What's new
Nirjonmela Desi Forum

Talk about the things that matter to you! Wanting to join the rest of our members? Feel free to sign up today and gain full access!

Collected ছোছনা ও জননীর গল্প - উপন্যাস (3 Viewers)

কলিমউল্লাহ ইজিচেয়ারে শুয়ে আছে। তার মাথার উপরে ফ্যান ঘুরছে। সে কবিতা লেখার চেষ্টা করছে। প্রথম লাইনটা চট করে মাথায় এসে গেছে। লাইনটা খারাপ না–

একটি ধবল বক এক একা উড়িতেছিল বাংলার করুণ আকাশে।

সে করুণ শব্দটা কাটল। করুণ আকাশ মানেই জীবনানন্দ। কারুণের জায়গায় বসালে মেঘলা। এই শব্দটা ভালো লাগছে না। মেঘলা আকাশ, মেঘলা আকাশ লিখে লিখে মেঘলা শব্দটাকে সবাই পচিয়ে ফেলেছে। মেঘলা কেটে সে লিখলা রূপালি। কবিতার বাকি কয়েক পঙক্তি সে দ্রুত লিখে ফেলল।

একটি ধবল বিক একাকী উড়িতেছিল বাংলার রূপালি আকাশে
সঙ্গিনী তার, মরিয়া গেছে বহুকাল বহুকাল আগে।
সঙ্গিনীর দীর্ঘশ্বাস বার মাস বকের পাখায় লাগে
উড়িতে পারে না সে, সঙ্গিনীর নিঃশ্বাসের ভারে,
সে বড় ক্লান্ত হয়
খুঁজে ফিরে ডানা দুটি মেলিবার নিশ্চিন্ত আশ্রয়।

কবিতা লেখার খুব আবেগ এসে গেছে। বাকি লাইনগুলি কিউ-এর মতো একজনের পিছনে একজন দাঁড়িয়ে আছে। তারা ঠেলা ঠেলিও করছে। এমন সময় হেলাল সাহেব ঘরে ঢুকে বললেন, মেজর সাহেব এসেছেন, আপনাকে ডাকেন।

সঙ্গে সঙ্গে কবিতা লেখা বন্ধ করে উঠে চলে গেলে মনে হবে সেও মিলিটারির ভয়ে আধমরা। এটা করা যাবে না। কলিমউল্লাহ হাতের ইশারা করল। যাতে মনে হয় সে বলছে, এখন লেখালেখি করছি। এই সময় বিরক্ত করা যাবে না। পরে আসুন।

ইশারার পরেও হেলাল সাহেব। আবারো বললেন, স্যার আপনাকে ডাকেন।

কলিমউল্লাহ এমন ভাব করে উঠল যেন সে খুবই বিরক্ত হচ্ছে লেখার মাঝখানে উঠতে হয়েছে বলে।

মেজর সাহেব তাকে দেখেই বললেন, Hello poet!

কলিমউল্লাহ বিনয় এবং লজ্জায় (লজ্জাটা অভিনয়) নিচু হয়ে গেল।

মেজর সাহেব বললেন, কী করছিলে? (কথাবার্তা হচ্ছে উর্দুতে। কাজ চালাবার মতো উর্দু এখন কলিমউল্লাহ বলতে পারে।)

পাকিস্তানকে নিয়ে একটা কবিতা লিখছিলাম স্যার।

ভালো। খুব ভালো। A poet in action.

স্যারের শরীরটা কি খারাপ?

আমাকে দেখে কি মনে হচ্ছে শরীর খারাপ?

ইয়েস স্যার। (মেজর সাহেবের চেহারা দেখে শরীর খারাপ মোটেই মনে হচ্ছে না। তারপরেও কলিমউল্লাহ এই ধরনের কথা বলে, যাতে উনি মনে করেন মানুষটা তাঁর শরীর স্বাস্থ্য নিয়ে চিন্তিত।)

আমার শরীর ঠিকই আছে। মন সামান্য অস্থির। যুদ্ধাবস্থায় মন অস্থির থাকবে এটাই স্বাভাবিক।

যুদ্ধ কোথায় দেখলেন স্যার? পাটকাঠি দিয়ে যুদ্ধ হয় না। স্যারকে চা দিতে বলি?

না, চা খাব না। তুমি কি কিছু বাড়তি পয়সা রোজগার করতে চাও? তোমাকে আমি কাজ দিতে পারি।

স্যার, আপনার কোনো কাজের জন্যে অন্যরা পয়সা নিলে নিতে পারে। আমি কীভাবে নিব?

মেজর সাহেব বললেন, কাজ করে পয়সা নিবে। এমন এক কাজ যাতে দেশের সেবা হয়। শক্রর বিরুদ্ধে যুদ্ধ।

কলিমউল্লাহর শরীর ঠাণ্ডা হয়ে গেল। ব্যাটা বলে কী? যুদ্ধে যাব মানে? ছোটবেলায় গুলতি দিয়ে এক ছেলের মাথায় টং করে মার্বেল মেরেছিল। তার যুদ্ধ এই পর্যন্তই। বন্দুক দূর থেকে দেখেছে, হাত দিয়ে এখনো ছুঁয়ে দেখে নি। কলিমউল্লাহ ভােবল বলে–সব পারব স্যার, শুধু যুদ্ধটা পারব না। আমরা শাহ বংশ। শাহ বংশে মানুষ মারা নিষেধ! যা ভেবেছিল শেষ পর্যন্ত তা বলল না। মেজর সাহেব বললেই তো বন্দুক কাধে নিয়ে রওনা হতে হবে না। হাতে সময় আছে। সে বলল, জনাব। আপনি যা করতে বলবেন, আমি তাই করব। যুদ্ধ কী আমি জানি না। বন্দুক হাত দিয়ে ছুঁয়ে দেখি নাই। কিন্তু আপনি বললে বন্দুক নিয়ে শক্রর মোকাবিলা করব। আল্লাহর কীরা, আমাদের নবিজীর কীরা।

মেজর সাহেব বললেন, যুদ্ধ মানেই যে বন্দুক নিয়ে গোলাগুলি তা তো না। যুদ্ধের অনেক ধরন আছে। এই যে আমি পত্রিকা অফিস, রেডিও-টেলিভিশন অফিসে ছোটাছুটি করছি এইটাও যুদ্ধ। তোমাকে আমি একজনের ঠিকানা দেব। তাকে আমি তোমার কথা বলেছি, সে তোমাকে কাজ দিবে।

আলহামদুলিল্লাহ। আপনি ঠিকানা লিখে দেন। আমি আজই উনার কাছে যাব। উনার নাম কী?

তার নাম জোহর। পূর্ণিয়া জেলায় বাড়ি! খুব পড়াশোনা জানা লোক। তুমি যেমন কবিতা লেখ, সেও কবিতা লেখে।

বলেন কী? স্যার, আপনি আমাকে একটা চিঠি লিখে দেন। চিঠি নিয়ে উনার সঙ্গে দেখা করব।

চিঠি ফিটি কিছুই লাগবে না। তুমি তোমার নাম বলবে তাতেই হবে।

আপনার নাম কি স্যার বলব? আপনি পাঠিয়েছেন এটা বলব?

কিছু বলতে হবে না।

মেজর সাহেব উঠে দাঁড়ালেন। অন্য কোথাও যাবেন। কলিমউল্লাহ বলল, স্যার, এক কাপ চা খেয়ে যান। আপনার সঙ্গে চা খাব বলে আমি এখনো চা খাই নাই।

মেজর সাহেব। আবারো বসলেন। কলিমউল্লাহ ছুটে গেল চা আনতে।
 
জোহর সাহেবকে দেখে কলিমউল্লাহর আশাভঙ্গ হলো। সে ভেবেছিল জোহর সাহেব খুবই গুরুত্বপূর্ণ একজৎ, ব্যক্তি। তার চালচলন হাবভাব গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির মতো হবে। চেহারা ও কাজের গুরুত্বের সঙ্গে মানানসই হবে। কথায় আছে–পহেলা দর্শনধারি।

বাস্তবের জোহর সাহেব আধাবুড়া একজন মানুষ। মাথার চুল কালো ঠিক আছে, মুখভর্তি সাদা খোচা খোচা দাড়ি। চোখের নিচে কালি। চোখ গর্তে ঢুকে আছে। সেই চোখ। আবার গাজাখোরদের চোখের মতো লাল। এই গরমেও তার গায়ে চাদর। চাদরটা আধময়লা। লোকটা চেয়ায়ে পা তুলে বসে আছে। যেকোনো কাবাবের দোকানের এসিসটেন্ট হলে তাকে মানাত। কাবাবের মতোই আগুনে ঝলসানো চেহারা।

কলিমউল্লাহ বলল, মেজর সিদিক সাহেব আপনার কাছে আমাকে পাঠিয়েছেন।

জোহর সাহেব তার দিকে না তাকিয়ে শুদ্ধ বাংলায় বলল, আচ্ছা।

কলিমউল্লাহ বুঝতে পারল না এখন সে কী করবে। জোহর সাহেবের সামনের কাঠের চেয়ারটা টেনে বসবে? না-কি দাঁড়িয়েই থাকবে? জানালা বন্ধ ছোট্ট একটা ঘর। খালি চেয়ার বলতে একটাই, সেটাও অনেকটা দূরে। দুজন লোক বসলে বসবে মুখোমুখি। একজন এক কোনায় অন্য আরেকজন আরেক কোনায় বসবে না-কি! কে জানে হয়তো জোহর সাহেবের সঙ্গে কথা বলার নিয়মই এই। ঘরে সিগারেটের কটু গন্ধ। কলিমউল্লাহ নিজে সিগারেট খায়। তারপরেও সিগারেটের গন্ধে তার বমি এসে যাচ্ছে। ]

কলিমউল্লাহ বলল, মেজর সাহেব বলেছেন, আপনি একজন কবি। আপনাকে দেখার শখ ছিল।

জোহর বলল, আপনার ডানদিকে সুইচ আছে। সুইচটা জেলে দেন। ঘর আলো হোক। তারপর আমাকে ভালোমতো দেখেন।

কলিমউল্লাহ মনে মনে বলল, তুমি তো বাবাজি ত্যান্দির আছ। নিজেরে কি ভাবতেছ, টিক্কা খান?

