What's new
Nirjonmela Desi Forum

Talk about the things that matter to you! Wanting to join the rest of our members? Feel free to sign up today and gain full access!

Collected ছোছনা ও জননীর গল্প - উপন্যাস (1 Viewer)

মোবারক হোসেন বত্ৰিশ নম্বর বাড়ির গেটের কাছে দাঁড়িয়ে আছেন। আজ এই বাড়িতে অন্যদিনের চেয়েও অনেক ভিড়। লোক আসছেই। বাড়ির সামনের রাস্তােটা যেন নদী হয়ে গেছে। নদীতে মানুষের স্রোত। নদীতে যেমন ঢেউ উঠে এখানেও উঠছে। কখনো মানুষ বাড়ছে কখনো কমছে। মোবারক হোসেনের মানুষের এই প্রবল বেগবান স্রোত দেখতে ভালো লাগছে। হঠাৎ তাঁর মনে হলো তার তিন মেয়েকে নিয়ে এলে ভালো হতো। এরা হয়তোবা মজা পেত। এরা কখনো ঘর থেকে বের হয় না। এ ধরনের দৃশ্য কখনো দেখে না। এত কাছে বাড়ি। একবার নিয়ে এলে হয়।

এই তুই কী করছিস? আছিস কেমন?

মোবারক হোসেন চমকে উঠলেন। শেখ মুজিব দল বল নিয়ে বের হচ্ছেন।

মোবারক হোসেনকে দেখে থমকে দাঁড়ালেন। তাঁর মুখ হাসি হাসি।

স্যার, ভালো আছি।

তোর মেয়ে তিনটা ভালো আছে? কী যেন তাদের নাম–মরিয়ম, মাসুমা, মাফরুহা? নাম ঠিক হয়েছে?

জি স্যার, ঠিক হয়েছে।

আজ মাওলানা ভাসানী পল্টনে বক্তৃতা করবেন। শুনতে যাবি না? শুধু আমার কথা শুনলে হবে? অন্যদের কথাও শুনতে হবে।

শেখ মুজিব এগিয়ে গেলেন। মোবারক হোসেন এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন। তাঁর তিন মেয়ের নাম এই মানুষটা একবার মাত্র শুনেছেন। এখনো নাম মনে আছে। এই ক্ষমতাকে শুধু বিস্ময়কর বললেও কম বলা হয়।

মাওলানা ভাসানীর বক্তৃতা শোনার কোনো আগ্রহ মোবারক হোসেন বােধ করছেন না। তারপরেও তিনি বক্তৃতা শুনতে গেলেন। বিস্ময়কর ব্যাপার হচ্ছে, তিনি তাঁর দুই মেয়েকে সঙ্গে করে নিয়ে গেলেন। তিনজনকেই নেবার শখ ছিল। বড়টিকে বাড়িতে পাওয়া গেল, না; সে কাউকে কিছু না বলে কোথায় না-কি গেছে। মোবারক হোসেন ঠিক করে রেখেছেন, এ ধরনের কর্মকাণ্ডের উচিত শাস্তি সে পাবে। যথাসময়ে পাবে। বড় ময়ের বিয়ে হয়ে গেছে, তাতে কী? মেয়ে তো এখনো তার সঙ্গে থাকে। যতদিন মেয়ে তার বাড়িতে থাকবে, ততদিন তাকে বাড়ির নিয়মকানুন মানতে হবে।

মাসুমা এবং মাফরুহা দুজনেই ভয়ে অস্থির। বাবার সঙ্গে বেড়াতে যাওয়ায় কোনো আনন্দ নেই। আমরা কোথাও যাব না বলাও সম্ভব না। দুজনেই খুব মন খারাপ করে বাড়ি থেকে বের হলো। তারা খানিকটা ভয়ও পাচ্ছে। বাবা বলেন নি তাদের কোথায় নেয়া হচ্ছে। বাবাকে জিজ্ঞেস করে জানবে সেই সাহসও তাদের নেই।

মোবারক হোসেন রিকশা নিলেন। ছোট মেয়েটিকে বসালেন নিজের কোলে। মাফরুহাকে দেখে মনে হচ্ছে সে লজ্জায় মরে যাচ্ছে। কেন্দেই ফেলত, অনেক কষ্টে সে চোখের জল আটকে রাখছে।

মোবারক হোসেন বললেন, হাতে এখনো সময় আছে, তোরা আইসক্রিম খাবি?

দুজনই চাপা গলায় বলল, না।

খাবি না কেন? আয় আইসক্রিম কিনে দেই।

মোবারক হোসেন বেবি আইসক্রিমের দোকানে গিয়ে দুমেয়েকে আইসক্রিম কিনে দিলেন। দুজনই খুবই আগ্রহের সঙ্গে আইসক্রিম খাচ্ছে। দেখতে ভালো লাগছে। মোবারক হোসেন সিগারেট ধরাতে ধরাতে বললেন, শেখ সাহেব তোদের তিন বোনেরই নাম জানেন। আজকেও তোদের কথা আমাকে জিজ্ঞেস করলেন। তোরা কেমন আছিস জানতে চাইলেন।

মাসুম ভয়ে ভয়ে বলল, আমাদেরকে উনি কীভাবে চেনেন?

মোবারক হোসেন বললেন, সে বিরাট ইতিহাস। জানার দরকার নাই। তাড়াতাড়ি আইসক্রিম শেষ কর। বক্তৃতা শুরু হয়ে গেছে।

মাসুমা অবাক হয়ে বলল, কিসের বক্তৃতা?

মোবারক হোসেন জবাব দিলেন না। মেয়েদের সঙ্গে এত কথা বলতে তার ভালো লাগে না।

পল্টনের মাঠের জনসমুদ্রে মাওলানা বললেন–

তের বছর আগে কাগমারী সম্মেলনে আমি আসসালামু আলাইকুম বলেছিলাম। মরহুম শহীদ সোহরাওয়ার্দী তীক্ষ্ণ বুদ্ধিসম্পন্ন ব্যক্তি হয়েও সেদিন আমার কথা অনুধাবন করতে পারেন নাই। কারণ আমি বুঝতে পেরেছিলাম যে দুই অংশ যদি একত্রে থাকে তাহলে কালব্যাধি যক্ষ্মার জীবাণু যেমন দেহের হৃৎপিণ্ডের দুই অংশকে নিঃশেষ করে দেয়, তেমনি পাকিস্তানের দুই অংশই বিনষ্ট হবে। তাই বলছিলাম যে তোমরা তোমাদের শাসনতন্ত্র প্রণয়ন করো এবং আমরা আমাদের জন্য শাসনতন্ত্র প্রণয়ন করি। লাকুম দীনুকুম ওয়ালিয়া দীন। শেখ মুজিবর রহমান আজ ঘরের ছেলে ঘরে ফিরে এসেছে। আমি সাত কোটি বাঙালিকে আজ মোবারকবাদ জানাই এ জন্যে যে তারা এই বৃদ্ধের তের বছর আগের কথা এতদিন পর অনুধাবন করতে পেরেছে।

মাওলানা ভাসানী যখন বক্তৃতা দিচ্ছেন তখন মরিয়ম পুরনো ঢাকায়। সে আগামসি লেনের একটা ঠিকানা খুঁজে বেড়াচ্ছে। কিছুতেই পাচ্ছে না। ভয়ে সে অস্থির। একা একা এর আগে সে কখনো কোথাও যায় নি। অচেনা একটা জায়গায় ঠিকানা খুঁজে বেড়ানোর তো প্রশ্নই আসে না। সে খুঁজছে নাইমুলের বাসা। বিয়ের পর এই যে সে চলে গেল আর তার কোনো খোঁজ নেই। বাসার মানুষগুলিও যেন কেমন! তারাও তো খোঁজখবর করবে। এখন সময় ভালো না, চারদিকে আন্দোলন হচ্ছে। তার কিছু হয়েছে কি-না কে জানে।

মরিয়ম ঠিক করে রেখেছে, আজ সে মানুষটাকে সাথে করে নিয়ে যাবে। বাসার মানুষজন যার যা ইচ্ছা বলুক কিছুই যায় আসে না। বাবা যদি পিস্তল বের করে তাকে গুলি করে দেন তাহলে দেবেন, কিন্তু মানুষটাকে সে এখানে ফেলে রেখে যাবে না!

