খবরটা চাউর হয়ে গিয়েছিল। শুনে কার্ত্তিকের মাথা গরম হয়ে গেল। সটান সরস্বতীর কাছে এসে বলল, ‘পিতৃদেব নাকি ইনজাংশন জারি করেছেন, আমাদের পশ্চিমবাংলায় যাওয়া চলবে না!’
সরস্বতী বলল, ‘মা বলছিল বটে, তবে মা তো বাবাকে ঠিক ম্যানেজ করে নেবে। তুই ভাবিস না।’
‘ভাবব না? গত বার শুনে এসেছি, এক পুজোয় সেক্রেটারি বলছিল সামনের বার হয় মল্লিকা, নয় প্রীতি জিন্টাকে উদ্বোধনে নিয়ে আসবে। উঃ, কী জিনিস! আমি এ বারে ওদের দেখার জন্যে বসে আছি, পিতৃদেব না বললেই হল? এ রকম ডিক্টেটরশিপ সহ্য করবি?’
সরস্বতীর কপালে ভাঁজ পড়ল, ‘তুই ওই মেয়েদের জিনিস বললি কেন? পশ্চিমবাংলায় গিয়ে গিয়ে তোর ভাষা খুব নিম্নমুখী হয়েছে।’
‘সরি। আমাদের রম্ভা উর্বশীরা ওদের পায়ের নখের যুগ্যি নয়। তাই মুখ ফস্কে জিনিস বলে ফেলেছি। লক্ষ্মী কোথায়?’
‘জামাইবাবুর কাছে গেছে। পারমিশন নিতে। মা যদি না যায় তা হলে আমার কী দুরবস্থা বল? জামাইবাবু ছাড়া একটাও সুপুরুষ নেই, যার দিকে এখানে তাকানো যায়। বেশি তাকালে আবার বোনে বোনে ঝগড়া হয়ে যায়। চল, মায়ের কাছে গিয়ে শুনি, আসল ব্যাপার কী?’
কিন্তু যাওয়ার আগে গণেশ এল হেলেদুলে। বলল, ‘মা বলল রেডি হতে। মামার বাড়ি যেতে হবে।’ কার্ত্তিক চিৎকার করল, ‘পিতৃদেব রাজি হয়েছেন?’
‘হ্যাঁ। মা তোমাদের জানিয়ে দিতে বললেন।’ গণেশ বলল।
সরস্বতী বলল, ‘আমরা স্বর্গে থাকার সময় কেউ কারও মন জানতে পারি না। মর্তের মানুষদের মন কী ভাবছে, ঠিক টের পাই। আবার ইদানীং মর্তে গিয়ে দেখেছি, ওদের মনের কোনও খবরই বুঝতে পারি না। যাই, দিদিকে খবরটা দিই।’
কার্ত্তিক মনে মনে বলল, ‘এই সুযোগে জামাইবাবুকে এক বার দেখে আসবে। অদ্ভুত।’ যেহেতু স্বর্গে কেউ অন্তর্যামী নয়, তাই সরস্বতী বুঝতে পারল না।
কৈলাস থেকে শিবানী পুত্র কন্যাকে নিয়ে পশ্চিমবাংলায় যাত্রা শুরু করার আগে স্বামীকে প্রণাম করতে গেলেন। মহাদেব বললেন, ‘সাবধানে যাবে। বাসে বা অটোয় উঠবে না। ওরা ঠেলে ফেলে দেয়, নয় চড় মারে। একলা কোথাও যাবে না। তোমার বয়স তো শরীরে ছাপ ফেলেনি, ইভ মনে করে টিজ করবে রাস্তায়। আর হ্যাঁ, মহিষাসুর খবর পেয়েছে?’
শিবানী গলায় আঁচল জড়িয়ে প্রণাম সেরে উঠে বললেন, ‘হ্যাঁ। সে চরিত্র-সংশোধনাগার কেন্দ্র থেকে বেরিয়ে পৃথিবীর নভোমণ্ডলে আমাদের সঙ্গে যোগ দেবে। গত বার খুব সমস্যা করেছিল।’
‘কী করেছিল?’
‘কিছুতেই আমার দিকে মুখ করে লড়াই করতে চায় না। গেল বার যাওয়ার সময় বলে গেছে এ বারে যেন দর্শকের দিকে তার মুখ রাখা হয়। আমার তো হাত নেই, উদ্যোক্তারা যেমন চাইবে তেমনটাই হবে। বুঝতে চায় না।’
‘ও যায় বলে আমি একটু নিশ্চিন্তে থাকি। তোমার ধারে কাছে কেউ ঘেঁষতে পারে না।’ মহাদেব বললেন।
‘আহা! তিন কুল গিয়ে এক কুলে ঠেকেছে, তবু তোমার ভয় গেল না।’ শিবানী চোখের কোণে তাকিয়ে মুচকি হাসলেন।
‘সতীকে হারানোর যন্ত্রণা তোমাকে পেয়ে ভুলেছি। তাই ভয় তো হবেই।’
‘শোনো, দিদির শরীরের অংশ যেখানে যেখানে পড়েছিল, সেই জায়গাগুলো পবিত্র তীর্থ হয়ে গিয়েছে। লোক তাই এখনও দিদির নাম করে। আমার শুধু যাওয়া আসাই সার। আমার নামে কোনও তীর্থ নেই।’ ঠোঁট ফোলালেন শিবানী, চোখের পাতা ভিজে গেল।
‘কী যে বলো! পাঁচ ছয় দিন তো পাড়ায় পাড়ায় তোমার জন্যে তীর্থ হয়ে যায়। এ রকমটা আর কোনও দেবতা বা দেবীর বেলায় হয়েছে?’
