What's new
Nirjonmela Desi Forum

Talk about the things that matter to you! Wanting to join the rest of our members? Feel free to sign up today and gain full access!

Collected মৌষলকাল - সমরেশ মজুমদার (4 Viewers)

Kaptan Jacksparoow

Community Team
Elite Leader
Joined
Apr 6, 2019
Threads
325
Messages
5,984
Credits
44,713
T-Shirt
Profile Music
Recipe sushi
Rocket
Euro Banknote
Butterfly
মৌষলকাল
লেখক- সমরেশ মজুমদার


images-1.jpeg
 
কাছাকাছি কোথাও বৃষ্টি হয়েছে, বাতাসে তার আভাস পাওয়া যাচ্ছিল। সকাল থেকেই আকাশ কাদাটে মেঘ মেখে ঝিম ধরে আছে, গাছের পাতাগুলো মুখ নিচু করে, বাতাস পেলেই দুপাশে দুলছে, যে-কোনও মুহূর্তেই বৃষ্টি নামবে কিন্তু বৃষ্টির দেখা পাওয়া যাচ্ছিল না। ঈশ্বরপুকুর লেনের এই বস্তির সকালটাও বেশ চুপচাপ। মাধবীলতা কয়েকদিন আগে বলেছিল, সারা বছর ধরে যদি এইরকম থমথমে বৃষ্টি না ঝরা মেঘ, চারদিক ছায়া ঘনিয়ে থাকত তা হলে শান্তিতে কাটানো যেত!

অনিমেষ অবাক হয়েছিল, তুমি রোদ্র চাও না?

না। মাথা নেড়েছিল মাধবীলতা।

সে কী!

রোদ উঠতেই এই বস্তির মানুষগুলো পালটে যায়। সারাক্ষণ চিৎকার, ঝগড়া, অশ্লীল কথার বন্যা বয়ে যায়। যত দিন যাচ্ছে তত লক্ষ করছি, ওসব বলার সময় কেউ মা-বোন-দিদির উপস্থিতি কেয়ার করে না। কিন্তু রোদ না উঠলে, আকাশে মেঘ থাকলে এদের চরিত্র বদলে যায়। তখন কেউ চেঁচামেচি, ঝগড়া করে না। মাধবীলতা বলেছিল।

জানালার পাশের তক্তপোশে শুয়ে আকাশ দেখতে দেখতে মাধবীলতার কথাগুলো ভাবছিল অনিমেষ। কথাটা প্রায় সত্যি। অন্তত আজকের সকালে তো বটেই। এই সময় বস্তির কোথাও চিৎকার নেই। অথচ কাল রাত্রেও মনে হয়েছিল রক্তগঙ্গা বয়ে যাবে। বস্তির ওদিকের ঘরগুলোতে ইলেকট্রিকের কানেকশন দেয় সুরেন মাইতি। প্রতি পয়েন্টের জন্যে মাসে তিরিশ টাকা নেয়। ওর সঙ্গে ইলেকট্রিক কোম্পানির নাকি খুব ভাব আছে। তাই রাস্তার পেছনের লাইন থেকে হুক করে বিদ্যুৎ নিতে কোনও সমস্যায় পড়তে হয় না। সেই বিদ্যুৎ ওদিকের ঘরে ঘরে বিক্রি করে মোটা টাকা আয় করে প্রতি মাসে। ঈশ্বরপুকুর লেনের বামফ্রন্টের অন্যতম নেতা হল সুরেন মাইতি। কথাবার্তা চালচলন দেখে মনে হয় ও এই এলাকার মুখ্যমন্ত্রী। কখনও সখনও সুরেন মাইতি তার কাছে আসে। দরজায় দাঁড়িয়ে বলে, খুব খারাপ লাগে দাদা, আপনি এভাবে বসে গেলেন! সেদিন পার্টি অফিসে আপনার কথা বলছিলেন মিনিস্টার। ভুল রাজনীতি করে নিজের যে সর্বনাশ করেছিলেন তা শুধরে নেওয়ার প্রস্তাব নাকি দেওয়া হয়েছিল। আপনি রাজি হননি। এখন বলুন, কী লাভ হল তাতে?

অনিমেষ গম্ভীর গলায় বলেছিল, ভাবতে হবে।

ভাবুন। হেসে চলে গিয়েছিল সুরেন মাইতি।

আর একদিন দরজায় এসে পান চিবোতে চিবোতে বলেছিল, আজ বিকেলে লোকাল পার্টি অফিসে মিনিস্টার আসছেন। আপনাকে চা খেতে ডেকেছেন। যাবেন তো?

দেখি।

এতে দেখার কী আছে? কজনকে মিনিস্টার চা খেতে ডাকে বলুন?

পায়ে খুব যন্ত্রণা হচ্ছে।

দেখুন।

লোকটাকে একদম পছন্দ না হলেও নিজেকে চেপে রাখে অনিমেষ। আগে হলে মুখের ওপর সত্যি কথা বলে দিত। তাতে লোকটার কী প্রতিক্রিয়া হত তা নিয়ে মাথা ঘামাত না। বয়স এবং অর্থাভাব মানুষকে দুর্বল করে। এই সত্যিটা মেনে না নিয়ে কোনও উপায় নেই। গত রাত্রে ঝামেলাটা চরমে উঠেছিল। বস্তির দুটি ঘরের বাসিন্দা বিদ্যুতের দাম দিতে পারেনি বলে সুরেন মাইতির লোক কানেকশন কাটতে গিয়েছিল। যাদের ঘর তারা বাধা দিয়েছিল। লোকটা পার্টি অফিসে গিয়ে সুরেন মাইতিকে ব্যাপারটা জানায়। রাত এগারোটা নাগাদ দশজনের দলটা বস্তিতে ঢোকে। বেছে বেছে তারা ওই দুটি ঘরের বাসিন্দাদের বাইরে টেনে বের করে বেধড়ক মারে। ঘরের ভেতর যা ছিল তা আর আস্ত রাখেনি। বস্তির অন্য বাসিন্দারা এগিয়ে গিয়েছিল কিন্তু বাধা দিতে পারেনি। চারজনের হাতে অস্ত্র ছিল। অবাধ্য হওয়ার জন্যে শিক্ষা দিয়ে কয়েকটা বোমা ফাটিয়ে হাঁটতে হাঁটতে ওরা চলে গিয়েছিল রেললাইনের দিকে। তার মিনিট দশেকের মধ্যে ছুটে এসেছিল সুরেন মাইতি সদলে। এসে নাটক করল। চেঁচিয়ে ভর্ৎসনা করল ভিড় করে আসা জনতাকে। বাইরের কিছু গুন্ডা এসে বস্তিতে হামলা করে গেল আর সবাই কী করে মুখ বুজে সেটা সহ্য করল সুরেন মাইতি ভেবে পাচ্ছে না। যে দুটি ঘরের বাসিন্দারা আঘাত পেয়েছিল তাদের চিকিৎসার জন্যে ডাক্তার ডাকিয়ে আনল সে। এই ভূমিকা দেখে জনতা ধীরে ধীরে পাতলা হয়ে গেল।
 
