What's new
Nirjonmela Desi Forum

Talk about the things that matter to you! Wanting to join the rest of our members? Feel free to sign up today and gain full access!

Collected উতল হাওয়া (আত্মজিবনী) (1 Viewer)

১৭. ফুলশয্যা


পুকুর দেখেছি, নদী দেখেছি, সমুদ্র দেখা হয়নি কোনওদিন। বউ নিয়ে কক্সবাজারের সমুদ্র সৈকতে মধুচন্দ্রিমা করে আসার পর দাদাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম দাদা গো সমুদ্র দেখতে কেমন! দাদা একটি কথাই বলেছেন,না গেলে বুঝবি না। সমুদ্র কেমন সে কথা কখনও বইলা বুঝানো যায় না, সমুদ্রের সামনে দাঁড়ায়া উপলব্ধি করতে হয় সমুদ্র। সমুদ্রের চেয়ে বেশি উচ্ছ্বাস দাদার উড়োজাহাজ নিয়ে। উড়োজাহাজে প্রথম চড়েছেন তিনি। ছোটদা উড়োজাহাজের গল্প করলে দাদা এতকাল তৃষ্ণার্ত নয়নে তাকিয়ে থাকতেন। নয়নের সেই তৃষ্ণা দাদার ঘুচেছে এখন। আমার অবশ্য কিছুই ঘোচেনি। উড়োজাহাজের চেয়ে সমুদ্র দেখার উৎসাহটিই আমার বেশি।

সমুদ্রপাড়ে তোলা দাদা আর হাসিনার ছবি দেখে, সমুদ্র না দেখেই লিখে ফেলি সমুদ্র নিয়ে তিনটে কবিতা। না দেখা সমুদ্র যখন আমার হৃদয় জুড়ে, তখনই চল চল সমুদ্র দেখবে চল, কাপড় চোপড় গোছাও রব। চতথুর্ বষের্ এই একটি চমৎকার ঘটনা ঘটে, এক ক্লাস ছাত্রছাত্রী নিয়ে কমিউনিটি মেডিসিনের শিক্ষকরা দূরে কোথাও চলে যান, দূর বলতে দেশের মাথা থেকে লেজে যাওয়া, লেজের কাছে থই থই করছে রূপোলি জল, সেই জলে ডোবো, ভাসো। অবশ্য বলা হয় জলীয় আবহাওয়া দেখাতে নিচ্ছেন, আসলে এ অনেকটা হাওয়া বদলের মত, রোগীদের যেমন হাওয়া বদলের দরকার হয়, হবু ডাক্তারদেরও হয়। দিনরাত হাসপাতালের পুঁজ-গন্ধময় হাওয়া থেকে খানিকটা নিস্তার পাওয়া হয়।

ময়মনসিংহ থেকে ঢাকা, ঢাকা থেকে ট্রেনে চড়ে চট্টগ্রাম, চট্টগ্রাম থেকে বাসে চড়ে কক্সবাজার। বাড়িতে হইচই পড়ে গেল, হইচইই বটে, এমন তো কখনও ঘটে না, আত্মীয় কাউকে না নিয়ে দূরের কোনও শহরে চলে যাওয়া। মা বার বার জিজ্ঞেস করলেন মাস্টাররা থাকবে তো! দুঘন্টার পথ ঢাকা, ঠিক আছে মানায়, ঢাকায় আত্মীয়ও আছে, কিন্তু চট্টগ্রামে তো আমার মামাও থাকে না কাকাও না। মামা কাকার সীমানার বাইরে বলেই সম্ভবত পেখম মেলে একশ ময়ূর নাচে হৃদয়ে। বাবা দরাজ হসে ্ত দিয়েছেন টাকা, হাইজিন ট্যুরের চাঁদা তো আছেই, বাড়তি টাকাও। ট্রেনে চড়ে দলের ঢাকা যাত্রা হয়। সেগুনবাগিচা ছেড়ে ছোটদা এখন নয়াপল্টনে বাড়ি ভাড়া করেছেন। নয়াপল্টনে একরাত থেকে পরদিন কমলাপুর রেলইষ্টিশনে পৌঁছতে হবে সকাল আটটায়। রাতে গীতার কাছে শাড়ি চাইতেই আলমারি খুলে বিছানায় লাল নীল সবুজ হলুদ কাতান সিল্ক এমনকি মসলিন বিছিয়ে দিল পছন্দ করে নিতে একটি নয়, যত খুশি। বোতাম টিপলে আলো জ্বলে এমন একটি ক্যামেরাও মিলল। আর কি চাই! আশাতীত পাওয়া আমার।

পরদিন ট্রেনে চড়ে কখনও হৈ হল্লায় মেতে, কখনও জানালায় উদাস চোখ মেলে পৌঁছই চট্টগ্রাম। চট্টগ্রাম থেকে বনের ভেতর দিয়ে আঁকা বাঁকা পথে সারি সারি রাবার গাছের বাগান পার হয়ে কক্সবাজার যখন পৌঁছই, উত্তেজনা তুঙ্গে। একটি শব্দ, ভীষণ এক শব্দ, অন্যরকম, মাটি কাঁপানো, জল কাপাঁনো, শব্দটির দিকেই বাস যেতে থাকে। ঠিক কোত্থেকে শব্দটি আসছে বুঝতে আমি চারদিক খুঁজি। বাসের জানালা থেকে কিছুতেই চোখ সরে না। দূরে একটি শাদা কিছু একবার উঠছে একবার নামছে। সাফিনাজ, হালকা হালকা বন্ধুত্ব অতিক্রম করে ঘনিষ্ঠ হওয়া একজন, জানালায় ঝুঁকে বলল,ওইটাই কি সমুদ্র নাকি! কোনওদিন সমুদ্র না দেখা মেয়ে আমি, ইচ্ছে করে, বাস থেকে নেমে দৌড়ে যাই দেখতে ,যদি ওটাই সমুদ্র হয়, কিন্তু কে দেবে আমাকে ছুটে যেতে! আগে মোটেলে নামো, তারপর। মোটেলে দুজনের জায়গায় চারজনকে ঢোকানো হল এক ঘরে। বরাদ্দ ঘরে সুটকেস নামিয়ে রেখে আগে দৌড়ে যাই ওই শব্দের দিকে। গোসল নেই, খাওয়া নেই, বিশ্রাম নেই। আগে আমি সমুদ্র দেখব তারপর অন্য কিছু সাফিনাজ পরিপাটি মেয়ে, খাওয়ার সময় খাওয়া পড়ার সময় পড়া ঘুমের সময় ঘুমের মেয়ে। ওকে যেতে হয় আমার উত্তেজনাকে সঙ্গ দিতে। সেই তীব্র র্গজনের দিকে হেঁটে নয়, দৌড়ে যাই। যখন পৌঁছই, বিস্ময় আর মগ্ধু তা আমাকে স্থবির করে রাখে, আমাকে নিস্পন্দ করে রাখে,আমাকে বিবশ করে রাখে। একটি শব্দ আমি আর উচ্চারণ করতে পারি না। এত বিশাল কিছু এত অদ্ভুত সুন্দর কিছু এত আশ্চর্য হৃদয়রঞ্জন কিছু আমি আমার জীবনে কখনও দেখিনি। নানিবাড়ির ছোট্ট পুকুরের ধারে বড় হয়েছি, শহরের তিনকোনা পুকুর ছিল নানিবাড়ির পুকুরের চেয়ে দ্বিগুন, সেটি দেখতে যেতে আমাকে অপেক্ষা করতে হয়েছিল কয়েকটি বছর, বড় হয়ে ব্রহ্মপুত্র দেখা হয়েছে, ব্রহ্মপুত্রের শীর্ণ জলের ধারা দেখেই মনে হয়েছে এর চেয়ে বিশাল কিছু বুঝি পৃথিবীতে নেই। আমার কল্পনায় ছিল সমুদ্র। সেই সমুদ্র এই সমুদ্রের সৌন্দর্যের ধারে কাছে আসতে পারে না। আমার অবাধ কল্পনা এত বিশাল কিছু এত আশ্চর্য সুন্দর কিছু এত কূল কিনারাহীন কিছু আমাকে দিতে পারেনি। আমি লক্ষ করি না আমার চোখ যে ভিজে যাচ্ছে চোখের জলে। সূর্য ডুবছে সমুদ্রে। আমি তন্ময় হয়ে শব্দ শুনি সমুদ্রের, ভেজা চোখে সূর্যের ডুবে যেতে থাকা রূপ দেখি। সূর্যাস্ত আমি আগেও দেখেছি অনেক, এমন রূপ দেখিনি আগে। আমাকে বিহ্বল করে রাখে, বিমগ্ধু করে রাখে, বিমূঢ় করে রাখে প্রকৃতির এই অনিঃশেষ সৌন্দর্য। ধীরে ধীরে দল বেঁধে আসতে থাকে ছেলেমেয়েরা, সূর্যাস্তের দিকে নির্নিমেষ তাকিয়ে থাকে। এই সুন্দর থেকে কোথাও আমার আর ফিরে যেতে ইচ্ছে করে না। রাত নেমে এলে সাফিনাজ আমাকে টেনে নিয়ে যায় মোটেলে, রাতের সৈকত নাকি নিরাপদ নয়। মেয়েরা সব চলে যায় মোটেলে, ছেলেরা পূর্ণিমা দেখবে বলে থেকে যায় অনেক রাত অবদি সৈকতে। আমার বড় ছেলে হতে ইচ্ছে করে। ইচ্ছে করে সারারাত সমুদ্র আর চাঁদের জলে ভিজি। মোটেলের ঘরের বারান্দায় চাঁদের আলোয় বসে বসে একা একা সমুদ্রের ডাক শুনি। আয় আয় আয় বলে ডাকছে আমাকে। ভোরবেলা সূর্য ওঠার আগে সূর্যোদয় দেখব বলে দৌড়ে যাই সমুদ্রের দিকে। পরনে লাল একটি শাড়ি আমার। খালি পা। খোলা চুল। সমুদ্রের ঢেউ আমাকে ভাসিয়ে নেয়, ডুবিয়ে নেয়। উঠি উঠি সূর্য আমার শরীরের জলের ফোঁটায় চুমু খায়। ঝাঁক ঝাঁক মেয়ে আসে, ওদেরও বলি ঢেউএর সঙ্গে খেলা করতে। ওইতো ফেনিয়ে ওঠে শরীর ভাসিয়ে নেয় জোয়ারের ঢেউ, এর নাম ভালবাসা, আমি তাকে নেশা বলি, তীব্র তৃষ্ণা বলি। হৃদয় ভাসিয়ে নেয়, জীবন ভাসিয়ে নেয় মোহন ঘাতক, আয় আয় ডাকে আয়, সর্বনাশ তবু ডাকে আয় আয় আয়, এর নাম ভালবাসা, আমি তাকে সখু বলি, স্বপ্ন বলে ডাকি। সারাদিন সমুদ্রের জলে খেলা করি। আমাকে নেশায় পায়, ভালাবাসায় পায়। বিকেলে ঝুপড়ি দোকানে দারুচিনি চা পান করতে করতে সূর্যাস্তের জন্য অপেক্ষা করি। নোনাজলে ঠোঁট রেখে উপচে পড়েছে দেখি আকাশে পূর্ণিমা, শরীরে উল্লাস নাচে,কাঁচা অঘ্রাণের ঘ্রাণ তুফান নামায়। ঘুম আয় ঘুম আয় হৃদয়ে সমুদ্র ডাকে আয় আয় আয়, শিয়রে সোনার কাঠি রাজকন্যা ঘুম যায় যাদুর পালঙ্ক।

সমুদ্র থেকে আমাদের নিয়ে আসা হয় চট্টগ্রামে। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের ছাত্রীনিবাসে ছাত্রীদের, ছাত্রাবাসে ছাত্রদের থাকার জায়গা করা হয়েছে। হালিদা, সাফিনাজ, শিপ্রা আর কয়েকজন বন্ধু নিয়ে ঘুরে ফিরি সবুজ টিলার নিচে এঁকে বেঁকে চলে যাওয়া নীল জলের ফয়েজ লেকের ধারে। ঘাসে বসে বালিহাঁসের পাখনা মেলে ওড়া দেখি। সব কিছুই আমার এত ভাল লাগে, এত ভাল লাগে যে রুদ্রর না থাকা আমাকে একটু একটু বিষণ্ন করতে থাকে। রুদ্র এলে হাতে হাত রেখে পাশাপাশি হাঁটা যেত এই লেকের জল, এই পাহাড় এই সবুজের অপরূপ রূপে হৃদয়ে ভেজাতে ভেজাতে। ময়মনসিংহ ছাড়ার আগেই রুদ্রকে চিঠি পাঠিয়ে দিয়েছিলাম খবর জানিয়ে যে আমি সমুদ্রপাড়ে যাচ্ছি, যেন যায় সে ওখানে। কক্সবাজার থেকে কবে ফিরব চট্টগ্রাম, কোথায় থাকব, আবার চট্টগ্রাম থেকেই বা কবে ফিরে যাবো ঢাকায়, সবই জানিয়েছিলাম। এমন চমৎকার সময় আমার জীবনে আর আসেনি আগে, যে করেই হোক যেন সে যায়। মিঠেখালিতে বসে আছে সে অনেকদিন, মিঠিখালি থেকে রুদ্র যত কথাই দেয় যে বেরোবে এক বা দু সপ্তাহ পর, দুমাস তিনমাস কেটে যায়, তার বেরোনো হয় না। গ্রামটিতে একটি শেকল আছে, যখনই সে যায়, শেকলে জড়িয়ে যায়, সে চাক বা না চাক।

যেদিন আমরা চট্টগ্রাম থেকে ফিরে যাবো ঢাকায় তার আগের রাতে রুদ্র এসেছে। সাইফুল,রুদ্রর ছোটভাই, ছাত্রীনিবাসে আসে, রুদ্রকে সঙ্গে করে। সাইফুল চট্টগ্রাম মেডিকেলে প্রথম বষের্ সবে ভর্তি হয়েছে। সাইফুলকে প্রথম দেখি সে রাতে। ছোটখাটো হাসিখুশি ছেলে। রুদ্রর চোখের মত ডাগর চোখ ওর। পরিচ্ছত পরিপাটি ছেলে। ছেলেটি চমৎকার, কথা বলে এমন করে যেন আমাকে এক যগু ধরে চেনে। ওর সঙ্গে আমি সহজে সহজ হই। সে রাতে তিনজন রিক্সা করে বেরিয়ে একটি রেস্তোরাঁয় ঢুকে যখন রাতের খাবার খাচ্ছি, রুদ্রর লাল হয়ে থাকা চোখ, বড় হয়ে যাওয়া চুল,দাড়িতে দৃষ্টি বারবার হোঁচট খায়। সাতদিন স্নান করেনি, ঘুমোয়নি, যেন এইমাত্র কোনও গুহা থেকে উঠে এসেছে। সাতটি দিন কেটে গেল আমি ময়মনসিংহের বাইরে কেন সে আগে আসেনি, কেন ফিরে যাবার আগের দিন মাত্র কিছুক্ষণের জন্য এল, আমরা দুজন কি সুন্দর খেলা করতে পারতাম সমুদ্রের জল নিয়ে, ঢেউ নিয়ে, পাশাপাশি বসে দেখতে পারতাম সূর্যোদয়, সূর্যাস্ত, পূর্ণিমায় গভীর রাত অব্দি বালুতে পা ছড়িয়ে বসে দেখতে পারতাম জলের ওপর চাঁদের আলোর সাঁতার কাটা। বাবার রক্তচক্ষুহীন ঢিঁ ঢিঁ পড়ার ভয়হীন এই চট্টগ্রাম শহরটিতে রিক্সার হুড ফেলে আমি নিশ্চিন্তে তার সঙ্গে ঘুরে বেড়াতে পারতাম। অভিমান আমাকে ধোঁয়ায় ঢাকতে থাকে। ধোঁয়া সরিয়ে রুদ্রর ভারি কণ্ঠস্বর আমাকে স্পর্শ করে, চট্টগ্রাম থেকে কাল আমাকে ঢাকা নয়, যেতে হবে মোংলা। যদিও নতুন কোনও শহর দেখার ইচ্ছে আমার প্রচণ্ড, কিন্তু মোংলা যাওয়ার প্রস্তাবটি শুনে না বলে দিই। না বলি কারণ দল থেকে মাস্টারেরা আমাকে বেরোতে দেবেন না। হয় না, ঢাকায় আরও ট্যুর আছে, সেরে, দলের সঙ্গে ফিরতে হবে ময়মনসিংহে। রুদ্র চোখ কুঁচকে ঠোঁট কুঁচকে রাখে এই না বলায়। সাইফুল বলে, আরে যাও না বৌদি একটু ঘুরে আসো মোংলায়। সাইফুলের বৌদি ডাকে আমার চেতন হয় যে আমি কারও বৌদি, কারও বৌদি মানে আমি কারও বউ। রাতে ছাত্রীনিবাসে সাফিনাজের পাশে শুয়ে এপাশ ওপাশ করি, ভাবনার একটি রশি বেয়ে বন্ধ ঘর থেকে ছাদের ওপর উঠি, ছাদ থেকে আরও ওপরে শূন্যে, দুহাত মেলে দিই ভাসতে থাকি, কী আনন্দ কী আনন্দ! আর কবে পাবো এমন ছুটি!এর চেয়ে সুযোগ কি আমার জীবনে আসবে আর, হারিয়ে যাওয়ার সুযোগটি হাতছাড়া করি কেন! পরদিন রুদ্রকে নিয়ে ট্রেনে উঠে ঢোক গিলতে গিলতে দুজন শিক্ষকের মধ্যে সাদাসিধেটিকে বলি, যে আমাকে আজই খুলনা যেতে হচ্ছে, খুলনা থেকে কালই ঢাকায় ফিরব, ঢাকার ট্যুর এ থাকবো। কিন্তু শিক্ষক সাদাসিধে হোক আর যাই হোক, তিনি আমাকে যেতে যেবেন কেন, এতগুলো হবু ডাক্তাদের ভালয় ভালয় ভ্রমণ করিয়ে ভালয় ভালয় ফেরত নিয়ে যাওয়ার দায়িত্ব যখন নিয়েছেন, তিনি সুষ্ঠু ভাবেই পালন করবেন।

কার সঙ্গে যাবে?

কার সঙ্গে যাব? এর সহজ উত্তর, দাড়িঅলা লোকটিকে দেখিয়ে বলে দেওয়া, ওর সঙ্গে। এরপরই তো প্রশ্ন উঠবে ও কে, ও কি। তাও না হয় দেওয়া গেল, ও রুদ্র, ও কবি। এর পরের প্রশ্নটি, তিনি খুব সাদাসিধে বলেই করা স্বাভাবিক, ও তোমার কি হয়?

আমার অপ্রফুল্লবদনটি দেখে আমাকে উদ্ধার করতে এগিয়ে এলো শওকত আর মদিরা, দুজনে প্রেম করে বিয়ে করেছে, ওরা জানে দলছুট হওয়ার আনন্দ। শওকত কানে কানে বলে, আগে বল তুমি বিয়ে করেছ কি না, স্যারকে বলতে হবে হাজবেণ্ডের সাথে যাচ্ছে, তা না হইলে ছাড়বে না।

না, এ কথাটি বলা যাবে না, এই স্যার গিয়ে আমার বাবা-স্যারের কানে কথাটি দিলে সব্বনাশ হবে। শওকত হেসে, আমার বলব কি বলব না ভঙ্গির দিকে, তাকিয়ে, বলে, স্যাররে বইলা দিই জিনিসটা গোপন যেন কাউকে না জানায়!

যদি জানায়?

আরে তুমি ঢাকায় দুইদিন পর চইলা আসো, দলের সাথে পরে ময়মনসিংহে ফিরো, অসুবিধা কি!

শওকত আমার খুলনা যাওয়ার পথ পরিষ্কার করে। এ যে অবৈধ পুরুষ নিয়ে ভেগে যাওয়ার কোনও ব্যাপার নয়,রীতিমত বৈধ পুরুষের সঙ্গে হাওয়া হওয়া, তা সে ইঙ্গিতে শিক্ষক-কাম-পাহারাদারকে বুঝিয়ে আমাকে পার করে। আমি রুদ্রর সঙ্গে পথে নেমে পড়ি। পথ থেকে ট্রেনে করে খুলনা, খুলনা থেকে লঞ্চে মোংলা। দলছুট হওয়ার পর বড় একা লাগে আমার। দলের সঙ্গে উচ্ছঅ!স ছিল, হঠাৎ যেন মিইয়ে গেল সব। হঠাৎ যেন একটি সম্পর্কের বন্ধন এসে আমাকে জড়ালো। আমাকে একটি র্কতব্যের কুয়োয় টপু করে ব্যাঙের মত ফেলে দিল।



রূপসা নদীর ওপর দিয়ে লঞ্চ চলছে মোংলায়। নতুন একটি নদী দেখছি, নতুন নতুন মানুষ দেখছি। আমার ভাল লাগতে শুরু করে। লঞ্চে উঠে রুদ্র বলল শাড়িটা পাল্টো নাও। শাড়ি পাল্টাবো কেন? এই তো বেশ।

শাদা একটি সুতির শাড়ি পরনে আমার। শাড়ি পরার অভ্যেস না থাকলেও সমুদ্র যাত্রায় মেয়েরা সব শাড়ি পরেছে, শাড়ি পরার এই সুযোগ পেয়ে আমারও আহলাদ কম নয়।

যা বলছি কর।

কেন, এই শাড়িতে কি খারাপ লাগছে দেখতে?

হ্যাঁ লাগছে। পাল্টাও। শিগরি কর, ঘাট এসে গেল।

খুব কি দরকার শাড়ি পাল্টানোর?

হ্যাঁ খুবই দরকার।

রুদ্র কেবল কবিতা নয়, শাড়ি নিয়েও ভাবে। সুতি শাড়ি ও মানে না। কাতান পরতে হবে।

কাতান পরতে ইচ্ছে করছে না।

কেন ইচ্ছে করবে না?

করছে না।

কি আশ্চর্য!

কোনওটা তো ইস্ত্রি নেই।

না থাক, তবু পর।

কাতান পরতে হবে। সবুজ বা নীল হলে চলবে না। লাল পরতে হবে।সমুদ্রে ভিজে সব শাড়ি দলামোচা হয়ে আছে। দলামোচা থেকেই একটি পরতে হল।লাল। দুপুরবেলা ঘাটে পৌঁছে দেখি এক বিরান বন্দর। কটি খালি সাম্পান বাধাঁ ঘাটে। কেমন গ্রাম গ্রাম,আবার ঠিক গ্রামও নয়। বুকের মধ্যে হু হু করে ওঠে। টানা বস্তি পেরিয়ে রুদ্র একটি দোতলা বাড়ির সামনে রিক্সা থামিয়ে বলল, এবার লক্ষ্মী মেয়ের মত মাথায় ঘোমটা দাও তো!

আমি চমকে উঠি রুদ্রর কথায়।

মাথায় ঘোমটা? কেন?

আরে দাও না।

আমি কখনও এসব দিই না।

দাও না জানি, এখন দাও।

কেন?

বুঝতে পারছ না কেন, তুমি তো এ বাড়ির বউ!

শুনে গা কাঁপে। অনেকটা আনন্দ, অনেকটা শরম, অনেকটা ভয় মিশিয়ে আমি তখন ঠিক বুঝে পাচ্ছি না কী করব। রুদ্র বলল, সালাম করতে হবে কিন্তু পা ছুঁয়ে।

না।

কেন?

আমি কখনও ওসব করি না।

করতে হবে।

আমার দ্বারা হবে না। অসম্ভব।

তুমি বুঝতে পারছ না কেন! সালাম না করলে খারাপ দেখায়।

কেন খারাপ দেখাবে?

দেখায়।

দেখায় কেন? কী মানে আছে পা ছোঁয়ার?

বড়দের করতে হয়। বুঝতে পারছ না কেন! আর তুমি তো এ বাড়ির বউ।

খারাপ দেখাক। আমি পারব না এসব।

ইস কি জ্বালা!

পা না ছুঁয়ে মুখে সালাম বললে হবে না?

না, হবে না।

আনন্দ উবে গিয়ে এক শরীর অস্বস্তি আমাকে গ্রাস করে। এই পা ছোঁয়ার ব্যাপারটি আমি পারি না। ঈদ এলে নতুন কাপড় জামা পরার পর মা এখনও বলেন, যাও তোমার বাবারে সালাম কইরা আসো।

দরজায় কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকি। মা যত ঠেলেন, কাঠ তত ভারি পাথর-মত হয়ে ওঠে। ঈদের সময় মুরব্বিদেরে সালাম করতে হয়। এই করতে হয় ব্যাপারটি আমি বুঝি, কিন্তু কেন করতে হয় তা ঠিক বুঝি না। তোমাকে বড় বলে মানি, শ্রদ্ধা করি, ভালবাসি, তা কেন পা ছুঁয়ে বোঝাতে হবে আমাকে! আর কোনও উপায় কি নেই বোঝাবার! আমি অবাক তাকিয়ে থাকি রুদ্রর দিকে, ধর্ম না মানা, রীতি নীতির তোয়াক্কা না করা রুদ্রও পা ছোঁয়ার ব্যাপারটিকে কেমন সায় দিচ্ছে! এত দূরে একটি বিরান বন্দরে এনে রুদ্র যেন আমার ঘাড় ধরে ধাক্কা দিল তার মা বাবার পায়ের দিকে। আত্মীয় নেই, বন্ধু নেই, এই বন্দরে চেনা কেউ নেই এক রুদ্র ছাড়া, অথচ এই রুদ্রকেই বড় অচেনা লাগে। মাথা আমার আঁচলে ঢাকা, পিঠে রুদ্রর খোঁচা, এক খোঁচা, দুই খোঁচা,তিন খোঁচার পর আমি তার মার পায়ের দিকে নত হই। ঠিক জানিও না সালাম জিনিসটি কি করে করে। পায়ে হাত ছুঁইয়ে হাতদুটো বুকে নিতে হয়, নাকি কপালে নাকি ঠোঁটে ধাধাঁ লাগে। পা ছুঁইয়ে সংশয়ের ভারে আমার হাত হাতের জায়গায়ই থাকে। এক দঙ্গল ভাই বোন রুদ্রর, এক এক করে এল পরিচিত হতে। ভিড়ের মধ্যে আরও একা লাগে আমার। যেন আমি অদ্ভুত এক জীব এসেছি মানুষের ভিড়ে। বীথি, রুদ্রর ছোটবোন, বলল কী দাদা, তোমার বউ কি বোবা নাকি কথা কচ্ছে না কেন! কি কথা বলব ঠিক বুঝে পাই না। বুঝে পাই না কি কথা বলা উচিত আমার। আমি গুটিয়ে থাকি।

রুদ্রর বাবা, রুদ্রর চেয়েও লম্বায় খাটো, পাশে দাঁড়ালে তিনি আমার কাধঁ সমান হবেন, মাথায় টুপি, মুখে দাড়ি, পাজামা পাঞ্জাবি পরা, বাড়িতে ঢোকেন। রুদ্রকে ফিসফিসিয়ে জিজ্ঞেস করি, উনি তো ডাক্তার তাই না!

হ্যাঁ।

তাহলে এই পোশাক যে!

ধর্ম বিশ্বাসী।

ডাক্তার হয়ে ধর্ম বিশ্বাস করেন!

আমি অবাক তাকিয়ে রই। বারান্দায় পিঁড়িতে বসে বদনির তোলা পানিতে অযু করেন তিনি। রুদ্রর মা তোয়ালে এগিয়ে দিলেন অযুতে ভেজা হাত মখু মুছতে, ঘরে জায়নামাজ বিছানো, তিনি নামাজ পরবেন। নামাজ শেষ হলে রুদ্র আমাকে নিয়ে যাবে তার বাবার সামনে। বুক ঢিপঢিপ করে। বাবা জিনিসটিই আমার মনে হতে থাকে বড় ভয়ের। রুদ্র অস্থির পায়চারি সেরে আমাকে নিয়ে ঢোকে নামাজ সেরে চেয়ারে হেলান দিয়ে হাতে তসবিহ জপতে থাকা তার বাবার কাছে। আমি শাড়ির আঁচলে আঙুল পেচাচ্ছি।

আব্বা, এই আমার বউ! বলে আমাকে বলল, যাও আব্বাকে সালাম কর। আমি লজ্জার মাথা খেয়ে উপুড় হই। তিনি দাড়িতে আঙুল বুলোতে বুলোতে বলেন, বস।

তোমার বাবা মার শরীর ভাল?

আমার বাবা মাকে তিনি চেনেন না, তাঁদের শরীর ভাল কি না ভাল নয় তা জানতে চাচ্ছেন কেন আমি বুঝতে পারি না। মুহূর্তে বাবা মার মখু মনে ভেসে ওঠে। হাইজিন ট্যুরে যাওয়া মেয়ে তাঁদের কোথায় এখন, যদি জানেন, তবে তাঁদের ভাল থাকা কোথায় যে উবে যাবে!

কোন ইয়ারে পড় তুমি।

ফোথর্ ইয়ার।

ও। ডাক্তার হতি তো বেশি দেরি নেই। তোমাদের বাড়ি তো ময়মনসিংহে!

হ্যাঁ ময়মনসিংহে।

এ কি ঢাকার উত্তরে না দক্ষিণে।

উত্তরে।

তা মোংলায় থাকবে কিছুদিন তো!

রুদ্র বলে, হ্যাঁ থাকবে।

তা শহিদুল্লাহ, ওকে নিয়ে মিঠেখালি যাবে কি?

দেখি।

মিঠেখালি ঘুরি আসো।

খাওয়া দাওয়া হইছে?

না।

যাও খাওয়া দাওয়া করি বিশ্রাম নাওগে যাও, অনেকদূর জানির্ করে এসেছো।

রুদ্র আমাকে নিয়ে দোতলায় ওঠে। নতুন চুনকাম হয়েছে। দোতলা নতুন করা হচ্ছে, এখনও কাজ শেষ হয়নি। এই দোতলা করার ব্যাপারটি রুদ্র বলে,যা তা, হুড়মুড় করে ওপরের ঘরগুলো একদিন ভেঙে পড়বে, কারণ মাটির তত গভীরে যায়নি বাড়ির শেকড়। শুনে ইট কাঠ লোহার সঙ্গে চুন সুরকির মত আমিও ভেঙে পড়ি। দোতলার একটি ঘর রুদ্র আর আমার জন্য গুছিয়ে দেওয়া হয়েছে, মোংলা এলে রুদ্র এ ঘরটিতেই থাকে। একটি মাঝারি খাট, একটি টেবিল, টেবিলের পাশে দুটো চেয়ার ঘরে। শাদা দেয়াল চারদিকে, একটি শুধু জানালা। তাকালে কিছু গোলপাতার গাছ আর একটি দোতলা বাড়ির পশ্চাতদেশ ছাড়া কিছু চোখে পড়ে না।

বিকেলে রুদ্র বেরিয়ে যায়,একা। আমি সঙ্গে যেতে চাইলে বলেছে এই বন্দরে বাড়ির বউএর এভাবে বেরোনো ঠিক নয়। তবে কি আমি মোংলা বন্দরটি, এই নতুন জায়গাটি দেখব না? না,দেখার কিছু নেই এখানে, শ্রমিকদের বস্তি ছাড়া আর কিছু নেই। শ্রমিকদের বস্তিই দেখব। না। শ্রমিকেরা আমাকে হাঁ হয়ে দেখবে, গিলে খাবে। তার চেয়ে রুদ্রর ভাই বোনদের সঙ্গে আমি যেন গল্প করি। কিন্তু ওদের সঙ্গেই বা কি গল্প করব! কাউকে আমি চিনি না। আমার বড় একা লাগে। বারান্দায় দাঁড়িয়ে দেখি সামনে জল আর জল। উঠোন পেরোলেই নদী। বীথিকে বলি, আমি ওই নদীটি দেখতে দেখতে যাবো। নদী? ও দেখার কিছু নেই। ও তো কেবল জল! জলই দেখব। জল দেখে কি করবে, বীথি হাসে। জলের কাছে গেলে আমাকে বলে, নোংরা জল, জলে হাত দিও না, পা ভিজিও না। জলহীন হাঁস আমি, হাওয়ায় সাঁতার কাটি। ডাঙাই আমার ঠিকানা, ডাঙায় আমার বসতবাড়ি, শ্বশুরবাড়ি। হাতের কাছে পায়ের কাছে অগাধ অফুরন্ত জল, যেদিকে চোখ যায় জল, থৈ থৈ জল অথচ বাড়িটিতে জলের অভাব। বাইরে থেকে একটি ছেলে দু তিন বালতি নদীর জল দিয়ে যায় প্রতিদিন, ও দিয়ে রান্না করা, পায়খানা পেচ্ছাব করা, গোসল করা, সবই সারতে হয়। গা লবণ লবণ লাগবে, চুল আঠা আঠা লাগবে, করার কিছু নেই, জলের অভাব, জলের তীরে বাস করে জলের এমন অভাব দেখে বিস্ময়ের ঘোর কাটে না আমার। পান করার জলও আসে বাইরে থেকে। ওরা বলে মিষ্টি জল, যদিও এক ফোঁটা মিঠে নয় স্বাদ, খরচা করতে হবে বুঝে, কেবল যদি তেষ্টায় ছাতি ফাটতে থাকে। মিষ্টি জল এ বন্দরে মেলে না, খুলনা শহর থেকে এখানে নৗকো করে জল আসে, এ দিয়েই তেষ্টা মেটাতে হয় বন্দরের সবার। বীথি বলে খুলনা থেকে পানি তো এই সেদিন থেকে আসে, এর আগে তো খাতি হত বিষ্টির পানি।

বৃষ্টির পানি?

মিঠেখালিতে তো ওই খাই আমরা। বড় বড় কলসি পেতে রাখি উঠোনে, ওতে বিষ্টির পানি জমি থাকে, ওই খাই।

ও পানি খাওয়া যায়?

যাবে না কেন?

বীথি জলপানির প্রসঙ্গ থেকে আলটপকা সরে গিয়ে বলে, আচ্ছা বৌদি তুমি কি গয়নাগাটি কিছু আননি? বাড়ির বউ, লোকে কি বলবে বল! কাল বিকেলে লোকজন আসবে, সীমুর জন্মদিন। আমি কিছু গয়না দিয়ে যাবনি, ও পরে রেখো।

সন্ধে শেষ হয়ে রাত নেমে আসে। বার বার ঘড়ি দেখি,ছটফট করি।

তোমার দাদা এখনো ফিরছে না!

ফিরবেনি, অত ভেবো না। পুরুষমানুষ, বাইরে বন্ধুবান্ধব থাকি, যাতি হয়।

তাই বলে এত রাত করবে?

ফিরবে ফিরবে। বউ আছে ঘরে, যত রাত হোক ফিরবে। বীথি হাসে। হাসিতে মুক্তো ঝরে।

অনেক রাত করে রুদ্র ফেরে। যখন শার্ট প্যান্ট খুলে লুঙ্গি পরে নিচ্ছে, বিছানাটির দিকে আড়চোখে তাকিয়ে আমার বুক কাঁপে, খুব বৈধভাবে এ বিছানায় আমাদের শুতে হবে দুজনকে, শোবার দিন শেষ অবদি এলই আমাদের। একটি রাত কাটানোর জন্য রুদ্র সেই যে কবে থেকে মরিয়া হয়ে উঠেছে, সেই রাত কাটানোর রাত তবে এলই। যেন আমরা দাম্পত্য জীবনে কতকালের অভ্যস্ত মানুষ, চল শুয়ে পড়ি, বলে সে মশারি ফেলে শুয়ে পড়ে।

কই এসো।

আসছি।

আসছি, বুকের কাঁপন খানিক থামুক, আসছি। তৃষ্ণায় ছাতি ফেটে যাচ্ছে, এক গেলাস জল খেয়ে এই আসছি। অস্থির হয়ো না, আমি আসছি। না এসে আমার উপায় কি!

কি ব্যাপার বসে আছো কেন? সারারাত ওখানেই কাটাবে নাকি?

আমাকে যেতে হয় বিছানায়, শরীর যেতে থাকে দেয়ালের দিকে। দেয়াল সাঁটা শরীর টেনে রুদ্র তার বুকের কাছে নিয়ে আসে। দুহাতে জড়িয়ে ধরে, শক্ত করে জড়িয়ে ধরে, যেন ছুটে যেতে না পারি। ছুটে আর কোথায় যাব আমি! আমার তো যাওয়ার আর জায়গা নেই। রুদ্রর কাছে আসব বলেই তো নিজেকে তৈরি করছি। নিজেকে শতবার করে বুঝিয়েছি রুদ্র তোমার স্বামী, স্বামীর সঙ্গে রাত কাটানোর এই সুযোগ তুমি নষ্ট করো না, তুমি বাইশ বছরের তরুণী এখন, ছোট্ট খুকি নও, আর সবাই যদি স্বামীর সঙ্গে শুতে পারে, তুমি পারবে না কেন! নিষিদ্ধ জিনিসটির স্বাদ পেতে আমারও ইচ্ছে করে গোপনে গোপনে। রুদ্র আমাকে সম্পণূর্ করে পেতে চাইছে। আমি প্রাণ মন তাকে কবেই দিয়ে বসে আছি, কেবল শরীর গুটিয়ে থাকে শামুকের মত। সমস্ত লজ্জা আর ভয় ভাঙার সময় কি আমার আসেনি! আজ যদি আমার গুটিয়ে থাকা শরীরকে খুলে না দিই, যদি আজ আমি শেকল ছিঁড়ে শরীরটিকে মুক্ত না করি, আজ যদি আমার ভালবাসার মানুষকে বঞ্চিত করি, এ আমার নিজেকেই বঞ্চিত করা হবে। রুদ্র কোনও অন্যায় দাবি করেনি। স্বামীর কাছে নিজেকে সমর্পণ করা অন্যায় নয়। একদিন না একদিন তো আমাকে দিতেই হবে যেটুকুৃ বাকি আছে দিতে, তবে আজ নয় কেন! রুদ্র আমাকে চুমু খায়। ঠোঁটে গাঢ় করে চুমু খায়। চুমু থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে বলি, বাতি জ্বলছে। এর অর্থ বাতি নেবাতে হবে। বাতি নিবিয়ে ঘর কালো করে তুমি এবার যা ইচ্ছে কর, আমি বারণ করব না। রুদ্র বাতি নিবিয়ে ঘর কালো করে আমার বোজা চোখ, শুকনো ঠোঁট, চিবুকের ভাঁজ ভিজিয়ে দেয়। ব্লাউজের বোতাম খুলে মখু ডুবিয়ে দেয়। স্তনবৃন্ত কেবল ভিজিয়ে দেয় না, দাঁতে কাটে। দুহাতে মুঠো করে ধরে স্তন, এত জোর-চাপ মুঠোয় যেন সে গলিয়ে এদের জল বানাবে, রূপসার ঘোলা জলের মত জল। রুদ্র আমার শাড়ি ওঠাতে থাকে ওপরের দিকে, আমি চাই না তবু আমার হাত আমার অজান্তে চলে যায় সে হাত থামাতে। আমার শরীরের ওপর নিজের শরীর তুলে দেয় রুদ্র। আমি চাই না, তবু আমার হাত চলে যায় তাকে শরীর থেকে নামাতে। এরপর সেই একই পদ্ধতি, দুপায়ে বিযুক্ত করতে থাকে আমার দু পা। চোখ বুজে আছি শক্ত করে। যেন চোখ না খোলে, যেন চোখের সামনে আমি লজ্জায় মরে যেতে হয় এমন কোনও দৃশ্য না দেখি। শক্ত করে দাঁতে দাঁত চেপে থাকি, সজোরে যুক্ত করে রাখি ঠোঁটজোড়া, যেন কোনও শব্দ আমার মুখ ফুটে না বেরোয়। এরপর আচমকা একটি আঘাতে আমি চিৎকার করে উঠি। রুদ্র আমার চিৎকারের মুখে দুহাত চেপে বলে, আরেকটু সহ্য করলেই হয়ে যাবে, এইতো হয়ে এল। লক্ষ্মীটি আরেকটু সহ্য কর। আরেকটু। রুদ্র ক্রমাগত আঘাত করেও নড়াতে পারে না কোনও পাথর। শরীর থেকে নেমে এসে সে তার আঙুল ব্যবহার করে অদৃশ্য পাথরখানি সরাতে। থরথর করে কাপঁ ছে আমার উরু, উরু থেকে কাপঁ ন সঞ্চারিত হয় সারা শরীর। মনে হচ্ছে আমি মারা যাচ্ছি। রুদ্র ঘেমে উঠেছে কিন্তু হাল ছাড়ছে না। পথে কোনও বাধা সে মানবে কেন, যে করেই হোক পথ প্রশস্ত করে তার এগোতে হবে, সামনে সোনার খনি, ওই খনি তার হাতের মুঠোয় চাই। নিজেই নিজের মখু দুহাতে চেপে রেখেছি। হাত ফুঁড়ে যেই না বেরিয়ে চায় কিছু রুদ্র শাড়ির আঁচল গুজে দেয় মুখে, যেন এই রাতের একটি কণাও আমার চিৎকারে না ভেঙে পড়ে। না কিছুই ঘটছে না, আমি কোনও যনণ্ত্রা পাচ্ছি না, এই যে নিম্নাঙ্গ, এ আমার নয়, এ আমার শরীরের কোনও অংশ নয়। অপারেশন থিয়েটারের টেবিলে শুয়ে থাকা এ কোনও অবশ হয়ে থাকা শরীর। ধরা যাক আমাকে পেথিডিন দেওয়া হয়েছে। রক্তে থায়োপেনটাল সোডিয়াম ঢুকিয়ে আমাকে অচেতন করা হয়েছে। শরীরের সমস্ত কষ্ট আমার উবে গেছে। মাথার ওপর সিলিংপাখা বনবন করে ঘুরছে, আমার অচেতন শরীর তবু ঘেমে উঠছে। শাড়ির আঁচল, হাত, ঠোঁট দাঁতের কামড়ে ছিঁড়ে যাচ্ছে। রুদ্র বাধা বিঘ্ন যা কিছু ছিল সব সরিয়ে সোনার খনির দিকে আমার ভেতর বাহির চুরমার করে ঢুকে যায়।

রুদ্র নেমে যায় ওপর থেকে। একদিকে দেয়াল আরেকদিকে রুদ্র, আমার শক্তি নেই কোনও দিকে একবিন্দু নিজেকে সরাই। স্থির হয়ে আছি। ধীরে ধীরে চোখ মেলে দেখছি যেন আমি অপারেশন থিয়েটারের বাইরে, পোস্ট অপারেটিভ রুমে। আমার জ্ঞান ফিরছে। জ্ঞান ফিরলে আমি টের পাই আমি কোনও পোস্ট অপারেটিভ রুমেও নই, আমি রূপসা নদীর ঘোলা জলে শুয়ে আছি। আমার শরীর ভাসছে জলের ওপর। চারদিকে কেউ নেই, একা আমি। এত একা কোনওদিন বোধ করিনি। যেন আমার কেউ নেই, কোনওকালে ছিল না। আমার বাবা নেই, মা নেই। আমার কোনও ভাই বোন নেই। আমার কোনও বন্ধু নেই, কোনও প্রেমিক নেই, কোনও স্বামী নেই। আমার কোনও ঠিকানা নেই কোথাও যাওয়ার। আমি রূপসার জলের ওপর ভেলার মত ভেসে কোথাও যাচ্ছি আমি জানি না। যখন শক্তি জোটে নিজেকে তোলার, তুলে আমি নামতে যাই বিছানা থেকে, পথ জুড়ে পাহাড়ের মত একটি বাধা, সেটি রুদ্র। বলি, যেতে দাও। এই প্রথম আমি রুদ্রকে সম্বোধন করি। রুদ্র পথ ছেড়ে দিলে আমি নেমে পেচ্ছাবখানা খুঁজতে থাকি অন্ধকার হাতড়ে হাতড়ে। নিম্নাঙ্গ ছিঁড়ে যাচ্ছে, হাঁসের মত হাঁটতে থাকি জলহীন ডাঙার অন্ধকারে। পেচ্ছাবখানায় পেচ্ছাব নয়, রক্ত বয়ে যায়, রূপসার জলের দিকে যায়। আর্তনাদের শক্তি আমার নেই। গোঙাতে থাকি অসহ্য যনণ্ত্রায়।
 
পরদিন রুদ্র যখন বেরিয়ে যায় আমাকে ফেলে, আমার আবারও একা লাগতে থাকে। আমি ঠিক বুঝে পাই না কি র্কতব্য আমার। শ্বশুরের পা টেপা, শাশুড়ির উকুন বাছা, তেষ্টা পেলে পানিটা এগিয়া দেওয়া, গোসলের সময় গামছাটা, নামাজের সময় জায়নামাজটা! আমাকে কি ঘোমটা মাথায় রান্নাঘরে ঢুকতে হবে রান্না করতে, যেহেতু এ বাড়ির বউ আমি! আমাকে কি রান্নাঘরের পিড়িতে বসে পেঁয়াজটা রসুনটা অন্তত কেটে দিতে হবে! হাঁসের মত হেঁটে রান্নাঘরে ঢুকি। গোলপাতার ছাউনি দেওয়া রান্নাঘর, মাটির মেঝেয় মাটির চুলো, চুলোর আগুন থেকে ধোঁয়া উঠছে, যেন আলাউদ্দিনের প্রদীপ থেকে ওঠা ধোঁয়া, ইচ্ছে করে এক্ষুনি ধোঁয়া থেকে দৈত্য বেরিয়ে আমাকে বলে দিক, কি করা উচিত আমার, ভাত তরকারি রান্না করব, নাকি রুদ্রর ভাইবোনদের ইশকুলের পড়া দেখিয়ে দেব, বলে দিক বাড়ির মানুষগুলো আমি কি করলে খুশি হবে, বলে দিক কি করলে বলবে বউটি বড় লক্ষ্মী, বড় ভাল। দৈত্যের দেখা পেতে আমি ধোঁয়ার দিকে এগোই। রান্নাঘরে যেই না মাথা গলিয়ে দিই, বীথি বলে, এখানে ঢুকছো কেন? ধোঁয়ায় টিকতে পারবে না।

কি করছ তোমরা দেখি।

দৈত্যের অপেক্ষায় বসে না থেকে বলি, আমি কি কিছু করব!

বীথি হাসে, রুদ্রর আর সব ভাই বোনেরাও হাসে। আমার অস্বস্তি হতে থাকে। আমাকে ঠিক কোথায় দাঁড়াতে হবে, কোথায় বসতে হবে, কার সঙ্গে কথা বলতে হবে, বললে কি কথা বলতে হবে এসব আমি জানি না। আমার একা লাগে। আমি চাই দ্রুত রাত নেমে আসুক, তখন আমি জানি, আমাকে কি করতে হবে, তখন আমাকে শুতে হবে, ঘুমোতে হবে।

রান্নাঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে থাকা আমাকে বীথি বলে, তুমি গোসল করে নাও! পরে পানি ফুরিয়ে যাবে। এখন কি করতে হবে এ ব্যাপারে নিশ্চিন্ত হয়ে গোসলখানায় ঢুকে দেখি দরজা আছে, কিন্তু দরজায় কোনও ছিটকিনি নেই। সংকোচে বেরিয়ে আসি। দেখে বীথি হাসতে হাসতে বলে, নিশ্চিন্ত মনে গোসল করে নাও তো, কেউ ঢুকবে না। আমার গোসল হয়, কিন্তু নিশ্চিন্ত মনে হয় না।

বারবার খসে যেতে থাকা আঁচলটি বারবার মাথায় তুলে দিতে দিতে, আঁচলের কোণ টেনে আঁচলকে মাথা থেকে খসতে না দিয়ে, নিশ্চিন্ত হয়ে, শুয়ে থাকা শাশুড়ির সামনে গিয়ে দাঁড়ালে রুগ্ন কণ্ঠে তাঁর ন ছেলেমেয়ের মধ্যে বাড়িতে উপস্থিত সাতজনের একজনকে, এই তর বৌদিরে বসতে দে বলে আপাতত আমাকে তাঁর চক্ষুর সামনে থেকে সাদরে বিদেয় করে চক্ষু বন্ধ করেন। শাশুড়ির ঘরের পাশে একটি ঘরে আমকে বসতে বলা হয়, বিছানার এক কোণে বসি। বউ কথা বলে না, বউএর দেমাগ বেশি এরকম কথা যেন কেউ না বলে, তাই হাতের কাছে যাকে পাই ছোট ছোট ভাই বোন, নাম জিজ্ঞেস করি, কোন ইশকুলে কোন ক্লাসে পড়ে জিজ্ঞেস করে উত্তর পেয়ে বসে থাকি চুপ হয়ে, আর কোনও প্রশ্ন পাই না করার, ওরাও কোনও প্রশ্ন করে না। ভাইবোনগুলো আশ্চর্যরকম শান্ত, কোনও চিৎকার চেঁচামেচি নেই বাড়িতে। এতগুলো ভাইবোন থাকলে অবকাশ সারাদিন মাছের বাজার হয়ে থাকত। নদী থেকে তপ্ত হাওয়া আসে ঘরগুলোয়। কেমন হু হু করে। আমার একা লাগে। বিকেলে বীথি আমাকে সোনার গয়না দেয় পরতে। সোনার গয়না না পরলে সংসারে মান থাকে না, তাই মান বাঁচাতে বীথির দেওয়া ভারি গয়না পরে বসে থাকতে হয়, নিজেকে কিম্ভুত লাগে দেখতে। আসলে কানে গলায় হাতে এত অলংকার আমাকে মানায় না। আমার সয়ও না এসব। মাত ৃ জুয়েলাসের্ হালখাতার নেমন্তন্ন খেতে গিয়ে কানের লম্বা লম্বা দুল কিনে দিয়েছিলেন বাবা, সবই হারিয়েছে। আমি অনেকক্ষণ পরে রাখতে পারি না কানে কিছু সে সোনা হোক রূপো হোক, কান চুলকোয়। আঙুলে কিছু পরলে আঙুল চুলকোয়, খুলে রাখি এখানে সেখানে, ব্যস অদৃশ্য হতে সময় নেয় না। মা আক্ষেপ করেন, স্বর্ণের গয়নার দিকে ওর একদম নজর নাই। কই যে খুইলা রাখে জানেও না। অতিথিরা চলে গেলে বীথির গয়না খুলে রাখি, নিজেকে এক জড়ববস্তু বলে মনে হয়, যেন পুতুল আমি, আমাকে শাড়ি পরানো হচ্ছে, গয়না পরানো হচ্ছে, আর আমার মুখে কোনও রা নেই, উঠতে বললে উঠছি, বসতে বললে বসছি আর হ্যাঁ শুতে বললেও শুচ্ছি।



এই রাতেও রুদ্র বাড়ি ফিরে আমাকে লক্ষীটি একটু সহজ হও, এত শক্ত করে রেখো না, একটু নরম করো শরীর বলে বলে প্রশস্ত করা পথে প্রবেশ করে। অন্ধকার ঘরটি চোখ বুজে থেকে আরও অন্ধকার করে আমি যখন রুদ্রর দেওয়া যন্ত্রণা শরীর পেতে নিচ্ছি, নিচ্ছি—হঠাৎ সারা শরীরে এক তীব্র ভাল লাগা মাথা থেকে পা অবদি বিদ্যুতের মত ছড়িয়ে যায়। আমি সেই বিদ্যুৎ-চমকে রুদ্রর পিঠ খামচে ধরি দশ নখে। হাপাঁতে থাকি, হাপাঁতে হাপাঁতে বলি, কি হল!

কি হল তার কিছু বলে না রুদ্র। আমার সোনা আমার মানিক আমার লক্ষ্মী বউ বলতে বলতে সে আমার ওপর এলিয়ে পড়ে। রাতে একবার নয়, বহুবার সে আমাকে তীব্র সুখ দেয়। এই সুখে যন্ত্রণার স্নায়ু নিষ্ক্রিয় হতে থাকে। আমি সুখে, শীর্ষসুখে কাতরাতে থাকি। কাতরানো আমি একসময় লক্ষ করি রুদ্র আমার পাশে নেই। অনেকক্ষণ সে আমার পাশে নেই।

কোথায় তুমি!

অন্ধকারে লাল একটুকরো আগুন জ্বলছে। আগুনটি নড়ছে।

শোবে না?

আসছি।

লাল আগুন নিবে যায়, সিগারেট শেষ হয়ে যায় খাওয়া, রুদ্র তবু শুতে আসে না। আমার আবেশে অবশ তনু চাইছে তাকে নিবিড় করে কাছে, একটি হাত ফেলে রাখি তার বালিশে, এলে তাকে জড়িয়ে ধরে ঘুমোবো বাকি রাত, তার শরীরের ঘ্রাণ নিতে নিতে ঘুমোবো। আবারও ডাকি, কই গেলে!

ডেটলের গন্ধ ঘরে।

কি ব্যাপার ডেটলের গন্ধ কেন!

ডেটল লাগাচ্ছি আমি। অন্ধকার থেকে রুদ্রর কন্ঠ।

কেন, কি হয়েছে?

শরীরে চুলকোনি হয়েছে।

তা হলে বুঝি ডেটল লাগাতে হয়!

মলমও দিচ্ছি।

কি মলম?

জানি না।

আলোটা জ্বালো তো, দেখি কোথাও চুলকোচ্ছে, কি মলম লাগাচ্ছে! দেখি। রুদ্র আলো জ্বেলে আসছি বলে মলম নিয়ে চলে গেল পেচ্ছাবখানায়। আলোর নিচে আলথুালু শাড়ি গুছিয়ে বসে থাকি অপেক্ষায়। রুদ্র এলে হাত পা দেখি, ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখি, কোনও স্ক্যাবিসের চিহ্ন নেই।

কোথায় চুলকোচ্ছে?

রুদ্র কথা না বলে আলো নিবিয়ে শুয়ে পড়ে। পাশে শুয়ে, তার বুকের ওপর একটি হাত রেখে বলি, স্ক্যাবিস তো দেখছি না।

আছে।

কোথায়?

হয়েছে ওই জায়গায়।

ওই জায়গা কোন জায়গা?

পেনিসে হয়েছে।

কোথায়?

পেনিসে।

ডেটল দিচ্ছ কেন?

ডেটল দেওয়া ভাল তো।

কোনও ডাক্তার বলেছে দিতে?

না।

মলম দিয়েছে কে? কোনও ডাক্তার?

না। নিজে কিনেছি।

এই মলম কি কাজে দেবে?

জানি না।

তাহলে দিচ্ছ কেন! পারমেথ্রিন মলম লাগাতে হয় স্ক্যাবিস হলে। খুব চুলকোয় কি?

হ্যাঁ চুলকোয়। আবার গোটা হয়েছে।

ছোট?

অত ছোট না।

বড় হওয়ার তো কথা নয়। বড় হবে কেন?

বড়ই।

ডাক্তারি উৎসাহে উঠে বসে, আলো জ্বেলে, বলি, দেখি তো কিরকম!

রুদ্র নিচের দিকে নামাতে থাকে লুঙ্গি। লোমশ শরীর আরও লোমশ হয়ে আসছে নিচে, লোমশ হতে হতে একটি শীতল পুরুষাঙ্গ। পুরুষাঙ্গের গোড়ায় একটি লাল ফুল। এই বাসরশয্যায় আমার প্রথম রাত্রিযাপনে কেউ কোনও ফুল বিছিয়ে দেয়নি। না গোলাপ,না গাঁদা, না জবা, না জুঁই। রুদ্রর পুরুষাঙ্গের ফুলটিই আমাকে ফুলশয্যা দেয়। কিন্তু এরকম পুরুষাঙ্গ আমি অনেক দেখেছি। পুরুষাঙ্গের এই ঘা খুব চেনা ঘা। হাসপাতালে, যৌনরোগ-বহির্বিভাগে পুরুষ-রোগীরা লুঙ্গি নিচের দিকে নামিয়ে ঠিক এমন ঘা ই দেখায়, যে ঘাগুলোকে যৌনরোগের ডাক্তার সিফিলিসের ঘা বলে চিহ্নিত করেন, যে ঘাগুলো নিরাপদ দূরত্ব থেকে অনেক দেখেছি। রুদ্রর ঘা যদিও সিফিলিসের ঘা এর মত দেখতে, কিন্তু একটি ঘা অন্য একটি ঘা এর মত দেখতে তো হতে পারে! নিশ্চয়ই অনেক নিরীহ ঘা আছে, দেখতে অন্য কুৎসিত ঘা এর মত। নিশ্চয়ই আছে, মন বলে, আছে।

কবে হয়েছে এটি?

এই তো দশ বারোদিন আগে।

রক্ত বেরোয়?

না।

রুদ্রর আর যে রোগই হোক, সিফিলিস হওয়ার কোনও কারণ নেই। আমি অন্য অন্য রোগের কথা ভাবতে থাকি। এ কি একজিমা নাকি সোরিওসিস! নাকি পিনাইল প্যাপিউলস! নাকি রেইটারস সিনড্রাম! নাকি পেমফিগাস!

পেইন আছে?

