What's new
Nirjonmela Desi Forum

Talk about the things that matter to you! Wanting to join the rest of our members? Feel free to sign up today and gain full access!

Collected ছোছনা ও জননীর গল্প - উপন্যাস (1 Viewer)

শাহেদ গায়ে পানি ঢালা বন্ধ করল। তার অতি ঘনিষ্ঠ বন্ধু নাইমুল। আজ রাতে তার বিয়ে–এই খবরটা জানানোর প্রয়োজনও সে বোধ করে নি। নাইমুল সবসময় এরকম। সে কি আসলেই এরকম, না-কি এটা তার এক ধরনের শো? সবাইকে জানানো— তোমরা আমাকে দেখ, আমি নাইমুল, আমি জীবনে কখনো কোনো পরীক্ষায় সেকেন্ড হই নি। আমি তোমাদের মতো না। আমি আলাদা।

শাহেদ!

বল।

মেয়ের নাম মরিয়ম। আমি ঠিক করেছি। শর্ট করে তাকে ডাকব মরি।

ভালো তো।

আমার শ্বশুরসাহেব পুলিশের লোক। তার নাম মোবারক হোসেন।

তুই কি সত্যিই আজ বিয়ে করছিস?

হ্যাঁ। আজ বিয়ে করাটাই আমার জন্যে সুবিধা। আজ বিশেষ দিন। ৭ই মার্চ। শেখ সাহেব স্বাধীনতার ঘোষণা দেবেন। এক সময় এই দিনটি আমাদের জাতীয় দিবস হয়ে যাবে। সরকারি ছুটি থাকবে। আমি আমার ম্যারেজ ডে কখনো ভুলব না। ভালো কথা, তুই কি শেখ সাহেবের ভাষণ শুনতে যাবি?

হ্যাঁ।

কী দরকার? রেডিওতে প্রচার হবে, রেডিও শোন। ক্রিকেট খেলা এবং ভাষণ–এইসব রেডিওতে শোনা ভালো।

শাহেদ বাথরুম থেকে বের হলো। নাইমুলের দিকে তাকিয়ে শান্ত গলায় বলল, গোসল করে আরাম পেয়েছি।

নাইমুল মুখের উপর ধরে রাখা বইয়ের পাতা উল্টাতে উল্টাতে বলল, আরাম পাবি জানতাম।

শাহেদ বলল, আমি এখন যাচ্ছি।

নাইমুল বিস্মিত গলায় বলল, যাচ্ছি মানে কী?

যাচ্ছি মানে যাচ্ছি।

ভাত খাবি না?

না।

তুই কি রাগ করে চলে যাচ্ছিস না-কি?

রাগ করব কেন? রাগ করার মতো তুই তো কিছু করিস নি।

এই যে তোকে কোনো খবর না দিয়ে বিয়ে করে ফেলছি। আসলে বিয়ের মতো পার্সেনাল কোনো ব্যাপার নিয়ে আমি ঢাক পিটাতে চাই না। এমন তো না যে তুই আমার স্বভাব জানিস না।

শাহেদ কিছু না বলে দরজার দিকে এগুচ্ছে। নাইমুল বলল, সাতটার আগে চলে আসিস, বরযাত্রী যাবি। ধীরেন স্যারের কাছে যাব। উনাকেও বলব, বরযাত্রী যেতে। আমার ধারণা স্যারকে বললেই তিনি যাবেন। তোর কী ধারণা?

শাহেদ জবাব না দিয়ে ঘর থেকে বের হয়ে গেল। সে আহত এবং অপমানিত বোধ করছে। নাইমুল তাকে খবর না দিয়ে বিয়ে করে ফেলছে? শাহেদের গা জ্বালা করছে।



শাহেদ রেসকোর্সের দিকে এগাচ্ছে! শেখ মুজিবুর রহমান রেসকোর্সের ময়দানে ভাষণ দেবেন। তিনি কী বলেন তা শোনা অতি জরুরি। ঘরে বসেও শোনা যেত, রেডিওতে ভাষণ প্রচার করা হবে। তবে কিছুই বলা যায় না। হঠাৎ হয়তো ভাষণ বন্ধ করে ইয়াহিয়া খান রাস্তায় মিলিটারি নামিয়ে দেবে। সেই প্রস্তুতি তাদের নেওয়া আছে। পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর বদল হয়েছে। ভাইস এডমিরাল এস এম আহসানের বদলে নতুন গভর্নর হয়ে এসেছে লেফটেন্যান্ট জেনারেল টিক্কা খান। টিক্কা খান, নামটাই তো ভয়াবহ। ইয়াহিয়া তাকে শুধু শুধু নিয়ে আসছে না। তার মাথায় অন্য পরিকল্পনা। যে-কোনো দিন এই পরিকল্পনার বাস্তবায়ন হবে। কী ভয়ঙ্কর যে হবে সেই দিন কে জানে! ড়ুমস ডে। দেশের বেশিরভাগ মানুষ ড়ুমস ডের ব্যাপারটা বুঝতে পারছে না। তারা কল্পনা করছে স্বাধীন দেশে বাস করছে। স্বাধীনতা এত সস্তা না।
 
রেসকোর্সের ময়দানে মানুষের স্রোত নেমেছে। তারা চুপচাপ চলে আসছে তা না। স্লোগান দিতে দিতে এগুচ্ছে–বীর বাঙালি অস্ত্র ধরো, বাংলাদেশ স্বাধীন করো। ভুট্টোর মুখে লাথি মারো, বাংলাদেশ স্বাধীন করো। পরিষদ না রাজপথ-রাজপথ, রাজপথ। তোমার আমার ঠিকানা–পদ্মা-মেঘনা-যমুনা। ঢাকায় যত মানুষ ছিল সবাই বোধহয় চলে এসেছে। লাখ লাখ মানুষ। যেদিকে চোখ যায়। শুধু মানুষের মাথা। অনেকে আবার বাচ্চাকাচ্চা সঙ্গে নিয়ে এসেছে। ঘোমটা দেওয়া বৌরাও আছে। তারা চোখ বড় বড় করে এদিক-ওদিক তাকাচ্ছে। বাবার ঘাড়ে বসে একটা বাচ্চা মেয়ে ট্যা ট্যা করে কাঁদছে। মেয়েটার মাথায় চুল বেণি করা। বেণির মাথায় লাল ফিতা বাধা। কাঁদতে কাঁদতে মেয়েটা মাথা ঝাকাচ্ছে। আর তার বেণি নাড়ছে। সুন্দর লাগছে দেখতে। শাহেদ মুগ্ধ চোখে মেয়েটির বেণি নাড়ানো দেখল। তার মনে হলো রুনিকে নিয়ে এলে হতো। তাকে ঘাড়ে বসিয়ে মানুষের সমুদ্রের এই অসাধারণ দৃশ্য দেখানো যেত। এই দৃশ্য দেখাও এক পরম সৌভাগ্য। পৃথিবীর কোথাও কি এত মানুষ কখনো একত্রিত হয়েছে?

ভাষণ শুরু হওয়ার আগে আগে দুটা হেলিকপ্টার উড়ে গেল। মানুষের সমুদ্রে একটা ঢেউ উঠল। চাপা আতঙ্কের ঢেউ। শাহেদের পাশে বুড়োমতো এক লোক দাঁড়িয়ে আছে, তার হাতে একটা ছাতা। ছাতাটাকে লাঠির মতো বাগিয়ে ধরে আছে সে, যেন এক্ষুণি যুদ্ধ শুরু হবে। সে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়বে ছাতা হাতে। বুড়ো শাহেদের দিকে তাকিয়ে হাসি হাসি মুখে বলল, আইজ শেখসাব স্বাধীন ডিক্লার দিব। বলেই সে থু করে পানের পিক ফেলল। সেই পিক পড়ল শাহেদের প্যান্টে। সাদা প্যান্টে লাল পানের পিক, মনে হচ্ছে রক্ত লেগে গেছে। শাহেদ কঠিন কিছু কথা বলতে যাচ্ছিল, তার আগেই ভাষণ শুরু হয়ে গেল। চারদিকে ভয়াবহ নীরবতা, লাখ লাখ মানুষ নিঃশ্বাস বন্ধ করে আছে। তারা তাদের মহান নেতার প্রতিটি শব্দ শুনতে চায়। কোনো কিছুই যেন বাদ না পড়ে। মাঝে মাঝে শেখ মুজিব দম নেবার জন্যে থামছেন আর তখনই আকাশ বাতাস কাপিয়ে ধ্বনি উঠছে–জয় বাংলা! জয। বাংলা!

