ফিক্সড ডিউটিতে ব্যস্ত থাকার সময়ই মা একদিন বলেন, বাজানের শইলডা বালা না। কেন, কি হইছে?
চলতে ফিরতে পারে না। উল্ডা পাল্ডা কথা কয়।
কেন, সেইদিন না জাম্পার লইয়া আইল!
নানা পকেটে করে বা প্যাকেটে করে কিছু না কিছু আনেন,সামান্য হলেও আনেন, যখন আসেন। মেয়ের হাতে একটি বিস্কুট হলেও দিয়ে বলেন, মা, তুমি খাইও। একগাদা লান্ডির জাম্পার দিয়ে গেছেন, ওগুলো দিয়েই আমাদের অনেকগুলো শীত চলে যাবে। নানা কেন অসুস্থ হবেন! মাত্র দু সপ্তাহ আগে নানিবাড়ি বেড়াতে গিয়েছিলাম, তিনি দিব্যি সুস।্থ খাচ্ছেন। পাতে মাছের ঝোল ঢেলে দিতে দিতে নানি বলছেন, দোকানে তো আয় তেমন হইতাছে না। নানার দাতা হাতেমতাই স্বভাব আর যারই পছন্দ হোক, নানির মোটেই পছন্দ নয়।
আয় লাগব না, যা আছে তাই ভাল। কই একটু নুন দেও ত! শীতল পাটিতে আসন করে বসে ভাত মাখতে মাখতে মাখতে বললেন নানা।
নানি নুনের বয়াম নানার দিকে ঠেলে দিয়ে বললেন, আয় না করলে চলব! পুলাপান খাইব কি!
পুলাপান কি না খাইয়া থাকে নাকি?
দোকানের বাবুর্চিরা নিজেরা বড় বড় দোকান দিয়া হাজার টাকা ঘরে নিতাছে। আপনের তো পসার কিছু হইল না।
ওরা চুরি করলে আমিও কি চুরি করুম নাকি?
আপনেরে চুরি করতে কইতাছি না। ব্যবসাডায় মন দিতে কইতাছি।
ব্যবসায় যে মন নেই নানার, সে নানি বেশ ভাল জানেন। সেদিনও দোকানে হুট করে ঢুকে দেখলেন রাস্তার তিনটে পাগল চেয়ারে ঠ্যাং তুলে হাপুস-হুপুস খাচ্ছে। নানা পাশে বসে পাগলদের পাতে বড় বড় মাংস তুলে দিচ্ছেন। নানি বললেন, গাহেকের খবর নাই, পাগল খাওয়াইতাছেন বওয়াইয়া? নানা ভেংচি কেটে বললেন, আমার দোকান, আমি যারে ইচ্ছা খাওয়াইয়াম। তোমার কি? যাও যাও বাড়িত যাও।
দুটো গ্রাস মুখে দিয়েছেন কি দেননি, নানি গেলেন কলতলায়, ঠিক পেছন পেছন তিনি ভাতের থাল হাতে উঠে পুরো পাতের ভাত ঢেলে দিলেন উঠোনে।
কী ব্যাপার ভাত ফালাইছেন কেন? কলতলা থেকে চেঁচিয়ে নানি বলেন।
কুত্তা টুত্তা আছে খাইব নে!
নানির কাছে এ নতুন নয়। প্রায়ই তিনি দেখেন নানা জানলা দিয়ে টুকরো টুকরো করে পাউরুটি ছুঁড়ছেন।
কি ব্যাপার পাউরুটি বাইরে ফেলতাছেন কেন?
নানা বলেন, পিপঁ ড়া পপু ড়া আছে, খাইব নে।
পুলাপান পাউরুটি পায় না, আর আপনে পিপঁ ড়ারে পাউরুটি দেইন!
খায়রুন্নেসা, ওরাও তো আশা করে। নানা মধুর হেসে বলেন।
পকেটের বাতাসাও পুকুর পাড় দিয়ে আসার সময় পুকুরে ছুঁড়ে ফেলেন।
কেন?
মাছ টাছ আছে, খাইব। ওরাও তো আশা করে।
অবকাশেও এরকম ঘটে। মা ভাত বেড়ে দিলেন, বড় রুই মাছের টুকরো পাতে দিয়ে ডাল আনতে গেলেন বাটি করে। এসে দেখেন নানার পাতের মাছ পাতে নেই, পাতে শাদা শুকনো ভাত। রুই মাছ টেবিলের তলায়, বেড়ালে খাচ্ছে।
কি বাজান,মাছ বিলাইয়ে খায় কেন?
নানা হেসে বললেন দেখি তো তুমার ডাইলডা। কেমন রানছ দেখি।
ডাইল দিতাছি। কিন্তু মাছ ফালাইয়া দিছেন কেন?
আরে ফালামু কেন? বিলাইয়ের কি পছন্দ অপছন্দ নাই! ওদের কি কাঁটা খাইতে ইচ্ছা করে! মাছ টাছ ওরাও তো আশা করে!
কলতলা থেকে ফিরে এসে গামছায় মুখ মুছতে মুছতে নানি বললেন, মানুষের খবর নাই, আছে কুত্তা বিলাই লইয়া। রাস্তার পাগলা খাওয়াইয়া দোকানের বারোডা বাজাইছে। শান্তি আর এ জীবনে হইল না।
ততক্ষণে নানা নকশি কাথাঁর তলে। বিছানায়। ঘুমোচ্ছেন। দুপুরের খাওয়া দাওয়ার পর নানা লম্বা ঘুম দেন, ঘুম থেকে উঠে আবার দোকান। নতুন বাজারের মুখে পৌঁছলেই নানার পেছন পেছন ও পাড়ার যত পাগল আর ভিখিরি পিছু নেবে। টাকা পয়সা পাউরুটি বাতাসা বিলিয়ে হাঁটতে থাকবেন তিনি, দোকান অবদি পৌঁছলে পকেটে আর কিছুই অবশিষ্ট থাকবে না, তখন হাত দেবেন ক্যাশবাক্সে, মুঠি ধরে দেবেন দবির পাগলকে। দবির পাগল নানার খুব প্রিয় পাগল। ওই দবির পাগলের জন্যই নানা একবার খালি গায়ে বাড়ি পৌঁছেছিলেন।
কি ব্যাপার, পাঞ্জাবি কই?
দবিরডার পরনের জামা নাই। রাস্তায় আধা ল্যাংডা খাড়োইয়া রইছে।
তাই বইলা নিজের পরনের পাঞ্জাবি খুইলা দিয়া আইছেন?
না দিলে এই শীতের মধ্যে ও বাঁচব কেমনে!
আর এই শীতের মধ্যে আপনে কেমনে খালি গায়ে রইছেন?