রুদ্র মাথা নাড়ে। নেই।

এই নেইটিই অন্য সব সম্ভাবনাকে নষ্ট করে দেয়। সিফিলিসের ঘাএ কোনও ব্যথা থাকে না।

পেইন কি একটওু নেই?

ভাবছে রুদ্র। ভাবো রুদ্র, আরও ভাবো, আরও একটু ভাবলে তুমি নিশ্চয়ই মনে করতে পারবে যে তোমার ব্যথা আছে।

রুদ্র মাথা নাড়ে আবারও। নেই।

আচ্ছা তুমি কি কোনও অচেনা লোকের কোনও নোংরা বিছানায় শুয়েছো? তোয়ালে ব্যবহার করেছো কারও!

মাথা নাড়ে এবারও। না।

রাজিয়া বেগম নামের এক লেখিকা চা বাগানের শ্রমিকদের নিয়ে একটি উপন্যাস লেখার জন্য সিলেটের চা বাগানে তিন মাস ছিলেন। এরকম কি হতে পারে রুদ্র কোনও কবিতা লিখতে, বা কোনও গল্প, কোনও গল্পের প্রয়োজনে কোনও গণিকালয়ে গেছে, সেখানে কিছু ব্যবহার করেছে, তোয়ালে বা কিছু। পেচ্ছাবখানায় কিছু ছুঁয়েছে, ওসব জায়গা থেকে হাতে এসে লেগেছে সিফিলিসের জীবাণু ট্রিপোনেমা পেলিডাম। যদিও জানি ওভাবে সিফিলিস ছড়ায় না, তবু জিজ্ঞেস করি, যদি ছড়ায়! যদি কোনও না কোনও ভাবে কোনও ফাঁক ফোকড় দিয়ে প্রবেশ করে!

তুমি কি কোনও কারণে প্রস্টিটিউশানে গিয়েছো। ধর লেখালেখির কারণে বা কিছু?

কেন, না তো!

কক্ষনো যাওনি?

নাহ।

আমি খুঁজছি আরও আরও কারণ, এরকম দেখতে ঘা এর অন্য কারণ। খুঁজছি। খুঁজছি। রুদ্রর তো এই প্রথম কারও সঙ্গে শরীরের সম্পর্ক, আমার যেমন। এমনই তো হওয়ার কথা। ভালবাসার নিয়মই তো এমন। যাকে ভালবাসি, তার জন্য শরীর খানা তোলা থাকে। শরীরের গোপন গভীর সখু গুলো তোলা থাকে। রুদ্রর ঘা-টির দিকে তাকিয়ে থাকি। তবে কেন এই ঘা? এই ঘা তো আর কোনও ঘা এর মত লাগছে না! হারপেস সিম−প্লক্স, বা জেনিটাল ওয়ার্টস যদি হয়, সেও তো সেক্সুয়ালি ট্রান্সমিটেড ডিজিজ! ধরা যাক এটি সিফিলিস, কিন্তু সিফিলিস রুদ্রর শরীরে কোন পথে ঢুকবে! সে যদি কোনওদিন কোনও গণিকালয়ে না যায়! গভীর ভাবনায় মগ্ন আমি। ঘা-টিকে ছুঁয়ে দেখি, ডান থেকে দেখি, বাঁ থেকে দেখি। ঘা এর আকার আকৃতি দেখি। রং দেখি।

একেবারে সিফিলিসের ঘা এর মত দেখতে। চোখ বলে, মন বলতে চায় না। কিন্তু সিফিলিস হওয়ার তো কোনও কারণ নেই। তবে কি হতে পারে এটি! দু ভুরুর মাঝখানে ভাঁজ পড়ে আমার।

আচ্ছা, তোমার কি কোথাও কোনও মেয়ের সঙ্গে কোনও রকম সম্পর্কে হয়েছে।

আবোল তাবোল কি বলছ তুমি!

রুদ্র লুঙ্গি ওপরে তুলে নেয়। ঘা ঢেকে যায়।

শুয়ে পড় তো। অনেক রাত হয়েছে।

রাত হোক, আমার নিদ্রা উবে গেছে। এই ঘাটির কারণ জানার জন্য আমি উদগ্রীব। কোনও রকম মেলামেশা ছাড়া এমন একটি ঘা কেন হতে যাবে!

তোমার বাবাকে দেখিয়েছো?

না।

দু সপ্তাহ ধরে এটি, কোনও ডাক্তারের কাছে গেলে না কেন?

যাইনি।

পরীক্ষা না করে মলম লাগালে ঘা তো যাবে না।

রুদ্র তার দাড়ি চুলকোতে থাকে। কিছু নিয়ে খুব ভাবলে সে এই করে।

আমি হঠাৎ বলি, জানো, প্রস্টিটিউটদের সঙ্গে রিলেশান হলে এরকম ঘা হয়। তুমি নিশ্চয়ই কোনও প্রস্টিটিউটের কাছে যাওনি! প্রশ্ন করি।

না। রুদ্রর বরফ-কন্ঠ।

সত্যিই তো তুমি যাওনি? এই প্রথম তো আমার সঙ্গে তোমার সম্পর্ক, তাই না!

রুদ্রর মখু টি হঠাৎ বদলে যায়। কালো ভুরু দুটো জড়ো হতে থাকে। যেন তার যন্ত্রণা হচ্ছে শরীরে কোথাও। অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকে আমার চোখে। চেষ্টা করেও আমি পড়তে পারি না তার চোখের ভাষা।

অনেকক্ষণ নীরব বসে থাকি দুজন। হঠাৎ রুদ্র বলে, আসলে কি জানো, আমি পাড়ায় গিয়েছি।

পাড়া মানে?

বেশ্যাপাড়া।

গিয়েছো? কেন?

যে কারণে লোকেরা যায়।

কি কারণে?

রুদ্র কথা বলে না। আমার মাথাটি কি ঝিমঝিম করছে? বুকের মধ্যে কি হুড়মুড় করে একটি শ্বাসকষ্ট ঢুকে গেল? শব্দগুলো আগের চেয়ে ধীরে উচ্চাজ্ঞরত। স্বরটি ভাঙছে, কাপঁছে।

কোনও প্রস্টিটিউটের সঙ্গে শুয়েছো?

কথা বলছে না। তার চোখদুটো পাথর হয়ে আছে।

বল, বলছো না কেন, বল।

আমার দুচোখে আকুলতা, বল না, তুমি না বল রুদ্র। না বল। একটি না শব্দের আশায় আমি মোহগ্রস্তের মত বসে থাকি।

হ্যাঁ। রুদ্র বলে।

কি, সেক্সুয়াল রিলেশান হয়েছে?

নিজের স্বরকে আমি চিনতে পারি না, যেন এ আমার কণ্ঠস্বর নয়, অন্য কারও। যেন একটি যন্ত্রে বোতাম টিপে দেওয়া হয়েছে, যন্ত্রটি কথা বলছে।

হ্যাঁ।

আলো জ্বলছে ঘরে, অথচ অন্ধকার ঘনিয়ে আসছে আমার চোখের সামনে। আমি নিঃশ্বাস নিতে পারছি না। অনেকক্ষণ আমি কোনও নিঃশ্বাস নিতে পারি না। আমার সামনে এ কি কোনও যৌনরোগী, নাকি এ রুদ্র! আমার প্রেমিক, আমার স্বামী! আমার বিশ্বাস হয় না এ রুদ্র, বিশ্বাস হয় নার এর সঙ্গে আমার বছর বছর ধরে প্রেম।

গিয়েছো কবে?

এই তো দু সপ্তাহ আগে।

একবারই গিয়েছো?

হ্যাঁ।

আর কোনওদিন যাওনি?

না।

তোমার ঘা তো দু সপ্তাহ থেকে!

হ্যাঁ।

যেদিন সম্পর্কে হয়েছে, সেদিনই তো ঘা হয় না। হতে কিছু সময় নেয়। মনে করে দেখো একবারের বেশি আরও গিয়েছো কি না।

রুদ্র আমার চোখের দিকে অনেকক্ষণ অপলক তাকিয়ে থেকে ধীরে বলে, আরও গিয়েছি।

নিজের কানকে বিশ্বাস হয় না। আমার বিশ্বাস হতে চায় না যে আমি রুদ্রর জীবনে প্রথম মেয়ে নই! অনেকক্ষণ ওভাবেই নিস্পন্দ বসে থাকি।

আমাকে তো কখনও বলনি এসব?

বলিনি।

কেন বলনি?

রুদ্র দীর্ঘশ্বাস ফেলে। শাদা দেয়ালের দিকে তাকিয়ে জানি না কি দেখে সে, কোনও উত্তর দেয় না।

বেশ্যপাড়া, তাই না? কোথায় সেটা?

বানিশান্তায়।

বানিশান্তা কোথায়?

এই বন্দরেই।

কেন যাও? তুমি না আমাকে ভালবাস?

ভাল তো বাসিই।

ভালবাসলে অন্য কাউকে ছুঁয়েছো কি করে? আমাকে এতদিন তুমি মিথ্যে কথা বলেছ, বলেছ তুমি আমাকে ছাড়া আর কাউকে স্পর্শ করনি কোনওদিন। জানো, আমার বিশ্বাস হচ্ছে না এসব কিছু।



আমার বিশ্বাস করতে কষ্ট হয় রুদ্র অন্য কোনও মেয়ের সঙ্গে শুয়েছে, যেভাবে আমার সঙ্গে সে শুয়েছে। যেভাবে আমার মুখে বুকে চুমু খেয়েছে সেভাবে আর কাউকে খেয়েছে। বিশ্বাস করতে কষ্ট হয় রুদ্র আর কারও গভীরে প্রবেশ করেছে এমন। মনে হতে থাকে মাঝসমুদ্রে আমার তরীটি ডুবে গেছে। আমি ডুবে যাচ্ছি, যতদূর চোখ যায়, কেউ নেই, কিছু নেই। আমি একা, আমি ডুবছি। আমার আকাশ ভেঙে পড়েছে, আমার জগতটি খণ্ড খণ্ড হয়ে ছিটকে পড়েছে, ছিটকে পড়া টুকরোগুলো গড়াতে গড়াতে সমুদ্রে তলিয়ে যাচ্ছে। কূলকিনারাহীন উত্তাল সমুদ্রে খড়কুটো নেই, আমি ডুবছি। আমি যেন আমি নই, অন্য কেউ। সেই অন্য কেউএর জন্য আমার কষ্ট হতে থাকে। কষ্টটি আমার স্নায়ুতন্ত্রে্র পাক খেয়ে খেয়ে নামতে থাকে বুকে। বুকের মধ্যে পৃথিবীর সমস্ত পাথর এসে যেন চাপ দিচ্ছে। কোনও শব্দ উচ্চারণ করার সামথর্ আমার নেই। আমি বোধবুদ্ধি হারিয়ে হু হু করে কাঁদি, সারারাত কাঁদি। চোখের জলে ভিজে যেতে থাকে আমার বালিশ, শাড়ি, বিছানার চাদর। রুদ্রর হাত ধরে পা ধরে আমি কাঁদি, বল বল যে তুমি মিথ্যে কথা বলেছো। বল যে তুমি কারও কাছে যাওনি। কারও সঙ্গে শোওনি। বল বল।

পাথরের মত স্তব্ধতা রুদ্রর। ফ্যাকাসে মুখে সে আমার কান্না দেখে সারারাত।

কান্না দেখে সে সকাল, দুপুর, বিকেল। না খাওয়া না নাওয়া আমার কান্না দেখে সে সারাদিন। নিজে সে নায়, খায়। নিজে সে আর দিনের মত যাপন করে দিন। ঘুমোতে চাই, সব ভুলে ঘুমোতে চাই। কিন্তু ঘুম তো আসছে না। ঘুমের ওষধু চাইলে তার বাবার ডাক্তারখানা থেকে রুদ্র দু পাতা সিডাক্সিন এনে দেয়। খুঁজে দু পাতা পেয়েছে, দু পাতাই দিয়েছে। দু পাতার কুড়িটি বড়ি থেকে একটি বড়ি শুধু তুলে নেব। একটি বড়ি শুধু খাব, এরপর মোট কুড়িদিন যেন বড়ি খেয়ে ঘুমোতে পারি। কিন্তু বড়ি যখন রুদ্রর আড়ালে আমি কুড়িটিই একবারে খেয়ে নিই, সেদিনই, সেই বিকেলে, আমি দূরে চলে যাবো তবু আমারে দেব না ভুলিতের কোনও সুর আমার ভেতর ছিল না, চাচ্ছিল!ম দূরে চলে যেতে, আমাকে রুদ্র ভুলে যাক, কখনও আর মনে না করুক আমি নামে কেউ ছিল তার জীবনে। নিজের এই অস্তিত্বকে আমার আর মোটেও মনে হচ্ছিল না আমি বহন করতে পারব, মনে হচ্ছিল না যে আমার জীবনের কোনও মূল্য আর আছে। মনে হচ্ছিল না তীব্র এই কষ্টগুলো নিয়ে তীব্র এই অপমানগুলো নিয়ে আমি আর একটি মুহূতর্ও বাচঁ তে পারব বেশি। কাঙিক্ষত মৃত্যুর দিকে আমি যখন দৌড়ে যাচ্ছি, আমাকে পেছন থেকে খামচে থামাল কেউ। যখন ফিরিয়ে আনা হল ওই পথ থেকে দেখি শক্ত নল আমার নাকে, পাশে দাঁড়িয়ে আছেন রুদ্রর ডাক্তার বাবা। বিষ বের হল শরীর থেকে, কিন্তু মন থেকে একফোঁটা বিষ বের হয়নি, মন মরতে থাকে। আমার চোখের সামনে মৃত্যুযনণ্ত্রায় কাতরাতে থাকে মন। সারারাত মৃত মনকে পাশে নিয়ে নির্ঘুম কাটাই।

ভোরের আলো ফুটলে বলি, আমি এক্ষুনি যাব।

রুদ্র তৈরি হয়। একবারও বলে না, আরও দুদিন থাকো বা কিছু। বাড়ির সবাই অবাক,কী ব্যাপার, হঠাৎ চলে যাচ্ছ যে।

রুদ্র ওদের বলে, ওর যেতে হবে। কেন যেতে হবে, তা কিছু বলে না। নাস্তা খেতে বলে ওরা, আমি না বলি।

লঞ্চের ভেতরে পেচ্ছাবের ঝাঁজালো আর মাছের আঁশটে গন্ধে বারান্দায় দাঁড়িয়ে ক্রমাগত ভোঁ শব্দের মধ্যে দাঁড়িয়ে আমার গা গুলোয়, সারারাত জেগে থেকে কেঁদে ভোরের হাওয়া নিতে গিয়ে বমি করে ভাসাই লঞ্চের বারান্দা। রুদ্র লোকের ভিড়ে বসে পেছনে ঘাড় ফেলে ঘুমোচ্ছে, হাঁ হয়ে আছে মখু । এই লোকটিকে আমার চেনা কেউ বলে মনে হয় না। মনে হয় না এই মানুষটি আমার কেউ হয়।

লম্বা লঞ্চ যাত্রা, ততোধিক লম্বা রেল যাত্রা নিঃশব্দে ফুরোয়। রেল যাত্রা ফুরোলো নিঃশব্দে। সব জেনেও মৃত মনকে বারবার বলেছি, ও আসলে অন্য রোগ। অন্য ঘা।

যৌনাঙ্গে তো কত রকম ঘা হতে পারে। আমি কি আর সব জানি, এখনও ডাক্তার হওয়ার ঢের বাকি আমার। পরীক্ষা করে একবার দেখি না কেন ঘা- টি! হয়ত এমনও হতে পারে, এটি নতুন একরকম ভাইরাস রোগ। এমনও হতে পারে, রুদ্র আমার সঙ্গে মজা করছে বলে যে সে বেশ্যালয়ে গেছে, একাধিকবার গেছে। সে নিশ্চয় আমাকে একদিন চমকে দেবে বলে, যে সব মিথ্যে ছিল, যা সে বলেছে। আমাকে পরীক্ষা করেছে সে, কতটুকু তাকে বিশ্বাস করি, তার পরীক্ষা। রাত কাটিয়েছে, যেরকম রাত আমার সঙ্গে কাটাতে সে বার বার চেয়েছে।

ঢাকায় নেমে দেখি ঢাকা মখু থুবড়ে পড়ে আছে অন্ধকারের পায়ে। শহরটি এত প্রিয় আমার, এত প্রাণবন্ত শহরটিকে মনে হয় নিস্তেজ। রাতে মুহম্মদপুরে রুদ্রর ভাড়া বাড়িটিতে যাই।একটি পড়ো পড়ো তিনতলা বাড়ি, বাড়িটির দোতলায় রুদ্রর দুটো ঘর, একটি ঝুল বারান্দা, ঘরের বাইরে ছোট্ট একটি রান্নাঘর, আর করিডোর পেরিয়ে একটি মলমূুত্রগোসলের জায়গা, সেটি বাড়িঅলাও ব্যবহার করে, রুদ্রও। খুব বেশিদিন হয়নি সে এটি ভাড়া নিয়েছে। দুটো ঘরের একটি শোবার, একটি পড়ার। পড়ার ঘরে টেবিল চেয়ার আর বই রাখার একটি তাক, বইয়ে উপচে পড়ছে তাকটি। জায়গা নেই বলে বই মেঝেয়, ছড়িয়ে নয়, গোছানো। শোবার ঘরের বিছানাটিও গোছানো। রুদ্র খুব গোছানো মানুষ। বিছানা টেবিল আমার এরকম গোছানো হয় না। তাই নিজের জীবনটিকে বড় এলোমেলো বলি। রুদ্রও নিজেকে বলে এলোমেলো, গুছিয়েই যদি সে রাখে তবে কেন এলোমেলো? তবে কি তার নিয়নণ্ত্র হীন জীবনটিকে বোঝাতে সে এলোমেলো শব্দটি ব্যবহার করে! দুই জীবনে একটি শব্দের অ−র্থর কী ভীষণ পার্থক্য! আমাকে ঘরে রেখে রুদ্র বেরিয়ে যায় দুজনের জন্য খাবার কিনে নিয়ে আসতে। আমি মেঝেয় শুয়ে তাকের কিছু বই উল্টো দেখি। মোটা মোটা দুটো কবিতার খাতা তাকটির নিচে সাজানো। পাতা উল্টো যাই, এত কবিতা সে জীবনে লিখেছে! সবই গভীর প্রেমের কবিতা। কাউকে খুব সাংঘাতিক ভাবে ভালবাসতো রুদ্র। কে সে যাকে বলছে আমার গান আমার সকল কবিতা তোমার জন্যই লেখা। রুদ্র খাবার নিয়ে ফিরে এলে জিজ্ঞেস করি, কে এই রমণী যাকে জীবন উৎসর্গ করেছো?

করেছিলাম।

কে সে?

খুব কি জানার দরকার?

বলই না শুনি।

নেলি।

লালবাগে বসে কবিতাগুলো লেখা।

লালবাগে মামার বাড়ি। ওখানে ছিলাম। নেলি হচ্ছে আমার মামির বোন। ও বাড়িতেই থাকত।

মামির বোন হলে তো তোমার খালা হয়।

হ্যাঁ খালা হয়।

খালার সঙ্গে প্রেম করতে?

রুদ্র মাথা নাড়ে, করত। বয়সে যে তার চেয়ে অনেক বড় তার খালা সে কথাও বলে।

কেবল কি প্রেমই করতে? নাকি আরও কিছু?

আরও কিছু।

মানে শুয়েছো তোমার খালার সঙ্গে?

হ্যাঁ।

ও বাড়িতে যখন ছিলে, তখন তো ইশকুলে পড়তে। ওই ইশকুলে পড়ার সময়ই শুয়েছো?

হ্যাঁ, রুদ্র সেই ইশকুলে পড়ার সময়ই জীবনের সব সেরে নিয়েছে। ছোটবেলাতেই সঙ্গম শিখেছে।

উপদ্রুত উপকূলে পেছনে হলুদ বাড়ি পঞ্চাশ লালবাগ, নিবেদিত বকুল বেদনা নামের ওসব তাহলে নেলিকে নিয়ে লেখা?

হ্যাঁ।

আমি হেসে বলি, জানো, ওই বইয়ের কবিতাগুলো পড়ে আমি তোমার প্রেমে পড়েছিলাম, ভাবলে এখন হাসি পায়।

তা তোমার প্রেমিকা নেলি এখন কোথায়?

এক মাস্টারের সঙ্গে বিয়ে হয়েছিল। তালাক হয়ে গেছে। এখন লালবাগে আছে।

যাও না ওর কাছে? গিয়ে রাত কাটাও না ওর সঙ্গে? তোমার খালার সঙ্গে?

বাজে কথা বোলো না।

বাজে কথা বুঝি?

বাজে কথাই তো।

রুদ্রর চোখের ভেতর লাল রক্তের রেখা, সবুজাভ দাগ, চোখে এসব কি জিজ্ঞেস করাতে রুদ্র একবার বলেছিল, শ্যাওলা জমেছে। শ্যাওলা জমা চোখ রুদ্র আমার চোখে ফেলে রেখে অনেকক্ষণ, বলে,ও প্রস্তাব দিয়েছিল, রাজি হইনি।

কেন? তোমার তো কারও সঙ্গে এই সম্পর্কে যেতে কোনও বাধা নেই! রাজি হবে না কেন?

ওর সঙ্গে তো হৃদয়ের কোনও সম্পর্কে নেই, সম্পর্কে তোমার সঙ্গে।

বাহ, বেশ ভাল নীতি তোমার। যার সঙ্গে হৃদয়ের সম্পর্ক মানে যাকে ভালবাসো তার সঙ্গেই শোও শুধু হাসতে হাসতে বলি, তাহলে বেশ্যাদের কি কর? ভালবেসে ওদের সঙ্গে শুতে যাও?

রুদ্র কোনও উত্তর না দিয়ে উঠে যায়। দুটো কাপে পানি নিয়ে আসে। চল খেয়ে নি। খাবার ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছে। তাড়া দেয়।

তোমার খালাকে বিয়ে করলে না কেন? অবশ্য এখনো করতে পারো। শান্ত স্বর আমার।

অতীতের কথা টানছো কেন?

অতীত! কেবল তোমার অতীতেই ওসব ছিল। বর্তমানে তুমি শুদ্ধতম মানুষ, তাই না?

কোনও উত্তর দেয় না রুদ্র। খেতে খেতে আমি তাকে দেখি। এত চেনা তার খাওয়ার, তার হাত ধোওয়ার, মখু মোছার, এত চেনা তার সিগারেটে আগুন ধরাবার, সিগারেট ফোঁকার ভঙ্গি!

রুদ্র প্রসঙ্গ পাল্টায় কবিতা পড়ে। চৌদ্দই ফেব্রুয়ারিতে সরকারি আদেশে পুলিশ ট্রাক চালিয়ে দিয়েছিল ছাত্র মিছিলে। ট্রাকের তলায় পিষ্ট হয়েছে অগুনতি মানুষ। স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ বাড়ছে, আর সরকারি আদেশে গুলি চালাচ্ছে পুলিশ নিরীহ মানুষের বুক লক্ষ করে।

আমি তোমাকে আর ঘণৃা করতে চাই না,
আমি থুতু দিতে চাই জলপাই বাহিনীর মুখেযা
রা শিশু একাডেমি, নীলক্ষেত রক্তে ভিজিয়েছে,
যারা বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠিয়েছে গুলিবিদ্ধ লাশ,
বুটের তলায় পিষে যারা খুন করেছে মানুষ,
আজ সেই জলপাই বাহিনীর রক্ত নিতে চাই। ..
রুদ্র একটির পর একটি কবিতা পড়ছে। ভারি কণ্ঠে, স্পষ্ট উচ্চারণে।
একদা অরণ্যে যেভাবে অতিকায় বন্যপ্রাণী হত্যা করে
আমরা অরণ্য জীবনে শান্তি ফিরিয়ে এনেছি,
আজ এইসব অতিকায় কদাকার বন্যমানুষগুলো নির্মূল করে
আমরা আবার সমতার পৃথিবী বানাবো,
সম্পদ আর আনন্দের পৃথিবী বানাবো। শ্রম আর প্রশান্তির পৃথিবী বানাবো।

মেঝেয় আধশোয়া হয়ে কবিতা শুনতে শুনতে আমি ভুলে যেতে থাকি মোংলা বন্দরে ঘটে যাওয়া কোনও ঘটনা। যেন চট্টগ্রাম থেকে সরাসরি আমি ঢাকায় এসেছি, রুদ্রকে সেই আগের মত আমি ভালবাসি, তার জীবনের কুৎসিত নোংরা চেহারাটি আমার দেখা হয়নি। আমি মগ্ধু তাকিয়ে থাকি, বিলীন হতে থাকি তার বলিষ্ঠ কণ্ঠে, সচেতন শব্দাবলীতে, মনে হতে থাকে রুদ্র আমার কেবলই এক বন্ধু আমার প্রেমিক নয়, স্বামী নয়। কবিতার খাতাটি পাশে রেখে রুদ্র জানালায় স্থির তাকিয়ে বলে আমার একটা খুব স্বপ্নের কথা তোমাকে বলি। আমি মিছিলে মরতে চাই গুলি খেয়ে। চোখদুটোয় দু ফোঁটা স্বপ্ন, চোখদুটো তার রাতের আকাশের দুটো তারা। মৃত্যু নিয়ে কাউকে এমন স্বপ্ন দেখতে দেখিনি আগে। মিছিলে মরতে রুদ্র কেন চায়! তাকে নিয়ে যেন মিছিল হয়, আন্দোলন জমে ওঠে, যেন সে অমর হয়ে থাকে! মৃত্যু ভাবনাটি আমাকে স্পর্শ করতে থাকে, সেই স্পর্শ সরিয়ে রুদ্র আমাকে চুমু খায়। চুমু খেতে খেতে আমার শরীর সে একটু একটু করে অবশ করতে থাকে। অবশ হতে থাকি, ভুলে যেতে থাকি আমি কে আমি কোত্থেকে, আমার সঙ্গে রুদ্রর সম্পর্ক, যেন আমি নই, এ অন্য কেউ, রুদ্রর প্রেমিকা, যে প্রেমিকাকে নিয়ে সে অনেক কবিতা লিখেছে। সেই প্রেমিকাকে সে আদর করছে, প্রেমিকা শরীর ভরে রুদ্রর আদর নিচ্ছে। রুদ্র তার বুকের কাপড় খুলে নিচ্ছে। সমস্ত শরীর দিয়ে ভালবাসছে তার সমস্ত শরীর। তার প্রতি অঙ্গ লাগি কাঁদছে তার প্রতি অঙ্গ। এক শরীর হারিয়ে যাচ্ছে আরেক শরীরে। সুখে, তীব্র সুখে প্রেমিকা জড়িয়ে ধরছে প্রেমিকের শরীর। যখন সব থেমে যায়, যখন চেতন ফেরে, প্রেমিকা হাঁসের মত হেঁটে যৌনাঙ্গে যন্ত্রণা নিয়ে পেচ্ছাব করতে যায়। ফোঁটা ফোঁটা রক্ত ঝরতে থাকে পথে, ফোঁটা ফোঁটা রক্ত পেচ্ছাবখানায়। তখন সে আর প্রেমিকা নয় রুদ্রর। তখন সে আমি, রুদ্রর বউ আমি। এ কি হল! এমন তো হওয়ার কথা ছিল না। কি করে আমি রুদ্রর সঙ্গে মিলিত হয়েছি আবার, আবার কেন আমি তাকে আমার শরীর স্পর্শ করতে দিয়েছি? সে তো এই দাবি রাখে না। তার সঙ্গে ওই রাতের পরই কি আমার সম্পর্কে শেষ হয়নি? শেষ হয়েছে নিশ্চয়ই। তবে জেনেও কেন আমি একটি অসখু তার শরীর থেকে আবার নিয়েছি। কেন এই ভুল। কেন আবার পাপের সঙ্গে নিজেকে জড়ানো! কেন আবার রোগের জীবাণু নিজের শরীরে নিয়ে নিজেকে অসুস্থ করা! ছি ছি! নিজেকে আমি কি একটওু ভালবাসি না। সাধ করে কেউ অসুস্থ হতে চায়! একটি নোংরা রোগ নিতে চায় নিজের রক্তে! নাকি ওই যৌনসুখ এমনই সুখ যে আমি এর গায়ে লেগে থাকা সংক্রামক অসখু টির কথা ভুলে যাচ্ছি! জানি না। আমি কিছুই জানি না! নিজের ওপর রাগ হয়, ঘণৃা হয়। আবার এও মনে হয়, রোগের জীবাণু তো ঢুকেই গেছে আমার রক্তে!শুদ্ধতা তো গেছেই শরীর থেকে, তাহলে আর কিসের প্রতিরোধ! যে জীবাণু আমার রক্তে নেচে বেড়াচ্ছে সেই প্রথম মিলনের রাত থেকে সেই জীবাণু দ্বিতীয় বার গ্রহণ করতে আর ক্ষতি কি! রুদ্র আমাকে তো নষ্ট করেছে, আমার আর নতুন করে নষ্ট হতে বাধা কোথায়! নিজেকে একটি নষ্ট পচা কীটের মত মনে হয়, নর্দমাতেও আমার স্থান হওয়া উচিত নয়। আমি আর আগের আমি নই। আগের আমার মৃত্যু হয়েছে। এ আমি নতুন আমি। এ আমি নষ্ট আমি। এ আমি রুদ্রর মতই পথভ্রষ্ট, রুদ্রর মতই নিয়নণ্ত্র হীন। বোধহীন। নিজের লাগাম খসে গেছে নিজেরই হাত থেকে। এখন আমাকে নিয়ে যে কেউ যা খুশি করতে পারে। নিজেকে বেশ্যার মত মনে হয়। বেশ্যার রোগ শরীরে। আমি বেশ্যাই তো। আর কি! সারা রাত দীর্ঘশ্বাসের এপাশ ফিরি, দীর্ঘশ্বাসের ওপাশ ফিরি। পরদিন ময়মনসিংহে যাওয়ার জন্য বেরোই ছোট্ট গুমোট ঘরটি থেকে, ভোরের শীতল স্নিগ্ধ হাওয়া আমার শরীরের ক্লান্তি তুলে নেয় এক নিমেষেই। রুদ্র পেছনে দৌড়ে আসে, সেও যাবে আমার সঙ্গে ময়মনসিংহে।

তুমি কেন যাবে? পথে যদি বিপদ হয় রক্ষা করতে? কারণ তুমি আমার খুব মঙ্গল কামনা করো, তাই না? আমার শরীরে যেন কারও আঘাত না লাগে, আমার দিকে চোখ তুলে যেন কোনও পুরুষ না চায়, সে কারণে, তাই তো!

রুদ্র কথা বলে না।

ঠিক আছে চল। আমার জন্য নয়। তোমার জন্য চল ময়মনসিংহে। ওখানে তোমার চিকিৎসার ব্যবস্থা করে দেব।

মহাখালির বাসস্ট্যান্ড থেকে বাস দুঘন্টা সময় নেয় ময়মনসিংহে পৌঁছতে। বাসের পুরো পথ দীর্ঘশ্বাসের শব্দ ছাড়া আর কোনও শব্দ শুনি না নিজের। পৃথিবীতে আর যেন কোনও শব্দ নেই। পাশে বসে রুদ্র নিঃশব্দে ঘুমোয়। ঘুমের রুদ্রর মখু হাঁ হয়ে থাকে। কি করে মানুষটির ঘুম আসে, এমন নিশ্চিন্তি সে কোত্থেকে পায় আমি বুঝে পাই না। ময়মনসিংহে নেমে রুদ্র কোথাও যায়, কোনও হোটেলে। আমি অবকাশে ফিরি। মা দৌড়ে এসে আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরেন, আহারে আমার মেয়েটা কতদিন ঘরছাড়া ছিল। ইয়াসমিন বুবু আইছে বুবু আইছে বলে ছুটে আসে। ইয়াসমিনের কোল থেকে ঝাঁপিয়ে পড়ে আমার কোলে সুহৃদ। আমি লুকোতে চেষ্টা করি চোখের জল, পারি না। ইচ্ছে হয় চিৎকার করে কাঁদি। গলা ছেড়ে কাঁদি। ইচ্ছে হয় মেঝেয় লুটিয়ে কাঁদি। বাবা বলেন, সমুদ্র কেমন দেখলা মা? আমারই সমুদ্র দেখা হয় নাই এখনও, আমার মেয়ে সমুদ্র দেইখা ফেলল। মা দৌড়ে গেলেন রান্নাঘরে, তাড়াতাড়ি ভাল কিছু রান্না বসাতে। সুফি হেসে বলে,ইস কতদিন পরে আইলাইন! মা বাপ ছাড়া কেমন লাগছে এত দূরে! মামি ত নিত্যিদিন কয়, আমার মেয়েডা না জানি কি করতাছে! সুহৃদকে ইয়াসমিনের কোলে তুলে দিয়ে দৌড়ে গোসলখানায় যাই, আমার এক্ষুনি পেচ্ছাব না করলে নয়। গোসলখানায় বসে মুখে পানি ঢালি যেন চোখের জল পানির স্রোতের সঙ্গে চলে যায়। বদনি বদনি পানি ঢালি, বালতির পানি ফুরিয়ে যায়, চোখের জল ফুরোয় না। আমি প্রাণপণ শক্তি দিয়ে নিজের চিৎকার থামাতে পারি, চোখের জলকে পারি না। তার চেয়ে এরকম যদি হত, আমি বাড়ি ঢুকলেই বাবা আমাকে গাল দিতেন, গালে দুটো চড় কষিয়ে বলতেন, আইজকা সকালে তো হাইজিন ট্যুরের দল ময়মনসিংহ পৌঁচেছে, তর দেরি হইল কেন হারামজাদি? মা যদি বলতেন, সমুদ্রের নাম কইয়া আসলে কই গেছিলি ক তো! ওই যে যেই বেডা তরে বউ কইয়া চিঠি লেকছিল, হেই বেডার সাথে কাডইিয়া আইছস না তো। ইয়াসমিন যদি কাছে না আসত, আমার বাড়ি ফেরায় না ফেরায় ওর যদি কিছু না যায় আসত, সুহৃদকে কোলে নিতে চাইলে সুহৃদ যদি মখু ফিরিয়ে নিত, আমার ভাল লাগত। আমি ভালবাসা পেতে চাই না কারও কাছ থেকে আর। ঘণৃা করুক আমাকে সবাই। প্রচণ্ড ঘণৃা করুক।

পরদিন কলেজে গিয়ে কোনও ক্লাস না করে রুদ্রকে ক্যান্টিন থেকে উঠিয়ে নিয়ে চড়পাড়ার রাস্তায় সারি সারি ওষুধের দোকান, ডাক্তারের চেম্বার আর ল্যাবরটরির পাশ দিয়ে হাঁটি। কোথায় যাব, কোন ডাক্তারের কাছে? যে কোনও ডাক্তারই আমাকে চেনে, নামে চেনে, মুখে চেনে, নয়ত বাবার মেয়ে হিসেবে চেনা। যে কোনও ডাক্তারই অবাক হবে আমি একটি সিফিলিস রোগিকে নিয়ে ডাক্তারের কাছে গেলে, বার বার প্রশ্ন করবে কে এই রোগি? কি হয় আমার? ভাবি কোনও ডাক্তারের না গিয়ে রক্ত পরীক্ষাই করে নেওয়া ভাল। ভেবে কোনও ডাক্তারের চেম্বারে নয়, রক্ত পরীক্ষার জন্য ঢুকি একটি প্যাথলজি ল্যাবএ। এক চৌকোনা চোয়ালের কালো লোক, চোখ দুটো বেরিয়ে আসছে কোটর থেকে, অনুমান করি টেকনিশিয়ান, বলি এর ভিডিআরএল টেস্ট করতে হবে। বলার সময় কণ্ঠ কাঁপে আমার। লোকটি তীক্ষ্ম চোখে আমাকে দেখে। চোখের প্রশ্ন লোক কি হয় আপনার? আমি চোখ নামিয়ে ফেলি, যেন পড়িনি কোনও প্রশ্ন। চোখের তীক্ষ্মতা দেখিনি। মেডিকেলের ছাত্রছাত্রীরা চেনা রোগি নিয়ে এমন কি রাস্তায় পড়ে থেকে কাতরাতে থাকা রোগীদের দয়া করে তো চিকিৎসার ব্যবস্থা করে। এরকমই হয়ত কিছু। হাসপাতালের করিডোরে এক লোক হাঁটছিল, আমার সাহায্য চাইল তার রোগের চিকিৎসার জন্য। আমার অবসর ছিল বলে, ঠিক এক্ষুনি কোনও ক্লাস ছিল না বলে, লোকটিকে দেখাতে নিয়ে এসেছি কি করতে হবে, কোথায় যেতে হবে। মুখের ভাবে যে রকম কারণই দিই না কেন লোকটির ঠোঁটে বাঁকা একটি হাসি খেলতে থাকে, বুঝি যে এই লোক আমাদের দুজনকে আগে অনেক দেখেছে, এই লোক খুব ভাল করে চেনে আমাকে, রুদ্র আমার স্বামী এ কথা না জানলেও জানে রুদ্র আমার প্রেমিক।

রুদ্রর রক্ত পরীক্ষার ফল হাতে এল। ভিডিআরএল পজিটিভ।

কাগজটির দিকে তাকিয়ে, যে এক চিলতে আশাকে লালন করেছিলাম, শক্ত পায়ে কেউ মাড়িয়ে গেল। হাহাকার ছাড়া কিছু আর অবশিষ্ট নেই। সারা জীবনের জন্য ওই আমার সম্বল।

রক্ত পরীক্ষা হল মেডিকেল কলেজের আঙিনায়। চৌকোনা লোকটি হাসপাতালে যেতে আসতে আমাকে ফিরে ফিরে দেখে। এ লোক কি তাবৎ ডাক্তারদের কাছে বলে বেড়াচ্ছে যে আমার সঙ্গে একটি দাড়িঅলা লোক ঘোরে, লোকটির সিফিলিস হয়েছে! বোধবুদ্ধি লোপ পেয়েছে, আর কিসের সতর্কতা আমার! ওই আঙিনাতেই বিকেলে যৌনবিশেষজ্ঞের চেম্বারে ঢুকি প্যাথলজির কাগজটি হাতে নিয়ে। পেছনে রুদ্র। বিশেষজ্ঞ চোখ কুঁচকে কাগজের দিকে, রুদ্রর দিকে, আমার দিকে ঘন ঘন তাকিয়ে ব্যবস্থাপত্র লিখে জিজ্ঞেস করলেন আমাকে, এ কি তোমার চেনা রোগি?

হ্যাঁ স্যার। শান্ত কন্ঠ।

ও।

বিশেষজ্ঞের ভাবনার ভেতরে নেই এই রোগী আমার কোনও আত্মীয় হতে পারে। কোনও উদ্ভট কল্পনাও যদি এই বিশেষজ্ঞ করেন, তার ত্রিসীমানার মধ্যে নেই এই রোগী আমার প্রেমিক হতে পারে, অথবা আমার স্বামী। তাই রোগী তোমার কি হয় জিজ্ঞেস না করে জানতে চেয়েছেন এ আমার চেনা রোগী কি না। চেনাই তো। রুদ্র আমার সেই কতকালের চেনা। ফের কোনও বাক্যালাপের সুযোগ না দিয়ে ডাক্তারের চেম্বার থেকে বেরোই। বাইরে এসে ফুসফুস ভরে মুক্ত হাওয়ার ঘ্রাণ নিয়ে শান্ত গলায় বলি, এবার? সবই তো হল। যাও, ঢাকায় গিয়ে পেনিসিলিন ইনজেকশন নাও। কোনও এক ফার্মেসিতে গিয়ে বল, কমপাউন্ডার পুশ করে দেবে।

আর তুমি?

আর আমি?

হ্যাঁ তুমি।

আমি কি?

তুমি কি করবে?

আমি আর কি করব, লেখাপড়া করব, ডাক্তার হব, রোগির চিকিৎসা করব।

সম্পর্ক?

কিসের সম্পর্ক? কার সঙ্গে?

আমার সঙ্গে।

আমি হেসে উঠি।

তোমার সঙ্গে এখনও কি সম্পর্কে আমার ফুরোয়নি রুদ্র?

রুদ্র অনেকক্ষণ চপু করে থেকে ভাঙা গলায় বলে, ক্ষমা করতে পার না?

ক্ষমা? ক্ষমা তো আমি তোমাকে করেছিই। নিজের মান সম্মানের তোয়াক্কা না করে এই জন্ম-চেনা শহরে এনে তোমার চিকিৎসার ব্যবস্থা করলাম। তোমাকে তো ওই মোংলা বন্দরেই পারতাম, পারতাম না ত্যাগ করতে?

পারতে।

রুদ্রর চোখে সেই চিরকেলে ধূসরতা।

আমার জীবনে আর আছে কি বল। এত বছর প্রেম করে, বিয়ে করে স্বামীর সঙ্গে প্রথম মিলন, দীর্ঘ বছর অপেক্ষার পর সেই দিনটি এল। বিষম সুখের সময় আমার, বিষম আনন্দের। তাই না? সমস্ত ভয় লজ্জা দূর করে নিজের সমস্তটুকু দিয়েছি তোমাকে, যে সমস্তটুকু চাইতে তুমি। সম্পণূর্ করে আমাকে চাইতে। পেলে তো! এখন তো তোমার সাধ মিটেছে, তাই না! আমার বিয়েতে তো আমি কোনও লাল বেনারসি পরিনি, গয়না পরিনি, বিয়েতে তো কোনও বাদ্য বাজেনি, অতিথি আসেনি, কেবল তুমি আর আমি উদযাপন করেছি। আমি তোমাকে উপহার দিয়েছি আমার সমস্ত ভালবাসা, সমস্ত বিশ্বাস, তুমি আমাকে উপহার দিয়েছো একটি রোগ। আমার বিয়ের উপহার তোমার কাছ থেকে তো এটিই। কি বল?

তোমারও তো ইনজেকশন নিতে হবে। ঢাকায় চল।

আমাকে নিয়ে তোমাকে আর ভাবতে হবে না। অনেক ভেবেছো। এবার অন্য কিছু নিয়ে ভাবো। নিজের জীবন নিয়ে ভাবো। পারোতো রোগ বালাই থেকে দূরে থেকো।

তুমি আমাকে ত্যাগ করছ?

নিস্পৃহ কণ্ঠ আমার।

হ্যাঁ ত্যাগ করছি। ভেব না তোমার সিফিলিস হয়েছে বলে আমি তোমাকে ত্যাগ করছি। নেহাত দুভার্গা বলে তোমার রোগটি হয়েছে, তুমি বেশ্যাবাড়ি যাও, ওদের সঙ্গে থাকো, নাও হতে পারত এই রোগ তোমার। সবার হয় না। আমি তোমাকে ত্যাগ করছি, তুমি আমার সঙ্গে প্রতারণা করেছ বলে।

রুদ্রর চোখ ছলছল করে।

আমার জায়গায় হলে তুমি কি করতে রুদ্র?

সত্যিই আমাকে ছেড়ে যাচ্ছ?

সত্যিই।

একবার ভাল হবার সুযোগ দেবে না?

আমি মলিন হাসি। নিঃস্ব, রিক্ত, সব হারানো মানুষ আমি। আমি সুযোগ দেবার কে! আমি কি কোনও মানুষ। নিজের ওপরই লজ্জা হয়, নিজেকেই ঘৃণা হয়। রুদ্র দাঁড়িয়ে থাকে চরপাড়ার রাস্তায়, একা। আমি চলে আসি, আমার একবারও ইচ্ছে হয় না পেছনে তাকাতে। একবারও ইচ্ছে হয় না রুদ্রকে বলি আবার এসো, চিঠি লিখো। ইচ্ছে হয় না আমার। আমি জানি এই শেষ দেখা আমার তার সঙ্গে। আর হয়ত কোনওদিন দেখা হবে, হঠাৎ কখনও ঢাকার রাস্তায়, কখনও কোনদিন কোনও বইমেলায়। রুদ্রকে আমার স্বামী বলে তো নয়ই, কোনও প্রেমিক বলেও মনে হয় না। মনে হয় এক চেনা লোক। চেনা লোকটি কবিতা লেখে। চেনা লোকটির অসখু হয়েছে বলে, যেহেতু আমার হাতের কাছে চিকিৎসার সৃুযোগ আছে, করুণা করে চিকিৎসার ব্যবস্থা করেছি। চেনা লোকটি তার চেনা জায়গায় ফিরে যাচ্ছে। আমি ফিরে যাচ্ছি আমার চেনা জায়গায়। চেনা লোকটিকে নিয়ে আমার কোনও স্বপ্ন নেই। চেনা লোকটি আর কোনওদিন আসবে না আমার কাছে, আমার জীবনে, আমার শরীরে, আমার মনে। আর কোনও প্রেমের চিঠি নয়। আর কোনও শোয়াশোয়ি নয়। আর কোনও সংসার নয়। কোনও বন্ধন নয়। বন্ধন ছিন্ন করতে কোনও একদিন কোনও একটি কাগজে সই করে দেব। চেনা লোকটি ধীরে ধীরে অচেনা হয়ে উঠবে। চেনা লোকটির কবিতাই শুধু চেনা থেকে যাবে। আর কিছু নয়। চেনা লোকটির কবিতা হয়ত পড়ব, ধূসর ধূসর কিছু স্মৃতি হয়ত আমাকে মুহূর্তের জন্য আনমনা করবে। কেবল এই। এর বেশি নয় কিছু আর।
 
১৮. অনুতপ্ত অন্ধকার



সমুদ্রে তোলা ছবিগুলো দেখে মা বলেন, আমাকে নাকি জলকন্যার মত লাগছে। সমুদ্রের শাদা ঢেউয়ে ভেসে যাচ্ছি, ডুবে যাচ্ছি, জলে ভেজা শরীর রোদে চিকচিক করছে, খালি পায়ে সূর্যাস্তের দিকে হেঁটে যাচ্ছি, অনেক সময় এক দঙ্গল মেয়ে আছে সঙ্গে। মা বলেন, আর কাউরে তো তোমার মত এত সুন্দর লাগতাছে না। তোমারেই মনে হইতাছে জল থেইকা উইঠা আইছো। মা যদি জানতেন কি ঘটেছে আমার জীবনে, আমার শরীর এখন আর জলকন্যার মত পবিত্র নয়, তবে নিশ্চয়ই এ নামে আমাকে ডাকতেন না। মা যদি জানতেন সমুদ্রের হাওয়া খেয়েই আসিনি আমি, কদিনের জন্য হাওয়া হয়েও গিয়েছিলাম। আগুনের হলকা ছিল সে হাওয়ায়। আমি শুকনো হাসি হাসি। কার কাছে বলব নিজের এই পরাজয়ের কথা! না কেউ নেই কোথাও যার কাছে বসে কাঁদি। আমাকে একা একাই কাঁদতে হয়। একা একাই বসে থাকতে হয় ছাদে, নৈঃশব্দের কোলে মাথা রেখে। চোখের জল লুকিয়ে রাখতে হয় জলকন্যার। শওকত টিপ্পনি কেটেছে, কি, হাইমেন রাপচার হইছে?

আমি ম্লান হেসেছি।

কি গো জলকন্যা সমুদ্র নিয়া কবিতা লিখবা না! ইয়াসমিন বার বারই জিজ্ঞেস করে। নাহ, কবিতায় মন নেই, মন শরীরে। দীর্ঘ দিন কবিতা লিখিনা, কবিতা আসে না আজকাল। জলকন্যাকে মনে মনে যাদুর পালঙ্কে ঘুম পাড়াই, মনে মনে বুঝি ঘুম নেই তার চোখে, দুশ্চিন্তার চাদর মুড়ি দিয়ে একা একা জেগে থাকে সে। জলকন্যা চিঠি পায়, এসেই নিয়ে নিয়েছি। ব্যথা তেমন লাগেনি। ক্ষত এখনো অপরিবর্তিত। অভাবিত নিয়ন্ত্রণে নিয়ে এসেছি নিজেকে। তবে শোচনার কষ্ট খুব বেশি। .. দুর্ভাবনা করো না। কিছুই হারাইনি আমরা। সোনা মানিক, বিভ্রান্তির কালো রোদ আর কখনো আমাকে স্পর্শ করবে না। আমি ভাল থাকছি। ভাল থাকবো। আমি তোমার স্বপ্নের মত ভাল থাকব। তোমার শরীরের ঘ্রাণ ছড়িয়ে রয়েছে সারা ঘরে—আমি সেই ঘ্রাণের সাথে খেলি। তোমার হৃদয়ের রোদ উজ্জ্বল করে রেখেছে আমার পরান। আমি সকালের রোদ হয়ে উঠব, সকালের রোদ। রুদ্রকে আমি চিঠিতে রোদ বলে ডাকতাম, রুদ্র ডাকত আমাকে সকাল বলে। ওইসব বাঁধনছেঁড়া প্রেম এখন কী বিষম অর্থহীন মনে হয়। রুদ্র এখন সকালের রোদ হয়ে উঠতে চায়। সে এখন আমার রুদ্র হয়ে উঠতে চায়। এখন কেন? কেন সে সেই প্রথম থেকেই ছিল না আমার! কেন সে বার বার বলেছে সে আমার ছিল! কেন সে ঠকিয়েছে আমাকে! কেন মিথ্যে বলেছে! এখন সে সকালের রোদ হয়ে উঠবে, কি করে বিশ্বাস করি তাকে!কেন আর চিঠি লেখে রুদ্র আমাকে। আমি তো তাকে আর আমার এ জীবনের সঙ্গে জড়াবো না। আমি মন থেকে ঝেড়ে ফেলেছি রুদ্র নামের প্রতারকটির নাম। ধূসর আকাশ থেকে অবিরল বৃষ্টি হয় হোক, জলের প্রপাত বেয়ে বন্যা এসে দুকূল ভাসাক, তবু ভাল নির্বাসন। খানিকটা ঝিকমিক রোদ আচমকা সুখ এনে পণূর্ করে ঘরের চৌকাঠ, গোপনে বিনাশ করে স্বপ্নে ধোয়া সোনার বাসর, ঘণু পোকা খুঁটে খায় শরীরের সুচারু বৈভব, হৃদয়ের রক্ত খায়, খেয়ে যায় বাদামি মগজ। সেই রোদে পুড়ে পুড়ে খাক হয় অনন্ত আগামী, জীবন পুড়িয়ে দিয়ে আগুনের হল্কা ওঠে নেচে। আমার উঠোন জুড়ে মাটি আর খরায় চৌচির, জগত আধাঁর করে নামে যদি তুমুল তুফানতবু ভাল নির্বাসন, রোদহীন বিষণ্ন সকাল। পৃথিবী আধাঁর করে ফিরে যায় অমল রোদ্দুর, পেছনে কালিমা রেখে ফিরে যায় সবুজ সুষমা, শিকার খুবলে খেয়ে ফিরে যায় চতুর শগৃাল, লম্পট জুয়ারি ফেরে, অমানুষ, মদ্যপ শকুন। তুমিও তেমনি করে ফিরে যাও পরানের রোদ, ঘুরঘুট্টি কালো রাত ফেলে তুমি বনবাসে যাও, সোনালী ডানার রোদ উড়ে যাও পরবাসে যাও। এক ফোঁটা জ্যোৎস্না নেই, সেই ভাল, নিকষ আন্ধার, অমাবস্যা ডুবে থাক, তবু রোদ খুঁজো না সকাল। তবু রোদ তার সকালকে খুঁজেই যাবে। আর যা কিছুই হারাক, সে তার সকালকে হারাতে চায় না।

কেবল চিঠি নয়, চিঠির সঙ্গে কবিতাও পাঠায় রুদ্র। কবিতায় সেই রাতের কথা, সেই আমাদের প্রথম মিলন-রাত্রির কথা, আমার রাত জাগা রাতটির কথা।

ধ্বংসস্তূপের উপর বসে আছে একটি শালিক
পাশে এক মৃত্যুমাখা বেদনার বাজপোড়া তরু,
শূন্যতার খা খা চোখ চারপাশে ধূসর আকাশ।
দুঃখিতা আমার, তুমি জেগে আছো স্বপ্নহীন আঁখি।
তোমার চোখের তীর ভেঙে পড়ে পাড়ভাঙা নদী,
তোমার বুকের পাশে জেগে থাকে নিভৃত পাথর।
কিসের পার্বন যেন চারদিকে কোলাহল রটে—
দুঃখিতা আমার, তুমি জেগে আছো পরাজিত পাখি।
সুচাগ্র সুযোগে সাপ ঢুকে গেছে লোহার বাসরে,
বিষের ছোবলে নীল দেহে নামে শীতল আধাঁর,
গাঙুরের জলে ভাসে কালো এক বেদনার ভেলা।
দুঃখিতা আমার, তুমি জেগে আছো বালিয়াড়ি-নদী।
নিখিল ঘুমিয়ে গেছে দিনশেষে রাতের চাদরে,
কামিনীর মিহি চোখে ঘুম এসে রেখেছে চিবুক,
জোনাকিরা নিভে গেছে সংসারের স্বপ্ন শুনে শুনে—
জেগে আছো, শুধু তুমি জেগে আছো আমার দুঃখিতা।

রুদ্র কি সত্যিই অনুভব করেছে আমার কষ্টগুলো! যদি তার হৃদয় বলে কিছু থাকে, তবে কেন সে অন্য মেয়েদের ছুঁয়েছে! হৃদয় বলে কিছু আমার ছিল বলে আমি কখনও কল্পনাও করতে পারিনি রুদ্র ছাড়া অন্য কোনও পুরুষকে। প্রতিদিন কলেজের সুদর্শন বুদ্ধিমান হিরের টুকরো ছেলেদের দেখেছি, কারও দিকে আমি তো ফিরে তাকাইনি। কেবল হাবিবুল্লাহ নয়। আরও অনেক হিরের টুকরো তো আমাকে প্রেমের প্রস্তাব পাঠিয়েছে, সব তো দ্বিধাহীন ছুঁড়ে দিয়েছি। রুদ্র কেন পারেনি! শরীর তো আমারও ছিল, এই শরীর তো কখনও কাউকে কামনা করেনি! এই শরীর প্রতিদিন একটু একটু করে প্রস্তুত হয়েছে রুদ্রর জন্য। এই প্রস্তুত শরীরটি রুদ্র তার বহুভোগী কালিমায় কালো করেছে।

ভাঙনের শব্দ শুনি, আর যেন শব্দ নেই কোনও,
মাথার ভেতর যেন অবিরল ভেঙে পড়ে পাড়।
করাত কলের শব্দে জেগে উঠি স্নায়ুতে শিরায়
টের পাই বৃক্ষ হত্যা সারারাত রক্তের ভেতর।
কেন এত বৃক্ষহত্যা, এত ভাঙনের শব্দ কেন?
আর কোনও ধ্বনি নেই পৃথিবীতে, ব্রহ্মাণ্ডে, নিখিলে?
কোথায় ভাঙছে এত? কোনখানে? নাকি নিজেরই
গভীর মহলে আজ বিশ্বাসের গোপন ভাঙন!
উদাসীন দূর থেকে ডেকে যাই সকাল সকাল..
তবে কি সকাল ভাঙে পৃথিবীতে আমার সকাল!
আমার নগর ভাঙে, প্রিয় এই নিভৃত নগর?
তবে কি আকাঙক্ষা ভাঙে, স্বপ্নময় পরম পিপাসা?
প্লাবনের ক্ষতচিহ্ন মুছে নেয় মানবিক পলি,
আগুনের দগ্ধ শোক কবে আর মনে রাখে গৃহ।
দুর্যোগের রাত্রি শেষে পুনরায় তুলেছি বসত,
চিরকাল তবু এই ভাঙনের শব্দ শুনে যাব?

