What's new
Nirjonmela Desi Forum

Talk about the things that matter to you! Wanting to join the rest of our members? Feel free to sign up today and gain full access!

Collected ছোছনা ও জননীর গল্প - উপন্যাস (2 Viewers)

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ

দলিলপত্ৰ : অষ্টম খণ্ড

গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার, তথ্য মন্ত্রণালয়

যতিন্দ্ৰনাথ মণ্ডল

গ্ৰাম : শশীদ

ডাকঘর : মোশাণী

থানা : স্বরূপকাঠি

জেলা : বরিশাল

১৭ই বৈশাখ পাকবাহিনী গান বোট নিয়ে ঝালকাঠি দিয়ে কাটাখালী নদী দিয়ে শশীদের হাটে আসে। তারা এসে হাটের পাশে গান বোট রেখে গ্রামের উপর নেমে পড়ে। পাকবাহিনী গ্রামের ভেতর প্রবেশ করার সঙ্গে সঙ্গে গ্রামের নারী-পুরুষ প্ৰাণের ভয়ে যে যেদিকে পারে পালাতে চেষ্টা করে। পাকবাহিনী গ্রামে প্রবেশ করে প্রথমে দামি দামি জিনিসপত্র লুঠতরাজ করে এবং পরে ৯ খানা বাড়ি অগ্নিসংযোগে ধ্বংস করে দেয়। ঐ দিন ২জন লোককে তারা গুলি করে। এদের একজন সঙ্গে সঙ্গে মারা যায় আর একজন গুরুতব রূপে আহত হয়।

২৬শে বৈশাখ পাকবাহিনী গু রাজাকাররা পুনরায় আমাদের গ্রামে আসে। তারা গান বোট ও স্পিড বোট নিয়ে ছোট খাল দিয়ে গ্রামের ভেতর ঢুকে পড়ে। মতিলাল দেবনাথ (ব্যানাজী) ও হিরালাল দেবনাথের কাপড়ের দোকান লুঠ করে স্পিড বোট বোঝাই করে কাপড় নিয়ে যায়। এই সময় মতিলাল দেবনাথের কাছ থেকে নগদ ১২০০০ হাজার টাকা নেয় এবং তাকে বেয়োনেট চার্জ করে পরে গুলি করে নির্মমভাবে হত্যা করে। এইদিন আমাদের গ্রামের ১৮জন লোককে পাকবাহিনী গুলি করে বেয়োনেট চার্জ করে হত্যা করে। এর মধ্যে জিতেন নামে একজনকে পাক বর্বর বাহিনী নারিকেল গাছের সঙ্গে দড়ি দিয়ে শক্ত করে বেঁধে তার পায়ের কাছে খড়কুটা দিয়ে আগুন ধরিয়ে দেয়। তার সারা শরীরে আগুন ধরে গেলে সে ভীষণভাবে চিৎকার করতে থাকে, তখন পাক বর্বর বাহিনী গুলি করে তার মাথার অর্ধেক অংশ উড়িয়ে দেয়।

এই ঘটনা তার স্ত্রীর সম্মুখে হয়। কেননা পাকবাহিনী তার স্ত্রীকে ধরে এনে তার সম্মুখে তাকে নৃশংসভাবে হত্যা করে। এই সময় ক্ষীরদা সুন্দরী নামি এক বিধবা মেয়েকে পাকবাহিনী সারা শরীর বেয়োনেট নিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করে। এইসময় আর এক মহিলা পাশের জঙ্গলের ভেতর পালিয়ে ছিল তার ছোট ১ ছেলে ও ১ মেয়েকে নিয়ে। পাকবাহিনী তাদের লক্ষ করে গুলি ছুড়লে এক গুলিতে ছেলে, মেয়েসহ তিনজনই মারা যায়।

ঐ দিন আমাদের গ্রামের মোট চারখানা বাড়ি বাদে আর সব বাড়ি অগ্নিসংযোগে ধ্বংস করে দেয়।

৫ই জ্যৈষ্ঠ পাকবাহিনী ঝালকাঠি থেকে গান বোট নিয়ে পুনরায় শশীদ হাটে আসে এবং হাটের উপর ক্যাম্প স্থাপন করে। ঐ দিনই পাকবাহিনী আমাদের গ্রাম থেকে ২জন লোককে হত্যা করে। তার মধ্যে একজন ছিল স্থানীয় স্কুলের সেক্রেটারি কালী কান্ত মণ্ডল। এইসময় পাকবাহিনী স্কুলের লাইব্রেরি লুট করে এবং ভেঙেচুরে সব তছনছ করে দেয়। এবং লাইব্রেরির ভেতরে ছাত্রদের দেওয়া রিলিফের গম পেট্রোল ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেয়। এই গমের আগুন নেভাতে গিয়েই সেক্রেটারি সাহেব গুলি খান। পাকবাহিনী এই সময় ১০ দিন শশীদ হাটে ক্যাম্প করে। থাকে। এই সময় তারা ব্যাপক হারে নারী ধর্ষণ করে। একমাত্ৰ আমাদের গ্রামে অনেক মেয়েকে পাকবাহিনী ধর্ষণ করে।
 
পাকবাহিনী রাত্ৰিতে গ্রামের ভেতর ঢুকে মেয়েদের উপর পাশবিক অত্যাচার করে এবং কিছু কিছু মেয়েকে তারা ধরে ক্যাম্পে নিয়ে যায় এবং এক একজনের উপর পর পর কয়েকজন পাক পশু ধর্ষণ করে। এই সময় ১১ বৎসরের একটা ছোট মেয়েকে পাকবাহিনী তাদের ক্যাম্পে নিয়ে যায় এবং একাধারে তার উপর চলে পাশবিক অত্যাচার। পাকবাহিনী চলে যারবার পর এই মেয়েটিকে উদ্ধার করা হয়। ৩ মাস পর্যন্ত এই ছোট মেয়েটি হাঁটতে পারত না।

৮ মাসের গর্ভবতী একটি মেয়ের উপর পাকবাহিনী এই সময় অমানুষিক পাশবিক অত্যাচার চালায়, যার দরুন সন্তান প্রসব করার পর সে ও সন্তান মারা যায়।

২৫শে শ্রাবণ পাকবাহিনী দালালের সহযোগিতায় ঝালকাঠি থেকে গান বোট নিয়ে শঙ্কর ধবল গ্রামে আসে এবং আছমত আলী ও রহিনী মিস্ত্ৰিকে ধরে নিয়ে শশীদ গ্রামে আসে এবং সুনীল সরকার নামে একটা ছেলেকে গুলি করে হত্যা করে। এই সময় খুব বৃষ্টি নেমে পড়ে। পাকবাহিনী তখন রহিনী কুমার মণ্ডলের ঘরে আশ্রয় নেয়। এবং হারমোনিয়াম, ঢোল, তবলা নিয়ে খুব গান-বাজনা করে এবং কলা খায়। বৃষ্টি শেষে যাবার সময় গৃহকর্তা রহিনী কুমার মণ্ডলকে গুলি করে হত্যা করে। যে দুইজন লোককে তারা বন্দি করে আনে, তাদের একজনকে টাকার বিনিময়ে ছেড়ে দেয় এবং একজনকে শশীদ হাটে বসে গুলি করে হত্যা করে। তাকে হত্যা করার আগে খুব মারপিট করে এবং খুব গালাগালি দেয়। যাকে এইসময় ছেড়ে দেয় তাকে বলে দেয় তোমরা জয় বাংলা বলতে পারবে না, বলবে জয় পাকিস্তান।

মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে স্বরূপকাঠি থানার অশ্বথকাঠি, জিনহার, মাদ্রা, পূর্বজলা বাড়ি, মৌশানী, জুলুহার, আতা, জামুয়া, জৌসার, গণপতিকাঠি, আরামকাঠি প্রভৃতি গ্রাম জ্বালিয়ে দেয়। এই সময় বহু লোককে তারা নির্মমভাবে হত্যা করে। এই সময় মাদ্রা গ্রাম থেকে দুইজন লোককে কুঠার দিয়ে কুপিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করে। তাদের অপরাধ ছিল পাকসৈন্য যখন একটা মেয়েকে ধর্ষণ করার জন্য যায়, তখন তারা দুইজন বাধা দেয়। এই সময় তারা বহু মেয়েকে ধর্ষণ করে। একমাত্র স্বরূপকাঠি থানাতেই ১০০০ হাজারের বেশি মেয়েকে পাকবাহিনী ধর্ষণ করেছে।

বিভিন্ন সময় আমাদের থানাতে প্ৰায় ২০০/৩০০ লোককে পাকবাহিনী হত্যা করে। স্বাধীনতার পর আটঘর কুড়িয়ানা স্কুলঘরের পেছনে একটা পুকুরের ভেতর থেকে ১৫৬টা মাথার খুলি উদ্ধার করা হয়।

পাকবাহিনী স্বরূপকাঠি দখল করার পর স্বরূপকাঠি, কুড়িয়ানা, শশীদ, বাউকাঠি, জলাবাড়ি–এইসব জায়গায় ক্যাম্প স্থাপন করে এবং এখান থেকেই বিভিন্ন জায়গায় অপারেশন চালায়। জলাবাড়ি ক্যাম্প অঞ্চলে ৩৩টা গ্রাম শুধু হিন্দু বসতি ছিল, পাকবাহিনী সব গ্রাম একেবারে নিশ্চিহ্ন করে দেয়।

স্বাক্ষর/–যতিন্দ্ৰনাথ মণ্ডল



আলেয়া বেগম

গ্ৰাম : বাঘেরিয়া

ডাকঘর : সোনাগাজী

জেলা : নোয়াখালী

পাকবাহিনী সোনাগাজী ও মতিগঞ্জে শিবির স্থাপন করিয়া স্থানীয় দালাল ও রাজাকারদের সহায়তায় শিবিরের আশেপাশের গ্রামগুলি আক্রমণ করিত। হঠাৎ গ্রামে প্রবেশ করিয়া ধনরত্ন লুণ্ঠন করিত এবং অসহায় নারীদের উপর চালাইত নির্মম অত্যাচার। পাকবাহিনীর অত্যাচারের ভয়ে উক্ত এলাকার প্রায় সকল যুবক, যুবতীগণ নিজ বাড়ি ছাড়িয়া কেহ ভারতে এবং অন্যেরা সুদূর গ্রামে আত্মীয় পরিজনের বাড়িতে আশ্রয় গ্রহণ করে।

জুন মাসে পাকবাহিনী সোনাগাজী দখল করিলে আমি আমার স্বামীর বাড়ি ত্যাগ করিয়া সুদূর পল্লীর গ্রামে পলাইয়া ছিলাম। আগষ্ট মাসে আমি নবজাত সন্তান প্রসব করি। সন্তান প্রসবের দুই মাস পর শরীর অসুস্থ থাকায় পিতার বাড়ি হইতে স্বামীর বাড়ি বাঘেরিয়ায় আশ্রয় নেই। তখন আমার স্বাস্থ্য অত্যন্ত দুর্বল ছিল। আমি তখন নিয়মিত ডাক্তারের ওষুধ ব্যবহার করিতাম।
 
অক্টোবর ও নভেম্বর মাসে পাকবাহিনী, দালাল, রাজাকার, আল-বদর ও আল-শামসের অত্যাচার খুব বৃদ্ধি পায়, পাকবাহিনী গ্রামে প্ৰবেশ করার সংবাদ পাইলেই গ্রাম ছাড়িয়া অন্য গ্রামে আত্মগোপন করিতাম। নভেম্বর মাসের ১৫ তারিখে পাকবাহিনী ও মিলিশিয়া আমার স্বামীর বাড়ি আক্রমণ করে। পাকবাহিনীরা আমাকে ধরিয়া ফেলে এবং হাত হইতে আমার নবজাত সন্তানকে মাটিতে ফেলিয়া দিয়া সেখানেই নির্মমভাবে পশুর মতো অত্যাচার করে। তাহাদের অত্যাচারে আমি জ্ঞান হারাইয়া ফেলি। অনুমান ৪/৫ জন নরপশু আমার অসুস্থ দেহের উপর পাশবিক অত্যাচার করিয়া আমাকে জ্ঞানহীন অবস্থায় ফেলিয়া চলিয়া যায়। পরে আমার স্বামী ও অন্যান্য আত্মীয়স্বজন স্থানীয় ডাক্তারের সহায়তায় আমার জ্ঞান ফিরাইয়া আনে।

স্বাক্ষর/-
আলেয়া বেগম



ডা. আব্দুল লতিফ

গ্রাম : ছিরামিসি

থানা : বিশ্বনাথ

জেলা : সিলেট

৩১শে আগষ্ট রোজ মঙ্গলবার সময় সকাল ৯ ঘটিকার সময় অনুমানিক ১৫জন পাক সৈন্য ও সমপরিমাণ রাজাকার ছিরামিসি বাজারে আসে। তাহার পূর্বে ঐ বাজারে পাক সৈন্য আর আসে। নাই। রাজাকার কমান্ডার স্কুলের শিক্ষক, পোস্ট অফিস ও তহশিল অফিসের কর্মরত লোকজন সকলকে ছিরামিসি হাই স্কুলে যাইবার জন্য আদেশ দিল। সেখানে শান্তিকমিটি গঠন করা হইবে। নিরীহ জনগণ ভয়ে বিদ্যালয়ে উপস্থিত হইল। কয়েক মিনিট আলাপআলোচনার পর পাক বাহিনী ছিরামিসি এলাকার লোকদিগকে একদিকে এবং সরকারি কর্মচারী ও বাহির হইতে আগত লোকদের অপর পাৰ্থে বসাইল। কিছুক্ষণের মধ্যে আমাদেরকে দুইভাগে দুই জায়গায় নিয়া যায়। আমি ঐ জায়গায় প্রায় ৭ বৎসর যাবৎ ডাক্তারি করিতেছি। সরকারি কর্মচারীসহ আমাদের বহিরাগত ২৬ জনকে উক্ত স্কুলের প্রধান শিক্ষকের অফিসে নিয়া শক্ত করিয়া দড়ি দিয়া বাধিয়া ফেলে এবং আমাদিগকে পার্শ্ববর্তী থানা জগন্নাথপুর নিয়া ছাড়িয়া দিবে বলিয়া ঘর হইতে বাহির করিয়া নৌকায় লইয়া যায়। অপর দিকে ছিরামিসি গ্রাম ও বাজারের ৩৭ জনকেও বাধিয়া অপর গ্রামের দিকে নিয়া যায়। আমাদের ২৬জনকে নৌকা যোগে কচর্যাকেলী গ্রামে নিয়ে যায়। সেখানে আমাদিগকে পুকুরের পাড়ে কিছু পানির মধ্যে সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করায়। ঐ সময় আমাদের হাত পেছনের দিকে শক্তভাবে বাধা ছিল। দুইদিক হইতে পাকবাহিনী ও রাজাকার গুলি করিতে থাকে। আমি হাতে ও পায়ে গুলিবিদ্ধ হইয়া পুকুরের পানিতে ড়ুব দেই। বহুকষ্টে পুকুরের অপর পাড়ে গাছের আড়ালে আশ্রয় নেই। কিছুক্ষণ সেখানে থাকার পর আমি সেখান হইতে আবার পুকুরের অপর পাড়ে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় শহিদ লোকদের পার্শ্বে আসি। সেখানে প্ৰত্যেককে ভালোভাবে লক্ষ্য করিয়া দেখি সকলেই নরপিশাচদের গুলিতে শাহাদৎ বরণ করিয়াছে। অপরদিকে ছিরামিসি এলাকার ৩৭জনকে মাঠে নিয়া অনুরূপ অবস্থায় গুলি করিয়া হত্যা করিয়াছে। আমি আহত অবস্থায় অপর গ্রামে গিয়া আশ্রয় নেই। সেইদিন যাহারা শহিদ হইয়াছেন তাহাদের নাম নিম্নে দেওয়া হইল।

