What's new
Nirjonmela Desi Forum

Talk about the things that matter to you! Wanting to join the rest of our members? Feel free to sign up today and gain full access!

Collected ছোছনা ও জননীর গল্প - উপন্যাস (2 Viewers)

বিলাক সিনেমাহলের কাছে এসে আসাগরের হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে গেল। পাঁচছয়জন কলা-মিলিটারি দাড়িয়ে আছে। তাদের সঙ্গে কাপড়ের হুড় লাগানো আলিশান এক ট্রাক। ট্রাকের ভেতরও মিলিটারি, তবে কালা-মিলিটারি না। আসগর চাপা গলায় বলল, বাপধন তাকাইস না। সিনেমাহলের দিকে তাকাইস না। দমে দমে আল্লাহু বল। মাথার টুপি ঠিক করা। বেঁকা হইয়া আছে।

আসগর আলি পেছনে ফিরে ছেলের কাণ্ড দেখে হতভম্ব। টুপি ঠিক করার বদলে সে চোখ বড় বড় করে কালো-মিলিটারির দিকেই তাকিয়ে আছে। এখন ছেলেকে ইশারা করে কিছু বলা ঠিক হবে না। মিলিটারি বুঝে ফেলবে ইশারায় কথাবার্তা চলছে। মিলিটারিরা ইশারা একেবাবেই পছন্দ করে না।

এই ঠেলাওয়ালা, থাম!

আসগর আলির মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল। একে বিপদ বলে না। একে বলে মহাবিপদ। নবিজীর শাফায়াত ছাড়া এই বিপদ থেকে রক্ষা নাই। আসগর আলি চোখ বন্ধ করে এক মনে সূরা ফাতেহা পড়ে ফেলল। এই একটা সূরাই তার মুখস্থ।

তোমার নাম কী?

আসগর আলি ভালোমতো তাকিয়ে দেখে মিলিটারি না। বাঙালি এক লোক তাকে প্রশ্ন করছে। বিশিষ্ট কোনো লোক হবে। তার সঙ্গে আরো লোকজন আছে। তাদের হাতে ক্যামেরা। আরো কী সব যন্ত্রপাতি। যে প্রশ্ন করছে তার গায়ে রঙচঙা শার্ট। মাথায় হইলদা টুপি। মিলিটারি যমানায় রঙচঙা শার্ট, মাথায় বাহারি টুপি পরে ঘুরে বেড়ানো সহজ ব্যাপার না। যে কেউ পারবে না। আসগর আলি বিনীত গলায় বলল, জনাব আমার নাম আসগর। আমার ছেলের নাম মজনু। আমারা ভালোমন্দ কোনো কিছুর মধ্যে নাই।

টুপিওয়ালা বলল, ভয় পােচ্ছ কেন? ভয়ের কিছু নেই। আমরা তোমার কিছু কথাবার্তা রেকর্ড করব। টিভিতে প্রচার হবে। টিভি চিন?

জি জনাব চিনি।

আমরা সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষদের ইন্টারভ্যু নিচ্ছি। ঢাকার পরিস্থিতি স্বাভাবিক। কোনো ঝামেলা নাই–এইটা বলবে। বুঝেছি?

জি।

উল্টাপাল্টা কিছু বলবে না। শুধু ভালো ভালো কথা বলবে। যেমন শহর শান্ত। কোনো সমস্যা নাই। দোকানপাট খুলেছে। ব্যবসা বাণিজ্য হচ্ছেএইসব। ঠিক আছে?

জি।

ওকে, ক্যামেরা।

একজন এসে আসগর আলির মুখের সামনে ক্যামেরা ধরল। একজন ধরল ছাতির মতো একটা জিনিস। টুপিওয়ালা মাইক হাতে প্ৰায় আসগর আলির গা ঘেসে দাঁড়াল। টুপিওয়ালার মুখভর্তি হাসি।

আমরা এখন কথা বলছি ঢাকা শহরের খেটে খাওয়া একজন শ্রমজীবির। সঙ্গে। তিনি এবং তার পুত্র এই শহরে দীর্ঘদিন ধরে ঠেলা চালান। ভাই, আপনার নাম কী?

আমার নাম আসগর। আমার ছেলের নাম মজনু।

ঢাকা শহরে এখন ঠেলা চালাতে আপনার কি কোনো সমস্যা হচ্ছে?

জে-না।

শহরের অবস্থা কী?

অবস্থা ভালো। মাশাল্লাহ। অবস্থা খুবই ভালো।

চারদিকে যা দেখছেন তাতে কি মনে হয়–শহরে কোনো সমস্যা আছে?

জে-না।

শহরের বর্তমান অবস্থায় আপনি কি সন্তুষ্ট? আয় রোজগার হচ্ছে?

জি জনাব। পাকিস্তান জিন্দাবাদ।

ভাই আসগর আলি, আপনাকে ধন্যবাদ।

আসগর কপালের ঘাম মুছল। আল্লাপাকের অসীম দয়ায় বিপদ থেকে অল্পের উপর রক্ষা পাওয়া গেছে। টুপিওয়ালা লোকটা ভালো। সে পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট বের করে তাকে একটা সিগারেট দিল। এখানেই শেষ না। পাঁচটা টাকাও দিল। আসগর ভেবেছিল তার মহা বিপদ। এখন দেখা গেলবড়ই সুখের সময়। আল্লাপাক কখন যে মানুষকে বিপদ দেন, কখন যে বিপদ থেকে উদ্ধার করে পুরস্কার দেন বোঝা মুশকিল। কে ভেবেছিল কোনো পরিশ্রম ছাড়া মুখের কথায় রোজগার হয়ে যাবে। এই জমানায় পাঁচ টাকা কোনো সহজ ব্যাপার না।
 
খেতে বসে মজনু সিদ্ধান্ত বদল করল। ডিমের সালুন না, সে গরুর মাংস খাবে। আসগর আনন্দিত গলায় বলল, যত ইচ্ছা খা। যেইটা খাইতে ইচ্ছা করে খা। তয় এইখানেও একটা ঘটনা আছে।

মজনু বলল, কী ঘটনা?

আসগর বলল, রিজিক আল্লাপাকের নিজের হাতে। তুই কী খাবি না খাবি সবই আল্লাপাক আগেই ঠিক কইরা রাখছেন। এখন যদি তুই ডিমের সালুন খাস, বুঝতে হবে। আল্লাপাক নির্ধারণ কইরা রাখছেন ডিমের সালুন। আর যদি গরুর মাংসের ভুনা খাস, তবে বুঝন লাগব রিজিকে ছিল গো মাংস।

যদি দুইটাই খাই?

তাইলে বুঝতে হবে। আল্লাহপাক নির্ধারণ কইরা রাখছেন আমার পেয়ারের বান্দা মজনু মিয়া ডিমের সালুনও খাবে, গো মাংসও খাবে। তোর কি দুইটাই খাইতে মন চাইতেছে?

হুঁ।

খা, দুইটাই খা। অসুবিধা নাই। সবই আল্লাপাকের নির্ধারণ। আমার করনের কিছু নাই। আমি উসিলা। পুরা দুনিয়াটাই তার উসিলার কারখানা।

মজনু মিয়ার খাওয়া দেখে আসগধের ভালো লাগছে। কী আগ্রহ করেই না সে খাচ্ছে! সে খাচ্ছে মাংস দিয়ে কিন্তু ডিমটাও পাতে রেখে দিয়েছে। মাঝেমাঝে ডিমটা হাতে নিয়ে দেখছে। আবার থালার এক কোনায় রেখে দিচ্ছে। তার মনে হয় খেতে মায়া লাগছে। আহা বেচারা! পাঁচিশে মার্চ রাত থেকে ছাবিবশে মার্চ সারাদিন-রাত সে ছিল না খাওয়া। তারা বাপ-বেটা লুকিয়ে ছিল গর্তের ভেতর। মতিঝিলে বিল্ডিং বানানোর জন্যে বড় গর্ত করা হয়েছিল, সেই গর্তে। এই দীর্ঘ সময়ে মজনু একবারও বলে নাই— ভুখ লাগছে। বড়ই বুঝদার ছেলে। আসগর বলল, মাংস স্বাদ হইছে?

মজনু বলল, ই।

ডিমটা খা।

অখন না। পরে।

মার জন্যে তোর কি বেশি পেট পুড়তাছে?

হুঁ।

আসগর আলি রহস্যময় গলায় বলল, পেট বেশি পুড়লে একটা ঘটনা অবশ্য ঘটানি যায়। আইজও যাওয়া যায়। খাওয়া শ্যাষ কইরা বাসে উঠলাম। চইলা গেলাম। সন্ধ্যার আগে আগে উপস্থিত। এখন বাস চলাচল আছে।

মজনু একদৃষ্টিতে বাবার দিকে তাকিয়ে আছে। তার চোখ ছলছল করছে। মনে হচ্ছে যে-কোনো মুহুর্তে সে আনন্দে কেঁদে ফেলবে। আসগর আলির খাওয়া শেষ হয়েছে। সে টুপিওয়ালা সাহেবের দেয়া সিগারেটটা আরাম করে ধরিয়েছে। দোকানের ছেলেটাকে বলেছে জর্দা দিয়ে একটা পান দিতে। সে মন ঠিক করে ফেলেছে–আজই যাবে। ছেলেটা এত খুশি হয়ে তাকিয়ে আছে! খুশি নষ্ট করা ঠিক না। ছেলেমেয়ের খুশি অনেক বড় জিনিস।



টঙ্গী ব্রিজের কাছে মিলিটারি চেকপোষ্ট। বাসের সব যাত্রীদের নামিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। মিলিটারিরা যাত্রীদের মালামাল পরীক্ষা করে দেখে। আসগর আলির বাস চেকপোষ্টে থামল। বাসের আটত্রিশজন যাত্রীর মধ্যে ছয়জনকে আলাদা করা হলো। কোনোরকম কারণ ছাড়াই তুরাগ নদীর পাড়ে দাঁড় করিয়ে তাদের গুলি করা হলো। মৃতদেহগুলি ভাসতে থাকল। তুরাগ নদীতে। সেই ছয়জন হতভাগ্যের একজন আসগর আলি। গুলি করার আগমুহূর্তেও সে বুঝতে পারে নি তাকে গুলি করা হচ্ছে। সে তাকিয়েছিল মজনুর দিকে। মজনুর হাতে তার মার জন্যে কেনা কচুয়ারঙের শাড়ির প্যাকেট। আসগর আলির একমাত্র দুশ্চিন্তা–মিলিটারিরা শাড়ির প্যাকেট রেখে দিবে না তো?

