What's new
Nirjonmela Desi Forum

Talk about the things that matter to you! Wanting to join the rest of our members? Feel free to sign up today and gain full access!

Collected ছোছনা ও জননীর গল্প - উপন্যাস (2 Viewers)

সিরাজ সাহেব অতি ভদ্রলোক, অতি সরল। তাঁর সঙ্গে কিছুক্ষণ গল্প করলেই এই ধরনের ভরসা পাওয়া যায়। মনে হয় দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হবার মতো কিছু ঘটে নি। ভদ্রলোকের শরীর যেমন ভারী গলার স্বরও ভারী। তিনি কথা বলেন গলা নামিয়ে। প্রতিটি শব্দ এমনভাবে উচ্চারণ করেন যে মনে গেথে যায়।

এসডিপিও সাহেব শোনেন, আপনি আমি অর্থাৎ আমরা যারা পিরোজপুরে মোটামুটি আন্দামানটাইপ জায়গায় পড়ে আছি তাদের অবস্থাটা বুঝতে পারছেন? তারা আছে আল্লাহর খাস রহমতের তালিকায়। বুঝিয়ে বলি, পাকিস্তানি মিলিটারি মারামারি কাটাকাটি করতে থাকবে বড় বড় শহরে। তারা বিগ সিটি সামলাতেই এখন ব্যস্ত। তারপর যাবে ডিসট্রিক্ট লেভেলে, তারপর সাবডিভিশন। তার আগেই খেল খতম।

কীভাবে খেল খতম?

যা ঘটার ঘটে যাবে। হয় পাকিস্তান, না হয়। বাংলাদেশ। মাঝামাঝি ধরনের কিছু হবার সম্ভাবনাও আছে। লুজ ফেডারেশন টাইপ। কিংবা ধরেন আমেরিকার মতো United States of Pakistan. সেখানে বাংলাদেশ একটা রাষ্ট্র, পাঞ্জাব একটা, সিন্ধু, বেলুচিস্তান… বুঝেছেন?

বোঝার চেষ্টা করছি।

পাকিস্তানিরা খুব মারামারি কাটাকাটি যে করতে পারবে তাও না। জাতিসংঘ আছে না? বড় বড় রাষ্ট্র আছে। রাশিয়ার পদগোনি যদি এক ধমক দেয়। ইয়াহিয়ার পাতলা পায়খানা শুরু হয়ে যাবে। সেই পায়খানা বন্ধ করা ডাক্তারের সাধ্য না। বোতলের ছিপি ব্যবহার করা ছাড়া উপায় নাই। আচ্ছা, মনে করেন। কেউ কোনো ধমক ধামক দিল না, তারপরেও এক হাজার মাইল দূর থেকে উড়ে এসে যুদ্ধ কলা? যুদ্ধ এত সোজা? যুদ্ধ কি মামার বাড়ির উঠানে ডাংগুলি খেলা?

যত সহজ সমাধানের কথা। আপনি বলছেন, তত সহজ আমার কাছে মনে হচ্ছে না।

আপনার কাছে জটিল মনে হচ্ছে?

জি।

আপনি তো ধর্ম বিশ্বাসী মানুষ। কোরআন শরীফ বিশ্বাস করেন?

কী বলেন, কোরআন শরীফ বিশ্বাস করব না মানে?

পাক কোরআনে সূরা বনি ইসরাইলে আল্লাহপাক বলেছেন, আমি তোমাদের ভাগ্য তোমাদের গলায় হারের মতো ঝুলাইয়া দিয়াছি। কাজেই আমাদের কী হবে না হবে সব আগে থেকেই ঠিক করা। যা আগে থেকে ঠিক করা তা নিয়ে দুশ্চিন্তা করে লাভ আছে?

না, লাভ নেই। যা হবার তা হবে। তারপরেও আমরা নিশ্চয়ই হাত-পা কোলে নিয়ে বসে থাকব না।

কী করবেন?

বিপদের জন্যে তৈরি হবো।

কীভাবে? মিলিটারি আসবে মেশিনগান, রকেট লাঞ্চার নিয়ে, আর আপনারা যুদ্ধ করবেন। একশ বছরের পুরনো থ্রি নট থ্রি রাইফেল দিয়ে? ওদের আছে যুদ্ধের ট্রেনিং, আর আপনাদের ট্রেনিং হলো চোৱের পিছনে দৌড় দেয়া। মাথা থেকে সব চিন্তা-ভাবনা ঝেড়ে ফেলুন। ভাবিকে ভালো করে চা বানাতে বলুন। চা খেতে খেতে গল্প করব। খামাখা দুশ্চিন্তা করে ব্লাড প্রেসার বাড়াবেন না। Do ফুর্তি।



ফয়জুর রহমান সাহেব বাগানে রাখা বালতিতে হাত ধুলেন। ইরা পেছনে পেছনে আসছে। পানি খেতে চায় হয়তো। তিনি বালতি নিচু করে ধরলেন। বালতিতে মুখ ঢুকিয়ে চুমুক দিয়ে পানি খাচ্ছে ইরা। গরু ভেড়া ছাগল সবাই চুমুক দিয়ে পানি খায়। অথচ কুকুর শ্রেণী পানি খায় জিভ ড়ুবিয়ে। এর মানে কী? বড় ছেলেকে কি ব্যাপারটা জিজ্ঞেস করবেন? সে দিনরাত বই পড়ে। এই প্রশ্নের জবাব নিশ্চয়ই সে জানে। তাছাড়া এ ধরনের টুকটাক কথাবার্তা দিয়ে সম্পর্ক স্বাভাবিক হবার পথ হয়তো তৈরি হবে। তিনি লক্ষ করলেন, বড় ছেলের হাতে চায়ের কাপ। সে চোখ বন্ধ করে সূর্যের দিকে তাকিয়ে আছে। এই অবস্থাতেই চায়ের কাপে চুমুক দিচ্ছে। এর মানে কী? তিনি ছেলের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্যে গলাখ্যাকড়ি দিলেন। ছেলে চমকে তার দিকে তাকাল। ছেলের চোখ দেখেই মনে হচ্ছে সে ভয় পাচ্ছে। জড়সড় হয়ে গেছে। ভয় পাবার কী আছে? তিনি বললেন, কী করছিস?

কিছু না।

চোখ বন্ধ করে সূর্যের দিকে তাকিয়ে আছিস কেন?

ছেলে জবাব দিল না। বিব্ৰত ভঙ্গিতে এদিক-ওদিক তাকাচ্ছে। বাবার সামনে থেকে চলে যেতে পারলে সে বাঁচে। অথচ তার কিছুক্ষণ কথা বলতে ইচ্ছা হচ্ছে। তিনি বললেন, স্বরূপকাঠির একটা লোক আছে, তার না-কি জীন সাধনা। সে ঘরের ভেতর জীন নামাতে পারে। সেই জীন কথা বলে। মাথায় হাত দিয়ে দােয়া করে। ভাবছি লোকটাকে আনাই। দেখি ঘটনা কী। আনাব?

ছেলে আগ্রহের সঙ্গে বলল, জি আনান। কবে আনাবেন?

ইচ্ছা করলে আজকেই আনা যায়। দেখি।

তিনি লক্ষ করলেন, উৎসাহ এবং উত্তেজনায় ছেলের চোখ চকচক করছে। ছেলে খুবই মজা পাচ্ছে। তিনি পুরনো প্রসঙ্গে ফিরে গেলেন। তিনি বললেন, চোখ বন্ধ করে সূর্যের দিকে তাকিয়ে ছিলি কেন?

তাঁর ধারণা এইবার ছেলে প্রশ্নের জবাব দেবে। তাকে কিছুটা হলেও সহজ করা হয়েছে। তার ধারণা ঠিক হলো, ছেলে কথা বলতে শুরু করল। তিনি আগ্ৰহ নিয়ে শুনছেন। ছেলের কথা বলার মধ্যে মাস্টার মাস্টার ভাব আছে। যেন সে ক্লাসে বক্তৃতা দিচ্ছে। তাঁর এই ছেলে কি ভবিষ্যতে মাস্টার হবে?
 
সূর্যরশ্মি মানুষের শরীরে ভিটামিন ডি তৈরি করে। চোখ বন্ধ করে সূর্যের দিকে মুখ করে থাকলে চোখে ভিটামিন ডি তৈরি হয়। চোখ খোলা রাখা যাবে না, কারণ সূর্যরশ্মিতে আলট্রাভায়োলেট আছে। সেটা চোখের ক্ষতি করে।

আলট্রাভায়োলেট কী?

ছোট তরঙ্গ দৈঘ্যের আলো। হাই এনার্জি।

আমি গ্রামে দেখেছি, হিন্দু ব্ৰাহ্মণরা পুকুরে গোসলের সময় সূর্যের দিকে তাকিয়ে মন্ত্র পড়ে।

তারা সূর্যমন্ত্র পাঠ করে। সূর্যের উপাসনা। আমি মন্ত্রটা জানি।

তিনি বিস্মিত হয়ে ছেলের দিকে তাকিয়ে বললেন, তুই সূর্যমন্ত্র জানিস?

জানি। অং জবাকুসুম শংকাসং কাস্যপেয়ং মহা দুৰ্গতিং। ধ্বন্তারিং সর্ব পাপগনিং প্ৰণত হোসমি দিবাকরম ।

তিনি অবাক হয়ে বললেন, সূর্যমন্ত্র মুখস্থ করে বসে আছিস কেন? তুই মুসলমানের ছেলে?

ছেলে লজা পাচ্ছে। এই লজা দেখতে ভালো লাগছে। আজ একদিনে অনেক কথা হয়ে গেছে। আরেকদিন ওজজ্ঞেস করতে হবে, ছেলে এই মন্ত্র কেন শিখেছে?



ফয়জুর রহমান সাহেব সকালের নাশতা শেষ করে পুলিশের পোশাক পরতে বসলেন। গত দুদিন তিনি পোশাক পরেন নি। আজ পোশাক পরার বিশেষ কারণ আছে। কারণটা গোপন। কাউকেই এই বিষয়ে কিছু বলেন নি।

তাঁর অফিস নিজের বাসাতেই। এসডিপিওর বাংলোর একটা কামরায় অফিস। খুবই পুরনো ব্যবস্থা। সিলিং-এ বিশাল এক টানা পাখা। সরকারি খরচে একজন পাংখাপুলার আছে। তার নাম রশীদ। ফয়জুর রহমান সাহেব চেয়ারে বসা মাত্ৰ পাংখাপুলার রশীদ দড়ি ধরে টানতে শুরু করে। তিনি অবশ্যি বলে দিয়েছেন। পাখা টানতে হবে না। টেবিলফ্যান আছে। তারপরেও রশীদ নিয়মমতো কিছুক্ষণ পাংখা টানে। এই পাংখার বিষয়ে তাঁর ছেলেমেয়েদের খুব আগ্রহ আছে। একদিন দেখেছেন, তার মেজ মেয়ে শিখু পাংখার দড়ি ধরে বুলছে। হাতে টানা পাংখার ব্রিটিশ আমলের নিয়ম এখনো কেন এই জায়গায় চালু আছে ভেবে তিনি বিস্ময় বোধ করেন।

রশীদ!