আব্দুল বারিক মেম্বার, আব্দুল লতিফ, সুন্দর মিঞা, তহশীলদার ও তাহার দুই ছেলে, পোস্টমাস্টার ছিরামিসি বাজার, ছিরামিসি হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক, ছিদ্রামিসি প্রাইমারি স্কুল শিক্ষক একজন, নজীর আহমদ, একলাস মিঞা, মজীদ উল্লা, দবীর মিঞা, রুসমত উল্লাহ, তৈয়ুব আলী, মোসাদের আলী ও অন্যান্য। ৩১শে আগস্ট পাকবাহিনী ও তাঁহাদের অনুচরগণ ৬৩জন নিরীহ জনসাধারণকে হত্যা করিয়া ক্ষান্ত হয় নাই। ১লা সেপ্টেম্বর ছিরামিসি বাজার ও গ্রাম জ্বালাইয়া দেয় ও মা-বোনদের উপর পাশবিক নিৰ্যাতন করে।

স্বাক্ষর/–আবদুল লতিফ



মোছাঃ চানুভান

গ্রাম; ফুলবাড়িয়া

থানা : ব্ৰাহ্মণবাড়িয়া

জেলা : কুমিল্লা

আমি দরিদ্র পিতৃহীন অবিবাহিতা নারী। বিধবা মাতা একমাত্র সংসারের আপনি পরিজন। আমার কোনো ভাইবোন নাই।

বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলন আরম্ভ হইলে পাকবাহিনী পত্তন ইউনিয়নে শিবির স্থাপন করে। জুন মাসের শেষের দিকে পাক সৈন্য ও রাজাকারদের অত্যাচার ও নৃশংসতা বৃদ্ধি পায়। স্থানীয় রাজাকাররা গ্রামের ও ইউনিয়নের বহু ধনসম্পত্তি লুণ্ঠন করে। জুলাই মাসের ১৭ তারিখ বানু মিঞা, সোনা মিঞা ও চাদ মিঞা। গভীর রাত্রে আমার নিজ বাড়ি হইতে ধরিয়া লইয়া পাকবাহিনীর শিবিরে নিয়া যায়। আমাকে দেখিয়া পাকবাহিনীরা আনন্দে নাচিয়া উঠে, আমার ক্ৰন্দন তাহাদের প্রাণে একটুও মায়ার সঞ্চার করে নাই। রাজাকাররা ধরিয়া নিবার সময় তাহাদের নিকট বহু আকুতি মিনতি ও পায়ে জড়াইয়া পড়িয়াছি। উক্ত রাজাকারদের নিকট আমি যতই ক্ৰন্দন করিয়াছি, রাজাকারগুলি আমার সহিত তত বেশি অমানুষিক ব্যবহার করিয়াছে।

পাঁচদিন পাক নরপিশাচরা আমাকে তাহদের শিবিরে ও বাঙ্কারে আটকাইয়া রাখে ও আমার দুর্বল দেহের উপর অমানুষিক অত্যাচার করে ও মুক্তিবাহিনীর সংবাদ জানি কি-না জিজ্ঞাসা করে। আমি মুক্তিবাহিনীর সম্বন্ধে জানি না বলিলে আমার উপর ক্রুদ্ধ হইয়া প্ৰহার করে। এই পাঁচদিন তাহারা আমাকে গোসল করিতে পর্যন্ত দেয় নাই।

আমাকে ধরিয়া দিবার পরিবর্তে রাজাকারগণ পাক নরপিশাচদের হইতে প্রচুর মদ ও গ্রামে গ্রামে লুণ্ঠন করার অনুমতি পাইয়াছিল। সৈন্যদের অত্যাচারে বহুবার আমি জ্ঞান হারাইয়া ফেলিয়াছি। জ্ঞান ফিরিয়া পাইলেও দেখি ও অনুভব করি আমার দুর্বল শরীরে অত্যাচার করিতেছে। সেই কথা ভাবিতে আজো আমার ভয় হয়।

আমাকে ১৭ জুলাই রাত্রে রাজাকাররা ধরিয়া নিবার পর ১৮ জুলাই আমার মা কেসবিপুর গ্রামে মুক্তিবাহিনীর কমান্ডার নজীর আহমদ সাহেবের নিকট আমাকে পাক শিবিরে ধরিয়া নিবার করুণ সংবাদ বলিলে উক্ত মুক্তিবাহিনীর কমান্ডার ২১ জুলাই গভীর রাত্রে বহু মুক্তিযোদ্ধা নিয়া ফুলবাড়িয়া পাক সৈন্যদের শিবির ও বাঙ্কার আক্রমণ করেন। হঠাৎ আক্রমণে পাকবাহিনী ও রাজাকাররা আত্মসমৰ্পণ করে। আক্রমণের সময় তাহারা সকলে আমার উপর অত্যাচার করিতেছিল! মুক্তিযোদ্ধা ভাইরা আমাকেসহ ১৪জন সৈন্য ও তিনজন রাজাকারকে গ্রেপ্তার করিয়া ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যে নিয়া যান। তাহারা আমার সম্মুখে রাজাকার ও পাক নরপিশাচদের জীবন্ত মাটি চাপা দেন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর আমি ত্রিপুরা রাজ্য হইতে নিজ জন্মভূমি ফুলবাড়িয়া ফিরিয়া আসি।

স্বাক্ষর/–

মোছাঃ চানুভান
 
রাত দশটা।

তুমুল বর্ষণ হচ্ছে। নাইমুল অতিতবাড়ি স্কুলের অ্যাসিসটেন্ট হেডমাস্টার

প্রবলবেগে বৃষ্টির পানি নেমে আসছে। নাইমুল এই পানিতে গোসল সারছে। বৃষ্টির পানি বরফের মতো ঠাণ্ডা। নাইমুলের শরীর কাঁপছে কিন্তু গোসল শেষ না করে উঠতে ইচ্ছা করছে না।

তালেব সাহেব একটা শুকনা গামছা এবং ধোয়া লুঙি নিয়ে বারান্দায় অপেক্ষা করছেন। তালেব সাহেবের পাশে তার বড়মেয়ে চাপা। চাঁপা নাইনে পড়ে। চাঁপার হাতে একটা হারিকেন। চাঁপার মা আমেনা বেগমও কিছুক্ষণ স্নানের দৃশ্য দেখেছেন। এখন তিনি গেছেন রান্নার আয়োজনে। ঘরে কিছুই নেই। অতি দ্রুত কিছু ব্যবস্থা করতে হবে। ডিমের তরকারি, বেগুনভাজি, মাষকলাইয়ের ডাল। খোয়াড়ে মুরগি আছে। মুরগির মাংস করতে পারলে ভালো হতো। সন্ধ্যার পর মুরগি জবেহ করা নিষেধ বলেই মুরগি জবেহ করা যাচ্ছে না।

যে মানুষটা গোসল করছে, সে কোনো সাধারণ মানুষ না। সে মুক্তিযোদ্ধা। মুক্তিযোদ্ধারা যুদ্ধ শুরু করেছে–স্বাধীন বাংলা বেতার থেকে এরকম খবর পাওয়া গেলেও তালেব সাহেবের পরিবার এই প্রথম চোখের সামনে মুক্তিযোদ্ধা দেখছে। কী সুন্দর চেহারা! দেখেই মনে হয় বড় ঘরের সন্তান। পথে পথে ঘুরছে।

তালেব সাহেব বললেন, আপনার সাবান লাগবে? ঘরে সাবান আছে।

নাইমুল বলল, সাবান লাগবে না।

বৃষ্টির পানি ঠাণ্ডা না?

