What's new
Nirjonmela Desi Forum

Talk about the things that matter to you! Wanting to join the rest of our members? Feel free to sign up today and gain full access!

Collected ছোছনা ও জননীর গল্প - উপন্যাস (2 Viewers)

দরজা খুলেই ধীরেন্দ্রনাথ রায় চৌধুরী আনন্দিত গলায় বললেন, আরো তুমি! কেমন আছ শাহেদ?

নাইমুল স্যারের পা ছুঁয়ে সালাম করতে করতে বলল, স্যার, আমি শাহেদ না, আমি নাইমুল।

ধীরেন্দ্রনাথ রায় চৌধুরী বিন্দুমাত্র বিচলিত না হয়ে বললেন, নাইমুল নামটাই মাথায় এসেছে। বলার সময় শাহেদ বলে ফেলেছি। তোমার ঐ বন্ধুটা কোথায়?

সে ইন্ডিয়ার দিকে রওনা হয়েছে। তার স্ত্রী-কন্যার অনুসন্ধানে। আজ সকালেই রওনা দিয়েছে।

ধীরেন্দ্রনাথ রায় চৌধুরী বিস্ময়ে অভিভূত হবার মতো ভঙ্গি করলেন। মুখে বললেন, বিলো কী! আশ্চর্য তো! নাইমুল মনে মনে হাসল। কী অদ্ভুত মানুষ। জগতের কোনো কিছুর সঙ্গে মানুষটার যোগাযোগ নেই, অথচ তা তিনি প্ৰকাশ করতেও অনিচ্ছুক।

স্যার, দুপুরে আপনার সঙ্গে খাব।

অবশ্যই খাবে। স্পেশাল ডিশ হবে। তুমি বাজার করে নিয়ে আসো। ঘরে চাল-ডাল ছাড়া কিছুই নেই। ইলিশ মাছ খাওয়া যাক, কী বলো? মাছ কাটিয়ে নিয়ে আসবে। তেলে ভেজে গরম গরম খাব।

নাইমুল বলল, মাছ খাওয়া যাবে না স্যার। বাংলাদেশের মানুষ এখন মাছ খায় না।

কেন? মাছ খায় না কেন? মিলিটারিরা মানুষ মেরে মেরে নদীতে ফেলে। নদীর মাছ মরা-গলা ডেড বডির মাংস খায়। এই জন্যেই মাছ খাওয়া নিষেধ।

ধীরেন্দ্রনাথ রায় চৌধুরী বললেন, ইলিশ মাছ তো নদীর মাছ না। সাগরের মাছ।

সাগরের মাছ হলেও এরা ধরা পড়ে নদীতে।

সেটাও কথা। তবে মাছ ডেডবডি খাবে কেন? মাছ কি আমিষাশী? লাইব্রেরি ঘরে যাও তো। মাছের উপর কিছু বইপত্র থাকার কথা। পড়ে দেখি মাছ আমিষাশী কি-না। দেখা যাবে মাছ আমিষই খায় না। মাটি শৈবাল এইসব খায়। মাঝখান থেকে আমরা মাছ খাওয়া বন্ধ করে বসে আছি।

নাইমুল লাইব্রেরি ঘরে গেল না। সরাসরি রান্নাঘরে ঢুকে গেল। তার চায়ের পিপাসা হয়েছে। নাইমুল রান্নাঘর থেকে বলল, স্যার, আপনি চা খাবেন?

ধীরেন্দ্রনাথ রায় চৌধুরী বিরক্ত গলায় বললেন, তুমি রান্নাঘরে কী করছ? তোমাকে বললাম না, মাছের উপর বই খুঁজে বের করতে?

নাইমুল চায়ের পানি বসিয়ে দিয়ে মাছের উপর বই খুঁজতে গেল। স্যারের উপর তার সামান্য রাগ হচ্ছে। ডেডবডি পানিতে ফেলছে বলে মাছ খাওয়া বন্ধ, এই বিষয়টি তার কাছে গুরুত্বহীন। গুরুত্ব পেয়ে গেছে মাছের খাদ্য কী!

নাইমুল!

জি স্যার।

বই পাওয়া গেছে?

খুঁজছি স্যার। সব বই এলোমেলো করে রাখা।

বই তো এলোমেলোই থাকবে। গোছানো থাকবে শাড়ি, জামা-কাপড়। ভালো কথা, তুমি কি বিয়ে করেছ?

জি স্যার।

ঐ রাতে তো আমি ভালো বিপদে পড়েছিলাম। তুমি ভুল ঠিকানা দিয়ে চলে গেলে। আমি রাত দশটা পর্যন্ত বাড়ি খুঁজলাম। তোমার স্ত্রীর নাম কী?

মরিয়ম।

সুন্দর নাম। যিশুর মাতা মরিয়ম। তুমি বৌমাকে নিয়ে অবশ্যই একদিন আসবে। আগে থেকে খবর দিয়ে আসবে যেন সার্ট-পাঞ্জাবি কিছু একটা গায়ে থাকে। খালি গায়ে থাকা হয়েছে। অভ্যাস। মেয়েদের সামনে খালি গায়ে থাকা বিরাট অসভ্যতা।

আমি খবর দিয়েই তাকে আনিব। বই পাওয়া গেছে স্যার।

ভেরি গুড। আমার কাছে বই দাও, আর একটা কাগজ-কলম দাও।

কাগজ-কলম কী জন্যে?

নোট করি। ছাপার অক্ষরের উপর দিয়ে শুধু চোখ বুলিয়ে গেলে তো হবে না। নোট নিতে হবে। কী পড়েছ সেটা ভাবতে হবে।

স্যার, আমি কয়েকদিন আপনার সঙ্গে থাকব।

থাক।

আপনার অসুবিধা হবে না তো?

ধীরেন্দ্রনাথ রায় চৌধুরী জবাব দিলেন না। তিনি খাতায় নোট নেয়া শুরু করেছেন।

নাইমুল বলল, গতকাল আপনার বাড়ির কথা একেবারেই মনে আসে নি। গতকাল রাতে থাকার জায়গা খুঁজে পাচ্ছিলাম না।

ধীরেন্দ্রনাথ রায় চৌধুরী এই কথার উত্তরেও কিছু বললেন না।

চায়ের পানি ফুটছে। নাইমুল চা বানাতে গেল। মৎস্য বিষয়ক জটিলতা শেষ না হওয়া পর্যন্ত ঋষিতুল্য এই মানুষটি কোনো কথা বলবেন না–এটা বোঝা যাচ্ছে।


পুণ্যবান মানুষের আশেপাশে থাকলেই পুণ্য হয়। আলাদা করে পুণ্য করতে হয় না। নাইমুল ঠিক করল, কয়েকদিন এই মানুষটার আশেপাশে থেকে সে পুণ্য সঞ্চয় করে নেবে। এই আলাভোলা মানুষ তাঁর জীবনের সমস্ত সঞ্চয়, পৈতৃক বাড়িঘর–সবই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে দান করে গেছেন। তিনি এখন চলেন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাওয়া পেনসনের টাকায়। মাঝে-মাঝে তার মেয়ে কানাডা থেকে ডলার পাঠায়।

স্যার!

বলো।

একটা প্রশ্ন ছিল, আপনি কি এই বাড়িটাও ইউনিৰ্ভাসিটিকে দিয়ে দিয়েছেন?

হুঁ। তবে আমার মৃত্যুর পর।

ইউনিৰ্ভাসিটি যদি এখনই বাড়ি চায়, আপনি কী করবেন?