জি স্যার।

দেশের অবস্থা কেমন?

অবস্থা ভালো স্যার। চারদিকে জয় বাংলা।

জয় বাংলার বাইরে কিছু আছে?

রশীদ। চুপ করে আছে। জয় বাংলার বাইরে কিছু নিশ্চয়ই আছে। সেই কিছুটা সে এখন বলবে না। সময়মতো বলবে। রশীদ মাঝে-মাঝে তাকে খুবই গুরুত্বপূর্ণ কিছু খবর দেয়।

ঘাটে নৌকা আছে রশীদ?

জি স্যার।

নৌকায় সুন্দর করে বিছানা করে রাখবে। কলসিতে পানি ভরে রাখবে। আমার ছেলেমেয়েরা যদি নৌকায় করে কোথাও যেতে চায়, তাদের নিয়ে যাবে।

জি স্যার।

মহকুমার পুলিশ প্রধান একটা সরকারি নৌকা পান। বড় নৌকা। নৌকার মাঝিরাও সরকারি কর্মচারী। ফয়জুর রহমান সাহেবের ছেলেমেয়েদের এই নৌকা নিয়ে ঘুরে বেড়ানোর খুব শখ। এই কাজটা তিনি কখনোই করতে দেন। না। আজ নিয়মের ব্যতিক্রম করলেন।

ফয়জুর রহমান সাহেব ঘড়ির দিকে তাকালেন। সকাল দশটা পঁচিশ। তিনি সাড়ে এগারোটা বাজার অপেক্ষা করছেন। সময় কাটছে না। টেবিলে অনেক ফাইল আছে; ফাইল দেখতে ইচ্ছা করছে না। টিএ বিল করা যায়। গত মাসের টিএ বিল করা হয় নি। তবে এখন টিএ বিল করা অর্থহীন। কে দেবে বিল? তিনি ড্রয়ার খুলে দুশ পৃষ্ঠার বাঁধানো খাতা বের করলেন। তিনি বেশ কিছুদিন হলো একটা রেডিও নাটক লেখার চেষ্টার করছেন। নাটকের নাম কত তারা আকাশে। এই নামকরণের একটা ইতিহাস আছে। তাঁর সর্বকনিষ্ঠ সন্তান শাহীন এক রাতে উঠানে বসেছিল। হঠাৎ সে আকাশের দিকে তাকিয়ে মুগ্ধ গলায় বলল, কত তারা আকাশে! তিনি ছেলের মুখে শুদ্ধ বাংলায় এই বাক্য শুনে মোহিত হলেন এবং ততক্ষণাৎ ঠিক করলেন, এই নামে একটা গল্প লিখবেন।
 
গল্প না লিখে রেডিও নাটক লেখারও ইতিহাস আছে। রেডিও পাকিস্তান ঢাকার সহকারী প্রোগ্রাম প্রডিউসার বাহারুল হক সাহেবের বাড়ি পিরোজপুর। তাঁর সঙ্গে ফয়জুর রহমান সাহেবের পরিচয় হয়েছে। বাহারুল হক সাহেব। আশা দিয়েছেন, নাটক ভালো হলে রেডিওতে প্রচারের চেষ্টা করবেন।

ফয়জুর রহমান সাহেব গভীর মনোযোগে সাড়ে এগারোটা পর্যন্ত নাটক লিখলেন। কয়েকটা দৃশ্য বাদ দিলেন। নতুন যে দৃশ্যটি লিখলেন সেটি এতই আবেগময় যে লিখে শেষ করে তার চোখে পানি এসে গেল। তিনি চোখের পানি মুছে উঠে দাঁড়ালেন। রশীদ অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। নতুন এসডিপিও সাহেবের অনেক ব্যাপারই তার কাছে অদ্ভুত মনে হয়। এই এসডিপিও সাহেব প্রায়ই কী যেন লেখেন, তখন তার চোখ দিয়ে পানি পড়ে। এর মধ্যে নিশ্চয়ই কোনো ঘটনা আছে। এই ঘটনা তার জানতে ইচ্ছা করে। জানতে চাইলেই তো আর জানা যায় না। সে সামান্য পাংখাপুলার। পুলিশের কতাঁর মনের রহস্য জানার তার সুযোগ কোথায়?



এসডিও মুহিবুল্লাহ তার বাংলোর বারান্দায় বেতের চেয়ারে বসেছিলেন। ফয়জুর রহমানকে আসতে দেখে তিনি ভুরু কুঁচকে তাকালেন। মহকুমা পুলিশ প্রধানের তাঁর কাছে আসার একটাই অৰ্থ–আইন-শৃঙ্খলাঘটিত কোনো সমস্যা হয়েছে। সমস্যা হবেই। সমস্যার সমাধান দেয়ার ক্ষমতা এখন তার নেই। এসডিপিওকে ফুল পুলিশ ইউনিফর্মে দেখেও তিনি খানিকটা বিস্মিত।

ফয়জুর রহমান সাহেব স্যালুট করলেন। মহিবুল্লাহ চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন। শান্ত গলায় বললেন, Is anything wrong?

ফয়জুর রহমান বললেন, স্যার, আপনাকে পিরোজপুর ছেড়ে চলে যেঙ্গে হবে।

মহিবুল্লাহ চুপ করে রইলেন।

স্যার, আমি হুলারহাটে লঞ্চ রেডি করে রেখেছি। লঞ্চ আপনাকে বরিশালে নিয়ে যাবে। বরিশালে আপনি নিরাপদে থাকবেন। চেষ্টা করবেন বরিশাল থেকে ঢাকা চলে যেতে। সেখান থেকে নিজের দেশে।

বরিশাল যাবার পথেও তো আমাকে মেরে ফেলতে পারে।

ট্রেজারির পনেরোজন আর্মড পুলিশ সেই লঞ্চে যাচ্ছে। তাদের আমি আপনার নিরাপত্তার বিষয়টি বলে দিয়েছি।

তারা আপনার কথা শুনবে?

জি স্যার, শুনবে।

কখন যাব?

এখন।

আপনি এই চেয়ারটায় বসুন। আমি তৈরি হয়ে আসছি। আপনাকে ছোট্ট একটা প্রশ্ন করব, জবাব ভেবে চিন্তে দেবেন।

স্যার, প্রশ্ন করুন।

আপনার লয়েলটি কোন দিকে? পাকিস্তানের দিকে, না-কি বিদ্রোহীদের দিকে?

অবশ্যই বিদ্রোহীদের দিকে!

তাহলে আমাকে পালিয়ে যেতে সাহায্য করছেন কেন? আচ্ছা থাক, এই প্রশ্নের জবাব দিতে হবে না।

হুলারহাট লঞ্চ টার্মিনালে ফয়জুর রহমান সাহেব মহকুমা প্রধানকে বিদায় দিলেন। মুহিবুল্লাহ লঞ্চে উঠার আগে হঠাৎ থমকে দাঁড়িয়ে বললেন, You are a brother that I never had.



রাত নটা। কিছুক্ষণ আগে ফয়জুর রহমান সাহেব খবর পেয়েছেন মুহিবুল্লাহ ঠিকমতো বরিশাল পৌঁছেছেন। আজ রাতেই রকেট স্টিমারে তার বরিশাল থেকে ঢাকায় রওনা দেবার কথা।

পিরোজপুরের রাস্তায় রাস্তায় জঙ্গি মিছিল। মিছিলের স্লোগান–ইয়াহিয়ার বিরুদ্ধে আমরাও প্রস্তুত। বিরুদ্ধে শব্দটা বরিশালের বিশেষ উচ্চারণে হয়েছে ক্ৰদ্ধে। শুনতে অদ্ভুত লাগছে। মিছিলের নেতৃত্ব দিচ্ছেন ন্যাশনাল আওয়ামী পাটির অল্পবয়েসী নেতা আলি হায়দার খান! ফয়জুর রহমান সাহেবের সঙ্গে এই মানুষটির বিশেষ সখ্য আছে। প্রায় রাতেই মিছিল শুরুর আগে আগে তিনি এসডিপিওর বাংলোয় চা খেতে আসেন। সেখান থেকে যখন মিছিলে যান, তখন তাঁর সঙ্গে এসডিপিও সাহেবের দুই ছেলেও থাকে। তারাও মহাউৎসাহে ইয়াহিয়ার ব্রুদ্ধে আমরাও প্রস্তুত। স্লোগান দেয়। তাদের হাতে থাকে বাবার ব্যক্তিগত পয়েন্ট টু টু বোরের একটা রাইফেল। একটাই রাইফেল দুজন হাত বদল করে। রাইফেল হাতে ছেলেদের দেখে তাঁর মনে একই সঙ্গে আনন্দ হয় এবং শঙ্কাও হয়।

আজ এসডিপিও সাহেবের দুই ছেলে মিছিলে যাচ্ছে না। কারণ আজ তাদের বাসায় জীন নামানো হবে। তাদের উৎসাহের কোনো সীমা নেই।

যে ব্যক্তি জীন আনবেন তার নাম কফিলুদ্দি। মধ্যবয়স্ক বলশালী একজন লোক। মুখভর্তি দাড়িগোফের জঙ্গল। ঘোলাটে চোখ। তার পরনে লুঙ্গি, গায়ে গাঢ় সবুজ রঙের পাঞ্জাবি।

কফিলুদ্দি একটা ঘরে সবাইকে নিয়ে বসাল। সেখানে জায়নামাজ পাতা। সে জায়নামাজে বসে বিভিন্ন সূরা বিশেষ করে সূরায়ে জীন পাঠ করে সশরীরে উপস্থিত করবে। যখন জীন আসবে তখন জীনের সঙ্গে বেয়াদবিমূলক কোনো কথাবার্তা বলা যাবে না। জীনকে প্রশ্ন করলেও করতে হবে অত্যন্ত আদবের সঙ্গে। জীনের উপস্থিতি অনুভব করা যাবে, তবে তাকে দেখা যাবে না। কারণ ঘর থাকবে অন্ধকার। ঘরে কোনো আলো জ্বালা যাবে না।

