১৭. ফুলশয্যা
পুকুর দেখেছি, নদী দেখেছি, সমুদ্র দেখা হয়নি কোনওদিন। বউ নিয়ে কক্সবাজারের সমুদ্র সৈকতে মধুচন্দ্রিমা করে আসার পর দাদাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম দাদা গো সমুদ্র দেখতে কেমন! দাদা একটি কথাই বলেছেন,না গেলে বুঝবি না। সমুদ্র কেমন সে কথা কখনও বইলা বুঝানো যায় না, সমুদ্রের সামনে দাঁড়ায়া উপলব্ধি করতে হয় সমুদ্র। সমুদ্রের চেয়ে বেশি উচ্ছ্বাস দাদার উড়োজাহাজ নিয়ে। উড়োজাহাজে প্রথম চড়েছেন তিনি। ছোটদা উড়োজাহাজের গল্প করলে দাদা এতকাল তৃষ্ণার্ত নয়নে তাকিয়ে থাকতেন। নয়নের সেই তৃষ্ণা দাদার ঘুচেছে এখন। আমার অবশ্য কিছুই ঘোচেনি। উড়োজাহাজের চেয়ে সমুদ্র দেখার উৎসাহটিই আমার বেশি।
সমুদ্রপাড়ে তোলা দাদা আর হাসিনার ছবি দেখে, সমুদ্র না দেখেই লিখে ফেলি সমুদ্র নিয়ে তিনটে কবিতা। না দেখা সমুদ্র যখন আমার হৃদয় জুড়ে, তখনই চল চল সমুদ্র দেখবে চল, কাপড় চোপড় গোছাও রব। চতথুর্ বষের্ এই একটি চমৎকার ঘটনা ঘটে, এক ক্লাস ছাত্রছাত্রী নিয়ে কমিউনিটি মেডিসিনের শিক্ষকরা দূরে কোথাও চলে যান, দূর বলতে দেশের মাথা থেকে লেজে যাওয়া, লেজের কাছে থই থই করছে রূপোলি জল, সেই জলে ডোবো, ভাসো। অবশ্য বলা হয় জলীয় আবহাওয়া দেখাতে নিচ্ছেন, আসলে এ অনেকটা হাওয়া বদলের মত, রোগীদের যেমন হাওয়া বদলের দরকার হয়, হবু ডাক্তারদেরও হয়। দিনরাত হাসপাতালের পুঁজ-গন্ধময় হাওয়া থেকে খানিকটা নিস্তার পাওয়া হয়।
ময়মনসিংহ থেকে ঢাকা, ঢাকা থেকে ট্রেনে চড়ে চট্টগ্রাম, চট্টগ্রাম থেকে বাসে চড়ে কক্সবাজার। বাড়িতে হইচই পড়ে গেল, হইচইই বটে, এমন তো কখনও ঘটে না, আত্মীয় কাউকে না নিয়ে দূরের কোনও শহরে চলে যাওয়া। মা বার বার জিজ্ঞেস করলেন মাস্টাররা থাকবে তো! দুঘন্টার পথ ঢাকা, ঠিক আছে মানায়, ঢাকায় আত্মীয়ও আছে, কিন্তু চট্টগ্রামে তো আমার মামাও থাকে না কাকাও না। মামা কাকার সীমানার বাইরে বলেই সম্ভবত পেখম মেলে একশ ময়ূর নাচে হৃদয়ে। বাবা দরাজ হসে ্ত দিয়েছেন টাকা, হাইজিন ট্যুরের চাঁদা তো আছেই, বাড়তি টাকাও। ট্রেনে চড়ে দলের ঢাকা যাত্রা হয়। সেগুনবাগিচা ছেড়ে ছোটদা এখন নয়াপল্টনে বাড়ি ভাড়া করেছেন। নয়াপল্টনে একরাত থেকে পরদিন কমলাপুর রেলইষ্টিশনে পৌঁছতে হবে সকাল আটটায়। রাতে গীতার কাছে শাড়ি চাইতেই আলমারি খুলে বিছানায় লাল নীল সবুজ হলুদ কাতান সিল্ক এমনকি মসলিন বিছিয়ে দিল পছন্দ করে নিতে একটি নয়, যত খুশি। বোতাম টিপলে আলো জ্বলে এমন একটি ক্যামেরাও মিলল। আর কি চাই! আশাতীত পাওয়া আমার।
পরদিন ট্রেনে চড়ে কখনও হৈ হল্লায় মেতে, কখনও জানালায় উদাস চোখ মেলে পৌঁছই চট্টগ্রাম। চট্টগ্রাম থেকে বনের ভেতর দিয়ে আঁকা বাঁকা পথে সারি সারি রাবার গাছের বাগান পার হয়ে কক্সবাজার যখন পৌঁছই, উত্তেজনা তুঙ্গে। একটি শব্দ, ভীষণ এক শব্দ, অন্যরকম, মাটি কাঁপানো, জল কাপাঁনো, শব্দটির দিকেই বাস যেতে থাকে। ঠিক কোত্থেকে শব্দটি আসছে বুঝতে আমি চারদিক খুঁজি। বাসের জানালা থেকে কিছুতেই চোখ সরে না। দূরে একটি শাদা কিছু একবার উঠছে একবার নামছে। সাফিনাজ, হালকা হালকা বন্ধুত্ব অতিক্রম করে ঘনিষ্ঠ হওয়া একজন, জানালায় ঝুঁকে বলল,ওইটাই কি সমুদ্র নাকি! কোনওদিন সমুদ্র না দেখা মেয়ে আমি, ইচ্ছে করে, বাস থেকে নেমে দৌড়ে যাই দেখতে ,যদি ওটাই সমুদ্র হয়, কিন্তু কে দেবে আমাকে ছুটে যেতে! আগে মোটেলে নামো, তারপর। মোটেলে দুজনের জায়গায় চারজনকে ঢোকানো হল এক ঘরে। বরাদ্দ ঘরে সুটকেস নামিয়ে রেখে আগে দৌড়ে যাই ওই শব্দের দিকে। গোসল নেই, খাওয়া নেই, বিশ্রাম নেই। আগে আমি সমুদ্র দেখব তারপর অন্য কিছু সাফিনাজ পরিপাটি মেয়ে, খাওয়ার সময় খাওয়া পড়ার সময় পড়া ঘুমের সময় ঘুমের মেয়ে। ওকে যেতে হয় আমার উত্তেজনাকে সঙ্গ দিতে। সেই তীব্র র্গজনের দিকে হেঁটে নয়, দৌড়ে যাই। যখন পৌঁছই, বিস্ময় আর মগ্ধু তা আমাকে স্থবির করে রাখে, আমাকে নিস্পন্দ করে রাখে,আমাকে বিবশ করে রাখে। একটি শব্দ আমি আর উচ্চারণ করতে পারি না। এত বিশাল কিছু এত অদ্ভুত সুন্দর কিছু এত আশ্চর্য হৃদয়রঞ্জন কিছু আমি আমার জীবনে কখনও দেখিনি। নানিবাড়ির ছোট্ট পুকুরের ধারে বড় হয়েছি, শহরের তিনকোনা পুকুর ছিল নানিবাড়ির পুকুরের চেয়ে দ্বিগুন, সেটি দেখতে যেতে আমাকে অপেক্ষা করতে হয়েছিল কয়েকটি বছর, বড় হয়ে ব্রহ্মপুত্র দেখা হয়েছে, ব্রহ্মপুত্রের শীর্ণ জলের ধারা দেখেই মনে হয়েছে এর চেয়ে বিশাল কিছু বুঝি পৃথিবীতে নেই। আমার কল্পনায় ছিল সমুদ্র। সেই সমুদ্র এই সমুদ্রের সৌন্দর্যের ধারে কাছে আসতে পারে না। আমার অবাধ কল্পনা এত বিশাল কিছু এত আশ্চর্য সুন্দর কিছু এত কূল কিনারাহীন কিছু আমাকে দিতে পারেনি। আমি লক্ষ করি না আমার চোখ যে ভিজে যাচ্ছে চোখের জলে। সূর্য ডুবছে সমুদ্রে। আমি তন্ময় হয়ে শব্দ শুনি সমুদ্রের, ভেজা চোখে সূর্যের ডুবে যেতে থাকা রূপ দেখি। সূর্যাস্ত আমি আগেও দেখেছি অনেক, এমন রূপ দেখিনি আগে। আমাকে বিহ্বল করে রাখে, বিমগ্ধু করে রাখে, বিমূঢ় করে রাখে প্রকৃতির এই অনিঃশেষ সৌন্দর্য। ধীরে ধীরে দল বেঁধে আসতে থাকে ছেলেমেয়েরা, সূর্যাস্তের দিকে নির্নিমেষ তাকিয়ে থাকে। এই সুন্দর থেকে কোথাও আমার আর ফিরে যেতে ইচ্ছে করে না। রাত নেমে এলে সাফিনাজ আমাকে টেনে নিয়ে যায় মোটেলে, রাতের সৈকত নাকি নিরাপদ নয়। মেয়েরা সব চলে যায় মোটেলে, ছেলেরা পূর্ণিমা দেখবে বলে থেকে যায় অনেক রাত অবদি সৈকতে। আমার বড় ছেলে হতে ইচ্ছে করে। ইচ্ছে করে সারারাত সমুদ্র আর চাঁদের জলে ভিজি। মোটেলের ঘরের বারান্দায় চাঁদের আলোয় বসে বসে একা একা সমুদ্রের ডাক শুনি। আয় আয় আয় বলে ডাকছে আমাকে। ভোরবেলা সূর্য ওঠার আগে সূর্যোদয় দেখব বলে দৌড়ে যাই সমুদ্রের দিকে। পরনে লাল একটি শাড়ি আমার। খালি পা। খোলা চুল। সমুদ্রের ঢেউ আমাকে ভাসিয়ে নেয়, ডুবিয়ে নেয়। উঠি উঠি সূর্য আমার শরীরের জলের ফোঁটায় চুমু খায়। ঝাঁক ঝাঁক মেয়ে আসে, ওদেরও বলি ঢেউএর সঙ্গে খেলা করতে। ওইতো ফেনিয়ে ওঠে শরীর ভাসিয়ে নেয় জোয়ারের ঢেউ, এর নাম ভালবাসা, আমি তাকে নেশা বলি, তীব্র তৃষ্ণা বলি। হৃদয় ভাসিয়ে নেয়, জীবন ভাসিয়ে নেয় মোহন ঘাতক, আয় আয় ডাকে আয়, সর্বনাশ তবু ডাকে আয় আয় আয়, এর নাম ভালবাসা, আমি তাকে সখু বলি, স্বপ্ন বলে ডাকি। সারাদিন সমুদ্রের জলে খেলা করি। আমাকে নেশায় পায়, ভালাবাসায় পায়। বিকেলে ঝুপড়ি দোকানে দারুচিনি চা পান করতে করতে সূর্যাস্তের জন্য অপেক্ষা করি। নোনাজলে ঠোঁট রেখে উপচে পড়েছে দেখি আকাশে পূর্ণিমা, শরীরে উল্লাস নাচে,কাঁচা অঘ্রাণের ঘ্রাণ তুফান নামায়। ঘুম আয় ঘুম আয় হৃদয়ে সমুদ্র ডাকে আয় আয় আয়, শিয়রে সোনার কাঠি রাজকন্যা ঘুম যায় যাদুর পালঙ্ক।
