রুনি চমকে পেছনে তাকাল। অতি বৃদ্ধ এক লোক। বানরের মতো দেখতে। চোখ চকচক করে জুলছে। কী অদ্ভুত ভঙ্গিতে বাঁকা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে! বুড়ো আবার বলল, ফুল কেন ছিড়লা? রুনির কোল থেকে সব ফুল মাটিতে পড়ে গেল।
বুড়ো খনখনে গলায় বলল, খবরদার নড়বি না। যেখানে আছস সেখানে দাঁড়ায়ে থােক। এক কদম নড়লে অসুবিধা আছে।
রুনি তার জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকল। ইচ্ছা থাকলেও তার নড়ার ক্ষমতা নেই। ভয়ে ও আতঙ্কে তার শরীরের সমস্ত মাংসপেশি শক্ত হয়ে গেছে। সে চোখ বড় বড় করে দেখল, বুড়ো মানুষটা প্ৰায় বানরের মতো লাফিয়ে লাফিয়ে ঘরের ভেতর ঢুকে গেল। এই সুযোগে পালিয়ে যাওয়া যায়। পালাতে হলে বুড়ো যে দরজা দিয়ে ঢুকেছে। তাকেও সেই দরজা দিয়ে ঢুকতে হয়, সেটা সম্ভব না। সে দৌড় দিয়ে পুকুরঘাটে যেতে পারে। কিন্তু মা পুকুরের কাছে যেতে নিষেধ করেছেন। সে আগের জায়গাতেই দাঁড়িয়ে রইল। বুড়ো যেভাবে লাফাতে লাফাতে ঘরে ঢুকেছিল, সেভাবেই লাফাতে লাফাতে ঘর থেকে বের হয়ে এলো। এবারে তার হাতে দুনরা এক বন্দুক!
খবরদার নড়বি না। তোরে আমি গুল্লি করে দেব। তুই আমার ফুল ছিঁড়ছস।
রুনি জানে বুড়ো তাকে গুলি করবে না। অবশ্যই বন্দুকে গুলি নেই। খুব সম্ভব বন্দুকটা খেলনা বন্দুক। বড়রা অনেক সময় ছোটদের খেলনা বন্দুক দিয়ে ভয় দেখায়। তার বাবা একবার একটা পিস্তল তার দিকে তাক করে গুলি করেছিল। বিকট শব্দ হয়েছিল। শব্দের সঙ্গে সঙ্গে পিস্তলের মাথায় ছোট আগুন জ্বলে উঠেছিল। আসলে সেটা ছিল একটা সিগারেট লাইটার। বুড়োর হাতের বন্দুকটাও নিশ্চয়ই সে-রকম কিছু।
আল্লাহ খোদার নাম নে ছেমড়ি। আইজ তোর রোজ কিয়ামত।
রুনি চিৎকার করে তার মাকে ডাকল। কিন্তু তার গলা দিয়ে কোনো শব্দ বের হলো না।
সফররাজ মিয়া তাঁর অভ্যাসমতো আকাশের দিকে বন্দুক তাক করে ফাঁকা গুলি করলেন। রুনি অজ্ঞান হয়ে জবা ফুলের উপর পড়ে গেল। সারা বাড়িতে একটা হৈচৈ পড়ে গেল।
রুনির জ্ঞান প্ৰায় সঙ্গে সঙ্গেই ফিরল। কিন্তু তার গায়ের তাপ হু-হু করে বাড়তে থাকল। ঘরে থার্মোমিটার নেই, জ্বর কত উঠেছে বোঝার উপায় নেই। আসমানী স্তব্ধ হয়ে মেয়ের মাথার কাছে বসে আছে। মেয়ের গায়ে হাত দিয়ে জ্বর দেখার ইচ্ছাও তার হচ্ছে না। জীবনটাকে অর্থহীন মনে হচ্ছে। আসমানীর ইচ্ছা করছে নির্জনে কোথাও গিয়ে কাদতে। এ বাড়িটা বিরাট বড়, নির্জনে কাদার মতো অনেক জায়গা আছে। রুনিকে নিয়ে চিন্তার কিছু নেই। এরা দেখবে। এখন মাথায় পানি ঢালা হচ্ছে, ডাক্তারের জন্য লোক গেছে। রুনির পাশে বসে থাকার কিছু নেই। আসমানী তারপরও বসে রইল। ডাক্তার এসে ওষুধ দিলেন। জ্বর কমে গেল। রুনি স্বাভাবিক ভঙ্গিতে হাসল। আসমানী স্বাভাবিক হতে পারল না। সে সারারাত জেগে কাটিয়ে দিল। অদ্ভুত অদ্ভুত সব চিন্তা তার মাথায় আসছে।
কুমকুমের মা হঠাৎ যদি তাকে ডেকে বলেন, অনেকদিন তো হয়ে গেল, এবার তুমি অন্য কোথাও যাও। সে তাহলে যাবে কোথায়? মহিলা আগে যে আন্তরিকতার সঙ্গে কথা বলতেন এখন তা বলেন না। আসমানী একদিন শুনেছে। তিনি কাজের মেয়েকে বলছেন, নিজের মেয়ের খোঁজ নাই, পরোয় মেয়ে পালতেছি।
আসলেই তো তাই। আসমানী কুমকুমের বান্ধবী। তাদের তো কেউ না। তারা কেন শুধু শুধু তাকে পুষিবেন?
আসমানী আজকাল প্রতিদিনই একবার করে ভাবে রুনিকে সঙ্গে নিয়ে এক একা ঢাকা চলে গেলে কেমন হয়। খুব কি অসম্ভব ব্যাপার? কেউ কি ঢাকা যাচ্ছে
একটা সমস্যা আছে। তার হাত খালি। হ্যান্ডব্যাগে পনেরোটা মাত্র টাকা। তার হাতে চারগাছা সোনার চুড়ি আছে। চুড়ি বিক্রি অবশ্যই করা যায়। রুনির গলায় চেইন আছে। এক ভরি ওজনের চেইন। চেইনটাও বিক্রি করা যায়। সোনার দাম এখন দুশ টাকা ভরি। চুড়ি আর চেইন মিলিয়ে খাদ কাটার পরেও আড়াইশ-তিনশ টাকা পাওয়া উচিত। হাত খালি থাকলে অস্থির লাগে। আসমানীর সারাক্ষণই অস্থির লাগছে।
আসমানীর ধরাবাধা জীবনটা হঠাৎ এমন হয়ে গেল কেন? অন্য একটা পরিবারের জীবনের সঙ্গে তার জীবনটা জট পাকিয়ে গেছে। এরকম কি কথা ছিল? শাহেদ কোথায় আছে সে জানে না। বেঁচে আছে তো? তাও জানে না। তার মা কোথায়? দেশের বাড়িতে? খোঁজ নেবার উপায় কী? সবকিছুই জট পাকিয়ে এলোমেলো হয়ে গেছে। এই জটি কি কখনো খুলবো?
মানুষের জীবন এমন যে একবার জট পাকিয়ে গেলে জট বাড়তেই থাকে। রাত জেগে আসমানী বেশ কয়েকটা চিঠি লিখল। শাহেদকে, তার মাকে, নীলগঞ্জে শাহেদের বড়ভাইকে, চিটাগাং-এর ছোটমামাকে। চিঠিতে নিজের ঠিকানা জানাল। কীভাবে মুন্সিগঞ্জের অজপাড়াগায়ে চলে এসেছে তা লিখল। ডাক বিভাগ কোনো দিন চালু হবে কি-না তা সে জানে না। যদি কখনো চালু হয়, তাহলে যেন আসমানীর আত্মীয়স্বজনরা সঙ্গে সঙ্গে জানতে পারেন আসমানী কোথায় আছে।
দেশের অবস্থা কি ভালো হবে? যদি হয় সেটা কবে? কত দিন আসমানীকে একটা অপরিচিত জায়গায় একদল অপরিচিত মানুষের সঙ্গে থাকতে হবে? আসমানী জানে না। শুধু আসমানী কেন, দেশের কেউই বোধহয় জানে না।
বিবিসি থেকে ভয়ঙ্কর সব খবর দিচ্ছে। সারাদেশে নাকি গৃহযুদ্ধ শুরু হয়েছে। একটা গৃহযুদ্ধ কত দিন চলে? ছয় মাস, এক বছর, সাত বছর? বাংলাদেশের এই গৃহযুদ্ধ কত দিন চলবে? সাত বছর যদি চলে, এই সাত বছর তাকে মুন্সিগঞ্জের দারোগাবাড়িতে পড়ে থাকতে হবে? আর পাগলটা যখন-তখন তার মেয়েকে ভয় দেখাবে? তার অতি আদরের মেয়েকে বান্দি ডাকবে?