সবাই অজু করে অপেক্ষা করছে। ঘর অন্ধকার। কেউ তার নিজের হাতই দেখতে পাচ্ছে না। এমন অবস্থা। কফিলুদ্দি একমনে সূরা পড়ে যাচ্ছে। তার গলার স্বর ভারী। সে কেরাত পড়ছে বিশেষ ভঙ্গিমায়। হঠাৎ কী যেন হলো, ঘরের মাঝখানে থপ করে শব্দ। যেন ছাদ থেকে কেউ লাফিয়ে মেঝেতে নামল। মেঝেতে সে ব্যাঙের মতো থপথপ শব্দ করে হাঁটছে। কফিলুদ্দি তখনো কেরাত পড়ে যাচ্ছে। এই অবস্থায় জীন বলল, আসসালামু আলায়কুম। আমি আসছি।

ভয়াবহ অবস্থা। বসার ঘরে বাইরের লোক বলতে কফিলুদ্দি একা। জীন সেজে দ্বিতীয় ব্যক্তির প্রবেশের প্রশ্নই ওঠে না। অথচ কফিলুদ্দিনের কোরআন পাঠ এবং জীনের কথাবার্তা একই সঙ্গে শোনা যাচ্ছে। সে যে থপথপ করে ঘরের এক মাথা থেকে অন্য মাথায় যাচ্ছে তাও বোঝা যাচ্ছে। মাঝে-মাঝে সাপের শিসের মতো তীব্র শিসের শব্দও পাওয়া যাচ্ছে।

এসডিপিও সাহেবের মেজ ছেলে জাফর ইকবাল ভয়ে ভয়ে বলল, আপনি কোথায় থাকেন?

জীন বলল, আমি থাকি কোহকাফ নগরে।

বাংলাদেশ কি স্বাধীন হবে?

কোনোদিন হবে না।

স্বাধীন কেন হবে না?

আমরা সব জীন একত্র হয়ে পাকিণ্ডানের জন্যে দোয়া করি। পাকিস্তান জিন্দাবাদ।

জীন আরো কিছু প্রশ্নের জবাব দিল। সবার মাথায় হাত রেখে দোয়া করল এবং বলল, সে আর বেশিক্ষণ এখানে থাকতে পারবে না। কারণ তার চলে যাবার সময় এসেছে। পাকিস্তানের তাঁরক্কির জন্যে জীন সমাজে আজ বিশেষ দোয়া হবে। তাকে সেই দোয়ায় সামিল হতে হবে।
 
ফয়জুর রহমান সাহেব এবং তার স্ত্রী দুজনই জীন যে সত্যি এসেছিলএই বিষয়ে পুরোপুরি নিশ্চিত হলেন। কফিলুদ্দিকে ভালো বখশিশ দিয়ে বিদায় করা হলো। জীন নামানোর এই অদ্ভুত কর্মকাণ্ড তাঁরা কেউই আগে দেখেন নি। বাংলাদেশ স্বাধীন হবে না–এই ভয়ঙ্কর কথা যদি জীন না বলত, তাহলে জীন অনুভবের আনন্দ ষোল আনা হতো। জাফর ইকবাল বলল, দেশ স্বাধীন অবশ্যই হবে। কারণ জীন আসে নাই। জীনের সব কথাবার্তা আমি টেপ রেকর্ডারে টেপ করেছি। জীন যদি সত্যি আসত, সে দেখত যে আমি এই কাণ্ড করছি। তখনই সে রেগে যেত। সমস্তই কফিলুদ্দির কারসাজি।

ফয়জুর রহমান সাহেব তাঁর মেজ ছেলের সাহস দেখে চমৎকৃত হলেন। সে এক ফাঁকে জীনের কথাবার্তা রেকর্ড করে ফেলেছে। এই চিন্তা তো তার নিজের মাথায় আসে নি। তার জন্যে আরো বড় চমক অপেক্ষা করছিল। তাঁর বড় ছেলে জীনের কথাবাতাঁর রেকর্ড বাজিয়ে পুরোটা শুনে জীন যে আসে নাই সে বিষয়ে কঠিন প্রমাণ উপস্থিত করল। জীন কথাবাতাঁর এক পর্যায়ে পুরোপুরি বরিশালের ভাষায় বলেছে পরথম। তার যুক্তি হচ্ছে, যে জীন থাকে কোহকাফ নগরে সে বরিশালের আঞ্চলিক ভাষায় প্রথমকে পরথম বলবে না।

দেশ স্বাধীন হবে না। জীনের এই কথায় মন খারাপ করার কোনোই কারণ নেই। কারণ জীন আর কেউ না, কফিলুদ্দি নিজে।

ফয়জুর রহমান সাহেব তাঁর ছেলেদের সাহস এবং বুদ্ধিতে অত্যন্ত প্ৰীত হয়ে সেই রাতে ঘুমুতে গেলেন। তাঁর মনে হলো এরকম ছেলেমেয়ে যার আছে তার চিন্তিত হবার কিছু নেই। যে-কোনো বিপদ এরা সামাল দিতে পারবে। তিনি ঘুমুবার জন্যে বিছানায় শুয়ে পড়েছিলেন। কী মনে করে বিছানা থেকে উঠলেন। অজু করে তাহাৰ্জ্জুতের নামাজ পড়তে গেলেন।

নামাজে দাঁড়ানোর সঙ্গে সঙ্গেই দরজার কড়া নড়ল। অতি ব্যস্ত ভঙ্গিতে কেউ একজন কড়া নাড়ছে। কড়া নাড়ার ভঙ্গি থেকে বোঝা যাচ্ছে, ভয়ঙ্কর কিছু ঘটেছে। ভয়ঙ্কর কিছু না ঘটলে রজনীর দ্বিতীয় প্রহরে এসডিপিওর বাংলোর কড়া কেউ এইভাবে নাড়বে না।

তিনি এখন কী করবেন? নামাজ শেষ করবেন? না-কি কে কড়া নাড়ছে সেই খোঁজ করবেন? তার উচিত আগে নামাজ শেষ করা। যে কড়া নাড়ছে তার তর সইছে না। সে কড়া নেড়েই যাচ্ছে। কড়া নাড়ার শব্দে ফয়জুর রহমান সাহেবের স্ত্রী আয়েশার ঘুম ভেঙেছে। তাঁর বড় মেয়ে সুফিয়ার ঘুম ভেঙেছে। দুজনই ভীত মুখে বিছানা থেকে নেমেছে।

তিনি নামাজের পাটি থেকে নেমে পড়লেন। অসম্ভব খারাপ সময়ের ভেতর দিয়ে সবাই যাচ্ছে। কখন কী ঘটে যায় কিছুই বলা যায় না। আগে খোেজ নেয়া দরকার।

কড়া নাড়ছেন পিরোজপুর সদর থানার ওসি। তার সঙ্গে আছেন সেকেন্ড অফিসার। ফয়জুর রহমান সাহেব দরজা খোলার সঙ্গে সঙ্গে ওসি নিচু গলায় বলল, স্যার, থানায় যেতে হবে।

কী হয়েছে?

ওয়ারলেসে জরুরি ম্যাসেজ দেবে। আপনার সঙ্গে কথা বলবে।

কে দিচ্ছে জরুরি ম্যাসেজ?

সেটা কিছু বলে নাই, তবে মনে হয় মিলিটারি হাইকমান্ড। তবে পুলিশ হেড কোয়াটারও হতে পারে।

ফয়জুর রহমান সাহেব অতি দ্রুত লুঙ্গি বদলে প্যান্ট পরলেন। শার্ট গায়ে দিলেন। তাঁর স্ত্রী ভীত মুখে বললেন, কোথায় যাচ্ছ?

থানায় যাচ্ছি।

কেন?

পরে বলব। পরে।

ছেলেদের কাউকে সাথে নিয়ে যাও। ওদের ডেকে তুলি?

কাউকে ডাকতে হবে না। খামাখা ভয় পেও না। ভয় পাবার মতো কিছু হয় নাই।


ওয়ারলেস ম্যাসেজ এসেছে ঢাকার পুলিশ সদরদপ্তর থেকে। আইজির বক্তব্য প্রচার করা হচ্ছে। ঢাকার অবাঙালি ওয়ারলেস অপারেটর জানাল–দেশের সব জেলা মিলিটারির দখলে আছে। সাবডিভিশন এবং থানা লেভেলেও মিলিটারি অতি দ্রুত অভিযান শুরু করবে। পুলিশ বাহিনীকে জানানো যাচ্ছে, তারা যেন সামরিক বাহিনীকে পূর্ণ সহযোগিতা করে। তারা দেশের আইনশৃঙ্খলা দেখবে এবং দেশের মঙ্গলের জন্যে সামরিক বাহিনীর নির্দেশ পালন করবে।

ফয়জুর রহমান ম্যাসেজ নিলেন। ওসি সাহেব বললেন, স্যার আমরা কী করব? ওসি সাহেবের মুখ দুশ্চিন্তায় ছোট হয়ে গেছে। তিনি রীতিমতো ঘামছেন।

ফয়জুর রহমান বললেন, পুলিশ সবসময় থেকেছে। সাধারণ মানুষদেব সঙ্গে। এখানো আমরা তাই করব। দেশের মানুষের সঙ্গে থাকব।

যারা থাকতে চায় না, তারা কী করবে?

তাদেরটা তারা জানে।

আপনি কোনো নির্দেশ দেবেন না?

না। পুলিশের কমান্ড ভেঙে পড়েছে। এই অবস্থায় নির্দেশ চলে না।

পুলিশ বাহিনীর কেউ যদি দেশে চলে যেতে চায়, তাহলে কি চলে যাবে?

হ্যাঁ যাবে।

ফয়জুর রহমান সাহেব হেঁটে হেঁটে বাসায় ফিরছেন। এই শহরে কোনো স্ট্রীট লাইট নেই। কোনো বাড়িতেও আলো জুলছে না। তবে আকাশে চাঁদ আছে। চাঁদের আলোয় পথ চলতে অসুবিধা হচ্ছে না। হঠাৎ তার কাছে মনে হলো, জোছনার গ্রামের চেয়ে জোছনার শহর অনেক সুন্দর।

তিনি থমকে দাঁড়ালেন। বেশ কিছু সময় জোছনা অনুভব করলেন। আবার যখন হাঁটতে শুরু করলেন, তখন লক্ষ করলেন দূর থেকে কেউ একজন তাকে অনুসরণ করছে। তিনি যখন দাঁড়িয়ে যান, সেও দাঁড়ায়। তিনি হাঁটতে শুরু করলে সেও হাঁটে। ব্যাপারটা কী?