ধীরেন্দ্ৰনাথ রায় চৌধুরী রেগে গেলেন। ধমকের স্বরে বললেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের এটা তো খুবই অন্যায় সিদ্ধান্ত। আমি তো বলে দিয়েছি, মৃত্যু পর্যন্ত আমাকে এই বাড়িতে থাকতে দিতে হবে। লিখিত কোনো ডিড অবশ্যি হয় নাই, মৌখিক কথা। দেখি টেলিফোনটা দাও তো। ভাইস চ্যান্সেলর সাহেবের সঙ্গে কথা বলি। হুট করে আমাকে এত বড় ঝামেলায় ফেলা তো ঠিক না।

নাইমুল বলল, স্যার, আপনি আপনার কাজ করুন। ইউনিৰ্ভাসিটি এমন কোনো সিদ্ধান্ত নেয় নি। চা খান স্যার। চা ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছে।

ধীরেন্দ্রনাথ রায় চৌধুরী চায়ে চুমুক দিয়ে খাতায় নোট নিতে লাগলেন

রুই মাছ
বৈজ্ঞানিক নাম : Labeo rohita
খাদ্য : উদ্ভিদ ভুক। মাটিও খায়।

কাতল
বৈজ্ঞানিক নাম : Catila catla
খাদ্য : ফ্লাইটো প্লাঙ্কটন, জুপ্রাঙ্কটন। শ্যাওলা, জলজ উদ্ভিদ, ছোট চিংড়ি ও পোকামাকড়।

মৃগেল মাছ
বৈজ্ঞানিক নাম : Cirrhinus mrigala
খাদ্য : পচা জলজ উদ্ভিদ, পোকামাকড়, মৃত প্রাণীর দেহাবশেষ, মাটি।

চিতল
বৈজ্ঞানিক নাম : Notopterus chitala
খাদ্য : আমিষাশী

এপর্যন্ত লিখে ধীরেন্দ্রনাথ রায় চৌধুরী ঘোষণা দিলেন–মাছ খাওয়া যাবে না; মাছের ডেডবডি খাবার সম্ভাবনা আছে। দুপুরে হবে ডিমের ঝোল।
 
মিলিটারিরা গৌরাঙ্গকে ধরে নিয়ে যাচ্ছে। তার পরনে একটা অতি ময়লা কালো রঙের প্যান্ট। খালি গা। অনেকদিন দাত ব্ৰাশ করা হয় নি বলে দাঁত কালচে হয়ে আছে। ঠোঁটের কোণে দগদগে ঘায়ের মতো হয়েছে। গৌরাঙ্গের কোমরে দড়ি বাধা। তবে তাকে মোটেই চিন্তিত বলে মনে হচ্ছে না। সে মনের আনন্দে সিগারেট টানছে। এই সিগারেট কিছুক্ষণ আগে এক লেফটেনেন্ট সাহেব দিয়েছেন। তিনি যে শুধু সিগারেট দিয়েছেন তা না। লাইটার দিয়ে সিগারেট ধরিয়েও দিয়েছেন।

মিলিটারিরা বদ্ধ উন্মাদ এই মানুষটাকে নিয়ে খুবই মজা পাচ্ছে। লেফটেনেন্ট সাহেব এক একবার পাগলটার সঙ্গে কথা বলেন এবং আনন্দে প্ৰায় ভেঙে পড়েন।

এই তুমি হিন্দু?

ইয়েস স্যার।

তুমি যে হিন্দু এটা প্রমাণ করো। প্যান্ট খুলে দেখাও।

গৌরাঙ্গ সঙ্গে সঙ্গে প্যান্ট খুলে দেখাল। তার মুখভর্তি হাসি।

তোমহারা বিবি কাহা?

মিলিটারি লে গিয়া।

তোমহারা বাচ্চা?

গুল্লি। খতম।

খতম বলার সময় গৌরাঙ্গ চোখ বন্ধ করে জিভ বের করে মরে যাওয়ার ভঙ্গি করল। মিলিটারি দলটার বড় আনন্দময় সময় যাচ্ছে। গৌরাঙ্গ যাই করছে তাই তাদের পছন্দ হচ্ছে।

শেখ মুজিব কে?

Leader our great leader. জয় বাংলা।

তুমি জয় বাংলার লোক?

Yes sir.

জয় বাংলার লোকদের আমরা কী করি জানো?

জানি স্যার। গুল্লি করেন।

তোমাকেও তো গুল্লি করব।

জি আচ্ছা, স্যার।

আরেকটা সিগারেট খাবে?

জি স্যার।

লেফটেনেন্ট সাহেব। আবারো সিগারেট দিলেন, আবারো নিজেই ধরিয়ে দিলেন। তিনি পাগলটাকে আমি মেসে নিয়ে যেতে বলেন। গাছের সঙ্গে বাধা থাকবে। সবাই মজা পাবে। পাগলটা ইংরেজি জানে। এটাও একটা ইন্টারেষ্টিং ব্যাপার।

What is your name?

My name is গৌরাঙ্গ।

What is the meaning of the name?

Fair Skin.

লেফটেনেন্ট সাহেব বললেন, বিলো, পাকিস্তান জিন্দাবাদ।

গৌরাঙ্গ লজ্জা লজ্জা গলায় বলল, জয় বাংলা।

এতেও লেফটেনেন্ট সাহেব খুব মজা পেলেন। গৌরাঙ্গকে আর্মি মেসে নিয়ে যাওয়া হলো।
 
৩৬ ডিভিশনের প্রধান মেজর জেনারেল জামশেদের খাস কামরায় জরুরি স্টাফ মিটিং বসেছে। উপস্থিত আছেন ৯৩ ব্রিগেডের প্রধান ব্রিগেডিয়ার কাদির। ট্যাংকাবাহিনী প্ৰধান কর্নেল ফজলে হামিদ। বিমানবাহিনীর ঢাকা বেস কিমান্ডার এয়ার কমোডর এনাম আহমেদ। ব্রিগেডিয়ার কাসিম এবং ব্রিগেডিয়ার বশীর। নারায়ণগঞ্জ এলাকার দায়িত্বে নিযুক্ত ব্রিগেডিয়ার মনজ্বর শুধু আসেন নি। তিনি জেনারেল নিয়াজীকে নিয়ে আসবেন বলে জানিয়েছেন।

জরুরি স্টাফ মিটিং সকাল নটায় শুরু হবার কথা। এখন বাজছে দশটা এগারো, মিটিং শুরু হয় নি। কারণ জেনারেল নিয়াজী এসে পৌঁছান নি। তিনি জানিয়েছেন–পাকিস্তান সেনাবাহিনীর চিফ অব জেনারেল স্টাফ গুল হাসানের সঙ্গে তার অতি জরুরি কিছু কথা হবে। পশ্চিম পাকিস্তানের সঙ্গে যোগাযোগ করা যাচ্ছে না বলে কথা হচ্ছে না। আরো কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে হবে।

ব্রিগেডিয়ার বশীর বললেন, আমরা নিজেরা কি আলোচনা শুরু করতে পারি না?

জেনারেল জামশেদ প্রশ্নের জবাব দিলেন না। তিনি তার সামনে রাখা টিপট থেকে চায়ের কাপে চা ঢাললেন। ছোট্ট একটা দুর্ঘটনা ঘটল। চায়ের কাপ উল্টে গেল। চা পড়ল। ধবধবে সাদা টেবিলে। গতি স্টাফ মিটিংয়ে একই ব্যাপার ঘটেছে। এর পেছনে কি কোনো ইঙ্গিত আছে? যুদ্ধকালীন সময়ে ছোটখাটো বিষয়েরও অর্থ খোঁজা হয়। লক্ষণ বিচার করা হয়। ডেজার্ট ফক্স ট্যাংক সেনাপতি জেনারেল রোমেলও অভিযান শুরুর আগে নানান লক্ষণ বিচার করতেন।

টেবিলক্লথে পড়া চা মুছে দেবার জন্যে জেনারেল জামশেদের এডিসি রুমাল নিয়ে এগিয়ে এলেন। জামশেদ তাকে হাতের ইশারায় চলে যেতে বললেন। টেবিলক্লথের চা ম্যাপের মতো তৈরি করছে। কে জানে এই ম্যাপেও হয়তো ইশারা আছে। ম্যাপটা দেখতে হয়েছে ইংল্যান্ডের ম্যাপের মতো।

বিগ্রেডিয়ার কাদির হাতের ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বিরক্ত গলায় বললেন, আমরা কতক্ষণ অপেক্ষা করব?

জেনারেল জামশেদ টেবিলক্লথে তৈরি হওয়া ম্যাপ থেকে দৃষ্টি সরিয়ে ব্রিগেডিয়ার কান্দিরের দিকে তাকালেন।

কাদির বললেন, স্যার, আপনি কি জেনারেল নিয়াজীর সঙ্গে আরেকবার কথা বলে দেখবেন? আমরা আর কতক্ষণ অপেক্ষা করব? আমাকে টঙ্গী যেতে হবে। সেখানে আমার ফিল্ড মিটিং আছে।

জেনারেল জামশেদ টেলিফোনের দিকে হাত বাড়ালেন। আর তখনি টেলিফোন বাজল। নিয়াজীর ফুর্তিমাখা গলা শোনা গেল— হ্যালো জামশেদ!

