What's new
Nirjonmela Desi Forum

Talk about the things that matter to you! Wanting to join the rest of our members? Feel free to sign up today and gain full access!

Collected ছোছনা ও জননীর গল্প - উপন্যাস (2 Viewers)

সামরিক নির্দেশাবলির পর প্রচারিত হলো যন্ত্রসঙ্গীত। যন্ত্রসঙ্গীতের পর স্বাস্থ্যবিষয়ক কথিকা। বিষয় জলবসন্ত। সোবাহান সাহেব জলবসন্ত বিষয়ক কথিকাও অত্যন্ত মনোযোগের সঙ্গে শুনলেন। জলবসন্তে এন্টিবায়োটিক কোনো কাজে আসে না–এই তথ্য তাঁর কাছে হঠাৎ করেই খুব গুরুত্বপূর্ণ মনে হলো। এখন তাঁকে দেখে গত রাতের সোবাহান সাহেব বলে মনে হচ্ছে না। মনে হচ্ছে মোটামুটিভাবে আনন্দে আছেন এমন একজন মানুষ। যে মানুষটি। কানের কাছে ট্রানজিস্টার রেডিও ধরে রাখার মতো গুরুত্বপূর্ণ কাজ পেয়েছেন। রেডিওতে পাওয়া খবর অন্যদের জানানোর বিষয়েও তাকে উৎসাহী মনে হচ্ছে। শাহেদকে বললেন, ভালো খবর আছে, আগামীকালও দুঘণ্টার জন্যে কার্ফ তোলা হবে। এমনিতে দুঘণ্টা কম সময় মনে হয়, আসলে কিন্তু অনেক সময়। দুই ঘণ্টায় দুনিয়ার কাজ করে ফেলা যায়। কাল মনে করে আরো ব্যাটারি কিনবে।

মনোয়ারাকে রাতে কী রান্না হবে সেই বিষয়ে বললেন, বৌমা খিচুড়ি রান্না করো। বর্ষা বাদলায় আনন্দের দিনে খিচুড়ি খেতে হয়, আবার বিপদে-আপদেও খিচুড়ি খেতে হয়। পাতলা খিচুড়ি সঙ্গে ডিমভুনা।

খিচুড়ি ডিমভুনা খেতে খেতে রাত দশটা বেজে গেল। তার পরপরই উত্তর দিক থেকে প্রবল গোলাগুলির শব্দ আসতে লাগল। গতকালের মতোই অবস্থা। রাস্তায় ভারী মিলিটারি গাড়ির চলার শব্দ কিছুক্ষণ পরপরই শোনা যাচ্ছে। গোলাগুলির সঙ্গে বুম বুম শব্দের বিকট আওয়াজও কানে আসছে। এই শব্দ কিসের তা সোবাহান সাহেব বুঝতে পারছেন না। তিনি চিন্তিত গলায় শাহেদকে বললেন, বুম বুম শব্দটা কিসের? শাহেদ বলল, জানি না। চাচা। কামান দাগছে না-কি? কামান দাগছে কী জন্যে?

রাত বারটার দিকে শব্দ আসতে শুরু করল পশ্চিম দিক থেকে। এই শব্দ অনেক কাছ থেকে আসছে। গুলি মনে হচ্ছে শী শী শব্দ করে এই বাড়ির ছাদের উপর দিয়ে উড়ে যাচ্ছে। সোবাহান সাহেব ভীত গলায় বললেন, সবাই মেঝেতে শুয়ে থাকে। সবাই একঘরে শোও। মহাআজাবের সময় আত্মীয়-অনাত্মীয় নারীপুরুষে কোনো ভেদাভেদ নাই। শাহেদ, তুমিও আমাদের সঙ্গে শুয়ে থাকে।

বসার ঘরের মেঝেতে সবাই শুয়ে আছে। কংকন শুয়েছে শাহেদের পাশে। সে একটা পা শাহেদের গায়ে তুলে দিয়েছে। রুনি এইভাবে ঘুমায় না। সে হাতপা গুটিয়ে পুটলির মতো শুয়ে থাকে। একটা আঙুল থাকে তার মুখে। ঘুমের মধ্যে সে আঙুল চুষতে থাকে। খুবই খারাপ অভ্যাস।

সোবাহান সাহেব অত্যন্ত ভয় পেয়েছেন। ভয়ের কারণে হঠাৎ তার কথা জড়িয়ে যেতে শুরু করেছে। তিনি বললেন, সবাই একমনে আল্লাহপাকের নাম নাও–আমাদের বড়পীর সাহেব আবদুল কাদের জিলানি সব সময় যে জপ। করতেন। ঐটা করো। এক মনে বলো–লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ।

কংকন বলল, বাতি জ্বালাও, আমার ভয় লাগে। সোবাহান সাহেব বললেন, বাতি জ্বালানো যাবে না।

গুলির শব্দ আরো কাছে এগিয়ে এসেছে। মানুষজনের চিৎকার শোনা যাচ্ছে। সোবাহান সাহেব শব্দ করেই জিগির করছেন–লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ। লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ।
 
১৬.
মাত্র দুঘণ্টার জন্যে কারফিউ-বিরতি।

এই দুঘণ্টায় শাহেদকে অনেক কাজ করতে হবে। যেভাবেই হোক আসমানীর খোঁজ বের করতে হবে। সে নিশ্চিত আজি খোঁজ পাওয়া যাবে। সে যেমন আসমানীর খোঁজ বের করার চেষ্টা করছে, আসমানীও নিশ্চয়ই করছে। প্ৰথমবার কারফিউ তোলা ছিল আকস্মিক । হঠাৎ করে আসমানীরা খবর পেয়েছে দুঘণ্টার জন্যে কারফিউ নেই। তৎক্ষণাৎ কোনো ব্যবস্থা করতে পারে নি। আজকেরটা আগেভাগেই জানা। কাজেই আসমানী নিশ্চয়ই প্ল্যান করে রেখেছে। শাহেদ ঠিক করেছে সে প্রথমে যাবে শ্বশুরবাড়িতে। সেখানে কোনো খোঁজ না বের করতে পারলে নিজের বাসায় এসে বসে থাকবে। তবে আজ খবর পাওয়া যাবেই। গতরাতে সে একটা ভালো স্বপ্ন দেখেছে। সেই স্বপ্নের একটাই অর্থ। আসমানীর সঙ্গে দেখা হবে। স্বপ্নে সে নিজের ঘরের বারান্দায় বসে হাউমাউ করে কাঁদছে, এমন সময় তার বড় ভাই ইরতাজউদ্দিন বারান্দায় এসে বিরক্ত গলায় বললেন, কাদছিস কেনরে গাধা? সে ফোঁপাতে ফোঁপাতে বলল, আসমানীর খোঁজ পাচ্ছি না। ইরতাজউদ্দিন বললেন, ঘরে বসে ভেউ ভেউ করে কাঁদলে খোঁজ পাবি কী করে? আয় আমার সঙ্গে। দুজন রাস্তায় নামল। রাস্তায় প্রচুর লোকজন। তাদের মধ্যেই দেখা গেল, একটা ঠেলাগাড়িতে আসমানী বসে আছে। সে খুব সুন্দর করে সেজেছে। তার গা ভর্তি গয়না। মুখে চন্দনের ফোঁটা দেয়া। পরনের শাড়িটাও মনে হচ্ছে বিয়ের শাড়ি। শাহেদ ঠেলাগাড়ির দিকে অতি দ্রুত যাবার চেষ্টা করছে। এত লোকজন যে যাওয়া যাচ্ছে না। তবে আসমানী তাকে দেখতে পেয়েছে। সে হাসছে।

ভোরের স্বপ্ন সত্যি হয়। এই স্বপ্ন অবশ্যই সত্যি হবে। শাহেদ অতি দ্রুত হাঁটছে। স্বপ্নে যেমন দেখেছিল রাস্তায় প্রচুর মানুষ, বাস্তবেও তাই দেখা যাচ্ছে। প্রচুর লোক। মনে হয় শহরের সমস্ত লোকজন এক সঙ্গে পথে নেমেছে। রিকশাও নেমেছে, তবে সংখ্যায় কম। খালি রিকশা দেখা মাত্র শাহেদ ছুটে যাচ্ছে। রিকশা কি কলাবাগান যাবে? প্রতিটি রিকশাওয়ালাই এই প্রশ্নের জবাব দিতে অনেক সময় নিচ্ছে। চট করে বলে দিলেই হয় যাবে না। তা না করে একেকজন আকাশ-পাতাল ভাবছে। এদিক ওদিক তাকাচ্ছে। রাস্তায় থুথু ফেলছে। কপালের ঘাম মুছছে। তারপর বিড়বিড় করে বলছে–ঐ দিকে যামু। না। রিকশা ঠিক করতে যাওয়া মানে সময় নষ্ট। এখন প্রতিটি সেকেন্ড মূল্যবান। মূল্যবান সেকেন্ডের একটিও নষ্ট করা ঠিক না।

