What's new
Nirjonmela Desi Forum

Talk about the things that matter to you! Wanting to join the rest of our members? Feel free to sign up today and gain full access!

Collected ছোছনা ও জননীর গল্প - উপন্যাস (1 Viewer)

আবু তাহের সিগারেট টানছে। সিগারেট তার বা হাতে ধরা। সে ডান হাত তুলতে পারছে না। তার ডান হাতের প্রতিটি আঙুলে পিন ফুটানো হয়েছে। মধ্যমা আঙুলের পিন ঠিকমতো ফুটে নি। অর্ধেক বের হয়ে আছে। একবার তার কাছে মনে হলো, এরকম কিছুই ঘটে নি। সে ভয়ঙ্কর কোনো দুঃস্বপ্ন দেখছে। তার বোঝায় ধরা রোগ হয়েছে। বোঝায় ধরার আগে আগে সে এরকম দুঃস্বপ্ন দেখে। ঘুম ভাঙলেই দেখা যাবে সব ঠিক আছে।

মোহাম্মদ আবু তাহের?

জি।

অনেকে শাস্তির হাত থেকে বাচার জন্যে সব অপরাধ স্বীকার করে। তাদেরকে যখন বলা হয়–মুক্তি যেখানে থাকে সেখানে নিয়ে চল— তখন তারা কোথাও নিয়ে যেতে পারে না। কাউকে ধরিয়েও দিতে পারে না। তারা আমাদের সময় নষ্ট করে। তুমি বলে আমাদের সময় নষ্ট করা কি উচিত?

জি-না।

তুমি আমাদের সময় নষ্ট করছ না তো?

জি-না।

কাউকে যদি ধরিয়ে দিতে না পোর, তাহলে আমরা তোমাকে মজার একটা শাস্তি দেব। শাস্তির ইংরেজি নাম Castration. তোমার দুটা অণ্ডকোষ কেটে ফেলে দেব। খোঁজা বানিয়ে দেব। খোঁজা কী চেন?

চিনি।

পূর্ব পাকিস্তানের প্রতিটা পুরুষকে খোজা বানিয়ে দিতে পারলে হতো; একটা নতুন জাতি তৈরি হতো। নপুংসক জাতি। ভালো হতো না?

জি স্যার। ভালো হতো।

এক ঘণ্টার মধ্যে আমরা তোমাকে নিয়ে বের হব। তুমি বাড়িগুলি চিনিয়ে দেবে। তোমার হাত থেকে আমরা পিন সরাব না। যে রকম আছে, সে রকমই থাকবে। ঠিক আছে?

জি স্যার।

তোমার একটা আঙুলের পিন দেখছি ঠিকমতো ঢোকানো হয় নি। ঢুকিয়ে দেই?

দিন স্যার।

আচ্ছা এখন থাক। আমরা ভ্ৰমণ শেষ করে কাজটা করব।

জি আচ্ছা স্যার।

ভ্ৰমণে যাবার আগে কিছু কি খাবে? এক পিস কেক। এক কাপ চা।

খাব স্যার।

কাজটা সেরে এসে খাই? প্ৰথমে কাজ তারপর খাদ্য। সেটা ভালো না?

জি স্যার ভালো। খুব ভালো।



গাঢ় নীল রঙের একটা টয়োটা গাড়ি নগরীর বিভিন্ন এলাকায় ঘুরছে। গাড়ির কাচ এমন যে, ভেতবের আরোহীদের বাইরে থেকে দেখা যাচ্ছে না। কিন্তু গাড়ির ভেতরের মানুষরা বাইরে কী হচ্ছে দেখতে পাচ্ছে। পেছনের সিটে আবু তাহের বসে আছে। তার শায়ে কম্বল জড়ানো। আবু তাহেরের মুখ দিয়ে এখনো লালা পড়ছে। প্রচণ্ড জ্বর এসেছে। কিছুক্ষণ পরপর শরীর কেঁপে কেঁপে উঠছে। আবু তাহেবের দুপাশে দুজন। আবু তাহের বাড়ি দেখিয়ে দিচ্ছে, এই দুজন নোট নিচ্ছে। বাড়ি দেখানোর কাজটা আবু তাহের করছে কিছুই না জেনে। মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে তার কোনোই যোগ নেই। তারা কে কোথায় থাকে সে কিছুই জানে না।

স্যার, এই বাড়ি।

এটা তো দোতলা বাড়ি। দোতলা বাড়ির কোন তলা?

সেটা বলতে পারছি না। স্যার।

ভালো করে দেখে বলো, এই বাড়ি?

জি স্যার।

এখন কোন দিকে যাব?

পুরানা পল্টন।

পুরানা পল্টন?

জি স্যার।

পুরানা পল্টনে যে থাকে তার নাম কী?

নাম জানি না স্যার। রাতে এই বাড়িতে এসে ঘুমায়।

একা ঘুমায় নাকি আরো লোকজন থাকে?

সেটা বলতে পারছি না স্যার। আবু তাহের ঢাকা নগরের বিভিন্ন এলাকায় পাঁচটি বাড়ি দেখিয়ে দিল। সেই রাতেই পাঁচটি বাড়ি থেকে নয়জনকে মিলিটারি ধরে নিয়ে গেল। তাদের কেউই জীবিত ফিরে এলো না। এই নয়জনের কেউই মুক্তিবাহিনীর বিষয়ে কিছুই জানত না।

এই নয়জন আরো কিছু মানুষের নাম বলল। অদ্ভুত এক চেইন রিঅ্যাকশন। তরুণ যুবকরা ধরা পড়ছে। কেন ধরা পড়ছে তারা জানে না। কোনো একজনের নাম বলে দিলে অত্যাচারের হাত থেকে বাচার সম্ভাবনা। তারা নাম বলছে। বাড়িঘর দেখিয়ে দিচ্ছে।

সেই সময় দুস্কৃতিকারী ধরার জন্যে পুরস্কারও ঘোষণা করা হয়েছিল। পুরস্কারের লোভে যদি কেউ এগিয়ে আসে। জেলা প্রশাসকরা যে-কোনো মুক্তিযোদ্ধাকে ধরিয়ে দিতে পারলে এক হাজার টাকা পুরস্কার দিতে পারতেন।*

ক. সাধারণ দুস্কৃতিকারী বিষয়ে খবর দেয়ার জন্যে ৫০০ টাকা।

খ. ভারতের ট্রেনিংপ্রাপ্ত দুস্কৃতিকারীর বিষয়ে খবর দেয়ার জন্যে ৭৫০ টাকা।

গ. আগ্নেয়াস্ত্রসহ গ্রেফতারের জন্যে ১,০০০ টাকা।

ঘ. দুস্কৃতিকারী দলের নেতা গ্রেফতারের জন্যে ২,০০০ টাকা।

ঙ. অন্ত্রশস্ত্রসহ দুস্কৃতি দলের নেতা গ্রেফতারের জন্যে ১০,০০০ টাকা।

————–

*সূত্র : দৈনিক পাকিস্তান
 
জওহরলাল নেহেরুর একমাত্র কন্যা ইন্দিরা গান্ধীকে তাঁর দেশের মানুষ শ্ৰদ্ধা ও ভালোবাসার সঙ্গে ডাকে ইন্দিরাজি।

ইন্দিরাজী কোলকাতা বিগ্রেড প্যারেড গ্রাউন্ডে বক্তৃতা দেবেন। তারিখ ডিসেম্বর তিন। তাঁর আসার কথা ছিল চার তারিখে, তিনি একদিন আগেই চলে এসেছেন। এর কোনো বিশেষ তাৎপর্য কি আছে? আজই কি সেই দিন? সেই মাহেন্দ্ৰক্ষণ? আজই কি বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়া হবে? হিন্দুস্থান সেনাবাহিনী মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্যে সরাসরি নেমে পড়বে। স্বাধীন হবে বাংলাদেশ। এক কোটি শরণার্থ যারা অন্য এক দেশে, অচেনা পরিবেশে অবর্ণনীয় দুঃখে। জীবনযাপন করছে তারা ফিরে যাবে নিজ বাসভূমে।

বিগ্রেড প্যারেড গ্রাউন্ড লোকে লোকারণ্য। উদগ্ৰীব মানুষের সমুদ্র। বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়ার বিশেষ ভাষণ সবাই শুনতে চায়।