ইয়েস স্যার।

তোমরা মিটিং শুরু করে দাও। আমি আজ আর আসব না।

ঠিক আছে স্যার।

উপস্থিত সবাইকে তাদের অতি বীরত্বপূর্ণ কর্মকাণ্ডের জন্যে আমার অভিনন্দন জানাবে।

অবশ্যই জানাব।

তারা সবাই পাকিস্তানের নিবেদিত যোদ্ধা এবং পাকিস্তানের অহঙ্কার।

জি স্যার।

তোমার গলার স্বর বিষণ্ণ কেন? গতরাতে কি তুমি তোমার স্ত্রীকে স্বপ্নে দেখেছ? স্ত্রীকে স্বপ্নে দেখলে সৈনিক পুরুষদের মন বিষণ্ণ হয়। হা হা হা। হ্যালো জামশেদ।

ইয়েস স্যার।

মজার একটা জোক শোনো। এই জোকটা তুমি তোমার অফিসারদের সঙ্গে শেয়ার করতে পার। সবাই মজা পাবে। এক পাঞ্জাবি সুবাদার মেজর, নাম মিঠা খান। তার আসল যন্ত্রটার দৈর্ঘ্য ছিল এক ফুট। মন দিয়ে শোন, এক ফুট। সে তার এই বিশেষ যন্ত্র সুরক্ষিত রাখার জন্যে তার স্ত্রীকে একটা উলের মোজার মতো জিনিস বানাতে বলল। জামশেদ, শুনতে পাচ্ছ?

পাচ্ছি।

যন্ত্রটার দৈর্ঘ্য কত মনে আছে তো?

এক ফুট।

রাইট। তোমার স্মৃতিশক্তি অসাধারণ। যাই হোক, মূল গল্প শোনো। মিঠা খানের স্ত্রী উলের মোজার মতো জিনিস তৈরি করল। তারপর… হা হা হা।

জেনারেল জামশেদ ধৈর্য ধরে কুৎসিত রসিকতাটা শুনলেন।

ভদ্রতার হাসি হাসা উচিত। তার প্রয়োজন নেই। কারণ নিয়াজী নিজেই হোসে টেলিফোন ফাটিয়ে ফেলছেন। অন্য কারো হাসি শোনার প্রয়োজন তার নেই।

জামশেদ, রসিকতাটা কেমন?

ভালো রসিকতা।

এই লাইনের আরেকটা গল্প আছে। মডিফায়েড ভার্সন। তোমাকে আরেকদিন শোনাব। মনে করিয়ে দেবে।

জি। মনে করিয়ে দেব।

আমি যে আনন্দে আছি বুঝতে পারছ?

আপনি সবসময়ই আনন্দে থাকেন।

দ্যাটস রাইট। তবে আজ আনন্দিত হবার মতো ব্যাপার আছে। চাইনিজ আর কামিং।

সে তো অনেকদিন থেকেই শুনছি।

অনেকদিনর শোনা আর আজকের শোনা আলাদা। তারা ঝাঁকে ঝাঁকে নামবে।

নামলে তো ভালোই।

এক সপ্তাহের মধ্যেই ঘটনা ঘটবে। ভালো কথা, চাইনিজদের নিয়ে একটা মজার রসিকতা আছে। শুনবে?

বলুন, শুনছি।

নিয়াজী চাইনিজদের নিয়ে রসিকতাটা শুরু করেও শেষ করতে পারলেন না। হেড কোয়ার্টার থেকে তার সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হচ্ছে। তাকে লাইনে থাকতে হলো।
 
জেনারেল জামশেদ জরুরি মিটিং শুরু করলেন। আজকের এজেন্ডা সর্বশেষ পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা। তিনি সিগারেট ধরাতে ধরাতে বললেন, আমাদের সৈনিকদের মরাল কী? তার এই প্রশ্নের কেউ উত্তর দিল না। জেনারেল জামশেদ বললেন, সৈনিকদের মরাল সর্বনিম্ন পর্যায়ে আছে বলে আমার ধারণা। এর কারণটা কী? যুদ্ধ শুরুই হয় নি। কিছু মুক্তি এদিক ওদিক ফুটফাট করছে। এতেই এই অবস্থা? কিছু বর্ডার আউটপোস্ট চাপের মধ্যে আছে। কিন্তু এখনো তো কোনো আউটপোস্ট কেউ দখল করে নি। ইন্ডিয়া সর্বাত্মক যুদ্ধ ঘোষণা করলে তবেই আমরা খানিকটা চাপে পড়ব।

এয়ার কমোডর এনাম আহমেদ বললেন, খানিকটা চাপে পড়ব? আমরা কি নিজেদের সম্পর্কে অতিরিক্ত আস্থা দেখাচ্ছি না?

একজন প্রকৃত সৈনিক কি নিজেকে শক্রর কাছে তুচ্ছ ভাববো?

জেনারেল, আপনি কী বলতে চাচ্ছেন? আমি প্রকৃত সৈনিক না?

আপনি অকারণে উত্তেজিত হচ্ছেন কেন? বিমানবাহিনীর প্রধান কাজ উত্তেজিত হওয়া। মূল যুদ্ধ করে স্থল বাহিনী। বাকিরা উত্তেজিত হয়।

আপনি কি এই জরুরি মিটিং ব্যক্তিগত কোন্দলের জন্যে ডেকেছেন?

জেনারেল জামশেদ বললেন, আপনি এই মিটিং অপ্রয়োজনীয় মনে করলে চলে যেতে পারেন।

কিছুক্ষণের জন্যে সবাই চুপ করে গেল। পরিস্থিতি সামাল দিলেন কর্নেল ফজলে হামিদ। তিনি বললেন, আমাদের সামনের সময়টা ভালো না। সামনের দুঃসময়ের কথা ভেবে আমরা কি আমাদের কথাবার্তায় কিছুটা সংযত হতে পারি না?

জেনারেল জামশেদ বললেন, আমি যে সাময়িক উত্তেজনা দেখিয়েছি, তার জন্যে দুঃখিত। সত্যি কথা আপনাদের বলি, আমি হতাশাগ্ৰস্ত। বড় বড় কথা হতাশাগ্রস্তরা বলে। মুক্তিদের আমরা তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করছি। এদের তুচ্ছ করা কি আর এখন উচিত? এরা শক্তি সঞ্চয় করছে।

এয়ার কমোডর বললেন, এরা এমন কোনো শক্তি সঞ্চয় করে নি যে আপনার মতো একজন শক্ত জেনারেল হতাশাগ্ৰস্ত হবেন।

জেনারেল জামশেদ তার রিভলভিং চেয়ার পুরোপুরি এয়ার কমোডরের দিকে ফিরিয়ে বললেন, কাদের সিদ্দিকী নামের সিভিলিয়নকে আপনি চেনেন? চেনেন না?

নামটা পরিচিত বলে মনে হচ্ছে না।

নামটা পরিচিত হবার কথা। ছয়ত্রিশতম ব্রিগেডের একটা বড় অংশ আমরা তার পেছনে লাগিয়েছি। আপনাকে আপনার বিমানবাহিনী নিয়ে বেশ কয়বার তাদের আক্রমণ করতে হয়েছে। তার টিকির দেখাও আমরা পাচ্ছি না। তারপরেও আপনি যদি বলেন, তার নাম আপনার পরিচিত মনে হচ্ছে না, তাহলে আমার কিছু বলার নেই।

তার ভয়ে এতটা ভীত হবার কোনো কারণ দেখি না।

আপনি দেখছেন না। আমি দেখছি। আমাদের অস্ত্ৰ বোঝাই জাহাজ সে দখল করে নিয়েছে। তাও একটা না। তার হাতে এখন অন্ত্রের অভাব নেই।

আমাদের আজকের এই জরুরি মিটিং কি তাকে নিয়ে?

তার মতো আরো তৈরি হবে।

হোক, তখন দেখা যাবে। ভবিষ্যতে কী হবে তা নিয়ে এখনই দুঃস্বপ্ন দেখা কাজের কথা না।

বেশ তাহলে কাজের কথা কী আপনি বলুন।

সভা আবারো নীরব হয়ে গেল। একসময় ব্রিগেডিয়ার কাসিম বললেন, চাইনিজ সাহায্যের কথা শুনছি। সেই সাহায্য কলে এসে পৌঁছবে?

জেনারেল জামশেদ ক্লান্ত গলায় বললেন, চাইনীজ সাহায্যের আমাদের প্রয়োজন কী? এয়ার কমোডর এনাম আহমেদের মতো দুৰ্যর্ধ মানুষজন থাকতে আমরা কেন বাইরের দিকে তাকিয়ে আছি? যাই হোক, আজকের মিটিং অসম্পূর্ণ। জেনারেল নিয়াজীর উপস্থিতিতে আমরা অতিসত্ত্বর আবার বসব। গুড ডে।
 
পাকিস্তান সেনাবাহিনীর চিফ অব জেনারেল স্টাফ জেনারেল গুল হাসান খানের সঙ্গে জেনারেল নিয়াজীর টেলিফোনের মাধ্যমে কিছু কথাবার্তা হলো। অস্ত্র এবং বিশটি মাঝারি ধরনের ট্যাংক নিয়ে একটা চীনা জাহাজ চিটাগাং পোর্টে ভিড়েছে। কথাবার্তা হলো মাল খালাস প্রসঙ্গে। গুল হাসান খান বললেন, আপনি অস্ত্ৰ খালাস করবেন। কিন্তু ট্যাংকগুলো পাঠিয়ে দেবেন। পশ্চিম পাকিস্তানে।

নিয়াজী বললেন, ট্যাংকগুলোই আমার প্রয়োজন।

ট্যাংকগুলো আপনি চিটাগাং থেকে ঢাকা কীভাবে নিয়ে যাবেন? ট্রেন যোগাযোগ বন্ধ। সড়কপথের সমস্ত ব্রিজ নষ্ট।

ট্যাংকগুলো কীভাবে ঢাকায় নেব তা আমার ব্যাপার।

আপনি কি দয়া করে বলবেন, ট্যাংকগুলি কীভাবে নেবেন?

