What's new
Nirjonmela Desi Forum

Talk about the things that matter to you! Wanting to join the rest of our members? Feel free to sign up today and gain full access!

Collected দ্বিখণ্ডিত (আত্মজিবনী) (3 Viewers)

dwikhondito-360x57080578f7807d2642f.jpg


দ্বিখণ্ডিত, ২০০৩ সালে প্রকাশিত তসলিমা নাসরিনের আত্মজীবনীর তৃতীয় খণ্ড। পশ্চিমবঙ্গে এটি “ক” নামে প্রকাশিত হয়।
 
অবকাশ দিন দিন আমার কাছে আরও অসহ্য হয়ে উঠছে। কারও নরম গরম কোনও কথাই আমার ভাল লাগে না। ইচ্ছে করে এ বাড়ি থেকে চলে যাই কোথাও। কোথাও আমি নিজের মত করে থাকি। ইয়াসমিন চলে যাওয়ার পর বাড়িটিতে আমার আর কেউ নেই যার সঙ্গে আমি দু কথা বলে সময় কাটাতে পারি। বুকের ধন সুহৃদও নেই। বড় ফাঁকা লাগে সবকিছু। বড় হু হু করে বুক। বাড়িটিকে আর বাড়ি বলে মনে হয় না। মার নিজের জগতটি বড় সংকীর্ণ, রান্নাঘর আর পীরবাড়ি, বাবার জগতে এ বাড়ির কারও কোনও স্থান নেই, যদি থাকে কারও, সে দাদার। দাদা আরোগ্য বিতানের দায়িত্ব নেওয়ায় বাবার সঙ্গে দাদার একটি ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। আরোগ্য বিতানে চুরি হল এক রাতে। দাদা সন্দেহ করলেন শরাফ মামাকে, বাবাও তাই। টুটু মামা একবার দাদার কাছ থেকে টাকা ধার নিয়ে আর ফেরত দেন নি, সে নিয়ে দাদা প্রায়ই মামাদের গুষ্ঠি উদ্ধার করেন। মাকে উঠতে বসতে টুটু মামার টাকা নেওয়ার এবং না দেওয়ার কেচ্ছ! শোনান। দাদার অনেক আচরণই বাবার মত। বাবা যেমন নানিবাড়ির কাউকে আপন বলে ভাবেন না, দাদাও তেমন। বাপকা বেটা সিপাইকা ঘোড়া, কুছ নেহি তো থোড়া থোড়া। হাশেম মামা আকুয়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান হয়েছেন। বক্তৃতা ভাল করতে পারেন না বলে বীর মুক্তিযোদ্ধা হয়েও ইউনিয়ন পরিষদের ওপরের কোনও ধাপে পা ফেলতে পারেন না। মুখে খই না ফুটলে আর নানারকমের প্রতিশ্রুতি, সে মিথ্যে হোক, না দিতে পারলে কারও ভোট জোটে না। হাশেম মামা তাঁর ভাতের দোকানে বসে থাকেন, দোকানেই বন্ধুদের ডেকে ডেকে রাজনীতির আলাপ করেন। দোকান করে সংসার চালাতে হয় হাশেম মামাকে। একটি ছোট্ট ঘরে বউ আর পাঁচ কন্যা নিয়ে গাদাগাদি করে থাকেন, কন্যাদের সবাইকে লেখাপড়া করাচ্ছেন। একটি মাত্র ছেলে সুমন, খুনের মামলার আসামী হয়ে আরও কজন সমবয়সী ছেলের সঙ্গে জেল খাটছে। হাশেম মামা ম্যালা টাকা ঢালছেন ছেলে যে নির্দোশ এই প্রমাণ নিয়ে হাই কোর্টে মামলা করার জন্য। কোনও অবৈধ পথে টাকা ঢালতে তিনি চান না, চাইলে ছেলেকে ছাড়িয়ে আনতে পারতেন অনেক আগেই। মামাদের মধ্যে এক হাশেম মামারই আগ্রহ খুব আমার বই পড়ার। দেখা হলে প্রায়ই তিনি বলেন, ‘কই তোমার বই টই কিছু বাইর হইছে? দেও একটা বই দেও।’ একদিন হাশেম মামা এসে পাঁচশ টাকা ধার নিয়ে গেলেন আমার কাছ থেকে। টাকা চাইতে লজ্জা হচ্ছিল তাঁর, তারপরও উপায় ছিল না। সুমনের মামলার জন্য খরচের কোনও মা বাপ ছিল না। তবু হাশেম মামার আমার কাছ থেকে টাকা নেওয়াটি মার ভাল লাগে নি। মা মুখ কালো করে বসে রইলেন, খবরটি বাবা বা দাদার কানে গেলে মার চৌদ্দ গুষ্ঠির বাপান্ত করে ছাড়বেন। হাশেমমামাকে খুব ভালবাসেন মা, তাঁর নীতির জন্যই ভালবাসেন। নীতির কথা কইতে হাশেমমামা নিজের বাপকে ছেড়ে দেন না। এমন মানুষটিকে কেন আজ ভাগ্নীর কাছে হাত পাততে হয়! না খেয়ে থাকতে হবে, না খেয়ে থাক, তবু যেন হাত না বাড়ায় কারও কাছে। মা যতই গুষ্ঠি নিয়ে ভাল কথা বলতে চান, গুষ্ঠি নিয়ে তাঁর লজ্জাও কম নয়। মা খুব একা, মার জগতটিতে মা ছাড়া আর কেউ নেই। সংসারে যখন কোনও অঘটন ঘটে অথবা ছেলেমেয়েদের কারও কোনও গোপন সংবাদ যদি বাবা আহরণ করতে চান অথবা কারও বিরুদ্ধে অভিযোগ করতে চান, তবেই মার ডাক পড়ে। আজকাল মাকে তিনি পই পই করে জিজ্ঞেস করেন আমার গতিবিধি, কী করছি , কী ভাবছি, বাকি জীবনের জন্য কোনও পরিকল্পনা করছি কী না। নাকি এরকম যা ইচ্ছে তাই করে বেড়াবো। এরকম ঢাকা ময়মনসিংহ। এরকম আগল বাঁধনহীন জীবন যাপন। মা আমার পরিকল্পনার কথা পরিস্কার করে বাবাকে কিছু বলতে পারেন না।

বাবা বাড়ি এসে আমাকে শুনিয়ে শুনিয়ে মাকে বলেন, ‘শহরে কারও কাছে মুখ দেখানো যায় না। আজকেও একটা লোক আইসা কইল, আপনার মেয়ে তো ডাক্তার হইছে, তার কি বিয়া টিয়া দিছেন? জামাই কি ডাক্তার নাকি? সে যে একটা বিয়া করছিল, তা অনেকে জানে। ব্যাডা মদারু মাগীবাজ এইসব না জাইন্যা বিয়া করছিল কেন? এহন এই মেয়েরে কেডা বিয়া করব? সব ব্যাডাই এরে লইয়া ঘুইরা বেড়াইব। বিয়া কেউ করব না। মাইনষের সামনে আমি মুখ দেখাইতে পারি না। মাইনষে জিগায়, মেয়ে বিয়ার উপযোগী হইছে তো বিয়া দেন না কেন? মাইনষে খবর জানতে চায়। কী উত্তর দিব মানুষের প্রশ্নের! মুখটা নামাইয়া রাখতে হয়। আমি কি কইরা বলব যে মেয়ে নিজের ইচ্ছ!য় বিয়া করছিল, জামাইরে ছাইড়া দিছে, এহন ব্যাডাইন লইয়া ঘুরে। মানুষে কি খবর রাখে না, ঠিকই রাখে। ছি ছি করে। কোনও ডাক্তার ছেলেরে বিয়া করলে বালা অইলো না অইলে? এতদিনে দুই তিনডা বাইচ্চা কাইচ্চা লইয়া সংসার করতে পারত।’

মা মাথা নাড়েন, হ্যাঁ পারত। আমার বয়সী মুন্নির বিয়ে হয়েছে, বাচ্চা হয়েছে, লক্ষ্মী মেয়ের মত সুন্দর সংসার করছে। উদাহরণটি মা দেন। উদাহরণের অভাব নেই। যেদিকে তাকান মা, আমার বয়সী এমনকী আমার বয়সে ছোটোদেরও চমৎকার সংসার হয়েছে দেখেন। কেবল আমারই হয়নি।

ভীষণ উৎপাত শুরু হয় বাড়িতে। উঠতে বসতে আমাকে কথা শুনতে হয়। কেউ ফোন করলে কে ফোন করেছে, কেউ চিঠি লিখলে কে চিঠি লিখেছে, কেউ বাড়ি এলে কে এই লোক, কি সম্পর্ক, সম্পর্ক যদি ভাল হয়, তাহলে কেন এখনো বিয়ে করছি না! সারাজীবন একা কাটাবো, বিয়ে করব না এ কথা স্পষ্ট করে জানিয়ে দিলে বাবার কড়া হুকুম, খুব ভাল কথা, বিয়ে না করেও অনেকে মেয়েরো বেঁচে থাকে, তবে ছেলেপিলেদের সঙ্গে মেলামেলা বন্ধ করতে হবে, বান্ধবী থাকতে পারে, তবে কোনও বন্ধু নয়। কেবল হুকুম দিয়েই তিনি শান্ত হন না, জরুরি অবস্থাও জারি করেন, আমার কোনও বন্ধু নামক পদার্থ যদি এ বাড়িতে আসে, তবে তার সঙ্গে জোর করে বিয়ে দিয়ে দেবেন আমাকে। ইয়াসমিনকে মেরে বাড়িছাড়া করেছেন, আমাকে তিনি মারেন না। আমার শরীরে না পড়লেও মনে পড়তে থাকে শক্ত শক্ত চাবুকের ঘা। কুঁকড়ে যেতে থাকি যন্ত্রণায়। ইয়াসমিন নেই যে বিকেলে বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়ব দুজন রিক্সা করে শহর ঘুরতে, অথবা গানের নাচের কবিতার অনুষ্ঠানে যাবো। একা কোথাও যেতে ইচ্ছে করে না। ও চলে যাওয়ার পর সকাল কবিতা পরিষদও একরকম ভাঙা ভাঙা। আমি একটি অপদার্থ, অলক্ষ্মী হিসেবে প্রতিদিন চিহ্নিত হতে থাকি। রুদ্রকে বাড়ির কেউই পছন্দ করেনি, রুদ্রকে ছেড়ে আসায় সকলে প্রথম প্রথম খুশি হয়েছিল, কিন্তু ধীরে ধীরে আমার ডিভোর্সী পরিচয়টিই আমার সবচেয়ে বড় পরিচয় হয়ে ওঠে, আমার স্বামীহীন জীবন কারও কাছে আর তেমন ভাল লাগে না। একটি খাঁচা না হলে যেন আমাকে আর মানাচ্ছে না। খাঁচাহীন নিরীহ জন্তুটিকে খেয়ে ফেলবে যে কেউ, তাই কোনও একটি যেন তেন খাঁচায় আমাকে যে করেই হোক ঢুকতেই হবে। এফসিপিএস এ পড়ার জন্য আমার কোনও আগ্রহ নেই, আমি একটা যাচ্ছেত!ই ভবিষ্যত গড়ে তুলছি আমার, এসব নিয়ে বাবা এত বিরক্ত যে জঘন্যতম নোংরা কথা বলতে তাঁর আর বাঁধে না এখন। আমার মনে হতে থাকে যে স্বামী সংসার না থাকলেও একটি মেয়ে যে ভাল হতে পারে, তা প্রমাণ করার একটিই উপায়, কিছু অর্জন বা বর্জন। কিছু বাড়তি যোগ্যতা। কিছু বাড়তি দক্ষতা। বর্জনের মধ্যে পুস্টিকর আহারাদি বর্জন, সাধ আহলাদ আরাম আয়েস বর্জন, বিধবারা যা করে থাকে। অথবা সন্ন্যাস বরণ। অথবা আত্মহত্যা। অথবা চিতায় ওঠা। অর্জনের মধ্যে অসামান্য সাফল্য লাভ করা কোনও কিছুতে। কোনও কিছুর শীর্ষে ওঠা। সবোগচ্চ পদে অধিষ্ঠিত হওয়া। এফসিপিএস পাশ করা। এফসিপিএস এর আবরণে স্বামীহীনতার গ্লানি আমাকে ঢাকতে হবে। অসাধারণ কোনও যোগ্যতা বা দক্ষতা দেখাতে হবে আমার অস্বাভাবিক জীবনকে সহনীয় করার জন্য। যেন বয়স হলে স্বামী সন্তান না থাকাটা একধরনের পাপ, এই পাপ মোচন করতে হলে আমাকে প্রায়শ্চিত্য করতে হবে নির্বোধের মত খেটেখুটে বড় একটি ডিগ্রি নিয়ে। স্বামীহীনতা একটি যেন বিশ্রি ঘা, এটিকে ঢেকে রাখতে হলে আমার একটি মূল্যবান রঙিন চাদর চাই। আমি যেমন আছি তেমন থেকে আমার পাপ মোচন করতে পারবো না। গ্লানি দূর করতে পারবো না। কারও ক্ষমার যোগ্য হব না। অন্য কোনও মেয়ের এই বাড়তি যোগ্যতা না থাকলেও চলে, না থাকলে তাদের কেউ মন্দ বলবে না। কিন্তু স্বামীকে ছেড়েছো যখন, তোমার কয়েক ধাপ ওপরে উঠতেই হবে অন্য মেয়েদের চেয়ে। কয়েক ধাপ ওপরে উঠেই অন্য মেয়েদের কাতারে দাঁড়াবার যোগ্যতা অর্জন করবে। কী জানি, তারপরও কি অর্জন হয়! পঞ্চম শ্রেণী পাশ করা স্বামীর সংসারে গতর খেটে মরা একটি মেয়ের দিকে তো এত করুণ আর এত নিস্করুণ দৃষ্টি নিয়ে কেউ তাকায় না, আমি ডাক্তার হওয়ার পরও কেবল আমার স্বামী নেই বলে আমার দিকে যেভাবে তাকায়!

পরিবার পরিকলল্পনার পরিকল্পনাহীন দপ্তরে যা ইচ্ছে তাই হচ্ছে, ওষুধ চুরি, টাকা চুরি, পুরুষ কর্তাদের আধিপত্য, সুন্দরী কোনও কর্মী দেখলেই হাত বাড়ানো। এসবের বিরুদ্ধে উচ্চয়রে কথা বলতে গিয়ে দেখি আমি একা। আমি হেরে যাচ্ছি। পুরুষ কর্তারা আমাকে হেনস্থা করার জন্য ওত পেতে থাকেন। গ্রামে গঞ্জে ক্যাম্প করে যখন লাইগেশন বা টিউবেকটমি করি, বেশ ভাল লাগে, কোনও একটি কাজের মধ্যে থাকলে সাংসারিক দুঃখ শোকগুলো সরিয়ে রাখা যায় দূরে। ক্যাম্প যদি না না থাকে তবে আপিসে যাও, বসে থাকো, কে কেমন আছে দেখ, কে কী বলে শোনো, মাছি মারো বসে বসে। কোনও একদিন হারুন-উর-রশিদ, বড়কর্তা ওরফে ডিপুটি ডিরেক্টর, যাকে লোকে ডিডি বলে ডাকে, বিকেল পাঁচটায় অনেকটা প্রমোদবিহারে যাওয়ার মত পানে মুখ লাল করে, লাল চশমা পরে দেখতে গেলেন কালিবাড়ির টিনের ঘরটি। টিনের ঘরে মুজিবর রহমান আর আম্বিয়া কপোত কপোতির মত সময় কাটাচ্ছেন। বাকিরা সব বাড়ি চলে গেছেন। সাইদুল ইসলাম নেই। তিনি নেই, তাঁর না থাকার একশ একটা কারণ আছে, কিন্তু আমি নেই কেন! ঢাকার স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে পাঠিয়ে দিলেন নালিশ। কেবল একবারই নয়, ঘন ঘন তিনি আমার বিরুদ্ধে নালিশ করছেন। তাঁর আর সইছিল না তাঁর মধুর আহবানকে যে আমি হেলা করেছি সেই অপমান। তিনি তাঁর আকুয়ার আপিসে আমাকে প্রায়ই যেতে বলতেন। আমি গিয়েছিলাম একদিন। তিনি আমাকে তাঁর আপিসে ঘরে বসিয়ে বেল টিপে বেয়ারাকে ডেকে দাঁড় করিয়ে আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কি খাবেন, দুধ চা না রং চা?’

‘রং চা।’

‘একটা দুধ, একটা রং।’ বেয়ারার দিকে চোখ। বেয়ারা আদেশ মাথায় নিয়ে চলে গেল।

‘রং চা খান কেন? রং চা খেলে তো গায়ের রং নষ্ট হয়ে যায়। আপনারা মেয়েমানুষ, রং এর কথা তো ভাবতে হবে। হা হা।’ কুমড়োর ওপর বসানো বত্রিশটি শুকনো সীমির বীচি।

‘খেয়ে অভ্যেস বলে খাই। .. রংএর কথা আমি অত ভাবি না।’

‘সুন্দরী মেয়েদের অবশ্য অত কিছু না ভাবলেও চলে। হা হা।’

প্রসঙ্গ সঙ্গে সঙ্গে অন্যদিকে ফেরাই, ‘আমাকে যে আসতে বলেছেন, কোনও কাজ আছে স্যার?’

‘কী আর কাজ! ফ্যামিলি প্ল্যানিংএ আবার কোনও কাজ থাকে নাকি.. হা হা হা।’

‘তাহলে যে আসতে বলেছেন, কোনও দরকারে?’

‘বসেন গল্প করি। আমার ওয়াইফ বাচ্চাদের নিয়ে ঢাকায় গেছে কয়েকদিনের জন্য। আপনি একদিকে ভালই আছেন। লাইফ এনজয় করতে পারছেন। ফ্যামিলি থাকলে লাইফ এনজয় করা যায় না।’

আমি চোখ নামিয়ে চা খাওয়ায় মন দিই।

‘আপনি কি খুব শাই নাকি!’

‘না তো!’ চোখ ওঠাই।

‘আপনিই যদি শাই হন, তা হইলে আর মেয়েরা কি হবে বলেন।’

আমার চোখ দেয়ালে, দেয়ালের টাঙানো ছবিতে। দূর থেকে ছবির অনেক কিছু চোখে পড়ে না কিন্তু এমন ভাবে তাকিয়ে থাকি যেন ছবির খুঁটিনাটি গুলো আমার এখন না উদ্ধার করলেই নয়।

‘আপনার কথা এইবার কিছু বলেন। আপনি তো দেখছি কথাই বলতে চান না। আপনার জীবন তো খুব ইন্টারেস্টিং জীবন! ঠিক না?’

‘ কই না তো! আমার জীবন খুব সিম্পল..’

‘কী বলেন! আমি তো শুনি মানুষের কাছে, বেশ ইস্টারেস্টিং লাইফ আপনার। আপনি তো অনেকটা ড্যাম কেয়ার। এই ক্যারেকটারটা অবশ্য ভাল। হা হা হা।’ সীমির বীচিগুলো ঝলসে ওঠে।

‘স্যার, ক্যাম্প ট্যাম্প কিছু হবে নাকি শিগরি!’ জানি ক্যাম্প আছে আগামী বুধবারে। তবু জিজ্ঞেস করি।

‘ক্যাম্প? হ্যাঁ তা আছে। নেক্সট ক্যাম্পে আপনি তো আমার গাড়িতেই যেতে পারেন। আপনি চলে আসবেন সকালে। আমার সঙ্গে যাবেন আপনি।’

‘আমার তো যাওয়ার কোনও অসুবিধা নাই..’

‘আপনি তো একদিন ডাক্তার সাইদুলের সাথে তার মোটর সাইকেলে গেলেন.. হা হা হা। মোটর সাইকেলের চেয়ে তো জিপে যাওয়া ভাল। আরামের যাওয়া।’

আমি চুপ করে থাকি।

‘তা বলেন, লাইফএর প্ল্যান কি আপনার?’

‘না, কোনও প্ল্যান নাই।’

‘প্ল্যান নাই! বিয়ে টিয়ে করবেন না?’

‘নাহ!’

‘বলেন কী! এইভাবে ইয়াং বয়সটা নষ্ট করে দিবেন নাকি!’

‘নষ্ট হবে কেন! লেখালেখি করি অবসর সময়ে। এইভাবেই তো ভাল।’

হাসির চোটে কুমড়ো নড়ছে।

‘ও আপনি তো আবার কবি।..ভাবুক মানুষ। হা হা হা’

পরিবার পরিকল্পনার বড়কর্তা আমাকে আরও অনেকক্ষণ বসিয়ে রাখেন। আরও অনেকক্ষণ অর্থহীন কথাবার্তা বলেন। অর্থহীন হাসেন। আমি যতবারই উঠে আসতে চাই, ততবারই তিনি বসতে বলেন। শেষ পর্যন্ত, জরুরি কাজ আছে বলে আমাকে উঠতে হয়। যখন উঠছি, বলেন, ‘আপনি পরশু বিকালে চলে আসেন। আমি কাজ টাজ সেরে ফ্রি হয়ে থাকব। আমার ওয়াইফ ফিরবে আর সাতদিন পর। সুতরাং কোনও অসুবিধা নাই।’

পরশু বিকেলে কেন, আমি কোনওদিনই আর তাঁর আপিসে যাইনি। তাঁর আর সইছিল না আমার স্পর্ধা। তাঁর আর সইছিল না তাঁর অশোভন আহবানে সাড়া না দেওয়ার জন্য সুন্দরী কর্মীদের আমার ইন্ধন যোগানো। এই ময়মনসিংহ থেকে তিনি আমাকে সরিয়ে দেওয়ার যতরকম ষড়যন্ত্র সম্ভব, করে যাচ্ছেন। বাড়ির বাইরে ডিডির বিরোধিতা, বাড়িতে বাবার —- আমাকে কাবু করতে করতে এমন অবস্থায় ফেলল যে আমার আত্মহত্যা করতে ইচ্ছে হতে থাকে।

ইয়াসমিনের ওপর যত অভিমান ছিল, সব অভিমান একদিন ধুয়ে মুছে ওর কাছে যাই, ওকে দেখি আর সেই সচল সজল উচ্ছল উতল দিনগুলোর কথা ভাবি। দিনগুলো কখনও আর ফিরে আসবে না। ইচ্ছে করে ইয়াসমিনকে নিয়ে এ বাড়ি থেকে পালিয়ে যাই কোথাও, কিন্তু শৃঙ্খলে ও নিজেকে এত বেশি জড়িয়েছে, এত বেশি আপোস করে জীবন যাপন করতে চাইছে যে ওকে নিয়ে কোথাও এক পা যাওয়া সম্ভব হয় না। ‘চল ঘুরে আসি, চল আগের মত। চল কথা বলি, হাসি, চল আগের মত।’ আমার এইসব আবদার অনুরোধ এখন আর ওকে স্পর্শ করে না। গৃহবধূ তার গত জীবনের ইতি টেনেছে, এই জীবনটি ওর স্বপ্নের ধারে কাছে না হলেও ও আর বদনাম কামাতে চায় না। এক বোনের সংসারহীন জীবনের বদনামই যথেষ্ট সংসারে। আরেক বোন না হয় প্রায়শ্চিত্যই করল নিজের জীবন দিয়ে। শ্বশুরবাড়ির চৌহদ্দিতে ইয়াসমিন বন্দি। আমি ঘন ঘন ওর শ্বশুর বাড়িতে যাই, তা ও চায়ও না। বুঝি আমাকে নিয়ে ও বাড়িতে মুখরোচক কথা হয়। এ বয়সে সকলে ঘর সংসার করে, সকলের স্বামী থাকে, আমারই নেই, আমি মানুষটি ঠিক স্বাভাবিক নই, এসব। আমার বিয়ে ভেঙে গেছে, আমি পাপী তাপী নষ্ট ভ্রষ্ট মেয়ে, এসব। আমার সঙ্গে লক্ষ্মী গৃহবধূর এত মাখামাখি থাকবেই বা কেন! তাই মাখামাখিতে যায় না ও। ওর মাখামাখি শ্বশুরবাড়ির লোকদের সঙ্গে, ওর মন শ্বশুরবাড়ির মানুষের মন যোগাতে। বাবাকে বলে শ্বশুর বাড়ির আত্মীয়দের নেমন্তন্ন করায়। মা ভুতের মত রান্না করেন। কদিন পর পরই ইয়াসমিন তার শাশুড়ি, স্বামী, ভাসুর, আর ভাসুরবউদের নিয়ে অবকাশে এসে নেমন্তন্ন খেয়ে যায়। ভারত থেকে আনা জিনিসপত্রগুলো ইয়াসমিনকে দিয়ে দিই, ও খুশি হয়। সোনার গয়নাতেও আকর্ষণ নেই আমার, গয়নাগুলোও দিয়ে দিই, ওর চোখ ঝিকমিক করে আনন্দে।

জানি দুঃসময় ঝাঁক বেঁধে আসে। কিন্তু ঝাঁক বেঁধে আসতে থাকলেও তো সীমা থাকে সব কিছুরই। কিন্তু সীমা ছাড়িয়ে যাওয়া দুঃসময় আমার ওপর ভারী ভারী পাথরের মত পড়তে থাকে। চূড়ান্ত দুঃসময়টি আসে এক সকালে। তিরিশ হাজার টাকা ধার নিয়ে মাত্র পাঁচ হাজার টাকা শোধ করেছি, বাকিটা এখনও শোধ করছি না বলে আবদুল করিম তুলকালাম কাণ্ড বাঁধান অবকাশে। আমি তাঁর টাকায় বেড়াতে গিয়েছি ভারতে, আমি একটা বদমাশ মেয়ে মানুষ, আমার মত খারাপ তিনি ইহজীবনে কাউকে দেখেননি ইত্যাদি বলে বাড়ি মাথায় তোলেন। আবদুল করিমের কাছ থেকে ভারত যাওয়ার আগে টাকা ধার নিয়েছিলাম, কিন্তু ফেরত দেওয়ার কথা ছিল প্রতিমাসে মাইনে পেয়ে। তিনি রাজি হয়েছিলেন, আর এখন হুট করে বাকি সবটা টাকাই একবারে চাচ্ছেন। এই আবদুল করিমও কম কৌশল করেননি আমাকে নাগাল পেতে। বুঝতে দিইনি কখনও, যে, আমি বুঝতে পারছি তাঁর কৌশল। ফুল ফুলের চারা দেখাতে আবদুল করিম একদিন আমাকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন ছোটবাজারের এক ব্যবসায়ীর বাড়িতে। সাদা মনে সেই বাড়িতে গিয়ে দেখি সবুজ পাঞ্জাবি পরা, পকেটে টাকার বাণ্ডিল নিয়ে ঘোরা মধ্যবয়সী ব্যবসায়ী আর আবদুল করিম বসে আছেন একটি অন্ধকার অন্ধকার ঘরে। ব্যবসায়ীটির অনেক টাকা, আমার টাকা পয়সার দরকার হলে তাঁর কাছে চাইলেই দিয়ে দেবে, এমনকী শোধ না দিলেও চলবে এধরনের কথা যখন আবদুল করিম বলছিলেন, যেন বুঝিনি তিনি কি ইঙ্গিত করছেন, হেসে, চা খেয়ে, সবুজ পাঞ্জাবির সবজি-বাগানের ব্যবসা নিয়ে সাধারণ কিছু আলাপ করে আমার হাসপাতালে যাবার তাড়া আছে এক্ষুনি না গেলেই নয় বলে বেরিয়ে এসেছি। এই আবদুল করিমই অবকাশে এসে আমাকে ডেকে একদিন বলেছেন, ‘ডাক্তার, আমার একটা অসুখ আছে, কী করা যায় বল তো!’ কি অসুখ জানতে চাইলে তিনি গলা চেপে বলেন, তাঁর সেক্সুয়াল ডিজায়ার অত্যন্ত বেশি, দুই বউএর কেউই তাঁকে হ্যাপি করতে পারছে না, তিনি যত বেশি চান, তারা তত বেশি মিইয়ে যায়, তিনি স্টে করেন অনেকক্ষণ, তারা খুব তাড়াতাড়িই ফিনিশ। শুনে, এ যেন হরহামেশা হচ্ছে এমন সহজ রোগ, যেন সর্দি জ্বর, যেন আমাশা, যেন অম্বল— কান নাক চোখ ঠোঁট যথাসম্ভব অপরিবর্তিত রেখে অত্যন্ত সহজ সুরে, টাক মাথা, উপরি টাকায় পকেট বোঝাই করা, পান-দাঁতে হাসা, হাসিতে ভুঁিড় কাঁপা লোকটির চিকিৎসা করি, চিকিৎসা বলতে উপদেশ ‘এ তো এমন কোনও সমস্যা না, আপনি যৌনরোগবিশেষরি কাছে যান, ওখানে ভাল ট্রিটমেন্ট পাবেন, আমি তো যৌনরোগের বিশেষজ্ঞ না।’

‘কী বল, তুমি ডাক্তার হইছ, তুমি ট্রিটমেন্ট করতে পারবা না কথা হইল!’

‘আপনের যে রোগ করিম ভাই, তার জন্য বিশেষজ্ঞ দরকার।’

‘কী যে বল, তুমি হইলা আপন মানুষ, আত্মীয়। বাইরের ডাক্তারের কাছে এইসব বলা যাবে নাকি!’

‘কেন যাবে না? রোগ তো রোগই।’

‘নাহ, এই রোগ কোনও ডাক্তারে সারাইতে পারবে না।’

‘আমি তো ডাক্তার, আমার কাছে তাইলে বললেন কেন!’

ফ্যাক ফ্যাক করে হাঁসের মত হেসে করিম বললেন, ‘আমার চিকিৎসা কি তা আমি জানি।’

কি চিকিৎসা তা জিজ্ঞেস করি না, তিনি নিজেই বলেন, ‘আমার একটা ইয়ং মেয়ে দরকার।’

আমি বলি, ‘কিরণ আর কুমুদ তো আছে, আপনের দুই মেয়ে। ইয়ং মেয়ে।’

করিম জিভে কামড় দিয়ে বলেন, ‘ওরা তো আমার সন্তাান। বলতাছি আমার নিজের জন্য।’

‘ও তাই বলেন!’

না বোঝার এই ভানটুকু আমার না করলেই নয়। আমি লোকটিকে জুতোপেটা করে বাড়ি থেকে তাড়াতে চাই না, লোকটি এবাড়ির আত্মীয়। কিন্তু লোকটিকে বুঝতে দিতেও চাই না যে তাঁর কোনও ইঙ্গিত আদৌ আমার বোধগম্য হয়েছে। আমি বুঝেছি তিনি যা বলতে চেয়েছেন, তা যদি তিনি বোঝেন, তবে এটুকুই তাকে যৌনতৃপ্তি দিত হয়ত। ভানটুকু করেছি, কারণ, তাঁকে, যত কুকথাই তিনি বলুন, ভাল মানুষ হিসেবেই বিচার করি, তিনি যে কোনও অশোভন ইঙ্গিত দিতে পারেন তা যে আমি কল্পনাও করতে পারি না, তাও বোঝানো। এটুকু যদি তাঁকে অন্তত আমার সঙ্গে আর কখনও এমন আলাপচারিতায় আগ্রহী না করে, যে আলাপের রস গ্রহণ করার মত যোগ্যতাও আমার নেই।

সেই করিম।

সেই আবদুল করিম।

বাড়ি মাথায় তুলছেন চেঁচিয়ে। আমি খারাপ মেয়ে। আমি তাঁর টাকায় লাঙ নিয়ে ফুর্তি করে এসেছি। আমি মৌজ করে এসেছি, আমোদ করে এসেছি। এইসব খারাপ চরিত্রের মেয়েদের যে কেউ চাইলেই পেতে পারে! ইত্যাদি ইত্যাদি।

মা ধমকে থামান করিমকে। বলেন, ‘বাজে কথা বলতাছো কেন! টাকা ধার নিছে। টাকা দিয়া দিবে। আজ না পারে, কাল দিবে, এইজন্য এইসব কথা বলার তুমি কে?’

করিম থামেন। ওদিকে হাসিনা কিন্তু দরজায় দাঁড়িয়ে করিমের প্রতিটি কথা শুনে যাচ্ছিল, কোনও রকম প্রতিবাদ করেনি। করার কোনও কারণ নেই, কারণ তার একধরণের আনন্দই হচ্ছিল কথাগুলো শুনতে। এরকম মোক্ষম সুযোগ ছেড়ে দেওয়ার সে কোনও মানে দেখে না।

যখন ইয়াসমিন ঘরে ঢোকে মিলনকে নিয়ে, করিম চলে গেছেন। গয়নাগাটি আমার যেখানে যা ছিল বের করে নিয়ে যাই সোনার দোকানে, ইয়াসমিন সঙ্গে যায়। যত দাম সোনার, তার চেয়ে অর্ধেক দাম বলে দোকানী, সেই দামেই দিয়ে দেখি কুড়ি হাজার টাকা হচ্ছে। ইয়াসমিন মিলনের কাছ থেকে পাঁচ হাজার টাকা ধার নিয়ে দেয়। পঁচিশ হাজার টাকা সেদিনই হাসিনার হাতে তুলে দেওয়া হয় তাঁর ভদ্রলোক বোন জামাইকে যেন দিয়ে আসে। টাকা হাতে পেয়ে হাসিনার মুখে কোনও স্বস্তির ছোঁয়া দেখা যায় না, যেন আমি দীর্ঘদিন এই দেনায় বেঁধে থাকলে তার আনন্দ হত।

আমি পালাই ময়মনসিংহ থেকে। শ্বাস নিতে যাই কোনও শুদ্ধ হাওয়ায়। ঢাকায় গীতার দুর্ব্যবহার যথারীতি চলে। ঢুকতে দেয় তো বসতে দেয় না, বসতে দেয় তো শুতে দেয় না। সুহৃদকে নাগাল থেকে সরিয়ে রাখে। সুখের সময় গীতা হয়ত পিঁড়ি দেয় বসতে, দুঃখের সময় দূর দূর করে তাড়ায়। গীতার যে কত রকম নিয়ম আছে অপদস্থ করার, তা বোঝার সাধ্য থাকে না আমার। নাইমের কাছে যাই ভাঙা মন নিয়ে। হীনতা স্বার্থপরতা আর কুটকচাল এসব তার নেই তো নেই ই, বরং কী করলে আমি খুশি হব, কী করলে আমি তাকে বেশ বুদ্ধিমান মনে করব, কী করলে মনে করব তার কোনও সংকীর্ণতা নেই, কী বললে মনে করব নারী পুরুষে যে কোনও রকম বৈষম্যের সে বিরোধী, প্রগতিশীল রাজনীতিতে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনায়, ধর্মনিরপেক্ষতায় বিশ্বাসী, কী বললে তাকে অসাম্প্রদায়িক ভাবব, কী করলে তাকে স্বচ্ছল, স্বচ্ছ, উদার, উচ্ছল, প্রাণবান বলে ভাবব এবং তার প্রতি আকৃষ্ট হব, তার সবই সে করার বলার প্রাণান্ত চেষ্টা করে যায়। নাইমের এত চেষ্টার পরও তার প্রতি আমার জন্য কোনও ভালবাসা জন্ম নেয় না। আমার অনাথ অভুক্ত অবাধ অসার শরীরটি নাইমের স্পর্শে স্পর্শে যেদিন জেগে ওঠে, সেদিনও তার জন্য আমার কোনও প্রেম জাগে না। চল বিয়ে করি! নাইম বলে সেই বিকেলেই, যে বিকেলে শরীর জাগে। বাক্যটি এমনভাবে সে বলে যে মনে হয় সে অন্য যে কোনও দিনের মত চল চা খাই, চল মেলায় যাই বা চল ঘুইরা আসি বলছে। বাক্যটি আমাকে মোটেও চমকে দেয় না। নাইমের যে কোনও প্রস্তাবে আমি রাজি হই, যেহেতু আমি জানি যে সে আমার সবচেয়ে বড় বন্ধু, জানি যে পৃথিবীর আর কেউ চাইলেও সে আমার কোনও অমঙ্গল চায় না। নাইমকে আমার কোনও খাঁচা বলে মনে হয় না। লাঞ্ছনা আর অপমানের পুঁতিগন্ধময় পরিবেশ থেকে নাইম আমার জন্য একরকম মুক্তি।

সেই বিকেলেই ধানমণ্ডির দিকে রিক্সা করে ঘুরে বেড়াতে বেড়াতে রাস্তার পাশে ছোট্ট একটি ঘরে নাইম থামে, ঘরটির মাথায় ছোট একটি নোটারি পাবলিক লেখা সাইনবোর্ড ঝোলানো। স্যাঁতসেঁতে অন্ধকার ঘরটিতে ভূুতের মত একটি লোক বসা ছিল, নাইম জিজ্ঞেস করল বিয়ে করতে হলে কি করতে হয়। দুজনের দুটো সই, আর কিছু টাকা। পাঁচ মিনিটের মধ্যে সইও হল, টাকাও দেওয়া হল। সে রাতে নাইমের ইস্কাটনের বাড়িতে ফিরে দুজনের শোয়া হল, প্রথম শোয়া। শুতে হলে কি সই করে শুতে হয়! সই না করেও তো হয়! সই ব্যপারটিকে আমার খুব গুরুত্বপূর্ণ কিছু বলে মনে হয় না। আপিসের কাগজপত্রে সই চাইলেই সই দিয়ে দিই। আমি একটি তুচ্ছ মানুষ, আমার সই এর মূল্যই বা কী! সই হয়। এতে আমার কিছু না হলেও নাইমের হয়। শুতে হলে নাইমের সই করে শোয়ার সংস্কারটির একটি রফা হয়। ঘর ভর্তি বাবা মা ভাই বোন, বোন জামাই, ভাই বউ সবার মধ্যেই নাইম আমাকে নিয়ে পুরোটা রাত না হলেও অর্ধেক রাত কাটায়। এ বাড়িতে নাইমের অধিকার আছে যা কিছু করার। এ বাড়িতে নাইমই হল কর্তা, সে যা করে, তাতে কারও জিভে প্রতিবাদের টুঁ ওঠে না কারণ বাড়ির বাসিন্দাদের খাওয়া পরার সব খরচ নাইমই জোগায়, মন্ত বড় বাড়িটির ভাড়াও। এ বাড়িতে তার বন্ধু বান্ধবীরা অহরহ আসছে, খাচ্ছে, রাত কাটাচ্ছে। এ বাড়িতে এক রাতে আমিও থেকেছি, নাইম তার ঘরটি আমার জন্য ছেড়ে দিয়েছিল। এবারের থাকা অন্যরকম যদিও, সই করে থাকা, কিন্তু আমার মোটেও অন্যরকম মনে হয় না। যেমন বন্ধু ছিল নাইম, তেমনই থেকে যায়। তেমনই তুই তোকারি।

ময়মনসিংহে পানে লাল হওয়া জিভের, লাল চশমার,পরিবার পরিকল্পনার সুন্দরী কর্মীদের দিকে বাঁকা বাঁকা হাসি হাসা ডিজির আবেদনে কাজ হয়েছে। বদলি চৌদ্দগ্রামে। এক লাথিতে চৌদ্দ পুরুষের নাম ভুলিয়ে দিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। আমি যে খুব নিরানন্দে ভুগেছি বদলির আদেশ পেয়ে তা নয়। একরকম চাচ্ছিল!মও অবকাশ থেকে দূরে যেতে, পরিবার পরিকল্পনার অসুস্থ পরিবেশ থেকে, যে অসুস্থতার বিরুদ্ধে কোনও জীবানুনাশক কাজ করে না, চাচ্ছিল!মও সরতে। চৌদ্দগ্রাম চলে যাবো শুনে মা চিৎকার করে কাঁদলেন। কিন্তু যেতে তো হবেই। বদলির চাকরি। চৌদ্দগ্রামের স্বাস্থ্য কেন্দ্রে যোগ দিয়ে কদিন আসা যাওয়া কুমিল্লায় নাইমদের বাড়িতে থেকে করেছি। ওখানে প্রায়ই চলে যেত নাইম, ভোরে উঠে আবার ঢাকা ফিরত।

আমাকে চমকে দেওয়ার অভ্যেস তখনও যায়নি নাইমের। হঠাৎ একদিন একটি কাগজ হাতে দিল নাইম, আমার বদলির কাগজ। চৌদ্দগ্রাম থেকে দু সপ্তাহের মধ্যেই ঢাকার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ ও মিটফোর্ড হাসপাতালের রক্তব্যাংকে মেডিকেল অফিসার পদে বদলি। নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারি নি। প্রভাব বুঝি একেই বলে! আমার পক্ষে জীবনে কখনও সম্ভব ছিল না কোনও ভাল জায়গায় বদলি হওয়া, ঢাকা শহরে মোটে দুটো মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল। লোকে বলে মামা কাকার জোর না থাকলে এসব জায়গায় পোস্টিং হয় না। আমার মামা কাকারা কেউ ওপরতলায় বাস করেন না। সুতরাং আমার কপালে চৌদ্দগ্রাম, পঞ্চগ্রাম, অষ্টগ্রামই ছিল। একটি সাপ্তাহিক পত্রিকার সম্পাদকের দৌড় খবরের কাগজ আপিস পর্যন্ত না হয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় পর্যন্ত যে হতে পারে, তা কটি লোক জানে! নাইমের এই চমকটি আগের সব চমককে ছাড়িয়ে যায়। কিন্তু এতদসত্বেও তার সঙ্গে সইএর সম্পর্কটিও আমার দুমাসও টেকেনি। নাইমের ইচ্ছে ছিল একদিন ঘটা করে বিয়ের অনুষ্ঠান করবে, বন্ধু বান্ধব চেনা পরিচিত সবাইকে জানাবে বিয়ের খবর। তার এই ইচ্ছেটি সফল হয় না। একদিন রিক্সা নিয়ে ধানমণ্ডির দিকে যেতে যেতে হঠাৎ থেমে ওই ছোট্ট অন্ধকার ঘরটিতে গিয়ে কিছু টাকা আর একটি সই দিয়ে আসি, এবারের সইটি আগের সইটির উল্টো। সই থাকা না থাকায় কোনও কিছু যায় আসে না। আমি সেই আগের আমি। আমার মনে হয় না কিছু হারিয়েছি বা কিছু পেয়েছি আমি। প্রথমবার এখানে সই করতে এসেও যেমন নিস্পৃহ ছিলাম, এবারও তাই। সই এর গুরুত্ব আমার কাছে বন্ধুত্বের চেয়ে বেশি নয়। বন্ধুত্ব যদি ম্লান হয়ে আসে, সেখানে কোনও সই কোনও সম্পর্ক ধরে রাখতে পারে না।

সইএর ঘটনার পর থেকেই নাইমের সংকীর্ণ, প্রতিশোধপরায়ণ, অনুদার, হিংসুক চেহারাটি ধীরে ধীরে এত প্রকট হয়ে ফুটে ওঠে যে ভাবতে লজ্জা হয় এই নাইম সেই নাইম, যাকে আমি নিজের সবচেয়ে ভাল বন্ধু বলে মনে করেছিলাম। আমার ওপর কর্তৃত্ব করার স্পৃহা তাকে উন্মাদ করে তুলেছে।

আমি ময়মনসিংহে যেতে চাইলে নাইম বলে এখন যাওয়ার দরকার নাই।

মানে?

মানে হইল এখন যাওয়ার দরকার নাই।

তাইলে কখন যাওয়ার দরকার?

পরে।

পরে কবে?

আমি বলব।

যেদিন নাইম সিদ্ধান্ত নেবে সেদিন আমাকে ময়মনসিংহে যেতে হবে। যেদিন সে আমাকে বাইরে বেড়াতে নেবে, সেদিন আমাকে বাইরে বেড়াতে যেতে হবে।

সইএর আগে নাইম যেমন সারাক্ষণ ব্যস্ত ছিল আমাকে আনন্দ দেওয়ার জন্য, সই এর পর সে ব্যস্ত হয়ে যায় তার ইচ্ছের খাঁচায় আমাকে বন্দি করার জন্য। বন্দি হতে না চাইলে নাইম চিৎকার করে, দপদপ করে কাঁপতে থাকে তার কপালের শিরা। সই এর আগে তার যে গাড়িটি আমি মাঝে মধ্যে চালাতাম, সইএর পর কৌশলে সেই গাড়ির চালকের আসনে আমার বসা সে বন্ধ করে দেয়। সইএর আগে প্রতি সপ্তাহে আমার কলাম ছাপার জন্য ভীষণ আগ্রহ ছিল তার, সইএর পর সেই আগ্রহ আর থাকে না। আমি ক্রমশ নাইমের হাতের পুতুল হয়ে উঠি। আমি যদি একটি কলম চাই, নাইম আমাকে দশটি কলম এনে দেবে কিন্তু সে দেবে, আমাকে সংগ্রহ করতে দেবে না। আমার সব ইচ্ছে আকাঙ্খা নাইম মেটাতে চায়, আমাকে সে কিছুই মেটাতে দেয় না। আমাকে সে আমার জন্য অহংকার করতে দেয় না, আমার জন্য অহংকার সে নিজে করতে চায়। আমার সব দায়িত্ব সে নিজে নিতে চায়, যেখানে আমার কোনও ভুমিকা থাকবে না, কেবল তার ভুমিকাই থাকবে। সে যে আমার চেয়ে সবদিক দিয়ে বড়, তা বোঝাতে এমন মরিয়া হয়ে উঠল যে আমার কৃতিত্ব ক্রমে ক্রমে তার কাছে তুচ্ছ বিষয় হয়ে ওঠে, যে কৃতিত্ব নিয়ে তার একসময় গৌরবের সীমা ছিল না। যে নাইম নিজেকে নিয়ে হাস্যরস করত, বলত ‘আমি কিচ্ছু জানি না, আমার কোনও ধারণাই নাই, আমি হইলাম একটা গবেট,’ সেই নাইমই নিজেকে জ্ঞানের আধার, সর্বগুণে গুণান্বিত, সর্ববিদ্যায় পারদর্শী বলতে কোনও দ্বিধা করে না। নিজের মহানুভবতার কথা চোখ ফুলিয়ে, নাক ফুলিয়ে, বুক ফুলিয়ে, পেট ফুলিয়ে অনর্গল বলে যায়। আমার মনে হতে থাকে নাইমের আগের চরিত্রের আদ্যোপান্ত ছিল আমাকে জয় করার জন্য। আসল চেহারাটি মানুষের কোনও না কোনও সময় বেরোয়, মুখোশ একসময় খুলে পড়েই। আমাকে যে করেই হোক সে তার মুঠোয় পেয়েছে। মুঠোর মধ্যে কোনও মেয়েমানুষ এসে গেলে তাকে আর মাথা ছাড়াতে দিতে কোনও পুরুষেরই ইচ্ছে করে না। নাইম তো পুরুষই।

নাইম নিজের বাবার প্রশংসায় পঞ্চমুখ, প্রায়ই উল্লেখ করে বাবা তার পকিস্তান আমলে সংসদ সদস্য ছিলেন। এ নিয়ে গৌরবের কিছু আছে বলে আমার মনে হয় না। কারণ তার এই বাবাই কুমিল্লার দেবীদ্বারে মুসলিম লীগের নেতা ছিলেন, এমনকি মুক্তিযুদ্ধের সময় কেবল রাজাকারই নয়, শান্তি কমিটির বড় নেতা ছিলেন। নাইম কখনও তার বাবার অতীতের ভূমিকা নিয়ে গ্লানিতে ভোগে না। একবারও বলে না যে তার বাবা ভুল করেছিলেন। বাবাকে এমনই সে ভালবাসে যে আমাকে কোনও কারণ ছাড়াই তাঁর রক্তচাপ মাপতে বলে। একবার মেপে দেখেছি রক্তচাপ ঠিক আছে, পরদিনও আবার সে মাপতে বলে। পরদিনও মাপি। তার পর আবারও। আমি অবাক হয়ে বলি, কেন? নাইম বলে, এমনি। এমনি কেন? এমনি এমনি প্রতিদিন কারও রক্তচাপ মাপার তো কোনও অর্থ হয় না। বাবা তার রীতিমত সুস্থ মানুষ, রক্তচাপে কোনও ওঠানামা নেই, কিন্তু তার বাবা বলেই, বাবাকে সে ভালবাসে বলেই আমাকে খামোকা তাঁর রক্তচাপ মাপতে হবে। আমি না বলে দিই, আমি মাপবো না। নাইম রাগে থরথর করে কাঁপে। এমনিতেই তার আঙুল কাঁপে কোনও কারণ ছাড়াই। রেগে গেলে সারা গা কাঁপে। চোখ বেরিয়ে আসে গর্ত থেকে। নাইম যেমনই হোক, নাইমের পরিবারের সকলে খুব চমৎকার মানুষ। নাইমের মা দেখতে অপূর্ব সুন্দরী, সুন্দরীর স্বামীটি অসুন্দরের ডিপো। ডিপো হলেও আমি যে কটাদিন নাইমের বাড়িতে ছিলাম আমার সঙ্গে মধুর ব্যবহার করেছেন। কেবল তিনিই নন, বাড়ির সকলেই আমাকে মাথায় তুলে রেখেছে। মাথায় তুললেই কি সুখ হয়!

নাইমের বিনয়ী স্বভাবে অনেকে আকৃষ্ট হয়, কিন্তু ভেতরে ভেতরে অহংকার তার প্রচণ্ড। নিজেকে নিয়ে যেমন, তার বাবাকে নিয়েও তার অহংকারের শেষ নেই। নাইমের রাজনৈতিক বিশ্বাস নিয়ে আমার মনে প্রশ্ন জাগে। খবরের কাগজের দায়িত্ব নেওয়ার আগে সে চাকরি করত ইনকিলাব পত্রিকায়। ইনকিলাব পত্রিকাটি একশ ভাগ মৌলবাদিদের পত্রিকা। এর সম্পাদক প্রকাশক মাওলানা মান্নান দেশের নামকরা রাজাকার। স্বাধীনতার পক্ষের শক্তির বিরুদ্ধে হামেশা লিখে যাচ্ছে। দেশে ইসলাম ধর্ম প্রচারে সবচেয়ে বড় ভূমিকা পালন করছে। নাইম এই পত্রিকাার বিরুদ্ধে একটি বাক্য উচ্চারণ করে না। বরং ইনকিলাব পত্রিকাটির মেক আপ গেট আপ, ইনকিলাবের ছাপাখানার অকুণ্ঠ প্রশংসা করে। খবরের কাগজও সে ছাপে ইনকিলাবের ছাপাখানা থেকে। একদিন রাতে আমাকে নিয়ে ইনকিলাবের আধুনিক ছাপাখানা দেখিয়ে আনে। দেশে দুটি পক্ষ, একটি মৌলবাদ, আরেকটি মৌলবাদের বিরুদ্ধ। খবরের কাগজের সম্পাদকের ভূমিকায় এসে মৌলবাদের বিরুদ্ধ শক্তির সঙ্গে তার খাতির জমে ওঠে, কিন্তু সে নিজে খুব স্পষ্ট করে কোনও পক্ষ নেয় না। ইনকিলাবের অন্ধকার গুহা থেকে বেরিয়ে সে এক আলোকিত জগতে এসেছে। সাংবাদিকতায় বিশ্ববিদ্যালয় পাশ করা নাইম খবরের কাগজ আর আজকের কাগজের কোনও সম্পাদকীয় আজ পর্যন্ত লেখেনি, আশেপাশের ডেস্কে বসা পাতি সাংবাদিকদের দিয়ে সম্পাদকীয় লিখিয়ে নেয়। কোনও রাজনৈতিক বা সামাজিক নেতার বা কোনও কবি লেখকের কোনও সাক্ষাৎকারও সে আজ পর্যন্ত নেয়নি। এসবে তার দক্ষতা নেই। তার দক্ষতা বাণিজ্যে। কাজী শাহেদ আহমেদ তাকে পছন্দ করে সম্পাদকের দায়িত্ব দিয়েছেন। বড় বড় লেখকদের জড়ো করে কলাম লিখিয়ে কাগজের বাণিজ্যিক সাফল্য অর্জন করেছে তার ওপর জনপ্রিয়তা জুটিয়েছে। নাইম যদিও লেখালেখির জগতে উড়ে এসে জুড়ে বসা একটি নাম তার পরও তার কৃতিত্বের জন্য সে বাহবা পাওয়ার যোগ্যতা রাখে। এরকম হঠাৎ এসে ঝড় তোলা কম কথা নয়।

নাইমের সঙ্গে ওই শোয়াশোয়ির শুরুতেই ঘটনা বা দুর্ঘটনাটি ঘটে। রুদ্রর সঙ্গে দীর্ঘদিন শুয়েও যে ঘটনাটি ঘটেনি, তা নাইমের সঙ্গে দুদিন শুয়েই ঘটে যায়। পেটে বাচ্চা আসে। সারা শরীরে আশ্চর্য এক পরিবর্তন লক্ষ করি। মনেও। যেন এ আমি অন্য আমি। এ আমাকে আমি চিনি না। নিজের রূপান্তরিত এই অস্তিত্বটি অভাবিত এক শিহরণ সৃষ্টি করে আমার ভেতর। এই রূপটিকে আগে কখনও আমি কল্পনা করিনি। ভয়, লজ্জা, সুখ, স্বপ্ন, সব বিজলির মত চমকাতে থাকে আমার আকাশ জুড়ে। নাইম আমাকে অনেক চমকে দিয়েছে। কিন্তু এবারের চমকটি ভিন্ন। এই চমকটির কোনও তুলনা হয় না।

চল ক্লিনিকে চল।

ক্লিনিকে কেন?

