What's new
Nirjonmela Desi Forum

Talk about the things that matter to you! Wanting to join the rest of our members? Feel free to sign up today and gain full access!

Collected ছোছনা ও জননীর গল্প - উপন্যাস (2 Viewers)

আমরা ক্লান্ত ও ক্ষুধার্ত হয়ে সর্ষিনা পৌঁছলাম বিকেলে। মাদ্রাসার ছাত্ররা দুধে রুটি ছিঁড়ে চিনি মাখিয়ে খেতে দিল। গপগপ করে খেলাম। তাদের যে মিলিটারিরা কিছুই বলছে না–এ জন্যে তাদের মধ্যে আনন্দ ও উল্লাসের সীমা নেই। তাদের কাছেই জানলাম, পিরোজপুরের সঙ্গে সর্ষিনার পীর সাহেবের সরাসরি টেলিফোন যোগাযোগের ব্যবস্থা আছে। ক্যাপ্টেন সাহেব দিনের মধ্যে তিন-চার বার টেলিফোন করেন। অপারেশনে যাবার আগে পীর সাহেবের দোয়া নিয়ে যান। আমরা দুভাই মাদ্রাসায় ভর্তি হতে এসেছি শুনে তারা যথেষ্ট আনন্দ প্ৰকাশ করল। আমরা আমাদের পরিচয় প্ৰকাশ করলাম না।

সঙ্গের মাওলানা সাহেব সন্ধ্যার আগে আগে আমাদের দুজনকে পীর সাহেবের কাছে উপস্থিত করলেন। পীর সাহেব চারদিকে কিছু লোকজন নিয়ে গল্প করছেন। কাছে যাওয়ার সাহস হলো না। শুনলাম, মৌলানা পীর সাহেবকে নিচু গলায় কিছু বলছেন এবং পীর সাহেব রেগে যাচ্ছেন। সব কথা বুঝতে পারছি না। পীর সাহেব বেশিরভাগ কথার জবাবই দিচ্ছেন; উর্দুতে। আমার বাবার প্রসঙ্গে কী কথা যেন বলা হলো; পীর সাহেব বললেন, আমি এই লোকের কথা জানি। বিরাট দেশোদ্রোহী। ক্যাপ্টেন সাহেবের সঙ্গে আমার কথা হয়েছে। যাও যাও, তুমি চলে যাও।

মাওলানা সাহেব আরো নিচু গলায় সম্ভবত আমাদের দুভাই সম্পর্কে কিছু বললেন। পীর সাহেব ভয়ঙ্কর রেগে বললেন–না, না। এদের কেন এখানে এনেছ?

মাওলানা সাহেব আমাদের নিয়ে ফিরে চললেন। কী কথাবার্তা তার হয়েছে। তিনি কিছুই ভেঙে বললেন না। নৌকায় করে ফিরছি এবং প্রার্থনা করছি খুব তাড়াতাড়ি যেন চারদিক অন্ধকার হয়ে যায়। অন্ধকারে মিলিটারিরা গানবোট নিয়ে বের হয় না। খোলা নৌকার পাটাতনে বসে আছি। ভরা জোয়ার, আকাশ মেঘাচ্ছন্ন। টিপটিপ বৃষ্টি পড়ছে। হঠাৎ মাঝি বলল, দেহেন দেহেন। তোকালাম। দুটি মৃতদেহ ভাসতে ভাসতে যাচ্ছে; এমন কোনো দৃশ্য নয় যে অবাক বিস্ময়ে দেখতে হবে। খুবই সাধারণ দৃশ্য। রোজই অসংখ্য দেহ নদীতে ভাসতে ভাসতে যায়। শকুনের পাল দেহগুলির উপর বসে বসে বিমোয়। নরমাংসে তাদের এখন আর রুচি নেই। কিন্তু আজকের মৃতদেহ দুটির উপর শকুন বসে নেই। আমি এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি। চোখ ফেরাতে পারছি না। সবুজ। সার্ট গায়ে দেয়া ত্রিশ-পঁয়ত্ৰিশ বছরের একজন যুবকের মৃতদেহ। তার গলা জড়িয়ে ধরে আছে সাত-আট বছরের একটি বালিকা। বালিকার হাতভর্তি লাল কাচের চুড়ি। মৃত্যুর আগ মুহুর্তে হয়তো পরম নির্ভরতায় এই বালিকা তার বাবার গলা জড়িয়ে ধরে রেখেছিল।

এখন আমরা বাস করছি স্বাধীন দেশে। স্বাধীন বাংলাদেশ। এই দেশে সবচে সম্মানিত, সবচে বড় পদকটির নাম–স্বাধীনতা পদক। বঙ্গবীর আতাউল গণি ওসমানী, বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম, মুনীর চৌধুরী, রনদা প্ৰসাদ সাহা, শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীন এই পদক পেয়েছেন।

মুক্তিযুদ্ধের ননছর পর, মহান বিজয় দিবসে রেডিও ও টেলিভিশনের খবরে শুনলাম–স্বাধীনতা পদক দেয়া হয়েছে সর্ষিনার পীর মাওলানা আবু জাফর মোহাম্মদ সালেহকে।

হায়, এই দুঃখ আমি কোথায় রাখি?
 
ঢাকা শহরে আজ শাহেদের শেষ রাত্রিযাপন।

সে মনস্থির করে ফেলেছে ভোরবেলা কুমিল্লা রওনা হবে। কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামে আসমানীর দাদার বাড়ি। শাহেদ সেখানে কখনো যায় নি। তাতে সমস্যা নেই। খুঁজে বের করতে পারবে। আসমানীর দাদা তার গ্রামের প্রভাবশালী মানুষ ছিলেন। তিনি রেঙ্গুনে ব্যবসা করতেন বলে গ্রামের বাড়ি রেঙ্গুন বাড়ি নামে পরিচিত। আসমানীর দাদার নাম শাহেদের মনে নাই। রেঙ্গুন বাড়ি নাম মনে আছে। শাহেদের ধারণা রেঙ্গুন বাড়িতে উপস্থিত হলেই সে একসঙ্গে সবার দেখা পাবে।

কুমিল্লার পাশেই আগরতলা। এমনও হতে পারে সবাই বাড়িঘর ছেড়ে আগরতলা চলে গেছে। সে-রকম হলে শাহেদও আগরতলা যাবে। শরণার্থী শিবির ঘুরে ঘুরে দেখবে। এতগুলি মানুষ হারিয়ে যেতে পারে না।

আবার এটাও হতে পারে শাহেদ যেদিন রওনা হবে, সেদিন দুপুরে বা সন্ধ্যায় আসমানীরা এসে উপস্থিত হবে। আসমানী যেন তার খোঁজ পায়, সে ব্যবস্থাও শাহেদ করেছে। বাথরুমের আয়নায় একটা চিঠি বুলিয়ে রেখেছে। চিঠিতে লেখা–

আসমানী,

তুমি যদি এই চিঠি পড়, তাহলে ধরে নিও আমি এখনো নিরাপদে আছি। আমি তোমাদের খোঁজ বের করার চেষ্টায় ঢাকা ছেড়েছি। আমাকে নিয়ে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে না। একটা বড় বিপদ বারবার আসে না। কাজেই ধরে নাও আমি নিরাপদেই থাকব। তুমি আমার জন্যে এই বাড়িতেই অপেক্ষা করবে। রান্নাঘরে চাল, ডাল, আটা এবং তেল রেখে দিয়েছি। ডালের কোটা ভালোমতো দেখবে।

ইতি

শাহেদ

ডালের কোটা সে আন্ডারলাইন করে দিয়েছে। ডালের কোটায় ডালের নিচে টাকা রাখা আছে। আসমানী হয়তো খালিহাতে উপস্থিত হবে। তার টাকার দরকার হবে।

শাহেদের নিজের টাকা এখন আর কিছুই অবশিষ্ট নেই। সে চলছে গৌরাঙ্গের টাকায়। গৌরাঙ্গের কোনো খোঁজ নেই। গৌরাঙ্গের খোঁজ বের করার জন্যে সে ভয়ে ভয়ে একদিন পুরনো ঢাকায় গিয়েছিল। গৌরাঙ্গের বাড়ি তালাবন্ধ। শাহেদ দরজার নিচ দিয়ে একটা চিঠি দিয়ে এসেছে। সেই চিঠি পড়লে গৌরাঙ্গ অবশ্যই তার সঙ্গে দেখা করত। বোঝাই যাচ্ছে গৌরাঙ্গ চিঠি পায় নি।

শাহেদের কুমিল্লায় যাবার ব্যাপারে তার অফিসের বি হ্যাপী স্যার অনেক সাহায্য করেছেন। এই অফিসে আইডেনটিটি কার্ডের কোনো ব্যবস্থা ছিল না। তিনি আইডেনটিটি কার্ড ছাপিয়ে, ছবি লাগিয়ে সব কর্মচারীকে দিয়েছেন। শাহেদের জন্যে আলাদা যে কাজটা করেছেন তা হলো–এক কর্নেল সাহেবের দেয়া পাশের ব্যবস্থা করেছেন। সেই পাশে লেখা–শাহেদুদিন নামের এই লোক খাঁটি পাকিস্তানি। তাকে যেন কোনো হ্যারাসমেন্ট না করা হয়। বি হ্যাপী স্যারের কিছু কথা শাহেদের কাছে অদ্ভুত মনে হয়েছে। এই অবাঙালি মানুষ শাহেদকে তার খাসকামরায় নিয়ে দরজা বন্ধ করে নিচু গলায় বলেছেন, আমি ঠিক করেছি। মুক্তিযোদ্ধা হবো। আমার বয়স যুদ্ধে যাবার মতো না। তারপরেও চেষ্টা করছি। যোগাযোগ বের করতে পারছি না। তবে পারব।

শাহেদ বলেছে, আপনি যুদ্ধ করবেন কেন?

বি হ্যাপী স্যার বলেছেন, কেন করব না বলো? আমি এই দেশে পথের ফকির হয়ে ঢুকেছিলাম। এই দেশে ব্যবসা-বাণিজ্য করে আমি অবস্থার পরিবর্তন করেছি। আজ আমার বাড়ি আছে, গাড়ি আছে, ব্যাংকে টাকা আছে। যে দেশ আমাকে এত কিছু দিয়েছে, সেই দেশকে আমি কিছু দেব না?