কীভাবে নেব সেটা আমার ব্যাপার।

আমারও জানার ব্যাপার থাকতে পারে।

অস্ত্র এবং ট্যাংক এসেছে ইস্টার্ন কমান্ডের জন্যে।

মূল প্রসঙ্গে আসুন, ট্যাংকগুলো আপনি এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় কীভাবে নেবেন?

আমি তো আগেও বলেছি, সেটা আমার ব্যাপার।

শুনুন জেনারেল, সব ট্যাংক আপনি করাচি পোটে পাঠাবেন। এটা হচ্ছে একটি সামরিক আদেশ।

গুল হাসান খান টেলিফোন রেখে দিলেন। নিয়াজী সামরিক আদেশ অগ্রাহ্য করলেন। জাহাজের সব কিছুই চিটাগাং পোর্টে খালাস করা হলো।*

টেলিফোনের কথাবার্তায় জেনারেল নিয়াজীর মেজাজ বেশ খারাপ হলো। তবে এই খারাপ মেজাজ বেশিক্ষণ স্থায়ী হলো না। তিনি সামান্য ভদকা পান করলেন। ভদকা শীতের দেশের পানীয় হলেও বাংলাদেশের গরমেও এটা ভালো লাগে। প্রচুর বরফ এবং প্রচুর লেবু দিয়ে বানানো ভদকার গ্লাসে চুমুক দেয়া মাত্রই তার মনে একধরনের ফুরফুরে ভাব হয়। মনে হয় সৈনিক জীবনটা তো খারাপ না। বিশাল এক দায়িত্ব নিয়ে তিনি এসেছেন। দায়িত্ব তিনি ভালোমতোই পালন করছেন। এই যুদ্ধ কিছুদিনের মধ্যেই থেমে যাবে। তখন তিনি ইতিহাসের পাতায় স্থায়ী হয়ে যাবেন। পাঠ্যবই-এ লেখা হবে পাকিস্তানের অতি দুঃসময়ে টাইগার নিয়াজী হাল ধরেছিলেন।

তিনি অতি দ্রুত ভদকার গ্লাসে চুমুক দিচ্ছেন। এত দ্রুত খাওয়া ঠিক না। কিন্তু তার অসুবিধা হচ্ছে না। বরং মনে হচ্ছে তার চিন্তা পরিষ্কার হচ্ছে। মাথা থেকে কুয়াশা সরে যাচ্ছে। তিনি ঠিক করলেন একটি আত্মজীবনীও লিখবেন। যেখানে পূর্বপাকিস্তানকে পোষ মানানোর গল্প সুন্দরভাবে লেখা থাকবে। বইটি লেখার সময় তিনি বিনয়ী থাকবেন। বীরপুরুষরা বিনয়ী হয়। বিনয়ও বীরত্বের লক্ষণ।

আত্মজীবনীটা ইংরেজিতে লেখা হবে, যাতে সব ভাষাভাষীরা পড়তে পারে। বইটার প্রথম লাইনটা হবে–it was a monson of discontent.

জেনারেল নিয়াজীর মান অতিদ্রুত আনন্দে পূর্ণ হলো। এত আনন্দ একা এক ধারণ করা যায় না। আনন্দ বিলিয়ে দিতে হয়। তিনি জেনারেল জামশেদকে টেলিফোন করলেন। তাকে একটা জরুরি নির্দেশও দিতে হবে। কী নির্দেশ তা মনে পড়ছে না, তবে মনে পড়বে। কথা বলতে বলতেই মনে পড়বে। নেশা করার এই এক আনন্দ। মানুষ একইসঙ্গে সবকিছু ভুলে যায়, আবার তায় সবকিছুই মনে পড়ে।

হ্যালো জামশেদ।

ইয়েস স্যার।

আমি একটি আত্মজৈবনিক গ্ৰন্থ লেখার পরিকল্পনা করেছি।

ভালো করেছেন স্যার।

এটি হবে পাকিস্তান রক্ষা বিষয়ক একটি প্রামাণ্য দলিল।

অবশ্যই।

বইটিকে আমি সুখপাঠ্য করার ব্যবস্থা করব।

আপনার পক্ষে কাজটা কঠিন হবে না। অসংখ্য গল্প আপনি জানেন। সেইসব গল্প নিশ্চয় বইতে পাওয়া যাবে।

তা পাবে। ইস্টার্ন কমান্ডে তুমি এবং তোমার বীর সৈনিকরা যে সাহসী ভূমিকা রেখেছ–তার উল্লেখ থাকবে।

স্যার, আপনাকে ধন্যবাদ। ধন্যবাদ দিতে হবে না। আমি সবাইকে সবার প্রাপ্য সম্মান দেব। ভালো কথা, তোমার প্রতি একটি জরুরি নির্দেশ আছে। এতক্ষণ মনে পড়ছিল না। এখন মনে পড়েছে।

স্যার বলুন।

চিটাগাং পোর্টে কিছু ট্যাংক খালাস করা হচ্ছে। তুমি ট্যাংকগুলো ঢাকায় আনার ব্যবস্থা করো।

সেটা কীভাবে সম্ভব?

আমি তোমাকে নির্দেশ দিলাম, কীভাবে সম্ভব তা তোমার ব্যাপার। আমি দেখতে চাই নির্দেশ পালিত হয়েছে।

জেনারেল জামশেদ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, ছোট্ট একটা দুঃসংবাদ আছে।

নিয়াজী বিরক্ত গলায় বললেন, দুঃসংবাদ শোনার মতো মানসিক অবস্থা এখন আমার নেই। তারপরেও বলো।

আমাদের একটা পুরো কোম্পানি কাদের সিদ্দিকী ধ্বংস করে ফেলেছে। কয়েকজন তার হাতে ধরাও পড়েছে।

কাদের সিদ্দিকী কে? ইন্ডিয়ান আর্মির?

জি-না স্যার, একজন সিভিলিয়ান মুক্তি।

তাকে মৃত অথবা জীবিত অবস্থায় আমার সামনে হাজির করবে। তোমার প্রতি এটি আমার আদেশ, একটি সামরিক আদেশ।

জেনারেল নিয়াজী টেলিফোন রেখে দিলেন। তার মেজাজ প্ৰচণ্ড খারাপ। তবে কিছুক্ষণের মধ্যেই পুরনো ফুরফুরে ভাব আবার ফিরে এলো। তিনি তার আত্মজীবনী নিয়ে ভাবতে লাগলেন।

—————

*সূত্র : Memoir গুল হাসান খান
 
নদীর নাম ধলেশ্বরী। তারিখ বারই আগষ্ট।

সাতটা জাহাজের বিশাল বহর এগুচ্ছে। তাদের গন্তব্য ফুলছরিঘাট। জাহাজ বোঝাই অস্ত্রশস্ত্ৰ গোলাবারুদ এবং রসদ। ফুলছরিঘাটে মাল খালাস হবে। সেখান থেকে যাবে রংপুর এবং সৈয়দপুর। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ক্যান্টনমেন্টে।

জাহাজ বহরের দায়িত্বে আছেন ক্যাপ্টেন আমানুল্লাহ, সহকারী কমান্ডার লেফটেনেন্ট আতাউল্লাহ। জাহাজগুলি মালামাল বহন করছে, কাজেই নৌবাহিনীর সঙ্গে সম্পর্কিত না। স্থলবাহিনীর বেশ বড় দল জাহাজে আছে। তারাই নির্বিঘ্নে জাহাজগুলি গন্তব্যে পৌঁছে দেবে। জাহাজের সারেংরা সবাই বাঙালি, নদী ভালো চেনে। তারা নদীর গভীরতা দেখে দেখে এগুচ্ছে।

ক্যাপ্টেন আমানুল্লাহ আছেন এস. ইউ. ইঞ্জিনিয়ারস এলসি থ্রি জাহাজে। তাঁর সঙ্গে আছেন লেফটেনেন্ট আতাউল্লাহ। বিশাল আকৃতির এই জাহাজের পাশাপাশি যাচ্ছে ত্রিপল ঢাকা ট্যাংকার এস. টি. রাজন। এখানে আছেন সুবেদার রহিম খান।