শাহেদকে লেখা চিঠির সে দুটা কপি করল। একটা যাবে বাসার ঠিকানায়, একটা অফিসের ঠিকানায়। কোনো না কোনোদিন শাহেদ নিশ্চয়ই অফিসে যাবে। অফিসে যাওয়া মাত্রই সে যেন চিঠিটা পায়। শাহেদের চিঠি সম্বোধনবিহীন। বিয়ের আগেও আসমানী শাহেদকে অনেক চিঠি লিখেছে। তার কোনোটিতেই সম্বোধন ছিল না। কী লিখবে সে? প্রিয়তমেষু, সুপ্রিয়, সুজনেষু, নাকি সাদামাটা শাহেদ। তার কখনো কিছু লিখতে ইচ্ছে করে নি। আসমানীর ধারণা শাহেদের জন্য যে সম্বোধন তার মনে আছে সেই সম্বোধনের কোনো বাংলা শব্দ তার জানা নেই।
আসমানী চিঠিতে খুব সহজ-স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করেছে। এমনভাবে চিঠিটা লিখেছে যেন সে পিকনিক কালতে মুন্সিগঞ্জের এক গ্রামে এসেছে। পিকনিকে খুব মজা হচ্ছে। পিকনিক শেষ হলেই ফিরে আসবে।
সে লিখেছে–
তুমি নিশ্চয়ই অস্থির হয়ে আমাদের খুঁজে বেড়ােচ্ছ। অস্থির হওয়ার কিছু নেই। আমরা ভালো আছি। খুব ভালো। নিজেদের জন্য আমাদের দুশ্চিন্তা নেই, তবে তোমার জন্য খুব দুশ্চিন্তা করছি।
কাউকে কিছু না জানিয়ে চলে এসেছি বলে আবার রাগ করছি না তো? প্লিজ, রাগ করো না। আর রাগ করে তো লাভও কিছু নেই। দূর থেকে তোমার রাগ ভাঙাবার জন্য কিছু করতে পারছি না। যে রাগ কেউ জানতে পারছে না, সেই রাগ করাটা অর্থহীন নয় কি?
ও, আমরা কোথায় আছি সে-খবর এখনো তোমাকে দেওয়া হয় নি। আমরা ঢাকার খুব কাছাকাছিই আছি। জায়গাটার নাম মুন্সিগঞ্জ। মুন্সিগঞ্জ লঞ্চঘাট থেকে দশ মাইল যেতে হয়। গ্রামের নাম সাদারগঞ্জ। যে বাড়িতে আছি সেই বাড়িরও একটা নাম আছে। দারোগাবাড়ি। যিনি এ বাড়ি বানিয়েছেন তিনি একসময় দারোগা ছিলেন। তার নাম সরফরাজ মিয়া। ভদ্রলোক এখনো জীবিত! কিঞ্চিৎ মস্তিষ্ক বিকৃতি হয়েছে। যখন-তখন বন্দুক নিয়ে বের হয়ে আকাশের দিকে ফাঁকা গুলি করেন। আমরা এ বাড়িতে আসার পরদিনই এই কাণ্ড করেছেন। এখন তার বন্দুকের সব গুলি সরিয়ে ফেলা হয়েছে। বন্দুকটাও লুকিয়ে ফেলার কথা হচ্ছিল–শেষ পর্যন্ত লুকানো হয় নি। কাবণ সবার ধারণা বন্দুক লুকিয়ে ফেললে তার পাগলামি আরো বেড়ে যাবে।
এখন তোমাকে বলি দারোগাবাড়িতে কীভাবে এলাম। তোমার সঙ্গে রাগ করে আমি আমার বান্ধবী কুমকুমাদের বাড়িতে চলে গিয়েছিলাম। তাদের বাড়ি গেণ্ডারিয়ায়। কুমকুমের বাবা মোতালেব সাহেব আমাকে অত্যন্ত স্নেহ করেন। কুমকুমের মা-ও আমাকে তার মেয়ের মতোই দেখেন। ২৫ মার্চের ভয়াবহ ঘটনার পর কুমকুমের বাড়ির সবাই গেল ঘাবড়ে। আশপাশের সবাই পালাচ্ছে। তারাও পালাবার জন্য তৈরি। এদিকে তোমার কোনো খোঁজ পাচ্ছি না। আমাদের বাসা তালাবন্ধ করে কোথায় যে তুমি পালিয়েছ তুমিই জানো। শুধু যে আমাদের বাসা তালাবন্ধ তাই না–মার বাড়িও তালাবন্ধ।
এরকম অবস্থায় আমি বাধ্য হয়ে মোতালেব চাচার সঙ্গে চলে এসেছি। দারোগাবাড়ির সরফরাজ মিয়া হলেন মোতালেব চাচার বাবা।
যা-ই হোক, মোতালেব চাচার গেণ্ডারিয়ার বাসায় মজনু বলে একজন আছে। তার দায়িত্ব হচ্ছে রোজ একবার তোমার খোজে যাওয়া। আমার ধারণা ইতিমধ্যে সে তোমার খোঁজ পেয়ে গেছে এবং তুমি জানো আমরা কোথায় আছি, কীভাবে আছি।
রুনি তোমাকে খুব মিস করছে। তবে মিস করলেও সে ভালো আছে। মন নিশ্চয়ই ভালো নেই।— কিন্তু শরীরটা ভালো। যে-অবস্থার ভেতর দিয়ে আমরা যাচ্ছি সে অবস্থায় শরীরটা ভালো রাখা ও কম কথা না। কী বলো? তুমি ভালো থেকে। অনেক অনেক আদর।
আসমানীর ইচ্ছা করছিল–অনেক অনেক আদর-এর জায়গায় সে লেখে অনেক অনেক চুমু। লজ্জার জন্য লিখতে পারল না। তার মনে হচ্ছিল। কেউনা-কেউ তার চিঠি খুলে পড়ে ফেলবে। সেটা খুব লজ্জার ব্যাপার হবে।
চিঠিটা শেষ করার পরপরই আসমানীর মনে হলো যেন আসল কথাটাই লেখা হয় নি। যদিও সে জানে না। আসল কথাটা কী। সে আরেকটা চিঠি লিখতে শুরু করল। এই চিঠির সম্বোধন আছে। সম্বোধন লিখতে লিখতেই তার চোখ ভিজে গেল। সে লিখল–
এই যে বাবু সাহেব,
তুমি কোথায়, তুমি কোথায়, তুমি কোথায়? আমি মরে যাচ্ছি। তোমাকে না দেখতে পেলে আমি মরে যাব। আমি সত্যি মরে যাব। তুমি কি জানো এখন আমি কারো কথাই ভাবি না। মার কথা না। বাবার কথা না। ভাইবোন কারো কথাই না। আমি সারাক্ষণ ভাবি তোমার কথা। এই বাড়িতে খুব সুন্দর একটা পুকুর আছে। পুকুরের ঘাট বাঁধানো। অনেক রাতে আমি রুনিকে ঘুম পাড়িয়ে ঘাটে এসে বসে থাকি। তখন শুধু তোমার কথাই ভাবি। আমি দেশের স্বাধীনতা চাই না–কোনো কিছু চাই না। শুধুই তোমাকে চাই। কেন এরকম হলো? কেন আমি তোমার কাছ থেকে আলাদা হয়ে গেলাম? তোমার দেখা পেলে আর কোনোদিন তোমাকে ছেড়ে কোথাও যাব না। আমি আর পারছি না। তুমি এসে আমাকে জড়িয়ে ধরো। কবে আসবে, কবে আসবে, কবে আসবে?