সেদিন রাত নটায় নগরীর হালচাল অনুষ্ঠানে ঢাকা নগরে সমাজের বিভিন্ন স্তরের কিছু মানুষের ইন্টারভিউ প্রচার করা হলো। তাদের মধ্যে সরকারি চাকুরে আছেন, ব্যবসায়ী আছেন, গৃহিণী আছেন এবং শ্রমজীবী মানুষের প্রতিভূ হিসেবে আসগর আলিও আছে। গৃহিণী হাসিমুখে বললেন, শহরের অবস্থা এখন অনেক ভালো। বিশৃঙ্খলার সময় গরুর মাংসের সের হয়েছিল দুটাকা। এখন সবচে ভালোটা দেড় টাকায় পাওয়া যায়। পেয়াজ এবং লবণের দামও কমেছে।

অনুষ্ঠান শেষ হলো আসগর আলিকে দিয়ে। উপস্থাপক জিজ্ঞেস করলেন, শহরের বর্তমান অবস্থায় আপনি কি সন্তুষ্ট?

আসগর আলি বলল, জি জনাব। পাকিস্তান জিন্দাবাদ।



আসগর আলির সঙ্গে গলা মিলিয়ে গৌরাঙ্গ বলল, পাকিস্তান জিন্দাবাদ!

গৌরাঙ্গ খাটে লম্বা হয়ে শুয়ে আছে। তার গায়ে গরম চাদর। সে চোখ বড় বড় করে টিভি দেখছে। সন্ধ্যার পর থেকে যত রাত পর্যন্ত টিভি চলে সে টিভি দেখে। শেষ অধিবেশনে পাকিস্তানের জাতীয় সঙ্গীত হয়–পাক সারা যামিন সাদবাদ। গৌরাঙ্গ সুর কবে জাতীয় সঙ্গীত গায়। তখন তাকে দেখে মনে হয় সে বেশ আরাম পাচ্ছে। শাহেদের সঙ্গে সে কথা বলে না। প্রশ্ন জিজ্ঞেস করলে চুপ করে থাকে। কথা বলে নিজের মনে। বিড়বিড় করে কথা। শাহেদ যখন বলে, কী বলছ? তখন সে এমন ভঙ্গিতে তাকায় যেন শাহেদ খুবই অন্যায় কোনো কথা বলেছে, যে কথা শুনে সে আহত! গৌরাঙ্গের আরেক সমস্যা হলো, বাথরুমে যখন যায়। তখন বাথরুমের দরজা পুরোপুরি খোলা রাখে। দরজা বন্ধ করলে তার নাকি ভয় লাগে।
 
শাহেদ বুঝতে পারছে, গৌরাঙ্গের বড় ধরনের কোনো মানসিক সমস্যা হয়েছে। তাকে ভালো ডাক্তার দেখানো উচিত। এখন কোথায় ডাক্তার, কোথায় কী? শহর পুরো এলোমেলো। কখন এই এলোমেলো অবস্থা কাটবে কে জানে! তার বাসার কাছেই যে ফ্যামেসি সেখানে মাঝে-মাক্সে একজন ডাক্তার বসেন। তার সঙ্গে শাহেদ কথা বলেছে। ডাক্তার সাহেব বলেছেন, পাগলের দেশে সবাই মানসিক রোগী। এই রোগের কোনো চিকিৎসা নাই। ঘুমের ওষুধ দিচ্ছি। ওষুধ খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে রাখবেন।

ঘুমের ওষুধ গৌরাঙ্গকে রাতে খাওয়ানো হয়। এতে তার ঘুম আসে না। তবে ওষুধ খাবার পর সে মোটামুটি স্বাভাবিকভাবে কথা বলে। কথার বিষয়বস্তু এলোমেলো, তবে বলার ভঙ্গি স্বাভাবিক।

মিতা, আমি ঠিক করেছি। মুসলমান হবো। আসল মুসলমান। তুমি ব্যবস্থা করো। হিন্দু হওয়ার অনেক যন্ত্রণা। আর ভালো লাগে না। তবে দুর্গাপূজা দিতে হবে। বৎসরে একবার তো। চুপেচাপে দিয়ে দিব। তাতে কি কোনো সমস্যা হবে?

এই জাতীয় প্রশ্নের জবাব দেয়া অর্থহীন। শাহেদ চুপ করে থাকে। গৌরাঙ্গের তাতে সমস্যা হয় না। সে নিজের মনে কথা বলতে থাকে।

মিতা শোন, এই মুহুর্তে বাংলাদেশের সবচে নিরাপদ জায়গা কোনটা জানো?

জানি না।

সবচে নিরাপদ জায়গা হলো, পুরনো ঢাকার হিন্দুবাড়ি। যে-সব বাড়িতে মিলিটারি অ্যাটাক করে মানুষজন মেরে ফেলেছে সেইসব বাড়ি। যেমন ধরো, আমার বাড়ি। দ্বিতীয় দফায় সেইসব বাড়িতে মিলিটারি ঢুকবে না। বুঝেছি মিতা?

বুঝেছি।

আমি ঠিক করেছি, নিজের বাড়িতে গিয়ে থাকব। বাড়ির দখল ছেড়ে দেয়া তো ঠিক না। বুদ্ধি ভালো বের করেছি না?

হুঁ।

তুমিও চলো আমার সঙ্গে। দুই ভাই একসঙ্গে থাকল।

ঘুমাও। রাত অনেক হয়েছে।

রাত হয়েছে বলেই তো আমি ঘুমাব না। মিতা, তোমার তো জানা উচিত আমি রাতে ঘুমাই না, দিনে ঘুমাই। নিজের নাম এখন দিয়েছি–গৌরাঙ্গ প্যাচক। নাম ভালো হয়েছে না?

হুঁ।

মুসলমান হওয়ার পর নাম বদলাতে হবে। মিতা, বলে তো কী নাম দেই? তোমার নামের সঙ্গে মিল দিয়ে একটা নাম ঠিক করো।

আচ্ছা করব।

করব না, এখন করো।

বিরক্ত করো না তো! নানান যন্ত্রণায় আছি। এখন আর বিরক্তি ভালো লাগে না।

আমি তোমাকে বিরক্ত করি?

শাহেদ চুপ করে আছে। তার এখন সত্যি সত্যি বিরক্তি লাগছে। গৌরাঙ্গ গলা উচিয়ে বলল, বিরক্ত করি? জবাব দাও, বিরক্ত করি?

হ্যাঁ, করো।

আর করব না। কাল সকালে আমি চলে যাব।

কোথায় যাবে?

সেটা আমার বিষয়। তুমি কোনোদিনই আমাকে পছন্দ করো না, সেটা আমি জানি। সকাল হোক। রাস্তায় রিকশা নামলেই আমি বিদায় হবো।

তোমার শরীর ভালো না। এখন পাগলামি করার সময়ও না।

এখন কী করার সময়? বিরক্ত করার সময়। Time of annoyance? আমার নতুন নাম এখন কি গৌরাঙ্গ বিরক্ত দাস? সংক্ষেপে জি বি দাস?

প্লিজ চুপ করো।

না মিতা, আমি চুপ করব না। আমি বিরক্ত করতেই থাকব। যা বিরক্ত করার আজ রাতেই করব। সকালে আমাকে পাবে না।



পরদিন ভোরবেলা গৌরাঙ্গ সত্যি সত্যিই শাহেদের বাসা ছেড়ে চলে গেল। শাহেদকে কিছু বলে গেল না। শাহেদ তখনো ঘুমে। শাহেদের বালিশের কাছে একটা চিঠি লিখে গেল। দু লাইনের চিঠি–

মিতা, চলে গেলাম।

তুমি ভালো থেকে।

ইতি

গৌরাঙ্গ বিরক্ত দাস
 
শাহেদের চেহারায় পাগল পাগল ভাব চলে এসেছে। চোখ হলুদ, চোখের নিচে গাঢ় কালি। ছয় সাত দিন হলো দাড়ি কামানো হয় নি। একটা সার্ট পরে আছে যার মাঝের একটা বোতাম নেই। জায়গাটা ফাক হয়ে আছে–মাঝে মাঝেই পেট দেখা যাচ্ছে। পাগলের এলোমেলো ভাব তার চলাফেরার মধ্যেও চলে এসেছে। কথা জড়িয়ে যাচ্ছে। আজ এপ্রিল মাসের দশ, এখনো সে আসমানীর কোনো খবর বের করতে পারে নি। তার রোজাকার রুটিন হলো, ঘুম থেকে উঠেই কলাবাগানে চলে যাওয়া। তার শাশুড়ি এসেছেন। কিনা কিংবা কেউ কোনো খবর পাঠিয়েছে কিনা সেই খোঁজ নেয়া। তারপর তার অফিসে যাওয়া। তার অফিস খুললেও সেখানে বলতে গেলে কোনো লোকজন নেই, কাজকর্মও নেই। বি হ্যাপী স্যারের কোনো খোঁজ নেই। সম্ভবত তিনি পাকিস্তান চলে গেছেন। শাহেদ অফিসে তার নিজের ঘরে বসে। কয়েক কাপ চ খেয়ে বের হয়ে পড়ে এবং বেলা দুটা পর্যন্ত রাস্তায় রাস্তায় হাঁটে। তার সারাক্ষণই মনে হয় এই বুঝি রুনি চেচিয়ে ডাকবে–বাবা! বাবা!