জানলা দিয়ে আকাশ দেখতে দেখতে হাসল অনিমেষ। সেই কবে থেকে একই খেলা চলে আসছে। মাঝে মাঝে তার মনে হত এই বস্তি, পার্টির নিচুতলার নেতাদের কীর্তিকাহিনি নিশ্চয়ই কেন্দ্রীয় নেতাদের কানে পৌঁছোয় না। যাদের সঙ্গে সে বিশ্ববিদ্যালয়ে একসঙ্গে পড়েছে তাদের অনেকেই তো হয় কেন্দ্রীয় নেতা নয় মন্ত্রী। কিন্তু ক্রমশ ধারণা বদলে যাচ্ছে তার। আর যাই হোক নেতারা মূর্খ বা বধির নয়। এতদিনে খবরগুলো তাদের অজানা থাকতে পারে না।

দরজায় শব্দ হল। তারপরই প্রশ্ন, এখনও শুয়ে আছ?

অনিমেষ চোখ ফেরাল। মাধবীলতা দাঁড়িয়ে আছে। হাতে বাজারের ব্যাগ।

অনিমেষ উঠে বসল, কী করব! এরকম ওয়েদারে কিছুই তো ভাল লাগে না।

ছেলে উঠেছে? মাধবীলতা জিজ্ঞাসা করল।

বোধহয় না। সাড়া পাইনি।

কাল কখন ফিরেছে জানো?

না।

পৌনে একটায়। কিছু খেল না, বলল ঘুম পাচ্ছে।

অনিমেষ কিছু বলল না। তক্তপোশ থেকে নামতে নামতে দেখল মাধবীলতা বাজারের ব্যাগ হাতে রান্নাঘরের দিকে চলে গেল। সে চোখ বন্ধ করল। ধীরে ধীরে তার মাথার চুলের সব কালো মুছে গেছে। আজকাল দাড়ি কামাতেও ইচ্ছে হয় না কিন্তু মাধবীলতার তাড়ায় একদিন অন্তর কামাতে হয়। কিন্তু সে গোঁফ রেখেছে, কঁচাপাকা গোঁফ। আয়নার সামনে দাঁড়ালে নিজেকে অপরিচিত মনে হয়। মাধবীলতা পালটে গিয়েছে অনেক। শরীর খুবই শীর্ণ হয়েছে, মুখের আদল বদলে গিয়েছে। চুলে সাদা ছোপ থাকলেও তা আগের মতন কোমরের নীচে থমকে আছে। এখন সে হাঁটে খুব শ্লথ গতিতে। অনিমেষের সন্দেহ হয় মাধবীলতা পুরোপুরি সুস্থ নয়। ওকে অনেকবার ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে চেয়েছে সে, কিন্তু মাধবীলতার এক কথা, আমার কিছুই হয়নি। খামোক ডাক্তারকে পয়সা দিতে কেন যাব? অথবা, শরীর থাকলেই অসুখ থাকবে, যে অসুখ ঘুমিয়ে আছে, কোনও ঝামেলা করছে না, খুঁচিয়ে তাকে জাগাবার কোনও মানে আছে?

অনিমেষ ক্রাচ বগলে নিয়ে ব্রাশে পেস্ট লাগিয়ে চিলতে উঠোনে নামল। এই বস্তির সেরা এলাকা এটা। প্রথমে যে বারোয়ারি বাড়ির ছোট্ট ঘরে ছিল ওরা তা থেকে একসময় সরে এসে এই বাড়িতে থাকছে কয়েক বছর আগে থেকে। দুটো ঘর, একচিলতে উঠোন, রান্নাঘর, আলাদা কল-পায়খানা। বস্তির মালিকের বদান্যতায় অনেক কম ভাড়ায় পেয়ে গেছে অর্ক। ফলে অন্যদের সঙ্গে একটা ব্যবধান তৈরি হয়েছে। একটু আড়াল, যার কারণে স্বচ্ছন্দে থাকা যায়। কলের জলে মুখ ধুয়ে, প্রাকৃতিক কাজ শেষ করে সে ছেলের ঘরের সামনে দাঁড়াল। দরজা ভেতর থেকে বন্ধ।

রান্নাঘর থেকে মাধবীলতার গলা ভেসে এল, ওকে ডেকো না!

কটা বাজে এখন? অনিমেষ জিজ্ঞাসা করল।

যাই বাজুক। সারাদিন পরিশ্রম করে অত রাত্রে এসেছে, ঘুমোতে দাও।

চা করবে নাকি?

একটু দেরি হবে।

তা হলে আমি কালীবাবুর দোকান থেকে ঘুরে আসি।

যাও, কিন্তু কোনও মন্তব্য কোরো না।

কীসের মন্তব্য?

কাল রাত্রে সুরেন মাইতিরা যা করেছে তা নিয়ে নিশ্চয়ই এখন ওখানে কথা হচ্ছে। সেসব কথার মধ্যে তোমার যাওয়ার দরকার নেই।

মাধবীলতা বলল।

অনিমেষ হাসল, মত প্রকাশের স্বাধীনতা হরণ করছ?
 