বেশ ঠাণ্ডা।

তাহলে বেশিক্ষণ থাকবেন না। উঠে পড়েন।

নাইমুল বলল, আরেকটু থাকি।

তালেব সাহেব বললেন, আপনার জন্যে একটু চা করতে বলব? ঘরে চায়ের ব্যবস্থা আছে। গুড়ের চা। রান্না হতে সামান্য বিলম্ব হবে। গোসল সেরে চা খান। ভালো লাগবে।

চা দিতে বলুন।

চাঁপা দৌড়ে তার মাকে চায়ের কথা বলতে গেল। সে একটা মুহুর্তের জন্যেও মানুষটাকে চোখের আড়াল করতে চাচ্ছে না। তাদের বাড়িতে একজন মুক্তিযোদ্ধা অস্ত্ৰ হাতে উঠে এসেছে। অবিশ্বাস্য ব্যাপার। মানুষটার প্রতিটা কথা সে খুব মন দিয়ে শুনতে চায়।

তালেব মাস্টার বললেন, কিছু মনে করবেন না, আপনার দলের আর লোকজন কোথায়?

আমার দলে আর লোক নেই। আমি একাই একটা দল করেছি। দলের নাম বললে আপনি হয়তো চিনবেন। আমার দলের নাম হাছুইন্যার দল। ইংরেজিতে হাছুইন্যা গ্রুপ।

তালেব মাস্টার চমকে মেয়ের দিকে তাকালেন। হাছুইন্যার দলের অসীম সাহসী কর্মকাণ্ডের খবর এই অঞ্চলের সবাই জানে। এই মানুষটা হাছুইন্যা?

নাইমুল বলল, নামটা ভালো হয়েছে না? হাছুন অর্থ ঝাড়ু। হাঙ্গুইন্যার দল ঝাড়ু মেরে দেশ থেকে মিলিটারি তাড়াবে।

চাঁপা হেসে ফেলল। মানুষটার কথা তার এত মজা লাগছে! সে চট করে হাসি থামিয়েও ফেলল। হাছুইন্যার দলের হাছুইন্যা অবাক হয়ে এখন তাকে দেখছে। তার খুব লজ্জা লাগছে। সে চা আনতে রান্নাঘরে চলে গেল। গোসল যে করছে এই মানুষটাই বিখ্যাত হাছুইন্যা–এই খবর মাকে দিতে হবে।

চাপার হাসি শুনে কিছুক্ষণের জন্যে নাইমুল বিভ্রান্ত হয়ে গিয়েছিল। মনে হচ্ছিল মরিয়ম হাসছে। হারিকেন হাতে মেয়েটির সঙ্গে মরিয়মের কোনো মিল নেই। কিন্তু দুজনের হাসিব শব্দ এত কাছাকাছি!
 
আমেনা বেগম রান্না প্ৰায় সেরে ফেলেছেন। মাষকলাইয়ের ডালটা শুধু বাকি। ডাল সিদ্ধ হতে সময় লাগছে। স্বামী এবং কন্যার মতো তারও ইচ্ছা! করছে অদ্ভুত মানুষটার আশেপাশে থাকতে। সেটা সম্ভব হচ্ছে না। রান্নাঘর ছেড়ে যাওয়া যাবে না। ডাল ধরে যাবে। আয়োজন সামান্য, এর মধ্যে একটা যদি নষ্ট হয় বেচারা খাবে কীভাবে? এরা বনে-জঙ্গলে ঘুরে বেড়ায়, আরাম করে একবেলা হয়তো খেতেই পারে না।

নাইমুল আয়েশ করে চায়ে চুমুক দিচ্ছে। তার এবং মাস্টার সাহেবের হাতে সিগারেট। মাস্টার সাহেব সিগারেট খান না। আজ একটা বিশেষ রাত, এই রাত বারবার ঘুরেফিরে আসবে না। রাতটা স্মরণীয় করে রাখার জন্যেই একটা সিগারেট খাওয়া দরকার।

তালেব মাস্টার বললেন, চা খেতে খেতে গল্প করেন। আপনার কথা শুনি।

নাইমুল বলল, কী গল্প করব?

যুদ্ধের গল্প করেন। কীভাবে যুদ্ধ করেন এইসব।

যুদ্ধের গল্প করতে ভালো লাগে না। অন্য গল্প করি?

চাঁপা খুবই আগ্রহ নিয়ে বলল, জি জি করেন!

নাইমুল মজার কোনো গল্প মনে করার চেষ্টা করছে। গল্প মনে পড়ছে না। মজার কোনো গল্প শুনে যদি মেয়েটা হেসে দিত, তাহলে মরিয়মের হাসি আরেকবার শোনা যেত। নাইমুল চাঁপার দিকে তাকিয়ে গল্প শুরু করল।

শোন চাঁপা, একবার এক জীববিজ্ঞানী সুন্দর একটা গবেষণা করলেন। তিনি করলেন কী, বড় একটা অ্যাকুরিয়ামে দুধরনের মাছ রাখলেন। এক ধরনের মাছ বড় বড়, আরেক ধরনের মাছ ছোট। ছোট মাছগুলি বড় মাছের খাদ্য। তিনি করলেন কী, অ্যাকুরিয়ামের মাঝামাঝি কাচের একটা পার্টিশন দিয়ে দিলেন। এখন কী হলো শোন–বড় মাছগুলি ছোট মাছ দেখে খাবার জন্যে হা করে ছুটে আসে। এসেই এক সময় কাচের দেয়ালে ধাক্কা খায়। ছোট মাছ তারা আর খেতে পারে না। দিনের পর দিন এরকম চলল। তারপর তারা একসময় বুঝলকোনো এক বিচিত্র কারণে ছোট মাছগুলিকে খাওয়া সম্ভব হচ্ছে না, তারা ছোট মাছ খাবার চেষ্টা বন্ধ করে দিল। আর তখনই বিজ্ঞানী ভদ্রলোক কাচের পার্টিশন তুলে দিলেন। দুধরনের মাছই একসঙ্গে মিশে গেল। কিন্তু বড় মাছগুলি ছোট মাছ খায় না। মুখের সামনে দিয়ে যাচ্ছে কিন্তু তারা খাচ্ছে না। খাবার চেষ্টাও করছে না।

চাঁপা বলল, ও আল্লা! সত্যি?

হ্যাঁ সত্যি। অ্যাকুরিয়াম থেকে কাচের পার্টিশন উঠে গেছে কিন্তু সেই পার্টিশন চলে গেছে বড় মাছগুলির মাথায়।

চাঁপা বলল, মাছের মাথায় কাচের পার্টিশন যাবে কীভাবে?