সায়েন্স ল্যাবরেটরির মোড়ে এসে শাহেদ রিকশা পেল। এই রিকশা পাওয়া না-পাওয়া একই। জোয়ান রিকশাওয়ালা অথচ সে রিকশা টানতেই পারছে না। পায়ে হেঁটে এরচে দ্রুত যাওয়া যায়। শাহেদ বলল, ভাই একটু তাড়াতাড়ি যান। রিকশাওয়ালা ঘাড় ঘুরিয়ে শাহেদের কথা শুনল। তার রিকশার গতি আরো শ্লথ হয়ে গেল। শাহেদের ইচ্ছা করছে, লাফ দিয়ে রিকশা থেকে নেমে হাঁটা শুরু করে।

কলাবাগানের কাছাকাছি এসে সে একটা অদ্ভুত দৃশ্য দেখল। রঙিন কাগজ দিয়ে সাজানো একটা ঘোড়ার গাড়ি। গাড়িতে পাকিস্তানি পতাকা উড়ছে। গাড়ির ভেতর বার-তের বছর বয়েসী একটা কিশোরী। তার পরনে ঘাঘড়া। চুল লাল। কিশোরীকে ঘিরে চারজন যুবক। সবাই পান খাচ্ছে। তাদের মুখ আনন্দে উজ্জ্বল। তারা কি কোনো উৎসবে যাচ্ছে? বিয়ের উৎসব নিশ্চয়ই না। অন্য কোনো উৎসব। এরা বিহারি। বিহারিরা উৎসব করতে পছন্দ করে। আজকের এই দুঃসময় তাদের জন্যে না। এরা দুঃসময়ের বাইরে।

শাহেদ শ্বশুরবাড়িতে কাউকে পেল না। বাড়ির সামনের চায়ের দোকানটা খুলেছে। দোকানদার কিছু বলতে পারল না। আশেপাশে চার-পাঁচটা বাড়িতে সে গেল। তারাও কিছু জানে না। একজন শুধু বলল, কালো রঙের একটা প্ৰাইভেট গাড়িতে করে সবাই চলে গেছে। কখন গেছে, কবে গেছে সেটা আবাব বলতে পারছে না।
 
শাহেদ নিজের বাড়িতে ফিরল কারফিউর মেয়াদ শেষ হবার আধঘণ্টা আগে। গেট খুলে ভেতরে ঢোকার সময় হঠাৎ মনে হলো, তার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে–এক্ষুনি বোধহয় সে মাথা ঘুরে পড়ে যাবে। বাসার সদর দরজায় তালা নেই। বাড়িতে লোক আছে। অবশ্যই আসমানী ফিরেছে। চাবি দিয়ে সদর দরজা খুলেছে। বাড়ির অন্য দরজা-জানোলা সবই বন্ধ। এটাই স্বাভাবিক। এই সময়ে কেউ দরজা-জানালা খোলে না। শাহেদ দ্রুত চিন্তা করছে–চাল-ডাল কি আছে? আসমানী খুব গোছানো মেয়ে। সবকিছুই থাকার কথা। কেরোসিন আছে কি-না কে জানে। যদি না থাকে এক্ষুণি নিয়ে আসতে হবে। আধঘণ্টা সময় এখনো হাতে আছে। সে দেখে এসেছে রাস্তার মোড়ের বড় দোকানটা খোলা। কেরোসিন চা-পাতা চিনি। আসমানী একটু পর পর চা খায়। কড়া মিষ্টির ঘন চা। শাহেদ ঠিক করতে পারছে না–সে কি বাসায় না। ঢুকে আগে বাজারটা করে নিয়ে আসবে? না-কি আগে আসমানীর সঙ্গে দেখা করে বলবেভয় নাই আমি আছি। তাকে না দেখে আসমানী নিশ্চয়ই ভয়ে অস্থির হয়ে আছে। তবে আসমানীর সঙ্গে দেখা হলে একটা বিপদ হবে। রুনি তাকে দেখা মাত্ৰ বাপ দিয়ে কোলে উঠে পড়বে। তাকে তখন কোল থেকে নামানো যাবে না। দোকানে যেতে হলে তাকে কোলে নিয়েই যেতে হবে।

সদর দরজা ভেতর থেকে বন্ধ। শাহেদ অনেকক্ষণ দরজা ধাক্কাবার পর ভেতর থেকে ভীত পুরুষগলা শোনা গেল— কে?

শাহেদ বলল, আমি শাহেদ। দরজা খুলেন।

দরজা খুলল। শাহেদ অবাক হয়ে দেখে, দরজার ওপাশে গৌরাঙ্গ দাঁড়িয়ে আছে। তার মুখভর্তি খোচা খোচা দাড়ি। চোখ হলুদ। তাকে দেখে মনে হচ্ছে, সে বিরাট কোনো অসুখ থেকে উঠেছে।

শাহেদ বলল, তুমি কোত্থেকে?

গৌরাঙ্গ জবাব দিল না। শাহেদ আবার বলল, তুমি কোথেকে? গৌরাঙ্গ এমনভাবে তাকাচ্ছে যেন সে শাহেদের কথা বুঝতেই পারছে না। শাহেদ বলল, বাসায় আর কেউ আছে?

গৌরাঙ্গ বলল, না।

শাহেদ বলল, তুমি বাসায় ঢুকলে কীভাবে?

গৌরাঙ্গ বিড়বিড় করে বলল, তালা ভেঙে ঢুকেছি। মিতা, আমার কোনোখানে যাবার জায়গা নাই। তুমি যদি বের করে দাও, মিলিটারিরা আমাকে মেরে ফেলবে।

শাহেদ বলল, আমি বের করে দেব কেন?

গৌরাঙ্গ জবাব দিচ্ছে না। একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে শাহেদের দিকে। শাহেদ বলল, তোমার বৌ-মেয়ে ওরা কোথায়?

শাহেদ বিড়বিড় করে বলল, ওরা ভালো আছে।

তারা কোথায়?

আমার শ্বশুরমশাইয়ের সঙ্গে। আমি তোমার সঙ্গে থাকব।

শাহেদ বলল, আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। তুমি আমার সঙ্গে থাকবে কেন?

গৌরাঙ্গ আগের মতোই অস্পষ্ট গলায় বলল, মিতা, আমি তোমার সঙ্গে থাকব। আমার সঙ্গে টাকা আছে। শ্বশুরমশাই যে টাকাটা দিয়েছেন, সবটা আমার সঙ্গে আছে। তুমি টাকাটা নাও। খরচ করো। শুধু আমাকে থাকতে দাও।

শাহেদ হতভম্ব গলায় বলল, ঠিক করে বলো তো–ভাবি, বাচ্চ ওরা কোথায়?

গৌরাঙ্গ বলল, বলেছি তো ওরা ভালো আছে। দুজনই ভালো আছে। মেয়েটার জ্বর এসেছিল, এখন মনে হয় জ্বর কমেছে। আমার নিজের শরীরও ভালো না। আমি তোমার এখানে বিশ্রাম নিতে এসেছি। সারাক্ষণ আমার মাথা ঘোরে। মিতা, আমার ক্ষিধাও লেগেছে। তুমি আমাকে কিছু খাওয়াও। টাকা নিয়ে চিন্তা করবে না। আমার কাছে টাকা আছে। মিতা, আমি এখন শুয়ে থাকব। খাবার জোগাড় হলে আমাকে ডেকে তুলবে।
 
গৌরাঙ্গ সন্ধ্যা পর্যন্ত মরার মতো ঘুমাল। কয়েকবার চেষ্টা করেও শাহেদ তাকে তুলতে পারল না। সন্ধ্যার পর পর সে নিজেই জেগে উঠল। শাহেদ বলল, এখন শরীর কেমন? মাথা ঘোরা কমেছে?

গৌরাঙ্গ বলল, শরীর ভালো আছে। আমার বাচ্চাটাকে মিলিটারিরা মেরে ফেলেছে—এই জন্যে মনটা সামান্য খারাপ।

ভাবি? ভাবি কোথায়?