মনের কথা কেউ শুনতে পায় না–এটা বিরাট সুবিধার একটা বিষয়! কলিমউল্লাহ বাতি জ্বালাতে জ্বালাতে বলল, স্যার, আমি কি চেয়ারটা এনে আপনার সামনে বসব?

জোহর বলল, আচ্ছা বসুন।

স্যার, আমি নিজেও একজন কবি। টুকটাক কবিতা লেখি। ইদানীং গদ্য লেখার চেষ্টা করছি।

ভালো। ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী গদ্যময়। যুদ্ধের রাজ্যে পৃথিবী কী?

কলিমউল্লাহর মুখে চট করে কোনো উত্তর এলো না। এই বিহারি কাবাবওয়ালা সুকান্তের কবিতা জানে–খুবই আশ্চর্যের কথা। মেজর সাহেব অবশ্যি বলেছিলেন পড়াশোনা জানা লোক। সে চেয়ার টেনে জোহর সাহেবের সামনে বসতেই জোহর সাহেব বললেন, আপনি আরেকদিন আসুন। আজ আমার শরীরটা ভালো না।

কলিমউল্লাহ। সঙ্গে সঙ্গে বলল, জি আচ্ছা। স্যার, কবে আসব?

যে-কোনো দিন আসতে পারেন। আমি এই ঘরেই বেশিরভাগ থাকি। গর্তজীবী হয়ে গেছি।

স্যার তাহলে যাই। স্নামালিকুম।

ওয়ালাইকুম সালাম। আপনার সঙ্গে কাগজ-কলম আছে?

কলিমউল্লাহ উৎসাহের স্বরে বলল, জি স্যার আছে, আমি সবসময় সঙ্গে কাগজ-কলম রাখি।

একটা ঠিকানা লেখেন।

কলিমউল্লাহ ঠিকানা লিখল। জোহর সাহেব বললেন, ঠিকানাটা একজন পুলিশ ইন্সপেক্টরের বাসার, নাম মোবারক হোসেন।

স্যার, আমি কি উনার সঙ্গে দেখা করব?

উনার সঙ্গে দেখা করা সম্ভব হবে না। উনি পঁচিশে মার্চের রাতে মারা গেছেন। আপনি উনার পরিবারের লোকজনদের সঙ্গে দেখা করবেন। ইন্সপেক্টর সাহেব যে মারা গেছেন–এই সংবাদ সম্ভবত তার পরিবারের লোকজন জানে না।

স্যার, আমি কি সংবাদটা তাদের দিব?

আপনাকে কোনো সংবাদ দিতে হবে না! ইন্সপেক্টর সাহেবের ফ্যামিলি কেমন আছে, তাদের কোনো সমস্যা আছে কি-না–এটা জেনে আসবেন। আমি এই পরিবারের জন্যে কিছু করতে চাই। ইন্সপেক্টর সাহেব একজন খাঁটি মানুষ ছিলেন। ভেজাল মানুষের যুগে খাঁটি মানুষ পাওয়া মুশকিল। দুএকটা খাঁটি মানুষ যখন দেখি, তখন ভালো লাগে।

স্যার, আপনার কথা কি উনাদের বলব?

আমার কথা বলার কোনো দরকার নাই। কলিমউল্লাহ সাহেব?

জি স্যার?

আপনি কেমন মানুষ? খাঁটি মানুষ, না ভেজাল মানুষ?

আমি স্যার ভেজাল।

ঠিক আছে আমাদের ভেজাল মানুষই দরকার। এখন যান।

স্যার স্লামালিকুম।

জোহর সাহেব সালামের জবাব না দিয়ে সিগারেট ধরালেন।

কলিমউল্লাহ মনে মনে বলল, শালা কাবাবওয়ালা!

হ্যালো কবি, মনে মনে কী ভাবছ?

কলিমউল্লাহ চমকে উঠল। এই শালা কি মনের কথা বুঝতে পারে? বিচিত্র কিছু না। পৃথিবীতে নানান কিসিমের মানুষ আছে। কলিমউল্লাহ বিনীত ভঙ্গিতে বলল, স্যার আমি কিছু ভাবছি না। কবিতার একটা লাইন মাথায় এসেছে। ঐটা নিয়ে নাড়াচাডা করছি।

বেশি নাড়াচাড়া করবেন না। ভেঙে যেতে পারে।

জি আচ্ছা স্যার।

বিদায় হন। ক্লিয়ার আউট।

জি আচ্ছা স্যার।
 
শিউলি গাছে আশ্বিন কার্তিক মাসে ফুল ফুটবে। এইটাই নিয়ম। কদম গাছে ফুল ফুটবে আষাঢ়ের পূর্ণিমায়, শিমুল ফুটবে চৈত্র দিনের উত্তাপে। অথচ মরিয়মদের বাড়ির সামনের শিউলি গাছে চৈত্র মাসে ফুল ফুটেছে। গাছের একটা ডাল দোতলার বারান্দায় এসেছে। ডাল-ভর্তি ধবধবে সাদা ফুল। গাছটার কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে? মানুষের মাথা খারাপ হতে পারলে গাছের হবে না কেন? গাছেরাও তো জীবন আছে।

চৈত্র মাসে শিউলি গাছে ফুল–এই খবরটা মাসুমাকে দিতেই সে বলল, ফুটুক। মরিয়ম বলল, আয় দেখে যা। মাসুমা বলল, বুরু, আমার ফুল দেখার শখ নাই।

সাফিয়াকে এই খবরটা দিতেই তিনি অনাগ্রহের সঙ্গে বললেন, আচ্ছা। মরিয়ম বলল, মা, চল তোমাকে দেখাই। সাফিয়া বললেন, পরে দেখব। হাতের কাজটা সারি। অথচ তার হাতে কোনো কাজ নাই। তিনি বাবুর পাশে ঝিম ধরে বসে আছেন। মরিয়ম আরেকবার বারান্দায় গেল ফুল দেখতে। ডালটা উঁচুতে। হাতের কাছে থাকলে কয়েকটা ফুল পাড়ত। শিউলি ফুলের বেঁটা দিয়ে সুন্দর হলুদ রঙ হয়। এই হলুদ রঙ দিয়ে পায়েস রান্না করলে পায়েসে ফুল ফুল গন্ধ চলে আসে।

মরিয়ম মুগ্ধ চোখে আরো কিছুক্ষণ ফুলের দিকে তাকিয়ে নিজের ঘরে ঢুকল। এই খবরটা একজনকে দিতে হবে। সেই একজন কোথায় আছে, সে জানে না। তার কাছে খবর কীভাবে পৌছানো যাবে তাও জানে না। তারপরেও সে প্রায় রোজই একটা করে চিঠি লিখে খাতা ভর্তি করে ফেলছে। কোনো এক সময় চিঠিগুলি নিশ্চয়ই পৌছানো যাবে। মরিয়ম দরজা বন্ধ করে দিল। চিঠি লেখার সময় ইট করে কেউ ঘরে ঢুকলে তার বড় বিরক্তি লাগে। চিঠি লেখার সময়টা সম্পূর্ণ তার একার। তখন আশেপাশে কেউ থাকবে না।

চিঠির সম্বোধন নিয়ে মরিয়মের খুব সমস্যা হয়। কোনো সম্বোধনই তার পছন্দ হয় না। তার খুব ইচ্ছা করে নাইমুলকে সংক্ষেপ করে নাই লিখতে। সে যদি মরিয়মকে সংক্ষেপ করে মরি ডাকতে পারে তাহলে মরিয়ম কেন নাইমুলকে সংক্ষেপ করে নাই ডাকতে পারবে না। সমস্যা অবশ্যি আছেপ্রিয় নাই লিখতে যেন কেমন লাগছে। মনে হয় যাকে লেখা হচ্ছে সে নাই।

মরিয়ম লিখল—

এই যে,

তুমি কেমন আছ? জানো কী হয়েছে? আমাদের বাড়ির সামনের শিউলি গাছে ফুল ফুটেছে। এটা অনেক বড় ঘটনা, কারণ শিউলি গাছে চৈত্র মাসে ফুল ফুটে না। আমার ধারণা গাছটার মাথা খারাপ হয়ে গেছে। মানুষের যদি মাথা খারাপ হয়, গাছের কেন হবে না? গাছের জীবন আছে–জগদীশ বসু আবিষ্কার করেছেন।

তুমি কি জানো আমারও মাথা খারাপ হয়ে গেছে? রাতে আমি এক ফোটা ঘুমাই না। জেগে বসে থাকি। আমার ঘুম আসে। ফজরের নামাজের পর। আযান শুনে নামাজ পড়বার বদলে ঘুমিয়ে পড়ি। দশটা সাড়ে দশটায় ঘুম ভাঙে। দুপুরবেলা খেয়ে আবার ঘুমুতে যাই। ঘুম থেকে উঠি ঠিক সন্ধ্যায়। উঠি বলা ঠিক হবে না। আমাকে উঠিয়ে দেয়া হয়। কারণ সন্ধ্যাবেলা ঘুমানো খুবই অলক্ষণ। পৃথিবীর কোনো পশুপাখি না-কি সন্ধ্যাবেলা ঘুমায় না। তারা তখন অস্থির হTে ছটফট করতে থাকে! আচ্ছা এটা কি সত্যি?