কে ওখানে, কে?

যে অনুসরণ করছিল সে থেমে গেল। ফয়জুর রহমান সাহেব পুলিশি গলায় ডাকলেন, কাছে আসো।

ভীত পায়ে মাথা নিচু করে কেউ একজন আসছে; কাছাকাছি এসে দাড়াবার পর তাকে চেনা গেল। পাংখাপুলার রশিদ।

ফয়জুর রহমান সাহেব হাঁটতে শুরু করলেন। রশিদ পেছনে পেছনে মাথা নিচু করে আসছে। রশিদের এই এক অভ্যাস–তিনি যেখানে যান রশিদ তাকে অনুসরণ করে, যত রােতই হোক। এর কোনো ব্যতিক্রম হয় না।

অদ্ভুত স্বপ্নটার কথা ফয়জুর রহমান সাহেবের হঠাৎ মনে পড়ল। স্বপ্নে তিনি বরযাত্রী যাচ্ছিলেন। সেখানেও তাঁর পেছনে ছিল রশিদ। বাস্তবের অনুসরণকাবী স্বপ্নেও ছিল।

রশিদ!

জি স্যার।

বিয়ে করেছ?

জি-না স্যার।

পরিপূর্ণ জোছনায় দুজন হাঁটছে। ফয়জুর রহমান সাহেবের হঠাৎ মনে হলো— স্বপ্নদৃশ্যেও আকাশে জোছনা ছিল; বরযাত্রী চাঁদের আলো গায়ে মাখতে মাখতে এগুচ্ছিল।
 
জেনারেল টিক্কা খান আজ চোস্ত পায়জামার সঙ্গে মিলিয়ে হালকা ঘি কালারের পাঞ্জাবি পরেছেন। পায়ে পরেছেন কাবুলি চপ্পল। পাঞ্জাবির উপর নকশাদার কাশ্মিরী কটি পরেছিলেন। কাটির লাল, হলুদ এবং কড়া সবুজ রঙ বেশি কটকট করছিল বলে কটি খুলে ফেলেছেন। কানের লতিতে সামান্য আতর দিয়েছেন। আতরের নাম মেশক-এ আম্বর। তাঁর ফুপাতো ভাই এই আন্তর সৌদি-আরব থেকে পাঠান। আতরের কড়া গন্ধ তাঁর ভালো লাগে না। তবে আজ খারাপ গছে না। মেজাজে সামান্য ফুরফুরে ভাব চলে এসেছে। আগামী দুঘণ্টা তাকে এই ফুরফুরে ভাব ধরে রাখতে হবে।

আজ তার জন্মদিন। জনদিন উপলক্ষে হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল থেকে দুটি কেক আনা হয়েছে। দুটি কেকের উপর উর্দুতে লেখা জিন্দা পাকিস্তান। অর্ডার দিয়ে বানানো এই দুটা কেক আজ রাতে দুই দফায় কাটা হবে। প্রথম দফায় কাটবেন ঢাকা শহরের কিছু বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবীদের সঙ্গে। এদের মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আছেন, কবি-সাহিত্যিক আছেন, শিল্পী আছেন, ফিল্ম লাইনের কিছু লোকজন আছেন। তাদের সময় দেয়া হয়েছে সন্ধ্যা সাতটা। গাড়ি যাবে, তাদের নিয়ে আসবে। অনুষ্ঠান শেষে গাড়ি তাদের পৌঁছে দেবে।

অনুষ্ঠানের পরিকল্পনা যখন করা হয়, তখন তার এডিসি ইসমত খান বলেছিল, কেউ আসবে না। টিক্কা খান বলেছেন, যাদের দাওয়াত করা হবে, তারা সবাই আসবে। কেউ বাদ যাবে না।

ইসমত খান তারপরেও বলল, স্যার, মনে হয় না কেউ আসবে।

টিক্কা খান বললেন, বাজি ধরতে চাও? এসে তোমার সঙ্গে ছোট একটা বাজি হয়ে যাক।

এডিসি বলল, বাজি রাখলে আপনি হেরে যাবেন। কারণ আমার বাজির ভাগ্য খুব ভালো। আমি সবসময় বাজিতে জিতি।

চলো দেখা যাক। if you win you get a big fruit basket. কেন তুমি উইন করবে না শুনতে চাও?

If you please.

ইন্টেলেকচুয়ালস আর কাউয়ার্ডস। শেকসপিয়ার বলে গিয়েছেন, cowards die many times before their death. V53TT KŘ মৃত। মৃতদের ইচ্ছাঅনিচ্ছা বলে কিছু নেই। বুঝেছ?

চেষ্টা করছি।

জীবন বঁচিয়ে রাখার জন্যে তারা মাটি চাটবে। দুএকটা ব্যতিক্রম থাকতে পারে। যে-কোনো নিয়মেই কিছু ব্যতিক্রম থাকে। ভালো কথা, আমি গায়ে যে আতর দিয়েছি, তার গন্ধ তোমার কাছে কেমন লাগছে?

কড়া।

ওয়াটার কালারের মতো হালকা টান না। তেলরঙের কঠিন ব্ৰাসের টান। ঠিক বলেছি?

ইয়েস স্যার।

যুদ্ধাবস্থায় ওয়াটার কালার থাকে না। তখন সবই তেলরঙ। সেই অর্থে আন্তরটা মানিয়ে যাচ্ছে।

ইয়েস স্যার।



অতিথিরা সময়মতো এসে পড়লেন। তারা ভীত। তাদের দাড়াবার ভঙ্গি, বসার ভঙ্গি–সব কিছুর মধ্যেই জবুথবু ভাব। তাদের নিঃশ্বাস ফেলার ভঙ্গিও বলে দিচ্ছে তারা ঠিকমতো নিঃশ্বাস ফেলতে ভয় পাচ্ছেন। সবাই মেরুদণ্ড সোজা করে বসেছেন। ভীত মানুষ মেরুদণ্ড সোজা করে বসে। তখন তাদের স্নায়ু টানটান হয়ে থাকে।

জেনারেল টিক্কা বললেন, আপনারা আমার নিমন্ত্রণ রক্ষা করার জন্যে কষ্ট করে এসেছেন, এতে আমি অত্যন্ত আনন্দিত। আপনাদের কাউকে কাউকে আমি চিনি, সবাইকে চিনি না। আপনারা যদি নিজের পরিচয় দেন, তাহলে আমি অত্যন্ত সম্মানিত বোধ করব। না না, উঠে দাঁড়াতে হবে না। বসে বসে বলুন। Please.

আমি ডঃ …। আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্যের অধ্যাপক।

Thank you sir, thank you for coming.

আমি ডঃ …। আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক।

Thank you sir, thank you for coming.

আমি …। আমি একজন কবি।

I am honoured to meet a poet.

পরিচয়পর্ব শেষ হতে সময় লাগল, কারণ জেনারেল টিক্কা সবার সামনেই কিছুক্ষণ দাঁড়াচ্ছেন। ভদ্রতার হাসি হাসছেন। কারো কারো সঙ্গে হাত মেলাচ্ছেন। একজনের সঙ্গে কোলাকুলিও করলেন। পরিচয়পর্ব শেষ হবার পর জেনারেল সুন্দর একটা ভাষণ দিলেন। ভাষণটা পুরোপুরি ইংরেজিতে দেয়া হলো।

আমার মতো সামান্য একজন সৈনিকের আমন্ত্রণে সাড়া দিয়ে আপনাদের মতো গুণী-জ্ঞানীরা যে এসেছেন তাতে আমি নিজেকে ধন্য মনে করছি। আমার জন্যে আজকের দিনটি একটি বিশেষ দিন। এই দিনে পাঞ্জাবের এক অখ্যাত দুৰ্গম গ্রামে আমার জন্ম হয়। জন্মদিন পালন করার মতো হাস্যকর ছেলেমানুষি করা কোনো সৈনিকের শোভা পায় না। আমি এই ছেলেমানুষিটা করছি মূলত আপনাদের কাছে পাওয়ার একটি অজুহাত হিসেবে।

আপনারা নিশ্চয়ই স্বীকার করবেন, দুষ্কৃতকারীদের সব চক্রান্ত আমরা গুড়িয়ে দিয়েছি। দুষ্কৃতকারীদের পেছনে আছে বেঈমান আওয়ামী লীগ। এক বেঈমানকে সাহায্য করবে: অন্য বেঈমান। আওয়ামী লীগকে সাহায্য করছে বেঈমান হিন্দুস্তান। আমরা এখন প্ৰস্তুত হচ্ছি বেঈমান হিন্দুস্তানকে শায়েস্তা করার জন্যে। আওয়ামী লীগ ইতোমধ্যেই শায়েস্তা হয়েছে। বড় শয়তান খাঁচায় ঢুকে গেছে। আমরা আমাদের সুবিধামতো সময়ে বড় শয়তানটাকে খাঁচা থেকে বের করব। তাকে নিয়ে আমাদের ইন্টারেস্টিং পরিকল্পনা আছে।

স্বাধীন বাংলা বেতার নামে হিন্দুস্তানের আকাশবাণীর একটি শাখা এতদিন প্রচার করছিল–শেখ মুজিব বিদ্রোহীদের সঙ্গে থেকে আন্দোলনে নেতৃত্ব দিচ্ছে। আশা করি, আমার ভাষণের পর এই বিষয়ে আপনাদের মনে আর কোনো প্রশ্ন থাকবে না। আগামীকালের সংবাদপত্রে করাচি এয়ারপোর্টে বসে থাকা শেখ মুজিবের একটি ছবি ছাপা হবার কথা।

আমি আমার বক্তৃতার শেষপর্যায়ে চলে এসেছি। কিছুক্ষণের মধ্যেই কেক কাটা হবে। তারপর আপনারা আমার সঙ্গে এক কাপ চা খাবেন। আপনাদের সবার জন্যে সামান্য কিছু উপহারও আছে। Fruit basket. ইংরেজিতে একটা প্রবচন আছে Say it with flowers. আমি প্রবচনটা সামান্য বদলেছি। আমি বলছি Say it with fruits.

