১১.
মা, শেফালিকে অবকাশে রেখে চলে গেছে, আমিও ওকে রেখে এসেছি অবকাশে। শেফালির সৎমার সংসারে আপন বলতে একটি মাত্র ভাই, সে ভাইও জানি না কী অপরাধ করে এখন জেলখানায়। শেফালি তার বেতনের টাকা জমিয়ে ভাইকে দিয়ে আসতো দুতিন মাস পর পর। একদিন ভাইটি বেরোবে জেল থেকে, বিয়েথা করে সংসার শুরু করবে, শেফালির এই একটিই স্বপ্ন। তার আর কোনও স্বপ্নের কথা আমি জানি না। বয়স আঠারো বা উনিশ, ছিলো বোধহয় কোনও স্বপ্ন, তুমি সম্ভবত জানো। এক শেফালি ছাড়া আর কেউ তোমার ওপর নির্ভর ছিলো না, তুমি ওকে একা রেখে চলে যাওয়ার পর বাবার দেখাশোনা করার দায়িত্ব শেফালি নিজেই নিলো। সে কাজটা বাড়তি কাজ, বাড়ির সবার জন্য সারাদিনের খাটাখাটনির পর বাবার ঘরটা গুছিয়ে রাখবে, বাবাকে খাবার দেবে। শেফালিকে প্রায়ই ফোন করে খুব আদর করে বলি, যেন বাবাকে দেখে রাখে, বাবার যেন কিছুতে খুব মন খারাপ না হয়। সেই হাসিখুশি শেফালি, ছুটে ছুটে বাড়ির সব কাজ একাই সেরে ফেলা শেফালি, হঠাৎ শুনি, মারা গেছে। সকালে কাপড় কাঁচতে গিয়ে কলের পাইপে হাত দিতেই ইলেকট্রিক শক লেগে ঠায় দাঁড়িয়ে রইলো। চিৎকার করেছিলো, সে চিৎকারে বাড়ির লোক দৌড়ে গিয়েছে বটে কাছে, কিন্তু ওকে বাঁচাবার চেষ্টা করতে কেউ সাহস পায়নি। মা, যে মেয়েটা তোমার কাছে কাছে থাকতো অনেক বছর, তুমি মারা গেলে সবচেয়ে বেশি কেঁদেছে যে মেয়ে, যে মেয়ে বাড়ির সবার আরামের জন্য দিন রাত পরিশ্রম করেছে, তাকে ইচ্ছে করলেই বাঁচানো যেত, কিন্তু সবাই দূর থেকে দাঁড়িয়ে দেখেছে ওর মরে যাওয়া। শেফালির ভাই মোটা অংকের একটা টাকা দাবি করেছিলো, নাহলে মামলা করবে বলেছিলো। দাদা নানা রকম আয়োজন করেছে টাকা না দিয়ে মীমাংসা করার। অথবা যদি দিতেই হয় টাকা, দাদার মাথায় শুধু যত কম দিয়ে পার পাওয়া যায় সেই ভাবনা। আমি টাকার পরিমাণ দাদাকে বারবার বলি বাড়াতে। কিন্তু আমার বলায় কী যায় আসে বলো! ওদের সবার কাছে আমি তোমার মতোই মৃত। আমার কণ্ঠস্বরকে ওরা কণ্ঠস্বর বলে মনে করে না। কণ্ঠস্বরের ওপারে যে জলজ্যান্ত একটা মানুষ আমি, তা তাদের আচরণে কোনওদিন প্রকাশ পায়নি। টাকা জিনিসটা চারদিকের সবার কাছে অত্যন্ত প্রিয়। শেফালির চলে যাওয়া সবচেয়ে বেশি ভুগিয়েছে বাবাকে। তুমি নেই, আমি নেই, ইয়াসমিন নেই, শেফালি নেই। বাবাকে নিঃস্বার্থভাবে ভালোবাসার আর কেউ তখন সংসারে নেই। দাদা আর হাসিনার ইচ্ছের মুঠোয় বাবাকে বন্দি হতে হল।
বাবা কেমন আছে, কী করছে খোঁজ নিতে প্রায়ই ফোন করি। বাবা বলে বটে যে ভালো আছে, কিন্তু বাবার কণ্ঠস্বরে আমি টের পাই বাবা ভালো নেই। বাবা কোনওদিনই তার অসুখের কথা কাউকে জানায় না। একদিন দাদা খুব সহজ শান্ত গলায় বললো বাবার কিডনি নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। শুনে আমার বুকের ভেতর থেকে ঠাণ্ডা একটা, জানি না কী নাম তার, মুহূর্তে সারা শরীরে ছড়িয়ে গেল। কিডনি কবে থেকে নষ্ট হচ্ছে? দাদার বক্তব্য আমার নাকি জানার কথা সব। সেই যে বাবা কলকাতায় এসেছিলো, তখনই নাকি কলকাতার ডাক্তাররা বলেছিলো কিডনি নষ্ট হচ্ছে। এসবের কিছুই জানি না আমি। কোনও ডাক্তার আমাকে বাবার কিডনি নষ্ট হওয়ার কথা কিছু বলেনি। ঘরে বাইরে সারাদিন অস্থির পায়চারি করলাম। ভেতরে বুদবুদের মতো দেশে ফেরার ব্যাকুলতা। বাবার এই দুঃসময়ে যদি পাশে না থাকতে পারি, তবে বেঁচে থাকার কী অর্থ! আশংকায় আমি কুঁকড়ে থাকি। অন্ধকারে নিজেকে মুড়ে একাপড়ে থাকি ঘরের কোনও কোণে। ফোন বাজলে বুকের ধুকপুক এমন বাড়ে যে মনে হয় দৌড়ে পালাই। একদিন অভিমানের গায়ে পাথর চাপা দিয়ে ইয়াসমিনকেই কাতর অনুনয় করি, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব যেন সে দেশে যায়। ইয়াসমিনেরও নিজের সমস্যার অন্ত নেই। বলতেও পারতো সে যাবে না, কিন্তু তোমার মৃত্যু তার স্নায়ুর ঘরবাড়িতে ভূকম্পন তুলে জানিয়ে গেছে মৃত্যু জিনিসটা ঠিক কী। কারও মৃত্যু না হলে আমরা বোধহয় দেখতে পাই না মৃত্যুর সত্যিকার চেহারা। ইয়াসমিন তড়িঘড়ি বাবার জন্য খাবার দাবার কাপড় চোপড় আর নানারকম উপহার কিনে রওনা হলো দেশে।
দাদার অভিযোগ শুরু হয়েছে বাবার নাকি হরেকরকম বান্ধবী আছে। বান্ধবীরা বাবার সঙ্গে দেখা করতে বাড়িতে ঢুকতে চায়। ওদের অর্ধচন্দ্র দিয়ে বাড়ি থেকে প্রতিদিনই বিদেয় করে দাদা। বিদেয় করার ঘটনা দাদা বেশ বীরত্বের সঙ্গে বর্ণনা করে। তার বীরত্ব আমাকে মোটেও পুলকিত করে না। দাদাকে বলি যা ইচ্ছে হয় বাবার, তাই যেন তাকে করতে দেওয়া হয়। বান্ধবীদের সঙ্গে বাড়িতে বসে বাবা কথা বলতে চাইলে বলবে। শুতে চাইলে শোবে। বাবার চরিত্র সংশোধনের গুরুদায়িত্ব দাদাকে নিতে বারবার বারণ করি। জীবন একটিই, এই জীবনটি যেমন ইচ্ছে যাপন করার অধিকার আরসবারমতো বাবারও আছে। সারা জীবন স্বাধীনতা ভোগ করে আসা মানুষকে অসুখের দোহাই দিয়ে টেনে হিঁচড়ে একটি বন্ধ ঘরে ঢুকিয়ে বন্দি করা হলে কেমন অস্থির হয় তার ভেতর বাহির, তা বাবা না হয়েও আমি অনুভব করি। বাবার মন ভেঙে যাচ্ছে, শরীর ভেঙে যাওয়ার চেয়েও তা অনেক বেশি ক্ষতিকর। শরীর যখন যাবার, যাবে। মনকে মরতে দিতে নেই। তুমি নেই মা, এখন আর বাবাকে তার বান্ধবীদের কাছ থেকে জোর করে দূরে সরিয়ে কার কী ভালো দাদা করছে! তুমি থাকাকালীন যে কাজটা কেউ কোনওদিন করেনি, তুমি না-থাকাকালীন কেন? বাবাকে এরকমও আর আশ্বাস দেওয়া হচ্ছেনা যে সে তার হারিয়ে যাওয়া জগৎটি ফিরে পাবে একদিন। অবকাশের অন্দরে বন্দি করে বাবার মতো কাজপাগল মানুষকে বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে, মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করা ছাড়া বাবার আর কাজ কিছু নেই। কী ভয়ংকর নিষ্ঠুর এই আচরণ। বাবার চেম্বারে চিরতরে তালা লাগিয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা দাদার একার। ধীরে ধীরে বাবাকে নিজের মুঠোয় নিয়ে দাদা কী খেলা খেলছিলো কে জানে! কারও কথায় বাবা উঠছে বসছে, দৃশ্যটি বড় অচেনা ঠেকে। কী করে জানিনা দাদার হাতের ক্রীড়নক হয়ে পড়েছিল বাবার মতো ভয়ংকর একগুঁয়ে মানুষ! সম্ভবত কিডনি নষ্ট হওয়ার খবর বাবাকে বদলে দিয়েছিলো আগাগোড়া। মনে আছে, অবকাশের একটি ঘরে মৃত্যুর সঙ্গে রোজ যুদ্ধ করে চলেছো, বাবা বাড়ির বাইরে যেতে চাইলে আমি কালো ফটকে তালা দিয়ে রাখতাম, চাইতাম বাবা বাড়ি থাকুক। দিন দিন তুমি যুদ্ধে হেরে যাচ্ছো, মৃত্যু তোমার শরীর জুড়ে উলঙ্গ নৃত্য করছে, আমি চাইনি বাবা এ সময় বাড়ি ছেড়ে অন্য কোথাও যাক। কিন্তু বাবার ওপর জোর চালিয়ে শেষ পর্যন্ত আমি জিততে পারিনি। যে করেই হোক বেরিয়ে গেছে বাবা। কেঁদে কেটে, অনশন করে, অভিমান করে, রাগ করে, চিৎকার করে হলেও বেরিয়েছে। তুমি মরে যাচ্ছে, তাতে কী, বাবা তো বেঁচে আছে, বেঁচে থাকতে হলে সবার আগে তাকে তার জগতে ফিরতে হবে। সেই জগৎ আমাদের সবার জগৎ থেকে আলাদা। সেখানে রোগী আছে, রোগিণী আছে। রোগ শোক চিকিৎসা বন্ধু বান্ধব আড্ডা গল্পগুজব চানাচুর বাদাম ইত্যাদি আছে। বহুঁকাল ধরে গড়ে তোলা বাবার নিজস্ব এই জগৎ। কোনও কিছুই তাকে সেই জগৎ থেকে সরাতে পারে না। তোমার মৃত্যুও নয়। সেই জগৎটি বাবার কাছ থেকে হঠাৎ কেড়ে নেওয়া হল। অনেককাল আগে বাবা আমাকে বলেছিলো তার মৃত্যু যেন হয় ওই চেম্বারের ওই চেয়ারে বসে, রোগীর প্রেসক্রিপশান লিখতে লিখতে, হঠাৎ। যে বাবা কোনওদিন একটি মুহূর্তের জন্য অবসরে বিশ্বাস করতো না, তার কেন ভালো লাগবে ভয়াবহ অবসর! বাবা যতটা অসুস্থ ছিল, তার চেয়ে বেশি অসুস্থ হতে লাগলো। অস্থিরতা চরমে উঠে সর্বনাশ করতে লাগলো তার। জীবনে প্রথম তাকে ভোগ করতে হচ্ছে বন্দিত্ব, প্রথম তাকে বুঝতে হচ্ছে যে তার ইচ্ছের কোনও মূল্য নেই আর। পুরুষদের সঙ্গে দেখা করার অধিকার বাবার আছে, মহিলাদের সঙ্গে নেই। এই নেইটা দাদার আদেশ। প্রথম প্রথম উপদেশ দিতো হয়তো, সেই উপদেশ ধীরে ধীরে আদেশে পরিণত হয়েছে। বাবার শারীরিক বা মানসিক অবস্থার কথা ভাবার কারও সময় নেই তখন! দাদা আর ছোটদা অলক্ষ্যে হয়তো বাবাকে মৃত্যুর জন্য তৈরি করেছিলো। ইচ্ছে করে ছুটে যাই, বাবাকে বাবার মতো করে তার শেষ কটা দিন বাঁচতে দিই। কিন্তু বন্দি তো বাবার চেয়েও বেশি আমি। বাবার মন প্রফুল্ল থাকে, আনন্দময় থাকে, এমন পরিবেশই বাবাকে দেওয়া হোক, এক এক করে ভাইদের, আত্মীয়দের সবাইকেই বলি। কিন্তু দূরের মানুষের দীর্ঘশ্বাস বা উপদেশ কিছুই কেউ গ্রাহ্য করে না। খুব ভালো করে বুঝি যে বাবা আর আগের বাবা নেই। কণ্ঠে অবসাদ। আশার আঙিনাগুলো আশংকায় আচ্ছাদিত। দাদা আগে বাবার কানে কানে কথা বলতো, মামা খালাদের বিরুদ্ধে যা নয় তা বলে কান ভারি করতে বাবার। কানাকানি দাদা এখন বাবার সঙ্গে করে না, যদি করে, করে ছোটদার সঙ্গে। কী করে বাবাকে শেকলে বাঁধা যায় এ নিয়ে জল্পনা। বাবা নাকি কথা শোনে না, বাইরে বেরিয়ে যায়। বাবাকে হয়তো শেকল দিয়ে বাঁধারই বন্দোবস্ত হচ্ছিল। বেঁধেছিল কি না জানি না, তবে ঘরে ঢুকিয়ে বাইরে থেকে যে শেকল দিয়েছিল তা জানি। কেন, খুব নাকিপাগলামি করে বাড়ি থেকে বাইরে বেরোনোর জন্য? যদি বাইরে বেরিয়ে আবার ওই মহিলাদের বাড়ি চলে যায়! দুএকজন মহিলা নিয়ে দাদার তখন মাথা খারাপ হবার যোগাড়। কেন, মহিলারা বাবার বান্ধবী। এ বাবার ব্যক্তিগত ব্যাপার। তুমি যখন হা হুতাশ করে মরতে, বাবার বান্ধবী বা স্ত্রী নিয়ে তুমি যখন বছরের পর বছর কেঁদে বুক ভাসাচ্ছো, কই দাদা তো মোটেও বাবার বান্ধবী-নেশা ঘোচানোর কোনও চেষ্টা করেনি। এখন হঠাৎ কেন? কারণ তুমি কি অনুমান করতে পারছে না মা? দাদার একটিই কেবল দুশ্চিন্তা। ওই মহিলাদের কাউকে আবার বিয়ে টিয়ে করে বসেনি তো কখনও। তাহলে তো বাবার বিরাট সম্পত্তির কোনও অংশ ওদের কারও হাতে চলে যাবে।
তোমার অবর্তমানে শুনেছিলাম কোন এক বিধবা ভদ্রমহিলার সঙ্গে নাকি বাবার বিয়ে জাতীয় কিছুকরিয়ে নেওয়া হয়েছিল, বৈধভাবে তারা মেলামেশা করতে পারবে এরকম কিছু। অবকাশে দাদারাই এটি ঘটার ব্যবস্থা করেছিলো। ভদ্রমহিলা নাকি অবকাশে প্রায়ই যেত, বাবাও যেতে তার বাড়িতে। যার সঙ্গে বাবা ঢাকায় বসে ফোনে কথা বলেছিলো, শুনে তুমি কেঁদেছিলে, তার সঙ্গেই এই ঘটনা। মেলামেশা করার আর কোনও রকম আইন আছে কিনা বিয়ে ছাড়া, আমার জানা নেই। তবে মুসলমানের আইন তো, পুরুষের বহুগামিতার সুযোগ সুবিধে বিস্তর। আমি তো দূরের মানুষ, দেশে আর কোনও দিন ফিরতে না পারা মানুষ। আমাকে খুব বেশি কিছু। জানানোও হয় না। নিজে ফোন করে বার বার জিজ্ঞেস করে করে যদি কিছু জানি তো জানি।
বাবা যা কিছুই করুক, তোমার অসুস্থতার সময় বাবার ওপর আমার যত রাগছিল, তুমি না থাকার পর কী করে যেন সব জল হয়ে গেল। তাকেই আঁকড়ে ধরে তোমার শূন্যতাকে আড়াল করতে চাইতাম মনে মনে। আমার সব মনে মনেই ছিল মা। তোমার সঙ্গে তোমার জীবনের বেশির ভাগ সময়ই বাবা অন্যায় ছাড়া আর কোনও আচরণ করেনি জানি মা। কিন্তু তারপরও বাবাকে আমি শ্রদ্ধা না করে পারি না। তুমিও তো চাওনি বাবার সঙ্গে কোনও অশোভন আচরণ করি। চিরকাল ভয়ে সিঁটিয়ে থেকেছি। বাবা আমাদের পেটাতো, ভয় দেখাতো। কিন্তু ভালোও তো বাসতো। তার ভালোবাসা কখনও অন্য বাবাদের ভালোবাসার মতো ছিল না। বাবারশাসনে জানি না ছেলেমেয়েরা কতটুকু মানুষ হয়েছে। দাদা তো চিরকালই বাবার ওপর নির্ভর করেই জীবন কাটালো। ছোটদাও অনেকটা। বাবার স্বপ্নপূরণ এক আমিই করেছিলাম। হুট করে ঢাকা মেডিকেল কলেজের চাকরি ছেড়ে দেওয়ায় বাবা মাথায় হাত দিয়ে বসেছিলো। কিন্তু আমার সিদ্ধান্ত আমার সিদ্ধান্ত। আমি সম্ভবত বাবার মতো হয়েছিলাম। আমার মনোবলটা বাবার কাছ থেকে পাওয়া। ঝড় ঝঞ্জার সামনে ঋজু দাঁড়িয়ে থাকা বাবা। ভয় না পাওয়া, রুখে ওঠা, প্রতিবাদ করা বাবা। স্বনির্ভর হওয়া, মাথা উঁচু করে বাঁচা, বাবা। অহংকার, আত্মবিশ্বাস, বাবা। আর তুমি হচ্ছ আমার ভেতরে যে অবিশ্বাস্যরকম যে এক নরম হৃদয় আছে, মানুষের জন্য কাঁদা, কেঁদে বুক ভাসানো, সেটা বিলিয়ে দেওয়া, ভালোবেসে অকাতরে দান করা, তুমি। মাঝে মাঝে তীব্র হতাশায় যখন ডুবে থাকি, মনে হতে থাকে পৃথিবীতে কেউ বুঝি আমাকে ভালোবাসে না, আমি একা, একটি বিন্দুর মতো আমি একা, মনে হতে থাকে কী দরকার এই বেঁচে থাকার–সেটা তুমি। ছেলেমেয়েদের আর কারও মধ্যে এত তীব্র ভাবে তোমাদের দুজনের উপস্থিত নেই। ইয়াসমিন একটা সময় দুর্বিনীত দুরন্ত মেয়ে ছিল। কিন্তু ধীরে ধীরে বয়স বাড়ার পর বাবার সব গুণ চলে গিয়ে তুমি এসে উপস্থিত হয়েছে ওর মধ্যে। ঠিক তোমার মতোই অশান্তির সংসার ও করে যাচ্ছে। প্রায়ই স্বামীকে ত্যাগ করার কথা বলে, কিন্তু সন্তানের জন্য পারে না। আত্মবিশ্বাসের এক ফোঁটা কিছু নেই। নিজেকে কুৎসিত বলে মনে করছে, যদিও কুৎসিত নয়। তোমার আত্মবিশ্বাস ছিল, কিন্তু তোমার উপায় ছিল না। ইয়াসমিনের উপায় থাকলেও মনের জোর নেই। আসলে তোমার গুণগুলো ওর মধ্যে গিয়ে দোষে পরিণত হয়েছে। গুণএর মাত্রা অতিরিক্ত হলে সেটা আর গুণ থাকে না। ধরো মানুষের জন্য জীবন দেওয়ার গুণ যদি আমার ভেতরে আরও বেশি মাত্রায় থাকে, আমাকে হয়তো আত্মহত্যা করতে হবে। আর, বাবার গুণই ধরো, শক্তি সাহস, সংকল্প, দৃঢ়তা ঋজুতা ইত্যাদি অতিরিক্ত হলে জানি না কী করবো, হয়তো মৌলবাদীর সশস্ত্র মিছিলের সামনে বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়ে বলবো, সাবধান এক পা এগোবি না। দাদা আর ছোটদার মধ্যে আমি তোমাকে দেখি না। বাবার মেয়েমানুষের দোষ দ্বিগুণ বা ত্রিগুণ হয়ে ছোটদাকে ধরেছে। একসঙ্গে বেশ কটি সুন্দরীর সঙ্গে গোপন সম্পর্ক রাখতে সে পারদর্শী। বাবার সেদিক থেকে কপাল ভালো ছিল না। বিবাহিতা, অসুখী, অসুন্দরী, নিগুণ, এমনই দুএকটি ছিল হয়তো কপালে, কেউই কিন্তু তোমার চেয়ে দেখতে ভালো, তোমার চেয়ে বুদ্ধিমতী বা কম বয়সি ছিলো না, অন্তত যে দুজনের কথা শুনেছি। দাদার মাথা থেকে পা পর্যন্ত বাবার একটি গুণই দোষের মতো দেখা দেয়। বাবার মিতব্যয়িতা দাদার ভেতরে প্রবল পরিমাণে ঢুকে কৃপণতার আকার ধারণ করেছে। বাকিগুণ বা দোষ অত প্রকাশিত নয়। কৃপণতা অবশ্য তার বউ ছেলেদের ক্ষেত্রে তত নেই, যতটা বাকি পৃথিবীর জন্য।
