What's new
Nirjonmela Desi Forum

Talk about the things that matter to you! Wanting to join the rest of our members? Feel free to sign up today and gain full access!

Collected ছোছনা ও জননীর গল্প - উপন্যাস (1 Viewer)

গৌরাঙ্গ হঠাৎ খুবই বিস্মিত হয়ে বলল, খাঁচাতে করে কী এনেছিস? পাখি? (সামান্য মদ্যপান করার পরই সে শাহেদকে তুই করে বলে।)

শাহেদ বলল, হ্যাঁ।

গৌরাঙ্গ বলল, তুই নীলিমাকে জিজ্ঞেস করে দেখ– আমি কিন্তু তাকে বলেছি। শাহেদ আজ পাখি নিয়ে আসবে। সন্ধ্যার সময় হঠাৎ করে মনে হলো। প্রথমে আমি বললাম রুনুকে, তারপর বললাম তার মাকে। তোর তো বিশ্বাস হচ্ছে না। তুই রুনুকে প্রথম জিজ্ঞেস কর, তারপর রুনুর মাকে জিজ্ঞেস করা। তোর চোখ দেখেই মনে হচ্ছে তুই বিশ্বাস করছিস না।

শাহেদ বলল, বিশ্বাস হবে না কেন? বিশ্বাস হচ্ছে।

তারপরেও তুই জিজ্ঞেস করা। তোকে জিজ্ঞেস করতে হবে।

নীলিমা বলল, ভাই, আপনি জিজ্ঞেস করে ঝামেলা মিটিয়ে ফেলুন তো। জিজ্ঞেস না করা পর্যন্ত সে একই কথা বলতে থাকবে। আপনি যে পাখি নিয়ে আসবেন এটা সে সত্যি বলেছে। আমার কথাটা বিশ্বাস করুন। আপনি বিশ্বাস না করা পর্যন্ত সে হৈচৈ করতেই থাকবে।

গৌরাঙ্গ বলল, তোমার কি ধারণা আমি মাতাল হয়ে গেছি?

নীলিমা বলল, হ্যাঁ।

গৌরাঙ্গ আহত গলায় বলল, তুমি আমার বন্ধুর সামনে আমাকে মাতাল বললে? তুমি? আজকের এই very specialday-তে?

শাহেদ বলল, আজকের দিনটা কী? ম্যারেজ অ্যানিভার্সারি?

নীলিমা বলল, এইসব কিছু না। ও শুধু শুধু হৈচৈ করছে।

গৌরাঙ্গ স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে বলল, আমার বন্ধু আজ রাতে থাকবে। আগে তার ঘর ঠিক করা। তার রাতে একটু পর পর জল খাওয়ার অভ্যাস। জলের ব্যবস্থা রাখা। একটা জগ আর গ্লাস।

নীলিমা বলল, উনি যদি থাকেন তাহলে কী দিতে হবে দিতে হবে না তা আমি জানি।

গৌরাঙ্গ বলল, তুমি কিছুই জানো না। তুমি যা পার তার নাম কটকট করে কথা বলা। তুমি কটকটি রানী। এর বেশি কিছু না। কটকটি, তুমি এখন আমার সামনে থাকবে না। তোমাকে দেখলেই আমার রাগ লাগছে। তুমি আমার বন্ধুর রাতে থাকার ব্যবস্থা করো।



যে-কারণে আজ শাহেদের নিমন্ত্রণ সেই কারণ জানা গেল। গৌরাঙ্গের শ্বশুর। তাকে নগদ আঠারো হাজার টাকা দিয়েছেন। গৌরাঙ্গ নিচু গলায় বলল, চামচিকার ভীমরতি হয়েছে। সে ইন্ডিয়া চলে যাচ্ছে। বুড়ার মাথায় বুদ্ধির ছিটাফোটা নাই। দেশ জয় বাংলা হয়ে যাচ্ছে। আমরা তখন আর সেকেন্ড ক্লাস সিটিজেন থাকব না। আমাদের অবস্তা হবে–নিজের দেশের মাটি দাবাদবাইয়া হাঁটি টাইপ। তুই এখন কেন চলে যাচ্ছিস? ইন্ডিয়া গিয়ে তুই করবি কী? তোর পাকা… ছিড়বি?

শাহেদ বলল, প্রথম সুসংবাদটা তো শুনলাম। দ্বিতীয়টা কী?

গৌরাঙ্গ বলল, দ্বিতীয়টা ফালতু।

ফালতুটাই শুনি।

নীলু রেডিও অডিশনে পাস করেছে। রবীন্দ্রসঙ্গীত। সি গ্রেড পেয়েছে।

শাহেদ বিস্মিত হয়ে বলল, ভাবি গান জানেন–তা তো জানতাম না!

গৌরাঙ্গ বিরক্ত ভঙ্গিতে বলল, রবীন্দ্রসঙ্গীত আবার গাইতে জানতে হয় নাকি? রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইতে হলে হাঁপানি থাকতে হয়, আর না-কি সুরে গলা টানতে হয়। তোর বৌদির হাঁপানি আছে। আর নাকেও সে কথা বলতে পারে।

শাহেদ বলল, ভাবির গান শুনব না।

গানের নামও মুখে আনবি না। তোর বৌদির হাঁপানির টান আমার অসহ্য। আমার সিক্সথ সেন্স কেমন প্রবল হয়েছে সেটা বল। কী সুন্দর। এডভান্স বলে দিলাম–তুই পাখি নিয়ে আসবি। পয়েন্টে পয়েন্টে মিলেছে কি-না বল।

মিলেছে।

আমি এডভান্স অনেক কিছু বলতে পারি। ঐ চামচিকা ইন্ডিয়াতে পৌঁছেই খাবি খেয়ে মারা যাবে, এটাও তোকে এডভান্স বলে দিচ্ছি। মিলিয়ে নিস।

গৌরাঙ্গ গ্লাসে লম্বা করে চুমুক দিয়ে দেখতে দেখতে ঘুমিয়ে পড়ল।

শাহেদ রাতের খাওয়া খেল একা। নীলিমা বলল, আপনাকে একা খেতে হচ্ছে। আমি খুবই লজ্জা পাচ্ছি। রুনুও বাসায় নেই। ও থাকলে আপনার সঙ্গে বসত।

রুনু কোথায়?

সে উপরেরতলায় ওর দিদিমার কাছে। তার শরীরটা ভালো না। জ্বর এসেছে। আমি আপনার পাখির খাঁচা তাকে দিয়ে এসেছি। খুব খুশি। ও আচ্ছা! ভাই, আপনাকে একটা কথা বলা দরকার–আপনি আজ পাখি নিয়ে আসবেন এরকম কোনো কথা রুনুর বাবা বলে নি। মদ বেশি খেয়ে ফেলেছে বলে যা মনে আসছে বলছে। ভাই, আপনাকে একটা অনুরোধ করব, আপনি কি রাখবেন?