এখন তোমাকে জরুরি কিছু খবর দেই। এক নম্বর খবর–বাবার কোনো খোঁজ এখনো পাই নাই। উনি কোথায় কেউ বলতে পারছে না। বাবা বাড়িতে না থাকায় সবচে বড় সমস্যা হয়েছে মার। উনি সংসার চালাতে পারছেন না। বাবা তো মার হাতে বাড়তি কোনো টাকা দিতেন না। যা টাকা ছিল সব শেষ। চাল-ডাল-তেল কেনা ছিল বলে কিছুদিন চলেছে। এখন তাও শেষ। মা তার তিন মেয়ের যাকেই দেখেন তাকেই জিজ্ঞেস করেন, এখন কী কবি বল তো?
 
ব্যাংকে বাবার টাকা আছে। সেই টাকা আমরা তুলতে পারছি না। তবে তুমি এইসব নিয়ে দুশ্চিন্তা করবে না। কারণ ঢাকা শহরে আমাদের আত্মীয়স্বজন আছেন, তারা কেউ-না-কেউ আমাদের খোঁজ করতে আসবে। দেশের বাড়ি থেকে দাদাজানও নিশ্চয় কাউকে-না-কাউকে আমাদের খোজে পাঠাবেন। যাত্ৰাবাড়িতে আমার ছোট নানার (যিনি আমাদের বিয়ে দিয়েছেন)। নিশ্চয়ই কোনো সমস্যা হয়েছে। উনি যদি একবার আসতেন, তাহলেই আমাদের সব সমস্যার সমাধান হতো।

মার এবং আমাদের তিন বোনেরই কিছু প্ৰণয়না আছে। প্রয়োজনে গয়না বিক্রি করা হবে। তুমি এইসব নিয়ে মোটেই চিস্তা করবে না। আমাদের সামনের বাড়ির বাড়িওয়ালা সবাইকে নিয়ে দেশে চলে গেছেন। বাড়ি পাহারা দেবার জন্যে তার শালাকে রেখে গেছেন। তার নাম রতন। আমরা তাকে ডাকি বগা ভাই (দেখতে বকের মতো, এই জন্যে বগা ভাই)। মা ঠিক করেছে বগা ভাইকে দিয়ে গয়না বিক্রি করাবে। আমরা তিন বোন চাচ্ছি না বগা ভাই আমাদের বাড়িতে আসুক। তার ভাব-ভঙ্গি ভালো না। তার কিছু বিহারি বন্ধু-বান্ধব আছে। তাদের নিয়ে সে প্রায়ই তাদের বাড়িতে আডিডা বাসায়। সে নিজেও বিহারিদের মতো ঘাড়ে রঙিন রুমাল বাধে।

তুমি কি জানো বিহারিদের ভয়ে আমরা সবাই আতঙ্কে থাকি? রাত নটা থেকে ভোর পাঁচটা পর্যন্ত কারফিউ থাকে, এই সময় বিহারিরা না-কি মানুষের বাড়িতে ঢোকে। বিশেষ করে সেইসব বাড়িতে যেখানে অল্পবয়েসী মেয়েরা আছে। কী যে ভয়ঙ্কর অবস্থা!

রাতে আমরা সবাই একই ঘরে ঘুমাই। মা হাতের কাছে একটা বটি রাখেন। এখন তুমিই বলো–ওরা যদি দল বেঁধে আসে, মা বটি দিয়ে কী করবে?

যাই হোক, তুমি এইসব নিয়ে চিন্তা করবে না। আমরা ঠিক করে রেখেছি, পরিচিত কাউকে পেলেই আমরা দেশের বাড়িতে চলে যাব; একবার দেশের বাড়িতে পৌঁছতে পারলে আমাদের আর কোনো ভয় নেই।

তুমি ভালো থেকো। শরীরের যত্ব নিও। বেশি সাহস দেখানোর দরকার নেই। অন্যরা সাহস দেখাক, তোমাকে সাহস দেখাতে হবে না।

খুবই অন্যরকম একটা খবর তোমাকে দেই। মার ধারণা আমার সন্তান হবে। আমার চেহারায় না-কি মা মা ভাব চলে এসেছে। ঘটনা তা না। তবে আমি এমন ভাব করছি যে ঘটনা। তাই। দেখেছি আমি কেমন মজা করতে পারি?

আজ এই পর্যন্ত। কাল আবার চিঠি লিখব। আচ্ছা! শোন, রাতে ঘুমুতে যাবার আগে আয়াতুল কুরশি পড়ে তিনবার হাততালি দিয়ে ঘুমুতে যাবে। তালির শব্দ যতদূর যায়, ততদূর পর্যন্ত কোনো বালামুসিবন্ত আসতে পারে না। আমরা সবসময় তাই করি।

ইতি

তোমার মরি

চিঠি শেষ করে মরিয়ম আবার বারান্দায় গেল। অসময়ের ফুল আবার দেখতে ইচ্ছা করছে। ফুল পাড়তে পারলে চিঠিতে ফুলের বোটার হলুদ রঙ লাগিয়ে দেয়া মৃেত। বারান্দা থেকে বগা ভাইকে দেখা যাচ্ছে। বগা ভাই তাকিয়ে আছে তার দিকে। তার সঙ্গে আরো তিনজন আছে। প্রত্যেকেরই পান খাওয়া লাল ঠোট। কাঁধে রুমাল বাধা। তারাও তাকিয়ে আছে বারান্দার দিকে। তাদের একজন হঠাৎ হাততালি দিতে শুরু করল। তার দেখাদেখি অন্য দুজনও হাততালি দিচ্ছে। শুধু বগা ভাই দিচ্ছে না। মরিয়ম ছুটে বারান্দা থেকে ঘরে ঢুকে গেল।

সাফিয়া বললেন, কী হয়েছে?

মরিয়ম বলল, কিছু হয় নাই; কেন জানি ভয় লাগছে।

ভয় লাগছে কেন?

বারান্দা থেকে দেখেছি, বগা ভাই কয়েকজন বন্ধু-বান্ধব নিয়ে তাকিয়ে আছে। তোকানোটা ভালো না। মা চল আমরা দেশের বাড়িতে চলে যাই।

কীভাবে যাবে? কে নিয়ে যাবে?

বোরকা পরে আমরা আমরা চলে যাব। ট্রেনে উঠব। ট্রেন থেকে নামব।

সাফিয়া কিছু বললেন না। ছেলে কাঁদছে, তিনি ছেলে সামলাতে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। মেয়ে তিনটিকে তার খুবই পছন্দ। ভালো মেয়ে, বুদ্ধিমতী, কিন্তু বেশি সরল। মনে কোনো প্যাচ গোছ নাই। তারপরেও তিন মেয়ের একটা ব্যবহারে তিনি মনে খুবই কষ্ট পেয়েছেন। তাদের বাবার কোনো খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে নাএটা নিয়ে তাদের মনে কোনোরকম দুশ্চিন্তা নেই। যেন তাদের বাবা মফস্বলে ইন্সপেকশনে গিয়েছে, কয়েক দিন পরে ফিরে আসবে। বাবার প্রতি মেয়েদের সামান্য মমতা থাকবে না? এই দুঃসময়ে একটা মানুষ নিখোঁজ হওয়া যে কত ভয়াবহ ব্যাপাব–এটা কি এরা জানে না? ধরে নেয়া গেল মানুষটা খারাপ। খুবই খারাপ। সবার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করে। সবসময় ধমকা-ধমকি। সবসময় মেজাজ খারাপ। তারপরেও তো বাবা।
 
একজনের বিয়ে হয়েছে। স্বামীর চিন্তা তার মাথায়। অন্য কিছুই তার মাথায় ঢুকছে না। তার কথা বাদ দেয়া গেল। সে থাকুক শিউলি ফুল নিয়ে। অন্য দুজন? তাদের তো বিয়ে হয় নি। তাদের তো সম্পূর্ণ নিজের লোক নেই। তারা কেন বাবাকে নিয়ে সামান্য দুশ্চিন্তাও করবে না? বাবা ঘরে ফিরছে না–এতে তারা যেন খানিকটা নিশ্চিন্ত। প্ৰত্যেকেই স্বাধীনভাবে জীবন-যাপন করতে পারছে। গতকাল রাতে মাসুমা ছুটে এসে বলল, মা, আকাশবাণী থেকে খুব ভালো নাটক হচ্ছে। শুনবে?

