কি না!”

“বউ ছিল, এখন নেই,” গম্ভীর গলায় বলল লোকটা।

চোখ কপালে উঠল ছোট নার্সের, “সে কী! কেন?”

“শহরে গিয়ে ও একদম বদলে গিয়েছে। দেখছ না, শহরের মেয়ের মতো শাড়ি পরেছে। যার অত বড় মেয়ে, সে কেন ওভাবে শাড়ি পরবে?”

হাসপাতাল ছেড়ে যেতে চাইছিল না লোকটা। দু’বেলা পেট ভরতি খাবার, সকাল-বিকেল চা বিস্কুট, মেঝেতে শুতে হলেও মাথার নীচে বালিশের আরাম ছেড়ে লাইনের ঘরে যাবে না বলে প্রায় বিদ্রোহ করে বসেছিল, তাকে অনেক বুঝিয়ে রিকশায় চাপিয়ে মেয়ে-বউয়ের সঙ্গে বাড়ি পাঠানো হল।

সেই রাতে এতোয়ারি মায়ের অন্য রূপটা প্রথম দেখল।
 

Users who are viewing this thread

Back
Top