What's new
Nirjonmela Desi Forum

Talk about the things that matter to you! Wanting to join the rest of our members? Feel free to sign up today and gain full access!

Collected ছোছনা ও জননীর গল্প - উপন্যাস (1 Viewer)

কলিমউল্লাহর বাবুর্চি বাচ্চু মিয়া ভোল পাল্টে বিহারি হয়ে গেছে। বিহারি হবার জন্যে তাকে খুব বেশি পরিশ্রম করতে হয় নি–মাথার চুল ছোট ছোট করে কাটতে হয়েছে, একটা সানগ্লাস কিনতে হয়েছে, গলায় বাঁধার জন্যে বাহারি রুমাল। প্যান্টের পকেটে রাখার জন্যে মুখ বন্ধ চাকু।

প্রতিদিনই ঢাকা শহরে সে কিছুক্ষণের জন্যে ঘুরতে বের হয়। তখন মুখ ভর্তি থাকে পান, হাতে সিগারেট। তার গা থেকে ভুরতুর করে আন্তরের গন্ধ বের হয়।

লোকজন তার দিকে ভীত চোখে তাকায়। বাচ্চু মিয়ার বড় ভালো লাগে। যে-কোনো পান-সিগারেটের দোকানের সামনে সে যখন দাড়াম, দোকানি তটস্থ হয়ে পড়ে। কীভাবে খাতির করবে বুঝতে পারে না। বাচ্চু মিয়া পানের পিক ফেলে ঢেকুরের মতো শব্দ করে (ঢেকুরের শব্দ করাটা সে সম্প্রতি আয়ত্ত করেছে। এই শব্দেও লোকজন চমকায়। চমকানি দেখেও তার বড় ভালো লাগে।) এবং পিক করে পানের পিক ফেলে। বিহারিদের পানের পিক ফেলা বাঙালিদের মতো নয়। তারা আয়োজন কয়ে পিক ফেলে। এই কায়দাও এখন সে জানে। দোকানি যখন আতঙ্কে অস্থির হয়ে যায়, তখন সে বলে, তুমি সাচ্চা পাকিস্তান? (গলা গম্ভীর।)

দোকানি ক্রমাগত হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়তে থাকে। তখন বাচ্চু মিয়া দ্বিতীয় দফায় পানের পিক ফেলে বলে, সিগ্রেট নিকালো। (গলা আগের চেয়েও গম্ভীর।)

দোকানি তৎক্ষণাৎ এক প্যাকেট সিগারেট (বেশিরভাগ সময় ক্যাপস্টান, এক একটা শলার দাম দশ পয়সা, সহজ ব্যাপার না) বের করে এগিয়ে দেয়।

পান খিলাও। জর্দা ডবল। চুনা কম।

দোকানি অতি দ্রুত পান বানাতে বসে। পান বানাতে শুরু করে। ভয়ে যখন তার হাত কাঁপতে শুরু করে, তখন বাচুর মায়া হয়। সে নিচু গলায় বলে, ভাইজান, এত ডরাইতেছেন কী জন্যে? আমি বিহারি না, বাঙালি। বিহারির ভাব ধরছি।

দোকানির ভয় তাতেও কাটে না। তার চোখে তখন সন্দেহ। নতুন কোনো ফাঁদ নিশ্চয়ই।

ডর খাইয়েন না ভাইজান। আল্লাহর কসম আমি বাঙালি। বাচ্চু মিয়া নাম। খালি যে বাঙালি এইটাও ঠিক না, আমি মুক্তি। (এখন গলার স্বর চাপা।)

দোকানির চোখ বড় বড় হয়ে যায়।

বাচ্চু মিয়া ফিসফিস করে বলে, দিনে বিহারি সাইজা ঘুরি। মিলিটারির খোঁজ-খবর নেই। রাইতে বুম বুম বোমা। রাইতে আমরার বোমার আওয়াজ পান না?

পাই।

কাইল রাইতে পাইছিলেন? ইয়াদ কইরা দেখেন।

জি।

কয়বার পাইছেন বলেন দেখি? তিনবার। সইন্ধ্যা রাইতে দুইবার। এগারোটার সময় একবার। রাইত এগারোটার অপারেশনে আমি ছিলাম। সইন্ধ্যা রাইতে ছিলাম না। এগারোটার অপারেশনে মিলিটারি মারা পড়েছে তিনটা।

এই পর্যায়ে দোকানির বিশ্বাস ফিরে আসে। তার চোখ-মুখ থেকে ভয় কেটে যায়। মুখ হাসি হাসি হয়ে যায়। সে আনন্দিত গলায় বলে, ভাই, চা খাইবেন?

আপনার দোকানে চায়ের ব্যবস্থা কই?

ব্যবস্থা নাই, আনায়ে দেই।

আচ্ছা আনান। তার আগে সিগ্রেটের দামটা নেন। আমরা মুক্তি। জোরজবরদস্তি কইরা জিনিস নেওয়া আমরার নিষেধ আছে।

দোকানি প্রায় চেচিয়ে বলে, কী সর্বনাশ। আপনের কাছ থাইক্যা সিগারেটের দাম নিমু? আমি কি বেজন্মা?

মুক্তি সেজে গল্প করতে বাচ্চু মিয়ার ভালো লাগে। তখন নিজেকে মুক্তিই মনে হয়।

ভাইসব, আপনাদের অপারেশন চলতেছে কেমন?

রাইতে বোমা শুনেন না?

অবশ্যই শুনি। মাঝে মধ্যে দিনেও শুনি।

রাইত-দিন বইল্যা এখন আমরার কিছু নাই। সব সময় শুনবেন। আমরার দলের লোকজন আরো আসতেছে। প্ৰতিদিনই আসে।

আলহামদুলিল্লাহ।

মিলিটারির পাতলা পায়খানা শুরু হয়ে গেছে। বুঝতেছেন না?

অবশ্যই বুঝতেছি।

চরমপত্র শুনেন?

আরে কী বলেন? এইটা না শুনলে চলে? চরমপত্র আর ঢাকা শহরে বোমার শব্দ–এই দুইটা না শুনলে আমার আর আমার পরিবারের ঘুম হয় না।
 
যতই দিন যাচ্ছে বাচ্চু মিয়ার সাহস ততই বাড়ছে। এখন সে মাঝে-মধ্যে মিলিটারির কোনো দল দেখলে এগিয়ে যায়। মিলিটারিরাও বিহারি দেখলে মনে ভরসা পায়। বাচ্চু মিয়া, তাদের দিকে সিগারেটের প্যাকেট বাড়িয়ে দিতে দিতে বলে–ভাই হালত কিয়া? মিলিটারিদের সঙ্গে তার ভালোই কথাবার্তা হয়।

পানের পিক ফেলতে ফেলতে সে গম্ভীর গলায় বলে, সব মুক্তি ফিনিস করডো। বাঙালি খতম করো। সব খতম।

তার উর্দু ঠিক হয় না। তাতে সমস্যা নেই। বিহারিরাও ভালো উর্দু বলতে পারে না। বিহারিদের চেনার উপায় হলো–বাংলা উর্দুর মিকচার ভাষা। এই ভাষা বাচ্চু মিয়া জানে।

সন্ধ্যার আগে আগে বাচু ঘরে ফিরে আসে। চাল-ডালের খিচুড়ি বসিয়ে দেয়। রান্না ভালো হবে না খারাপ হবে–এটা নিয়ে চিন্তা করার কিছু নাই। সে একা মানুষ। কাঁচা চাল-ডাল চিবায়ে খেলেও কারো কিছু বলার নেই। একা থাকার এই মজা। সে কলিমউল্লাহর বাসাতেই আছে। মাঝে-মাঝে লোকটাকে নিয়ে তার চিন্তা হয়। দশ টাকা হাত খরচ দিয়ে মানুষটা যে গেল, আর তার খোঁজ নেই। মারা যায় নি তো? আজকাল মরে যাওয়া কোনো ব্যাপারই না। ঘর থেকে বের হলে মৃত্যু, ঘরে বসে থাকলেও মৃত্যু। ঢাকা শহরে আজরাইলের কোনো বিশ্রাম নাই।

বাচ্চু মিয়া খাওয়া-দাওয়া শেষ করে রেডিও কানের কাছে নিয়ে শুয়ে পড়ে। স্বাধীন বাংলা বেতারের কোনো কিছুই যেন বাদ না পড়ে। বিশেষ করে চরমপত্র। চরমপত্র যখন হয় তখন বাচু চরমপত্রের লোকটার মতো গলা করে বলে, দে দে গাববুইরা মাইর দে।

চরমপত্ৰ শোনার সময় তার মনে হয়, ইস যদি সত্যি মুক্তি হতে পারতাম তাহলে গাবুইরা মাইর দিতাম। মিলিটারি বুঝত মাইর কী জিনিস। বাঙালি কী জিনিস!