আপনার ফ্যামিলি? তারা কি আপনার সিদ্ধান্তের ব্যাপারে জানেন?

জানে। তারা পাকিস্তান চলে গেছে। তাদের চিন্তা ভিন্ন। প্রত্যেকেই প্ৰত্যেকের মতো চিন্তা করে।

শাহেদ বলল, স্যার, আপনার কি মনে হয় দেশ স্বাধীন হবে?

হবে। পাকিস্তানিদের দিন শেষ হয়ে আসছে। তারা মেয়েদের উপর অত্যাচার করছে। নারীদের উপর অত্যাচার আল্লাহ পছন্দ করেন না। যাই হোক, তুমি যাও। স্ত্রী-কন্যার খোঁজ বের করো। যে চিঠিটা তোমাকে জোগাড় করে দিয়েছি, সেই চিঠি তাবিজের মতো যত্ন করে রাখবে। বিপদে কাজে দিবে। বি হ্যাপি ম্যান। বি হ্যাপি।
 
ঢাকা থেকে বের হবার মুখে বেশ কিছু চেকপোস্ট পার হতে হয়। রাজাকারদের চেক পোস্ট, পশ্চিমা পুলিশের চেক পোস্ট। সবশেষে সেনাবাহিনীর চেক পোস্ট। সব জায়গায় ডান্ডি কার্ড দেখাতে হয়। ডান্ডি কার্ড দেখার পর চলে ব্যাগ সুটকেস, তল্লাশী। একজন এসে ঘাড় টিপে দেখে ঘাড় নরম না শক্ত। ঘাড় শক্ত হলে পলাতক বাঙালি পুলিশ বা বিডিআর। রাইফেল কাঁধে ট্রেনিং-এর ফলে ঘাড় শক্ত হয়ে গেছে।

সবচে অপমানসূচক পরীক্ষাটা হলো খৎনা পরীক্ষা। প্যান্ট খুলে দেখাতে হয়। সত্যি খৎনা আছে কি-না! পশ্চিম পাকিস্তানি পুলিশরা এই পরীক্ষাটার সময় বেশ আনন্দ পায়। নানান ধরনের রসিকতা করে। হেসে একে অন্যের গায়ে সঁড়িয়ে পড়ার মতো অবস্থা হয়।

শাহেদকে এই পরীক্ষাও দিতে হলো। প্যান্ট-আন্ডারওয়ার খুলতে হলো। যে পরীক্ষা নিচ্ছে, তার হাতে অর্ধেক লাল অর্ধেক নীল রঙের মোটা একটা পেন্সিল। সে পেন্সিল দিয়ে খোঁচার মতো দিল; মনে হচ্ছে এই খোঁচা দেয়াতেই তার আনন্দ।

নাম বলো।

শাহেদ।

কিধার যাতা?

কুমিল্লা চৌদ্দগ্ৰাম।

ইধার যাতা কেউ?

মেরা পিতাজি বিমার। হাম মিলনা চাতে হে।

শাহেদ যে অসুস্থ পিতাকে দেখার জন্যেই যাচ্ছে, এটা দেখানোর জন্যে সে সঙ্গে একটা ঠোংগায় আঙ্গুর, আপেলও নিয়েছে। শাহেদ ফলের ঠোংগা দেখাল। তার ভাগ্য ভালো কর্নেল সাহেবের পাশ ছাড়াই সে বাসে উঠার সুযোগ পেল। কয়েকজন ছাড়া পায় নি, আটকা পড়ে আছে। জিজ্ঞাসাবাদ চলছে। তারা হয়তো ছাড়া পাবে, হয়তো পাবে না। অনিশ্চয়তা। The day and nights of uncertainity.

মেঘনা ফেরিতে উঠার সময় আবারো চেকিং। এবার চেক করতে এসেছে মিলিটারিরা। বোরকা পরে যে সব মহিলা এসেছেন, তাদেরও নেকাব খুলে মুখ দেখাতে হচ্ছে। তারা যে আসলেই জেনানা, মিলিটারি সে ব্যাপারে নিশ্চিত হতে চায়। যে মিলিটারির দায়িত্ব পড়েছে মহিলাদের চেক করা, সে ভদ্র। সবাইকেই বলছে, ডরো মৎ। তোম মেরা বহিন হ্যায়।

শাহেদের জীবনের অতি বিস্ময়কর ঘটনার একটি ফেরিতে ঘটল। সে এক ঠোংগা ঝালমুড়ি কিনেছে। সারাদিন কিছু খাওয়া হয় নি, ক্ষিধেয় নাড়িতুড়ি জ্বলে যাচ্ছে। ঝালমুড়ি খেয়ে ক্ষিধেটা কোনোমতে চাপা দেয়া। সে যখন মুড়ি মুখে দিতে যাচ্ছে, তখনই রুনির বয়েসি ভিখিরী ধরনের এক মেয়ে ঝাঁপ দিয়ে তার গায়ে পড়ল। তার ঝাপ্টায় হাতের মুড়ির ঠোংগা পড়ে গেল।

শাহেদ মেয়েটিকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে তুই কে বলে চিৎকার করতে গিয়ে থমকে গেল। এই মেয়ে তার অতি পরিচিত। এর নাম কংকন। মেয়েটার নিজের নাম কংকন বলতে পারে না। সে বলে ককন।

তুমি? তুমি কোথেকে? তোমার মা কোথায়? তোমার দাদু কোথায়?

মেয়েটি কোনো প্রশ্নেরই জবাব দিচ্ছে না। শাহেদের পায়ে ক্ৰমাগত মুখ ঘষছে।

কংকন আমার কথা শোন, এইখানে তুমি কার সঙ্গে এসেছ?

মেয়েটা এই প্রশ্নেরও উত্তর দিল না। শাহেদকে ঘিরে ছোটখাটো একটা ভিড় জমে গেল।

কংকন এখানে কার সঙ্গে এসেছে, সেই রহস্য ভেদ হলো। তার নাম রমজান। সে বাডডায় রং মিস্ত্রির কাজ করে। সে শাহেদকে পেয়ে পরম স্বস্তিবোধ করছে এটা বোঝা যাচ্ছে। ঘটনা হলো, ক্র্যাকডাউনের পর সে তার ছোটশালাকে নিয়ে বুড়িগঙ্গা পার হয়ে ওপারে চলে গিয়েছিল। সে একা না, তার সঙ্গে শত শত মানুষ। তখন মিলিটারি শুরু করল বোম্বিং। যে যেখানে পেরেছে, দৌড় দিয়ে পালিয়েছে। অবস্থা কিছুটা যখন শান্ত, তখন সে দেখে এই মেয়ে তার সঙ্গে। মেয়ে তার সার্ট ধরে আছে। কিছুতেই সার্ট ছাড়ে না।

বুঝছেন ভাইসব, মেয়ে কিছুই বলতে পারে না। বাপ-মায়ের নাম জানে। বাপ-মায়ের নাম দিয়া আমি কী করুম কেন? আমার দরকার ঠিকানা। আমি রঙ মিস্ত্রি। কাজকর্ম নাই–খায়া না-খায়া আছি। এরে পালিব ক্যামনে?

শাহেদ বলল, এখন যাচ্ছেন কোথায়? আমার বড়শালার বাড়িতে। সে বিবাহ করেছে মাইজদি। সেখানে তার দোকান আছে। ঠিক করেছিলাম তার কাছে মেয়েটারে রাইখা আসব। আল্লাহপাক আপনেরে মিলায়ে দিয়েছে। যন্ত্রণা ঘাড় থাইক্যা নামছে। ভাইজান, আপনে তার কে হন?

আমি তার চাচা।

আলহামদুলিল্লাহ, থাকেন এখন চাচায়-ভাইস্তিতে।

কংকন এখনো খামচি দিয়ে শাহেদের পা ধরে আছে। কিছুতেই মুখ তুলছে না। বারবার তার ছোট্ট শরীর কোপে কেঁপে উঠছে। শাহেদ তার পিঠে হাত রেখে বলল, কংকন ভয় পেও না। আমি তোমাকে তোমার বাবা-মার কাছে নিয়ে যাব। কংকন, ঠিক আছে?

হুঁ।

ক্ষিধে লেগেছে? কিছু খাবে? কলা খাবে? কলা কিনে দেই, একটা কলা খাও?

হুঁ।

শাহেদ কলা কিনে কংকনের হাতে দিতে গিয়ে দেখল, মেয়েটা ঘুমিয়ে পড়েছে। তার গা গরম। জ্বর এসেছে। ঘুমের মধ্যে বমি করে সে শাহেদের প্যান্ট ভিজিয়ে দিল।
 
কংকনের সঙ্গে আমার দেখা হয় নিউইয়র্কে। মুক্তধারার বিশ্বজিৎ আমাকে বইমেলায় নিয়ে গেছে। বাংলাদেশের প্রবাসী বাঙালিরা বইমেলা উপলক্ষে খুব হৈচৈ আনন্দ কবছে। খাবারের দোকান বসেছে। একদিকে ভিডিও প্রদর্শনী, বড় প্রজেকশন টিভিতে নাটক দেখানো হচ্ছে। শাড়ি-গয়নার দোকানও আছে। অতি জমজমাট অবস্থা। এর মধ্যে ত্রিশ-পঁয়ত্ৰিশ বছরের অতি রূপবতী এক তরুণী এসে পুরো বাঙালি কায়দায় আমাকে পা ছুঁয়ে সালাম করল। আমি চমকে পা সরিয়ে নিলাম।

তরুণী বলল, আপনাকে চাচা ডাকব, না স্যার ডাকব?