আরে শীত কই তেমন! হাইটা আইছি ত। হাঁটলে শরীর গরম থাকে খায়রুন্নেসা।
নানি আর কথা বাড়ান না। লাভ নেই বলেই বাড়ান না। নানাকে তিনি চার যগু হল চেনেন। টিনের এই চৌচালা ঘরে সংসার পেতেছিলেন সেই কবে, ছেলে মেয়ে হল, তাদের বিয়ে হল, নাতি নাতনি হল, পুতিও হল, কিন্তু চালা ঘর ঠিক তেমনই আছে, যেমন ছিল। একটি খুঁটিও পাল্টোনি। চোখের সামনে ধাঁ ধাঁ করে এ বাড়ির চাকর বাকররাও বড়লোক হয়ে গেছে, রীতিমত দালান তুলেছে বস্তিতে। নানির অবশ্য দালানের লোভ নেই। কোনওভাবে খেয়ে পরে বেঁচে থাকাটাকেই তিনি যথেষ্ট মনে করেন। নানির ভাবনা টুটুমামা আর শরাফ মামাকে নিয়ে। এ দুজন লেখাপড়া ছেড়ে পীরবাড়িতে ভিড়েছিল। সংসার চালানোর কোনও ক্ষমতা না থাকলেও হুট করে বিয়ে করেছেন, কদিন পর পর এখন নানির কাছে হাত পাতেন। শেষ পর্যন্ত দুই ছেলের হাত পাতার জ্বালায় অতিষ্ঠ হয়ে নানি নিজে গিয়ে আমিরুল্লাহকে ধরেন, কিছু একটা গতি করুইন বেয়াই সাব, টুটু আর শরাফ আল্লাহর পথে আইছিল দুনিয়াদারির লেহাপড়া ছাইড়া। এহন তো চাকরি বাকরি পাওনের যোগাড় নাই। পয়সাকড়ি না থাকলে খাইব কি! আপনে একটা ব্যবস্থা কইরা দেন।
আমিরুল্লাহ পান খাওয়া খয়েরি দাঁতে হেসে বললেন, ব্যবস্থার মালিক আল্লাহ তায়ালা। আমি তো তাঁর নিরীহ বান্দা। আল্লাহর ওপর ভরসা রাখুন, সব ঠিক হবে।
আল্লাহর উপর আমার ভরসা আছে বেয়াই সাব। কিন্তু ছেলে দুইডা তো বিয়া শাদি কইরা বিপদে পড়ছে। এই দুইজনরে আপনি চাকরির ব্যবস্থা কইরা দেন। আপনি চাইলেই পারেন দিতে।
আমিরুল্লাহ বললেন, ওই চাকরি ফাকরি দেবার মালিকও তিনি। রিজকের মালিক আল্লাহ। তিনিই চাকরি যোগাবেন।
নানি নামাজ পড়েন, রোজা করেন, কিন্তু ঘোরতর দুনিয়াদারির মানুষ। তিনি জানেন, জায়নামাজে বসে আল্লাহর কাছে মোনাজাতের হাত তুলে চাকরির জন্য কেঁদে পড়লেও চাকরি হবে না। আমিরুল্লাহর কাছে কাঁদলে বরং কিছ হওয়ার সম্ভাবনা আছে। আবু বকরের স্টিলের ইন্ডাস্ট্র্রির এখন আমিরুল্লাহই হর্তকর্তা, বাছাই করে পীরের ভক্তদের কেবল চাকরি দেওয়া হচ্ছে, ভক্ত ক অক্ষর গোমাংস হলেও সই। তদবিরে কাজ হয়। আমিরুল্লাহ অনেকক্ষণ আল্লাহর ওপর সব ঝামেলা চাপিয়ে দিলেও নাছোড়বান্দা নানিকে তিনি শেষে এই বলে বিদেয় করেন, ঠিক আছে ওরাও আকবরিয়া ইন্ডাস্ট্রিতে কারখানায় লেগে পড়ুক। কিন্তু শতর্ একটিই, সুন্নত পালন করতে হবে, দাড়ি রাখতে হবে, আর ওই দুনিয়াদারির পোশাক খুলে পাজামা পাঞ্জাবি পরতে হবে, মাথায় টুপি।
নানি পীর বাড়ি থেকে ফিরে বলেন, আই এ পর্যন্ত পইরা তো কোনও অফিসে কেরানির চাকরিও পাওয়া যায় না। পোশাক পাল্ডাইয়া, দাড়ি রাইখা যদি কারখানায় কাম কইরা টাকা পয়সা রোজগার করতে পারে, তাইলে তাই করুক।
টুটু আর শরাফ মামা পোশাক পাল্টো দিব্যি ঢুকে গেলেন কারখানায়। ছটকু পীর বাড়ির পোশাক আশাক বহু আগেই ছেড়েছে। মাদ্রাসা থেকে বেরিয়ে নাসিরাবাদ ইশকুলে কিছুদিন পড়েছিল কিন্তু মেট্রিক পাশ করার আগেই ইশকুল ছেড়ে দিয়ে নানার ভাতের দোকানে বসতে শুরু করেছে। নানা এদিক ওদিক গেলে ছটকু দেখাশোনা করে দোকান। টুটু মামা আর শরাফ মামার বিয়ের পর বিয়ের হিড়িক লাগে নানিবাড়িতে। একদিন শুনি ফেলু মামাও বিয়ে করবেন, পাড়াতেই এক সুন্দরী মেয়েকে দেখে পছন্দ হয়ে গেল, বিয়ের প্রস্তাব পাঠানোর পর মেয়ের মা বাবা রাজি হয়ে গেলেন, তিন গজ দূরের শ্বশুরবাড়ি থেকে মেয়েকে রিক্সা করে বউ নিয়ে এলেন বাড়িতে। ফেলু মামার বিয়ের পরই ছটকু বলল সেও বিয়ে করবে। জিলা ইশকুলের উল্টোদিকের দোতলা বাড়িতে এক সুন্দরী কিশোরীকে আসা যাওয়ার পথের ধারে দেখতে দেখতে কিছু হাসি এবং কিছু চিরকুট ছুঁড়ে দিয়ে পটানোর চেষ্টা করেছে যথেষ্ট। হাসি বা চিরকুটে কাত না হওয়া কিশোরীটিকে চিঠি লেখার জন্য ছটকু প্রায়ই অবকাশে আসত, আমাকে অথবা ইয়াসমিনকে যাকেই সামনে পেত, বলত, খুব ভাষা টাষা দিয়া একটা চিঠি লেইখা দে তো! ছটকুর আবদারে আমরা প্রেমের চিঠি লিখে দিতে থাকি। চিঠি বুকপকেটে পুরে ছটকু বেরিয়ে যেত, পরে সুযোগ বুঝে মেয়ের কাছে পাচার করত। সেসব চিঠি পেয়ে মেয়ে গলে গেল, গলে চৌদ্দ বছর বয়সেই ছটকুর গলায় লটকে গেল। ফকরুল মামার বিয়ে আর সব ভাইদের মত এরকম সহজে ঘটেনি। নিজে তিনি যুবইউনিয়নের নেতা। বড়মামার কাছ থেকে ছোটবেলাতেই কম্যুনিস্ট হওয়ার দীক্ষা পেয়েছিলেন। দলের আর সব নেতাদের বাড়িতে অবাধ যাতায়াত ছিল ফকরুল মামার। ওই করে করেই এক নেতার বউএর সঙ্গে প্রেমের সম্পর্কে দাঁড়াল। বউটি ফকরুল মামার চেয়ে বয়সে বড় পরন্তু দুই বাচ্চার মা। সম্পর্কে অনেকদূর পৌঁছেছিল। যেদিন নেতাটি হাতে নাতে ধরে ফেলেন দুজনকে, বউকে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিয়ে তালাকের কাগজ পাঠিয়ে দিলেন বউএর বাপের বাড়িতে। ফকরুল মামা সিদ্ধান্ত নিলেন তিনি বিয়ে করবেন বউটিকে, ওর এই অবস্থার জন্য দায়ি যখন তিনিই। কিন্তু বড়মামা রাজি নন। তিনি ফকরুল মামাকে ছলে বলে কৌশলে ময়মনসিংহে নিয়ে এসে আদেশ এবং উপদেশের রশি দিয়ে বাধঁ লেন। সেই রশি ছিঁড়ে ফকরুল মামা বেরিয়ে গেলেন দুদিন পর। ওই দুই বাচ্চার মাকে বিয়ে করে নিজের ঘরে তুললেন। বিয়েতে কোনও আত্মীয় স্বজন যায়নি। ছ ফুট লম্বা, ছিপছিপে গড়ন, সুদর্শন যুবক ফকরুল মামা বিয়ে করছেন কালো এক ধুমসি বুড়িকে। আত্মীয় স্বজন যাবে কেন বিয়েতে!