ক্যাপ্টেন আমানুল্লাহ জাহাজের ডেকে রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে আছেন। তার কাছে এই প্রথম মনে হচ্ছে তিনি ছুটি কাটাতে এসেছেন। আনন্দময় নৌভ্রমণ হচ্ছে। জাহাজ বহর দেখে দুই তীরের আতঙ্কিত মানুষদের ছোটাছুটিতেও তিনি খুব মজা পাচ্ছেন। বাঙালি অতিরিক্ত মাছ খাওয়ার কারণে ভীরু স্বভাবের হয় বলে তিনি জানেন। আজ তার প্রমাণ দেখছেন। বাড়িঘর ছেড়ে লোকজন পালাচ্ছে। মাছ মারতে আসা জেলেরা নৌকা এবং জাল ফেলে ঝাঁপ দিয়ে পড়ছে পানিতে। ক্যাপ্টেন আমানুল্লাহ তাদের দোষ দিতে পারছেন না। সাতটা জাহাজের বহর দেখে যে-কেউ ভয় পাবে। ভীতু বাঙালির ছোটাছুটি দেখতে ভালো লাগে।

জাহাজ এগুচ্ছে ধীর গতিতে। নদী সব জায়গায় সমান গভীর না। জায়গায় জায়গায় চর জেগেছে। নদীর গভীরতা দেখে দেখে এগুতে হচ্ছে সাবধানে। জাহাজের গতি আরেকটু বেশি হলে ভালো হতো।

লেফটেনেন্ট আতাউল্লাহ ডেকে উঠে এলেন। তার হাতে ক্যামেরা। তার উদ্দেশ্য নিজের কিছু ছবি তুলবেন। দেশে পাঠাবেন। ছবি এমনভাবে তোলা হবে যেন জাহাজ বহরের অনেকটাই ছবিতে আছে। তার বৃদ্ধা মা ছেলের ছবি খুব আগ্রহ করে দেখেন।

ক্যাপ্টেন আমানুল্লাহ হাসিমুখে বললেন, হ্যালো মি. ফটোগ্রাফার, তুমি যে হারে ছবি তোল, তোমার ক্যামেরায় ফিল্ম অবশিষ্ট থাকার কথা না। যদি থাকে আমার একটা ছবি তুলে দাও।

লেফটেনেন্ট আতাউল্লাহ বললেন, অবশ্যই স্যার।

ছবিটা এমনভাবে তুলবে যেন আমাকে দেখে মনে হয় আমি ক্রিস্টোফার কলম্বাস।

অবশ্যই স্যার। এখানে ছবি না তুলে চলুন ছাদে যাই। ছাদে ছবি ভালো আসবে। জাহাজ বহরের অনেকখানি পাওয়া যাবে।

চল যাই।

ক্যাপ্টেন আমানুল্লাহ ছাদে উঠার সিঁড়িতে পা রেখেছেন, তখনই মটারের গোলা এসে জাহাজে পড়ল। ব্যাপার কী বুঝে উঠার আগেই বৃষ্টির মতো মেশিনগানের গুলি এসে পড়তে লাগল। তিনি বিস্মিত হয়ে বললেন, What is happening? বিশাল এই জাহাজ বহর আক্রমণ করার স্পর্ধা কে দেখাচ্ছে? লেফটেনেন্ট আতাউল্লাহ বলল, স্যার আমরা কাদের সিদ্দিকীর এলাকার ভেতর দিয়ে যাচ্ছি। আমাদের আক্রমণ করেছে কাদের সিদ্দিকীর বাহিনী। সে ছাড়া এই কাজ আর কেউ করবে না।

ততক্ষণে নারকীয় কাণ্ড শুরু হয়েছে। পেছনের জাহাজগুলি উল্টোদিকে চলতে শুরু করেছে। তার জাহাজটি এবং এস. টি. রাজন ছাড়া সামনের জাহাজগুলিও দেখা যাচ্ছে না। এস. টি. রাজনে যেভাবে মর্টারের গোলা এসে পড়ছে যে-কোনো মুহুর্তে এতে আগুন ধরে যেতে পারে। এই ট্যাংকারটিতে ডিজেলই আছে এক লক্ষ আশি হাজার গ্যালন।

জাহাজের কন্ট্রোলরুম থেকে ওয়্যারলেসে হেড কোয়াটারের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলো।

আমরা আক্রান্ত হয়েছি। আমরা আক্রান্ত হয়েছি। বৃষ্টির মতো মর্টারের গোলা, এসে পড়ছে। লেফটেনেন্ট আতাউল্লাহ নিহত। সুবেদার রহিম খান নিহত।

কী বলছ এসব?

মে ডে। মে ডে।

জাহাজ নিয়ে পিছিয়ে আসা। কোনোক্রমেই যেন জাহাজ কাদের সিদ্দিকীর হাতে না পড়ে। জাহাজ বোঝাই অস্ত্রশস্ত্ৰ।

আমরা চড়ায় আটকা পড়েছি। সেনাবাহিনীর প্রায় সবাই নিহত। বিমানবাহিনীর সাহায্য লাগবে। অবিলম্বে বিমানবাহিনীর সাহায্য লাগবে।

বিমানবাহিনীর সাহায্য যাচ্ছে। জাহাজের অস্ত্ৰ যেন তাদের হাতে না পড়ে। কাদের সিদ্দিকীর বাহিনী এগিয়ে আসছে। তাদের দেখতে পাচ্ছি। হেভি মেশিনগান দিয়ে ওদের আটকে রাখ; বিমানবাহিনীর সাহায্য আসছে।

মেশিন গানাররা কেউ জীবিত নেই। কথা শেষ হবার আগেই বিকট শব্দে রকেট লাঞ্চারের গোলা ফাটল। ক্যাপ্টেন আমানুল্লাহ ঝাঁপ দিয়ে পড়লেন পানিতে।

———–

* মাটিকাটা অঞ্চলে অসীম সাহসিকতায় যে মানুষটি জাহাজ আক্রমণের নেতৃত্ব দেন। তিনি কাদের সিদ্দিকীর বাহিনীর এক বীর যোদ্ধা। তাঁর নাম মোহাম্মদ হাবিবুর রহমান। জাহাজ দখলের পর তাঁর নাম হয়ে গেল জাহাজ মারা হাবীব। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার তাঁকে বীর বিক্রম সম্মানে সম্মানিত করেন। কাদের সিদ্দিকীর বাহিনীতে যোগদানের আগে তিনি ছিলেন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের হাবিলদার।
 
বরিশালের বানিয়াপাড়ায় একটি বড় দোতলা লঞ্চের দোতলায় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ক্যাপ্টেন জানে রসুল শুকনা মুখে বসে আছেন। লঞ্চে ত্ৰিশজন সৈনিক, পাঁচজন পশ্চিম পাকিস্তানি পুলিশ এবং কিছু রাজাকারকে উঠানো হয়েছে। জানে রসুলকে একটি বিশেষ উদ্দেশ্যে পাঠানো হচ্ছে। হেমায়েত বাহিনীকে শেষ করে দেয়া। হেমায়েত বাহিনী বর্তমানে কোথায় আছে কীভাবে আছে–সেই তথ্য নিয়ে একজন ইনফরমার এসেছে। ইনফরমারের নাম কয়েস আলি। তার বয়স চল্লিশের নিচে। থুতনিতে ছাগলাদাড়ি। মাথায় বেতের গোলটুপি। তিনি চোখে সুরমা দিয়েছিলেন। এক চোখের সুরমা কী কারণে জানি লেস্টে গিয়েছে। এখন তাকে দেখে মনে হচ্ছে মারামারি করে তিনি চোখে কালশিটা ফেলেছেন।

ক্যাপ্টেন জানে রসুল এই ইনফরমারের উপর খুবই বিরক্ত হচ্ছেন। তাঁর কথাবার্তা থেকে তেমন কিছুই উদ্ধার করা যাচ্ছে না। বরং উল্টা সন্দেহ হচ্ছে, এই লোক আসলে হেমায়েত বাহিনীরই একজন স্পাই। এর কথায় লঞ্চ নিয়ে কোথাও উপস্থিত হওয়া মানে বিপদে পড়া। অথচ উপর থেকে নির্দেশ এসেছে অভিযানে বের হতে হবে। নদীপথের অভিযানের দায়িত্ব নৌবাহিনীর। তারা গানবোট নিয়ে বের হবে। কাজ শেষ করে গানবোট নিয়ে ফিরে আসবে। এইসব জায়গায় স্থলবাহিনীকে লক্কর লঞ্চে করে পাঠানোর মানে কী? ক্যাপ্টেন জানে রসুলের ধারণা–সেনাবাহিনী এখন চলছে হুজুগের উপর। উপরের লোকজনের যার মাথায় যা আসছে তাই করছে। ওয়ারলেস অর্ডার পাঠিয়ে দিয়ে খালাস।

কয়েস আলি পাঞ্জাবির পকেট থেকে পানের ডিব্বা বের করে দুটা পান একসঙ্গে মুখে দিয়ে বলল, মেজর সাব এখন কী করবেন ঠিক করলেন? কথাগুলি সে বলল, কাজ চালাবার মতো উর্দুতে। এটা ভালো। অনেক ইনফরমার আছে যারা উর্দু বলতে পারে না। বুঝতেও পারে না। তাদের সঙ্গে কথা বলতে হয় দোভাষির মাধ্যমে। দোভাষিরা সব সময় নিজেদের কিছু কথাবার্তাও ঢুকিয়ে দেয়।

তোমার নাম কয়েস আলি?

