What's new
Nirjonmela Desi Forum

Talk about the things that matter to you! Wanting to join the rest of our members? Feel free to sign up today and gain full access!

Collected উতল হাওয়া (আত্মজিবনী) (1 Viewer)

ফিক্সড ডিউটিতে ব্যস্ত থাকার সময়ই মা একদিন বলেন, বাজানের শইলডা বালা না। কেন, কি হইছে?

চলতে ফিরতে পারে না। উল্ডা পাল্ডা কথা কয়।

কেন, সেইদিন না জাম্পার লইয়া আইল!

নানা পকেটে করে বা প্যাকেটে করে কিছু না কিছু আনেন,সামান্য হলেও আনেন, যখন আসেন। মেয়ের হাতে একটি বিস্কুট হলেও দিয়ে বলেন, মা, তুমি খাইও। একগাদা লান্ডির জাম্পার দিয়ে গেছেন, ওগুলো দিয়েই আমাদের অনেকগুলো শীত চলে যাবে। নানা কেন অসুস্থ হবেন! মাত্র দু সপ্তাহ আগে নানিবাড়ি বেড়াতে গিয়েছিলাম, তিনি দিব্যি সুস।্থ খাচ্ছেন। পাতে মাছের ঝোল ঢেলে দিতে দিতে নানি বলছেন, দোকানে তো আয় তেমন হইতাছে না। নানার দাতা হাতেমতাই স্বভাব আর যারই পছন্দ হোক, নানির মোটেই পছন্দ নয়।

আয় লাগব না, যা আছে তাই ভাল। কই একটু নুন দেও ত! শীতল পাটিতে আসন করে বসে ভাত মাখতে মাখতে মাখতে বললেন নানা।

নানি নুনের বয়াম নানার দিকে ঠেলে দিয়ে বললেন, আয় না করলে চলব! পুলাপান খাইব কি!

পুলাপান কি না খাইয়া থাকে নাকি?

দোকানের বাবুর্চিরা নিজেরা বড় বড় দোকান দিয়া হাজার টাকা ঘরে নিতাছে। আপনের তো পসার কিছু হইল না।

ওরা চুরি করলে আমিও কি চুরি করুম নাকি?

আপনেরে চুরি করতে কইতাছি না। ব্যবসাডায় মন দিতে কইতাছি।

ব্যবসায় যে মন নেই নানার, সে নানি বেশ ভাল জানেন। সেদিনও দোকানে হুট করে ঢুকে দেখলেন রাস্তার তিনটে পাগল চেয়ারে ঠ্যাং তুলে হাপুস-হুপুস খাচ্ছে। নানা পাশে বসে পাগলদের পাতে বড় বড় মাংস তুলে দিচ্ছেন। নানি বললেন, গাহেকের খবর নাই, পাগল খাওয়াইতাছেন বওয়াইয়া? নানা ভেংচি কেটে বললেন, আমার দোকান, আমি যারে ইচ্ছা খাওয়াইয়াম। তোমার কি? যাও যাও বাড়িত যাও।

দুটো গ্রাস মুখে দিয়েছেন কি দেননি, নানি গেলেন কলতলায়, ঠিক পেছন পেছন তিনি ভাতের থাল হাতে উঠে পুরো পাতের ভাত ঢেলে দিলেন উঠোনে।

কী ব্যাপার ভাত ফালাইছেন কেন? কলতলা থেকে চেঁচিয়ে নানি বলেন।

কুত্তা টুত্তা আছে খাইব নে!

নানির কাছে এ নতুন নয়। প্রায়ই তিনি দেখেন নানা জানলা দিয়ে টুকরো টুকরো করে পাউরুটি ছুঁড়ছেন।

কি ব্যাপার পাউরুটি বাইরে ফেলতাছেন কেন?

নানা বলেন, পিপঁ ড়া পপু ড়া আছে, খাইব নে।

পুলাপান পাউরুটি পায় না, আর আপনে পিপঁ ড়ারে পাউরুটি দেইন!

খায়রুন্নেসা, ওরাও তো আশা করে। নানা মধুর হেসে বলেন।

পকেটের বাতাসাও পুকুর পাড় দিয়ে আসার সময় পুকুরে ছুঁড়ে ফেলেন।

কেন?

মাছ টাছ আছে, খাইব। ওরাও তো আশা করে।

অবকাশেও এরকম ঘটে। মা ভাত বেড়ে দিলেন, বড় রুই মাছের টুকরো পাতে দিয়ে ডাল আনতে গেলেন বাটি করে। এসে দেখেন নানার পাতের মাছ পাতে নেই, পাতে শাদা শুকনো ভাত। রুই মাছ টেবিলের তলায়, বেড়ালে খাচ্ছে।

কি বাজান,মাছ বিলাইয়ে খায় কেন?

নানা হেসে বললেন দেখি তো তুমার ডাইলডা। কেমন রানছ দেখি।

ডাইল দিতাছি। কিন্তু মাছ ফালাইয়া দিছেন কেন?

আরে ফালামু কেন? বিলাইয়ের কি পছন্দ অপছন্দ নাই! ওদের কি কাঁটা খাইতে ইচ্ছা করে! মাছ টাছ ওরাও তো আশা করে!

কলতলা থেকে ফিরে এসে গামছায় মুখ মুছতে মুছতে নানি বললেন, মানুষের খবর নাই, আছে কুত্তা বিলাই লইয়া। রাস্তার পাগলা খাওয়াইয়া দোকানের বারোডা বাজাইছে। শান্তি আর এ জীবনে হইল না।

ততক্ষণে নানা নকশি কাথাঁর তলে। বিছানায়। ঘুমোচ্ছেন। দুপুরের খাওয়া দাওয়ার পর নানা লম্বা ঘুম দেন, ঘুম থেকে উঠে আবার দোকান। নতুন বাজারের মুখে পৌঁছলেই নানার পেছন পেছন ও পাড়ার যত পাগল আর ভিখিরি পিছু নেবে। টাকা পয়সা পাউরুটি বাতাসা বিলিয়ে হাঁটতে থাকবেন তিনি, দোকান অবদি পৌঁছলে পকেটে আর কিছুই অবশিষ্ট থাকবে না, তখন হাত দেবেন ক্যাশবাক্সে, মুঠি ধরে দেবেন দবির পাগলকে। দবির পাগল নানার খুব প্রিয় পাগল। ওই দবির পাগলের জন্যই নানা একবার খালি গায়ে বাড়ি পৌঁছেছিলেন।

কি ব্যাপার, পাঞ্জাবি কই?

দবিরডার পরনের জামা নাই। রাস্তায় আধা ল্যাংডা খাড়োইয়া রইছে।

তাই বইলা নিজের পরনের পাঞ্জাবি খুইলা দিয়া আইছেন?

না দিলে এই শীতের মধ্যে ও বাঁচব কেমনে!

আর এই শীতের মধ্যে আপনে কেমনে খালি গায়ে রইছেন?

আরে শীত কই তেমন! হাইটা আইছি ত। হাঁটলে শরীর গরম থাকে খায়রুন্নেসা।

নানি আর কথা বাড়ান না। লাভ নেই বলেই বাড়ান না। নানাকে তিনি চার যগু হল চেনেন। টিনের এই চৌচালা ঘরে সংসার পেতেছিলেন সেই কবে, ছেলে মেয়ে হল, তাদের বিয়ে হল, নাতি নাতনি হল, পুতিও হল, কিন্তু চালা ঘর ঠিক তেমনই আছে, যেমন ছিল। একটি খুঁটিও পাল্টোনি। চোখের সামনে ধাঁ ধাঁ করে এ বাড়ির চাকর বাকররাও বড়লোক হয়ে গেছে, রীতিমত দালান তুলেছে বস্তিতে। নানির অবশ্য দালানের লোভ নেই। কোনওভাবে খেয়ে পরে বেঁচে থাকাটাকেই তিনি যথেষ্ট মনে করেন। নানির ভাবনা টুটুমামা আর শরাফ মামাকে নিয়ে। এ দুজন লেখাপড়া ছেড়ে পীরবাড়িতে ভিড়েছিল। সংসার চালানোর কোনও ক্ষমতা না থাকলেও হুট করে বিয়ে করেছেন, কদিন পর পর এখন নানির কাছে হাত পাতেন। শেষ পর্যন্ত দুই ছেলের হাত পাতার জ্বালায় অতিষ্ঠ হয়ে নানি নিজে গিয়ে আমিরুল্লাহকে ধরেন, কিছু একটা গতি করুইন বেয়াই সাব, টুটু আর শরাফ আল্লাহর পথে আইছিল দুনিয়াদারির লেহাপড়া ছাইড়া। এহন তো চাকরি বাকরি পাওনের যোগাড় নাই। পয়সাকড়ি না থাকলে খাইব কি! আপনে একটা ব্যবস্থা কইরা দেন।

আমিরুল্লাহ পান খাওয়া খয়েরি দাঁতে হেসে বললেন, ব্যবস্থার মালিক আল্লাহ তায়ালা। আমি তো তাঁর নিরীহ বান্দা। আল্লাহর ওপর ভরসা রাখুন, সব ঠিক হবে।

আল্লাহর উপর আমার ভরসা আছে বেয়াই সাব। কিন্তু ছেলে দুইডা তো বিয়া শাদি কইরা বিপদে পড়ছে। এই দুইজনরে আপনি চাকরির ব্যবস্থা কইরা দেন। আপনি চাইলেই পারেন দিতে।

আমিরুল্লাহ বললেন, ওই চাকরি ফাকরি দেবার মালিকও তিনি। রিজকের মালিক আল্লাহ। তিনিই চাকরি যোগাবেন।

নানি নামাজ পড়েন, রোজা করেন, কিন্তু ঘোরতর দুনিয়াদারির মানুষ। তিনি জানেন, জায়নামাজে বসে আল্লাহর কাছে মোনাজাতের হাত তুলে চাকরির জন্য কেঁদে পড়লেও চাকরি হবে না। আমিরুল্লাহর কাছে কাঁদলে বরং কিছ হওয়ার সম্ভাবনা আছে। আবু বকরের স্টিলের ইন্ডাস্ট্র্রির এখন আমিরুল্লাহই হর্তকর্তা, বাছাই করে পীরের ভক্তদের কেবল চাকরি দেওয়া হচ্ছে, ভক্ত ক অক্ষর গোমাংস হলেও সই। তদবিরে কাজ হয়। আমিরুল্লাহ অনেকক্ষণ আল্লাহর ওপর সব ঝামেলা চাপিয়ে দিলেও নাছোড়বান্দা নানিকে তিনি শেষে এই বলে বিদেয় করেন, ঠিক আছে ওরাও আকবরিয়া ইন্ডাস্ট্রিতে কারখানায় লেগে পড়ুক। কিন্তু শতর্ একটিই, সুন্নত পালন করতে হবে, দাড়ি রাখতে হবে, আর ওই দুনিয়াদারির পোশাক খুলে পাজামা পাঞ্জাবি পরতে হবে, মাথায় টুপি।

নানি পীর বাড়ি থেকে ফিরে বলেন, আই এ পর্যন্ত পইরা তো কোনও অফিসে কেরানির চাকরিও পাওয়া যায় না। পোশাক পাল্ডাইয়া, দাড়ি রাইখা যদি কারখানায় কাম কইরা টাকা পয়সা রোজগার করতে পারে, তাইলে তাই করুক।

টুটু আর শরাফ মামা পোশাক পাল্টো দিব্যি ঢুকে গেলেন কারখানায়। ছটকু পীর বাড়ির পোশাক আশাক বহু আগেই ছেড়েছে। মাদ্রাসা থেকে বেরিয়ে নাসিরাবাদ ইশকুলে কিছুদিন পড়েছিল কিন্তু মেট্রিক পাশ করার আগেই ইশকুল ছেড়ে দিয়ে নানার ভাতের দোকানে বসতে শুরু করেছে। নানা এদিক ওদিক গেলে ছটকু দেখাশোনা করে দোকান। টুটু মামা আর শরাফ মামার বিয়ের পর বিয়ের হিড়িক লাগে নানিবাড়িতে। একদিন শুনি ফেলু মামাও বিয়ে করবেন, পাড়াতেই এক সুন্দরী মেয়েকে দেখে পছন্দ হয়ে গেল, বিয়ের প্রস্তাব পাঠানোর পর মেয়ের মা বাবা রাজি হয়ে গেলেন, তিন গজ দূরের শ্বশুরবাড়ি থেকে মেয়েকে রিক্সা করে বউ নিয়ে এলেন বাড়িতে। ফেলু মামার বিয়ের পরই ছটকু বলল সেও বিয়ে করবে। জিলা ইশকুলের উল্টোদিকের দোতলা বাড়িতে এক সুন্দরী কিশোরীকে আসা যাওয়ার পথের ধারে দেখতে দেখতে কিছু হাসি এবং কিছু চিরকুট ছুঁড়ে দিয়ে পটানোর চেষ্টা করেছে যথেষ্ট। হাসি বা চিরকুটে কাত না হওয়া কিশোরীটিকে চিঠি লেখার জন্য ছটকু প্রায়ই অবকাশে আসত, আমাকে অথবা ইয়াসমিনকে যাকেই সামনে পেত, বলত, খুব ভাষা টাষা দিয়া একটা চিঠি লেইখা দে তো! ছটকুর আবদারে আমরা প্রেমের চিঠি লিখে দিতে থাকি। চিঠি বুকপকেটে পুরে ছটকু বেরিয়ে যেত, পরে সুযোগ বুঝে মেয়ের কাছে পাচার করত। সেসব চিঠি পেয়ে মেয়ে গলে গেল, গলে চৌদ্দ বছর বয়সেই ছটকুর গলায় লটকে গেল। ফকরুল মামার বিয়ে আর সব ভাইদের মত এরকম সহজে ঘটেনি। নিজে তিনি যুবইউনিয়নের নেতা। বড়মামার কাছ থেকে ছোটবেলাতেই কম্যুনিস্ট হওয়ার দীক্ষা পেয়েছিলেন। দলের আর সব নেতাদের বাড়িতে অবাধ যাতায়াত ছিল ফকরুল মামার। ওই করে করেই এক নেতার বউএর সঙ্গে প্রেমের সম্পর্কে দাঁড়াল। বউটি ফকরুল মামার চেয়ে বয়সে বড় পরন্তু দুই বাচ্চার মা। সম্পর্কে অনেকদূর পৌঁছেছিল। যেদিন নেতাটি হাতে নাতে ধরে ফেলেন দুজনকে, বউকে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিয়ে তালাকের কাগজ পাঠিয়ে দিলেন বউএর বাপের বাড়িতে। ফকরুল মামা সিদ্ধান্ত নিলেন তিনি বিয়ে করবেন বউটিকে, ওর এই অবস্থার জন্য দায়ি যখন তিনিই। কিন্তু বড়মামা রাজি নন। তিনি ফকরুল মামাকে ছলে বলে কৌশলে ময়মনসিংহে নিয়ে এসে আদেশ এবং উপদেশের রশি দিয়ে বাধঁ লেন। সেই রশি ছিঁড়ে ফকরুল মামা বেরিয়ে গেলেন দুদিন পর। ওই দুই বাচ্চার মাকে বিয়ে করে নিজের ঘরে তুললেন। বিয়েতে কোনও আত্মীয় স্বজন যায়নি। ছ ফুট লম্বা, ছিপছিপে গড়ন, সুদর্শন যুবক ফকরুল মামা বিয়ে করছেন কালো এক ধুমসি বুড়িকে। আত্মীয় স্বজন যাবে কেন বিয়েতে!

ছটকুর বউও এল বাড়িতে, নানাও অসুখে পড়লেন। কিছুর দিশা পাননা তিনি। নতুন বাজারের রাস্তা ভুলে গেছেন। পথ হারিয়ে ফেলেন। বিছানা ভিজিয়ে ফেলেন পেচ্ছাব করে। পেচ্ছাব পায়খানা কিছুরই খোঁজ রাখতে পারেন না। বিছানাতেই সারেন সব। নিজের হাতে নিজের মল তুলে তুলে জানালা দিয়ে ফেলেন। নানি আঁচলে নাক চেপে বলেন, গুগুলা ফিইক্যা মারে ক্যা? এইগুলাও কি কুত্তা বিলাইরে বিলাইতাছে না কি? বাবা একদিন দেখে এলেন নানাকে, ওষধু লিখে দিয়ে এলেন। ওষুধে কাজ হয় না। কি হয়েছে নানার? বাবা বললেন ডায়বেটিস। ডায়বেটিসের ওষুধ কখনও তিনি খাননি। কেবল জানতেন মিষ্টি খাওয়া বারণ। নানা বারণ মানেননি কোনওদিন। আমি নতুন ডাক্তার, নানার গায়ের চামড়া চিমটি দিয়ে তুলে ডিহাই−ড্রশন দেখি। শরীরে পানি নেই। মহাসমারোহে স্যালাইন দেওয়ার ব্যবস্থা করি। ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়েছিলেন, সুঁই ফোটালে যন্ত্রণায় কুঁকড়ে গিয়ে কেবল বলেছেন, ইস কি কষ্টটা দিল রে! যেদিন স্যালাইন দিই, সেদিনই নানা মারা যান। রাতে।

বাবাকে নানার মৃত্যুর কারণ জিজ্ঞেস করলে বললেন, রেসপিরেটরি ফেইলুর। শুনে আমার আশঙ্কা হয় স্যালাইন বেশি পড়ার কারণেই ফুসফুসে পানি জমে গেছে, নানা আর শ্বাস নিতে পারেননি।

স্যালাইন দেওয়াটা কি ভুল হইছে?

বাবা মাথা নাড়েন, ভুল হইছে। কিন্তু আমার ভুলের জন্য আমার ওপর কোনও রাগ বা নানার মরে যাওয়ার জন্য কোনও দুঃখ বা নানাকে কোনওদিন ডায়বেটিসের ওষধু না দেওয়ার জন্য বাবার কোনও অনুতাপ হয় না। ছোট্ট একটি আহা শব্দও উচ্চারণ করেন না। স্যালাইন না দিলে কি নানা বেঁচে থাকতেন! অসম্ভব নির্লিপ্তিতে উত্তর দেন, না! আমার তবু মনে হতে থাকে আমার দোষেই নানাকে মরে যেতে হয়েছে। গা নিথর করা একটি আতঙ্ক আমার মনের দখল ছাড়ে না। নিজেকে খুনী মনে হতে থাকে। হাসপাতালে কোনওদিন কোনও রোগীর এ পর্যন্ত কোনও ক্ষতি আমার দ্বারা হয়নি, আর নিজের নানার মৃত্যুর কারণই কি না আমি! আমার সাদাসিধে নানা, আমার ভালমানুষ নানা, সাতেনেইপাঁচেনেই নানা, প্রকাণ্ড একটি হৃদয়ের নানা। এই অপরাধের কোনও ক্ষমা নেই, ক্ষমা হয় না। স্তব্ধ উদাস বসে থাকি সারাদিন, সারারাত অন্ধকারের দিকে মুখ করে অবিন্যস্ত রাত পার করি। নিজেকে আমি ইচ্ছে করেই ক্ষমা করি না। নিজের ওপর এত রাগ হয় আমার, ইচ্ছে করে না নানিবাড়ি যেতে—নানির আর মামা খালাদের রোরুদ্যমান মুখ গুলো দেখতে। মেঝেয় গড়িয়ে বাজান গো আমার বাজান কই গেল বলে কেঁদেছেন মা, মা ই নানার অমন চলে যাওয়ায় সবচেয়ে বেশি কেঁদেছেন। যার চোখে এক ফোঁটা জল ছিল না, তিনি ফজলিখালা। ফজলিখালা জানেন, আল্লাহর মাল আল্লাহ উঠিয়ে নিয়েছেন, এ নিয়ে কান্নাকাটি করে লাভ নেই। কাঁদতে যদি হয়ই, আল্লাহর জন্য কাঁদো, আল্লাহর কাছে ভিক্ষে চাও, আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাও। কি কারণে ভিক্ষে, কি অপরাধের জন্য ক্ষমা—তা আমার বোঝা হয় না। ফজলিখালা কি অনেক পাপ করেছেন জীবনে যে প্রতিদিন তাকে ক্ষমা চাইতে হয় আল্লাহর কাছে!

নানারে স্যালাইন দেওয়া উচিত হয় নাই—মার ফুলে থাকা চোখদুটোর দিকে তাকিয়ে আমি আর এই স্বীকারোক্তিটি করতে পারি না। ইয়াসমিনকে আড়ালে ডেকে বলি। নিজেকে বারবার বলি, নিঃশব্দে চেঁচাই। মার দুপুরগুলো বিষণ্নতার রোদে পুড়তে থাকে, দেখি। কেউ আর শান্ত স্নিগ্ধ হাসি মুখে নিয়ে দুপুরগুলোকে শীতল করতে আসেন না। অনেকদিন নানির বাড়িতে এরপর আমি যাইনি। মা সেধেছেন যেতে, এ কাজ ও কাজের ছুতোয় এড়িয়ে গেছি। মাঝে মাঝেই বিকেলে ইচ্ছে করে নানি বাড়ি যাওয়ার, ইচ্ছেজ্ঞটকে দড়ি দিয়ে ঝুলিয়ে রাখি কড়িকাঠে। কিন্তু মা আমাকে তর নানি কইছে যাইতে, বার বারই কইতাছে নাসরিনডা তার নানার লাইগা কত কষ্ট করছে, হাসপাতাল থেইকা দৌড়াইয়া দৌড়াইয়া আইছে, স্যালাইন দিছে। চল চল তর নানিরে একটু সান্ত্বনা দিয়া আয় বলে আমাকে এক দুপুরবেলা ও বাড়িতে নিয়েই যান। নানিবাড়িটি যেরকম অনুৃমান করেছিলাম, থমথমে, সবাই কাঁদছে, মন খারাপ করে বসে আছে ওরকম মোটেও নয়। নানি রান্না করছেন ইলিশ মাছ। বাড়ির বাচ্চারা হই চই করছে। উঠোনে খেলার ধুম। মামারা ঘরে সেঁধিয়ে আছে নতুন বউ নিয়ে। ঘরগুলো থেকে হা হা হিহি ভেসে আসছে। বাড়িটিতে একটি মানুষ ছিল, এখন নেই, কেউ আর তাঁর না থাকার জন্য কাঁদছে না, কেউ আর নানার না থাকা জুড়ে বসে নেই। বাড়িতে, আমি অনুমান করি, একধরণের স্বস্তি এসেছে। মাথা-পাগল উদাসীন লোকটি নেই। পরের জন্য নিজের যা আছে সব বিলিয়ে দেওয়ার বোকা লোকটি আর নেই।

নানি ভাত বেড়ে দেন পাতে, পাতের কিনারে ইলিশ মাছের টুকরো। বাজান ইলিশ মাছ বড় পছন্দ করতেন বলে ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকেন মা, চোখের জল টপু টপু পড়তে থাকে ভাতের ওপর। নানি খাচ্ছেন। এক ফোঁটা জল নেই নানির চোখে। নানির সময় নেই পেছনের কারও কথা ভেবে চোখের জল ফেলার। আমার গলায় ফুটে থাকে মাছের কাঁটা। কাঁটাটি গলায় নিয়ে উঠোনে বসে থাকা ক্ষুধাতর্ কুকুরটির মুখের সামনে এক থাল ভাত ফেলে দিয়ে কলতলায় গিয়ে আমি হাত ধুয়ে ফেলি।



হাসপাতালে আরও মৃত্যু আমার দেখা হয়। প্রশ্ন করতে থাকি নিজেকে, কি অর্থ এই জীবনের। মৃত্যু আমার চারদিকে উদ্বাহু নৃত্য করে। মৃত্যু আমার কানে তারস্বরে গান শোনাতে থাকে। কি অর্থ এই জীবনের, নিজেকে প্রশ্ন করি। বারবার করি। এত মায়া এত ভালবাসা এত স্বপ্ন নিয়ে এই যে জীবন, যে কোনও মুহূর্তে জীবনটি ফুরিয়ে যাবে। কি লাভ!কি লাভ বেঁচে থেকে! পনেরো বিলিয়ন বছর আগে কিছু একটা ঘটে মহাশূন্যে ছিটকে পড়ল কিছু, সেই ছিটকে পড়া কিছু থেকে বিলিয়ন বিলিয়ন নক্ষত্র, নক্ষত্রপুঞ্জের জন্ম, সেইসব নক্ষত্রপুঞ্জের মধ্যে শামুকের মত পেঁচানো একটি পুঞ্জে চারশ মিলিয়ন বছর আগে পৃথিবী নামের এক গ্রহের জন্ম হল। এই পৃথিবীতে এক সময় প্রাণের জন্ম। এক কোষি থেকে বহুকোষি, ধীরে ধীরে বিবর্তনে বিবর্তনে মানুষ। এই মানুষ নামক প্রাণীও হয়ত ডায়নোসোর যেমন নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছে ছশ আশি লক্ষ বছর আগে, তেমন একদিন নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। তার আগেই হয়ত যাবে। অথবা যাবে না, বিবর্তনে বিবর্তনে অন্য কিছু। পৃথিবী পৃথিবীর মত থেকে যাবে। সূর্য তারা সূর্য তারার মত। কোনও একদিন আমাদের এই সূর্যটিও তাপ হারাতে হারাতে কালো একটি পিণ্ড-মত হয়ে যাবে। কোনও একদিন এই যে গ্রহনক্ষত্রগুলো প্রসারিত হচ্ছে হচ্ছেই—মহাশূন্যে হয়ত চপু সে যাবে। হয়ত যাবে না। হয়ত অনন্তকাল ধরে প্রসারিত হতেই থাকবে। বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডের এই খেলায় মানুষ কি আদৌ সামান্য কোনও ঘটনা? এই বিশাল মহাজগতে ক্ষণজীবী এই মানুষ নামক প্রাণীর জীবন ও জগতের কোনও ভূমিকাই নেই। মহাজগতের কোথাও নিজের এই ক্ষুদ্র অস্তিত্বটুকু এক পলকের জন্যও দেখি না। নানার রুহু ফজলিখালা বলেন দেখেছেন উড়ে যেতে। রুহু নাকি উড়ে গিয়েছে আসমানে, আল্লাহর কাছে। এই রুহুগুলো আল্লাহর কাছে জমা থাকবে, আল্লাহ সব রুহুকে আবার মানুষে রূপান্তরিত করবেন। তারপর তো সেই বিচারসভা। আল্লাহ বিচারকের আসনে বসে সমস্ত মানুষের বিচার করবেন। প্রতিটি মানুষের দুই কাঁধে দুই ফেরেসতা বসা, মুনকার আর নাকির, তারা ভাল মন্দের হিশেব লিখে রাখছে। সেই হিশেব দেখে আল্লাহ কাউকে বেহেসতের ঝরনার তলে পাঠাবেন, কাউকে দোযখের আগুনে। জীবন এমনই সরল অঙ্ক তাঁদের কাছে। দুই আর দুইএ চার। ফজলিখালা বিশ্বাস করেন নানার সঙ্গে তাঁর দেখা হবে আবার। নানা যেহেতু আল্লাহর নাম জপেছেন, রাতে রাতে উঠে জায়নামাজে বসে আল্লাহ ছাড়া কোনও মাবুদ নাই লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ বলে জিকির করেছেন, নিশ্চিত তিনি বেহেসতে যাবেন। আর ফজলিখালা যখন বেহেসতে যাচ্ছেনই, তখন দেখা তো হবেই। ফজলিখালা তাই কারও মৃত্যুতে কোনও দুঃখ পান না। জীবনের অর্থ তাঁর কাছে আছে। মার কাছেও আছে। জীবন হচ্ছে আল্লাহর পরীক্ষা। আল্লাহ জীবন দিয়ে পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন, কড়া নজর রাখছেন কে কি করছে না করছে, মৃত্যুর পর তিনি সবাইকে কর্মফল দেবেন। সরল অঙ্কে বিশ্বাসী সবকটা মানুষই একধরনের নিশ্চিন্তি বা সন্তুষ্টি নিয়ে থাকে। আমারই কেবল অস্থিরতা, অস্বসি।্ত উল্টো বিশ্বাস, মরে যাওয়া মানে সব শেষ হয়ে যাওয়া, কোনও ফল পাওয়ার নেই, আবার জন্ম নেই, কিছু নেই, সব ফাঁকা। জীবনের কোনও মানে নেই, অর্থ নেই। এই বিশ্বাস আমাকে ভয়াবহ বিষণ্নতা দেয়, জীবনবিমুখ করে। বাবাকে যদি প্রশ্ন করি জীবনের মানে কি, তিনি বলবেন জীবনের মানে হচ্ছে সংগ্রাম। পৃথিবীতে সংগ্রাম করে নিজের পায়ে দাঁড়ানোই হচ্ছে জীবনের সার্থকতা। তিনি শৈশব কৈশোর যৌবন ও বার্ধক্যকে ভাগ করে ফেলেন খুব সহজে। প্রথম শিক্ষাজীবন, তারপর কর্মজীবন, তারপর অবসরজীবন। শিক্ষা অর্জনে বা কর্মের কোনও রকম হেরফের হলে তার ফল ভোগ করতে হবে এই জীবনেই। স্বাচ্ছন্দ্য আর সচ্ছলত!র মধ্যেই তিনি ভাবেন জীবনের সাফল্য। জীবন অর্থপূণর্ হয় জীবনের সাফল্যে। কিন্তু জীবন যদি ফুরিয়েই যায় একদিন, জীবন সফল হল বা ব্যর্থ হল, তাতে কি ই বা যায় আসে! ব্যর্থতা আর সাফল্যের সংজ্ঞাও তো ভিন্ন মানুষের কাছে। এক দার্শনিক বলেছেন জীবনের কোনও অর্থ নেই, কিন্তু জীবনকে অর্থ দিতে হবে আমাদের। আমার মনে হয় না কোনও কিছু করেই আসলে আমরা জীবনের কোনও অর্থ দাঁড় করাতে পারি। এ কি নিজেকেই নিজের ফাঁকি দেওয়া নয়! অর্থ তৈরি করছে বলে জীবনকে গুরুত্বপণূর্ ভাবতে যেন পারে। যে লিখতে জানে ভাল তাকে লিখে, যে খেলতে জানে ভাল তাকে খেলে জীবনকে অর্থ দিতে হবে। আসলে কি অর্থ দেওয়া হয় না কি সুখ পাওয়া হয়? নিজের জন্য এক ক্ষণস্থায়ী সুখ । আমার মন বলে অর্থহীন জীবনকে অর্থপ ণূর্ করার শক্তি মানুষের নেই। মানুষ বড়জোর যা করতে পারে যতদিন প্রাণ আছে ততদিন কোত্থেকে এসেছি কোথায় যাবো তা নিয়ে দুশ্চিন্তা না করে ক্ষণিকের এই জীবনের সধুারসটুকুর শেষ বিন্দুটুকওু পান করতে পারে। কিন্তু পান করেই বা কিছু লাভ হয় কি? আমি যদি পান না করি, তাতে কি? আমি যদি আজ বেঁচে থাকি তাতেই বা আমার কি, আজ মরে গেলেই বা কি! এক ঘোর বিষণ্নতা আমাকে আচ্ছত করে রাখে।
 