এক শুক্রবারে দরজার কড়া নড়ছে। কড়া নড়ার ভঙ্গি ভালো না। খারাপ কিছু না তো? কোনো বাঙালি এখন এত জোরে কড়া নাড়ে না। বাঙালি কড়া নাড়ে ভয়ে ভয়ে। লালমুখা মিলিটারি?

শুয়োরের বাচ্চারা এখন বাড়ি বাড়ি তালাশ শুরু করেছে। জোয়ান ছেলে সব ধরে নিয়ে যায়। এরা ফিরত আসে না। জোয়ান হওয়ার এই এক বিপদ হয়েছে। বড় পীর গাউসুল আযমের নাম নিয়ে বাক্ষু মিয়া দরজা খুলল। দরজা খুলে হতভম্ব! কলিউমউল্লাহ দাঁড়িয়ে আছেন। দাড়ি, মাথায় টুপি, ইন্ত্রি করা পাঞ্জাবি।

কলিমউল্লাহ বলল, কিরে তুই এখনো আছিস? পালায়ে যাস নাই?

বাচ্চু মিয়া কদমবুসি করতে কবতে বলল, আমি যামু কই? আপনে খরচ বরচ কিছুই দিয়া যান নাই। খায়া না খায়া আছি। আপনি ছিলেন কই?

কলিমউল্লাহ তীক্ষ্ণ চোখে ঘর-দুয়ার দেখতে দেখতে বলল, জিনিসপত্র বিক্রি করেছিস না-কি? খালি খালি লাগছে।

হিসাব মিলাইয়া দেখেন।

চা বানা। চা খাই। ভালো কথা, তুই কি আমার বিছানায় শুয়ে ঘুমাস নাকি? বিছানা দেখে তো সে রকমই লাগে।

বাচ্চু মিয়া জবাব না দিয়ে চা বানাতে গেল। ঘটনা সত্যি।

সে আগে মেঝেতে ঘুমাতো। এখন স্যারের বিছানাতেই ঘুমায়। যুদ্ধের বাজারে সব সমান। আম কাঠ সেগুন কাঠের একই দর। সে কেন বিছানায় ঘুমাবে না?

কলিমউল্লাহ চায়ে চুমুক দিয়ে কিছুটা শান্ত হলো। বাচ্চু মিয়া যে ঘর বাড়ি ফেলে পালিয়ে যায় নি–এটা বড় ব্যাপার। চুরি অবশ্যই করেছে। টুকটাক চুরি তো করবেই।

স্যার, আপনে ছিলেন কই?

কলিমউল্লাহ বলল, বিয়ে করলাম। এই নিয়ে ব্যস্ত ছিলাম।

বাচ্চু মিয়া অবাক হয়ে বলল, বিবাহ করেছেন?

হুঁ।

ভাবিসাব কই?

আছে। অন্য একটা বাড়িতে তুলেছি।

উনার নাম কী?

নাম দিয়ে তুই কী করবি? ফাজিলের মতো কথা।

উনার সাথে পরিচয় হবে না?

তুই এত বড় তালেবর যে পরিচয় করায়ে দিতে হবে? তুই এই বাড়িতে যে রকম আছিস, সে রকম থাকিবি। বাড়ি পাহারা দিবি। বুঝেছিস?

বুঝলাম।

আমি মাঝে-মধ্যে এসে দেখে যাব। খরচ দিয়া যাব। জিনিস বিক্রি বন্ধ।

বাচ্চু মিয়া নিজের জন্যেও চা বানিয়ে এনেছে। বেয়াদবি যেন না হয়। সে জন্যে অন্যদিকে তাকিয়ে চায়ে চুমুক দিচ্ছে। স্যার বিবাহ করেছেন শুনে ভালো লাগছে। যে বাড়িতে মেয়েছেলে নাই, সে বাড়িতে কাজ করে মজা নাই।

স্যার, দেশ স্বাধীন হইব কবে?

স্বাধীন তো হয়েই আছে। নতুন করে কী হবে? উল্টা পাল্টা কথা বন্ধ।

জি, আচ্ছা বন্ধ।

তুই চাকর, চাকরের মতো থাকিবি। তোর কাজ ভাত রান্দা, বুঝেছিস?

জি, বুঝলাম। তয় এখন অবশ্য ভাত রান্দনের সময় পাই না। কাজকর্মে ব্যস্ত থাকতে হয়।

কলিমউল্লাহ তীক্ষ্ণ গলায় বলল, কী কাজকর্ম?

বাচ্চু মিয়া উদাস গলায্য বলল, মুক্তি হয়েছি স্যার।

কী হয়েছিস?

মুক্তি।

কলিমউল্লাহ অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। স্যারের অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকার দৃশ্যটা বাচ্চু মিয়ার বড় ভালো লাগছে। এখন সে আর ভাত রান্দা চাকর না। সে মুক্তি! মুক্তি কোনো সহজ জিনিস না।

তুই মুক্তি হয়েছিস?

জি। দিনে ঘুমাই, রাইতে অপারেশন। আইজ রাইতেও অপারেশন আছে। দোয়া রাইখেন। চা কি আরেক কাপ খাইবেন? বানাই?

কলিমউল্লাহ হ্যাঁ না কিছু বলল না। বাচ্চু মিয়া চা বানাতে গেল। তার বড় ভালো লাগছে যে স্যার তার কথা পুরোপুরি বিশ্বাস করেছে। যুদ্ধের বাজার বলেই এটা সম্ভব হয়েছে। যুদ্ধের বাজারে মিথ্যা কথাকে সব সময় সত্যি মনে হয়। এইটাই হলো যুদ্ধের বাজারের মজা।
 
চায়ের কাপ কলিমউল্লাহর হাতে দিতে দিতে বাচ্চু মিয়া বলল, স্যার, একটু দোয়া রাইখেন আইজি আমরার বিরাট অপারেশন আছে। জীবন নিয়া ফিরতে পারব কি-না। আল্লাহ মান্বুদ জানে। মনে হয় না।

অপারেশন কোথায়?

এইটা বলা নিষেধ আছে।

বাচ্চু মিয়া!

জি স্যার।

আমার সঙ্গে ফাজলামি না করলে ভালো হয়। কয়েকদিনের জন্যে বাইরে ছিলাম, এর মধ্যে তুই মুক্তি হয়ে গেছিস?

বাচ্চু মিয়া কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, ধরছেন ঠিক। তয় স্যার মুক্তিতে ঢুকতেছি। কথাবার্তা চলতেছে।

চুপ!

জি আচ্ছা চুপ করলাম। স্যার গোসল করবেন? পানি গরম করি?

না।

গায়ে তেল ডলে দেই? আরাম পাবেন। তেল ডলার পরে গোসলে মজা আছে। দিব?

কলিমউল্লাহ উদার গলায় বলল, দে।

আরামে কলিমউল্লাহর চোখ বন্ধ হয়ে আসছে। তার কাছে মনে হচ্ছে, বাচ্চু মিয়ার শরীর ম্যাসাজেব এই গুণটি তুচ্ছ করার মতো না। মাঝে-মাঝে এই বাড়িতে এসে গা ম্যাসাজ করালে খারাপ হবে না। ম্যাসাজে রক্ত চলাচল ভালো হয়। শরীর ঠিক থাকে। শরীর ঠিক থাকা মানেই মেজাজ ঠিক থাকা।

বাচ্চু মিয়া!

জি স্যার।

এত ভালো ম্যাসাজ তুই শিখেছিস কার কাছে?

আমার ওস্তাদ মনু মিয়া বাবুর্চির শইল ডালতে ডালতে শিখছি।

তোর কাজ যুদ্ধও না, রান্দাও না। তোর কাজ শইল ডলা। বুঝেছিস?

জি স্যার।

যুদ্ধ বিষয়ে একটা পাঞ্জাবি শের শুনবি? জোহর সাহেবের কাছ থেকে শুনে নোট করে রেখেছিলাম। শেরাটা হলো

সুলেহ, কীতিয়ান ফাতেহ যি বাতাবে
কমর জং তি মূল না কাসেয়ে নি

এর অর্থ হলো, যদি শান্তি বিজয় আনে, তাহলে যুদ্ধ করো না। কবিতাটা সুন্দর না?

কলিমউল্লাহ স্যারের ঘাড় ম্যাসাজ করতে করতে বাচু বলল, যুদ্ধ ছাড়া আমরার গতি নাই। বিনা যুদ্ধে পাঞ্জাবি যাবে না। খাবিস জাত।

চুপ থাক।

জি আচ্ছা।

বাঙালি যুদ্ধ করার জাত না। বুঝেছিস?