কেউ ডাকে না। দুপুর দুটিায় কোনো একটা হোটেলে ভাত খেতে বসেতখন মনে হয়, আসমানীরা বাড়ি ফিরে এসেছে। আসমানী তার স্বভাবমতো ঝাড়মোছা শুরু করেছে। রুনি বারবার বারান্দায় আসছে। আসমানী তাকে কঠিন বকা দিচ্ছে, খবরদার বারান্দায় যাবি না। এখন সময় খারাপ। মার বকা খেয়ে রুনির ঠোঁট বেঁকে যাচ্ছে কিন্তু সে কাঁদছে না।

এই জাতীয় চিন্তা মাথায় এলে আর ভাত খেতে ইচ্ছা করে না। শাহেদ আধখাওয়া অবস্থায় হাত ধুয়ে উঠে পড়ে। দ্রুত বাসায় যেতে হবে। সে বাসায় ফিরে এবং দেখে দরজায় ঠিক আগের মতো তালা ঝুলছে। গৌরাঙ্গেরও কোনো খোঁজ নেই। সে কোথায় গিয়েছে কে জানে!



শাহেদ তার অফিসে চেয়ারে পা তুলে জবুথবু হয়ে বসে আছে। তার সামনে চায়ের কাপ। এক চুমুক দিয়ে সে কাপ নামিয়ে রেখেছে আর মুখে দিতে ইচ্ছে করছে না। অথচ চা-টা খেতে ভালো হয়েছে। গতরাতে তার এক ফোটা ঘুম হয় নি। একবার তন্দ্রার মতো এসেছিল, তখন ভয়াবহ দুঃস্বপ্ন দেখেছে। প্ৰকাণ্ড একটা ট্রাক। মিলিটারি ট্রাক। ট্রাকভর্তি একদল শিশু। সবাই চিৎকার করে কাদছে। শিশুদের মধ্যে আছে রুনি। রুনি চিৎকার করে কাদছে না, তবে ফ্রকের হাতায় ক্রমাগত চোখ মুছছে। একজন মিলিটারি মেশিনগান তাক তরে শিশুগুলির দিকে ধরে আছে। মিলিটারির মুখ হাসি হাসি। স্বপ্ন দেখে শাহেদ ঘুম ভেঙে ধড়মড় করে উঠে বসেছে, তারপর আর ঘুম আসে নি।

এখন ঘুম ঘুম পাচ্ছে, ইচ্ছা করছে অফিসের চেয়ারেই কিছুক্ষণ ঘুমিয়ে নিতে। অফিসের পিওন মোশতাক খবরের কাগজ এনে টেবিলে রাখল। মোশতাক বিহার প্রদেশের লোক। চমৎকার বাংলা জানে। এতদিন সে রাংলাতেই কথা বলত— এখন উর্দুতে কথা বলে! মোশতাকের গলায় নকশাদার নীল রুমাল বাঁধা। শাহেদ লক্ষ করেছে, বিহারিরা এখন কেন জানি গলায় রঙিন রুমাল বাঁধছে। হয়তো আগেও বাধত— চোখে পড়ত না। এখন চোখে পড়ছে কারণ বিহারিদের এখন খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখা হচ্ছে। বিহারিরা আলাদা হয়ে পড়েছে। তারা যোগ দিয়েছে মিলিটারিদের সঙ্গে। বাঙালির দুর্দশায় তারা বড় তৃপ্তি পাচ্ছে। হয়তো তাদের ধারণা, মিলিটারি সব বাঙালি শেষ করে এই দেশটাকে বিহার রাজ্য বানিয়ে দিয়ে যাবে।



শাহেদের ঝিমুনি চলে এসেছিল–মোশতকের খুকধুক কাশিতে নড়েচড়ে বসিল। মোশতাক গায়ে আতর দিয়েছে। আতরের বোটিক গন্ধ আসছে। চোখে সুরমা দেয়া হয়েছে। সুবম অবশ্যি সে আগেও দিত। বিহারিদের সুরমাখ্ৰীতি আছে। শাহেদ বলল, কিছু বলবে মোশতাক?

মোশতাক দাঁত বের করে হাসল।

দেশের খবরাখবর কী বলো?

বহুত আচ্ছা জনাব। বহুত খুব।

মিলিটারি সব ঠাণ্ডা করে দিয়েছে?

গাদার সব খতম হো গিয়া। আল্লাহ কা মেহেরবানি।

পুরানা গাদ্দার হয়তো খতম হয়েছে–নতুন গাদ্দার তৈরি হয় কি-না কে জানে।

আউর কুছ নেহি হোগা। ইন্ডিয়া খামোস রাহোগা— কিউকে চায়না। হ্যায় হামালোগাকো সাথ।

শাহেদ হাই তুলতে তুলতে বলল, এখন যাও তো মোশতাক–আমি ঘুমোব।

তবিয়ত আচ্ছা নেহি?

শাহেদ জবাব দিল না। সস্তা আতরের গন্ধে তার গা গুলাচ্ছে। এইসব আতর তৈরি হয়েছে ডেডবডির গায়ে ঢালার জন্যে। জীবিত মানুষদের জন্য না।

মোশতাক চলে গেল। দেশের সাম্প্রতিক অবস্থা নিয়ে গল্পগুজব করার তার বোধহয় ইচ্ছা ছিল। বিহারিরা বাঙালিদের মতোই আডিডাবাজ।

শাহেদ খবরের কাগজ হাতে নিল। দুই পাতার দৈনিক পাকিস্তান বের হচ্ছে। খবর বলতে কিছুই নেই। অভ্যাসবশে চোখ বুলিয়ে যাওয়া—

দেশের পাঁচজন বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবী সেনাবাহিনীর কার্যক্রমকে স্বাগত জানিয়েছেন। তারা জেনারেল ইয়াহিয়া খানকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন সময়োপযোগী পদক্ষেপ নেয়ার জন্য। অখণ্ড পাকিস্তানে যারা বিশ্বাসী নয়। তাদের ব্যাপারে জনগণকে তাঁরা সদা প্ৰস্তুত থাকতে আহবান জানাচ্ছেন।…

খোলাবাজারে চালের দাম স্থিতিশীল

সচিত্র প্রতিবেদন। এক বেপারির হাসিমুখের ছবিও ছাপা হয়েছে। বেপারি দাড়িপাল্লায় চাল ওজন করছে। তার হাসিমুখ দেখে মনে হচ্ছে চালের ব্যবসা করে এত আনন্দ সে কোনোদিন পায় নি।

সুইজারল্যান্ডে বাস খাদে পড়ে চারজন নিহত

বিশাল রিপোর্ট। ক্রেন দিয়ে বাস তোলার ছবিও আছে।

শাহেদের মুখ বিকৃত হয়ে গেল। যে দেশে প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ কুৎসিতভাবে মারা যাচ্ছে, সে দেশের একটি পত্রিকায় কী করে সুইজারল্যান্ডে বাস খাদে পড়ার ছবি ছাপায়? চারজন কেন, চারশ জন মারা গেলেও তো সেই ছবি ছাপা উচিত না। পত্রিকাটা কি সে দলামচা করে ডাস্টবিনে ফেলবে? কী হবে তাতে।

শাহেদ ভাই আছেন না-কি?

দরজা ঠেলে দেওয়ান সাহেব ঢুকলেন। দেওয়ান সাহেবের মুখভর্তি পান। হাতে সিগারেট। মনে হয় তিনি খুব আয়েশ করে সিগারেট টানছেন। তার মুখ হাসি হাসি।

শরীর খারাপ না-কি শাহেদ?

জি-না।

দাড়ি-গোঁফ গজিয়ে একেবারে দেখি সন্ন্যাসী হয়ে গেছেন। ভাবির কোনো খবর পেয়েছেন?

জি-না।

দেশের বাড়িতে খবর নিয়েছেন?

জি-না।

ঢাকা থেকে যারা পালিয়েছে, তাদের বেশিরভাগই কোনো না কোনোভাবে দেশের বাড়িতে উপস্থিত হয়েছে। আপনার শ্বশুরবাড়ি কোথায়?

ময়মনসিংহের ভাটি অঞ্চলে। অনেক দূরের দেশ। এত দূরে একা একা আসমানী যাবে না।

ক্ষিধে পেলে বাঘ ধান খায়। ভয় পেলে বাঙালি একা একা অনেক দূর যায়।

ও আমাকে ফেলে রেখে কোথাও যাবে না। আমার ধারণা, সে ঢাকা কিংবা ঢাকার আশপাশেই আছে।

দেওয়ান সাহেব চেয়ার টেনে বসলেন। শাহেদ অবাক হয়ে লক্ষ করল, ভদ্রলোক আনন্দিত ভঙ্গিতে পা নাচাচ্ছেন।

শাহেদ ভাই!

জি।

তখন যদি আমার কথা শুনতেন, তাহলে আজ আর এই সমস্যা হতো না।

আপনার কী কথা?

ভুলে গেছেন? শেখ সাহেবের ৭ই মার্চের ভাষণের পরদিন আপনাকে বললাম না? ফ্যামিলি দেশে পাঠিয়ে দেন–সিচুয়েশন ভেরি গ্রেভ।

বলেছিলেন নাকি?