নাইমুলের কাছে অদ্ভুত লাগছে কারণ মরিয়মও চাঁপার মতোই একই প্রশ্ন করেছিল–কাচের পার্টিশন মাছের মাথায় যাবে কীভাবে? মেয়েটা শুধু যে মরিয়মের মতো হাসছে তা না, তার চিন্তা-ভাবনাও মরিয়মের মতো।

আমেনা বেগম দরজার ওপাশ থেকে বললেন, খাওয়া কি এখন দিব? নাইমুল বলল, দিন। খুবই ক্ষুধার্তা। তালেব মাস্টার বললেন, আপনি খাওয়াদাওয়া করে আরামে ঘুমান। বিছানা করে দিতেছি। আপনার ভয়ের কিছু নাই। আমি ঘুমাব না। সারারাত জেগে থাকব। পাহারায় থাকব। চাঁপা বলল, আমিও জেগে থাকিব।

নাইমুল বলল, কারো জেগে থাকতে হবে না। আমি আরামেই ঘুমোব। আমার ভয়-ডর একেবারেই নাই।

নাইমুল খেতে বসেছে। তালেব মাস্টারের পরিবার তাকে ঘিরে আছে। আমেনা বেগমের মন খারাপ লাগছে–ছেলেটা কী আগ্রহ করেই না খাচ্ছে! একটু ভালো আয়োজন যদি করা যেত! নাইমুল তালেব মাস্টারের দিকে তাকিয়ে বলল, চন্দ্রপুর এখান থেকে কত দূর?

তালেব মাস্টার বললেন, দূর আছে। আপনি চন্দ্রপুর যাবেন? চন্দ্রপুর কার কাছে যাবেন?

নাইমুল জবাব দিল না। চন্দ্রপুর কার কাছে সে যাবে–এই তথ্য প্রকাশ করার কিছু না।

ভাত দ্রুত শেষ হয়ে যাচ্ছে। আমেনা বেগমের বুক ধড়ফড় করছে। ভাতে টান পড়বে না তো?
 
চন্দ্রপুরের পীর সাহেবকে তার খাদেম এবং ভক্তরা ডাকে সুরমা বাবা। তিনি চোখে সুরমা ছাড়া সারা গায়ে কোনো কাপড় পরেন না বলেই এই নাম। তিনি দিনরাত অন্ধকার একটা ঘরে থাকেন। ঘরের একটা মাত্র দরজা। সেই দরজা চটের ভারি পর্দায় ঢাকা থাকে। সেই ঘরে খাদেম ছাড়া অন্য কারো প্ৰবেশ নিষেধ। ভক্তরা বিশেষ চাপাচাপি করলে দর্শন দেন। ভক্তদের তখন ঘরে ঢোকার অনুমতি দেয়া হয়। সুরমা বাবার সঙ্গে দেখা করার আগে ভক্তদেরও চোখে সুরমা দিতে হয়। সুরমাদানি নিয়ে খাদেম দরজার পাশে বসে থাকেন; হাদিয়ার বিনিময়ে খাদেম চোখে সুরমা দিয়ে দেন।

আজ চন্দ্ৰপুরের পীর সাহেবের হুজরাখানা জমজমাট। প্রথমত, আজি বৃহস্পতিবার। সারারাত জিগির হবে। জিগির শেষ হবে ফজর ওয়াক্তে, তখন সিন্নি দেয়া হবে। সিন্নি হলো গরু, খাসি, মুরগি এবং চাল-ডালের খিচুড়ি জাতীয় খাদ্য। সুরমা বাবার দোয়ায় এই খাদ্য অতি সুস্বাদু হয়। একবার যে খেয়ে যায়, বাকি জীবন তার এই সিনির কথা মনে থাকে।

জিগির ছাড়াও আজ আরেকটি বড় ঘটনা আছে। পীর সাহেবের দাওয়াতে ধর্মপাশা থেকে মিলিটারির মেজর সাহেব আসছেন। তিনি যেহেতু সন্ধ্যার পর থাকবেন না, কাজেই আজ সিন্নি সকাল সকাল রান্না হচ্ছে। মেজর সাহেবকে ইজ্জত করার জন্যে আজ সিন্নি দেয়া হবে আছর ওয়াক্তে। সিন্নি দেয়ার আগে পাকিস্তানের জন্যে দোয়া করা হবে। এই দোয়ায় শামিল হবার জন্যে পীর সাহেব তার ভক্তদের ডেকেছেন। ভক্তদের মধ্যে অনেকেই এসেছে।

মেজর সাহেবকে ইজ্জত করার জন্যে সুরমা বাবা আজ ঘিয়া রঙের একটা চাদর লুঙির মতো কোমরে পেঁচিয়ে রেখেছেন। একবার নিজে এসে রান্নার খোঁজও নিয়ে গেলেন। সচরাচর এই কাজ তিনি করেন না।

সুরমা বাবার হুজরাখানার সামনে নাইমুল বসে আছে। তার গায়ে চাদর। মুখভর্তি দাড়ি-গোঁফের জঙ্গল। সে সুরমা বাবার সঙ্গে একান্তে দেখা করতে চায়। আজ যে ব্যস্ততা তাতে দেখা করা অসম্ভব, তবে সুরমা বাবার এক খাদেমের হাতে দুপ্যাকেট ক্যাপস্টেন সিগারেট এবং দশটা টাকা দেয়ায় খাদেম আশ্বাস দিয়েছে দেখা করিয়ে দেবে। নাইমুল ধৈৰ্য নিয়ে অপেক্ষা করছে। সে খাদেমকে বলেছে, সুরমা বাবার জন্যে সে কিছু নজরানা নিয়ে এসেছে। বাবার সঙ্গে দেখা হবার পর সে খাদেমকেও খুশি করে দেবে।

এই গরমেও নাইমুলের গায়ে কালো রঙের প্রায় কম্বল জাতীয় চান্দর। তার চোখ লাল। সে মাঝে-মাঝে কাশছে। চোখ লালের কারণ তার চোখ উঠেছে। এই চোখ উঠার নাম জয় বাংলা রোগ। সবারই হচ্ছে। এই রোগ এক সপ্তাহের বেশি থাকে না। নাইমুলের বেলায় রোগ মনে হয় স্থায়ী হয়ে গেছে। আজ নিয়ে বারদিন হলো রোগ সারছে না। এমন কোনো কষ্ট নাই, শুধু রোদের দিকে তাকানো যায় না। চোখ কটকট করে।

সকাল থেকে নাইমুলের কিছু খাওয়া হয় নি। এখন দুপুর। সিনির গন্ধে পেটের ভেতর পাক দিচ্ছে। গন্ধেই বোঝা যাচ্ছে এই সিন্নি আসলেই খেতে ভালো হবে।

সুরমা বাবার হুজরাখানায় নাইমুলের ডাক পড়েছে। খাদেম বলল, আপনার সমস্যার কথা বাবাকে অতি অল্প কথায় বলবেন। লম্বা ইতিহাস বলার প্রয়োজন নাই। বাবা সবই বুঝেন। এখন আসেন, চোখে সুরমা দিয়ে দেই। সুরমার নজরানা এক টাকা।

নাইমুল বলল, সুরমা না দিলে হয় না? আমার চোখের অসুখ।

খাদেম বিরক্ত গলায় বলল, সুরমা চোখে না দিলে বাবার সঙ্গে সাক্ষাৎ হবে। না। মেজর সাহেব যে আসতেছেন, উনারও চোখে সুরমা দিতে হবে। টিক্কা খান দেখা করতে আসলে তার জন্যেও একই ব্যবস্থা।

দেন, চোখে সুরমা দেন। ব্যথা দিবেন না।
 
সুরমা বাবা গা থেকে চাদর খুলে ফেলেছেন। ঘরের ভেতরটা গরম। গরমে তিনি ঘামিছেন। চাদর দিয়ে বিরক্ত ভঙ্গিতে গায়ের ঘাম মুছছেন। বাবার সামনে জলচৌকি। জলচৌকিতে পিতলের গ্রাসে পানি। একপাশে হাতপাখা। তিনি হাতপাখা দিয়ে অতি দ্রুত নিজেকে কিছুক্ষণ বাতাস করেই এক চুমুক পানি খান। নাইমুল কাউকে কখনো এত দ্রুত বাতাস করতে দেখে নি। সুরমা বাবা নাইমুলের দিকে তাকিয়ে বিরক্ত গলায় বললেন, কী চাস? তুই চাস কী?

