What's new
Nirjonmela Desi Forum

Talk about the things that matter to you! Wanting to join the rest of our members? Feel free to sign up today and gain full access!

Collected ছোছনা ও জননীর গল্প - উপন্যাস (2 Viewers)

আজ বুধবার।

মোবারক হোসেনের ছুটির দিন। ছুটির দিনেও তিনি কিছু সময় অফিস করেন। সকাল দশটা সাড়ে দশটা পর্যন্ত শেখ সাহেবের বাড়িতে থাকেন। সেখান থেকে সরাসরি চলে যান। আমিনবাজার। সপ্তাহের বাজার আমিনবাজার থেকে করে চলে আসেন মৌলবীবাজার। সেখানে কুদ্দুস নামের একজন কসাই তাকে গরুর মাংস দেয়। বাজারের সেরা মাংস । তিনি বাসায় ফিরেন দুপুর বারোটার মধ্যে। তখন ইয়াহিয়াকে গোসল দেয়া হয়। গোসলের আগে তার গায়ে খাঁটি সরিষার তেল মাখানো হয়। তেল মাখানোর সময় সে খুব হাত-পা ছুঁড়ে হাসে। আবার যখন তাকে গামলার পানিতে নামানো হয়, তখন সে হাত-পা ছুঁড়ে কাঁদে। শিশুপুত্রের হাসি এবং কান্না দুটাই তিনি দেখতে ভালোবাসেন।

মোবারক হোসেন সপ্তাহে একদিন দুপুরে ঘুমান। ঘুম ভাঙার পর মোহাম্মদপুর যাবার ব্যাপারে প্রস্তুতি নিতে থাকেন। প্রস্তুতি মানে মানসিক প্ৰস্তুতি। মোহাম্মদপুরের শের শাহ সুরী রোডে যেতে হবে মনে হলেই তিনি এক ধরনের অস্বস্তি অনুভব করেন। বুধবার দুপুরের ঘুমও তাঁর ভালো হয় না। ঘুমের মধ্যে বিকট এবং অর্থহীন স্বপ্ন দেখেন। একবার স্বপ্নে দেখলেন, কর্নেল শাহরুখ খানের কোলে তিনি বসে আছেন। স্বপ্নের মধ্যে ব্যাপারটা খুব স্বাভাবিক মনে হচ্ছিল। যেন কর্নেল সাহেবের কোলে বসে থাকাটাই যুক্তিযুক্ত এবং শোভন।। আরেকবার স্বপ্নে দেখলেন–তিনি, কর্নেল সাহেব এবং জোহর সাহেব খেতে বসেছেন। টেবিলে আস্ত খাসির একটা রোষ্ট সাজানো। সবাই সেই রোষ্ট থেকে মাংস ছিঁড়ে ছিঁড়ে নিচ্ছে। সমস্যা হচ্ছে খাসিটা জীবিত। যখনই তার গা থেকে মাংস ছেড়া হচ্ছে তখনই সে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাচ্ছে এবং বিড়বিড় কবে বলছেআস্তে, আস্তে।

এরকম কুৎসিত এবং অর্থহীন স্বপ্ন দেখার কোনো মানে হয় না। জোহর সাহেব তার সঙ্গে খুবই সহজ-স্বাভাবিক ভঙ্গিতে কথা বলেন। মাঝে-মাঝে হাসি তামাশাও করেন। সন্ধ্যাবেলা চায়ের সঙ্গে কাবাব খেতে দেন। মাঝেমাঝে থাকে গরুর পায়া। গরম গরম রুমালি রুটি দিয়ে পায়া খেতে অতি সুস্বাদু।

জোহর সাহেব বেশিরভাগ কথাবার্তাই বলেন খাবারদাবার নিয়ে। তিনি কোথায় কখন কোন ভালো খাবারটা খেয়েছেন সেই গল্প। মিঠা কাবাব নামের একটা কাবাবের কথা তার কাছে প্রায়ই শোনা যায়। গাজরের রসে মাংস। জ্বাল দেয়া হয়। তারপর সেই মাংস টুকরা টুকরা করে আগুনে ঝলসে খাওয়া। জোহর সাহেবের ধারণা, বেহেশতেও এই খানা পাওয়া যাবে কি-না সেই বিষয়ে সন্দেহ আছে।

খাওয়া-দাওয়ার ফাকে ফাঁকে রাজনীতি নিয়েও কথা হয়। রাজনৈতিক আলাপের সময় এই মানুষটা কোনোরকম সংশয় ছাড়া কথা বলেন। তখন তার চোখ বন্ধ থাকে। তাকে দেখে মনে হয়, তিনি যা বলছেন তা যেন চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছেন।
 
বুঝলেন ইন্সপেক্টর সাহেব, একটা দেশ স্বাধীন হবে কি হবে না তা সেই দেশের মানুষ কিংবা সেই দেশের কোনো বিপ্লবী নেতার উপর নির্ভর করে না। নির্ভর করে আন্তর্জাতিক রাজনীতির খেলার উপর। ভারত চাচ্ছে পূর্ব পাকিস্তান স্বাধীন হোক, এতে তার সুবিধা। তার চিরশত্রু পাকিস্তানের একটা শিক্ষা হয়। পাকিস্তানের কোমর ভেঙে যায়। আরেক দিকে আছে চীন। ভারতের আরেক শত্ৰু। কাজেই পাকিস্তানের বন্ধু। বিরাট এক শক্তি। ১৯৬২ সনে ভারতের উপর এমন চড়াও হয়েছিল যে ভারতের বুকোব রক্ত জমে পানি হয়ে গিয়েছিল। চীন কিছুতেই চাইবে না পাকিস্তান ভেঙে যাক। যেহেতু চীন চাচ্ছে না, আমেরিকাও চাইবে না। ভারতের পাশে থাকবে সোভিয়েত ইউনিয়ন। এইসব হিসাবনিকাশে যে পাল্লা ভারী হবে সেই পাল্লাই… বুঝতে পারছেন?

জি পারছি।

শেখ মুজিব। যদি বোকামি করেন, কোনোরকম প্রস্তুতি ছাড়াই স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে দেন, তাহলে কী হবে দেখা যাক। সাতদিনের মাথায় মিলিটারি বিদ্রোহ দমন করবে। ভারত যদি যুদ্ধে জড়িয়ে না পড়ে, তাহলে পনেরো দিনের মাথায় সব ঠিকঠাক হয়ে যাবে। অনেক বড় বড় বিপ্লবী নেতাকে তখন দেখা যাবে–পাক সার যামিন শাদ বাদ গান করছেন। মানুষ সবসময় শক্তের পূজারী। দুর্বলকে মানুষ কখনো পছন্দ করে না। কেন বলুন তো?