হ্যাঁ তোমাকে চিরকালই এই ভাঙনের শব্দ শুনে যেতে হবে। আমি আর ফিরব না তোমার ওই নষ্ট জীবনে। কবিতা পড়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলি, কবিতা আমাকে কাঁদায়, কিন্তু না, কবিতা আর জীবন এক নয়, কবি হতে হলে যদি বাণিশান্তার বেশ্যার সঙ্গে শুয়ে অসুখ বাধাঁতে হয়, তবে সে কবির কবিতা আমি ভালবাসতে পারি, সে কবির সঙ্গে জীবন জড়াতে পারি না। ফাঁকি তো যথেষ্ট দিয়েছ, আর কত রুদ্র! আমাকে বোকা পেয়ে কাছে টেনে যেটুক অবশিষ্ট আছে আমার, তাও নষ্ট করতে চাও! আর কত ফাঁকি দেবে, আমি কি বুঝি না ভাবো চাতুরি তোমার! ভেতরে নরক রেখে কেমন বাহানা ধরো সুবোধ শিশুর! চুম্বনের স্বাদ দিলে বিষাক্ত সাপের মত ছোবলের ঘায়ে, মুখোশ খুলেই দেখি আসলে তোমার এক বীভৎস আদল। আর কত প্রতারণা, ভাঙনের নৃশংস খেলা এতটা নির্মম! পুন্নিমাবিহীন চাঁদ অশুভ অমাবস্যাকে ডাকে আয় আয়—জোনাকিকে জোৎস্না ভেবে নিকষ আন্ধার রাতে উৎসবে মেতেছি, এই তো আমার ভুল, এই তো আমার পাপ জালেতে জড়ানো.,এখন ছুটতে চাই, দুদাঁতে কামড়ে চাই ছিঁড়তে বাধঁ ন,এখন বাঁচতে চাই, প্রাণপণে পেতে চাই বিশুদ্ধ বাতাস। আর কত ফাঁকি দেবে, আমি কি বুঝি না ভাবো চাতুরি তোমার? জীবনে জঞ্জাল রেখে সুবাসিত হাসি টানো ঠোঁটের কিনারে ! গ্লানিতে অতীত ভরা, গ্লানিতে শরীর ভরা, ঘণৃার জীবন। অমৃতের মত ভেবে তবওু ছুঁয়েছি আমি বিষের অনল। এই কি আমার প্রেম, সাজানো গোছানো সাধ, সাধনার ধন? এই তো আমার ঘর, মাটি নেই, খুঁটি নেই, অলীক মহল, নিশ্চিত মরণ থেকে এবার বাঁচতে চাই, শুভ্র মুক্তি চাই, সুচারু স্বপ্নকে চাই, অমল ধবল চাই হৃদয়ের ঘ্রাণ। কিন্তু শুভ্র মুক্তি আমি পেতে পারি না। অমল ধবল জীবন আমি পেতে পারি না। রুদ্র নিজের অসুখের চিকিৎসা করে অনুতপ্ত অন্ধকার লিখছে। তার অনুতাপ আমাকে অসুখ থেকে রক্ষা করে না। আমি একা, আমার সমস্ত যন্ত্রণা নিয়ে একা আমি। হঠাৎ একদিন লক্ষ করি যৌনাঙ্গে ঘা হচ্ছে। তাহলে সংক্রামিত হয়েছিই! মনে একটি ক্ষীণ আশা ছিল, হয়ত হইনি। কেবল আশায় বসতি। এই চেনা শহরে আমার পক্ষে সম্ভব নয় রক্ত পরীক্ষা করা, কোনও ওষুধের দোকানে গিয়ে পেনিসিলিন ইনজেকশন চাওয়া। সম্ভব নয় নিজের শরীরে নিজে সুঁই ফোটানো। সম্ভব নয় কাউকে সুঁই ফোটাতে বলা। পেনিসিলিন ইনজেকশনের ডোজ দেখেই সকলে জেনে যাবে কোন রোগের চিকিৎসার জন্য এই হাই ডোজ। রুদ্র সুস্থ হচ্ছে, তার ক্ষত সেরে যাচ্ছে একটু একটু করে, ক্ষত আমার যৌনাঙ্গে বাড়ছে একটু একটু করে, আমি অসুস্থ হচ্ছি। এই অসুখ টি আমি লুকিয়ে রাখি শরীরের গভীর গুহায়। কেউ যেন না দেখে, কেউ যেন না জানে। একটি ভয় আমার গায়ে লেগে থাকে সারাক্ষণ, যেখানেই যাই যা কিছুই করি, ভয়টি আমাকে ছেড়ে কোথাও যায় না। হাসপাতালে নার্সের ঘরে শত শত পেনিসিলিন, হাসপাতালে ভর্তি হওয়া রোগীদের বিভিন্ন রোগের চিকিৎসা লিখে দিচ্ছি, নানারকম পেনিসিলিনের নাম, রোগীর আত্মীয়রা সে ওষধু আনছে, নার্সকে বলছি ইনজেকশন দিতে রোগীদের, চোখের সামনে নার্সও দিচ্ছে। কিন্তু নিজে একটি পেনিসিলিন নিজের জন্য নিতে পারছি না। নিজে কোনও ডাক্তার বা নার্সকে বলতে পারছি না আমাকে একটি ইনজেকশন দিয়ে দিন, একটি হাই ডোজের পেনিসিলিন দিন। এর চেয়ে যদি ক্যান্সার হত আমার, যে কোনও দুরারোগ্য রোগ, স্বস্তি পেতাম, অন্তত বলতে পারতাম আমার অসুখের নাম, চিকিৎসা করাতে কোনও লজ্জা হত না। কাকে বলব এখন কি রোগে ভগু ছি আমি। কণ্ঠুার করাত আমাকে ফালি ফালি করে কাটে। ভয় লজ্জা আমাকে শক্ত দড়িতে বাঁধে। আমার সীমানা কমতে কমতে একটি বিন্দুতে এসে পৌঁছোয়। কিন্তু কতদিন লুকিয়ে রাখব এই রোগ! ক্যানেসটেন মলম ব্যবহার করে জানি কাজের কাজ কিছু হবে না, তবু কিনি ওষধু টি। সঠিক ওষধু টি কেনার উপায় নেই বলে অন্য ওষধু কিনি। এ মলম যৌনাঙ্গের ফাংগাস দূর করে, এ মলম ট্রিপোনেমা পেলিডামএর মত ভয়ঙ্কর ব্যাকটেরিয়া ধং্ব স করতে পারে না। তারপরও প্রতিদিন জামার আড়ালে মলম নিয়ে গোসলখানায় ঢুকি, যেন গোসল করতে বা পেচ্ছাব পায়খানা সারতে যাচ্ছি। আর কারও চোখে কিছু পড়ে না, কেবল মার চোখে পড়ে। মলমটি বিছানার সবচেয়ে তলের তোশকের তলে লুকিয়ে রাখি। কেউ কখনও তোশকের ওই তলে হাত ঢোকায় না। এত লুকোনোর পর মা বলেন, তর হইছে কি রে, বারে বারে বাথরুমে যাস কেন?

কিছু হয় নাই তো! ফ্যাকাসে মুখটি আড়াল করে বলি।

তর কি কিছু অসুখ টসুখ হইছে নাকি?

কি কও এইসব? অসুখ হইব কেন!

আমার কিন্তু মনে হইতাছে তর কিছু হইছে।

মার চোখের দিকে তাকাই না। বুকের ধুকপুক বুকেই থাকতে দিই।

সামনে পরীক্ষা। ছেলেমেয়েরা দিনরাত পড়ছে। কলেজে যাই, ক্লাস করি। অধ্যাপক অধ্যাপিকাদের বক্তৃতার দিকে চোখ, কিন্তু মনটি অন্য কোথাও, মন শরীরে। বাড়িতে বই সামনে নিয়ে বসে থাকি, মন চলে যায় বইয়ের অক্ষর থেকে শরীরে। শরীরে ভয়ঙ্কর কিছু একটা ঘটতে যাচ্ছে। চিকিৎসা এক্ষুনি দরকার। কিন্তু কি করে চিকিৎসা পাবো, কোথায় পাবো! রুদ্র মোংলায় বসে কবিতা লিখছে। ঢাকা গিয়ে চিকিৎসা করারও উপায় নেই। হাই ডোজের পেনিসিলিন সিফিলিস ছাড়াও হৃদপিণ্ডের অসুখে ব্যবহার হয়। হৃদপিণ্ডের অসুখ ও যদি হত আমার, বাঁচা যেত। অন্তত সে কারণে নিশ্চিন্তে একটি ইনজেকশন আমি নিতে পারতাম। চাইলেই তো হৃদপিণ্ডকে অসুখ দিতে পারি না। মাঝে মাঝে কনুইয়ে যে ব্যথা হয়, এক কনুই থেকে আরেক কনুইয়ে লাফ দিয়ে ব্যথা যায়, এই রিউমাটয়েড আরথ্রাইটিসএর সময় হৃদপিণ্ডের মাইট্রাল স্টেনোসিস ঘটাতে পারে। মাইট্রাল স্টেনোসিস হলে শ্বাসকষ্টের উপসর্গ থাকে। এই যে হঠাৎ রাতে রাতে আমার শা্ব স বন্ধ হয়ে আসে, যেন একটি ছোট্ট ট্রাংকের মধ্যে বন্দি হয়ে আছি, শ্বাস নেওয়ার জন্য বাতাস পাচ্ছি না সেরকম লাগে, শোয়া থেকে উঠে বসে ফুসফুসে বাতাস নিতে থাকি, বসে না হলে দাঁড়িয়ে, তাতেও না হলে জানালা খুলে হলে শ্বাস নিই। সেটিরই তো নাম অকেশনাল নকচারনাল ডিসনিয়া। তবে তো আমি যোগ্যতা রাখি হাই ডোজ পেনিসিলিন পাওয়ার। এই যোগ্যতার সুযোগ পেয়ে আমি ক্লাসের একটি সাদাসিধে ভালছাত্রী নাসিমাকে বলি, আমার নকচারনাল ডিসনিয়া হয়। ভয় করছি মাইট্রাল স্টেনোসিস আবার না হয়ে যায়। ভাবছি পেনিসিলিন ইনজেকশন নেব। নিলে তো মাইট্রাল স্টেনোসিস অন্তত প্রিভেন্ট করা যাবে কি বল। নাসিমা যদি বলে আমার নেওয়া উচিত পেনিসিলিন, তবেই নাসিমাকে সাক্ষী রেখে আমি ইনজেকশনটি নিতে পারি। নাসিমাই আমার হৃদডিণ্ডটি বাঁচাতে সাহায্য করতে পারে। কিন্তু আমার অত বড় অসুখের কথা শুনে নাসিমা হাসে। বলে, আগেই ইনজেকশন নেবে কেন? আগে হার্টটা দেখ। মারমার পাও হাটের্? বিপাকে পড়ি, স্টেথোসকোপ নিজের বুকে কখনও লাগাইনি। রোগির হৃদপিণ্ড নিয়েই ব্যস্ত, নিজের হৃদপিণ্ডের খবর কে রাখে। কেবলই অনুমান। অবশ্য এসব অনুমানের ওপর আমাকে কেউ পেনিসিলিন নিতে দেবে না, কাউকে না জানিয়ে গোপনে কোনও ইনজেকশনও আমাকে দেবে না কেউ, এমন কি নাসিমাও। ভাল ছাত্রীর ভাল কান স্টেথোর নলে, নল বেয়ে আমার হৃদপিণ্ডের কোনও মন্দ শব্দ ভাল কানে পৌঁছে না। কোনও মারমার নেই, সুতরাং পেনিসিলিন নেওয়ার কোনও প্রয়োজন নেই আমার। বুঝি, ইনজেকশন ছাড়া উপায় নেই।

রুদ্র মোংলা থেকে ফিরে এলে বাড়ির কাউকে কিছু না বলে আমি ঢাকার বাসে চড়ি। বাড়ির কারও অনুমতির জন্য অপেক্ষা করলে আমার চলবে না। ঢাকায় শাহবাগের এক ওষুধের দোকানে, রুদ্র যেখানে নেয় ইনজেকশন, নিয়ে যায়। নিতম্বের মাংসে লম্বা মোটা সুঁই ফোঁটালো যে লোকটি, বাঁকা একটি হাসি ঝুলে রইল তার ঠোঁটে, ষ্পষ্ট দেখি। দাঁতে দাঁত চেপে সহ্য করি সুঁই আর হাসি, দুটোই। ওষুধের দোকানের পাশেই চায়ের দোকান, ওখানে বসে রুদ্র খুব নরম কণ্ঠে বলে আজ থেকে যাও। রুদ্রর চোখদুটোয় তাকালে আমার এখনও, অবাক কাণ্ড,আগের মতই, কীরকম যেন লাগে। ঘরে ফিরে রুদ্র আমার হাতে আঙুল বুলোয়, আঙুলগুলো দেখি যে আঙুল অন্য কোনও নারীর শরীর ছোঁয় ঠিক এভাবেই। রুদ্র চুমু খায় আমাকে, এভাবেই সে চুমু খায় অন্য নারীদের। রুদ্র বুকে হাত রাখে, এভাবেই সে রাখে অন্য নারীর বুকে। রুদ্র বিছানায় নিয়ে আমাকে শুইয়ে দেয়, সারা শরীরে আদর করে, এভাবেই সে করে আর নারীদের। এভাবেই সে আরেক নারীর সঙ্গে শোয়। কোথাও খুব যনণ্ত্রা হয়। বুকের ভেতরে। নিজেকে বার বার বলি, না, এ জীবন আর নয়। আমি ফিরে যাব ময়মনসিংহে আজই, আর কোনওদিন রুদ্র বলে কোনও মানুষের কথা ভাবব না। রুদ্র আমার পাশে শুয়ে আমার চুলে আঙুল বুলিয়ে দিতে দিতে ধরা গলায় বলতে থাকে মদ আর মেয়েমানুষের নেশা তার জীবনের শুরু থেকে ছিল। আমাকে সে ইঙ্গিতে বোঝাতে চেয়েছিল, আমি বুঝিনি। আমাকে তার জীবনের সব খুলে বলার ইচ্ছে ছিল খুব, কিন্তু বলা হয়নি তার। আমাকে বিয়ে করার পর তার যে খুব ইচ্ছে ছিল আগের জীবন যাপন করতে, তা নয়। আমি তার সঙ্গে যৌন সম্পর্কে দ্বিধা করেছি বলেই তাকে যেতে হয়েছে বেশ্যাবাড়ি। কিন্তু আমার প্রতি ভালবাসা কোনও বেশ্যাবাড়ি গিয়ে নষ্ট হয়নি।



যে পেনিসিলিন আমাকে সুস্থ করার কথা, আমাকে অসুস্থ করতে থাকে আরও। একটি গোটার জায়গায় আরও পাঁচটি গোটা জন্ম নেয়। গোটা আর গোটা নেই, মখু খুলে মেলে দেয়, খোলা ঘা থেকে পাজামায় রস গড়িয়ে নামছে। রস থিকথিকে হয়, রস শাদা থেকে কালো হয়। দগুর্ ন্ধ থেকে দগুর্ ন্ধতর হয়। রসের রং শাদা থেকে বাদামি হয়। বাদামি থেকে গাঢ় বাদামি, গাঢ় বাদামি থেকে লালচে, লালচে থেকে কালচে। কালচে থেকে কালো। কালো থেকে আলকাতরার মত কালো। আমি মানুষ থেকে দূরে সরিয়ে রাখি নিজের শরীর। আতর কিনে গায়ে মাখতে থাকি। যেন কেউ গন্ধ না পায়। সারা রাত কড়া আলো জ্বেলে রাখি ঘরে, রাত জেগে পড়তে হবে বলে। পরীক্ষা সামনে। টেবিলে নয়, বিছানায় বইখাতা এমন ছড়ানো যে আমি আমার আর বইখাতার পর ইয়াসমিনের শোয়ার জায়গা হয় না। আমি চাই না ওর জায়গা হোক। আমি চাই না এই জীবাণু আমার এই শরীর থেকে আমার জামা পাজামা, বিছানার চাদর বালিশ থেকে ইয়াসমিনকে স্পর্শ করুক। গোসলখানায় গোসল করি একবারের জায়গায় দুবার, কখনও তিনবার। বলি যে আমার গরম লাগছে। এত গরম যে বার বার গোসল না করলে আমার হয় না। গোসল করার উদ্দেশ্য পাজামা ধোয়া। পাজামা ভিজে যায় দগুর্ ন্ধ নির্যাসে। শেষ অবদি আমাকে তুলো ব্যবহার করতে হয়। তুলোও বড় লুকিয়ে। কারণ আমার ঋতুর হিসেব আমার না থাকলেও মার কাছে থাকে। প্রতি মাসেই আমাকে তলপেটের ব্যথায় বিছানায় গড়াতে হয়। সেইসব কোনওরকম উপসর্গ ছাড়াই আমি ঋতুর দেখা পেয়েছি এ একটি বড় প্রশ্নবোধক চিহ্ন হয়ে দাঁড়াবে। গোসলপেচ্ছাবপায়খানার পেছন দিকে একটি বন্ধ বারান্দায় রক্তভেজা কাপড় তুলো ফেলে দেওয়ার অভ্যেস আমার আর ইয়াসমিনের। বাবা মাঝে মাঝে ওই বারান্দা পরিষ্কার করেন।নিজের হাতে আমাদের রক্তের তুলো তোলেন। ওখানে রক্তহীন কোনও তুলো পড়ে থাকতে দেখলে মার সন্দেহ হবে, ভেবে গুটিয়ে যাই। তুলো যদি পায়খানায় ফেলি, বদনি বদনি পানি ঢেলেও সেটি দূর করা যাবে না। আটকে যাবে পথে, গু মুত সব ফোয়ারার মত উত্থিত হবে। মাথা থেকে সার্জারি মেডিসিন গায়নোকলজি গেছে আমার, মাথায় কেবল একটি রোগ, একটি রোগ থেকে বাঁচার উপায়। শরীরে মাথা ফুঁড়ে বেড়ে ওঠা একটি রোগ সবার চোখ থেকে লুকোনো।

হাসপাতালে প্রতিদিন রোগির চিকিৎসা করছি, অথচ নিজের শরীরে একটি রোগ। এই রোগ নিয়ে কোনও চেনা ডাক্তারের কাছে যাওয়া যায় না। এই রোগ এখন আর প্রাথমিক স্তরে নেই, দ্বিতীয় স্তরে চলে গেছে। পেনিসিলিন ইনজেকশন যেটি নেওয়া হয়েছে সেটিও শরীরে কাজ করেনি। রোগটি তৃতীয় স্তরে এসে স্নায়ুতন ্ত্র অচল করে দেবে। নিউরোসিফিলিসে আক্রান্ত হওয়া মানে মৃত্যু। আমি মৃত্যুর অপেক্ষা করতে থাকি। রাতে একটি মৃত্যুকে আমি পাশে নিয়ে ঘুমোই। একটি মৃত্যুকে নিয়ে সকালবেলা জেগে উঠি। কলেজে যাই, সঙ্গে একটি মৃত্যু যায়। কলেজ থেকে ফিরি, একটি মৃত্যু ফেরে। সন্ধের বারান্দায় একা একা বসে থাকি উঠোনের দিকে মখু করে। একটি মৃত্যু বসে থাকে পাশে। এ অবস্থায় একদিন মুখে খাওয়ার পেনিসিলিন ট্যাবলেট কিনি।এ কাজে দেবে না জেনেও কিনি। যদি অ−লৗকিক ভাবেও কাজে দেয়। যদি হাই ডোজ খেয়ে এ থেকে সামান্য হলেও মুক্তি পাই। ওষধু লুকিয়ে রাখি তোশকের তলে যেন কেউ না দেখে। একসময় জ্বর হলে ওষধু লুকিয়ে ফেলে দিতাম, ওষধু খেতে,গিলতে ভয় ছিল। এখন লুকিয়ে ওষধু খাই। এখন বারোটির জায়গায় বাহাত্তরটি খাই। এতেও কিন্তু কাজ হয় না। দাদার ফেলে যাওয়া ওষুধের বাক্স ঘেঁটে ঘুমের ওষধু নিয়ে খাই। অন্তত ঘুমিয়ে যদি মৃত্যুকে আড়াল করা যায়। কিন্তু একসময় জাগতে তো হয়। মার মুখোমুখিও দাঁড়াতে হয়। বাড়ির আর কেউ লক্ষ না করলেও মা ঠিকই লক্ষ করেন, আমি ঠিক আগের মত নেই। কড়িকাঠের দিকে চোখ রেখে শুয়ে আছি, মা দরজার কাছে থামেন, কী এত ভাবস?

না কিছু ভাবি না তো! এমনি শুইয়া রইছি।

আমার কাছে লুকাস কেন?

লুকোনো ছাড়া আমার আর উপায় নেই মা, মনে মনে বলি।

তর কিছু একটা হইছে রে। খুব খারাপ কিছু হইছে তর। খুব খারাপ কিছু আমি পাশ ফিরে শুই। মার মখু যেন আমাকে না দেখতে হয়। অথবা আমার মখু টি মাকে।

রুদ্র আবার মোংলা চলে গেছে। ওখানে বসে ধান চালের হিসেব করে। টাকা গোনে। কবিতা লেখে। আর আমার জন্য হঠাৎ হঠাৎ দুশ্চিন্তা করে। তার দুশ্চিন্তার উত্তর লিখি।

অবকাশ
১৬.৮.৮৩

রোদ,
এগারো তারিখে লেখা তোমার ছোট্ট চিঠিটি হাতে নিয়ে বাসায় ফিরলাম। তোমার কিচ্ছু ভাল লাগে না, আমার কথা ভেবে তুমি একফোঁটা শান্তি পাচ্ছে! না—এসব পড়ে রীতিমত হাসি পায়। দয়া করে এধরণের কথা অন্তত আমাকে তুমি দ্বিতীয়বার বোলো না। বিশ্বাস করো, আর যা কিছুই সহ্য করি, এসব ন্যাকামো কথায় আমার ভেতরে আগুন জ্বলে ওঠে। আর কত আগুন তুমি জ্বালাবে? পুড়ে পুড়ে আমি তো ছাই হয়ে গেছি। এতটুকু টের পাও না? কিচ্ছু বুঝতে পারো না?

তুমি অনুযোগ করতে আমি নাকি কথা বলি না। আমি তো এখন অনর্গল কথা বলি, প্রচুর হাসি, হাসতে হাসতে ইদানিং আমার চোখ ভিজে যায়। চোখের ভেতরে একটা সমুদ্র লুকিয়ে থাকে, একটি নোনা জলের সমুদ্র নিয়ে এসেছি আমি। প্রতিনিয়ত যে রোগ আমাকে খুবলে খাচ্ছে, তা বাজারে সস্তায় বিক্রি হয়ে যাওয়া খারাপ মেয়ে মানুষদের রোগ। নিজেকে খুব বেশি ভালমানুষ ভাবতাম, ফুলের মত সুন্দর পবিত্র ভাবতাম, একফোঁটা পাপ করিনি কোনোদিন। তাই বোধহয় অহংকারের শাস্তি পেতে হল এভাবে। ফুলে যেমন কীট এসে খেয়ে ফেলে পাপঁ ড়ি, সব সৌন্দর্য নষ্ট করে, মানুষের ঘৃণায় অবহেলায় বেঁচে থাকতে থাকতে একদিন সবার অলক্ষ্যে টপু করে মরে যায়। কেউ তাতে দুঃখ করে না।

খুব বেশি স্বপ্ন ছিল আমার। এতটা স্বপ্ন কেউ দেখে না। খুব বেশি বিশ্বাস আর ভালবাসায় নির্মাণ করা স্বপ্ন। চোখের সামনে দেখেছি আকাঙক্ষার ঘরদোর পুড়ে গেল। পুড়ে ছাই হয়ে গেল। এখন শাদামাটা মানুষ আমি, স্বপ্নের বালাই নেই। বুকে বাসনা নেই, আশা নেই, আকাঙক্ষা নেই। কেবল একটা মানুষের শরীরের মত শরীর। ভেতরে সব ফাঁকা, সব শূন্য। বেশ হালকা মনে হয় নিজেকে। কেউ নেই, কিচ্ছু নেই, ভবিষ্যতের ভাবনা নেই। কোথায় আছি, কি করছি, এসবও ভুলে থাকতে ইচ্ছে করে বলে ডায়জিপাম খাই। মনে হয় আকাশে উড়ছি, রাতের আকাশ। চাঁদ নেই, জ্যোৎস্না নেই, কালো আধাঁর আকাশ।

বাবা মার উচ্চাকাঙ্খাকে পায়ে মাড়িয়ে, সমস্ত আত্মীয় স্বজনের কল্পনাকে গুড়িয়ে দিয়ে, তাবৎ লোকের সমালোচনাকে তুচ্ছ মনে করে আমি তোমার কাছে গেলাম। বিনিময়ে তুমি আমাকে যা দিলে সে তো আমার সারাজীবনের পরম পাওয়া। তোমার এই উপহার আমি মাথায় করে রাখব।

এ থেকে আমার পরিত্রাণ নেই। তাই তো আমি ভাল হচ্ছি না এবং ভাল হবো না। চারপাশে বড় বড় স্যাংকারে ভরে গেছে। আর প্রতিনিয়ত যে ডিসচার্জ হচ্ছে খুব র‌্যাপিডলি তার ক্যারেকটার পাল্টাচ্ছে। কালো আবর্জনার মত ডিসচার্জ, দগুর্ ন্ধে ডুবে থাকে শরীর। জটিল একটি ব্যাপার, খুব বড় একটি দুর্ঘটনা ঘটছে, ষ্পষ্ট বোঝা যায়।

এখন একটি কম−প্লক্স এসেছে আমার মধ্যে, ইনফিরিওরিটি কম−প্লক্স। হঠাৎ খুব বেশি নীরব হয়ে গেছি। কারো সঙ্গেই কথাবার্তা বলি না। সব্বাই খুব পড়াশোনা করে। সামনে পরীক্ষা। আমি কোনোকিছু পড়তে পারি না। বইপত্র ছুঁতে ইচ্ছে করে না।

কেবল ওই আকাশ। রাতের স্তব্ধ আকাশ। কেউ নেই, কিচ্ছু নেই, দুঃখ নেই, সুখ নেই। ভুলতে চাই। ভুলতে চাই। সবকিছু ভুলে থাকতে চাই। তুমি আমার যনণ্ত্রাগুলো জানো না। বুঝতে পারো না। মাঝে মাঝে আমার অবাক লাগে। আমি কি মানুষ!

একটা মানুষের মধ্যে তো অভিমান থাকে, রাগ থাকে, প্রতিশোধের ইচ্ছা থাকে। একটা মানুষের মধ্যে তো ঘণৃা থাকে,বিদ্বেষ থাকে, অবিশ্বাস থাকে। কেবল কি নোনা জলের সমুদ্রই থাকে!

দূরে কোথাও চলে যেতে ইচ্ছে করে। যেখানে কেউ নেই, কিচ্ছু নেই, দুঃখ নেই, সুখ নেই। যেখানে সব কিছু ভুলে থাকা যায়। কষ্টগুলো এভাবে পোড়ায় না। কতটুকু আগুন তুমি আমাকে দিয়েছো, তুমি জানো না। আমি জানি কি হতে যাচ্ছে আমার শরীরে। তুমি এসব বুঝবে না। এসব খুব খারাপ জিনিস। ভাল মানুষদের এসব হয় না, বাজারে সস্তায় বিক্রি হয়ে যাওয়া খারাপ মেয়েমানুষদের হয়।

সকাল



অবকাশ
২০.৮.৮৩

রোদ,
বড় সাধ ছিল তোমাকে রোদ ডাকার। আসলে এ নামে তোমাকে মানায় না। তুমি তো অন্ধকারের মানুষ। তুমি কালো অভিশাপ ডেকে আনো আলোকিত জীবনে। সুন্দর স্বপ্নগুলোয় দুঃস্বপ্নের কালিমা লেপে দাও। তুমি তো জাহান্নামের আগুনের মত, পুড়ে ছাই করে দাও। তুমি তো ভালবাসতে জানো না, তুমি জানো প্রতারণা করতে। তোমাকে বিশ্বাস করা পাপ, তোমাকে ভালবাসা পাপ। এই পাপ আমার শরীরে ঢুকেছে। আমি কেমন জ্বলে মরছি, জ্বালায় যন্ত্রণায় প্রতিনিয়ত আমি ধং্ব স হয়ে যাচ্ছি, তা তো তুমি জানো। আর কতটুকু ধ্বংস দরকার মরতে হলে? আর কতটুকু? বড় সাধনার ধন তুমি। জীবনভর সাধনা করে আমি একটা নষ্ট মানুষ পেয়েছি। আমার ভাগ্য দেখে তোমার হাসি পায় না রোদ, মনে মনে নিশ্চয়ই তুমি অট্টহাসি হাসো।

জানো রোদ, তোমাকে কাছে পেলে আমি, কি অবাক কাণ্ড, সব ভুলে যেতে চাই। আমার আর কোনও আশ্রয় নেই, কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই, আর কোনও পথ নেই ঘুরে দাঁড়াবার—তাই হয়ত ভুলতে চাই—ভাবতে চাই সাজানো স্বপ্নের কথা, অস্বীকার করতে চাই তোমার নষ্ট অতীত। আসলে এভাবে হয় না, নিজের সাথে বেশি অভিনয় হয়ে যায়। বুকের মধ্যে চেপে রাখা কষ্টগুলো আগুন হয়ে ছড়িয়ে পড়ে। তুমি তো ভালবাসতে জানো না, তাই বোঝোনা এ কষ্ট কেমন, কতটা পোড়ায়।

আজ সারা বিকেল প্রাণভরে কেঁদেছি। এখনও কণ্ঠের কাছে কষ্টের মেঘ জমে আছে। পারি না, আমি আর এভাবে পারি না। এখন কেবল দুঃস্বপ্ন দেখি। পুরোপুরি নষ্ট হয়ে যাওয়ার দুঃস্বপ্ন। এখন আর সৃষ্টির স্বপ্ন নয়, এখন ধ্বংসের, ভাঙনের দুঃস্বপ্ন দেখি। কষ্ট ভুলতে লোকে মদ পান করে, আমি প্রচুর মদ চাই। ঘুমোবার জন্য ট্রাংকুলাইজার চাই, সিডেটিভ চাই। এরপর মরবার জন্য একটু বেশি ডোজ হলেই চলবে।

জীবনের প্রতি এক ফোঁটা মোহ নেই, ভালবাসা নেই। আমি তো পাথর হতে চাই, পারি না। চোখের ভেতর পুরো একটা নোনা জলের সমুদ্র।

সে রাতে তুমি যখন অল্প অল্প করে আবেগের তুমুল জোয়ার আনলে, আমার শরীরে কোনও অনুভূতি ছিল না। এইসব ব্যাপারগুলোয় নরমাল সেস্কুয়াল অরগানে যে নরলাম স্টিমুলেশন হয়, তা আমার হচ্ছিল না। আমার মাথার ভেতর কেবল যন্ত্রণা হচ্ছিল। তীব্র যন্ত্রণা। তীব্র যন্ত্রণা।

তুমি কেন ঘুমোওনি? আমার যন্ত্রণায়? ঘুম হয়নি বলে সারা সকাল ঘুমোতে চেষ্টা করলে!

তোমার অনুশোচনা হয় না রোদ? এতটুকু অনুশোচনা হয় না? তোমার মরে যেতে ইচ্ছে হয় না? বিষ খেয়ে মরতে পারো না? তুমি মরে গিয়ে আমাকে একটু বাঁচাও। তুমি মরে গিয়ে আমাকে একটু শান্তি দাও।

সকাল



ইনজেকশনেও কাজ হয়নি, ট্যাবলেটেও নয়। আর কোনও রকম ওষুধের কথা তো বইয়ে লেখা নেই। কাজ না হলে ডাক্তারের কাছে যে যাবো, সে উপায়ও নেই। অতএব ছেড়ে দাও, অসুখ অসুখের মত বেড়ে যাক। বাড়িতে এমন কঠিন লেখাপড়া সম্ভব নয় বলে আমি কাপড় চোপড় বই পত্র নিয়ে হোস্টেলে চলে যাই। বাড়ির সকলের বাধাকে তুচ্ছ করার দুঃসাহস আমি দেখাচ্ছি। আমার ইচ্ছে যাব। ওখানে থেকে যে দল বেঁধে পড়া হয় আমার, তা নয়। সাফিনাজের ঘরে, যে ঘরে ওর আরও তিনজন রুমমেট আছে, সে ঘরেই ঢুকি। চারজনের জায়গায় পাঁচজন। এতে কারও আপত্তি নেই। ওরা জানে আমি প্রাণোচ্ছঅল এক মানুষ। ওরা জানে যে আমি হাসতে জানি, আনন্দ করতে জানি। চমৎকার চমৎকার কথা বলতে জানি। আমার উদাসিনতা যেমন সুন্দর, আমার উচ্ছ্বলতাও। ওরা সব জানে, কেউ জানে না একটি রোগ খুব গোপনে গোপনে আমি পুষছি। এই মেডিকেল কলেজ, এই হাসপাতাল, এই রোগ এই ওষধু এই চিকিৎসার রাজত্যের মধ্যিখানে বাস করেও আমার একটি রোগ পুষতে হচ্ছে। ঘাগুলো ধীরে ধীরে নির্যাস কমাতে থাকে, ধীরে ধীরে বীভৎস চেহারাটির পরিবর্তন করতে থাকে, আবার হঠাৎ ফুলে ফেঁপে ফুঁসে ওঠে। আমার সঙ্গে লুকোচুরি খেলা খেলছে রোগটি। আমার সঙ্গে লুকোচুরি রুদ্রও খেলছে। ঢাকা ফিরে আসবে বলছে, অথচ আসছে না। এক সপ্তাহ পর ফিরবে বলেছে। দুমাস পার হয়ে যায় ফেরার নাম নেই। রুদ্রর চিঠি এখন আর ডালিয়ার ঠিকানায় আসার দরকার হয় না। হাসপাতালের পোস্ট অফিসের ঠিকানায় আসে চিঠি। পোস্ট মাস্টার আমার চিঠি রেখে দেয় যত্ন করে এক পাশে, তুলে নিই দুপুরের দিকে। চিঠির খামে আবারও কবিতা।

জানি না কখন হাতে বিষপাত্র দিয়েছি তোমার,
পিপাসার জল ভেবে তুমি তাকে গ্রহণ করেছ।
জীবনের খামে মোড়া মৃত্যু এনে কখন দিয়েছি
জানি না কখন হাতে দ্রাক্ষা ভেবে দিয়েছি গন্ধম।
রাত নামে, মৃত্যুময় রাত নামে শরীরের ঘরে,
এই রাত জ্যোৎস্নাহীন, জোনাকিও নেই এই রাতে।
কেবল আঁধার, এক ভাঙনের বিশাল আধাঁর,
কেবল মুত্যুর ছায়া স্বপ্নমগ্ন দুটি চোখ জুড়ে।
জানি না গোলাপ ভেবে বিষফুল করবীর স্মৃতি
কখন দিয়েছি তুলে হেমলক-জীবনের ভার,
কখন নিয়েছি টেনে ঘুণেজীণর্ উষর অতীতে—
আজ শুধু শোচনার ম্লান শিখা সেঁজুতি সাজায়।
আধাঁর মরে না এই রুগ্ন ভাঙা আধাঁরের দেশে,
রোদের আকাঙক্ষা বুকে প্রান্তরের পথে নামে তবু
জীবনের গাঢ় তৃষ্ণা অমলিন ঊর্ণনাভ হিয়া—
রাতের আকাশ তবু নিয়ে আসে রোদের সকাল।

হোস্টেলের জীবন অন্য রকম। পড়ার সময় পড়া, গল্পের সময় গল্প, ঘুমের সময় ঘুম। সাফিনাজের নিয়মপালনে কোনও রকম ত্রুটি থাকার জো নেই। আমি এসেই অনেকটা এলোমেলো করে দিই। আমার রুটিন না মানা জীবন, আর হাতের কাছে এত মেয়ে, এত মেয়েদের গার্হস্থ্য জীবন, ব্যক্তিগত, সমষ্টিগত আমার কাছে এত নতুন যে আমি বই থেকে বার বার উঠে যাই, ঘুমের সময় গল্প, পড়ার সময় অট্টহাস্য আর আড্ড ার সময়ও আড্ডা দিতে থাকি। যাদের এপ্রোন পরা দেখেছি এতবছর কলেজ বা হাসপাতালে, এপ্রোন খুলে ফেললে যে তাদের আর সাধারণ মেয়েদের মতই দেখতে লাগে, তখন আর সাধারণ মেয়েদের মতই তারা হাসে কাঁদে অভিমান করে, তারা খায় দায় ঘুমোয়, গান গায় নাচে আউটবই জাতীয় জিনিস পড়ে, তারাও প্রেম করে তারাও স্বপ্ন দেখে—পড়াশোনার চেয়ে বেশি উৎসাহ আমার এসবে। আমি রুদ্রহীন জীবন চাই এখন। যে জীবন আমাকে ভুলে থাকতে দেবে আমার অতীত। আমি নিজেকে একা হতে দিতে চাই না। একা হলেই একটি রোগ আমার শরীর থেকে মাথায় ভ্রমণ করে। আমি আত্মহত্যার স্বপ্ন দেখতে থাকি। তবু হোস্টেলেও মাঝে মাঝে একা হতে হয়। একা হলে আবার সেই রোগটি আমার স্নায়ুর ওপর শুঁয়োপোকার মত হাঁটে। আবার রুদ্র নামের একটি দুঃস্বপ্ন। আবার চোখের জল, সে জল চিঠির অক্ষরে পড়ে অক্ষর মুছে দিতে থাকে।
 
হোস্টেল
১৫.৯.৮৩

রোদ
সেই সকাল থেকে হোস্টেলে বসে আড্ডা দিচ্ছি। খেয়ে দেয়ে এখন সবাই খানিকটা ঘুমোচ্ছে। ঘুম আসছে না বলে আমি লিখছি। তোমার সবকিছু জানিয়ে তুমি নাকি খুব বড় করে আমাকে চিঠি লিখবে, কেন? সব কিছুর শেষে, আমার জীবনের চরম সর্বনাশ করে এখন তুমি তোমাকে জানাবে কেন? আগে জানাতে পারোনি? আগে কেন ভাষার খোলসে ঢেকে রেখেছিলে তোমার আসল আদল? তখন তো নষ্ট হওয়ার মানে বুঝি না, তখন তো অন্ধকারের মানে বুঝি না, উড়নচণ্ডি, এলোমেলো এসবের মানে বুঝি না। তখন কেন স্পষ্ট করে কাঠখোট্টা ভাষায় তুমি আমাকে জানালে না? এসব রকমারি শব্দের আড়ালে কেন তুমি আমার সঙ্গে এতকাল অভিনয় করে গেলে?

আমার আর কি জানার বাকি আছে! কি আর জানা দরকার আমার? আর কি জানাতে চাও? এতকাল বাদে এসব জেনে কি দরকার আমার বলো? তোমার নষ্ট জীবনের কথা আর কতভাবে তুমি আমাকে জানাতে চাও?বিশ্বাস করো আমার মরে যেতে ইচ্ছে করে। যতক্ষণ মেয়েদের সঙ্গে কথা বলি, স্ফূর্তিতে থাকি, ভাল থাকি। বাসায় একা থাকি, কষ্ট বাড়ে। এই হোস্টেলে যদি একটা রুম থাকত আমার, কোনোদিন বাসায় যেতাম না।

তুমি ক্ষমাহীন অন্ধকার কি না আসলে—সন্দেহ প্রকাশ করেছো? আশ্চর্য! তোমার লজ্জা হয় না? তোমার এতটুকু লজ্জা হয় না? তুমি কি মানুষ না জন্তু? তোমার মরতে ইচ্ছে করে না কেন? তুমি ক্ষমাহীন অন্ধকার নও, তবে তুমি কি? তুমি আর কি হতে চাও? পৃথিবীতে এমন কোন দয়ার সাগর আছে তাকে বলো, বলো তোমার কীর্তির কথা, কে তোমাকে ক্ষমা করবে? একটি মানুষ আনো, সারা দেশ ঘুরে তুমি এমন একটি মানুষ এনে আমাকে দেখাও যে বলবে তুমি ক্ষমার যোগ্য, যে বলবে তুমি নষ্ট অন্ধকার নও। পারবে?

তুমি শিল্পের মানুষ জানি। তুমি ভাল কবিতা লেখো, তাতো জানিই। তাতে কি? তোমাকে অন্যভাবে দেখবো মানে? কিভাবে দেখতে বলছো? হ্যাঁ, তুমি যদি আমার কেউ না হতে, তুমি যদি কেবল একটি শিল্পের মানুষই থাকতে, তবে হয়ত অন্যভাবে দেখতাম। তুমি একশ একটা মেয়েমানুষ নিয়ে লীলা করতে, বেশ্যাবাড়ি যেতে, তোমার সিফিলিস হতো, তুমি মদ খেতে, গাঁজা খেতে—তাতে আমার কোনোকিছু আসতো যেতো না। তোমার ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে আমার কোনো মাথাব্যথা থাকতো না। তুমি শিল্পের মানুষ। তুমি যা সৃষ্টি করছ, তুমি যা লিখছ, আমি কেবল তা নিয়েই ভাবতাম। কিন্তু তুমি আমার স্বামী। তুমি শিল্পের হও, অশিল্পের হও, তুমি আমার স্বামী। তুমি অন্য কোনো মেয়েমানুষ নিয়ে ভাবলে, কবিতা লিখলে, বুকে বড় লাগে। তুমি গাঁজা খাও, মদ খাও, দুঃখে কাঁদি। আর কত? বিয়ের আগে হাজারটা মেয়ের সাথে প্রেম করেছো, তাতে ক্ষতি নেই, কিন্তু মেয়ে নিয়ে স্বামী স্ত্রীর মত রাত কাটিয়েছো, উপভোগ করেছো অন্য কোনো নারীর শরীর, বিশ্বাস করো এসব সহ্য করা যায় না। প্রেমে মত্ত হয়ে কোনো মেয়েকে বিয়ে করার জন্য উন্মাদ হয়ে উঠেছিলে একথা শুনলে বুকের ভেতরটা ভেঙে যায়। আমাকে বিয়ে করেছো অথচ তুমি নিয়মিত মদ খাও, বেশ্যাবাড়িতে যাও, এসব তো কোনোকালে কল্পনাও করিনি। এসব কোনো মেয়ে সহ্য করতে পারে না, কোনো মেয়েই পারে না, বিশ্বাস করো। তুমি এক্সাইটেড হবে ভাল কথা, অস্বাভাবিক তো কিছু নয়, তুমি মাস্টারবেট করো। তুমি বেশ্যার কাছে যাবে কেন? তুমি আমাকে এত বড় অপমান করবে কেন?

আমাকে ধোঁকা দিয়ে এতটা পথ এনে তুমি তোমার স্বরূপ দেখালে? এ আমার নারীত্বের অপমান। কোনো মেয়েই এসব সহ্য করতে পারে না। কোনো স্ত্রী এসব সহ্য করতে পারেনা। তুমি আমার কাছে ধরা পড়ে গিয়েও বহুবার মিথ্যে বলার চেষ্টা করেছো। মিথ্যে বলাটাকে আমি দারুণ ঘণৃা করি। অথচ তুিম কি অনায়াসে বলে যেতে পারো, নিজেকে কি সুন্দর লুকোতে পারো! অন্য কোনো মেয়ে এ সময়ে কি করত আমি জানি না। সহ্য করার প্রশ্নই তো ওঠে না এখানে। তবে এটা নিশ্চিত, তোমার মত স্বামী নামক প্রতারকের কাছে কেউ এক মুহূতর্ থাকত না। হয় তোমাকে বিষ খাইয়ে মেরে ফেলত, নয় নিজে মরত। নয়ত বেরিয়ে গিয়ে অন্য কোনোভাবে কেঁচে থাকত। কিন্তু আমি কেন এখনো নিজেকে মুক্ত করছি না—ভাবলে আমার অবাক লাগে। আমার কিসের অভাব? তোমাকে ছাড়া আমার জীবন যাপনের এতটুকু হেরফের হবে না। তবে? আসলে বোধহয় আমি খুব ভীরু, পাছে লোকে কিছু বলে এসব ভাবি। অথচ এদুটোকে অস্বীকার করেই তোমাকে ভালবেসেছিলাম। আমি তো তোমার রূপ দেখিনি, কেবল শিল্প দেখেছি, আমি তো তোমার ধন দেখিনি, তোমার শিল্প দেখেছি। তোমাকে সম্পণূর্ আমার করে নিয়েছি।

এখন দুজনের আবেগঘন মুহূর্তে স্মৃতিচারণ এলেই তোমার অতীত খুঁড়ে বের করে আনো পচা গলা নষ্ট জীবন, আমি সহ্য করতে পারি না। তুমি আমাকে কি চমৎকার অসুখ দিলে, এ আমার ভেতর শক্ত খুঁটি গেড়ে বাসা বেঁধেছে। আর কি দেবে তুমি আমাকে? আমার জীবন কি শেষ হয়নি, আমার ভবিষ্যত? আমার তো স্বপ্ন শেষ, সাধ শেষ।

তুমি লিখেছো, সব লিখবে, সব।

কি লিখবে? কি জানাবে? তোমার জীবন জেনে আর আমার কি লাভ? তোমার জীবনে তো আমার জন্য একনিষ্ঠতা নেই, ভাল থাকা নেই, ভালবাসা নেই। আমার স্বপ্নের সেই সুন্দর মানুষ তো তুমি আর হতে পারো না!

তোমার জীবন জানলে কি হবে আমার? কি ফিরে পাবো আমি? তুমি তো আমাকে কোনওদিন ভালবাসোনি। নাছোড়বান্দার মত একগুঁয়ে হয়ে তোমাকে ভালবেসেছি কেবল আমিই। তুমি আমাকে ভালবেসে মানুষ হতে পারোনি। কবিতা লিখেই কি তুমি আমাকে স্ত্রীর মর্যাদা দিতে চাও, শুধু তোমার কবিতা দিয়েই কি আমার নারীত্ব সার্থক করতে চাও? কোনো মেয়ে কি এভাবে চায়?

তুমি তো বোঝোনা, নারী হয়ে দেখোনি, স্ত্রী হয়ে দেখোনি, এই ব্যাপারগুলো ধ্বংস করে দেয়, জ্বালিয়ে ছারখার করে দেয় মন। তোমার ভালবাসা পাইনি। তোমার ভালথাকা পাইনি আমার জন্য। তবে কিসের বিশ্বাস থাকে? তুমি অবিশ্বাসের আর প্রতারণার ওপর কি ঘর বানাতে চাও?

তাইতো তোমাকে বলেছি, তুমি বন্ধু হিসেবে চমৎকার। কিন্তু স্বামী হিসেবে তোমাকে কোনো মেয়েই সহ্য করতে পারবে না। পারে না। আনো সারা দুনিয়া খুঁজে আনো এমন একটি মেয়ে যে কি না তোমাকে বলবে—তুমি শিল্পের মানুষ বলে তোমাকে অন্যভাবে দেখা যায়।

এতই যদি অন্যের উদারতা পেতে চাও তবে নিজে তুমি উদারতা দেখালে না কেন? কেন যুদ্ধে ধর্ষিতা কোনো বীরাঙ্গনা নারীকে বিয়ে করলে না? কেন অভাব ও দুর্দশা থেকে একজন বেশ্যাকে বিয়ে করে বাঁচালে না? কেন স্বামী পরিত্যক্তা গৃহহারা কোনো অভাগীকে বিয়ে করে সমাজ ও দেশের উপকার করলে না? দেখাও, কালো কুচ্ছিত একটি আইবুড়ি বিয়ে না হওয়া মেয়েকে বিয়ে করে, রাস্তার একটি অনাথ ভিখিরি মেয়েকে বিয়ে করে দেখাও। অথবা নিজের স্ত্রীকে একশ একটা পরপুরুষের কাছে সঁপে দাও, এরকম উদারতা এখন দেখাও! আমার এতে কিছু যায় আসে না। তোমার কোনো কিছুতে এখন আমার কিছু যায় আসে না। তবে অন্যের উদারতা আশা করার আগে নিজের ওই উদারতাটুকু আমাকে দয়া করে দেখিও।

সকাল



আমি ফিরব না রুদ্র, মনে মনে বলি। আমি আর ফিরব না, আমি নৈঃশব্দের সঙ্গে বেঁধেছি ঘর। তুমি আমাকে আর ওই নষ্ট অতীত স্মরণ করিও না। আমাকে একা থাকতে দাও। রুদ্র আমাকে একা থাকতে দেয় না তবু। তবু তার কবিতা এসে আমাকে বিষণ্ন করতে থাকে।

নীরবতা কোনও এক উদাসীন পাথরের নাম—
অহল্যা সে কোনওদিন জানি আর হবে না জীবন।
হবে না সে পারিজাত, কোনোদিন হবে না সকাল,
দিন আর নিশিথের সন্ধিক্ষণে থেকে যাবে জানি—
অহল্যা সে চিরকাল থেকে যাবে, রক্ত মাংস নিয়ে।
যাবে না সে দগ্ধ ক্ষুব্ধ মানুষের মিছিলে কখনও,
পোড়া মানুষের ক্ষত, রক্ত, গ্লানি বুকে সে নেবে না,
যাবে না সে জানি আর কোনওদিন সবুজ নিভৃতে।
ছোঁবে না সে চিবুকের থরো থরো বিষণ্ন উত্তাপ,
সেই হাত কখনও ছোঁবে না আর উদাসীন চুল।
নিঃশ্বাসের ঘ্রাণে আর জাগবে না ভেজা চোখ দুটি,
নক্ষত্রের স্মৃতি শুধু বেঁচে রবে স্নায়ুর তিমিরে।
হবে না বেহুলা জানি সে কখনও গাঙুরের জলে
ভাসবে না ভেলা তার, ভাসবে না স্বপ্নের সাহস,
বেহুলার স্বপ্ন-ভেলা কোনওদিন জলে ভাসবে না—
নীরবতা কার নাম? কার নামে নির্বাসন জ্বলে?

রুদ্র মোংলা থেকে ফিরে এলে হোস্টেল থেকে ঢাকা চলে যাই। বাড়ির কাউকে বলার প্রয়োজন নেই যে আমি ঢাকা যাচ্ছি। কেন যাচ্ছি সে কথাও কেউ জিজ্ঞেস করার নেই। যাচ্ছি, আমার ইচ্ছে। এই উত্তরটিও আমার প্রয়োজন নেই উচ্চারণ করার। মাসের পর মাস ধরে পুষে রাখা অসুখ টি এখন কোথায় গিয়ে পৌঁছেছে দেখতে হবে। কোনও ডাক্তার চাই, অচেনা ডাক্তার। শাহবাগের মোড়ের একটি ডাক্তারের চেম্বারে রুদ্র আমাকে নিয়ে যায়। ডাক্তারকে সে বলে, এ অসুস্থ। কোথাও ঘা হয়েছে, যাচ্ছে না।

ডাক্তার জিজ্ঞেস করলেন, কোথায় ঘা?

রুদ্র আমার দিকে ফিরে বলে, কোথায় ঘা বল।

তুমি বল।

রুদ্র ডাক্তারের দিকে ফিরে বলে, ওর প্রাইভেট পার্টসে।

কবে হয়েছে? কি রকম ঘা? ডাক্তার জিজ্ঞেস করলেন।

রুদ্র তারিখ গোনার চেষ্টা করে। আঙুলের কড়ায় মাস গোনে। আমি ওকে থামিয়ে দিয়ে কোনওরকম রাখঢাক না করেই বলি, এ আমার স্বামী, এর সিফিলিস হয়েছিল, আমাকে সংক্রামিত করেছে। পেনিসিলিন নিয়েছিলাম। কিন্তু এখনো ভাল হচ্ছি না।

ও এই কথা।

ডাক্তার অনেকক্ষণ আমাদের দুজনকে দেখলেন বোকার মত। তিনি আগে আমাদের দেখেছেন এ এলাকায়, তার চোখ দেখেই বুঝি। ডাক্তার রক্ত পরীক্ষার কথা লিখে দেন। রক্ত দিয়ে, তাজমহল রোড মুহম্মদপুর। ওখানে বসে থাকো। ওখানে কবিতা পড়ো। ওখানে রুদ্রর সংসার -স্বপ্ন দেখো। রুদ্র থাল বাসন কিনবে। এ বাড়িতে সংসার গড়ে তুলবে সে। ছোট সংসার,সুখী সংসার। রুদ্র আপাদমস্তক শুদ্ধ হয়ে উঠবে। আমাকে আর কোনওদিন দুঃখ পেতে হবে না। কোনওদিন কষ্ট পেতে হবে না আর। একবার যেন আমি তাকে ক্ষমা করি। ক্ষমা জিনিসটি নিয়ে তাকে আগেই আমি বলেছি। রুদ্রর মেয়েমানুষের নেশা আছে, মেয়েমানুষ পেলে তার মাংস নিয়ে খেলতে তার আনন্দ হয়। এ তার হঠাৎ করে হয়ে যাওয়া কোনও ভুল নয়। নিজের জীবনের সব কথা যদি সে আগে খুলে বলত, আমি আমার জীবনটি তার সঙ্গে জড়াতাম না। কিন্তু সে বলেনি। ভুল সেখানে। ভুল তার নেশায় নয়। এ সম্পণূর্ ই তার ব্যক্তিগত নেশা। এ রকম নেশা মানুষের থাকে। তার নেশাকে আমি দোষ দিচ্ছি না। দিচ্ছি তার প্রতারণাকে। এই প্রতারণার একটিই উত্তর, সেটি তাকে ত্যাগ করা। ভেরি সিম্পল।

ভিডিআরএল পজিটিভ।

আবারও ইনজেকশন নিতে হল। একদিন নয়। তিনদিন।

তিনদিন পর ময়মনসিংহে ফিরি। হোস্টেলে। কাউকে জবাব দিতে হয় না কোথায় ছিলাম, কার কাছে। একধরনের মুক্ত জীবন। অথচ এই জীবনটিকে রুদ্রর বিষাক্ত হাওয়ায় আমি উড়তে দিই না। একটি মুক্ত জীবনের সাধ ছিল কত, পেলে যেন ঢাকার সাহিত্য অঙ্গন সাংস্কৃতিক চত্ত্বর চষে বেড়াবো। কই! আমার তো একটওু ইচ্ছে করে না। আমি ফিরে আসি, রুদ্র পেছনে নিজের ওই ঘরে বসে লেখে,

বুকের ভেতরে জ্বলে, জ্বলে ওঠে নির্বাসন -শিখা।
পরান পোড়ায়ে আজ নির্বাসনে চলেছে সকাল
শরীর পোড়ায়ে আজ নির্বাসনে চলেছে সকাল
পৃথিবী আঁধার করে নির্বাসনে চলেছে সকাল..
কুসুমের মর্মমূল ছিঁড়ে গেছে গোপন-ঘাতক।
দখল নিয়েছে ঘণু আজ নীল নক্ষত্রের দেশে,
নিয়েছে রঙিন ঘুড়ি ছিঁড়ে ওই দিগন্তের গ্রাম,
ফিরে আসে ব্যথর্ সুতো, ফিরে আসে স্বপ্নভাঙা হিয়া।
বিষের পেয়ালা হাতে দাঁড়িয়েছে ঘাতক সময়—
নগ্ন এই দুই চোখে সর্বনাশা অপচয় জ্বলে,
সময় দিয়েছে তুলে এই হাতে অফুরন্ত ক্লেদ,
দিয়েছে রক্তে মাংসে জীবনের তপ্ত অন্ধকার।
ঘোর কৃষ্ণপক্ষ রাত, দুঃসাহসে ছুঁয়েছিল তবু
আধাঁরে পুড়েছে আজ স্বপ্ন তার নিভৃত নগর,
আধাঁরে পুড়েছে তার বিশ্বাসের সবুজ নিখিল।
স্বপ্নহীন পোড়া ভিটে, পোড়া ঘর—কে ফেরাবে তারে?

