What's new
Nirjonmela Desi Forum

Talk about the things that matter to you! Wanting to join the rest of our members? Feel free to sign up today and gain full access!

Collected ছোছনা ও জননীর গল্প - উপন্যাস (2 Viewers)

ইরতাজউদ্দিন বেতের চেয়ারে কাত হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছেন। ঘুমিয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে তিনি স্বপ্নে মেয়েটিকে দেখলেন। এইবার মেয়েটির কোলে চার-পাঁচ বছরের একটি শিশু। শিশুটি দেখতে রুনির মতো। তবে খুবই রোগা। মনে হয় অসুস্থ।

মেয়েটি কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, তুমি এখনো ঘুমাচ্ছ? বাইরে কী অবস্থা তুমি জানো না? বাড়িঘর সব জ্বলিয়ে দিচ্ছে। মিলিটারিরা সমানে গুলি করছে। নাও, ওকে কোলে নাও, চল পালাই।

ইরতাজউদ্দিন সঙ্গে সঙ্গে বুঝে ফেললেন তিনি স্বপ্ন দেখছেন। ঘুম ভাঙলেই এই দৃশ্য মিলিয়ে যাবে; তিনি চেষ্টা করলেন জেগে উঠতে, চেষ্টা তেমন জোরালো না। কারণ স্বপ্নটা দেখতে তাঁর ভালো লাগছে। মেয়েটার (নাম আসমা বেগম)। ভীত মুখ দেখে মজা লাগছে। কারণ তিনি জানেন যা ঘটছে স্বপ্নে ঘটছে। ভয় পাবার কিছু নেই।

এ কী, তুমি এখনো বসে আছ মেয়েটাকে কোলে নাও। তার জ্বর।

ইরতাজউদ্দিন লজ্জিত গলায় বললেন, মেয়েটার নাম কী?

আসমা অত্যন্ত বিরক্ত হলো। এই ভয়ঙ্কর সময়ে তুমি তামশা করছি? নিজের মেয়ের নাম তুমি জানো না?

এই বলেই সে চুপ করে মেয়েটাকে ইরতাজউদিনের কোলে ফেলে দিল। তখন বাইরের হৈচৈ প্ৰবল হলো। লোকজন আগুন আগুন করছে। চারদিকে ছোটাছুটি করছে। মেশিনগানের একটানা গুলির শব্দও শোনা যাচ্ছে। ইরতাজউদ্দিন মেয়েটাকে কোলে নিয়ে ছুটে রাস্তায় নেমে এলেন। রাস্তায় শত শত মানুষ। সবাই একসঙ্গে দৌড়াচ্ছে। আসমা শক্ত করে ইরতাজউদ্দিনের বাঁ হাত ধরে আছে। একজন রূপবতী তরুণী তার হাত ধরে দৌড়াচ্ছে—এটা একটা লজ্জাজনক দৃশ্য। অত্যন্ত দৃষ্টিকটু এবং ইসলামের দৃষ্টিকোণ থেকে সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। তবে একটা সুবিধা হয়েছে, কেউ তাদের দিকে ফিরে তাকাচ্ছে না। রোজ-হাসরের মতো অবস্থা। সবাই নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত। সবাই ইয়া নফসি ইয়া নফসি করছে। মহাবিপদের আশঙ্কায় সবাই ভীত।

বিপদের উপর বিপদ, লোকজন যে দিকে যাচ্ছে ঠিক সেই দিক থেকেই আরো একদল মানুষ দৌড়াতে দৌড়াতে আসছে। তারা জয় বাংলা জয় বাংলা বলে চিৎকার করছে। তাদের চিৎকারে ইরতাজউদিনের ঘুম ভেঙে গেল। তিনি অবাক হয়ে দেখলেন–সত্যি সত্যি বিশাল মিছিল বের হয়েছে। রাস্তায় শত শত মানুষ। তাদের হাতে লাঠিসোটা, বর্শা। তারা আকাশ ফাটিয়ে চিৎকার করছে।–জয় বাংলা জয় বাংলা। মিছিলের সঙ্গে একটা ঠেলাগাড়িও যাচ্ছে। ঠেলাগাড়ির মাঝখানে একজন পা ছড়িয়ে বসে আছে। তার হাতে একটা তলোয়ার।

ইরতাজউদ্দিন মিছিলের দিকে তাকিয়ে আছেন। তার ভুরু কুঁচকে আছে। জয় বাংলা বাক্যটা তার ভালো লাগছে না। জয় বাংলা এসেছে জয় হিন্দ থেকে। এটা ঠিক না। তাছাড়া লাঠিসোটা, বল্লম দিয়ে কিছু হয় না। একশ বছর আগেও বাঁশের কেল্লা দিয়ে তিতুমীর কিছু করতে পারে নি। শুধু শুধুই পরিশ্রম। এটা একটা আফসোস যে বাঙালি জাতি কাজে পরিশ্রম করতে পারে না, অকাজে পারে।



শাহেদ রাত বারোটার দিকে শুকনো মুখে ফিরল। সঙ্গে কেউ নেই। সে একা ফিরেছে। ইরতাজউদ্দিন বললেন, কিরে এত দেরি? শাহেদ মাটির দিকে তাকিয়ে নিচু গলায় বলল, ওদের পেলাম না ভাইজান।

পেলি না মানে কী?

আমার শাশুড়ির এক দূরসম্পর্কের বোন থাকেন। ভূতেরগলিতে। ওরা দল বেঁধে ঐ বাড়িতে গিয়েছে। এতক্ষণ অপেক্ষা করলাম। যদি ফেরে। ফেরে নি। মনে হয় থেকে যাবে। মাঝে মাঝে ওরা সেখানে থেকে যায়। ঐ মহিলা রুনিকে খুব আদর করেন। ওদের কোনো বাচ্চাকাচ্চা নেই তো, রুনিকে নিজের মেয়ের মতো দেখেন। বলতে গেলে উনিই জোর করে রেখে দিয়েছেন।

ইরতাজউদিনের মন আবারো খারাপ হলো। শাহেদ মিথ্যা কথা বলছে। হড়বড় করে মিথ্যা বলছে। বউ আসতে রাজি হয় নি, এটা বললেই হয়। বানিয়ে বানিয়ে মিথ্যা বলার দরকার কী? মিথ্যা এমন জিনিস যে কয়েকবার বললেই অভ্যাস হয়ে যায়। তখন কারণ ছাড়াই মিথ্যা বলতে ইচ্ছা করে।

ভাইজান, আপনি কি শুয়ে পড়বেন? রাত অনেক হয়েছে। শুয়ে পড়াই ভালো। বিছানা করে দেই?

দে।

খালি পেটে ঘুমুবেন? ক্ষুধা হয় নি?