মা, মাঝে মাঝে মনে হয় বহুগামিতা মানুষ নামক প্রজাতির স্বাভাবিক প্রবৃত্তি। আমরা সমাজের বিধি নিষেধ নিজেদের ভেতর ধারণ করে আমাদের স্বভাবজাত বহুগামিতাকে শরীরের না হলেও মনের শক্তি দিয়ে রোধ করি। ভালোবাসা নামক একটি দেয়াল এসে আমাদের সামনে অনড় দাঁড়ায়। সেই দেয়াল ডিঙিয়ে আমরা তথাকথিত পরনারী বাপরপুরুষের কাছে যেতে পারি না। বাবা যদি বহুগামিনা হতো, তোমরা দুজনেই খুব সুখী হতে পারতে। হঠাৎহঠাৎ যখন বাবার সঙ্গে তোমার ঘনিষ্ঠতা হতো, দুজনকেই কী প্রফুল্ল দেখতাম। ওরকম যদি সবসময় থাকতে পারতে। জানি তোমার উদ্যোগে কোনও কাজ হত না। বাবা যদি এগিয়ে আসতো, তবেই সম্ভব হত সম্পর্ক মধুর করা। তুমি তো একপায়ে সারাজীবন খাড়াই ছিলে বাবার সামান্য ভালোবাসা পেতে। তোমার অসুখ ধরা পড়ার পর বাবা যে বাধ্য স্বামীর মতো তোমাকে আদরযত্ন করতে শুরু করলো, নিজের বাড়িঘর, রোগী দেখা, বান্ধবী, সব ফেলে সব ভুলে–জানি না ওর পেছনে কী কাজ করেছিলো? অপরাধবোধ! মনে হয়। দুজনই তোমার অসুস্থতার সময় সবচেয়ে বেশি নিঃস্বার্থভাবে সেবা করেছে, সে বাবা আর আমি। বাবার আর আমার আরও গুরুত্বপূর্ণ মিল বোধহয় এটাও।
বাবাকে কোনওদিন কি বোঝাতে পেরেছি ভালোবাসি? তোমার জীবনের শেষ কটা দিন তোমার পাশে থেকে না হয় মিথ্যে হোক সত্যি হোক, বুঝিয়েছি ভালোবাসি। বাবার সেবা করা আমার পক্ষে সম্ভব হয়নি মা। সুইডেনের বাংলাদেশ দূতাবাসে গিয়ে আমার পাসপোর্টের মেয়াদ বাড়ানোর জন্য আবেদন করলাম, শেখ হাসিনার কাছে চিঠিও লিখলাম যেন আমাকে কিছুদিনের জন্য অনুমতি দেন দেশে ফেরার। জানিয়েছি, বাবা ভীষণ অসুস্থ, তাকে না দেখলেই নয় আমার। তারপরও কোনও উত্তর নেই। রাষ্ট্রদূত নিজে বেশ কয়েকবার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ে চিঠি পাঠালেন এর গুরুত্ব বুঝিয়ে, সেসবেরও কোনও উত্তর নেই। উত্তর নেই ঠিক বলবো না, উত্তর হচ্ছে, না। অথচ দেখ, উঠতে বসতে শেখ হাসিনা কী কান্নাই না কাঁদছেন তাঁর নিজের বাবার জন্য! অথচ আমার বাবাকে দেখতে যেতে দিতে তাঁর আপত্তি। ওদিকে বাবা আমাকে যে কথা আগে কখনও বলেনি, বলছে যেন দেশে ফেরার চেষ্টা করি। বুঝি আমাকে দেখার জন্য বাবা ব্যাকুল হচ্ছে। ভয় নাপাওয়া বাবাও, বুঝি যে ভেঙেপড়েছে। আমারআর্তনাদ, আমারআকুলতা কিছুই বাংলাদেশ সরকারকে স্পর্শ করে না। বাবা তার মেয়েকে ডাক্তার বানালো, বাবার অসুস্থতার পাশে সবাই আছে, শুধু তার ডাক্তার মেয়েটি নেই। ডাক্তারির কিছুই না জানা দুই পুত্রধন বাবার পাশে আছে, যারা অনেকটা বাবার চিকিৎসকের ভূমিকা নিয়েছে। বিশেষ করে দাদা। দাদা নিজেকে প্রায়শ ডাক্তার বলে মনে করে। নিজের ডাক্তারি পড়া হয়নি, ওষুধ কোম্পানিতে চাকরি করেছে, গ্রামে গঞ্জে ওষুধ নিয়ে গেছে, গ্রামের অশিক্ষিত লোকেরা দাদাকে ডাক্তার বলে ডেকেছে। তারপর চাকরি ছেড়ে বাবার ফার্মেসিতে বসেছে, ওষুধ নিয়ে কারবার বলে বাজারের মাছওলা, তরকারিওলা ভাবতো ডাক্তারের ছেলে বুঝি ডাক্তারই হয়েছে। তারাও দাদাকে ডাক্তার ঠাওরাতো। ও কারণেও দাদারও ধারণা হয়েছে দাদা বুঝি ডাক্তারই। এখন বাবার অসুখের চিকিৎসা দাদা নিজ দায়িত্বে নিজের হাতে তুলে নিয়েছে। দাদাই সিদ্ধান্ত নেয় বাবাকে কখন হাসপাতালে যেতে হবে, বা ডাক্তার দেখাতে হবে। বাবা, কী কারণে জানিনা নিজের কোনও অসুখের জন্য বড় কোনও ডাক্তার দেখাতো না। নিজের চিকিৎসা নিজেই করতো। জানতে চিকিৎসা, কিন্তু কখনও কখনও তো অভিজ্ঞ ডাক্তারের কাছে যেতে হয়। শহরে নতুন নতুন বিলেত ফেরত ডাক্তার এসেছে। অনেকে বাবার ছাত্র। ডাক্তারি বিদ্যায় বাবার জ্ঞান এমন ছিল যে বিলেত ফেরত এফ আর সি। এস পাশ করা ডাক্তারের হাতে রোগী মরতে বসলে বাবার কাছে এসে বাঁচতো। বাবাকে অনেক বলতাম বড় ডাক্তার দেখাতে, কখনও রাজি হত না। কলকাতার ডাক্তার যে ওষুধ দিয়েছিলো সেগুলো কখন কোনটা খেতে হবে, বড় কাগজে লিখে দিয়েছিলাম, যেন ভুলে না যায় বাবা, প্রয়োজনে যেন ঘরের দেয়ালে টাঙিয়ে রাখে। দেশে ফিরে বাবা ওই কাগজও ফেলে দিয়েছে, ডাক্তারের দেওয়া ওষুধও খায়নি। নিজের যা পছন্দ তাই খেয়েছে। খেয়ে তো দিব্যি ভালো ছিল মা। হৃদপিণ্ডের কোনও অসুখে তাকে ভুগতে হয়নি। রক্তচাপ নিজের মতো করে ওষুধ খেয়ে কমিয়ে রেখেছে। গোলটা বাধলো ডায়বেটিস নিয়ে। ওটাও ঠিক থাকতো যদি খাবারটা বাবার ঠিক থাকতো। বাড়িতে সবার জন্য যে খাবার রান্না হয়েছে সেগুলোই তো বাবাকে খেতে হয়েছে। কোনওদিন মদ সিগারেট খায়নি। শাক সবজি খেতো। স্বাস্থ্যকর বা পুষ্টিকর খাবার বাড়িতে আনতো। যখন দাদা বা সিনা দায়িত্ব নিয়ে নিল বাড়ির সব ব্যাপারের, সংসার খরচের টাকা পয়সাও তখন তাদের হাতে, তারাই সিদ্ধান্ত নেয় কী তারা খাবে। বাজার থেকে মাছমাংস অঢেল আসে। দই মিষ্টি আসে। বাবার খাবারের জন্য কিছু আসার চল ছিল না। ক্ষিধে পেলে বাবা হয়তো’সামনে যা পেতো খেয়ে নিতো। কলকাতায় যখন এসেছিলো, বাবাকে শর্করামুক্ত খাবার খাওয়ানোর দিকে খেয়াল করিনি। বাবার ডায়বেটিস ধরা পড়ার পর, তুমি যতদিন অবকাশে ছিলে, শাক সবজিই বেশি খাওয়াতে। তুমি বাবার খাবারটা ঠিকঠাক দিতে, তুমি না থাকলে দেওয়ার কেউ নেই। বাবার সবকিছু ওলোট পালোট হয়ে গেলো। চেম্বার নেই। রোগী দেখা নেই। বাড়িতে যখন বসেছিলো, বাড়িতে দুটো তিনটে রোগী আসতো। কিন্তু বাড়ি তো আর চেম্বার নয়, এতকালের চেম্বারের স্বাধীনতা বাবা বাড়িতে পেতো না, সেই আনন্দও আর ছিল না। কারও ওপর নির্ভরশীল বাবা কোনওকালেই ছিল না। নিজের অসুখ নিয়ে অন্যের মাথাব্যথাও কোনওদিন সইতে পারতো না।
একসময় শুনি বাবাকে ঢাকায় নিয়ে আসা হয়েছে। কী করে এলো বাবা? না, যে গাড়ি বাবার জন্য কেনা হয়েছিল, সেটায় নয়, বাসে করে। আমার দেওয়া সেই গাড়ি হাসিনার এদিক ওদিক ঘোরার কাজে লাগবে, অসুস্থ বাবার জন্য গাড়ি ব্যবহার করলে চলবে কেন! বাবাকে ঢাকার হাসপাতালে নিয়ে গেল দাদারা। আমি সারাক্ষণ ফোনে খবর নিচ্ছি বাবাকে সান্ত্বনা দিচ্ছি। এত কালের প্রতাপশালী মানুষের বিষঃ কণ্ঠস্বর। বাবার মতো মানুষকে ভীত হওয়া মানায় না। বাবাকে জানাতে খুব কষ্ট হয়, যে, আমাকে দেশে যেতে দিচ্ছে না সরকার। বাবা যে কী অসহায় বোধ করছে, সে আমি বুঝি। বাবা তো আমার জন্ম থেকে চেনা। তারশক্তি যেমন জানি, তার দুর্বলতাও জানি। চিরকাল শক্তিমান হিসেবেই বাবা থেকেছে সবার কাছে। ভেতরে কোনও কারণে দুর্বল হলেও প্রকাশ করেনি কোনওদিন। কিন্তু ভালোবাসলে টেরপাওয়া যায়। যায় না মা? শক্তিমানেরও হৃদয় থাকে, সেই হৃদয় একসময় ভাঙে। বাবা যে কত অভিমানী ছিল, তা আমি আগে না বুঝলেও এখন বুঝি। বাবা অনেকটা শিশুর মতোও ছিলো। নিউইয়র্কের হাসপাতালে যখন চেকআপের জন্য ধরে বেঁধে ভর্তি করিয়েছিলাম, মনে আছে একবার ডাক্তার এসে জিজ্ঞেস করেছিলেন, আপনার জন্ম তারিখটা বলুন তো! বাবা বললো, কোনটা বলবো? পাসপোর্টেরটা, সার্টিফিকেটেরটা, নাকি অরিজিনালটা। আমি হাসবো না কাঁদবো, বুঝিনি। বাবার কথা শুনে ডাক্তাররা মুখ টিপে হেসে বলেছিলেন, অরিজিনালটা বলুন।