আপনারা সবাই পাকিস্তানের পক্ষে কাজ করবেন। বেঈমানদের কথায় প্রতারিত হবেন না। দেশে যুদ্ধাবস্থা চলছে। যুদ্ধাবস্থায় আমাদের কিছু কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে হয়। আপনারা এমন কিছু করবেন না যাতে আমাদের কঠিন অবস্থা নিতে বাধ্য করা হয়।

কেক কাটা হলো। কেকের এক কোনায় সবুজ রঙের বড় সাইজের একটা মোমবাতি। জেনারেল টিক্কা বললেন, I am making a wish. বলেই চোখ বন্ধ করলেন। চোখ বন্ধ অবস্থায় ফু দিয়ে মোমবাতি নিভিয়ে বললেন, আমার wish ছিল শান্তি ও ফ্রেন্ডশিপের। আসুন কেক খাওয়া যাক। উনি নিজেই সবার হাতে কেক তুলে দিলেন। উপস্থিত বিশিষ্ট অতিথিরা জেনারেলের ভদ্রতায় মোহিত হলেন।
 
পরবর্তী আধঘণ্টা জেনারেল নানান গল্পগুজব করলেন। কচ্ছের রান এলাকায় তিনি জেভলিন দিয়ে একটা বন্য শূকরী মেরেছিলেন সেই গল্প। অতিথিদের একজন কচ্ছের রান মরুভূমিতে বন্য শূকর আছে কিনা সেই সন্দেহ প্রকাশ করায় তাৎক্ষণিকভাবে ফটো অ্যালবাম এনে বন্য শূকরীসহ তার ছবি দেখালেন।

যুদ্ধবিদ্যা সম্পর্কে কিছু কথাও হলো। তিনি ইতিহাসের অধ্যাপককে বললেন, পৃথিবীর প্রধান যুদ্ধবিশারদ হলেন আলেকজান্ডার দ্য গ্রেট। পবিত্র কোরআন শরিফে যে আলেকজান্ডার দ্য গ্রেটের নাম আছে, তা কি আপনি জানেন?

ইতিহাসের অধ্যাপক বিস্মিত হয়ে বললেন, জানি না স্যার।

আমাদের পবিত্র ধর্মগ্রন্থে আলেকজান্ডার দ্য গ্রেটের নাম আছে। তাকে সেখানে উল্লেখ করা হয়েছে জুলকারনাইন নামে।

জেনারেলের কথাবার্তায় সবাই চমৎকৃত এবং বিস্মিত। তাঁর জ্ঞানের ব্যাপকতায়ও মুগ্ধ। ইনি যে মোটামুটি ভয়াবহ একজন মানুষ এবং বালুচিস্তানের জল্লাদ নামে খ্যাত–সেটা কারোর মনেই রইল না। জেনারেল সবাইকে নিজে উপস্থিত থেকে গাড়িতে তুলে দিলেন।

তাঁর দ্বিতীয় দফা মিটিং শুরু হলো পুলিশের উপরের দিকের কর্মকর্তাদের সঙ্গে। আইজি ছিলেন না। তিনজন ডিআইজি এবং দুজন এআইজি। এদের মধ্যে একজন ছাড়া বাকি সবাই বাঙালি। জেনারেল তাদের জন্যে দ্বিতীয় কেকটি কাটলেন। প্ৰথম দফায় তিনি যা যা করেছেন এবং বলেছেন তার সবই আবারো করলেন। কোনো কিছুই বাদ পড়ল না। কচ্ছের রানে বন্য শূকরী শিকারের গল্পটাও করলেন। এইবার অবশ্যি মরুভূমিতে বন্য শূকরী পাওয়া যায় কি যায় না–এই নিয়ে কেউ কোনো সন্দেহ প্ৰকাশ করল না। তারপরেও তিনি মৃত শূকরীর পাশে বর্শা হাতে তার দাঁড়িয়ে থাকার ছবি দেখালেন। বাঙালি পুলিশকর্তাদের সঙ্গে তাঁর বক্তৃতা হলো অল্প।

কাজের কথা আমি সংক্ষেপে বলতে পছন্দ করি। আপনারা মন দিয়ে আমার কথা শুনুন। আমি বাঙালি পুলিশের কাছ থেকে ৯৫ ভাগ লায়েলটি আশা করছি। তারা পাঁচ ভাগ লয়েলটি তাদের বাঙালি ভাইদের জন্যে রাখুক। এই পাঁচ ভাগ নিয়ে আমার কোনো মাথাব্যথা নেই। আপনাদের কাজে সাহায্য করার জন্যে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে বেশ কিছু পুলিশ অফিসার আসছেন। প্যারামিলিশিয়া বাহিনীও আপনাদের সঙ্গে থাকবে। আপনাদের কিছু বলার আছে?

স্পেশাল ব্রাঞ্চের এআইজি বললেন, আমাদের কিছু বলার নেই স্যার।

জেনারেল বিরক্ত গলায় বললেন, সবার হয়ে আপনি কথা বলছেন কেন? আপনার কিছু বলার নেই, সেটা আপনি বলবেন। অন্যদেরও যে কিছু বলার নেই তা। আপনি জানেন কীভাবে?

এআইজির মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেল। জেনারেল টিক্কা বললেন, প্রত্যেকেই প্ৰত্যেকের কথা আলাদাভাবে বলবে।

সবাই জানালেন, তাদের বলার কিছু নেই।

জেনারেল বললেন, আপনাদের সঙ্গে আমার কথা শেষ হয়েছে। আপনারা যেতে পারেন। আপনাদের প্রতি আমার নির্দেশ–আগামী চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে আপনারা পুলিশের শাসন কাঠামো ঠিকঠাক করবেন। সেনাবাহিনীর গোয়েন্দা বিভাগ পুলিশ বাহিনীর কর্মকাণ্ডের প্রতি তীক্ষ্ণ নজর রাখছে–এই তথ্যটা আপনাদের জানিয়ে রাখলাম। আপনাদের প্রত্যেকের জন্যে একটা ফুট বাসকেট রাখা হয়েছে। দয়া করে নিয়ে যাবেন। Good day officers.



জেনারেল ডিনার করতে গেলেন। আমি অফিসার্স মেসে। তিনি সামরিক বাহিনীর উধৰ্ব্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে ডিনার করবেন–এই খবর আগেই দেয়া ছিল। ডিনারের আয়োজন ব্যাপক। নৌ-বাহিনীর বাবুর্চি আব্দুল খালেককে এই উদ্দেশ্যেই আজকের রাতের খাবার তৈরির জন্যে কমিশন করা হয়েছে। জাফরান-মুরগি নামের একটি আইটেম রান্নার ব্যাপারে তার খ্যাতি প্রবাদের মতো। বিশেষ আইটেমটি রান্না হয়েছে। গরুর মাংসের কাবাব রান্নার জন্যে মিরপুর এলাকা থেকে এক বিহারিকে আনা হয়েছে। সে মেসের বাইরে আগুন করে কাবাব তৈরি করছে। যারা কাবাব খেতে ইচ্ছুক, তাদের প্লেট হাতে কাবাবওয়ালার কাছে আসতে হচ্ছে। কাবাবওয়ালা আগুনগরম কাবাব তাদের প্লেটে তুলে দিচ্ছে।

মেসের বাইরে খোলা মাঠেও কিছু চেয়ার-টেবিল রাখা হয়েছে। অনেকে সেখানেও বসেছেন।

উত্তম খাদ্যের সঙ্গে পানের ব্যবস্থাও রাখা হয়েছে। অস্ট্রেলিয়ান রেড ওয়াইন, রাশিয়ান ভদকা এবং ব্ল্যাক লেভেল হুইস্কি। কয়েক ধরনের বিয়ার আছে, তবে সবচেয়ে বেশি চলছে ভদকা। বিশেষ বিশেষ দিনে বিশেষ কোনো একটা ড্রিংক ক্লিক করে। আজ ক্লিক করেছে ভদকা। সবাই দামি ব্ল্যাক লেভেল বাদ দিয়ে ভদকা টানছেন। শুধু জেনারেল টিক্কার হাতে রেড ওয়াইনের একটা গ্লাস। তিনি প্ৰথম গ্রাস রেডওয়াইন শেষ করেছেন। এখন আছেন। দ্বিতীয় গ্রাসের মাঝামাঝি। আবহাওয়া মনোরম। গুমোট গরমের পর ঠাণ্ডা বাতাস দিচ্ছে। দূরে কোথাও বৃষ্টি হয়েছে বলে মনে হয়।
 
বৃষ্টির কথা মনে আসায় জেনারেলের ক্ৰ কুঞ্চিত হলো। বৃষ্টি ভালো জিনিস না। মনসুন এসে পড়ার অর্থ আমি চলাচলের সমস্যা। বিচিত্র এক দেশ–নদী, খাল,বিল, পানি। তিনি শুনেছেন সিলেটের দিকের বিশাল এক অঞ্চল নাকি বৃষ্টি নামলেই অতলে তলিয়ে যায়। যখন বাতাস বয়, তখন নাকি সেখানে সমুদ্রের ঢেউয়ের মতো ঢেউ ওঠে। এসব এলাকা কাজ করা সেনাবাহিনীর কর্ম না। নৌবাহিনীর ব্যাপার। জেনারেল এক চুমুকে গ্লাস শেষ করে আবার গ্লাস ভর্তি করলেন। ওয়াইন খাবার নিয়ম এরকম না। ওয়াইন খেতে হয়। হালকা চুমুকে। ঠোট ভিজল কি ভিজল না–এই ভঙ্গিতে। ভদকা-হুইস্কি এসব হলো ঢোল, খোল-করতাল, আর ওয়াইন হলো কোমল বাঁশি।

ব্রিগেডিয়ার শামস হঠাৎ লাফ দিয়ে দাঁড়িয়ে ভদকার গ্লাস উঁচু করে বললেন, জেনারেলের জন্মদিন উপলক্ষে চিয়ার্স। যারা বসেছিল তারা উঠে দাঁড়াল। একের পর এক টেষ্ট হতে থাকল।

টেস্ট ফর পাকিস্তান।

টেস্ট ফর দ্য গ্রেট পিপল অব পাকিস্তান।

টেস্ট ফর দ্য লস্ট সোলজার্স।

আর্মি অফিসারদের পার্টি সাধারণত দ্রুত জমে যায়। এতকিছুর পরেও আজ পার্টি জমছে না। ক্যাটালিস্টের অভাবই কি এর মূল কারণ? আর্মি অফিসারদের রূপবতী বধুরা এইসব পার্টিতে থাকেন। তারাই ক্যাটালিষ্ট। তারা পার্টি জমাবার অনেক কায়দা জানেন। অনেক ঢং করতে পারেন। আজকের পার্টি নারী বিবর্জিত।