কেবল কবিতা নয়। রুদ্রর পর পর অনেকগুলো চিঠির উত্তর লিখতে বসি। ঘা সেরে যাওয়া রুদ্র এখন মরিয়া হয়ে সংসারের স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছে। ঘা সেরে যেতেই সে ভুলে গেছে আমাদের দুজনের মাঝখানে এখন একটি রোগ না থাক রোগের স্মৃতি আছে। মাঝখানে একটি দগদগে অবিশ্বাস আছে। আমার ভোলা হয় না।

অবকাশ
৪.১০.৮৩

রোদ,
বাসায় চলে এসেছি আজ দুপুরে। আসলে বাসা ছাড়া অন্য কোথাও আমার পক্ষে থাকা সম্ভব নয়। বড়জোর দুদিন কিম্বা তিনদিন। শেষ পর্যন্ত হোস্টেলেও থাকতে পারিনি। আসলে সারা জীবন যে পরিবেশে অভ্যস্ত হয়ে গেছি, হঠাৎ করে তার পরিবর্তন সহ্য করা যায় না। শুধু বিছানায় শুয়ে, টেবিলে পড়ার বই পড়ে আমার জীবন এগোতে চায় না। প্রচুর আড্ডা আছে, আনন্দ আছে। কিন্তু জীবন এগোতে চায় না। আমার যখন ইচ্ছে যেমন ইচ্ছে পা ছড়িয়ে অথবা পা গুটিয়ে শুয়ে থাকব, একাডেমিক পড়াশোনার বাইরে আমার বহুকিছু পড়ার আছে, করার আছে। আমার লিখতে হয়, আমার মাথার মথ্যে দুলক্ষ ভাবনা চিন্তুা এলোমেলো নাচানাচি করে একেবারে নিশব্দে আমাকে একা থাকতে হয়।

যাবতীয় ঝুটঝামেলা, একশ একটা কাজের কাজ ফেলে আমাকে উদাসীন হতে হয়— এ আমার চিরকেলে স্বভাব। তাই বাসা ছেড়ে অন্য কোথাও নিজেকে খাপ খাওয়াতে পারি না। এখানে আমার নিজস্ব একটাজট পাকানো আগোছালো সংসার আছে। আমি একাই এর অধিশ্বর। আমার এই নানান ধরণের বইয়ে কাগজে এলোমেলো ধুলোবালির বিছানায় খানিকটা কিনার করে শোয়ার জায়গা করে নিই, গভীর সুনিদ্রায় রাত্রি পেরোয়। অথচ সাজানো গোছানো পরিপাটি অন্য বিছানায় আমার একরত্তি ঘুম আসে না। অস্বস্তিতে এপাশ ওপাশ করে কষ্টের রাত্রি পেরোয়।

বইখাতার কোনো ঠিক নেই। কিচ্ছু ঠিকঠাক খুঁজে পাই না, একটি আকাশে তো আরেকটি পাতালে। একটি এ মাথায়, আরেকটি ও মাথায়। তবু পড়াশোনা হয়। খুব অল্প সময় গভীর মনোযোগে পড়তে পারি।

এটা ঠিক নয় যে বাড়িসুদ্ধ লোক সবাই আমাকে খুব ভালবাসে, স্নেহ করে, আমার প্রয়োজন আমার সুবিধে অসুবিধে একটু বিচার করেদেখে। তা কেউ করে না। সম্ভবত এ বাড়িতে আমি একটি অহেতুক অপ্রেয়োজনীয় মানুষ হিসেবে বেঁচে থাকছি। এটা ঠিক যে আমি এখন মরে গেলেও এ বাড়ির কেউ একফোঁটা কাঁদবে না, এতে কারো কিছু যায় আসে না। আমি খুব বেশিরকম অপরাধি মানুষ বলে এ বাড়ির সকলে ভাবে। ইদানিং এসব আর গায়ে মাখি না। আদরিণী কন্যার মত এখন আর কারো কাছে কোনোকিছুর আবদার করি না। কোনো কিছু নিয়ে অনুযোগ করি না। আমার একা থাকার এবং ভাবনার রাজ্যে অবাধ বিচরণের সময়সীমা আরো বৃদ্ধি পেয়েছে বলে আমি এদের কাছে কৃতজ্ঞ। আসলে হোস্টেলের শাদামাটা গোছানো জীবনে আমার দমবন্ধ হয়ে আসে। যেন খাঁচা থেকে উড়াল দিয়ে বনের পাখি বনে পালাতে চাই।

তোমার ঘরেও অবিকল একই অবস্থা। আমার দম বন্ধ হয়ে যায়। পারি না। আমার ভাল লাগে না। বড়জোর দুদিন, এরপর সবকিছু অসহ্য লাগে আমার। এমনকি তোমাকেও, তোমার চালচলন, কথাবার্তা সব।

যে চরম পর্যায়ে আমাকে নিয়ে তুমি নিজেকে দমন করতে পারো, আমি পারি না। তাই অজান্তে ওই চরম ভুলটি হয়ে গেল। এতে এখন অবশ্য আমার একটি লাভ হয়েছে, তা হলো, এসবে চরম বিতৃষ্ণা এসেছে। আমি এখন খুব সহজেই স্বাভাবিক তৃষ্ণাগুলোকে অনায়াসে দমন করতে পারি। এ আমার জন্য খুব লাভ হল। কিন্তু লাভ ছাড়া যে ক্ষতিটা হয়ে গেল এবং অল্প কদিনের মধ্যে যা আমি হাড়ে হাড়ে টের পাবো সে ক্ষতি থেকে আমাকে তুমি যে করেই হোক দয়া করে বাঁচিয়ো। অন্তত একটু নির্ভরতা থাকলে শান্তি পাবো।

ব্যস, আর কিছু চাই না। যে অসুখ টি যাচ্ছে না এবং যাবে না তা নিয়ে অযথা ঢাকা ময়মনসিংহ করে লাভ নেই। কারণ ও রোগ যাবে না। ও রোগ নাছোড়বান্দার মত আমার গায়ে সেঁটেছে। আমাকে বিনাশ করে তবেই ওর সুখ ।

সেই যে বলেছিলাম হুট করে আবেগে আবেগে কিছু একটা করে আমাকে সারাজীবন পস্তাতে হয়। ঠিক তাই। যদি উদাহরণ চাও বলব, তোমাকে চিঠি লিখেছি, তোমার সঙ্গে প্রেম করেছি, তোমাকে বিয়ে করেছি, তোমাদের বাড়িতে গিয়েছি, নিজেকে সমপর্ণ করেছি.. মাঝে মাঝে প্রশ্ন করি নিজেকেই কার কাছে সমপর্ণ করেছি?: এর কি উত্তর আমি দেব? চারপাশ থেকে হা হা হাস্যধ্বনি ওঠে।

এর কোনো সদুত্তর আমি জানি না। লোকে বলে, অতি সোজা মানুষ যদি একবার বেঁকে বসে তখন আর রক্ষে থাকে না। একবার বেঁকে বসতে ইচ্ছে করে। একবার তছনছ করে, চুরমার করে ভাঙতে ইচ্ছে করে তোমার সাজানো স্বপ্ন। একবার জ্বালাতে ইচ্ছে করে তোমার সংসার। আমাকে যেমন ভেঙেছো, আমাকে যতটা কাঁদিয়েছো, ততটা তোমাকে কাঁদাতে ইচ্ছে করে। কষ্টের আগুনে পোড়াতে ইচ্ছে করে। কেন ইচ্ছে করবে না বলো? আমি তো মানুষ, দেবতা নই। দেবতা নেই বলে আমি তোমার ঘরে যাবো না। সুন্দর সাজানো গোছানো ব্যাপার স্যাপার, বাড়ি যাওয়া, বিয়ের অনুষ্ঠান, সামাজিকতা, দীর্ঘদিন থেকে খেয়ে বিশ্রাম নেওয়া, ঢাকায় প্রেসের কাজ, হাঁড়িকুড়ি কেনা, রান্নাবান্না, ঘরে খাওয়া, নিয়মমাফিক ঘরে ফেরা, রাত হলে বউকে নিয়ে শুয়ে থাকা—ইত্যাদি কোনোকিছুই আমি হতে দেব না। এতো সহজেই তোমার মত মানুষের হাতে সুখের পাখি ধরা দিক, তা আমি চাই না। তোমার জন্য কেন আমি বাড়ির সবাইকে ফাঁকি দিয়ে আত্মীয় স্বজন বন্ধু বান্ধব সবাইকে ফাঁকি দিয়ে, আমার এই এতদিনকার প্রিয় আগোছালো জীবন থেকে চলে যাবো প্রেমে মত্ত উন্মাদিনীর মত? তুমি আমাকে কি দিয়েছো এবং কি দেবে? যার বিনিময়ে এমন করে তোমার সঙ্গে চলে যাওয়ার সাহস আমি করতে পারি! তুমি কি কারণ দেখাবে? ওই একটি সই করা বিয়ের কাগজ! ঠিক ওরকম একটি সই করা তালাকনামাও পাওয়া যায়! এ কথা নিশ্চয়ই জানো। যদি বলো এদ্দিনকার মেলামেশা! আমি বলব ভুল। শুরু থেকে সবটাই আমার ভুল। হুট করে আবেগে আবেগে কিছু একটা করে ফেলা।

আমি তো মানুষ, দেবতা নই। তাই ভুল করেছি। এবং ভুল থেকে নিজেকে মুক্ত করার সাহসও আছে। একটু সাহস তুমি আমার থাকতে দাও। তুমি তোমার পরিকল্পনাগুলো বাদ দিয়ে দাও। আমি আমার এই বিরুদ্ধ পরিবেশকে যথাসম্ভব মানিয়ে নিয়েছি। একা থাকতে আমার এখন ভাল লাগে। চারপাশের শত্রুতা থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখত দারুন একটা সুখ । এখানে আমি কারো সাতে পাঁচে নেই। আমার জন্য কেউ ভাবে না, আমি ও কারো জন্য ভাবি না। ব্যস সুন্দর কেটে যাচ্ছে।

প্রেম করে ঘর ছাড়ব, অতবড় প্রেমিক তুমি হতে পারোনি। লক্ষ্মী স্ত্রী হয়ে সংসারে মন দেব, অত বড় স্বামী তুমি হতে পারোনি। তোমার জন্য জীবন বাজি রেখে পৃথিবীসুদ্ধ তুলকালাম কাণ্ড বাঁধাবো, অতটুকু মানুষ তুমি হতে পারোনি।

তোমার ঘরের চেয়ে আমার এই ঘরে সুখ না থাক, শান্তি আছে। এখনো আমার সুনিদ্রা হয়। তোমার কাছ থেকে দূরে থেকে, আমার ভুলগুলোকে আমি ভুলে থাকতে পারবো। আর যেভাবেই আমি বেঁচে থাকি না কেন, ভাল থাকব। এটুকু নিশ্চয়তা তোমাকে আমি দিতে পারি। আমার কোথাও যাওয়ার প্রয়োজন নেই। আমি আমার ঘরে ফিরে এসেছি। আমি আমার মা বাবা ভাই বোনের কাছে ফিরে এসেছি—তা কিন্তু নয়। আমি আমার কাছেই ফিরে এসেছি। এবং বাকিটা জীবন আমি আমার কাছেই থাকব। পৃথিবীতে আমার চেয়ে বেশি আমাকে আর কেউ ভালবাসে না। আমি ছাড়া আমার সবচেয়ে আপন আর কেউ নেই।

তুমি আমাকে ভুলে যেও। অঘটন এ যাবৎ বহু ঘটেছে, আর ঘটাতে চেষ্টা কোরো না। দয়া করে আমাকে ভুলে যেয়ে আমাকে বাঁচাও।

আমি তো মানুষ। মানূষ বলেই বহুদিন বেঁচে থাকতে ইচ্ছে করে।

সকাল



আমি যখন বেঁচে থাকায় মন দিয়েছি, রুদ্র ময়মনসিংহে এল। এল কিন্তু কিছুই আর আগের মত নয়। আমাদের সেই আগের মত দেখা করা, আবার আগের মত ভালবাসার হাওয়ায় হাওয়ায় দোলা, চেয়ে থাকা দুজনের চোখে কথাহীন শব্দহীন কিছুই হয় না। মাসুদের বাড়িতে বসে যে কবিতাটি লেখে সে, ঢাকা ফেরত যাবার সময় আমাকে ডাকে পাঠিয়ে যায়। কবিতাটি যখন বাড়ির ছাদে বসে সূর্যাস্তের মুছে যেতে থাকা আলোয় পড়ছিলাম, হু হু করে ওঠে বুকের ভেতর। তার প্রতিটি শব্দ আমাকে স্পর্শ করে। একা আমি কাঁদি বসে, অনেকক্ষণ কাঁদি, নিজের জন্য কাঁদি, রুদ্রর জন্য কাঁদি।

তোমাকে ফেরাবে প্রেম, মাঝরাতে চোখের শিশির,
বুকের গহীন ক্ষত, পোড়া চাঁদ তোমাকে ফেরাবে।
ভালবাসা ডাক দেবে আশ্বিনের উদাসীন মেঘ,
তোমাকে ফেরাবে স্বপ্ন, পারিজাত, মাটির কুসুম।
তোমাকে ফেরাবে প্রাণ, এই প্রাণ নিষিদ্ধ গন্ধম,
তোমাকে ফেরাবে চোখ, এই চোখ শাণিত আগুন,
তোমাকে ফেরাবে হাত, এই হাত নিপুণ নির্মাণে,
তোমাকে ফেরাবে তনু এই তনু নিকষিত হেম।
তোমাকে ফেরাবে ওই নিশিথের নিদ্রাহীন পাখি,
বুকের বাপাঁশে জমা কালো এক কষ্টের কফিন,
তোমাকে ফেরাবে ফেনা, সমুদ্রের আদিগন্ত সাধ,
সৌরভের ভেজা চোখ, নীলমাছি ফেরাবে তোমাকে।
এই বিষ-কাঁটালতা ভালবেসে আগলাবে পথ,
ঝরা শেফালির শব পড়ে রবে পথের উপর,
নিভৃত অঙ্গার এক চিরকাল তোমাকে ফেরাবে,
অনুতপ্ত অন্ধকার মৃত্যু ছুঁয়ে ফেরাবে সকাল।

নির্বাসন আমার জন্য নয়। ট্রিপোনেমা পেলিডাম যত শক্তিমানই হোক, এর শক্তি নেই রুদ্রর জন্য আমার ভালবাসাকে এতটুকু মলিন করে। জীবনে মানুষ একবারই সম্ভবত ভালবাসতে পারে, বার বার পারে না। আর কারওর জন্য তো বুকের ভেতর এত কষ্ট জমে না, আর কারওর জন্য তো চোখের জল এমন ঝরে না! রুদ্রর ভালবাসাই আমাকে ফিরিয়েছে, আর কিছু নয়। আমি তার ভালবাসার কাছেই হেরে যেতে পারি। রুদ্রকে ঘৃণা করতে চেয়েছি প্রাণপণে, পারিনি। তার কবিতার প্রতিটি শব্দ আমার সেই চাওয়াকে দূরদূরান্তে উড়িয়ে দিয়েছে। সূর্যাস্তের দিকে জল-চোখে চেয়ে নতুন একটি দিনের কথা ভাবি। সব অন্ধকার ধুয়ে দিয়ে যে দিনটি কাল আসবে, সে দিনটি নিশ্চয় অন্যরকম হবে।
 
১৯. নিষেধের বেড়া


নিষেধ কেন! শুদ্ধ সুন্দর থাকার জন্যই তো! এ ব্যাপারটির সঙ্গে সম্পর্কে আমার জন্মের মত চুকেছে। আর তবে কি কারণে আমার ওপর আদেশ নিষেধ! কিসের জন্য আমি বাবা মার আদেশ নিষেধ পালন করতে যাব। ওঁদের তো আর ভয়ের কিছু নেই। যে কারণে ভয় তার চেয়ে অনেক বড় কিছু ঘটে গেছে আমার জীবনে। আমার জন্য আর সতর্কে থাকার কিছু নেই। নিষেধ আরোপ করেই বা লাভ কি!নিষেধের বেড়া আমি পার হই। বেড়া ডিঙিয়ে ঘাস না খাই, বেড়া ডিঙিয়ে রুদ্রকে অবকাশে নিয়ে যাই। সবাই দেখুক কাকে আমি ভালবাসি, সবাই জানুক যখন জানতেই হবে একদিন, যখন ডাক্তারি পাশ করে তার কাছে যেতেই হবে সারাজীবনের জন্য! রুদ্রর সঙ্গে কারও পরিচয় করিয়ে দেওয়ার উদ্দেশ্যেও রুদ্রকে নিয়ে যাওয়া নয় বাড়িতে। অবকাশে হরদম আমার ক্লাসের বন্ধুরা আসছে। কেবল বন্ধুরাই নয়, বড় ক্লাসের ভাইরা জ্ঞান দিতে আসেন, ছোট ক্লাসের ভাইরা জ্ঞান নিতে আসে। কারও জন্য বাধা নয় আর অবকাশ, বাবা হয়ত অনেককে দেখে আড়ালে দাঁতে দাঁত ঘঁত্রে, কিন্তু সামনে কখনও নয়, তিনি নিস্পৃহতা দেখান, দেখিয়েছেন কিন্তু কাউকে তাড়িয়ে দিতে পারেননি, কাউকে মুখের ওপর বলতে পারেননি চলে যাও, ছাত্র শিক্ষক সম্পর্কটিই বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। কৃতিত্ব আমারও আছে, আমিই সেই মেডিকেলের প্রথম বর্ষ থেকে একটু একটু করে এ বাড়িতে চোখ সওয়া করেছি ছেলেপিলেদের উপস্থিতির, কেবল রুদ্রর জন্যই অলিখিত নিষেধাজ্ঞা ছিল, রুদ্রর জন্যই ভয় ছিল আমার, এই ভয়টি আমার হঠাৎ করেই উবে গেছে, তাই নিষেধাজ্ঞাটি ডিঙোতে আমার বুক ধুকপুক করে না। ইয়াসমিন বাড়িতে ছিল। মাও ছিলেন। কিন্তু রুদ্রর সামনে কারও যাওয়া হয়নি। তার চা খাওয়া হয়নি। চা খেতে খেতে বাড়িতে আসা আর ছেলেরা যেমন গল্প করে আমার সঙ্গে, তেমন করা হয়নি। কারণ বাবা এসেছেন। এই দুপুরবেলার সাড়ে বারোটায় চরম অসময়ে বাবার বাড়ি আসার কোনও কারণ নেই তবওু এসেছেন তিনি। আমরা দুজন তখন কেবল বাড়িতে ঢুকেছি। বাইরের দরজা তখনো হাট করে খোলা। রুদ্র কেবল সোফায় বসেছে। আমি কেবল বৈঠকঘর পার হয়ে ভেতর বারান্দায় দাঁড়িয়ে চাএর কথা বলতে যাবো লিলিকে বা নার্গিসকে বা সুফিকে বা মাকে, তখন কালো ফটক খোলার শব্দ শুনে ঘুরে দাঁড়িয়ে দেখি বাবা হেঁটে আসছেন মাঠ পেরিয়ে সিঁড়ি পেরিয়ে বারান্দাঘর পেরিয়ে বৈঠকঘরের দিকে। রুদ্রকে দেখলেন তিনি,বিস্ফারিত দু চোখ রুদ্রর দিকে ফেলে, তর্জনি কালো ফটকের দিকে তুলে, সারা বাড়ি কাঁপিয়ে তিনি বললেন, গেট আউট। বাবার চিৎকারে রান্নাঘর থেকে ছুটে এলেন মা, শোবার ঘর থেকে ইয়াসমিন। রুদ্র কালো ফটকের বাইরে অদৃশ্য হতেই আমি সকলকে হতবাক করে দিয়ে ফটকের দিকে হেঁটে যাই। পেছনে বাবার রক্ত চোখ, পেছনে তর্জনি, পেছনে মার আর্তচিৎকার নাসরিন যাইস না, ফিইরা আয়, পেছনে ইয়াসমিনের বুবু বুবু বলে আমাকে ফেরাতে চাওয়া।

পিচ গলছে রাস্তায়। গোলপুকুর পাড়ের দিকে হাঁটতে থাকা রুদ্রর কাছে পৌঁছোই আমি, রুদ্র ফুঁসছে রাগে। আমি যে নিষেধের এই বেড়া ডিঙিয়ে তার কাছে চলে এলাম, আমি যে একদিকে বাবা মা বোন আরেক দিকে রুদ্র এ দুজনের মধ্যে রুদ্রকে বেছে নিলাম, এ যে কত বড় একটি পদক্ষেপ আমার, এ সম্ভবত তার পক্ষে বোঝা সম্ভব হয়নি। আমি যে সবল অস্বীকার করলাম তাঁকে যাকে আমি সবচেয়ে বেশি শ্রদ্ধা করি, যিনি আমার জীবনটি গড়ে তুলতে সবচেয়ে বেশি সাহায্য করছেন, তাঁরই আদেশ জীবনে এই প্রথম আমি অমান্য করার সাহস করেছি, তাঁরই রক্তচক্ষুকে জীবনে এই প্রথম আমি পরোয়া করিনি, তাঁরই অহঙ্কার আমি চুড়ো থেকে এক ধাক্কায় ফেলে দিয়েছি মাটিতে, তাঁরই সম্মান আমি আজ ধুলোয় মিশিয়ে দিয়েছি, তাঁরই স্বপ্ন আমি আজ ভেঙে টুকরো করেছি, বোঝা সম্ভব নয় বলেই রুদ্র বলে, আমাকে অপমান করতে বাড়িতে নিয়েছিলে তুমি! না অপমান করতে নয়। আমি তো জানতাম না বাবা অমন হঠাৎ বাড়ি আসবেন! তুমিই তো চাইতে অবকাশে যেতে, বাবার সঙ্গে দেখা করতে! চাইতে তো! চাইতে না! গোলপুকুর পাড়ের আগুনে রাস্তা থেকে একটি রিক্সা নিয়ে সোজা বাসস্ট্যান্ডের দিকে দুজন। কোনও প্রস্তুতি নেই আমার ঢাকা যাওয়ার কিন্তু বাসে চড়ি। বাড়ি থেকে অনুমতি তো নেওয়া হয়ইনি, এমন কি কাউকে না জানিয়ে, যে, আমি ঢাকা যাচ্ছি, আমি বাসে চড়ি। সকলে ভাববে কোথায় আমি, আমি কেন বাড়ি ফিরছি না, বিকেল হবে রাত হবে দুশ্চিন্তা বাড়বে তা জেনেও আমি বাসে চড়ি। বাস যেতে থাকে ঢাকার দিকে। আগুনে বাতাস আগুনে ধুলো উড়িয়ে চোখে মুখে ছিটোতে থাকে। আমি শীতল চোখে চেয়ে থাকি ওড়াওড়ি ধুলোর দিকে, শীতল চোখে চেয়ে থাকি রাস্তার কাক কুকুর আর মানুষের ছোটাছুটির দিকে। আমি শীতল চোখে চেয়ে থাকি গরুগাড়ি, মটর গাড়ি, রিক্সা,বাস, ট্রাকের দিকে। আমি শীতল চোখে চেয়ে থাকি ফসল উঠে যাওয়া নিঃস্ব খেতের দিকে, চেয়ে থাকি নিজের দিকে।

বাসের সবচেয়ে পেছনের আসনে বসা রুদ্রর বাঁ পাশে একটি লোক রাজনীতি নিয়ে কথা বলছে তার পাশের লোকের সঙ্গে। রুদ্র সেই রাজনীতিতে একটু একটু করে ঢুকে যায়। এরশাদ সরকারের পতন যে হবেই হবে, এ ব্যাপারে সে নিশ্চিত, পাশের লোকগুলোও নিশ্চিত। রাজনীতি থেকে আলোচনা গড়িয়ে বাজার দরে নামে। চাল ডাল তেল নুন থেকে শুরু করে মাছ মাংসের দামে, এবং কি হারে কি গতিতে সব সাধারণের নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে এসব নিয়ে ক্ষোভ হতাশা ইত্যাদিও শেষ হয়। এরপর আলোচনায় মানুষের চরিত্র। অসততা এবং সততা। এ নিয়েও কিছুক্ষণ। রুদ্রর মতের সঙ্গে পাশের লোকটির মত প্রায় একশভাগ মিলছে বলে লোকটি বারবারই প্রসন্ন চোখে রুদ্রকে দেখছিল। এবার যে সব প্রশ্ন বাসে ট্রেনে করা স্বাভাবিক বলে ধরে নেওয়া হয়, সেই প্রশ্নগুলিই রুদ্রকে করা হয়। তা আপনের বাড়ি কই ভাই?

বাড়ি খুলনায়।

থাকেন কি ময়মনসিংহে।

না। ঢাকায় থাকি।

ও। তা উনি কি হয় আপনার?

আমার স্ত্রী।

আপনার শ্বশুরবাড়ি বুঝি ময়মনসিংহে।

হ্যাঁ।

তা ভাই কি করেন আপনে? মানে চাকরি বাকরি ..

লিখি।

মানে?

আমি লিখি।

লেখেন?

হ্যাঁ লিখি।

কী লেখেন?

কবিতা লিখি।

কবিতা লেখেন? লোকটি ফ্যাক ফ্যাক করে হাসে। কৌতূহলে লোকটির চোখ একবার ছোট হচ্ছে, বিস্ময়ে হচ্ছে বড়। ছোট বড় চোখ স্থির হয়ে আছে রুদ্রর চোখে, রুদ্রর শান্ত চোখে, শ্যাওলা পড়া চোখে।

লোকটি এবার চোখে চোখ রেখেই, শব্দগুলোকে বিচ্ছিত করে,ধীরে, কিন্তু যথাসম্ভব গলার এবং মনের জোর খাটিয়ে,যেন একটি শব্দও আবার কোনও ফাঁক ফোকর দিয়ে বেরিয়ে না যায়, বলে তা তো বুঝলাম কবিতা লেখেন, আমার ছেলেও কবিতা লেখে, কিন্তু আপনার পেশা কি?

আমার পেশা কবিতা লেখা। রুদ্র অত্যন্ত শান্ত কণ্ঠে জবাব দেয়।

এরকম উত্তর লোকটি সম্ভবত প্রথম শুনেছে। এরপর আর কোনও কথা বাড়ায়নি, বাসের জানালায় চোখ রেখে বাকি পথ পার করে।

রুদ্র আমাকে আগেও বলেছে, সে কোথাও চাকরি বাকরি করতে চায় না। চায় লেখাকেই পেশা হিসেবে নিতে। কেন এ দেশে লেখকেরা লেখাকে একমাত্র পেশা হিসেবে নেয় না তা তার আজও বোধগম্য নয়।

নেয় না কারণ টাকা পাওয়া যায় না ভাল। একটা কবিতার জন্য বল তুমি কত পাও? কুড়ি টাকা পঁচিশ টাকা, বড়জোর পঞ্চাশ টাকা, এই তো! এই টাকায় কি থাকা খাওয়া চলবে?

লেখকের সম্মানী বাড়াতে হবে।

বাড়াবে কে?

পত্রিকার লোকেরা।

তারা না বাড়ালে কি করবে?

আন্দোলন করব। লেখা দেব না।

লেখা না দিলে, যারা বিনে পয়সায় বা কম পয়সায় লেখা দেবে, তাদের লেখা নেবে ওরা।

বিনে পয়সায় কেউই দেবে না লেখা।

লিখি তো আমিও, লিখে টাকা রোজগারের কথা কখনও ভাবিনি। কবিতার সঙ্গে কোনও কিছুর বিনিময়, ভাবলে লজ্জা হয় আমার। তুমি আমাকে কবিতা দাও, আমি তোমাকে ভালবাসা দেব। এ চলে। কিন্তু টাকা দাও তাহলে কবিতা লিখব, কবিতা কি বেচা কেনার জিনিস! ওরকম হলে কবিতাকে আমার পেঁয়াজ রসুনের মত মনে হতে থাকে। টাকা জিনিসটি আমার হাতের ফাঁক গলে সবসময়ই বেরিয়ে যায়, কবিতাকে টাকার হাতে সঁপে দিলে ওই হবে, বেরিয়ে যাবে।

রুদ্রকে শত বলে প্রেমিক বানাতে না পারলেও এমএ পরীক্ষাটি দেওয়াতে পেরেছি। পরীক্ষায় তাকে বসতেই দেওয়া হচ্ছিল না, শেষ পর্যন্ত ভিসিকে মহা অনুরোধ উপরোধে নরম করিয়ে পরীক্ষা দিতে সে পেরেছে। এমএ পাশ করে এ দেশে কিছু হওয়ার বা কিছু করার জো নেই জেনেও বলেছি বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢুকেছো যখন বেরোও, যে কোনও কোথাও ঢুকে পড়লে যেমন বেরোতে হয়, তেমন। পেছনের জানালা বা ঘুলঘুলি দিয়ে বেরোলে ঠিক ভাল দেখায় না, বেরোলে সদর দরজা দিয়েই বেরোও। বেরিয়েছে বটে কিন্তু লেখাকে পেশা করার স্বপ্ন তার যায়নি।

মহাখালিতে বাস থামলে রিক্সায় মুহম্মদপুর যাই। শেষ বিকেলে বেরোই বাইরে। টিএসসি চত্বরে দাঁড়িয়ে রুদ্র বন্ধু খুঁজতে থাকে আড্ডা দেওয়ার। সন্ধের অন্ধকারে মাঠে দাঁড়িয়ে চা খেতে খেতে বন্ধুদের দেখা মেলে। লেখক বন্ধু কবি বন্ধু সাংবাদিক বন্ধু নাটক করা বন্ধু রাজনীতি করা বন্ধু গান গাওয়া বন্ধ কিছু না করা বন্ধু। কারও না কারও দেখা মেলেই। রুদ্র বউ বলেই আমার পরিচয় দেয় এখন, আমি আপত্তি করি না। এক বাড়িতে থাকছি, বাবার তর্জনি উপেক্ষা করেছি, আর কিসের সঙ্কোচ! আড্ডা শেষে বাড়ি ফেরার পথে দুটো থালা, চারটে চায়ের কাপ, দুটো পানির গেলাস, দুটো ছোট পাতিল চাল ডাল তেল ডিম নুন চাপাতা চিনি ইত্যাদি কিনে বাড়ি ফিরি। সংসারের প্রথম কেনাকাটা, রুদ্র হেসে বলে। রেস্তোরাঁয় খেতে তার আর ভাল লাগে না, এখন থেকে ঘরে রান্না হবে, ঘরে খাবে। কিন্তু রান্নাটি করবে কে! আমি তো কখনও রান্না করিনি, না করলেও এটি আমাকেই করতে হবে। এখন থেকে সংসারি হবে সে। আর বাহির নয়, আর টইটই নয়, আর এলোমেলো জীবন নয়। আমি যে রান্না করতে জানি না, আমাকে যে কাল সকালেই চলে যেতে হবে ময়মনসিংহে, ক্লাস আছে, খুব জরুরি ক্লাস, পরীক্ষা আছে, খুব কঠিন পরীক্ষা, বলা হয় না। সংসার উদ্বোধন করতে গিয়ে ভাত রাঁধতে গিয়ে ভাত হয় না সেদ্ধ, বাড়িঅলার কাছ থেকে মশলা ধার করে ডাল চুলোয় দেওয়া হয় বটে, তবে ডাল না হয়ে জিনিসটি অন্য কিছু হয়। শেষ পর্যন্ত ডিম ভেজে মখু রক্ষা করি। ওই খেয়ে উৎফুল্ল রুদ্র রাতে আমাকে স্পর্শ করে। রুদ্র স্পর্শ করলে আমার সারা শরীর অবশ-মত হয়ে যায়। শরীরে রোধ নিরোধ মনে জোর যুক্তি যা কিছু আছে, নষ্ট হয়ে যায়। আমি জলের মত রুদ্র-পাত্রে গড়িয়ে যাই। এ কি ভালবাসা নাকি সংস্কার, নিজেকে প্রশ্ন করি।যেহেতু একটু একটু করে লোকে জানতে পারছে যে আমাদের বিয়ে হয়েছে, কাগজপত্রে নয়ত মনে, যেহেতু একবার বিয়ে হলে আর ফেরার উপায় থাকে না, যেহেতু লোকে বলে স্বামীর সঙ্গে যে করে হোক মানিয়ে নিয়ে বাকি জীবন পার করা, আর দশটা মেয়ে যেমন করে, ভাল, তাই কি!তাই কি আমি রুদ্র থেকে সরে আসতে পারছি না, সরবো ভেবেও? নাকি খুব সরল এবং সোজা একটি কারণ,যে,আমি তাকে ভালবাসি। সংস্কার কি আমি খুব একটা মানি? মানলে হাবিবুল্লাহর সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব হত না,যেহেতু মেয়েদের ছেলেবন্ধু থাকাটা সংষ্কারের বাইরে। মানলে রুদ্রর সঙ্গেই কোনও সম্পর্কে দাঁড়ায় না, যেহেতু রুদ্র ডাক্তারও নয়, ইঞ্জিনিয়ারও নয়, একজন ডাক্তার-মেয়ের স্বামী সাধারণত যা হয়ে থাকে, এবং যা হওয়া স্বাভাবিক বলে সকলে, সকলে বলতে আমার আত্মীয়, প্রতিবেশি, চেনা অচেনা মানুষেরা মনে করেন। আমি তো সেই সংস্কারের পরোয়া না করে রুদ্রর মত চালচুলোহীন ছেলেকে বলেছি ভালবাসি। স−ম্ভাগে তৃপ্ত তুষ্ট রুদ্রকে দেখে ভাবি রুদ্র কি সত্যিই আমাকে ভালবাসে? ভালবাসলে অন্য নারীর শরীর কি করে ছোঁয় সে? আমি তো পারি না। এই যে হাবিবুল্লাহ প্রেমার্ত চোখে তাকিয়ে থাকে নির্নিমেষ, আমার তো ইচ্ছে হয় না ওকে খানিকটা ছুঁয়ে দেখতে। হাবিবুল্লাহর মত সুদর্শন পুরুষ চোখের সামনে ন্যাংটো হয়ে দাঁড়িয়ে থাকলেও আমি তো এতটুকু তৃষ্ণাতর্ হব না। শরীর তো মন থেকে খুব দূরে থাকে না। এই ভাবনাগুলি একান্ত আমার, দূরে সরাতে চাইলেও ভাবনা আমাকে ছেড়ে এক পাও দূরে যায় না।

ময়মনসিংহে ফিরে আসি। মা জিজ্ঞেস করেন, কই ছিলি? আমি কোনও উত্তর দিই না।

আমি কোথায় যাই, বা না যাই, কোথায় থাকি না থাকি, তা কারও জানার দরকার নেই। বলে দিই। স্পষ্টই বলে দিই।

বাড়ি থেইকা বাইর হইয়া যা না। যেই বেডার সাথে রাইত কাডাইছস, তার কাছেই যা।

সময় হইলেই যাইয়াম। কারো কইয়া দিতে হইব না।

মা গাল দিয়ে হলেও কথা বলেছেন, বাবা কথা বলেন না। আমার ছায়াও মাড়ান না। কলেজে যাওয়ার রিক্সাভাড়াও দেন না। সাত দিন পার হয়ে যায়, বাবার হাত থেকে টাকা খসছে না। আমি যে একটি প্রাণী বাড়িতে আছি, বাবা যেন তা জানেন না, জানলেও ভুলে গেছেন। সাতদিন পর সকালবেলা মা মিনমিন করে বাবাকে বলেন, ও কি কলেজ বন্ধ কইরা বইসা থাকব নাকি। রিক্সাভাড়া দিয়া যান।

মার দিকে একটি খেয়ে ফেলা দৃষ্টি ছুঁড়ে দিয়ে রুখে ওঠেন, ওরে বাসাত থেইকা বাইর হইয়া যাইতে কও। আমার বাসায় থাকার ওর কোনও অধিকার নাই। বাবা আমার উদ্দেশে ছুঁড়ে দিতে থাকেন এক একটি বিষমাখা তীর, আমার বাসায় থাকতে তাকে কেডা কইছে? ওই বেডা কেডা? কোথাকার বেডা? বেডা কি করে? কত বড় সাহস এই ছেড়ির ওই বেডারে বাসায় আনে। কত বড় সাহস আমার সামনে দিয়া বেডার সাথে বাইরে যায়! ও আমার বাসায় কি করে? লাত্থি দিয়া বাসা থেইকা বার করব, না কি ও এমনে যাইব?

বাবা চলে গেলে মা বলেন আমাকে, বুঝ,মজা বুঝ। নিজের জীবনডার কত সর্বনাশ করছস। তর বাপে তরে আর লেহাপড়ার খরচ দিব না। মেডিকেলে পড়া তো বন্ধ হইব। বাপের খুব স্বপ্ন আছিল একটা মেয়ে ডাক্তার হইতাছে। সব গেছে।

সব গেছের বিলাপ শুনি বসে।

রাতে আমার পাশে বসে মা নরম স্বরে বলেন, যেই লোকটার সাথে গেছিলি, তার নাম কি? তার নাম কি রুদ্র? রুদ্রকে কি তুই বিয়া করছস?

আমি মার সামনে থেকে উঠে চলে যাই কথা না বলে। মা আমার পেছন পেছন হাঁটেন আর বলেন, বিয়া না করলে ক যে বিয়া করস নাই। কই তর বাপেরে। তর বাপ হয়ত নরম হইতেও পারে।

দম বন্ধ হয়ে আসতে থাকে বাড়ির পরিবেশে। আমার দিকে সকলের চোখ। ঘৃণার চোখ!চোখ সংশয়ের, অবিশ্বাসের। আমি যেন আর আগের আমি নই, আমি অপ্রকৃতিস,্থ মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে বাড়িতে বসে আছি। ইচ্ছে করে বেরিয়ে পড়ি বাড়িটি থেকে। যেদিকে দুচোখ যায়, যাই। অনিশ্চয়তা আমাকে ছোবলে ছোবলে নীল করছে। এ সময় আপাতত সমস্যার একটি সমাধান করেন মা। মা নিজে গিয়ে নতুন বাজার থেকে ডাবঅলা ধরে আনেন। রশিদকে পাননি, অন্য লোক। নিজের দুটো গাছের কটি ডাব বিক্রি করে আমাকে টাকা দিলেন কলেজে যাওয়ার। দিলেন কিন্তু বললেন বাবার কাছে যেন আমার অন্যায়ের জন্য ক্ষমা চেয়ে, এমন অন্যায় জীবনে আর কখনও করব না প্রতিজ্ঞা করে, নিয়মিত কলেজে হাসপাতালে যাওয়ার খরচ নিই। না আমি তা করি না। রুদ্রকে চিঠি লিখি বাড়ির অবস্থা জানিয়ে। এও লিখি সে যেন আমাকে কিছু টাকা পাঠায়। রুদ্র চিঠি পেয়ে মানিঅর্ডার করে টাকা পাঠায়। এক হাজার টাকা। এই টাকা আমার সকল দুর্ভাবনাকে আমার চৌহদ্দি থেকে দূর দূর করে দূর করে। কেবল কলেজে যাওয়া আসাতেই যে টাকা খরচ হতে থাকে তা নয়। বিকেল হলে ইয়াসমিনকে নিয়ে রিক্সায় হুড ফেলে দিয়ে অর্থাৎ বাধ্যতামূলক ঘোমটাটি খসিয়ে ঘুরে বেড়াতে থাকি শহরময়। অদ্ভুত এক আনন্দ এই ঘুরে বেড়ানোয়। যেন দুটি মুক্ত পাখি, যেন বাধঁ ন ছিঁড়ে বেরিয়েছি এইমাত্র। মালাইকারি খেতে ইচ্ছে হচ্ছে, শ্রীকৃষ্ণ মিষ্টান্ন ভাণ্ডারে নেমে খেয়ে নিই দুটো মালাইকারি, দইয়ের ওপর ভেসে থাকা রসগোল্লাও। বাবা বাড়িতে বিস্কুট পাঠাচ্ছেন না অনেকদিন, বিস্কুটের দোকানে গিয়ে এক পাউন্ড বিস্কুট কিনে নিই। মা পীরবাড়ি যাবেন, রিক্সা ভাড়া নেই, উদার হস্ত দিয়ে দেয় পাঁচ টাকা। বাড়িতে ডাল ভাত ছাড়া কিছু নেই, ইয়াসমিনকে নিয়ে গাঙ্গিনার পাড়ের রেস্তোরাঁয় গিয়ে মাংস ভাত খেয়ে আসি, কখনও আবার নতুন চিনে রেস্তোরাঁয়।



বাবা লক্ষ করেন আমি কলেজে যাচ্ছি, কিন্তু তার কাছে হাত পাতছি না। লক্ষ করেন, বাড়িতে ডাল ভাত ছাড়া অন্য কিছুর ব্যবস্থা না করার পরও কোনও বাজারের লিস্টি কেউ পাঠাচ্ছে না তাঁর কাছে, এসব তাঁর দম্ভে বিঘ্ন ঘটায়। মাকে ডেকে জিজ্ঞেস করেন, ওই ছেড়ি কলেজে যে যায় রিক্সাভাড়া কই পায়? তুমি দেও?

আমি দিয়াম কোত্থেকা? আমার হাতে কোনও টাকা পয়সা দেইন নাকি?

তাইলে পাইছে কই?

কি জানি!

কি জানি মানে? তোমার জানতে হইব না?

জাইনা কি হইব? টাকা পয়সা দেওয়া বন্ধ কইরা দিছেন। তার তো যোগাড় করতে হইব! যোগাড় করছে।

কিভাবে যোগাড় করছে? কার কাছ থেইকা।

সেইডা তারে গিয়া জিগান। কথা বন্ধ করছেন কেন? কথা বন্ধ করলে কি সব সমস্যার সমাধান হইয়া যায়?

আমার বাড়ি থেইকা যে চইলা যাইতে কইছি, যায় না কেন?

কই যাইব?

যেই বেডার কাছ থেইকা টাকা নিছে তার কাছে যাক গা।

গেলে খুশি হইন নাকি? এহন তো নোমান কামালরে আর টাকা পয়সা দিতে হয় না। আমারে ত কিছুই দেইন-ই না। দুইডা মেয়েরে যা দিতাছিলেন, তাও সহ্য হইতাছে না আপনের। আপনের টাকা পয়সা একলা আপনেই ভোগ করতে চান, ভোগ করেন। মেয়েরা ত আইজ না হইলেও কাইল যাইবই এই বাড়ি ছাইড়া। এহনই ভাগাইতে চান কেন? বাড়ি খালি করতে চাইলে কন, আমরা সবাই যাই গা। একলা থাকেন।

বাবা কোনও উত্তর দেন না। শূন্য চোখে তাকিয়ে থাকেন উঠোনের দিকে। বাবা যে ইয়াসমিনকে ডেকে নিয়ে বলবেন, তুমিই এখন আমার স্বপ্ন। তুমি এখন আমার মান রাখো। সে সম্ভাবনাটিও নেই। ইয়াসমিন, বৃত্তিধারী ছাত্রী, মেট্রিকে প্রথম বিভাগ পাওয়া, রসায়নে তারকাখচিত নম্বর পাওয়া, ইন্টারমিডিয়েটে এসে দ্বিতীয় বিভাগ। বাবার আশার প্রদীপ নিবিয়ে খোলাম-কুচির মত ভেঙে পরীক্ষার ফল বেরোনোর পর ও বলতে শুরু করেছে, আসলে ওই দেবনাথ স্যারের জন্যই আমার পরীক্ষা ভাল হয় নাই।

দেবনাথ পণ্ডিত ইয়াসমিনকে বাড়িতে এসে পড়াননি, আমাকে যেমন পড়িয়েছিলেন। দলে পড়িয়েছেন।একশ ছাত্র ছাত্রীকে পড়াতে হলে দল ছাড়া আর কোনও গতি নেই। ওই দলের এক কোণে পড়ে থেকে ইয়াসমিন অংকের মাথামুণ্ডু কিচ্ছু বোঝেনি। আমার অবশ্য মনে হয় বাড়ির নতুন দুজন মানুষ এক হাসিনা দুই সুহৃদ নিয়ে ওর উত্তেজনা এত বেশি ছিল যে বই নিয়ে ও মোটেও বসতে চায়নি। আমি পড়তে বসার জন্য অনুরোধ করলে আমাকে ধমকে সরিয়ে দিয়েছে। বাবা বললে অবশ্য বসেছে, কিন্তু সে বসা সত্যিকার বসা ছিল না। দ্বিতীয় বিভাগ নিয়ে ওর পক্ষে মেডিকেলে ভর্তি হওয়া সম্ভব নয়। বাবা জলদগম্ভীর স্বরে বলেন,জীবন তো বরবাদ হইয়া গেল। এখন ইমপ্রুভমেন্ট পরীক্ষা দিয়া দেখ ফাস্ট ডিভিশান পাস কি না। মেডিকেলে ভর্তি হইতে পারস কি না। তা না হইলে গাধা ছাত্রীদের মত ওই আনন্দমোহনে গিয়াই বিএসসি তে ভর্তি হ। কি করবি আর।

বাড়িতে ইয়াসমিনের আদর খানিকটা কমে যায়। অবশ্য মার কাছে কমে না। মা বলেন, কোনও লেখাপড়াই খারাপ না। ভাল কইরা পড়লে সব লেখাপড়াই ভাল। শুনে, বাবা নাক সিটকে বলেন, এই অশিক্ষিত বেটি বলে কি এইসব!

মা ঘুরে দাঁড়িয়ে বলেন, কেন সুলেখা তো ডাক্তারি পড়ে নাই। কি সুন্দর এম এ পাশ কইরা এখন ব্যাংকের জি এম হইছে।

বাবা খ্যাঁক খ্যাঁক করে হাসেন। বাবার হাসি থেকে দূরে সরতে মা রান্নাঘরের দিকে যখন যেতে থাকেন, থামিয়ে বলি, কওতো জিএম মানে কি?

বড় অফিসার।

আমিও খ্যাঁক খ্যাঁক।

মা চলে যান রান্নাঘরে। ও ঘরটিই মার জন্য শ্রেয়, তা মাও বোঝেন, আমরাও। ইয়াসমিনকে জন্য বিজ্ঞানের কোনও একটি ভাল বিষয় নিয়ে অনার্স পড়ার পরামর্শ দিই। চেয়ারে দুলতে দুলতে, পা টেবিলের ওপর।

ফিজিক্স?

অসম্ভব।

কেন অসম্ভব?

কঠিন।

তাইলে কেমেস্ট্রি। মেট্রিকে তো লেটার পাইছিলি।

না। কেমেস্ট্রিও কঠিন।

তাইলে ম্যাথ?

প্রশ্নই আসে না।

জুওলজি নে।

না।

তাইলে এক কাজ কর।

কি?

লেখাপড়া ছাইড়া দে।

ইয়াসমিনের লেখাপড়া অনেকটা ছেড়ে দেওয়া পর্যায়েই দাঁড়িয়েছে। ওকে দেখে মনে হয় না কোনও রকম ইচ্ছে আছে কখনও বই হাতে নেওয়ার। ইমপ্রুভমেন্ট পরীক্ষার ফরম পূরণ করে এসে, দাদা বগুড়া থেকে ময়মনসিংহে বেড়াতে এলেন দুদিনের জন্য, বললেন, চল বগুড়া বেড়াইয়া আসবি, ইয়াসমিন হৈ হৈ করে বগুড়া চলে গেল বেড়াতে। দাদা আর হাসিনার বদৌলতে পাওয়া ইয়াসমিনের ঘাড়ের আর হাঁটুর ব্যথা তখনও কিন্তু সারেনি। সেদিনের সেই উঠোনের ঘটনার পর, দাদা আর হাসিনা দুজনের সঙ্গেই আমরা কথা বন্ধ করে দিয়েছিলাম। আমি বন্ধই রেখেছি, ইয়াসমিন শুরু করেছে, তবে ভাববাচ্যে। ওকে বগুড়া থেকে ঘুরিয়ে দাদা যখন ফেরত দিতে এলেন ময়মনসিংহে, বাবা কাছে ডাকলেন তাঁর জ্যষ্ঠ পুত্রটিকে, ঘন হয়ে বসলেন পাশে।

বগুড়ায় কেমন লাগতাছে?

ভাল।

কি রকম ভাল?

কোম্পানী বাড়িভাড়া দিতাছে।

বাড়ি কেমন?

ভালই। তিনটা রুম আছে। ড্রইং বেড ডাইনিং।

উঠান আছে?

না উঠান নাই, উঠান থাকব কেন? এপার্টমেন্ট বিল্ডিং ত।

নিজে বাজার কর?

জিনিসপত্রের দাম কেমন বগুড়ায়?

তা একটু দাম বেশিই আছে ওইখানে।

সংসার খরচে মাসের পুরা টাকাই কি চইলা যায়?

খরচ ত আছে, কিছু তো যায়ই।

রিপ্রেজেনটিটিভের চাকরি কইরা আর কতই বা পাও!

আমি ত আর রিপ্রেজেনটিটিভ না, কবেই না সপুারভাইজার হইয়া গেছি!

তফাতটা কি?

ঘোরাঘুরিটা কিছু কম।

টাকা পয়সা জমাইতাছ ভবিষ্যতের জন্য?

কিছু কিছু।

শরীরে সেন্ট মাইরা বাবুগিরি কইরা ঘুরতাছ, টাকা পয়সা ইচ্ছামত উড়াইতাছ, জমাইবা কেমনে?

কই সেন্ট? সেন্ট ত আজকাল কিনিই না।

নিজের বাড়িঘর সব রাইখা বিদেশে পইড়া আছ কেন?

চাকরি তো করতে হইব।

ওই চাকরি ছাইড়া দিয়া ময়মনসিংহে ফিরো। আমি তোমারে আরোগ্য বিতান দিয়া দিতাছি। ওষুধের ব্যবসা কর। চাকরিতে যা পাও, তার চেয়ে ব্যবসা ভাল কইরা করলে ভাল টাকা কামাইতে পারবা।

টানা চার ঘন্টার বৈঠকে এই সিদ্ধান্ত হয়, দাদা ফাইসন্স কোম্পানীর চাকরি ছেড়ে বাপের ব্যবসা দেখাশুনো করবেন। বগুড়া ফিরে গেলেন তিনি, ওখান থেকে মাস খানিক পর বউবাচ্চাজ্ঞজনিসপত্র সব নিয়ে, কেবল শখের চাকরিটি না নিয়ে ফিরে এলেন। দাদা বগুড়ায় চাকরি নিয়ে চলে যাওয়ার পর বাবা নতুন আসবাব কিনেছেন, টেলিভিশন, ফ্রিজ, এসবও কিনেছেন। ঘর এখন খালি নেই যে দাদা তাঁর সব আসবাব ফেলতে পারবেন। বিশাল খাবার টেবিলটি আর তালাবন্ধ কাচের বাসনপত্রের আলমারিটি দাদা তাঁর আগের শোবার ঘরে রেখে ঘরটিকে আলাদা একটি খাবার ঘর বানিয়ে বাবার নির্দেশে নিজের আজদাহা খাট আলমারি আয়নার টেবিল আলনা ইত্যাদি উঠোনের দুটো টিনের ঘরের একটিতে গুছিয়ে স্ত্রীপুত্রসহ থাকতে শুরু করলেন। দাদারা ফিরে আসার পর দাদা আর হাসিনার কোনও প্রশ্নের উত্তরে হ্যাঁ বা না ছাড়া কিছু কথা হয় না আমার, বড়জোর খুব প্রয়োজনে দুএকটি কথা হতে থাকে, কিন্তু যা হতে থাকে তা ভাববাচ্যে। সম্বোধনহীন কথা বলায় পারদশির্ আমার জন্য এ কঠিন কিছু নয়। বাবা আরোগ্য বিতানের পাশে দুটি ঘর ভাড়া নিয়ে একটি লেপতোশকের ব্যবসায়ীর কাছে ভাড়া দিয়ে আরেকটিতে নিজের আলাদা চেম্বারের ব্যবস্থা করে ফেলেছেন। দাদার হাতে আরোগ্য বিতান, ওষুধের দোকান। বাবার হাতে রোগী দেখা, দাদার হাতে ব্যবসা। ব্যবসায় খাটাতে বাবা নিজের কয়েক লক্ষ টাকা অকাতরে ঢেলে দিলেন দাদার হাতে।

আমার খরচ চলতে থাকে রুদ্রর টাকায়। আমার কি প্রয়োজন না প্রয়োজন তার দিকে বাবা ফিরে তাকান না। আমাকে নিয়ে তাঁর কোনও আর উৎসাহ নেই। আমি উচ্ছন্নে চলে গেছি, লাগাম ছিঁড়ে বেরিয়ে গেছি, আমি নিষেধের বেড়া ডিঙিয়ে গেছি, আমি আর আমি নেই, আমি নষ্ট হয়ে গেছি। আমাকে নিয়ে আশা ভরসাও নেই আর। এই বাবা, মনে হত,আমাকে ডাক্তার বানানোর জন্য, জীবন উৎসর্গ করেছেন। অথচ রুদ্রকে অপমান করে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেওয়ার প্রতিবাদে আমার বেরিয়ে যাওয়া, এবং একরাত বাড়ি না ফেরার কারণে তিনি আমাকে প্রায় ত্যাজ্য-কন্যা করে দিলেন! ধ্বসে গেল আমাকে নিয়ে তাঁর স্বপ্নের প্রাসাদ!কি সহজ এই ধ্বসে যাওয়া! কী পলকা স্বপ্ন নিয়ে ছিল তাঁর বাস!এমন তো নয় যে আমি কাউকে বলেছি রুদ্রর সঙ্গে আমার কোনও সম্পর্কে আছে বা রুদ্রকে আমি বিয়ে করেছি বা আমি তোমাদের আর পরোয়া করি না!যদি বলতাম, বুঝতাম, তিনি হিতাহিতজ্ঞান হারিয়ে যা করার করছেন। বাবার আচরণ আমাকে ক্ষুব্ধ করে। মনে হতে থাকে এ জগতে রুদ্র ছাড়া আপন কেউ নেই আমার।

রুদ্র আসে ময়মনসিংহে। শহরে রিক্সার হুড ফেলে দুজন ঘুরি। যে দেখে দেখুক। বাবার কাছে খবর যায় যদি, যাক, আমার আর ভয় কিসের! রুদ্রর দাবি আমাকে তার সঙ্গে হোটেলে থাকতে হবে রাতে। ময়মনসিংহ শহরের ঘিঞ্জি এলাকায়, ছোটবাজারে, শান্তনীড় নামের হোটেলে একটি ঘর ভাড়া করে সে। অন্ধকার সিঁড়ি পার হতে ভয় ভয় লাগে। চারতলায় একটি ছোট্ট স্যাঁতসেঁতে ঘরে, একজনের একটি চৌকি কেবল ধরে, ঢুকে আমি নিঃশ্বাসের জন্য একটু শুদ্ধ হাওয়া খুঁজি, পাই না। হাওয়া ভারি হয়ে আছে, হাওয়ায় পেচ্ছাবের গন্ধ, কফ থুতুর গন্ধ। ঘরে কোনও জানালাও নেই যে খুলে দেব। বিছানার চাদরে বালিশে এমনকি এক চিলতে পেচ্ছাবপায়খানাটির সর্বত্র মনে হয় ছড়িয়ে আছে সিফিলিসের জীবাণু শরীর বেয়ে বিμছুর মত হেঁটে উঠবে কোথাও যদি স্পর্শ করি। গা ঘিন ঘিন করে। বিছানায় নতুন চাদর বিছিয়ে দিতে বল। বালিশ পাল্টো দিতে বল। আমার ঘেন্না লাগছে, অন্য কোনও ভাল হোটেলে চল। না রুদ্র কিছুই করবে না। আমাকে টেনে সে বিছানায় নেয়। টেনে আমার জামা খুলে নেয়, টেনে আমার পাজামা। আমার ওপর নিজে সে ন্যাংটো হয়ে চড়ে বসে। আমার মন বিছানার নোংরা চাদরে, নোংরা বালিশে। ভয়ে সিঁটিয়ে থাকা আমার শরীর নিয়ে রুদ্র আনন্দ করে। আনন্দ শেষে সে সিগারেট ধরায়। গুমোট ঘরটির নানা গন্ধের মধ্যে যোগ হয় সিগারেটের গন্ধ। পেটের নাড়ি বেয়ে বমি উঠে আসে গলায়। মাথা ঘোরে। রুদ্র বলে, কাল ঢাকা চল।

আমার ওয়ার্ড এন্ডিং পরীক্ষা আর দুদিন পর।

বাদ দাও ওয়ার্ড এন্ডিং। ও না দিলে কিছু হবে না।

কিছু যে হবে সে আমি জানি। জেনেও বাড়ি গিয়ে নিজের দুটো বাড়তি জামা একটি ব্যাগে নিয়ে বেরোই দুপুরের বাস ধরতে, মা পেছন থেকে বলেন, কই যাস? ঢাকা যাই। ঢাকা কার কাছে যাস? প্রশ্নের কোনও উত্তর না দিয়ে আমি বোবা কালা আমি এগোতে থাকি। পেছনে বেড়া ডিঙোনোর আমার জন্য মার উদ্বেগ, পেছনে আমার না গেলেই নয় ক্লাস। পেছনে আমার না দিলেই নয় ওয়ার্ড এন্ডিং। ঢাকা পৌঁছে রুদ্রর দুটো ঘরে শুয়ে থাকা বসে থাকা, তার নতুন কবিতা পড়া, জীবনে কখনও রান্না-না-করা হাতে রান্না করা, রিক্সার হুড ফেলে বিকেলে হাওয়া খেতে বাইরে যাওয়া, সন্ধেয় অসীম সাহার ইত্যাদি প্রিন্টাসের্ বসে নির্মলেন্দু গুণ,মহাদেব সাহার সঙ্গে রাজনীতি,সাহিত্য-সমাজ-সংস্কৃতি নিয়ে গল্প করে রাতে ঘরে ফেরা। রাতে শরীর নিয়ে খেলা করে রুদ্র। শরীরের গভীরে যেতে যেতে বলে, যেন পাথরকুচির ওপর দিয়ে যাচ্ছি। এত পাথরকুচি!এত পাথরকুচি!আরও গভীরে আরও গহনে অন্ধকারে পাথরকুচির ওপর ছুটতে ছুটতে ক্লান্তিতে নুয়ে বলে, উফ তোমার দাঁত এত ধারালো, এমন কামড় দিয়ে ধরো, কিছুতেই ছুটতে পারি না।

ভোর হলেই আমি ছটফট করি ময়মনসিংহে ফিরতে। এত উতলা হওয়ার কি আছে, আর দুটো দিন থাকো। দুদিন থাকা হয়। দুদিন পর রুদ্ররও দিন ফুরিয়ে আসে ঢাকার। তাকে ফিরতে হবে মোংলায়।

কিছু টাকা লাগবে আমার?

যে টাকা পাঠিয়েছিলাম ফুরিয়ে গেছে?

হ্যাঁ।

কি করে ফুরোলে?

হিসেব রাখিনি।

এত বেহিসেবি হলে চলবে কেন?

মাথাটি আপনাতেই নত হয়ে আসে আমার। বাবার সামনে টাকার জন্য হাত পাততে গিয়ে ঠিক যেভাবে নত হয় মাথা, সেভাবেই নত হয়ে আসে। চোখদুটো নত। বাবার সামনে চোখও এমন নত থাকে।

কত দরকার এখন? কত দিলে চলবে?

আমি নখ খুঁটি। হাতের নখ। পায়ের নখ।

তিনশ হলে চলবে?