২৪. সংসার ধর্ম



হাসপাতালে চিকিৎসক হিসেবে প্রশিক্ষণ নিতে হবে এক বছর, না কম না বেশি। বছর শেষ হলে ঢাকায় পাকাপাকি ভাবে নিজের সংসারে ফিরব এরকমই কথা রুদ্রর সঙ্গে। রুদ্রও মোংলা মিঠেখালির পাট চুকিয়ে ঢাকায় ফিরবে। শুরু হবে সংসার আমাদের। কোনও ছেদ না পড়া সংসার। পাকাপাকির আগেই অবশ্য নানা ছুতোয় আমার ঢাকা যাওয়া হতে থাকে, রুটিনে এক মাস গ্রাম পড়ল তো ঢাকা যাও, পড়ে গিয়ে হাত ভাঙল তো ঢাকা যাও। ডান হাতের কনুইয়ের হাড় ভেঙে টুকরো হয়নি, সামান্য ফেটেছে, ওটুকুর জন্যই হাড়ের ডাক্তার প্লাস্টার লাগিয়ে দিয়ে বললেন, পুরো এক মাস। স্ত্রীরোগপ্রসুতিবিদ্যা বিভাগে তখনও আমার ডিউটি শেষ হয়নি, অধ্যাপক জোবায়েদ হোসেন, গলার দড়িতে নব্বই ডিগ্রি কোণে ঝুলে থাকা হাত দেখেই বললেন, ভাঙলা? হুম, ভাল একটা কারণ জুটে গেল ফাঁকি মারার, কি বল? না, জোবায়েদ হোসেন এটি ঠিক বলেননি। ডিউটিতে ফাঁকি মারার গোপন কোনও ইচ্ছে আমার ছিল না।

হাত ভাঙা তো গা-গরম হওয়া বা খুসুখসে কাশির মত নয়, রীতিমত বড় একটি ঘটনা, এই ঘটনায় নিদ্বির্ধায় প্রশিক্ষণ কামাই করা যায়, বাঘ হয়েও জোবায়েদ হোসেন মেনেছেন, আমি না মানার কে! মা দুদিন মুখে তুলে খাইয়ে দিলেন, গোসল করিয়ে জামা পরিয়ে দিলেন। মাকে ঠেলে সরিয়ে একদিন ঢাকায় রওনা হই। ঢাকা যাওয়ার কোনও ইচ্ছে হত না যদি না রুদ্র ময়মনসিংহে এসে সে রাতের ব্যাপারে স্বীকার করত যে সে রাতে সে মাতাল ছিল, যা করেছে কোনও সুস্থ মস্তিস্কে করে নি। আজকাল ঢাকা যেতে বাড়িতে কোনও কৈফিয়ত দিই না যে সার্টিফিকেট তুলতে হবে বা অপারেশন করাতে হবে বা অন্য কোনও বড় কারণ যে কারণে ঢাকা না গেলেই নয়। দিব্যি ঢাকা যাচ্ছি বলে বেরিয়ে যাই, কোথায় থাকব কার বাড়িতে তাও বলি না, বলি না কারণ বাড়ির সবাই জানে আমি কোথায় কার কাছে যাই। এ নিয়ে কেউ আমার সঙ্গে কোনও আলোচনায় বসে না। আমার ঢাকা যাওয়ার প্রসঙ্গ এলেই কলকলে বাড়িটি হঠাৎ চপু হয়ে যায়। ওই নৈঃশব্দ থেকে আমি নিঃশব্দে মিলিয়ে যাই। বাড়ি থেকে রিক্সা নিয়ে বাসস্ট্যান্ড। ঢাকা যাওয়ার বাস, ঘন্টায় ঘন্টায় ছাড়ছে।

রুদ্র আমাকে মুখে তুলে খাইয়ে দেয়, যেহেতু আমার ডান হাতটি অকেজো। গোসলখানায় নিয়ে আমার কাপড় জামা খুলে গায়ে জল ঢেলে সাবান মেখে গোসল করিয়ে দেয়। গোসল করানোর সময় আমার শরীর স্পর্শ করে তার শরীরের ভেতর ফুঁসে উঠতে থাকে আরেকটি শরীর। নরম তোয়ালেয় গা মাথা মুছিয়ে আমাকে ঘরে আনে, শুইয়ে দেয়। উর্ধাঙ্গ অচল হলে কি হবে, নিম্নাঙ্গ তো অচল নয়। রাতে যখন গাছপালা দুলিয়ে মেঘ জমিয়ে ঘরে তুমুল তুফান তোলে রুদ্র, সেই তুফানে চৌকি ভেঙে পড়ে তলায় তোশক বালিশ সহ আমি। ভাল হাতটি ভাঙতে ভাঙতেও ভাঙেনা। এর পরের তুফান মেঝের ওপর বয়, মেঝে ভেঙে নিয়ে নিচতলায় না পড়লেও মজবুত দেখে বড় একটি খাট কেনা হয়, যেন কোনও ঝড় তুফানে না ভেঙে পড়ে। বড় বিছানায় শুয়ে অভ্যেস আমার। হাত পা ছড়িয়ে শুতে না পারলে ঘুম ভাল হয় না। তার ওপর আবার কোলবালিশের ব্যাপারও আছে। মাথার বালিশকে কোলবালিশ করে আপাতত ঝড় তুফান শেষে নিদ্রা যাই। খাট কিনে তোশক বালিশ কিনে টাকা ফুরিয়ে যায়। টাকা ফুরোলে রুদ্র যা করে, মোংলা রওনা হয়। এবার আমাকে নিয়ে মোংলা যাবে সে। আমি বাধা দিই না। রুদ্রর সঙ্গ আমার প্রার্থিত। সাত সমুদ্দুর তের নদীর ওপারে যেতে হলেও যাব, আর এ তো শ্বশুর বাড়ি!



হাত ভাঙা বলে কোনও লাল কাতান পরার দায় নেই, একরকম বাঁচি। লম্বা একটি ঢিলে জামা পরে থাকি, পরতে খুলতে সুবিধে। ঢাকা থেকে রেলে করে, লঞ্চে করে, দীর্ঘ পথ পেরিয়ে মোংলায়, রূপসার ঘোলা জলের পাড়ে সেই নিঝুম বাড়িটিতে আবার, দোতলার ঘরটিতে আবার। বাড়িতে অনেকগুলো মানুষ, অথচ মনে হয় কেউ নেই বুঝি, কেউ ছিল না বুঝি! মানুষ খুঁজতে আমাকে ঘরে ঘরে উঁকি দিতে হয়। রুদ্রর মা তাঁর ভারি শরীরটি নিয়ে শুয়ে আছেন পালঙ্কে। বাকি ঘরগুলোয় আছে বাকিরা। বাকিরা যা কিছুই করছে, নিঃশব্দে করছে। পিঠাপিঠি ভাই বোন, অথচ কোনও চড়চিমটি-চুলোচুলো নেই। গোসলের সময় গোসল করছে, খাওয়ার সময় খাচ্ছে, ঘুমের সময় ঘুমোচ্ছে। চাবি দেওয়া যন্ত্রের মত, কাঁটায় কাঁটায় ঘটে যাচ্ছে সব, কিছুই পড়ে থাকছে না, কিছুরই এদিক ওদিক হয়না, এমন নিয়ম, পালনের প্রশ্ন ওঠে না, দেখলেই হাঁসফাঁস লাগে, আমি কোনও রুটিন মেনে চলতে পারি না, ক্ষিধে লাগলে খেয়ে উঠি, গোসল করে পরে খেতে হবে এমন নিয়মের মধ্যে নিজেকে কখনই ফেলতে পারি না, আজ গোসল করি তো কাল করি না, আজ নাস্তা খাই তো কাল খাই না, দুপুরে কোনওদিন ঘুমোই, কোনওদিন ঘুমোই না, রাত নটা বা দশটা বাজলেই আমার ঘুমোতে যেতে হবে এমন কোনও কথা নেই। কখনও আটটায় যাই, কখনও দশটায়, কখনও আবার সারা রাত্তির যাওয়াই হয় না। আমার উপস্থিতি এ বাড়িটির মন্থর ছন্দে একটুকু পরিবর্তন আনে না। অবকাশে যেরকম উৎসব শুরু হয় নতুন কেউ এলে, তার কিছুই ঘটে না এ বাড়িতে। সম্ভাষণও এমন শীতল, যেন মানুষগুলো সকাল বিকাল আমাকে দেখছে, যেন আমি এ বাড়িতে দীর্ঘ দীর্ঘ বছর ধরে বাস করছি। ইচ্ছে করে বাড়িটির মরচে ধরা দরজা ভীষণ ধাক্কা দিয়ে খুলি, মাকড়শার জালগুলো সরাই। মানুষ একটু চিৎকার করুক, গলা ছেড়ে গান গাক, উঠোনের কাদায় হঠাৎ পিছলে পড়ে যাক, কেউ কাউকে ধমক লাগাক, কেউ তর্কে করুক কিছু নিয়ে, কিছু একটা ঘটুক, কেউ কিছু একটা করুক, হো হো করে হাসুক, হাসতে যদি না পারে তবু কিছু একটা করুক, না হয় কাঁদুক। তবু কিছু করুক। আমিই ওদের গায়ের শ্যাওলা সরিয়ে বলি, চল গল্প করি, চল তাস খেলি। বিছানায় সবাইকে নিয়ে গোল হয়ে বসে আসর জমাতে চাই, জমে না। কারও কোনও গল্প নেই। অসম্ভব নিস্পৃহতার আঁচলে ওরা মুখ লুকিয়ে রাখে। ভাঙা হাত, তবু শুয়ে বসে থাকতে ইচ্ছে করে না, কিছু একটা করার তীব্র আকাঙক্ষা রক্তের কণার সঙ্গে মাথা থেকে পা অবদি দৌড়োয়। সারা বাড়িতে কোনও বই নেই যে পড়ব, সময় আমার প্রতি লোমকূপে বাবলা গাছের কাঁটা হয়ে বেঁধে। সময় আমার খুব বড় শত্রু হয়ে দাঁড়ায়, চাবুকে চাবুকে আমাকে রক্তাক্ত করতে থাকে। প্রতিদিন সকালে বা দুপুরে বেরিয়ে যায় রুদ্র, অসহ্য অপেক্ষার প্রহর কাটাই একা একা, মধ্যরাতে মাতাল স্বামী ঘরে ফেরে। দিনগুলো এভাবেই পেরোতে থাকে। এভাবেই রাতগুলো। ঘর থেকে বেরোতে গেলেই একটি কিম্ভূতকিমাকার না এসে আমাকে অচল করে রাখে। তবওু গোঁ ধরে যাবই যাবই বলে এক রাতে বেরোলাম, একটি হোটেলে সে গেল, একটি আড্ডায়, মদের আড্ডায়। বন্দরে ভদ্রলোকদের যাওয়ার জায়গা বলতে এই হোটেলটিই, রুদ্র বলে। গুমোট ঘরের বাইরে এসে আমি ফুসফুস ভরে হাওয়া নিতে চেয়েছিলাম, হাওয়া জোটে, মদগন্ধময়হাওয়াই জোটে।

প্রাণ ফিরে পাই যেদিন বন্দর ত্যাগের আয়োজন হয়, যদিও ঢাকার পথে নয়, যাত্রাটি আরও গভীর গ্রামের পথে, তবু এ বাড়ির শুয়ে বসে থাকা জীবনটি শেষ করার জন্য আমি আকুল হয়ে রওনা হই। গ্রামে নিশ্চয়ই বন্দরের মত শ্রমিকের উৎপাত নেই, রুদ্রর হাত ধরে সেইসব শস্যের সবুজ ক্ষেতের আলপথ ধরে হাঁটতে পারব, যেসব ক্ষেতের কথা বারবার সে লিখেছে কবিতায়। মিঠেখালি গ্রামটি নিশ্চয়ই ছবির মত সুন্দর একটি গ্রাম, যে গ্রামের সৌন্দর্য রুদ্রকে বারবার টেনে আনে এখানে। কোথায় বসে সে কবিতা লেখে, কোন বৃক্ষতলে সে উদাস বসে আমাকে ভাবে, কোন ভরা জ্যোৎস্নার মাঠে সে একা একা দৌড়ে যায়, দুচোখ ভরে দেখব সব। মোংলা থেকে ছইঅলা নৌকোয় মুখ আড়াল করে আরও সব মেয়েমানুষের সঙ্গে খাল পেরিয়ে মিঠেখালি যেতে হয়। গভীর গ্রামের ভেতর চারদিকে ফসলের ক্ষেত, কিছু গোলপাতার ঘর এদিকে ওদিকে, মাঝখানে গাছগাছালি ঘেরা বড় একটি দোতলা বাড়ি। বাড়ির সামনে একটি পুকুর, পুকুরে শান বাধাঁনো ঘাট। সন্ধে হলেই বাড়ির ঘরে, বারান্দায়, সিঁড়িতে প্রচুর হারিকেন জ্বলে। ঝাড়বাতি থাকলে এটিকে সত্যিকার জমিদার বাড়িই বলা যেত। অবাক হই, এই ঘোর গহীন গ্রামে কে এনেছে ইট পাথর, কে গড়েছে এই বাড়ি! রুদ্রর নানার বাড়ি এটি। নানার দাপট ছিল এলাকায়, তার চেয়ে বেশি দাপট ছিল তার বড়মামার। গ্রামগঞ্জের দাপুটে অনেক লোক একাত্তরে শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান ছিলেন, তিনিও ছিলেন। রুদ্রর মেজমামাও স্বাধীনতা সংগ্রামের পক্ষে ছিলেন না। এমন পরিবারে মানুষ হয়ে রুদ্র অন্যরকম। নিজে সে নিজের নাম রুদ্র রেখেছে। না রাখলে পিতৃদত্ত মুহম্মদ শহিদুল্লাহ নামটি নিয়েই তাকে জীবন কাটাতে হত। কবিতা লেখে স্বাধীনতার পক্ষে, মসনদে রাজাকারের ফিরে আসায় প্রচণ্ড ক্ষোভে সে বলে, জাতির পতাকা আজ খামছে ধরেছে সেই পুরোনো শকুন। কবিতায় শকুন বলে গাল দিলেও রুদ্রর অগাধ শ্রদ্ধা দেখি তার সেই মামাদের জন্য। গোবরে পদ্মফুলটির জন্য গৌরব হয় হয় করেও হয় না। গ্রামের বাড়িতে যখন থাকে সে, তার বড়মামার ঘরে থাকে। ঘরে বড় বড় দুটো পালঙ্ক, বড় বড় কাঠের আলমারি, বড় বড় চেয়ার। সবই বড় বড়। জমিদারি গন্ধ বেরোচ্ছে সব কিছু থেকে। বড়মামা বেঁচে নেই, কিন্তু তাঁর বউ আছেন, বউটি একদিকে তার বড়মামি আরেকদিকে বড়ফুপু। রুদ্র কাকু বলে ডাকে তাঁকে। কাকুর কথা সে আমাকে চিঠিতে লিখেছে অনেক। কাকুর নিজের কোনও ছেলেমেয়ে নেই। রুদ্রকেই তিনি নিজের ছেলের মত লালন পালন করেছেন। এখানে জানালার কাছে বড়মামার পুরোনো টেবিলটিতে বসে রুদ্র কবিতা লেখে, বড়মামার পালঙ্কে নরম গদিতে ঘুমোয়। ঘুমোয়, চাকরবাকর আরদালি খানসামা তার আদেশ পালনের অপেক্ষায় থাকে। মাসের পর মাস কাটিয়ে দেয় সে এ বাড়িতেই। এমন জমিদারি আমি যখন ফ্যালফ্যাল করে দেখছি, রুদ্র বলে, আরও ছিল, এখন তো পড়তির মুখে! এখন পড়তির মুখে না হয়ে উঠতির মুখে হলে সম্ভবত আনন্দ হত তার! যৎসামান্য অবশিষ্ট আছে, আগে অনেক ছিল, আরও ছিল! সেই আগের আরোর জন্য, আগের অঢেলের জন্য, অনেকের জন্য রুদ্রর গর্ব হচ্ছে টের পাই। ধনসম্পত্তি নিয়ে তার অহঙ্কার সে চাইলেও গোপন করতে পারে না। কিন্তু দরিদ্রকে শোষণ না করে কেউ কি এত ধনসম্পত্তি করতে পারে? পারে না, মন বলে, পারে না। রুদ্র তো সেই আশিভাগের পক্ষে কবিতা লেখে, যারা তার দোতলার ঘরটিতে কখনও পৌঁছতে পারে না, নিচের সিঁড়ি থেকেই যাদের হটিয়ে দেয় পাইক পেয়াদারা। যারা রোদে পুড়ে পুড়ে ক্ষেতে লাঙল দিচ্ছে, ওইসব বরগাচাষীরা, যাদের শ্রমের ফসল উঠছে এ বাড়ির গোলায়! যাদের আর রুদ্রর মধ্যে অনেক ফারাক। আমি মেলাতে পারি না। সা−ম্যর জন্য চিৎকার করে কবিতা পড়ে রুদ্র, সাম্য কি সত্যিই সে মন থেকে চায়! ঘরের চার দেয়াল ক্রমশ পা পা করে এগোতে থাকে আমার দিকে। রুদ্রকে বলি, চল বাইরে বেরোই।

বাইরে কোথায় যাবে?

গ্রাম দেখতে।

গ্রামে তো দেখার কিছু নেই।

দেখার কিছু থাকবে না কেন?

দেখার কিছু নেই, শুধু ক্ষেত।

ক্ষেতই দেখব।

ক্ষেত দেখে কি করবে? এসব ধানের ক্ষেত দেখার কোনও মানে হয়?

চল দুজন হাঁটি গ্রামের পথে। তুমি তো আমাকে চিঠিতে কতবার লিখেছো, যে, তোমার নাকি ইচ্ছে করে দিগন্ত অবদি সুবজ ধানের ক্ষেত দেখাতে আমাকে? দেখাতে গ্রামের আশ্চর্য সুন্দর রূপ!

খামোকা বাইরে যাওয়ার দরকার নেই। বাড়িতে বসে কাকুর সাথে গল্প কর। বীথি ওরা আছে, ওদের সাথে সময় কাটাও।



সময় তো আমি রুদ্রর সঙ্গে কাটাতে চাই। কথা বলতে বলতে দপু রু গড়িয়ে যাবে, বিকেল গড়িয়ে যাবে, টের পাবো না। রাতের কালো পর্দা এসে আমাদের মুখ ঢেকে দেবে, আমরা যে পরস্পরকে আর দেখতে পাচ্ছি না, টের পাবো না। আমাদের নিঃশ্বাসের কাছাকাছি আমরা থাকব, আমাদের স্পর্শের কাছে থাকব, আমাদের অনুভবের কাছে, টের পাবো না। জীবনের টুকরো টুকরো নিয়ে, টুকরো টুকরো জীবন নিয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা, অথবা কোনও কিছু না নিয়ে, মনে যা আসে তাই নিয়ে, সপুুরি গাছের মাথায় এইমাত্র যে পাখিটি এসে বসল, সেই পাখিটি নিয়ে, একটি বালক দৌড়ে এসে পুকুরে ঝাপঁ দিল, সেই বালকটি নিয়ে। কিন্তু আমি চাইলেও রুদ্রর নিস্পৃহতা লক্ষ করি, সে একা একা শুয়ে থাকতে চায় পালঙ্কটিতে। তার বুকের লোমে আঙুলে আঁকিবুকি কাটতে কাটতে জীবনে কি কি আমার ইচ্ছে করে, কি কি করে না বলব, চায় না সে। আমার হাঁটুর কাছে তার মাথা, তার হাঁটুর কাছে আমার, এভাবেই শুয়েই স্মৃুতি থেকে কবিতা পড়ে যাব যে যতটা জানি, চায় না সে। সে চায় সারাদিন আমি বাড়ির মেয়েদের সঙ্গে কাটাই, রাতে শুতে আসি তার বিছানায়। ঢাকার রুদ্র আর মিঠেখালির রুদ্রকে আমি শত চেষ্টা করেও মেলাতে পারি না।

কাকুর সঙ্গে গল্প করতে গেলে তিনি আলমারি খুলে শাড়ি বের করেন আমার জন্য, গয়নার বাক্স খুলে ভারি ভারি গয়না পরিয়ে দেন গায়ে। স্বামীকে সুখী করার জন্য যা যা করতে হয় স্ত্রীদের, তার সবই যেন আমি পরম নিষ্ঠার সঙ্গে করে যাই, কর্তব্যকাজে যেন কখনও অবহেলা না করি। কাকুর উপদেশের সাগরে আমি খড়কুটোর মত ভাসতে থাকি। কাকু না হয় পুরোনো কালের মানুষ, স্বামীর প্রতি স্ত্রীর একশ রকম কর্তব্যের কথা তিনি জানেন, কিন্তু নতুন কালের মানুষ বীথির কাছে গিয়ে স্ত্রীর প্রতি স্বামীর অন্তত একটি কর্তব্য সম্পর্কে জ্ঞান আহরণ করা দুষ্কর হয়ে ওঠে। রূপসী বীথির রূপসী কপাল নিভাঁজ পাওয়ার আশায় বসে থাকি, ব্যর্থ হয়ে ফিরতে হয়। বীথি সারাদিনই সংসারের নানারকম সমস্যা নিয়ে এর ওর সঙ্গে কথা বলছে, আমি সামনে গিয়ে দাঁড়ালে বলে বৌদি বস, কিন্তু সমস্যার খুব কাছে আমি বসে থাকি, তা সে চায় না। বীথির সমস্যার অন্ত নেই। তার অভিযোগের শেষ নেই। বাবা মা মেজমামা কাকু সবার বিরুদ্ধে তার গণ্ডা গণ্ডা অভিযোগ। মোংলা বন্দরের সংসার তাকে দেখাশোনা করতে হয়, এ সংসারও। মেজ মামার ছেলে মণির সঙ্গে বীথির বিয়ে হয়েছে। সম্পর্কের শেকলে মোংলা আর মিঠেখালির মানুষেরা খুব শক্ত করে বাধাঁ, বীথির মেজমামাই বীথির শ্বশুর, সম্পর্কগুলো কি রকম একটির সঙ্গে আরেকটি লেগে আছে শেকলের মত! শেকল নিয়ে রুদ্রর মা মোটেও ভাবেন না, সংসারের কোনও কাজ নিয়েও ভাবেন না অথচ অগুনতি দুর্ভাবনা নিয়ে মিঠেখালির বাড়ি এসেও পালঙ্কে শুয়ে দিন কাটান। তাঁর সেবায় আমি সামান্যও ব্যবহৃত হতে পারি কি না জানতে যখন ঘরে ঢুকি, তিনি কাউকে জলদি করে ডেকে বলেন, দেখ তো শহিদুল্লাহর বউএর কিছু লাগবে কি না দেখ!

না, আমার কিছু লাগবে না, আমি এমনি এসেছি। বিব্রত শাশুড়ির সামনে ঘোমটা- মাথার ততোধিক বিব্রত বউটি বলে।

এমনি এসে তাঁর ঘরে কেউ বসে থাকলে তিনি যে বিব্রত হন বেশ বুঝতে পারি। তাঁর সঙ্গে দীর্ঘ সময় ধরে আমার যে গল্প করার ইচ্ছে, তা বলে তাঁকে আরও বিব্রত করতে ইচ্ছে করে না।

বিকেলে রুদ্র একা বেরোবে বাইরে। তার কাজের অন্ত নেই। কেন যাচ্ছে!, যেও না, প্লিজ, থাকো, আমার এসব ছেঁদো অনুরোধ পুকুরে ঢিলের মত ছুঁড়ে দিয়ে সে মোংলা বন্দরে যায়, ফিরে আসে গভীর রাতে, এক শরীর ঝাঁঝালো গন্ধ নিয়ে।

গন্ধ কেন?

এই একটু মদ খেয়েছি।

কেন খেয়েছো?

খেতে ইচ্ছে করেছে তাই খেয়েছি।

তোমাকে আর কত বলব মদ খেও না! তুমি কি কোনওদিন আমার কথা শুনবে না?

ঘরে কাকু আছেন, অন্য বিছানায়, রুদ্র ভ্রুক্ষেপ করে না, যত রাতই হোক তার শরীর চাই।

তুমি কি কেবল শরীরই বোঝো রুদ্র? মন বোঝো না?