সমুদ্র থেকে আমাদের নিয়ে আসা হয় চট্টগ্রামে। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের ছাত্রীনিবাসে ছাত্রীদের, ছাত্রাবাসে ছাত্রদের থাকার জায়গা করা হয়েছে। হালিদা, সাফিনাজ, শিপ্রা আর কয়েকজন বন্ধু নিয়ে ঘুরে ফিরি সবুজ টিলার নিচে এঁকে বেঁকে চলে যাওয়া নীল জলের ফয়েজ লেকের ধারে। ঘাসে বসে বালিহাঁসের পাখনা মেলে ওড়া দেখি। সব কিছুই আমার এত ভাল লাগে, এত ভাল লাগে যে রুদ্রর না থাকা আমাকে একটু একটু বিষণ্ন করতে থাকে। রুদ্র এলে হাতে হাত রেখে পাশাপাশি হাঁটা যেত এই লেকের জল, এই পাহাড় এই সবুজের অপরূপ রূপে হৃদয়ে ভেজাতে ভেজাতে। ময়মনসিংহ ছাড়ার আগেই রুদ্রকে চিঠি পাঠিয়ে দিয়েছিলাম খবর জানিয়ে যে আমি সমুদ্রপাড়ে যাচ্ছি, যেন যায় সে ওখানে। কক্সবাজার থেকে কবে ফিরব চট্টগ্রাম, কোথায় থাকব, আবার চট্টগ্রাম থেকেই বা কবে ফিরে যাবো ঢাকায়, সবই জানিয়েছিলাম। এমন চমৎকার সময় আমার জীবনে আর আসেনি আগে, যে করেই হোক যেন সে যায়। মিঠেখালিতে বসে আছে সে অনেকদিন, মিঠিখালি থেকে রুদ্র যত কথাই দেয় যে বেরোবে এক বা দু সপ্তাহ পর, দুমাস তিনমাস কেটে যায়, তার বেরোনো হয় না। গ্রামটিতে একটি শেকল আছে, যখনই সে যায়, শেকলে জড়িয়ে যায়, সে চাক বা না চাক।
যেদিন আমরা চট্টগ্রাম থেকে ফিরে যাবো ঢাকায় তার আগের রাতে রুদ্র এসেছে। সাইফুল,রুদ্রর ছোটভাই, ছাত্রীনিবাসে আসে, রুদ্রকে সঙ্গে করে। সাইফুল চট্টগ্রাম মেডিকেলে প্রথম বষের্ সবে ভর্তি হয়েছে। সাইফুলকে প্রথম দেখি সে রাতে। ছোটখাটো হাসিখুশি ছেলে। রুদ্রর চোখের মত ডাগর চোখ ওর। পরিচ্ছত পরিপাটি ছেলে। ছেলেটি চমৎকার, কথা বলে এমন করে যেন আমাকে এক যগু ধরে চেনে। ওর সঙ্গে আমি সহজে সহজ হই। সে রাতে তিনজন রিক্সা করে বেরিয়ে একটি রেস্তোরাঁয় ঢুকে যখন রাতের খাবার খাচ্ছি, রুদ্রর লাল হয়ে থাকা চোখ, বড় হয়ে যাওয়া চুল,দাড়িতে দৃষ্টি বারবার হোঁচট খায়। সাতদিন স্নান করেনি, ঘুমোয়নি, যেন এইমাত্র কোনও গুহা থেকে উঠে এসেছে। সাতটি দিন কেটে গেল আমি ময়মনসিংহের বাইরে কেন সে আগে আসেনি, কেন ফিরে যাবার আগের দিন মাত্র কিছুক্ষণের জন্য এল, আমরা দুজন কি সুন্দর খেলা করতে পারতাম সমুদ্রের জল নিয়ে, ঢেউ নিয়ে, পাশাপাশি বসে দেখতে পারতাম সূর্যোদয়, সূর্যাস্ত, পূর্ণিমায় গভীর রাত অব্দি বালুতে পা ছড়িয়ে বসে দেখতে পারতাম জলের ওপর চাঁদের আলোর সাঁতার কাটা। বাবার রক্তচক্ষুহীন ঢিঁ ঢিঁ পড়ার ভয়হীন এই চট্টগ্রাম শহরটিতে রিক্সার হুড ফেলে আমি নিশ্চিন্তে তার সঙ্গে ঘুরে বেড়াতে পারতাম। অভিমান আমাকে ধোঁয়ায় ঢাকতে থাকে। ধোঁয়া সরিয়ে রুদ্রর ভারি কণ্ঠস্বর আমাকে স্পর্শ করে, চট্টগ্রাম থেকে কাল আমাকে ঢাকা নয়, যেতে হবে মোংলা। যদিও নতুন কোনও শহর দেখার ইচ্ছে আমার প্রচণ্ড, কিন্তু মোংলা যাওয়ার প্রস্তাবটি শুনে না বলে দিই। না বলি কারণ দল থেকে মাস্টারেরা আমাকে বেরোতে দেবেন না। হয় না, ঢাকায় আরও ট্যুর আছে, সেরে, দলের সঙ্গে ফিরতে হবে ময়মনসিংহে। রুদ্র চোখ কুঁচকে ঠোঁট কুঁচকে রাখে এই না বলায়। সাইফুল বলে, আরে যাও না বৌদি একটু ঘুরে আসো মোংলায়। সাইফুলের বৌদি ডাকে আমার চেতন হয় যে আমি কারও বৌদি, কারও বৌদি মানে আমি কারও বউ। রাতে ছাত্রীনিবাসে সাফিনাজের পাশে শুয়ে এপাশ ওপাশ করি, ভাবনার একটি রশি বেয়ে বন্ধ ঘর থেকে ছাদের ওপর উঠি, ছাদ থেকে আরও ওপরে শূন্যে, দুহাত মেলে দিই ভাসতে থাকি, কী আনন্দ কী আনন্দ! আর কবে পাবো এমন ছুটি!এর চেয়ে সুযোগ কি আমার জীবনে আসবে আর, হারিয়ে যাওয়ার সুযোগটি হাতছাড়া করি কেন! পরদিন রুদ্রকে নিয়ে ট্রেনে উঠে ঢোক গিলতে গিলতে দুজন শিক্ষকের মধ্যে সাদাসিধেটিকে বলি, যে আমাকে আজই খুলনা যেতে হচ্ছে, খুলনা থেকে কালই ঢাকায় ফিরব, ঢাকার ট্যুর এ থাকবো। কিন্তু শিক্ষক সাদাসিধে হোক আর যাই হোক, তিনি আমাকে যেতে যেবেন কেন, এতগুলো হবু ডাক্তাদের ভালয় ভালয় ভ্রমণ করিয়ে ভালয় ভালয় ফেরত নিয়ে যাওয়ার দায়িত্ব যখন নিয়েছেন, তিনি সুষ্ঠু ভাবেই পালন করবেন।
কার সঙ্গে যাবে?
কার সঙ্গে যাব? এর সহজ উত্তর, দাড়িঅলা লোকটিকে দেখিয়ে বলে দেওয়া, ওর সঙ্গে। এরপরই তো প্রশ্ন উঠবে ও কে, ও কি। তাও না হয় দেওয়া গেল, ও রুদ্র, ও কবি। এর পরের প্রশ্নটি, তিনি খুব সাদাসিধে বলেই করা স্বাভাবিক, ও তোমার কি হয়?
আমার অপ্রফুল্লবদনটি দেখে আমাকে উদ্ধার করতে এগিয়ে এলো শওকত আর মদিরা, দুজনে প্রেম করে বিয়ে করেছে, ওরা জানে দলছুট হওয়ার আনন্দ। শওকত কানে কানে বলে, আগে বল তুমি বিয়ে করেছ কি না, স্যারকে বলতে হবে হাজবেণ্ডের সাথে যাচ্ছে, তা না হইলে ছাড়বে না।
না, এ কথাটি বলা যাবে না, এই স্যার গিয়ে আমার বাবা-স্যারের কানে কথাটি দিলে সব্বনাশ হবে। শওকত হেসে, আমার বলব কি বলব না ভঙ্গির দিকে, তাকিয়ে, বলে, স্যাররে বইলা দিই জিনিসটা গোপন যেন কাউকে না জানায়!
যদি জানায়?
আরে তুমি ঢাকায় দুইদিন পর চইলা আসো, দলের সাথে পরে ময়মনসিংহে ফিরো, অসুবিধা কি!
শওকত আমার খুলনা যাওয়ার পথ পরিষ্কার করে। এ যে অবৈধ পুরুষ নিয়ে ভেগে যাওয়ার কোনও ব্যাপার নয়,রীতিমত বৈধ পুরুষের সঙ্গে হাওয়া হওয়া, তা সে ইঙ্গিতে শিক্ষক-কাম-পাহারাদারকে বুঝিয়ে আমাকে পার করে। আমি রুদ্রর সঙ্গে পথে নেমে পড়ি। পথ থেকে ট্রেনে করে খুলনা, খুলনা থেকে লঞ্চে মোংলা। দলছুট হওয়ার পর বড় একা লাগে আমার। দলের সঙ্গে উচ্ছঅ!স ছিল, হঠাৎ যেন মিইয়ে গেল সব। হঠাৎ যেন একটি সম্পর্কের বন্ধন এসে আমাকে জড়ালো। আমাকে একটি র্কতব্যের কুয়োয় টপু করে ব্যাঙের মত ফেলে দিল।
রূপসা নদীর ওপর দিয়ে লঞ্চ চলছে মোংলায়। নতুন একটি নদী দেখছি, নতুন নতুন মানুষ দেখছি। আমার ভাল লাগতে শুরু করে। লঞ্চে উঠে রুদ্র বলল শাড়িটা পাল্টো নাও। শাড়ি পাল্টাবো কেন? এই তো বেশ।
শাদা একটি সুতির শাড়ি পরনে আমার। শাড়ি পরার অভ্যেস না থাকলেও সমুদ্র যাত্রায় মেয়েরা সব শাড়ি পরেছে, শাড়ি পরার এই সুযোগ পেয়ে আমারও আহলাদ কম নয়।
যা বলছি কর।
কেন, এই শাড়িতে কি খারাপ লাগছে দেখতে?
হ্যাঁ লাগছে। পাল্টাও। শিগরি কর, ঘাট এসে গেল।
খুব কি দরকার শাড়ি পাল্টানোর?
হ্যাঁ খুবই দরকার।
রুদ্র কেবল কবিতা নয়, শাড়ি নিয়েও ভাবে। সুতি শাড়ি ও মানে না। কাতান পরতে হবে।
কাতান পরতে ইচ্ছে করছে না।
কেন ইচ্ছে করবে না?
করছে না।
কি আশ্চর্য!