কর্নেল জামশেদকে সবাই ধরে বসল ম্যাজিক দেখানোর জন্যে। ম্যাজিকের কিছু কলাকৌশল সবসময় তাঁর পকেটে থাকে। কিছু মুদ্রা, দড়ি কাটার খেলা দেখানোর জন্যে দড়ি এবং কাঁচি, এক প্যাকেট তাস, পিংপং বল। দেখা গেল আজ তিনি কিছুই আনেন নি। একজনের কাছ থেকে এক টাকার একটা মুদ্রা নিয়ে তিনি কয়েন ভ্যানিসিং দেখালেন। হাতের মুঠোয় কয়েন রাখা হচ্ছে। মুঠো খুলতে দেখা যাচ্ছে কয়েন নেই। কয়েন রাখা হলো ডান হাতের মুঠোয়, পাওয়া গেল বাম হাতের মুঠোয়।

কর্নেল জামশেদের হাত সাফাইর খেলাও জমছে না। পার্টি শেষ করা উচিত। যে পার্টি জমে না, তাকে দীর্ঘসময় চলতে দিলে শেষে নানান সমস্যা হয়। জেনারেল টিক্কা পার্টির সমাপ্তি ঘোষণা করলেন। ছোট্ট একটা সমাপনী ভাষণও দিলেন। এই ভাষণটি দিলেন উর্দুতে।

বিশ্বের শ্রেষ্ঠ সেনাবাহিনীর অন্যতম পাকিস্তানের সেনাবাহিনী। এই বাহিনী দেশরক্ষার যে পবিত্র কর্তব্য নিয়ে নেমেছে, সে-কর্তব্য তারা এমনভাবে পালন করবে। যে জাতির ইতিহাসে তা লেখা থাকবে। মুর্থ পূর্ব পাকিস্তানিদের আমরা বুদ্ধিমান বানিয়ে ছাড়ব। বুদ্ধিমান বানানোর এই প্রক্রিয়া এমনই কঠিন হবে যে কাঠিন্য সম্পর্কে তাদের ধারণা নেই। আমরা যুদ্ধাবস্থায় আছি। যুদ্ধাবস্থায় দয়া, মায়া, করুণা নামক মানবিক গুণগুলি মাটির নিচে তিন হাত গর্ত কবে পুতে রাখতে হয়। আমরা সাত হাত গর্ত করে পুতে রাখব। মানবিক গুণাবলি মানুষদের জন্যে। পূর্ব পাকিস্তানিদের মতো সুবিধাবাদী, হিন্দুর পাছা চাটা বাহেনচোদদের জন্যে না।

আমি ডেজার্ট ফক্স টেংক সেনাপতি রোমেলের একটি উদ্ধৃতি দিয়ে এবং আপনাদের সবাইকে আগাম অভিনন্দন জানিয়ে বক্তৃতা শেষ করছি। জেনারেল রোমেল মিশর এক্সপিডিসনের সময় বলেছেন–তুমি যখন শক্রকে দয়া দেখাবে, তখন বুঝবে তুমি সৈনিক নও। তুমি শক্রর বুকের উপর বেয়োনেট উঁচু করে ধরেছ। হঠাৎ শত্রুর করুণ মুখ দেখে তোমার মায়া হলো। তুমি দ্বিধাগ্ৰস্ত হয়ে বেয়োনেট নামিয়ে নিলে। শত্রু তখন তোমার করণীয় কাজটি নিজে সুন্দরভাবে সমাধা করবে। তার বেয়োনেট তোমার হৃৎপিণ্ডে ঢুকিয়ে দেবে।

জেনারেল আর্মি মেস থেকে ফিরেছেন। ড্রাইভারকে সরিয়ে তিনি নিজেই স্টিয়ারিং হুইল ধরলেন। চমৎকার লাগছে গাড়ি চালাতে। ঢাকা শহর স্বাভাবিক হয়ে আসছে। ভালো, খুব ভালো। পত্র-পত্রিকা, রেডিও-টিভিতে এই স্বাভাবিকতার খবর পৌঁছে দিতে হবে। বিদেশী সাংবাদিকদের ডাকা হবে। তারা দেখবে একটি পরিচ্ছন্ন নগরী।

ঢাকার খবরের কাগজগুলি দুপৃষ্ঠা করে বের হচ্ছে। এটা কাজের কথা না। পত্রিকা বের হবে পত্রিকার মতো। মেজর সিদিক সালেককে বলতে হবে। এই দায়িত্ব ইন্টার সার্ভিসেস পাবলিক রিলেশন্স অফিসারের।
 
দৈনিক পাকিস্তান-এর সাহিত্যপাতায় শাহ কলিম-এর একটি গদ্যরচনা প্রকাশিত হয়েছে। রচনার শিরোনাম— শুদ্ধ প্ৰাণ পাকিস্তান। পঁচিশে মার্চের পর সে নতুন একটা নামে লেখালেখি শুরু করেছে। তার বর্তমান নাম গোলাম কলিন্দর। চেহারাও কিছু পাল্টেছে। দাড়ি, চুল দুটাই বড় হয়েছে। বাবরি চুল মিলিটারিরা সন্দেহের চোখে দেখে বলে রাস্তায় বের হবার সময় সে মাথায় সুচোর কাজ করা একটা রঙিন টুপি পরে। চোখে থাকে সানগ্লাস। সানগ্লাসটা তাকে এক পাকিস্তানি মেজর সাহেব (সিদিক সালেক) উপহার দিয়েছেন। এই মেজর সাহেব প্রেস সেকশনের দায়িত্বে আছেন। তিনি মাঝে-মাঝেই পত্রিকা অফিসে উপস্থিত হন। কলিমউল্লাহর সঙ্গে মেজর সাহেবের ভালো খাতির হয়েছে। তার জিপে কলিমউল্লাহকে মাঝে-মাঝে দেখা যায়। মেজর সাহেব একদিন তাকে আমি মেসে দুপুরের খানা খেতে দাওয়াত করেছিলেন।

দুপুরের খানা খাবার পর কলিমউল্লাহ মেজর সাহেবকে বলেছে, পাকিস্তান রক্ষার জন্যে শরীবের শেষ রক্তের ফোটোটাও সে দেবে। যে রাতে পাকিস্তান রক্ষা পেল, সেই রাতে সে বিশ রাকাত নামাজ পড়ে আল্লাহর দরবারে মোনাজাত করেছে। কিছু প্রাণহানী হয়েছে। কিছু নিরীহ মানুষও মৃত্যুবরণ করেছে। এটা হবেই। কিছু করার নাই। যে-কোনো মহৎ কাজের ধর্ম হলো, মহৎ কাজের সঙ্গে দুএকটা নোংরা কাজও হয়। আমরা দেখব মহৎ কাজটা।

মেজর সিদিক সালেক কলিমউল্লাহকে একটা পাস দিয়েছেন। পাসটা কলিমউল্লাহর খুব কাজে লাগছে। কারফিউ চলার সময় পাস দেখিয়ে সে রাস্তায় নামতে পারে।

কলিমউল্লাহ মিরপুর এলাকায় তিন রুমের একটি বাসা ভাড়া করেছে। ভাড়া বলা ঠিক হবে না, সে বিনা ভাড়াতেই থাকছে। বাড়িওয়ালা ঘর-বাড়ি ছেড়ে দেশের বাড়িতে চলে গেছেন। কলিমউল্লাহকে বলেছেন, কোনো ভাড়া দিতে হবে না। আপনি বাড়িটা দেখেশুনে রাখবেন। অনেক কষ্টে বাড়ি করেছি, হাতছাড়া যেন না হয়। গরিব মানুষ বড় কষ্টের পয়সায় বাড়ি। শুনেছি বিহারিরা বাড়িঘর নিয়ে নিচ্ছে।

কলিমউল্লাহ বলেছে, আপনি বে ফিকির থাকেন (তার কথাবার্তায় কিছু কিছু উর্দু শব্দ এখন ঢুকে পড়ছে।) এই বাড়ি কেউ নিতে পারবে না। আমি বিহারির বাবা। তাছাড়া বাড়ির গায়ে উর্দুতে লেখা থাকবে–ইহা মুসলমানের বাড়ি। কালো একটা তারা চিহ্নও থাকবে। এই চিহ্নটাই আসল । চিহ্ন দেখলে বিহারি মিলিটারি সবাই বুঝবে–সাচ্চা মুকাম। (আবার উর্দু। শুনতে খারাপ লাগে না।)

মিরপুরের এই বাড়িতে কলিমউল্লাহর দিনকাল খারাপ কাটছে না। বাচ্চু মিয়া নামে সে একজন বাবুর্চি রেখেছে। বাবুর্চির বয়স সর্তে রো-আঠারো। বাড়ি নেত্রকোনার রুয়াইলে। চাকরি নেবার সময় সে বলেছিল সব রান্না জানেদেশী, মোগলাই, ইংলিশ। সে আগে চাইনিজ রেস্টুরেন্টে কিছুদিন কাজ করেছিল বলে টুকটাক চাইনিজও জানে।

কার্যক্ষেত্রে দেখা গেল, সে কোনো রান্নাই জানে না। তার সব তরকারির চেহারা রোগীর পথ্যের মতো। খেতেও রোগীর পথ্যের মতো। তবে তার সবচে বড় গুণ হলো সেই খাবার মুখে দিয়ে সে-ই প্রথম চিৎকার করবে—আস্তাগাফিরুল্লাহ, তরকারির কী অবস্থা! ভাইজান মুখে দেওন যায়? হলুদ খারাপ কিনেছি। হলুদের জন্যে এই অবস্থা। নতুন হলুদ কিনতে হবে।

নতুন হলুদ কেনার পরেও স্বাদ বা বর্ণের কোনো তারতম্য হয় না।

কলিমউল্লাহ আর কাউকে পাচ্ছে না বলে বাচ্চু মিয়াকে হজম করছে। শহরে লোক পাওয়া কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। শহর ফাঁকা। ২৭/২৮ তারিখের দিকে যারা পালিয়েছিল তারা ফেরে নি, বরং দফায় দফায় আরো লোকজন চলে যাচ্ছে। রেডিওতে অবশ্যি বলা হচ্ছে শহরের জীবনযাত্রী স্বাভাবিক। স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, শীঘ্রই খুলে দেয়া হবে। ব্যাংকের কাজকর্ম চলছে। সরকারি অফিস-আদালত চলছে।