অবশ্যই বলেছিলাম। অফিসের এমন লোক নেই–যাকে আমি এই সাজেশন দেই নি। গরিবের কথা বাসি হলে ফলে। আমার কথা বাসি হয়েছে তো–তাই ফলেছে। টাটকা অবস্থায় ফলে নি। বললে বিশ্বাস করবেন নাআপনার ভাবি কিছুতেই দেশে যাবে না। ঝগড়া, চিৎকার, কান্নাকাটি। বলতে গেলে জোর করে তাকে লঞ্চে তুলে দিয়েছি। তুলে দিয়েছি বলে আজ ঝাড়া হাত-পা। যদি সেদিন লঞ্চে না তুলতাম–আজ আমার অবস্থাও আপনার মতো হতো। শাহেদ ভাই!

জি।

আজ আমার সঙ্গে চলেন এক জায়গায়।

কোথায়?

খুব কামেল একজন মানুষ আছেন–সবাই ভাই পাগলা ডাকে। অলি টাইপের মানুষ। তার কাছে আপনাকে নিয়ে যাব।

তাঁর কাছে গেলে কী হবে?

ওলি টাইপ মানুষ। তাদের আধ্যাত্মিক ক্ষমতা প্রচুর। চোখ বন্ধ করে বলে দিতে পারবেন। ভাবি এখন কোথায়?

শাহেদ চুপ করে রইল। দেওয়ান সাহেব আগ্রহের সঙ্গে বললেন, হুজ্বরের কাছে খুব ভিড়। নিরিবিলি কথা বলাই মুশকিল। আমার কানেকশন আছে—ব্যবস্থা করব। যাবেন?

জি-না।

ক্ষতি তো কিছু হচ্ছে না–এরা কামেল আল্লাহওয়ালা আদমি।

শাহেদ বিরক্ত মুখে বলল, আমি পীর ফকিরের কাছে যাব না।

বিপদে পড়লে মানুষ গু পর্যন্ত খায়, আর আপনি যাবেন। একজন কামেল মানুষের কাছে। উনার কাছে পাকিস্তানি মিলিটারিরাও যায়। হাইলেভেলের অফিসারদের আনাগোনা আছে।

একবার তো বলেছি। যাব না। কেন বিরক্ত করছেন?
 
যাবে না বলার পরও শাহেদ ভাই পাগলা পীর সাহেবের কাছে এসেছে। দেওয়ান সাহেব তার কথা রেখেছেন। পীর সাহেবের সঙ্গে নিরিবিল কথা বলার ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। পীর সাহেব বসে আছেন তার খাস, কামরায়। ছোট্ট ঘরের মাঝখানে কার্পেটের উপর হাঁটুমুড়ে তিনি বসে। তাঁর সামনে পানের বাটা ভর্তি পান।

পীর সাহেব পান চিবুচ্ছেন। পানের রস ফেলার জন্য পিকদান আছে। পিকদানটা মনে হচ্ছে রুপার। ঝকমক করছে। একটু পর পরই পিকদানে পিক ফেলছেন। তাঁর ডানহাতে বড় বড় দানার এক তসবি। সেই তসবি দ্রুত ঘুরছে। পীর সাহেব যখন কথা বলছেন তখনো তসবি ঘুরছে। সম্ভবত কথা বলা এবং আল্লাহর নাম নেয়ার দুটো কাজই তিনি এক সঙ্গে করতে পারেন। ভাই পাগলা পীর সাহেবের বয়স অল্প। তার মুখভর্তি ফিনফিনে দাড়ি। সেই দাড়ি সামান্য বাতাসেই কাঁপছে। পীর সাহেবের গলার স্বর অতিমধুর।

আপনার কন্যা এবং স্ত্রীর কোনো খোঁজ পাচ্ছেন না?

জি-না।

বাইশ তেইশ। (স্ত্রীর বয়স জানার প্রয়োজন কী শাহেদ বুঝতে পারছে না)

দেখতে কেমন? (দেখতে কেমন দিয়ে প্রয়োজন কী?)

জি, ভালো।

নাম বলেন।

আসমানী।

ভালো নাম বলেন।

নুশরাত জাহান।

ভাই পাগলা চোখ বন্ধ করলেন। মিনিট পাঁচ ছয় তিনি চোখ বন্ধ অবস্থাতেই থাকলেন। তার হাতের তসবি অতি দ্রুত ঘুরতে লাগল। তিনি এক সময় চোখ মেলে বললেন, চিন্তার কিছু নাই, সে ভালো আছে।

ভালো আছে?

হুঁ। আপনার কন্যা ও মাশাল্লাহ ভালো আছে।

তারা কোথায় আছে?

ঢাকা শহরে নাই। শহর থেকে দূরে। ঢাকা থেকে নদী পথে গিয়েছে।

শাহেদ মনে মনে বলল, চুপ কর ব্যাটা ফাজিল। ঢাকা থেকে যারা বের হয়েছে, তাদের সবাই নদী পথেই গিয়েছে। আকাশপথে কেউ যায় নাই। ব্যাটা বুজরুক।

ভাই পাগলা বললেন, তারা আছে এক দোতলা বাড়িতে। বাড়ির সামনে ফুলের বাগান। জবা ফুল।

শাহেদ মনে মনে বলল, ব্যাটা থাম।।

তাদের সঙ্গে দীর্ঘদিন আপনার দেখা হবে না।

তাই নাকি?

জি। আপনার স্ত্রী তো সন্তানসম্ভবা। আপনার আরেকটি কন্যাসন্তান হবে।

শুনে খুব ভালো লাগল। হুজুর, আজ তাহলে উঠি?

ভাই পাগলা তাঁর পা বাড়িয়ে দিলেন–কদমবুসির জন্য। শাহেদ কদমবুসি করল না। লোকটির বুজরুকিতে তার মাথা ধরে গেছে।

ভাই পাগলা পীর সাহেবের কাছ থেকে ফেরার পথে সে মিলিটারির হাতে ধরা পড়ল। নাটকীয়তাবিহীন একটা ঘটনা। দেওয়ান সাহেবকে বিদায় দিয়ে সে সিগারেট কেনার জন্য পান, সিগারেটের দোকানে গিয়েছে। এক প্যাকেট সিজার্স সিগারেট কিনে টাকা দিয়েছে, তখন তার পাশে এক ভদ্রলোক এসে দাড়ালেন। বাঙালি ভদ্রলোক। তিনি সহজ গলায় বললেন, আপনার নাম কী?

শাহেদ বলল, নাম দিয়ে কী করবেন?

লোকটি নিচু গলায় বলল, আপনি একটু আসুন আমার সঙ্গে।

কেন?

দরকার আছে। বিশেষ দরকার।

শাহেদ তার সঙ্গে রাস্তা পার হলো। রাস্তার ওপাশে একটা মিলিটারি জিপ দাড়িয়ে আছে তা সে লক্ষ করে নি।

শাহেদকে জিপে উঠতে হলো।



মিলিটারি জিপগুলো সাধারণ জিপের মতো না। লম্বাটে ধরনের। বসার জায়গায় গদি বিছানো না–লোহার সিট। জিপটা সম্ভবত রঙ করা হয়েছে। নতুন রঙের কড়া গন্ধ। গা গুলিয়ে উঠছে। শাহেদকে ধাক্কা দিয়ে জিপে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে–সে পিছলে পড়ে যেত। অন্ধকারে, কেউ একজন তাকে ধরলা, সিটে বসিয়ে দিল। শাহেদ মনে মনে বলল, ধন্যবাদ। ইংরেজিতে থ্যাংক যু শব্দ করে বলা যায়। বাংলা ধন্যবাদ মনে মনে বলতেই ভালো লাগে।

অন্ধকারে কিছু দেখা না গেলেও শাহেদ বুঝতে পারছে জিপ ভর্তি তার মতো সাধারণ মানুষ। মানুষগুলো ভয়ে অস্থির হয়ে আছে। ভীত মানুষের গা থেকে এক ধরনের গন্ধ বের হয়। সেই গন্ধ সূক্ষ্ম হলেও কটু ও ভারি। ভয়ের গন্ধ মানুষের স্নায়ুকে অবশ করে দেয়।

জিপ চলতে শুরু করেছে। মিলিটারি গাড়ি খুব দ্রুত চলে বলে যে জনশ্রুতি তা ঠিক না। জিপটা খুব আস্তে চলছে। জিপের সাসপেনশনও খুব খারাপ। গাড়ি খুব লাফাচ্ছে। জিপের ছাদে লোহার রডে শাহেদের মাথা ঠেকে গেল! শাহেদ যার পাশে বসেছে সেই ভদ্রলোক আশ্চর্যরকম মিষ্টি গলায় বললেন, এই ডাণ্ডাটা শক্ত করে ধরে বসে থাকুন। তিনি অন্ধকারেই শাহেদের হাত ধরে ডাণ্ডা দেখিয়ে দিলেন। কিছু কণ্ঠস্বর আছে একবার শুনলেই আবার শুনতে ইচ্ছে করে। ভদ্রলোকের কণ্ঠস্বর সে-রকম। সেই কণ্ঠস্বর আবারো শোনার জন্য শাহেদ বলল, আমরা কোথায় যাচ্ছি?

ভদ্রলোক বললেন, জানি না। গাড়ি এখন মিরপুর রোডে পড়েছে।

শাহেদ বলল, আমাদের ধরেছে কেন?