শাহেদ বলল, অবশ্যই রাখব।

আপনার বন্ধু আপনাকে এতই পছন্দ করে যে সে আপনার কোনো কথা ফেলবে না। আপনি কি তাকে একটু বলবেন মদটা ছেড়ে দিতে? আমি নিশ্চিত আপনি একবার বললে সে আর এই জিনিস খাবে না।

ভাবি, আমি বলব।



রাত দুটায় হৈচৈ-এর শব্দে শাহেদের ঘুম ভাঙল। হৈচৈ-এর কারণ গৌরাঙ্গের ঘুম ভেঙেছে। কিছুক্ষণের মধ্যে সে স্ত্রীর হাত ধরে শাহেদের ঘরে ঢুকল। গম্ভীর গলায় বলল, তুই গান শুনতে চেয়েছিলি, ওকে নিয়ে এসেছি।

শাহেদ বলল, বেচারি সারাদিন খাটাখাটনি করেছে। এখন রাত দুটা। আরেকদিন এসে গান শুনব।

গৌরাঙ্গ বলল, আরেকদিন কী? আজই গান হবে। আমি তবলা হারমোনিয়াম নিয়ে আসছি।

শাহেদ বলল, তবলা কে বাজাবে?

গৌরাঙ্গ বলল, আমি বাজাব। আর কে বাজাবে?

নীলিমা গান করছে। শাহেদ অবাক হয়ে কিন্নর কণ্ঠ শুনল। মনে হচ্ছে অনেক দূর থেকে কেউ অতি সুরেলা গলায় গান করছে—

ওপারে মুখর হলো কেকা ঐ
এপারে নীরব কেন কুহু হায়
 
পুলিশ ইন্সপেক্টর মোবারক হোসেন গত দুবছরে সকাল হওয়া দেখেন নি। তিনি ঘুমুতে যান রাত দেড়টার দিকে। তাঁর ঘুমের সমস্যা আছে। শোয়ামাত্র ঘুম আসে না। এপাশ ওপাশ করতে করতে কোনোদিন রাত তিনটাও বেজে যায়। যে রাত তিনটায় ঘুমুতে যায়, সে সুবেহসাদেক দেখবে এরকম আশা করা অন্যায়। তবে আজ তিনি বাড়ির ছাদে উঠে সকাল হওয়া দেখলেন। সোবহানবাগে তাঁর একতলা পাকাবাড়ির ছাদটা সুন্দর। ছাদে উঠলে মনে হয় গ্রামে চলে এসেছেন। চারদিকে প্রচুর গাছপালা থাকায় উপর থেকে কেমন জঙ্গল জঙ্গল লাগে। গাছপালার মাথায় রাত কেটে সকাল হওয়ার দৃশ্য অপূর্ব, যে-কেউ মোহিত হবে। মোবারক সাহেব এই দৃশ্য দেখলেন, মোহিত হলেন, এরকম বলা যায় না। কোনো কিছু দেখে মোহিত হওয়া তার চরিত্রের মধ্যে নেই। তাঁর মন অসম্ভব খারাপ। শরীরও খারাপ, প্রচণ্ড মাথা ধরেছে। এই অবস্থায় প্রকৃতির শোভায় মন বসে না।

তার স্ত্রীর সন্ধ্যা থেকে প্ৰসব ব্যথা শুরু হয়েছে। পানি ভেঙেছে রাত একটার দিকে। তখন থেকেই খিচুনির মতো হচ্ছে। লক্ষণ ভালো না, তবে মোবারক হোসেন তার জন্য খুব চিন্তিতও বোধ করছেন না। মেয়েছেলের প্রাণ, কই মাছের প্রাণের চেয়েও শক্ত। যাই যাই করবে। কিন্তু যাবে না। ঘরে অভিজ্ঞ ধাই আছে। এর হাতেই তার আগের তিনটি সন্তান হয়েছে। তিনটাই মেয়ে। খুবই আফসোসের ব্যাপার। এবারেরটা ছেলে হবার সম্ভাবনা আছে। আজমির শরিফের সুতা এনে পরানো হয়েছে। শাহজালাল সাহেবের দরগায়ে তিনি নিজে গিয়ে সিন্নি চড়িয়ে এসেছেন। সময়ের অভাবে শাহ পরাণের মাজারে যেতে পারেন নি। এটা একটা ভুল হয়েছে। শাহ পরাণ শাহ জালাল সাহেবের ভাগ্নে। মামা-ভাগ্নে দুজনের কবর জিয়ারত না করলে মনের বাসনা পূর্ণ হয় নাএরকম কথা প্ৰচলিত আছে।

এবার যে তার স্ত্রীর প্রসব ব্যথা জটিল আকার ধারণ করেছে–এটা একটা শুভ লক্ষণ। পুত্রসন্তান প্রসবে যন্ত্রণা বেশি হয়। জমিলার ব্যথার নমুনা দেখে আশা করা যাচ্ছে শুভ সংবাদ পাওয়া যাবে। তবে মানুষ সব সময় যা আশা করে তা হয় না, এটাই চিন্তার কথা।

তার এখন খারাপ সময় যাচ্ছে। ছিলেন আইবিতে, সাদা পোশাক থেকে হঠাৎ বদলি করে দিল ইউনিফর্মে। তাঁর খুশি হওয়ারই কথা। পায়জামা-পাঞ্জাবি পরা পুলিশ ইন্সপেক্টর হলো ডাল বরাবর। তাদের দেখায় প্রাইভেট কলেজের বাংলার প্রফেসরের মতো। বাজারে গেলে মাছওয়ালাও ফিরে তাকায় না। পুলিশের চাকরির আসল মজা ইউনিফর্মে। দেখামাত্র সবাই সমীহ করে তাকাবে। কিন্তু এমনই তাঁর কপাল, খাকি পোশাকটা পরার পর থেকেই শুরু হলো যন্ত্রণা। পোশাকটা পরার পর থেকে বলতে গেলে রোজই হাঙ্গামা হুজ্জত হচ্ছে। বাঙালি অদ্ভুত এক জাতি। যাদের বিশ্বাস করে তাদের সব কথা বিশ্বাস করে। তারা যদি বলে–চিলে কান নিয়ে গেছে— কান নিয়েছে কি নেয় নি। যাচাই করে না। গালের পাশে হাত দিলেই বুঝবে কান এখনো আছে। জুলপির পাশে ঝুলছে। তারপরেও লাঠিসোটা নিয়ে দলবেঁধে ছুটতে থাকে চিলের পিছনে। আবার যাদের অবিশ্বাস করে তাদের কোনো সত্য কথাও বিশ্বাস করে। না। তথ্যমন্ত্রী সাহাবুদিন সাহেব বললেন, রবীন্দ্রসঙ্গীত ইসলাম এবং পাকিস্তানের ঐতিহ্যের পরিপন্থী বলে রেডিও-টেলিভিশনে রবীন্দ্রসঙ্গীত প্রচারিত হবে না। এতেই লেগে গেল ধুন্ধুমার কাণ্ড। ধরোরে, মারোরে, জ্বালাওরে, পোড়াওরে। একটা লোক একটা কথা বলেছে তাতেই এই? রবীন্দ্রসঙ্গীত এমন কী রসগোল্লা? প্যানপ্যানানি ছাড়া আর কী? তথ্যমন্ত্রী তো ভুলও বলেন নি। ইসলামি কোনো গান কি রবীন্দ্ৰনাথ লিখেছেন? তার কোনো গানে কি মা আমিনার কথা আছে? নজরুল তো অনেক হিন্দু-গান লিখলেন। শ্যামাসঙ্গীত। রবীন্দ্রনাথ দুএকটা ইসলামি গান তো লিখতেও পারতেন। যে গান লিখতে পারে, সে হিন্দু গান মুসলমান গান সবই লিখতে পারে। লিখলেন না কেন? দাড়ি রাখার সময় তো এক হাত লম্বা দাড়ি রেখে ফেললেন। কুর্তা যেটা পরেন। সেটাও তো ইসলামি কুর্তা। তিনি যদি দুএকটা ইসলামি গান লিখতেন, তাহলে এই সমস্যা হতো না।

মিটিং মিছিল, লাঠি চার্জ, কাদানি গ্যাস। সামান্য গানের জন্যে কী অবস্থা!
 
সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি হামিদুর রহমান সাহেব একটা কথার কথা বলেছেন। সেটা নিয়েও কত কাণ্ড! সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি তো আর ঘাস খেয়ে হয় না। এরা যখন কথা বলে অনেক চিন্তা-ভাবনা করে বলে। ভদ্রলোক আরবি হরফে বাংলা লেখার কথা বলেছেন। কথা যে খুব খারাপ বলেছেন তাও তো না। গ্রামের অনেক মানুষ আছে, যারা বাংলা জানে না। কিন্তু কোরান শরীফ পড়তে পারে। তারা তখন বাংলাও পড়তে পারবে। এটা খারাপ কী? আরবি হরফে বাংলা লিখলে বাংলার ইজ্জত কমে না। ইজ্জত বাড়ে। নবিজীর ভাষায় বাংলা লেখা হচ্ছে এটা কি কম কথা? কত বড় ইজত! আচ্ছা তারপরেও তর্কের খাতিরে ধরে নিলাম এটা খারাপ। যদি খারাপ হয়ও এত হৈচৈ করার কী আছে? অদ্ভুত একটা জাতি। শান্তি চায় না, চায় অশান্তি। অশান্তি ছাড়া তাদের ভালো লাগে না। আয়ুব খানের মতো নেতাকে পছন্দ না। ভোট দিতে হবে খুড়গুড়ি বুড়ি ফাতেমা জিন্নাহকে। মেয়েছেলে হবে দেশের প্রধান। কথা হলো? হাদিস-কোরানে আছে মেয়েছেলেকে রাষ্ট্রপ্রধান করা যাবে না। সেই ফাতেমা জিন্নাহকে ভোট দেওয়ার জন্য লাফাচ্ছে মাওলানা ভাসানী। হাদিসকোরান জানা একজন মানুষ। নামের আগে মাওলানা। তাকে ভোট দিলে তোমার লাভটা কী? দেশে অশান্তি হয় এটাই লাভ । কী আশ্চর্য দেশ! কী আশ্চর্য দেশের নেতা!

নতুন একটা জিনিস শুরু হয়েছে–দফা। আজ ছয় দফা। কাল এগারো দফা। তারপরের দিন চৌদ্দ দফা। দফাই যে দেশের দফা রফা করবে। এই সাধারণ জ্ঞানটা যে জাতির নাই, সে জাতির ভবিষ্যৎ তো অন্ধকার।

মোবারক হোসেনের ধারণা আগরতলা মামলাটা প্রত্যাহার করা আয়ুব খানের জন্য খুব বড় বোকামি হয়েছে। আয়ুব খান বোকা না, সে এত বড় বোকামি করল কেন? এই কাজটায় তার দুর্বলতা প্ৰকাশ পেয়েছে। বাঙালি জাতি দুর্বলতার গন্ধ পেলে লাফিয়ে ওঠে। এখন শুরু করেছে। লাফ-বাপ। শেখ মুজিবুর রহমান হিরো বনে গেছেন; আয়ুব খানের উচিত ছিল ফাঁসিতে ঝুলিয়ে দেওয়া। দশ-বারোটাকে ফাঁসিতে ঝোলালে সব ঠাণ্ডা হয়ে যেত। বাঙালি গরমের ভক্ত নরমের যম। একটু নরম দেখলে আর উপায় নেই–ঝাঁপ দিয়ে পড়বে। তারা যত বাপ দেবে পুলিশ তত বিপদে পড়বে। বাঙালি জাতির যত রাগ খাকি পোশাকের দিকে। পুলিশের দিকে ঢ়িল মারতে পারলে তারা আর কিছু চায় না। আসাদুজ্জামানের মৃত্যুর পর পর কী অবস্থা! মানুষ দেখতে দেখতে ক্ষেপে গেল। তার নিজের জীবন নিসে টানাটানি। আরেকটু হলে মারাই পড়তেন। আস্ত একটা ইট এসে পড়ল বা হাতের কনুইতে। মট করে শব্দ। হাত যে ভেঙে গেছে তখনো বোঝেন নি। বোঝার কথা না। মাথা ছিল পুরোপুরি আউলা। ভাঙা হাত জোড়া লাগলেও পুবোপুরি সারে নি। অমাবশ্যা-পূর্ণিমায় ব্যথা হয়। হাতে জোর বলতে কিছু নেই। পানিভর্তি গ্লাস পর্যন্ত এই হাতে তুলতে পারেন না।

মোবারক হোসেন বিষণ্ণ মুখে ছাদ থেকে নেমে এলেন।

বাড়ির ভেতর থেকে তখনো কোনো খবর আসে নি। লেডি ডাক্তারের খোজে। একজন গিয়েছে। পাশের বাড়ির ভদ্রমহিলা এসেছেন। ভদ্রমহিলা খুব পর্দা মানেন। আজ দেখা গেল পর্দার বরখেলাপ করেই মোবারক হোসেনের সঙ্গে কথা বললেন। কথার বিষয়বস্তু হচ্ছে; রোগীকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া।

মোবারক হোসেন বললেন, আচ্ছা, দেখি। জ্ঞার মেজাজ আরো খারাপ হলো। রোগী আবার কী! গৰ্ভবতী মহিলা সন্তান প্রসব করছে। সাধারণ একটা ব্যাপার। হাসপাতাল-ফাসপাতাল আবার কী!
 