যারা দুষ্টলোকের কথায় বিভ্রান্ত হয়ে কাজকর্ম ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন, তারা কাজে যোগদান করলে তাদের সাময়িক কর্মবিরতি ক্ষমা করা হবে।

লোকজন মনে হয় রেডিওর খবরে বিশ্বাস করছে না। তারা বিশ্বাস করছে। গুজবে। কত ধরনের গুজব যে ছড়াচ্ছে তার কোনো মা-বাপ নেই। বাচ্চু মিয়া গুজব সংগ্রহ করে আনার ব্যাপারে অত্যন্ত দক্ষ। বাতাসে কোনো গুজব ভাসছে, বাচ্চু মিয়া সেই গুজব সংগ্রহ করে আনে নি। এটি কখনো হবে না। একদিন ভোরবেলা সে উধাও হয়ে গেল। সারাদিন তার কোনো খোঁজ নেই। ফিরল রাত আটটায়। তার মুখভর্তি হাসি।

ভাইজান, বলেন দেহি ঘটনা কী হইছে? দুই মিলিট সময়, দুই মিলিটের মধ্যে বলেন।

কলিমউল্লাহ বলল, তোকে আমি আর রাখব না। তুই চলে যা।

বাচ্চু মিয়া বিন্দুমাত্র বিচলিত না হয়ে বলল, না রাখলে নাই। কপালে যা আছে তাই ঘটব। কিন্তু আপনে কন দেখি আইজের ঘটনা। এক মিলিট সময়। (বাচ্চু মিয়ার ন উচ্চারণে কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু মিনিট-কে সে বলবে মিলিট।)

কথা বলিস না, চুপ করে থাক।

ভাইজান, টিক্কা তো শেষ। শে-এ-এ-এ-এ-ষ।

কে শেষ?

টিক্কা। জেনারেল টিক্কা। চাইর গুলি খাইয়া উল্টাইয়া পড়ছে। বুনকা বুনিকা রক্ত। মিলিটারির অবস্থা ছেড়াবেড়া। তারার কমান্ডারই নাই।

তোকে কে বলেছে?

বেবাক শহরের লোক জানে। যদি মিথ্যা বইল্যা থাকি, তাইলে আমি বাপের ঘরের না। আমি জারজ সন্তান। স্বাধীন বাংলা খুইল্যা শুনেন কী ডিক্লার দিছে।
 
সন্ধ্যার পর স্বাধীনবাংলা বেতার থেকেও এই খবর বলা হলো। জেনারেল টিক্কা নিহত। অসমর্থিত খবরে বলা হয়েছে, পূর্বপাকিস্তানের সামরিক আইন প্রশাসক জেনারেল টিক্কা মুক্তিবাহিনীর হাতে নিহত। ঢাকা শহরে তুমুল উত্তেজনা। মিলিটারি সর্বোচ্চ সতর্কাবস্থায়।

বাচ্চু মিয়া বলল, ভাইজান, এখন কী কন? গিরিবের কথা বাসি হইছে বইল্যা ফলছে। আল্লাহ। গরিব নাম দিয়া কী অদ্ভুত জাত বানাইছে। গরিবের টাটকা কথার উপরে বিশ্বাস নাই। বাসি কথার উপরে বিশ্বাস। এখন দেন দুইটা টেকা।

দুটাকা দিয়ে কী করবি?

পোলাও-এর চাল কিনব, ঘি, কিনব। আইজ মোরগপোলাও করব। আমি মোরগপোলাও রান্ধন শিখেছি মনা বাবুর্চির কাছে। একবার খাইয়া দেখেন। উস্তাদ আমায় বিরাট স্নেহ করতেন।

মনা বাবুর্চির মেহের শিষ্যের অতি অখাদ্য মোরগপোলাও খাবার সময়ই রেডিও ও টিভিতে জেনারেল টিক্কার ভাষণ প্রচারিত হলো। জেনারেল টিক্কা সশরীরে উপস্থিত হয়ে নতুন কিছু সামরিক নির্দেশ দিলেন। টিভিতে তাঁর মুখ হাস্যময়। যেন সামরিক নির্দেশ দিতে গিয়ে তিনি বড়ই আনন্দ পাচ্ছেন।

কলিমউল্লাহ বাচ্চু মিয়ার দিকে তাকিয়ে বলল, এটা কী হলো? বাচ্চু মিয়া বলল, ভাইজান এইটা আসল টিক্কা না। এইটা নকল। মিলিটারিরে বুঝ দেওনের জন্যে আনছে। আসলটা শেষ। এইটা মনে হয় তার কোনো ভাই। ভাইয়ে ভাইয়ে চেহারায় মিল থাকে। আমার কথা যদি সত্যি না হয় তাইলে আমি বাপের ঘরের না, আমি জারজ সন্তান। মোরগপোলাও কেমন হয়েছে বলেন।

তুই বল কেমন হয়েছে।

অতি জঘন্য হয়েছে। ঘি ভালো ছিল না। ডালডার ভেজাল। ভেজাল ঘি দিয়া মোরগপোলাও আমার উস্তাদ মনা বাবুর্চিও পাকাবে না। লাখ টেকা দিলেও না।

চুপ থাক।

আচ্ছা যান। চুপ থাকলাম।

তুই তো রান্নার কিছুই জানিস না।

এইটা কী কইলেন ভাইজানি! আমি ছিলাম মনা বাবুর্চির এক নম্বর এসিসটেন। ওস্তাদ আমারে নিজের সন্তানের চেয়ে অধিক স্নেহ করতেন। এখন যুদ্ধের সময় রান্ধনে মন বসে না বইল্যা কিছু হয় না।

যুদ্ধ তুই কই দেখলি?

আরে কী কন? ঢাকার বাইরে ধুরুম ধারুম, গুরুম গারুম সমানে চলতাছে। বেঙ্গল রেজিমেন্ট খাবালা দিয়া ধরছে। মেজর জিয়া পাকিস্তান আমিরে কামড় দিয়া ধরছে। কচ্ছপের কামড়। জীবন যাবে কিন্তু কামড় ছাড়বে না।

চুপ থাক গাধা। কিছুই হচ্ছে না। যুদ্ধ যা হচ্ছে স্বাধীন বাংলা বেতারে হচ্ছে, जबई छूशा यूक।

বাচ্চু মিয়া আহত গলায় বলল, ভুয়া যুদ্ধ!

কলিমউল্লাহ পাইপ ধরাতে ধরাতে বলল (এই পাইপটাও সে মেজর সাহেবের কাছ থেকে সংগ্ৰহ করেছে। অবসর সময়ে ইজিচেয়ারে হেলান দিয়ে পাইপ ধরাতে তার ভালো লাগে), শোন মন দিয়ে, যুদ্ধ হচ্ছে বেতারে। এই যুদ্ধে গোলাবারুদ লাগে না, শুধু লাগে গলার জোর। স্বাধীন বাংলা বেতার ভুয়া। তার সব খবর ভুয়া।

এইটা কী কন?

তারা খবর দিল শেখ সাহেব মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে আছেন। আদেশ নির্দেশ দিচ্ছেন। পরে পত্রিকার ছবি দেখলাম। উনি করাচি এয়ারপোর্টে। তারা খবর দিল, সুফিয়া কামাল, ড. নীলিমা ইব্রাহিম মারা গেছেন। আমরা পত্রিকায় উনাদের ছবি দেখলাম। মাশাল্লাহ দুজনেই ভালো আছেন। তারপর শুনলাম টিক্কা খান মারা গেছে। এখন তুই বল মারা গেছে?

অবশ্যই। যে টিক্কারে আপনে দেখছেন বিশ্বাস করেন ভাইজান, আপনের আল্লাহর দোহাই লাগে, এইটা নকল। আসলটা শেষ। আমার কথা যদি মিথ্যা হয়, আমার মাথায় যেন ঠাডা পড়ে।

তুই যা আমার সামনে থেকে।



বর্তমান জীবনটা কলিমউল্লাহর বেশ ভালো লাগছে। থাকার জায়গার কোনো অসুবিধা নেই। এই বাড়ি তো আছেই, এ ছাড়াও থাকার মতো বাড়ি আছে। ঝিকাতলার যে বাড়িতে কলিমুল্লাহ প্রাইভেট টিউশনি করত, সেই ভদ্রলোক দেশে চলে যাচ্ছেন। তিনিও কলিমউল্লাহকে তার বাড়ি দেখাশোনা করতে বলেছেন! একটা চাবিও দিয়ে গেছেন। ঝিকাতলার বাড়িটা বড়। জিনিসপত্রে ঠাসা। কলিমউল্লাহ ঠিক করেছে, কোনো এক সময় ঐ বাড়িতে উঠবে। এক জায়গায় বেশি দিন থাকতে নেই। তাতে শিকড় গজিয়ে যায়। যারা গদ্য লেখে শিকড় গজানো তাদের সমস্যা হয় না। কবিদের জন্যে হয় সমস্যা। কবিদের শিকড় থাকতে হয় না। চলমান ছন্দের মতো কবিদেরও হতে হয় চলমান।

তাছাড়া অবসর সময়ে অন্যের বাড়ির জিনিসপত্র নেড়েচেড়ে দেখতে তার ভালো লাগে। এখন যে বাড়িতে আছে সেই বাড়ির মূল শোবার ঘরের খাটের নিচে রাখা একটা ট্রাঙ্কের তালা খুলে সে খুবই আরাম পেয়েছে। অনেক টুকিটাকি জিনিস, চিঠিপত্র। ছবি। এর মধ্যে নায়লা নামের এক মেয়েকে লেখা কয়েকটা চিঠি আছে চূড়ান্ত অশ্লীল। নায়লার স্বামী নায়লাকে লিখেছে। এত অশ্লীল কোনো লেখা কলিমউল্লাহ আগে পড়ে নি। চিঠিগুলি সে নিজের সংগ্রহে রেখে দিয়েছে। ট্রাঙ্কের ভেতর দুশ একুশ টাকা পাওয়া গেছে (হরলিকসের কৌটাতে মুখবন্ধ করে রাখা)। এরা টাকা ফেলে চলে গেল কেন কে বলবো? হরলিকসের কৌটাসহ টাকাটা কলিমউল্লাহ নিজের কাছে রেখে দিয়েছে। এখান থেকে সে টুকটাক খরচ করছে। তার তেমন খারাপ লাগছে না।
 
ঝাঁ ঝাঁ দুপুরে কলিমউল্লাহ হাঁটছে। হাইকোর্টের সামনের রাস্তা ধরে হাঁটা। সে যাবে দৈনিক পাকিস্তান অফিসে। তার পকেটে নতুন আরেকটি গদ্যরচনা। শিরোনাম–

