What's new
Nirjonmela Desi Forum

Talk about the things that matter to you! Wanting to join the rest of our members? Feel free to sign up today and gain full access!

Collected নেই কিছু নেই (আত্মজিবনী) (1 Viewer)

১১.

মা, শেফালিকে অবকাশে রেখে চলে গেছে, আমিও ওকে রেখে এসেছি অবকাশে। শেফালির সৎমার সংসারে আপন বলতে একটি মাত্র ভাই, সে ভাইও জানি না কী অপরাধ করে এখন জেলখানায়। শেফালি তার বেতনের টাকা জমিয়ে ভাইকে দিয়ে আসতো দুতিন মাস পর পর। একদিন ভাইটি বেরোবে জেল থেকে, বিয়েথা করে সংসার শুরু করবে, শেফালির এই একটিই স্বপ্ন। তার আর কোনও স্বপ্নের কথা আমি জানি না। বয়স আঠারো বা উনিশ, ছিলো বোধহয় কোনও স্বপ্ন, তুমি সম্ভবত জানো। এক শেফালি ছাড়া আর কেউ তোমার ওপর নির্ভর ছিলো না, তুমি ওকে একা রেখে চলে যাওয়ার পর বাবার দেখাশোনা করার দায়িত্ব শেফালি নিজেই নিলো। সে কাজটা বাড়তি কাজ, বাড়ির সবার জন্য সারাদিনের খাটাখাটনির পর বাবার ঘরটা গুছিয়ে রাখবে, বাবাকে খাবার দেবে। শেফালিকে প্রায়ই ফোন করে খুব আদর করে বলি, যেন বাবাকে দেখে রাখে, বাবার যেন কিছুতে খুব মন খারাপ না হয়। সেই হাসিখুশি শেফালি, ছুটে ছুটে বাড়ির সব কাজ একাই সেরে ফেলা শেফালি, হঠাৎ শুনি, মারা গেছে। সকালে কাপড় কাঁচতে গিয়ে কলের পাইপে হাত দিতেই ইলেকট্রিক শক লেগে ঠায় দাঁড়িয়ে রইলো। চিৎকার করেছিলো, সে চিৎকারে বাড়ির লোক দৌড়ে গিয়েছে বটে কাছে, কিন্তু ওকে বাঁচাবার চেষ্টা করতে কেউ সাহস পায়নি। মা, যে মেয়েটা তোমার কাছে কাছে থাকতো অনেক বছর, তুমি মারা গেলে সবচেয়ে বেশি কেঁদেছে যে মেয়ে, যে মেয়ে বাড়ির সবার আরামের জন্য দিন রাত পরিশ্রম করেছে, তাকে ইচ্ছে করলেই বাঁচানো যেত, কিন্তু সবাই দূর থেকে দাঁড়িয়ে দেখেছে ওর মরে যাওয়া। শেফালির ভাই মোটা অংকের একটা টাকা দাবি করেছিলো, নাহলে মামলা করবে বলেছিলো। দাদা নানা রকম আয়োজন করেছে টাকা না দিয়ে মীমাংসা করার। অথবা যদি দিতেই হয় টাকা, দাদার মাথায় শুধু যত কম দিয়ে পার পাওয়া যায় সেই ভাবনা। আমি টাকার পরিমাণ দাদাকে বারবার বলি বাড়াতে। কিন্তু আমার বলায় কী যায় আসে বলো! ওদের সবার কাছে আমি তোমার মতোই মৃত। আমার কণ্ঠস্বরকে ওরা কণ্ঠস্বর বলে মনে করে না। কণ্ঠস্বরের ওপারে যে জলজ্যান্ত একটা মানুষ আমি, তা তাদের আচরণে কোনওদিন প্রকাশ পায়নি। টাকা জিনিসটা চারদিকের সবার কাছে অত্যন্ত প্রিয়। শেফালির চলে যাওয়া সবচেয়ে বেশি ভুগিয়েছে বাবাকে। তুমি নেই, আমি নেই, ইয়াসমিন নেই, শেফালি নেই। বাবাকে নিঃস্বার্থভাবে ভালোবাসার আর কেউ তখন সংসারে নেই। দাদা আর হাসিনার ইচ্ছের মুঠোয় বাবাকে বন্দি হতে হল।

বাবা কেমন আছে, কী করছে খোঁজ নিতে প্রায়ই ফোন করি। বাবা বলে বটে যে ভালো আছে, কিন্তু বাবার কণ্ঠস্বরে আমি টের পাই বাবা ভালো নেই। বাবা কোনওদিনই তার অসুখের কথা কাউকে জানায় না। একদিন দাদা খুব সহজ শান্ত গলায় বললো বাবার কিডনি নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। শুনে আমার বুকের ভেতর থেকে ঠাণ্ডা একটা, জানি না কী নাম তার, মুহূর্তে সারা শরীরে ছড়িয়ে গেল। কিডনি কবে থেকে নষ্ট হচ্ছে? দাদার বক্তব্য আমার নাকি জানার কথা সব। সেই যে বাবা কলকাতায় এসেছিলো, তখনই নাকি কলকাতার ডাক্তাররা বলেছিলো কিডনি নষ্ট হচ্ছে। এসবের কিছুই জানি না আমি। কোনও ডাক্তার আমাকে বাবার কিডনি নষ্ট হওয়ার কথা কিছু বলেনি। ঘরে বাইরে সারাদিন অস্থির পায়চারি করলাম। ভেতরে বুদবুদের মতো দেশে ফেরার ব্যাকুলতা। বাবার এই দুঃসময়ে যদি পাশে না থাকতে পারি, তবে বেঁচে থাকার কী অর্থ! আশংকায় আমি কুঁকড়ে থাকি। অন্ধকারে নিজেকে মুড়ে একাপড়ে থাকি ঘরের কোনও কোণে। ফোন বাজলে বুকের ধুকপুক এমন বাড়ে যে মনে হয় দৌড়ে পালাই। একদিন অভিমানের গায়ে পাথর চাপা দিয়ে ইয়াসমিনকেই কাতর অনুনয় করি, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব যেন সে দেশে যায়। ইয়াসমিনেরও নিজের সমস্যার অন্ত নেই। বলতেও পারতো সে যাবে না, কিন্তু তোমার মৃত্যু তার স্নায়ুর ঘরবাড়িতে ভূকম্পন তুলে জানিয়ে গেছে মৃত্যু জিনিসটা ঠিক কী। কারও মৃত্যু না হলে আমরা বোধহয় দেখতে পাই না মৃত্যুর সত্যিকার চেহারা। ইয়াসমিন তড়িঘড়ি বাবার জন্য খাবার দাবার কাপড় চোপড় আর নানারকম উপহার কিনে রওনা হলো দেশে।

দাদার অভিযোগ শুরু হয়েছে বাবার নাকি হরেকরকম বান্ধবী আছে। বান্ধবীরা বাবার সঙ্গে দেখা করতে বাড়িতে ঢুকতে চায়। ওদের অর্ধচন্দ্র দিয়ে বাড়ি থেকে প্রতিদিনই বিদেয় করে দাদা। বিদেয় করার ঘটনা দাদা বেশ বীরত্বের সঙ্গে বর্ণনা করে। তার বীরত্ব আমাকে মোটেও পুলকিত করে না। দাদাকে বলি যা ইচ্ছে হয় বাবার, তাই যেন তাকে করতে দেওয়া হয়। বান্ধবীদের সঙ্গে বাড়িতে বসে বাবা কথা বলতে চাইলে বলবে। শুতে চাইলে শোবে। বাবার চরিত্র সংশোধনের গুরুদায়িত্ব দাদাকে নিতে বারবার বারণ করি। জীবন একটিই, এই জীবনটি যেমন ইচ্ছে যাপন করার অধিকার আরসবারমতো বাবারও আছে। সারা জীবন স্বাধীনতা ভোগ করে আসা মানুষকে অসুখের দোহাই দিয়ে টেনে হিঁচড়ে একটি বন্ধ ঘরে ঢুকিয়ে বন্দি করা হলে কেমন অস্থির হয় তার ভেতর বাহির, তা বাবা না হয়েও আমি অনুভব করি। বাবার মন ভেঙে যাচ্ছে, শরীর ভেঙে যাওয়ার চেয়েও তা অনেক বেশি ক্ষতিকর। শরীর যখন যাবার, যাবে। মনকে মরতে দিতে নেই। তুমি নেই মা, এখন আর বাবাকে তার বান্ধবীদের কাছ থেকে জোর করে দূরে সরিয়ে কার কী ভালো দাদা করছে! তুমি থাকাকালীন যে কাজটা কেউ কোনওদিন করেনি, তুমি না-থাকাকালীন কেন? বাবাকে এরকমও আর আশ্বাস দেওয়া হচ্ছেনা যে সে তার হারিয়ে যাওয়া জগৎটি ফিরে পাবে একদিন। অবকাশের অন্দরে বন্দি করে বাবার মতো কাজপাগল মানুষকে বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে, মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করা ছাড়া বাবার আর কাজ কিছু নেই। কী ভয়ংকর নিষ্ঠুর এই আচরণ। বাবার চেম্বারে চিরতরে তালা লাগিয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা দাদার একার। ধীরে ধীরে বাবাকে নিজের মুঠোয় নিয়ে দাদা কী খেলা খেলছিলো কে জানে! কারও কথায় বাবা উঠছে বসছে, দৃশ্যটি বড় অচেনা ঠেকে। কী করে জানিনা দাদার হাতের ক্রীড়নক হয়ে পড়েছিল বাবার মতো ভয়ংকর একগুঁয়ে মানুষ! সম্ভবত কিডনি নষ্ট হওয়ার খবর বাবাকে বদলে দিয়েছিলো আগাগোড়া। মনে আছে, অবকাশের একটি ঘরে মৃত্যুর সঙ্গে রোজ যুদ্ধ করে চলেছো, বাবা বাড়ির বাইরে যেতে চাইলে আমি কালো ফটকে তালা দিয়ে রাখতাম, চাইতাম বাবা বাড়ি থাকুক। দিন দিন তুমি যুদ্ধে হেরে যাচ্ছো, মৃত্যু তোমার শরীর জুড়ে উলঙ্গ নৃত্য করছে, আমি চাইনি বাবা এ সময় বাড়ি ছেড়ে অন্য কোথাও যাক। কিন্তু বাবার ওপর জোর চালিয়ে শেষ পর্যন্ত আমি জিততে পারিনি। যে করেই হোক বেরিয়ে গেছে বাবা। কেঁদে কেটে, অনশন করে, অভিমান করে, রাগ করে, চিৎকার করে হলেও বেরিয়েছে। তুমি মরে যাচ্ছে, তাতে কী, বাবা তো বেঁচে আছে, বেঁচে থাকতে হলে সবার আগে তাকে তার জগতে ফিরতে হবে। সেই জগৎ আমাদের সবার জগৎ থেকে আলাদা। সেখানে রোগী আছে, রোগিণী আছে। রোগ শোক চিকিৎসা বন্ধু বান্ধব আড্ডা গল্পগুজব চানাচুর বাদাম ইত্যাদি আছে। বহুঁকাল ধরে গড়ে তোলা বাবার নিজস্ব এই জগৎ। কোনও কিছুই তাকে সেই জগৎ থেকে সরাতে পারে না। তোমার মৃত্যুও নয়। সেই জগৎটি বাবার কাছ থেকে হঠাৎ কেড়ে নেওয়া হল। অনেককাল আগে বাবা আমাকে বলেছিলো তার মৃত্যু যেন হয় ওই চেম্বারের ওই চেয়ারে বসে, রোগীর প্রেসক্রিপশান লিখতে লিখতে, হঠাৎ। যে বাবা কোনওদিন একটি মুহূর্তের জন্য অবসরে বিশ্বাস করতো না, তার কেন ভালো লাগবে ভয়াবহ অবসর! বাবা যতটা অসুস্থ ছিল, তার চেয়ে বেশি অসুস্থ হতে লাগলো। অস্থিরতা চরমে উঠে সর্বনাশ করতে লাগলো তার। জীবনে প্রথম তাকে ভোগ করতে হচ্ছে বন্দিত্ব, প্রথম তাকে বুঝতে হচ্ছে যে তার ইচ্ছের কোনও মূল্য নেই আর। পুরুষদের সঙ্গে দেখা করার অধিকার বাবার আছে, মহিলাদের সঙ্গে নেই। এই নেইটা দাদার আদেশ। প্রথম প্রথম উপদেশ দিতো হয়তো, সেই উপদেশ ধীরে ধীরে আদেশে পরিণত হয়েছে। বাবার শারীরিক বা মানসিক অবস্থার কথা ভাবার কারও সময় নেই তখন! দাদা আর ছোটদা অলক্ষ্যে হয়তো বাবাকে মৃত্যুর জন্য তৈরি করেছিলো। ইচ্ছে করে ছুটে যাই, বাবাকে বাবার মতো করে তার শেষ কটা দিন বাঁচতে দিই। কিন্তু বন্দি তো বাবার চেয়েও বেশি আমি। বাবার মন প্রফুল্ল থাকে, আনন্দময় থাকে, এমন পরিবেশই বাবাকে দেওয়া হোক, এক এক করে ভাইদের, আত্মীয়দের সবাইকেই বলি। কিন্তু দূরের মানুষের দীর্ঘশ্বাস বা উপদেশ কিছুই কেউ গ্রাহ্য করে না। খুব ভালো করে বুঝি যে বাবা আর আগের বাবা নেই। কণ্ঠে অবসাদ। আশার আঙিনাগুলো আশংকায় আচ্ছাদিত। দাদা আগে বাবার কানে কানে কথা বলতো, মামা খালাদের বিরুদ্ধে যা নয় তা বলে কান ভারি করতে বাবার। কানাকানি দাদা এখন বাবার সঙ্গে করে না, যদি করে, করে ছোটদার সঙ্গে। কী করে বাবাকে শেকলে বাঁধা যায় এ নিয়ে জল্পনা। বাবা নাকি কথা শোনে না, বাইরে বেরিয়ে যায়। বাবাকে হয়তো শেকল দিয়ে বাঁধারই বন্দোবস্ত হচ্ছিল। বেঁধেছিল কি না জানি না, তবে ঘরে ঢুকিয়ে বাইরে থেকে যে শেকল দিয়েছিল তা জানি। কেন, খুব নাকিপাগলামি করে বাড়ি থেকে বাইরে বেরোনোর জন্য? যদি বাইরে বেরিয়ে আবার ওই মহিলাদের বাড়ি চলে যায়! দুএকজন মহিলা নিয়ে দাদার তখন মাথা খারাপ হবার যোগাড়। কেন, মহিলারা বাবার বান্ধবী। এ বাবার ব্যক্তিগত ব্যাপার। তুমি যখন হা হুতাশ করে মরতে, বাবার বান্ধবী বা স্ত্রী নিয়ে তুমি যখন বছরের পর বছর কেঁদে বুক ভাসাচ্ছো, কই দাদা তো মোটেও বাবার বান্ধবী-নেশা ঘোচানোর কোনও চেষ্টা করেনি। এখন হঠাৎ কেন? কারণ তুমি কি অনুমান করতে পারছে না মা? দাদার একটিই কেবল দুশ্চিন্তা। ওই মহিলাদের কাউকে আবার বিয়ে টিয়ে করে বসেনি তো কখনও। তাহলে তো বাবার বিরাট সম্পত্তির কোনও অংশ ওদের কারও হাতে চলে যাবে।

তোমার অবর্তমানে শুনেছিলাম কোন এক বিধবা ভদ্রমহিলার সঙ্গে নাকি বাবার বিয়ে জাতীয় কিছুকরিয়ে নেওয়া হয়েছিল, বৈধভাবে তারা মেলামেশা করতে পারবে এরকম কিছু। অবকাশে দাদারাই এটি ঘটার ব্যবস্থা করেছিলো। ভদ্রমহিলা নাকি অবকাশে প্রায়ই যেত, বাবাও যেতে তার বাড়িতে। যার সঙ্গে বাবা ঢাকায় বসে ফোনে কথা বলেছিলো, শুনে তুমি কেঁদেছিলে, তার সঙ্গেই এই ঘটনা। মেলামেশা করার আর কোনও রকম আইন আছে কিনা বিয়ে ছাড়া, আমার জানা নেই। তবে মুসলমানের আইন তো, পুরুষের বহুগামিতার সুযোগ সুবিধে বিস্তর। আমি তো দূরের মানুষ, দেশে আর কোনও দিন ফিরতে না পারা মানুষ। আমাকে খুব বেশি কিছু। জানানোও হয় না। নিজে ফোন করে বার বার জিজ্ঞেস করে করে যদি কিছু জানি তো জানি।

বাবা যা কিছুই করুক, তোমার অসুস্থতার সময় বাবার ওপর আমার যত রাগছিল, তুমি না থাকার পর কী করে যেন সব জল হয়ে গেল। তাকেই আঁকড়ে ধরে তোমার শূন্যতাকে আড়াল করতে চাইতাম মনে মনে। আমার সব মনে মনেই ছিল মা। তোমার সঙ্গে তোমার জীবনের বেশির ভাগ সময়ই বাবা অন্যায় ছাড়া আর কোনও আচরণ করেনি জানি মা। কিন্তু তারপরও বাবাকে আমি শ্রদ্ধা না করে পারি না। তুমিও তো চাওনি বাবার সঙ্গে কোনও অশোভন আচরণ করি। চিরকাল ভয়ে সিঁটিয়ে থেকেছি। বাবা আমাদের পেটাতো, ভয় দেখাতো। কিন্তু ভালোও তো বাসতো। তার ভালোবাসা কখনও অন্য বাবাদের ভালোবাসার মতো ছিল না। বাবারশাসনে জানি না ছেলেমেয়েরা কতটুকু মানুষ হয়েছে। দাদা তো চিরকালই বাবার ওপর নির্ভর করেই জীবন কাটালো। ছোটদাও অনেকটা। বাবার স্বপ্নপূরণ এক আমিই করেছিলাম। হুট করে ঢাকা মেডিকেল কলেজের চাকরি ছেড়ে দেওয়ায় বাবা মাথায় হাত দিয়ে বসেছিলো। কিন্তু আমার সিদ্ধান্ত আমার সিদ্ধান্ত। আমি সম্ভবত বাবার মতো হয়েছিলাম। আমার মনোবলটা বাবার কাছ থেকে পাওয়া। ঝড় ঝঞ্জার সামনে ঋজু দাঁড়িয়ে থাকা বাবা। ভয় না পাওয়া, রুখে ওঠা, প্রতিবাদ করা বাবা। স্বনির্ভর হওয়া, মাথা উঁচু করে বাঁচা, বাবা। অহংকার, আত্মবিশ্বাস, বাবা। আর তুমি হচ্ছ আমার ভেতরে যে অবিশ্বাস্যরকম যে এক নরম হৃদয় আছে, মানুষের জন্য কাঁদা, কেঁদে বুক ভাসানো, সেটা বিলিয়ে দেওয়া, ভালোবেসে অকাতরে দান করা, তুমি। মাঝে মাঝে তীব্র হতাশায় যখন ডুবে থাকি, মনে হতে থাকে পৃথিবীতে কেউ বুঝি আমাকে ভালোবাসে না, আমি একা, একটি বিন্দুর মতো আমি একা, মনে হতে থাকে কী দরকার এই বেঁচে থাকার–সেটা তুমি। ছেলেমেয়েদের আর কারও মধ্যে এত তীব্র ভাবে তোমাদের দুজনের উপস্থিত নেই। ইয়াসমিন একটা সময় দুর্বিনীত দুরন্ত মেয়ে ছিল। কিন্তু ধীরে ধীরে বয়স বাড়ার পর বাবার সব গুণ চলে গিয়ে তুমি এসে উপস্থিত হয়েছে ওর মধ্যে। ঠিক তোমার মতোই অশান্তির সংসার ও করে যাচ্ছে। প্রায়ই স্বামীকে ত্যাগ করার কথা বলে, কিন্তু সন্তানের জন্য পারে না। আত্মবিশ্বাসের এক ফোঁটা কিছু নেই। নিজেকে কুৎসিত বলে মনে করছে, যদিও কুৎসিত নয়। তোমার আত্মবিশ্বাস ছিল, কিন্তু তোমার উপায় ছিল না। ইয়াসমিনের উপায় থাকলেও মনের জোর নেই। আসলে তোমার গুণগুলো ওর মধ্যে গিয়ে দোষে পরিণত হয়েছে। গুণএর মাত্রা অতিরিক্ত হলে সেটা আর গুণ থাকে না। ধরো মানুষের জন্য জীবন দেওয়ার গুণ যদি আমার ভেতরে আরও বেশি মাত্রায় থাকে, আমাকে হয়তো আত্মহত্যা করতে হবে। আর, বাবার গুণই ধরো, শক্তি সাহস, সংকল্প, দৃঢ়তা ঋজুতা ইত্যাদি অতিরিক্ত হলে জানি না কী করবো, হয়তো মৌলবাদীর সশস্ত্র মিছিলের সামনে বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়ে বলবো, সাবধান এক পা এগোবি না। দাদা আর ছোটদার মধ্যে আমি তোমাকে দেখি না। বাবার মেয়েমানুষের দোষ দ্বিগুণ বা ত্রিগুণ হয়ে ছোটদাকে ধরেছে। একসঙ্গে বেশ কটি সুন্দরীর সঙ্গে গোপন সম্পর্ক রাখতে সে পারদর্শী। বাবার সেদিক থেকে কপাল ভালো ছিল না। বিবাহিতা, অসুখী, অসুন্দরী, নিগুণ, এমনই দুএকটি ছিল হয়তো কপালে, কেউই কিন্তু তোমার চেয়ে দেখতে ভালো, তোমার চেয়ে বুদ্ধিমতী বা কম বয়সি ছিলো না, অন্তত যে দুজনের কথা শুনেছি। দাদার মাথা থেকে পা পর্যন্ত বাবার একটি গুণই দোষের মতো দেখা দেয়। বাবার মিতব্যয়িতা দাদার ভেতরে প্রবল পরিমাণে ঢুকে কৃপণতার আকার ধারণ করেছে। বাকিগুণ বা দোষ অত প্রকাশিত নয়। কৃপণতা অবশ্য তার বউ ছেলেদের ক্ষেত্রে তত নেই, যতটা বাকি পৃথিবীর জন্য।

মা, মাঝে মাঝে মনে হয় বহুগামিতা মানুষ নামক প্রজাতির স্বাভাবিক প্রবৃত্তি। আমরা সমাজের বিধি নিষেধ নিজেদের ভেতর ধারণ করে আমাদের স্বভাবজাত বহুগামিতাকে শরীরের না হলেও মনের শক্তি দিয়ে রোধ করি। ভালোবাসা নামক একটি দেয়াল এসে আমাদের সামনে অনড় দাঁড়ায়। সেই দেয়াল ডিঙিয়ে আমরা তথাকথিত পরনারী বাপরপুরুষের কাছে যেতে পারি না। বাবা যদি বহুগামিনা হতো, তোমরা দুজনেই খুব সুখী হতে পারতে। হঠাৎহঠাৎ যখন বাবার সঙ্গে তোমার ঘনিষ্ঠতা হতো, দুজনকেই কী প্রফুল্ল দেখতাম। ওরকম যদি সবসময় থাকতে পারতে। জানি তোমার উদ্যোগে কোনও কাজ হত না। বাবা যদি এগিয়ে আসতো, তবেই সম্ভব হত সম্পর্ক মধুর করা। তুমি তো একপায়ে সারাজীবন খাড়াই ছিলে বাবার সামান্য ভালোবাসা পেতে। তোমার অসুখ ধরা পড়ার পর বাবা যে বাধ্য স্বামীর মতো তোমাকে আদরযত্ন করতে শুরু করলো, নিজের বাড়িঘর, রোগী দেখা, বান্ধবী, সব ফেলে সব ভুলে–জানি না ওর পেছনে কী কাজ করেছিলো? অপরাধবোধ! মনে হয়। দুজনই তোমার অসুস্থতার সময় সবচেয়ে বেশি নিঃস্বার্থভাবে সেবা করেছে, সে বাবা আর আমি। বাবার আর আমার আরও গুরুত্বপূর্ণ মিল বোধহয় এটাও।

বাবাকে কোনওদিন কি বোঝাতে পেরেছি ভালোবাসি? তোমার জীবনের শেষ কটা দিন তোমার পাশে থেকে না হয় মিথ্যে হোক সত্যি হোক, বুঝিয়েছি ভালোবাসি। বাবার সেবা করা আমার পক্ষে সম্ভব হয়নি মা। সুইডেনের বাংলাদেশ দূতাবাসে গিয়ে আমার পাসপোর্টের মেয়াদ বাড়ানোর জন্য আবেদন করলাম, শেখ হাসিনার কাছে চিঠিও লিখলাম যেন আমাকে কিছুদিনের জন্য অনুমতি দেন দেশে ফেরার। জানিয়েছি, বাবা ভীষণ অসুস্থ, তাকে না দেখলেই নয় আমার। তারপরও কোনও উত্তর নেই। রাষ্ট্রদূত নিজে বেশ কয়েকবার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ে চিঠি পাঠালেন এর গুরুত্ব বুঝিয়ে, সেসবেরও কোনও উত্তর নেই। উত্তর নেই ঠিক বলবো না, উত্তর হচ্ছে, না। অথচ দেখ, উঠতে বসতে শেখ হাসিনা কী কান্নাই না কাঁদছেন তাঁর নিজের বাবার জন্য! অথচ আমার বাবাকে দেখতে যেতে দিতে তাঁর আপত্তি। ওদিকে বাবা আমাকে যে কথা আগে কখনও বলেনি, বলছে যেন দেশে ফেরার চেষ্টা করি। বুঝি আমাকে দেখার জন্য বাবা ব্যাকুল হচ্ছে। ভয় নাপাওয়া বাবাও, বুঝি যে ভেঙেপড়েছে। আমারআর্তনাদ, আমারআকুলতা কিছুই বাংলাদেশ সরকারকে স্পর্শ করে না। বাবা তার মেয়েকে ডাক্তার বানালো, বাবার অসুস্থতার পাশে সবাই আছে, শুধু তার ডাক্তার মেয়েটি নেই। ডাক্তারির কিছুই না জানা দুই পুত্রধন বাবার পাশে আছে, যারা অনেকটা বাবার চিকিৎসকের ভূমিকা নিয়েছে। বিশেষ করে দাদা। দাদা নিজেকে প্রায়শ ডাক্তার বলে মনে করে। নিজের ডাক্তারি পড়া হয়নি, ওষুধ কোম্পানিতে চাকরি করেছে, গ্রামে গঞ্জে ওষুধ নিয়ে গেছে, গ্রামের অশিক্ষিত লোকেরা দাদাকে ডাক্তার বলে ডেকেছে। তারপর চাকরি ছেড়ে বাবার ফার্মেসিতে বসেছে, ওষুধ নিয়ে কারবার বলে বাজারের মাছওলা, তরকারিওলা ভাবতো ডাক্তারের ছেলে বুঝি ডাক্তারই হয়েছে। তারাও দাদাকে ডাক্তার ঠাওরাতো। ও কারণেও দাদারও ধারণা হয়েছে দাদা বুঝি ডাক্তারই। এখন বাবার অসুখের চিকিৎসা দাদা নিজ দায়িত্বে নিজের হাতে তুলে নিয়েছে। দাদাই সিদ্ধান্ত নেয় বাবাকে কখন হাসপাতালে যেতে হবে, বা ডাক্তার দেখাতে হবে। বাবা, কী কারণে জানিনা নিজের কোনও অসুখের জন্য বড় কোনও ডাক্তার দেখাতো না। নিজের চিকিৎসা নিজেই করতো। জানতে চিকিৎসা, কিন্তু কখনও কখনও তো অভিজ্ঞ ডাক্তারের কাছে যেতে হয়। শহরে নতুন নতুন বিলেত ফেরত ডাক্তার এসেছে। অনেকে বাবার ছাত্র। ডাক্তারি বিদ্যায় বাবার জ্ঞান এমন ছিল যে বিলেত ফেরত এফ আর সি। এস পাশ করা ডাক্তারের হাতে রোগী মরতে বসলে বাবার কাছে এসে বাঁচতো। বাবাকে অনেক বলতাম বড় ডাক্তার দেখাতে, কখনও রাজি হত না। কলকাতার ডাক্তার যে ওষুধ দিয়েছিলো সেগুলো কখন কোনটা খেতে হবে, বড় কাগজে লিখে দিয়েছিলাম, যেন ভুলে না যায় বাবা, প্রয়োজনে যেন ঘরের দেয়ালে টাঙিয়ে রাখে। দেশে ফিরে বাবা ওই কাগজও ফেলে দিয়েছে, ডাক্তারের দেওয়া ওষুধও খায়নি। নিজের যা পছন্দ তাই খেয়েছে। খেয়ে তো দিব্যি ভালো ছিল মা। হৃদপিণ্ডের কোনও অসুখে তাকে ভুগতে হয়নি। রক্তচাপ নিজের মতো করে ওষুধ খেয়ে কমিয়ে রেখেছে। গোলটা বাধলো ডায়বেটিস নিয়ে। ওটাও ঠিক থাকতো যদি খাবারটা বাবার ঠিক থাকতো। বাড়িতে সবার জন্য যে খাবার রান্না হয়েছে সেগুলোই তো বাবাকে খেতে হয়েছে। কোনওদিন মদ সিগারেট খায়নি। শাক সবজি খেতো। স্বাস্থ্যকর বা পুষ্টিকর খাবার বাড়িতে আনতো। যখন দাদা বা সিনা দায়িত্ব নিয়ে নিল বাড়ির সব ব্যাপারের, সংসার খরচের টাকা পয়সাও তখন তাদের হাতে, তারাই সিদ্ধান্ত নেয় কী তারা খাবে। বাজার থেকে মাছমাংস অঢেল আসে। দই মিষ্টি আসে। বাবার খাবারের জন্য কিছু আসার চল ছিল না। ক্ষিধে পেলে বাবা হয়তো’সামনে যা পেতো খেয়ে নিতো। কলকাতায় যখন এসেছিলো, বাবাকে শর্করামুক্ত খাবার খাওয়ানোর দিকে খেয়াল করিনি। বাবার ডায়বেটিস ধরা পড়ার পর, তুমি যতদিন অবকাশে ছিলে, শাক সবজিই বেশি খাওয়াতে। তুমি বাবার খাবারটা ঠিকঠাক দিতে, তুমি না থাকলে দেওয়ার কেউ নেই। বাবার সবকিছু ওলোট পালোট হয়ে গেলো। চেম্বার নেই। রোগী দেখা নেই। বাড়িতে যখন বসেছিলো, বাড়িতে দুটো তিনটে রোগী আসতো। কিন্তু বাড়ি তো আর চেম্বার নয়, এতকালের চেম্বারের স্বাধীনতা বাবা বাড়িতে পেতো না, সেই আনন্দও আর ছিল না। কারও ওপর নির্ভরশীল বাবা কোনওকালেই ছিল না। নিজের অসুখ নিয়ে অন্যের মাথাব্যথাও কোনওদিন সইতে পারতো না।