ক্ষুধা হয়েছে তারপরেও ইরতাজউদ্দিন বললেন, না। মিথ্যা বলা হলো। তিনি যদি বলতেন। ক্ষুধা হয়েছে, তাহলে ভাত রাধার ব্যাপার চলে আসবে। শাহেদ বিব্রত হবে। সে তার বড় ভাইকে ভাত রাঁধতে দেবে না। নিজেই রাধতে গিয়ে ছেড়াবেড়িা করবে। এরচেয়ে মিথ্যা বলাই ভালো। উপকারী মিথ্যা। তারপরেও মিথ্যা মিথ্যাই। অপকারী মিথ্যা যেমন দূষণীয়, উপকারী মিথ্যাও তেমনি দূষণীয়। ইরতাজউদ্দিন ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে বললেন, তোকে ক্ষুধা হয় নি বলেছিলাম এটা ঠিক না, মিথ্যাচার করেছি; ক্ষুধা হয়েছে। তবে কিছু খাব না। শুয়ে পড়ব। বিছানা করে দে। মশারি খাটাবি না।

মশারি না খাটালে ঘুমুতে পারবেন না। খুব মশা।

থাকুক। মশা। মশারির ভেতর আমার ঘুম আসে না। দমবন্ধ দমবন্ধ লাগে।
 
শাহেদ বসার ঘরে তার ভাইয়ের জন্য বিছানা করল। খুঁজে-পেতে একটা হাতপাখাও বের করল। ইব্রতাজউদ্দিন শোবার সময় অবধারিতভাবে সিলিং ফ্যান বন্ধ করে দেবেন। কারণ, ফ্যানের বাতাসেও তিনি ঘুমুতে পারেন না। ফ্যানের বাতাসে না-কি তার শরীর চিড়বিড় করে।

মশা আসলেই বেশি। চারদিকে পিনপিন করছে। বাতি নেভালে কী অবস্থা হবে কে জানে। হাতো এই গবমেও চাদর মুড়ি দিয়ে শুতে হবে। ইরতাজউদ্দিন যেসব কারণে ঢাকা আস৩ে চান না মশা তার একটি। তিনি ছোটভাইকে বললেন, তুই শুধু শুধু জেগে আছিস কেন? শুয়ে পড়।

শাহেদের কিছুক্ষণ গল্প করতে ইচা করছে। দেড়টা-দুটার আগে সে কখনো ঘুমায় না। এখন বাজছে মাত্র সাড়ে বারটা। তা ছাড়া শ্বশুরবাড়িতে গিয়ে তার মেজাজ খারাপ হয়েছে। তার বড়ভাই এসেছেন–এটা জানার পরেও আসমানী তার সঙ্গে আসবে না, এটা ভাবাই যায় না। শাহেদ খুবই করুণ গলায় বলেছে, ভাইজান এসেছে। আস, প্লিজ আস। তার উত্তরে আসমানী বলেছে, তোমার ভাইজান এসেছে, তুমি তাকে কোলে নিয়ে বসে থাক। আমি কী জন্যে যাব?

আসমানী এধরনের কথা বলতে পারে তা শাহেদের কল্পনার মধ্যেও ছিল না। তার খুবই মনখারাপ হয়েছে। ভাইয়ের সঙ্গে গল্প করে সে মনখারাপ-ভাবটা কাটাতে চাচ্ছে। কিন্তু ইরতাজউদ্দিনের মনে হয় গল্প করার মতো অবস্থা না।

শাহেদ বলল, ভাইজান, ঢাকায় কোনো কাজে এসেছেন? না-কি বেড়াতে এসেছেন?

কাজে এসেছি। তোদের দেখতে এসেছি, এটাও তো একটা কাজ। কাজ না?

জি কাজ।

ভালো আতর কিনব। আন্তর শেষ হয়ে গেছে।

আমি আতর কিনে দেব।

তোকে কিনতে হবে না। আতরের ভালো-মন্দ তুই কী বুঝিস! আমিই কিনব। আর স্কুলের জন্যে একটা পতাকা কিনতে হবে। আগেরটার রঙ রোদে জুলে গেছে।

শাহেদ বিস্মিত হয়ে বলল, কী পতাকা কিনবেন?

ইরতাজউদ্দিন বিরক্ত গলায় বললেন, জাতীয় পতাকা। এছাড়া আর কী * পতাকা আছে!

ভাইজান, পতাকা কেনোটা ঠিক হবে না।

কেন ঠিক হবে না?

দেশ স্বাধীন হয়ে যাবে–নতুন পতাকা আসবে।

হুজুগের কথা আমার সঙ্গে বলবি না। দেশ স্বাধীন হয়েই আছে। নতুন করে আবার স্বাধীন কীভাবে হবে?

শাহেদ নরম গলায় বলল, ভাইজান, আপনি পরিস্থিতিটা বুঝতে পারছেন না!

ইরতাজউদ্দিন ভাইকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, পরিস্থিতি তোরা বুঝতে পারছিস না। জয় বাংলা জয় বাংলা বলে চোঁচালেই দেশ স্বাধীন হয় না। পাকিস্তানি মিলিটারি যখন একটা ধাক্কা দিবে, তখন কোথায় যাবে জয় বাংলা!

শাহেদ বলল, ভাইজান, আমি দুএকটা কথা বলি?

ইরতাজউদ্দিন বিরক্ত গলায় বললেন, কথা বলার দরকার নাই। যা, ঘুমুতে যা। সকালে কথা হবে। সিলিং ফ্যান বন্ধ করে দিয়ে যা।

ঢাকায় কতদিন থাকবেন?

কাল সকালে চলে যাব ইনশাল্লাহ।

কালকের দিনটা থেকে যান।

কালকের দিনটা থেকে গেলে কী হবে?

শাহেদ জবাব দিতে পারল না। ইরতাজউদ্দিন সাহেব প্রশ্নের উত্তর দেন। পাল্টা প্রশ্ন দিয়ে। সেইসব প্রশ্ন আচমকা চলে আসে বলে তার জবাব চট করে দেওয়া যায় না। ইরতাজউদ্দিন হাই তুলতে তুলতে বললেন, থেকে যেতাম, রুনি কত বড় হয়েছে দেখার শখ ছিল। উপায় নেই, স্কুল খোলা। স্কুল কামাই দিয়ে তো আর শখ মেটানো যায় না। আগে স্কুল, তারপর অন্য কিছু। মানুষকে কম্পাসের মতো হতে হয় বুঝলি। কম্পাসের কাটা যেমন একটা নির্দিষ্ট লক্ষ্যে স্থির হয়ে থাকে, মানুষকেও সে-রকম থাকতে হয়। মনের কােটাটাকে আমি স্কুলের দিকে ঠিক রেখে বাকি কাজকর্মগুলো করি।

ইরতাজউদ্দিনের মনে হলো তিনি ক্লাসে বক্তৃতা দিচ্ছেন। এই এক সমস্যা হয়েছে। কথা বলতে গেলেই বক্তৃতার ভঙ্গি চলে আসে। দীর্ঘদিন মাস্টারি করার কুফল। সবাইকে ছাত্ৰ মনে হয়।

শাহেদ।

জি।

ঘরে চিড়ামুড়ি জাতীয় কিছু আছে? এখন কেমন জানি ক্ষিধেটা বেশি লাগছে।

শাহেদ শুকনো মুখে উঠে গেল; কারণ সে মোটামুটি নিশ্চিত ঘরে কিছু নেই। আর থাকলেও সে খুঁজে পাবে না। চিড়ামুড়ি তো নিশ্চয়ই নেই। চানাচুর থাকতে পারে। সেই চানাচুর রান্নাঘরের অসংখ্য কৌটার কোনটায় আছে কে বলবে? একজন ক্ষুধার্তা মানুষকে ছাতা পড়া বাসি চানাচুর দেওয়া যায় না।
 
পিরিচে ঢাকা দেওয়া আধাগ্রাস দুধ পাওযা গেল। দুধ থেকে কেমন টকটক গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে। নষ্ট হয়ে গেছে কি-না কে বলবে। শাহেদ লজ্জিত ভঙ্গিতে দুধের গ্লাস নিয়ে ভাইয়ের সামনে রাখল। বিব্রত গলায় বলল, আর কিছু পেলাম না ভাইজান।

ইরতাজউদ্দিন একচুমুকে দুধটা খেয়ে ফেললেন। খেতে গিয়ে টের পেলেন দুধটা নষ্ট। না খেলে শাহেদ মনে কষ্ট পাবে বলেই গ্রাসের তলানি পর্যন্ত শেষ করে বললেন, আলহামদুলিল্লাহ।

শাহেদ বলল, ভাইজান, দুধটা কি নষ্ট হয়ে গিয়েছিল?