হাসি ফুটল শিবানীর ঠোঁটে, ‘তা অবশ্য হয়নি। এই যে ছেলেমেয়েরা যখন একা একা যায়, তখন ওদের পুজো তেমন জমে না। তবে তুমি যখন আমার সতীনের সঙ্গে যাও তখন তো বাঙালি বাঁধনহারা।’
‘ভয়ে। ওই কালো রূপ, হাতে খাঁড়া, গলায় মুণ্ডুর মালা দেখে ভয় পায় ওরা। ওর গায়ের রং যদি তোমার মতো হত, তা হলে ভয়ের বদলে লোকে ভাবত ক্যাবারে দেখছি। যাক গে, এটা রাখো।’
মহাদেব একটা ফুল এগিয়ে ধরলেন।
শিবানী সেটা নিয়ে বললেন, ‘তুমি আমাকে ফুল দিয়ে বিদায় জানাচ্ছ?’
‘না, না। এ ফুল যে সে ফুল নয়। তোমরা যেই পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে প্রবেশ করবে, তখন গোপনে এই ফুল বের করে ঘ্রাণ নেবে। ব্যস, সঙ্গে সঙ্গে স্যাটেলাইটগুলো আর বাধা হবে না। তোমার অন্তর্দৃষ্টি অটুট থাকবে। তুমি অন্তর্যামিনী হয়ে মানুষের মনের কথা বুঝতে পারবে।’
‘উঃ। তুমি কী ভাল। আচ্ছা, ছেলেমেয়েদের ঘ্রাণ নিতে ফুলটা দেব?
‘আমার মনে হয়, না দেওয়াই ভাল। তা হলে পাবলিকের মনের কথা বুঝতে পেরে ওদের দুষ্টুমি বেড়ে যাবে।’ মহাদেব হাসলেন।
‘ঠিক বলেছ। শুনছি মল্লিকা আর প্রীতি নামের অপ্সরা আসবে উদ্বোধন করতে। ওরা কী ভাবছে, তা কার্ত্তিক জানতে পারলে মুশকিল হয়ে যাবে। আমি কাউকে ফুলটার কথা বলব না! এ বার আসি?’
মহাদেব বসে বসে হাত বাড়ালেন, ‘আয়ুষ্মতী ভব।’
‘তা হব। শোনো, এই ক’দিন একটু থিতু হয়ে থেকো। কৈলাস ছেড়ে কোথাও যেও না। ওখানে যাওয়ার পর অন্তর্দৃষ্টি থাকত না বলে জানতে পারতাম না আমি চলে গেলে তুমি কী কী করছ। এ বার তো জানতে পারব। যদি দেখি আবার কাউকে দু’দিনের জন্যে জুটিয়েছ, তা হলে আর ফিরে আসব না। এই বলে যাচ্ছি।’ শিবানী মহাদেবের সামনে থেকে বিদায় নিলেন। মহাদেবের মনে হল যেন রাজহংসী হেঁটে চলেছে। এখন বাহনদের নিয়ে যেতে হয় না। মণ্ডপে মণ্ডপে মাটির বাহন রেডি করা থাকে। উঠে বসলেই হল। যেহেতু তাদের কোনও নড়াচড়া নেই, নিয়ে যাওয়ার দরকারও পড়ে না। শিবানীর একটা পোষা সিংহ আছে। সেটা এখন এত বুড়ো হয়ে গিয়েছে হাঁটতে খুব কষ্ট হয়। ইঁদুর কিংবা হাঁস ওর লেজে ঠোকর দিলেও কিছু বলতে পারে না। মাটির ময়ূরে কার্ত্তিকের খুব আপত্তি। জ্যান্ত হলে রাতবিরেতে একটু ঘোরাঘুরি করতে পারত।
লক্ষ্মী বলল, ‘মা, এ বার আমরা কীসে যাব?’
‘অদৃশ্য দোলায় চেপে।’
কার্ত্তিক গুণগুণ করল, ‘দোলা, এ দোলা, রাজা মহারাজাদের দোলা।’
সরস্বতী ধমক দিল, ‘অ্যাই! কী গাইছিস?’
‘ভূপেন হাজারিকার গান। তিরিশ বছর আগে মণ্ডপে বাজিয়েছিল ওরা। এখনও মনে আছে।’ কার্ত্তিক বলল হাসতে হাসতে।
শুভক্ষণ দেখে শিবানী ছেলেমেয়েদের নিয়ে বায়ুতে শরীর ভাসিয়ে দিলেন। এখন তাঁদের শরীর অতি সূক্ষ্ম, তাই ভেসে যেতে কোনও সমস্যা হল না। যেতে যেতে তাঁরা প্রথমে গন্ধর্ব এবং অপ্সরাদের লীলা করতে দেখলেন। তারাও শিবানীকে সপরিবার দেখে দ্রুত সরে গেল।