জি জনাব।

উর্দু কোথায় শিখেছ?

আমি কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টে পাঁচ বছর চাকরি করেছি।

কী চাকরি?

কিচেনে হেলপার।

চাকরি চলে গেল কেন?

রিজিকের মালিক আল্লাহ। তিনি মিলিটারি থেকে রিজিক উঠায়ে নিয়েছেন বলে চাকরি চলে গেছে।

তুমি হেমায়েত বাহিনীকে চেন?

কেন চিনব না? দূরসম্পর্কের আত্মীয়তা আছে।

কার সঙ্গে আত্মীয়তা?

হেমায়েতউদিনের সঙ্গে। উনার স্ত্রীর নাম হাজেরা খাতুন। যুদ্ধের সময় গুলি খেয়ে মারা গেছে। সে এক হিন্দু মেয়েরে দ্বিতীয় বিবাহ করেছে। তার নাম সোনেক রাণী রায়। তার বড় ছেলের নাম হাছিবউদ্দিন, ডাকনাম পাঞ্ছ।

তুমি হেমায়েতউদ্দিনকে ধরিয়ে দিতে চাও?

অবশ্যই।

কারণ কী?

পাকিস্তান টিকয়ে রাখতে হবে না?

শুধু পাকিস্তান টিকায়ে রাখার জন্যে তাকে ধরিয়ে দেবে?

অন্য কারণও আছে। পারিবারিক।

হেমায়েতউদ্দিন কোথায় আছে তুমি জানো?

অবশ্যই।

সেখানে গেলে আমরা তাকে পাব?

সে হইল শুশুক। এইটা বিবেচনায় রাখতে হবে।

শুশুক কী?

শুশুক থাকে পানিতে। ভুস কইরা ভাইসা উঠে আবার ড়ুব দেয়।

সে এখন যেখানে আছে–সেখানে পথ দেখিয়ে আমাদের নিয়ে যেতে পারবে?

আমারে সারেঙ্গের সাথে বসায়ে দেন, আমি নিয়া যাব। তবে খালে ঢুকতে হবে। জোয়ার-ভাটা বিবেচনা করে চলতে হবে।

নদীতে জোয়ার-ভাটা আছে না-কি?

কী যে বলেন, আমরার এইটা জোয়ার-ভাটার দেশ। নদীপথে চলতে হলে নদীর হিসাবে চলতে হবে।

নদীর হিসাবে চলতে হলে কখন রওনা দিতে হবে?

আরো এক ঘণ্টা পরে।

ঠিক আছে তুমি এখন যাও, এক ঘণ্টা পরে রওনা দেব।
 
ক্যাপ্টেন জানে রসুল বরিশাল এলাকার একটা ম্যাপ বের করে সামনের টেবিলে রাখলেন। ম্যাপ দেখে কোনো কিছুই বোঝার উপায় নেই। মাকড়শার জালের মতো চারদিকে নদী-নালা। অতি দুৰ্গম অঞ্চল। এই অঞ্চল যে চেনে না–তার জন্যে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় যাওয়া পুরোপুরি অসম্ভব। একটা ব্যাপার। এই রকম অবস্থায় তাকে অভিযানে যেতে হচ্ছে এমন একজনকে শায়েস্তা করতে–যার সম্পর্কে তেমন কোনো তথ্য তার কাছে নেই। এই লোক সেকেন্ড ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের হাবিলদার ছিল। দীর্ঘদিন এবোটাবাদ সেনাবাহিনী স্কুলে প্রশিক্ষক ছিল। এখন সে মুক্তি হয়েছে। বিদের হাডিড হয়েছে। ভারতের কোনো রকম সাহায্য ছাড়াই নাকি বিশালবাহিনী তৈরি করেছে। এই বাহিনী কোনো রকম ভয়ভীতি ছাড়াই সরাসরি পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধ করছে। ঢুশঢাশ কয়েকটা গুলি করে পালিয়ে যাওয়া টাইপ যুদ্ধ না। সরাসরি সম্মুখ যুদ্ধ। পাকিস্তান সেনাবাহিনী এদের গুণতির মধ্যে ধরছে–এটাও এক বিস্ময়কর ঘটনা।

ব্যাটা এখন আবার হিন্দু বিয়ে করেছে। স্ত্রীর নাম সোনেকা রাণী রায়। হিন্দু বিয়ে তো করবেই, এরা এমনিতেই হাফ হিন্দু। ক্যাপ্টেন জানে রসুলের কাছে খবর আছে, পূর্বপাকিস্তানের মুসলমানরা বেশির ভাগ সময় মুসলমানি করায় না।

এক ঘণ্টার জায়গায় লঞ্চ ছাড়ল দেড় ঘণ্টা পরে। লঞ্চের নাম এমডি যমুনা। কয়েস আলি সারেঙের পাশে বসে তাকে পথ দেখিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। তারা যাচ্ছে বানারিপাড়া থেকে স্বরূপকাঠির দিকে। হেমায়েত বাহিনীর মূল লক্ষ্য শর্ষিনার পীরসাহেবের আস্তানায় যে মিলিটারি ক্যাম্প আছে সেখানে আক্রমণ করা। তারা সময় এবং সুযোগের অপেক্ষায় আছে। ক্যাপ্টেন জানে রসুল কয়েস আলিকে ডেকে পাঠালেন। তথ্যগুলি ভালোমতো আবারো যাচাই করে নেয়া দরকার।

হেমায়েত বাহিনী যেখানে লুকিয়ে আছে, সেই জায়গাটা তুমি চেন?

অবশ্যই। বিরাট পেয়ারা বাগান। জংলার মতো সেইখানে আছে।

হেমায়েতউদ্দিন নিজেও কি দলের সঙ্গে আছে?

উনি নিজে সব অপারেশনে থাকেন। তার স্ত্রীও থাকেন। স্ত্রী হিন্দু। নাম সোনেকা রাণী। রায় বংশ।

তার স্ত্রী যে হিন্দু এটা একবার বলেছ। নতুন কিছু থাকলে বলে।

তার স্ত্রীও যুদ্ধ করে। রাইফেল চালাইতে পারে। এলএমজি চালাইতে পারে। এইটা অবশ্য শোনা কথা। আমি নিজে দেখি নাই। স্যার কি একটা পান খবেন?

আমি পান খাই না।

কয়েস আলি দুটা বড় পান মুখে দিয়ে তৃপ্তির সঙ্গে চাবাতে চাবাতে বলল, আমি সারেঙের সাথে বসি। এর বাড়ি চিটাগাং, এই অঞ্চল সম্পর্কে কিছুই জানে না।

যাও।

কয়েস আলি চলে যাবার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই লঞ্চের ইঞ্জিন থেমে গেল। একটু পর পর ঘটং ঘটাং শব্দ ছাড়া আর কোনো শব্দ নেই। লঞ্চ থেমে আছে মাঝনদীতে। তবে এখানে নদী তেমন চওড়া না। মাছধরার নৌক চোখে পড়ছে। ইলিশের মরসুম। জেলেরা প্ৰাণের ভয় তুচ্ছ করে মাছ মারতে বের হয়। শুধু গানবোটের বিশেষ শব্দ কানে এলে নৌকা নিয়ে দ্রুত কোনো খালে ঢুকে পড়ে।

এমভি যমুনাকে দেখে তারা সাধারণ লঞ্চই মনে করছে। লঞ্চ সাজানো হয়েছে সেইভাবেই। সৈন্যরা লুকিয়ে আছে এক তলায়। তাদেরকে বলা হয়েছে কেউ যেন জানোলা দিয়ে মুখ বের না করে। কেউ যেন তাদের দেখতে না পারে। একতলা দোতলা দুটাই মালে বোঝাই। নারিকেল, পেয়ারা, কাউফল। আলাদা করে মাল বোঝাই করতে হয় নি। মিলিটারিরা মাল বোঝাই এই লঞ্চ রিক্রুট করেছে।

ক্যাপ্টেন জানে রসুল খবর নিয়ে জানলেন, লঞ্চের ইঞ্জিনে কী না-কী সমস্যা হয়েছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই ইঞ্জিন ঠিক হবে। একঘণ্টা পরে জানানো হলো, ইঞ্জিন ঠিক করা যাচ্ছে না, তবে খুব কাছেই এক লঞ্চ মেকানিকের বাড়ি। ক্যাপ্টেন সাহেব অনুমতি দিলে সারেং সেই লঞ্চ মেকানিককে নিয়ে আসতে পারবে। মেকানিককে বাড়িতে না পাওয়া গেলেও অসুবিধা নেই, তার বাড়ি থেকে কয়েকটা রেঞ্জ নিয়ে এলে সে নিজেই ঠিক করতে পারবে।

জানে রসুল অত্যন্ত বিরক্ত হয়ে বললেন, কতক্ষণ লাগবে?