সকাল আটটার দিকে জমিলার অবস্থা আরো খারাপ হলো। খিচুনি বেড়ে গেল। তিনি ক্লান্ত গলায় তার মাকে ডাকতে লাগলেন। সেই মা অনেককাল আগে মারা গেছেন। কন্যার অসহনীয় কষ্টের সময় তিনি পাশে থাকতে পারবেন। না। তাঁর কন্যা বারবার ডাকতে লাগল, মাইজি ও মাইজি।

দুপুর একটায় জমিলা একটি পুত্রসন্তান প্রসব করে মারা গেলেন।

মোবারক হোসেন স্ত্রীর মৃত্যুতে দুঃখিত হলেন ঠিকই, সেই দুঃখের মধ্যেও কিছু আনন্দ লেগে থাকল। পরপর তিনটি কন্যাসন্তানের পর তার এবার পুত্ৰ হয়েছে। গায়ের রঙ সুন্দর, ধবধবে সাদা। নাক খাড়া, মেয়েগুলোর নাকের মতো উপজাতীয় টাইপ থ্যাবড়া নাক না।

তিনি ছেলের নাম রাখলেন, ইয়াহিয়া।

একজন নবির নামে নাম, তবে এই নামকরণের শানে-নুযুল অন্য। তাঁর ছেলের জন্ম ১৯৬৯ সনের ২৫ মার্চ। ঐ দিন জেনারেল ইয়াহিয়া ক্ষমতায় যান এবং দেশে সামরিক শাসন জারি করেন। সঙ্গে সঙ্গেই দেশের অবস্থা ঠাণ্ডা। জ্বালাও-পোড়াও, মারামারি, কাটাকাটি বন্ধ। জাগো জাগো, বাঙালি জাগো বন্ধ। শহরে মিলিটারি নেমে গেল। ভীতু বাঙালি বলতে গেলে ভয়ে গর্তে ঢুকে গেল। পুলিশরা ইজ্জত ফিরে পেল। এখন আর খাকি পোশাক দেখলে কেউ বলে না— ঠেলা।।

মোবারক হোসেন ইয়াহিয়া নামক যে জেনারেলের কারণে এই ঘটনা ঘটল, তাকে সম্মান করেই ছেলের নাম ইয়াহিয়া রাখলেন। ছেলের জন্যে আকিকা করলেন শাহজালাল সাহেবের দরগায়।

আয়ুব খানের লেখা যে-চিঠিতে এই বিস্ময়কর ঘটনা ঘটল, মোবারক হোসেন সেই চিঠি যত্ন করে পত্রিকা থেকে কেটে রেখে দিলেন।

আয়ুব খান সাহেব জেনারেল ইয়াহিয়াকে লিখলেন—

প্রিয় জেনারেল ইয়াহিয়া,

অতীব দুঃখের সহিত আমাকে এই সিদ্ধান্তে আসিতে হইয়াছে যে, দেশের সমুদয় বেসামরিক প্রশাসন ব্যবস্থা ও নিয়মতান্ত্রিক কর্তৃত্ব সম্পূর্ণ অচল হইয়া পড়িয়াছে। বর্তমান উদ্বেগজনক অবস্থার যদি অবনতি ঘটিতে থাকে, তাহা হইলে দেশের অর্থনৈতিক জীবনধারা তথা সভ্য জীবনের অস্তিত্ব বজায় রাখা সম্পূর্ণ অসম্ভব হইয়া পড়িবে।

এমতাবস্থায় ক্ষমতার আসন থেকে নামিয়া যাওয়া ছাড়া আমি কোনো গত্যন্তর দেখিতেছি না। তাই আমি পাকিস্তান দেশরক্ষা বাহিনীর হস্তে দেশের পূর্ণ কর্তৃত্ব ন্যস্ত করিয়া যাওয়ার সাব্যস্ত করিয়াছি, কেননা সামরিক বাহিনীই দেশের আজিকার একমাত্র কর্মক্ষম ও আইনানুগ যন্ত্র।

আয়ুব খান

পুত্ৰ ইয়াহিয়া আশীৰ্বাদ হিসেবে জন্ম নিয়েছে–এই বিশ্বাস মোবারক হোসেনের মনে শিকড় গেড়ে বসে গেল। ভালো যা হয় তাই তিনি পুত্রের জন্মের কারণে হচ্ছে বলে ধরে নেন। এই সময় তিনি তাঁর মৃতা মাকেও স্বপ্নে দেখেন। স্বপ্নে তিনি শিশু ইয়াহিয়াকে কোলে নিয়ে আদর করছেন। হঠাৎ সেখানে মোবারক হোসেনকে দেখে কিছু রাগ কিছু বিরক্তি মেশানো গলায় বললেন, ও মনু (মোবারক হোসেনকে তিনি মনু ডাকতেন), তোর বিপদআপদের দিন শেষ। এই ছেলে তোর জন্য কবজ হিসাবে দুনিয়াতে আসছে। এরে ভালো মতো দেখভাল করবি। বৎসরে একবার এরে আজমিরে নিয়া যাবি। আর মাঝেমধ্যে হরিণের মাংস দিয়া ভাত খাওয়াবি।

পুত্রের দেখভালের জন্যে তিনি পরোয় বৎসর সাফিয়া নামের এক মধ্যবয়স্ক মহিলাকে বিয়ে করেন। এই বিয়ে তাঁর জীবনে আশীর্বাদের মতোই হয়েছিল।

সাফিয়া মোটাসোটা ধরনের মহিলা। তার প্রধান যে তিনটি গুণ মোবারক হোসেনের চোখে পড়ল তা হলো–এই মহিলার রাঁধার হাত খুব ভালো। সে যা-ই রাঁধে অমৃতের মতো লাগে।

মহিলা তার স্বামীকে যমের মতো ভয় পায়। (মোবারক হোসেনের মতে, এই গুণটি স্ত্রীদের মহত্তম গুণের একটি। যে পরিবারে স্ত্রী স্বামীকে ভয় পায় না, মান্য করে না, সেই পরিবারে কখনো সুখ আসে না।)

সাফিয়ার তৃতীয় গুণটি কোনো গুণের মধ্যে পড়ে না। বেকুবির মধ্যে পড়ে। অতি বোকা মহিলাদের মধ্যে এই গুণটি দেখা যায়। তারা স্বামীর সংসারের সবকিছুকেই নিজের মনে করে। স্বামীর আগের পক্ষের সন্তানকে তারই সন্তান বলে ভাবতে থাকে। সাফিয়ার ক্ষেত্রেও এই জিনিস ঘটল। মোবারক হোসেনের তিন মেয়ে অতি দ্রুত হয়ে গেল তার তিন মেয়ে। ছেলেটিকেও যেন সে-ই কিছুদিন আগে প্রসব করেছে।
 
মোবারক হোসেন একদিন দুপুরে হঠাৎ কী জন্যে যেন বাসায় এসেছেন। তিনি শোবার ঘরে ঢুকে দেখেন, মেঝেতে পাটি বিছিয়ে সাফিয়া পান খাচ্ছে। তার তিন মেয়ের একজন সাফিয়ার কোলে মাথা রেখে শুয়ে আছে। একজন গায়ে হেলান দিয়ে আছে। আর তৃতীয়জন হাত-পা নেড়ে গল্প করছে। তিন মেয়ের মুখেই পান।

বাবাকে দেখে তিন মেয়ে অতি দ্রুত পালিয়ে গেল। সাফিয়া হঠাৎ এমন ভয় পেলেন যে মুখ থেকে পানের রস বের হয়ে শাড়িতে পড়ে গেল! মোবারক হোসেন অত্যন্ত বিরক্ত হলেন। মার চেয়ে যে মাসির দরদ বেশি, সেই মাসি হলো ডান। মার চেয়ে যদি সৎমায়ের দরদ বেশি হয়, তাহলে সেই সৎমা ডানের চেয়েও খারাপ। মেয়েদের নিয়ে পান খাওয়া-খাওয়ি আবার কী? পানবিড়ি-সিগারেট ছেলে-মেয়েদের সঙ্গে ভাগাভাগি করে খাওয়া যায় না।