এবরশন করতে চল।

মানে?

মানে কিছু না। এবরশন করতে হইব।

এবরশন করতে হইব কেন?

আরে এহনই আবার বাচ্চা কাচ্চা কি? এইসব পরে চিন্তা করলেই হইব।

আমার কোনও আপত্তি নাইম মানে না। সে আমাকে গুলশানের একটি ক্লিনিকে টেনে নিয়ে গিয়ে আমার গর্ভপাত ঘটায়। আমি জানি কেন ঘটায় সে এটি। তার ধারণা, ভ্রূণের জন্য যে স্পার্মের প্রয়োজন হয়, তা অন্য কোথাও থেকে আমি সংগ্রহ করে এনেছি। নাইমের জন্য আমার মায়া হয়, সন্দেহের মন তার নিজের বাচ্চাকে মেরে ফেলতে দ্বিধা করেনি। সন্দেহ এমনই এক ভয়ংকর আগুন, আমি পুড়ে ছাই হয়ে যেতে থাকি। আমি কোথায় যাচ্ছি, কার সঙ্গে কথা বলছি, কে আমাকে জন্মদিনে কি উপহার দিচ্ছে, কেন দিচ্ছে এসব নিয়ে সন্দেহের চোখ ক্রমশ বাঘের মত হতে থাকে, আমাকে ছিঁড়ে খেতে চায় সে চোখ। মায়া হয় নাইমের জন্য, তার সন্দেহের মন এ কথা তাকে বুঝতে দেয় না যদি কারও সঙ্গে আমার কোনও রকম শারীরিক মানসিক সম্পর্ক থেকে থাকে, তবে তা তার সঙ্গেই, আর কারও সঙ্গে নয়। নাইম ভেবেছে আমি তার সঙ্গে চালাকি করেছি, তাই সে অতি চালাকি করে আমার চালাকির জবাব দিয়েছে। মন ধীরে ধীরে নয়, খুব দ্রুতই ওঠে নাইম থেকে।

একসময় খবরের কাগজ আপিসেও শুরু হয় নাইমের অতি চালাকির বিরুদ্ধে বিস্ফোরণ। কাজী শাহেদ আহমেদের ব্ল্যাংক চেক এর অপব্যবহার করেছে নাইম। কাজী শাহেদ অর্ধচন্দ্র নয়, পূর্ণচন্দ্র দিয়েই বিদেয় করেন নাইমকে। কাগজের মালিক কাজী শাহেদ নিজে সম্পাদকের দায়িত্ব নেন। যে কাজীর প্রশংসায় নাইমের মুখে খই ফুটত, সেই একই কাজী সম্পর্কে সে বলে বেড়াতে লাগল তাঁর মত বদ লোক দুনিয়ায় আর নেই। কুৎসা ছাড়া আর কিছু তার মুখে ফোটে না। তাকে তার বিশালাসন থেকে নামিয়ে দেবার শোধ সে যে করেই হোক নেবে। নাইমের ঘটে বুদ্ধি কম নয়, এই বুদ্ধির জোরেই সে খবরের কাগজ সাপ্তাহিকীটি জনপ্রিয় করে আজকের কাগজ নামে একটি দৈনিকে হাত দেয়। রাতারাতি আজকের কাগজ দেশের এক নম্বর না হলেও দু নম্বর জনপ্রিয়তার তালিকায় চলে আসে, বুদ্ধি আছে, তবে সেই বুদ্ধির সঙ্গে কিছু কিছু কুবুদ্ধি সব কিছু গোলমাল করে দেয়। নাইম দমে যাওয়ার পাত্র নয়। আজকের কাগজের কাজ ফুরিয়ে গেলে সে যে বিমর্ষ বসে থাকবে তা নয়, দল বল জোগাড় করে ভোরের কাগজ নামে একটি পত্রিকা বের করে। আজকের কাগজে যে লেখকদের দিয়ে লেখাতো, অনেককে সরিয়ে নিয়ে আসে নতুন কাগজে। ভোরের কাগজ জনপ্রিয় হতে থাকে ধীরে ধীরে।

নাইম যখন বুঝতে পারে আমি আর তাকে বিশাল কিছু বলে মনে করছি না, সে উঠে পড়ে লেগে যায় প্রতিশোধ নিতে। তার বিনয় ঝুলে পড়ে মরা ডালের মত, তার ভদ্রতা নম্রতা সৌজন্য সব গ্যাসবেলুনের মত শূন্যে উড়ে যায়, সত্যিকার নাইম তার চোখ রাঙানো, দাঁত দেখানো, গলা ফাটানো নিয়ে প্রকাশিত হয়। তার কোনও আচরণ আমাকে কষ্ট দেবে কি না, ক্ষুব্ধ করবে কি না তা নিয়ে আর সে চিন্তিত নয়। আমার চেনা পরিচিত আত্মীয় বন্ধু যাকেই সে চেনে সবার কাছে গিয়ে সে আমার জন্য সে এই করেছে সেই করেছে আর আমি তার জন্য এই করিনি সেই করিনির লম্বা ফিরিস্তি দিয়ে বুঝিয়ে আসে যে তার মত এত অনুগত, অনবদ্য, অসাধারণ ছেলের সঙ্গে আমি খুব অন্যায় করেছি। আমি অকৃতজ্ঞ। আমি অপয়া। আমি অশালীন। আমি অবিবেচক। আমি অপ্রকৃতিস্থ।

নাইম যখন বুঝতে পারে যে তাকে আমি র্নিদ্বিধায় ত্যাগ করতে পারি, তখন সে জোঁকের মত আমাকে আঁকড়ে ধরতে চায়। যখন সে টের পায় যে তার সন্দেহের ধারে কাছে আমি আর যেতে চাইছি না, সে ফেটে পড়ে রাগে। যখন সে দেখে তার রাগের আমি মোটেও পরোয়া করছি না, সে আমাকে হেনস্থা করার পরিকল্পনা আঁটে। পরিকল্পনায় নাইম বরাবরই বড় পাকা।

মিটফোর্ড হাসপাতালের কাছে আরমানিটোলায় একটি বাড়ি ভাড়া করে থাকছি। হঠাৎ একদিন দরজায় কড়া নাড়ে কেউ। খুলে দেখি নাইম। তার জানার কথা নয় আমার ঠিকানা। কিন্তু বাজপাখির চোখ ঠিক ঠিক চিনে নেয় কোথায় শিকার তার। দরজা সে এমন জোরে ধাককাতে থাকে যে আশেপাশের লোক জমে যায়। অতিষ্ঠ হয়ে বেরিয়ে এসে তাকে জানিয়ে দিই, কিছুতেই আমি তাকে ভেতরে ঢুকতে দেব না। ঢুকতে তাকে দিইনি কারণ আমি চাইনি রুদ্রকে সে একফোঁটা অসম্মান করুক। একসময় নাইম সরে যায় আমার দরজা থেকে, কিছু করার পরিকল্পনা নিয়েই সে সরে। এক, আমাকে এ বাড়ি থেকে উচ্ছেদ করা। দুই, সত্যিকার একটি বিয়ে করা।
 
০৯. সুখের সংসার



মিটফোর্ডের ব্লাড ব্যাংকে পোস্টিং আমার। রক্ত বিক্রি করার জন্য দরিদ্র কিছু লোক আসে, সেই লোকদের শরীর থেকে রক্ত কি করে নিতে হয়, কি করে রক্তের ব্যাগে লেবেল এঁটে ফ্রিজে রাখতে হয় তা ডাক্তারদের চেয়ে টেকনিসিয়ানরাই জানে ভাল। সকাল আটটা থেকে বেলা দুটো পর্যন্ত খামোকা বসে থাকতে হয় আমার। মাঝে মধ্যে কিছু কাগজে সই করা ছাড়া আর কোনও কাজ নেই। এরকম কাজহীন বসে থাকা আমার অসহ্য লাগে। ব্লাড ব্যাংকের পাশেই স্ত্রীরোগ ও প্রসূতি বিভাগ। ওখানে ডাক্তাররা দম ফেলার সময় পায় না এমন ছুটোছুটি করে কাজ করে। দেখে আমার বড় সাধ হয় ব্যস্ত হতে। দিন রাত কাজ করতে। একদিন গাইনি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক বায়েস ভুঁইয়ার কাছে একটি আবেদন পত্র লিখে নিয়ে যাই। ‘আমি গাইনি বিভাগে কাজ করতে আগ্রহী, আমাকে কাজ করার অনুমতি দিয়ে বাধিত করবেন।’ অধ্যাপক বায়েস ভুঁইয়া আমাকে বাধিত করেন।

হাসপাতালের কাছেই আরমানিটোলায় আমার বাড়ি। বাড়িটি ভাড়া নিতে আমাকে সাহায্য করেছেন বিদ্যাপ্রকাশের মালিক মজিবর রহমান খোকা। খোকার প্রকাশনায় আমার কবিতার বই খুব ভাল চলছে। আরও লেখার প্রেরণা দিচ্ছেন তিনি। হাসপাতাল থেকেই ব্লাড ব্যাংকের অকাজের সময়গুলোয় মিটফোর্ডের কাছেই বাংলাবাজারে গিয়েছি বইয়ের খবর নিতে, দুএকদিন যাওয়ার পর একদিন তাঁকে বলি, যে করেই হোক একটি বাড়ি যেন তিনি আমার জন্য খোঁজেন, ভাড়া নেব। ইতিমধ্যে হাসপাতালের আশে পাশে বাড়ি খুঁজতে খুঁজতে মাথায় টু লেট লেখা যে বাড়িতেই গিয়েছি, বাড়ি, বাড়িভাড়া সবই পছন্দ হবার পর, বাড়িঅলা জিজ্ঞেস করেছেন, ‘কে কে থাকবে বাড়িতে?’

‘আমি থাকব।’

‘আপনি সে তো বুঝলাম, কিন্তু পুরুষ কে থাকবে আপনার সঙ্গে?’

‘কোনও পুরুষ থাকবে না, আমি একা থাকব।’

বাড়িঅলা চমকে উঠেছেন, ‘একা আবার কোনও মেয়েমানুষ কোনও বাড়িতে থাকে নাকি!

আপনার স্বামী নাই?’

‘না।’

‘না, কোনও একা মেয়েমানুষকে আমরা বাড়ি ভাড়া দিই না।’

মুখের ওপর দরজাগুলো ধরাম করে বন্ধ হয়ে যায়। তারপরও আশা ছেড়ে দিই না। খোকা রাজি হলে খোকাকে নিয়ে বেরোই বাড়ি দেখতে। যে বাড়িই পছন্দ হয়, সে বাড়িতেই, যেহেতু খোকা পুরুষ মানুষ, বাড়িঅলা তাঁকেই জিজ্ঞেস করেন, কে কে থাকবে বাড়িতে? খোকা বলেন, ‘উনি থাকবেন, উনি ডাক্তার, মিটফোর্ড হাসপাতালে চাকরি করেন।’

‘উনার স্বামী নাই?’

খোকা খুব নরম কণ্ঠে বলেন, ‘না, উনার স্বামী নাই। মিটফোর্ড হাসপাতালে নতুন বদলি হয়ে এসেছেন। হাসপাতালের কাছাকাছি থাকলে সুবিধা। আপনারা ভাড়ার জন্য চিন্তা করবেন না। উনি যেহেতু ডাক্তারি চাকরি করেন, বুঝতেই তো পারছেন, মাস মাস বাড়িভাড়া দিতে উনার কোনও অসুবিধে হবে না।’

খোকাকে নিয়ে এসে এইটুকু অন্তত কাজ হয় একজন ডাক্তার যে বাড়িভাড়া দেওয়ার ক্ষমতা রাখে তা তিনি নিজমুখে ব্যাখ্যা করে বাড়িঅলাদের রাজি করাতে চেষ্টা করেন। কিন্তু যতই মধুর কণ্ঠে মধুর হেসে বলা হোক না কেন, সত্যিকার কোনও কাজ হয় না। কেউই বাড়ি ভাড়া দিতে চায় না কোনও একলা মেয়েমানুষকে। অত্যন্ত অমায়িক কিছু সজ্জন বাড়িঅলা পেয়েছি, যাঁরা মুখের ওপর ধরাম করে দরজা বন্ধ করে দেননি, বা যান ভাই রাস্তা মাপেন, বাড়ি ভাড়া দেওয়া যাবে না বলে দূর দূর করে তাড়াননি, খোকার সবিশেষ অনুরোধে রাজি হয়েছেন বাড়ি ভাড়া দিতে তবে মেয়ের বাবা বা ভাইকে সঙ্গে থাকতে হবে। এর অর্থ স্বামী যদি না থাকে, কি আর করা যাবে, পোড়া কপাল মেয়ের, তবে কোনও একজন পুরুষ আত্মীয়ের থাকতেই হবে সঙ্গে। কেন একটি মেয়ের একা থাকা চলবে না তা বিশদ করে কেউ বলেন না। আমার অভিভাবক একজন কেউ থাকতেই হবে। আমি একজন প্রাপ্ত বয়স্ক মানুষ, আমিই আমার অভিভাবক— এ কথা কেউ মানেন না। বাবা ভাই মামা কাকা কাউকেই যে সম্ভব নয় তাদের জীবন থেকে তুলে এনে আমার সঙ্গে রাখার, তা খোকাকে বলি। খানিক পর মার কথা মনে হয়, এক মাকেই আনা যেতে পারে। কিন্তু মা তো পুরুষ নন, বাড়িঅলারা পুরুষ চান। একজন ডাক্তার মেয়ের সঙ্গে যদি তার মা বাস করেন তবে বাড়ি ভাড়া পাওয়া যাবে কি না তার খোঁজও নেওয়া হল, এতেও লাভ হল না। খুঁজে খুঁজে ঘেমে নেয়ে রাস্তা মাপতে মাপতে আশা ছেড়ে দেওয়ার আগে শেষ চেষ্টা করে দেখার মত যে বাড়িটিতে ঢুকি সেটি আরমানিটোলার এই বাড়িটি। বাড়ির মালিকের সামনে খোকা যতটা বিনীত হতে পারেন হয়ে ঘন্টা দুয়েকের প্রশ্নোত্তরে পাশ মার্ক জুটিয়ে মা আর মেয়ের থাকার ব্যপারে অনুমতি লাভ করেন। জাহাজের মত এই বিশাল বাড়িটির মালিক একটি অশিক্ষিত লোক, লোহা লককরের ব্যবসা করে টাকার পাহাড় হয়েছেন। টাকার পাহাড় হলে যা করে বেশির ভাগ লোক, তিনি তাই করেছেন, দাড়ি রেখেছেন, মাথায় টুপি পরেছেন আর আল্লাহকে সাক্ষী রেখে চারটে বিয়ে করেছেন। চার বউকে পৃথক পৃথক চারটে বাড়িতে রেখেছেন। জাহাজ বাড়িটির দোতলায় চার নম্বর বউ নিয়ে বাস করেন। বাড়িভাড়া তিন হাজার, আর আমার মাইনে কচ্ছপের মত হেঁটে হেঁটে সাকুল্যে আড়াই হাজারে দাঁড়িয়েছে। এই পার্থক্য সত্ত্বেও বাড়ির পাঁচতলায় দুটো ঘর আর লম্বা টানা বারান্দার একটি অ্যাপার্টমেন্ট ভাড়া নিই। একা আমি নিজের বাড়িতে থাকব, অন্যের বাড়িতে অন্যের আদেশ মত নয়, এই আনন্দ এবং উত্তেজনায় আমি কাঁপি। জীবনের প্রথম কারও ওপর ভরসা না করে জীবন যাপন করার জন্য আমি দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। সস্তায় একটি খাট, সস্তায় তোশক বালিশ চাদর, একটি ইস্পাতের আলমারি আর কিছু প্রয়োজনীয় বাসন কোসন কিনে আপাতত বাড়িটি বাসযোগ্য করি। ময়মনসিংহ থেকে মাকে নিয়ে আসি, লিলিকেও। আলাদা একটি বাড়ি ভাড়া করে সম্পূর্ণ নিজের পছন্দ মত থাকায় মাও খুব খুশি। মা এসেই লিলিকে দিয়ে ঘরদোর পরিষ্কার করে গুছিয়ে রান্নাবান্না করে বারান্দায় দাঁড়িয়ে আরমানিটোলার মাঠে ছেলেপেলেদের ফুটবল খেলা, রাস্তার গাড়িঘোড়া আর খোলা আকাশ দেখেন। ধীরে ধীরে জানালার পর্দা কিনি, বিস্তর দরদাম করে বড় একটি লাল সবুজ রঙের তকতির ডিজাইন করা লাল কার্পেট কিনি, রং মিলিয়ে কয়েকটি কুশনও। কোনও সোফা বা চেয়ার টেবিল কেনার টাকা নেই, তাই কুশনেই হেলান দিয়ে কোনও অতিথি এলে যেন বসতে পারে। সোফা যে কিনতে পারিনি, সে জন্য মনে কোনও দুঃখ থাকে না। নিজের প্রথম সংসারটি বড় সুন্দর করে সাজাতে ইচ্ছে করে, সুন্দর সুন্দর জিনিসের দিকে চোখ যায়, কিন্তু আমার সামর্থের বাইরে বলে সুন্দর থেকে চোখ ফিরিয়ে কম দাম কিন্তু দেখতে অসুন্দর নয়, তেমন জিনিস খুঁজি। তেমন জিনিসই নিজের উপার্জিত টাকায় কিনে নিজের সংসারে এনে যে আনন্দ হয় তার তুলনা হয় না। যে মাসে কার্পেট কেনা হয়, সেই মাসে অন্য কিছু কেনার জো থাকে না। পরের মাসের জন্য অপেক্ষা করি। এই অপেক্ষাতেও একধরনের সুখ আছে। মাইনের টাকায় বাড়িভাড়াই যেহেতু দেওয়া সম্ভব নয়, ভরসা লেখার ওপর। সাপ্তাহিক পূর্বাভাস আর পাক্ষিক অনন্যায় কলাম লিখি। খবরের কাগজ আর আজকের কাগজ থেকে নাইমের প্রভাব দূর হওয়ার পর ওসবেও লিখতে শুরু করি। বিদ্যাপ্রকাশ থেকে আরও একটি কবিতার বই বেরিয়েছে অতলে অন্তরীণ নামে। বই চলে ভাল। বই চললেও রয়্যালটির টাকা আমি দাবি করি না। লজ্জা হয় টাকা চাইতে তাছাড়া আমার স্বনির্ভর জীবনে খোকার আন্তরিক সহযোগিতা আমাকে বড় কৃতজ্ঞ করে রেখেছে। বাজার করতে যাব, কোথায় বাজার দেখিয়ে দিচ্ছেন। আসবাবপত্র কিনতে যাবো, থাল বাসন কিনতে যাব, কোথায় যেতে হবে, নিয়ে যাচ্ছেন, দরদাম করে দিচ্ছেন। ডাল ভাত খাচ্ছি অনেকদিন, দেখে একদিন তিনি দুটো মুরগি কিনে নিয়ে এলেন। আমার টাকা ফুরিয়ে আসছে দেখলে মা ময়মনসিংহে চলে যাচ্ছেন, বাবার ভাণ্ডার থেকে নিয়ে বস্তা ভরে চাল ডাল আনাজপাতি নিয়ে বাসে করে চলে আসছেন ঢাকায়। আমার দারিদ্র আছে ঠিকই, কিন্তু সেই সঙ্গে আনন্দও আছে। আমার জীবনে আমি এত দরিদ্র অবস্থায় কাটাইনি, এবং এত আনন্দও এর আগে আমি পাইনি। ভাইএর মত, বন্ধুর মত খোকা আছেন পাশে। মা আছেন তাঁর উজাড় করে ভালবাসা নিয়ে। লিলিও খুশি অবকাশের গাধার খাটুনি থেকে এসে অল্প কাজ আর শুয়ে বসে অনেকটা আকাশের কাছাকাছি থাকার আনন্দে। আমার হিসেবের সংসার অথচ সুখে উপচে পড়া জীবন। হাসপাতালে গাইনি বিভাগে প্রচণ্ড ব্যস্ততা আমার। রোগিতে সয়লাব হয়ে যায় বিভাগটি। ময়মনসিংহের হাসপাতালে গাইনি বিভাগে ইন্টার্নশিপ করার সময় যেমন উত্তেজনা ছিল, যেমন দম ফেলাম সময় ছিল না, এখানেও তেমন। ডেলিভারি করাচ্ছি, এপিসিওটমি দিচ্ছি, এক্লাম্পসিয়ার রোগী ভাল করছি, রিটেইন্ড প্লাসেন্টা বের করছি, ফরসেপ ডেলিভারি করছি, কারও এক্ষুনি সিজারিয়ান, দৌড়োচ্ছি অপারেশন থিয়েটারে, ঝটপট মাস্ক গ্লবস পরে সিজারিয়ানে অ্যাসিস্ট করতে দাঁড়িয়ে যাচ্ছি, আবার গাইনি আউটডোরেও রোগী দেখতে হচ্ছে, সারাদিনে শত শত রোগীর ভিড়, সময়ের চেয়ে বেশি সময় চলে যায় রোগীর চিকিৎসা করে। সারাদিন এসব কাজ করার পর আবার রাতেও ডিউটি পড়ছে। সারারাত জেগে কাজ করতে হচ্ছে। অল্প যেটুকু সময় হাতে থাকে নিজের জন্য, তখন কলাম লিখি। বাড়তি টাকা রোজগার না করলে বাড়িভাড়া দেওয়া যাবে না, উপোস করতে হবে। হাসপাতালের ইন্টার্নি ডাক্তাররা আমি জানি না কেন, আমার বেশ ভক্ত হয়ে পড়ে, অনেকটা বন্ধু-মত। আমার চেয়ে বয়সে অনেক ফারাক থাকলেও এই বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। আমার পরিচয় ওরা সকলেই জানে। আমাকে বলতে হয় না আমি কে। পরিচয় জানার অসুবিধে এই, আমি কাজ করলেও মনে করা হয় আমার মন বুঝি ডাক্তারিতে নেই, মন কবিতায়। আমি প্রেসক্রিপশান লিখতে থাকলে দূর থেকে দেখে কেউ ভেবে বসে আমি হয়ত প্রেসক্রিপশান লিখছি না, কলাম লিখছি। আমার বয়সী ডাক্তাররা এফসিপিএস পাশ করে অথবা পুরো পাশ না করলেও ফার্স্ট পার্ট পাশ করে এসে রেজিস্টার হয়ে বসেছে নয়ত সিএ, ক্লিনিক্যাল এ্যাসিস্টেন্ট। এই বয়সে আমার মত কেবল মেডিকেল অফিসার হয়ে যারা কাজ করছে বিভিন্ন বিভাগে, তাদেরও এফসিপিএস পরীক্ষা দেওয়ার ধান্দা। আমারই কোনও ধান্দা নেই। মোটা মোটা বই নিয়ে বসে যাব, বছরের পর বছর কেটে যাবে বইয়ে ঝুঁকে থেকে, এর কোনও মানে হয়! দেখেছি দশ বছরেও অনেকের পাশ হয় না, অথচ বছর বছর ক্লান্তিহীন দিয়েই যাচ্ছে পরীক্ষা, ফেলই করছে প্রতিবছর। টাকাঅলা বাপ যাদের তারা পিজির এফসিপিএস এ ফেল করে লণ্ডনে গিয়ে কোনও রকম ফেল টেল ছাড়াই এফআরসিএস ডিগ্রি নিয়ে দেশে ফেরত আসে। বাংলাদেশের এফসিপিএস পাশ করার চেয়ে বিলেতের এফআরসিএস পাশ করা সহজ, এ কথা বিশ্বাস না হলেও কথা সত্য। এসব দেখে ইচ্ছে উবে গেছে। মিটফোর্ড হাসপাতালে চাকরি করছে এরকম যে ডাক্তারকেই দেখি আমার কাছাকাছি বয়সী, সকলেই চাকরি করার পাশাপাশি এফসিপিএসএর পড়াশোনা করছে। আমাকে অনেকে জিজ্ঞেস করে, আমি পরীক্ষা দিচ্ছি কি না। আমি সোজা না বলে দিই। অবাক হয় হবু এফসিপিএসরা। হাসপাতালে বসে তাহলে কি ঘোড়ার ডিম করছি, মনে মনে বলে তারা। খানিক পর হেসে, আবার মনে মনেই বলে, কদিন পর তো ঘাড় ধরে বের করে দেবে পোস্টিং দিয়ে কোনও গাঁও গেরামে। শহরের বড় হাসপাতালে চাকরি করতে আসবে যারা পড়াশোনা করছে, এফসিপিএসের মাঝপথে অথবা শেষের পথে। তা ঠিক, হবু এফসিপিএসরা পড়ার ঘোরেই থাকে, তাদের কাজে কোনও অনিয়ম হলে কোনও অসুবিধে নেই, কিন্তু আমার মত ছোট ডাক্তারদের ওপর ইন্টার্নি ডাক্তারদের মত খাটনি যায়। আমার আপত্তি নেই খাটনিতে। কিন্তু কবি বলে নাম থাকায় আমাকে উদাসীন বলে মনে করা হলে আমার বড় মন খারাপ হয়। আর কেউ উদাসীন না বললেও প্রফেসর রাশিদা বেগম বলেন। তিনি আমাকে প্রথম দিন থেকেই মোটেও পছন্দ করতে পারছেন না। প্রথম দিন বিভাগে যেতে আমার দু মিনিট দেরি হয়েছিল বলে। রাশিদা বেগমের মাথার কোষে কোষে গেঁথে গেছে সেই দুমিনিটের কাহিনী। এমনিতে খিটখিটে মেজাজ তাঁর। গাইনি বিভাগের তিনটি শাখার মধ্যে তিন নম্বর শাখার তিনি অধ্যাপিকা। ছাগলের তিন নম্বর বাচ্চার মত মহাশয়ার অবস্থা। মেজাজ ছাড়া তাঁর বিশেষ কিছু সম্পদ নেই। রোগী সামলাতে নাস্তানাবুদ হন, কারও গোচরে এলে তিনি অবস্থা সামাল দিতে চোখের সামনে যাকেই পান তাঁর ওপর চোট দেখান, এতে যেন তাঁর গলার স্বর সকলে শোনে এবং তাঁকেও যেন খানিকটা মান্যগন্য করে তাঁর সহকারীরা, যেমন করে বিভাগের প্রধান অধ্যাপক বায়েস ভুইয়াকে। বায়েস ভুঁইয়া চমৎকার মানুষ। তাঁর কাউকে ধমক দেওয়ার প্রয়োজন হয় না। তাঁর কাজই তাঁর মূল্য নির্ধারণ করে। দেখা হলেই তিনি আমাকে জিজ্ঞেস করেন কেমন আছি, ইতিবাচক উত্তর ছুঁড়ে দিয়ে খুব দ্রুত সরে যাই তাঁর সামনে থেকে। প্রথমত আমার একটু কুণ্ঠাও থাকে পোস্ট গ্রাজুয়েশন করছি না বলে। অধ্যাপকের আশে পাশে যারাই ভিড় করে থাকেন, সকলেই পোস্ট গ্রাজুয়েশনের অর্ধেক নয়ত পুরো ডিগ্রি নিয়েছে। আমি তাই সংকোচে দূরে থাকি। এই সংকোচই আমার ইচ্ছের অংকুরোদগম ঘটায় মনে, এফসিপিএসএর জন্য লেখাপড়া শুরুই না হয় করে দিই। মাও বলেন, বিসমিল্লাহ বইলা শুরু কইরা দেও, তোমার বাপও খুশি হইব। বায়েস ভুঁইয়া বিভাগের অধ্যাপক হয়েও আমাকে বেশ খাতির করেন, কারণটি আমার ডাক্তারি বিদ্যে নয়, আমার লেখা। পত্রিকায় আমার লেখা পড়েন তিনি। মাঝে মধ্যে আমাকে ডেকে আমার এই লেখাটি কিংবা ওই লেখাটি তাঁর খুব ভাল লেগেছে বলেন। লেখালেখির বিষয়টি হাসপাতালের চৌহদ্দিতে উঠলে আমার বড় অস্বস্তি হয়। তবু ওঠে। হাসপাতালে আমি যে কোনও ডাক্তারের মত ডাক্তার। আমার অন্য পরিচয়টি হাসপাতালে এসে আমার হাসপাতালের পরিচয়টি সামান্যও গৌণ করবে তা আমার মোটেও পছন্দ নয়। অ্যপ্রোন পরে হাতে স্টেথোসকোপ নিয়ে হাসপাতালে যাচ্ছি, দেখে মা খুব খুশি হন। আমাকে মুখে তুলে খাওয়ান। আমার পরিচর্যা করতে মা সদাসর্বদা ব্যস্ত। টাকা জমিয়ে একদিন স্টেডিয়াম মার্কেট থেকে ছোট একটি লাল রঙের রেফ্রিজারেটর কিনে আসি। ফ্রিজটি মা দিনে দুবেলা পরিষ্কার করেন নিজের শাড়ির আঁচল দিয়ে। লিলিকে হাত দিতে দেন না ফ্রিজে, কিছু যদি কোথাও দাগ লাগিয়ে ফেলে লিলি। বাইরে থেকে গরমে সেদ্ধ হয়ে এলে মা দৌড়ে এক গেলাস ঠাণ্ডা পানি এনে দেন। রান্না করে করে ফ্রিজে রেখে দেন যেন অনেকদিন খেতে পারি, যেন বাজার করতে না হয় ঘন ঘন। আমাদের সুখের সংসার অভাবে আনন্দে চমৎকার কাটতে থাকে। ইন্টার্নি ডাক্তাররা বেড়াতে আসে বাড়িতে, খেয়ে দেয়ে হল্লা করে ডাক্তারি ভাষায় আড্ডা পিটিয়ে চলে যায়। আমার এই একার সংসারটি সকলের বেশ পছন্দ হয়। খাওয়া দাওয়া প্রথম প্রথম কার্পেটে বসেই হত, এরপর বাড়িতে অতিথির আগমন ঘটতে থাকায় ছোট একটি টেবিল আর দুটো চেয়ার রান্নাঘরে বসিয়ে দিই। ছোট একটি টেলিভিশন, ছোট একটি গান শোনার যন্ত্রও কিনি। আর কিছুর কি দরকার আছে? মা বলেন, না নেই। মা আমাকে বাধা দেন টাকা খরচ করতে। টেবিল চেয়ার গুলো যদি অবকাশ থেকে আনা যেত, তিনি খুশি হতেন। বাপের সম্পদে তো মেয়েরও ভাগ আছে। অথচ বাপ তো কোনওরকম সাহায্য করছে না, মা গজগজ করেন। বাপ সাহায্য না করলেও বাপের প্রতি ভালবাসা আমাকে বায়তুল মোকাররমের ফুটপাত থেকে হলেও বাপের জন্য সার্ট কেনায়, জুতো কেনায় ময়মনসিংহে যাওয়ার আগে। ছুটিছাটায় দুএকদিনের জন্য ময়মনসিংহে যাওয়া হয়। বাপকে দেখতেই যাওয়া হয়। বাপের কোনও সাহায্য নিতে আমার ইচ্ছে করে না বরং বাপকে সাহায্য করতে ইচ্ছে হয়। সাধ আছে অনেক, সংগতি তত নেই। সংগতি বাড়াতে সাইনবোর্ড টাঙিয়েছি আরমানিটোলার বাড়ির সদর দরজায়। ডাক্তার তসলিমা নাসরিন, এম বি বি এস। রোগী দেখার সময় এতটা থেকে এতটা। মাইনের টাকা, রোগী দেখার টাকা, লেখালেখির টাকা সব মিলিয়ে যা হয় তা পই পই হিসেব করে ইস্পাতের আলমারিতে রাখি। বাপের সার্ট জুতো এসব হিসেবের বাইরে। হোক না! বাড়তি খরচের জন্য শাক ভাত খেতে হয়। না হয় খেলামই।

ময়মনসিংহের আত্মীয় স্বজন ঢাকায় কোনও কাজে এলে আমার বাড়িতে ওঠে। দেখে আমার খুব ভাল লাগে। ছটকু এল একবার। কার্পেটে শুল। তাতে কী! ভালবাসা থাকলে ছেঁড়া কাঁথায় শুয়েও সুখ। ছটকু নিজেই বলেছে যে বড় মামা, ফকরুল মামা, ঝুনু খালা বা ছোটদার বাড়িতে গিয়ে এ যাবৎ কোনও স্বস্তি পায়নি, পেয়েছে আমার বাড়িতে এসেই, ছোট হোক বাড়ি, এটা না থাক, ওটা না থাক, কিন্তু নিজের মত পা ছড়িয়ে বসা যায়, গলা ছেড়ে গান গাওয়া যায়, কিছু খেতে ইচ্ছে করলে চেয়ে খাওয়া যায়। মনে হয় নিজের বাড়ি, এমন।

কেবল যে গাইনি বিভাগের ব্যস্ততায় আর পত্রিকার জন্য কলাম লিখেই সময় পার করি তা নয়। মাঝে মধ্যে সাহিত্যের আড্ডায় অনুষ্ঠানেও যাই। ময়মনসিংহের জাকারিয়া স্বপন, ইয়াসমিনের পাতানো ভাই, প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে, অনুষ্ঠানের বিতর্ক প্রতিযোগিতায় বিচারক হতে আমাকে একদিন নিয়ে গেল। এর আগে আমাকে যা-ই হতে হয়েছে, কোথাও বিচারক হতে হয়নি। বিচারকদের যে গাম্ভীর্য থাকে, তা যথাসম্ভব ধারণ করে বিচার করে আসি বিতর্কের। একবার ফরহাদ মজহার আমন্ত্রণ জানালেন তার এনজিও উবিনিগে, উবিনিগের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের টাকা সাহায্য জোটে মজহারের অথচ নিজে তিনি এককালের সমাজতান্ত্রিক। টিএসসিতে তাঁর গান শুনেছিলাম অনেক আগে, নিজে গান লিখতেন, সুর দিতেন, গাইতেনও। নিজে হারমোনিয়াম বাজিয়ে ঘর ভরা দর্শককে যতগুলো গান শুনিয়েছিলেন তার মধ্যে সাততাড়াতাড়ি যাচ্ছি বাড়ি গানটি বেশ লেগেছিল। বামপন্থী গায়কটি গান টান ছেড়ে দিয়ে নিজের কবিতার বই বের করলেন। চমৎকার সব কবিতা লিখেছেন। পড়ে মুগ্ধতার শেষ নেই আমার। যাই হোক, তাঁর খবর পেয়ে সাততাড়াতাড়ি তাঁর আপিসে গিয়ে দেখা করি। একটি হাড়গিলে মহিলা নাম ফরিদা আখতার উঠে এলেন ফরহাদ মজহারের ঘর থেকে, মনে হল যেন শয্যা থেকে উঠে এলেন। আমাকে বসিয়ে ভেতর ঘরে ডাকতে গেলেন তাঁকে। ভেতর থেকে বেরোতে অনেকটা সময় নিল তাঁর। মনে হল শয্যা থেকে উঠে উদোম গায়ে সবে কাপড় চড়িয়ে এলেন। চা বিস্কুট এল। কথা চলল। কথা চলল, আসলে তিনি একাই কথা বললেন। তাঁর নিজের কবিতার কথা বললেন, কবিতার কিছু আরবি শব্দ আমি বুঝতে পারিনি বলে তিনি আরবির অর্থ বলে দিলেন। অবোধ্য আরবি শব্দ কবিতায় ব্যবহার করার কি কারণ এই প্রশ্ন করার আগেই তিনি বললেন, এ দেশের বাংলা হচ্ছে ইসলামি বাংলা, আর পশ্চিমবঙ্গের বাংলা হিন্দু বাংলা। আমাদের সংস্কৃতি ইসলামি সংস্কৃতি, আমাদের ভাষায় প্রচুর আরবি উর্দু শব্দ মেশানো উচিত ইত্যাদি ইত্যাদি। ধাঁধা লাগে শুনে। তিনি কি আমাকে দলে টানতে চাইছেন তাঁর এই উদ্ভট মিশনে! তা না হলে আমাকে এমন তলব করার কারণ কি! আসলেই তিনি আমাকে দলে টানতে চাইছেন। এসব আজগুবি চিন্তা নিয়ে তিনি চিন্তা নামে একটি পত্রিকা বের করবেন, ওতে যেন লিখি আমি। ফরহাদ মজহার সম্পূর্ণই পাল্টো গেছেন। এই দেশে ইসলামি মৌলবাদ যখন মাথা চাড়া দিয়ে উঠছে, গুটিকয় মানুষ এর বিরুদ্ধে লড়াই করছে, গুটিকয় মানুষ চাইছে বাঙালি সংস্কৃতি যে সংস্কৃতি হিন্দু মুসলমান বৌদ্ধ খ্রিস্টান সকলের সংস্কৃতি, তাকে সবলে অস্বীকার করছেন মজহার। দেশ বিভাগের ভূল সিদ্ধান্ত বাংলাকে বিভক্ত করেছে, কিন্তু পূর্ব ও পশ্চিম বাংলার ভাষা ও সংস্কৃতিতে মৌলিক কোনও পার্থক্য নেই, সে যে কোনও সুস্থ মানুষই জানে। কিন্তু ফরহাদ মজহারের মত চিন্তাবিদের এ কী হাল, সমাজতান্ত্রিক বিশ্বাস থেকে ফট করে পুঁজিবাদীদের টাকায় এনজিও খুলেছেন, এখন আবার গাইছেন ধর্মের গান! কোনও এক ফকিরের গানও শোনালেন আহা কি মধুর বলতে বলতে, দীনের নবী মোস্তফা.. হরিণ একটা বান্ধা ছিল গাছেরই তলায়। আরব দেশের মরুভূমিতে গাছও নেই, হরিণও নেই, অথচ নাকি কী অভাবনীয় কল্পনার মিশ্রণ এই গানটিতে! এই গানকেই তিনি বাংলাদেশের গান বলছেন। রবীন্দ্রসঙ্গীত হিন্দু দের গান, মুসলমানদের গান নয়। বলে দিলেন। ফরহাদ মজহারের এই মতের বিরুদ্ধে পরে আমি একটি কলাম লিখি পত্রিকায়, সঙ্গে শামসুর রাহমানের কবিতায় উর্দূ শব্দ ব্যবহার আর হুমায়ুন আজাদের রবীন্দ্রনাথ বিরোধী বক্তব্যেরও প্রতিবাদ ছিল আমার কলামে। দীর্ঘদিন আমার ওই ভাষা নিয়ে লেখাটির সূত্র ধরে পত্রিকায় লেখালেখি চলল। ফরহাদ মজহার নিজে লিখলেন। তাঁর যুক্তি এবং ইনকিলাব পত্রিকার ছাপা হওয়া কোনও মৌলবাদির যুক্তির মধ্যে কোনও পার্থক্য নেই। তাঁর যুক্তি খণ্ডন করে আরও অনেকে কলাম লিখলেন। পূরবী বসু আমেরিকার পাট চুকিয়ে দিয়ে বাংলাদেশে চলে এসেছেন, তিনি এসেই কলম ধরলেন ফরহাদ মজহারের মতের বিপক্ষে। লোকটির চরিত্র ক্রমশ সন্দেহজনক হয়ে উঠছে, তা স্বীকারও করলেন অনেকে।

ভাষা নিয়ে আমার লেখাটি ছাপা হওয়ার পর শামসুর রাহমান বড় একটি কলাম লিখলেন আমার কলামের উত্তরে। তসলিমাকে তসলিম জানিয়ে তিনি শুরু করেছেন। লিখেছেন আত্মপক্ষ সমর্থন করে। আমি, এটা ঠিক, যে, বাংলা ভাষায় আরবি ফার্সি, উর্দূর অনধিকার প্রবেশ নিয়ে মন্তব্য করতে গিয়ে শামসুর রাহমানকে দোষারোপ করেছি তিনি উর্দু শব্দ ব্যবহার করেন বলে। যে শব্দগুলো বাংলা অভিধানে আছে, তার ওপর প্রচলিত, কী দরকার সেই শব্দগুলো ব্যবহার না করে সে ক্ষেত্রে উর্দু শব্দ ব্যবহার করার! শামসুর রাহমান লিখেছেন, ‘প্রত্যেক ভাষাতেই অতিথি শব্দের সমাবেশ ঘটে। অতিথির মুখের ওপর দরজা বন্ধ করে দেওয়া আতিথেয়তার রীতিবিরুদ্ধ কাজ। দরজা খোলা রাখা দরকার, সব অতিথিই যে বাঞ্ছিত ও কাঙ্খিত হবে, এটা বলা যাবে না। অবাঞ্ছিত অতিথি অনাদরে নিজে থেকেই কেটে পড়বে। ..অন্নদাশংকর রায় কিন্তু বেশ কিছু উর্দু ও হিন্দি শব্দ অবলীলাক্রমে ব্যবহার করেন। আমার কাছে কখনো দুর্বোধ্য কিংবা শ্রুতিকটু মনে হয়নি। তিনি এক জায়গায় জান পেহচান ব্যবহার করেছেন চেনাজানার বদলে। তাঁর একটি বাক্য উদ্বৃতি করছি, কমলি নেহি ছোড়তি। তসলিমা নাসরিন, আমি কিন্তু এতদূর যাইনি। তাহলে কি আপনি বলবেন শ্রদ্ধেয় অন্নদাশংকর রায় পশ্চিমবঙ্গে বসে ইসলামি বাংলা ভাষা তৈরি করছেন?’ আমি যে লিখেছিলাম ভাষাকে নতুনত্ব দেবার বা সমৃদ্ধ করবার জন্যে এই বাংলা ভাষা এত ভিখিরি হয়ে যায়নি যে অন্য ভাষা থেকে শব্দ হরণ করবার বা ধার করবার কোনো দরকার আছে। আমাদের যা আছে তা নিয়েই আমরা সন্তুষ্ট থাকি না কেন! বরং শব্দভাণ্ডারকে সমৃদ্ধ করবার চেয়ে সাহিত্যকে গুণগত সমৃদ্ধি দেবার আগ্রহ থাকা উচিত সকল সৎ সাহিত্যিকের। .. এ কথার উত্তরে তিনি লিখেছেন, ‘না, তসলিমা, এই উক্তি আপনার মত প্রগতিশীল ব্যক্তির যোগ্য হয়নি। আমাদের সমাজ একটি জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে বলেই কি তা নিয়ে সন্তুষ্ট থাকতে হবে আমাদের? এর পরিবর্তনের জন্যে চেষ্টাশীল হতে হবে না? বাইরের দুনিয়ার ভালো ভালো জিনিস কি আমরা আমদানি করবো না সমাজ বদলের জন্যে? কোনো ভাষাই, সে ভাষা যত উন্নত ও ধনীই হোক, শব্দঋণ বিষয়ে লাজুক কিংবা নিশ্চেষ্ট নয়, এ কথা নিশ্চয় আপনার জানা আছে।’ আমার জানা আগে না থাকলেও জানা হয়। শামসুর রাহমান আমার চোখ খুলে দিয়েছেন। তিনি বাঙালির ভাষার মধ্যে হিন্দু মুসলমানের ভাগ আনেন না। তিনি একশ ভাগ অসাম্প্রদায়িক মানুষ। ফরহাদ মজহারের মত ইসলামি বাংলা কায়েম করতে চান না। আমি নতুন করে ভাবতে বসি, ভেবে আমি তাঁর সঙ্গেই একমত হই, নিজের ভুলগুলো স্পষ্ট হয়। আসলে সত্যি কথা বলতে, ইসলামি ভাষা বলে কোনও ভাষা নেই। ভাষার কোনও ধর্ম নেই। আরবি ভাষাকেই বা ইসলামি ভাষা বলব কেন! আরবি ভাষার লোক নানা রকম ধর্মে বিশ্বাস করে, তারওপর ওদের মধ্যে এমন লোকও প্রচুর, যারা কোনও ধর্মেই বিশ্বাস করে না। ভাষা আপন গতিতে চলবে, চলেছে, ভাষাকে কোনও নির্দিষ্ট ধর্মে অন্তর্ভুক্ত করা ঠিক নয়। আসলে, ইসলামি ভাষা নিয়ে উদ্বিগ্ন হওয়ার আমার কারণ ছিল একটিই, ইসলামপন্থী লোকেরা এ দেশটিকে একটি ইসলামি রাষ্ট্র তৈরি করার পরিকল্পনা করেছে, লোকগুলো একসময় বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিপক্ষে ছিল, এখন এই স্বাধীন বাংলায় বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতিকে নিশ্চিহ্ন করে দিয়ে জোর জবরদস্তি করে ইসলামি বাংলা বানানোর ষড়যন্ত্র করছে— এই আশঙ্কা থেকেই তথাকথিত ইসলামি ভাষাকে রোধ করতে চেয়েছিলাম। মুশকিল কিছু ধর্মান্ধ লোক নিয়ে। কিছু মন্দ লোক মন্দ উদ্দেশে ভাষাকে খৎনা করে ভাবছে ইসলামি পতাকা ওড়াবে দেশে। কেবল ভাষাতেই তো নয়, রাজনীতির মগজেও গাদা গাদা ইসলাম ঢোকানো হচ্ছে। যদি দেশটি শেষপর্যন্ত ইসলামি শাসনে চলে, তবে আর ভাষা থেকে আরবি ফার্সি উর্দু বিদেয় হলেই বা কী! আমার দুশ্চিন্তা দূর হয় না।

কী এমন আর কলাম লিখি! কী এমন ভাল! সাহিত্যের কতটুকুই বা আমি জানি! বাংলা সাহিত্যে লেখাপড়া করার ইচ্ছে ছিল, বাবা তো ঘাড় ধরে মেডিকেলে ঠেলেছেন। এতটা জীবন ডাক্তারি বিদ্যা ঘেঁটে সাহিত্যের কিছুই নিশ্চয়ই শেখা হয় নি আমার। কবিতা লেখার অভ্যেস না হয় আছে, কিন্তু সেই অভ্যেস থেকে গদ্যে হাত পড়লে আদৌ কিছু রচিত হয় বলে আমার মনে হয় না। যা রচিত হয়, তা আলোচিত হলেও প্রশংসিত হলেও আমার সংশয় যায় না। খুঁতখুঁতি থেকেই যায়। তবে গদ্য পদ্য যা কিছুই লিখি না কেন, সবই হৃদয় থেকে আসে। লোকে যেন পড়ে বাহবা দেয়, যেন খুশি হয়, বানিয়ে বানিয়ে এমন কিছু, এমন কিছু যা আমাকে ভাবায় না, যা আমাকে কাঁদায় না, আমার ভাবনার নির্যাসটুকু নিংড়ে আনে না, আমার দ্বারা লেখা হয় না। খোকা একদিন বললেন, আমার কলামগুলো জড়ো করে একটি বই প্রকাশ করবেন তিনি। শুনে অবাক হই! পত্রিকার এসব কলাম কি সাহিত্য নাকি যে তিনি বই করতে চাইছেন! লজ্জায় মরি! বলি, ‘বলছেন কি! এসব তো প্রতিদিনকার অনুভব নিয়ে, খবর নিয়ে! কি হয়েছে গতকাল, কি হচ্ছে আজ এসব নিয়ে! কদিন পরই এসব সাময়িক ঘটনার ওপর লেখাগুলোর কোনও গুরুত্ব থাকবে না।’ খোকা মাথা নাড়েন, বলেন, ‘তা হোক না, সবই কি আর একরকম! কিছু কিছু তো আবার সবসময়ের জন্য চলে।’ আমি হাতের কাছে যে কটি পত্রিকায় আমার কলাম পেয়েছি, দেখিয়ে পড়িয়ে প্রমাণ দিয়ে বলি যে চলে না। মন কিছুতেই সায় দেয় না এই ভাষায় দুর্বল এমনকী বিষয়ে দুর্বল কলামগুলো নিয়ে কোনও বই করতে। খোকাকে নানাভাবে বোঝাতে চেষ্টা করি, বলি যে বই যদি ছাপতেই চান, তবে কবিতার বই লিখে দিচ্ছি, সেটা ছাপুন। দৈনিক সাপ্তাহিকীর তুচ্ছ বিষয়বস্তু নিয়ে বই করার দুঃসাহস অনুগ্রহ করে দেখাবেন না। আরও একটি বৈষয়িক কারণ দেখাই, কলামের বই কেউ কিনবে না, কারণ সবারই কলামগুলো পড়া হয়ে গেছে। কিন্তু খোকার ইচ্ছে এতই তীব্র যে তিনি পুরোনো পত্রিকা ঘেঁটে ঘেঁটে জড়ো করতে থাকেন কলাম। কী নাম দেওয়া যায় বইএর, তিনি আমার কাছে জিজ্ঞেস করেছেন। কোনও নামই আমার মাথায় আসে না। ভোঁতা মাথার সঙ্গে একদিন শাহরিয়ারের দেখা। বইয়ের নামের প্রসঙ্গ উঠতেই শাহরিয়ার বলল, নির্বাচিত কলাম। নির্বাচিত কলাম? এ কোনও নাম হল? কলাম তো পত্রিকার লেখা, বইএ চলে গেলে কোনও লেখাকে তো আর কলাম বলা যায় না, নিবন্ধ বা প্রবন্ধ বলা যেতে পারে। আমি যুক্তি দেখাই। কিন্তু আমার এসব কলামকে নিবন্ধ বা প্রবন্ধ বলতেও সাহস হয় না। ওগুলোকে অনেক তথ্যভিত্তিক হতে হয়, রীতিমত গবেষণা করে লিখতে হয়। আমার কলামগুলো হালকা, মোটেও ভারী কিছু নয়, এসব আর যা কিছুই হোক কোনও নিবন্ধ বা প্রবন্ধ হয়নি। শেষ পর্যন্ত শাহরিয়ারের কথাই রইল। নির্বাচিত কলাম নামটিই পছন্দ করেন খোকা। লেখাগুলো কলাম হিসেবে পরিচিত হওয়ার কারণেই সম্ভবত তিনি সরাসরি বইয়ের নামে কলাম শব্দটি ব্যবহার করতে চাইলেন। আমি আগ্রহ না দেখালেও খোকা বই বের করলেন। বই হু হু করে চলল, এক মেলাতেই সব বই শেষ হয়ে আবার নতুন মুদ্রণ এল। খোকার মুখ থেকে হাসি সরে না। বইমেলায় বইয়ের বিক্রি দেখে খোকা তো খুশি, আবার বিস্মিতও। তিনিও ভাবেননি, কলামের বইটি এত বিক্রি হবে। আমাকে তাঁর স্টলে বসতে অনুরোধ করেন। বসলে লোকে অটোগ্রাফ নিয়ে বই কেনে। কবিতার বইও দেদার বিক্রি হচ্ছে, মেলাতেই বই বিক্রি সব হয়ে যায়, বই আবার ছেপে আনেন খোকা। কোনও কবিতার বই এরকম বিক্রি হয় না তিনি বলেন। ঢাকার মানুষ তো আছেই, ঢাকার বাইরে থেকেও মানুষ আসে আমাকে এক নজর দেখতে, আমার সই করা বই কেনার জন্য রীতিমত ভিড় জমে যায়। সব কেমন অদ্ভুত লাগে। অবিশ্বাস্য লাগে।

হাসপাতালে ডিউটি না থাকলে অথবা কোনও বিকেলে হঠাৎ হঠাৎ অবসর পেলে সাহিত্যিক যে আড্ডায় আমার যাওয়া হয় সে নীলক্ষেতে অসীম সাহার ইত্যাদির আড্ডা। ওখানেই এক বিকেলে রুদ্রর সঙ্গে হঠাৎ দেখা হয়। দুজনে পরস্পরের দিকে তাকাই। দুজনেরই কত না বলা কথা জমে আছে। সেই কতদিন থেকে আমরা আমাদের চিনি, অথচ জানি না কে কেমন আছে। কারও জীবন যাপনের কিছু আমাদের জানা নেই। আড্ডা থেকে উঠে আসার আগে জিজ্ঞেস করি, যাবে আমার সঙ্গে? কোথায় যাব, কি হবে কিছুই না জিজ্ঞেস করে রুদ্র বলে, যাবো। রিক্সা নিয়ে আরমানিটোলার দিকে যাই। পথে রুদ্র আমাকে বলে যে তার চিংড়ির ব্যবসা সে গুটিয়ে নিয়েছে। মিঠেখালিতে বহুদিন ছিল। কবিতা লিখছে, নতুন একটি গান লিখেছে। গানটি সে রিক্সাতেই গেয়ে শোনায়, ভাল আছি, ভাল থেকো, আকাশের ঠিকানায় চিঠি লিখো। হৃদয় স্পর্শ করে গানের প্রতিটি শব্দ। রুদ্রকে নিয়ে আরমানিটোলার বাড়িতে ঢোকার পর সেই বিকেলেই নাইম দরজার কড়া নেড়েছিল।

রুদ্র চোখ মেলে দেখে আমার সুখের সংসারটিকে।

‘কেমন দেখছো আমার সংসার!’ অহংকার আমার গ্রীবায় এসে বসে যখন বলি। রুদ্র বলে, ‘তুমি পারোও বটে।’

‘পারবো না কেন! ইচ্ছে থাকলেই হয়! অনেক আগেই এই ইচ্ছেটি করা উচিত ছিল আমার। নিজের বাড়ি। নিজের টাকা। কেউ নাক গলাবার নেই। কেউ আদেশ দেবার নেই। কি করছি না করছি তা নিয়ে কাউকে কৈফিয়ত দেবার নেই। এর চেয়ে সুখ আর কী আছে, বল!’