ছটকুর বউও এল বাড়িতে, নানাও অসুখে পড়লেন। কিছুর দিশা পাননা তিনি। নতুন বাজারের রাস্তা ভুলে গেছেন। পথ হারিয়ে ফেলেন। বিছানা ভিজিয়ে ফেলেন পেচ্ছাব করে। পেচ্ছাব পায়খানা কিছুরই খোঁজ রাখতে পারেন না। বিছানাতেই সারেন সব। নিজের হাতে নিজের মল তুলে তুলে জানালা দিয়ে ফেলেন। নানি আঁচলে নাক চেপে বলেন, গুগুলা ফিইক্যা মারে ক্যা? এইগুলাও কি কুত্তা বিলাইরে বিলাইতাছে না কি? বাবা একদিন দেখে এলেন নানাকে, ওষধু লিখে দিয়ে এলেন। ওষুধে কাজ হয় না। কি হয়েছে নানার? বাবা বললেন ডায়বেটিস। ডায়বেটিসের ওষুধ কখনও তিনি খাননি। কেবল জানতেন মিষ্টি খাওয়া বারণ। নানা বারণ মানেননি কোনওদিন। আমি নতুন ডাক্তার, নানার গায়ের চামড়া চিমটি দিয়ে তুলে ডিহাই−ড্রশন দেখি। শরীরে পানি নেই। মহাসমারোহে স্যালাইন দেওয়ার ব্যবস্থা করি। ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়েছিলেন, সুঁই ফোটালে যন্ত্রণায় কুঁকড়ে গিয়ে কেবল বলেছেন, ইস কি কষ্টটা দিল রে! যেদিন স্যালাইন দিই, সেদিনই নানা মারা যান। রাতে।
বাবাকে নানার মৃত্যুর কারণ জিজ্ঞেস করলে বললেন, রেসপিরেটরি ফেইলুর। শুনে আমার আশঙ্কা হয় স্যালাইন বেশি পড়ার কারণেই ফুসফুসে পানি জমে গেছে, নানা আর শ্বাস নিতে পারেননি।
স্যালাইন দেওয়াটা কি ভুল হইছে?
বাবা মাথা নাড়েন, ভুল হইছে। কিন্তু আমার ভুলের জন্য আমার ওপর কোনও রাগ বা নানার মরে যাওয়ার জন্য কোনও দুঃখ বা নানাকে কোনওদিন ডায়বেটিসের ওষধু না দেওয়ার জন্য বাবার কোনও অনুতাপ হয় না। ছোট্ট একটি আহা শব্দও উচ্চারণ করেন না। স্যালাইন না দিলে কি নানা বেঁচে থাকতেন! অসম্ভব নির্লিপ্তিতে উত্তর দেন, না! আমার তবু মনে হতে থাকে আমার দোষেই নানাকে মরে যেতে হয়েছে। গা নিথর করা একটি আতঙ্ক আমার মনের দখল ছাড়ে না। নিজেকে খুনী মনে হতে থাকে। হাসপাতালে কোনওদিন কোনও রোগীর এ পর্যন্ত কোনও ক্ষতি আমার দ্বারা হয়নি, আর নিজের নানার মৃত্যুর কারণই কি না আমি! আমার সাদাসিধে নানা, আমার ভালমানুষ নানা, সাতেনেইপাঁচেনেই নানা, প্রকাণ্ড একটি হৃদয়ের নানা। এই অপরাধের কোনও ক্ষমা নেই, ক্ষমা হয় না। স্তব্ধ উদাস বসে থাকি সারাদিন, সারারাত অন্ধকারের দিকে মুখ করে অবিন্যস্ত রাত পার করি। নিজেকে আমি ইচ্ছে করেই ক্ষমা করি না। নিজের ওপর এত রাগ হয় আমার, ইচ্ছে করে না নানিবাড়ি যেতে—নানির আর মামা খালাদের রোরুদ্যমান মুখ গুলো দেখতে। মেঝেয় গড়িয়ে বাজান গো আমার বাজান কই গেল বলে কেঁদেছেন মা, মা ই নানার অমন চলে যাওয়ায় সবচেয়ে বেশি কেঁদেছেন। যার চোখে এক ফোঁটা জল ছিল না, তিনি ফজলিখালা। ফজলিখালা জানেন, আল্লাহর মাল আল্লাহ উঠিয়ে নিয়েছেন, এ নিয়ে কান্নাকাটি করে লাভ নেই। কাঁদতে যদি হয়ই, আল্লাহর জন্য কাঁদো, আল্লাহর কাছে ভিক্ষে চাও, আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাও। কি কারণে ভিক্ষে, কি অপরাধের জন্য ক্ষমা—তা আমার বোঝা হয় না। ফজলিখালা কি অনেক পাপ করেছেন জীবনে যে প্রতিদিন তাকে ক্ষমা চাইতে হয় আল্লাহর কাছে!
নানারে স্যালাইন দেওয়া উচিত হয় নাই—মার ফুলে থাকা চোখদুটোর দিকে তাকিয়ে আমি আর এই স্বীকারোক্তিটি করতে পারি না। ইয়াসমিনকে আড়ালে ডেকে বলি। নিজেকে বারবার বলি, নিঃশব্দে চেঁচাই। মার দুপুরগুলো বিষণ্নতার রোদে পুড়তে থাকে, দেখি। কেউ আর শান্ত স্নিগ্ধ হাসি মুখে নিয়ে দুপুরগুলোকে শীতল করতে আসেন না। অনেকদিন নানির বাড়িতে এরপর আমি যাইনি। মা সেধেছেন যেতে, এ কাজ ও কাজের ছুতোয় এড়িয়ে গেছি। মাঝে মাঝেই বিকেলে ইচ্ছে করে নানি বাড়ি যাওয়ার, ইচ্ছেজ্ঞটকে দড়ি দিয়ে ঝুলিয়ে রাখি কড়িকাঠে। কিন্তু মা আমাকে তর নানি কইছে যাইতে, বার বারই কইতাছে নাসরিনডা তার নানার লাইগা কত কষ্ট করছে, হাসপাতাল থেইকা দৌড়াইয়া দৌড়াইয়া আইছে, স্যালাইন দিছে। চল চল তর নানিরে একটু সান্ত্বনা দিয়া আয় বলে আমাকে এক দুপুরবেলা ও বাড়িতে নিয়েই যান। নানিবাড়িটি যেরকম অনুৃমান করেছিলাম, থমথমে, সবাই কাঁদছে, মন খারাপ করে বসে আছে ওরকম মোটেও নয়। নানি রান্না করছেন ইলিশ মাছ। বাড়ির বাচ্চারা হই চই করছে। উঠোনে খেলার ধুম। মামারা ঘরে সেঁধিয়ে আছে নতুন বউ নিয়ে। ঘরগুলো থেকে হা হা হিহি ভেসে আসছে। বাড়িটিতে একটি মানুষ ছিল, এখন নেই, কেউ আর তাঁর না থাকার জন্য কাঁদছে না, কেউ আর নানার না থাকা জুড়ে বসে নেই। বাড়িতে, আমি অনুমান করি, একধরণের স্বস্তি এসেছে। মাথা-পাগল উদাসীন লোকটি নেই। পরের জন্য নিজের যা আছে সব বিলিয়ে দেওয়ার বোকা লোকটি আর নেই।
নানি ভাত বেড়ে দেন পাতে, পাতের কিনারে ইলিশ মাছের টুকরো। বাজান ইলিশ মাছ বড় পছন্দ করতেন বলে ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকেন মা, চোখের জল টপু টপু পড়তে থাকে ভাতের ওপর। নানি খাচ্ছেন। এক ফোঁটা জল নেই নানির চোখে। নানির সময় নেই পেছনের কারও কথা ভেবে চোখের জল ফেলার। আমার গলায় ফুটে থাকে মাছের কাঁটা। কাঁটাটি গলায় নিয়ে উঠোনে বসে থাকা ক্ষুধাতর্ কুকুরটির মুখের সামনে এক থাল ভাত ফেলে দিয়ে কলতলায় গিয়ে আমি হাত ধুয়ে ফেলি।