সাফিয়া হতভম্ব। এই মেয়ে কী বলে! এখন কি নাটক শোনার সময়? মাসুমা উত্তেজিত গলায় বলল, অচিন্তকুমার সেনগুপ্তর উপন্যাস থেকে নাটক। উপন্যাসের নাম প্রথম কদম ফুল । সাফিয়া বললেন, মা, তোমরা শোন। আমার বাবুকে দেখতে হবে।

মাসুম বলল, মা, বাবু তো ঘুমাচ্ছে।

সাফিয়া বললেন, নাটক শুনতে আমার ভালো লাগে না, তোমরা শোন। তিনি গম্ভীর মুখে বাবুর পাশে বসে রইলেন। বাবুকে এখন আর ইয়াহিয়া ডাকা হয় না। তার বাবু নামই মনে হয় স্থায়ী হয়ে গেছে।

বাবু ঘুমাচ্ছে, তিনি তাকিয়ে আছেন তার দিকে। এক সময় এই ছেলের ঘুম ভাঙবে। ঘুম ভাঙার পরেও তার জগতের অন্ধকার কাটবে না। সে হাত বাডিয়ে প্রিয়জনের স্পর্শ খুঁজবে। তার প্ৰিয়জন কে? সাফিয়া নামের একজন যার সঙ্গে তার কোনো সম্পর্কই নেই। বাবু যে চোখে দেখে না এবং কানে শোনে নাএই বিষয়ে তিনি এখন পুরোপুরি নিশ্চিত। বোনদের এই ভয়ঙ্কর খবরটা তিনি দেন নি। কেন দেন নি তার কারণ তার কাছেও স্পষ্ট না।

সাফিয়া নিশ্চিত মেয়েরা এখনো বুঝতে পারছে না বাইরের জগতে কী ভয়ানক ওলট-পালট হয়ে গেছে। তারা তাদের নিজেদের জীবন নিয়ে প্রায় চিন্তাহীন সময় কাটাচ্ছে। সব কিছুর মধ্যেই এক ধরনের মজা পাচ্ছে। রাতে একই ঘরে সবাই যখন ঘুমুতে আসছে, তার মধ্যেও যেন মজা আছে। তিন বোন পাশাপাশি শুয়ে থাকে। গুটুর গুটুর করে কথা বলে। হঠাৎ হঠাৎ খিলখিল হাসি। একজন সঙ্গে সঙ্গে বলবে, আস্তে হাসো, আস্তে, মিলিটারি শুনবো। ওমনি আরো জোরালো হাসি। সবচে ছোটটা একরাতে বলল, আপু, মিলিটারিরা মেয়েদের ধরে নিয়ে যায় কী জন্যে?

মাসুমা বলল, আদর করার জন্যে ধরে নিয়ে যায়। তোকে যদি ধরে নিয়ে যায় এমন আদর করবে…

মাসুমা কথা শেষ না করেই শুরু করল হাসি। মাসুমা হাসে, মরিয়ম হাসে। তাদের হাসির মাঝখানে মাফরুহ অবাক হয়ে বলে, তোমরা হাসছ কেন? তিন বোনের হাসি তখন আরো প্ৰবল হয়।

হাসির শব্দে সাফিয়ার বুক ধড়ফড় করে। সুসময়ে হাসি সংসারে আরো সুসময় নিয়ে আসে। দুঃসময়ের হাসি আনে ভয়ঙ্কর কোনো দুঃসময়। মরা বাড়িতে লাশ কবর দেওয়ার আগেই যদি কেউ হাসে, অবশ্যই সে বাড়িতে আরো একজন কেউ মারা যায়। এটা পরীক্ষিত সতী।

মেয়েরা হাসে, সাফিয়ার বুক ধড়ফড় করে। নিঃশ্বাসে কষ্ট হয়। মেয়েরা বুঝতে পারছে না। কিন্তু তিনি বুঝতে পারছেন সামনের দিন ভয়ঙ্কর। ভয়ঙ্কর সেই দিনের কথা ভেবে রাতে তাঁর ঘুম হয় না। অনেক রাত পর্যন্ত এপাশি-ওপাশ করেন। চোখ যখন লাগে বিকট সব স্বপ্ন দেখেন। স্বপ্নগুলি বিকট শুধু না, নোংরাও। এত নোংরা যে ঘুম ভাঙার পর তার গা ঘিনীঘিন করে। মনে হয়। শরীর অশুচি হয়ে আছে। প্রায়ই স্বপ্লে তিনি তাঁর মৃত বাবাকেও দেখেন। বাবা যেন বাসায় এসেছেন। ছটফট করছেন। যেন খুব ব্যস্ততা। হুড়মুড় করে তিনি শোবার ঘরে ঢুকে বললেন, ও খুকি, তাড়াতাড়ি কর। লঞ্চ ধরতে হবে। (সাফিয়াকে তার বাব, সারাজীবন সাফি ডেকেছেন। কখনো খুকি। ডাকেন নি। অথচ স্বপ্নে কেন খুচুক ডাকেন কে জানে)। স্বপ্লের মধ্যেই সাফিয়া বলে, বাবা এত ব্যস্ত কেন? বললেই তো যাওয়া যায না। আমার ছেলে-মেয়ে আছে, স্বামী আছে, সংসার আছে।

বাবা মাথা ঝাকাতে ঝাকাতে বললেন, আরো রাখা রাখ। কিসের স্বামী কিসের ছেলেমেয়ে, লঞ্চ ছেড়ে দিবে; আয় খুকি–তাড়াতাড়ি আয়। বলেই তিনি সাফিয়ার হাত ধরে টানাটানি শুরু করেন। তখন সাফিয়ার ঘুম ভাঙে।

এই স্বপ্ন সাফিয়া প্রায়ই দেখে, তবে সবসময় লঞ্চ থাকে না। মাঝে-মাঝে থাকে ট্রেন, নৌকা, বাস। স্বপ্নের মূল বিষয়ের কোনো পরিবর্তন হয় না।

স্বপ্নে মৃত ব্যক্তির হাত ধরে টানাটানি খুব খারাপ। এই ধরনের স্বপ্ন দেখলে জানের সদকা দিতে হয়। মাওলানা ডাকিয়ে তওবা করে মৃত্যুর জন্যে প্রস্তুতিও নিতে হয়। সাফিয়া তার কোনোটিই করেন নি। একটা খতম পড়তে চেষ্টা করছেন–এক লক্ষ চব্বিশ হাজার বার দোয়া ইউনুস।
 
ইউনুস নবি যখন তিমি মাছের পেটে চলে গেলেন–তখন জীবনের সমস্ত আশা ছেড়ে এক মনে এই দোয়া পড়লেন–লাইলাহা ইল্লা আনতা সোবাহানাকা ইন্নি কুনতু মিনাজাজোয়ালেমিনা। এই দোয়ার কারণে তিমি মাছ ইউনুস নবিকে উগরে ফেলে দিল। তাঁর জীবন রক্ষা হলো। দোয়াটার নাম হয়ে গেল। দোয়া ইউনুস। মাছের পেটে চলে যাবার মতো ভয়ঙ্কর কোনো পরিস্থিতিতে যদি মানুষ পড়ে, তাহলে এই দোয়া পাঠ করলে সে নাজাত পাবে।

সাফিয়ার ধারণা তিনি মাছের পেটেই আছেন। তিনি একা না। পুরো দেশটাই এখন মাছের পেটে। দেশের সব মানুষের উচিত দোয়া ইউনুস পাঠ করা।



শুক্রবারে আসরের নামাজের সময় মরিয়মদের বাড়ির দরজার কড়া কে যেন জোরে জোরে নাড়তে লাগল। মরিয়ম ভয় পেয়ে ছুটে গেল মার কাছে। মাসুমা গল্পের বই পড়ছিল। নাইমুল এই বাড়িতে অনেক গল্পের বই নিয়ে এসেছিল। এখন বইগুলি মাসুমার দখলে। সে একটার পর একটা বই পড়ে যাচ্ছে। দরজার কড়া নাড়ার সময় মাসুমা যে বইটা পড়ছিল তার নাম জঙ্গম। লেখকের নাম বনফুল। কড়া নাড়ার প্রবল শব্দে সে বই ছুঁড়ে ফেলে দৌড়ে এলো মায়ের ঘরে।

সাফিয়া তিন মেয়েকে একটা ঘরে ঢুকিয়ে বাইরে থেকে মাস্টারলিক তালা লাগালেন। বাবুকে কোলে নিয়ে দরজা খুলতে এলেন। যদি মিলিটারি হয়, কোলে শিশুকে দেখে দয়া হতে পারে।

সাফিয়া ভীত গলায় বললেন, কে?

বাইরে থেকে কেউ একজন বলল, ভয়ের কিছু নাই, দরজা খুলেন।

আপনি কে?

নাম বললে আপনি আমাকে চিনবেন না। আমার নাম শাহ কলিম।

সাফিয়া বলল, কী চান?

দরজা খুলেন, তারপর বলি কী চাই। বললাম তো ভয়ের কিছু নাই। আমি বিহারি না। বাঙালি। আমি মিলিটারির কোনো লোক না। বিহারি বা মিলিটারি হলে এতক্ষণে দরজা ভেঙে ভেতরে ঢুকে যেত।

সাফিয়া দরজা খুললেন। শাহ কলিম নামের লোকটাকে ঘরে ঢুকতে দিলেন। শাহ কলিম বলল, আপনার বাড়ি খুঁজে বের করতে বিরাট পরিশ্রম হয়েছে। ঠিকানা ছিল ভুল। দুপুর একটা থেকে হাঁটাহাঁটি করছি, এখন খুব সম্ভব চারটা বাজে। এক গ্রাস পানি খাওয়াবার ব্যবস্থা করেন। বাড়িতে কি আপনি একা?

হ্যাঁ, আমি একা।

আপনি তো একা না, এই বাচ্চাটা ছাড়াও আপনার তিনটা মেয়ে আছে। আমার সঙ্গে মিথ্যা কথা বলছেন কেন? ভয় পাচ্ছেন? ভয় পাওয়ার কিছু নাই। যান, পানি নিয়ে আসেন।

সাফিয়া পানি আনলেন। লোকটার সঙ্গে কিছুক্ষণ কথা বলার পর তার মনে হলো, আসলেই ভয় পাওয়ার কিছু নাই। লোকটা বলল, আমি এসেছি আপনাদের খোঁজ-খবর নেবার জন্যে। আপনাদের কোনো সমস্যা আছে কি-না তা জানার জন্য।

সাফিয়া বললেন, আপনি কে?