জি বুঝেছি। তয় মনে একটা বিরাট শখ ছিল যুদ্ধ করব। একটা পাঞ্জাবি মারতে পারলেও জীবন সার্থক হইত।

আর কথা না চুপ।।

জি আইচ্ছা।

ম্যাসাজ অতি আরামের হচ্ছে। কলিমউল্লাহ ঘুমিয়ে পড়েছে। এই সুযোগে বাচ্চু মিয়া তার মনের কথা বলে যাচ্ছে—

স্যার, ধরেন যুদ্ধ করা যদি কপালে নাও থাকে, একটা অপারেশন যদি খালি দেখতে পারতাম! একদিকে গুলি করতাছে মুক্তি আরেক দিকে পাকিস্তান। পাকিস্তান মইরা সাফ, এরা আমরার মুক্তির বালটাও ছিঁড়তে পারল না। এমন একটা দৃশ্য যদি দেখতে পারতাম— দেখি আল্লা কী করে। কপালে থাকলে দেখব। আপনে কী বলেন স্যার? আপনে কি ঘুমে?

কলিমউল্লাহ পুরোপুরি ঘুমে— এই বিষয়ে নিশ্চিত হবার পরেই বাচ্চু মিয়া তার পকেট থেকে দশ টাকার একটা নোট সরিয়ে ফেলল। যুদ্ধের বাজারে চুরি দোষের মধ্যে পড়ে না।



পরম করুণাময় মানুষের সমস্ত ইচ্ছা পূরণ করেন বলেই হয়তো বাচ্চু মিয়ার ইচ্ছাও পূর্ণ করলেন। সে চোখের সামনে মুক্তিদের একটা বড় অপারেশন দেখার সুযোগ পেল। সে বাংলা মোটরের কাছে বিহারি সেজে কয়েকজন পশ্চিম পাকিস্তানি পুলিশ, কালো পোশাকের মিলিটারি এবং সেনাবাহিনীর একজন সেকেন্ড লেফটেনেন্টের সঙ্গে গল্প করছিল। এমন সময় দেখল একটা কালো রঙের টয়োটা গাড়ি তাদের কাছে এসে হঠাৎ যেন ব্রেক করে থামল। মুহুর্তেই গাড়ির জানালা থেকে প্রবল গুলি বর্ষণ হতে লাগল। একটি গ্রেনেড উড়ে এলো গাড়ির ভেতর থেকে।

গাড়ি যেমন উড়ে এসেছিল ঠিক তেমনিভাবে উড়ে চলে গেল। বাচ্চু মিয়া মারা গেল চোখের সামনে ঢাকা শহরের গেরিলাদের ভয়াবহ একটি আক্রমণ দেখে। মৃত্যুর আগ মুহূর্তে খুব কম মানুষের মনই আনন্দে অভিভূত থাকে। তারটা ছিল।
 
কোলকাতায় পার্ক সার্কাসের একটি অ্যাপার্টমেন্ট কমপ্লেক্সের নাম কোহীনূর ম্যানশন। কোহীনূর ম্যানশনের মাঝারি ধরনের ফ্ল্যাটে বাংলাদেশের প্রবাদ পুরুষ মাওলানা ভাসানী বাস করেন। তাঁর সঙ্গী মুজাফফর-ন্যাপের এক সময়ের কমী জনাব সাইফুল ইসলাম। সাইফুল ইসলামের দায়িত্ব বিভিন্ন জায়গায় মাওলানা ভাসানীর বিবৃতি পাঠানো, রাষ্ট্রপ্রধানদের কাছে লেখা চিঠি কপি করা। চিঠি পাঠানোর ব্যবস্থা করা।

মাওলানা সেখানে খানিকটা নির্বাসিত জীবন-যাপন করছেন; স্বাধীনতা যুদ্ধের মূলধারা থেকে আলাদা। সংগ্ৰামময় দীর্ঘ জীবন পার করে এখন একটু যেন ক্লান্ত।

তিনি ইন্দিরা গান্ধীকে নিজের হাতে একটি চিঠি লিখেছেন। তার বক্তব্য–

আমার প্রথম পুত্রের মৃত্যু হয় ধুবড়ির গ্রামে। তাই আমার
বৃদ্ধ স্ত্রীর আশা শেষ দাফন ধুবড়ির কোনো গ্রামে হয়।…*

চিঠিতেও বিষাদের সুর। যেন তিনি দূরাগত ঘণ্টা ধ্বনি শুনতে পাচ্ছেন।

মাওলানা ভাসানী তার ফ্ল্যাটের বসার ঘরে বসে আছেন। তার পরনে সেলাইবিহীন লুঙ্গি, গায়ে ধবধবে সাদা ফতুয়া। ডান হাতে তসবির ছড়া। তিনি তসবি টানছেন। তাঁর দৃষ্টি স্থির। তাঁর সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমেদ। প্রধানমন্ত্রী মাওলানার পা স্পর্শ করে সালাম করলেন। বিনীত, গলায় বললেন, হুজুর কেমন আছেন?

মাওলানা বললেন, ভালো আছি মনের সুখে মাছি মারতেছি। এদিকে অনেক মাছি।

আপনার খাওয়া দাওয়ার কোনো অসুবিধা কি হচ্ছে?

মাওলানা তসবি টানা বন্ধ করে বললেন, খাওয়া দাওয়ার সুবিধা অসুবিধার কথা বাদ দেও। কোনো কাজের কথা থাকলে বলো।

হুজুর, আমি নানান অসুবিধায় আছি।

কেউ সুবিধায় নাই। তবে তোমার অসুবিধা বুঝতে পারি। বাতাস বড় গাছে লাগে। ছোট গাছে লাগে না। তুমি এখন বড় গাছ।

বড় গাছ হওয়ার বাসনা কোনো দিন আমার ছিল না।

হ্যাঁ, এই কথাটা সত্য বলেছ।

আপনার কাছে পরামর্শের জন্যে এসেছি।

শোনো তাজউদ্দিন, আমি পরামর্শের মুদির দোকান খুলি নাই। দোয়া যদি চাও বলো দোয়া দিতে পারি।

আমি আপনার কাছে পরামর্শ চাই।

কোন বিষয়ে?

তাজউদ্দিন চুপ করে গেলেন। বেশ কিছুক্ষণ মওলানার হাতের তসবি দ্রুত ঘুরল। একসময় তসবির ঘূর্ণন বন্ধ হলো। তিনি শান্ত গলায় বললেন, নিজের বুদ্ধিতে চলবা–এইটাই আমার পরামর্শ। যুদ্ধের বাজারে ভেজাল বুদ্ধির বিকিকিনি হয়। বুদ্ধি কিনতে গেলে ভেজাল বুদ্ধি পাইবা। এই আমারে দেখ, সারাজীবন নিজের বুদ্ধিতে চলেছি। ভালো কথা, তোমার কি ক্ষুধা হয়েছে? কিছু খাবা?

তাজউদ্দিন না-সূচক মাথা নাড়লেন। মাওলানা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, বয়স হয়ে গেছে। শরীরে শক্তি নাই। মনে শক্তি আছে শরীরে নাই। শরীরে শক্তি থাকলে তোমারে বলতাম, আমারে মুক্তিবাহিনীর কমান্ডার বানায়া আমার নিজ গ্রামে পাঠায়ে দেও।

অনেক বড় যুদ্ধ অস্ত্র ছাড়া করা যায়।

শেষে কিন্তু অস্ত্ৰ লাগে। খবরের কাগজে দেখলাম, ফ্রান্সের আঁদ্রে মালরো এই বয়সেও বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে থেকে সরাসরি যুদ্ধ করতে চান। খবরটা পড়ে এত ভালো লেগেছে সঙ্গে সঙ্গে চোখে পানি এসেছে। আমি খাস দিলে উনার জন্যে দোয়া করেছি। আমি উনাকে ধন্যবাদ জানায়ে একটা পত্ৰ দিব। তুমি পাঠাবার ব্যবস্থা করো।

জি করব। আমার প্রতি আপনার আর কোনো আদেশ কি আছে?

একটা আদেশ আছে। আদেশ বলো, অনুরোধ বলো, নির্দেশ বলো একটা আছে।

বলুন কী আদেশ?

