What's new
Nirjonmela Desi Forum

Talk about the things that matter to you! Wanting to join the rest of our members? Feel free to sign up today and gain full access!

Collected ছোছনা ও জননীর গল্প - উপন্যাস (2 Viewers)

গত তিনদিন ধরে তিনি খাকি পোশাক গায়ে নিয়ে ঘুরছেন। শরীর ঘামছে। সেই ঘাম শরীরে শুকিয়ে যাচ্ছে। কুৎসিত অবস্থা। গত সপ্তাহের নিউজ উইক সঙ্গে আছে–এখনো পড়া হয় নি। রাতে পড়া যেতে পারে। গাড়ির চাকা বদলাতে অনেক সময় লাগল। সব কী রকম ঢিলাঢ়ালা হয়ে গেছে। যুদ্ধ অবস্থায় কোচকালেন। মনের বিরক্তি প্ৰকাশ করলেন না।



নীলগঞ্জ থানার ওসি মেজর সাহেবকে স্যালুট দিলেন। তার পেছনে তিনজন কনষ্টেবল। তারা প্রেজেন্ট আর্ম ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে।

মেজর সাহেব বললেন, সব ঠিক হ্যায়?

ছদরুল আমিন বললেন, ইয়েস স্যার।

ভেরি গুড। হোয়াটস ইয়োর নেম?

ছদরুল আমিন।

নাম তো বহুত আচ্ছ হ্যায়।

মেজর মোশতাক আবারো হাসলেন। ছদারুল আমিনের বুকের রক্ত এবং পেটের ক্ষুধা দুই-ই মিলিটারি দেখে পানি হয়ে গিয়েছিল। মেজর সাহেবের মুখের হাসি দেখেও লাভ হলো না। বুক ধ্বক ধ্বক করেই যাচ্ছে।

মেজর সাহেব হ্যান্ডশোকের জন্যে হাত বাড়ালেন; ছদারুল আমিন হ্যান্ডশেক করলেন। গম্ভীর গলায় বললেন, ডরতা কেউ ডরো মাৎ।

এই ঘটনা ঘটল দুপুর তিনটায়। বিকেল পাঁচটায় ঘটল সম্পূর্ণ অন্য ঘটনা। ছদরুল আমিনকে সোহাগী নদীর কাছে নিয়ে গুলি করে মেরে ফেলা হলো। ছদরুল আমিন সাহেব একা ছিলেন না। তাঁর সঙ্গে ছিল পাঁচজন হিন্দু, দুজন আনন্দমোহন কলেজের ছাত্র–এরা মুসলমান।

মৃত্যুর আগে আগে ছদরুল আমিন একটা ব্যাপার নিয়ে ভাবছিলেনউতার আনতে যাকে পাঠানো হয়েছে, সে কি এসেছে?

মৃত্যুর আগে মানুষ কত কী ভাবে–তার মাথায় শুধু ঘুরতে লাগল। উতার–এর পানি। উতার শব্দটা বারবার উচ্চারণ করতেও তাঁর খুব মজা লাগছিল।



নীলগঞ্জ থানা কম্পাউন্ড খুব জমজমাট। গেটে মিলিটারি সেন্ট্রি। থানার মূল বিল্ডিং-এর বারান্দায় দুটা পেট্রোম্যাক্স জুলছে। রাজ্যের পোকা এসে জড়ো হয়েছে। পোকাদের আনন্দের সীমা নেই।

থানার পেছনেই বঁধানো কুয়া। কুয়ার পাশে মেজর সাহেবের থাকার জন্য তাঁবু খাটানো হয়েছে। আজ রাত মেজর সাহেবকে নীলগঞ্জে থাকতে হবে। মেজর মোশতাক আহমেদ তার তাবুর সামনে চেয়ারে বসে আছেন। টুলের উপর পা তুলে ক্লান্তি দূর করার চেষ্টা করছেন। তিনি গা থেকে দুদিনের বাসি কাপড় এখনো খোলেন নি। তবে শিগগিরই খুলবেন। তাঁর গোসলের জন্য কুয়া থেকে বালতিভর্তি ঠাণ্ডা পানি তোলা হয়েছে। তিনি মানে যাওয়ার আগে পুরোপুরি নিশ্চিত হতে চান যে, তার দলটির রাতে থাকা এবং খাওয়ার ব্যবস্থা হয়েছে। জোয়ানদের রাতে ঘুমানোর ব্যাপারটা তেমন জরুরি নয়, তবে খাওয়ার ব্যবস্থােটা জরুরি। পুরো দলটি বলতে গেলে সারাদিন না খাওয়া।

মোশতাক আহমেদ মোটামুটি নিশ্চিত হয়েছেন— খাওয়ার ব্যবস্থা হচ্ছে। গ্রামে বাজার-হাটের সুবিধা নেই। চট করে কিছু জোগাড় করা মুশকিল। এখানে সব জোগাড় হয়েছে। দুটা খাসি জবেহ হয়েছে। রান্নাও শুরু হয়েছে। রুটিগোশত করা যাচ্ছে না, চাল-গোশত হচ্ছে। বাঙালের দেশে এসে বাঙালি ব্যবস্থা। ক্ষুধার্ত অবস্থায় কোনো খাবারই খারাপ লাগবে না।

মোশতাক আহমেদ চুরুট ধরিয়ে আকাশের দিকে তাকালেন। এখন আকাশ পরিষ্কার। তারায় তারায় ঝলমল করছে। ঐ তো দেখা যাচ্ছে সপ্তর্ষিমণ্ডল। শহর থেকে সপ্তর্ষিমণ্ডল ভালোমতো দেখা যায় না। এই সাতটি তারা দিগন্তরেখার কাছাকাছি। এদের দেখতে হলে খোলা জায়গায় যেতে হবে। থানা কম্পাউন্ডটা খুব খোলামেলা। দুশ গজের ভেতর গাছপালার সংখ্যা কম। বর্তমান সময়ের জন্য এটা খুব জরুরি। প্রতিটি থানাকে থাকতে হবে থ্রি নট থ্রি রাইফেল রেঞ্জের বাইরে। গাছপালার কভারে কোনো অতি-উৎসাহী যেন গুলি করার স্পর্ধা না করে।

মগভর্তি এক মগ কফি মোশতাক আহমেদের পাশে এনে রাখা হলো। কফি নিয়ে এসেছেন নীলগঞ্জ থানার সেকেন্ড অফিসার ফরিদ উদ্দিন। থানার চার্জ বর্তমানে তাকে দেওয়া হয়েছে। ফরিদ উদ্দিন মেজর সাহেবের সামনে অ্যাটেনশন হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। চলে যেতে পারছেন না, আবার দাড়িয়ে থাকতেও পারছেন না। তার পা অল্প অল্প কাপছে। তিনি যেন তার সামনে সাক্ষাৎ মৃত্যু দেখতে পাচ্ছেন। মোশতাক আহমেদ কফির মাগে চুমুক দিয়ে বললেন, Do you have something in your mind?

প্রশ্ন না বুঝেই ফরিদ উদ্দিন বললেন, Yes sir.

Speak out.

ফরিদ উদ্দিন আগে যেমন দাঁড়িয়ে ছিলেন, এখনো তেমনি দাঁড়িয়ে রইলেন। মেজর সাহেব হাতের ইশারায় তাকে চলে যেতে বললেন। সেই ইশারাও তিনি বুঝতে পাবলেন না। ফরিদ উদিনের মাথা আসলে এলোমেলো হয়ে গেছে। এখনো তাঁর বিশ্বাস হচ্ছে না, এমন নির্বিকার ভঙ্গিতে এতগুলি মানুষকে মেরে ফেলা যায়! নদীর পাড়ে নিয়ে লাইন করে দাঁড়া করাল। কী হচ্ছে বোঝার আগেই একজন হাই তুলে বলল, ফায়ার। দ্রুত বাজনার মতো কিছু গুলি হয়ে গেল। গুলি করা হচ্ছে তাও ফরিদ উদ্দিন বুঝতে পারেন নি। পুরো ব্যাপারটা মনে হচ্ছে স্বপ্লের মধ্যে ঘটে গেছে। কে জানে, হয়তো স্বপ্লই। স্বপ্ন ছাড়া বাস্তবে এত ভয়ঙ্কর ঘটনা ঘটে না। বাস্তবে কেউ হাই তুলতে তুলতে ফায়ার বলে না। হাই তোলার ব্যাপারটা বানানো না। যে ফায়ার বলেছে তিনি তার পাশেই দাঁড়িয়েছিলেন। তালগাছের মতো লম্বা একটা মানুষ। পাতলা গোফ আছে। নিচের ঠোঁটে শ্বেতীর দাগ। ফরিদ উদ্দিন নিশ্চিত জানেন–বাকি জীবনে তিনি অসংখ্যবার দুঃস্বপ্নের ভেতর এই মানুষটাকে দেখবেন।