ওরা তাকে তুলে নিয়ে গেছে। বঁচিয়ে রেখেছে কি-না। আমি জানি না। মেরে ফেললে তার জন্যেও ভালো, সবার জন্যেই ভালো। আমার শ্বশুরসাহেবও মারা গেছেন। মিতা, তোমাকে স্থা বলেছি। সব গোপন রাখবে। মিলিটারি যদি শুনে তাদের নামে আজেবাজে কথা বলছি, তাহলে তারা রাগ করবে। আমাকেও ধরে নিয়ে যাবে। মিলিটারিদের দোষ কী! ওরা হুকুমের চাকর। ওদের যেভাবে হুকুম দিয়েছে, ওরা সেইভাবে কাজ করেছে। তাই না?

শাহেদ বলল, ভাবিকে যখন ওরা নিয়ে যাচ্ছিল তুমি কোথায় ছিলে? আমি দরজার আড়ালে বসে ছিলাম। ওরা সব ওলট পালট করে দেখেছে, শুধু দরজার আড়ালটা দেখে নাই। সবই ভগবানের লীলা। মিতা, তোমাকে যা বললাম সব গোপন রাখবে। কোনে কিছুই যেন প্ৰকাশ না হয়। মিলিটারির কানো গেলে তোমার বিপদ। আমারও বিপদ।

শাহেদ বলল, ভাত-ডাল রান্না করেছি, খেতে আসো।

গৌরাঙ্গ বলল, ঠিক আছে। খুবই ক্ষুধা লেগেছে। ইলিশ মাছের পাতুরি খেতে ইচ্ছা করছে। গরম ধোঁয়া উঠা ভাত, ইলিশ মাছের পাতুরি।

কথা শেষ করেই গৌরাঙ্গ বিছানায় শুয়ে পড়ল। সঙ্গে সঙ্গেই ঘুম। শাহেদ তার পাশেই বসে আছে। মানুষটা ঘুমের মধ্যে কাঁদছে। ঘুমের মধ্যে কাদার দৃশ্যটা যে দেখতে এত ভয়ঙ্কর তা শাহেদ আগে কখনো বুঝতে পারে নি।

রাত বাড়ছে। ইলেকট্রসিটি সন্ধ্যা থেকেই নেই। ঘর অন্ধকার না। শাহেদ টেবিলের উপর পাশাপাশি দুটা মোমবাতি জ্বলিয়েছে। মোমবাতি পাওয়া গেছে রান্নাঘরের তাকে। আসমানী রান্নাঘরের দরজায় লিস্ট টানিয়ে রেখেছে। কোন জিনিসটি কোথায় তার তালিকা। প্রায়ই সে বাবার বাড়ি চলে যায়, তালিকাটা সে জন্যেই। আজ এই তালিকা পড়তে গিয়ে শাহেদের চোখে পানি এসে গেছে।

চাল, ডাল, মুড়ি–টিনে ভরা। রুনির ঘরে। চৌকির নিচে।

কাপড় ধোবার সাবান, মোমবাতি, দেয়াশলাই— রান্নাঘরের তাকে। সর্ববামে।

মশলা, লবণ–রান্নাঘরের তাকে। সর্ব ডানে। কৌটার গায়ে কী মসলা নাম লেখা আছে।

চা, চিনি–মিটাসেফের উপরে।

পেয়াজ, রসুন, আদা— মিটসেফের পাশের খলুইয়ে।

সরিষার তেল–চুলার পাশে।

ভালোবাসা–আমার কাছে। আমি যেখানে থাকি সেখানে।

আসমানীর পক্ষেই সম্ভব কাজের কথা লিখতে লিখতে হঠাৎ মজার কিছু লিখে ফেলা। তেল, মসলার কথা লিখতে লিখতে লেখা ভালোবাসা–আমার কাছে। আমি যেখানে থাকি সেখানে।

বিয়ের রাতেও সে এরকম মজা করল। বাসর হচ্ছে আসমানীদের কলাবাগানের বাড়িতে। দোতলার বড় একটা ঘর। ফুল দিয়ে সুন্দর করে সাজানো। ঘরে পা দিয়েই শাহেদের মনে হলো— আসমানী কি এত সুন্দর! সে আগেও তো কয়েকবার দেখেছে। এত সুন্দর তো তাকে কখনো মনে হয় নি? শাহেদ খাটে বসতে বসতে বলল, আজ কী রকম গরম পড়েছে দেখেছ? (সে ঠিক করে রেখেছিল প্রথম যে বাক্যটি বলবে তা হচ্ছে–আসমানী কেমন আছ? বলার সময় সম্পূর্ণ অন্য কথা বের হয়ে এলো। বলার সময় বলে বসল— আজি কী গরম পড়েছে দেখেছি? যেন সে দেশের আবহাওয়া নিয়ে খুবই চিন্তিত।)

শাহেদের কথার উত্তরে আসমানী মুখ তুলে তাকাল। শান্তগলায় স্পষ্টভাবে বলল, গরমের সময় গরম তো পড়বেই। গরমকালে গরম পড়বে, ঠাণ্ডাকালে ঠাণ্ডা। আপনার জন্যে তো আল্লাহ আবহাওয়া বদলে দেবেন না।

শাহেদ হতভম্ব! হড়বড় করে এইসব কী বলছে? বিয়ের টেনশনে, অত্যধিক গরমে কি তার মাথা আউলায়ে যাচ্ছে?

আসমানী বলল, চোখ বড় বড় করে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন কেন? কোনো পুরুষমানুষ এইভাবে তাকিয়ে থাকলে আমার রাগ লাগে। আমি কিন্তু চোখ গেলে দেব।


আতঙ্কে অস্থির হয়ে শাহেদ খাট ছেড়ে উঠে দাঁড়াতেই আসমানী হোসে ফেলল। হাসতে হাসতেই বলল, সরি। কিছু মনে করো না। আমি তোমার সঙ্গে ঠাট্টা করেছি। আমি আমার দুই খালাতো বোনের সঙ্গে বাজি ধরেছি। বাসর রাতে আমি যদি তোমাকে ভয় দেখাতে পারি, তাহলে তারা আমাকে একশ টাকা দেবে। ওরা দুজনেই জানালার ফাঁক দিয়ে আমাদের দেখছে। তুমি দাড়িয়ে আছ কেন? বসো।

শাহেদ বসল। সে তখনো পুরোপুরি স্বস্তি পাচ্ছে না। তার মনে হচ্ছে অদ্ভুত সুন্দর এই মেয়েটি আবারও উদ্ভট কিছু করবে। আসমানী বলল, তুমি কি রাগ করেছি?

শাঙ্গেদ ভীত গলায় বলল, না।

আসমানী বলল, প্রথম রাতেই তোমাকে ভয় দেখিয়ে দিলাম। কাজটা খুব খারাপ করেছি। এতে কী হবে জানো–সারাজীবন তুমি আমাকে ভয় করে চলবে।



শাহেদ এসে বারান্দায় বসেছে। বৃষ্টি পড়তে শুরু করেছে। ঠাণ্ডা বাতাস দিচ্ছে। গুমোট গরম কমতে শুরু করেছে; ভেতর থেকে মাঝে মাঝে গৌরাঙ্গ গোঙানির মতো শব্দ করছে। যেন কেউ তার গলায় পা দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সে চিৎকার করতে গিয়েও করতে পারছে না। একটা ব্যাপার দেখে শাহেদ খুবই অবাক হচ্ছে–গৌরাঙ্গের ভয়াবহ দুঃসময় তাকে তেমন স্পর্শ করছে না। যেন গৌরাঙ্গের এই সমস্যায়। তার কিছু যায় আসে না। ভয়াবহ দুর্যোগের সময় মানুষ কি বদলে যায়? তখন নিজের সুখ নিজের দুঃখই প্রধান হয়ে দাঁড়ায়? দেশের সব মানুষই কি বদলাতে শুরু করেছে? আসমানী বদলে যাচ্ছে? রুনি বদলে যাচ্ছে?

শাহেদ আসমানীর কথা ভাবতে চাচ্ছে না। আসমানীর কথা মনে করলেই বুকের ভেতর কেমন জানি করছে। কী একটা দলা পাকিয়ে যাচ্ছে। আসমানী এখন আছে কোথায়? কী করছে? সেও কি তার মতো জেগে আছে। গল্পের বই পড়ছে না-কি? নিশিরাতে গল্পের বই পড়ে হাউমাউ করে কেঁদে উঠা তার পুরনো রোগ। একবার তো আসমানীর কান্নার শব্দে সে ঘুম ভেঙে উঠে বসে

নাই। ঘুমাও। গল্পের বই পড়ে কাদছি।

কী বই?

তারাশংকর লেখা একটা বই, নাম–বিপাশা।

বই পড়ে কাদার কী আছে?