নাইমুল বিনয়ে নিচু হয়ে বলল, আপনার জন্যে কিছু নজরানা এনেছি। নিজের হাতে দিতে চাই।

জিনিসপত্র না টেকা?

টাকা।

পরিমাণ কত?

পরিমাণ ভালো।

সুরমা বাবার মুখের বিরক্তি দূর হলো। তিনি প্রায় হাসিমুখে বললেন, আমার কাছে টেকার পরিমাণ কোনো বিষয় না। আমার কাছে এক টেকার যে মূল্য, হাজার টেকার একই মূল্য। সব টেকা-পয়সা গরিব দুঃখীর কাজে ব্যবহার হয়। এইটাও একটা ইবাদত। এই ইবাদতের নাম হাকুল ইবাদ। নজরানার টেকা জলচৌকির নিচের দানবাক্সে রাখা। যা বলার তাড়াতাড়ি বলে চলে যা। মেজর সাব আসতেছেন।

হুজুর কি মেজর সাহেবকে দাওয়াত দিয়েছেন?

অবশ্যই দাওয়াত দিয়েছি। দাওয়াত ছাড়া তারা আসবেন?

হুজুর যদি কিছু মনে না করেন, যদি বেয়াদবি না নেন–একটা প্রশ্ন করব?

কী প্রশ্ন?

শুনেছি মিলিটারিরা অনেক মানুষ মেরেছে, মেয়েদের ধরে ক্যাম্পে নিয়ে গেছে। তাদেরই দাওয়াত করেছেন–ব্যাপারটা কেমন না?

সুরমা বাবা তীক্ষ্ণ গলায় বললেন, কেমন মানে? বিধমীর সাথে যুদ্ধের নিয়ম তুমি জানো? বিধমীর মালা হলো গনিমতের মাল। সেই মাল নেওয়ার হুকুম আছে। বিধমীদের মেয়েছেলেও মালের মধ্যে পড়ে।

যুদ্ধ তো বিধমীর সঙ্গে হচ্ছে না। এই দেশের মানুষের সঙ্গে হচ্ছে।

তুমি চাওটা কী পরিষ্কার করে বলো তো? তুমি কে?

আমার আসল নাম নাইমুল। আসল নামে আপনি আমাকে চিনবেন না। যে নামে আপনি আমারে চিনবেন সেই নাম হলো–হাছুইন্যা। এখন চিনেছেন?

সুরমা বাবার মুখ যে ফ্যাকাশে হয়ে গেল, তা এই প্রায়ান্ধকার ঘরেও বোঝা গেল। নাইমুল গায়ের কালো চাদর খুলে ফেলল। স্টেনগান এখন পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। নাইমুল বলল, শুনেন সুরমা বাবা–চিৎকার চোঁচামেচি কিছুই করবেন। না। যেভাবে বসে আছেন, বসে থাকেন। আমি এসেছি মেজরটাকে মারার জন্যে। আমার সঙ্গে আরো চারজন আছে। এরা বাইরে আছে। আপনি হাছুইন্যা গ্রুপের নাম শুনেছেন?

জি বাবা শুনেছি।

আমার দলটার নাম হাছুইন্যার দল।

ইয়া গাফুরুর রহিম। এইটা কী বলেন!

ভয় লাগে?

জি লাগে।

নেংটা বসে থাকবেন না, কাপড় গায়ে দেন।

সুরমা বাবা অতি দ্রুত চাদর গায়ে প্যাচালেন। নাইমুলও চাদর গায়ে দিল। ভয় যতটুকু দেখানোর দেখানো হয়েছে। সুরমা বাবা কঁপা কাপা গলায় বললেন, বাবাজি, আমাকে কিছু করবেন না তো?

নাইমুল বলল, আপনি যদি মেজরটাকে মারার জন্যে আমাকে সাহায্য করেন, তাহলে আপনাকে কিছু করব না। আর যদি সাহায্য না করেন–আপনাকে মেরে ফেলব। আমি আপনার সঙ্গেই থাকব। মেজর আপনার সঙ্গে কথা বলতে যখন আসবে, তখন গুলি করব।

বাবাজি এইসব কী বলেন?

ভয় পাচ্ছেন কেন? আপনি এত বড় পীর! মারা যাবার সঙ্গে সঙ্গে বেহেশতে চলে যাবেন। সত্তরটা হুর আপনার গা টিপা টিপি করবে।

বাবাজি, ভুল-ত্রুটি কিছু হয়ে থাকলে ক্ষমা দেন।

হাছুইন্যা গ্রুপের কাজ-কারবার তো জানেন। ক্ষমা এক বস্তু এদের মধ্যে নাই। বিদায় নিয়েছে। দেশ যেদিন স্বাধীন হবে, সেদিন হয়তো ফিরে আসবে।

চটের পর্দা ফাঁক করে একজন খাদেম উঁকি দিল। নাইমুলের দিকে তাকিয়ে কঠিন গলায় বলল, এই তুমি আসো। বাবার সামনে বেশিক্ষণ থাকার নিয়ম নাश्।

নাইমুল বলল, আরেকটু দেরি হবে। বাবার সঙ্গে আসল কথাই এখনো হয় নাই। সুরমা বাবা, আপনি আপনার খাদেমকে বলেন, আমার দেরি হবে।

সুরমা বাবা যন্ত্রের মতো বললেন, উনার দেরি হবে। তুমি এখন যাও।
 
খাদেম পর্দা নামিয়ে চলে গেল। ঘর আবারও অন্ধকার হয়ে গেল। নাইমুল বলল, সুরমা বাবা, মেয়েভক্তরা আপনার কাছে আসে না?

আসে। তাদের সামনেও নেংটিা হয়ে বসে থাকেন? বাবাজি, আমার শরীরে গরম বেশি, এই জন্যে গায়ে কাপড় রাখতে পারি না। বাবাজি গো, এইবার আমারে মাফ দেন। মাফ দিলে আমি জয় বাংলার লোক হবো।

নাইমুল সিগারেট ধরাল। সুরমা বাবার দিকে সিগারেটের প্যাকেট এগিয়ে দিয়ে বলল, নিন। সিগারেট খান।

সুরমা বাবা সিগারেট নিলেন। দেয়াশলাই দিয়ে সিগারেট ধরাতে তার অনেক সময় লাগল। তার হাত কাঁপছে।

লোকে বলে আপনার জীন সাধনা আছে। সত্যি নাকি?

জি বাবা সত্যি।

কয়েকটা পোষা জীনও নাকি আছে। কয়টা আছে?

তিনজন আছে। চারজন ছিল। একজনের মৃত্যু হয়েছে। এখন আছে তিনজন।

তাদের ডাকেন, তারা আপনাকে বিপদ থেকে উদ্ধার করুক। যার কন্ট্রোলে তিনটা জীন আছে, সে যদি এত ভয় পায় তাহলে কীভাবে হবে? আপনি কি পিসাব করে দিয়েছেন?