মেজর সাহেব। আবারো হাত ইশারা করে ফরিদ উদ্দিনকে যেতে বললেন। কফি খেতে ভালো হয়েছে। তিনি একা একা আরাম করে কফি খেতে চান। ক্ষুধা নষ্ট করার জন্যও কফি দরকার। রাতের খাবার খেতে দেরি হবে।
 
ফরিদ উদ্দিন থানায় ওসি সাহেবের চেয়ারে বসে আছেন। তাঁর খুব ঘাম হচ্ছে। থানার ভেতর মিলিটারিদের কেউ নেই। দুজন কনস্টেবল আছে–তারা ংশুমুখে বসে আছে লম্বা বেঞ্চটায়। ফরিদ উদ্দিনের সামনের চেয়ারে বেশ আয়েশ করে বসে আছে হারুন মাঝি। মেজর সাহেব সব হাজতিদের ছেড়ে দেওয়ার হুকুম দিয়েছেন।

সব হুকুমই মুখে। কাগজপত্রে কিছু নেই। পরবর্তীতে এই নিয়ে নিশ্চয়ই ঝামেলা হবে। এক ফাঁকে জেনারেল ডায়েরিতে লিখতে হবে–মেজর মোশতাক আহমেদের মৌখিক নির্দেশে থানার সকল হাজতিকে ছেড়ে দেওয়া হয়। হাজতিদের মধ্যে ছিল কুখ্যাত ডাকাত হারুন মাঝি।

নদীর পাড়ে যে হত্যাকাণ্ডগুলো হয়–তার কথাও লেখা থাকা দরকার। কীভাবে লিখবেন? ঘটনার সময় তিনি নিজে উপস্থিত ছিলেন। কোনো এক সময় যদি তাঁকে জিজ্ঞেস করা হয়–পুলিশের উপস্থিতিতে এমন ঘটনা ঘটল, পুলিশ কেন বাধা দিল না? স্থানীয় আইনশৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্ব তো পুলিশের। তাকে যদি বলা হয়, ফরিদ উদ্দিন, দণ্ডবিধির ৩২৪ নম্বর ধারায় তুমি কেন মিলিটারিদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করলে না? ৩২৪ নম্বর ধারা তো অতি স্পষ্ট, বিপজ্জনক অস্ত্র দ্বারা বা বিপজ্জনক উপায়ে ইচ্ছাকৃত আঘাত করা। ১৪৮ ধারায় মামলা হতে পারে–মারাত্মক অন্ত্রে সজ্জিত হইয়া দাঙ্গা।

ওসি সাহেব!

ফরিদ উদ্দিন চমকে উঠলেন। হারুন মাঝি হাত বাড়িয়ে বসে আছে। হারুন মাঝির মুখ হাসি হাসি। ফরিদ উদ্দিন বললেন, কী হয়েছে?

বিড়ি সিগারেট কিছু একটা দেন ওসি সাহেব, দুইটা টান দেই।

ফরিদ উদ্দিন কথা বাড়ালেন না। একটা সিগারেট এগিয়ে দিলেন। তার নিজেরও সিগারেট খেতে ইচ্ছা করছে কিন্তু সাহসে কুলোচ্ছে না।

অবস্থা তো ওসি সাহেব গুরুতর।

হুঁ।

এক কথায় আটজনের মৃত্যু–সাক্ষাৎ আজরাইল। কী বলেন ওসি সাহেব?

হুঁ!

এর নাম পাক-মিলিটারি, ইচ্ছা হইল গুলি কইরা হিসাব শেষ কইরা দিল। নগদ হিসাব। বাকির কারবার নাই।

বেশি কথা বলিস না হারুন। হারুন মাঝি গলা নামিয়ে বলল, মৃত্যুর সময় আমরার আগের ওসি সাহেব কী করল? কান্দাকাটি কবল?

জানি না।

জানেন না বললেন ক্যান? আপনে তো লগে ছিলেন।

না, আমি ছিলাম না।

কয়েকটা হিন্দু ধইরা আনতে বলল – আপনে না ধইরা আনলেন?

ফরিদ উদ্দিন তিক্ত গলায় বললেন, হারুন, সময় খুবই খারাপ। কথা যত কম বলবি তত ভালো। তোকে ছেড়ে দিয়েছে–তুই চলে যা। ডাকাতি শুরু কর। এত কিসের কথা?

মিলিটারি কি এইখানেই থাকব?

জানি না।

আগের ওসি সাহেবের যে সন্তান হওনের কথা ছিল সেই বিষয়ে কিছু জানেন? সন্তান হইছে?

জানি না।

উতারের পানির জন্য ওসি সাহেব লোক পাঠাইছিল। পানি নিয়া আসছে কিনা জানেন না?

হারুন, চুপ।

জি আইচ্ছা, এই চুপ করলাম। দেন, আরেকটা সিগ্রেট দেন।

ফরিদ উদ্দিন নিঃশব্দে আরেকটা সিগারেট দিলেন। হারুন মাঝি প্রথম সিগারেটের আগুন দিয়ে সিগারেট ধরাতে ধরাতে বলল, আমরার আগের ওসি সাহেব, ছদরুল সাহেব বিরাট সাহসী লোক ছিল। বাঘের কইলজা ছিল।

ফরিদ উদ্দিন জবাব দিলেন না। হঠাৎ করে তাঁর প্রচণ্ড মাথা ধরেছে। তিনি মাথা তুলতেই পারছেন না। এরকম কখনো হয় না। আজ কেন হচ্ছে?

ওসি সাহেব, ছদরুল স্যার আমারে ক্যামনে ধরছে হেই গল্প শুনেন। সে এক ইতিহাস।

ইতিহাস বলতে হবে না। চুপ করে থাক।

আমি গেছি আমার বড় শ্যালকের বাড়িত। তার একটা পুত্রসন্তান হয়েছেসংবাদ পেয়ে গিয়েছি। সন্তানের মুখ দেখে একশ টাকার একটা চকচকা নোট দিলাম। শ্যালক বলল, দুলাভাই রাতটা থাকেন–ভালোমন্দ চারটা খান। আমি রাজি হইলাম। শেষ রাইতে বাড়ি ঘেরাও দিল পুলিশে। ব্যাগের ভিতরে আমার গুলিভরা বন্দুক। টান দিয়া হাতে নিতেই দরজা খুইল্যা ওসি সাহেব ঢুকলেন। বললাম, ওসি সাব, গুলি কইরা দেব। ওসি সাহেব বললেন, কর, গুলি কর। বন্দুকের সামনে এই রকম কথা বলা সহজ না। কইলজা লাগে। বাঘের কইলজা লাগে। ওসি সাহেবের ছিল বাঘের কইলজা।

হারুন, আর কথা না। আরেকটা কথা বললে হাজতে নিয়ে ঢোকাব।

হারুন মাঝি দাত বের করে হাসতে হাসতে বলল, এইটা পারবেন না! মিলিটারি মুক্তি দিছে, আফনের কিছু করনের ক্ষ্যামতা নাই। ছদারুল আমিন স্যার হইলেও একটা কথা ছিল। তার ছিল বাঘের কইলজা। আর আফনের হইল খাটাসের কইলজা। হিহিহি। মনে কষ্ট নিয়েন না। ওসি সাব। সত্য কথা শুইন্যা মনে কষ্ট নিতে নাই।


রান্না হয়ে গেছে। জোয়ানদের খাবার দেওয়া হচ্ছে। মেজর সাহেব কুয়ার পাড়ে গোসল করছেন। তিনি সম্পূর্ণ নগ্ন হয়ে নিচু একটা জলচৌকিতে বসে আছেন। দুজন ব্যাটম্যান হিমশীতল পানি বালতি বালতি তুলে তার মাথায় ঢালছে। স্নানপর্ব মেজর সাহেবের অসাধারণ লাগছে। শরীরের ক্লান্তি সম্পূর্ণ দূর হয়ে গেছে। এখন নেশার মতো লাগছে। কয়েকটা বিয়ার খেয়ে নিলে হতোব্যাপারটা আরো জমত। সঙ্গে বিয়ার নেই। এক বোতল ভদকা আছে, ভালো এক বোতল ফ্রেঞ্চ ওয়াইন আছে। ওয়াইনের বোতলটা আনন্দময় উৎসবের জন্য রেখে দেওয়া হয়েছে। সেই আনন্দময় উৎসবের তারিখটা হলো মে মাসের এগারো তারিখ, তার ম্যারেজ অ্যানিভার্সারি। রোজিনা তাকে বলে দিয়েছে–সে যেভাবেই হোক মে মাসের এগার তারিখে বাঙািল মুলুকে উপস্থিত হবে। তের বছরের বিবাহিত জীবনে সব ম্যারেজ ডে-তে তারা একসঙ্গে ছিলেন। এ বছর ব্যতিক্রম হবে না। যুদ্ধবিগ্রহের এই ভয়াবহ সময়ে রোজিনা কী করে বাঙাল মুলুকে আসলে তিনি জানেন না। তবে এসে যেতে পারে। রোজিনার বুদ্ধি ও সাহস সীমাহীন। তারচে বড় কথা রোজিন লে. জে. গুলহাসান খানের ভাগ্নি। পাকিস্তানের লেফটেনেন্ট জেনারেলরা অনেক কিছু পারেন।