ইন্দিরাজী ভাষণ শুরু করলেন। শান্ত গলায় প্রায় উত্তেজনাহীন বক্তৃতা। তিনি নতুন কিছু বললেন না। শরণার্থীদের দুঃখ-দুৰ্দশার কথা বললেন। বিদেশী শক্তিদের আবারো আহ্বান করলেন সমস্যা সমাধানে ভূমিকা রাখার জন্যে। বক্তৃতা শেষ হয়ে গেল। তবে বক্তৃতা চলাকালিন সময়ে তিনি একটা ছোট্ট চিরকুট পেলেন। চিরকুট দেখে কয়েক মুহূর্তের জন্যে তাঁর ভুরু কুঁচকে গেল। চোখের দৃষ্টি হলো তীব্র। তাৎক্ষণিকভাবে নিজেকে সামলে নিয়ে যেন কিছুই হয় নি এমন ভঙ্গিতে বক্তৃতা শেষ করলেন।

চিরকুটে লেখা ছিল— পাকিস্তান বিমানবাহিনী হঠাৎ করে অমৃতসর, পাঠানকোট, শ্ৰীনগর, অবন্তিপুর, যোধুপুর, আম্বালা এবং আগ্ৰায় বোমা বর্ষণ করেছে। পাঞ্জাব সীমান্তে পাকিস্তান স্থলবাহিনী যুদ্ধ শুরু করেছে। তারা ভারতের ভেতরেও কিছুদূর ঢুকে পড়েছে।

ইন্দিরা গান্ধী দিল্লি ফিরে গেলেন। ডিসেম্বরের চার তারিখ মধ্যরাতে আকাশবাণী দিল্লি কেন্দ্র থেকে তিনি বাংলাদেশের মানুষদের বহু প্ৰতীক্ষিত বিশেষ ঘোষণাটা দিলেন। এই ঘোষণায় বাংলাদেশের স্বীকৃতি ছিল না, কিন্তু বোঝা যাচ্ছিল সেই স্বীকৃতি আসার পথ তৈরি হচ্ছে

Today the war in Bangladesh has become a war on india…

Aggression must be met and the people of india will meet it with fortitude and determination and with discipline and atmost unity.

ইন্দিরা গান্ধীর ঘোষণার জবাবে ইয়াহিয়া খান আনুষ্ঠানিক যুদ্ধ ঘোষণা করলেন। ডিসেম্বরের চার তারিখ সকালে। তিনি রেডিও ভাষণে বললেন,

Our enemy has once again challenged us…. March forward. Give the hardest blow of Allah ho Akbar to the enemy.

ইয়াহিয়া খানের যুদ্ধ ঘোষণার জবাবে ইন্দিরা গান্ধী লোকসভায় বললেন, আমি ভোরবেলায় খবর পেয়েছি পাকিস্তান আমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে। আমরা তৈরি আছি।

কিসিং কনটেম্পরারি আর্কাইভসের সেই সময়ের বিবরণ। এইভাবে দেয়া–

The tindian Army, linking up with the Mukti Bahini entered East Pakistan On Dec. 4 from five main direction, (1) in the Comilla Sector, east of Dacca; (2) In the Sylhet Sector, in the north-east of the province (3) in the Mymensingh Sector, in the North (4) in the Rangpur Dinajpur Sector, in the north west; (5) in the Jessore Sector, south west of Dacca….

শুরু হয়ে গেল অদ্ভুত এক আন্তর্জাতিক দাবা খেলা।

শক্তিমান দেশগুলি মেতে গেল নিজেদের অবস্থান এবং শক্তি পরীক্ষায়।
 
ডিসেম্বরের পাঁচ তারিখে মার্কিন সরকারের উদ্যোগে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের অধিবেশন বসল। যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব আনলেন মার্কিন প্রতিনিধি জর্জ বুশ।* মার্কিন প্রস্তাবের পক্ষে এগারোটা ভোট পড়ে। গ্রেট ব্রিটেন ও ফ্রান্স ভোটদানে অংশগ্রহণ করে নি। সোভিয়েত ইউনিয়ন মার্কিন প্ৰস্তাবের বিপক্ষে সরাসরি ভেটো প্রয়োগ করে প্রস্তাব বাতিল করে দেয়। সোভিয়েত প্ৰতিনিধি কমরেড জ্যাকভ মালিক বলেন, আপনারা কেউ কি পরিস্থিতি বুঝতে পারছেন না? জাতিসংঘের ৮৮টি দেশের কোনোটির জনসংখ্যা এক কোটির বেশ না অথচ পূর্ব পাকিস্তান থেকে এক কোটির বেশি শরণার্থী ভারতে আশ্রয় নিয়েছে।

রেডিও পিকিং থেকে বলা হলো, চীন পাকিস্তানকে সবরকম সাহায্য দেবে। ভারতীয় বাহিনীকে পরাজয়ের তিক্ত স্বাদ গ্রহণ করতে হবে।

চীন যাতে লাদাক সীমান্ত দিয়ে সরাসরি ভারতে ঢুকে না পড়তে পারে, সেই ব্যবস্থা নিতে এগিয়ে এলো রাশিয়া। রাশিয়া, চীন-রাশিয়া সীমান্তে দশ লক্ষ সৈন্য মোতায়েন করল।

মার্কিন প্রেসিডেন্ট-রিচার্ড নিক্সন সাংবাদিকদের কাছে বললেন, ভারত যা করছে তার নাম সরাসরি যুদ্ধের মাধ্যমে একটি স্বাধীন দেশের অংশ দখল করার অশুভ পায়তারা।

মার্কিন সরকারের সপ্তম নৌবহর তখনো ছিল উত্তর ভিয়েতনামের কাছে। সপ্তম নৌবহরকে বাংলাদেশের দিকে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিল। সপ্তম নৌবহর রওনা হলো বঙ্গোপসাগরের দিকে। সপ্তম নৌবহরে ছিল পরমাণু শক্তি চালিত বোমারু বিমান বহনকারী বিশাল জাহাজ এন্টারপ্রাইজ, একটি এমফিবিয়াস এসল্ট শিপ, একটি গাইডেড মিজাইল ফ্রিগেট, চারটি গাইডেড মিজাইল ডেসট্রিয়ার এবং একটি ল্যান্ডিং ক্রাফট।

এর জবাবে রাশিয়া বিশটি সোভিয়েত রণতরীকে ভারত সাগবে নিয়ে এলো। একটি ক্ষেপণাস্ত্রবাহী রাশিয়ান ফ্রিগ্রেট এবং ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপে সক্ষম পরমাণু চালিত একটি সোভিয়েট ড়ুবোজাহাজও বঙ্গোপসাগরে উপস্থিত হবার জন্যে রওনা হলো।

হতভম্ব নিয়াজীকে গুল হাসান খান টেলিফোন করে পশতু ভাষায় জানালেন, নার্ভাস হবার কিছু নেই। মনে সাহস রাখ, হলুদ এবং সাদা জাতি উত্তর ও দক্ষিণ উভয় দিক দিয়ে আসছে।

ইয়াহিয়া খানও টেলিফোনে যোগাযোগ করলেন, যে-কোনো মুহুর্তে বিদেশী সাহায্য আসবে। যে-কোনো মূহুর্তে।

সাহায্য কীভাবে আসবে?

কীভাবে সাহায্য আসবে সে ব্যাখ্যা করা যাচ্ছে না, তবে বিদেশী সাহায্য আসবে। এই খবরে কোনো ভুল নেই। অতি গোপন খবর এবং আসল খবর। যে-কোনো ভাবেই হোক ঢাকার পতন যেন না হয়। ঢাকা ধরে রাখা। শুধু ঢাকা। সাহায্য আসবে, কঠিন সাহায্য।



গভর্নর হাউসে মিটিং বসেছে। পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর ড. মালিকের মাথায় (ড, আব্দুল মোত্তালেব মালিক) সাদা টুপি। তিনি এইমাত্র নামাজ শেষ করেছেন। তাঁর চোখে-মুখে দিশাহারা ভাব। জেনারেল নিয়াজীকে বেশ হাসিখুশি দেখাচ্ছে। মিটিং-এ আরো উপস্থিত আছেন, রাও ফরমান আলি (গভর্নরের সামরিক উপদেষ্টা), জেনারেল জামশেদ। জেনারেল জামশেদকে অসম্ভব চিন্তিত দেখাচ্ছে। তবে রাও ফরমান আলির মুখমণ্ডল ভাবলেশশূন্য। তাঁকে দেখে মনে হচ্ছে, আশেপাশে কী হচ্ছে না হচ্ছে তার সঙ্গে তিনি নিজেকে সম্পৃক্ত করছেন না।

ড. মালিক খাকাড়ি দিয়ে গলা পরিষ্কার করে মিনমিনে স্বরে বললেন, আমাদের অবস্থাটা কী?

নিয়াজী বললেন, অবস্থা ভালো। কাপুরুষ হিন্দুবাহিনী ঢাকায় আসার চেষ্টা করছে। তাদের আগমন শিক্ষাসফরের মতো। পদে পদে শিক্ষা পেয়ে তারা এগুচ্ছে।

ড. মালিক বললেন, মূল অবস্থাটা কী জানতে পারি?