আমার স্বভাবই এরকম। নিজের দুঃখে আমি কাদি না। গল্প-উপন্যাসের চরিত্রদের দুঃখে আমি কাদি।

তোমার মাথা কিন্তু সামান্য খারাপ আছে।

তা তো আছেই। পুরোপুরি সুস্থ মাথার একটা মেয়েকে বিয়ে করো। তোমরা সুখে সংসার করো। আমি দূর থেকে দেখে খুব মজা পাব।

শাহেদ বিরক্ত হয়ে বলল, এইসব কী ধরনের কথা?

আসমানী বলল, খুবই ভালো কথা। আমি নিজে এসে তোমাদের সংসার সাজিয়ে দিয়ে যাব। বিয়ে করবে? প্লিজ প্লিজ।

বাতি নেভাও। বাতি নিভিয়ে ঘুমুতে আসো।

না, ঘুমাব না। বইটা আমি আবার পড়ব।

এখন?

হ্যাঁ এখন। গল্পের শেষ না জেনে পড়ার এক ধরনের আনন্দ। আবার শেষ জেনে পড়ার অন্য ধরনের আনন্দ। বাতি জ্বলিয়ে রাখলে তোমার যদি অসুবিধা হয়, তাহলে আমি বরং অন্য ঘরে যাই।

যা ইচ্ছা করো।
 
বৃষ্টি বাড়ছে। সঙ্গে সামান্য বাতাসও আছে। বাতাসে ছাতিম গাছের পাতা নড়ছে। বারান্দা থেকে গাছটাকে এখন জানি কেমন ভৌতিক লাগছে। এই গাছ দেখে একবার আসমানী খুব ভয় পেয়েছিল। রাতের বেলা তার ঘুম ভেঙেছে, সে এক গ্রাস পানি হাতে নিয়ে বারান্দায় এসে বসেছে। কিছুক্ষণ পরই বিকট চিৎকার। ঘুম ভেঙে শাহেদ ছুটে এসে দেখে, আসমানী থারথার করে কাঁপছে। তার হাত থেকে পানির গ্রাস পড়ে ভেঙে টুকরা টুকরা হয়েছে। শাহেদ বলল, কী হয়েছে? আসমানী বিড়বিড় করে বলল, গাছটা মানুষের মতো হাত নেড়ে ডেকেছে।

শাহেদ বলল, বাতাসে পাতা নড়েছে, তোমার কাছে মনে হয়েছে। অন্য কিছু।

আসমানী কাঁদতে কাঁদতে বলল, আমি ছোট বাচ্চা না, আমি জানি কী হয়েছে।

ভয়ে সেই রাতেই আসমানীর জ্বর উঠে গেল।

না, সে এখন আসমানীর কথা ভাববে না। সে নিশ্চয়ই ভালো আছে। সে আছে তার বাবা-মার সঙ্গে। একজন সন্তান সবচে নিরাপদে থাকে যখন সে বাবা-মার সঙ্গে থাকে। তার সঙ্গে দেখা হচ্ছে না–কাল অবশ্যই দেখা হবে। আগামীকাল কারফিউ ভাঙার সঙ্গে সঙ্গে সে যাবে মিরপুর দশ নম্বরে। সেখানে আসমানীর এক খালা থাকেন। তিনি নিশ্চয়ই কোনো খবর দিতে পারবেন। আসমানীর সরাসরি কোনো খবর না পেলেও তার অন্য আত্মীয়দের ঠিকানা তার কাছ থেকে নেবে।

মিরপুর যাবার পথে সোবাহান সাহেবদের খোঁজ নিয়ে যেতে হবে। তারা নিশ্চয়ই আজও অপেক্ষা করে বসেছিলেন। সোবাহান সাহেবদের নিরাপদ কোনো জায়গায় পাঠাবার ব্যবস্থা করতে হবে।

গৌরাঙ্গ! তার ব্যাপারটা কী? গৌরাঙ্গ কি তার কোনো আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে যাবে? না-কি এখানে থাকবে? এখানে থাকতে কোনো সমস্যা নেই। যতদিন ইচ্ছা থাকতে পারবে। আসমানী যদি এর মধ্যে চলে আসে, তাহলে কোনো অসুবিধাই হবে না। আসমানীর মেজাজ যখন ঠিক থাকে, তখন সে অসাধারণ একটি মেয়ে। গৌরাঙ্গের ভয়াবহ কষ্ট অনেকখানি কমিয়ে দেয়া কোনো ব্যাপারই না।

মিতা! মিতা!

ভারী গলায় গৌরাঙ্গ ডাকছে। শাহেদ ভেতরে গেল। গৌরাঙ্গ খাটে বসে। আছে। বড় বড় নিঃশ্বাস ফেলছে। তার মুখও হা হয়ে আছে। তাকে দেখে মনে হচ্ছে তার শ্বাসকষ্ট হচ্ছে। শাহেদ বলল ভাত-ডাল রান্না করেছি। কিছু খাবে?

গৌরাঙ্গ সঙ্গে সঙ্গে বলল, হুঁ।

নামো বিছানা থেকে। দাড়াও আমি ধরছি।

শাহেদ ধরাধরি করে গৌরাঙ্গকে নামাল। গৌৰাঙ্গ বলল, মিতা, আমার স্নান করতে হবে। আমি তিনদিন স্নান করি নাই।

শাহেদ বলল, বাথরুমে পানি আছে, সাবান আছে। গরম পানি করে দেব?

দাও। মিতা শোন, আমি কিন্তু তোমার এখানে থাকব। আমি অন্য কোনোখানে যাব না।

কোনো অসুবিধা নেই। থাকবে।

আগারগাঁও-এ আমার এক মামা থাকেন। ওয়্যারলেস অফিসার না-কি কী যেন। আমি উনার কাছেও যাব না।

তোমার যত দিন ইচ্ছা তুমি থাকবে।

মিতা আমার বুকে ব্যথা করছে। আমি নিঃশ্বাস নিতে পারছি না।

গরম পানি দিয়ে গোসল করে। গোসল করলে আরাম পাবে।

গৌরাঙ্গ ক্ষীণ গলায় বলল, আচ্ছা। মিতা আমার হাত-পা কেমন শক্ত হয়ে গেছে। হাত-পা নাড়তে পারছি না। এই দেখ, আঙুল বঁকা করতে পারছি না।

গৌরাঙ্গ হাত উচু করে দেখাল। তার আঙুল ঠিকই বঁকা হচ্ছে।

মিতা দেখেছি আঙুল বাঁকছে না।

শাহেদ বলল, ঠিক হয়ে যাবে।

গৌরাঙ্গ বলল, কখন ঠিক হবে?

শাহেদ বলল, ভোর হোক।

গৌরাঙ্গ বলল, আচ্ছা।



আরেকটি ভোর হয়েছে। আগে একটি ভোরের সঙ্গে আরেকটি ভোর আলাদা করা যেত না। এখন আলাদা করা যায়। এখন মনে হয় প্রতিটি ভোর আলাদা।

কারফিউ উঠেছে। লোকজন রাস্তায় নেমেছে। শাহেদ বের হয়েছে। গৌরাঙ্গকে নিয়ে। গৌরাঙ্গের শরীরের অবস্থা ভালো না। তাঁর গায়ে জ্বর। কিন্তু সে এক কিছুতেই বাসায় থাকবে না। একা বাসায় বসে থাকলে সে না-কি ভয়েই মরে যাবে। রাস্তায় নেমেও আরেক বিপদ, সে একটু পর পর বলছে–মিতা ফিরে চল। মিতা ভয় লাগছে, ফিরে চল। শাহেদের খুবই বিরক্ত লাগছে। ফিরে যাবার প্রশ্নই উঠে না। যে করেই হোক আসমানীদের খোঁজ বের করতে হবে। প্রথমে যেতে হবে মিরপুর দশ নম্বর, তার খালার বাড়িতে। বাড়ির নাম্বার সে জানে না। আগে দুবার এসেছে, কাজেই তার ধারণা সে বাড়ি চিনবে। তবে মিরপুর যাবার আগে তাকে সোবাহান সাহেবের খোজে যেতে হবে। এরা নিশ্চয়ই আতঙ্কগ্ৰস্ত হয়ে অপেক্ষা করছে। গতকাল শাহেদ যায় নি। বৃদ্ধ ভদ্রলোক নিশ্চয়ই তাকে নিয়ে অনেক দুশ্চিন্তা করছেন।
 