গোসল করতে করতেই ওয়্যারলেসে খবর এলো–কর্নেল মোশতাককে তার দল নিয়ে এই মুহুর্তেই দুর্গাপুরে রওনা হতে হবে। কর্নেল সাহেব খবরটা শুনে নিচু গলায় বললেন, বাস্টার্ডস! কাদেরকে বললেন তা বোঝা গেল না।

দলটাি দুৰ্গাপুরের দিকে রওয়ানা হলো রাত তিনটায়। সেই সময়ই ওসি ছদরুল আমিন সাহেবের স্ত্রী একটি পুত্রসন্তানের জন্ম দিলেন। শিশুটির ফুসফুসে অসম্ভব জোর। সে ওঁয়া ওঁয়া চিৎকারে থানা কম্পিাউন্ড মাতিয়ে দিল। জিপে উঠতে উঠতে কর্নেল সাহেল সেই ওঁয়া ওঁয়া চিৎকার শুনলেন। চিৎকার শুনেই বোঝা যাচ্ছে নিউবর্ন বেবি। নিউবর্ন বেবির কান্নার শব্দ অত্যন্ত শুভ। কর্নেল সাহেবের যাত্রা শুভ হবে। তিনি আনন্দিত মুখে জিপে উঠে বসলেন।
 
সকাল থেকে বিরামহীন বৃষ্টি। দুপুরে একটু থেমেছিল। বিকেলে আবার আকাশ কালো করে বৃষ্টি নামল। আসমানী বৃষ্টি দেখছিল। দারোগাবাড়ির টানা বারান্দায় দাঁড়ালে চোখ অনেক দূর পর্যন্ত চলে যায়। খোলা প্রান্তরে বৃষ্টি দেখতে অন্যরকম লাগে। সাদা একটা পর্দা যেন আকাশ থেকে নেমে এসেছে। বাতাস পেয়ে পর্দাটা কাঁপতে থাকে, একেবেঁকে যায়। বড় অদ্ভুত লাগে। শহরে বসে এই বৃষ্টি দেখা যায় না। দোতলা বারান্দা থেকে দেখা যাচ্ছে রুনি ভিজছে। পা টিপে টিপে বাগানে নেমেছে। ফুল ছেড়ার চেষ্টা করছে। বেলি ফুল। সরফরাজ সাহেবের চোখে পড়লে প্ৰচণ্ড ধমক খাবে। ধমকের চেয়েও যেটা বড়–আবারো জ্বরজারি হবে। কয়েকদিন আগে মাত্র জ্বর থেকে উঠেছে। মেয়েটাকে শক্ত ধমক দেওয়া দরকার, ধমক দিতে ইচ্ছা করছে না। বাচ্চাদের শাসন করার সময় বাবা-মা দুজন থাকতে হয়। একজন শাসন করবে, আরেকজন আদর দিয়ে তা পুষিয়ে দেবে। এখানে আদরের কে আছে? শাহেদের কথা মনে করে আসমানীর চোখে পানি এসে পড়ার মতো হলো। সে নিজেকে সামলাল। কথায় কথায় চোখে পানি ফেলার মতো সময় এখন নয়। এর চেয়ে বরং বৃষ্টি দেখা ভালো। আচ্ছা বৃষ্টি যে চাদরের মতো পড়ে–এটা কোনো লেখকের লেখায় আসে নি কেন? সব লেখকই কি শহরবাসী? শাহেদের সঙ্গে দেখা হলে বৃষ্টির চাদরীরূপেব কথা বলতে হবে। সে এখন কোথায় আছে? যেখানে আছে সেখানে কি বৃষ্টি হচ্ছে? শাহেদ কি দেখছে? মনে হয় না। শাহেদের মধ্যে কাব্যভাব একেবারেই নেই। বর্ষা-বাদলার দিনে সে কাথামুড়ি দিয়ে ঘুমোতে পছন্দ করে। ঘুম ভাঙলে মাথা উঁচু করে বলে, এই একটু খিচুড়ি-টিচুড়ি করা যায় না? বেগুনভাজা দিয়ে খিচুড়ি হেভি জমতো। মানুষটার খাওয়া-দাওয়ার কোনো ঠিক-ঠিকানা নেই। খিচুড়ি জমবে ইলিশ মাছ ভাজা দিয়ে, ভুনা গোশত দিয়ে। বেগুনভাজা দিয়ে খিচুড়ি আবার কী?

ভেতরের বাড়ি থেকে মোতালেব সাহেব ডাকলেন, আসমানী কোথায়? আসমানী!

আসমানীর বারান্দা ছেড়ে যেতে ইচ্ছা করছে না। বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে রুনি ফুল চুরি করছে। এদিক-ওদিক তাকাচ্ছে। এই দৃশ্যটা দেখতে বড় ভালো লাগছে। মেয়েটা ভালো দুষ্ট হয়েছে তো। আড়াল থেকে মেয়ের এই নতুন ধরনের দুষ্টমি দেখার সুযোগ তো আর সবসময় হবে না। তাছাড়া মোতালেব সাহেব কী জন্য ডাকছেন আসমানী জানে–গল্প করার জন্য। গল্প বলার সময় একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকবে। সান্ত্ৰনা দেবার ভঙ্গিতে পিঠে হাত দেবে। কী কুৎসিত স্বভাব! যতই দিন যাচ্ছে মানুষটার কদৰ্য স্বভাব ততই স্পষ্ট হচ্ছে। আর গল্পের বিষয়বস্তুও অদ্ভুত। সব গল্পই মিলিটারি-বিষয়ক। একই গল্প দুবার তিনবার করে বলছে। মিলিটাবিরা যে কত ভয়ঙ্কর তার বিশদ বর্ণনা। কোনো মানে হয়? মিলিটারি-বিষয়ক গল্প এখন শুনতেও অসহ্য লাগে।

আসমানী! আসমানী!

চাচা, আসছি।

আসছি বলেও আসমানী কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল। মোতালেব সাহেবের কাছে এক মিনিট পরে গেলেই লাভ। এক মিনিটের জন্য হলেও তো যন্ত্রণা থেকে বাঁচা যাবে।

আসমানী ভেতরে ঢুকে দেখল, মোতালেব সাহেব গল্প করার জন্য ডাকেন। নি। অন্যকোনো ব্যাপারে। বাড়ির সবাই সরফরাজ সাহেবের শোবার ঘরে। সরফরাজী সাহেব ইজিচেয়ারে শুয়ে লম্বা নলের হুক্কা টানছেন। তিনি তামাক খেয়ে মজা পাচ্ছেন বলে মনে হচ্ছে। ইজিচেয়ারের হাতলে বড় কাপে এক কাপ চা। মোতালেব সাহেবের মুখ শুকনো। ঠিকমতো কথাও বলতে পারছেন না। শব্দ জড়িয়ে যাচ্ছে। বাড়ির সবাই জড়ো হয়েছে। তাদের মুখও শুকিয়ে আছে। শুধু সরফরাজ সাহেব বেশ স্বাভাবিক। হুক্কা টানা বন্ধ করে তিনি এখন চায়ের কাপ হাতে নিলেন। নির্বিকার ভঙ্গিতে চায়ে চুমুক দিচ্ছেন। প্রতিবারই চায়ে চুমুক দেবার পর জিভ বের করে নাড়াচাড়া করছেন। মনে হচ্ছে চা খুব গরম।

সবাইকে ডেকে মিটিং কেন হচ্ছে আসমানী বুঝতে পারল না। কাউকে কিছু জিজ্ঞেস করতেও ইচ্ছা করছে না। সে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল।
 
মোতালেব সাহেব বললেন, বাবা, এই বিষয়ে আপনার মতামত কী? সরফরাজ সাহেব চায়ের কাপে লম্বা চুমুক দিয়ে বললেন, উড়া কথায় কান দেয়া ঠিক না। মিলিটারি ঘরে ঘরে ঢুকে মেয়েছেলে ধরে নিয়ে যাচ্ছে–এটা একটা উদ্ভট কথা। গুজবে কান দিবা না। পাকিস্তানি মিলিটারি বিশ্বে নামকরা মিলিটারি। ভদ্রলোকের ছেলেপুলেরা সেই মিলিটারিতে যায়। তাদের আদবকায়দাও বিশ্বের নামকরা। এইটা তোমরা ভুলে যাও কেন?

