জলপাইগুড়িতে তার খবর এখনও পৌঁছায়নি। তার পকেটে অবশ্য এমন কিছু ছিল না যা থেকে কেউ তার ঠিকানা খুঁজে পাবে। অবশ্য স্যুটকেস খুললে সব কিছু পাওয়া যাবে। বাবার বন্ধুকে লেখা চিঠিও ওতে আছে। তা হলে কি স্যুটকেস বিডিং–এর হদিস কেউ পায়নি? ও দুটো হারালে সে কি করবে? তার সব শার্ট প্যান্ট তো ওই স্যুটকেসেই আছে। খুব দুর্বল লাগছে এখন।
জ্ঞান ফিরেছে?
অনিমেষ দেখল একজন ডাক্তার–ডাক্তারই, কেননা গলায় স্টেথো ঝোলানো; ওকে প্রশ্ন করছেন। শরীরের পাশে নেতিয়ে থাকা ডান হাতের কবজিটা তুলে পালস্ দেখলেন তিনি, তারপর বললেন,
পাঁচ মিনিটের বেশি কথা বলবেন না।
বাঁধা গৎ। মোটা গলার চাপা হাসি কানে এল।
যা বলেন, তবে এ কেসে আর একটু ব্লিডিং হলে বাঁচানো যেত না। অনিমেষ ডাক্তারকে চলে যেতে দেখল। শরীর থেকে অনেক রক্ত বেরিয়ে গেছে? অনিমেষের ইচ্ছে করছিল ডাক্তারকে জিজ্ঞাসা করে তার পা আস্ত আছে কিনা? সে নিজে উঠে বসে যে দেখবে তেমন শক্তি নেই। যদি পা বাদ দিয়ে থাকে ওরা তা হলে সে কি করবে? চিরকাল খোঁড়া হয়ে হাঁটা–, মেঝেতে কিছু ঘষটে আনার শব্দ হতে অনিমেষ ঘাড় ফিরিয়ে তাকাল। একজন রোগা মানুষ কিন্তু কাতলা মাছের মত মুখ, সবুজ হাওয়াই শার্ট আর প্যান্ট পরা, ওপাশ থেকে একটা টুল ঘষটে খাটের কাছে নিয়ে এল। লোকটার চোখ সে ভাল করে দেখতে পাচ্ছে না; কারণ, নাকের পাশে আর ভ্রূর তলার ঢিপি মাংস সে দুটোকে প্রায় ঢেকে রেখেছে।
বিপ্লব হল? মুখের ভেতর চিবিয়ে ছিবড়ে ছুঁড়ে ফেলছে এমন ভঙ্গি কথা বলার । প্রশ্নটা বুঝতে পারল না, কিসের বিপ্লব, তার সঙ্গে ওর কি সম্পর্ক।
ফেরেব্বাজী আমি একদম পছন্দ করি না। যা জিজ্ঞাসা করব চটপট জবাব দেবে, তোমার চৌদ্দ পুরুষের ভাগ্য যে হাসপাতালে শুয়ে আছ। কথা বলে নিঃশব্দে হাঁ করে হাসল লোকটা। অনিমেষ দেখল ওর দাঁতগুলো খুব ছোট, চোখের মত, আছে কি নেই বোঝা যায় না। সে খুব সাহস করে জিজ্ঞাসা করল, আপনি কে?
তোমাদের পরিত্রাতা, ঈশ্বর। ঈশ্বরকে চেনো? যার ডাক নাম ভগবান? বলেই ভেঙচিয়ে উঠল লোকটা, আপনি কে? নবাব সাহেব আমাকেই প্রশ্ন করছেন উল্টে। একদম না। যা জিজ্ঞাসা করার তা আমিই করব। হাতের ডায়েরি খুলে প্রথম প্রশ্ন হল, বাপ-মার দেওয়া নামটা কি?
অনিমেষ। ঠোঁট শুকিয়ে যাচ্ছে, জিভ টানছে অনিমেষের।
পুরো নাম বলার অভ্যেস নেই নাকি? আচ্ছা ত্যাঁদোড় তো! যেন রবীন্দ্রনাথ, হিটলার, বললেই চিনে ফেলতে হবে। পুরো নাম ঠিকানা বলো!
অনিমেষ বাধ্য হয়ে লোকটার হুকুম তামিল করতেই খিঁচুনি শুনতে পেল, আবার নক্করবাজী! বোমা ছুঁড়লে শ্যালদায় আর ঠিকানা দিচ্ছ সেই জলপাইগুড়ির, ওখান থেকে বিপ্লব করতে এসেছিলে?