বারডেম হাসপাতালের ডায়ালাইসিসের যন্ত্রপাতি সব আধুনিক। ডাক্তাররা যত্ন নিয়ে বাবাকে দেখছে, ওখানকার অনেক বিশেষজ্ঞই বাবার ছাত্র। দাদার কাছে এসব শুনে খানিকটা স্বস্তি হয়। কিন্তু একদিন অন্তর অন্তর শরীরের রক্ত পাল্টেনতুন রক্ত ভরতে বাবা কি আদৌ কোনও স্বস্তি পাবে, আমি বুঝে পাই না কী করবো। অকেজো কিডনির জায়গায় নতুন কিডনি বসানোর ব্যবস্থা যে করেই হোক করতে হবে। বাবাকে বলি কিডনি পাওয়া যাবে, অনেকে কিডনি দান করে, বিক্রি করে, কোনও একটা কিডনি তার জন্য পাওয়া যাবেই। একটুও যেন না ঘাবড়ে যায় বাবা। প্রতিদিনই মানুষের কিডনি ট্রান্সপ্লান্ট হচ্ছে। ট্রান্সপ্লান্টের জন্য তাকে বিদেশে নিয়ে আসবো, ইওরোপের কোনও দেশে নয়তো ভারতে। ওখানে কিডনি বিক্রি করার জন্য প্রচুর গরিব বসে আছে। কড়ি ফেললেই কেনা যায়। বাবা শুনে ভরসা পায়, কিন্তু বুঝি কী ভীষণ কষ্টকরই না এই অনিশ্চয়তার মধ্যে থাকা। টাকা পয়সার ব্যাপারে একদম না ভাবতে বলি বাবাকে। কিডনি নিয়ে দরদাম করার কোনও দরকার নেই। যত টাকা দরকার হয় কিডনি ট্রান্সপ্লান্টের জন্য, সব আমি দেব। বাবা একদিন জানালো, নান্দাইলএর এক লোক টাকার বিনিময়ে কিডনি দিতে রাজি। তাহলে কী আর ভাবনা, ওই লোককে নিয়ে বিদেশে যেতে হবে ট্রান্সপ্লান্টের জন্য। আমিও বসে নেই, বিভিন্ন দেশে হাসপাতাল আর ডাক্তারদের সঙ্গে কথা বলে কিডনির ব্যাপারে পাকাঁপাকি একটা ব্যবস্থা করতে থাকি। বাবার ডায়ালাইসিস এবং হাসপাতাল খরচের টাকা ব্যাংকের মাধ্যমে পাঠিয়ে দিই দাদার অ্যাকাউন্টে। বাবার কি টাকা নেই মা? তবে এই টাকা কেন আমাকে পাঠাতে হয়? এই প্রশ্নটি নিজে আমি করি না। কেউ চায়নি টাকা, তারপরও পাঠিয়ে দিই। পাঠিয়ে দিই এই কারণে যে বাবার টাকা পয়সার তদারকি এখন দাদা করছে। আর দাদার মতো কল্পণ লোক টাকা খরচের ভয়ে যদি চিকিৎসায় গাফিলতি করে, এই আশংকায় আমি পাঠাই। আমার টাকা নিয়ে অন্তত কৃপণতা করবে না এই একটি বিশ্বাস আমার। কিন্তু যারই টাকা হোক, যার পকেটে যখন যায়, সেটি তখন তার নিজের টাকা। আমার পাঠানো টাকা তখন দাদার হাতে, সে টাকা তখন দাদার, সুতরাং স্বভাবজাত কৃপণতা তার শুরু হয়ে গেল। দ্বিতীয়দিন যখন বাবা ডায়ালাইসিস করতে গেল বারডেমে, ডাক্তার বলেছিলো অ্যান্টিবায়োটিক দিতে হবে স্যালাইনের সঙ্গে। কিন্তু দাদা বাবাকে হাসপাতালে রাখতে রাজি নয়। রাজি নয়ের কারণ একটিই, খামোকা টাকা খরচ। বাবার গলায় ফুটো করে নল ঢুকিয়েছে ডাক্তার, কড়া অ্যান্টিবায়োটিক সরাসরি রক্তে ঢোকাতে হবে, মুখের ওষুধে কাজ হবে না। হাসপাতালে ডাক্তারদের কড়া নজরে রাখতে হবে বাবাকে। কিন্তু ডাক্তারদের কথা দাদা শুনবে কেন? বাবার নিজের কি আর মত দেওয়ার সামর্থ্য আছে, দাদা যা ভালো বোঝে তাই করবে। বাবা এখন দাদার সম্পত্তি। আমি যে ফোন করে বারবার বলছি, ডাক্তার যা বলে তাই করো, নিজে কোনও সিদ্ধান্ত নিও না। দাদা আমাকে শান্ত করতে বলে দিল, ডাক্তার নাকি বলেছে বাড়ি নিয়ে যেতে পারে, মুখের ওষুধ দিয়ে দিয়েছে। গলায় কাঁচা ফুটো নিয়ে বাড়ি যাবে, আমার কিছুতে মন সায় দেয় না। কিন্তু দূর থেকে কতটুকুই বা করতে পারি আমি! বাবার সঙ্গে কথা কী বলবো, শরীরের ওই অবস্থায় বাবা শারীরিক ভাবে যত না, মানসিক ভাবে তার চেয়ে অনেক দুর্বল। ডাক্তার যখন দেখলো রোগীকে বাড়ি নিয়ে যাবেই দাদা, বললো পারলে বাড়িতে যেন স্যালাইনে কড়া অ্যান্টিবায়োটিক ইনজেকশান দেওয়ার ব্যবস্থা করে। না তা দেওয়া যাবে না, অগত্যা দাদা মুখে খাওয়ার কড়া ওষুধ লিখিয়ে নিয়ে এলো। কিন্তু ওই ওষুধের দাম যদি একটা পাঁচ টাকা হয়, দাদা নিশ্চিতই ভাববে ওষুধ কোম্পানিগুলোর মাথা খারাপ, লোক ঠকানোর ব্যবসায় নেমেছে ওরা। কী করবে দাদা? দেশি কোনও কোম্পানির অ্যান্টিবায়োটিক কিনে আনবে যেটার পঞ্চাশ পয়সা করে দাম। তাই করলো দাদা। সাংঘাতিক বুদ্ধিমানের কাজ করলো বটে। নিজের অতিবুদ্ধির জন্য দাদা নিজে বেশ গর্বিতও। সাধারণের চেয়ে বুদ্ধি তার বেশি, তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত নিতে দাদার মতো খুব বেশি কেউ আর নেই।
কী হল তারপর, বাড়িতে ভীষণ জ্বরে পড়লো বাবা। জ্বরে অনেকটাই অজ্ঞান। তখন হাসপাতালে নিয়ে গেলে ডাক্তার বলে দিল, সেপটিসেমিয়া। সারা শরীরে, সারা রক্তে তখন ব্যাকটেরিয়া ছড়িয়ে পড়েছে। বাবার মাথাও অকেজো করে দিয়েছে। সেপটিকশকে চলে গেছে বাবা। যেন মুহূর্তের মধ্যে হয়ে গেল এমন। বাবা তখন কিছু বুঝতে পারে না, কিছু বলতে পারে না, মুখ দিয়ে শুধু গাঁ গ্যাঁ শব্দ বেরোয়। ভেবেছিলাম বেঁচে থাকলে বাবাকে কোনও না কোনও একদিন বাবা বলে ডাকবো, ভেবেছিলাম বাবাকে তুমি বলে ডাকবো। ডাকি বাবাকে। বাবার কানের কাছে ফোন দেওয়া হয়। বাবা তখন তো বোবা, বধির। বাবাকে বাবা বলে ডেকেছি, বলেছি বাবা তুমি জেগে ওঠো। হ্যাঁ, যখন সত্যি ডাকলাম, বাবা আমার এই ডাক শুনতে পায়নি। বড় দেরি হয়ে গেল মা।
বড় মামা, ঝুনু খালা সব গেছে দেখতে। তারা এই বোবা বাবাকে দেখে বিমূঢ়। আমি স্তব্ধ হয়ে আছি দূর বিদেশে। আমার সারা গা কাঁপছে আশংকায়। যদি আমাকে দেশে ফিরতে দেওয়া হত, বাবার এই অবস্থা হতে পারতো না মা। তুমি ভাগ্যে বিশ্বাস করতে পারো, আমি করি না। আমি মনে করি না কোথাও কেউ মানুষের জন্ম মৃত্যুর তারিখ লিখে রেখেছে। এবং সেই তারিখ অনুযায়ী সব ঘটছে। বাবা আজও বেঁচে থাকতে পারতো, বিদেশে তার কিডনি ট্রান্সপ্লান্ট হতে পারতো, দিব্যি আগের মতো জীবন যাপন করতে পারতো। জীবন তো মানুষের একটাই। এই জীবনটাকে যে করেই হোক বাঁচিয়ে রাখতে চাই আমরা। কিন্তু তুমি যদি জীবনের মূল্য না বোঝে, তবেই তুমি টাকা পয়সার হিসেব করবে, হাসপাতালে অসুস্থ মানুষকে চিকিৎসার জন্য না রেখে তুমি বাড়ি নিয়ে আসবে, কারণ এতে সুবিধে, দৌড়োদৌড়িটা কম হয়।
বাবা আবার কথা বলতে পারবে, এই আশায় আমি বসে থাকি, বার বার শুনছি অবস্থার কোনও পরিবর্তন হয়নি। দাদা, ছোটদা, ঝুনু খালা, বড় মামা, ফকরুল মামা সবার সঙ্গে কথা বলি। সবাই বিষণ্ণ। বাবা ফিরছেনা। তাকাচ্ছে চারদিকে, সেই তাকানো অর্থহীন। মুখের শব্দকে কেউ কেউ অনুবাদ করার চেষ্টা করছে, কিন্তু সবই নিশ্চয়ই ভুল অনুবাদ। ঝুনু খালা শুধু বললো, দুলাভাই কিছু বলতে চাইছে, পারছে না। কী বলতে চাইছিলো বাবা?
একসময় আমাকে জানিয়ে দেওয়া হল, বাবা আর শ্বাস নিচ্ছেনা। ঝুনু খালা ফোনে হাউমাউ করে কাঁদলো। আমি আর জানতে চাইনি এরপর কী ঘটছে। বাবাকে নিয়ে কী মৃত্যুউৎসব তারা করছে, জানতে চাইনি। আমার আগ্রহ, আবেগ সব বেঁচে থাকাকালীন। আমি মৃত্যুরপরের কোনও কিছুতেই বিশ্বাসী নই। জগৎ আমার সম্পূর্ণই ফাঁকা হয়ে গেছেমা। শেষ আশ্রয় বলে কিছু থাকে, বাবা আমার তাই ছিলো। বাবা ছিলো আমার গৌরব, জীবনের সবচেয়ে বড় অহংকার। বাবা ছিলো আমার পথ প্রদর্শক, আমার সাহস আর শক্তির উৎস। বাবা ছিলো বলেই আমি আজ আমি, এই যে মাথা উঁচু করে আজ পৃথিবীর সব দেশে চলতে পারি, সে বাবা আমাকে গড়ে দিয়েছিলো বলেই। আমার বাবা যদি অন্য কেউ হতো, তাহলে আজি আমিও অন্য কেউ হতাম। জীবনের যা কিছুই আমার কৃতিত্ব, বাবা ছাড়া কিছুই সম্ভব হতো না। সংগ্রামী বাবাকে দেখে দেখেই সংগ্রাম করতে শিখেছি। সামনে দুর্যোগ এলে বাবা যেমন করে সামলাতো, তেমন সামলাতে আমিও শিখেছি। আদর্শের জন্য প্রাণপাত করতে বাবা ছাড়া আর কাকে দেখেছি, চোখের সামনে!