আমি বললাম, তোমার যা ডাকতে ইচ্ছা করে ডাক।

তাহলে চাচা ডাকি। স্যার ডাকলে মনে হবে। আপনি সত্যি আমার স্যার। এক্ষুনি আমাকে ধমক দেবেন। তাছাড়া আপনার চেহারাও রাগী রাগী।

তরুণীর গুছিয়ে কথা বলার ভঙ্গি বেশ ভালো লাগল। সে বলল, আমি আপনাকে আমার বাসায় নিয়ে যাব। আপনি তো লেখক মানুষ, আপনাকে সুন্দর একটা গল্প শুনাব।

আমি বললাম, শোনা গল্প আমি লিখি না।

সে বলল, আমার গল্পটা আপনার লিখতে ইচ্ছা করবে। এই নিয়ে আমি আপনার সঙ্গে এক হাজার ডলার বাজি রাখতে পারি।

মেলা শেষ করে আমি কংকনের সঙ্গে তার অ্যাপার্টমেন্টে গেলাম। নিউ ইয়র্কের অ্যাপার্টমেন্টগুলি যেমন হয় সেরকম। ছোট কিন্তু খুব গোছানো। এক কথায় বললে বলতে হবে, ছবির মতো সাজানো সংসার। কংকন বিয়ে করেছে এক আমেরিকানকে। সে কনস্ট্রাকশান ফার্মে চাকরি করে। তাদের একটা ছেলেও আছে। ছেলের নাম রবিন। তবে তাকে ডাকা হয় রবি নামে। ছেলে তার বাবার সঙ্গে লায়ন কিং ছবি দেখতে গিয়েছে। কংকন বলল, আপনি থাকতে থাকতেই ওরা এসে পড়বে। আমরা একসঙ্গে ডিনার করব।

আমাকে ডিনার পর্যন্ত থাকতে হবে?

অবশ্যই। তবে আপনার ভয় নেই–বাংলাদেশের মতো রাত দশটায় ডিনার না। এখানে সন্ধ্যা নামার সঙ্গে সঙ্গেই ডিনার করা হয়। আপনি যেভাবে পা তুলে বসেন, সেইভাবে আরাম করে বসুন, আমি গল্প করি।

আমি পা তুলে বসি তুমি জানো কীভাবে?

বইমেলায় দেখলাম। আপনাদের লেখকদেরই শুধু পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা থাকবে, আমাদের পাঠকদের থাকবে না?

আমি নরম সোফায় পা তুলে বসেছি। কংকন গল্প শুরু করেছে।

খুব ছোট ছিলাম তো, পরিষ্কার কিছু মনে নেই। আবছা আবছা সব স্মৃতি। সেই আবছা স্মৃতির মধ্যেও কিছু কিছু আবার খুবই স্পষ্ট। যেমন ধরুন, আমার খুব স্পষ্ট মনে আছে–শাহেদ চাচা বাজারের মতো একটা জায়গায় আমাকে গোসল করাচ্ছেন। মাথায় পানি ঢালছেন কেতলি দিয়ে। সেই পানিটা গরম। কিছুক্ষণ মাথায় পানি ঢালেন, তারপর গায়ে সাবান ডলেন। সাবান থেকে লেবুর মতো গন্ধ আসছিল— এটা পরিষ্কার মনে আছে। সেই স্মৃতি এমনভাবে মাথায় ঢুকে আছে যে আমি এখনো লেমন ফ্লেভারের সাবান ছাড়া অন্য সাবান ব্যবহার করি না।

শাহেদ চাচা আমাকে নতুন জামা কিনে দিলেন। জুতা কিনে দিলেন। সস্তা ধরনের প্লাস্টিকের পুতুল কিনে দিলেন। পুতুলটা এখনো আমার সঙ্গে আছে। আপনাকে দেখােব। আমরা এক রাত থাকলাম হোটেলে। চাচাকে জড়িয়ে ধরে কী আরাম করে যে সেই হোটেলে ঘুমালাম! আমি ঠিক করেছি। যদি কোনোদিন বাংলাদেশে যাওয়া হয়, তাহলে হোটেলটা খুঁজে বের করব। এক রাত থাকব সেই হোটেলে।

হোটেল খুঁজে বের করতে পারবে?

অবশ্যই পারব। হোটেলটি দাউদকান্দি নামের এক জায়গায়। টিনের ঘর। হোটেল থেকে নদী দেখা যায়। হোটেলের সব খুঁটিনাটি আমার মনে আছে।

তারপর বলো।

আমার স্পষ্ট মনে আছে, মাইলের পর মাইল শাহেদ চাচা আমাকে ঘাড়ে নিয়ে হেঁটেছেন। আমরা তখন বর্ডার ক্রস করছি। বাংলাদেশ থেকে যাচ্ছি আগরতলায়। চাচা ক্লান্ত হয়ে যান। আমাকে ঘাড় থেকে নামিয়ে বলেন, মা, কিছুক্ষণ হাঁটতে পারবে? আমি বলি, হ্যাঁ। আমি হাঁটতে পারি না। চাচা আবার আমাকে ঘাড়ে তুলে নেন। আমার কোনো কষ্ট হচ্ছিল না। আমার খুবই মজা লাগছিল। আমাদের সঙ্গে আরো অনেক লোক যাচ্ছিল। একজন বৃদ্ধা মহিলা যাচ্ছিলেন। তাঁর ছেলে তাকে কোলে করে নিচ্ছিল।

বৃদ্ধ মহিলার কথা তোমার মনে আছে?

জি আমার মনে আছে। কারণ শাহেদ চাচা আমাকে বলছিল–ছেলে তার মাকে কোলে করে নিয়ে যাচ্ছে। আর আমি আমার মাকে ঘাড়ে করে নিয়ে যাচ্ছি। মজা না?

তারপর কী হলো বলো।

আমরা আগরতলা পৌঁছলাম সন্ধ্যায়। সেখান থেকে শরণার্থী শিবিরে ট্রাকে করে যেতে হয়। ট্রাকে ওঠার সময় শাহেদ চাচা বললেন, মা শোন, অনেকগুলো শিবির আছে। আমরা তোমার মাকে প্রত্যেকটা শিবিরে খুঁজব। তাকে পাওয়া যাবে–সে সম্ভাবনা খুবই কম। পাওয়া না গেলে তুমি মন খারাপ করবে না। আমি তো তোমার সঙ্গে আছি! আমি যেভাবেই হোক তোমাকে তোমার মার কাছে পৌঁছে দেব। ঠিক আছে মা? আমি বললাম, ঠিক আছে।


ট্রাকে আমার জ্বর এসে গেল। চাচা চাদর দিয়ে আমাকে ঢেকে জড়িয়ে ধরে বসে রইলেন। আমার কাছে মনে হচ্ছিল, আমি যেন আমার মাকে জড়িয়ে ধরে আছি। মজার ব্যাপার কী জানেন? প্ৰথম শরণার্থী শিবিরেই আমার মা এবং দাদকে পাওয়া গেল বলো কী? জি। তবে আমাদের দেখা হওয়ার কোনো স্মৃতি আমার মাথায় নেই। শুধু মনে আছে আমার মা, দাদু আর শাহেদ চাচা তিনজনেই খুব কাদছিলেন। শাহেদ চাচার কান্না দেখে আমার খুবই মজা লাগছিল। আমি তাকিয়েছিলাম শাহেদ চাচার দিকে।



কংকন কাঁদছে! প্ৰথমে নিঃশব্দে কাদছিল। কিছুক্ষণের মধ্যেই দুহাতে মুখ ঢেকে শব্দ করে কাঁদতে শুরু করল। অ্যাপার্টমেন্টের বেল বাজছে। হয়তো কংকনের স্বামী তার সন্তানকে ছবি দেখিয়ে ঘরে ফিরেছে। কংকন দরজা খোলার জন্যে এগিয়ে যাচ্ছে না। সে প্ৰাণপণ চেষ্টা করছে নিজের কান্না থামাতে।

রোরুদ্যমান তরুণীর দিকে তাকিয়ে হঠাৎ আমার মনে হলো, কংকন কাঁদছে না। কাঁদছে আমাদের বাংলাদেশ। আমাদের জননী।
 
আগরতলার যে হোটেলে শাহেদ উঠেছে তার নাম নিরালা। স্কুলঘরের মতো লম্বা একতলা দালান। টিনের ছাদ। জানোলা দিয়ে টিলা এবং দূরের শালবন দেখা যায়। হোটেলের রুম খুপড়ির মতো হলেও প্রচুর আলো-বাতাস খেলে। হোটেলের রান্না ভালো। সবজি এবং অড়হড়ের ডালের মিশ্রণে যে খাদ্যটি তৈরি হয় তা অতি স্বাদু। হোটেলের মালিকের নাম মিশ্র। তিনি প্রথম পরিচয়েই শাহেদকে বলেছেন, বাংলাদেশের সব মানুষ আমারে ডাকে মিছরি বাবু। আপনিও তাই ডাকবেন। আমি আসলে বাংলাদেশেরই মানুষ। কুমিল্লার নবীনগরে আমার মায়ের বাড়ি।

শাহেদ বলল, কেমন আছেন ভাই?