বেচারা একা একা থাকে। হোটেলে খায়। কেন সে হোটেলে খাবে? দিনের পর দিন হোটেলের খাবার খেলে কি শরীর ঠিক থাকবে? শরীর যদি খারাপ হয় তাহলে তো মরিয়মকেই সেটা দেখতে হবে। আর কে দেখবো?

সন্ধ্যার ঠিক আগে আগে গুণ্ডাটাইপ একটা গোফওয়ালা ছেলে সঙ্গে এসে বাসা দেখিয়ে দিল।। ঢাকাইয়া ভাষায় বলল, নাইমুল ছাব এই চিপায় থাকে। ডাক দেন–আওয়াজ দিব।

মরিয়ম নিশ্চিত যে সে একটা ফাঁদে পড়েছে। এরকম একটা জঘন্য। জায়গায় নাইমুল থাকতেই পারে না। এই গুণ্ডাটা ভুলিয়ে ভালিয়ে এখানে নিয়ে এসেছে। এক্ষুনি সে ধাক্কা। ময়ে মরিয়মকে ঘরে ঢুকিয়ে দরজা বন্ধ করে দেবে। মরিয়ম কাপতে কাপতে দরজার কড়া নাড়ল। তার এক চোখ গুণ্ডাটার দিকে। গুণ্ডাটা চলে যায় নি। রাস্তায় দাঁড়িয়ে তার দিকে তাকিয়ে আছে।

দুবার কড়া নাড়তেই ভেতর থেকে নাইমুলের গভীর গলা শোনা গেলমরিয়াম চলে এসো, দরজা খোলা।

শুধু কড়া নাড়ার শব্দ শুনে একটা লোক কী করে বুঝল কে এসেছে–এই রহস্য মরিয়ম কখনো ভেদ করতে পারে নি। নাইমুল কখনো বলে নি।
 
চায়ের কাপ নামিয়ে রাখতে রাখতে আসমানী হাসিমুখে বলল, এই শোনো, তোমাকে একটু দোকানে যেতে হবে।

আসমানী তার স্বভাবমতো ভোরবেলা গোসল করেছে। ধোয়া একটা শাড়ি পরেছে। কপালে টিপা। খুব সম্ভব চোখে হালকা করে কাজলও দিয়েছে। সুন্দর লাগছে তাকে। আসমানী বলল, এই, কথা বলছি না কেন?

শাহেদ ভুরু কুঁচকে চায়ের কাপে চুমুক দিল। তার সামনে দুটা পত্রিকা–দৈনিক পাকিস্তান, ইত্তেফাক। দৈনিক পাকিস্তানের ভাজ এখনো খোলা হয় নি। পত্রিকার পাতায় পাতায় আগুনগরম সব খবর। এখন স্ত্রীর কথা শোনা তেমন জরুরি না। দোকানে যাওয়াটাও জরুরি না। কাগজ পড়া শেষ হোক, তারপর দেখা যাবে।

আসমানী শাহেদের পাশে বসতে বসতে বলল, চট করে চা-টা খেয়ে নাও। আসমানীকে আজ অন্য দিনের চেয়ে অনেক বেশি হাসিখুশি লাগছে। তার কারণ স্পষ্ট নয়।

শাহেদ চায়ের কাপে চুমুক দিল। মিষ্টি কম হয়েছে। আরেকটু চিনি দাওএই কথাটা বলতেও আলসেমি লাগছে। মনে হচ্ছে চিনির কথাটা বললেও সময় নষ্ট হবে। দৈনিক পাকিস্তান-এর প্রথম পাতায় সুন্দর একটা ছবি ছাপা হয়েছে। কালো পতাকা উড়িয়ে শেখ মুজিবুর রহমান যাচ্ছেন প্রেসিডেন্ট ভবনে, প্রেসিডেন্টের সঙ্গে বৈঠক। বৈঠকে কী হলো না হলো পত্রিকায় নিশ্চয়ই তার বিস্তারিত বিবরণ আছে।

তুমি এখন পত্রিকায় হাত দিও না। পড়তে শুরু করলে তুমি এক ঘণ্টার আগে উঠবে না। চা-টা শেষ করে তোমাকে একটু দোকানে যেতে হবে। শেখ মুজিব এবং ইয়াহিয়ার বৈঠকের চেয়েও এটা অনেক বেশি জরুরি।

তাই না-কি?

হ্যাঁ তাই। শেখ মুজিব ভাববেন তাঁর দেশ নিয়ে, আমি ভাবব আমার সংসারের তেল-চিনি নিয়ে।

দেশটা তোমার না?

আমার কাছে আগে আমার সংসার। তারপর দেশ।

কঠিন কিছু কথা শাহেদের মুখে এসে গিয়েছিল। সে নিজেকে সামলালো। সকালবেলাটা তিক্ততার জন্যে ভালো না। সে পত্রিকায় মন দিল।

আসমানী হাত বাড়িয়ে পত্রিকা দুটা নিয়ে নিল। শাহেদের মাথায় চট করে রক্ত উঠে গেল। সে নিজেকে সামলে সিগারেট ধরাল। এখন সে একটা ঝগড়া শুরু করতে চায় না। ঝগড়া করার সময় অনেক পাওয়া যাবে। আপাতত যা করতে হবে তা হচ্ছে, কায়দা করে পত্রিকা দুটা নিয়ে নিতে হবে। এমনভাবে নিতে হবে যেন আসমানী টের না পায়। এই মুহুর্তে পত্রিকা পড়ার প্রতিই তার আগ্রহটিা অনেক বেশি। স্ত্রীরা স্বামীর যে-কোনো বিষয়ের প্রতি অতিরিক্ত আগ্রহকেই সন্দেহের চোখে দেখে।

আসমানী শাহেদের পিঠে হাত রেখে বলল, দোকানে যাওয়া ছাড়াও তোমাকে কাঁচাবাজারেও যেতে হবে, ঘরে কোনো বাজার নেই। চাল-ডাল সব কিনতে হবে। সবাই খাবার কিনে ঘরে জমা করে রাখছে। শুধু আমাদের ঘরে কিছু নেই।

শাহেদ অনগ্রহের মতো ভঙ্গি করে বলল, দেখি কাগজটা?