সারেং জানাল, যেতে আসতে যতক্ষণ লাগে। ঊর্ধ্বে একঘণ্টা।

ক্যাপ্টেন অনুমতি দিলেন। অনুমতি না দিয়ে তার উপায়ও ছিল না। দ্বিতীয় কোনো বিকল্প তার হাতে নেই। অন্য কোনো লঞ্চ নিয়ে তিনি যে ফিরে যাবেনসেই উপায়ও নেই। নদীপথে এখন লঞ্চ চলাচল করে না বললেই হয়। তার সঙ্গে ওয়্যারলেস সেট নেই। কারো সঙ্গে যোগাযোগ করে সাহায্য চাওয়ার উপায় নেই।
 
একঘণ্টার মধ্যে সারেঙের ফেরার কথা। দুঘণ্টার কাছাকাছি হয়ে গেল সারেঙের খোঁজ নেই। বেলা হয়েছে। পাঁচটার উপর বাজে। দিনের আলো কমে এসেছে। আকাশে মেঘ জমতে শুরু করেছে। মেজর জানে রসুল কয়েস আলিকে ডেকে পাঠালেন। কয়েস আলি বিনীত মুখে সামনে এসে দাঁড়াল। জানে রসুল বিরক্ত মুখে বললেন, ঘটনা কী?

কয়েস আলি উদাস গলায় বলল, ঘটনা ভালো না।

ঘটনা ভালো না মানে কী?

সারেঙ লঞ্চ ফালায়ে তার হেলপার নিয়ে পালায়ে গেছে বলে মনে হয়।

এরকম মনে হবার কারণ কী?

হাবেভাবে বুঝলাম। দুই আর দুই-এ মিল করে চার বের করলাম। সহজ হিসাব, জটিল হিসাব তো না।

জটিল হিসাব না?

জি-না। আপনাকে আগেই বলেছি। সারেঙের বাড়ি চিটাগাং, এই অঞ্চলের কিছুই সে চিনে না। সে কীভাবে মেকানিক ধরে আনবে?

এটা আমাকে আগে বলো নি কেন?

একবার ভাবলাম বলি। পরে ভাবলাম মানুষরে এত সন্দেহ করা ঠিক না। সে লঞ্চ নিয়া এই অঞ্চলেই চলাফেরা করে। মেকানিকের বাড়ি চিনতেও পারে।

সারেঙ যদি সত্যি সত্যি পালিয়ে গিয়ে থাকে, তাহলে আমাদের করণীয় কী?

জনাব, এই বিষয়ে আমি গভীর চিন্তায় আছি। একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছি। অনুমতি দিলে বলি।

বলো।

আমার মন বলতেছে লঞ্চের ইঞ্জিন ঠিক আছে। ব্যাটা ইচ্ছা কইরা লঞ্চ চড়ায় উঠায়ে দিয়েছে।

লঞ্চ কি চড়ায় বেধে আছে?

জি। শিকারপুরে ছোট লঞ্চ আছে। আপনি যদি আমার সঙ্গে কোনো লোক দেন। আমি নৌকাযোগে শিকারপুর যাব। সেখান থেকে লঞ্চ নিয়ে ফিরব। জায়গাটা ভালো না। রাতে এখানে লঞ্চে আটকা পড়লে বিপদ আছে। হেমায়েত বাহিনী শক্ত জিনিস।

তুমি শিকারপুর থেকে লঞ্চ নিয়ে আসতে চাও?

শিকারপুরের দুই-একজন লঞ্চ মালিকের সঙ্গে আমার পরিচয় আছে। তবে আপনি যদি অন্য কাউকে পাঠাইতে চান, পাঠাইতে পারেন। আমার একটাই কথা, সন্ধ্যার পর এই অঞ্চলে থাকা অতি বিপদজনক। আমি সারেঙের ঘরে আছি। কোন সিদ্ধান্ত হয় আমাকে জানাবেন। আছরের নামাজ পড়ব। আমি সব নামাজ কাজ পড়তে রাজি আছি, আছরের নামাজ কাজ পড়তে রাজি না। ক্যাপ্টেন সাহেব কি জানেন রোজকেয়ামত হবে আছরের ওয়াক্তে?

ক্যাপ্টেন জানে রসুল জবাব দিলেন না। সরু চোখে মানুষটার দিকে তাকিয়ে রইলেন। তার এখন সন্দেহ হচ্ছে, লঞ্চ মাঝনদীতে এনে চড়ে আটকে ফেলার পেছনে এই লোকটার ভূমিকা আছে। বেশ বড় ভূমিকা। এই লোক কাজ করছে তার পরিকল্পনা মতো। সারেঙের সঙ্গে পরামর্শ করে লঞ্চ আটকানোর ব্যবস্থা করেছে। নদীর দুপাশে ঘন নারিকেল বন। নারিকেল বনের কভার নিয়ে হেমায়েত বাহিনী সহজ যুদ্ধ করবে। তিনি লঞ্চ নিয়ে খোলা জায়গায় আছেন, তার কোনো কভার নেই।

তোমার নাম কয়েস আলি?

জি স্যার।

বিয়ে কবেছ?

জি স্যার।

ছেলেমেয়ে আছে?

দুই ছেলে এক মেয়ে। ছেলে দুইজনকেই মাদ্রাসায় ভর্তি করায়ে দিয়েছি। হাফেজিয়া মাদ্রাসা। তালা কোরান মজিদ মুখস্থ করতেছে। ছোট ছেলের পাঁচ পারা মুখস্থ হয়েছে। বড়টার এক পাড়া। বড়টার মাথার তেজ কম।

আমার ধারণা তুমি হেমায়েত বাহিনীরই একজন। ইচ্ছা করে আমাদের এখানে এনে ফেলেছি।

আপনি যা চিন্তা করতেছেন তা ঠিক না।

আমি তোমার সঙ্গে তর্ক-বিতর্কে যাব না। আমি তোমাকে এখন লঞ্চের ছাদে নিয়ে তুলব। সেখানে গুলি করে ডেডবডি নদীতে ফেলে দেব।

আপনি আপনার বিবেচনা মতো কাজ করবেন, তবে হায়াত মাউতের মালিক আল্লাহপাক। আমার মৃত্যু যেমন হতে পারে, আপনাদের সবার মৃত্যুও এখানে হতে পারে। একটা লঞ্চ এখানে আটকা পড়ে আছে আর হেমায়েত বাহিনী এই খবর জানবে না তা কি হয়? যে সারেং পালেয়ে গেছে–খবর তার মাধ্যমেই চলে গেছে।

তুমি ছাদে চল।

কয়েস আলি বলল, জি আচ্ছা। মৃত্যুর আগে একটা পান খাওয়ার সুযোগ দিয়েন জনাব। জর্দা দিয়া ভালোমতো একটা পান খাইয়া নেই।

মাথায় গুলি করলেন। গুলি করার আগমুহুর্তে কয়েস আলি পানের পিক ফেলতে ফেলতে বলল, আপনাদের আজরাইল আসতাছে। বেশি দেরি কিন্তু নাই।

সন্ধ্যার পর পরই হেমায়েত বাহিনী দক্ষিণ দিক থেকে লঞ্চ আক্রমণ করল।

তখনো কয়েস আলির মৃতদেহ লঞ্চের আশেপাশেই আছে। জোয়ারের টান শুরু হয় নি বলে মৃতদেহ ভেসে যায় নি।*

—————–

* অসীম সাহসিকতাপূর্ণ কর্মকাণ্ডের জন্যে মোঃ হেমায়েতউদ্দিনকে বাংলাদেশ সরকার বীরবিক্রম সম্মানে সম্মানিত করেন। কয়েস আলি সম্মান স্বীকৃতি কোনোটাই পান নি। সমগ্র দেশের পক্ষ থেকে আমি এই লেখার মাধ্যমে তাঁর প্রতি সম্মান জানালাম। (কয়েস আলি নামটি ঠিক না। আসল নাম আমি ভুলে গেছি। কোনো পাঠক মূল নামটি জানালে পরবর্তী সংস্করণে ঠিক করে দেব।) আরেকটি তথ্য যোগ করার লোভ সামলাতে পারছি না। স্বাধীনতা যুদ্ধে খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা গ্রন্থে মোঃ আব্দুল হান্নান লিখছেন– যুদ্ধকালিন সময়ে মুজিবনগর সরকার মোঃ হেমায়েতউদ্দিনকে সুবেদার পদ প্রদান করেন। এবং তার ডাকনাম দেয়–হিমু।
 
তোমার নাম কী?