মিছরি বাবু আনন্দিত গলায় বললেন, ভালো আছি, তবে আপনাদের দুঃখকষ্ট দেখে মনটা অস্থির।

শাহেদ বলল, আপনার হোটেলটা ভালো। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন।

মিছরি বাবু বললেন, জলের কিছু সমস্যা আছে। মানুষ বেশি হয়ে গেছে। সাপ্লাই-এর জল পাওয়া যায় না। নিজগুণে ক্ষমা করবেন। প্ৰতিদিন স্নান করা সম্ভব না। ফতু বলে একটা ছেলে আছে, তারে একটা টাকা দিলে দুই বালতি জল এনে দিবে।

শাহেদ এই হোটেলে আছে চারদিন ধরে। প্রতিদিনই সে এক টাকা খরচ করে দুই বালতি পানি আনাচ্ছে। ঘুমুতে যাবার আগে দুই বালতি পানি খরচ করে দীর্ঘ গোসল করে। রাতে খুব ভালো ঘুম হয়। ভোরবেলায় ঘুম ভাঙার পর তার মনে হয়, এত শান্তির ঘুম সে দীর্ঘদিন ঘুমায় নি। রাতে ঘুম ভাঙিয়ে মিলিটারি ধরে নিয়ে যাবে–এ ধরনের কোনো দুশ্চিন্তা নেই। বিহারিরা ঘুমন্ত অবস্থাতেই জবাই করে যাবে সেই আশঙ্কা নেই। প্রায়ই তার মনে হয়, সে পৃথিবীতে বাস করছে না। সে বেহেশতি আরামে আছে।

কংকনকে সে তার মায়ের হাতে তুলে দিতে পেরেছে–এই ঘটনোটা তার কাছে বিস্ময়কর মনে হয়। এই অসম্ভব কীভাবে সম্ভব হয়েছে? তাহলে কি সত্যি এমন কেউ আছেন যিনি আমাদের দিকে লক্ষ রাখছেন? তিনি তার বিচিত্র কৌশলে হারানো শিশুদের ফিরিয়ে দিচ্ছেন বাবা-মার কোলে? পঁচিশে মার্চের পর এই বিশ্বাস প্রায় ভেঙে পড়তে বসেছিল। এখন আবার ফিরে আসছে।

কংকনের ঘটনার পর শাহেদের ভেতর কেমন এক আলস্য এসে গেছে। তার কাছে মনে হচ্ছে, তার দায়িত্ব শেষ হয়েছে। এখন সে বিশ্রাম করতে পারে। আগরতলা নামের এই দেশ যার নাম শুনেছে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার সময়, সেই আগরতলা এখন টুরিস্টের মতো দেখা যেতে পারে। নিশ্চয়ই অনেক কিছু দেখার আছে। শাহেদের এইটাই প্রথম বিদেশ ভ্ৰমণ। বিদেশ ভ্ৰমণ সে কীভাবে করবে? তার পাসপোর্টও নেই। এখন পাসপোর্ট ছাড়াই চলে এসেছে বিদেশে।

আসমানীদের খোঁজ সে প্রথম দুই দিনেই নিয়েছে। সবকটা শরণার্থী শিবির দেখেছে। লষ্ট পারসন বুরোতে খোঁজ নিয়েছে। এখানকার প্রতিটি হোটেলের অতিথি তালিকা দেখেছে। আসমানীরা আগরতলায় নেই। তারপরেও কিছুই বলা যায় না, হয়তো দেখা যাবে কোনো একদিন সে রাস্তায় ভাড়ে করে চা খাচ্ছে–হঠাৎ বাচ্চা একটা মেয়ে ছুটে এসে তাকে জড়িয়ে ধরল। ধরার সময় এমন ধাক্কা লেগেছে যে তার হাত থেকে চায়ের খুড়ি পড়ে ভেঙে গেল। সে বিরক্ত হয়ে ধমক দিতে যাবে তখন মেয়েটা বলবে–বাবা বাবা আমি। কংকনের ক্ষেত্রে যদি এ রকম ঘটতে পারে, তার মেয়ের ক্ষেত্রে কেন ঘটবে না?

শাহেদ এক সন্ধ্যায় সিনেমাহলে গিয়ে সিনেমা দেখে এলো। উত্তম-সুচিত্রার ছবি সাগরিকা। খুবই ভালো লাগল। ছবি দেখে। ছবিঘর থেকে বের হয়ে মনে হলো, সব ঠিক আছে। আমি ভালো আছি। আসমানীরাও ভালো আছে। এই ছবিটাই আমি কোনো একদিন আসমানীকে নিয়ে দেখব। অবশ্যই দেখব।

কংকনরা যে শরণার্থী শিবিরে ছিল শাহেদ সেখানে আর যায় নি। যদিও তার উচিত প্ৰতিদিন একবার গিয়ে খোঁজ নেয়া। কেন জানি শাহেদের এটা করতে ইচ্ছা করে না। একদিন শিবিরের কাছাকাছি গিয়ে ফিরে এলো। কেন এ রকম হচ্ছে কে জানে? কংকনকে দেখলেই নিজের মেয়ের কথা মনে পড়বে।–এই ভেবেই কি এ রকম হচ্ছে? হতে পারে।

মিছরি বাবুর কাছে ঠিকানা নিয়ে একদিন সে নীরমহল দেখে এলো। ত্রিপুরার মহারাজাদের প্রাসাদ। পানিতে প্রাসাদের ছায়া পড়েছে। দূরে নাগকেশর ফুলের বন। কী অপূর্ব দৃশ্য! শাহেদ তৎক্ষণাৎ ঠিক করল, দেশ স্বাধীন হলে অতি অবশ্যই সে আসমানীকে নিয়ে এদিকে আসবে। উঠবে। হোটেল নিরালায়। সেখান থেকে কোনো এক সন্ধ্যায় যাবে নীরমহল দেখতে। সেখান থেকে শালবন, শালবন দেখে নাগকেশরের বন। ঐ গানটা যেন কী?

হেলিয়া দুলিয়া পড়ে নাগকেশরের ফুল।
বালা নাচ তো দেখি।
বালা নাচ তো দেখি।
 
একদিন সে গেল মুক্তিযোদ্ধারের ক্যাম্প দেখতে। জায়গাটার নাম মেলাঘর। বাংলাদেশের কসবা এবং ভারতের বিলুনিয়ার মাঝামাঝি একটা জায়গা। ক্যাম্পের দায়িত্বে আছেন দুই নম্বর সেক্টর অধিনায়ক মেজর খালেদ মোশাররফ। ঘন জঙ্গলের ভেতর সেই ক্যাম্প। পানির বড়ই অভাব। সব অভাব সহ্য করা যায়, পানির অভাব না। শত শত যুবক ছেলে প্রশিক্ষণ নিচ্ছে। তাদের একজনের সঙ্গে শাহেদের পরিচয় হলো। নাম ইফতেখার।* ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিদ্যার ছাত্র। সেকেন্ড ইয়ার অনার্স।

শাহেদ বলল, কেমন আছেন ভাই?

ইফতেখার বলল, ভালো আছি।

আপনার কি ট্রেনিং শুরু হয়েছে?

এখনো হয় নাই। নাম লেখালেখি চলছে।

আপনাদের খাওয়া-দাওয়া কী?

দুইবেলা খাই। রাতের খাওয়াটা ভালো হয়।

রাতের খাওয়াটা ভালো হয় কেন?

ইফতেখার হাসিমুখে বলল, অন্ধকারে খাই তো এই জন্যে ভালো হয়।

শাহেদ বলল, বুঝলাম না।

ভাতে অসংখ্য সাদা সাদা কীরার মতো থাকে। অন্ধকারে কীরা দেখা যায় না বলে খেতে সমস্যা হয় না। হা হা হা।

শাহেদ নিতান্তই অল্পবয়েসী এই ছেলের আনন্দময় হাসি দেখে মুগ্ধ হলো। সে বলল, ভাই, আপনি যদি কিছু মনে না করেন। আপনাকে কি আমি হোটেলে একবেলা খাওয়াতে পারি? একদিনের ছুটি নিয়ে আমার সঙ্গে শহরে আসবেন?

ইফতেখার বলল, না। তবে আপনি আমাকে একটা সিগারেট খাওয়াতে পারেন। আগে সিগারেট খেতাম না। এখন ধরেছি।

শাহেদ খুবই লজ্জার মধ্যে পড়ে গেল। তার সঙ্গে সিগারেট নেই। সে বলল, আমি কাল আপনার জন্যে সিগারেট নিয়ে আসব। কয়েক প্যাকেট সিগারেট নিয়ে আসব।

কোনো দরকার নেই।

শাহেদ বলল, দরকার আছে। অবশ্যই দরকার আছে। আমি কাল আসব। এমনিতেই আমার আসতে হবে। আমি আপনাদের সঙ্গে যোগ দেব। এখানকার রিত্রুটিং অফিসার কে? মুক্তিযোদ্ধা হতে যোগ্যতা কী লাগে? নিশ্চয়ই সাহস লাগে। আমার একেবারেই সাহস নেই।

ইফতেখার বলল, আমারো নাই।



শহরে ফিরতে শাহেদের অনেক রাত হলো। ট্রাকের পেছনে চড়ে উঁচু-নিচু রাস্তায় অনেক দূর আসা; পথে কয়েক দফা বৃষ্টির মধ্যে পড়তে হলো। পাহাড়ি বৃষ্টি। এই আছে এই নাই। তার জ্বর উঠে গেল ট্রাকেই।

রাতে শাহেদ কিছু খেতে পারল না। জ্বর হু-হু করে বাড়তে লাগল। একটা কম্বলে শীত মানে না। হোটেলের বয়কে দিয়ে আরেকটা কম্বল আনানো হলো। মিছরি বাবু একবার এসে দেখে গেলেন। কিছু ট্যাবলেট দিলেন। প্রবল জ্বরের ঘোরে শাহেদ স্বপ্ন দেখল আসমানীকে। যেন আসমানী ঢাকায়, তার বাসার শোবার ঘরে বসে আছে। রুনির জ্বর এসেছে। সে রুনির মাথায় জলপট্টি দিচ্ছে। রুনির সঙ্গে রাগী রাগী গলায় কথা বলছে–তোর বাবার কাণ্ডটা দেখেছিস? আমরা ঢাকায় এসেছি আর সে বসে আছে আগরতলায়। তার কি বুদ্ধিশুদ্ধি পুরোটাই গেছে?

রুনি বলল, বাবাকে বকা দিও না মা।

আসমানী বলল, বিকা দিব না তো কী করব? আমি একা মানুষ। আমি তোকে এখন কার কাছে নিয়ে যাব? কে ডাক্তার ডেকে আনবে?