আশ্চর্য! আমি কিছুই করি না। কোনওদিন কিছু করেছি? ওখানে পাঁচজনের সামনে যা বলবে তা রিলে তো হবেই, তার সঙ্গে অনেক রং মিশে নানান জায়গায় পৌঁছে যাবে। তাই তোমাকে সাবধান করলাম। স্বাধীনতা হরণ করার আমি কে? মাধবীলতার গলায় বিরক্তি স্পষ্ট। ঘর থেকে পাঁচটা টাকা নিয়ে উঠোনের খোলা দরজা দিয়ে গলিতে পা বাড়াল অনিমেষ। দুধারে একতলা টিনের চালাওয়ালা বাড়ি, উনুনের ধোঁয়া, বাচ্চাদের বসে থাকার মধ্যে দিয়ে বস্তির সামনে চলে এল অনিমেষ। কালীবাবুর চায়ের দোকানে এখন একদম ভিড় নেই। এরকম তো হওয়ার কথা নয়। রোজ সকাল দশটা পর্যন্ত ভিড় উপচে পড়ে। খবরের কাগজ পড়া নিয়ে কাড়াকাড়ি হয়। এখন যে দুজন বসে আছে তাদের বিলক্ষণ চেনে অনিমেষ। দুজনই বাড়ির দালাল। কাগজ মুখে নিয়ে বসে আছে।

বেঞ্চিতে বসে অনিমেষ জিজ্ঞাসা করল, আজ খদ্দেরদের দেখা নেই কেন?

কালীবাবু নেই, তার পুত্রবধূ এখন দোকান চালায়। বলল, কী জানি!

চা পাওয়া যাবে?

দিচ্ছি!

অনিমেষ চুপ করে গেল। কালীবাবুর পুত্রবধূর বয়স বেশি নয়। স্বামী কাঠের কাজ যতটা না করে তার চেয়ে বেশি চোলাই খেয়ে পড়ে থাকে। ফলে বউটির কথাবার্তায় অদ্ভুত নিরাসক্তি এসে গেছে। চেঁচিয়ে বলল, চায়ের দাম বাড়ছে।

কত?

তিন টাকা। আপনি তো বাজারে যান না, মাসি যায়। মাসিকে জিজ্ঞাসা করলে জানবেন জিনিসপত্রের দাম কীরকম বেড়ে গেছে। আমি তো চায়ের সঙ্গে চামড়ার গুঁড়ো মেশাতে পারব না। নিন। এক গ্লাস চা এগিয়ে ধরল বউটা।

উঠে গিয়ে সেটা নিতেই একজন দালাল কাগজ এগিয়ে ধরল।

পড়বেন?

অনিমেষ মাথা নাড়ল, না

সে কী!

কী হবে পড়ে? সেই একই খবর। খুন, জখম, রাহাজানি আর মিথ্যে কথার ফুলঝুরি। সাত দিন আগের কাগজকে তারিখ বদলে আজকের বলে চালালে কোনও তফাত পাব না। চায়ে চুমুক দিল অনিমেষ। চিনি কম। চাইতে গিয়ে থমকে গেল সে। বাড়িতে চা বানালে মাধবীলতা তত এর চেয়ে কম চিনি দেয়। বলে, চায়ের চিনি রক্তে জমুক তা নিশ্চয়ই চাও না।

চায়ে চুমুক দিতে দিতে নিজের মনে হাসল অনিমেষ। ষাট পেরিয়ে গেলেও শুধু পা ছাড়া এই শরীরের আর কোথাও রোগ ঢুকেছে বলে মনে হয় না। বাবা বা দাদুর রক্তে সুগার ছিল বলে ছেলেবেলায় সে শোনেনি। ওটা উত্তরাধিকারসূত্রে আসে অথবা টেনশনের কারণে তৈরি হয়। এখন সে যে জীবনযাপন করে তাতে টেনশনের কণামাত্র নেই। তবে খবরের কাগজ পড়লে মনখারাপ হয়ে যায়। একটু-আধটু রাগও হয়, কিন্তু সেটাকে নিশ্চয়ই টেনশন বলে না।

দুটো ছেলে চায়ের দোকানের সামনে এসে দাঁড়াল। একজন কালীবাবুর পুত্রবধুকে বলল, জলদি, দুটো চা ছাড়ো।

পাঁচটা টাকা বের করো। দিচ্ছি। কাল থেকে ছয় নেব।

দ্বিতীয়জন হাসল, পাগল নাকি!

পুত্রবধূ বলল, মানে?

বেলগাছিয়াতে কেউ আমাদের কাছে চায়ের দাম নেয় না।

যারা নেয় না তাদের কাছে যাও। আমার দোকানে সুরেনদা পর্যন্ত চা কিনে খায়।

সুরেনদা চা কিনে খায়? হি হি হাসল প্রথমজন, আমাদের চমকিয়ো বউদি।

পুত্রবধু এতক্ষণ বসে ছিল, এবার উঠে দাঁড়াল, আমি চমকাচ্ছি? ডাকব সুরেনদাকে?

সঙ্গে সঙ্গে চুপসে গেল ছেলে দুটো। প্রথমজন দ্বিতীয়জনকে বলল, ফোট। দ্বিতীয়জন বলল, না। বউদির হাতের চা খেয়ে যাব।

পকেট থেকে খুচরো বের করে গুনে সামনের পাটাতনে রাখল, দিন বউদি।
 
অনিমেষ ওদের দেখছিল। কী দ্রুত নিজেদের বদলে ফেলতে পারে। চায়ের গ্লাস নিয়ে ওরা খানিকটা দূরে সরে যেতেই সে কালীবাবুর পুত্রবধূকে বলল, তোমার বেশ সাহস আছে।

সাহস না থাকলে এই কাকগুলো ঠুকরে শেষ করে দেবে কাকা। বউটি বলল।

কাকা! আজকাল কাকা শুনলে ভাল লাগে। বেশিরভাগ সময় হয় দাদু নয় জেঠু শুনতে হয়, তার তুলনায় কাকা শুনলে নিজেকে কমবয়সি বলে মনে হয়।

এইসময় মহেন্দ্র ঘটককে দেখা গেল। একসময় অভিজাত পরিবার বলে এই পাড়ার লোক ওঁদের খুব সম্মান করত। এখনও সাতসকালেও আদ্দির পাঞ্জাবি আর ধুতি পরে বের হন। হাতে দামি লাঠি থাকে। ওঁর বাবা তো

বটেই উনিও এককালে কংগ্রেসি ছিলেন। ইন্দিরা গাঁধীর মৃত্যুর পর রাজনীতি ছেড়ে দিলেও মুখ খুললেই ইতিহাস বলেন। সেইসঙ্গে খিস্তিখেউড় করতে দ্বিধা করেন না। দোকানের সামনে এসে একবার তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, এই যে অনিমেষবাবু, কাল রাত্রে নাকি সুরেনের লোক দাঁত উপড়ে দিয়ে গেছে?