.
মা, শেফালিকে অবকাশে রেখে চলে গেছে, আমিও ওকে রেখে এসেছি অবকাশে। শেফালির সৎমার সংসারে আপন বলতে একটি মাত্র ভাই, সে ভাইও জানি না কী অপরাধ করে এখন জেলখানায়। শেফালি তার বেতনের টাকা জমিয়ে ভাইকে দিয়ে আসতো দুতিন মাস পর পর। একদিন ভাইটি বেরোবে জেল থেকে, বিয়েথা করে সংসার শুরু করবে, শেফালির এই একটিই স্বপ্ন। তার আর কোনও স্বপ্নের কথা আমি জানি না। বয়স আঠারো বা উনিশ, ছিলো বোধহয় কোনও স্বপ্ন, তুমি সম্ভবত জানো। এক শেফালি ছাড়া আর কেউ তোমার ওপর নির্ভর ছিলো না, তুমি ওকে একা রেখে চলে যাওয়ার পর বাবার দেখাশোনা করার দায়িত্ব শেফালি নিজেই নিলো। সে কাজটা বাড়তি কাজ, বাড়ির সবার জন্য সারাদিনের খাটাখাটনির পর বাবার ঘরটা গুছিয়ে রাখবে, বাবাকে খাবার দেবে। শেফালিকে প্রায়ই ফোন করে খুব আদর করে বলি, যেন বাবাকে দেখে রাখে, বাবার যেন কিছুতে খুব মন খারাপ না হয়। সেই হাসিখুশি শেফালি, ছুটে ছুটে বাড়ির সব কাজ একাই সেরে ফেলা শেফালি, হঠাৎ শুনি, মারা গেছে। সকালে কাপড় কাঁচতে গিয়ে কলের পাইপে হাত দিতেই ইলেকট্রিক শক লেগে ঠায় দাঁড়িয়ে রইলো। চিৎকার করেছিলো, সে চিৎকারে বাড়ির লোক দৌড়ে গিয়েছে বটে কাছে, কিন্তু ওকে বাঁচাবার চেষ্টা করতে কেউ সাহস পায়নি। মা, যে মেয়েটা তোমার কাছে কাছে থাকতো অনেক বছর, তুমি মারা গেলে সবচেয়ে বেশি কেঁদেছে যে মেয়ে, যে মেয়ে বাড়ির সবার আরামের জন্য দিন রাত পরিশ্রম করেছে, তাকে ইচ্ছে করলেই বাঁচানো যেত, কিন্তু সবাই দূর থেকে দাঁড়িয়ে দেখেছে ওর মরে যাওয়া। শেফালির ভাই মোটা অংকের একটা টাকা দাবি করেছিলো, নাহলে মামলা করবে বলেছিলো। দাদা নানা রকম আয়োজন করেছে টাকা না দিয়ে মীমাংসা করার। অথবা যদি দিতেই হয় টাকা, দাদার মাথায় শুধু যত কম দিয়ে পার পাওয়া যায় সেই ভাবনা। আমি টাকার পরিমাণ দাদাকে বারবার বলি বাড়াতে। কিন্তু আমার বলায় কী যায় আসে বলো! ওদের সবার কাছে আমি তোমার মতোই মৃত। আমার কণ্ঠস্বরকে ওরা কণ্ঠস্বর বলে মনে করে না। কণ্ঠস্বরের ওপারে যে জলজ্যান্ত একটা মানুষ আমি, তা তাদের আচরণে কোনওদিন প্রকাশ পায়নি। টাকা জিনিসটা চারদিকের সবার কাছে অত্যন্ত প্রিয়। শেফালির চলে যাওয়া সবচেয়ে বেশি ভুগিয়েছে বাবাকে। তুমি নেই, আমি নেই, ইয়াসমিন নেই, শেফালি নেই। বাবাকে নিঃস্বার্থভাবে ভালোবাসার আর কেউ তখন সংসারে নেই। দাদা আর হাসিনার ইচ্ছের মুঠোয় বাবাকে বন্দি হতে হল।
বাবা কেমন আছে, কী করছে খোঁজ নিতে প্রায়ই ফোন করি। বাবা বলে বটে যে ভালো আছে, কিন্তু বাবার কণ্ঠস্বরে আমি টের পাই বাবা ভালো নেই। বাবা কোনওদিনই তার অসুখের কথা কাউকে জানায় না। একদিন দাদা খুব সহজ শান্ত গলায় বললো বাবার কিডনি নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। শুনে আমার বুকের ভেতর থেকে ঠাণ্ডা একটা, জানি না কী নাম তার, মুহূর্তে সারা শরীরে ছড়িয়ে গেল। কিডনি কবে থেকে নষ্ট হচ্ছে? দাদার বক্তব্য আমার নাকি জানার কথা সব। সেই যে বাবা কলকাতায় এসেছিলো, তখনই নাকি কলকাতার ডাক্তাররা বলেছিলো কিডনি নষ্ট হচ্ছে। এসবের কিছুই জানি না আমি। কোনও ডাক্তার আমাকে বাবার কিডনি নষ্ট হওয়ার কথা কিছু বলেনি। ঘরে বাইরে সারাদিন অস্থির পায়চারি করলাম। ভেতরে বুদবুদের মতো দেশে ফেরার ব্যাকুলতা। বাবার এই দুঃসময়ে যদি পাশে না থাকতে পারি, তবে বেঁচে থাকার কী অর্থ! আশংকায় আমি কুঁকড়ে থাকি। অন্ধকারে নিজেকে মুড়ে একাপড়ে থাকি ঘরের কোনও কোণে। ফোন বাজলে বুকের ধুকপুক এমন বাড়ে যে মনে হয় দৌড়ে পালাই। একদিন অভিমানের গায়ে পাথর চাপা দিয়ে ইয়াসমিনকেই কাতর অনুনয় করি, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব যেন সে দেশে যায়। ইয়াসমিনেরও নিজের সমস্যার অন্ত নেই। বলতেও পারতো সে যাবে না, কিন্তু তোমার মৃত্যু তার স্নায়ুর ঘরবাড়িতে ভূকম্পন তুলে জানিয়ে গেছে মৃত্যু জিনিসটা ঠিক কী। কারও মৃত্যু না হলে আমরা বোধহয় দেখতে পাই না মৃত্যুর সত্যিকার চেহারা। ইয়াসমিন তড়িঘড়ি বাবার জন্য খাবার দাবার কাপড় চোপড় আর নানারকম উপহার কিনে রওনা হলো দেশে।
দাদার অভিযোগ শুরু হয়েছে বাবার নাকি হরেকরকম বান্ধবী আছে। বান্ধবীরা বাবার সঙ্গে দেখা করতে বাড়িতে ঢুকতে চায়। ওদের অর্ধচন্দ্র দিয়ে বাড়ি থেকে প্রতিদিনই বিদেয় করে দাদা। বিদেয় করার ঘটনা দাদা বেশ বীরত্বের সঙ্গে বর্ণনা করে। তার বীরত্ব আমাকে মোটেও পুলকিত করে না। দাদাকে বলি যা ইচ্ছে হয় বাবার, তাই যেন তাকে করতে দেওয়া হয়। বান্ধবীদের সঙ্গে বাড়িতে বসে বাবা কথা বলতে চাইলে বলবে। শুতে চাইলে শোবে। বাবার চরিত্র সংশোধনের গুরুদায়িত্ব দাদাকে নিতে বারবার বারণ করি। জীবন একটিই, এই জীবনটি যেমন ইচ্ছে যাপন করার অধিকার আরসবারমতো বাবারও আছে। সারা জীবন স্বাধীনতা ভোগ করে আসা মানুষকে অসুখের দোহাই দিয়ে টেনে হিঁচড়ে একটি বন্ধ ঘরে ঢুকিয়ে বন্দি করা হলে কেমন অস্থির হয় তার ভেতর বাহির, তা বাবা না হয়েও আমি অনুভব করি। বাবার মন ভেঙে যাচ্ছে, শরীর ভেঙে যাওয়ার চেয়েও তা অনেক বেশি ক্ষতিকর। শরীর যখন যাবার, যাবে। মনকে মরতে দিতে নেই। তুমি নেই মা, এখন আর বাবাকে তার বান্ধবীদের কাছ থেকে জোর করে দূরে সরিয়ে কার কী ভালো দাদা করছে! তুমি থাকাকালীন যে কাজটা কেউ কোনওদিন করেনি, তুমি না-থাকাকালীন কেন? বাবাকে এরকমও আর আশ্বাস দেওয়া হচ্ছেনা যে সে তার হারিয়ে যাওয়া জগৎটি ফিরে পাবে একদিন। অবকাশের অন্দরে বন্দি করে বাবার মতো কাজপাগল মানুষকে বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে, মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করা ছাড়া বাবার আর কাজ কিছু নেই। কী ভয়ংকর নিষ্ঠুর এই আচরণ। বাবার চেম্বারে চিরতরে তালা লাগিয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা দাদার একার। ধীরে ধীরে বাবাকে নিজের মুঠোয় নিয়ে দাদা কী খেলা খেলছিলো কে জানে! কারও কথায় বাবা উঠছে বসছে, দৃশ্যটি বড় অচেনা ঠেকে। কী করে জানিনা দাদার হাতের ক্রীড়নক হয়ে পড়েছিল বাবার মতো ভয়ংকর একগুঁয়ে মানুষ! সম্ভবত কিডনি নষ্ট হওয়ার খবর বাবাকে বদলে দিয়েছিলো আগাগোড়া। মনে আছে, অবকাশের একটি ঘরে মৃত্যুর সঙ্গে রোজ যুদ্ধ করে চলেছো, বাবা বাড়ির বাইরে যেতে চাইলে আমি কালো ফটকে তালা দিয়ে রাখতাম, চাইতাম বাবা বাড়ি থাকুক। দিন দিন তুমি যুদ্ধে হেরে যাচ্ছো, মৃত্যু তোমার শরীর জুড়ে উলঙ্গ নৃত্য করছে, আমি চাইনি বাবা এ সময় বাড়ি ছেড়ে অন্য কোথাও যাক। কিন্তু বাবার ওপর জোর চালিয়ে শেষ পর্যন্ত আমি জিততে পারিনি। যে করেই হোক বেরিয়ে গেছে বাবা। কেঁদে কেটে, অনশন করে, অভিমান করে, রাগ করে, চিৎকার করে হলেও বেরিয়েছে। তুমি মরে যাচ্ছে, তাতে কী, বাবা তো বেঁচে আছে, বেঁচে থাকতে হলে সবার আগে তাকে তার জগতে ফিরতে হবে। সেই জগৎ আমাদের সবার জগৎ থেকে আলাদা। সেখানে রোগী আছে, রোগিণী আছে। রোগ শোক চিকিৎসা বন্ধু বান্ধব আড্ডা গল্পগুজব চানাচুর বাদাম ইত্যাদি আছে। বহুঁকাল ধরে গড়ে তোলা বাবার নিজস্ব এই জগৎ। কোনও কিছুই তাকে সেই জগৎ থেকে সরাতে পারে না। তোমার মৃত্যুও নয়। সেই জগৎটি বাবার কাছ থেকে হঠাৎ কেড়ে নেওয়া হল। অনেককাল আগে বাবা আমাকে বলেছিলো তার মৃত্যু যেন হয় ওই চেম্বারের ওই চেয়ারে বসে, রোগীর প্রেসক্রিপশান লিখতে লিখতে, হঠাৎ। যে বাবা কোনওদিন একটি মুহূর্তের জন্য অবসরে বিশ্বাস করতো না, তার কেন ভালো লাগবে ভয়াবহ অবসর! বাবা যতটা অসুস্থ ছিল, তার চেয়ে বেশি অসুস্থ হতে লাগলো। অস্থিরতা চরমে উঠে সর্বনাশ করতে লাগলো তার। জীবনে প্রথম তাকে ভোগ করতে হচ্ছে বন্দিত্ব, প্রথম তাকে বুঝতে হচ্ছে যে তার ইচ্ছের কোনও মূল্য নেই আর। পুরুষদের সঙ্গে দেখা করার অধিকার বাবার আছে, মহিলাদের সঙ্গে নেই। এই নেইটা দাদার আদেশ। প্রথম প্রথম উপদেশ দিতো হয়তো, সেই উপদেশ ধীরে ধীরে আদেশে পরিণত হয়েছে। বাবার শারীরিক বা মানসিক অবস্থার কথা ভাবার কারও সময় নেই তখন! দাদা আর ছোটদা অলক্ষ্যে হয়তো বাবাকে মৃত্যুর জন্য তৈরি করেছিলো। ইচ্ছে করে ছুটে যাই, বাবাকে বাবার মতো করে তার শেষ কটা দিন বাঁচতে দিই। কিন্তু বন্দি তো বাবার চেয়েও বেশি আমি। বাবার মন প্রফুল্ল থাকে, আনন্দময় থাকে, এমন পরিবেশই বাবাকে দেওয়া হোক, এক এক করে ভাইদের, আত্মীয়দের সবাইকেই বলি। কিন্তু দূরের মানুষের দীর্ঘশ্বাস বা উপদেশ কিছুই কেউ গ্রাহ্য করে না। খুব ভালো করে বুঝি যে বাবা আর আগের বাবা নেই। কণ্ঠে অবসাদ। আশার আঙিনাগুলো আশংকায় আচ্ছাদিত। দাদা আগে বাবার কানে কানে কথা বলতো, মামা খালাদের বিরুদ্ধে যা নয় তা বলে কান ভারি করতে বাবার। কানাকানি দাদা এখন বাবার সঙ্গে করে না, যদি করে, করে ছোটদার সঙ্গে। কী করে বাবাকে শেকলে বাঁধা যায় এ নিয়ে জল্পনা। বাবা নাকি কথা শোনে না, বাইরে বেরিয়ে যায়। বাবাকে হয়তো শেকল দিয়ে বাঁধারই বন্দোবস্ত হচ্ছিল। বেঁধেছিল কি না জানি না, তবে ঘরে ঢুকিয়ে বাইরে থেকে যে শেকল দিয়েছিল তা জানি। কেন, খুব নাকিপাগলামি করে বাড়ি থেকে বাইরে বেরোনোর জন্য? যদি বাইরে বেরিয়ে আবার ওই মহিলাদের বাড়ি চলে যায়! দুএকজন মহিলা নিয়ে দাদার তখন মাথা খারাপ হবার যোগাড়। কেন, মহিলারা বাবার বান্ধবী। এ বাবার ব্যক্তিগত ব্যাপার। তুমি যখন হা হুতাশ করে মরতে, বাবার বান্ধবী বা স্ত্রী নিয়ে তুমি যখন বছরের পর বছর কেঁদে বুক ভাসাচ্ছো, কই দাদা তো মোটেও বাবার বান্ধবী-নেশা ঘোচানোর কোনও চেষ্টা করেনি। এখন হঠাৎ কেন? কারণ তুমি কি অনুমান করতে পারছে না মা? দাদার একটিই কেবল দুশ্চিন্তা। ওই মহিলাদের কাউকে আবার বিয়ে টিয়ে করে বসেনি তো কখনও। তাহলে তো বাবার বিরাট সম্পত্তির কোনও অংশ ওদের কারও হাতে চলে যাবে।
তোমার অবর্তমানে শুনেছিলাম কোন এক বিধবা ভদ্রমহিলার সঙ্গে নাকি বাবার বিয়ে জাতীয় কিছুকরিয়ে নেওয়া হয়েছিল, বৈধভাবে তারা মেলামেশা করতে পারবে এরকম কিছু। অবকাশে দাদারাই এটি ঘটার ব্যবস্থা করেছিলো। ভদ্রমহিলা নাকি অবকাশে প্রায়ই যেত, বাবাও যেতে তার বাড়িতে। যার সঙ্গে বাবা ঢাকায় বসে ফোনে কথা বলেছিলো, শুনে তুমি কেঁদেছিলে, তার সঙ্গেই এই ঘটনা। মেলামেশা করার আর কোনও রকম আইন আছে কিনা বিয়ে ছাড়া, আমার জানা নেই। তবে মুসলমানের আইন তো, পুরুষের বহুগামিতার সুযোগ সুবিধে বিস্তর। আমি তো দূরের মানুষ, দেশে আর কোনও দিন ফিরতে না পারা মানুষ। আমাকে খুব বেশি কিছু। জানানোও হয় না। নিজে ফোন করে বার বার জিজ্ঞেস করে করে যদি কিছু জানি তো জানি।
বাবা যা কিছুই করুক, তোমার অসুস্থতার সময় বাবার ওপর আমার যত রাগছিল, তুমি না থাকার পর কী করে যেন সব জল হয়ে গেল। তাকেই আঁকড়ে ধরে তোমার শূন্যতাকে আড়াল করতে চাইতাম মনে মনে। আমার সব মনে মনেই ছিল মা। তোমার সঙ্গে তোমার জীবনের বেশির ভাগ সময়ই বাবা অন্যায় ছাড়া আর কোনও আচরণ করেনি জানি মা। কিন্তু তারপরও বাবাকে আমি শ্রদ্ধা না করে পারি না। তুমিও তো চাওনি বাবার সঙ্গে কোনও অশোভন আচরণ করি। চিরকাল ভয়ে সিঁটিয়ে থেকেছি। বাবা আমাদের পেটাতো, ভয় দেখাতো। কিন্তু ভালোও তো বাসতো। তার ভালোবাসা কখনও অন্য বাবাদের ভালোবাসার মতো ছিল না। বাবারশাসনে জানি না ছেলেমেয়েরা কতটুকু মানুষ হয়েছে। দাদা তো চিরকালই বাবার ওপর নির্ভর করেই জীবন কাটালো। ছোটদাও অনেকটা। বাবার স্বপ্নপূরণ এক আমিই করেছিলাম। হুট করে ঢাকা মেডিকেল কলেজের চাকরি ছেড়ে দেওয়ায় বাবা মাথায় হাত দিয়ে বসেছিলো। কিন্তু আমার সিদ্ধান্ত আমার সিদ্ধান্ত। আমি সম্ভবত বাবার মতো হয়েছিলাম। আমার মনোবলটা বাবার কাছ থেকে পাওয়া। ঝড় ঝঞ্জার সামনে ঋজু দাঁড়িয়ে থাকা বাবা। ভয় না পাওয়া, রুখে ওঠা, প্রতিবাদ করা বাবা। স্বনির্ভর হওয়া, মাথা উঁচু করে বাঁচা, বাবা। অহংকার, আত্মবিশ্বাস, বাবা। আর তুমি হচ্ছ আমার ভেতরে যে অবিশ্বাস্যরকম যে এক নরম হৃদয় আছে, মানুষের জন্য কাঁদা, কেঁদে বুক ভাসানো, সেটা বিলিয়ে দেওয়া, ভালোবেসে অকাতরে দান করা, তুমি। মাঝে মাঝে তীব্র হতাশায় যখন ডুবে থাকি, মনে হতে থাকে পৃথিবীতে কেউ বুঝি আমাকে ভালোবাসে না, আমি একা, একটি বিন্দুর মতো আমি একা, মনে হতে থাকে কী দরকার এই বেঁচে থাকার–সেটা তুমি। ছেলেমেয়েদের আর কারও মধ্যে এত তীব্র ভাবে তোমাদের দুজনের উপস্থিত নেই। ইয়াসমিন একটা সময় দুর্বিনীত দুরন্ত মেয়ে ছিল। কিন্তু ধীরে ধীরে বয়স বাড়ার পর বাবার সব গুণ চলে গিয়ে তুমি এসে উপস্থিত হয়েছে ওর মধ্যে। ঠিক তোমার মতোই অশান্তির সংসার ও করে যাচ্ছে। প্রায়ই স্বামীকে ত্যাগ করার কথা বলে, কিন্তু সন্তানের জন্য পারে না। আত্মবিশ্বাসের এক ফোঁটা কিছু নেই। নিজেকে কুৎসিত বলে মনে করছে, যদিও কুৎসিত নয়। তোমার আত্মবিশ্বাস ছিল, কিন্তু তোমার উপায় ছিল না। ইয়াসমিনের উপায় থাকলেও মনের জোর নেই। আসলে তোমার গুণগুলো ওর মধ্যে গিয়ে দোষে পরিণত হয়েছে। গুণএর মাত্রা অতিরিক্ত হলে সেটা আর গুণ থাকে না। ধরো মানুষের জন্য জীবন দেওয়ার গুণ যদি আমার ভেতরে আরও বেশি মাত্রায় থাকে, আমাকে হয়তো আত্মহত্যা করতে হবে। আর, বাবার গুণই ধরো, শক্তি সাহস, সংকল্প, দৃঢ়তা ঋজুতা ইত্যাদি অতিরিক্ত হলে জানি না কী করবো, হয়তো মৌলবাদীর সশস্ত্র মিছিলের সামনে বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়ে বলবো, সাবধান এক পা এগোবি না। দাদা আর ছোটদার মধ্যে আমি তোমাকে দেখি না। বাবার মেয়েমানুষের দোষ দ্বিগুণ বা ত্রিগুণ হয়ে ছোটদাকে ধরেছে। একসঙ্গে বেশ কটি সুন্দরীর সঙ্গে গোপন সম্পর্ক রাখতে সে পারদর্শী। বাবার সেদিক থেকে কপাল ভালো ছিল না। বিবাহিতা, অসুখী, অসুন্দরী, নিগুণ, এমনই দুএকটি ছিল হয়তো কপালে, কেউই কিন্তু তোমার চেয়ে দেখতে ভালো, তোমার চেয়ে বুদ্ধিমতী বা কম বয়সি ছিলো না, অন্তত যে দুজনের কথা শুনেছি। দাদার মাথা থেকে পা পর্যন্ত বাবার একটি গুণই দোষের মতো দেখা দেয়। বাবার মিতব্যয়িতা দাদার ভেতরে প্রবল পরিমাণে ঢুকে কৃপণতার আকার ধারণ করেছে। বাকিগুণ বা দোষ অত প্রকাশিত নয়। কৃপণতা অবশ্য তার বউ ছেলেদের ক্ষেত্রে তত নেই, যতটা বাকি পৃথিবীর জন্য।