রুনি বলল, বাবা ডাক্তার ডেকে আনবে। বাবা চলে আসবে।

স্বপ্ন দেখে শাহেদের ঘুম ভেঙে গেল। পরদিন ভোরেই গায়ে একশ দুই ডিগ্রি জ্বর নিয়ে সে রওনা হলো ঢাকার দিকে।

—————-
* দুর্ধর্ষ ক্র্যাক প্লাটুনের সদস্য হিসেবে ইফতেখার ঢাকা শহরে যথাসময়ে প্রবেশ করে। এই ক্র্যাক প্লাটুনের সদস্যরা ব্যতিব্যস্ত করে রাখে ঢাকা শহরের পাকিস্তানি বাহিনীকে। মুক্তি শব্দটাই তাদেরকে তখন আতঙ্কে অস্থির করে তুলত। তারা তখন ঘরে ঘরে অনুসন্ধান চালাত, একটাই তাদের প্রশ্ন–মুক্তি কাহা? কোথায় মুক্তি? শহীদ জননী জাহানারা ইমামের পুত্র দুঃসাহসী রুমি এই গ্রুপেরই একজন সদস্য ছিলেন। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর হাতে তিনি ২৯ আগষ্ট ধরা পড়েন। তারা বাংলার এই বীর সন্তানকে নৃশংসভাবে হত্যা করে।
 
বিকালে বৌমা আমি হাসিনার* ছেলে দেখতে হাসপাতালে গেলাম। কী ভীষণ দুর্ব্যবহার যে করল ওখানের মিলিটারি পাহারাদারটা! হাসিনার মা মাত্র দশ মিনিটের জন্যে গতকাল ওদের দেখতে পেয়েছিলেন। আজ হতে কড়া নিয়ম চালু করা হলো, কোনো মানুষই আর ওদের দেখতে যেতে পারবে না। এ যে কী অমানুষিক ব্যবহার! জেলখানার কয়েদিও সাক্ষাতের জন্য সময় পায়। আল্লাহ আর কত যে দেখাবো! আজও ছোটনের চিঠি নেই, কারোর কোনো খবর নেই। আল্লাহর হাতে সঁপে দিয়েছি, আল্লাহ মেহেরবান।*

————–

*সূত্র : বেগম সুফিয়া কামালের দিনলিপি–মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তির জয়। হাসিনা–শেখ হাসিনা। পরে প্রধানমন্ত্রী। পুত্রের নাম জয়।



--------

জেনারেল ইয়াহিয়ার সাক্ষাৎকার

সানডে টাইমস-এ প্রকাশিত সাংবাদিক রালফ শ-র নেয়া পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়ার সাক্ষাৎকার।

প্রেসিডেন্ট বলছেন, শেখ মুজিব পাকিস্তানের সর্বোচ্চ কারাগারে জীবিত ও সুস্থ আছেন। তবে আজকের পর তাঁর জীবনে কী হবে সেই ওয়াদা আমি দিতে পারছি না।

দেশের আইন অনুসারে তাঁর বিচার হবে। তার মানে এই নয় যে, আগামীকালই আমি তাকে গুলি করব। তাঁর স্বাভাবিক মৃত্যুও তো হতে পারে। তাকে সর্বোচ্চ শ্রেণীর কারাগারে রাখা হয়েছে। তাকে কোনো পরিশ্রম করতে হয় না। বিছানা, পাখা ও গরম পানির ব্যবস্থা সমেত ছোট ঘর তার রয়েছে। দেখাশোনার জন্যে একজন ডাক্তারও আছেন।

পশ্চিম পাকিস্তানি খাবারের কারণে শেখ মুজিবের স্বাস্থ্য সাময়িকভাবে ক্ষুন্ন হয়েছিল, তবে এখন তাকে বাঙালি খাবার দেয়া হচ্ছে। তার ওজন আবার বেড়েছে।

তিনি এখনো দৈনিক বিশ থেকে এক ডজন গালগল্পো করেন। কথার তুবড়ি ছোটান।



--------------
লায়ালপুরের (বর্তমান নাম ফয়সলাবাদ) জেলের একটি বিশেষ কক্ষ। সেই বিশেষ কক্ষে আটকে রাখা হয়েছে। একজন বিশেষ বন্দিকে। তার উপর কঠিন খবরদারি। সশস্ত্র প্রহরীদের একটি দল সার্বক্ষণিক নজর রাখছে। বন্দি এখন কী করছেন? তার অভ্যাসমতো সেলের ভেতর হাঁটাহাটি করছেন? নাকি সেলের জানালায় বাইরের আকাশ দেখার চেষ্টা করছেন?

বন্দির কর্মকাণ্ড তিনে সীমাবদ্ধ। কোরান শরীফ পাঠ করা। সেলের জানালায় আকাশ দেখার চেষ্টা করা এবং হাঁটাহাটি করা। প্রহরীদের কেউ কেউ বন্দিকে সালাম দেয়। বন্দি তাদের সালামের জবাব দেন। সেই খবর আবার তাৎক্ষণিকভাবে জেলারকে দিতে হয়। বন্দির কর্মকাণ্ডের প্রতিটি খুঁটিনাটি পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়াকে জানাতে হয়।

বন্দির অবস্থান, তাঁর দিনযাপন বিষয়ে পৃথিবীর কোনো মানুষ কিছু জানে না। চরম গোপনীয়তা। তবে নানান গুজব দেশী এবং বিদেশী পত্রপত্রিকায় আসছে। পাকিস্তান সরকার এইসব গুজবের সত্য-মিথ্যা নিয়েও কিছু বলছে না। শেখ মুজিবর রহমান বিষয়ে তাদের কিছু বলার নেই।

একটি জোর গুজব যা কোলকাতার স্টেটমেন্ট পত্রিকাতেও এসেছে তা হলো–শেখ মুজিব অনশন করছেন। অনশন শুরু হয়েছে জুন মাস থেকে। তিনি জানিয়েছেন, স্ত্রী এবং সর্বকনিষ্ঠ সন্তান রাসেলের সঙ্গে দেখা হলেই তিনি অনশন ভঙ্গ করবেন। তিনি এখন দিনরাত লিখে চলছেন। পাতার পর পাতা লেখা হচ্ছে। কী লেখা কেউ জানে না।

এমনও রটনা হলো যে, শেখ মুজিব পাগল হয়ে গেছেন। তিনি সারাদিন সারারাত দুর্বোধ্য বক্তৃতা করেন। যখন বক্তৃতা করেন না। তখন বিড়বিড় করেন।



শেখ মুজিবর রহমান অস্থির সময় কাটাচ্ছিলেন। যে চিন্তা তাঁকে গ্ৰাস করে রেখেছিল তা হচ্ছে–তাকে মেরে ফেলা হবে, না জীবিত রাখা হবে? পাইপ টানতে টানতে তিনি প্রায়ই এই হিসাব করেন (কারাগারে তাকে তামাক নামক একমাত্র বিলাসদ্রব্যটি সরবরাহ করা হতো)। পাকিস্তানি মিলিটারি যদি যুদ্ধে জয়লাভ করে, তাহলে অবশ্যই তাকে হত্যা করা হবে। যদি পরাজিত হয় তাহলে কী হবে? পরাজিত হলেও তাকে হত্যার সম্ভাবনা। প্ৰতিশোধ নেবার তীব্ৰ আকাঙ্ক্ষা থেকেই এটা করা হবে। সেই হত্যা প্রক্রিয়াটি কী রকম হবে? তাঁকে কি ফাঁসি দেয়া হবে, নাকি ফায়ারিং স্কোয়াডে নেয়া হবে? পুত্র রাসেলের প্রিয়মুখ কি মৃত্যুর আগে দেখে যেতে পারবেন না? তাঁর বড়মেয়েটির সন্তান হবার কথা। তা কি হয়েছে?

নিজের পুত্রকন্যাদের কথা যখনই তাঁর মনে হয়, তখনি তিনি খানিকটা লজ্জিত বোধ করেন। এ-কী, দেশের কথা একপাশে সরিয়ে তিনি কিনা নিজের প্রিয়মুখগুলির কথা ভাবছেন! একটি জাতির আশা-আকাঙ্ক্ষার রূপকার তিনি। দেশের প্রতিটি মানুষ তাকিয়ে আছে তাঁর দিকে। আর তিনি কি-না তাঁর মৃত্যু কীভাবে হবে তাই নিয়ে ভাবছেন?

মাঝে-মাঝে তার ঘোরের মতো হয়। তিনি শুনতে পান। তার জীবনের মধুরতম শব্দ জয় বাংলা। হৃদয়ের গভীর গোপন কোনো জায়গা থেকে কেউ একজন বলে, ভয় পেও না। এই মধুর শব্দ তুমি আবারো শুনবে। তাঁর নিজের ভাষ্যমতে— একে বলতে পারেন স্বজ্ঞা, টেলিপ্যাথি, ইন্দ্ৰিয় কিংবা অন্য যা খুশি তাই। কিংবা সম্ভবত এটা এক ধরনের ঐশী প্রেরণা, আমি যেটা জানি তা হলো আমার মন বলছিল বিজয় আমাদের হবেই।

আগষ্ট মাসের তিন তারিখ টেলিভিশনে জাতির উদ্দেশে ভাষণে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া ঘোষণা করেন–রাষ্ট্রদ্রোহিতার অপরাধে শেখ মুজিবকে বিচার করা হবে।

অতি দ্রুত বিচারপর্ব শুরু হলো। তারিখ ৯ আগস্ট। প্রধান বিচারক পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একজন ব্রিগেডিয়ার। তার সঙ্গে আছেন দুজন কর্নেল, একজন উইং কমান্ডার, একজন নেভাল কমোডর ও একজন (একমাত্র সিভিলিয়ন) জেলা সেশন জজ।

শেখ মুজিব আত্মপক্ষ সমর্থনে অস্বীকৃতির কথা জানান এবং কোনো আইনজীবীর সঙ্গে বসতে রাজি হন না। বিচার চলতে থাকে। প্রতিদিন ভোরবেলা শেখ মুজিবকে কঠিন পাহারায় বিচারকক্ষে নিয়ে যাওয়া হয়। বিকেল পাঁচটায় আবারো সেলে ফিরিয়ে আনা হতে থাকে।

বিচারকক্ষটি লায়ালপুর জেলের ভেতরই। লাল ইটের দালান। বন্দিকে লোহার চারটি ভারি দরজা পার হয়ে লম্বা সরু করিডোর দিয়ে আদালতে প্ৰবেশ করতে হতো। পাহারা থাকত সাব-মেশিনগান হাতে যুদ্ধসাজে সজ্জিত একদল কমান্ডো। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়াকে দেখে সবসময়ই নেশাগ্ৰস্ত মনে হয়। মনে হয় তিনি তার প্রিয় সুরা ব্ল্যাকডগে আকণ্ঠ ড়ুবে আছেন। অতি গুরুত্বপূর্ণ মিটিংয়েও তার কথাবার্তা থাকে জড়ানো। এতে তিনি কোনো অস্বস্তি বোধ করেন না।

আজ তাকে নেশাগ্ৰস্ত মনে হচ্ছে না। তিনি একগাদা ফাইল নিয়ে বসেছেন। দ্রুত ফাইল ক্লিয়ার করা হচ্ছে। তার হাতে সময় নেই। চীনা রাষ্ট্রদূত প্রেসিডেন্ট ভবনে তার সঙ্গে দেখা করার জন্যে আসছেন। দশ মিলিয়ন ডলার অর্থ সাহায্য চীনের কাছ থেকে পাওয়া গেছে। এখন আলাপ আলোচনা চলছে এক জাহাজ বােঝাই সমরাস্ত্র নিয়ে, এর মধ্যে হালকা চৈনিক ট্যাংকও আছে। চীনা রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে আজকের আলোচনা এই কারণেই অতি গুরুত্বপূর্ণ।

প্রেসিডেন্টের অতি ব্যস্ততার মধ্যে ঘরে ঢুকলেন জুলফিকার আলি ভুট্টো। প্রেসিডেন্ট এক ঝলক ভুট্টোর দিকে তাকিয়ে বললেন, আপনার যা বলার বলুন। আমি কাজ করতে করতে আপনার কথা শুনব। আজ আমার সীমাহীন ব্যস্ততা।

জুলফিকার আলি বললেন, শেখ মুজিবকে কি মৃত্যুদণ্ড দেয়া হবে?