সন্ধের পর রুদ্র তখনও ঘরে, মিনার আসে একটি প্রস্তাব নিয়ে, একটি গাড়ি যোগাড় করে ময়মনসিংহে যাচ্ছে সে, যদি আমি যেতে চাই, যেতে পারি। মিনার গল্প লিখত একসময়, এখন বিচিন্তা নামে একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা ছাপে। জানি না কোত্থেকে আমি কোথায় চাকরি করছি তার খবর নিয়ে একদিন টেলিফোন করেছিল হাসপাতালে। গভীর রাতে ফোন করেছে কদিন, নাইট ডিউটিতে তখন রোগী নেই, রোগী না থাকলেও ডিউটির ডাক্তারদের ঘুমোনো ঝিমোনো সব নিষেধ, অগত্যা বসে বসে কথা বলেছি। কথা বলতে ভালও লেগেছে। মিনার সমাজ রাজনীতি এসব নিয়ে কোনও আলোচনায় যায় না।। কেবল হাসির কথা বলে। হাসির গল্প বলে একটি বই আছে, সম্ভবত মিনারের তা মুখস্ত। দেখা করতে এক বিকেলে এসেওছিল আরমানিটোলার বাড়িতে। বলল বহুদিন সে বিদেশে ছিল, বা্রজিলে চলে গিয়েছিল পালিয়ে। তার সেই পাগল করা সুন্দরী স্ত্রী কবিতার সঙ্গে ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে। এখন সে থাকে ইস্কাটনে। সেই মোহাম্মদ আলী মিনার নাম পাল্টো এখন মিনার মাহমুদ, চেকনাই বেড়েছে। গালে মুখে মাংশ, ত্বক আগের চেয়ে উজ্জ্বল।

‘বহু বছর পর দেখা। কেমন আছেন?’

কার্পেটের ওপর বসে চা খেতে খেতে মিনার বলে, ‘হ্যাঁ বহু বছর। আমি তো বেশ ভালই আছি। আপনার এই আস্তানাটি বেশ ভাল বানিয়েছেন তো!’

ঘরটিতে চোখ বুলোই। হ্যাঁ বেশ বানিয়েছি। বাবুই আর চড়ুই পাখির সেই কবিতাটি মনে পড়েছে । বাবুই গর্ব করে বলছে যেমনই তার বাসা হোক সে তো পরের বাসায় থাকছে না, থাকছে নিজের বাসায়।

কবিতা আর মিনারের ছাড়াছাড়ির খবরটি আমার মন খারাপ করে দেয়। তারুণ্যের তেজি ঘোড়ায় সওয়ার হয়ে দুজনে উল্টো হাওয়ায় ছুটছে দেখতে ভাল লাগত। কেন ছাড়াছাড়ি হল, সমস্যা হলে মীমাংসার তো পথ আছে, কেন মিনার সেটির চেষ্টা করছে না, ইত্যাদি প্রশ্ন করলে খেয়ালি উত্তর জোটে।

‘ঝগড়াঝাটি মিটিয়ে ফেলে কবিতাকে নিয়ে আবার জীবন শুরু করেন।’ পরামর্শ দিই। আমার পরামর্শ মিনার কতটুকু গ্রহণ করে তা বুঝতে পারি না।

মিনারের ময়মনসিংহের প্রস্তাবে আমি রাজি হয়ে যাই, রুদ্রকে জিজ্ঞেস করলে সেও রাজি। রুদ্র আর মিনারেরও দেখা হল বহুকাল পর। দু বন্ধু গাড়ির সামনে বসে। পেছনে আমি, পেছনে একসময় ঝুনুখালাও যোগ হয়, উঠিয়ে নিয়েছি ভূতের গলি থেকে। রুদ্রর সঙ্গে ঝুনুখালারও অনেকদিন পর দেখা হয়। রুদ্রর ইচ্ছে ময়মনসিংহে পৌঁছে একবার ইয়াসমিনের সঙ্গে দেখা করার। গাড়ি জয়দেবপুর পার হয়, ভালুকা পার হয়, ত্রিশাল পার হয়ে গাড়ির চাকা পিছলে রাস্তার মধ্যে উল্টো পাল্টা চককর থেয়ে একেবারে খাদে, না, ঠিক খাদে পড়তে গিয়েই কি কারণে জানি না, খাদের ঠিক কিনারটিতে আটকে যায়। ভেতরে মুত্যর সঙ্গে সকলের একটি সশব্দ মোলাকাত হয়ে যায়। অনেকক্ষণ ঠাণ্ডা হয়ে থাকি গাড়ির সবাই। ঝুনু খালাকে নানির বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে অবকাশের কালো ফটক দেখি ভেতর থেকে তালা দেওয়া, রাত তখন অনেক, এত রাতে ডাকাডাকি করে বাবাকে ঘুম থেকে তুলে তালা খুলিয়ে অবকাশে ঢোকার সাহস হয় না। বাবা আবার এত রাতে কী করে এলাম, কার সঙ্গে এলাম এসব জিজ্ঞেস করে পাগল করে ছাড়বেন, বিশেষ করে গাড়িতে বসা রুদ্রকে যদি চোখে পড়ে, তবে আর আস্ত রাখবেন না। অগত্যা লজ্জার মাথা খেয়ে ইয়াসমিনের শ্বশুর বাড়িতে গিয়ে ওর ঘরে রাতটুকু পার করে সকালবেলায় অবকাশে যাই। সারাদিন অবকাশে কাটে। সন্ধের পর অবকাশের সামনে গাড়ি এসে থামে, কথা ছিল ঢাকায় ফেরার পথে আমাকে বাড়ি থেকে তুলে নেওয়ার। গাড়িতে উঠতে গেলে রুদ্র বলে, আমি ইয়াসমিনের সঙ্গে দেখা করব। ইয়াসমিন অবকাশেই ছিল। ওকে আড়ালে ডেকে নিয়ে বলি, ‘রুদ্র আইছে। তর সাথে দেখা করতে চাইতাছে।’

ইয়াসমিন বলে, কেন?

‘কেন মানে? গেটের কাছে দাঁড়াইয়া রইছে। যা, দেখা কইরা আয়।’

‘না।’

‘না কস কেন। কথা কইলে তর ক্ষতি কি?’

‘না আমি যাব না।’

‘আশ্চর্য! ঢাকা থেইকা আইছে, বার বার বলতে বলতে যে ইয়াসমিনের সঙ্গে দেখা করব। আর তুই দেখা করবি না? এত কাছে দাঁড়াইয়া রইছে। একটু কথা কইয়াই যাইব গা। তর অসুবিধাডা কি?’

ইয়াসমিনকে ঠেলেও পাঠাতে পারি না। রুদ্রকে গিয়ে বলি, ‘ইয়াসমিন আসছে না।’

‘আসছে না? বলেছো যে আমি দেখা করতে চাইছি?’

‘বলেছি। তবু আসছে না।’

রুদ্রর মন খারাপ হয়ে যায়। রুদ্রর এই মন খারাপ করা আমাকে কষ্ট দেয়। ইয়াসমিন যে রুদ্রর অনুরোধ ফিরিয়ে দিল তা না বলে আমি হয়ত বলতে পারতাম, ইয়াসমিন এ বাড়িতে নেই বা কিছু। ও এ বাড়িতে নেই, থাকলে দেখা করতে পারত বললে রুদ্রর মন নিশ্চয়ই খারাপ হত না। ফেরার পথে আমাদের খুব বেশি কথা হয়নি। রুদ্র জানালা খুলে বমি করে দুবার। ময়মনসিংহে বসে দুজনেই নাকি পেট ভরে মদ খেয়েছে। মিনার আমাকে আর রুদ্রকে আরমানিটোলায় নামিয়ে দিয়ে চলে যায় যেখানে যাবার।

রুদ্রকে আমিই বলি সে রাতে আমার বাড়িতে থেকে যেতে। আমার বিছানাতেই আমি তাকে শুতে দিই। এক হাতে যখন আমাকে নিবিড় করে জড়িয়ে ধরে, আমি তার হাতটিকে দিই জড়িয়ে ধরতে। যখন সে মুখটি এগিয়ে আনে আমার মুখের দিকে, চুমু খেতে চায়, দিই চুমু খেতে। যখন সে আমাকে আরও কাছে টেনে নিতে চায়, দিই নিজেকে তার আরও কাছে। যখন সে একটু একটু করে আরও ঘনিষ্ঠ হতে চায়, দিই তাকে ঘনিষ্ঠ হতে। যেন সেই আগের রুদ্র, আমি সেই আগের আমি। যেন মাঝখানে বিচ্ছেদ বলে কিছু নেই, কিছু ছিল না। যেন আগের মত আমাদের প্রতিদিন দেখা হচ্ছে। প্রতিদিন আমরা হৃদয় মেলাচ্ছি, শরীর মেলাচ্ছি। রুদ্রর উষ্ণ নিঃশ্বাস, খানিকটা জ্বরজ্বর গা আমার অনেকদিনের শীতল শরীরে উত্তাপ ছড়ায়। রুদ্রর অঙ্গ, অঙ্গ সঞ্চালন সবই এত চেনা আমার! কখন সে হাই তুলবে, কখন সে শোয়া থেকে উঠে বসবে, হাতদুটো ঘাড়ের পেছনে নেবে, কখন সে একটি সিগারেট ধরাবে, কোন কাতে শোবে সে, কটা বালিশ প্রয়োজন হয় তার, কথা বলার সময় কোন হাতটি নাড়বে, কোন আঙুলটি, সব জানা আমার। রুদ্রকে তাই চাইলেও ভাবতে পারি না সে আমার আপন কেউ নয়। বিয়ে নামক জিনিসটিকে অদ্ভূতুড়ে একটি ব্যপার বলে মনে হয়। বিয়ে কি সত্যি কাউকে আপন করে, অথবা বিচ্ছেদই কাউকে পর করে! ইচ্ছে হয় বলি, যতদিন ইচ্ছে থাকো এই বাড়িতে, এটিকে নিজের বাড়ি বলেই মনে কোরো।

‘যদি কখনও ইচ্ছে হয় এখানে আসতে, এসো।’ খুব সহজ কণ্ঠে বলি।

রুদ্র ভাবলেশহীন চোখে তাকিয়ে থাকে।

‘তোমার ওই যে প্রেম চলছিল, সেটি চলছে এখনও?’

রুদ্র শুকনো কণ্ঠে বলে, ‘হ্যাঁ চলছে।’

‘বিয়ে টিয়ে শিগরি করছো নাকি?’

‘করব।’

ম্লান একটি হাসি ঠোঁটের কিনারে এসেই মিলিয়ে যায়। রাতেই আমি রুদ্রর ডান হাতের বুড়ো আঙুলটি দেখি। আঙুলে পচন ধরেছে। কালো হয়ে গেছে আঙুলটি। সকালে হাসপাতালের সার্জারি বিভাগে চেনা এক সার্জনকে দিয়ে পূঁজ আর পচা রক্ত বের করে রুদ্রর আঙুল ব্যাণ্ডেজ করিয়ে নিয়ে আসি। গ্যাংগ্রিনের আভাস দেখেছি আঙুলটিতে। তবে কি ধীরে ধীরে আঙুলে পচন আরও বেশি ধরবে! পুরো হাতটিই তো পরে কেটে ফেলতে হবে। পেরিফেরাল সার্কুলেশনে তা নাহলে বাধা পড়বে। রক্ত জমাট বেঁধে হৃদপিণ্ডের বা মস্তিস্কের রক্তনালী বন্ধ করে না দিলেই হয়। কি বলব রুদ্রকে! অনেক বেশি শান্ত সে আগের চেয়ে। বড় মায়া হয়। ডান হাতটি সে আর ব্যবহার করতে পারছে না। মুখে তুলে রুদ্রকে ভাত খাইয়ে দিই, মুখ ধুয়ে মুছিয়ে দিই।

রুদ্র যখন যাচ্ছে, তার ব্যাণ্ডেজ বাঁধা আঙুলের হাতটি ধরে বলি, ‘যদি কোনও অসুবিধে দেখ, তবে ডাক্তারের কাছে যেও, নয়ত আমার এখানে চলে এসো, আমি তোমার চিকিৎসার ব্যবস্থা করব। এরকম পচন ধরা কিন্তু ভাল লক্ষণ নয়।’

ডাক্তার প্রেসক্রিপশান লিখে দিয়েছেন। রুদ্রকে বারবার বলি নিয়মিত ওষুধ খেতে। জিজ্ঞেস করি, ‘টাকা পয়সা কিছু আছে?’

রুদ্র মাথা নাড়ে। মাথা নাড়ে, আছে। হাতে চলার মত টাকা থাকলে মুখে বলত, মাথা নাড়ত না। পাঁচশ টাকা দিতে চাই হাতে। হাতটি সংকোচে টাকাটি ছোঁয় না।

টাকার দিকে তাকিয়ে রুদ্র বলে, ‘তোমার লাগবে তো!’

‘সে আমি বুঝবো। তুমি রাখো এটা।’

চুপ হয়ে থাকে রুদ্র। একটু কি সে লজ্জা পায়! বলি, ‘তুমি তো আমাকে অনেক দিয়েছো, আমি না হয় সামান্য কিছু দিলাম।’

টাকাটি রুদ্রর সার্টের বুকপকেটে পুরে দিই। রুদ্র চলে যায়।

পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা আমার চোখে দু ফোঁটা জল। আবার কখন কোথায় দেখা হবে অথবা আদৌ দেখা হবে কি না আমাদের তা আমরা দুজনের কেউই জানি না।

বাড়িঅলা নোটিশ পাঠান, আমাকে বাড়ি ছাড়তে হবে। এই আশঙ্কা আমি আগেই করেছিলাম। যেদিন নাইম এসে দরজা ধাককালো, সেদিনই আশঙ্কার অঙ্কুরটি গেঁথে যায় মনে। ডালপালা ছড়িয়ে বড় হওয়ার আগেই নোটিশ। খোকার দ্বারস্থ হয়েছিলাম নাইমের গন্ধ পেয়েই। খোকা বাড়ি খুঁজতে শুরু করেছেন। যেখানেই যান, আবারও একই সমস্যা, একা একটি মেয়ে থাকবে, বিয়ে শাদি হয়নি? স্বামী নেই? একা মেয়ে কি করে থাকে বাড়িতে? মেয়ে ডাক্তার। ডাক্তার হয়েছে তাতে কি! স্বামী থাকতে হবে। স্বামীহীন মেয়ে ডাক্তার হোক কী ইঞ্জিনিয়ার হোক কী বিজ্ঞানী হোক, কী পতিতা হোক, এক। মেয়ে হল জ্বলজ্যান্ত ঝামেলা। খোকা বাড়ি খুঁজতে খুঁজতে বাড়িঅলাদের বিদ্রুপ, চোখ কপালে তোলা, আকাশ থেকে পড়া, ভ্রুকুঞ্চন, নাসিকাকুঞ্চন, কপালের ভাঁজ, চু চু চু, অপারগতা ইত্যাদি দেখতে থাকেন, শুনতে থাকেন। ভাড়ার জন্য কোনও বাড়ি পাওয়ার আগেই দুর্ঘটনাটি ঘটে যায়। সে রাতে মা ছিলেন না বাড়িতে, মা ময়মনসিংহে। সে রাতে মিনার এল। ময়মনসিংহে গাড়ি করে নিয়ে গিয়েছিল, আমার তো কিছু করতে হয় তার জন্য, তাই নেমন্তন্ন করেছিলাম রাতের খাবারের। হাতে তিনটি বিয়ারের কৌটো নিয়ে এসেছে। বিয়ার শেষ করে সে খাবার খাবে। মিনার বসে বিয়ার খেতে থাকে, আমি যেহেতু বিয়ার পানে অভ্যস্ত নই, এক কাপ চা নিয়ে বসে বসে মিনারের গল্প শুনি। এই মিনারকে দেখলে আমার একটুও মনে হয় না এ সেই আগের মিনার যাকে চিনতাম। যেন এ সম্পূর্ণ নতুন একজন মানুষ। আগের চেয়ে আরও ভদ্র, নম্র, আরও প্রাণবান, আরও গভীর। মিনারের বিয়ার তখনও শেষ হয়নি, তখনই দরজায় শব্দ। দরজায় বাবা আর দাদা দাঁড়িয়ে। দরজা থেকেই বাবা মিনারের দিকে এমন কটমট করে তাকালেন যে আমি মিনারকে বললাম চলে যেতে। না খেয়ে চলে গেল বেচারা। আমার খুব আনন্দ হয় দুজনকে দেখে। এই প্রথম তাঁরা আমার বাড়িতে এলেন। এই প্রথম আমি সুযোগ পাচ্ছি বাবাকে আমার স্বনির্ভর জীবনটি দেখাবার। তাঁরা কি কোনও কাজে এসেছেন ঢাকায়! রাত হয়ে গেছে বলে ময়মনসিংহে ফিরতে পারেননি! নাকি আমাকেই দেখতে এসেছেন! আমি কেমন আছি দেখতে, আমার চাকরি বাকরি কেমন চলছে দেখতে, নিজের বাড়িটি কেমন সাজালাম দেখতে! নাকি এফসিপিএস এর জন্য পড়াশোনা শুরু করেছি কি না দেখতে! নাকি আমার কোনও অর্থনৈতিক অসুবিধে আছে কি না জানতে! জানলে আমাকে সাহায্য করবেন! বাবা কোনও কিছুই বলেন না। উৎসুক বসে থাকি বাবার কথা শোনার জন্য। লিলিকে বলে দিয়েছি শিগরি ভাত চড়াতে। ভাত রাঁধা হলে হলে ভাত দেওয়া হয় টেবিলে। কিন্তু দুজনের কেউই খাবেন না। দুজনেরই মুখ ভার। কেউ কোনও উত্তরও দেন না আমার কোনও প্রশ্নের। বাবা জিজ্ঞেস করেন, ‘যে লোকটি ঘরে ছিল, সে কে?’ প্রশ্নটি বাবা দাদাকে করেন। দাদা আমার দিকে তাকান। আমি বলি, ‘মিনার, বিচিন্তা পত্রিকার সম্পাদক।’ বাবা দাদার দিকে প্রশ্ন চোখে তাকান। দাদা নরম স্বরে বলেন, ‘নাম মিনার, বিচিন্তা পত্রিকার সম্পাদক।’

‘কেন আইছিল এই বাসায়?’ প্রশ্নটি দাদাকে করা হয়। দাদা আমাকে জিজ্ঞেস করেন, ‘ওই লোক কেন আইছিল?’ আমি বাবার দিকে তাকিয়ে উত্তর দিই, ‘এমনি।’ দাদা বাবাকে বলেন, ‘এমনি।’

‘ওই লোকের সাথে তার সম্পর্কটা কি?’ বাবা দাদাকে জিজ্ঞেস করেন।

দাদা আমাকে জিজ্ঞেস করেন, ‘ওই লোকের সাথে তর সম্পর্ক কি?’

আমি কাঁধ নাড়িয়ে বলি, ‘জাস্ট ফ্রেন্ড।’

দাদা বাবাকে বলেন, ‘জাস্ট ফ্রেন্ড।’

টেবিলে ভাত তরকারি ঠাণ্ডা হয়ে যায়। বাবা বারান্দায় হাঁটাহাঁটি করেন। আর ক্ষণে ক্ষণে দাদাকে ডেকে পিলপিল করে কথা বলেন। কী কথা, আমার সাধ্য নেই বুঝি। কাপড় চোপড় পাল্টাতে হবে তো! দুজন এসেছেন খালি হাতে, কোনও লুঙ্গি গেঞ্জি আনেননি। আমার শাড়ি দেব নাকি লুঙ্গির মত করে পরতে! বাবা দাদার দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়েন। না, তিনি কাপড় পাল্টাবেন না। রাতে খাটের বিছানায় যেখানে আমি আর মা ঘুমোই, নতুন চাদর বিছিয়ে দিই দাদা আর বাবার জন্য। ও বিছানায় বাবা বললেন ঘুমোবেন না। কোথায় ঘুমোবেন? তা নিয়ে নাকি আমাকে ভাবতে হবে না। কিছুতেই রাজি হলেন না বিছানায় যেতে! আমি বড় বিছানায় একা রানীর মত শুয়ে থাকব আমি আর নিজের বাবা আর দাদা কার্পেটে শোবেন! দুজনকে ঠেলে যে পাঠাবো বিছানায়, তাও সম্ভব নয়। তাঁরা লোহার মত হয়ে আছেন, শরীরেও, মনেও। খাটে দুটো তোশক নেই যে একটি এনে কার্পেটে বিছিয়ে দেব। বিছানার একটি চাদর দিই পেতে শোবার। কিন্তু বাবা শোবেন না। কি করবেন সারারাত? বসে থাকবেন। দাদাও বসে থাকবেন বাবার সঙ্গে। বাবার হাতে একটি সুগন্ধা। সুগন্ধার মত নিম্নরুচির পত্রিকা বাবা কবে থেকে পড়ছেন, তা জানি না। সুগন্ধা মৌলবাদী গোষ্ঠীর পত্রিকা। একে তাকে গালাগাল, যৌনতা, মিথ্যে সংবাদ, রটনা, ফালতু আলাপ, যা কিছু হলুদ সাংবাদিকতার জন্য প্রয়োজন, সুগন্ধায় সব কিছুর দুর্গন্ধ আছে। শেষ অবদি অনেক রাতে লোহা গলাতে না পেরে আমি শুতে যাই বিছানায়।

সকালে উঠে যখন আমি হাসপাতালে যাবার জন্য তৈরি হচ্ছি, দেখি বাবা আর দাদা কাপড় চোপড় পরে তৈরি, তাঁরাও যাবেন। কোথায়? ময়মনসিংহ। আজ থেকে গেলে হয় না? বললেন, হয় না। ঠিক আছে। তারা বললেন কিছুই ঠিক নেই। আমাকে এখন তাঁদের সঙ্গে ময়মনসিংহে যেতে হবে। ময়মনসিংহে কেন? যেতে হবে। যে করেই হোক যেতে হবে। পাগল নাকি! হেসে ফেলি। হাসপাতালের গাইনি ওয়ার্ডে আমার ডিউটি, আজকে রোগী ভর্তির দিন, এক্ষুনি যেতে হবে। বাবা বললেন, না যেতে হবে না। মানে? মানে আমার আর হাসপাতালে যেতে হবে না। আমার আর চাকরি বাকরি করতে হবে না। আমাকে এক্ষুনি এই মুহূর্তে তাঁদের সঙ্গে ময়মনসিংহে যেতে হবে। আমি বলি, আমি যাবো না। যাবো না বলে যেই না ঘুরে দাঁড়িয়েছি, বাবা চিৎকার করে বাঘের মত ঝাঁপিয়ে পড়েন আমার ওপর। এমন জোরে চড় লাগান গালে যে মনে হয় ঘাড় থেকে যেন ছিটকে পড়ল মাথাটি। ভয়াবহ চড়গুলো আমার মাথায় মুখে মিনা-পর্বতে হাজীদের ছোঁড়া পাথরের মত পড়তে থাকে। বাবা ধাককা দিয়ে আমাকে মেঝেয় ফেলে লাথি কষাতে থাকেন পিঠে পেটে। দৌড়ে গিয়ে বিয়ারের ক্যানগুলো এনে ছুঁড়ে মারেন আমাকে লক্ষ্য করে, কপালে লেগে কপাল কেটে যায়। ঠোঁটে লেগে ঠোঁট কেটে যায়। রক্ত ঝরতে থাকে। দূর থেকে ছুটে এসে আমার চুল ধরে টেনে উঠিয়ে আবার ধাককা দিয়ে ফেলেন আলমারির দরজায়। ধরাম করে মাথাটি গিয়ে পড়ে আয়নায়। আয়নার মুখটিতে চোখ যায়, দেখি কপালের আর ঠোঁটের রক্ত ঝরা। বাবার এমন আগুন হওয়ার কি কারণ থাকতে পারে আমি তার কিছুই জানি না। আমি হতবুদ্ধির মত চেয়ে থাকি। কাঁপতে কাঁপতে গা শিথিল হয়ে আসে, যেন জ্ঞান হারাচ্ছি। আমার দিকে বাবা ছুঁড়ে দেন সুগন্ধা পত্রিকাটি। পত্রিকাটি আমার গায়ের ওপর পড়ে থাকে। দাদা ওটি তুলে নিয়ে পাতা খুলে মেলে ধরেন আমার সামনে, বলেন, ‘লেখছে তর সব কাহিনী। কি করতাছস সব লেখছে।’ কে আমার কি কাহিনী লিখেছে আদৌ দেখার ইচ্ছে হয় না। মনের শক্তিতে উঠে দাঁড়াই। অ্যাপ্রোনটি হাতে নিয়ে দরজার দিকে যেতে থাকি। বাবা দৌড়ে এসে দরজা ধরে দাঁড়ান।

‘হাসপাতালে যাইতে হইব আমার। দেরি হইয়া যাইতাছে।’ শক্ত গলায় বলি।

তর কোথাও যাইতে হইব না। আমার চেয়ে দ্বিগুণ শক্ত গলায় বলেন বাবা।

আমি চিৎকার করে উঠি, ‘হইব। আমার যাইতে হইব।’ বলতে গিয়ে দেখি গলা কাঁপছে আমার। কান্নায় কাঁপছে।

বাবার রক্তচোখের দিকে তাকানো যায় না, চোখ ঝলসে যায় আমার। আমার যেতে চাওয়াকে তিনি টেনে এনে ছুঁড়ে ফেলে দেন। যেতে চাওয়া কাতর অনুনয় জানায়। বাবা যে আমার হাসপাতালের ডিউটিতে যাওয়ার পথ রোধ করে জীবনে কখনও দাঁড়াতে পারেন, আমার বিশ্বাস হয় না। এই বাবার মুখ দিয়ে কখনও যে উচ্চারিত হতে পারে যে আমার চাকরি করতে হবে না, তা আমি স্বপ্নেও ভাবিনি। অকল্পনীয় সব ব্যপার চোখের সামনে ঘটতে থাকে। হঠাৎ আমার মনে হয়, এ সত্যি নয়, এরকম ঘটনা সত্যি সত্যি ঘটতে পারে না। এ নিশ্চয়ই দুঃস্বপ্ন। নিশ্চয়ই আমি ঘুমিয়ে আছি, আর স্বপ্নের ভেতর দেখছি অবিশ্বাস্য সব কাণ্ড। ঘুম ভাঙলেই দেখব আমি ধবল বিছানায় শুয়ে, জানলা গলে পূর্ণিমার রং এসে গা ঢেকে দিয়েছে।

আমার কোনও প্রতিবাদ টেকেনি। সুগন্ধা পত্রিকার লেখাটি মিথ্যে এ কথা যতবারই বলি বাবা ধমকে ওঠেন। হাতে নাতে তিনি এক লোককে ধরেছেন আমার ঘরে, রাতে। এর চেয়ে বেশি কী আর প্রমাণ তাঁদের দরকার! অবশ্য এই প্রমাণটি না পেলেও দুজনে ময়মনসিংহ থেকেই পরিকল্পনা করেই এসেছেন কী করবেন। বাবা আর দাদা আমাকে টেনে হিঁচড়ে নিচে নামান। লিলিকেও নামান দরজায় তালা দিয়ে, চাবি বাবার পকেটে। নিচে অপেক্ষা করে থাকা একটি ভাড়া গাড়িতে আমাকে তোলেন। গাড়ি ময়মনসিংহে পৌঁছে। আমার মন পড়ে থাকে ঢাকায়। মন পড়ে থাকে আমার সুখের সংসারে। পড়ে থাকে হাসপাতালে, আমার অনুপস্থিতি নিয়ে তুলকালাম হচ্ছে নিশ্চয়ই। গাইনি বিভাগের সব ডাক্তারদেরই চোখে পড়ছে আমি নেই। নামটিতে একটি লাল দাগ পড়ছে। নামটিতে একটি ভ্রুকুঞ্চন এসে যোগ হচ্ছে। এই যে ভীষণ উদ্দীপনায় কাজ করছি হাসপাতালে, এতে রোগীর সেবা যেমন হচ্ছে, বিদ্যেটিও আমার আবার হাতে কলমে শেখা হচ্ছে। শেখার, শেখানোর এই উৎসাহই আমাকে নিয়ে যেতে পারত এফসিপিএসের দিকে। এফসিপিএস বড় সংক্রামক, কেউ একজন পড়ছে দেখলে নিজের ভেতর ইচ্ছে জাগে পড়ার। বাবা কি সত্যি সত্যি আমার সমস্ত সম্ভাবনার গলা জবাই করছেন! ভাবতে পারি না।

অবকাশে পৌঁছলে ঘাড় ধরে আমার ঘরটির দিকে আমাকে ঠেলে দিয়ে দরজা বন্ধ করে দিলেন বাবা। বাইরে থেকে তালা লাগিয়ে দিলেন দরজায়। ওপাশে দাঁড়িয়ে চেঁচিয়ে বলতে থাকেন, ‘এখন এইভাবে এই ঘরে তর সারাজীবন কাটাইতে হইব। তর বাইরে যাওয়া বন্ধ। চাকরি বাকরির খেতা পুরি। ডাক্তারি করতে হইব না। পাখনা গজাইছে তর। তর পাখনা আমি পুড়াইয়া দিতাছি।’

সুগন্ধায় আমাকে নিয়ে লেখাটির শিরোনাম ছিল তসলিমা নাসরিন এখন উড়ে বেড়াচ্ছেন। উড়ে বেড়াচ্ছি আমি আজ এর সঙ্গে, কাল ওর সঙ্গে। আমাকে রিক্সায় দেখা গেছে আজ লম্বা মত কালো মত এক ছেলের সঙ্গে, কাল ফর্সা মত মোটা মত এক লোকের সঙ্গে ইত্যাদি। আমি মধূ আহরণে ব্যস্ত ইত্যাদি। সুগন্ধার মত পত্রিকার এই কড়া হলুদ লেখাটি আমার সুখের সংসার ধূলিসাৎ করে দিতে পারে, এত শক্তি এর। ছাপার অক্ষরে বাবার প্রচণ্ড বিশ্বাস। যে কোনও কাগজে যা কিছই লেখা থাকে, তিনি তা বিশ্বাস করেন।

সেদিনই ঢাকায় লোক পাঠিয়ে আরমানিটোলার বাড়িতে যা কিছু ছিল সব ট্রাকে তুলে ময়মনসিংহে নিয়ে এসেছেন বাবা। জানালা দিয়ে দেখি উঠোনের কাদা মাটিতে আমার বড় শখের বড় সুখের সংসারের জিনিসপত্র পড়ে আছে। বন্ধ ঘরটির তালার চাবি বাবার বুক পকেটে। আমাকে খাবার দিতে হলে মা বাবার কাছ থেকে চাবি নিয়ে তালা খুলে ভেতরে ভাত রেখে চলে যাবেন, দরজা তালা বন্ধ করে। বাবা এই নিয়ম করে দিয়েছেন। ভেতরে একটি বালতি দেওয়া হয়েছে। ওতে আমার পেচ্ছ!ব পায়খানা বমি কফ থুতু সারতে হবে। পছন্দ না করলেও বাবার নিয়মে চলতে হয় মার। দরজার ওপাশ থেকে মাঝে মাঝে আমার উদ্দেশ্যে সবাই ঘেউ ঘেউ করেন। মাও গলা চড়ান, ‘বালাই ত আছিলি। ব্যাডাইনগর সাথে না মিশলে কী হয়! পত্রিকায় এইসব লেখা উডে কেন? কত মেয়ে আছে, চারদিকে কত মেয়েরা ডাক্তারি করতাছে। সুন্দর ভাবে থাকতাছে। তর জীবনে ত তা আর হইল না। বিয়া যদি না করতে চাস, বালা কথা। কত মেয়ের জামাই মইরা গেছে অথবা বিয়াই করে নাই, তারা একলা থাকে না? তাদের নামে ত এইসব লেখা হয় না। মেয়েদের কথা এত লেখস, ব্যাডাইনগর বদনাম এত লেখস, ব্যাডাইন ছাড়া বাছস না কেন?’
 
১০. গোল্লাছুট



বন্দী জীবন থেকে মুক্তির কোনও পথ নেই। কোনওদিন মুক্তি পাবো বলে মনে হয় না। নিজ ভূমে পরবাসী হওয়ার যন্ত্রণা অনেক। আমি আমার সকল যন্ত্রণা নিয়ে একা বসে থাকি। হাসপাতাল থেকে বিনা নোটিশে আমার বিচ্ছিত হওয়া দেখে ডাক্তাররা নিশ্চয়ই বিস্মিত এবং বিরক্ত। কিন্তু কী করতে পারি আমি! নিজের জীবনটি নিজের হাত থেকে ফসকে গেল হঠাৎ। আমার অক্ষমতাগুলো আমাকে দুমড়ে মুচড়ে আমাকে ক্ষুদ্র করে ফেলতে থাকে। কষ্ট কান্নায় বুক ভারি হয়ে আছে। কথা বলতে চাই, কাঁদতে চাই কিন্তু পারি না। দিন রাত পড়ে পড়ে গোঙাই কেবল। নিজেকে বকুলির মত মনে হয়। সেই বকুলি। কথা বলতে না পারা বকুলি। বকুলি টিকাটুলির মেয়ে। হাসপাতালে একদিন বকুলির মা তাকে নিয়ে এসেছিল। এর আগে কোনওদিন বকুলি বা তার মা হাসপাতালে আসেনি। হাসপাতালের কোথায় যেতে হয়, কি করতে হয় কোনও চিকিৎসা পেতে হলে, দুজনের কেউই জানে না। সকালে হাসপাতালে ঢুকেই দেখেছি দুজন বসে আছে বহির্বিভাগের বারান্দায়। একজনের ষোল সতেরো বছর বয়স হবে, আরেকজনের বয়স অনুমান করি তিরিশের মত। হাসপাতালের আঙিনায় এরকম কত মানুষই তো বসে থাকে। কিন্তু বারান্দায় চোখ পড়তেই দেখি অল্প বয়সী মেয়েটি আমার দিকে বড় বড় চোখ করে তাকিয়ে আছে। কেন তাকিয়ে আছে, আমাকে কি চেনে নাকি! একবার মনে হয়, হয়ত আমার রোগী ছিল কোনও এক সময়, তাই চিনেছে। আমি গাইনির বর্হিবিভাগে রোগী দেখতে ঢুকে যাই। দুপুরবেলা বেরিয়ে দেখি ওরা দুজন ঠিক একই জায়গায় একই রকম করে বসে আছে। আমি কি জানি কেন ধীরে ধীরে বসে থাকা দুজনের দিকে এগিয়ে যাই, বলি, ‘রোগী কে?’

‘বকুলি।’

‘ওর নাম বুঝি বকুলি!’

‘হ আমার মেয়ে। আমার মেয়ে বকুলি।’ তিরিশ হাত রাখেন ষোলর পিঠে।

‘কি অসুখ?’

‘বকুলি কথা কয় না।’

‘অসুখ কি? কি জন্য আসছেন এইখানে।’

‘বকুলি কথা কয় না।’

‘কথা কয় না তো বুঝলাম, অসুখ টা কি? পেটে অসুখ. নাকি বুকে অসুখ। বলেন, কিসের চিকিৎসা করতে চান।’

‘বকুলির কথা ফিরাইয়া দেন। বকুলি যেন আবার আগের মত কথা কয়।’

‘কবে থেইকা কথা কয় না?’

‘আজকে একমাস হইয়া গেল কোনও কথা কয় না।’

বকুলি আমার দিকে তাকিয়ে ছিল, বড় ডাগর চোখে। কী আশ্চর্য সুন্দর চোখ। এরকম চোখ যদি আমার থাকত, মনে মনে ভাবি। বিধ্বস্ত চুল। কপালে ঘামে ভেজা কিছু চুল লেপটে আছে। পরনে একটি নীল সুতি শাড়ি। আলু থালু।

‘কেন কথা কয় না?’

‘তা তো জানি না।’ মহিলা মাথা নাড়ে। বকুলির দিকে তাকিয়ে এরপর বলে, ‘বকুলি কথা ক। ক কি হইছিল। কথা ক বকুলি। ও বকুলি কথা ক। একবার কথা ক। ক কথা। কথা ক।’

‘কী হইছিল যে কথা কয় না! একমাস আগে কিছু কি ঘটছিল?’

বকুলির মা এদিক ওদিক তাকিয়ে দাঁড়িয়ে উঠে আসে আমার দিকে, আমার খুব কাছে এসে কানের কাছে মুখ রেখে আস্তে বলে, ‘ও নদীর ধারে পইড়া ছিল। মানুষে আইয়া খবর দিলে আমি গিয়া নিয়া আইছি।’

‘পইড়া ছিল কেন?’

‘কী জানি, কারা নাকি ধইরা নিছিল। গেছিল ত কামে। জিনজিরার ফ্যাক্টরিতে কাম করত। কাম থেইকা দুইদিন ফিরে নাই। পরে ত খবর পাইলাম।’

‘যখন নদীর পাড়ে পইড়া ছিল , জ্ঞান ছিল?’

‘তা ছিল। আমার সাথে উইঠা আইল। আমি তারে নিয়া আইলাম বাড়িত। এত জিগাইলাম কী হইছিল ক। বকুলি কথা কইল না। সেই যে কইল না। আইজও কয় না।’

‘খারাপ কিছু ঘটছিল নাকি?’

‘মানুষে কয় ব্যাটারা নাকি তার ইজ্জত নিছে।’

বকুলির মা ফুপিয়ে কেঁদে ওঠে। কেঁদে কেঁদে বলতে থাকে, ‘এক আশ্বিন মাসে বকুলি হইল, পরের আশ্বিনে তার বাপ মরল।.. ‘ আমার সময় নেই বকুলির মার গল্প শোনার, থামিয়ে দিয়ে বলি, ‘কালকে সকালে আইসা নাক কান গলা বিভাগে যাইয়া ডাক্তার দেখান। গলায় হয়ত কোনও অসুবিধা থাকতে পারে।’

আমি সরে আসি। প্রতিদিনই আমাকে মানুষের কষ্টের গল্প শুনতে হয়। হাজারও রকম কষ্টের মধ্যে এও এক কষ্ট।

বকুলির মা আমাকে পেছন থেকে ডাকে, ‘আপা, বকুলি কি কথা কইব না আর?’

‘জানি না।’

আবারও ডাকে, ‘আপা একটু খাড়ন।’

দাঁড়াই।

‘আপনের বড় মায়া। বকুলি যেন কথা কয়, এই ব্যবস্থাটা কইরা দেন। বোবা মেয়ে নিয়া আমি এখন কই যামু, কি করমু।’

‘কালকে আইসা ডাক্তার দেখান। শুনেন ডাক্তার কি কয়।’ হাঁটতে হাঁটতে বলি।

হাসপাতালের গেটের কাছ থেকে একটি রিক্সা নিয়ে উঠে বসি। তখনও বকুলি ওভাবেই বসা ছিল। বারান্দা থেকে বকুলির মা আমার চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে ছিল। সারা পথ আমার কানে কেবল বকুলির মার কথাটি বাজল,বকুলি কথা ক।

পরদিন বর্হিবিভাগের বারান্দায় আমার চোখ যায়, বকুলি যেখানে বসে ছিল। অনেক রোগীর ভিড়, কিন্তু বকুলি নেই, বকুলির মাও নেই। পরদিনও দেখি। না, বকুলি নেই। হয়ত এসেছিল, ডাক্তার দেখিয়েছে, ডাক্তার বলে দিয়েছে, বকুলির গলায় কোনও রোগ নেই। বকুলির মা নিশ্চয়ই তখন বারবারই বকুলিকে বলছিল, ‘বকুলি কথা ক, কথা ক বকুলি।’ সেই থেকে বকুলিকে খুঁজি আমি মনে মনে। হাসপাতালে ঢুকলেই বসে থাকা রোগীদের মধ্যে বকুলির মুখটি খুঁজি। খুব জানতে ইচ্ছে করে বকুলি কি শেষ পর্যন্ত কথা বলেছে কি না।

আমার নির্বাচিত কলাম ওদিকে শীতের সকালের মুড়ির মত বিক্রি হচ্ছে। খোকা একটির পর একটি সংস্করণ ছেপে যাচ্ছেন। এদিকে বন্দী আমি। জেলখানার দাগী আসামীর মত বন্দী। দাগী আসামীকে সম্ভবত এত গালিগালাজ করা হয় না, যত করা হয় আমাকে। বাড়িতে অতিথি এলেও উঁকি দিয়ে একবার দেখে যায় আমার বন্দীদশা। বাড়ির কুকুর বেড়ালও দেখে দরজার ফাঁক দিয়ে। হাঁস মুরগি হাঁটছে, ঘুরে বেড়াচ্ছে ঘরে উঠোনে, আহা ওদের মত স্বাধীনতাও যদি আমি পেতাম! পরাধীনতা কাকে বলে আমি হাড়ে মজ্জায় টের পাই। চিৎকার করি, সকলে শোনে, কিন্তু তালা খোলে না। যে কাপড়ে এসেছিলাম, সেই কাপড়টিই পরা, আর কোনও কাপড় নেই যে পাল্টাবো। গোসলহীন গা থেকে বিশ্রি গন্ধ বেরোতে থাকে। ঘরে একটি বই নেই যে পড়ব। কোনও টেলিভিশন নেই যে দেখব, কোনও গানের যন্ত্র নেই যে গান শুনব। কোনও মানুষ নেই যে কথা বলব। কেবল শুয়ে শুয়ে কড়িকাঠের দিকে তাকিয়ে থাকা ছাড়া আমার আর করার কিছু নেই। আমার এখন চোখে কোনও জল নেই যে জমবে। দুটো গালে জল শুকোতে শুকোতে দাগ পড়ে গেছে। দুশ্চিন্তা এসে পাশে শুয়ে থাকে, দুর্ভাবনার কণিকারা এখন রক্তের লাল সাদা কণিকার মত আমার রক্তে ভাসছে। সামনে একটি ঘোর কালো অন্ধকার ছাড়া কিছু নেই। দীর্ঘদিনের অনুপস্থিতির কারণে চাকরিটি একদিন আমার চলে যাবে। কী করে আবার নিজের ভাঙা বাড়িঘর গুছোবো আমি! স্বপ্নের দালানকোঠা ধ্বসে পড়েছে। স্বপ্নহীন, ভবিষ্যতহীন, মরা মানুষের মত শুয়ে থাকি। এই আমাকে আমি চিনি না। এই আমার নাম আমি জানি না। যখন দলিত মথিত বঞ্চিত লাঞ্ছিত আমি সাহসে বুক বেঁধে উঠে দাঁড়িয়েছি, নিজের পায়ে দাঁড়িয়েছি, সুন্দর একটি জীবন গড়ে তুলছি, তখনই আবার আমাকে দুমড়ে মুচড়ে ভেঙে ফেলা হল। বাবা জানেন না, বাবা আমার জীবনের কতটুকু ক্ষতি করেছেন। তাঁর মত লোকের কোনওদিনই জানা হবে না। কোনওদিনই তিনি কাছে এসে বসবেন না, জিজ্ঞেস করবেন না কোথাও কোনও অসুবিধে হচ্ছে কি না, হলে কী অসুবিধে, কোনওদিন জানতে চাইবেন না আমার সুখ বা দুঃখ বলে কিছু আছে কি না। এভাবে কত দিন আমাকে বন্দী করে রাখা হবে! কত মাস! কত বছর! কী অপরাধের শাস্তি আমি পাচ্ছি! আদৌ কি কোনও অপরাধ আমি করেছি! আমার লেখার প্রশংসা যেমন হচ্ছে, ইচ্ছেমত নিন্দাও হচ্ছে। এসবে ধীরে ধীরে অভ্যস্ত হয়ে গেছি আমি। সস্তা পত্রিকাগুলোয় প্রায়ই আমাকে নিয়ে লেখা হয়, আমাকে কুচি কুচি করে কাটা হয় সেসব লেখায়। আমার লেখা নিয়ে আলোচনা না করে কেবল মেয়ে হয়েছি বলে ব্যক্তিগত জীবন ঘাঁটে কিছু লোক। কেবল মেয়ে হয়েছি বলে খুব সহজে চরিত্রে কালিলেপন হয়ে যায়। বলে দিলেই হল যা ইচ্ছে তাই। মেয়েদের নিয়ে রটনা ঘটনা জিভে খুবই রোচে। কিছু লোক আমাকে নিয়ে মজা করছে বলে আমাকে বন্দী জীবন যাপন করতে হবে! এতে কি আমার না কি আমার বাবার মার আমার ভাই বোনের এক রত্তি কিছু লাভ হচ্ছে! বাবা জানেন না সুগন্ধায় আমার সম্পর্কে এসব লেখার মূল উদ্দেশ্যটি। বাবা জানেন না যে পত্রিকার লোকেরা পত্রিকার বিক্রি বাড়াবার জন্য বানিয়ে বানিয়ে মজাদার মুখরোচক খবর ছাপে। আমার জীবন জানার জন্য বাবার উচিত ছিল আমাকে জিজ্ঞেস করা, আমার জীবনের খবর আমার চেয়ে বেশি সুগন্ধার কোনও লোক জানে না। বাবার ওপর আমার রাগ হয়। ভীষণ রাগ হয়। ভীষণ রাগে আমি ছটফট করি। এ ঘরটি একসময় আমারই ঘর ছিল, এখন এই ঘরটিকে একটি কফিন বলে মনে হয়। যে আমি অসম্ভব সাহস আর দৃঢ়তা অনুভব করতাম নিজের ভেতর, সেই আমি দেখি হাত পা ছোঁড়া শিশুর মত। পাখি উড়ে বেড়াচ্ছিল বলে পাখিকে খাঁচায় এনে বন্দী করেছেন বাবা। আমাকে জন্ম দিয়েছেন, সেই অধিকারে তিনি ভেবেছেন তাঁর যা খুশি তিনি তা করতে পারেন। আর কতকাল আমাকে সইতে হবে তাঁর প্রভুত্ব, রাজত্ব, তাঁর নির্মমতা, তাঁর নির্বুদ্ধিতা! জন্মের ঋণ কি মৃত্যুর আগে শেষ হয় না! নিজের জীবনকে কি নিজের পছন্দ মত যাপন করার অধিকার আমার নেই! আমি ভেঙে ছিন্নভিন্ন হয়ে পড়ে থাকি। এত অসহায় আমি বোধহয় কখনও বোধ করিনি জীবনে। আমার লেখা পড়ে অনেকে বলে আমি নাকি সাহসী, আমি নাকি মেয়েদের শক্তি যোগাচ্ছি! তারা যদি দেখতে পেত কিরকম শক্তিহীন আমি, কি রকম সহায়সম্বলহীন, কি রকম অন্যের হাতে বাঁধা!

