এখন সময় অন্যরকম। এই সময়ের নাম সংগ্রামের সময়। এই সময়ে মানুষজন কোনো বাধাধরা নিয়মে চলে না। জুম্মাবারে মুসল্লিরা প্ৰবল আতঙ্ক নিয়ে মসজিদে প্রবেশ করেন এবং কেউ কিছু শুনতে চান না।
ইরতাজউদ্দিন মাথা নিচু করে ইমামের জায়নামাজে বসে আছেন। তাঁর হাতে তসবি। তসবির নিরানব্বইটা দানা তিনি এক এক করে টানছেন এবং একেক দানায় আল্লাহপাকের একেকটি নাম স্মরণ করছেন।
ইয়া রাহমানু : হে দয়াময়।
ইয়া সাদেকু : হে সত্যবাদী।
ইয়া কুদ্দুসু : হে পবিত্র।
ইয়া মুমীতু : হে মৃত্যুদাতা।
ইরতাজউদ্দিন ইয়া মুমীতু বলে থেমে গেলেন। আল্লাহপাকের পরের নামগুলি এখন আর তাঁর মনে পড়ছে না। ঘুরেফিরে মাথায় আসছে ইয়া মুমীতু ইয়া মুমীতু।
মসজিদের বাইরে উঠানের দক্ষিণ পাশে কদমগাছের ছায়ায় চারজন হিন্দু বসে আছে। তাদের একজন মিষ্টির দোকানের মালিক পরেশ, ধুতি পরে আছে। চরম দুঃসময়ে সে ধুতি পরার সাহস দেখিয়েছে। কারণ আজ জুম্মা নামাজের পর তারা মুসলমান হবে। মুসলমান হবার পর লুঙি-পাঞ্জাবি পরবে। কাজেই শেষবারের মতো ধুতি পরা যায়। চারজন হিন্দুর মধ্যে দুজন নমশূদ্র। নমশূদ্ররা সাহসী হয়–এমন কথা চালু থাকলেও এরা ভয়ে কুঁকড়ে আছে।
হিন্দু মুসলমান হচ্ছে–এই দৃশ্য দেখার জন্যে ক্যাপ্টেন সাহেব আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। এই চার হিন্দুর জন্যে মুসলমান নাম তিনিই ঠিক করে দিয়েছেন।
আবদুর রহমান।
আবদুর কাদের।
আবদুর হক।
আবদুর সালেহ।
ক্যাপ্টেন সাহেবের ইচ্ছা ছিল চারজনকেই একটা করে কোরান শরীফ দেবেন। নীলগঞ্জের একমাত্র লাইব্রেরিতে কোনো কোরান শরীফ পাওয়া যায় নি। ক্যাপ্টেন সাহেব এতে বিরক্ত হয়েছেন।
যে চারজনকে আজ মুসলমান করা হবে তাদের যেন নিয়মমাফিক খৎনা করানো হয়–সেই বিষয়েও ক্যাপ্টেন সাহেব নির্দেশ দিয়েছেন। হাজামকে খবর দেয়া হয়েছে। সে ধারালো বাঁশের চল্টা দিয়ে খৎনা করবে। ক্যাপ্টেন সাহেবের ধারণা এই দৃশ্যও উপভোগ্য হবে। তার নিজের ক্যামেরা ছিল না। এই মজার দৃশ্য ক্যামেরায় তুলে রাখার জন্যে তিনি ক্যামেরার ব্যবস্থাও করেছেন।
পৌনে একটায় জুম্মার নামাজের আযান দেয়া হলো। আযানের পরপরই ইরতাজউদ্দিন মসজিদ থেকে বের হয়ে কদমগাছের কাছে গেলেন। গাছের নিচের চারজনই নড়েচড়ে বসল। এদের একজন শুধু তার চোখে চোখ রাখল। অন্যরা মাটির দিকেই তাকিয়ে রইল।
ইরতাজউদ্দিন বললেন, আপনারা ভালো আছেন?
তিনজন হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়ল। একজন অন্যদিকে তাকিয়ে রইল।
ইরতাজউদ্দিন বললেন, আপনারাই শুধু মুসলমান হবেন? আপনাদের রবারের কেউ হবে না?