একসময় শুনি বাবাকে ঢাকায় নিয়ে আসা হয়েছে। কী করে এলো বাবা? না, যে গাড়ি বাবার জন্য কেনা হয়েছিল, সেটায় নয়, বাসে করে। আমার দেওয়া সেই গাড়ি হাসিনার এদিক ওদিক ঘোরার কাজে লাগবে, অসুস্থ বাবার জন্য গাড়ি ব্যবহার করলে চলবে কেন! বাবাকে ঢাকার হাসপাতালে নিয়ে গেল দাদারা। আমি সারাক্ষণ ফোনে খবর নিচ্ছি বাবাকে সান্ত্বনা দিচ্ছি। এত কালের প্রতাপশালী মানুষের বিষঃ কণ্ঠস্বর। বাবার মতো মানুষকে ভীত হওয়া মানায় না। বাবাকে জানাতে খুব কষ্ট হয়, যে, আমাকে দেশে যেতে দিচ্ছে না সরকার। বাবা যে কী অসহায় বোধ করছে, সে আমি বুঝি। বাবা তো আমার জন্ম থেকে চেনা। তারশক্তি যেমন জানি, তার দুর্বলতাও জানি। চিরকাল শক্তিমান হিসেবেই বাবা থেকেছে সবার কাছে। ভেতরে কোনও কারণে দুর্বল হলেও প্রকাশ করেনি কোনওদিন। কিন্তু ভালোবাসলে টেরপাওয়া যায়। যায় না মা? শক্তিমানেরও হৃদয় থাকে, সেই হৃদয় একসময় ভাঙে। বাবা যে কত অভিমানী ছিল, তা আমি আগে না বুঝলেও এখন বুঝি। বাবা অনেকটা শিশুর মতোও ছিলো। নিউইয়র্কের হাসপাতালে যখন চেকআপের জন্য ধরে বেঁধে ভর্তি করিয়েছিলাম, মনে আছে একবার ডাক্তার এসে জিজ্ঞেস করেছিলেন, আপনার জন্ম তারিখটা বলুন তো! বাবা বললো, কোনটা বলবো? পাসপোর্টেরটা, সার্টিফিকেটেরটা, নাকি অরিজিনালটা। আমি হাসবো না কাঁদবো, বুঝিনি। বাবার কথা শুনে ডাক্তাররা মুখ টিপে হেসে বলেছিলেন, অরিজিনালটা বলুন।

বারডেম হাসপাতালের ডায়ালাইসিসের যন্ত্রপাতি সব আধুনিক। ডাক্তাররা যত্ন নিয়ে বাবাকে দেখছে, ওখানকার অনেক বিশেষজ্ঞই বাবার ছাত্র। দাদার কাছে এসব শুনে খানিকটা স্বস্তি হয়। কিন্তু একদিন অন্তর অন্তর শরীরের রক্ত পাল্টেনতুন রক্ত ভরতে বাবা কি আদৌ কোনও স্বস্তি পাবে, আমি বুঝে পাই না কী করবো। অকেজো কিডনির জায়গায় নতুন কিডনি বসানোর ব্যবস্থা যে করেই হোক করতে হবে। বাবাকে বলি কিডনি পাওয়া যাবে, অনেকে কিডনি দান করে, বিক্রি করে, কোনও একটা কিডনি তার জন্য পাওয়া যাবেই। একটুও যেন না ঘাবড়ে যায় বাবা। প্রতিদিনই মানুষের কিডনি ট্রান্সপ্লান্ট হচ্ছে। ট্রান্সপ্লান্টের জন্য তাকে বিদেশে নিয়ে আসবো, ইওরোপের কোনও দেশে নয়তো ভারতে। ওখানে কিডনি বিক্রি করার জন্য প্রচুর গরিব বসে আছে। কড়ি ফেললেই কেনা যায়। বাবা শুনে ভরসা পায়, কিন্তু বুঝি কী ভীষণ কষ্টকরই না এই অনিশ্চয়তার মধ্যে থাকা। টাকা পয়সার ব্যাপারে একদম না ভাবতে বলি বাবাকে। কিডনি নিয়ে দরদাম করার কোনও দরকার নেই। যত টাকা দরকার হয় কিডনি ট্রান্সপ্লান্টের জন্য, সব আমি দেব। বাবা একদিন জানালো, নান্দাইলএর এক লোক টাকার বিনিময়ে কিডনি দিতে রাজি। তাহলে কী আর ভাবনা, ওই লোককে নিয়ে বিদেশে যেতে হবে ট্রান্সপ্লান্টের জন্য। আমিও বসে নেই, বিভিন্ন দেশে হাসপাতাল আর ডাক্তারদের সঙ্গে কথা বলে কিডনির ব্যাপারে পাকাঁপাকি একটা ব্যবস্থা করতে থাকি। বাবার ডায়ালাইসিস এবং হাসপাতাল খরচের টাকা ব্যাংকের মাধ্যমে পাঠিয়ে দিই দাদার অ্যাকাউন্টে। বাবার কি টাকা নেই মা? তবে এই টাকা কেন আমাকে পাঠাতে হয়? এই প্রশ্নটি নিজে আমি করি না। কেউ চায়নি টাকা, তারপরও পাঠিয়ে দিই। পাঠিয়ে দিই এই কারণে যে বাবার টাকা পয়সার তদারকি এখন দাদা করছে। আর দাদার মতো কল্পণ লোক টাকা খরচের ভয়ে যদি চিকিৎসায় গাফিলতি করে, এই আশংকায় আমি পাঠাই। আমার টাকা নিয়ে অন্তত কৃপণতা করবে না এই একটি বিশ্বাস আমার। কিন্তু যারই টাকা হোক, যার পকেটে যখন যায়, সেটি তখন তার নিজের টাকা। আমার পাঠানো টাকা তখন দাদার হাতে, সে টাকা তখন দাদার, সুতরাং স্বভাবজাত কৃপণতা তার শুরু হয়ে গেল। দ্বিতীয়দিন যখন বাবা ডায়ালাইসিস করতে গেল বারডেমে, ডাক্তার বলেছিলো অ্যান্টিবায়োটিক দিতে হবে স্যালাইনের সঙ্গে। কিন্তু দাদা বাবাকে হাসপাতালে রাখতে রাজি নয়। রাজি নয়ের কারণ একটিই, খামোকা টাকা খরচ। বাবার গলায় ফুটো করে নল ঢুকিয়েছে ডাক্তার, কড়া অ্যান্টিবায়োটিক সরাসরি রক্তে ঢোকাতে হবে, মুখের ওষুধে কাজ হবে না। হাসপাতালে ডাক্তারদের কড়া নজরে রাখতে হবে বাবাকে। কিন্তু ডাক্তারদের কথা দাদা শুনবে কেন? বাবার নিজের কি আর মত দেওয়ার সামর্থ্য আছে, দাদা যা ভালো বোঝে তাই করবে। বাবা এখন দাদার সম্পত্তি। আমি যে ফোন করে বারবার বলছি, ডাক্তার যা বলে তাই করো, নিজে কোনও সিদ্ধান্ত নিও না। দাদা আমাকে শান্ত করতে বলে দিল, ডাক্তার নাকি বলেছে বাড়ি নিয়ে যেতে পারে, মুখের ওষুধ দিয়ে দিয়েছে। গলায় কাঁচা ফুটো নিয়ে বাড়ি যাবে, আমার কিছুতে মন সায় দেয় না। কিন্তু দূর থেকে কতটুকুই বা করতে পারি আমি! বাবার সঙ্গে কথা কী বলবো, শরীরের ওই অবস্থায় বাবা শারীরিক ভাবে যত না, মানসিক ভাবে তার চেয়ে অনেক দুর্বল। ডাক্তার যখন দেখলো রোগীকে বাড়ি নিয়ে যাবেই দাদা, বললো পারলে বাড়িতে যেন স্যালাইনে কড়া অ্যান্টিবায়োটিক ইনজেকশান দেওয়ার ব্যবস্থা করে। না তা দেওয়া যাবে না, অগত্যা দাদা মুখে খাওয়ার কড়া ওষুধ লিখিয়ে নিয়ে এলো। কিন্তু ওই ওষুধের দাম যদি একটা পাঁচ টাকা হয়, দাদা নিশ্চিতই ভাববে ওষুধ কোম্পানিগুলোর মাথা খারাপ, লোক ঠকানোর ব্যবসায় নেমেছে ওরা। কী করবে দাদা? দেশি কোনও কোম্পানির অ্যান্টিবায়োটিক কিনে আনবে যেটার পঞ্চাশ পয়সা করে দাম। তাই করলো দাদা। সাংঘাতিক বুদ্ধিমানের কাজ করলো বটে। নিজের অতিবুদ্ধির জন্য দাদা নিজে বেশ গর্বিতও। সাধারণের চেয়ে বুদ্ধি তার বেশি, তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত নিতে দাদার মতো খুব বেশি কেউ আর নেই।

কী হল তারপর, বাড়িতে ভীষণ জ্বরে পড়লো বাবা। জ্বরে অনেকটাই অজ্ঞান। তখন হাসপাতালে নিয়ে গেলে ডাক্তার বলে দিল, সেপটিসেমিয়া। সারা শরীরে, সারা রক্তে তখন ব্যাকটেরিয়া ছড়িয়ে পড়েছে। বাবার মাথাও অকেজো করে দিয়েছে। সেপটিকশকে চলে গেছে বাবা। যেন মুহূর্তের মধ্যে হয়ে গেল এমন। বাবা তখন কিছু বুঝতে পারে না, কিছু বলতে পারে না, মুখ দিয়ে শুধু গাঁ গ্যাঁ শব্দ বেরোয়। ভেবেছিলাম বেঁচে থাকলে বাবাকে কোনও না কোনও একদিন বাবা বলে ডাকবো, ভেবেছিলাম বাবাকে তুমি বলে ডাকবো। ডাকি বাবাকে। বাবার কানের কাছে ফোন দেওয়া হয়। বাবা তখন তো বোবা, বধির। বাবাকে বাবা বলে ডেকেছি, বলেছি বাবা তুমি জেগে ওঠো। হ্যাঁ, যখন সত্যি ডাকলাম, বাবা আমার এই ডাক শুনতে পায়নি। বড় দেরি হয়ে গেল মা।

বড় মামা, ঝুনু খালা সব গেছে দেখতে। তারা এই বোবা বাবাকে দেখে বিমূঢ়। আমি স্তব্ধ হয়ে আছি দূর বিদেশে। আমার সারা গা কাঁপছে আশংকায়। যদি আমাকে দেশে ফিরতে দেওয়া হত, বাবার এই অবস্থা হতে পারতো না মা। তুমি ভাগ্যে বিশ্বাস করতে পারো, আমি করি না। আমি মনে করি না কোথাও কেউ মানুষের জন্ম মৃত্যুর তারিখ লিখে রেখেছে। এবং সেই তারিখ অনুযায়ী সব ঘটছে। বাবা আজও বেঁচে থাকতে পারতো, বিদেশে তার কিডনি ট্রান্সপ্লান্ট হতে পারতো, দিব্যি আগের মতো জীবন যাপন করতে পারতো। জীবন তো মানুষের একটাই। এই জীবনটাকে যে করেই হোক বাঁচিয়ে রাখতে চাই আমরা। কিন্তু তুমি যদি জীবনের মূল্য না বোঝে, তবেই তুমি টাকা পয়সার হিসেব করবে, হাসপাতালে অসুস্থ মানুষকে চিকিৎসার জন্য না রেখে তুমি বাড়ি নিয়ে আসবে, কারণ এতে সুবিধে, দৌড়োদৌড়িটা কম হয়।

বাবা আবার কথা বলতে পারবে, এই আশায় আমি বসে থাকি, বার বার শুনছি অবস্থার কোনও পরিবর্তন হয়নি। দাদা, ছোটদা, ঝুনু খালা, বড় মামা, ফকরুল মামা সবার সঙ্গে কথা বলি। সবাই বিষণ্ণ। বাবা ফিরছেনা। তাকাচ্ছে চারদিকে, সেই তাকানো অর্থহীন। মুখের শব্দকে কেউ কেউ অনুবাদ করার চেষ্টা করছে, কিন্তু সবই নিশ্চয়ই ভুল অনুবাদ। ঝুনু খালা শুধু বললো, দুলাভাই কিছু বলতে চাইছে, পারছে না। কী বলতে চাইছিলো বাবা?

একসময় আমাকে জানিয়ে দেওয়া হল, বাবা আর শ্বাস নিচ্ছেনা। ঝুনু খালা ফোনে হাউমাউ করে কাঁদলো। আমি আর জানতে চাইনি এরপর কী ঘটছে। বাবাকে নিয়ে কী মৃত্যুউৎসব তারা করছে, জানতে চাইনি। আমার আগ্রহ, আবেগ সব বেঁচে থাকাকালীন। আমি মৃত্যুরপরের কোনও কিছুতেই বিশ্বাসী নই। জগৎ আমার সম্পূর্ণই ফাঁকা হয়ে গেছেমা। শেষ আশ্রয় বলে কিছু থাকে, বাবা আমার তাই ছিলো। বাবা ছিলো আমার গৌরব, জীবনের সবচেয়ে বড় অহংকার। বাবা ছিলো আমার পথ প্রদর্শক, আমার সাহস আর শক্তির উৎস। বাবা ছিলো বলেই আমি আজ আমি, এই যে মাথা উঁচু করে আজ পৃথিবীর সব দেশে চলতে পারি, সে বাবা আমাকে গড়ে দিয়েছিলো বলেই। আমার বাবা যদি অন্য কেউ হতো, তাহলে আজি আমিও অন্য কেউ হতাম। জীবনের যা কিছুই আমার কৃতিত্ব, বাবা ছাড়া কিছুই সম্ভব হতো না। সংগ্রামী বাবাকে দেখে দেখেই সংগ্রাম করতে শিখেছি। সামনে দুর্যোগ এলে বাবা যেমন করে সামলাতো, তেমন সামলাতে আমিও শিখেছি। আদর্শের জন্য প্রাণপাত করতে বাবা ছাড়া আর কাকে দেখেছি, চোখের সামনে!

.
 
তোমাকে যেমন অবকাশে অত্যাচার করছিলো দাদা আর দাদার বউ, একইরকম ভাবে বাবার ওপর শুরু হল অত্যাচার। এসব আমাকে বাবাই বলতো আর কাঁদতো। একসময় অবকাশে খাওয়া বন্ধ করে দিয়েছিলো। নিজের বাড়ি। নিজের টাকা। সব নিজের অথচ খাবার জোটেনি বাবার। অভিমানে বাবা, ডায়বেটিসে কিডনি নষ্ট হতে থাকা বাবা, যেখানে তার মাছমাংস খাওয়া বারণ, ছটকুর রেস্তোরাঁয় গিয়ে ওসবই খেতো৷ কী করবে বলো! কে তাকে আদর করে সবুজ সবজি সেদ্ধ করে দেবে। হাসিনা তো দেবে না। হাসিনার সঙ্গে রাগ করে বা অভিমান করে বাবা কথা বন্ধ করে দিলে লাভ হাসিনারই হয়। হাসিনা, আমার ধারণা, চাইছিলো বাবা যেন তাড়াতাড়ি মারা যায়। যেমন চাইছিলো তুমি যেন মারা যাও। কষ্ট পেতে পেতে, দুর্ভোগ পোহাতে পোহাতে যেন মরো। এত আদর করে বউকে ঘরে তুলেছিলে। মুখে তুলে খাওয়াতে। কোনওদিন যাকে রান্নাঘরের ছায়াও মাড়াতে হয়নি। কারও জন্য রাঁধা তো দূরের কথা। বরং বিয়েরপর বাবা তাকে কলেজে ভর্তি করিয়ে দিল, বিএড এমএড পাশ করতে। বউ কলেজ থেকে ফিরলে তুমি তাকে আদর করে খেতে বসাও, ঠিক যেমন করে তোমাদের ছেলেমেয়েদের খাওয়াও। যে বউ শুধু আমাদের দু বোনকে অপমান করে অবজ্ঞা করে অপদস্থ করে ছাড়েনি, এমনকী গায়েও হাত তুলেছে। ভেবেছিলাম দুবোনকেই বোধহয় শুধু। কিন্তু তোমার মতো মাটির মানুষকে, যে মানুষ জীবন দিয়ে দেয় ছেলে মেয়েদের জন্য, ছেলের বউদের জন্য, তাকে চোখের জলে ভাসাতো। তোমার টাকাপয়সা ধন দৌলত কিছু ছিল না। ছিল বড় একটা হৃদয়। এই তোমাকেই যে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছাই করে দিয়েছে, সে বাবাকে দেবে না কেন! বাবার আজীবন প্রতাপছিল। যে বাবাকে দেখে ভয়ে কেঁপেছি সারাজীবন, সেই বাবা দুর্বল হয়ে পড়লে গালি গালাজ করার স্পর্ধা তো আমাদের কারও হয়নি। হয়েছে হাসিনার। হাসিনা দিনভর অকথ্য ভাষায় বাবাকে গালি দিত। উঠতে বসতে অপমান করতো। বাবার সেই রোষ আর ছিল না। দাদা ভেঙে দিয়েছিল। বাবাকে ঘরবন্দি করে ভেঙে দিয়েছিল বাবার সব দাপট। বাবার চেম্বারবিক্রি করে দিয়ে গুঁড়ো করে দিয়েছিল বাবার সব স্বাধীনতা। পরাধীন বাবা মাথা নিচু করে দাদার আর দাদার বউএর অত্যাচার সইতো। প্রতিদিন। যে মামাদের বিরুদ্ধে কথা বলে বলে বাবা সময় কাটাতো দাদার সঙ্গে, দাদার বউএর অত্যাচার থেকে বাঁচতে সেই মামাদের কাছে গিয়ে বাবা আশ্রয় নিতো। ছটকুর কাছে সংসারের দুঃখের কাহিনী বাবা বলতো। সব শুনে ছটকু আমাকে ফোন করতো। যেন বাবার সমস্যার সমাধান করি, যেন বাবার কান্নাগুলো শুনি। বাবা সত্যি সত্যি কাঁদতো। মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকা বাবা, কোনও দুর্যোগ দুঃসময় যাকে ভাঙতে বা মচকাতেপারতোনা, সেইভয়ংকর প্রতাপশালী বাবা কী করে এমন অসহায় হয়ে যেতে পারে! কে তাকে অত নিরস্ত্র করেছিলো? বয়স? ওই বয়সে মানুষ দাপিয়ে বেড়ায়। অসুখ? অসুখ তো বাবাকে কোনওদিনই কাবু করতে পারেনি। কী অসুখ ছিল বাবার? ধীরে ধীরে কিডনি নষ্ট হচ্ছিল। হচ্ছিল, হয়ে তো আর যায়নি। কত কিডনি নষ্ট হওয়া মানুষকে দেখেছি, রক্ত পাল্টাচ্ছে, আর দিব্যি বেঁচে থাকছে। আত্মীয় স্বজন আর বন্ধুরা পাশে থাকলে শরীরে অসুখ থাকলেও, মনে সুখ থাকে। কিন্তু বাবার শারীরিক কষ্টের চেয়ে মানসিক কষ্টটাই দুর্বিষহ হয়ে উঠেছিল। বাবার টাকায় দাদা তার বউ বাচ্চা নিয়ে বাবার বাড়িতে থাকছে, খাচ্ছে, পরছে। সেই বাবাই বাড়িতে জবুথবু বসে থাকে। শুভ, তার আদরের নাতি তাকে ছুরি নিয়ে তাড়া করে, বাবা ছুরির ভয়ে দৌড়ে পালায়। না, নাতির সঙ্গে দাদাভাইয়ের খেলা নয়, বাবা সত্যি সত্যি ভয়ে দৌড়োয়। কাঁদতে কাঁদতে আমাকে তো বললোও হাসিনা নাকি ফাঁক পেলেই বলে, দুনিয়ার কত কেউ মরে, বুড়োটা মরে না কেন!’ বাবার চুল পাকেনি, বয়স সত্তরও হয়নি, মাথায় কোনও গণ্ডগোল হয়নি, দিব্যি শক্ত সমর্থ মানুষ, সেই বাবাকে বুড়ো, দুর্বল, পঙ্গুর মতো ঘরে বসিয়ে রাখলো, ঘরে বসিয়ে বাবার মতো কর্মঠ কাজপাগল মানুষকে মেরে ফেললো! হ্যাঁ মা, বাবা আর সেই বাবা ছিল না। দাদা দৌড়োচ্ছে বাবার সম্পত্তি পেতে। দাদার বউ ঘরে অতিষ্ঠ করে মারছে বাবাকে। যে অসুখে যে খাবার খাওয়া বারণ বাবার, বাবার কপালে সেসব ছাড়া আর কিছু জুটছেনা। ক্ষিধে পেলে বাবা করবে কী? তার নিজের বাড়ির রান্না করার তোক তো আর তার কথা শুনবে না, শুনবে দাদা, হাসিনা আর তাদের ছেলেদের হুকুম। বাবার কান্না শুনতে হয় আমাকে দিনের পর দিন। দাদাকে জিজ্ঞেস করেছি, বাবা কেন খাচ্ছেনা বাড়িতে? ’দাদার ঠাণ্ডা উত্তর, বাবা কথা শোনে না, বাইরে বেরিয়ে যায়, বাড়িতে খাওয়া বন্ধ করে দিয়েছে। বাবা খাওয়া বন্ধ করেছে, এতে দাদার কী। তার কোনও উদ্বেগ নেই। দাদার উদ্বেগ অন্য কিছুতে। বাবা আবার গোপনে কোনও বিয়ে নিয়ে যদি করে বসে তাহলে তো সম্পত্তির ভাগ চলে যাবে অন্য কোনওদিকে। বাবাকে সত্যিকার বাঘ বা সিংহের মতো চেপে ধরে দাদা একদিন শুনে নিল বাবা নাকি এদিকে ওদিকে দুএকটি বিয়েও করে রেখেছে। মা, তোমার কি কষ্ট হচ্ছে শুনতে? নাকি কষ্টের ওপারে চলে গেছ! বাবার কোনও স্থলনে তোমার হয়তো আর কষ্ট হয় না। জানতেও না। তো কত কিছু। যখন অসুখ তোমার, অসুখ যখন ধরা পড়লো, শুধু ধরা পড়া বলবো কেন, যখন ডাক্তার বলে দিয়েছে সব, কবে তুমি মরে যাবে, সব জেনেও তোমাকে তো কাঁদিয়েছে বাবা। জীবনে কেঁদেছো মা অনেক। দাদা তো বাবার ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে মাথা কখনও ঘামায়নি। কিন্তু হঠাৎ এমনই অসভ্যের মতো ঘামানো শুরু করলো যে দেখলে হয়তো তোমার ভালো লাগতো। কিন্তু ভালো কি সত্যিই লাগত! তুমি তো নিশ্চয়ই জানতে এই ঘামানোটা আসলে বাবার সম্পত্তির ভাগ বাইরের কাউকে না দেওয়ার জন্য ঘামানো।