কোনওটা তো ইস্ত্রি নেই।
না থাক, তবু পর।
কাতান পরতে হবে। সবুজ বা নীল হলে চলবে না। লাল পরতে হবে।সমুদ্রে ভিজে সব শাড়ি দলামোচা হয়ে আছে। দলামোচা থেকেই একটি পরতে হল।লাল। দুপুরবেলা ঘাটে পৌঁছে দেখি এক বিরান বন্দর। কটি খালি সাম্পান বাধাঁ ঘাটে। কেমন গ্রাম গ্রাম,আবার ঠিক গ্রামও নয়। বুকের মধ্যে হু হু করে ওঠে। টানা বস্তি পেরিয়ে রুদ্র একটি দোতলা বাড়ির সামনে রিক্সা থামিয়ে বলল, এবার লক্ষ্মী মেয়ের মত মাথায় ঘোমটা দাও তো!
আমি চমকে উঠি রুদ্রর কথায়।
মাথায় ঘোমটা? কেন?
আরে দাও না।
আমি কখনও এসব দিই না।
দাও না জানি, এখন দাও।
কেন?
বুঝতে পারছ না কেন, তুমি তো এ বাড়ির বউ!
শুনে গা কাঁপে। অনেকটা আনন্দ, অনেকটা শরম, অনেকটা ভয় মিশিয়ে আমি তখন ঠিক বুঝে পাচ্ছি না কী করব। রুদ্র বলল, সালাম করতে হবে কিন্তু পা ছুঁয়ে।
না।
কেন?
আমি কখনও ওসব করি না।
করতে হবে।
আমার দ্বারা হবে না। অসম্ভব।
তুমি বুঝতে পারছ না কেন! সালাম না করলে খারাপ দেখায়।
কেন খারাপ দেখাবে?
দেখায়।
দেখায় কেন? কী মানে আছে পা ছোঁয়ার?
বড়দের করতে হয়। বুঝতে পারছ না কেন! আর তুমি তো এ বাড়ির বউ।
খারাপ দেখাক। আমি পারব না এসব।
ইস কি জ্বালা!
পা না ছুঁয়ে মুখে সালাম বললে হবে না?
না, হবে না।
আনন্দ উবে গিয়ে এক শরীর অস্বস্তি আমাকে গ্রাস করে। এই পা ছোঁয়ার ব্যাপারটি আমি পারি না। ঈদ এলে নতুন কাপড় জামা পরার পর মা এখনও বলেন, যাও তোমার বাবারে সালাম কইরা আসো।
দরজায় কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকি। মা যত ঠেলেন, কাঠ তত ভারি পাথর-মত হয়ে ওঠে। ঈদের সময় মুরব্বিদেরে সালাম করতে হয়। এই করতে হয় ব্যাপারটি আমি বুঝি, কিন্তু কেন করতে হয় তা ঠিক বুঝি না। তোমাকে বড় বলে মানি, শ্রদ্ধা করি, ভালবাসি, তা কেন পা ছুঁয়ে বোঝাতে হবে আমাকে! আর কোনও উপায় কি নেই বোঝাবার! আমি অবাক তাকিয়ে থাকি রুদ্রর দিকে, ধর্ম না মানা, রীতি নীতির তোয়াক্কা না করা রুদ্রও পা ছোঁয়ার ব্যাপারটিকে কেমন সায় দিচ্ছে! এত দূরে একটি বিরান বন্দরে এনে রুদ্র যেন আমার ঘাড় ধরে ধাক্কা দিল তার মা বাবার পায়ের দিকে। আত্মীয় নেই, বন্ধু নেই, এই বন্দরে চেনা কেউ নেই এক রুদ্র ছাড়া, অথচ এই রুদ্রকেই বড় অচেনা লাগে। মাথা আমার আঁচলে ঢাকা, পিঠে রুদ্রর খোঁচা, এক খোঁচা, দুই খোঁচা,তিন খোঁচার পর আমি তার মার পায়ের দিকে নত হই। ঠিক জানিও না সালাম জিনিসটি কি করে করে। পায়ে হাত ছুঁইয়ে হাতদুটো বুকে নিতে হয়, নাকি কপালে নাকি ঠোঁটে ধাধাঁ লাগে। পা ছুঁইয়ে সংশয়ের ভারে আমার হাত হাতের জায়গায়ই থাকে। এক দঙ্গল ভাই বোন রুদ্রর, এক এক করে এল পরিচিত হতে। ভিড়ের মধ্যে আরও একা লাগে আমার। যেন আমি অদ্ভুত এক জীব এসেছি মানুষের ভিড়ে। বীথি, রুদ্রর ছোটবোন, বলল কী দাদা, তোমার বউ কি বোবা নাকি কথা কচ্ছে না কেন! কি কথা বলব ঠিক বুঝে পাই না। বুঝে পাই না কি কথা বলা উচিত আমার। আমি গুটিয়ে থাকি।
রুদ্রর বাবা, রুদ্রর চেয়েও লম্বায় খাটো, পাশে দাঁড়ালে তিনি আমার কাধঁ সমান হবেন, মাথায় টুপি, মুখে দাড়ি, পাজামা পাঞ্জাবি পরা, বাড়িতে ঢোকেন। রুদ্রকে ফিসফিসিয়ে জিজ্ঞেস করি, উনি তো ডাক্তার তাই না!
হ্যাঁ।
তাহলে এই পোশাক যে!
ধর্ম বিশ্বাসী।
ডাক্তার হয়ে ধর্ম বিশ্বাস করেন!
আমি অবাক তাকিয়ে রই। বারান্দায় পিঁড়িতে বসে বদনির তোলা পানিতে অযু করেন তিনি। রুদ্রর মা তোয়ালে এগিয়ে দিলেন অযুতে ভেজা হাত মখু মুছতে, ঘরে জায়নামাজ বিছানো, তিনি নামাজ পরবেন। নামাজ শেষ হলে রুদ্র আমাকে নিয়ে যাবে তার বাবার সামনে। বুক ঢিপঢিপ করে। বাবা জিনিসটিই আমার মনে হতে থাকে বড় ভয়ের। রুদ্র অস্থির পায়চারি সেরে আমাকে নিয়ে ঢোকে নামাজ সেরে চেয়ারে হেলান দিয়ে হাতে তসবিহ জপতে থাকা তার বাবার কাছে। আমি শাড়ির আঁচলে আঙুল পেচাচ্ছি।
আব্বা, এই আমার বউ! বলে আমাকে বলল, যাও আব্বাকে সালাম কর। আমি লজ্জার মাথা খেয়ে উপুড় হই। তিনি দাড়িতে আঙুল বুলোতে বুলোতে বলেন, বস।
তোমার বাবা মার শরীর ভাল?
আমার বাবা মাকে তিনি চেনেন না, তাঁদের শরীর ভাল কি না ভাল নয় তা জানতে চাচ্ছেন কেন আমি বুঝতে পারি না। মুহূর্তে বাবা মার মখু মনে ভেসে ওঠে। হাইজিন ট্যুরে যাওয়া মেয়ে তাঁদের কোথায় এখন, যদি জানেন, তবে তাঁদের ভাল থাকা কোথায় যে উবে যাবে!
কোন ইয়ারে পড় তুমি।
ফোথর্ ইয়ার।
ও। ডাক্তার হতি তো বেশি দেরি নেই। তোমাদের বাড়ি তো ময়মনসিংহে!
হ্যাঁ ময়মনসিংহে।
এ কি ঢাকার উত্তরে না দক্ষিণে।
উত্তরে।
তা মোংলায় থাকবে কিছুদিন তো!
রুদ্র বলে, হ্যাঁ থাকবে।
তা শহিদুল্লাহ, ওকে নিয়ে মিঠেখালি যাবে কি?
দেখি।
মিঠেখালি ঘুরি আসো।
খাওয়া দাওয়া হইছে?
না।
যাও খাওয়া দাওয়া করি বিশ্রাম নাওগে যাও, অনেকদূর জানির্ করে এসেছো।
রুদ্র আমাকে নিয়ে দোতলায় ওঠে। নতুন চুনকাম হয়েছে। দোতলা নতুন করা হচ্ছে, এখনও কাজ শেষ হয়নি। এই দোতলা করার ব্যাপারটি রুদ্র বলে,যা তা, হুড়মুড় করে ওপরের ঘরগুলো একদিন ভেঙে পড়বে, কারণ মাটির তত গভীরে যায়নি বাড়ির শেকড়। শুনে ইট কাঠ লোহার সঙ্গে চুন সুরকির মত আমিও ভেঙে পড়ি। দোতলার একটি ঘর রুদ্র আর আমার জন্য গুছিয়ে দেওয়া হয়েছে, মোংলা এলে রুদ্র এ ঘরটিতেই থাকে। একটি মাঝারি খাট, একটি টেবিল, টেবিলের পাশে দুটো চেয়ার ঘরে। শাদা দেয়াল চারদিকে, একটি শুধু জানালা। তাকালে কিছু গোলপাতার গাছ আর একটি দোতলা বাড়ির পশ্চাতদেশ ছাড়া কিছু চোখে পড়ে না।
বিকেলে রুদ্র বেরিয়ে যায়,একা। আমি সঙ্গে যেতে চাইলে বলেছে এই বন্দরে বাড়ির বউএর এভাবে বেরোনো ঠিক নয়। তবে কি আমি মোংলা বন্দরটি, এই নতুন জায়গাটি দেখব না? না,দেখার কিছু নেই এখানে, শ্রমিকদের বস্তি ছাড়া আর কিছু নেই। শ্রমিকদের বস্তিই দেখব। না। শ্রমিকেরা আমাকে হাঁ হয়ে দেখবে, গিলে খাবে। তার চেয়ে রুদ্রর ভাই বোনদের সঙ্গে আমি যেন গল্প করি। কিন্তু ওদের সঙ্গেই বা কি গল্প করব! কাউকে আমি চিনি না। আমার বড় একা লাগে। বারান্দায় দাঁড়িয়ে দেখি সামনে জল আর জল। উঠোন পেরোলেই নদী। বীথিকে বলি, আমি ওই নদীটি দেখতে দেখতে যাবো। নদী? ও দেখার কিছু নেই। ও তো কেবল জল! জলই দেখব। জল দেখে কি করবে, বীথি হাসে। জলের কাছে গেলে আমাকে বলে, নোংরা জল, জলে হাত দিও না, পা ভিজিও না। জলহীন হাঁস আমি, হাওয়ায় সাঁতার কাটি। ডাঙাই আমার ঠিকানা, ডাঙায় আমার বসতবাড়ি, শ্বশুরবাড়ি। হাতের কাছে পায়ের কাছে অগাধ অফুরন্ত জল, যেদিকে চোখ যায় জল, থৈ থৈ জল অথচ বাড়িটিতে জলের অভাব। বাইরে থেকে একটি ছেলে দু তিন বালতি নদীর জল দিয়ে যায় প্রতিদিন, ও দিয়ে রান্না করা, পায়খানা পেচ্ছাব করা, গোসল করা, সবই সারতে হয়। গা লবণ লবণ লাগবে, চুল আঠা আঠা লাগবে, করার কিছু নেই, জলের অভাব, জলের তীরে বাস করে জলের এমন অভাব দেখে বিস্ময়ের ঘোর কাটে না আমার। পান করার জলও আসে বাইরে থেকে। ওরা বলে মিষ্টি জল, যদিও এক ফোঁটা মিঠে নয় স্বাদ, খরচা করতে হবে বুঝে, কেবল যদি তেষ্টায় ছাতি ফাটতে থাকে। মিষ্টি জল এ বন্দরে মেলে না, খুলনা শহর থেকে এখানে নৗকো করে জল আসে, এ দিয়েই তেষ্টা মেটাতে হয় বন্দরের সবার। বীথি বলে খুলনা থেকে পানি তো এই সেদিন থেকে আসে, এর আগে তো খাতি হত বিষ্টির পানি।
বৃষ্টির পানি?