আসমানী বলল, এখন কাগজ পাবে না। দোকানো যাবে, কাঁচাবাজারে যাবে; তারপর কাগজ। কাগজ পালিয়ে যাচ্ছে না।

শাহেদ রাগ চাপতে চাপতে বলল, দোকান এবং কাঁচাবাজারও পালিয়ে যাচ্ছে না।

আসমানী বলল, আচ্ছা, তোমার প্রতি সামান্য দয়া করলাম। কাঁচাবাজারে পরে যাবে। দোকান থেকে ঘুরে আসো। রুনির জন্য দুনম্বরি খাতা কিনতে হবে। সে ছবি আঁকবে, তারপর নাশতা খাবে। নাশতা না খেয়ে বসে আছে। তোমার মেয়ে যে কী পরিমাণ মেজাজি হয়েছে! আমার ধারণা, সে মেজাজ পেয়েছে তোমার কাছ থেকে। যা বলবে তাই করবে। তোমার চা খাওয়া শেষ হয়েছে না? এখন ওঠে। মেয়ে ঘুম থেকে উঠেছে সাতটার সময়, এখন বাজছে দশটা । কিছু মুখে দেয় নি।
 
শাহেদ বামেলা করল না। উঠে দাঁড়াল, শার্ট গায়ে দিল। আসমানী বলল, তোমাকে কাগজ পড়তে না দেওয়ার জন্য আমার নিজেরই খারাপ লাগছে, তবে দোকান থেকে ফিরেই দেখবে গরম চা এবং চায়ের কাপের পাশে ভাজ করা পত্রিকা। ভালো কথা, খাতা যে আনবে খাতার কভারে হাতির ছবি থাকতে হবে। হাতির ছবি ছাড়া খাতা আনলে চলবে না। তোমার মেয়ে কী চিজ হয়েছে, তুমি তো জানো না। হাতির ছবির কথা মনে থাকে যেন।

মনে থাকবে।

মুখটা এমন প্যাচার মুখের মতো করে রেখেছ কেন? তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে, তুমি প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া। পাকিস্তানের সমস্যায় হতাশ, বিরক্ত ও ক্লান্ত। আমি লক্ষ করেছি। ভোরবেলাতেই তোমার মেজাজ থাকে বেশি খারাপ। ইয়াহিয়া সাহেব! হিজ এক্সিলেন্সি! আজ কি অফিসে যাবে?

नों! ভালো হয়েছে। আজ তাহলে তুমি রুনির মাথা কমিয়ে দেবে। ছোটবেলায় কয়েকবার মাথা না কামালে চুল ঘন হয় না। একটা রেজার ব্লেড এনো তো। এক বোতল ডেটল। মাথা কেটে গেলে দিতে হবে।

আর কী কী লাগবে একসঙ্গে বলো। আর কিছু লাগবে না। দোকানে ভালোবাসা কিনতে পেলে তোমাকে সের খানেক ভালোবাসা কিনতে বলতাম। ইদানীং তোমার মধ্যে এই জিনিসের সাংঘাতিক অভাব দেখছি। ভালো কথা, চা পাতা নেই, চা পাতা আনতে হবে। প্লাস চিনি। এই দুটা যদি না আন তাহলে চা পাতা এবং চিনি ছাড়া চা খেতে হবে।

কিছু বাকি পড়ল কি-না। আবার মনে করে দেখ। তাতের মাকুর মতো আমি দোকান-বাসা, দোকান-বাসা করতে পারব না।

আর কিছু লাগবে না। ভালো কথা, তুমি যখন খুব রেগে যাও তখন তোমার চেহারা কিন্তু খানিকটা ইয়াহিয়া খানের মতো হয়ে যায়। ঠাট্টা করছি না। অনেষ্ট। যে জায়গায় তোমরা গোফ রাখি, তোমার সেই জায়গাটা ইয়াহিয়া খানের মতোই বড়। আচ্ছা গোফ রাখার জায়গাটার নাম যেন কী?

জানি না।

কী আশ্চৰ্য, যেখানে তোমরা এত কায়দা করে গোফ রাখা তার নামও জানো না।

শাহেদ বিরক্ত গলায় বলল, অকারণে এত কথা বলছি কেন? তুমি তো মাথা ধরিয়ে দিচ্ছি।

খাতা, চা, চিনি, রেজার ব্লেড নিয়ে শাহেদ মিনিট দশেকের মধ্যে ফিরে এলো। আসমানী বলল, তোমাকে না বললাম হাতির ছবি মার্কা খাতা কিনতে। এই খাতা দেখেই তো তোমার মেয়ে কাঁদতে শুরু করবে।

হাতিমার্কা খাতা ছিল না।

থাকবে না কেন? ছিল তো বটেই। তুমি বলতে ভুলে গেছ। যা দিয়েছে তাই নিয়ে চলে এসেছি। প্লিজ, খাতাটা বদলে আন।

শাহেদ সার্ট খুলতে খুলতে বলল, বদলাতে পারব না। যা এনেছি তাই তোমার মেয়েকে দাও। আদর দিয়ে দিয়ে তুমি মেয়েটাকে নষ্ট করছ। জগতের নিয়ম হচ্ছে, কোনো জিনিস চাইলেই পাওয়া যায় না। অথচ তোমার মেয়ের ধারণা হয়েছে, যা চাওয়া যায়। তাই পাওয়া যায়। হাতি মার্কা খাতা চেয়েছে, হাতি মার্কা খাতা দিতে হবে। বাঘ মার্কা চাইলে বাঘ মার্কা। এসব কী?

তুমি এমন চোখ বড় বড় করে আমার সঙ্গে কথা বলছি কেন?

জন্ম থেকেই আমার চোখ বড়। এই জন্য চোখ বড় বড় করে কথা বলছি। তুমিই বা সরু চোখে তাকিয়ে আছ কেন? সরু চোখে তাকিয়ে থাকার মতো অপরাধ কি করেছি?

মেয়ে যখন কেঁদে বাসা মাথায় তুলবে, তখন কী করবে?

ওকে বুঝিয়ে বলো! বুঝিয়ে বললেই কেঁদে বাড়ি মাথায় তুলবে না। শিশুরা লজিক বুঝতে পারে। সমস্যা বড়দের নিয়ে। বড়রা লজিক বুঝতে চায় না।

তাহলে দয়া করে তোমার বিখ্যাত লজিক দিয়ে ওকে বোঝাও।
 
শাহেদ খবরের কাগজ নিয়ে বসল। আসমানী কিছুক্ষণ স্বামীর দিকে তাকিয়ে রুনির কাছে গেল। এবং তার প্রায় সঙ্গে সঙ্গে রুনীর আকাশ ফাটানো চিৎকার শোনা যেতে লাগল। ভয়াবহ চিৎকার। মনে হচ্ছে বাড়িঘর ভেঙে পড়বে। চিৎকার অগ্রাহ্য করে কাগজে মন দেয়া যাচ্ছে না। শাহেদের মেজাজ দ্রুত খারাপ হচ্ছে। ইচ্ছা করছে উঠে গিয়ে মেয়েটার গালে একটা চড় বসিয়ে দেয়। এটাও করা যাবে না। তাহলে সারাদিন আসমানী মুখ ভোতা করে রাখবে। সন্ধাবেলা দেখা যাবে মেয়েকে নিয়ে মার বাড়ির দিকে রওনা হয়েছে। শাহেদ ডাকল, রুনি মা, শুনে যাও তো। রুনি সঙ্গে সঙ্গে ঘরে ঢুকল।

কেন কাঁদছ গো মা?