আমাকে স্বাধীন বাংলাদেশের ধুবড়ি গ্রামে পাঠাবার ব্যবস্থা করো। আমার সময় শেষ হয়ে আসছে। আমি আমার নিজ গ্রামে মরতে চাই।

মাওলানা চোখ বন্ধ করলেন। আবারো তসবি ঘুরতে লাগল। প্রধানমন্ত্রী উঠার ভঙ্গি করতেই মাওলানা ইশারায় তাঁকে বসতে বললেন। মাওলানা চোখ মেলে শান্ত গলায় বললেন, মাথা কাছে আনো, তোমার জন্যে একটু দোয়া করে দেই। ভালো কথা, আমার এখান থেকে কিছু মুখে না দিয়া যাবে না। চালভাজা খাবে? চাল ভাজতে বলি। তেল-মরিচ দিয়ে চালভাজা খাও। বাংলাদেশী খাদ্য।

প্রধানমন্ত্রী মাথা এগিয়ে দিয়ে চোখ বন্ধ করে বসে আছেন। মাওলানা তাঁর মাথায় হাত রেখে বিড়বিড় করে দোয়া পড়ছেন।

—————

সূত্র : স্বাধীনতা ভাসানী ভারত, সাইফুল ইসলাম
 
জনৈক মুক্তিযোদ্ধার চিঠি

ত্রিপুরার বাংলাদেশ হাসপাতাল থেকে পাঠানো
মায়ের কাছে লেখা জনৈক মুক্তিযোদ্ধার চিঠি

৭৮৬

পাক জনাবেষু আম্মাজান,

পত্রে আমার শতকোটি ছালাম জানিবেন। দাদিজান এবং দাদাজানের কদম মোবারকেও আমার শতকোটি ছালাম। বাড়ির অন্য সকলের জন্যে শ্রেণীমতো ছালাম ও দোয়া।

পর সমাচার এই যে, আমি ভালো আছি। আপনারা আমার যে মৃত্যুসংবাদ শুনিয়াছেন ইহা সত্য নহে। আমার দুই পায়ে মর্টারের শেল লাগিয়াছিল। যথাযথ চিকিৎসা হইয়াছে। এখন আমি হাসপাতালে আছি, সুস্থ হইয়া উঠিতেছি, ইনশাআল্লাহ। অনেক বিশিষ্ট মানুষ আমাকে দেখিতে আসিয়াছে। আহত মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকায় আমার নাম উঠিয়াছে। ইহা বিরাট সুসংবাদ। দেশ স্বাধীন হইলে আমি সারাজীবন সরকার হইতে ভাতা পাইব।

এখন একটি দুঃসংবাদ দিতেছি, শুভপুরের গফুর ভাই এবং মিশাকান্দির এনায়েত (এনায়েতকে আপনি চিনিবেন না। অতি সাহসী মুক্তিযোদ্ধা। পরহেজগার আদমি। যুদ্ধের সময়ও উনি কোনো নামাজ কাযা করেন নাই।) মিলিটারির হাতে ধরা পড়িয়াছেন। তাঁহাদের ভাগ্যে কী ঘটিয়াছে আমরা জানি না। এখনো কোনো খবর নাই। আমি যখন আহত হইয়া বিরামপুরের মাঠে পড়িয়া ছিলাম, তখন গফুর ভাই আমাকে পিঠে নিয়া তিন মাইলের বেশি দৌড়াইয়াছিলেন। আমাকে ক্যাম্পে রাখিয়া তিনি আবার যুদ্ধে যান এবং মিলিটারির হাতে ধরা পড়েন। ইহাকেই বলে নিয়তির পরিহাস। গফুর ভাইয়ের কথা মনে উঠিলেই আমি অশ্রু সামলাইতে পারি না।

আম্মাজান, এখন আপনাকে একটা দুঃসংবাদ দিব। আপনাকে আল্লাহর দোহাই লাগে, আপনি অধিক কান্নাকাটি করিবেন না। আল্লাহ যা করেন মঙ্গলের জন্যে করেন। এই কথাটি মনে রাখিবেন। ডাক্তাররা আমার দুইটা পা হাঁটুর নিচ হইতে কাটিয়া বাদ দিবার সিদ্ধান্ত নিয়াছেন। ডাক্তাররা বলিতেছেন, ইহা ব্যতীত আমার জীবন রক্ষা করা সম্ভব। হইবে না। দাদিজানের কাছে এই সংবাদ লুক্কায়িত রাখিবেন। তিনি বৃদ্ধ মানুষ, এই সংবাদে তিনি অত্যধিক কষ্ট পাইবেন। শেষে তাহার ভালো-মন্দ কিছু হইয়া যাইবে।

আম্মাজান, আমি গত পরশু দিবাগত রাতে আকবাজানকে খোয়াবে দেখিয়াছি। তিনি সাদা রঙের একটা বড় পাঞ্জাবি পরিধান করিয়া আমার বিছানার পাশে বসিয়া আছেন। এবং আমার গায়ে মাথায় হাত বুলাইয়া আমাকে আদর করিতেছেন। তাঁহার সহিত আমার কিছু টুকটাক সাংসারিক আলাপ হয়। আফসোস, কী আলাপ হয় তাহার কিছুই মনে নাই। অনেকদিন পরে আব্ববাজানকে খোয়াবে। দেখিয়া মনে অতীব আনন্দ পাইয়াছি।

আম্মাজান, আমি ভালো আছি। আমাকে নিয়া কোনো দুশ্চিন্তা করিবেন না।

ইতি
আপনার অতি আদরের সন্তান
আব্দুল গণি
পুনশ্চ : অপারেশনের তারিখ এখনো নির্ধারণ হয় নাই।
 
ত্রিপুরার বাংলাদেশ হাসপাতালের ডাক্তার ক্যাপ্টেন সিতারা বেগম, বীর প্রতীকএর নিজের কথা।

১৯৬১ সালের কথা। তখন আমি হলিক্রস কলেজের ছাত্রী। প্রচুর খেলাধুলা করতাম। ডাক্তার হওয়ার পর ৬ মাস ইন্টার্নিশিপ করে আর্মিতে ১৯৬১ সালের জুন-জুলাই মাসে যোগদান করি। কারণ, আমার বড় ভাইও ছিলেন। আমিতে। ১৯৬১ সালে যোগ দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের আগ পর্যন্ত একজন লেফটেনেন্ট-এর পদে ছিলাম। ১৯৬১-এ শেষের দিকে জেনারেল ওসমানীর নির্দেশে আমার পদোন্নতি ঘটে— আমি ক্যাপ্টেন হই। বড় ভাই হায়দার সক্রিয়ভাবে মুক্তিযুদ্ধে জড়িত ছিলেন। ছোট ভাই এ টি এম সাফদার (জিতু) মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে বিভিন্ন খবর এবং গোপনবার্তা পৌঁছে দেবার কাজে নিয়োজিত ছিল।

১৯৬১ সালের অক্টোবর মাসে আমি ছিলাম কুমিল্লায়। বড় ভাই মেজর হায়দার পিণ্ডির চেরাট থেকে এই সময় বদলি হয়ে তৃতীয় কমান্ডো ব্যাটালিয়নে চলে আসেন। যদ্দুর মনে পড়ে তারিখটা ছিল ৫ ফেব্রুয়ারি, রোজার দিন। দুভাইবোন কিশোরগঞ্জে বেড়াতে এসেছি। আমার ছুটি ছিল ১ মাস আর বড় ভাই হায়দারের ছুটি ছিল ২ সপ্তাহের। তিনি কুমিল্লায় ফিরে গেলেন একমাস পর ছুটি শেষ হবার আগেই। আর তখুনি শুরু হয়ে গেল দেশে রাজনৈতিক সজঘাতজনিত আলোড়ন।

মার্চের প্রথম বা দ্বিতীয় সপ্তাহে আমি ঢাকায় ফিরে আসি। বড় ভাই তখন ক্যান্টনমেন্টে। আমার এক ফুপার বাসায় এসে তিনি লুকিয়ে-ছুপিয়ে আমার সঙ্গে দেখা করতেন। তাঁর কথা মতো, ছুটির পর সেনাবাহিনীতে আবার যোগ দিয়ে কিশোরগঞ্জে বাসায় ফিরে আসি। কিন্তু যেদিন কিশোরগঞ্জ ক্টেশনে air-raid হলো, সেদিনই আমরা পালালাম। মামার শ্বশুরবাড়ি আমাদের বাড়ি থেকে ৩ মাইল দূরে ছিল। চলে গেলাম। সেখানেই। এক সপ্তাহ থাকার পর আবার কিশোরগঞ্জে ফিরে এলাম। ক্যাপ্টেন নাসের এবং বড় ভাই হায়দার ময়মনসিংহের দুটো ব্রিজ উড়িয়ে দিতে এখানে এলেন। এই সময় কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্ট হেড কোয়ার্টার্স থেকে ২/৩টা টেলিগ্রাম এলো জয়েন করার জন্য চাপ দিয়ে। আকাবাই এগুলোর উত্তর দিতেন এই লিখে–she is sick, অর্থাৎ আমি অসুস্থ।

এক সপ্তাহ কিশোরগঞ্জে থাকার পর মিলিটারি আসার মাত্র দুদিন আগে দশ-বারো মাইল উত্তরে হোসেনপুরে আম্মার নানার বাড়ি পালিয়ে গেলাম। ওখানে থাকার সময় বড় ভাইয়ের খবর পেতাম। লোক মুখে শুনতাম, তিনি আগরতলায় আছেন, ট্রেনিং দিচ্ছেন। বিশ্বাস করতাম না। কিশোরগঞ্জে সেই তখন আমার বড় ভাই ও আকবার নামে কাগজে বেরুত যে, তাদেরকে ধরে দিলে ১০ হাজার টাকা পুরস্কার দেয়া হবে। জুলাইয়ের শেষের দিকে বড় ভাই একজন মুক্তিবাহিনীর সদস্যকে আমাদের কাছে পাঠালেন বাবা-মাকে পাকবাহিনী মেরে ফেলেছে–এই খবর পেয়ে। তিনি নিশ্চিত হতে চেয়েছিলেন খবরটার সঠিকতা সম্পর্কে।