আমার জন্য বাংলাদেশের দরজা বন্ধ। ইয়াসমিনকে পাঠিয়েছিলাম বাংলাদেশে বাবার সঙ্গে থাকার জন্য। ইয়াসমিন গিয়ে হাসিনার দাপট উপেক্ষা করে কিছুটা বাবার যত্ন করেছিল বটে, কিন্তু ও চলে আসার সঙ্গে সঙ্গে আবার আগের মতো দুরবস্থায় ফিরে যেতে হয়েছিল বাবাকে। ইয়াসমিনকে দিয়েও দাদা যে কাজটি করতো, সে কাজ করিয়েছে। বাবার বান্ধবীরা বাবার সঙ্গে দেখা করতে এলে অপমান করে বাড়ির ফটক থেকে তাড়িয়েছে। জানিনা সবাই হয়তো ভেবেছে, বাবার সাংঘাতিক উপকার তারা করে ফেলেছে। কী জানি কিসের উপকার। বাবাকে তারা জীবনের শেষ সময়ে এসে সতী সাধ্বী পুরুষ বানাতে চাইছিল হয়তো। বাবা একা একা পড়ে থাকতো হতাশার চরমে ডুবে। ওষুধ টষুধ সম্ভবত খেতো না। ওষুধ খাওয়াবার দায়িত্ব নেবে দাদা, সে সময় তার কই! আমার কেন যেন মনে হয়, হাসিনা বাবার মৃত্যুর জন্য দিন রাত প্রার্থনাই শুধু করছিল না, মরতে হলে যা যা করা প্রয়োজন তার সবই প্রাণপণে করে যাচ্ছিল। দাদা তড়িঘড়ি সব গুছিয়ে রাখছিল বাবার মৃত্যু হলে যেন তার কোনও অসুবিধে না হয়। বাবাকে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে জেনেছে কাকে কাকে বিয়ে করেছে, তাদের সবাইকে দাদাই বাবার সই নিয়ে তালাকনামা পাঠিয়ে দিয়েছে। পুংখানুপুঙ্খ হিসেব নিচ্ছিল দাদা, বাবার ধন দৌলত কোথায় কী আছে। কোথায় কোন অঞ্চলে কোন মাটি লুকিয়ে আছে। ইয়াসমিন দেশ থেকে ফিরে খবর দিল, বাবা উকিল ডাকছে বাড়িতে, দাদার সঙ্গে বসে পরামর্শ করছে সম্পত্তির ব্যাপারে। বিশাল সম্পত্তির মালিক বাবা, এ তো আমরা জানতাম। ঠিক কীরকম বিশাল সেই সম্পত্তি, তা হয়তো জানা ছিল না। বাবা যখন দাদার সঙ্গে জমি জমা নিয়ে কথা বলতে, ইয়াসমিন ঘরে ঢুকলে দুজনই চুপ হয়ে যেত। বাড়িতে উকিল এসে কথা বললেও সে ঘরে বাবার সঙ্গে দাদা থাকতো, ইয়াসমিনের থাকাটা কেউ চাইতো না। ইয়াসমিন বুঝতে পারছিল, তার উপস্থিতি অনাকাঙ্ক্ষিত। কিন্তু বাবার সন্তান হিসেবে দাদার যেটুকু অধিকার, সেটুকু তো ইয়াসমিনেরও অধিকার। বাবা যদি হিসেব করতে বসে তার সম্পদ সম্পত্তির, সেখানে তার সব সন্তানের উপস্থিতিই তো স্বাভাবিক। আলোচনা থেকে ইয়াসমিনকে বাদ দেওয়া হয় কেন! কেন হয়েছে তার রহস্য তখন না বুঝলেও সে অবশ্য পরে বুঝেছে।

বাবার মতো মানুষ, যে জীবনে কোনওদিন প্যান্ট সার্ট কোট ছাড়া কিছুপরেনি। পাজামা পাঞ্জাবি শুধুঈদের সময় পরতো। অনেকটা সামাজিক কারণেইপরতো। ধর্মীয় কোনও কারণ তো বাবার ছিল না। পাঞ্জাবিপাজামা টুপি দাড়িঅলা পাঁচবেলা নামাজ পড়া বিচক্ষণ বড়লোক এম এ কাহহার আর তারই ভাই মোমেনকে বাবা খুব শ্রদ্ধা করতো। বাবা কিন্তু ওদের পোশাক দ্বারা কোনও রকম প্রভাবিত হত না। এম এ কাহহার নিজেরপাড়ায় একটি মাদ্রাসা আর মসজিদ গড়ে দিয়েছে। বাবা জীবনে কখনও মসজিদে যায়নি, মাদ্রাসাতেও যায়নি, ওসব তৈরি করা তো দূরের কথা। মসজিদের চাঁদাও কখনও দিয়েছে বলে মনে হয় না। শুধু কি ওরাই, বাবার চারদিকে যারা ছিলো তাদের সবারই তো ধর্মের দোষ ছিল! বাবা কেন মোটেও চারপাশ দ্বারা প্রভাবিত হয়নি, অন্তত এই বিশ্বাসের ব্যাপারে! অন্য কত কিছুতে তো প্রভাবিত হত। জীবনের সব কিছু তো বাবার নিজের উদ্ভাবনের বিষয় ছিল না! নিজে ঘোষিত নাস্তিক না হয়েও কী করে দিব্যি ধর্ম থেকে। যোজন দূরে বাস করেছে! বছরে দুবার শুধু নামাজে দাঁড়াতো। তাও ওইঈদের মাঠে। সামাজিকতা বজায় রাখার জ্ঞান আবার টনটনে ছিলো। ওটা না করলে চলে না। কিন্তু নামাজ তত বাবা পড়তে জানতো না। কোনও সুরা সে জানতো না। লোকরা মাথা নোয়ালে সেও নোয়াতো, ওঠালে ওঠাতো। এ ছাড়া আর কী! একবার সুরা শেখার জন্য একটা লোক রেখেছিলো মনে আছে, জানিনা ওটা আবার কারপাল্লায়পড়ে করেছিলো। দুদিনপর লোককে বিদেয় করে দিয়েছে। ও বাবার পোষাতো না।

মানুষ তো এমন, বয়স বাড়লো, হঠাৎ হুট করে টুপি দাড়ি শুরু হল, পাজামা পাঞ্জাবি শুরু হল, পাঁচবেলা নামাজ শুরু হল। কিন্তু বাবা কেন কোনওদিন সামান্যও বদলাতে চায়নি নিজেকে! .. একটুও ধর্মচিন্তা তার ভেতরে আসেনি। বাবার ওই মেয়েমানুষের দোষ ছাড়া আর তোমাকে অবহেলা করা ছাড়া আর তো কোনও দোষ ছিল না। সব তো তার গুণই ছিল। তারপরও দেখ মেয়েদের নিয়ে যা করতো, সব কিন্তু বাইরে করতো। কোনওদিন ঘরে কোনও মেয়েকে আনেনি। কোনওদিন আমাদের কাউকে বুঝতে দেয়নি আদৌ তার কোনও সম্পর্ক কারও সঙ্গে আছে। কেবল শুনেছি, প্রমাণ পাইনি। নিজের কোনওকিছু ছেলেমেয়েদের না জানানোর মানসিকতাই। বা কোথায় বাবা পেয়েছিলো, যখন অন্যরা দিব্যি দ্বিতীয় বিয়ে করে বাড়িতে বউ তুলছে! বাবা তার নিজের ব্যক্তি-জীবন, অন্য কারও সঙ্গে সম্পর্ক বা বিয়ে আমাদের জীবন এবং জীবন যাপন থেকে সম্পূর্ণ আলাদা রেখেছিলো। এক শহরেই বাস করি, অথচ কোনওদিন আমাদের জানা ছিল না বাবা বাড়ির বাইরে কোথায় কার সঙ্গে কী সম্পর্ক করছে। এমন কোনও রাত নেই, যে রাতে বাবা অবকাশে রাত কাটায়নি। শুধু শহরের বাইরে কোনও মেডিকেল কলেজে পরীক্ষা নিতে গেলে বা চাকরিসূত্রে কোথাও গেলে দেখেছি বাবা নেই অবকাশে। ইস্কুল শেষ না হতেই দেখতাম মেয়েদের বিয়ে হয়ে যাচ্ছে। শহরের অন্য বাবারা তো মেয়েদের যে লেখাপড়া করে বড় হবার, নিজের পায়ে দাঁড়াবার দরকার আছে, তা-ই মনে করেনি। কিন্তু বাবা তো ওদের মতো ছিল না। এমনকী বন্ধু কাহহার বা মোমিনের মেয়েদেরও তো ইস্কুলের গণ্ডি পেরোতে না পেরোতে ধরে বেঁধে বিয়ে দিয়ে দিয়েছে, শুধু ছেলেদের লেখাপড়ার জন্য যা করার সব করেছে। বাবা ওদের কাছ থেকে শেখেনি সমাজের এই নিয়মটা। তার কাছে প্রতিদিন লোক আসতো মেয়েদের বিয়ের জন্য পাত্রর খোঁজ নিয়ে, সবাইকে এক বাক্যে বাবা না করে দিত। বাবা তো ওই সমাজেই বাস করতো, যেখানে মেয়েদের অল্পবয়সে বিয়ে দিয়ে দেওয়াটাকেই যৌক্তিক মনে করতে সবাই। বাবা তো তার গন্ডগ্রাম নান্দাইল থেকে মেয়েদের ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার বানানোর চিন্তাধারা নিয়ে আসেনি! যদি বাবাকেশিখতেই হয় অন্যদের থেকে, যদি তার নিজের না হয় এই আবিষ্কার, তবে দেখ, যারা শহরের শিক্ষিত বনেদি বাড়ির বড় বড় লোক, যাদের মেয়েরা লেখাপড়া চালিয়ে যেত, বড় হতো, সেসব বাড়ির সঙ্গে বাবার খুব মেলামেশা না থাকার পরও বাবা ওদের ওই নিয়মকে পছন্দ করলো কেন, কেন সমাজের বেশির ভাগ মানুষের নিয়মকে নয়!

মনে আছে বাবার ওপর ক্ষুব্ধ তখন আমি, যখন তোমার ওই বৃত্তির ব্যানারটা দেখিয়ে দেখিয়ে বলেছিলাম, হ্যাঁ মার নামে ইস্কুল হবে, মার নামে বৃত্তি হয়ে গেল, বাবার মতো চরিত্রের লোকদের জন্য কিছুহবেনা। কেউ করবেনাইস্কুল, কেউ দেবে না বৃত্তি। বাবা তোমার পাশে বসে শুনলো। বাবাকে অপমান করার জন্য জোরে জোরেই বলছিলাম। তোমাকে খুশি করার জন্য, তৃপ্তি দেওয়ার জন্য, বাবাকে কেঁচোর মতো কুঁচকে ফেলার জন্য। জীবনে যে কখনও ভেঙে পড়ে না, তাকে ভাঙতে চাইছিলাম। যার জীবনে কোনও কষ্ট নেই, তাকে কষ্ট দিতে চাইছিলাম। তোমাকে এতকাল যেভাবে বাবা অপমান করেছে, সেই অপমানের প্রতিশোধ নিচ্ছিলাম মা। কীরকম বেপরোয়া আর বেয়াদপ হয়ে উঠেছিলাম। যে বাবার চোখের দিকে তাকিয়ে কোনওদিন কথা বলার সাহস ছিল না, সেই বাবাকে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দেওয়ার সব আয়োজন আমি করছি। তোমারও বোধহয় আমার ব্যবহার দৃষ্টিকটু লাগছিল। তুমি সম্ভবত বলেছিলে, এরকম বলো না, তোমার বাবারও তো শরীর ভালো নয়, পরে এই ব্যবহারের জন্য তোমারই কষ্ট হবে। তুমি ঠিকই জানতে মা, ওই ব্যবহারের জন্য আমার পরে কষ্ট হবে। বাবা শিশুর মতো বলেছিলো, আমার জন্যও ইস্কুল হবে। কোনওদিন কাঁদতে দেখিনি বাবাকে। কোনওদিন কোনও কারণে চোখের জল ফেলতে দেখিনি। কিন্তু যখন বলছিলো আমার নামেও ইস্কুল হবে, নান্দাইলে। বাবার ঠোঁট কেঁপে উঠছিল অভিমানে, অপমানে। হয়তো চোখও ভিজে উঠেছিল। বাবা বোধহয় একটু আড়াল করে চোখটা মুছেও নিয়েছিল মা। সারাজীবন বাবার কাছ থেকে যে দুঃখ পেয়েছো তুমি, তার শোধ নিতে চেয়েছিলাম। কিন্তু শোধ নিতে গিয়ে বাবাকে যে কষ্ট দিয়েছি, সেটাও কি এখন আমাকে কম ভোগাচ্ছে!

নান্দাইলে বাবার নামে ইস্কুল তো হওয়া উচিত মা। বাবা কাদামাটি থেকে উঠে এসে নিজে একার চেষ্টায় লেখাপড়া করে ডাক্তার হয়েছে। নিজের বই ছিল না, বই কেনার টাকা ছিল না, মেডিকেল কলেজের এক সহপাঠীকে অনুরোধ করে করে রাজি করিয়েছিলে রাতে যখন সে ঘুমিয়ে যাবে, তখন তার অ্যানাটমি বা ফিজিওলজি বই নিয়ে আসবে বাবা, রাত জেগে সে বই পড়ে ভোরবেলা সহপাঠীর বাড়িতে গিয়ে বই ফেরত দিয়ে আসবে। হ্যাঁ মা, রাতে সহপাঠীর বাড়ির বাইরে দাঁড়িয়ে থাকতো, কখন সহপাঠী ঘুমোত যাবে, আর তার বইটা বাবা পাবে। রাত জেগে বাবা ধার করা বই এনে পড়তো। সকালে সে বই সহপাঠীর বাড়িতে ফেরত দিয়ে পরে কলেজে যেতো। এভাবেই পড়ে বাবা ক্লাসে সবচেয়ে ভালো নম্বর পেতো। এই বাবার নামে ইস্কুল কেন হবেনা, মা? নিজের ছেলেমেয়ে তো বটেই, কাকাঁদের, কাকার ছেলেমেয়েদের, ফুপুদের ছেলেমেয়ে সবাইকেই তো বাবা লেখাপড়া করিয়েছে। এমনকী অবকাশে রেখে ওদের অনেককেইস্কুল কলেজে পড়িয়েছে। যত তার আত্মীয়, দূর আত্মীয় সবাইকে লেখাপড়া করিয়েছে, গ্রামের কত গরিবদের লেখাপড়া করার জন্য ইস্কুলে ভর্তি করিয়ে দিয়েছে, লেখাপড়ার খরচ জুগিয়েছে। বাড়ির বউদেরও ছাড় দেয়নি। ওদের সংসার করা বন্ধ করে কলেজে ইউনিভার্সিটিতে পাঠিয়েছে। তার নামে কেন ইস্কুল হবে না? চিরকাল পড়াশোনা করে বড় হও, নিজের পায়ে দাঁড়াও, ছেলে মেয়ে নির্বিশেষে শুধু শুকনো উপদেশ দেয়নি, দিন রাত ওদের পেছনেই অর্থ আর সময় ব্যয় করেছে। আমার সুযোগ থাকলে আমি ওই গ্রামে বাবার নামে ইস্কুল খুলতাম একটা। বাবা ছাড়া কে আর আছে ওই গ্রামের ছেলে যে লেখাপড়াকে সবচেয়ে মূল্য দিয়েছে! আমার কেন ইস্কুল খুলতে হবে, ওই গ্রামের লোকদের যদি বিবেক বলে কিছু থাকে, বাবার নামে ইস্কুল কলেজ খুলবে।

বাবার হয়তো জমিজমা কেনার আগ্রহ ছিলো, সন্তানের ভবিষ্যতের কথা ভেবেঅথবা নিজের শেকড়ের টানে। কিন্তু তাছাড়া পার্থিব জিনিসের প্রতি লোভ বাবার ছিলো না। কোনওদিন কারও দেওয়া কোনও উপহার ছুঁয়ে দেখেনি। দাদা, ছোটদা, আমি, ইয়াসমিন কত উপহার দিয়েছি তাকে। সবকিছুই আলমারিতে যত্ন করে রেখে দিতো। তোমার অসুখের সময় যখন বাবার ঘরটা তোমার জন্য পরিষ্কার করছিলাম, তোমাকে ও ঘরে শোয়াবো বলে, বাবার আলমারি খুলে দেখি আমার দেওয়া সব লোশন, পারফিউম, অডিটয়লেট, অডি কোলন, শেভিং কিটস, জামা জুতো, আরও নানা রকম উপহার সব সুন্দর করে সাজিয়ে রাখা কিছুই বাবা এত বছরে ব্যবহার করেনি। কিন্তু আলমারি খুলে প্রতিদিনই দেখতে সব, আলমারি তো নয়, তার এক বিচিত্র জাদুঘর। আলমারির চাবিটা খুব যত্ন করে পকেটে রেখে দিত, কাউকে দিত না। নিজের জামা জুতো না ছেঁড়া অবদি কিনতো না। সেলাই করে পরার অভ্যেস ছিলো। টুথ ব্রাশের দাঁতগুলো প্রায় সব ভেঙে গেলে তবে নতুন কিনতো। আমি কিনে দিলে সেটা যত্ন করে রেখে দিত, নিজে একটা কমদামি কিছু কিনে নিতো। দাড়ি কামাবার ব্রাশও, সেই কোন আমলের প্রায় ভোঁতা রেজর দিয়েই কামাতো, গাল কেটে কেটে যেতে। ফোম, আফটার শেভ? ওগুলো আলমারিতে পড়ে থাকতো। বাবা বোধহয় ভুলে যেতো না গ্রামের গরিব ঘর থেকে উঠে এসেছে সে। ঝকমকে ঝলমলে জিনিস তার জন্য নয়। নিউইয়র্কে একটা গাউন জোর করে ঘরে যখন থাকতো, পরিয়ে রাখতাম। হয়তো ভালো লাগতো তার, কিন্তু কী যেন আবার সব তাকে খুলিয়ে রাখতো।

কলকাতায় যখন এসেছিলো, হোটেল ঘরে বাবা আমার বই পেয়েছিল, আমার মেয়েবেলা। আমি তো নানা কাজে ব্যস্ত থাকি। হঠাৎ একদিন দেখি বাবা বইটা মন দিয়ে পড়ছে। আমি কেড়ে নিয়েছি বই। বাবাকে ওই বই আমার পড়তে দিতে ইচ্ছে করেনি। আমি জানি বাবা কষ্ট পাবে পড়লে যেসব অংশে বাবার সব দুষ্কর্মের কথা লেখা আছে, ওই যে গভীর রাতে বাড়ির কাজের মহিলার সঙ্গে একরাতে শুতে গিয়েছিলো। না, মা। আমি বাবাকে বাঁচিয়ে বা কাউকে বাঁচিয়ে আত্মজীবনী লিখতে পারিনি। এক রাতে হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেলে দেখি বাবা বই পড়ছে। আমাকে লুকিয়ে লুকিয়ে পড়েও নিয়েছে বইয়ের অনেকটা। দেশে ফিরে যাওয়ার সময় যখন নিয়ে যেতে চাইলো একটা বই, জানি না কী ভেবে আর না করিনি। দাদার কাছে শুনতাম, বাবা নাকি আমার মেয়েবেলা বইটা যত্ন করে বালিশের তলায় রেখে দিয়েছে। প্রতিরাতে শুয়ে শুয়ে বইটাপড়ে। উতল হাওয়া বইটাও যোগাড় করেছিল। ওটাও বালিশের তলায় রেখে দিত। প্রতিদিন পড়তো, চেম্বারে যাওয়ার আগে, চেম্বার থেকে ফিরে। বাবা আমার লেখা ভালোবাসতো, তাই পড়তো। কিন্তু কষ্ট কী কম পেয়েছে। কোনওদিন আমাকে বলেনি কেন আমি তার কথা ওভাবে লিখেছি! কেন তার সম্মান আমি গুঁড়িয়ে দিয়েছি। কোনওদিন না। এই না বলা, এই না ধমক দেওয়া, এই না অভিযোগ করা, এই না নিন্দা করা আমাকে আরও ভুগিয়েছে। একবার দাদাকে বলেছিলাম আমার মেয়েবেলা আর উতল হাওয়া বইদুটো যেন যতীন সরকারকে আমার পক্ষ থেকে উপহার দেয়। যতীন সরকার একদিন অবকাশেও গিয়েছিলেন বইদুটো নিতে। কিন্তু বাবা তাঁকে বই দিতে চায়নি। বই না নিয়েই তাকে ফিরে যেতে হয়। কেন বাবা বই দিতে চায়নি আমি বুঝি। লজ্জায়। নিজের অহংকার, নিজের মাথা অন্যের সামনে মাটিতে মিশে যাক চায়নি। কিন্তু জগৎ যেপড়ছে! একদিকে ভালো হয়েছে, বইদুটোই বাংলাদেশে বেরোবার আগেই বা বেরোবার সঙ্গে সঙ্গেই নিষিদ্ধ হয়ে গেছে। আমি মনে মনে স্বস্তিই পেয়েছি মা। তা না হলে কত লোক বই পড়ে বাবাকে হয়তো বলতো, কী ব্যাপার, মেয়ে তো লিখে দিয়েছে তার দুশ্চরিত্র বাবার কীর্তি কাহিনী। বাবা যে প্রতিদিন আমার বইদুটো পড়তো, বাবা কোন অংশগুলো পড়তো, বাবাকে নিয়ে আমার প্রশংসার কথা, নাকি নিন্দার কথা! বাবাকে কেন প্রতিদিন বইদুটো পড়তে হত। কী পেত বাবা ওই বইয়ের মধ্যে। অতীত? হারিয়ে যাওয়া অতীত, সে যত নিষ্ঠুরই হোক, মধুরও তো ছিল মা।

দাদার কাছে আমার মেয়েবেলা বইটা খুব ভালো লাগে। দাদা বলে, কবিতার মতো। একদিন বাবাকে ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করেছিলাম, ফোনে, যেন ভুলে গিয়েছি বাবা সম্পর্কে যত মন্দ কথা লিখেছি, সব, কেমন লেগেছে বই? বাবা বললো, খুব ভালো। আমি আবার জিজ্ঞেস করলাম, ভালো? বাবা আবারও বললো, হ্যাঁ খুব ভালো। তোমার লেখার হাত খুব ভালো। ভাষাটা চমৎকার। খুব সুন্দর লিখতেপারো তুমি। বাবা কিছু বলেনি তার সম্পর্কে যা লিখেছি তার কোনও কথা। আমিও বলিনি। বাবার প্রশংসা শুনতে শুনতে আমার চোখে জল চলে এসেছে। আমি আর কথা বলতে পারিনি বাবার সঙ্গে। গলা বুজে আসছিল। বই নিয়ে বাবার প্রশংসা আমাকেই বাবার সামনে ছোট করে দিয়েছে। ইচ্ছে হয়েছে বাবার চুলে সেই ছোটবেলার মতো হাত বুলিয়ে দিই। বাবার চুলে এখন তো আর কেউ হাত বুলোয় না।

তুমিও নেই। বাবাও নেই। আমার আর দেশে কারও সঙ্গে যোগাযোগ করার কোনও ইচ্ছে, হয়নি। প্রায় বছর গেলে যোগাযোগটা করতে হয়েছে তোমার নামে যে বৃত্তি দিচ্ছিলাম, সেটি যেন প্রতি বছর দেওয়া হয় সেই তাগাদা দিতে। আমার যে ফিক্সড ডিপোজিট আছে বাংলাদেশের ব্যাংকে, সেটির ইন্টারেস্ট চলে যায় বৃত্তির অ্যাকাউন্টে। কিন্তু ও টাকায় তো বৃত্তি সম্ভব নয়। আবারও টাকা পাঠিয়ে দিলাম যেন বৃত্তি দেওয়ায় কোনও ছেদ না পড়ে। দেওয়া হল বৃত্তি। তবে ছবি দাদা যা পাঠালো, দেখে অবাক আমি। হাসিনাকে সামনে আনা হয়েছে বৃত্তি অনুষ্ঠানে। যে তোমার সঙ্গে দুর্ব্যবহার করতো, আমি চাইনি এই বৃত্তির অনুষ্ঠানে তার উপস্থিতি। যে তোমাকে ভালোবাসেনি কোনওদিন, সে কেন তোমার পবিত্র অনুষ্ঠানাদিতে তার কুৎসিত মন নিয়ে সরবে উপস্থিত হবে! শুধু উপস্থিত নয়, রীতিমত ভালো কাজের নেত্রী বনে যাবে! দূর থেকে কী আর করতে পারি আমি, শুধু কষ্ট পেয়ে যাওয়া ছাড়া আমার করার কিছু নেই।

.

খবর পাই অবকাশ পুরো পাল্টে ফেলেছে দাদা। কত কোটি টাকা থাকলে বাড়িটাকে ওরকম বিরাট বড়লোকের বাড়ি করা যায়, তা না দেখলে নাকি বোঝা যাবে না। বাড়ির মোজাইক মেঝে ফেলে দিয়ে মার্বেল বসিয়েছে। বিশাল বিশাল সবুজ দরজা ভেঙে এখন নাকি লাগিয়েছে ছোট ছোট খয়েরি রঙের দরজা। বাবার ঘরটাকে শুভর ঘর করে দিয়েছে। ঝকঝকে তকতকে সব। সেই জানালাগুলোও নেই, সেই নানা রঙের কাঁচের জানালাগুলো। অবকাশের স্থাপত্য শিল্প আমাকে সবসময় মুগ্ধ করেছে। জানি না কী করে পুরোনো স্থাপত্য ভেঙে ম্যাচবাক্স করতে পারে লোকে। কী করে উঁচু সিলিং ধ্বংস করে, কড়িকাঠ ভেঙে মাথার এক হাত ওপরে নামাতে পারে ছাদ। কী করে কেটে ফেলতে পারে দেয়ালের বা কাঠের কারুকাজ। পশ্চিমের দেশগুলোয় দেখেছি যে কোনও মূল্যে তারা পুরোনো বাড়িগুলোকে রক্ষা করে। পুরোনো স্থাপত্য অমূল্য সম্পদ। দাদাকে আন্দালুসিয়া নিয়ে গিয়েছিলাম, স্পেনের দক্ষিণে। ওখানে তো তার দেখা হয়েছে। পুরোনো স্থাপত্য কী করে হাজার বছর ধরে রক্ষা করা হচ্ছে। এমনকী ঘোর শত্রুর বানানো বাড়ি বা মসজিদকিছুই স্পেনের লোকেরা ফেলে দেয়নি। ওখান থেকেও দাদা কিছু শেখেনি। আমার কেন যেন মনে হয় মা, বাড়ি ভেঙে নতুন করে বানানো, দাদার নয়, হাসিনার আবদার। দাদা এখন আর দাদার কথায় ওঠে বসে না। উঠোনের দুটো টিনের ঘরও ভেঙে ফেলেছে। বাইরের কালো ফটক পাল্টে ফেলেছে। ফটকের দুধারে কামিনী আর মাধবীলতার গাছও আর নেই। নারকেল গাছগুলোর পায়ে সাদা মোজা পরিয়েছে। বাথরুম ভেঙে নতুন করা হয়েছে, কমোড লাগানো হয়েছে। শুভর জন্য আলাদা বাথরুম, অ্যাটাচড। বাড়ির সামনের সেই রক আর সিঁড়ি সব ভেঙে মোগলদের বাড়ির মতো বড় থাম বসিয়ে ওপরে বড় করে অবকাশ নাম বসানো হয়েছে। যে অবস্থা বাড়িঘরের, অবকাশ নামটা যে রেখেছে, এই হয়তো বেশি। হয়তো অবকাশ বাদ দিয়ে ব্ল হেভেন বা ইডেন গার্ডেন রাখতে পারতো। বৈঠক ঘর আর আমার শোবার ঘরের মাঝখানে যে অসাধারণ তিনটে গরাদওয়ালা দরজা ছিল, সেগুলো আর নেই। দেয়াল তুলে দিয়ে ঘর জুড়ে পেল্লাই সব রাজা বাদশাদের বাড়ির মতো আসবাবপত্র বসানো হয়েছে। হঠাৎ করে আমাদের সেই অবকাশ ধনী লোকের আধুনিক বাড়িতে রূপান্তরিত হয়ে গেছে। পেয়ারা গাছ, জাম গাছ, কাঁঠাল গাছ, সেগুন গাছ কিছু আর নেই। যে গাছটা শেষে লাগিয়েছিলে, সেই কামরাঙা গাছটা, ওটা বিশাল বড় হয়ে ঝুঁকে আছে শত শত সবুজ কামরাঙায়। দেখলে নিশ্চয়ই তোমার খুব ভালো লাগতো। হয়তো ভেবেছিলে, ছেলে মেয়েরা খাবে। ছেলেরা নাতিরা হয়তো খায় মা, তোমার কথা কেউ মনেও করে না। বাড়িতে মামা খালাদের কোনও যাওয়া আসা নেই। যাওয়া আসা শুধু হাসিনার আত্মীয়দের। হাসিনা রানির মতো বাস করে। তার দুই পুত্র প্রাসাদের রাজপুত্তুর। অবকাশে আমাদের কোনও চিহ্ন রাখা হয়নি। আমাদের কারওরনা। অবকাশ এখন আগাগোড়াই হাসিনার বাড়ি। যেন হাসিনাই জন্ম থেকে থাকে ও বাড়িতে। হাসিনার বাপ দাদা কেউ বানিয়েছে বাড়ি, উত্তরাধিকার সূত্রে সে বাড়ির দখল পেয়েছে। দেখে মনে হয়, এরকম দামি আসবাবপত্রে, এরকম দামি মার্বেলে বাড়ি সাজাবে বলেই সে অপেক্ষা করছিল, কখন তুমি যাবে, কখন বাবা যাবে। জন্মের মতো যাবে। কখন বাড়ি খালি হবে। তোমাদের নিশ্চিহ্ন করার চেষ্টা বাড়িতে ঢোকার পর থেকেই সে করছিল। কী ভয়ংকর এবং কী রকম বীভৎস যে সেই লোভ, রাজত্বের লোভ! হাসিনার সারা শরীরে মনে অদ্ভুত পরিতৃপ্তি। কী ভীষণ কষ্টই না দিত ও তোমাকে! কী অপমানই না করেছে তোমাকে! তোমার মতো নিরীহ ভালো মানুষকে খুশি করতে খুব বেশি কিছুর দরকার ছিল না। তারপরও তোমাকে তোমারই সংসারে ক্রীতদাসীর মতো রেখেছে। বাবাকেও ওরকমভাবে বাবার বাড়িতে, বাবার খেয়ে, বাবার পরে, বাবাকে একইরকম ভাবে ক্রীতদাস করেছে। কাউকেই ছাড়েনি। এই যে বাবা তার দুই মেয়েকে বঞ্চিত করে সব সহায় সম্পত্তি দুই ছেলের নামে লিখে দিয়েছে, হাসিনা তো তাই চেয়েছিল, অঢেল সম্পদ একা একা ভোগ করার বাসনা তার অনেক দিন থেকেই ছিল। বিরাট প্রাসাদের রানি হওয়ার স্বপ্ন সে পূরণ করেছে। দাদা অসুখে ভুগছে, যে কোনও একদিন মরে যাবে। এর মধ্যে ছোটদা তার ভাগ যে করে হোক কবজা করেছে। বাবার বিশাল এসটেট মূলত এখন ভোগ করছে হাসিনা তার ছেলেদুটো সহ তার বাপের বাড়ির আত্মীয় স্বজন। বাবা কি ওর জন্য মাথার ঘাম পায়ে ফেলে সমস্ত বিষয় আশয় করেছিলো? কোটি কোটি নগদ টাকা কি বাবা হাসিনার আরাম আয়েশের জন্য রেখে গিয়েছিলো?