যে অবকাশ আমার চেতনায়, আমার স্মৃতিমেদুরতায়, যে অবকাশ আমার ভালবাসার ধন, সেই অবকাশকে হাবিয়া দোযখের মত মনে হয়। অবকাশ থেকে শেষ অবদি আমি পালাই। সকালে দরজার তালা খুলে মা মাত্র নাস্তা দিয়ে গেছেন, রান্নাঘর থেকে সুফির চিৎকার আর থালবাসন ভাঙার শব্দ শুনে তালা না লাগিয়েই মা দৌড়ে যান রান্নাঘরে। এ সময় পাহারা বসা নেই বৈঠক ঘরে। বাবা নেই বাড়িতে। দাদা ফার্মেসিতে। আমি যে কাপড়ে যেমন ভাবে ছিলাম, তেমনি দৌড়ে বেরিয়ে যাই। দ্রুত হাঁটতে থাকি আঁকাবাঁকা গলিতে। যে গলিতে আমি যেতে পারি বলে কেউ ধারণা করবে না। দৌড়োনোও সম্ভব নয়। দৌড়োলে লোকের সন্দেহ হবে। পেছনে আমি দেখতে চাই না কেউ আমাকে চুলের মুঠি ধরে টেনে নিতে আসছে কী না। যে জিনিসটি সবচেয়ে বেশি চাইছিলাম তখন, সেটি একটি রিক্সা, যেমন তেমন রিক্সা। সেটিকে বাড়ির পেছনের দিকে সুতিয়াখালি হাউজের দিকে যে রাস্তায় অবকাশের কেউই যায় না, সেদিকে যেতে বলি। আমি পালিয়েছি খবর পেয়ে কেউ আমাকে দৌড়ে ধরতে গেলে সেরপুকুর পাড়ের দিকে বা গোলপুকুরপাড়ের দিকে যাবে। সুতিয়াখালির গলি পার হয়ে রিক্সাকে যখন রাজবাড়ি ইশকুলের সামনে নিয়ে যাচ্ছি, বলি টাঙ্গাইল যাওয়ার বাসস্ট্যাণ্ডে যেতে। ঢাকা যাওয়ার বাসস্ট্যাণ্ডে পালানোর খবর পেয়ে বাবা স্বয়ং গিয়ে হাজির হতে পারেন।। টাঙ্গাইল যাওয়ার বাসস্ট্যাণ্ডে লোকাল ছাড়া আর বাস ছিল না। বাসে উঠেও আমার হৃদকম্প থামে না। লোকাল বাসেই উঠে পড়ি, লোকাল বাস টাঙ্গাইল যাওয়ার পথে যত বাসস্ট্যাণ্ড আছে সবকটাতে থেমে থেমে যাবে। আমার পক্ষে বাসস্ট্যাণ্ডে দাঁড়িয়ে এক্সপ্রেস বাসের জন্য অপেক্ষা করাও নিরাপদ নয়। কোনও থামাথামি না করে এক্সপ্রেস বাস সোজা টাঙ্গাইল যায়। কতক্ষণে এক্সপ্রেস এসে থামবে এখানে তার কোনও ঠিক নেই। বাসস্ট্যাণ্ডে অপেক্ষা করতে গেলে কেউ আমাকে চিনে ফেলতে পারে, কেউ খবর দিতে পারে বাবাকে অথবা বাবাই ঢাকার বাসস্ট্যান্ডে আমাকে না পেয়ে টাঙ্গাইল বাসস্ট্যাণ্ডে আমাকে খুঁজতে আসতে পারেন। রেলইস্টিশিনেও যেতে পারেন, তাই সেদিকে পা দিইনি। লোকাল বাসটি লককর ঝককর মুড়ির টিন। শহর এলাকাটি বাস যেন দ্রুত পার হয়, যেন খুব দ্রুত পার হয়। বার বার জানালার দিকে আমার অস্থির চোখদুটো চলে যাচ্ছে। বুকের দপদপ শব্দ আমি চাইলেও থামাতে পারছি না। বাসটি ধীরে ধীরে লোক তুলতে তুলতে লোক নামাতে নামাতে বাসের গায়ে থাপ্পড় মারতে মারতে এগোতে থাকে। আমি মেয়ে বলে সাধারণ কোনও সিটে আমাকে বসতে দেওয়া হয়নি। ড্রাইভারের পাশে যেখানে ইঞ্জিনের গরম এসে গা পুড়ে যেতে থাকে, যেখানে পা রাখার কোনও জায়গা নেই, দুটো পা কে বুকের কাছে মুড়ে বসে থাকতে হয় এবং কোনও নড়ন চড়ন সম্ভব নয়, সেই অসাধারণ সিটে বসতে হয়েছে। বাস পুরো আটটি ঘণ্টা নেয় টাঙ্গাইল পৌঁছতে। টাঙ্গাইলে নেমে ঢাকার বাস কোত্থেকে ছাড়ে খবর নিয়ে নিয়ে সেদিকে যাই। ঢাকার বাসে চেপে যখন ঢাকা এসে পৌঁছি, রাত তখন এগারোটা। কোথায় যাব আমি এত রাতে! আমার তো একটি ঘর ছিল, আশ্রয় ছিল। সেটি নেই। আত্মীয়স্বজন কাউকেই আমার আর আপন বলে মনে হয় না। আমি এদের সবার কাছ থেকে দূরে চলে যেতে চাই। আমি যাদের কাছে এত ব্রাত্য, তাদের আমি এই মুখ দেখাতে চাই না। তাদের সামনে আমার অনাকাঙ্খিত উপস্থিতি ঘটিয়ে চাইনা বিব্রত করতে। একটি রেস্তোরাঁয় ঢুকলে অন্তত ফোন ব্যবহার করার সুযোগ পাবো। ক্ষিধেয় পেট চোঁ চোঁ করছে। তার চেয়ে মন চোঁ চোঁ করছে বেশি। কার কাছে কার বাড়িতে আমি আশ্রয় চাইতে পারি এখন! মাথা ঘুরোচ্ছে, বেশিক্ষণ মাথাটি আমাকে ভাবতে দেয় না। মুখস্ত ছিল মিনারের ফোন নম্বরটি। সেটিতেই ডায়াল ঘোরাই। মিনার খবর শুনে অবাক! সে নাকি একদিন ফোন করেছিল হাসপাতালে, হাসপাতাল থেকে বলে দিয়েছে আমি ছুটিতে আছি। কেমন ছুটি কাটিয়েছি আমি তা আর তাকে বলি না। শুধু জিজ্ঞেস করি, এই রাতটা কি তার বাড়িতে আমি থাকতে পারব! মিনার একবাক্যে রাজি হয়। মোটর সাইকেলে এসে আমাকে তার বাড়িতে নিয়ে যায়। আমাকে, বৈঠক ঘরে একটি বাড়তি বিছানা ছিল অতিথিদের শোবার জন্য, দেওয়া হয়। পরদিন পার হয়। কী করে পার হয় আমি তার কিμছু জানি না। ঘুমিয়ে! অনেক ঘুম বাকি ছিল আমার। মনের ওপর যে ঝড় গেছে, সেটি শান্ত করতে আমার দরকার ছিল সাতদিন টানা বিশ্রামের। কিন্তু তার পর দিন মিনার বলল, তার মা নাকি বলছে এভাবে একটি মেয়ের এখানে থাকা ঠিক নয়, লোকে মন্দ বলবে, মিনার যেন আমাকে বিয়ে করে নেয়, তাহলে আমার থাকাটা এখানে জায়েজ হবে। সেদিনই শুনেছি এক লোক নাকি এসেছে সবুজ একটি খাতা নিয়ে, খাতাটি মিনার আমার কাছে নিয়ে আসে, নিয়ে আসে সই নিতে। আবার সেই সই। আমি বোধবুদ্ধি লোপ পাওয়া মানুষের মত সই করি। সইএর গূঢ় অর্থ কী তা বোঝার বা ভাবার সময়টুকু নিইনি। সই কেন করি, বাবার ওপর রাগ করে! আর কোনও আশ্রয় নেই বলে! এ দুটোর কোনওটিই আমি এখন মানতে পারি না। বাবার ওপর রাগ আমার অনেক হয়েছে, রাগ করে সই করা কেন, রাগ করে দেখিয়ে দেওয়া যেত যে যে জীবন আমি যাপন করছিলাম, সেই স্বনির্ভর জীবন আমি যাপন করার শক্তি সাহস স্পর্ধা সবই রাখি। কোনও আশ্রয় নেই তা ঠিক, কিন্তু আশ্রয় কেন আমি খোঁজার চেষ্টা করিনি! হাসপাতালে ডাক্তারদের জন্য কোনও হোস্টেল নেই, না থাক, মুখ নত করে হলেও কেন যাইনি আত্মীয়দের বাড়িতে! কেন ছোটদার বাড়িতে গীতার অত্যাচার সয়েও থাকিনি! কেন বড়মামার বাড়িতে বলে কয়ে জায়গার অভাব হলেও মেঝেতে ঘুমোবার ব্যবস্থা করিনি! রাতে ঘুমোনোর জন্যই তো! অপেক্ষা করতে পারতাম তার চেয়ে, খোকা হয়ত আমার জন্য কোনও বাড়ি পেতেন ভাড়া নেওয়ার! কেন আমি খোকাকে ফোন না করে মিনারের কাছে ফোন করেছি, অত রাতে খোকার দোকান খোলা থাকে না, খোকার বাড়ির নম্বর জানা ছিল না, কিন্তু পরদিন সকালেই কেন খোকাকে ফোন করে তার সহযোগিতা ভিক্ষে চাইনি! নাকি আমি নিজের ওপর বিশ্বাস হারিয়েছিলাম! নাকি সত্যি সত্যিই ধিককার দিতে শুরু করেছিলাম স্বামীহীন জীবনকে! নাকি আর দশটা মেয়ের মত স্বামী সন্তান নিয়ে সংসার করার সাধ হয়েছিল হঠাৎ! নাকি মিনারকে আমি ভালবেসেছিলাম! নাহ! ভালবাসা ওই দুদিনের দেখায় আর কথায় হয় না। নাকি পুরুষের নিবিড় আলিঙ্গন চাইছিলাম! স্পর্শ চাইছিলাম! উত্তাপ চাইছিলাম! তাই ছোট্ট একটি সইএর মধ্য দিয়ে সেই স্পর্শ, সেই উত্তাপ নিয়ে শরীরের গভীর গহন খেলাটি চাইছিলাম! দীর্ঘদিনের অতৃপ্ত শরীর চাইছিল তৃপ্ত হতে। একটি পুরুষ-শরীরের জন্য ভেতরে বান ডাকছিল! নাকি নিজেকে এতিম, অনাথ, নিস্পেষিত, গলিত দলিত কীটের মত মনে হচ্ছিল। এ জীবন কার পাতে গেল কার হাতে গেল তা নিয়ে ভাবনা করার কোনও কারণ দেখিনি! আমি ঠিক জানি না কী সেটি!

এক বাড়িতে থাকার জন্য বা এক বিছানায় রাত কাটানোর জন্য সইটি খুব প্রয়োজন। সই ছাড়া যদি কোনও ছেলে এবং মেয়ের মধ্যে শারীরিক সম্পর্ক হয়, তবে ছেলের দোষ হয় না, দোষ হয় মেয়ের। মেয়েকে ছিনাল, বেশ্যা, মাগী, বদ, রাক্ষুসে ইত্যাদি নামে ডাকা হয়। মিলনের সঙ্গে মিলন হওয়ার পর আমি জানি সই ছাড়াও মিলন হওয়া সম্ভব। আসলে কোনও সইই আমাকে বিয়ের কোনও অনুভূতি দেয় না। মিনারের নতুন আবরণটি দুদিনেই খসে গিয়ে আগের সেই মিনার, মোহাম্মদ আলী মিনার, কবিতার স্বামী বেরিয়ে আসে। কবিতার স্বামী কবিতার জন্য আকুল হয়ে কাঁদে, কবিতার বিয়ে হয়ে যাচ্ছে এই শোকে সে কাঁদে। জীবনে কি বিচ্ছিরিরকম ওলোট পালোট এসে গেছে। ইচ্ছে হয় সময়কে পেছনে নিয়ে যেতে, ইচ্ছে করে দেখতে মিনার আর কবিতা দুজন আবার আগের মত দুজনকে ভালবাসছে, দুজনে সুখে সংসার করছে।

হাসপাতালে কেউ খুব বেশি অবাক হয় না আমার ওই কদিনের অনুপস্থিতি নিয়ে। যে দিন বাবা আমাকে উঠিয়ে নিয়ে যান আরমোনিটোলা থেকে, সেদিন সকালেই আমি জানি না যে বাবা আমার ছুটির একটি দরখাস্ত পাঠিয়ে দিয়েছিলেন গাইনি বিভাগে। হাসপাতাল থেকে খোকার সঙ্গে যোগাযোগ হয়। খোকা আমাকে জানান যে তিনি শান্তিবাগে একটি বাড়ি পেয়েছেন ভাড়ার জন্য। বাড়িঅলাকে বলেছেন তাঁর বোন ভাড়া নেবে বাড়ি, বোন ডাক্তার, একা থাকেন। বাড়িঅলা শিক্ষিত ভদ্রলোক। তিনি রাজি। বাড়িটি দোতলা, সুন্দর বাড়ি। ঝকঝকে। মিনার এদিকে বাড়ি খুঁজছে। সে একটি বড় বাড়ি খুঁজছে, অনেকগুলো শোবারঘরঅলা বাড়ি। তার আত্মীয়স্বজন থাকবে তার বাড়িতে। আমার ইচ্ছে শান্তিবাগের বাড়িটি ভাড়া নেওয়ার। সেটিই নিই। মিনারকে নিয়ে শান্তিবাগের বাড়িতে উঠি। আমাদের অনেকটা যার যার তার তার জীবন শুরু হয়। হাসপাতালে চলে যাই খুব সকালবেলা। সারাদিন মিনারের সঙ্গে আমার দেখা হয় না। আমি হাসপাতালে যাওয়ার পর সে বেরিয়ে যায়, ফেরে অনেক রাত করে। হয় মাতাল, নয় হাতে প্রতিরাতেই একটি মদের বোতল। ঘরে বসে পুরো বোতল না হলেও অর্ধেক বোতল সে শেষ করে খেয়ে। খেতে খেতে মাঝে মাঝে বিচিন্তার জন্য সম্পাদকীয় লেখে। মিনার যা কিছুই লেখে খুব দ্রুত লেখে। কাটাকুটি নেই, কলম থামিয়ে রেখে কখনও ভাবতে হয় না কি লিখবে। মদ তার মাথা খুলে দেয়। তবে যা কিছুই লেখে সে, ভাল লেখে। মিনার ইচ্ছে করলে খুব ভাল গল্প লেখক হতে পারত। আমি জানি না কেন সে ও কাজে হাত দিয়েও আবার বাদ দিয়েছে। হঠাৎ একদিন মদ খেতে খেতেই সে বলে পূর্বাভাস পত্রিকায় যেন আমি লেখা বন্ধ করে দিই। আমি কোনও কারণ খুঁজে পাই না আমার লেখা বন্ধ করার। এই পত্রিকায় আমার এই লেখা কোনও লেখাই হয়নি, ওই পত্রিকায় আমার ওই লেখা না লিখলেও চলত, ইত্যাদি অভিযোগ শুনে আমার মনে হতে থাকে, মিনার আমাকে দলামোচা করে খুব ক্ষুদ্র বানিয়ে তার হাতের মুঠোয় নিতে চাইছে। অমাতাল মিনারকে হয়ত বাইরের লোকেরা দেখে, আমার খুব একটা সুযোগ হয় না। আমি যতক্ষণ মিনারকে দেখি, মাতাল মিনারকেই দেখি। প্রতিরাতে তার মদ খাওয়া চাই। বাধা দিয়ে কাজ হয় না। সে খাবেই। শেষরাতের দিকে ঘুমোতে আসে। আমাদের সম্পর্কের মধ্যে এক সঙ্গম ছাড়া আর কিছুই থাকে না। সঙ্গম তুচ্ছ কোনও ব্যপার নয়। শরীর চায় এই সঙ্গম। শরীর জেগে ওঠে প্রতিরাতে। যে ব্যপারটি আমার জানা ছিল না, কিন্তু খুব শিগরি জানা হয় তা হল, মিনারের সঙ্গে দীর্ঘ বছর ধরে এক ধনী মহিলার প্রেম। মহিলা বিবাহিত। ইস্কাটনে মিনার যে বাড়িতে থাকত, সেটি ওই মহিলারই বাড়ি ছিল। মহিলার সঙ্গে প্রেমে কদিন ভাটা পড়লে মিনার আমার দিকে ঝুঁকেছিল। কিন্তু অচিরে প্রেম আবার জেগে ওঠে। আবার তাদের আগের মত দেখা হতে থাকে। কোনও একটি দিন নেই যে মদ না খেয়ে মিনার কাটাতে পারে। সে এরকমই ছিল। মদ খেয়ে রাতে এখানে ওখানে ফোন করত, আমাকেও করত হাসপাতালে। আমি ফোনে কোনও মদের গন্ধ পেতাম না, ভাবতাম ফোনের ওপারের মানুষটি বুঝি খুবই রসঘন প্রাণঘন ঘনশ্যাম। হায়! মাতাল কোনওদিন গলা ফাটিয়ে হাসছে, কোনওদিন বেধড়ক চিৎকার করছে, অশ্রাব্য ভাষায় গালাগাল করছে, কোনওদিন প্যাণ্টের বেল্ট খুলে চাবকাচ্ছে। কোনও কারণ ছাড়াই করছে। ইচ্ছে হচ্ছে বলে করছে। বাড়িটির দোতলাকে দুভাগে ভাগ করা হয়েছে, দুভাগের একভাগে থাকে সোমারা। সোমা একুশ বাইশ বছর বয়সী একটি মেয়ে, প্রায়ই আমার সঙ্গে গল্প করতে আসে, মাতালের কাণ্ড কারখানা সীমা ছাড়িয়ে গেলে রাত বিরেতে এই সোমার কাছে আমাকে বাকি রাতটুকু পার করার জন্য আশ্রয় চাইতে হয়। উন্নাসিক মাতালটি কোন রাতে কি করবে তা কেউ জানে না। চুমু খাবে না চাবকাবে। মাতাল এক রাতে বাড়ি ফিরে ঘুমের মেয়েটিকে তুলে চাবকাতে থাকে। কি কারণ জানতে চাইলে কোনও উত্তর নেই। গালে শক্ত শক্ত চড় দিয়ে গাল লাল করে ফেলে। চোখে ঘুসি মেরে চোখের রক্ত ঝরায়। গলা টিপে ধরে, আমি পারি না তার শক্ত আঙুলগুলো থেকে নিজেকে বাঁচাতে। নিজেই একসময় ছেড়ে দিয়ে হাসতে হাসতে চুলের মুঠি ধরে টেনে নিয়ে দরজার বাইরে রেখে দরজা বন্ধ করে দেয়। সিঁড়িতে বসে রাত পার করতে হয়। পরের রাতেও এই হয়। সিঁড়ি থেকে আবার টেনে হিঁচড়ে ভেতরে নিতে চাইলে পরের রাতে রক্তাক্ত আমি প্রাণে বাঁচার জন্য দৌড়ে গিয়ে বাড়িঅলার বাড়িতে আশ্রয় নিই। লজ্জায় মাথা নত হয়ে থাকে। লজ্জা ভয় ঘৃণা হীনমন্যতা আশঙ্কা আমাকে কুঁকড়ে রাখে। আমি তো একাই ছিলাম, আমি সেই একাই আছি। আগে উপদ্রব ছিল না, এখন জলজ্যান্ত উপদ্রুব চোখের সামনে। ছি ছি ছি! এ কী করেছি আমি! কাকে আমি আমার আশ্রয় ভেবেছি! নিজে কি নিজের জন্য যথেষ্ট ছিলাম না! কিসের অভাব ছিল আমার! ঘৃণায় আমি মিশে যেতে থাকি মাটিতে, নিজের ওপর ঘৃণা আমার। নিজেকে এতটা অসন্মানিত হতে, এতটা হীন দীন হতে আমি নিজেই দিয়েছি। কী প্রয়োজন ছিল আমার অন্যের আশ্রয়ের! স্বামী নামক নিরাপত্তার! কী প্রয়োজন ছিল সমাজের সাধ মেটানোর! স্বামী সন্তান সংসার ইত্যাদির সামাজিক কাদায় কী ভীষণ ডুবে গেছি, যত বেরোতে চাই তত যেন পাকে পড়ি, টেনে নিয়ে যায় আরও গভীরে। রীতির জালে অন্যের মুখ চেয়ে নিজেকে জড়িয়েছি। নিজেই নিজের গলায় দড়ি দিয়েছি। লোকে এই দড়ি দেখলে পছন্দ করে বলে! আমি আর দড়িছেঁড়া গরু নই বলে! কলুর বলদের মত ঘুরছি! খামোকা বিয়ে নামের একটি কলংকের বোঝা ঘাড়ে চাপল। আমার বোধোদয় হবার পরও বোধ হারিয়েছিলাম, আবার নতুন করে বোধের উদয় হল। বিয়ে করলেও কলংক, না করলেও কলংক। যে কোনও একটি কলংক যদি আমাকে বরণ করতেই হয়, তবে বিয়ের কলংককে কেন! এই শিক্ষাটি কি আগে আমার হয়নি! তবে কেন আবার দুর্ভোগ পোহাতে যাওয়া! পুরুষমানুষকে চেনা কি আমার হয়নি! তবে কেন আবার চিনতে যাওয়া! কেন আবার স্বপ্ন রচনা করা! কেন ভাবা যে একজন যে কষ্ট আমাকে দিয়েছে, আরেকজন হয়ত সেই কষ্ট দেবে না! বোকা বুদ্ধু মেয়ে, কষ্ট ওরা দেবেই। এক রকম না হলে আরেক রকম! তুমি কারও ওপর আর নির্ভর কোরো না। কেউ সুখ দেবে তোমাকে, এই আশাটি আর কোরো না। আমি একাধিক বিয়ে করেছি, তার মানে একাধিক পুরুষের সঙ্গে শুয়েছি আমি, এই কলঙ্কটি আমার ত্বকের মত আমার গায়ে সেঁটে থাকে। লোকে আমার ত্বক দেখলেই কলঙ্কিনী বলে আমাকে বিচার করে। এমনকী রুদ্রও। এর মধ্যে দু বার রুদ্রর সঙ্গে দেখা হয়েছে। প্রথম দেখাটি ইত্যাদিতে, ইত্যাদি থেকে বেরিয়ে সেই ভীষণ ঝড় বৃষ্টির রাতে কোনও রিক্সা খালি পাওয়া যাচ্ছিল না, কোনও বেবি ট্যাক্সিও না। অপেক্ষা করতে করতে একটি বেবি পাওয়া গেল, তখন আরেকটির জন্য অপেক্ষা না করে রুদ্র আমার নেওয়া বেবিতে উঠে পড়ল। আমাকে শান্তিবাগ নামিয়ে দিয়ে সে ইন্দিরা রোডে চলে যাবে। সেদিন সেই ঝড়ের রাতে আধমাতাল রুদ্র আমার কোমর জড়িয়ে ধরে কোমরে চাপ দিয়ে বলল, তোমাকে খুব পেতে ইচ্ছে করছে! কী রকম পেতে! রুদ্র চোখ নাচায়। আমার শরীরটি পেতে তার ইচ্ছে করছে। কোমর থেকে তার হাতটি সরিয়ে দিয়ে মালিবাগের কাছে মাথা ভরা বৃষ্টির রাস্তায় নেমে যাই। গালে মুখে জলের বিন্দু, কোনটি বৃষ্টির, কোনটি চোখের জলের, জানি না। দীর্ঘ একটি শ্বাস যন্ত্রযানের শব্দের তলে চাপা পড়ে যায়। রুদ্রকে বিদায় দিয়ে মনে মনে বলি, ইচ্ছে হলে আমি তোমার সঙ্গে শুতে পারি। আরমানিটোলায় আমি ইচ্ছে করেছিলাম। এখন আমি ইচ্ছে করছি না। এতকাল অন্যের ইচ্ছের মূল্য দিয়েছি, এবার নিজের ইচ্ছের মূল্য দিতে চেষ্টা করছি। রুদ্রর সঙ্গে এর পরের দেখাটি সাকুরায়। কথা ছিল সাকুরায় দেখা হবে। রুদ্র আমাকে বলেছে সে তার সমগ্র বের করতে চায়। যত লেখা এ যাবৎ লিখেছে, সব মিলিয়ে একটি বই। আমি যেন তাকে সাহায্য করি। কী রকম সাহায্য! আমি যেন আমার প্রকাশককে দিয়ে তার সমগ্র ছাপার ব্যবস্থা করি। আমার বই ভাল চলছে, সে কারণে প্রকাশক যে আমার সব দাবি মেনে নেবেন, তা নয়। আমি খোকাকে কদিন বলেছি, রুদ্রর একটি সমগ্র কি বের করবেন! রুদ্র খুব চাচ্ছে। খোকা বললেন, অসম্ভব, চাইলেই হবে! আমাকে তো বিক্রির দিকটা দেখতে হবে। যদি সমগ্র না বের করতে চান, তবে অন্তত রাজনৈতিক কবিতা, প্রেমের কবিতা এরকম কিছু একটা বের করুন। এতে খোকা রাজি, কিন্তু সমগ্রতে রাজি নয়। আপাতত তাঁকে রুদ্রর সঙ্গে দেখা করার জন্য অনুরোধ করি। অন্তত দেখা তো করুন। সাকুরায় রুদ্র আর আমি দুজনই অপেক্ষা করি খোকার জন্য। খোকা আসেন। রুদ্র নিজ মুখে তার ইচ্ছের কথা জানায় খোকাকে। তখন ওই কথাই আবার তুলি, যে কথা তার সমগ্র বের করার ইচ্ছে শুনে বলেছিলাম, ‘তুমি সমগ্র বের করতে চাইছো কেন! সমগ্র তো মরবার পর বের হয়।’ রুদ্র তবু সমগ্র বের করবেই। কয়েকটি ঘণ্টা কেটে যায়। শেষ পর্যন্ত মিমাংসা কিছু হয় না, খোকা রাজি হন না সমগ্রতে। রুদ্রকে বার বার বলি, ‘বিদ্যাপ্রকাশ থেকে তোমার বই অবশ্যই বের হবে, তবে সমগ্র নয়। অন্য কিছু বের করো।’ অন্য কিছুতে রুদ্রর ইচ্ছে নেই। রুদ্রর ইচ্ছে সমগ্র।

‘আশ্চর্য তুমি কি মরে গেছো নাকি! অন্তত বুড়ো যদি হতে তাহলেও কথা ছিল। কত বয়স! পয়ত্রিশও তো হয়নি। এক্ষুনি তোমার সমগ্র করার ইচ্ছে কেন?’

অনমনীয় খোকা চলে যান। রুদ্রকে বড় বিষণ্ন দেখতে লাগে। রুদ্রর মন খারাপ দেখে আমারও মন খারাপ হয়ে যায়। সাকুরা থেকে বেরোই আমরা। আমি আর রুদ্র। পথই আমাদের ঠিকানা। ঘরের মানুষ হয়ে উঠেছি এখন পথের মানুষ। রুদ্রর হাঁটার কষ্ট সারেনি। পথে তাকে বার বার থামতে হয়। ইচ্ছে করে রুদ্রকে নিয়ে রিক্সায় সারা শহর আগের মত ঘুরি। আগের মত টিএসসির মাঠে বসে তুমুল আড্ডা দিই। ঝালমুড়ি আর চা খেতে খেতে কবিতার কবিতায় কথা কই। আগের সেই উতল প্রেমের দিন গুলো আবার ফিরে আসুক। মাঝখানে এই যে বিভেদ, বিচ্ছেদ, বিষাদ, বিরাগ সব এক নিমেষে উড়ে যাক। রুদ্রর শ্যাওলা পড়া বিষণ্ন চোখে চেয়ে বলি, একটি হাত হাতে নিয়ে, ‘তুমি ভেবো না, তোমার সমগ্র বের করার জন্য আবার আমি বলব খোকা ভাইকে।’

রুদ্র দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, ‘রাজি তো হতে চাইছেন না।’

বলি, ‘দেখি, আমি বই দেব এই কনডিশনে রাজি করাতে পারি কী না। মানুষটা ভাল। তাকে আমি বুঝিয়ে বলব যে তোমার বই অবশ্যই বিক্রি হবে। তোমার জনপ্রিয়তা তো কম নয়। লোকে হরদম আবৃত্তি করছে তোমার কবিতা। বিক্রির দিকটাই কি সব প্রকাশক দেখে! কেউ কেউ তো ভাল কিছু, সে কম বিক্রি হলেও ছাপতে চান। খোকা ভাই বাংলাবাজারের অন্য প্রকাশকের মত অত কমার্সিয়াল দিক নিয়ে ভাবেন না। তিনি আজ রাজি না হলেও হয়ত অন্যদিন রাজি হবেন।’

রুদ্র খানিকটা স্বস্তি পায়। আমরা কিছুদূর পাশাপাশি হেটেঁ এরপর দুটো রিক্সা নিয়ে আমাদের ভিন্ন গন্তব্যের দিকে চলে যাই।

সেই চাবুকের রাতে, যে রাতে আমাকে বাড়িঅলার বাড়িতে আশ্রয় নিতে হয়েছিল, বাড়িঅলার বউ পারুল ভয়ে থরথর কাঁপতে থাকা আমাকে জিজ্ঞেস করছিলেন অনেক কিছু, কি করে মিনারের সঙ্গে আমার সম্পর্ক হল, কেন হল। আমি কোনও প্রশ্নের জবাব দিতে পারিনি, সাদা দেয়ালের দিকে নির্বাক তাকিয়েছিলাম। পারুল আমাকে বৈঠক ঘরের এক কোণে শুয়ে পড়তে বললেন। শুয়ে দেয়ালের দিকেই তাকিয়ে থেকেছি বাকি রাত। একটি মুহূর্তের জন্যও আমি চোখের পাতা এক করতে পারিনি। আমি কি বোবা হয়ে গিয়েছি! কেন আমি কিছুই বলতে পারছি না। কেন আমি কাঁদতে পারছি না। কেন আমি পাথর হয়ে আছি! কেন আমি চিৎকার করছি না! কেন আমি কোনও দেয়াল ভেঙে দিচ্ছি না! কেন আমি কাউকে গাল দিচ্ছি না! বকুলির কথা মনে পড়েছে। আমি কি বকুলি হয়ে যাচ্ছি! বকুলির মত বোবা! সেই যে বাবা আরমানিটোলায় সাজানো আমার সুখের সংসারটি ভেঙে দিলেন, আমার মেরুদণ্ড ভেঙে দিলেন, সেই থেকে মনে হয় অনেকদিন আমি বোবা হয়ে আছি। আমি কাউকে কিছু বলছি না। নিজের সঙ্গে কোনও কথা হয় না আমার। ভয় লজ্জা আমার কণ্ঠ রোধ করে আছে। আমি হেরে গেছি বার বার। যেন হেরে যাওয়াই আমার নিয়তি। এই সমাজ সংসার আমাকে আমার মত করে বাঁচতে দিচ্ছে না। আমার শক্তি সাহস উদ্দম, আমার অহংকার আমার ক্রোধ সব আমি কোথাও কারও কাছে বন্ধক দিয়ে বসে আছি। সামনের দেয়ালটি মনে হয় পা পা করে এগিয়ে আসছে আমার দিকে। চারদিকের দেয়ালগুলো এগিয়ে আসছে। মাথার ভেতর থেকে মস্তিস্কগুলো ছিটকে বেরিয়ে আসতে চাইছে। বড় বড় করে শ্বাস নিতে চাইছি। যেন হাওয়াগুলো সব বেরিয়ে গেছে ঘরটি থেকে। বার বার নিজেকে বলি, এই বার তুই তোর কথা বল, তোর মত করে কথা বল তুই। অন্যের সুখের জন্য নিজের সর্বনাশ করিস না আর। নিজের দিকে তাকা তুই, নিজেকে একবার একটু ভালবাসতে চেষ্টা কর। অনেক তো হল, আর কত! আর কত সর্বনাশ করবি নিজের! সাদা দেয়ালে চোখ, দেয়ালটি মনে হয় আমার দিকে পা পা করে এগিয়ে আসছে। একটি দেয়াল নয়, চারদিকের সবগুলো দেয়াল এগিয়ে আসছে। আমি এপাশ ওপাশ করছি। কী এক ঘোরের মধ্যে আমি মাথা নাড়ছি। মাথা নাড়ছি আর অস্ফুট কণ্ঠে বলছি, কথা ক বকুলি। বকুলি কথা ক। কথা ক ..

বোবা হয়ে জেগে থাকা রাতটি পার হয়ে যখন ভোরের সূর্য ওঠে, আমি কথা বলি। পারুলকে বলি, এ বাড়ি থেকে যেন মিনারকে চলে যেতে বলেন তিনি, মিনার চলে গেলে আমি বাড়িটিতে ফিরব। পারুল আমাকে বলেছিলেন কোনও একটি মীমাংসা করে নিতে। আমি না বলেছি। বলেছিলেন পুরুষ মানুষ তো এরকম একটু আধটু করেই, আমি যেন ঠাণ্ডা মাথায় ভেবে দেখি আরেকবার। আমি পারুলকে বলেছি, এ আমি ঠাণ্ডা মাথাতেই ভাবছি, আগে যা কিছু করেছিলাম, মাথার ঠিক ছিল না অথবা মাথা গরম ছিল। বাড়িঅলার বাড়ি থেকে সেই ভোরবেলাতেই আমি বেরিয়ে গিয়েছি। আমি আর শান্তিবাগের অশান্তিতে ফিরিনি। পাখির বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছি। পাখি আমার জন্য একটি ঘরে লেখার টেবিল পেতে সাজিয়ে দিল ঘরটি। হাসপাতাল থেকে ফিরে পাখির সঙ্গে কিচির মিচির করে সময় পার হয়। লেখার চেয়ে মানুষের জীবনের গল্প শুনতেই আগ্রহ বেশি আমার। শান্তিবাগের বাড়িতে ভক্ত হিসেবে আমার সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিল, সেই থেকে আসা যাওয়া করতে করতে বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে পাখির সঙ্গে। পাখি দশ তলার একটি অ্যাপার্টমেণ্টে থাকে। একা থাকে। স্বামীর সঙ্গে তালাক হয়ে গেছে। প্রাক্তন স্বামীটি থাকে আমেরিকায়। পাখি দেখতে সুন্দরী, এমন রং মেখে মুখের ভাঁজ ঢেকে রাখে যে বয়স বোঝার উপায় থাকে না। পাখি অনেকটা মা মা, অনেকটা বোন বোন। পাখি তার জীবনের সব গল্প অকপটে আমার সঙ্গে করে। পাখির একটি মেয়ে আছে, মেয়েটির বিয়ে হয়ে গেছে, থাকে আরব দেশে। পাখি একা থাকে ঢাকায়। অবশ্য নিজের উপার্জন তেমন কিছু নেই। মাঝে মধ্যে এটা ওটা সেলাই করে বিভিন্ন কাপড়ের দোকানে সেসব বিক্রি করার চেষ্টা করে। স্বামীর সঙ্গে তালাক হওয়ার পর ঢাকার পল্লবীতে একটি বাড়ি ছিল, স্বামী কিনেছিল স্ত্রীর নামে, সেটি সে বিক্রি করে বড় এই অ্যাপার্টমেন্টটি কিনেছে। বাকি টাকা ব্যাংকে। একা থাকা পাখির যে মনের শক্তি, সেটি আমাকে মুগ্ধ করে। পাখি নাকি আমার লেখা পড়ে একা থাকার সাহস আর শক্তি পেয়েছে। আমার লেখা যে মানুষকে এমন শক্তি যোগায় তা আমার জানা ছিল না। কুষ্টিয়া থেকে পাখির বড় বোন এসেছিলেন, তিনিও আমার লেখা পড়েন। আমাকে দেখে নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারেননি তিনি আমাকে দেখছেন। জড়িয়ে ধরে রেখেছিলেন বুকে। লাগামছাড়া প্রশংসার সামনে আমি কিংকর্তব্যবিমুঢ়ের মত বসে থাকি। লেখা পড়ে আমাকে যে রকম ভাবে মানুষ, আমি সাংঘাতিক সাহসী, পুরুষ টুরুষ একেবারেই পছন্দ করি না, পুরুষ দেখলে গালে চড় কষিয়ে দিই, তলপেটে লাথি মেরে শুইয়ে দিই, অথচ মোটেও সেরকম নই দেখে, কেউ কেউ হয়ত অবাক হয়, আহত হয়। মুর্ছা যাবে যদি জানে আমাকে পুরুষের চাবুক খেতে হয়। পাখি এমন ভক্ত আমার, এই পাখির বাড়িতেও আমার আশ্রয়হীনতার অসহায়ত্ব নিয়ে অস্বস্তি হয়। আমি লক্ষ্য করি পাখি আমাকে অনির্দিষ্ট কালের জন্য তার বাড়িতে থাকার কথা বলে না। বলে না যতদিন না আমি নিজের জন্য একটি ঘর পাই, ততদিন তার বাড়িকে নিজের বাড়ি মনে করে আমি থাকতে পারি। আমারও ইচ্ছে করে না পাখির কাছে করজোড়ে আরও কয়েকটি দিন ভিক্ষে চাইতে। পাখির বাড়িতে থাকার নির্দিষ্ট সময় দ্রুত ফুরিয়ে আসে।

ঢাকা শহরে অনেক বন্ধু, বান্ধবী, অনেক আত্মীয় স্বজন, কিন্তু এ সময়, আমি জানি, কেউ আমাকে পেয়ে খুশিতে বাগবাগ করবে না। পাখির বাড়ি থেকে বিদেয় হওয়ার পর আশ্রয়হীন আমি হোটেলে থাকার সিদ্ধান্ত নিই। গুলিস্তানের একটি হোটেলে আমার জীবন শুরু হয়। রেস্তোরাঁয় খাওয়া। সারাদিন হাসপাতালে, রাতে ঘুমোনোর জন্য হোটেলে ফেরা। হোটেলে থাকা সহজ ব্যপার নয়। ঘিঞ্জি এলাকায় শহরের সস্তা হোটেলগুলোয় কোনও পুরুষই কোনও মহিলা-আত্মীয় নিয়ে ওঠে না। হোটেলের ম্যানেজারও চোখ কপালে তুলেছিলেন আমি থাকব শুনে। আবারও সহযোগিতার হাত বাড়িয়েছেন খোকা। সুসময়ে অনেকেই আসে কাছে। দুঃসময়ে খুব বেশি মানুষের সন্ধান পাওয়া যায় না। আমার দুঃসময়ে খোকা সত্যিকার ভাইএর মত, বাবার মত, বন্ধুর মত পাশে থাকেন। আমার নিদারুণ নিরূপায় অবস্থা দেখে আর কারও মত আমাকে স্পর্শ করার কোনও সুযোগ খোঁজার চেষ্টা করেন না। খোকা হোটেলের ম্যানেজারকে আলাদা করে ডেকে নিয়ে বলেছেন, ‘মা বোন তো সবারই আছে, কি কন! তাদের অসুবিধা তো আমাদের দেখতে হবে। উনি হচ্ছেন ডাক্তার, মিটফোর্ডে চাকরি করেন। আপাতত থাকার অসুবিধে বলে হোটেলে কদিন থাকতে হবে।’ ম্যানেজার শেষ পর্যন্ত রাজি হন। কেবল রাজিই নন, রাতে আমার ঘরের দরজায় কোনও রকম উৎপাত যেন না হয় সে দিকে কড়া নজরও রাখেন। তবু ঘরের ভেতর বেশির ভাগ রাতেই আমার ঘুম হয় না। দরজা কেউ লাথি দিয়ে ভাঙতে চাইলে ভেঙে ফেলতে পারে। মাতাল বদমাশদের আড্ডাখানা হোটেল, নিশ্চিত হই কী করে! হোটেল জীবনের অবসান ঘটে যখন শান্তিবাগের বাড়িঅলা জানান যে মিনারকে তারা বাড়ি থেকে নোটিশ দিয়ে বের করেছেন। মিনার তার জিনিসপত্র নিয়ে চলে গেছে। বাড়িটিতে উঠে আমার আবার আগের সেই আনন্দ ফিরে পাই। আরমানিটোলার বাড়িতে যেমন সুখের সংসার গড়েছিলাম, তেমন একটি সংসারের স্বপ্নে আবার আমি বিভোর হই। খালি বাড়ির মেঝেয় শুয়েই সুখনিদ্রা যাই। নিজের ওপর যে বিশ্বাস টুকু হারিয়েছিলাম, সেটি নিঃশব্দে, আমাকেও বুঝতে না দিয়ে ফিরে আসে। নিজেকে আর দীন হীন কীট সম কিছু মনে হয় না।
 
১১. দিবস রজনী আমি যেন কার আশায় আশায় থাকি



দুপুরে অসীম সাহা হাসপাতালে ফোন করে খবর দেন রুদ্র অসুস্থ, হলি ফ্যামিলি হাসপাতালের দুশ একত্রিশ নম্বর কেবিনে ভর্তি। খবরটি শুনে আমি আর দেরি করিনি, একটি রিক্সা নিয়ে সোজা হলি ফ্যামিলি হাসপাতালের দিকে যাই। হাসপাতালের গেটের কাছে ফুলের দোকানে নেমে একগোছা রজনীগন্ধা কিনি। রুদ্রর খুব প্রিয় ফুল রজনীগন্ধা। হাসপাতালের নার্সের ঘরে গিয়ে একজন নার্সকে অনুরোধ করি দুশ একত্রিশ নম্বরে গিয়ে আমার নামটি রুদ্রকে বলতে, রুদ্র অনুমতি দিলে আমি ভেতরে ঢুকবো। ভেতরে রোগী দেখার অনুমতি হয়ত সবাই পায় না। আমি পাবো সে ব্যপারে আমি নিশ্চিত নই। রুদ্রর ঘরে রুদ্র ছাড়াও অন্য কেউ থাকতে পারে, আমার উপস্থিতি হয়ত পছন্দ করবে না। নার্স একবার বলেছিল, আপনি সোজা চলে যান রুমে। সোজা চলে যাওয়ার চেয়ে অনুমতি নিয়ে যাওয়া উচিত বলে আমি অপেক্ষা করি। অনুমতি মেলে। আমি জানি, অন্য কেউ না বললেও রুদ্র আমার নাম শুনলেই দেখা করতে বলবে। রুমে রুদ্রর তিনটে বোন ছিল, কারও সঙ্গে কোনও কথা হয়নি, কথা কেবল রুদ্রর সঙ্গেই হয়েছে। কাছে গিয়ে দাঁড়ালে বলেছে, ‘বসো’।

রজনীগন্ধাগুলোর ঘ্রাণ নেবে কী! নাকে নল। ফুলগুলো টেবিলের ওপর রেখে দিই। শিয়রের কাছের চেয়ারটিতে বসে জিজ্ঞেস করি, ‘কী হয়েছে তোমার?’

‘ডাক্তার বলল পেটে নাকি আলসার।’ রুদ্র মাথা নাড়ায় না। কেবল চোখ নাড়িয়ে এপাশ ওপাশ তাকায়। মুখটি বড় মলিন।

‘পেটের আলসার এমন কোনও ব্যপার নয়। সেরে যাবে।’

‘সেরে যাবে?’

‘নিশ্চয়ই। এ রোগ শতকরা আশি জনের হয়। এ কোনও রোগ হল!’

‘নাকে নল নিয়ে তোমাকে লাগছে কেমন বলো তো!’ আমি মুচকি হাসি।

আমার ডানহাতের আঙুলগুলো রুদ্রর চুলে বিলি কাটছে। বাম হাত তার বুকে।

‘কষ্ট হচ্ছে?’

‘কষ্ট তো হচ্ছেই।’

‘একটুও ভেবো না। তুমি খুব শিগরি ভাল হয়ে উঠবে।’

‘কী জানি! এ যাত্রাই শেষ যাত্রা কি না।’

‘বাজে কথা বলো না।’

এরপর রুদ্র মৃদু স্বরে কে কে তাকে দেখতে এসেছিল, কোন কোন কবি লেখক, কি কি বলেছে তারা, কি কি করেছে, বলে। বলে শিমুলের কথাও।

‘আজই এসেছিল। চুপচাপ বসেছিল। মুখ ভার।’

‘কেন, ভার কেন?’

‘বোধহয় আমার এই অবস্থা দেখে মন খারাপ হয়ে গেছে। কোনও কথাই বলেনি।’

‘বিয়ে করছো কবে?’

‘যদি সুস্থ হই..’

‘সুস্থ তো নিশ্চয়ই হবে।’

শিমুলের কথা যখন বলে রুদ্র তার মলিন মুখটি উজ্জ্বল দেখায়। বুঝি, শিমুলকে খুব ভালবাসে রুদ্র। অনেকক্ষণ শিমুলের কথাই বলে সে।

‘দূরে বসেছিল। কাছে এসে বসতে বলেছে, কাছে আসেনি।’

‘কেন আসেনি?’

‘রাগ করে আসেনি। অসুখ বাঁধিয়েছি বলে রাগ করেছে।’

‘ভাল, ওর হাতে পড়লে তোমার অনিয়ম করা চলবে না।’

রুদ্রর উজ্জ্বল মুখে হাসি। আমিও হাসতে চেষ্টা করি। যেন রুদ্রকে অন্যের হাতে সঁপে দিতে আমার মোটেও কষ্ট হচ্ছে না।

রুদ্রর সঙ্গে কখনও আমার ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কে কোনও কথা হয়নি। সম্ভবত লোকের কাছে শোনে সে। আমি একা থাকি নাকি কারও সঙ্গে থাকি, ভাল আছি কী ভাল নেই — কিছু সে কোনওদিন জানতে চায়নি। নিজের কথা বলে সে। নিজের প্রেমের কথা। নিজের কবিতার কথা। অসুখের কথা। সুখের কথা।

‘শিমুলকে নিয়ে লিখলে কিছু,কোনও কবিতা?’

‘হ্যাঁ।’ রুদ্র ধীরে মাথা নাড়ে।

‘কাছে নেই?’

‘কাছে! হাসপাতালে!’ রুদ্র ম্লান হাসে।

‘নয় কেন! তোমার কবিতার খাতা তো সঙ্গে থাকেই তোমার! সে যেখানেই যাও।’

‘আর বোলো না। এই হাসপাতাল থেকে জলদি বেরোতে পারলে বাঁচি।’

‘অস্থির হয়ো না। আগে সুস্থ হও, তারপর বাড়িতে তো যাবেই। খাবারের আগে পরে খাওয়ার জন্য ডাক্তার কিছু ওষুধ লিখে দেবে। সেসব খেও নিয়মিত। পকেটে এন্টাসিড ট্যাবলেট রাখবে বাইরে গেলে। এসিডিটির ভাব দেখলে খেয়ে নেবে।’

‘ডাক্তার বলেছে ব্লাড প্রেশার বেশি।’

‘ব্লাড প্রেশার বেশি? বল কি! এই বয়সে ব্লাড প্রেশার বাড়বে কেন! ঠিক দেখেছে ডাক্তার?’

‘বলল তো!’

‘তাহলে তোমাকে খুব সাবধান থাকতে হবে। প্রেশার কমার ওষুধ দিচ্ছে তো!’

‘দিচ্ছে।’

‘কি বলল? সিগারেট মদ সব আগের মত চালিয়ে যেতে বলেছে?’

‘এবার বোধহয় সব ছাড়তেই হবে।’

‘ছেড়ে দাও। ছেড়ে দাও। নিয়মিত খাওয়া দাওয়া কোরো, দেখবে পেটের অসুখে আর ভুগতে হবে না।’

সেদিন কথা দিয়েছিলাম আবার তাকে দেখতে যাবো। সেই দেখতে যাওয়া আর হয়নি। এরপর তো ইয়াসমিন এল শান্তিবাগের বাড়িতে, মিলন এল। মিলন ঢাকায় এসেছে চাকরি করতে। বাসাবোর এক গলিতে তার বোনের বাড়িতে ছিল, এখন এ বাড়িতে নিয়ে এসেছি। এতদিন বিয়ের কলংক নিয়ে মুখ লুকিয়েছিলাম। অবকাশে যাইনি। আত্মীয় স্বজন কারও সঙ্গেই দেখা করিনি। পূর্বাভাস পত্রিকায় আমার কলামের সমালোচনা করতে গিয়ে এক লোক লিখেছিল, যার এক কান কাটা সে কাটা কানটি আড়াল করতে রাস্তার এক কিনার দিয়ে হাঁটে, আর দুই কান কাটা যার, সে রাস্তার মধ্যিখান দিয়ে হাঁটে, কারণ তার আড়াল করার কিছুই নেই, আমি কাটা দুটো কান নিয়ে নির্লজ্জের মত রাস্তার মধ্যিখান দিয়ে হাঁটছি। আমি নির্লজ্জ বলে এমন আবোলতাবোল কথা লিখছি কলামে। আমাকে অপদস্থ করার জন্য লেখাটি। হেনস্থার যেহেতু শেষ নেই, রাস্তার মধ্যিখান দিয়েই হাঁটব পণ করেছি। একাধিক বিয়ের লজ্জা, দুর্নামের ভয় ইত্যাদি নিয়ে মুখ লুকিয়ে থাকলে আর কারও লাভ হয় হয়ত, আমার কিছু হয় না।

ইয়াসমিনকে নিয়ে ছোটদার বাড়িতে গিয়েছি সুহৃদকে দেখতে, তখনই ও বাড়িতে আমার ফোন এল। ও বাড়িতে আমার ফোন, অবাক কাণ্ড বটে। হ্যাঁ ওটি আমারই ফোন। করেছে ক্যারোলিন রাইট। ক্যারোলিন রাইট আমেরিকার কবি, এখানে ফুলব্রাইট স্কলারশিপ নিয়ে বাঙালি মহিলা কবিদের কবিতা নিয়ে গবেষণা করতে এসেছে। আমার কবিতার ওপরও তাঁর গবেষণা চলছে, অনুবাদও কয়েকটি কবিতার করেছে। ক্যারোলিনের সঙ্গে দুদিন দেখা হয়েছে বাংলা একাডেমিতে যখন সে মুহম্মদ নুরুল হুদার সাহায্য নিয়ে আমার কবিতা অনুবাদ করছিল। ক্যারোলিনকে যে আমার খুব পছন্দ হয়েছে তা নয়। কিছুদিন এখানে থেকেই ভাব এমন যে এখানকার রাজনীতি, সমাজনীতি অর্থনীতি, সাহিত্য সংস্কৃতি সবই তার নখদর্পণে। এর মধ্যেই সৈয়দ মঞ্জুরুল ইসলামের প্রেমে পড়ে গেছে, মঞ্জুরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, ক্যারোলিনকে সাহায্য করছিলেন অনুবাদে। ক্যারোলিন যে কারও শোবারঘরে বড় নাক গলাতে চায়। আমি কটি বিয়ে করেছি, কাকে বিয়ে করেছি, ইত্যাদি জানার জন্য ক্যারোলিনের উৎসাহ টগবগ করে। বিদেশি মেয়ে, ধারণা ছিল কারও ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে মাথা ঘামায় না। দেখলাম, কবিতার চেয়ে কবি নিয়ে গবেষণা করার আগ্রহ তার বেশি। চরিত্র অবিকল গুঁজাবুড়ি কুটনিবুড়ির। পরে এই ক্যারোলিনকেই, যেহেতু সে সুন্দর বাংলা শিখেছে, একদিন টেলিভিশনের একটি অনুষ্ঠানে তার কবিতা পড়ার সুযোগ করে দিই। টেলিভিশন থেকে আমাকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল, আমি প্রযোজিকাকে বলে কয়ে ক্যারোলিনকে ঢুকিয়েছি অনুষ্ঠানে। ক্যারোলিন সে কী খুশি! চশমা পরলে তাকে নাকি কুৎসিত লাগে তাই চশমা খুলে ক্যামেরার সামনে এসেছিল। চশমা ছাড়া কাগজ দেখে নিজের লেখা পড়তেও তার অসুবিধে হচ্ছিল, তবু সে চশমাটা পরে নেয়নি, এমন। চশমা জিনিসটি আমার এত ভাল লাগে যে ছোটবেলায় চশমা পরার জন্য মধ্যাহ্নের সূর্যের দিকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা তাকিয়ে থাকতাম, চোখের ভেতর খোঁচাতাম যেন চোখ নষ্ট হয়, যেন বাবা আমাকে চোখের ডাক্তারের কাছে নিয়ে যান, যেন চোখের ডাক্তার আমার চোখ পরীক্ষা করে বলেন যে আমার চোখ নষ্ট, যেন একটি চশমা আমাকে দেন পরতে। ক্যারোলিন সেদিন ফোনের ওপাশ থেকে ভাঙা বাংলায় বলল, ‘রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ মারা গেছে, তুমি জানো?’

‘কি বললে?’

‘রুদ্র মারা গেছে।’

‘রুদ্র মারা যাবে কেন?’

‘আজ সকালে মারা গেছে।’

‘পাগলের মত কথা বলছো কেন! আমি তো সেদিন মাত্র রুদ্রকে দেখে এলাম হলি ফ্যামিলি হাসপাতালে। মরে যাওয়ার মত কোনও অসুখ ওর হয়নি।’

‘কিন্তু আমি শুনলাম মারা গেছে।’

‘তোমাকে কে বলেছে এসব কথা?’

‘বলেছে একজন। একজন কবি।’

‘নাম কি? যদি বলে থাকে মিথ্যে বলেছে ।’

‘কিন্তু সে কবিটি মিথ্যে বলবে না। তুমি খোঁজ নিয়ে দেখো।’

‘শোনো ক্যারোলিন,রুদ্র হাসপাতালে এই কথাটি হয়ত তোমাকে বলেছে, তুমি শুনতে ভুল করেছো।’

‘আমাকে ষ্পষ্ট বলল মারা গেছে।’

‘তাহলে যে বলেছে সে জানে না। কারও কাছে হয়ত শুনেছে যে রুদ্রর অসুখ। বানিয়ে বানিয়ে বলে দিল মারা গেছে। কানে কানে কত রকম খবর যে পৌঁছোয়।’

‘যাই হোক, তুমি খবর নিও।’

ক্যারোলিনের খবরটিকে সত্য মনে করার কোনও কারণ আমি দেখিনি। তবু ইয়াসমিনকে নিয়ে হলি ফ্যামিলি হাসপাতালে যাই। হাসপাতালে রুদ্র যে কেবিনে ছিল সে কেবিনে খোঁজ নিয়ে দেখি রুদ্র নেই। নার্সকে জিজ্ঞেস করলে বলল, ‘রোগী গতকাল বাড়ি চলে গেছে।’

‘সুস্থ হয়েছিল?’

‘হ্যাঁ হয়েছিল।’

‘পুরোপুরি সুস্থ হয়েছিল, নাকি রোগী এখানে থাকতে চায়নি বলে নাকে নল টল নিয়ে বাড়ি চলে গেছে।’

নার্স আমার দিকে বিরক্ত ভঙ্গিতে তাকিয়ে বলে, ‘সুস্থ না হলে কি ডাক্তার ডিসচার্জ দেয় নাকি?’

নার্স রুদ্রর ফাইল বের করে আমাকে দেখিয়ে বলল, ‘রোগী ভাল হয়ে গেছে, ডাক্তার তাই বাড়ি চলে যেতে বলেছে।’

হলি ফ্যামিলি থেকে রিক্সায় উঠে গজরাতে থাকি। ‘মানুষের মুখের কোনও লাগাম নাই। যা ইচ্ছ! তাই বইলা ফালায়। রুদ্র ভাল হইয়া দিব্যি হাসপাতাল থেইকা বাসায় গেছে । আর মানুষে কয় যে মারা গেছে।’ বলি কিন্তু রিক্সাঅলাকে বলি ইন্দিরা রোডের দিকে যেতে।

ইয়াসমিন বলে, ‘ইন্দিরা রোডে যাইবা কেন?’

‘দেখি গিয়া। রুদ্র বাসায় ঠিক মত গেছে এইডা একটু কনফার্ম হইয়া আসি। অবস্থা খারাপ হইলে তো নার্সই কইত।’

জানি খবরটি সত্য নয়, তবু সারা রাস্তা আমি অন্যমন বসে থাকি। ইয়াসমিন বলে, ‘কি চিন্তা কর? কিছু ত হয় নাই। এমনি একটা গুজব।’

‘গুজবই আসলে।’

‘কী অসুখ ছিল? হাসপাতালে ছিল কেন?’