না রুদ্র মন বোঝে না, সে বিশ্বাস করে শরীরেই বসত করে মনরূপ পাখি। শরীর মেলালে মনের দেখা মেলে।

রুদ্রর শরীর চাই। প্রতি রাতেই তার চাই, যে করেই হোক, যে পরিবেশেই হোক, চাই। পূর্ণিমায় যখন গ্রাম ভেসে যাচ্ছে, আলোয় আমার মন ভাসছে, রুদ্রকে নিয়ে ছাদে যাই পূর্ণিমা দেখতে। ঝকঝকে চাঁদের তলে শীতল পাটিতে শুয়ে আছি, আলোয় আমার মন নাচছে, তার একটি হাত হাতের মুঠোয় নিয়ে আলোয়-ভেজা শীতে কাঁপি, এভাবেই চল সারারাত চাঁদের আলোয় স্নান করি, চল সারারাত, চল সারারাত এভাবেই। আলোয় আমার মন উড়ছে। রুদ্র আলোয় ভাসতে চায় না, উড়তে চায় না, সে আমার শরীরে ডুবতে চায়। ওই ছাদে যে কেউ চলে আসতে পারের বিপদের দুআঙুল দূরে দাঁড়িয়ে সে শরীর ভোগ করে। বেঘোরে ঘুমোয়। আমি আর চাঁদ জেগে থাকি একা একা, সারারাত একা একা।



ঘরে বসে থাকব আর খাবার চলে আসবে ঘরে, এ খুব আরামের হয়ত, কিন্তু আমার দ্বিধা হয় এ বাড়ির সমস্ত আরাম আয়েশে গা এলিয়ে দিতে। এ আমার শ্বশুর বাড়ি না হোক, শাশুড়ির বাড়ি তো। নিজেকে সংসারের প্রয়োজনে লাগাতে রান্নাঘরে গিয়ে দেখি আমি একটি বাড়তি মানুষ, হুকুম খাটার লোকের অভাব নেই বাড়িতে। জমিদারের বাড়িতে যা হয়। এ বাড়ির বড় বড় জিনিসগুলো আমার বোধগম্য হয় না সহজে। রুদ্র যখন বীথির সঙ্গে জমিজমা ধান চাল সহায় সম্পত্তি ইত্যাদি বিষয়ে কথা বলে, আমি বেশির ভাগই বুঝি না। রুদ্র পরে ব্যাখ্যা করে বুঝিয়েছে, ভীষণ এক জটিল অবস্থার মধ্যে আছে এই জমিদারি। মিঠেখালির জমি থেকে যা আয় হয়, তার মায়ের ভাগ সে নিয়ে যায় এখান থেকে। বহু বছর হল এভাবেই নিচ্ছে সে ভাগটি। ভাগ নিয়ে কিছু সে নিজের জন্য রেখে বাকিটা রেখে যায় বন্দরের সংসার-কাজে। কিন্তু রুদ্র এখন ভাগের ধান বিক্রিতে বিশ্বাসী নয় আর। অনেকদিন থেকে সে তার মাকে বলছে যেন মেজ মামা জমি ভাগের ব্যবস্থা করেন। তার মায়ের ভাগেরটুকু থেকে কিছু বিক্রি করে সে ঢাকায় ছাপাখানার ব্যবসা শুরু করবে। রুদ্র ঢাকার পঞ্চাশ লালবাগের বাড়িটিতেও তার মায়ের ভাগ দাবি করে, ওটিও ছেড়ে দিতে সে রাজি নয়। বীথি তার দাদাকে লোক চক্ষুর অন্তরালে সমর্থন জানিয়ে যায়। জমি ভাগ করতে মেজ মামা রাজি হন না। বড়মামার পর এখন মেজই হর্তকর্তা, তিনি না চাইলে ভাগ সম্ভব নয়। জমিজমা বিষয়ক জটিলতা থেকে আমার মন উঠে দৌড়ে যায় শান বাধাঁনো পুকুরঘাটে। চল যাই, হাঁসের সাঁতার দেখি বসি। চল, পুকুরে গোসল করি। আমার আবদার শুনে বাড়ির সবাই হাসে, রুদ্রও হাসে। যেন আমার বোধ হয়নি বুদ্ধি হয়নি, যেন জীবন কাকে বলে তার কিছুই আমি এখনও জানি না। আমি আমার শিশুসুলভ অপরিপক্বতা দিয়ে কেবল লোক হাসাতে পারি। পুকুরে বাইরের মানুষ গোসল করতে আসে, ও পুকুরে বাড়ির বউএর নাওয়া চলবে না। গোসল করতে হলে বাড়ির মেয়েদের সঙ্গে ভেতরের পুকুরে। ভেতরের ঘোলা পুকুরে আমি পা ডুবিয়ে বসে থাকি।

দোতলার জানালা থেকে আমি তাকিয়ে থাকি পুকুরটির দিকে। পুকুরটিকেও আমার মত খুব একলা মনে হয়। যেন দীর্ঘ দীর্ঘ দিন তারও কোথাও কোনও পুকুরে গোসল সারা হয়নি। গায়ে শ্যাওলা জমে আছে পুকুরের। এই পুকুরটির পানি দিয়েই এ বাড়ির রান্নাবান্না ধোয়া পাকলা অযু গোসল সব হয়। পানি খাওয়াও হয়। বড় বড় মটকিতে বর্ষার সময় বর্ষার জল জমিয়ে রাখার নিয়ম। মটকিগুলো উঠোনেই পড়ে থাকে। সারাবছর মটকির পানিও খাওয়া হয়। ফুরিয়ে গেলে পুকুরের পানি। একদিন পানি খেতে গিয়ে গেলাসের পানিতে দেখি অনেকগুলো কিড়ে কিলবিল করে সাঁতার কাটছে। অন্যরা দিব্যি কিড়েঅলা পানি খেয়ে নিচ্ছে। আমি হা হা করে থামাতে এলে বীথি বলল, ও কিড়ে কোনও ক্ষতি করে না, ও খাওয়া যায়। বীথি আমাকে পানির উৎসের কথা বলে, বলে কি করে খাবার পানি সংগ্রহ করে ওরা। আমি থ হয়ে বসে থাকি। দেখে হাসে সবাই। আমাকে খুব অদ্ভুত চিড়িয়া কিছু ভাবে নিশ্চয়ই ওরা। পানিহীন দিন কাটতে থাকে আমার। দিনে যে দুকাপ চা খাওয়া হয়, তা দিয়ে পানির অভাব পুরণ করি শরীরের। রুদ্র মোংলা বন্দর থেকে অনেকগুলো ফানটা কোকোকোলা আনিয়ে দিয়েছে আমার জন্য। জানালায় দাঁড়িয়ে দেখি পুকুরটিতে লোকেরা সাবান মেখে গোসল করছে। বুঝি না, কি করে এত নিশ্চিন্তে এই পুকুরের পানিই পান করছে সবাই! এত জমি এত টাকা, অথচ কোনও বিশুদ্ধ খাবার পানির ব্যবস্থা কি কেউ করতে পারে না? রুদ্র বলে, ব্যবস্থা করার কোনও প্রয়োজন নেই। এই পানি খেয়ে আসছি সেই ছোটবেলা থেকে, কখনও কোনও অসুখ হয়নি। কাকুর ঘরটিতে বসে আমার অলস অবসর সময় কাটতে থাকে। এ বাড়িতেও বই খুঁজি। হাদিস কোরানের ওপর কিছু বই ছাড়া অন্য কোনও বই নেই, কিছু পঞ্জিকা আছে শুধু এ ঘরে বসেই পুরোনো পঞ্জিকা খুলে রুদ্র একদিন আমার জন্মতারিখ বের করেছিল। আরবি সালের বারোই রবিউল আওয়াল আগস্ট মাসের মাঝামাঝি পড়েছে ইংরেজি কোন সালে, আটান্ন থেকে চৌষট্টি পর্যন্ত খুঁজে বের করে জানিয়েছিল বাষট্টি সালে। বাষট্টি সালের পঁচিশে আগস্টে। এই কাকুর ঘরে খামোকা কাজকম্মহীন বসে থাকতে রুদ্রর কোনও অসুবিধে হয় না। দীর্ঘ দীর্ঘ মাস এ ঘরেই বসে থাকে সে। এ ঘরে বসেই কবিতা লেখে, এ ঘরে বসেই ডাকে পাঠানো আমার চিঠি পড়ে, নিজেও লেখে। ঘরে বসে থাকতে থাকতে জীবন স্যাঁতসেঁতে লাগে, রুদ্রকে যখনই বলি, চল ঢাকা ফিরে যাই। রুদ্র এক কথাই বলে টাকার যোগাড় হোক আগে। কি করে টাকার যোগাড় হবে আমার বোঝা হয় না। যেদিন আমরা মিঠেখালি ছাড়ি, তার আগের রাতে রুদ্র মোংলা বন্দর থেকে মদ খেয়ে ফিরেছে। প্রায়-মাতাল রুদ্র একটি কাণ্ড ঘটাতে চায়। আমার বাধা না মেনে সে কাণ্ডটি ঘটায়। তার মেজ মামার আলমারির তালা ভেঙে জমির দলিল বের করে আনে। দলিল হাতে তার। যে দলিলটি পেতে বছরের পর বছর সে অপেক্ষা করেছে। সে এখন দিব্যি কোনওরকম প্রতিবন্ধকতা ছাড়াই তার মার ভাগের জমি বিক্রি করে দিতে পারে যে কারও কাছে। কিন্তু বাড়ির কেউই রুদ্রর এই কাণ্ডটিকে সমর্থন করে না। কাকু এত যে তার আদরের, তিনিও করেন না, রুদ্রর মা, যাঁর জমি, তিনিও তার পুত্রের এমন অসভ্যতা মেনে নেন না, বীথিও না, যে কি না তার দাদার প্রতি কাজে বাহবা দিয়ে আসছে। রুদ্রর পদক্ষেপটি সম্পূর্ণই বিফলে যায়। মেজমামার কাছে ক্ষমা চেয়ে তাঁর হাতেই শেষ অবদি তুলে দিতে হয় দলিলটি। চলে যাওয়ার দিন রুদ্র আমাকে ঠেলে পাঠায় মেজমামাকে যেন পা ছুঁয়ে সালাম করি, কদমবুসি করি। রুদ্রর আদেশ আমি নতমুখে পালন করি, স্বামীর প্রতি স্ত্রীর একশ কর্তব্যের এটি একটি।



রুদ্রর অনেক কিছু বিফলে যায়। নটা পাঁচটা চাকরি তার পোষাবে না বলেছিল, তারপরও ঢাকায় সে চাকরির জন্য ধরনা দেয়। চাকরি পাওয়া হয় না। পত্রিকা অফিসগুলোয় ঘোরে, ওখানেও ব্যবস্থা হয় না কিছুর। অন্তত কোনও পত্রিকায় যদি সাহিত্য সম্পাদক হিসেবে তার একটি চাকরি জুটত। কে দেবে চাকরি! নামি লেখক সৈয়দ শামসুল হকের আলিশান বাড়ি গিয়ে অনুরোধ করে তিনি যদি অন্তত চিত্রনাট্য লেখার কোনও কাজ রুদ্রকে দেন, সৈয়দ হক কথা দেন না। তিনি যে ছদ্মনামে বাংলা চলশ্চিত্রের চিত্রনাট্য লিখে পয়সা কামাচ্ছেন, এ কথা অনেকেই জানে। সৈয়দ হকের ছোটভাই এর প্রকাশনী সব্যসাচী থেকে রুদ্রর তৃতীয় কবিতার বই মানুষের মানচিত্র বের হয়। এটুকুই। এর বেশি রুদ্রর ভাগ্যে কিছু জোটে না। মানুষের মানচিত্র যেবার বেরোলো বইমেলায়, প্রতিদিন বিকেলে মেলায় গিয়ে সে ঠায় বসে থেকেছে বইয়ের স্টলটিতে। তার বসে থাকার কারণে যদি বিক্রি হয় বই অথবা কেউ যদি বই কিনে বইয়ে সই চায়। মেলা ভাঙা পর্যন্ত রুদ্র বসে থাকে। রুদ্র কেবল কবিতা লিখে আর কবিতার বই ছেপেই শান্ত হয় না। সুযোগ পেলেই নানারকম দলে ভিড়ে যায় । সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট নামে একটি সংগঠন গড়ে তুলেছে রুদ্র আর তার বন্ধুরা। এরশাদ বিরোধী নানা রকম অনুষ্ঠান করছে এই জোট। কিন্তু ঢাকায় রুদ্রর দীর্ঘদিনের অনপু স্থিতির কারণে সাংস্কুতিক জোটে তার বড় দাযিত্বটি অন্য কাউকে দিয়ে দেওয়া হয়। নিজের হারানো পদটি ফিরে পেতে সে হন্যে হয়ে ঘোরে, ফিরে পাওয়া হয় না। রুদ্র জানে যে পাকাপাকি ভাবে ঢাকা না এলে সংসার তো তার করা হবেই না, দেশের সাহিত্যঅঙ্গনে প্রতিভাবান তরুণ কবি হিসেবে তার যে একটি পরিচিতি হয়েছে, সেটিকেও কিছু হিংসুক কবিকুল বিনাশ করতে চেষ্টা করবে।

রুদ্রর জন্য মায়া হয় আমার। আমি বলি, তুমি কবিতা লেখ, আমি সংসার চালাবো। টাকা পয়সা রোজগার নিয়ে তোমার ভাবতে হবে না। প্রথমেই নিজের টাকায় যে জিনিসটি কিনি সে বইয়ের আলমারি। রুদ্রর পুরোনো বাঁশের তাক থেকে তার বইগুলো নিয়ে আলমারিতে সাজিয়ে রাখি। নয়াপল্টনে ছোটদার বাড়ি যেতে আসতে ইস্পাতের দোকানে থেমে কাপড় চোপড় রাখার আলমারি কিনেও তাজমহল রোডের ঘরে তুলি। দুজনের কাপড় চোপড় গুছিয়ে রাখি ওতে। একটু একটু করে সংসারের জিনিস কেনা শুরু করতে হবে, সে রুদ্রও জানে। অবকাশ থেকে আমার কাপড় চোপড় বইপত্র হাজার রকম টুকিটাকি জিনিস ট্রাংকে করে তাজমহল রোডে নিয়ে এসেছি। মন প্রাণ শরীর সব ঢেলে দিই সংসার সাজানোয়। রুদ্রর টাকা উড়তে থাকে মেথরপট্টির মদের আড্ডায়, সাকুরায়। সাকুরায় প্রায় রাতে যায়, ওখানে মদ নিয়ে বসে। বন্ধুদের সঙ্গে চিৎকার করে কথা বলতে বলতে মদ পান করে, ম্যাচবাক্সে আঙুলের টোকা দিয়ে দিয়ে আমার মনের কোণে বাউরি বাতাস .. গেয়ে ওঠে মাতাল রুদ্র। প্রায়ই। মধ্যরাতে টলতে থাকা রুদ্রকে নিয়ে রিক্সা করে বাড়ি ফিরি। রুদ্র মদ খাচ্ছে না, মদ রুদ্রকে খাচ্ছে। মদ ছাড়া সন্ধে বা রাত তার কাটে মন মরা। আমি তাকে কেঁদে বোঝাই, ধমকে বোঝাই, রাগ করে, আদর করে বোঝাই যে মদ খাওয়া শরীরের জন্য ভাল নয়। রুদ্র সব বোঝে, আবার কিছুই বোঝে না। মদ যদি না জোটে, কিছু একটার দরকার তার হয়ই, গাঁজা নয়ত চরস। কালো চরস কাগজে মুড়ে রাখে, সেগুলো গুঁড়ো করে সিগারেটের খোলে ঢুকিয়ে খায় সে। রুদ্রকে এসব খাওয়া বন্ধ করার জন্য নিশিদিন অনুরোধ করেও কোনও লাভ নেই। সে তার নেশা করেই যাবে যে করেই হোক। আমিও মদ খাবো, আমিও গাঁজা চরস খাবো- যেদিন বলি, সে বাধা দেয় না। বরং পিঠে চাপড় মেরে উৎসাহ দেয়। চরস ভরা সিগারেট এগিয়ে দেয় আমার দিকে, দু টান দিয়ে কেশে নাশ হই। সাকুরায় মদের গেলাস এগিয়ে দেয় বিষম উৎসাহে, গন্ধ শুঁকতেই বিবমিষা আমাকে গ্রাস করে ফেলে বলে এক গেলাস কমলার রসে তিন ফোঁটা ভদকা মিশিয়েও মদে আমার শুরুটা করে দিতে সে মরিয়া হয়ে ওঠে। গলা ছিঁড়ে যায় ঝাঁঝে, দু চুমুক পান করার পর সে আমাকে বাহবা দেয়, এই তো বেশ হচ্ছে, এভাবে চালিয়ে যাও, হয়ে যাবে। কিন্তু হয় না। রুদ্রর পথ অনুসরণ করা সম্ভব হয় না। সে একাই তার পথে চলতে থাকে, সঙ্গে কিছু মদারু গাঁজারু বন্ধু। মদের আড্ডায় সঙ্গী হয়ে মাগনা মদ খেতে বন্ধুরা সন্ধের পরই ভিড় জমাতে থাকে। রুদ্রর হস্ত উদার হস্ত পেটে মদ পড়লে পারলে দশ বারোজনকে মাগনা মদ খাওয়াতে রাজি হয়ে যায়। রুদ্রর এই জনমদসেবায় সংসার খরচের টাকা দ্রুত ফুরিয়ে যায়। টাকা ফুরোনো মানে তার ঢাকা ছেড়ে চলে যাওয়া। এভাবে কি চলে রুদ্র? চলে না সে জানে, কিন্তু আর কোনও উপায় নেই। আমি সংসারের খরচ বহন করতে পারি, কিন্তু তাই বলে রুদ্রর মদের টাকা যোগাতে তো পারি না। আমার প্রশিক্ষণ-ভাতার টাকায় এত তো কুলোবে না। রুদ্র জানে যে কুলোবে না, তাই তাকে মোংলা পাড়ি দিতেই হয়।

যতদিন সে মোংলা বা মিঠেখালিতে পড়ে থাকে, ততদিন আমি ডাক্তারি প্রশিক্ষণে মন নিবেশ করি, না করতে পারলেও অন্তত উপস্থিতিটি রাখি। রুদ্র ঢাকায় ফিরলেই প্রশিক্ষণ গুল্লি মেরে তার কাছে চলে যাই। রুদ্রই আমার ঠিকানা, তাকে নিয়ে আমার সংসারের স্বপ্ন-চারা লকলক করে বড় হতে থাকে, বৃক্ষ হতে থাকে। রুদ্রর ছোট বোন মেরি এখন ঢাকায়, লালবাগে মেজমামার বাড়িতে থেকে লালমাটিয়া কলেজে আইএ ভর্তি হয়েছে। শুনে রুদ্রকে বলি, মেরিকে এ বাড়িতে নিয়ে এসো। এখান থেকে কলেজ কাছে হবে। মামার বাড়িতে থাকার চেয়ে ভাইএর বাড়িতে থাকা ভাল। এখানে নিজের বাড়ির মত থাকতে পারবে। রুদ্র প্রথম রাজি হয় না। এ বাড়িতে কি করে থাকবে মেরি! আরাম আয়েশের ব্যবস্থা নেই, কাজের লোক নেই, আমাদেরও পাকাপাকি থাকা হচ্ছে না এখানে। আমার প্রশিক্ষণ তো খুব শিগগির শেষ হয়ে যাচ্ছে, রুদ্র না থাক, আমি তো থাকতে পারব মাসের বেশির ভাগ সময়ই, হয়ত পাঁচ সাতদিনের জন্য যাবো। এক সন্ধেয় লালবাগ থেকে মেরিকে নিয়ে আসি আমরা। মেরি থাকা শুরু করার পর বাড়িটিকে সত্যিকার বাড়ির মত লাগে। গীতার কাছ থেকে রান্নাবান্না করার জন্য সবুজ নামের এক কিশোরিকে নিয়ে আসি। প্রতিদিন সংসারের টুকিটাকি জিনিস কিনছি। এক ঘোরের মধ্যে বাঁচি। কিন্তু সব ফেলে ময়মনসিংহ যেতেই হয় যেহেতু প্রশিক্ষণ আমার এখনো শেষ হয়নি। ময়মনসিংহ থেকে যখনই ঢাকায় ফিরি, আমার সংসারটিকে অনেকটাই পাল্টো যেতে দেখি। দেখি রুদ্রর আরেক বোন সাফিকে মোংলা থেকে রুদ্র ঢাকা নিয়ে এসেছে। রুদ্রর ভাইবোনগুলো সব দেখতে এক, সবগুলো মুখে তাদের মায়ের মুখ । সাফি লেখাপড়া ছেড়ে দিয়েছে, বিয়ের জন্য বসে আছে। মোংলার চেয়ে ঢাকায় পাত্র পাওয়া সুবিধে বলে রুদ্র ওকে ঢাকায় এনেছে। বাড়িটি এখন আর কোনও ছন্নছড়া দম্পতির ছন্নছাড়া সংসার বলে মনে হয় না, বাড়িটি নপুূর পরে নাচে, কলবল খরবল করে বাড়িটি কথা কয়। আমার ভাল লাগে, ভাল লাগে এ ভেবেও যে রুদ্র তার দুবোনের সামনে নিজের মান বাঁচাতে আর মাতাল হয়ে বাড়ি ফিরবে না। ভাল লাগে রুদ্রর সংসারি হওয়া দেখে। কিন্তু, একবারও কি সে আমাকে জানাতে পারত না যে সে সাফিকে ঢাকায় নিয়ে আসছে! আমি একটু একটু করে টের পাই, সংসারের অনেক সিদ্ধান্ত সে একা নিচ্ছে। মেরি আর সাফি শোবার ঘরে থাকছে, বড় বিছানাটিতে। আলমারিতে ওদের কাপড় চোপড়, জিনিসপত্র। আমার কাপড়গুলো এক পাশে এক কোণে সরে যাচ্ছে। আমার জায়গা দিন দিন কমতে কমতে ছোট হয়ে আসছে। আমি আর রুদ্র সামনের পড়ার ঘরটিতে ভেঙে পড়া চৌকির ছোট তোশকটি বিছিয়ে ঘুমোই। কৃচ্ছউস!ধন করি। অথবা কেষ্ট পেতে চাই। কষ্ট করিলে নাকি কেষ্ট মেলে। সংসারের মধ্যে রুদ্রকে নিয়ে সন্ন্যাসযাপন করেও তাকে আমার সারাক্ষণের জন্য পাওয়া হয় না। তার সময় হয় মোংলা যাওয়ার। আমাকে চুমু খেয়ে, ভাল থেকো লক্ষ্মী সোনা, ভাল থেকো প্রাণ ইত্যাদি বলে সাফির হাতে সংসার খরচের টাকা দিয়ে রাতের ট্রেন ধরতে চলে যায়। সংসার নিজের টাকায় সাজিয়েছি, কিন্তু সংসার খরচের টাকা আমার হাতে না দিয়ে বোনের হাতে দেওয়ায় সংসার নিয়ে আমার উত্তেজনায় একটি ছোট্ট ঢিল পড়তে গিয়েও পড়েনি, আমার বিশ্বাস হয় না যে আমার এই সংসার আমার হাতছাড়া হয়ে গেছে।



রুদ্র বলেছে, বড় একটি বাড়ি প্রয়োজন, কারণ তার ছোট ভাই আবদুল্লাহকেও ঢাকায় এনে সে ইশকুলে ভর্তি করিয়ে দেবে। প্রতিদিন পত্রিকার পাতায় বাড়িভাড়ার বিজ্ঞাপন দেখে বাড়ি খুঁজতে থাকি। পছন্দ হয় না বেশির ভাগ, পছন্দ হলে ভাড়া বেশি। ভাড়া কম হলে ঘর ছোট, জায়গা কম। খুঁজতে খুঁজতে একদিন ইন্দিরা রোডের রাজাবাজারে একটি বাড়ি পছন্দ হয়। বাড়িভাড়া এক মাসের জমা দিয়ে রুদ্রর ফেরার অপেক্ষায় বসে থাকি। ফিরে এলে মুহম্মদপুরে তাজমহল রোডের বাড়িটি ছেড়ে দিয়ে জিনিসপত্র ইন্দিরা রোডের নতুন বাড়িতে নিয়ে যাই। দুটো শোবার ঘর, একটি বড় একটি ছোট, বড় একটি বৈঠক ঘর, বড় শোবার ঘরের পাশে একটি টানা বারান্দা। সাফি বড় শোবার ঘরটি পছন্দ করে ওর জন্য, সাফির প্রস্তাবে রুদ্র রাজি হয় না, মেরি আর সাফি দুজনকেই সে বুঝিয়ে বলে বড় ঘরটিতেই তার এবং আমার থাকা উচিত। আমাদের জন্য নতুন একটি খাট কিনে বড় শোবার ঘরে পাতে। নিজের লেখার টেবিলটিও। নতুন একটি আলমারি কেনাও হয় এ ঘরের জন্য, সেটি জানালার কাছে। আবদুল্লাহর জন্য একটি ছোট খাট কিনে বৈঠক ঘরে পেতে দেওয়া হয়। ছোট শোবার ঘরে আগের বড় খাটটি আর আগের ইস্পাতের আলমারিটি মেরি আর সাফির জন্য বসানো হয়। ওদিকে ময়মনসিংহে হাসপাতালে যেতে আসতে পথে যে আসবাবপত্রের দোকান পড়ে, ওখান থেকে খাবার টেবিল, চেয়ার, সোফা ইত্যাদি যা বানাতে দিয়েছি, ময়মনসিংহে নিয়ে গিয়ে ট্রাক ভাড়া করে আসবাবের দোকান থেকে সমস্ত আসবাব নিয়ে এমনকি অবকাশ থেকেও একটি পুরোনো চেস্ট অব ড্রয়ার আর একটি −শ্বত পাথরের টেবিল তুলে নিয়ে দুজন ঢাকায় ফিরি। একটি সাজানো গোছানো সুন্দর বাড়ি, একটি সুখের শান্তির সংসার ছাড়া আমার মাথায় আর কিছু নেই। নিপুণ হাতে সংসার সাজাই। সংসারের হাজার রকম জিনিস ঘোরের মধ্যে কিনে নিই, সঞ্চয় যা ছিল সব ঢেলে, স্থির হই সংসারে। প্রশিক্ষণ সমাপ্ত। আর ময়মনসিংহে যাওয়ার প্রয়োজন নেই। এবার তোমার খবর কি রুদ্র! আমি তো তোমার কাছে চলে এসেছি, আমার অনপু স্থিতি তোমাকে যে নিয়ন্ত্রণহীন জীবন দিত, এলোমেলো জীবন দিত, সে জীবন আর দেবে না। এই দেখ, আমার সমস্ত নিয়ে আমি এখানে। তোমার কাছে। রুদ্র কথা দেয়, সেও তার সংসারে পাকাপাকি চলে আসছে, আর যেন তাকে টাকার জন্য ছুটতে না হয় কোথাও। একটি ছোটখাট হলেও ছাপাখানা খুলতে পারে এমন টাকা যে করেই হোক, নিয়ে আসবে মোংলা বা মিঠেখালি থেকে। তার বাবা বা মায়ের কোনও জমি বিক্রি করে। ঢাকায় সে ছাপাখানার ব্যবসা শুরু করবে। বাবা মার সম্পত্তি থেকে যে ভাগ তার পাওয়ার কথা, সেটি এখনই সে নিয়ে নেবে।

ছাপাখানা। ছাপাখানা। রুদ্র সব পরিকল্পনা করে ফেলে , কোথায় হবে। কেমন হবে। প্রতিদিন তাকে কাছে পাবো, এই সুখে আমি তিরতির করে কাঁপি। আর কোনওদিন তাকে প্রতিমাসের খরচ আনতে দূরে যেতে হবে না। আর কোনওদিন নিঃসঙ্গতার কষ্ট তাকে ছিঁড়ে খাবে না। আমার স্বপ্নের বৃক্ষ ছেয়ে যাচ্ছে ফুলে।