পরেশ বলল, সবেই হবে। প্রথমে আমরা, তারপর পরিবার।
ইরতাজউদ্দিন বললেন, আপনাদের ধর্ম কী বলে আমি জানি না। আমাদের ধর্ম বলে জীবন বাঁচানো ফরজ। মুসলমান হলে যদি জীবন রক্ষা হয়, তাহলে মুসলমান হন। জীবন রক্ষা করেন।
মুকুল সাহা ধুতির এক প্রান্ত দিয়ে চোখ ঢেকে ফুঁপিয়ে উঠল। ইরতাজউদ্দিন তার দিকে তাকিয়ে বললেন, পবিত্র কোরান মজিদে একটা বিখ্যাত আয়াত আছে— লাকুম দিনুকুম ওয়ালিয়া দ্বিনি। যার যার ধর্ম তার তার কাছে। ইসলাম অন্য ধর্মের উপর জবরদস্তি করে না।
ইরতাজউদিনের আরো কিছু বলার ইচ্ছা ছিল, এর মধ্যেই মুয়াজ্জিন মুনশি ফজলুল হক তার কাছে ছুটে এসে বলল, ক্যাপ্টেন সাহেব থানা কম্পাউন্ড থেকে বের হয়েছেন। আজ তাঁর সঙ্গে ছয়জন আছেন। ক্যাপ্টেন সাহেবকে নিয়ে সাতজন।
ইরতাজউদ্দিন বললেন, জুম্মার নামাজ আমি পড়াব না। এখন থেকে আপনি পড়াবেন।
এইটা কী বলেন!
ইরতাজউদ্দিন বললেন, কেন জুম্মার নামাজ পড়াব না। সেই ব্যাখ্যা আজ নামাজ শুরুর আগে দিতে চেয়েছিলাম, কিন্তু দিব না। আমি এখন চলে যাব।
জুম্মার নামাজও পড়বেন না?
না!
এইসব কী বলতেছেন!
যা বলতেছি চিন্তাভাবনা করে বলতেছি। এখন থেকে আমি জুম্মার নামাজ পড়ব না। পরাধীন দেশে জুম্মার নামাজ হয় না। নবি-এ-করিম যতদিন মক্কায় ছিলেন জুম্মার নামাজ পড়েন নাই। তিনি মদীনায় হিজরত করার পর একতা সূরা নাজেল হয়। সূরার নাম জুমুয়া। সেই সূরায় জুম্মার নামাজের নির্দেশ দেয়া হয়। তখন তিনি জুম্মার নামাজ শুরু করেন।
মাথা খারাপের মতো কথা বলবেন না। ক্যাপ্টেন সাহেব চলে এসেছেন।
আসুক। আমি চলে যাচ্ছি।
ইরতাজউদ্দিন মাথা নিচু করে ইমামের জায়নামাজে বসে আছেন। তাঁর হাতে তসবি। তসবির নিরানব্বইটা দানা তিনি এক এক করে টানছেন এবং একেক দানায় আল্লাহপাকের একেকটি নাম স্মরণ করছেন।
ইয়া রাহমানু : হে দয়াময়।
ইয়া সাদেকু : হে সত্যবাদী।
ইয়া কুদ্দুসু : হে পবিত্র।
ইয়া মুমীতু : হে মৃত্যুদাতা।
ইরতাজউদ্দিন ইয়া মুমীতু বলে থেমে গেলেন। আল্লাহপাকের পরের নামগুলি এখন আর তাঁর মনে পড়ছে না। ঘুরেফিরে মাথায় আসছে ইয়া মুমীতু ইয়া মুমীতু।
মসজিদের বাইরে উঠানের দক্ষিণ পাশে কদমগাছের ছায়ায় চারজন হিন্দু বসে আছে। তাদের একজন মিষ্টির দোকানের মালিক পরেশ, ধুতি পরে আছে। চরম দুঃসময়ে সে ধুতি পরার সাহস দেখিয়েছে। কারণ আজ জুম্মা নামাজের পর তারা মুসলমান হবে। মুসলমান হবার পর লুঙি-পাঞ্জাবি পরবে। কাজেই শেষবারের মতো ধুতি পরা যায়। চারজন হিন্দুর মধ্যে দুজন নমশূদ্র। নমশূদ্ররা সাহসী হয়–এমন কথা চালু থাকলেও এরা ভয়ে কুঁকড়ে আছে।
হিন্দু মুসলমান হচ্ছে–এই দৃশ্য দেখার জন্যে ক্যাপ্টেন সাহেব আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। এই চার হিন্দুর জন্যে মুসলমান নাম তিনিই ঠিক করে দিয়েছেন।