‘বেশি কিছু না। পেটের আলসার ছিল। আমি দেইখা গেলাম সেইদিন। ভাল ট্রিটমেন্ট চলতাছিল। মারা যাবে কেন? মারা যাওয়ার তো কোনও কারণ থাকতে হবে। যে মানুষ হাসপাতাল থেইকা আলসারের ট্রিটমেন্ট পাওয়ার পর সুস্থ হইয়া বাসায় যায় গা, সেই মানুষ নাকি মারা গেছে। এর মত আজগুবি কথা আরও আছে? যদি কোনও কঠিন অসুখ হইত, বুঝতাম।’

ইন্দিরা রোডে যাচ্ছি কিন্তু রুদ্রর বাড়ির ঠিকানা জানি না। ঝিনাইদহ থেকে যে রাতে এসেছিলাম, পথ আবছা যেটুকু মনে আছে, অনুমান করে এগোতে থাকি। হঠাৎ দেখি এক গলিতে চার পাঁচজন লোক দাঁড়িয়ে আছে। এরমধ্যে দুজনকে চিনি, একজন মইনুল আহসান সাবের। বুকের ভেতর হঠাৎ ভীষণ ঝড়ো হাওয়া এসে যা কিছু ছিল বুকে সব ছিনিয়ে নিয়ে যায়। মুহূর্তে রক্ত যেন ঠাণ্ডা হয়ে গেছে। শরীরে কাঁপুনি ওঠে। অন্ধকার লাগে সামনের সব কিছু। চোখ বন্ধ করে দাঁতে দাঁত চেপে নিজের এই কাঁপনকে রোধ করতে করতে বলি, ‘ইয়াসমিন রুদ্রর বন্ধুরা এইখানে কেন! কী হইছে?’

ইয়ামমিন কোনও কথা বলে না।

‘তাইলে কি সত্যি খবরটা?’

ইয়াসমিন কোনও কথা বলে না।

রিক্সা এগোতে থাকে। আরও মানুষের জটলা, আরও চেনা মুখ।

‘না, খবরটা সত্যি হইতে পারে না। অসুখ বোধহয় বেশি।’

আমি সান্ত্বনা খুঁজি। ইয়াসমিনের হাত চেপে ধরে রাখি।

‘ক কথা ক। ঠিক না!’

ইয়াসমিন কোনও কথা বলে না।

‘এত মানুষ কেন! সবাই ইন্দিরা রোডে কেন! কোনও কবিতার অনুষ্ঠান আছে বোধহয় এই গলিতে! নাকি রুদ্রর কাছে আইছে তারা! কিন্তু এত মানুষ আইব কেন?’ চাপা আর্তনাদ আমার কণ্ঠে।

ইয়াসমিন তার হাতটি আমাকে শক্ত করে চেপে রাখতে দেয়। কোনও কথা বলে না। যে বাড়িটির সামনে লোকের ভিড়, সেই বাড়ির কাছে রিক্সা থামিয়ে নেমে ভিড় সরিয়ে দৌড়ে দোতলায় উঠি আমি। ঘরের দরজা খোলা, কান্নার শব্দ ভেসে আসছে ভেতর ঘর থেকে। দরজার পাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন অসীম সাহা।

‘অসীম দা, কী হয়েছে?’ বলার সঙ্গে সঙ্গেই তিনি হাউ মাউ করে কেঁদে উঠে বললেন, ‘নাসরিন, রুদ্র নেই।’

‘কি বলছেন এইসব!’

শরীর থেকে শরীরের সব শক্তি কর্পুরের মত উবে যায়। শরীরটি দাঁড়িয়ে থাকতে পারে না, পেছনের দেয়ালে ভর রেখেও শক্তিহীন শরীরটিকে আমি দাঁড় করাতে পারি না। পালকের মত এটি নিচে পড়তে থাকে। পুরো জগতটি লাটিমের মত ঘুরতে থাকে, শব্দহীন হয়ে যেতে থাকে সব। নিজের গলা ছেড়ে কাঁদার বা গোঙানোর বা কাতরানোর কোনও শব্দও আর শুনতে পাই না। অসীম সাহার কান্নার শব্দও আমার কানে আর পৌঁছে না। চারদিকের মানুষগুলোর মুখগুলোও আমার আর চেনা মনে হতে থাকে না। মানুষগুলো জলের ভেতরে নানারকম আকার নিয়ে ভাসতে থাকে। যেন মাছ সবাই। আমি একটি মৃত ডাল পড়ে আছি জলের তলে। মাছগুলো নিঃশব্দে সাঁতার কাটছে। ওভাবে কতক্ষণ পার হয় জানি না। চলতে চলতে হঠাৎ স্থির হয়ে আছে সময়। ঘড়ির কাঁটা হয়ত কোথাও টিক টিক করে চলছে, জগত হয়ত যেমন চলছিল, তেমন চলছে, আমার জগতে স্থির সময়ের মত সবকিছুই নির্বাক নিথর নিস্পন্দ হয়ে আছে। আমি আমাকে আর আমার ভেতর অনুভব করি না। আমি আর কিছুই অনুভব করি না। কেউ আমাকে স্পর্শ করলেও না। কেউ আমাকে ডাকলেও না।

একটি মাছ এগিয়ে আসে মৃত ডালের দিকে। প্রজ্ঞা লাবণীর আকার ধরে মাছটি আমাকে স্পর্শ করে। স্পর্শটি আমাকে কোথাও কোনও মাছের বাজারের ভীষণ কোলাহলের মধ্যে টুপ করে ফেলে দেয়। আমি মাঝখানে দাঁড়িয়ে থাকি চারদিকের দরদামের চিৎকার, ঘামের গন্ধ আর এক ঘর নোংরার মধ্যে। আশ্চযর্, সব কিছুর মধ্যে, মেঝেয় শুয়ে কী নিশ্চিন্তে ঘুমোচ্ছে রুদ্র। কোনও দুর্গন্ধ, কোনও কোলাহল তাকে জাগাচ্ছে না। রুদ্র, সেই রুদ্র, আমার ভালবাসার রুদ্র, দিবস রজনী আমি যার আশায় আশায় থাকি। ঘুমিয়ে আছে রুদ্র। একটি রেখা রেখা সাদা চাদরের ওপর শুয়ে ঘুমিয়ে আছে রুদ্র। এই চাদরটিতে দুজন শুয়েছি আমরা কত রাত। কত রাত আমাদের আনন্দ রসে ভিজেছে এই চাদর। কত রাত এই চাদরের যাদু আমাদের সাত আসমান ঘুরিয়ে এনেছে। কত রাত আমার সারা শরীরে চুমু খেতে খেতে আমাকে নিবিড় করে জড়িয়ে ধরে এই চাদরে ঘুমিয়েছে রুদ্র। এখন সে পুরো চাদর জুড়ে স্বার্থপরের মত একা শুয়ে আছে। আমাকে পাশে শুতে ডাকছে না। যেন রুদ্র শোনে, কেবল সে-ই শোনে শুধু, এমন নিভৃতে, প্রায় কানে কানে বলি ‘এই, এখন কি ঘুমোবার সময়! ওঠো। দেখ আমি এসেছি। চল কোথাও বেরিয়ে পড়ি। এখানে এত লোক! চল দুজন চুপ চুপ করে আলাদা হয়ে যাই। সেই আগের মত, ভিড় থেকে বেরিয়ে সেই যে চলে যেতাম কোথাও! হন্যে হয়ে নির্জনতা খুঁজতাম। ওঠো। না হয় না গেলে কোথাও, উঠে বসো তো বাবা, কবিতা শোনাও, নতুন কি লিখেছো, শোনাও। তোমার কোলে মাথা রেখে শুনব কবিতা। চমৎকার আবৃত্তি করে মুগ্ধ করে দাও সবাইকে।’

রুদ্র ওঠে না। মিহি সুরে একটি কান্নার শব্দ শুনি, কান্নার কণ্ঠটি হঠাৎ কথা বলে ওঠে, ‘কী দেখতে এসেছো তুমি! কারে দেখতে এসেছো! দেখে যাও! দেখে যাও! প্রাণ ভরে দেখে যাও আমার ছেলেরে। কম কষ্ট তো দাওনি ওরে। দেখতে এসেছো এখন!’ পাথরের মত পার্থিব জগতটিতে দাঁড়িয়ে থাকি রুদ্রর পাশে। জগতের অশ্লীল শব্দগুলো আমাকে খোদাই করছে। শব্দ ভেসে আসছে লাশ ওঠাও, লাশ নামাও। রুদ্রকে রুদ্র না বলে ওরা লাশ বলে সম্বোধন করছে ! আহ রুদ্র, চোখ খোলো, দেখ, মোহন রায়হান তোমাকে লাশ বলে ডাকছে। মনে আছে, মেরে তোমার লাশ ফেলে দেবে বলেছিল যে ছেলেটি! দেখ, মুখে কেমন ফেনা তুলে ফেলছে তোমাকে লাশ ডাকতে ডাকতে। রাগ হচ্ছে না তোমার! আমি জানি না কখন পাথরটিকে কে সরিয়ে নিয়ে রিক্সায় তুলে দেয়। রিক্সা যাচ্ছে ট্রাকটির পেছন পেছনে, ট্রাকে রুদ্র। রুদ্র এখন টি এসসিতে যাবে। ওখান থেকে মিঠেখালি।

‘কি হইছে রুদ্রর?’ পাথর গলে যেতে থাকে।

‘সকালে ঘুম থেইকা উইঠা দাঁত মাজতে গেছিল। দাঁত মাজতে মাজতে হঠাৎ পইড়া গেছে। হার্ট এ্যাটাক।’

‘বাজে কথা কইস না। ইয়াসমিনকে ধমকে থামাই। ইয়াসমিন চুপ হয়ে যায়।

অনেকক্ষণ পর ধীরে আমি, এই জগতে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করি, ‘ইয়াসমিন, রুদ্র কি সত্যিই মারা গেছে?’

ইয়াসমিন কথা বলে না।

‘কথা ক। কথা ক ইয়াসমিন। সত্যি কইরা ক, ক যে মারা যায় নাই। ওর হার্ট এ্যাটাক হইব কেন? হার্টের তো কোনও প্রবলেম ছিল না ওর। ক যে মারা যায় নাই। ক যে ও ঘুমাইয়া রইছে।’

ইয়াসমিন কথা বলে না।

না, কোথাও কিμছু হয়নি। আমি আর ইয়াসমিন ঘুরে বেড়াচ্ছি ঢাকা শহরে। ইয়াসমিনের সঙ্গে আমার অনেকদিন পর দেখা। দুজন আমরা ময়মনসিংহের রাস্তায় যেমন ঘুরে বেড়াতাম, তেমন ঘুরে বেড়াচ্ছি। কোথাও যাইনি আমরা, কোনও ইন্দিরা রোডে যাইনি, কিছুই দেখিনি। রিক্সায় বসে ঘুমিয়ে পড়ার অভ্যেস আমার আছে, ঘুমিয়ে থাকার সময় কোনও দুঃস্বপ্ন দেখেছি হয়ত। কলকল করে উঠি সুখী স্রোতের মত, রিক্সার হুড ফেলে দিয়ে, ‘চল বেইলি রোডে যাই, শাড়ি কিনি গা।’

‘না।’

‘না কেন!’

‘বাসায় চল।’

‘কিসের বাসা! বাইরইছি ঘুরতে। চল ঘুইরা বেড়াই।’

‘না, বাসায় চল বুবু।’

অনেকক্ষণ চুপ হয়ে বসে থেকে রিক্সাকে বলি টিএসসির দিকে যেতে। ইয়াসমিন বলে, ‘টিএসসিতে যাইও না।’

ইয়াসমিনকে জোরে ধমক লাগাই চুপ থাকতে। ধমকে ইয়াসমিন চুপ হয় না। আমাকে জাপটে ধরে ভাঙা গলায় বলে, ‘বুবু, তুমি এমন কইর না।’

‘চল টিএসসিতে যাই। ওইখানে রুদ্র আছে।’

‘না।’

‘আমি রুদ্রর কাছে যাবো।’

‘বুবু, থামো এইবার। ওরা কেউ তোমারে পছন্দ করতাছে না। তুমি যাইও না টিএসসিতে।’

আমি বিশ্বাস করতে চাই যে রুদ্র নেই। নিজেকে বার বার বলি রুদ্র নেই। রুদ্র আর নেই। রুদ্রর শরীর পড়ে আছে শুধু। সেই শরীরে হৃদপিণ্ডটি থেমে আছে, কোনও রক্ত সেখানে যাচ্ছে না, সেখান থেকে বেরোচ্ছে না, হৃদপিণ্ডের কোনও সংকোচন প্রসারণ হচ্ছেন!। রক্ত বইছে না শরীরে।ফুসফুস দুটো স্থির হয়ে আছে। রুদ্র শ্বাস নিচ্ছে না, ফেলছে না। রুদ্র আর জেগে উঠবে না। রুদ্র আর কবিতা লিখবে না। রুদ্র আর হাসবে না। রুদ্র আর কোনও মঞ্চে কবিতা পড়বে না। সবাই যার যার জীবন যাপন করবে, কেবল রুদ্র করবে না। বিশ্বাস করতে চাই, কিন্তু পারি না। আমার কিছুতে বিশ্বাস হয় না, রুদ্র সত্যি সত্যি নেই। রুদ্র নেই, এ কথা যখনই ভাবি, শকুন খেয়ে যাওয়া গরুর পাঁজর যেমন পড়ে থাকে বধ্যভূমিতে, আমার পাঁজরও অনুভব করি তেমন। খালি। ভেতরে কিছু নেই। হু হু করছে চারদিক, হু হু করছে বুকের ভেতর। শ্বাস নিতে চেষ্টা করি, কষ্ট হয়, যেন বাতাস ফুরিয়ে গেছে, পৃথিবীর সকল বাতাস। চারপাশের মানুষগুলো মানুষ নয়, সব শকুন। আমার চোখের কোটরে চোখ নেই। আমার খুলির ভেতর মস্তিস্ক নেই। সব খেয়ে গেছে কেউ। এই অনুভবটি আমার সমস্ত শরীরে সংক্রামক ব্যধির মত ছড়িয়ে যায়। রিক্সা কখন থেমেছে শান্তিবাগের বাড়িতে বুঝিনি, কখন উঠে এসেছি ঘরে, কখন দেয়ালে হেলান দিয়ে একা বসে আছি বুঝিনি। কতক্ষণ কত দীর্ঘক্ষণ বসে আছি কিছুই জানি না। হঠাৎ কাঁধে একটি হাত অনুভব করি কারওর, গভীর শূন্যতা থেকে চোখ উঠিয়ে দেখি নাইম। তখনই বাঁধ ভেঙে উতল সমুদ্রের জল নামে, ভাসিয়ে দেয় স্তব্ধ চরাচর।

আমার পক্ষে ঢাকায় এক মুহূর্তের জন্য থাকা সম্ভব হয় না। ঢাকা যেন আচমকা আস্ত একটি শ্মশান হয়ে গেছে। শ্মশানে কোনও মানুষের চিহ্ন নেই। বাতাসে লাশের গন্ধ। ছোটদা খবর পেয়ে গাড়িতে মাল ওঠান। সপরিবার তিনি রওনা হন ময়মনসিংহে। আমি গাড়ির জানালায় মুখ রেখে দেখছিলাম গাছপালা ক্ষেত খামার। সবই তো যেমন ছিল, তেমনই আছে। কেবল রুদ্র নেই। রুদ্র আর হাঁটবে না কোনও পথে, আর ঘ্রাণ নেবে না কোনও ফুলের, আর নদীর রূপ দেখবে না, ভাটিয়ালি গান শুনবে না। আমার বিশ্বাস হয় না রুদ্র আর হাঁটবে না, ঘ্রাণ নেবে না, দেখবে না, শুনবে না। কেন যেন মনে হয় রুদ্র ফিরে আসবে। আবার হঠাৎ করে ফিরে আসবে একদিন। বলবে ‘মিঠেখালি গিয়েছিলাম, আজ ফিরেছি।’ যেমন ফিরে আসত বার বার। আমি কোনও অলৌকিকে বিশ্বাস করি না, কিন্তু আমার বিশ্বাস করতে ভাল লাগে যে রুদ্র ফিরে আসবে। আবার হাসবে, লিখবে,ভাববে, ভালবাসবে।

ঢাকা শ্মশান শ্মশান লাগছিল বলে ময়মনসিংহে ফিরে দেখি এটিও শ্মশান। বিছানার তল থেকে আমার ট্রাংকটি টেনে এনে খুলি। রুদ্রর স্পর্শ পেতে খুলি। যে করেই হোক রুদ্রর স্পর্শ চাই আমি। তাকে আমি স্মৃতি হতে দিতে চাই না। রুদ্রর চিঠিগুলো পড়তে পড়তে পুরোনো দিনগুলো চোখের সামনে এসে দাঁড়ায়। দিনগুলো আমার এত কাছে যে আমি দিনগুলোকে স্পর্শ করি। দিনগুলোতে ভাসি, ডুবি, দিনগুলো নিয়ে খেলি, দিনগুলোকে চুলে বিনুনির মত বেঁধে রাখি। দিনগুলো হঠাৎ ঝাপসা হয়ে আসতে থাকে যখন কেউ আমাকে ডাকে। তাহলে সেই দিনগুলো নেই! সেই ভালবাসার দিনগুলো! সবই কেবল স্মৃতি! ভয়ংকর রকম নিঃসঙ্গ লাগে নিজেকে, ভয়ংকর রকম একা। নিজেকে সামনে নিয়ে বসে থাকি, এ জীবন নিয়ে কি করব আমি বুঝি না, মূল্যহীন মনে হতে থাকে জীবনটি। যে মানুষটি আমাকে ভালবাসত, সেই মানুষটি নেই! যে মানুষটির জন্য কতকাল আমি স্বপ্ন দেখেছি, নেই! যে মানুষটিকে ছেড়েছি, কিন্তু ছাড়িনি; যে মানুষটি থেকে দূরে সরেছি, কিন্তু দূরে সরিনি, সে নেই। এই নেই টি আমাকে বাড়ি কাঁপিয়ে কাঁদায়। পাড়া কাঁপিয়ে কাঁদায়। কালো ফটকের কাছে ভিড় করে কৌতুহলী চোখ। বাবা বাড়িতে। তিনি শুনেছেন একটি মুত্যুর খবর। তিনি আমার কান্নার দিকে কোনও ঢিল ছোঁড়েন না। আমাকে কাঁদতে দেন। বাড়ির সবাই আমাকে প্রাণভরে কাঁদতে দেয়।

ঢাকায় ফিরে শ্মশান শ্মশান ঢাকাটি আমার আর সয় না। অসীম সাহার বাড়িতে যাই, অঞ্জনা সাহা, অসীম সাহার স্ত্রী, আমাকে আলিঙ্গন করেন শোকে। আমরা এক একটি কাঁধ খুঁজছিলাম মাথা রেখে কাঁদার। গভীর গোপন দুঃখগুলো প্রকাশের জন্য মানুষ খুঁজছিলাম আমরা। রুদ্রহীন এই নিস্তরঙ্গ নিঃসঙ্গ জগতের কথা বলতে থাকি আমরা। একসময় আমাদের শোক কোনও শব্দে প্রকাশ হয় না। আমাদের প্রতিবিন্দু অশ্রু রুদ্রর জন্য। আমাদের প্রতি কণা দীর্ঘশ্বাস রুদ্রর জন্য। কাছে পিঠে কোথাও যদি রুদ্র তুমি থাকো, দেখ, দেখ যে তোমার এই প্রস্থান আমরা কেউই গ্রহণ করতে পারি না। সম্ভব হয় না আমাদের কারওর পক্ষেই।

যে মানুষটি ধর্মে বিশ্বাস করত না, তার জানাজা হবে, কুলখানি হবে। এগুলোকেও যদি অন্তত বন্ধ করা যেত! শক্তি নেই রুদ্রকে ফিরিয়ে আনার। শক্তি নেই ধর্মকে বিদেয় করার রুদ্রর আশপাশ থেকে। আমাদের অক্ষমতা, অপারগতা নিয়ে আমরা নির্বোধের মত বসে থাকি।

শাহরিয়ার আজকের কাগজ পত্রিকার সাহিত্য পাতার সম্পাদক। আমাকে একদিন অনুরোধ করল রুদ্রকে নিয়ে কিছু লিখতে। লেখায় প্রকাশ হয় না রুদ্রর না থাকার কষ্ট। কেবল হৃদয় খুলে যদি দেখাতে পারিতাম। কাকে দেখাবো! কাউকে দেখাতে ইচ্ছে করে না। কষ্টগুলো আড়াল করে রাখি। সংগোপনে কেবল নিজের জন্য রাখি। রুদ্রই যদি নেই, দেখে আর কার কী লাভ!

ইসহাক খান নামে রুদ্রর এক বন্ধু লিখছেন বলছেন খিস্তি ছুঁড়ছেন আমার বিরুদ্ধে, আমি নাকি রুদ্রর মৃত্যুর জন্য দায়ী। আমিই রুদ্রকে হত্যা করেছি। কী করে হত্যা করেছি, তা অবশ্য তিনি বলেননি। তাঁর লেখা পড়ে আমার খুব মন খারাপ হয়ে যায়। ইসহাককে আমি চিনি দীর্ঘদিন। রুদ্রর কাছে প্রায়ই আসতেন। সংসারে অভাব ছিল তাঁর, রুদ্রর উদার হস্ত, বন্ধুকে টাকা পয়সা দিয়ে সাহায্য করত। ইসহাকের সঙ্গে যতবারই দেখা হয়েছে আমার, অন্তর ঢেলে আপ্যায়ন করেছি। ইসহাক খান গল্প লেখেন, গল্পকার হিসেবে তেমন টাকা রোজগার করতে পারেননি, এখন কুৎসা রটিয়ে রোজগার করছেন। তসলিমা বিষয়ে যে কোনও লেখাই এখন পত্রিকাগুলো লুফে নেয়। কিছু ছাপাতে তাঁর এখন আর অসুবিধে হয় না। ইসহাকের লেখা পড়ে, আমি নিশ্চিত, পাঠকেরা চুক চুক করে দুঃখ করেছে রুদ্রর জন্য আর আমাকে ছিনাল পিশাচ খানকি বলে গাল দিয়েছে। রুদ্রর এক বন্ধু একদিন হেসে বলল, ‘রুদ্র না থাকায় মাগনা মদ খেতে পাচ্ছেন না বলে ইসহাকের মাথা খারাপ হয়ে গেছে!’ রুদ্রকে নিয়ে বাণিজ্য করার ধুম পড়েছে চারদিকে। একদিন সাইফুল্লাহ মাহমুদ দুলাল নামের এক কবি আসে, আমাকে লেখা রুদ্রর চিঠিগুলো যেন তাকে দিই, ছাপবে সে। আমি না বলে দিই। এই দুলালই রুদ্রর ট্রাক থেকে পেছনে রিক্সায় বসা আমার দিকে দলা দলা ঘৃণা ছুঁড়ে দিয়েছিল।

যে কাজটি সবচেয়ে জরুরি সে কাজটি করি। রুদ্রর সমগ্রটি প্রকাশ করার উদ্যোগ নিই। রুদ্রর খুব ইচ্ছে ছিল তার সমগ্র প্রকাশ হোক। বেঁচে থাকলে কেউ প্রকাশ করেনি। রুদ্র কি তাই মরে গেল! মরে গিয়ে তার সমগ্র করার সুযোগ দিয়ে গেল! যা কিছু জীবনে সে লিখেছিল, সব নিয়ে সমগ্র। প্রকাশক বিদ্যাপ্রকাশ। খোকা এবার আর রুদ্রর সমগ্র বের করতে অনিচ্ছ! প্রকাশ করেননি। বইয়ের রয়্যালটি চলে যাবে রুদ্রর ভাই বোনদের কাছে। সম্পাদনার দায়িত্ব অসীম সাহার। আমার দায়িত্ব প্রুফ দেখা। ইত্যাদি প্রেসে ছাপা হতে থাকা রুদ্রর লেখাগুলোর প্রুফ যখন দেখি ঘরে বসে, যেন প্রুফ দেখি না, দেখি রুদ্রকে। যেন বসে আছে পাশে, শুনছে সে, আমি তার কবিতাগুলো পড়ছি, বার বার পড়ছি। প্রতিটি শব্দ পড়ছি, প্রতিটি অক্ষর। মেঝের ওপর একরাশ কাগজের মধ্যে সারা সারা রাত প্রুফ দেখতে দেখতে কোনও কোনও সময় ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছি ওই কাগজের ওপরই মাথা রেখে। স্বপ্নে রুদ্র আর আমি দুজন আমরা হাতে হাত রেখে হাঁটি আর কবিতার কথা বলি।

রুদ্র কমিটি গঠন করে অসীম সাহা এবং আরও কয়েকজন রুদ্রর নামে মেলার আয়োজন করেন। মেলায় বই বিক্রি হয়, কুটির শিল্পের জিনিসপত্র বিক্রি হয়। এই মেলাই অকাল প্রয়াত এক প্রতিভাবান কবিকে প্রতিবছর স্মরণ করার দায়িত্ব নিয়েছে।

রুদ্রকে নিয়ে অনুষ্ঠানে এখন অনেক বড় বড় লেখকরাই বড় বড় দীর্ঘশ্বাস ফেলে রুদ্রকে স্মরণ করেন, যাঁরা ইচ্ছে করলেই পারতেন রুদ্রকে ঢাকায় একটি চাকরি যোগাড় করে দিতে। রুদ্র তো দ্বারে দ্বারে কম ঘোরেনি। সেই গানটি, ভাল আছি, ভাল থেকো আকাশের ঠিকানায় চিঠি লিখো টেলিভিশনের একটি নাটকে ব্যবহার হওয়ার পর লোকের মুখে মুখে ফেরে। বেঁচে থাকলে কী বিষম আনন্দ পেত রুদ্র। বেঁচে থাকলে তার গান কি টেলিভিশনের কেউ ব্যবহার করতে চাইত! কে জানে! আকাশের ঠিকানায় আমি প্রতিদিন চিঠি লিখি রুদ্রকে। চিঠি সে পাক বা না পাক, লিখি।
 
১২. বৈধ অবৈধ



অবকাশ থেকে আমার সব জিনিসপত্র, আরমানিটোলা থেকে যেগুলো তুলে নেওয়া হয়েছিল, মাকে বলেছিলাম নিয়ে আসতে, বৈঠকঘরের বইয়ের আলমারিতে রাখা আমার বইগুলো তো আনবেনই, আলমারিটিও যেন আনেন। ময়মনসিংহে ট্রাক ভাড়া করে মা জিনিসপত্র ট্রাকে তুলে নিয়ে এলেন শান্তিবাগের বাড়িতে। তখন রাত অনেক হয়ে গেছে। জিনিসপত্র ঘরে ওঠানো হলে দেখি সব আছে, কেবল বইয়ের আলমারিটিই নেই। মা ক্লান্তিতে নুয়ে আছেন। ঘামছিলেন। মাকে ধমকে আরও ঘামিয়ে দিই।

‘বুকশেল্ফ আনো নাই কেন?’

মা বললেন, ‘কত চাইছি, তর বাপে দিল না। বইয়ের আলমারিটি আমার নিজের না হলেও বাপের।’ কিন্তু মেয়ে বাড়ি ভাড়া নিয়েছে, দেওয়া কি যেত না আলমারিটি! মা কেঁদে ফেলেন, ‘আমি কি করতাম! তর বাপেরে এত কইলাম। তর বাপে কিছুতেই দিল না।’

আমি চেঁচিয়ে বলি, ‘দিল না কেন? বুকশেলফে তো আমার বই ই ছিল। এহন খালি বুক শেলফের মধ্যে কী ঘোড়ার ডিম সাজাইব? সব বই তো নিয়া ‌আইছি। অবকাশে কেউ বই পড়ে? কি করব আলমারি দিয়া? খাইব?’

মা কপালের ঘাম মুছতে মুছতে বললেন, ‘আমি কইছি তর বাপেরে যে এইডা দেইন, মেয়েডা কইয়া দিছে, বই রাখব। ভ্যাংচাইয়া উডে। কয় এইডা আমি বানাইছি। তার দরকার লাগলে সে কিন্যা নিব নে।’

আমার মাথায় রক্ত চড়ে যায়। ‘সে দিল না তো তুমি জোর কইরা নিয়া আইলা না কেন! ট্রাকে যখন উডাইছো আমার জিনিসপত্র, কেন ওইডাও তুইল্যা লইলা না। এহন বই যে সব আনছো, বই আমি রাখবো কই? বুকশেল্ফটাই তো সবচেয়ে দরকার ছিল। কি রকম বাপ হইছে যে একটা বুকশেল্ফ দিতে পারে না নিজের মেয়েরে!’

বাবার ওপর রাগ আমার গিয়ে পড়ে মার ওপর। মা আমার গাল খেয়ে বারান্দার অন্ধকারে দাঁড়িয়ে নিঃশব্দে কাঁদেন। কারও কান্না আমার সহ্য হয় না।

দুপাশে সাইডটেবিল সহ নরম স্পঞ্জের গদিঅলা নতুন একটি বড় খাট, লেখার টেবিল, চেয়ার, কাঠের সোফা কেনার সামর্থ নেই বলে বেতের সোফা, চারটে ডিজাইন করা চেয়ার সহ খাবার টেবিল, কাপড় চোপড় রাখার কাঠের আলমারি, থালবাসন রাখার আলমারি সব ধীরে ধীরে কিনে এনে বাড়িটি সাজিয়েছি। সব করেছি একা, ভাল কিন্তু অত দামি নয় জিনিস পেতে অনেক দোকান ঘুরেছি, দোকান থেকে ঠেলাগাড়িতে মাল তোলা, ঠেলাগাড়ির সঙ্গে সঙ্গে রিক্সা নিয়ে আসা, মাল ঘরে ওঠানোর ব্যবস্থা করা, কোন জায়গায় কোনটি বসবে তা ঠিক করে দেওয়া। কেউ কোনও টাকা পয়সা দিয়ে সাহায্য করেনি। বইয়ের আলমারিটি খালি পড়ে থাকবে অবকাশে, তাই ইচ্ছে ছিল ওটি নিয়ে এসে মেঝেয় পড়ে থাকা বইগুলো রাখব। কিন্তু বাবা তা হতে দিলেন না। বাবা আমার সংসার ভাঙার বেলায় বেশ ওস্তাদ, সংসার যখন গড়ি তখন তিনি ফিরে তাকান না। ঠিক আছে, না তাকান, তাঁকে আমার জীবনের কোনও কিছুতেই কোনও প্রয়োজন নেই। আমার জীবনে তিনি তাঁর নাক যেন কখনও না গলাতে আসেন। আমার সিদ্ধান্তেই আমার জীবন চলবে, আত্মীয় স্বজন কাউকেই আমার প্রয়োজন নেই। আমাকে তাদের প্রয়োজন হতে পারে, আমার যেন কখনও কারও প্রয়োজন না হয়।

সংসার ভাবনা আমাকে ঘিরে থাকে সারাক্ষণ। মার আনা পুরোনো খাটটি পেতে দিই অন্য ঘরে, যে ঘরে আত্মীয় বা অতিথি যে কেউ এলে থাকবে। কার্পেট বিছিয়ে দিই বৈঠকঘরে। হাঁড়িপাতিল বাসন কোসন পাঠিয়ে দিই রান্নাঘরে। লিলির বড় বোন কুলসুমকে মা নিয়ে এসেছেন শান্তিবাগে। কুলসুমকে দিয়ে ঘরদোর পরিস্কার করিয়ে রান্নাঘরের জিনিসপত্র রান্নাঘরে সাজিয়ে কি করে কাটা বাছা করতে হবে, কি করে রান্না করতে হবে সব শিখিয়ে দেন। এই রান্নাঘর তো আর অবকাশের রান্নাঘরের মত নয়, এখানে বসে নয়, দাঁড়িয়ে রান্না করতে হয়, গ্যাসের চুলো, মাটির চুলো নয়। এখানে কোনও উঠোন নেই যে হাঁস মুরগি কাক পাখিদের জন্য নষ্ট হয়ে যাওয়া ভাত তরকারি ছুঁড়ে ফেলা যাবে, থাল বাসন ধুয়ে পানি ছুঁড়ে দেওয়া যাবে কোনও গাছের শিকড়ে। এখানে প্লাস্টিকের ব্যাগে বা বালতিতে ময়লা জমিয়ে রেখে বাইরের আবর্জনা ফেলার স্তূপে ফেলে দিয়ে আসতে হয়। বাড়িটি আমি মনের মত করে সাজাতে ব্যস্ত, রান্নাঘরের দিকে যাবার আমার সময় নেই, ও নিয়ে আছেন মা আর কুলসুম। আমাকে খুব যত্ন করে খাবার টেবিলে খাবার দেওয়া হয়। আমি খাবার সময় মা পাশে দাঁড়িয়ে পরেবেশন করেন। আমার কখন কি লাগবে, না চাইতেই মা এগিয়ে দেন সব। মা প্রায়ই ময়মনসিংহে চলে যান, অবকাশ থেকে চাল ডাল তেল পেঁয়াজ যতটা সম্ভব সংগ্রহ করে আনেন। আমার অজান্তেই এসব করেন। কাঁচা বাজারটা আমিই করি শান্তিনগরের বাজার থেকে। বাইরের কাজগুলো করতে অনেক সময় মিলনকে নিয়ে বেরোই। মিলন তার বোনের বাড়ি ছেড়ে আমার বাড়িতে উঠে এসেছে। বাবা তাঁর এক বন্ধুকে ধরে মিলনের জন্য একটি চাকরি যোগাড় করে দিয়েছেন। চাকরিটি মিলন করছে ঠিকই কিন্তু তার মন পড়ে থাকে ময়মনসিংহে। ইয়াসমিন ময়মনসিংহে বসে মাস্টার্স পরীক্ষা দেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। সপ্তাহের ছুটির দিনটি কবে আসবে পুরো সপ্তাহ মিলন তারই অপেক্ষা করে। বৃহস্পতিবার বিকেলে সে আর বাড়িতে ফেরে না, আপিস থেকেই সোজা চলে যায় ময়মনসিংহে। কখনও কখনও ছুটি ছাটায় ইয়াসমিন ঢাকায় এসে কাটিয়ে যায়। মার ঢাকা ময়মনসিংহ দৌড়োদৌড়ি করে কাটে। ময়মনসিংহে আমি পারতপক্ষে যাই না। আমি ব্যস্ত আমার চাকরি নিয়ে, লেখালেখি নিয়ে, আর নতুন সংসারটি নিয়ে।

একদিন একটি ফোন আসে হাসপাতালে। মিনারের ফোন। আর ঘণ্টা কয়েক পর সে চিরকালের জন্য চলে যাচ্ছে আমেরিকা, আমি যেন একবার তার সঙ্গে দেখা করি। সে তার বাড়ির ঠিকানা দেয়। হাসপাতাল থেকে একটি বেবি ট্যাক্সি নিয়ে যাই তার বাড়িতে। বাড়ির সামনে বেবি ট্যাক্সিটি দাঁড় করিয়ে রেখেই মিনারের সঙ্গে দেখা করতে যাই। মিনার মদ খেয়ে টাল হয়ে ছিল। গলায় অনেক গুলো চুমুর লাল দাগ। বুজে যেতে চাওয়া চোখ কোনওরকম খুলে রাখছিল। মিনারের প্রেম নিয়ে, ধনী মহিলাটির সঙ্গে সম্পর্ক নিয়ে আমি কোনওদিন কোনও প্রশ্ন করি নি, সেদিনও করি না। মিনার নিজেই বলে সেই মহিলাই তাকে আমেরিকা পাঠাচ্ছেন। মিনার রুদ্রর কথা তোলে, বলে রুদ্র যেদিন মারা গেল, সেদিন বিকেলে সে টিএসসিতে গিয়েছে যেখানে রুদ্রকে এনে রাখা হয়েছিল, রুদ্রকে স্পর্শ করে মিনার কেঁদেছে, একটি কথাই বার বার সে বলেছে, রুদ্র আমাকে ক্ষমা করে দিও। মিনারের মধ্যে যেমন একটি নিষ্ঠুর মিনার বাস করে, তেমনি একটি হৃদয়বান মিনারও হয়ত বাস করে। মিনারের কোন রূপটি সত্যিকারের রূপ কোনওদিন আমার জানা হয়নি। তাকে কোনওদিন আমার খুব আপন মানুষ বলে মনে হয়নি। ভেবেছিলাম তার সঙ্গে শেষ দেখাটি করেই চলে যাবো কিন্তু সে হঠাৎ করে দরজা বন্ধ করে দিয়ে আমাকে বিছানায় টেনে নেওয়ায় তক্ষুনি চলে যাওয়া সম্ভব হয়নি। বিছানায় মিনার আমাকে কেন নেয়! ধর্ষণ করতে! মিনারের শরীরের জন্য আমার শরীরে কোনওরকম আবেগ ছিল না। তার কাছে এই ব্যপারটি মজার একটি খেলার মত। জীবনের অনেক কিছুই তার কাছে নিতান্তই তুচ্ছ খেলা। আমার সঙ্গে মিনারের সম্পর্কটি মিনারের জন্য বা আমার জন্য কোনও গুরুত্বপূর্ণ কিছু ছিল না। তার কাছে সবচেয়ে যে জিনিসটির গুরুত্ব ছিল, সেটি বিচিন্তা। বিচিন্তা পত্রিকাটি বেশ ভাল চলছিল, কিন্তু সেটিও তার কাছে খেলা হয়ে উঠল, নদীর পাড়ের বালুতে মিছিমিছির ঘর বানানো খেলার মত, সন্ধের আগে আগে খেলাঘর পায়ে মাড়িয়ে বাড়ি চলে যাওয়ার মত করে মিনার চলে যাচ্ছে। হতে পারে বিচিন্তা ছাপতে যে মানুষটি টাকা দিচ্ছিলেন তিনি আর দেবেন না সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। হতে পারে মিনারের আর ভাল লাগছিল না পত্রিকা সম্পাদনা করতে। অথবা হেথা নয় হোথা নয়, যেথায় সোনার হরিণ আছে সেথা যেতে সে ব্যাকুল হয়ে উঠছিল তাই বিচিন্তার চিন্তা বাদ দিয়ে বিচিন্তাকে মায় দেশটাকেই টা টা বাই বাই জানিয়ে দিয়েছে। আজকাল মেধাগুলো এভাবেই পাচার হয়ে যাচ্ছে। এ দেশের ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার পদার্থবিদ অংকবিদ সব গিয়ে বিদেশের রেস্তোরাঁয় বাসন মাজে। এতে সপ্তাহ গেলে বা মাস গেলে যে কটি ডলার হাতে আসে, তা বাংলাদেশের টাকায় বেশ বড় অংকের। বাংলাদেশের একটি জনপ্রিয় সাপ্তাহিক পত্রিকার সম্পাদক মোহাম্মদ আলী মিনার ওরফে মিনার মাহমুদ আমেরিকায় গিয়ে বাসন না মাজলেও ট্যাক্সি ড্রাইভিং এ নিজের কেরিয়ার গড়ে তুলেছে। আমার সঙ্গে দুদিন ফোনে কথা হয়েছে। মিনারই ফোন করেছিল, কাগজের সম্পর্কটির কাগুজে মিমাংসার জন্য। আমি ভুলেই গিয়েছিলাম ওই একটি সম্পর্ক যে ঝুলে আছে। কাগজের সম্পর্কের মূল্য আমার কাছে নেই বলেই হয়ত মনে পড়েনি। যেরকম নিরুত্তাপ সই ছিল সম্পর্কের জন্য, সম্পর্ক ভাঙার জন্য একইরকম নিরুত্তাপ সই দিয়ে দিই। তার এক দূত এসে কাগজে সই নিয়ে যায়, সেই দূতই তাকে কাগজখানা পাঠিয়ে দেয় আমেরিকায়।

একটি জিনিস আমি লক্ষ করেছি, কারও সঙ্গে আমার সম্পর্ক একবার গড়ে উঠলে, সে যে সম্পর্কই হোক, সে সম্পর্ক অন্তত আমার দিক থেকে ভাঙে না। দীর্ঘদিন কারও ওপর আমি রাগ পুষে রাখতে পারি না। সব বরফই হৃদয়ের উত্তাপে গলে জল হয়ে যায়। কারওর ওপরই আমার ঘৃণা নেই। কেউ কোনও ভুল করলে আমি বুঝতে চেষ্টা করি কেন সে ভুলটি করেছে। নিজের ভুলগুলো নিয়েও আমার একইরকম ভাবনা। ক্ষতি করার উদ্দেশ্য কারওর যদি থাকে, আমি নিজেকে তার থেকে দূরে সরিয়ে নিই কিন্তু সম্পর্ক বিষাক্ত হতে দিই না। আমার এই চরিত্রটি অনেকটা মার চরিত্রের মত। মা খুব দ্রুত ক্ষমা করে দিতে পারেন মানুষের যে কোনও ভুল। মার চরিত্রের এই দিকটি আমার খুব অপছন্দ, কিন্তু এই চরিত্রটিই আমি গোপনে গোপনে ধারণ করে বসে আছি। মিনার যখন আমাকে দেখা করতে ডেকেছিল, আমি জানি তার সঙ্গে আমার মনের কোনও সম্পর্ক নেই, তার সঙ্গে আমি কখনই বসবাস করব না, কিন্তু সে আমার বন্ধু ছিল একসময়, একসময় সে আমাকে সামান্য হলেও আনন্দ দিয়েছিল, চলে যাওয়ার দিন কেন তাকে আমি কিছু শুভেচ্ছ! দেব না! দেখেছি, কোনও শত্রুর জন্য আমি কোনও অমঙ্গল কামনা করতে পারি না। বাবা আমার সঙ্গে অতবড় শত্রুতা করার পরও বাবার কখনও কোনও রকম ক্ষতি হোক আমি তা চাই না। মাকে সারা জীবন ধরে বাবা হেলা করেছেন, কষ্ট দিয়েছেন, তারপরও মা বাবার কোনও অমঙ্গল চান না। বাবার সামান্য সর্দিজ্বরেই অস্থির হয়ে পড়েন সেবা করতে। মা ভালবাসেন বাবাকে, সেটি একটি কারণ। কিন্তু ভালবাসার সম্পর্ক না থাকলেও মার আচরণ খুব ভিন্ন নয়। গীতা আর হাসিনা মাকে মা বলে গণ্য করে না, মাকে অপমান করতে কোনও দ্বিধা নেই তাদের, তারপরও মা ওদের জন্য পারলে জীবন দেন। আবদুস সালামের বাড়িতে মার গরুটি বড় হচ্ছিল, একদিন সালাম এসে জানাল যে গরু হারিয়ে গেছে। কেন সালামদের বাড়ির কোনও গরু হারালো না, কেবল মার গরুটি হারালো, এ প্রশ্ন মার মনে উদয় হয়েছে, কিন্তু সালাম বাড়ি এলে ঠিকই মা তাকে আদর করে খেতে বসান। লিলির মাকে গালগাল করলেন আজ, কালই তাকে নিজের পরনের শাড়িটি খুলে দিয়ে দেন। লিলি বা কুলসুমের ওপর রাগ করে গালে শক্ত চড় কষালেন, ঘণ্টাখানিক পরই মার রাগ জল হয়ে যায়। হাতে টাকা থাকলে তখন দোকানে গিয়ে লিলি বা কুলসুমের জন্য কিনে আনেন ভাল কোনও জামা বা লালফিতেঅলা সেণ্ডেল। মার চরিত্রে কোনও দৃঢ়তা নেই, যেটুকু আছে সেটুকুই পলকে ভেঙে যায়। আমার দৃঢ়তাও লক্ষ করেছি খানখান হয়ে পড়ে যখন তখন। এর কারণ কি নিঃসঙ্গতা! হয়ত বা। দৃঢ়তা তাকেই মানায় যার গায়ের জোর আর টাকার জোর আছে অথবা সমাজে একটি পোক্ত অবস্থানে বাস করার জোর আছে। যে নাইম একসময় আমার অনিষ্ট করার জন্য অথবা আমার সুখে বিঘ্ন ঘটাবার জন্য হেন কাজ নেই যে করেনি, আরমানিটোলার বাড়িঅলা আমাকে নোটিশ দিয়েছিল বাড়ি ছাড়ার, সে নাইমের ষড়যন্ত্রের কারণেই, এও শুনেছি যে সুগন্ধা পত্রিকাটির লেখাটির পেছনে এবং পত্রিকাটি বাবার হাতে পৌঁছোর পেছনে নাইমের বড় একটি অবদান আছে — সেই নাইমের সঙ্গেও আমার দেখা হয়, কথা হয়। হঠাৎ হঠাৎ সে শান্তিবাগের বাড়িতে আসে। নাইম আমার একলা থাকার শখের বারোটা বাজাতে চেয়েছিল। আমার শখের ওপর দশ টনের ট্রাক চলে গেছে, গুঁড়ো করে দিয়ে গেছে আমার শখের হাড়গোড়, তারপরও আমার শখ যায়নি। শখ যে আমি যে করেই হোক মেটাচ্ছি, তা সে শান্তিবাগের বাড়িতে এসে দেখে যায়। আমার সুখী য়চ্ছল জীবন দেখে আড়চোখে। নাইম হিংসেয় মরে, সে আমি অনুমান করি। আমার কলামের জন্য দৈনিক সাপ্তাহিক পত্রিকা থেকে অনুরোধ আবদার আসে, নাইম কিন্তু তার ভোরের কাগজে লেখার জন্য আমাকে কখনও বলে না। সে চায় না আমাকে আরও বিখ্যাত হতে দিতে। ভোরের কাগজে লিখছি না বলে আমার কোনও আক্ষেপ নেই, এমনিতে আমি অনেকগুলো পত্রিকায় লিখে কুলিয়ে উঠতে পারি না। নাইমের দোষে বা তার ভাগ্যের দোষে এত চালাক চতুর হয়েও তার পরিকল্পনা মত সব কিছু এগোয় না। ভোরের কাগজ থেকেও তাকে একসময় তাড়িয়ে দেওয়া হয়। তারপরও দমে যাওয়ার পাত্র সে নয়। নতুন উদ্যমে এবার আর পত্রিকা নয়, নিউজ এজেন্সি খুলে বসেছে। খুব ধুমধাম করে নাইম একটি বিয়ে করেছে। চট্টগ্রামের মেয়ে। বিএ পাশ। দেখে শুনে বুঝে সুঝে বিয়েটি সে করেছে। পতিব্রতা স্ত্রী হওয়ার গুণ যে মেয়ের মধ্যে আছে, তেমন মেয়েকেই ঘরে এনেছে। মেয়ে রাঁধবে বাড়বে চমৎকার, শ্বশুর শাশুড়ির যত্ন নেবে, দেবর ননদের দেখভাল করবে, স্বামী যাহা বলিবে তাহাই করিবে জাতীয় মেয়ে। এমন মেয়ে বিয়ে করেও নাইম আমার বাড়িতে আসে। আমার শরীরের দিকে সে ঝুঁকে থাকে। আমি বাধা দিই না শরীরের সম্পর্কে। দীর্ঘদিনের পুরুষস্পর্শহীন শরীরটি নাইমের স্পর্শে কেমন তির তির করে কেঁপে ওঠে। দীর্ঘদিন নিজের অবদমিত ইচ্ছেগুলো মাথা ফুঁড়ে বেরিয়ে আসতে চায়, দীর্ঘদিন অন্যের ইচ্ছের সঙ্গে আপোস করে করে নিজের ভেতরে একটি ইচ্ছের জন্ম হয়। ইচ্ছেটি আমার, ইচ্ছেটি অন্য কারওর নয়। ইচ্ছেটিকে আমি ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখি। ইচ্ছেটির হাতে হাত রেখে বসে থাকি মুখোমুখি, নিজেকে শুনিয়ে শুনিয়ে বলি, ‘এ শরীর আমার, শরীর সম্পর্কিত যে কোনও সিদ্ধান্ত নেবার দায়িত্বও আমার।’ শরীরের ক্ষুধা তৃষ্ণা মেটাবার অন্য কোনও উপায় যদি আমার জানা থাকত, তবে নাইমের সঙ্গে মাসে একবার কি দুবার যে সম্পর্কটি হয়, হত না। তার পরও হয়েছে, ইচ্ছে করেছি বলে হয়েছে। সমাজের হাজার রকম যুক্তিহীন নিয়ম অস্বীকার করার মত এই নিয়মটিও আমি অস্বীকার করি যে আমার শরীর কেউ স্পর্শ করলে আমি পচে যাব। পান থেকে চুন খসলে লোকে নষ্ট বলে, অবশ্য মেয়েদের কিছু খসলেই বলে। পুরুষেরা বলে মেয়েদের অমূল্য সম্পদের নাম সতীত্ব। পুরুষেরাই সমাজের এই নিয়মগুলো তৈরি করেছে। মেয়েদের বাধ্য করা হয় বিয়ের আগে কুমারীত্ব আর বিয়ের পর সতীত্ব রক্ষা করতে। বিয়ে নামক সামাজিক নিয়মটি মেয়েদের শরীর এবং মনকে পুরুষের সম্পত্তি করে ফেলে। এই নিয়মের জালে আটকা পড়ে আছে মেয়েরা। নির্বাসিত বাহিরে অন্তরে বইটির প্রথম পাতায় একটি কথা লিখেছিলাম, শৃঙ্খল ভেঙেছি আমি, পান থেকে খসিয়েছি সংস্কারের চুন। কিন্তু সত্যিকার শৃঙ্খল ভাঙতে কি আমি পেরেছি! নাকি ভাঙার একটি গোপন ইচ্ছে নিয়েই বাস করি কেবল! শৃঙ্খল ভাঙার ইচ্ছেটি যেন কেবল বলার জন্য বলা না হয়, প্রাণপণে জীবনে তার প্রয়োগ চেয়েছিলাম। সেই কচি বয়সে আমাকে যখন বোরখা পরানোর চেষ্টা হয়েছিল, সেই যে বোরখা ছুঁড়ে ফেলেছিলাম, সংষ্কার না মানার শুরু তখনই। রিক্সার হুড মাথায় ঘোমটার মত তুলে মেয়েরা বসবে, এই নিয়ম ভেঙেও রিক্সার হুড ফেলে দিয়ে রিক্সায় চড়েছি ছোট্ট ঘিঞ্জি শহর ময়মনসিংহে। লোকে হাঁ হয়ে দেখেছে, দেখুক। মন্দ বলেছে, বলুক। আমার ইচ্ছে হয়েছে বলে করেছি, আমার ভাল লেগেছে বলে করেছি। সামাজিক নিয়মগুলোয় আমি কোনও যুক্তি পাইনি বলে করেছি। সোজা কথা। সাফ কথা। বাবা মা ছেলে পছন্দ করবেন, তারপর মেয়ের বিয়ে হবে। সেই নিয়মও মানিনি। প্রেম করতে মানা। প্রেম করেছি। স্বামী যেমনই হোক, মানিয়ে চলা নিয়ম, সেই নিয়ম মানিনি। পরপুরুষের সঙ্গে কথা বলা, আড্ডা দেওয়া, ঘনিষ্ঠ হওয়া মানা, সেই নিয়মও মানিনি। আমি আমার নিয়মে চলতে চাই। যে নিয়মটিকে আমি পালনযোগ্য মনে করি, সেটি গ্রহণ করতে চাই, বাকি নিয়ম যেগুলো আমারে আমিত্ব নষ্ট করে, সেগুলোকে বর্জন করতে চাই। কোনও অযৌক্তিক কিছুর সঙ্গে, কোনও মন্দের সঙ্গে মানিয়ে চলতে যে পারে পারুক, আমি পারি না। আমি না পেরে দেখিয়েছি আমি পারি না। খুব অল্পদিনেই আমি বুঝতে পারি, নাইম আমার শরীরে তার তৃষ্ণা মেটাচ্ছে, এতে তার লাভ হলেও আমার কোনও লাভ হচ্ছে না। আমি কোনও তৃপ্তি পাচ্ছি না এই সম্ভোগে। এর কারণ আমি একটিই খুঁজে পাই, নাইমের জন্য আমার কোনও ভালবাসা নেই। একসময় যখন তাকে ভাল লাগত, তখন তৃপ্তি হত। ভাললাগাটিও যখন ফুরিয়ে যায়, তখন সম্ভোগ নিতান্তই শারীরিক যন্ত্রণা হয়ে দাঁড়ায়। ভালবাসা না হোক ভাল লাগা বলে কিছু থাকতে হয়, কেবল শরীরের জন্যই শরীর উত্তেজিত হয় না। ধীরে ধীরে আরও একটি ইচ্ছের জন্ম হয় আমার মধ্যে, সেটি সম্ভোগের নামে শারীরিক যন্ত্রণাটি না মানার ইচ্ছে। এটিও সিদ্ধান্ত। একটি জিনিস আমার বিশ্বাসের ভেতরে পাকাপাকি জায়গা করে নিতে চাইছে, সেটি নিজের ইচ্ছের মূল্য দেওয়া। যে কোনও ব্যপারেই। হ্যাঁ, আমার শরীর সম্পূর্ণই আমার, এর ওপর কর্তৃত্ব করার অধিকার আমার ছাড়া আর কারও থাকা উচিত নয়। এ শরীর নিয়ে কি করব আমি, একে পাঁকে ফেলব নাকি মাথায় তুলব, এ আমার নিজের সিদ্ধান্তেই হবে। অন্যের সিদ্ধান্তে নয়। আমি একাধিক পুরুষের সঙ্গে যৌন সম্পর্ক করেছি, একথা জেনে অনেক পুরুষই জুলজুল করে তাকায় আমার শরীরের দিকে। যেন শরীরটি খুব সুলভ কিছু, যেন হাত বাড়ালেই মেলে। যদি হাত বাড়ালে না মেলে, জুলজুল চোখগুলো ক্রমেই বিস্ফারিত হয়। অন্য কোনও মেয়েকে যত না কাদা ঘাঁটতে হয়, যত না কাঁটাতার পেরোতে হয় পথ চলতে, আমার বেশি হয়। কারণ পুরুষের দৃষ্টিগুলো সন্দিহান, জিভগুলো বেরিয়ে আসা, চোখগুলো লোলুপ, নাকগুলো শুকর শুকর। নারী হচ্ছে ভোগের সামগ্রী, এই কথাটি সকলের মস্তিস্কের কোষে গ্রথিত। একাধিক পুরুষের সঙ্গে সম্পর্ক হয়েছে বলে আমি অন্যরকম জীব, আমি এই বয়সে স্বামী সন্তানহীন জীবন কাটাচ্ছি, আমার জীবনটি অস্বাভাবিক, ঠিক তাদের মা বোন খালা ফুপু বা বউদের মত আমি নই। চোখ টিপতে হাত ধরতে গায়ে ঢলতে তাই কারও কোনও শরম হয় না। তাদের আরেকটি ভাবনা কখনও হয় না যে পুরুষও ভোগের সামগ্রী হতে পারে, নারীও ভোগ করতে পারে পুরুষকে এবং এই ভাবনাটি তো একেবারেই হয় না যে আমি ইচ্ছে না করলে এক ধর্ষণ ছাড়া কারও সাধ্য নেই আমার শরীর পাওয়া।

আমার শান্তিবাগের বাড়িতে হঠাৎ একদিন শিপ্রা উদয় হয়। শিপ্রার জীবনে কিছু পরিবর্তন ঘটেছে। মানুর সঙ্গে সম্পর্ক ভেঙে যাওয়ার পর সে পড়াশোনায় মন দিয়েছিল। এতে কাজ হয়েছে, সে পিজিতে ভর্তি হয়েছে। এখন সে ঢাকায় পিজির হোস্টেলে থেকে এফসিপিএসএর ক্লাস করছে। মানু থেকে মন উঠেছে শিপ্রার, এ খুব ভাল সংবাদ কিন্তু সে নতুন করে প্রেমে পড়েছে। প্রেমিকের নাম হারুন। দেখতে ফর্সা, ছোট খাটো, ভাল ছাত্র গোছের চেহারা। হারুনও পিজিতেই পড়াশোনা করছে। হাঁটুর বয়সী না হলেও শিপ্রার বুকের বয়সী হবে হারুন। এই হারুনের সঙ্গে কী করে কী করে দু কথা হয় শিপ্রার। তারপরই ওকে লেজের মত করে নিয়ে আমার শান্তিবাগের বাড়িতে হাজির। সোফায় ঘন হয়ে বসে ফিসফিস করেই ছেড়ে দেয়নি, দুজনে শোবার ঘরে গিয়ে দরজা বন্ধ করল। হারুনও তাকে, মানুর মত অতটা না হলেও, শিপ্রা বলে যে আনন্দ দিতে পারে। এরকম একটি চমৎকার বাড়ি পেয়ে শিপ্রা ঘন ঘন আসতে শুরু করল হারুনকে নিয়ে। মিলনও দেখে শিপ্রার কাণ্ড। সে আগেও দেখেছে তার নিজের ভাই মানুর সঙ্গে শিপ্রার মাখামাখি। মিলন আগে অনেকবার বলেছে শিপ্রাকে, মানুর কোনও প্রতিশ্রুতিতে যেন সে বিশ্বাস না করে। শিপ্রা তখন এমনই মানু -পাগল যে কারও কোনও উপদেশই তার কানে প্রবেশ করলেও অন্তরে প্রবেশ করত না। মিলনের সামনে, শিপ্রার, আমি বুঝি, হারুনের সঙ্গে সম্পর্কটি নিয়ে খানিকটা অস্বস্তি হয়। কিন্তু অচিরে সে অস্বস্তি ধুলো ধুলো ঝেড়ে ফেলার মত ঝেড়ে ফেলে। আমি বা মিলন দুজনের কেউই শিপ্রাকে অতীত অভিজ্ঞতার কথা স্মরণ করিয়ে দিই না। পুরোনো কথা শিপ্রাও আর মনে করতে চায় না। নতুন জীবন নিয়ে সে ব্যস্ত। একদিন হারুনের হাঁড়ির খবর নিয়ে পড়ল। হারুন কেন বলেছে যে তার সঙ্গে তার বউএর সম্পর্ক ভাল নয়, কিন্তু সে যে দেখলো দুজনকে সেদিন পার্কে বেড়াতে! হারুন হোস্টেল ছেড়ে শিপ্রাকে লুকিয়ে প্রায় রাতেই শ্বশুর বাড়ি চলে যায় রাত কাটাতে। এ নিয়ে দুশ্চিন্তায় শিপ্রা রাতের ঘুম ছেড়ে দিল। তার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় ব্যস্ত হারুনের গতিবিধি নিয়ে। কেন যায় সে এত ঘন ঘন বউএর কাছে, তবে কি তার বউকে সে ভালবাসে, কিন্তু হারুন তো শিপ্রার গা ছুঁয়ে বলেছে, তার বউএর সঙ্গে বছর দুই ধরে কোনও রকম সম্পর্ক নেই, মনের এবং শরীরের সম্পর্ক যদি থাকে কারও সঙ্গে, তবে তা শিপ্রার সঙ্গেই! বউ থাকে বউএর বাপের বাড়ি। বাচ্চাটিকে নাকি হারুন মাঝে মাঝে দেখতে যায়। কিন্তু শিপ্রার মনে সন্দেহ, কেবল বাচ্চার উদ্দেশেই যাওয়া নয়। উদ্দেশ্য বউএর সঙ্গে শোয়া। আবার শিপ্রার চোখে জল। আবার উদ্বিগ্ন সে! আবারও দুশ্চিন্তার একশ পোকা তার মাথায় কালো উকুনের মত কিলবিল করে। এই হারুনের সঙ্গেও, আমার আশঙ্কা, সম্পর্ক ঘুচবে শিপ্রার। প্রেম করবে বিয়ে হওয়া বাচ্চা কাচ্চা হওয়া পুরুষের সঙ্গে, যেখানে অবিবাহিতরাই বিশ্বস্ত হয় না, সেখানে আবার বিবাহিতকে বিশ্বস্ত করতে চাইছে সে, তাও আবার জোর জবরদস্তি করে!