মোতালেব সাহেব বললেন, এইটা আপনি অবশ্যিই ঠিক বলেছেন বাবা। আমি এই দিকে চিন্তা করি নাই।

সরফরাজ সাহেব বললেন, আরো কথা আছে। এইটা হলো দারোগাবাড়ি। এই বাড়ির একটা আলাদা ইজ্জত আছে। যাকে যতটুকু ইজ্জত দেয়া দরকার, মিলিটারি তাকে ততটুকু ইজ্জত দেয়। এই শিক্ষা তাদের আছে।

মোতালেব সাহেব বললেন, এই কথাটাও আপনি ঠিক বলেছেন। বাড়ি ছেড়ে যাওয়ার পরিকল্পনা আপাতত বাদ দিই।

অবশ্যই বাদ দিবা। ঝড়-বৃষ্টির মধ্যে যাইবা কই? আমরা তো যার-তার বাড়িতে উঠতে পারি না।

মোতালেব সাহেব তৎক্ষণাৎ বললেন, সেটাও একটা বিবেচনার বিষয়। ঝড়বৃষ্টির মধ্যে একদল মানুষ নিয়ে কার বাড়িতে উঠব?

সরফরাজ সাহেব চায়ের কাপে শেষ চুমুক দিয়ে বললেন, গুজবের ওপর ভরসা করবা না। ভরসা করবা আল্লাহপাকের ওপর। আয়াতুল কুরসি পড়ে বাড়ি বন্ধন দিয়ে বসে থাকো, ইনশাল্লাহ কিছু হবে না।

মোতালেব সাহেব বললেন, সত্যি সত্যি যদি মিলিটারি আসে, এসে যদি দেখে দারোগাবাড়ির লোকজন পালিয়ে গেছে তাহলে তারা ধরেই নিবেদারোগাবাড়ির লোকদের মধ্যে কিন্তু আছে।

সরফরাজ সাহেব বললেন, কিন্তু তো আছেই। তুমি সবচে বড় কিন্তু। প্যাচাল শেষ করে। সকালবেলা এই প্যাচাল শুনতে ভালো লাগে না! অন্য ঘরে নিয়া মিটিং বসাও।



মিলিটারি-বিষয়ক খবর যে নিয়ে এসেছে, তার নাম কুদ্দুস। লুঙ্গিপরা গেঞ্জি গায়ের একজন মানুষ। মাথা নিচু করে সে মেঝেতে বসে আছে। এই শ্রেণীর মানুষদের কথার ওপর ভদ্রলোকেরা এমনিতেই বিশ্বাস করেন না। মোতালেব সাহেব কুদ্দুসের দিকে তাকিয়ে বললেন, ঠিক আছে কুদ্দুস, তুমি যাও। অবস্থা তেমন দেখলে তোমাকে খবর দিব।

কুদ্দুস নড়ল না। শক্ত গলায় বলল, খবর দেওনের সময় পাইবেন না। যা বলতেছি শুনেন। এক্ষণ বাড়ি ছাড়েন। মিলিটারি অপেক্ষা করতেছে বৃষ্টি কমনের জন্য। বৃষ্টি কমব আর এরা দলে দলে বাইর হইব। পরথমে আসব দারোগাবাড়ি।

মোতালেব সাহেব বললেন, এত নিশ্চিন্ত হয়ে বলছি কী করে? মিলিটারিরা কি তোমার সঙ্গে শলাপরামর্শ করেছে?

কুদ্দুস ঘাড় বাঁকিয়ে বলল, হ, করছে। আপনারে যা করতে বলছি করেন। হাতে সময় নাই। সময় খুবই সংক্ষেপ।

প্রথমে দারোগাবাড়ি আসবে কেন?

মিলিটারির সাথে আছে মজিদ মিয়া, দারোগাবাড়ির সাথে তার পুরানা বিবাদ।

মোতালেব সাহেব বললেন, দারোগাবাড়ির সাথে তার বিবাদ থাকতে পারে, মিলিটারির সঙ্গে তো দারোগাবাড়ির কোনো বিবাদ নাই।

হাত জোড় করতেছি, আমার কথাটা শোনেন।

মোতালেব সাহেব বললেন, আচ্ছা, ঠিক আছে কুদ্দুস, তুমি এখন যাও। আমরা এইখানেই থাকব। বাড়ি-ঘর ছেড়ে যাওয়া ঠিক না। এতে মিলিটারির সন্দেহ আরো বাড়ে। মিলিটারিরা যুদ্ধের সময় খুবই সন্দেহপ্রবণ থাকে।

চাচামিয়া, আমার কথাটা শোনেন।

তোমার কথা তো মন দিয়েই শুনলাম। এখন আমাদের নিজের বুদ্ধি বিবেচনা মতো কাজ করতে দাও। তোমার বিবেচনায় কাজ করলে তো আমাদের পোষাবে না।

কুদ্দুস উঠে চলে গেল। জাহেদা বললেন, আমার তো ভালো লাগছে না, ওর কথা শুনলেই হতো।

মোতালেব সাহেব বললেন, এত গুজব শুনলে বাঁচা যাবে না। তুমি বরং মিলিটারির জন্যে চা-নাশতার আয়োজন কর। মুরগির কোরমা আর পরোটা। এরা পরোটা-মাংসের ভক্ত।

জাহেদা পরোটা মাংসের ব্যবস্থা করতে গেলেন।


বৃষ্টি সন্ধ্যার আগে আগে ধরে গেল। এবং আশ্চর্য কাণ্ড, সন্ধ্যায় সন্ধ্যায় দারোগাবাড়িতে একদল মিলিটারি এলো। তাদের সঙ্গে আছে হোমিওপ্যাথ মজিদ ডাক্তার। কুদ্দুস এই মজিদ ডাক্তারের কথাই বলছিল। সরফরাজী সাহেব পাঞ্জাবি গায়ে বের হয়ে এলেন। মজিদ ডাক্তার ছুটে এসে কদমবুসি করল।সরফরাজ বললেন, ব্যাপার কী মজিদ?ইনারা আপনারে দুই একটা কথা জিজ্ঞেস করবে।তুমি এদের সাথে কেন?পথঘাট চিনে না। আমারে বলল পথ চিনায়ে দাও। মিলিটারি মানুষ কিছু বললে তো না করতে পারি না। এরা না শোনার জাত না।তুমি পথ চিনাচ্ছি? খুবই ভালো কথা।মিলিটারি দলের প্রধান অল্পবয়স্ক একজন ক্যাপ্টেন। সরফরাজ সাহেব খুব আদবের সঙ্গে ক্যাপ্টেন সাহেবকে বসতে বললেন। ক্যাপ্টেন আদবের ধার দিয়েও গেল না, কঠিন গলায় বলল, কেয়া তুমি আওয়ামী লীগ?সরফরাজ সাহেবের মেজাজ খারাপ হয়ে গেল, তিনি প্ৰায় নব্বই বছরের এক বৃদ্ধ। আর সেদিনের চেংড়া ছেলে তাকে তুমি করে বলছে। তিনি তার মেজাজ নিয়ন্ত্রণ করলেন, বিনয়ের সঙ্গে বললেন, জি নেহি, মুসলিম লীগ।তুম মুসলমান?জি হ্যাঁ।তোমকো দাড়ি কাঁহা?সরফরাজ সাহেব এই পর্যায়ে একটা বোকামি করলেন। তিনি নিখুঁত উর্দুতে যা বললেন, তার সরল বাংলা হলো তুমিও তো মুসলমান, তোমার দাড়ি কোথায়? যার নিজের দাড়ি নেই সে অন্যের দাড়ির খোঁজ কেন নেবে?এত বড় বেয়াদবি মিলিটারির সহ্য হবার কথা না। ক্যাপ্টেন সাহেবের ইশারায় একজন জোয়ান এসে বুটের লাথি বসাল, সরফরাজ সাহেব গড়িয়ে বারান্দা থেকে বাগানে পড়ে গেলেন। তার গলা থেকে কোনোরকম শব্দ বের হলো না।মোতালেব এবং সরফরাজ সাহেব ছাড়াও বাড়িতে আরো তিনজন পুরুষ মানুষ ছিল। তারা লুকিয়ে পড়েছিল। এই পর্যায়ে তারা বের হয়ে এলো। মিলিটারি সরফরাজ সাহেবকে বাদ দিয়ে বাকি সবাইকে ধরে নিয়ে গেল।সেই রাতেই তাদের গুলি করে মেরে ফেলা হলো। সরফরাজ সাহেব মারা গেলেন ভোরবেলায় রক্তবমি করতে করতে।
 
রুনি বলল, মা, আমরা কোথায় যাচ্ছি?