মহাকবি ইকবাল

একুশে এপ্রিল ইকবাল দিবস। সেই দিবসে রচনাটা প্রকাশিত হবে। বিশেষ বিশেষ দিবসের জন্যে লেখা পাওয়া দুষ্কর । এই লেখাও যাচ্ছে গোলাম কলিন্দর নামে। গোলাম কলন্দির নামটা ভালো পরিচিতি পাচ্ছে। ইংরেজি পত্রিকাগুলিতে কিছু লেখা দিতে পারলে ভালো হতো। কলিমউল্লাহর ইংরেজি একেবারেই আসে না। পেসিভ ভয়েস, একটিভ ভয়েস, টেন্স বড়ই ঝামেলার জিনিস।

হাঁটতে কলিমউল্লাহর ভালো লাগছে। প্রায় ফাঁকা রাস্তা। যারা হাঁটছে রাস্তার দিকে তাকিয়ে নিঃশব্দে হাঁটছে।

আগে রিকশাওয়ালারা রিকশা চালাবার সময় প্রয়োজন না থাকলেও টুং-টাং করত। এখন টুং টাং বন্ধ! বেশিরভাগ রিকশাই খালি। যাত্রী নেই। আগে কাজ না থাকলেও লোকজন রাস্তায় হাঁটাহাঁটি করত, এখন তা না। নিতান্ত প্রয়োজন না হলে কেউ পথে নামছে না।

দেয়াল, বাড়িঘর পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন। কোথাও চিকা মারা নেই। সামরিক নির্দেশে সব তুলে ফেলা হয়েছে। গভীর রাতে চিকামারা পার্টি এসে চিকা মেরে যাবে সেই উপায় নেই। রাত নটা থেকে ভোর পাঁচটা পর্যন্ত কারফিউ। পথে কাউকে দেখা গেলেই গুলি।

কলিমউল্লাহ সিগারেট ধরাল। হাঁটতে হাঁটতে সিগারেট খাওয়া স্বাস্থ্যের জন্যে হানিকর। এত স্বাস্থ্য স্বাস্থ্য করলে স্বাস্থ্য থাকে না। কোনো কিছু নিয়েই বাড়াবাড়ি করতে হয় না। হাইকোটের বিচারপতি বিএ সিদ্দিকী সাহেবের কথাই ধরা যাক। উনি এমনই কঠিন লোক যে জেনারেল টিক্কাকে গভর্নর হিসাবে শপথ নেওয়াতে রাজি হলেন না। জয় বাংলা, জয় সিদ্দিকী। স্লোগান পর্যন্ত হয়ে গেল। সেই তিনি এখন সোনামুখ করে জেনারেল টিক্কাকে শপথ পাঠ করিয়েছেন। বল হরি হরি বল। আয় বাবা দেখে যা, দুটি সাপ রেখে যা।

ঢাকা এখন ঠিক আছে। ঢাকায় কোনো সমস্যা নেই। কোথাও প্যা পোর ভাব হলেই হেলিকপ্টার বোমা ফেলে আসছে। বোমারু বিমানও আছে। কোদাল খুন্তি নিয়ে যে বাঙালি দেশ স্বাধীন করে ফেলবে বলে ঠিক করেছিল, সেই বাঙালি আসমানী বালা মসিবতের কথা ভাবে নি। তাদের ফ্যাড়াফ্যাড়ানি বন্ধ। এখন বসে বসে আরবি হরফে বাংলা লেখা শিখ। ইয়াহিয়ার বিশেষজ্ঞ কমিটি সুপারিশ দিয়েছে–আরবি হরফে বাংলা লেখার। কী মজা! কী মজা! বে। জবর বা, নুন লাম আলিফ জবর লা। বানলা। মজা হচ্ছে না?

দৈনিক পাকিস্তান-এর সামনে এসে কলিমউল্লাহ শান্তি মিছিলের সামনে পড়ল। শান্তি মিছিল চলে ট্রাকে। তাদের শহরের নানান জায়গায় ঘুরতে হয়। হেঁটে এত জায়গা কাভার করা যাবে না। শান্তির দূতদের দিকে কলিমউল্লাহ আগ্রহ করে তাকাচ্ছে। এদের সঙ্গে পরিচয় থাকা ভালো। বিপদে কাজে আসবে। সবাইকে চেনা যাচ্ছে না। খান-এ-সবুর আছেন, খাজা খয়েরউদ্দিন, গোলাম আযম, বেনজির আহমদ। কলিমউল্লাহর মনে হলো–বাংলাদেশ যদি কোনোদিন (সম্ভাবনা নেই, তবু কথার কথা) স্বাধীন হয়ে যায়, তাহলে এদের কী হবে? শান্তির এই কপোতরা কি তখনো শান্তির বকম বকম করবেন?
কলিমউল্লাহকে দেখে দৈনিক পাকিস্তান অফিসে প্রায় অস্পষ্ট এক ধরনের উত্তেজনা দেখা গেল। দারোয়ান টুল ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে সালাম দিল। অফিসে ঢোকার মুখে ছাপাখানার একজন বললেন, কলিম ভাই, কেমন আছেন? গতকাল আপনাকে দেখি নাই। শরীর খারাপ ছিল? আমাদের এখান থেকে এক কাপ চ খেয়ে যান।

এই খাতিরের কারণ মেজর সাহেবের সঙ্গে ঘোরাঘুরি। সূর্যের কাছাকাছি যারা থাকে তারাও আলো বিচ্ছুরণ করে। কলিমুল্লাহ ইকবাল-বিষয়ক রচনাটা জমা দিয়ে চা নিয়ে বসল। পত্রিকা অফিসের চা সবসময় ভালো হয়। প্রথম কাপ শেষ করার পর দ্বিতীয় কাপ খেতে ইচ্ছা করে।

কলিম ভাই, কেমন আছেন?

ক্যাশিয়ার সাহেব মনে হয় কোনো কাজে ঢুকেছিলেন। কলিমউল্লাহকে দেখে থিতামত খেয়ে গেলেন। তার চোখে স্পষ্ট ভীতি। ভয়ের চোখে তাকে কেউ দেখছে – বাহ, ভালো তো! কলিমউল্লাহর মনটা হঠাৎ ভালো হয়ে গেল। তার জীবনটা মোটামুটি ভয়ের মধ্যেই কেটেছে। আজ পাশার দান পাল্টেছে। তাকেও লোকজন ভয় পাচ্ছে। কলিমউল্লাহ চায়ে চুমুক দিয়ে বলল, আপনি ভালো আছেন?

জি। আপনার দোয়া।

আমার আবার দোয়ার টাইম কোথায়?

ঠিকই বলেছেন দোয়ার টাইম নাই। ইয়া নফসি, ইয়া নফসি।

ইয়া নফসি ইয়া নফসি হবে কী জন্যে?

কলিমউল্লাহ খুবই আনন্দের সঙ্গে লক্ষ করল ভদ্রলোকের মুখ শুকিয়ে গেছে। বেফাঁস কথাটা বলে তিনি এখন আতঙ্কে অস্থির। কলিমউল্লাহ ঠাণ্ডা গলায় বলল, আপনার সঙ্গে আমার কিছু প্ৰাইভেট কথা আছে।

অবশ্যই অবশ্যই।

আপনি আপনার ঘরে যান। আমি চা-টা শেষ করে আসি।

অবশ্যই অবশ্যই।

ঘরে যেন আর কেউ না থাকে।

জি জি জি।

আপনার নাম হেলাল না?

জি জি জি।

আপনি অপেক্ষা করুন, আমি আসছি।

হেলাল সাহেব জড়ানো পায়ে তার ঘরের দিকে যাচ্ছেন। ভদ্রলোকের কলিজা শুকিয়ে গেছে। এখন চলছে কলিজা শুকাবার কাল। ড্রাই লিভার ওয়েদার।

কলিমউল্লাহ চা শেষ করে আরেক কাপ চা নিল। হেলাল সাহেবের কাছে যত দেরি করে যাওয়া যায় ততই ভালো। টেনশনে ব্যাটার ঘাম বের হয়ে যাক। আমি আমার এক জীবনে অনেক টেনশন নিয়েছি। এখন তোরা খানিকটা নে।



কেমন আছেন হেলাল সাহেব?

জি ভালো আছি। চো

খমুখ শুকনা, ভালো তো মনে হয় না। রাতে ঘুম ভালো হচ্ছে না?

জি ঘুম হচ্ছে। কলিম ভাই, চা খাবেন?

না, চা দুকাপ খেয়েছি।

অন্য কিছু খাবেন? আনায়ে দেই।

না, কিছু খাব না। আচ্ছা শুনেন, কবি শামসুর রাহমান সাহেব অফিসে আসতেছেন না, ব্যাপারটা কী? যুদ্ধে চলে গেছেন না-কি?

জি-না। জি-না।

উনি আছেন কোথায়?

তা তো জানি না। ঢাকা শহরে কি আছেন?

জি-না।

কোথায় আছেন? আমি উনার কোনো খোঁজ জানি না।

ঢাকা শহরে যে উনি নাই সেটা তো আপনি জানেন। তাহলে আপনি কেন বলছেন তার খোঁজ জানেন না? কবির গ্রামের বাড়ি কোথায়? ঠিকানাটা দেন। আমি দেখা করে আসব। ইদানীং কী লেখালেখি করছেন–দেখব।

উনি কোথায় আছেন আমি কিছুই জানি না।

জেনে তারপর আমাকে জানান।

হেলাল সাহেব চুপ করে আছেন। তার কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম। কলিমউল্লাহ বলল, একটা জর্দা দিয়ে পান আনার ব্যবস্থা করেন। চা খেয়ে মুখ মিষ্টি হয়ে গেছে।

অবশ্যই অবশ্যই।

আমাকে কাগজ আর কলম দেন। নিরিবিলি একটা ঘর দেন। কেউ যেন আমাকে বিরক্ত না করে। শুধু মেজর সাহেব এলে খবর দিবেন।

অবশ্যই অবশ্যই।

দুপুরে আমার জন্যে কোনো খাবারের ব্যবস্থা করবেন না। মেজর সাহেবের সঙ্গে তাঁর মেসে খাবার কথা। (সম্পূর্ণ মিথ্যা। এই জাতীয় মিথ্যা বলতে কলিমউল্লাহর সবসময় ভালো লাগে।)
 

Users who are viewing this thread

Back
Top