শাহ কলিম বলল, আমি কে সেটা তো বলেছি। আমার নাম শাহ কলিম। কবিতা লেখি। নানান পত্রপত্রিকায় আমার লেখা ছাপা হয়। আপনাদের কাছে এক ভদ্রলোক আমাকে পাঠয়েছেন। উনি আপনার স্বামীর বন্ধু মানুষ। আপনার স্বামীকে খুব পছন্দ করেন। আপনাদের কোনো সমস্যা আছে কি-না জানার জন্যে পাঠিয়েছেন। এখন বলেন–আছে কোনো সমস্যা?

সাফিয়া আগ্রহ নিয়ে বললেন, মরিয়মের বাবা কোথায় আপনি জানেন?

শাহ কলিম বলল, আমি জানি না।

উনি কি বেঁচে আছেন?

আমি উনার বিষয়ে কিছুই জানি না।

উনার বন্ধু কি জানেন? তাঁর সঙ্গে দেখা করতে পারি?

শাহ কলিম বলল, উনার খন্ধুও কিছু জানেন না। আমাকে পাঠিয়েছেন আপনাদের কাছ থেকে খবর নেবার জন্য। এখন দেখি আপনারাও কিছু জানেন না। যাই হোক, অনেক কথা বলে ফেলেছি। গলা শুকিয়ে গেছে। এক কাপ চ্যা খেতে পারলে ভালো হয়। চা খাওয়াতে পারবেন?

চা খাবার সময় শাহ কলিমের দেখা হলো মরিয়ম এবং মাসুমার সঙ্গে। মাসুমাকে দেখে শাহ কলিমা খুবই বিস্মিত হলো। অতি রূপবতী মেয়ে। নাক সামান্য চাপা। এতেই যেন রূপ ফুটেছে। মেয়েটার কথাবার্তাও চমৎকার। কথা বলার এক পর্যায়ে সে ঘাড় কাত করে। চোখ পিটপিট করতে থাকে। দেখতে ভালো লাগে।

মাসুমা বলল, আপনাকে দেখেই মনে হচ্ছে আপনি সত্যি সত্যি একজন কবি।

শাহ কলিম বলল, আমি তো আসলেই কবি।

মাসুম বলল, যখন চাঁদ উঠে, তখন আপনি কী করেন? হা করে চাঁদের দিকে তাকিয়ে থাকেন?



আমি জোছনা দেখি। চাঁদের দিকে তাকিয়ে থাকলে তো জোছনা দেখা যায় না। কোনো কবিই চাঁদ দেখেন না। তারা জোছনা দেখেন।

বলুন দেখি পূর্ণিমা কবে? যদি বলতে পারেন তাহলে বুঝব আপনি আসলেই কবি। জোছনার হিসােব আপনার কাছে আছে। আর যদি বলতে না। পারেন তাহলে আপনি ভু-কবি।

শাহ কলিম অবাক হয়ে বলল, ভু-কবি মানে কী?

মাসুমা বলল, ভু-কবি মানে ভুয়া কবি।

ও আচ্ছা।

আপনি কি রাগ করেছেন?

না।

রাগ করা উচিত ছিল, রাগ করেন নি কেন?

তুমি এমন একটি মেয়ে–যার উপর রাগ করা একজন ভু-কবির পক্ষে খুবই কঠিন।

কবি শাহ কলিম রাত আটটা পর্যন্ত থাকল। তার নিজের লেখা কবিতা মেঘবালিকাদের দুপুর গভীর আবেগের সঙ্গে আবৃত্তি করল। কবিতা আবৃত্তির মাঝখানে অবশ্যি মাসুমা দুইবার খিলখিল করে হেসে উঠল। এতে কবি হিসেবে শাহ কলিমের রাগ করা উচিত ছিল। সে রাগ তো করলেই না, বরং তার কাছে মনে হলো–এত সুন্দর শব্দ ও ঝংকারময় হাসি সে এর আগে কোনোদিন শুনে নি। তার মাথায় এক লাইন কবিতাও চলে এলো–

তার হাসি তরঙ্গ ভঙ্গের মতো শব্দময় ধ্রুপদী নদী

ধ্রুপদী শব্দটা যাচ্ছে কি-না বোঝা যাচ্ছে না, তবে শব্দটা জুৎসই। ধ্রুপদীর শেষ অক্ষর দী, আবার নদীর শেষ অক্ষরও দী। মিলাটা ভালো।

কবি শাহ কলিম ঠিক করল, এই অসহায় পরিবারটিকে সে নিজ দায়িত্বে গ্রামের বাড়িতে পৌঁছে দেবে। শহর ছেড়ে গ্রামে যাওয়া এখন সমস্যা না। শহরে রিকশা, ঠেলাগাড়ি সবই চলছে। শহর থেকে বের হলেই নৌকা। ট্রাক আছে, বাস আছে। সামান্য চেকিং মাঝেমধ্যে হয়, সেটা তেমন কিছু না।
 
আমার নাম গৌরাঙ্গ বিরক্ত দাস। এখন আমি নিজের বাড়িতে আছি। কী মজা কী মজা! নিজ বাড়িতে বাস করি নিজের মনে খাই। তাই তাই তাই।

গৌরাঙ্গের কাছে মনে হলো, সে আনন্দে আছে। বেশ আনন্দে আছে। তার বাড়ি-ঘর ঠিক আছে। জিনিসপত্রও ঠিক আছে। বুক শেলফের পেছনে হাত দিয়ে সে একটা পুরো ওল্ড স্মাগলারের বোতল পেয়ে গেল। মুখ পৰ্যন্ত খোলা হয় নি। আধা বােতল রাম পাওয়া গেল। রাম এমন জিনিস যে নষ্ট হয় না। যত দিন যায় ততই তার স্বাদ বাড়তে থাকে। রামের স্বাদ ঠিক আছে কি-না তা দেখার জন্যে বোতল থেকে সরাসরি কয়েক ঢোক খেল। স্বাদ ভালো আছে। শুধু যে ভালো আছে তা-না, স্বাদ জমেছে। হেভি জমেছে। গৌরাঙ্গের মনে হলো, রাম নামে এমন একটা ভালো জিনিস তৈরি হয়েছে অথচ লক্ষণ নামে কিছু তৈরি হয় নি। লক্ষণ নামে কিছু থাকলে সে দুই ভাইকে পাশে নিয়ে বসতো। এক চুমুক রাম, এক চুমুক লক্ষণ–বাহ কী আনন্দ!

সদর দরজা বন্ধ। বাড়ির জানালাগুলিও বন্ধ।। ঘর দিনের বেলাতেও অন্ধকার হয়ে আছে। এই ভালো। অন্ধকারের আলাদা আনন্দ আছে। মানুষ এমন এক জীব যে আনন্দ পেতে চাইলে আনন্দ পাওয়ার ব্যবস্থা করতে পারে। এই যে গৌরাঙ্গ আনন্দ পাচ্ছে। সে বসার ঘরে কাপেটে পা ছড়িয়ে বসেছে। তার কাছে এখন মনে হচ্ছে, সংসার আগের মতোই আছে। নীলিমা উপরের তলায় তার বাবার কাছে গেছে। সঙ্গে রুনিকে নিয়ে গেছে। নিশ্চয়ই গৌরাঙ্গের সঙ্গে কোনো ঝগড়া হয়েছে। রাগ করে বাবার কাছে গিয়ে বসে আছে।

মেয়েদের এই স্বভাব–ঝগড়া মাথার ভেতর রেখে দেয়। পুরুষমানুষ এই কাজ কখনো করে না। যখন ঝগড়া হবে পুরোপুরি হবে। পাঁচ-দশ মিনিটে ভুলে যাবে। মেয়েরা ভুলবে না। তারা পাঁচ-দশ বছর ঝগড়া মাথায় রেখে দিবে।

গৌরাঙ্গ রামের বোতলে আরো কয়েক বার চুমুক দিল। প্রায় খালি বোতল রেখে দেবার কোনো মানে হয় না। তাছাড়া আজ দুপুরে খাওয়ার কোনো ব্যবস্থাও নেই। এই জিনিস পেটে থাকলে ক্ষিধে লাগবে না।

ঘরে পিন পিন করছে মশা। তবে মশাগুলি ভালো। তাকে কামড়াচ্ছে না। দিনের মশা কামড়ায় না। রাতের মশা কামড়ায়। ব্যথা লাগে চামড়ায়। বাহ ভালো কবিতা হয়েছে তো! দিনের মশা কামড়ায় না, রাতের মশা কামড়ায়, ব্যথা লাগে চামড়ায়।

কবিতাটা রুনিকে বললে মজা হতো। মেয়েটা কবিতা পছন্দ করে। মেয়েটা এখন আছে তার দাদুভাইয়ের কাছে। দাদুভাইয়ের নাম–হরিভজন সাহা। সমাসের ব্যাসবাক্য নির্ণয় কর হরিভজন। হরিকে যে ভজন করে হরিভজন। যা ব্যাটা হরিকে ভজন করতে থাক, এদিকে সংসার শেষ।

মশারা এখন গৌরাঙ্গকে কামড়াতে শুরু করেছে। ভালো যন্ত্রণা হয়েছে তো! আচ্ছা ঘরে কি ধূপ আছে? ধূপের ধোঁয়ায় মশা থাকে না। আছে তো বটেই। নীলিমা যেমন ধর্ম-কৰ্ম করা মহিলা, প্রতি সন্ধ্যাবেলায় মহাদেবের পটে সে ধূপের ধোঁয়া দেয়। পটে মাথা ঠেকিয়ে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে। প্রার্থনা করে। কী প্রার্থনা করে? হে দেবাদিদেব মহাদেব। তুমি আমার সংসার সুখে রাখো। মহাদেবকে এত ধোয়া খাইয়েও লাভ হয় নি। সংসার মিলিটারি ছারখার করে দিয়েছে। সব শেষ করে একজনকে বাঁচিয়ে রেখেছে মশার কামড় খাওয়ানোর জনো। গৌরাঙ্গ বোতলে লম্বা চুমুক দিয়ে মনে মনে বলল, খা মশা খা। হিন্দুর রক্ত খা।