চলবে।

টাকাটি হাতে নিই, হাতে নিতে যদিও খুব লজ্জা হয়। নিজেকে একটি উপদ্রব মনে হতে থাকে। দাঁড়াবার শক্তি নেই, মেরুদণ্ডের জোড় নেই, একটি পরগাছার মত নিজেকে মনে হয়। আমার লজ্জা যায় না। কারও কাছ থেকে যদি না নিতে হত টাকা, যদি নিজে উপার্জন করতে পারতাম! যদি শরমের এই নত মাথাটি আমি একটু তুলতে পারতাম! ময়মনসিংহে ফিরে এলে মা বলেন, ঢাকায় কার কাছে ছিলি, কামালের বাসায়? তর বড়মামার বাসায়? ঝুনুর বাসায়?

না।

তাইলে কার বাসায়?

আমি কথা বলি না।

মা বলেন, তুই যে কোন পথে যাইতাছস! তর কপালে যে কি আছে!আল্লাহ খোদা বিশ্বাস করস না। যা ইচ্ছা তাই করতাছস। যেই বেডা তরে ফুসলাইয়া বাড়ির বাইর করতাছে, তারে নিয়া কি তুই সুখী হইবি? এখনও বাদ দে। এখনও সময় আছে। বাবা মা ভাই বোন সবার কথা ভাব একটু। কত ডাক্তার ছেলে তরে বিয়া করতে চায়। কাউরে পাত্তা দেস নাই। এখন কারে নিয়া ঘুরস, তুইই জানস। জীবনটারে নষ্ট করিস না। তর বাপের কাছে ক, ক যে তুই ভালা হইয়া চলবি। বাপের কথা শুইনা চলবি। তর বাপে তর সব খরচ দিব। এখনও সময় আছে ক।

মাকে পাশ কাটিয়ে আলনা থেকে এপ্রোনটি হাতে নিয়ে চলে যাই হাসপাতালে।



এখন থেকে বেহিসেবি হলে চলবে না। সোনার গয়নার মত টাকা পয়সা গোসলখানায়, জানালায়, টেবিলে, বিছানায় ফেলে রাখা চলবে না।জমা খরচের খাতা করে দুদিন রিক্সাভাড়া- ১২টাকা, বাদাম- ১টাকা, চা- ৩ টাকা, চিরুনি- ১ টাকা, কলম- ২টাকা, কাগজ- ৫ টাকা.. লেখার পর আর লেখা হয় না, হিসেবের খাতাটিও খুঁজে পাওয়া যায় না। প্রায় বিকেলেই, রোদের তাপ কমে এলে,পড়ার টেবিল থেকে উঠে ইয়াসমিনকে বলি, চল, বাইরে থেইকা ঘুইরা আসি। ইয়াসমিন বাইরে যাওয়ার নাম শুনে লাফিয়ে ওঠে। মা বলতে থাকেন, ও নিজে নষ্ট হইছে, এহন ইয়াসমিনডারেও নষ্ট করব।
 
২০. নারী


পঞ্চম বর্ষে দিনরাত্তির একটি জিনিসই করতে হয়, সেটি লেখাপড়া। সেটি থেকে আমারও নিস্তার পাওয়া হয় না। হাসপাতালে দিনে তো আছেই, রাতেও ক্লাস থাকে। অধ্যাপক দিনে পড়ান, রাতে পড়ান। কেবল অধ্যাপকই নন, ওপরের ক্লাসে যারা সবে ডাক্তার হয়েছেন, তাঁরাও পড়াতে ্‌ আসেন। রাজিব আহমেদও পড়াতে আসেন মেডিসিন বিভাগে। রাজিব আহমেদ এবারও প্রথম হয়েছেন,ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে যত চিকিৎসা মহাবিদ্যালয় আছে, সবগুলোর মধ্যে শেষ বর্ষের পরীক্ষায় প্রথম। ধন্দে পড়ি, এত জ্ঞান তিনি তাঁর ছোট্ট মাথাটিতে ধারণ করেন কি করে! আমার টেবিল জুড়ে রাজিবের সার্জারি মেডিসিন গাইনির খাতা। ছাপলে সাহেবদের লেখা বইএর চেয়ে ভাল বই হবে, আমার বিশ্বাস। রাজিবের করুণাধন্যা আমি, অকাতরে যা আমাকেই দিয়েছেন তাঁর রত্নরাজি। অথচ এই আমার দিকেও বড় একটা চোখ তুলে তাকান না তিনি। ডাক্তারি বিদ্যা ছাড়া অন্য কিছুতে তার কোনও ঝোঁক আছে বলে মনে হয় না। তিনি রোগীর মাথার কাছে দাঁড়িয়ে বিভিন্ন রোগ এবং রোগ নির্ণয় এবং রোগের চিকিৎসায় দীক্ষা দিয়ে যান। রাত্তিরে ক্লাস শেষে আমাকে ফিরতে হয় বাড়িতে। একা ফিরতে ভয় হয়। অন্ধকারকে ভীষণ ভয় আমার। প্রায়ই ক্লাসের বন্ধুদের অনুরোধ করি আমাকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে আসতে। যেদিন অমন কেউ থাকে না যাকে বলা যায়, তখন শহরে বাড়ি যে ছেলের, যে ছেলে শহরের দিকে যাচ্ছে, তাকে বলি আমার রিক্সার পেছনে যেন তার রিক্সা যায়, বাড়ি অবদি না গেলেও অন্ধকার পথটুকু অন্তত। অন্ধকারের কি শেষ আছে! পেছনের রিক্সা আমাকে অনেকটা পার করে দিলেও থোকা থোকা কিছু কালো একা পার হয়ে যাওয়ার জন্য রয়ে যায়। বিদ্যাময়ী ইশকুলের সামনে ডান দিকের যে গলিতে আমাকে ঢুকতে হয় বাড়ির পথে, অন্ধকার ভুতের মত পড়ে থাকে ও গলিতে—বুক ঢিপঢিপ করে, রিক্সাঅলাকে জোরে চালাতে বলি, যেন এই পথটি দ্রুত পার হয়—মনে হতে থাকে এই বুঝি এক পাল ছেলে আমাকে রিক্সা থেকে নামিয়ে কাছের কোনো ঝোপের আড়ালে নিয়ে ধষর্ণ করবে, ধর্ষণের পর বুকে ছুরি বসাবে, রিক্সাঅলাটিই হয়ত অন্ধকারে রিক্সা থামিয়ে আমাকে টেনে নিয়ে চলে যাবে কোথাও। দিনে যে কিছু ঘটে না তা নয়, এতকাল যা ঘটেছে, ঘটেছে দিনে। রিক্সায় বসা আমার দিকে কেউ শখ করে থুতু ছুঁড়ে দিল, পানের পিক ছুঁড়ে দিল, হা হা হাসল, খু খু কাশল। ঢিল ছুঁড়ল, ঢিল গেল কানের পাশ দিয়ে, ঢিল লাগল বুকে, মাথায়, হা হা হাসল, খু খু কাশল, দাঁত বেরোলো বত্রিশটি, খুশির দাঁত। রিক্সায় বসা আমার বাহুতে জ্বলন্ত সিগারেট নিবিয়ে মজা করল কেউ, কেউ ওড়না টেনে নিল, কেউ খোঁচা দিল, কেউ ধাক্কা, কেউ পথ আটকালো, কেউ বুক টিপে ধরল, হা হা হাসল, খু খু কাশল। তারপরও মনে হয়, দিনের চেয়েও রাত আরও ভয়ংকর, রাতে আরও ভয়ংকর কিছু ঘটতে পারে। রাত আমাকে অন্ধকার কুয়োয় জন্মের মত ডুবিয়ে দিতে পারে। বাড়ি পৌঁছে আমি নিঃশ্বাস ফেলি। প্রতিবারই বাড়ি ফিরে আসা প্রতিবারই একটি বেঁচে যাওয়া দিন। গায়নোকলজি বিভাগের রাতে ডিউটি থাকে, সারারাত। রাত আটটা থেকে সকাল আটটা অবদি। রাত আটটার ডিউটিতে আমি সন্ধে ছটায় গিয়ে বসে থাকি, অন্ধকার নামার আগে আমি চলে যাই হাসপাতালে, সময়ের পোঁছলে কোনো অসুবিধে নেই, সময়ের আগে চলে আসাই অসুবিধে। এই রাত্তিরের ক্লাস-ডিউটি আমাকে অন্ধকারের ভয় দিয়েছে বটে, কিন্তু একটি চমৎকার জিনিস দেখিয়েছে, ছায়াবাণী থেকে অজন্তা সিনেমাঘরের মাঝখানের রাস্তার কিনারে বসে কুপি জ্বেলে গ্রাম থেকে আসা বিভিন্ন বয়সের মেয়েরা চাল ডাল সবজি চিড়ে মুড়ি ইত্যাদি বিক্রি করছে। দৃশ্যটি আমাকে আলোড়িত করে, মাকে বলি ঘটনা, মা বলেন, ওদের মতও যদি হইতে পারতাম, তাইলে বাঁচতাম। আমার মনে হয় মা হয়ত ঠিক বলেন। ফুটপাতের ওই মেয়েদের যে দৃঢ়তা এবং সাহস দেখেছি তা আমি লক্ষ করি মার নেই, আমারই বা আছে কি? নারী আমাকে উদ্বুদ্ধ করে, উদ্বুদ্ধ করে কলম হাতে নিতে, দুটো শাদা কাগজ নিতে, লিখতে। আমি না লিখে পারি না।

বিস্তৃত এলাকা জুড়ে মেয়ে মানুষেরা আজ বেসাতি সাজায়, দেহ নয়, রূপ নয়, সমুখে তাদের পণ্য ধুলায় বিছানো, কুমড়া পটল লাউ পুঁই আর ডাঁটা শাক ক্ষেতের বেগুন, কে যেন সুদূর থেকে করুণ বেসুরো বাঁশি নিয়ত বাজায়। কারো বউ, কারো বোন,কারো বা জননী তারা, তোমরা তো জানো, ঘোমটা ফেলেছে তারা, খসিয়েছে পান থেকে সংস্কারের চুন। অভাব নেমেছে দেশে, অসুরের শক্তি দেহে বেজায় বেহায়া, বিশাল হাঙর মখু , ছিঁড়ে খায় মাটি থেকে শস্যের শিকড়, অপয়া অভাব ঘরে শুষে খায় প্রিয় খুব ভাতের সুঘ্রাণ, মারমুখো জানোয়ার দুহাতে খাবলে নেয় প্রশান্তির ছায়া, রাত থেকে নিদ্রা কেড়ে আগামীর স্বপ্ন ভেঙে পুড়িয়েছে ঘর, ভিটেমাটি সব গেছে, পোড়া দেহে শুধু কাঁদে বিকলাঙ্গ প্রাণ। অন্ধকার জীবনের দরোজায় কড়া নাড়ে আলোকিত ক্ষিদে, বিকট হাত পা মেলে বেলাজ বেঢপ ক্ষিদে নৃত্য করে খুব, গতর খাটিয়ে খেয়ে অভাগীরা তীর ছোঁড়ে ক্ষিদের শরীরে, রঙচঙ মুখে মেখে তেরঙা শাড়িতে নয়, বড় সাদাসিধে, শহরের ফুটপাতে সাহসে দাঁড়লো এসে পুণ্যবতী রূপ, সুলভে শরীর নয়, গর্বিত নারীরা বেচে দধু কলা চিড়ে।

নারীর জীবন আমাকে আয় আয় বলে ডাকে। নারী আমাকে ভাবাতে থাকে। নারীর দুঃখ বেদনা আমি অনুভব করতে থাকি। নিজে যে কষ্ট পেয়েছি জীবনে, সে তো নারীর কষ্টই। কেবল আমার কি! মনে হয় এ কষ্ট আরও হাজার নারীর।

কোমল কুমারী নারী শরমে আনত মখু বিবাহের দিন, অজানা সুখের ভয়ে নীলাভ শরীর কাঁপে কি জানি কি হয়। সানাইয়ের সুর শেষ, রাত বাড়ে, বধূটির কন্ঠ হয় ক্ষীণ, পুরুষ প্রথম এসে নিশব্দ নির্জন ঘরে কি কথা যে কয়! দেবতা নামক স্বামী লাগিয়ে দোরের খিল বক্র চোখে দেখে, লোভনীয় মাংসময় অনাঘ্রাতা বালিকার সলজ্জ শরীর। বহুদেহ বহুবার উ−ন্মাচিত করেছে সে নিষিদ্ধ পল্লীর, অভ্যস্ত হাতের কালি নারীর কপাল জুড়ে ভাগ্যখানি লেখে। অবুঝ কিশোরী মেয়ে, স্বপ্ন সাধ ভাঙে তার, দুঃখে বাঁধে বুক, এরকমই বুঝি হয়, পৃথিবীর এরকমই নিয়ম কানুন। পিশাচি উল্লাস করে নি−ষ্পষিত দেহমনে বাসনার খুন, পরম সোহাগে বধূ উপহার নিল অঙ্গে নিষিদ্ধ অসুখ । বছর পেরোলে নারী বিকলাঙ্গ শিশু এক করলো প্রসব, জটিল রোগের বিষ, আগুন জ্বালিয়ে দেহে স্বাগত জানায়! সিফিলিস রোগ নাম, রক্তের প্রপাত বেয় বসত বানায়, পেলব শুভ্রতা ছেঁড়ে, বিষাক্ত নখরে ছেঁড়ে হাড় মাংস সব। রাত্রির হিংস্রতা এসে জীবনের সূর্য খেয়ে নেভায় সকাল, দুরারোগ্য কালো পাপ অকালে নারীকে শুষে কেড়ে নেয় আয়ু। অবশ হাত পা মেলে পড়ে থাকে বোবা কালা জর্জরিত স্নায়ু আছর করেছে জীনে—এমন কথাই লোকে জানে চিরকাল।

আমাকে নারীতে পায়। আমাকে বেদনায় পায়।

মেয়েটির বাপ নেই, জমিজমা কিছু নেই, কোমল বয়স, গ্রামজুড়ে কথা ওঠে, মায়ে তাকে খুঁটি দেবে পুরোনো ঘরের। কেউ তো নেয়না মেয়ে, বাঁশির বাদকও শুনি যৌতুকের বশ, কে তবে কোথায় আছে? ভীমরতি-বুড়ো পরে পোশাক বরের। বুড়োর হাপাঁনি রোগ, চারটে সতিন ঘরে ঠ্যাং মেলে শোয়, আকুল নয়নে মেয়ে চারপাশে খোঁজে শুধু বাঁচার আশ্রয়, কোথায় বাসর ঘর, ভেঙে চুরে স্বপ্ন সব ছত্রখান হয়, নিয়তির কাছে হেরে এইভাবে হল তার যৌবনের ক্ষয়।

মা সে মা হোক, মা তো নারীই, মার কষ্টগুলো এই প্রথম আমি স্পর্শ করি।

অনেক বলেছে নারী, তাবিজ কবজ করে ফেরাতে চেয়েছে, তবু তো ফেরে না স্বামী, একেতে মেটেনা শখ, বিচিত্র স্বভাব। কোথায় মোহিনী মায়া কি জানি কেমন করে কি সুখ পেয়েছে, একেতে মেটে না শখ, বিপুল আমোদে নাচে বিলাসি নবাব। একাকিনী ঘরে নারী চোখের জলের নদী বহায়ে ভীষণ, মাজারে পয়সা ঢালে পীরের মুরিদ হয় দুনিয়া বিমখু , বুকের ভেতরে তার কষ্টের পাহাড় জমে, ছেঁড়াখোঁড়া মন, বানানো বিশ্বাস নিয়ে বিকৃত স্নায়ুরা চায় দেখানিয়া সুখ । পীরকে হাদিয়া দিয়ে, মাজারে সেজদা দিয়ে উদাসীন নারী, একালে সুখের ঘর কপালে জোটেনি বলে পরকাল খোঁজে, খোদা ও নামাজে ডুবে দিতে চায় জীবনের হাহাকার পাড়ি, বিস্বাদ জীবনে নারী অ−লৗকিক স্বপ্ন নিয়ে চক্ষু দুটি বোজে।

একদিন শেষ-বিকেলে সাফিনাজের সঙ্গে রিক্সা করে হাসপাতাল থেকে বাড়ি ফিরছিলাম, গাঙ্গিনার পাড় থেকে ডানদিকে রিক্সা মোড় নিতেই ও চাপা স্বরে বলে উঠল,ওই যে দেখ প্রস্টিটিউট যায়। বল কি! আমি প্রতিবাদ করেছি। এ তো সাধারণ একটি মেয়ে। সাফিনাজ হেসেছিল শুনে। আমি এদের প্রায়ই দেখি রাস্তায়, কোনওদিন মনে হয়নি, এরা পতিতা। দরিদ্র মেয়ে, গায়ে সস্তা শাড়ি, মুখে হয়ত শখ করে আলতার রং লাগিয়েছে। এরকম শখ তো যে কোনও মেয়েরই হয়। রাস্তায় দেখা বেশ্যা নামের মেয়েটির প্রতি আমার কোনো ঘণৃা হয়নি। বরং ওর জন্য আশ্চর্য রকম মমতা জন্ম নেয় আমার।

তিনকূলে কেউ নেই, ডাঙর হয়েই মেয়ে টের পেয়ে যায়, অভাবের হিংস্র হাত জীবন কামড়ে ধরে ছিঁড়েখুঁড়ে খায়। যুবতী শরীর দেখে গৃহিণরা সাধ করে ডাকে না বিপদ, বেসুমার ক্ষিদে পেটে, নিয়তি দেখিয়ে দেয় নারীকে বিপথ। দুয়ারে ভিক্ষার হাত বাড়িয়ে বেকার নারী তবু বেঁচে থাকে, স্টেশন কাচারি পেলে গুটিসুটি শুয়ে পড়ে মানুষের ফাঁকে। এইসব লক্ষ্য করে ধড়িবাজ পুরুষেরা চোখ টিপে হাসে, দেখাতে ভাতের লোভ আধাঁর নিভৃতে তারা ফন্দি এঁটে আসে। তিনকুলে কেউ নেই, কোথাও কিছুই নেই, স্বপ্ন শুধু ভাত, শরমের মাথা খেয়ে এভাবেই নারী ধরে দালালের হাত।

প্রতিদিনই নারী আমাকে ভাবায়। কোনও নারীকেই আমার সুখী বলে মনে হয় না। এমন কি কি যে মেয়ে নাচছে, গাইছে, চমৎকার পোশাক পরছে।

কাখের কলস ফেলে শোভন রমনী হয় ক্যাবারে ডান্সার, বাঁকানো দেহের ভাঁজে অশ্লীল ইশারা থাকে উন্মত্ত নারীর, ফুরিয়েছে চাল ঘরে, ভাবছে দেহের ভাড়া এ মাসে বাড়াবে, নেশাখোর পুরুষেরা চোখের ভাষায় ডাকে নিকটে আসার। যাত্রার উদ্বাহু নৃত্য ছেড়ে নগ্নপ্রায় নারী লাখপতি ঘাটে, এখন বাজার ভাল, যতটুকু পারা যায় করবে সম্বল। সকলে হাতিয়ে নেয় সুবিধা স−ম্ভাগ যত মুখোশের নিচে, নারীর মুখোশ নেই, লোকে তাকে পাপ বলে পৃথিবীর হাটে। রূপালী পর্দার লোভ পুষছে যতনে খুব মগ্ন নিরন্তর, ধাপে ধাপে উধের্ ওঠে, আসলে পাতালে নামে প্রগাঢ বিষাদ, শিল্পের সুনাম ভেঙে পতিত জমিনে গড়ে সুরম্য নরক, কালো হাত দূরে থাকে, নিয়ন্ত্রণ তার কাছে, ভাঙে সব ঘর। কাখের কলস ভাঙে, নারীকে দেখিয়ে দেয় আধাঁরের পথ, কালো হাত আছে এক, লোমশ নৃশংস হাত কলকাঠি নাড়ে, বিপুল ধ্বংসের ধ্বস তৃতীয় বি−শ্বর কাঁধে ভাঙছে ক্রমশ, ভাঙছে স্বপ্নের ঘর, সুবর্ণ কঙ্কণ আর সোনালিমা নথ।

অথবা

বাপের ক্যান্সার রোগ, মরণ দুয়ারে এসে দাঁড়িয়ে রয়েছে। ফিরিয়ে নিয়েছে চোখ, গুটিয়ে রেখেছে হাত পরম স্বজন, রোজগারি ছেলে নেই, কিচিমিচি ভাইবোন দুবেলা উপোস, চাকরির খোঁজে নারী মধ্যাহ্নের পথে রাখে কোমল চরণ। এত বড় রাজধানী, আপিস দালানগুলো আকাশকে ছোঁয়, নগরের মাটি চষে প্রয়োজনে নারী কোনও পেল না ফসল। কোথাও ভরসা দিলে বিনিময়ে সরাসরি পেতে চায় দেহ, দ্বিপদী জীবনের ভিড়, কোথাও মানুষ নেই, সকলে অচল। শরীরের ঘ্রাণ পেলে শেয়াল শকুনগুলো নখর বসায়, উপোসের আয়ু বাড়ে, অভাবের বানে ভাসে সুফলা সংসার। খড়কুটো আঁকড়িয়ে জীবন বাঁচালো নারী উজানের জলে, দাঁড়াবার মাটি নেই, তুমুল তুফানে নদী ভাঙে দুই পার।

গলায় রুমাল বেঁধে শহরতলির ছেলে ভোলায় নারীকে, ঝোপের আড়ালে নারী প্রেম শিখে পার করে নিদ্রাহীন রাত, ধং্ব সের আগুন দেখে ভালোবেসে গলে যায় মোমের মতন, প্রেমিকের হাত ধরে অবুঝ কিশোরী মেয়ে ফেলে যায় জাত। ছলাকলা পৃথিবীর কিছুই জানে না নারী, অবাক দুচোখ! সুদূরে পালিয়ে দেখে ছেলের মুখোশ খুলে বিকট আদল, কোথাও স্বজন নেই, আটকা পড়েছে এক সুচতুর ফাঁদে, প্রেমান্ধ যুবতী মেয়ে শেখেনি চিনতে হয় কি করে আসল। আঁধার গলিতে ছেলে চড়াদামে বিক্রি করে রূপসী শরীর, সমাজের উঁচুমাথা তাবৎ বিজ্ঞেরা দেয় কপালের দোষ, শরীরের মাংস নিয়ে রাতভর হাট বসে, দরদাম চলে, আমাদের বোন ওরা, টাকার বদলে দেয় খানিকটা তোষ। আমার দেশের নারী গলিত শবের মত নর্দমায় ভাসে, ভয়াল রাতের গ্রাস আকাঙক্ষা চিবিয়ে খেয়ে ফেলে রাখে বিষ, সজোরে হাত পা বেঁধে সেই বিষ কে ঢেলেছে এইসব মুখে? মরণের জ্বালা এরা পোহাতে জীবনভর পৃথিবীতে আসে?

আরও নারীর মখু চোখে ভাসে আমার, আরও নারী আমাকে কাঁদাতে থাকে।

কোলের বাচ্চাটা কাঁদে, পুঁজ ও পাঁচড়া ভরা ঘিনঘিনে দেহ, বুকে তার দধু নেই, বেকার রমণী চায় ঘরে ঘরে স্নেহ, শ্রমের জীবন চায়, বিনিময়ে ভাত চায় রাতে, সন্তানের শিক্ষা চায়, চিকিৎসার নিশ্চয়তা পেতে চায় হাতে। এ হাতে কে দেবে চাবি, ওই চাবি কোন ঘরে, কে রাখে লুকিয়ে? অসুখে অভাবে ভুগে সন্তানেরা ফি বছর মরছে শুকিয়ে। মাস মাস স্বামী জোটে, গোখরা সাপের মত ফণা তুলে চায়, সোমত্থ শরীরে তারা সন্তানের বিষ ঢেলে গোপনে পালায়। ওই চাবি কোন ঘরে? পেতে চায় নারী খুব সিন্দুকের স্বাদ, আসলে একাকী নয়, দল বেঁধে যেতে হয় ভাঙতে প্রাসাদ।



ইচ্ছে হয় প্রতিদিন এমন করে নারীর কষ্টগুলো লিখি, প্রতিদিন লিখি। কিন্তু জটিল চিকিৎসাশাস ্ত্র উড়িয়ে নিতে থাকে সমস্ত সময়। কলেজ থেকে ক্লাস করে বিকেলে বাড়ি ফিরে খেয়ে বিশ্রাম নিতে নিতেই আবার সময় হাসপাতালে যাওয়ার। প্রতিদিন নারী নিয়ে মগ্ন হয়ে থাকা সম্ভব হয় না। এ তো টেবিলে বসে বই পড়া নয় আর, যে, বই থেকে মাঝে মাঝে চোখ সরিয়ে অন্য কিছুতে দিতে পারি। দৌড়োতে হয় হাসপাতালে। দিনেও যেমন, রাতেও তেমন। রোগী টিপে পরীক্ষা করতে হয়, এভাবেই পড়া। বইপড়া বিদ্যেয় ডাক্তার হওয়া যায় না, রোগী পড়তে হয়। মেডিসিনে যেমন রাজিব আমাদের বাড়তি ক্লাস নেন, গাইনি বিভাগে নেন হীরা, হীরা দীর্ঘদিন থেকে আছেন এই স্ত্রীরোগ আর প্রসুতিবিদ্যা বিভাগে, নিজে তিনি বড় কোনও ডিগ্রি নেননি, কিন্তু গাইনি বিদ্যায় তিনি এক নম্বর, কাটা ছেঁড়ায় তাঁর মত দক্ষ অনেক অধ্যাপকও নন। হীরা রোগিও পান প্রচুর। অনেকে বলে স্বয়ং জোবায়েদ হোসেনের চেয়ে হীরার প্র্যাকটিস ভাল। তা হয়ত বাড়িয়ে বলে, কিন্তু কলেজের সহযোগি অধ্যাপক সহকারি অধ্যাপক রেজিস্টার ক্লিনিক্যাল এসিস্ট্যান্টএর চেয়ে হীরার ভাল কামাই এ নিয়ে সন্দেহ নেই কারও। মেডিসিনে না হয় প্রভাকর পুরকায়স্থ আছেন, বাঘ নন তিনি যাই হন। জোবায়েদ হোসেনকে দেখে বাঘে ছাগলে একঘাটে জল খায়, এমন ভয়ঙ্কর। সার্জারির এনায়েত কবির যেমন। কোনো ধমক লাগানো বা দাঁত খিঁচিয়ে কিছু বলার দরকার হয় না, এ দুজনের উপস্থিতিই যথেষ্ট ছাত্রছাত্রীদের হাড় ঠাণ্ডা করে দেওয়ার জন্য।জোবায়েদ হোসেন ছফুট লম্বা, চোখে চশমা, ঢিলেঢালা শার্ট প্যান্ট পরনে, লম্বা একটি এপ্রোন, খুলনার উচ্চারণে কথা বলেন, যখন ওয়ার্ড থেকে ওয়ার্ড ঘোরেন, পেছনে একগাদা ডাক্তার আর ছাত্রছাত্রী, যেন ভগবান হাঁটছেন, পেছনে পয়গম্বরবৃন্দ (ডাক্তার), শাগরেদবৃন্দ (ছাত্র-ছাত্রী)। কিন্তু নিজেকে যখন হাঁটতে হল জোবায়েদ হোসেনের, মনে হয়নি আমি তাঁর শাগরেদ,যেন বিচারের অপেক্ষায় থাকা আসামি। বিচারের সময় সামনে, পরীক্ষা সামনে। কি কারণে আমি জানি না, আমাকে নজরে রাখেন তিনি। অধ্যাপকদের নজর দু প্রকার, এক খারাপ, দুই ভাল। নজরে পড়ার পর ঠিক বুঝে পাই না, এ ঠিক কোন ধরনের নজর। কখন কোন ক্লাসে দেরি করে এসেছি, প্রসবকক্ষে কতগুলো প্রসব ঘটিয়েছি এসব তাঁর মুখস্ত একরকম। আচমকা স্ত্রীরোগসম্পর্কিত জটিল কোনও প্রশ্ন করে বসেন যে কোনো জায়গায়, ওয়াডের্, করিডোরে, অপারেশন থিয়েটারে, প্রসবকক্ষে। আমাকে তটস্থ থাকতে হয়, ক্লাস শেষ হলে জোবায়েদ হোসেন যে পথে যান তার আশপাশ দিয়েও আমি হাঁটি না। দূর থেকে তাঁকে দেখলে দ্রুত আমার গতি এবং গন্তব্য দুইই পরিবর্তন করি তাঁর মুখোমুখি না হওয়ার জন্য। মুখোমুখি হওয়ার একটি বিপদ আছে, অবশ্য না হওয়ারও বিপদ আছে। মুখোমুখি হলে তিনি আচমকা প্রশ্ন করতে পারেন, যার উত্তর, আমি নিশ্চিত নই আমার বিদ্যের ঝুড়িতে আছে। আর না হওয়ার বিপদটি হচ্ছে তিনি কোনো একদিন বলে বসতে পারেন এ মখু তো সচারচর দেখা যায় না হাসপাতালে, তার মানে পড়াশোনায় ফাঁকি দিচ্ছ। মুখ চিহ্নিত হওয়ার ভাল দিক যতই থাক, আমি এড়িয়ে চলি তাঁর ছায়া। অন্য ছাত্রছাত্রীরা দূর থেকে তাঁকে দেখলে শথ্ল পায়ে এপ্রোনটি টেনে টুনে এমনকি কোনো বই খুলে সে বইয়ের দিকে চোখ বুলোতে বুলোতে এগোয়, আর জোবায়েদ হোসেন কাছাকাছি হলে একটি সালাম ঠুকে দেয়। এটি করার কারণটি হচ্ছে ছাত্র বা ছাত্রীটি যে ক্লাসে কেবল নয় করিডোরেও পড়ছে এবং আদব কায়দাও ভাল জানে সে ব্যাপারটি জোবায়েদ হোসেনের মস্তি−স্কর স্মরণ-কোষে ঢুকিয়ে দেওয়া, পরীক্ষার সময় এই স্মরণ কোষে কোনওরকম টোকা যদি পড়ে। ভাল পড়াশোনা করলেই যে ডাক্তারি পাশ করা যায় তা নয়। শিক্ষকদের করুণা না জুটলে সব গেল। এক্সটারনালদের কবল থেকে বাঁচার জন্য ইন্টারনালদের ওপর ভরসা করতেই হয়, ইন্টারনালদের শ্যেন নজরে পড়লে এক্সাটারনাল আর ইন্টারনাল এই দুকবলে পড়ে প্রাণ বিসর্জন দেওয়া ছাড়া আর কোনও উপায় থাকবে না। বাবা এ কলেজের অধ্যাপক বলে যে এনায়েত কবির আর জোবায়েদ হোসেনের মত হিংস্র বাঘের কবল থেকে রক্ষা পাবো, তা মনে করার কোনও কারণ নেই। এ কথা বাবাও বলে দিয়েছেন। যত ছাত্র ছাত্রী মেডিকেল কলেজ থেকে ডাক্তার হয়ে বেরোতে গিয়েও বেরোতে পারে না, কারণ এই শেষ পরীক্ষাতেই দূর্ঘটনাটি ঘটে। আমার সঙ্গেই ক্লাস করছে আমার চেয়ে দুবছর তিনবছর এমনকি পাঁচ ছ বছর আগে আটকে যাওয়া ছাত্র ছাত্রীরা। ওদের মলিন মখু দেখে নিজের ভবিষ্যতের কথা ভাবি, এরকমই কি হতে যাচ্ছি আমি!সুতরাং আমাকে বাবার উপদেশে আর জোবায়েদ হোসেনের ভয়ে মনোযোগী হতে হয় তা নয়, নিজের জন্যই হতে হয়, এক ক্লাসে দুদুবার পড়ে থাকলে নিজের জীবনের যে সমস্যা, তার সমাধান তো হবেই না বরং আরো জট পাকাবে, যত দ্রুত ঝামেলা শেষ করে রুদ্রর সঙ্গে সংসার করা যায়, রুদ্রর এলোমেলো জীবনকে পরিপাটি করা যায়!সংসার করার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছে সে, যে সংসার তাকে স্থিরতা দেবে বলে সে বিশ্বাস করে, প্রতিজ্ঞা করেছে যে ভুলটি সে করেছে এমন ভুল ভবিষ্যতে হবে না আর, আশায় আশায় থেকে বছরগুলি এই তো ফুরিয়ে আসছে, রুদ্র পরিকল্পনা করে ফেলেছে পাকাপাকি ভাবে সে ঢাকায় চলে আসবে, ঢাকায় ছাপাখানার ব্যবসা শুরু করবে। রুদ্রর এই উদ্যোগ আমার জ্বলতে থাকা পুড়তে থাকা স্বপ্নের বাড়িঘরে ফোঁটা ফোঁটা জলের মত ঝরে।



প্রসূতিবিদ্যা বিভাগের প্রসবকক্ষে বিরামহীন আসছে বিভিন্ন বয়সের প্রসূতি, কেউ প্রথম সন্তান, কেউ দ্বিতীয়, এমনকি সপ্তম সন্তানও জন্ম দিতে। যন্ত্রণায় চিৎকার করে প্রসুতিরা।একটি নিম্নগামি চাপের উপদেশ দিই তাদের। যে চাপের ফলে জলের থলি নেমে আসবে নিচের দিকে, থলি ফুটো করে দিলে পৃথিবীর পথে যাত্রা করবে একটি শিশু। এই যাত্রা যেন শুভযাত্রা হয়, শিশুর হৃদপিণ্ডের ধ্বনিতে যেন কোনও কিন্তু না থাকে, সেদিকে চোখ কান খোলা রাখি। পথ প্রশস্ত করে দিই শিশুর যাত্রায় যেন বিঘ্ন না হয়। কিন্তু যখনই, সে প্রথম হোক, দ্বিতীয় হোক তৃতীয় হোক, আগমন ঘটে কোনও শিশুর, যদি সে মেয়ে-শিশু হয়, আর্তনাদ করে ওঠে শিশুর মা। কক্ষের বাইরে অপেক্ষারত আত্মীয়দের কাছে কন্যাসন্তান জন্মের খবর দেওয়ামাত্র মখু গুলো চোখের সামনে বিষাদে আচ্ছত হয়। মেয়ে জন্ম যে কি রকম অনাকাংখিত, তা আমার প্রতিদিন দেখা হতে থাকে। সাতটি পুত্রসন্তান জন্ম দেবার পর কেউ হয়ত একটি কন্যাসন্তান আকাঙক্ষা করে, তাও হাতে গোনা কজন মাত্রই করে। কন্যা নয়, কন্যা নয় পুত্র চাই পুত্র চাই, এই প্রবল প্রখর আকাঙক্ষা নিয়ে প্রসূতির আত্মীয়রা ভিড় করে প্রসুতিকক্ষের বাইরে। কন্যাজন্মদানের পর আমি একুশ বছর বয়সী এক তরুণীর আর্তনাদ থামাতে বলেছিলাম, নিজে মেয়ে হয়ে আপনি একটি মেয়ের জন্ম চাইছেন না, ছি!

তরুণী অস্ফুট স্বরে বলল, আমারে যে তালাক দিবে, তালাক দিলে আমি কই যাবো!

তালাক দিবে কেন? একটা সুস্থ সুন্দর বাচ্চা জন্ম দিছেন আপনি। আপনার খুশি হওয়ার কথা। মিষ্টি খাওয়ান সবাইরে।

মেয়ে জন্ম দিছি আপা। আমি তো অপয়া!

ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকে তরুণী। প্রসবকক্ষের দেয়ালে দেয়ালে ধ্বনিত হতে থাকে, আমি তো অপয়া, আমি তো অপয়া। কানে হাত চাপা দিয়ে বেরিয়ে যাই আমি।

ডাক্তারদের, হতে যাওয়ার ডাক্তারদের, নার্সদের জন্য খাঁচা ভরে মিষ্টি আসে প্রসবকক্ষের বাইরে। সে মিষ্টি পুত্রজন্মের আনন্দে। আমি অপেক্ষা করে থাকি কন্যা জন্মের কারণে কোনও একটি দম্পতির সন্তুষ্টি দেখার। আমার দেখা হয় না।

মেয়ে হইছে, তাতে কি হইছে। মেয়েরাই তো ভাল। মেয়েরা বাপ মায়ের দেখাশোনা করে। আপনার মেয়েরে লেখাপড়া করাইবেন, ইশকুল কলেজে পড়াইবেন, আমার মত ডাক্তার হবে আপনার মেয়ে। দুঃখ করবেন না। বলে বলে যতবারই আমি কাঁদতে বারণ করি দুঃখিতা নারীদের, ততই তারা কাঁদে, প্রাণ ভরে কাঁদে প্রসব কক্ষের ভেতর। জরায়ুর ফুল ঝরে যায়, অন্তরে বিঁধে থাকে সহস্র কাঁটা। কেবল পুত্রসন্তান জন্ম দিলেই প্রসব যন্ত্রণা ম্লান হয়ে প্রশান্তির হাসি ফোটে মুখে, প্রসবকক্ষে হাসি ফোটে, প্রসবকক্ষের বাইরে ফোটে। প্রসব যনণ্ত্রার চেয়েও বড় এক যন্ত্রণা বুকে নিয়ে আমাকে প্রতিদিন প্রসবকক্ষ থেকে বেরোতে হয়। সমাজের বিকট কৎু সিত রূপটি পরিষ্কার হতে থাকে চেতনায়। কে আমি কি আমি কেন আমি এই প্রশ্নগুলো আমি তসবিহর গোটা নাড়ার মত নাড়তে থাকি। অনাকাঙ্খিত কোনও কন্যা সন্তান, কন্যাসন্তান জন্ম দিয়ে আর্তনাদ করা প্রসবকক্ষের কোনও দুঃখিতা এবং এই আমার মধ্যে কোনও পার্থক্য খুঁজে পাই না।

সমাজের নিয়মগুলো ছিঁড়ে ফেলার জন্য যখন আমার হাতদুটো নিশপিশ করছে, লিলির গালে একটি শক্ত চড় কষাই কেন আমি একবার নয় চার চার বার ডাকার পরও ও কাছে আসেনি, কেন জানতে চায়নি আমার কি প্রয়োজন। চড় খেয়ে থতমত খাওয়া লিলিকে ধাক্কা দিয়ে দরজার বাইরে ঠেলে বলি, যা এক্ষুনি চা নিয়া আয়। লিলি, দশ বছর বয়সের মেয়েটি নিঃশব্দে চোখের জল ফেলতে ফেলতে যায় রান্নাঘর থেকে এঁটো বাসনের সপ্তূ নিয়ে কলতলার দিকে যেতে থাকা তার মায়ের কাছে বলতে যে আমি চা চাচ্ছি। লিলির মা সপ্তূ নামিয়ে রেখে চায়ের পানি বসায় চুলোয়। লিলি ধীরে হেঁটে, যেন ছলকে না যায়, ধোঁয়া ওঠা চা এর কাপটি রেখে যায় টেবিলে। একটি মলিন হাফপ্যান্ট পরনে লিলির, খালি গা, পায়ের হাঁটু অবদি ধুলো, নাকে একটি দপু য়সা দামে কেনা একটি টিনের নাকফুল। আমি যখন চা খেতে খেতে কন্যাজন্ম নিয়ে একটি কবিতা লেখার চেষ্টা করছি, মনোযোগ ছিন্ন করতে এ সময় কেউ ঘরে ঢুকুক আমি চাইনি। কিন্তু মা কেবল ঢোকেন না, তিক্ত স্বরে বলেন, ডাক্তার হইতাছস বইলা কি মানুষরে মানুষ জ্ঞান করস না নাকি? এত দেমাগ তর?

কেন কি হইছে? আমি বিরক্ত কণ্ঠে বলি।

এই বাচ্চা মেয়েডারে যে মারলি, এইভাবে মারা কি ঠিক হইছে তর? মেয়েডার গাল লাল হইয়া রইছে।

আমি লিলি লিলি কইয়া অনেকক্ষণ ডাক দিছি। আইল না কেন?

আইল না হয়ত শুনে নাই। হয়ত দূরে ছিল। তাই বইলা মারবি? একটা গরিব বাচ্চা। বাপ নাই। মা মানুষের বাড়িত কাম কইরা খায়। ছেড়িডা ফুটফরমাইস করে, দৌড়াইয়া দৌড়াইয়া করে। করে যে এইডাই তো বেশি। তার মায়ে তো দিন রাইত খাটতাছে। গরিব মাইনসেরে মারিস না। আল্লাহরে অখুশি করিস না। এইসবের শাস্তি তো আল্লাহ দিবেন। ধর্ম বিশ্বাস করস না। আল্লাহ মানস না। তর কপালে যে কি আছে!

মা সরে যান। আবার মিনিট দুই পর এসে টেবিলে ছড়ানো কাগজ থেকে নারী বিষয়ে লেখা কবিতাগুলো আমার দিকে ঠেলে দিয়ে বলেন, এই যে মেয়েদের নিয়া কবিতা লেখস, অথচ মেয়েদের গায়ে হাত তুলস! কি লাভ এইসব লেইখা তাইলে!

আমার হাতে শাদা কাগজ, কাগজে কাটাকুটি করা কবিতার দুটি লাইন। আমার চোখ দুটি লাইনে। আমার মন অন্যত্র।
 
২১. আবার একদিন পীর বাড়ি


পীরবাড়ি যাওয়া হয় আমার একদিন। এবার মার সঙ্গে নয়। তিনজন বান্ধবীর সঙ্গে। হোস্টেলে মেয়েরা একটি মিলাদের আয়োজন করার ইচ্ছে করেছে। যদিও উদ্ভট শখ এটি, ডাক্তারি পড়া মেয়েদের আল্লাহুম্মা সাল্লিআলা গাওয়ার সময়ও নেই বেশি, আর এটি গাওয়ার কারণ খুঁজেও তারা পাবে না কিছুই, তবু। উদ্ভট হলেও যেহেতু শখটি হয়েছে একজন মৌলবির দরকার তাদের। মৌলবি খুঁজছে মেয়েরা, এদিক ওদিক খুঁজে ব্যথর্ হয়ে শেষে আমাকে ধরলো, যেহেতু শহরের মেয়ে আমি, চেনা জানা থাকতে পারে কেউ। আমি কথা দিই মৌলবি যোগাড় করে দেব, আবেগে আবেগে আবার এও বলে ফেলি, দেব তো দেব মেয়ে-মৌলবি দেব একখানা। মেয়েদের হোস্টেলে মেয়ে-মৌলবি এসে মিলাদ পড়িয়ে যাবে। এর চেয়ে ভাল প্রস্তাব আর কি হতে পারে। তবে আমি যেহেতু আল্লাহ রসুলে মিলাদে মসজিদে বিশ্বাসী নই, আমি মিলাদের মিষ্টি খাওয়া ছাড়া আর কিছুই করব না। ওই আল্লাহুম্মা সাল্লিআলা সাইয়েদেনায় শরিক হওয়ার কোনও রুচি নেই আমার। ঠিক আছে, তাই সই। আমার সঙ্গে রওনা হয় সাফিনাজ, হালিদা আর পারুল। চারজন দুটি রিক্সা নিয়ে নওমহলের পীরবাড়ি পৌঁছই। বহু বছর পর পীরবাড়ি আসা আমার। ছোটবেলায় যেমন গা ছমছম করত এ বাড়ি ঢুকতে, এই বড়বেলাতেও সেই গা ছমছমটি যায়নি। যেন এ পৃথিবী নয়, পৃথিবীর বাইরে কোনও এক জগতে ঢুকছি। এই জগতের সবাই আমাদের দিকে বিস্ময়বিস্ফারিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। দৃষ্টিগুলো অতিক্রম করে অন্দরমহলে ঢুকি, খুঁজি ফজলিখালাকে। ফজলিখালা আমাকে দেখে, লক্ষ করি, খুব অবাক হননি, যেন কোনও একদিন এবাড়িতে আমার আসারই কথা ছিল। ফজলিখালাকে, যেহেতু তিনি আমার খালা, যেহেতু এ বাড়ির সবাই সবকিছু বেজায় অদ্ভুতুড়ে হলেও তিনি পুরোটা নন, বলি যে আমাদের একটি মেয়ে-মৌলবি দরকার, আজ বিকেলেই। মেয়েদের হোস্টেলে মিলাদ পড়িয়ে আসবে। এই আহবানে ফজলিখালার মুখে হাসি ফোটার কথা, কারণ গোটা শহরে এই একটি জায়গাতেই, এই পীরবাড়িতে, মেয়ে-মৌলবি পয়দা করা হয়, আর এই মেয়ে-মৌলবির চাহিদা আছে বাজারে, কেউ কেউ এসে মেয়ে-মৌলবি পাওয়ার জন্য তদবির করে অথবা করতে পারে। ফজলিখালার অ-বিস্মিত অ-খুশী মখু টির সামনে দাঁড়িয়ে তাড়া দিই, এক্ষুনি কোনও একটি মেয়েকে যেন আমাদের হাতে দেওয়া হয়, আমাদের সময় নেই বেশি। যে কোনও একটি মেয়ে, হুমায়রা বা সুফায়রা বা যে কেউ। আমার এই প্রস্তাব শুনেও অবাক হন না ফজলিখালা, কিন্তু হাসেন। সম্ভবত তাঁর দুটো কন্যার নাম উল্লেখের কারণে এই হাসিটি। ফজলিখালার মখু টি আগের মতই সুন্দর। হাসিটি সেই আগের মতই নির্মল। সেই হাসিটি যখনও মিলিয়ে যায়নি, হুমায়রা এসে উপস্থিত। আঁটসাঁট জামাটি থেকে হুমায়রার পেটের থাক থাক চবির্ প্রায় ফেটে বেরোতে চাইছে।বড় ওড়নায় ঢেকে রেখেছে মাথা। হুমায়রার ওড়না ঢাকা মাথাটি সামনে পেছনে নড়ে যখন আমরা বলি একজন মেয়ে-মৌলবি দরকার আমাদের। এই হুমায়রা, যে নিজের প্রেমিক প্রবর ফুপাতো ভাইকে মেদেনিপুর থেকে আনিয়ে হলেও নিজের বিয়ে ঘটিয়েছে, যখন পীরবাড়ির সব যুবতি মেয়েরা আল্লাহর পথে নিজেদের উৎসর্গ করে নিজেদের বিয়ে থা সংসার সন্তান ইত্যাদি জলাঞ্জলি দিয়েছিল যেহেতু পীর নিজে ঘোষণা করেছিলেন এই শেষ জমানায় বিয়ে করার কোনও মানে হয়না। কিন্তু এই হুমায়রা, পীরের নাতনি হয়ে, পীরের ঘোষণার অবাধ্য হয়েছে প্রথম, অবাধ্য হয়েছে ঠিক বিয়ের বয়সে এসে। ওদিকে ঘোষণা পালন করতে গিয়ে হুমায়রার চেয়ে বয়সে বড় যুবতীকুল আইবুড়ি রয়ে গেছে। এই হুমায়রা, যার বিয়ের কারণে পীরের কাছে আসা শেষ জমানায় বিয়ে না করার জন্য আল্লাহর নির্দেশটি এক রাতেই পাল্টো যায়, পাল্টো গিয়ে দাঁড়ায় আল্লাহ বলেছেন শেষ জমানায় সঙ্গী বেছে নাও খুব তাড়াতাড়ি, বান্দারা শেষ জমানায় বিয়ে করলে আল্লাহতায়ালা বড় খুশী হবেন। আল্লাহতায়ালা বড় ঘন ঘন সিদ্ধান্ত পাল্টান। এই পীরবাড়ির সদস্যদের সুবিধে অসুবিধে অনুযায়ী সিদ্ধানগ্তুলো নেন তিনি। হুমায়রা আমাদের আকাঙক্ষাটি শুনে ঠিক আছে, ব্যবস্থা করছি, যা চাইছ তা পাবে বলে আমাদের অপেক্ষা করার নির্দেশ দিয়ে অন্দরমহলের অন্দরে চলে গেল। ফজলিখালাও অদৃশ্য। সম্ভবত হুমায়রা নিজে বোরখা পরে আসছে আমাদের সঙ্গে যেতে। কিন্তু ওভাবে প্রায় পঁচিশ মিনিট দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করার পর নিজে তো সে বোরখা পরে এলই না আমাদের সঙ্গে হোস্টেলে যেতে, বরং আমাদের নিয়ে স্বয়ং পীর আমিরুল্লাহর ঘরে ঢুকল। পীর আমিরুল্লাহ শাদা আলখাল্লায় শাদা টুপিতে বসেছিলেন বিছানায়। তাঁর মেহেদি লাগানো দাড়ি নড়ছিল যখন তিনি আমাদের দেখে মাথা নাড়ছিলেন আসুন আসুন ভঙ্গিতে। হুমায়রা দাঁড়িয়ে রইল পাশে। পীর ছাড়াও পীরের কন্যা জোহরা ছিল ঘরে, আর কিছু আইবুড়ি। আমাদের এ ঘরে ঢোকানোর কারণ আমার কাছে স্পষ্ট নয়। অনুমান করি, মেয়ে-মৌলবি পেতে হলে কেবল ফজলিখালা আর হুমায়রার অনুমতি যথেষ্ট নয়, আমাকে স্বয়ং পীর আমিরুল্লাহর কাছে আবেদন পেশ করতে হবে আমাকে, তাঁর অনুমতি মিললেই আমাদের কাজ হাসিল হবে। কিন্তু ঘরে ঢোকার পর পীর আমিরুল্লাহ কিছু জানতে চাইলেন না আমরা কেন এসেছি, কি কারণ। আদৌ তিনি আমাদের এ বাড়িতে আগমনের উদ্দেশ্য জানেন কি না আমার সন্দেহ হয়। সম্পণূর্ অপ্রাসঙ্গিকভাবে, আর কাউকে না হলেও, আমাদের, আমাকে সাফিনাজকে, হালিদা আর পারুলকে হতবাক করে বলেন, তারপর বুঝলেন কি না আল্লাহর পথে আসা খুব সহজ কথা নয়, দুনিয়াদারির মোহ ত্যাগ যারা করতে পেরেছে, তাদের জন্য আল্লাহতায়ালা আখেরাতে সর্বোচ্চ সম্মানের আয়োজন করেছেন। ঘরের অন্যান্যদের মখু থেকে আহ আহ শব্দ ওঠে। সর্বোচ্চ সম্মানের জন্য তৃষ্ণা সেই আহ শব্দে। দুনিয়াদারির লেখাপড়া, দুনিয়াদারির সাময়িক সংসার, মায়ার জাল ছিঁড়ে যারা বেরিয়ে আসে তাদের জন্য কি ধরণের সম্মান অপেক্ষা করছে পরকালে তার পুঙ্খানপুুঙ্খ বর্ণনা করেন এবং দুনিয়াদারিতে ডুবে থাকলে আল্লাহতায়ালা কি ধরনের শাস্তি লিখে রেখেছেন তারও ভয়াবহ বিবরণ দিতে তিনি ভোলেন না। বর্ণনা দীর্ঘ। বিবরণ অতিদীর্ঘ।সাফিনাজ, হালিদা আর পারুল বার বার আমার দিকে কুঞ্চিত চোখে তাকাচ্ছে, বুঝে পাচ্ছে না কি ঘটছে এখানে, ফিসফিস করছে, চল চল। দেরি হয়ে গেল। আমিও ঠিক বুঝে পাচ্ছি না কেন আমাদের এখানে দাঁড় করিয়ে আল্লাহতায়ালার শাস্তি এবং পুরস্কারের আদ্যোপান্ত জ্ঞান দেওয়া হচ্ছে। হুমায়রাকে ইঙ্গিতে বলার চেষ্টা করি যে আমাদের সময় নেই সময় খরচ করার। মেয়ে-মৌলবির জন্য এসেছি আমরা, এসব শুনতে নয়। আমার ইশারার দিকে ফিরে তাকায় না হুমায়রা। বড় বিব্রত বোধ করি বান্ধবীদের সামনে। মেয়ে-মৌলবি যোগাড় করে দেবার লোভ দেখিয়ে এদের এই বাড়িতে নিয়ে এসে এখন স্পষ্ট বুঝতে পারছি, আটকে পড়েছি। পীর আমিরুল্লাহ আমাদের দিকে আড়চোখে মাঝে মাঝে তাকান, বাকি সময় তিনি মেঝে নয়ত সিলিংএর দিকে, উঠোনের গাছগাছালি নয়ত আইবুড়িদের দিকে তাকিয়ে বলতে থাকেন আল্লাহতায়ালার গুণাগুণ। যেন কোনও মানুষের মখু থেকে নয়, রবোটের মুখ থেকে বেরোচ্ছে সব। কোরান হাদিসের প্রতিটি শব্দ আমিরুল্লাহ মুখস্থ ঠোঁটস্থ অন্তঃস্থ করে ফেলেছেন, পরীক্ষা সামনে এলে পরীক্ষার্থীরা যেমন মখু স্থ করে সিলেবাসের বইগুলো। শব্দগুলো আমিরুল্লাহর মখু থেকে ছিটকে বেরোচ্ছে আগুনের ফুলকির মত, গায়ে এসে লাগছে ফুলকি। হঠাৎ মনে হয়, লোকটি আমিরুল্লাহ নন, লোকটি স্বয়ং আল্লাহতায়ালা। এই ঘরটি ঘর নয়, এটি হাশরের মাঠ, এখানে চারজন পাপীর বিচার করছেন আল্লাহতায়ালা। বিরতিহীন বয়ানে পীর আমিরুল্লাহর মুখে ফেনা উঠে এলে হুমায়রা একটি ক্যাসেট চালিয়ে দেয়। ক্যাসেটে আমিরুল্লাহর কণ্ঠে কোরান হাদিসের কথা। ঠিক একই কথা যা তিনি বর্ণনা করেছেন মুখে। একই কথা একই ভাষায় একই সুরে। আমি এরমধ্যে অনেকবার ঘড়ির দিকে তাকিয়েছি। অনেকবার বলেছি আমি যাই। হুমায়রা চাপা কণ্ঠে ধমক দিয়েছে, আল্লাহর কথা শুনলে এত ধৈর্যহারা হও কেন? অসীম ধৈর্য নিয়ে শুনতে হয় আল্লাহতায়ালার কথা। আল্লাহর পথে এসেছো। এখন মন থেকে শয়তান ঝেড়ে ফেলতে হবে। শয়তানই আল্লাহ থেকে মন ফেরায় অন্যদিকে। এ কথায় স্পষ্ট হয় সে কি অনুমান করছে। সারা বাড়ির চোখ আমাদের দিকে, চোখগুলো জানে যে আমরা দুনিয়াদারি ফেলে আল্লাহর পথে চলে এসেছি, না এলেও এ বাড়িতে ঢুকেছি বলে আল্লাহর পথে নেওয়ার জন্য আমাদের মস্তিষ্ক ধোয়া হচ্ছে পণু ্যজলে। ঘন্টা পেরিয়ে যাচ্ছে, এক ঘন্টা পেরেলো, দু ঘন্টাও। দেখছি সাফিনাজ আর হালিদার মুখে বিস্ময়, বিরক্তি আর বিষম বিষাদ। আমার গা ছমছম করে, ভূুতের ভয়ে এককালে যেমন করত। মনে হতে থাকে এ বাড়ির কোনও মানুষই সত্যিকার মানুষ নয়। এই ভূতুড়ে বাড়িটি থেকে পালাবার পথ খুঁজতে থাকি। কিন্তু যতক্ষণ আমিরুল্লাহর কোরান হাদিসের ব্যাখ্যা শেষ না হচ্ছে ক্যাসেটে, আমাকে উঠতে দেবে না হুমায়রা। অদৃশ্য শেকলে আমরা বাধাঁ। এভাবে দিন ফুরিয়ে যাবে, রাতও, টের পাই। এক ক্যাসেট ফুরিয়ে গেলে আরেক ক্যাসেট চালানো হচ্ছে। আল্লাহতায়ালার এই অন্ধকার স্যাঁতসেঁতে কানাগলি থেকে বেরোবার সবকটি রাস্তা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। ক্ষিধেয় আমাদের পেট জ্বলছে। বিকেল পার হয়ে যাচ্ছে, হোস্টেলে মিলাদের সময় পার হয়ে যাচ্ছে। আমাদের পিঠ দেয়ালে ঠেকে আছে অনেকক্ষণ। শ্বাস দ্রুত হচ্ছে। এবার যান্ত্রিক বয়ানের মাঝখানে হঠাৎ উঠে দরজার দিকে পা বাড়াই, ভূতের রাজ্য থেকে যত শিগগির সম্ভব পালানোই যে মঙ্গল তা আমি যেমন জানি, আমার গতিময় পাদুটেও জানে। উঠোনের অনেকগুলো চোখ আমাকে হাঁ করে দেখতে দেখতে ফিসফিস করছে, হামিমা আপার মেয়ে আল্লাহর পথে এসেছে। দুনিয়াদারির লেখাপড়া আর করতে চায় না, এখন থেকে নিয়মিত কোরান হাদিস শুনতে এখানে আসবে। শুনছি বিচিত্র উচ্চারণে বাক্যগুলো, কত সুমতি হয়েছে মেয়েদের। ডাক্তারি পড়া ছেড়ে দিচ্ছে, দুনিয়াদারি ছেড়ে দিয়ে যারাই আসে, কাউকে হুজুর ফিরিয়ে দেন না। হুমায়রার আদেশ উপদেশ উপেক্ষা করে দৌড়ে ঘর থেকে বেরোই। পেছনে হুমায়রার চিৎকার, আল্লাহর পথে আসছে, অথচ ঘাড়ের ওপর শয়তান বসে আছে। সব ফাঁকিবাজি। উঠোনে ফজলিখালা সামনে পড়েন, তিনি তাজ্জব, চলে যাস কেন?