তোমার আসমানী
কয়েকদিন থেকেই আসমানী খুব চেষ্টা করছে রুনির মন থেকে সরফরাজ মিয়ার ভয় ভাঙানো। যাতে সে রাতদিন ঘরে বসে না থেকে বাড়ির বাগানে হেঁটে বেড়াতে পারে। শহরের ঘিঞ্জিতে যে মেয়ে বড় হয়েছে গ্রামের খোলামেলায় সে মহানন্দে থাকবে এটাই স্বাভাবিক। রুনি তা করছে না। সে দোতলা থেকে একতলায়ও নামবে না। মাঝেমধ্যে বারান্দায় এসে ভীত চোখে সরফরাজ মিয়াকে দেখবে, তারপর আতঙ্কে কাঁপতে কাঁপতে ঘরে ঢুকে যাবে।
এই বয়সে মনের ভেতর ভয় ঢুকে গেলে সেই ভয় কিছুতেই দূর হয় না। ভয় গাছের মতো মনের ভেতর শিকড় ছড়িয়ে দেয়। সেই শিকড় বড় হতে থাকে। ভয়টাকে শিকড়সুদ্ধ উপড়ে ফেলা দরকার। কীভাবে তা করা যাবে তা আসমানী জানে না। সরফরাজ মিয়া যদি রুনিকে কাছে ডেকে আদর করে দুটা কথা বলেন, তাতে কি কাজ হবে? আসমানী পুরোপুরি নিশ্চিত নয়। তারপরও সে সরফরাজ মিয়ার সঙ্গে কথা বলতে গেল। বৃদ্ধ মানুষটা মোটামুটি স্বাভাবিক ভঙ্গিতে আসমানীর সঙ্গে কথা বললেন।
খুপরি দিয়ে তিনি জবা গাছের নিচের মাটি আলগা করে দিচ্ছিলেন। আসমানী সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই বললেন, কেমন আছ গো মা?
আসমানী বলল, জি ভালো আছি।
সম্পর্কে তুমি আমার নাতনির মতো, তারপরও মা বললাম। রাগ করবা না মা। যে-কোনো মেয়েকে মা ডাকা যায়। রাগ করব না। বুঝছি রাগ করব না।
জি-না, আমি রাগ করব না।
এই বাড়িটা তোমার নিজের বাড়ি–এরকম মনে করে থাকবা। আমি দেখি প্রায়ই তুমি দিঘির ঘাটলায় বসে থাক। ঘাটলাটা কি তোমার পছন্দ?
জি খুব পছন্দ।
শুনে আনন্দ পেলাম। অনেক যত্ন করে বাড়ি বানিয়েছি। দিঘি কেটেছি। ঘাট বানিয়েছি। বাগান করেছি–দেখার কেউ নাই। আমি এক পড়ে থাকি। আল্লাহর কাছে হাজার শুকরিয়া যে সংগ্রাম শুরু হয়ে গেছে। সংগ্রাম শুরু হয়েছে বলেই তোমরা এসেছ। ঠিক না মা?
জি ঠিক।
ঐ দিন তোমার মেয়েটা বড় ভয় পেয়েছে। আমি খুবই শরমিন্দা। মাঝেমাঝে কী যে হয়–মাথার ঠিক থাকে না। মাথার মধ্যে আগুন জ্বলে। বয়সের কারণে এসব হয়; বয়স খুব খারাপ জিনিস।
আপনি আমার মেয়েটাকে ডেকে একটু আদর করে দিন।
করব গো মা। করব। সময় হলেই করব। সব কিছুরই একটা সময় আছে, জ্যৈষ্ঠ মাসে আম পাকে, কার্তিক মাসে পাকে না–বুঝলা মা?
আসমানী বলল, আমি যাই?
সরফরাজ মিয়া মুখ না তুলেই বললেন, আচ্ছা মা যাও। একটা কথা— মন প্রস্তুত করো। আমাদের জন্য খুব খারাপ সময়। বিষয়টা আমি স্বপ্নে পেয়েছি। স্বপ্নে আমি অনেক জিনিস পাই। দেশে আগুন জ্বলবে গো মা— আগুন জ্বলবে। তোমার কন্যাকে কোলে নিয়ে তোমাকে পথে পথে ঘরতে হবে। এইটা কোনো পাগল ছাগলের কথা না। স্বপ্নে পাওয়া কথা।
আসমানী স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। মানুষটা এইসব কী বলছেন? বিকৃত মস্তিষ্ক একজন মানুষের কথাকে গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনার কোনোই কারণ নেই। তারপরেও কেমন যেন লাগে।
বৃদ্ধ উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বললেন, আরেকটা কথা গো মা। তোমার স্বামী কাছে নাই। তোমার চেহারা সুন্দর। তোমার অল্প বয়েস। মেয়েদের প্রধান শক্ৰ তার সুন্দর চেহারা আর অল্প বয়েস। তুমি অনোর বাড়িতে আশ্রিত। এই অবস্থায় নানান বিপদ আসতে পারে। নিজেরে সামলায়ে চলবা।
আসমানী বৃদ্ধের এই কথা ফেলে দিতে পারছে না। সে সম্পূর্ণ নতুন ধরনের সমস্যা আঁচ করতে পারছে। সমস্যাটা এরকম যে কাউকে বলতেও পারছে না। কারো কাছে পরামর্শও চাইতে পারছে না। তার বান্ধবী কুমকুমের বাবার ভাবভঙ্গি তার একেবারেই ভালো লাগছে না। সাত্ত্বনা দিতে গিযে তিনি প্রায়ই আসমানীর পিঠে হাত রাখেন। আসমানী তার কন্যার বান্ধবী। তিনি অবশ্যই পিঠে হাত রাখতে পারেন। কিন্তু আসমানী জানে এই স্পর্শটা ভালো না। মেয়েরা ভালো স্পর্শ মন্দ স্পর্শ বুঝতে পারে।
একদিন আসমানী পুকুরে গোসল করছিল। মোতালেব সাহেব হঠাৎ গামছা হাতে উপস্থিত। তিনিও পুকুরে নামবেন। আসমানী সঙ্গে সঙ্গে উঠে যেতে চাচ্ছিল। তিনি বললেন, উঠবা না উঠবা না, ঘাট খুব পিছল। আমি তোমাকে ধরে ধরে নামব। বলতে বলতেই তিনি এলেন। আসমানীর হাত ধরলেন। হাত ছেড়ে দিয়ে পরের মুহূর্তেই তিনি আসমানীর বুকে হাত রাখলেন। যেন এটা একটা দুর্ঘটনা। হঠাৎ ঘটে গেছে।
আসমানী চট করে সরে গেল। তার হাত-পা কাঁপতে লাগল। তার মনে হলো, এক্ষুনি সে মাথা ঘুরে পুকুরের পানিতে পড়ে যাবে। মোতালেব সাহেব স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বললেন, পানি তো দেখি ঠাণ্ডা। তোমার ঠাণ্ডা লাগছে না?
আসমানী জবাব দিল না। সে উঠে আসবে কিন্তু তার পা এখনো স্বাভাবিক হয় নি। পা নড়াতে পারছে না। মোতালেব সাহেব বললেন, মিলিটারির ঘটনা শুনেছি? চকের বাজার পর্যন্ত এসে পড়েছে। হিন্দুর বাড়িঘর টার্গেট করেছে। মেয়েগুলিরে ধরে নিয়ে যাচ্ছে। ধরেই কী করে শোন, সব কাপড়াচোপড় খুলে নেংটা করে ফেলে। তারপর বড় একটা ঘরে রেখে দেয়। ঘরের দরজা বন্ধ করে না। গায়ের কাপড়চোপড় নাই–এই অবস্থায় তারা পালাতেও পারে না। দিনের বেলায় মিলিটারিরা অপারেশন করে। রাতে মেয়েগুলারে নিয়ে ফুর্তি করে। ভয়াবহ অবস্থা।
আসমানী পুকুর থেকে উঠে আসছে। মোতালেব সাহেব পেছন থেকে ডাকলেন, যাও কোথায়? পাঁচটা মিনিট থাকে। গোসল সেরে এক সঙ্গে যাই। আমার বয়সে পুকুরে একা একা গোসল করা ঠিক না। কখন ষ্ট্রোক হয় কে বলবে। স্ট্রোক হয়ে পানিতে পড়ে গেলে তুমি টেনে তুলতে পারবে?