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভরাট গলা ভেসে আসছে। মাথার উপরে চিলের মতো উড়ছে হেলিকপ্টার। শাহেদ ভাষণ শুনছে আকাশের দিকে তাকিয়ে। আজই ঘটে যাবে না তো? হয়তো আজই ফেলে দিল হেলিকপ্টার থেকে কিছু বোমা।

আজ দুঃখ ভারাক্রান্ত মন নিয়ে আপনাদের সামনে হাজির হয়েছি। আপনারা সকলে জানেন এবং বুঝেন আমরা আমাদের জীবন দিয়ে চেষ্টা করেছি। কিন্তু দুঃখের বিষয় রাজপথ রঞ্জিত হয়েছে। আজ বাংলার মানুষ বাঁচতে চায়, বাংলার মানুষ অধিকার চায়। কী অন্যায় করেছিলাম? নির্বাচনে বাংলাদেশের মানুষ সম্পূর্ণভাবে আমাকে ও আওয়ামী লীগকে ভোট দেন। আমাদের ন্যাশনাল এসেম্বলি বসবে, আমরা সেখানে শাসনতন্ত্র তৈরি করব এবং এ দেশের ইতিহাসকে আমরা গড়ে তুলব।…

হেলিকপ্টার বড় যন্ত্রণা করছে। এরা কী চাচ্ছে? বাচ্চা মেয়েটা কাঁদতে শুরু করেছে। মনে হয় সে ভয় পাচ্ছে।

ভাষণ শেষ হবার পর শাহেদ কি ফিরে যাবে বন্ধুর কাছে? আজ তার বিয়ে। সেই বিয়েতে শাহেদ অবশ্যই অনুপস্থিত থাকতে পারে না। তার উপর রাগ হচ্ছে। রাগ চাপ{ থাক। রাগ দেখানোর সময় আরো পাওয়া যাবে। এ-কী, সে ভাষণ না শুনে মনে মনে কী সব ভাবছে? নেতার প্রতিটি কথা খুব মন দিয়ে শুনতে হবে। এই ভাষণে অনেক সাংকেতিক নির্দেশও থাকতে পারে।

সৈন্যরা তোমরা আমার ভাই। তোমরা ব্যারাকে থাকো, তোমাদের কেউ কিছু বলবে না। কিন্তু আর তোমরা গুলি করার চেষ্টা করো না। সাত কোটি মানুষকে দাবায়ে রাখতে পারব না। আমরা যখন রক্ত দিতে শিখেছি তখন কেউ আমাদের দাবায়ে রাখতে পারবে না।

শাহেদ গভীর মনোযোগে বক্তৃতা শোনার চেষ্টা করছে। অতিরিক্ত মনোযোগের কিছু সমস্যা আছে–মাঝে-মাঝে সব আবছা হয়ে যায়। মানুষের মস্তিষ্ক এত মনোযোগ নিতে পারে না! সে কিছু সময়ের জন্যে বিশ্রাম নেয়।
 
অনেকক্ষণ কড়া নাড়ার পর দরজা খুলল। কোমরে ধুতি পেঁচানো খালি গায়ের যে মানুষটি দরজা খুললেন–তাঁর নাম ধীরেন্দ্রনাথ রায় চৌধুরী। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক সময়ের প্রফেসর এখন অবসর জীবনযাপন করছেন। সময় কাটছে বই পড়ে। সকালে নাশতা খেয়ে তিনি বই পড়া শুরু করেন। দুপুরের খাবারের পর কিছুক্ষণের জন্যে ঘুমুতে যান। ঘুম ভাঙার পর আবার বই পড়া শুরু হয়। শেষ হয় রাতে ঘুমুতে যাবার সময়। তাঁর অবসর জীবন বড়ই আনন্দে কাটছে।

নাইমুল নিচু হয়ে তার অতি পছন্দের মানুষের পা ছুঁয়ে কদমবুসি করতে করতে বলল, স্যার কি ঘুমাচ্ছিলেন? ঘুম থেকে তুললাম?

ধীরেন্দ্রনাথ রায় চৌধুরী আসলেই ঘুমুচ্ছিলেন। এই কথা শুনলে ছাত্র যদি অস্বস্তি বোধ করে সে কারণেই তিনি হাসিমুখে অবলীলায় মিথ্যা বললেন, আরে না। এই সময় কেউ ঘুমায় না-কি?

নাইমুল বলল, স্যার, আমাকে চিনতে পেরেছেন?

আরে চিনব না কেন? অবশ্যই চিনেছি। আসো, ভিতরে আসো। তুমি আছ কেমন, ভালো?

নাইমুল বলল, স্যার আজও যদি আমাকে চিনতে না পারেন, তাহলে ঘরে ঢুকব না। এর আগে যে কয়বার এসেছি, কোনোবারই আপনি আমাকে চিনতে পারেন নি। অথচ ভাব করেছেন যে চিনে ফেলেছেন।

অবশ্যই চিনেছি।

তাহলে আপনি আমার নাম বলুন।

দাঁড়াও, চশমাটা পরে আসি। চশমা ছাড়া দূরের জিনিস কিছুই দেখি না।

নাইমুল হাসিমুখে দরজা ধরে দাঁড়িয়ে রইল। ধীরেন্দ্রনাথ রায় চৌধুরী শোবার ঘর থেকে চশমা পরে এলেন এবং বেশ কিছুক্ষণ নাইমুলের দিকে তাকিয়ে বললেন, তোমার নাম শাহেদ। হয়েছে?

নাইমুল ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বলল, ফিফটি পারসেন্ট কারেক্ট হয়েছে স্যার।

তিনি বিস্মিত হয়ে বললেন, ফিফটি পারসেন্ট কীভাবে কারেক্ট হবে?

আমার নাম নাইমুল। আপনি শাহেদের নাম বলেছেন। শাহেদ আমার বন্ধু। তাকে নিয়ে আপনার কাছে তিন-চারবার এসেছি। আপনি শাহেদের নাম মনে রেখেছেন। অথচ সে আপনার ছাত্র না। আমি আপনার ডাইরেক্ট স্টুডেন্ট।

শাহেদ আছে কেমন?

ভালো আছে।

তাকে আনলে না কেন? তোমার এক আসা উচিত হয় নি। তাকে সঙ্গে করে আনা উচিত ছিল।

নাইমুল বলল, তাকে আনা উচিত ছিল কেন স্যার?

ধীরেন্দ্রনাথ রায় চৌধুরী তাঁর ছাত্রের দিকে তাকিয়ে বিব্ৰত ভঙ্গিতে হাসলেন। ছাত্ররা মাঝে-মাঝে তাকে খুবই বিব্রতকর অবস্থায় ফেলে।

নাইমুল, চা খাবে?

খাব।

যাও, রান্নাঘরে চলে যাও। পানি গরমে দাও। চায়ের সঙ্গে আজ তোমাকে অসাধারণ একটা জিনিস খাওয়াব। তিলের নাড়ু। তুমি কতক্ষণ থাকবে এখানে?

ঘণ্টাখানিক। আমি সাতটার সময় চলে যাব।

ঠিক আছে। কোনো অসুবিধা নেই।

আমি আপনার কাছে বিশেষ একটা কাজে এসেছি স্যার।

কী কাজ?

আমি বিয়ে করতে যাচ্ছি। আমার মুরুবি কেউ ঢাকায় নেই। আপনি আমার সঙ্গে গার্জিয়ান হিসেবে যাবেন।

ধীরেন্দ্রনাথ রায় চৌধুরী বললেন, অবশ্যই অবশ্যই।

অবশ্যই অবশ্যই বলা তার মুদ্রাদোষ। কোনো কথা না শুনেই তিনি বলেন অবশ্যই অবশ্যই। ইউনিভার্সিটিতে তার নাম ছিল অবশ্যই স্যার।

নাইমুল বলল, স্যার, আপনি কি আমার কথা মন দিয়ে শুনেছেন?

কোন কথার ব্যাপারে জানতে চাচ্ছ?