সোবাহান সাহেবদের বাড়ির সদর দরজায় তালা ঝুলছে। বেশ বড় তালা। মনে হচ্ছে তারা গতকাল বাসা ছেড়ে নিরাপদ কোনো জায়গায় চলে গেছে। ঢাকা শহরের মানুষ কোনোখানেই এখন নিশ্চিন্তু বোধ করছে না। তারা শুধুই জায়গা বদল করছে। দরজায় তালাবন্ধ, তারপরেও শাহেদ অনেকক্ষণ কড়া নাড়ল। ঢাকা শহরে আরেকটি নিয়ম এখন চালু হয়েছে। সদর দরজায় তালা লাগিয়ে বাড়ির ভেতরে বসে থাকা। মিলিটারি যদি আসে তাহলে যেন তালা দেখে মনে করে এই বাড়িতে লোকজন নেই।

গৌরাঙ্গ বলল, মিতা চল, বাসায় ফিরে যাই। কেউ তো নাই।

শাহেদ বলল, আমাকে মিরপুর যেতেই হবে।

গৌরাঙ্গ বলল, মিতা, আমার খুব ভয় লাগছে।

ভয় লাগলে তুমি বাসায় চলে যাও। আমাকে যেতেই হবে। যে করেই হোক আমাকে আসমানীর খোঁজ বের করতে হবে।

মিতা, আমি একা বাসায় থাকব না। আমি ভয়েই মরে যাব। আমি খুবই ভীতু।

শাহেদ জবাব দিল না। কথা বলে নষ্ট করার মতো সময় তার হাতে নেই। তাকে এখন কোনো বেবিট্যাক্সি খুঁজে বের করতে হবে। বেবিট্যাক্সি না পাওয়া গেলে শক্ত-সমর্থ শরীরের কোনো রিকশাওয়ালা, যে তাকে অতি দ্রুত মিরপুর পৌঁছে দেবে। হাতে সময় অল্প। বারোটা থেকে আবার কারফিউ শুরু হবে।

মিরপুর দশ নম্বরের মাথায় তারা রিকশা ছেড়ে দিল। বাড়ি খুঁজতে শুরু করতে হবে এখান থেকেই। শাহেদের অস্পষ্টভাবে মনে আছে, বাড়ির সামনের গেটের কাছে একটা জবা গাছ আছে! বাড়ির একটা ইংরেজি নামও আছে। নামটা মনে পড়ছে না। তবে শুরুটা ‘S’ দিয়ে।

গৌরাঙ্গ চাপা গলায় বলল, মিতা মিলিটারি। ডানদিকে চায়ের দোকানের সামনে মিলিটারি। মিতা, আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে।

শাহেদ থমকে দাঁড়াল। চায়ের দোকানের নাম রহমানিয়া টি স্টল। পাঁচজন মিলিটারির একটা দল দোকানের সামনে। একজন পিরিচে চা ঢেলে খাচ্ছে। বাকিরা শক্ত মুখ করে দাড়িয়ে আছে। এদের আশেপাশে কোনো লোকজন নেই। শুধু শাদা গেঞ্জি পরা চায়ের দোকানদার মাথা নিচু করে বসে আছে। দোকানদারকে দেখে মানুষ বলে মনে হচ্ছে না। দূর থেকে মনে হচ্ছে হার্ডবোর্ডে দোকানদারের ছবি এঁকে বসিয়ে দেয়া হয়েছে।

গৌরাঙ্গ চাপা গলায় বলল, মিতা, আমাদেরকে ডাকে। এখন কী করব?

পিরিচে ঢেলে যে চা খাচ্ছিল সে-ই ডাকছে। তার মুখ হাসি হাসি। গৌরাঙ্গ বিড়বিড় করে বলল, মিতা, এখন কী করব? দৌড় দিব?

শাহেদ বলল, যেভাবে দাড়িয়ে আছ সেইভাবে দাঁড়িয়ে থাকে। খবরদার দৌড় দেবে না। আমি শুনে আসি।

মিতা, ওদের কাছে যাবার দরকার নাই।

শাহেদ এগুচ্ছে। মিলিটারি দলটির দুজন বন্দুক উচিয়ে ধরল। তার দিকে। কেন ধরল শাহেদ বুঝতে পারছে না। হয়তো এটাই তাদের নিয়ম। কোনো বাঙালি তাদের দিকে আসতে থাকলে বন্দুক উচিয়ে নিশানা করতে হয়। তাকে ডাকছেই বা কেন? যে চা খাচ্ছিল, সে চা খাওয়া বন্ধ করে তাকিয়ে আছে। তার মুখ এখনো হাসি হাসি। এটা একটা ভরসার কথা। কিংবা তার মুখ হয়তো হাসি হাসি না। অনেকে এরকম থাকে। খুব রাগ করে তাকালেও মনে হয়। হাসছে। আচমকা খুব কাছেই কোথাও গুলি হলো। শাহেদ অবাক হয়ে তাকাচ্ছে। গুলি কি তাকে করা হলো? মনে হয় না। তাকে গুলি করা হলে ব্যথা বোধ হতো। রক্তে সার্ট ভিজে যেত। সে-রকম কিছু তো হয় নি।

গৌরাঙ্গ তাকিয়ে আছে। শাহেদের দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে সে। মিলিটারিদের দিকে তাকাল। যে মিলিটারি চা খাচ্ছিল, তার চা খাওয়া শেষ হয়েছে। সে হাতের ইশারায় গৌরাঙ্গকে চলে যেতে বলল। গৌরাঙ্গ চলে যাচ্ছে।

শাহেদ মিলিটারিদের দিকে এগুচ্ছে। সে হাঁটতে পারছে, এর অর্থ তাকে গুলি করা হয় নি। শরীরে বুলেট নিয়ে কেউ হাঁটতে পারে না। মিলিটারিদের ছয়-সাত হাত কাছাকাছি গিয়ে শাহেদ থমকে দাঁড়াল।

নাম কেয়া? তেরা নাম কিয়া?

মিলিটারিরা তার নাম জানতে চাচ্ছে। নাম দিয়ে তারা কী করবে। তার নাম শাহেদ হলেও যা ফখরুদিন হলেও তা। শাহেদ নাম বলল। যে মিলিটারি চা খাচ্ছিল, সে চায়ের কাপের কিছু চা মাটিতে ফেলে দিয়ে বিড়বিড় করে কী যেন বলল। শাহেদ একদৃষ্টিতে মিলিটারিটার দিকে তাকিয়ে আছে।

কান পাকাড়ো।

এর মানে কী? মিলিটারিটা তাকে কানে ধরতে বলছে? অপরাধটা কী? শাহেদ কানো ধরল। মিলিটারি ইশারা করল উঠবোস করতে। শাহেদ উঠবোস। করছে। মিলিটারিরা মনে হয় ব্যাপারটায় মজা পাচ্ছে। সবার মুখ হাসি হাসি।
 
মরিয়ম খুব ভালো করেই জানে ভয়ঙ্কর দিন যাচ্ছে। যে-কোনো সময় যে-কোনো কিছু ঘটে যেতে পারে। তারপরেও তার মনে চাপা আনন্দ। এই আনন্দের জন্যে নিজেকে তার খুবই ছোট লাগছে, মনে হচ্ছে সে বাথরুমের তেলাপোকার চেয়ে জঘন্য কোনো প্ৰাণী। কিন্তু সে কী করবে? জোর করে তার আনন্দ চেপে রেখে দুঃখ দুঃখ মুখ করে ঘুরবে?

তার আনন্দের প্রধান কারণ হলো, কারফিউ ভাঙার পরপর নাইমুল বলেছে, আমি একটু বাইরে যাব, শহরের অবস্থা দেখব। মরিয়ম সঙ্গে সঙ্গে বলেছে, আমি তোমাকে ছাড়ব না। তুমি যেতে পারবে না।

নাইমুল বলল, আচ্ছা। তুমি অনুমতি না দিলে যাব না।

কী সুন্দর কথা! তুমি অনুমতি না দিলে যাব না। চোখে পানি চলে আসার মতো কথা। মরিয়ম বলল, দুপুরে কী খাবে বলো। আজ দুপুরে আমি রান্না করব। মার শরীর খারাপ।

নাইমুল বলল, তুমি যা রানা করবে। আমি তাই খাব। তবে…

তবে কী?

