গত তিনদিন ধরে তিনি খাকি পোশাক গায়ে নিয়ে ঘুরছেন। শরীর ঘামছে। সেই ঘাম শরীরে শুকিয়ে যাচ্ছে। কুৎসিত অবস্থা। গত সপ্তাহের নিউজ উইক সঙ্গে আছে–এখনো পড়া হয় নি। রাতে পড়া যেতে পারে। গাড়ির চাকা বদলাতে অনেক সময় লাগল। সব কী রকম ঢিলাঢ়ালা হয়ে গেছে। যুদ্ধ অবস্থায় কোচকালেন। মনের বিরক্তি প্ৰকাশ করলেন না।
নীলগঞ্জ থানার ওসি মেজর সাহেবকে স্যালুট দিলেন। তার পেছনে তিনজন কনষ্টেবল। তারা প্রেজেন্ট আর্ম ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে।
মেজর সাহেব বললেন, সব ঠিক হ্যায়?
ছদরুল আমিন বললেন, ইয়েস স্যার।
ভেরি গুড। হোয়াটস ইয়োর নেম?
ছদরুল আমিন।
নাম তো বহুত আচ্ছ হ্যায়।
মেজর মোশতাক আবারো হাসলেন। ছদারুল আমিনের বুকের রক্ত এবং পেটের ক্ষুধা দুই-ই মিলিটারি দেখে পানি হয়ে গিয়েছিল। মেজর সাহেবের মুখের হাসি দেখেও লাভ হলো না। বুক ধ্বক ধ্বক করেই যাচ্ছে।
মেজর সাহেব হ্যান্ডশোকের জন্যে হাত বাড়ালেন; ছদারুল আমিন হ্যান্ডশেক করলেন। গম্ভীর গলায় বললেন, ডরতা কেউ ডরো মাৎ।
এই ঘটনা ঘটল দুপুর তিনটায়। বিকেল পাঁচটায় ঘটল সম্পূর্ণ অন্য ঘটনা। ছদরুল আমিনকে সোহাগী নদীর কাছে নিয়ে গুলি করে মেরে ফেলা হলো। ছদরুল আমিন সাহেব একা ছিলেন না। তাঁর সঙ্গে ছিল পাঁচজন হিন্দু, দুজন আনন্দমোহন কলেজের ছাত্র–এরা মুসলমান।
মৃত্যুর আগে আগে ছদরুল আমিন একটা ব্যাপার নিয়ে ভাবছিলেনউতার আনতে যাকে পাঠানো হয়েছে, সে কি এসেছে?
মৃত্যুর আগে মানুষ কত কী ভাবে–তার মাথায় শুধু ঘুরতে লাগল। উতার–এর পানি। উতার শব্দটা বারবার উচ্চারণ করতেও তাঁর খুব মজা লাগছিল।
নীলগঞ্জ থানা কম্পাউন্ড খুব জমজমাট। গেটে মিলিটারি সেন্ট্রি। থানার মূল বিল্ডিং-এর বারান্দায় দুটা পেট্রোম্যাক্স জুলছে। রাজ্যের পোকা এসে জড়ো হয়েছে। পোকাদের আনন্দের সীমা নেই।
থানার পেছনেই বঁধানো কুয়া। কুয়ার পাশে মেজর সাহেবের থাকার জন্য তাঁবু খাটানো হয়েছে। আজ রাত মেজর সাহেবকে নীলগঞ্জে থাকতে হবে। মেজর মোশতাক আহমেদ তার তাবুর সামনে চেয়ারে বসে আছেন। টুলের উপর পা তুলে ক্লান্তি দূর করার চেষ্টা করছেন। তিনি গা থেকে দুদিনের বাসি কাপড় এখনো খোলেন নি। তবে শিগগিরই খুলবেন। তাঁর গোসলের জন্য কুয়া থেকে বালতিভর্তি ঠাণ্ডা পানি তোলা হয়েছে। তিনি মানে যাওয়ার আগে পুরোপুরি নিশ্চিত হতে চান যে, তার দলটির রাতে থাকা এবং খাওয়ার ব্যবস্থা হয়েছে। জোয়ানদের রাতে ঘুমানোর ব্যাপারটা তেমন জরুরি নয়, তবে খাওয়ার ব্যবস্থােটা জরুরি। পুরো দলটি বলতে গেলে সারাদিন না খাওয়া।
মোশতাক আহমেদ মোটামুটি নিশ্চিত হয়েছেন— খাওয়ার ব্যবস্থা হচ্ছে। গ্রামে বাজার-হাটের সুবিধা নেই। চট করে কিছু জোগাড় করা মুশকিল। এখানে সব জোগাড় হয়েছে। দুটা খাসি জবেহ হয়েছে। রান্নাও শুরু হয়েছে। রুটিগোশত করা যাচ্ছে না, চাল-গোশত হচ্ছে। বাঙালের দেশে এসে বাঙালি ব্যবস্থা। ক্ষুধার্ত অবস্থায় কোনো খাবারই খারাপ লাগবে না।