না।

আবারো একটু মিথ্যা বলতে হলো। শাহেদের মনে কষ্ট দিয়ে লাভ কী। কিন্তু মিথ্যার আশ্রয় নেওয়াটা কি ঠিক হলো? না, ঠিক হয় নি। সত্যের জন্য কেউ যদি মনে কষ্ট পায় তাহলে পাক। ইরতাজউদ্দিন বললেন, দুধটা টিকে গেছে। তবে খেতে খারাপ লাগে নি।

দুধ খেতে গিয়ে তার একটা মজার স্মৃতি মনে পড়ল। গতবছর জুন মাসে শান্তাহার স্টেশনে তিনি দুধ খাওয়ার একটা দৃশ্য দেখেছিলেন। তিনি যাবেন বগুড়া। ট্রেনের জন্য শান্তাহারে তাকে চারঘণ্টা অপেক্ষা করতে হবে। ট্রেন বিকেল পাঁচটায়। স্টেশনের ওয়েটিং রুমের একটা ইজিচেয়ারে তিনি শুয়ে পড়লেন এবং একসময় ঘুমিয়ে পড়লেন। হঠাৎ ঘুম ভেঙে দেখেন ওয়েটিং রুম ভর্তি মানুষ। চারদিক গমগম করছে। মনে হচ্ছে বিরাট জলসা। আসরের মধ্যমণি হয়ে যিনি বসে আছেন তাকে চেনা-চেনা মনে হচ্ছে কিন্তু ঠিক চেনা যাচ্ছে না। হৃষ্টপুষ্ট একজন মানুষ, মাথায় গোল টুপি । মুখভর্তি সফেদ দাড়ি। তার হাতে কে একজন কানায় কানায় ভর্তি একগ্লাস দুধ এনে দিল। বিনীত ভঙ্গিতে বলল, আমার নিজের গাইয়ের দুধ। হুজ্বরের জন্য এনেছি। মাওলানা ধরনের মানুষটা দুধের গ্লাস হাতে নিয়ে বললেন, দুধ খেতে ইচ্ছা করতেছে না। তবে দুধ এবং মধু এই দুই তরল খাদ্যদ্রব্য আমাদের আখেরি নবির বড়ই পছন্দের পানীয়। কাজেই খাচ্ছি। বলেই তিনি একচুমুকে গ্লাস শেষ করে বললেন, আলহামদুলিল্লাহ। খুবই ভালো দুধ। কালো গাইয়ের দুধ?

যে লোক দুধ এনেছিল সে বিনয়ে নিচু হয়ে বলল, জি হুজুর।

দুধে চুমুক দিয়েই বুঝেছি। কালো গাইয়ের দুধ ছাড়া দুধ এত মিষ্টি হয় না।

ইরতাজউদ্দিন তখনি মাওলানা সাহেবকে চিনলেন–ইনি মাওলানা ভাসানী। পত্রিকায় কত ছবি দেখেছেন। এই প্ৰথম সামনাসামনি দেখা।

ইরতাজউদ্দিন তৎক্ষণাৎ উঠে দাঁড়িয়ে সালাম দিলেন। মাওলানা ভাসানী তার দিকে তাকিয়ে হাসিমুখে বললেন, ঘুম ভালো হয়েছে? যেন কতদিনের চেনা মানুষ।

ইরতাজউদ্দিন বিনয়ের সঙ্গে বললেন, জি।

আপনার ঘুমের ব্যাঘাত করেছি, কিছু মনে করবেন না।

ইরতাজউদ্দিন আরো লজ্জার মধ্যে পড়ে গেছেন। এরকম একজন বিখ্যাত মানুষের সামনে ইজিচেয়ারে শুয়ে থাকা যায় না। তিনি উঠে দাঁড়ালেন। মাওলানা তখন অন্যপ্রসঙ্গে চলে গেছেন। সুট পরা রোগামতো এক ভদ্রলোককে বলছেন— দেশের অবস্থা শুনবা? পাঁচটা গ্রামে ঘুরে আমি একটা পঞ্চাশ টাকার নোট ভাঙাতে পারি নাই। এই হলো দেশের অবস্থা। কিছু একটা করা দরকার। কিছু করো। মাছি আর কত মারবা? অনেক তো মাছি মারলা।

মাওলানা ভাসানী ওয়েটিং রুমেই আছরের নামাজ পড়লেন। বিরাট জামাত হলো। ইরতাজউদ্দিন সেই জামাতে সামিল হলেন। জামাতে সামিল হওয়ার জন্য তিনি ট্রেন ফেল করলেন। কারণ মাওলানা দীর্ঘ দোয়া শুরু করলেন। সেই দোয়া চল্লিশ মিনিট স্থায়ী হলো। এর মধ্যে ইরতাজউদ্দিন সাহেবের গাড়ি ছেড়ে দিল। একবার ইরতাজউদ্দিন ভাবলেন, দোয়া ছেড়ে দৌড়ে গিয়ে গাড়ি ধরে ফেলেন। শেষপর্যন্ত তিনি তা করলেন না। দোয়ার মাঝখানে উঠে যাওয়া যায় না, সেটা অভদ্রতা হয়। এতবড় একজন মানুষের সঙ্গে তিনি অভদ্রতা করতে পারেন না। ট্রেন ফেল করা এমন কোনো বড় ব্যাপার না। একটা ফেল করলে আরেকটা পাওয়া যায়। এই ধরনের মানুষের সঙ্গ সবসময় পাওয়া যায় না।

নষ্ট দুধ খেতে দিয়ে শাহেদ কেমন মনমরা হয়ে আছে। মাওলানা ভাসানীর গল্পটা বলে তার মনমরা ভাবটা কাটাবেন কি-না ইরতাজউদ্দিন তা ধরতে পারলেন না। শাহেদ বলল, ভাইজান, শুয়ে পড়েন। তিনি শুয়ে পড়লেন।

ফ্যানটা বন্ধ করে দে।

ফ্যান থাকুক-না ভাইজান। গরম খুব বেশি।

ফ্যানের বাতাসে ঘুম হয় না–এটা কতবার বলব!

শাহেদ ফান বন্ধ করে দিল।

ইরতাজউদ্দিন সাহেব ক্লান্ত হয়েছিলেন। সঙ্গে সঙ্গে ঘুমিয়ে পড়লেন। এক ঘুমে রাত পার করে দিলেন। এত তৃপ্তি করে তিনি অনেকদিন ঘুমুন নি। ঘুম ভেঙে তিনি বিস্ময়ের সঙ্গে দেখলেন, তার উপরে মশারি খাটানো আছে এবং ফুল স্পিডে ফ্যান ঘুরছে। তার ঘুমের মধ্যেই শাহেদ এই কাজটি করেছে। এতে তাঁর ঘুমের কোনো অসুবিধা হয় নি। বরং অন্য দিনের চেয়েও অনেক তৃপ্তি করে ঘুমিয়েছেন। মশারি এবং ফ্যান সম্পর্কে তার এতদিনের ধারণায় কিছু ভুল আছে। এই ভুল শোধরাতে হবে। মানুষমাত্রই ভুল করে, তবে তার সুবিধা হচ্ছে সে ভুল শোধরাবার সুযোগ পায়।
 
শাহেদের অফিস মতিঝিলে। আধুনিক কেতার ছিমছাম অফিস বলতে যা বোঝায়, এই অফিস মোটেই সে-রকম না। আউলা ঝাউলা অফিস। অফিসের কর্মচারীদের টেবিল চেয়ারের পাশেই গাদা করে রাখা মালামাল। যদিও মালামাল রাখার জন্যে নিচে গোডাউন আছে। কোনো অফিস ঘরেই খাটিয়া থাকার কথা না, এই অফিসে খাটিয়া পাতা আছে। প্রায়ই সেখানে কাউকে না। কাউকে গড়াগড়ি করতে দেখা যায়। কেউ কিছু মনে করে না। আশপাশের সাত-আট তলা দালানের মাঝখানে কটকটা হলুদ রঙের (শাহেদের ভাষায় গু–কালার) দোতলা দালান। বারো হাত কাকুড়ের সাড়ে পনেরো হাত বিচির মতো বিশাল এক সাইনবোর্ড। সেখানে লেখা–United Commercial. সাইনবোর্ডের কয়েকটা অক্ষর মুছে গেছে। তাতেও কারো কোনো গরজ নেই।