মোবারক হোসেন ভয়ে অস্থির হয়ে যাওয়া স্ত্রীকে শুধু বললেন, আডিডা গুলবাজি কম করব। এইসব আমার পছন্দ না। সাফিয়া সঙ্গে সঙ্গে মাথা নাড়ল। আবার তার মুখে থেকে পানের রস গড়িয়ে পড়ল।



তার ছেলে যে সৌভাগ্যের কবচ হয়ে এসেছে–এই বিষয়ে মোবারক হোসেন নিশ্চিত হলেন ১৯৭০ সনের ১ জানুয়ারিতে। এই দিনই ইয়াহিয়া খান রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড শুরু করার অনুমতি দিলেন। মোবারক হোসেন খান ঐ দিনই বদলি হলেন খাকি পোশাক থেকে ডিএসবি-তে। খাকি পোশাক বাতিল। এখন সাদা পোশাকের চাকরি, তাও আবার সেন্ট্রাল গভর্নমেন্টের আন্ডারে। দেশে অরাজকতা চলছে, এই সময়ে খাকি পোশাক বিপদজনক পোশাক। দেশের লোকজন ধরেই নিয়েছে, খাকি পোশাক মানেই খারাপ জিনিস। খাকি পোশাক মানেই শক্ৰ।

গোয়েন্দা বিভাগে যোগ দেয়ার দুমাসের মাথায় মার্চ মাসের পঁচিশ তারিখ যেদিন তাঁর ছেলের বয়স এক বছর, তাঁর ডাক পড়ল সামরিক গোয়েন্দা বিভাগের অফিসে। কর্নেল শাহরুখ খান তাঁর সঙ্গে কথা বলতে চান। কথা বলবেন সন্ধ্যা সাতটায়, মোহাম্মদপুরের শেরশাহ সুরি রোডের এক বাসায়।

সেদিন বিকাল পাঁচটায় ছেলের জন্মদিন উপলক্ষে তিনি বাড়িতে মিলাদের আয়োজন করেছেন। আত্মীয়স্বজনদের খবর দিয়েছেন। কাচ্চি বিরিয়ানি রাধার জন্যে পুরনো ঢাকা থেকে বাবুর্চি সালু মাতবরকে আনা হয়েছে। মোবারক হোসেন সামান্য দুশ্চিন্তায় পড়লেন। মিটিং কতক্ষণ চলবে কে জানে! ছেলের প্রথম জন্মদিনে মিলাদ হবে। আর তিনি থাকতে পারবেন না–এটা অবশ্যই একটা আফসোসের ব্যাপার। তবে তার ধারণা এই মিটিংয়ে তার জন্যে শুভ কিছু আছে। তা না থাকলে বেছে বেছে ছেলের জন্মদিনেই এই মিটিং পড়বে কেন?
 
কর্নেল শাহরুখের সঙ্গে দেখা করার জন্যে তিনি সন্ধ্যা ছাঁটার সময়ই উপস্থিত হলেন। যে বাড়িতে মিটিং হচ্ছে সেটা কোনো অফিস না। একজনের বাড়ি। ছেলেমেয়ে নিয়ে থাকে। তাদের হৈচৈ কান্নাকাটি সারাক্ষণ হচ্ছে। সামরিক বাহিনীর গোয়েন্দা বিভাগের একজন বড় কর্তা তাকে এ ধরনের একটা বাড়িতে ডেকেছেন তা ভাবাই যায় না। মোবারক হোসেনকে বসার ঘরে এক। ঘণ্টা বসে থাকতে হলো। বসার ঘর দেখে মনে হয় না। এখানে কেউ বসে। এক দিকে গাবদা গাবদা কিছু সোফা। অন্য দিকে তিন-চারটা বেতের চেয়ার। সোফার কভার নেই। একটা সোফার গদি ছিঁড়ে ভেতরের কাঠ বের হয়ে গেছে। ঘরের সাজসজ্জা বলতে গোয়ালে কাবা শরীফের ছবি। ছবিটা ঝকঝকে। ঠিক সন্ধ্যা ৭টায় তার ডাক পড়ল।

কর্নেল সাহেবকে দেখে মোবারক হোসেন ধাক্কার মতো খেলেন। তাকে দেখে মনে হচ্ছে, একুশ-বাইশ বছরের একজন রূপবান যুবক, চুপ করে বসে আছে। প্ৰেমঘটিত জটিলতায় সে কিছু সমস্যায় আছে। যার জন্যে তার বয়স সামান্য বেশি লাগছে!

যে ঘরে কর্নেল সাহেব বসে আছেন, সেই ঘরটা বেশ বড়। তবে ঘরে আলো কম। এই কম আলোতেও কনেল সাহেবের চোখে কালো চশমা। কালো চশমার কারণে মনে হচ্ছে, কর্নেল সাহেবের চোখ উঠেছে। কর্নেল সাহেব ছাড়াও ঘরে আরেকজন ব্যক্তি উপস্থিত। তিনি সম্ভবত বাঙালি। তবে সাধারণ বাঙালির চেয়ে অনেক লম্বা। তিনি বসেছেন বড় একটা টেবিলের পেছনে। তার সামনে চায়ের কাপ। চায়ের কাপটা এষ্ট্রে হিসেবে কাজ করছে। চায়ের কাপের পাশে ছপ্যাকেট K-2 সিগারেট। ভদ্রলোকের বয়স চল্লিশ বা তারচেয়ে বেশি। চিমশে ধরনের চেহারা। আজ শেভ করেন নি বলে মুখে খোচা খোচা দাড়ি। কোনো কারণ ছাড়াই তিনি মাঝে মাঝে ঠোঁট ফাঁক করছেন। তখন তাঁর দাঁত দেখা যাচ্ছে। অতিরিক্ত সিগারেট খাবার জন্যেই হয়তো তার দাঁতে লাল লাল ছোপ পড়েছে। ভদ্রলোকের সমস্ত মনোযোগ তাঁর সামনে রাখা চায়ের কাপের দিকে। তিনি একবারও মোবারক হোসেনের দিকে তাকান নি। কর্নেল সাহেব তাকিয়েছেন কি-না তাও মোবারক হোসেন ধরতে পারছেন না। কারণ কর্নেল সাহেবের চোখ কালো চশমায় ঢাকা।

ইন্সপেক্টর মোবারক হোসেন, সিট ডাউন প্লিজ।

মোবারক হোসেন কর্নেল সাহেবের সামনে রাখা চেয়ারে বসলেন। তার নিজের উপর খুবই রাগ লাগছে, কারণ ঘরে ঢুকে তিনি সালাম দিতে ভুলে গেছেন। এখন সালাম দেয়াটা কি ঠিক হবে?

হাউ আর ইউ ইন্সপেক্টর?