‘হুমায়ুন কোথায়?’

‘ওর কথা বোলো না। ওর নাম শুনলে আমার গা ঘিনঘিন করে।’

হুমায়ুন থাকে রাজশাহী। আনন্দ হুমায়ুনের কাছে। শিপ্রার মাও চলে গেছেন রাজশাহী। খুব সংক্ষেপে তথ্যগুলো জানিয়ে শিপ্রা আবার হারুনের কথায় ফিরে এল। হারুন কি তাকে ভালবাসে না?

আমি কি করে জানব হারুন শিপ্রাকে ভালবাসে কী না! আমার নিরুত্তর মুখখানার দিকে চেয়ে শিপ্রা হঠাৎ হু হু করে কাঁদতে শুরু করে।

‘কী করব বলো তো! হারুন কি আমাকে মিথ্যে কথা বলছে যে আমাকে সে ভালবাসে!’ ‘হারুন তোমাকে ভালবাসে কি না সে তুমি বুঝবে, আমি বুঝবো কী করে!’

‘আমি তো ভেবেছিলাম ভালই বাসে, কিন্তু মনে হচ্ছে ও আমাকে মিথ্যে বলেছে।’

‘মিথ্যে যদি বলে, তবে তুমি আর লেগে আছো কেন?’

‘লেগে না থেকে যে পারি না। অনেকবার ভেবেছি ওকে ভুলে যাবো। কিন্তু ভুলতে যে পারি না।’

‘চেষ্টা করেছো?’

‘তা করেছি। লেখাপড়ায় মন দিতে চেষ্টা করেছি। কিন্তু বই খুলে কেবল বসেই থাকি, মন থাকে হারুনে।’

‘বিবাহিত লোকদের নিয়ে ঝামেলা। প্রেম করলে অবিবাহিহতদের সঙ্গে কোরো।’

‘আমাদের বয়সী বা কাছাকাছি বয়সী কোন ছেলেটা আছে এখনও অবিবাহিত?’

‘ছেড়ে দাও তো। হারুন কি করল কোথায় গেল, কি বলল, মিথ্যে বলল কী সত্যি বলল, এসব নিয়ে ভাবো কেন?’

‘ভাববো না?’

‘না।’

‘তাহলে কি কেবল শরীর?’

‘সেটিই তো তোমার প্রয়োজন। ঠিক না?’

‘কিন্তু ভালবাসাহীন কোনও স্পর্শ যে আমার শরীরকে কোনও উত্তাপ দেয় না।’

শিপ্রার চোখে চোখ রেখে আমি গম্ভীর কণ্ঠে জিজ্ঞেস করি, ‘হারুনকে কি তুমি ভালবাসো?’

শিপ্রা মাথা নাড়ে। সত্যি সত্যি সে বাসে। না বাসলে হারুন তার বউএর কাছে গেলে তার কষ্ট হয় কেন!

শিপ্রার জন্য আমার মায়া হতে থাকে। আমি তাকে কোনওরকম সান্ত্বনা দিতে পারি না। ভালবাসা ছাড়া শিপ্রাও কোনও শরীরের সম্পর্কে উৎসাহ পায় না। ভালবাসার জন্য যোগ্য কোনও মানুষ আমাদের নেই। আমরা ভালবাসা পেতে চাই, দিতে চাই। কিন্তু বারবারই পুরুষের প্রতারণার শিকার হই। তারপরও ভালবাসার শখ যায় না আমাদের। এত আঘাত পাওয়ার পরও হৃদয়ের দুয়ার খুলে বসে থাকি। ভালবাসা জিনিসটি একরকম ফাঁদ, ভাল লাগিয়ে, ভালবাসিয়ে, প্রেমে পড়িয়ে পুরুষেরা অন্যরকম এক দাসত্বের শৃঙ্খলে বাঁধে মেয়েদের। কোনও পুরুষের সঙ্গে আমার এখন ভালবাসার সম্পর্ক নেই, আমি হয়ত ততটা অনুভব করি না, কিন্তু এটি আমাকে একধরনের মুক্তি দেয়। প্রেমহীন জীবন বর্ণাঢ্য না হলেও স্বস্তিকর। আমার এখন স্বস্তিই দরকার।

এরপর একদিন খুব খুশি খুশি মুখে আমার বাড়িতে এল শিপ্রা। আমাকে জড়িয়ে ধরে উচ্ছ্বসিত আনন্দে সে জানাল যে জীবনে প্রথম সে অরগাজমের স্বাদ পেয়েছে। হারুনের সঙ্গে কবে কোথায় তার মিলন হয়েছে জিজ্ঞেস করলে সে মাথা নাড়ে। হারুন তাকে দেয়নি এটি। তবে দিয়েছে কে, অন্য আবার কার সঙ্গে তার প্রেম হল! না কারও সঙ্গে নয়। কেউ তাকে এই শীর্ষসুখ দেয়নি। সে নিজেই দিয়েছে নিজেকে। কি করে? এক মধ্য রাতে শিপ্রার শরীর জেগে উঠেছে, সে এপাশ ওপাশ করছে, তারপর নিজেই সে ঘটনাটি ঘটায়। শিপ্রা নিখূঁত বর্ণনা করে কি করে সে নিজের উত্তপ্ত শরীর শীতল করার জন্য হস্তমৈথুন করেছে। হস্তমৈথুন পুরুষের ব্যপার, সে আমি জানতাম। শিপ্রাও তাই জানত, কিন্তু নিজে সে নিজের শরীরে কোনও রকম অভিজ্ঞতা ছাড়াই যে কাজটি করেছে, তা তাকে একটি নতুন স্বাদ দিল, অরগাজমের স্বাদ। প্রথম স্বাদ।

শিপ্রার উদঘাটন করা স্বমৈথুন আমাকে আকর্ষণ করে না। শিপ্রার মত কারও প্রেমেও আমি পড়ি না। যৌনতা শিকেয় তোলা। ডাক্তারি চাকরির বাইরে যে অবসরটুকু জোটে সেটুকু আমি সাহিত্য জগতে খরচ করি।
 
১৩. ঘটনার ঘনঘটা


এর মধ্যে অনেক কিছু ঘটে গেছে। বিশেষ করে দেশের রাজনীতিতে। দেশজড়ে বিশাল স্বতস্ফূর্ত স্বৈরাচারবিরোধী গণআন্দোলন রাষ্ট্রপ্রধান এরশাদকে বাধ্য করেছে গদি থেকে নেমে যেতে। এরশাদের ধারণা ছিল না এই আন্দোলন এমন প্রবল হয়ে তাঁকে গদিচ্যূত করতে এভাবে ধাবিত হবে। তিনি বেশ ছিলেন। ভেবেছিলেন যে কোনও আন্দোলন তিনি অস্ত্র আর ধর্মের আঘাতে চূর্ণ করে দেবেন। জনগণ কি চায় না চায় তার তোয়াককা না করে তিনি যা চান তাই তিনি নিজেকে দিয়ে যাচ্ছিলেন। আটরশির পীরের কাছ থেকে দেশ কি করে চালাতে হবে কদিন পর পরই তার উপদেশ নিয়ে আসতেন। রাজনীতিবিদদের এরকম একএকজন পীর থাকে। দেশের রাজা মন্ত্রীদের দয়া দাক্ষিণ্যে পীরদের অবস্থা পোয়াবারো। পীরের কাছে তদবির করে চাকরি পাওয়া যায়, মন্ত্রীত্ব মেলে। হাফেজ্জী হুজুর নামের এক পীর সবাইকে চমকে দিয়ে পীরালি ব্যবসা বাদ দিয়ে রাজনীতি ব্যবসায় ঢুকেছিল। বুক ফুলিয়ে ছিয়াশি সালে নির্বাচনে দাঁড়িয়েছিল। পীরদের রাজনীতির শখ প্রচণ্ড। আটরশির পীর, শর্ষিনার পীর এরকম হরেক রকম পীর রাজনীতির হরেক রকম ব্যবসা নিয়ে জমকালো জীবন যাপন করছেন। ঢাকায় এখন সাইদাবাদি পীরের রমরমা ব্যবসা। এই লোকটি গুলিস্তানের মোড়ে দাঁড়িয়ে একসময় পুরোনো কাপড় বিক্রি করত, আর এখন ঢাকায় বিশাল এক প্রাসাদের মত বাড়িতে বসে পীর ব্যবসা করছে। এই পীর, লোকে বলে কাঁচা ডিম হাতে নিয়েই পাকা করে ফেলে। বাচ্চা দরকার, চাকরি দরকার, কাউকে সর্বস্বান্ত করা দরকার সব দরকারের জন্য পীরের কাছে ডিম নিয়ে হাজির হচ্ছে হাজার হাজার লোক। পীরের যাদু যখন বড় এক আলোচনার বিষয়, তখন স্বয়ং এরশাদও এক যাদু দেখালেন। এরশাদের বাচ্চা কাচ্চা নেই বলে কুসংস্কারাচ্ছত মানুষ তাঁকে আঁটকূড়ে বলে ডাকা শুরু করেছে, যে পুরুষ বাচ্চা হওয়াতে পারে না সে আবার কেমন পুরুষ, এমন পুরুষ দেশ চালালে দেশের ফলন যাবে কমে ইত্যাদি কথা বাতাসে ভাসে, বাতাসকে বাগে আনতে তিনি একটি আধখেঁচড়া নাটক করলেন। অনেকটা কাঁচা ডিম পাকা করে ফেলার মত। হঠাৎ একদিন স্ত্রী রওশনকে জনসমক্ষে এনে কোলে একটি বাচ্চা বসিয়ে বলে দিলেন, এই তো তিনি বাপ হয়েছেন। এতে অবশ্য এরশাদ বিরোধী আন্দোলন মোটেও থেমে যায়নি। আন্দোলন যখন তুঙ্গে, এরশাদ পুলিশকে আদেশ করেছেন মিছিলে মিটিংএ গুলি চালাতে। অজস্র গুলি চলেছে। অগুনতি মানুষের মৃত্যু হয়েছে। সব মৃত্যুই শোকের, সব মৃত্যুই মানুষের ভেতর ক্রোধ সৃষ্টি করেছে। যদিও অনেক মৃত্যুতে কোনও সাড়া পড়ে না, নূর হোসেনের মৃত্যু আন্দোলনকে অনেক ধাপ এগিয়ে নিয়েছে। আশ্চর্য এক সাহসী যুবক নূর হোসেন। নূর হোসেন মিছিলে সবার সামনে ছিল। সাধারণ মানুষ। বেবি ট্যাক্সি চালাত। কোনও রাজনীতি করেনি কোনওদিন, লেখাপড়া শেখেনি খুব, বুকে লিখেছে গণতন্ত্র মুক্তি পাক, পিঠে লিখেছে স্বৈরাচার নিপাত যাক। পুলিশের গুলি গণতন্ত্র মুক্তি পাক ভেদ করে চলে গেছে। নূর হোসেন মারা গেল মিছিলে। শেষ পর্যন্ত গণতন্ত্র মুক্তি পেয়েছে, কিন্তু নূর হোসেনের দেখা হয়নি সে মুক্তি। গণতন্ত্রকে মুক্তি পেতে কিছুতেই দিতে চাইছিলেন না এরশাদ। শেষ পর্যন্ত দীর্ঘ তিনটি বছর জোট বেঁধে আন্দোলনের পর, নব্বইএর তুমুল জোয়ারে ভেসে গেল এরশাদের গদি।

এরশাদের পতনের পর তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন করে নির্বাচন হল। নির্বাচনে দুটো বড় দলের প্রতিদ্বন্দ্বিতা হল। আওয়ামী লীগ আর বিএনপি। শেখ মুজিবের কন্যা শেখ হাসিনা একদিকে, আরেকদিকে প্রয়াত প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের অষ্টম শ্রেণী পাশ সুন্দরী পুতুল ওরফে বেগম খালেদা। হাসিনা আর খালেদা যদিও এরশাদকে গদিচ্যূত করার সময় হাতে হাত রেখেছিলেন কিন্তু এরশাদ যেই না সরে গেল, যেই না নির্বাচনী প্রচারে নেমে গেলেন দুজন, কাদা ছোঁড়াছুঁড়ি শুরু হয়ে গেলে দুই দলে। হাসিনা কেঁদে কেটে বুক ভাসান তাঁর পরিবারের সকল সদস্যদের কি করে পঁচাত্তরের পনেরোই আগস্টে খুন করা হয়েছিল সেসব কথা বলে বলে। আওয়ামী শাসনামলের ভয়াবহ দুঃশাসনের কথা বর্ণনা করেন খালেদা। রাষ্ট্রধর্ম ইসলামের দেশে ধর্মও হয়ে উঠল অস্ত্র। খালেদা জিয়া যদি দুকথা ধর্মের বলেন, হাসিনা চারকথা বলেন। আওয়ামি লীগ ধর্মের পরোয়া করে না, এরকম একটি দুর্নাম ছিল আগে, যেহেতু ধর্মনিরপেক্ষতা ছিল আওয়ামী লীগ সরকারের রাষ্ট্রগঠনের চার নীতির এক নীতি। এই দুর্নাম থেকে যতই হাসিনা মুক্তি পেতে চান, খালেদা ততই কায়দা করে এটিকে ব্যবহার করেন। আশা ছিল শেখ হাসিনার দল সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাবে। কিন্তু ঘটনা তা ঘটে না। অনেক মানুষই বাংলাদেশ স্বাধীনতার পর আওয়ামি লীগ সরকারের অরাজকতার কথা স্মরণ করে ভোট আর যাকে দিক আওয়ামি লীগের কাউকে দেয় না। ভারতের সঙ্গে সুসম্পর্ক ছিল একদা আওয়ামি লীগের, এটি খালেদার আরেকটি অস্ত্র। নির্বাচনে দুটি জিনিসই কাজ করেছে, এক, আওয়ামি লীগ জিতে গেলে দেশে ধর্ম বলতে কিছু থাকবে না, দুই হাসিনা ভারতের কাছে বিক্রি করে দেবে এই দেশ। দুটো টোপই পাবলিক গিলেছে। অথবা দুটো দুর্নামেরই সঠিক ব্যবহার হয়েছে। আওয়ামি লীগ ভোট পায়, কিন্তু অধিকাংশের নয়। জনগণকে আওয়ামি আতংকে ভুগিয়ে খালেদা জিয়া ভোটে জিতে পেয়ারের কিছু রাজাকারদের মন্ত্রী বানিয়ে প্রধান মন্ত্রী হন। আবদুর রহমান বিশ্বাস নামের এক রাজাকারকে প্রেসিডেন্ট পদে বহাল করেন। মহা সমারোহে জামাতে ইসলামি আঠারোটি আসন নিয়ে সংসদে ঢুকেছে। ভারতের কাছে দেশ বিক্রির দুর্নাম ঘোচাতে শেখ হাসিনা মুখে ভারতবিরোধী কথা বলা শুরু করলেন। ধর্ম যাবে, এই দুর্নাম ঘোচাতেও ধার্মিক হয়ে গেলেন রাতারাতি। বিশাল করে ইফতার পার্টির আয়োজন করেন, টঙ্গীর বিশ্ব ইজতেমায় গিয়ে দু হাত তুলে আল্লাহর কাছে মোনাজাত করেন। মককা গিয়ে হজ্ব করে এলেন।। এই প্রথম দেশের প্রধান মন্ত্রী একজন মহিলা, প্রতিপক্ষ দলের পুরোধাও একজন মহিলা এ কারণে একটি আনন্দ ছিল আমার, সেই আনন্দটির শরীরে উঠে আসতে থাকে একটি অজগর, গা শিউরে ওঠা আতঙ্ক।

খালেদা জিয়া ক্ষমতায় বসার পর এরশাদকে অস্ত্র মামলায় ফাঁসিয়ে জেলে ঢুকিয়ে দিল। কিন্তু একই স্বৈরাচারি আচরণ খালেদার সরকারও দেখাতে শুরু করেছে। প্রচার মাধ্যমকে নিরপেক্ষ রাখার কথা ছিল, কথা আরও কত কিছু ছিল, কোনও কথাই ক্ষমতা পেয়ে গেলে আর কারও রাখতে ইচ্ছে করে না। সংবিধানের রাষ্ট্রধর্মটিকে সরিয়ে ধর্মনিরপেক্ষতা বহাল করার কথাও উচ্চারণ করে না কেউ। দেশের মানুষের ভালর জন্য এ দেশের রাজনীতি নয়, রাজনীতি ক্ষমতার রাজনীতি। ছলে বলে কৌশলে ক্ষমতা পাওয়ার উদ্দেশ্যই সব রাজনৈতিক দলের। ক্ষমতার আনন্দ ভোগ করার উদ্দেশ্যই রাজনীতিকদের মূল উদ্দেশ্য। দেশের এহেন রাজনীতি আমাকে দুশ্চিন্তার পাঁকে ডুবিয়ে রাখে।

গাইনি বিভাগে গাধার মত পরিশ্রম করে লেখালেখির জন্য কোনও সময় পাওয়া যায় না, সে কারণে গাইনি থেকে অ্যানেসথিসিয়া বিভাগে চলে গিয়েছি। গাইনির পরিবেশও আগের মত নেই আর। নতুন ইন্টার্নি এসে গেছে, পুরোনোরা বিদেয় নিয়েছে। অধ্যাপক বায়েস ভুঁইয়াও বদলি হয়ে অন্য হাসপাতালে চলে গেছেন। আমার ইউনিটে নতুন সি এ এসেছে। তার ওপর রাত দিন ডিউটি, লেখার জন্য তেমন সময় পাওয়া যায় না। আগের চেয়ে লেখার চাপ অনেক বেড়েছে। কিন্তু লিখতে হলে তো সময় চাই। সময় কোথায়! অ্যানেসথেসিয়া বিভাগেও যে একেবারে কাজের অভাব নেই, তা নয়, রাতে যে ডিউটি নেই, তা নয়। সবই আছে। কিন্তু এখানে দু হাত হলেই চলে, দশ হাতের দুর্গা দেবী না হলেও কাজ হয়। গাইনিতে দশ হাতে কাজ না করলে কাজকে কাজ বলে গণ্য করা হয় না। আমার বাড়তি আটটি হাত নেই, যার থাকে থাকুক। আর যেহেতু পোস্ট গ্রাজুয়েশনের পথ শেষ পর্যন্ত মাড়াচ্ছি না, কী দরকার অত ডুবে থেকে! তা ছাড়া যা শেখার ছিল, শেখা হয়ে গেছে। এ বিদ্যে নিয়ে দিব্যি বাকি জীবন গাইনির ডাক্তার হিসেবে কাজ করা যাবে। অ্যানেসথেসিয়া বিভাগে গাইনি বিভাগের মত চব্বিশ ঘন্টা খাটাখাটনি নেই। ছিমছাম, পরিচ্ছত, কাজের ফাঁকে চা সিঙ্গারা, ডাক্তারি আড্ডা। বিভাগের অধ্যাপক মজিবর রহমান এবং মানস পাল দুজনই চমৎকার মানুষ। বন্ধুর মত। বাকি দুজন ডাক্তার শামিমা বেগম আর দেবব্রত বণিকের সঙ্গে আমার সম্পর্ক প্রথম দিন থেকেই মধুর হয়ে ওঠে। বিশেষ করে শামিমার সঙ্গে। প্রথম দিনই দুএকবার দেখে শিখে গেলাম কী করে অ্যানেসিথিসিয়া দিতে হয়। দ্বিতীয় দিন থেকে নিজেই দিতে শুরু করি। মাঝে মাঝে এখানেও ব্যস্ততার শেষ নেই বিশেষ করে গাইনির অপারেশন থিয়েটারে যখন দৌড়োতে হয়। এমনও হয়, সারা রাতে দুমিনিটের জন্য অবসর জোটে না, সারারাতই একটির পর একটির অপারেশন হচ্ছে। আমি এবার আর ছুরি কাঁচি হাতে নিয়ে দাঁড়াই না, আমার হাতে অজ্ঞান করার ওষুধ, অক্সিজেন, কৃত্রিম উপায়ে শ্বাস নেওয়ার যন্ত্রপাতি। রোগীকে ঘুম পাড়ানো, অপারেশন শেষ হয়ে গেলে রোগীর ঘুম ভাঙানো খুব সহজ মনে হলেও সহজ নয়। ঘুমের ওষুধ আর মাংসপেশি অবশ হওয়ার ওষুধ দেওয়ার পর যদি কৃত্রিম শ্বাস চালু না করা হয়, তবে শ্বাসই নেবে না রোগী। ফুসফুস থেমে থাকার একটি নির্দিষ্ট সময় আছে, সময় পার হয়ে গেলে রোগীর পক্ষে শ্বাস নেওয়া আর সম্ভব নয়। ঘুম পাড়াচ্ছি, অপারেশন শেষ হবে, রোগীকে টেবিলেই ওষুধ দিয়ে জাগিয়ে পোস্ট অপারেটিভ রুমে পাঠাতে হবে, সেখানেও খবর নিতে হবে রোগীর শ্বাস প্রশ্বাস, রক্তচাপ ইত্যাদি সব ঠিক আছে কি না। কখনও আমার হাতে কোনও রোগীর কোনও অসুবিধে হয়নি। আমার সব রোগীই সুন্দর ঘুমিয়ে যায়, সুন্দর জেগে ওঠে। একবারই হয় অসুবিধে। সেটি অবশ্য আমার কারণে নয়। সেটি উঁচু নাক মালিহার কারণে। তিনি রোগীর সিজারিয়ান অপারেশন করার জন্য তৈরি। রোগীকে অজ্ঞান করার ইনজেকশান দিয়ে রোগীর শ্বাসনালী খুঁজছি নল ঢোকাতে, দুবার চেষ্টা করে পাইনি, তৃতীয়বার চেষ্টা করতে যাবো, তখন মালিহা তার হাতের ছুরি কাঁচি ফেলে গ্লবস খুলে আমার হাত থেকে নল কেড়ে নিয়ে আমাকে কনুইয়ের গুঁতোয় সরিয়ে দিয়ে নিজে দাঁড়িয়ে গেলেন আমার জায়গায়। এফসিপিএস ফার্স্ট পার্ট পাশ করার দেমাগে তিনি নল ঢোকাবেন, যেন আমার হাত থেকে এ কাজে তাঁর হাত বেশি পাকা। খুঁজে তো তিনি পেলেনই না শ্বাসনালীর মুখ, মাঝখান থেকে রোগীর সর্বনাশ করলেন। ডাক্তার দেবব্রত বণিককে ডেকে আনতে লোক পাঠালেন তিনি। বণিক এফ সিপিএস পুরোটা না করলেও অর্ধেক করেছে, ডাকা হলে সে দৌড়ে এসে সমস্যার সমাধান করে, তার পক্ষেও সহজ ছিল না শ্বাসনালী পাওয়া, আট নবার চেষ্টা করার পর অবশেষে ঢোকে নল। বণিকেরও ঘাম বেরিয়ে গেছে ঢোকাতে। অপারেশন হল। বণিকের হাতে রোগী। সুতরাং অপারেশন থিয়েটারে উঁচু নাকটির সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে আমার ইচ্ছে করে না। আমি বেরিয়ে যাই। পরদিন বণিক আমাকে জানাল যে রাগীকে সে জাগাতে পারেনি। অল্প বয়সের মেয়েটি প্রথম সন্তানের জন্ম দিয়ে আর জাগেনি। আমার খুব কষ্ট হয় শুনে। বণিক রোগীকে পাঠিয়ে দিয়েছিল পিজিতে। সেখানেও চেষ্টা করে রোগীকে বাঁচানো সম্ভব হয়নি। সবকিছুর দোষ আমার ঘাড়ে পড়ে। মালিহাই দোষটি দেন। নিজের মাতব্বরির গল্পটি তিনি কায়দা করে লুকিয়ে ফেলেন। আমি যখন কারণ দেখাই মালিহার মাতব্বরির, দেবব্রত উল্টো আমাকে দায়ী করে বলে, ‘আপনি কেন আপনার রোগী ওকে ধরতে দিয়েছিলেন?’

‘আমাকে তো ধাককা দিয়ে সরিয়ে দিল!’

‘সরিয়ে দিলে আপনি সরবেন কেন! আপনার দায়িত্ব রোগীকে অ্যানেসথেসিয়া দেওয়া। মালিহার দায়িত্ব অপারেশন করা।’

‘সে তো ট্রাকিয়া খুঁজতে চাইল, আমার হাত থেকে টিউব নিয়ে গেল। সে বলল ইনটিউবেশন সে করবে।’

‘আপনি দেবেন কেন? সে কী জানে এনডোট্রাকিয়াল ইনটিউবেশনের? তার কোনও অভিজ্ঞতা আছে? ওই রোগির ট্রাকিয়া পাওয়া খুব কঠিন ছিল। যখন আপনি ট্রাকিয়া পেলেন না, সঙ্গে সঙ্গে অক্সিজেন চালিয়ে দিয়ে আমাকে খবর পাঠাতেন!’

‘অক্সিজেন দেব কী করে, আমাকে তো কাছেই যেতে দেয়নি।’

‘আপনি ওকে ধাককা দিয়ে সরিয়ে দিলেন না কেন!’

তা ঠিক, আমি কেন মালিহাকে ধাককা না দিলেও ধমকে সরিয়ে দিই নি! কয়েক রাত আমি ঘুমোতে পারিনি। মেয়েটির পান পাতার মত মুখটি, সুন্দর কাজলকালো চোখদুটো সারাক্ষণই মনে পড়েছে। আসলে আমি ধাককা দিতে পারি না। উচিত কথা বলতে, উচিত কাজ করতে আমার কেন এতে দ্বিধা থাকে, কেন এত লজ্জা আমার, কেন আমি মুখ বুজে থাকি মানুষ যখন চোখের সামনে অন্যায় করে! নিজের ওপর রাগ হয় আমার। নিজের এই মাথা নুয়ে লজ্জাবতী লতার মত পড়ে থাকার দিকে আমার রাগ হয় বড়। অনেক কিছুই আমার দ্বারা হয়ে ওঠে না, আমি লক্ষ করেছি। বাড়িতে কিছু অনাকাঙ্খিত অতিথি এসে এমন দীর্ঘ দীর্ঘ ক্ষণ বসে থাকে যে আমি এখন ব্যস্ত, এখন তোমাকে বা আপনাকে সময় দিতে পারব না বলা হয় না। ভেতরে ভেতরে গুমড়ে মরতে থাকি, কেবল না কথাটিই বেরোতে চায় না মুখ থেকে। ছোটবেলা থেকেই দেখেছি, আমার এই না বলতে পারার অক্ষমতা। কেউ আমার বুকের দিকে হাত বাড়াচ্ছে যেন দেখিনি সে যে চাইছে, আসলে কিন্তু দেখেছি, সেই বাড়ানো হাতে দ্রুত একটি কলম বা খাতা গুঁজে দিয়ে সরল হেসে বলি, ও এটি চাইছিলে বুঝি! সেই বাড়ানো হাতে কলম বা খাতাটি নিয়ে থতমত ভাবটি যেন সে আড়াল করতে যেন বাধ্য হয়, আড়াল করতে চেয়ে যেন বলতে বাধ্য হয় যে হ্যাঁ এটিই চেয়েছিলাম। দ্রুত কিছু একটা কাজের কথা বলে হাতের নাগাল থেকে দূরে সরে যাই। অথবা সম্পূর্ণ একটি অন্য প্রসঙ্গ টানি, যে প্রসঙ্গে তার মন উদাস হয়, যেমন তোমার বা আপনার বোনের যে বিয়ে হয়েছে, স্বামীর সঙ্গে নাকি বনছে না! গালে চড়, জুতো মারা এসব তো অনেক সাহসের ব্যপার, সামান্য যে মুখের কথা, ছি ছি তোমার মনে এই ছিল! অথবা সরে যা এখান থেকে হারামজাদা, কী অসভ্যরে কী অসভ্যতাও কখনও হাজার চেয়েও বলতে পারি না। বলি না, কারণ বলতে পারি না। তাকে বুঝতে দিই না যে তার অপকর্মের ইচ্ছেটি আমি বুঝেছি, আমি বুঝেছি জেনে যদি সে লজ্জা পায় অথবা আশকারা পায়। তাকে আমি লজ্জা বা আশকারা পেতে দিই না। তার অসুস্থতাকে আমাকে না বোঝা শিশুসুলভ সারল্য দিয়ে সুস্থ করে তুলতে চাই। সব লজ্জা একা ধারণ করি। পুরুষের জগতে এভাবেই আমাকে গা বাঁচিয়ে চলতে হয়, বুঝতে না দিয়ে তাদের চোখ টেপা, তাদের গা ঘেসা, তাদের হাত ছোঁয়া, রসের আলাপের ফাঁক ফোঁকর খোঁজা। যেন কিছুই ঘটেনি, যেন আমি তাকে যেরকম ভাল মানুষ ভাবি, সেরকম ভাল মানুষই সে, কখনও সে কোনও অশোভন ইঙ্গিত করে না, কখনও সে সুযোগ নিতে চায় না।

এফসিপিএস না করলে সম্ভবত এই হয়, দূর দূর করে তাড়ায় নাক উঁচু ডাক্তারগুলো। আমার হাত ভাল, অপারেশন ভাল করছি, বা অ্যানেসথেসিয়া ভাল দিচ্ছি এগুলো কেউ গণনায় নেবে না। আমি ভুল করলে লোকে বলবে ওর লেখাপড়া বেশি নেই বলে ভুল করেছে, জানে না বলে ভুল করেছে। আর এফসিপিএস ডাক্তার যদি ভূল করে তবে দোষ দেওয়া হয় অন্য কিছুকে। লিভার কাটতে গিয়ে কিডনি কেটে ফেললে দোষ হয় ছুরির, ডাক্তারের নয়। ছুরিটি নিশ্চয়ই বাঁকা ছিল। হাসপাতালে সবসময়ই এফসিপিএসগুলোর সামনে মাথা নুয়ে থাকতে হয়, তারা হাঁটলে রাস্তা ছেড়ে দিতে হয়। তারা যখন ডাক্তারি বিষয়ে কোনও বিদ্যা ঝাড়ে, নিশ্চুপ শুনতে হয়, তারা যখন পাগালামো করে, তখন পাগলামোকে জিনিয়াসরা ওরকম একটু আধটু করেই বলেই ভাবতে হয়। বাবাকেও আমি দেখেছি, বাড়িতে অত্যাচারি রাজার ভূমিকায়, আর মেডিকেল কলেজে একেবারে নিরীহ প্রজা। কাঁচুমাচু হয়ে হাত কচলে কচলে এফসিপিএস বা এফআরসিএস পাশ করা অধ্যাপকদের সঙ্গে কথা বলতেন। ওঁদের দেখলেই একটি সশ্রদ্ধ হাসি ফুটতো বাবার মুখে। বাবার লজ্জা ছিল, যত না গরিব কৃষকের পুত্র হওয়ার লজ্জা, তার চেয়ে বেশি এফসিপিএস না করার লজ্জা। এটি না করলেও জুরিস প্রুডেন্সের বাড়তি কিছু পড়াশোনা করে একটি ডিপ্লোমা নিয়েছেন। মাঝে মাঝে দুঃখ করে বলেন সংসার সামলানোর কারণেই তাঁর এফসিপিএস করা হয়নি। তা ঠিক, বাবা চাইলে এই ডিগ্রিটি নিতে পারতেন। আমি না হয় যেমন তেমন ছাত্রী ছিলাম, বাবা ছিলেন মেডিকেল ইশকুলের ভাল ছাত্রদের মধ্যে এক নম্বর। বাবার চেয়ে খারাপ ছাত্ররা বড় বড় ডিগ্রি নিয়ে বাবার সামনে বুক ফুলিয়ে হাঁটেন। বাবার নিজের অনেক ছাত্রই বাবার চেয়ে অনেক বড় হয়ে বসে আছে। আমিও কি বাবার মত হচ্ছি! আমিও তো বাবার মত নিজের অস্তিত্ব নিয়ে মাঝে মাঝে বড় অস্বস্তিতে ভুগি। বড় ডাক্তারদের সামনে বাবাকে কাঁচুমাচু হতে দেখলে আমার কখনই ভাল লাগত না। একবার বাবাকে অহংকারে মাটিতে পা পড়ে না এমন এক ডাক্তারের সামনে মাথা উঁচু করিয়েছি। প্রেসিডেন্ট কবি এরশাদ এশীয় কবিতা উৎসবের আয়োজন করছেন, তিনি আমাকে খুঁজছেন আমন্ত্রণ জানাতে, এরশাদের খোঁজার কারণে স্বাস্থ্য সচিব, তিনিও কবি, আমার খোঁজ করতে লাগলেন। আমি ময়মনসিংহ মেডিকেলের ছাত্রী ছিলাম এটুকুই বোধহয় তাঁর জানার দৌড়, তিনি ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজেন অধ্যক্ষ মোফাখখারুল ইসলামের কাছে ফোন করে তাঁকে দায়িত্ব দিলেন আমাকে খুব জরুরি ভিত্তিতে প্রেসিডেণ্টের আমন্ত্রণ পৌঁছে দিতে। স্বাস্থ্য মন্ত্রী আর স্বাস্থ্য সচিবের সরাসরি আদেশ বা অনুরোধ পাওয়া কোনও এক মেডিকেল কলেজের কোনও এক অধ্যক্ষ মোফাখখারুল ইসলামের জন্য অকল্পনীয় ব্যপার। আমার খোঁজ পাওয়ার জন্য মোফাখখারুল ইসলাম বড় বিগলিত হাসি নিয়ে একাধিকবার বাবার দ্বারস্থ হলেন। বাবা নিশ্চয়ই তখন কাঁচুমাচু মোফাখখারুলের সামনে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছিলেন। আমি দৃশ্যটি কল্পনা করে স্বস্তি পাই। বাবা আমাকে ঢাকায় ফোন করে বড় সুখী সুখী কণ্ঠে আমাকে খবরটি জানিয়েছিলেন। যদিও এরশাদের আমন্ত্রণে এশীয় কবিতা উৎসবে আমি অংশ নেব না, এশীয় কবিতা উৎসবের প্রতিবাদে গণতন্ত্রে বিশ্বাসী কবিদের নিয়ে যে জাতীয় কবিতা উৎসব হয়, আমি শুরু থেকেই সেখানে, তারপরও আমার অন্যরকম আনন্দ দেয় এরশাদের এই আমন্ত্রণটি। আনন্দ দেয় এই জন্য যে এই আমন্ত্রণের কারণে স্বাস্থ্য সচিব ফোন করেছেন মোফাখখারুল ইসলামকে, যে মোফাখখারুল ইসলাম তাঁর অধ্যক্ষ-কক্ষে ডেকে নিয়ে একটি উড়ো চিঠির ওপর ভিত্তি করে আমাকে কী জঘন্য অপমানটাই না করেছিলেন। আমার মত নিরীহ মানুষ কোনওদিন শোধ নিতে পারেনি সেই অপমানের। তবে আমার জন্য স্বাস্থ্য মন্ত্রী বা স্বাস্থ্য সচিবের উতলা হওয়াটিই তাঁকে অন্তত এইটুকু বুঝিয়েছে যে আমি নিতান্তই একটি তুচ্ছ জীব নই, যে রকম জীব ভেবে তিনি ঘৃণায় আমাকে মাটির সঙ্গে থেতলে ফেলতে চাচ্ছিলেন। এইটিই আমার শোধ। এর চেয়ে ভাল শোধ আর কী হতে পারে! চড়ের বদলে চড় দেওয়া আমি পছন্দ করি না, শারীরিক পীড়নের চেয়ে মানসিক পীড়ন ঢের বেশি যন্ত্রণা দেয়। স্বাস্থ্য সচিব ইমরান নূর মোফাখখারুল ইসলামের কাছ থেকে আমার ফোন নম্বর নিয়ে আমাকে ফোন করেছিলেন, অনুরোধ করেছেন আমি যেন প্রেসিডেণ্টের সাদর আমন্ত্রণটি রক্ষা করি। আমি রক্ষা করিনি।

শান্তিবাগের বাড়িটি সাজিয়ে নিয়েছি খুব সুন্দর করে। আরমানিটোলার বাড়িটির সঙ্গে শান্তিবাগের বাড়ির তুলনা হয় না। ও বাড়িটি ছিল বস্তির বাড়ি, এ বাড়ি আধুনিক, ঝকঝকে। ড্রইং কাম ডাইনিং। দুটো বাথরুম। দুটো বেডরুম। বারান্দা। আধুনিক কিচেন। বাড়িটি যেমন সুন্দর, পরিবেশও চমৎকার। আরমানিটোলার তুলনায় শান্তিবাগের সংসার অনেক য়চ্ছল। অবশ্য এই য়চ্ছলত!টুকু দিতে পরিশ্রমও করতে হয়। মাইনেতে বাড়িভাড়া কুলোয় না, সুতরাং কলাম লিখে টাকা রোজগার করতে হয়। যদিও লেখা থেকে ডাক্তারি চাকরির চেয়ে বেশি আয় হয়, তবু লেখার চেয়ে ডাক্তারি চাকরিতে সময় যায় কয়েকশ গুণ বেশি। লেখা আজ লোকে চাইছে, কাল হয়ত চাইবে না। চাকরিটিই তখন ভরসা। ভরসার জায়গাটি হেলাফেলায় নষ্ট করি না মোটেও। একটি কলামে কখনও তিনশ টাকা, কখনও পাঁচশ টাকা আসে, মাসে দশটি কলাম লিখলে বাড়িভাড়া, বিদ্যুৎ খরচ হয়ে যায়। মাইনের টাকায় বাজার খরচা আর রিক্সাভাড়া চলে। দশটির বেশি কলাম লিখলে নাটক থিয়েটার দেখে বই পত্র কিনে বেশ চলে যায়। তবে সবসময় যে এই নিয়মে সবকিছু চলে তা নয়, কখনও কোনও পত্রিকা বন্ধ হয়ে যায়, কোনও পত্রিকার মালিক বদলে যায়, নতুন মালিক আমার লেখা আর ছাপতে চায় না অথবা পত্রিকার টাকা ফুরিয়ে যায়, অথবা টাকা দেবে কথা দিয়েও কেউ হয়ত দেয় না। তারপরও আমি পিছু হটি না। আমি হার মানি না। অন্য কারও হাতে নিজেকে সমর্পণ করি না। মিলন মাঝে মাঝে সেও এটা সেটা বাজার করে। আর মা রান্নাঘর সামলালে তো খরচ বড় রকম বাঁচিয়ে চলেন। নিজে তলে তলে কৃচ্ছউস!ধন করে এই কাজটি করেন। শান্তিবাগের সব ভাল, তবে মিটফোর্ড হাসপাতালটি দূরে পড়ে যায়, এই যা সমস্যা। আরমানিটোলা থেকে হেঁটেই হাসপাতালে যাওয়া যেত। এখান থেকে রিক্সা নিতে হয়। রিক্সা গুলিস্তানের ট্রাফিক জ্যামে পড়ে আধঘণ্টা একঘণ্টা বসে থাকে।

শান্তিবাগের বাড়িতে অতিথির আগমন অনেক বেশি। কবি বন্ধু, ডাক্তার বন্ধু, ভক্তকূল, আত্মীয়কূলের কেউ না কেউ আসছেই। শান্তিবাগের বাড়িটি সত্যিকার যাকে বলে হোম, সুইট হোম। যে অবকাশের টান কোনও দিনই অবকাশ ছেড়ে যেখানেই থেকেছি, কমেনি, এই শান্তিবাগের শান্তি আমার অবকাশের মোহ অনেক কমিয়ে দেয়। তাছাড়া একটি তো চ্যালেঞ্জ আছেই, আমি স্বনির্ভর হব এবং একা থাকব, কোনও স্বামী নামক প্রভু পুরুষ আমার আশেপাশে থাকবে না, আমি হব আমার নিয়ন্ত্রক, যেভাবে আমি জীবন যাপন করতে পছন্দ করি, সেভাবে করব, কেউ আমাকে বলবে না এটা কর, ওটা কর। কারও কাছে আমার জবাবদিহি করতে হবে না কিছুর জন্য। ঠিক এরকম জীবনই আমি তো চেয়েছিলাম। সম্পূর্ণ একটি স্বাধীন জীবন। বাবার অধীন থেকে, স্বামীর অধীন থেকে মুক্ত একটি জীবন। এই জীবনটি অর্জন করতে আমাকে কম পথ পেরোতে হয়নি। স্বামী সন্তান নিয়ে সংসার করার স্বপ্ন সাধকে আমি খুব অনায়াসে এখন ছুঁড়ে ফেলতে পারছি। তুলোর মত উড়ে যাও স্বপ্ন। এই স্বপ্ন আমার জন্য নয়। এই স্বপ্ন লালন করে নিজেকে কম অপদস্থ করিনি। স্বপ্ন তুমি ভেসে যাও বুড়িগঙ্গার জলে, তোমাকে আমার আর প্রয়োজন নেই। স্বপ্ন তোমাকে মাটির তলায় পুঁতে দিচ্ছি, তুমি মরে যাও। স্বপ্ন তুমি আমার আঙিনামুক্ত হও, আমার হৃদয়মুক্ত হও। আমাকে আর নাশ করতে এসো না কখনও। এক স্বপ্ন চলে গেলে অন্য স্বপ্ন আসে। স্বপ্ন তো কত রকম হতে পারে। আমার এখন অন্য রকম স্বপ্ন। এই স্বনির্ভরতাটুকু, নিজের এই স্বাধীনতাটুকু নিয়ে বাকি জীবন বেঁচে থাকবার স্বপ্ন। এখন বড় নির্ভার লাগে, বড় দুঃস্বপ্নমুক্ত লাগে। যেন দীর্ঘ একটি দুঃস্বপ্নের রাত পার হয়ে এখন দেখছি চারদিকে আলোয় ঝলমল সকাল। যেন ঘুমিয়ে ছিলাম, ঘুমের মধ্যে অনেক দুর্ঘটনা ঘটে গেছে। জেগে উঠেছি। দীর্ঘ দীর্ঘ কাল একটি অন্ধকার গুহার ভেতরে আটকা পড়ে ছিলাম, অন্ধকারই আমার জীবন আর জীবনের স্বপ্নগুলো নিয়ন্ত্রণ করত। আলোর কোনও ঠিকানা আমার জানা ছিল না। নিজে আলো খুঁজে খুঁজে বের করেছি, আলো আমি ছড়িয়ে দিই চাই আর যারা অন্ধকারে আছে, তাদের দিকে। অন্ধকারে পড়ে থেকে স্যাঁতসেঁতে জীবন কাটাচ্ছে যারা, তাদের দিকে একটি হাত বাড়াতে চাই, যে হাতটি ধরে তারা উঠে আসতে পারবে আলোর মিছিলে। আমার হাত কি তেমন কোনও শক্ত হাত! শক্ত নয় জানি, তবু তো একটি হাত! এই একটি হাতই বা কে বাড়ায়!