জেনারেল জামশেদ বললেন, মূল অবস্থা আপনার জানার প্রয়োজন নেই। যুদ্ধ কী হচ্ছে কেমন হচ্ছে তা দেখার দায়িত্ব গভর্নরের না। তিনি বেসামরিক বিষয় দেখবেন। জাতীয় পরিষদের সাধারণ অধিবেশনে যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব এসেছে, আপনি সেই বিষয় নিয়ে ভাবুন।

ড. মালিক আগের চেয়েও ক্ষীণ গলায় বললেন, আমার মাথায় অন্য পরিকল্পনা ছিল।

রাও ফরমান আলি তীব্ৰ গলায় বললেন, কী পরিকল্পনা?

ড. মালিক থতমত খেয়ে গেলেন। কিছু বলতে পারলেন না। ফরমান আলি বললেন, দাবা খেলা এখন শেষপর্যায়ে চলে এসেছে। এখন আমরা মিডল গেম পার হয়ে এন্ড গেমে এসেছি। এন্ড গেম চট করে শেষ হয় না। চলতেই থাকে। চলতেই থাকে। এই খেলাও চলতে থাকবে। ইন্ডিয়া-পাকিস্তান কেউ জয়ী হবে না। স্টিলমেট অবস্থা হবে। তখন বিদেশী রাষ্ট্রগুলির মধ্যস্থতায় একধরনের সমঝোতা হবে।

ড. মালিক বললেন, এই বিষয়ে কি আপনি নিশ্চিত?

ফরমান আলি বললেন, অবশ্যই। একজন পূর্ব পাকিস্তানি নুরুল আমিনকে প্রধানমন্ত্রী এবং জুলফিকার আলী ভুট্টোকে উপপ্ৰধানমন্ত্রী করে কোয়ালিশন সরকার গঠন করা হয়েছে। আপনি কি এর মধ্যে কোনো ইঙ্গিতে দেখতে পারছেন না? এই কোয়ালিশন সরকার আলাদা আলোচনার মাধ্যমেই গঠন করা হয়েছে। এমনও হতে পারে যে, ইন্দিরা গান্ধীর পরামর্শেই এই সরকার গঠন করা হয়েছে। ড. মালিক বললেন, ইন্ডিয়ান সৈন্যরা যেভাবে এগিয়ে আসছে তাতে মনে হয়, অতি দ্রুত তারা ঢাকায় ঢুকে পড়বে।

জেনারেল নিয়াজী বললেন, ঢাকায় ঢুকতে তাদের খুব কম করে ধরলেও পাঁচ বছর লাগবে। ইন্ডিয়ানরা কাপুরুষ। আমাদের গোলাগুলির ভেতর দিয়ে এরা ঢাকায় কিছুতেই ঢুকবে না। ইন্ডিয়ানরা কেন কাপুরুষ সেই গল্প শুনতে চান?

কেউ জবাব দিল না। তাদের ভাবভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে তারা এই মুহুর্তে গল্প শোনায় আগ্রহী না। নিয়াজীর উৎসাহে তাতে ভাটা পড়ল না। তিনি গল্প শুরু করলেন–পুরুষদের কাপুরুষতার অংশটা থাকে তাদের নুনুর আগায়। আমরা তা কেটে ফেলে দেই বলে আমরা সাহসী। ওরা তা ফেলে না বলে ওরা কাপুরুষ। হা…হা…হা…।

জেনারেল গলা ফাটিয়ে হাসছেন। সেই হাসি অন্য কারো মুখে সংক্রামিত হচ্ছে না। সাইরেনের শব্দ হচ্ছে। আবারো বিমান আক্রমণ হবে। অতি দ্রুত সবাই স্থান ত্যাগ করলেন। ইন্ডিয়ান বিমানবাহিনী বড় যন্ত্রণা করছে।
 
গভীর রাত। টাঙ্গাইলে পাকবাহিনীর অধিনায়ক বিগ্রেডিয়ার কাদির খান অবস্থান করছেন এলেঙ্গায়। কয়েকটি দুঃসহ রাত তিনি নির্মুম পার করেছেন। এখন আর শরীর টানছে না। মন অবসন্ন। একের পর এক ভয়াবহ দুঃসংবাদ আসছে। নিয়তির কী অপূর্ব রসিকতা! টাঙ্গাইল এলাকার মুক্তিবাহিনীর সর্বাধিনায়কের নামও কাদের। কাদের সিদ্দিকী। কাদির খান এখন প্রায়ই দুঃস্বপ্ন দেখেনতিনি বন্দি হয়েছেন কাদের সিদ্দিকীর হাতে।

কাদের সিদ্দিকী কি তার সঙ্গে সম্মানসূচক আচরণ করবে? তার মনে হয় না। মুক্তিবাহিনীর কাছে তারা অতি ঘূণ্য প্রাণী। একজন মর্যাদাসম্পন্ন সামরিক বাহিনীর অফিসারের সম্মান এবং মর্যাদার ব্যাপারটা বুঝবেন আরেকজন মর্যাদাসম্পন্ন সামরিক অফিসার। আত্মসমর্পণ যদি করতেই হয়, তাহলে করতে হবে ইন্ডিয়ানদের কাছেই। তিনি কী করবেন? তার কী করা উচিত?

উপর থেকে অস্পষ্ট সব নির্দেশ আসছে। একবার বলা হলো, নিজের অবস্থানে শক্ত হয়ে বসে থাকে। তারপর বলা হলো, পশ্চাদ অপসারণ করে ঢাকায় চলে এসো। ঢাকা রক্ষা করতে হবে। এখন ঢাকা রক্ষা মানেই পূর্ব পাকিস্তান রক্ষা।

তিনি ঢাকায় কীভাবে যাবেন? ঢাকা যাবার কোনো উপায় নেই। প্রতিটি ব্রিজ মুক্তিবাহিনী ভেঙে ফেলেছে। এতে অবশ্যি একটা সুবিধা হয়েছে, ইন্ডিয়ান সেনাবাহিনীও ঢাকায় যেতে পারছে না। তাদেরকেও পায়ে হেঁটে যেতে হবে।

ব্রিগেডিয়ার কাদির খান ডিনার করতে বসলেন রাত দুটায়। কয়েকটা শুকনা রুটি, এক বাটি ঠাণ্ডা গরুর মাংস। সেই মাংস সিদ্ধ হয় নি। পাথরের মতো শক্ত। সময় যখন খারাপ হয়, তখন সবদিক থেকেই খারাপ হয়। রসুইখানায় রান্না হয় নি। রসদের সমস্যা কিংবা অন্যকিছু হবে। তিনি এই নিয়ে ভাবতে চান না। এখন তাঁর একমাত্ৰ চিন্তা–কীভাবে কোন পথে ঢাকায় পৌঁছানো যায়? এবং কত দ্রুত পৌঁছানো যায়।

কাদির খান মাংস ছাড়াই রুটি মুখে দিলেন, আর তখন তার কাছে একটা সুসংবাদ এলো। এত বড় সুসংবাদ তিনি তার দীর্ঘজীবনে পান নি। বিদেশী সাহায্য চলে এসেছে। ঝাঁকে ঝাঁকে চাইনিজ প্যারটুপার নামছে। টাঙ্গাইলে নামছে।

ব্রিগেডিয়ার কাদির খান বললেন, আলহামদুলিল্লাহ। শেষপর্যন্ত তাহলে তাদের দেখা পাওয়া গেল?

সংখ্যায় কত?