জুলাইয়ের শেষ সপ্তাহে একটানা আট-দশদিন নৌকায় চেপে কিশোরগঞ্জের গোজদিয়া ঘাটি হয়ে মেঘালয় পৌঁছলাম। তারপর সিলেটের টেকেরহাটে ছিলাম এক সপ্তাহ। এরই মধ্যে বড় ভাই কী করে যেন আমার খবর পেলেন, জানি না। সেখান থেকে ট্রারেন্স করে পৌঁছলাম শিলং-এ। পথে আকবা অসুস্থ হয়ে পড়ায় শিলং-এ থাকলাম। ৪/৫ দিন। পরে গৌহাটি হয়ে আগস্টের প্রথম সপ্তাহে পৌঁছলাম মেলাঘরে। দুতিন সপ্তাহ পরে যোগ দিলাম। বাংলাদেশ হাসপাতালে।

আমি ২ নম্বর সেক্টরের অধীনে ছিলাম। মেলাঘরের বাংলাদেশ হাসপাতালটি বাশের তৈরি ছিল এবং তাতে বেড ছিল চারশোর মতো। মেডিকেল কলেজের তিন-চারজন ফাইনাল ইয়ারের ছাত্র সেখানে নিয়োজিত ছিলেন। লন্ডন থেকে মবিন এসেছিলেন, এসেছিলেন ডা. জাফরউল্লাহ, ডা. কিরণ সরকার দেবনাথ, ডা. ফারুক মাহমুদ, ডা. নাজিমুদ্দিন এবং ডা. মোর্শেদ। এদের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। দশ-বারো জন ভলান্টিয়ারও আমি থেকে এসেছিলেন। তবে সুবেদারের ওপরে কেউ ছিলেন না। কোনো ভারতীয় ডাক্তার আমাদের সাথে নিয়মিতভাবে থাকতেন না। তবে ওষুধের জন্য আগরতলা ও উদয়পুরে যেতে হতো। উদয়পুরের ডিসি মি. ব্যানার্জি, আগরতলা এড়ুকেশন বোর্ডের পরিচালক ডা. চ্যাটার্জি, ডা. মজুমদার এবং ডা. চক্রবর্তী ঐরা আমাদের প্রচুর সাহায্য-সহযোগিতা করেছেন।

আমাদের OT অর্থাৎ Operation Theatre ছিল প্লাস্টিক ক্লথ দিয়ে চারদিকে ঘের দেয়া একটা ঘর। এর মেঝেও আবৃত ছিল প্লাস্টিক ক্লথে। আমি ওখানে থাকার সময় কেবল দুজন রোগী ডায়রিয়া-ডিসেন্ট্রিতে মারা গিয়েছিল।

ভারতীয় আর্মিরও অনেক সৈন্য আসতো এখানে চিকিৎসার জন্য। আমি আগরতলা IA HOSPITAL-এ মাঝে-মধ্যে যেতাম। ভারতীয় সেনাবাহিনীর কাছ থেকেও আমরা প্রচুর সাহায্য পেয়েছি। আমাদের রোগীদের মধ্যে বেশির ভাগই থাকত ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত।

একবার ভারতীয় সেনাবাহিনীর একটা ট্রাক রাস্তার খাদে উল্টে পড়ে গিয়েছিল। ট্রাকটি সেনা সদস্যে ছিল। ঠাসা। আহতদেরকে আমাদের অ্যাম্বুলেন্সে করে এনে এখানে চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। জেনারেল রবি-এর হেলিকপ্টারে গুলি লেগেছিল। তিনিও এখানে চিকিৎসা গ্ৰহণ করেছিলেন।

যখন হাসপাতালে ছিলাম, তখনো বড় ভাই হায়দারের সঙ্গে দেখা করতে পারতাম না। অধিকাংশ সময় অসম্ভব ব্যস্ত থাকতেন তিনি। মাঝে সাঝে দেখা হতো। আকবা-আৰ্ম্মা মেলাঘর ক্যাম্পের কাছেই একটা মাটির ঘর ভাড়া নিয়ে মেঝেতে প্লাস্টিক ব্যাগ বিছিয়ে দিনরাত যাপন করতেন। তাদের সাথেও ভাইয়া দেখা করার সময় পেতেন না।
 
শ্রাবণ মাসের এক দুপুরে (১৬ আগষ্ট) নাইমুল ঢাকা শহরে ঢুকে পড়ল। তার তেমন কোনো অসুবিধা হলো না। সে ঢুকেছে নরসিংদী এলাকার গ্রামের ভেতর দিয়ে। বাস, ট্রেন কিংবা লঞ্চে ঢুকলে চেকপোষ্টের সমস্যায় পড়তে হতো। ডান্ডি কার্ড (আইডেনটিটি কার্ড) দেখানো, নানান প্রশ্নের জবাব দেয়া হাজারো ফ্যাকড়া। সন্দেহ হলেই আটক। তার মতো রোদে পোড়া শহুরে ধরনের চেহারা হলে কথাবার্তা ছাড়াই আটক। ইসকুরুপের চাবি আঁটা।

গ্রামের ভেতর দিয়ে যাতায়াতও যে খুব নিরাপদ তা না। রাজাকারবাহিনী ভালোমতো গজিয়ে গেছে। লুটপাট করার সুযোগ থাকায় তারা বেশ উৎসাহী। শান্তি কমিটিও উৎসাহী। অচেনা কেউ গ্রামে ঢুকলেই–আপনের নাম? আপনের পরিচয়?

নাম-পরিচয় সংক্রান্ত কিছু কাগজপত্র নাইমুলের সঙ্গে আছে। শান্তি কমিটির এক চেয়ারম্যান সাহেব হাজী আসমতউল্লাহর চিঠি আছে। টাইপ করা এবং পিস কমিটির সীল দেয়া চিঠিতে লেখা–

বিসমিল্লা হে রাহমানের রহিম

পত্ৰবাহক সিরাজগঞ্জ নিবাসী ফরহাদ খান পাকিস্তানের একনিষ্ঠ সেবক। তাহাকে সব রকম সাহায্য সহযোগিতা করার জন্য অনুরোধ করা যাইতেছে।

নাইমুলকে সেই চিঠি একবার শুধু দেখাতে হয়েছে। ঢাকায় ঢোকার মুখে এক রাজাকার কমান্ডার গম্ভীর ভঙ্গিতে চিঠি উল্টেপাল্টে দেখেছে। তার চিঠির দিকে তাকিয়ে থাকার ভঙ্গিই বলে দিচ্ছে কমান্ডার সাহেব চিঠি পড়তে পারছেন না।

আপনার পরিচয় বলেন। নাইমুল বলেছে, পরিচয় এখানে লেখা আছে। কমাণ্ডার সাহেব ধমক দিলেন–লেখা তো জানি, মুখে বলেন। মুখে তো তালা নাই। তালা থাকলে বলেন, চাবি দিয়া খুলব। আমার কাছে মুখের চাবি আছে।

আমার নাম ফরহাদ খান।

কই মেলা দিছেন?

ঢাকা।

কী জন্যে?

আমার স্ত্রী ঢাকায়, তাকে দেখতে যাচ্ছি।

স্ত্রীর নাম বলেন।

নাইমুল সত্যি কথাই বলল, মরিয়ম।

হাত তুইল্যা খাড়ান। চেকিং হবে।

নাইমুল হাত তুলে দাঁড়াল। অন্য একজন এসে গায়ে থাবা দিয়ে চেকিং পর্ব শেষ করল। নাইমুলের মনে হলো কাজটা করতে গিয়ে দুজনই মজা পাচ্ছে। এই মজার উৎস নাইমুল জানে। বন্দুকের সামনে মানুষ ভয়ে ছোট হয়ে থাকে। এই ভয়টা দেখতে ভালো লাগে।

নাইমুল বলল, ঢাকা শহরের অবস্থা কিছু জানেন?

কমান্ডার বলল, অবস্থা ভালো।

শহরে কি মুক্তি আছে?