সাড়ে বত্রিশ ভাজা অফিস। ইন্সুরেন্স, ইনডেনটিং, শেয়ার বিজনেস। অফিসের মালিকের নাম মইন আরাফী। মুর্শিদাবাদ বাড়ি। দেশ বিভাগের সময় দুইশ রূপেয়া, একটা রুপার হুক্কা এবং একটা দামি শাল নিয়ে চলে এসেছিলেন। শাল বিক্রি করে প্রথম তিনি ফলের ব্যবসা শুরু করেন। রুপার হুক্কাটা অনেক কষ্টে রক্ষা পায়। সেই হুক্কা তিনি অফিসে ব্যবহার করেন। মইন আরাফী সাহেবের ধারণা, হুক্কা টানার সময় হুক্কা কথা বলে। কাজকর্ম যখন থাকে না তখন না-কি হুক্কার কথা শুনতে ভালো লাগে। মইন আরাফী সাহেব এখন লক্ষপতির উপরে যা আছে সেই পতি। ভদ্রলোকের মাথায় যখন যে বিজনেস এসেছে তিনি করেছেন এবং টাকা এসেছে জলের মতো।

ভদ্রলোকের বয়স ষাট। বেটে গাটাগুট্টা চেহারা। টকটকে গৌরবর্ণের মানুষ। মাথায় কোনো চুল নেই, কিন্তু বাদামি রঙের বাহারি গোফ আছে। অফিসের কর্মচারীদের সঙ্গে তার ব্যবহার অত্যন্ত অমায়িক। কোনো কর্মচারীকে যখন তার প্রয়োজন হয়, তিনি তাকে ডেকে পাঠান না। নিজে তার কাছে উপস্থিত হন। সবার সঙ্গে হাসিমুখে কথা বলেন। এবং একটা পর্যায়ে বলেন, Be happy man! Be happy!

অফিসে তাঁর নাম বি হ্যাপি স্যার। অফিসের সমস্ত কর্মচারী মানুষটিকে সত্যিকার অর্থেই পছন্দ করে। বিবাহ বার্ষিকী, ছেলের জন্মদিন, মেয়ের পানচিনিতে বি হ্যাপি স্যারের দাওয়াত হয়। ভদ্রলোক যান বা না যান, একটা উপহার পাঠান। বেশ দামি উপহার।

শাহেদ অফিসের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। তার মেজাজ যথেষ্ট পরিমাণ খারাপ। ঘড়িতে নটা বাজছে। দশটা থেকে অফিস। সে একঘণ্টা আগে চলে এসেছে। দেরি করে অফিসে আসার নানান কারণ থাকে। একঘণ্টা আগে অফিসে আসার কারণ একটাই–বেকুবি। শাহেদ বেকুব না। আসমানীর সঙ্গে রাগ দেখাতে গিয়ে সে কাজটা করেছে। এই রাগটা না দেখালে একঘণ্টা আগে অফিসের সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে হতো না।

আসমানী চারদিন বাবার বাড়িতে পার করে আজ সকালে হাসিমুখে হাতে একটা ছােট্ট টিফিন কেরিয়ার ঝুলিয়ে উপস্থিত হয়েছে। শাহেদের সঙ্গে কোনো সমস্যাই হয় নি–এরকম ভঙ্গি করে বলেছে, এই রিকশা ভাড়াটা দিয়ে এসো তো। আমার কাছে ভাংতি নেই। নাশতা করেছ? আমি নাশতা নিয়ে এসেছি।

শাহেদ জবাব না দিয়ে রিকশা ভাড়া দিতে গেল। একবার ভাবল রিকশা ভাড়া দিয়েই সে দিলবাগ রেস্টুরেন্টে চলে যাবে। সেখানে পরোটা বুন্দিয়া নাশতা খেয়ে সোজা অফিস। এতে রাগ দেখানো হবে। কাজটা করতে পারল না, কারণ রুনিকে আদর করা হয় নি। চারদিন মেয়ের সঙ্গে দেখা হয় নি। তার কাছে মনে হচ্ছে চার বছর।
 
পত্রিকা দিয়ে গেছে। শাহেদ পত্রিকা হাতে ঘরে ঢুকল। সে ঠিক করেছে, আসমানীর কোনো প্রশ্নেরই জৈবাব দেবে না। মুখের সামনে পত্রিকা ধরে রাখবে। শাহেদ বিস্ময়ের সঙ্গে লক্ষ করল, আসমানী খুবই স্বাভাবিক ভঙ্গিতে ঘর ঠিকঠাক করছে। তারচেয়েও বিস্ময়কর রুনির ব্যবহার। সে কাগজে ছবি আঁকছে। একবারও বাবার দিকে তাকাচ্ছে না। যেন সে বাবাকে চিনতেই পারছে না।

আসমানী বলল, এই কদিন কোথায় খেয়েছ? নিজে রান্না করেছ, না হোটেলে?

শাহেদ গম্ভীর গলায় বলল, হোটেলে।

ভাইজান কবে গেছেন?

চেপে রেখে বলল, যেদিন এসেছেন তার পরদিনই চলে গেছেন।

আমি উনাকে চিঠি লিখেছিলাম আমচুর নিয়ে আসতে। এনেছেন?

শাহেদ জবাব দিল না। সে স্পষ্ট বুঝতে পারছে, এইসব হচ্ছে আসমানীর খাতির জমানো কথা। খেজুড়ে আলাপ। এই আলাপে যাবার কোনো মানে হয় না।

আসমানী বলল, তোমাকে নাশতা দিয়ে দেই? চালের আটার রুটি আর কবুতরের মাংস।

কবুতর খাই না।

কবুতর খাও না কেন?

কেন খাই না। এত ব্যাখ্যা তো দিতে পারব না। খাই না মানে খাই না।

কবুতরের মাংস ছাড়া অন্য কোনো মাংস হলে খাবে?

শাহেদ বিরক্ত চোখে তাকাল। আসমানীর চোখে-মুখে চাপা হাসি। আসমানী বলল, তুমি কবুতরের মাংস খাও না, আমি জানি। মা কবুতরের মাংস রান্না করেছিল। আমি ফ্রিজের বাসি গরুর মাংস নিয়ে এসেছি। গরম করে দিচ্ছি, তুমি খাও।

শাহেদ কিছু বলল না। গভীর মনোযোগে পত্রিকা পড়তে লাগল। তার মেজাজ খারাপ হচ্ছে রুনির দিকে। মেয়েটা বাবাকে চিনতে পারছে না–এই ঢং কোখেকে শিখেছে? নিশ্চয়ই মার কাছ থেকে। কাগজে কাকের ঠ্যাং, বকের ঠ্যাং আঁকাটা কি এখন এতই জরুরি? তার উপর দেখা যাচ্ছে তার বা হাতের একটা আঙুলে ব্যান্ডেজ বাধা। কী করে ব্যথা পেয়েছে এটাও সে বলবে না?

আসমানী বলল, হ্যালো রাগ কুমার! তুমি যদি ভাবো। আমি তোমার কাছে সরি বলব, তাহলে ভুল করেছ। তোমার উপর রাগ করে আমি যে চারদিন মায়ের কাছে ছিলাম, আমি ঠিকই করেছি। তবে ভাইজানের সঙ্গে দেখা করতে আসি নি–এটা খুবই বড় ভুল হয়েছে। এই ভুলের জন্যে আমি বড় ভাইজানের কাছে ক্ষমা চাইব। তোমার কাছে ক্ষমা চাইব কেন?

শাহেদ বলল, আমি তো তোমাকে ক্ষমা চাইতে বলছি না। কেন এত কথা दब्लछ?