আমার জীবনে অভাবিত কিছু ঘটনা ঘটতে থাকে। বাংলাবাজারের প্রকাশকরা ভিড় করেন আমার বাড়িতে। সকলের প্রশ্ন আমি কি পণ করেছি বিদ্যাপ্রকাশকে ছাড়া আর কোনও প্রকাশককে বই দেব না! এরকম পণ আমি নিশ্চিতই করিনি। খোকা আমার বই ছাপেন কিন্তু আমাদের মধ্যে এরকম কোনও চুক্তি হয়নি যে অন্য প্রকাশকেকে বই দেওয়া যাবে না। তাহলে বই দিন। আজই দিন। আশ্চর্য বই কোত্থেকে দেব! যা লিখেছি কবিতা। বিদ্যাপ্রকাশ থেকে সবই ছাপা হয়ে গেছে। যা কলাম ছাপা হয়েছে পত্রিকায়, সব বই হয়ে বেরিয়ে গেছে। তা হলে লিখুন। একটি উপন্যাস লিখুন। উপন্যাস! পাগল হয়েছেন! উপন্যাস আমি লিখতে জানি না। জীবনে কখনও লিখিনি। জীবনে কখনও না লিখলেও এখন লিখুন। খোকার কাছেও তাঁর প্রকাশক বন্ধুরা অনুরোধ নিয়ে যাচ্ছেন। খোকাও একদিন আমাকে বললেন তাঁর বন্ধু অনন্যা প্রকাশকের মুনিরকে যেন একটি বই দিই, শিখা প্রকাশনীর লোককে নিয়ে এলেন, তাকেও বই দিতে হবে। আবার একদিন আফসার ব্রাদার্সএর প্রকাশককে নিয়ে এলেন, একেও কিছু না কিছু দিতে হবে। উপন্যাস না দিলেও যেন গল্পের বই দিই, তা না হলে যেন কবিতা, বেশি যদি না দিতে পারি, অন্তত দশটি কবিতা, দশটি না হলেও পাঁচটি, শিল্পীকে দিয়ে ছবি আঁকিয়ে কবিতা কার্ডের প্যাকেট করবেন। যে ব্যপারটি ঘটে, তা হল অগ্রিম টাকা দিয়ে যান প্রকাশকগণ। রয়্যালটির টাকা পেতে কখনও অভ্যস্ত নই আমি। খোকা আমার ভাই বন্ধু শুভাকাঙ্খী, বাড়িতে এলে খালি হাতে আসেন না, নানা রকম ফল মিষ্টি বিস্কুট চানাচুর ইত্যাদি নিয়ে আসেন, কখনও কখনও হঠাৎ কোথাও বেশি খরচ করে একেবারে কপর্দকহীন হয়ে গেলে খোকা কিছু টাকা রেখে যান। সে তো প্রয়োজনে, শখের ব্যপারটিও দেখেন তিনি, লেখার টেবিলের জন্য সুন্দর একটি চেয়ার পছন্দ করেছিলাম, কিন্তু টাকা ছিল না বলে কিনতে পারিনি, খোকা সেটি কিনে একদিন বাড়িতে পাঠিয়ে দিলেন। কিন্তু রয়্যালটির হিসেব কখনও আমাকে দেননি। হিসেব আমি চাইও নি। চাইনি লজ্জায়। তাছাড়া খোকার সঙ্গে আমার সম্পর্ক হিসেবের সম্পর্ক নয়। যে কোনও প্রয়োজনে কোনও রকম দ্বিধা ছাড়াই আমি খোকাকে ডাকতে পারি, খোকা সব ফেলে ছুটে আসেন। কোনও টাকা দিয়ে এই সহানুভূতি কেনা যায় না। রয়্যালটির টাকা ব্যপারটি আসলেই বড় লজ্জার, যখন অনন্যা বা শিখা প্রকাশনীর লোক টাকা বাড়াল, আমার কান নাক সব লাল হয়ে গেল মুহূর্তে। টাকা হাতে নিতেও এমন লজ্জা হচ্ছিল যে হাত পেছনে গুটিয়ে রেখেছিলাম। প্রকাশকরা টাকা টেবিলে রেখেছেন নয়ত খোকার হাতে দিয়েছেন আমাকে দেওয়ার জন্য। অগ্রিম রয়্যালটির টাকা। অবশ্য টাকা দেওয়ার আগে আমি অনেক বলেছি, টাকা দেবেন না, বই তো লিখি নি। বই লিখিনি তাতে কারওর আপত্তি নেই। টাকা থাকুক, যখন লেখা শেষ হবে, এসে নিয়ে যাবেন। লিখতে যদি এক বছর লাগে? তা লাগুক। যদি পাঁচ বছর লাগে? তাতেও নাকি ক্ষতি নেই। টাকার দরকার নেই আমার। দরকার না থাকলেও যেন আমি রেখে দিই। বই লিখে নিই, ছাপা হোক, বিক্রি হয় কি না দেখুন, তারপর তো রয়্যালটি। প্রকাশকরা আমার কথা মানেন না, বলেন বই প্রকাশের পর তো রয়্যালটি পাবোই, তার আগেও টাকাটা থাকুক। টাকা থাকে। এত টাকা এক সঙ্গে কখনও দেখিনি আগে। শুনেছি এক হুমায়ুন আহমেদকেই রয়্যালটির টাকা বই লেখার আগেই দেওয়া হয়। এখন আমাকেও! মনে পড়ে সেই সব দিনের কথা। শিকড়ে বিপুল ক্ষুধা বইটির পরিবেশনার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল নসাস প্রকাশনীকে। নসাস প্রকাশনী বইটি বিলি করার কোনও রকম আগ্রহ প্রকাশ করেনি। দুবছর পর নসাসের গোডাউনে পড়ে থাকা পোকায় খাওয়া বই নিয়ে এসেছিলাম বাড়িতে। দ্বিতীয় বইটি প্রকাশের জন্য যে অনিন্দ্য প্রকাশনের নাজমুল হকের দ্বিধা ছিল, নিশ্চয়ই সেই নাজমুল হক আমার বই ছাপার জন্য আগ্রহ প্রকাশ করছেন এখন। আমি খুব ভাল করেই জানি আজ যে প্রকাশকরা করজোড়ে বই এর জন্য অনুরোধ করছেন, একসময় তাঁরাই হয়ত নাক সিটকোতেন নাম শুনলে। আমাকে লিখতে হয় প্রকাশকদের চাপে। হাসপাতালের অপারেশন থিয়েটারে বসে রোগী দেখার ফাঁকে ফাঁকে লিখি। বাড়িতে অতিথি এলে সময় দিতে হয়। সংসারে এটা নেই তো ওটা নেই, সেগুলোও দেখতে হয়, একশ একটা কাজের ফাঁকে ফাঁকে লিখি। লেখা আদৌ কিছু হয়েছে কি না তা ভাবার আগেই প্রকাশক এসে ছোঁ মেরে নিয়ে যান। প্রায় প্রতিদিন তাগাদা দেন, কতদূর হয়েছে লেখা, দেখি! হচ্ছে হচ্ছে হবে হবে করে করে সময় পার করি। সময় প্রকাশনের ফরিদ আমার বাড়ি এসে দিনের পর দিন অনুরোধ করে গেছেন, তাঁকে দিই অপরপক্ষ নামের একটি উপন্যাস। অনন্যাকে শোধ নামে একটি উপন্যাস দিই, উপন্যাস না বলে উপন্যাসিকা বলা উচিত অথবা বড় গল্প। গাইনিতে কাজ করে হাত দক্ষ হয়েছে হয়ত, এতদিনে অ্যানেসথেসিয়া দিতে দিতেও হাত পেকেছে, উপন্যাস লেখার জন্য মোটেও কিন্তু হয়নি। সভয়ে সলাজে লিখে শেষ করি। মনে খুঁতখুঁতি থেকেই যায়। লেখাগুলোয় একটি বক্তব্য অন্তত দাঁড় করাতে পেরেছি, নারীর শরীর এবং হৃদয় সবই যে তার নিজের, এসব অন্য কারও সম্পত্তি নয়, এক একটি নারীর জীবন বর্ণনা করে তা বলেছি। খোকার জন্য নতুন কলামের বই নষ্ট মেয়ের নষ্ট গদ্য আর বালিকার গোল্লাছুট নামে একটি কবিতার বই। কবিতাতেও দেখেছি আমি, কেবলই নারীর কথা। নারীর সুখের কথা, কষ্টের কথা, নারীর পায়ের নিচের মাটির কথা, শেকল ছেঁড়ার কথা, সমাজের রাষ্ট্রের পরিবারের নিয়মগুলো ভেঙে বেরিয়ে আসার কথা। মানুষের অধিকার নিয়ে বাঁচার কথা। জীবনে হোঁচট খেতে খেতে জীবনের যে মর্মান্তিক রূপ দেখেছি, জীবনে স্বপ্ন দেখতে দেখতে স্বপ্নের যে ভাঙন দেখেছি, তারপরও যে আবারও স্বপ্ন রচনা করেছি, আবারও যে উঠে দাঁড়িয়েছি এবং ক্লান্ত রক্তাক্ত জীবনের যে অভিজ্ঞতাই জীবনের রাজপথে, পথে, অলিতে, গলিতে সঞ্চয় করেছি তার সবই কবিতা, কলাম, উপন্যাস যা কিছুই লিখি না কেন, আমার অজান্তেই রক্ত ঝরার মত করে ঝরে কলমের নিব থেকে।

আমার দিনগুলো অদ্ভুত রকম পাল্টো যাচ্ছে। মাঝে মাঝে সংশয় জাগে এ সত্যিই আমি তো! ব্রহ্মপুত্রের পাড়ের লজ্জাবতী ভীতু কিশোরীটি তো! মাঝে মাঝে আমার বিশ্বাস হয় না অনেক কিছুই। বিশ্বাস হয় না যে টেলিভিশনের প্রযোজিকা আমার বাড়ি এসে গান লিখিয়ে নিয়ে যান, আর সেই শৃঙ্খল ভাঙার গান দেশের জনপ্রিয় গায়িকা সামিনা নবী গান টেলিভিশনের অনুষ্ঠানে। এ অবশ্য প্রথম নয়, আগেও আমার কবিতাকে গান করা হয়েছে। সুর দিয়েছে ইয়াসমিন। সঙ্গী সাথী নিয়ে ইয়াসমিন সেসব গান গেয়েছে মঞ্চে। কিন্তু সে তো ময়মনসিংহে। ঢাকা শহরে, তার ওপর ঢাকার টেলিভিশনে যেখানে সাধারণের প্রবেশ নিষেধ সেখানে আমার মত সাধারণের কবিতা বা গান টেলিভিশনের পর্দায় দেখানো হবে তা কি আমি কখনও ভেবেছিলাম! বিখ্যাত গায়ক ফকির আলমগীর আমাকে গান লেখার জন্য তাগাদা দেন। তাঁর জন্যও গান লিখতে হয় আমাকে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপিকা আসেন আমার কাছে, আমার কবিতা ইংরেজিতে অনুবাদ করে বড় একটি এনথলজি বের করছেন, ওতে দেবেন। ব্রিটিশ কাউন্সিলে ডাকেন আমাকে কবিতা পড়ার জন্য। নারী সংস্থার নেষনীরা আসেন তাঁদের অনুষ্ঠানে আমাকে আমন্ত্রণ জানাতে। অনন্যা পত্রিকা থেকে বছরের সেরা দশ নারী নির্বাচন করা হয়েছে, এবং তাদের সম্মানিত করা হয়েছে চমৎকার অনুষ্ঠান করে, সেরা দশ নারীর মধ্যে একজন আমি। ঢাকায় তো আছেই, ঢাকার বাইরে থেকেও লোক আসে আমাকে আমন্ত্রণ জানাতে বিভিন্ন সাহিত্য অনুষ্ঠানে, বইমেলায়। টেকনাফ থেকে ডাক্তার মোহিত কামাল ঢাকায় আসে আমার সঙ্গে দেখা করতে। মোহিতের ইচ্ছে টেকনাফে তার প্রিয় দুই লেখক ইমদাদুল হক মিলন এবং তসলিমা নাসরিনকে সে সম্বর্ধনা দেবে। টেকনাফের কচি কাঁচার মেলার সে সভাপতি, মেলা থেকেই সম্বর্ধনা দেওয়ার ব্যবস্থা হবে। মোহিত সাহিত্য অনুরাগী, আমারই সমবয়সী, খোকার সঙ্গে পরিচয় হয় তার, কি করে কি করে খোকার সঙ্গে তার বন্ধুত্ব হয়ে যায়। টেকনাফে ফিরে গিয়ে খোকার সঙ্গে চিঠিতে যোগাযোগ করে এই ব্যবস্থাটি মোহিত পাকা করে। খোকা আমাকে আর মিলনকে নিয়ে টেকনাফে রওনা হন। দেশের আনাচ কানাচে কত কিছু দেখার আছে, আমার দেখা হয়নি দেশের বেশির ভাগ অঞ্চলই। দূরে কোথাও যাওয়ার জন্য আমি এক পায়ে খাড়া। টেকনাফে, দেশের দক্ষিণের শেষ বিন্দুটিতে পৌঁছে খুব আনন্দ হয় আমার। মোহিতের বাড়িতে অতিথি হই আমরা সবাই। অনুষ্ঠানে সম্বর্ধনা দেওয়া হয় দুই লেখককে। সম্বর্ধনা পেয়ে আমি অভ্যস্ত নই, শরমে মুখ তুলতেই পারিনি। দুই লেখককে দিয়ে কচি কাঁচাদের বাৎসরিক পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে পুরস্কারও দেওয়ানো হয়। অনুষ্ঠানের পর মোহিত আমাদের সেন্ট মার্টিন দ্বীপ আর মহেশখালি দ্বীপে বেড়াতে নিয়ে যাবার আয়োজন করল। ভযাবহ যাত্রা। মাছ ধরার ট্রলারে বসে আছি, উত্তাল সমুদ্রের এক স্রোত ট্রলার ডুবিয়ে নেয়, আরেক স্রোত ভাসায়, ডুবতে ডুবতে ভাসতে ভাসতে প্রবাল- দ্বীপ সেন্ট মার্টিনে পৌঁছি। আশ্চর্য সুন্দর একটি দ্বীপ। উঁচু উঁচু বাঁশের ঘরে কিছু মানুষ বাস করে। চারদিকে অচেনা সব গাছগাছালি। সমুদ্রের য়চ্ছ সবুজ জল ছুঁয়ে ছুঁয়ে হাঁটি। সেন্ট মার্টিন থেকে মহেশখালি দ্বীপেও গিয়ে জেলেদের জীবন দেখি, জলই এই জেলেদের বাঁচাচ্ছে, জলই এই জেলেদের মারছে। জলকে ভালবাসে, আবার জলের সঙ্গেই যুদ্ধ করে বেঁচে থাকে এরা। সমুদ্রের তীরে চমৎকার সময় কাটিয়ে ফিরে আসি ঢাকায়। টেকনাফে মিলন ছিল, সাধারণ এক লেখক-বন্ধুর মতই সে ছিল। মিলনের জন্য অন্যরকম কোনও আবেগ আমি অনুভব করিনি। কাশ্মীরের কিছু স্মৃতি আছে সুখের, তা থাক। স্মৃতি স্মৃতির জন্যই। এর পরের আমন্ত্রণ সিলেটে। সিলেটের বইমেলায়। এবারও খোকা ব্যবস্থা করেন সিলেট যাত্রা। আমি, খোকা, অসীম সাহা যাত্রা করি। সময় প্রকাশনের ফরিদ তাঁর বউসহ আমাদের সঙ্গী হন। সিলেটেও খুব ভাল সময় কাটে। বইমেলায় অটোগ্রাাফ শিকারির ভিড়ে চিড়েচ্যাপ্টা হয়ে যাই। এই সুদূর সিলেটেও লোকে আমার লেখা পড়ে! দেখে আমি অভিভুত। সিলেটের চা বাগানে ঘুরে, তামাবিলে শিলং পাহাড়ের গা বেয়ে নেমে আসা ঝর্নার স্রোত এসে নদীতে পড়েছে, সেই নদীর য়চ্ছ সুন্দর জলের পাথরকুচির ওপর খালি পায়ে হেঁটে হেঁটে আমি অপূর্ব রূপ দেখি প্রকৃতির। ওপারেই ভারত, হাত বাড়ালে ছোঁয়া যায় এমন দূরে। অথচ একটি কাঁটাতার বসানো মাঝখানে। এই বাধাটি দেখে বেদনায় নুয়ে থাকি। এখানের গাছ থেকে ফুল পাতা ঝরে পড়ছে ওখানের মাঠে। ওখানের পাখি উড়ে এসে বসছে এখানের গাছে, কেবল মানুষের অধিকার নেই দুকদম সামনে হাঁটার। আমরা এই পৃথিবীর সন্তান, আমরা কেন যতদূর ইচ্ছে করে হাঁটতে পারবো না এই পৃথিবীর মাটিতে, কেন সাঁতার কাটতে পারবো না যে কোনও নদী বা সমুদ্রে? মানুষই মানুষের জন্য রচনা করেছে অসভ্য শৃঙ্খল। সীমান্তের কণ্টক থেকে একটি কণ্টক এসে হৃদয়ে বেঁধে।

আমন্ত্রণ আসতে থাকে আরও বড় শহর থেকে, আরও বড় বড় সাহিত্য অনুষ্ঠানে। আমাকে সম্বর্ধনা দেওয়া হয়। প্রধান অতিথির সম্মান দেওয়া হয়। মঞ্চের পেছনের বড় পর্দায় বড় বড় করে লেখা থাকে আমার নাম। ঢাকায় নাট্যসভা থেকে সাহিত্য পুরষ্কারও দেওয়া হল, শামসুর রাহমান আর আমি পাই পুরস্কার। শহিদুল হক খান পুরষ্কার বিতরণ অনুষ্ঠানটি করলেন জাতীয় যাদুঘরের মিলনায়তনে। শহিদুল হক নাটক লেখেন, নাটক পরিচালনা করেন আবার নাট্যসভা নামে একটি সংগঠনও করেন। প্রতিভা আছে লোকটির। লোকে বলে বড় শঠ লোক, আমি অবশ্য তার শঠতা দেখিনি নিজ চোখে। আমার সঙ্গে অসম্ভব আন্তরিক তিনি।
 
কবি সাহিত্যিকরা ঘন ঘন আসেন আমার বাড়িতে, পুরো বিকেল জুড়ে আদা-চা খেতে খেতে আড্ডা জমে। শামসুর রাহমানের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বাড়ে আমার। দীর্ঘ দীর্ঘক্ষণ আড্ডা হয় সাহিত্য নিয়ে রাজনীতি নিয়ে। লেখক রশীদ করিম শামসুর রাহমানের বিশেষ বন্ধু। তাঁর বাড়িতে আমাকে আর শামসুর রাহমানকে প্রায়ই তিনি ডাকেন সাহিত্যের আলোচনা করতে। সাহিত্য নিয়ে হয়, ধর্ম নিয়েও আমাদের কথা হয়, আমি আর শামসুর রাহমান ধর্মহীনতার পক্ষে, রশীদ করীম ধর্মের পক্ষে। পক্ষে হলেও তিনি একজন সুসভ্য সুশিক্ষিত সুসাহিত্যিক। এই যে আমাকে দেশের বড় বড় সাহিত্যিকরা স্নেহ করেন সে আমি অল্প বয়সী (তাঁদের বয়সের তুলনায়), সুন্দরী (!) মেয়ে বলে নয়, আমার লেখার কারণে করেন। আমার কবিতায় গদ্যে আমার বক্তব্যে তাঁরা নতুন প্রজন্মের নতুন দিনের একটি সম্ভাবনা দেখছেন বলে করেন। আমার লেখা তাঁরা পড়েন, আলোচনা করেন এবং বিশ্বাস করেন যে আমি খুব প্রয়োজনীয় কথা লিখছি। আমার সমবয়সী সাহিত্যিকদের চেয়ে আমার দ্বিগুণ ত্রিগুণ বয়সী সাহিত্যিকদের সঙ্গে আমার চলাফেরা বেশি হতে থাকে। শিল্প সাহিত্য সমাজ সংস্কৃতি এসব তো আছেই, মানবিক দিকটিও অপ্রধান নয়। যেদিন আমাকে শামসুর রাহমান খবর দিলেন যে রশীদ করিম হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েছেন, আমি হাসপাতাল থেকে ছুটে গিয়ে রশীদ করিমকে বাড়ি থেকে দ্রুত তুলে নিয়ে সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের ভর্তি করিয়ে দিই। রশীদ করিম বেঁচে যান কিন্তু মস্তিস্কে রক্তক্ষরণ হওয়ায় শরীরের অর্ধেকটা অচেতন হয়ে পড়ে থাকে। হাসপাতাল থেকে তিনি বাড়ি ফিরে যাওয়ার পর তাঁকে দেখতে, সঙ্গ দিতে, তাঁর মন ভাল করে তুলতে আমি আর শামসুর রাহমান দুজনই তাঁর বাড়িতে যাই। শামসুর রাহমানের সঙ্গে পান্না কায়সারের ভাল বন্ধুত্ব। ইস্কাটনে পান্না কায়সারের বাড়িতেও আমরা যাই পানাহার আর আড্ডার নেমন্তন্নে। পান্না কায়সার আর আমি যশোরের সাহিত্য সভায় গিয়েছিলাম। লেখক শহীদুল্লাহ কায়সারের স্ত্রী পান্না কায়সার নিজেও উপন্যাস লিখছেন, রাজনীতির মঞ্চে তিনি কথা বলে অভ্যস্ত, চমৎকার বক্তৃতা করলেন যশোরে। নতুন শহর দেখে, নতুন নতুন মানুষের সঙ্গে পরিচিত হয়ে ভাল লাগে আমার কিন্তু মঞ্চে যখন আমাকে ঠেলে দেওয়া হয় বক্তৃতা করতে, আমি দর্শক শ্রোতা কাউকে মুগ্ধ করতে পারি না, বক্তৃতা করতে হলে কিছু শক্ত শক্ত শব্দ ব্যবহার করতে হয়, সেই শব্দগুলো আমি কখনও আয়ত্ত্ব করতে পারি না।

বেইলি রোডে চরমপত্রের নরম লোক এম আর আখতার মুকুলের বইয়ের দোকান সাগর পাবলিশার্সে বই কিনতে গেলে প্রায়ই দেখি শওকত ওসমান বসে আছেন ওখানে। আমাকে দেখেই খলবল করে রাজ্যির কথা বলেন। দেশের কত বড় একজন সাহিত্যিক। একদিন আমার নামের অর্থ করে দিলেন। তার পর দেখি তিনি ফটোকপি করে বিলোচ্ছেন আমাকে নিয়ে লেখা তাঁর একটি কবিতা। নাসরিন নামের অর্থ বন্য গোলাপ, কমতি হয় না তাই সুগন্ধের তাপ।পাওয়ার একটি সীমা আছে। আমার পাওয়া সীমা ছাড়িয়ে যায়।

দেশের জনপ্রিয় কবি নির্মলেন্দু গুণের সঙ্গে আমার খুব চমৎকার বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। ধীরে ধীরে তিনি বাড়ির লোকের মত আপন হয়ে ওঠেন। গুণের চরিত্রের একটি সাংঘাতিক দিক আছে, তিনি কোনও অপ্রিয় সত্য কথা বলতে কোনও দ্বিধা করেন না, লোকে কি বলবে তা নিয়ে ভাবেন না। শুধু বলে তিনি ক্ষান্ত নন, জীবনে তিনি তা করেও দেখান। গুণের হুলিয়া কবিতাটি পড়ে যে কোনও পাঠকের মত আমিও ভেবেছিলাম, গুণের বিরুদ্ধে বুঝি কোনও রাজনৈতিক মামলার হুলিয়া জারি হয়েছিল। একদিন জানতে চেয়েছিলাম হুলিয়া জারি হওয়ার পর তিনি কি করে গা ঢাকা দিয়েছিলেন, শেষ পর্যন্ত ধরা পড়েছিলেন কি না এসব নিয়ে, তখনকার নিষিদ্ধ বাম রাজনীতির রোমহর্ষক কাহিনী বা পাকিস্তানী সরকারের বিরুদ্ধে কোনও গোপন আন্দোলনের কথা শুনব বলে কান মন সব সজাগ রেখে বসেছি, গুণ তখন অত্যন্ত শান্ত কণ্ঠে বললেন যে তিনি ডাকাতির মামলার আসামী ছিলেন। সত্যি সত্যিই ডাকাতির মামলা। কোনওরকম সংকোচ না করে বলে দিলেন ঘটনা, নেত্রকোনার এক গ্রামে এক রাতে তিনি সত্যিকার ডাকাত দলের সঙ্গে ভিড়ে ডাকাতি করতে গিয়েছিলেন। কেন ডাকাতি? খুব সরল জবাব, টাকার দরকার ছিল। টাকার দরকার জীবনে প্রচুর এসেছে গুণের। আনন্দমোহন কলেজের হোস্টেলে থাকাকালীন হোস্টেলের ক্যাপ্টেন হয়ে তিনি বাজার করার টাকা থেকে চুরি করতেন টাকা। নতুন শার্ট কিনেছিলেন সে টাকায়। হোস্টেলের ঘরে রাতে রাতে জুয়ো খেলতেন। ধরা পড়ে যাওয়ার পর তাঁকে কলেজ থেকে বের করে দেওয়া হয়েছিল। ঢাকায় যখন বাস করতে শুরু করলেন, কবিতা লিখে টাকা যা রোজগার করেন, তাতে জীবন চলে না। ক্ষিধে পেটে হাঁটেন, পকেটে পয়সা নেই। এরকম অনেক হয়েছে যে হাতে কোনও টাকা পয়সা ছাড়াই রেস্তোরাঁয় ঢুকে ভাত খেয়েছেন। এরপর মার খাবার ভয়ে পালানোর মতলব করেছেন। পানি নিয়ে বারান্দায় হাত ধুতে যাবার ভান করে পানির গেলাস ফেলে উর্ধ্বশ্বাসে দৌড়। রেস্তোরাঁর লোক পেছনে দৌড়েও রবীন্দ্রনাথের মত দেখতে লম্বু গুণের টিকি দাড়ি কিছুই ছুঁতে পারেনি। খেয়ে পয়সা না দিয়ে ঝড় বৃষ্টি কিছু মানেননি, দৌড়ে পালিয়েছেন। এসব বলতে গুণের আসলেই কোনও সংকোচ হয় না। তাঁর এই সংকোচহীনতা আমাকে মুগ্ধ করে। নিজেকে নিয়ে কোনও রকমের অহংকার না করে বরং প্রাণখুলে এমন রসিকতা করতে আমি আর কাউকে দেখিনি আগে। আমার যখন দশ বছর বয়স, ইশকুলের নতুন ক্লাসে উঠেছি, বাবা আমাকে নতুন ক্লাসের সব বই কিনে দেননি তখনও। ক্লাস শুরু হয়ে গেছে ওদিকে। ক্লাসে মেয়েরা নতুন নতুন বই নিয়ে আসছে। আমার চেয়ে বেশি বই তাদের। তখন ছুটির পর দেখি আভা রুদ্র নামে ক্লাসের একটি মেয়ে ভুলে তার বাংলা দ্রুতপঠনের গল্পের বইটি ফেলে চলে গেছে। আমিই সবচেয়ে শেষে বেরিয়েছিলাম ক্লাস থেকে। আভা রুদ্রর বেঞ্চে পড়ে থাকা বইটি হাতে নিয়ে এদিক ওদিক তাকিয়ে বইটির লোভ সামলাতে না পেরে আমি পাজামার মধ্যে বইটি গুঁজে নিয়েছিলাম। ক্লাসঘর থেকে বেরিয়ে হাঁটছি আর বুক কাঁপছে। পেটে বই। আমার কেবলই মনে হচ্ছিল জামার তলের বইটি বুঝি যে-ই আমার দিকে তাকাচ্ছে দেখে ফেলছে। গেটের কাছে মেয়েরা দাঁড়িয়ে আছে। আভা রুদ্রও দাঁড়িয়ে আছে। ওর বইটি আমার পেটে, আমার ইচ্ছে করছিল বইটি পেট থেকে বের করে তাকে দিয়ে দিই। কিন্তু পেট থেকে বইটি তখন ভরা মাঠে আমি বের করি কি করে! পেটে বই নিয়েই হেঁটে বাড়ি ফিরেছি। বুক ধড়ফড় তখনও থামেনি। তোশকের তলে লুকিয়ে রেখেছিলাম বইটি, কেউ যেন টের না পায় বইটি আমি চুরি করে এনেছি। বইটি পেটে করে গোসলখানায় নিয়ে, ছাদে নিয়ে পুরোটাই পড়ে ফেলি পরদিনই। দুদিন পর বাবা আমাকে বাকি পাঠ্য বইগুলো কিনে দিলেন, দ্রুতপঠন বইটি অবশ্যই ছিল। ইশকুলে গিয়ে আভা রুদ্রকে দেখে আমার বুক ভেঙে যায়। হারিয়ে যাওয়া বইটির জন্য সে কান্নাকাটি করছে, ক্লাসের সবাইকে জিজ্ঞেস করছে তার বইটি কেউ দেখেছে কিনা। তাকে আমি বইটি ফিরিয়ে দিতে পারছি না, ফেরত দিলে সে আমাকেই গাল দেবে চুরি করেছিলাম বলে। এদিকে মন খুব খারাপ আমার, নিজেকে চোর বলে মনে হচ্ছে প্রতিটি মুহূর্তে। রাতে ঘুম আসে না, এপাশ ওপাশ করি। কাউকেই নিজের এই চুরির কথাটি বলতে পারি না। ওই চিকন বইটি আমার কাঁধে গারো পাহাড়ের মত এমন ভারী হয়ে বসেছিল যে একদিন পেটে করে বইটি নিয়ে সকাল সকাল ইশকুলে গিয়ে ক্লাসঘরে কেউ না ঢোকার আগেই ঢুকে আভার ডেস্কের ওপর রেখে দিয়ে ভারমুক্ত হই। পরে আভার সঙ্গে আমার ভাল বন্ধুত্ব হয়েছিল। কোনওদিন তাকে বলিনি বই চুরির কথা। বড় হবার পরও কোনও দিন কাউকে বলিনি। বইটি গোপনে ফেরত দিয়েও চুরি করার অপরাধবোধ থেকে মুক্তি আমি পাইনি। নির্মলেন্দু গুণ, আমি জানি, এরকম অপরাধের কথা অনায়াসে বলে ফেলতে পারেন। নির্মলেন্দু গুণের চুরি ডাকাতি জুয়োখেলা এসব আমি পছন্দ না করলেও তাঁর স্বীকারোক্তি আমি পছন্দ করি। নিজের অংসযম নিয়েও তিনি কবিতা লিখেছেন অনেক, তাঁর বেশ্যাগমন নিয়ে তিনি কোনও রাখঢাক করেননি। মেডিকেলের ছাত্রী নীরা লাহিড়ির সঙ্গে গুণের বিয়ে হয়েছিল। কবি আর হবু ডাক্তারের সুন্দর সংসার, কন্যা মৃত্তিকা জন্মেছে। কবি ব্যস্ত অর্থ উপার্জনে, হবু ডাক্তার ব্যস্ত ডাক্তারি বিদ্যা অর্জনে। মৃত্তিকাকে দেখাশোনা করার জন্য নেত্রকোনা থেকে গীতাকে আনা হয়েছে। গীতার নিজের কোনও বাচ্চা কাচ্চা নেই, মৃত্তিকাকে সে পরম আদরে লালন করছে। এর মধ্যেই হঠাৎ একদিন গুণের সঙ্গে সম্পর্ক চুকিয়ে ফেললেন নীরা। বিয়ে ভেঙে নীরা তাঁর কন্যা নিয়ে চলে গেলেন। নির্মলেন্দু গুণ গীতাকে নিয়ে একা পড়ে রইলেন। ময়মনসিংহ থেকে ঢাকায় এসে বস্তিতে বাস করছেন কেবল গীতাকে নিয়ে নয়, গীতার জ্ঞাতিগুষ্ঠি নিয়ে, সবারই দায়িত্ব তিনি নিয়েছেন। নীরা দেখেশুনে একটি ডাক্তার ছেলেকে বিয়ে করে নিয়েছেন। মৃত্তিকা থাকে তাঁর দিদিমার বাড়িতে। গুণ থাকেন মৃত্তিকার ধারে কাছেই বস্তিতে। বস্তিতে থাকা নিয়ে বা গীতার গুষ্ঠি পালন করা নিয়ে গুণকে কোনও দুঃখ প্রকাশ করতে দেখিনি। তিনি সুখী। অভাব আছে কিন্তু অভাবের বোধ নেই। জীবনের প্রতি বিন্দু তিনি উপভোগ করেন। প্রাণ খুলে হাসেন, বুক খুলে ভালবাসেন, হাত খুলে লেখেন। ধন দৌলতের কোনও মোহ নেই। বিলাস ব্যসনের কোনও সাধ নেই। বিলাস বহুল বাড়ির বিলাস বহুল খাবার-টেবিলে সুস্বাদু সব উপাদেয় খাবার খেতে পারেন আবার বস্তির মাটির উঠোনে বসে মাছি তাড়াতে তাড়াতে নেড়ি কুত্তা খেদাতে খেদাতে বাসি ডাল ভাতও খেতে পারেন। দুটোতেই তাঁর সমান তৃপ্তি। লাস ভেগাসের ক্যাসিনোয় বসেও কয়েক হাজার ডলারের জুয়ো খেলে যে সুখ পান, ঢাকার কোনও ঘিঞ্জি গলিতে বসে দু পাঁচ টাকা নিয়ে জুয়ো খেলেও তাঁর একই সুখ। নির্মলেন্দু গুণ যে চোখে জীবন দেখেন, সে চোখটি বড় নির্মোহ কিন্তু বড় অভিজ্ঞ চোখ। বিশাল বিশ্ব ব্রম্মাণ্ডে জীবন হল সরু সুতোর মত, যে সুতোটি টান টান হয়ে আছে যে কোনও মুহূর্তে ছিঁড়ে যাবে বলে, সেই সুতোর ওপর নির্ভয়ে দাঁড়িয়ে জীবনের রস সন্ধানে এবং পানে তিনি কোনও কার্পণ্য করেন। আড্ডা দিতে দিতে একদিন অনেক রাত হয়ে যাওয়ায়, সেদিন মিলন, মা কেউ ছিল না বাড়িতে, বাড়তি ঘর আছে, বিছানা আছে, গুণকে বলেছি রাতে থেকে যেতে। তিনি থেকে গেলেন। ভোরবেলায় দেখি গীতা এসে হাজির। দাদা রাতে বাড়ি ফেরেননি, পাতি পাতি করে শহর খুঁজে শেষে আমার ঠিকানা যোগাড় করে এখানে দেখতে এসেছে গুণ আছেন কি না।

গীতা গুণকে দেখেই বলল, ‘দাদা, আপনে কেমন মানুষ গো! আমরা চিন্তায় মইরা যাইতাছি। একটা খবর দিবেন না যে ফিরবেন না?’

গুণ হাসতে হাসতে বললেন, ‘তুই জানলি কেমনে আমি যে নাসরিনের বাসায়?’

গীতার উৎকণ্ঠিত মুখে প্রশান্তি এখন, ‘অসীমদা কইল যে দিদির বাসায় থাকতে পারেন।’

‘রিক্সা দিয়া আইছস না হাইট্যা?’ গুন জিজ্ঞেস করেন।

‘হাইট্যা কি এতদূর আইতে পারাম। রিক্সা লইছি।’

‘ভাড়া দিছস?’

‘না, রিক্সারে গেটের সামনে খাড়া কইরা থইয়া আইছি।’

‘তুই যে আইলি, তুই ইস্কুলে যাইতি না?’

‘হ যাইয়াম। চলেন বাড়িত চলেন। আমার ইস্কুলের দেরি অইয়া যাইব।’

নির্মলেন্দু গুণ চা নাস্তা খেয়ে গীতাকে নিয়ে চলে যান। গুণ তাঁর কাব্য সমগ্রের প্রথম পর্ব উৎসর্গ করেছেন কবি শামসুর রাহমানকে, দ্বিতীয় পর্ব উৎসর্গ করেছেন এই গীতাকে, গীতা গাণ্ডীবা দাসীকে। গীতা আজিমপুরের একটি ইশকুলে ঘণ্টা বাজাবার কাজ করে। এখন সে কারও বাড়ির কাজের মহিলা নয়। শরীরটি শক্ত সমর্থ, টান টান। মাথাটি উঁচু। গীতার ছোট বোনগুলোকে গীতা নিজের কাছে নিয়ে এসেছে, তাদেরও কোথাও কাজে নামিয়ে দেওয়ার ইচ্ছে তার। গুণ আমাকে বলেছেন আমার বাড়িতে কোনও একটিকে তিনি পাঠাবেন কাজ করতে। কুলসুম বাড়ি থেকে পালিয়ে গেলে গীতার ছোট বোন বেবিকে নিয়ে এসেছিলাম বাড়ির কাজ করার জন্য। বেবি বেশিদিন থাকেনি। পরে একসময় গার্মেন্টস ফ্যাক্টরিতে কাজ করতে শুরু করে। সুইয়ে সুতো ভরার কাজ। মাসে তিনশ টাকা মাইনে।

নির্মলেন্দু গুণের পরিবারের ঘনিষ্ঠ লোক এরাই। গুণের মুখে এদের গল্প অনেক শুনি। একবার গুণকে বলেছিলাম, তিনি কেন বস্তি ছেড়ে উঠে আসছেন না, কেন তিনি একটি ভাল জায়গায় বাড়ি ভাড়া করে থাকছেন না। গুণ আমাকে বুঝিয়ে বলেন, ভাল জায়গা ওদের জন্য বস্তিই। ওখানেই ওরা আনন্দে থাকে। চেঁচিয়ে গালি গালাজ করে ইচ্ছে মত থাকা যায়। মধ্যবিত্ত ভাল এলাকায় এরকম বস্তিপনা প্রতিবেশিদের সহ্য হবে না। গীতা আর গীতার বোনদের সঙ্গে সম্পর্ক নিয়ে বাড়িভাড়া নিতে গেলে প্রশ্নও উঠবে। বস্তিতে এসব প্রশ্ন কখনও ওঠে না। এ কথা ঠিকই, সমাজের কঠোর কঠোর নিয়মগুলো মধ্যবিত্ত শিক্ষিতরাই পালন করে, উচ্চবিত্ত আর নিম্নবিত্তই কোনও রীতি নীতির ধার ধারে না। এটা করলে ইজ্জত যাবে, ওটা করলে মান যাবে এসব মধ্যবিত্তের ব্যপার। নির্মলেন্দু গুণের অবাধ যাতায়াত সব শ্রেণীর মানুষের মধ্যে। নিজে তিনি শ্রেণীহীন মানুষ। অনেকটা রাজহাঁসের মত, আজিমপুর বস্তির আবর্জনা তাঁর গায়ে লাগছে না, গুলশানের অট্টালিকার চাকচিক্য তাঁকে স্পর্শ করছে না।

নির্মলেন্দু গুণ কোনওদিন জুয়ো খেলায় জেতেননি। খেলায় বসা মানে, খেলায় হারা। তারপরও তিনি খেলতে যান জুয়ো। বলেছিলাম, ‘ধুর, বাদ দেন তো। কেন খেলেন এই সব? সময় নষ্ট। পয়সা নষ্ট।’

গুণ মলিন মুখে বলেন, ‘কি করব বল। না খেইলা তো উপায় নাই।’

‘উপায় নাই কেন?’

গুণ খেলার সঙ্গীদের দোষ দিয়ে বললেন, ‘আমি না খেললে আমারে ওরা হারামজাদা বইলা গাল দেয়।’

হারামজাদা গাল খেতে তিনি পছন্দ করেন না বলে জুয়ো খেলতে যান।

জীবন নিয়ে তিনি যত মজাই করুন না কেন, রাজনীতির ব্যপারে তিনি খুবই সিরিয়াস। তবে একানব্বই এর নির্বাচনে তিনি এ নিয়ে একটু মজা করেছিলেন। তাঁর খুব নির্বাচনে দাঁড়াবার শখ হল। তাঁর দৃঢ় বিশ্বাস ছিল যেহেতু তিনি আওয়ামি লীগের ঘোর সমর্থক, আওয়ামি লীগ থেকে তিনি প্রার্থী হিসেবে মনোনয়ন পাবেন। কিন্তু মনোনয়ন তাঁকে দেওয়া হল না। না দিলে কি হবে, নির্বাচন তিনি করতে চেয়েছেন, করবেন যে করেই হোক। কুমীর মার্কায় দাঁড়িয়ে গেলেন সতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে। নৌকো নেই ভাগ্যে, কিন্তু কুমীর তো আছে। নেত্রকোনা ছেয়ে ফেললেন পোস্টারে, পুরোদমে নির্বাচনী প্রচারে ব্যস্ত হয়ে গেলেন। কবিতা পড়ার কণ্ঠ স্লোগান দিতে দিতে বক্তৃতা করতে করতে ঘরে ঘরে গিয়ে ভোট চাইতে চাইতে ভেঙে টুকরো হয়ে গেল। গলায় কাগজের মালা পরে রিক্সায় দাঁড়িয়ে হাত দোলাতে দোলাতে পেছনে কুমীর মার্কার সমর্থক নিয়ে স্বতন্ত্র নেতা নির্মলেন্দু গুণ ঘুরে বেড়ালেন পুরো নেত্রকোণা। এতে অবশ্য তাঁর নির্বাচনের অভিজ্ঞতা হল অনেক, তবে ভোটে জেতা হয়নি। সাকুল্যে পাঁচটি ভোট পেয়েছিলেন।

শেখ মুজিবকে নিয়ে একমাত্র নির্মলেন্দু গুণই সবচেয়ে বেশি এবং সবচেয়ে হৃদয়স্পর্শী কবিতা লিখেছেন। যে আওয়ামি লীগ নির্মলেন্দু গুণের কবিতা ব্যবহার করে যে কোনও উৎসবে অনুষ্ঠানে, সেই আওয়ামি লীগ অনেক অগাবগাগাগরুছাগলকে প্রার্থী করেছে, নির্মলেন্দু গুণকে করেনি। শেখ মুজিবকে নিয়ে যখন কেউ কোনও কথা বলতে সাহস পায়নি, লেখালেখি তো দূরের কথা, সেই সময় গুণই কাউকে পরোয়া না করে কবিতা লিখে গেছেন এবং প্রকাশ্য সভায় প্রথম তিনিই নির্ভয়ে সেসব কবিতা পড়েছেন। ‘মুজিব মানে আর কিছু না, মুজিব মানে মুক্তি, পিতার সাথে সন্তানের না লেখা প্রেম চুক্তি। মুজিব মানে আর কিছু না, মুজিব মানে শক্তি, উন্নত শির বীর বাঙালির চিরকালের ভক্তি।’ গুণের কবিতা আওয়ামি লীগের খুব বড় সম্পদ। রেসকোর্সের ময়দানে একাত্তর সালের সাতই মার্চের ভাষণকে তিনি কবিতা আর মুজিবকে কবি বলে উল্লেখ করে লিখেছেন স্বাধীনতা শব্দটি কিভাবে আমাদের হল কবিতাটি। বিএনপি যখন দাবি করছে জিয়াউর রহমান ছিলেন স্বাধীনতার ঘোষক, তখন একাত্তরে মুজিবের মহান ভূমিকাকে বার বার স্মরণ করিয়ে দিতে চাইছে আওয়ামি লীগ, আপাদমস্তক মুজিবভক্ত কবি নির্মলেন্দু গুণকে নিজেদের সভা সমাবেশে ডেকে মুজিবকে নিয়ে লেখা কবিতাগুলো পড়িয়ে বেশ গর্বিত মুজিব কন্যা হাসিনা। গুণ তাঁর ভরাট কণ্ঠে পিন পতন নিস্তব্ধতার মধ্যে পড়েন, সমবেত সকলের মত আমিও গোলাপফুল খুব ভালবাসি/রেসকোর্স পার হয়ে যেতে সেইসব গোলাপের একটি গোলাপ /গতকাল কানে কানে আমাকে বলেছে/ আমি যেন কবিতায় শেখ মুজিবের কথা বলি/আমি তার কথা বলতে এসেছি। /সমকাল পার হয়ে যেতে সদ্যফোঁটা একটি পলাশ/ গতকাল কানে কানে আমাকে বলেছে /আমি যেন কবিতায় শেখ মুজিবের কথা বলি/ আমি তার কথা বলতে এসেছি।/ শাহবাগ এভিন্যূর ঘুর্ণায়িত জলের ঝর্ণাটি গতকাল/ আর্তস্বরে আমাকে বলেছে /আমি যেন কবিতায় মুজিবের কথা বলি/আমি তার কথা বলতে এসেছি।/ শহীদ মিনার থেকে খসে পড়া একটি রক্তাক্ত ইট/ গতকাল কানে কানে আমাকে বলেছে/ আমি যেন কবিতায় শেখ মুজিবের কথা বলি/ আমি তার কথা বলতে এসেছি।/ সমবেত সকলের মত আমারও স্বপ্নের প্রতি পক্ষপাত আছে /ভালবাসা আছে –গতকাল রাতে দেখা একটি সাহসী স্বপ্ন/ গতকাল কানে কানে আমাকে বলেছে আমি যেন/ কবিতায় শেখ মুজিবের কথা বলি/ আমি তার কথা বলতে এসেছি।/এই বটমূলে সমবেত মানুষগুলো সাক্ষী থাকুক/ না ফোটা কৃষ্ণচূড়ার অপ্রস্তুত প্রাণের এই গোপন মঞ্জুরিগুলি কান পেতে শুনুক/ বিষণ্ন বসন্তের এই কালো কোকিলটি জেনে যাক/ আমার পায়ের তলার পূন্য মাটি ছুঁয়ে/ আমি আজ সেই গোলাপের কথা রাখলাম/ সেই পলাশের কথা রাখলাম/ আমি আজ কারো রক্ত চাইতে আসিনি,/আমি আমার ভালবাসার কথা বলতে এসেছিলাম।

আওয়ামি লীগের সঙ্গে তার পরও নির্মলেন্দু গুণ সম্পর্ক নষ্ট করেননি। হাসিনার সঙ্গে তাঁর আগের মতই ভাল সম্পর্ক। হাসিনা বিরোধী দলের নেষনী হিসেবে মিন্টোরোডের সরকারি বাসভবনে ওঠার পর যেহেতু সরকারি দল থেকে বিশাল করে ইফতার পার্টির আয়োজন করেছে, তিনিও করেছেন আয়োজন। হাসিনার ইফতার পার্টিতে যাবার আমন্ত্রণ জোটে আমার। আমি আর গুণ ভরা পেটে হাসিনার দাওয়াত খেতে যাই। গুণের পকেটে একটি ডোভ ক্রিমের কৌটো, আমেরিকা থেকে আনা হাসিনার জন্য একটি উপহার। আমার খালি হাত, খালি পকেট, ভরা শুধু চোখ দুটো, রাজনৈতিক ইফতার দেখার কৌতূহলে। মিন্টো রোডের বাড়ির মাঠে বিশাল ত্রিপলের তলে চেয়ার টেবিল বসানো। মাইকে কোরান তেলোয়াত হচ্ছে। রোজদার আওয়ামী নেতারা সাইরেন পড়ার সঙ্গে সঙ্গে বিসমিল্লাহ বলে পানি মুখে দিয়ে রোজা ভাঙছেন। হাসিনা ঘোমটা মাথায় টেবিলে টেবিলে গিয়ে অতিথিদের সম্ভাষণ জানাচ্ছেন। আজ তিনি খবর করে দিচ্ছেন যে আওয়ামী লীগও বিএনপি বা জামাতে ইসলামীর মত ধর্মভীরু দল। ধর্মের সঙ্গে রাজনীতির এই মিশ্রণ আমি দেখতে থাকি বড় বেদনার্ত বড় ভীত চোখে।

ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধ ছিল এ দেশে, এখন সিদ্ধ। যে জামাতে ইসলামির খুনীরা দেশ স্বাধীন হওয়ার পর গর্তে লুকিয়েছিল, তারাই এখন এ দেশের সংসদের মহামান্য সদস্য। কি ভীষণ পাল্টো গেছে দিন! জামাতে ইসলামি আজ এই জায়গায় এসে পৌঁছোতে পারত না, যদি না তারা বিএনপি আর আওয়ামী লীগের আশকারা পেত। একাত্তরের গণহত্যাকারী গোলাম আযম বাংলাদেশে ফিরে জামাতে ইসলামির আমীর হয়ে বসেছেন। ঘাতক দালালরা এখন মাথা উঁচু করে এ দেশে চলাফেরা করে। একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি নামে একটি সংগঠন গড়ে তুলেছে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের কিছু মানুষ, জাহানারা ইমাম এই কমিটিতে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। একাত্তরের দিনগুলি নামে তিনি একটি স্মৃতিকথা লিখেছেন, ভয়াবহ সেই দিনগুলির বর্ণনা আছে বইয়ে। যুদ্ধে কী করে তিনি তাঁর স্বামী আর পুত্রকে হারিয়েছেন লিখেছেন। জাহানারা ইমামের বাড়িতে একদিন খোকা আমাকে নিয়ে গিয়েছিলেন। জাহানারা ইমাম তখন গোলাম আযমের শাস্তি হওয়ার পক্ষে জনগণের সই যোগাড় করছিলেন। আমাকেও দিয়েছিলেন সই যোগাড়ের দায়িত্ব। নির্মূল কমিটির উদ্যোগে সোহরোওয়ার্দী উদ্যানে যেদিন গণআদালত ডেকে গোলাম আযমের বিচার করা হয়, সেদিন হাজার হাজার দর্শকের মিছিলে আমিও ছিলাম। গণআদালতে গোলাম আযমের ফাঁসির রায় হল। কিন্তু ফাঁসি কে দেবে তাঁকে! সরকার পুলিশ লেলিয়ে দিয়েছে গণআদালত পণ্ড করতে। পুলিশ এসে স্বতস্ফূর্ত আন্দোলনের জনতাকে ছত্রভঙ্গ করে দিয়েছে, মাইক খুলে নিয়েছে, মঞ্চ ভেঙে ফেলেছে। গোলাম আযমকেও জেলে ভরা হয়েছে, নেহাতই লোক দেখানো জেল। পাকিস্তানি পাসপোর্টে এ দেশে ঢুকে ভিসার মেয়াদ ফুরিয়ে যাওয়ার পরও কেন থাকছেন— এই তুচ্ছ অপরাধের জন্য তাঁকে জেলে নেওয়া হয়েছে, কিন্তু একাত্তরের যুদ্ধের সময় যে তিনি পাকিস্তানি সামরিক জান্তার পক্ষ হয়ে হাজার হাজার বাঙালিকে খুন করেছেন তাঁর সেই অপরাধ নিয়ে সরকারের মুখ থেকে কোনও শব্দ বেরোচ্ছে না। আমার আশঙ্কা হয় পরিস্থিতি শান্ত হলে গোলাম আযমকে জেল থেকে আবার না মুক্তি দেওয়া হয়, গোলাম আযম এ দেশের নাগরিকত্বের জন্য যে আবেদন করেছেন, সেই নাগরিকত্ব না আবার তাঁকে দিয়ে দেওয়া হয়। এই দেশটি দেখতে তখন কেমন হবে! আদৌ কি বাসযোগ্য হবে! ধর্ম যেরকম প্রধান অঙ্গ হয়ে উঠছে রাজনীতির, আমার আশঙ্কা হয় ধীরে ধীরে জামাতে ইসলামির হাতেই না চলে যায় রাষ্ট্রক্ষমতা একদিন!

শান্তিবাগে কুলসুম ফিরে এসেছে। পালিয়ে সে বেশিদূর যেতে পারেনি। যদিও তার ইচ্ছে ছিল ময়মনসিংহে তাদের গ্রামের বাড়িতে চলে যাওয়ার, ওখানে তার মাকে আর বোনকে নিয়ে জীবন যাপন করার, সেই স্বপ্নটি সফল হয়নি কুলসুমের। শান্তিবাগেই এক বাড়িতে সে কিছুদিন কাজ করেছে, ওখানে অশান্তি এমন বেশি যে ও বাড়ি থেকে পালিয়ে আবার আমার বাড়িতেই এসে থেমেছে। কুলসুম তেরো চৌদ্দ বছরের কিশোরী। এ বয়সেই পাঁচবেলা নামাজ পড়ে, সবগুলো রোজা রাখে, মাথা থেকে ওড়না সরতে দেয় না। পীর বাড়িতে অনেকদিন কাজ করেছে, ওখান থেকেই মাথায় আবর্জনা ভরে এনেছে সে। একদিন কুলসুমকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, ‘এই যে নামাজ রোজা করস, কী লাভ!’

কুলসুম ঘর মুছছিল, বালতির পানিতে নোংরা ত্যানা ধুয়ে চিপে আবার মেঝেয় ফেলে মুছতে মুছতে বলে, ‘বেহেস্তে যাইতে পারব।’

‘বেহেস্তে কী আছে?’ আমি জিজ্ঞেস করি।

কুলসুম ঘর মোছা থামিয়ে মিষ্টি করে হাসে। চোখের তারাদুটো ঝিলমিল করছে ওর। বলল, ‘বেহেস্তে মাছের কলিজা খাইতে দিব আল্লাহ।’

আমি বলি, ‘মাছের কলিজা? তর মাছের কলিজা খাইতে ইচ্ছ! করতাছে? যা, তরে মাছের কলিজা খাওয়াবো। শান্তিনগর বাজার থেইকা কালকেই আমি মাছের কলিজা কিন্যা আনব।’ কুলসুমের নাক কুঁচকে ওঠে, ঠোঁট বেঁকে থাকে, কপালে ভুরুতে ভাঁজ পড়ে বাজারের মাছের কলিজার কথা শুনে।

‘মাছের কলিজা তো তর খাইলেই হইল। এহন নামাজ রোজা বাদ দিয়া দে। মাথার কাপড় ফালা। এই গরমের মধ্যে মাথায় যে কাপড় দিয়া রাখস, আরও তো গরম লাগে। মাছের কলিজা..’