মোশতাক আহমেদ চুরুট ধরিয়ে আকাশের দিকে তাকালেন। এখন আকাশ পরিষ্কার। তারায় তারায় ঝলমল করছে। ঐ তো দেখা যাচ্ছে সপ্তর্ষিমণ্ডল। শহর থেকে সপ্তর্ষিমণ্ডল ভালোমতো দেখা যায় না। এই সাতটি তারা দিগন্তরেখার কাছাকাছি। এদের দেখতে হলে খোলা জায়গায় যেতে হবে। থানা কম্পাউন্ডটা খুব খোলামেলা। দুশ গজের ভেতর গাছপালার সংখ্যা কম। বর্তমান সময়ের জন্য এটা খুব জরুরি। প্রতিটি থানাকে থাকতে হবে থ্রি নট থ্রি রাইফেল রেঞ্জের বাইরে। গাছপালার কভারে কোনো অতি-উৎসাহী যেন গুলি করার স্পর্ধা না করে।
মগভর্তি এক মগ কফি মোশতাক আহমেদের পাশে এনে রাখা হলো। কফি নিয়ে এসেছেন নীলগঞ্জ থানার সেকেন্ড অফিসার ফরিদ উদ্দিন। থানার চার্জ বর্তমানে তাকে দেওয়া হয়েছে। ফরিদ উদ্দিন মেজর সাহেবের সামনে অ্যাটেনশন হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। চলে যেতে পারছেন না, আবার দাড়িয়ে থাকতেও পারছেন না। তার পা অল্প অল্প কাপছে। তিনি যেন তার সামনে সাক্ষাৎ মৃত্যু দেখতে পাচ্ছেন। মোশতাক আহমেদ কফির মাগে চুমুক দিয়ে বললেন, Do you have something in your mind?
প্রশ্ন না বুঝেই ফরিদ উদ্দিন বললেন, Yes sir.
Speak out.
ফরিদ উদ্দিন আগে যেমন দাঁড়িয়ে ছিলেন, এখনো তেমনি দাঁড়িয়ে রইলেন। মেজর সাহেব হাতের ইশারায় তাকে চলে যেতে বললেন। সেই ইশারাও তিনি বুঝতে পাবলেন না। ফরিদ উদিনের মাথা আসলে এলোমেলো হয়ে গেছে। এখনো তাঁর বিশ্বাস হচ্ছে না, এমন নির্বিকার ভঙ্গিতে এতগুলি মানুষকে মেরে ফেলা যায়! নদীর পাড়ে নিয়ে লাইন করে দাঁড়া করাল। কী হচ্ছে বোঝার আগেই একজন হাই তুলে বলল, ফায়ার। দ্রুত বাজনার মতো কিছু গুলি হয়ে গেল। গুলি করা হচ্ছে তাও ফরিদ উদ্দিন বুঝতে পারেন নি। পুরো ব্যাপারটা মনে হচ্ছে স্বপ্লের মধ্যে ঘটে গেছে। কে জানে, হয়তো স্বপ্লই। স্বপ্ন ছাড়া বাস্তবে এত ভয়ঙ্কর ঘটনা ঘটে না। বাস্তবে কেউ হাই তুলতে তুলতে ফায়ার বলে না। হাই তোলার ব্যাপারটা বানানো না। যে ফায়ার বলেছে তিনি তার পাশেই দাঁড়িয়েছিলেন। তালগাছের মতো লম্বা একটা মানুষ। পাতলা গোফ আছে। নিচের ঠোঁটে শ্বেতীর দাগ। ফরিদ উদ্দিন নিশ্চিত জানেন–বাকি জীবনে তিনি অসংখ্যবার দুঃস্বপ্নের ভেতর এই মানুষটাকে দেখবেন।
মেজর সাহেব। আবারো হাত ইশারা করে ফরিদ উদ্দিনকে যেতে বললেন। কফি খেতে ভালো হয়েছে। তিনি একা একা আরাম করে কফি খেতে চান। ক্ষুধা নষ্ট করার জন্যও কফি দরকার। রাতের খাবার খেতে দেরি হবে।
নীলগঞ্জ থানার ওসি মেজর সাহেবকে স্যালুট দিলেন। তার পেছনে তিনজন কনষ্টেবল। তারা প্রেজেন্ট আর্ম ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে।
মেজর সাহেব বললেন, সব ঠিক হ্যায়?