মোবারক হোসেন বললেন, স্যার, আমি ভালো আছি। বলেই মনে হলো এটা কী করলাম! বাংলা তো উনি বুঝবেন না। আর এমন তো না যে ইংরেজি ভাষাটা তার জানা নেই। তিনি অনায়াসে বলতে পারতেন–স্যার, আই এম ফাইন।

কর্নেল সাহেব কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে আচমকা মোবারক হোসেনকে চমকে দিয়ে সুন্দর বাংলায় স্পষ্ট উচ্চারণে বললেন–ইন্সপেক্টর, তুমি কি কোনো কারণে ভীত?

মোবারক হোসেন বিস্ময়ের ধাক্কা সামলে নিয়ে বললেন, জি-না স্যার।

সরাসরি কাজের কথায় চলে যাই–তুমি কি শেখ মুজিবর রহমানকে কাছ থেকে দেখেছি?

জি-না স্যার।

কখনো তাকে দেখতে যাও নি? তাকে সালাম করবার জন্যে যাও নি?

জি-না স্যার।

শত শত মানুষ রোজ তাকে দেখতে যায়। তাঁর দোতলা বাড়ির ব্যালকনির নিচে দাঁড়িয়ে থাকে তার কথা শোনার জন্যে। তাকে এক নজর দেখার জন্যে। তুমি যাও নি কেন?

মোবারক হোসেন শান্ত গলায় বললেন, স্যার, আমার শেখ সাহেবের বাড়িতে কোনো দিন ডিউটি পড়ে নাই।

ডিউটি পড়লে যাবে?

অবশ্যই স্যার।

কর্নেল সাহেব এবার মোবারক হোসেনের দিকে সামান্য ঝুঁকে এসে বললেন, তোমার কি ধারণা শেখ মুজিব পূর্ব বাংলার স্বাধীনতা চায় না-কি অখণ্ড পাকিস্তানের কর্তৃত্ব চায়?

স্যার, আমি জানি না। এইগুলি অনেক বড় ব্যাপার। আমি সামান্য পুলিশ ইন্সপেক্টর। সরকারের নুন খাই।

সরকার যদি শেখ মুজিবের হাতে চলে যায়, তাহলে তো তুমি শেখ মুজিবের নুন খাবে?

জি স্যার।

কর্নেল সাহেব তাঁর শার্টের পকেট থেকে সিগারেট বের করলেন। সাধারণত সিগারেট প্যাকেটে থাকে–ইনার সিগারেট প্যাকেট ছাড়া অবস্থায় পকেটে আছে। ব্যাপারটা মজার তো! কর্নেল সাহেব সিগারেট ধরাতে ধরাতে বললেন, তোমার দেশের কোন জিনিসটা সবচে ভালো?

মোবারক হোসেন বললেন, স্যার, আপনি তোমার দেশ বলছেন কেন? দেশটা তো আপনারও।
 
কর্নেল সাহেবের ঠোঁটে সামান্য হাসি দেখা গেল। তিনি সেই হাসি তৎক্ষণাৎ মুছে ফেলে গভীর গলায় বললেন–তোমাকে খুশি করার জন্যে বলেছি। এই দেশ যে আমার সেটা আমি জানি। যাই হোক, প্রশ্নের জবাব দাও–তোমার দেশের কোন জিনিসটা তোমার সবচে ভালো লাগে?

মোবারক হোসেন শান্ত গলায় বললেন, মুক্তাগাছার মণ্ডা।

জিনিসটা কী?

এক ধরনের মিষ্টান্ন। ছানা দিয়ে তৈরি হয়। ভাপে পাকানো হয়।

এত জিনিস থাকতে তোমার কাছে তোমার দেশের সবচে পছন্দের জিনিস মুক্তাগাছার মণ্ডা!

জি স্যার।

ভালো কথা, এখন বলো–তোমার কি মনে হয়। এই দেশটা আলাদা হয়ে যাবে? দুই দেশের পতাকা হবে দুই রকম?

স্যার পাকিস্তান ভাঙবে না।

কোন যুক্তিতে বলছি ভাঙবে না?

কোনো যুক্তি না। আমার মন বলছে ভাঙবে না।

কর্নেল সাহেব পকেট থেকে আরেকটি সিগারেট বের করে ঠোঁটে দিতে দিতে বললেন, আমারও তাই ধারণা। যার রাজনৈতিক গুরু সোহরাওয়াদী তিনি পাকিস্তান ভাঙতে চাইবেন না। তিনি চাইবেন অখণ্ড পাকিস্তানের ক্ষমতায় যেতে। তবে জেনারেল ইয়াহিয়াকেও তিনি বিশ্বাস করতে পারছেন না। যদিও জেনারেল ইয়াহিয়া শেখ মুজিবের সব কথাই মেনে নিচ্ছেন। নভেম্বরের জলোচ্ছাসের পর মাওলানা ভাসানী চাইলেন ইলেকশন পিছিয়ে দিতে। মানুষের এত দুর্ভোগ, এর মধ্যে ইলেকশন কী! কিন্তু শেখ মুজিব ইলেকশন পিছিয়ে দিতে রাজি হলেন না। জেনারেল ইয়াহিয়া শেখ মুজিবকে খুশি করার জন্যে ইলেকশন পিছলেন না। আমার ধারণা ইয়াহিয়া শুধু একটা জিনিসই চাচ্ছেন–যা হবার হোক, যার ইচ্ছা ক্ষমতায় যাক, শুধু পাকিস্তান টিকে থাকুক। ইন্সপেক্টর মোবারক!

জি স্যার

তোমার মনের ইচ্ছাটাও তো সে-রকম। তাই না?

জি স্যার।

তোমাকে এখানে ডেকে পাঠিয়েছি, এখন থেকে তোমার ডিউটি শেখ মুজিবর রহমান সাহেবের ধানমণ্ডির বাড়িতে। তুমি সেই বাড়িতে ঢুকবে। নিজের একটা জায়গা করে নিবে। কীভাবে করবে। সেটা তোমার ব্যাপার।

স্যার, আমার কাজটা কী?

ঐ বাড়িতে অবস্থান নেওয়াটাই তোমার কাজ। আর কিছু না।

আর কিছুই না?

না। আর কিছু না। প্রতি সপ্তাতে একবার বুধবার সন্ধ্যায়–জোহর সাহেবের সঙ্গে এই বাড়িতে দেখা করবে। তার সঙ্গে গল্পগুজব করবে। জোহর কে নিশ্চয়ই বুঝতে পারছি। ঐ যে একটার পর একটা সিগারেট খেয়ে যাচ্ছে।
 
মোবারক হোসেন জোহর সাহেবের দিকে তাকাল। চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে বিনীত ভঙ্গিতে সালাম দিল। জোহর তার জবাব দিলেন না। আগের মতোই চায়ের কাপের দিকে তাকিয়ে রইলেন।

কর্নেল সাহেব বললেন, জোহর পূর্ণিয়া জেলার লোক। আমার অতি ঘনিষ্ঠ একজন। সে একজন কবি। তার শায়ের শুনলে মুগ্ধ হবে। তার পছন্দের কবির নাম শুনলেও তুমি চমকে উঠবে। তার পছন্দের কবির নাম টেগোর। তোমাদের রবীন্দ্রনাথ।

মোবারক হোসেন চমকালেন না। তবে বিস্মিত হবার ভঙ্গি করলেন। কর্নেল সাহেব বললেন, জোহর একজন চেইন স্ম্যোকার। এখন ইন্সপেক্টর মোবারক বলো তো দেখি–তুমি এই ঘরে ঢোকার পর থেকে জোহর কয়টা সিগারেট খেয়েছে?