সবচে ভালো হয় রান্নাবান্নার ঝামেলায় না গিয়ে তুমি যদি আমার সামনে বসে থাকে। দুঃসময়ে প্ৰিয়জনদের দিকে তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছা করে। এখন আমাদের দুঃসময়।

নাইমুলের কথা শুনে আনন্দে মরিয়মের চোখে পানি চলে এলো। তার কাছে মনে হচ্ছে, বাংলাদেশের সব মানুষের জন্যে দুঃসময় হলেও আজ তার জন্যে দুঃসময় নয়। কোনো দুঃসময় তাদের দুজনের মাঝখানে ঢুকতে পারবে না।

নাইমুলট্রানজিস্টারের নব ঘোরাচ্ছে। তার মধ্যে কোনো অস্থিরতা নেই। বাইরে এত ঝামেলা অথচ মানুষটা শান্ত-সহজ ভঙ্গিতে ট্রানজিস্টারের নব ঘোরাচ্ছে। মনে হচ্ছে সে কোনো গানের অনুরোধের আসরের অনুষ্ঠান ধরতে চাচ্ছে। মরিয়ম বলল, এই, তোমার কি সত্যি সত্যি বাইরে যেতে ইচ্ছা করছে?

নাইমুল বলল, ইচ্ছা করছে কিন্তু আজ আমি তোমার ইচ্ছাটাকেই গুরুত্ব দেব। তুমি যদি বলো Yes তা হলে Yes, তুমি যদি বলো No তা হলে No।

আচ্ছা যাও, ঘুরে আসো। এক ঘন্টার জন্যে যাবে।

থ্যাংক য়্যু।

তুমি যতক্ষণ বাইরে থাকবে ততক্ষণ আমি জায়নামাজে বসে থাকব।

আমি খুব তাড়াতাড়ি ফিরব।

রাস্তায় যতক্ষণ থাকবে দোয়া ইউনুস পড়বে। দোয়া ইউনুস জানো তো? না জানলে একটা কাগজে লিখে দেই।

লিখে দিতে হবে না। জানি।

তাড়াতাড়ি ফিরবে কিন্তু।

নাইমুল বলল, এখন বাজছে নটা পঁচিশ, আমি অবশ্যই দশটা পঁচিশে ফিরব।

ইনশাল্লাহ বলো। ইনশাল্লাহ ছাড়া কথা বলছি কেন?

ইনশাল্লাহ। তুমি চায়ের পানি গরম রেখ। এসেই লেবু চা খাব।

মরিয়ম জায়নামাজে বসে আছে। যে কটা সূরা সে জানে সে কটা তিনবার তিনবার করে পড়ে নফল নামাজ পড়তে শুরু করবে। নাইমুল ঘর ছেড়ে যাবার পরই মরিয়মের মনে হলো, মস্ত ভুল করা হয়েছে, তাকে যেতে দেয়া ঠিক হয় নি। সে সূরা পড়া বন্ধ রেখে ক্ৰমাগত বলতে লাগিল— আল্লাহ, তুমি তাকে ভালো রাখা। আল্লাহ তুমি তাকে ভালো রাখ। মরিয়মের একবারও তার বাবার কথা মনে পড়ল না, পঁচিশে মার্চের পর থেকে তার কোনো খবর নেই। হয়তো মরিয়মের মনে হয়েছে তাঁকে নিয়ে দুশ্চিন্তা করার কিছু নেই। পুলিশের চাকরিতে দিনের পর দিন অনুপস্থিত থাকা কোনো ব্যাপার না।



সাফিয়ার মুখ ভয়ে-আতঙ্কে ছোট হয়ে আছে। তাঁর ভীতির কারণ সম্পূর্ণ অন্য। পঁচিশে মার্চ রাতে তিনি একটি ভয়াবহ সত্য আবিষ্কার করেছেন। টুনটুনি (ইয়াহিয়াকে এখন টুনটুনি ডাকা হচ্ছে। একমাত্র মোবারক হোসেনই ছেলেকে ইয়াহিয়া নামে ডাকেন।)। কানে শোনে না। এই যে এত গোলাগুলি, কামানের শব্দ তাতে তার কিছুই হচ্ছে না। সে জেগেই আছে কিন্তু একবারও চমকে উঠছে না। তখন তার সন্দেহ হলো, ছেলে হয়তো চোখেও দেখে না। তিনি তার সামনে রঙিন ফিতা ধরলেন। টুনটুনি হাত বাড়াল না। চোখের সামনে ঝুমঝুমি বাজালেন। সে ঝুমঝুমির দিকে তাকাল না। সম্পূর্ণ অন্যদিকে তাকিয়ে আনন্দে হাসতে লাগল। তিনি বুঝতেই পারছেন না। এই ভয়ঙ্কর খবরটা তিনি মরিয়মের বাবাকে কীভাবে দেবেন। মরিয়মের বাবা কি খবরটা সহ্য করতে পারবেন? তিনি যদি বলেন, এই ব্যাপারটা ধরতে তোমার এত দিন লাগল? তখন তিনি কী জবাব দেবেন? সাফিয়ার একটা ভয়ঙ্কর ইচ্ছা হচ্ছে। ছেলেকে কোলে নিয়ে ছাদে চলে যেতে ইচ্ছা করছে। ছাদ থেকে ছেলে কোলে নিয়ে কাপ দিয়ে নিচে পড়ে যাওয়া। চোখ-কান আছে এমন শিশুই এদেশে টিকে থাকতে পারে না, এ কীভাবে টিকবে? তিনিইবা ছেলের বাবার রাগ কীভাবে সামাল দেবেন?
 
নাইমুলের দশটা পঁচিশে ফেরার কথা। সে ঠিক দশটা পঁচিশেই ফিরল। মরিয়ম তখনো জায়নামাজ ছেড়ে ওঠে নি। নাইমুল বলল, মরি! আমার লেবু চা কই?

মরিয়ম লজ্জায় মরে যাচ্ছে। নাইমুল তার কথা রেখেছে। সে কাটায় কাটায় দশটা পঁচিশে ফিরেছে। সে তার কথা রাখতে পারে নি। চুলায় চায়ের পানিই দেয়া হয় নি।

নাইমুল বলল, চা লাগবে না, তুমি বসো।

মরিয়ম বলল, কী দেখলে?

নাইমুল বলল, ওরা যা দেখাতে চেয়েছিল তাই দেখলাম।

মরিয়ম বলল, ওরা কী দেখাতে চেয়েছিল?

ওরা ওদের হাতের সূক্ষ্ম কাজ দেখানোর জন্যেই তিন ঘণ্টার জন্যে কারফিউ তুলেছে। যেন ওদের কর্মকাণ্ড দেখে আমরা জেলি ফিসের মতো হয়ে যাই!

কী বলছি বুঝতে পারছি না।

নাইমুল হাসল। তার অদ্ভুত হাসি। সে হাসি দেখলেই মরিয়মের শরীর কেমন করতে থাকে।

মরিয়ম বলল, আমি তোমার জন্যে চা নিয়ে আসি।

নাইমুল বলল, চা আনতে হবে না। চুপ করে বসে থাকো। আমি একটা মজার জিনিসও দেখে এসেছি।

এর মধ্যে মজার জিনিস কী দেখলে?

ওরা শহীদ মিনার ভেঙে গুড়া করে দিয়েছে। সেখানে একটা সাইনবোর্ড টানিয়ে দিয়েছে। সাইনবোর্ডে লেখা–

মসজিদ, নামাজ পড়িবার স্থান।

নাইমুল হাসছে। তবে এই হাসি কেমন যেন অন্যরকম। হাসির শব্দ ভোঁতা। শুনতে ভালো লাগে না।

মরিয়ম এখন তোমাকে খুব জরুরি একটা কথা বলব। মন দিয়ে শোনো। পাকিস্তানি মিলিটারিদের সঙ্গে সত্যিকার যুদ্ধ এখন শুরু হবে। কী ভয়াবহ যুদ্ধ যে হবে ওরা বুঝতেও পারছে না। আমি কিন্তু যুদ্ধে যাব।

মরিয়ম হতভম্ব গলায় বলল, কী বললে?

নাইমুল সিগারেট ধরাতে ধরাতে বলল, আমি যুদ্ধ করব। কীভাবে করব, অস্ত্ৰ কোথায় পাব।— কিছুই জানি না। শুধু এইটুকু জানি যে ব্যবস্থা হবে।

যুদ্ধে যাবে? তুমি যুদ্ধ করবে?

হ্যাঁ। তবে তোমার ভয়ের কিছু নাই। আমি মরব না। আমি অত্যন্ত বুদ্ধিমান। আমি খুবই সাবধান থাকব। বুদ্ধিমান মানুষ সবার আগে নিজেকে রক্ষা করে। আমি তাই করব।

নাইমুল সিগারেটে লম্বা টান দিয়ে বলল, হ্যাঁ। তোমার সঙ্গে আমার আবার দেখা হবে–স্বাধীন বাংলাদেশে।

মরিয়ম আর্তনাদের মতো করে বলল, তুমি কি এখন চলে যাচ্ছ?