কিন্তু, মোংলা থেকে ফিরে আসে খবর নিয়ে যে তার মেজো মামার কাছ থেকে মায়ের জমি আলাদা করে যে বিক্রি করে ঢাকায় একটি ছাপাখানা দেবে বলেছিল সেটি সম্ভব হচ্ছে না। সুতরাং ঢাকায় পাকাপাকি এখনও বসবাস তার সম্ভব নয়। তবে নিজে সে একটি ব্যবসা শুরু করেছে মোংলায়, চিংড়ির ব্যবসা। ব্যবসাটি দেখাশোনা করার লোক আছে। তার খুব না গেলেও চলবে। বছরে দুবার গিয়ে দেখে এলেই হবে। বেশ তো, এবার মন দিয়ে ঘর সংসার করি চল। এতকাল যে স্বপ্নটি লালন করছি আমরা, দুজন একসঙ্গে থাকব, একজন আরেকজনকে ছেড়ে কখনও দূরে যাবো না। শুরু করার আগে বিয়ের অনুষ্ঠান করে নিই। চল ঘটা করে জানাই সবাইকে যে বিয়ে করেছি। বিয়ে তো সামাজিকতা ছাড়া আর কিছুই নয়। এই অনুষ্ঠানের জন্য রুদ্র নিজে নিমন্ত্রণ পত্র লেখে।

আমরা জ্বালাবো আলো কৃষ্ণপক্ষ পৃথিবীর তীরে, জীবনে জীবন ঘসে অপরূপ হৃদয়ের আলো।

কোনও শাদা শাড়ি পরে বিধবা সেজে বিয়ে করব না, লাল বেনারসি চাই, সঙ্গে সোনার গয়না। রুদ্র রাগ করে খরুচে মেয়ের বেআক্কেলি তালিকা দেখে। কিন্তু আমার ভাষ্য, বউ যখন সাজব আর সব বাঙালি বউএর মতই সাজব। রুদ্রকে কিনে দিই যা যা পরবে সে বিয়ের অনুষ্ঠানে। রুদ্রর চেয়ে আমার উৎসাহ বেশি। শহরের একটি চিনে রেস্তোরাঁকে উনত্রিশে জানুয়ারি তারিখের রাতের জন্য তৈরি থাকতে বলি। আত্মীয় স্বজন বন্ধু বান্ধব সবাইকে নিমন্ত্রণ করব। যেখুক সবাই আমি ভাল আছি, সুখে আছি। যেহেতু ভাল থাকা সুখে থাকা শাড়ি গয়না দিয়েই বিচার করে মানুষ। ঢাকায় ঈদ করে ময়মনসিংহে ফিরে গেলে মা জিজ্ঞেস করেছিলেন, বিয়া যে করছস, তা তর জামাই কি শাড়ি দিল ঈদে? আমি কোনও উত্তর দিই নি। না ঈদে কোনও শাড়ি রুদ্র আমার জন্য কেনেনি। আমরা যেহেতু ধমের্ বিশ্বাস করি না, ঈদে বিশ্বাস করি না। শাড়ির প্রশ্ন আসে না। মা দীর্ঘশ্বাস ফেলেন। ঈদে বিশ্বাস করি না বলে নয়, আমি আমার স্বনির্বাচিত স্বামীর কাছ থেকে শাড়ি গয়না পাচ্ছি না বলে। শাড়ি গয়না সুখ দেয় বলে মা হয়ত বিশ্বাস করেন না, কিন্তু শাড়ি গয়না স্ত্রীকে ভালবাসলেই স্বামীরা উপহার দিতে পারে। মা ভালবাসার সন্ধান করেন, আমার জন্য রুদ্রের। রুদ্রর টাকা কত আছে, সে কোনও উপহার দিতে সক্ষম কি না তা না দেখে একজন ডাক্তার মেয়ের জন্য যে ধরনের স্বামী পাওয়া যায়, সে সব স্বামীর যে যোগ্যতা থাকে দামি শাড়ি গয়না উপহার দেওয়ার তা থেকেই বিচার করা হয় আমি আদৌ যোগ্য স্বামী পেয়েছি কি না। রুদ্রর যোগ্যতা নিয়ে সকলের সন্দেহ আমার মনে হুল ফোটাতে থাকে। সামজিক নিয়ম কানুন অস্বীকার করি বলে ভাবি, কিন্তু সমাজে বাস করে তার সবটুকু হয়ে ওঠে না ডিঙোনো। বিয়ের অনুষ্ঠানে −ঝঁপে বৃষ্টি আসা রাতে লাল বেনারসি শাড়ি পরা সোনার অলংকার পরা লাল টুকটুক বউ চিনে রেস্তোরাঁয় যায়। বউকে ঠিক বউএর মত লাগে না, বউএর মাথায় ঘোমটা নেই। কিন্তু তবু তো বউ। রুদ্রর লেখক বন্ধুরা আসে, আমার দুচারজন ডাক্তার বন্ধু আসে, দপু ক্ষের আত্মীয়রাও আসেন, আমার আত্মীয়দের মধ্যে বড়মামা তাঁর ছেলেমেয়ে নিয়ে, ছোটদা গীতাকে নিয়ে, রুনুখালা তাঁর বরিশালি স্বামী নিয়ে। অনুষ্ঠান বলতে খাওয়া আর গল্প গুজব। ক্যামেরার সামনে মুখে ভুবনমোহিনী হাসি নিয়ে যার সঙ্গে যার যত বিরোধই থাক না কেন, পাশাপাশি দাঁড়িয়ে যাওয়া, ফটো তোলা।



ছোটদার বাড়িতে, রুনুখালার বাড়িতে নেমন্তন্ন খেয়ে আসি রুদ্রকে নিয়ে। মা ঢাকায় এলে মাকে নিয়ে নিজের সংসার দেখিয়ে আসি। সামাজিকতা শেষ হয়। এবার কি? এবার রুদ্র মোংলা চলে যাবে, চিংড়ির ব্যবসা। বাড়িভাড়া আর সংসার খরচের টাকা বোনের হাতে দিয়ে মোংলা চলে যায় বরাবরের মত। প্রশিক্ষণ ভাতার জমানো টাকা সব অকাতরে ঢেলে বাড়িঘর সাজিয়ে, আত্মীয় স্বজন বন্ধু বান্ধবীদের বিয়ের খবর প্রচার করে ভাল আছি সুখে আছি বুঝিয়ে, সংসার করছি জানিয়ে, ময়মনসিংহে নিজের যা কিছু জিনিসপত্র ছিল সব নিয়ে এসে, এমন কি নিজের শেকড়টি তুলে নিয়ে ঢাকায় পুঁতে, ভালবাসার মানুষকে নিয়ে একটি সাজানো গোছানো দাম্পত্য জীবনের স্বপ্ন দেখা মেয়ে লক্ষ্য করি নিজের সংসারে নিজে আমি গৌণ একজন মানুষ। রুদ্র কি আমাকে বিশ্বাস করে না যে আমি এই সংসারের দায়িত্ব নিতে পারব? এরকম তো নয় প্রশিক্ষণের জন্য আমার আবার ময়মনসিংহে দৌড়োতে হবে। ও পাট তো চুকেছেই। তবে কেন এই অবিশ্বাস! কেন এই আস্থাহীনতা! তীব্র অপমানবোধ আমাকে থাবা দিয়ে ধরে। রুদ্রর ভাই বোনগুলো চমৎকার। ওদের সঙ্গে আমার কোনও বিরোধ নেই। হাসিখুশি প্রাণচঞ্চল মানুষ। মোংলা বন্দরের বাড়িতে যেমন সবাই ঝিমিয়ে আছে বলে মনে হত এ বাড়িতে তা নয়। আবদুল্লাহ বাইরের গাড়িবারান্দায় ক্রিকেট খেলে, ইশকুলে বন্ধু বান্ধব হয়েছে অনেক। মেরিরও তাই। বন্ধু বান্ধবী বাড়িতে আসছে। হৈ হুল্লোড় হচ্ছে। ওদের সঙ্গে আমিও কদিন হৈ হুল্লোড়ে যোগ দিয়ে নিজেকে পরিবারের একজন ভাবার চেষ্টা করি। কিন্তু চেষ্টা করলেই যে হয় তা নয়। সংসারে আমার কোনও সিদ্ধান্ত নেই। ভূমিকা নেই। দায়িত্ব নেই। সবুজ চলে গেছে। ময়মনসিংহ থেকে নার্গিসের ছোট বোন বিলকিসকে নিয়ে এসেছিলাম। বিলকিসও চলে গেছে। ওরা মোংলা থেকে কাজের মেয়ে নিয়ে এসেছে। মেয়েটি ঘরদোর গুছিয়ে রাখে, রাঁধে বাড়ে, ওদের খাওয়ায়। কি বাজার হবে, কি দিয়ে কি রান্না হবে সব সিদ্ধান্ত নেয় রুদ্রর বোনেরা। টেবিলে খাবার দেওয়া হলে ডাক পড়ে আমার। খেয়ে চলে আসি নিজের ঘরে। বুঝি এ বাড়িতে আমি অতিথি ছাড়া কিছু নই। রুদ্র নিজে টাকা রোজগারের পথ পেয়ে গেছে। পরিবারের অকর্মণ্য অপদার্থ ছেলেটি হঠাৎ খুব গুরুত্বপূণর্ হয়ে উঠেছে কারণ সে পরিবারের বড় একটি দায়িত্ব নিয়েছে। বীথি সংসার করছে, সাইফুল মেডিকেলে পড়ছে। বাকি ছ ভাই বোনকে লালন পালন করার দায়িত্ব নিয়েছে রুদ্র। তিনজন এসে গেছে ঢাকায়, বাকি তিনজন আসছে। এই বড় দায়িত্বটি পেয়ে সে উত্তেজিত। রুদ্রর স্বপ্নে আমাকে নিয়ে একান্ত করে একটি সংসার পাতা নেই। ঢাকায় বাস করারও কোনও স্বপ্নটিও নেই আর। ওসব পুরোনো স্বপ্নকে ঠেলে সরিয়ে অন্য স্বপ্ন শির উঁচু করে দাঁড়িয়েছে, রুদ্রর স্বপ্নে চিংড়ির ব্যবসা করে প্রচুর টাকার মালিক হওয়া আছে, স্বপ্নের মধ্যে সুষ্ঠু ভাবে তার ছভাইবোনকে বড় করা আছে। রুদ্র বলে যায় দু সপ্তাহ পর ফিরবে, দু মাস চলে গেলেও ফেরার নাম নেই। ওদের সংসারে থেকে ওদের অন্ন ধং্ব স করতে আমার লজ্জা হয়। ছোটদার বাড়ি চলে আসি। গীতার নতুন একটি বাচ্চা হয়েছে। এ বাচ্চাজ্ঞট হওয়ার সময় ক্লিনিকে ডাঃ টি এ চৌধুরি যখন বাচ্চাজ্ঞট প্রসব করাচ্ছিলেন, ডাক্তার বলে আমাকে অনুমতি দেওয়া হয়েছিল ভেতরে যেতে। বাচ্চাজ্ঞটর জন্ম আমার দেখা।ছোটদা নাম দিয়েছেন ঐন্দ্রিলা কামাল। ডাক নামটি আমি দিই, পরমা। পরমাকে লালন পালন করার জন্য গীতা চাকরি ছেড়েছে। ছোটদা আর গীতা দুজনই নতুন বাচ্চা নিয়ে খুশিতে লাফাচ্ছে। সুহৃদকে কাছে রাখার কোনও উৎসাহ নেই, দু বাচ্চাকে দেখাশোনা করার ঝামেলা গীতা নিতে পারবে না বলে ঢাকায় এনেও, কিছুদিন পরই সুহৃদকে যেখানে মানায়, সুহৃদের যাদের জন্য টান, তাদের কাছেই পাঠিয়ে দিয়েছে। আমার অলস অবসর কাটতে থাকে ছোটদার বাড়িতে। কখনও কখনও ঝুনু খালার বাড়িতে গিয়ে বসে থাকি। ঝুনু খালার কাছে শুনি বরিশালি স্বামীটি নাকি বড়মামার কাছে মোটা অংকের টাকা ধার চেয়েছেন। অত টাকা বড় মামার নেই যে ধার দেবেন। ঝুনু খালাকে প্রায়ই নাকি বরিশালিটি বলছেন, ফকিরের জাতরে বিয়া করে কি ঠকা ঠকেছি! আমাকে সামনে পেলেই তিনি ঝুনু খালার বয়স বেশি, ঝুনু খালা ছলে বলে কৌশলে বিয়ে করেছেন তাঁকে, তাঁর আরও ভাল পাষনী জুটতে পারত ইত্যাদি বলেন। রুনুখালার বাড়িতেও আমার ভাল লাগে না সময় কাটাতে। আমি ময়মনসিংহে ফিরি। ময়মনসিংহেও আর আগের মত ভাল লাগে না। অতিথি-মত লাগে অবকাশেও। রুদ্র ঢাকায় ফিরে এলেই আমি ও বাড়িতে যাই। রুদ্র সংসারের একজন হয়ে যায়, অতিথি আমি অতিথিই থাকি। তাকে বলি, বারবার বলি, রাগ করে বলি, আদর করে বলি, বুঝিয়ে বলি, চিংড়ির ব্যবসা ছেড়ে তুমি ঢাকায় থাকা শুরু কর, ঢাকায় কিছু কর। কিন্তু ওই ব্যবসা ছেড়ে আসা সম্ভব হবে না তার। অনেক টাকা খাটিয়েছে, লেগে থাকতে হবে। রুদ্র লেগে থাকে ব্যবসায়, আমি লেগে থাকি রুদ্রে।



ফেব্রুয়ারি মাসটি রুদ্র যে করেই হোক ঢাকা থাকে। এ মাসে বই ছাপা, এ মাসে বইমেলা, এ মাসে মঞ্চে মঞ্চে কবিতা পাঠ। জানুয়ারির শেষ দিকে রুদ্র তার স্বৈরাচার নিপাত করতে নিজের হাতে অস ্ত্র নেওয়ার তীব্র ইচ্ছে প্রকাশ করা কবিতাগুলো জড়ো করতে থাকে, বই ছাপবে। প্রকাশক খুঁজে লাভ হয়নি। নিজেই ছাপবে সে বই। আমাকেও বলে আমার কবিতা জড়ো করতে। গত কয়েক বছরের লেখা কবিতাগুলো খুঁজে খুঁজে আটত্রিশটি কবিতা জড়ো করি। কবিতাগুলো রুদ্রর কবিতার মতই বেশিরভাগ অন্যায় অত্যাচার বৈষ−ম্যর বিরুদ্ধে, এবং অবশ্যই স্বৈরাচারের বিপক্ষে। দুটো পাণ্ডুলিপি নীলক্ষেতে শ্মশ্রুমণ্ডিত শ্রীমণ্ডিত কবি অসীম সাহার ছাপাখানা ইত্যাদি প্রিন্টাসের্ দিয়ে আসি ছাপতে। প্রতিদিন বিকেলে দুজন ইত্যাদিতে গিয়ে প্রুফ দেখে আসি কবিতার। শাদামাটা পঈচ্ছদ তৈরি করে বই দুটো ছেপে বাধাঁই হয়ে বেরিয়ে আসে, রুদ্রর বইএর নাম ছোবল, আমারটির নাম শিকড়ে বিপুল ক্ষুধা। এই প্রথম একটি কবিতার বই বের হল আমার। আনন্দধারা নিরবধি বইতে থাকে আমার ভুবনে। বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গনে বইমেলা শুরু হওয়ার পর প্রতিদিন দুজন মেলায় যাই। একুশে ফেব্রুয়ারির ভোরে শহিদ মিনারে ফুল দিয়ে বইমেলার প্রবেশদ্বারে ভিড়ের মধ্যে মেয়েদের স্তন ও নিতম্ব মর্দন করার জন্য ওত পেতে থাকা থাবাগুলো থেকে বহু কষ্টে নিজেকে বাঁচিয়ে মেলায় ঢুকি। মঞ্চে মঞ্চে কবিতা পড়ে সারাদিন মেলার ঘাসে, খাবার দোকানে, একাডেমির সিঁড়িতে, বইয়ের স্টলে, কবি লেখকদের সঙ্গে লম্বা লম্বা আড্ডা দিয়ে আমাদের চমৎকার সময় কাটতে থাকে। আড্ডার মূল বিষয় সাহিত্য এবং রাজনীতি। বাংলা একাডেমির মঞ্চে তো বটেই ভাষা আন্দোলনের এই মাসটিতে বিভিন্ন মঞ্চে রুদ্রও কবিতা পড়ে, রুদ্রর সঙ্গে যেহেতু আছি আমি, যেহেতু আমার কবিতা লেখার অভ্যেস আছে, আমাকেও কবিতা পড়তে বলা হয়, পড়ি। মেলার বিভিন্ন স্টলে দুজনের বইগুলো বিক্রির জন্য দেওয়ার পর প্রতিদিনই খবর নিয়ে দেখি রুদ্রর বই বিক্রি হচ্ছে কিছু আমার কিছুই নয়। মেলা শেষ হলে শিকড়ে বিপুল ক্ষুধার অবিক্রিত বইগুলো বাড়িতে ফেরত আনতে হয়। খাটের নিচে প্যাকেট বন্দি পড়ে থাকে বই। কবিতা যে আমার জন্য নয়, তা বেশ বুঝি। আমার যে এককালে কবিতা লেখার অভ্যেস ছিল, সেঁজুতি নামে পত্রিকা ছেপেছিলাম, সেসব এখন ইতিহাস, কবিতা লিখি না আর, কবিতা লেখা হয় না, পারি না—রুদ্রর বউ হিসেবেই আমি পরিচিত হয়ে উঠি সবখানে। কক্সবাজারে কবিতা পড়তে যাওয়ার আমন্ত্রণ জোটে রুদ্রর। বেশ কজন কবি রওনা হন কক্সবাজারে। রুদ্রর সঙ্গী হয়ে আমি। দুপুরে মহাদেব সাহা সমুদ্রে স্নান করতে নামেন লুঙ্গি পাঞ্জাবি আর কাঁধে গামছা নিয়ে। রুদ্র খালি গা। আমি ক্যাঙ্গারু গেঞ্জি আর জিনস। সূর্যাস্তের সময় সৈকতের বালুতে বসে কবিতাপাঠের অনুষ্ঠানটি হয়। অনুরোধে ঢেকি গেলার মত কবিতা পড়তে হয় আমাকে ওখানেও।



আলাওল সাহিত্য পুরস্কার দেওয়া হচ্ছে মুহম্মদ নূরুল হুদাকে। কিছু তরুণ কবিকে আমন্ত্রণ জানানো হল। রুদ্রকেও। সে ফরিদপুরেও গেল আমাকে সঙ্গে নিয়ে। দল বেঁধে গ্রামে গিয়ে কবি জসিমুদ্দিনের বাড়ি দেখে এলাম, এইখানে তোর দাদির কবর ডালিম গাছের তলে, তিরিশ বছর ভিজায়ে রেখেছি দুই নয়নের জলে র বিখ্যাত ডালিম গাছটিও। রুদ্রর সঙ্গ এবং জীবনের এই প্রচণ্ড গতি ও ছন্দ আমাকে অপার আনন্দে ডুবিয়ে রাখে। জীবন তো আমার আর সাধারণ দশটি বাঙালি বধূর মত হতে পারত। তেল ডাল নুনের হিসেব করে সংসার কাটতে পারত। সমাজের কুসংস্কার আর বিধি নিষেধ অমান্য করেই তো আমরা এতদূর এসেছি। তবে আর অত বেশি সামাজিক হওয়ারই বা স্বপ্ন দেখা কেন! রুদ্রর সঙ্গে আলাদা করে একটি সংসার হল না বলে আমার মনের কোণে লুকিয়ে থাকা একটি আক্ষেপকে আমি ঝেঁটিয়ে বিদেয় করি। রুদ্র এখন নিজের সংসারটিকে চাইছে অন্য যে কোনও সংসার থেকে সম্পণূর্ আলাদা। জগত থেকে আলাদা হয়ে, মানুষ থেকে আলাদা হয়ে দুজনে স্বাথর্প রের মত কোনও খাঁচা তৈরি করার নাম সংসার নয়। বাইরের মুক্ত জগতে আমরা বাস করব, একটি বৈষম্যহীন সুস্থ সুন্দর সমাজের জন্য আমরা লড়াই করে যাবো, এভাবেই আমরা যাপন করব বিশ্বাসে ও ভালবাসায় আমাদের যৌথ জীবন। পরষ্পরের আমরা সহযাষনী বা সহযোদ্ধা হব। ক্ষুদ্র স্বা−র্থর লেশমাত্র যেখানে থাকবে না। রুদ্রর ভাইবোনেরা মোংলা বন্দরের স্যাঁতসেঁতে সম্ভাবনাহীন পরিবেশ থেকে ঢাকায় এসে নিজেদের প্রতিভার বিচ্ছুরণ ঘটিয়ে এক একজন বিশাল ব্যক্তি হয়ে দেশ ও দেশের সেবায় নিজেদের নিয়োজিত করবে। ওদের আমরা আমাদের আদর্শে গড়ে তুলব।

ঢাকায় চন্দনার সঙ্গে আমার দেখা হয়েছিল। স্বামী নিয়ে ও তার স্বামীর বোনের বাড়িতে ছিল ও। যতক্ষণ আমি ও বাড়িতে ছিলাম, চন্দনা আমার সঙ্গে কথা বলেছে গলা চেপে। স্বামীসহ একদিন এসেও ছিল আমাদের বাড়িতে, ইচ্ছে ছিল কোনও রেস্তোরাঁয় খেতে যাবো সবাই মিলে। কিন্তু স্বামী বলল তার সময় নেই। আমার সঙ্গে সময় কাটানোর ইচ্ছে থাকলেও স্বামীর কারণে চলে যেতে হয়েছে চন্দনাকে। চন্দনার জীবনটি দেখে আমার কষ্ট হয়েছে, এরকম একটি জীবনের স্বপ্ন কি ও দেখেছিল! না দেখলেও এ জীবনটিতেই ও এখন অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে। গলা চেপে কথা বলা কুণ্ঠিত জীবনে। চন্দনার, আমার ধারণা হয়, আকাশ দেখারও অবসর জোটে না হয়ত। অথবা দেখতে হলেও স্বামী বা স্বামীর কোনও আত্মীয়ের অনুমতি নিতে হয়।



ফেব্রুয়ারির উৎসব ফুরোলে রুদ্র আমাকে জিজ্ঞেস করে এই সংসারে তোমার কনট্রিবিউশান কি? শুনে আমি লজ্জায় বেগুনি রং ধারণ করি। প্রতি মাসে রুদ্র যেমন টাকা ঢালছে সংসারে, আমি কেন ঢালছি না! আমার এই না ঢালার কারণটি খুব সহজ, আমার হাতে কোনও টাকা পয়না নেই ঢালার, সরকারি চাকরির জন্য অপেক্ষা করছি, চাকরিটি পেলেই, যেহেতু আমি নারী পুরুষে বৈষম্যহীন জীবনের পক্ষপাতি, আমি যে স্বামীর ওপর অর্থ নৈতিক নির্ভরতা চাই না সে আমি প্রমাণ করতে পারব তার ওপর সংসারের খরচ অর্ধেক যোগাড় করতে পারব। কিন্তু সরকারি চাকরি না হওয়াতক আমি কেন উপার্জন করার চেষ্টা করছি না, না করে নিজের শরীরটিকে একটি মেদবহুল মাংসপিণ্ড তৈরি করছি! রুদ্র বলে, যদিও আমার শরীরে মেদের ছিঁটেফোঁটা নেই বরং পিঠে পড়া লম্বা চুলগুলো গীতার প্রেরণায় ঘাড় অবদি কেটে ফেলে আরও হাড়সর্বস্ব লাগে দেখতে। রুদ্রর উৎসাহে সিদ্ধেশ্বরীতে তার বন্ধু সেলিমের ওষুধের দোকানের ভেতর ডাক্তারের চেম্বারটিকে রোগি দেখার জন্য আমার বসার ব্যবস্থা হয়। শান্তিনগর মোড়ে বি এন মেডিকেল হলে

ডাঃ তসলিমা নাসরিন,
এম বি বি এস, বিএইচ এস আপার,
রোগী দেখার সময় সকাল ৯টা থেকে বিকাল ৩টা

লেখা একটি সাইনবোডের্ ঝুলিয়ে দেয় সেলিম। ওখানে বিকেলে প্রজেশ কুমার রায় বসেন। ময়মনসিংহ মেডিকেল থেকেই পাশ করেছেন প্রজেশ, দাদার সহপাঠি ছিলেন ইশকুলে। প্রজেশ পিজি হাসপাতালে মেডিসিন বিভাগে সহকারি অধ্যাপক হিসেবে চাকরি করেন, বিকেলে রোগী দেখতে বসেন বিএন মেডিকেল হলে। আমি প্রতিদিন হাতে স্টেথোসকোপ আর রক্তচাপ মাপার যন ্ত্র নিয়ে ফার্মেসিটিতে যাই। বসে থাকি চপু চাপ। রোগী আসার নাম গন্ধ নেই। রুদ্রকে বলি, ধুর রোগী আসে না, খামোকা বসে থাকা! রুদ্র বলে, উফ এমন বাচ্চাদের মত করো না তো! বসে থাকো, ধীরে ধীরে রোগী পাবে। দিন যায়, দু একটি রোগী যা মেলে তাতে আমার রিক্সাভাড়ার অর্ধেকও ওঠে না। কোনও একটি ক্লিনিকে চাকরি খুঁজতে থাকি। পত্রিকার পাতা দেখে প্রাইভেট ক্লিনিকগুলো খুঁজতে খুঁজতে ইস্কাটনের একটি ক্লিনিকে চাকরি পেয়ে যাই। ডিউটি রাতে। মাসে দেড়হাজার টাকা। প্রশিক্ষণ থেকে মাস মাস ভাতাও এই পেতাম। এ টাকায় সংসার চালানো সম্ভব নয় জানি। বাড়ি ভাড়াই বারোশো টাকা। কিন্তু তারপরও নিজে উপার্জন করার আনন্দই আলাদা। এ টাকায় নিজের হাত খরচ হবে, বাড়ির বাজার খরচাও হবে। ক্লিনিকে ঢোকার পর দেখি বাড়তিু উপার্জনের ব্যবস্থাও এখানে আছে। আমি যদি অপারেশনে এসিস্ট করি, তবে পাঁচশ থেকে একহাজার টাকা পেতে পারি। যদি রোগীর মেন্সট্রুয়েশন রেগুলাশেন অর্থাৎ এবরশন করি, তবেও পাঁচশ টাকা পাবো। রাতে যদি রোগী আসে সে রোগী দেখা আমার দায়িত্ব। রোগি যে টাকা দেবে ক্লিনিকে, তার থেকেও পারসেনটেজ পাবো। বাহ! বেশ তো। চাকরিটি চমৎকার চলছিল। মালিক ভদ্রলোকটি বেশ আন্তরিক। তিনি আমাকে এবরশান এর কটি রোগী দিয়ে এ কাজে হাত পাকানোর ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। কিন্তু রোগীর ভিড় নেই এমন এক রাতে, দশটার দিকে, মালিক আমাকে দোতলায় তার আপিসরুমে ডেকে পাঠান। খুব জরুরি হলেই সাধারণত মালিক ডেকে পাঠান। কি কারণ ডাকার? না কোনও কারণ নেই, তিনি গল্প করবেন। আমি বলি আমার নিচে যেতে হবে, কারণ যে কোনও সময় রোগি আসতে পারে। আরে বাদ দেন, রোগী এলে নাসর্ আপনাকে ডাকবে, চিন্তু করবেন না। চিন্তা আমি ও নিয়ে করি না, কারণ জানি রোগী এলেই নাসর্ আমাকে খবর পাঠাবেন। চিন্তা করি মালিকের উদ্দেশ্য নিয়ে। মালিক কি কারণে আমাকে ডেকেছেন এখানে, কোনও জরুরি কথা কি আছে? থাকলে তিনি জরুরি কথাটি না বলে আমাকে বসতে বললেন কেন! বসলে ইন্দিরা রোডের রাজাবাজারে ঠিক কোন গলিতে আমার বাড়ি, তিনি প্রায়ই ওদিকে যান বলে কোনও এক বিকেলে আমার বাড়িতেও যাবেন, বলেন কেন! একজন কবিকে কি কারণে বিয়ে করেছি, কবিকে বিয়ে করে মোটেও বুদ্ধির কাজ করিনি, বলেন কেন! স্বামীকে আমার পাশে একদমই মানায় না, স্বামী নিয়ে আমি আদৌ সুখে আছি কি না ইত্যাদিই বা কেন! আমার ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে তাঁর এত ভাবনা কেন! আমি নিশ্চিত, এগুলো কোনও জরুরি কথা নয়। কথা বলতে বলতে যে মাঝে মাঝেই চুমুক দিচ্ছেন গেলাসে, না বললেও আমি বুঝি তিনি মদ্যপান করছেন। নিশ্চিন্তে বসে, মালিক যা চাইছেন, সুখ দুঃখের গল্প করা আমার হয় না। আমি তাঁর অবাধ্য হয়ে নিচে নেমে আসি। নিচে নেমে শাদা একটি কাগজে বড় বড় করে লিখি সজ্ঞানে য়ইচ্ছায় চাকরিতে ইস্তফা দিচ্ছি আমি।
 