এই যে আমি বললাম, আমি বিয়ে করতে যাচ্ছি, আপনি আমার গার্জিয়ান।

অবশ্যই মন দিয়ে শুনেছি। এবং তোমাকে একটা সত্যি কথা বলি–এখন তোমাকে আমি চিনেছি। তুমি যখন বললে নাম নাইমুল, তখনো চিনতে পারি নি। এখন তোমার কথা বলার ধরন থেকে চিনেছি। তুমি তো কমনওয়েলথ স্কলারশিপ পেয়েছ?

জি স্যার। এবারডিন ইউনিভার্সিটিতে আমার প্লেসমেন্ট হয়েছে শুধুমাত্র আপনার একটা চিঠির কারণে।

ধীরেন্দ্রনাথ রায় চৌধুরী বিস্মিত হয়ে বললেন, চিঠি কখন লিখলাম?
 
চা খেতে খেতে নাইমুল স্যারের সঙ্গে গল্প শুরু করল। গল্প করার সময় সাধারণত মুখোমুখি বসা হয়। ধীরেন্দ্রনাথ রায় চৌধুরীর বিচিত্র স্বভাবের একটি হচ্ছে, তিনি তার ছাত্রদের সঙ্গে গল্প করার সময় তাদের নিজের বা পাশে বসান! এবং বেশিরভাগ সময় তাঁর বাঁ হাত ছাত্রের পিঠের উপর রাখেন। নাইমুলের ধারণা–স্যার মুখ দেখেন না বলেই ছাত্রদের কখনোই চিনতে পারেন না। তবে যে-কোনো ছাত্রের পিঠে হাত দিয়ে তিনি নাম বলতে পারবেন।

স্যার, আমি একটা বিশেষ দিনে বিয়ে করছি। সেটা কি বুঝতে পারছেন?

বিশেষ দিনটা কী?

আজ সাতই মার্চ।

সাতই মার্চ বিশেষ দিন কেন?

স্যার, আপনি নিজে একটু চিন্তা করে বলুন তো সাতই মার্চ কেন বিশেষ দিন।

ধীরেন্দ্রনাথ রায় ভুরু কুঁচকে সামান্য চিন্তার ভেতর দিয়ে গেলেন। নাইমুলের দিকে তাকিয়ে বললেন, সাত হলো একটা প্ৰাইম নাম্বার। মৌলিক সংখ্যা। মার্চ মানে তিন। তিন আরেকটা প্ৰাইম নাম্বার। এই জন্যেই দিনটা বিশেষ দিন। হয়েছে?

হয় নি স্যার। আজ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান স্বাধীনতার ঘোষণা দিবেন। হয়তো ইতিমধ্যে দিয়েও ফেলেছেন।

স্বাধীনতার ঘোষণা? বলো কী? ইন্টারেষ্টিং তো!

যদিও তিনি যথেষ্ট আগ্রহের সঙ্গে বললেন, ইন্টারেস্টিং তো, নাইমুল জানে তিনি মোটেই ইন্টারেস্ট পাচ্ছেন না। এই মানুষটার কাছে পদার্থবিদ্যার যেকোনো সমস্যা জাগতিক সমস্যার চেয়ে অনেক বেশি ইন্টারেটিং।

নাইমুল বলল, দেশ, রাজনীতি–এইসব নিয়ে আপনি কি কখনোই কিছু ভাবেন না?–

কে বলল ভাবি না? ভাবি তো। প্রায়ই ভাবি।

মোটেও ভাবেন না। আপনার সমস্ত ভুবন জুড়ে আছে কোয়ান্টাম বলবিদ্যা। আপনি এর বাইরে কোনো কিছু নিয়েই ভাবেন না।

সেটা কি দোষের?

জি স্যার দোষের। আপনি দেশ বা রাজনীতির বাইরের কেউ না। আপনি সিস্টেমের ভেতর আছেন।

ধীরেন্দ্রনাথ রায় চৌধুরী শান্ত গলায় বললেন, নাইমুল, তোমার কথার কাউন্টার লজিক কিন্তু আছে। সবার কাজ কিন্তু ভাগ করা। একদল মানুষ যুদ্ধ করবেন, তারা যোদ্ধা। একদল রাজনীতি করবেন। তারা সেটা বুঝেন। অর্থনীতিবিদেরা দেশের অর্থনীতি নিয়ে ভাববেন। আমি কোয়ান্টাম বলবিদ্যার লোক, আমি সেটা নিয়ে ভাববা। তুমি যে সিস্টেমের কথা বললে–এসো সেই সিস্টেম সম্পর্কে বলি। সিস্টেম কী? সিস্টেম হলো, Observable part of an experiment, একগ্লাস পানিতে আমি এক চামচ সোডিয়াম ক্লোরাইড দিয়ে দিলাম। এখন আমার সিস্টেম হলো, গ্লাসে রাখা লবণের দ্রবণ। তর্কের খাতিরে ধরে নেই এটা একটা closed System.

ধীরেন্দ্রনাথ রায় চৌধুরী প্রবল আগ্রহে বক্তৃতা করে যাচ্ছেন। তাঁর বক্তৃতার ভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে, তিনি একগাদা ছাত্ৰ-ছাত্রীর সামনে কোয়ান্টাম বলবিদ্যার অতি জটিল কোনো বিষয় ব্যাখ্যা করছেন। নাইমুল এক ফাঁকে ঘড়ি দেখল। হাতে সময় আছে। স্যারকে মনের আনন্দে আরো কিছুক্ষণ কথা বলার সুযোগ দেয়া যেতে পারে। এই মানুষটার আত্মীয়স্বজন কেউ নেই। সবাই হয ইন্ডিয়া কিংবা আমেরিকায় চলে গেছে। এই মানুষটা, ওয়ারির তিন কামরার ছোট্ট বাড়ি কামড়ে পড়ে আছে। তাঁর একটাই কথা–নিজের বাড়ি-ঘর দেশ ছেড়ে আমি যাব কোথায়? আমি কেন ইন্ডিয়াতে যাব? আমার জন্ম হয়েছে এই দেশে। দেশ ছেড়ে চলে যাব? আমি কি দেশের এত বড় কুসন্তান?

ধীরেন্দ্রনাথ রায় চৌধুরী তাঁর বিখ্যাত ভোকসওয়াগন গাড়ি বের করলেন। নাইমুল বলল, রিকশায় করে গেলে কেমন হয় স্যার?

রিকশায় করে যাবে কেন? আজি তোমার বিয়ে।

আপনার সঙ্গে গাড়িতে করে যেতে ভয় লাগে স্যার। আপনি নিজের মনে গাড়ি চালান। রাস্তার দিকে তাকান না।

ধীরেন্দ্রনাথ রায় চৌধুরী বিস্মিত হয়ে বললেন, নাইমুল, আমার সম্পর্কে তোমাদের ভুল ধারণা আছে। আমি অত্যন্ত সাবধানী চালক। এখন পর্যন্ত আমি গাড়িতে কোনো একসিডেন্ট করি নি।

গাড়িতে একসিডেন্ট করেন নি, তার কারণ কিন্তু স্যার আপনার ড্রাইভিং না।

তাহলে কী?

আপনি গাড়ি নিয়ে কখনো বের হন না। ঘরেই থাকেন। আমি নিশ্চিত, আপনি গত তিন মাসে আজ প্ৰথম গাড়ি বের করেছেন।

ধীরেন্দ্রনাথ রায় চৌধুরী বিরক্ত গলায় বললেন, তুমি তর্ক-প্রিয় হয়ে যাচ্ছ। তর্ক ভালো জিনিস না।
 
গাড়িতে উঠেই তাঁর বিরক্তি অতি দ্রুত কেটে গেল। তিনি গভীর আগ্রহে Kaluza-klein theory সম্পর্কে বলতে লাগলেন। নাইমুল, মন দিয়ে শোন কী বলি–Kaluza তাঁর পেপার পাঠালেন আইনস্টাইনের কাছে। তারিখটা মনে রাখ–এপ্রিলের একুশ, সনটা খেয়াল করো-উনিশ শ উনিশ। Kaluza সেই পেপারে পাঁচটা ডাইমেনশনের কথা প্ৰথম বললেন। এর আগে আইনষ্টাইন চারটা ডাইমেনশনের কথা বলেছিলেন। Kaluza কী করলেন–ডাইমেনশন একটা বাড়ালেন। আইনস্টাইন বলেছিলেন–না, পেপার গ্রহণযোগ্য না।

নাইমুল বলল, স্যার, আপনি রাস্তার দিকে তাকিয়ে গাড়ি চালাচ্ছেন না। আমার দিকে তাকিয়ে চালাচ্ছেন।

আমি ঠিকই গাড়ি চালাচ্ছি–তুমি মন দিয়ে শোন কী বলছি। অক্টোবরের ১৪ তারিখ উনিশ শ একুশ সনে ঠিক দুবছর পর আইনস্টাইন তার মত বদলালেন। তিনি Kaluza-র পেপার একসেপ্ট করলেন। অরিজিনাল সেই পেপার আমি জোগাড় করেছি। পেপারটা জার্মান ভাষায়। আমার এখন দরকার ভালো জার্মান জানা লোক। তোমার খোজে কি জার্মান জানা লোক আছে?