বাবা, ছবি আঁকব।

ছবি আঁকবে সেটা তো খুবই ভালো কথা। আঁকো। তোমার জন্য তো খাতা কিনে এনেছি। একটা কেনার কথা ছিল, দুটা কিনেছি।

হাতির ছবির খাতা লাগবে। এই খাতায় আঁকিব না। এই খাতা পচা।

হাতির ছবির খাতা দোকানে ছিল না, তাই আনা হয় নি। আমি আবার যখন বের হবো। তখন নিয়ে আসব।

না, আমার এখনি লাগবে।

চাইলেই সব কিছু পাওয়া যায় না মা।

পাওয়া যায়।

না, পাওয়া যায় না।

পাওয়া যায়।

এরকম করে কথা বলবে না। রুনি। এরকম করে কথা বললে আমার মেজাজ খুব খারাপ হবে। হঠাৎ দেখা যাবে তোমার গালে ঠাস করে একটা চড় বসিয়ে দিয়েছি।

না তুমি চড় বসাবে না।

তুমি কিন্তু আমার মেজাজ খুব খারাপ করছ রুনি। এখন লক্ষ্মী মেয়ের মতো যাও, ছবি আঁকো, আমি কাগজ পড়ি।

না, তুমি কাগজ পড়বে না।

রুনি হাত বাড়িয়ে খবরের কাগজ টেনে নিল এবং শাহেদের কিছু বলার আগেই ছিঁড়তে শুরু করল। রুনির মুখ গম্ভীর। তাকে দেখে মনে হচ্ছে কাগজ ছেড়ার এই কাজটি সে অত্যন্ত আনন্দের সঙ্গে করছে। শাহেদের অধিক শোকে পাথর হওয়ার মতো ব্যাপার হলো। সে মেয়ের কাগজ ছেড়া দেখল। শোকের প্ৰবল ধাক্কাটা কমে যাওয়ার পরপরই মেয়ের গালে চড় বসিয়ে দিল, রুনি সারা বাড়ি কাঁপিয়ে চিৎকার করতে লাগল। আসমানী ছুটে এসে মেয়েকে তুলে নিয়ে গেল। শাহেদের মনটা হলো খারাপ। ইচ্ছে করলে ছেড়া কাগজগুলো হাতে নিয়ে পড়া যায়। ইচ্ছা করছে না। মেয়েটার গালে আরেকটা চড় দিতে ইচ্ছা করছে। মনে হচ্ছে আগেরবারেরটা তেমন জোরালো হয় নি।

রুনির কান্না থেমে গেছে। জোরালো চড় হলে এত সহজে কান্না থামত না। বাসা থেকে কিছুক্ষণের জন্য দূরে কোথাও চলে যেতে ইচ্ছে করছে। কাঁচাবাজারে যাওয়া যেতে পারে। চাল-ডাল-তেল-নুন আসলেই কিনে রাখা দরকার। সবাই কিনেছে। সে কেন। কিনবে না? কয়েক কাৰ্টন সিগারেট। যুদ্ধের সময় সবচে দুষ্প্রাপ্য হয় সিগারেট।

আসমানী রুনিকে কোলে নিয়ে ঘরে ঢুকল। ভীত গলায় বলল, দেখ তো দেখ তো ওর মুখ দিয়ে রক্ত পড়ছে। রুনি, হা করো তো মা। হা করো।

রুনি হা করল। আসলেই মুখভর্তি রক্ত। আসমানী হতভম্ব গলায় বলল, কী করেছ তুমি মেয়ের?

শাহেদ অপ্ৰস্তুত গলায় বলল, গালটাল কোথায়ও কেটে গেছে। এত অস্থির হওয়ার মতো কিছু হয় নি। দেখি, ওকে আমার কোলে দাও।

না, আমি আমার মেয়েকে তোমার কোলে দেব না। তুমি কোন সাহসে আমার মেয়েকে কোলে নিতে চাও?

আসমানী ঝরঝর করে কেঁদে ফেলল। রুনি হাত বাড়িয়ে দিয়েছে বাবার কোলে যাবার জন্য। শিশুরা অতি সহজে অন্যের অপরাধ ক্ষমা করতে পারে।

শাহেদ বলল, কোথায় কেটেছে একটু দেখি। দরকার হলে একজন ডাক্তার দেখিয়ে আনি।

তোমাকে কিছুই করতে হবে না। খবরদার, তুমি আমার মেয়েকে কোলে নেবে না। খবরদার তুমি আমার মেয়েকে ছোবে না।

তুমি এমন ভেউ ভেউ করে কাদছ কেন? তোমার মেয়ে তো কাঁদছে না। এই দেখ, রক্ত পড়াও বন্ধ হয়েছে। আর রক্ত পড়ছে না।
 
আসমানী কাঁদতে কাঁদতেই মেয়ে কোলে নিয়ে পাশের কামরায় চলে গেল। শাহেদের মন এমনই খারাপ হলো যে তার নিজেরও কান্দতে ইচ্ছা করল। দিনটা সুন্দরভাবে শুরু হয়ে হঠাৎ কেমন এলোমেলো হয়ে গেল। তার আর ঘরে চুপচাপ বসে থাকার কোনো মানে হয় না। সবচেয়ে ভালো হয় কিছুক্ষণ বাইরে কাটিয়ে এলে। অফিসে যাওয়া যেতে পারে। অফিস থেকে ফেরার পথে বাজার করে আনলে আসমানীর রাগ হয়তো কিছু কমবে। মেয়েটার জন্য গাদাখানিক হাতির ছবি আঁকা খাতা আনতে হবে। আর একটা ঘুড়ি কিনতে হবে। কবে যেন ঘুড়ির কথা বলছিল।



অফিসে শাহেদের সময়টা খুব খারাপ কাটল। খা-খা করছে অফিস। বলতে গেলে কেউ আসে নি।

অফিসের পিওন রুস্তম টুলে বসে ঝিমুচ্ছে। চোখ মেলে একবার সে শাহেদকে দেখল। উঠে দাঁড়াচ্ছে–এমন ভঙ্গি করে আবারো চোখ বন্ধ করে বিমাতে লাগল।

ইউনাইটেড ইনসুরেন্স কোম্পানি। একসময় লোকজন গমগম করত। আজ মাছি উড়ছে। যে-সব কোম্পানির মালিক অবাঙালি তার সবগুলোরই এই অবস্থা। মালিকরা অফিসে আসা বন্ধ করেছেন। অফিসে মাছি উড়া শুরু হয়েছে।

ক্যাশিয়ার নিবারণ বাবু বললেন, আজ অফিসে এসেছেন কেন? আজি জোর গুজব শহরে আর্মি নামবে। শেখ সাহেব। আর ইয়াহিয়ার বৈঠক বানচাল হয়ে গেছে। সবাই এখন ঘর সামলাতে ব্যস্ত, আপনি কেন অফিসে?

শাহেদ বলল, আপনিও তো অফিসে।

আমার ঘরে কিছু করার নেই। ফ্যামিলি দেশে পাঠিয়ে দিয়েছি। কাজেই চলে এসেছি। আপনাদের সঙ্গে গল্পগুজব করব।

বেশ তো করুন গল্পগুজব।

নিবারণ সাহেব অনেক ধরনের মজার মজার গল্প করলেন। এর মধ্যে ভৌতিক গল্পও আছে। তার কাকার শ্রাদ্ধের দিন না-কি সবাই দেখেছে অবিকল তার কাকার মতো দেখতে এক লোক শোবার ঘরের খাটে বসে আছে। লোকটা সম্পূর্ণ নগ্ন। শুধু গলায় পৈতা। শাহেদের কোনো গল্পই তেমন মজা লাগল না। নিবারণ বাবু বুকে এসে বললেন, আপনাকে খুব চিন্তিত লাগছে। ভাবিকে দেশের বাড়িতে পাঠিয়ে দেন। তাহলে দেখবেন আমার মতো হয়ে যাবেন। চিন্তাভাবনাহীন লান্টু মিয়া। যখন ইচ্ছে বনবান করে ঘুরবো।