আসমানী মেয়ের প্রশ্নের জবাব দিতে পারল না। কারণ সেও জানে না তারা কোথায় যাচ্ছে। তারা নৌকায় উঠেছে বেলা উঠার পর। বেশ বড়সড় পালওয়ালা নৌকা। যদিও নৌকায় এখনো পাল তোলা হয় নি। দুজন মাঝি লাগি ঠেলে ঠেলে নিয়ে যাচ্ছে। মাঝারি ধরনের খাল–এখনো ভালোমতো পানি আসে নি। নৌকায় দারোগাবাড়ির পরিবারের সকল মহিলা সদস্য ছাড়া দুজন পুরুষ আছে। একজন আমাদের পূর্বপরিচিত— কুদ্দুস। কুদ্দুসের পরনে আজ পায়জামা পাঞ্জাবি। মাথায় নীল রঙের কিস্তি টুপি। তাকে ভদ্রলোকের মতো লাগছে। সে মোটামুটি নির্বিকার ভঙ্গিতে পান খাচ্ছে। পানের রসে তার ঠোঁট টকটকে লাল। সে পরনের পাঞ্জাবি দিয়েই তার ঠোঁট মুছছে। পাঞ্জাবি লাল দাগে ভরে যাচ্ছে। অন্যজন অপরিচিত এক হিন্দু ভদ্রলোক–কেশব বাবু। এই গরমেও গায়ে ভারি চাদর। তিনি নৌকার পাটাতনে উপুড় হয়ে শুয়ে আছেন। ভদ্রলোক ময়মনসিংহ জজ কোটের পেশকার। দেশের অবস্থা খারাপ মনে করে দুই মেয়েকে নিয়ে গ্রামের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিলেন। মিলিটারি আসার পর মেয়ে দুটিকে তার মাসির বাড়ি ইছাপুরে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। এখন যাচ্ছেন মেয়েদের খোজে। কেশব বাবু বয়স্ক মানুষ, অসুস্থ। তার হাঁপানি আছে। নৌকায় উঠার পরপর তার হাঁপানির টান উঠেছে। তিনি ফুসফুসে বাতাস ভরানোর চেষ্টায় ছটফট করছেন। ফুসফুস ভরছে না। এই ভদ্রলোক কে, তাদের সঙ্গে কোথায় যাচ্ছেন?–আসমানী তাও জানে না। মনে হচ্ছে আসমানী জানার আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে। নৌকা যেখানে ইচ্ছা যাক, কিছু যায় আসে না।

নৌকার ছাঁই শাড়ি দিয়ে ঢাকা, যেন ভেতরের মহিলাদের দেখা না যায়। আসমানী শাড়ির ফাঁক দিয়ে মাথা বের করে আছে। ভেতরের মহিলারা চাপা। গলায় কাঁদছেন। কান্নার শব্দ সম্পূর্ণ অন্যরকম এবং কেউই একনাগাড়ে কাঁদছে না। হঠাৎ একসঙ্গে সবাই চুপ করে যাচ্ছে, আবার এক সঙ্গে সবাই কাঁদতে শুরু করছে।

আসমানী শান্ত হয়ে বসে আছে। সে কাঁদছে না বা তার কান্না আসছেও না। এজন্য সে একটু লজ্জিতও বোধ করছে। তার চোখের সামনে এত বড় শোকের ঘটনা ঘটল। বলতে গেলে এখন সে এই পরিবারেরই একজন সদস্য, তার কেন কান্না আসবে না?

রুনি নৌকার পাটাতনে বসে পানি স্পর্শ করার চেষ্টা করছে। যেভাবে বুকে আছে পানিতে উল্টে পড়ে যেতে পারে। রুনিকে একটা ধমক দেওয়া দরকার। সেই ধমক দিতেও ইচ্ছা করছে না। পানিতে পড়ে গেলে পড়ে যাক।

রুনি আবারো বলল, মা, আমরা কোথায় যাচ্ছি?

আসমানী বিরক্ত গলায় বলল, জানি না।

জানো না কেন?

আসমানী চুপ করে রইল। রুনি বলল, মা, বিলো আমরা কোথায় যাচ্ছি?

কুদ্দুস বলল, আমরা যাইতেছি ইছাপুর।

ইছাপুরে যাচ্ছি কেন?

আসমানী বলল, রুনি, তুমি কি একটু চুপ করবে?

চুপ করব কেন?

আসমানী জবাব দিল না। কুদ্দুস বলল, ছোট আম্মা, মিলিটারির কারণে বাঁচনের জন্য যাইতেছি।

মিলিটারি সবাইকে মেরে ফেলছে?

ঘটনা পেরায় সেই রকম।

ইছাপুরে মিলিটারি নেই?

জে না।

ইছাপুরে মিলিটারি নেই কেন?

আমাদের দেশটা কি বিরাট?

আরেকবাসরে, বিরাট বলে বিরাট!

ঐ বুড়ো ভদ্রলোক এরকম করছেন কেন?

শরীর ভালো না, হাঁপানি।

উনি কি মারা যাচ্ছেন?

আরে না ছোট আখ, কী যেন কম। মিত্যু অত সহজ না। মিত্যু বড়ই কঠিন।

আসমানী এক ঝলক কুদ্দুসের দিকে তাকাল। মৃত্যু সহজ না সে বলছে কীভাবে? সে নিজে কি দেখছে না মৃত্যু কত সহজ হয়ে গেছে! তিনজন মানুষকে ধরে নিয়ে গেল। সুস্থ সবল ভালোমানুষ। ভোরবেলা খবর এলো, মোতালেব সাহেবের ডেডবডি গাঙের পারে পড়ে আছে। অন্য দুটি ডেডবডি পানিতে ভেসে চলে গেছে। মোতালেব সাহেবের শবদেহ উদ্ধার হয় নি। কে আনতে যাবে? সবাই জীবন বাচানোর জন্য ব্যস্ত। তারা পালিয়ে যাচ্ছে। আতঙ্কে সবচেয়ে বেশি অস্থির হয়েছেন মোতালেব সাহেবের স্ত্রী জাহেদা খানম। তাকে কুদ্দুস এসে বলেছিল, আম্মা, চলেন আপনে আর আমি দুইজনে যাই। লাশটা নিয়া আসি। আপনে সঙ্গে থাকলে মিলিটারি কিছু বলবে না। ইস্ত্রী স্বামীর ডেডবিডি নিতে আসছে এটা অন্য ব্যাপার। মিলিটারি যত খারাপই হউক, এরা মানুষ। এইটা বিবেচনা করব। জাহেদা রাজি হন নি।

নৌকায় তিনি বেশ স্বাভাবিক আছেন। কান্নাকাটি করছেন না। অপরিচিত এক মহিলার কাছ থেকে পান নিয়ে মুখে দিলেন। তার পান খাওয়া দেখে মনে হচ্ছে, তিনি পান খেয়ে খুব আরাম পাচ্ছেন। মাথা বের করে নদীর পানিতে পিক ফেলছেন। তার কোলে একটা বালিশ। তিনি বালিশ হাতছাড়া করছেন না। বালিশের তুলার ভেতর টাকা এবং সোনার গয়না।

আসমানী অলস চোখে তাকিয়ে আছে। চারদিক এত সুন্দর! মানুষের দুঃখ কষ্টে প্রকৃতির কিছু যায় আসে না। সে তার মতোই থাকে। খালের পানি কী পরিষ্কার! ঝকঝকি করছে। এই সময়ে নদীর পানি ঘোলা থাকে। ভদ্র মাসের দিকে পানি পরিষ্কাব হতে থাকে। এই খালের পানি এত পরিষ্কার কেন? কিছুক্ষণ পরপর আকাশে ঝাঁকে ঝাঁকে বিক উড়ে যাচ্ছে। নীল আকাশে বক, উড়ছে–এই দৃশ্যটা এত সুন্দর! দেশ যদি ঠিকঠাক হয়ে যায়, আবার যদি শাহেদের সঙ্গে দেখা হয়, তাহলে শাহেদকে নিয়ে ঠিক এই খাল দিয়ে নৌকাভ্রমণে যেতে হবে। শাহেদের সঙ্গে কি দেখা হবে?

কেশব বাবু উঠে বসেছেন। তার চোখ টকটকে লাল। চোখের কোণে ময়লা জমেছে। তার দিকে তাকানো যাচ্ছে না; কুদ্দুস বলল, শরীরের ভাব কী?

কেশব বাবু বললেন, একটু ভালো বোধ করছি! চোখ যন্ত্রণা দিচ্ছে।

মনে হয় চউখ উঠতেছে। চাইরদিকে চউখ উঠা ব্যারাম।

ইছাপুর যেতে আর কতক্ষণ লাগবে?

ধরেন আর দুই ঘণ্টা।

রুনি এক দৃষ্টিতে কেশব বাবুর দিকে তাকিয়ে আছে। কুদ্দুস বলল, ছোট আম্মা, এই রকম কইরা চউখ উঠা মাইনসের চউখের দিকে তাকাইতে নাই। যে তাকায় তারও চউখ উঠে।

রুনি বলল, কেন?

কুদ্দুস উদাস গলায় বলল, কেন তা ক্যামনে বলব? এইটা হইল আল্লাপাকের বিধান।

আল্লাপাকের বিধান থাকা সত্ত্বেও রুনি তাকিয়েই রইল। এরকম লাল চোখের মানুষ সে আগে দেখে নি।

কেশব বাবু বললেন, খবরটা শোনা দরকার।

কুদ্দুস বলল, শোনা দরকার হইলে শুনেন, আপনের কাছে তো টেনজিস্টার আছে।

মেয়েরা সব কান্নাকাটি করছে, এর মধ্যে টেনজিস্টার ছাড়াটা কি ঠিক হবে?