আমি তো মিলাদ পড়াইতে পারে এমন একজন মেয়েরে নিতে আইছিলাম, তা পাওয়া যাবে নাকি যাবে না তা বইলা দিলেই ত হয়!

কোনও উত্তর নেই। যেন মেয়ে-মৌলবি দিয়ে মিলাদ পড়াতে চাইছি কলেজের হোস্টেলে, এই বাক্যটি ফজলিখালা প্রথম শুনলেন, আগে শোনেননি, শুনলেও মাথায় ঢোকেনি, অথবা ঢুকলেও এ বাড়িতে আমাদের আসার সত্যিকার উদ্দেশ্য মেয়ে- মৌলবির,তা মনে করেননি। অন্দরমহল থেকে বেরিয়ে গিয়ে হাপঁ ছাড়ি। বাঘের খাঁচায় ঢুকে বাঘের দধু আশা করার বোকামো হাড়ে হাড়ে টের পাই।

জঙ্গল সাফ করে যে ছোট ছোট ঘর বানিয়ে ভাড়া দেওয়া হয়েছে আল্লাহর পথে আসা লোকদের, সেগুলোর একটি ঘর ভাড়া নিয়েছেন রুনু খালা। ঘরের দরজা ধরে দাঁড়িয়ে থাকা রুনখুালাকে দেখে প্রথম চিনতে পারিনি। তিনি এখন শাড়ি ছেড়ে এ বাড়ির মেয়েদের মত জামা পাজামা পরেন। বড় একটি ওড়না মাথা বুক ঢেকে রাখে রুনখুালার। পায়ে নপূুর পরে গান গেয়ে নেচে বেড়ানো,বিএ পাশ করা,প্রেম করে বাড়ি থেকে পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করা সেই রুনখুালা ই যে পীরবাড়ির ভেতরে এক শরীর শূন্যতা নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা এই রুনখুালা আমার বিশ্বাস হতে চায় না। এই রুনখুালাকে মনে হয় সারাজীবন কাটিয়েছেন অন্ধকার আল্লাহর গলিতেই, তাঁর কোনও অতীত ছিল না ঝলমলে। রাসু খালু ময়মনসিংহ পৌরসভায় হিশাব রক্ষকের চাকরি করতেন, চোখা প্যান্ট চোখা পাম্পশুর সেই রাসূ খালুর বিরুদ্ধে টাকা পয়সার গরমিল করা, প্রচুর টাকা হাওয়া করে দেওয়ার অভিযোগ আনা হয় আপিস থেকে, রাসু খালুর চাকরি চলে যায়। চাকরি যাওয়ার পর তিনি স্ত্রী কন্যা নিয়ে আল্লাহর পথে চলে এসেছেন। এখন চাকরি খোঁজেন, পান না। এখন বেগুনবাড়ি থেকে নিজের ভাগের জমি থেকে ধান চাল বিক্রির টাকা এনে শহরে আল্লাহর পথে বাস করেন। পাঁচ বেলা নামাজ পরেন। কপালে বড় একটি কালো দাগ, নামাজ পড়তে পড়তে মেঝেয় কপাল ঠুকতে ঠুকতে কালো এই দাগটি পড়েছে কপালে। মলি নামের যে মেয়ে আছে রুনখুালার, তার মলি নাম পাল্টো মতিয়া রাখা হয়েছে এই পীর বাড়িতে। নাম পাল্টানোর নিয়মটি বড় পুরোনো নিয়ম এ বাড়ির। মার ঈদুল ওয়ারা নাম ঝেঁটিয়ে বিদেয় করে হামিমা রহমান করা হয়েছে, মা হামিমা নামেই পরিচিত এই পীরবাড়িতে। রুনু খালার ফ্রক পরা ছোট্ট সুন্দর মেয়েটি এখন শরীরের আগাগোড়া আবৃত করে। ইশকুলে থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে আসা মলিকে এখন পীরবাড়ির মাদ্রাসায় কোরান পড়তে দেওয়া হয়েছে। রুনখুালার একটি ছেলেও ছিল, ছেলেটির পেট ফুলে ঢোল হয়ে একদিন মারা গেল। কোনও পীরের ফুঁ কাজে লাগেনি, দুনিয়াদারির কোনও ডাক্তারের ওষধু ও নয়। রুনখুালা তাঁর ছোট্ট টিনের ঘরটিতে আমাকে যখন টেনে নিয়ে বলেন কিছু খাইবা? একটু সেমাই খাও! কইরা দিই। না বলি। বড় মায়া হয় রুনখুালার জন্য। পেছনে ফজলিখালার শ্বশুরবাড়িটির দিকে তাকাই। বাড়ির সামনের পুকুরটি বুজে ফেলা হয়েছে। লিচু গাছটিও আর নেই। জঙ্গল নেই, ভূত পেত্নীর ভয় নেই, কিন্তু তারপরও মনে হয় আগের চেয়ে আরও ভূতুড়ে হয়েছে বাড়িটি। হুমায়রা পীরের ডান হাত এখন। সুফায়রা পীরের এক মুরিদকে বিয়ে করে সংসারি হয়েছে। মুবা−শ্বরা তো নেই ই। মুবা−শ্বরার ছোট বোন আতিয়া বসন্ত হয়ে একদিন টপু করে মরে গেছে। আতিয়া দেখতে খুব সুন্দর ছিল। দুদিনের জন্য মা পাঁচ বছরের আতিয়াকে অবকাশে এনেছিলেন। ওই দুদিনে ওকে টুইস্ট নেচে মাই নেইম ইজ এটিয়া গিলবার্ট বলতে শিখিয়েছিলেন দাদা। আতিয়ার মস্তিষ্ক থেকে শয়তানি বিদেয় করা হয়েছে এ বাড়িতে ফেরত এনে। আতিয়ার ছোট আরও অনেকগুলো বোন আছে, আমি ওদের নাম কেবল শুনেছি মার কাছে, মখু চিনি না। এত কাছের আত্মীয় হওয়ার পরও আমাদের কোনও যোগাযোগ হয় না একটি কারণেই, আমরা দুনিয়াদারির লোক, আর তারা আল্লাহর পথের লোক। আমার মায়া হয় এ বাড়ির সবার জন্য। আল্লাহর পথে বড় বিভ্রম, বড় ফাঁকি। ফাঁকি দিয়ে আমাদের সবাইকে সারা দুপুর বসিয়ে রাখা হয়েছে। ফাঁকি দিয়ে আল্লাহ রসুলের বাণী শোনানো হয়েছে। আমাদের কথা দেওয়া হয়েছে মেয়ে-মৌলবি দেওয়া হবে, সেই কথা রাখা হয়নি। আল্লাহর এই পথটি বড় মিথ্যেয় ভরা। মেয়ে-মৌলবি তো আমাদের পাওয়া হয়নিই, বরং অযথা সময় নষ্ট হয়েছে। প্রথমেই যদি বলে দেওয়া হত মেয়ে-মৌলবি পাওয়া যাবে না, আমরা ফিরে যেতে পারতাম কিন্তু আমাদের আশা দিয়ে বসিয়ে মাথায় মস্তিষ্ক ধোয়ার জল ঢালা হয়েছে। আর কার জানিনা, আমার মস্তি−স্কর ব্যাপারে আমি অন্তত এইটুকু জানি,এটি এখন আর কোনও জলে নষ্ট হবে না। সাফিনাজ হালিদা আর পারুল বুঝে পায় না এই অদ্ভুত জগতের সঙ্গে আমার সম্পর্কে কি। ওদের সামনে লজ্জা হয় আমার। এই শহরের এই অদ্ভুত পীরবাড়িটির এই অদ্ভুত জগত সম্পর্কে কিছুই জানা ছিল না ওদের।

ঘটনাটি মার কাছে বলি। মা বলেন, মিলাদ পড়াইতে পারে এমন মহিলা খুঁজনের জন্য ওই বাড়িতে গেলি কেন? ওরা তো কেউ ওই এরিয়ার বাইরে যায় না। বাইরে গিয়া মিলাদ পড়ায় না কোনওদিন। যা করে, সব এরিয়ার ভিতরে করে। তা ঠিক, ওদের সঙ্গে ওই পীরবাড়ির এলাকার বাইরের কোনও মসজিদ মাদ্রাসার সঙ্গেও সম্পর্কে নেই। ওদের সঙ্গে ওই পীরবাড়ির বাইরের কোনও আল্লাহরসুল মানা কোনও মানুষেরও সম্পর্কে নেই। নানা নিজে একজন হাজি মানুষ, সুদূর মক্কা গিয়ে হজ্ব করে এসেছেন, হযরে আসওয়াদে চুমু খেয়ে এসেছেন, মদিনায় হজুরের রওজা শরিফ জিয়ারত করে এসেছেন, জীবনে কোনও রোজা তিনি বাদ দেননি, কোনও নামাজ কাজা করেননি, প্রতিদিন ভোরবেলা উঠে কোরান পড়েন—সেই নানাও পীরবাড়িতে কোনও সম্মান পান না। কারণ পীর আমিরুল্লাহর মুরিদ না হলে কাউকেই গ্রাহ্য করা হয় না ও বাড়িতে, কাউকেই পীরবাড়ির কেউ মনে করে না যে সত্যিকার ঈমানদার। নানা কোনওদিন ওই পীরবাড়িকে পরোয়া করেননি। নিজের ধর্ম নিজে পালন করে গেছেন। পীরবাড়িতে মার যাওয়া নিয়েও তিনি বলেছেন, আল্লাহরে নিজের ঘরে বইয়া ডাকো,আল্লাহ শুনবেন। দৌড়াদৌড়ি করার দরকার নাই।



মেয়ে-মৌলবি আনতে যাওয়া চারজন ডাক্তার হতে যাওয়া মেয়েকে আল্লাহর পথে যাওয়ার দীক্ষা দেওয়ার চেষ্টা করে ব্যথর্ হওয়ার কোনও খবর রাষ্ট্র হয় না, তবে ওই এরিয়ায় অন্তত এমন বলার সুযোগ হয়েছে যে আজকাল ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার সবার চোখ খুলছে, দুনিয়াদারিতে মেতে থেকে যে আখেরাতে কোন ফল পাওয়া যাবে না, তা তারা বুঝে গেছে বলে আল্লাহর পথে আসার চেষ্টা করছে। ওসব ছেদো কথা আমি কানে দিই না। তবে পীরবাড়ির যে কথাটি শুনে আঁতকে উঠি তা হল পীর আমিরুল্লাহ একটি বিয়ে করেছেন। নিজের চেয়ে চল্লিশ বছর বয়সের ছোট এক মেয়েকে। আইবুড়িদের মধ্য থেকে একজনকে।

কি মা, তার না বউ আছে। আরেকটা বিয়া করল কেন? ঠোঁটে বাঁকা হাসি আমার।

মা ইতস্তত করেন উত্তর দিতে, থেমে থেমে বলেন,—মাওই সাবের বয়স হইয়া গেছে। এখন আর তালই সাবের যত্ন করতে পারেন না তাই।

তার যত্ন করার লাইগা বাড়ি ভর্তি মানুষ। বিয়া কইরা নিতে হয় নাকি যত্ন করতে হইলে?

তালই সাবরে এখন ধইরা ধইরা পেশাবপায়খানায় নিতে হয়। রাইতেও যাইতে হয় ঘরের বাইরে। এই সব পরিষ্কারের জন্য একজন তো লাগে!

কেন, কাজের লোকের ত অভাব নাই ওই বাড়িতে, তারাই তো করতে পারে। আর তার নাতি নাতনিতে বাড়ি ভরা। তারা করতে পারে।

তাদের কাজ আছে না?

কী কও এইসব!পীরের কাজই ত তাদের আসল কাজ। পীরের কাজ করলেই ত আল্লাহর কাজ করা হয়।

রাতের বেলায় ত ঘুমায় ওরা!

সারা রাত কি তোমার হুজুর পেশাবপায়খানা করে নাকি?

বাজে কথা কইস না।

এক ঘরেই তো থাকে তারা দুইজন। এক বিছানায় তো শোয়, তাই না? খালি গু মুত ফালায় নতুন বউ তাতো না।

মা অপ্রস্তুত। আমার বিশ্বাস মা নিজেও হয়ত পীরের শেষ বয়সে এই বিয়ে করার ব্যাপারটির কোনও কারণ খুঁজে পাননি। কারণ না পেলেও পীরের পক্ষ নেওয়া মার একরকম দায়িত্ব।

এত চুক্ষা চুক্ষা কথা কইস না আল্লাহর ওলি সম্পকের্। গুনাহ হইব। মা বলেন।

গুনাহ গুনাহ গুনাহ। এই গুনাহ শব্দটি আমি বহুকাল শুনে আসছি। গুনাহ শব্দটিকে একসময় খুব ভয় হত, শব্দটির ওপর পরে রাগ হয়েছে, এখন ভয় রাগ কিছুই হয় না।

গুনাহ হোক। গুনাহ হইলে তো ভালই। গুনাহ হইলে দোযখে যাব। দোযখে গেলে তো তোমার প্রিয় দিলীপ কুমার মধুবালা, তোমার উত্তম কুমার সুচিত্রা সেনরে দেখতে পাবো। তোমার ছবি বিশ্বাস পাহাড়ি সান্যালকে দেখতে পাবো। আর তুমি যে বেহেসতে যাইবা, দেখবা তো সব কাঠমোল্লাদেরে। চাইরটা বিয়া করা শয়তান বদমাশ মোল্লাদেরে দেখবা। মানুষরে কষ্ট দিছে, হিংসামি করছে, কুটনামি করছে, মানুষরে খুন করছে। একশ একটা ধষর্ণ করছে, বউদেরে জ্বালাইছে, পিটাইছে, কিন্তু সারাদিন আল্লাহ আল্লাহ জপছে বইলা বেহেসত পাইছে। কি সুখটা পাইবা তুমি শয়তানগুলার সাথে থাকতে! তারচে গুনাহ কইরা দোযখের খাতায় নাম লেখাও। আইনস্টাইনের মত পৃথিবীবিখ্যাত বিজ্ঞানী পাইবা, নেলসন ম্যান্ডেলারে পাইবা, পৃথিবীর বড় বড় বিজ্ঞানী, বড় বড় গায়ক, নায়ক সবার সান্নিধ্য পাইবা। আর বেহেসতে গিয়া তো দেখবা বাবা বাহাত্তরটা হুরির সাথে লীলা করতাছে। আর তুমি পাইছ এক বাবারেই, যে তোমার দিকে সারাজীবন ফিইরা তাকায় নাই। এক রাজিয়া বেগমের সাথে বাবার সম্পর্কে তুমি সহ্য করতে পারো না, বেহেসতে ওই বাহাত্তরটার সাথে বাবার সম্পর্ক সহ্য করবা কেমনে? কোন সুখ পাওয়ার আশায় বেহেসতে যাইতে চাও? কিসের জন্য নামাজ রোজা কর?

মা অসহায় চোখ মেলে তাকিয়ে থাকেন আমার দিকে। আমার ভবিষ্যতের কথা ভেবে তাঁর দুচোখে আতঙ্ক।

তুই কি আল্লাহরে একটু ডরাস না? ভয়াতর্ কণ্ঠে বলেন মা।

আমি হেসে উঠি। হাসতে হাসতে বলি,—আল্লাহ কি ভাল কাজটা করছে যে আল্লাহরে ডরাইয়াম? মেয়েদের স্থান পুরুষের স্থানের চেয়ে নিচে, এইটা আল্লাহর নিজের কথা। যেহেতু পুরুষ টাকা কামাই করে, তাই পুরুষের অধীনে থাকতে হবে মেয়েদের। আজকে যদি মেয়েরা টাকা কামাই করে, তাইলে মেয়েদের অধীনে পুরুষদের থাকার কথা তো আল্লাহ কয় নাই!

কি কইতাছস এইগুলা নাসরিন? তর ত ঈমান নষ্ট হইয়া গেছে!! মার বিস্ফারিত চোখ।

বিস্ফারিত চোখের সামনেই বিস্ফোরণ ঘটে আমার, ভেতর থেকে −শ্লষ কণ্ঠে,ঘণৃা কণ্ঠে আমি বলে যেতে থাকি–

আমি বুঝি না তুমি মেয়ে হইয়া কি কইরা মেয়েদের প্রতি এত অপমান মাইনা নেও। পুরুষেরা কোরান হাদিস মাইনা চলতে পারে, তাদেরে মর্যাদা দেওয়া হইছে। মেয়ে হইয়া কি করে মানো? মেয়ে হইয়া কি কইরা মানো যে তুমি পুরুষের চেয়ে নিম্নমানের। তোমার স্বামীর তোমারে পিটানোর অধিকার আছে। তোমার বাপের সম্পত্তি তোমার ভাই যা পাবে, তা তোমার পাওয়ার অধিকার নাই। কি কইরা মানো যে পুরুষেরা তালাক কইলে মেয়েদের তালাক হইয়া যাবে। আর তোমার তালাক কওয়ার অধিকার নাই। কি কইরা মানো যে তুমি বাহাত্তরটা সঙ্গী পাইবা না বেহেসতে, তোমার স্বামী পাইব শুধু যেহেতু সে পুরুষ! কোটের্ সাক্ষী দিতে যাও, তোমার একার সাক্ষীতে হবে না, দুইজন মেয়ে সাক্ষী লাগবে। অথচ পুরুষ সাক্ষী হইছে দুইজন পুরুষ লাগে না, একজন হইলেই চলে। ইহজগতেও পুরুষের জাত সুখে থাকবে, পরকালেও। তোমার জন্য, আমার জন্য, মেয়েদের জন্য এই জগতেও আল্লাহ ভোগান্তি রাখছে, ওই জগতেও। এই হইল তোমার আল্লাহর বিচার। এই আল্লাহরে নমো নমো করো কি বুইঝা?

মা আমাকে থামান ফুঁপিয়ে কেঁদে। দুহাতে আমাকে জড়িয়ে ধরে বলেন, যা কইছ কইছ আর কইও না। এখন যাও অযু কইরা আসো, আল্লাহর কাছে তওবা করো।

তওবা করবো কেন? আমি তো কোনও ভুল করি নাই।



মা নিশ্চিত আমি দোযখের আগুনে পুড়ে মরব। আমার দিকে তাকিয়ে আমাকে আর দেখেন না মা, দেখেন গনগনে আগুনে আমি জ্বলছি পুড়ছি। পুঁজ আর পচা রক্ত পান করছি। সাপ বিচ্ছু কামড়াচ্ছে আমার সারা শরীর। মাথার একহাত ওপরে সূর্য নেমে এসেছে। ফুটন্ত পানিতে আমাকে চোবানো হচ্ছে। এই হৃদয় বিদীর্ণ করা দৃশ্যটি কল্পনা করে মা আতঙ্কে কেবল ফুঁপিয়ে নয়, হাঁউমাউ করে আড়াই বছরের বাচ্চার মত কেঁদে ওঠেন।
 
২২. উন্মীলন


পরীক্ষার আগে আগে বাবা যেচে কথা বললেন এসে। ঠাইস্যা লেখাপড়া কর। আর উপায় নাই।

আর উপায় নাই সে আমিও জানি। কবিতাকে ছুট্টি দিয়ে দিয়েছি সেই কবে, এখন রোগ আর রোগী নিয়ে দিন কাটে, কেবল দিন নয়, রাতও। হাসপাতাল আর বাড়ি, বাড়ি আর হাসপাতাল, এই করে দিনের বেশির ভাগ যাচ্ছে, আর রাতও যাচ্ছে না ঘুমিয়ে। মা গরম দধু এনে সামনে রাখছেন, দধু পড়ে থেকে নষ্ট হতে থাকে, মা বলেন, দধু টা খাইয়া লও মা, খাইলে মাথায় পড়া ঢুকব। যখন মাথা ঘামাতে থাকি লেখাপড়া নিয়ে, মা বেড়ালের মত পা টিপে টিপে এসে, যেন কোনও শব্দে আমার মনোযোগ নষ্ট হয়, মাথায় ঠাণ্ডা তেল দিয়ে যান, ফিসফিস করে বলেন, মাথাটা ঠাণ্ডা থাকব।

এত রোগ বালাই নিয়ে পড়ে থেকে মনে হয়, পৃথিবীতে কত কিছু ঘটে যাচ্ছে, কেবল আমিই তার খবর জানি না। মাঝে মাঝে চেয়ার ঠেলে উঠে পড়ি, উঠোনের খোলা হাওয়ায় দাঁড়িয়ে আড়মোড়া ভাঙি। অবকাশ যেভাবে চলে, চলছে। উত্থান পতনে। ভাল মন্দে। সুখে অসুখে। সুহৃদ হাঁটতে শিখেছে, দৌড়োতে, কথা বলতে। বাড়ির সবাইকে ভালবাসতে শিখেছে, অবশ্য একটি জিনিস তাকে শিখিয়ে দেওয়া হলেও শেখেনি সে হল তার বাবা মাকে আপন ভাবতে। তাদের কোলে কাখে যেতে। তারা ঢাকা নিয়ে যেতে চাইলে ঢাকা যেতে। আরেকটি ছেলে শুভ, দাদার চেয়েও বেশি সে হাসিনার ছেলে। দেখতে হাসিনার মতই কাঠি। দিনে ছবেলা খেয়েও কাঠি। এই দুই কাঠির গায়ে মাংস বাড়াতে বাবা থলে ভরে মাছ মাংস কেনেন। দুই কাঠির পাতে বেশির ভাগ মাছ মাংস চলে যায়। তবু কাঠিরা কাঠিই থেকে যায়। মা বলেন, আসলে শরীরের গঠনই ওদের ওইরকম। বাবার চাপে হাসিনার বিএড করা হয়েছে। এখন সে বিএবিএড, যে কোনও সময় যে কোনও ইশকুলে একটি মাস্টারির চাকরি পেয়ে যেতে পারে। বাবার চাপ তাপ ভাপ ইয়াসমিনের ইমপ্রুভমেন্ট পরীক্ষা দেওয়াতে পারেনি। শেষ অবদি আনন্দমোহনেই উদ্ভিদবিদ্যা বিভাগে ভর্তি হয়েছে।

বোটানি পইড়া কি হইবি রে?

বোটানিস্ট হইয়াম। ইয়াসমিনের খেয়ালি উত্তর।

ওই আর কি, মালি হইবি। হা হা।

ইয়াসমিন মালি না হলেও অনেকটা মালির মতই হয়ে গেল। বাড়ির গাছগুলো দিব্যি বাড়ছে, কিন্তু ওদের পাতা দেখে দেখে বলছে, এই গাছের এই রোগ, ওই গাছের ওই রোগ।

রোগ সারানোর ওষধু কি? এন্টিবায়োটিক গুইলা খাওয়াবি নাকি?

ইয়াসমিনকে অপদস্থ করায় বাবার চেয়ে আমি কম যাই না। অপদস্থ ও কতটুকু হয় তা বোঝা যায় না, কারণ বোটানিতে ভর্তি হওয়ার প্রথম কিছুদিন ওর যে উদ্দীপনার দীপটি ছিল, তা ধীরে ধীরে নিভতে শুরু করেছে। প্রতিদিন কচুরিপানার মত বান্ধবী বাড়ছে ওর, বান্ধবীদের বাড়িতে যাওয়া আসা হচ্ছে। পাড়াতেও ওর জনপ্রিয়তা বেশ। ভাইফোঁটায়, বিয়েতে, জন্মদিনে, বারো মাসের তেরো পুজোয় ওর নেমন্তন্ন থাকে। আমার কোনও নেমন্তন্ন থাকে না পাড়ায়।

ওরা আমারে ডাকে না কেনরে?

তুমি মানুষের সাথে মিশতে পারো না, তাই ডাকে না। সোজা উত্তর।

আমার সীমানা ইয়াসমিনের সীমানার চেয়ে অনেক ছোট। সুহৃদের জন্মদিনে ছোটদা ঢাকার পূর্বাণী হোটেল থেকে বারো পাউন্ডের একটি কেক এনে উৎসবের আয়োজন করলেন। আমার ক্লাসের ছেলেমেয়ে এসেছিল ছ জন, ইয়াসমিনের নিজস্ব জগত থেকে এল আঠারো জন। ইয়াসমিনকে অনেকটা বাঘের মত মনে হয়, তর্জন গর্জন বেশ, আঠারো ঘা দিয়ে দিতে পারে ইচ্ছে করলেই।



হাসিনা সেই আগের মত এখনও সুহৃদের কেন এটা আছে, শুভর কেন এটা নেই, সুহৃদ কেন আদর বেশি পাচ্ছে, শুভ কেন কম পাচ্ছে—এসব নিয়ে চিনচিন জিনজিন ঝিনঝিন করে। ঈদে বাড়ির সবার হাতে যার যার কাপড় চোপড় কেনার জন্য বাবা টাকা দিলেন। শুভ সুহৃদের জন্য সমান অঙ্কের টাকা। আমার আর ইয়াসমিনের জন্য সমান। গীতা আর হাসিনার জন্য সমান। দাদা ছোটদার জন্য সমান। লিলি লিলির মা নার্গিস আর ঝর্ণার জন্য সমান। মার জন্য কিছু নয়। মাকে ছোটদা দেবেন, যেহেতু মা ছোটদার ছেলেকে লালন পালন করছেন। অনেকটা পারিশ্রমিক দেওয়ার মত বছরে একটি বা দুটি সুতি শাড়ি। ঈদে আমার আগের মত উৎসব করা হয় না। ঈদে এমন কি আমি নতুন জামাও পরি না। ঈদের এই গরু জবাই, নতুন জামা কাপড়, পোলাও মাংস জর্দা সেমাই, আমার কাছে বড় অর্থহীন লাগে। একটি জিনিসই ভাল লাগে, বালতি ভরে মাংস নিয়ে বাইরে বসে কালো ফটকে ভিড় করা শত শত ভিখিরিদের থালায় টোনায় হাতে মাংস দিতে। ভেতরের বারান্দায় বসে মাংস কাটা আর ভাগ করায় দাদার উৎসাহ সব চেয়ে বেশি। তিনি সারাদিন ধরে তাই করেন। নিজেদের জন্য, ধনী প্রতিবেশিদের জন্য, আত্মীয় স্বজনদের জন্য ভাল ভাল মাংস রেখে রগতেলহাড়সর্বস্ব মাংসগুলো দেওয়া হয় ভিখিরিদের। ভিখিরিদের কাছে মন্দ বলে কিছু নেই। তারা যা পায়শুকুরআলহামদুলিল্লাহ বলে লুফে নেয়।



রোজা আসে, রোজা যায়। রোজায় বিশ্বাস করি না বলে রোজা রাখি না। সন্ধেবেলায় ইফতার খেতে ভাল লাগে, খাই। অবশ্য সাইরেন পড়ার জন্য অপেক্ষা আমার সয় না। পিঁয়াজি বেগুনি ছোলাভাজা সাজিয়ে রাখা হয় টেবিলে, খেতে স্বাদ জিনিসগুলোর। আমি ফেলে রাখি না। বাবা, আমার খুব অবাক লাগে, পীরবাড়িতে কাফের হিসেবে পরিচিত হলেও, নামাজ না পড়লেও, কোরান হাদিস ইত্যাদিতে কোনও আগ্রহ না দেখালেও পুরো মাস রোজা রাখেন। রোজা রাখার কারণ সম্পর্কে বাবাকে কখনও জিজ্ঞেস করা হয়নি। আমার বিশ্বাস বাবা রোজা রাখেন দশজনের একজন হতে। তাঁর বয়সী সবাই যখন রোজা রাখেন, তিনিও রাখেন। রাখলে প্রশ্নহীন নিঝর্ঞ্ঝাট জীবনে যাপন করতে পারেন বলে রাখেন। দাদাও রোজা রাখেন, যদিও ঈদের নামাজ ছাড়া আর কোনও নামাজ তিনি পরেন না, বাবার মত। ছোটদা ঈদের নামাজে যান, কিন্তু সারা বছর নামাজের নাম নেই, রোজার নাম নেই। হাসিনা আল্লাহ বিশ্বাস করলেও, নামাজ রোজায় বিশ্বাস করলেও রোজা রাখে না, রাখে না কারণ তার কাঠিত্ব এখনও ঘোচেনি। রোজা রাখলে, তার ভয়, হাড়ের ওপর যে চামড়াটি আছে, সেটিও ঝুরঝুর করে ঝরে যাবে। এরশাদ সরকার দেশে একটি নতুন নিয়ম চালু করেছেন, রোজার সময় দিনেরবেলা খাবার দোকানগুলো বন্ধ থাকবে। এ কি আশ্চর্য, সবাই কি রোজা রাখে নাকি! কত মুটে মজুর কুলি, দুপুরবেলা না খেলে কাজই করতে পারবে না, তারা ক্ষিধে পেলে কি করবে? হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টানদের কথাও তো ভাবতে হবে! নাস্তিকদের কথাও। দেশ তো কেবল মুসলমানের নয়। মুসলমান যারা আছে, সবাই তো রোজা রাখে না। খাবার দোকান বন্ধ থাকলে চলবে কেন! আমি অবশ্য প্রতিবাদ হিসেবে রোজার সময় মুখে একটি চুইংগাম রাখি। সারাদিন চিবোতে থাকি চুইংগামটি। কলেজ ক্যান্টিনে ঘন ঘন চা পান করে আসি। কলেজের ক্যান্টিনটি কলেজের ভেতর হওয়ায় পুলিশ এসে হানা দেয় না, রক্ষে। এরশাদের এই নিয়মে জামাতে ইসলামির লোকেরা বেজায় খুশি, কিন্তু কেউ কেউ যারা ধর্মনিরপেক্ষ মানুষ, আপত্তি করছেন। কারও আপত্তি শোনার লোক নন এরশাদ। তিনি ক্ষমতায় থাকতে চান যে করেই হোক। সংখ্যাগরিষ্ঠের ধর্মের প্রতি অতিরিক্ত ভীরুতা দেখালে সংখ্যাগরিষ্ঠ তাঁকে বাহবা দেবে এরকম বিশ্বাস নিয়ে তিনি দেশ চালাচ্ছেন। এরশাদকে কখনও আমার ধার্মিক লোক বলে মনে হয় না। মুখে গাম্ভীর্য এনে তিনি যতই ধর্মের কথা বলুন, যতই তিনি সংবিধানে রাষ্ট্রধর্ম নামে নতুন একটি জিনিস আমদানি করুন এবং সেই রাষ্ট্রধর্মকে ইসলাম বলে ঘোষণা করে ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধানের সর্বনাশ করুন, আমার মনে হয় লোকটি দেশের মানুষকে ফাঁকি দিচ্ছেন, বোকা বানাতে চাইছেন। লোকটি নিরক্ষর অশিক্ষিত ধর্মভীরু মানুষের ভোট চাইছেন, আর কোনও উদ্দেশ্য তাঁর নেই।



ধমর্, রাজনীতি ইত্যাদি নিয়ে মেতে থাকলে যে আমার চলবে না, তা বাবা আমাকে বলেন। পরীক্ষা যখন গায়ে জোরে ধাক্কা দিল, রাত তিনটেয়, চারটেয় আমাকে ঠেলে তোলেন, পড়তে। আমি হুড়মুড়িয়ে বিছানা ছেড়ে পড়ার টেবিলে বসি, মা ওই রাতে উঠে ফ্লা−স্ক চা বানিয়ে রেখে যান টেবিলে। আমার লিখিত পরীক্ষা হয়ে গেলে বাবা শশব্যস্ত হয়ে মৌখিকে অন্য মেডিকেল থেকে পরীক্ষক কারা আসছেন, বাবার চেনা কিনা, বাবার ছাত্র কিনা, বাবার সহপাঠী কি না, খোঁজ নেন। খোঁজ নিয়ে তিনি পেয়ে যান যে কেউ কেউ তাঁর ছাত্র ছিলেন কোনও এক কালে। তাঁদেরই বাবা কাঁচুমাচু মখু নিয়ে হাত কচলাতে কচলাতে বলে আসেন আমার মেয়েটা পরীক্ষা দিচ্ছে এবার, একটু দেখবেন। একটু দেখবেন, এর মানে এই যে মেয়েটাকে ইচ্ছে করে কম নম্বর দেবেন না। আসলে কেউ কাউকে পাশ করিয়ে দিতে পারেন না। পারেন না, কারণ একজনের হাতে দায়িত্ব থাকে না পাশ করাবার। দেখবেন এর অনুরোধটি হল, ইচ্ছে করে যেন ফেল করাবেন না। ইন্টারনাল পরীক্ষকরা সবাই যে আমার ওপর খুশি তা নয়। সালাম না দেওয়ার কারণে আমাকে বেশির ভাগ অধ্যাপকই বেয়াদব বলে জানেন। যাই হোক, দীর্ঘদিন ধরে পরীক্ষা চলে। দীর্ঘদিন ধরে বাবা দুশ্চিন্তায় থাকেন। দীর্ঘদিন ধরে পাশ করব না এই আশংকা নিয়ে দুরুদুরু বক্ষে শুষ্ক হয়ে ওঠা গলদেশ নিয়ে ভয়ে ঘন ঘন তেষ্টা পাওয়া পেচ্ছাব পাওয়া আমি পরীক্ষা দিই মৌখিক। মৌখিক পরীক্ষাকে পরীক্ষা বলে মনে হয় না। মনে হয় যেন পুলসেরাত পার হচ্ছি। সরু একটি সুতোর ওপর দিয়ে হাঁটছি। একটু কাত হলাম কি ধপাশ। ধপাশ একেবারে সাপ বিচ্ছু আর দাউ দাউ আগুনের মধ্যে। ভাল ছাত্র রাজিব আহমেদের চিকিৎসাজ্ঞানে টইটম্বুর খাতা পড়ে পরীক্ষা দিয়ে হয়ত লিখিত পরীক্ষায় ভাল করা যায় কিন্তু মৌখিকের দুশ্চিন্তায় আমার মুখের ভাষা হারিয়ে যেতে থাকে। মাথা থেকে কর্পূরের মত উড়ে যেতে থাকে যা জানি তাও। এই করে পরীক্ষা হয়। ওয়ার্ডের ভেতর সারি সারি রোগীর মাঝখানে বিশাল টেবিল পেতে অধ্যাপকরা বসে থাকেন। অধ্যাপকদের অধ্যাপক মনে হয় না, যেন এক একজন আজরাইল। গলা যে কার কাটা যাচ্ছে, কারও বোঝার উপায় নেই। পরীক্ষা শেষ হয়, কিন্তু জানা হয় না, আমার মণ্ডুুটি আছে কি না এখনও ধড়ে।



পরীক্ষার পর ঢাকা যাওয়ার জন্য উতলা হই। কিন্তু রুদ্র ঢাকায় নেই। মিঠেখালি থেকে ফেরেনি। ময়মনসিংহে বসে রুদ্রর ঢাকা ফেরার অপেক্ষা করতে থাকি। অপেক্ষা জিনিসটি বড় অশান্তির। অশান্তির হলেও বইখাতা নিয়ে আপাতত আর বসতে হচ্ছে না, এই এক স্বস্তি আমার। হাসিনা বি এড পাশ করার পর এমএডএ ভর্তি করিয়ে দিয়েছেন বাবা। শুভকে মার দায়িত্বে রেখে প্রতিদিন কড়া রঙের শাড়ি পরে মুখে নানারকম রং লাগিয়ে কলেজে যায় সে। মার হাতে এখন দুজনের লালন পালনের ভার। এক হাতে শুভকে সামলাচ্ছেন, আরেক হাতে সুহৃদকে। হাসিনা কলেজ থেকে ফিরেই প্রথম দেখে শুভর যতে ্ন কোনও ত্রুটি হয়েছে কি না। না, মা কোনও ত্রুটি রাখেন না, রাখেন না এই কারণে যে শুভর য−ত্নর ত্রুটি হলে তুলকালাম কাণ্ড বাধাঁবে হাসিনা। বাড়িটিকে কলহমুক্ত রাখতে মা ত্রুটির ত্রিসীমানা মাড়ান না। সুহৃদ আর শুভ দুজনকেই গোসল করিয়ে দুজনের গায়ে পাউডার মেখে জামা পরিয়ে দুজনকে খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে রেখেছিলেন মা, হাসিনা এসেই শুভকে ছোঁ মেরে নিয়ে বলল, ইস ছেলেটা ঘাইমা গেছে। ফ্যানের নিচে তো সুহৃদরে শোয়ানো হইছে, শুভরে ফ্যানের থেইকা দূরে শোয়ানো হইল কেন? ঘরের সিলিংএ একটি মাত্র পাখা। পাখার তলে শুভও ছিল, সুহৃদও ছিল। কিন্তু সুহৃদ নাকি পাখার কাছাকাছি ছিল বেশি। মা বলেন, এইগুলা কি কও ! শুভ গড়াইয়া কিনারে গেছে। মা পছন্দ করেন না ছেলের বউএর চিৎকার চেঁচামেচি। কারণ যে কোনও চেঁচামেচিতে দাদা এসে উপস্থিত হন, এবং হাসিনা যদি অসঙ্গত বা অযৌক্তিক কোনও কথা বলে, দাদা তা নতমস্তকে মেনে নেন। দাদা রায় দিয়ে দিলেন, মা ইচ্ছে করেই শুভকে কষ্ট দেওয়ার জন্য পাখার ঠিক তলে রাখেননি। মা চোখের জল গোপনে মোছেন। গোপনে মুছেই সুহৃদের চেয়ে চতগু র্ণু যত্ন করেন শুভর। গোসল করিয়ে যখন চুল আঁচড়ে দেন, সিঁথিটিও লক্ষ রাখেন যেন একেবারে সোজা হয়। কারণ একবার সিঁথিটি এক চুল পরিমাণ বাঁকা ছিল বলে হাসিনা বলেছে, সুহৃদের সিঁথি তো বেঁকে নাই, শুভরটা বেঁকল কেন? এসব প্রশ্নের উত্তর মার কাছে নেই। নেই বলে মার সারা শরীরে ভয়। সারা মনে ভয়। এমএড ক্লাস করে গোড়তোলা জুতোর ঠক ঠক শব্দ তুলে বাড়ি ঢোকে হাসিনা। এসেই গলা ছেড়ে ঝর্ণাকে ডাকে, ঝর্ণা দৌড়ে যায় কাছে। হাসিনা খবর নেয় বাড়ির সব ঠিকঠাক আছে কি না। বাড়ির অবস্থা সম্পর্কে ঝর্ণা তার জানা এবং অজানা দু খবরই বেশ অনেকটা সময় নিয়েই দেয়। শুভর কাপড় চোপড় ধোয়া, শুভর বোতলবাটি ধোওয়া, শুভর বিছানা গোছানো, খেলনা গোছানো ইত্যাদি সারা হয়ে গেলে ঝর্ণা বারান্দায় পা ছড়িয়ে বসে থাকে। হাসিনার কড়া নির্দেশ শুভর কাজ ছাড়া বাড়ির অন্য কাজে হাত না দেওয়ার। অন্য কাজে হাত দিতে হয় লিলির মার, লিলির, ওদের দিয়েও যখন কুলোয় না, নার্গিসের। এই অন্য কাজের মধ্যে হাসিনার কাপড় ধুয়ে দেওয়া,ইস্ত্রি করে দেওয়া, তাকে রেঁধে বেড়ে খাওয়ানো, তার এঁটো বাসন পত্র ধোয়া সবই আছে। লিলি আর লিলির মা দুদিনের জন্য গ্রামের বাড়ি গিয়েছিল, তখন নার্গিসকে সুহৃদের কাজ ফেলে বাড়ির রান্না বান্না,কাপড় ধোয়া, ঘর মোছা ইত্যাদি কাজ করতে হয়েছে। ঝর্ণা বারান্দায় বসে থেকেছে।

ঝর্না শুভ কই?

শুভ খেলে।

শুভ খেলে কেন? শুভর তো এখন ঘুমানির কথা! মা ঘুম পাড়ায় নাই কেন শুভরে? দুপুর দেড়টার জায়গায় পৌনে দুটো হয়ে গেছে, শুভ ঘুমোয়নি। কি ব্যাপার? শুভর তো দেড়টার সময় ঘুমোনোর কথা। ঘড়ি দেখে ঠিক বারোটায় দধু খাবে, একটায় মুরগির সপু খাবে, একটা দশে ভাত মাছ সবজি খাবে, খেয়ে দেড়টায় ঘুমোবে। শুভকে দধু সপু ভাত সবই খাওয়ানো হয়েছে কিন্তু না ঘুমিয়ে ছেলে খেলতে শুরু করেছে।

হাসিনার কর্কশ কন্ঠ, এইরকম অবস্থা হইলে তো আমার কলেজে যাওয়া হবে না। বাসায় বইসা বাচ্চা পালতে হবে।

হাসিনা পরদিন কলেজে যায় না।

কি শুভর মা, কলেজে যাইবা না?

নাহ! আজকে শরীরটা ভাল লাগতাছে না বলে সারাদিন শুয়ে থেকে শুভকে বিকেলে মার কোল থেকে তুলে নিয়ে নিজের ঘরে দুঃখী মখু করে বসে থাকে হাসিনা।

বাবা বাড়ি ফিরেই আজকাল বৌমা বৌমা বলে হাসিনাকে ডাকেন, প্রতিদিনই তিনি খবর নেন ক্লাস কেমন হচ্ছে, পড়াশোনা সে ঠিক ঠিক করছে কি না।

হাসিনা এবার মখু মলিন করে বলল, যাইতে পারি নাই কলেজে।

মানে? যাইতে পারো না ই মানে? কেন যাইতে পারো নাই? উত্তেজনায় বাবা চশমা খুলে ফেললেন।

শুভরে দেখতে হয়, তাই। ঝর্না তো আর শুভরে গোসল করাইতে খাওয়াইতে পারে না।

শুভর দাদি আছে না এইসব করার জন্য?

হাসিনা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। না,মা তো সময় পান না। মার তো সুহৃদরে দেখতে হয়।

যাও বেডিরে ডাকো।

কোন বেডিরে? লিলির মারে?

বাবা খেঁকিয়ে ওঠেন, লিলির মারে ডাকবা কেন? মাথায় বুদ্ধি সুদ্ধি নাই নাকি? নোমানের মারে ডাকো।

হাসিনা মাকে ডেকে আনে। ঠোঁটে চিকন হাসি তার।

বাবা দাঁতে দাঁত ঘঁষে মাকে বলেন, ছেলের মা যায় কলেজে,ছেলেরে তুমি রাখবা না তো রাখবে কে?

আমি তো রাখিই, শান্ত গলা মার, আমার গোসল করানি খাওয়ানি যদি শুভর মার না পছন্দ হয়, তাইলে আমি কি করতাম?

তুমি কি করতা মানে?

মানুষ রাইখা লন শুভরে পালনের লাইগা।। আমি দুই বাচ্চা আর কুলাইতে পারতাছি না।

দাদি থাকতে ছেলে কাজের মানুষের কাছে বড় হইব?

কামালরে খবর দেন। সুহৃদরে নিয়া যাক। আমার নিজের অসুখ । নিজের একটু বিশ্রাম নাই, ঘুম নাই। এত পারতাছি না।

দেখ দেখ কথার ছিরি দেখ। বাবা হাসিনার দিকে চেয়ে মাকে ইঙ্গিত করেন বাঁকা চোখে, বাঁকা ঠোঁটে।

চিকন হাসিটি দীর্ঘদীর্ঘদিন একটি নতুন বিμছুর মত সেঁটে থাকে হাসিনার ঠোঁটে।



সুহৃদকে ছোটদার কাছে দিয়ে দেওয়াও হয় না। শুভর জন্য আলাদা কাজের বেটি রাখাও হয় না। মা ই একা লালন পালন করতে থাকেন দুই নাতি। বালতি ভর্তি কাপড় ফেলে রাখে হাসিনা। লিলির মার তা ধুতে ধুতে বেলা যেতে থাকে, মাকে দৌড়ে রান্নাঘরে যেতে হয়। মাকে রাধঁ তে হয় বাড়ির সবার জন্য। মা পারেন না লিলির মাকে হাসিনার কাপড় ধোয়া থেকে তুলে আনতে। আমার মনে হতে থাকে, মা হাসিনাকে ভয় পাচ্ছেন। বাবাকেও মা সম্ভবত এত ভয় পান না। মার ভয় দাদাকে নিয়ে, দাদা যদি আবার বাড়ি ছেড়ে চলে যান, দাদা যদি হাসিনার মন খারাপ দেখলে অখুশি হন। দাদা যদি মাকে আর মা বলে না ডাকেন! মার রক্ত যাওয়া শরীরটি দুর্বল হতে থাকে। অথচ এই দুর্বলতা নিয়েই মা ভোরবেলা থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত ব্যস্ত থাকেন সংসারকাজে। বাবার কাছে বিনিয়ে বিনিয়ে বলেন, আমার ত রক্ত নাই শইলে আর। আমার তো কিছু ভাল খাইতে হইব। এক পোয়া কইরা দধু , দুইটা কলা,দুইটা ডিম আমার লাইগা কি দিবেন? বাবা ক্রুদ্ধ দৃষ্টিতে মার স্পর্ধা দেখেন। মা যত না মার দাবিতে তার চেয়ে বেশি শুভকে রাখার দাবি নিয়ে বলেন, কি রে নোমান, তর বাপে তো কিছু দেয় না, তুই কি আমার লাইগা একটু দধু কলার ব্যবস্থা করতে পারবি? আমার ত শইল ভাইঙ্গা যাইতাছে।

দাদা হাসতে হাসতে জিভ কেটে বলেন, কি যে কন মা। আপনার শইল কই ভাঙতাছে! বরং খুব বেশি মোটা হইয়া যাইতাছেন। ডায়েট ক−ন্ট্রাল করেন। খাওয়া কমাইয়া দেন।

পাইলসের কি কোনও ওষধু তর দোকানে আছে?

নাহ। পাইলসের কোনও ওষধু নাই।

ওষধু নেই। সাফ কথা। দাদা এখন বাবার ওষধু ব্যবসার কর্তা। রমরমা ব্যবসা তার। চমৎকার সাজিয়ে নিয়েছেন দোকান। হাসপাতালে ওষুধের যোগান দেন। বড় বড় ক্লিনিকেও দেন। ওদিকে বাবা নিজের চেম্বারটির পরিসরও বড় করেছেন। এক্সরে মেশিন বসিয়েছেন। মাইত্রে²াসকোপ কিনে প্যাথলজি বসিয়েছেন। জুরিসপ্রুডেন্স বিভাগের অধ্যাপক আবদুল্লাহকে বাবা তাঁর প্যাথলজিতে অবসরে বসতে বলেছেন, বাড়তি আয়ের লোভে আবদুল্লাহ আসেন এখানে। বাবার চেম্বারে কোনও কারণে গেলে রোগীর ভিড় ঠেলে ভেতরে ঢুকতে হয়। গ্রামের দরিদ্র রোগীর ভিড়ই বেশি। কেউ পেট ব্যথা নিয়ে এলেও দেখি বাবা বুকের এক্সরে করতে দিচ্ছেন। মল মুত্র পরীক্ষা করতে দিচ্ছেন। কাশির সঙ্গে রক্ত যেতে থাকা এক বুড়ো এল ধোবাউড়া থেকে, বাবা এক্সরে করে বলে দিলেন যক্ষা। বুড়োকে জিজ্ঞেস করি, কবে থেইকা রক্ত যায়? কোটরাগতে চোখ ক্লান্তিতে নুয়ে আসে, হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, আইজ দেড় বছর।

যখন রক্ত যাওয়া আরম্ভ হইল তখন আসলেন না কেন?

আমু যে টেকা কই বইন? ধার কর্জ কইরা আইলাম শহরে।

আপনাদের গ্রামে ডাক্তার নাই?

না।

গ্রামে গঞ্জে ডাক্তার থাকলেও লোক চলে আসে বাবার কাছে, ভাল ডাক্তার হিসেবে বাবার খুব নাম। শহরের পুরোনো লোকেরা এখনও অসুখে বিসুখে বাবাকে ডাকেন। বাবার নির্দিষ্ট কোনও ফি নেই, যে যা দেয়, তিনি তাই নেন। কেউ পাঁচ টাকা দিয়ে বিদেয় হয়, কেউ দু টাকা। বাবা কেবল একটি অনুরোধই করেন রোগীদের, যেন পাশের আরোগ্য বিতান নামের ওষুধের দোকান থেকে ওষুধ কিনে নিয়ে যায়। মলমুত্রথুতুকফ পরীক্ষা করিয়ে এক্সরে করিয়ে অনেকের টাকা থাকে না ওষধু কেনার। ফিরে যায়। এরকম ফিরে যেতে থাকা যক্ষা রোগিটিকে থামিয়ে আমি আরোগ্য বিতানে নিয়ে দাদাকে বলি ওষধু মাগনা দিতে। দাদা তাচ্ছিলউ করেন,পাগল হইছস? নিজের পকেটের টাকা বের করে দিই, দাদা সে টাকা গুনে নিয়ে ওষধু দেন। আজকাল তিনি টাকা গুনতে পছন্দ করেন খুব। অবসর হলেই তিনি ড্রয়ারে সাজিয়ে রাখা টাকাগুলো পুনরায় গোনেন, টাকাগুলোর একদিকে ধানের শিষ, আরেক দিকে মসজিদ, সব টাকার ধানের শিষকে ধানের শিষের দিকে রাখেন, মসজিদকে মসজিদের দিকে। এই টাকা থেকে সংসারের কোনও খরচ হয় না। যা খরচ হয় তা হাসিনার শখ মেটাতে, তার শাড়ি গয়নায়,তার মেকআপে, চেকআপে। ইয়াসমিন মাঝে মাঝে আরোগ্যবিতানে নামে রিক্সাভাড়ার দুটো টাকা নিতে, দাদা ড্রয়ারে তালা দিয়ে চাবি পকেটে রেখে দুহাত দগুালে রেখে উদাস বসে থাকেন, ইয়াসমিনকে বলে দেন, বিক্রি টিক্রি নাই, এহনও বউনিই করি নাই।

যক্ষা রোগিটি ওষধু পেয়ে কৃতজ্ঞতায় মিইয়ে যায়। রাতে আর সে ধোবাউড়া ফিরবে না, থেকে যাবে জুবলিঘাটের চিৎকাত হোটেলে। হোটেলে লম্বা টানা বিছানা পাতা, ভাড়া বেশি নয়,চিৎ হয়ে শুলে আটআনা, কাত হয়ে শুলে চারআনা। হোটেলগুলোয় লোকের গিজগিজ ভিড়, গ্রাম থেকে শহরে ডাক্তার দেখাতে,মামলা করতে আসা লোকেরা খুব দূরের যাষনী হলে দিন ফুরোলে আর নদী পার হয় না, ঘাটের হোটেলে রাত কাটিয়ে পরদিন সকালে নৌকো ধরে।



মার পাইলসের চিকিৎসা হয় না। মার ইদানিং ধারণা জন্মেছে, মার রোগটি পাইলস নামক কোনও সাধারণ রোগ নয়, দুরারোগ্য কোনও রোগ এটি। মার সংশয় নিয়ে মা থাকেন, কারও সময় নেই রোগশোক নিয়ে ফালতু কথা শোনার। আমার আর্তচিৎকার ফালতু হওয়ার আগে, নিজেই ব্যবস্থা নিই। এনাল ফিশারের যন্ত্রণা যখন আমাকে ধরল, বেদনানিরোধক নিউপারকেইনল মলম ব্যবহার করেও সে যন্ত্রণা যখন কমেনি, হাসপাতালের সব চেনা ডাক্তারদের সামনে গোপনাঙ্গ প্রদর্শন যখন আমার পক্ষে অসম্ভব, অচেনা ডাক্তারের চিকিৎসা পেতে আমি ঢাকা যাই। বড় সার্জন দেখিয়ে ঢাকা মেডিকেলে ভর্তির ব্যবস্থা করলেন ছোটদা। কেবিন পাওয়া শক্ত, কেবিন পাওয়ার জন্য মনি ্ত্র আমানুল্লাহ চৌধুরিকে ধরতে হয়েছে। দুদিন পর অপারেশন। ভর্তি হব হব, তখনই রুদ্র মোংলা থেকে ফিরে আমার চিঠি পেয়ে জেনে যে আমি এখন ঢাকায়, ছোঁ মেরে নয়াপল্টন থেকে তুলে নিয়ে গেল। ছোঁএর সময় ছোটদা বাড়ি ছিলেন না। গীতা হাঁ হয়ে ছিল। তার এক ডাক্তার-মামাতো ভাই ঢাকা মেডিকেলে চাকরি করছে, রুদ্র আমাকে সেই পঞ্চাশ লালবাগে নিয়ে গেল ডাক্তার ভাইটিকে বলতে আমার অপারেশনের সময় যেন থাকে সে। বৈঠকঘরের সোফায় তখন চুল এলিয়ে বসা ছিল নেলি। নেলিকে ওই প্রথম আমি দেখি। রুদ্রকে দেখি চোখ বারবার নেলির এলিয়ে পড়া চুলের দিকে যাচ্ছে, নেলির আলথুালু শাড়ির দিকে যাচ্ছে। দুজন গল্প করে, পুরোনো দিনের গল্প। হাসে। একটি পত্রিকা হাতে নিয়ে মুখ ডুবিয়ে রাখি, যেন কিছু দেখছি না, কিছুই আমার চোখে পড়ছে না, কথা বলতে বলতে তোমাদের দুজনের চোখে স্মৃতি যে কাপঁ ছে তা আমি দেখছি না, সেই সব উতল প্রেমের স্মৃতি, সেই সব চুম্বন, গোলাপের গন্ধে শরীরে শরীর ডুবিয়ে মাছ মাছ খেলা— দেখছি না, তোমাদের যে পরস্পরকে স্পর্শ করতে ইচ্ছে করছে খুব, আবার ইচ্ছে করছে জগতের সকল কিছু সকল সম্পর্কে তুচ্ছ করে আগের মত প্রেমের অথৈ জলে ঝাপঁ দিতে, চুম্বনে চুম্বনে প্রতি লোমকপূ কে আবার আগের মত জাগাতে, আবার আগের মত স্বপ্নের কথা বলতে বলতে খুব খুব গভীরে চলে যেতে শরীরের—দেখছি না। আমার চোখ পত্রিকাটির অক্ষরে, তোমরা নিশ্চিন্তে যে কথা বলতে ইচ্ছে করো, বলো। সেই সব স্বপ্নের কথা, সেই সেইসব ভীষণ আবেগের কথা, যে আবেগ নিয়ে তুমি নেলির বিয়ে ভেঙে দিতে গিয়েছিলে রুদ্র। আমি মন দিয়েছি অক্ষরে, আমি শুনছি না। অক্ষরগুলোয় তাকিয়ে থাকি, অক্ষরগুলো বৃষ্টিতে ভিজছে। ভেজা অক্ষরগুলো আমার দিকে চেয়ে থাকে, ভেজা অক্ষরগুলোর মায়া হতে থাকে আমার জন্য।

হাসপাতালে অপারেশন টেবিলে আমাকে অজ্ঞান করা। আমি যখন ঘুমিয়ে যেতে থাকি, কেউ আমাকে জিজ্ঞেস করতে থাকে আমার নাম ঠিকানা, বলতে চেয়েও আমি বলতে পারছি না, কোত্থেকে এক পাখি এসে আমাকে ডানায় করে আকাশে উড়িয়ে নিতে থাকে, আমি মেঘের মত উড়তে থাকি, আমার ভাল লাগতে থাকে। ভীষণ ভাল লাগতে থাকে। জ্ঞান ফিরলে দেখি অন্য এক বিছানায় শুয়ে আছি। পাশে ছোটদা, গীতা, রুনুখালা। গীতা আমার চুলে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে, ছোটদা রুনুখালা জিজ্ঞেস করেন, ব্যথা লাগতাছে? ব্যথা আছে কি বুঝতে পারি না, থাকলেও প্রিয় এই মখু গুলো ব্যথা কমিয়ে দিয়েছে। হঠাৎ সবাইকে অপ্রস্তুত করে ঘরে রুদ্র ঢোকে। ছোটদা বেরিয়ে যান। কে এই রুদ্র, কি সম্পর্কে তার সঙ্গে আমার, এ কাউকে বলিনি। সকলে বুঝে নেয়। বেরিয়ে যাওয়া ছোটদাও বুঝে নেন। দুদিন থাকতে হয় হাসপাতালে, এই দুদিন গীতা আমার জন্য তিনবেলা খাবার আনে। বসে থেকে গল্প করে। গরম জলের গামলায় বসিয়ে রাখে। হাসপাতাল ত্যাগের দিন একদিকে ছোটদা, আরেকদিকে রুদ্র। ছোটদা বললেন, চল বাসায় চল।

আমি মাথা নাড়ি, না।

না মানে?