শাহেদ বলল, উঠি।

আরো কিছুক্ষণ বসুন, গল্প করি। চা খাবেন? চা আনিয়ে দেই।

না, চা খাব না।

কেন খাবেন না! চা খান। বি হ্যাপী।

শাহেদ উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলল, আপনি অফিসে কতক্ষণ থাকবেন? নিবারণ বাবু আনন্দিত গলায় বললেন, আমি তো অফিসেই থাকি। বিছানা বালিশ নিয়ে চলে এসেছি। অফিস হলো এখন সবচে নিরাপদ জায়গা।

একটিার দিকে শাহেদ অফিস থেকে বের হলো।

মনে হচ্ছে শহর কোনো উৎসবের জন্য প্রস্তুত হচ্ছে। রাস্তায় রাস্তায় ব্যারিকেড দেওয়া হচ্ছে। শাহেদের সামনেই হাজার হাজার মানুষ মহা-উৎসাহে পুরনো একটা বাস ঠেলতে ঠেলতে এনে রাস্তায় শুইয়ে দিল। এরা কার বাস নিয়ে এসেছে কে জানে! শেখ সাহেব কি রাস্তা ব্যারিকেড দেওয়ার কোনো নির্দেশ দিয়েছেন? তাঁর নির্দেশ ছাড়া তো এখন কিছুই হয় না। অফিস চলছে তার নির্দেশে। ব্যাংক চলছে তার নির্দেশে।

২৩ মার্চ, পাকিস্তানের প্রজাতন্ত্র দিবসে কোথাও পাকিস্তানি পতাকা উড়ে নি। শুধু তিনটা জায়গায় পতাকা উড়েছে–প্রেসিডেন্ট ভবনে যেখানে ইয়াহিয়া থাকেন, গভর্নর ভবনে এবং এয়ারপোর্টে। ব্রিটিশ ডেপুটি হাই কমিশন এবং সোভিয়েত কনসুলেটে উড়েছে বাংলাদেশী পতাকা। চীন, ইরান, ইন্দোনেশিয়া এবং নেপাল পাকিস্তানি পতাকা তুললেও জনতার চাপে পাকিস্তানি পতাকা নামিয়ে বাংলাদেশের পতাকা উড়িয়েছে। আমেরিকান দূতাবাস অবশ্যি কোনো ঝামেলায় যায় নি। তারা কোনো পতাকাই উড়ায় নি। ভয়াবহ কাণ্ডটা করেছে। ইপিআর। তারা যশোহর সদর দপ্তরে উড়িয়েছে বাংলাদুেশী পতাকা।
 
সে-রাতে টিভি অনুষ্ঠান শেষ হবার পর পাকিস্তানের জাতীয় সঙ্গীত পাক সার যামিন শাদ বাদ ঠিকই বাজানো হয়েছে, কিন্তু পাকিস্তানি পতাকা দেখানো হয় নি।

লক্ষণ ভালো না। লক্ষণ খুবই খারাপ। পাকিস্তানের সৈন্যবাহিনী এত কিছু দেখার পরেও চুপ করে থাকবে, কিছু বলবে না–তা হতেই পারে না। ভয়ঙ্কর কিছু ঘটতে যাচ্ছে তো বটেই। সেটা কবে ঘটবে?

বাসায় ফিরতে ইচ্ছা করছে না। কী করা যায়? কী করা যায়? নাইমুলের কাছে গেলে কিছুটা সময় কাটে। সে বিয়ে করেছে— এই খবরটা পেয়েছে। বিয়ের পর তার সাথে দেখা হয় নি। নাইমুলকে যে মেয়ে বিয়ে করেছে, সে খুবই ভাগ্যবতী। এই খবরটা মেয়েকে দিতে ইচ্ছা করছে। শাহেদ ঠিক করল, নাইমুলকে পেলে তাকে নিয়ে সে তার শ্বশুরবাড়ি যাবে। নাইমুলের স্ত্রীকে বলবে, ভাবি, কী অসাধারণ একটি ছেলেকে আপনি স্বামী হিসেবে পেয়েছেন জানেন না। আমি জানি। নাইমুল অনেক তুচ্ছ জিনিস নিয়ে আপনার সঙ্গে রাগারগি করবে। আপনাকে বিরক্ত করবে। সব আপনি সঙ্গে সঙ্গে ক্ষমা করে দেবেন। কারণ এই ছেলে খাঁটি হীরা। তার মধ্যে কোনো ভেজাল নেই। আপনি যদি চান, আপনাকে লিখিতভাবে দিতে পারি।

নাইমুলকে পাওয়া গেল না। ঘর তালাবন্ধ। তবে তালার সঙ্গে সেঁটে দেয়া একটা ছোট্ট চিরকুটে লেখা

যার জন্যে প্ৰযোজ্য

কিছুদিন ঘরজামাই জীবনযাপন করছি। আমার নতুন ঠিকানা–১৮নং সোবাহানবাগ (দোতলা), মিরপুর রোড। নিতান্ত প্রয়োজন ছাড়া কেউ যেন আমার কাছে না। আসে।

শাহেদ নোট পড়ে হাসল। মনে মনে ঠিক করল, আসমানীর রাগ ভাঙিয়ে তাকে সঙ্গে নিয়ে সন্ধ্যার পর উপস্থিত হবে নাইমুলের শ্বশুরবাড়িতে।

শাহেদ বাসায় ফিরল দুটার দিকে। কাঁচাবাজার ছাড়াই ফিরল। কী কী লাগবে তার লিষ্ট আসমানীর কাছ থেকে নেয়া হয় নি। তবে সে ছটা হাতিমার্ক খাতা কিনল। একবাক্স রঙ-পেনসিল কিনল। আসমানীর রাগ ভাঙানোর জন্যে সে কিনল একটা রাগভাঙনি-শাড়ি। শাড়ির রঙ অবশ্যই আসমানী। রাজশাহী সিল্কের শাড়ি। শাড়ি হাতে নিলেই আসমানীর রাগ অনেকখানি কমবে। শাড়ির সঙ্গে লেখা নোটটা পড়লে এতটুকু রাগও থাকবে না। নোটে লেখা— জান গো! কেন এমন করো?

বাসায় তালা দেওয়া। শাহেদ এতে তেমন বিস্মিত হলো না। তার মনে ক্ষীণ আশঙ্কা ছিল, বাসায় ফিরে এরকম কিছু সে দেখবে। ঘরে তালা দিয়ে আসমানী রাগ করে চলে যাবে কলাবাগানে তার মার কাছে।

আসমানী কলাবাগানে ছিল না। শাহেদের শাশুড়ি বিরক্ত গলায় বললেন, শহরের অবস্থা এত খারাপ, এর মধ্যে আসমানী বের হলো কেন? রোজ রোজ কী নিয়ে তোমাদের এত ঝগড়া? আমি আমার মেয়ের উপর যেমন রাগ করছি, তোমার উপরও রাগ করছি। এখন যাও তাড়াতাড়ি খুঁজে বের করো ও কোথায়। তুমি তো বাবা আমাকে মহা-দুশ্চিন্তায় ফেললে। শহরের অবস্থা এত খারাপ, এর মধ্যে এই খবর…

শাহেদ নানান জায়গায় ওদের খুঁজল। কোনোরকম সন্ধান পাওয়া গেল না। শাড়িটা সে রেখে এসেছে তার শাশুড়ির কাছে। এটা নিয়েও সে দুশ্চিন্তা করছে। শাশুড়ি যদি নোটটা পড়ে ফেলেন, তাহলে খুব লজ্জার ব্যাপার হবে। রাত অনেক হয়েছে। ঘড়ি নেই বলে কত রাত তা বোঝা যাচ্ছে না। রাস্তাঘাটে লোক-চলাচল একেবারেই বন্ধ। রিকশাও চলছে না। কিছুদূর পরপরই রাস্তায় এমন ব্যারিকেড দেওয়া, রিকশা চলার প্রশ্নও আসে না।