আমার নাম মোহাম্মদ আবু তাহের।

নাম বলো।

আমার নাম মোহাম্মদ আবু তাহের।

কেয়া নাম?

আবু তাহের।

Tell me your name.

Sir, my name is Abu Taher.

তোমার নাম কী?

আমার নাম মোহাম্মদ আবু তাহের।

কেয়া নাম?

আবু তাহের।

Tell me your nare.

Sir, my name is Abu Taher.

মোহাম্মদ আবু তাহের সম্পূৰ্ণ নগ্ন অবস্থায় একটা কাঠের চেয়ারে বসে আছে। তার মুখের উপর দুশ পাওয়ারের বাতি জ্বলছে। চোখ বন্ধ করেও তীব্ৰ আলোর হাত থেকে সে বাঁচতে পারছে না। কঠিন এই আলো চোখের পাতা ভেদ করে মাথার ভেতর ঢুকে যাচ্ছে। মস্তিষ্কের গভীরে কোনো এক জায়গায় পিন ফুটানোর মতো যন্ত্রণা হচ্ছে। এই যন্ত্রণার কোনো সীমা পরিসীমা নেই। আবু তাহের মাঝে মধ্যেই ভাবছে, শুধুমাএ বাতি জ্বলিয়ে একজন মানুষকে এত কষ্ট দেয়া যায়!

তার হাত চেয়ারের হাতলের সঙ্গে বাধা, চেয়ারের পায়ের সঙ্গে দুটা পা বাধা। পায়ের বাঁধন এত শক্ত যে দড়ি চামড়া কেটে মাংসে ঢুকে পড়েছে। আশ্চর্য ব্যাপার হচ্ছে, পায়ে কোনো ব্যথা বোধ নেই। আবু তাহেরের মুখ দিয়ে লালা পড়ছে। লালা পড়া শুরু হয়েছে কিছুক্ষণ আগে। তার সামনে মিলিটারি গোয়েন্দা বিভাগের দুজন বসে আছে। দুজনের চেহারাটা তার কাছে একরকম মনে হচ্ছে। গোলাকার ফর্স মুখ। নাকের নিচে হালকা গোফ। আবু তাহেরের পেছনে একজন দাঁড়িয়ে আছে। সেই একজন মাঝে-মধ্যে তার সামনে আসছে। সেই একজনের চেহারাও অন্য দুজনের মতো। তবে সে রোগা। তার মুখে বসন্তের দাগ। এরা কি যমজ ভাই? এক সঙ্গে তিনজনের জন্ম কি হতে পারে?

তোমার নাম কী?

আমার নাম মোহাম্মদ আবু তাহের।

নাম বলো।

আবু তাহের।

কেয়া নাম?

মোহাম্মদ আবু তাহের।

Telt me your name.

Sir, my name is Abu Taher.

তোমার নাম কী?

আমার নাম মোহাম্মদ আবু তাহের।

তারা একই প্রশ্ন করে যাচ্ছে। কতদিন ধরে করছে? একদিন দুদিন নাকি কয়েক বছর হয়ে গেল? তারা কি এই প্রশ্ন করেই যাবে? একই প্রশ্ন বারবার করার পেছনের অর্থ কী? আবু তাহের কিছুক্ষণ আগে চেয়ারে প্রস্রাব করেছে। সেই প্রস্রাব গড়িয়ে গেছে সামনে বসে থাকা দুজনের দিকে। তারা তাকিয়ে দেখেছে। কিন্তু এই বিষয়ে কিছুই বলে নি। তারা কিছুক্ষণ পর পর সিগারেট ধরাচ্ছে। সেই সিগারেটের ধোঁয়ার গন্ধ ভয়াবহ। নাড়ি পাক দিয়ে বমি আসছে।

মোহাম্মদ আবু তাহের?

জি স্যার।

ঢাকা শহরে যেসব মুক্তিবাহিনীর গেরিলারা কাজ করছে।–তাদের কাউকে তুমি চেন?

জি-না স্যার।

কিন্তু তুমি তো মতিঝিলে হাটখোলা শাখার হাবীব ব্যাংক লুটের সময় জড়িত ছিলে। তোমার সঙ্গে আর কে কে ছিল?

স্যার, আমি হাবীব ব্যাংক লুটের সঙ্গে জড়িত ছিলাম না।

তুমি কী করো?

আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ি। ফিজিক্সে M.Sc. থিসিস গ্রুপ।

টিকাটুলি ওয়েল ট্যাংকার হাইজ্যাকে তুমি ছিলে না?

জি-না স্যার।

এখন আমরা তোমার ডান হাতের পাঁচটা আঙুলে পিন ঢুকিয়ে দিব। তুমি যদি অপরাধ স্বীকার করো, তবেই তা বন্ধ করা হবে।

স্যার, মুক্তিবাহিনীর কোনোকিছুর সঙ্গেই আমি জড়িত না।

তোমরা তিনভাই। বাকি দুজন কোথায়?

স্যার, বাকি দুজন কোথায় আমি জানি না।

আমরা যতদূর জানি বাকি দুজন মুক্তিবাহিনীতে যোগ দিয়েছে।

ওদের খবর আমি জানি না। স্যার।

তুমি মুক্তিবাহিনীতে যোগ দাও নাই কেন?

আমি পাকিস্তানে বিশ্বাস করি। ইন্ডিয়া আমাদের শক্র। পাকিস্তান জিন্দাবাদ। কায়দে আজম জিন্দাবাদ। লিয়াকত আলি খান জিন্দাবাদ। মহাকবি ইকবাল জিন্দাবাদ।

গোয়েন্দা বিভাগের দুজন শব্দ করে হেসে উঠল। তাদের একজন হাসতে হাসতে বলল, দাও ওর আঙুলে পিন ফুটিয়ে দাও।

আবু তাহের বিড়বিড় করে বলল, আল্লাহ আমাকে অজ্ঞান করে দাও। আল্লাহপাক আমাকে অজ্ঞান করে দাও। আমাকে অজ্ঞান করে দাও।

কী তীব্র ব্যথা! কী ভয়াবহ যন্ত্রণা! চোখের সামনে হঠাৎ করে আগুনের মতো কী যেন ঝলসে ওঠে। পিন ফুটানোর ব্যথাটা হাতের আঙুলে হয় না। অন্য কোথাও যেন হয়।

স্যার পানি খাব। স্যার পানি খাব।

তোমার নাম কী?

আমার নাম আবু তাহের, স্যার পানি খাব।

ঢাকা মেডিকেল কলেজের চৌরাস্তার ট্রাফিক স্টপে মন্ত্রী মাওলানা মোহাম্মদ ইসহাকের গাড়িতে গ্রেনেড ছোড়া হয়। যারা এই কাজটা করে, তুমি কি তাদের সঙ্গে ছিলে?

সার, পানি খাব।

প্রশ্নের জবাব দাও, তুমি তাদের সঙ্গে ছিলে?

ছিলাম স্যার।

হাবীব ব্যাংক লুটের সময় ছিলে?

ছিলাম স্যার। পানি খাব।

টিকাটুলি অপারেশনে ছিলে?

জি স্যার। এক গ্রাস পানি দেন। পানি খাব।

গেরিলারা কে কোথায় লুকিয়ে থাকে, তুমি জানো?

জানি স্যার।

ওদের দুইজনকে, শুধুমাত্র দুইজনকে ধরিয়ে দিতে পারলে আমরা তোমাকে ছেড়ে দিব। ধরিয়ে দেবে?

জি স্যার। একটু পানি খাব।

আবু তাহেরকে পানি খেতে দেয়া হলো। চোখের উপরের বাতি নিভিয়ে দেয়া হলো। ঘরে এখনো বাতি জ্বলছে। কিন্তু আবু তাহের কিছুই দেখতে পাচ্ছে না। তার কাছে মনে হচ্ছে ঘর অন্ধকার। কবর কি এরকম অন্ধকার হয়?

মোহাম্মদ আবু তাহের।

জি স্যার।

নাও সিগারেট নাও।

আমি সিগারেট খাই না।

না খেলেও সিগারেটে টান দাও। এই অবস্থায় শরীর নিকোটিন পছন্দ করে।
 

Users who are viewing this thread

Back
Top