অসংখ্য। শুধু নামছেই।

আমার তরফ থেকে তাদের অভ্যর্থনার ব্যবস্থা করে। তাদের পরিকল্পনা কী আমার জানা দরকার। আমার ধারণা তারা ইচ্ছা করে টাঙ্গাইল নেমেছে, যাতে শুরুতেই কাদের সিদ্দিকীকে শায়েস্তা করতে পারে।

হতে পারে স্যার।

হতে পারে না, এটাই সত্য। হেড কোয়ার্টারের সঙ্গে যোগাযোগ করে চাইনিজ প্যারাষ্ট্ৰপার নামার সুসংবাদ দাও। এবং যে-কোনো ভাবেই হোক তাদের সঙ্গে আমার যোগাযোগের ব্যবস্থা কর।

কাদির খান অতি তৃপ্তির সঙ্গে ডিনার শেষ করলেন। মদ্যপানের মতো মানসিক অবস্থা তার এই কদিন ছিল না। আজ এক বোতল রাম নিজে একা শেষ করলেন।

চাইনিজ প্যারাষ্ট্ৰপারদের অভ্যর্থনা জানাতে এগিয়ে যাওয়া কাদির খানের বাহিনীর সবাই মারা পড়ল, কারণ এরা চাইনিজ প্যারাষ্ট্ৰপার ছিল না। এরা ছিল ইন্ডিয়ান প্যারাট্র্যপার।

ভাগ্যের পরিহাস টাঙ্গাইল পাকবাহিনীর সেক্টর অধিনায়ক ব্রিগেডিয়ার কাদির খান ধরা পড়েন। কাদের সিদ্দিকীর হাতেই। তখন তার সঙ্গে ছিলেন দুজন কর্নেল, তিনজন মেজর এবং একজন লেফটেনেন্ট। তার সব সৈন্য কালিহাতি এলেঙ্গায় ধ্বংস হয়ে গেছে। এই কজনই শুধু জীবন নিয়ে পালাবার চেষ্টা করছিল।

কাদের সিদ্দিকী ব্রিগেডিয়ার কাদির খানের প্রতি কোনো অসৌজন্যমূলক আচরণ করেন নি। তিনি বন্দিকে ইন্ডিয়ান সেনাবাহিনীর হাতে তুলে দেন।
 
ডিসেম্বরের ছয় তারিখ। ভারত স্বাধীন সার্বভৌম দেশ হিসেবে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়েছে। মুক্তিবাহিনী-ভারতীয় বাহিনী এগিয়ে যাচ্ছে ঢাকার দিকে। ঢাকার বাইরের পাকিস্তানি ঘাঁটিগুলি একে একে তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়ছে; বাংলাদেশের আকাশে ভারতীয় বিমানবাহিনীর একচ্ছত্র আধিপত্য।

শরণার্থী শিবিরেব মানুষরা অস্থির হয়ে পড়েছেন দেশে ফেরার জন্যে; দুই পক্ষের ভয়াবহ গোলাগুলির মধ্যেই তারা দেশে ঢুকতে শুরু করেছেন। স্বাধীন হবার আনন্দ তারা নিজ দেশে বসে পেতে চান।

এমনই এক অস্থির সময়ে (সন্ধ্যার ঠিক পর পর) শাহেদকে বারাসতের গ্রামের একটি বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে থাকলে দেখা গেল। তার হাতে নাইমুলের দেযা ঠিকানা। সে অনেক কষ্টে এই পর্যন্ত এসেছে। কাগজে লেখা ঠিকানা শেষ পর্যন্ত খুঁজে বের করেছে। এখন আর তার সাহসে কুলাচ্ছে না; বাড়ির দরজায় ধাক্কা দিয়ে সে যে জানতে চাইবে–এখানে আসমানী নামের কেউ আছে, এই সহজ কাজটা কালতে পারছে না। তার মনে হচ্ছে তাকে বলা হবে, না। এই নামে তো কেউ থাকে না,। কিংবা বলা হবে–হ্যাঁ এই নামে একটি মেয়ে ছিল, তারা এখন নেই। কোথায় আছে তাও বলতে পারছি না।

হঠাৎ শাহেদের মনে হলো, তার কৃষ্ণা পেয়েছে। তৃষ্ণায় বুক ফেটে যাচ্ছে। আসমানীর খোঁজ না করে তার এখন উচিত ঠাণ্ডা এক গ্লাস পানি খেতে চাওয়া।

দরজার কড়া নাড়তে হলো না, দরজা খুলে গেল। এক সৌম্যদর্শন বৃদ্ধ বিস্মিত ভঙ্গিতে এগিয়ে এলেন। শাহেদকে বললেন, কাকে চান?

শাহেদ আমতা আমতা করে বলল, পানি খাব, এক গ্রাস পানি খাব। আসুন ভেতরে এসে বসুন। জল এনে দিচ্ছি। শাহেদ বিড়বিড় করে বলল, এই বাড়িতে কি আসমানী নামের কেউ থাকে? আর একটি ছোট্ট মেয়ে রুনি।

আপনি তাদেব কে হন?

রুনি আমার মেয়ে।

শাহেদের শরীর কাঁপছে। মনে হচ্ছে এক্ষুনি সে মাথা ঘুরে পড়ে যাবে। বৃদ্ধ এগিয়ে এসে শাহেদের হাত ধরলেন। কোমল গলায় বললেন, আপনার স্ত্রী এবং কন্যা আমার এখানেই আছে। তারা ভালো আছে। আসমানী বাড়ির পেছনে পুকুর ঘাটে আছে। মেয়েটা বেশিরভাগ সময় সেখানেই থাকে। আপনি কি আগে তার কাছে যাবেন, না জল খাবেন?

শাহেদ বিড়বিড় করে বলল, পুকুরঘাট কোন দিকে?

বৃদ্ধ ঘাট দেখিয়ে দিলেন। শাহেদ এলোমেলো পা ফেলে এগুচ্ছে। সে নিশ্চিত ঘাট পর্যন্ত যেতে পারবে না। তার আগেই মাথা ঘুরে পড়ে যাবে। এখন সে নিঃশ্বাসও নিতে পারছে না। তার শ্বাসকষ্ট হচ্ছে।



তারো কিছুক্ষণ পরে রুনি মায়ের খোঁজে পুকুরঘাটে এসে একটা অদ্ভুত দৃশ্য দেখল। মা অচেনা অজানা দাড়ি গোফওয়ালা এক লোককে জড়িয়ে ধরে পাগলের মতো চুমু খাচ্ছে। কী ভয়ঙ্কর লজ্জার ব্যাপার!

রুনি তীক্ষ্ণ গলায় বলল, এসব কী হচ্ছে মা? কী হচ্ছে এসব?
 
ভারতীয় সেনাবাহিনীর চিফ অব স্টাফ জেনারেল স্যাম মানেক শ’র আহ্বান ভারতীয় বেতারে ক্রমাগত প্রচারিত হচ্ছে–

আমার সৈন্যরা এখন ঢাকাকে ঘিরে ধরেছে এবং ঢাকার সেনানিবাস কামানের গোলার পাল্লার মধ্যে। আত্মসমৰ্পণ করুন। নিরাপত্তা ও ন্যায়সঙ্গত ব্যবহার করা হবে।

আমার সৈন্যরা এখন ঢাকাকে ঘিরে ধরেছে এবং ঢাকার সেনানিবাস কামানের গোলার পাল্লার মধ্যে। আত্মসমপণ করুন। নিরাপত্তা ও ন্যায়সঙ্গত ব্যবহার করা হবে।

আমার সৈন্যরা এখন ঢাকাকে ঘিরে ধরেছে এবং ঢাকার সেনানিবাস কামানের গোলার পাল্লার মধ্যে। আত্মসমৰ্পণ করুন। নিরাপত্তা ও ন্যায়সঙ্গত ব্যবহার করা হবে।

আমার সৈন্যরা এখন ঢাকাকে ঘিরে ধরেছে এবং ঢাকার সেনানিবাস কামানের গোলার পাল্লার মধ্যে! আত্মসমৰ্পণ করুন। নিরাপত্তা ও ন্যায়সঙ্গত ব্যবহার করা হবে।

আমার সৈনারা এখন ঢাকাকে ঘিরে ধরেছে এবং ঢাকার সেনানিবাস কামানের গোলার পাল্লার মধ্যে। আত্মসমৰ্পণ করুন। নিরাপত্তা ও ন্যায়সঙ্গ ত ব্যবহার করা হবে।


--------

চৌদ্দই ডিসেম্বর ভোরবেলা মরিয়মের ঘুম ভাঙল একটা অদ্ভুত স্বপ্ন দেখে। কে যেন দরজার কড়া নাড়ছে। কড়া নাড়ার শব্দে একধরনের অস্থিরতা। মরিয়ম বলল, কে? দরজার ওপাশ থেকে ভারী গম্ভীর গলা শোনা গেল, মরি, দরজা খোল। ঘুমের মধ্যেই মরিয়মের শরীর কঁািপতে লাগল। চলে এসেছে, মানুষটা চলে এসেছে! সে তার কথা রেখেছে। সে বলেছিল দেশ যেদিন স্বাধীন হবে সেদিন আসবে। দেশ তো স্বাধীন হবেই। মনে হয় আজই হবে। মরিয়ম সাবধানে বিছানা থেকে নামল। সবাই গভীর ঘুমে। সে শুধু জেগেছে। ভালো হয়েছে। খুব ভালো হয়েছে। মানুষটার সঙ্গে যখন তার দেখা হবে, তখন আশেপাশে কারো না থাকাই ভালো। স্বপ্ন হঠাৎ সামান্য পরিবর্তিত হলো। সে ফিরে গেল পুরনো বাড়িতে। শোবার ঘরের দরজা খুলেই সে দেখল তার বাবাকে। দীর্ঘদিন তার কোনো খোঁজ নেই, অথচ স্বপ্নে সে ব্যাপারটা মনে থাকল না।