প্রেসিডেন্ট কাগজ থেকে মুখ না তুলেই বললেন, অবশ্যই।

ফর গডস সেক। ডোন্ট ড়ু দ্যাট।

না কেন?

আপনার হাতে মৃত্যুর চেয়ে সে বড় মাপের মানুষ।

জুলফি, আপনার ধারণা তাকে হত্যা করার মতো বড় আমি না?

তাকে হত্যা করলে সারা পৃথিবী আমাদের উপর ঝাঁপ দিয়ে পড়বে। বিশেষ করে আমেরিকানরা। আমেরিকানরা আপনাকে যত খুশি বাঙালি মারতে দেবে, কিন্তু নট শেখ মুজিব।

জুলফি, আপনি কি মনে করেন আমেরিকানদের মনোভাব আমি জানি না? খুব ভালো যোগাযোগ তাদের সঙ্গে আমার আছে। শেখের কী হলো নিক্সন তার পরোয়া করে না। আমি নিক্সনকে ভালোমতো জানি। আমরা যোগাযোগ রেখে চলি। আপনার সঙ্গে আমি এখন আর কথা বলতে পারছি না, চীনা রাষ্ট্রদূত আসছেন। শুনুন জুলফি, আমি শেখকে অবশ্যই ফাঁসির দড়িতে ঝুলাব। যে ঝামেলায় সে আমাকে ফেলেছে তাকে তার মূল্য দিতে হবে। Good bye.
 
বেগম মুজিবের বিষাদঘন দিনগুলোর কয়েকটি কথা

নববর্ষের দিন সূর্যের আলোয় পথ চিনে এগিয়ে গেলাম, আঠার নং রোডের দুর্গসদৃশ সেই বাড়িটার দিকে। বাইরের ঘরেই বসেছিলেন বেগম শেখ মুজিব। হাসিমুখেই আহবান জানালেন আমাকে। বাড়িটার উল্লেখ করতেই হেসে বললেন–এটা তো তবুও একটা মাথা গুজবার ঠাই, কিন্তু ২৫শে মার্চের পর পুরো দেড় মাস তাও কোথাও পাই নি। আজ এখানে কাল সেখানে, এমনি করে সেই মাসে কম করে হলেও চৌদ্দ পানেরটা বাসা বদল করেছি।

হাসছিলেন বেগম মুজিব, কিন্তু দেখলাম হাসির মাঝে কেমন জানি অস্পষ্ট এক বিষণ্ণতার ছোয়ায় করুণ হয়ে উঠেছে তাঁর চোখের দৃষ্টি।

২৫শে মার্চের সেই ভয়াবহ রাত। অন্ধকার শোবার ঘরটাতে বিছানায় শুয়ে শেখ সাহেব শুনছিলেন বাইরে বোমায় বিধ্বস্ত ঢাকার আর্তনাদ। উত্তেজনায় এক এক সময় উঠে বসছিলেন তিনি।

ঠিক এমনি এক মুহুর্তে গুলির একটি টুকরো জানোলা ভেদ করে ছোট ছেলে রাসেলের পায়ে আস্তে করে লাগে। অন্ধকারে হাতড় গুলিট কুড়িয়ে নিয়েছিলেন শেখ সাহেব। আর সেই দুঃসহ রাতেই নরপিশাচরা তাকে বন্দি করে নিয়ে গিয়েছিল। বাড়িতে তখন ছিলেন বেগম মুজিব, আর তার দুছেলে।

২৬শে মার্চ–সমস্ত দিন ছিল কারফিউ। গোলাগুলির শব্দ তখনও থামে নি। নিস্তব্ধ বাড়িটা জুড়ে যেনো এক ভৌতিক বিভীষিকা মাথা খাড়া করে উঠেছে। সামনে ধানমণ্ডি বালিকা বিদ্যালয়ে তাক করে রাখা বড় বড় কামানের মুখগুলো আমার বাসার দিকে। ভয়ে জানালাগুলো পর্যন্ত বন্ধ করে দিতে পারি নি। দুপুরে কারফিউর মধ্যেই এবাসা ওবাসা করে বড় ছেলে কামাল এসে পৌঁছালো।

রাত এলো। সেই আধার কালো রাত। ইয়াহিয়া খানের হিংস্রভাবে চিবিয়ে চিবিয়ে বলা বিবৃতি শুনেই নিজেদের অবস্থা বুঝতে পারলেন বেগম মুজিব। তাই কালবিলম্ব না করে ছোট ছেলে আর মেজ ছেলেকে নিয়ে পাচিল টপকে প্রতিবেশী ডাক্তার সাহেবের বাড়িতে আশ্রয় নিলেন। অন্যদিকে বড় ছেলে কামাল এবং মহিউদ্দীন সাহেব পালালেন অন্যদিকের পাচিল ডিঙিয়ে। রাত ১১টা থেকেই তোপ দাগার শব্দে কানে তালা লাগার জোগাড়। কতকটা চেতন কতকটা অচেতন অবস্থায় বেগম মুজিব ২৬শে মার্চের সেই ভয়াবহ রাতে শুনলেন তার আদরের বাড়িতে গোলাগুলির শব্দ। রাত ১১টা থেকে ভোর ৫টা পর্যন্ত। সেরাতে এভাবে না পালালে তার এবং তার সন্তানদের ভাগ্যে কী যে ঘটতো আজও তিনি তা ভাবতে পারেন না।

২৭শে তারিখ সকালে বাচ্চা দুটো সাথে নিয়ে তিনি আবার পালালেন। পুরো দেড় মাস এ বাসা ও বাসা করেন। শেষে মগবাজারের এক বাসা থেকে পাক বাহিনী তাকে আঠারো নং রোডের এই বাসায় নিয়ে আসে।

১৮নং রোডে আসবার পূর্বকার মুহুর্তটি স্মরণ করে গভীর হয়ে গেলেন বেগম মুজিব। বললেন–আমি তখন মগবাজারে একটা বাসায় থাকি। আমার বড় মেয়ে হাসিনা তখন অন্তঃসত্ত্বা। সে, জামাই, আমার দেওর, জা, মেয়ে রেহানা, পুত্র রাসেলসহ বেশ কয়েকজন একসাথে ছিলাম মগবাজারের বাসাটাতে। হঠাৎ একদিন পাকবাহিনী ঘেরাও করে ফেলল বাসাটা। একজন অফিসার আমাকে জানাল যে আমাকে তাদের তত্ত্বাবধানে অন্যত্র যেতে হবে। জানি না। কী হবে। ঠিক সেই মুহুর্তটাতে ভীষণ সাহসী হয়েছিলাম। আমি। কড়াভাবেই সেই অফিসারকে বললাম, লিখিত কোনো আদেশপত্র না দেখালে আমি এক পা-ও বাড়াব না। উত্তরে সে উদ্ধতভাবে জানাল যে ভালোভাবে তাদের সাথে না গেলে তারা অন্য পন্থা গ্ৰহণ করবে। তখন বাধ্য হয়ে আমি বললাম যে, আমার মগবাজার বাসায় যারা আছেন তাদের প্রত্যেককে আমার সাথে থাকতে দিতে হবে। আমার কথায় তারা নিজেরা কী যেন আলোচনা করল, পরে তারা রাজি হয়ে নিয়ে এলো আমাদেরকে ১৮নং রোডের এই বাসাটাতে।


১৮নং রোডে আসার প্রথম দিনের কথা বলতে গিয়ে আবার হেসে ফেললেন বেগম মুজিব। ময়লা আবর্জনা পূর্ণ এই বাড়িটাতে তখন বসবার মতো কোনো আসবাবপত্র দূরে থাক, একটা মাদুর পর্যন্ত ছিল না। জানালার পাশ ঘেসা ৩/৪ ফুট প্রশস্ত একফালি জায়গায় ঘেসাঘেসি করে বসেছিলেন তিনি এবং পরিবারের সমস্ত সদস্যরা।

অন্তঃসত্ত্বা মেয়েকে এইভাবে কষ্ট করে বসে থাকতে দেখে সেদিন বুক ফেটে যাচ্ছিল তাঁর। মুখ ফুটে কিছু বলতে পারেন নি, শুধু অসহায়ভাবে তাকাচ্ছিলেন চারিদিক। হয়তো অসহায়ের করুণ ডাক আল্লাহতায়ালা সেদিন শুনেছিলেন। প্রহরী পাক-বাহিনীর এক পাঠান অফিসার অনুভব করেছিল তাঁর অসহায় অবস্থাকে। সেই অফিসার একজন ঝাড়ুদার সংগ্রহ করে পরিষ্কার করে দেয় ঘর দুয়ারি–সংগ্রহ করে দিয়েছিল। কয়েকটি চেয়ার এবং একটি কম্বল।