হাসপাতালে আরও মৃত্যু আমার দেখা হয়। প্রশ্ন করতে থাকি নিজেকে, কি অর্থ এই জীবনের। মৃত্যু আমার চারদিকে উদ্বাহু নৃত্য করে। মৃত্যু আমার কানে তারস্বরে গান শোনাতে থাকে। কি অর্থ এই জীবনের, নিজেকে প্রশ্ন করি। বারবার করি। এত মায়া এত ভালবাসা এত স্বপ্ন নিয়ে এই যে জীবন, যে কোনও মুহূর্তে জীবনটি ফুরিয়ে যাবে। কি লাভ!কি লাভ বেঁচে থেকে! পনেরো বিলিয়ন বছর আগে কিছু একটা ঘটে মহাশূন্যে ছিটকে পড়ল কিছু, সেই ছিটকে পড়া কিছু থেকে বিলিয়ন বিলিয়ন নক্ষত্র, নক্ষত্রপুঞ্জের জন্ম, সেইসব নক্ষত্রপুঞ্জের মধ্যে শামুকের মত পেঁচানো একটি পুঞ্জে চারশ মিলিয়ন বছর আগে পৃথিবী নামের এক গ্রহের জন্ম হল। এই পৃথিবীতে এক সময় প্রাণের জন্ম। এক কোষি থেকে বহুকোষি, ধীরে ধীরে বিবর্তনে বিবর্তনে মানুষ। এই মানুষ নামক প্রাণীও হয়ত ডায়নোসোর যেমন নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছে ছশ আশি লক্ষ বছর আগে, তেমন একদিন নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। তার আগেই হয়ত যাবে। অথবা যাবে না, বিবর্তনে বিবর্তনে অন্য কিছু। পৃথিবী পৃথিবীর মত থেকে যাবে। সূর্য তারা সূর্য তারার মত। কোনও একদিন আমাদের এই সূর্যটিও তাপ হারাতে হারাতে কালো একটি পিণ্ড-মত হয়ে যাবে। কোনও একদিন এই যে গ্রহনক্ষত্রগুলো প্রসারিত হচ্ছে হচ্ছেই—মহাশূন্যে হয়ত চপু সে যাবে। হয়ত যাবে না। হয়ত অনন্তকাল ধরে প্রসারিত হতেই থাকবে। বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডের এই খেলায় মানুষ কি আদৌ সামান্য কোনও ঘটনা? এই বিশাল মহাজগতে ক্ষণজীবী এই মানুষ নামক প্রাণীর জীবন ও জগতের কোনও ভূমিকাই নেই। মহাজগতের কোথাও নিজের এই ক্ষুদ্র অস্তিত্বটুকু এক পলকের জন্যও দেখি না। নানার রুহু ফজলিখালা বলেন দেখেছেন উড়ে যেতে। রুহু নাকি উড়ে গিয়েছে আসমানে, আল্লাহর কাছে। এই রুহুগুলো আল্লাহর কাছে জমা থাকবে, আল্লাহ সব রুহুকে আবার মানুষে রূপান্তরিত করবেন। তারপর তো সেই বিচারসভা। আল্লাহ বিচারকের আসনে বসে সমস্ত মানুষের বিচার করবেন। প্রতিটি মানুষের দুই কাঁধে দুই ফেরেসতা বসা, মুনকার আর নাকির, তারা ভাল মন্দের হিশেব লিখে রাখছে। সেই হিশেব দেখে আল্লাহ কাউকে বেহেসতের ঝরনার তলে পাঠাবেন, কাউকে দোযখের আগুনে। জীবন এমনই সরল অঙ্ক তাঁদের কাছে। দুই আর দুইএ চার। ফজলিখালা বিশ্বাস করেন নানার সঙ্গে তাঁর দেখা হবে আবার। নানা যেহেতু আল্লাহর নাম জপেছেন, রাতে রাতে উঠে জায়নামাজে বসে আল্লাহ ছাড়া কোনও মাবুদ নাই লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ বলে জিকির করেছেন, নিশ্চিত তিনি বেহেসতে যাবেন। আর ফজলিখালা যখন বেহেসতে যাচ্ছেনই, তখন দেখা তো হবেই। ফজলিখালা তাই কারও মৃত্যুতে কোনও দুঃখ পান না। জীবনের অর্থ তাঁর কাছে আছে। মার কাছেও আছে। জীবন হচ্ছে আল্লাহর পরীক্ষা। আল্লাহ জীবন দিয়ে পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন, কড়া নজর রাখছেন কে কি করছে না করছে, মৃত্যুর পর তিনি সবাইকে কর্মফল দেবেন। সরল অঙ্কে বিশ্বাসী সবকটা মানুষই একধরনের নিশ্চিন্তি বা সন্তুষ্টি নিয়ে থাকে। আমারই কেবল অস্থিরতা, অস্বসি।্ত উল্টো বিশ্বাস, মরে যাওয়া মানে সব শেষ হয়ে যাওয়া, কোনও ফল পাওয়ার নেই, আবার জন্ম নেই, কিছু নেই, সব ফাঁকা। জীবনের কোনও মানে নেই, অর্থ নেই। এই বিশ্বাস আমাকে ভয়াবহ বিষণ্নতা দেয়, জীবনবিমুখ করে। বাবাকে যদি প্রশ্ন করি জীবনের মানে কি, তিনি বলবেন জীবনের মানে হচ্ছে সংগ্রাম। পৃথিবীতে সংগ্রাম করে নিজের পায়ে দাঁড়ানোই হচ্ছে জীবনের সার্থকতা। তিনি শৈশব কৈশোর যৌবন ও বার্ধক্যকে ভাগ করে ফেলেন খুব সহজে। প্রথম শিক্ষাজীবন, তারপর কর্মজীবন, তারপর অবসরজীবন। শিক্ষা অর্জনে বা কর্মের কোনও রকম হেরফের হলে তার ফল ভোগ করতে হবে এই জীবনেই। স্বাচ্ছন্দ্য আর সচ্ছলত!র মধ্যেই তিনি ভাবেন জীবনের সাফল্য। জীবন অর্থপূণর্ হয় জীবনের সাফল্যে। কিন্তু জীবন যদি ফুরিয়েই যায় একদিন, জীবন সফল হল বা ব্যর্থ হল, তাতে কি ই বা যায় আসে! ব্যর্থতা আর সাফল্যের সংজ্ঞাও তো ভিন্ন মানুষের কাছে। এক দার্শনিক বলেছেন জীবনের কোনও অর্থ নেই, কিন্তু জীবনকে অর্থ দিতে হবে আমাদের। আমার মনে হয় না কোনও কিছু করেই আসলে আমরা জীবনের কোনও অর্থ দাঁড় করাতে পারি। এ কি নিজেকেই নিজের ফাঁকি দেওয়া নয়! অর্থ তৈরি করছে বলে জীবনকে গুরুত্বপণূর্ ভাবতে যেন পারে। যে লিখতে জানে ভাল তাকে লিখে, যে খেলতে জানে ভাল তাকে খেলে জীবনকে অর্থ দিতে হবে। আসলে কি অর্থ দেওয়া হয় না কি সুখ পাওয়া হয়? নিজের জন্য এক ক্ষণস্থায়ী সুখ । আমার মন বলে অর্থহীন জীবনকে অর্থপ ণূর্ করার শক্তি মানুষের নেই। মানুষ বড়জোর যা করতে পারে যতদিন প্রাণ আছে ততদিন কোত্থেকে এসেছি কোথায় যাবো তা নিয়ে দুশ্চিন্তা না করে ক্ষণিকের এই জীবনের সধুারসটুকুর শেষ বিন্দুটুকওু পান করতে পারে। কিন্তু পান করেই বা কিছু লাভ হয় কি? আমি যদি পান না করি, তাতে কি? আমি যদি আজ বেঁচে থাকি তাতেই বা আমার কি, আজ মরে গেলেই বা কি! এক ঘোর বিষণ্নতা আমাকে আচ্ছত করে রাখে।
চলতে ফিরতে পারে না। উল্ডা পাল্ডা কথা কয়।
কেন, সেইদিন না জাম্পার লইয়া আইল!