অনিমেষ এতক্ষণে বিপ্লব শব্দটার অর্থ ধরতে পারল। সেদিন যে ট্রাম জ্বলছিল, বোমা পড়ছিল, লোকটা তাকেই ব্যঙ্গ করছে। নার্স যার কথা বলছিলেন বাবাজী তিনি যে সুবিধের নন সেটা এতক্ষণে বোঝা হয়ে গেছে। কিন্তু এখন আর কোন ভয় লাগছে না অনিমেষের। সে সহজ গলায় জিজ্ঞাসা করল,
আপনাকে কেউ সত্যি কথা বলে না, না?
না, নেভার । পুলিশদের কারবার সেরা মিথ্যুকদের সঙ্গে। এবার আসল ঠিকানাটা বলে ফেল। আরে বাবা, বাপ-মা থাকলে তারা এতক্ষণে হেদিয়ে মরছে, ঠিকানা জানলে আমি খবরটা দিয়ে দেব। স্নেহ-স্নেহ মুখ করার চেষ্টা করতেই লোকটার চোখের তলার মাংসের ঢিবি নেচে উঠল।
আমি ঠিকই বলছি। জলপাইগুড়ি শহরের হাকিমপাড়ায় আমি থাকতাম। বাবা স্বৰ্গছেঁড়া চা বাগানে কাজ করেন। কথা বলতে এখন ক্লান্ত লাগছে। লোকটা যদি সত্যিই দাদুকে খবরটা দিয়ে দেয়। ঠিকানা লিখে নিয়ে লোকটা জিজ্ঞাসা করল, তোমার সঙ্গে আর যারা ছিল তাদের নাম বল?
একজন বৃদ্ধ ভদ্রলোক। উনি ফুটপাতে পড়ে গিয়েছিলেন, নাম জানি না।
বৃদ্ধ–ইয়ার্কি?
আমরা নর্থ বেঙ্গল এক্সপ্রেসে এসেছিলাম। স্টেশনে নেমে দেখলাম খুব গোলমাল হচ্ছে। অনেকক্ষণ অপেক্ষা করার পর উনি আমায় নিয়ে বেরিয়েছিলেন।
বেশ, বেশ, বলে যাও। পকেট থেকে একটা চারমিনারের প্যাকেট বের করেও কি ভেবে আবার বুক পকেটে রেখে দিল লোকটা।
আমি এর আগে কখনও কলকাতায় আসিনি!
বাঃ, গুড, চলুক।
আমরা যখন রাস্তায় এলাম তখন চারপাশে নিস্তব্ধ আর একটা ট্রাম দাউ দাউ করে জ্বলছিল।
জ্ঞান ফিরেছে?
অনিমেষ দেখল একজন ডাক্তার–ডাক্তারই, কেননা গলায় স্টেথো ঝোলানো; ওকে প্রশ্ন করছেন। শরীরের পাশে নেতিয়ে থাকা ডান হাতের কবজিটা তুলে পালস্ দেখলেন তিনি, তারপর বললেন,
পাঁচ মিনিটের বেশি কথা বলবেন না।
বাঁধা গৎ। মোটা গলার চাপা হাসি কানে এল।
যা বলেন, তবে এ কেসে আর একটু ব্লিডিং হলে বাঁচানো যেত না। অনিমেষ ডাক্তারকে চলে যেতে দেখল। শরীর থেকে অনেক রক্ত বেরিয়ে গেছে? অনিমেষের ইচ্ছে করছিল ডাক্তারকে জিজ্ঞাসা করে তার পা আস্ত আছে কিনা? সে নিজে উঠে বসে যে দেখবে তেমন শক্তি নেই। যদি পা বাদ দিয়ে থাকে ওরা তা হলে সে কি করবে? চিরকাল খোঁড়া হয়ে হাঁটা–, মেঝেতে কিছু ঘষটে আনার শব্দ হতে অনিমেষ ঘাড় ফিরিয়ে তাকাল। একজন রোগা মানুষ কিন্তু কাতলা মাছের মত মুখ, সবুজ হাওয়াই শার্ট আর প্যান্ট পরা, ওপাশ থেকে একটা টুল ঘষটে খাটের কাছে নিয়ে এল। লোকটার চোখ সে ভাল করে দেখতে পাচ্ছে না; কারণ, নাকের পাশে আর ভ্রূর তলার ঢিপি মাংস সে দুটোকে প্রায় ঢেকে রেখেছে।
বিপ্লব হল? মুখের ভেতর চিবিয়ে ছিবড়ে ছুঁড়ে ফেলছে এমন ভঙ্গি কথা বলার । প্রশ্নটা বুঝতে পারল না, কিসের বিপ্লব, তার সঙ্গে ওর কি সম্পর্ক।
ফেরেব্বাজী আমি একদম পছন্দ করি না। যা জিজ্ঞাসা করব চটপট জবাব দেবে, তোমার চৌদ্দ পুরুষের ভাগ্য যে হাসপাতালে শুয়ে আছ। কথা বলে নিঃশব্দে হাঁ করে হাসল লোকটা। অনিমেষ দেখল ওর দাঁতগুলো খুব ছোট, চোখের মত, আছে কি নেই বোঝা যায় না। সে খুব সাহস করে জিজ্ঞাসা করল, আপনি কে?