নাইমুল বলল, না। আজ দিনটা আমি তোমার সঙ্গে থাকব। আমি যাব আগামীকাল। কারফিউ লিফট হওয়া মাত্র বিদায়। আজকের দিনটা শুধুই আমাদের দুজনের–

She was a child and was a child,
In this kingdom by the sea,
But we loved with a love that was more than love
I and my Annabel Lee–

মরিয়ম হাউমাউ করে কাঁদছে। নাইমুল হাসিমুখে স্ত্রীর কান্না দেখছে।



২৭ মার্চ শনিবার রাত আটটায় রেডিওর নব ঘুরাতে ঘুরাতে এই দেশের বেশ কিছু মানুষ অদ্ভুত একটা ঘোষণা শুনতে পায়। মেজর জিয়া নামের কেউ একজন নিজেকে রাষ্ট্রপ্রধান ঘোষণা দিয়ে বলেন, আমি বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করছি। তিনি সর্বাত্মক যুদ্ধের ডাক দেন।

দেশের মানুষদের ভেতর দিয়ে তীব্ৰ ভোল্টেজের বিদ্যুতের শক প্রবাহিত হয়। তাদের নেতিয়ে পড়া মেরুদণ্ড একটি ঘোষণায় ঋজু হয়ে যায়। তাদের চোখ ঝলমল করতে থাকে। একজন অচেনা অজানা লোকের কণ্ঠস্বর এতটা উন্মাদনা সৃষ্টি করতে পারে ভাবাই যায় না।

পিরোজপুর মহকুমার সাব ডিভিশনাল পুলিশ অফিসার এই ঘোষণা শুনে আনন্দে ছেলেমানুষের মতো চিৎকার শুরু করতে থাকেন–যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। আমরা যুদ্ধ শুরু করে দিয়েছি। আর ভয় নাই। তিনি পিরোজপুরের পুলিশদের অস্ত্ৰভাণ্ডার থেকে দুইশ রাইফেল স্থানীয় জনগণকে দিয়ে দেন। যুদ্ধ শুরুর প্রস্তুতি হিসেবে। পাকিস্তান মিলিটারি তাঁকে হত্যা করে ৫ মে। এই ঘটনার বত্ৰিশ বছর পরে তার বড় ছেলে জোছনা ও জননী নামের একটা উপন্যাস লেখায় হাত দেয়।



————-


কালুরঘাট রেডিওস্টেশন থেকে প্রচারিত মেজর জিয়ার স্বাধীনতা ঘোষণা নিয়ে পরে নানান বিভ্রান্তি তৈরি হয়। তিনি মোট কবার ঘোষণা পাঠ করেছেন? বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানকে বাংলাদেশের একচ্ছত্র নায়ক এবং তার পক্ষেই বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করা হচ্ছে–এই বিবৃতি কত তারিখে পড়া হলো, কবার পড়া হলো? এই নিয়ে বিভ্ৰান্তি। জিয়াউর রহমানের স্বাধীনতা ঘোষণা পাঠের আগেই স্বয়ং বঙ্গবন্ধুর দেয়া স্বাধীনতা ঘোষণা পাঠের প্রসঙ্গ বইপত্রে পাওয়া যাচ্ছে। যেমন চট্টগ্রাম জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি জনাব আব্দুল হান্নান দুপুর দুটায় বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণার বাংলা অনুবাদ প্রচার করেন। ২৬ মার্চ সন্ধ্যা ৭টা ৪০ মিনিটে স্বাধীনতা ঘোষণার বাংলা অনুবাদ দ্বিতীয়বার পড়া হয়। পাঠ করেন। হাটহাজারী কলেজের ভাইস প্রিন্সিপাল জনাব আবুল কাশেম সন্দীপ।

স্বাধীনতার ঘোষণা প্রসঙ্গে মেজর জিয়া নিজে তার ডায়েরিতে যা লিখেছেন তা হলো—২৭শে মার্চ শহরের চারদিকে তখন বক্ষিপ্ত লড়াই চলছিল। সন্ধ্যা সাড়ে ছটায় রেডিওস্টেশনে এলাম। এক টুকরা কাগজ খুঁজছিলাম। হাতের কাছে একটা এক্সারসাইজ খাতা পাওয়া গেল; তার একটি পৃষ্ঠায় দ্রুত হাতে স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রথম ঘোষণার কথা লিখলাম। স্বাধীন সার্বভীেম বাংলাদেশ সরকারের অস্থায়ী রাষ্ট্র প্রধানের দায়িত্বভার নিয়েছি, সে কথাও লেখা হলো সেই প্রথম ঘোষণায়. কিছুক্ষণের মধ্যে সে ঘোষণা বেতারে প্রচার করলাম।। ২৮ মার্চ সকাল থেকে পনেরো মিনিট পর পর ঘোষণাটি প্রচার করা হলো কালুরঘাট রেডিওস্টেশন থেকে। ৩০ মার্চ দ্বিতীয় ঘোষণাটি প্রচার করা হলো রাজনৈতিক নেতাদেব অনুরোধক্রমে।

স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাসে কোনোরকম বিভ্রান্তি থাকতে পারে না। এই একটি বিষয়ে দল মতের উর্ধে আমাদেরকে উঠতেই হবে। সত্যে- ধাৰ্যতে পৃথুি, সত্যেন তাপতে রবি, সত্যেন বাতি বায়ুশ্চ, সৰ্ব্বং সত্যে প্রতিষ্ঠিতম। সত্যই পৃথিবীকে ধারণ করে আছে, সত্যের দ্বারাই সূর্য তাপ বিকিরণ কবছে, সত্যের জন্যেই বাতাস বইছে, সত্যেই সবকিছু প্রতিষ্ঠিত।–লেখক
 
পিরোজপুর মহকুমার পুলিশপ্রধান ফয়জুর রহমান সাহেবের মন আজ অত্যন্ত ভালো। মন ভালো থাকার অস্বাভাবিক ঘটনার জন্যে তিনি খানিকটা লজ্জিত বোধ করছেন। দেশ ড়ুবে গেছে ভয়াবহ অনিশ্চয়তায়। এখন চরম দুঃসময়। এই অবস্থায় কোনো সুস্থ মানুষের মন ভালো থাকতে পারে না। তাহলে তিনি কি মানসিকভাবে খানিকটা অসুস্থ?

তিনি মানসিকভাবে খানিকটা অসুস্থ–এই ধারণা তাঁকে কিছুক্ষণ পীড়িত করল। সেই কিছুক্ষণ তিনি একমনে সূরা আর-রাহমান পড়লেন। একটু পরপর ফাবিয়ায়্যি আ-লা ই রাব্বিকমা তুকাজজিবান । তোমরা আমার কোন কোন নিয়ামত অস্বীকার করবে? আহারে, কী সুন্দর আয়াত!

তিনি বসে আছেন নামাজের পাটিতে। ফজরের নামাজ পড়া হয়েছে। নামাজের পাটি ছেড়ে উঠতে ইচ্ছা করছে না। ফজরের নামাজ নিয়মিত পড়া তাঁর কখনো হয় না। অনেক রাতে ঘুমুতে যান বলে সকালে ঘুম ভঙে না। আজ অসম্ভব সুন্দর স্বপ্ন দেখে তার ঘুম ভেঙেছে। স্বপ্নে তিনি বিরাট এক বরযাত্রী দল নিয়ে যাচ্ছেন। দলের সঙ্গে নানান ধরনের বাদ্যবাজনার লোক আছে। তারা বাদ্যবাজনা করছে। বিয়েটা কার তা স্বপ্নে বুঝতে পারছেন না, তবে তার অতি ঘনিষ্ঠ কোনো একজনের, এ বিষয়ে তিনি নিশ্চিত। স্বপ্নের মধ্যে তাঁর মনে হলো, বিয়ে সম্ভবত তাঁর বড় মেয়ে শেফুর। কিন্তু মেয়ের বিয়েতে তো বরযাত্রী যায় না। তাহলে ঘটনাটা কী? ঘটনাটা জানার জন্যে তিনি মনের ভেতর অস্থিরতা বোধ করলেন। এই অস্থিরতাতেই ঘুম ভাঙল। তিনি টেবিলে রাখা ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখেন, ভোর চারটা পঁচিশ। কিছুক্ষণের মধ্যেই ফজরের আযান হবে। তিনি নিঃশব্দে বিছানা থেকে নামলেন। অজু করে আযানের অপেক্ষা করতে করতে হঠাৎ অনুভব করলেন–তিনি সুখী একজন মানুষ। স্ত্রী-পুত্ৰ-কন্যা নিয়ে সুখী পরিতৃপ্ত একজন। আল্লাহপাক তাঁর প্রতি অসীম দয়া করেছেন।