মিঠেখালিতে তো ওই খাই আমরা। বড় বড় কলসি পেতে রাখি উঠোনে, ওতে বিষ্টির পানি জমি থাকে, ওই খাই।
ও পানি খাওয়া যায়?
যাবে না কেন?
বীথি জলপানির প্রসঙ্গ থেকে আলটপকা সরে গিয়ে বলে, আচ্ছা বৌদি তুমি কি গয়নাগাটি কিছু আননি? বাড়ির বউ, লোকে কি বলবে বল! কাল বিকেলে লোকজন আসবে, সীমুর জন্মদিন। আমি কিছু গয়না দিয়ে যাবনি, ও পরে রেখো।
সন্ধে শেষ হয়ে রাত নেমে আসে। বার বার ঘড়ি দেখি,ছটফট করি।
তোমার দাদা এখনো ফিরছে না!
ফিরবেনি, অত ভেবো না। পুরুষমানুষ, বাইরে বন্ধুবান্ধব থাকি, যাতি হয়।
তাই বলে এত রাত করবে?
ফিরবে ফিরবে। বউ আছে ঘরে, যত রাত হোক ফিরবে। বীথি হাসে। হাসিতে মুক্তো ঝরে।
অনেক রাত করে রুদ্র ফেরে। যখন শার্ট প্যান্ট খুলে লুঙ্গি পরে নিচ্ছে, বিছানাটির দিকে আড়চোখে তাকিয়ে আমার বুক কাঁপে, খুব বৈধভাবে এ বিছানায় আমাদের শুতে হবে দুজনকে, শোবার দিন শেষ অবদি এলই আমাদের। একটি রাত কাটানোর জন্য রুদ্র সেই যে কবে থেকে মরিয়া হয়ে উঠেছে, সেই রাত কাটানোর রাত তবে এলই। যেন আমরা দাম্পত্য জীবনে কতকালের অভ্যস্ত মানুষ, চল শুয়ে পড়ি, বলে সে মশারি ফেলে শুয়ে পড়ে।
কই এসো।
আসছি।
আসছি, বুকের কাঁপন খানিক থামুক, আসছি। তৃষ্ণায় ছাতি ফেটে যাচ্ছে, এক গেলাস জল খেয়ে এই আসছি। অস্থির হয়ো না, আমি আসছি। না এসে আমার উপায় কি!
কি ব্যাপার বসে আছো কেন? সারারাত ওখানেই কাটাবে নাকি?
আমাকে যেতে হয় বিছানায়, শরীর যেতে থাকে দেয়ালের দিকে। দেয়াল সাঁটা শরীর টেনে রুদ্র তার বুকের কাছে নিয়ে আসে। দুহাতে জড়িয়ে ধরে, শক্ত করে জড়িয়ে ধরে, যেন ছুটে যেতে না পারি। ছুটে আর কোথায় যাব আমি! আমার তো যাওয়ার আর জায়গা নেই। রুদ্রর কাছে আসব বলেই তো নিজেকে তৈরি করছি। নিজেকে শতবার করে বুঝিয়েছি রুদ্র তোমার স্বামী, স্বামীর সঙ্গে রাত কাটানোর এই সুযোগ তুমি নষ্ট করো না, তুমি বাইশ বছরের তরুণী এখন, ছোট্ট খুকি নও, আর সবাই যদি স্বামীর সঙ্গে শুতে পারে, তুমি পারবে না কেন! নিষিদ্ধ জিনিসটির স্বাদ পেতে আমারও ইচ্ছে করে গোপনে গোপনে। রুদ্র আমাকে সম্পণূর্ করে পেতে চাইছে। আমি প্রাণ মন তাকে কবেই দিয়ে বসে আছি, কেবল শরীর গুটিয়ে থাকে শামুকের মত। সমস্ত লজ্জা আর ভয় ভাঙার সময় কি আমার আসেনি! আজ যদি আমার গুটিয়ে থাকা শরীরকে খুলে না দিই, যদি আজ আমি শেকল ছিঁড়ে শরীরটিকে মুক্ত না করি, আজ যদি আমার ভালবাসার মানুষকে বঞ্চিত করি, এ আমার নিজেকেই বঞ্চিত করা হবে। রুদ্র কোনও অন্যায় দাবি করেনি। স্বামীর কাছে নিজেকে সমর্পণ করা অন্যায় নয়। একদিন না একদিন তো আমাকে দিতেই হবে যেটুকুৃ বাকি আছে দিতে, তবে আজ নয় কেন! রুদ্র আমাকে চুমু খায়। ঠোঁটে গাঢ় করে চুমু খায়। চুমু থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে বলি, বাতি জ্বলছে। এর অর্থ বাতি নেবাতে হবে। বাতি নিবিয়ে ঘর কালো করে তুমি এবার যা ইচ্ছে কর, আমি বারণ করব না। রুদ্র বাতি নিবিয়ে ঘর কালো করে আমার বোজা চোখ, শুকনো ঠোঁট, চিবুকের ভাঁজ ভিজিয়ে দেয়। ব্লাউজের বোতাম খুলে মখু ডুবিয়ে দেয়। স্তনবৃন্ত কেবল ভিজিয়ে দেয় না, দাঁতে কাটে। দুহাতে মুঠো করে ধরে স্তন, এত জোর-চাপ মুঠোয় যেন সে গলিয়ে এদের জল বানাবে, রূপসার ঘোলা জলের মত জল। রুদ্র আমার শাড়ি ওঠাতে থাকে ওপরের দিকে, আমি চাই না তবু আমার হাত আমার অজান্তে চলে যায় সে হাত থামাতে। আমার শরীরের ওপর নিজের শরীর তুলে দেয় রুদ্র। আমি চাই না, তবু আমার হাত চলে যায় তাকে শরীর থেকে নামাতে। এরপর সেই একই পদ্ধতি, দুপায়ে বিযুক্ত করতে থাকে আমার দু পা। চোখ বুজে আছি শক্ত করে। যেন চোখ না খোলে, যেন চোখের সামনে আমি লজ্জায় মরে যেতে হয় এমন কোনও দৃশ্য না দেখি। শক্ত করে দাঁতে দাঁত চেপে থাকি, সজোরে যুক্ত করে রাখি ঠোঁটজোড়া, যেন কোনও শব্দ আমার মুখ ফুটে না বেরোয়। এরপর আচমকা একটি আঘাতে আমি চিৎকার করে উঠি। রুদ্র আমার চিৎকারের মুখে দুহাত চেপে বলে, আরেকটু সহ্য করলেই হয়ে যাবে, এইতো হয়ে এল। লক্ষ্মীটি আরেকটু সহ্য কর। আরেকটু। রুদ্র ক্রমাগত আঘাত করেও নড়াতে পারে না কোনও পাথর। শরীর থেকে নেমে এসে সে তার আঙুল ব্যবহার করে অদৃশ্য পাথরখানি সরাতে। থরথর করে কাপঁ ছে আমার উরু, উরু থেকে কাপঁ ন সঞ্চারিত হয় সারা শরীর। মনে হচ্ছে আমি মারা যাচ্ছি। রুদ্র ঘেমে উঠেছে কিন্তু হাল ছাড়ছে না। পথে কোনও বাধা সে মানবে কেন, যে করেই হোক পথ প্রশস্ত করে তার এগোতে হবে, সামনে সোনার খনি, ওই খনি তার হাতের মুঠোয় চাই। নিজেই নিজের মখু দুহাতে চেপে রেখেছি। হাত ফুঁড়ে যেই না বেরিয়ে চায় কিছু রুদ্র শাড়ির আঁচল গুজে দেয় মুখে, যেন এই রাতের একটি কণাও আমার চিৎকারে না ভেঙে পড়ে। না কিছুই ঘটছে না, আমি কোনও যনণ্ত্রা পাচ্ছি না, এই যে নিম্নাঙ্গ, এ আমার নয়, এ আমার শরীরের কোনও অংশ নয়। অপারেশন থিয়েটারের টেবিলে শুয়ে থাকা এ কোনও অবশ হয়ে থাকা শরীর। ধরা যাক আমাকে পেথিডিন দেওয়া হয়েছে। রক্তে থায়োপেনটাল সোডিয়াম ঢুকিয়ে আমাকে অচেতন করা হয়েছে। শরীরের সমস্ত কষ্ট আমার উবে গেছে। মাথার ওপর সিলিংপাখা বনবন করে ঘুরছে, আমার অচেতন শরীর তবু ঘেমে উঠছে। শাড়ির আঁচল, হাত, ঠোঁট দাঁতের কামড়ে ছিঁড়ে যাচ্ছে। রুদ্র বাধা বিঘ্ন যা কিছু ছিল সব সরিয়ে সোনার খনির দিকে আমার ভেতর বাহির চুরমার করে ঢুকে যায়।
রুদ্র নেমে যায় ওপর থেকে। একদিকে দেয়াল আরেকদিকে রুদ্র, আমার শক্তি নেই কোনও দিকে একবিন্দু নিজেকে সরাই। স্থির হয়ে আছি। ধীরে ধীরে চোখ মেলে দেখছি যেন আমি অপারেশন থিয়েটারের বাইরে, পোস্ট অপারেটিভ রুমে। আমার জ্ঞান ফিরছে। জ্ঞান ফিরলে আমি টের পাই আমি কোনও পোস্ট অপারেটিভ রুমেও নই, আমি রূপসা নদীর ঘোলা জলে শুয়ে আছি। আমার শরীর ভাসছে জলের ওপর। চারদিকে কেউ নেই, একা আমি। এত একা কোনওদিন বোধ করিনি। যেন আমার কেউ নেই, কোনওকালে ছিল না। আমার বাবা নেই, মা নেই। আমার কোনও ভাই বোন নেই। আমার কোনও বন্ধু নেই, কোনও প্রেমিক নেই, কোনও স্বামী নেই। আমার কোনও ঠিকানা নেই কোথাও যাওয়ার। আমি রূপসার জলের ওপর ভেলার মত ভেসে কোথাও যাচ্ছি আমি জানি না। যখন শক্তি জোটে নিজেকে তোলার, তুলে আমি নামতে যাই বিছানা থেকে, পথ জুড়ে পাহাড়ের মত একটি বাধা, সেটি রুদ্র। বলি, যেতে দাও। এই প্রথম আমি রুদ্রকে সম্বোধন করি। রুদ্র পথ ছেড়ে দিলে আমি নেমে পেচ্ছাবখানা খুঁজতে থাকি অন্ধকার হাতড়ে হাতড়ে। নিম্নাঙ্গ ছিঁড়ে যাচ্ছে, হাঁসের মত হাঁটতে থাকি জলহীন ডাঙার অন্ধকারে। পেচ্ছাবখানায় পেচ্ছাব নয়, রক্ত বয়ে যায়, রূপসার জলের দিকে যায়। আর্তনাদের শক্তি আমার নেই। গোঙাতে থাকি অসহ্য যনণ্ত্রায়।