নানা পকেটে করে বা প্যাকেটে করে কিছু না কিছু আনেন,সামান্য হলেও আনেন, যখন আসেন। মেয়ের হাতে একটি বিস্কুট হলেও দিয়ে বলেন, মা, তুমি খাইও। একগাদা লান্ডির জাম্পার দিয়ে গেছেন, ওগুলো দিয়েই আমাদের অনেকগুলো শীত চলে যাবে। নানা কেন অসুস্থ হবেন! মাত্র দু সপ্তাহ আগে নানিবাড়ি বেড়াতে গিয়েছিলাম, তিনি দিব্যি সুস।্থ খাচ্ছেন। পাতে মাছের ঝোল ঢেলে দিতে দিতে নানি বলছেন, দোকানে তো আয় তেমন হইতাছে না। নানার দাতা হাতেমতাই স্বভাব আর যারই পছন্দ হোক, নানির মোটেই পছন্দ নয়।
আয় লাগব না, যা আছে তাই ভাল। কই একটু নুন দেও ত! শীতল পাটিতে আসন করে বসে ভাত মাখতে মাখতে মাখতে বললেন নানা।
নানি নুনের বয়াম নানার দিকে ঠেলে দিয়ে বললেন, আয় না করলে চলব! পুলাপান খাইব কি!
পুলাপান কি না খাইয়া থাকে নাকি?
দোকানের বাবুর্চিরা নিজেরা বড় বড় দোকান দিয়া হাজার টাকা ঘরে নিতাছে। আপনের তো পসার কিছু হইল না।
ওরা চুরি করলে আমিও কি চুরি করুম নাকি?
আপনেরে চুরি করতে কইতাছি না। ব্যবসাডায় মন দিতে কইতাছি।
ব্যবসায় যে মন নেই নানার, সে নানি বেশ ভাল জানেন। সেদিনও দোকানে হুট করে ঢুকে দেখলেন রাস্তার তিনটে পাগল চেয়ারে ঠ্যাং তুলে হাপুস-হুপুস খাচ্ছে। নানা পাশে বসে পাগলদের পাতে বড় বড় মাংস তুলে দিচ্ছেন। নানি বললেন, গাহেকের খবর নাই, পাগল খাওয়াইতাছেন বওয়াইয়া? নানা ভেংচি কেটে বললেন, আমার দোকান, আমি যারে ইচ্ছা খাওয়াইয়াম। তোমার কি? যাও যাও বাড়িত যাও।
দুটো গ্রাস মুখে দিয়েছেন কি দেননি, নানি গেলেন কলতলায়, ঠিক পেছন পেছন তিনি ভাতের থাল হাতে উঠে পুরো পাতের ভাত ঢেলে দিলেন উঠোনে।
কী ব্যাপার ভাত ফালাইছেন কেন? কলতলা থেকে চেঁচিয়ে নানি বলেন।
কুত্তা টুত্তা আছে খাইব নে!
নানির কাছে এ নতুন নয়। প্রায়ই তিনি দেখেন নানা জানলা দিয়ে টুকরো টুকরো করে পাউরুটি ছুঁড়ছেন।
কি ব্যাপার পাউরুটি বাইরে ফেলতাছেন কেন?
নানা বলেন, পিপঁ ড়া পপু ড়া আছে, খাইব নে।
পুলাপান পাউরুটি পায় না, আর আপনে পিপঁ ড়ারে পাউরুটি দেইন!
খায়রুন্নেসা, ওরাও তো আশা করে। নানা মধুর হেসে বলেন।
পকেটের বাতাসাও পুকুর পাড় দিয়ে আসার সময় পুকুরে ছুঁড়ে ফেলেন।
কেন?
মাছ টাছ আছে, খাইব। ওরাও তো আশা করে।
অবকাশেও এরকম ঘটে। মা ভাত বেড়ে দিলেন, বড় রুই মাছের টুকরো পাতে দিয়ে ডাল আনতে গেলেন বাটি করে। এসে দেখেন নানার পাতের মাছ পাতে নেই, পাতে শাদা শুকনো ভাত। রুই মাছ টেবিলের তলায়, বেড়ালে খাচ্ছে।
কি বাজান,মাছ বিলাইয়ে খায় কেন?
নানা হেসে বললেন দেখি তো তুমার ডাইলডা। কেমন রানছ দেখি।
ডাইল দিতাছি। কিন্তু মাছ ফালাইয়া দিছেন কেন?
আরে ফালামু কেন? বিলাইয়ের কি পছন্দ অপছন্দ নাই! ওদের কি কাঁটা খাইতে ইচ্ছা করে! মাছ টাছ ওরাও তো আশা করে!
কলতলা থেকে ফিরে এসে গামছায় মুখ মুছতে মুছতে নানি বললেন, মানুষের খবর নাই, আছে কুত্তা বিলাই লইয়া। রাস্তার পাগলা খাওয়াইয়া দোকানের বারোডা বাজাইছে। শান্তি আর এ জীবনে হইল না।
ততক্ষণে নানা নকশি কাথাঁর তলে। বিছানায়। ঘুমোচ্ছেন। দুপুরের খাওয়া দাওয়ার পর নানা লম্বা ঘুম দেন, ঘুম থেকে উঠে আবার দোকান। নতুন বাজারের মুখে পৌঁছলেই নানার পেছন পেছন ও পাড়ার যত পাগল আর ভিখিরি পিছু নেবে। টাকা পয়সা পাউরুটি বাতাসা বিলিয়ে হাঁটতে থাকবেন তিনি, দোকান অবদি পৌঁছলে পকেটে আর কিছুই অবশিষ্ট থাকবে না, তখন হাত দেবেন ক্যাশবাক্সে, মুঠি ধরে দেবেন দবির পাগলকে। দবির পাগল নানার খুব প্রিয় পাগল। ওই দবির পাগলের জন্যই নানা একবার খালি গায়ে বাড়ি পৌঁছেছিলেন।
কি ব্যাপার, পাঞ্জাবি কই?
দবিরডার পরনের জামা নাই। রাস্তায় আধা ল্যাংডা খাড়োইয়া রইছে।
তাই বইলা নিজের পরনের পাঞ্জাবি খুইলা দিয়া আইছেন?
না দিলে এই শীতের মধ্যে ও বাঁচব কেমনে!
আর এই শীতের মধ্যে আপনে কেমনে খালি গায়ে রইছেন?