সে এখন কী করবে? চাচিকে গিয়ে বলবে, চাচি, আপনার স্বামী আমার বুকে হাত দিয়েছেন।
আসমানীর শরীর কেমন যেন করছে। সে বাড়িতে পা দিয়েই বমি করল। মাথা এমন করে ঘুরছে যে তাকে বসে পড়তে হলো। সে এখন প্রায় নিশ্চিত যে, হঠাৎ তার এই শরীর খারাপের কারণ শুধু মোতালেৰ চাচা না—তার শরীরে নতুন একটা প্রাণের সৃষ্টি হতে যাচ্ছে। ঢাকা থেকে রওনা হবার সময়ই তার ক্ষীণ সন্দেহ ছিল। এখন আর সন্দেহ নাই।
আসমানী বসে আছে। উঠে দাঁড়াবার মতো জোর সে পাচ্ছে না।
ফজরের নামাজ সময়মতো পড়তে পাবেন নি, এ জাতীয় দুর্ঘটনা ইরতাজউদ্দিনেব দীর্ঘ জীবনে কখনো ঘটে নি। সব মানুষের শরীরের ভেতর একটা ঘড়ি আছে। সেই ঘড়ি নিঃশব্দে টিকটিক করে সময় রাখে। যখন যা মনে করিয়ে দেবার মনে করিয়ে দেয়। ইরতাজউদ্দিন সাহেবের ঘড়িতে কোনো গোলমাল হয়েছে। ফজর নামাজের ওয়াক্তে তার ঘুম ভাঙল না। যখন ঘুম ভাঙল তখন বেশ বেলা হয়েছে। পায়ের কাছে রোদ ঝলমল করছে। লজা ও অনুশোচনার তার সীমা রইল না। কী ভয়ঙ্কর কথা! ফজরের নামাজ ছাড়া তার দিন শুরু হতে যাচ্ছে?
গতরাতে ঘুমোতে যেতে অনেক দেরি হয়েছিল। এই কারণেই কি ভোরে ঘুম ভাঙে নি? এটা কোনো যুক্তি না। মানুষ একটা ভুল করলে ভুলের পক্ষে একের পর এক যুক্তি দাঁড়া করায়। এটা ঠিক না। ভুলকে ভুল হিসেবে স্বীকার করে নেয়াই ভালো। ইরতাজউদ্দিন মন খারাপ করে অজু করলেন। নামাজ পড়লেন। নামাজের সময পার হয়ে যাবার পরেও তাকে কাজ পড়তে হলো না। কারণ আমাদের নবি–এ-করিম একবার অতিরিক্ত ঘুমের কারণে ফজরের নামাজ সময়মতো পড়তে পারেন নি। তার প্রতি সম্মান দেখানোর জন্যেই এই বিশেষ ব্যবস্থা। ফজরের নামাজ কাজা ছাড়াই দুপুর পর্যন্ত পড়া যাবে। জায়নামাজে দাঁড়িয়ে ইরতাজউদিনের মনে হলো, কী অসাধারণ মানুষ ছিলেন আমাদের নবি! তার প্রতিটি কাজ, প্রতিটি কর্ম কত না শ্ৰদ্ধা কত না ভালোবাসার সঙ্গে স্মরণ করা হয়।
ইরতাজউদ্দিন নিজেকে শাস্তি দেবার জন্যে সকালে নাশতা খেলেন না। স্কুলের দিকে বাওনা হলেন ঠিক সাড়ে নটায়। স্কুলে পৌঁছতে পনেরো মিনিট লাগে। তারপরেও হাতে থাকে। পনেরো মিনিট। ক্লাস শুরু হয় দশটায়। এখন অবশ্যি কোনো ক্লাস হচ্ছে না। ছাত্ররা আসছে না। স্কুল বন্ধ থাকবে না খোলা থাকবে–এধরনের কোনো সরকারি ঘোষণাও নেই। কিছু শিক্ষক আসেন। কমনরুমে বসে কিছুক্ষণ গল্পগুজব করে যে যার বাড়ি চলে যান।
গল্পগুজবের একমাত্র বিষয়–দেশের কী হচ্ছে? শিক্ষকদের প্রায় সবাইকেই দেখা যায় আনন্দিত ভঙ্গিতে আলোচনায় অংশ নিচ্ছেন। পাকিস্তানি মিলিটারি যে ভয়াবহ জিনিস–এ ব্যাপারে তারা অতি দ্রুত ঐকমত্যে পৌঁছেন। কোনো এক বিচিত্র কারণে পাকিস্তানি মিলিটারির শৌর্যবীর্যের কথা বলতে এদের
জ্বালাওপোড়াও বলে এত যে লাফালাফি ঝাঁপঝাঁপি, এক ধাক্কায় শেষ। পাকিস্তানি মিলিটারি কী জিনিস যে জানে সে জানে।
এদের মধ্যে কিছু আছে যাদের এরা অন্ধকারে চেইন দিয়ে বেঁধে রাখেসাক্ষাৎ আজরাইল। দরকারের সময় ছাড়ে–তখন আর কোনো উপায় থাকে না। এদের এখনো ছাড়ে নাই। ইন্ডিয়ার সঙ্গে যুদ্ধ লাগলে ছাড়বে। তার আগে ছাড়ার দরকার নাই।
দয়ামায়া বলে এক বস্তু এদের মধ্যে নাই। এরা হলো ধর তক্তা মার পেরেক টাইপ। তক্তা একবার ধরলে পেরেক মেরে ছেড়ে দিবে।
পেরেক মারতে মারতে আসছে। পেরেক মেরে বাঙালি সিধা করে দেবে। বাঙালি ভেবেছিল সিংহের সাথে সাপলুড়ু খেলবে। সিংহ সাপলুড়ু খেলে না।
মিলিটারিবিষয়ক আলাপ-আলোচনার শেষে ঝালমুড়ি দিয়ে চা খাওয়া হয়। আগে পত্রিকা নিয়ে টানাটানি করা হতো, এখন পত্রিকা আসছে না বলে সেই পর্ব হয় না। অংক স্যার ছগিরউদ্দিন এক দুই দান দাবা খেলেন স্কুলের ইংরেজি স্যার কালিপদ বাবুর সঙ্গে। কালিপদ বাবু তুখোড় খেলোয়াড়–কাজেই প্ৰতিবারই তিনি হারেন এবং হেরে কিছু চিল্লাচিল্লি করেন। এই হলো এখনকার স্কুলের রুটিন। রুটিনের তেমন কোনো হেরফের হয় না। উত্তেজনাহীন জীবনে মিলিটারি। আসছে। এই একমাত্র উত্তেজনা। এই নিয়ে কথা বলতেও তাদের ভালো লাগে। এতেও কিছুটা উত্তেজনা পাওয়া যায়। খারাপ ধরনের উত্তেজনা। তাতেই বা ক্ষতি কী?
মিলিটারি নীলগঞ্জে কবে নাগাদ আসবে?
দেরি নাই। আসলো বলে। ময়মনসিংহ চলে এসেছে। যে-কোনোদিন নীলগঞ্জ চলে আসবে। খবর দিয়ে তো আসবে না। হঠাৎ শুনবেন আজাদহা উপস্থিত। মেশিনগানের ট্যাট ট্যাট গুলি।
ভয়ের কথা, কী বলেন?
ভয়ের কথা তো বটেই। এরা সাক্ষাৎ আজরাইল। মুখের কথার আগেই গুল্লি। হিন্দু হলে ছাড়ান নাই।
হিন্দু মুসলমান বোঝে কীভাবে?
কাপড় খুলে খৎনা দেখে। তারপরে চার কলমা জিজ্ঞেস করে। কলমায় উনিশ বিশ হয়েছে কি গুল্লি।
চার কলমা তো আমি নিজেও জানি না।
মুখস্থ করেন, তাড়াতাড়ি মুখস্থ করেন। মিলিটারি এসে পড়লে আর মুখস্থ করার সময় পাবেন না। ময়মনসিংহের এডিসির যে দশা হয়েছে সেই দশা হবে।
উনার কী হয়েছিল?
