ঘরের ভেতর ছেলেটি একা চিৎপাত হয়ে খাটে শুয়ে চোখ বন্ধ করে মাউথ অর্গান বাজাচ্ছে। বেশ ঢ্যা চেহারা, জুতো সুদ্ধ পা দুটো খাটের বাইরে ঝুলছে। ঘরটা দারুণ অগোছালো, সাজগোছ করায় কোন চেষ্টাই নেই। কয়েক সেকেন্ড দাঁড়িয়ে সে ফিরে আসছিল এমন সময় ছেলেটি বাজনা থামিয়ে, উঠে বসে বলল হে-ই! কথাটা জড়ানো, মানে না বুঝলেও অনিমেষ অনুমান করল যে তাকেই কিছু বলছে ছেলেটি। পরমুহূর্তেই এক লাফে দাঁড়িয়ে দু-হাত বাড়িয়ে তাকে ডাকল ছেলেটি, গেট ইন, প্লিজ!
এবার বুঝতে পারলেও অনিমেষ লক্ষ্য করল ওর উচ্চারণে একটা মোটা আওয়াজ এমন জড়িয়ে থাকে যেটা অন্য শব্দগুলোকে স্পষ্ট হতে দেয় না। অনিমেষ ভেতরে ঢুকতেই চকচকে সাদা দাঁতে হাসল ছেলেটি, ইয়া–!
ওর আসার কারণটা বোঝাতে গিয়ে বিপদে পড়ল অনিমেষ। মনে মনে দ্রুত ইংরেজি করে নিয়েও ঠিক গুছিয়ে উঠতে পারছে না সে। সঙ্কোচ হচ্ছিল ইংরেজিটা ভুল হতে পারে। শেষ পর্যন্ত সহজ রাস্তাটা বেছে নিল অনিমেষ, আঙ্গুল তুলে মাউথ অর্গানটাকে দেখাল। ছেলেটি যেন খুব খুশি হয়েছে এমন ভঙ্গীতে বাদ্যযন্ত্রটা শূন্যে ছুঁড়ে দিয়ে ফের লুফে নিয়ে বলল, য়ু লাইক ইট?
ইয়েস! অনিমেষ ধাতস্থ হল, তারপর জুড়ে দিল, ভেরি সুইট।
থ্যাঙ্কু! ইটস মাই ফ্রেও। মাদার গেভ ইট। সিট ডাউন, সিট হেয়ার প্লিজ।
ওর টেবিলের সামনে রাখা চেয়ারটাকে টেনে নিয়ে খাটের পাশে রেখে সে অনিমেষকে ইঙ্গিত করল বসার জন্য।
এর এগে ইংরেজিতে কখনো কথা বলেনি অনিমেষ। জলপাইগুড়িতে যখন ছিল তখন এ প্রশ্ন উঠতই না। ত্রিদিব যখন বাংলা হিন্দী বলতে বলতে নিজের অজান্তে অনর্গল ইংরেজি বলে যায় তখন সেটা লক্ষ্য করেছে অনিমেষ। অনেক শব্দ যার অর্থ অন্য রকম ছিল, ব্যবহারে তার চেহারা পাল্টে যায়। এই যেমন ছেলেটি তাকে ভেতরে আসার জন্য বলল, গেট ইন। অনিমেষ নিজে গেট কথাটা ভাবতেই পারত না, বলত কাম ইন। অথচ বেরিয়ে যাওয়ার জন্য গেট আউট তো স্বচ্ছন্দে মনে আসে। জলপাইগুড়ির বাঙালি স্কুলে ইংরেজি ভাষাটা যেভাবে শিখিয়েছে তাতে নিজের মত করে কথা বলা যায় না। এই মুহূর্তে সে বিব্রত হয়ে পড়েছিল।