অনিমেষ মাথা নাড়ল, যখন সবই জানেন, তখন প্রশ্ন করছেন কেন?

কনফার্ম করার জন্য প্রশ্ন করছি। আপনার গায়ে বিছুটি লাগছে কেন?

কালীবাবুর পুত্রবধূ গলা তুলল, দাদু, আমার দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে এসব বলবেন না।

কেন? এই রাস্তাটা তোমার কাকার নাকি! শোনো হে, তোমার শ্বশুরমশাই, আমাদের কালীপ্রসাদ, জীবনে কখনও আমাকে না বলেনি। এসেছিলাম ভাল করতে–! হ্যাঃ। এইজন্যে বলে কখনও কারও ভাল কোরো না। লাঠির ওপর ভর দিয়ে বৃদ্ধ মহেন্দ্র ঘটক চলে গেলেন ট্রামরাস্তার দিকে।

বাড়ির দালালদের একজন মন্তব্য করল, আজ কী হল? বুড়োর মুখে খিস্তি শুনলাম না।

চায়ের দাম দিয়ে ক্রাচ নিয়ে উঠে দাঁড়াল অনিমেষ। ঠিক তখনই বস্তিতে ঢুকতে গিয়ে সাইকেল থেকে নেমে পড়ল খবরের কাগজের হকার শ্যামল। এগিয়ে এসে বলল, জেঠু, আপনার একটা চিঠি ভুল করে আমাদের ঘরে দিয়ে গেছে। একটু দাঁড়ান, নিয়ে আসছি।

মিনিট তিনেকের মধ্যে শ্যামল খামটা নিয়ে এসে অনিমেষের হাতে দিল।

কবে পেয়েছিলে এটা? খামটা দেখতে দেখতে প্রশ্ন করল অনিমেষ।

গতকাল রাত্রে চিঠির বাক্সে পড়ে থাকতে দেখেছিলাম। আমাদের ওদিকের বস্তিতে তো একটাই চিঠির বাক্স। ভুল করে ওখানেই ফেলে গেছে। পিয়ন। রাত হয়ে গিয়েছিল বলে আপনাকে আর বিরক্ত করিনি।

শ্যামল দেরির কারণ ব্যাখ্যা করল।

অনেক ধন্যবাদ ভাই। অন্য কেউ হলে হয়তো এটা পাওয়াই যেত না।

অনিমেষ হাসলে শ্যামল আবার বস্তির ভেতর ঢুকে গেল। খামটা দেখল অনিমেষ। তার নাম-ঠিকানা লেখা। গোটা গোটা অক্ষরে। বুঝতে অসুবিধে হচ্ছে না, মহিলার হাতের লেখা। পোস্ট অফিসের স্ট্যাম্প দেখতে গিয়ে হতাশ হল। কলকাতারটা স্পষ্ট কিন্তু অন্য স্ট্যাম্প একদম ঝাপসা, কোথায় পোস্ট হয়েছে বোঝা যাচ্ছে না। খাম ছিঁড়ে চিঠি বের করে রাস্তায় দাঁড়িয়ে পড়তে বাধল অনিমেষের, ওটা আপাতত পকেটে ঢুকিয়ে রাখল। কিন্তু কে তাকে চিঠি দিল? সে মনে করতে পারছিল না শেষবার কবে তার নামে চিঠি এসেছে! শুধু তার নামে কেন, মাধবীলতা স্কুল থেকে অবসর নেওয়ার পরে কিছু কাগজপত্র ডাকে এসেছিল। এ ছাড়া ওকেও চিঠি লেখার কেউ পৃথিবীতে আছে বলে মনে হয় না। আর অর্ক! ওর পকেটের মোবাইল কথা বলা এবং চিঠি লেখার দুটো কাজই করে দেয়। খাম পোস্টকার্ডের দরকার পড়ে না।

.
 
বাড়ির দিকে এগোচ্ছিল অনিমেষ, পেছন থেকে একটি ছেলে জেঠু জেঠু বলে ডাকতে ডাকতে ছুটে এল। অনিমেষ ঘুরে দাঁড়ালে ছেলেটি বলল, আপনাকে একটু দাঁড়াতে বলল।

কে?

সুরেনদা।

অনিমেষ মুখ তুলে তাকাতেই দূরে দাঁড়ানো সুরেন মাইতিকে দেখতে পেল। তিনজন লোকের সঙ্গে কথা বলছে। সে তাকালে হাত নেড়ে থামতে বলল। কথা শেষ করে এগিয়ে এল সুরেন মাইতি, গুড মর্নিং। চা খেতে এসেছিলেন?

হ্যাঁ।

কাল রাত্রের ঘটনা শুনেছেন?

হ্যাঁ।

কী শুনেছেন? থামল সুরেন মাইতি।

ওপাশের দুটো ঘরে ভাঙচুর হয়েছিল। এইটুকু।

তা হলে এর বেশি কিছু শোনেননি! কিন্তু আমি শুনেছি। আমি নাকি ইলেকট্রিকের ভাড়া না পেয়ে ক্যাডার দিয়ে ওদের ঘরে হামলা করেছি, ওদের মেরেছি। আমি একটা কথা বুঝতে পারি না, এরা আমাকে কী ভাবে? আমি উজবুক? যে ডালে বসে আছি সেই ডাল কাটব? যাদের সঙ্গে থাকি, যাদের ভোটে আমার দল পাওয়ারে আছে তাদের ঘর ভাঙব? আরে, মুখের ওপর কিছু বলবে না কিন্তু ব্যালটে যখন ছাপ মারবে তখন তো আমি সামনে থাকব না। দুজনের ঘর ভাঙলে দুহাজার ভোট আমাদের বিরুদ্ধে যাবে। জেনেশুনে এই বোকামিটা আমি করব? বলুন? সুরেন মাইতি জিজ্ঞাসা করল।

করা উচিত নয়।

একশোবার। খবর পেয়েই পার্টির মিটিং ছেড়ে আমি দৌড়ে এসেছিলাম। আমিই যদি ওটা করতাম তা হলে কি আসতাম? আপনি বলুন!

আপনার কথায় যুক্তি আছে। অনিমেষ ফিরে যাওয়ার জন্যে পাশ ফিরতেই সুরেন মাইতি বলল, এখন কথা হচ্ছে, হামলা যখন হয়েছে, তখন

কারা সেটা করল?

একটু অবাক হল অনিমেষ। সে কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেল। সুরেন মাইতি মাথা নাড়লেন, কাল রাত থেকে চেষ্টা করছি কারা কাজটা করল তা জানতে। আজ একটু আগে খবরটা পেলাম।

কী খবর?

হরিনাথ আর ক্ষিতিশ, ওই দুঘরে যারা থাকে, রোজ মালগাড়ির টানা মাল ক্যারি করে পৌঁছে দিত আড়তে। তার জন্যে দুজনে পার ট্রিপ দুশো করে পেত। কদিন থেকে নাকি ওরা ক্যারি করার সময় খানিকটা মাল সরিয়ে অন্যদের বিক্রি করে দিত। সেটা ধরতে পেরে ওয়াগন ব্রেকাররা যার কাছে খাটে, সে নোক পাঠিয়ে কাণ্ডটা করেছে। সুরেন মাইতি হাসল।

সে কী!

বুঝুন কাণ্ড। এলাকায় থেকে যাদের ভাল ভাবি তারা বাইরে গিয়ে এই কাণ্ড করছে তা বুঝব কী করে? কাল যে এখানে খুন হয়ে যায়নি তাই ওদের ভাগ্য। সুরেন মাইতি বলল, আমি কারও ব্যক্তিগত ব্যাপারে নাক গলাতে চাইনি। কার মেয়ে আয়ার কাজ করতে যাওয়ার নাম করে শরীর বেচে পয়সা কামাচ্ছে তাতে আমার কী? যতক্ষণ না সেই সমস্যা সে এলাকায় টেনে আনছে ততক্ষণ আমার মুখ বন্ধ থাকবে। ঠিক কি না? সুরেন মাইতি জিজ্ঞাসা করল।

মাথা নাড়ল অনিমেষ, তার আর ওখানে দাঁড়াতে ইচ্ছে করছিল না। সে বুঝতে পারছিল লোকটা সমানে মিথ্যে বলে যাচ্ছে কিন্তু সেটা বললে বোকামি করা হবে। এতদিনে অনেক দেখার পর এই সত্যিটাকে মানতে বাধ্য হচ্ছে সে।

দূরে গাড়ির আওয়াজ হতে সুরেন মাইতি বলল, এসে গেছে।

কে?

পুলিশ। আমিই খবরটা দিয়েছি। যারা মার খেয়েছে তারা থানায় যায়নি কেন, আমিই পুলিশকে বলেছি এসে তদন্ত করতে। সুরেন মাইতির কথা শেষ হতেই গাড়িটা এসে দাঁড়াল। আজকাল পুলিশের গাড়ি দূর থেকে দেখলে চেনা যায় না। সেই জিপগুলোকে বোধহয় আর ব্যবহার করা হয় না।
 
একটা আধুনিক গাড়ি থেকে নেমে এলেন যে ভদ্রলোক তার পরনে পুলিশের ইউনিফর্ম নেই। হাতজোড় করে বললেন, সুপ্রভাত সুরেনবাবু। ঘটনাটা কোথায় ঘটেছিল?

ওই ওপাশের গলির ভেতর।

হরিনাথ এবং ক্ষিতিশকে এখন পাওয়া যাবে?

হ্যাঁ। মনে হয় ওরা ঘরেই আছে। সুরেন মাইতি অনিমেষকে দেখাল, চেনেন?

মাথা নাড়লেন দুপাশে ভদ্রলোক।

সুরেন মাইতি বললেন, ইনি অনিমেষ মিত্র। এককালে বিখ্যাত নকশাল নেতা ছিলেন। আমাদের মন্ত্রীদের অনেকেই ওঁর বন্ধু ছিলেন তার আগে। দাদা, উনি থানার বড়বাবু।

নকশাল? এখনও ওসব করেন নাকি?

ওই আন্দোলন এখনও আছে নাকি? অনিমেষ না জিজ্ঞেস করে পারল না।

চেহারা বদলেছে, রং পালটেছে। তারা এখন মাওবাদী হয়েছে।

আমি ঠিক জানি না। আপনার পূর্বসূরিরা আমার এই পা-কে অকেজো করে দেওয়ার পর আর ওইসব নিয়ে ভাবার আগ্রহ চলে গেছে। অনিমেষ বলল।

সুরেন মাইতি বললেন, দাদাকে তো ছোট্টবেলা থেকে দেখছি, রাজনীতি থেকে সাত হাত দূরে থাকতেন। এলাকার বাইরে খুব কম যান। একসময় তো আমাদের পার্টিতে ছিলেন, তাই কতবার বলেছি, পার্টি অফিসে আসুন, আসেননি। মন্ত্রী খবর দিলেও যান না। থাকগে, চলুন স্যার, আপনাকে ঘটনাস্থলে নিয়ে যাচ্ছি।

ওরা এগিয়ে গেলে অনিমেষ দেখল একটু একটু করে মানুষ বেরিয়ে আসছে বস্তির ভেতর থেকে। কিন্তু কারও মুখে কথা নেই। ওরা ওপাশের গলিতে ঢুকতেই ভিড় পেছন পেছন চলল।

সুরেন মাইতি বুদ্ধিমান লোক। নিজের মুখোশটাকে মুখ প্রমাণ করতে থানার বড়বাবুকে ডেকে নিয়ে এসেছে। বড়বাবু নিশ্চয়ই খুব জেরা করবেন হরিনাথ আর ক্ষিতিশকে। চোরাই মালের ক্যারিয়ার হওয়ার জন্যে খুব ধমকাবেন। হয়তো এও বলবেন, সুরেন মাইতির অনুরোধে এবার ছেড়ে দিচ্ছেন ওদের। কাজটা যে ওয়াগন ব্রেকাররা করিয়েছে তাতে তার বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই। এইসব বলে যখন তিনি চলে যাবেন, তখন গোটা বস্তির লোক সুরেন মাইতির প্রশংসায় পঞ্চমুখ হবে।

কাকা, ব্যাপারটা কিছু বুঝলেন?