গৌরাঙ্গ চিন্তিত বোধ করছে। চিন্তা-ভাবনা অন্যদিকে চলে যাচ্ছে। মাতাল অবস্থায় কষ্টের কথা ভাবলে কষ্ট দশগুণ বেড়ে যায়। আবার আনন্দের কথা ভাবলে আনন্দ বাড়ে মাত্র দুইগুণ। এই বিচার ঠিক হয় নাই। কষ্ট দশগুণ বাড়লে অনিন্দ ও দাশগুণ বাড়া উচিত; গৌরাঙ্গ আনন্দের ভাবনা ভাবতে শুরু করল। যেন তার পেছনে তার পিঠে হেলান দিয়ে রুনি বসে আছে। (রুনি প্রায়ই এ রকম করে। বাবার পিঠে হেলান দিয়ে নিজের মনে পুতুল নিয়ে খেলে। গুটি গুষ্ট করে কথা বলে। এই সময় সে রুনির মুখ দেখতে পায় না।) এখনো যেন সে রকম হচ্ছে।

ও রুনি, কী করো মা?

গৌরাঙ্গের মনে হলো রুনি ক্ষীণস্বরে জবাব দিয়েছে। জবান্ধটা স্পষ্ট না বলে গৌরাঙ্গ শুনতে পায় নি।

মাগো, গল্প শুনবে?

হুঁ।

কিসের গল্প শুনবে মা?

মশার গল্প।

গৌরাঙ্গ চমকে উঠল। কারণ মশার গল্প এই বাক্যটা সে স্পষ্ট শুনেছে। রুনি যেমন প্রতিটি শব্দ টেনে টেনে বলে, মশা শব্দটাও টেনে টেনে বলেছে–ম… শা…। সে কি পেছন ফিরে দেখবে রুনি সত্যি সত্যি তার পিঠে পিঠ লাগিয়ে বসে আছে কি-না? থাকা দরকার নেই, তারচে বরং মশার গল্প করা যাক।

মাগো শোন, এই পৃথিবীতে আগে মশা ছিল না। কীভাবে মশার জন্ম হলো সেই গল্প শোন। জেলেরা সারারাত মাছ ধরে। কিন্তু রাতে তাদের খুব ঘুম পায়। প্রায়ই দেখা যায় মাছ ধরতে গিয়ে তারা ঘুমিয়ে পড়েছে। একদিন তারা দেবী শীতলাকে বলল, ও দেবী, তুমি একটা ব্যবস্থা করে দাও না যেন আমাদের রাতে ঘুম না পায়। দেবী বললেন, তথাস্তু। বলেই নিজের বাম হাত থেকে কিছু ময়লা জেলেদের হাতে দিয়ে বললেন, এই ময়লা তোরা তোদের বাড়ির কাছের ডোবায় ফেলে দিয়ে আসবি। এতেই কাজ হবে। রাতে আর তোদের ঘুম হবে না। তারা তাই করল। দেবীর হাতের ময়লা নিয়ে ডোবায় ফেলল। ওমি ডোবা থেকে পিন পিন করতে করতে হাজারে বিজারে মশা বের হয়ে এলো। এরপর কী হলো শোন। জেলেরা মাছ ধরতে যায়। মাছ ধরতে গিয়ে ঘুমুতে পারে না। তাদের সারা রাত মশা কামড়ায়।

গৌরাঙ্গ রামের বোতলের পুরোটা গলায় ঢেলে দিল। এখন তার মাথা ঘুরছে। শরীর যেন কেমন করছে। বমি হবে কি? হলে হবে। কী আর করা! দরজায় খট করে শব্দ হলো। গৌরাঙ্গ চমকে তাকাল। কী আশ্চর্য নীলিমা দরজা ধরে দাঁড়িয়ে আছে! অবশ্যই চোখের ভুল। রাম বেশি খাওয়া হয়ে গেছে। গৌরাঙ্গ বিড়বিড় করে বলল, নীলিমা কেমন আছ?

নীলিমা জবাব দিল না। দরজায় ওপাশে সামান্য সরে গেল! এখন আর তার মুখ দেখা যাচ্ছে না, তবে শাড়ির আঁচল দেখা যাচ্ছে। বাতাসে যে শাড়ির আঁচল কাঁপছে তাও বোঝা যাচ্ছে। গৌরাঙ্গের হঠাৎ মনে হলো, এখন সে যা দেখছে তাই সত্যি। আগে যা ঘটেছে তা সত্যি না। সে হাড়হড় করে বলল, কয়েকদিন বাসায় ছিলাম না। শাহেদের ওখানে ছিলাম। শাহেদ ভালো আছে।

নীলিমা জবাব দিল না। গৌরাঙ্গ বলল, তুমি কি রাগ করেছে না কি? এখন সময় খারাপ। এখন রাগ করা ঠিক না। তুমি এক কাজ করো, অল্প কিছু জিনিসপত্র ব্যাগে গুছিয়ে নাও। তোমাকে আর রুনিকে নিয়ে বর্ডার পাস করে। আগরতলা চলে যাব। অনেকেই যাচ্ছে। সমস্যা নাই।

এই এই!

কে বলল–এই এই? নীলিমা বলেছে? তাহলে তো ব্যাপারটা স্বপ্ন না। যা ঘটছে, বাস্তবেই ঘটছে। অবশ্যই বাস্তব। নীলিমার চুলের গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে। সে গন্ধরাজ না কী তেল মাথায় দেয়। অনেক দূর থেকে সেই গন্ধ পাওয়া যায়। গন্ধরাজ নাম সার্থক।

কে কথা বলছে? নীলিমা তুমি?

হুঁ।

দূরে কেন? কাছে এসো?

নীলিমা বলল, তুমি কোথায় বসেছ জানো?

গৌরাঙ্গ অবাক হয়ে বলল, কোথায় বসেছি?

তাকিয়ে দেখো।

গৌরাঙ্গ তাকিয়ে দেখল। সে সোফায় বসে নি। সোফায় হেলান দিয়ে মেঝেতে পা ছড়িয়ে বসেছে। গৌরাঙ্গ বলল, মেঝেতে বসেছি। সামান্য ধুলা আছে।

ভালো করে দেখো। কালো দাগ দেখতে পাচ্ছ না?

পাচ্ছি। কিসের দাগ?

কিসের দাগ তুমি জানো না?

না।

রক্ত শুকিয়ে গেলে কালো দাগ হয়, তুমি জান না?

গৌরাঙ্গ অবাক হয়ে কালো দাগ দেখছে। তার হাত-পা শিরশির করছে। বুকে চাপা যন্ত্রণা। কেমন যেন লাগছে। গৌরাঙ্গ বিড়বিড় করে বলল, পানি খাব। পানি।
 
নীলিমা দরজায় আড়াল থেকে সরে গেল। সে কি পানি আনতে গিয়েছে? গৌরাঙ্গ পানির জন্যে অপেক্ষা করতে করতে বমি করল। কালো দাগগুলি এখন বমিতে ঢাকা পড়েছে। ভালো হয়েছে। বেশ ভালো হয়েছে।

ঘর নষ্ট হয়েছে। তাতে অসুবিধা নেই। এই ঘরে সে তো থাকছে না। সে মেয়েকে আর স্ত্রীকে নিয়ে বর্ডার ক্রস করে আগরতলা যাবে। কোলকাতা যেতে পারলে ভালো হতো। আত্মীয়স্বজন আছে। আগরতলায় পরিচিত। কেউ নেই। তাতে অসুবিধা হবে না। অনেকগুলি ক্যাশটাকা তার সঙ্গে আছে। উহু ভুল হয়েছে। তার সঙ্গে নেই। সে টাকা শাহেদের কাছে রেখে এসেছে। শাহেদের কাছে টাকা রাখা আর ব্যাংকে টাকা রাখা সমান। বরং ব্যাংকে রাখার চেয়েও ভালো। ব্যাংক ছুটির দিন বন্ধ থাকে। শাহেদকে সবদিনই পাওয়া যাবে। শুধু একটাই সমস্যা–শাহেদ সারাদিন পথে পথে ঘোরে। কখন গুলি করে মিলিটারি তাকে মেরে ফেলবে কে জানে!

গৌরাঙ্গ চাপা গলায় ডাকল, নীলিমা নীলিমা।

মনে হলো অনেক দূর থেকে নীলিমা বলল, কী?

আচাৰ্য ভবতোষ বাবুর ঠিকানা কি তোমার কাছে আছে?

হুঁ।

উনার ঠিকানা লাগবে। বর্ডারের দিকে রওনা হবার সময় ভবতোষ বাবুর কাছে থেকে তিনটা রক্ষা কবচ নিব। তোমার জন্যে, রুনির জন্যে আর আমার জন্যে। রক্ষা কবচ গলায় থাকলে আর কোনো ভয় নেই।

হুঁ।

তোমার বাবাকে যে মিলিটারিরা মেরে ফেলেছে, এতে এক দিক দিয়ে ভালো হয়েছে। উনি বেঁচে থাকলে উনাকে নিয়ে বর্ডার ক্রস করা মুশকিল হতো। বুড়ো মানুষ হাঁটতে পারত না। তুমি তোমার বাবার মৃত্যু নিয়ে মন খারাপ করবে না। বয়স হয়েছে, মারা গেছেন। অপঘাতে মৃত্যু হয়েছে এইটাই সমস্যা। প্রেতিযোনী প্রাপ্ত হবেন। তাঁর নামে পিণ্ডি দিতে হবে। সব ব্যবস্থা আমি করব। মোটেই চিন্তা করবে না।

আচ্ছা।

পানি আনো। কুলি করব।

গৌরাঙ্গ দেখছে নীলিমা দরজা ধরে দাড়িয়ে আছে। নড়ছে না। তার চেহারাও অস্পষ্ট। তাহলে সে কি মদের ঝোঁকে চোখে ভুল দেখছে? গৌরাঙ্গ এবার হতাশ গলায় মেয়েকে ডাকতে লাগল। রুনি! ও রুনি! রুনি!