নয়টা।

ভালো! তোমার অবজারবেশন ভালো। তুমি যেতে পাের।

স্যার চলে যাব?

হ্যা চলে যাবে।

স্নামালিকুম স্যার।

ওয়ালাইকুম সালাম। ইন্সপেক্টর শোন, তোমার ছেলের জন্মদিন উৎসব থেকে তোমাকে বঞ্চিত করেছি— এতে তুমি কিছু মনে করবে না। দেশের কল্যাণের জন্যে ছোটখাটো স্বাৰ্থ বিসর্জন দিতে হয়।

মোবারক হোসেন চমকালেন না। এরা তার ছেলের জন্মদিন জানে–এতে বিস্মিত হবার কিছু নাই। গোয়েন্দা বিভাগ তার সম্পর্কে কিছু না জেনেশুনে তাকে ডাকবে না। তার ছেলের নাম যে ইয়াহিয়া–এটাও তারা অবশ্যই জানে।

ইন্সপেক্টর!

ইয়েস স্যার।

তুমি কিছু বলবে?

জি-না স্যার।

তোমাকে সামান্য টিপস্ দিয়ে দেই। শেখ মুজিবের আস্থাভাজন হওয়া খুবই সহজ কাজ। এই মুহূর্তে প্রতিটি বাঙালির প্রতি তাঁর অগাধ বিশ্বাস। তিনি সমস্ত বাঙালিকে বিশ্বাস করেন। আর আমরা প্রতিটি বাঙালিকে অবিশ্বাস করি। তিনিও ভুল করছেন। আমরাও ভুল করছি। ভুলের মাশুল তিনি যেমন দেবেন। আমরাও দেব। কে কতটুকু দেবে কে জানে! ঠিক আছে, তুমি যাও। Happy birthday to your son.



ধানমণ্ডি ৩২ নম্বর বাড়িটাকে কি বাড়ি বলা যাবে? বাড়ি মানেই অলস দুপুর। বাড়ি মানেই ভদ্র মাসের গরমে আচমকা উড়ে আসা হিমেল হাওয়া। বাড়ি মানে বারান্দার রেলিং-এ শুকাতে দেয়া রঙিন শাড়ি।

এখানে সেরকম কিছু নেই–বাজারের মতো ভিড়। এই একদল আসছে। এই যাচ্ছে। যারা আসছে প্রথম কিছুক্ষণ খুবই উত্তেজিত অবস্থায় থাকছে। কয়েকবার স্লোগান দেয়ার পর তাদের উত্তেজনা বাপ করে অনেকখানি কমে যাচ্ছে। তখন তাদের খানিকটা দিশাহরাও মনে হচ্ছে। স্লোগান পর্ব শেষ। এখন কী করা উচিত তা বুঝতে না পেরে দিশাহারা। দল নিয়ে এসে হুট করে চলে যাওয়া যায় না। কিছুক্ষণ থাকতে হয়। দল পরিচালনা করে যারা এসেছেন, শেখ সাহেবের সঙ্গে দেখা না করে চলে গেলে তাদের মান থাকে না।

গ্রহকে ঘিরে উপগ্রহ ঘুরপাক খায়। শেখ সাহেব বিশাল গ্রহ। তাকে ঘিরে ঘুরপাক খাওয়া উপগ্রহের সংখ্যাও সেই কারণে অনেক। তাদের ডিঙিয়ে শেখ সাহেবের দেখা পাওয়া মুশকিল। তবু চেষ্টা চালাতে হয়।
 
মোবারক হোসেন সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত এখানে থাকেন। কাণ্ডকারখানা দেখেন। তাঁর ভালোই লাগে। দুপুরে কখনো কখনো বড় বড় হাঁড়ি ভর্তি খাবার আসে। কোনোদিন তেহারি, কোনোদিন খিচুড়ি মাংস। তখন চারদিকে আলাদা উত্তেজনা তৈরি হয়। এই উত্তেজনা দেখতেও খারাপ লাগে না। সবচে ভালো লাগে পাতি নেতাদের জ্ঞানী জ্ঞানী আলোচনা। পাতি নেতাদের সঙ্গেও পাতি উপগ্ৰহ থাকে। পাতি নেতাদের আলোচনা চলে পাতি উপগ্রহদের সঙ্গে।

মাওলানা কী চাচ্ছে বুঝলাম না। তার দলের স্লোগান ভোটের আগে ভাত চাই। ভাতের অধিকার নিশ্চিত করার জন্যেই তো ভোট দরকার। তার ভাবভঙ্গি দেখে মনে হওয়া অস্বাভাবিক না যে, ইয়াহিয়ার সাথে তার একটা অশুভ আঁতাত হয়েছে। এদিকে আবার কমুনিস্ট পার্টির হাবভাব ভালো লাগছে না। কমু্যনিস্টরা কী করবে না করবে সেটা বোঝা অবশ্যি খুবই মুশকিল। বিষয়টা নিয়ে শেখ সাহেবের সঙ্গে বসতে হবে।

যিনি বিষয়টা নিয়ে শেখ সাহেবের সঙ্গে বসতে চাচ্ছেন–তাঁর ভঙ্গি এরকম যেন তিনি শেখ সাহেবের প্রধান উপদেষ্টাদের অন্যতম। এই শ্রেণীর নেতারা দলীয় কমীদের উৎসাহ বৃদ্ধির জন্যে কিছুক্ষণ পর পর স্লোগানের আয়োজন করে। সবার চেষ্টা থাকে যেন তাদের স্লোগানটা অন্যদের চেয়ে আলাদা হয়।

ইয়াহিয়ার বুকে লাথি মারো
সোনার বাংলা স্বাধীন করো।

একটা দুটা মিলিটারি ধরো
সকাল বিকাল নাশতা করো।

ছাত্রনেতাদের ভাবভঙ্গি সবার চেয়ে আলাদা। যেন বিরাট আন্দোলন, তারাই চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। শেখ মুজিবর রহমান সঙ্গে আছেন ভালো কথা। সঙ্গে না থাকলেও খুব অসুবিধা হবে না, আমরা চালিয়ে নিয়ে যাব। দেশ স্বাধীন করা আমাদের কাছে কোনো ব্যাপার না। শেখ মুজিবর রহমান এদের প্রশ্ৰয়ও দিচ্ছেন। প্রশ্রয় না দিয়ে তার হয়তো উপায়ও নেই।

মোবারক হোসেনের এই বাড়িতে তৃতীয় দিনের ঘটনা। সকাল হচ্ছে। শেখ মুজিব ফজরের নামাজ শেষ করে দোতলা থেকে একতলায় নামলেন। সরাসরি এগিয়ে গেলেন মোবারক হোসেনের দিকে। ভরাট গলায় বললেন, তুই কে?