নিরুত্তর আমি। ছোটদা আমাকে হাত ধরে টানেন, বাসায় যাইবি না ত কই যাইবি তুই? ছোটদার হাতটি আমি ধীরে ধীরে ছাড়িয়ে নিই। নিরুত্তাপ শান্ত চোখ রাখি তাঁর কষ্টভাঙা চোখে। চোখের কোণে জল উপচে ওঠে তাঁর,আড়াল করে দাঁতে ঠোঁট চাপেন। আমি রুদ্রর সঙ্গে বেরিয়ে যাই। নিরুত্তর।

মুহম্মদপুরের বাড়িতে ফিরে একটি দুর্ভাবনার সঙ্গে আমি বসে থাকি চপু চাপ। রুদ্রর মামাতো ভাইটি যদি না জেনে থাকে আমাদের বিয়ে হয়েছে! রুদ্র বলে, তুমি তো কাউকে জানাতে চাও না বিয়ের কথা। অজ্ঞান করার পর আমার গোপনাঙ্গ নিশ্চয়ই আর গোপন থাকেনি কোনও ডাক্তারের কাছে, আর গোপন না থাকা মানে জেনে যাওয়া যে আমি কুমারী নই! অন্তত তাকে জানাও যে আমরা বিয়ে করেছি। তা না হলে ভেবে বসবে আমার বুঝি বিয়ের আগেই কুমারীত্ব গেছে ছি ছি। আমি মখু নত রাখি লজ্জায়। আমার লাজ রাঙা মখু টি রুদ্রর খুব পছন্দ। মখু টি দুহাতে নিজের দিকে ফিরিয়ে সে চুমু খায়। কথা দেয়, কালই সে জানাবে তার ভাইকে বিয়ের কথা। সে রাতটি যখন গভীর হয়ে আমাদের ঘুম পাড়িয়ে দেয়, ঘুমে অচেতন করে রাখে, রুদ্রর বন্ধু মিনার দরজা ধাক্কিয়ে আমাদের ভাঙা ঘরে তুফান তোলে। সুন্দরী বউ কবিতাকে নিয়ে মিনার এসেছে ঘুমোতে, সারা শহরে ঘুমোনোর কোনও জায়গা পায়নি বলে। শোবার ঘরটি ছেড়ে দিই ওদের জন্য, রুদ্র আর আমি শুই শীতল পাটি বিছিয়ে অন্য ঘরে। ভোরবেলা দেখি রুদ্র নেই আমার পাশে। সে ঘুমোচ্ছে বিছানায় মিনার আর কবিতার সঙ্গে। কি হয়েছে? ঘটনা কি! তুমি এখানে কখন এসেছো? রুদ্রর সরল উত্তর, শীতল পাটিতে তার ঘুম আসছিল না। বুদ্ধি করে মিনারের পাশে শুয়েছে, কবিতার পাশে যদি মিনার আবিষ্কার করত তাকে, তবে নিশ্চয়ই বন্ধুটির কাণ্ডে অট্টহাসি হেসে সকালে বিদেয় হত না সস্ত্রীক। সেদিন সকালেই আমি রুদ্রর ড্রয়ারে চিঠি লেখার কাগজ খুঁজতে গিয়ে বিয়ের দলিলটি দেখি। দলিলে লেখা উকিলের সামনে বসে আমি নাকি এ দলিলে সই করেছি। আশ্চর্য এতে তো মিথ্যে কথা লেখা! বলতেই রুদ্র আমার হাত থেকে দলিলটি কেড়ে নিয়ে ড্রয়ারে রেখে দেয়। শুয়ে বসে ঘর গুছিয়ে বাইরে খেয়ে আড্ডা দিয়ে কবিতায় সঙ্গমে দুদিন কাটার পর আমার মন কেমন করতে থাকে অবকাশের সবার জন্য। মার জন্য, ইয়াসমিনের জন্য, সুহৃদের জন্য, মিনুর জন্য। কি রকম আছে ওরা! আমার কথা মা নিশ্চয়ই প্রতিদিন বলছেন, বাবা প্রতিদিন, ইয়াসমিন প্রতিদিন, সুহৃদও বলছে দোলফুপু এখনো আসে না কেন? সুহৃদকে শিখিয়েছি আমাকে দোলফুপু ডাকতে। একদিন ওকে দোলনায় দোলাতে দোলাতে দে দোল দে দোল ফুপু দে দোল দে দোল বলতেই বলতেই। মন পড়ে থাকে অবকাশে। আমার এলোমেলো আবার খুব গোছানো জীবনে। মিনুর জন্যও কষ্ট হতে থাকে, নিশ্চয়ই সে ঘরে বারান্দায় ক্ষিধে পেটে হাঁটতে হাঁটতে আমাকে খুঁজছে, রাতে তার খুব খালি খালি লাগছে বোধহয়! ঢাকাকে আমার আপন শহর মনে হয় না। ঢাকায় কদিনের জন্য বেড়াতে আসা যায়। পাকাপাকি থাকার জন্য এ শহরটিকে আজও আমি মনে নিতে পারি না। ময়মনসিংহে ফিরে যেতে চাইলে রুদ্র আর একটি দিন থাকতে অনুরোধ করে। সেই একটি দিনের একটি বিকেলে আমাকে নিয়ে মগবাজার যায়, কাজির আপিসে। রুদ্রর দুটো বন্ধওু যায়। কাজির কাছে কাবিন হবে, দুই বন্ধু সাক্ষী। সারপ্রাইজ!

তা আমাকে আগে জানালে আমি কি আপত্তি করতাম রুদ্র?

কাবিন কত টাকার হবে?

টাকার অক কি দিতেই হবে?

হ্যাঁ দিতেই হবে।

শূন্য দেওয়া যায় না?

না।

তাহলে এক টাকা।

ধুর এক টাকা কি করে হয়!

যত ইচ্ছে তত দাও, এসবের কোনও মানে হয় না, তুমি কি ভাবছ আমাদের কোনওদিন তালাক হবে, আর হলে আমি কোনও টাকা দাবি করব?

আমি হেসে উঠি। সশব্দে নিঃশব্দে।

কাবিনের কি দরকার রুদ্র?

দরকার আছে।

কি দরকার?

এসব অর্থহীন জিনিস। দুজন মানুষকে একসঙ্গে বাস করাতে পারে কোনও কাবিননামা? নাকি ভালবাসা? আমি ভালবাসায় বিশ্বাসী, কাবিনে নয়। রুদ্র ভালবাসায় কতটা জানি না, তবে সে কাবিনে বিশ্বাসী, সে কাবিন করে। পরদিন ময়মনসিংহে ফিরে যাই। অপারেশন হয়েছে শুনে মা আমার যত্ন করেন, গরম জল গামলায় ঢেলে জলে ডেটল মিশিয়ে আমাকে বসিয়ে দেন দিনে চারবার। মাকে আমার পুরোনো নিউপারকেইনল মলমটি দিই। এনাল ফিশারের যন্ত্রণা কমার মলম। মা মলম পেয়ে ভাবেন, এটিই তাঁর রক্ত যাওয়া বন্ধ করবে। রক্ত যাওয়া বন্ধ হয় না মার। ভাবেন, কোনও একদিন নিশ্চয়ই বন্ধ হবে। মার আবদারের এক পোয়া দধু , দুটো কলা আর দুটো ডিমও পাওয়া হয় না। মা সম্ভবত আশা করেন, তাঁর মেয়েটি ডাক্তার হচ্ছে, উপার্জন করবে, সেই মেয়েই তাঁর চিকিৎসা করবে, সেই মেয়েই দুধ কলা কিনে দেবে। সেই মেয়ের ডাক্তারি পাশ হয়। সেই মেয়ের ইন্টারনিশীপ শুরু হয়। সেই মেয়ের হাতে টাকা আসে। টাকা পেয়ে আর যা কিছুই হয় তার মার দীর্ঘ দীর্ঘ দিনের আবদারের দধু ডিম কেনা হয় না। ভাগীরথীর মা আসে, দুই বাচ্চার জন্য দধু দিয়ে যায়। বারান্দায় বসে দুবাচ্চার দুধ মেপে দিয়ে জিজ্ঞেস করে প্রায়ই, ও মাসি, আরও এক পোয়া দধু রাখবেন বলিয়েছিলেন না! মা বড় শ্বাস ফেলে বলেন, না ভাগীর মা, দুধ খাওয়ার কপাল আমার নাই।
 
বিছানায় দু পা বিছিয়ে সেই পায়ের ওপর শুইয়ে মা হাঁটু ভেঙে ভেঙে দোল দিয়ে ঘুম পাড়ান সুহৃদকে,ছড়া বলতে বলতে। জানালায় উদাস তাকিয়ে ছিলেন মা, সুহৃদ ঘুমিয়ে গেছে পায়ে, তখনও ওকে পা থেকে আলতো করে তুলে বিছানায় শুইয়ে দিচ্ছেন না.. চোখের নিচে কালি পড়েছে,চোখদুটো ফোলা, জানালা থেকে চোখ সরিয়ে বলেন,নোমানের বউ আমারে বেডি কইয়া ডাকে।

কেমনে জানো?

পাকঘরে গিয়া শুনি লিলির মারে কইতাছে, ওই বেডি আমার ছেলেডারে দুই চোক্ষে দেখতে পারে না।

ও।

সাহস পাইছে তর বাপের কাছ থেইকা। তর বাপ ত সবার সামনেই বেডি কয়।

জানালায় আবার উদাস তাকিয়ে মা বলেন, শাশুড়ি আমি, আমারে গ্রাহ্যই করে না।

সুহৃদের ঘুমন্ত মখু খানার দিকে তাকিয়ে থাকি। অনেক সুন্দর বাচ্চা দেখেছি। সুহৃদের মত কেউ নয়। ঘুমিয়ে থাকলে মনে হয় না কি ভীষণ দুরন্ত ছেলে সে। প্রতিদিন খাট থেকে টেবিল থেকে সিঁড়ি থেকে ধুপ ধাপ পড়ে যাচ্ছে বাতাসের আগে ছুটতে যেয়ে। ভ্রুক্ষেপ নেই কোনও। শুভ একটি পা কোথাও দিলে আগে দেখে নেয় কোথায় দিচ্ছে, সাবধানী ছেলে, কোনও লম্ফ ঝম্ফ নেই। শুভর শরীরে কোনও চিহ্ন নেই কাটা দাগের। সুহৃদের আজ হাঁটু ছিলে যায় তো কাল কনুইএ কালশিটে দাগ পড়ে থাকে। সারা শরীরে তার দস্যিপনার চিহ্ন। সুহৃদ আধো আধো কথা বলে। শুভ কথা বলতে শেখা অবদি কোনওদিন কোনও আধো কথা বলেনি। সবসময় ষ্পষ্ট। খাওয়ার ব্যাপারে শুভর কোনও না নেই। সুহৃদের সবসময়ই না। মার ভোগান্তি বাড়ে। ছেলে যত বড় হচ্ছে, তত তাকে বাগে আনা মুশকিল হয়ে পড়ছে। দৌড়ে ছাদে চলে গেল। পেছনে পেছনে দৌড়োতে হয় মার, যদি আবার ছাদ থেকে লাফ দেয় নিজেকে সিক্স মিলিয়ন ডলার ম্যান মনে করে! ফটক খোলা পেলে রাস্তায় চলে গেল, দৌড়ে ধরে আনতে হয়। মার যত না খাটনি, তার চেয়ে বেশি দুশ্চিন্তা। ছোটদা অবকাশে এসে গন্ধ টের পান হাওয়ায়, গন্ধটি হাসিনার অসন্তুষ্টির। হাসিনার দৃঢ় বিশ্বাস, শুভর চেয়ে সুহৃদকে ভাল বেশি বাসা হচ্ছে। মা ছোটদাকে বলেছেন, সুহৃদের জন্য কিছু আনলে শুভর জন্যও নিয়া আসিস। হাসিনাকে তুষ্ট করতে বিদেশ থেকে আনা বাচ্চার জামা কাপড় খেলনা শুভর জন্য দেওয়া হয়েছে। কিন্তু দিলেও হাসিনা জানে যে শুভর যা আছে তার চেয়ে অনেক বেশি আছে সুহৃদের। সুহৃদের জন্য ছোটদা তিন চাকার একটি সাইকেল এনেছেন। এটি ঘরে বারান্দায় মাঠে উঠোনে চালায় সে ঝড়ের বেগে চালায়। মা সুহৃদকে খানিক পর পর উঠিয়ে শুভকে দেন চালাতে, শুভ তো তোমার ভাই, ওরে চালাইতে দেও। সুহৃদের প্যারামবুলেটরটিও শুভকে দিয়ে দিয়েছিলেন মা। সুহৃদের ছ মাসের ছোট শুভ। প্যারামবুলেটর থেকে সুহৃদের নামা হয়েছে, শুভর ওঠা হয়েছে। কিন্তু হাসিনা দাদাকে বলেছে শুভর জন্য নতুন কিনে নিয়া আসো।

ময়মনসিংহে পাওয়া যায় না এইসব।

না পাওয়া যাক। ঢাকা যাও, ঢাকা থেকে কিনে নিয়ে আসো।

কি কও মুমু! ঢাকা যাব এইটা কিনার জন্য?

হ, এইটা কিনার জন্য তোমারে ঢাকা যাইতে হইব। আর যদি ঢাকায় না পাও তাইলে লন্ডন গিয়া হইলেও কিন্যা নিয়া আসতে হইব।

সুহৃদ সাইকেল পাওয়ার পর শুভকে ঠিক এরকম সাইকেল কিনে দেওয়ার জন্য হাসিনা দাদাকে আবার ধরল। দাদা সারা শহর খুঁজে একটি তিন চাকার সাইকেল কিনে নিয়ে বাড়ি এলে হাসিনা সাইকেলটি ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে বলল, রাস্তা থেইকা টুকাইয়া আনছ নাকি?

এর চেয়ে ভাল সাইকেল আর নাই বাজারে। পারলে গিয়া দেইখা আসো।

মা বলেন, সুহৃদের সাইকেলটা নাকি কামাল সিঙ্গাপুর থেইকা আনছে। এইরম সাইকেল তো দেশেই পাওয়া যাবে না।

সমস্যার সমাধান সুহৃদই করে। সে নতুন আনা সাইকেলটির ওপর আকর্ষণে নতুন সাইকেলটি চালাতে থাকে। শুভ চালায় সিঙ্গাপুরি। হাসিনার দেখে খুশি হওয়ার কথা। কিন্তু খুশি হয় না। তার মুখে হাসি মোটেও ফুটতে চায় না। হাসি ফোটানোর জন্য মা পরিশ্রম করেন। মা তাকে ছোটদার আনা আপেল আঙুল কমলালেবু দিতে থাকেন। মাছ মাংস রান্না হলে হাসিনাকে সবচেয়ে বেশি এবং সবচেয়ে ভাল টুকরোগুলো দেওয়া হয়। হাতে টাকা পয়সা এলে হাসিনা আর শুভর জন্য বাজার থেকে কিছু না কিছু উপহার কিনে নিয়ে আসেন। হাসিনার হাসি নেই তবু। দাদাকে তিনি অহর্নিশি বলতে থাকেন, কি নড়ো না কেন! মরার মত শুইয়া থাকলেই হবে? ফকিরের মত টিনের ঘরে আর কতদিন পইড়া থাকবা। আলদা বাসা নেও। আমার ছেলেরে তোমার এই গুষ্ঠি থেকে দূরে সরাইতে হবে।

সুহৃদ সংসারের কোনও কুটকচাল বোঝে না, শুভর জন্য সুহৃদের মমতা অনেক। শুভকে পারলে সে তার নিজের যা কিছু সম্পদ সব দিয়ে দেয়। কিল চড় আঁচড় এগুলো সুহৃদের শরীরে বসাতে শুভ সবচেয়ে বেশি পারদর্শী। একবার ধাক্কা দিয়ে সুহৃদকে ফেলে দিয়েছিল খাটের রেলিং থেকে, মাথায় চোট পেয়ে সুহৃদ পুরো চব্বিশঘন্টা অজ্ঞান হয়ে পড়েছিল। মা পাগল মত হয়ে গিয়েছিলেন। মার ভয় কখন না আবার কি দুর্ঘটনা ঘটে যায়। তিনি ছোটদাকে বলেছেন, এই পরিবেশে সুহৃদরে মানুষ করা যাবে না। তুই ওরে ঢাকায় নিয়া যা। ছোটদা মার এই প্রস্তাবের জন্য প্রস্তুত ছিলেন না। তিনি মুখ শুকনো করে বলেন, হ নিয়া যাইতে হইব। ঢাকায় নিয়া ইশকুলে ভর্তি করাইতে হবে। সুহৃদকে ঢাকা নিয়ে যাওয়া হলও এরপর। মা গেলেন সঙ্গে। দু সপ্তাহ পর মা ফিরে এসে সুহৃদের জন্য চোখের জল ফেলতে থাকেন। কেবল চোখের জলই নয়। হাঁউমাউ কান্না। কেঁদে কেটে নিজেই তিনি উন্মাদিনীর মত ঢাকা চলে যান, সুহৃদকে ফের অবকাশে ফেরত আনেন। সুহৃদ মহাসুখে অবকাশে দিন যাপন করতে থাকে। ওকে নিয়ে প্রায় বিকেলেই বেড়াতে বেরোই। রিক্সা করে উদ্দেশ্যহীন ঘুরে বেড়ানো। কখনও কখনও বান্ধবীদের বাড়িতে নিয়ে যাওয়া। ওর আবদারের খেলনা কিনে দেওয়া। আজ চাবিঅলা গাড়ি কিনে দিলাম তো কাল চাবিঅলা উড়োজাহাজ লাগবে। নিজের জন্যও রেডিমেড টু পিস থ্রি পিস কিনি। দুটো জামা, একটি ধোব, আরেকটি পরব, বাবার এই নিয়ম ভেঙে আমার জামা পাজামার সংখ্যা দাঁড়িয়ে যায় দশাধিক। শখ করে নীল জিনসের কাপড় কিনে দরজি দিয়ে একটি প্যান্টও বানাই। এবার দরজিকে বলি, সামনের দিকে বোতাম বা চেইন দিবেন, কিনারে না। লপু দিবেন। যদি বেল্ট পরতে ইচ্ছে হয়, পরব। রেডিমেড ছাড়া কখনও যদি কাপড় কিনে জামা বানাই, দরজির ফিতে নিজের হাতে নিয়ে বুকের মাপ দিই। ইয়াসমিনকে বলে দিই, এখন থেইকা নিজে মাপ দিবি। ইয়াসমিনকে বলা হয় না কেন ওর নিজের এ কাজটি করা দরকার, কেন দরজির নয়। সম্ভবত ও বুঝে নেয়। হাসপাতাল থেকে ফিরেই ওর সঙ্গ চাই আমার। জগতের সকল কথাই হয় ওর সঙ্গে, কেবল শরীরের কোনও গোপন কিছু নিয়ে কোনও কথা নয়। আমরা দুজন যেন আজও শিশু। আমরা হাসি আনন্দ করি, কবিতা পড়ি গান গাই। ঘুরে বেড়াই। যেদিন জিনস প্যান্ট পরেছি, বাবা দেখে বলেন, এইডা কি পরছস। এক্ষুনিখোল। খুইলা পায়জামা পর। আমি বলি, জিনস প্যান্ট সবাই পরে। মেয়েরাও পরে।

না মেয়েরা পরে না। এইসব ছেলেদের পোশাক।

বাবার প্রতিবাদ করি না আমি, সরে আসি সামনে থেকে। কিন্তু জিনস খুলে রাখি না, পরে থাকি। পরদিনও পরি। আমার কাপড় চোপড় ইয়াসমিনের গায়ে আঁটে। সে নিজেও আমার জামা কাপড় অবলীলায় ব্যবহার করতে থাকে। আমি না করি না। বাবা ইয়াসমিনকেও জিনস পরতে দেখে দাঁত খিচোন, কি হইছে এইগুলা? বড়টার শয়তানি তো ছোটটারেও ধরছে। যেইদিন ধরব আমি, সেইদিন কিন্তু পিটাইয়া হাড্ডিা গুড়া কইরা দিয়াম। হাড্ডি গুঁড়ো হোক, ইয়াসমিনকে বলি খুলবি না। খুলবি না বলি, কারণ আমি কোনও যুক্তি দেখি না জিনস পরা মেয়েদের জন্য অনুচিত হওয়ার। এটি পরলে আমি যে ছেলে বনে যাবো, তা তো নয়। এর ভেতরে যে শরীর, সে তো ঠিকই থাকছে। সেটি ঠিক রাখার জন্যই যদি বাবার আদেশ হয়ে থাকে। ইয়াসমিনকে ছোট বাজারের সুর তরঙ্গ থেকে একটি পুরোনো হারমোনিয়াম কিনে দিই। গানের মাস্টারও রেখে দিই। একটিই শতর্ আমার, ও যেন রবীন্দ্রসঙ্গীত গায়। ঈশান চক্রবর্তী রোডের একটি দেয়াল ফুঁড়ে বটগাছের চারা ওঠা পুরোনো বাড়িতে ময়মনসিংহ সঙ্গীত বিদ্যালয়, ওতে ভর্তি করিয়ে দিই ওকে। গেল, কিন্তু সাতদিনের মাথায় বলে দিল ওর ভাল লাগছে না ওখানে। ঠিক আছে ইশকুলে যদি ভাল না লাগে বাড়িতে এসে মাস্টার গান শেখাবে, এই ভেবে সুনীল ধরের কাছে নাকি মিথুন দের কাছে! কার কাছে যাবো! শেষ অব্দি ঠিক হল, বাদল চন্দ্র। সঙ্গীত বিদ্যালয়ের গানের মাস্টার বাদল চন্দ্রর বাড়ি কোথায় খোঁজ নিয়ে জেনে ইয়াসমিনকে নিয়ে গিয়ে তাঁকে অনুরোধ করি গান শেখাতে। বাদল চন্দ্র দের ছোট ভাই সমীর চন্দ্র দে ওরফে কটন এককালে ছোটদাকে গিটার শেখাতেন। শহরের এক নম্বর গিটার শিল্পী। বাদল চন্দ্র দে বিয়ে থা করেননি। তাঁর ঘরটিতে তানপুরা হারমোনিয়াম তবলা সেতার বীণা নানা রকম যন,্ত্র ঘরের এককোণে একটি তক্তপোষ। এত অল্পে কি করে যে মানুষের জীবন যাপন চলে!ভোগ বিলাসের চিহ্ন নেই বাড়িটিতে। একটি উঠোন ঘিরে টিনের কতগুলো ছোট ছোট ঘর। পৈতৃক ভিটে। ভাইরা বিভিন্ন ঘরে থাকেন, ছেলেমেয়েও বড় হয়ে গেছে। সকলে সঙ্গীত সাধনায় উৎসর্গ করেছে জীবন। বাদল চন্দ্র আমাদের দুজনকে তক্তপোষে বসিয়ে নিজে একটি মোড়ায় বসে সঙ্গীতের গভীর কথা শোনাতে থাকেন, কতক বুঝি, কতক বুঝি না। তিনি কাউকে শখের গান শেখাতে চান না, এ যদি সত্যিকারের সঙ্গীত সাধনার উদ্দেশ্য হয়, মন প্রাণ উৎসর্গ করা হয় সঙ্গীতে, তবেই তিনি ছাত্রী নেবেন। আমাদের, আমি জানি না কেন, পছন্দ হল বাদল চন্দ্রের। তিনি সপ্তাহে দু দিন ইয়াসমিনকে শেখাতে বাড়ি আসতে লাগলেন। দীর্ঘাঙ্গ ধবল শরীর বাদল চন্দ্রের। ধবধবে শাদা পাঞ্জাবি আর ধুতি পরনে। এক হাতে ধুতির কোচা ধরে তিনি ঢোকেন অবকাশে। বৈঠক ঘরে সা রে গা মা পা ধা নি সা চলতে থাকে সারা বিকেল। আমি ট্রেতে করে চা বিস্কুট নিয়ে ঘরে ঢুকি। বাদল ওস্তাদ আমাকে দেখলে কেবল সঙ্গীত নিয়ে নয়, সাহিত্য নিয়েও গল্প করেন। রবীন্দ্রনাথের কবিতাগুলি মুখস্ত বলে যেতে থাকেন। কবিতা মুখস্ত করার মাথা আমার নেই, আমি মুগ্ধ শ্রোতার ভূমিকায়। ইয়াসমিনের সা রে গা মা বাদল চন্দ্রের কাছেই প্রথম শেখা নয়। ওর যখন পাঁচ কি ছয় বছর বয়স, বাবা ওকে রাজবাড়ি ইশকুলের শিক্ষিকা রোকেয়ার বাড়িতে নিয়ে যেতেন গান শিখতে, ও বাড়িটিও নাচ গানের বাড়ি ছিল। রোকেয়ার মেয়ে পপি নাচত। ছেলে বাকি গান গাইত। রোকেয়ার বোন আয়শা, বোনের সঙ্গে একই বাড়িতে থাকতেন, তিনিও শিক্ষিকা, নিজেও গান গাইতেন, মেয়ে দোলনকেও গান শেখাতেন। ইয়াসমিনকে ও বাড়িতে নিয়ে যাওয়া, বাড়ি থেকে নিয়ে আসা এসব নিয়ে মা বলতেন, ইয়াসমিনরে গান শেখানোর উদ্দেশে ত তর বাপে ওই বাড়িতে যায় না, আয়শার সাথে রঙ্গরস করাই আসল উদ্দেশ্য। ইয়াসমিনকে ও বাড়িতে নিয়ে বাচ্চাদের সঙ্গে বসিয়ে দিয়ে অন্য ঘরে কোঁকড়া চুলের টানা টানা চোখের ফর্সা চামড়ার প্রায় গোলাপি ঠোঁটের ভরা বুকের যুবতী আয়শার সঙ্গে বাবা কথা বলতেন। বাবার রাজিয়া বেগমকে দিয়েও সাধ মেটেনি কোনওদিন। খুচরো আরও কিছু প্রেম বাবার এদিক ওদিক থাকতই। ইয়াসমিনের এক বান্ধবীর কৃকলাশ খালার সঙ্গেও, খালাটি উকিল, বাবাকে দেখা গেছে এদিক ওদিক ঘুরে বেড়াতে। ইয়াসমিন বাদল চন্দ্র দের কাছে সা রে গা মা যখন শিখছে, কলেজের কিছু গানের মেয়ের সঙ্গে নতুন পরিচয়ের পর খোঁজ দিল যে শহরে আনন্দধ্বনি নামে একটি গানের ইশকুল আছে, ওতে মেয়েরা যাচ্ছে। এই গানের ইশকুলটি ছুটির দিনে মহাকালি ইশকুলে বসে। আনন্দধ্বনি রবীন্দ্রসঙ্গীতের ওস্তাদ ওয়াহিদুল হকের ইশকুল। ময়মনসিংহে ওয়াহিদুল হকের শিষ্য তপন বৈদ্য, নীলোৎপল সাধ্য, আর নূরুল আনোয়ার আনন্দধ্বনির ছাত্র ছাত্রীদের গান শেখান। ছাত্র ছাত্রীরা যে কোনও বয়সের। পাঁচও আছে, পঞ্চাশও আছে। একই সঙ্গে বসে তাল দিয়ে গান গাইছে। রবীন্দ্রসঙ্গীত আমাকে বাঁচিয়ে রাখে একরকম। দাদার সন্ধ্যা ফিরোজা হেমন্ত মান্না দে ডিঙিয়ে রবীন্দ্রসঙ্গীতে বুঁদ হয়েছি বেশ অনেকদিন। বিশেষ করে কণিকা আর সুবিনয় রায়ে। মাঝখানে গণসঙ্গীতের ভক্ত হয়ে উঠেছিলাম। কিন্তু সরিয়ে রেখে আবার রবীন্দ্রসঙ্গীতে। এই এক সঙ্গীত, যে সঙ্গীতে মন দিলে জীবন বড় সুন্দর হয়ে ওঠে। জীবনের এমন কোনও অনুভবের কথা নেই, যা না বলা আছে এই সঙ্গীতে। কেবল সুখ বোধই নয়, দুঃখবোধও একরকম আনন্দ দেয়। ইয়াসমিনকে আনন্দধ্বনিতে ভর্তি করে দিই। বাদল চন্দ্রের বেতন, আনন্দধ্বনির বেতন মাস মাস দিতে থাকি আমি। আনন্দধ্বনিতে যাওয়া শুরু করার পর নীলোৎপল সাধ্যের নজরে পড়ে ইয়াসমিনকে, কোনও একদিন ও খুব বড় শিল্পী হবে আশায় নীলোৎপল সাধ্য ওকে যত্ন নিয়ে গান শেখাতে শুরু করেন। ইয়াসমিন একদিন তবলার আবদার করায় ভাল দেখে তবলাও কিনে দিই গোলপুকুরপাড়ে প্রমোদ বিহারির তবলার দোকান থেকে। বাদল চন্দ্র দের আগ্রহ ইয়াসমিনকে উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত শেখাতে। ঘরে উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত চলল, বাইরে রবীন্দ্রসঙ্গীত। চারপাশের মানুষের ক্ষুদ্রতা নিচতা স্বাথর্প রতা থেকে চোখ ফিরিয়ে রেখে ইয়াসমিনকে নিয়ে একটি চমৎকার জগত তৈরি হয় আমার। ইয়াসমিন যখন আনন্দধ্বনিতে শেখা গান গুলো গাইতে থাকে বাড়িতে, আমি মগ্ধু হয়ে দেখি ওকে। কোনও মন খারাপ করা বিকেলে, তোমার কাছে শান্তি চাব না, থাক না আমার দুঃখ ভাবনা.. গানটি আমাকে ফোঁটা ফোঁটা চোখের জল ঝরাতে থাকে। ইয়াসমিন মাঝে মাঝে বাড়িতে নীলোৎপলকে নিয়ে আসে, সুদর্শন যুবক নীলোৎপল সাধ্য, কাঁধে শান্তিনিকেতনি ঝোলা, পায়ে শানিপ্তুরি চপ্পল, ঠোঁটে শান্তি ছড়ানো হাসি। আমার মনে হতে থাকে নীলোৎপল বুঝি মনে মনে ইয়াসমিনকে ভালবাসছে। ভয় হয়। ওর এক বান্ধবীর ভাই ইয়াসমিনের কাছে আসে মাঝে মাঝে তবলা বাজাতে, ইয়াসমিনের দিকে ছেলেটিকে মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে থাকতে দেখেছি। ভয় হয়। কলকাতা থেকে ইয়াসমিনকে গোটা গোটা অক্ষরে চিঠি লিখছে কৌশিক মজুমদার। কে এই কৌশিক মজুমদার? ইয়াসমিন বলে, ওই যে ধ্রুব। মৃত্যঞ্জয় ইশকুলের সামনে থেকে প্রায় বিকেলে যে হাফপ্যান্ট পরা বড় বড় কাজল কালো চোখের মিষ্টি চেহারার কালো একটি ছেলে এই পাড়ায় বিকেলে হাঁটতে আসত, ওই ধ্রুব। ইয়াসমিনও চিঠি লেখে কৌশিককে। কৌশিক একদিন ওকে আর ইয়াসমিন নামে সম্বোধন করে না, সম্বোধন করে মৌমি বলে। ইয়াসমিন নিজের নাম সেই থেকে মৌমি লিখছে। ভয় হয় আমার। ভীষণ ভয় হয়। কৌশিকের চিঠি এলেই আমি পড়ি। খুঁটিয়ে খুঁিটয়ে দেখি কোনও প্রেমের ইঙ্গিত আছে কি না। আসলে আগলে রাখি ওকে সকল সর্বনাশ থেকে, কারও প্রেমে যেন সে না পড়ে। কোনও মোহ যেন ওর সততা ও সারল্যকে, ওর সৌন্দর্যকে এতটুকু ম্লান না করে। আমার যা হয়েছে, হয়েছে। ওকে বাঁচাতে চাই সকল কৎু সিত থেকে। যখন ইয়াসমিন কলেজে যাবে বা আনন্দধ্বনিতে যাবে বা বান্ধবীর বাড়ি যাবে বলে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে সাজে, চোখে কাজল পরে, ঠোঁটে লিপস্টিক। ধমক লাগাই, এত সাজস কেন?

এমনি।

কেউ এমনি এমনি সাজে না। কোনও কারণ থাকে।

কোনও কারণ ছাড়া কি সাজা যায় না?

পিছনে কারণ থাকেই। তুই চাস তর রূপ দিয়া মানুষরে মগ্ধু করাইতে। ঠিক না?

না ঠিক না। আমার ভাল লাগতাছে সাজতে, তাই সাজতাছি।

তাইলে তুই ঘরে যখন থাকস, তখন এইরকম সাজস না কেন? ঘরের বাইরে বার হওয়ার জন্য তর খয়েরি ঠোঁটটারে লাল করস কেন?

ইয়াসমিন কোনও উত্তর দেয় না। আমি −শ্লষ গলায় বলি, তুই কি ভাবছস মুখে রং মাখলে তরে সুন্দর লাগে দেখতে? মোটেই না। নিজের যা আছে, তা নিয়া থাকাই সবচেয়ে ভাল। নিজের আসল চেহারা রঙের মুখোশ পইরা নষ্ট করিস না। কৃত্রিমতার আশ্রয় নেওয়ার দরকার কি তর! তর অভাব কিসের? নিশ্চয়ই ইনফিরিওরিটি কম−প্লক্সে ভগু তাছস!

ইয়াসমিন আমার যুক্তি মেনে নেয় না, সেজে যায়।একটি শীত শীত ভয় আমাকে বুকে হুল ফোটাতে থাকে।



হাসপাতালে পোস্টমাস্টারের ঠিকানায় রুদ্রর চিঠি আসে, চিঠি পেয়েই ঢাকা চলে এসো। মেডিসিন ওয়াডের্ ডিউটি আমার। ডিউটি থেকে একদিন কেন, এক ঘন্টার জন্যও ছুটি নেই। ছুটি নেওয়ার জন্য আমি পরদিন থেকে চেষ্টা করতে থাকি। ছুটি তিনদিন পরও নেওয়া যায় না। ওদিকে বাবাও একটি চিঠি পেয়েছেন। রুদ্রর বাবা শেখ ওয়ালিউল্লাহর চিঠি। কি লিখেছেন তিনি, কিছুই আমার জানা নেই। রুদ্রও এ সম্পর্কে আমাকে কিছু বলেনি। মার কাছে শুনি চিঠির কথা। মাকে হুংকার ছেড়ে ডেকে নিয়ে বাবা চিঠি দেখিয়েছেন, আমার পথভ্রষ্ট পুত্র শহিদুল্লাহ অবশেষে আপনার কন্যাকে বিবাহ করিয়া সঠিক পথে চলিবে বলিয়া অঙ্গীকার করিয়াছে। তাহাদের বিবাহকে মানিয়া লইয়া তাহাদিগকে সুখে শান্তিতে বসবাস করিবার সুযোগ দিয়া বাধিত করিবেন ইত্যাদি। বাবা তাঁর কালো মিশমিশে চুল খামচে ধরে অনেকক্ষণ বসেছিলেন। এর পর বিকেলে রোগী দেখা বাদ দিয়ে লম্বা হয়ে শুয়ে রইলেন বিছানায়। চোখ কড়িকাঠে। মা শিয়রের কাছে বসে বাবার মাথার চুলে আঙুল বুলিয়ে দেন। বাবা ক্ষীণ কণ্ঠে বলেন, চুলগুলা জোরে জোরে টাইনা দেও। জোরে চুল টেনে চুল ছিঁড়ে চলে আসে হাতে, তবু মাথার যন্ত্রণা বাবার মাথাতেই থাকে। ঘুমের ওষধু খেয়েও ঘুম আসে না।

কি কইরা বিয়া করল, কখন করল! কেন করল!

আমারে কি কয় কিছু এইসবের! যা ইচ্ছা তাই করে।

এত সাহস কি কইরা হইছে তার?

সাহস না। আসলে সরল সোজা পাইয়া মেয়েটারে পটাইছে। এমন সুন্দর ডাক্তার মেয়ের সামনে দাঁড়ানোর কি যোগ্যতা আছে ছেলের? নিজের সর্বনাশ করল নাসরিন। বাবা কড়িকাঠে চেয়েই অপলক চোখ রেখে বলে যান, তার বাপেই তারে কইল পথভ্রষ্ট ছেলে। একবার ভাবো, কতটুকু খারাপ ছেলে হইলে বাপে পথভ্রষ্ট ছেলে কয়। কামাল তো কইছে ছেলে নাকি সিগারেট খায় মদ খায়।

বাবার মাথা থেকে হাত সরিয়ে নিজের আগুন-জ্বলা বুকে হাত ঘঁষেন, চোখ ভিজে ওঠে, চোখের জল গাল বেয়ে বুকে নামে,বুকের আগুন তবু নেভে না, এই বুকের মধ্যে রাইখা মেয়েটারে পালছি। আপনে বেডিগর পেছনে পেছনে ঘুরছুইন। মেয়েটারে কোলে নিয়া চোক্ষের পানি ফালাইছি। এই বুকটার মধ্যে দিন রাইত পইড়া থাকত। মেয়ে বড় হইছে, ডাক্তার হইছে। কত বড় অনুষ্ঠান কইরা কত আয়োজন কইরা দেইখা শুইনা একটা ভাল ছেলের সাথে বিয়া হইব। সারা শহর জানব যে বিয়া হইতাছে। আর কি ভাবে সে বিয়া করল?কারে করল, কি জানে এই ছেলের সম্পর্কে সে?

মার চোখের জল ফুরোয় না। বাবার ঘুমও আসে না। আমি অন্য ঘরে ব্যাগে কাপড় গুছিয়ে নিই। ঢাকা যাব।

বাবাকে বা মাকে কিছু না বলে আমি কোথায় যাচ্ছি, কেন যাচ্ছি, কার কাছে যাচ্ছি কবে ফিরব আমি ঢাকা রওনা হই। মেডিসিন বিভাগে ডিউটির কি হবে তাও আর ভাবি না। মা পথ আটকেছিলেন,পাশ কেটে আমি বেরিয়ে যাই। ঢাকা পৌঁছি দুপুরে। বাসস্ট্যান্ড থেকে রিক্সা করে তাজমহল রোডের বাড়িটিতে গিয়ে দেখি দরজায় তালা, রুদ্র নেই ঘরে। কিন্তু জানি সে ঢাকায় আছে, অপেক্ষা করা ছাড়া আর কোনও পথ নেই। দ্বিতীয় দরজা যেটি ভেতর থেকে বন্ধ, আধঘন্টার পরিশ্রমে খানিক ফাঁক করে ফাঁকের ভেতর আড়াআড়ি বসানো খিলটি ওপরের দিকে তুলে দিতেই দরজা খুলে যায়। ভেতরে সব আছে, রুদ্র নেই। টেবিলে পড়ে আছে অপেক্ষার দিনলিপি,তুমি এখনো আসছো না কেন? আমি অপেক্ষা করছি। অপেক্ষা করছি। তুমিহীনতা ছড়িয়ে আছে সারা ঘরে। আমার ভাল লাগছে না। কখন এসে পৌঁছবে তুমি! সারাদিন ঘরে আর বারান্দায় হাঁটাহাঁটি করি, অপেক্ষার হাঁটাহাঁটি। প্রতিটি মুহর্ত আমার অপেক্ষায় কাটে। বিকেল পার হয়। রুদ্র আসে না। ঘরে বসেই অপেক্ষা করতে হবে, দরজা খোলা রেখে কোথাও তাকে খুঁজতেও যেতে পারি না। অপেক্ষা করতে করতে সন্ধে পেরিয়ে যায়। রাত হয়। রাত সাতটা আটটা নটা দশটা হয়ে যায়, রুদ্র ফেরে না। বাড়িঅলার বাড়ি থেকে আমার জন্য থালায় করে খাবার আসে। রাত বারোটাও যখন বেজে যায়, বাড়িঅলার বউকে বলি, আমার খুব ভয় লাগছে ঘরে, আপনাদের বাতাসিকে দেবেন আমার ঘরে শুতে? বউটি ভাল মানুষ। কাজের মেয়ে বাতাসিকে কাথাঁ বালিশ দিয়ে পাঠিয়ে দেন। আমি বিছানায়, বাতাসি মেঝেয় কাঁথা বিছিয়ে। রাত পার হয়। ঘুম থেকে বাতাসি জাগে, আমার জাগার কোনও দরকার হয় না। জেগেই ছিলাম, মুখে পানি ছিটিয়ে দিন শুরু করি আবার। অপেক্ষার দিন। অপেক্ষার অসহ্য প্রহর। অপেক্ষা আমার কোনও কালেই ভাল লাগে না, মন দিতে চেষ্টা করি কবিতায়, পারি না। অক্ষরে চোখ, মন দরজায়। সারা বিকেল দাঁড়িয়ে থাকি ঝুল বারান্দায়। সারা বিকেল তাজমহল রোডের দিকে আসা প্রতিটি রিক্সায় বসা লোক দেখি, দেখি রুদ্র কি না। রুদ্র যদি একবার জানত আমি এসেছি, ছুটে চলে আসত খুিশতে! কেন সে ভাবছে না যে আমি এসেছি, কেন সে একবারও ভাবতে পারছে না! রুদ্র কোথায় রাত কাটিয়েছে তা আমার সমস্ত কল্পনা দিয়েও আমি অনুমান করতে পারি না। সন্ধে নেমে আসে,রুদ্র ফিরবে এক্ষুনি এই আশায় বসে থাকি। ঘরে ইঁদুর দৌড়োয়, বাইরে লোক হাঁটে, যে কোনও শব্দকেই রুদ্রর বাড়ি ফেরার শব্দ ভেবে ভুল করতে থাকি। যে কোনও রিক্সার টুং টং শব্দকে রুদ্রর রিক্সা ভেবে ভুল করতে থাকি। দিন পার হয়। আবারও রাত আসে। রাত সাড়ে দশটায় বাতাসি কাঁথা বালিশ নিয়ে এঘরে শুয়ে পড়েছে। আমি জেগে থাকি। সাড়ে বারোটায় দরজার শব্দে লাফিয়ে উঠি আনন্দে। হৃদপিণ্ডে উত্তেজনার ঢোল বাজে। দরজা খুলে রুদ্র ঢোকে। বাতাসি কাথাঁ বালিশ নিয়ে নিঃশব্দে বেরিয়ে যায়। এ কে বেরোলো? এ কে? রুদ্র চেঁচাচ্ছে। এ বাতাসি। বাতাসি কেন? বাতাসি কি চায়? বাতাসি কিছু চায় না। ঘুমোতে এসেছিল। কেন ঘুমোতে এসেছিল? আমি ডেকেছিলাম। কেন? কে ডেকেছিলে? রাতে ভয় লাগে বলে। ভয়? কিসের ভয়? ভয় আবার কিসের? রুদ্র দরজা সশব্দে বন্ধ করে ঘুরে দাঁড়ায়। এবার আমাকে জড়িয়ে ধরে চুমু খাবে সে। কিন্তু আমাকে জড়িয়ে ধরছে না, চুমু খাচ্ছে না। আমি রুদ্রর দিকে এগোতে থাকি, তার নাগালের দিকে যেন সে আমাকে স্পর্শ করতে পারে, যেন আমাকে তার উষ্ণ আলিঙ্গনে বেঁধে হৃদয় শীতল করতে পারে। আমার ঠোঁটজোড়া এগোতে থাকে তার ঠোঁটের নাগালে, যেন দীর্ঘ দিন পর আমার ঠোঁটজোড়া তার ঠোঁটের ভেতর নিয়ে উষ্ণ উষ্ণ লালায় ভিজেয়ে −তঁতুলের মত চুষে রক্তহীন করে দিয়ে সুখ পেতে পারে। আমার মসণৃ কন্ঠদেশ এগোয়, যেন সে দাঁতে ঠোঁটে জিভে চেপে রক্ত জমাট করে আনন্দ পেতে পারে।যেন তার অপেক্ষার কষ্টগুলো শরীর থেকে মন থেকে একটু একটু পলেস্তারা খসার মত খসে যায়। এই আমি রুদ্র। তোমার অপেক্ষার দিন ফুরিয়েছে, আমাকে নাও।কিন্তু আমার মুখোমুখি যে লোকটি ,সে কি সত্যিই রুদ্র! বিশ্রি গন্ধ বেরোচ্ছে মখু থেকে। কড়া স্পিরিটের গন্ধ।যেন গ্যালন গ্যালন নেল পালিশের রিমোভারে স্নান সেরে এসেছে সে। টলছে সে। টলতে টলতে কিছু বলতে চাইছে। শব্দ জড়িয়ে যাচ্ছে মুখে। আমি থমকে দাঁড়িয়ে থাকি, হৃদপিণ্ডে উত্তেজনার ঢোল আচমকা বন্ধ হয়ে গেছে, একটি আতঙ্ক হিশহিশ করে এগোচ্ছে। সামনে নয়, পেছনে ফেলতে থাকি পা। পা দু পা করে পেছনে। গন্ধ থেকে পেছনে, রক্তচোখ থেকে পেছনে। আমাকে ধরতে রুদ্র হাত বাড়ায়। যেন হাডুডু খেলছে, খপ করে ধরে ফেলে জিতে যেতে চাইছে। দূরে সরতে থাকি আমি। রুদ্রকে মোটেও চেনা কোনও মানুষ মনে হয় না।মাতাল কোনও লোক আমি আমার জীবনে এর আগে কখনও দেখিনি। এই প্রথম। এই প্রথম কোনও মাতাল লোক দেখা, ভয়ে আমার সারা শরীর থরথর করে কাঁপে। আমাকে পেছনে হটতে দেখে জোরে হাসছে সে, হাসিটি বীভৎস। গভীর জঙ্গলে যেন আটকা পড়েছি কোনও হায়েনার হাতে। এমন করে রুদ্রকে আমি হাসতে দেখিনি কখনও। পেছোতে থাকি। হৃদপিণ্ডে ঢিপঢিপ ধিকধিক বাড়ছে। রুদ্রর শব্দ একটির ওপর আরেকটি ঢলে পড়েছে। জড়ানো শব্দে চেঁচাচ্ছে,কেন তোমার আসতে দেরি হল? দেরি হল বলে সে অদ্ভুত অচেনা চোখে তাকাচ্ছে, কর্কশ কণ্ঠে কদাকার চিৎকার। এগোচ্ছে আমার দিকে। আমি পালাবার কথা ভাবি। দৌড়ে গিয়ে বাড়িঅলার বাড়িতে আশ্রয় চাওয়ার কথা ভাবি। দেয়াল ঘেঁষে নিজেকে হাডুডুর খপ থেকে সনপ্তর্ ণে বাঁচিয়ে দরজার দিকে যেতে নিলেই রুদ্র আমাকে খামচি দিয়ে ধরে, চুল ধরে হেঁচকা টানে কাছে আনে। সেই উৎকট গন্ধের মধ্যে আমাকে ডুবিয়ে বলে, কেন দেরি করলে? কেন যেদিন চিঠি পেয়েছ সেদিনই আসনি? কণ্ঠ কাঁপে যখন বলি, ছুটি পাইনি। কেন পাওনি? আবারও চিৎকার। কদাকার। রুদ্রর হাত থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে পেছনে যেতে যেতে দেয়ালে আটকে থাকি। জানালার কিনারে রাখা থালবাসন তছনছ করে কিছু খোঁজে সে। তোশকের তল, চৌকির তল, খুঁজতে খুঁজতে পেয়ে যায় ছুরি, মহররমের মিছিলে যেমন আকাশের দিকে তুলে তলোয়ার নাচায় হায় হাসান হায় হোসেন করা ধর্মান্ধগুলো, তেমন করে রুদ্র তার হাতের ছুরিটি নাচায়। ছুরিটি দেখে আমার চোখ বুজে আসে। আমি কান্না আটকে রাখি। শ্বাস আটকে রাখি। সে কি আমাকে খুন করবে এখন! করবে। খুনের নেশায় উদ্বাহু নৃত্য করছে সে। এই তাজমহল রোডের বাড়িটিতে আজ রাতে আমাকে মরে যেতে হচ্ছে। আমার জীবনের এখানেই সমাপ্তি। কেউ জানবে না, আমার বাবা মা ভাই বোন কেউই কোনওদিন জানবে না এই বাড়িটিতে কি করে মরতে হয়েছে আমাকে। কেউ হয়ত জানবেও না যে আমি মৃত। খবরটি ওদের কে দেবে! রুদ্র আমাকে বস্তায় পুরে বুড়িগঙ্গায় ভাসিয়ে দেবে হয়ত! একবার কেন আমাকে রক্ষা করতে বাড়িঅলার বাড়ি থেকে কেউ আসছে না! রুদ্র আমার বুকে ছুরি তাক করে ধেয়ে আসতে থাকে দেয়ালে আটকে থাকা আমার দিকে। এই মুহূর্তে হাতের কাছের দরজাটি খুলে ঝুল বারান্দা থেকে নিচের রাস্তায় ঝাপঁ দেওয়া ছাড়া আমার আর পথ নেই যাওয়ার। আমার সামনে মৃত্যু, পেছনে মৃত্যু। একা অসহায় দাঁড়িয়ে থাকি। আমার কথা বলার, কাঁদার, এমনকি শ্বাস ফেলারও কোনও শক্তি নেই। রুদ্রর হাত থেকে এই ছুরি আমি শক্তি খাটিয়ে নিতে পারব না, অসুরের শক্তি এখন তার দেহে। তার এক হাতে ছুরি আরেক হাতে আমার হাত, হাতটি টেনে সে দ্বিতীয় ঘরটির দরজার মুখে এনে বিছানায় ধাক্কা দিয়ে ফেলল। আবারও একই প্রশ্ন, কেন দেরি হল আমার ঢাকায় আসতে। আমি ক্ষীণ কণ্ঠে উত্তর দিই, একই উত্তর দিই, ছুটি পাইনি। আবারও তার এক প্রশ্নই, কেন পাইনি। ফাঁক খুঁজি, তাকে বসিয়ে শান্ত করে শান্ত স্বরে কেন পাইনি ছুটি তার কারণটি বলতে, যেন খুনের ইচ্ছেজ্ঞট মাতাল-মাথা থেকে দূর হয়। মাতালের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার আমি কোনও নিয়ম জানিনা, অবধারিত মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচার কোনও পদ্ধতি শিখিনি। অসহায় চোখে তাকিয়ে থাকি ছুরিটির দিকে। শানানো ছুরিটির শরীর থেকে ছিটকে বেরোচ্ছে চিকচিক আলো। ছুরিটি আমার গলায় নাকি বুকে বসাবে রুদ্র। আমি চোখ বুজি, যেন আমাকে দেখতে না হয় প্রেমিকের হাতে খুন হওয়ার দৃশ্যটি। হঠাৎ ছুরি ফেলে সে পেচ্ছাবখানার দিকে দৌড়োয় রুদ্র। বুকের মধ্যে কোত্থেকে জানিনা প্রাণপাখি উড়ে আসে। চকিতে ছুরিটি নিয়ে দৌড়ে যাই বারান্দায়, রাস্তায় ফেলে দিতে। কিন্তু আমাকে থামায় একটি ভাবনা, যদি ছুরি ফেলে দিয়েছি বলে রেগে গিয়ে আমাকে গলা টিপে মেরে ফেলে! ছুরিটি আমি খাটের তলে একটি চালের কৌটোর ভেতর লুকিয়ে রাখি। ছুরি পেলে আমাকে খুন করবে না, এই শতর্ যদি দেয়, দেব। এই মুহুর্তে কোথায় পালাব আমি। বাড়িঅলার বাড়ি কড়া নাড়লে ও বাড়ির কেউ দরজা খোলার আগে রুদ্র আমাকে ধরে ফেলতে পারে। এই পালানোর শাস্তি তখন মৃত্যুই। তার চেয়ে ঘরে বসে বুঝিয়ে তাকে শান্ত করতে চেষ্টা করি, তার মাথা থেকে মদের বিষ নামাতে চেষ্টা করি। ছলে বলে কৌশলে প্রাণপাখিটিকে বুকের খাঁচায় আটকে রাখতে হবে আমার। মানুষের জীবন একটিই, এ জীবনটি শত চাইলেও আর ফেরত পাবো না। ঘরে এসে রুদ্র ছুরি খোঁজে। ছুরি কোথায়? আমার ছুরি কোথায়? চিৎকারে বাড়ির পলেস্তারা খসে। চিৎকারে বাড়িঅলার বাড়ির লোকেরা জানে। ওই চিৎকারে আমি হু হু করে কেঁদে বলি, ছুরি নেই। ছুরি চাইছো কেন? আমাকে মেরে ফেলতে চাও? কেন মারবে? কি করেছি আমি। ছুরি আমি ফেলে দিয়েছি! ভেতরে আর কান্না আটকে রাখা সম্ভব হয় না আমার। রুদ্র তার ক্রন্দসী প্রেয়সীর গলা টিপে ধরে। হাতদুটো শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে সরিয়ে দৌড়ে অন্য ঘরে গিয়ে দরজার ছিটকিনি আটকে দিই। অনেকক্ষণ দরজায় সে লাথি দেয়। খোল খোল বলে তারস্বরে নিঝুম নিথর রাতটির ঘুম ভাঙায়। জাগায়। রাতটিতে লণ্ডভণ্ড করে। একসময় আর কোন শব্দ নেই। দরজার ফুটো দিয়ে দেখি বিছানায় ওভাবেই শার্ট প্যান্ট জুতো পরে শুয়ে আছে রুদ্র। আর কোনও শব্দ নেই। নৈঃশব্দের সঙ্গে আমার চোখের জলের ফিসফিস করে কথা হয়। ভোর হওয়ার জন্য প্রকৃতির কাছে প্রাথর্ণা করতে থাকি। এই দুঃসহ কালো রাত পার যেন হয়। এত দেরি করে কোনও রাতকে আমি পার হতে দেখিনি এর আগে। ভোরবেলা ব্যাগটি নিয়ে আলগোছে দরজা খুলে বেরিয়ে যাওয়ার আগে রুদ্রর ওই অপেক্ষার দিনলিপির পাশে লিখে রাখি, রোদ, দুদিন থেকে অপেক্ষা করেছি তোমার জন্য। তুমি আসোনি। কাল রাতে একটি অচেনা লোক ঘরে এসেছে, লোকটিকে আমি চিনি না। আমি চলে যাচ্ছি। যেখানেই থাকো তুমি, ভাল থেকো। তোমার সকাল।

এত ভোরে রাস্তায় বেশি যানবাহন থাকে না। দএু কটি রিক্সা মন্থর গতিতে চলছে। একটি মন্থরকে নিয়ে বাসস্ট্যান্ডে পৌঁছোই। ভোরবেলার প্রথম বাসটি ঘুম ঘুম চোখে দাঁড়িয়ে আছে। বাসের দরজায় পা রাখতেই কনডাকটর জিজ্ঞেস করে সঙ্গে পুরুষলোক নাই?

না।

এই লেডিস একটা।লেডিস একটা। কনডাকটর চেঁচিয়ে বলে। কাকে বলে কে জানে। লেডিস একটা মানে সতর্কে করে দেওয়া সবাইকে যে আমাকে নিরাপদ একটি জায়গায় বসতে হবে। লেডিসের নিরাপত্তা হল লেডিস সিটে, ড্রাইভারের পাশের জায়গাগুলোকে বলা হয় লেডিস সিট। মেয়েরা একা বাসে উঠলে ওখানেই, ওই জায়গায় বসারই নিয়ম। বাসে, লেডিসের সঙ্গে লেডিসকে না বসালে লেডিসের জন্য যাত্রা নিরাপদ হয়না বলে ভাবা হয়। লেডিস সিট ভরে যাওয়ার পর যদি বাড়তি লেডিস উদয় হয় তখন তাকে অলেডিস সিটে বসিয়ে দ্বিতীয় লেডিসের অপেক্ষা করতে থাকে কনডাকটর যেন প্রথম লেডিসের পাশে দ্বিতীয়টিকে বসিয়ে দিতে পারে। সেদিন লেডিস সিটে জায়গা নেই, অপেক্ষা করেও কোনও দ্বিতীয় লেডিসএর টিকিটি দেখা যাচ্ছে না। তাহলে কি করা? মাঝবয়সী স্বামী স্ত্রী বসে আছে পাশাপাশি, কনডাকটর স্বামীটিকে বলল, ভাইজান আপনে অন্য সিটে বসেন, আপনের লেডিসের সাথে এই লেডিসরে বসাইয়া দেই। আমি বললাম, না থাক, ওদেরে উঠাইয়েন না। সমস্যা সমাধানের আরও উপায় বাসের কনডাকদের জানা আছে। লেডিসের পাশে বসার জন্য কোনও লেডিস অগত্যা পাওয়া না গেলে বাসে যে পুরুষটি সবচেয়ে বুড়ো বা যে ছেলেটি একেবারে বাচ্চা, দাড়িমোচ ওঠেনি, তার সঙ্গে বসিয়ে দেওয়া। কোনওভাবেই কোনও যুবকের পাশে নয়।

লেডিস সিট খালি নাই। ছোট কনডাকটর বড়টিকে বলে। বড়টি এরপর খুঁজে পেতে এক বুড়োকে আবিস্কার করে জিজ্ঞেস করে, চাচা আপনে একলা?

