ওপাশের বস্তিতে সুরেন মাইতি থানার বড়বাবুকে নিয়ে ঢুকেছে। ওদিকে যাস না। অনিমেষ কথাগুলো বললে অর্ক কাধ নাচিয়ে বেরিয়ে গেল। বারান্দার চেয়ারে বসল অনিমেষ। একদম বদলে গিয়েছে ছেলেটা। এই বস্তির কারও সঙ্গে মেলে না, কথা বলে যতটা সম্ভব না বললে না, ততটাই।
চা খেয়েছ? মাধবীলতার গলা ভেসে এল রান্নাঘর থেকে।
হ্যাঁ। কাল থেকে চায়ের দাম বাড়ছে। অনিমেষ বলল।
অনেক আগেই বাড়ানো উচিত ছিল। বাজারে গেলে বুঝতে পারতে জিনিসপত্রের দাম কোথায় পৌঁছেছে। আমাদের না হয় ছেলের রোজগার আছে। স্কুল থেকে পাওয়া টাকার ইন্টারেস্ট আছে কিন্তু ভেবে দ্যাখো তো, যাদের মাসিক রোজগার পাঁচ-ছয় হাজার তারা কী করে সংসার চালাচ্ছে। বলতে বলতে গরম রুটি আর আলু-পেঁয়াজের চচ্চড়ি প্লেটে নিয়ে বেরিয়ে এল মাধবীলতা, নাও।
অনিমেষ প্লেটটা ধরে বলল, তোমারটা?
কাল থেকে ঢেকুর উঠছে। আমি মুড়িজল খাব।
আমাকেও তাই দিতে পারতে। এসব করার দরকার ছিল না।
মাধবীলতা হেসে ফেলল, বাব্বাঃ। এত প্রেম! তা হলে তুমিও ঢেকুর তোলো, শুনি।
বললেই ঢেকুর তোলা যায় নাকি! এত করে বলছি, চলো ডাক্তারের কাছে যাই।
প্লিজ আর উপদেশ দিয়ো না।
তোমার মুড়িজল নিয়ে এসো এখানে।
মাধবীলতা তাকাল। তারপর চলে গেল রান্নাঘরে। অনিমেষ অপেক্ষা করছিল। ওকে এক বাটি জলে মুড়ি ডুবিয়ে আনতে দেখে রুটিতে হাত দিল। পাশের চেয়ারে বসে চামচে মুড়ি তুলে মুখে দিয়ে মাধবীলতা বলল, এটা খেতে তো আমার ভালই লাগে।
খবরের কাগজ দেয়নি? অনিমেষ জিজ্ঞাসা করল।
দিয়েছিল। অর্ক ঘরে রেখে গেছে। আনব?
না। থাক। পরে পড়ব। তারপর সে সুরেন মাইতির সঙ্গে যা কথা হয়েছিল তা মাধবীলতাকে বলল। সব শুনে মাধবীলতা বলল, এইটেই তো স্বাভাবিক।
স্বাভাবিক?
নয়তো কী? তুমি যদি তখন পড়তে পড়তে পার্টি ছেড়ে না-দিতে তা হলে নিশ্চয়ই এখন মন্ত্রী হতে হলে তুমি আরও বড়মাপের মিথ্যাচার করতে।
সেটাও স্বাভাবিক হত।
আমিও করতাম! অনিমেষ অবাক হয়ে তাকাল।
শেয়ালদের দলে বাঘ যেমন থাকে না বেড়ালও থাকতে পারে না। মাধবীলতা বলল, তুমি সুরেন মাইতিকে মনের কথা বলে ফেলোনি তো?
হাসল অনিমেষ, নাঃ! আমি এখন অনেক বুদ্ধিমান হয়েছি।
হলে ভাল। অনেক লড়াই করার পর এখন স্বস্তিতে আছি। অর্ক বলত, চলো, কলকাতার কাছাকাছি অল্প দামে ফ্ল্যাট ভাড়া করে চলে যাই। কিন্তু এই বাড়িতে আসার পর আমার ফ্ল্যাটে যেতে ইচ্ছে করে না। এই উঠোন, রান্নাঘর, একদম আলাদা থাকতেই ভাল লাগে। বেশ মফসসল মফস্সল বলে মনে হয়। মাধবীলতা বলল।
সবই ঠিক আছে। কিন্তু ছেলেটার কথা ভাবো।
ভেবে যখন সুরাহা করতে পারব না তখন মাথা ঘামিয়ে কী লাভ?
ওরা এভাবেই আলাদা থাকবে? তার চেয়ে কোর্টে গিয়ে সম্পর্ক ছিন্ন করলে অনেক ভাল হত। মেয়ে ডিভোর্স দেবে না তাই ছেলেও ওই পথে হটবে না। অদ্ভুত।
এই সময় কয়েক ফোঁটা জল আকাশ থেকে নেমে এল উঠোনে, ঘরের চালে। মাধবীলতা বলল, শেষ পর্যন্ত বৃষ্টি নামল।
কোথায় বৃষ্টি! দ্যাখো, আর জল পড়ছে না। খাওয়া শেষ করে হাত ধুতে উঠতে গিয়ে মনে পড়ল তারা বলল, আমার পকেট থেকে খামটা বের করো তো।
কী খাম?
জানি না, শ্যামলদের লেটার বক্সে পিয়ন রেখে গিয়েছিল। খুলে দ্যাখো কে পাঠিয়েছে।
মাধবীলতা মুড়ির জল খেয়ে নীচে বাটি রেখে অনিমেষের পকেট থেকে খামটা বের করল। উলটে পালটে দেখে বলল, কালই তো এসেছে।
হাত ধুতে ধুতে অনিমেষ বলল, মেয়েলি হাতের লেখা, দ্যাখো।
মাধবীলতা খামের মুখ ছিঁড়ে সাদা কাগজটা বের করে চোখ রাখল। পড়ে নিয়ে অনিমেষের দিকে তাকাল।
কাছে এসে অনিমেষ জিজ্ঞাসা করল, কে লিখেছে?
ছোটমা।
অ্যাঁ। ছোটমা? কী লিখেছেন?
পড়ো।
তুমিই পড়ো।
মাধবীলতা পড়ল। স্নেহের অনিমেষ, স্নেহের মাধবীলতা। দীর্ঘকাল তোমাদের সঙ্গে যোগাযোগ নেই। বড়দিদির কাজের সময় তোমরা এসেছিলে, ফিরে গিয়ে পৌঁছানোর সংবাদ দেওয়ার পর আর কোনও চিঠি লেখোনি। এতকাল এই বাড়ি ভূতের মতো আগলে রেখেছিলাম। ধীরে ধীরে বাড়িটির অবস্থা খারাপ হচ্ছে। আমার অবস্থাও করুণ। লোকজন এসে ক্রমাগত চাপ দিচ্ছে এই বাড়ি বিক্রি করে দেওয়ার জন্যে। জানি না এই চিঠি তোমরা পাবে কিনা। যদি পাও তা হলে কি একবার এখানে আসতে পারবে? তোমরা এবং অর্ক আমার আশীর্বাদ জেনো। ইতি, ছোটমা।