আবদুর রহমান।
আবদুর কাদের।
আবদুর হক।
আবদুর সালেহ।
ক্যাপ্টেন সাহেবের ইচ্ছা ছিল চারজনকেই একটা করে কোরান শরীফ দেবেন। নীলগঞ্জের একমাত্র লাইব্রেরিতে কোনো কোরান শরীফ পাওয়া যায় নি। ক্যাপ্টেন সাহেব এতে বিরক্ত হয়েছেন।
যে চারজনকে আজ মুসলমান করা হবে তাদের যেন নিয়মমাফিক খৎনা করানো হয়–সেই বিষয়েও ক্যাপ্টেন সাহেব নির্দেশ দিয়েছেন। হাজামকে খবর দেয়া হয়েছে। সে ধারালো বাঁশের চল্টা দিয়ে খৎনা করবে। ক্যাপ্টেন সাহেবের ধারণা এই দৃশ্যও উপভোগ্য হবে। তার নিজের ক্যামেরা ছিল না। এই মজার দৃশ্য ক্যামেরায় তুলে রাখার জন্যে তিনি ক্যামেরার ব্যবস্থাও করেছেন।
পৌনে একটায় জুম্মার নামাজের আযান দেয়া হলো। আযানের পরপরই ইরতাজউদ্দিন মসজিদ থেকে বের হয়ে কদমগাছের কাছে গেলেন। গাছের নিচের চারজনই নড়েচড়ে বসল। এদের একজন শুধু তার চোখে চোখ রাখল। অন্যরা মাটির দিকেই তাকিয়ে রইল।
ইরতাজউদ্দিন বললেন, আপনারা ভালো আছেন?
তিনজন হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়ল। একজন অন্যদিকে তাকিয়ে রইল।
ইরতাজউদ্দিন বললেন, আপনারাই শুধু মুসলমান হবেন? আপনাদের রবারের কেউ হবে না?
পরেশ বলল, সবেই হবে। প্রথমে আমরা, তারপর পরিবার।
ইরতাজউদ্দিন বললেন, আপনাদের ধর্ম কী বলে আমি জানি না। আমাদের ধর্ম বলে জীবন বাঁচানো ফরজ। মুসলমান হলে যদি জীবন রক্ষা হয়, তাহলে মুসলমান হন। জীবন রক্ষা করেন।
মুকুল সাহা ধুতির এক প্রান্ত দিয়ে চোখ ঢেকে ফুঁপিয়ে উঠল। ইরতাজউদ্দিন তার দিকে তাকিয়ে বললেন, পবিত্র কোরান মজিদে একটা বিখ্যাত আয়াত আছে— লাকুম দিনুকুম ওয়ালিয়া দ্বিনি। যার যার ধর্ম তার তার কাছে। ইসলাম অন্য ধর্মের উপর জবরদস্তি করে না।
ইরতাজউদিনের আরো কিছু বলার ইচ্ছা ছিল, এর মধ্যেই মুয়াজ্জিন মুনশি ফজলুল হক তার কাছে ছুটে এসে বলল, ক্যাপ্টেন সাহেব থানা কম্পাউন্ড থেকে বের হয়েছেন। আজ তাঁর সঙ্গে ছয়জন আছেন। ক্যাপ্টেন সাহেবকে নিয়ে সাতজন।
ইরতাজউদ্দিন বললেন, জুম্মার নামাজ আমি পড়াব না। এখন থেকে আপনি পড়াবেন।
এইটা কী বলেন!
ইরতাজউদ্দিন বললেন, কেন জুম্মার নামাজ পড়াব না। সেই ব্যাখ্যা আজ নামাজ শুরুর আগে দিতে চেয়েছিলাম, কিন্তু দিব না। আমি এখন চলে যাব।
জুম্মার নামাজও পড়বেন না?
না!
এইসব কী বলতেছেন!
যা বলতেছি চিন্তাভাবনা করে বলতেছি। এখন থেকে আমি জুম্মার নামাজ পড়ব না। পরাধীন দেশে জুম্মার নামাজ হয় না। নবি-এ-করিম যতদিন মক্কায় ছিলেন জুম্মার নামাজ পড়েন নাই। তিনি মদীনায় হিজরত করার পর একতা সূরা নাজেল হয়। সূরার নাম জুমুয়া। সেই সূরায় জুম্মার নামাজের নির্দেশ দেয়া হয়। তখন তিনি জুম্মার নামাজ শুরু করেন।
মাথা খারাপের মতো কথা বলবেন না। ক্যাপ্টেন সাহেব চলে এসেছেন।
আসুক। আমি চলে যাচ্ছি।