মোবারক হোসেন মেয়েকে দেখে হাসিমুখে বললেন, নাইমুল এসে কখন থেকে দরজা ধাক্কাচ্ছে, তুই দরজা খুলছিস না কেন? কী রকম ঘুম ঘুমাস! মেয়েছেলের নিদ্রা হবে পাখির পালকের মতো। যা দরজা খোল। মরিয়ম সিঁড়ির দিকে দৌড় দিল, তখন মোবারক হোসেন আরেকবার ধমক দিলেন, সেজোগুজে যা। শাড়িটা বদলা। এতদিন পরে জামাই এসে যদি দেখে একটা ফকিরনি বসে আছে, তার ভালো লাগবে? তোর গয়নাগুলি কই? গয়না পর। ভালো শাড়ি যদি না থাকে বিয়ের শাড়িটা পর।

মরিয়ম শাড়ি বদলাল। স্বপ্নে শাড়ি বদলানোটা অতি দ্রুত হলো। হালকা নীল রঙের শাড়ি চোখের নিমিষে হয়ে গেল বিয়ের শাড়ি। গা ভর্তি হয়ে গেল গয়নায়। দেরি হচ্ছে শুধু কাজল দিতে। ঘরে আলো কম বলে চোখ পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে না। দেরি দেখে মোবারক হোসেন মেয়ের বন্ধ দরজায় ধুম ধুম করে কিল দিচ্ছেন। মরিয়মের ঘুম ভাঙল ধুম ধুম শব্দে।

সঙ্গে সঙ্গে তার চোখে পানি এসে গেল। এতক্ষণ যা ঘটেছে সবই স্বপ্ন? কেউ আসে নি? কেউ দরজায় কড়া নেড়ে মারি মরি বলে ডাকে নি? স্বপ্নের বাস্তব অংশ। শুধু একটাই–ধুম ধুম শব্দ। তবে এই শব্দ তার শোবার ঘরের দরজায় হচ্ছে না। অনেক দূরে হচ্ছে। এই শব্দ কামানের শব্দ। ঢাকা শহর মুক্তিবাহিনী ঘিরে ফেলেছে। তাদের সঙ্গে আছে। ইন্ডিয়ান সৈন্য। তারা কামান দাগছে। নাইমুল কি তাদের সঙ্গে আছে? তারা যখন শহরে ঢুকবে, নাইমুল কি থাকবে তাদের সঙ্গে? অবশ্যই থাকবে। মরিয়ম সাবধানে বিছানা থেকে নামল। তার পাশে সবচেয়ে ছোটবোন মাফরুহা শুয়ে আছে। কী যে সুন্দর দেখাচ্ছে তাকে! একেকটা দিন যায় আর মাফরুহা আরো সুন্দর হয়। যে ছেলের সঙ্গে মাফরুহার বিয়ে হবে, সেই ছেলে আদর করে তার স্ত্রীকে কী ডাকবে? মাফ? মাফরুহা থেকে মাফ। নাইমুল যেমন তাকে ডাকে মরি।

বাবা তাদের নাম ঠিকমতো রাখতে পারেন নি। নামগুলি এমন রেখেছেন যে ছোট করে ডাকা যায় না। মাসুমাকে ছোট করলে হয় মা। কোনো স্বামী স্ত্রীকে আদর করে মা ডাকবে?

মরিয়ম ঘর থেকে বের হয়ে রান্নাঘরে ঢুকল। তার নতুন এক অভ্যাস হয়েছে, ঘুম ভাঙলেই সে রান্নাঘরে যায়; দুকাপ চা বানিয়ে চট করে আড়ালে কোথাও চলে যায়। এক কাপ চা সে খায়, আরেক কাপ সামনে রেখে দেয়। এই কাপটা সে রাখে নাইমুলের জন্যে! একধরনের খেলা। সে ঠিক করুল, চায়ের কাপ নিয়ে আজ ছাদে যাবে। আজও নিশ্চয় ইন্ডিয়ান বিমান আসবে। ছোটাছুটি করবে। আকাশে; চা খেতে খেতে বিমানের খেলা দেখতে খুব ভালো লাগবে।

চা নিয়ে ছাদে উঠাব মুখে কলিমউল্লাহর সঙ্গে দেখা। মরিয়ম অবাক হয়ে কলিমউল্লাহর দিকে তাকিয়ে রইল। গতকাল রাতেও লোকটার গালভর্তি দাড়ি ছিল। আজ মুখ পরিষ্কার কী যে অদ্ভুত লাগছে দেখতে!

কলিমউল্লাহ গালে হাত বুলাতে বুলাতে বলল, দাড়িতে উকুন হয়ে গিয়েছিল। বাধ্য হয়ে ফেলে দিয়েছি। চা নিয়ে কোথায় যান, ছাদে? ছাদে যাওয়া ঠিক না, ইন্ডিয়ান বিখন যেখানে সেখানে গুলি করে। সমানে সিভিলিয়ান মেরে শেষ করে দিচ্ছে। পাকিস্তান মিলিটারি যেদিকে আছে, সেদিকে তারা যায় না! সিভিলিয়ান এলাকায় ঘুরাফিরা করে। চা দুই কাপ কেন?

মরিয়ম লজ্জিত গলায় বলল, আমি পরপর দুকাপ চা খাই।

দেখি আমাকে এক কাপ দেন। খালি পেটে চা খাওয়ার অভ্যাস আমার নাই। খাই এক কাপ।

মরিয়ম খুবই অনিচ্ছায় চায়েব কাপ বাড়িয়ে দিল। কলিমউল্লাহ চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে বলল, আমাদের সামনে যে কী ভয়ঙ্কর দিন–সেটা কেউ বুঝতে পারছে না।

ভয়ঙ্কর দিন কেন?

মূল যুদ্ধ এখন শুরু হবে। ঢাকা দখলের যুদ্ধ। পাকিস্তানি মিলিটারি ঢাকা ধরে রাখবে। কিছুতেই ঢাকা ছাড়বে না। তারা তাদের পুরো ফোর্স ঢাকায় নিয়ে এসেছে। এক বছর ঢাকা ধরে রাখার শক্তি তাদের আছে। এই এক বছরে নিগোসিয়েশন হবে। একটা লুজ কনফেডারেশনের মতো হবে। বিদেশী শক্তি সেটাই চায়।

দেশ স্বাধীন হবে না?

আরে না, স্বাধীন হওয়া এত সোজা? অতি জটিল জিনিস। কয়েকটা লক্কর পুরনো বিমান নিয়ে ইন্ডিয়ানরা আকাশে উড়ছে। মানেক শ বলে আরেক লোক দিল্লিতে বসে চিৎকার করছে–সারেন্ডার কর। সারেন্ডার কর। ভাবটা এরকম যে তার মুখের কথায় পাকিস্তান আর্মি অস্ত্র ফেলে দিয়ে কানে ধরে দাড়িয়ে থাকবে। পাকিস্তান আর্মিকানে ধরা আর্মি না। আপা শুনুন, পৃথিবীর সেরা দুটা আর্মির একটা হলো গুর্থ রেজিমেন্ট, আরেকটা হলো পাকিস্তান আর্মি। এই জিনিস ইন্ডিয়ানরা খুব ভালো করে জানে। জানে না। শুধু আমাদের দেশের গামছা মাথার মুক্তিবাহিনী।

মরিয়ম শুকনা গলায় বলল, ও।

কলিমউল্লাহ বলল, আপা চা-টা শেষ করে সবাইকে ডেকে তুলেন। আমাদের কাজ আছে।

কী কাজ?