নাইমুলের মজা লাগছে। কী অদ্ভুত মানুষ! জগতের কোনো কিছুর সঙ্গেই এই মানুষটির যোগ নেই। রাস্তায় জনস্রোত। অদ্ভুত অদ্ভুত স্লোগান হচ্ছে

ইয়াহিয়া ভুট্টো দুই ভাই
এক দড়িতে ফাঁসি চাই।

ইয়াহিয়ার চামড়া
তুলে নিব আমরা।

বীর বাঙালি অস্ত্র ধরো
ইয়াহিয়াকে খতম করো।

অথচ ধীরেন্দ্রনাথ রায় চৌধুরীর দৃষ্টি একবারও সেদিকে যাচ্ছে না। তাঁর জগৎ Kaluza-র পঞ্চম ডাইমেনশনে আটকে গেছে।

নাইমুল!

জি স্যার।

তুমি সত্যি সত্যি একা বিয়ে করতে যাচ্ছ–এটা খুবই আশ্চর্যজনক ঘটনা।

একা তো যাচ্ছি না। আপনিও যাচ্ছেন। আমি আমার দুজন আত্মীয়কেও খবর দিয়েছি, তারাও চলে আসবেন। সরাসরি মেয়ের বাড়িতে চলে যাবেন।

তাহলে বরযাত্রীর মোট সংখ্যা দাঁড়াল চার। আরেকজন হলে ভালো হতো।

ভালো হতো কেন স্যার? Kaluza সাহেবের থিওরিতে পাঁচটা ডাইমেনশন, আমার বিয়েতেও বরযাত্রী পাঁচজন এই কারণে?

ঠিক ধরেছ। তোমার বুদ্ধি ভালো। আমি তোমার বুদ্ধি দেখে খুশি হয়েছি।

ধীরেন্দ্রনাথ রায় চৌধুরী ছাত্রের বুদ্ধিতে এতই খুশি হলেন যে গাড়ি নিয়ে রাস্তার পাশের নর্দমায় পড়ে গেলেন।

অনেক ঠেলা ঠেলি করেও গাড়ি সেখান থেকে উঠানো গেল না। তিনি হতাশ গলায় ছাত্রকে বললেন, তোমার দেরি হয়ে যাচ্ছে। তুমি একটা রিকশা করে চলে যাও। আমাকে ঠিকানা দিয়ে যাও। আমি গাড়ি উঠানোর ব্যবস্থা করে চলে আসব।

নাইমুল বলল, আমি আপনাকে রেখে একা একা চলে যাব?

অবশ্যই যাবে। তুমি হচ্ছি। বর। সবাই তোমার জন্যে অপেক্ষা করছে। তোমার দেরি হলে সবাই দুশ্চিন্তা করবে। বিশেষ করে মেয়েটি। তুমি যাও তো। এটা তোমার প্রতি আমার আদেশ। ঠিকানাটা বলো, আমি মুখস্থ করে রাখি।

নাইমুল চলে যাবার পরপরই লোজজন মিলে ঠেলে তাঁর গাড়ি তুলে দিল। ধীরেন্দ্রনাথ রায় চৌধুরী ছাত্রের দেয়া ঠিকানায় রওনা হলেন। তাকে নাইমুল বলেছে ১৮নং সোবহানব গ। কিন্তু তিনি চলে গেলেন চামেলীবাগে। অনেক রাত পর্যন্ত তিনি চামেলীবাগের আঠারো নম্বর দোতলা বাড়ি খুঁজতে লাগলেন। যে বাড়ির গেট হলুদ রঙের। বাড়ির সামনে দুটা কাঁঠাল গাছ আছে।
 
০৯.
মরিয়ম কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছে না–তার বিয়ে হয়ে গেছে। তার যেন কেমন লাগছে। গা হাত পা কাঁপছে। বুকে ধুকধুক শব্দ হচ্ছে। প্রচণ্ড পানির পিপাসা হচ্ছে কিন্তু এক চুমুক পানি খেলেই পিপাসা চলে যাচ্ছে। পানি খেতে আর ভালো লাগছে না। কিছুক্ষণ পর আবার পিপাসা হচ্ছে। সে নিজের কপালে হাত দিল। গায়ে কি জ্বর আছে? জ্বরের সময় এরকম উল্টাপাল্টা লাগে। না জ্বর তো নেই। কপাল ঠাণ্ডা।

কী আশ্চর্য! বসার ঘরে যে লম্বা রোগা ছেলেটি বসে আছে, সে তার স্বামী। যাকে সে আগে কোনোদিন দেখে নি, যার সঙ্গে কোনো কথা হয় নি। মাত্র পনেরো মিনিট আগে থেকে সে তার জীবনের সবচে ঘনিষ্ঠজন। বিয়ে নামক অদ্ভুত একটা ঘটনায় আজ রাত আটটা সাত মিনিট থেকে দুজন শুধু দুজনের।

মরিয়ম তার স্বামীকে এখনো ভালোমতো দেখে নি। দূর থেকে আবছাভাবে দেখেছে। তার খুবই ইচ্ছা করছে কাছ থেকে দেখতে। তার চোখ দুটা কেমন? বিড়াল-চোখা না তো? বিড়াল-চোখা মানুষের চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বলা যায় না। কথা বললে মনে হয় বিড়ালের সঙ্গে কথা বলা হচ্ছে। এই বুঝি মানুষটা মিউ করে উঠবে। তার কি জোড়া ভুরু? জোড়া ভুরুর মানুষ মরিয়মের খুব অপছন্দ। যার যা অপছন্দ তাই সে পায়। দেখা যাবে নাইমুল নামের মানুষটার জোড়া ভুরু। আচ্ছা থাকুক জোড়া ভুরু। কপালে যা থাকে তাই তো হবে। বিয়ে হলো কপালের ব্যাপার।

একটু আগে তার সবচে ছোটবোন মাফরুহা এসে বলল, বুকু, তোমার বর খুব সুন্দর। মরিয়মের ইচ্ছে করছিল। জিজ্ঞেস করে–তোর দুলাভাইয়ের জোড়া ভুরু না-কি? চট করে দেখে আয় তো। লজ্জায় প্রশ্নটা সে করতে পারে নি।

মাফরুহা বলল, দুলাভাই কিন্তু রাতে থাকবে না। এখনই চলে যাবে।

মরিয়মের বুক ধক করে উঠল। সে এখনো দেখলই না, তার আগেই চলে যাবে? এমন ঘটনা কি এর আগে কখনো ঘটেছে–বর এসে বিয়ে করেই উধাও হয়ে গেছে? মরিয়মের মনটা খারাপ হয়ে গেল। সে অবশ্যি অবহেলার ভঙ্গিতে বলল, চলে গেলে চলে যাবে। আমার কী? যাবে কখন?