২৫. দূরত্ব


ছিয়াশি সালের শেষদিকে ঘটনাটি ঘটে। দেড়মাস পর ফিরবে বলে রুদ্র মোংলায় চিংড়ির ব্যবসা দেখতে গেলে যেহেতু আমার কিছু করার নেই ঢাকায়, ময়মনসিংহে চলে যাই। ময়মনসিংহ থেকে দেড়মাস পর ফিরে দেখি রুদ্র ফেরেনি এখনও। কবে ফিরবে জানতে চাইলে মেরি বলে আরও দুসপ্তাহ দেরি হবে। রুদ্রহীন ঘরটিতে একলা বসে থাকি, ঘরটি খুব খালি খালি লাগে। টেবিলে কবিতার খাতা পড়ে আছে, যেন লিখছিল, এই মাত্র উঠে সে অন্য ঘরে গেছে, এক্ষুনি ফিরে আবার লিখবে কবিতা। আমি চোখ বুজে অন্য ঘর থেকে রুদ্রর ফেরার অপেক্ষা করি মনে মনে। মনে মনে তার একটি হাত রাখি আমার কাঁধে, শুনি একটি খুব চেনা কণ্ঠস্বর, কখন এলে? সেই কবে থেকে অপেক্ষা করছি তোমার! কাঁধের হাতটি ক্রমশ নেমে আসছে বুকে, আরেকটি কাঁধেও আরেকটি উষ্ণ হাত, সেই হাতটিও নেমে আসছে। গা শিথিল হয়ে আসছে আমার, আমার গালে তার দাড়ি- গাল ঘসতে ঘসতে বলছে, সোনা আমার মানিক আমার, বউ আমার, তোকে ছাড়া আমি বাঁচি না রে! আমার তৃষ্ণাতর্ ঠোঁট জোড়া সিক্ত হতে চাইছে, ঠোঁটে তার দীর্ঘ দীর্ঘ উষ্ণ সিক্ত চুম্বন। অভূত এক শিহরণ আমার গা কাপাঁচ্ছে। মাথাটি এলিয়ে পড়ে টেবিলের খাতায়। অনেকক্ষণ ওভাবেই পাওয়ায় না পাওয়ায় চণূর্ হই। খাতাটির শেষ পাতায় লিখি, আমার ভাল লাগছে না, ভাল লাগছে না। কেন আসোনি তুমি। বউ ছেড়ে এত দীর্ঘদিন কি করে থাকো তুমি। বড় একা লাগে আমার। তুমিহীন একটি মুহূতর্ও আমার কাছে অসহ্য। আমার আপন কেউ নেই এক তুমি ছাড়া। আমার জীবন কাটে না তুমি ছাড়া। হয় আমাকে তোমার কাছে নিয়ে যাও, নয় তুমি আমার কাছে চলে এসো। গোছানো বিছানাটির দিকে তাকিয়ে থাকি এক শরীর তৃষ্ণা নিয়ে। একটি বেদনার্ত হাত এগিয়ে যায় বিছানার চাদরে রুদ্রর ফেলে যাওয়া স্পর্শ পেতে, বুলোতে থাকে চাদর। ফেলে যাওয়া ঘ্রাণ পেতে বালিশে মুখ চেপে তার ছিঁটেফোঁটা শুঁকতে শুঁকতে বলি, কবে আসবে তুমি, আমার আর ভাল লাগে না একা থাকতে। তুমি ফিরে এসো প্রাণ। আমার বক্ষে ফিরিয়া এসো, আমার চক্ষে ফিরিয়া এসো, আমার নিতিসুখ ফিরে এসো। আমার সর্বসুখ তুমি ফিরে এসো। বালিশ ভিজে যায় শব্দহীন কান্নায়। সচকিত হই বাড়ির মানুষদের সম্ভাব্য কোতূহলের কথা ভেবে, দুহাতে চোখ মুছে, মেরিকে ডেকে, আমি না হয় দুসপ্তাহ পর ফিরব, বলে দরজার দিকে এগোতে নিলে ও বলে, এক্ষুনি যাচ্ছ বৌদি? বসো, চা খেয়ে যাও। শুষ্ক-হাসি ঠোঁটে, বলি, না চায়ের তৃষ্ণা নেই।

রাজাবাজারের মোড় থেকে একটি রিক্সা নিয়ে মহাখালি বাসস্ট্যান্ডের দিকে যেতে থাকি। রুদ্রহীন ঢাকা শহর আমার কাছে ধু ধু মরুর মত লাগে। মহাখালি থেকে হঠাৎ ধুত্তরি বলে রিক্সা ঘুরিয়ে নয়াপল্টনের দিকে যাই। ভাল লাগে না ময়মনসিংহ যেতে। অবকাশে আমি অনাকাঙ্খিত অতিথি। মা প্রায়ই বলেন, বাপ মার অমতে বিয়া করছস। খুব সুখে না থাকবি কইছিলি! এখন এত বাপের বাড়ি আসতে হয় কেন? বাবার চোখের সামনে পড়লে কঠোর দৃষ্টি ছুঁড়ে দেন, মাকে ডেকে বলেন, ওই ছেড়ি আমার বাসায় আইছে কেন? ওরে বাসা থেইকা ভাগাও। আমার বাসায় আসার ওর কি অধিকার আছে? আমি কি কামাই করি আরেক বেডার বউরে খাওয়ানির জন্য নাকি? ওরে খাওন দিবা না। নয়াপল্টনে ছোটদার বাড়িতে উদাস বসে রুদ্রকে ভাবি, দিন রাত কি অক্লান্ত পরিশ্রম করছে বেচারা। নিশ্চয়ই নির্ঘুম রাত কাটাচ্ছে। নিশ্চয়ই বউটির কথা মনে করে যত শীঘ্র সম্ভব ফিরে আসতে চাইছে। পারছে না বলে নিশ্চয়ই তার কষ্ট হচ্ছে খুব। ইচ্ছে করে তার কপালের ঘাম মুছিয়ে দিই আঁচলে। আমার এই মগ্নতায় টোকা দিয়ে গীতা বলে, কি রে, কি ভাবস? তর জামাই কই? তারে লইয়া আইলি না কেন?

আমার বুঝি একলা আসা মানা? সবসময় জামাই লইয়া আইতে হইব?

কি, রাগারাগি হইছে নাকি!

নাহ! রাগারাগি হইব কেন!

তাই তো মনে হইতাছে। জামাই আছে ঢাকায়?

নাহ।

গীতার ঠোঁটে বাঁকা হাসি। টুলুর ঠোঁটেও হাসি। এ বাড়িতে গীতার ছোট ভাই টুলু থাকে। কালো-ছেলে মোটা-ছেলে, নাকের-নিচে-শুঁয়োপোকা-মোচ- ছেলে টুলুকে বাংলাদেশ বিমানে চাকরি দিয়ে ঢাকায় এনে ছোটদা নিজের বাড়িতে রাখছেন। বাঁকা হাসিটি নিয়েই টুলু হাঁক দেয় এক গেলাস জল দে তো নার্গিস। নার্গিস গেলাসে পানি নিয়ে টুলুর হাতে দেয়। ওর সঙ্গে চোখাচোখি হয় একটি মুহূতর্। চোখ সরিয়ে নেয় ও। কেন সরালো চোখ ও! ওর চোখে কি একটি তিরতির ভয় কাপঁ ছিল। পরমার কাজকর্ম করার জন্য অবকাশ থেকে ওকে এনেছে গীতা, পরমার কাজ তো আছেই, বাড়ির আর সব কাজ একাই ও করছে। পরমাকে কোলে নিয়ে বসে ভাবছিলাম নিজের একটি সন্তানের কথা, কোনও একদিন সন্তানের মা হব আমি, রুদ্র নিশ্চয়ই তখন নিজের বাচ্চা রেখে এমন দূরে দূরে পড়ে থাকবে না। ভাবনাটি ছিন্ন করে নার্গিসের উসকোখুসকো চুল, আধোয়া ছেঁড়া মলিন জামা, শুকনো মুখ ।

বিকেল ফুরোতে থাকে, খেয়ে ঘুমিয়ে আড়মোড়া ভেঙে পরমাকে আবার কোলে নিয়ে বসেছি সোফায়, নার্গিস বালতির পানিতে ত্যানা ডুবিয়ে জল চিপে ঘর মুছছে। এখনও সে গোসল করেনি, খায়নি। গীতা ভাত খেতে বললে তবে সে খাবে।

কি রে নার্গিস, আছস কেমন?

আপা, ময়মনসিং থেইকা আইছেন কবে? চাপা স্বরে নার্গিস জিজ্ঞেস করে।

আজকেই আইছি।

কবে যাইবেন?

জানিনা। তুই যাইবি ময়মনসিং?

হ।

নার্গিস চকিতে উঠে দাঁড়ায় উত্তেজনায়। গীতা ঘরে ঢুকতেই ও ত্রস্ত উবু হয় ত্যানায়। কি হইতাছে? গীতা প্রশ্ন চোখে নার্গিসের দিকে তাকায়।

ও তো এখনও খায় নাই! ওর তো খাওয়া দরকার! মিনমিন করি। চেঁচায় গীতা, সব কাজ শেষ হইলে পরে খাইব।

আমি নরম স্বরে বলি, ওর কি কোনও ভাল জামা টামা নাই নাকি? গোসল করে নাই কতদিন কে জানে!

এ কথা শুনেই গীতা ওর উবু হওয়া শরীরে একটি লাথি কষিয়ে বলে, বাথরুম মুইছা দেস নাই কেন? ও গোসলখানার মেঝে মুছে এসেছিল, টুলু গিয়ে ভিজিয়েছে আবার। এ কথা নার্গিস বলে না, বলি আমি। আমার এই নাক গলানোয় সে নার্গিসের চুলের মুঠি ধরে উঠিয়ে খাবার ঘরের মেঝেয় ওকে ফেলে শক্ত শক্ত লাথি মারতে থাকে বুকে মুখে। ঘর থেকে হেলে দুলে বেরিয়ে এসে টুলু বলে, দে এইডারে আরো দে, ছেড়িডা বড় শয়তান। আমি দৌড়ে গিয়ে নার্গিসকে গীতার লাথির তল থেকে টেনে সরিয়ে নিই।

গীতা আমার কোল থেকে পরমাকে ছিনিয়ে নিয়ে চেঁচাতে থাকে, আমার বাড়িতে থাকস, আমার খাস, আবার আমার নামে মানুষের কাছে বিচার দেস? কারও কি ক্ষমতা আছে আমার বিচার করার?

নার্গিসের পিঠে হাত বুলিয়ে দিয়ে বলি, ও আমার কাছে বিচার দেয় নাই। আমিই কইছি।

যেই না বলেছি, পরমাকে টুলুর কোলে দিয়ে গীতা নার্গিসকে টেনে নিয়ে জানালার শিকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে চুলের মুঠি ধরে ওই শিকেই বার বার মাথা ঠোকাতে থাকে। আমি চোখ ফিরিয়ে নিই, চোয়াল শক্ত হয়ে আসে। ইচ্ছে করে এ বাড়ি থেকে এমুহূর্তে নার্গিসকে নিয়ে বেরিয়ে যাই, পারি না। ইচ্ছে করে ঠেলে সরিয়ে দিই গীতাকে, পারি না। এ বাড়ি আমার নয়, গীতার। তার আদেশ নির্দেশ মেনে চলতে হবে নার্গিসকে। জঘন্য দৃশ্যটির দিকে তাকিয়ে আমার আর ইচ্ছে করে না বাড়িটিতে দুদণ্ড থাকার। আমার সকল অক্ষমতা নিয়ে আমি বেরোই।

বাসে ময়মনসিংহ যেতে যেতে দেখি তিনটে ট্রাক রাস্তার কিনারে উল্টো পড়ে আছে। দুটো বাস খাদে। বাসদুটোর পাশে দশ বারোটি মৃতদেহকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে মানুষ। মনে হয় এ বাসটিও বুঝি খাদে পড়বে। এভাবে আমিও হয়ত আজ মরে পড়ে থাকব রাস্তার পাশে। কেউ জানবে না কি আমার নাম, কোথায় আমার বাড়ি। অজ্ঞাত পরিচয় মেয়েকে কোনও এক গণকবরে শুইয়ে দেওয়া হবে। আত্মীয় স্বজন বন্ধু বান্ধব কেউ জানে না আমি আজ বাসে ঢাকা থেকে ময়মনসিংহে যাচ্ছি। ঢাকা-ময়মনসিংহ বাসের দুর্ঘটনার খবর তারা জানলেও কেউ জানবে না দুর্ঘটনায় আমার মৃত্যু হয়েছে। ভাবতে ভাবতে হাত ব্যাগ থেকে ছোট একটি কাগজ বের করে নিজের নাম ঠিকানা লিখে কাগজটি ব্যাগে ভরে, নতুন একটি ভাবনার শিকার হই, কি লাভ মৃতদেহের সৎকারে! মরে গেলে কি আর আমি বুঝবো আমার সৎকার মহা আড়ম্বরে করে হচ্ছে কি হচ্ছে না! হলেই বা আমার কি লাভ! গ্রামে পড়ে থাকা আমার লাশটি যদি শেয়াল শকুনে খায়, অথবা যদি সিল্কের কাফনের কাপড়ে আর আতর লোবানের ঘ্রাণে মুড়ে আমাকে ভাল একটি কবরে রাখা হয়, যদি শ্বেত পাথরে বাঁধিয়ে দেওয়া হয় কবর—কি পার্থক্য দুটিতে! মৃত্যুর পর আমার তো বোঝার শক্তি থাকবে না আমাকে কেউ ভালবাসছে কি বাসছে না। তখন যত্ন আত্তি পেলেই কি না পেলেই কি! মা বলেন, কবরে রেখে আসার ঠিক চারদিন পরই নাকি মানুষ ভুলে যায়, যত বড় স্বজন বা বন্ধু হোক সে। ভাবনাটি পাশে বসে থাকে, আমি ব্যাগ থেকে কাগজটি নিয়ে ছিঁড়ে কুটিকুটি করে ফেলে দিই জানালার ওপাশের হাওয়ায়। সন্ধের অন্ধকারের ছেঁড়া কাগজের টুকরো গুলো হারিয়ে যেতে থাকে।



অবকাশ সেই আগের মত আছে। বেঁচে আছে। মা সুহৃদকে পরম আদরে মানুষ করছেন। নিজের রক্ত-যাওয়া-অসুখ টির কোনও চিকিৎসা নেই জানার পর তিনি আর অভিযোগও করেন না এ নিয়ে। এমএড পাশ করার পর বাবার আদেশে শহরের ভাল ইশকুলগুলোয় শিক্ষিকা হওয়ার আবেদন জানিয়ে দরখাস্ত করেছে হাসিনা। মেট্রিক ইন্টারমিডিয়েটে তৃতীয় বিভাগে পাশ করা হাসিনার পক্ষে বিএড এমএড ডিগ্রি নিয়েও চাকরি জোটেনা ভাল। কিন্তু বাবা লেগে থাকেন নতুন নতুন ইশকুলের খোঁজ করতে। স্বজন খুঁজতে থাকেন প্রীতি পেতে। ইয়াসমিনের উদ্ভিদবিদ্যায় মন নেই। মন প্রাণীবিদ্যায়। কলেজের নানারকম বান্ধবী-প্রাণী নিয়ে তার সময় কাটে। দাদা আরোগ্য বিতানে ওষধু ব্যবসায় যতটুকু মন দেন, তার চেয়ে বেশি দেন চিঠি লেখায়। প্রতি সপ্তাহে বত্রিশ পৃষ্ঠা লম্বা চিঠি লেখেন শীলাকে। প্রেমের চিঠি। ঘরে ফিরে তিনি মুমু মুমু বলে কাছে ডাকেন হাসিনাকে। তার সদারাগ মুখে হাসি ফোটাতে প্রায়ই সোনার গয়না আর দামি শাড়ি কিনে আনেন। হাসিনার মুখে হাসি ফোটানো দুরূহ কাজ।

আমার নাম হাসিনা সস্তা আমার হাসি না প্রতিদিনই বস্তা বস্তা অভিযোগ নিয়ে বসে দাদার সামনে। দাদা দুপুরে ফেরার পর বলে সে, মাকে নাকি সে বলেছিল আলু দিয়ে মুরগির মাংস রাঁধতে, মা পটল দিয়ে রেঁধেছেন। তার যেভাবে ইচ্ছে করে সেভাবে যদি তার খাওয়া দাওয়া না হয়, তবে তার আর স্বামীর সংসার করার ইচ্ছে নেই। এ কথা শুনেই দাদা দৌড়ে ঘরবার হয়ে উঠোনের মাঝখানে দাঁড়িয়ে বাড়ির সবাইকে শুনিয়ে লিলির মাকে ডেকে বলেন, রাত্রে যদি আলু দিয়া মুরগির মাংস না রান্ধ্যা তাইলে পিটাইয়া তোমার লাশ ফালাইয়া দিয়াম।

মা শুনে ঘর থেকে বের হয়ে চিল্লিয়ে বলেন, লিলির মারে কস কেন? আমারে ক। আমি পটল দিয়া মাংস রানছি। রাইন্ধা যে অন্যায় করছি তার শাস্তি দে আমারে। পিটাইয়া লাশ ফালাইয়া রাখ। এইটাই ত বাকি আছে করার। মার কথার উত্তর না দিয়ে লিলির মার মুখে থাপড় দিয়ে দাদা গলা ছাড়েন, মুমু যেইভাবে কইব, ঠিক সেইভাবে চলবা। উল্ডা পাল্ডা কর তো মরবা। লিলির মা ফুঁপিয়ে বলতে থাকে, আপনেরা নিজেগোর মধ্যে গোস্বা করেন। আর রাগ ঢালেন আমার উপরে। আমি এই বাড়িত আর কাম করতাম না। লিলির মার ঘাড় ধরে বেলগাছের দিকে ধাক্কা দিয়ে দাদা বলেন, যাও গা, এক্ষুনি বাইর হও বাড়ি থেইকা। লিলির মাকে বাধা দেন মা, বলেন, সুহৃদের দাদা আসুক, তারে সব কইয়া পরে তুমি বাড়ি থেইকা যাইবা। মা দাদার উদ্দেশ্যে গলা নামিয়ে বলেন, আমি যে মা, লেখাপড়া না জানলেও, আইএ বিএ না পাশ করলেও আমি তো তর মা। আমারে ত একটওু মায়ের সম্মান দেস না! দাদা উঠোন থেকে টিনের ঘরটির বারান্দায় উঠেছেন মাত্র, ভেতর থেকে হাসিনা বলে, কইতে পারো না, সম্মান আশা করে কেন! আপন দেওরের সাথে লীলা কইরা আবার ছেলের সামনে সম্মান আশা করে! দাদা সায় দেন হাসিনার কথায়, উচিত কথা শুনাইয়া দেওয়া দরকার ছিল। বাবা ফিরলে মা আদ্যোপান্ত বলেন ঘটনা। এও বলেন, হাসিনা মনে করতাছে আমার ছেড়ারে সে নিজে বিয়াইয়া লইছে। বাবা দাদাকে ডাকেন, হাসিনাকে ডাকেন। বৈঠকঘরে বসে নিচু গলায় কথা বলেন দুজনের সঙ্গে। মা অন্য ঘরে অপেক্ষা করেন এই আশায় যে বাবা এবার একটি আইন করে দেবেন বাড়িতে যেন মার সঙ্গে রয়ে সয়ে কথা বলে পুত্রবধূ। পুত্রবধূ আজ যদি শাশুড়িকে অসম্মান করে, কাল শ্বশুরকেও করবে। কিন্তু শলা পরামর্শ বিচার যা হয়, তা হল এখন থেকে হাসিনার দায়িত্বে সংসার চলবে। অনেকদিন পর হাসিনার সদারাগ মুখ টিকে এক চিলতে হাসি খেলে।

হাসিনার হাতে সংসারের ক্ষমতা যেদিন চলে গেল, ছোটদা ময়মনসিংহে আসেন। সংসারের হস্তান্তর দেখে মাকে বলেন, ঠিকই হইছে মা, আপনে এখন আর সংসারের ঝামেলায় যাইবেন কেন? বৌদিই সব সামলাক। কিন্তু ছোটদা একা কেন? বউরে কি তার বাপের বাড়িত রাইখ্যা আইছ না কি? না বউ আনেননি ছোটদা। একা এসেছেন। সুহৃদকে দেখতে এসেছেন। সুহৃদকে দেখা যদি মূল উদ্দেশ্য হত, তবে তিনি ছেলের সঙ্গে মাত্র দুমিনিট কাটিয়ে কি রে বেড়াইতে যাইবি নাকি চল বলে আমাকে নিয়ে বেরোতে চান? কই যাইবা? চল চল। তরে একটা নতুন জায়গায় নিয়া যাই। নতুন জায়গায় যাওয়ার ইচ্ছে ঘুড়ির মত ওড়ে। ছোটদা দিন দিন সুদর্শন হচ্ছেন। শরীরে কোনও মেদ নেই। লম্বা ছিপছিপে। দেখে মনে হয় বয়স কমছে তার। ছোটদাকে এমনই বালক বালক লাগে দেখতে যে যখন তিনি আমাকে ক্যান্টনমেণ্টের এক আর্মি অফিসারের বাড়িতে নিয়ে গেলেন সন্ধেয়, অফিসারের সুন্দরী কচি বউটি বলল, কি কামাল, উনি কি তোমার বড় বোন নাকি? ছোটদা বাড়িটিতে বেশ য়চ্ছন্দে পায়চারি করতে করতে বললেন, কি যে বল, ও আমার আট বছরের ছোট। ছোটদা গীতার সঙ্গে যে সূরে আর ঢংয়ে কথা বলেন, নীনার সঙ্গেও একইরকম করে বলেন। নীনার চিবুক তুলে ধরে বলেন, বাহ দারুণ লাগতাছে তো! আমার নিজের চোখ কান কিছুকে বিশ্বাস হয় না, বিশ্বাস হয় না যে আমার সামনের মানুষটি সৈণ্ত্র হিসেবে নাম কামিয়েছেন। চা টা কিছু খাবা? নীনা জিজ্ঞেস করে। ছোটদা বলে ওঠেন, না না কিছু খাব না। তোমারে দেখতে আসলাম সুন্দরী। দেইখা মন জুড়াইল। এখন যাই। ছোটদার ঠোঁটে অবিকল একই হাসি গীতার সঙ্গে প্রেম করার সময় যে হাসিটি তাঁর ঠোঁটে শোভা পেত। নীনা না না করে ওঠে, কি বল, বোনরে নিয়া আসছ কিছু খাও। রান্নাঘরের দিকে যেতে নিলে ছোটদা হাত ধরে টেনে নিয়ে আসেন নীনাকে, প্রায় বুকের কাছে লেপ্টে থাকে ছোটদার সুন্দরীটি। যাও কই? কিচ্ছু খাবো না, কখন তোমার জামাই আইসা পড়ব, আজকে যাইগা, আরেকদিন আসব নে। বলে সুন্দরীর গালে আঙুলের আলতো আদর রেখে ছোটদা বেরোন। জিজ্ঞেস করি ছোটদাকে, কে এই মেয়ে?

গায়িকা পিলু মমতাজের ছোট বোন।

তা তোমার সাথে পরিচয় কেমনে?

ফ্লাইটে পরিচয়। প্রায়ই বিদেশ যায়।

ও।

মেয়েটা খুব ভাল। আমাকে কিছু গাহেক দিছে। ধান্দার জিনিস বেচি।

বিমানের ক্রুরা দেশে বিক্রি করার জন্য বিদেশ থেকে কিনে আনা তাদের জিনিসপত্রকে বলে ধান্দার জিনিস। ওগুলো নিজের ব্যবহারের বলে কাস্টম পার করে লাভে বিক্রি করেন মানুষের কাছে। নির্দিষ্ট কিছু লোক কেনে। এগুলা কর কেন? ছোটদাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম। আরে ধান্দাই ত আসল। ধান্দাতেই তো পয়সা। বেতন আর কত পাই! ছোটদা ঠোঁট ওল্টান।

শোন, গীতার কাছে কিন্তু কোনওদিন কইস না এই মেয়ের কথা।

কেন, কি হইব কইলে?