চার কলমা জিজ্ঞেস করেছে। কলমা তৈয়ব বলেছে ঠিকঠাক। কলমা শাহাদতে গিয়ে বেড়াছেড়া করল। তখন জিজ্ঞেস করল বেতেরের নামাজের নিয়ত। পারল না–সঙ্গে সঙ্গে গাংগানির পাড়ে নিয়ে দুম দুম দুই গুল্লি।
বেতেরের নামাজের নিয়তও জিজ্ঞেস করে?
সব জিজ্ঞেস করে। পাকিস্তানি মিলিটারি ধর্মের ব্যাপারে খুব শক্ত।
রোজ কেয়ামত বলতে পারেন। বিপদের আশঙ্কায় কাউকে তেমন চিন্তিত মনে হয় না। নীলগঞ্জ গ্রামের রৌদ্রকরোজুল দিন। ঝকঝকি করছে এপ্রিলের নীলাকাশ। খেতে খামারে কাজ কর্ম হচ্ছে–চিন্তিত হবার কী আছে। শহরে ঝামেলা হচ্ছে। শহরে ঝামেলা হয়েই থাকে। শহরের ঝামেলা গ্রামকে স্পর্শ করে না। রাজা আসে রাজা যায়–এ তো বরাবরের নিয়ম। রাজা বদলের ছোফা শরীরে না লাগলেই হলো। লাগবে। না বলাই বাহুল্য। বড় বড় আন্দোলন শহরে শুরু হয়ে শহরেই শেষ হয়। গ্রাম পর্যন্ত আসে না।
ইরতাজউদ্দিন স্কুলে এসে দেখলেন, স্কুলের শিক্ষকরা সবাই চলে গেছেন। জোর গুজব মিলিটারিরা ময়মনসিংহ থেকে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করেছে। একটা বড় দল গেছে হালুয়াঘাট। যে-কোনো সময় নীলগঞ্জে চলে আসতে পারে। স্কুলে আছেন হেডমাস্টার সাহেব। ছাত্র থাকুক না থাকুক। তিনি দশটা-পাঁচটা স্কুলে হাজির থাকেন। ছগির সাহেব এবং কালিপদ বাবুও আছেন।
ছগির সাহেব দাবা খেলছিলেন, আজ তিনি ভালো খেলেছেন। কালিপদ বাবু সুবিধা করতে পারছে না। তার মন্ত্রী আটকা পড়ে গেছে। মন্ত্রী খোয়ানো ছাড়া কালিপদ বাবুর সামনে কোনো বিকল্প নেই। অংক স্যারের মুখভর্তি হাসি। আনন্দ তিনি চেপে রাখতে পারছেন না। ইরতাজউদ্দিনকে দেখে অংক স্যার আনন্দিত গলায় বললেন, নীলগঞ্জে মিলিটারি চলে আসতেছে শুনেছেন না-কি?
ইরতাজউদ্দিন বললেন, তাই না-কি?
হেড স্যারের কাছে যান। উনার কাছে লেটেস্ট সংবাদ আছে।
মিলিটারি আসছে এরকম খবর পাঠিয়েছে?
আরে না। এরা কি খোঁজ-খবর দিয়ে আসে? হুট করে চলে আসবে। এসেই রাজা আটক করে ফেলবে। সরাসরি গজের আক্রমণ। হা-হা-হা।
হাসতেছেন কেন? মিলিটারি আসা কি কোনো আনন্দের বিষয়?
আমাদের জন্যে সমান। আমরা আমেও নাই ছালাতেও নাই। দেশ শান্ত হলেই খুশি। ছাত্র পড়াব, বেতন পাব। আর কী?
ইরতাজউদ্দিন হেডমাস্টার সাহেবের ঘরের দিকে রওনা হলেন। ছগির সাহেব দাবার বোর্ডের উপর ঝাঁকে পড়লেন। ইচ্ছা করলেই তিনি মন্ত্রীটা খেতে পারেন। খেতে ইচ্ছা করছে না। আটকা থাকুক, ধীরেসুস্থে খাবেন। খাদ্য তো আর পালিয়ে যাচ্ছে না। তিনি গজের চাল দিলেন। তেমন চিন্তা-ভাবনা করে দিলেন না। বিপক্ষের মন্ত্রী আটকা পড়ে আছে, এখন এত চিন্তা-ভাবনার কিছু নেই।
হেডমাস্টার মনসুর সাহেব মাথা নিচু করে কী যেন লিখছিলেন। ইরতাজউদ্দিনকে দেখে মাথা তুললেন। ইরতাজউদ্দিন বললেন, আপনার কী হয়েছে?
মনসুর সাহেব জবাব দিলেন না। নিজের ব্যক্তিগত ব্যাপার নিয়ে তিনি কথা বলতে চান না। তাঁর ভালো লাগে না। গত তিন রাত ধরে তার ঘুম হচ্ছে না। তিনি তাঁর স্ত্রীকে নিয়ে এসেছেন। স্বামী আশেপাশে থাকলে মহিলা অনেকটা সুস্থ থাকেন। এবার তার ব্যতিক্রম দেখা যাচ্ছে। এখন তিনি স্বামীকে চিনতে পারছেন না। এক রাতে তিনি স্বামীকে ঘরে ঢুকতে দেখে চিৎকার করে উঠলেন– এই তুমি কে? তুমি ঘরে ঢুকলা কেন? খবরদার! খবরদার! মনসুর সাহেব বললেন, আসিয়া আমাকে চিনতে পারছি না? আমি আমি।
খবরদার আমি আমি করব না। খবরদার। হেডমাস্টার সাহেব রাতে আলাদা ঘরে ঘুমান। আসয়াকে তালাবন্ধ করে রাখতে হয়। ছাড়া পেলে তিনি একা একা নদীর পাড়ে চলে যান।
দেশটাকে নিজের মুঠোয় নিতে হলে আসতেই হবে। কবে আসবে সেটা কথা। শহরগুলোর দখল এরা নিয়ে নিয়েছে–এখন ছড়িয়ে পড়বে। কোনো রেসিসটেন্স পাচ্ছে না, কাজেই ছড়িয়ে পড়ার ব্যাপারটা দ্রুত ঘটবে।
রেসিসটেন্স হবে?
অবশ্যই হবে। কে জানে, এখনই হয়তো শুরু হয়েছে। সামনের দিন বড়ই ভয়ঙ্কর ইরতাজ সাহেব। কেউ বুঝতে পারছে না। কিন্তু আমি বুঝতে পারছি।
ভাবি সাহেবের শরীর কেমন? ভালো না। তাকে এখানে আনা ঠিক হয় নাই। মনে হয়। বাপ-ভাইয়ের কাছেই সে ভালো ছিল। তাকে এখানে এনে ভুল করেছি।
মানুষের কর্মকাণ্ড কোনটা ভুল কোনটা শুদ্ধ সেই বিবেচনা কঠিন বিবেচনা। মানুষ প্রায়ই এই বিবেচনা করতে পারে না। ভুল এবং শুদ্ধ একমাত্র আল্লাহপাকই বলতে পারেন।
মনসুর সাহেব বড় করে নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, আপনার মতো আল্লাহভক্ত মানুষদের একটা সুবিধা আছে–সব দায়দায়িত্ব আল্লাহর উপর ফেলে দিয়ে নিশ্চিন্ত হয়ে বাস করতে পারেন। বড় কোনো বিপদ যদি আসে, তখনও আপনার মতো মানুষরা সবই আল্লাহর হুকুম বলে স্বাভাবিকভাবে কাজকর্ম করতে থাকে।
এইটা কি ভালো না?
না, এটা ভালো না। মানুষকে বিবেক দেয়া হয়েছে। চিন্তা করার ক্ষমতা দেয়া হয়েছে। যুক্তিবিদ্যার মতো কঠিন বিদ্যায় জন্মসূত্ৰেই মানুষ পারদশী। সেই মানুষ যদি সবই আল্লাহর হুকুম বলে চুপ করে থাকে, তাহলে কীভাবে হয়?
আল্লাহপাক আমাদের সবুর করতে বলেছেন।
ভালো কথা, সবুর করেন। আপনার ছোট ভাইয়ের কোনো খবর পেয়েছেন? শাহেদ না তার নাম?