দুলাভাইয়ের ছোট চাচা তো এক্ষুনি চলে যাবেন বলছেন। উনি নারায়ণগঞ্জ থাকেন। অনেক দূর যেতে হবে। তাঁর সঙ্গে দুলাভাইও চলে যাবেন কি-না বুঝতে পারছি না। দুলাভাই কিছু বলছেন না।

মরিয়ম বলল, দুলাভাই দুলাভাই করছিস কেন? শুনতে বিশ্ৰী লাগছে। চেনা নেই, জানা নেই একটা মানুষ।

কথাটা মরিয়মের মনের কথা না। ছোট বোনের মুখে দুলাভাই ডাকটা শুনতে তার খুবই ভালো লাগছে। কী সুন্দল টেনে টেনে বলছে— দু—লা ভাই।

মাফু, দেখ তো আমাকে কি বিয়ের শাড়িতে মানিয়েছে? (ছোট বোনকে মরিয়ম আদর করে মাফু ডাকে)

মাফরুহা বলল, তোমাকে খুবই সুন্দর লাগছে।

খোঁজ নিয়ে আয় তো ওরা সত্যি সত্যি চলে যাচ্ছে কি-না। ওরা চলে গেলে মা যে এত রান্নাবান্না করেছেন সেগুলি কে খাবে? মাসুমা সন্ধ্যা থেকে চুলার পাড়ে বসে আছে। তার কষ্ট হচ্ছে না?

মাফরুহ খোঁজ নিতে গেল। মরিয়াম দাড়ালো আয়নার সামনে। সে আগেও কয়েকবার দাঁড়িয়েছে। প্ৰতিবারই নিজেকে সুন্দর লেগেছে। এখন মনে হয়। একটু বেশি সুন্দর লাগছে। অথচ খুবই সাধারণ শাড়ি। ওরা নিয়ে এসেছে। সবুজ রঙের শাড়ি। ভাগ্যিস কাঢ়া সবুজ না। গ্রামের মেয়েরাই শুধু কটকট কড়া রঙের সবুজ শাড়ি পরে। শাড়ি যত সাধারণই হোক মরিয়ম ঠিক করে রেখেছে, এই শাড়ি সে খুব যত্ন করে রাখবে। প্রতি বছর ৭ মার্চ বিয়ের দিনে এই শাড়ি সে পরবে। তার মেয়েরা বড় হলে মায়ের বিয়ের শাড়ি দেখতে চাইবে। মেয়েদের কেউ একজন হয়তো বলবে, তোমার বিয়ের শাড়ি এত সস্তা কেন মা? এ তো সত্যি ক্ষেত শাড়ি। পরলে মনে হবে ধানক্ষেত।

তখন মরিয়ম বলবে, আমাদের খুব তাড়াহুড়াল বিয়ে হয়েছিল। দেশজুড়ে তখন অশান্তি। তোর বাবার হাতে বোনো টাকা-পয়সা নেই। সে তার দূরসম্পর্কের এক চাচা এবং এক ফুফাকে নিয়ে এসেছিল। সন্ধ্যাবেল বাসায় এসেছে, তখনো আমি জানি না যে আমার বিয়ে।

মা, তোমার বিয়েতে কোনো উৎসব হয় নি?

না।

গায়েহলুদ-টলুদ কিছুই হয় নি?

না, সে-রকম করে হয় নি। তবে শাড়ি পরার আগে গোসল করলাম, তখন তোর ছোট খালা আমার গালে এক গাদা হলুদ মেখে দিল। মসলা পেষার পাটায় হলুদ পেষা হয়েছিল। শুকনা মরিচের ঝাল চোখে লেগে গেল। কী জুলুনি! চোখ দিয়ে সমানে পানি পড়ছে, আর সবাই ভাবছে বিয়ে হয়ে যাচ্ছে এই জন্যে কাদছি।

তোমার কান্না পাচ্ছিল না?

না।

বিয়ের দিন সবারই কান্না পায়। তোমার পাচ্ছিল না কেন মা?

জানি না। তখন সময়টা তো অন্যরকম ছিল। প্ৰতিদিন মিটিং মিছিল, পুলিশের গোলাগুলি, কাফু–এই জন্যেই বোধহয়।

বাবাকে প্রথম দেখে কি তোমার ভালো লেগেছিল মা?

না দেখেই ভালো লেগেছিল।

সেটা কেমন কথা! না দেখে ভালো লাগে কীভাবে?

তুই যা তো। তোকে এত কিছু ব্যাখ্যা করতে পারব না।

মরিয়মের ধারণা তার মেয়ে ধমক খেয়েও যেতে চাইবে না। সে চোখ বড় বড় করে তার বাবা-মার বিয়ের গল্প শুনতে চাইবে। সেটাই স্বাভাবিক। মেয়েরা মায়ের বিয়ের গল্প খুব আগ্রহ করে শোনে।
 
নাইমুলের সঙ্গে বরযাত্রী মাত্র দুজন। তার দূরসম্পর্কের চাচা হাফিজুদিন এবং তার ফুপা হামিদুল ইসলাম। এরা দুজনই থাকেন নারায়ণগঞ্জে। কাজি সাহেব বিয়ে পড়ানো শেষ করতেই দুজনই অতি ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন চলে যাবার জন্যে। লক্ষণ খারাপ। শেখ সাহেবের ভাষণ রেডিওতে প্রচার করে নাই। ভাষণের বদলে অন্য কোনো অনুষ্ঠানও নাই। রেডিও নীরব। মিলিটারিরা হয়তো রেডিও স্টেশনের দখল নিয়ে নিয়েছে। এখন হয়তো রাস্তাঘাটের দখল নিবে। যত তাড়াতাড়ি বাড়িতে পৌছানো যায় ততই ভালো।

মুসলেম উদ্দিনও চলে যেতে চাচ্ছেন। ঝামেলার সম্ভাবনা যেহেতু আছে তাড়াতাড়ি চলে যাওয়াই তো ভালো। তিনি যাবেন যাত্রাবাড়ি। নারায়ণগঞ্জ যাবার পথেই যাত্রাবাড়ি পড়বে। এক সঙ্গে চলে যাওয়া যায়। এখন সময় এমন যে চলে যাওয়াই ভালো। মুসলেম উদ্দিন বললেন, ঘণ্টাখানিক অপেক্ষা করলে খানা দিয়ে দেয়া যাবে। মরিয়মের মা একা মানুষ, সব সামাল দিতে পারছে না। আমি খবর নিয়েছি পোলাও চুলায় বসানো হয়েছে। (কথা সত্যি নয়। পোলাওএর চাল আনতে দোকানে লোক গেছে। আগে যে কালিজিরা চাল আনা হয়েছিল, সে চাল থেকে পচা গন্ধ বের হচ্ছে।)

হাফিজুদিন বললেন, সম্পর্ক যখন হয়েছে অনেক খাওয়া ইনশাল্লাহ হবে। আজ বিদায় দিয়ে দেন। মেয়ের বাবাকে ডাকেন, উনার কাছ থেকে বিদায় নিই।

মুসলেম উদ্দিন বললেন, আমার ভাগ্নে তো কিছুক্ষণ আগে চলে গেছে। অফিসের ডাক পড়েছে। বুঝেন না–ডাক পড়লে সঙ্গে সঙ্গে চলে যেতে হয়। বড়ই কঠিন চাকরি।

হামিদুল ইসলাম গম্ভীর গলায় বললেন, বেয়াই সাহেব তো আমাদের কাছ থেকে বিদায়ও নিলেন না। অবশ্য আমরা তুচ্ছ মানুষ। আমরা কোনো কঠিন চাকরি করি না। দুই পয়সার ব্যবসায়ী।

মুসলেম উদ্দিনকে অবস্থা সামলাবার জন্যে হড়বড় করে অনেক কথা বলতে হলো। তাতে তেমন লাভ হলো না। দুজনই এমন ভাব করতে থাকেন যেন তাদের বিরাট অপমান করা হয়েছে। অপমান যেহেতু করা হয়েছে সেহেতু না খেয়ে উঠে যাওয়ার ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে।

মোবারক হোসেন ঘরেই আছেন। তিনি কিছুক্ষণ আগে মুসলেম উদ্দিনকে আড়ালে ডেকে নিয়ে বলেছেন–বিয়ে তো হয়েছে, এখন আর ঘাটর ঘটর আমার ভালো লাগছে না। এদের বিদায় করেন। ছেলেকেও চলে যেতে বলেন। পরে একটা তারিখ করে তারা বউ উঠিয়ে নিবে।

মুসলেম উদ্দিন বললেন, না খাইয়ে তো বিদায় করতে পারি না।

খাওয়ান। আমাকে আর এর মধ্যে ডাকবেন না। আমি আর আসব না। আমার নিজের শরীর ভালো না। ইয়াহিয়ারও এসেছে জ্বর। অসুখ-বিসুখের মধ্যে বিয়ের যন্ত্রণা অসহ্য লাগছে।