ভদ্রলোক জবাব দিলেন না। জিপ আবারো বড় রকমের বাকুনি খেল। শাহেদ জিপের ডাণ্ড শক্ত করে ধরেছিল বলে ব্যথা পেল না। যে বাকুনি তাতে ছিটকে পড়ে যাবার কথা।

মিলিটারিরা রাস্তাঘাট থেকে লোকজন ধরে নিয়ে যাচ্ছে কেন? তাদের উদ্দেশ্যটা কী? শাহেদ তাকে ধরার কারণ কিছুতেই বের করতে পারছে না। সে কোনো রাজনৈতিক নেতাও না, কমী ও না। লেখক না, কবি না, গায়ক না। সামান্য একজন। নিজের পরিবারের বাইরে কেউ তাকে চেনে না। মিলিটারির লোকজন তাকে চিনল কী করে? এই কদিনের দুঃখে, কষ্টে, চিন্তায়, দুর্ভাবনায় তার চেহারা কি ভয়ঙ্কর হয়ে গেছে? তাকে দেখলেই কি মনে হয় সে ভয়ঙ্কর কিছু করবে? ভয়ঙ্কর কিছু করার ক্ষমতা শাহেদের নেই। সে অতি সাধারণ একজন। সাধারণরা সাধারণ কাজ করে। পড়াশোনায় সাধারণ রেজাল্ট করে, সাধারণ একটা চাকরি যোগাড় করে, সাধারণ একটা মেয়েকে বিয়ে করে সাধারণ জীবনযাপন করে। শাহেদ তাই করছে। তার জীবনযাত্ৰা ছোট্ট গণ্ডির মধ্যে বাধা। ঝামেলাহীন গণ্ডিবদ্ধ জীবন।
 
গাড়ি আরেকটা বড় ধরনের বাকি খেয়ে থেমে গেল। আর নড়নচড়ন নেই। কী হচ্ছে? তারা কি পৌঁছে গেল? পৌঁছে গেলে মিলিটারিরা তাদের নামাবে। নামাবার জন্যে কেউ আসছে না। শাহেদ প্যান্টের পকেট থেকে সিগারেট এবং দিয়াশলাই বের করেছে। ধরাচ্ছে না। সিগারেট হাতে বসে থাকার মধ্যেও শান্তি আছে। গাড়ি অন্ধকার একটা জায়গায় থেমেছে। ভেতরে আলো আসছে না বলে শাহেদ তার সহযাত্রীদের মুখ দেখতে পাচ্ছে না। মুখ দেখলেও খানিকটা ভরসা। পাওয়া যেত। ভয়াবহ দুঃসময়ে মানুষের মুখ দেখলে মনে সাহস চলে আসে। শাহেদ বিড়বিড় করে বলল, কী হচ্ছে?

শাহেদের পাশের ভদ্রলোক বললেন, আবো লোক তুলবে।

কাদেরকে তুলবো?

হাতের কাছে যাদের পায়।

কেন?

জানি না ভাই, কিছুই জানি না। আপনি সিগারেট খান–কোনো অসুবিধা নাই। আমরা এখন সুবিধা অসুবিধার অতীত।

আপনি একটা খাবেন?

আমি ধূমপান করি না।

শাহেদ সিগারেট ধরাল। দিয়াশলাই-এর আগুনে সে একবালকের জন্যে সহযাত্রীদের মুখ দেখল। শুরুতে সে প্রচণ্ড ধাক্কা খেল–সবাই একপলকে তার দিকে তাকিয়ে আছে। সবাই তার দিকে তাকিয়ে আছে কেন? সে কী করেছে? সে কি ভয়ঙ্কর কিছু করেছে? নাকি ভয়ঙ্কর কিছু তার জীবনে ঘটতে যাচ্ছে? সিগারেটে টান দিয়ে প্রথম শিকের ধাক্কাটা শাহেদ সামলে ফেলল। সবাই তার দিকে তাকিয়ে আছে কেন–সেই রহস্য ভেদ হয়েছে। সে দিয়াশলাই জুলিয়েছে। সবাই তাকিয়েছে আগুনের দিকে। তার দিকে না। কাজেই তার ভীত হবার কিছু নেই। শাহেদ লক্ষ করল তাঁর ভয়টা একটু যেন কমে গেল। সিগারেটের নিকোটিন শরীরে ঢোকার কারণে কি কমল? নিকোটিন কি মানুষকে সাহসী করে? সেকেন্ড ওয়ার্ল্ড ওয়ারের সে একটা ছবি দেখেছিল–নাম মনে পড়ছে না। রাশিয়ান ছবি। সেখানে রাশিয়ান একজন কর্নেলকে নাৎসি সৈন্যরা ফায়ারিং স্কোয়াডে গুলি করে মারে। কর্নেলকে পেছন দিকে হাত বেঁধে দেয়ালের দিকে মুখ করে দাঁড় করিয়ে দেয়। তখন কর্নেল মাথা ঘুরিয়ে বলেন, আমি কি একটা সিগারেট পেতে পারি? তাকে সিগারেট দেয়া হয়। যেহেতু হাত বাধা, একজন সিগারেট ধরিয়ে কর্নেলের ঠোঁটে পুরে দেয়। কর্নেল জ্বলন্ত সিগারেট ঠোঁটে নিয়েই বলেন, থ্যাংক য়্যু সোলজার। তারপর বেশ আয়েশ করে সিগারেট টানতে থাকেন। কর্নেলের ঠোঁটে সামান্য হাসির আভাস, যেন পুরো ব্যাপারটায় তিনি খুব মজা পাচ্ছেন।

ছবিতে যে-সব ঘটনা ঘটে বাস্তবে কি তাই ঘটে? মিলিটারিরা যদি শাহেদকে গুলি করে মারার জন্যে নিয়ে যায় তাহলে কি সে বলতে পারবে, আমি কি একটা সিগারেট পেতে পারি? ধরা যাক তারা তাকে একটা সিগারেট দিল। সে কি কর্নেল সাহেবের মতো ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসি নিয়ে সিগারেট টানতে পারবে? মৃত্যুর আগে আগে বিশেষ কোনো স্মৃতি কি তার মনে পড়বে? বিশেষ কোনো স্মৃতি শাহেদের নেই– তার সব স্মৃতিই সাধারণ। অতি সাধারণ মানুষের জীবনেও কিছু নাটকীয় ঘটনা থাকে, তার তাও নেই। মিলিটারিরা তাকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে যাচ্ছে–এটাই বোধহয় তার জীবনের সবচেয়ে নাটকীয় ঘটনা। সে যদি এ যাত্রা বেঁচে যায়, তাহলে সে বৃদ্ধ বয়সে সে এই ঘটনা নিয়ে রুনির ছেলেমেয়েদের সঙ্গে গল্প করবে–বুঝলে দাদুরা, সে এক কাল রাত্রি, উনিশশো একাত্তর সনের ঘটনা। তোমাদের মার বয়স তখন ছয় বছর। সে কোথায় আছে কী করছে কিছুই জানি না। দুশ্চিন্তায় আমার মাথা খারাপের মতো হয়ে গেছে। ভাই পাগলা বলে এক পীর সাহেবের কাছে

গাড়ি আবার চলতে শুরু করেছে–নতুন কাউকে তোলা হয় নি। খুবই আশ্চর্যের ব্যাপার, শাহেদের ঘুম পাচ্ছে। ঘুমে চোখ প্ৰায় বন্ধ হয়ে আসছে। বারবার ঘুমের ঘোরে পাশের ভদ্রলোকের কাধে মাথা লেগে যাচ্ছে। শাহেদের খুব লজ্জা লাগছে–তার সামনে এত বড় বিপদ আর সে এরকম ঘুমিয়ে পড়ছে কেন? তার উচিত এক মনে দোয়া দরুদ পড়া। আয়াতুল কুরসি পড়ে তিনবার বুকে ফু দিতে পারলে হতো। আয়াতুল কুরসি সূরাটা শাহেদের মুখস্থ নেই। আয়তুল কুরসি ছাড়াও তো দোয়া আছে। ইউনুস নবি মাছের পেটে বসে যে দোয়া পড়ে উদ্ধার পেলেন। দোয়া ইউনুস। লা ইলাহা ইল্লা আনতা সুবাহানাকা ইন্নি কুনতু মিনাজাজোয়ালেমিনা। এমন ঘুম পাচ্ছে–ঘুমের কারণে দোয়া এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। শাহেদ সত্যি সত্যি ঘুমিয়ে পড়ল। বেশ আরামের ঘুম। সে ঘুমুল পাশের ভদ্রলোকের কাধে মাথা রেখে। তিনি কিছুই বললেন না। কাঁধ পেতে রাখলেন–যাতে ঘুমকাতুর মানুষটা আরামে ঘুমোতে পারে।
 
লেফটেন্যান্ট কর্নেল জামশেদ তার বয়স্যদের কাছে জাশ নামে পরিচিত। গোয়েন্দা বিভাগের এই অফিসার বড় মজাদার মানুষ। কথায় কথায় রসিকতা করেন। এমন রসিকতা যে নিতান্তই অরসিক মানুষও হো হো করে হেসে উঠবে। রসিকতা ছাড়াও তিনি আর যে বিদ্যা জানেন তার একটি হচ্ছে ম্যাজিক। এক প্যাকেট তাস পেলে সেই এক প্যাকেট তাস দিয়ে তিনি আধঘণ্টা দর্শকদের মন্ত্ৰমুগ্ধ করে রাখেন। পামিং-এর বিদ্যাও ভালো আয়ত্ত করেছেন। শূন্য থেকে কাঁচা টাকা বের করা, সেই কাঁচা টাকা শূন্যে মিলিয়ে দেওয়া তার কাছে কিছুই না। কর্নেল জাশ অবিবাহিত। বিয়ে না করার পেছনে তার যুক্তি হচ্ছে–তিনি ট্রেনে করে ঘুরতে পছন্দ করেন। জানালার পাশে বসে দৃশ্য দেখতে দেখতে যাওয়া। বিয়ে করলে এই সুযোগ পাওয়া যাবে না–কারণ স্ত্রীকে জানালার পাশে বসতে দিতে হবে। এই কারণেই বিয়ে করছেন না।