সেইটা আফনের বিবেচনা।
 
কেশব বাবু ঢাকা ধরলেন। খবরে বলা হলো–পূর্ব পাকিস্তানের অবস্থা সম্পূর্ণ স্বাভাবিক। বিদেশী সাংবাদিকদের একটি টিম সারা প্রদেশে ঘুরে বলেছেন— আইনশৃঙ্খলা সেনাবাহিনীর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে। দেশের কাজকর্ম স্বাভাবিক গতিতে চলছে। অফিস আদালতে উপস্থিতির সংখ্যা আগের মতো। যারা এখনো কাজে যোগ দেন নি তাদের অবিলম্বে কাজে যোগ দিতে বলা হয়েছে। গণচীনের পররাষ্ট্র দপ্তর থেকে বলা হয়েছে, পূর্ব পাকিস্তানে যা ঘটছে তা সম্পূর্ণ পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার। এ ব্যাপারে বাইরের হস্তক্ষেপ বাঞ্ছনীয় নয়, পূর্ব পাকিস্তানে চালের দাম স্থিতিশীল রাখার জন্য পশ্চিম পাকিস্তান থেকে চালভর্তি জাহাজ চট্টগ্রাম নৌবন্দরে ভিড়েছে। মাল খালাস শুরু হয়েছে।

কুদ্দুস বলল, দেশের অবস্থা তো ভালোই।

কেশব বাবু বললেন, হুঁ।

তাকে খুব চিন্তিত মনে হলো।

ইছাপুরে নৌকা ভিড়ল দুপুর নাগাদ। নৌকাঘাট জনশূন্য। অন্য সময় কেরায়া নৌকা, ঘাস কাটা নৌকায় জায়গাটা জমজমাট হয়ে থাকে। আজ একটা প্রাণীও নেই। চা-বিস্কিটের একটা দোকান ছিল, সেটাও বন্ধ। কুদ্দুস বলল, কেমন কেমন জানি লাগতেছে, বিষয়টা কী?

বিষয় জানতে দেরি হলো না। মিলিটারির একটা দল আজ ভোরবেলাতেই ইছাপুরে এসেছে। তারা জায়গা নিয়েছে ইছাপুর থানায়। তাণ্ডব শুরু হয়েছে। মিলিটারিরা ড্রাম ভর্তি কেরোসিন নিয়ে এসেছে। হিন্দু ঘরবাড়ি জ্বালানো শুরু ধ্ৰুং।। ঘরবাড়ি জ্বালানোর জন্য আজকের দিনটাও শুভ। বাতাস নেই, বৃষ্টি

কুদ্দুসরা নৌকা থেকে নামল না। শুধু কেশব বাবু নেমে গেলেন। কাঁদো। কাঁদো মুখে রুনিকে বললেন, মা গো, আমার জন্য একটু প্রার্থনা করো।

রুনি খুবই অবাক হলো। এত মানুষ থাকতে এই লোকটা তাকে প্রার্থনা করতে বলছে কেন? প্রার্থনা কীভাবে করে তাও তো সে জানে না।

নৌকা ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। মাঝি দুজনই প্ৰাণপণে লগি ঠেলছে। এই অঞ্চল থেকে যত দ্রুত সরে যাওয়া যায়।

খালের পাড়ে বুড়ো এক লোক বসে ছিল। সে চাপা গলায় বলল, তাড়াতাড়ি চইল্যা যান। তাড়াতাড়ি।

আসমানী বলল, আমরা যাব কোথায়?

কুদ্দুস পানের কৌটা থেকে পান বের করে মুখে দিল। উদাস গলায় বলল, জানি না।

জাহেদা বললেন, কুদ্দুস, সিংধা এখান থেকে কত দূর?

কুদ্দুস নদীর পানিতে থুথু ফেলে বলল, কাছেই।

জাহেদা বললেন, আমাদের সিংধা নিয়া চল। সিংধায় আমার ফুফু-শাশুড়ির বাড়ি।

কুদ্দুস বলল, আইচ্ছা।

জাহেদা আসমানীর দিকে তাকিয়ে বললেন, আসমানী শোন, সিংধায় তুমি আমাদের সঙ্গে যাবে না। তুমি আমাদের ঘাড়ে চাপার পর থেকে বিপদ-আপদ শুরু হয়েছে। তাছাড়া সিংধায় এত মানুষ নিয়ে আমি উঠতে পারব না।

আসমানী বিস্মিত হয়ে বলল, আমি কোথায় যাব? জাহেদা তার প্রশ্নের জবাব দিলেন না। কোলবালিশ নিয়ে ঘুরে বসলেন। তিনি আরেকটা পান মুখে দিয়েছেন। তাঁর মুখভর্তি পানের রস। রুনি বলল, মা উনি আমাদের নিতে চাচ্ছেন না কেন? আসমানী মেয়ের প্রশ্নের জবাব দিল না। তার কাছে জবাব ছিল না। রুনি বলল, আমরা এখন কোথায় যাব মা?

আসমানী অবিকল কুদ্দুসের মতো উদাস গলায় বলল, জানি না।

জাহেদা বালিশে মাথা রেখে চোখ বন্ধ করে শুয়েছেন। তাকে দেখে মনে হবে তিনি ঘুমিয়ে পড়েছেন। তবে পান খাবার জন্যে মুখ নড়ছে। আসমানী একবার ভাবল বলে, খালাম্মা, আমার শরীরের অবস্থা ভালো না। আমার পেটে সন্তান। আমাকে এইভাবে ফেলে রেখে যাবেন না। তারপরই মনে হলো, কী হবে! তার নিজেরও ঘুম পাচ্ছে। একটা বালিশ থাকলে কিছুক্ষণ ঘুমাত। চিন্তাভাবনাহীন কিছু সময় পার হয়ে যেত ঘুমে ঘুমে।
 
এসডিপিও ফয়জুর রহমান সাহেবের পুত্রকন্যারা এবং তার স্ত্রী আয়েশা বেগম নৌকায় বসে আছেন।

আয়েশা বেগম রোজা রেখেছেন। স্বামীর মঙ্গলের জন্যে নফল রোজা। মাগরেবের সময় হয়ে গেছে। রোজা ভাঙতে হবে। রোজা ভাঙার কোনো প্রস্তুতি নেই। সামান্য পানিও নেই যে পানি খেয়ে রোজা ভাঙা যায়।

তিনি তাঁর ছেলেমেয়ে নিয়ে দুর্গাপুর ইউনিয়নের বাবলা গ্রামে এক সম্পন্ন বাড়িতে লুকিয়ে ছিলেন। এসডিপিও সাহেবের স্ত্রী–সেই হিসেবে বাড়ির লোকজন তাদেরকে খুব আদর-যত্ন করছিলেন। হঠাৎ কী হয়ে গেল, বাড়ির কর্তা খসরু মিয়া (ছদ্মনাম*) আয়েশা বেগমের কাছে উপস্থিত হয়ে বললেন, আমরা আপনাদের এই বাড়িতে রাখতে পারব না। বাড়ি ছাড়তে হবে।

আয়েশা বেগম অবাক হয়ে বললেন, বাড়ি ছেড়ে কোথায় যাব?

বাড়ি ছেড়ে কোথায় যাবেন–সেটা আপনি খুঁজে বের করেন। আমি নৌকা আনায়ে রেখেছি, নৌকায় উঠেন।

আমি আপনাদের অঞ্চল কিছুই চিনি না। বাচ্চাদের নিয়ে আমি যাব কোথায়? আমার বড় বড় দুটা মেয়ে আছে।

আপনি খামাখা সময় নষ্ট করতেছেন। নৌকায় উঠতে বলছি, নৌকায় উঠেন। আমরা খবর পেয়েছি, আপনার স্বামীকে মিলিটারি মেরে ফেলেছে। আপনার দুই ছেলেকে খুঁজতেছে। আপনাকে এখানে বাখলে আমরা সবাই মারা পড়ব।

আয়েশা বেগম বললেন, আজকের রাতটা থাকতে দিন। সকালবেলা আমি যেখানে পারি চলে যাব।

অসম্ভব। নৌকায় উঠেন। সামান্য দয়া করেন। আমরা মহাবিপদে আছি।

সবাই বিপদে আছে, এখন দয়া করাকরির কিছু নাই।

খসরু মিয়ার হুকুমে জিনিসপত্র নৌকায় তোলা হতে লাগল। আয়েশা বেগম তার ছোট মেয়ের হাত ধরে কাঁদতে কাঁদতে নৌকায় উঠলেন। নৌকার মাঝি বলল, আপনারা কোথায় যাবেন? তিনি বললেন, জানি না।



সন্ধ্যা মিলিয়ে গেছে। নৌকা বরিশালের আঁকাবাঁকা খাল দিয়ে এগুচ্ছে। আয়েশা বেগম কিছুক্ষণ আগে নৌকা থেকে হাত বাড়িয়ে খালের পানি দিয়ে রোজা ভেঙেছেন। নৌকার মাঝি খুবই অস্থির হয়ে গেছে। কোথায় যাবে কেউ বলছে না। সে কিছুক্ষণ পরপর জিজ্ঞেস করছে, পরিষ্কার করেন। কথা পরিষ্কার করেন। আপনেরা যাইবেন কই? এসডিপিও সাহেবের বড় ছেলে বলল, আমরা কোথাও যাব না। নৌকায় নৌকায় ঘুরব।

মাঝি বলল, এইটা কেমন কথা?