উপায় নাই। আমি কোনও মেয়ের সাথে কথা কইলে গীতা কোনওদিন সহ্য করে নাই। সর্বনাশ হইয়া যাবে জানলে।

ছোটদা সে দিনই চলে যান ঢাকায়। তাঁর ময়মনসিংহে আসার আরও একটি উদ্দেশ্য ছিল গীতাদের পিয়নপাড়ার বাড়িতে টাকা দিয়ে যাওয়া। ওখানে ভাঙা টিনের ঘর ভেঙে দিয়ে এখন দালান তোলা হচ্ছে।

বাবা আগের মত প্রতাপ নিয়েই আছেন। বড়দাদা মারা যাওয়ার পর বড়দাদার নামে যত জমি বাবা কিনেছিলেন, নিজের এবং ভাইদের নামে সমান ভাগ করে দেবেন উদ্দেশ্য নিয়ে যখন গ্রামে গিয়েছেন, তাঁর সুযোগ্য ভ্রাতা রিয়াজউদ্দিন তাঁর সুযোগ্য পুত্র সিরাজউদ্দিনকে সঙ্গী করে বাবার মাথা মুলি বাঁশের আঘাতে ধরাতলে ফেলে ফের যদি গ্রামমুখো হন তবে জীবন নিয়ে আর ফিরতে হবে না হুমকি দিয়ে শহরের আপদকে শহরে বিদেয় করেন। বাবা বাড়ি ফিরে সাতদিন যত না শরীরের তার চেয়ে বেশি মনের অসুখে ভগু তে থাকেন। সারা জীবন আমি এ কি করলাম হায় হায় করেন, মা পাশে বসে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলেন, ওদের ভালর জন্যই তো করছেন, এখন আর পস্তাইয়া কি হইব! শরীর সারে বাবার, মনের হাহারবও দূর হয়। জমির নেশা ধাঁ করে ছুটে এসে আবার তাঁকে কামড়ে ধরে। নানির বাড়ির পাশে কড়ইতলা, তার সামনে বিশাল খোলা মাঠ, ছোটবেলায় যে মাঠে আমরা গোল্লাছুট ডাংগুলি চোর চোর ক্রিকেট ইত্যাদি রাজ্যির খেলা খেলতাম, যে পুকুরে পা ডুবিয়ে বসে থাকতাম, বস্তির মেয়েরা গোসল করত কাপড় ধুতো, মাঠের কিনারে বেড়ার যত ঘর ছিল সব কিনে নিয়ে ভেঙে চুরে বুজে সাফ করে পঁচিশটি বাড়ি বানিয়ে ভাড়া দিয়েছেন বাবা। দেয়াল তুলে দিয়েছেন রজব আলী কলোনির চারদিকে। দেয়াল তুলতে গিয়ে নানির বাড়ি থেকে বেরোবার রাস্তা গেছে বন্ধ হয়ে। নানি অনুযোগ করেন। কি গো নোমানের বাপ, রাস্তা যে বন্ধ কইরা দিলাইন! বাবা নানিকে কৈফিয়ত দেন না। কেবল আকুয়ায় জমি কিনে তাঁর আশ মেটে না। অবকাশের দেয়াল ঘেঁষা বাড়ির মালিক প্রফুল্ল ভট্টাচার্য মরে যাওয়ার পর যেদিন টপু করে তাঁর বউটিও মরে গেলেন, একটিই মেয়ে বোম্বে থাকে, সে মেয়ে মায়ের সৎকার করতে আসেনি, ঘর বাড়ি জিনিসপত্র জায়গাজমির দায়িত্ব নিতেও না, বাবা তক্কে তক্কে রইলেন প্রফুল্লর জমিটি সস্তায় কারও কাছ থেকে কিনতে পারেন কি না। বাবার তক্কে তক্কের মাথায় চাটি মেরে একদিন পরিমল সাহা প্রফুল্লর বাড়িতে বাস শুরু করলেন। প্রফুল্লর উত্তরাধিকারি জমি নিতে আসেনি, অনাত্মীয় প্রতিবেশি পরিমল সাহা প্রফুল্লর জায়গা দখল করে নিয়ে, বাবার বাউন্ডারি ওয়ালের গায়ে গা লাগিয়ে নতুন ঘর তোলার স্পর্ধা দেখিয়েছে। কেন তুলবে ঘর, বাবা পরিমলের বিরুদ্ধে মামলা ঠুকে দিলেন। মা বলেন, এ তো আর এমন না যে আপনের জায়গার উপরে ঘর তুলছে, আপনের কোনও ক্ষতি করছে! খামাকা মানুষের বিরুদ্ধে লাগেন কেন! বাবার কটমট করে তাকানো চোখের দিকে তিক্ততা ছুঁড়ে দেন,ছোটলোকের পয়সা হইলে মানুষরে আর মানুষ জ্ঞান করে না। মা ঠিক বলেননি, বাবা কিন্তু কিছু মানুষকে নিজের ভাইয়ের ছেলেদের লেখাপড়া করিয়ে মানুষ করেছেন। মেয়েদের বিয়ে দিয়েছেন। মেয়ে জামাইদের চাকরি যোগাড় করে দিয়েছেন। আমানউদদৌলা গফরগাওঁ এ চাকরি করতে গিয়ে বিয়ে করেছিলেন, গফরগাওঁ থেকে নেত্রকোনা বদলি হয়ে ওখানেও আরেকটি বিয়ে করেছেন। ভাইদের একাধিক বিয়েতে বাবার কোনও আপত্তি নেই। নেত্রকোনা থেকে ময়মনসিংহে এলে চেম্বারে গিয়ে বাবার সঙ্গে দেখা করতে আসেন আমানউদদৌলা, চাকরি বাকরি কেমন চলছে, টাকা পয়সা কেমন রোজগার হচ্ছে এসব বিষয়ে জিজ্ঞেস করেন বাবা, কখনও তাঁর বিয়ে নিয়ে প্রশ্ন করেন না। আমানউদদৌলার ছেলেমেয়েদের তিনি লেখাপড়া করার সমস্ত খরচ দিচ্ছেন। প্রতি মাসেই আমানউদদৌলার বড় বউ এসে ছেলেমেয়ের ইশকুল কলেজের বেতন, মাস্টারদের বেতন, বই খাতা কেনার টাকা, বাড়িভাড়া এমনকি খাওয়ার দাওয়ার জন্য মোটা অংকের টাকা নিয়ে যান বাবার কাছ থেকে। বংশ প্রতিপালনে বাবার কোনও না নেই। হাসিনাকে বিএডএমএড পাশ করিয়ে ইশকুলের শিক্ষিকা বানানোর জন্য বাবার অতি-আবেগ দেখে মা একদিন বলেছিলেন, ছেলের বউএর লাইগা এত যে করতাছেন, ইয়াসমিনের কলেজে যাওয়ার রিক্সাভাড়াডাও তো ঠিক মত দেন না! মানুষ তো নিজের মেয়ের জন্য করে, মেয়ে বাদ দিয়া ছেলের বউরে লইয়া পড়ছেন কেন?

বাবা ধমকে থামান মাকে, ছেলের বউ লেহাপড়া শিইখা নাম করলে কার লাভ? ইশকুল কলেজের মাস্টার হইলে কার লাভ? মাইনষে কি কইব হাসিনা মমতাজ অমুক ইশকুল বা অমুক কলেজে মাস্টারি করে? কইব ডাক্তার রজব আলীর ছেলের বউ মাস্টারি করে। ছেলের বউ আইছে আমার বংশে, মেয়ে ত যাইব গা পরের বংশে। মার গলায় ধিক্কারের সুর ওঠে, বংশ বংশ বংশ। বংশ ধুইয়া পানি খাইবাইন? আপনের মেয়ের আপনের প্রতি যে দরদ, সেই দরদ কি ছেলের বউএর কাছ থেইকা পাইবাইন? নিজের নামের কথা এত ভাবেন, নিজের বউরে যে কিছু দেন না, এই সব যদি মানুষে জানে, আপনের নাম কই যাইব?

মার প্যাঁচাল শোনার জন্য বাবা অপেক্ষা করেন না। তিনি চেম্বারে চলে যান রোগী দেখতে। তাঁর অনেক রোগী। আলাদা চেম্বার করার পর থেকে কিছু কিছু বাঁধা মেয়ে-রোগী নিয়ে চেম্বারের দরজা বন্ধ করতে শুরু করেছেন। মা একদিন বাবার পছন্দের গাজরের হালুয়া বানিয়ে বাটিতে করে নিয়ে গিয়েছিলেন চেম্বারে, বাবা যেন রোগি দেখার ফাঁকে হালুয়াটুকু খান। চেম্বারের বন্ধ দরজায় টোকা দিয়েছেন অনেকক্ষণ। টোকার পর টোকা। দরজা ভেতর থেকে বন্ধ। বাবা যখন টোকার জ্বালায় জ্বলতে জ্বলতে দরজা খুলেছেন, প্যাণ্টের বোতামও তখনও খোলাই ছিল তাঁর, লাগাতে ভুলে গিয়েছিলেন। ওয়াক থু বলে বেরিয়ে এসেছেন মা। মার ওয়াক থুতে বাবার কিছু যায় আসে না। তিনি বাজার না পাঠালে বাড়িতে সবাইকে উপোস থাকতে হবে, তিনি বাড়ি থেকে বের করে দিলে সবাইকে রাস্তায় পড়ে থাকতে হবে। তাঁর শক্তির কথা অস্বীকার করার কোনও উপায় নেই। মা প্রায়ই বলেন, মেট্রিকটা পাশ করলে একটা চাকরি করতে পারতাম। চাকরি করলে কবেই যে পারতাম এই বাড়ি থেইকা চইলা যাইতে! কোনও একটি চাকরি করতে পারলেই মা ভাবেন, মার আর পরোয়া করতে হতো না বাবাকে।

মা জ্বরে সাধারণত কাতর হন না, জ্বর নিয়েই সংসার ধর্ম পালন করেন, কিন্তু জ্বর মাকে একদিন এমনই কাবু করল তিনি বিছানা থেকে ওঠার শক্তি হারালেন। মার জন্য ভাল কোম্পানির এমক্সিসিলিন পাঠাতে বলেছি দাদাকে। এখন বাড়ির কারও ছোটখাট অসুখ বিসুখে আমিই চিকিৎসা করার উদ্যোগ নিই। আজ দিচ্ছি কাল দিচ্ছি বলে দাদা তিনদিন পর দশটি ক্যাপসুল এনে মাকে দেন খেতে। মা ঘড়ি দেখে আট ঘন্টা পর পর ওষধু খাচ্ছেন। সাতদিন পরও জ্বর সারছে না মার, জ্বর নিয়ে উদাস তাকিয়েছিলেন জানালায়। কপালে হাত দিয়ে দেখি গা পুড়ে যাচ্ছে। কপালে রাখা আমার হাতটি নিজের হাতে নিয়ে মা বললেন, কাছে বসো মা, তোমারে একটা গোপন কথা বলি। মা কখনও কোনও গোপন কথা বলার জন্য এত কোমল কণ্ঠে আমাকে পাশে বসতে বলেন না। গোপন কথা তো মার আছেই একটি, বাবার সঙ্গে রাজিয়া বেগমের সম্পর্কে সত্যিকার কি, তা নতুন করে আবিষ্কার করে শোনানো। গোপন কথা শোনার জন্য আমার ভেতরে কোনও কৌতূহলের অঙ্কুরোদগম হয় না। নিস্পৃহ দৃষ্টিটি ঘুরতে থাকে মার মুখে, বালিশে, চাদরে, জানালায়, রঙিন কাচে। মা খুব ধীরে ধীরে বলেন, তোমার বাবার অত্যাচারে একদিন ভাবলাম আমি যাইগা এই বাড়ি থেইকা। সত্যিই সত্যিই ভাবলাম। কিন্তু কই যাই, কার কাছে যাই! যাই কইলেই তো যাওয়া যায় না। এই যে মাঝে মাঝে রাগ কইরা কই জঙ্গলে চইলা যাবো, জঙ্গলে কি আর সত্যি সত্যি চইলা যাওয়া যায়! যায় না। মা থামেন, জানালার ওপারে বুকে মেঘ জমা আকাশটির নীল নীল কষ্টের দিকে তাকিয়ে বলেন, ছোটবেলায় আমার এক মাস্টার ছিল, বাসায় আইসা আরবি পড়াইত। মাস্টারটা আমারে খুব পছন্দ করত। কয়েক বছর আগে তার খোঁজ নিছিলাম কই আছে সে, কি অবস্থা। শুনলাম সে বিয়া করছিল, বউটা মইরা গেছে। সেই মাস্টাররে একটা চিঠি লিখলাম একদিন। সোজাসুজিই জিগাস করলাম , আমাকে বিয়া করতে সে রাজি আছে কি না। খুব উৎসাহ নিয়া সে আসল আমার সাথে দেখা করতে। পার্কে গিয়া দেখা করলাম। জানে যে আমার বিয়া হইছে এক ডাক্তারের সাথে। ডাক্তারের বিরাট নাম। বড় বাড়ি। আমারে প্রথম কথা জিগাইল, তোমার জমি জমা কিরম আছে? জমিজমা? আমি ত অবাক। জমির কথা জিগাস করে কেন? আমি যা সত্য তাই কইলাম। কইলাম আমার কোনো জমিজমা নাই, টাকা পয়সা নাই। শুইনা সে আর উৎসাহ দেখাইল না।

তার মানে তোমার জমিজমা থাকলে তোমারে বিয়া করত!

হ।

তুমি মুন্সি বেডারে বিয়া করতে চাইছিলা? নাক সিঁটকে বলি।

তোমার বাপের শয়তানি আর দেখতে ইচ্ছা করে না। তাই রাগ কইরা ওই লোকরে ডাকছিলাম। তোমার বাপরে দেখাইয়া দিতে চাইছিলাম, আমিও চইলা যাইতে পারি। পারলাম না।

তুমি গেলে গা আমাদের কি হইব চিন্তা করছ?

তোমাদের কথা ভাইবাই ত কোথাও যাওয়ার চিন্তা কইরাও পারি না। তোমরা বড় হইয়া গেছ। তারপরও যাইতে পারি না। তোমরা ঘর সংসার করবা, ছেলেমেয়ে হবে। মা গেছে গা আরেক বেডার সাথে এইডা তো ছেলেমেয়ের জন্য কলঙ্ক। বাপে সাত বেডি নিয়া থাকলেও কোনও কলঙ্ক হয় না।

মার মলিন মুখ টির দিকে তাকিয়ে থাকি। দীর্ঘশ্বাস ফেলে মা বলেন, আত্মহত্যা করলে গুনাহ হয় বইলা আইজও করি নাই। গুনাহ না হইলে কবেই করতাম!

মার মলিন মুখ থেকে চোখ সরিয়ে দিশি এমক্সিসিলিনের মলিন স্ট্রিপটি নাড়তে নাড়তে চোখ চলে যায় ওষুধের নামে, ওষধু তৈরির তারিখে, ওষধু বাতিল হওয়ার তারিখে। বাতিলের তারিখ তিন বছর সাত মাস আগের। দাদা কি ইচ্ছে করেই মাকে এই বাতিল ওষধু দিয়েছেন? আমার বিশ্বাস হয় না ইচ্ছে করে দিয়েছেন। মাকে বলি না যে এই ওষধু ওষুধ হিসেবে অনেক আগেই বাতিল হয়ে গেছে, এ দিয়ে জ্বর সারবে না। মাকে বলি না কিন্তু দাদাকে গিয়ে বলি, ডেট এক্সপায়ারড হইয়া গেছে ওষুধের! ভেবেছিলাম তিনি বলবেন যে তিনি দেখেননি বাতিলের তারিখ, এক্ষুনি তারিখ পার হয়নি এমন ওষধু পাঠিয়ে দিচ্ছেন। কিন্তু তাঁর নির্লিপ্ত মুখ এবং সে মুখে এক্সপাইরি ডেট পার হইলে কিচ্ছু হয় না, ওষধু ঠিক আছে, বাক্যটি শুনে আমি অনেকক্ষণ বাকশূন্য দাঁড়িয়ে থাকি। একটি হু হু হাওয়া এসে আমার ওপর আছড়ে পড়ে। আকাশের নীল নীল কষ্টগুলো বৃষ্টি হয়ে ঝরে আমাকে ভেজাতে থাকে, ভাবি, ভেজা গা মুছে মার বালিশের পাশ থেকে নষ্ট ওষধু টি নিয়ে গোপনে ফেলে দেব, নতুন ওষধু কিনে মার বালিশের কাছে ঠিক আগের ওষুধের মতই গোপনে রেখে দেব। মা সুস্থ হয়ে উঠবেন, কোনওদিন জানবেন না তাঁর জ্যেষ্ঠ পুত্রটি তাঁকে ঠকাতে চেয়েছিলেন। মার জীবনটির কথা ভাবার অবসর আমার কখনও হয়নি। ভাল ছাত্রী হওয়ার পরও মাকে জোর করে বিয়ে দেওয়া হয়েছে মার যখন দশ কি এগারো বছর বয়স। স্বামী সেই বিয়ের পর থেকে অন্য মহিলাদের সঙ্গে সম্পর্কে করে যাচ্ছেন। চারটে ছেলেমেয়ের ওপর ভরসা করে সংসারের ঘানি টেনে গেছেন মা। দুটো ছেলে বিয়ে করে পর হয়ে গেছে। নিজের নাতিকে লালন পালন করছেন, এর বিনিময়ে বছরে দুটো শাড়ি পান। বাচ্চা রাখার জন্য দাসি নিযুক্ত করা হলেও শাড়ি দেওয়া হয়। মা কোনও ব্যতিক্রম নন। মার আসলে অভাবে থেকে অভ্যেস হয়ে গেছে। কোনও শাড়ি গয়নার প্রয়োজন নেই মার। কোনও তেল সাবানের প্রয়োজন নেই। ডিম দধু কলারও প্রয়োজন নেই। মার প্রয়োজন সামান্য একটু ভালবাসা। সেটি পেতে চাতক পাখির মত বসে থাকেন। মার চোখের জলে লকলক করে বড় হচ্ছে একটি পদ্মফুল। দিন একদিন নিশ্চয়ই আসবে, কোনও মেয়ে মহিলা যেদিন আর ভিড়বে না, তখন নিশ্চয়ই স্থির হবেন বাবা। ষাট সত্তর পার হলে, আশি, নব্বই বছরে এসে হয়ত তিনি মার দিকে ফিরবেন। কিন্তু মা, মনে মনে বলি, জীবন ফুরিয়ে গেলে ভালবাসার মানুষকে নিজের করে পেয়ে কি লাভ? ও কি আর ভালবেসে ফেরা! ও নিতান্তই সব হারিয়ে সব ফুরিয়ে কেবল বাকল টুকু নিয়ে আর কিছু করার নেই বলে ফেরা।

মাকে বলি নার্গিসের ওপর গীতার অকথ্য নির্যাতনের কাহিনীটি। শুনে কোনও মন্তব্য করেন না তিনি। মার নৈঃশব্দ আমাকে ধীরে ধীরে মার পাশ থেকে উঠিয়ে অন্য ঘরে নিতে থাকে। পেছন থেকে তিনি বলেন, কামাল কি একলা আইছিল সেদিন? নাকি গীতারে ওর বাপের বাড়িত রাইখা সুহৃদরে দেখতে আইছিল?

জানি না। খেয়ালি উত্তর আমার।

নার্গিসরে বাসায় একলা রাইখা আসা উচিত হয় নাই।

মন্তব্যটি আমাকে থামায়। কেন উচিত হয়নি জিজ্ঞেস করি। মা বলেন, টুলুটা ভাল না। আমি সুহৃদরে নিয়া কয়দিন ছিলাম না কামালের বাসায়? টুলু ত রাইতে গিয়া নার্গিসরে ধরছিল। গীতারে অনেক কইছি নার্গিসরে আমার সাথে দিয়া দেও। দিল না।

মার এ কথা শোনার পর আমি বেরিয়ে একটি রিক্সা নিয়ে কৃষ্টপুর নার্গিসদের বাড়ি গিয়ে তার মাকে বলি যেন ঢাকা থেকে তার মেয়েকে নিয়ে আসে, দেরি না করে। সে তার মেয়েকে নিয়ে আসতে প্রস্তুত কিন্তু গাড়িভাড়া নেই। কোনওদিন ঢাকায় যায়নি না নার্গিসের বাবা, না মা। কথা দিই কাল আমি টাকা নিয়ে আসব। টাকা হলে বাসে চড়ে বা ট্রেনে চড়ে যেন চলে যায়, দেরি না করে। ঠিকানা লিখে দেব। ঢাকায় নেমে কোনও রিক্সাঅলাকে বললে একেবারে নয়াপল্টনে বাড়ির সামনে থামাবে। ফেরার পথে চোখ্যে ভাসাতে থাকি টাকা যোগাড় করার উপায় কি কি আছে সামনে। ভাবনার জালে ঢিল ছোঁড়ে চড়পাড়া মোড়ের একটি জটলা। জটলার মুখ গুলো চেনা। শেষ বষের্ আটকে থাকা সাত আটজন পুরোনো সহপাঠী দাঁড়িয়ে। উদ্বিগ্ন মুখ সবার। রিক্সা থামিয়ে কি হয়েছে, র‌্যাগডের উৎসব মনে হচ্ছে! বলতেই রতিশ দেবনাথ বলল, রিজওয়ান মারা গেছে।

আমাদের রিজওয়ান?

হ্যাঁ আমাদের রিজওয়ান।

মারা গেছে মানে?

পেথিডিন নিত। বেশি নেশা করতে গিয়া মাসল রিলাক্সেন্ট নিছিল। চরপাড়া হোটেলের একটা রুম ভাড়া নিয়া থাকত। সকালে হোটেলের মালিক দরজা ভাইঙ্গা ঘরে ঢুইখা দেখে এই অবস্থা। সিরিঞ্জ আর এম্পটি ভায়াল পইরা রইছে। বোঝে নাই যে আর্টিফিসিয়াল রেসপিরেশান না থাকলে মাসল প্যারালাইসিস হইয়া লাংগস কাজ করবে না। আরে ডায়াফ্রাম যদি মুভ না করে, লাংগসের ফাংশান তো হবে না!

বেচারা।

মৃত্যু এত সহজে ঘটে যায়। এই বেঁচে থাকছি, মুত্যুর ভাবনা ছিঁটে ফোঁটা নেই, হঠাৎ মৃত্যু এসে বলল, চল। সময় ব্যয় না করে বাড়ির দিকে যাই। কেউ সুখে মরে, কেউ দুঃখে মরে। সুখে যারা মরে, তাদেরই ভাল। জীবনের কোনও যন্ত্রণাই তাদের পাওয়া হয়নি। রিজওয়ানের হয়ত কোনও যন্ত্রণা পাওয়া হত না। ডাক্তার হয়েছে, তার ওপর আবার পুরুষ মানুষ। কেউ তাকে ঠকাবার ছিল না। কেউ তাকে ধর্ষণ করবারও ছিল না। রিজওয়ানের বাবার অঢেল টাকা, বাবা নিশ্চয়ই পুত্রের সুখের জন্য টাকা ব্যয় করতেও কোনওরকম দ্বিধা করতেন না। বাড়ি ফিরে আমি টাকার কথা ভাবি আবার। মার কাছে টাকা নেই। বাবার কাছে চাওয়ার প্রশ্ন আসে না। তিনি আমাকে পারলে বাড়ি থেকে ঘাড় ধরে বের করে দেন। দাদা তো বদলে গেছেন, তিনি আমার হাত পাতার দিকে বড় জোর থুতু ছিটোতে পারেন। ইয়াসমিনকে কথা দিয়ে যে চাকরির প্রথম বেতনের টাকা পেলে ওকে আমি নতুন একটি হারমোনিয়াম কিনে দেব, ওর হারমোনিয়ামটি নিয়ে যাই ছোটবাজারে সুর তরঙ্গ দোকানটিতে, যে দোকান থেকে এটি কিনে ছিলাম। পাঁচশ টাকায় কিনছি, বেচলে কত দিবেন? সুর তরঙ্গে খাটো ধুতি পরা গোল ফ্রেমের চশমা চোখের বুড়োটি বললেন, দেড়শ দিতে পারি। দরাদরি করে তিনশ টাকা পাওয়া গেল। সেই টাকা নিয়ে কালের জন্য দেরি করিনি আমি। সেদিনই কৃষ্টপুর গিয়ে নার্গিসের মার হাতে টাকা কটি দিয়ে আসি। বারবার করে বলে আসি যেন কাল ভোরেই চলে যায় তারা ঢাকায়, দেরি না করে। ঠিকানা লিখে দিয়ে আসি কাগজে। বাড়ি ফিরে এলে মা জিজ্ঞেস করেন, হারমোনিয়াম কই থইয়া আইছস?

আমি কোনও উত্তর দিই না।
 
রুদ্রর চিঠি পাওয়ার পর ঢাকা ছুটি। সকালে ইন্দিরা রোডের বাড়িতে পৌঁছে দেখি সে ঘরে নেই। ঘরে তার ঘ্রাণ আছে, সে নেই। একটু আগেই নাকি বেরিয়েছে। সারাদিন অপেক্ষায় বসে থাকি। রুদ্র ফেরে না। রাত হয়। ফেরে না। অপেক্ষায় রাত জেগে থাকি, যদি গভীর রাত্তিরে হলেও ফেরে,যদি শেষ রাতের দিকেও ফেরে। কোথাও হয়ত আড্ডায় বসে গেছে, কোথাও হয়ত রাজনীতি নিয়ে, সাহিত্য নিয়ে তুমুল জমে উঠেছে। দীর্ঘ দিন পর ঢাকায় এসে ঢাকার আড্ডা থেকে নিজেকে তুলে আনা কঠিন, এ বুঝি আমি। ভোরের আলো আমার গা স্পর্শ করে। চোখচুলচিবুক স্পর্শ করে। বুক থেকে কিরণ ছড়িয়ে যায় বাকি শরীরে। রুদ্রর স্পর্শ নেই। একা বিছানায় তার মাথার বালিশটিকে বুকে চেপে শুয়ে থাকি। সকাল চলে যায়। রুদ্র আসে দুপুরবেলা। ঘরে ঢুকেই আমাকে দেখে একটু চমকায় সে।

কখন এলে?

আজ নয়, কাল এসেছি।

কাল?

হ্যাঁ কাল।

রাতে বাড়ি ফেরোনি কেন? কোথায় ছিলে?

ছিলাম কোথাও।

কোথাওটি কোথায়?

ছিলাম।

কোথায়?

রুদ্র কোনও উত্তর না দিয়ে তোয়ালে আর লুঙ্গি নিয়ে গোসলখানায় ঢোকে। এত সময় নিয়ে গোসল করতে তাকে এর আগে দেখিনি। গোসল সেরে এসে সগু ন্ধি সাবানের ঘ্রাণ নিয়ে শরীরময়,বলে, খেয়েছো?

হ্যাঁ, খেয়েছি।

তাহলে বসো তুমি। আমি খেয়ে আসি।

রুদ্র খাবার টেবিলের দিকে চলে যায়। আমি বিছানায় শুয়ে ভাবি, কেন সে বলল না কোথায় ছিল! কেন শুধু ছিলাম শব্দের আড়ালে ঢেকে রাখল কোথায় ছিল! ভাবনা আমাকে কোথাও নিয়ে পৌঁছয় না। এত সময় নিয়ে খেতে রুদ্রকে এর আগে আমি দেখিনি। তার স্পর্শ পেতে আমার শরীরের প্রতিটি কণা উন্মুখ হয়ে আছে। ইচ্ছে করে খাবার টেবিলে তার পাশের চেয়ারে বসে দেখি কি করে খাচ্ছে সে। নিশ্চয়ই কাল রাতে খায়নি। তা না হলে আমাকে একটুও স্পর্শ না করে সে কেন এমন চলে গেল খেতে! অভিমান আর আশঙ্কা আমাকে জাপটে ধরে রাখে। রুদ্র খেয়ে ফিরলে পাশে বসতে বলি। তার হাতখানি হাতে নিয়ে বলি, তুমি মনে হয় এড়িয়ে যাচ্ছে! আমাকে।

নাহ। এড়িয়ে যাবো কেন?

কোথায় ছিলে কাল রাতে বললে না যে!

বললাম তো ছিলাম!

কোথায়? কোনও বন্ধুর বাড়ি?

না।

কোনও আড্ডায়?

না।

তবে?