আরে শীত কই তেমন! হাইটা আইছি ত। হাঁটলে শরীর গরম থাকে খায়রুন্নেসা।
নানি আর কথা বাড়ান না। লাভ নেই বলেই বাড়ান না। নানাকে তিনি চার যগু হল চেনেন। টিনের এই চৌচালা ঘরে সংসার পেতেছিলেন সেই কবে, ছেলে মেয়ে হল, তাদের বিয়ে হল, নাতি নাতনি হল, পুতিও হল, কিন্তু চালা ঘর ঠিক তেমনই আছে, যেমন ছিল। একটি খুঁটিও পাল্টোনি। চোখের সামনে ধাঁ ধাঁ করে এ বাড়ির চাকর বাকররাও বড়লোক হয়ে গেছে, রীতিমত দালান তুলেছে বস্তিতে। নানির অবশ্য দালানের লোভ নেই। কোনওভাবে খেয়ে পরে বেঁচে থাকাটাকেই তিনি যথেষ্ট মনে করেন। নানির ভাবনা টুটুমামা আর শরাফ মামাকে নিয়ে। এ দুজন লেখাপড়া ছেড়ে পীরবাড়িতে ভিড়েছিল। সংসার চালানোর কোনও ক্ষমতা না থাকলেও হুট করে বিয়ে করেছেন, কদিন পর পর এখন নানির কাছে হাত পাতেন। শেষ পর্যন্ত দুই ছেলের হাত পাতার জ্বালায় অতিষ্ঠ হয়ে নানি নিজে গিয়ে আমিরুল্লাহকে ধরেন, কিছু একটা গতি করুইন বেয়াই সাব, টুটু আর শরাফ আল্লাহর পথে আইছিল দুনিয়াদারির লেহাপড়া ছাইড়া। এহন তো চাকরি বাকরি পাওনের যোগাড় নাই। পয়সাকড়ি না থাকলে খাইব কি! আপনে একটা ব্যবস্থা কইরা দেন।
আমিরুল্লাহ পান খাওয়া খয়েরি দাঁতে হেসে বললেন, ব্যবস্থার মালিক আল্লাহ তায়ালা। আমি তো তাঁর নিরীহ বান্দা। আল্লাহর ওপর ভরসা রাখুন, সব ঠিক হবে।
আল্লাহর উপর আমার ভরসা আছে বেয়াই সাব। কিন্তু ছেলে দুইডা তো বিয়া শাদি কইরা বিপদে পড়ছে। এই দুইজনরে আপনি চাকরির ব্যবস্থা কইরা দেন। আপনি চাইলেই পারেন দিতে।
আমিরুল্লাহ বললেন, ওই চাকরি ফাকরি দেবার মালিকও তিনি। রিজকের মালিক আল্লাহ। তিনিই চাকরি যোগাবেন।
নানি নামাজ পড়েন, রোজা করেন, কিন্তু ঘোরতর দুনিয়াদারির মানুষ। তিনি জানেন, জায়নামাজে বসে আল্লাহর কাছে মোনাজাতের হাত তুলে চাকরির জন্য কেঁদে পড়লেও চাকরি হবে না। আমিরুল্লাহর কাছে কাঁদলে বরং কিছ হওয়ার সম্ভাবনা আছে। আবু বকরের স্টিলের ইন্ডাস্ট্র্রির এখন আমিরুল্লাহই হর্তকর্তা, বাছাই করে পীরের ভক্তদের কেবল চাকরি দেওয়া হচ্ছে, ভক্ত ক অক্ষর গোমাংস হলেও সই। তদবিরে কাজ হয়। আমিরুল্লাহ অনেকক্ষণ আল্লাহর ওপর সব ঝামেলা চাপিয়ে দিলেও নাছোড়বান্দা নানিকে তিনি শেষে এই বলে বিদেয় করেন, ঠিক আছে ওরাও আকবরিয়া ইন্ডাস্ট্রিতে কারখানায় লেগে পড়ুক। কিন্তু শতর্ একটিই, সুন্নত পালন করতে হবে, দাড়ি রাখতে হবে, আর ওই দুনিয়াদারির পোশাক খুলে পাজামা পাঞ্জাবি পরতে হবে, মাথায় টুপি।
নানি পীর বাড়ি থেকে ফিরে বলেন, আই এ পর্যন্ত পইরা তো কোনও অফিসে কেরানির চাকরিও পাওয়া যায় না। পোশাক পাল্ডাইয়া, দাড়ি রাইখা যদি কারখানায় কাম কইরা টাকা পয়সা রোজগার করতে পারে, তাইলে তাই করুক।
টুটু আর শরাফ মামা পোশাক পাল্টো দিব্যি ঢুকে গেলেন কারখানায়। ছটকু পীর বাড়ির পোশাক আশাক বহু আগেই ছেড়েছে। মাদ্রাসা থেকে বেরিয়ে নাসিরাবাদ ইশকুলে কিছুদিন পড়েছিল কিন্তু মেট্রিক পাশ করার আগেই ইশকুল ছেড়ে দিয়ে নানার ভাতের দোকানে বসতে শুরু করেছে। নানা এদিক ওদিক গেলে ছটকু দেখাশোনা করে দোকান। টুটু মামা আর শরাফ মামার বিয়ের পর বিয়ের হিড়িক লাগে নানিবাড়িতে। একদিন শুনি ফেলু মামাও বিয়ে করবেন, পাড়াতেই এক সুন্দরী মেয়েকে দেখে পছন্দ হয়ে গেল, বিয়ের প্রস্তাব পাঠানোর পর মেয়ের মা বাবা রাজি হয়ে গেলেন, তিন গজ দূরের শ্বশুরবাড়ি থেকে মেয়েকে রিক্সা করে বউ নিয়ে এলেন বাড়িতে। ফেলু মামার বিয়ের পরই ছটকু বলল সেও বিয়ে করবে। জিলা ইশকুলের উল্টোদিকের দোতলা বাড়িতে এক সুন্দরী কিশোরীকে আসা যাওয়ার পথের ধারে দেখতে দেখতে কিছু হাসি এবং কিছু চিরকুট ছুঁড়ে দিয়ে পটানোর চেষ্টা করেছে যথেষ্ট। হাসি বা চিরকুটে কাত না হওয়া কিশোরীটিকে চিঠি লেখার জন্য ছটকু প্রায়ই অবকাশে আসত, আমাকে অথবা ইয়াসমিনকে যাকেই সামনে পেত, বলত, খুব ভাষা টাষা দিয়া একটা চিঠি লেইখা দে তো! ছটকুর আবদারে আমরা প্রেমের চিঠি লিখে দিতে থাকি। চিঠি বুকপকেটে পুরে ছটকু বেরিয়ে যেত, পরে সুযোগ বুঝে মেয়ের কাছে পাচার করত। সেসব চিঠি পেয়ে মেয়ে গলে গেল, গলে চৌদ্দ বছর বয়সেই ছটকুর গলায় লটকে গেল। ফকরুল মামার বিয়ে আর সব ভাইদের মত এরকম সহজে ঘটেনি। নিজে তিনি যুবইউনিয়নের নেতা। বড়মামার কাছ থেকে ছোটবেলাতেই কম্যুনিস্ট হওয়ার দীক্ষা পেয়েছিলেন। দলের আর সব নেতাদের বাড়িতে অবাধ যাতায়াত ছিল ফকরুল মামার। ওই করে করেই এক নেতার বউএর সঙ্গে প্রেমের সম্পর্কে দাঁড়াল। বউটি ফকরুল মামার চেয়ে বয়সে বড় পরন্তু দুই বাচ্চার মা। সম্পর্কে অনেকদূর পৌঁছেছিল। যেদিন নেতাটি হাতে নাতে ধরে ফেলেন দুজনকে, বউকে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিয়ে তালাকের কাগজ পাঠিয়ে দিলেন বউএর বাপের বাড়িতে। ফকরুল মামা সিদ্ধান্ত নিলেন তিনি বিয়ে করবেন বউটিকে, ওর এই অবস্থার জন্য দায়ি যখন তিনিই। কিন্তু বড়মামা রাজি নন। তিনি ফকরুল মামাকে ছলে বলে কৌশলে ময়মনসিংহে নিয়ে এসে আদেশ এবং উপদেশের রশি দিয়ে বাধঁ লেন। সেই রশি ছিঁড়ে ফকরুল মামা বেরিয়ে গেলেন দুদিন পর। ওই দুই বাচ্চার মাকে বিয়ে করে নিজের ঘরে তুললেন। বিয়েতে কোনও আত্মীয় স্বজন যায়নি। ছ ফুট লম্বা, ছিপছিপে গড়ন, সুদর্শন যুবক ফকরুল মামা বিয়ে করছেন কালো এক ধুমসি বুড়িকে। আত্মীয় স্বজন যাবে কেন বিয়েতে!