জি-না। পিসাব করি মাই। তবে বাবাজি আমারে টাট্রিঘরে যেতে হবে। পিসাব চেপেছে।

পিসাব এখানেই করেন। আপনাকে টাট্টিঘরে যেতে দিব না।

ছড়ছড় শব্দ হচ্ছে। সুরমা বাবা সত্যি সত্যি পিসাব করছেন।

আছরের সময় খবর পাওয়া গেল মেজর সাহেব। আসবেন না। তবার রুক পাঠিয়ে দিতে বলেছেন। তবারারুক নেয়ার জন্যে ধর্মপাশা থানার একজন সেপাই নৌকা নিয়ে এসেছে।

নাইমুল উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলল, কাজ তো হলো না, এখন তাহলে উঠি?

সুন্নামা বাবা অত্যন্ত আগ্রহের সঙ্গে বললেন, জি আচ্ছা বাবাজি। জি আচ্ছা।

নাইমুল সহজ গলায় বলল, আপনি কাপড় খুলে আবার নেংটা হয়ে যান। আপনি নেংটা বাবা। আপনাকে নেংটা অবস্থায় মারি।

সুরমা বাবা এমনভাবে তাকাচ্ছেন যেন তিনি নাইমুল কী বলছে বুঝতে পারছেন না। নাইমুল বলল, দেরি করছেন কেন? কাপড় খুলেন।

খুব কাছ থেকে নাইমুল স্টেনগান দিয়ে গুলি করল। সে সামান্যতম বিকারও বোধ করল না। তার একটাই সমস্যা হলো–ক্ষিধে নষ্ট হলো।



ধর্মপাশা থানা থেকে হাছুইন্যা গ্রুপের নাইমুলকে জীবিত বা মৃত ধরিয়ে দেবার জন্যে এক হাজার টাকা পুরস্কার ঘোষণা করা হলো। পুরস্কার ঘোষণা করলেন শান্তি কমিটির প্রেসিডেন্ট। তিনি রাতে থাকেন থানায়। বাড়িতে থাকা নিরাপদ বোধ করেন না। পুরস্কার ঘোষণার দুদিনের মাথায় শান্তি কমিটির প্রেসিডেন্ট দুপুরে বাজারে চায়ের দোকানের সামনে মারা গেলেন। নাইমুলের হাতেই মারা গেলেন। গুলি করার আগে নাইমুল জিজ্ঞেস করল, প্রেসিডেন্ট সাহেব, ভালো আছেন? আমাকে চিনেছেন তো, আমি হাছুইন্যা।

প্রেসিডেন্ট সাহেব জর্দা দিয়ে পান খাচ্ছিলেন। তার মুখ থেকে জর্দার রস গড়িয়ে পড়ল। নাইমুল বলল, থানায় কতগুলি মেয়েকে আটকে রাখা হয়েছে एका?

প্রেসিডেন্ট সাহেব বিড়বিড় করে বললেন, থানায় কোনো মেয়ে আটক নাই।

নাইমুল বলল, সত্যি কথা বলেন। আমি কিন্তু চাদরের নিচে ষ্টেনগান তাক করে আছি।

প্রেসিডেন্ট সাহেব বললেন, কয়টা মেয়ে আছে আমি সঠিক জানি না।

আপনার নিজের মেয়ে তো নাই। না-কি আছে?

আপনি কী বলতেছেন বুঝতে পারতেছি না।

গুলি খাওয়ার পরে বুঝবেন। এটা খুবই আশ্চর্যের বিষয়–বুলেট শরীরে ঢোকামাত্র মাথা পরিষ্কার হয়ে যায়। বুলেট হলো মাথা পরিষ্কারের ট্যাবলেট।

প্রেসিডেন্ট সাহেব কথাবাতাঁর এই পর্যায়ে দৌড়ে পালাতে গিয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়লেন। তাকে সেই অবস্থাতেই গুলি করা হলো।
 
একটা সময় পর্যন্ত দেশের মানুষ কলমিলতার মতো নিজের দেশেই পালিয়েছে। যারা ঢাকার মানুষ, তারা ঢাকা ছেড়ে গেছে গ্রামে। গ্রামের মানুষেরা নিজ গ্রাম ছেড়ে অন্য গ্রামে। যারা রাজশাহীর মানুষ, তাদের কাছে মনে হয়েছে রাজশাহী ছাড়া অন্য যে-কোনো জায়গা বোধহয় নিরাপদ। এক জায়গা ছেড়ে আরেক জায়গায় যাওয়া। নিরাপদ আশ্রয়ের অনুসন্ধান।

জুন মাসের মাঝামাঝি যখন রাজাকার বাহিনী ভালোমতোই তৈরি হয়ে গেছে, তখন শুরু হলো Exodus, দেশ ছেড়ে ভিন্ন দেশে যাত্ৰা। শত শত মানুষ বর্ডার পাড়ি দেয়া শুরু করল। তাদের কাছে মনে হলো, কোনোরকমে নিজ দেশের সীমানার বাইরে যেতে পারলেই প্ৰাণে বেঁচে যাওয়া হবে। আহারে কী কষ্টের সেই যাত্ৰা!

ফয়জুর রহমান সাহেবের অসহায় পরিবারও সেই যাত্রার জন্যে প্রস্তুত হলো। তারাও বর্ডার পার হয়ে কোলকাতার দিকে যাবে। যাবার ব্যবস্থা একটাই–নদীপথে সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে যাওয়া। অনেকেই যাবে। অনেকের যাত্রা আবার মাঝখানেই শেষ হয়ে যাচ্ছে। তারা ধরা পড়ছে সুন্দরবনের জলদস্যুদের হাতে।

পাকিস্তানি মিলিটারিও এই যাত্রাপথের খবর পেয়ে গেছে। তাদের গানবোট নিয়মিত নদীপথ টহল দিচ্ছে। নৌকাভর্তি মানুষ দেখা মাত্ৰই গানবোট থেকে কামান দাগছে।

আয়েশা বেগম এই পরিস্থিতিতে ছেলেমেয়ে নিয়ে সুন্দরবন পাড়ি দিতে রাজি হলেন না। তাঁর প্রধান চিন্তা তীর দুই ছেলেকে নিয়ে। অবস্থা যা দাঁড়িয়েছে, যেকোনো দিন রাজাকার দল নিয়ে মিলিটারি বাড়ি ঘেরাও করে ছেলে দুটিকে তুলে নিয়ে যেতে পারে। তিনি যে বাড়িতে আশ্ৰয় নিয়েছেন, সেই বাড়ির প্রধান ব্যক্তিটির সঙ্গে পবামর্শ করে ছেলে দুজনকে নিরাপদ আশ্রয়ে পাঠাবার ব্যবস্থা করলেন। এই গল্পটি বরং আমরা আয়েশা বেগমের বড় ছেলের জবানিতেই শুনি–

পিরোজপুর শহর থেকে পনেরো-ষোলো মাইল দূরের অজ পাড়া গা। নদীর পাশে ছোট্ট গ্রাম। নদীর নাম মনে নেই–বলেশ্বর বা রূপসা হতে পারে। নদী যেমন সুন্দর, গ্রামটা তার চেয়েও সুন্দর। নারিকেল আর সুপারি গাছ দিয়ে অতি যত্নে কেউ যেন এই গ্রাম সাজিয়ে দিয়েছে। ভরা বর্ষা— থৈ থৈ করছে নদী। জ্যোৎস্নারাতে আলোর ফুল ঝরে ঝরে পড়ে। কিছু ফুল আটকে যায় গাছের পাতায়। সব মিলিয়ে পুরো ব্যাপারটা স্বপ্নদৃশ্যের মতো। এই স্বপ্নদৃশ্যে আমি আমার মা এবং ভাইবোনদের নিয়ে বাস করছি। আমাদের মধ্যে কোনো স্বপ্ন নেই।