এই অতি মজাদার কর্নেল জাশ গোয়েন্দা বিভাগে আছেন চাকরির শুরু থেকেই। কাজটা তার খুব পছন্দের। গোয়েন্দা বিভাগের কাজের পেছনে রহস্য থাকে, মজা থাকে এবং আচমকা বিস্ময় থাকে। এইসব জিনিস একজন ম্যাজিসিয়ানের পছন্দ হবারই কথা।

সামরিক গোয়েন্দা বিভাগ তাদের কর্মকাণ্ড মূলত সামরিক বাহিনীর মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখে। কর্নেল জাশ সেই সীমা বৃদ্ধি করেছেন। তিনি সিভিলিয়ানদের মধ্যেও কাজ করছেন। তেমন গুরুত্বপূর্ণ কোনো কাজ না। ঢাকা শহরের বিভিন্ন পয়েন্ট থেকে নানান ধরনের লোকজন ধরে নিয়ে আসা। তাদের সঙ্গে কিছুক্ষণ গল্পগুজব করা। আতঙ্কে অস্থির হয়ে যাওয়া মানুষদের সঙ্গে গল্প করতেও তার ভালো লাগে। কর্নেল জাশ যে-সব হতভাগ্যকে গল্পগুজব করার জন্যে ডেকে আনেন–তাদের বেশিরভাগকেই ডেথ স্কোয়াডের কাছে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। এই ব্যাপারে কর্নেল জাশের বিবেক খুব পরিষ্কার। তার যুক্তি হচ্ছে—আমরা যুদ্ধাবস্থায় আছি। যুদ্ধাবস্থার প্রথমদিকে শক্রর মনে ভয়াবহ আতঙ্ক তৈরি করতে হয়। আতঙ্ক, হতাশা এবং অনিশ্চয়তা। এই তিনটি আবেগ একসঙ্গে তৈরি করা মানে যুদ্ধের প্রাথমিক বিজয়। শত্রুপক্ষের মরাল যাবে ভেঙে। ভাঙা মরাল নিয়ে শত্ৰু কখনো সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারে না।

একদল লোক ধরে আনা হচ্ছে, তারা উধাও হয়ে যাচ্ছে। আত্মীয়স্বজনরা তাদের কোনো খোঁজ বের করতে পারছে না। এরচেয়ে অনিশ্চয়তা তো আর কিছু হতে পারে না। এই খবর তারা চারদিকে ছড়াবে। মুখে মুখে পল্লবিত হবে ভয়ঙ্কর গল্প। যুদ্ধাবস্থায় এর প্রয়োজন আছে।

কর্নেল জাশ হালকা ঘিয়া রঙের একটা হাওয়াই শার্ট পরেছেন। তার হাতে চুরুট। তিনি চুরুট বা সিগারেট কিছুই খান না। সিগারেটের গন্ধে তার মাথা ধরে যায়। বন্দিদের জেরা করার সময় তিনি হাতে চুরুট রাখেন। চুরুট জুলিয়ে রাখা কঠিন–ক্ৰমাগত টানতে হয়। কাজটা তার খারাপ লাগে না। চুরুট নিয়ে কথা বলতে বলতে জেরা করায় আলাদা নাটকীয়তা আছে। কর্নেল জাশের ঘরটা ছোট। আসবাবপত্র বলতে ছোট্ট একটা টেবিলের পেছনে রিভলভিং

করা হবে সে-ই এই চেয়ারে বসে। একটা সিলিং ফ্যান আছে। ডিসি কারেন্টের পাখা–বাতাসের চেয়ে শব্দ বেশি হয়। কর্নেল সাহেব ইচ্ছা করলেই ফ্যানটা বদলে ভালো একটা ফ্যান নিতে পারেন। তিনি নেন না। ফ্যানের ঘড়ঘড় শব্দের ভয় ধরানো এফেক্টটা তার ভালো লাগে। তার রিভলভিং চেয়ার যখন ঘুরে তখনো কটকট ধরনের শব্দ হয়। সেই শব্দও তার ভালো লাগে। মৃত্যুভয়ে অস্থির একটা মানুষ তার সামনে বসে আছে। তিনি নিভে যাওয়া চুরুট ধরাতে ধরাতে হঠাৎ চেয়ার ঘুরিয়ে তাকালেন–কটকট শব্দে সামনে বসে থাকা লোকটা আতঙ্কে নীল হয়ে গেল। এই দৃশ্য মজার দৃশ্য।

শাহেদ কর্নেল জাশের সামনের চেয়ারে জবুথবু হয়ে বসে আছে। প্রথম সে তার দুটা হাত চেয়ারের হাতলে রেখেছিল। হঠাৎ মনে হলো এতে বেয়াদবি প্ৰকাশ পেতে পারে। এখন তার হাত কোলের উপর রাখা। তার প্রচণ্ড প্ৰসাবের বেগ হয়েছে। মনে হচ্ছে এক্ষুণি ব্লাডার ফেটে যাবে।

কর্ণেল সাহেব চেয়ার ঘুরিয়ে শাহেদের দিকে তাকালেন। হালকা গলায় বললেন, আপ কা তারিফ?

শাহেদ প্রশ্নটার মানে বুঝতে পারল না। তারিফ শব্দটার মানে কী? উর্দুটা মোটামুটি জানা থাকলে সহজে এই বিপদ থেকে উদ্ধার পাওয়া যেত। উর্দু জানাটা উচিত ছিল। ক্লাস সিক্সে এরাবিক না নিয়ে উর্দু নেওয়া উচিত ছিল। এরাবিক নিয়েছিল নাম্বার বেশি পাওয়া যায় বলে। তাতে লাভ হয় নি। ক্লাস এইট থেকে নাইনে উঠার পরীক্ষায় সব বিষয়ে পাসমার্ক থাকলেও এরাবিকে পেয়েছিল বত্ৰিশ।

কর্নেল সাহেব একটু ঝুকে এসে বললেন, স্যার, আপ কা নাম?

শাহেদ একটু কেঁপে উঠল। মানুষটা তাকে স্যার বলছে কেন? রসিকতা করে বলছে? মুখ দেখে তো মনে হচ্ছে না রসিকতা। মনে হচ্ছে, সম্মান দেখাচ্ছে।

মাই নেম ইজ শাহেদ।

আপকা উর্দু নেহি আতা?

জি-না স্যার।

কর্নেল সাহেব টেবিল থেকে তাসের প্যাকেট হাতে নিলেন। এটা তার *একটা খেলা। নাম জিজ্ঞেস করে তিনি কিছুক্ষণ তাস সাফল করে একটা তাস টেনে নেবেন। লাল রঙের তাস উঠে এলে মৃত্যুদণ্ড। কালো তাস হলে লোকটাকে ছেড়ে দেওয়া হবে। চান্স ফিফটি ফিফটি। ভাগ্য পরীক্ষা। তিনি এই ভাগ্য পরীক্ষার খেলাটা যখন খেলেন, তখন নিজেকে ঈশ্বরের কাছাকাছি মনে হয়। কর্নেল সাহেব তাস টানলেন–লাল রঙের তাস উঠে এলো। ফোর অব ডায়মন্ডস। লোকটার ভাগ্য খারাপ।

আর ইউ ম্যারেড?

ইয়েস স্যার।

লোকটা যেহেতু বিবাহিত, তাকে আরেকটা সুযোগ দেয়া যেতে পারে। কর্নেল সাহেব আরেকবার তাস টানলেন। এবারো লাল রঙের তাস। হাটের দুই। আশ্চর্য! এর ভাগ্য তো খাঁ বাপ। খুবই খারাপ।

ডু ইউ হ্যাভ চিলড্রেন?

ইয়েস স্যার। ওয়ান ডটার।

আচ্ছা ঠিক আছে; মেয়েটার খাতিরে আরেকটা সুযোগ। তবে এই দফায় লাল উঠলে খেল খতম। কর্নেল জাশ আরেকবার তাস সাফল করলেন। কালো তাস উঠার প্রবাবিলিটি খুব বেশি। পরপর তিনবার লাল উঠার কোনো কারণ নেই।

তৃতীয়বারও লাল কার্ড উঠল। ডায়মন্ডের কুইন। কর্নেল জাশ হাসিমুখে বললেন, ওকে স্যার। ইউ ক্যান লিভ।

শাহেদ ঘর থেকে প্রায় টলতে টলতে বের হলো। কর্নেল জাশ শাহেদের নামের পাশে লাল ক্রস দিলেন।
 
কোনোরকম কারণ ছাড়া মানুষ মেরে ফেলা যায়? মৃত্যু এত তুচ্ছ, এত সহজ? শাহেদ ভয়ে অস্থির হলো না, বিস্ময়ে অভিভূত হলো। সামান্য গাছের পাতাও তো মানুষ অকারণে ছিঁড়তে পারে না। বর্ষায় পিপড়ার লম্বা সারি দেখা যায়। মানুষ সেই পিপড়ার সারিও ডিঙিয়ে যায়। মানুষ চায় না পিপড়ার মতো তুচ্ছ প্রাণীও তার পায়ের চাপে মারা পড়ুক। এরা কেন অকারণে এতগুলি মানুষ মেরে ফেলবে? কোথাও কি ভুল হচ্ছে? ভুলটা কে করছে? সে করছে না তো? হয়তো এমনিতেই তাদের এনে মাঠে লাইন করে দাঁড়িয়েছে। নাম ঠিকানা লিখে ছেড়ে দেবে। না ছাড়লেও কোনো শাস্তি-টাস্তি দেবে। মেরে ফেলার প্রশ্ন আসছে কেন?