আসমানী বলল, তুমি যদি স্বাভাবিকভাবে আমার সঙ্গে কথা না বলো, তাহলে আমি কিন্তু আবার মার কাছে চলে যাব।

যেতে চাইলে যাবে। মাংস গরম করে এনেছি, খেতে এসো। আচ্ছা আমি ভুল করেছি। সরি। এখন পায়ে ধরতে পারব না। রাতে পায়ে ধরব। সত্যি পায়ে ধরব।

এই কথার পর শাহেদের উচিত ছিল স্বাভাবিকভাবে খেতে বাসা। ঝোল ঝোল মাংস, চালের আটার রুটি তার খুবই পছন্দের খাবার। আসমানী নিঃশর্ত ক্ষমা প্রার্থনা করার জন্যেই বোধহয় হঠাৎ শাহেদের রাগ বেড়ে গেল। সে খবরের কাগজ ছুঁড়ে ফেলে গাঁটগট করে বের হয়ে গেল। তার রাগটা কমে গোল রিকশায় উঠার সঙ্গে সঙ্গে। তখন আর ফেরা যায় না। রিকশাওয়ালা রিকশা টানতে শুরু করেছে।
 
শাহেদ দাঁড়িয়ে আছে অফিসের সামনে। অফিস খুলেছে। সে ইচ্ছা করলেই তার চেয়ারে বসতে পারে। অফিসের পাশেই ছাপড়া রেস্টুরেন্টের মতো আছে। রেস্টুরেন্টের মালিক বিহারি, সে সকালে রুমালি রুটি এবং মুরগির লটপট নামে একটা খাদ্য তৈরি করে। অতি সুস্বাদু। অফিসের পিওন পাঠিয়ে সেখান থেকে নাশতা আনা যায়। ভালো ক্ষিধে লেগেছে। ক্ষিধের চোটে বুক জ্বালা করছে। কিন্তু শাহেদের অফিসে ঢুকতে ইচ্ছা করছে না। তার ইচ্ছা করছে বাসায় ফিরে যেতে।

কেমুন আছেন Young man?

শাহেদ চমকে তাকাল। বি হ্যাপি স্যার ঠিক তার পিছনেই দাঁড়িয়ে আছেন। এই ভদ্রলোকের শরীর ভারী কিন্তু তিনি হাঁটেন নিঃশব্দে।

অফিসে এখন এমুন কী কঠিন কাজ যে Early আসতে হোবে?

স্যার, ভালো আছেন?

অফকোর্স ভালো আছি। আপনার ছোট বাচ্চাটা কেমুন আছে–Little baby?

স্যার, ভালো আছে।

Be happy young man, Be happy

বলেই আরাফী সাহেব শাহেদের কাধে হাত রাখলেন। শাহেদ জানে, ভদ্রলোক কাঁধ থেকে হাত সরাবেন না। এইভাবেই অফিসে ঢুকবেন। ভদ্রলোকের ব্যবহার কতটুকু আন্তরিক এবং কতটুকু ভান কে জানে! বেস জাতীয় মানুষদের কাছ থেকে ভালো ব্যবহার পাওয়া যায় না। যখন পাওয়া যায়। তখন মনে হয় কোথাও বোধহয় সমস্যা আছে।

শাহেদ সাব।

জি স্যার।

ব্যবসা তো সব বন্ধ। জয় বাংলা বলে চিৎকার করলে তো পেটে দানাপানি আসবে না। ঠিক বুলেছি?

বসদের সব কথাতেই হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়তে হয়। শাহেদ তাই নাড়ল।

মইন আরাকী হাসিমুখে বললেন, বি হ্যাপি ইয়াং ম্যান। বি হ্যাপি।

শাহেদ মনে মনে ঠিক করল কোনো একদিন সুযোগ পেলে সে জিজ্ঞেস করবে–বি হ্যাপি বলা তিনি কবে থেকে শুরু করেছেন? প্রথম তিনি কাকে বলেছিলেন, বি হ্যাপি?



ঢিলাঢালাভাবে অফিস শুরু হয়েছে। অফিসের লোকজনও সব আসে নি। চারদিক ফাঁকা ফাকা। এই অফিস আগে গামগম করত। নানান ধরনের লোকজন নানান ধান্ধায় ঘুরত। একতলার গোডাউন সেকশনে হৈহল্লা হতো। মারামারি মাথা ফাটাফাটি হতো। এখন সব ফাঁকা। গোডাউনে কোনো মাল নেই। অফিসের লোকজনেরও কোনো কাজকর্ম নেই। আগে যেখানে হেড ক্যাশিয়ার আসগর আলি দেওয়ান এক হাজার ভাউচারে সই করতেন, সেখানে উনি এখন পনেরো-বিশটার বেশি ভাউচার সই করেন না। হাতের কাজ শেষ হয়ে যায় দুপুরের আগেই। তখন তিনি আরাম করে পান খান এবং এই দেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে আলাপ করেন। এই বিষয়ে গল্প করতে তার ভালো লাগে। তার ধারণা এই দেশের কপালে আল্লাহপাক বোল্ড লেটারে লিখে দিয়েছেন–Closed, রেস্টুরেন্টে যেমন Closed সাইনবোর্ড কুলায় সে-রকম। তাঁর ধারণা এই দেশের অতীতে কিছু হয় নি, ভবিষ্যতেও কিছু হবে না। কেউ তাঁর কথার বিবোধিতা করলে তিনি ঠাণ্ডা গলায় বলেন, আপনার পুরা নামটা যেন কী? আব্দুল গনি না? এখন থেকে নামের শেষে শিশু টাইটেল লাগায়ে দেন। বর্তমানে আপনার নাম আব্দুল গনি শিশু। আপনার চিন্তাশক্তি শিশু লেভেলে। বুঝেছেন?

দেওয়ান সাহেবের আশপাশে কেউ যায় না। আগ বাড়িয়ে শিশু টাইটেল নেয়ার দরকার কী?
 
দুপুর বারোটার দিকে দেওয়ান সাহেব পান-জর্দা নিয়ে বসলেন। শাহেদের দিকে হাত ইশারা করে বললেন, একটু শুনে যান।

শাহেদ বলল, দেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে কথাবার্তা শুনতে ইচ্ছা করছে না।

দেওয়ান সাহেব বিরক্ত গলায় বললেন, কাছে আসেন। অন্য ব্যাপার। মুখোমুখি না বসলে বলা যাবে না। জরুরি ব্যাপার।

শাহেদ নিতান্ত অনিচ্ছায় উঠে এসে দেওয়ান সাহেবের সামনের চেয়ারে বসল।

দেওয়ান সাহেব বললেন, পান খাবেন না-কি?

শাহেদ বলল, আমি পান খাই না।

খান না বলেই তো খাবেন। টেষ্ট কী রকম দেখবেন।

জরুরি ব্যাপারটা কী বলেন।

দেওয়ান সাহেব পান চিবুতে চিবুতে বললেন, ছটফট করছেন কেন? হাতে কোনো কাজ নাই। ছটফট কবরও কিছু নাই। আপনার একটা চিঠি আছে আমার কাছে।

কী চিঠি?

কাল তো আপনি অফিসে আসেন নাই। গৌরাঙ্গ বাবু আপনাকে খুব ব্যস্ত হয়ে খোজ করছিলেন। একটা চিঠি আমার কাছে দিয়ে গেলেন। খামের উপরে লেখা—জরুরি।

শাহেদ বলল, চিঠিটা দিন।

দেওয়ান সাহেব বললেন, দিচ্ছি। এত অস্থির হচ্ছেন কেন? দেশ কোন দিকে যাচ্ছে কিছু বুঝতে পারছেন?

না।

দেশেব ইকনমি টোটালি ধ্বংস হয়ে গেছে, কেউ কিছু বুঝতে পারছে না। শেষ ভরসা আমেরিকা। পিএল ফোর এইটির পশম; গম যাবে আমরাও যাব।

শাহেদ বলল, ও আচ্ছা।

দেওয়ান সাহেব গলা নিচু করে বললেন, আমাদের অফিস যে বিক্রি হয়ে যাচ্ছে এটা জানেন?