.

বাবা মারা যাবার বছর দুই পর আমি দাদার কাছে জানতে চেয়েছি, বাবার জমি জমা টাকা পয়সা বাড়ি ঘরের কী করা হবে, কবে হবে ভাগবাঁটোয়ারা। বাংলাদেশ সরকার যেহেতু আমাকে দেশে ফিরতে দিচ্ছে না, ভাগাভাগির সময় ইয়াসমিনের যদি দেশে যাওয়ার দরকার হয়, যাবে। দাদা বললো, বাবা তার যা কিছু আছে, উইল করে দিয়ে গেছে তার চার ছেলেমেয়েকে। উইলের একটা কপি দাদা একদিন আমেরিকায় পাঠিয়ে দিল। জমি জমা ভাগের কথা আমার মাথায় আসতো না, যদি না আমি ইয়াসমিনের অর্থনৈতিক দুরবস্থা দেখতাম। উইল দেখে আমি আকাশ থেকে পড়ি। নান্দাইলের হাজার হাজার একর জমি, শহরের চব্বিশটা বাড়ি, অবকাশ, ঢাকার সবচেয়ে দামি এলাকা বারিধারার বিশাল প্লট সব ভাগ করা হয়েছে দাদা আর ছোটদার মধ্যে। বাবাকে অসুস্থ অবস্থাতেই ঢাকায় টেনে এনে বারিধারার জমিটা তার নিজের নামে লিখিয়ে নিয়েছিলো ছোটদা। ঢাকার বারিধারার জমি, জানিনা সেটা দশ কোটি নাকি কুড়ি কোটি টাকা দাম, ছোটদার। নান্দাইলের বিশাল জমিদারি দাদার। শহরের বাড়িগুলোও দাদার আর ছোটদার, আমি আর ইয়াসমিন শুধু ওই বাড়িগুলো থেকে ভাড়া যা আসে, তার শতকরা পনেরো ভাগ পাবো। ওই বাড়িগুলোর মালিক আমরা কোনওদিন হতেপারবো না। অবকাশ দাদার। অবকাশের পেছনে যে উঠোন আছে, সেই সেদিকটায়, ওই তেমনই, শতকরা পনেরো ভাগদু মেয়ে পাবে। কী দরকার ছিল বাবার এই উইলটা করার? বাবার সই আছেউইলে, এসইকি সত্যিই বাবার সই, আমি বারবার দেখি। হ্যাঁ বাবার সই, কিন্তু বিশ্বাস হয় না বাবা এই উইল সুস্থ মাথায় করেছে। কোনও উইল যদি বাবা না করতো, চারভাইবোনের মধ্যে সব ভাগ হতো। বাংলাদেশে যে নারীবিরোধী ইসলামি উত্তরাধিকার আইন আছে, সেই আইনেও যদি ভাগ করা হতো, তাহলেও আমার আর ইয়াসমিনের অর্থনৈতিক দুরবস্থা চিরকালের মতো ঘুচে যেতো। মা, তুমি কি জানতে বাবা এত সম্পদশালী ছিলো? আমার জানা ছিলো না। উইলের কোথাও লেখা নেই বাবার ব্যাংকের টাকার কথা। বাবার নতুন বাজারের চেম্বার, আরোগ্য বিতান এবং আরও কয়েকটা দোকান বিক্রি করে সব টাকা ব্যাংকে রেখেছিলো বাবা, সেসব হয়তো দাদা আর ছোটদাকে আগেই দিয়ে দিয়েছে। শুধু স্থাবর সম্পত্তির কথাই লেখা উইলে। আমার ভেবে কষ্ট হয়, বাবা তার দুই মেয়েকে কখনও ভালোবাসেনি। বাবা আর তার দুই পুত্র যদি ভেবেই থাকে, যে, আমি বিশাল এক ধনী কেউ, বাবার কোনও সম্পদ বা সম্পত্তি আমার না হলেও চলবে, তাহলে ইয়াসমিনের কথা কেউ ভাবেনি কেন? ইয়াসমিন তো অভাবে থাকে, ছোট একটা মুদির দোকানে কাজ করে। বাবা আর তুমি নিজের চোখে দেখে গেছো ইয়াসমিনের অভাব। তাহলে কে স্বচ্ছল, আর কেনয়, তার ওপর ভিত্তিকরে উইল হয়নি, উইল করা হয়েছে লিঙ্গের ভিত্তিতে। পুরুষ লিঙ্গ বেশি পাবে, স্ত্রী লিঙ্গ কমপাবে, অথবা পাবেনা। আমি বুঝি না কী করে বাবা এই চরম অসাম্যকে সমর্থন করেছে। দুটো মেয়ে যেন তার সম্পত্তির কিছু না পেতে পারে, সে কারণেই উইলটি করা হয়েছে বাবার মৃত্যুর আগে। বাবা যে বলতো, আমার লেখা বাবা খুব ভালোবাসে। নারী পুরুষের সমানাধিকারের কথাই তো জীবনভর লিখে গেছি। আসলেই কি সত্যিই ভালোবাসতো বাবা আমার লেখা! উইল তো তা বলে না মা। আমার আরও একটি কারণে, বিশ্বাস হয় না এই উইল বাবা কোনও চাপ ছাড়া করেছে। ধরা যাক, বাবা সম্পূর্ণ নিজের ইচ্ছেতে এই উইল করেছে, দাদাদের কোনও চাপ বাবার ওপর ছিলো না। কিন্তু দাদারা যদি বিশ্বাস করতো বোনদের উত্তরাধিকারে, তবে বাবার লেখা উইল তারা মেনে নিতো না। মেনে নেওয়ার একটাই কারণ তারা মেয়েদের কোনও অধিকারে বিশ্বাস করে না। সম্পত্তি ভাগ করার কথা আমি শত বলার পরও তারা যখন সমান ভাগে বা দেশের উত্তরাধিকার আইনেও ভাগ করছে না, তাতে আরও প্রমাণ হয় বাবাকে এই উইল করাতে বাধ্য করেছে দাদা আর ছোটদা। আমাদের চার ভাই বোনের মধ্যে শুধু অভাবেই নয়, সবচেয়ে বেশি মানসিক কষ্টে আছে ইয়াসমিন। আজ যদি ও বাবার সম্পত্তির ভাগ পেতো, তাহলে ও অশান্তির সংসার ছেড়ে একা বেঁচে থাকার মনোবল পেতো। দুই দাদা ওর কথা ভাবে না। ভাবলে কি আর বাবার বিশাল সম্পত্তি নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নিত! আমি দাদাদের অনেক বোঝাতে চেয়েছি। বাবা যেভাবে ভাগ করেছে তার সম্পদ সম্পত্তি, তা অন্যায়। বাবা ভুল করেছে, অন্যায় করেছে, তোমরা তা মেনে নিচ্ছো কেন! তোমরা তো বলো আমার লেখা বই তোমাদের ভালো লাগে, আমি খুব সত্য কথা বলি, আমার আদর্শকে তোমরা সম্মান করো আমার বইয়ে আমি তো মেয়েদের অধিকারের কথাই বলি। বাবার সম্পত্তি ভাই বোনের মধ্যে সমান ভাগের কথা বলি। বাবা ভুল করেছে এ তো জানো তোমরা, তবে বাবার ভুলটা সংশোধন করছো না কেন, বাবার অন্যায়টা মেনে নিচ্ছো কেন? অনেক চিঠি পাঠিয়েছি। বলেছি, বাবার সম্পত্তি সমান ভাগ করতে প্রাণ না চায়, তাহলে দেশি আইনেই ভাগটাই বা করছে না কেন, যে ভাগে তোমরাই বেশি পাবে, আমরা কম পাবো? না, ওরা দু বোনকে উত্তরাধিকার থেকে বঞ্চিত করবেই। দেশে ফেরার অনেক চেষ্টা আমি করেছি। সে খালেদা বলো, তত্ত্বাবধায়ক সরকার বলো, হাসিনা বলো, কেউ আমাকে দেশে ফিরতে দিচ্ছেনা। ফেরার সব পথ যদি বন্ধ করে রাখে, তবে কী করে কী করবো বলো, কী করে দাদাদের এই অন্যায়ের প্রতিবাদ করবো! ইয়াসমিনের বিশ্বাস বাবা স্বেচ্ছায় ঠাণ্ডা মাথায় এই উইল করেছে। ইয়াসমিনের বিশ্বাস বাবাপুরুষতান্ত্রিক মনোভাবের লোক, বাবার কাছে পুত্ররাই তার বংশের লোক, কন্যারা নয়। বাবা যদি এত পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতার মানুষ হতো, তাহলে মেয়েদের লেখাপড়ার জন্য প্রাণপাত করেছে কেন, পনেরো বছর বয়স হলে ধরে বেঁধে বিয়ে দিয়ে দেয়নি কেন? ছেলেদের ইস্কুল কলেজ নিয়ে যা করেছে, মেয়েদের ইস্কুল কলেজ নিয়ে তার চেয়ে কিছু কম তা করেনি! কী করে তবে বিশ্বাস করবো বাবা পুরুষতান্ত্রিকতায় বিশ্বাস করতো! সবচেয়ে মজার ব্যাপার, উইলে যে তিল পরিমাণ উত্তরাধিকার আমার আর ইয়াসমিনের, সেটুকুও আমরা কোনওদিন পাইনি। বাড়িগুলোর ভাড়া থেকে যে সামান্য আমাদের কাছে আসা উচিত, তা তো আসেইনি, অবকাশের উঠোনও ভাগহয়নি। দাদা আর ছোটদাইসব ভোগ করছে। দুভাইয়ে আগে এত সখ্য ছিলো না, বাবার অসুস্থতার সময় এবং বাবা মারা যাওয়ার সময় তাদের বন্ধুত্ব এবং ভ্রাতৃত্ববোধ তুঙ্গে উঠেছে। চারভাইবোনের মধ্যে অর্থনৈতিক অবস্থা সবচেয়ে খারাপইয়াসমিনের আর সবচেয়ে অনিশ্চিত জীবন আমার। আজ খেয়ে পরে বেঁচে আছি, কিন্তু কাল পারবো কিনা জানি না। লেখালেখি আমার উপার্জনের উৎস। তার ওপর আমি বাংলায় বই লিখি, পাশ্চাত্যের কোনও ভাষায় লিখি না। বাংলাদেশ থেকে বইয়ের কোনও রয়্যালটি আমি পাইনা। অন্য দেশে আজ বই চলছে, কাল হয়তো চলবে না। ভারতে বা বাংলাদেশে, যেখানে জীবন যাপনপশ্চিমের দেশগুলোর মতো এত ব্যয়বহুল নয়, আমার বাস করার কোনও অধিকার নেই। আজপশ্চিমে আমার মাথা গোঁজার ঠাঁই আছে, কাল কী হবে জানি না। জমানো টাকা ফুরিয়ে যেতে সময় খুব নেয় না। দাদারা যে আমাদের এই অনিশ্চয়তা জানে না, তা তো নয়, খুব ভালো করে জানে। কিন্তু একটা জিনিসই তারা নির্লিপ্ত থেকে প্রমাণ করেছে, আমাদের অভাবে অসুখে তাদের কিছু যায় আসে না।

কেমনপুত্রধন পেটে ধরেছিলে মা? তোমার সততা, তোমার বিবেক, তোমার মায়া মমতার এক ফোঁটা ওরা কিছুপায়নি কেন! বাবার উদারতা, বিচক্ষণতা, বাবার আদর্শ, মনোবলও তো ওরা কিছু পায়নি। যে দিকটা বাবার মন্দ ছিল, সেই মন্দটাই বিকট করে বীভৎস করে দুজনকে গড়ে তুলেছে। ওরা ধনলোভ, কৃপণতা, স্বার্থপরতা পেয়েছে। বাবাও কিন্তু এতপাষণ্ড কোনওকালে ছিল না। বাবা শুধু তোমার সঙ্গেই নিষ্ঠুরতা করেছে, আর কারও সঙ্গে তো করেনি। শেষ বয়সে তার দুটো কন্যার সঙ্গে এই নিষ্ঠুরতা সত্যিই করেছে কিনা কোনওদিন তা জানার সুযোগ না হলেও, এই বোধোদয়ের সুযোগটা অন্তত হচ্ছে, যে, আপন দুটো ভাইয়ের সামান্যও ভালোবাসা দু বোনের জন্য নেই। ভাবতে দুঃখ হয়, ওরা আমার ভাই। কী জানি কী সুখ ওরা পায় বোনদের ঠকিয়ে। দুটো মাত্র বোন, এমন তো নয়, যে, সম্পত্তি অতি সামান্য, এমন তো নয় যে বারো কী তেরোটি বোন তাদের ভাগ নিয়ে নিলে ভাইদের কিছু কম পড়ে যাবে। বেঁচে থাকার জন্য কত টাকার দরকার হয় মা! কত সম্পদের দরকার! জানি, তুমি এই অন্যায় মেনে নিতে পারতে না। বাবা নিজেই অন্যায়টি জেনে বুঝে করে গিয়েছিলো, নাকি তাকে ভয় দেখিয়ে, ভুল বুঝিয়ে অন্যায়টি করতে বাধ্য করা হয়েছিল! আমরাও তো বাবারই সন্তান ছিলাম, আমাদের বঞ্চিত করার জন্য বাবা এত উদগ্রীব ছিলো কেন! এই রহস্যের সমাধান কোনওদিনই করা সম্ভব নয়। কারণ দাদা আর ছোটদা ছাড়া আর কেউ জানে না আসলে ঘটেছিল কী। তারা আমাদের কিছুই জানাচ্ছে না, শুধু এটুকুই বলছে যে বাবা নিজে উইল লিখে গেছে। বাবা যা করে গেছে তা যদি সত্যিই বাবার একক সিদ্ধান্তে হয়, ভাইরা, আমি অনুমান করি, ক্রমাগত এই মন্ত্রই বাবার কানে দিয়েছে যে আমাকে আর ইয়াসমিনকে সম্পদ বা সম্পত্তির যা-ই দেওয়া হবে, নিশ্চিতই সব মামাদের হাতে চলে যাবে। আমরা দু বোন মায়ের মতো মন পেয়েছি, সহানুভূতি সমবেদনা ইত্যাদি এত বেশি যে মামাদের অভাব দেখলে আমাদের যা কিছু আছে, সব ঢেলে দেব। বিশেষ করে আমি, মামাদের দুঃখ দুর্দশা ঘোচাবার পণ করেছি আমি, না দিয়ে আমি পারবো না। ভালো যে তুমি বেঁচে নেই মা, বেঁচে থেকে এসব দেখনি। আরও কষ্ট পেতে মা। তোমার বাবা মার জমিজমা তোমার ভাই বোনের মধ্যে দেশের উত্তরাধিকার আইনে ভাগ হয়েছিলো। ভাইরা দুভাগ পেয়েছে, তুমি আর তোমার বোনেরা একভাগ করে পেয়েছে। তোমার ভাগটায় শরাফ মামা একটা ঘর বানিয়ে থাকছে, নিজে যা পেয়েছিলো, তা সে বিক্রি করে দিয়েছে। তোমার ভাগে কে থাকছে, না থাকছে তা নিয়ে মাথা ঘামাওনি তুমি। শরাফ মামাকে তোমার ভাগটা লিখে দিতে তোমার আপত্তি ছিলো না, তোমার উত্তরাধিকারী হিসেবে আমার আর ইয়াসমিনেরও আপত্তি ছিল না যে তোমার ভাইদের কেউ নিয়ে যাক তোমার অংশ। এখনও নেই। কিন্তু তোমার ওইটুকু ছোট্ট জমিই নাকি এখন দাদা দাবি করেছে। যেহেতু লিখে পড়ে দাওনি কিছু, তাই দাদা ওটুকুও ছাড়েনি। যে ভাগ তুমি নিতে চাওনি, আজ তোমার গর্ভের সন্তান, তোমার প্রতি ভালোবাসা না দেখালেও তোমার জমির প্রতি তার ভালোবাসা দেখাচ্ছে। তোমাকে ছেড়ে দিতে তার মায়া হয়নি, তোমার ওই ছোট্ট সামান্য জমিটুকু ছাড়তে তার মায়া। তুমি কী দেখ এসব মা, আকাশের কোথাও থেকে দেখ? দেখে কী তোমার লজ্জা হয় না?
 
১২.


যতই বলি না কেন যে বাবা তার জীবনের শেষ সময়ে চরম নিষ্ঠুরতা করে গেছে তার দুই কন্যার সঙ্গে, অসম্ভব অপমান করেছে দুই কন্যাকে, বাবার জন্য তবু আমার কষ্ট হয়। তার পরও বাবার না থাকা আমাকে কাঁদায়। বাবা কবে থেকে নেই? মনে নেই। হয়তো দুহাজার এক বা দুই সাল হবে। তোমার আর বাবার ক্ষেত্রে মারা গেছে এই শব্দ আমি উচ্চারণ করি না কখনও। আমি পারি না। এরমধ্যে একদিন বাংলাদেশের একপুরোনোপরিচিতর সঙ্গে কথা হচ্ছিল। কথায় কথায় আমার ভাই বোন কে কেমন আছে প্রশ্ন ওঠায় বলেছিলাম, বাবা তো সব সহায় সম্পত্তি ছেলেদের নামে উইল করে দিয়ে গেছে। যার সঙ্গে কথা বলছিলাম, শুনে তাজ্জব, বলে, বাংলাদেশের ইসলামি আইনে তো উইল চলে না? চলে না? না চলে না। সমস্ত সম্পত্তির তিন ভাগের একভাগ শুধু লিখে দিতে পারে কাউকে, তাও আবার উত্তরাধিকারীদের অনুমতি নিয়ে। তাছাড়া সম্পত্তি লিখে দেওয়ার বা উইল করার নিয়ম নেই। ছোটদাকে একদিন বলেছিলাম, তুমি কি জানো যে বাংলাদেশে উইল চলে না? বললো, জানি। তাহলে বাবার উইলটা তো অবৈধ। ছোটদা বললো, তোরা মেনে নিলে বৈধ, না মেনে নিলে অবৈধ। আমি বললাম, আমরা তো মেনে নিইনি এই উইল, তাহলে সম্পত্তি ভাগ করার ব্যবস্থা করো। ছোটদা বললো, সম্পত্তি ভাগ আমরা করবো না, বাবা যা দিয়ে গেছে আমাদের, তা নেব। বললাম, আইনের আশ্রয় যদিনিই? ছোটদা বললো, নে, দেখি কী করে নিতে পারিস। ছোটা এবং দাদা জানে যে আমার পক্ষে দেশে ফেরা সম্ভব নয়। আর ইয়াসমিনের সেই মানসিক সবলতা বা সুস্থতা নেই যে ভাইদের বিরুদ্ধে দাঁড়াবে। অগত্যা আর সব দুর্ভাগা মেয়েরা বাংলাদেশে যেভাবে বঞ্চিত হয়, আমাদেরও তেমন ভাবেই বঞ্চিত হতে হবে। কিন্তু যে আমি সমানাধিকারের পক্ষে এতকাল লড়াই করে এসেছি, মেয়েদের বিরুদ্ধে সমাজের আর আইনের যে অন্যায় চলে, তার প্রতিবাদ করে এসেছি সেই অন্যায় যখন নিজের পরিবারে, নিজের জীবনে, তখন আপোস করবো? আপোস যদি করি, তাহলে আমার বিশ্বাসের সঙ্গে আমার নিজেরই প্রতারণা করা। না, মা, সম্পত্তির লোভ আমার নেই। পরিবারের সবার জন্য আমার উপার্জিত টাকার সিংহভাগ আমি খরচ করেছি ইচ্ছে করেই করেছি, ভালোবেসে করেছি। কিছু পাওয়ার আশায় করিনি। কিন্তু যাদের জন্য জীবন দিই, তারাই যখন পেছন থেকে পিঠে ছুরি বসানোর পরিকল্পনা করে, এবং বসায়, তখন চমকে উঠি। বিশ্বাস হতে চায় না রূঢ় নিষ্ঠুর বাস্তব।

ছোটদার সঙ্গে আরও কথা বলার পর যা বুঝেছি তা আরও ভয়ংকর। আমার টাকা পয়সার ওপর, সে মনে করে, তার অধিকার একশ ভাগ। কারণ আমার স্বামী নেই, সন্তান নেই, তার মানে আমার ‘সংসার’ নেই, এবং আমি যেহেতু পুরুষ নই, মেয়ে, আমার টাকায় আমার ওপর আমার যত অধিকার, ভাইদের অথবাপুরুষ আত্মীয়দের তার চেয়ে অনেক বেশি অধিকার। সুতরাং আমার যা কিছু আছে, তা আসলে ছোটদার। আমি মরে গেলে আমার সব সে পাবে। আর স্বামী সন্তানহীন সংসারহীন বেঁচে থাকা মানে তো ঠিক বেঁচে থাকা নয়, তাই আমি বেঁচেও মৃত, আর যে দেশে আমার জন্ম বড় হওয়া, যে দেশে আমার সম্পদ সম্পত্তি এখনও বর্তমান, সে দেশেই যেহেতু আমি বেঁচে থাকা অবস্থায় উপস্থিত থাকতে পারবো না, তাই বিদেশের বরফে ডুবে থাকা আর মরে থাকা ওই একই কথা। বাবার উত্তরাধিকারী হওয়ার যোগ্য আমি নই।

তুমি যদি এই নিষ্ঠুর পৃথিবীটায় থাকতে, তবে সইতে পারতে এই অন্যায়! পারতে না। তোমার স্বামী পুত্রদের এই অনাচার আর অবিচারের বিরুদ্ধে তুমি মুখর হতে। নিশ্চয়ই হতে। কতই বা আর লড়াই করার ক্ষমতা ছিল তোমার! জানি তুমি কষ্ট পেতে, বাকি জীবনভর কাঁদতে। কেঁদে তো জীবনে কিছুই অর্জন করতে পারোনি। রাগ করে, চেঁচিয়েও তো কিছু করতে পারোনি। তোমার চিৎকার অবকাশের চার দেয়ালের ভেতর ধাক্কা খেয়ে খেয়ে তোমার কাছেই ফিরে এসেছে। তোমার চোখের জল নদী হয়ে হয়ে তোমাকেই ভাসিয়েছে, ডুবিয়েছে।

মা, আপন আসলে কাঁদের বলবো মা? ভাইরা কি আপন? কী করে ছোটদাপারলো তার যে বোনটা দেশে ফিরতে পারছে না, তার বাড়িতে থেকে তারই সর্বনাশ করতে? তুমি যতদিন ছিলে, আমার যা কিছু সব যত্ন করে রেখেছিলে। ছোটদাকে তুমি খুব ভালোবাসতে বাসতে তো মা। আমার বাড়িতে ছিলে একসঙ্গে। কী হিসেবে ছিলে মা? ছোটদার দাসী হিসেবে, তাকে খাওয়ানো দাওয়ানো তো আছেই, তার কাপড়চোপড় ধোয়া, ইস্ত্রি করা, ফ্লাইটে যাওয়ার আগে তার সুটকেস গুছিয়ে দেওয়া, তার ঘর দোর, বিছানাপত্র সাজিয়ে রাখা, তার জন্য অপেক্ষা করা। কখন ফিরবে অপেক্ষা। ভোগবাদী ছোটদা বাইরে থাকতো প্রেম করতে, অথবা বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিতে, বাড়ি ফিরতো মদ খেয়ে মাতাল হয়ে, অথবা বাড়িতে বসেই মদ খেতো। তুমি ওগুলোকে মদ বলতে না, হাইনেকেন বিয়ার কে তুমি ভাবতে সবুজ কোকোকোলার ক্যান। কিন্তু ওই সবুজ কোক খেয়ে তোমার ছেলে অমন মাতাল হয় কেন, জীবনে কোনওদিন মাতাল না দেখা তুমি, কী রকম দুঃখ পেতে, তা আমি বেশ বুঝি। এই আদরের ছেলে যে অল্প বয়সে বিয়ে করে গীতা গীতা করে জীবন পার করলো, গীতার মুঠোর ভেতর থেকে বেরিয়ে আসা ছেলেকে তুমি প্রথম পেলে। কিন্তু কী রকম সে পাওয়া তোমার! ছোটদার আমার মনে হয় না তোমার প্রতি কোনও ভালোবাসা ছিল।