ছটকুর বউও এল বাড়িতে, নানাও অসুখে পড়লেন। কিছুর দিশা পাননা তিনি। নতুন বাজারের রাস্তা ভুলে গেছেন। পথ হারিয়ে ফেলেন। বিছানা ভিজিয়ে ফেলেন পেচ্ছাব করে। পেচ্ছাব পায়খানা কিছুরই খোঁজ রাখতে পারেন না। বিছানাতেই সারেন সব। নিজের হাতে নিজের মল তুলে তুলে জানালা দিয়ে ফেলেন। নানি আঁচলে নাক চেপে বলেন, গুগুলা ফিইক্যা মারে ক্যা? এইগুলাও কি কুত্তা বিলাইরে বিলাইতাছে না কি? বাবা একদিন দেখে এলেন নানাকে, ওষধু লিখে দিয়ে এলেন। ওষুধে কাজ হয় না। কি হয়েছে নানার? বাবা বললেন ডায়বেটিস। ডায়বেটিসের ওষুধ কখনও তিনি খাননি। কেবল জানতেন মিষ্টি খাওয়া বারণ। নানা বারণ মানেননি কোনওদিন। আমি নতুন ডাক্তার, নানার গায়ের চামড়া চিমটি দিয়ে তুলে ডিহাই−ড্রশন দেখি। শরীরে পানি নেই। মহাসমারোহে স্যালাইন দেওয়ার ব্যবস্থা করি। ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়েছিলেন, সুঁই ফোটালে যন্ত্রণায় কুঁকড়ে গিয়ে কেবল বলেছেন, ইস কি কষ্টটা দিল রে! যেদিন স্যালাইন দিই, সেদিনই নানা মারা যান। রাতে।
বাবাকে নানার মৃত্যুর কারণ জিজ্ঞেস করলে বললেন, রেসপিরেটরি ফেইলুর। শুনে আমার আশঙ্কা হয় স্যালাইন বেশি পড়ার কারণেই ফুসফুসে পানি জমে গেছে, নানা আর শ্বাস নিতে পারেননি।
স্যালাইন দেওয়াটা কি ভুল হইছে?
বাবা মাথা নাড়েন, ভুল হইছে। কিন্তু আমার ভুলের জন্য আমার ওপর কোনও রাগ বা নানার মরে যাওয়ার জন্য কোনও দুঃখ বা নানাকে কোনওদিন ডায়বেটিসের ওষধু না দেওয়ার জন্য বাবার কোনও অনুতাপ হয় না। ছোট্ট একটি আহা শব্দও উচ্চারণ করেন না। স্যালাইন না দিলে কি নানা বেঁচে থাকতেন! অসম্ভব নির্লিপ্তিতে উত্তর দেন, না! আমার তবু মনে হতে থাকে আমার দোষেই নানাকে মরে যেতে হয়েছে। গা নিথর করা একটি আতঙ্ক আমার মনের দখল ছাড়ে না। নিজেকে খুনী মনে হতে থাকে। হাসপাতালে কোনওদিন কোনও রোগীর এ পর্যন্ত কোনও ক্ষতি আমার দ্বারা হয়নি, আর নিজের নানার মৃত্যুর কারণই কি না আমি! আমার সাদাসিধে নানা, আমার ভালমানুষ নানা, সাতেনেইপাঁচেনেই নানা, প্রকাণ্ড একটি হৃদয়ের নানা। এই অপরাধের কোনও ক্ষমা নেই, ক্ষমা হয় না। স্তব্ধ উদাস বসে থাকি সারাদিন, সারারাত অন্ধকারের দিকে মুখ করে অবিন্যস্ত রাত পার করি। নিজেকে আমি ইচ্ছে করেই ক্ষমা করি না। নিজের ওপর এত রাগ হয় আমার, ইচ্ছে করে না নানিবাড়ি যেতে—নানির আর মামা খালাদের রোরুদ্যমান মুখ গুলো দেখতে। মেঝেয় গড়িয়ে বাজান গো আমার বাজান কই গেল বলে কেঁদেছেন মা, মা ই নানার অমন চলে যাওয়ায় সবচেয়ে বেশি কেঁদেছেন। যার চোখে এক ফোঁটা জল ছিল না, তিনি ফজলিখালা। ফজলিখালা জানেন, আল্লাহর মাল আল্লাহ উঠিয়ে নিয়েছেন, এ নিয়ে কান্নাকাটি করে লাভ নেই। কাঁদতে যদি হয়ই, আল্লাহর জন্য কাঁদো, আল্লাহর কাছে ভিক্ষে চাও, আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাও। কি কারণে ভিক্ষে, কি অপরাধের জন্য ক্ষমা—তা আমার বোঝা হয় না। ফজলিখালা কি অনেক পাপ করেছেন জীবনে যে প্রতিদিন তাকে ক্ষমা চাইতে হয় আল্লাহর কাছে!
নানারে স্যালাইন দেওয়া উচিত হয় নাই—মার ফুলে থাকা চোখদুটোর দিকে তাকিয়ে আমি আর এই স্বীকারোক্তিটি করতে পারি না। ইয়াসমিনকে আড়ালে ডেকে বলি। নিজেকে বারবার বলি, নিঃশব্দে চেঁচাই। মার দুপুরগুলো বিষণ্নতার রোদে পুড়তে থাকে, দেখি। কেউ আর শান্ত স্নিগ্ধ হাসি মুখে নিয়ে দুপুরগুলোকে শীতল করতে আসেন না। অনেকদিন নানির বাড়িতে এরপর আমি যাইনি। মা সেধেছেন যেতে, এ কাজ ও কাজের ছুতোয় এড়িয়ে গেছি। মাঝে মাঝেই বিকেলে ইচ্ছে করে নানি বাড়ি যাওয়ার, ইচ্ছেজ্ঞটকে দড়ি দিয়ে ঝুলিয়ে রাখি কড়িকাঠে। কিন্তু মা আমাকে তর নানি কইছে যাইতে, বার বারই কইতাছে নাসরিনডা তার নানার লাইগা কত কষ্ট করছে, হাসপাতাল থেইকা দৌড়াইয়া দৌড়াইয়া আইছে, স্যালাইন দিছে। চল চল তর নানিরে একটু সান্ত্বনা দিয়া আয় বলে আমাকে এক দুপুরবেলা ও বাড়িতে নিয়েই যান। নানিবাড়িটি যেরকম অনুৃমান করেছিলাম, থমথমে, সবাই কাঁদছে, মন খারাপ করে বসে আছে ওরকম মোটেও নয়। নানি রান্না করছেন ইলিশ মাছ। বাড়ির বাচ্চারা হই চই করছে। উঠোনে খেলার ধুম। মামারা ঘরে সেঁধিয়ে আছে নতুন বউ নিয়ে। ঘরগুলো থেকে হা হা হিহি ভেসে আসছে। বাড়িটিতে একটি মানুষ ছিল, এখন নেই, কেউ আর তাঁর না থাকার জন্য কাঁদছে না, কেউ আর নানার না থাকা জুড়ে বসে নেই। বাড়িতে, আমি অনুমান করি, একধরণের স্বস্তি এসেছে। মাথা-পাগল উদাসীন লোকটি নেই। পরের জন্য নিজের যা আছে সব বিলিয়ে দেওয়ার বোকা লোকটি আর নেই।
নানি ভাত বেড়ে দেন পাতে, পাতের কিনারে ইলিশ মাছের টুকরো। বাজান ইলিশ মাছ বড় পছন্দ করতেন বলে ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকেন মা, চোখের জল টপু টপু পড়তে থাকে ভাতের ওপর। নানি খাচ্ছেন। এক ফোঁটা জল নেই নানির চোখে। নানির সময় নেই পেছনের কারও কথা ভেবে চোখের জল ফেলার। আমার গলায় ফুটে থাকে মাছের কাঁটা। কাঁটাটি গলায় নিয়ে উঠোনে বসে থাকা ক্ষুধাতর্ কুকুরটির মুখের সামনে এক থাল ভাত ফেলে দিয়ে কলতলায় গিয়ে আমি হাত ধুয়ে ফেলি।