জানি না তো।

আমাদের নি। হ্যাপি স্যার, আপনাদের সবার চোখে আদর্শ মানব, তলে তলে সব বিক্রি করে দিচ্ছেন। ক্যাশ নিয়ে চলে যাবেন করাচি। ফ্যামিলি চলে গেছে। তিনি থেকে গেছেন। আগামী মাসে বেতন হবে না। বুড়ো আঙুলে সামান্য চিনি মাখিয়ে চুষতে হবে। যাদের ডায়াবেটিস আছে, তারা চুষবে শুধু বুড়ো আঙুল।

শাহেদ বলল, আপনাকে কে বলেছে। অফিস বিক্রি হয়ে যাচ্ছে?

দেওয়ান সাহেব বললেন, এইসব গোপন কথা কি কেউ আগ বাড়িয়ে বলে? হাবে ভাবে বুঝেছি। তবে স্যারের ফ্যামেলি যে করাচি চলে গেছে এইটা জানি। তাদের পিআইএর টিকিট আমি কেটেছি।

বাড়িতে কি স্যার একা থাকেন?

একা থাকেন, না-কি দোকা থাকেন আমি জানি না। তবে স্যারের ফ্যামিলি যে ফুড়ুৎ করে চলে গেছে এইটা জানি। বি হ্যাপি স্যারের নাম এখন হওয়া উচিত বি স্যাড স্যার।

শাহেদ উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলল, চিঠিটা দিন, চলে যাই।

দেওয়ান সাহেব বললেন, কথা শুনতে ভালো লাগছে না? সত্য কথার প্রধান সমস্যা হলো, সত্য কথা শুনতে ভালো লাগে না। যে বলে তাকেও ভালো লাগে না। মিথ্যা কথা শুনতে ভালো লাগে। যে বলে তাকেও বড় আপন মনে যা হোক, আমার সঙ্গে কথা বলতে না চাইলে নাই। এই দিন গৌরাঙ্গ বাবুর চিঠি।



গৌরাঙ্গের সঙ্গে শাহেদের খুব যে মাখামাখি পরিচয় তা-না। গৌরাঙ্গ এবং শাহেদ একই দিনে এই অফিসে চাকরিতে জয়েন করেছিল। কাকতালীয়ভাবে দুজনের পরনেই ছিল ঘিয়া রঙের পাঞ্জাবি। গৌরাঙ্গ সেদিন অবাক হয়ে বলেছিল, শাহেদ ভাই, আমাদের কোইনসিডেন্সটা দেখেছেন? পয়েন্টে পয়েন্টে মিলে যাচ্ছে।

তারচেয়েও বড় মিল যেটা পাওয়া গেল— দুজনেরই প্রথম সন্তান কন্যা। একজনের নাম রুনি, আরেকজনের রুনু।।
 
গৌরাঙ্গ এই মিল দেখে অফিসের শেষে ক্যান্টিনে চা খেতে খেতে বললআমি পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছি। এর মধ্যে ঈশ্বরের একটা খেলা আছে। দেখবেন আমাদের জীবনে একজনের ঘটনার সঙ্গে আরেকজনের ঘটনা মিলে যাবে। আমি যেদিন অফিসে নীল শার্ট পরে আসব দেখা যাবে আপনিও নীল শার্ট পরে এসেছেন। আমার পরিবারে যেদিন আনন্দের কোনো ঘটনা ঘটবে, আপনার পরিবারেও ঘটবে। আমার ঠাকুরমা যেদিন মারা যাবে, দেখা যাবে আপনার দাদিও সেদিন মারা যাবে।

শাহেদ হেসে ফেলল।

গৌরাঙ্গ বলল, হাসছেন কেন?

শাহেদ বলল, কোনো কারণ ছাড়াই হাসছি।

গৌরাঙ্গ আহত গলায় বলল, আমি সিরিয়াস একটা বিষয় নিয়ে কথা বলছি, আপনি হেসে দিলেন কেন?

সরি।

না, এরকম করবেন না। এতে আমি মনে কষ্ট পাই।

কিছুদিনের মধ্যেই শাহেদ লক্ষ করল গৌরাঙ্গের স্বভাবই হলো তুচ্ছ সব কারণে মনে কষ্ট পাওয়া। যেমন একদিন গৌরাঙ্গ এসে শাহেদের টেবিলে বসতে বসতে বলল, আজ থেকে আমি আপনাকে তুই করে বলব। আপনিও আমাকে তুই করে বলবেন। দিস ইজ ফাইনাল।

শাহেদ অবাক হয়ে বলল, কেন?

গৌরাঙ্গ আহত গলায় বলল, কারণ আমরা বন্ধু, এই জন্যে। আপনি কখনো শুনেছেন দুই ঘনিষ্ঠ বন্ধু একে অন্যকে আপনি করে বলছে?

শাহেদ কিছু বলল না।

গৌরাঙ্গ বলল, তুই রাজি না?

শাহেদ বলল, একমাসও হয় নি আমাদের পরিচয়, এর মধ্যে হঠাৎ করে একদিন দুজন দুজনকে তুই বলছি–এটা চোখে লাগবে না?

গৌরাঙ্গ বলল, কার চোখে লাগবে?

শাহেদ বলল, সবার।

গৌরাঙ্গ বলল, ঠিক আছে, আপনাকে তুই বলতে হবে না। আমিও বলব না। কথা দিচ্ছি। প্রয়োজন ছাড়া আমি আপনার সঙ্গে কথাও বলব না।

গৌরাঙ্গ নিজের টেবিলে ফিরে গেল। কিছুক্ষণের মধ্যে দেখা গেল আরেক সহকমীরি সঙ্গে কথা বলে সে জায়গা বদল করছে। আগের জায়গাটা ছিল শাহেদের মুখোমুখি, এখনেরটা দূরে। এই অবস্থায় চার-পাঁচ দিন কাটাবার পর গৌরাঙ্গ আবার আগের জায়গায় চলে এলো। বিকেলে অফিস শেষ করে জোব করে ক্যান্টিনে চা খাওয়াতে নিয়ে এলো শাহেদকে।

হাস্যকর যেসব ছেলেমানুষী গৌরাঙ্গের মধ্যে আছে তার কিছু কিছু শাহেদের বেশ ভালো লাগে, আবার কিছু কিছু খুবই বিরক্তিকর।

সবচে বিরক্তিকর হলো, গৌরাঙ্গের বাড়িতে নিমন্ত্রণ খেতে যাওয়া। যে রাতে নিমন্ত্রণ সেই রাতে অবধাবিতভাবে গৌরাঙ্গ কিছু মদ্যপান করবে। দুপেগ খাওয়ার পর বদ্ধ মাতাল। তখন কথাবাতাঁর ঠিক ঠিকানা নেই। এই হাসছে, এই কাদছে, এই পা ধরতে আসছে। খাওয়াদাওয়া শেষ করার পর বাড়িতে ফেরার নাম নেয়া যাবে না। গৌরাঙ্গ কিছুতেই বাড়ি ফিরতে দেবে না। তাকে থাকতেই হবে। একটা পৰ্যায় আসে যখন গৌরাঙ্গের স্ত্রী নীলিমা এসে করুণ গলায় বলে, ভাই, আপনি থেকে যান। আপনি চলে গেলে সে বড় যন্ত্রণা করবে। কাঁদবে, জিনিসপত্র ভাঙবে। শাহেদকে অতি অনগ্রহের সঙ্গে রাতে থেকে যেতে হয়।

গৌরাঙ্গের চিঠি হাতে নিয়ে শাহেদ বসে আছে। চিঠি খুলতে ভরসা পাচ্ছে না। সে নিশ্চিত চিঠিতে কোনো একটা নিমন্ত্রণের ব্যাপার আছে।