এই বাড়ি ছেড়ে আপনাদের পুরনো বাড়িতে চলে যাব। আমার কাছে মনে হচ্ছে, আপনাদের পুরনো বাড়িটাই সেফ। দুই-তিন মাস চলার মতো চাল-ডাল কিনতে হবে। ঐ বাড়িতে গিয়েই বাংকার খুঁড়তে হবে। সবচেয়ে ভালো হতো ঢাকা ছেড়ে চলে যেতে পারলে। সেটা সম্ভব না।

মরিয়ম বলল, এই বাড়ি ছেড়ে যাবেন কীভাবে? কারফিউ চলছে।

কার্ফুর মধ্যেই যাব, কোনো সমস্যা নাই। ব্যবস্থা করব। আপনারা জিনিসপত্র গুছায়ে নেন।
 
যে বিশেষ গাড়িটি ঢাকা শহর থেকে বুদ্ধিজীবীদের বিভিন্ন জায়গা থেকে ধরে ধরে নিয়ে যাচ্ছিল–সেই গাড়ি দিয়েই কলিমউল্লাহ তার স্ত্রী এবং শাশুড়ির পরিবারকে তাদের পুরনো বাড়িতে পার করল।

বিকোল তিনটায় এই গাড়ি এসে থামল প্রফেসর ধীরেন্দ্রনাথ রায় চৌধুরীর একতলা বাড়িতে। তিনি তখন খেতে বসেছেন। নিজেই রান্না করেছেন। ভাত ডিমের ভর্তা। অতি সহজ রান্না। ভাতের সঙ্গেই একটা ডিম ছেড়ে দিয়েছিলেন। ডিমের সঙ্গে তিনটা কাঁচামরিচ। ভাতে-ভাতে ডিম সিদ্ধ হয়েছে। কাঁচামরিচ নরম হয়েছে। তিনি ডিমের খোসা ছড়িয়ে কাঁচামরিচ ডাল-ভৰ্তা বানিয়ে ফেলেছেন। ভর্তায় লবণ দেয়া হয়েছে। ঝাঁঝালো সরিষার তেল দেয়া হয়েছে। আধা চামচ। যে জিনিস তৈরি হয়েছে, সেটা এককথায় অমৃত। এখনো মুখে দেন নি। কিন্তু গন্ধ থেকে বোঝা যাচ্ছে। তিনি যখন খেতে বসবেন, তখন দরজার কড়া নড়ল। তিনি দরজা খুলতেই কলিমউল্লাহ এসে তার পা ছুঁয়ে সালাম করল। ধীরেন্দ্রনাথ রায় চৌধুরী হাসিমুখে বললেন, কেমন আছ বাবা? তিনি ধরেই নিলেন সামনে দাঁড়িয়ে থাকা যুবকটি তার ছাত্র। তার বেশিরভাগ ছাত্ৰই অসময়ে আসে।

কলিমউল্লাহ বলল, স্যার, ভালো আছি। আপনি কি আমাকে চিনতে পেরেছেন স্যার?

ধীরেন্দ্রনাথ রায় তাকে চিনতে পারেন নি। (চিনতে পারার কথা না। কলিমউল্লাহকে তিনি আগে কখনো দেখেন নি।) তারপরও হাসিমুখে বললেন, চিনতে পারব না কেন? চিনেছি।

মিথ্যা বলার কারণ হলো তিনি অতীত অভিজ্ঞতায় দেখেছেন, যতবার কোনো ছাত্রকে দেখে তিনি না চেনার কথা বলেছেন, ততবারই তারা ভয়ঙ্কর মনে কষ্ট পেয়েছে। এক ছাত্র তো কেঁদেই ফেলেছিল।

বাবা, তোমার নামটা যেন কী?

কলিমউল্লাহ।

হ্যাঁ, তাই তো। কলিমউল্লাহ, কলিমউল্লাহ। এখন পরিষ্কার মনে পড়েছে। তুমি কি খাওয়া-দাওয়া করেছ?

জি-না স্যার।

এসো, আমার সঙ্গে চারটা ভাত খাও। আয়োজন খুব সামান্য। ভাত ডিম ভর্তা। ঘরে আরো ডিম আছে। তোমাকে ডিম ভেজে দেব। ঘরে এক কৌটা খুব ভালো গাওয়া ঘি ছিল। কোঁটাটা খুঁজে পাচ্ছি না।

কলিমউল্লাহ বলল, স্যার, এখন খেতে পারব না। আপনার কাছে আমি একটা অতি জরুরি কাজে এসেছি।

জরুরি কাজটা কী? মিলিটারির এক কর্নেল সাহেব আপনার সঙ্গে কথা বলতে চান। ধীরেন্দ্রনাথ রায় চৌধুরী বিস্মিত হয়ে বললেন, আমার সঙ্গে মিলিটারির কী কথা?

আমি জানি না। তবে স্যার, আপনার ভয়ের কিছু নাই। আমি সঙ্গে আছি।

ধীরেন্দ্রনাথ রায় বললেন, তুমি আমার কোন ব্যাচের ছাত্র বলো তো?

কথা বলে সময় নষ্ট করতে পারব না স্যার। মিটিংটা শেষ করে আসি, তারপর আপনার সঙ্গে গল্প করব।

দুইটা মিনিট অপেক্ষা কর, ভাত খেয়ে নেই। খুবই ক্ষুধার্তা। সকালে নাশতা করি নাই।

ভাত খাবার জন্যে অপেক্ষা করার সময় নাই স্যার।

তাহলে দাঁড়াও, পাঞ্জাবিটা গায়ে দিয়ে আসি। আমার সঙ্গে কী কথা বুঝলাম না। সে আমার ছাত্র না তো? করাচি ইউনিভার্সিটিতে আমি দুই বছর মাস্টারি করেছি। প্রফেসর সালাম সাহেব সেখানে আমার কলিগ ছিলেন।

কলিমউল্লাহ বলল, আপনার ছাত্র হবার সম্ভাবনা আছে। কর্নেল সাহেব যেভাবে বললেন, স্যারকে একটু নিয়ে আসে–তাতে মনে হচ্ছে উনি আপনার ছাত্র।

ধীরেন্দ্রনাথ রায় গাড়িতে উঠে দেখলেন, গাড়িভর্তি মানুষ। তারা সবাই চিন্তায় অস্থির। ধীরেন্দ্ৰনাথ রায় তাদের দিকে তাকিয়ে আন্তরিক ভঙ্গিতে হাসলেন। ভুলে তিনি চশমা ফেলে এসেছেন বলে কাউকে চিনতে পাবলেন না। চোখে চশমা থাকলে এঁদের অনেককেই চিনতেন। বাংলাদেশের শ্রেষ্ঠ সন্তানরা গাড়িতে বসে ছিলেন। তাদের নিয়ে যাওয়া হবে বধ্যভূমিতে।
 
কলিমউল্লাহ জোহর সাহেবের ঘরে হাতলবিহীন একটা কাঠের চেয়ারে বসে। আছে। সময় সন্ধ্যা। ঘরে বাতি জুলছে! প্রথমবারের মতো জোহর সাহেবের ঘরের দুটা জানালা খোলা; জোহর সাহেব আগের মতোই গায়ে চাদর জড়িয়ে টেবিলের সঙ্গে লাগোয়া চেয়ারে বসে আছেন। তার সামনে একটা খোলা বই। তাকে দেখে মনে হচ্ছে তিনি গভীর মনোযোগে বই পড়ছেন। ঘরে একশ পাওয়ারের একটা বান্ধ জুলছে। তারপরেও জোহর সাহেব টেবিলে তার বইয়ের সামনে দুটা মোমবাতি জ্বলিয়ে রেখেছেন; খোলা জানোলা দিয়ে মাঝে-মাঝে হওয়া আসছে, তাতে মোমবাতির শিখা কাপছে এবং পতপত শব্দ হচ্ছে। তখনই শুধু জোহর সাহেব বই থেকে মুখ তুলে মোমবাতির দিকে তাকাচ্ছেন।

কলিমউল্লাহ, দৃষ্টি আকর্ষণের জন্যে গলা খাকড়ি দিল। জোহর সাহেব বই থেকে মুখ না তুলেই বললেন, কেমন আছ কলিমউল্লাহ?

কলিমউল্লাহ বলল, ভালো আছি স্যার। আপনার শরীর কেমন?

এই প্রশ্নের জবাব না দিয়ে জোহর সাহেব বললেন, কলিমউল্লাহ, তুমি তো কবি মানুষ। বিলো দেখি আত্মা কী?

কলিমউল্লাহ বলল, জানি না স্যার। জোহর সাহেব বললেন, কোরআন শরীফে আত্মাকে বলা হয়েছে order of god, ভালো কথা, তুমি আল্লাহ বিশ্বাস করা?

কলিমউল্লাহ বিস্মিত হয়ে বলল, এটা কী বলেন স্যার? আল্লাহ বিশ্বাস করব না কেন? পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ সবসময় ঠিকমতো পড়া হয় না, কিন্তু আল্লাহ অবশ্যই বিশ্বাস করি। রোজা ত্ৰিশটা রাখি।

জোহর সাহেব বই থেকে মুখ তুলে কলিমউল্লাহর দিকে ঘুরে তাকিয়ে বললেন, তুমি গত কয়েকদিনে যে ভয়ঙ্কর অন্যায়গুলি করেছ, একজন আল্লাহ বিশ্বাসী মানুষ কি তা করতে পাবে?

প্রশ্ন শুনে কলিমউল্লাহ হতভম্ব হয়ে গেল। মনে মনে বলল, তুই এখন এইগুলা কী বলিস? আমি যা করেছি। তোদের কথামতো করেছি। হাতে যাদের লিষ্টি ধরিয়ে দিয়েছিস, খুঁজে খুঁজে তাদের এনে দিয়েছি। পরে তাদেরকে নিয়ে তোরা কী করেছিস সেটা তোদের ব্যাপাব। পাপ যদি কারো হয় তোদের হবে। জোহর সাহেব বললেন, আত্মা সম্পর্কে এই বইটিতে কী বলা হয়েছে শোন–

The experience of every soul becomes the experience of the divine mind; therefore, the devine mind has the knowledge of all beings.