তুমি ঢাকায় এক ছেলের যত্ন করবে। আর বাবা ময়মনসিংহে আরেক ছেলের যত্ন করবে। এই তত ছিল অলিখিত নিয়ম, মা। তোমাদের যত্ন করার, তোমাদের কথা ভাবার কেউ ছিল না মা। সবাই যার যার নিজের জীবন নিয়ে ব্যস্ত। তোমার আদরের ধনেরা। তুমি বোধহয় আশা করতে তোমার বিপদে আপদে, অসুখে বিসুখে তোমার সন্তানেরা তোমার পাশে থাকবে। কিন্তু হল কই মা। কাউকেই তো পাওনি। আমার যে বাড়িটা তুমি গুছিয়ে রাখতে, আগলে রাখতে, তুমি বিদেয় নেওয়ার পর সংসারে আর কেউ নেই তুমি যা করতে, তার সামান্য হলেও করার। আমার আলমারিগুলো দেশ থেকে আমি বেরোবার পরই ছোটদা খুলে ফেললো সব। আমার এতদিনকার সব কিছু আমার জরুরি, অতি জরুরি কাগজপত্র, চিঠি, অপ্রকাশিত গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ কবিতা–সব ছোটা খুলে দিল সবার জন্য। যে কেউ এসে যা ইচ্ছে করতে পারে আমার সব প্রয়োজনীয় সবকিছুকেই। ভেঙে ফেলতে পারে, আবর্জনার বাক্সে ফেলে দিতেপারে, নির্দ্বিধায় নিজের মনে করে নিয়ে যেতে পারে, ছিঁড়ে ফেলতে পারে। হ্যাঁ মা, বিশ্বাস করো নাই করো, আমার যক্ষের ধনকে ছোটদা বিলিয়ে দিল যার তার কাছে। যে কাউকে যা ইচ্ছে তাই করার অধিকার ছোটদা দিয়ে দিল। আমার কিছু আর আমার রইলো না। ছোটদা কেন এই কাজটি করেছে আমি আজও ভাবি। তার টাকার দরকার, সে সবকটি আলমারির তালা ভেঙে টাকা পয়সা খুঁজে যা কিছু তার দরকার নিয়ে আবার ঠিক সেরকম করেই রেখে দিতে পারতো যেমন ছিল সব, যেমন আমি রেখেছিলাম। একটি মেয়ে দেশে ফিরতেপারছে না, একটি মেয়ে নির্বাসনের দুঃসহ যন্ত্রণার মধ্যে দিন কাটাচ্ছে, সে তার নিজের যা কিছু গড়েছিল, সব ফেলে আসতে বাধ্য হয়েছে, আর তার বাড়িতে থেকে এত বড় অকৃতজ্ঞ হতে পারে কেউ মা? পারে, ছোটদা পারে। বাড়িতে কত কেউ থেকেছে, কী করেছে কে জানে। তোমার আলমারিটায় আমি তোমার জিনিসপত্র গুছিয়ে, যেভাবে তুমি নিজের হাতে রেখেছিল, সেভাবেই, তোমার চিঠিপত্র, তোমার বইখাতা, তোমার ব্যবহারের জিনিসপত্র, তোমার জগৎটাকে রেখে তালা লাগিয়ে এসেছিলাম। ইয়াসমিনকে বলেছিলাম, তুই দেশে গেলে ঢাকা আর ময়মনসিংহে রাখা মার দুটো আলমারি খুলে মার স্মৃতিগুলো স্পর্শ করিস। ইয়াসমিন গিয়েছিলো বটে দেশে, কিন্তু তোমার ময়মনসিংহে আলমারি খুলে তোমার জিনিসপত্রগুলোকে স্পর্শ করার তার সময় বা ইচ্ছে কোনওটাই হয়নি। ঢাকার বাড়িতে রাখা তোমার আলমারি ও বললো, খোলা। ঢাকায় এখন শুভ থাকে, তোমার আলমারিতে শুভ তার কাপড় চোপড় রাখে। শুনে আমি বাকরুদ্ধ বসে ছিলাম। শুভর কাপড় চোপড় রাখার জন্য মার আলমারি খুলে দিতে হল ছোটদাকে! শুভর জন্য কি কোনও আলমারি কিনে দেওয়া যেত না! ছোটদা ঠিক কী দিয়ে গড়া মানুষ, আমি জানি না। তোমার গর্ভ থেকেই তো জন্ম মা। তোমার হৃদয় উপচে ওঠা মায়া মমতার সামান্য এক তিলও পায়নি কি ছোটদা? কিন্তু পেয়েছে তো, সেটা ও কাজে লাগায় শুধু তার বেলায়, অথবা জুইএর বেলায়। তোমার সব স্মৃতি এক ফুৎকারে উড়িয়ে দিতে তার এতটুকু বাধে না। আমার জগৎকেপায়ের তলায় পিষে ফেলতে তার কোনও কষ্ট হয় না। সে তোমাকে আমাকে সবাইকে বিনা দ্বিধায় হাটে বাজারে বিক্রি করে দিতে পারে। সেই বিক্রির টাকাগুলো ডলার করে গীতার চরণে উৎসর্গ করতে পারে। কিন্তু গীতার সঙ্গে তো শারীরিক এবং সামাজিক সম্পর্ক চুকিয়ে ফেলে জুইকে বিয়ে করে তার সঙ্গেই জীবনযাপন করছে। তাহলে গীতার প্রতি তার এখনও এই ভালোবাসা কেন! আজও সে গীতার মতো দুষ্টু চরিত্রের মহিলার বিরুদ্ধে একটি শব্দও উচ্চারণ করে না, কারণ কি? গীতা, ছোটা বেশ জানে যে আমাদের বাড়ির সবাইকে ভুগিয়েছে। বাবাকে, তোমাকে, আমাকে, ইয়াসমিনকে অকথ্য অপমান করতে ছাড়েনি। গীতাকে কোনওদিন সে এ কারণে দোষ দেয়নি। ভালোবাসতে যে ছোটদা পারে না, তা নয়, পারে। নিজের জীবনে সে তা প্রমাণ করেছে। তবে বহুগামিতা তার রক্তে, তাকে দমন করার কোনও ইচ্ছে তার নেই। আমি পারি না এমন। দাদা, আমি, তুমি, ইয়াসমিন বড় দুর্ভাগ্যজনকভাবে একগামি। আমাদের পরিবারের সবচেয়ে সুখী এবং পরিপূর্ণ মানুষ ছোটদাই। দুঃখতার ধারে কাছে ঘেঁষতে পারে না। আমার চেয়ে বয়সে আট বছরের বড় হলেও তাকে দেখতে এখনও আমার চেয়েও কমবয়সি। আনন্দে থাকার এই একটা গুণ, মনের বয়স যেমন বাড়ে না, শরীরের বয়সও কোন অদৃশ্য গুহায় যেন লুকিয়ে থাকে। তুমি ভেবো না এরপরও ছোটদাকে আমি কোনও মন্দ কথা বলি। দেখা হলে এখনও আগের মতো আনন্দে ফেটে পড়ি। তার সামান্য কটা চুল পেকেছে বলে আমার সে কী মন খারাপ, কলপ লাগিয়ে কালো করার পরামর্শ দিই। ছোটদা অবশ্য বললো, মেয়েরা নাকি বলে ওই গ্রেতেই তাকে বেশি সেক্সি দেখতে লাগে। এই সেদিনও ছোটদার প্রেমে মেয়েরা কী করে উন্মাদ হয়, তার হাই-ইস্কুল-সুইটহার্টনাসরিন এতকাল পর কী করে স্বামী সন্তান ফেলে ছোটদার কাছে ছুটে ছুটে আসে, বললো। ছোটদার মন ভালো আছে, ভাবলে আমার ভালো লাগে। ছোটদা যা খেতে ভালোবাসে, তাই তাকে আদর করে খাওয়াই। ওয়াইন খেতে ভালোবাসে, সবচেয়ে ভালো ওয়াইন কিনে রাখি ওর জন্য। এই সেদিনও ছোটদাকে তার দুই ছেলেমেয়েসহ লাস ভেগাস আর গ্র্যাণ্ড ক্যানিয়েন বেড়াতে নিয়ে গিয়েছি, সবচেয়ে ভালো হোটেলে থেকেছি, ভালো রেস্তোরাঁগুলোয় খেয়েছি। আর সারাদিন রাত শুধু তুমুল হৈহল্লা আর গল্প করে কাটিয়েছি। যেন ছোটদার ভাল লাগে। ছোটদা খালি হাতে এলেও কখনও তাকে খালি হাতে বিদেয় দিই না। নিউইয়র্কে আমার বাড়িতে তাকে জোর করেই রেখে দিই, আমার বিছানায় তাকে ঘুমোতে দিয়ে যে বিছানায় আমার ভালো ঘুম হয় না, সে বিছানাতেই আমি রাত কাটাই। ছোটদার যেন আরাম হয়, ছোটদার যেন ভালো ঘুম হয় চাই। ইয়াসমিন আমার চেয়েও আরও এক কাঠি ওপরে, ছোটদা বলতে পাগল সে। ছোটদা আসবে শুনলে সে বাড়িঘরপরিষ্কার পরিচ্ছন্ন অভিযানে নেমে যায়, সারাদিনপনেরো যোলো রকম খাবার রান্না করে। দাদার জন্য একইরকম করি। কলকাতায় দাদা আমাকে দেখতে আসতো। খালি হাতেই আসতো, তবে একবার মুক্তাগাছার মণ্ডা আর গরুর মাংসের ঝুরি নিয়ে এসেছিলো, দুটোই আনার সময় গরমে নষ্ট হয়ে গিয়েছিলো। কিন্তু রেফ্রিজারেটরে ওইনষ্টগুলোই রেখে দিয়েছিলাম অনেকদিন। খেতে পারিনি, কিন্তু দেখে ভালো লাগতো, দাদা কিছু এনেছে। বন্ধুদের বলেছি, দাদা আমার জন্য দেশ থেকে কত কিছু নিয়ে এনেছে। দাদার রক্তে বেশি সুগার পেয়ে আমি দিন রাত ব্যস্ত হয়ে পড়লাম তার সুগার কমাতে, ডাক্তারের কাছে নিয়ে ইনসুলিন কতটা নেবে কী নেবে তা শুধু জেনে আসা নয়, সবচেয়ে আধুনিক যে ইনসুলিন বেরিয়েছে, সেসব ব্যবহার করিয়ে, তাকে পথ্য খাইয়ে, তার সুগার কমিয়ে, তার হতাশা দুর্বলতা ইত্যাদি ঘুচিয়ে পরে আমি শান্ত হলাম। দাদা নাটক দেখতে ভালোবাসে, তাকে প্রায় সন্ধেয় নাটক দেখাতে নিয়ে যেতাম। গান ভালোবাসে, একশ গানের সিডি কিনে দিই। তরুণ মজুমদারের সিনেমা তার ভালো লাগে, তাঁর সঙ্গেও যে করেই হোক আলাপ করিয়ে দিই। দাদার তাজমহল দেখার ইচ্ছে, সেই তাজমহলও দাদাকে দেখিয়েছি। রেডফোর্ট, আগ্রাফোর্ট সব। তোমাকে যেমন সেবা করেছিলাম, দাদাকে কিছু আমি কম করি না, মা। বাবার সম্পত্তি নিয়ে যা করেছে, সব জানার পরও দাদাকে পেলে জগৎ সরিয়ে রেখে দাদার শরীর মন সব সুস্থ করে তুলি। দাদা চলে গেলে চোখের জলে ভাসি। ভালোবাসাটা জগদ্দল পাথরের মতো হৃদয়ে বসে থাকে, সম্পত্তি বা টাকা পয়সার মতো তুচ্ছ কারণ এসে সে পাথর নড়াতে পারে না।

.

জীবন অনেক বদলে গেছে মা। তোমার স্বপ্ন শেষ পর্যন্ত সফল হলো না। বাংলাদেশে ফেরার আমার কোনও উপায় নেই। আমার পাসপোর্টের মেয়াদ উত্তীর্ণ করা হয় না। বিদেশের বাংলাদেশ দূতাবাসগুলোয় ধর্না দিয়ে ওই একই উত্তর শুনতে হয়, তারা আমার পাসপোর্টের মেয়াদ বাড়াবে না। আমি যেন দেশে যেতে না পারি তার সবরকম কায়দা কানুন ওরা করে রেখেছে। সুইডেনের পাসপোর্ট হাতে, ওতেও বাংলাদেশের ভিসার জন্য আবেদন করেছি। একই উত্তর মা। না। যে সরকারই বাংলাদেশে আসে, নিজেদের মধ্যে আর সব বিষয়ে তাদের মত পার্থক্য থাকলেও আমার ব্যাপারে সবাই একমত, আমাকে দেশের মাটিতে পা রাখতে দেবে না তারা। অগত্যা সুয়েনসনের বাড়িটিকেই নিজের বাড়ি মনে করে সাজিয়ে তুলোম। ঢাকায় ফেলে আসা আমার সবকিছুকে ভুলে তো যেতে পারি না, কিন্তু আর কতকাল জীবন আমাকে কেবল শেকড়হীন হাহাকার দিয়ে যাবে, যেন রূঢ় বাস্তবতার বিরুদ্ধেই রুখে দাঁড়ালাম। স্বপ্নের বীজ ছড়াতে শুরু করলাম জীবনের ধূসর ঊষর অকর্ষিত জমিতে। কিন্তু তাই বা কদিন বলো। ভিন দেশে ভিন মানুষের সঙ্গে তুমি চলতে ফিরতে পারো, কিন্তু কোথায় যেন কিসের এক ফাঁক থেকে যায়, অথবা ফাঁকি। অস্তিত্বের লড়াই শুরু হয় অলক্ষ্যে। সুয়েনসনের বাড়িতে অন্তত চোখ কান নাক মুখ বুজে একটি কাজ করা যায়, সে লেখা। প্যারিস থেকে ফিরে এসে ফরাসি প্রেমিক নামে বড় উপন্যাস লিখে ফেলেছি। উপন্যাস লেখা আমার হয় না, ও লেখা একরকম বাদই দিয়েছিলাম। আমার মেয়েবেলার কথা তো জানোই। বইটা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশে বেরোবার আগেই নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছেন। কলকাতায় আমার বই বেরোনোর সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশ দূতাবাস থেকে লোক এসে কিনে নিয়ে যান। এরকমই বোধহয় নির্দেশ। সে বই তারা নিজেরা পড়ে মত জানান, অথবা সরাসরি প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরে পাঠিয়ে দেন। প্রধানমন্ত্রী পড়ে বা নাপড়ে বই নিষিদ্ধ করেন। কেন, কী বুঝে, কে জানে। অবাক লাগে এসব চরিত্র দেখে। চারদিকে এই বই নিয়ে উচ্ছাস। আর এটি কি না যে দেশের কাহিনী, সে দেশেই নিষিদ্ধ। হাসিনা কী কারণে যেন ফ্রান্সে এসেছিলেন। ওকে দেখে ফরাসি সাংবাদিকরা ছুটে গিয়ে একটা প্রশ্নই করেছে, আপনি তসলিমার আমার মেয়েবেলা নিষিদ্ধ করেছেন কেন, হাসিনা ঠেটি উল্টে বলে দিয়েছেন, ও বই ভালগার, পর্নোগ্রাফি। ভেবেছেন বেশ বিজ্ঞের মতো বুঝিমন্তব্যটি করা হল। ফরাসিরা ওই বইটা পড়েছে, হাসিনার মন্তব্য শুনে তাজ্জব বনে যায়। ল্য মন্দ পত্রিকার সাংবাদিক ব্রুনো আমাকে পরে বলেছে এমহিলা দেখি আগাগোড়া মূর্খ। ফরাসিরা জানে বইটা কী বই, ভালগারের কিছু আদৌ আছে কী বইয়ে। তাদের তো আর বোকা বানানো যাবে না। নিজেকেই বরং বোকা হয়ে যেতে হবে। সরকার বই নিষিদ্ধ করে, সে সরকারের দোষ। আমি আমার লেখাকে, আমার মতকে অস্বীকার করবো কেন, নিষিদ্ধ করবো কেন। নিজের লেখা নিজের নিষিদ্ধ করার মতো ভয়ংকর আর কিছু নেই। বলো, বই কি আমি কাউকে খুশি করতে লিখি নাকি? যা বিশ্বাস করি, তাই তো লিখি। আমার মেয়েবেলা শুধু ফরাসি ভাষায় নয়, জার্মানির বড় একটি প্রকাশকও বের করেছে। আমেরিকাতেও বের হয়েছে। আমেরিকায় আবার আমাকে বুক ট্যুরে যেতে হল, আমেরিকার উত্তর দক্ষিণপূর্বপশ্চিম সব অঞ্চলের বিশ্ববিদ্যালয়ে বা বড় বড় মঞ্চে বই প্রকাশ উপলক্ষে আমার বক্ততা হল। আমেরিকার প্রায় সবপত্রিকায় বইয়ের সমালোচনা বের হল, সবাই উচ্ছ্বসিত প্রশংসা তো করলোই, লস এঞ্জেলেস টাইমস আর গ্লোব এণ্ড মেইল নামের দুটো নামি পত্রিকা বইটিকে দুহাজার দুই সালের শ্রেষ্ঠ নন ফিকশন বইএর লিস্টেও রাখলো। কিন্তু রয়্যালটির টাকা? পাইনি বললেই চলে। আমেরিকার ওই প্রকাশক এককালীন টাকা দিয়ে ফরাসি প্রকাশকের কাছ থেকে কপিরাইট কিনে নিয়েছে। আমেরিকায় ভালো বিক্রি হয়েছে বই। হলিউড থেকে একটি মুভি কোম্পানি যোগাযোগ করেছিলো। বই নিয়ে ছবি বানাতে চায়। লিটারেরি এজেন্ট থাকলে এসব সমস্যা হয় না। কিন্তু ওইসব এজেন্ট টেজেন্ট রাখা আমার ভালো লাগে না, লেখাটা আমার পেশা, কিন্তু ভেতরে ভেতরে আমি সেই এলোমেলো লেখক, লেখা যার নেশা। পেশা হলেও পেশাদারি মনোভাব আমার আসে না। ভারতের বিভিন্ন ভাষাতেও বইটি ছাপা হয়েছে। কোথায় কে ছাপাচ্ছে, কী ছাপাচ্ছে, তার হিসেবও আমার রাখা হয় না। মহেশ ভাট অনেকদিন আগেই বলেছিলেন, আমার জীবন নিয়ে ছবি বানাবেন, সে কথা অবশ্য কথাতেই রয়ে গেছে। উতল হাওয়া নামে দ্বিতীয় আত্মজীবনীর দ্বিতীয় ভাগটিও একদিন লেখা হয়ে যায়। বাংলার বাইরে অন্য ভাষাতেও এ বই অনূদিত হয়। ফরাসি প্রকাশক লুফে নেন উতল হাওয়া। লেখাই আমার আশ্রয় হয়ে ওঠে। তুমি নেই, বাবা নেই, সব আশ্রয় যখন শেষ হয়ে যায়, বোধহয় আশ্রয় খুঁজি অন্য কিছুতে। ফরাসি প্রেমিক বইটি বাংলাদেশে বের হয়, এই বইটির যেখানেই যৌনতা পেয়েছে, কেটে বাদ দিয়েছে বাংলাদেশের প্রকাশক। কলকাতার প্রকাশক বাদ দেয়নি কিছু। বিরাট করে বইটি বের করেছে, এবং পেঙ্গুইন ইন্ডিয়াও বইটি ইংরেজিতে অনুবাদ করে ছাপিয়েছে। এত সব লেখালেখি, এর মধ্যে তোমাকে কি ভুলে থাকি একটি দিনের জন্য? না, মা, ভুলে থাকতে পারি না। উতল হাওয়ায় তোমাদের কথাই লিখি, তোমার কথা, বাবার কথা। লিখতে লিখতে কাঁদি। চোখ মুছি। আবার লিখি। আমার শব্দে, আমার স্মৃতিতে তুমি জীবন্ত হয়ে দেখা দাও। পুরোনো দিনগুলোয় ফিরে যেতে হলে কী যে প্রয়োজন হয় রেখে আসা কত কিছুর। দাদাকে বলি রুদ্রর চিঠিগুলো অন্তত পাঠিয়ে দিতে। শান্তিনগরের বাড়িতে আমার লেখার ঘরে কত চিঠি যে পড়ে আছে, কত যে ডায়রি, কত যে বই, স্মৃতির পাহাড় ওখানে। গোটা পাহাড় কে পাঠাবে বলো! রুদ্রকে লেখা আমার চিঠিগুলোই পেয়েছি, আমাদের বিচ্ছেদের সময়ই ওর কাছ থেকে চিঠিগুলো নিয়ে এসেছিলাম। আমাকে লেখা রুদ্রর চিঠির খুব অল্প কিছু ছাড়া আর কিছু পাঠায়নি দাদা। বলেছেপায়নি। কোথায় সব গেল জানি না। শুধু কিরুদ্রর চিঠি, বাক্সরপর বাক্স চিঠিতে বোঝাই ছিল। পাঠকদের চিঠি, দেশ বিদেশের শিল্পী সাহিত্যিকদের চিঠি। আমাকে লেখা বাবার এক ট্রাংক চিঠি। নিজের জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময় নিয়ে আত্মজীবনীর তৃতীয় বইটি যখন লিখছি, তখন তথ্যের দরকার পড়েছে। যদি হাতের কাছে তথ্য না থাকে, তবে কত আর স্মৃতি থেকে লেখা যায় বলো! আমার লেখক জীবন কী করে শুরু হল, সেই সব জনপ্রিয়তা, একইসঙ্গে সমাজের সব বাধার বিরুদ্ধে আমার রুখে দাঁড়ানো, হাসপাতালের ব্যস্ততা, সরকারের বিরোধিতা, পাসপোর্ট আটকে রাখা, ফতোয়া, মিছিল, বইমেলায় আমাকে আক্রমণ, বইমেলায় আমার উপস্থিতি নিষিদ্ধ হওয়া, বই বাজেয়াপ্ত হওয়া, দেশের রাজনৈতিক পরিবর্তন, ব্যক্তিজীবনের ভয়াবহ অস্থিরতা আর সব কিছু ভেঙেচুরে নিজের পায়ে দাঁড়ানোর প্রবল মনোবল আর শক্তি নিয়ে কুৎসিত পুরুষতান্ত্রিক সমাজে একটি মেয়ের মাথা উঁচু করে একা থাকা, এত কিছু নিয়ে বড় একটি বই লেখা শুধু স্মৃতির ওপর নির্ভর রইলো।

শান্তিনগরের আমার বাড়িটা দাদা আর ছোটদা দুজনই ব্যবহার করে। বাড়িটা ভাড়া দিলে বা বিক্রি করে দিলে ভালো টাকা পেতাম। কিন্তু কিছুই করি না আমি। নিজের ভাইদের কাজে লাগছে বাড়ি, লাগুক। ইট কাঠ কংক্রিটের কোনও মোহ আমার নেই। আমার মন পড়ে থাকে আমার সেই বইগুলোয়, সেই আধ-লেখা লেখাগুলোয়, আমার সেই সহস্র রকম খেরোখাতার লেখালেখিতে। কত যে অপ্রকাশিত লেখা আমার কমপিউটারের ভেতরে বা বাইরে ছিল। কার এত সময় বাইচ্ছে আছে ওগুলো যত্ন করে রাখার, বা আমাকে পাঠিয়ে দেওয়ার। ছোটদা আসে আমেরিকায়। সুটকেস ভরে ভরে গীতার জন্য জিনিসপত্র নিয়ে আসে, তার সুটকেসে আমার প্রয়োজনীয় কোনও কিছুর জায়গা হয় না। আসলে জায়গা বড় ব্যাপার নয়, মা, ইচ্ছে হয় না। আমি এখন তাদের কাছে কোনও আর মূল্যবান কিছু নই। আমার রেখে আসা জিনিসপত্র অনেকটাই আবর্জনা তাদের কাছে। তারা হয়তো ঝেড়ে ফেলে দেয়, নয়তো কাউকে দিয়ে দেয়, এসবে কোনও মমতা নেই তাদের। তুমি যখন ছিলে, কাজের লোক ঘর ঝাড় দেওয়ার সময় বলতে, ঘর থেকে কোনওদিন যেন কোনও কাগজ না বেরোয়। মেঝেয় পড়ে থাকা হাবিজাবি কাগজও তুমি কোনওদিন ফেলতে দিতে না। আবর্জনার ঝুড়ি থেকে কুড়িয়ে নিয়ে আসতে যে কোনও কাগজ। অথচ কত মূল্যবান কত কিছু ছোটদা ফেলে দিচ্ছে। কারণ তার ওসব দরকার নেই। আমি আর বেঁচে থাকতে ও দেশে ফিরতে পারবো না, সুতরাং ওসবপুরোনো জিনিসে ঘর ভরে থাকলে তাদের চলবে কেন। কলকাতায় যখন ছিলাম, দাদাকে বলেছিলাম দেশে যখন ফেরা কোনওদিনই সম্ভব হবার নয়, যেন পাঠিয়ে দেয় শান্তিনগরের বাড়ি থেকে আমার যা আছে সব। দাদা একাঁপারবে না বলে মিলনকে টিকিট পাঠিয়েছি আমেরিকা থেকে দেশে যাওয়ার। বিয়াল্লিশটা বড় বড় কার্টুনে সব ভরে ওরা কুরিয়ার করে দিয়েছে। কিন্তু কলকাতায় সামান্য কিছু বই এসে পৌঁছেছে। বাকিগুলো নাকি কুরিয়ারের লোক বলে দিয়েছে কাস্টমস-এ আটকে রেখেছে। ওগুলো ছাড়িয়ে আনার চেষ্টা কেউ করেনি। আমার জিনিসপত্র সব দূর করে বাড়িঘর এখন বেশ হালকা করা গেছে। সবার জন্য বিস্তর জায়গা হয়েছে এখন। কী বলবো মা, শোকে পাথর হয়ে যাই। জোরে যে কাঁদবো, পারি না। বুঝি, জীবন তছনছ হয়ে গেছে, এ জীবনে স্মৃতি ছাড়া আর কিছু নেই নিয়ে বাঁচার।

.