গৌরাঙ্গ লিখেছে–

প্রিয় মিতা,

আমার জীবনে দুইটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা সংঘটিত হইয়াছে। অতীব অতীব গুরুত্বপূর্ণ, যাহা পত্র মারফত বলা সম্ভব নহে। আমি অফিসে আসিয়া আপনাকে না পাইয়া হতাশ হইয়া বাসায় ফিরিয়া গেলাম। মিতা, পত্র পাওয়া মাত্র যেখানে যে অবস্থায় আছেন আমার বাড়িতে চলিয়া আসিবেন। যদি না আসেন, ঈশ্বরের দোহাই বাকি জীবন আমি আপনার সহিত কোনো বাক্যব্যয় করিব না। আমি তিন দিনের আর্নড লিভ নিয়া বাড়িতে বসিয়া আছি আপনার

অপেক্ষায়।

ইতি

গৌরাঙ্গ

শাহেদ মনে মনে বলল, অসম্ভব টু দা পাওয়ার টেন। যাওয়ার প্রশ্নই উঠে না। চারদিন হয়েছে সে তার মেয়ের সঙ্গে কথা বলতে পারে নি। আজ পুরনো ঢাকায় গৌরাঙ্গের সঙ্গে দেখা করার অর্থ রাতে ফেরা যাবে না। মেয়ের সঙ্গে আরো একদিন কথা হবে না।

অফিস ছুটি হয় পাঁচটায়, তিনটা বাজতেই দেখা গেল কর্মচারীরা উঠতে শুরু করেছে। বি হ্যাপি স্যার লাঞ্চের সময় চলে গেছেন। ব্যবসা সংক্রান্ত কী একটা কাজে (চিটাগাং পোর্টে জাহাজে মাল খালাস বিষয়ক কাজ) তিনি চিটাগাং যাচ্ছেন। ফিরবেন দুদিন পর। কর্মহীন অফিসে পাঁচটা পর্যন্ত বসে থাকার অর্থ হয় না।

শাহেদ চারটার দিকে উঠল। দেওয়ান সাহেব একা বসে আছেন। তিনি কখনো অফিস শেষ হবার আগে চেয়ার ছেড়ে উঠেন না। তিনি শাহেদকে বললেন, আরো কিছুক্ষণ থাকুন না। দুই ভাই একসঙ্গে বের হই।

শাহেদ বলল, কাজ আছে।

দেওয়ান সাহেব বললেন, বাঙালির এখন কাজ কী? বর্ষার ঘোেতা ব্যাঙের মতো গলা ফুলিয়ে শ্লোগান দেয়া–জয় বাংলা, জয় বাংলা। এখন আমাদের কী স্লোগান হওয়া উচিত জানেন? আমাদের স্লোগান হওয়া উচিত–নয় বাংলা, নয় বাংলা। অর্থাৎ বাংলা না, অন্য কিছু। শুনেন শাহেদ সাহেব, এখনো সময় আছে। আমরা যদি বাঁচতে চাই আমাদের খোল নলচে সব বদলাতে হবে। পোশাক চেঞ্জ করতে হবে। লুঙ্গি শাড়ি চলবে না। ফুড হ্যাবিট বদলাতে হবে। No Fish. No Rice. বাংলা ভাষা বাতিল। কথা বলতে হবে অন্য ভাষায়–উর্দু, হিন্দি, পাঞ্জাবি চলতে পারে। বুঝতে পারছেন, না-কি পারছেন না?

আপনি আগে ভালোমতো বুঝে নিন।

চা খাবেন না-কি? আসুন আপনাকে এক কাপ বিদায়ী চা খাওয়াই।

চা খাব না।

তাহলে আর আপনাকে আটকে রেখে কী হবে! চলে যান। নয়। বাংলা।
 
বাসায় ফেরার পথে শাহেদ মরণাচাদের দোকান থেকে এক সেরা রসগোল্লা কিনল। রসগোল্লা আসমানীর পছন্দের মিষ্টি। রসগোল্লা খাওয়ার কায়দাটাও তার অন্যরকম। প্রথমে চিপে রস বের করে রসহীন রসগোল্লা খায়। পরে চুমুক দিয়ে খায় রসটা। সব বয়স্ক মানুষদের কর্মকাণ্ডেই কিছু ছেলেমানুষী থাকে। আসমানার রসগোল্লা খাওয়ার মধ্যে ছেলেমানুষীটা আছে। তার একটা পছন্দের মিষ্টি নিয়ে বাসায় ফেরার অর্থই হচ্ছে আসমানীকে নিঃশব্দে বলা–আই অ্যাম সরি। বেচারি। আজ সকালে কষ্ট করে খাবার গরম করে টেবিলে দিয়েছে, সে রাগ দেখিয়ে চলে এসেছে–এটা ঠিক হয় নি।

ইত্তেফাক অফিসের সামনে মাঝে মধ্যে পাখিওয়ালা বসে। খাঁচায় বন্দি পাখি বিক্রি হয়। টিয়া, মুনিয়া, কালিম পাখি, ঘুঘু। রুনির জন্যে একটা পাখি কিনে নিলে হুলুস্কুল ঘটনা হবে। খাঁচা হাতে সারা বাড়িতে ছোটাছুটি করবে। পাখি কেনা নিতান্তই বাজে খরচ। এই পাখি কয়েক দিন পরেই ছেড়ে দিতে হবে। যে মেয়ের সঙ্গে চারদিন কথা হচ্ছে না, সেই মেয়ের আনন্দের জন্যে কয়েকটা সস্তার মুনিয়া পাখি কেনা যেতে পারে। শাহেদ রিকশা নিয়ে পাখিওয়ালার খোজে। ইত্তেফাক অফিসের সামনে গেল। সে পাঁচটা মুনিয়া পাখি কিনল দেড় টাকা দিয়ে। খাঁচাটা ফ্রি।

এক হাতে মিষ্টি অন্য হাতে পাখির খাঁচা নিয়ে শাহেদ বাসায় ফিরল। বিকেল পাঁচটায়। অমঙ্গল আশঙ্কার মতো তার মনে হচ্ছিল বাসায় ফিরে দেখবে কেউ নেই। দরজায় তালা ঝুলছে। তালার ফাঁকে গুজে রাখা নোট–চলে গেলাম। ভোরবেলা নাশতা না খাওয়া এবং রাগ দেখানোর শাস্তি আসমানী দেবে নাতা হবে না।

দরজায় তালা নেই। হঠাৎ শাহেদের মন আনন্দে পূর্ণ হলো। নিজের ছোট্ট বাসাটাকে মনে হচ্ছে রবীন্দ্রনাথের ধন নয় মান নয় এতটুকু বাসা। তার কাছে মনে হলো শুধু বেঁচে থাকার জন্যে হলেও দীর্ঘকাল বেঁচে থাকা যায়।

আসমানী তাকে দেখে খুবই স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বলল, এখন চা খাবে, না-কি গোসল করে চা খাবে? (অফিস থেকে ফিরে শাহেদ গরম পানি দিয়ে গোসল সেরে চা খায়।) শাহেদ বলল, এখন এক কাপ খাব। গোসল সেরে আরেক কাপ খাব। আসমানী বলল, আবার পাখি এনেছ? এইগুলাকে কে দেখবো? দুদিন পর রুনির শখ মিটে যাবে, তারপর কী হবে?

শাহেদ কিছু না বলে হাসল। হাসি দিয়ে জানান দেয়া–এখন আর আমাদের মধ্যে কোনো ঝামেলা নেই।

আসমানী বলল, চুলায় গরম পানি আছে, বালতিতে ঢেলে দিচ্ছি।

শাহেদ বলল, আমি ঢেলে নেব। রুনি কোথায়?

আসমানী বলল, ও বাসায় নেই। ও মার বাসায় চলে গেছে।

শাহেদ বলল, তার মানে?