অনিমেষ তাকাল। ছেলেটির নাম বিশ্বজিৎ। বি. এ. পাশ করে টিউশনি করে সারাদিন। সন্ধ্যায় কংগ্রেসের পার্টি অফিসে গিয়ে বসে। মাঝে মাঝে আসে তার কাছে। গাঁধী এবং মার্কসের মধ্যে তুলনা করে কথা বলে। বেশ সিরিয়াস ধরনের ছেলে।

এখন আর আমি কিছু বুঝতে চাই না বিশ্বজিৎ। হাসল অনিমেষ।

এটা কী বলছেন? আপনি অসুস্থ হয়ে বিছানায় শুয়ে নেই। ভারতীয় নাগরিক হিসেবে আপনারও তো একটা ভূমিকা আছে।

অনিমেষ জবাব দিল না। এখনও রোদ ওঠেনি। সে আকাশের দিকে তাকাল।

জানি, আপনি ভোট দেন না। গত লোকসভা নির্বাচনে ৫৪ শতাংশ ভোট পড়েছিল। তার মানে হল, ৪৬ শতাংশ ভোট পড়েনি। অঙ্কটা বিশাল। কিন্তু ওই ভোট না দেওয়া মানুষগুলোও কিন্তু ভারতের নাগরিক। বিশ্বজিৎ গম্ভীর গলায় বলল।

তুমি কী বলতে চাইছ?

সুরেন মাইতি একজন চুনোপুঁটি নেতা। কিন্তু দেখুন, তার কাছেও পুলিশ কীরকম বিক্রি হয়ে গেছে। ও যা ভাববে পুলিশ তাই বলবে।

তোমার মতো সবাই তো দেখছে, ভাবছে। তা হলে বামবিরোধীরা ভোট পায় না কেন?

সত্যি কথা বলব?

অনিমেষ তাকাল।

বিরোধী দলকে কেউ বিশ্বাস করে না। আমাদের একজন নেতা নেই যার ওপর মানুষ আস্থা রাখতে পারে। থাকলে ওই ৪৬ শতাংশ মানুষের অর্ধেক ভোট বাক্সে পড়ত। ধুয়ে মুছে সাফ হয়ে যেত শাসকরা। আচ্ছা, চলি।

বিশ্বজিৎ যেভাবে এসেছিল সেভাবেই চলে গেল।

ধীরে ধীরে বাড়িতে ফিরে এল অনিমেষ। উঠোনে পা রাখতেই দেখল অর্ক বাইরে যাওয়ার পোশাকে বেরিয়ে আসছে ওর ঘর থেকে।

বেরুচ্ছিস নাকি? অনিমেষ জিজ্ঞাসা করল।

হ্যাঁ। অর্ক বলল, একটু দেরি হয়ে গেছে। ওপাশ থেকে মাধবীলতা জিজ্ঞাসা করল, কখন ফিরবি? দুপুরে একবার ঘুরে যাব। অর্ক উঠোনের দরজার দিকে এগিয়ে গেল।
 
ওপাশের বস্তিতে সুরেন মাইতি থানার বড়বাবুকে নিয়ে ঢুকেছে। ওদিকে যাস না। অনিমেষ কথাগুলো বললে অর্ক কাধ নাচিয়ে বেরিয়ে গেল। বারান্দার চেয়ারে বসল অনিমেষ। একদম বদলে গিয়েছে ছেলেটা। এই বস্তির কারও সঙ্গে মেলে না, কথা বলে যতটা সম্ভব না বললে না, ততটাই।

চা খেয়েছ? মাধবীলতার গলা ভেসে এল রান্নাঘর থেকে।

হ্যাঁ। কাল থেকে চায়ের দাম বাড়ছে। অনিমেষ বলল।

অনেক আগেই বাড়ানো উচিত ছিল। বাজারে গেলে বুঝতে পারতে জিনিসপত্রের দাম কোথায় পৌঁছেছে। আমাদের না হয় ছেলের রোজগার আছে। স্কুল থেকে পাওয়া টাকার ইন্টারেস্ট আছে কিন্তু ভেবে দ্যাখো তো, যাদের মাসিক রোজগার পাঁচ-ছয় হাজার তারা কী করে সংসার চালাচ্ছে। বলতে বলতে গরম রুটি আর আলু-পেঁয়াজের চচ্চড়ি প্লেটে নিয়ে বেরিয়ে এল মাধবীলতা, নাও।

অনিমেষ প্লেটটা ধরে বলল, তোমারটা?

কাল থেকে ঢেকুর উঠছে। আমি মুড়িজল খাব।

আমাকেও তাই দিতে পারতে। এসব করার দরকার ছিল না।

মাধবীলতা হেসে ফেলল, বাব্বাঃ। এত প্রেম! তা হলে তুমিও ঢেকুর তোলো, শুনি।

বললেই ঢেকুর তোলা যায় নাকি! এত করে বলছি, চলো ডাক্তারের কাছে যাই।

প্লিজ আর উপদেশ দিয়ো না।

তোমার মুড়িজল নিয়ে এসো এখানে।

মাধবীলতা তাকাল। তারপর চলে গেল রান্নাঘরে। অনিমেষ অপেক্ষা করছিল। ওকে এক বাটি জলে মুড়ি ডুবিয়ে আনতে দেখে রুটিতে হাত দিল। পাশের চেয়ারে বসে চামচে মুড়ি তুলে মুখে দিয়ে মাধবীলতা বলল, এটা খেতে তো আমার ভালই লাগে।

খবরের কাগজ দেয়নি? অনিমেষ জিজ্ঞাসা করল।

দিয়েছিল। অর্ক ঘরে রেখে গেছে। আনব?

না। থাক। পরে পড়ব। তারপর সে সুরেন মাইতির সঙ্গে যা কথা হয়েছিল তা মাধবীলতাকে বলল। সব শুনে মাধবীলতা বলল, এইটেই তো স্বাভাবিক।

স্বাভাবিক?

নয়তো কী? তুমি যদি তখন পড়তে পড়তে পার্টি ছেড়ে না-দিতে তা হলে নিশ্চয়ই এখন মন্ত্রী হতে হলে তুমি আরও বড়মাপের মিথ্যাচার করতে।

সেটাও স্বাভাবিক হত।

আমিও করতাম! অনিমেষ অবাক হয়ে তাকাল।

শেয়ালদের দলে বাঘ যেমন থাকে না বেড়ালও থাকতে পারে না। মাধবীলতা বলল, তুমি সুরেন মাইতিকে মনের কথা বলে ফেলোনি তো?