এদিকে যত আমি সুয়েনসনের বাড়িতে শেকড় গাড়ছি, যত আমি তার এলোমেলো বাড়িকে সাজাচ্ছি, তত রুক্ষ হতে শুরু করলো সুয়েনসনের ব্যবহার। তার অটিজম রোগ কোনও নতুন কিছু সহ্য করতে পারে না। যেটা যেখানে ছিল, সেভাবে থাকলেই স্বস্তি বোধ করে। আমার একটা রুট ক্যানেলের দাঁত ছিলো তোমার মনে আছে? ওই দাঁতটার ওপর যে ছোট্ট একটা মুকুট পরিয়ে দেওয়া হয়েছিল, সেই মুকুটের একটা অংশ একদিন ভেঙে গিয়েছিলো। দাঁতেরহাসপাতালের জরুরি বিভাগে দেখালে বললো মুকুট একটা নতুন বানিয়ে নিতে হবে। পরসালিন মুকুট বানাবো, এরকম ঠিকও করে রাখলাম। কিন্তু দাঁতের হাসপাতাল বাড়ি থেকে দূর, কত আর দূর, পনেরো মিনিট লাগে যেতে। সুয়েনসনের পরামর্শ, তার চেয়ে পাঁচ মিনিট সময় নেবে, এমন কাছের কোনও ক্লিনিকে যাওয়া উচিত, যে ক্লিনিকে অন্য সব রোগের চিকিৎসার পাশাপাশি দাঁতের ব্যাপারটাও আছে। সুয়েনসনের অবসর সময়ে তাই করলো, বাড়ির কাছের ক্লিনিকে নিয়ে গেল আমাকে। থেরেস নামের এক বেঁটে মেয়ে, দাঁতের ডাক্তার বলে কিছুতেই তাকে মনে হবে না, নার্স বলেও মনে হবে না, আমার রুট ক্যানেলের দাঁতের ওপর থেকে মুকুটটা সামান্য ভেঙে গেছে, মুকুটটা যেন লাগিয়ে দেয় সে, বলাতে যত দাঁত আছে আমার মুখে, সবগুলো দাঁতের আলাদা আলাদা করে এক্সরে নিল। যত বেশি এক্সরে, তত বেশি ক্যানসারের সম্ভাবনা, জানো তো। তোমার কোলন ক্যানসার হয়েছিল, তাই তোমার সব ছেলেমেয়েদের কোলন ক্যানসার হওয়ার আশংকা আছে। এর মধ্যে একটা কেলোনোস্কপি আমাকে করতে হয়েছে। হাশেম মামার ক্যানসার হল, তোমার হলো। আমাদের শরীরে ক্যানসার হওয়ার আশংকা, যাদের পরিবারে ক্যানসার নেই, তাদের চেয়ে বেশি। বিজ্ঞান তাই বলে, মা। আমি থেরেসকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, প্রত্যেকটা দাঁতের আলাদা এক্সরে করছো কেন? দুটি দাঁতের তো এক এক্সরেই যথেষ্ট! দাঁতাল হাসি দিয়ে মেয়ে বলে, তাদের ক্লিনিকে নাকি ওই সুবিধে নেই। আসলে কি জানো, তখনই আমার উঠে চলে আসা উচিত ছিল। এখনও আমি অনুতাপ করি, কেন আমি উঠে আসিনি। এক্সরে করে ফিরে আসার কদিন পর থেরেসের ফোন আসে আমার কাছে। তার দাবি, আমার রুট ক্যানেলের দাঁতের ওপরের হাড়ে ব্যাকটেরিয়া জমেছে, সুতরাং আমি যেন এক্ষুনি গিয়ে দাঁতটা ফেলে আসি। বলে কী! দাঁত ফেলতে হবে কেন! তখন আমার উচিত ছিল দাঁতের হাসপাতালে বড় দাঁতের ডাক্তারের কাছেগিয়ে জিজ্ঞেস করা, তোমরা যে বলেছো মুকুট পরিয়ে দেবে দাঁতের ওপর, তো ওদিকে যে আমাকে ডাকা হচ্ছে দাঁত ফেলতে। বলো তো ঘটনা কী! ঘটনা ওরা বলে দিতে পারতো, থেরেস দন্ত বিজ্ঞানের কচু জানে। রুট ক্যানেলের দাঁতের ওপরের হাড়ে একটু ছায়াপড়েছে, ওটা ইনফেকশন নয়। কিন্তু দাঁতের হাসপাতালে নাগিয়ে আমি থেরেসের আহ্বানে বাড়ির কাছের সেই ক্লিনিকে উপস্থিত হলাম। অবশ্য জিজ্ঞেস করেছিলাম, দাঁত তোলার আগে, যে, আমি কিনতুন দাঁত বসাতে পারবো ওখানে, ইমপ্ল্যান্ট করতে পারবো? থেরেস সঙ্গে সঙ্গে বললো, নিশ্চয়ই নিশ্চয়ই। তারপর যে কী ঘটলো, সে যে কী ভয়াবহ দৃশ্য, তুমি না দেখলে বিশ্বাস করতেপারবেনা। মাড়ি অবশ করে শুরু করে দিল থেরেস তার অজ্ঞতার চর্চা। নানারকম সাঁড়াশি দিয়ে চেষ্টা করেও কিছুতেই সে আমার শক্ত পোক্ত দাঁত তুলতে পারে না। শেষ পর্যন্ত আশা ছেড়ে দিয়ে সে ডেকে আনলো তার মতোই এক অজ্ঞতার পিণ্ডকে। সেই পিণ্ডও অনেক ছুরি কাচি চালিয়ে মাড়ি কেটে ব্যর্থ হয়ে কোত্থেকে কুড়োল, কোদাল, করাত নিয়ে এলো জানি না, দাঁতের ওপরের হাড় কাটতে লাগলো, হাড় একটু কেটে দাঁত টেনে তোলার চেষ্টা করলো, হল না। আবারও কাটতে লাগলো। হাড় কাটার সময়, মা, আমার চোখ বেয়ে অঝোরে জল ঝরছিলো। খুলির ভেতর মস্তিষ্ক প্রতি কুড়োল আর করাতের আঘাতে প্রবল নড়ছিলো। অবশ করা কিছুই আর অবশ ছিলো না। ওই প্রবল আঘাতগুলোতে আমার হাড় গোড় সব ভেঙে যাবার অবস্থা। আমি বুঝতে পারছিলাম। ওদের বলার চেষ্টা করলাম, এবার থামো। তোমরা ভুল করছো, তোমাদের কোথাও ভুল হচ্ছে। তোমরা আমার হাড় কেটে ফেলছে। কিন্তু কে শোনে কার কথা, সাদা মূর্খগুলো বাদামি রঙের বুদ্ধিকে সহ্য করে না। ধমক দিয়ে থামায়। আমি এখন তাদের হাতের মুঠোয়, তারা যা ইচ্ছে তাই করবে। ক্রুদ্ধ কসাই দুটো আমার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছে। মনে হচ্ছিল, খুলি ফেটে মস্তিষ্ক ছিটকে বেরিয়ে পড়বে। তখনও যদি আমি ওভাবেই উঠে চলে আসতে পারতাম। আমার যদি তখন মনে হতো, এই সুইডেনের ডাক্তাররা তোমাকে ভুল চিকিৎসা দিয়ে মেরেছে। আমাকেও মারতে যাচ্ছে। যদি মনে হতো, এদের হাতে মরার আমার কোনও সাধ নেই। কিন্তু আমাকে ওরা জোর করে চেপে ধরেছে এমন করে যে বাঁচার আর উপায় ছিল না। অসহায় চোখে সুয়েনসনের দিকে তাকাচ্ছিলাম। ও যদি আমাকে এই বর্ণবাদী অজ্ঞদের হাত থেকে বাঁচাতে পারে। কিন্তু সুয়েনসনের মুখে মিষ্টি মিষ্টিহাসিও হয়তো বোঝেইনি কী ঘটছে, আর বুঝলেও প্রতিবাদ করার চরিত্র ওর নেই। সুয়েনসন তো ওদের চেয়ে আলাদা নয়, তারও বিশ্বাস বাদামির চেয়ে সাদা বেশি বোঝে, বেশি জানে। সুতরাং আমাকে যদি ওই ওখানে মরে পড়ে থাকতে হতো, তাহলেও সুয়েনসন মনে করতো, নিশ্চয়ই মৃত্যুটাও আমার প্রাপ্য ছিলো। আমি জানি না কেন আমি এই দেশ তোমাকে মেরেছে জেনেও আমি এই দেশের অজ্ঞদের হাতে নিজেকে সঁপে দিয়েছি! আমার উচিত ছিল ওই হাড়কাটা দস্যুদের কবল থেকে দৌড়ে পালিয়ে আসা। চার ঘণ্টা সময় ওরা নিল আমার হাড় কাটতে, আমার সর্বনাশ করতে। পিণ্ড চলে গেল। থেরেসকে তারপরও জিজ্ঞেস করলাম, দাঁত ইমপ্ল্যান্ট হবে তো! সে সজোরে মাথা নেড়ে আবার বললো নিশ্চয়ই। মাড়ি কাটা হাড় কাটা অবস্থায় ফেরত এলাম। সঙ্গেতৃপ্ত সন্তুষ্ট সুয়েনসন। এর মাথার ব্যারাম আছে সে গ্রীসেই দেখেছি। এথেন্সের এক ট্যাক্সি ড্রাইভার যখন আমাকে অন্ধকার গলিতে থামিয়ে কয়েক হাজার ডলার ডাকাতি করে নিয়ে গেল, সুয়েনসন পাশে থেকেও বুঝতে পারেনি কী ঘটেছে। পরে গলি থেকে বেরিয়ে এথেন্সের এক ক্যাফেতে বসে ওকে যখন বলেছি, কী ঘটেছে, ওর গা এত কাঁপছিলো যে হাতে ধরা গ্লাসটিও কাঁপছিলো, ছলকে উঠছিলো গ্লাসের পানীয়। দাঁতের ডাক্তাররা যে হাড় কেটে ভুল করেছে, তা সুয়েনসনকে বলার পরও তার বোঝা সম্ভব হয়নি। পরদিন দাঁতের হাসপাতালে গিয়ে বড় ডাক্তারদের বললাম ইমপ্ল্যান্ট করতে চাই। ডাক্তাররা এক্সরে দেখে নিয়ে আমাকে বললেন, তোমার হাড় এত বেশি কাটা হয়েছে যে কোনও ইমপ্ল্যান্ট আর সম্ভব নয়। বলেছিলাম, হাড়ে কিইনফেকশন হয়েছিলো? বড় ডাক্তার সোজাসুজি বলে দিলেন, দাঁত ফেলার কোনও প্রয়োজন। ছিলো না। ওসব ইনফেকশন নয়। কালো যে ছায়াপড়ে, রুট ক্যানেল করা দাঁতের ওপরের হাড়ে ওই ছায়া স্বাভাবিক। হাড় কি গজাবে? আমার প্রশ্নের উত্তরে বিশেষজ্ঞরা বললেন, হাড় গজায় বটে, তবে তোমার হাড় অনেকটাই কেটে নিয়েছে, গজালেও এত গজাবে না যে নতুন একটা দাঁত লাগানো সম্ভব হবে। নতুন দাঁতের জন্য হাড় চাই। তখন কী করতে ইচ্ছে হয় বলো! মনে হয় না ওই থেরেস আর এই অজ্ঞতার পিণ্ডকে গিয়ে গলা টিপে মেরে আসি! যেমন ইচ্ছে হয়েছিলো ওই অজ্ঞ ডাক্তারটিকে, কুপিয়ে মেরে ফেলতে, যে তোমাকে দেখেছিলো! ইচ্ছেই শুধু হয়, কারও বিরুদ্ধে আইনের আশ্রয় নেওয়া বলো, কারও অন্যায়ের প্রতিশোধ নেওয়া আমার পক্ষে সম্ভব হয় না। আমি অসহায়পড়ে থাকি একা পাশে সুয়েনসনও থাকেনা দুটো সান্ত্বনার কথা শোনাবার জন্য! হাসিতে আমার আর মুক্তো ঝরবে না আগের মতো। সে কথা না হয় ছেড়েই দিলাম, সৌন্দর্যের বারোটা বেজেছে সামনের চার নম্বর দাঁত না থাকায়, সে কথাও চলো ভুলে যাই। মস্তিষ্ক যেভাবে খাবি খেয়েছে, ওতে যদি আবার ওতে কোনও সমস্যা দেখা দেয়, কাটা হাড় পড়ে থেকে থেকে হাড়ে ঘা হয়ে যদি আবার হাড়ের ক্যানসার হয়ে যায়! এসবে ওই অজ্ঞদের ওপর যত রাগ হয়েছে, তার চেয়ে বেশি হয়েছে নিজের ওপর রাগ। কেন আমি চলে এলাম না! কেন আমি তখনই প্রতিবাদ করিনি যখন ঘটনা ঘটছে। তোমাকে কেন আমি বড় ডাক্তার দেখাইনি, সে কারণে নিজের ওপর আমার যেমন রাগ হয়, দাঁতাল দস্যুদের হাত থেকে নিজেকে কেন বাঁচাইনি, নিজের ওপর সেই রাগটাও হয়। সুয়েনসন একটা আবেগহীন অপদার্থ। আর কিছুদিন ও দেশে থাকলে আমাকে অঘোরে প্রাণ দিতে হবে। নিজেকে বাঁচাই আমি অতঃপর। চিরবিদায় জানিয়ে দিই দেশটাকে। আমার বইপত্র, আমার যাবতীয় সবপড়ে থাকে সুয়েনসনের বাড়িতে। আমি চরম হতাশা আর শূন্যতার হাত থেকে বাঁচতে দেশ ত্যাগ করি। অনেকবার আমার এও মনে হয়েছে, এই শাস্তি বুঝি আমার প্রাপ্য ছিলো। তোমার ভালো ভালো দাঁতগুলোও যখন ফেলে দিয়েছিলো, তখন তো আমি প্রতিবাদ করিনি। তুমি জানতে তোমার দাঁত ফেলে দেওয়ার যে সিদ্ধান্ত ওরা নিয়েছে, ভুল নিয়েছে। কোথাও ওদের ভুল হচ্ছে। তুমি অসহায় চোখে তাকিয়েছিলে আমার দিকে। ওদের হাত থেকে বাঁচতে চাইছিলে। কিন্তু আমার হাত থেকে তো বাঁচোনি মা। আমি তো ডাক্তারদের বিশ্বাস করেছিলাম। ওই অজ্ঞ অশিক্ষিত ডাক্তারদের অন্যায়ের বিরুদ্ধে কোনও প্রতিশোধও নিইনি। প্রতিবাদও করিনি। নিজের জীবনে যখন ঘটলো একই রকম দুর্ঘটনা, ভুল চিকিৎসা, ভুল সিদ্ধান্ত, নিজে যখন একই রকম অসহায় হলাম, নিজে যখন কষ্ট পেলাম অন্যের নির্বুদ্ধিতার কারণে, তখনই তোমাকে আমি অনুভব করলাম সত্যিকারের। নিজের জীবন দিয়ে অনুভব না করলে সম্ভবত কোনও অনুভবই এত তীব্র হয় না।

আমেরিকার হারভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে বক্তৃতা দিতে গেলে হারভার্ডের এক প্রফেসর আমার খোঁজ করেন, তাঁর বাড়িতে আমন্ত্রণ জানান। সুয়ানি হান্ট, বিখ্যাত মহিলা। উনিই দুপুরের খাবার খাওয়াতে খাওয়াতে আমাকে প্রস্তাব দেন হারভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে কোনও ফেলোশিপ করতে চাই কিনা। লুফে নিই প্রস্তাব। কদিন পর যখন চিঠি আসে হারভার্ড থেকে, যাবো কী যাবো নার দোলনায় দুলি। বিশ্ববিদ্যালয়ে আবার কোনও পড়ানোর দায়িত্ব পড়লে আমার লেখালেখি নষ্ট হবে। কিন্তু সুইডেন ছাড়ার ইচ্ছেয় জানিয়ে দিলাম রাজি আছি। জে ওয়ান ভিসা, যেটি স্কলার বা প্রফেসরদের জন্য নিয়ে রওনা হলাম বোস্টন শহরেরপাশে কেমব্রিজ শহরে। প্রফেসর ডাক্তার জো গারস্টেনের বাড়িতে দুদিন থেকে একসময় কেমব্রিজে একটা বাড়িও ভাড়া করে নিলাম। প্রফেসর জো গারস্টেন সাহায্য করলেন বাড়ি নিতে। উনি ম্যাসাচুস্টেস-এর মানববাদী দলের একজন। নিজে মানববাদী, তাই বিশ্বের চারদিকে মানববাদী মানুষগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ। নারীবাদীদের সঙ্গেও। মানুষের মঙ্গলের জন্য, সত্যের জন্য সংগ্রামে বিশ্বাসী আমি, এই সংগ্রামে, এই ত্যাগে খ্যাতি জোটে হয়তো, যশ জোটে না। সম্মান জোটে কিন্তু প্রাচুর্য জোটে না। যে সাধারণ সাদাসিধে সরল সহজ মানুষ ছিলাম আমি, তেমনই থেকে যাই। টাকা পয়সা আগের মতোই আমার কাছে নিতান্তই অনাকর্ষণীয় হয়ে পড়ে থাকে। হারভার্ডে বসে সেই সব অন্ধকার, আত্মজীবনীর চতুর্থ খণ্ড লিখতে থাকি। মাঝে মাঝে নিউইয়র্কে ইয়াসমিনকে দেখতে যাই। ইয়াসমিন আমার প্রায় এক বছরের হারভার্ডের জীবনে একদিন এসেছিলো বেড়াতে, তাও একদিনের জন্য। প্রচুর জামা প্যান্ট কিনে দিয়ে গেছে আমাকে। সুহৃদ, মিলন, আর ছোটদাও এসেছিলো। সুহৃদকে হারভার্ডের বিশাল লাইব্রেরিটা দেখিয়ে বলেছি যেন সে একদিন বড় হয়ে এই বিশ্ববিদ্যালয়েপড়তে আসে, এই লাইব্রেরিতে বসেপড়তে পারে অনেক দুর্লভ বই। দূর থেকে কিছু বন্ধু বান্ধবও এসেছিলো। ম্যাট চেরি, পুরোনো সেই ইংরেজ মানববাদী বন্ধুটি আমেরিকার এক মেয়েকে বিয়ে করেছে, বউ নিয়ে দুদিন থেকে গেল আমার কাছে। হারভার্ডের বাড়িটি বড়, অতিথিদের জন্য কোনও অসুবিধে হয় না। টাঙ্গাইলের সেই রতন এসেছিলো, ছোটবেলায় যে ছেলেটা আসতো অবকাশে। জার্মানিতে ও রাজনৈতিক আশ্রয় চেয়েছিলো, আমার সাহায্য চেয়ে লিখেছিলো। আমি লিখে দিয়েছিলাম সত্য কথা যে রতনকে আমি চিনি বটে কিন্তু ও আমার কোনও অনুসারি ছিল না, আমার জন্য কোনও মিছিল তাকে আমি করতে দেখিনি। ও চিঠির পর জার্মানিতে তার আর রাজনৈতিক আশ্রয় পাওয়া হয়নি। ঘুরে ঘুরে কানাডায় এসে বসত শুরু করেছে। অনেককালপর যোগাযোগ হয়। রতন দেখতে আসে আমাকে বোস্টনে। ওকে বোস্টন থেকে নিউইয়র্কেও নিয়ে যাই। ইয়াসমিনের বাড়িতে দুদিন থেকে ও ফিরে যায় কানাডায়। ওর জন্য খুব মায়া হয়েছিল। এখন ভালো আছে দেখতে পেয়ে ভালো লাগে। পূরবী বসুকে তো তুমি চেন, সাহিত্যিক, আমার শান্তিনগরের বাড়িতে যেতেন। উনিও এসেছিলেন তার স্বামী জ্যোতিপ্রকাশ দত্ত, আর বন্ধু সংবাদপত্রিকার সম্পাদক বজলুর রহমানকে নিয়ে। ওঁরাও থেকেছেন ও বাড়িতে। ওঁদের অনেক বলেছি, আমাকে দেশে ফিরিয়ে নিন। কেউ আমার দেশে ফেরার ব্যাপারে খুব একটা কিছু রা শব্দ করেন না। ওঁরা মনে করেন আমি বিদেশেই ভালো আছি। আমাকে যে কেউ দেখলেই ভাবে আমি বেশ আছি। কিন্তু আমি সত্যি ঠিক কেমন আছি কাউকে বোঝাতে পারি না। দেশে ফিরলে মৌলবাদীরা আমাকে মেরে ফেলবে বা তারা আবার তাদের নোংরা আন্দোলন শুরু করবে, এই ভয় সবার। দেখলে বড় রাগ হয় আমার। হারভার্ডের জীবন আমার অন্যরকম। রক্তের চিনি প্রায় সীমানা ছুঁয়েছিলো বলে স্বাস্থ্যের প্রতি এমন সচেতন হই যে বিকট বেড়ে যাওয়া ওজন প্রচুর কমিয়ে নিই, এতে চিনি বাপ বাপ করে আমাকে ছেড়ে পালায়, রক্তচাপও এত কমে যায় যে ডাক্তারের কাছে গেলে হারভার্ডের ডাক্তার ইসিজি করে বলে, আমার নাকি একটা হার্ট অ্যাটাক হয়েছে। দুঃসংবাদটি শুনেই আমার হৃৎপিণ্ডের ক্রিয়া বন্ধ হওয়ার জোগাড় হয়েছিল। অ্যাম্বুলেন্সে করে বোস্টনের উইমেন এণ্ড ব্রিঘাম হাসপাতালে পাঠিয়ে দেয় ওরা। ওখানে বড় হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ এসে নানারকম সব পরীক্ষা করেন, পরীক্ষার ফল হাতে নিয়ে বলে দেন, তোমার কিচ্ছুহয়নি। তোমার হৃদপিণ্ড যে কোনও সুস্থ সবল মানুষের হৃৎপিণ্ডের চেয়েও বেশি সুস্থ। বললেন, রক্তচাপ কমাবার ওষুধ আর খেতে হবে না। জিজ্ঞেস করলাম, তবে যে হারভার্ড হেলথ সেন্টার থেকে বললো, হার্ট অ্যাটাক? বললো, ওদের ইসিজি করতে কিছু গোলমাল হয়েছিল। তবে বিদায় দেবার আগে একটা কথা জিজ্ঞেস করেন, তোমার পরিবারে কারও কি রক্তচাপ বেশি? হ্যাঁ বাবার ছিল। ডায়বেটিস? বলি, বাবা মা দুজনের। কবে ওরা মারা গেছেন? বলি। আজকাল ডাক্তারদের কাছে বাবা মার কত বছর বয়সে মৃত্যু হয়েছে, এ খুব জরুরি তথ্য। বাবা মার যে বয়সে মৃত্যু হয়, সন্তানদেরও ওই একই বয়সে মৃত্যু হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। বলেন, সিগারেট খাও? বলি খাই। দিনে কটা? দুপ্যাকেট। তারপর জিজ্ঞেস করেন, বাঁচতে চাও? বলি, চাই। বলেন, বাঁচতে চাইলে সিগারেট খাওয়া বন্ধ করো। হাসপাতালে পৌঁছেইইয়াসমিনকে খবর দিয়েছিলাম। ইয়াসমিন ওই রাতেই নিউইয়র্ক থেকে মিলন আর সুহৃদকে বোস্টনে পাঠিয়ে দিয়েছিল। ওরা আসায় খুব ভালো লাগে। নিজেকে খুব একা মনে হয় না। জীবনে ওরা না থাকলেও, অন্তত মৃত্যুর সময় পাশে থাকবে এই বিশ্বাস আমার হয়। কিন্তু মৃত্যু নিয়ে আমার বিলাসিতা নেই। সঙ্গে কেউ না থাকলেও আমার চলবে। আমি চাই, আমার জীবনে ওরা পাশে থাকুক। বিশেষ করে ইয়াসমিন আর সুহৃদ। ওদের দুজনের জন্য আমার ভালোবাসা প্রচণ্ড। বোস্টনের হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে আমি আর সিগারেট খাইনি মা। তুমি আমাকে কত বলেছো সিগারেট না খেতে। তোমার অনুরোধ শুনিনি। বলেছো সিগারেটের তৃষ্ণা পেলে মুখে এলাচ রাখতে, চুইংগাম চিবোতে। তোমার ওসব অনুরোধ হেসে উড়িয়ে দিয়েছি। আর মৃত্যুর কথা যখন মনে করিয়ে দিল ডাক্তাররা, তখনই সিগারেট খাওয়া বন্ধ করলাম। মৃত্যু জিনিসটাকে আমি সহ্য করতে পারি না। স্টেম সেল রিসার্চ হচ্ছে, তোমাকে বলেছিলাম বিজ্ঞানের এই আবিষ্কারের কথা? বাচ্চাদের নাভিতে অনেক স্টেম সেল থাকে, এক একটা সেল থেকে শরীরের এক একটা অঙ্গ প্রত্যঙ্গ সব তৈরি হয়। বাড়তি সেলগুলো বিনা কাজেপড়ে থাকে। ওই সেলগুলো থেকেই গজিয়ে ওঠে নতুন অঙ্গ। ধরো তোমার লিভার যখন নষ্ট হয়ে গেল, লিভারের একটা স্টেম সেল ঢুকিয়ে দিলেই নতুন একটা লিভার তৈরি হয়ে যেত তোমার শরীরে। তোমার শরীরে যেপ্যানক্রিয়াস নামের একটা জিনিস ছিল, সেটাপর্যাপ্তপরিমাণ ইনসুলিন তৈরি করতে পারছিলো না বলে তোমার ডায়বেটিস হয়েছিল। সেই পুরোনো অকেজো প্যানক্রিয়াসটা ফেলে দিয়ে প্যানক্রিয়াসের একটা নতুন সেল লাগিয়ে দিলে নতুন প্যানক্রিয়াস তৈরি হতে পারতো, তুমি দিব্যি সব রোগ শোক ঝামেলা থেকে মুক্ত হতে পারতে। জরায়ুর মধ্যে থাকাকালীন বাচ্চাদের শরীর তৈরি হতে থাকে এসব সেল থেকে। তবে একটা অঙ্গের জন্য কেবল একটা সেল বা কোষ অপেক্ষা করে থাকে না, অনেকগুলোই থাকে, একটা শুধু কাজে লাগে। বাকিগুলো, যেগুলো কাজে লাগে না, তা অসুখে বিসুখে নষ্ট হয়ে যাওয়া, ক্ষয় হতে থাকা মানুষের অঙ্গ প্রত্যঙ্গকে রীতিমত গড়ে দিতে পারে। বিজ্ঞানের এই আশ্চর্য আবিষ্কার মানবজীবনকে অনন্তকাল বাঁচিয়ে রাখবে। ডারউইনের বিবর্তন প্রমাণ যদি মানুষের বিশ্বাস না হয়, তবে এই স্টেম সেলের ঘটনাতেই ধর্ম তাসের ঘরের মতো ভেঙে যেতে বাধ্য। কিন্তু মা, মূর্খরা ধর্মকে বাঁচিয়ে রাখতেপণ করেছে। মূর্খ যতদিন থাকবেপৃথিবীতে, ততদিন ধর্ম থাকবে। আমার মরে যেতে ইচ্ছে করে না, পৃথিবীতে হাজার বছর থেকে দেখতে চাই কী হয় পৃথিবীর, পৃথিবীর মানুষের, কী হয় এই বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডের। কিন্তু আমি বেঁচে থাকতে চাইলেই কি আর বেঁচে থাকতে পারবো মা! তোমার মতো, বাবার মতো আমাকেও চলে যেতে হবে একদিন। যারা ধর্মে বিশ্বাসী, কারও মৃত্যু হলে তাদের কোনও কষ্ট হয় না। আল্লাহর জিনিস আল্লাহ নিয়ে যাচ্ছে, সুতরাং দুঃখ পাওয়ার তারা কোনও কারণ দেখে না। পরপারে একদিন তাদের আবার দেখা হবে, এই ভেবে একধরনের সান্ত্বনা পায়। আচ্ছা তুমিই বলো মা, তুমি কি এখন আল্লাহর কছে পোঁছেছে, আল্লাহ ঠিক কেমন দেখতে বলো তো আমাকে! ওখান থেকে পৃথিবীর কারও সঙ্গে যোগাযোগ করার ব্যবস্থা নেই বুঝি! তোমার কি ইচ্ছে হয় না তোমার ভালোবাসার মানুষদের সঙ্গে কথা বলতে? ইচ্ছে নিশ্চয়ই হয়, তুমি পারো না। তাহলে কিপরকালে মানুষের সাধ আহ্লাদের কোনও মূল্য থাকতে নেই, সব আল্লাহর ইচ্ছেয় ঘটবে! তাহলে নিশ্চিতই একনায়কতন্ত্র চলছে ওখানে। পৃথিবীর একনায়কদের আমরা পছন্দ করি না জানো তো। ডিকটেটরদের বিরুদ্ধে মানুষ কী রকম আন্দোলন করে দেখেছো। পরকালেও দেখবে মানুষ একনায়কতন্ত্রের বিরুদ্ধে রুখে উঠছে। না, মা, পরকাল বিশ্বাসের কোনও কারণ আমার নেই। কারও মৃত্যু হলেই আমার কষ্ট হয়। কেউ, যে কেউ, যদি চলে যায়, জানি ফিরে আসবে না সে কোনওদিন। কোনওদিন আর তার সঙ্গে তার ভালোবাসার মানুষদের দেখা হবে না, কথা হবে না। এ আমাকে কষ্ট দেবে না কেন, বলো! অবিশ্বাসীদের কষ্ট অনেক বেশি। হারভার্ডে থাকাকালীন স্টিভ লেসির মৃত্যু আমাকে দেখতে হল। খুব বড় জাজ বাদক ছিলেন, থেলোনিয়াস মংকের নামি জাজ দলের সঙ্গে যৌবনে বাজাতেন। শুরু থেকেই সপ্রানো বাজাতেন স্টিভ। আমেরিকায় জন্ম। ইহুদি। ইওরোপে থেকেছেন বহু বছর। আমার সঙ্গে দেখা হয়েছিল, যখন আমি জার্মানিতে। আমার অনেকগুলো কবিতা, যেগুলো ইংরেজিতে অনুবাদ হয়েছে, সেগুলোতে সুর দিয়ে সাত জন জাজ বাদক নিয়ে সারা পৃথিবীতে গেয়েছেন। স্টিভের সুর দেওয়া গান গেয়েছেন সুইজারল্যান্ডের মেয়ে ইরেন এবি। স্টিভ আর ইরেন বেশি বয়সে বিয়ে করেছেন। জার্মানিতেই ওঁদের সঙ্গে সখ্য গড়ে ওঠে আমার তখনই। তারপর ওঁরাপ্যারিসে চলে যান। দুবছর পর আমিও প্যারিস থাকতে শুরু করি। ওঁদের সঙ্গে দেখা হতো প্রায়ই। আবার প্যারিস থেকে বোস্টনে চলে যান ওঁরা, আর তার পর পরই আমিও বোস্টনের পাশের শহর ক্যামব্রিজ শহরে ডেরা বাঁধি। কী আশ্চর্য যোগাযোগ! হারভার্ড থেকে প্রায়ই চলে যেতাম ওঁদের বাড়িতে। স্টিভ তখন নিউ ইংলেণ্ড কনজারভেটরিতে সঙ্গীত শিক্ষক হিসেবে চাকরি করছেন। ওইসময় একদিন ধরা পড়ে স্টিভের লিভার ক্যানসার। স্টিভ খুব ভালোবাসতেন আমাকে। ম্যাকআরথার জিনিয়াস পুরস্কার পাওয়া এত বড় একজন সঙ্গীতশিল্পী কিনা আমার মতো এক ছোট কবির এতগুলো কবিতা গানে রূপ দিয়ে ইওরোপ আমেরিকায় বড় বড় থিয়েটারে গাইছেন। মাঝে মাঝে স্বপ্নের মতো মনে হয় এই ঘটনাগুলো। বিশ্বাস হতে চায় না সত্যি সত্যি ঘটছে এসব। স্টিভের ক্যানসার ধরা পড়ার পর দিব্যি আছেন। সপ্রানো বাজাচ্ছেন, বইপড়ছেন, সিনেমা দেখছেন, লোকের সঙ্গে আড্ডা দিচ্ছেন। জিজ্ঞেস করলে বলেন, দিব্যি আছি। কী করে যে পারেন মৃত্যুর মতো বীভৎস কিছুকে মেনে নিতে। স্টিভ কোনও ধর্ম বিশ্বাস করেন না। অসাধারণ এক দার্শনিক তিনি। স্টিভের সঙ্গে সময় কাটাতে যখনই সুযোগপাই, যাই। খুব বেশিদিন স্টিভকে কষ্ট করতে হয়নি। শরীর কেমন কেমন করছে বলে হাসপাতালে গেলেন, আর ফেরেননি। আমি ভেবেছিলাম তোমার মৃত্যুর পর আর কারও মৃত্যুতে আমার কষ্ট হবে না। কিন্তু স্টিভের জন্য হয়। একসময় যে মানুষটি আমার খুব কাছের মানুষ ছিলেন, সেই নিখিল সরকারেরও শুনি ফুসফুসে ক্যানসার হয়েছে। ফুসফুস থেকে মাথায় উঠেছে ক্যানসার। মৃত্যু সামনে এসে দাঁড়ালে মানুষ যোদ্ধা হয়ে ওঠে। নিখিল সরকারকে কাঁদতে বা হাহাকার করতে দেখিনি। বরং নিজের অপ্রকাশিত লেখাগুলো প্রকাশের ব্যবস্থা করলেন, জীবনে যে কাজগুলো করার স্বপ্ন দেখে ছিলেন, তাড়াহুড়ো করে তার সবটা না হলেও কিছুটা করে নিলেন, নিপাট গুছিয়ে নিলেন সব। তোমার কোনও কিছু ছিল না গুছোবার। নাহলে তুমিও হয়তো গুছিয়ে নিতে। তোমার ছিল না কিছু কাউকে দেবার, না হলে দিয়ে যেতে। শূন্য হাতে সারাজীবন ছিলে, শূন্য হাতে গেলে। তোমার মৃত্যু আমাকে পার্থিব জিনিসপত্রের প্রতি আমার সব মোহ জন্মের মতো ঘুচিয়ে দিয়েছে মা। আমার এখন প্রচুর টাকা খোয়া গেলে, বা যা কিছু অর্জন উপার্জন সব হাওয়া হয়ে গেলেও কিছু কষ্ট হয় না। আমি অমরত্বে বিশ্বাস করি না। আমি আমার লেখার মাধ্যমে বা সন্তানের মাধ্যমে, বা কোনও কিছুর মাধ্যমে বেঁচে থাকবো, এই ভেবে আমার কোনও সুখ হয় না। জীবন যতদিন আছে, ততদিনই যা পাওয়ার পাবো। ভালোবাসা ছাড়া আর কোনওকিছুর গুরুত্ব আমার কাছে নেই। সাধারণ মানুষের যে ভালোবাসা জোটে, ওতেই আমার মন ভরে। নিখিল সরকারের মৃত্যু আমাকে কাঁদিয়েছে। কাছের মানুষগুলো একে একে চলে যাচ্ছে মা। যারা ভালোবাসতেন, তাঁদের অনেকেই আর নেই। অন্নদাশংকর রায় নেই। শিবনারায়ণ রায় নেই। বড় খালি খালি লাগে এই জগৎ। ভেবেছিলাম তোমার মৃত্যুর পর আর কারও মৃত্যু আমাকে কষ্ট দেবে না। কিন্তু ভুল ভেবেছিলাম মা। সবার মৃত্যুই আমাকে কষ্ট দেয়।