পুকুর দেখেছি, নদী দেখেছি, সমুদ্র দেখা হয়নি কোনওদিন। বউ নিয়ে কক্সবাজারের সমুদ্র সৈকতে মধুচন্দ্রিমা করে আসার পর দাদাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম দাদা গো সমুদ্র দেখতে কেমন! দাদা একটি কথাই বলেছেন,না গেলে বুঝবি না। সমুদ্র কেমন সে কথা কখনও বইলা বুঝানো যায় না, সমুদ্রের সামনে দাঁড়ায়া উপলব্ধি করতে হয় সমুদ্র। সমুদ্রের চেয়ে বেশি উচ্ছ্বাস দাদার উড়োজাহাজ নিয়ে। উড়োজাহাজে প্রথম চড়েছেন তিনি। ছোটদা উড়োজাহাজের গল্প করলে দাদা এতকাল তৃষ্ণার্ত নয়নে তাকিয়ে থাকতেন। নয়নের সেই তৃষ্ণা দাদার ঘুচেছে এখন। আমার অবশ্য কিছুই ঘোচেনি। উড়োজাহাজের চেয়ে সমুদ্র দেখার উৎসাহটিই আমার বেশি।
সমুদ্রপাড়ে তোলা দাদা আর হাসিনার ছবি দেখে, সমুদ্র না দেখেই লিখে ফেলি সমুদ্র নিয়ে তিনটে কবিতা। না দেখা সমুদ্র যখন আমার হৃদয় জুড়ে, তখনই চল চল সমুদ্র দেখবে চল, কাপড় চোপড় গোছাও রব। চতথুর্ বষের্ এই একটি চমৎকার ঘটনা ঘটে, এক ক্লাস ছাত্রছাত্রী নিয়ে কমিউনিটি মেডিসিনের শিক্ষকরা দূরে কোথাও চলে যান, দূর বলতে দেশের মাথা থেকে লেজে যাওয়া, লেজের কাছে থই থই করছে রূপোলি জল, সেই জলে ডোবো, ভাসো। অবশ্য বলা হয় জলীয় আবহাওয়া দেখাতে নিচ্ছেন, আসলে এ অনেকটা হাওয়া বদলের মত, রোগীদের যেমন হাওয়া বদলের দরকার হয়, হবু ডাক্তারদেরও হয়। দিনরাত হাসপাতালের পুঁজ-গন্ধময় হাওয়া থেকে খানিকটা নিস্তার পাওয়া হয়।
ময়মনসিংহ থেকে ঢাকা, ঢাকা থেকে ট্রেনে চড়ে চট্টগ্রাম, চট্টগ্রাম থেকে বাসে চড়ে কক্সবাজার। বাড়িতে হইচই পড়ে গেল, হইচইই বটে, এমন তো কখনও ঘটে না, আত্মীয় কাউকে না নিয়ে দূরের কোনও শহরে চলে যাওয়া। মা বার বার জিজ্ঞেস করলেন মাস্টাররা থাকবে তো! দুঘন্টার পথ ঢাকা, ঠিক আছে মানায়, ঢাকায় আত্মীয়ও আছে, কিন্তু চট্টগ্রামে তো আমার মামাও থাকে না কাকাও না। মামা কাকার সীমানার বাইরে বলেই সম্ভবত পেখম মেলে একশ ময়ূর নাচে হৃদয়ে। বাবা দরাজ হসে ্ত দিয়েছেন টাকা, হাইজিন ট্যুরের চাঁদা তো আছেই, বাড়তি টাকাও। ট্রেনে চড়ে দলের ঢাকা যাত্রা হয়। সেগুনবাগিচা ছেড়ে ছোটদা এখন নয়াপল্টনে বাড়ি ভাড়া করেছেন। নয়াপল্টনে একরাত থেকে পরদিন কমলাপুর রেলইষ্টিশনে পৌঁছতে হবে সকাল আটটায়। রাতে গীতার কাছে শাড়ি চাইতেই আলমারি খুলে বিছানায় লাল নীল সবুজ হলুদ কাতান সিল্ক এমনকি মসলিন বিছিয়ে দিল পছন্দ করে নিতে একটি নয়, যত খুশি। বোতাম টিপলে আলো জ্বলে এমন একটি ক্যামেরাও মিলল। আর কি চাই! আশাতীত পাওয়া আমার।
পরদিন ট্রেনে চড়ে কখনও হৈ হল্লায় মেতে, কখনও জানালায় উদাস চোখ মেলে পৌঁছই চট্টগ্রাম। চট্টগ্রাম থেকে বনের ভেতর দিয়ে আঁকা বাঁকা পথে সারি সারি রাবার গাছের বাগান পার হয়ে কক্সবাজার যখন পৌঁছই, উত্তেজনা তুঙ্গে। একটি শব্দ, ভীষণ এক শব্দ, অন্যরকম, মাটি কাঁপানো, জল কাপাঁনো, শব্দটির দিকেই বাস যেতে থাকে। ঠিক কোত্থেকে শব্দটি আসছে বুঝতে আমি চারদিক খুঁজি। বাসের জানালা থেকে কিছুতেই চোখ সরে না। দূরে একটি শাদা কিছু একবার উঠছে একবার নামছে। সাফিনাজ, হালকা হালকা বন্ধুত্ব অতিক্রম করে ঘনিষ্ঠ হওয়া একজন, জানালায় ঝুঁকে বলল,ওইটাই কি সমুদ্র নাকি! কোনওদিন সমুদ্র না দেখা মেয়ে আমি, ইচ্ছে করে, বাস থেকে নেমে দৌড়ে যাই দেখতে ,যদি ওটাই সমুদ্র হয়, কিন্তু কে দেবে আমাকে ছুটে যেতে! আগে মোটেলে নামো, তারপর। মোটেলে দুজনের জায়গায় চারজনকে ঢোকানো হল এক ঘরে। বরাদ্দ ঘরে সুটকেস নামিয়ে রেখে আগে দৌড়ে যাই ওই শব্দের দিকে। গোসল নেই, খাওয়া নেই, বিশ্রাম নেই। আগে আমি সমুদ্র দেখব তারপর অন্য কিছু সাফিনাজ পরিপাটি মেয়ে, খাওয়ার সময় খাওয়া পড়ার সময় পড়া ঘুমের সময় ঘুমের মেয়ে। ওকে যেতে হয় আমার উত্তেজনাকে সঙ্গ দিতে। সেই তীব্র র্গজনের দিকে হেঁটে নয়, দৌড়ে যাই। যখন পৌঁছই, বিস্ময় আর মগ্ধু তা আমাকে স্থবির করে রাখে, আমাকে নিস্পন্দ করে রাখে,আমাকে বিবশ করে রাখে। একটি শব্দ আমি আর উচ্চারণ করতে পারি না। এত বিশাল কিছু এত অদ্ভুত সুন্দর কিছু এত আশ্চর্য হৃদয়রঞ্জন কিছু আমি আমার জীবনে কখনও দেখিনি। নানিবাড়ির ছোট্ট পুকুরের ধারে বড় হয়েছি, শহরের তিনকোনা পুকুর ছিল নানিবাড়ির পুকুরের চেয়ে দ্বিগুন, সেটি দেখতে যেতে আমাকে অপেক্ষা করতে হয়েছিল কয়েকটি বছর, বড় হয়ে ব্রহ্মপুত্র দেখা হয়েছে, ব্রহ্মপুত্রের শীর্ণ জলের ধারা দেখেই মনে হয়েছে এর চেয়ে বিশাল কিছু বুঝি পৃথিবীতে নেই। আমার কল্পনায় ছিল সমুদ্র। সেই সমুদ্র এই সমুদ্রের সৌন্দর্যের ধারে কাছে আসতে পারে না। আমার অবাধ কল্পনা এত বিশাল কিছু এত আশ্চর্য সুন্দর কিছু এত কূল কিনারাহীন কিছু আমাকে দিতে পারেনি। আমি লক্ষ করি না আমার চোখ যে ভিজে যাচ্ছে চোখের জলে। সূর্য ডুবছে সমুদ্রে। আমি তন্ময় হয়ে শব্দ শুনি সমুদ্রের, ভেজা চোখে সূর্যের ডুবে যেতে থাকা রূপ দেখি। সূর্যাস্ত আমি আগেও দেখেছি অনেক, এমন রূপ দেখিনি আগে। আমাকে বিহ্বল করে রাখে, বিমগ্ধু করে রাখে, বিমূঢ় করে রাখে প্রকৃতির এই অনিঃশেষ সৌন্দর্য। ধীরে ধীরে দল বেঁধে আসতে থাকে ছেলেমেয়েরা, সূর্যাস্তের দিকে নির্নিমেষ তাকিয়ে থাকে। এই সুন্দর থেকে কোথাও আমার আর ফিরে যেতে ইচ্ছে করে না। রাত নেমে এলে সাফিনাজ আমাকে টেনে নিয়ে যায় মোটেলে, রাতের সৈকত নাকি নিরাপদ নয়। মেয়েরা সব চলে যায় মোটেলে, ছেলেরা পূর্ণিমা দেখবে বলে থেকে যায় অনেক রাত অবদি সৈকতে। আমার বড় ছেলে হতে ইচ্ছে করে। ইচ্ছে করে সারারাত সমুদ্র আর চাঁদের জলে ভিজি। মোটেলের ঘরের বারান্দায় চাঁদের আলোয় বসে বসে একা একা সমুদ্রের ডাক শুনি। আয় আয় আয় বলে ডাকছে আমাকে। ভোরবেলা সূর্য ওঠার আগে সূর্যোদয় দেখব বলে দৌড়ে যাই সমুদ্রের দিকে। পরনে লাল একটি শাড়ি আমার। খালি পা। খোলা চুল। সমুদ্রের ঢেউ আমাকে ভাসিয়ে নেয়, ডুবিয়ে নেয়। উঠি উঠি সূর্য আমার শরীরের জলের ফোঁটায় চুমু খায়। ঝাঁক ঝাঁক মেয়ে আসে, ওদেরও বলি ঢেউএর সঙ্গে খেলা করতে। ওইতো ফেনিয়ে ওঠে শরীর ভাসিয়ে নেয় জোয়ারের ঢেউ, এর নাম ভালবাসা, আমি তাকে নেশা বলি, তীব্র তৃষ্ণা বলি। হৃদয় ভাসিয়ে নেয়, জীবন ভাসিয়ে নেয় মোহন ঘাতক, আয় আয় ডাকে আয়, সর্বনাশ তবু ডাকে আয় আয় আয়, এর নাম ভালবাসা, আমি তাকে সখু বলি, স্বপ্ন বলে ডাকি। সারাদিন সমুদ্রের জলে খেলা করি। আমাকে নেশায় পায়, ভালাবাসায় পায়। বিকেলে ঝুপড়ি দোকানে দারুচিনি চা পান করতে করতে সূর্যাস্তের জন্য অপেক্ষা করি। নোনাজলে ঠোঁট রেখে উপচে পড়েছে দেখি আকাশে পূর্ণিমা, শরীরে উল্লাস নাচে,কাঁচা অঘ্রাণের ঘ্রাণ তুফান নামায়। ঘুম আয় ঘুম আয় হৃদয়ে সমুদ্র ডাকে আয় আয় আয়, শিয়রে সোনার কাঠি রাজকন্যা ঘুম যায় যাদুর পালঙ্ক।