হ।

যান ওই চাচার সাথে বসেন গিয়া। আমাকে নির্দেশ।

আমি মেয়ে বলে আমার সিট পছন্দ করে দেওয়ার দায়িত্ব তাদের। কোনও এক বুড়ো চাচার পাশে বসিয়ে কনডাকটর ভেবেছে আমার নিরাপত্তার ব্যবস্থা করেছে সে। কোনও পুরুষ বাসে উঠলে সে তার পছন্দ মত জায়গা বেছে নিয়ে বসে। কিন্তু একা কোনও মেয়ে এলে তাকে অপেক্ষা করতে হবে যতক্ষণ না কনডাকটর তার বসার আয়োজন করে। আমাকে নিরাপদ সিটে বসার ব্যবস্থা করে ছোট এবং বড় দু কনডাকটরই স্বস্তি পায়। বাসের জানালায় মাথা রেখে আমি ভাবি, পরপুরুষের পাশে বসা নিরাপদ নয় বলে বাসে এই নিয়ম চালু করা হয়েছে, মেয়েদের জন্য সবচেয়ে নিরাপদ,লোকে জানে যে আপন পুরুষ। সবচেয়ে নিরাপদ স্থানটি আপন পুরুষের ঘর! স্বামীর ঘর। কনডাকটরটি যদি জানত, আমার জন্য ওটিই কত অনিরাপদ!

অবকাশে ফিরে নিরাপদ বোধ করি। অবকাশের চারদিকে উঁচু দেয়াল, দেয়ালের ওপর ভাঙা কাচ বসানো। তার ওপর আরও উঁচু করে দেওয়া কাঁটাতারের বেড়া। বাইরের জগত থেকে আলাদা করা এই বাড়িটিকে একসময় কারাগার বলে মনে হত আমার। এখন মনে হয় এখানেই থোকা থোকা শান্তি লুকিয়ে আছে। মা আমার দিকে তীক্ষ ্ন একটি দৃষ্টি ছুঁড়ে দেন যদিও, বুঝি ওই দৃষ্টির আড়ালে ওত পেতে আছে স্নেহ। যত দুর্ঘটনাই আমি ঘটাই না কেন, ওই স্নেহ আমার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়বেই। নার্গিসকে দিয়ে মা ভাত পাঠান আমার ঘরে। ভাতের সঙ্গে আমার প্রিয় বেগুন ভাজা, খাসির মাংস। খুব যতে ্ন বেড়ে দেওয়া। মা কি করে জানেন, এই সকালে আমার পেটে ভাতের ক্ষিধে! মা মানেই কি এই, মা সব বুঝে নেবেন, কোনও কিছু বলার দরকার হবে না! ইয়াসমিন ওর নতুন তোলা একটি গান গাইছে বিছানায় বসে। সুহৃদ একটি প্রজাপতির গা রং করছে জল রংএ, আর বলছে, প্রজাপতি প্রজাপতি কোথায় পেলে তুমি এমন রঙিন পাখা! সুমন ইয়াসমিনের গান শুনতে শুনতে বলছে, ইয়াসমিন আপা তুমি এত সুন্দর গান গাইতে পারো তা আগে জানতাম না। সুমন হাশেমমামার ছেলে, একটিই ছেলে হাশেমমামার, বাকি সব মেয়ে। গতকাল এ বাড়িতে হাশেমমামা সুমনকে রেখে গেছেন। আকুয়া রেললাইনের ওপর কিছুদিন আগে একটি চৌদ্দ পনেরো বছর বয়সের ছেলেকে সমবয়সী কিছু ছেলে খুন করেছে। খুন করতে কোনও পিস্তল বা বন্দুকের প্রয়োজন হয়নি, একটি ছুরিই যথেষ্ট ছিল। খুনের আসামিদের তালিকায় সুমনের নামটিও আছে। হাশেমমামা মুক্তিযুদ্ধ থেকে ফিরে এসে আওয়ামি লিগের আকুয়া ইয়নিয়ন শাখার সভাপতি হয়েছেন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর মুক্তিযোদ্ধারা নাম ভাঙিয়ে অনেক সুবিধে লুটেছে। টাকা করেছে অনেকে অনেক রকম উপায়ে। অনেকে মন্ত্রী হয়েছে, বিদেশে রাষ্ট্রদূত হওয়ার চাকরি পেয়েছে। হাশেমমামার কিছুই হয়নি। তিনি এসবের পেছনে দৌড়োননি। জীবিকার জন্য কায়ক্লেশে নতুন বাজারে ভাত মাছ বিক্রি করার ছোট্ট একটি দোকান কিনেছেন। এই করে ঘরের পারুল বউ আর পাঁচটি মেয়ে একটি ছেলেকে নিয়ে তিনি গাদাগাদি করে থাকছেন সেই খুপড়ি একটি ঘরে। যে ঘরে বিয়ের পর থেকেই থাকছেন। এতগুলো ছেলেমেয়ে হল, ছেলেমেয়ে বড়ও হয়েছে, কিন্তু তিনি আজও সেই ঘরে। টাকা পয়সা বাড়ি গাড়ি সম্পত্তির কোনও মোহ নেই। নিজের লেখাপড়া হয়নি হাশেমমামার, ছেলেমেয়েকে লেখাপড়া করাচ্ছেন। মেয়েগুলো পরীক্ষায় ভাল ফল করে, কেবল ছেলে নিয়েই ঝামেলা। পাড়ায় ছেলের বন্ধুবান্ধব বেশি, লেখাপড়ায় মন নেই। বন্ধু হলে শত্রু হয়। কোনও এক শত্রু সুমনের নামটি আসামির তালিকায় ঢুকিয়ে দিয়েছে। হাশেমমামা ছেলেকে বংশের বাতি বলে মনে করেন না। ননীটা ছানাটা খাইয়েও একে মানুষ করতে হবে বলে তিনি বিশ্বাস করেন না। পনোরো ষোল হলেই মেয়েদের এক এক করে বিয়ে দিয়ে দেওয়ার কথা কখনও ভাবেন না। মেয়ের চেয়ে ছেলেকে গুরুত্ব দেওয়ার পক্ষপাতি নন তিনি। এই সমাজে বাস করে হাশেমমামা সমাজের আর দশটা লোকের মত নন। এই অন্যরকম হাশেমমামার প্রতি আমার বিষম আগ্রহ। খুব ইচ্ছে করে তাঁকে জিজ্ঞেস করি, মুক্তিযুদ্ধে তাঁর অভিজ্ঞতার কথা। কি করে ভারত চলে গিয়েছিলেন, কি করে ওখানে প্রশিক্ষণ নিয়েছেন যুদ্ধের, কি করে মুক্তিযুদ্ধের গ্রুপ-কমান্ডার হয়ে তিনি জঙ্গল পার হয়ে নদী সাঁতার কেটে দেশের এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় জীবনের ঝুঁকি নিয়ে গিয়েছেন! কি করে তিনি পাক সেনাদের দিকে গুলি ছুঁড়েছেন, কটাকে কুপোকাৎ করেছেন কোনওদিন জিজ্ঞেস করা হয় নি। সুমনকে বিপদ থেকে রক্ষা করতে হাশেমমামা হন্যে হয়ে ঘুরছেন। এক আশ্চর্য সততা সম্বল করে হাশেমমামা বাঁচেন। তিনি মিথ্যে মামলা থেকে ছেলেকে রক্ষা করতে পারেন না। কারাগারের মত এই বাড়িটি আপাতত তাঁর ছেলেকে বাঁচাবে বলে পুলিশের হাত থেকে না হলেও পাড়ার শত্রুদের হাত থেকে, হাশেমমামা বাবাকে অনুরোধ করেছেন সুমনকে এ বাড়িতে কদিন রাখার। বাবা রাজি হয়েছেন। কিন্তু ঢাকা থেকে ফিরে আসার পর সুমন আর ইয়াসমিনকে নিয়ে গান কবিতায় হাসি ঠাট্টায় গল্পেগাছায় খেলায় ধুলায় মেতে থেকে প্রমোদে মন ঢেলে দিয়ে ঠিক দুদিন পর এই আমি রাজি হইনা সুমন অবকাশে আর একটি মুহূতর্ থাকুক। কারণটি হল একটি অসহায় মেয়ের থরথর কাপঁুনি দেখেছি আমি মধ্যরাতে। নার্গিসের দৌড়ে আসার শব্দ শুনে ঘুম ভেঙে গিয়েছে আমার। ওর ভয়াতর্ শ্বাসের শব্দে আমি চোখ খুলেছি। আমার দরজায় দাঁড়ানো কাঁথা বালিশ হাতে, কাপঁ ছে ও। শরীর কাপঁ ছে। চোখ বিস্ফারিত।

কি হইছে তর?

আমি ঘুমাইতাছিলাম। সুমন ভাইয়া আমারে জাইত্যা ধরছে।

আমি তড়িতে বিছানা থেকে নেমে নার্গিসকে দুহাতে জড়িয়ে ধরে ওর গায়ের কাপঁুনি থামাই। ঘরের ভেতর ওকে ঢুকিয়ে ভেতর থেকে দরজা বন্ধ করে দিই। নার্গিস সে রাতে আমার ঘরের মেঝেয় কাথাঁয় গা মুড়ে কুকুরকুণ্ডলি হয়ে বলে, আমি জিগাইছি, আপনে এইখানে আইছেন কেল্লিগা? কইতেই আমার মখু চাইপা ধরছে। আমারে কয়, তুই রাও করিস না। কেউ জানব না। কেউ বুঝব না। আমি চিল্লাইয়া আপনেদেরে ডাকতে চাইছিলাম। অনেক কষ্টে নিজেরে ছুটাইয়া আইছি আপা।



কত হবে বয়স নার্গিসের? তেরো। বাবা গরিব বলে মেয়েকে অন্যের বাড়ি কাজ করতে দিয়েছে। ভোরবেলা থেকে মধ্যরাত অবদি কাজ করে ঘুমোতে যায়। এই সময়টুকুই নিজের ওর। এই ঘুমোনোর সময়টুকু। অথবা তাও হয়ত নয়, ঘুমোতে ওকে দেওয়া হয় পরদিন তাজা শরীরে বাড়ির সমস্ত কাজ যেন সারতে পারে। নার্গিসের তো ইশকুলে যাওয়ার কথা এ বয়সে। অথচ ও এখনও স্বরে অ স্বরে আ পড়তে জানে না। সুহৃদ যখন বই খুলে স্বরে অ স্বরে আ পড়ে, নার্গিস অভিভূত চোখে তাকিয়ে থাকে। ওরও নিশ্চয়ই ইচ্ছে করে এমন করে বই খুলে পড়তে। নার্গিসের বাবা অবকাশে মাঝে মাঝে নার্গিসকে দেখতে আসেন। মা তখন নার্গিসকে তড়িঘড়ি ময়লা জামা পাল্টো ধোয়া জামা পরে, হাতে পায়ে তেল মেখে রুক্ষতা আড়াল করে চুল আঁচড়ে ওর বাবার সামনে যেতে বলেন। ওর বাবা যেন দেখে মনে করেন মেয়ে তাঁর সুখে আছে এখানে। ভাতে মাছে গোসলে কাপড়ে তেলে খেলে। দুপুর হলে নার্গিসের বাবাকে বারান্দার ঘরে বসিয়ে ভাতও খাইয়ে দেন মা। খাওয়ার সময় মা দরজার পর্দা ধরে দাঁড়িয়ে বলেন, আপনের মেয়ে খুব ভাল আছে এইখানে, কোনও চিন্তা কইরেন না।

খেয়ে দেয়ে নার্গিসের বাবা মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে বলেন, সবার কথা শুইনা থাইকো মা, তোমারে সবাই কত আদর করে এই বাড়িতে! সবাইরে মাইনা চলবা। নার্গিস দরজা ধরে দাঁড়িয়ে ওর বাবার চলে যাওয়া দেখে, চোখে বানের পানি। কি রে নার্গিস কানতাছস কেন? যদি কখনও বলি, নার্গিস দ্রুত পানি মুছে হেসে ফেলে।

না আপা, কান্দি না। ঝুল পরিষ্কার করতাছিলাম, চোখে ময়লা পড়ছে।

নার্গিসের এরকমই উত্তর, না আপা কান্দি না,পিঁয়াজ কাটতাছিলাম, চোখে ঝাঁজ লাগছে।



সকালে আমি মাকে বলি ঘটনা। মা চপু হয়ে যান শুনে। হাশেমমামাকে মা খুব পছন্দ করেন। প্রায়ই বলেন, এই একটা ভাই আমার, বড় ভাল। কাউরে ঠগায় না। কারও ক্ষতি করে না। কাউরে খারাপ কথা কয় না। মানুষের উপকার করে যেইভাবে পারে। মানুষের কত শত্রু থাকে। হাশেমের কোনও শত্রু নাই।



এ বাড়িতে ভাল ভাইটির ছেলেটিকে আপাতত রেখে ভাল ভাইটিকে সামান্য হলেও দুশ্চিন্তামুক্ত করছেন বলে মার আনন্দ হচ্ছিল। মার আত্মীয়স্বজনকে বাবা কখনও সাদর আমন্ত্রণ জানান না অবকাশে। সুমনকে অবকাশে কদিন থাকতে দিতে রাজি হয়েছেন বাবা, সুমনের জন্য বাবার এমন উদার হৃদয়, হাশেমমামার ব্যক্তিত্বের কারণেই। মার কষ্টের নদীতে সুমনকে আশ্রয় দেওয়ার যে আনন্দ-ডিঙ্গিটি ছিল, তা ডুবিয়ে দিই। সুমনকে জিজ্ঞেস করেন মা, রাতে সে নার্গিসের বিছানায় গিয়েছিল কি না। আকাশ থেকে পড়ে সুমন। গলা ফাটায়, ছেড়ি মিছা কথা কয়।

মা শান্ত গলায় বললেন, না ছেড়ি মিছা কথা কয় নাই।

মা সেদিনই হাশেমমামাকে ডেকে সুমনকে অবকাশ থেকে নিয়ে যাওয়ার জন্য অনুরোধ নয়, আদেশ করেন।



হাশেমমামা সুমনকে অবকাশ থেকে ছেড়ারে জেলে ভইরা থওয়াই ভাল বড়বু বলে নিয়ে যাওয়ার পরদিন হাসপাতালে পেছনে কৃষ্টপুরে নার্গিসদের বাড়িতে গিয়ে নার্গিসের মায়ের হাতে পাঁচশ টাকা দিয়ে বলে আসি, বিলকিসকে যেন ইশকুলে ভর্তি করায়, কারও বাড়িতে যেন বান্দিগিরি করতে না দেয়। ছোট্ট সুন্দর গোল মুখের নাকছাবি পরা বিলকিস উঠোনের ধুলোয় বসে মিছেমিছির রান্নাবাড়ি খেলছিল, ছ বছরের এই বাচ্চাজ্ঞটকে কৃষ্টপুরের এক ব্যবসায়ীর বাড়িতেই নার্গিসের মা পেটে ভাতে কাজে দেবেন বলে ঠিক করেছিল।
 
২৩. ডাক্তারি


এক বছরের ইন্টার্নশিপের জন্য ডিউটি ভাগ করা হয়ে গেছে। যে কোনও একটি বিষয়ে ফিক্সড ডিউটি করতে হয়। যে বিষয়টিকে আমি প্রধান বলে মনে করি, সেই বিষয়ে। বেশির ভাগ মেয়েরা স্ত্রীরোগ ও প্রসূতি বিভাগে ফিক্সড ডিউটিটি নিয়েছে। মেডিসিন সার্জারি এক মাস করে হলেও স্ত্রীরোগে চার মাস। যৌনাঙ্গ ঘাঁটাঘাঁটি করা আমার বিশেষ পছন্দের ছিল না ছাত্রী থাকাকালীন, কিন্তু এই বিষয়টিকেই আমি প্রধান বিষয়ে হিসেবে নির্বাচন করে ফিক্সড ডিউটি নিই এই বিভাগে। চারমাসে চার মিনিট ফাঁকির কোনও সুযোগ নেই। ফাঁকি দেওয়া মানে নিজেকে ফাঁকি দেওয়া। ডাক্তারি প্রশিক্ষণে অংশ নিতে প্রতি বছর বিদেশের মেডিকেল কলেজ থেকে পাশ করা ডাক্তার আসে। এ দেশে চাকরি করতে গেলে এ দেশে ডাক্তারি প্রশিক্ষণ নিতে হয়, নিয়ম এমন। প্রথম দিনই পরিচয় হয় মস্কো থেকে পাশ করে আসা দিবালোক সিংহের সঙ্গে। দিবালোক কমরেড মণি সিংহের ছেলে। সুসং দুর্গাপুরের মণি সিংহ। হাজং বিদ্রোহের মণি সিংহ। দুঃস্থ দরিদ্র মানুষের জন্য পুরো জীবন উৎসর্গ করা মণি সিংহ। সাধারণত বিদেশ থেকে পাশ করে আসা ডাক্তারদের আহামরি কিছু ভাবা হয় না। ভাবা হয় না কারণ তাদের মাথায় বিদ্যে থাকলেও হাতে দক্ষতা কম। বিদেশে এদেশের মত বেওয়ারিশ লাশও পাওয়া যায় না ইচ্ছেমত কেঁটে ছিঁড়ে বিদ্যেটি শেখার। এমন দরিদ্র রোগীর ভিড়ও নেই অন্য দেশে যে নির্ভাবনায় যখন তখন রোগির শরীরে গুঁতোগুঁতি করা যাবে, কোনও রোগী টুঁ শব্দ করবে না। আর অপারেশন থিয়েটারে সার্জনদের সহযোগিতা করার যে সুযোগ চতথুর্ বর্ষ থেকে আমাদের মেলে সেই সুযোগ তারা বিদেশের হাসপাতালে পায় না। খোদ বিলেত থেকে ডাক্তারি পাশ করে আসা এক মেয়েকে অধ্যাপক জোবায়েদ হোসেন যখন জিজ্ঞেস করলেন, কি মেয়ে, সিজারিয়ানে এসিস্ট করতে পারবা? মেয়ে মাথা নাড়ে, পারবে না। কোনওদিন করেনি। হেসে, জোবায়েদ হোসেন দেশি কাউকে ডাকেন। বিদেশিগুলোর পড়া বিদ্যে, দেখা বিদ্যে, করা বিদ্যে নেই। দিবালোক সিংহের পড়া বিদ্যে দেখা বিদ্যে থাকলেও আমি তাকে খাতির করি। প্রসব কক্ষে রোগির কাটা যৌনাঙ্গ কি করে পরতে পরতে সেলাই করতে হবে হাতে ধরে শিখিয়ে দিই তাকে। ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজটিতে ভাল লেখাপড়া হয়, এ কলেজ থেকেই প্রতিবছর ছাত্রছাত্রীরা দেশের অন্য যে কোনও কলেজের ছাত্রছাত্রীর চেয়ে পরীক্ষায় ভাল ফল করে। আমাদের আগের বছরে রাজিব আহমেদ হয়েছিলেন প্রথম। আমাদের বছরে এম-ষোল ব্যাচের প্রতিটি প্রফেশনাল পরীক্ষায় প্রথম হয়েছে মনসুর খলিল। এ কলেজটি ভাল হলেও এবং ঢাকা মেডিকেল কলেজে বেশির ভাগ সময় ছাত্র আন্দোলনের কারণে ছাত্রছাত্রীদের লেখাপড়া কম হলেও ঢাকা মেডিকেল কলেজ বিলেতি পরিদর্শকদের অনুমোদন পেয়েছে, এ কলেজ পায়নি। পরিদর্শকবৃন্দ আসার আগে এই কলেজ হাসপাতাল দুটোই ধুয়ে মুছে তকতক করা হয়েছিল, ডাক্তার ছাত্রছাত্রী সবাই ধোয়া কাপড় পরে পরিপাটি হয়ে নিয়ম শৃঙ্খলা মেনে চলেছিল সেদিন, তারপরও মহামূল্যবান অনুমোদন জোটেনি, কারণ পরিদর্শকবৃন্দ একটি নেড়ি কুকুরকে বসে থাকতে দেখেছেন হাসপাতালের বারান্দায়। অনুমোদন পাওয়া মানে এ কলেজ থেকে পাশ করে বিলেতের কলেজে বাড়তি লেখাপড়া করার অনুমতি পাওয়া। অনুমোদন পাওয়া হয়নি বলে আমরা খুব একটা মুষড়ে পড়িনি। মনসুর খলিল তো নয়ই। যে ছেলে বাড়ি আর কলেজ ছাড়া আর কোথাও নড়তে চায় না, তার জন্য বিলেত কোনও স্বপ্ন নয়। মনসুর খলিল দেখতে আস্ত একটি পাহাড়। ওজন দুশ কিলোর মত। খায় আর লেখাপড়া করে। শরীরটির লজ্জায় সে বাইরে কোথাও বেরোয় না, কোনও মেয়ের সঙ্গে কথা বলে না। মাঝে মাঝে আমি যেচে কথা বলি মনসুরের সঙ্গে। অবশ্য বেশির ভাগই মজা করতে। করি সাফিনাজ সঙ্গে থাকলে। আমাদের দেখতে ভাল লাগে কথা বলতে গিয়ে মনসুর খলিলের ফর্সা মুখ টি যখন পাকা আমের মত লাল হয়ে ওঠে। হাসপাতাল এলাকাটিতে আমি সবচেয়ে বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করি নিজের পরিচয় নিয়ে। এখানে আমার মধ্যে আর একটি ডাক্তার-ছেলের মধ্যে কোনও পার্থক্য নেই। আমি যদি মেধায় দক্ষতায় ছেলেটির চেয়ে ভাল হই, এখানে আমি মর্যাদা পাবো ছেলের চেয়ে বেশি। এখানে আমরা নারী পুরুষের যৌনাঙ্গ নিয়ে খোলাখুলি আলোচনা করে অভ্যস্ত, ঘেঁটে অভ্যস্ত যে শব্দ মুখে উচ্চারণ করা এই এলাকার বাইরে মানা সে সব শব্দ উচ্চারণ করতে এই এলাকায় লজ্জা বা দ্বিধার লেশমাত্র কারও জিভে থাকে না। ইন্টানির্ হয়েই হাসপাতালের ডক্টরস ক্যান্টিনে আমি যেতে শুরু করেছি। ডিউটির ফাঁকে ক্ষিধে লাগলে চা সিঙ্গারা খাই। সময় থাকলে আড্ডা আর টেবিল টেনিস দুটোই চলে। এখানে পুরুষ ডাক্তারের গায়ে যদি আমার গা লাগে বা হাতে হাত লাগে তবে আমি নষ্ট হয়ে গেছি বলে মনে করা হয় না। আমার বাইসেপ ব্র্যাকিতে ওর ট্রাইসেপ ব্র্যাকির টাচ লেগেছে বলেই বলা হয়। এখানে সবচেয়ে বড় পরিচয় আমি একজন ডাক্তার। মাঝে মাঝে ওয়ার্ডের রোগীরা ভুল করে সিস্টার ডাকলে অবশ্য শুধরে দিতে হয়, যে আমি নাসর্ নই। আর্কিটেকচারে পড়তে না পারার জন্য যে আফসোসটি ছিল আমার, সেটি ডক্টরস ক্যান্টিনের চায়ের ধোঁয়ার সঙ্গে উড়ে যায়। ডাক্তার হয়ে আমি ভুল করিনি, এ বিশ্বাসটি শক্ত হয়ে মনের মাটিতে গেড়ে বসে, যদিও ডাক্তারি পড়তে গিয়ে আমার সাহিত্য চর্চা গোল্লায় গেছে, শখের যে কবিতা, সেও আর লেখা হয় না। কবিতা লিখে নিজের একার আনন্দ হয়, কিন্তু চিকিৎসা করে হাজার মানুষকে আনন্দ দিতে পারি। হাসপাতালে সব ধরনের রোগী আসে, উচ্চজ্ঞবত্তরা কেবিন ভাড়া করে, মধ্যবিত্তরা সামর্থ হলে করে, দরিদ্র থাকে ওয়াডের্। হাসপাতালে ওষুধের অভাব, সব ওষুধ সরকার দেয় না। সেই ওষুধগুলো রোগীদের কিনে আনতে হয় বাইরে থেকে। কিন্তু দরিদ্র রোগীর পক্ষে বাইরে থেকে ওষধু কেনা সম্ভব নয়। উচ্চজ্ঞবত্ত বা মধ্যবিত্ত রোগিকে যখন কেনার জন্য ওষুধের নাম লিখে দিই কাগজে, একটির দরকার হলে লিখি পাঁচটি। পাঁচটির দরকার হলে লিখি দশটি। লিখি, কারণ উচ্চজ্ঞবত্তর জন্য ব্যবহারের পর বাকি যা থাকবে তা দেব দরিদ্র রোগিকে। কোনও রোগিকে জানানো হয় না যে আমরা ডাক্তাররা গোপনে গোপনে এই কাজটি করি, দরিদ্র বাঁচাই। দরিদ্রদের জন্য সন্ধানীতেও দৌড়োই। দরিদ্ররা রক্তের ব্যাংক থেকে টাকা দিয়ে রক্ত কিনতে পারে না, দরিদ্রদের রক্ত লাগলে সন্ধানী থেকে এনে নিই। কলেজের ছাত্র ছাত্রীরা সন্ধানী নামের এই সংস্থাটি দরিদ্রদের সাহায্য করতেই খুলেছে। একদিন সন্ধানী আপিসে গিয়ে আমি চোখ দান করে আসি। মৃত্যুর পর চোখদুটো যেন কাজে লাগে কোনও অন্ধের। ওদের বলি, আমি দেহদান করব। মৃত্যুর পর আমার দেহ যেন মেডিকেল কলেজের শব ব্যবচ্ছেদ কক্ষে পাঠানো হয়। সন্ধানীতে দেহদানের কোনও কাগজপত্র নেই যে দান করতে পারি। সম্ভবত বেওয়ারিশ লাশের আধিক্য বলে এই প্রয়োজনটির কথা সদস্যরা উপলব্ধি করে না। আমার এপ্রোনের পকেটে ঝুনঝুন করে প্রচুর অ্যাম্পুল। ধনীর টাকায় কেনা ওষুধ পকেটে জমছে। ওষধু কোম্পানির প্রতিনিধিদের দিয়ে যাওয়া ওষধু জমছে। একদিকে জমছে, আরেকদিকে যাচ্ছে, দরিদ্র রোগীর হাতে যাচ্ছে। সব ডাক্তারের পকেটেই দরিদ্রকে সাহায্য করার জন্য কিছু না কিছু ওষধু থাকে। কেউ কেউ ওষুধ না থাকলে নিজের পকেট থেকে টাকা দেয় ওষধু কিনে আনতে। এমন উদারতা আর সততার মধ্যে আমার ডাক্তারি চর্চা চলে। কেউ কেউ আবার ওষুধের ভেতর ডুবে থেকে মাঝে মাঝে উদ্ভট সব কাণ্ড করে ফেলে। আমারই ক্লাসের ছেলে রিজওয়ান দেখতে বুদ্ধিতে তুখোড়, রোগির জন্য সরকারি ওষুধের ভাণ্ডার থেকে পেথিডিন নিয়ে নিজে মজা করতে গিয়ে একদিন নিজের শরীরেই পেথিডিন ঢুকিয়ে মজা পেয়ে বার বারই পেথিডিন ঢোকাচ্ছে এখন। এ তো আটকে যাওয়া জালে। নেশার জালে। অনেক ডাক্তার আবার নিজেরাই নানা উদ্ভট কাজে নিজেদের আটকাতে চেষ্টা করে। সার্জারি ওয়াডের্ ডিউটি আমার তখন। মস্তিষ্কের অপারেশন করছেন অধ্যাপক। মাথার খুলি খোলা। খুলি খুলে রেখেই অধ্যাপক হাত ধুয়ে ফেললেন। কেন? নামাজ পরবেন তিনি। কোনও নামাজই তিনি বাদ দেন না। অপারেশন চলাকালীন সময়ে আযান পড়লে রোগিকে পনেরো মিনিট বেশি অজ্ঞান রেখে নামাজ সারেন। ডাক্তার হয়ে কি করে ধমের্ বিশ্বাস করেন, আমি বুঝে পাই না। মস্তিষ্কের মত জটিল জিনিস যে অধ্যাপকের মাথায় এত পরিষ্কার ঢোকে, তাঁর কেন এ জিনিসটি মাথায় ঢোকে না যে ধর্ম একটি যুক্তিহীন ব্যাপার। কি করে তিনি বিশ্বাস করতে পারেন আল্লাহ নামের একজন বসে আছেন সাত আসমানের ওপর, তিনি এই পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন, তিনি নিজের হাতে গড়া এই পৃথিবী ধং্ব স করে ফেলবেন একদিন, তারপর শেষ বিচারের দিন সব মানুষকে আবার জীবিত করবেন, সকলেই কুড়ি বছরের বয়সের মত দেখতে হবে, হাশরের মাঠে জিন এবং মানুষের বিচার হবে, তারপর অনন্ত কালের জন্য মানুষেরা বাস করবে বেহেসত অথবা দোযখে, যারা আল্লাহকে মানেনি তারা দোযখে যাবে, যারা মেনেছে তারা বেহেসতে,এরকম উদ্ভট রূপকথা!আসলে রূপকথাগুলোকেও আমার এত অবাস্তব ঠেকে না, যত ঠেকে ধমর্গু লোকে। ব্যাঙ থেকে রাজকুমার বেরোতে পারে, মুরগির ঠ্যাংয়ের ওপর ডাইনির বাড়ি থাকতে পারে, কিন্তু এই জীবনের পরে আরও কোনও জীবন থাকতে পারে না। কিছু কিছু ডাক্তার ওই জটিল অ−স্ত্রাপচার করতে করতে বিশ-্ব ইস্তেমায় যাওয়ার কথাও বলেন। টঙ্গীতে ইস্তেমা হচ্ছে, মুসল্লিরা যাবে, ওয়াজ মাহফিল শুনবে, বিশাল জমায়েতে নামাজ পড়বে। তিন দিনের ছুটি নিয়ে টুপি পরা ডাক্তাররা যায় ইস্তেমায়। টুপিঅলা ডাক্তারের সংখ্যা অবশ্য হাতে গোনা। কিন্তু তাই বা হবে কেন! কেনই বা একজন ডাক্তার মাথায় টুপি পরবে! আর কেউ ধর্ম বিশ্বাস করলে আমি বলি যে শিক্ষা নেই দীক্ষা নেই, বিজ্ঞান সম্পর্কে কিছুই জানে না, তাই ধর্ম বিশ্বাস করে। কিন্তু ডাক্তারদের বেলায় আমি কোনও কারণ দেখি না এসব বিশ্বাসের। ইস্তেমা যাষনী বাবুলকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, তুমি কি কারণে আল্লাহ বিশ্বাস কর?

কি কারণে করব না?

খুব সাধারণ যুক্তির কারণে। চিকিৎসা বিজ্ঞানে তো মাথা ঢের খাটিয়েছো। ধর্মের ব্যাপারে খাটাও না! দুনিয়ার সব কিছু তো যুক্তি দিয়ে বঝু তে চেষ্টা করো, কোরান হাদিসের কথাগুলো কি একবার যুক্তি দিয়ে বোঝার চেষ্টা করেছো?

বাবুল নিজেই বলে সে তা করেনি। সে করতে চায় না। কারণ সে মনে করে যুক্তি এক জিনিস, বিশ্বাস আরেক। দুটোকে সে মেলাতে চায় না। বাবুল, আমার বিশ্বাস, জানে যে ধর্ম সম্পণূর্ যুক্তিহীন একটি ব্যাপার। সে ভাল জানে যে এই বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ড ছদিনে সৃষ্টি হয়নি। জানে যে সূর্য পৃথিবীর চারদিকে ঘুরছে না। জানে যে পাহাড়গুলো আল্লাহ কিলকের মত আটকে রেখেছেন বলে পৃথিবী ডানে বামে হেলে পড়ছে না এই তথ্য মিথ্যে। মিথ্যে যে পৃথিবীর প্রথম মানুষ আদম, দ্বিতীয় মানুষ আদম থেকে সঙ্গিনী হাওয়াকে তৈরি করা হয়েছে, মিথ্যে যে গন্দম ফল খেয়েছে বলে আল্লাহ তাদের শাস্তি দিয়ে পৃথিবীতে নিক্ষেপ করেছেন। বাবুল জানে বিং ব্যাং এর কথা, জানে যে কোটি কোটি বছর ধরে মহাশূন্যে কোটি কোটি গ্রহ উপগ্রহ, নক্ষত্র ঘুরে চলছে। মানুষ নামক প্রাণীর কি করে উৎপত্তি জানে সে, জানে বিবর্তনের তত্ত।্ব কিন্তু তারপরও সে নামাজ রোজা করছে, ইস্তেমায় যাচ্ছে। এর কারণটি হল, সে লোভী। লোভী বলেই ইহজগতও চায়, পরজগতও চায়। ইহজগতে ডাক্তার হয়ে সমাজে উঁচু স্তরের মানুষ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেল, এতে তো সুখ আছেই। আর যদি আল্লাহ বলে কিছু থাকে, পরকাল বলে কিছু থাকে, তবে পাঁচবেলা নামাজ, এক মাস রোজা আর বছরে একবার ইস্তেমায় গিয়ে যদি বেহেসত জোটে, তবে মন্দ কি!

বাবুলের মত ছেলের সঙ্গে তর্কে গিয়ে কোনও লাভ নেই। বাবুল কোনও তর্কে যেতেও চায় না। সে তার বিশ্বাস নিয়ে থাকতে চায়।



আজকাল কোরান হাদিসএর অনেক বিষয় নিয়ে প্রশ্ন করলে জৎু সুই উত্তর মার মুখে খেলে না। মা যখন কোরান শরিফ সামনে নিয়ে দুলে দুলে পড়েন, সামনে বসি। কোরান পড়তে পড়তে দোযখের আগুনের কথা মনে করে মার মুখ টি যখন বিবণর্ হয়ে থাকে, আমার ওই বসে থেকে মার কোরান পড়া শোনাটিকে আমার সুমতি হয়েছে বলে ধরে নিয়ে মুখের আদি বণর্ ফিরে আসে মার। মা স্নিগ্ধ হেসে বলেন, কি,পড়বা কোরান শরিফ?

আমি হেসে বলি, আমি তো পড়ছিই। একটা বই আর কতবার পড়তে হয়?

আমার যে মোটেও সুমতি হয়নি, তা আঁচ করেন মা।

আচ্ছা মা, এই যে ছেলেরা টুপি পরে, কেন পরে?

সুন্নত পালন করে। হযরত মুহম্মদ সাল্লাল্লাহু আলায়েসসাল্লাম যেই পোশাক পরতেন, সেই পোশাকই পরাটা সুন্নত। দাড়ি রাখাটা সুন্নত।

নবীজিরে অনুকরণ করতে চায় কেন?

বাহ! করবে না কেন। উনি তো শেষ নবী। শ্রেষ্ঠ নবী। আল্লাহর পেয়ারা রসুল। নবীজির গুণের শেষ নাই, তাই না?

তাঁর মত গুণ আর কারও নাই। তিনি মানুষের মধ্যে শ্রেষ্ঠ মানুষ।

কোলে একটি বালিশ নিয়ে বালিশে দু কনুইয়ের ভর দিয়ে বসে হেসে উঠি আমি।

তুমিই বল আল্লাহর পেয়ারা রসুলের, শ্রেষ্ঠ নবীর, শ্রেষ্ঠ মানুষের আমাদের নবীজির কি ছয় বছর বয়সের আয়শারে বিয়া করা উচিত হইছিল?

তিনি অনেক মেয়েরে বিয়ে করছেন মেয়েদের দারিদ্র থেকে মুক্তি দেওয়ার জন্য। অসহায় মেয়েদের একটা গতি করছেন তিনি।

ছয় বছরের মেয়ে আয়শার কি গতিটা করছেন শুনি? যদি তিনি আয়শার গতি করতে চাইতেন সত্যিকারের, তাইলে তারে ওই বয়সে বিয়া করতেন না, পালক মেয়ে হিসাবে পালতে পারতেন। গরিব মেয়েদের উপকার করতে চাইলে তাদের টাকা পয়সা দিয়া সাহায্য করতে পারতেন। বিয়া কইরা না। বিয়াই যদি অত দরকার হইতো, নিজের বন্ধু বান্ধব যারা বিবাহিত না, তাদের সাথে বিয়া দিতে পারতেন। নিজের বিয়া করার দরকার কি ছিল, দেশে কি আর পুরুষ মানুষ ছিল না নাকি?

উনারে পছন্দ করছেন মেয়েরা.. তাই উনারে..

পছন্দ করছে? কারও পছন্দের ধার কি উনি ধারছেন নাকি? নিজের ছেলের বউ জয়নব কি উনারে পছন্দ করছিল? নাকি ছেলের বাড়িত গিয়া বউরে দেইখা পাগল হইয়া বিয়া কইরা ফেলছেন! কি কইরা ছেলের বউরে মানুষ বিয়া করে কও তো! বাবা যদি এহন দাদারে বলে, হাসিনারে তালাক দে, আমি ওরে বিয়া করাম। কিরকম হইব? দাদা বাপের আদেশে হাসিনারে তালাক দিল। আর বাবা হাসিনারে বিয়া করল। ছি ছি ছি।

নবীজির নিজের কোনও ছেলে ছিল না। জাইদ পালক ছিল।

পালক থাকুক। পালক হইছে বইলা কি ছেলে না? মানুষ তো ছেলে মেয়ে পালক রাখলে নিজের ছেলে মেয়ের মতই মানুষ করে। ধর তুমি যদি একটা মেয়ে পাইলা টাইলা বড় কর, তারপরে কি বলতে পারবা যে এইডা তোমার মেয়ে না? পারবা ওই পালক মেয়ের স্বামীরে বিয়া করতে? পারবা না তো। ওই ছেলের বউরে বিয়া করার পরই তো আইন পাইল্টা গেল। পালক পুত্র কন্যা সত্যিকার পুত্র কন্যা নহে। সুতরাং তাদেরে উত্তরাধিকার থেইকা বঞ্চিত কর। নিজের স্বার্থের জন্য কেউ এমন নির্মমতা করে?

স্বার্থ না। স্বার্থ না। না বুইঝা কথা কইস না।

স্বার্থ ছিল বইলাই তো ধনী খাদিজারে বিয়া করছিলেন। খাদিজার ধন লইয়া ব্যবসা করলেন। তহন অন্য মেয়ের দিকে নজর দেন নাই। যেই খাদিজা মারা গেল, সমানে বিয়া করতে লাগলেন।একটার পর একটা। কেন? খাদিজা বাইচা থাকতে তো ওই সাহস হয় নাই! স্বার্থ না তো কি? যুদ্ধে শত্রুসম্পত্তি তো দখল করছেনই, শত্রুপক্ষের মেয়েদেরও ভোগ করছেন। করেন নাই? নিজের জন্য সুন্দরীগুলারে রাইখা বাকিগুলা বন্ধুদের বিলাইছেন। কোরানেও তো লেখা আছে, নবীরে ভোগ করতে দাও এই সব মেয়ে!! ছি!! কোনও বিবেকবান মানুষ এই জঘন্য কাজ করে? কোনও সুস্থ লোক চৌদ্দটা বিয়া করে?

চৌদ্দটা না, তেরোটা।

কি পার্থক্য? চৌদ্দটা না কইরা তেরোটা করলে তোমার কাছে ভাল মনে হয়? বাবা দুইটা বিয়া করছে, খবর শুইনা ত তুমি বাবারে অমানুষ বইলা গাল দেও। তোমার নবীজিরে গাল দেও না কেন?

তখনকার সময় আর এখনকার সময় এক না। তখন সমাজের অবস্থা অন্যরকম ছিল।

এহন সমাজের অবস্থা কি রকম? এহন তো চারটা বিয়া করতে পারে পুরুষ মানুষ! বাবা যদি তিনটা বউ আইনা বাড়িত রাখে, তুমি কি করবা? থাকতে পারবা তিন সতিন নিয়া?

মা মুখ বিষ করে কোরান বন্ধ করে রেখে বলেন, নবীজি কাউরে এক বাড়িতে রাখেন নাই।

এক বাড়িতে রাখেন নাই, তাতে কি হইছে? এক বাড়ি থেইকা আরেক বাড়িতে তো গেছেন। বিবিদের চাকরানিদেরও ওপর তো লোভ করছেন! তাদেরও তো ভোগ করছেন। কাউরে তো ভোগ করতে বাদ রাখেন নাই!

যা করছেন আল্লাহর হুকুমে করছেন।

আল্লাহ এইরকম জঘন্য হুকুমই বা দিছেন কেন? প্রেরিত পুরুষ! মহানবী! সকলের শ্রদ্ধার মানুষ! তার চরিত্রটা তো আল্লাহ একটু ভাল বানাইতে পারতেন।

নাসরিন, তুই নবীজিরে নিয়া বাজে কথা বলতাছস। তর তো দোযখেও স্থান হইব না। তর যে কি হইব? তর কপালে যে কি আছে!



মার সঙ্গে এরকম কথা হওয়ার পর মা বারান্দায় একলা বসে থাকেন অথবা জানালার দিকে মুখ করে চুপচাপ শুয়ে থাকেন। আমি অনুমান করি মা ভাবছেন প্রেরিত পুরুষের কথা, কেন আল্লাহর প্রেরিত পুরুষটি কোনও আদর্শ চরিত্রের হলেন না! কেন তিনি সমালোচনার উর্ধে ওঠার মত হলেন না! এধরনের কথা হওয়ার পর মা অনেকক্ষণ পর আমার কাছে এসে আমার বুকে মুখে সুরা পড়ে ফুঁ দেন। নরম গলায় বলেন, তওবা করো আল্লাহর কাছে। বল যে ভুল হইছে তোমার। ভুল করছ। আল্লাহ ক্ষমা কইরা দিবেন। আল্লাহ থাকলে তো ক্ষমা করবেন?

যদি থাকেন! যদি থাকেন! যদি আল্লাহ থাকেন? তাইলে কি করবি? তাইলে কি অবস্থা হইব তর, একবার চিন্তা করছস?

মা যখন খুব মন দিয়ে ফরজ সুন্নত নফল সব রকমের নামাজ পড়তে থাকেন, আর আমি যখন বলি, কেন যে এইসব পড়! কি লাভ? মরার পর দেখবা আর জীবিত হইতাছ না। ফক্কা। কোনও দোযখও নাই। কোনও বেহেসতও নাই। তহন?

মা বলেন, হ যদি দেখি কিছু নাই, তাইলে তো নাইই। আমার সব ইবাদত বথৃা গেল। কিন্তু, যদি থাকে? যদি থাকে সব?

মা এই যদির ওপর আশঙ্কা করে নামাজ রোজা করেন। যদি শেষ বিচারের দিন বলে কিছু থাকে, তবে যেন ভাল ফল পান। আমার মনে হয় কেবল মা নন, আরও অনেকে এই যদি র কারণেই আল্লাহ রসুল মেনে চলে। মার সঙ্গেও তর্কে বেশিদূর এগোয় না।

হাসপাতালের রোগীদের ওপর, যেহেতু রোগিরা আল্লাহর পরই যে মানুষকে বিশ্বাস করে, সে হল ডাক্তার, খানিকটা কঠোর হই। ডাক্তারদের আদেশ উপদেশ তারা অক্ষরে অক্ষরে পালন করে। করলে কি!বালিশের নিচে মৌলানার ফুঁ দেওয়া গাছের শেকড় রাখে, অসুখ ভাল হলে ডাক্তারের চিকিৎসায় নয়, শেকড়টির কারণে অসুখ ভাল হয়েছে বলে বিশ্বাস করে। এক রক্তশূন্যতার রোগিকে সন্ধানী থেকে যোগাড় করে চার ব্যাগ রক্ত দিয়ে আর ওষধু দিয়ে যায়-যায় হৃদপিণ্ডকে ভাল করে তোলার পর রোগিকে উঠে বসতে বলি। উঠতে গিয়ে লোকের বালিশ সরে যায়। বালিশের তলে একটি শেকড়।

এইটা কি?

দোয়া পড়া শেকড়।

এইটা কাছে রাখছেন কেন?

রোগি হেসে বলে, এইটা রাখলে রোগ বালাই দূর হয়, তাই রাখছি।

কি মনে হয় ডাক্তারের ওষুধে ভাল হইছেন নাকি ওই শেকড়ে?

রোগী বলে, এবারও হেসে, ওষধু দিয়া চেষ্টা করছেন ভাল করতে। কিন্তু আল্লায় ভাল করছে। আল্লাহ ছাড়া কেউ কি বাচাইতে পারে? শেকড়ডাতে আল্লাহর কালাম পইড়া ফুঁ দেওয়া আছে।

এরপর যে রোগিই আসে, আগে দেখি হাতে পায়ে কোমরে বাধাঁ কোনও তাবিজ আছে কি না, কোনও শেকড় আছে কি না। থাকলে ওগুলো নিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে পরে চিকিৎসা শুরু করি। বলে দিই তাবিজ কবজ কাছে রাখলে চিকিৎসা পাইবেন না। ওইসব যদি রোগ ভাল করে বইলা মনে করেন তাইলে বাড়ি যান। বাড়ি গিয়া শেকড় বালিশের নিচে রাইখা শুইয়া থাকেন। তাবিজ কবজ শরীরে বান্ধেন। যত মৌলবি আছে সবার ফুঁ লন। পড়া পানি খান। রোগ কি কইরা ভাল হয় দেখব।

এক এক ওয়ার্ডের এক এক দিন ভর্তির তারিখ থাকে। ওদিন নাগাড়ে রোগী আসতে থাকে। বিছানা ভরে যায়, এমন কি মেঝেও। প্রতিটি রোগীর হিস্ট্রি লেখা, প্রতিটি রোগীর মাথা থেকে পা অবদি পরীক্ষা করা, রোগ নির্ণয় করা, প্রতিটি রোগীর জন্য প্রাথমিক ওষধু লিখে দেওয়া,মরো মরো রোগী এলে নিজে সামলাতে না পারলে বড় ডাক্তারদের খবর দেওয়া ইত্যাদি কাজে ব্যস্ত থাকতে হয়। পুরুষ রোগীর চেয়ে মেয়ে রোগীর সংখ্যা কম হাসপাতালে। মেয়েরা মৃত্যপু থযাষনী হওয়ার আগে তাদের কেউ হাসপাতালে আনে না। বিষ খেয়ে মরছে কোনও মেয়ে, শরীরের কোথাও ছোট্ট কোনও পলিপ থেকে না- চিকিৎসায় না-চিকিৎসায় ক্যান্সার ঘটিয়ে আসা মেয়ে—প্রতিটি মেয়ের শরীরে রক্তশূন্যতা, পুষ্টিহীনতা। আমি এদের কাছ থেকে, কেবল ডাক্তার যেটুকু জানলেই চলে, তার চেয়ে, অধিক জানতে আগ্রহী। সংসারের সবাইকে ভাল খাইয়ে নিজেরা এঁটো কাঁটা খায়! অসুখ বিসুখ পুষে রাখে শরীরে। মেয়েদের অসুখ হলে সংসার চলে না, তাই। অসুখের কথা জানালেও বাড়ির লোকেরা তেমন গা করে না। অসুখ দেখতে গিয়ে ডাক্তাররা ছোঁবে মেয়েদের, এ জিনিসটিতে বাড়ির পুরুষেরা সায় দেয় না। তাই অসুখ পোষা ছাড়া মেয়েদের আর করার কিছু থাকে না। নিজেরা একা চলে আসবে হাসপাতালে এই সাহস তাদের নেই। বিবাহিত মেয়েরা অসুখ নিয়ে স্বামীর বাড়ি থেকে বাপের বাড়ি বেড়াতে গেলে, সাধারণত বাপের বাড়ি থেকেই তারা আসে হাসপাতালে, বাপের বাড়ির আত্মীয়রা নিয়ে আসে।

কেবল যে আমার ডিউটি থাকে ওয়াডের্, তা নয়,অন্য ডাক্তারদেরও থাকে। গুরুতর জখম হওয়া এক রোগীর হিস্ট্রি লিখতে গিয়ে এক ডাক্তার বন্ধু লিখেছে, শি ওয়াজ বিটেন। সেটি কেটে দিয়ে নতুন কাগজে হিস্ট্রি লিখে দিই রোগীর ঘটনা বিস্তারিত জেনে।শি ওয়াজ ব্রুটালি হিট বাই হার হাজবেন্ড। দ্যা ক্রুয়েল ম্যান ইউজড অ্যাক্স এন্ড বাম্বু অন হার বডি। হি ওয়াণ্টেড টু কিল হার। হি ইভেন সেইড তালাক টু হার। হার ক্রাইম ওয়াজ দ্যাট হার ফাদার কুডনট পে দাউরি মানি ইন টাইম। ওষুধের লিষ্টিতে একটি এন্টি ডিপ্রেসেন্ট যোগ করে দিই। ডাক্তার বন্ধুটি আমার হিস্ট্রি লেখা দেখে মন্তব্য করে, কে মারল কি দিয়ে মারলো কেন মারল সেটা আমাদের জেনে কি দরকার! আমাদের কাজ হল চিকিৎসা করা। তা ঠিক, এ কথা সব ডাক্তারই বলবে আমি জানি। বাড়তি যে হিস্ট্রিটুকু লিখেছি আমি, লিখে আমার একধরনের তৃপ্তি হয়, মেয়েটিকেও বলেছি, লেইখা রাখলাম যে আপনের স্বামী আপনের এই অবস্থা করছে। হাসপাতালে কাগজে মেয়েটির করুণ দশার কথা লিখে মেয়েটির জীবনের কোনও পরিবর্তন হবে না জানি। তবু লিখলে ক্ষতি কি? ডাক্তারদের যে একেবারে কোনও সামাজিক দায়িত্ব নেই তা নয়। অপারেশনের পর রোগীদের ব্যথা কমাতে পেথিডিন দেওয়া হয়। পেথিডিন পেয়ে শরীর এমন ভাল-লাগায় ভগু তে থাকে যে ব্যথা কমে গেলেও রোগীরা কোঁকাতে থাকে পেথিডিন পেতে। রোগির যেন পেথিডিনে আসক্তি না হয়, ডাক্তার ডি-ডব ্লু ইনজেকশন দিতে নার্সকে ডাকেন। নার্স সিরিঞ্জে ডিসটিল্ড ওয়াটার ভরে রোগীর নিতম্বের মাংসে সুঁই ফুঁটিয়ে আসে। রোগিদের কোঁকানো আর থেকে থেকে নাসর্ বা ডাক্তারকে ডাকা বন্ধ হয়, এভাবেই পেথিডিনের নেশা হওয়া থেকে রোগীদের বাঁচায় ডাক্তার। এ নিশ্চয়ই সামাজিক দায়িত্ব।

ডাক্তার বটে আমি, ওয়াডের্ দিন রাত পড়ে থেকে রোগীদের চিকিৎসা করছি বটে, তবে সব রোগের চিকিৎসা করার অধিকার আমার নেই। গাইনিতে কেবল দিনে নয়, রাতেও ডিউটি পড়ে। সপ্তাহে তিন থেকে চার রাত কাটাতে হয় হাসপাতালে। তো এক রাতের ডিউটিতেই দুটো ঘটনায় আমার ওপর সমন জারি হয়। রাত বারোটায় রোগী এল রিটেইন্ড প্লাসেন্টা নিয়ে। বাচ্চা হয়েছে দুদিন আগে, জরায়ুর ফুল পড়েনি এখনো। রিটেইনন্ড প্লাসেন্টা এলে নিয়ম বড় ক্লিনিক্যাল এসিস্ট্যান্ট বা রেজিস্টারকে ডাকা। কাউকে না ডেকে আমি নিজে চেষ্টা করি ফুল বের করতে। জরায়ুর বন্ধ মুখ ধীরে ধীরে হাতে খুলতে চেষ্টা করে ঘন্টা খানিক পর সফল হই, ফুল বেরিয়ে আসে। সে রাতেই রাত আড়াইটার দিকে এক রোগী আসে, বাচ্চা বেরোচ্ছে না, পানি ভেঙে গেছে দুপুরে, বাচ্চার মাথা জরায়ুর মুখের কাছে এসে আটকে আছে ঘন্টা কয়েক। ভেতরে বাচ্চার অবস্থা যায় যায় প্রায়। যদি বড় ডাক্তারদের খবর দিতে যাই, ওরা ডক্টরস কোয়ার্টার থেকে হাসপাতাল অবদি আসতে আসতে বাচ্চা বেঁচে থাকবে না বলে আমার আশঙ্কা হয়। নিজেই হাতে ফরসেপ নিই। এতকাল অন্যকে দেখেছি ফরসেপ-ব্যবহার করতে, নিজে কখনও ব্যবহার করেনি। আমার সঙ্গে যে ডাক্তারদের ডিউটি ছিল, নিরাপদ দূরত্বে দাঁড়িয়ে আমার কাণ্ড দেখেছে। কাণ্ডটি ঘটার সময়ই একজন দৌড়ে গিয়ে সিএকে কল দিয়ে এসেছে। সিএ যখন এসেছে, বাচ্চাকে অক্সিজেন দিয়ে স্বাভাবিক শ্বাস নেওয়ানো হয়ে গেছে। আমি তখন সেলাই করছি ফরসেপের জন্য প্রশস্ত করা যোনিদেশ। সকাল আটটায় অধ্যাপক আসেন। তিনি পৌঁছোনোর দুমিনিটের মধ্যেই তাঁকে ঘটনা জানানো হয়। ক্যান্টিন থেকে চা খেয়ে চাঙ্গা হয়ে অধ্যাপকের সঙ্গে ওয়ার্ড রাউন্ড দিতে এসেছি, দিয়ে চলে যাবো বাড়িতে, ঘুমোতে। যদিও ডাক্তার হয়ে গেছি, জোবায়েদ হোসেনের সামনে কিন্তু আগের মতই, ছাত্রী। তাঁর পেছন পেছন ওয়াডর্গু লো ঘুরতে হয় সকাল বেলা, ঘোরার সময় ছাত্রী অবস্থায় বুক কেঁপেছে, ডাক্তার হয়েও কাঁপে। বাঘের সামনে দাঁড়ানো আর জোবায়েদ হোসেনের সামনে দাঁড়ানো এক কথা। অধ্যাপক জোবায়েদ হোসেন রাউন্ড দিতে শুরু করে দিয়েছেন। আমি রাউন্ডে ঢুকতে গেলেই তিনি আমার দিকে এগোন। চশমার তলে বাঘের দৃষ্টি। আমাকে এক্ষুনি ভক্ষণ করার মত কি কাণ্ড ঘটেছে, তা ঠাহর করার আগেই তিনি বললেন, তুমি রিটেইন্ড প্লাসেন্টা ম্যানুয়েলি রিমুভ করছ? হ্যাঁ স্যার।

জোবায়েদ হোসেনের পেছনে থেকে পঁচিশ জোড়া চোখ আমার দিকে তাকিয়ে আছে। সুন্দরবনের মাচায় বসে বাঘের হরিণ খাওয়া দেখতে যেমন উৎসুক চোখ, সে রকম। আবারও জোবায়েদ হোসেনের গলা থেকে হালুম হালুম,তুমি ফরসেপ ডেলিভারি করেছ?

হ্যাঁ স্যার।

কেন করেছ?

বাচ্চার অবস্থা খারাপ ছিল।

রিটেইন্ড প্লাসেন্টা ম্যানুয়ালি রিমুভ করছ কেন?

রোগির অবস্থা খারাপ ছিল। তাই..

যদি কোনও এক্সিডেন্ট হত?

রোগি ভাল আছে। একটু আগে দেখে এসেছি। বাচ্চাও ভাল আছে।

রোগি ভাল আছে, এটা কোনও এক্সকিউজ না।

আমাকে বাহা−ন্নাটি চোখের সামনে মাথা নত করতে হয়। সেই সকালেই জোবায়েদ হোসেন বড় একটি নোটিশ ঝুলিয়ে দেন প্রসুতি কক্ষে, ইন্টানির্ ডক্টরস আর নট এলাউড টু ডু এনিথিং উইদ ফরসেপ ডেলিভারি এন্ড রিটেইন্ট প্লাসেন্টা।

সেই জোবায়েদ হোসেনই, পরদিন প্রসুতিকক্ষে এক রোগী এপিসিওটমির জন্য বসে ছিল অপেক্ষায়, ডাক্তার নেই ডাক্তার নেই! কোথায় ডাক্তার! হাতের কাছে একজনকে পাওয়া গেলেই খপ করে ধরে রোগী পড়ে আছে কেন লেবার রুমে জিজ্ঞেস করতেই ডাক্তার ইতিউতি তাকিয়ে ঢোক গিলতে গিলতে যখন বলল, স্যার তসলিমার কথা ছিল এপিসিওটমি করার, তিনি দাঁত খিঁচিয়ে বললেন,তসলিমাকে দোষ দিতে চাও তো! শোনো, ওরই সাহস আছে কিছু করার। কারেজিয়াস মেয়ে। সেই পারবে ডাক্তারি করে খেতে। তোমার মত মূষিক পারবে না।
 

Users who are viewing this thread

Back
Top