ছদরুল আমিন বললেন, ইয়েস স্যার।
ভেরি গুড। হোয়াটস ইয়োর নেম?
ছদরুল আমিন।
নাম তো বহুত আচ্ছ হ্যায়।
মেজর মোশতাক আবারো হাসলেন। ছদারুল আমিনের বুকের রক্ত এবং পেটের ক্ষুধা দুই-ই মিলিটারি দেখে পানি হয়ে গিয়েছিল। মেজর সাহেবের মুখের হাসি দেখেও লাভ হলো না। বুক ধ্বক ধ্বক করেই যাচ্ছে।
মেজর সাহেব হ্যান্ডশোকের জন্যে হাত বাড়ালেন; ছদারুল আমিন হ্যান্ডশেক করলেন। গম্ভীর গলায় বললেন, ডরতা কেউ ডরো মাৎ।
এই ঘটনা ঘটল দুপুর তিনটায়। বিকেল পাঁচটায় ঘটল সম্পূর্ণ অন্য ঘটনা। ছদরুল আমিনকে সোহাগী নদীর কাছে নিয়ে গুলি করে মেরে ফেলা হলো। ছদরুল আমিন সাহেব একা ছিলেন না। তাঁর সঙ্গে ছিল পাঁচজন হিন্দু, দুজন আনন্দমোহন কলেজের ছাত্র–এরা মুসলমান।
মৃত্যুর আগে আগে ছদরুল আমিন একটা ব্যাপার নিয়ে ভাবছিলেনউতার আনতে যাকে পাঠানো হয়েছে, সে কি এসেছে?
মৃত্যুর আগে মানুষ কত কী ভাবে–তার মাথায় শুধু ঘুরতে লাগল। উতার–এর পানি। উতার শব্দটা বারবার উচ্চারণ করতেও তাঁর খুব মজা লাগছিল।
নীলগঞ্জ থানা কম্পাউন্ড খুব জমজমাট। গেটে মিলিটারি সেন্ট্রি। থানার মূল বিল্ডিং-এর বারান্দায় দুটা পেট্রোম্যাক্স জুলছে। রাজ্যের পোকা এসে জড়ো হয়েছে। পোকাদের আনন্দের সীমা নেই।
থানার পেছনেই বঁধানো কুয়া। কুয়ার পাশে মেজর সাহেবের থাকার জন্য তাঁবু খাটানো হয়েছে। আজ রাত মেজর সাহেবকে নীলগঞ্জে থাকতে হবে। মেজর মোশতাক আহমেদ তার তাবুর সামনে চেয়ারে বসে আছেন। টুলের উপর পা তুলে ক্লান্তি দূর করার চেষ্টা করছেন। তিনি গা থেকে দুদিনের বাসি কাপড় এখনো খোলেন নি। তবে শিগগিরই খুলবেন। তাঁর গোসলের জন্য কুয়া থেকে বালতিভর্তি ঠাণ্ডা পানি তোলা হয়েছে। তিনি মানে যাওয়ার আগে পুরোপুরি নিশ্চিত হতে চান যে, তার দলটির রাতে থাকা এবং খাওয়ার ব্যবস্থা হয়েছে। জোয়ানদের রাতে ঘুমানোর ব্যাপারটা তেমন জরুরি নয়, তবে খাওয়ার ব্যবস্থােটা জরুরি। পুরো দলটি বলতে গেলে সারাদিন না খাওয়া।
মোশতাক আহমেদ মোটামুটি নিশ্চিত হয়েছেন— খাওয়ার ব্যবস্থা হচ্ছে। গ্রামে বাজার-হাটের সুবিধা নেই। চট করে কিছু জোগাড় করা মুশকিল। এখানে সব জোগাড় হয়েছে। দুটা খাসি জবেহ হয়েছে। রান্নাও শুরু হয়েছে। রুটিগোশত করা যাচ্ছে না, চাল-গোশত হচ্ছে। বাঙালের দেশে এসে বাঙালি ব্যবস্থা। ক্ষুধার্ত অবস্থায় কোনো খাবারই খারাপ লাগবে না।