কলিমউল্লাহ বলল, বইটা কার লেখা স্যার?

একজন সুফির লেখা। সুফির নাম হযরত এনায়েত খান।

কলিমউল্লাহ তার মুখ হাসিহাসি করে রাখল, তবে মনে মনে বলল, শালা বিহারি! এখন সুফি সাধনা করছি। মোমবাতি জ্বালায়ে সাধনা।

জোহর সাহেব বই বন্ধ করতে করতে বললেন, আল্লাহ খোদা, বেহেশতদোযখ এইসব বিষয়ে আমার বিশ্বাস কিছু কম। তারপরেও মাঝে-মাঝে মনে হয়–থাকতেও পারে। যদি থাকে আমি সরাসরি দোযখে যাব।

কলিমউল্লাহ বলল, এটা স্যার আপনি বলতে পারেন না। কে দোযখে যাবে। কে বেহেশতে যাবে–এটা আল্লাহপাক নির্ধারণ করবেন।

জোহর সাহেব দৃঢ় গলায় বললেন, দোযখ যে আমি যাব এই বিষয়ে আমার কোনো সন্দেহ নাই। আমার কোনো আপত্তিও নাই। আপত্তি এক জায়গায়দোযখে তোমার মতো লোকজন আমার সঙ্গে থাকবে, এটাতেই আমার আপত্তি।

কলিমউল্লাহ কী বলবে ভেবে পেল না। সে এসেছিল জোহর সাহেবের কাছ থেকে ভেতরের কিছু খবর বের করতে। তার এখানে আসা ঠিক হয় নি।

কলিমউল্লাহ!

জি স্যার।

তোমার জন্যে বড় একটা দুঃসংবাদ আছে।

কলিমউল্লাহর বুক ছ্যাৎ করে উঠল। কী বলে এই লোক! বড় দুঃসংবাদ মানে কী?

জোহর সাহেব চাদরের নিচ থেকে সিগারেট বের করে মোমবাতির আলোয় সিগারেট ধরালেন। তখন বোঝা গেল। তিনি মোমবাতি জ্বলিয়ে রেখেছেন সিগারেট ধরানোর সুবিধার জন্যে।

কলিমউল্লাহ!

জি স্যার।

দুঃসংবাদটা হচ্ছে–তোমাদের দেশ স্বাধীন হতে যাচ্ছে। ইন্ডিয়ান সেনাবাহিনী এখনো শহরে ঢুকে নাই। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধা ঢুকে পড়েছে।

বলেন কী স্যার!

জোহর সাহেব সিগারেটে লম্বা টান দিয়ে বললেন, আমি যতদূর জানি জেনারেল ইয়াহিয়া খান জেনারেল নিয়াজীকে সম্মানজনক শর্তে আত্মসমর্পণ করতে বলেছেন। ঘটনাটা ঘটতে যাচ্ছে। স্বাধীন দেশের নাগরিক হিসেবে তোমাকে অগ্ৰিম অভিবাদন। আমার অবস্থা দেখা–আমি একজন বিহারি, দেশ নেই এমন এক জাতি।

স্যার, আমি যাই।

যাও। দাড়ি কখন কামিয়েছ? আজ?

জি স্যার। উকুন হয়েছিল।

দাড়ি কেটে ভালো করেছি। বুদ্ধিমানের কাজ করেছ।

কথা শেষ করে তিনি বই পড়ায় মন দিলেন।
 
মরিয়ম বিকাল থেকেই ছাদে। আগে ছাদে যেতে ভয় ভয় লাগত। আজ ভোর থেকে ভয় লাগছে না। সব বাড়ির ছাদেই মানুষ। তারা তাকিয়ে আছে আকাশের দিকে। ইন্ডিয়ান প্লেন বারবার আসছে। নিচু হয়ে উড়ছে। শী করে চলে গেল, আবার ফিরে এলো। কী সুন্দর দৃশ্য! কোনো কোনো বাড়ির ছাদ থেকে চিৎকারও শোনা যাচ্ছে। জয় বাংলা বলে চিৎকার। ঢাকার মানুষদের এখন এত সাহস হয়েছে? জয় বাংলা বলছে! বিশ্বাস হতে চায় না। মনে হয় কোথাও কোনো ভুল হচ্ছে।

সাফিয়া পুত্রকে কোলে নিয়ে ছাদে এলেন। মরিয়মকে দেখে বললেন, বাবুকে একটু কোলে নে। মনে হয় জ্বর আসছে।

মরিয়ম ভাইকে কোলে নিতে নিতে বলল, মা, কিছুক্ষণ ছাদে থাক

সাফিয়া বললেন, ইফতারের সময় হয়ে গেছে, ইফতার করব।

তুমি রোজা?

হুঁ।

কিসের রোজা মা?

দেশ স্বাধীন হবার রোজা।

আমাকে বললে না কেন? আমিও রোজা রাখতাম। মা, দেশ কি সত্যি সত্যি স্বাধীন হচ্ছে?

এইসব তো আমি বুঝি না।

তোমার মন কী বলছে মা?

সাফিয়া জবাব না দিয়ে নিচে নেমে যেতে গিয়েও ফিরে এসে বললেন, দে বাবুকে দে, নিয়ে যাই।

মরিয়ম বলল, নিয়ে যাবে কেন? থাকুক আমার কোলে।

তুই সুন্দর শাড়ি পরে আছিস, শাড়িটা নষ্ট হবে।

নষ্ট হবে না, থাকুক। মা, আমাকে কি দেখতে সুন্দর লাগছে?

খুব সুন্দর লাগছেরে মা! খুব সুন্দর।

আচ্ছা মা, বিয়ের শাড়ি না-কি বিবাহ বার্ষিকী ছাড়া অন্য কোনো সময় পরা অলক্ষণ?

কে বলেছে?

কে বলেছে আমার মনে নেই। অলক্ষণ হলে এই শাড়ি বদলে অন্য শাড়ি পরব।

সফিয়া কিছু বললেন না। বিয়ের শাড়ি অন্য সময পরা অলক্ষণ কি না। তিনি জানেন না। যদি অলক্ষণ হয়, তাহলে না পরাই ভালো। কিন্তু মেয়েটা এত আগ্রহ করে শাড়িটা পরেছে। সেই শাড়ি বদলাতে তিনি কী করে বলেন!



ভাইকে কোলে নিয়ে মরিয়ম ছাদের এক মাথা থেকে আরেক মাথায় যাচ্ছে। গুজগুজ করে গল্প করছে। তার ভাই যে চোখে দেখে না, এই বিষয়ে এখন সবাই নিশ্চিত। এখন সন্দেহ হচ্ছে সে কানেও শোনে না। তার সঙ্গে যত গল্পই করা হোক সে শোনে না। নিজের মনে তা তা করে একধরনের শব্দ করে। শুধু পেটে খোচা দিলে শব্দ করে হাসে। সেই হাসির শব্দ সুন্দর।

মরিয়ম একটু পর পর ভাইয়ের পেটে খোচা দিয়ে ভাইকে হাসাচ্ছে। আর বলছে–এই গুটকু, এই। তার ভাইকে ইয়াহিয়া নামে এখন কেউ ডাকে না। একেকজন একেক নামে ডাকে। সে ডাকে গুটিকু।

এই গুটকু, দেশ স্বাধীন হচ্ছে বুঝতে পারছিস। ই ই স্বাধীন হচ্ছে। স্বাধীন কী বুঝিস? স্বাধীন হলো জয় বাংলা। সব মিলিটারি চলে যাবে। উই চলেও যাবে না।; এদেরকে আমরা কচুকাটা করব। ঘ্যাচ ঘ্যাচ ঘ্যাচ ঘ্যাচ।

গুটকু হাসছে। মনের আনন্দে হাসছে। কারণ ঘ্যাচ ঘ্যাচ করার সময় মরিয়ম ভাইয়ের পেটে করাত চালানোর মতো ভঙ্গি করছে।

আমি যে বিয়ের শাড়ি পরেছি। বুঝতে পারছিস? বল দেখি কেন পরেছি? বলতে পারলে বুঝতে পারব তোর বুদ্ধি আছে। দেশ স্বাধীন হলে আমাদের বাসায় একজন লোক আসবে। তার জন্যে শাড়ি পরেছি। বল দেখি লোকটা কে? সে আমার কে হয়? হাসি বন্ধ, হাসি বন্ধ। প্রশ্নের জবাব দে।

মরিয়ম ছাদের কার্নিশে হেলান দিয়ে দাঁড়াল। এখান থেকে অনেকদূর পর্যন্ত দেখা যায়। এখন কারফিউ চলছে; অথচ রাস্তায় লোকজন। মিলিটারির কোনো গাড়ি দেখা যাচ্ছে না। দেশ কি স্বাধীন হয়ে গেছে?
 