শাহেদ হেঁটে হেঁটে ফিরছে, এই সময় শহরে মিলিটারি নামল। রাতটা হলো ____
 
আকাশে ট্রেসার উড়ছে। আকাশ আলো হয়ে উঠছে। তৈরি হচ্ছে আলোর নকশা। যেন বারবার কালো আকাশে ঝলমলিয়ে উঠছে উৎসবের হাউই বাতি। তারাবাতির মতো আগুনের ফুলকি বেরুচ্ছে মেশিনগানের মুখ থেকে। বাজির শব্দের মতো গুলি। উৎসব। অন্য ধরনের উৎসব। হত্যা ও ধ্বংসের উৎসব। এই উৎসবের জন্যে কেউ কি তৈরি ছিল? ঢাকার ঘুমন্ত মানুষ ভয়াবহ আতঙ্ক নিয়ে জেগে উঠল। কী হচ্ছে? কী হচ্ছে?

সবাই জানে কী হচ্ছে। তারপরেও যেন কেউ কিছু জানে না। ভারী মিলিটারি ট্রাক, মিলিটারি জিপ অবলীলায় রাস্তায় চলাচল করছে। সবকটি রাস্তায় না বেরিকেড ছিল? এরা এত দ্রুত বেরিকেড সরালো কীভাবে? অদ্ভুত শব্দ হচ্ছে রাস্তায়। ট্যাংক নেমেছে নাকি? ট্যাংক চললে রাস্তায় এমন অদ্ভুত শব্দ হয়? একটানা যে ট্যা ট্যা শব্দ হচ্ছে সেই শব্দ কিসের? তার চেয়েও বিচিত্র আরেক ধরনের শব্দ হচ্ছে–শো শো হুস হুইইই।

ভয় এবং কৌতূহল বোধহয় পাশাপাশি চলে। প্রচণ্ড ভীত মানুষের কৌতূহলও হয় প্রচণ্ড। এরা জানালার শিক ধরে দাঁড়িয়েছে। দেখতে চেষ্টা করছে কী হচ্ছে বাইরে। কেউ কেউ চলে এসেছে বারান্দায়। চোখের সামনে ভয়াবহ ধ্বংসযজ্ঞ দেখার আলাদা মাদকতা আছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই এক ধরনের ঘোর তৈরি হয়। মাথার ভেতরে জগাখিচুড়ির মতো কিছু হয়। তখন মানুষ যুক্তি দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায় না। এমনসব কাণ্ড করে।

এই জাতীয় কাণ্ড কিছু শুরু হলো। কিছু কিছু নিতান্তই নিরীহ ছাপোষা ধরনের মানুষ জয় বাংলা, জয় বাংলা বলে গলা ফাটিয়ে চোঁচাল। দীর্ঘ আন্দোলনে এদের কেউ হয়তো কোনোদিন রাজপথে নামে নি। কোনো মোগান দেয় নি। অফিসে গিয়েছে, অফিস থেকে ফেরার পথে বাজার করে নিয়ে এসেছে। চটের ব্যাগের ভেতর থেকে উঁকি দিয়েছে একটা লাউ, ইলিশ মাছের লেজ। আজ হঠাৎ তাদের কী হয়ে গেল?

ভীত মানুষের কান্না ও চিৎকার শোনা যেতে শুরু করল তারও কিছু পরে। আকাশে তখন ট্রেসারের সংখ্যা কমে এসেছে। কারণ তার প্রয়োজন নেই। সারা ঢাকা শহর আলোকিত। অসংখ্য জায়গায় আগুন জুলছে, কুণ্ডলী পাকিয়ে উঠছে কালো ধোয়া। আগে সারা শহরে একসঙ্গে গুলি হচ্ছিল, এখন তা হচ্ছে না। গুলি হচ্ছে অঞ্চল বিশেষে। টেলিফোন কাজ করছে না। রাস্তা শুধু যে জনশূন্য তাই নয়, প্রথমবারের মতো কুকুরশুন্য। কোথায় কী হচ্ছে কেউ জানতে পারছে না। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কী হলো? তাঁর আঙুলের ইশারায় দেশ চলছিল। এখন তিনি কিছু বলছেন না কেন? ইয়াহিয়ার সঙ্গে শেষ বৈঠকের আগে, সাংবাদিকদের বলেছিলেন, ভালো কিছু আশা করছি। খারাপ কিছুর জন্যেও প্রস্তুত আছি। কোথায় তাঁর প্রস্তুতি? নাকি যুদ্ধ শুরু হয়েছে, কেউ কিছু জানে না।

একদল মিলিটারি ঢুকে পড়ল বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায়। তাদের হাতে শিক্ষকদের তালিকা। তারা মানুষ না, তারা সাক্ষাৎ আজরাইল। মানুষের বেশে জানি কবজ করতে এসেছে।

এটা কার বাড়ি? জগন্নাথ হলের প্রভোস্ট? হিন্দু মালাউন? বদমাশটার নাম কী? জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা?

মিলিটারি লেফটেনেন্ট বাড়িতে ঢুকে পড়ল। জোয়ানরা বাড়ি ঘিরে আছে। হতভম্ব জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা অবাক হয়ে তাকিয়ে আছেন।

আপ প্রফেসর সাব হ্যায়?

Yes.

আপকো লে যায়গা।

Why?

হোয়াই প্রশ্নের জবাব দেবার সময় নেই। তাকে টেনে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। তাঁর স্ত্রী বাসন্তী গুহঠাকুরতা, তার অতি আদরের কন্যা দোলা তখনো বুঝতে পারছে না। কী হচ্ছে। জিজ্ঞাসাবাদ করার জন্যে নিয়ে যাচ্ছে। এর বেশি কী হবে? খালি পায়ে স্বামীকে নিয়ে যাবে? বাসন্তী গুহঠাকুরতা দৌড়ে ঘরে ঢুকলেন স্যান্ডেল আনতে। এর মধ্যেই জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতাকে বাইরে নিয়ে গুলি করা হয়েছে।

তাদের বসার ঘরের সঙ্গেই চিৎ হয়ে পড়ে আছে ড. মনিরুজ্জামানের মৃতদেহ। একটু দূরে আরো তিনজন। একজন ক্ষীণস্বরে বলছে, পানি পানি।

মারা গেলেন দার্শনিক আত্মভোলা অধ্যাপক ড. জি. সি. দেব। জি. সি. দেব। মৃত্যুর আগে প্রায় হাসিমুখে বললেন, আমি হিন্দু। আমার বাড়িতে যারা আছে সবাই হিন্দু।

তিনি হয়তো ভাবলেন, সংখ্যালঘু হিন্দুদের প্রতি কোনো অত্যাচার করা হবে না। কিংবা অন্য কিছু তখন তার মাথায় খেলা করছিল।
 
মারা গেলেন মৃত্তিকাবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. ফজলুর রহমান, ফলিত পদার্থবিদ্যার অধ্যাপক অনুদ্বৈপায়ন ভট্টাচাৰ্য, পরিসংখ্যান বিভাগের প্রধান ড. মনিরুজ্জামান, ভূতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক মুহম্মদ আব্দুল মুকতাদির, অংক বিভাগের অধ্যাপক শরাফত আলী, পদার্থবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক এম. আর. খান খাদিম, শিক্ষা ও গবেষণা ইন্সিটিউটের শিক্ষক মুহম্মদ সাদিক ও ড. মুহম্মদ সাদত আলী।