টুকটাক দুই-একটা থাকতে পারে। আমাদের অঞ্চলে নাই।

তারপরেও সাবধানে থাকবেন। এখন নাই, হঠাৎ চলে আসবে।

কমান্ডার সাহেব বিরক্ত গলায় বললেন, এত প্যাচালের দরকার নাই। যেখানে যাইতেছেন যান। আমাদের পান খাওয়ার খরচ দিয়া যান।

নাইমুল দশ টাকার একটা নোট দিল। কমান্ডার সাহেব সেই নোট অনগ্রহের সঙ্গে হাতে নিলেন।



শ্রাবণ মাসে আকাশ মেঘলা থাকবে। রোদ থাকবে না। আর থাকলেও রোদের তেজ থাকবে না। এটাই নিয়ম। আজ নিয়মের ব্যতিক্রম। ঝকঝকি করছে রোদ। শহর তোতে আছে। শহর থেকে ভাপ বের হচ্ছে।

দীর্ঘদিন গ্রামগঞ্জের কাঁচা সড়ক, চাষা মাঠের উপর হাঁটাহাঁটি করার পর শহরের পাকা রাস্তায় হাঁটতে নাইমুলের চমৎকার লাগছে। রাস্তাঘাট পরিষ্কার। দেয়ালে লেখা নেই। পথে ভিড় নেই। প্রতিটি বাড়িতে পাকিস্তানি পতাকা উড়ছে। রিকশার সঙ্গেও কাগজের পতাকা।

নাইমুল যাচ্ছে শান্তিবাগের দিকে। সেখানে তার পরিচিত একটা হোটেল আছে। হোটেল জিন্দাবাহার। বেশ কিছুদিন এই হোটেলের একটা ঘর (রুম নং ১৮) ভাড়া করে সে ছিল। হোটেলের লোকজন তার চেনা। সেই হোটেলে ওঠাই তার জন্যে সম্ভবত নিরাপদ। সে প্রথমে হোটেলের একটা ঘর (চেষ্টা করবে রুম নং ১৮) নেবে। বয়কে একটা টাকা দিয়ে বলবে দুই বালতি গরম পানি দিতে। দুই বালতি গরম পানি গায়ে ঢেলে আরামের একটা গোসল তাকে দিতে হবে। সে আস্ত একটা সাবান গায়ে ডলবে। অনেকদিন আরাম করে গোসল করা হয়। না। আরামের গোসলের জন্যে শরীর খাপ ধরে অপেক্ষা করছে।

গোসলের পর খাওয়া-দাওয়া। এই হোটেলের ইলিশ মাছের ডিমের তরকারি এবং কাতল মাছের মাথার মুড়িঘণ্ট তুলনাবিহীন। সে রুমে অর্ডার দিয়ে আরাম করে খাওয়া-দাওয়া করবে। খাওয়ার পর একটা মিষ্টি পান। একটা সিগারেট। কিছুক্ষণ আরামের ভাতসুম।

মরিয়মের খোঁজে। সে যাবে ঘুম ভাঙার পর। তাদের কোনো খোঁজ যে পাওয়া যাবে না। এই বিষয়ে সে প্রায় নিশ্চিত। তাদের ঢাকায় থাকার কথা না। নিরাপদ কোনো জায়গায় চলে যাবার কথা। ঢাকা কি এখন নিরাপদ? পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন নগরী কি নিরাপত্তার কথা বলে?

ঢাকা এখন কুকুর এবং কাকমুক্ত নগর। কুকুরমুক্ত হবার পেছনে যুক্তি আছে। মিলিটারিরা না-কি কুকুর সহ্য করছে না। দেখলেই গুলি করে মারছে। কিন্তু কাক গেল কোথায়? তারা নিশ্চয়ই কাকও গুলি করে মারে নি।

নাইমুল হাঁটছে আর মনে মনে কাক খুঁজছে।

কাক বলে কা কা
ঢাকা শহর খা খা।

বাহ সুন্দর মিলেছে তো! কুকুরের দেখা নাইমুল কিছুক্ষণের মধ্যে পেয়ে গেল। মোটামুটি স্বাস্থ্যবান একটা ঘিয়া রঙের কুকুর ফুটপাতে শুয়ে আছে। তার শুয়ে থাকার ভঙ্গি বিষণ্ণ। নাইমুল বলল, এই তোর খবর কিরে?

কুকুর সঙ্গে সঙ্গে উঠে এলো। ঢাকা শহরে এই প্রথম নাইমুলের কারো সঙ্গে কথা বলা। ডায়েরি লেখার অভ্যাস থাকলে এই ঘটনাটা সুন্দর করে লেখা যেত–

আমি ঢাকায় প্রবেশ করি ১৬ আগস্ট দুপুরে। প্রথম কথা যা বলি তা হলো–এই তোর খবর কিরে? প্রশ্নটি করা হয় একটা কুকুরকে। কুকুরের গায়ের রঙ ঘিয়া। সে পা খুঁড়িয়ে হাঁটে। এই কুকুরটা আমার সঙ্গে অনেকদূর হেঁটে হেঁটে আসে। আমি যখন শান্তিনগরের মোড় পার হই। তখনই শুধু সে থেমে যায়। তবে তাকিয়ে থাকে আমার দিকে। তার তাকানোর ভঙ্গি এরকম যে আমি একটু ইশারা দিলেই সে আবারো আমার পেছনে পেছনে আসবে। আমি তাকে ইশারা দিতাম। কিন্তু দেই নি, তার কারণ আমার চোখে পড়ল একটা নাপিতের দোকান। সঙ্গে সঙ্গে চুল কাটার কথা মনে পড়ল। আমি ঢুকে গেলাম নাপিতের দোকানে।

চুল কাটার সময় কথা বলা সব নাপিতের অভ্যাস। যে নাইমুলের চুল কাটছে তার মুখে কোনো কথা নেই। কচকচ করে চুল কেটে যাচ্ছে। নাইমুলের খুবই আরাম লাগছে। চুলকাটার ব্যাপারটা যে আরামদায়ক নাইমুল তা আগে কখনো টের পায় নি। তার ঘুম ঘুমও পাচ্ছে। চুল কাটাতে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়া কোনো কাজের কথা না। নাইমুলকে বেশ কষ্ট করে জেগে থাকতে হচ্ছে। নাইমুল হাই তুলতে তুলতে বলল, আপনার নাম কী?

নাপিত চাপা গলায় বলল, তৈয়ব।

দোকান আপনার?

মহাজনের দোকান।

কারিগর কি আপনি এক?

হুঁ।

কাস্টমার কেমন হয়?

হয় কিছু।

মিলিটারিরা চুল কাটতে আসে?

তৈয়ব এই প্রশ্নের জবাব দিল না। মিলিটারি প্রসঙ্গে কোনো কথা বলা বোধহয় নিষেধ।

শহরে কি মুক্তি আছে?

নাপিত কিছুক্ষণের জন্যে কাচির ক্যাচ ক্যাচ বন্ধ করে আবার শুরু করল। এই প্রশ্নের উত্তর দিল না। নাইমুল বলল, আপনারা শহরে আছেন, মুক্তির নাড়াচাড়া বুঝেন না? বোঝার তো কথা।

আছে, নাড়াচাড়া আছে। আপনে কি মুক্তি?

নাইমুল সহজ ভঙ্গিতে বলল, হুঁ।

আপনেরে দেইখ্যাই বুঝেছি।

কীভাবে বুঝলেন?

এইসব বোঝা যায়। মাথা মালিশ কইরা দিব?

দেন। আগে শেভ করেন।

মাথা মালিশ এতই আরামদায়ক হলো যে, নাইমুল সত্যি সত্যি ঘুমিয়ে পড়ল। ছোটখাটো ঘুম না, লম্বা ঘুম। তৈয়ব তার ঘুম ভাঙালি না। খবরেব কাগজ ভাঁজ করে পাশে বসে রইল। মাছি খুব উপদ্রব্য করছে। ঘুমন্ত লোকটার মুখে বারবার এসে বসছে। তৈয়ব খবরের কাগজ দিয়ে মাছি তাড়াচ্ছে।
 
নাইমুলের ঘুম ভাঙল বিকেলে। তখন শহরে রোদ নেই। আকাশ মেঘলা। শ্রাবণ মাসের আকাশে মেঘ মানেই বৃষ্টি। বৃষ্টি নামলে খুবই সমস্যা হবে। নাইমুল এক কাপড়ে ঢাকা এসেছে।

তৈয়ব তাকিয়ে আছে। তার মুখ ভাবলেশহীন।

নাইমুল বিরক্ত গলায় বলল, ঘুমিয়ে পড়েছিলাম, ডাকলেন না কেন?

তৈয়ব জবাব দিল না।

কত হয়েছে আমার? চুল কাটা, শেভ, মাথা মালিশ। কত হয়েছে বলেন।

তৈয়ব বলল, আপনের কিছু দিতে হবে না।

নাইমুল বলল, দিতে হবে না কেন?

তৈয়ব এই প্রশ্নেরও উত্তর দিল না।

নাইমুল বলল, আমার দেরি হয়ে যাচ্ছে। ভাই, তাড়াতাড়ি বলেন–কত?

তৈয়ব আগের মতোই আবেগশূন্য গলায় বলল, আপনে মুক্তি। আমি মুক্তির কাছে টেকা নেই না। আমারে টেকা দেওনের চেষ্টা কইরা ফয়দা নাই। দিতে পারবেন না।

বৃষ্টির ফোঁটা পড়তে শুরু করেছে। নাইমুল রাস্তায় নেমে পড়ল। সে হোটেলে জায়গা পেল না। হোটেলের মালিক বদল হয়েছে। মালিকের সঙ্গে নোমও পাল্টেছে। এখন নতুন নাম পাকিস্তান হোটেল। নতুন মালিক নাইমুলকে কঠিন গলায় বলল, হোটেলে লোক নেওয়া নিষেধ আছে। রেস্টুরেন্ট আছে, খানা খাইতে পারেন। থাকার জায়গা নাই।

মিলিটারির নিষেধ?