মা, মাঝে মাঝে মনে হয় বহুগামিতা মানুষ নামক প্রজাতির স্বাভাবিক প্রবৃত্তি। আমরা সমাজের বিধি নিষেধ নিজেদের ভেতর ধারণ করে আমাদের স্বভাবজাত বহুগামিতাকে শরীরের না হলেও মনের শক্তি দিয়ে রোধ করি। ভালোবাসা নামক একটি দেয়াল এসে আমাদের সামনে অনড় দাঁড়ায়। সেই দেয়াল ডিঙিয়ে আমরা তথাকথিত পরনারী বাপরপুরুষের কাছে যেতে পারি না। বাবা যদি বহুগামিনা হতো, তোমরা দুজনেই খুব সুখী হতে পারতে। হঠাৎহঠাৎ যখন বাবার সঙ্গে তোমার ঘনিষ্ঠতা হতো, দুজনকেই কী প্রফুল্ল দেখতাম। ওরকম যদি সবসময় থাকতে পারতে। জানি তোমার উদ্যোগে কোনও কাজ হত না। বাবা যদি এগিয়ে আসতো, তবেই সম্ভব হত সম্পর্ক মধুর করা। তুমি তো একপায়ে সারাজীবন খাড়াই ছিলে বাবার সামান্য ভালোবাসা পেতে। তোমার অসুখ ধরা পড়ার পর বাবা যে বাধ্য স্বামীর মতো তোমাকে আদরযত্ন করতে শুরু করলো, নিজের বাড়িঘর, রোগী দেখা, বান্ধবী, সব ফেলে সব ভুলে–জানি না ওর পেছনে কী কাজ করেছিলো? অপরাধবোধ! মনে হয়। দুজনই তোমার অসুস্থতার সময় সবচেয়ে বেশি নিঃস্বার্থভাবে সেবা করেছে, সে বাবা আর আমি। বাবার আর আমার আরও গুরুত্বপূর্ণ মিল বোধহয় এটাও।
বাবাকে কোনওদিন কি বোঝাতে পেরেছি ভালোবাসি? তোমার জীবনের শেষ কটা দিন তোমার পাশে থেকে না হয় মিথ্যে হোক সত্যি হোক, বুঝিয়েছি ভালোবাসি। বাবার সেবা করা আমার পক্ষে সম্ভব হয়নি মা। সুইডেনের বাংলাদেশ দূতাবাসে গিয়ে আমার পাসপোর্টের মেয়াদ বাড়ানোর জন্য আবেদন করলাম, শেখ হাসিনার কাছে চিঠিও লিখলাম যেন আমাকে কিছুদিনের জন্য অনুমতি দেন দেশে ফেরার। জানিয়েছি, বাবা ভীষণ অসুস্থ, তাকে না দেখলেই নয় আমার। তারপরও কোনও উত্তর নেই। রাষ্ট্রদূত নিজে বেশ কয়েকবার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ে চিঠি পাঠালেন এর গুরুত্ব বুঝিয়ে, সেসবেরও কোনও উত্তর নেই। উত্তর নেই ঠিক বলবো না, উত্তর হচ্ছে, না। অথচ দেখ, উঠতে বসতে শেখ হাসিনা কী কান্নাই না কাঁদছেন তাঁর নিজের বাবার জন্য! অথচ আমার বাবাকে দেখতে যেতে দিতে তাঁর আপত্তি। ওদিকে বাবা আমাকে যে কথা আগে কখনও বলেনি, বলছে যেন দেশে ফেরার চেষ্টা করি। বুঝি আমাকে দেখার জন্য বাবা ব্যাকুল হচ্ছে। ভয় নাপাওয়া বাবাও, বুঝি যে ভেঙেপড়েছে। আমারআর্তনাদ, আমারআকুলতা কিছুই বাংলাদেশ সরকারকে স্পর্শ করে না। বাবা তার মেয়েকে ডাক্তার বানালো, বাবার অসুস্থতার পাশে সবাই আছে, শুধু তার ডাক্তার মেয়েটি নেই। ডাক্তারির কিছুই না জানা দুই পুত্রধন বাবার পাশে আছে, যারা অনেকটা বাবার চিকিৎসকের ভূমিকা নিয়েছে। বিশেষ করে দাদা। দাদা নিজেকে প্রায়শ ডাক্তার বলে মনে করে। নিজের ডাক্তারি পড়া হয়নি, ওষুধ কোম্পানিতে চাকরি করেছে, গ্রামে গঞ্জে ওষুধ নিয়ে গেছে, গ্রামের অশিক্ষিত লোকেরা দাদাকে ডাক্তার বলে ডেকেছে। তারপর চাকরি ছেড়ে বাবার ফার্মেসিতে বসেছে, ওষুধ নিয়ে কারবার বলে বাজারের মাছওলা, তরকারিওলা ভাবতো ডাক্তারের ছেলে বুঝি ডাক্তারই হয়েছে। তারাও দাদাকে ডাক্তার ঠাওরাতো। ও কারণেও দাদারও ধারণা হয়েছে দাদা বুঝি ডাক্তারই। এখন বাবার অসুখের চিকিৎসা দাদা নিজ দায়িত্বে নিজের হাতে তুলে নিয়েছে। দাদাই সিদ্ধান্ত নেয় বাবাকে কখন হাসপাতালে যেতে হবে, বা ডাক্তার দেখাতে হবে। বাবা, কী কারণে জানিনা নিজের কোনও অসুখের জন্য বড় কোনও ডাক্তার দেখাতো না। নিজের চিকিৎসা নিজেই করতো। জানতে চিকিৎসা, কিন্তু কখনও কখনও তো অভিজ্ঞ ডাক্তারের কাছে যেতে হয়। শহরে নতুন নতুন বিলেত ফেরত ডাক্তার এসেছে। অনেকে বাবার ছাত্র। ডাক্তারি বিদ্যায় বাবার জ্ঞান এমন ছিল যে বিলেত ফেরত এফ আর সি। এস পাশ করা ডাক্তারের হাতে রোগী মরতে বসলে বাবার কাছে এসে বাঁচতো। বাবাকে অনেক বলতাম বড় ডাক্তার দেখাতে, কখনও রাজি হত না। কলকাতার ডাক্তার যে ওষুধ দিয়েছিলো সেগুলো কখন কোনটা খেতে হবে, বড় কাগজে লিখে দিয়েছিলাম, যেন ভুলে না যায় বাবা, প্রয়োজনে যেন ঘরের দেয়ালে টাঙিয়ে রাখে। দেশে ফিরে বাবা ওই কাগজও ফেলে দিয়েছে, ডাক্তারের দেওয়া ওষুধও খায়নি। নিজের যা পছন্দ তাই খেয়েছে। খেয়ে তো দিব্যি ভালো ছিল মা। হৃদপিণ্ডের কোনও অসুখে তাকে ভুগতে হয়নি। রক্তচাপ নিজের মতো করে ওষুধ খেয়ে কমিয়ে রেখেছে। গোলটা বাধলো ডায়বেটিস নিয়ে। ওটাও ঠিক থাকতো যদি খাবারটা বাবার ঠিক থাকতো। বাড়িতে সবার জন্য যে খাবার রান্না হয়েছে সেগুলোই তো বাবাকে খেতে হয়েছে। কোনওদিন মদ সিগারেট খায়নি। শাক সবজি খেতো। স্বাস্থ্যকর বা পুষ্টিকর খাবার বাড়িতে আনতো। যখন দাদা বা সিনা দায়িত্ব নিয়ে নিল বাড়ির সব ব্যাপারের, সংসার খরচের টাকা পয়সাও তখন তাদের হাতে, তারাই সিদ্ধান্ত নেয় কী তারা খাবে। বাজার থেকে মাছমাংস অঢেল আসে। দই মিষ্টি আসে। বাবার খাবারের জন্য কিছু আসার চল ছিল না। ক্ষিধে পেলে বাবা হয়তো’সামনে যা পেতো খেয়ে নিতো। কলকাতায় যখন এসেছিলো, বাবাকে শর্করামুক্ত খাবার খাওয়ানোর দিকে খেয়াল করিনি। বাবার ডায়বেটিস ধরা পড়ার পর, তুমি যতদিন অবকাশে ছিলে, শাক সবজিই বেশি খাওয়াতে। তুমি বাবার খাবারটা ঠিকঠাক দিতে, তুমি না থাকলে দেওয়ার কেউ নেই। বাবার সবকিছু ওলোট পালোট হয়ে গেলো। চেম্বার নেই। রোগী দেখা নেই। বাড়িতে যখন বসেছিলো, বাড়িতে দুটো তিনটে রোগী আসতো। কিন্তু বাড়ি তো আর চেম্বার নয়, এতকালের চেম্বারের স্বাধীনতা বাবা বাড়িতে পেতো না, সেই আনন্দও আর ছিল না। কারও ওপর নির্ভরশীল বাবা কোনওকালেই ছিল না। নিজের অসুখ নিয়ে অন্যের মাথাব্যথাও কোনওদিন সইতে পারতো না।
একসময় শুনি বাবাকে ঢাকায় নিয়ে আসা হয়েছে। কী করে এলো বাবা? না, যে গাড়ি বাবার জন্য কেনা হয়েছিল, সেটায় নয়, বাসে করে। আমার দেওয়া সেই গাড়ি হাসিনার এদিক ওদিক ঘোরার কাজে লাগবে, অসুস্থ বাবার জন্য গাড়ি ব্যবহার করলে চলবে কেন! বাবাকে ঢাকার হাসপাতালে নিয়ে গেল দাদারা। আমি সারাক্ষণ ফোনে খবর নিচ্ছি বাবাকে সান্ত্বনা দিচ্ছি। এত কালের প্রতাপশালী মানুষের বিষঃ কণ্ঠস্বর। বাবার মতো মানুষকে ভীত হওয়া মানায় না। বাবাকে জানাতে খুব কষ্ট হয়, যে, আমাকে দেশে যেতে দিচ্ছে না সরকার। বাবা যে কী অসহায় বোধ করছে, সে আমি বুঝি। বাবা তো আমার জন্ম থেকে চেনা। তারশক্তি যেমন জানি, তার দুর্বলতাও জানি। চিরকাল শক্তিমান হিসেবেই বাবা থেকেছে সবার কাছে। ভেতরে কোনও কারণে দুর্বল হলেও প্রকাশ করেনি কোনওদিন। কিন্তু ভালোবাসলে টেরপাওয়া যায়। যায় না মা? শক্তিমানেরও হৃদয় থাকে, সেই হৃদয় একসময় ভাঙে। বাবা যে কত অভিমানী ছিল, তা আমি আগে না বুঝলেও এখন বুঝি। বাবা অনেকটা শিশুর মতোও ছিলো। নিউইয়র্কের হাসপাতালে যখন চেকআপের জন্য ধরে বেঁধে ভর্তি করিয়েছিলাম, মনে আছে একবার ডাক্তার এসে জিজ্ঞেস করেছিলেন, আপনার জন্ম তারিখটা বলুন তো! বাবা বললো, কোনটা বলবো? পাসপোর্টেরটা, সার্টিফিকেটেরটা, নাকি অরিজিনালটা। আমি হাসবো না কাঁদবো, বুঝিনি। বাবার কথা শুনে ডাক্তাররা মুখ টিপে হেসে বলেছিলেন, অরিজিনালটা বলুন।