হাসল অনিমেষ, নাঃ! আমি এখন অনেক বুদ্ধিমান হয়েছি।

হলে ভাল। অনেক লড়াই করার পর এখন স্বস্তিতে আছি। অর্ক বলত, চলো, কলকাতার কাছাকাছি অল্প দামে ফ্ল্যাট ভাড়া করে চলে যাই। কিন্তু এই বাড়িতে আসার পর আমার ফ্ল্যাটে যেতে ইচ্ছে করে না। এই উঠোন, রান্নাঘর, একদম আলাদা থাকতেই ভাল লাগে। বেশ মফসসল মফস্সল বলে মনে হয়। মাধবীলতা বলল।

সবই ঠিক আছে। কিন্তু ছেলেটার কথা ভাবো।

ভেবে যখন সুরাহা করতে পারব না তখন মাথা ঘামিয়ে কী লাভ?

ওরা এভাবেই আলাদা থাকবে? তার চেয়ে কোর্টে গিয়ে সম্পর্ক ছিন্ন করলে অনেক ভাল হত। মেয়ে ডিভোর্স দেবে না তাই ছেলেও ওই পথে হটবে না। অদ্ভুত।

এই সময় কয়েক ফোঁটা জল আকাশ থেকে নেমে এল উঠোনে, ঘরের চালে। মাধবীলতা বলল, শেষ পর্যন্ত বৃষ্টি নামল।

কোথায় বৃষ্টি! দ্যাখো, আর জল পড়ছে না। খাওয়া শেষ করে হাত ধুতে উঠতে গিয়ে মনে পড়ল তারা বলল, আমার পকেট থেকে খামটা বের করো তো।

কী খাম?

জানি না, শ্যামলদের লেটার বক্সে পিয়ন রেখে গিয়েছিল। খুলে দ্যাখো কে পাঠিয়েছে।

মাধবীলতা মুড়ির জল খেয়ে নীচে বাটি রেখে অনিমেষের পকেট থেকে খামটা বের করল। উলটে পালটে দেখে বলল, কালই তো এসেছে।

হাত ধুতে ধুতে অনিমেষ বলল, মেয়েলি হাতের লেখা, দ্যাখো।

মাধবীলতা খামের মুখ ছিঁড়ে সাদা কাগজটা বের করে চোখ রাখল। পড়ে নিয়ে অনিমেষের দিকে তাকাল।

কাছে এসে অনিমেষ জিজ্ঞাসা করল, কে লিখেছে?

ছোটমা।

অ্যাঁ। ছোটমা? কী লিখেছেন?

পড়ো।

তুমিই পড়ো।

মাধবীলতা পড়ল। স্নেহের অনিমেষ, স্নেহের মাধবীলতা। দীর্ঘকাল তোমাদের সঙ্গে যোগাযোগ নেই। বড়দিদির কাজের সময় তোমরা এসেছিলে, ফিরে গিয়ে পৌঁছানোর সংবাদ দেওয়ার পর আর কোনও চিঠি লেখোনি। এতকাল এই বাড়ি ভূতের মতো আগলে রেখেছিলাম। ধীরে ধীরে বাড়িটির অবস্থা খারাপ হচ্ছে। আমার অবস্থাও করুণ। লোকজন এসে ক্রমাগত চাপ দিচ্ছে এই বাড়ি বিক্রি করে দেওয়ার জন্যে। জানি না এই চিঠি তোমরা পাবে কিনা। যদি পাও তা হলে কি একবার এখানে আসতে পারবে? তোমরা এবং অর্ক আমার আশীর্বাদ জেনো। ইতি, ছোটমা।
 
অনিমেষ বিড়বিড় করল, আমি জানতাম এই দিনটা একদিন আসবে।

মাধবীলতা কাগজটা ভাঁজ করে খামে ঢুকিয়ে বলল, সত্যি তো, আমাদের খুব অন্যায় হয়ে গিয়েছে। ভাড়াটের দেওয়া টাকায় বেশ চলে যাবে বলেছিলেন, তাই বিশ্বাস করেছিলাম, কিন্তু ওঁরও তো বয়স হচ্ছে।

অনিমেষ বলল, দাদু এবং পিসিমা চলে যাওয়ার পর ওই বাড়ির কথা আর ভাবিনি, টানও চলে গিয়েছিল। তা ছাড়া, আমরা গিয়েই বা কী করতে পারি।

যেতে লিখেছেন– মাধবীলতা থেমে গেল।

লিখে দাও, উনি যেন বাড়িটা বিক্রি করে দেন। আমাদের আপত্তি নেই।

সেটা চাইলে তো নিজেই করতে পারেন। আমাদের চিঠি লিখবেন কেন?

কিন্তু আমরা ওখানে গিয়ে কী করব?

হয়তো কিছুই করব না। কিন্তু একদিন যোগাযোগ না রেখে যে অন্যায় করেছি তার প্রায়শ্চিত্ত তো কিছুটা করা হবে। মাধবীলতা উঠল, আমার মনে হয় তোমার যাওয়া উচিত। যদি টিকিট পাও তা হলে আজই চলে যাও।

আমি? একা?

তুমি তো একাই স্বৰ্গছেঁড়া থেকে কলকাতায় এসেছিলে?

তখন আমি তরুণ। আর এখন? তুমি যাবে না কেন?

আমি গেলে ছেলের কী হবে? ওর খাওয়া দাওয়া–।

আশ্চর্য! একটা মাঝবয়সি ছেলের জন্যে তোমাকে থেকে যেতে হবে? না, তুমি সঙ্গে না গেলে আমি যাব না। অনিমেষ মাথা নাড়ল।

এই সময় ভেতরের ঘরে মোবাইল বেজে উঠল। মাধবীলতা দ্রুত ঘরে ঢুকে সেটাকে তুলে নিয়ে অন করল, হ্যালো। বল। দুপুরে আসতে পারবি না? কেন? ও। ঠিক আছে। আর হ্যাঁ, তুই দুটো ট্রেনের টিকিট কেটে আনতে পারবি? জলপাইগুড়ির, সঙ্গে টাকা আছে! জোগাড় করে নে, কাল দিয়ে দিবি। হ্যাঁ, কালকের টিকিট। রাখছি।

বাইরে বেরিয়ে মাধবীলতা বলল, ছেলে ফোন করেছিল।

তোমার কথায় সেটা বুঝলাম। কিন্তু তুমি কালই টিকিট কাটতে বললে কেন?