জানি না।

কারণ বেশিরভাগ মানুষই দুর্বল। সে তার নিজের দুর্বলতা জানে। এই দুর্বলতা সে ঘৃণা করে। কাজেই অন্যের দুর্বলতাকেও সে ঘৃণা করে। Mankind abhors timidity because he is timid. এখন ইন্সপেক্টর সাহেব বলুন দেখি, শেখ মুজিব কি ভুল করবেন? স্বাধীনতার ঘোষণা দেবেন? ঢাল-তলোয়ার ছাড়া নিধিরাম সর্দার হতে চাইবেন।

জি করবেন। এটা ছাড়া তাঁর অন্য কোনো বিকল্প নাই। মানুষ তাঁকে নেতা বানিয়েছে, মানুষের ইচ্ছাকে তাঁর দাম দিতে হবে।

স্বাধীনতার ঘোষণা যদি সত্যি সত্যি দেয়া হয়, তাহলে কী পরিমাণ মানুষ এই দেশে মারা যাবে সেই সম্পর্কে তাঁর কি কোনো ধারণা আছে? শুধুমাত্র ঢাকা শহরের রাস্তাতেই এক হাঁটু রক্ত হবার কথা। বাদ দেন এসব, যা হবার হবে। এখন বলেন আছেন কেমন?

জি ভালো।

ছেলে-মেয়ে-স্ত্রী সবাই ভালো?

জি। এদের ঢাকায় রেখে লাভ নাই। এদের কোনো নিরাপদ জায়গায় পাঠিয়ে দেন।

নিরাপদ জায়গা কোনটা?

সেটাই একটা কথা, নিরাপদ জায়গাটা কী? এই বিষয়ে একটা শের আছে। পুরোপুরি মনে নাই, ভুলে গেছি। ভাবাৰ্থ হলো–

আমাকে একটা নিরাপদ জায়গার সন্ধান
হে পারোয়ার দেগার তুমি দাও
যে নিরাপদ স্থানে প্ৰেম আমাকে স্পর্শ করবে না।



দুপুর বারোটা থেকে সাড়ে বারোটা পর্যন্ত মোবারক হোসেন পুত্রের হাসি এবং কান্না দেখলেন। তিনি বড়ই মজা পেলেন। এই সময়টাতে তার একবারও শের শাহ সুরী রোডের কথা মনে পড়ল না। আজই যে সেখানে যেতে হবে এবং আজই কর্নেল সাহেব উপস্থিত থাকবেন— এটাও মনে থাকল না। অথচ তিনি খবর দিয়ে রেখেছেন। মুক্তাগাছার মণ্ডা নিয়ে আসরের নামাজের আগেই একজনের আসার কথা। কর্নেল সাহেবকে মণ্ডা খাওয়াতে হবে।

বুধবারে তাঁকে বাসায় পাওয়া যায়–এই খবরটা হয়তো প্রচার হয়ে গেছে। অনেকেই এই দিনে তাঁর সঙ্গে দেখা করতে আসে। বেশিরভাগই আসে দুপুরে খাওয়ার সময়। আজ এসেছেন মুসলেম উদ্দিন সরকার। মোবারক হোসেনের ছোট মামা। তিনি টুকটাক ব্যবসা করেন। কোনো ব্যবসাই গোছাতে পারেন। না। টাকা-পয়সার টানাটানি হলেই ভাগ্লের কাছে টাকা ধার করতে আসেন। মোবারক হোসেন প্রতিবারই বিরক্ত হন, তবে প্রতিবারই কিছু না কিছু সাহায্য করেন।
 
দুপুরে মোবারক হোসেন একা খেতে পছন্দ করেন। খাবার সময় কেউ সামনে থাকবে না। সবগুলি পদ হাতের কাছে সাজানো থাকবে, তিনি নিজের মতো ধীরে-সুস্থে খাওয়াদাওয়া সারবেন। তার হাত ধোয়ার শব্দ শুনে একজন কেউ পিরিচে দুটা জর্দা দেয়া পান নিয়ে আসবে।

আজ তাকে বাধ্য হয়ে ছোট মামাকে সঙ্গে নিয়ে খেতে বসতে হলো। ছোটমামা মুসলেম উদ্দিন সরকার ভাগ্নের দিকে তাকিয়ে আনন্দিত গলায় বললেন, তুই এমন বিরক্ত মুখ করে আমার দিকে তাকাচ্ছিস কী জন্যে? আজি টাকা ধার করতে আসি নাই। গগুগোলের বাজারে আমার ব্যবসা ভালো যাচ্ছে। ভালো পয়সা কামাচ্ছি।

এখন আপনার কিসের ব্যবসা?

লবণের ব্যবসা আর মোমবাতির ব্যবসা। কেরোসিনের ব্যবসাতেও নামব। কেরোসিনের ব্যবসাতেও রমরমা ভাব। শুধু আল্লা আল্লা করতেছি। গণ্ডগোল আরো কিছুদিন চলুক। দুই মাস চললেই আল্লাহর কাছে হাজার শুকুর। তুই রাজি থাকলে কেরোসিনের ব্যবসায় তোকে পার্টনার নিতে পারি। ফিফটি ফিফটি শেয়ার। করবি পার্টনারশিপ ব্যবসা?

না।

আচ্ছা থাক, যে জন্যে এসেছি সেট শোন। তোর বড় মেয়ের বিয়ে দিবি? মেয়ে ইন্টারমিডিয়েট দিবে–এখন বিয়ে দেয়া যায়। হাতে ভালো ছেলে আছে।

মোবারক হোসেন কথা বলছেন না। শুনে যাচ্ছেন। খাওয়ার সময় কথা বলতে তার মোটেই ভালো লাগে না।

ছেলে অত্যন্ত ভালো। এই ছেলে হাতছাড়া করলে আল্লাহ নারাজ হবেন। সুযোগ তো তাঁরই করে দেয়া।

মোবারক হোসেন বললেন, ছেলে কী করে?

ছেলে কিছু করে না, তবে ভবিষ্যতে বড় কিছু করবে ইনশাল্লাহ।

মোবারক হোসেন বিরক্ত চোখে তাকালেন। কী সুন্দর বিয়ের প্রস্তাব—ছেলে কিছু করে না, তবে ভবিষ্যতে বড় কিছু করবে!

মুসলেম উদ্দিন সরকার আগ্রহ নিয়ে বললেন, ছেলের বাবা-মা নাই। মা জন্মের সময় মারা গেছেন। বাবা মারা গেছেন–ছেলের বয়স যখন এগারো। ছেলে নিজের চেষ্টায়, বন্ধুবান্ধবদের চেষ্টায় লেখাপড়া করেছে।

মোবারক হোসেন কিছু বললেন না। কথা বলার কোনো মানে হয় না। পাত্র কিছু করে না, এতিম— এরপর আর কথা কী?