মিলিটারিরা ঢুকে পড়ল ইকবাল হল এবং জগন্নাথ হলে। তাদের পরিকল্পনা একটি ছাত্রও যেন জীবিত বের হয়ে সেতে না পারে। তোমাদের জয় বাংলা অনেক সহ্য করেছি। আর না।

রোকেয়া হল এবং শামসুন্নাহার হল। মেয়েদের দুটি হল। হলের মেয়েরা আতঙ্কে অস্থির হয়ে দেখল, গেট ভেঙে মিলিটারিরা ঢুকছে। আমাদের বাঁচাও বলে চিৎকার করার মতো মানসিক শক্তিও তাদের রইল না। তারা দেখল, পাকিস্তানি জোয়ানরা মার্চ করে হলের দিকে এগুচ্ছে।

সেনাবাহিনী আগুন জুলিয়ে দেয়। ইত্তেফাক অফিসে। দাউদাউ করে আগুন জুলতে থাকে দি পিপলস, গণবাংলা এবং সংবাদ অফিসে। আত্মনিমগ্ন কবি শহীদ সাবের সংবাদ অফিসেই ঘুমাতেন। সংবাদ অফিসই ছিল তাঁর ঘর-বাড়ি। তিনি জীবন্ত দগ্ধ হয়ে মারা গেলেন সংবাদ অফিসেই।

পাকিস্তান মিলিটারি রাত একটায় যে অপারেশন শুরু করে তার নাম অপারেশন সার্চ লাইট।* ব্রিগেডিয়ার আরবাবের ৫৭ ব্রিগেড ছিল ঢাকা অপারেশনের দায়িত্বে। অধিনায়ক মেজর জেনারেল ফরমান আলি। তিনি শায়েস্তা করবেন। ঢাকা নগরী। মেজর জেনারেল খাদেমের উপর দায়িত্ব পড়ল ঢাকা ছাড়া বাকি দেশ শায়েস্তা করার।

ব্রিগেডিয়ার আরবাব ১৮ পাঞ্জাব, ২২ বেলুচ এবং ৩২ পাঞ্জাবের যৌথ দলকে লেলিয়ে দিল বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায়।

৩২ পাঞ্জাব রেজিমেন্টকে পাঠাল রাজারবাগের এক হাজার পুলিশকে জন্মের শিক্ষা দেবার জন্যে।

পুরনো ঢাকার গাদারদের শায়েস্তা করবে ১৮ পাঞ্জাব।

২২ বালুচের দায়িত্ব পড়ল পিলখানা ইপিআরদের ঠাণ্ডা করা।

১৩ ফ্রিন্টিয়ার ফোর্সকে কোনো কাজে লাগানো হলো না। রিজার্ভ বাহিনী হিসেবে তাদের ক্যান্টনমেন্ট এলাকাতে রেখে দেয়া হলো।

৪৩ হালকা বিমান বিধ্বংসী রেজিমেন্টকে পাঠানো হলো তেজগাও বিমানবন্দরের দায়িত্ব দিয়ে।

এক প্লাটুন কমান্ডো পাঠানো হলো ধানমণ্ডি ৩২ নম্বর থেকে শেখ মুজিবকে ধরে আনতে।

রাত একটায় ওয়্যারলেসে ৫৭ ব্রিগেডের ব্রিগেড কমান্ডার মেজর জাফরের উৎফুল্ল কণ্ঠ ভেসে এলো–Big Bird in the cage… others not in the nests…over.

সামরিক বাহিনীর জিপে করে তাকে নিয়ে আসা হলো ক্যান্টনমেন্টে। মেজর জাফর জানতে চাইল জেনারেল টিক্কা কি তাকে চোখের দেখা দেখতে চান? টিক্কা উত্তর দিল–I dont want to see his face.
 
জেনারেল টিক্কা ২৫ মার্চ রাত নটায় ঢাকা অঞ্চল কমান্ডার মেজর জেনারেল ফরমান আলীর স্টাফ অফিসে ঢাকা অপারেশনের দায়িত্বে নিযুক্ত অফিসারদের হাসতে হাসতে বলেছিলেন–ঢাকা শহরে এমন তাণ্ডব তৈরি করতে হবে যেন আতঙ্কে দুগ্ধবতী মাতার বুকের দুধ জমে দই হয়ে যায়। বাংলাদেশ ছোট্ট একটি দুষ্ট প্রাণী। ঢাকা হলো সেই প্রাণীর মাথা। আমরা শুধু মাথাটা ভেঙে গুড়ো করে দেব। আমাদের আর কিছু করতে হবে না। ২৭ মার্চ ভোরবেলা আমি কারফিউ তুলে দেব। দেখা যাবে ২৭ মার্চেই ইনশাল্লাহ দেশ ঠিক হয়ে গেছে।

জেনারেল টিক্কা পরম সৌজন্যে টিপট থেকে নিজেই সবার জন্য চা ঢেলে দিলেন। হাসিমুখে বললেন, শেকসপিয়র তার হ্যামলেটে বলেছিলেন, I have to be cruel only to be kind. VONTAİK FC3orf5 TRICK qKF KKG3 TS21*fr। বাঙালিদের প্রতি দয়া। গ্যাংগ্রীনে আক্রান্ত অংশ শল্যচিকিৎসক কেটে বাদ দেন। তিনি তা করেন রোগীর মঙ্গলের জন্য, রোগী তা বুঝতে পারে না। রোগগ্ৰস্ত বাঙালিকে আমরা বাঁচাব না তো কে বাচাবে? মিটিং-এর শেষ পর্যায়ে তিনি পাঞ্জাবি সৈন্যদের বুদ্ধি-সুদ্ধি নিয়ে একটা রসিকতা করলেন। সেই রসিকতায় এক একজন হেসে প্রায় গড়িয়ে পড়ল। একজন জেনারেলের সামনে এভাবে হাসা বড় ধরনের বেয়াদবি, কিন্তু না হেসে পারা যাচ্ছিল না। রসিকতাটা ছিল বড়ই মজার।

জেনারেল টিক্কা খানের সঙ্গে ভুট্টোর সাক্ষাৎ হলো গভর্নর হাউসে। ততক্ষণে অপারেশন সার্চ লাইট শুরু হয়ে গেছে। ভুট্টো খানিকটা উত্তেজিত। অস্থির। তার জানার আগ্রহ, কী হচ্ছে? অপারেশন কোন পর্যায়ে? জেনারেল টিক্কা খান তাকে তেমন পাত্তা দিচ্ছে না। মিলিটারি অপারেশন কী হচ্ছে কীভাবে হচ্ছে তা সিভিলিয়ানদের জানানোর কিছু নেই। উত্তেজিত ভুট্টো রাতেই মিলিটারি কনভয়ের সঙ্গে বের হয়ে শহরের অবস্থা দেখতে আগ্রহী। জেনারেল টিক্কা হাসি হাসি মুখে বলল, No. ভুট্টো মেঝেতে জুতা ঠিকে বলল, why no? জেনারেল টিক্কা বলল, Because said no.

ভুট্টো বলল, আমি প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার সঙ্গে কথা বলতে চাই।

টিক্কা বলল, প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া ঢাকা ত্যাগ করেছেন। তিনি এখন পাকিস্তানের পথে।

ভুট্টো আবারো মেঝেতে জুতা ঠিকে বলল, এই তথ্যটা আমি কেন জানলাম না? আমিও তো তার সঙ্গে চলে যেতে পারতাম।

আপনাকে রেখে যাওয়া হয়েছে বিদ্রোহী পূর্ব পাকিস্তানের শান্ত রূপ দেখে যাবার জন্যে। অখণ্ড পাকিস্তানের সম্ভাব্য প্রধানমন্ত্রী, কফি খাবেন?