ওই চিঠি পড়ার পরে দেরি করার কোনও যুক্তি আছে?

যাওয়ার আগে তো কিছু কাজ থাকে। অর্ক আসুক, ওর সঙ্গে কথা বলা তো দরকার। টাকাপয়সার ব্যাপারটাও তো আছে। অনিমেষ বলল।

তোমাকে এসব নিয়ে ভাবতে হবে না। মেঝে থেকে প্লেট বাটি তুলে রান্নাঘরের দিকে এগিয়ে গেল মাধবীলতা।

এই সময় উঠোনের দরজায় শব্দ হল। বাসনগুলো নামিয়ে রেখে মাধবীলতা জিজ্ঞাসা করল, কে? ভেতরে এসো।

মেয়েটি ভেতরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে উঠোনে কয়েক পা এগোল, মাসিমা আর পারছি না। মনে হচ্ছে আত্মহত্যা করি। ভগবান! ঠোঁট কামড়াল মেয়েটি।

আবার কী হল? মাধবীলতা সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে।

আমাকে শেষ না করে ও ছাড়বে না।

তোকে এর আগেও বলেছি সুজাতা, থানায় যা। ওর বিরুদ্ধে ডায়েরি কর।

গিয়েছিলাম। ডায়েরি নেয়নি। মেয়েটি কেঁদে ফেলল।

কেন?

আমরা স্বামী-স্ত্রী নই শুনে এমন হাসাহাসি করল যে পালিয়ে এসেছিলাম। ব্যঙ্গ করছিল, যার সঙ্গে ঘর ছেড়েছ এখন সে-ই তোমার শত্রু হয়ে গেল! জিজ্ঞাসা করল, কী করো তুমি? বললাম, কারখানায় কাজ করি। বিশ্বাসই করল না। সুজাতা বলল, আমি কী করব?

এখন ও কী চাইছে?
 
রোজ সন্ধ্যায় আমার ঘরে এসে মদ গিলবে আর সমানে খিস্তি করে যাবে। কিছু বললেই চেঁচাবে। তারপর জোর করে দশ টাকা নিয়ে চলে যাবে। ওর পকেটে অনেক টাকা থাকলেও দশ টাকা ওর চাই-ই। আমি কারখানা থেকে রোজ ষাট টাকা পাই। তাতে ঘর ভাড়া দিয়ে খেতেই সব ফুরিয়ে যায়। তার ওপর এই অত্যাচার সহ্য করতে পারছি না।

সুজাতা কথা শেষ করতেই অনিমেষ জিজ্ঞাসা করল, আজ কাজে যাওনি?

না। আজ কারখানা বন্ধ। মালিক হাসপাতালে ভরতি হয়েছে কাল। সুজাতা বলল।

বন্ধ কারখানা যদি না খোলে–? মাধবীলতা জিজ্ঞাসা করল।

আমি জানি না কী হবে। দুহাতে মুখ ঢাকল সুজাতা।

এখন একটা কথা বল তো। মুখ থেকে হাত সরা–!

কয়েক সেকেন্ড সময় নিল সুজাতা। আঙুল দিয়ে জল মুছল।

মাধবীলতা জিজ্ঞাসা করল, তুই কি এখনও লোকটাকে ভালবাসিস?

দ্রুত মাথা নাড়ল সুজাতা, না। একদম না।

ঠিক আছে এখন যা। বিকেল বিকেল এখানে চলে আসিস ঘরে তালা দিয়ে। আশপাশের লোকজন যেন না জানতে পারে তুই এখানে এসেছিস। যা।

সুজাতা মাথা নেড়ে চলে গেল।

অনিমেষ বলল, একদিন লুকিয়ে রেখে তুমি ওর কী উপকার করবে? এইসব মেয়েরা কেন যে ঘর ছাড়ার আগে ভালবাসার মানুষটাকে চিনতে পারে না।

মাধবীলতা হেসে ফেলল। অনিমেষ জিজ্ঞাসা করল, হাসছ যে? মাধবীলতা বলল, সবাই তো ভবিষ্যৎ দেখতে পায় না।

.

০৩.

বিকেল বিকেল চলে এল সুজাতা। মাধবীলতা তখন সুটকেসের সামনে বসে।

অনিমেষ বলেছে দিন সাতেক ওখানে থাকবে। সেই হিসেবে জামাকাপড় নিতে গিয়ে দেখল বছরে একবার, পুজোর সময় ছাড়া জামাকাপড় কেনা

না হওয়ায় ভালর সংখ্যা বেশ কম। এই কয় বছরে অনিমেষ বস্তির বাইরে একদম যায় না। তাই ভাল পোশাকের প্রয়োজন হয় না ওর। মাধবীলতার অবশ্য কয়েকটা ভাল শাড়ি জামা আছে। হঠাৎ খেয়াল হল, অর্কর জামা তো অনিমেষের গায়ে খুব একটা বেমানান হবে না, মনে হওয়াতে স্বস্তি এল।

দরজায় সুজাতাকে দেখে মাধবীলতা বলল, ও, এসো।

সুটকেস গোছাচ্ছেন? সুজাতা জিজ্ঞাসা করল।

হ্যাঁ, কাল আমরা জলপাইগুড়িতে যাচ্ছি।

সে কী। চমকে উঠল সুজাতা।

অবাক হয়ে তাকাল মাধবীলতা।

আমি আজ সারাদিন ভাবছিলাম আপনাকে পাশে পেলে ওর বিরুদ্ধে। লড়াই করতে পারব।

লড়াই করতে হলে অন্যের সাহায্য ছাড়া করা যায় না?

আমি আর পারছি না। নিজের ওপর এক ফোঁটা ভরসা নেই আমার।

ঝরঝর করে কেঁদে ফেলল সুজাতা। তারপর আঁচলে চোখ ঢাকল।

বসো। ওই মোড়াটা টেনে নাও। মাধবীলতা জিজ্ঞাসা করল, কীভাবে আলাপ হয়?

কয়েক সেকেন্ড সময় নিল সুজাতা। তারপর বলল, আমাদের স্কুলের টিচার।

তোমার থেকে কত বড়?

বারো-তেরো বছর।

একটু পরিষ্কার করে বলো তো!
 

Users who are viewing this thread

Back
Top