.
 
হারভার্ড থেকে যে বছর গেলাম কলকাতার বই মেলায়, সে বছর আমার আত্মজীবনীর তৃতীয় খণ্ড দ্বিখণ্ডিত পশ্চিমবঙ্গ সরকার নিষিদ্ধ করেছে। একই বই ক নামে বেরিয়েছিলো বাংলাদেশে, বেশ কিছুদিন আগে সেটিও নিষিদ্ধ হয়েছে। কলকাতার মেলায় আত্মজীবনীর চতুর্থ খণ্ড সেই সব অন্ধকার বইটার উদ্বোধন হলো, এই বইও বাংলাদেশে প্রকাশ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে নিষিদ্ধ হয়ে যায়। পৃথিবীতে কোথাও কোনও লেখক পাবে না, যার এতগুলো বই নিষিদ্ধ। বাংলাদেশ ছাড়া কোথাও কোনও দেশ তুমি পাবে না যে দেশে বই নিষিদ্ধ করার বিরুদ্ধে আন্দোলন হয়নি। পৃথিবীর কোথাও তুমি এমন অসম্ভব ঘটনা দেখবে না, যেখানে লেখক-বুদ্ধিজীবীরা বই নিষিদ্ধ করার জন্য সরকারকে অনুরোধ করেন, মত প্রকাশের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে দাঁড়ান। পশ্চিমবঙ্গে নিষিদ্ধ দ্বিখণ্ডিতর জাল বই বেরিয়ে গেছে। বই বাজেয়াপ্ত করার বুদ্ধি, পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন, তাঁকে পঁচিশ জন লেখক-বুদ্ধিজীবী দিয়েছেন। দ্বিখণ্ডিত লেখার জন্য সৈয়দ শামসুল হক বাংলাদেশে আমার বিরুদ্ধে এক কোটি টাকার মানহানির মামলা করেছেন। তাঁর রাগ, তাঁর শালির সঙ্গে তাঁর গোপন সম্পর্ক ফাঁস করে দিয়েছি। কলকাতার এক ছোটখাটো কবিও একই কাণ্ড করেছে। সেও এককোটি টাকার মানহানির মামলা করেছে। মানহানির উকিল বললেন, কবিটি আমার বিরুদ্ধে মামলা করেছে ওর সঙ্গে আমার দুদিনের ওই আকস্মিক সম্পর্কের কথা ফাঁস হয়ে গেছে বলে নয়, তার হিন্দু বিরোধী মানসিকতা ফাঁস হয়েছে বলে।

.

সুযোগ পেলেই কলকাতা চলে যাই। ঝুনু খালা কলকাতায় আমাকে দেখতে আসে। ঝুনু খালাকে পেয়ে আমার মনে হয়েছে যেন তোমাকেই পেয়েছি। ঝরঝর করে ঝুনু খালা কাঁদে আমাকে জড়িয়ে ধরে! জানিনা আমার জন্য কাঁদে, নাকি তোমার জন্য। কলকাতার একটা হোটেলে আমি অনেকদিন ছিলাম। ওখানে ঝুনু খালাও ছিল আমার সঙ্গে। ঝুনু খালার রিউমাটয়েড আরথ্রাইটিস সারাবার জন্য বড় ডাক্তার দেখিয়ে চিকিৎসার ব্যবস্থা করি। তাকেও শারীরিক মানসিক সুস্থতা দিতে যা কিছু করার সব করি। যেখানে যাই, সব জায়গায় সঙ্গে নিয়ে যাই ঝুনুখালাকে। ভারতের সিকিম নামের পাহাড়ি এলাকায় ঝুনু খালাকে বেড়াতে নিয়ে গেছি। লক্ষ করি, ঝুনু খালা তোমার বোন হলেও তার আর তোমার মধ্যে এক পাহাড় পার্থক্য। প্রিয়জনের মৃত্যু মানুষকে পাথর করে তোলে, আবার কিছু মানুষ যেমন ছিল, তেমনই রয়ে যায়। ঝুনু খালা আগের মতোই আছে, হাসিখুশি, ঝকঝকে। আরথ্রাইটিস নিয়ে খুব একটা দুর্ভাবনা নেই। ঝুনু খালার সঙ্গেও আমি তোমাকে নিয়ে কথা বলি না। মাঝে মাঝে ঝুনু খালা হয়তো বলতে শুরু করে কিছু আমি থামিয়ে দিই। তোমার না-থাকার কষ্টকে আমি কারও কাছে বলে হালকা করতে চাই না। কষ্টটা যেমন আছে থাক। কষ্টটা আমার একার। আর যা কিছু দুঃখ সুখ ভাগ করি না কেন, এই কষ্টটাকে কারও সঙ্গে আমি ভাগ করি না। ফকরুল মামা তার মেয়ের অসুখ দেখাতে কলকাতার হাসপাতালে ছিল কদিন। অনেক আগেই আমার কাছে এক লাখ টাকা ধার চেয়েছিলো। সেদিন সেই টাকার কথাটা তুললে পাঁচশ ডলার ছিল হাতে, দিয়ে দিই। ধার নয়, এমনিতেই দিই। এ কারণে আরও, যে, তোমার অসুখের সময় ঢাকায় যখন ছিলে, তোমাকে দেখতে নিয়মিত আসতো। তোমার হয়তো খারাপ লাগবে শুনে যে ফকরুল মামা টাকা চাইছে। কিন্তু মা, তোমার মতো কজন আছে যে দিতে চায়, নিতে চায় না? ছটকুও এসেছিল। বউএর জন্য অনেক কিছু কিনে নিয়ে যায়। নানির শাড়ি কেনার জন্য কিছু টাকা দিই। নিজের অনেক শাড়িও দিয়ে দিই গরিবদের দিতে। দিতে আমার তোমার মতোই ভালো লাগে। কারও কাছ থেকে কিছু আমার চাওয়ার নেই। আমি না পেতে জানি। তুমিও যেমন না পেতে জানতে। এর আরও দুবছর পর আবারও কলকাতায় যখন আমি, দাদা, ঝুনু খালা, বড় মামা, বড় মামার দুই ছেলে বিক্রম আর রুদ্র, ছটকুসবাই আমার সঙ্গে দেখা করতে কলকাতা এসেছিলো, কীযে ভালো লেগেছিলো আমার! যেন এক ঝাঁক তুমি এসেছো। তুমি ছিলে না ওই ভরা আসরে, কিন্তু তুমি ছিলে মা। তোমার হয়ে আমি ছিলাম। বড়মামা একদিন অনেকক্ষণ তাকিয়ে থেকে আমার মুখের দিকে, বললো, তোকে একেবারে ঈদুনের মতো দেখতে লাগছে। শুনে, যেন শুনিনি, আমি বাথরুমে চলে যাই, আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের মুখটা দেখি, দেখতে দেখতে চোখের জলও দেখি আমার। অনেকক্ষণ দেখি।

আমি জানিনা নিজে ডাক্তার বলে, নাকি বাবা আর তোমার মৃত্যু আমাকে এত ভয় পাইয়ে দিয়েছে যে চাইনা কারও অসুখ হোক, কেউমরে যাক। যাদের ভালোবাসি তাদের সামান্য অসুস্থতার খবর পেলে আমি অস্থির হয়ে উঠি। বড় মামাকে ডাক্তার দেখিয়ে দিই। রক্তের চিনি কমিয়ে রাখার জন্য দিনরাতপরামর্শ দিই। আসলে ডায়বেটিস যাদের আছে, তাদের বোধহয় অত নিয়ম কানুন মানতে ইচ্ছে করে না। সবাই এমন নয়। তুমি মানতে। আর তো কাউকে দেখিনা যে মেনে চলে। বেঁচে থাকার জন্য তোমার যে প্রচণ্ড ইচ্ছে ছিল, এই ইচ্ছে সবার মধ্যে নেই। তুমি অত যে ভুগতে জীবন নিয়ে, তারপরও চাইতে বেঁচে থাকতে। তুমি কি খুব ধার্মিক ছিলে! ধর্ম তো তোমাকে বলে, মরে গেলেই তুমি সোজা আল্লাহর কাছে পৌঁছে যাবে, আর কোনও দুর্ভাবনা তোমার নেই। কিন্তু মৃত্যু নিয়ে তোমার দুর্ভাবনা ছিল। তোমার সব ভাই বোনদের মধ্যে বড় মামাকে আমি সবচেয়ে বেশি শ্রদ্ধা করি। মানুষটার যুক্তি তর্ক, মানুষটার আদর্শ সেই ছোটবেলা থেকেই আমার পছন্দ। কদিন কলকাতায় কাটিয়ে কলকাতা থেকে শাড়ি কাপড়, শাল এসব কিনে সবাই ফিরে যায় দেশে। ছোট খাটো সাংসারিক আর ব্যবহারিক জিনিস থেকে মানুষের মন ওঠানো খুব সহজ কথা নয় মা। আমি সেই জায়গায় এসে পৌঁছে গেছি, যেখানে জিনিসপত্রের জন্য কোনও মোহ থাকে না। চারদিকের আর কাউকে দেখি না মোহ থেকে মুক্ত হতে। সবাইকে আমি ভালোবাসা বিলিয়ে দিই। যা চাই, তা নিতান্তই ভালোবাসা, অন্য কিছু নয়। তবে মাঝে মাঝে কষ্ট হয়, এই মামা খালারা কেউ আমাকে কখনও দূর বিদেশে একা পড়ে থাকি যখন, ফোন করে জিজ্ঞেস করে না কেমন আছি। দেশ থেকে কারও ফোন আমি পাই না। দাদারাও খোঁজ করে না। আমি বেঁচে আছি কী মরে গেছি, কারও জানার প্রয়োজন হয় না। এরা কি সত্যিই আমার আত্মীয়! যে যার জীবন নিয়ে চমৎকার বেঁচে আছে। যদি আমি স্বার্থপর হতাম, হয়তো চমৎকার আমিও বেঁচে থাকতে পারতাম। কিন্তু পারি না মা। তোমার রক্ত বইছে আমার শরীরে। ভালো থাকা আমাদের জন্য নয়। মা, আসলেই কি ওরা চমৎকার বেঁচে আছে! নাকি আমি নদীর এপারের মতো, ওপারেই যত সুখ আছে বলে আমার বিশ্বাস! ওরাও হয়তো ভাবে, আমি ওদের ভুলে থাকি। ওরাও হয়তো ভাবে, আমার জাঁকজমকের জীবনে আমি চাইনা ওদের মতো ছাপোষা লোকদের সঙ্গে কথা বলে সময় নষ্ট করতে! অভিমান আমি করি, নাকি ওরা করে, বুঝি না।

.

আমার ইচ্ছে করে মামা খালাদের সবার অভাব আমি দূর করি। ওরা তোমারই ভাই বোন। ভালো তো তোমাকে ওরা কিছু হলেও বাসতো। শুধু তোমার ভাই বোন বলে যে ওদের আমি ভলোবাসি নয়। কাকা ফুপুদের চেয়েও মামা খালাদের সঙ্গে স্বাভাবিকভাবেই আমার ঘনিষ্ঠতা বেশি। আমি জন্মেছি ওদের বাড়িতে। শৈশব কেটেছে ওদের কোলে কাখে, ওদের সঙ্গে উঠোনে মাঠে সারা বিকেল খেলে, একই খাবার খেয়ে, ভূতের গল্প শুনে, একই ইস্কুলে পড়ে। ওদের কারও দুঃখ দেখলে মন আমার কাঁদবে না কেন! আশ্চর্য কী, জানো মা, ওদের সঙ্গে দেখা হলে মনে হয় না যে আমাদের দেখা হয়নি অনেক বছর, সেই আগের মতো কথা বলি, সেই শৈশব কৈশোরের মতো। অবশ্য বয়স দেখলে চমকে উঠি, ছটকুর পাকা চুল দেখে, শরাফ মামার হাড়গিলে শরীর দেখে, ফেলু মামার হতাশা দেখে বুকের ভেতরটা হুহু করে উঠেছিলো। ওদের অভাব ইচ্ছে করলেও ঘোচাতেপারি না আমি। শুধু তোমার ভাইবোনের নয়, ইচ্ছে করে তোমার আদরের ওই গরিব ভিখিরিদের দারিদ্র ঘুচিয়ে দিই। কিন্তু কী করে পারবো দূর থেকে, ওদের কাছে পৌঁছোনোর ক্ষমতা আমার নেই। কলকাতায় গিয়ে গরিবদের দুহাত ভরেদান করি। ওখানেও তুমি চারদিকে গরিব দেখতে পাবে। পৃথিবীর সব দেশেই গরিব আছে। গরিবদের জীবন পৃথিবীর সব দেশেই প্রায় একইরকম। তুমি আমার ভবিষ্যতের কথা ভাবতে। আমার সে কথা ভাবতে ইচ্ছে করে না। ভবিষ্যৎ–এই ব্যাপারটাকে আমি আর বিশ্বাস করি না। আমার এক অতীত ছিল। আর আছে এক বর্তমান। অতীতই আমার সম্পদ। বর্তমানটা আমি শুধু যাপন করি। তোমার মৃত্যু আমাকেপার্থিব জীবন থেকে কতটা যে দূরে সরিয়েছে, কতটা নির্মোহ করেছে, তা না দেখলে তুমি বিশ্বাস করতে পারবে না। জীবনে কোনও চাওয়া নেই আমার আর। শুধু দেশে ফিরতে চাই, তুমি আমার দেশে ফেরা চাইতে বলে। তুমি নেই বলে দেশে ফেরার ইচ্ছেটা অনেকটা উবে যায়, কিন্তু যেহেতু তুমি চাইতে ফিরি, ঘরের মেয়ে ঘরে ফিরি, সেই ঘরের মেয়েটি তার ঘরে ফিরে তোমার স্বপ্নপূরণ করতে চায়। দেশের দুয়ার যেহেতুবন্ধ, কলকাতায় বসবাস শুরু করেছিলাম, সে আরও অনেক পরে। কলকাতায় দাদা তার মস্ত এক অসুখ নিয়ে এসেছিলো। হাঁটা চলা করতে পারতো না, কথা বলতে পারতো না ভালো করে। যত বড় বড় ডাক্তার আছে কলকাতায়, সবাইকে দেখিয়ে তার চিকিৎসা করার ব্যবস্থা করি। হ্যাঁ মা, কাড়িকাড়ি টাকা খরচ করি খুব দামি সব চিকিৎসায়। জীবন ঢেলে দিই এই দাদার জন্য, যে দাদা তোমার চিকিৎসার জন্য এক পা নড়তে চায়নি, যে দাদা বাবার মৃত্যুর জন্য দায়ী। তারপরও কী হয় জানি না, দাদাকে অসুস্থ দেখে আমি স্থির থাকতে পারি না। বুঝি এ তোমার কারণেই, তোমার যে চরিত্র আমার ভেতরে স্থায়ী আসন গেড়ে বসেছে, সেখানে উদারতা ছাড়া, ক্ষমা ছাড়া, মায়া মমতা ছাড়া, শর্তহীন ভালোবাসা ছাড়া কিছু নেই। তুমিও তো সেই দাদাকেই ভালোবাসতে, যে তোমাকে ভালোবাসেনি। তুমিও তো সেই মানুষদের কাছে টেনে নিতে, যারা তোমাকে দিনের পর দিন অপমান করেছে। তোমার সেই চরিত্রকে আমি নিন্দা করি বটে, কিন্তু ভেতরে বুঝি, চরিত্রটি আমারও। যে মৌলবাদীরা আমার মুণ্ডু চেয়ে মিছিল করে, সম্ভবত ওদের কাউকে বিপদে পড়তে দেখলে আমিই গিয়ে সবার আগে ওদের বাঁচাবো। মুসলমানদের মধ্যে নাস্তিক বা খুব প্রগতিশীল, সমানাধিকারে, মানববাদে বিশ্বাসী না হলে আমার মতের সঙ্গে একমত তো হবেই না বরং তীব্র নিন্দাই করবে। গোটা একটা সমাজের মানুষের মানসিকতার এই হাল দেখলে অবশ্যই মন খারাপ হয়ে যাওয়ার কথা। তারপরও দেখ, যখন দেখলাম হিন্দু মৌলবাদী দ্বারা ভারতে গুজরাতের মুসলমানরা আক্রান্ত হয়েছে, উদ্বাস্তু হয়েছে হাজার হাজার গরিব মুসলমান, আমি উঠে দাঁড়ালাম। আমি তো মিছিল মিটিং করায় পারদর্শী নই। কলকাতায় বসে কবিশঙ্খ ঘোষ গুজরাতের ওই আক্রান্ত মুসলমানদের সাহায্য করার জন্য টাকা তুলছিলেন, শঙ্খ ঘোষের হাতে দশ হাজার টাকা দিয়ে এসেছি। বলেই দিয়েছি, প্রচারের জন্য নয়। তুমি যেমন দিতে মানুষকে, তোমাকে লোকে ভালো বলুক বা বাহবা দিক, সে কারণে কিন্তু দিতে না। তোমার মন কাঁদতে মানুষের জন্য, তাই দিতে। মানুষ যদি কষ্ট পায়, সে মানুষ হিন্দু হোক, বৌদ্ধ হোক, খ্রিস্টান বা মুসলমান হোক, পাশে দাঁড়াই। তাদের ধর্ম পরিচয়কে আমি কোনওদিন মূল্য দিইনি। মানুষ পরিচয়কেই দিই। খুব বেশি সামর্থ্য আমার নেই। যেটুকু আছে সাধ্য, তার মধ্যে অথবা তার বাইরেও করি বা করার চেষ্টা করি। মানুষের জন্য সবচেয়ে বড় যে কাজটি করি, তা আমার লেখা। কেউ লেখা বোঝে, কেউ বোঝে না। কিন্তু জীবনের ওপর নেমে আসা শত ঝড় ঝঞ্ঝার মধ্যেও লেখা আমি বন্ধ করতে পারি না। তুমিও তোআমার লেখা ভালোবাসতে, শুধু ধর্মকে আক্রমণ করে লিখতে আমাকে বারণ করতে। কিন্তু মা, মেয়েদের স্বাধীনতার কথা লিখতে গেলে সবচেয়ে বড় যে বাধা, ধর্ম, এবং পুরুষতন্ত্র, এদুটোর বিরুদ্ধে কথা না বললে চলবে কেন বলো। বাধা রেখে কি স্বাধীনতা বা অধিকার আদায় করা যায়! বড় বাধার পরও শত শত ছোট বাধা আছে, সেগুলো ডিঙোনোও তো চাট্টিখানি কথা নয়। ছোট ছোট বাধার বিরুদ্ধে বললে লোকেরা খুব আপত্তি করে না। বড় বাধার কথা বললেই বড় বড় লোকেরা আমার লেখায় বাধা দিতে শুরু করে, আমার জীবন তছনছ করে দিতে তাদের কোনও দ্বিধা হয় না। ধর্মের সমালোচনা আর না করলেই যে ধর্মান্ধ, ধার্মিক বা ধর্মব্যবসায়ীরা আমাকে মুক্তি দেবে তা আর হবার নয়। ওদের স্বার্থ উদ্ধার করতে, ওদের শক্তি প্রদর্শন করতে একটা সমাজকে পিছনে টেনে নেওয়ার জন্য, পুরো জগতে ধর্মের আইন কায়েম করতে ওরা আমাকে হত্যা করতে চাইবেই অথবা আমার মুণ্ডু কেটে নেওয়ার জন্য, বা আমার ফাঁসির জন্য রাস্তায় নামবেই। এব্যাপারে তুমি নিশ্চিন্ত থাকতে পারো। আমাকে খুন করে যে কোনও মূর্খ ধর্মান্ধ বেহেসতে যেতে চাইবেই। সারা পৃথিবীতে তাই ঘটছে। ভারত বা বাংলাদেশে কোনও বিচ্ছিন্ন ঘটনা ঘটছে না। আমেরিকার টুইন টাওয়ারের পতনের কথা তুমি জানো না। মুসলমান মৌলবাদীরা আল্লাহর নাম নিয়ে শত শত নিরপরাধ মানুষকে ওই টুইন টাওয়ারের ভাঙনের মধ্যে ফেলে মেরেছে। আমি জানি, ওদের ওই অপকর্মের কথা শুনলে তুমি শিউরে উঠতে। তুমি মরে যাওয়া মানুষগুলোর জন্য দুঃখ পেতে। তোমার কাছেও তো মানুষ সবচেয়ে বড়, যে ধর্মের বা যে লিঙ্গেরই সে হোক না কেন। হিন্দুদের, কাফেরদের ঘৃণা করার জন্য তোমাকে পীরবাড়ি থেকে শিখিয়ে দেওয়া হয়েছিল। তুমি মন থেকে কখনও পারোনি ওদের ঘৃণা করতে। পাশের বাড়ির ডলি পালকে ডেকে এনে গল্প করতে। ওর দুরবস্থায় ওকে সাহায্যও করেছে। এসব আমার নিজের চোখে দেখা। তুমি মানুষ ছিলে মা। সব ধর্মের ঊর্ধ্বে ছিলে, তুমি নিজেই জানতে না যে, ছিলে। তুমি যদি কোরানের অর্থ ঠিক ঠিক জানতে, হয়তো ওই ধর্ম ছেড়ে যোদ্ধার মতো বেরিয়ে আসতে। তুমি তো মূর্খ ছিলে না মা। বুদ্ধিমতী ছিলে। কিন্তু সমাজের নারীবিরোধী সংস্কারের শেকলে বন্দি হতে হয়েছিল তোমাকে, যে বন্দিত্ব থেকে মুক্তি কিছুতেই পেতে পারোনি।

.