সমুদ্র থেকে আমাদের নিয়ে আসা হয় চট্টগ্রামে। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের ছাত্রীনিবাসে ছাত্রীদের, ছাত্রাবাসে ছাত্রদের থাকার জায়গা করা হয়েছে। হালিদা, সাফিনাজ, শিপ্রা আর কয়েকজন বন্ধু নিয়ে ঘুরে ফিরি সবুজ টিলার নিচে এঁকে বেঁকে চলে যাওয়া নীল জলের ফয়েজ লেকের ধারে। ঘাসে বসে বালিহাঁসের পাখনা মেলে ওড়া দেখি। সব কিছুই আমার এত ভাল লাগে, এত ভাল লাগে যে রুদ্রর না থাকা আমাকে একটু একটু বিষণ্ন করতে থাকে। রুদ্র এলে হাতে হাত রেখে পাশাপাশি হাঁটা যেত এই লেকের জল, এই পাহাড় এই সবুজের অপরূপ রূপে হৃদয়ে ভেজাতে ভেজাতে। ময়মনসিংহ ছাড়ার আগেই রুদ্রকে চিঠি পাঠিয়ে দিয়েছিলাম খবর জানিয়ে যে আমি সমুদ্রপাড়ে যাচ্ছি, যেন যায় সে ওখানে। কক্সবাজার থেকে কবে ফিরব চট্টগ্রাম, কোথায় থাকব, আবার চট্টগ্রাম থেকেই বা কবে ফিরে যাবো ঢাকায়, সবই জানিয়েছিলাম। এমন চমৎকার সময় আমার জীবনে আর আসেনি আগে, যে করেই হোক যেন সে যায়। মিঠেখালিতে বসে আছে সে অনেকদিন, মিঠিখালি থেকে রুদ্র যত কথাই দেয় যে বেরোবে এক বা দু সপ্তাহ পর, দুমাস তিনমাস কেটে যায়, তার বেরোনো হয় না। গ্রামটিতে একটি শেকল আছে, যখনই সে যায়, শেকলে জড়িয়ে যায়, সে চাক বা না চাক।
যেদিন আমরা চট্টগ্রাম থেকে ফিরে যাবো ঢাকায় তার আগের রাতে রুদ্র এসেছে। সাইফুল,রুদ্রর ছোটভাই, ছাত্রীনিবাসে আসে, রুদ্রকে সঙ্গে করে। সাইফুল চট্টগ্রাম মেডিকেলে প্রথম বষের্ সবে ভর্তি হয়েছে। সাইফুলকে প্রথম দেখি সে রাতে। ছোটখাটো হাসিখুশি ছেলে। রুদ্রর চোখের মত ডাগর চোখ ওর। পরিচ্ছত পরিপাটি ছেলে। ছেলেটি চমৎকার, কথা বলে এমন করে যেন আমাকে এক যগু ধরে চেনে। ওর সঙ্গে আমি সহজে সহজ হই। সে রাতে তিনজন রিক্সা করে বেরিয়ে একটি রেস্তোরাঁয় ঢুকে যখন রাতের খাবার খাচ্ছি, রুদ্রর লাল হয়ে থাকা চোখ, বড় হয়ে যাওয়া চুল,দাড়িতে দৃষ্টি বারবার হোঁচট খায়। সাতদিন স্নান করেনি, ঘুমোয়নি, যেন এইমাত্র কোনও গুহা থেকে উঠে এসেছে। সাতটি দিন কেটে গেল আমি ময়মনসিংহের বাইরে কেন সে আগে আসেনি, কেন ফিরে যাবার আগের দিন মাত্র কিছুক্ষণের জন্য এল, আমরা দুজন কি সুন্দর খেলা করতে পারতাম সমুদ্রের জল নিয়ে, ঢেউ নিয়ে, পাশাপাশি বসে দেখতে পারতাম সূর্যোদয়, সূর্যাস্ত, পূর্ণিমায় গভীর রাত অব্দি বালুতে পা ছড়িয়ে বসে দেখতে পারতাম জলের ওপর চাঁদের আলোর সাঁতার কাটা। বাবার রক্তচক্ষুহীন ঢিঁ ঢিঁ পড়ার ভয়হীন এই চট্টগ্রাম শহরটিতে রিক্সার হুড ফেলে আমি নিশ্চিন্তে তার সঙ্গে ঘুরে বেড়াতে পারতাম। অভিমান আমাকে ধোঁয়ায় ঢাকতে থাকে। ধোঁয়া সরিয়ে রুদ্রর ভারি কণ্ঠস্বর আমাকে স্পর্শ করে, চট্টগ্রাম থেকে কাল আমাকে ঢাকা নয়, যেতে হবে মোংলা। যদিও নতুন কোনও শহর দেখার ইচ্ছে আমার প্রচণ্ড, কিন্তু মোংলা যাওয়ার প্রস্তাবটি শুনে না বলে দিই। না বলি কারণ দল থেকে মাস্টারেরা আমাকে বেরোতে দেবেন না। হয় না, ঢাকায় আরও ট্যুর আছে, সেরে, দলের সঙ্গে ফিরতে হবে ময়মনসিংহে। রুদ্র চোখ কুঁচকে ঠোঁট কুঁচকে রাখে এই না বলায়। সাইফুল বলে, আরে যাও না বৌদি একটু ঘুরে আসো মোংলায়। সাইফুলের বৌদি ডাকে আমার চেতন হয় যে আমি কারও বৌদি, কারও বৌদি মানে আমি কারও বউ। রাতে ছাত্রীনিবাসে সাফিনাজের পাশে শুয়ে এপাশ ওপাশ করি, ভাবনার একটি রশি বেয়ে বন্ধ ঘর থেকে ছাদের ওপর উঠি, ছাদ থেকে আরও ওপরে শূন্যে, দুহাত মেলে দিই ভাসতে থাকি, কী আনন্দ কী আনন্দ! আর কবে পাবো এমন ছুটি!এর চেয়ে সুযোগ কি আমার জীবনে আসবে আর, হারিয়ে যাওয়ার সুযোগটি হাতছাড়া করি কেন! পরদিন রুদ্রকে নিয়ে ট্রেনে উঠে ঢোক গিলতে গিলতে দুজন শিক্ষকের মধ্যে সাদাসিধেটিকে বলি, যে আমাকে আজই খুলনা যেতে হচ্ছে, খুলনা থেকে কালই ঢাকায় ফিরব, ঢাকার ট্যুর এ থাকবো। কিন্তু শিক্ষক সাদাসিধে হোক আর যাই হোক, তিনি আমাকে যেতে যেবেন কেন, এতগুলো হবু ডাক্তাদের ভালয় ভালয় ভ্রমণ করিয়ে ভালয় ভালয় ফেরত নিয়ে যাওয়ার দায়িত্ব যখন নিয়েছেন, তিনি সুষ্ঠু ভাবেই পালন করবেন।
কার সঙ্গে যাবে?
কার সঙ্গে যাব? এর সহজ উত্তর, দাড়িঅলা লোকটিকে দেখিয়ে বলে দেওয়া, ওর সঙ্গে। এরপরই তো প্রশ্ন উঠবে ও কে, ও কি। তাও না হয় দেওয়া গেল, ও রুদ্র, ও কবি। এর পরের প্রশ্নটি, তিনি খুব সাদাসিধে বলেই করা স্বাভাবিক, ও তোমার কি হয়?
আমার অপ্রফুল্লবদনটি দেখে আমাকে উদ্ধার করতে এগিয়ে এলো শওকত আর মদিরা, দুজনে প্রেম করে বিয়ে করেছে, ওরা জানে দলছুট হওয়ার আনন্দ। শওকত কানে কানে বলে, আগে বল তুমি বিয়ে করেছ কি না, স্যারকে বলতে হবে হাজবেণ্ডের সাথে যাচ্ছে, তা না হইলে ছাড়বে না।
না, এ কথাটি বলা যাবে না, এই স্যার গিয়ে আমার বাবা-স্যারের কানে কথাটি দিলে সব্বনাশ হবে। শওকত হেসে, আমার বলব কি বলব না ভঙ্গির দিকে, তাকিয়ে, বলে, স্যাররে বইলা দিই জিনিসটা গোপন যেন কাউকে না জানায়!
যদি জানায়?
আরে তুমি ঢাকায় দুইদিন পর চইলা আসো, দলের সাথে পরে ময়মনসিংহে ফিরো, অসুবিধা কি!
শওকত আমার খুলনা যাওয়ার পথ পরিষ্কার করে। এ যে অবৈধ পুরুষ নিয়ে ভেগে যাওয়ার কোনও ব্যাপার নয়,রীতিমত বৈধ পুরুষের সঙ্গে হাওয়া হওয়া, তা সে ইঙ্গিতে শিক্ষক-কাম-পাহারাদারকে বুঝিয়ে আমাকে পার করে। আমি রুদ্রর সঙ্গে পথে নেমে পড়ি। পথ থেকে ট্রেনে করে খুলনা, খুলনা থেকে লঞ্চে মোংলা। দলছুট হওয়ার পর বড় একা লাগে আমার। দলের সঙ্গে উচ্ছঅ!স ছিল, হঠাৎ যেন মিইয়ে গেল সব। হঠাৎ যেন একটি সম্পর্কের বন্ধন এসে আমাকে জড়ালো। আমাকে একটি র্কতব্যের কুয়োয় টপু করে ব্যাঙের মত ফেলে দিল।
রূপসা নদীর ওপর দিয়ে লঞ্চ চলছে মোংলায়। নতুন একটি নদী দেখছি, নতুন নতুন মানুষ দেখছি। আমার ভাল লাগতে শুরু করে। লঞ্চে উঠে রুদ্র বলল শাড়িটা পাল্টো নাও। শাড়ি পাল্টাবো কেন? এই তো বেশ।
শাদা একটি সুতির শাড়ি পরনে আমার। শাড়ি পরার অভ্যেস না থাকলেও সমুদ্র যাত্রায় মেয়েরা সব শাড়ি পরেছে, শাড়ি পরার এই সুযোগ পেয়ে আমারও আহলাদ কম নয়।
যা বলছি কর।
কেন, এই শাড়িতে কি খারাপ লাগছে দেখতে?
হ্যাঁ লাগছে। পাল্টাও। শিগরি কর, ঘাট এসে গেল।
খুব কি দরকার শাড়ি পাল্টানোর?
হ্যাঁ খুবই দরকার।
রুদ্র কেবল কবিতা নয়, শাড়ি নিয়েও ভাবে। সুতি শাড়ি ও মানে না। কাতান পরতে হবে।
কাতান পরতে ইচ্ছে করছে না।
কেন ইচ্ছে করবে না?
করছে না।
কি আশ্চর্য!