বড় ছেলে বলল, এইটাই আসল কথা।

মাঝি ভীত চোখে তাকাচ্ছে, কারণ এই ছেলের হাতে বন্দুক। শুধু এই ছেলের হাতেই যে বন্দুক তা-না, তোর ছোটভাইয়ের হাতেও বন্দুক।

এসডিপিও সাহেবের অস্ত্রশস্ত্রের প্রতি অন্যরকম অনুরাগ ছিল। সরকারি পিস্তল ছাড়াও তার ব্যক্তিগত একটা পিস্তল আছে। দুটা আছে পয়েন্ট টু টু বোর রাইফেল! জীবনের বিরাট দুঃসময়ে এসডিপিও সাহেবের ছেলেমেয়েরা এইসব অস্ত্ৰ হাতে নিয়ে বসে আছে। বরিশাল ডাকাতের দেশ। ডাকাতদের কাছে খবর চলে যাবার কথা যে একটা অসহায় পরিবার নৌকায় ঘুরছে।

নৌকা বড় একটা বাঁক পার হলো আর তখনি দেখা গেল একুশ-বাইশ বছর বয়েসি মাথায় টুপি পরা এক যুবক ছুটতে ছুটতে আসছে। হাত উঁচিয়ে ইশারা করছে নৌকা থামানোর জন্যে। নৌকা থামানো হলো। যুবক বলল, আপনাদের যে বাড়ি থেকে বের করে দেয়া হয়েছে, আমি সেই বাড়ির ছেলেমেয়েদের কোরান শরিফ পড়াই। আপনাদের বিপদ দেখে আমার মন খারাপ হয়েছে। আপনারা কি আমার বাড়িতে উঠবেন? আমার ছোট্ট একটা ঘর আছে। আমি একা থাকি।

আয়েশা বেগম সঙ্গে সঙ্গে বললেন, উঠব। তাঁর বড় ছেলে বলল, এই লোক যে গভীর রাতে ডাকাত খবর দিয়ে আনবে না বা আমাদের মিলিটারির হাতে ধরিয়ে দেবে না–তার নিশ্চয়তা কী?

আয়েশা বেগম বললেন, একটা লোক আশ্রয় দিতে চাচ্ছে, আল্লাহর নাম নিয়ে তার বাড়িতে উঠ।
 
সবাইকে নিয়ে রাত দশটার দিকে গভীর জঙ্গলের ভেতর এক বাড়িতে আয়েশা বেগম উঠলেন। স্বামীর মৃত্যু বিষয়ে তিনি নিশ্চিত হতে পারছেন না। উড়া উড়া খবর এসেছে। কেউ নিশ্চিত হয়ে কিছু বলছে না। তিনি সারা রাত তাঁর দুই মেয়েকে নিয়ে কোরান পাঠ করলেন। তাঁর দুই ছেলে রাইফেলে গুলি ভরে পাহারায় থাকল। ভোরবেলা পাংখাপুলার রশিদ এসে উপস্থিত। তার চোখ লাল, মুখ শুকনা। রশিদকে দেখে আয়েশা বেগম বললেন, তোমার সাহেবের খবর কী? উনি কোথায়?

রশিদ চুপ করে রইল।

উনি কি বেঁচে আছেন?

রশিদ বলল, জি আম্মা। (এটা রশিদের মিথ্যা ভাষণ। সে সব জেনেই এসেছে। পরিবারটিকে গভীর বেদনার সংবাদ দিতে পারছে না।)

আয়েশা বেগম বললেন, বেঁচে আছেন, তাহলে উনি কোথায়?

পলাতক আছেন। আম্মা শুনেন, উনার কথা এখন চিন্তা করে লাভ নাই। আপনাদের বিষয়টা এখন চিন্তা করা দরকার। অনেক সন্ধান করে আপনাদের পেয়েছি। এইখানে আমি আপনাদের রাখব না। অন্য জায়গায় নিয়ে যাব।

গোয়ারেভখার পীর সাহেবের বাড়িতে নিয়া যাব। উনাদের সঙ্গে আমার কথা হয়েছে। আপনারা নিরাপদে থাকবেন।

কখন নিয়ে যাবে?

এখন নিয়া যাব। আমি নৌকার ব্যবস্থা করতেছি। আম্মা অস্থির হয়েন না। আমি আছি। আমি আপনাদের জন্যে জীবন দিয়া দিব। আপনাদের কোনো বিপদ হইতে দিব না। নবিজির কসম, আল্লাহপাকের কসম।

রশিদ এই অসহায় পরিবারটিকে গোয়ারেভখার পীর সাহেবের কাছে নিয়ে গেল। তাদের সে বাড়িতে স্থায়ী করে ফিরে গেল পিরোজপুরে। এসডিপিও সাহেবের বাসা থেকে প্রয়োজনীয় কিছু জিনিসপত্র নিয়ে ফিরে আসবে।

রশিদকে পিরোজপুর শহরে ঢোকার মুখেই অ্যারেক্ট করে থানায় নিয়ে যাওয়া হলো। তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করে এসডিপিও সাহেবের পরিবার কোথায় আছে সেই খবর বের করা হবে। পিরোজপুরের মিলিটারি কমান্ডের প্রধান কর্নেল আতিক (ফুটবল প্লেয়ার–পাকিস্তান জাতীয় ফুটবল দলের একজন) এসডিপিওর ইউনিভার্সিটি পড়ুয়া তিন ছেলেমেয়েকে খুঁজছে। তাকে খবর দেয়া হয়েছে পিরোজপুরে মুক্তিযোদ্ধাদের ট্রেনিং-এ তারাও ছিল। তারা ট্রেনিং নিয়েছে।

কর্নেল আতিককে সাহায্য করছে পিরোজপুর থানার ওসি। এই ওসি সাহেব খুব সম্ভব জীবন রক্ষার জন্যেই মিলিটারিদের সঙ্গে হাত মিলিয়েছেন। রশিদের সঙ্গে ওসি সাহেবের নিম্নোক্ত কথাবার্তা হলো–

এসডিপিও সাহেবের ফ্যামিলি কোথায় আছে?

স্যার, আমি জানি না।

অবশ্যই তুমি জানো। আমার কাছে খবর আছে তুমি জানো। তুমি যে শুধু জানো তাই না। তুমি তাদের দেখভালও করছি।

স্যার, আমি জানি। কিন্তু বলব না।

মিলিটারি কী ভয়ঙ্কর জিনিস তুমি জানো। এই খবর না দিলে কিন্তু ভয়ঙ্কর ঘটনা ঘটবে।

স্যার, আমি কিছুই বলব না!

আরে ব্যাটা নিজের জীবন বাঁচা। এখন ইয়া নফসি সময়। বলে দে তারা কোথায় আছে?

আমি কোনোদিন ও বলব না।

রশিদকে সেই দিনই সন্ধ্যায় হুলারহাট লঞ্চঘাটে নিয়ে গুলি করে মেরে

ফেলা হলো।

————-
*মূল নাম ব্যবহার করছি না। এই মানুষটির নিদায়তা ও নিষ্ঠুরতার অপরাধ আমার মা ক্ষমা করেছেন। বলে অ্যামিও ক্ষমা করলাম।
 
হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর মেয়ে বেগম আখতার সোলায়মান করাচিতে এক সাংবাদিক সম্মেলনে বলেন–পূর্ব পাকিস্তানে সামরিক অভিযান চালানো ছাড়া পাকিস্তান সরকারের অন্য কোনো উপায় ছিল না। তিনি বলেন, মার্চের প্রথম দিকে যখন ধারণা করা হচ্ছিল যে শেখ মুজিবুর রহমান পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতা ঘোষণা করতে পারেন, তখন তিনি ঢাকায় গিয়ে তার মরহুম পিতার দোহাই দিয়ে শেখ মুজিবুর রহমানকে এ ধরনের মারাত্মক কাজ থেকে বিরত থাকার অনুরোধ জানিয়েছিলেন।



পাকিস্তান সরকার স্বীকার করে ৩০ হাজার পুলিশ বাহিনী সদস্য, ১৪ হাজার নিয়মিত বাহিনী সদস্য, ৪ হাজার ইপিআর পাকিস্তান কর্তৃপক্ষের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করেছে।

সূত্র : দৈনিক পাকিস্তান


বুদ্ধিজীবীদের বিবৃতি
পূর্ব পাকিস্তান গভর্নর লেফটেনেন্ট জেনারেল টিক্কা খান রাজাকার অর্ডিনেন্স জারি করেন।