তিনি দুরাকাত শোকরানা নামাজ পড়লেন। অতি বিনয়ের সঙ্গে বললেন, পরম করুণাময়, আমাকে তুমি অনেক করুণা করেছ। আমি তার শোকরানা আদায় করি। দেশের আজ চরম দুঃসময়। আমার ছেলেমেয়েরা কেউ আমার পাশে ছিল না। তিনজন ছিল ঢাকায়, একজন কুমিল্লায়। তাদের তুমি নিরাপদে আমার কাছে এনে দিয়েছ। আল্লাহ, আমি তোমার শোকারগুজার করি।

তাঁর আরো কিছুক্ষণ নামাজের পাটিতে বসে থাকার ইচ্ছা ছিল। সেটা সম্ভব। হলো না, তার অতি আদরের পোষা হরিণ ইরা লাফ দিয়ে বারান্দায় উঠে নানানভাবে তাকে যন্ত্রণা করতে লাগল। শিং-এর গুতা, সার্ট কামড়ে ধরে পেছন দিকে টানার মতো কর্মকাণ্ড চলতে লাগল। বাধ্য হয়ে তিনি হরিণের সঙ্গে গল্প শুরু করলেন। যখন আশেপাশে কেউ থাকে না, তখন তিনি গলা নিচু করে হরিণের সঙ্গে গল্প করেন। আড়াল থেকে হরিণের সঙ্গে তার কথোপকথন শুনলে যে কেউ ভাববে, তিনি তার ছয় ছেলেমেয়ের যে-কোনো একজনের সঙ্গে গল্প করছেন।

কিরে তুই চাস কী? সার্ট ছেড়ার মতলব করেছিস? ফোস ফোঁস করছিস কেন? তুই কি সাপ যে ফোস ফোস করবি? শান্ত হয়ে বোস আমার পাশে। গলা লম্বা কর। গলা চুলকে দেব। খবরদার চাটোচাটি করবি না। অজু ভেঙে शाद।

হরিণের সঙ্গে গল্পগুজব শেষ করে তিনি খুরপি হাতে বাগানে কাজ করতে গেলেন। হরিণ ইরা গেল তার সঙ্গে। বাগানে নানান ধরনের শীতের সবজি তিনি লাগিয়েছেন। তাদের পেছনে যত্নও কম করা হয় না। কিন্তু কোনো লাভ হচ্ছে না। অল্প কিছু টমেটো এবং কিছু টেরস হয়েছে। তিনি কয়েকটা টমেটো ছিঁড়ে হরিণকে খেতে দিলেন। হরিণ খাচ্ছে না। তাকে মনে হয় খেলার নেশায় পেয়েছে। সে নানান ভঙ্গিমায় লাফ বাপ করছে।
 
ভোর হয়েছে। ঘুম ভেঙে সবাই একে একে উঠতে শুরু করেছে। তিনি লক্ষ করলেন–তাঁর বড় ছেলে বাচু টুথব্রাশ দিয়ে দাঁত ঘষতে ঘষতে বারান্দার এক মাথা থেকে আরেক মাথায় যাচ্ছে, আবার ফিরে আসছে। ছেলেটার এই অদ্ভুত স্বভাব–সবসময় হাঁটাহাঁটি। সে কি কোনো চিন্তার মধ্যে থাকে? তার এই পুত্রের জন্ম এবং ইংল্যান্ডের যুবরাজ প্ৰিন্স চার্লসের জন্ম একই সময়ে একই দিনে। নিশ্চয়ই শুভক্ষণ। প্রিন্স চার্লসের জীবন এবং তার পুত্রের জীবন মিলিয়ে দেখতে হবে।

ছেলেকে এখন আর দেখা যাচ্ছে না। সে বাবাকে দেখে আড়ালে চলে গেছে। তিনি ছোট্ট করে নিঃশ্বাস ফেললেন। কোনো এক অজানা কারণে তার সব পুত্রকন্যাই তাকে অসম্ভব ভয় পায়। ছেলেমেয়েদের সঙ্গে তাঁর সহজস্বাভাবিক সম্পর্ক তৈরি হয় নি। ষোড়শ বর্ষেন্তু পুত্ৰ মিত্র বদাচারেৎ। তাঁর পুত্ৰ মিত্র হয় নি। হলে ভালো হতো। দেশের অবস্থা নিয়ে পিতা-পুত্রের মিটিং হতো। ছেলের কাছে শুনতেন সে ঢাকায় কী দেখে এসেছে। তিনি বলতেন, পিরোজপুরে কী হচ্ছে। এই ছোট্ট মফস্বল শহরে অনেক কিছুই হচ্ছে। ভবিষ্যতে ভয়ঙ্কর সব ঘটনা। এখানেও ঘটতে পারে। ট্রেজারিতে এক কোটি টাকার মতো আছে। পনেরোজন আর্মড পুলিশের একটা দল ট্রেজারি পাহারা দেয়। পুলিশের এই দল আসে বরিশাল থেকে। এক মাস থাকে। অন্য এক দল আসে, পুরনো দল ফিরে যায়। দীর্ঘদিনের ব্যবস্থা। এই ব্যবস্থা ভেঙে পড়তে পারে। আইনশৃঙ্খলা যেদিন ভাঙবে সেদিন সবকিছু ভাঙবে। ট্রেজারি লুট হয়ে যাবে।

পিরোজপুর মহকুমার প্রধান ব্যক্তি সিএসপি মুহিবুল্লাহ। সাব ডিভিশনাল অফিসার। সিন্ধু প্রদেশের মানুষ। তার স্থান হবে কোথায়? যদি শত শত মানুষ এসে এসডিওর বাংলো ঘেরাও করে বলে, এই পশ্চিম পাকিস্তানিটাকে আমাদের হাতে তুলে দাও, তখন তিনি কী করবেন? তাঁর পুলিশ বাহিনী দিয়ে এসডিও মুহিবুল্লাহ সাহেবকে রক্ষা করবেন? না-কি একপাশে দাঁড়িয়ে দেখবেন কী করে অসহায় একজন মানুষকে ধরে নিয়ে যায়? তাঁর ভূমিকা কী হবে? পুলিশ বাহিনী কি তখন তাঁর কথা শুনবে? রাষ্ট্ৰীয় শৃঙ্খলা যখন ভেঙে পড়ে, তখন তার প্রথম ধাক্কা এসে লাগে পুলিশ বাহিনীতে। কর্তৃত্ব ভেঙে পড়ে। তখন আর হুকুম চলে না। হুকুমবিহীন পুলিশ বাহিনী কোনো বাহিনী না।

এই অঞ্চলে অন্য এক ধরনের উপদ্রবও আছে। এই উপদ্রবের নাম নকশাল উপদ্রব। একদল ছেলে নকশাল নাম নিয়ে গ্রামে-গঞ্জে ডাকাতি করে বেড়ায়। এই দলের প্রধান ছেলেটির নাম বজলু। সে তার দলবল নিয়ে গা ঢাকা দিয়েই ছিল। সুযোগ বুঝে সে দর্শন দিয়েছে। বিশেষ ভঙ্গিমায় প্রকাশ্যে হাঁটাহাঁটি করছে। তিনি গোপন খবর পেয়েছেন তার লক্ষ্য ট্রেজারির দিকে।

ফয়জুর রহমান সাহেব ক্ষেতের কাজ বন্ধ করলেন। হঠাৎ তার খানিকটা অস্থির লাগছে। দিনের আলো বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে অস্থিরতা বাড়তে শুরু করেছে। গত কয়েকদিন হলো এই সমস্যা তার হয়েছে–বেলা বাড়তে থাকে, তার অস্থিরতা বাড়তে থাকে। অস্থিরতা তীব্ৰ হয় সন্ধ্যাবেলা! সন্ধ্যার পর থেকে অস্থিরতা আবার কমতে থাকে। এটা কি কোনো শারীরিক অসুখ? না-কি মনের সমস্যা? সরকারি হাসপাতালের সিভিল সার্জন সিরাজ সাহেবের সঙ্গে বিষয়টা নিয়ে আলাপ করলে হয়। তিনি প্রতিদিনই আসেন। যখন আসেন তখন আর অস্থিরতার বিষয়টা নিয়ে আলাপ করার কথা মনে থাকে না।
 

Users who are viewing this thread

  • RAli
Back
Top