হুঁ। মাঝে মধ্যে চেকিং হয়। বিরাট দিগদারি।

আশেপাশে কোনো হোটেল আছে?

খুঁজেন। খুঁইজ্যা দেখেন।

নাইমুল আরো দুটা হোটেলে চেষ্টা করল। একটাতে বলল, ফ্যামিলির সাথে বাচ্চাকাচ্চা থাকলে ঘর দিতে পারে। একা মানুষকে ঘর দেবে না।

নাইমুল বলল, একটা রাতের জন্যে আমার কোথাও থাকা দরকার। একটু ব্যবস্থা করে দেন।

হোটেল মালিক ক্লান্ত গলায় বলল, আত্মীয়স্বজনের বাসায় যান। এইটা ছাড়া পথ নাই। হোটেলে আপনেরে কেউ রাখব না। ঢাকা শহরে আপনের স্বজন আছে না?

নাইমুল দেরি না করে স্বজনের খোঁজে বের হলো। অপ্রত্যাশিত একটা ব্যাপার তো ঘটেও যেতে পারে। দেখা যাবে মরিয়মরা ঢাকাতেই আছে, ঐ বাড়িতেই আছে। অনেকক্ষণ কড়া নাড়ার পর মরিয়মের মার ভীত গলা শোনা যাবে–কে? কে?

এই মহিলা মেয়েদের কখনো দরজা খুলতে দেন না। নিজে আসেন দরজা খুলতে। পরিচয় দেয়ার পরেও আরো কয়েকবার বলেন, কে কে?

নাইমুল কড়া নাড়ার পর তিনিই দরজার ওপাশ থেকে ভয়ে অস্পষ্ট হয়ে যাওয়া গলায় বলবেন, কে?

নাইমুল গলা নামিয়ে বলবে, মা আমি। আমি নাইমুল। দরজাটা খুলুন। তবে কাউকে বলবেন না যে আমি এসেছি। আমি একটা সারপ্রাইজ দিতে চাই।

তিনি দরজা খুলবেন, তবে নিজেকে নিশ্চয়ই সামলাতে পারবেন না। চিৎকার করে বলবেন, মরিয়ম, দেখে যা কে এসেছে! মরিয়ম কী করবে–দ্রুত সিঁড়ি দিয়ে নামতে গিয়ে পা মচকে ফেলবে। এই মেয়ের সিঁড়িতে পা পিছলানো রোগ আছে। সে সিড়ি দিয়ে নামবে অথচ পা পিছলাবে না–এটা হতেই পারে না।

তাকে দেখে মরিয়ম কী করবে? ঝাপ দিয়ে তার গায়ের উপর পড়বে এবং তাকে সুদ্ধ মেঝেতে ফেলে দেবে। এরকম ঘটার সম্ভাবনা আছে। মরিয়ম এমনই মেয়ে যে উত্তেজনার মুহুর্তে চিন্তাই করবে না। আশেপাশে কে আছে। মা দাঁড়িয়ে আছে। বোন দাঁড়িয়ে আছে। থাকুক দাঁড়িয়ে। আমি আমার মানুষটার গায়ে ঝাপ দেবী। যার যা ইচ্ছা মনে করুক, আমার কিছু যায় আসে না। মানুষটা যখন দোতলায় উঠবে, আমি শক্ত করে তার হাত ধরে রাখব। মানুষটা যদি লজ্জা পেয়ে হাত ছাড়িয়ে নিতে চায় তাতেও লাভ হবে না। আমি আরো শক্ত করে হাত চেপে ধরব।
 
মরিয়মদের বাড়ির সদর দরজা তালাবন্ধ। একটা না, দুটা বড় বড় তালা। নাইমুল কিছুক্ষণ তালা ধরে দাঁড়িয়ে থাকল। কেন দাঁড়িয়ে থাকল। সে নিজেও জানে না।

রাত নটা থেকে কারফিউ। আগে ছিল রাত এগারোটা থেকে। গত এক সপ্তাহ হলো এই সময় এগিয়ে এনে নটা করা হয়েছে। এর মধ্যেই থাকার জন্যে নাইমুলকে একটা জায়গা খুঁজে বের করতে হবে। ঢাকা শহরে তার পরিচিত মানুষ নেই বললেই চলে। সে রওনা হলো আগামসি লেনের দিকে। অনেকদিন সেই অঞ্চলে থেকেছে। যে বাড়িতে ছিল তার বাড়িওয়ালা নিশ্চয়ই তাকে ফেলে দেবে না।

আগামসি লেনে ঢোকা গেল না। কোনো সমস্যা হয়েছে নিশ্চয়ই। এলাকা কর্ডন করে মিলিটারি বাড়িতে বাড়িতে ঢুকছে।

কমলাপুর রেল স্টেশনে চলে যাওয়া যায়। একরাত স্টেশনের বেঞ্চিতে গড়াগড়ি করে কাটিয়ে দেয়া। কমলাপুর স্টেশনে থাকাও বিপদজনক। সেখানে কঠিন মিলিটারি পাহারা। সঙ্গে ব্যাগ সুটকেস নেই, একটা লোক ঘোরাঘুরি করছে–অতি সন্দেহজনক ব্যাপার।

রাত আটটা বেজে গেছে। আর এক ঘণ্টা পরেই কারফিউ শুরু হবে। শেষ চেষ্টা হিসেবে নাইমুল রওনা হয়েছে শাহেদের বাসার খোঁজে। কয়েকবারই সে এই বাসায় গিয়েছে, তারপরেও রাতে হয়তো খুঁজে পাওয়া যাবে না। পঁচিশে মার্চের পর শহর মনে হয় নিজে নিজেই নিজেকে বদলে ফেলেছে। কিছুই চেনা যায় না। নাইমুল ঠিক করল শাহেদকে পাওয়া না গেলে দরজার ফাঁক দিয়ে আসমানীর চিঠিটা ঢুকিয়ে দেবে। এতে একটা বড় দায়িত্ব শেষ হবে। তারপর যে-কোনো একটা বাড়ির কড়া নেড়ে বলবে, আমার রাতে থাকার জায়গা নেই। আজকের রাতটা আপনাদের বাসায় থাকতে দিন। কারফিউ ভাঙলেই আমি চলে যাব।

নাইমুলের এখন মনে হচ্ছে, তার ঢাকা আসাটা ভুল হয়েছে। ঝোঁকের মাথায় সে চলে এসেছে। মাথায় একটা জিনিস কাজ করেছে–ছুটি কাটাতে যাচ্ছি। ছুটি। ভালো খাবার খাব। ভালো বিছানায় ঘুমাব। গরম পানি দিয়ে সাবান ডলে গোসল দিব। ভাগ্য ভালো হলে মরিয়মের সঙ্গে দেখা হবে।

এখন দেখা যাচ্ছে সবই এলোমেলো হয়ে গেছে। শুধু চুলটা কাটা হয়েছে। এখন পর্যন্ত গোসল হয় নি। খাওয়া হয় নি। আরামের কোনো বিছানায় শোয়ার প্রশ্নই আসছে না। রাতে কেউ যদি থাকতে দেয়, তাকে ঘুমাতে হবে বসার ঘরের সোফায়। তার জন্যে নিশ্চয়ই বিছানা ছেড়ে দেবে না।

কারফিউ শুরু হবার পাঁচ-সাত মিনিট আগে শাহেদের বাসা পাওয়া গেল। ভেতরে বাতি জ্বলছে। দরজা-জানালা বন্ধ। জানালার ফাঁক দিয়ে আলো আসছে। শাহেদ না থাকলেও কেউ না কেউ নিশ্চয়ই আছে। ঝুমিয়ে বৃষ্টি নেমেছে। নাইমুল এক দৌড়ে বারান্দায় উঠে পড়ল। উঁচু গলায় ডাকল, শাহেদ, বাসায় আছিস?

দ্বিতীয়বার ডাকার আগেই দরজা খুলে গেল। শাহেদ দাঁড়িয়ে আছে। তার চোখেমুখে গভীর বিস্ময়। নাইমুল প্রথম যে বাক্যটা বলল তা হচ্ছে–ঘরে গায়ে মাখা সাবান আছে তো? সাবান দিয়ে হেভি গোসল দিতে হবে। তুই এইভাবে তাকিয়ে আছিস কেন? আমাকে চিনতে পারছিস তো?

শাহেদ বন্ধুর প্রশ্নের জবাব দেয় নি। যেভাবে তাকিয়েছিল সেভাবেই তাকিয়ে রইল। তার দৃষ্টিতে বিস্ময় আনন্দ কিছুই নেই।

নাইমুল ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বলল, দাড়ি গোফ টোফ গজিয়ে তুই তো হানড্রেড পারসেন্ট মাওলানা হয়ে গেছিস। তোকে দেখে মনে হচ্ছে দেওবন্ধ থেকে পাস করা মাওলানা। মাথায় টুপিও আছে। সবসময় টুপি পরে থাকিস?