রাজাকার বাহিনী পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সাহায্যকারী হিসাবে দায়িত্ব পালন করবে। তাদেরকে অস্ত্র সরবরাহ করা হবে। তারা প্রধানত গেরিলাদের খুঁজে বের করা, তাদের আশ্রয়দাতাদের খবর সেনাবাহিনীর কাছে পৌঁছে দেয়া, রেললাইন, ব্রীজ পাহারা দেবে।*

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ৮৩ জন শিক্ষক এক যুক্ত বিবৃতিতে বলেন, তারা পাকিস্তান সেনাবাহিনীর কাছ থেকে খুবই বিনম্র সহানুভূতিশীল আচরণ পাচ্ছেন। বিবৃতিতে তারা বলেন, বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনের পেছনে প্রদেশের জনগণের কোনো সমর্থন ছিল না এবং নেই।*

ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকমণ্ডলীর পক্ষ থেকে যুক্ত বিবৃতিতে বলা হয়, আমরা আমাদের প্রিয় ভূমি পাকিস্তানকে খণ্ড করার অভিসন্ধির তীব্র নিন্দা করছি। রাজনৈতিক চরমপন্থীদের একতরফা স্বাধীনতা ঘোষণায় আমরা দুঃখ পেয়েছি ও হতাশ হয়েছি।*

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিকাংশ শিক্ষক কাজে যোগ দেন। তারা নির্বিঘ্নে কাজ করতে পারছেন এই মর্মে বিবৃতি দেন।

—————

* আমাদের বুদ্ধিজীবীরা বিবৃতি দিতে আগেও পছন্দ করতেন। এখনো করেন।–লেখক






জাতিসংঘের মহাসচিব উ থান্ট বললেন, মানব ইতিহাসের সবচে বিষাদময় ঘটনা বাংলাদেশে ঘটেছে।

ভ্যাটিকান সিটি থেকে জন পোপ পল পূর্ব পাকিস্তানে শান্তি ফিরিয়ে আনার জন্যে বিশ্ব নেতৃবৃন্দের প্রতি আবেদন জানিয়েছেন।*

————-

* বিস্ময়কর ব্যাপার হলো, মুসলিম দেশের কোনো রাষ্ট্রপ্রধান কোনো নেতা মুখ খোলেন নি। তবে পশ্চিম পাকিস্তানের লেনিন পুরস্কারপ্রাপ্ত প্ৰখ্যাত কবি ফয়েজ আহমেদ ফয়েজ ডন পত্রিকায় পাকিস্তানি মিলিটারিদের নৃশংসতার প্রতিবাদ করে একটি রচনা লিখেন। তিনি সংগ্রামী বাংলাদেশীদের উদ্দেশ করে একটি কবিতাও রচনা করেন যার শিরোনাম।–পাও সে লাহুকো ধো ডালো– পা থেকে রক্ত ধুয়ে ফেলো।




গভর্নর টিক্কা খান সকল বাঙালি দোষীদের জন্যে সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেন। দেশত্যাগীদের ফিরে আসার জন্যে অভ্যর্থনা শিবির খোলার কথা বলা হয়। এক ইস্তাহারে বলা হয়–খাঁটি পাকিস্তানিরা নিৰ্ভয়ে দেশে ফিরতে পারবেন।

তাদের ফিরে আসার সুবিধার জন্যে তিনি অভ্যর্থনা শিবির খোলার নির্দেশ দেন।*
 
কবি শামসুর রাহমান ভেতরের দিকের একটা প্রায়ান্ধকার ঘরে বসে আছেন। গ্রামের নাম পাড়াতলী। নরসিংদীর পাড়াতলীর যে বাড়িতে তিনি বাস করছেন সেটা মাটির। তার জানালা আছে। গ্রামের মানুষ বড় জানালা পছন্দ করে না। রেলের টিকিটঘরের জানালার মতো ছোট্ট জানালা। সেই জানালায় ঘরের ভেতর আলো-বাতাস কিছুই আসে না। তবুও তো জানালা।

কবি জানালার পাশে বেতের মোড়ায় বসে আছেন। বেতের মোড়াটা এই বাড়ির সবচে আরামদায়ক। একটাই সমস্যা–হেলান দেয়া যায় না। সবসময় ঋজু অবস্থানের কথা মনে রাখতে হয়। অবশ্যি এখন যে সময় সেই সময়ে ঋজু থাকারই কথা। তিনি উঠোনের দুটো বেগুন গাছের দিকে তাকিয়ে আছেন। বেগুন গাছে বেগুন হয়েছে–অদ্ভুত বেগুন। হাঁসের ডিমের মতো ধবধবে সাদা রঙ। এই জিনিস তিনি আগে দেখেন নি। মনে হচ্ছে গাছে ডিম ফলে আছে। তিনি নাগরিক মানুষ। এখন গ্রামে পড়ে আছেন। গ্রামগঞ্জের অনেক খুঁটিনাটি তাকে আকৃষ্ট করছে। কোনো একটি বিশেষ দৃশ্যে যখন তাঁর চোখ আটকাচ্ছে তিনি মনে মনে রবার্ট ফ্রস্টের কবিতা আবৃত্তি করছেন—

Heaven gives Her glimses only to those
Not in a position to look too close.

কবি সাহেব কি আছেন? কবি সাহেব!

কেউ কি তাঁকে খুঁজছে? নাকি তিনি ভুল শুনছেন? মেয়েলি ধরনের এই পুরুষগলা তিনি কি আগেও শুনেছেন? যেখানে তিনি অজ্ঞাত বাস করছেন সেখানে কবি সাহেব হিসেবে কেউ তাকে চেনার কথা না! অপরিচিত কেউ ডাকছে?

কবি চমকালেন। এখন দুঃসময়। দুঃসময় অপরিচিত আহ্বানের জন্যে ভালো না।

কবি খালি গায়ে আছেন। কড়া সবুজ রঙের লুঙ্গি নাভির উপর পরেছেন। অন্ধকারে তাঁর ফর্সা দুধসাদা শরীর জ্বলজ্বল করছে। এই অবস্থাতেই তিনি উঠে দাঁড়ালেন। গায়ে কিছু দেবার কথা তাঁর মনে হলো না। এই গণ্ড গ্রামে নাগরিক সভ্যতা ভব্যতা দেখাবার কিছু নেই। সুরুচি? দুঃসময়ে সুরুচি প্রথম নির্বাসনে যায়।

কবি কি আমাকে চিনেছেন? আমি শাহ কলিম। আপনার খাদেম।

আমার খাদেম মানে কী? আমি কি পীর সাহেব?

আমার পীর তো অবশ্যই।

কলিমুল্লাহ কদমবুসি করার জন্যে নিচু হলো। কবি চমকে সরে গিয়েও কদমবুসির হাত থেকে বাঁচতে পারলেন না। কলিমউল্লাহ হাসিমুখে বলল, আপনাকে দেখে কী যে ভালো লাগছে! মনে হচ্ছে লিভিংস্টোনের সাক্ষাৎ পেলাম।

তার মানে?

আমাজানের জঙ্গলে লিভিংস্টোন হারিয়ে গিয়েছিলেন। ন্যাশনাল জিওগ্রাফি থেকে কমিশন করে একজনকে আমাজানে পাঠানো হলো। তিনি অনেক ঝামেলা করে লিভিংস্টোনের খোঁজে উপস্থিত হলেন। গভীর অরণ্যে একদল কালো মানুষের মধ্যে একজন সাদা মানুষ দেখে তিনি এগিয়ে গিয়ে বললেন,। presume you are Dr. Livingstone.

কবি কলিমউল্লাহর দিকে তাকিয়ে আছেন। মানুষটা হড়বড় করে কী বলছে কিছু তার মাথায় ঢুকছে না। সবচে বড় সমস্যা হচ্ছে, মানুষটাকে তিনি চিনতে পারছেন না। দাড়ি রাখার কারণে কি তা হয়েছে? আজকাল অনেকেই দাড়ি রেখে চেহারা পাল্টে ফেলছে। দাড়ি, চোখে সুরমা, মাথায় টুপি। নতুন লেবাস।

লিভিংস্টোন সাহেবের মতোই আপনার গায়ের রঙ। পড়েও আছেন বলতে গেলে আমাজানের জঙ্গলে। কবি বোধহয় আমাকে চিনতে পারেন নাই। দৈনিক পাকিস্তান অফিসে আপনার সঙ্গে পরিচয়। আপনার একটা কবিতা ঝাড়া মুখস্থ বলেছিলাম। আসাদের শার্ট। মনে পড়েছে?

শামসুর রাহমান হতাশ ভঙ্গিতে মাথা নেড়ে বুঝালেন তিনি চিনেছেন। আসলে মোটেই চিনতে পারেন নি।

আপনাকে মনে মনে খুঁজছিলাম, এইভাবে যে পেয়ে যাব ভাবি নাই।

কীভাবে পেয়েছেন?

সে এক বিরাট ঘটনা। বসে বলি? ঘরে কোথাও গিয়ে বসি?

শামসুর রাহমান বিব্ৰত ভঙ্গিতে বললেন, অবশ্যই অবশ্যই।
 

Users who are viewing this thread

Back
Top