বন্দি জীবনের নৃশংস পাক-পাহারাদার বাহিনীর মধ্যে এই অফিসারটিই ছিল কিছুটা ব্যতিক্রম।

ধানমণ্ডির এই বাড়িটার মাঝে অনেক দুঃখ দৈন্যের স্মৃতি চিরদিনের মতো বেগম মুজিবের বুকে আঁকা হয়ে গেছে, তবুও এই বাসাতেই তিনি তার প্রথম আদরের নাতিকে বুকে নিতে পেরেছিলেন–এ স্মৃতি তার কাছে কম উজ্জ্বল নয়।

দৈনিক বাংলা

বেগম মুজিবের সঙ্গে বিশেষ সাক্ষাৎকার

ডিসেম্বরের দুপুর। বঙ্গবন্ধুব ৩২নং রোডের বাড়ির দ্বিতলের বসবার ঘরে বসে কথা বলছিলাম বেগম মুজিবের সাথে। গত বছরের বন্দি জীবনের দুর্বিষহ ও ভয়ঙ্কর মুহুর্তগুলোর কথা। বর্ণনা করছিলেন তিনি…

২৬শে মার্চের পর পরই বড় ছেলে কামাল চলে গেছে ওপারে। হাসিনার শরীর খারাপ। তবুও অসুস্থ শরীরে সে-ই ছিল আমার সব চেয়ে ভরসা।

মে মাসের ১২ তারিখ। ১৮নং রোডের সেই একতলা কারাগৃহে আমাদের নেয়া হয়। হানাদারদের পাহারাতে জীবন কাটাচ্ছিলাম। আমি। বাসার যে সব প্রহরী ছিল, তাদের মধ্যে দুজন সাদা পোশাকধারী সিভিল আর্মড ফোর্সের লোকও ছিল। এরা কাৰ্যত আমির প্রহরীদের ঠিক রাখতো।

একদিনের ঘটনা। আমার শোবার ঘরে জামাল আর রেহানা ঝগড়া করছিল। বন্দি জীবন জামালের মতো ছেলে সহ্য করতে পারছিল না। কেমন যেন ক্ষিপ্ত হয়ে গিয়েছিল।

সেদিন তাই ওদের দুভাই বোনের ঝগড়াটা একটু বেশি রকমের শুরু হয়েছিল। ওদের ঝগড়ার মাঝেই হুট করে ঘরের মধ্যে সিভিল আর্মড ফোর্সের একজন অফিসার ঢুকল। চোখ লাল করে হিংস্রভাবে সে জামালকে বলল, তুমি আজকাল বেশি। বাড়াবাড়ি করছি। এভাবে গোলমাল করলে আমরা তোমাকে আমি ক্যাম্পে নিয়ে যাব। পা দুটো উল্টো করে বেঁধে তোমাকে চাবুক মারা হবে। জীবনে আর যাতে কারো মুখ দেখতে না পাও, সে ব্যবস্থাও করা হবে। বেশ চিৎকার করেই অফিসারটি কথাগুলি বলেছিল। আমি প্রথমে পাথর হয়ে গিয়েছিলাম। কিন্তু পরীক্ষণেই সামলে নিয়ে তাকে বেরিয়ে যেতে বললাম ঘর থেকে। একটা হিংস্র। দৃষ্টি সে আমাদের ওপর নিক্ষেপ করে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে।

অফিসারটি চলে যাবার পর বেগম মুজিব তার ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা স্থির করে নিলেন। সে দিনই তিনি অফিসারটির জঘন্য আচরণের সমস্ত ঘটনা প্রেসিডেন্ট থেকে শুরু করে সমস্ত উপর মহলেই লিখে জানালেন।

কিন্তু এ ঘটনার পর থেকেই জামাল যেন আরও অশান্ত হয়ে উঠল। পালাবার জন্য সমস্ত সময় সে সুযোগ খুঁজত। ২৭শে জুলাই মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে হাসিনার সন্তান হলো। আমাদের জীবনে এলো প্ৰথম নাতি। অথচ তাকে দেখবার জন্য আমাদের কাউকেই অনুমতি দেয়া হলো না। ঘরের মধ্যে অসহ্য যন্ত্রণায় ছটফট করেছিলাম সেদিন। কেন্দেছিলাম পাক করুণাময় আব্দুল্লাহতায়ালার দরগায়।

৫ই আগষ্ট জামাল পালিয়ে গেল বাসা থেকে। কয়েকদিন আগে থেকেই পালিয়ে যাবার জন্য সে চেষ্টা চালাচ্ছিল। আমাকে বলছিল। আমি যদি পালাতে পারি। তাহলে ৩/৪ ঘন্টা ওদেরকে কোনো খবর দিও না। জামাল পালাবার পর বুঝতে পারলাম যে ও পালিয়েছে। মন আবার অশান্ত হলো। যদি ধরা পড়ে শেষ হয়ে যায়, আবার সান্ত্বনা পেলাম বাঁচলে এবার ও বাঁচার মতো বাঁচবে। বেলা দুটায় খাবারের সময় ওর খোঁজ পড়ল। খোঁজ খোঁজ, চারিদিকে খোঁজ। কিন্তু জামাল কোথায়? সন্তানের খোঁজে আমি তখন দিশেহারা হবার ভান করলাম।

সরাসরি চিঠি পাঠালাম ওপর মহলে। আমার ছেলেকে তোমরা ধরেছ। এবার ফিরিয়ে দাও। হানাদারদের তরফ থেকে কিছুই বলার ছিল না। কেননা আগেই আমি এ সম্পর্কে সজাগ হবার জন্য চিঠি লিখেছিলাম সর্বত্র। তদন্তের জন্য যে কর্নেলকে পাঠানো হয় সে মনে মনে শঙ্কিত হলো। হয়তো সত্যিই ওদের বাহিনীর কেউ জামালকে গুম করেছে। আমাকে সান্ত্বনা দিয়ে কর্নেল ফিরে গেলেন। কিন্তু আমাদের ওপরে কড়াকড়ির মাত্রা আরেক দফা বাড়ল।
 
আগষ্ট মাসের শেষের দিকে জামালের চিঠি পেলাম। এসময় আমার শাশুড়ির শরীর বেশি খারাপ থাকায় তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হলো। প্রতিদিন দুঘন্টার জন্য আমাকে হাসপাতালে যাবার অনুমতি দেয়া হলো; রোগী দেখার ভান করে ওপার থেকেও অনেকেই আসত। ওদের মাথায় হাত রেখে হানাদার প্রহরীদের দেখিয়ে উপদেশ দিতাম ঠিকমতো ঘরে থেকে লেখাপড়া করার জন্য। এক ফাকে চিঠিটা হস্তগত করে নিজে সাথে করে নিচ পর্যন্ত পৌঁছে দিতাম। ওদেরকে। ভীষণ ভয় লাগত। ওদের জন্য। কিন্তু আল্লাহকে ডাকা ছাড়া কীইবা আমি করতে পারতাম তখন!

ঠিক এভাবেই কেটে গেছে আমার দিন। সামান্য যা কিছু সঞ্চয় ছিল, তা দিয়েই চলত আমার ছোট সংসার। দুঃখ-দৈন্য যন্ত্রণা দেহমানে সবকিছুই যেন আটকে গিয়েছিল! প্রতি মুহুর্ত একটি সন্দেহ দিয়ে ঘেরা মৃত্যুর রাজত্বে ধুকেধুকে দিন কাটতো আমাদের।

প্রিয়জনরা ছড়িয়ে আছে চারিদিকে। জানতাম না কেমন আছে ওরা। স্বামীর জন্য আর চিন্তা করতাম না। কেননা আল্লাহ ছাড়া তাকে বাচাবার সাধ্য যে আর কারো নেই।

একথা নিজের অভিজ্ঞতা থেকেই বুঝতে পেরেছিলাম। তবুও মাঝে-মাঝে শিরা উপশিরাগুলো অবশ হয়ে আসত। কোথায় আমার বুকের সন্তানেরা আর এই কারাগৃহে আবদ্ধ আমাদের জীবনের স্থায়িত্বই বা কোথায়?

নভেম্বরের শেষের দিকেই বুঝতে পেরেছিলাম ডিসেম্বরে কিছু একটা ঘটতে যাচ্ছে। আমার বন্দি জীবনে বাইরের সংবাদ আসার কোনো উপায় ছিল না। কিন্তু ট্রানজিস্টার সেটটা ছিল। আমরা শুনেছিলাম ভারত বাংলাদেশকে যেদিন স্বীকৃতি দেবে সেই দিনই বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হবে। তিনি তারিখের কলকাতার ঐতিহাসিক জনসভা শোনার জন্য তাই আমাদের প্রতীক্ষা ছিল একটু ভিন্নতর। ইন্দিরাজীর ভাষণ শেষ হলো। খুবই বিস্ময় লেগেছিল। কেন জানি ট্রানজিস্টারের সামনে থেকে নড়তে ইচ্ছা করছিল না। রাত বাড়ল, আকাশ বাণীর সংবাদ শেষ হলো। হঠাৎ ঘোষণা করা হলো শীঘই বিশেষ ঘোষণা প্রচার করা হবে। সমস্ত দিনেক ব্লকান্ত দেহ,মন। পরিবারের সকলেই ঘিরে বসলাম ট্রানজিস্টারের চারিদিক। কিন্তু কোথায়, সে ঘোষণা! সময় কেটে যাচিছিল। একে একে বাচ্চারা ঘুমুতে চলে গেল। মাথার কাছে ট্রানজিস্টারটা খোলা রেখে প্রতীক্ষ্ণ করতে করতে কখন যেন ঘুমিয়ে পড়েছি; ঘুম ভাঙল বিমান বিধ্বংসী কামানের কটকট শব্দে। বুঝলাম যুদ্ধ বেঁধে গেছে।