আসমানী বলল, মেয়ে তার নানির বাসায় গেছে, এর আবার মানে কী? তার ছোট মামা এসেছিল, সে তার ছোট মামার সঙ্গে চলে গেছে।

শাহেদ বলল, ও আচ্ছা।

সে কিছুতেই রাগ সামলাতে পারছে না। পরিষ্কার বুঝতে পারছে সকালে নাশতা নিয়ে সে যে কাণ্ডটা করেছে, আসমানী তার শোধ তুলেছে। মেয়েকে নানির বাড়িতে পাঠিয়ে দিয়েছে। খুব কঠিন কিছু কথা আসমানীকে বলতে পারলে ভালো হতো। বলতে ইচ্ছা করছে না।

আসমানী চা এনে সামনে রাখল। শাহেদ বলল, রুনিকে একা পাঠিয়ে দিলে কেন? তুমিও সঙ্গে যেতে।

আসমানী বলল, আমিও যাব। আমি তোমার ফেরার জন্যে অপেক্ষা করছিলাম। এই তো এখন যাব।

তুমিও যাচ্ছ?

হ্যাঁ।

কেন জানতে পারি?

তোমার সঙ্গে তুচ্ছ বিষয় নিয়ে ঝগড়া করতে ইচ্ছা করছে না বলে চলে যাব। নিরিবিলি কয়েকটা দিন থাকব। বই পড়ব, গান শুনিব। রিল্যাক্স করব।

শাহেদ বলল, আচ্ছা ঠিক আছে।

আসমানী বলল, বাথরুমে গরম পানি দিয়ে এসেছি। গোসল করতে চাইলে করে।

গোসল সেরে এসে শাহেদ দেখে, আসমানী বাসায় নেই। সত্যি সত্যি চলে গেছে। শাহেদ রাত আটটা পর্যন্ত বারান্দার চেয়ারে বসে থাকল। তারপর ঠিক করল গৌরাঙ্গের বাড়িতে যাবে। রাতটা সেখানেই কাটাবে। সে সঙ্গে করে আসমানীর জন্যে কেনা রসগোল্লার হাঁড়িটা নিয়ে নিল। আরেক হাতে নিল খাঁচার মুনিয়া পাখি। আসমানীর উপর সে যতটা রেগেছে, মেয়ের উপর ঠিক ততটাই রেগেছে। তার কাছে মনে হচ্ছে রুনিকে পাখি উপহার দেবার কোনো মানে হয়। না। পাখিগুলি সে দেবে গৌরাঙ্গের মেয়েকে।
 
গৌরাঙ্গের বাড়ি পুরনো ঢাকার বংশাল রোডে। গলির ভেতর গলি, তার ভেতর গলি। শেষ গলিটা এতই সরু যে রিকশা চলার কথা না, তারপরেও রিকশা চলে। ফিতার মতো সরু গলির দুদিকেই নর্দমা। নর্দমায় মরা বেড়াল, মুরগির নাড়িভুঁড়ি থাকবেই। ঠিকই গন্ধ আসবে। মনে হবে এখানে কেন এসেছি? এই রাস্তায় হাঁটার অভ্যাস না থাকলে নর্দমায় পা পড়বেই।

গৌরাঙ্গ যে বাড়িতে থাকে সেটা তিনতলা। বাড়ির প্রথমতলায় সিমেন্ট রডের দোকান। দোতলায় থাকে গৌরাঙ্গ। তিনতলায় গৌরাঙ্গের শ্বশুর হরিভজন সাহা। সাহা সম্প্রদায়ের মানুষজন মিষ্টভাষী হয়ে থাকে। এই ভদ্রলোক সন্দেহ বান্তিকগ্ৰস্ত। তিনি কারো সঙ্গেই সহজভাবে কথা বলেন না। ধুতি পরার চল এই দেশ থেকে উঠে গেছে, হরিভজন সাহা এখনো ধুতি পরেন। শ্বশুরের সঙ্গে গৌরাঙ্গের সম্পর্ক খুবই খারাপ। কথাবার্তা প্ৰায় বন্ধ। গৌরাঙ্গ স্ত্রীর অগোচরে শ্বশুরকে ডাকে চামচিকা বাবাজি। বাড়িটা গৌরাঙ্গের শ্বশুরের। প্রতি মাসে বাড়ি ভাড়া বাবদ গৌরাঙ্গের তার শ্বশুরকে পঞ্চাশ টাকা দেয়ার কথা। সে কিছুই দেয় না।

শাহেদ গৌরাঙ্গের বাড়ি পৌঁছল। রাত নটায়। দরজা খুলে দিল নীলিমা। সে আনন্দিত গলায় বলল, আপনি তাহলে এসেছেন!! আপনার বন্ধুর তো মাথা খারাপের মতো হয়ে গেছে। আপনি না এলে কী যে করত কে জানে! সন্ধ্যা থেকে গ্লাস নিয়ে বসেছে। বুঝতেই পারছি আজ একটা কাণ্ড হবে।

পটে আঁকা ছবি বলে যে কথাটি প্রচলিত আছে তা নীলিমার জন্যে খুবই প্রযোজ্য। শাহেদের ধারণা সে তার সারা জীবনে এত রূপবতী কোনো তরুণীকে দেখে নি; ভবিষ্যতে দেখ,–সে সম্ভাবনাও ক্ষীণ। প্রথমবার দেখে সে হকচাকিয়ে গিয়েছিল। এর পরে অনেকবারই দেখা হয়েছে। শাহেদ প্রতিবারই হকচাকিয়েছে। আজ নিশ্চয়ই কোনো উৎসব। নীলিমা সাজগোজ করেছে। খোপায় গন্ধরাজ ফুল গুজেছে। পরনের তাতের শাড়িটা দামি। নতুন শাড়ি, আজই পরেছে। শাড়ি থেকে নতুন নতুন গন্ধ আসছে। শাহেদের মনে হলোএই মেয়ের সাজ করার দরকার কী?

ঘরের ভেতর থেকে গৌরাঙ্গ ভারি গলায় বলল, নীলু, শাহেদ এসেছে? (মদ খেলে গৌরাঙ্গের গলা ভারি হয়ে যায়।)

নীলিমা কিছু বলার আগেই গৌরাঙ্গ দরজা খুলে বাইরে চলে এলো। স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে বলল, তোমাকে তো বলেছি। শাহেদ আসবে। বলেছি, না-কি বলি নাই?

বলেছ।

গৌরাঙ্গ রাগী গলায় বলল, তাহলে কেন বললে সে আসবে না?

নীলিমা বলল, রাত বেশি হয়ে গেছে বলে বলেছি। এত রাত করে উনি আসবেন ভাবি নি।

অবশ্যই সে রাত করে আসবে। রাত একটা বাজিলেও সে আসবে। আমি তাকে আসতে বলেছি, সে আসবে না–আমার বন্ধু সম্পর্কে এটা তুমি কী ভাবলে?

নীলিমা চাপা গলায় বলল, চিৎকার করছ, কেন?

তুমি আমার বন্ধু সম্পর্কে উল্টাপাল্টা কথা বলবে, আর আমি চিৎকার করব না! অবশ্যই চিৎকার করব। তিনতলায় তোমার বাবা থাকে বলে আমি কি ভয় পাই না-কি? চামচিকা বাবাজিকে গৌরাঙ্গ… দিয়েও পুছে না। (গৌরাঙ্গ অবলীলায় কুৎসিত কথাটা বলল। নীলিমা বিব্রত ভঙ্গিতে শাহেদের দিকে তাকাল। বেচারি খুবই লজ্জা পাচ্ছে।)

নীলিমা বলল, ভাই, আপনি আপনার বন্ধুকে সামলান। এই জিনিস সহ্য করতে পারে না, তারপরেও রোজ খাওয়া চাই। কী যে যন্ত্রণা!
 

Users who are viewing this thread

Back
Top