তুই ছেলেটাকে একদিন দেখ।

প্ৰয়োজন দেখি না।

ছেলেটাকে দেখলে, তার সঙ্গে কথা বললে তোর ভালো লাগবে। ছেলে অত্যন্ত রূপবান।

মোবারক হোসেন বললেন, অত্যন্ত রূপবানকে আমার দেখতেও ভালো লাগে না, কথা বলতেও ভালো লাগে না।

আমি তাকে আজ সন্ধ্যায় তোদের বাসায় আসতে বলেছি।

কেন?

তোদের সঙ্গে চা খাবে।
 
মোবারক হোসেন অত্যন্ত বিরক্ত হয়ে বললেন, মামা শুনুন, এটা তো আপনার কেরোসিনের ব্যবসা না যে আপনি হঠাৎ কোনো এক ডিলারের কাছ থেকে একশ টিন কেরোসিন কিনে ফেললেন। আপনি কী মনে করে কারো সঙ্গে আলোচনা না করে ছেলেকে রাতে চা খেতে বলেছেন?

মুসলেম উদ্দিন সরকার বললেন, কারো সঙ্গে আলোচনা করি নাই— এটা তো ঠিক না। তোর স্ত্রীর সঙ্গে আলাপ করেছি। বৌমা খুব আনন্দের সঙ্গে রাজি হয়েছে।

মোবারক হোসেন ঠাণ্ডা গলায় বললেন, আপনি অবশ্যই ছেলেকে না করে আসবেন।

মুসলেম উদ্দিন বললেন, তুই শান্ত হ। এত রাগ করার কিছু নাই। আমি বিকালের মধ্যেই নিজে গিয়ে না করে আসব। ভালো একটা ছেলে হাতছাড়া হয়ে গেল–এটাই একটা আফসোস। বড়শিতে মাছ মারার সময় মাঝে মাঝে খুব বড় মাছ বড়শি গিলে তারপর সুতা ছিঁড়ে চলে যায়। তখন বর্শেলের আফসোসের সীমা থাকে না। আমার সে-রকম আফসোস হচ্ছে। এই মাছটা ছিল বিরাট কালবোস। কালবোস চিনিস?

মোবারক হোসেন জবাব দিলেন না। তার খাওয়া শেষ হয়েছে। তিনি হাতমুখ ধুয়ে পান মুখে দিচ্ছেন।

কালবোস হলো রুই এবং কাতলের শংকর। বাবা হলো রুই মাছ, মা হলো কাতল মাছ। অতি স্বাদু মাছ। একটাই সমস্যা–এরা বংশবিস্তার করতে পারে না। এই জন্যেই কালবোসের সংখ্যা এত কম। হঠাৎ হঠাৎ পাওয়া যায়।

মামা, আমি কিছুক্ষণ রেস্ট নেব। ফ্যান ছেড়ে শুয়ে থাকব।

আমিও চলে যাব। দেখি ছেলেকে পাই কি-না। সে থাকে পুরান ঢাকায়। গলির ভিতর গলি, তার ভিতরে গলি। বাড়ি খুঁজে পাওয়াই সমস্যা। এক কামরার একটা ঘর ভাড়া করে থাকে; ঘরে ঢুকলে মনে হয়, টিনের ট্রাংকের

মোবারক হোসেন শোবার ঘরের দিকে রওনা হলেন।

মুসলেম উদ্দিন বললেন, ছেলের সম্পর্কে আসল কথাটাই তো তোকে বলা হয় নি। গল্প-উপন্যাসে এক ধরনের ছেলের কথা থাকে যারা জীবনে কোনো পরীক্ষায় সেকেন্ড হয় না। সে-রকম ছেলে। ফিজিক্স অনার্সে ফাস্টক্লাস ফাস্ট, এমএসসি-তে ফাস্টক্লাস ফাস্ট, ইন্টারমিডিয়েটে ফাস্ট। শুধু ম্যাট্রিকে সেকেন্ড হয়েছিল; ছেলের কোনো দাবি-দাওয়া নাই, শুধু তাকে ক্যাশ এগারো হাজার টাকা দিতে হবে। তার কিছু ঋণ আছে, সে ঋণ শোধ করবে। ভবিষ্যতে এই ছেলে কী করবে চিন্তা কর। ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে লেকচারার হয়ে ঢুকবে। কমনওয়েলথ স্কলারশিপ পেয়ে স্ত্রী নিয়ে চলে যাবে পিএইচডি করতে। ছেলেকে চা খেতে আসতে বলব?

মোবারক হোসেন চুপ করে আছেন।

মুসলেম উদ্দিন বললেন বলধ চা খেতে আসার জন্য? আসুক না। এসে চা খেয়ে যাক। কত লোকই তো তোর এখানে এসে চা-নাস্তিা খেয়ে যায়। তাতে অসুবিধা কী?

সন্ধ্যার সময় আমি থাকব না।

তাহলে একটু রাত করে আসতে বলি। আমাদের সঙ্গে রাতের খানা খাক। বলব? বেচারা দিনের পর দিন হোটেলে খায়, একবার বাড়ির খাওয়া খেয়ে দেখুক খাওয়া কাকে বলে।

মোবারক হোসেন হ্যাঁ না কিছুই বললেন না। ঘুমোতে চলে গেলেন। ঘুমে তার চোখ বন্ধ হয়ে আসছে। এটা খারাপ লক্ষণ! যখন প্রচণ্ড ঘুম পায় তখন বিছানায় যাওয়া মাত্র ঘুম কেটে যায়।
 
কর্নেল সাহেবকে আজ আরো সুন্দর লাগছে। তিনি পরেছেন ফুলতোলা হাফ হাওয়াই সার্ট। সাদা রঙের উপর হালকা সবুজ ফুল। মাথায় লাল রঙের কাপড়ের ক্যাপ। চোখ যথারীতি কালো চশমায় ঢাকা। কর্নেল সাহেবকে দেখে মনে হচ্ছে তিনি একজন টুরিস্ট। সমুদ্রতীরের কোনো এক শহরে বেড়াতে এসেছেন। স্ত্রীকে হোটেলে রেখে জরুরি একটা মিটিং সারাতে এসেছেন। মিটিং শেষ করেই স্ত্রীর কাছে যাবেন। তারা হাত ধরাধরি করে সমুদ্রের কাছে বেড়াতে যাবে। মিটিং-এ মন বসছে না বলেই তিনি বারবার আঙুল দিয়ে টেবিলে ঠকঠক করছেন।

ইন্সপেক্টর, তোমার এই মাটির হাঁড়িতে কী আছে?

মুক্তাগাছার মণ্ডা। আপনার জন্য আনিয়েছি।

তোমার দেশের যে জিনিসটা তোমার সবচে প্ৰিয় সেটা?

ইয়েস স্যার।

থ্যাংকয়্যু। এখন বলো, কেমন আছ?

স্যার, ভালো আছি।

আমি খবর নিয়েছি, তুমি খুব ভালোভাবে তোমার ডিউটি পালন করছ। আমি তোমার উপর খুশি। You are a good Pakistani officer.

