আমরা ক্লান্ত ও ক্ষুধার্ত হয়ে সর্ষিনা পৌঁছলাম বিকেলে। মাদ্রাসার ছাত্ররা দুধে রুটি ছিঁড়ে চিনি মাখিয়ে খেতে দিল। গপগপ করে খেলাম। তাদের যে মিলিটারিরা কিছুই বলছে না–এ জন্যে তাদের মধ্যে আনন্দ ও উল্লাসের সীমা নেই। তাদের কাছেই জানলাম, পিরোজপুরের সঙ্গে সর্ষিনার পীর সাহেবের সরাসরি টেলিফোন যোগাযোগের ব্যবস্থা আছে। ক্যাপ্টেন সাহেব দিনের মধ্যে তিন-চার বার টেলিফোন করেন। অপারেশনে যাবার আগে পীর সাহেবের দোয়া নিয়ে যান। আমরা দুভাই মাদ্রাসায় ভর্তি হতে এসেছি শুনে তারা যথেষ্ট আনন্দ প্ৰকাশ করল। আমরা আমাদের পরিচয় প্ৰকাশ করলাম না।
সঙ্গের মাওলানা সাহেব সন্ধ্যার আগে আগে আমাদের দুজনকে পীর সাহেবের কাছে উপস্থিত করলেন। পীর সাহেব চারদিকে কিছু লোকজন নিয়ে গল্প করছেন। কাছে যাওয়ার সাহস হলো না। শুনলাম, মৌলানা পীর সাহেবকে নিচু গলায় কিছু বলছেন এবং পীর সাহেব রেগে যাচ্ছেন। সব কথা বুঝতে পারছি না। পীর সাহেব বেশিরভাগ কথার জবাবই দিচ্ছেন; উর্দুতে। আমার বাবার প্রসঙ্গে কী কথা যেন বলা হলো; পীর সাহেব বললেন, আমি এই লোকের কথা জানি। বিরাট দেশোদ্রোহী। ক্যাপ্টেন সাহেবের সঙ্গে আমার কথা হয়েছে। যাও যাও, তুমি চলে যাও।
মাওলানা সাহেব আরো নিচু গলায় সম্ভবত আমাদের দুভাই সম্পর্কে কিছু বললেন। পীর সাহেব ভয়ঙ্কর রেগে বললেন–না, না। এদের কেন এখানে এনেছ?
মাওলানা সাহেব আমাদের নিয়ে ফিরে চললেন। কী কথাবার্তা তার হয়েছে। তিনি কিছুই ভেঙে বললেন না। নৌকায় করে ফিরছি এবং প্রার্থনা করছি খুব তাড়াতাড়ি যেন চারদিক অন্ধকার হয়ে যায়। অন্ধকারে মিলিটারিরা গানবোট নিয়ে বের হয় না। খোলা নৌকার পাটাতনে বসে আছি। ভরা জোয়ার, আকাশ মেঘাচ্ছন্ন। টিপটিপ বৃষ্টি পড়ছে। হঠাৎ মাঝি বলল, দেহেন দেহেন। তোকালাম। দুটি মৃতদেহ ভাসতে ভাসতে যাচ্ছে; এমন কোনো দৃশ্য নয় যে অবাক বিস্ময়ে দেখতে হবে। খুবই সাধারণ দৃশ্য। রোজই অসংখ্য দেহ নদীতে ভাসতে ভাসতে যায়। শকুনের পাল দেহগুলির উপর বসে বসে বিমোয়। নরমাংসে তাদের এখন আর রুচি নেই। কিন্তু আজকের মৃতদেহ দুটির উপর শকুন বসে নেই। আমি এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি। চোখ ফেরাতে পারছি না। সবুজ। সার্ট গায়ে দেয়া ত্রিশ-পঁয়ত্ৰিশ বছরের একজন যুবকের মৃতদেহ। তার গলা জড়িয়ে ধরে আছে সাত-আট বছরের একটি বালিকা। বালিকার হাতভর্তি লাল কাচের চুড়ি। মৃত্যুর আগ মুহুর্তে হয়তো পরম নির্ভরতায় এই বালিকা তার বাবার গলা জড়িয়ে ধরে রেখেছিল।
এখন আমরা বাস করছি স্বাধীন দেশে। স্বাধীন বাংলাদেশ। এই দেশে সবচে সম্মানিত, সবচে বড় পদকটির নাম–স্বাধীনতা পদক। বঙ্গবীর আতাউল গণি ওসমানী, বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম, মুনীর চৌধুরী, রনদা প্ৰসাদ সাহা, শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীন এই পদক পেয়েছেন।
মুক্তিযুদ্ধের ননছর পর, মহান বিজয় দিবসে রেডিও ও টেলিভিশনের খবরে শুনলাম–স্বাধীনতা পদক দেয়া হয়েছে সর্ষিনার পীর মাওলানা আবু জাফর মোহাম্মদ সালেহকে।
হায়, এই দুঃখ আমি কোথায় রাখি?