কোনওটা তো ইস্ত্রি নেই।
না থাক, তবু পর।
কাতান পরতে হবে। সবুজ বা নীল হলে চলবে না। লাল পরতে হবে।সমুদ্রে ভিজে সব শাড়ি দলামোচা হয়ে আছে। দলামোচা থেকেই একটি পরতে হল।লাল। দুপুরবেলা ঘাটে পৌঁছে দেখি এক বিরান বন্দর। কটি খালি সাম্পান বাধাঁ ঘাটে। কেমন গ্রাম গ্রাম,আবার ঠিক গ্রামও নয়। বুকের মধ্যে হু হু করে ওঠে। টানা বস্তি পেরিয়ে রুদ্র একটি দোতলা বাড়ির সামনে রিক্সা থামিয়ে বলল, এবার লক্ষ্মী মেয়ের মত মাথায় ঘোমটা দাও তো!
আমি চমকে উঠি রুদ্রর কথায়।
মাথায় ঘোমটা? কেন?
আরে দাও না।
আমি কখনও এসব দিই না।
দাও না জানি, এখন দাও।
কেন?
বুঝতে পারছ না কেন, তুমি তো এ বাড়ির বউ!
শুনে গা কাঁপে। অনেকটা আনন্দ, অনেকটা শরম, অনেকটা ভয় মিশিয়ে আমি তখন ঠিক বুঝে পাচ্ছি না কী করব। রুদ্র বলল, সালাম করতে হবে কিন্তু পা ছুঁয়ে।
না।
কেন?
আমি কখনও ওসব করি না।
করতে হবে।
আমার দ্বারা হবে না। অসম্ভব।
তুমি বুঝতে পারছ না কেন! সালাম না করলে খারাপ দেখায়।
কেন খারাপ দেখাবে?
দেখায়।
দেখায় কেন? কী মানে আছে পা ছোঁয়ার?
বড়দের করতে হয়। বুঝতে পারছ না কেন! আর তুমি তো এ বাড়ির বউ।
খারাপ দেখাক। আমি পারব না এসব।
ইস কি জ্বালা!
পা না ছুঁয়ে মুখে সালাম বললে হবে না?
না, হবে না।
আনন্দ উবে গিয়ে এক শরীর অস্বস্তি আমাকে গ্রাস করে। এই পা ছোঁয়ার ব্যাপারটি আমি পারি না। ঈদ এলে নতুন কাপড় জামা পরার পর মা এখনও বলেন, যাও তোমার বাবারে সালাম কইরা আসো।
দরজায় কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকি। মা যত ঠেলেন, কাঠ তত ভারি পাথর-মত হয়ে ওঠে। ঈদের সময় মুরব্বিদেরে সালাম করতে হয়। এই করতে হয় ব্যাপারটি আমি বুঝি, কিন্তু কেন করতে হয় তা ঠিক বুঝি না। তোমাকে বড় বলে মানি, শ্রদ্ধা করি, ভালবাসি, তা কেন পা ছুঁয়ে বোঝাতে হবে আমাকে! আর কোনও উপায় কি নেই বোঝাবার! আমি অবাক তাকিয়ে থাকি রুদ্রর দিকে, ধর্ম না মানা, রীতি নীতির তোয়াক্কা না করা রুদ্রও পা ছোঁয়ার ব্যাপারটিকে কেমন সায় দিচ্ছে! এত দূরে একটি বিরান বন্দরে এনে রুদ্র যেন আমার ঘাড় ধরে ধাক্কা দিল তার মা বাবার পায়ের দিকে। আত্মীয় নেই, বন্ধু নেই, এই বন্দরে চেনা কেউ নেই এক রুদ্র ছাড়া, অথচ এই রুদ্রকেই বড় অচেনা লাগে। মাথা আমার আঁচলে ঢাকা, পিঠে রুদ্রর খোঁচা, এক খোঁচা, দুই খোঁচা,তিন খোঁচার পর আমি তার মার পায়ের দিকে নত হই। ঠিক জানিও না সালাম জিনিসটি কি করে করে। পায়ে হাত ছুঁইয়ে হাতদুটো বুকে নিতে হয়, নাকি কপালে নাকি ঠোঁটে ধাধাঁ লাগে। পা ছুঁইয়ে সংশয়ের ভারে আমার হাত হাতের জায়গায়ই থাকে। এক দঙ্গল ভাই বোন রুদ্রর, এক এক করে এল পরিচিত হতে। ভিড়ের মধ্যে আরও একা লাগে আমার। যেন আমি অদ্ভুত এক জীব এসেছি মানুষের ভিড়ে। বীথি, রুদ্রর ছোটবোন, বলল কী দাদা, তোমার বউ কি বোবা নাকি কথা কচ্ছে না কেন! কি কথা বলব ঠিক বুঝে পাই না। বুঝে পাই না কি কথা বলা উচিত আমার। আমি গুটিয়ে থাকি।
রুদ্রর বাবা, রুদ্রর চেয়েও লম্বায় খাটো, পাশে দাঁড়ালে তিনি আমার কাধঁ সমান হবেন, মাথায় টুপি, মুখে দাড়ি, পাজামা পাঞ্জাবি পরা, বাড়িতে ঢোকেন। রুদ্রকে ফিসফিসিয়ে জিজ্ঞেস করি, উনি তো ডাক্তার তাই না!
হ্যাঁ।
তাহলে এই পোশাক যে!
ধর্ম বিশ্বাসী।
ডাক্তার হয়ে ধর্ম বিশ্বাস করেন!
আমি অবাক তাকিয়ে রই। বারান্দায় পিঁড়িতে বসে বদনির তোলা পানিতে অযু করেন তিনি। রুদ্রর মা তোয়ালে এগিয়ে দিলেন অযুতে ভেজা হাত মখু মুছতে, ঘরে জায়নামাজ বিছানো, তিনি নামাজ পরবেন। নামাজ শেষ হলে রুদ্র আমাকে নিয়ে যাবে তার বাবার সামনে। বুক ঢিপঢিপ করে। বাবা জিনিসটিই আমার মনে হতে থাকে বড় ভয়ের। রুদ্র অস্থির পায়চারি সেরে আমাকে নিয়ে ঢোকে নামাজ সেরে চেয়ারে হেলান দিয়ে হাতে তসবিহ জপতে থাকা তার বাবার কাছে। আমি শাড়ির আঁচলে আঙুল পেচাচ্ছি।
আব্বা, এই আমার বউ! বলে আমাকে বলল, যাও আব্বাকে সালাম কর। আমি লজ্জার মাথা খেয়ে উপুড় হই। তিনি দাড়িতে আঙুল বুলোতে বুলোতে বলেন, বস।
তোমার বাবা মার শরীর ভাল?
আমার বাবা মাকে তিনি চেনেন না, তাঁদের শরীর ভাল কি না ভাল নয় তা জানতে চাচ্ছেন কেন আমি বুঝতে পারি না। মুহূর্তে বাবা মার মখু মনে ভেসে ওঠে। হাইজিন ট্যুরে যাওয়া মেয়ে তাঁদের কোথায় এখন, যদি জানেন, তবে তাঁদের ভাল থাকা কোথায় যে উবে যাবে!
কোন ইয়ারে পড় তুমি।
ফোথর্ ইয়ার।
ও। ডাক্তার হতি তো বেশি দেরি নেই। তোমাদের বাড়ি তো ময়মনসিংহে!
হ্যাঁ ময়মনসিংহে।
এ কি ঢাকার উত্তরে না দক্ষিণে।
উত্তরে।
তা মোংলায় থাকবে কিছুদিন তো!
রুদ্র বলে, হ্যাঁ থাকবে।
তা শহিদুল্লাহ, ওকে নিয়ে মিঠেখালি যাবে কি?
দেখি।
মিঠেখালি ঘুরি আসো।
খাওয়া দাওয়া হইছে?
না।
যাও খাওয়া দাওয়া করি বিশ্রাম নাওগে যাও, অনেকদূর জানির্ করে এসেছো।
রুদ্র আমাকে নিয়ে দোতলায় ওঠে। নতুন চুনকাম হয়েছে। দোতলা নতুন করা হচ্ছে, এখনও কাজ শেষ হয়নি। এই দোতলা করার ব্যাপারটি রুদ্র বলে,যা তা, হুড়মুড় করে ওপরের ঘরগুলো একদিন ভেঙে পড়বে, কারণ মাটির তত গভীরে যায়নি বাড়ির শেকড়। শুনে ইট কাঠ লোহার সঙ্গে চুন সুরকির মত আমিও ভেঙে পড়ি। দোতলার একটি ঘর রুদ্র আর আমার জন্য গুছিয়ে দেওয়া হয়েছে, মোংলা এলে রুদ্র এ ঘরটিতেই থাকে। একটি মাঝারি খাট, একটি টেবিল, টেবিলের পাশে দুটো চেয়ার ঘরে। শাদা দেয়াল চারদিকে, একটি শুধু জানালা। তাকালে কিছু গোলপাতার গাছ আর একটি দোতলা বাড়ির পশ্চাতদেশ ছাড়া কিছু চোখে পড়ে না।
বিকেলে রুদ্র বেরিয়ে যায়,একা। আমি সঙ্গে যেতে চাইলে বলেছে এই বন্দরে বাড়ির বউএর এভাবে বেরোনো ঠিক নয়। তবে কি আমি মোংলা বন্দরটি, এই নতুন জায়গাটি দেখব না? না,দেখার কিছু নেই এখানে, শ্রমিকদের বস্তি ছাড়া আর কিছু নেই। শ্রমিকদের বস্তিই দেখব। না। শ্রমিকেরা আমাকে হাঁ হয়ে দেখবে, গিলে খাবে। তার চেয়ে রুদ্রর ভাই বোনদের সঙ্গে আমি যেন গল্প করি। কিন্তু ওদের সঙ্গেই বা কি গল্প করব! কাউকে আমি চিনি না। আমার বড় একা লাগে। বারান্দায় দাঁড়িয়ে দেখি সামনে জল আর জল। উঠোন পেরোলেই নদী। বীথিকে বলি, আমি ওই নদীটি দেখতে দেখতে যাবো। নদী? ও দেখার কিছু নেই। ও তো কেবল জল! জলই দেখব। জল দেখে কি করবে, বীথি হাসে। জলের কাছে গেলে আমাকে বলে, নোংরা জল, জলে হাত দিও না, পা ভিজিও না। জলহীন হাঁস আমি, হাওয়ায় সাঁতার কাটি। ডাঙাই আমার ঠিকানা, ডাঙায় আমার বসতবাড়ি, শ্বশুরবাড়ি। হাতের কাছে পায়ের কাছে অগাধ অফুরন্ত জল, যেদিকে চোখ যায় জল, থৈ থৈ জল অথচ বাড়িটিতে জলের অভাব। বাইরে থেকে একটি ছেলে দু তিন বালতি নদীর জল দিয়ে যায় প্রতিদিন, ও দিয়ে রান্না করা, পায়খানা পেচ্ছাব করা, গোসল করা, সবই সারতে হয়। গা লবণ লবণ লাগবে, চুল আঠা আঠা লাগবে, করার কিছু নেই, জলের অভাব, জলের তীরে বাস করে জলের এমন অভাব দেখে বিস্ময়ের ঘোর কাটে না আমার। পান করার জলও আসে বাইরে থেকে। ওরা বলে মিষ্টি জল, যদিও এক ফোঁটা মিঠে নয় স্বাদ, খরচা করতে হবে বুঝে, কেবল যদি তেষ্টায় ছাতি ফাটতে থাকে। মিষ্টি জল এ বন্দরে মেলে না, খুলনা শহর থেকে এখানে নৗকো করে জল আসে, এ দিয়েই তেষ্টা মেটাতে হয় বন্দরের সবার। বীথি বলে খুলনা থেকে পানি তো এই সেদিন থেকে আসে, এর আগে তো খাতি হত বিষ্টির পানি।
বৃষ্টির পানি?