থ্যাংকয়্যু স্যার।

তোমার সঙ্গে যে পিস্তলটিা আছে, সেটা আমি রেখে দেব।

মোবারক হোসেন চিন্তিত গলায় বললেন, স্যার, আমাকে অফিসে হিসাব দিতে হবে। আপনার কাছে পিস্তল দিয়ে দিলে আমি বিপদে পড়ব।

তোমাকে বিপদে ফেলতে চাই না। তুমি বরং আগামীকাল তোমার অফিসে পিস্তল জমা দিয়ে দিবে।

জি আচ্ছা, স্যার।

তোমাদের এই পিস্তলগুলি পুরনো। ট্রিগার টিপলে দেখা গেল গুলি হলো না। আমি তোমাকে ভালো একটা পিস্তল দিব।

মোবারক হোসেনের পেটে কেমন যেন শব্দ হচ্ছে। মাথা বিমঝিম করছে। পায়ের নিচটা অবশ হয়ে যাচ্ছে এরকম অনুভূতি। মনে হচ্ছে তিনি চোরাবালিতে দাঁড়িয়ে আছেন। ধীরে ধীরে তার শরীর ডেবে যাচ্ছে। আশেপাশে কেউ নেই যে তাকে টেনে তুলবে। জোহর সাহেব অবশ্যি আছেন। তিনি আগের মতো মাথা নিচু করে সিগারেট টেনে যাচ্ছেন। কটা সিগারেট খাওয়া হয়েছে সেই হিসাব রাখা হয় নি। কর্নেল সাহেব হঠাৎ যদি জিজ্ঞেস করেন, তিনি জবাব দিতে পারবেন না। কর্নেল সাহেব নিশ্চয়ই খুব বিরক্ত হবেন।

ইন্সপেক্টর।

ইয়েস স্যার।

তুমি হঠাৎ খুবই চিন্তিত হয়ে পড়েছ। কী জন্যে?

স্যার, আমি চিন্তিত না।

অবশ্যই তুমি চিন্তিত। তোমার কপাল ঘামছে। তুমি মনে মনে কী ধারণা করছি সেটা বলব? তোমার ধারণা আমি নতুন পিস্তল দিয়ে তোমাকে নির্দেশ দিব–যাও, শেখ মুজিবকে খুব কাছ থেকে গুলি করো। তোমার প্রতি এটাই হাই কমান্ডের নির্দেশ। তাই ভাবিছ না?



মোবারক হোসেন তাকালেন জোহর সাহেবের দিকে। তার ঠোঁটে চাপা হাসি। এই ভদ্রলোক কটা সিগারেট খেয়েছেন? কর্নেল সাহেব যদি সিগারেটের সংখ্যা জিজ্ঞেস কলেন, তাহলে বিপদে পড়ে যেতে হবে। হে আল্লাহপাক, কর্নেল সাহেব আজ যেন সিগারেটের সংখ্যা না জিজ্ঞেস করেন।

ইন্সপেক্টর।

ইয়েস স্যার।

আমরা এ ধরনের কোনো পরিকল্পনা করলেও করতে পারি। আততায়ীর হাতে শেখ মুজিবের মৃত্যু। দলপতি শেষ মানেই দল শেষ। তবে এ ধরনের পরিকল্পনা করা হলে তার দায়িত্ব আমরা তোমাকে দিব না। তুমি বাঙালি। কোনো বাঙালিকে আমরা বিশ্বাস করি না। তোমার হাতের টিপ কেমন তাও জানি না। ভালো হবার কথা না। আমাদের দরকার সার্প শুটার। বুঝতে পারছি?

জি স্যার।

কর্নেল সাহেব মাথা ঝাকালেন। পকেটে হাত দিয়ে সিগারেট বের করে ঠোঁটে দিলেন। সিগারেট ধরলেন না। তবে তিনি সিগারেটে টান দিচ্ছেন এবং ধোয়া ছাড়ার ভঙ্গি করছেন। এটা যেন এক ধরনের খেলা।

ইন্সপেক্টর।

ইয়েস স্যার।

একটা শক্তিশালী বাঘ চুপচাপ বসে আছে। তোমরা বাঘটাকে খোচাচ্ছি। কাঠি দিয়ে খোচোচ্ছ, গায়ে পানি ঢেলে দিচ্ছ। বাঘটার কানের কাছে ক্ৰমাগত চিৎকার করছ–জয় বাংলা, জয় বাংলা। এই বাঘ তো অবশ্যই ঝাপ দিয়ে পড়বে। আচ্ছা ঠিক আছে, তুমি যাও। জোহর, তুমি তাকে পিস্তল আর ছয় রাউন্ড গুলি দিয়ে দাও। মিষ্টির জন্যে ধন্যবাদ।

মোবারক হোসেন রাতে বাসায় ফিরলেন জ্বর নিয়ে। জ্বর এবং তীব্র মাথার যন্ত্রণা। মুসলেম উদ্দিন ছেলেটিকে নিয়ে এসেছেন। তার নাম নাইমুল। দেখে মনে হচ্ছে ছায়ার কচুগাছ। প্রাণহীন বিবর্ণ। লম্বাতেও বেশি। স্কুলে এই ছেলেকে নিশ্চয়ই তালগাছ ডাকা হতো। মরিয়ম বেঁটে। এই তালগাছের সঙ্গে মরিয়মকে একেবারেই মানাবে না। ছেলের চোখে-মুখে উদ্ধত ভঙ্গি আছে। চোখে চোখ পড়ার পরেও চোখ নামিয়ে নিচ্ছে না। তাকিয়ে থাকছে।

মোবারক হোসেন তাদের সঙ্গে খেতে বসলেন, কিন্তু কিছু খেতে পারলেন না। তার জ্বর বেড়েছে। পেটে মোচড় দিচ্ছে। তিনি খাওয়া ছেড়ে উঠে পড়লেন।

মুসলেম উদ্দিন যখন তার ভাগ্নেকে জিজ্ঞেস করলেন, কি-রে ছেলেটাকে পছন্দ হয়েছে? তখন মোবারক হোসেন বললেন, ছেলে পছন্দ হয় নি। কিন্তু বিয়ের ব্যবস্থা করতে পারেন। ছেলের আত্মীয়স্বজনকে খবর দিন। ওদের সঙ্গে কথা বলেন। তবে আমাকে এইসবের মধ্যে জড়াবেন না। বিয়ের তারিখ ঠিক করে জানাবেন। আমি খরচ দিব। ছেলে ক্যাশ টাকা যেন কত চায়?