জি তার নাম শাহেদ। না, কোনো খবর এখনো পাই নাই।
এটা নিয়েও নিশ্চয়ই আপনার মনে কোনো দুশ্চিন্তা নাই? সবই আল্লাহর ইচ্ছায় হচ্ছে, তাই না?
ইরতাজউদ্দিন বললেন, আপনার মনটা মনে হয় আজ ভালো নাই।
মনসুর সাহেব জবাব দিলেন না। মন ভালো আছে–এই কথা প্ৰিয়জনদের জানাতে ইচ্ছা করে। মন ভালো নাই–এই খবর ঢোল পিটিয়ে দিতে ইচ্ছা করে না।
মাওলানা সাহেব!
জি।
কনফুসিয়াসের নাম শুনেছেন?
জি-না।
বিখ্যাত চীনা দার্শনিক। তিনি পাঁচটি সম্পর্কের কথা বলেছেন। পাঁচটি অতি গুরুত্বপূর্ণ সম্পর্ক। এই পাঁচটা সম্পর্ক কী, জানতে চান?
ইরতাজউদ্দিন উসখুসি করছেন। আসরের নামাজের সময় হয়ে গেছে। আসরের নামাজের সময় অল্প। পাঁচ সম্পর্কের কথা যদি হেডমাস্টার সাহেব ব্যাখ্যা করে বলা শুরু করেন, নামাজের সময় পার হয়ে যেতে পারে। নীলগঞ্জ থানার ওসি সাহেবের স্ত্রী খবর পাঠিয়েছেন। খুব নাকি জরুরি প্রয়োজন। সেখানেও যেতে হবে। তার সঙ্গে জরুরি প্রয়োজনটা কী তিনি বুঝতে পারছেন না!
মাওলানা সাহেব শুনেন, পাঁচটা সম্পর্ক হচ্ছে শাসকের সঙ্গে প্রজার সম্পর্ক। স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক। পিতা-পুত্র সম্পর্ক। বড়ভাই-ছোটভাই সম্পর্ক এবং বন্ধুর সঙ্গে বন্ধুর সম্পর্ক। বুঝতে পেরেছেন?
জি বুঝতে পেরেছি। কিন্তু হঠাৎ করে সম্পর্কের ব্যাপারটা আমাকে কেন বললেন, সেটা বুঝলাম না।
আপনাকে বললাম। কারণ পাঁচটা সম্পর্কের কোনোটাই আমার সঙ্গে সম্পর্কিত না। পাকিস্তানি শাসকের সঙ্গে প্ৰজা হিসাবে আমার কোনো সম্পর্ক নাই। স্ত্রীর সঙ্গে সম্পর্ক নাই। আমার কোনো ছেলে নাই যে পিতা-পুত্রের সম্পর্ক হবে। আমার কোনো ভাই নাই, বন্ধুও নাই।
ইরতাজউদ্দিন শান্ত গলায় বললেন, বন্ধু কি নাই?
হেডমাস্টার সাহেব সঙ্গে সঙ্গে বললেন, বন্ধু আছে। আপনি আছেন। আপনার কথাটা মনে ছিল না। খুব কাছাকাছি যারা থাকে, তাদের কথা মনে থাকে না।,
নামাজের সময় হয়ে গেছে, উঠি? বলতে বলতে ইরতাজউদ্দিন উঠে দাঁড়ালেন।
জয়নামাজে দাঁড়ানোর পর জাগতিক সব চিন্তা-ভাবনা মাথা থেকে দূর করতে হয়। বেশিরভাগ সময়ই এই কাজটা তিনি পারেন। আজ পারলেন না। কনফুসিয়াস নামের চীনা দার্শনিকের কথা মাথায় ঘুরতে লাগল। সূরা ফাতেহা পড়ার সময়ই তাঁর মনে হলো কনফুসিয়াস ভুল করেছেন। আসল দুটা সম্পর্ক বাদ দিয়ে গেছেন। মাতা-পুত্র সম্পর্ক, মাতা-কন্যা সম্পর্ক। তিনি কি ইচ্ছা করে এই ভুলটা করেছেন? না-কি ভুলটা অজান্তে হয়েছে? মার সঙ্গে কি তাঁর সম্পর্ক ভালো ছিল না?
ইরতাজউদিনের নামাজে গণ্ডগোল হয়ে গেল। তিনি আবারো শুরু থেকে নামাজ শুরু করলেন। এইবার তার মাথায় ওসি সাহেবের স্ত্রীর কথা চলে এলো। মহিলার নাম তিনি জানেন। নামটা এখন মনে পড়ছে না।
নামাজে দাড়ানোর অর্থ আল্লাহপাকের সামনে দাড়ানো। আল্লাহপাকের সামনে দাঁড়িয়ে একজন মহিলার নাম মনে করার চেষ্টা আল্লাহপাকের সঙ্গে বেয়াদবি করার চেয়ে বেশি। ইরতাজউদ্দিন প্ৰাণপণ চেষ্টা করছেন নাম মনে না। করার। লাভ হচ্ছে না। মাথার মধ্যে ঘুরছে–কী যেন নাম? কী যেন নাম? ফলের নামে নাম। ফলটাি কী? আঙ্গুর, বেদােনা? নামের মধ্যে কি আছে। কি নাম দিয়ে যে ফল, তার মনে পড়ছে। সেই নাম কেউ রাখবে না–কলা। তাহলে নামটা কী?
এদিকে ছগির সাহেবও খুব হৈচৈ শুরু করেছেন। কালিপদ বাবুর মন্ত্রী খাওয়ার পরেও তিনি হেরে গেছেন। আসলে মন্ত্রী খেতে গিয়েই ভুলটা হয়েছে। মন্ত্রী ছিল টোপ। তিনি বোকার মতো টোপ গিলেছেন। টোপ গিলে ফেসে গেছেন। ছগির সাহেব চেচাচ্ছেন, আপনি যা করেছেন তার নাম ভাওতাবাজি। ভাওতাবাজি খেলা না।
কালিপদ বাবু বললেন, ভাওতাবাজি কী করলাম?
ভাওতাবাজি কী করেছেন, বুঝেন না? হিন্দু জাতটাই ভাওতাবাজির জাত। মিলিটারি যে ধরে ধরে নুনু কেটে মুসলমান বানায়ে দিচ্ছে, ভালো করছে। আপনার যন্ত্রও কাটা দরকার।
এটা কী রকম কথা?
অতি সত্যি কথা। ভাওতাবাজির খেলা আমার সঙ্গে খেলবেন না। বুঝেছেন?
আমার সঙ্গে যদি খেলতে চান স্ট্রেইট খেলবেন।
আমি তো খেলতে চাই না, আপনিই জোর করে খেলতে বসান।
আমি জোর করে খেলতে বসাই?
অবশ্যই।
আপনি যে শুধু ভাওতাবাজ তা-না, আপনি মিথ্যাবাদী নাম্বার ওয়ান।
আমি মিথ্যাবাদী?
শাটআপ।
চিৎকার করছেন কেন?
আবার কথা বলে? শাটআপ মালাউন।
ইরতাজউদ্দিন নামাজ শেষ করে কমনরুমে এসে দেখেন, দুজনের ঝগড়া মিটমাট হয়ে গেছে। তারা আবারো দাবা খেলতে বসেছেন। কনফুসিয়াসের কথা হয়তোবা সত্যি। বন্ধুত্বের সম্পর্ক গুরুত্বপূর্ণ সম্পর্ক। ভাই এবং বোন পাওয়া যেমন ভাগ্যের ব্যাপার, বন্ধু পাওয়াও ভাগ্যের ব্যাপার।
ওসি সাহেবের স্ত্রী ইরতাজউদ্দিনকে চমকে দিয়ে কদমবুসির জন্যে নিচু হলো। ইরতাজউদ্দিন খুবই বিব্রত হলেন। ঠিক তখনই মেয়েটির নাম তাঁর মনে পড়ল। কমলা।
ইরতাজউদ্দিন বললেন, মাগো, মাথা নিচু করে সালাম করা ঠিক না। মানুষ একমাত্র আল্লাহপাক ছাড়া আর কারো কাছেই মাথা নিচু করবে না। এটাই আব্দুল্লাহপাকের বিধান।
কমলা নরম গলায় বলল, এইসব বিধান আপনাদের মতো জ্ঞানীদের জন্যে। আমার মতো সাধারণদের জন্যে না। আমি একটা স্বপ্ন দেখেছি। স্বপ্নের বিষয়ে কথা বলার জন্যে আপনাকে ডেকেছি।
স্বপ্নের তাফসির করার মতো যোগ্যতা আমার নাই। তারপরেও বলো শুনি কী স্বপ্ন দেখেছি। স্বপ্নটা কখন দেখেছ?