লম্বা দাড়িওয়ালা জোব্বা-জাব্বা ধরনের পোশাক পরা এক লোক এসে বলল, কলেমা পড়ে। কলেমা।

এ কি মিলিটারিদের মাওলানা? মৃত্যুর আগে কলেমা পড়াচ্ছে? শাহেদরা মোট নজন দাঁড়িয়ে আছে। শাহেদ আছে মাঝামাঝি জায়গায়। এরা কি একজন একজন করে নিয়ে গুলি করবে, না। সবাইকে একসঙ্গে গুলি করবে? গুলি করার হুকুম কে দেবে? অল্পবয়স্ক অফিসারটা? কাঁধের ব্যাজে তিনটা তারাক্যাপ্টেন। অফিসারটিকে তো বেশ হাসিখুশি দেখাচ্ছে। তার চেহারা দেখে তো মনে হয় না কিছুক্ষণের মধ্যে ভয়ঙ্কর কিছু ঘটবে।

ইজ পজিশনে আছে। মাটির ঢিবিটাই মনে হয় বধ্যভূমি। আশেপাশে কোনো গর্ত বা খানাখন্দ নেই। এরা ডেডবিডি ফেলবে কোথায়? আশেপাশে নদী থাকলে নদীতে নিয়ে ফেলত। নদী নেই, এরা কোনো গর্তও খোড়ে নি। পুরো ব্যাপারটা ওদের কোনো রসিকতা না তো? ভয় দেখিয়ে মজা করছে। মানুষকে ভয় দেখিয়ে আধমরা করে ফেলার ভেতর মজা আছে। দারুণ মজা।

শাহেদ তার পাশে দাঁড়ানো ভদ্রলোককে বলল, ভাই, আপনার ঘড়িতে কটা বাজে?

ভদ্রলোক কিছু বললেন না। অদ্ভুত দৃষ্টিতে শাহেদের দিকে তাকালেন। শাহেদ আবার বলল, ভাই, কয়টা বাজে? আমার হাতে ঘড়ি নেই, একটু কাইন্ডলি যদি টাইমটা বলেন।

চারটা পাঁচ।

থ্যাংক য়্যু।

ভদ্রলোক এখনো শাহেদের দিকে তাকিয়ে আছেন। শাহেদ বলল, এরা আমাদের বাইরে এনেছে কেন জানেন?

জানি।

কী জন্যে এনেছে?

এত কথা বলছেন কেন? কী জন্যে এনেছে আপনিও জানেন। আল্লাহ খোদার নাম নেন।

ভদ্রলোকের কথা শেষ হবার পরপরই লাইনে দাড়ানো প্রথম চারজনকে মাটির ঢিবির দিকে নিয়ে যাওয়া হলো। শাহেদরা যেখানে দাঁড়িয়ে আছে সেখানে আলো নেই। হলুদ রঙের টানা বারান্দা থেকে সামান্য যা আলো আসছে তাই। তবে মাটির ঢিবির কাছে বেশ আলো। তিনটা বাঁশ পাশাপাশি পোতা। সেখানে বান্ধ লাগানো। অল্প কয়েকটা বাল্প, কিন্তু খুব আলো। যে চারজনকে হাঁটিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে শাহেদ অত্যন্ত বিশ্বয়ের সঙ্গে তাদের দেখছে। তার কাছে মনে হচ্ছে পুরো ব্যাপারটা স্বপ্নে ঘটছে। পুতুলনাচের পুতুলীরা যেমন হেলেদুলে হাঁটে – তেমনি হাঁটার ভঙ্গি। বাস্তবের মানুষরা কখনো এই ভঙ্গিতে হাটে না।


চারজনের হাত পেছনের দিকে বাধা হচ্ছে। চারজনের একজন উঁচু গলায় বলছে— লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ। শাহেদ নিজেকেই জিজ্ঞেস করল, ব্যাপার কী? এদের হাত পেছনে বাঁধছে। কেন? এদের কী করবে? ওদের মেরে ফেলবে? তারপর আমাদের নিয়ে যাবে? আমরা কী করেছি? নিশ্চয়ই কোথাও ভুল হচ্ছে। এক্ষুণি ভুল ধরা পড়বে। দেখা যাবে এতক্ষণ যা দেখছে তা ভয়ঙ্কর কোনো দুঃস্বপ্ন। হঠাৎ ঘুম ভেঙে যাবে। দেখা যাবে সব আগের মতো আছে। আসমানী এবং সে শুয়ে আছে। দুজনের মাঝখানে গুটিসুটি মেরে ঘুমোচ্ছে রুনি। সে তার একটা পা তুলে দিয়েছে শাহেদের গায়ে। গা থেকে পা নামাতে গেলেই জেগে উঠবে। তারপর আর কিছুতেই তাকে ঘুম পাড়ানো যাবে। না। বারান্দায় নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে পা ব্যথা হয়ে যাবে। যখন মনে হবে রুনি পুরোপুরি ঘুমিয়ে পড়েছে, এখন তাকে শুইয়ে দেয়া যায়, তখন রুনি ঘাড়ে মাথা রেখে বলবে–বাবা গল্প। তৎক্ষণাৎ গল্প শুরু করতে হবে।

এটেনশান।

খটখট শব্দ হলো। শাহেদ একটু কেঁপে উঠল। চোখের সামনের দৃশ্যগুলি অস্পষ্ট হয়ে পড়েছিল। এখন আবার স্পষ্ট হয়েছে। ঐ তো চারজন মানুষ। তাদের উল্টোদিক করে দাঁড় করানো হয়েছে। তাদের বাধা হাত দেখা যাচ্ছে। রাইফেল তাক করে আছে অনেকে। কতজন? শাহেদ কি গুনে দেখবো? তার প্রয়োজন কি আছে? আচ্ছা, ভোর হতে কত দেরি? আকাশে কি তারা আছে? শাহেদ কি তাকাবে আকাশের দিকে? ঐ তো কালপুরুষ দেখা যাচ্ছে। কালপুরুষের কোমরের বেল্টে তিনটা তারা।

ফায়ার!

ঠিকই শব্দ হলো। যারা দাঁড়িয়েছিল তারা এখন দাঁড়িয়ে নেই।

কোনো চিৎকার, কোনো কাতরানি কিছুই শোনা যাচ্ছে না। কয়েক মুহুর্ত সমস্ত পৃথিবী শব্দহীন হয়ে রইল। আর তখন শোনা গেল চাপা গোঙানির শব্দ। গোঙাতে গোঙাতে মৃত্যুপথযাত্রী একজন ডাকছে— ফরিদা! ফরিদা! ফরিদা কে? তার মমতাময়ী স্ত্রী? তার আদরের ধন জ্যেষ্ঠা কন্যা?

শাহেদের সমস্ত পৃথিবী দুলে উঠল। সে গড়িয়ে মাঠে পড়ে গেল। আর প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই মনে হলো আসমানী তাকে কোলে করে খাটে শুইয়ে দিচ্ছে। মাথায় পানি ঢালছে। চুলে বিলি কেটে দিচ্ছে। কী আরামই না লাগছে! ঘুমে চোখ বন্ধ হয়ে আসছে। অদ্ভুত ঘুম। শরীরের সমস্ত জীবন্ত কোষ যেন একসঙ্গে ঘুমিয়ে পড়ছে। বড় আরামের ঘুম। এর মধ্যে আবার রুনি এসে তার ছোট ছোট হাতে তাকে ছুঁয়ে যাচ্ছে। মেয়েটার হাত অসম্ভব ঠাণ্ডা। সে মনে হয় পানি নিয়ে ছানাছানি করেছে। আসমানী অস্পষ্ট স্বরে বলল, কী হয়েছে? তুমি এরকম করছি কেন? শাহেদ অনেক কষ্টে বলল, আমি দুঃস্বপ্ন দেখছি আসমানী। ভয়ঙ্কর দুঃস্বপ্ন। তুমি আমাকে জড়িয়ে ধরে রাখ। কিছুতেই আমাকে ছাড়বে না। আসমানী গাঢ় স্বরে বলল, আমি তোমাকে ছাড়ব না।



অজ্ঞান হয়ে মাঠে পড়ে যাবার কারণেই হোক বা অন্য যে-কোনো কারণেই হোক শাহেদ বেঁচে গেল। তার বেঁচে যাওয়ার অংশটা যথেষ্ট বহস্যমণ্ডিত। শাহেদ অনেক চেষ্টা করেও রহস্য ভেদ করতে পারে নি। জ্ঞান হবার পর সে নিজেকে দেখেছে চৌকির উপর শুয়ে আছে। সে একাই শুধু শুয়ে আছে। সেই চৌকিতে আরো অনেকেই আছে। তারা কেউ শুয়ে নেই, সবাই বসে।

ব্যাপারটা স্বপ্ন না। সত্যি বোঝার আগেই সে হয় অজ্ঞান হয়ে পড়েছে, কিংবা ঘুমিয়ে পড়েছে। সেই অবস্থাতেও তার সারাক্ষণ মনে হয়েছে আসমানী তার গায়ে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে।

একবার তার খারাপ ধরনের চিকেন পস্তু হলো। সারা শরীরে অসহ্য যন্ত্রণা। আসমানী বলল, এসো, তোমার ব্যথা কমিয়ে দি।

শাহেদ বিরক্ত গলায় বলল, সবসময় রসিকতা করবে না। ব্যথা কমাবে কীভাবে??