এগারো হাজার।

মোবারক হোসেন বললেন, এগারো হাজার টাকা দিয়ে দিব। কোনো সমস্যা নাই।
 
কবিতা একবার পড়লে অনেকক্ষণ মাথায় থাকে। কবিতার শব্দগুলি না থাকলেও ছন্দটা থাকে। ট্রেন চলে যাবার পরেও যেমন ট্রেনের ঝিক ঝিক শব্দ মাথায় বাজতে থাকে সে-রকম। এ ধরনের একটা ব্যাপার শাহেদের হয় তার বড় ভাইয়ের চিঠি পাওয়ার পর। চিঠিটা অনেকক্ষণ মাথায় থাকে।

ইরতাজউদ্দিন চিঠি লেখেন রুলটানা কাগজে। সাদা কাগজে তার লাইন ঠিক থাকে না বলে তিনি সাদা কাগজে লিখতে পারেন না। অক্ষরগুলি বড় বড় এবং স্পষ্ট। অক্ষর যেমন স্পষ্ট চিঠির বক্তব্যও স্পষ্ট। এই মানুষটার ভেতর কোনো অস্পষ্টতা নেই।

শাহেদ তার বড় ভাইয়ের চিঠি গতকাল দুপুরে একবার পড়েছে। রাতে ঘুমুতে যাবার সময় একবার পড়েছে। এখন আরেক দুপুর। শাহেদ ঠিক করেছে, আজ সারাদিনের জন্যেই সে বের হয়ে যাবে। ফিরবে সন্ধ্যার পর। এর মধ্যে একটা ফাক বের করে বড় ভাইজানকে লেখা চিঠিটা পোস্ট করে দেবে।

বড় ভাইজান লিখেছেন–

প্রিয় শাহেদ, আসমানী ও রুনি, (তিনজনের নামে এক চিঠি। এই অদ্ভুত মানুষ শাহেদের বিয়ের পর কখনো শাহেদকে আলাদা চিঠি লিখেন নি। রুনির জন্মের পর সব চিঠিতেই তারা দুইজন ছাড়াও রুনির নাম আছে।)

তোমাদের জন্যে অতীব দুশ্চিন্তায় আছি। সুদূর পল্লীগ্রামে আছি। শহরের অবস্থা বুঝিতে পারিতেছি না। লোকমুখে নানান খবরাদি পাই। কোনটা সত্য কোনটা মিথ্যা তা আলাদা করিতে পারি না। দুশ্চিন্তায় কালক্ষেপণ করি। প্রতি রাতেই আলাদা করিয়া তোমাদের তিনজনের জন্যে আল্লাহপাকের নিকট দেয়া করি। তাহাতেও মন শান্ত হয় না। মন যে শাস্ত হয় না। তাহার প্রমাণ প্ৰায় প্রতি রাতেই তোমাদের নিয়া আজেবাজে স্বপ্ন দেখি। একটি স্বপ্নে দেখিলাম তুমি মা রুনিকে কোলে নিয়া দৌড়াইতেছ। তোমার পাশে রুনির স্নেহময়ী মা আসমানী। তোমাদের পিছনে ভীষণ-দর্শন একজন বলশালী পুরুষ বল্লম হাতে তোমাদের তাড়া করিতেছে। যে-কোনো মুহুর্তে সে বল্লম নিক্ষেপ করিবে এমন অবস্থা।

যদিও জানি স্বপ্ন মানবমনের দুশ্চিন্তার ফসল ছাড়া আর কিছুই না। তারপরেও চিন্তায় অস্থির হইয়াছি। এমন নজির আছে যে মহান আল্লাহপাক স্বপ্নের মাধ্যমে আমাদের সাবধান করিতেছেন।

ঘটনা যাহাই হউক, পত্রপ্রাপ্তির তিনদিনের মাথায় তুমি অতি অবশ্যই সবাইকে নিয়া চলিয়া আসিবা। ইহা তোমার প্ৰতি আমার আদেশ।

আল্লাহপাক তোমাদের সর্ব বিপদ হইতে মুক্ত রাখুন। আমিন।

ইতি ইরতাজউদ্দিন

বড় ভাইয়ের কাছে লেখা শাহেদের চিঠি খুবই সংক্ষিপ্ত। সে শুধু লিখেছে–

ভাইজান, আমরা আসছি। এক সপ্তাহের মধ্যেই আসছি।



আসমানী বলল, এই, কোথায় যাচ্ছ?

শাহেদ জবাব দিল না। এরকম ভাব করল যেন সে আসমানীর কথা শুনতে পায় নি। আসমানী আবারো বলল, ভরদুপুরে তুমি যােচ্ছ কোথায়?

শাহেদ এবারো জবাব দিল না। গত দুদিন ধরে সে আসমানীর সঙ্গে কথা বলা বন্ধ করে দিয়েছে। শাহেদ নিঃশব্দে ঝগড়া করার চেষ্টা করছে। সমস্যা হচ্ছে, সে কথা না বলে দীর্ঘ সময় থাকতে পারে না। আসমানী পারে। একনাগাড়ে আঠারো দিন কথা না-বলার রেকর্ড আসমানীর আছে। গিনিজ বুক অফ রেকর্ড স্বামী-স্ত্রীর কথা বলা না-বলা জাতীয় বাঙালি ব্যাপার নিমো মাথা ঘামায় না। মাথা ঘামালে স্বামী-স্ত্রীর একনাগাড়ে দীর্ঘ সময় কথা না-বলার রেকর্ড ধরে রাখার ব্যবস্থা করত। এবং শাহেদের ধারণা সেখানে অবশ্যই আসমানী নাম থাকত।

কথা না-বলে দিনের পর দিন পাশাপাশি বাস করা আসমানীর কাছে কিছুই না। কথা বলতে না পারলেই সে যেন ভালো থাকে। সমস্যা হয় শুধু শাহেদের। আসমানীর সঙ্গে কথা বলতে না পারলে তার পেট ফুলতে থাকে। সাত-আট ঘণ্টা পার হওয়ার পর দমবন্ধ দমবন্ধ ভাব হয়, তারপর এক সময় খুব অসহায় লাগতে থাকে। মনে হয় তাঁর ভয়ঙ্কর কোনো অসুখ করেছে। নিঃশ্বাসের কষ্ট হওয়ার অসুখ।
 
আটচল্লিশ ঘণ্টা হলো শাহেদ কথা না বলে আছে। দমবন্ধ ষ্টেজ পার করে সে এখন আছে অসহায় স্টেজে। তারপরেও ঠিক করেছে, আসমানী ক্ষমা প্রার্থনা না করা পর্যন্ত সে কথা শুরু করবে না। আসমানীর ভাবভঙ্গি দেখে মনে হয়, সে ক্ষমা প্রার্থনা করার জন্য মানসিকভাবে প্ৰস্তৃত। চক্ষুলজ্জার জন্য পারছে না। আসমানী এখন নিজ থেকে আগ বাড়িয়ে অনেক অপ্রয়োজনীয় কথা বলছে। আশেপাশে ঘুরঘুর করছে।

দুদিন আগের ঝগড়ার দায়দায়িত্ব বেশিরভাগই আসমানীর। শাহেদ রাতে ঘুমুতে যাওয়ার আগে বলেছে, আসমানী, তুমি এক কাজ করো। নীলগঞ্জে ভাইজানের কাছে চলে যাও।

আসমানী বলল, কেন?