আমার জীবন সম্পূর্ণই একার জীবন মা। রাজনৈতিক, সামাজিক, বৈষয়িক, ব্যক্তিক, শারীরিক, মানসিক, পারিপার্শ্বিক সব প্রলয় আমাকেই একা সামলাতে হয়। অনেকে বলে, পাশে আছি। এ ঠিক পাশে থাকা বলে না। তারা আমাকে সমর্থন করে, ভালোবাসে, তা ঠিক। এ মনে কিছুটা আনন্দ দেয় বৈকি, কিন্তু দুর্দশায় যখন আমি আক্রান্ত, তখন কেউই আসলে পাশে থাকে না। মনের জোর আমার কম হলে অনেক আগেই আমি মরে যেতাম মা। অথবা যেভাবে বাঁচতাম, সেই বাঁচার কোনও মানে থাকতো না। তোমাদের আমি পুরোনো পন্থার মানুষ বলে কত গালি দিয়েছি। অথচ দেখ, বিয়ে করলাম, ছাড়লাম, বিয়েতে মত হয়তো দাওনি, কিন্তু বিচ্ছেদে বা তালাকে কোনও দ্বিমত তোমাদের কারওর ছিল না। সাধারণত অন্য যে কোনও পরিবারেই স্বামী যেমনই হোক, যত অযোগ্য এবং পাষণ্ডই হোক, কেউ চায় না, বিচ্ছেদ হোক। কায়সারের সঙ্গে বিয়ের বাইরে সম্পর্ক মেনে নিতে তোমার তো কোনওদিন কোনও অসুবিধে হয়নি। তুমি তো চিরকালই সতী সাধ্বী ধর্মকর্ম করা নীতি আদর্শের মানুষ ছিলে। কেন একদিনের জন্যও আপত্তি করোনি! আমার যশ খ্যাতি ছিলো বলে আমাকে ভয় পেতে! না মা, আমার মনে হয় না। আমার মনে হয় তোমার কাছে আমাদের যৌনসম্পর্ককে অযৌক্তিক, অসুন্দর, অবৈধ বলে মনে হয়নি। তুমি বোরখা পরতে, জানি না কেন পরতে, অভ্যেস হয়ে গিয়েছিলো বলে হয়তো। অবশ্য শেষের দিকে কোনও বোরখাপরোনি, সুইডেনে, আমেরিকায়, তারপর দেশেও যে বাইরে বেরোলে, কোনও বোরখার চিহ্ন দেখিনি। মা, তুমি খুব আধুনিক মানুষ ছিলে। সম্ভবত বাড়ির সবার চেয়ে। খুব গভীর ভাবে দেখতে গেলে, আসলে অনেক ক্ষেত্রে বাবার চেয়েও বেশি আধুনিক ছিলে তুমি। বাবা হয়তো বিজ্ঞানমনস্ক বেশি ছিলো তোমার চেয়ে। ক্ষুদ্রতা, হীনম্মন্যতা, কূপমণ্ডুকতা এসবের অনেক ঊর্ধ্বে ছিলে তুমি। বাইরে থেকে বোঝা না গেলেও তোমার অসম্ভব মনের জোর ছিল। কিন্তু মনের জোরে স্বামীর সংসার ছাড়তে পারোনি। আমার মনের জোরের সঙ্গে অর্থের জোর ছিলো বলে পেরেছি। তা না হলে স্বামীর আদেশ নির্দেশ মেনে দুতিন ছেলে মেয়ের মা হয়ে সংসারের ঘানি টানতে হতো কোথাও, বাংলাদেশের কোনও অজপাড়াগাঁয়ে, অথবা শহরে বন্দরে কোথাও। এটা ঠিক, সাংসারিক অশান্তি থাকলেও কোনও রাজনৈতিক অশান্তি থাকতো না।

.

তুমি নেই। তারপরও জগৎ চলছে। তোমার স্বজন আত্মীয়, চেনা পরিচিতরা যে যার মতো আগের মতোই জীবন যাপন করছে। তুমি নেই বলে কারও জীবন কোথাও থমকে নেই। ইয়াসমিনের মানসিক অবস্থা দিন দিন খারাপ হচ্ছে। সুখের ছিটেফোঁটা ওর সংসারে নেই। ভালোবাসা ক্রমশ ভালোবাসাহীন হিংসুক প্রাণী হয়ে উঠেছে। হতাশার গহ্বরে তলিয়ে থাকে ইয়াসমিন, ওকে সবরকম চেষ্টা করেছি জীবনের দিকে ফেরাতে। বাড়ির অস্বাস্থ্যকর চিৎকার চেঁচামেচির পরিবেশেই ও অভ্যস্ত হয়ে গেছে। ফ্লাসিং নামের ওই এলাকায় বছরের পর বছর থেকে যাচ্ছে, একই বাড়িতে, আরশোলা, ছারপোকা আর ইঁদুরের সঙ্গে, অসুখীআর হতাশাগ্রস্ত মানুষগুলোর সঙ্গে। ওর বেড়ানো বলতে, জ্যাকসন হাইটসে বাজার করতে যাওয়া, বা অন্য কোনও দোকানে কেনাকাটা করতে যাওয়া। আজকাল ওকে জোর করেও কোথাও নিয়ে যাওয়া যায় না। কোনও সিনেমা থিয়েটারে, কোনও লেকচারে, বা কনসার্টে, কোথাও নিতে পারি না। অথচ এই ইয়াসমিন টই টই করে ময়মনসিংহ শহর ঘুরে বেড়াতো। কত বন্ধু ছিল ওর। এখন কোনও বন্ধু নেই। মেয়েটা কবিতা আবৃত্তি করত, কী অসাধারণ রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইতো। এখন কবিতা, গান, বই সব ওর জীবন থেকে সহস্র মাইল দূরে। আমেরিকায় ভালো কোনও চাকরি করার চেষ্টা করেনি। ভালোবাসার জন্য জীবন উৎসর্গ করেছে একরকম। নিজের জীবন নষ্ট করে মেয়েকে মানুষ করতে গিয়ে দেখে নিজের জীবনও গেছে, মেয়েও মানুষ হয়নি। মেয়ে সারাদিন ইংরেজিতে গালিগালাজ করে মাকে। ইয়াসমিন মনে করে ব্যাপারটা জেনেটিক। মিলনের জিন পেয়েছে ভালোবাসা, দেখতেও মিলনেরমতোও, স্বভাব চরিত্র ব্যবহার সবই মিলন। সুবুদ্ধি, কুবুদ্ধি, চতুরতা, হীনম্মন্যতা সব এক। ভালোবাসা একসময় সুন্দরপদ্য লিখতো, ওকে প্রচুর সাহিত্যের বই কিনে দিয়েছিলাম, না, একটারও পাতা উল্টে দেখেনি। সুহৃদও ভালো লিখতো, খুব ভালো ছিলো কবিতা লেখার হাত। ছবি আঁকতে চাইতো বলে ছবি আঁকার যাবতীয় সরঞ্জাম ওকে দিয়েছিলাম। না কোনওটাই বেশিদিন চালালো না। ওকে প্রেরণা দিয়ে গেছি বছরের পর বছর। শেষ অবধি দেখেছি কারও শিল্পী বা সাহিত্যিক হওয়ার কোনও সম্ভাবনাই নেই। সাহিত্য সংস্কৃতির প্রতি সত্যিকার কোনও আকর্ষণ কারওর নেই। পরিবারে একজন লেখক আছে, এ নিয়ে কোনও গৌরব কারওর নেই। আমার লেখা কেউ পড়েও দেখেনি, আমাকে নিয়ে কারও উৎসাহও নেই। ছোটদা আর গীতার রক্ত সুহৃদের ভেতরে। শুধু রক্তই তো সবনয় মা, পরিপার্শ্ব, সমাজ, সংস্কৃতি এগুলোও একজনের গড়ে ওঠার পেছনে বড় ভূমিকা রাখে। কিন্তু মনে হচ্ছে, পরিপার্শ্ব ছাপিয়ে রক্তটাই আমাদের পরিবারের সবার মধ্যে যেন বেশি কাজ করেছে। সুহৃদ তার বাবা আর মার চরিত্রই পেয়েছে, নিজের কোনও আলাদা চরিত্র নেই ওর। ইয়াসমিন যে জীবনটা যাপন করছে, তা প্রায় একশ ভাগ তোমার জীবন। ইয়াসমিন দেশে ফেরার স্বপ্ন দেখে। ভালোবাসাকে অনেক চেষ্টা করেছে। দেশে ফেরাতে, ও ফিরবে না। ও ফেরে না বলে ইয়াসমিনও ফিরতে পারে না। ভালোবাসা বড় হয়ে কলেজের হোস্টেলে চলে গেলে ভাবছে দেশে ফিরবে, কিন্তু আমি জানি ওর কোথাও ফেরা হবে না। ভালোবাসার টানে ওকে থেকেই যেতে হবে বিদেশ বিভুইয়ে। দেশ তো আসলে শৈশব কৈশোরের স্মৃতি ছাড়া আর কিছু নয়। কিন্তু দেশে ফিরলেই কী আর ও দেশ পাবে। যে দেশে মা নেই, সে দেশ আবার কী রকম দেশ মা! ইয়াসমিন ফিরেছিল, হতাশার গভীর গহ্বর থেকে পালিয়েছিলো, পুরোনো বন্ধুদের কাছে, আত্মীয়দের কাছে। হাসি আনন্দে ছিলো, কলকাতাতেও ওকে ঘিরে উৎসবের আয়োজন করেছি। সব উৎসব আনন্দ ছেড়ে ও আবারও আমেরিকায় ছুটে যায় ভালোবাসার টানে। কিন্তু যেই না মিলনের দুর্ব্যবহারের শিকার হয়, আবারও নিঃসঙ্গতার হাঁমুখ ওকে গিলে ফেলতে থাকে। মিলনকে ছাড়াও ওর চলে না, আবার মিলনকে নিয়েও ওর চলে না। দেশে বিদেশে কত কত মেয়ে আমার প্রেরণায় উঠে দাঁড়ায়, নিজের মতো করে বাঁচে। আর জন্ম থেকে যে আমার ছায়ার মতো ছিলো, সেই বোনটিই পারেনা কিছু।

মা, ইয়াসমিন আমাকে ঠিক তোমার মতো করে আদর করে। ও যে আমার ছোট বোন, মাঝে মাঝে ভুলে যাই। যেন মা ও। ঠিক তোমার মতোই কষ্ট ও করে যাচ্ছে প্রতিদিন, স্বামী সন্তান ওর হাড়মাংস জ্বালিয়ে যায়। তারপরও ও থেকে যাচ্ছে ওদেরই আঁকড়ে ধরে। মাঝে মাঝে মনে হয় তোমার আর ওর জীবনে কোনও পার্থক্য নেই। কতবার ওকে বের করতে চেয়েছি বাড়ি থেকে, বলেছি চল দুজনে দুরে কোথাও যাই, শুধু আনন্দ করবো ও রাজি নয়। বলেছি তাহলে বাড়ির সবাইকে নিয়ে চল দূরে কোথাও কোনও পাহাড়ের কাছে, বা সমুদ্রের ধারে চল, মন ভালো লাগবে, ও তবুও যেতে চায় না কোথাও, ওকে এক চুল নড়াতে পারি না বদ্ধ ঘর থেকে। ও ঠিক তোমার মতোই ভাবে আমার টাকা পয়সা যেন খামোকা খরচা না হয়। আমাকে বাঁচাতে চায় ও ঠিক তোমার মতো করে। যেখানেই ছিলাম, যে দেশেই, ইয়াসমিনকে দেখতে গিয়েছি প্রায় প্রতি বছরই। ওকে বের করতে পেরেছি একবারই, জোর করেই, প্রায় টেনে হিঁচড়ে। একটা ভাড়া গাড়ি নিয়ে চলে গিয়েছিলাম অতলান্তিকের পাড় ধরে যত শহর আছে, যত পাহাড় পর্বত, সব কিছুর কাছে, নায়াগ্রা জলপ্রপাতেও নিয়ে গেলাম, জলপ্রপাতের ধোঁয়ার মধ্যে, ও যে কী খুশি হয়েছিলো। তুমি বিশ্বাস করো বা না করো, ওকে আনন্দ দিলে আমার মনে হয়, আমি তোমাকে আনন্দ দিচ্ছি। নিউইয়র্ক শহরের ব্রডওয়ে মিউজিকাল শো গুলোতে জোর করে করে নিয়ে গেছি। পূতিগন্ধময় পরিবেশ থেকে বেরিয়ে ও যেন জীবনের সুঘ্রাণ পায়, সুন্দরের স্বাদ পায়। ইয়াসমিনের বাড়িতে একবার আমার হোঁচট খেয়ে পা মচকে গিয়েছিলো, ও আমাকে শুশৃষা করলো ঠিক তোমার মতো করে। ঠিক তোমার মতোই রান্না করে ও, আমাকে তোমার মতো করেই যত্ন করে খাওয়ায়, মুখে তুলে। আমরা দুজন কখনও তোমাকে নিয়ে আলোচনা করি না। খুব সচেতন ভাবেই করি না। তুমি নেই, এ কথা আমরা ভাবতে চাই না বলে করি না। যেন তুমি আছো কোথাও। দূরে আছো, কিন্তু আছো।

.

দাদা আর ছোটদা দুজনই নিজেদের কিডনি নিয়ে অতি সচেতন। যদিও কিডনিতে কিছুই ঘটেনি, কিন্তু বাবার কিডনি নষ্ট হয়ে যাওয়া ওদের ভীষণ ভয় পাইয়ে দিয়েছে। কিডনি নষ্ট হয়ে যেতে থাকলে যে খাবারগুলো খাওয়া বারণ, কিডনি সম্পূর্ণ সুস্থ থাকা অবস্থাতেও তারা ওগুলো মুখে তুলছেনা। তুমি মারা যাওয়ারপরও আমার আরইয়াসমিনের আশংকা হয়েছিলে বুঝি আমাদেরও কোলন ক্যানসার হয়েছে। সারাশরীরে মনে হতো, ক্যানসার। ছুটে ছুটে গিয়ে স্তন, জরায়ু, কোলন কোথাও কোনও ক্যানসারের ছিটেফোঁটা কিছু আছে কিনা পরীক্ষা করিয়েছি।

নানি বেঁচে আছে। তবে নানিকে তার নিজের ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে হয়েছে। ফেলু মামার সংসারে আরও জায়গা চাই, সোফা বসাতে হবে, বাড়তি খাট বসাতে হবে, তাইনানিকে একরকম বেরই করে দিয়েছে নানির ঘর থেকে। নানিবাড়ির লাগোয়া উঠোনটার ছোট্ট ঘরটায় যেখানে আমরা ছোটবেলায় একসময় থাকতাম, সেই টিনের ঘরটিতে নানির জায়গা হয়েছে। সারাদিন শুয়ে থাকছে আর নিজের মৃত্যু কামনা করছে। বেঁচে থাকা নানির জন্য এখন লজ্জা। হাশেম মামা নেই, তুমি নেই, টুটু মামাও হঠাৎ একদিন মরে গেল। তিন তিনটে সন্তান বেঁচে নেই, মা এখনও বেশি বয়সেও বেঁচে আছে, এ নানির জন্য লজ্জাই বইকি। অসুখ না থাকলেও অসুখ আছে এমন ভান করতে হয় তাকে, অন্যকে স্বস্তি দিতে। তারপরও নানিকে দেখে লোকে চোখ কপালে তোলে। নানিকে দেখাশোনার দায়িত্ব ছটকুর হাতে। মাঝে মাঝে একটু টাকা পয়সা পাঠাতে চাই নানির জন্য, হয় না মা। যা পাঠিয়েছি এপর্যন্ত, অতি সামান্যই। না মা, নানি আমার কাছে কোনও অর্থকড়ি কখনও চায়নি। নানিকে অনেকদিন ফোনে বলেছি, যেন উঠে হাঁটাচলা করে, যেন পাশের বাড়িগুলোয় বেড়াতে যায়। ছটকুদেরও বলেছি, নানি যে বেঁচে আছে, এ আমাদের সবার জন্য অনেক বড় গর্ব। নানিকে অবহেলা যেন না করে, নানির মৃত্যু কামনা যেন না করে। বলি বটে, কিন্তু নানিকে ওরা যদি বাড়তি বোঝা বলে বিশ্বাস করে, তবে আমিই বা কতটুকু বদ্ধমূল বিশ্বাসের বদল করতে পারবো! তবুও বলি, যদিও সে কথার কোনও মূল্য কারও কাছে নেই। নানির মতো সাহসী মানুষও কী রকম হতাশায় ডুবে থাকে! একটা সভ্য সমাজে মানুষের দীর্ঘকাল বেঁচে থাকাটা রীতিমত উৎসবের ব্যাপার। আর একটা অসভ্য সমাজে যখনই কারও প্রয়োজন ফুরিয়ে যায়, তখনই তাকে খড়কুটোর মতো ফেলে দেওয়া হয়। আসলে অভাব মানুষকে অত ভোগায় না, যত ভোগায় অভাববোধ। অভাবে মানুষ নিষ্ঠুর হয় না; অভাববোধের কারণে হয়। ধনী লোকেরও এই অভাববোধ থাকতে পারে, দরিদ্রের নাও থাকতে পারে। দরিদ্রর যত অভাববোধ দেখেছি, তার চেয়ে বেশি দেখেছি অভাব যাদের নেই, তাদের অভাববোধ। তোমার অভাব ছিল, অভাববোধ ছিল না। তবে সত্যি বলছি মা, নানিকে যতটা সাহায্য করা আমার উচিত ছিল, তার কিছুই করা হয় না। নানি বলে, ওই তোমার মতোই বলে, যেন দেশে ফিরি। চোখ ভিজে যায় শুনে। খুব ইচ্ছে করে নানির কাছে বসেপুরোনো দিনের গল্প করি। শুনি। নানির সঙ্গে গল্প করার সময় কারও নেই। ওই বাড়িটা ভাগ হয়ে গেছে, যে যার ভাগের মধ্যে দেয়াল তুলে দিয়েছে। বাড়ি নাতি পুতিতে গমগম করছে, কারও সময় নেই নানির কাছে এসে দুদণ্ড বসার। একটা ভুলে যাওয়া বাড়তি মানুষ উঠোনের এক কোণে একটা ভাঙা টিনের ঘরে পড়ে আছে। গরমকালে আগুন হয়ে থাকে টিন, আর শীতে অজস্র ফুটো দিয়ে ঠাণ্ডা ঢোকে। নানির জন্য অতি সামান্যই খরচ হয় ছটকুর। নানিরশরীর ঠিক আছেমা, মন ঠিক নেই। অসুস্থতার অভিনয় করতে হয়, মুহুর্মুহু মৃত্যুর কথা বলতে হয় লোককে ভারমুক্ত করতে, লোকের কপালে ওঠা চোখকে কপাল থেকে নামাতে। নানির জন্য খুব কষ্ট হয় আমার। নানি আমাকে অনুরোধ করেছিলো দু সপ্তাহ পর পর যেন তার সঙ্গে ফোনে কথা বলি। দু বছর পার হয়ে যায়, নানিকে ফোন করা হয় না আমার। কেন হয় না জানি না। জীবন বোধহয় এরকমই মা, দূরত্ব আরও দূরত্ব রচনা করে।

ফজলিখালা কেমন আছে জানি না। ফজলি খালাকে সেই যে বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছিলাম, তার পর আর দেখা হয়নি। জীবনে কখনও হয়তো আর ফজলিখালার সঙ্গে দেখা হবে না। রাগ করে তার সঙ্গে চরম দুর্ব্যবহার করেছিলাম, সে কথা ভাবলে আমার, সত্যি বলছি, মন খারাপ হয়ে যায়। ফজলিখালা কি আমাকে ক্ষমা করবে কখনও? কোনওদিন যদি দেখা হয়, তার দুটো হাত ধরে আমি ক্ষমা চাইবো মা। তার ওইহাত স্পর্শ করলে আমার মনে হতেই পারে তোমার হাতই আমি স্পর্শ করেছি। রুনু খালা কেমন আছে, তাও জানি না। সেদিন শুনেছি রাসু খালু মারা গেছে। আজকাল আত্মীয়দের কেউ মারা গেলেও আর জানানো হয় না আমাকে, অনেকদিন পর হয়তো কারও মুখে শুনি। শুনে সারাদিন মন খারাপ থাকে। হাডসন নদীকে হাডসন মনে হয় না, যেন ব্রহ্মপুত্রের পাড়ে বসে আছি রাসু খালা, রুনু খালা, ঝুনু খালা, তুমি, আর আমি, ভাজা মুড়ি আর গরম চা খেতে খেতে গল্প করছি সেইসব দিনের কথা, একাত্তরের যুদ্ধে শহর ছেড়ে যখন রাসুখালুর গ্রামের বাড়িতে উঠেছিলাম, কী যত্ন করেই না রাসুখালুর বাড়ির সবাই আমাদের খাওয়াতো, রঙিন ফুল আঁকা গ্লাসে জল দিতো খেতে, নিজেদের লেপ তোশক বালিশ দিয়ে আমাদের বিছানা করে দিয়ে ওরা শুধু মাদুরে ঘুমোতো।

.

ঝুনু খালা ভিখারুন্নিসা ইস্কুলে পড়াচ্ছে আগের মতোই। অনেকবার বলেছিলাম ছোটদাকে যে আমার বাড়িতে এখন থেকে ঝুনুখালা থাকুক। আমার বাড়ি খালি পড়ে আছে, ঝুনু খালা থাকলে ঢাকা শহরে তার বাড়িভাড়ার খরচটা বাঁচতো। কিন্তু ছোটদা কিছুতেই চায় না ঝুনুখালা থাকুক আমার বাড়িতে। আসলে শান্তিনগরের ওই বাড়িটা, ছোটদা বিশ্বাস করে, ছোটদার। ছোটদাই সিদ্ধান্ত নেয় ও বাড়িতে কে থাকবে না থাকবে। আমি দূরের মানুষ। মৃত। ছোটদা একরকম আমাকে জানিয়ে দিয়েছে, বুঝিয়েও দিয়েছে, যে, বাড়িটা ওর। যেহেতু আমি মেয়েমানুষ, আমার উপস্থিতি যদি না থাকে ও দেশে, আমি একরকম মৃতই, উত্তরাধিকারসূত্রে বাড়িটা এখন ও পেয়ে গেছে। অথবা জোর যার দখল তার তত্ত্বে ও চলছে। এসব যখন শুনি, দেখি, মনে হয় তুমি বোধহয় পৃথিবী থেকে চলে গিয়ে একরকম ভালোই করেছো। তোমাকে হয়তো আরও কাঁদতে হতো। আমাকেও কাঁদতে হয় মা, যতদিন পৃথিবীতে মেয়েদের, শুধু তারা মেয়ে বলে, কষ্ট সইতে হচ্ছে দেখি, আমি না কেঁদে পারি না। ঝুনু খালার জন্য আমার খুব মায়া হয়। তুমি যখন ছিলে, ঢাকা শহরে তার একটা আশ্রয় ছিলো। তুমিও নেই, আমিও নেই। ঝুনু খালার নিশ্চয়ই খুব একা লাগে।

.

মা, আমার জীবন তছনছ হয়েছে আগের চেয়েও অনেক বেশি। হারভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের পাট শেষ হলে, যেহেতু বাংলাদেশের দরজা আমার জন্য বন্ধ, কলকাতায় থাকতে শুরু করেছিলাম। যে ভাষায় আমি লিখি, যে ভাষায় আমি কথা বলি, সে আমার মাতৃভাষা, সে তোমার ভাষা মা। এই ভাষা আমাকে টেনে নিয়ে গিয়েছিলো কলকাতায়। চার বছর থাকার পরপশ্চিমবঙ্গও বাংলাদেশ হয়ে ওঠে। শুধু কলকাতা থেকে নয়, আমাকে ভারত থেকেই তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। কিছু জঙ্গি মৌলবাদী আমার বিরুদ্ধে চেঁচিয়েছে বলে কোনও সরকারই আমাকে আর ও দেশে থাকতে দিতে চায় না। বাংলার মেয়ের বাংলায় ঠাঁই নেই। এখন উদ্বাস্তুর জীবন আমার, পৃথিবীর পথে পথে অনাথের মতো হাঁটি। তোমার স্বপ্নটাই ঘুরে ফিরে দেখি, ঘরের মেয়ে কি কোনওদিন ঘরে ফিরবে না! মাঝে মাঝে স্বপ্নটাও খুব ধোঁয়ার মতো, কী চাই বুঝি না, মাটি না মানুষ!

.

মা, আমাদেরও তো যাওয়ার সময় হচ্ছে। যে কোনও সময় যে কোনও দিন হুট করে চলে যাবো। কোথায় যাবো, বলোতো! এরকম যদি হত, কোথাও তোমার সঙ্গে আমার দেখা হবে, তোমার সঙ্গে বাকি জীবন আমি কাটাতে পারবো, পৃথিবীর মায়া তুচ্ছ করে চলে যেতাম। আসলে তুমি যখন গেছ, পৃথিবীর জন্য যে মায়া আমার ছিল, সেটি অনেকটা কাটিয়ে দিয়েও গেছ। এখন যেতে আমারও আর আপত্তি নেই। তুমিহীনপৃথিবীটা বড় ফাঁকা, বড় স্নেহহীন, বড় ভালোবাসাহীন, বড় নিষ্ঠুর, বড় কঠিন, বড় স্বার্থপর। কিন্তু আমি তো ভেতরে ভেতরে জানি, কোনও বেহেসতে বা দোযখে তুমি বা আমি কেউ যাবো না। তোমার সঙ্গে কোথাও দেখা হওয়ার, তোমার সঙ্গে একত্ৰ বাসের কোনও সম্ভাবনা নেই। মরে যাওয়ার কথা ভাবলে আজকাল আর অবাক হই না। একে অসম্ভব কোনও ঘটনা বলেও আর মনে হয় না। যার যাওয়ার সে চলে যায়। তবে যেভাবেই যাই, মা, তোমার মতো এত ভুগতে ভুগতে যেতে চাইনা। স্বার্থপরদের ধারে কাছেও মৃত্যুর সময় থাকতে চাইনা। কোনও একদিন হঠাৎ হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মরে যাবো, কোনওদিন কোনও বিমান আকাশে বিস্ফোরণ ঘটাবে, ছাই হয়ে হয়ে উড়ে যাবো বা কোনও মহাসমুদ্রের অতলে বিলীন হয়ে যাবো। যেন কষ্ট না হয়। যেন তোমার মতো শুয়ে থেকে থেকে আমার মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করা স্বজনদের চোখের অস্থিরতা পড়তে না হয়, যেন দ্রুত মৃত্যু হয়, যেন কেউ কোদাল শাবল আর কাফনের কাপড় হাতে অপেক্ষা করছে দেখতে না হয়। তুমি তো সারাজীবন প্রার্থনা করতে, আমার জন্য বেশি করতে, যেন তোমার আল্লাহতায়ালা আমাকে ক্ষমা করে দেন, যেন আমাকে দোযখে নিক্ষেপ না করেন, যেন দোযখের আগুন থেকে আমাকে রক্ষা করেন। তেমন প্রার্থনাই না হয় কয়রা, এই নিষ্ঠুর পৃথিবী আর এই প্রকৃতির কাছে প্রার্থনা করো যেন মৃত্যু হয় আমার, দ্রুত। যেন আমাকে দেখতে না হয় দোযখের আগুনের চেয়ে যে আগুন বেশি ভয়ংকর, সে আগুন। যাদের ভালোবাসি, তাদের নির্লিপ্তির আগুন, তাদের ভালোবাসাহীনতার আগুন।

জানি না কোথায় আছে, কেমন আছো। জানিনা কোথাও আদৌ আছে কিনা। এই চিঠিটা তুমি পড়ো বা না পড়ো, তোমার জন্য লেখা। তোমাকে লেখা চিঠি জগৎ দেখছে দেখুক। জগৎ আমাকে ক্ষমা করবে না, না করুক। আমি কোনও ক্ষমা চাইছি না। আমি চাইছি যে গ্লানিতে আমি ভুগছি, যে অপরাধবোধ আমাকে নিরন্তর ভোগাচ্ছে, এভাবেই যেন বাকিটা জীবন আমি ভুগি। এ থেকে, যতদিন বাঁচি, যেন আমার মুক্তি না হয়। এ প্রায়শ্চিত্ত নয় মা, এ স্বীকারোক্তি। আমি যতটুকু ভালো, তা তোমার কারণে, যতটুকু মন্দ আমি, আমার নিজের কারণে। আমার মন্দটুকুর দায়িত্ব আমাকেই নিতে দাও।

তোমার আদরের নাসরিন
 

Users who are viewing this thread

Back
Top