সম্ভাব্য প্রধানমন্ত্রী সম্বোধনে ভুট্টোকে খানিকটা তুষ্ট মনে হলো।



লন্ডনের ডেইলি টেলিগ্রাফের রিপোর্টার সিমন ড্রিং-এর পাঠানো প্ৰত্যক্ষদর্শীর ভাষ্য ঢাকা থেকে পাঠানো প্রথম বিদেশী প্রতিবেদন। তিনি তার দীর্ঘ প্রতিবেদনের এক অংশে লিখলেন–

City lies silent

Shortly before dawn most firing had stopped, and as the sun cane up an eerie silence settled over the city, deserted and completely dead except for the noise of the crows and occasional convoy of troops or two or three tanks rumbling by mopping Up.

At noon again without warning, columns of troops poured into the old section of the city where more than one million fived in a sprawling maze of narrow, winding streets. For the next 11 hours they devasted the old town as it is called.

The lead unit was followed by soldiers carrying cans of gasoline. Those who tried to escape was shot. Those who stayed were burnt alive.
 
নগরী নীরব

সকাল হবার কিছুক্ষণ আগে গোলাবর্ষণ থেমে গেল, সূর্য উঠল, এক ভৌতিক নীরবতা নগরীকে গ্রাস করল, পরিত্যক্ত ও মৃত এই নগরীতে শুধু শোনা যাচ্ছে কাকের ডাক, মিলিটারি কনভয় ও চলমান ট্যাংকের ঘর্ঘর শব্দ।

দুপুরে আচমকা সৈন্যদলের গাড়ি পুরনো ঢাকায় ঢুকে পড়ল, যার গোলকধাঁধার মতো গলিঘুজিতে দশ লাখ মানুষ বাস করেন। পরের এগারোটা ঘণ্টা ধরে চলল ধবংসযজ্ঞ।

অগ্রবর্তী দলের পেছনে পেছনে সৈন্যরা পেট্রোলের টিন হাতে করে যাচ্ছিল। যারা পালাতে চেষ্টা করছিল তাদের গুলি করা হলো। যারা পালালো না তাদের জীবন্ত পুড়িয়ে মারা হলো।

শাহেদ নিতান্ত অজানা অচেনা এক বাড়িতে আটকা পড়ে আছে। ২৫ মার্চের মধ্যরাতে সে উপায় না দেখে বিজয়নগরের এই গলিতে ঢুকে পড়েছিল। একতলা একটা বাড়ির বন্ধ গেট টপকে সে প্রাণপণ শক্তিতে বাড়ির দরজায় ধাক্কা দিল। জানালার পর্দা সরিয়ে বাচ্চা একটা মেয়ে উঁকি দিল। ভীত গলায় বলল, কে, কে?

শাহেদ বলল, খুকি, তুমি আমাকে চিনবে না। দরজা খোলো।

দরজা খুলছে না। রাস্তায় গাড়ির শব্দ পাওয়া যাচ্ছে। শাহেদ বলল, খুকি। দরজা খোলো।

খুকির মা দরজা খুললেন। তিনি তার মেয়ের মতোই ভয় পেয়েছেন। তার চোখ-মুখ সাদা। তিনি ভয়ে কাঁপিছিলেন। খুঁকির মা বললেন, বাইরে কী হচ্ছে? শাহেদ বলল, শহরে মিলিটারি নেমে গেছে। সব জানালা বন্ধ করে বাতি নিভিয়ে দিন। বাতি জ্বেলে রেখেছেন কেন? বাড়ির ভেতর থেকে এক বৃদ্ধর শ্লেষ্মাজড়ানো গলা ভেসে এলো, বউমা, দরজা কেন খুললা? তুমি কার সাথে কথা বলো?

শাহেদ বৃদ্ধের কথার জবাব দিতে পারে নি। তার আগেই খুব কাছে কোথাও মটারের গোলা পড়ল। প্রথম গোলার পর দ্বিতীয় গোলা পড়ল। এবারেরটা যেন আরো কাছে। পুরো বাড়ি কেঁপে উঠল। বসার ঘরের দেয়ালে ঝুলানো বঁধানো সবকটা ছবি খুলে পড়ে গেল। ঝন ঝন শব্দ হতেই থাকল। কারেন্ট চলে গিয়ে বাড়ি অন্ধকার হয়ে গেল। বৃদ্ধ ভয় পেয়ে শিশুর মতো চোঁচাতে লাগলেন, ও বউমা। বউমা।। ও বউমা। তুমি কার সঙ্গে কথা বলো?

বাচ্চা মেয়েটা চিৎকার করে কাদছে। গুলির চেয়েও সে অন্ধকারকে ভয় পাচ্ছে। শাহেদ বলল, খুকি, তুমি যেখানে দাঁড়িয়ে আছ সেখানেই দাঁড়িয়ে থাক। নড়বে না। ঘর ভর্তি কাচের টুকরা।

দুঃসময় মানুষকে অতিদ্রুত দলবদ্ধ করে। অরণ্যচারী মানুষ হিংস্ৰ শ্বাপদের ইশারা পেলেই যুথবদ্ধ হতো। সভ্য মানুষের ভেতরেও হয়তো সেই স্মৃতি রয়ে গেছে। আজ এই ভয়াবহ সময়ে তারা চলে এসেছে কাছাকাছি।

মাত্র তিন ঘণ্টা পার হয়েছে–শাহেদ এই পরিবারটির সঙ্গে আছে। এই তিন ঘণ্টায় নিজেকে সে এই পরিবারের একজন সদস্য বলেই মনে করছে। ঢাকা কলেজের ইংরেজির অধ্যাপক সানাউল্লাহ সাহেবের স্ত্রীকে তার নিজের ছোটবোনের মতোই মনে হচ্ছে। সানাউল্লাহ সাহেবের বাবাকে সে ডাকছে। চাচাজান। সানাউল্লাহ সাহেবের মেয়েটি সারাক্ষণ তার আঙুল ধরে আছে। মেয়েটির নাম কংকন। সে কংকন বলতে পারে না, নাম জিজ্ঞেস করলে বলে ককন! মেয়েটির বয়স পাচের কাছাকাছি। এই বয়সে অনুস্বারের উচ্চারণ আয়ত্তে এসে যাওয়া উচিত। মেযেটি মনে হয় কথা বলায় পিছিয়ে আছে। শাহেদ নিতান্তই অপরিচিত একজন তারপরেও সে সানাউল্লাহ সাহেবের শোবার ঘরের খাটে অন্য সবার সঙ্গে বসে আছে।

কংকনের মায়ের নাম এখনো জানা যায় নি। তার শ্বশুর তাকে মানু ডাকছেন। মানু নিশ্চয়ই তার নাম না। বড় নাম ভেঙে আদর করে তিনি হয়তো পুত্রবধূকে ছোট নামে ডাকেন। বৃদ্ধ যে তার পুত্রবধূকে অত্যন্ত পছন্দ করেন তা তার কথাবার্তায় বোঝা যাচ্ছে। তবে তিনি কথার ফাঁকে ফাকে ধমক দিচ্ছেন। কংকনের মা তাতে বিচলিত হচ্ছেন না। কথায় কথায় শ্বশুরের ধমক খেয়ে তার হয়তো অভ্যাস আছে।
 

Users who are viewing this thread

Back
Top