৬ই ডিসেম্বর ভারত স্বীকৃতি দিল স্বাধীন বাংলাদেশকে। সে এক অনন্য অনুভূতি। স্বাধীন বাংলাদেশের স্বীকৃতির সংবাদ এলোমেলো করে দিচ্ছিল। আমার দেহ মনকে। বাচ্চারা কাঁদছিল ওদের আব্বার জন্য। আমি চেষ্টা করছিলাম ওদেরকে সান্ত্বনা দিতে, কিন্তু স্বাধীনতার স্বীকৃতি আর অতি প্রিয়জনের মৃত্যুর আশঙ্কা আমার আত্মাকে যেন অসাড় করে তুলেছিল।

ডিসেম্বরের দিনগুলো প্রতিদিন যেন নতুন নতুন বিভীষিকা। হয়ে দাঁড়াতো। ১৮ তারিখ সকালে যখন পাক আর্মিকে সরিয়ে নেয়া হচ্ছিল তখন শেখ মুজিবের বাসা থেকে শুধুমাত্র সিভিল আর্মড অফিসার দুজনকে সরিয়ে নেয়া হয়। এক্ষেত্রে সিভিল আর্মড অফিসার দুজনকে ফিরিয়ে নেয়ার সাথে সাথেই আর্মি প্রহরীরা উদ্ধৃঙ্খল হয়ে পড়েছিল। প্রথম দিকে ওরা আশা করেছিল যে, ওদেরও নিয়ে যাবার ব্যবস্থা নেয়া হবে। কিন্তু দুপুর পর্যন্ত যখন চারিদিক থেকে জয় বাংলা ধ্বনি ভেসে আসতে লাগল। তখন ভীষণ রকম ক্ষেপে গেল ওরা।

আমাদের ঘরের মধ্যে কাপড় শুকোবার জন্য তার বাধা ছিল। রাতে তারটা ঝনঝন করে বেজে উঠতেই সবাই দাঁড়িয়ে পড়লাম। রক্তের মতো লাল দুটো চোখ। প্রহরী দলের অধিনায়ক সুবেদার রিয়াজ দাড়িয়ে ছিল বারান্দায়। কঠোরভাবে সে বলল, খোকাকে ডাকো। ঠাণ্ডা হয়ে বললাম, খোকা ঘুমিয়ে পড়েছে। কোনো কথা থাকলে আমাকে বলতে পারো। আমার মুখের দিকে কঠোরভাবে তাকিয়ে সে বলল, সাবধানে থাকো।

মেজর তারা সিং এলেন বেলা নটার সময়। তারা সিং সাধারণ বেশে এসেছিলেন। কিন্তু পেছনে তিনি একদল সৈন্যকে পজিশন নেয়া অবস্থাতে রেখে দিয়েছিলেন চারিদিকে। খালি হাতে শুধু ওয়্যারলেস সেট সাথে নিয়ে তিনি গেটের সামনে দাঁড়িয়ে ওদেরকে বুঝাচ্ছিলেন। প্ৰথমে ওরা সারেন্ডার করতে চায় নি। শেষে দুঘণ্টা সময় চেয়েছিল। গেটের সামনে থেকে ওদের কথা শুনে মেজর তারা সিং যেই পা বাড়ালেন অমনি ভেতর থেকে চিৎকার করে উঠল। বাচ্চারা–আপনি যাবেন না মেজর। যাবেন। না। সময় পেলেই ওরা আমাদেরকে মেরে ফেলবে। সত্যিই সময পেলে ওরা আমাদেরকে মেরে ফেলত। কিন্তু মেজর সিং তাদের আর সে সময় দেন নি। ঢুকে পড়েছিলেন গেটের মধ্যে।

পাশের বাঙ্কার থেকে কাঁপতে কাঁপতে হানাদাররা তখন বের হয়ে আসছে আত্মসমর্পণের জন্য।

—————-

*সূত্র : বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ
দলিলপত্র; ৮ম খণ্ড (পৃষ্ঠা : ৬৩৫)
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার, তথ্য মন্ত্রণালয়
 
হাজি মতলুব মিয়ার নির্মাণ নীলগঞ্জ জামে মসজিদ এই এলাকার সবচে সুদৃশ্য পাকা দালান। হাজি মতলুব মিয়া জীবনের শেষপ্রান্তে এসে ধর্মকর্মে মন দেন। তিনি ঘোষণা করেন, আসল ইবাদত হলো হাকুল ইবাদত। জনতার জন্যে কিছু করা। তিনি তখন তকুল ইবাদতের অংশ হিসাবে মসজিদ বানানো শুরু করেন। এই সময় তার বয়স সত্তরের কাছাকাছি। নানান ব্যাধিতে আক্রান্ত। মসজিদ তৈরি যেদিন শুরু করেন, সেদিন তিনি একটা স্বপ্ন দেখেন। স্বপ্নে অলি ধরনের এক মানুষ, যার পরনে সাদা লম্বা কুর্ত, মাথায় পাগড়ি, হাতে বাঁকা লাঠি, তাকে দেখা দেন। সেই সুফি মানুষ হাতের বাঁকা লাঠি দিয়ে তাকে বুকে খোচা দিয়ে বলেন–মতলুব মিয়া, তোমার আয়ু শেষ হয়ে গিয়েছিল। তুমি একটি সৎকর্মে হাত দিয়েছ, এই সৎকর্ম শেষ না হওয়া পর্যন্ত তোমার মৃত্যু হবে না। সৎকর্ম সুন্দরভাবে সমাধা করো। এই বলেই সুফি পুরুষ অদৃশ্য হয়ে যান। ঘুম ভেঙে মতলুব মিয়া দেখেন এই সুফি পুরুষ তার বুকের যে জায়গায় বঁকা লাঠি দিয়ে খোচা দিয়েছেন সেই জায়গা কালো হয়ে আছে।

তিনি বিপুল উৎসাহে মসজিদ বানানো শুরু করেন। কাজ দ্রুত সমাধা করার প্রয়োজন নাই। ধীরে-সুস্থে হবে। ভালোমতো হবে! যেভাবেই হোক কাজটা লম্বা করতে হবে। মেঝেতে প্ৰথমে সমেন্ট করা হলো। সেই সিমেন্ট উঠিয়ে মোজাইক করা হলো। মিনার একটা করার কথা ছিল। তিনি চার মিনারের সিদ্ধান্ত নিলেন। এতে সময় বেশি লাগবে। যত ইচ্ছা সময় লাগুক। মসজিদ নির্মাণ পুরোপুরি শেষ করা যাবে না। একটা দরজা কিংবা একটা জানোলা বাকি থাকবে। এই ছিল তার পরিকল্পনা। শরিকল্পনা কার্যকর হলো না। এক মিনার তৈরি হবার পরপরই তার মৃত্যু হলো। মসজিদের শুরু হলো তার জানাজা পাঠের মাধ্যমে।

হাজি মতলুব মিয়ার মসজিদের বর্তমান নাম এক মিনারি মসজিদ। ঈদের দিন দূরদূরান্ত থেকে এই মসজিদে লোকজন নামাজ পড়তে আসে। জুম্মাবারেও মুসল্লিদের ভালো সমাগম হয়।

নীলগঞ্জে মিলিটারি আস্তানা গাড়ার পর জুম্মাবারে লোক সমাগম আরো বেড়েছে। মসজিদের বাইরেও চাটাই বিছাতে হয়। জুম্মাবারে মিলিটারি ক্যাপ্টেন মুহাম্মদ বাসেত দুএকজনকে সঙ্গে নিয়ে মসজিদে নামাজ পড়তে আসেন। নামাজের শেষে তার সঙ্গে হ্যান্ডশেক করার জন্যে এক ধরনের ব্যস্ততা সমাগত মুসল্লিদের মধ্যে দেখা যায়। ঘটনাটা বিস্ময়কর হলেও সত্যি। দুএকজন কোলাকুলিও করেন।

জুম্মার নামাজ মাওলানা ইরতাজউদ্দিন পড়ান। সেদিন তাঁর পরনে থাকে ইন্ত্রি করা আচকান, ধবধবে সাদা পাগড়ি। জুম্মাবারে তিনি চোখে সুরমা দেন। কানের লতিতে আন্তর। নবি-এ-করিমের সুগন্ধী পছন্দ ছিল। সুগন্ধ ব্যবহার করা সেই কারণেই প্রতিটি মুসলমানের জন্যে সুন্নত।

নামাজ একটার সময় শুরু হয়, তবে মাঝে-মাঝে একটা বাজার পরেও অপেক্ষা করা হয়। ক্যাপ্টেন সাহেবের জন্যে অপেক্ষা। মসজিদের মুয়াজ্জিন মুনশি ফজলুল হক ক্যাপ্টেন সাহেবের অপেক্ষায় বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকেন। এখান থেকে থানা কম্পাউন্ড পর্যন্ত পরিষ্কার দেখা যায়। ক্যাপ্টেন সাহেব থানা কম্পাউন্ড থেকে ঢোলা কুর্ত পরে যখন বের হন, তখন মুনশি ফজলুল হকের ভেতর অন্যরকম উত্তেজনা দেখা যায়।

ইরতাজউদ্দিন জুম্মাবারে মসজিদে বারোটার মধ্যে এসে পড়েন। তখন মুয়াজ্জিনও আসে না। মসজিদ থাকে খালি। এক একজন করে মুসল্লি আসে, তাদের আসা দেখতে তার ভালো লাগে। কাউকে দেখে মনে হয় তার অসম্ভব তাড়া। বসে থাকতে পারছে না, সারাক্ষণ ছটফট করছে। আঙুল ফোটাচ্ছে। ঘড়ির দিকে তাকাচ্ছে। কেউ কেউ আসে নিতান্তই অনাগ্রহে। তাদের চোখেমুখে থাকে কী বিপদে পড়লাম? দূর দূরান্ত থেকে কিছু আগ্রহী লোকজনও আসে। এরা হাদিস-কোরান শুনতে চায়। এরা অনেক আগে চলে আসে। তাদের সঙ্গে হাদিসা-কেরান নিয়ে কথা বলতে ইরােতাজউদ্দিন পছন্দ করেন। ধর্মের কত জটিল বিষয় আছে। কত সূক্ষ্ম খুঁটিনাটি আছে। এইসব নিয়ে আলাপ করতেও उठाনা व्लांकों!
 

Users who are viewing this thread

Back
Top