নেশা কেটে যাবার পর গৌরাঙ্গ পুরোপুরি স্বাভাবিক হয়ে গেল। তৃপ্তি করে গোসল করল। চাল-ডালের খিচুড়ি রাধল। খিচুড়ি রাধার ব্যাপারটা সে শাহেদের কাছে শিখেছে। রান্না এত সহজ তা সে আগে বুঝতে পারে নি। আগে বুঝতে পারলে নীলিমার কাছ থেকে দুএকটা রান্না শিখে রাখত। ইলিশ মাছের পাতুরি শিখে রাখতে পারলে কাজের কাজ হতো।



গৌরাঙ্গ নিজের রান্না খুবই আনন্দ করে খেল। শাহেদের জন্যে তার সামান্য মন খারাপ হলো। শাহেদ এই খিচুড়ি খেলে মজা পেত। সে খিচুড়িতে বুদ্ধি করে তরকারির চামচে এক চামচ ঘি ঢেলে দিয়েছে। শুকনা মরিচের গন্ধের সঙ্গে ঘিয়ের গন্ধ মিলে অসাধারণ গন্ধ বের হচ্ছে। শাহেদ পাশে থাকলে গল্প করতে করতে খাওয়া যেত। সে বলত, মিতা খিচুড়ি কেমন হয়েছে? তোরটার চেয়ে ভালো না?

শাহেদ অবশ্যই বলতো, ভালো।

সে বলতো, বল দেখি ভালো খিচুড়ির পেছনে কার ভূমিকা প্রধান? দশ টাকা বাজি, তুই বলতে পারবি না। তুই হয়তো ভাবছিস, তোর অবদান। আসলে তা না।

তাহলে কার অবদান?

নীলিমার অবদান। সে প্রতিটা জিনিস গুছিয়ে রেখেছে বলে এত মজার খিচুড়ি খাওয়া যাচ্ছে। চাল-ডাল-মসলাপাতি-তেল-ঘি সবই আছে। মিউজিয়ামে জিনিসপত্র যে রকম যত্ন করে সাজিয়ে রাখে, সেইভাবে রাখা আছে।

শাহেদ বলতো, ভাবিকে সবসময় দেখেছি, গোছানো মহিলা।

সে বলতো, গোছানো এক জিনিস, আর নীলিমা অন্য জিনিস। বল দেখি, ঘরে কয় পদের ডাল? বলতে পারলে দশ টাকা বাজি।

বলতে পারব না।

ডাল আছে চার পদের। মসুরি, মাষকলাই, মুগা এবং বুটের ডাল। মধু খেতে চাস? মধু আছে দুই রকমের। সুন্দরবনের মধু, হামদর্দের ওষুধ টাইপ মধু। খাবি একটু মধু? খিচুড়ি শেষ করে এক চামচ খা। ডেজার্ট হিসেবে খা।

খাওয়া-দাওয়া শেষ করে গৌরাঙ্গ লম্বা একটা ঘুম দিল। ঘুম থেকে উঠল। সন্ধ্যা পার করে। সে কোনো বাতি জ্বালালো না। টিভি চালিয়ে কিছুক্ষণ টিভি দেখল। সামরিক আইন প্রশাসকের নির্দেশ প্রচারিত হচ্ছে। সে খুব চেষ্টা করল নির্দেশগুলি মনে রাখতে। নির্দেশ পুরোপুরি পালন করতে হবে। যে দেশে সে বাস করে, তাকে তো সেই দেশের নিয়মই মানতে হবে।

টিভি দেখার পর সে ট্রানজিস্টার রেডিও নিয়ে বসল। ট্রানজিস্টারের নব ঘুরানোয় মজা আছে। এই শোনা যাচ্ছে রেডিও পিকিং চ্যাও ম্যাও ক্যাও। এই বাংলা সংবাদ। এই আবার চিংমিং পিং। ট্রানজিস্টারের নব ঘুরাতে ঘুরাতেই সে আকাশবাণী শিলিগুড়ি ধরে ফেলল। সেখানে বলা হচ্ছে–স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার গঠন করা হয়েছে। তারিখ দশই এপ্ৰিল।

গৌরাঙ্গের মাথা পুরোপুরি খারাপ হয়ে গেল তার পরদিন। তাকে দেখা গেল রাস্তায় রাস্তায় ঘুরছে। যে কাউকে দেখলেই এগিয়ে যাচ্ছে। গলা নিচু করে। বলছে— বলুন দেখি, বাংলাদেশের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির নাম কী? এক মিনিট সময়। এক মিনিটের ভিতর বলতে পারলে পুরস্কার আছে। বলতে পারছেন না? সহজ প্রশ্ন করি বলেন দেখি, আমার মেয়ের নাম কী? তিনটা চান্স দেব। তিন চান্সে বলতে পারলে পাশ।
 
ঢাকা শহরের প্রায় ফাঁকা রাস্তায় ঠেলাগাড়ি নিয়ে বের হয়েছে আসগর আলি এবং তার পুত্র মজনু মিয়া। মজনু মিয়ার বয়স নয়-দশ। তার পরনে কালো রঙের প্যান্ট। গা খালি। তবে মাথায় কিস্তি টুপি আছে। মজনু মুসলমান এই পরিচয়ের জন্যে মাথার টুপি বাঞ্ছনীয়। যে-কোনো কারণেই হোক মজনুর মন বড়ই বিষণ্ণ। সেই তুলনায় আসগর আলিকে মনে হয় আনন্দেই আছে। তার বয়স চল্লিশ। শক্ত-সমর্থ শরীর। বা পায়ে কিছু সমস্যা আছে বলে পা টেনে টেনে হাঁটে। তাতে ঠেলাগাড়ি চালাতে অসুবিধা হয় না। পঁচিশে মার্চের পর সে দাড়ি রেখেছে। লোকমুখে শোনা যাচ্ছে মুখে দাড়ি আছে, কলমা জানে—এরকম সাচ্চা মুসলমানদের মিলিটারিরা কিছু বলে না। চড়-থাপ্পড় দিয়ে ছেড়ে দেয়। এই খবর প্রচারিত হবার ফলে অনেক হিন্দুও দাড়ি রেখেছে। বাইরে বের হবার সময় তারা মাথায় গোলটুপি দেয়। কানের ভাঁজে আতর মাখানো তুলা থাকে। এখন অবশ্যি মিলিটারিবা চালাক হয়ে গেছে। দাড়ি এবং টুপিতে কাজ হচ্ছে না। খৎনা হয়েছে কি-না, লুঙ্গি খুলে দেখাতে হচ্ছে।

আসগর আলি তার ছেলেকে নিয়ে চিন্তিত। তার খৎনা এখনো হয় নাই। মিলিটারির হাতে ধরা পড়লে কোন ঝামেলা হয়–এই চিন্তায় আসগর অস্থির হয়ে থাকে। চার কলমা বাপ-বেটা কারোরই মুখস্থ নাই। আসগর আলি একটা কলমা জানে। কলমা তৈহিদ। লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ। এক কলমায় কাজ হবে কি-না কে জানে! এই কলমা মজনুকে মুখস্থ করানোর চেষ্টা সে কয়েকদিন ধরেই করছে। মুখস্থ হচ্ছে না। দেখা গেল। কলমা জানার জন্যে এবং খৎনা থাকার কারণে মিলিটারি তাকে ছেড়ে দিল। ধরে নিয়ে গেল। মজনুকে। মিলিটারির সঙ্গে দরবার করে কোনো লাভ হবে না। দরবার করতে গেলে উল্টা গুলি খেতে হবে। চোখের সামনে থেকে ছেলে ধরে নিয়ে যাবে। কিছুই বলা যাবে না। চোখের পানিও ফেলা যাবে না। মিলিটারি চোখের পানি দেখলে রেগে যায়। মুখে হাসি দেখলে তারা রাগে, চোখে পানি দেখলেও রাগে। বড়ই আজিব জাত।

আসগর আলি ছেলের দিকে ফিরে বলল, বাপধন শইলটা কি খারাপ? শইল খারাপ হইলে গাড়ির উপরে উইঠ্যা বস। আমি টান দিয়া নিয়া যাব।

মজনু বলল, শ‍ইল ঠিক আছে।

ক্ষিধা লাগছে?

না।

ক্ষিধা লাগলে বলবা। আইজ গোছ-পর্যাটা খাব; অবশ্য রিজিকের মালিক আল্লাপাক। উনার হুকুম হইলে খাব। হুকুম না হইলে কলের পানি।

মজনু কিছুই বলছে না। মাথা নিচু করে হাঁটছে। আসগর বলল, মার জন্যে পেট পুড়ে?