বরযাত্রী দুজনই চলে গেছেন, মুসলেম উদ্দিনও তাদের সঙ্গে গেছেন। কাজি সাহেব আগেই গেছেন। তাঁর না-কি আজ আরেকটা বিয়ে পড়াতে হবে। নাইমুল বসার ঘরে একা বসে আছে। কিছুক্ষণ মাফরুহা ছিল। এখন সেও চলে গেছে। তার দায়িত্ব পড়েছে বাবার মাথার চুল টেনে দেবার। কাজটা সে করছে খুব ভয়ে ভয়ে। একটু জোরে টান লাগলে সে ধমক খাবে, আবার আস্তে টানলেও ধমক খাবে।

মেজ বোন মাসুমা রান্নাঘরে। আসকের রান্নাবান্না সে-ই করছে। সাফিয়া ইয়াহিয়াকে কোলে নিয়ে রান্নাঘরের বারান্দায় আছেন। মাঝে-মাঝে রান্নাঘরে ঢুকে মাসুমাকে কী করতে হবে তা বলে দিচ্ছেন। প্রবল জ্বর আসার কারণে ইয়াহিয়া খুবই কান্নাকাটি করছে; মার কোল থেকে একেবারেই নামতে চাচ্ছে না।

মাসুম বলল, মা, তোমার রান্নাঘরে আসার দরকার নাই। আমি পারব। তুমি বাবুর মাথায় পানি ঢালার ব্যবস্থা করো।

পানি ঢালব?

জ্বর এত বেশি, পানি ঢালবে না?

তোর বাবা যদি আবার রাগ করে! আরেকবার জ্বরের সময় পানি দিয়েছিলাম, তোর বাবা খুব রাগ করেছিল। এতে না-কি ঠাণ্ডা লেগে নিউমোনিয়া হয়।

বাবা যাতে জানতে না পারে। সেইভাবে পানি ঢাল।

তুই একটু সরে বোস না মা। কাপড়ে আগুন লেগে যাবে তো।
 
মাসুমা সরে বসল। তার হঠাৎ মনে হলো, তাদের এই সৎমা আসল মায়ের চেয়েও ভালো হয়েছেন। নিশ্চয়ই তারা তিনবোন খুব বড় ধরনের কোনো পুণ্য করেছে, যে কারণে আল্লাহ তাদের উপহার হিসেবে এমন একজন মা পাঠিয়ে দিয়েছেন।

না।

হুঁ।

দুলাভাই কি একা বসে আছেন?

হুঁ। এতক্ষণ মাফরুহা ছিল। এখন সে একা।

আহা বেচারা, বিয়ে করতে এসে কেউ এতক্ষণ একা একা বসে থাকে না। মা, এক কাজ করো, বুকুকে পাঠিয়ে দাও। বুৰু গল্প করুক।

তোর বাবা যদি রাগ করে?

বুবুর সঙ্গে বেচারার ভাব হবে না?

রান্না হোক, তখন খাবার দিয়ে মরিয়মকে পাঠাব। তাহলে তোর বাবা কিছু বলতে পারবে না।

দুলাভাই দেখতে রাজপুত্রের মতো, তাই না মা?

হুঁ। মরিয়মের খুব পছন্দ হবে।

বুবুর কথা বাদ দাও মা। রাস্তা থেকে কালু গুণ্ডাকে ধরে এনে যদি বুবুর বিয়ে দাও, বুবু তাকেও অন্তর দিয়ে ভালোবাসবে। মুগ্ধ গলায় বলবে, আমি সারা জীবন এরকম একজন গুণ্ডাই চেয়েছিলাম। ঠিক বলেছি না মা?

মনে হয় ঠিকই বলেছিস।

আমি কিন্তু বুবুর মতো না। আমার পছন্দ অনেক কঠিন।

একেক বোন একেক রকম হবি।–এটাই তো স্বাভাবিক।

আর এরকম আধাখেচড়া বিয়েও আমি করব না। আমার বেনারসি শাড়ি লাগবে। গা ভর্তি গয়না লাগবে। হুট হাটের বিয়ের মধ্যে আমি নাই।

চুলার আগুন কমিয়ে দে। আগুন বেশি।

মাসুমা চুলার আগুন কমাতে কমাতে বলল, আচ্ছা মা, বাবা আমাদের তিনবোনকে সহ্যই করতে পারে না। কেন বলে তো?

সহ্য করতে পারবে না কেন! তোদের জন্যে উনার খুব দরদ। মানুষটা অন্যরকম তো, প্ৰকাশ পায় না।

খুব দরদ থাকলে কি আর….

মাসুমা কথা শেষ করতে পারল না। বাবু আবারো হাত-পা ছুঁড়ে কাঁদতে শুরু করেছে। সাফিয়া তাকে বাথরুমে নিয়ে গেলেন। চুপিচুপি তার মাথায় পানি ঢালবেন।



রাত দশটা বাজে।

নাইমুলকে খেতে দেয়া হয়েছে। খাবার নিয়ে ঢুকেছে। মরিয়ম। তার হাত কাঁপছে। মনে হচ্ছে এক্ষুনি হাত ফসকে কোরমার বাটিটা মেঝেতে পড়ে যাবে।

নাইমুল তার দিকে তাকিয়ে বলল, মরিয়ম, কেমন আছ?

মরিয়মের শরীরে ঝিম ধরে গেল। এত সুন্দর গলার স্বর! আর কী আদর করেই না মানুষটা জিজ্ঞেস করেছে–মরিয়ম কেমন আছ? মরিয়মের খুব ইচ্ছা! করছে বলে, আমি ভালো আছি। তুমি কেমন আছ? প্রথম থেকেই তুমি করে বলা। একবার আপনি শুরু করলে তুমিতে আসতে কষ্ট হয়। তার এক বান্ধবী, নাম জসি, বিয়ের পরে প্রথম প্রথম স্বামীকে আপনি বলতে শুরু করেছিল। এখন আর তুমি বলতে পারছে না। এই ভুল মরিয়ম করতে রাজি না। সে শুরু থেকেই তুমি বলবে।

কিন্তু কথা বলবে কী, মরিয়মের গলা দিয়ে কোনো শব্দই বের হচ্ছে না। গলার কাছে কী যেন দলা পাকিয়ে আছে। নাইমুল বলল, তোমার নামটা এমন যে ছোট করে ডাকব সে উপায় নেই। ছোট করে ডাকলে তোমাকে ডাকতে হয় মারি। সেটা নিশ্চয় তোমার ভালো লাগবে না।

মরিয়ম মনে মনে বলল, যা ইচ্ছা তুমি আমাকে ডাক। তুমি যাই ডাকবে আমার ভালো লাগবে।

নাইমুল বলল, খাবার তুলে দিতে হবে না। আমি নিয়ে নিচ্ছি। তুমি চুপ করে বসো। তোমাকে খুব জরুরি কিছু কথা বলা দরকার। মেঝের দিকে তাকিয়ে আছ কেন? আমার দিকে তাকিয়ে কথা শোনো। জরুরি কথা শুনতে হলে চোখের উপর চোখ রাখতে হয়।

মরিয়ম চোখের উপর চোখ কীভাবে রাখবো? তার কেমন জানি লাগছে। মানুষটার কোনো কথাই এখন তার কানে ঢুকছে না।


মরিয়ম শোনো, তুমি নিশ্চয়ই আমাকে একটা লোভী মানুষ ভাবছ। কারণ তোমার বাবার কাছ থেকে আমি এগারো হাজার টাকা নিয়েছি। আমার কিছু ঋণ আছে যে ঋণ শোধ না করলেই না। তিন হাজার টাকা ঋণ। আর বাকি টাকাটা আমি নিয়েছি আমেরিকার টিকিট কেনার জন্যে। আমি একটা টিচিং এসিস্ট্যান্টশিপ পেয়েছি। স্টেট ইউনিভার্সিটি অব মোরহেড। নর্থ ডেকোটা। ওরা আমাকে মাসে চারশ ডলার করে দেবে। তবে আমেরিকা যাবার টিকিটের টাকা দেবে না। টাকাটা এইভাবেই আমার জোগাড় করতে হয়েছে।

কবে যাবেন?