ঢাকার অবস্থা ভালো না। লক্ষণ খুব খারাপ। কখন কী হয়! কী দরকার রিস্ক নিয়ে?

তুমি ঢাকায় থাকবে?

হ্যাঁ।

তুমি ঢাকায় থাকবে। আর আমি চলে যাব? ঢাকার অবস্থা আমার জন্য খারাপ আর তোমার জন্য রসগোল্লা?

এরকম করে কথা বলছি কেন?

কী রকম করে কথা বলছি?

খুবই অশালীন ভঙ্গিত কথা বলছি। যে মেয়ে ইংরেজিতে মাস্টার্স করেছে, তার কথাবার্তা কি আরো শালীন হবে না?

অশালীন, কথা কোনটা বললাম? রসগোল্লা শব্দটা অশালীন? তাহলে শালীন শব্দ কোনটা? পাস্তুয়া? নাকি রসমালাই?

প্লিজ, চুপ করো।

না, আমি চুপ করব না। তুমি আমাকে ব্যাখ্যা করবে। কেন ঢাকা আমার জন্যে খারাপ আর তোমার জন্যে পান্তুয়া।

শাহেদ বিরক্ত হয়ে বলেছে, আচ্ছা ঠিক আছে, তুমি থাকে। তোমাকে কোথাও যেতে হবে না।

আসমানী গম্ভীর গলায় বলেছে, ঠিক করে বলো তো, কোনো কারণে কি আমাকে তোমার অসহ্য বোধ হচ্ছে? কথায় কথায় নীলগঞ্জ চলে যাও। যেন আমি নীলগঞ্জ চলে গেলে তুমি হাঁপ ছেড়ে বাচ। আমি একা নীলগঞ্জ গিয়ে কী করব? তোমার মাওলানা ভাইয়ের সঙ্গে হাদিস-কোরান নিয়ে গল্প করব?

বললাম তো যেতে হবে না।

আর আমাকে যদি যেতেই হয় আমি নীলগঞ্জ যাব কেন? আমার কি যাওয়ার জায়গার অভাব আছে?

সামান্য ব্যাপার নিয়ে তুমি বাড়াবাড়ি করছি আসমানী।

শুধু আমি সামান্য ব্যাপার নিয়ে বাড়াবাড়ি করি? তুমি করো না? তুমি কি সবসময় অসামান্য ব্যাপার নিয়ে বাড়াবাড়ি করো? ঐ দিন চায়ে চিনি বেশি হয়েছিল বলে তুমি কি কাপসুদ্ধ চা মেঝেতে ছুঁড়ে ফেলে দাও নি?

ব্যাপারটা এখানেই শেষ হতে পারত। শেষ হলো না। আসমানী বালিশ নিয়ে উঠে গেল। শাহেদ বলল, কোথায় যােচ্ছ?

আসমানী বলল, তা দিয়ে তোমার দরকার কী? তুমি তোমার ঘুম ঘুমাও। আমি পাশে নেই, কাজেই রাতে ভালো ঘুম হওয়ার কথা। কে জানে হয়তো সুন্দর সুন্দর স্বপ্নও দেখবে।

আসমানী ঘুমুতে গেল বসার ঘরের সোফায়। শাহেদ এই সোফার নাম দিযেছে। রাগ-সোফা। স্বামী-স্ত্রীর ভেতর ঝগড়া হলে একজন কেউ সেই সোফায় গিয়ে শোয়। সেই একজনটা বেশিরভাগ সময়ই আসমানী।

আসমানী সোফায় ঘুমুতে গেছে। শাহেদ আছে বিছানায়। রুনি তার সঙ্গে। আসমানী রাগারগি যাই করুক রুনিকে সঙ্গে নিয়ে মশার কামড় খাওয়ায় না। শাহেদ মশারির ভেতর বসে আছে। তার কাছে মনে হচ্ছে, এমন কিছু ঘটে নি যে রাতে আলাদা ঘুমুতে হবে। ব্যাপারটা বাড়াবাড়ি তো বটেই। আসমানী বেশ কিছুদিন থেকে বাড়াবাড়ি করছে। দেশের অনিশ্চিত অবস্থা মনের উপর চাপ ফেলে, সবাই কিছুটা হলেও অস্বাভাবিক আচরণ করে। সেই যুক্তিতে আসমানীকে ক্ষমা করা যায়। পরীক্ষণেই মনে হলো, প্রতিবার আগ বাড়িয়ে এত ক্ষমার দরকার কী? সে হবে ক্ষমার সাগর আর আসমানী হবে চৌবাচ্চা। কেন? দেখি না কথা না-বলে কত দিন থাকা যায়।
 
শাহেদ প্যান্ট পরতে পরতে ভাবল, কথা বলা শুরু করা যাক। এমনিতেও নিজের কোমর সরু হয়ে গেছে কিংবা প্যান্টের কোমর কোনো এক অস্বাভাবিক কারণে বড় হয়ে গেছে। বেল্ট ছাড়া পরা যাবে না। বেল্ট খুঁজে বের করা যাবে না। আসমানীকে বললে সে নিমেষে বের করে দেবে। জিনিস খুঁজে বের করার অলৌকিক ক্ষমতা আসমানীর আছে।

শাহেদ বলল, (আসমানীর দিকে না তাকিয়ে) বেল্টটা কোথায় দেখ তো।

আসমানী বলল, দেখছি, তুমি যােচ্ছ কোথায় বলে।

কাজ আছে, কাজে যাচ্ছি।

কোনো কাজে যাওয়া-যাওয়ি নেই। রুনিকে ডাক্তারের কাছে নিতে হবে। চার দিন ধরে জ্বর চলছে। তুমি তো কপালে হাত দিয়ে মেয়ের জ্বরটা পর্যন্ত দেখ নি।

সন্ধ্যাবেলা নিয়ে যাব।

সন্ধ্যাবেলা না, এখনি নিয়ে যাবে।

এখন ডাক্তার পাব কোথায়?

তাহলে অপেক্ষা করো, যখন ডাক্তার পাবে তখন নিয়ে যাবে। এর আগে

বেরুতে পারবে না।

আসমানী, তোমার কি মনে হয় না। তুমি বাড়াবাড়ি করছি? বাড়াবাড়ি করলে করছি, তুমি বেরুতে পারবে না। আমি তোমাকে যেতে দেব না।

শাহেদ শান্তমুখে জুতাব ফিতা লাগাচ্ছে। জুতার ফিতা লাগানোর সহজ কাজটা সে কখনো ঠিকমতো করতে পারে না। কীভাবে কীভাবে প্যাচ লেগে আন্ধা গিন্টু হয়ে যায়। এবারো বোধহয় হয়ে গেল।

আসমানী শীতল গলায় বলল, তুমি তাহলে বেরুচ্ছ?