রুদ্র চপু করে থাকে, তার মৌনতা ক্রমে অসহ্য হয়ে আমাকে মর্মন্তুদ বেদনায় মন্থর করে। শ্বাস-কষ্ট হতে থাকে। রুদ্র তুমি বলে ফেলো, বলে ফেললে আমার কষ্ট যাবে। কিন্তু সে কি যায়! সে তো আরও বাড়ে। রুদ্র বলে সে নারায়ণ গঞ্জ ছিল। নারায়ণ গঞ্জ কেন, কোনও বন্ধু থাকে ওখানে? না। কেন গিয়েছো তবে? কার সঙ্গে গিয়েছো? একা। কার কাছে? কারও কাছে নয়। কোথায় ছিলে রাতে? টানবাজারে। রুদ্রর ভাষাহীন দুটো চোখ আমার চোখে পড়ে থাকে। হৃদপিণ্ডের ধুকপুক শব্দ শুনি। নারায়ণগঞ্জের টানবাজার দেশের সবচেয়ে বড় পতিতালয়, রুদ্র কি আমাকে বলতে চায় সে গেছে টানবাজার পতিতালয়ে রাত কাটাতে! না রুদ্র তুমি আর যা কিছুই বল, এ কথাটি বোলো না। ওখানে সারারাত তুমি কোনও চায়ের দোকানে, মদের দোকানে অথবা রাস্তায় ফুটপাতে গাছের তলে সারারাত শুয়েছিলে, এরকম কিছু বল। আমার চোখে আকুতি। কিন্তু রুদ্র বলে, টানবাজারে সে রাত কাটিয়েছে এক পতিতার ঘরে। আমার চোখে আকুলতা, পতিতা তো মানুষই রুদ্র, তোমার মায়ের মত, বোনের মত। বল যে তোমার ক্ষিদে পেয়েছে বলে পতিতাটি তোমাকে খেতে দিয়েছে, এত ঘুম পাচ্ছিল নেশা করে যে তুমি খেয়েই ঘুমিয়ে পড়লে। বল যে সারারাত বেঘোরে ঘুমিয়ে তুমি উঠে এসেছো। বল যে স্পর্শ করনি অন্য কারও শরীর। সেই যে কথা দিয়েছিলে স্পর্শ করবে না, বল যে তুমি তোমার কথা রেখেছো। বল যে কেবল এ ঠোঁটেই তুমি কেবল চুমু খাও, অন্য ঠোঁটে নয়। বল অন্য কোনও শরীরের জন্য তুমি তৃষ্ণাতর্ হও না। রুদ্র আমার চোখের ভাষা পড়তে পারে না, পতিতার সঙ্গে তার যৌনসম্পর্কের কথা বলে । আমার দিকে এক জগত অন্ধকার ছুঁড়ে দিয়ে বলে যায়। আমি স্তব্ধ বসে থাকি। শ্বাসের জন্য কোনও হাওয়া পাই না। সাজানো ঘরটি দেখি, রুদ্রকে দেখি, আমার সংসার দেখি। ভেঙে যাওয়া বিশ্বাস অল্প অল্প করে জোড়া দিয়ে জীবন শুরু করেছিলাম আবার। হায় জীবন! যেন এ সংসার নয়, আস্ত একটি শ্মশান। শ্মশান জুড়ে মৃত মানুষের মত শুয়ে থাকি। আমি পুড়ছি, পুড়ে ছাই হচ্ছি। কিন্তু একটি শক্তি আমি হঠাৎই অর্জন করি নিজের ভেতর। সেই শক্তি আমাকে দাউ দাউ আগুন থেকে টেনে সরায়, আমার অস্তিত্বের অবশিষ্টটুকু বাঁচায়। পতিতার শরীর থেকে আনা রসগন্ধ ধুয়ে ফেলা রুদ্র লম্বা হয়ে শুয়ে পড়ে বিছানায়। দুপুরে খেয়ে খানিকক্ষণ ঘুমোয় সে, এ তার স্বভাব। ঘুমিয়ে উঠে বিকেলে বাইরে বেরোবে। রাতে পেট ভরে মদ খাবে। রাতে হাতের কাছে আমি থাকলে আমার শরীরে, তা না হলে অন্য যে কোনও নারী- শরীরে উপগত হবে। রুদ্রর প্রতিদিনকার জীবনে কোনও এক বিন্দু এদিক ওদিক হবে না। একরত্তি না। আমার জন্য তার স্বভাবের এতটুকু বদল হবে না। নিজেকে ধিক্কার দিই। সেই ফুলশয্যার রাতেই তো তাকে আমার ত্যাগ করা উচিত ছিল, কি দরকার ছিল এতগুলো বছর এই প্রেম বয়ে বেড়ানো! একবার যে মানুষ বিশ্বাস ভাঙে, সে সবসময়ই ভাঙে। ভাঙাই তার স্বভাব। ভাঙাই তার নেশা।

নিরুত্তাপ কণ্ঠে জিজ্ঞেস করি, তালাক দিতে হলে কি করতে হয়?

ভাঙা গলায় বলে রুদ্র, উকিলের কাছে যেতে হয়, কি কারণ সম্পর্কে ভাঙার, এসব বলতে হয়। নানান ঝামেলা। লক্ষ করি, আগের বারের মত আমি কাঁদছি না। এক ফোঁটা জল নেই চোখে। স্তব্ধতার ভেতর থেকে একটি পাথুরে কন্ঠ, উকিলের বাড়ি কোথায় বল, যাব আমি, আজই। কেবল আমি কেন, তুমিও চল। তুমিতো বেশ ভাল করেই জানো আমাদের এই সম্পর্কটির কোনও অর্থ নেই। সুতরাং এ আমার আর রাগ করে তোমাকে ত্যাগ করা নয়। চল দুজনই কাজটি করি। সম্পর্কটি ছিন্ন করি। আর বিশ্বাস কর, আমার একেবারেই মনে হচ্ছে না যে তুমি অন্য মেয়ের সঙ্গে শুয়েছো বলে আমাদের সম্পর্কে শেষ হওয়া উচিত। সম্পর্কটি শেষ হওয়া উচিত, তুমি আমাকে ভাল বাসো না বলে।

ভাল তোমাকে আমি বাসি। রুদ্র জোর দিয়ে বলে।

যে ভালবাসায় বিশ্বাস নেই!

বিশ্বাস আমি তোমাকে করি।

তুমি কর আমাকে। কিন্তু আমার বিশ্বাসের কথা ভেবেছো? আমার জায়গায় তুমি হলে কি করতে? বিশ্বাস না থাকলে কি ভালবাসা যায়!

শিল্পের মানুষদের একটু এরকম হয়ই। শিল্পের মানুষেরা সমাজের সব নিয়ম কানুন মেনে চলে না। তোমার তা বোঝা উচিত। আমি শিল্পের মানুষ জেনেই তো আমাকে বিয়ে করেছো। তবে আর এত প্রশ্ন করো কেন?

সমাজের নিয়ম কানুনের কথা হচ্ছে না। ব্যক্তিগত সম্পর্কের মধ্যে সবচেয়ে জরুরি যে জিনিস, সেই বিশ্বাসের কথা হচ্ছে।

আমি হেসে উঠি। হাসতে হাসতে বলি, শিল্পের মানুষ হলে সাত খুন মাপ তাই না! শিল্পের মানুষ বলে যা কিছু করার স্বাধীনতা তোমার আছে। শিল্পের মানুষ না হলে বুঝি নেই!আমিও তো কবিতা লিখি, তাই বলে আমিও তাই তাই করতে পারব যা তুমি কর? নাকি আমার সেই স্বাধীনতা নেই যেহেতু আমি ভাল কবিতা লিখি না? যেহেতু তুমি ভাল লেখো, তুমি পারো! নাকি তুমি পুরুষ হয়েছো বলে পারো। আমি মেয়ে বলে আমার সে স্বাধীনতা থাকতে নেই?

রুদ্র চপু করে থাকে। অনেকক্ষণ সে চেয়ে থাকে জানালায়, একটি উঁচু দেয়াল ছাড়া আর কিছু নেই সামনে। শাদা চুনকাম করা একটি দেয়াল শুধু আমি রুদ্রর চোখে চেয়ে থাকি। অনেককক্ষণ ওভাবেই দেয়ালে চেয়ে থেকে সে বলে, শেষবারের মত ক্ষমা করতে পারো না?

গতবারও তো শেষবার বলেছিলে? সত্যিকার শেষবার তোমার কোনওদিন হবে না। হবে।

সে আগেও বলেছিলে। আসলে কি জানো, এ তোমার স্বভাব। স্বভাব বদলানো এত সহজে সম্ভব নয়।

ঠিক আছে আমাকে আরও সময় দাও। আমি স্বভাব বদলাবো।

কেন বদলাবে? তুমি কি সত্যিই চাও বদলাতে? চাইলে তুমি সেই শুরু থেকেই পারতে বদলাতে। আর বদলানোর প্রয়োজনটাই বা কি? তুমি তো মনে করো না তোমার স্বভাবে কোনও ত্রুটি আছে।

রুদ্র বিছানা ছেড়ে উঠে যায় ঝাঁঝালো কণ্ঠে বলতে বলতে, তোমাকে তো কতবার বলেছি,আমার সঙ্গে থাকো সবসময়। বিয়ের পর থেকে কতদিন আমার সঙ্গে থেকেছো বল! তোমার দ্বিধা ভাঙতেই লেগেছে তিন বছর। এভাবে একজন পুরুষ পারে নাকি একা থাকতে?

আমি তো পেরেছি একা থাকতে।

মেয়েদের জন্য যা সম্ভব, পুরুষের জন্য তা সম্ভব নয়।

কেন সম্ভব নয়?

যে কারণই হোক, আমি পারিনি। ঢাকা ফিরে তোমাকে বাড়িতে না দেখে আমার খুব রাগ হয়েছিল। তাই বেরিয়ে গিয়ে মদ খেয়েছি। আর মদ খাওয়ার কারণেই ওই ঘটনা ঘটেছে।

মনে হচ্ছে রাগ হলেই তুমি মদ খাও! আর যেন খাও না? তুমি না রাগ হলে মদ খাও না? তুমি কি সুখে থাকলে মদ খাও না?

মদের কথা বাদ দাও। সম্পর্কের শুরু থেকে যে আমার সঙ্গে থাকোনি সেটার কি বলবে?

ভাল করেই জানো ময়মনসিংহে থাকতে হয়েছে মেডিকেলে লেখাপড়া করার জন্য। এখন তো ঢাকায় পাকাপাকি থাকার আমার কোনও অসুবিধে নেই। দৌড়োচ্ছে! তো তুমিই।

আমার সঙ্গে শুরু থেকেই থাকা উচিত ছিল তোমার।

তার মানে তুমি কি বলতে চাও আমার ডাক্তারি পড়া ছেড়ে তোমার সঙ্গে থাকা উচিত ছিল? তোমার সুবিধের জন্য। তাই তো? যেন তোমার কোনও স্খলন না হয়! আচ্ছা, আমার যখন চাকরি হবে, সে যে মোংলা বা মিঠেখালিতে হবে, তার তো কোনও কথা নেই। আমাকে চাকরি ছেড়ে দিয়ে, তুমি চিংড়ির ঘের দেখতে যাবে বা ধান বিক্রি করতে যাবে, তোমার সঙ্গে মোংলা মিঠেখালি যেতে হবে কারণ যদি তোমার শরীর উত্তেজিত হয় সেই উত্তেজনা মেটাতে যেন একটি মেয়েমানুষের শরীর তুমি হাতের কাছে পাও?

রুদ্র চপু করে থাকে। আমি বলি,যখন তোমাকে ছাড়া থাকি, আমার শরীরের তৃষ্ণা মেটাতে আমি তো অন্য কোনও পুরুষের কাছে যাই না। অন্য কোনও পুরুষের কোনও ভাবনাই তো আমার মাথায় উঁকি দেয় না। আমি তো পারি না, তুমি পারো কি করে! এর কারণ কি জানো? এর কারণ হল, আমি তোমাকে ভালবাসি বলেই অন্য পুরুষের কাছে যেতে পারি না। আর তুমি আমাকে ভালবাসো না বলেই পারো। খুব সহজ উত্তর।

সহজ উত্তরটি রুদ্র মানবে না জানি। সে বলবে সে আমাকে ভালবাসে। সে যে অন্য মেয়েদের সঙ্গে শুয়েছে, সে ভালবেসে নয়। রুদ্রর উত্তরও খুব সহজ। কিন্তু সহজ উত্তরটি না দিয়ে রুদ্র গম্ভীর গলায় বলে, আমি মুক্ত দাম্পত্যে বিশ্বাস করি। তোমাকে আগেই বলেছি। যে দাম্পত্যে কোনও বন্ধন নেই। যে দাম্পত্য আর সব দাম্পত্য জীবনের মত নয়। যে দাম্পত্য জীবনে আমার কোনও শ্বাসকষ্ট হবে না। আমার মনে হবে না আমি আটকা পড়েছি। যে দাম্পত্য কোনও খাঁচা হয়, বরং মুক্ত আকাশ।

রুদ্র তার লেখার টেবিলের চেয়ারে বসে বিছানায় পা তুলে দিয়ে বলে,—হ্যাঁ। তাই তো তোমাকে বলেছি। বলেছি যে কোনও আঁটসাঁট জামা আমাকে পরাতে চেও না।

তার মানে কি এই যে তুমি যে কোনও মেয়ের সঙ্গে শোয়ার স্বাধীনতা চাও!

তুমি সঙ্গে থাকলে আমি তো সে চাই না।

আমি সঙ্গে না থাকলে তুমি চাও?

চাই না। হয়ে যায়।

হয়ে যায় মানে?

হয়ে যায় মানে হয়ে যায়।

ধর আমারও যদি হয়ে যায়!

তার মানে? চকিতে ভুরু কুঁচকে ওঠে রুদ্রর। পা নেমে যায় বিছানা থেকে। বিছানায় তার মুখোমুখি বসে, কুঁচকে থাকা ভুরুর তলে তার সঙ্কুচিত হয়ে আসা চোখের মণিতে চেয়ে বলি, মানে হল, তুমি যখন আমার সঙ্গে না থাকো, তখন আমার যদি কোনও পুরুষের সঙ্গে শোয়া হয়ে যায়!

কি বললে?

বললাম, আমারও যদি কোনও পুরুষের সঙ্গে শোয়া হয়ে যায়, যখন তুমি আমার সঙ্গে না থাকো!

বাজে কথা বলো না। দাঁত চিবিয়ে ধমকে ওঠে রুদ্র, ধমকে দলা দলা ঘেন্না।

বাজে কথা তো নয়। তোমার যেটি করার অধিকার আছে, তা আমার থাকবে না কেন? নরম স্বর আমার।

অধিকারের কথা হচ্ছে না, কাল মাতাল ছিলাম। রুদ্রর স্বরও নরম।

এটা কোনও অজুহাত নয়। মদ খাওয়া তোমার নেশা। তুমি প্রতিরাতেই মাতাল হও।

না, হই না। প্রতিরাতে আমি মদ খাই না।

তবে কি বলতে চাও, যে, যে রাতে তুমি মদ খাবে, মাতাল হবে, সে রাতগুলোয় তোমার মেয়েমানুষ চাই যেমন করে হোক, আমি হলে আমি, না হলে অন্য কেউ!

রুদ্র একটি বই হাতে নিয়ে চোখ ফেলে রাখে বইয়ের পাতায়। যেন এ মুহূর্তে আমার সঙ্গে কথা বলার চেয়ে বইটি পড়া তার জরুরি। বইটি হাত থেকে কেড়ে নিয়ে বলি— আমার সঙ্গে কথা বল। আমার চোখের দিকে তাকিয়ে বল। বল তোমার কেমন লাগবে আমিও যদি অন্য পুরুষের সঙ্গে রাত কাটিয়ে ঘরে ফিরি? ধর আজ রাতে আমি ঘরে ফিরব না। অন্য কোনও পুরুষের সঙ্গে রাত কাটিয়ে কাল দুপুরে ফিরব।

রুদ্র চোখ ছোট করে তাকায় আমার দিকে, বইটি টেনে নিয়ে বলে—প্রতিশোধ নিতে চাও?

প্রতিশোধ নিতে চাচ্ছি না, জানতে চাইছি এর নাম কি মুক্ত দাম্পত্য নয? নাকি মুক্ত দাম্পত্য কেবল নিজের বেলায় চাচ্ছ, আমার বেলায় নয়!

আমি তো বলেছি যে ভুলটি কাল হয়েছে আমার, আর হবে না এমন।

কেন হবে না ভুলটি আর? কারণ আমি পছন্দ করি না বলে?

হ্যাঁ।

কিন্তু তুমি তো পছন্দ কর। তোমার তো কোনও অসুবিধে নেই একাধিক মেয়ের সঙ্গে সম্পর্কে করতে!

শরীরের সম্পর্কটিকে এত গুরুত্ব দিচ্ছ কেন? এতে তো মনের কোনও সম্পর্কে হচ্ছে না।

ঠিক আছে, আমারও মনের কোনও সম্পর্কে হবে না কারও সঙ্গে। কেবল শরীরের। মানবে?

অনেকক্ষণ ভাবে রুদ্র। এরপর মাথা নাড়ে। তা সে মেনে নেবে না।

আমি হেসে বলি, আসলে অন্য কোনও পুরুষের সঙ্গে সম্পর্কে করার কোনও ইচ্ছে আমার নেই। এ আমার রুচিতে বাঁধে। তুমি চাইলেও এ জিনিস আমার পক্ষে সম্ভব হবে না। কিন্তু তুমি যে বলতে, তুমি নাকি নারী পুরুষের সমতায় বিশ্বাস কর। তা-ই দেখলাম। দেখলাম কেমন বিশ্বাস কর। তুমি আসলে সমতার কথা বলো, বলা একধরণের ফ্যাশন কি না। শিল্পের মানুষ হলে তাই বলতে হয় কি না। অথবা খুব প্র−গ্রসিভ সাজতে হলে এসব না বললে চলে না কি না। তুমি সমতায় বিশ্বাস করো ভাবো, কারণ বউ নিয়ে শহর ঘুরে বেড়াও, বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দাও, বউকে ঘরবন্দি করোনি, বউকে ঘরের কাজকর্ম করার জন্য রাখোনি। তাই বোধহয় একধরনের পুলক অনুভব কর ভেবে যে তুমি খুব প্রগতির পক্ষের মানুষ। অবশ্য প্রগতির পক্ষের মানুষ হওয়া খুব সহজ কথা, সমতার কথা বলাও খুব সহজ। কিন্তু নিজের জীবনে চর্চা করতে গেলেই কঠিন। ঠিক না?

যৌথ সিদ্ধান্তে তালাক ঘটানোর কথা বলি, রুদ্র রাজি হয় না। সাফ সাফ বলে দেয় তালাকের জন্য উকিলের কাছে সে যাবে না। বারবারই সে বলে প্রথম তার অসুখ ধরা পড়ার পর যে প্রতিজ্ঞা করেছিল আর কোনওদিন সে অন্য মেয়েমানুষের কাছে যাবে না, তা সে রেখেছে, কেবল সেদিনই টানবাজারে হঠাৎ করে দুর্ঘটনাটি ঘটে গেছে। আমি যেন এবারের মত, এবং এটিই শেষবার, তাকে ক্ষমা করে দিই। আমি যেন তালাকের মত ভয়ঙ্কর বিষয়টির কথা একটওু না ভাবি আর। রুদ্রর কোনও বাক্যই আমাকে স্বস্তি দেয় না। আমার মনে হয় না রুদ্র কেবল সেদিনই গিয়েছে নতুন করে পতিতালয়ে। আমার মন বলে, রুদ্র সেই যে তার কিশোর বয়সে যাওয়া শুরু করেছিল, সে যাওয়া কখনো বন্ধ করেনি। আমাকে সংক্রামিত করার পর অনুতপ্ত অন্ধকার নামে কবিতাই লিখেছে শুধু সত্যিকার অনুতপ্ত হয়নি। শব্দ রচনা করা আর শব্দকে বিশ্বাস করা এক জিনিস নয়। অস্থিরতা আমাকে কামড়ে খেতে থাকে। এমন কোনও উকিলকে আমি চিনি না যাকে তালাকের কাগজ তৈরি করতে বলব। আমার অবশ্য যাওয়া হয় সেই উকিলের কাছে, যে উকিল আমাদের বিয়ের কাগজ তৈরি করেছিলেন, রুদ্রকে নিয়েই যাওয়া হয়, সে আরও দুদিন পর। বলেছিলাম তুমি যদি না যাও, তবে একাই যাবো আমি। যে করেই হোক যাবো। যদিও আমি কাগজের কোনও সম্পর্কে বিশ্বাস করি না, ভালবাসি বলেই তোমার কাছে এসেছিলাম, বিয়ের কাগজের কারণে নয়। তালাকের কাগজটিও একটি কাগজ যদিও, কিন্তু এ কাগজটি আমার শরীরকে তোমার দাবি থেকে মুক্ত করবে। অন্তত আইনত। উকিল অবাক দেখে যে আমরা এসেছি তালাকনামায় সই করতে। ঠা ঠা করে হেসে বললেন বাড়ি যান, ঝগড়াঝাটি মীমাংসা করে ফেলেন। আপনাদের মত চমৎকার জুটি আর আছে নাকি? হুইল চেয়ারে বসে থাকা পঙ্গু উকিল তাঁর স্ত্রীকে ডাকলেন, অপবূর্ সুন্দরী স্ত্রীটি এসে রুদ্রকে দেখে ট্রেতে করে চা বিস্কুট সেমাই সাজিয়ে নিয়ে এসে দিব্যি সাহিত্যের গল্পে বসে গেলেন। স্ত্রীটি সাহিত্যরস কেবল আস্বাদন করেন না, রীতিমত সাহিত্য রচনা করেন। নিজে একটি বই লিখছেন। রুদ্র আর আমি ঘন হয়ে পাশাপাশি বসে স্ত্রীটির প্রথম বই লেখার উত্তেজনা এবং আনন্দ দুটোই উপভোগ করি। কে বলবে যে আমি আর রুদ্র পরস্পরকে তালাক দিতে এসেছি! চা বিস্কুট খেয়ে, সাহিত্যের গল্প শেষ করে উঠে আসার আগে উকিলকে বলি, ঝগড়াঝাটি হয়নি আমাদের। মীমাংসা করার কিছু নেই। কিন্তু সম্পর্কটি চুকিয়ে ফেলা ভাল।

আরও কিছুদিন সময় নেন। ভাবেন। হুমজিক্যালি কিছু করবেন না।

আমার আর ভাবার কিছু নেই, ভেবেই এসেছি।

উকিল গম্ভীর হয়ে মাস গেলে পর আমাকে আবার যেতে বলেন, কি কারণে আমি তালাক দিতে চাই, তাঁকে সব জানাতে হবে, তিনি যদি মনে করেন, কারণগুলো তালাক ঘটানোর জন্য উপযোগী, তবেই তালাক হবে, নচেৎ নয়। মোটা অংকের একটি টাকার কথাও বললেন নিয়ে যেতে।



যদিও রুদ্র প্রায়ই বলে শরীর মেলাই চল, শরীরে বসত করে মন রূপ পাখি কিন্তু এবার জলজ্যান্ত আমাকে হাতের কাছে পেয়েও শরীর সম্পণূর্ মেলায় না সে। যদিও চুমু খায়, স্তনজোড়া দলে পিষে উতল নদীর −স্রাত নামায় শরীরে, আর আমি তীব্র তৃষ্ণায় খড়কুটো আঁকড়ে ধরার মত তাকে আঁকড়ে ধরি, তাকে আশ্রয় করি, যেন নিয়ে তীরে ভেড়ায় আমাকে, যেন বাঁচায়, সে নিষ্ঠুরের মত কেড়ে নেয় খড়কুটো, পাশ ফিরে শোয়। তার অঙ্গ শীতল নয়, অথচ পাশ ফিরে শোয়। তার প্রতি অঙ্গ লাগি কাঁদে আমার প্রতি অঙ্গ, তবু পাশ ফিরে শোয়। কেন? আমার জেগে থাকা শরীরের পাশে সে নিশ্চল পড়ে থাকে। সে কি ঘুমিয়ে থাকে? না সে ঘুমোয় না। বিচ্ছিত হব বলে এ কি তার অভিমান? না তাও নয়। তবে কি? এর পরের রাতে অন্য ঘরে ঘুমোতে যায় রুদ্র। আমি এপাশ ওপাশ করি, হাত পা ছুঁড়ি, শরীর জেগে ওঠে শুভ্র বিছানায়, শরীর ভিজতে থাকে কামে, ঘামে। রুদ্রর স্পর্শ গন্ধ আমার শরীরে বিষম জোয়ার আনে, আমি পারি না নিজেকে অবদমনের ডালাপালায় আবৃত করতে।

কেন দূরে দূরে থাকছো? তোমার কি ইচ্ছে করে না? কী হয়েছে তোমার?

কি হয়েছে সে ঘটনাটিও সে বলে মাঝরাতে। তার আবার অসুখ করেছে।

সে দেখায় তার শিশ্নের গোড়ার লাল গোটা। আমাকে সে কিছুতেই এবার সংক্রামিত করতে চায় না। তার বিশ্বাস সেদিন টানবাজার থেকেই অসুখ টি সে বয়ে এনেছে।

পুরুষাঙ্গটি আড়াল করে অসম্ভব শান্ত কণ্ঠে বলি, না তুমি টানবাজার থেকে আনোনি এটি। এত দ্রুত এই অসুখ ফুটে বেরোবে না। তুমি কি টানবাজারের আগে আর কোনও বাজারে যাওনি?

কি বলতে চাইছ?

কি বলতে চাইছি সেটা নিশ্চয়ই বুঝতে পারছ।

রুদ্রর বুঝতে না পারার কোনও কারণ নেই। অনেকক্ষণ বিমূঢ় বসে থেকে সে বলে আগে দএু কবার দুর্ঘটনা ঘটেছে হঠাৎ হঠাৎ।

কোথায়? বানিশান্তায়?

মাথা নাড়ে ধীরে। বানিশান্তায় ঘটেছে। বানিশান্তায় যে সে নিয়মিতই যায় সে ব্যাপারে আমি নিশ্চিত। ঢাকায় আমি যখন তার পাশে থাকি, পতিতালয়ে যাওয়ার প্রয়োজন সে বোধ করে না। কিন্তু ঢাকা ছেড়ে যখনই সে মোংলা বন্দরে যায়, বানিশান্তার লোভ সম্বরণ করা তার পক্ষে সম্ভব হয় না। রুদ্রর কাছে আমি একটি শরীর ছাড়া, এক খণ্ড মাংসপিণ্ড ছাড়া আর কিছু নই। নিজের ওপর ঘৃণা হয় আমার।

তুমি তো বলেছিলে সেই তিরাশির পর আর ঘটেনি কিছু কেবল সেদিন টানবাজারেই ঘটল!

দীর্ঘশ্বাস ফেলে রুদ্র। দীর্ঘশ্বাস আমিও ফেলি।

সেই পরিচয়ের শুরু থেকে আমাকে মিথ্যে বলে আসছ। ঘা না বেরোলে তো এবারও তুমি মুখোশের আড়ালেই থাকতে আর বলতে তুমি সম্পণূর্ আমার আছ, শুদ্ধ আছ। টানবাজারের ঘটনার কথাও লুকোতে।

রুদ্রর মুখ টি খুব করুণ দেখায়। কোনও পতিতাকে আমি কি ঘণৃা করি? নিজেকে প্রশ্ন করি, বারবার করি। উত্তর মেলে, না। রুদ্রকে কি ঘৃণা করি? না। করি না। বরং রুদ্রর জন্য মায়া হয় আমার। পরদিন তাকে শাহবাগে নিয়ে যাই পেনিসিলিন নিতে। সেই একই ওষুধের দোকানের একই কর্মচারি রুদ্রকে ভেতরের ঘরে নিয়ে টেবিলে উপুড় করে শুইয়ে নিতম্বে ইনজেকশনটি দেয়। সুঁইএর যন্ত্রণায় বেশিক্ষণ ভোগে না রুদ্র। দুজন আগের মত বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে, শাহবাগে, সাকুরায় বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিই দিয়ে রাত করে ঘরে ফিরি। পরদিন সকালে যখন আমি আমার কাপড় চোপড় সুটকেসে ভরছি, রুদ্র আকাশ থেকে পড়ে।

কি ব্যাপার কোথায় যাচ্ছে!?

ময়মনসিংহে।

ময়মনসিংহে কেন?

যাচ্ছি।

কবে ফিরবে?

জানি না।

জানো না কবে ফিরবে?

না।

কবে ফিরবে ঠিক করে বল।

হয়ত ফিরবই না।

তার মানে?

তার কি মানে, তা তাকে বুঝে নিতে বলি। বলি যে যাচ্ছি, চলে যাচ্ছি।

চলে যাচ্ছি মানে?

চলে যাচ্ছি মানে চলে যাচ্ছি। এক মাস পর উকিলের কাছে গিয়ে কাগজ সই করব।

তাহলে এসব করলে কেন? ইনজেকশন দেওয়ালে কেন?

সে তো তোমার জন্য। তোমার ভালর জন্য।

আমার ভালর জন্য যদি ভাবনা কর, তবে আমার সঙ্গে থাকো।

ভাবনা করলেই বুঝি থাকতে হয়!

কেন নয়?

দূরে থেকেও তো তোমার ভাল চাইতে পারি আমি। পারি না?

কি দরকার! দূরেই যদি থাকো, তবে আর আমার কিসে ভাল হবে তা নিয়ে ভাববে কেন!

হেসে বলি, তাতে কি? এত দীর্ঘদিনের সম্পর্ক, তোমার প্রতি আমার ভালবাসা হঠাৎ ফুরিয়ে গেছে না কি? সে তো আছেই।

তবে আর যাচ্ছে! কেন! চল নতুন করে শুরু করি সব।

নাহ।

নাহ কেন।

আমি একটা মেয়েমানুষের শরীর, আমি আর কিছু নই, তোমার এই ধারণাটি, তোমার এই বিশ্বাসটি আমি অস্বীকার করতে চাচ্ছি।

কে বলল এটা আমার বিশ্বাস?