মোবারক হোসেন প্রশ্নের জবাব না দিয়ে পা ছুঁয়ে সালাম করল।

তোকে প্রায়ই দেখি। তুই কে?

স্যার, আমি আইবির লোক।

তোকে কি আমার বাড়িতে ডিউটি দিয়েছে?

জি স্যার।

তোর সঙ্গে পিস্তল আছে?

আছে।

তোর ডিউটি কী?

কে আসে কে যায় এইটা খেয়াল করা।

শেখ সাহেব হেসে ফেলে বললেন, তুই তো তোর গোপন কথা সবই বলে ফেললি। তুই আইবির লোক, তুই তোর পরিচয় গোপন রাখবি না?

আমি সরকারের হুকুমে আসলেও আমি ডিউটি করি আপনার। আমি খেয়াল রাখি যেন কেউ আপনার কোনো ক্ষতি করতে না পারে।

আমার ডিউটি করিস কী জন্যে?

কারণ আপনিই সরকার।

শেখ মুজিব এই কথায় খুবই তৃপ্তি পেলেন। মোবারক হোসেনের কাধে হাত রেখে বললেন, তুই আমার জন্যে কী করতে পারবি?

আপনি যা করতে বলবেন, করতে পারব। যদি বলেন ছাদ থেকে লাফ দিয়ে নিচে পড়। আমি পড়ব।

তোর নাম কী?

মোবারক হোসেন। পুলিশ ইন্সপেক্টর।

দেশের বাড়ি কোথায়?

কিশোরগঞ্জ।

ভালো জায়গায় জন্ম। বীর সখিনার দেশ। ছেলেমেয়ে কী?

তিন মেয়ে এক ছেলে। তিন মেয়ের নাম–মরিয়ম, মাসুমা, মাফরুহ। আর ছেলের নাম ইয়াহিয়া।

কী বলিস তুই, ছেলের নাম ইয়াহিয়া?

আমার দাদিজান রেখেছেন। নবির নামে নাম।

আয় আমার সঙ্গে।

স্যার, কোথায় যাব?

তোকে নিয়ে বাড়ির ছাদে উঠব। তারপর তোকে হুকুম দিব ছাদ থেকে লাফ দিয়ে নিচে পড়তে। দেখি হুকুম তালিম করতে পারিস কি-না।

মোবারক হোসেন শান্ত গলায় বললেন, স্যার চলেন।

শেখ মুজিব মোবারক হোসেনকে নিয়ে দোতলায় এলেন। তিনি তাঁর স্ত্রীকে বললেন, এই আমাদের দুজনকে নাশতা দাও। এ হলো আমার এক ছেলে।

শেখ মুজিবের চোখে-মুখে তৃপ্তি ও আনন্দ ঝলমল করতে লাগল।
 
ইরতাজউদ্দিন কাশেমপুরীর মনটা আজ খারাপ। তিনি নীলগঞ্জ হাইস্কুলের বারান্দায় কিছুক্ষণ হাঁটাহাটি করে এখন টিচার্স কমনরুমে বসে আছেন। তাঁর হাতে দুদিন আগের বাসি। খবরের কাগজ। দুদিন আগে ঢাকা শহরে কী ঘটেছে কাগজে মোটামুটি তাই লেখা। নীলগঞ্জ ঢাকা থেকে দুদিন পিছিয়ে আছে। ইরতাজউদ্দিন খবরের কাগজটা পড়ার চেষ্টা করছেন। তাঁর মন বসছে না! মেজাজ বিগড়ে গেলে কোনো কিছুতেই মন বসে না। হেডমাস্টার মনসুর সাহেব আজ সকালে তাকে কিছু কথা বলেছেন, যা শোনার জন্য তিনি প্ৰস্তুত ছিলেন না। মনসুর সাহেব বয়সে তার ছোট। বয়োকনিষ্ঠ একজন মানুষের কাছ থেকে কঠিন কথা শুনলে মন খারাপ হয়ে যায়। তবে বয়স কোনো ব্যাপার না। ধানী মরিচ সাইজে ছোট হলেও তার ঝাঝি বেশি। সেভাবে চিন্তা করলে হেডমাস্টার সাহেবের কঠিন কথাগুলো হজম করে নেওয়া যায়। ইরতাজউদ্দিন হজম করতে পারছেন না। কারণ হেডমাস্টার সাহেবের কথাগুলো তার কাছে গ্রহণযোগ্য বলে মনে হচ্ছে না।

ব্যাপারটা সামান্য। ঢাকা থেকে ফেরার সময় তিনি স্কুলের জন্যে একটা বড় পতাকা কিনে এনেছেন। ১২ টাকা নিয়েছে দাম। দাম বেশি নিলেও জিনিসটা সিল্কের তৈরি, সাইজেও আগেরটার তিনগুণ। সবুজ রঙটা গাঢ়। আগেরটার রঙ জ্বলে গিয়েছিল। পতাকাটা আজ তিনি নিজের হাতে টানিয়েছেন। ঝকঝকে নতুন পতাকা বাতাস পেয়ে ডানা মেলে উড়ছে। দেখলেই মন ভরে যায়। বাঁশটা যদি আরো লম্বা হতো আর পতাকাটা আবো বড় হতো, তাহলে অনেক দূর থেকে চোখে পড়ত। মানুষজন অহঙ্কার নিয়ে বলত, ঐ যে দেখা যায় পতাকাআমাদের নীলগঞ্জ হাইস্কুলের পতাকা। গ্রামের মানুষ ছোটখাটো ব্যাপার নিয়ে অহঙ্কার করতে ভালোবাসে।

ইরতাজউদ্দিন মুগ্ধ চোখে পতাকার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলেন। তার কাছে মনে হলো, নীল আকাশে সবুজ রঙের একটা টিয়া পাখি উড়ছে। গভীর আনন্দে ইরতাজউদ্দিন সাহেবের চোখে যখন প্রায় পানি এসে গেছে—তখন স্কুলের দপ্তরি। মধু এসে বলল, আপনেরে হেডস্যার ডাকে। তিনি আনন্দ নিয়েই হেডমাস্টার সাহেবের ঘরে ঢুকলেন। হেডমাস্টার সাহেব তার খুব পছন্দের মানুষ। ইরতাজউদ্দিন মনে মনে ঠিক করে ফেললেন, পতপত করে নতুন পতাকা উড়ছে–এই সুন্দর দৃশ্যটা হেডমাস্টার সাহেবকে দেখাবেন।

নীলগঞ্জ হাইস্কুলের হেডমাস্টার মনসুর সাহেব তাকে দেখে শুকনো গলায় বললেন, বসুন মাওলানা সাহেব। বলেই তিনি কী একটা লেখায় ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। তার সামনে যে কেউ বসেছে, এটা যেন তার আর মনেই রইল না।
 

Users who are viewing this thread

Back
Top