বারডেম হাসপাতালের ডায়ালাইসিসের যন্ত্রপাতি সব আধুনিক। ডাক্তাররা যত্ন নিয়ে বাবাকে দেখছে, ওখানকার অনেক বিশেষজ্ঞই বাবার ছাত্র। দাদার কাছে এসব শুনে খানিকটা স্বস্তি হয়। কিন্তু একদিন অন্তর অন্তর শরীরের রক্ত পাল্টেনতুন রক্ত ভরতে বাবা কি আদৌ কোনও স্বস্তি পাবে, আমি বুঝে পাই না কী করবো। অকেজো কিডনির জায়গায় নতুন কিডনি বসানোর ব্যবস্থা যে করেই হোক করতে হবে। বাবাকে বলি কিডনি পাওয়া যাবে, অনেকে কিডনি দান করে, বিক্রি করে, কোনও একটা কিডনি তার জন্য পাওয়া যাবেই। একটুও যেন না ঘাবড়ে যায় বাবা। প্রতিদিনই মানুষের কিডনি ট্রান্সপ্লান্ট হচ্ছে। ট্রান্সপ্লান্টের জন্য তাকে বিদেশে নিয়ে আসবো, ইওরোপের কোনও দেশে নয়তো ভারতে। ওখানে কিডনি বিক্রি করার জন্য প্রচুর গরিব বসে আছে। কড়ি ফেললেই কেনা যায়। বাবা শুনে ভরসা পায়, কিন্তু বুঝি কী ভীষণ কষ্টকরই না এই অনিশ্চয়তার মধ্যে থাকা। টাকা পয়সার ব্যাপারে একদম না ভাবতে বলি বাবাকে। কিডনি নিয়ে দরদাম করার কোনও দরকার নেই। যত টাকা দরকার হয় কিডনি ট্রান্সপ্লান্টের জন্য, সব আমি দেব। বাবা একদিন জানালো, নান্দাইলএর এক লোক টাকার বিনিময়ে কিডনি দিতে রাজি। তাহলে কী আর ভাবনা, ওই লোককে নিয়ে বিদেশে যেতে হবে ট্রান্সপ্লান্টের জন্য। আমিও বসে নেই, বিভিন্ন দেশে হাসপাতাল আর ডাক্তারদের সঙ্গে কথা বলে কিডনির ব্যাপারে পাকাঁপাকি একটা ব্যবস্থা করতে থাকি। বাবার ডায়ালাইসিস এবং হাসপাতাল খরচের টাকা ব্যাংকের মাধ্যমে পাঠিয়ে দিই দাদার অ্যাকাউন্টে। বাবার কি টাকা নেই মা? তবে এই টাকা কেন আমাকে পাঠাতে হয়? এই প্রশ্নটি নিজে আমি করি না। কেউ চায়নি টাকা, তারপরও পাঠিয়ে দিই। পাঠিয়ে দিই এই কারণে যে বাবার টাকা পয়সার তদারকি এখন দাদা করছে। আর দাদার মতো কল্পণ লোক টাকা খরচের ভয়ে যদি চিকিৎসায় গাফিলতি করে, এই আশংকায় আমি পাঠাই। আমার টাকা নিয়ে অন্তত কৃপণতা করবে না এই একটি বিশ্বাস আমার। কিন্তু যারই টাকা হোক, যার পকেটে যখন যায়, সেটি তখন তার নিজের টাকা। আমার পাঠানো টাকা তখন দাদার হাতে, সে টাকা তখন দাদার, সুতরাং স্বভাবজাত কৃপণতা তার শুরু হয়ে গেল। দ্বিতীয়দিন যখন বাবা ডায়ালাইসিস করতে গেল বারডেমে, ডাক্তার বলেছিলো অ্যান্টিবায়োটিক দিতে হবে স্যালাইনের সঙ্গে। কিন্তু দাদা বাবাকে হাসপাতালে রাখতে রাজি নয়। রাজি নয়ের কারণ একটিই, খামোকা টাকা খরচ। বাবার গলায় ফুটো করে নল ঢুকিয়েছে ডাক্তার, কড়া অ্যান্টিবায়োটিক সরাসরি রক্তে ঢোকাতে হবে, মুখের ওষুধে কাজ হবে না। হাসপাতালে ডাক্তারদের কড়া নজরে রাখতে হবে বাবাকে। কিন্তু ডাক্তারদের কথা দাদা শুনবে কেন? বাবার নিজের কি আর মত দেওয়ার সামর্থ্য আছে, দাদা যা ভালো বোঝে তাই করবে। বাবা এখন দাদার সম্পত্তি। আমি যে ফোন করে বারবার বলছি, ডাক্তার যা বলে তাই করো, নিজে কোনও সিদ্ধান্ত নিও না। দাদা আমাকে শান্ত করতে বলে দিল, ডাক্তার নাকি বলেছে বাড়ি নিয়ে যেতে পারে, মুখের ওষুধ দিয়ে দিয়েছে। গলায় কাঁচা ফুটো নিয়ে বাড়ি যাবে, আমার কিছুতে মন সায় দেয় না। কিন্তু দূর থেকে কতটুকুই বা করতে পারি আমি! বাবার সঙ্গে কথা কী বলবো, শরীরের ওই অবস্থায় বাবা শারীরিক ভাবে যত না, মানসিক ভাবে তার চেয়ে অনেক দুর্বল। ডাক্তার যখন দেখলো রোগীকে বাড়ি নিয়ে যাবেই দাদা, বললো পারলে বাড়িতে যেন স্যালাইনে কড়া অ্যান্টিবায়োটিক ইনজেকশান দেওয়ার ব্যবস্থা করে। না তা দেওয়া যাবে না, অগত্যা দাদা মুখে খাওয়ার কড়া ওষুধ লিখিয়ে নিয়ে এলো। কিন্তু ওই ওষুধের দাম যদি একটা পাঁচ টাকা হয়, দাদা নিশ্চিতই ভাববে ওষুধ কোম্পানিগুলোর মাথা খারাপ, লোক ঠকানোর ব্যবসায় নেমেছে ওরা। কী করবে দাদা? দেশি কোনও কোম্পানির অ্যান্টিবায়োটিক কিনে আনবে যেটার পঞ্চাশ পয়সা করে দাম। তাই করলো দাদা। সাংঘাতিক বুদ্ধিমানের কাজ করলো বটে। নিজের অতিবুদ্ধির জন্য দাদা নিজে বেশ গর্বিতও। সাধারণের চেয়ে বুদ্ধি তার বেশি, তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত নিতে দাদার মতো খুব বেশি কেউ আর নেই।
কী হল তারপর, বাড়িতে ভীষণ জ্বরে পড়লো বাবা। জ্বরে অনেকটাই অজ্ঞান। তখন হাসপাতালে নিয়ে গেলে ডাক্তার বলে দিল, সেপটিসেমিয়া। সারা শরীরে, সারা রক্তে তখন ব্যাকটেরিয়া ছড়িয়ে পড়েছে। বাবার মাথাও অকেজো করে দিয়েছে। সেপটিকশকে চলে গেছে বাবা। যেন মুহূর্তের মধ্যে হয়ে গেল এমন। বাবা তখন কিছু বুঝতে পারে না, কিছু বলতে পারে না, মুখ দিয়ে শুধু গাঁ গ্যাঁ শব্দ বেরোয়। ভেবেছিলাম বেঁচে থাকলে বাবাকে কোনও না কোনও একদিন বাবা বলে ডাকবো, ভেবেছিলাম বাবাকে তুমি বলে ডাকবো। ডাকি বাবাকে। বাবার কানের কাছে ফোন দেওয়া হয়। বাবা তখন তো বোবা, বধির। বাবাকে বাবা বলে ডেকেছি, বলেছি বাবা তুমি জেগে ওঠো। হ্যাঁ, যখন সত্যি ডাকলাম, বাবা আমার এই ডাক শুনতে পায়নি। বড় দেরি হয়ে গেল মা।
বড় মামা, ঝুনু খালা সব গেছে দেখতে। তারা এই বোবা বাবাকে দেখে বিমূঢ়। আমি স্তব্ধ হয়ে আছি দূর বিদেশে। আমার সারা গা কাঁপছে আশংকায়। যদি আমাকে দেশে ফিরতে দেওয়া হত, বাবার এই অবস্থা হতে পারতো না মা। তুমি ভাগ্যে বিশ্বাস করতে পারো, আমি করি না। আমি মনে করি না কোথাও কেউ মানুষের জন্ম মৃত্যুর তারিখ লিখে রেখেছে। এবং সেই তারিখ অনুযায়ী সব ঘটছে। বাবা আজও বেঁচে থাকতে পারতো, বিদেশে তার কিডনি ট্রান্সপ্লান্ট হতে পারতো, দিব্যি আগের মতো জীবন যাপন করতে পারতো। জীবন তো মানুষের একটাই। এই জীবনটাকে যে করেই হোক বাঁচিয়ে রাখতে চাই আমরা। কিন্তু তুমি যদি জীবনের মূল্য না বোঝে, তবেই তুমি টাকা পয়সার হিসেব করবে, হাসপাতালে অসুস্থ মানুষকে চিকিৎসার জন্য না রেখে তুমি বাড়ি নিয়ে আসবে, কারণ এতে সুবিধে, দৌড়োদৌড়িটা কম হয়।
বাবা আবার কথা বলতে পারবে, এই আশায় আমি বসে থাকি, বার বার শুনছি অবস্থার কোনও পরিবর্তন হয়নি। দাদা, ছোটদা, ঝুনু খালা, বড় মামা, ফকরুল মামা সবার সঙ্গে কথা বলি। সবাই বিষণ্ণ। বাবা ফিরছেনা। তাকাচ্ছে চারদিকে, সেই তাকানো অর্থহীন। মুখের শব্দকে কেউ কেউ অনুবাদ করার চেষ্টা করছে, কিন্তু সবই নিশ্চয়ই ভুল অনুবাদ। ঝুনু খালা শুধু বললো, দুলাভাই কিছু বলতে চাইছে, পারছে না। কী বলতে চাইছিলো বাবা?
একসময় আমাকে জানিয়ে দেওয়া হল, বাবা আর শ্বাস নিচ্ছেনা। ঝুনু খালা ফোনে হাউমাউ করে কাঁদলো। আমি আর জানতে চাইনি এরপর কী ঘটছে। বাবাকে নিয়ে কী মৃত্যুউৎসব তারা করছে, জানতে চাইনি। আমার আগ্রহ, আবেগ সব বেঁচে থাকাকালীন। আমি মৃত্যুরপরের কোনও কিছুতেই বিশ্বাসী নই। জগৎ আমার সম্পূর্ণই ফাঁকা হয়ে গেছেমা। শেষ আশ্রয় বলে কিছু থাকে, বাবা আমার তাই ছিলো। বাবা ছিলো আমার গৌরব, জীবনের সবচেয়ে বড় অহংকার। বাবা ছিলো আমার পথ প্রদর্শক, আমার সাহস আর শক্তির উৎস। বাবা ছিলো বলেই আমি আজ আমি, এই যে মাথা উঁচু করে আজ পৃথিবীর সব দেশে চলতে পারি, সে বাবা আমাকে গড়ে দিয়েছিলো বলেই। আমার বাবা যদি অন্য কেউ হতো, তাহলে আজি আমিও অন্য কেউ হতাম। জীবনের যা কিছুই আমার কৃতিত্ব, বাবা ছাড়া কিছুই সম্ভব হতো না। সংগ্রামী বাবাকে দেখে দেখেই সংগ্রাম করতে শিখেছি। সামনে দুর্যোগ এলে বাবা যেমন করে সামলাতো, তেমন সামলাতে আমিও শিখেছি। আদর্শের জন্য প্রাণপাত করতে বাবা ছাড়া আর কাকে দেখেছি, চোখের সামনে!
.