হাসপাতালে আরও মৃত্যু আমার দেখা হয়। প্রশ্ন করতে থাকি নিজেকে, কি অর্থ এই জীবনের। মৃত্যু আমার চারদিকে উদ্বাহু নৃত্য করে। মৃত্যু আমার কানে তারস্বরে গান শোনাতে থাকে। কি অর্থ এই জীবনের, নিজেকে প্রশ্ন করি। বারবার করি। এত মায়া এত ভালবাসা এত স্বপ্ন নিয়ে এই যে জীবন, যে কোনও মুহূর্তে জীবনটি ফুরিয়ে যাবে। কি লাভ!কি লাভ বেঁচে থেকে! পনেরো বিলিয়ন বছর আগে কিছু একটা ঘটে মহাশূন্যে ছিটকে পড়ল কিছু, সেই ছিটকে পড়া কিছু থেকে বিলিয়ন বিলিয়ন নক্ষত্র, নক্ষত্রপুঞ্জের জন্ম, সেইসব নক্ষত্রপুঞ্জের মধ্যে শামুকের মত পেঁচানো একটি পুঞ্জে চারশ মিলিয়ন বছর আগে পৃথিবী নামের এক গ্রহের জন্ম হল। এই পৃথিবীতে এক সময় প্রাণের জন্ম। এক কোষি থেকে বহুকোষি, ধীরে ধীরে বিবর্তনে বিবর্তনে মানুষ। এই মানুষ নামক প্রাণীও হয়ত ডায়নোসোর যেমন নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছে ছশ আশি লক্ষ বছর আগে, তেমন একদিন নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। তার আগেই হয়ত যাবে। অথবা যাবে না, বিবর্তনে বিবর্তনে অন্য কিছু। পৃথিবী পৃথিবীর মত থেকে যাবে। সূর্য তারা সূর্য তারার মত। কোনও একদিন আমাদের এই সূর্যটিও তাপ হারাতে হারাতে কালো একটি পিণ্ড-মত হয়ে যাবে। কোনও একদিন এই যে গ্রহনক্ষত্রগুলো প্রসারিত হচ্ছে হচ্ছেই—মহাশূন্যে হয়ত চপু সে যাবে। হয়ত যাবে না। হয়ত অনন্তকাল ধরে প্রসারিত হতেই থাকবে। বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডের এই খেলায় মানুষ কি আদৌ সামান্য কোনও ঘটনা? এই বিশাল মহাজগতে ক্ষণজীবী এই মানুষ নামক প্রাণীর জীবন ও জগতের কোনও ভূমিকাই নেই। মহাজগতের কোথাও নিজের এই ক্ষুদ্র অস্তিত্বটুকু এক পলকের জন্যও দেখি না। নানার রুহু ফজলিখালা বলেন দেখেছেন উড়ে যেতে। রুহু নাকি উড়ে গিয়েছে আসমানে, আল্লাহর কাছে। এই রুহুগুলো আল্লাহর কাছে জমা থাকবে, আল্লাহ সব রুহুকে আবার মানুষে রূপান্তরিত করবেন। তারপর তো সেই বিচারসভা। আল্লাহ বিচারকের আসনে বসে সমস্ত মানুষের বিচার করবেন। প্রতিটি মানুষের দুই কাঁধে দুই ফেরেসতা বসা, মুনকার আর নাকির, তারা ভাল মন্দের হিশেব লিখে রাখছে। সেই হিশেব দেখে আল্লাহ কাউকে বেহেসতের ঝরনার তলে পাঠাবেন, কাউকে দোযখের আগুনে। জীবন এমনই সরল অঙ্ক তাঁদের কাছে। দুই আর দুইএ চার। ফজলিখালা বিশ্বাস করেন নানার সঙ্গে তাঁর দেখা হবে আবার। নানা যেহেতু আল্লাহর নাম জপেছেন, রাতে রাতে উঠে জায়নামাজে বসে আল্লাহ ছাড়া কোনও মাবুদ নাই লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ বলে জিকির করেছেন, নিশ্চিত তিনি বেহেসতে যাবেন। আর ফজলিখালা যখন বেহেসতে যাচ্ছেনই, তখন দেখা তো হবেই। ফজলিখালা তাই কারও মৃত্যুতে কোনও দুঃখ পান না। জীবনের অর্থ তাঁর কাছে আছে। মার কাছেও আছে। জীবন হচ্ছে আল্লাহর পরীক্ষা। আল্লাহ জীবন দিয়ে পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন, কড়া নজর রাখছেন কে কি করছে না করছে, মৃত্যুর পর তিনি সবাইকে কর্মফল দেবেন। সরল অঙ্কে বিশ্বাসী সবকটা মানুষই একধরনের নিশ্চিন্তি বা সন্তুষ্টি নিয়ে থাকে। আমারই কেবল অস্থিরতা, অস্বসি।্ত উল্টো বিশ্বাস, মরে যাওয়া মানে সব শেষ হয়ে যাওয়া, কোনও ফল পাওয়ার নেই, আবার জন্ম নেই, কিছু নেই, সব ফাঁকা। জীবনের কোনও মানে নেই, অর্থ নেই। এই বিশ্বাস আমাকে ভয়াবহ বিষণ্নতা দেয়, জীবনবিমুখ করে। বাবাকে যদি প্রশ্ন করি জীবনের মানে কি, তিনি বলবেন জীবনের মানে হচ্ছে সংগ্রাম। পৃথিবীতে সংগ্রাম করে নিজের পায়ে দাঁড়ানোই হচ্ছে জীবনের সার্থকতা। তিনি শৈশব কৈশোর যৌবন ও বার্ধক্যকে ভাগ করে ফেলেন খুব সহজে। প্রথম শিক্ষাজীবন, তারপর কর্মজীবন, তারপর অবসরজীবন। শিক্ষা অর্জনে বা কর্মের কোনও রকম হেরফের হলে তার ফল ভোগ করতে হবে এই জীবনেই। স্বাচ্ছন্দ্য আর সচ্ছলত!র মধ্যেই তিনি ভাবেন জীবনের সাফল্য। জীবন অর্থপূণর্ হয় জীবনের সাফল্যে। কিন্তু জীবন যদি ফুরিয়েই যায় একদিন, জীবন সফল হল বা ব্যর্থ হল, তাতে কি ই বা যায় আসে! ব্যর্থতা আর সাফল্যের সংজ্ঞাও তো ভিন্ন মানুষের কাছে। এক দার্শনিক বলেছেন জীবনের কোনও অর্থ নেই, কিন্তু জীবনকে অর্থ দিতে হবে আমাদের। আমার মনে হয় না কোনও কিছু করেই আসলে আমরা জীবনের কোনও অর্থ দাঁড় করাতে পারি। এ কি নিজেকেই নিজের ফাঁকি দেওয়া নয়! অর্থ তৈরি করছে বলে জীবনকে গুরুত্বপণূর্ ভাবতে যেন পারে। যে লিখতে জানে ভাল তাকে লিখে, যে খেলতে জানে ভাল তাকে খেলে জীবনকে অর্থ দিতে হবে। আসলে কি অর্থ দেওয়া হয় না কি সুখ পাওয়া হয়? নিজের জন্য এক ক্ষণস্থায়ী সুখ । আমার মন বলে অর্থহীন জীবনকে অর্থপ ণূর্ করার শক্তি মানুষের নেই। মানুষ বড়জোর যা করতে পারে যতদিন প্রাণ আছে ততদিন কোত্থেকে এসেছি কোথায় যাবো তা নিয়ে দুশ্চিন্তা না করে ক্ষণিকের এই জীবনের সধুারসটুকুর শেষ বিন্দুটুকওু পান করতে পারে। কিন্তু পান করেই বা কিছু লাভ হয় কি? আমি যদি পান না করি, তাতে কি? আমি যদি আজ বেঁচে থাকি তাতেই বা আমার কি, আজ মরে গেলেই বা কি! এক ঘোর বিষণ্নতা আমাকে আচ্ছত করে রাখে।