শোবার ঘর থেকে আগরবাতির গন্ধ আসছে। মেঝেতে জায়নামাজ পাতা। জায়নামাজের পাশে আগরবাতি জুলছে। নাইমুল বলল, ঘটনা কী? আগরবাতি কেন?

শাহেদ বলল, একটা খতম পড়ছি! খতমে জালালী। এক লক্ষ পঁচিশ হাজারবার দোয়া ইউনুস।

খতম শেষ হয়েছে?

হুঁ। মাগরেবের ওয়াক্তে শেষ হয়েছে। আসমানীদের কোনো খবর পাচ্ছি না, এই জন্যেই খতম।

নাইমুল বলল, খতম যখন শেষ করেছিস তখন খবর হয়তো পাবি। কিছুই বলা যায় না। It is a strange world. গরম পানির ব্যবস্থা কর, গোসল করব। তুই খাওয়াদাওয়া কোথায় করিস?

নিজেই রাঁধি।

খাবারের ব্যবস্থা কর। প্রচণ্ড ক্ষিধা লেগেছে। কী খাওয়াবি? খিচুড়ি খেতে ইচ্ছা করছে। খিচুড়ি খাওয়াতে পারবি?

হুঁ।

ঘরে ডিম আছে?

আছে।

খিচুড়ি আর ডিম কর। আমার খাওয়া কিন্তু বেড়েছে। আগে যা খেতাম তার তিনগুণ খাই। বেশি করে রাধবি। লেবু, কাঁচামরিচ এইসব আছে?

না।

আচার নিশ্চয়ই আছে। ভাবি তো আচার পছন্দ করত।

আচার আছে।

গুড। আমার মাথায় খাওয়া ছাড়া কোনো চিন্তা নেই। অতীতে যেসব সুখাদ্য খেয়েছি তার সবগুলির কথা মনে পড়ছে।
 
শাহেদ রান্না বসিয়েছে। কেরোসিনের চুলায় রান্না হচ্ছে। নাইমুল ঢুকেছে বাথরুমে। বাথরুমের দরজা পুরোপুরি খোলা। শাহেদ যেখান থেকে রান্না করছে। সেখান থেকে বাথরুমের ভেতরটা পুরোপুরি দেখা যায়। শাহেদ সেদিকে তাকাচ্ছে না। কারণ নাইমুল সম্পূর্ণ নগ্ন হয়ে গোসল করছে। নাইমুল খুব আনন্দে আছে, এটা শাহেদ বুঝতে পারছে। এই প্রবল দুঃসময়ে একটা মানুষ এত আনন্দে কীভাবে থাকে সে বুঝতে পারছে না।

শাহেদ বলল, তুই মুক্তিযুদ্ধে গেছিস–তাই না?

হুঁ।

যুদ্ধ কেমন হচ্ছে?

ভালো।

ঢাকা শহরেও অনেক মুক্তিবাহিনী ঢুকেছে।

নাইমুল বলল, তুই যুদ্ধে গেলি না কেন? দাড়ি গজিয়ে দেওবন্ধের মাওলানা হয়ে বসে আছিস।

শাহেদ বলল, আসমানীদের কোনো খোঁজ পাচ্ছিলাম না বলে যেতে পারছিলাম না।

খোঁজ পেলে যুদ্ধে যাবি?

হুঁ।

খিচুড়ি থেকে তো ভালো গন্ধ বের হয়েছে। কী দিয়েছিস?

গরমমসল্লা।

ডিম কয়টা রান্না করছিস?

তিনটা। আমি একটা খাব, তোর দুটা।

চারটা ডিম দে। আমি তিনটা খাব।

আচ্ছা। তুই ঢাকায় যুদ্ধ করার জন্যে ঢুকেছিস?

না। বিশ্রাম নিতে এসেছিলাম। মরির সঙ্গে দেখা করার শখ ছিল। দেখা शला न्ग।

মরিটা কে?

আমার বউ, আদর করে মারি ডাকি। মরিয়মকে শর্ট করে মরি।

শাহেদ বিরক্ত গলায় বলল, তোর সবকিছুই উদ্ভট। আদর করে কেউ কাউকে মরি ডাকে!

একেকজনের আদরের ভঙ্গি একেকরকম। তুই ভাবিকে আদর করে কী ডাকিস?

জেপ ডাকি।

জেপ ডাকিস মানে? জোপের মানে কী?

কোনো মানে নাই।

মানে অবশ্যই আছে, তুই বলতে চাস না। না বললে নাই। ভাবির কাছ থেকে জেনে নেব। দেখা হলে আমি তাকে ডাকব জেপ ভাবি।

শাহেদের চোখে সঙ্গে সঙ্গে পানি এসে গেল। নাইমুলের মুখ থেকে জেপ ভাবি শোনার পরপরেই শাহেদের চোখের সামনে সুন্দর একটা ছবি ভেসে উঠেছে। সে, নাইমুল, আসমানী আর রুনি তারা চারজন যেন কোথায় বেড়াতে গেছে। অসম্ভব সুন্দর একটা জায়গা। দূরে পাহাড় দেখা যাচ্ছে। তাদের সবারই একটু শীত শীত করছে। এর মধ্যে নাইমুল আসমানীকে খুব বিরক্ত করছে। একটু পর পর বলছে–জেপ ভাবি, জেপ ভাবি।

নাইমুল বাথরুম থেকে বলল, তোর রান্না কি হয়েছে?

একটু বাকি আছে।

শেষ হলে আমাকে বলবি, তখন বাথরুম থেকে বের হবে। স্ট্রেইট খেতে বসব। রান্না শেষ না হওয়া পর্যন্ত গায়ে পানি ঢালতেই থাকব।

ঠাণ্ডা লাগাবি তো।

আমরা যারা মুক্তিতে আছি তারা ওয়াটারপ্রািফ ঘড়ির মতো ঠাণ্ডাপ্রািফ হয়ে গেছি। রোদবৃষ্টিতে এখন কিছুই হয় না। ভাবির হাতে হাঁসের মাংস খেতে ইচ্ছা! করছে। একবার ভাবি রান্না করেছিল, আমি একাই একটা আস্ত হাঁস খেয়ে ফেলেছিলাম। ভাবি আমার নাম দিয়েছিল হাস রাক্ষস! তোর মনে আছে?

মনে আছে।



খেতে বসে নাইমুল খিচুড়ি ছানাছানি করতে লাগল। শাহেদের দিকে তাকিয়ে করুণ গলা করে বলল, ক্ষিধা কেন জানি চলে গেছে। এখন শুধু ঘুম পাচ্ছে। আমার ভাগের খিচুড়ি রেখে দে। ঘুম ভাঙলে খাব।

শাহেদ বলল, কিছুই তো মুখে দিলি না।

ক্ষিধেটা ঘুমের দিকে টার্ন নিয়ে নিয়েছে। এখন না ঘুমালে মরে যাব।

নাইমুল খাওয়া ছেড়ে উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলল, তোর জন্যে একটা উপহার। আমি নিয়ে এসেছি। উপহারটা শুরুতেই দিতে পারতাম। ইচ্ছা করে দেরি করলাম।

শাহেদ বিস্মিত হয়ে বলল, কী উপহার?

একটা চিঠি।

কার চিঠি?

কোথায় ঘুমাব সেই জায়গাটা আগে দেখিয়ে দে। ঘুমিয়ে পড়লে খবরদার আমাকে জাগাবি না। তোর বাসায় মিলিটারি ঢুকে পড়লেও না। আমার প্যান্টের পকেটে চিঠিটা আছে। নিয়ে পড়।



শাহেদ চিঠি পড়ছে। তার কাছে মনে হচ্ছে ভূমিকম্প হচ্ছে। বাড়িঘর দুলছে। শা শা। শব্দ হচ্ছে। কানের পাশ দিয়ে গরম বাতাস যাচ্ছে। প্ৰবল আনন্দের সময় এরকম অনুভূতি হয় তার জানা ছিল না। রুলটানা কাগজে ছোট্ট চিঠি–

জেপ গো,

আমি রুনিকে নিয়ে ভালো আছি! শরণার্থী শিবিরে ছিলাম, তোমার বন্ধু নাইমুল সাহেব সেখান থেকে এনে তার এক আত্মীয় বাড়িতে রেখেছেন। সেই বাড়িতে আমরা অতি যত্নে আছি। নিরাপদে আছি।

ইতি–
তোমার জেপ, আসমানী

শাহেদ চিঠি হাতে নাইমুলের বিছানার পাশে দাঁড়িয়ে আছে। নাইমুল শিশুদের মতো কুণ্ডলি পাকিয়ে ঘুমাচ্ছে। আরামের গাঢ় ঘুম।
 

Users who are viewing this thread

Back
Top