মজনু সঙ্গে সঙ্গে বলল,হুঁ।

এইবার রোগ ধরা পড়েছে। ছেলের মন খারাপ মার জন্যে। অনেকদিন মায়েরে দেখে না। এদিকে আবার শুরু হয়েছে সংগ্ৰাম। খোঁজ-খবর নাই।

বলছি তো যাব। এখন পথেঘাটে চেকিং বেশি। মিলিটারি সমানে ধরতাছে। উনিশ-বিশ দেখলেই ঠুসঠাস। তোরে নিয়াই আমার বেশি বিপদ। খৎনা হয় নাই, এইদিকে আবার কইলমাও মুখস্থ নাই। মুখস্থ হইছে?

না।

ক দেহি, ধরাইয়া দিতেছি। প্রথমে–লা ইলাহা…। তারপর কী?

জানি না।

আসগর তাকিয়ে দেখল, ছেলে চোখ মুছছে। লক্ষণ ভালো না। চোখের পানি মার জন্যে। ছেলের বয়স তো কম হয় নাই। অখনো যদি দুধের পুলার মতো মা মা করে তাইলে চলবে ক্যামনে! এখন রোজগারপতি শিখতে হবে। দুইটা পয়সা কীভাবে আসে সেই ধান্ধায় থাকতে হবে। মা মা করলে মার আদর পাওয়া যায়, ভাত পাওয়া যায় না। জগতের সারকথা কী? জগতের সার কথা মা না, বাপ না। জগতের সারকথা ভাত। হিন্দুরা বলে অন্ন।

বাপরে, ক্ষিধা লাগছে?

না।

খেচুড়ি খাবি, খেচুড়ি? (আসগর কী কারণে জানি খিচুড়িকে বলে খেচুড়ি। এই খাদ্যটা তার বড়ই পছন্দ। এক প্লেট আট আনা নেয়। আট আনায় পেট ভরে না।)

খেচুড়ির কথাতেও ছেলের চেহারায় কোনো পরিবর্তন হলো না। সে এখনো রাস্তার দিকে তাকিয়ে হাঁটছে। চোখ তুলছে না। আসগর বলল, আচ্ছা যা বিষ্যুদবারে নিয়া যাব। বিষ্যুদবার দিন ভালো। রহমতের দিন। বারের সেরা জুম্মাবার কিন্তু বিষ্যুদবারও মারাত্মক। থাকিবি কিছুদিন মার সাথে। আমি চেষ্টা নিব। এর মধ্যে খৎনা করাইতে। হাজম পাইলে হয়। সংগ্রামের সময় কে কই গেছে.

মজনুর মুখে হাসি ফুটল। সে বলল, ভুখ লাগছে।

কী খাবি? খেচুড়ি?

ডিমের সালুন দিয়া ভাত।

আসগর ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলল। এই ছেলের ভবিষ্যৎ অন্ধকার। সুখাদ্য বাদ দিয়ে সে চায় ডিমের সালুন। খেচুড়ি খাওয়ার এত বড় সুযোগ সে হেলায় হারাচ্ছে। জীবনে যখন বড় বড় সুযোগ আসবে সেগুলিও হারাবে।

খেচুড়ি খাইয়া দেখ।

ডিমের সালুন খাব।

আচ্ছা যা ডিমের সালুন।
 
আসগর ঠেলাগাড়ি ঘুরাল। সে বেশ আনন্দে আছে। কারণ গত কিছুদিন তার রোজগার ভালো হয়েছে। লোকজন মালামাল নিয়ে ঢাকা ছাড়ছে। কেউ যাবে কমলাপুর, কেউ বাসস্টেশন। সঙ্গে দুনিয়ার জিনিস। তারা ভাড়া হিসাবে যা দিচ্ছে তার পুরোটাই লাভ। ঠেলার মালিককে কিছু দিতে হচ্ছে না। কারণ পাঁচিশে মার্চের পর ঠেলামালিকের কোনো খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। মনে হয়। ঘটনা ভালো না। পাঁচশে মার্চ ১৪ তে ঠেলাটা ছিল আসগারের কাছে। তার শরীর ভালো ছিল না। পা ফুলে গিয়েছিল। সে ঠেলাটা নিজের কাছে রেখে দিযে ভেবেছিল সকালে মালিকের কাছে যাবে, ঘটনা ব্যাখ্যা করবে। তারপর তো লেগে গেল ধুন্ধুমার। যাকে বলে রোজ কেয়ামত। দুদিন পর কেয়ামত একটু ঠাণ্ডা হলে সে গেল ঠেলামালিকের খোজে।

মালিক দুটা ঘর তুলে থাকে কাটাবনে। গিয়ে দেখে কোথায় ঘর কোথায় কী! বেবাক পরিষ্কার। ঘরবাড়ি কিছুই নাই। সে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে, এক দাড়িওয়ালা আদমি এসে বলল, কারে খুঁজেন?

সে ভয়ে ভয়ে বলল, ঠেলামালিক ইদ্রিসারে খুঁজি। টিনের ঘর ছিল। ঘরের সামনে দুইটা আম গাছ। কোমর সমান উচা।

দাড়িওয়ালা বলল, টিনের ঘর ছনের ঘর সব শেষ। আম গাছ জাম গাছও শেষ। ঘরের বাসিন্দারাও শেষ; বাড়িতে যান। আল্লাখোদার নাম নেন।

সেই দুঃসময়েও আসাগরের মনে হলো, আল্লা যা করেন মঙ্গলের জন্যে করেন। এইরকম ভয়ঙ্কর ঘটনার মধ্যেও কিছু মঙ্গল আল্লাপাক রেখেছেন। যেমন এখন ঠেলাটার মালিক বলতে গেলে সে। দৈনিক তিন টাকা ঠেলাব জমা তাকে দিতে হবে না। শরীরটা যদি কোনো কারণে খারাপ হয় ঠেলার উপরে চাদর বিছিয়ে ঘুম দিবে। মালিকের জমার টাকা কীভাবে দিবে–এই নিয়ে অস্থির হতে হবে না। বরং সে ঠেলা অন্যকে ভাড়া দিতে পারে। বলতে গেলে সে এখন ঠেলার মালিক। কথায় আছে–আইজ ফকির কাইল বাদশা। কথা মিথ্যা না। তাকে দিয়েই তো মীমাংসা হয়েছে।

আল্লাপাকের অসীম রহমত–সংগ্ৰাম-এর মধ্যেও সে ভালো রোজগার করছে। ঢাকা ছেড়ে যাওয়া এখন ঠিক না। কিন্তু যেতে হবে ছেলের জন্যে। মা ছাড়া ছেলে কিছু বোঝে না। জীবন যে বড় জটিল আল্লাপাক তাকে সেই বোধ দেন নাই। আসগর আলি মাঝে-মধ্যে তাকে বোঝাবার চেষ্টা করে। নানান বিষয়ে উপদেশ দেয়। ছেলেকে উপদেশ দিতে তার ভালো লাগে। উপদেশ শুনে তার ছেলে গম্ভীর ভঙ্গিতে মাথা নাড়ায় আর মুখে বলে ই। ছেলের মুখে ই শুনতে তার বড় ভালো লাগে। কঠিন সময়ে বেঁচে থাকার জন্যে উপদেশের প্রয়োজন আছে। আসগর নানান বিষয়ে উপদেশ দেয়। ধর্ম, আল্লাপাকের বিচার, সবুরে মেওয়া ফলের মীমাংসা। কিছুই বাদ যায় না। তবে তার বর্তমান উপদেশ প্ৰায় সবই মিলিটারি সম্পর্কিত।

বাপধন শোন, মিলিটারি দেখলে তার চোখের দিকে তাকাইবা না। মাথা নিচু কইরা হাঁইট্টা চইল্যা যাবা। যেন কিছুই দেখ নাই। মনে থাকব?

হুঁ।

মিলিটারি যদি বলে–হল্ট। দৌড় দিবা না। দৌড় দিছ কি শ্যাষ। ধুম! পিঠের মধ্যে এক গুল্লি। মনে থাকব?

হুঁ।

মিলিটারির দিকে তাকাইয়া হাসব না, চোখের পানিও ফেলবা না। হাসিচোখের পানি দুইটাই মিলিটারির কাছে বিষ। মনে থাকব?

হুঁ।

সময় সুযোগ হইলে বলবা–পাকিস্তান জিন্দাবাদ। জয় বাংলা বলছ কি গুড়ুম। গুড়ুম। গুল্লি যে কয়টা খাইবা তার নাই ঠিক। মনে থাকব?

হুঁ।

মিলিটারির মধ্যে কিছু আছে কালা পিরান পিন্দে। এরার নাম কালামিলিটারি। এরা সাক্ষাৎ আজরাইল। দূর থাইক্যা যদি দেখা কালা জামা, ফুড়ুৎ কইরা গলির মইধ্যে ঢুকবা। চুকি দিয়া দেখনের কথা মনেও আনবা না। মনে থাকব?

হুঁ।

পথে যখনই নামবা একদমে আল্লাহু আল্লাহু করবা। আল্লাপাকের নিরানব্ববুই নামের সেরা নাম আল্লাহু। খাওয়া-খাদ্যের মধ্যে সেরা খাদ্য যেমন খেচুড়ি। আল্লাপাকের নামের মধ্যে সেরা নাম আল্লাহু। দিলের মধ্যে আল্লাহু থাকলে ভয় নাই। মনে থাকব?

হুঁ।

আসগর আলির গন্তব্য নীলক্ষেতের ভাতের দোকান। এখানে কয়েকটা দোকান আছে খাওয়া এক নম্বর। তরকারির ঝোল দুই-তিনবার নেওয়া যায়, কোনো অসুবিধা নাই। ডাইলের বাটি দুই আনা। এক বাটি শেষ করলে আরো কিছু পাওয়া যায়। সেইটা মাগনা।
 

Users who are viewing this thread

  • RAli
Back
Top