কথাটা বলেই মরিয়মের ইচ্ছা করল নিজের গালে সে একটা চড় মারে। সে তো জসির মতোই আপনি শুরু করেছে।

নাইমুল বলল, আমার স্টুডেন্ট ভিসা হয়ে গেছে। এখন আমি যে-কোনো দিন যেতে পারি। আমি ব্যাপারটা কাউকে বলি নি, কারণ আগ বাড়িয়ে কিছু বলতে আমার ভালো লাগে না। মরিয়ম শোনো, আমি অবশ্যই আমেরিকায় পৌঁছেই তোমার বাবার টাকাটা ফেরত পাঠাব। তোমাকে কথাটা বললাম যাতে তোমার মন থেকে মুছে যায় যে আমি একটা খারাপ মানুষ।

মানুষটা কথা বলা বন্ধ করে এখন তার দিকে তাকিয়ে আছে। অন্য সময় যে-কোনো পুরুষমানুষ তার দিকে তাকালে গা ঘিনঘিন করত। এখন এত ভালো লাগছে! ইশ, তার গায়ের রঙটা যদি আরেকটু ফরসা হতো!

মরিয়ম!

জি।

রান্না খুব ভালো হয়েছে, আমি খুব আরাম করে খেয়েছি। কে রেঁধেছেন, তোমার মা?

জি।

আমি এখন চলে যাব। রাত অনেক হয়ে গেছে।

মরিয়ম নাইমুলকে চমকে দিয়ে হঠাৎ ঘর থেকে বের হয়ে গেল। যেন ভয়ঙ্কর জরুরি কোনো কাজ তাকে এই মুহুর্তেই করতে হবে।

সাফিয়া বারান্দায় বসে ছিলেন। বাবুকে মাসুমার কোলে দিয়ে এসেছেন। সারাদিনে খুব ধকল গেছে। তার নিজের শরীর এখন প্রায় নেতিয়ে পড়েছে। সাফিয়াকে চমকে দিয়ে মরিয়ম ঝড়ের মতো বারান্দায় এসে উপস্থিত হয়ে চাপা গলায় বলল, মা, আমি উনাকে এত রাতে এক ছেড়ে দেব না। কোনো মতেই r

মরিয়ম এসেছে যেমন ঝড়ের মতো কথাবার্তাও বলছে ঝড়ের মতো। সাফিয়া বুঝতেই পারছেন না প্ৰসঙ্গটা কী? মরিয়ম বলল, মা, বাবাকে বলে ব্যবস্থা করো যেন উনি এখানে থাকতে পারেন। আমি অবশ্যই উনাকে একা ছাড়ব না। উনি যদি চলে যান, আমিও উনার সঙ্গে যাব।

এতক্ষণে সাফিয়া বুঝলেন এবং হেসে ফেললেন।

মরিয়ম কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, তুমি হাসছ কেন মা? আমি হাসির কোনো কথা বলি নি। তুমি ব্যবস্থা করো। কীভাবে ব্যবস্থা করবে। আমি জানি না।

সাফিয়া কোনো ব্যবস্থা করতে পারলেন না। মোবারক হোসেন মেয়েজামাইকে বিদেয় দিয়ে বারান্দায় এসে দেখলেন, বড় মেযে ব্যাকুল হয়ে কাঁদছে। তিনি অত্যন্ত বিরক্ত হয়ে বললেন, কী হয়েছে? কাদছিস কেন? জামাই পছন্দ হয় নাই? আমি যা পেরেছি। ব্যবস্থা করেছি। চোখ মুছ।

মরিয়ম চোখ মুছল। যা ঘুমাতে যা। খবরদার চোখে যেন আর পানি না দেখি।

মরিয়ম চোখ মুছে তার ঘরের দিকে রওনা হলো।
 
মোবারক হোসেন তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন। জোহর সাহেব এখানে কেন? শেখ সাহেবের বাড়িতে এই সকালে তিনি কেন? এখনো ভালোমতো সকাল হয়। নি। ঘড়িতে বাজছে ছটা পাঁচ। ফজরের নামাজ যারা পড়ে, তারা ছাড়া এত ভোরে কেউ উঠে না। না-কি তিনি ভুল দেখছেন? এই ব্যক্তি জোহর না। এ অন্য কেউ। চেহারায় মিল আছে। সমিল চেহারার মানুষ প্রায়ই পাওয়া যায়। মোবারক হোসেন যতবার জোহর সাহেবকে দেখেছেন ততবার তাঁর মুখে খোঁচাখোচা দাড়ি দেখেছেন। এই লোকের মুখ ক্লিন শেভড। তাছাড়া জোহর সাহেবের হাতে অবশ্যই জুলন্ত সিগারেট থাকত। এই লোকের হাতে সিগারেট নেই। পাতলা ঘিয়া রঙের চাদরে তার শরীর ঢাকা। তার দুটা হাতই চাদরের নিচে। উনি নিশ্চয়ই চাদরের নিচে সিগারেট ধরান নি। ঘটনা। কী? এই গরমে চাদর গায়ে উনি কেন এসেছেন?

এই ভোরবেলাতে শেখ সাহেবের বাড়িতে অনেক লোকজন। টঙ্গি থেকে শ্রমিকদের একটা দল এসেছে মাথায় লাল ফেট্টি বেঁধে। তারা ফজরের ওয়াক্তের আগে এসে জয় বাংলা জয় বাংলা বলে প্ৰচণ্ড স্লোগান শুরু করেছিল। মনে হয় তারা তাদের গলার সমস্ত জোর সঞ্চয় করে রেখেছে শেখ সাহেবের বাড়িতে একটা হুলুস্কুল করার জন্যে। স্লোগান শুনে ভয় পেয়ে কাকের দল উড়াউড়ি শুরু করল। মোবারক হোসেন তাদের দলপতির কাছে গিয়ে বললেন, শেখ সাহেব নামাজ পড়ছেন। এখন কিছুক্ষণ চুপ করে থাকেন।

দলপতি (তার অত্যন্ত বলশালী চেহারা। মুখভর্তি পান। গলায় সোনার চেইন) রাগী গলায় বললেন, আপনি কে?

মোবারক হোসেন বললেন, আমি কেউ না।

আমি কেউ না বলাতে একটা রহস্য আছে। বলার ভঙ্গি সামান্য পরিবর্তন করে আমি কেউ না বলেও বুঝিয়ে দেয়া যায়–আমি অনেক কিছু। মোবারক হোসেন সেটা বুঝিয়ে দিলেন।

দলপতি পানের পিক ফেলতে ফেলতে বললেন, আমি টঙ্গি শ্রমিক লীগের সভাপতি। আমার নাম ইসমাইল মিয়া। শেখ সাহেব আমারে চিনেন। আমার বাড়িতে একবার খানা খেয়েছেন।

মোবারক হোসেন বললেন, শুনে খুশি হলাম।

আছে? আমরা কেউ নাশতা করি নাই।

টিফিনের কোনো ব্যবস্থা নাই।

শেখ সাব নিচে নামবেন কখন?

সেটা তো ভাই উনি জানেন।

আপনি এখানকার কে? কোন দায়িত্বে আছেন?

আমি কোনো দায়িত্বে নাই। আমি তো আপনাকে আগেই বলেছি–আমি কেউ না।

জোহরকে দেখা যাচ্ছে এই দলটির আশেপাশে ঘুরঘুর করতে। সে দুবার তাকাল মোবারক হোসেনের দিকে। কিন্তু তাকে দেখে মনে হচ্ছে না। সে মোবারক হোসেনকে চিনতে পারছে। তাহলে এমন কি হতে পারে যে, এই লোক জোহর না? তার মতো চেহারার অন্য কেউ?

মোবারক হোসেন এগিয়ে গেলেন। যা সন্দেহ করা হয়েছিল। তাই। এই লোক জোহরা। মোবারক হোসেনকে দেখে হাসল। পরিচিতের হাসি এবং আনন্দের হাসি। যেন হঠাৎ দেখা হওয়ায় খুশি হয়েছে।

মোবারক হোসেন বললেন, কেমন আছেন?

জোহর বলল, ভালো।

এখানে কী জন্যে এসেছেন?

দেখতে আসছি। কোনো বিহারি শেখ সাহেবকে দেখতে আসতে পারবে না, এমন আইন কি শেখ সাহেব পাশ করেছেন?