ভালোবেসে গায়ে হাত বুলিয়ে দেব। তাতেই ব্যথা কমবে।

আশ্চর্য কাণ্ড, আসমানী গায়ে হাত বুলিয়ে দিতেই ব্যথা কমে গেল।
 
অচেতন জগতে থেকেও শাহেদের স্পষ্ট মনে হতে লাগল, আসমানী ক্ৰমাগত তার গায়ে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। এপ্রিল মাসের ১৩ তারিখ মঙ্গলবার দুপুরেবেলা শাহেদ ছাড়া পেল। একজন মিলিটারি মেজর তার দিকে তাকিয়ে বলল, ক্লিয়ার আউট।

এই ক্লিয়ার আউটের অর্থ যে মুক্তি তা বুঝতে শাহেদের অনেক সময় লাগল। রিকশায় উঠে বসার পরও তার মনে হতে লাগিল–এটা আসলে সত্যি না, স্বপ্ন। রিকশা চলতে শুরু করা মাত্র স্বপ্ন ভেঙে যাবে। রিকশা চলতে শুরু করাল–স্বপ্ন ভাঙলি না। তখন তার মনে হলো–রিকশাওয়ালা কোনো একটা কথা বললেই স্বপ্ন ভাঙৰে। রিকশাওয়ালা কোনো কথা বলছে না–স্বপ্নও ভাঙছে। না। শাহেদই কথা বলল, দেশের অবস্থা কী?

রিকশাওয়ালা ঘাড় ফিরিয়ে শাহেদকে দেখল। জবাব দিল না।

শাহেদ বলল, তোমার দেশ কোথায়?

ফরিদপুর। গ্রামের নাম জয়নগর।

আচ্ছা ঠিক আছে। আমার গ্রামের বাড়ি— ময়মনসিংহের কেন্দুয়ায়। আমি মিলিটারির হাতে আটক ছিলাম। আজ ছাড়া পেয়েছি।

রিকশাওয়ালা আবার তাকে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখল। কিছু বলল না। রিকশাওয়ালার চোখে আগ্রহ, কৌতূহল, বিস্ময় কোনো কিছুই নেই। মরা মানুষের চোখ।

শাহেদ বাসায় পৌছাল দুটাির দিকে। বাসা খালি। গৌরাঙ্গ নেই। সদর দরজাও খোলা। সে দরজায় তালাও লাগিয়ে যায় নি। দুটা থেকে সন্ধ্যা ছটা পর্যন্ত সে এক নাগাড়ে ঘুমুল। সন্ধ্যাবেলায় ঘুম থেকে উঠে সে অল্প কিছু সময় বারান্দায় বসে রইল। তারপর ঘরে ঢুপে চিঠি লিখতে বসল।

আসমানী,

তুমি এবং রুনি, তোমরা কোথায় আছে আমি জানি না। কিছুদিন তোমাদের জন্যে খুব দুশ্চিন্তা করেছি। এখন আর করছি না। এই চিঠিটা আমি ভাইজানের কাছে পাঠাচ্ছি। ভাইজানের সঙ্গে যদি তোমার কখনো যোগাযোগ হয় তুমি চিঠি পাবে।

আসমানী, আমার ধারণা পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে এদেশের মানুষ যুদ্ধ শুরু করবে। আমি প্রথমদিকের যোদ্ধাদের একজন হতে চাই, কাজেই তোমাদের জন্য দুশ্চিন্তা বন্ধ করে আমি আজ থেকে খুঁজতে শুরু করব কীভাবে নিজেকে কাজে লাগাতে পারি।

পরাধীন দেশে নয়। আমি স্বাধীন দেশে তোমাকে আবার দেখব। যদি দেখা না হয়, যদি আমার মৃত্যু হয়, তাতে মনে কষ্ট পেয়ো না। রুনিকে বুঝিয়ে সব কিছু বলবে। এখন বুঝতে না পারলেও একদিন সে বুঝবে।

আমি ভয়ঙ্কর কিছু সময় পার করে এসেছি। সে-সময়ে তোমার উপস্থিতি আমি অনুভব করেছি। আমি জানি আমি যেখানেই থাকি–তুমি থাকবে আমার পাশেই।

অনেক অনেক আদর। তোমাকে ও রুনিকে।

চিঠি শেষ করে তারিখ লিখতে গিয়ে শাহেদ সামান্য চমকাল। তারিখ ১৩ এপ্ৰিল। তাদের বিয়ের দিন। তের তারিখে বিয়ে অশুভ হয় কি-না। এই নিয়ে সে দ্বিধার মধ্যে পড়ে গিয়েছিল। ইরতাজউদ্দিন সব শুনে ভাইকে ধমক দিয়ে বলছিলেন, আল্লাহপাকের সৃষ্টি প্রতিটা দিনই শুভ।
 
চীনের প্রধানমন্ত্রী চৌ এন লাই বলেছেন, বহিরাক্রমণ থেকে পাকিস্তানের অখণ্ডতা রক্ষার জন্যে গণচীন প্ৰতিশ্রুতিবদ্ধ। স্বাধীনতা রক্ষার জন্যে চীন সরকার পাকিস্তানকে পূর্ণ সহযোগিতা দেবে।

এই দিনেই খাজা খায়েরউদ্দিন ও জামায়াত নেতা গোলাম আযম জোহরের নামাজের পর বায়তুল মোকাররম থেকে শান্তি কমিটির মিছিল বের করেন। পাক সেনাবাহিনীর সাফল্যের জন্যে মোনাজাত পরিচালনা করেন জামায়াতের আমীর গোলাম আযম। তিনি ইসলাম ও পাকিস্তানের দুশমনদের মোকাবিলা করতে জিহাদের ডাক দেন।*

————–

*সূত্র : দৈনিক পাকিস্তান, দৈনিক পূৰ্ব্বদেশ




আসমানীরা যে-বাড়িতে বাস করছে তার নাম দারোগাবাড়ি। গ্রামের ভেতর হুলস্থূল ধরনের বাড়ি। দোতলা পাকা দালান, বাড়ির পেছনে আমবাগান! সানবাঁধানো ঘাটের পুকুরটা বাড়ির দক্ষিণ দিকে। পুকুরের পানি কাকের চোখের মতোই পরিষ্কার। ঘাটের সঙ্গে পাশাপাশি দুটা চেরিফুলের গাছ। গাছভর্তি সাদা রঙের চেরিফুলে। গ্রামে চেরিগাছ থাকার কথা না। বাড়ির সামনে অনেকখানি জায়গায় আছে নানান ধরনের জবা গাছ। (ভাই পাগলা পীর সাহেবের জবা গাছ প্রসঙ্গটা মিলে গেছে।)

মোতালেব সাহেবের বাবা সরফরাজ মিয়া ব্রিটিশ আমলের দারোগা ছিলেন। রিটায়ার করার পর তিনি এই পাকা বাড়ি বানান। ব্রিটিশ আমলের দারোগাদের মধ্যে শেষ বয়সে খানিকটা জমিদারি-ভাব চলে আসে। উনার মধ্যেও চলে এসেছিল। অজপাড়াগাঁয়ে বিশাল দালান এই কারণেই তুলেছিলেন। সরফরাজ মিয়া এখনো জীবিত। বৃদ্ধের বয়স প্রায় নব্বই। অতি রুগ্ন। বাকী হয়ে হাঁটেন। তবে চোখে দেখতে পান, কানে শুনতে পান। মাথা খানিকটা এলোমেলো হয়ে আছে। কথায় কথায় বন্দুক বের করতে বলেন। মাঝে-মাঝে নিজেই তাঁর শোবার ঘর থেকে দুনিলা বন্দুক বের করে নিয়ে আসেন। ক্ষিপ্ত গলায় বলেন–সব হারামজাদাদের জানে মেরে ফেলব। তারপর আকাশের দিকে বন্দুক তুলে একটা ফাঁকা গুলি করেন। গুলির শব্দ কানে যাবার পরপরই তাঁর সংবিৎ ফিরে আসে, তিনি খুব স্বাভাবিক আচরণ করতে থাকেন। তাকে দেখে মনে হয় তিনি তার অস্বাভাবিক উত্তেজনার প্রকাশে খানিকটা লজ্জিত।

রুনি এই বাড়িতে এসে আতঙ্কে অস্থির হয়ে আছে। বাড়ির প্রধান ব্যক্তি একজন পাগল। যে সারাদিন জবা গাছের যত্ন করে কাটিয়ে দেয়। জবা গাছের সঙ্গে কথা বলে। মাঝে-মাঝে বন্দুক হাতে বের হয়ে আসে। এ জাতীয় ভয়ঙ্কর মানুষের সঙ্গে বাস করা যে-কোনো শিশুর পক্ষেই অসম্ভব। রুনি বাস করছে ভয়ঙ্কর দুঃস্বপ্নের মধ্যে। আসমানী হাজার চেষ্টা করেও রুনিকে সেই দুঃস্বপ্ন থেকে বের করতে পারছে না।

সরফরাজ মিয়ার সঙ্গে রুনির প্রথম সাক্ষাৎটাই ছিল ভয়াবহ। শুরুতে বাড়িটা রুনির খুব পছন্দ হয়েছিল। চারদিকে এত ফাঁকা জায়গা। জবা ফুলগুলো এত সুন্দর। মনে হয় গাছে লাল আগুনের ফুল ফুটে আছে। রুনি ছুটে গিয়ে কোঁচড় ভর্তি করে জবা ফুল নিয়ে নিল। তার এত আনন্দ হচ্ছিল! আনন্দে কেঁদে ফেলতে ইচ্ছা করছিল। ঠিক তখন পিছন থেকে খনখনে গলায় কে যেন বলল, এই মেয়ে, ফুল কেন ছিড়লা? কার হুকুমে ফুল ছিড়লা? এই মেয়ে কোন বান্দির?
 

Users who are viewing this thread

Back
Top