কলিমউল্লাহ তার ঘরে। শরীর ম্যাজম্যাজ করছে বলে সে চাদর মুড়ি দিয়ে শুয়েছিল। মাসুম কয়েকবার এসে গায়ে হাত দিয়ে দেখে গেছে। জ্বর কি-না। মানুষটার কিছু হলে তার এমন অস্থির লাগে। সবচেয়ে অস্থির লাগে মানুষটা যদি কথা না বলে চুপ করে থাকে। গতকাল থেকে লোকটা কেমন চুপ মেরে গেছে।

মাসুম বলল, তোমার শরীর কি বেশি খারাপ লাগছে? এই! এই!

কলিমউল্লাহ বলল, গা ম্যাজম্যাজ করছে। তেমন কিছু না।

গা টিপে দেব?

দরকার নেই।

মাথায় হাত বুলিয়ে দেই?

উঁহুঁ। তুমি এক কাজ কর, অন্য ঘরে যাও। আমি কিছুক্ষণ একা একা চোখ বন্ধ করে শুয়ে থাকি।

মাসুমা করুণ গলায় বলল, আমি থাকি তোমার সঙ্গে। কথা বলব না। গায়ে-মাথায় হাত বুলিয়ে দেব, তোমার ভালো লাগবে।

কোনো দরকার নেই। তুমি বরং একটা পেন্সিল দাও আর কবিতার খাতাটা দাও।

মাসুমা এতক্ষণে তৃপ্তির নিঃশ্বাস ফেলল। মানুষটা যখন বলল, কিছুক্ষণ একা একা চোখ বন্ধ করে শুয়ে থাকি–তখন তার খুবই মন খারাপ হয়ে গিয়েছিল। তার মনে হচ্ছিল মানুষটা তার সঙ্গ পছন্দ করছে না। এখন দেখা যাচ্ছে ঘটনা সে রকম না। মানুষটা মনে মনে কবিতা নিয়ে ভাবছিল বলেই এরকম বলেছে। এইসব ছোটখাটো কারণে কবি টাইপ মানুষদের স্ত্রীরা ভুল বুঝে।

মাসুমা কবিতার খাতা এবং দুটা পেন্সিল নিয়ে বিছানায় উঠে এলো। লোকটা রাগ করুক বা যাই করুক, সে চাদরের নিচে লোকটাকে জড়িয়ে ধরে শুয়ে থাকবে। লোকটার পিঠে নাক ঘষবে। লোকটার পিঠে নাক ঘষতে মাসুমার অসম্ভব ভালো লাগে। কেন লাগে কে জানে!

কলিমউল্লাহ কবিতার খাতা এবং পেন্সিল নিয়ে আধশোয়া হয়ে বসেছে। মাসুমা স্বামীর সঙ্গে লেপ্টে শুয়ে আছে। কলিমউল্লাহ কিছু বলছে না। মাসুমা আদুরে গলায় বলল, কবিতাটার নাম কী?

কলিমউল্লাহ বলল, চুপচাপ শুয়ে থাকে। কথা বলবে না।

মাসুমা বলল, সরি! আর কথা বলব না।

কলিমউল্লাহ স্বাধীনতা নিয়ে একটা দীর্ঘ কবিতা লেখার চেষ্টা করছে। প্ৰথম লাইনটা মাথায় চলে এসেছে। দ্বিতীয় লাইন এখনো আসে নি। এইসব ক্ষেত্রে প্রথম লাইন অনেকক্ষণ মাথায় খেলাতে হয়। তখন দ্বিতীয় লাইন আপনাআপনি আসে।

এসেছে রঙিন, জল পড়ে পাতা নড়ে দিন।

এই হচ্ছে প্রথম লাইন। এখানে রঙিন মানে স্বাধীনতা। জল পড়ে পাতা নড়ে হলো শাশ্বত বাংলা।

এসেছে রঙিন, জল পড়ে পাতা নড়ে দিন।

অনেকক্ষণ কথা বলতে না পেরে মাসুমার দম বন্ধ হয়ে আসছে। দমবন্ধ ভাবটা কাটাবার জন্যে সে বলল, কবিতাঢ়া কী নিয়ে লিখছ?

কলিমউল্লাহ রাগ করল না, সহজ গলায় বলল, স্বাধীনতা নিয়ে। কলিমউল্লাহর গলার শান্ত স্বরে সাহস পেয়ে মাসুমা বলল, তুমি আমাকে নিয়ে অনেকদিন কবিতা লিখছ না। স্বাধীনতার কবিতা পরে লেখ, আগে আমাকে নিয়ে একটা কবিতা লিখ।

কলিমউল্লাহ জবাব দিল না। দ্বিতীয় লাইন তার মাথায় এসে গেছে। পুরোটা না, অর্ধেকটা।

বাতাসে বারুদগন্ধ …

এই, আমাকে নিয়ে কবিতাটা কবে লিখবো?

আহা একটু চুপ করো না!

আগে বলে আমাকে নিয়ে কবিতাটা কবে লিখবে, তারপর চুপ করব। স্বাধীনতা এখনো আসে নি, তাকে নিয়ে কবিতা লিখতে বসেছি। আমি তো এসেছি। আমি এতক্ষণ তোমার পাশে শুয়ে আছি, তুমি একবার আমার দিকে তাকাও নি। স্বাধীনতা চোখে দেখা যায় না। আমাকে চোখে দেখা যায়।

কলিমউল্লাহ স্ত্রীর দিকে তাকাল। মাসুমার গায়ে গাঢ় সবুজ রঙের শাড়ি। মাসুমাকে সুন্দর লাগছে। গাঢ় রঙ ফর্স মেয়েদের খুব মানায়।

মাসুমা বলল, তুমি আগে বলেছিলে দেশ স্বাধীন হবে না। এখন তো হচ্ছে। হচ্ছে না?

কলিমউল্লাহ জবাব দিল না। মাসুমা প্ৰায় ফিসফিস করে বলল, তুমি রাগ না করলে আমি তোমাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করব।

জিজ্ঞেস করো।

না। আগে বলো, রাগ করবে না। আমার গায়ে হাত দিয়ে বলে রাগ করবে না।

কলিমউল্লাহ স্ত্রীর গায়ে হাত দিয়ে বলল, রাগ করব না।

তুমি তো পাকিস্তানিদের পক্ষে অনেক কাজটাজ করেছ। এখন তুমি বিপদে পড়বে না?

না। আমি হচ্ছি গিরগিটি।

তার মানে কী?




গিরগিটি গায়ের রঙ বদলাতে পারে। আমিও পারি। মানুষকে বেঁচে থাকতে হলে, গিরগিটি হতে হয়। তাহলে একটা গল্প শোন। ডারউইন সাহেবের গল্প। সারভাইবেল নিয়ে story.

মাসুমা মুগ্ধ চোখে স্বামীর দিকে তাকিয়ে আছে। গল্প তার মাথায় ঢুকছে না। মানুষটার বক্তৃতার ভঙ্গিটা দেখতে ভালো লাগছে। মাসুমা মনে মনে জপ করতে লাগল। আমি তোমাকে ভালোবাসি।। আমি তোমাকে ভালোবাসি। সে ঠিক করেছে মানুষটা যতক্ষণ বক্তৃতা দেবে ততক্ষণ সে মনে মনে বলবে আমি তোমাকে ভালোবাসি। শুধু যে মনে মনে বলবে তা না। কতবার বলা হলো তার হিসাবও রাখবে।

কলিমউল্লাহ বক্তৃতা শেষ করে বলেন, আঙুলে কী শুনছিলে?

মাসুমা লজ্জিত গলায় বলল, কিছু না।

আমার যুক্তি তোমার পছন্দ হয়েছে? যে সমাজের জন্যে যে ফিট সেটিকে থাকবে। যে আনফিট সে করে যাবে। বিলো পছন্দ হয়েছে না?

তুমি যা বলো তাই আমার পছন্দ হয়।

তাহলে এখন একটা কাজ করো তো–কাঁচি নিয়ে এসো।

কাঁচি দিয়ে কী করবে?

তোমার সবুজ শাড়িটা কেটে বাংলাদেশের পতাকা বানাব। দেশ যেদিন স্বাধীন হবে সেদিনই পতাকা উড়াব। লাল রঙের কাপড় আছে? তোমার লাল শাড়ি আছে না?

আছে।

স্বামী-স্ত্রী দরজা বন্ধ করে বাংলাদেশের পতাকা বানাচ্ছে। মাসুমা খুবই মজা পাচ্ছে।
 

Users who are viewing this thread

Back
Top