সঙ্গের মাওলানা সাহেব সন্ধ্যার আগে আগে আমাদের দুজনকে পীর সাহেবের কাছে উপস্থিত করলেন। পীর সাহেব চারদিকে কিছু লোকজন নিয়ে গল্প করছেন। কাছে যাওয়ার সাহস হলো না। শুনলাম, মৌলানা পীর সাহেবকে নিচু গলায় কিছু বলছেন এবং পীর সাহেব রেগে যাচ্ছেন। সব কথা বুঝতে পারছি না। পীর সাহেব বেশিরভাগ কথার জবাবই দিচ্ছেন; উর্দুতে। আমার বাবার প্রসঙ্গে কী কথা যেন বলা হলো; পীর সাহেব বললেন, আমি এই লোকের কথা জানি। বিরাট দেশোদ্রোহী। ক্যাপ্টেন সাহেবের সঙ্গে আমার কথা হয়েছে। যাও যাও, তুমি চলে যাও।
মাওলানা সাহেব আরো নিচু গলায় সম্ভবত আমাদের দুভাই সম্পর্কে কিছু বললেন। পীর সাহেব ভয়ঙ্কর রেগে বললেন–না, না। এদের কেন এখানে এনেছ?
মাওলানা সাহেব আমাদের নিয়ে ফিরে চললেন। কী কথাবার্তা তার হয়েছে। তিনি কিছুই ভেঙে বললেন না। নৌকায় করে ফিরছি এবং প্রার্থনা করছি খুব তাড়াতাড়ি যেন চারদিক অন্ধকার হয়ে যায়। অন্ধকারে মিলিটারিরা গানবোট নিয়ে বের হয় না। খোলা নৌকার পাটাতনে বসে আছি। ভরা জোয়ার, আকাশ মেঘাচ্ছন্ন। টিপটিপ বৃষ্টি পড়ছে। হঠাৎ মাঝি বলল, দেহেন দেহেন। তোকালাম। দুটি মৃতদেহ ভাসতে ভাসতে যাচ্ছে; এমন কোনো দৃশ্য নয় যে অবাক বিস্ময়ে দেখতে হবে। খুবই সাধারণ দৃশ্য। রোজই অসংখ্য দেহ নদীতে ভাসতে ভাসতে যায়। শকুনের পাল দেহগুলির উপর বসে বসে বিমোয়। নরমাংসে তাদের এখন আর রুচি নেই। কিন্তু আজকের মৃতদেহ দুটির উপর শকুন বসে নেই। আমি এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি। চোখ ফেরাতে পারছি না। সবুজ। সার্ট গায়ে দেয়া ত্রিশ-পঁয়ত্ৰিশ বছরের একজন যুবকের মৃতদেহ। তার গলা জড়িয়ে ধরে আছে সাত-আট বছরের একটি বালিকা। বালিকার হাতভর্তি লাল কাচের চুড়ি। মৃত্যুর আগ মুহুর্তে হয়তো পরম নির্ভরতায় এই বালিকা তার বাবার গলা জড়িয়ে ধরে রেখেছিল।
এখন আমরা বাস করছি স্বাধীন দেশে। স্বাধীন বাংলাদেশ। এই দেশে সবচে সম্মানিত, সবচে বড় পদকটির নাম–স্বাধীনতা পদক। বঙ্গবীর আতাউল গণি ওসমানী, বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম, মুনীর চৌধুরী, রনদা প্ৰসাদ সাহা, শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীন এই পদক পেয়েছেন।
মুক্তিযুদ্ধের ননছর পর, মহান বিজয় দিবসে রেডিও ও টেলিভিশনের খবরে শুনলাম–স্বাধীনতা পদক দেয়া হয়েছে সর্ষিনার পীর মাওলানা আবু জাফর মোহাম্মদ সালেহকে।
হায়, এই দুঃখ আমি কোথায় রাখি?