নিজেকে জিজ্ঞেস কর। উত্তর পাবে।

সংসারের মায়া ত্যাগ করে পাকাপাকিভাবে ময়মনসিংহে ফেরার পথে একটি রাত কাটাতে থামি ছোটদার বাড়িতে। ছোটদার বিদেশ ভ্রমণের গল্প শুনে খেয়ে দেয়ে যেই না ঘুমিয়েছি, মুহুর্মুহু দরজা ধাক্কার শব্দে সবাই ঘুম ভেঙে জেগে উঠি মধ্যরাতে। জানালার পর্দা সরিয়ে দেখি রুদ্র দাঁড়িয়ে আছে। পাড় মাতাল।

কি হয়েছে, কি চাও?

রুদ্র চিৎকার করে, বেরিয়ে এসো।

কেন?

তুমি আমার বিয়ে করা বউ, আমি যা বলছি তাই তোমাকে শুনতে হবে, বেরিয়ে এসো, তা না হলে পুলিশ ডাকব। কোনও শুয়োরের বাচ্চাই আমাকে থামাতে পারবে না। চলে যাও। চিৎকার করো না।

আমি করবই চিৎকার। তুমি যতক্ষণ না বেরোচ্ছ, চিৎকার করব।

আমি বেরোবো না। চলে যাও তুমি।

কেন বেরোবে না? তোমাকে বেরোতেই হবে। আমি দরজা জানালা সব ভেঙে ফেলব বলে দিচ্ছি। এখনও বেরোও। বাড়ি চল। বেরোও বলছি।

রুদ্রর চিৎকারে পাড়া জাগে। দরজা ক্রমাগত লাথি মেরে ভাঙতে চাইছে সে।

ছোটদা আমাকে টেনে সরিয়ে আনেন জানালা থেকে। লজ্জায় আনত মুখটি বুকে চেপে আমাকে জড়িয়ে রাখেন দুবাহুতে, শুইয়ে দেন বিছানায়, পাশে শুয়ে চুলে হাত বুলিয়ে দিতে থাকেন, ছোটদার এই আদর পেয়ে আমার ভেতরের জমে থাকা কান্নাগুলো সমস্ত বাধা ফুঁড়ে বেরিয়ে আসে। চোখের জল মুছিয়ে দিতে দিতে তিনি রুদ্ধ স্বরে বলতে থাকেন, শক্ত হ, শক্ত হ। পরদিন সকালে গীতা নিজে গাড়ি চালিয়ে আমাকে দিয়ে আসে কমলাপুর ইশটিশনে। ঝকঝকে লাল রঙের এই টয়োটা করোলাটি গীতার জন্মদিনে উপহার দিয়েছেন ছোটদা।

আমি যে রুদ্রকে ত্যাগ করে এসেছি, অবকাশের কাউকে না বললেও বোঝে সবাই। সুটকেস থেকে আমার কাপড় চোপড় বের করে মা আলনায়, আলমারিতে গুছিয়ে রাখেন। বিছানায় নতুন চাদর বিছিয়ে দেন। এলোমেলো কাগজ সরিয়ে টেবিলটি সাজিয়ে দেন। ফুলদানিতে তাজা একটি গোলাপ এনে রাখেন। দুদিন পর চাকরির কাগজ আসে। নকলা উপজেলা স্বাস্থ্যকে−ন্দ্র মেডিকেল অফিসার মেডিসিন বিশেষজ্ঞ পদে আমার চাকরি। কাগজ পাওয়ার পরদিন বাবা আমাকে ট্রেনে করে জামালপুর নিয়ে যান। জামালপুর থেকে বাসে করে শেরপুর, ওখানে সিভিলসার্জনের আপিসে বসে চাকরিতে যোগদানের কাগজে সই করি। সাতদিনের মধ্যে আমাকে নকলার স্বাস্থকে−ন্দ্র কাজ শুরু করতে হবে। বাবাই আমাকে আর আমার সুটকেসটিকে ব্রহ্মপুত্র নদ পেরিয়ে শম্ভগু ঞ্জ, শম্ভগু ঞ্জ থেকে বাসে চড়ে ফুলপুর, ফুলপুর থেকে রিক্সায় করে নকলা স্বাস্থ্যকে−ন্দ্র দিয়ে আসেন। গ্রামের ভেতর ধান, পাট, কড়াইশুঁটির ক্ষেতের মধ্যিখানে একটি হাসপাতাল। হাসপাতালের কিনারে কয়েকটি শাদা দোতলা বাড়ি, ডাক্তারদের সরকারি আবাস। স্বাস্থ্যকে−ন্দ্রর বড় ডাক্তার আবদুল মান্নান। বউ ছেলেমেয়ে নিয়ে থাকেন সরকারি বাড়িতে। আবদুল মান্নান দাড়িঅলা লম্বা পাঞ্জাবি পরা পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়া ডাক্তার। তাঁর বাড়িতে আপাতত আমার থাকার ব্যবস্থা করা হল। বাবা হয়ত তাঁকেই ভেবেছেন সবচেয়ে বিশ্বাসযোগ্য। কিন্তু সারাদিন হাসপাতালে রোগী দেখে রাতে আমার আশ্রয়ে ফিরতেই আবদুল মান্নানের চোখ নেকড়ের চোখের মত জ্বলে, দেখি। তাঁর থাবা থেকে গা বাঁচাতে আমাকে বেশিদিন সন্ত্রস্ত থাকতে হয়নি, নকলা থেকে বদলি ঘটিয়ে আমাকে ময়মনসিংহ শহরে এনেছেন বাবা। শহরের সদর স্বাস্থ্য আপিসে কাজ বলতে কিছু নেই। আমি কাজ চাই। ব্যস্ততা চাই। কাচারির পাশে লাল দালানে অলস বসে থাকা ডাক্তার নূরুল হককে অনুরোধ করি তিনি যেন আমাকে পাঠিয়ে দেন এমন জায়গায় যেখানে প্রচুর কাজ, যেখানে সকালদুপুরবিকেলরাত কেবল কাজ। যেখানে এতটুকু শ্বাস ফেলার সময় আমি পাবো না।

আমি যখন শহরের সূর্যকান্ত হাসপাতালে বানের জলের সঙ্গে ভেসে আসা কলেরায় আক্রান্ত রোগীর চিকিৎসা করছি, রুদ্র মোংলায় বসে লিখছে

আর একবার তুমি বৃষ্টি দাও, দূরের আকাশ—
তরুণ শস্যের ক্ষেত জ্বলে যাচ্ছে করাল খরায়।
চাষাবাদে অনভিজ্ঞ কৃষকের নেই কোনও সেচ,
কেবল হৃদয় জুড়ে অকৃত্রিম শস্য-ভালবাসা।

একবার মেঘ দাও, ক্ষমা দাও বৃষ্টির ভাষায়,
জীবনের একমুঠো শস্য তুমি বিনাশ করো না।
আমাকে ফলতে দাও নৈরাজ্যের দুষিত দুপুরে,
হতে দাও শস্য ভার-অবনত সোনালি খামার।

ফিরে নাও বিরহের তপ্ত খরা, অনল দূরত্ব
মেঘ দাও, বৃষ্টি দাও জীবনের ব্যথিত শরীরে।
দহনে চৌচির হিয়া, ও আকাশ, মরমিয়া হাত
ছোঁয়াও মেঘের বুকে জল হয়ে ঝরুক আদোর।

লাঙলে হৃদয় চিরে বীজ বুনে ভালবাসা-ধান
একদিন অপেক্ষায় ছিল এক বিরান প্রান্তর,
তুমি তাকে মেঘ দিলে, বৃষ্টি দিলে, দিলে সম্ভাবনা,
ফসলের স্বপ্ন হল খরাজীণর্ অনাবাদি মাটি—

অনুতপ্ত অন্ধকার হল স্নিগ্ধ সকালের রোদ।
যে মাটি পুড়েছে দীর্ঘ সময়ের স্বপ্নহীন ক্লেদে,
প্লাবনের পরাজয় জমে জমে যে হয়েছে ভূমি—
দিয়েছিলে মেঘ তাকে, বৃষ্টি, জল, সকল আকাশ।

দিয়েছিলে সম্ভাবনা, দিয়েছিলে প্রথম প্রকাশ,
উড়বার স্বপ্ন শুধু দিয়েছিলে, দাও নাই ডানা।
সমস্ত জীবনটারে তুলে এনে দিয়েছিলে হাতে,
দাও নাই অতি তুচ্ছ নিভৃতের একান্ত ঠিকানা।

আমার যা ছিল, সব রুদ্রকেই দিয়েছিলাম আমি। অতি তুচ্ছ নিভৃতের ঠিকানাও। এ সম্ভবত তার সান্ত্বনা যে কিছু একটা তাকে দেওয়ার আমার অভাব ছিল, তাই এমন গোল পাকিয়ে গেছে সবকিছু কিছু একটা তাকে দিইনি বলেই সম্পর্কটির এই দশা আজ। অথচ কোনও গোপন কিছু ছিল না আমার। নিজের জন্য কিচ্ছু ছিল না। উকিলের কাগজে আমি সই করেছি, দাবি মত টাকাও দিয়ে এসেছি। এরপর আর খোঁজ নিইনি কি ঘটেছে। শুধু এটুকু জানি, রুদ্রর সঙ্গে জীবন যাপন সম্ভব নয় আমার, আবার এও জানি রুদ্রকে আমি ভালবাসি, রুদ্র ছাড়াও জীবন যাপন করা অসম্ভব। যে রকম হুট করে বিয়ের কাগজে সই করেছিলাম, তালাকের কাগজেও তেমন করে করেছি। স্বপ্নহীন ধূসর জীবন নিয়ে বসে থেকে থেকে নিজেকে বারবার বলছি, যে তোমাকে অপমান করেছে, তার কাছে আর যেও না মেয়ে, আর কষ্ট পেও না। তোমার প্রেমের এতটুকু মূল্য সে দেয়নি। কোনওদিনই সে দেবে না। মুক্ত দাম্পত্যে সে বিশ্বাস করে, যে দাম্পত্যে কোনও প্রতিশ্রুতি থাকে না। সে যে কোনও ঘাটের জল খাওয়া ছেলে, যে করেই হোক সুখের −স্রাতে গা ভাসাবে সে, পাড়ে কে একা দাঁড়িয়ে আছে তার অপেক্ষায়, ফিরে তাকাবে না। রুদ্রকে ত্যাগ করেছি, কিন্তু তার স্মৃতিগুলোই আমাকে দুবেলা গুছোতে হয়। রুদ্রকে ভুলে থাকতে চাই। কিন্তু নির্জন দুপুরে বাড়ির বারান্দায় বসে উঠোনের খাঁ খাঁ রোদ্দুরের দিকে তাকিয়ে থেকে থেকে যে মানুষের কথা ভাবি, না ভেবে পারি না, সে রুদ্র। বুক মুচড়ে একটি অসহ্য কষ্ট উঠে আসে চোখে। আমি প্রাণপণ চেষ্টা করি যেন রুদ্র নামক দুঃস্বপ্নটি, পেছনে ফেলে আসা আমার কালো অতীতটি আমাকে আর স্পর্শ করতে না পারে। আমি ব্যর্থ হতে থাকি। আমি বুঝি, খুব গোপনে গোপনে বুঝি, রুদ্রর জন্য ভালবাসা আমার আজও ফুরোয়নি। কিন্তু আমিই কি চাই এ ফুরোক!

ফিরে এসো নিশ্চয়তা, ফিরে এসো সর্বগ্রাসী প্রেম।
ব্যথিত স্রোতের তোড়ে ভেসে যাচ্ছি নিরুদ্দেশ খেয়া,
কোথাও বন্ধন নেই, স্নেহময় শীতলতা নেই,
কোথায় আশ্রয় নেই, ক্ষমা নেই, সুবিপুল ক্ষমা।

সারাদিন অন্ধকার চাষ করে ফিরে আসি ঘরে,
সারারাত বেদনার বীজ বুনি বুকের ভেতর—
তুমি তো আশ্রয় জানি, ফিরে আসবার স্নিগ্ধ নীড়,
মায়ের আঁচল তুমি—ফিরে এসো নিকষিত হেম।

আমাকে ভাঙছে ঋতু প্রকৃতি ও বিরুদ্ধ সময়,
মানুষের নৃশংসতা, ক্ষমাহীন চেতনার নোখ।
আমাকে ভাঙছে প্রেম, একই সাথে প্রেমহীনতাও—
না পেয়ে কেঁদেছি যত, পেয়ে বুঝি তারচে অধিক।

আমাকে জবাই করে নৈরাজ্যের নিরাকার চাকু
অস্থির অ−শ্বর ক্ষুর অবিশ্বাস আমাকে পোড়ায়।
সভয়ে গুটিয়ে রাখি বিশ্বাসের সুকোমল ডানা,
আশ্বিনের চাঁদ ওঠে, জেনে যায় অবিশ্বাসী নাম।

চারপাশে ফণা তোলে অন্ধ জল—ফিরে এসো তীর,
ফিরে এসো খড়কুটো, ভাসমান কাঠের শরীর।
পরিত্রাণ ফিরে এসো, তুলে নাও আমার সকল,
আমার ব্যর্থতা, পাপ, ভালবাসা, ঘণৃা ও আদোর।
রাতের সুতীব্র স্রোত হু হু করে টেনে নিয়ে যায়,
ফিরে এসো নিশ্চয়তা, ফিরে এসো রোদের সকাল।

কিন্তু কার কাছে ফিরব! সে তো আমাকে দুঃখ দেবে আরও। দুঃখ দেবে জেনেও যখন তাঁর শ্মশান কবিতাটি পড়ি, চোখে জল জমে। আমি ভেঙে পড়ি ভালবাসায়, বেদনায়।

বাড়াই তৃষ্ণার হাত, ফিরে আসে শূন্যতাকে ছুঁয়ে
তুমি নেই, নিষ্প্রদীপ মহড়ায় জ্বলে থাকে একা
পাথরের মত ঠাণ্ডা একজোড়া মানবিক চোখ,
তৃষ্ণাতর্ শরীর জুড়ে জেগে থাকে ব্যথিত রোদন।

নরম আলোর চাঁদ মরে যায় অঘ্রাণের রাতে,
বেঁচে থাকে ভালবাসা, নক্ষত্রের আলোকিত স্মৃতি।
তোমার শূন্যতা ঘিরে দীর্ঘশ্বাস, বেদনার ঘ্রাণ,
তোমার না থাকা জুড়ে জেগে থাকে সহস্র শ্মশান।

জীবন গুছিয়ে নিয়েছি ময়মনসিংহে। অবকাশে নিজের ঘরটি আবার নতুন করে গুছিয়েছি। ঘরের মেয়ে ঘরে ফিরে এসেছে। ঘরের মেয়ে তো ঘরেই ছিল, কেবল হঠাৎ হঠাৎ উধাও হয়ে যেত। সেই উধাও হওয়ার পাট চুকেছে। পুরোটাই কি চুকেছে! হঠাৎ একদিন এক মন-খারাপ-করা বিকেলে ঢাকায় এসো, আমি অপেক্ষা করছি তোমার জন্য, টেলিগ্রামটি পেয়ে উতল হাওয়ায় ভাসি, আমি যে রুদ্রর কেউ নই আর, সব সম্পর্ক যে চুকে বুকে গেছে, ভুলে গিয়ে, দুদিনের ছুটি নিয়ে ঢাকা ছুটি। দরজায় কড়া নাড়ি, রুদ্র দরজা খুলে দেয়। যেন জানতই আমি আসব। কথাহীন নিঃশব্দে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে থাকি দুজন। একটি উষ্ণ হাত আমাকে আলতো স্পর্শ করে। একটি স্পর্শই বিদ্যুৎ ছড়িয়ে দেয় সমস্ত শরীরে। আমাকে সে গাঢ় আলিঙ্গনে বেঁধে রাখে অনেকক্ষণ। কাঁদে। আমার কাঁধে, বুকে ফোঁটা ফোঁটা জল। কণ্ঠের নিচে কষ্ট জমে থাকে, কেঁদো না, এই ছোট্ট কথাটি জমা-কষ্টের তলে চাপা পড়ে। চোখের জল মুছিয়ে দিই তার। ঘরটি দেখি, সেই আগের মত সব, যেভাবে ছিল। দুচোখে সংসার দেখি আমার। রুদ্র আমার ঘাড়ে গলায়, আমার চিবুকে বুকে, ঠোঁটে, চোখের পাতায় চুমু খায়, সারা শরীরে আগের মত চুমু। দীর্ঘদিনের না-স্পর্শ শরীর রুদ্রর স্পর্শে তছনছ হয়ে যায়। যেন আগের মত জীবন আমাদের। যেন আগের মত আমরা যৌথজীবনের স্বপ্ন নিয়ে শরীর এবং হৃদয় বিনিময় করছি। পারিনি ভাবতে রুদ্র আমার কেউ নয়। মিলনে মিথুনে তৃপ্ত রুদ্র আমার চিবুক তুলে হেসে বলেছে, কি নিজেকে তো খুব শুদ্ধ মানুষ ভাবো তো! এবার? আমি তো তোমার পর পুরুষ, আমার সঙ্গে শুলে যে!

রুদ্রর দগুালে দুহাত রেখে হেসে উঠি। আঙুলের আদর দিয়ে সারা মুখে, বলি, তোমাকে ভালবাসি তাই।

ভালবাসো তাহলে চলে গেলেই বা কেন? আর চলেই যদি গেলে তাহলে এলেই বা কেন?

তুমি ডাকলে যে।

আমি ডাকলেই বা কি? আমার সঙ্গে তো তুমি কোনও সম্পর্কে রাখোনি।

আমি তো এখনও নিজের সঙ্গে যুদ্ধ করছি।

যুদ্ধ কেন?

নিজেকে যেন ভালবাসতে পারি। অন্যকে ভালবাসতে ভালবাসতে এই হয়েছে যে নিজেকেও যে ভালবাসা উচিত, সেটি ভুলে গিয়েছিলাম।

আমার বুকে মাথা রেখে ছোট্ট শিশুর মত শুয়ে থাকে রুদ্র। চুলে আঙুল বুলিয়ে দিই। বলে, চল উকিলের কাছে আবার। তালাকের কাগজটি তিনি যেন তৈরি না করেন।

আমি ম্লান হাসি।

সে রাতে কেঁপে জ্বর আসে আমার। পরদিনও জ্বর হু হু করে কেবলই বাড়ে। দুপুরবেলা আমার ওই জ্বর-শরীরের পাশ থেকে রুদ্র উঠে যায় কারও পায়ের আওয়াজ পেয়ে। কে যেন দরজায় কড়া নাড়ে, কে নাড়ে, কে জানে! পাশের ঘরে অতিথির সঙ্গে কথা বলছে রুদ্র। একটু জলের জন্য কাতরাই, রুদ্র নেই। ঘন্টা দুই পর সে ফেরে, খানিকক্ষণের জন্য।

কে এসেছে?

নেলি।

সেই নেলি! রুদ্রর নেলিখালা।

রুদ্র আর নেলির টুকরো টুকরো কথা, হাসি, অট্টহাসি, ফিসফিস, খিলখিল ভেসে আসে শোবার ঘরে। আমি সব নিয়ে জ্বরে ভুগি। মনে হতে থাকে রুদ্র আজও নেলিকে ভালবাসে। কিছু কিছু ভালবাসা আছে, সম্পর্ক শেষ হয়ে গেলেও, থেকে যায়। জ্বর আমাকে যত না কাপাঁয়, তার চেয়ে বেশি কাপাঁয় নিঃসঙ্গতা। আরও ঘন্টা দুই গেলে রুদ্র যখন নেলিকে বিদেয় দিয়ে ফিরে আসে শোবার ঘরে, আমি জ্বর-কণ্ঠে জড়-কণ্ঠে জিজ্ঞেস করি, নেলি কি করে জানল এ বাড়ির ঠিকানা?

আগে এসেছে।

প্রায়ই আসে বুঝি।

প্রায়ই না। মাঝে মাঝে।

ও।

আমার কি সামান্য ঈর্ষা হয়! হয়। প্রলাপের মত শোনায় যখন বলতে থাকি যে কোনও দূরত্বে গেলে তুমি আর আমার থাকো না, তুমি হও যার তার খেলুড়ে পুরুষ। যার তার পুরুষকে আমি আমার বলি না।

প্রলাপের মত শোনায় যখন বলতে থাকি, ফুলশয্যা কাকে বলে আমি জানি। কাকে বলে সারারাত জেগে থাকা বন্দরের ভয়ানক রাত। আমি জানি, আমার হাড় মাংস জানে, জানে বন্দরের সব কটি সাম্পান মাঝি, জানে কা−র্গার শ্রমিক, ভোরের লঞ্চ জানে, তুমিও কি কিছু কম জানো? ভালবাসা কতটুকু সর্বনাশা হলে সাঁতার না জানা দেহ রূপসার জলে ভেসে ফের ফিরে আসে। দিগন্তের ওইপার থেকে ফের, চতুর্দোলায় দুলে, দ্বিধার আগুনে পুড়ে ফের, নর্দমায় পড়ে থাকা মাতালের অপুষ্ট বাহুতে মুখ রেখে আরেকবার কেঁদে উঠতে ফের ফিরে আসে, বানিশান্তা থেকে তুলে আনা পুঁজ রক্ত চুমুকে চুমুকে নিতে ফিরে আসে ভিনদেশি বেভুল বালিকা। তুমি মদে চুর, তুমি ঘুমে ঘোর, তবু তুমি কিছু কম জানো না, তোমাকে ভেলায় তুলে আমি বেহুলা হয়েছি কতবার কত ক্লান্ত যমুনায়।



যেদিন জ্বর সারে, দুজন বাইরে বেরোই। সেই আগের মত বেরোই। বিশ্ববিদ্যালয়ের মাঠে কিছু তরুণ কবির সভা বসেছে। সভায় আমাদেরও অংশ নেওয়ার কথা। বসে যাই ঘাসে, সেই আগের মত ঘাসে। এরশাদের এশীয় কবিতা উৎসবের আয়োজনের প্রতিবাদে পাল্টা একটি কবিতা উৎসব তৈরি করার জন্য সভাটি। কিছু তরুণ কবি, আমি, রুদ্র জাতীয় কবিতা পরিষদের প্রথম সভার উপস্থিত সদস্য হিসেবে কাগজে সই করি। এসবে রুদ্র অত্যন্ত উৎসাহী। বহুদিন থেকে স্বৈরাচারি সরকারের বিরুদ্ধে কবিতা লিখছে, এবার একটি মোক্ষম অস ্ত্র তার হাতে, এক উৎসব দিয়ে আরেক উৎসব ঠেকানো। গুটিকয় হাতে গোনা সরকারি আর ইসলামপন্থী কবি এরশাদের দলে ভিড়েছে, বাকি সব জাতীয় কবিতা উৎসবে। এরশাদ ওই গুটিকয় নিয়েই নিজের কবিতা উৎসবের নাম দিয়েছেন এশীয় কবিতা উৎসব। এশীয়র আয়োজন বন্ধ ঘরে, জাতীয় খোলা রাস্তায়। এশীয় ঢুকে যায় কুয়োয়, জাতীয় সাঁতার কাটে সমুদ্রে।



জাতীয় কবিতা উৎসব নিয়ে রুদ্রর উৎসাহ যখন চরমে, এদিক ওদিক ছুটোছুটির করতে চায় সে, পারে না। ছুটোছুটি তো দূরের কথা, হাঁটতে গেলে পায়ে ব্যথা হয়, আগে দশ গজ হাঁটলে হত, এখন চার গজেই হয়। দিন দিন কমে আসছে দূরত্ব। রুদ্র তবু দমে যায় না, থেমে থেমে হলেও হাঁটে। ডান পায়ের বুড়ো আঙুলটির রং বদল হচ্ছে, কালচে হয়ে আসছে, ঠাণ্ডা হয়ে আসছে কালচের ত্বক। যেন আঙুল নয়, গাছের শেকড় এটি। রোগটি নিশ্চিত বারজারস ডিজিজ। আঙুলে গ্যাংগ্রিন হয়ে গেলে পা কেটে ফেলা ছাড়া আর উপায় নেই। আশংকায় নীল হয়ে থাকি। সিগারেট বন্ধ কর। তোমার রক্ত চলাচলে ব্যাঘাত ঘটছে। এ হচ্ছে একধরনের পেরিফেরাল ভাসকুলার ডিজিজ। তোমার ইন্টারমিটেন্ট ক্লডিকেশন হচ্ছে। এ তোমার কাফ মাসলে হচ্ছে, ফুটে হচ্ছে। এরপর পা রেস্টে থাকলেও ব্যথা হবে। রুদ্র বিশ্বাস করে না সিগারেটের জন্য এসব হতে পারে। কত লোক তো সিগারেট খায়, তাদের হয় না! সবার হয় না, কারও কারও হয়। আমার উপদেশ বাজে কবিতার কাগজ ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে উড়িয়ে দেওয়ার মত সে উড়িয়ে দেয়। বড় ডাক্তারের উপদেশ মেনে চলবে আশায় শান্তিনগর মোড়ে বি এন মেডিকেল হলে ডাক্তার প্রজেশ কুমার রায়ের কাছে রুদ্রকে নিয়ে যাই। যে কথাটি তাকে বারবার বলেছি, ডাক্তার প্রজেশও তাই বলেন, সিগারেট ছাড়তে হবে। তা না হলে পা কেটে ফেলা ছাড়া উপায় থাকবে না। ডাক্তার কিছু ওষধু ও লিখে দেন। যতদিন ঢাকায় থাকি, রুদ্রকে নিয়মিত ওষধু খাওয়াই, গামলার গরম জলে তার পা দুটো ডুবিয়ে রাখি যেন রক্তনালী সামান্য হলেও প্রসারিত হয়। রুদ্রর ঠোঁট থেকে সিগারেট কেড়ে নিয়ে ফেলে দিই। ভীষণ রাগ করে সে। আমাকে ঠেলে সরিয়ে প্রতি সন্ধেয় সে মদ খেতে চলে যায়, টাকা বেশি থাকলে সাকুরায়, কম থাকলে মেথরপট্টিতে। রাস্তায় সুন্দরী মেয়ে দেখলে রিক্সায় বসে এক চোখ টিপে শিস বাজায়, খাসা মাল বলে চেঁচিয়ে ওঠে, হি হি করে হাসে। আমার সঙ্গে তালাক হয়ে গেছে, আমি আর কোনও বাধা নই রুদ্রর এসব কাজে। অবশ্য ছিলামই বা কবে! ময়মনসিংহে ফেরত যাওয়ার আগে বার বার বলি নিয়মিত ওষধু খেতে, ডাক্তারের উপদেশ মেনে চলতে, বলি, জীবনের চেয়ে মূল্যবান অন্য কিছু নয়। রুদ্রর প্রেমিকা বা স্ত্রী মনে হয় না নিজেকে, বরং মনে হয় একজন বন্ধু একজন শুভাকাঙ্খি, একজন ডাক্তার।



রুদ্র মদ সিগারেট গাঁজা চরস আর মেয়েমানুষের নেশায় আগের মতই বুঁদ হয়ে থাকে। আমার তো ছিল রুদ্রর নেশাই, সেটি কাটাতে আমি প্রাণপণ চেষ্টা করতে থাকি। ওদিকে রুদ্র টলতে টলতে বলছে

তুমি আমার জীবন্ত ক্রাচ, তোমাকে চাই।
যেদিকে যাই, যেদিকে ফিরি,
স্মৃতি কিংবা ভবিষ্যতে,
আমার এখন তোমাকে চাই।

নাহ, কারও জীবন্ত ক্রাচ হওয়ার জন্য জীবন আমার নয়। নিজের জীবনকে অন্যের ক্রাচ হওয়ার জন্য বিসর্জন আমি দিতে পারি না। রুদ্রর জন্য মায়া হয় আমার, কিন্তু তার চেয়ে বেশি মায়া হয় নিজের জন্য।
 

Users who are viewing this thread

Back
Top