মা ক্ৰমাগত কাঁদছেন। কারণ খবর পাওয়া গেছে, পাক মিলিটারি আমার বাবাকে হত্যা করেছে। শুধু তাই না, তারা এখন খুঁজে বেড়াচ্ছে আমাকে এবং আমার ছোট ভাই জাফর ইকবালকে। দুজনই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ৰ। দুজনই রাইফেল নিয়ে প্রচুর ছোটাছুটি করেছি। ভেবেছি, পয়েন্ট টু টু বোরের রাইফেলে মিলিটারিদের আটকে দেয়া যাবে। বাস্তবে তা হয় নি। পাক আমির গানবোট বিনাবাধায় পিরোজপুরের হুলারহাটে ভিড়েছে। তাদের একটি দল মার্চ করে ঢুকেছে পিরোজপুর শহরে। শুরু হয়েছে ধ্বংস এবং হত্যার উৎসব।

আমরা তখন পলাতক। প্ৰথমে যেখানে ছিলাম, সেখান থেকে আমাদের তাড়িয়ে দিয়েছে। বিপদজনক মানুষ হিসেবে আমাদের কোথাও জায়গা হচ্ছে না। শেষপর্যন্ত আশ্ৰয় দিলেন গোয়ারেখার জনৈক মাওলানা। তিনি সর্ষিনার পীর সাহেবের ভক্ত খাদেম। মনেপ্ৰাণে পাকিস্তানি। পাকিস্তান যাতে টিকে যায়, সেই দোয়া তিনি প্রতি নামাজেই করছেন। তারপরেও আমাদের আশ্রয় দিয়েছেন। সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন। মাকে বারবার আশ্বাস দিচ্ছেন, জোর গলায় বলছেন–কোনো ভয় নাই। মিলিটারি আপনার ছেলেদের ধরতে পারবে না। উপরে আছেন আল্লাহপাক, নিচে আমি। আমাকে গুলি না করে তারা আপনার ছেলেদের গুলি করতে পারবে না।
 
মা তার কথায় খুব ভরসা পাচ্ছেন না। কারণ আশেপাশে মিলিটারি অপারেশন শুরু হয়ে গেছে। গ্রামের পর গ্রাম জ্বলিয়ে দিচ্ছে। নির্বিচার হত্যাকাণ্ড ঘটে যাচ্ছে। এইসব হত্যাকাণ্ডের খবর আবার মাওলানা সাহেব নিজেই নিয়ে আসছেন এবং আমাদের সবাইকে একত্র করে খুব উৎসাহের সঙ্গে বলছেন।

আজ কাউখালিতে বিশটা মানুষ লাইন করে দাঁড়া করছে। ব্রাশ ফায়ার। সব শেষ।

আজ দুইটা মানুষরে খেজ্বর গাছে তুলে বলল— জয় বাংলা বোল। তার পরেই ঠাস ঠাস গুলি।

আজি কুড়াল দিয়ে এক কোপ দিয়ে হিন্দু কম্পাউন্ডারের কল্লা আলাদা করে ফেলেছে।

হত্যাকাণ্ডের বর্ণনার সময় মাওলানা সাহেবের মুখে এক ধরনের আনন্দময় আভাও দেখতে পাই। আমি কিছুতেই হিসেব মেলাতে পাবি না। ভদ্রলোক নিতান্তই ভালোমানুষ। তিনি শুধু যে আমাদের আশ্রয় দিয়েছেন তাই না, কয়েকজন হিন্দু যুবককেও আশ্রয় দিয়েছেন।

হিন্দুদের জন্যে তখন সব পথ বন্ধ। হিন্দু জানলেই দ্বিতীয় কোনো কথা বলার সুযোগ নেই–গুলি। হিন্দু পরিবারগুলি বাড়ি-ঘর ছেড়ে ছোট ছোট ছেলেমেয়ে নিয়ে আশ্রয় নিয়েছে জঙ্গলে। বর্ষাকালে সাপ-খোপ। ভর্তি জঙ্গল। দিন-রাত বৃষ্টি পড়ছে। বর্ণনার অতীত সব দৃশ্য। এরা পালিয়ে সীমান্ত অতি ক্রম করতেও পারছে না। যেতে হবে সুন্দরবন হয়ে। নদীতে ঘুরছে মিলিটারি গানবোট। সাহায্য করবার জন্য মুক্তিবাহিনী তখনো শক্তি সঞ্চয় করে উঠতে পারে নি।

আমরা আমার নিজের দেশের অপূর্ব সুন্দর একটি গ্রামে আটকা পড়ে গেছি। পালিয়ে যেতে চাচ্ছি। অন্য একটি দেশে। চারপাশে মৃত্যু ঘোরাফেরা করছে। তীব্ৰ আতঙ্কে কাটছে আমাদের দীর্ঘ দিবস, দীর্ঘ রজনী।

এইরকম সময়ে গোয়ারেখার মাওলানা সাহেব চিন্তিত মুখে মাকে বললেন, আপনার ছেলে দুটাকে সরিয়ে দেয়া দরকার। আর দেরি করা যায় না।

মা চমকে উঠে বললেন, কেন?

অবস্থা ভালো দেখতেছি না।

ভালো দেখতেছেন না কেন?

জোয়ান ছেলেপুলে সব ধরে ধরে মেরে ফেলতেছে।

ওদের কোথায় সরিয়ে দিতে চান?

এমন জায়গায় সরাব যে মিলিটারি কোনো সন্ধান পাবে।

এমন জায়গা কি আছে?

অবশ্যই আছে। ওদের রেখে আসব সর্ষিনা পীর সাহেবের মাদ্রাসায়। ওরা মাদ্রাসার হোস্টেলে থাকবে। দরকার হলে ওদের মাদ্রাসায় ভর্তি করিয়ে দেব–জামাতে ছওম ক্লাসে।

মা বললেন, আপনার হাতে আমি ছেলে দুটাকে তুলে দিলাম। আপনি যা ভালো মনে করেন…।

আমরা দুভাই লুঙি-পাঞ্জাবি পারলাম। মাথায় দিলাম গোল বেতের টুপি। রওনা হলাম সর্ষিনা। যেতে হবে নৌকায়। পথ মোটেই নিরাপদ না। মিলিটারির গানবোট চলাচল করছে। আতঙ্কে অস্থির হয়ে যাত্ৰা। এই নৌকা ভ্ৰমণ মনে হচ্ছে কোনোদিন শেষ হবে না। ইঞ্জিনের বিজবিজ শব্দ হতেই অতি দ্রুত নৌকা কোনো খাড়িতে ঢুকিয়ে অপেক্ষা করতে হয়। মাঝে মাঝে মাওলানা সাহেব বলেন, বাবারা ডাইনে তাকাবা না। আমরা ডাইনে তাকাই না, কারণ তখন ডানে গলিত মৃতদেহ ভেসে যাচ্ছে।

সর্ষিনার পীর সাহেবের আস্তানা চমৎকার। জায়গাটা নদীর তীরে, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন পরিবেশ। মাদ্রাসার ছাত্রদের থাকার জন্যে বিশাল হোস্টেল। পাড়া গা মতো জায়গায় বিরাট কর্মযজ্ঞ। আর হবে নাই বা কেন! পাকিস্তানের সব রাষ্ট্রপ্রধানই এখানে এসেছেন। কিছু সময় কাটিয়েছেন।
 

Users who are viewing this thread

Back
Top