তোমাদের পরিত্রাতা, ঈশ্বর। ঈশ্বরকে চেনো? যার ডাক নাম ভগবান? বলেই ভেঙচিয়ে উঠল লোকটা, আপনি কে? নবাব সাহেব আমাকেই প্রশ্ন করছেন উল্টে। একদম না। যা জিজ্ঞাসা করার তা আমিই করব। হাতের ডায়েরি খুলে প্রথম প্রশ্ন হল, বাপ-মার দেওয়া নামটা কি?
অনিমেষ। ঠোঁট শুকিয়ে যাচ্ছে, জিভ টানছে অনিমেষের।
পুরো নাম বলার অভ্যেস নেই নাকি? আচ্ছা ত্যাঁদোড় তো! যেন রবীন্দ্রনাথ, হিটলার, বললেই চিনে ফেলতে হবে। পুরো নাম ঠিকানা বলো!
অনিমেষ বাধ্য হয়ে লোকটার হুকুম তামিল করতেই খিঁচুনি শুনতে পেল, আবার নক্করবাজী! বোমা ছুঁড়লে শ্যালদায় আর ঠিকানা দিচ্ছ সেই জলপাইগুড়ির, ওখান থেকে বিপ্লব করতে এসেছিলে?
অনিমেষ এতক্ষণে বিপ্লব শব্দটার অর্থ ধরতে পারল। সেদিন যে ট্রাম জ্বলছিল, বোমা পড়ছিল, লোকটা তাকেই ব্যঙ্গ করছে। নার্স যার কথা বলছিলেন বাবাজী তিনি যে সুবিধের নন সেটা এতক্ষণে বোঝা হয়ে গেছে। কিন্তু এখন আর কোন ভয় লাগছে না অনিমেষের। সে সহজ গলায় জিজ্ঞাসা করল,
আপনাকে কেউ সত্যি কথা বলে না, না?
না, নেভার । পুলিশদের কারবার সেরা মিথ্যুকদের সঙ্গে। এবার আসল ঠিকানাটা বলে ফেল। আরে বাবা, বাপ-মা থাকলে তারা এতক্ষণে হেদিয়ে মরছে, ঠিকানা জানলে আমি খবরটা দিয়ে দেব। স্নেহ-স্নেহ মুখ করার চেষ্টা করতেই লোকটার চোখের তলার মাংসের ঢিবি নেচে উঠল।
আমি ঠিকই বলছি। জলপাইগুড়ি শহরের হাকিমপাড়ায় আমি থাকতাম। বাবা স্বৰ্গছেঁড়া চা বাগানে কাজ করেন। কথা বলতে এখন ক্লান্ত লাগছে। লোকটা যদি সত্যিই দাদুকে খবরটা দিয়ে দেয়। ঠিকানা লিখে নিয়ে লোকটা জিজ্ঞাসা করল, তোমার সঙ্গে আর যারা ছিল তাদের নাম বল?
একজন বৃদ্ধ ভদ্রলোক। উনি ফুটপাতে পড়ে গিয়েছিলেন, নাম জানি না।
বৃদ্ধ–ইয়ার্কি?
আমরা নর্থ বেঙ্গল এক্সপ্রেসে এসেছিলাম। স্টেশনে নেমে দেখলাম খুব গোলমাল হচ্ছে। অনেকক্ষণ অপেক্ষা করার পর উনি আমায় নিয়ে বেরিয়েছিলেন।
বেশ, বেশ, বলে যাও। পকেট থেকে একটা চারমিনারের প্যাকেট বের করেও কি ভেবে আবার বুক পকেটে রেখে দিল লোকটা।
আমি এর আগে কখনও কলকাতায় আসিনি!
বাঃ, গুড, চলুক।
আমরা যখন রাস্তায় এলাম তখন চারপাশে নিস্তব্ধ আর একটা ট্রাম দাউ দাউ করে জ্বলছিল।