মিঠেখালিতে তো ওই খাই আমরা। বড় বড় কলসি পেতে রাখি উঠোনে, ওতে বিষ্টির পানি জমি থাকে, ওই খাই।
ও পানি খাওয়া যায়?
যাবে না কেন?
বীথি জলপানির প্রসঙ্গ থেকে আলটপকা সরে গিয়ে বলে, আচ্ছা বৌদি তুমি কি গয়নাগাটি কিছু আননি? বাড়ির বউ, লোকে কি বলবে বল! কাল বিকেলে লোকজন আসবে, সীমুর জন্মদিন। আমি কিছু গয়না দিয়ে যাবনি, ও পরে রেখো।
সন্ধে শেষ হয়ে রাত নেমে আসে। বার বার ঘড়ি দেখি,ছটফট করি।
তোমার দাদা এখনো ফিরছে না!
ফিরবেনি, অত ভেবো না। পুরুষমানুষ, বাইরে বন্ধুবান্ধব থাকি, যাতি হয়।
তাই বলে এত রাত করবে?
ফিরবে ফিরবে। বউ আছে ঘরে, যত রাত হোক ফিরবে। বীথি হাসে। হাসিতে মুক্তো ঝরে।
অনেক রাত করে রুদ্র ফেরে। যখন শার্ট প্যান্ট খুলে লুঙ্গি পরে নিচ্ছে, বিছানাটির দিকে আড়চোখে তাকিয়ে আমার বুক কাঁপে, খুব বৈধভাবে এ বিছানায় আমাদের শুতে হবে দুজনকে, শোবার দিন শেষ অবদি এলই আমাদের। একটি রাত কাটানোর জন্য রুদ্র সেই যে কবে থেকে মরিয়া হয়ে উঠেছে, সেই রাত কাটানোর রাত তবে এলই। যেন আমরা দাম্পত্য জীবনে কতকালের অভ্যস্ত মানুষ, চল শুয়ে পড়ি, বলে সে মশারি ফেলে শুয়ে পড়ে।
কই এসো।
আসছি।
আসছি, বুকের কাঁপন খানিক থামুক, আসছি। তৃষ্ণায় ছাতি ফেটে যাচ্ছে, এক গেলাস জল খেয়ে এই আসছি। অস্থির হয়ো না, আমি আসছি। না এসে আমার উপায় কি!
কি ব্যাপার বসে আছো কেন? সারারাত ওখানেই কাটাবে নাকি?
আমাকে যেতে হয় বিছানায়, শরীর যেতে থাকে দেয়ালের দিকে। দেয়াল সাঁটা শরীর টেনে রুদ্র তার বুকের কাছে নিয়ে আসে। দুহাতে জড়িয়ে ধরে, শক্ত করে জড়িয়ে ধরে, যেন ছুটে যেতে না পারি। ছুটে আর কোথায় যাব আমি! আমার তো যাওয়ার আর জায়গা নেই। রুদ্রর কাছে আসব বলেই তো নিজেকে তৈরি করছি। নিজেকে শতবার করে বুঝিয়েছি রুদ্র তোমার স্বামী, স্বামীর সঙ্গে রাত কাটানোর এই সুযোগ তুমি নষ্ট করো না, তুমি বাইশ বছরের তরুণী এখন, ছোট্ট খুকি নও, আর সবাই যদি স্বামীর সঙ্গে শুতে পারে, তুমি পারবে না কেন! নিষিদ্ধ জিনিসটির স্বাদ পেতে আমারও ইচ্ছে করে গোপনে গোপনে। রুদ্র আমাকে সম্পণূর্ করে পেতে চাইছে। আমি প্রাণ মন তাকে কবেই দিয়ে বসে আছি, কেবল শরীর গুটিয়ে থাকে শামুকের মত। সমস্ত লজ্জা আর ভয় ভাঙার সময় কি আমার আসেনি! আজ যদি আমার গুটিয়ে থাকা শরীরকে খুলে না দিই, যদি আজ আমি শেকল ছিঁড়ে শরীরটিকে মুক্ত না করি, আজ যদি আমার ভালবাসার মানুষকে বঞ্চিত করি, এ আমার নিজেকেই বঞ্চিত করা হবে। রুদ্র কোনও অন্যায় দাবি করেনি। স্বামীর কাছে নিজেকে সমর্পণ করা অন্যায় নয়। একদিন না একদিন তো আমাকে দিতেই হবে যেটুকুৃ বাকি আছে দিতে, তবে আজ নয় কেন! রুদ্র আমাকে চুমু খায়। ঠোঁটে গাঢ় করে চুমু খায়। চুমু থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে বলি, বাতি জ্বলছে। এর অর্থ বাতি নেবাতে হবে। বাতি নিবিয়ে ঘর কালো করে তুমি এবার যা ইচ্ছে কর, আমি বারণ করব না। রুদ্র বাতি নিবিয়ে ঘর কালো করে আমার বোজা চোখ, শুকনো ঠোঁট, চিবুকের ভাঁজ ভিজিয়ে দেয়। ব্লাউজের বোতাম খুলে মখু ডুবিয়ে দেয়। স্তনবৃন্ত কেবল ভিজিয়ে দেয় না, দাঁতে কাটে। দুহাতে মুঠো করে ধরে স্তন, এত জোর-চাপ মুঠোয় যেন সে গলিয়ে এদের জল বানাবে, রূপসার ঘোলা জলের মত জল। রুদ্র আমার শাড়ি ওঠাতে থাকে ওপরের দিকে, আমি চাই না তবু আমার হাত আমার অজান্তে চলে যায় সে হাত থামাতে। আমার শরীরের ওপর নিজের শরীর তুলে দেয় রুদ্র। আমি চাই না, তবু আমার হাত চলে যায় তাকে শরীর থেকে নামাতে। এরপর সেই একই পদ্ধতি, দুপায়ে বিযুক্ত করতে থাকে আমার দু পা। চোখ বুজে আছি শক্ত করে। যেন চোখ না খোলে, যেন চোখের সামনে আমি লজ্জায় মরে যেতে হয় এমন কোনও দৃশ্য না দেখি। শক্ত করে দাঁতে দাঁত চেপে থাকি, সজোরে যুক্ত করে রাখি ঠোঁটজোড়া, যেন কোনও শব্দ আমার মুখ ফুটে না বেরোয়। এরপর আচমকা একটি আঘাতে আমি চিৎকার করে উঠি। রুদ্র আমার চিৎকারের মুখে দুহাত চেপে বলে, আরেকটু সহ্য করলেই হয়ে যাবে, এইতো হয়ে এল। লক্ষ্মীটি আরেকটু সহ্য কর। আরেকটু। রুদ্র ক্রমাগত আঘাত করেও নড়াতে পারে না কোনও পাথর। শরীর থেকে নেমে এসে সে তার আঙুল ব্যবহার করে অদৃশ্য পাথরখানি সরাতে। থরথর করে কাপঁ ছে আমার উরু, উরু থেকে কাপঁ ন সঞ্চারিত হয় সারা শরীর। মনে হচ্ছে আমি মারা যাচ্ছি। রুদ্র ঘেমে উঠেছে কিন্তু হাল ছাড়ছে না। পথে কোনও বাধা সে মানবে কেন, যে করেই হোক পথ প্রশস্ত করে তার এগোতে হবে, সামনে সোনার খনি, ওই খনি তার হাতের মুঠোয় চাই। নিজেই নিজের মখু দুহাতে চেপে রেখেছি। হাত ফুঁড়ে যেই না বেরিয়ে চায় কিছু রুদ্র শাড়ির আঁচল গুজে দেয় মুখে, যেন এই রাতের একটি কণাও আমার চিৎকারে না ভেঙে পড়ে। না কিছুই ঘটছে না, আমি কোনও যনণ্ত্রা পাচ্ছি না, এই যে নিম্নাঙ্গ, এ আমার নয়, এ আমার শরীরের কোনও অংশ নয়। অপারেশন থিয়েটারের টেবিলে শুয়ে থাকা এ কোনও অবশ হয়ে থাকা শরীর। ধরা যাক আমাকে পেথিডিন দেওয়া হয়েছে। রক্তে থায়োপেনটাল সোডিয়াম ঢুকিয়ে আমাকে অচেতন করা হয়েছে। শরীরের সমস্ত কষ্ট আমার উবে গেছে। মাথার ওপর সিলিংপাখা বনবন করে ঘুরছে, আমার অচেতন শরীর তবু ঘেমে উঠছে। শাড়ির আঁচল, হাত, ঠোঁট দাঁতের কামড়ে ছিঁড়ে যাচ্ছে। রুদ্র বাধা বিঘ্ন যা কিছু ছিল সব সরিয়ে সোনার খনির দিকে আমার ভেতর বাহির চুরমার করে ঢুকে যায়।
রুদ্র নেমে যায় ওপর থেকে। একদিকে দেয়াল আরেকদিকে রুদ্র, আমার শক্তি নেই কোনও দিকে একবিন্দু নিজেকে সরাই। স্থির হয়ে আছি। ধীরে ধীরে চোখ মেলে দেখছি যেন আমি অপারেশন থিয়েটারের বাইরে, পোস্ট অপারেটিভ রুমে। আমার জ্ঞান ফিরছে। জ্ঞান ফিরলে আমি টের পাই আমি কোনও পোস্ট অপারেটিভ রুমেও নই, আমি রূপসা নদীর ঘোলা জলে শুয়ে আছি। আমার শরীর ভাসছে জলের ওপর। চারদিকে কেউ নেই, একা আমি। এত একা কোনওদিন বোধ করিনি। যেন আমার কেউ নেই, কোনওকালে ছিল না। আমার বাবা নেই, মা নেই। আমার কোনও ভাই বোন নেই। আমার কোনও বন্ধু নেই, কোনও প্রেমিক নেই, কোনও স্বামী নেই। আমার কোনও ঠিকানা নেই কোথাও যাওয়ার। আমি রূপসার জলের ওপর ভেলার মত ভেসে কোথাও যাচ্ছি আমি জানি না। যখন শক্তি জোটে নিজেকে তোলার, তুলে আমি নামতে যাই বিছানা থেকে, পথ জুড়ে পাহাড়ের মত একটি বাধা, সেটি রুদ্র। বলি, যেতে দাও। এই প্রথম আমি রুদ্রকে সম্বোধন করি। রুদ্র পথ ছেড়ে দিলে আমি নেমে পেচ্ছাবখানা খুঁজতে থাকি অন্ধকার হাতড়ে হাতড়ে। নিম্নাঙ্গ ছিঁড়ে যাচ্ছে, হাঁসের মত হাঁটতে থাকি জলহীন ডাঙার অন্ধকারে। পেচ্ছাবখানায় পেচ্ছাব নয়, রক্ত বয়ে যায়, রূপসার জলের দিকে যায়। আর্তনাদের শক্তি আমার নেই। গোঙাতে থাকি অসহ্য যনণ্ত্রায়।