এতক্ষণ হয়ে গেছে আপনাকে তো সিগারেট ধরাতে দেখলাম না।

শেখ সাহেবের বাড়িতে সিগারেট খাব! এত বড় বেয়াদবি তো করতে পারি না। আমি আর যাই হই বেয়াদব না।

গরমের সময় চাদর গায়ে দিয়ে এসেছেন কেন?

জোহর কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, যখন বের হয়েছিলাম তখন ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা ভাব ছিল। তবে আপনি যা ভাবছেন তা-না। চাদরের নিচে কিছু নাই। চাদর খুলে দেখাতে হবে?

দুজন দুজনের দিকে তাকিয়ে আছে! কেউ চোখ নামিয়ে নিচ্ছে না। মোবারক হোসেন বললেন, গরম বেশি, চাদর খুলে ফেললে ভালো হয়।

জোহরের ঠোঁটের কোণে ক্ষীণ হাসির রেখা দেখা গেল। হাসি ফুটল না। তার আগেই নিভে গেল। তাকে দেখে মনে হলো, সে মোবারক হোসেনের কথায় খুব মজা পাচ্ছে।

যদি চাদর না খুলি তাহলে কি আমাকে চলে যেতে হবে?

জি।

তাহলে চলেই যাই। চা খেতে ইচ্ছা করছে। আশেপাশে চায়ের দোকান আছে?

আছে।

আমাকে নিয়ে চলেন, দুজনে মিলে চা খাই। কোনো নেশাই একা একা করা যায় না। চা তো একরকম নেশাই, তাই না?

চলেন যাই।

বত্ৰিশ নম্বর থেকে বের হয়ে দুজন মিরপুর রোড পার হলো। ওপাশেই একটা নাপিতের দোকান। দোকানটা সবার চোখে পড়ে, কারণ সেখানে মজার একটা সাইনবোর্ড ঝুলছে–

মুজিবের বাড়ি যেই পথে
আমার দোকান সেই পথে।

নাপিতের দোকানটা এখনো খোলে নি। তবে চায়ের দোকান খুলেছে। দশবারো বছরের একটা ছেলে পরোটা বেলছে। দুখু মিয়া টাইপ চেহারা। বড় বড় চোখ।
 
জোহর চায়ের দোকানে ঢুকেই গায়ের চাদর খুলে ফেলল, ভাজ করে কাধে রেখে মোবারক হোসেনের দিকে তাকিয়ে হাসল। শান্ত গলায় বলল, চাদরের নিচে যে কিছু নাই কথাটা কি বিশ্বাস হয়েছে?

মোবারক হোসেন হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়লেন।

জোহর বলল, তার পরেও যদি বিশ্বাস না হয়। গায়ে হাত দিয়ে দেখতে °८।।

দেখতে হবে না।

আসুন চা নিয়ে রাস্তার পাশে বসে খাই। আপত্তি আছে?

না, আপত্তি নাই।

রাস্তার পাশে দুজন দাঁড়িয়ে আছে। জোহর সিগারেট ধরিয়েছে। সিগারেট ধরানোর কারণেই হয়তো তার চেহারায় উৎফুল্ল ভাব।

ইন্সপেক্টর সাহেব।

জি।

আপনাকে আগে একবার যুক্তি দিয়ে বুঝিয়েছিলাম যে, পূর্ব পাকিস্তান কখনো স্বাধীন হবে না। মনে আছে?

মনে আছে।

আমার যুক্তি কি আপনার কাছে বিশ্বাসযোগ্য মনে হয়েছিল?

জি, মনে হয়েছে।

এখন আমি বুঝতে পারছি আমার যুক্তি ঠিক না। শেখ মুজিব। যদি চান দেশ স্বাধীন হবে। কীভাবে বুঝলাম জানেন?

না,

আপনাকে দেখে বুঝলাম। কোনো বাঙালির পক্ষে শেখ মুজিবের কোনো অনিষ্ট করা সম্ভব না। অনিষ্ট অনেক দূরের ব্যাপার, তার কোনো ক্ষতির চিন্তা করার ক্ষমতাও বাঙালির নেই। এই যদি অবস্থা হয়, তাহলে স্বাধীনতা ছাড়া উপায় কী? একজন মানুষ কত দ্রুত এই অবস্থায় চলে গেছেন ভাবতেই বিস্মিত হতে হয়।

মোবারক হোসেন কিছু বললেন না। তার চায়ের নেশা নেই, কিন্তু সকালের এই চা-টা তার খেতে ভালো লাগছে।

ইন্সপেক্টর সাহেব!

জি।

আমি এখনো পাকিস্তানি শাসকদের চিন্তিত হবার মতো কিছু ঘটেছে বলে। মনে করি না। শেখ মুজিব মধ্যবিত্তের নেতা, বুর্জেীয়া নেতা। এ ধরনের নেতারা সরাসরি যুদ্ধের কথা ভাবেন না। এরা ঝামেলামুক্ত সমাধান চান। যেমন ধরেন ভারতের জওহরলাল নেহরু কিংবা মহাত্মা গান্ধী। এরা দেশ স্বাধীন করেছেন জেল খেটে। অসহযোগ আন্দোলন করে। কারণ এই দুজনও বুর্জেীয়া নেতা! সরাসরি যুদ্ধ এরা সমর্থন করেন নি। আপনাদের শেখ মুজিবও করবেন না। বুঝতে পারছেন কী বলছি?

বোঝার চেষ্টা করছি। আমার বুদ্ধি কম। সহজে কিছু বুঝি না।

আমার ধারণা আপনাদের শেখ মুজিবের মাথায়ও গান্ধী-টাইপ চিন্তা-ভাবনা আছে। অসহযোগ আন্দোলন করে জেল টেল খেটে দেশ স্বাধীন করে ফেলা। পুরোপুরি স্বাধীন করা যদি সম্ভব নাও হয়, তাতেও আপাতত চলবে। কনফেডারেশন, ইউনাইটেড স্টেটস। পাকিস্তানের যে এই অবস্থা হবে, সেটা কিন্তু তখনকার নেতারা ঠিকই বুঝেছিলেন। মোহাম্মদ আলি জিন্নাহ তো দুই পাকিস্তান হচ্ছে জেনে বিরক্ত হয়ে বলেছিলেন–পোকায় কাটা পাকিস্তান দিয়ে আমি কী করব?

মোবারক হোসেন বললেন, মানুষ তো বদলায়।

জোহর সঙ্গে সঙ্গে বললেন, অবশ্যই বদলায়। পরিস্থিতি মানুষকে বদলায়। ভয়াবহ ডাকাত হয়ে যায় নিজাম আউলিয়া। বিরাট সাধু সন্ত হয়ে যায় ভয়াবহ খুনি। সমস্যাটা এইখানেই। আপনার চা খাওয়া দেখে মনে হয়েছে আপনি খুবই আরাম করে চা খেয়েছেন। আরেক কাপ খাবেন?

জি খাব ।

বক্তৃতা শুনতে যাবেন না?

কী বক্তৃতা?

পল্টনে আজ মাওলানা ভাসানীর বক্তৃতা আছে। আমার ধারণা এটা হবে

খুবই গুরুত্বপূর্ণ বক্তৃতা। শোনা দরকার।

মোবারক হোসেন বললেন, আমি বক্তৃতা শুনি না। বক্তৃতা শুনতে ভালো লাগে না। তাছাড়া আমার ডিউটি শেখ সাহেবের বাড়িতে। ডিউটির জায়গা ছেড়ে যেতে পারব না।


জোহর দ্বিতীয় সিগারেট ফেলে দিয়ে তৃতীয়টি ধরাতে ধরাতে বলল, আপনি আসলে কার ডিউটি করছেন বলুন তো?

মোবারক হোসেন জবাব দিতে পারলেন না।

জোহর হালকা গলায় বলল, আপনি এই প্রশ্নের জবাব দিতে পারবেন না। কারণ জবাব আপনার নিজেরই জানা নেই। আমার জানা আছে। পুরো বাঙালি জাতি এখন একজনের ডিউটি করছে। সেই একজনের নাম শেখ মুজিব। আমি বিহারি না হয়ে বাঙালি হলে বিষয়টা এনজয় করতাম।
 

Users who are viewing this thread

Back
Top