চতুর্দিকে ছেলেটির রঙবেরঙের জামা-কাপড় ঝুলছে। ওর রুমমেটটি এখনও বোধ হয় ফেরেনি। কেউ যে রঙিন জাঙ্গিয়া পরে জানা ছিল না অনিমেষের। চেয়ারে বসে ছেলেটিকে ভাল করে দেখল সে। চামড়ার রঙ কালো হতে হতে তা থেকে কেমন নীলচে জেল্লা বেরুচ্ছে। চোখ দুটো ছোট, মাথার চুলে চিরুনি বোলানো অসম্ভব, এত কোঁকড়া এবং পাক খাওয়া বোধ হয় চুল আঁচড়ানোর প্রয়োজন পড়ে না। শরীর ওর বেতের মত হিলহিলে, সামান্য মেদ নেই।
মাই রুম, চকচকে সাদা দাঁত একবার ঝিলিক খেল। এই প্রথমবার, সে যে ইন্ডিয়ান তা কেউ অনিমেষকে বলল। তার হঠাৎ খেয়াল হল থম্বোটোর মাতৃভাষা ইংরেজি নয় অতএব সামান্য ভুলভাল হলে নিশ্চয়ই সে গ্রাহ্য করবে না। অনিমেষ নিজের নাম বলল, এখন কিছুটা স্বচ্ছন্দ হয়েছে সে।
অনিমেষ জিজ্ঞাসা করল, তুমি তো স্কটিশেই পড়?
হ্যাঁ, বি. এস-সি ফার্স্ট ইয়ার, তুমি?
আমি এম এ-তে অ্যাডমিশান নিয়েছি, এখনও ক্লাস শুরু হয়নি। আর্টস।
ও গড, তুমি তা হলে আমার সিনিয়ার, বাট য়ুলুক সো ইয়াং। অবাক চোখে তাকে দেখছিল থম্বোটো। সত্যি কি তাকে এম এ ক্লাসের ছাত্র বলে মনে হয় না? কি জানি।
সে জিজ্ঞাসা করল, এখানে কেমন লাগছে তোমার?
ভালই। তবে ওই মশলা দেওয়া খাবারগুলো যদি না থাকতো! দ্যাটস হরিবল। আমার স্টমাক প্রায়ই গোলমাল করছে, এ মান ক্যান নট লিভ অন মেডিসিন। তুমি হোস্টেলে থাকছ কেন, তোমার বাড়ি এখানে নয়?
না। আমি এখানে থেকে কয়েক শ মাইল দূরে ডুয়ার্স বলে একটা জায়গা থেকে এসেছি।
সেটা কি ভারতবর্ষ নয়?
কেন নয়? এই পশ্চিম বাংলারই একটা অংশ।
থম্বোটো চট করে টেবিল থেকে একটা বড় ভারতবর্ষের ম্যাপ সামনে বিছিয়ে বলল, শো মি হোয়ার ইট ইজ!
অনিমেষ ঝুঁকে পড়ে পশ্চিম বাংলার মাথায় জলপাইগুড়ি লেখা অঞ্চলটায় আঙুল রাখল। ও দেখল আলিপুরদুয়ার এবং ফালাকাটা ম্যাপে লেখা আছে কিন্তু স্বৰ্গছেঁড়ার উল্লেখ নেই। থম্বোটো জায়গাটা ভাল করে দেখে নিয়ে বলল, এ জায়গা তো হিমালয় পর্বতমালার নিচে, তুমি কি পাহাড়ী মানুষ?
না, না, আমি বাঙালী! হেসে ফেলল অনিমেষ।
স্টেঞ্জ! তোমাদের এই ভারতবর্ষে স্নো-রেঞ্জ আছে, সমুদ্র আছে, মরুভূমি আছে, আবার ডিফারেন্ট টাইপ অফ পিপল উইদ ডিফারেন্ট ল্যাঙ্গুয়েজেস এক সঙ্গে বাস করছ, কেউ বাঙালী কেউ পাঞ্জাবী আবার সকলেই ইন্ডিয়ান, তোমাদের কোন অসুবিধে হয় না? কি করে তোমরা ইউনাইটেড হলে? জানবার আগ্রহ থাম্বোটোর মুখে।