মোশতাক আহমেদ চুরুট ধরিয়ে আকাশের দিকে তাকালেন। এখন আকাশ পরিষ্কার। তারায় তারায় ঝলমল করছে। ঐ তো দেখা যাচ্ছে সপ্তর্ষিমণ্ডল। শহর থেকে সপ্তর্ষিমণ্ডল ভালোমতো দেখা যায় না। এই সাতটি তারা দিগন্তরেখার কাছাকাছি। এদের দেখতে হলে খোলা জায়গায় যেতে হবে। থানা কম্পাউন্ডটা খুব খোলামেলা। দুশ গজের ভেতর গাছপালার সংখ্যা কম। বর্তমান সময়ের জন্য এটা খুব জরুরি। প্রতিটি থানাকে থাকতে হবে থ্রি নট থ্রি রাইফেল রেঞ্জের বাইরে। গাছপালার কভারে কোনো অতি-উৎসাহী যেন গুলি করার স্পর্ধা না করে।
মগভর্তি এক মগ কফি মোশতাক আহমেদের পাশে এনে রাখা হলো। কফি নিয়ে এসেছেন নীলগঞ্জ থানার সেকেন্ড অফিসার ফরিদ উদ্দিন। থানার চার্জ বর্তমানে তাকে দেওয়া হয়েছে। ফরিদ উদ্দিন মেজর সাহেবের সামনে অ্যাটেনশন হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। চলে যেতে পারছেন না, আবার দাড়িয়ে থাকতেও পারছেন না। তার পা অল্প অল্প কাপছে। তিনি যেন তার সামনে সাক্ষাৎ মৃত্যু দেখতে পাচ্ছেন। মোশতাক আহমেদ কফির মাগে চুমুক দিয়ে বললেন, Do you have something in your mind?
প্রশ্ন না বুঝেই ফরিদ উদ্দিন বললেন, Yes sir.
Speak out.
ফরিদ উদ্দিন আগে যেমন দাঁড়িয়ে ছিলেন, এখনো তেমনি দাঁড়িয়ে রইলেন। মেজর সাহেব হাতের ইশারায় তাকে চলে যেতে বললেন। সেই ইশারাও তিনি বুঝতে পাবলেন না। ফরিদ উদিনের মাথা আসলে এলোমেলো হয়ে গেছে। এখনো তাঁর বিশ্বাস হচ্ছে না, এমন নির্বিকার ভঙ্গিতে এতগুলি মানুষকে মেরে ফেলা যায়! নদীর পাড়ে নিয়ে লাইন করে দাঁড়া করাল। কী হচ্ছে বোঝার আগেই একজন হাই তুলে বলল, ফায়ার। দ্রুত বাজনার মতো কিছু গুলি হয়ে গেল। গুলি করা হচ্ছে তাও ফরিদ উদ্দিন বুঝতে পারেন নি। পুরো ব্যাপারটা মনে হচ্ছে স্বপ্লের মধ্যে ঘটে গেছে। কে জানে, হয়তো স্বপ্লই। স্বপ্ন ছাড়া বাস্তবে এত ভয়ঙ্কর ঘটনা ঘটে না। বাস্তবে কেউ হাই তুলতে তুলতে ফায়ার বলে না। হাই তোলার ব্যাপারটা বানানো না। যে ফায়ার বলেছে তিনি তার পাশেই দাঁড়িয়েছিলেন। তালগাছের মতো লম্বা একটা মানুষ। পাতলা গোফ আছে। নিচের ঠোঁটে শ্বেতীর দাগ। ফরিদ উদ্দিন নিশ্চিত জানেন–বাকি জীবনে তিনি অসংখ্যবার দুঃস্বপ্নের ভেতর এই মানুষটাকে দেখবেন।
মেজর সাহেব। আবারো হাত ইশারা করে ফরিদ উদ্দিনকে যেতে বললেন। কফি খেতে ভালো হয়েছে। তিনি একা একা আরাম করে কফি খেতে চান। ক্ষুধা নষ্ট করার জন্যও কফি দরকার। রাতের খাবার খেতে দেরি হবে।