ভোররাত্রে। স্বপ্ন দেখে ঘুম ভাঙার পরে পরেই মোরগের বাগ শুনেছি। স্বপ্নে দেখলাম, বড় একটা মাঠ। মাঠ ভর্তি কাশফুল ফুটেছে। আমি মনের আনন্দে ছোটাছুটি করতেছি। এক সময় ছোটাছুটি বন্ধ করে বিশ্রামের জন্যে বসলাম। তখন দেখি, আমার শাড়ি ভর্তি হয়ে গেছে চোরকাটায়। আমি অবাক হয়ে ভাবতেছি, কাশীবনে চোরকাটা আসল কীভাবে? তারপর চোরকাটা বাছতে বসলাম। একটা চোরকাটা তুলি, সঙ্গে সঙ্গে সেই জায়গা থেকে এক ফোটা রক্ত পড়ে। দেখতে দেখতে শাড়ি ভর্তি হয়ে গেল রক্তে। এই হলো স্বপ্ন। স্বপ্ন দেখার পর থেকে খুব অস্থির লাগতেছে।
ইরতাজউদ্দিন বললেন, স্বপ্ন দেখে অস্থির হওয়ার কিছু নেই। সন্তানসম্ভব। মায়েরা ভয়ের মধ্যে থাকে। সেই ভয় থেকে তারা দুঃস্বপ্ন দেখে।
এইটা ছাড়া আর কিছু নাই?
অনেক সময় আল্লাহপাক স্বপ্নের মাধ্যমে মানুষকে সাবধান করেন। তবে তিনি সংবাদ পাঠান রূপকের মাধ্যমে। সেই রূপকের অর্থ উদ্ধার করা কঠিন। আমার এত জ্ঞান নাই। আমি মুর্থ কিসিমের মানুষ।
চাচাজি, আজ রাতে আমার এখানে খাবেন।
মাগো, আজ বাদ থাকুক।
জি-না, আজ আপনি খাবেন। আজ আমার একটা বিশেষ দিন।
বিশেষ দিনটা কী? আজ কি তোমার বিবাহের দিন?
কমলা জবাব না দিয়ে মাথা নিচু করে হাসল। ইয়তাজউদ্দিন বললেন, আমি অবশ্যই তোমার এখানে খানা খেতে আসব।
নীলগঞ্জ থানার ওসি ছদারুল আমিন তার বাসার সামনে মোড়ায় বসে। আছেন। তিনি অসম্ভব ক্ষুধার্তা। ক্ষুধার কথা বলতে পারছেন না, কারণ তাঁর স্ত্রী প্রসবব্যথায় সকাল থেকে ছটফট করছে। অবস্থা মোটেই ভালো না। প্রথম পোয়াতি, সমস্যা হবে জানা কথা। এই পর্যায়ের হবে ছদরুল আমিন বুঝতে পারেননি। বুঝতে পারলে স্ত্রীকে অবশ্যই তার বাপের বাড়িতে রেখে আসতেন। ডাক্তার কবিরাজ নিয়ে ছোটাছুটি যা করার তারাই করত। তিনি যথাসময়ে টেলিগ্রাম পেতেন–
A boy
Congratulations.
তিনি মিষ্টি নিয়ে শ্বশুরবাড়িতে উপস্থিত হতেন। তা না করে বেকুবের মতো স্ত্রীকে নিজের কাছে রেখে দিয়েছেন। এখন ম্যাও সামলাতে পারছেন না। নান্দিনায় একজন এমবিসিএস ডাক্তার আছেন। তাকে আনতে গতকাল একজন কনষ্টেবল পাঠিয়েছিলেন। ডাক্তার আসে নি, কনষ্টেবিলও আসে নি। ছদরুল আমিনের ধারণা, কনষ্টেবল নান্দিনা না গিয়ে বাড়ি চলে গেছে। হুকুম বলে এখন আর কিছু অবশিষ্ট নেই। যে যার মতো কাজ করছে। থানায় দশজন কনষ্টেবল, একজন সেকেন্ড অফিসার এবং একজন জমাদার থাকার কথা। আছে মাত্র চার জন। তারা কোনো ডিউটি করছে না। দিনরাত ঘুমুচ্ছে। আরামের ঘুম। থানার ওসিকে দেখে লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে স্যালুট করবে–তাও কেউ করছে না। বিছানায় পাশ ফিরে হাই তুলছে।
থানা হাজতে তিনটা ডাকাত আছে। পনেরো দিন ধরে। হারুন মাঝি আর তার দুই সঙ্গী। এদের নিয়ে কী করা যায় তাও বুঝতে পারছেন না। হারুন মাঝি ভয়াবহ ডাকাত। দিনকাল ঠিক থাকলে হারুন মাঝিকে ধরার জন্যে পাকিস্তান পুলিশ মেডেল পেয়ে যেতেন। এখন যা পাচ্ছেন তার নাম যন্ত্রণা। এদের সদরে পাঠাতে পারছেন না। নিজের বাড়ি থেকে রান্না করে খাওয়াতে হচ্ছে। সবচে ভালো হতো, যদি হারুন মাঝিকে ছেড়ে দিয়ে তিনি তার স্ত্রী নিয়ে শ্বশুরবাড়ি চলে যেতেন। দেশ ঠিকঠাক হলে আবার ফিরে আসা। দেশটা এখন কোন অবস্থায় আছে কিছুই বুঝতে পারছেন না। না পাকিস্তান, না বাংলাদেশ।
এইভাবে তো মানুষ বাঁচতে পারে না। সম্পূর্ণ অরাজক অবস্থায় বাঁচে বনের পশুপাখি। তাদের থানা নেই, কোট-কাঁচারি নেই। মানুষের আছে।
ওসি সাহেবের বাসা থানা কম্পাউন্ডের ভেতরে। থানা কম্পাউন্ডের ভেতরে বাইরের মহিলারা আসেন না। থানাকে ভয় ও সন্দেহের চোখে দেখা হয়। ছদরুল আমিন সাহেবের ভাগ্য ভালো, দুজন মহিলা এখন তার স্ত্রীর দেখাশোনা করছেন। একজন হলেন হাজী সাহেবের স্ত্রী। অন্যজন ধাই— সতী। সতী এই অঞ্চলের এক্সপার্ট ধাই। তার উপর ভরসা করা যায়। হাজী সাহেবের স্ত্রী বয়স্ক মহিলা। এদের উপরও ভরসা করা যায়। বয়স্ক মহিলারা অভিজ্ঞতা দিয়ে অনেক সমস্যা সমাধান করতে পারেন।
ছদরুল আমিন তেমন ভরসা করতে পারছেন না। সকাল থেকে তার মনে কু ডাক ডাকছে। মনে হচ্ছে ভয়ঙ্কর কিছু ঘটে যাবে। সেই ভয়ঙ্করটা কি স্ত্রীর মৃত্যু? এ চিন্তা মাথায় এলেই শরীর নেতিয়ে যাচ্ছে। গলা শুকিয়ে যাচ্ছে। দুশ্চিন্তাগ্রস্ত মানুষের ক্ষুধাবোধ তীব্ৰ হয়। ছদরুল আমিন ক্ষিধের কষ্টেই এখন বেশি কষ্ট পাচ্ছেন। ঘরে চিড়-মুড়ি আছে। গুড় আছে। কাউকে বললে এনে দেয়, কিন্তু কাউকে বলতে লজ্জা লাগছে। স্ত্রীর এখন-তখন অবস্থা আর তিনি ধামা ভর্তি গুড়মুড়ি নিয়ে বসেছেন, তা হয় না।
স্ত্রীর পাশে গিয়ে কিছুক্ষণ বসতে ইচ্ছা করছে। বেচারি নিশ্চয়ই ভয়ে অস্থির হয়ে আছে। এরকম অবস্থায় মা-খালারা পাশে থাকেন। তার কেউ নেই। স্বামী হাত ধরে পাশে বসে থাকলে অনেকটা ভরসা পেত। তাও সম্ভব না। এই অঞ্চলের নিয়মকানুন কড়া–আতুরঘরে পুরুষ মানুষের প্রবেশ নিষেধ। নবজাত শিশু নিয়ে মা আতুরঘর থেকে অন্য ঘরে যখন যাবেন, তখন শুধু পুরুষরা যেতে পারবে। তার আগে না। তাঁর একবার মনে হচ্ছে, নিয়মের গুষ্ঠি কিলাই। বসি কমলার পাশে। গতকাল রাতে বড় লজ্জা পেয়েছেন। পোলাও কোরমা দেখে অবাক হয়ে বলেছেন, ঘটনা। কী? কমলা কিছু বলে নি। শুধু হেসেছে। ইরতাজউদ্দিন দাওয়াত খেতে আসার পর জানতে পারলেন, আজ তাদের বিবাহ বার্ষিকী। এই তারিখ ভুলে যাওয়া খুবই অন্যায় হয়েছে।
ছদরুল আমিন সিগারেট ধরালেন। খালি পেটে সিগারেট ধরানোর জন্যে সারা শরীর গুলিয়ে উঠল। মনে হলো বমি হয়ে যাবে। হাজী সাহেবের স্ত্রী বের হলেন। এই মহিলাও হাজী। স্বামীর সঙ্গে হজ করে এসেছেন। তার প্রমাণ হিসেবে সব সময় আলখাল্লার মতো একটা বোরকা পরেন। বোরকা পরলেও ভদ্রমহিলা আধুনিক। পুরুষদের সঙ্গে কথা বলেন। নীলগঞ্জের অন্য মেয়েদের মতো পুরুষ দেখলেই পালিয়ে যাবার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়েন না কিংবা শক্ত খাম্বার মতো হয়ে পড়েন না।
ভদ্রমহিলা ছদরুল আমিনের দিকে তাকিয়ে শক্ত গলায় বললেন, গতিক ভালো না। আল্লাহর নাম নেন। কলসহাটির মৌলানা সাবের কাছ লোক পাঠান উতার-এর জন্যে। উতার দিয়া নাভি ধুইতে হবে।
উতারটা কী?