হুঁ।

বেশ, যাও, বাসায় ফিরে এসে কিন্তু আমাকে দেখবে না।

তুমি যাবে কোথায়?

যেখানে ইচ্ছা যাব, তা নিয়ে তোমাকে মাথা ঘামাতে হবে না।

বেল্ট খুঁজে দিতে বলছি, খুঁজে দাও।

বেল্টটা খুঁজে বের করতে পারব না। তুমি খুঁজে নাও। তুমি অন্ধ না, তোমার চোখ আছে।

শাহেদ ঘর থেকে বের হলো মন খারাপ করে। আসমানী অবুঝের মতো আচরণ করছে। এরকম সে কখনো ছিল না। তার হয়েছেটা কী? না-কি সমস্যা তার? সে এমন কিছু করছে যে আসমানী রেগে যাচ্ছে? দুজনের কেউ কাউকে বুঝতে পারছে না।

বাসায় ফিরতে ফিরতে শাহেদের সন্ধ্যা হয়ে যাবে এবং সে নিশ্চিত বাসায় ফিরে দেখবে দরজায় তালা ঝুলছে। আসমানী রুনিকে নিয়ে চলে গেছে। তখন আবার বের হতে হবে তাদের খোজে। ঢাকায় মা-বাবা ছাড়াও আসমানীর বেশ কিছু আত্মীয়স্বজন আছে। সে এমন একজনের বাড়িতে উঠবে যার ঠিকানা শাহেদ জানে না। দেশের পরিস্থিতি ভয়াবহ। যে-কোনো সময় শহরে মিলিটারি নেমে যাবে। অতি যে মুর্থ সেও এই সত্যটা খুব ভালো করেই জানে। জানে না শুধু আসমানী। সে ফিট করে রিকশা নিয়ে বের হয়ে পড়বে। এই সময়ে আর যাই করা যাক ছেলেমানুষি করা যায় না। আসমানী বেছে বেছে ছেলেমানুষি করার জন্য এই সময়টাই বেছে নিয়েছে। আশ্চর্য এক মেয়ে!
 
রাস্তায় পা দিয়েই শাহেদের মন ভালো হয়ে গেল। ব্যাপারটা সে আগেও লক্ষ করেছে–ইদানীং উদ্দেশ্যহীনভাবে রাস্তায় রাস্তায় হাঁটতে তার ভালো লাগে। এর কারণ কী হতে পারে? নগরী কোনো বিশেষ ঘটনার জন্যে প্ৰস্তৃত হচ্ছে। সেই প্ৰস্তুতি কাছ থেকে দেখার আনন্দ? নগরীর উত্তেজনার সাক্ষী হবার আনন্দ? নগরীর মানুষরা অনেক কাছাকাছি চলে এসেছে, সেই কাছাকাছি আসার আনন্দ?

বড় বড় উৎসবের আগে আগে এই ঘটনাগুলি ঘটে। কোরবানির ঈদে গরু কিনে পথে হাঁটার সময় অপরিচিতজনরা আনন্দের সঙ্গে কাছে এসে জিজ্ঞেস করে, কত দিয়ে কিনলেন? দাম শোনার পর খুশি খুশি গলায় বলে, ভাই আপনি জিতেছেন। গরু মাশাল্লাহ ভালো হয়েছে।

ঠিক এইরকম ব্যাপার এখন ঘটছে। যে দোকানে চাল-ডাল কিনতে যাচ্ছে তাকে নিতান্ত অপরিচিত মানুষ অন্যদের সঙ্গে উপদেশ দিচ্ছে— কেরোসিন বেশি করে কিনে রাখেন। কেরোসিনের শটেজ হবে। কেরোসিন, দেয়াশলাই আর মোমবাতি।

চায়ের দোকানে চা খেতে গেলে পাশ থেকে কেউ একজন অবধারিতভাবে জিজ্ঞেস করবে, ভাইসাহেব, দেশের অবস্থা কী বুঝেন? দেশ কি স্বাধীন হবেআপনার কী ধারণা? দেশ স্বাধীন হবে কি হবে না। এই নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে দীর্ঘ আলোচনা চলে। আশপাশের লোকজনও তাতে অংশ নেয়। এক সময় আলোচনা ঐকমত্যে শেষ হয়। দেশ যে স্বাধীন হবে–এই বিষয়ে সবাই একশ ভাগ নিশ্চিত হয়। এই উপলক্ষে আরেক দফা চা খাওয়া হয়।

নগরী স্বাধীনতার জন্যে অপেক্ষা করছে। এই অপেক্ষা খুব কাছ থেকে দেখা এক আনন্দময় অভিজ্ঞতা। শাহেদ মনের আনন্দে দুপুর একটা পর্যন্ত পথে পথে ঘুরল।

রোদ উঠেছে কড়া। ঘামে শরীর ভিজে গেছে। বাসায় গিয়ে সাবান ডলে গোসলটা আরামদায়ক হবে কিন্তু শাহেদের বাসায় যেতে ইচ্ছা করছে না। আসমানীর কাছে রাগ দেখাতে ইচ্ছা করছে। সে যদি রাত বারোটা পর্যন্ত বাইরে থাকে তাহলে রাগ দেখানোটা জামবে।

শাহেদ রিকশা নিয়ে নিল। সে যাবে আগামসি লেনে। সেখানে দুটা রুম ভাড়া করে তার অতি ঘনিষ্ঠ বন্ধু নাইমুল থাকে। তার সঙ্গে অনেক দিন যোগাযোগ নেই। নাইমুলের সমস্যা হলো, সে নিজ থেকে কারোর সঙ্গে যোগাযোগ করবে না। অন্যদের তার কাছে যেতে হবে।

প্ৰচণ্ড বেগে মধ্যবয়স্ক রিকশাওয়ালা ঝড়ের মতো রিকশা টানছে। শাহেদ বলল, কোনো তাড়াহুড়ো নাইরে ভাই, রিকশা আস্তে চালাও। রিকশার গতি তাতে কমল না। রিকশাওয়ালা দাঁত বের করে বলল, টাইট দিয়া বসেন, উড়াল দিয়া নিয়া যাব।

শাহেদ বলল, উড়াল দেয়ার দরকার নাই। এক্সিডেন্ট করবে। জানে মরব। এখন মরে গেলে স্বাধীন দেশ দেখে যেতে পারব না।

স্বাধীন। তাইলে আইতেছে কী কন স্যার?

আসছে তো বটেই।

আইজ শেখ সব স্বাধীন ডিক্লার দিব।

কে বলেছে?

এইটা সবেই জানে।

রিকশাওয়ালা রিকশার গতি কমাল। সম্ভবত স্বাধীনতা নিয়ে যাত্রীর সঙ্গে কথা বলতে তার ভালো লাগছে।

স্বাধীন হইলে আমরার মতো গরিবের দুঃখ-কষ্ট কিছু থাকব না, কী কন স্যার?

থাকার তো কথা না।

খাওয়া-দাওয়া, কাপড়-চোপড় সব দিব ইসটেট। ঠিক না। স্যার? সবই ফিরি।

শাহেদ চুপ করে বাইল। স্বাধীনতার এই চিত্রটা নিয়ে আলোচনায় না। যাওয়াই ভালো।

শেখ সাব একটা বাঘের বাচ্চা। কী কন্ন স্যার?

অবশ্যই বাঘের বাচ্চা।

খাঁটি মায়ের খাঁটি দুধ খাইয়া বড় হইছে। কী কন স্যার?

অবশ্যই।

জীবনে একটা শখ ছিল শেখ সাবরে একদিন আমার রিকশায় তুলব। বিষুদবার হাইকোর্টের মাজারে গিয়া দোয়াও করছি। জানি না দোয়া কবুল হইব কি না।

শাহেদ বলল, সৎ দোয়া সৎ ইচ্ছা সব সময় কবুল হয়।
 
আগামসি লেনে নেমে শাহেদ ভাড়া দিতে গেল। রিকশাওয়ালা ভাড়া নিবে না। শাহেদ বলল, ভাড়া নিবে না কেন? রিকশাওয়ালা বলল, স্বাধীন হইলে তো সবই ফিরি হইব। ধরেন দেশ স্বাধীন হইছে।

শাহেদ রিকশাওয়ালার দিকে তাকিয়ে আছে। এর চেহারা মনে রাখা দরকার। দেশ যদি সত্যি সত্যি স্বাধীন হয়, তখন একে খুঁজে বের করতে হবে।

ভোঁতা। পাথরের মতো মুখ। মাথার চুল খাবালা-খাব লাভাবে উঠে গেছে। কোনো একজন বিখ্যাত লোকের চেহারার সঙ্গে রিকশাওয়ালার চেহারার মিল আছে। সেই লোকটাকে মনে পড়ছে না। রিকশাওয়ালা হাসিমুখে বলল, এমন নজর কইরা কী দেখোন?

তার কথা শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গে শাহেদের বিখ্যাত লোকের নামটা মনে পড়ল। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট জর্জ ওয়াশিংটন।



নাইমুলের ঘরের দরজা বন্ধ। কড়ায় ঝাকুনি দিতেই নাইমুল বলল, দরজা খোলা আছে। জোরে ধাক্কা দিলেই খুলবে। ভেতরে চলে আয়।

ঘরে ঢুকতে ঢুকতে শাহেদ বলল, আমি কড়া নাড়ছি বুঝলি কী করে? তুই তুই করছিলি। অন্য কেউ তো হতে পারত।

নাইমুল বলল, অনুমানে বলেছি। সাত-আট দিন পর পর তোর দেখা পাওয়া যায়। আজ নাইনথ ডে।

নাইমুল খালি গায়ে লুঙ্গি পরে বিছানায় শুয়ে আছে। তার মুখের উপর মোটা একটা বই ধরা। সতীনাথ ভাদুড়ির জাগরী। ঘর খুবই ছোট। কোনোমতে একটা খাট এবং একটা চেয়ার-টেবিল এটেছে। ঘরে একটা আলনা আছে, সেই আলনা বসানো আছে খাটের মাথায়। সেই কারণে খাট ছোট হয়ে গেছে। নাইমুলের মতো লম্বা মানুষ পা মেলে ঘুমুতে পারে না, তাকে পা খানিকটা গুটিয়ে রাখতে হয়। তবে ঘরের সিলিং অনেক উচুতে। সেই উচু সিলিং থেকে লম্বা রডের মাথায় ফ্যান ঘুরছে। নাইমুল বই থেকে চোখ না। সরিয়ে বললকোনো কথা না। স্ট্রেইট বাথরুমে চলে যা। বালতিতে পানি তোলা আছে। সাবান আছে, গামছা আছে, একটা লুঙ্গিও আছে। আরাম করে গোসল কর। তারপর কথা হবে।

শাহেদ বলল, বাসায় গিয়ে গোসল করব।

যা বলছি শোন। তোর ঘামে ভেজা শরীর দেখে আমারই অস্বস্তি লাগছে।

শাহেদ বাথরুমে ঢুকে পড়ল। গায়ে পানি ঢালার পর তার মনে হলো, দীর্ঘ একত্ৰিশ বছর জীবনে সে এত আরামের গোসল কোনো দিনও করে নি।

নাইমুল বলল, এই গাধা, গোসল করে আরাম পাচ্ছিস?

শাহেদ বলল, পাচ্ছি।

নাইমুল বলল, দুই বালতি পানি আছে। প্রথম বালতি পানি গায়ে ঢেলে শরীর ঠাণ্ডা কর। শরীর পুরোপুরি ঠাণ্ডা হবার পর গায়ে সাবান মাখবি। তাড়াহুড়ার কিছু নেই, ধীরে সুস্থে সাবান মাখ। তারপর সেকেন্ড বালতি। দুপুরে কি আমার এখানে খাবি?

খেতে পারি।

তাহলে তোকে আজ ইলিশ মাছের ডিম খাওয়াব। এই ডিম খাওয়ার পর পৃথিবীর কোনো খাবার তোর মুখে রুচিবে না।

ডিম কে রাধছে?

গনি মিয়া বাবুর্চি। হোটেলে বলা আছে। খাওয়া যথাসময়ে চলে আসবে। হড়বড় করে পানি ঢালছিস কেন? আস্তে আস্তে ঢাল। শরীর আরাম পাক।

শাহেদ গায়ে পানি ঢালছে। আরামে ঘুম পেয়ে যাচ্ছে। ইচ্ছা করছে বাথরুমের ঠাণ্ডা মেঝেতে শুয়ে খানিকক্ষণ ঘুমায়। সে ঘুমাবে কেউ একজন গায়ে পানি ঢালবে। নাইমুলের গলা শোনা গোল— শাহেদ, তোকে বলা হয় নি। আমি বিয়ে করছি।

শাহেদ বলল, সে কী!

নাইমুল বলল, চমকে উঠলি কেন? আমি চিরকুমার থাকিব–এরকম তো কখনো বলি নি।

মেয়ে দেখা হয়েছে?

হঁ। চাকমা টাইপ চেহারা।

বলিস কী! মেয়েও ঠিক হয়ে গেছে? আমরা কিছুই জানলাম না।

বিয়ে করব আমি, তোদের জানার দরকার কী?

বিয়ের তারিখ ঠিক হয়েছে?

হ্যাঁ।।

কবে?

আজ।

ঠাট্টা করছিস?

আমি জীবনে কখনো কারো সঙ্গে ঠাট্টা করেছি–এরকম উদাহরণ আছে?

বিয়ে কখন?

রাতে। কাজি ডাকিয়ে বিয়ে। কবুল কবুল কবুল— ঝামেলা শেষ।
 

Users who are viewing this thread

Back
Top