পানি পড়া। কলসহাটির মৌলানা সাবের উতার হইল শেষ চিকিৎসা। তাড়াতাড়ি পুলিশ পাঠাইয়া দেন।
জি আচ্ছা।
ছদরুল আমিন থানার দিকে রওনা হলেন। টিপ টপ করে বৃষ্টি পড়ছে। আকাশ মেঘলা। সবকিছুই কেমন আধাখেচড়া। বৃষ্টি হলে ঝমঝমিয়ে হবে, আকাশ হবে ঘন কালো।
হাজতঘরের দরজায় ঘটাং ঘটাং শব্দ হচ্ছে। ছদারুল আমিনকে দেখে হারুন মাঝি তার ধবধবে সাদা দাঁত বের করে বলল, ওসি সাব, ভুখ লাগছে। খানা দিবেন না? কাইল খাইলাম পোলাও কোরমা। আইজ খালি পানি।
হারুন মাঝি হেসে ফেলল। তার গায়ের রঙ কুচকুচে কালো। সুন্দর মায়া কাড়া চেহারা। এই লোক ঠাণ্ডা মাথায় দশ-বারোটা খুন করেছে ভাবাই যায় না। ছদরুল আমিন বললেন, ঘরে অসুবিধা আছে। পাক হয় নাই।
না খাইয়া থাকমু? চিড়া-মুড়ির ব্যবস্থা করেন।
চিড়া-মুড়ির ব্যবস্থা অবশ্যি করা যায়। সেটাই ভালো হয়। তিনি খানিকটা খেয়ে নেবেন। উতারের জন্যেও কাউকে পাঠাতে হবে। তিনি আশপাশে কোনো কনষ্টেবল দেখলেন না। কী দিন ছিল আর কী দিন হয়েছে। আগে চব্বিশ ঘণ্টা সেন্ট্রি ডিউটি থাকত। ঘন্টায় ঘণ্টায়। ঘণ্টি পিটে সময় জানানো হতো। গ্রামের মানুষ থানা-ঘন্টি শুনে সময় বুঝত। আজ কিছুই নেই। ছদরুল আমিন থানার বারান্দায় এসে দাঁড়ালেন–আর তখনি চোখে পড়ল দুটা জিপ আর তিনটা ট্রাক আসছে। আস্তে আস্তে আসছে। রাস্তা ভালো না–দ্রুত আসার উপায়ও নেই। তার বুক ধ্বক করে উঠল— মিলিটারি। আসছে! ইয়া গফরুর রহিম-মিলিটারি।
মিলিটারি কনভয় নিয়ে যাচ্ছিলেন পাঞ্জাব রেজিমেন্টের মেজর মোশতাক। তার গন্তব্য ভৈরব। হঠাৎ তাকে বলা হলো ভৈরব না গিয়ে নীলগঞ্জ থানায় হল্ট করতে। কারণ কিছুই ব্যাখ্যা করা হলো না। ওয়ারলেসের সংক্ষিপ্ত ম্যাসেজ। পথে কোনো ঝামেলা হয়তো আছে। ছোটখাটো ঝামেলা তৈরি হচ্ছে। গুরুত্বহীন ঝামেলা। অতি উৎসাহী কিছু ছেলে।পুলে মিলিটারি কনভয় দেখে থ্রি নট থ্রি রাইফেলে গুলি ছুঁড়ে বসল। হাস্যকর কাণ্ড তো বটেই। হাস্যকর কাণ্ডগুলোর ফলাফল মাঝে মাঝে অশুভ হয়। তবে এখনো তার ইউনিটে কিছু হয় নি। বাঙালি সেনাবাহিনী বিদ্রোহ করেছে বলে শোনা যাচ্ছে। সরাসরি যুদ্ধে নেমে পড়েছে এমন খবর নেই। তাদের কাছে অস্ত্রশস্ত্ৰও নেই। অন্ত্রের সমস্যা তারা অবশ্যি মিটিয়ে ফেলতে পারবে। গায়ের সঙ্গে গা লেগে আছে হিন্দুস্থান। পাকিস্তানকে একটা শিক্ষা দেবার জন্যে ১৯৪৭ সাল থেকেই তারা খাপ ধরে বসে আছে। এই তাদের সুযোগ। মুর্থ বাঙালি বোঝে না হিন্দুস্থান আসলে কী চায়। তারা পূর্ব পাকিস্তান গিলে খেতে চায়। তবে সেই সুযোগ তারা পাবে না। উচিত শিক্ষা তাদের দেয়া হবে। সেই সঙ্গে উচিত শিক্ষা দেয়া হবে বদমাশ বাঙালিদের।
প্রবল ঝাকুনি খেয়ে মেজর মোশতাকের জিপ থেমে গেল। তিনি জানালা দিয়ে বিরক্তমুখে গাড়ির চাকা দেখার চেষ্টা করলেন। বোঝাই যাচ্ছে চাকা পাংচার হয়েছে। মিনিট দশেক সময় নষ্ট হবে। চলন্ত কনভয়ের কাছে মিনিট দশোক সময় অনেক সময়। এই সময়ে বড় ধরনের অঘটন ঘটে যেতে পারে। দেশে গেরিলা একটিভিটিজ নেই। যদি থাকত তিনি তার বাহিনীকে গাড়ি থেকে নামিয়ে সতর্ক অবস্থায় নিয়ে যেতেন। এখন তেমন সাবধানতা গ্রহণের সময় আসে নি। দরিদ্র একটা অঞ্চলের কাঁচা রাস্তা। দুপাশে ধানক্ষেত। ভয়ের কিছুই নেই। মেজর সাহেব জিপ থেকে নেমে গাড়ির চাকার বদল দেখতে লাগলেন। গরমে শরীর ঘেমে যাচ্ছে। নীলগঞ্জ থানায় রাত কাটাতে হলে একটা শাওয়ার নেবার ব্যবস্থা করতে হবে।