কুলসুম ওড়নাটিকে টেনে মাথার ওপর আরও বেশি করে এনে বলে, ‘দুনিয়ার মাছের কলিজা তিতা, বেহেস্তের মাছের কলিজা মিষ্টি।’

আমি হো হো করে হেসে উঠি। আমার হাসির দিকে কুলসুম বিরক্ত দৃষ্টি ছুঁড়ে বেরিয়ে যায়। আমাকে পাগল ভাবে নয়ত বোকার হদ্দ ভাবে।
 
১৪. পেষণ



পূর্বাভাস পত্রিকা আপিসে হামলা হয়েছে, রাতের অন্ধকারে এক দল দুর্বৃত্ত আপিসে ঢুকে জিনিসপত্র ভেঙে চুরে সব তছনছ করে গেছে। এর কারণ আমার লেখা। আমার লেখা পছন্দ হচ্ছে না অনেকের। ধর্মীয় মৌলবাদীরা পূর্বাভাস পত্রিকার সম্পাদকের বিরুদ্ধে মামলাও করেছে। একদিন গিয়ে দেখে আসি আপিসের দুরবস্থা। খুব মন খারাপ হয়ে যায়। এত মন খারাপ হয় যে লেখালেখি ছেড়ে দেবার কথা ভাবি। ডাক্তারি করছি, হাসপাতালে চাকরি করে বাড়তি সময় যা থাকে সে সময়ে একটি প্রাইভেট ক্লিনিকে কাজ করলে দিব্যি সংসার চালিয়ে নিতে পারব। সিদ্ধান্তটি নিয়ে আমি লেখা বন্ধ করে দিই। কিন্তু মোজাম্মেল বাবু তা মানবে না, পূর্বাভাসের জন্য লেখা সে চেয়েই যাচ্ছে। জরুরি তলব করল, দেখা করতে গেলে সেই এক কথা, ‘আপা আপনি লেখা বন্ধ করলে চলবে নাকি? লেখেন। আজকেই একটা লেখা দেন।’

হুমায়ুন আজাদ ফোন করেছেন তখন। তিনিও কলাম লেখেন পূর্বাভাসে। বাবু তাঁকে জানাল যে আমি লেখালেখি ছেড়ে দিয়েছি। শুনে তিনি কথা বলতে চাইলেন আমার সঙ্গে, আমার সিদ্ধান্ত শুনে বললেন, ‘ লেখা ছাড়বেন না, আপনার লেখা খুব ভাল হচ্ছে। লেখা চালিয়ে যান, কিছু দুষ্ট লোক কি করল কি বলল তা নিয়ে মোটেও ভাববেন না।’

হুমায়ুন আজাদের মত আরও অনেকেই উপদেশ দেন, পত্রিকায় লেখা আবার শুরু করার উপদেশ। কেউ কেউ বলেন, ধর্ম সম্পর্কে অত কড়া কথা না লিখলে কোনও অসুবিধে হবে না।

আমি লিখতে শুরু করি, কারণ না লিখে পারি না বলে। কয়েকদিন না লিখে দেখি ভেতরে কথা জমে জমে পাহাড় হয়ে আছে। হুমায়ুন আজাদ পূর্বাভাসে নতুন ধরণের কলাম লেখা শুরু করেছেন, রাজনীতি সমাজ ইত্যাদি নিয়ে কৌতুক করা হুমায়ুন আজাদ এখন নারী নিয়ে লিখছেন, না, আগে যেমন তিনি নারীর বদনাম গেয়ে প্রবচন রচনা করেছিলেন, তেমন নয়, এবারের লেখা নারীর গুণ গেয়ে। হুমায়ুন আজাদের লেখা আমার তখনও পড়া হয়নি, কিন্তু যেদিন নির্মলেন্দু গুণ আমাকে বললেন ‘হুমায়ুন আজাদ জনপ্রিয় হতে চাইছেন, তাই তোমার লেখা নকল করে তিনিও লিখতে শুরু করেছেন,’ পড়ে ঠিকই দেখি যে যে কথা আমি অনেক আগেই বলেছি, সে কথাগুলোই তিনি লিখছেন নতুন করে, তিনি বহু বই ঘেঁটে উদাহরণ দিচ্ছেন, আমি কোনও বই না ঘেঁটে মনে যা ছিল তাই লিখেছি, এই যা তফাৎ।

বইমেলা শুরু হচ্ছে। এবারের মেলায় আমার কয়েকটি বই প্রকাশ পাচ্ছে। কবিতার বই, কলামের বই, উপন্যাস। ফজলুল আলম আমার কবিতার ইংরেজিতে অনুবাদ করে লাইট আপ অ্যাট মিডনাইট নামের একটি পাণ্ডুলিপি তৈরি করেছেন। বইটি কে প্রকাশ করবে? এগিয়ে এলেন বিদ্যাপ্রকাশ। ফজলুল আলমের সঙ্গে প্রথম পরিচয় আমার আরমানিটোলার বাড়িতে। ও বাড়িতেই আমাকে অবাক করে দিয়ে ফরিদুর রেজা সাগর তাঁর লন্ডনপ্রবাসী কাকাকে নিয়ে উপস্থিত হয়েছিলেন। সাগরের বহুমুখী প্রতিভা। লেখিকা রাবেয়া খাতুনের গুণধর পুত্র তিনি। তিনি নিজেও সাহিত্যিক। বাচ্চাদের জন্য অনেকগুলো বই লিখেছেন। টেলিভিশনে বাচ্চাদের অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন। ব্যবসাতেও সাফল্য তাঁর অনেক। গার্মেন্টস ফ্যাক্টরির মালিক। আজকের কাগজ, খবরের কাগজেরও আধখানা মালিক হয়েছেন। এমনিতে সাগরকে সাহিত্যের আড্ডায় মোটেও দেখা যায় না। তিনি থাকেন তাঁর ব্যবসা নিয়ে। স্টেডিয়ামের কাছে খাবার দাবার নামে খুব ভাল একটি রেস্তোরাঁ আছে তাঁর। পাঁচবেলা নামাজ পড়েন সাগর, শান্তিনগরে তাঁর বিরাট আপিসে একটি নামাজের ঘর করে নিয়েছেন। রোজার মাসে তিরিশটা রোজা রাখেন। নিভৃতে লেখেন। নিভৃতে ছাপেন। ব্যস্ত লোক। ব্যস্ত লোকই তাঁর দুলাল কাককুর আবদারে আমার সঙ্গে দেখা করাতে এনেছেন, খুঁজে খুঁজে আরমানিটোলায়। দেশে বেড়াতে এসে ফজলুল আলমের প্রথম কথাই ছিল আমার সঙ্গে পরিচিত হবেন। লন্ডনে বসে কাগজে আমার কলাম পড়েই তাঁর এই আবেগ। একবার আমার সঙ্গে দেখা না করে তিনি যাবেন না। ফজলুল আলম আমুদে লোক। স্পষ্টভাষী, সৎ, কোদালকে যার তার সামনে কোদাল বলতে দ্বিধা করেন না, এতে লোকের মন খারাপ হলে হোক। লোকটি দেখতে বালুর বস্তার মত, কানে কম শোনেন, চেঁচিয়ে কথা বলেন, অল্প কিছুতেই ঠা ঠা করে হাসেন। সাগরের সঙ্গে আমার আগেই পরিচয় ছিল, তাঁর বাড়িতে অনেকদিন নেমন্তন্ন খেতে গিয়েছি, কেবল নেমন্তন্ন খেতে নয়, মন ভাল না থাকলে অনেকদিনই চলে গিয়েছি সাগরের বাড়িতে। সাগর না থাক, সাগরের স্ত্রী আছেন, তাঁর মা আছেন, তাঁদের সঙ্গে কথা বলেছি। সাগরের মা রাবেয়া খাতুন আমাকে ডেকে সাহিত্য নিয়ে কথা বলেছেন, লেখালেখির প্রসঙ্গ এলে আমি মনের কথাটি বলে দিই সবাইকে যে কি করে লিখতে হয় আমি জানি না, যা লিখি আদৌ কোনও লেখা হয় বলে মনে হয় না, কি করে উপন্যাস লিখতে হয় তাঁর কাছে জানতে চেয়েছিলাম, মৃদুভাষী রাবেয়া খাতুন আমাকে বলেছেন খুব কনসেনট্রেশন লাগে। এই জিনিসটিই যে আমার নেই আমি নির্দ্বিধায় তা স্বীকার করেছি। তাঁর বাবা কি করে তাঁর মাকে ছেড়ে চলে গেছেন, কি করে সংসারটির দৈন্যদশা তিনি ঘুচিয়েছেন, কি করে তিনি একটি নির্যাতিতা মেয়েকে মৃত্যুর হাত থেকে উদ্ধার করে বিয়ে করেছেন, সাগর আমাকে সব কথা খুব বন্ধু মনে করে বলেন। সাগরদের বাড়ির সবাইকে আমার খুব আপন মনে হয়। এই আপন পরিবারটির আপন লোক ফজলুল আলমও আমার খুব আপন হয়ে ওঠেন। ফজলুল আলম নিজে লন্ডনের বাংলা পত্রিকায় লেখালেখি করছেন অনেকদিন থেকে, খবরের কাগজেও লিখেছেন কলাম। আমিই তাঁকে একদিন বলি লেখাগুলো জড়ো করে একটি বই বের করতে। তিনি খুব উৎসাহে লেখা জড়ো করলেন। নাম দিলেন বইয়ের। এবার আমার দায়িত্ব প্রকাশক খোঁজা। আমার তো এক খোকাই আছেন অনুরোধ করার। তিনি, তত নাম নেই লেখক হিসেবে, এমন লোকের বই ছাপবেন কেন! আমার অনুরোধে ঢেঁকিটি গিললেন শেষ অবদি। বইয়ের পঈচ্ছদ আমি নিজে এঁকে দিলাম। ফজলুল আলমের খুশি দেখে কে! তিনি লন্ডনে যাওয়া পিছিয়ে দিলেন অথবা গিয়েও আবার ফিরে এলেন দেশে। এবারের বই মেলায় তাঁর বই থাকছে, তিনি কি না থেকে পারেন!

বই মেলা শুরু হয়ে গেল। পুরো ফেব্রুয়ারি মাস জুড়ে বইমেলা। বইমেলার মাসটি লেখকদের মাস। লেখকেরা সারা বছর এই মাসটির অপেক্ষায় বসে থাকেন। রাষ্ট্রভাষা বাংলা করার দাবি নিয়ে আন্দোলন করতে গিয়ে রফিক সালাম বরকত এ মাসে প্রাণ দিয়েছিলেন। এ মাসটি বাংলা ভাষার মাস। বাংলা সাহিত্যের, বাংলা গানের উৎসব। মেলায় সাহিত্যিক বিষয় নিয়ে ধুম আড্ডা হচ্ছে। বিরানব্বই সালের ফেব্রুয়ারিতে আমার আনন্দও কম নয়। আমার একাধিক বই মেলায় এসেছে, তার ওপর বিক্রি হচ্ছে খুব, মেলাতেই প্রথম মুদ্রণ শেষ, দ্বিতীয় মুদ্রণের জন্য প্রকাশক ছাপাখানায় দৌড়োচ্ছেন। খবর বেরোচ্ছে, ‘হুমায়ুন আহমেদ, ইমদাদুল হক মিলন আর তসলিমা নাসরিন এই তিনজনের বই বিক্রির শীর্ষ তালিকায়।’ ইমদাদুল হক মিলন অনেক আগে থেকেই জনপ্রিয় লেখক। হুমায়ুন আহমেদ তাঁর নন্দিত নরকে লিখে বাংলা একাডেমি পুরস্কার পেয়ে চলে গিয়েছিলেন আমেরিকায়। ওখান থেকে দেশে ফিরে নতুন করে লেখালেখি শুরু করলেন। মাত্র বছর কয় আগেও দেখেছি বুকের ওপর দুহাত আড়াআড়ি রেখে একা একা হাঁটছেন মেলায়। হুমায়ুন আহমেদের সঙ্গে তখনই আলাপ। তাঁকে যেদিন আমি বর্ণনা করেছি তাঁর লেখা আমরা ভাই বোনেরা কি করে পড়তাম বাড়িতে, একজন সশব্দে পড়েছে, বাকিরা শুনেছে —শুনে তিনি খুব আনন্দ পেলেন। বললেন তাঁর বাড়িতেও ওভাবে বই পড়া হত। ময়মনসিংহে মোহনগঞ্জে বড় হয়েছেন হুমায়ুন আহমেদ, কথা বলায় ময়মনসিংহের টান আছে। এরপর থেকে মেলায় এসে তিনি আমাকে খুঁজে বের করে পুরোনো দিনের গল্প বলতেন। আমাকে ডাকতেন কবি বলে। কবির খবর কি আজ? কবি চলেন চা খাই। গল্প বলতে তিনি এত চমৎকার পারেন যে তার শ্রোতা হয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকা যায়। আমার খুব ভাল লাগত হুমায়ুনের আহমেদের গল্প শুনতে, তিনি খুব চেনা জীবনের গল্প বলেন। নিজের কথাই বলেন, নিজের ভাই বোনের কথা বলেন, পাশের বাড়ির লোকের কথা বলেন, মফস্বলের এইসব মধ্যবিত্ত মানুষের সুখ দুঃখ নিয়ে কথা শুনে মনে হত চোখের সামনে দেখছি তাদের, যেন আমারই আত্মীয় স্বজন তারা। টেলিভিশনে যখন তাঁর নাটক সবে প্রচার হতে শুরু হল তিনি নাটকের রাতে বন্ধু বান্ধবদের ডাকতেন একসঙ্গে বসে নাটক দেখার জন্য। হুমায়ুন আহমেদ তখন আজিমপুরের ছোট একটি অ্যাপার্টমেণ্টে থাকতেন। সেখানে আমি আর নির্মলেন্দু গুণ তাঁর একা নাটকটি দেখেছিলাম। নাটকটি প্রচার হওয়ার আগে হুমায়ুন আহমেদ অস্থির হয়ে পায়চারি করছেন ঘরময়। তাঁর নাকি এরকমই হয় নাটকের আগে, খুব টেনশন হয়। অতি সাধারণ জীবন যাপন হুমায়ুন আহমেদের। আমেরিকায় অনেক বছর থেকে এসেছেন, তারপরও মনে হয় গ্রাম থেকে মাত্র শহরে এসে উঠেছেন। পাড়ার হিমু ভাইএর মত তিনি, উদাসীন, পড়ুয়া, জমিয়ে গপ্প করা, কারও সাতে নেই পাঁচে নেই, তরতর করে একা একা সিঁড়ি পেরোচ্ছেন। হিমু ভাইএর মত সত্যি সত্যি অনেক সিঁড়ি চোখের সামনে পার হয়ে গেলেন হুমায়ুন আহমেদ। এখন তাঁর সঙ্গে খুব একটা দেখা সাক্ষাৎ হয় না আর, কারণ তাঁর জনপ্রিয়তা। টেলিভিশনের নাটক তাঁকে এমন গগনচুম্বী জনপ্রিয়তা দিয়েছে যে এখন তিনি আর মেলায় একা একা হাঁটার লেখক নন। যতক্ষণ মেলায় থাকেন, ততক্ষণই তিনি অদৃশ্য হয়ে থাকে অটোগ্রাফ শিকারিরা আড়ালে। আমি যখন কলাম লিখছি কাগজে তখন একবার হুমায়ুন আহমেদ আমাকে ডেকে বলেছিলেন যে কলামগুলো পড়লে তাঁর তিন কন্যার জন্য খুব দুশ্চিন্তা হয় তাঁর, মেয়েদের জীবন যে ভয়াবহ রকমের নিরাপত্তাহীন তা তিনি অনুভব করতে পারছেন আগের চেয়ে বেশি করে। হুমায়ুন আহমেদের লেখার আমি শুরু থেকেই ভক্ত। অনেকে বলে তাঁর লেখা কালজয়ী নয়, উপন্যাসগুলো হালকা, চরিত্রগুলো পলকা, যে যাই বলুক আমার মনে হয় তিনি মানুষের হৃদয় স্পর্শ করতে পেরেছেন তাঁর লেখা দিয়ে। এই কাজটি সহজ কাজ নয়। তাঁর তীক্ষ্ম পর্যবেক্ষণের চোখ জানে পাঠকরা কি চায়, তিনি পাঠকের চাওয়া মেটাচ্ছেন। যারা কখনও বই পড়েনি বা পড়তে চায়নি, তারা আর কারও বই না পড়লেও তাঁর বই পড়ে। তাঁর সবচেয়ে বড় গুণ, তিনি প্রচুর পাঠক তৈরি করছেন।

বইমেলায় বিদ্যাপ্রকাশের স্টলে প্রতি বিকেলে আমাকে বসার জন্য অনুরোধ করেন খোকা। অন্য প্রকাশকরাও তাদের স্টলে আমাকে অন্তত কিছুক্ষণের জন্য হলেও বসার আবদার করেন। কোথাও আমার বসে থাকতে ইচ্ছে করে না দীর্ঘক্ষণ। ইচ্ছে করে মেলায় হাঁটতে, মানুষ দেখতে, লেখক বন্ধুদের সঙ্গে মেলার দোকানে গিয়ে চা খেতে খেতে আড্ডা দিতে। কিন্তু খোকার অনুরোধে আমাকে দীর্ঘক্ষণ বসে থাকতে হয় তাঁর স্টলে। ক্রেতারা বই কিনে সই নিতে চায়, সই দিতে হয় বসে বসে। অনেকে বই হাতে নিয়ে নেড়ে চেড়ে দাম দেখে চলে যায়, পকেটে পয়সা নেই বলে কিনতে পারে না। ইচ্ছে করে বিনে পয়সায় তাদের দিয়ে দিই বই। কয়েকজনকে এমন দিই, খোকা ‘করছেন কি করছেন কিঞ্চ দৃষ্টি ছুঁড়ে দিলে বলি, ‘এটা আমার সৌজন্য কপির পাওনা বই থেকে দিলাম।’ টাকার সঙ্গে বইএর সম্পর্কটি বড় অস্বস্তিতে ফেলে আমাকে। খোকা বলেন, ‘এত দিলদরিয়া হলে চলবে নাকি! আপনি এখন প্রফেশনাল লেখক।’

‘কি যে বলছেন! আমি ভাই ডাক্তারি করি, সেটা আমার প্রফেশন। লেখা আমার হবি।’ খোকা তা মানেন না। বই বেচেই তিনি সংসার চালান। স্টলে খোকা আছেন বউ, শালি শালা সব নিয়ে। উত্তেজিত ফজলুল আলম বারবার স্টলে এসে খবর নিচ্ছেন তাঁর বই আদৌ কেউ কিনেছে কী না। পরিচিত কাউকে পেলে ধরে ধরে নিজের বই দেখাতে নিয়ে আসছেন। হুমায়ুন আজাদকে নিয়ে এলেন একবার। হুমায়ুন আজাদ লাইট আপ এ্যাট মিডনাইট বইটি উল্টোপাল্টো দেখে বললেন, সেই কবিতাটি নেই, ‘সাত সকালে খড় কুড়োতে গিয়ে আমার ঝুড়ি উপচে গেছে ফুলে!’ ফজলুল আলম বললেন, না নেই।’ হুমায়ুন আজাদ বললেন, ‘তা থাকবে কেন! ভাল কবিতা থাকবে কেন!’

আমি হেসে বলি, ‘আমার কবিতা বুঝি ভাল!’

আজাদ আকর্ণবিস্তৃত হাসি হেসে বললেন, ‘নিশ্চয়ই। আপনার অনেক কবিতাই আমার ভাল লাগে।’

আমি বলি, ‘তবে যে সেদিন পত্রিকায় সাক্ষাৎকার দিলেন, আমি নাকি কবিই নই, আমার কলাম আপনি পড়েন না, কারণ কলামগুলো বালক বালিকারা পড়তে পারে!’ হুমায়ুন আজাদ কোনও উত্তর না দিয়ে বিদেয় নিলেন। হাসিটি তখন তেমন আর বিμছুর মত লেগে ছিল না মুখে। এই হুমায়ুন আজাদই খবরের কাগজে আমার লেখা জনপ্রিয় হওয়ায় ক্ষেপে আগুন হয়ে গিয়েছিলেন। এই হুমায়ুন আজাদই পূর্বাভাস আপিসে ফোনে আমাকে বলেছেন আমার কলাম তাঁর ভাল লাগে। হুমায়ুন আজাদকে আমার নিতান্তই বালক বলে মনে হয়। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, গবেষক, অত্যন্ত জ্ঞানী লোক, খুব ভাল লেখেন, তাঁর কবিতা, তাঁর গদ্য অত্যন্ত উন্নতমানের। কিন্তু এত গুণের অধিকারী হয়েও তিনি উদ্ভট উদ্ভট সব কাণ্ড করেন। অনেকে বলে এসব নিতান্তই তাঁর স্টান্টবাজি, লোকের নজরে পড়তে চান, তাই এসব করেন। তিনি গালাগাল দিয়ে বেড়ান সব লেখকদের, কবিদের। কিছু চেলা চামুণ্ডা নিয়ে মেলায় হাঁটেন, চেলারা উঠতে বসতে তাঁর প্রশংসা করেন। তিনি বেজায় রকম উপভোগ করেন এসব।

ফজলুল আলম লন্ডনি কায়দায় চলা লোক, ঠিক খাপ খাওয়াতে পারেন না এই মেলায়। আমার লেজ হয়ে থাকতে চান, আমি বসলে তিনি বসেন, দাঁড়ালে তিনি দাঁড়ান। আমি যেদিকে যাই, তিনি সেদিকে যান। আমি স্টলে এসে বসব, তিনিও স্টলে এসে বসবেন, আমি চা খেতে যাবো, তিনিও চা খেতে যাবেন। দেখে আমার রাগ হয়, বলি, ‘দুলাল কাককু, আপনি কি একা ঘুরে বেড়াতে পারেন না!’ ফজলুল আলম মন খারাপ করে আমার সঙ্গ ছাড়েন। মেলায় একা একা হাঁটেন অগত্যা। এদিকে তাঁর বইও বিক্রি হচ্ছে না যে মনে একটু সুখ পাবেন। মেলায় কোনও বন্ধু বা চেনা কাউকে খুঁজে পান না যার সঙ্গে কথা বলবেন। আমারও সময় নেই তাঁকে সময় দেওয়ার। কানে কম শোনেন বলে যে কোনও কথার উত্তর চেঁচিয়ে দেন, সেটি আরও বিরক্তিকর। বইমেলা শুরু হওয়ার আগে ফজলুল আলম আমাকে একবার নিয়ে গিয়েছিলেন এনায়েতুল্লাহ খানের বাড়ির পার্টিতে। আমার মোটেও ভাল লাগেনি বাড়িটিতে। কাউকেও আন্তরিক মনে হয়নি। ধনী স্বামীদের সঙ্গে সুন্দরী স্ত্রীরা ভয়াবহ রকম সেজে পার্টিতে এসে মদ খাচ্ছিলেন আর নিজেদের পরিচয় দিচ্ছিলেন মিসেস শাহাবুদ্দিন মিসেস আলম বলে বলে। কোনও মেয়েকেই দেখিনি যার নিজের কোনও পরিচয় আছে। আমার কাছে অদ্ভুত লাগছিল সবকিছু। টাকা পয়সা, ধন দৌলত, বাড়ি গাড়ি, ইত্যাদি ছাড়া আর কিছু নিয়েই আলোচনা হচ্ছিল না। জমজমাট পার্টি পেছনে ফেলে বেরিয়ে এসেছিলাম। এরপর ফজলুল আলমের ওপর আমার আরও একবার রাগ হয়েছিল। আমি ময়মনসিংহে যাবো বলে তিনি সাগরের গাড়ি নিয়ে রওনা হলেন আমাকে নিয়ে কিন্তু এত দ্রুত গতিতে গাড়ি চালাচ্ছিলেন যে যে কোনও সময় দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পারত। লণ্ডনে যে গতিতে তিনি গাড়ি চালান, একই গতি বাংলাদেশেও দিয়ে বসে আছেন। চিৎকার করেছি, যেন তিনি ধীরে চালান গাড়ি। কিন্তু ধীরে কি করে গাড়ি চালাতে হয় তা তিনি জানেন না, এককালে জানলেও ভুলে গেছেন। তিনি ভ্যাবাচাক্যা খেয়ে যাচ্ছেন, ধাককা ট্রাকের সঙ্গে লাগে, গরু গাড়ির সঙ্গে, রিক্সার সঙ্গে, বাসের সঙ্গে, এমনকী মানুষের সঙ্গেও লাগে লাগে।

সেদিন সতেরোই ফেব্রুয়ারির সন্ধেবেলা। মেলায় একটি চাপা উত্তেজনার গন্ধ পাওয়া যায়। উত্তেজনা কেন, কিসের জন্য, আমার জানা হয় না কিছু। বিশাল একটি ব্যানার নিয়ে একটি মিছিল বিদ্যাপ্রকাশের সামনে দিয়ে পার হয়ে গেল। মেলার মধ্যে ব্যানার নিয়ে মিছিল! এ আবার কেমন! এমন তো দেখিনি আগে কোনওদিন! কি সেই মিছিল কেন সেই মিছিল প্রশ্ন করে কারও কাছ থেকে উত্তর পাওয়া যায় না। হঠাৎ দেখি খোকা টেবিল থেকে আমার বইগুলো দ্রুত তুলে ফেলছেন, বইয়ের তাক থেকে খোকার শালা আমার বই নামিয়ে নিচ্ছেন। তখনই হঠাৎ মুহম্মদ নূরুল হুদা আর রফিক আজাদ আমাকে বের করে নিলেন স্টল থেকে। আমাকে নিয়ে বাংলা একাডেমির মূল দালানের ভেতর ঢুকে গেলেন। একেবারে মহাপরিচালকের ঘরে। ঘটনা কি! ঘটনা যা জানা গেল, তা হল, আমার বিরুদ্ধে মেলায় মিছিল বের হয়েছে। তসলিমা নাসরিন পেষণ কমিটি এই মিছিলটি করছে, যৌন-লেখিকা তসলিমাকে পিষে মারার জন্য এই মিছিল। মেলার বইয়ের স্টলগুলোয় কমিটির লোকেরা হুমকি দিয়ে এসেছে আমার বই যেন না রাখা হয় কোথাও। রাখলে ওরা স্টল ভেঙে ফেলবে নয়তো পুড়িয়ে ফেলবে। সঙ্গে সঙ্গে আমার বই যে স্টলগুলোয় ছিল, সরিয়ে ফেলা হল। আমি স্তম্ভিত বসে থাকি। ঘরে আরও লেখক বসা ছিলেন। ফজলুল আলমও উঠে এসেছিলেন আমার পেছন পেছন। আশঙ্কায় তাঁর মুখ চোখ সব গোল গোল হয়ে আছে। মহাপরিচালকের ঘরে এই নিয়েই আলোচনা হচ্ছিল। মিছিল কেন হয়েছে, কারা করেছে, মেলার অস্থিরতা কি করে বন্ধ করা যায়। ব্যানারে কী লেখা এই নিয়ে ফিসফিস চলছে লেখকদের মধ্যে। মহাপরিচালক হঠাৎ আমাকে প্রশ্ন করলেন, ‘কেন এই মিছিল হচ্ছে? আপনার বিরুদ্ধে অভিযোগ কি ওদের?’

‘তা তো আমি জানি না কি অভিযোগ।’ আমি বলি।

মহাপরিচালক গম্ভীর কণ্ঠে বলেন, ‘খুব অশ্লীল কথা লেখা আছে ব্যানারে। কি মনে হয় আপনার, কেন এসব করছে ওরা?’

‘সম্ভবত আমার লেখার কারণে।’

‘লেখে তো অনেকেই। এই যে এখানে যত লেখক আছেন, সকলেই বই লেখেন। তাঁদের বিরুদ্ধে তো মেলায় মিছিল হয় না। আপনার বিরুদ্ধে হয় কেন?’

ফজলুল আলমের কণ্ঠস্বর উঁচুতে উঠল, ‘হয় কেন মানে? উনি কি করে জানবেন হয় কেন! যারা হওয়ায় তারা জানে, কেন। আর তসলিমা নাসরিনের লেখা সকলে গ্রহণ করতে যাবে কেন! তাঁর লেখা তো আর সবার মত আপোসের লেখা না!’

গুঞ্জন ওঠে লেখকদের মধ্যে। তবে কি তিনি তাঁদের বলছেন আপোস করে লেখেন তাঁরা। গুঞ্জন থামিয়ে মহাপরিচালক ভুরু কুঁচকে চাইলেন আমার দিকে, আমাকে বললেন, ‘মেয়ে হয়ে আপনি পুরুষের মত লিখতে যান কেন? সে কারণেই তো ঝামেলা হচ্ছে।’

আমি ঝটিতে উত্তর দিই, ‘আমি পুরুষের মত লিখব কেন! আমি আমার মত করে লিখি।’ বসে থাকা লেখকরা একটু নড়ে চড়ে বসেন।

‘সবাইকে সব কিছু মানায় না। তা কি বুঝতে পারেন না?’ মহাপরিচালকের ঠোঁটের কোণে একটি হাসি ঝিকমিক করে। লেখকদের নিঃশ্বাসের টানে কিছু ঝিকমিক তাঁদের ঠোঁটের কোণেও আশ্রয় নেয়।

‘আপনার লেখা আমি পড়েছি। কোনও মেয়ে কি আপনি যে ভাষায় লেখেন, সে ভাষায় লেখে?’

আমি চুপ।

‘না, লেখে না।’

মহাপরিচালকের মন্তব্যে লেখকদের মাথাও নড়ে, না লেখে না।

আমার চোয়াল শক্ত হচ্ছে।

‘আপনার লেখা খুব অশ্লীল।’

এবার দাঁতে দাঁত চেপে মেয়ে বলে, ‘আমার লেখা — কারও কাছে তা অশ্লীল মনে হয়, কারও কাছে মনে হয় না।’

মুহম্মদ নূরুল হুদা বাইরে গিয়ে মাইকে ঘোষণা দিয়ে আসেন যে মেলার মধ্যে কোনও মিছিল যেন না হয়, এতে মেলার পরিবেশ নষ্ট হয়। কারও যদি কোনও অভিযোগ থেকে থাকে তবে যেন তা মেলা কমিটির সদস্যদের জানানো হয়। শান্ত হতে বলেন তিনি মিছিলের জনতাকে।

আগুন আগুন বলে একটি রব ওঠে মেলায়। ঘরে বসা লোকগুলোর কেউ কেউ জানালার দিকে ছুটে যান ঘটনা দেখতে। বই পোড়ানো হচ্ছে মেলার মাঠে। আমার বই মিছিলের লোকেরা যে যেখানে পেয়েছে মাঠের মাঝখানে জড়ো করে পুড়িয়ে দিয়েছে।

খোকা দাঁড়িয়ে আছেন মহাপরিচালক হারুন উর রশীদের ঘরের বারান্দায়। আমি উঠে যাই খোকার কাছে। খোকা ঘটনার আকস্মিকতায় বিমূঢ় হয়ে আছেন, ঘামছেন তিনি। চোয়াল খোকারও শক্ত হয়ে আছে।

‘কারা এই মিছিল করছে খোকা ভাই? জানেন কিছু?’

খোকা মাথা নাড়লেন। তিনি জানেন না।

মহাপরিচালক মেলাকমিটির সদস্য বাংলা একাডেমির উপপরিচালকদের সঙ্গে আলোচনা করে আমাকে জানালেন, ‘আপনি মেলায় না এলে ভাল হয়।’

‘এ কেমন কথা, কেন আমি আসব না?’

ফজলুল আলম বলে ওঠেন, ‘কেন তিনি আসবেন না? তাঁর কি দোষ?’

‘উনি এলে মেলায় গণ্ডগোল হয়, তাই তিনি আসবেন না।’

জানিয়ে দিলেন, মেলায় যদি আমার ওপর কোনও আক্রমণ হয়, সেই দায়িত্ব মেলা কমিটি নিতে পারবে না। সুতরাং আমার নিরাপত্তার জন্য বইমেলায় আমার না আসাই ভাল। আমার জন্য মেলার পরিবেশ নষ্ট হোক, মেলা পণ্ড হয়ে যাক, তা তাঁরা চান না।

ফজলুল আলম চোখ কপালে তুলে বলেন, ‘আপনারা মেলা কমিটির লোক, আপনারা তার নিরাপত্তার ব্যবস্থা করেন।’

ফজলুল আলমের দিকে ভুরু কুঁচকে তাকান মহাপরিচালক। চোখের ভুরুতে প্রশ্ন, লোকটি কে এখানে চিৎকার করছে! একে তো চিনি না!

কিছু ছেলে আমার বিরুদ্ধে মিছিল করছে বলে আমার মেলায় আসা বন্ধ হবে কেন! অনেকে তো আমার লেখা পছন্দ করে, তারা ..

আমার কোনও যুক্তিই মহাপরিচালক মেনে নেন না। মীমাংসা শেষ অবদি কিছুই হয় না। মহাপরিচালক তাঁর বক্তব্যে স্থির থাকেন। তাঁর পরামর্শ আমার আর মেলায় আসা উচিত নয়। যেহেতু আমি মেয়ে হয়ে পুরুষের মত লিখি, যেহেতু আমি অশ্লীল লেখা লিখি, যেহেতু আমার লেখা আদৌ কোনও ভাল লেখা নয়, সেহেতু আমার বিরুদ্ধে মেলায় মিছিল বের হওয়া অস্বাভাবিক কিছু নয়, আমাকে লোকে পেষণ করতে চাইবে, এও অবাক করা কোনও ব্যপার নয়। সুতরাং আমি যেন মেলা থেকে দূরে থাকি, এ যত না আমার নিরাপত্তার জন্য, তার চেয়ে বেশি মেলার সুষ্ঠু পরিবেশ রক্ষার জন্য।

পুলিশের ভ্যানে তুলে দিয়ে আমাকে বাড়ি পাঠিয়ে দেওয়া হয়।

মেলা জমজমাট। আমার মেলায় যাওয়া নিষেধ। লেখা নিয়ে মানুষের ক্ষোভ আমি দেখেছি। গতবারের মেলায় এক দল ছেলে, বয়স উনিশ কুড়ি হবে, হাতে আমার একটি কবিতার বই নিয়ে আমার কাছে এসে বিপরীত খেলা নামের একটি কবিতা দেখিয়ে বলেছিল, ‘আমি দশ টাকায় বিক্রি হতে চাই। আমাকে কেনেন।’ প্রথমে ভেবেছিলাম বুঝি মজা করছে। কিন্তু এরপরই যখন কড়া স্বরে চোখ পাকিয়ে বলল যে এক্ষুনি তাকে কিনতেই হবে আমার। আমি থতমত খেয়ে ঢোক গিলে মৃদু স্বরে বলেছি, ‘এটি কবিতা। সত্যিকার কেনার জন্য নয়।’ বলে কিছুটা পিছনে সরে এসেছি। খোকা লক্ষ করেছেন ব্যপারটি। তিনি স্টল থেকে বেরিয়ে গিয়ে ছেলেদের ডেকে বললেন, ‘বিক্রি হতে চাও ঠিক আছে, বিক্রি হলে কবিতায় আর যে সব শর্ত আছে, তা মানতে পারবে তো! পুরো কবিতা পড়ে তারপর বিক্রি হতে এসো।’

‘আমার এখন দশ পাঁচ টাকায় ছেলে কিনতে ইচ্ছে করে। ছেলে কিনে ছেলেকে তছনছ করে বুকে পিঠে লাথি কষে বলব, যাশশালা। ছেলে কিনে ছেলের কুঞ্চিত অণ্ডকোষে লাথি কষে বলে উঠবো, যাশশালা।.. ‘

কবিতাটি লিখেছিলাম রমনা পার্কের সামনে সন্ধের দিকে দাঁড়িয়ে থাকা দরিদ্র মেয়েদের ভদ্রলোকরা রিক্সা উঠিয়ে নিচ্ছেন দেখতে দেখতে। কোথায় নিয়ে যায় ওদের! কী করে ওদের নিয়ে! বড় কৌতূহল হয়। একদিন হেঁটে যাচ্ছিল!ম রমনার পাশ দিয়ে, ভাঙা আয়না সামনে নিয়ে তেলহীন শুকনো চুলে চিরুনি আর ধুলো বসা মুখে পাউডার লাগাতে থাকা মেয়েদের সামনে থেমে জিজ্ঞেস করেছি, ‘কেন সাজতাছেন এইখানে বইসা?’

আমার প্রশ্নের দিকে কেউ তাকায় না।

আবারও প্রশ্ন করলে একজন বলে, ‘পেটের ধান্দা করি বইন। পেটের ধান্দা।’

উসকো খুসকো চুল, রোদে পোড়া ত্বক, গালে বাহুতে কাটা দাগ, কারও চোখ ফুলে আছে, কারও কপাল। কপাল ফুলে লাল হয়ে আছে একটি অল্প বয়সী মেয়ে রেলিংএ হেলান দিয়ে উদাস দাঁড়িয়ে ছিল। জিজ্ঞেস করি, ‘কপালে কি হইছে?’

আমার দিকে একবার দৃষ্টি ফেলে সরিয়ে নেয় মেয়েটি। আমি যেন এক উপদ্রব ছাড়া কিছু নই। আমাকে তার প্রয়োজন নেই। কপালে কি হয়েছে তা বলার প্রয়োজন সে বোধ করে না। তবু আমি দাঁড়িয়ে থাকি। লু হাওয়ায় শুকনো চুল উড়ে মুখের ঘামে সেঁটে থাকে। সেই চুলও মেয়েটি সরিয়ে দেয় না। ইচ্ছে করে নিজে হাতে সরিয়ে দিই চুল, ইচ্ছে করে বাড়িতে নিয়ে মেয়েটিকে গোসল করিয়ে ভাল খাইয়ে দাইয়ে বিছানা দিই ঘুমোবার। চোখে ঘুম মেয়েটির। কত রাত বোধহয় ঘুমোয় না। মেয়েটি হঠাৎ বলে, কপালের দোষে কপাল পুড়ে, কপাল ফাটে, কপাল দিয়া রক্ত ঝরে।’

ধ ধু চোখদুটো এবার আমার দিকে ফিরিয়ে বলে, ‘বেডারা মারছে গো, বেডারা মারছে। আমি জিজ্ঞেস করি, ‘মারছে কেন?’

‘মারার শখ হইছে, মারছে।’

‘কত টাকা পান? কত টাকা দেয় তারা?’

‘দশটেকা। পাঁচটেকা। কোনওদিন দুই টেকা। কোনওদিন কোনও টেকা পয়সা দেয় না। লাত্থি দেয়, লাত্থি।’

মেয়েটি তেতো একটি হাসি মুখে নিয়ে সরে যায় আমার সামনে থেকে। বাকি মেয়েগুলোও তাদের প্রসাধনসামগ্রী নিয়ে দ্রুত উধাও। পুলিশ আসছে। পুলিশও তো পুরুষ। পুলিশও কি ভোগ করেনা এদের! করে। না করলেও অন্তত টাকা তো নেয়, এদের দশ পাঁচ টাকা থেকেও ভাগ নিতে দ্বিধা করে না। শর্ত মার দেবে না, জেলে পুরবে না। যে লোকেরা এদের দরদাম করে রিক্সায় উঠিয়ে নেয়, তাদের কি পুলিশ কখনও জেলে পুরতে চেয়েছে! চায়নি। তাদের কি কেউ মন্দ বলে? না, বলে না। নিজেকেই প্রশ্ন করতে করতে নিজেকেই উত্তর দিতে দিতে আমি হাঁটি। বুকের ভেতর কষ্টের পাথর নিয়ে হাঁটি।

বইমেলায় যাওয়া আমার জন্য নিষেধ, এ খবরটি খোকাকে ভীষণ রকম হতাশ করে। তিনি বই-ব্যবসা ভুলে যান, ভুলে যান বই ছাপা, প্রতিদিনকার টাকা পয়সার হিসেব নেওয়ার কাজ। এমনকী বইমেলায় যাওয়া বন্ধ করে দেন। তিনি দিন রাত ব্যস্ত ‘তসলিমা নাসরিন পেষণ কমিটিঞ্চর নাড়ি নক্ষত্র জানতে। কে এরা, কি করে, কি উদ্দেশ্য এদের, কোনও দল করে কি না, করলে কোন দল ইত্যাদি খবর নেন। কমিটির সভাপতি বিএনপির কর্মী এই খবর পেয়ে খোকা তাঁর খালাতো না কি মামাতো ভাইকে ধরে যেহেতু ভাইটি বিএনপির ছোটখাটো এক নেতা, সভাপতিটির সঙ্গে একটি সমঝোতায় আসতে চান। সমঝোতা কেবল মুখের কথায় হয় না, অর্থকড়ি ঢালতে হয়। খোকার কত টাকা গচ্চা যায় তা আমার জানা হয় না। কিন্তু টাকা খেয়েও যখন প্রতিপক্ষের ক্রোধ কমে না, তখন মুখোমুখি কথা বলার ব্যবস্থা করেন খোকা। প্রতিপক্ষ নেতা বনাম আমি। খোকার মুহুর্মুহু অনুরোধে আমি শেষ পর্যন্ত রাজি হই। খোকা আমাকে পই পই করে বলে দেন যে আমাকে উত্তেজিত হলে চলবে না, সভাপতি যা প্রশ্ন করবে তার উত্তর যেন আমি মাথা ঠাণ্ডা করে দিই। প্রশ্নোত্তরের বৈঠকটি হবে খোকার বাড়িতে। আমার ওপর বাংলা একাডেমির মহাপরিচালকের গুরুণ্ডাদেশ দেখে ফজলুল আলমের চোখ মুখ সেই যে গোল হয়ে ছিল, গোল হয়েই আছে। এই গোপন খবরটি শুনে যে আমি যাচ্ছি পেষণ কমিটির নেতার সঙ্গে দেখা করতে, গোঁ ধরলেন তিনিও যাবেন। তাঁর আশঙ্কা আমার ওপর আবার আক্রমণ করার চেষ্টা করবে নেতা। আমার বিপদ দেখলে তিনি ঝাঁপিয়ে পড়ে আমাকে বাঁচাবেন। আমি তাঁকে কিছুতেই সঙ্গে নেব না, কিন্তু তিনি যাবেনই। তিনি গেলেন। কিন্তু খোকা রাজি হন না বৈঠকে ফজলুল আলমের উপস্থিতি। নেতা শুধু আমার সঙ্গে কথা বলতে চায়, যদি তৃতীয় কারও ঘরে থাকতে হয়, বড় জোর খোকা থাকতে পারেন, কিন্তু তার প্রশ্নের উত্তর খোকাকে দিলে চলবে না, দিতে হবে আমাকে। খোকা ঠাণ্ডা মাথার লোক, তিনি অবস্থা বেগতিক দেখলে সামাল দেবার চেষ্টা করবেন। ফজলুল আলমের গরম মাথাকে তিনি পাশের ঘরে একটি পাখার তলে রেখে দিলেন। এসময় ঠাণ্ডা মাথা দরকার, গরম মাথা যে কোনও অঘটন ঘটিয়ে ফেলতে পারে, খোকার ধারণা। যে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আমাকে পিষে মারার জন্য দল গঠন করেছে, সেই ছাত্রনেতার মুখোমুখি বসি। নেতা দশাসই চেহারার কিছু নয়। নেতার মুখে মোচ, ব্রণ, ঘৃণা সব স্থির হয়ে আছে। আমার দিকে চোখ তুলে তাকায়, চোখে আমাকে পিষে মারার তৃষ্ণা থিকথিক করে। এবার আনুষ্ঠানিকভাবে অভিযোগ শোনার পালা আমার। ছেলেটি, কী নাম তার, হাফিজ বা হারুন বা হামিদ বা হাসান কিছু একটা হবে, বলল, ‘আপনি আমাদের মা বোনদের সর্বনাশ করছেন।’

‘কি রকম সর্বনাশ করছি?’

‘কি রকম সর্বনাশ করছেন জানেন না?’

‘আমি তো জানি, আমি মেয়েদের পক্ষে লিখি, আমি তাদের সর্বনাশ করতে যাবো কেন?’

‘তাদের ঘর থেকে বেরিয়ে যাওয়ার কথা বলছেন। সংসার ভেঙে তারা যেন বার হইয়া যায়।’

‘এরকম কথা আমি কোথাও তো বলি নাই।’

‘আপনার বালিকার গোল্লাছুট কবিতায় বলছেন, পৃথিবীর সকল বয়ষ্ক বালিকা দিই গোল্লা থেকে ছুট।’

হামিদ বা হাসান আমার কবিতার বই খুলে কবিতাটি দেখায়।

‘পড়েন, কবিতাটা আবার পড়েন। কী মনে করে এই কবিতা লিখেছেন, বলেন আমাকে।’

কণ্ঠস্বরের হুকুম এবং হুমকি দুটোই কান থেকে প্রাণে এসে বিষমাখা তীরের মত বেঁধে।

‘আমরা বালিকারা যে খেলাটি খেলব বলে পৃথিবীতে বিকেল নামত
সে খেলার নাম গোল্লাছুট
…. আমার আবার ইচ্ছে করে খেলি
এখনো মাঝে মধ্যে আঁকুপাঁকু করে পায়ের আঙুল
ধুলোয় ডুবতে চায় গোপন গোড়ালি
ইচ্ছে করে, যাই
পৃথিবীর সকল বয়ষ্ক বালিকা দিই গোল্লা থেকে ছুট।’

জবানবন্দি। যেন আমি কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে আছি, যাহা বলিব সত্য বলিব বলে আমাকে প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে। দিতে হবে, কারণ এই নেতাটি যতই হালকা পাতলা হোক, তাকে দু ঘা মেরে হয়ত বসিয়ে দেওয়া যাবে, তাকে দেখে শক্তিহীন মনে হলেও সে কিন্তু অসীম শক্তি ধারণ করে। সে একটি দল গঠন করার শক্তি রাখে, তারও চেয়ে বড় কথা তার দলবল নিয়ে আমাকে পিষে মারার শক্তি রাখে।

‘সকল বয়ষ্ক বালিকাকে গোল্লা থেকে ছুটে যেতে প্রেরণা দিচ্ছেন। আমাদের মা বোনেরা যেন সংসার ছেড়ে বের হইয়া যায়। আপনি এই সমাজের কত বড় ক্ষতি করছেন, তা জানেন?’

‘এটি গোল্লাছুট খেলা নিয়ে কবিতা। মেয়েরা যারা একসময় গোল্লাছুট খেলত ছোটবেলায়, বড় হয়ে গেলে তারা আর সেই খেলাটা খেলতে পারে না। ভেতরে ইচ্ছ!টা তো থাকে। আমি আমার ইচ্ছ!র কথা বলেছি।’

‘উহুঁ ।’ হাফিজ বা হাবিব মাথা নাড়ে।

‘আপনি এইখানে সকল বয়ষ্ক বালিকার কথা বলছেন। আপনার নিজের কথা কেবল বলেন নাই।’

‘সব মেয়েরই এমন ইচ্ছ! হয়। সবাই তো পেছনে ফেরে, শৈশবে ফিরতে চায়। চায় না কি? চায় তো। আমি যখন নিজের কথা বলি, একই সঙ্গে অনুভব করি যে এ অন্য মেয়েদেরও কথা। এই কবিতায় মেয়েদের ইচ্ছ!র কথা বলেছি….’

‘সব মেয়ের তো এমন ইচ্ছ! করে না..’

‘অনেকের করে।’

‘না অনেকের করে না। বলেন যে আপনার করে।’

আমি ঠিক বুঝে পাই না কি বলব।

হাবিব বা হারুন এবার তীক্ষ্ম চোখে আমার চোখে তাকিয়ে বলে, ‘গোল্লা বলতে তো আপনি স্বামী সন্তাান নিয়ে মেয়েরা যে সংসারটা করছে, তা বোঝাতে চেয়েছেন।’

আড়চোখে খোকাকে দেখি। খোকার চোখে আকুলতা, ‘ একবার আপনাকে আমি নেবই বইমেলায়, আপনি বলুন যে আপনি সংসার বোঝাননি, কেবল খেলাই বুঝিয়েছেন।’ আমি এই আকুলতার সামনে প্রায় বলতে যাওয়া ‘একভাবে ভাবতে গেলে এটি সংসারও হয়, সমাজের নিয়মের যে জাল পাতা মেয়েদের জন্য, সেটিও হয়’ আর বলি না। আমার মুখ খোলার আগেই হাসান বা হাফিজ বলে, ‘অন্য মেয়েদের ইচ্ছ!র কথা কি করে জানেন?’ হাতের কাছে বইটির পাতা ওল্টাতে ওল্টাতে বলি, ‘সেটা আমার মনে হয়েছে।’

‘কাউকে জিজ্ঞেস করেছিলেন লেখার আগে যে তারা গোল্লা থেকে ছুটতে চায় কি না? নাকি আপনি আপনাকে দিয়ে বিচার করেন সবাইকে?’ নেতার চোখ থেকে কিছু একটা বেরোয়। সেই কিছু একটার ঝাঁঝ আমার মুখটি তুলতে দিচ্ছে না।

বইটি টেবিলে রেখে দিয়ে বলি, ‘না, তা করি না।’

‘আপনার মনে হয়েছে অন্য মেয়েদের ইচ্ছ!টা কী। কিন্তু আপনি সঠিক জানেন না।’

এবার নেতার চোখের দিকে সরাসরি তাকিয়ে আমি বলি, ‘আমার ইচ্ছে, আমার মনে হওয়ার কথা তো আমি লিখব আমার কবিতায়। এটা কি দোষের কিছু?’

‘নিশ্চয়ই দোষের।’

‘কী দোষের?’

খোকা খুব আলতো স্বরে বলেন, ‘লেখা তো লেখকেরা যা ভাল মনে করেন, তাই লেখেন। সবাই তো আর সব লেখকের সব লেখাকে ভাল মনে করে না। তাদের সব বক্তব্যই তো সব পাঠক মেনে নেয় না। তবে আমার মনে হয় উনি বোঝাতে চেয়েছেন গোল্লাছুট খেলার কথা। লেখাটা পড়লে অনেকে ভুল বুঝতে পারে।’

খোকার বক্তব্যে মাথা নেড়ে আমি বলি, ‘হ্যাঁ, অনেকেই ভুল বোঝে। তা ঠিক। যেমন ধরেন ওই বিপরীত খেলা কবিতাটা। ওই কবিতায় কি আমি সত্যিই ছেলে কিনতে চেয়েছি? ওই কবিতাটি ছিল একটি প্রতিবাদ!’

‘এই কথাটাই আপনি ওকে বুঝিয়ে বলেন না কেন! খোকা বলেন আমাকে।’

‘আমি তো বোঝাচ্ছিই। বলতে চাইছি যে এক লেখাকে অনেকে অনেক রকম ব্যাখ্যা করে। লেখকের এক রকম ব্যাখ্যা থাকে, পাঠকের হয়ত আরেক রকম।’

ছাত্রনেতাটি আমাকে পিষে মারার জন্য বড় একটি দল বানিয়েছে। হাতের কাছে পেলে পুরো মেলার মানুষ যেন দেখে আমাকে ন্যাংটো করে পায়ের তলায় পিষবে, তেমন কথা ছিল। এই নেতাকে আমি নতুন করে বোঝাবো কী! আমার লেখার কিছুই না বুঝে সে দল বানায়নি। তার আশঙ্কা আমি সমাজটাকে নষ্ট করছি। মা বোনের মাথা বিগড়ে দিচ্ছি। এই বিশ্বাস কেবল এই হাসান বা হামিদের নয়, আরও অনেকের। তার চোখের দিকে তাকিয়ে আমি ঠিক বুঝতে পারি না, আমার গোল্লাছুটের সরল ব্যাখ্যাটি আদৌ সে মেনে নিয়েছে কী না। খোকার সঙ্গে আবার চোখাচোখি হয়। চোখের এবারের ভাষাটি আমার পক্ষে পড়া সম্ভব হয় না।

নেতা এবার জয় বাংলা কবিতা নিয়ে প্রশ্ন করল। ‘জয় বাংলা কবিতাটা কেন লিখেছেন?

আমার সহজ উত্তর, ‘জয় বাংলায় বিশ্বাস করি বলে।’

‘এই কবিতায় তো আপনি যারা জয় বাংলায় বিশ্বাস করে না, সেই দুর্ভাগাদের মৃত্যু চাইছেন। আমি তো জয় বাংলা মানি না। আপনি আমাকে দুর্ভাগা বলবেন কেন? যারা মানে না, তাদের সম্পর্কে বাজে কথা বলবেন কেন?’

‘আপনি কি বাংলাদেশের স্বাধীনতায় বিশ্বাস করেন না?’

‘বিশ্বাস করব না কেন? অবশ্যই করি।’

আমার গলার স্বরে সত্যিই ফুটে উঠতে থাকে উত্তেজনা, ‘যদি করেন বিশ্বাস তাহলে জয় বাংলায় বিশ্বাস না করার তো কোনও কারণ নেই। বাংলাদেশ স্বাধীন হলে কী স্লোগান আমরা সবাই দিয়েছিলাম? সবাই বলেছে জয় বাংলা। সবাই জয় বাংলার গান গেয়েছে।’ নেতার ক্রুদ্ধ মুখ থেকে চোখ খোকার দিকে ফিরিয়ে বলি, ‘কী খোকা ভাই, একাত্তরে জয় বাংলা বলেন নাই? একমাত্র রাজাকার আলবদররাই জয় বাংলা বলে নাই। আমি তাদেরই দুর্ভাগা বলছি।’

‘জয় বাংলা আওয়ামি লীগের স্লোগান।’ নেতা কঠিন কণ্ঠে বলে। নাকের পাটা ফুলে উঠছে তার।

‘জয় বাংলা আওয়ামি লীগের হবে কেন? এটা সবার। জয় বাংলা মানে বাংলার বিজয়, জয় বাংলা মানে স্বাধীন বাংলা। মুক্তিযোদ্ধারা, যারা কোনওদিন আওয়ামি লীগ করে নাই, তারা কি জয় বাংলা বলত না সবসময়ই? এই জয় বাংলা বলেই তো তারা প্রেরণা পেত শত্রুর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার।’

খোকা একগাল হেসে বলেন, ‘ওর ওইসময় হয়ত জন্মই হয় নাই। আপনার জন্ম বোধহয় যুদ্ধের পরে। ঠিক না?’

নেতাটির মাথা না বোধক নড়তে নিয়েও নড়ে না।

খোকা আমাকে বলেন, ‘আপনি রেগে যাচ্ছেন কেন! ওরা তো মুক্তিযুদ্ধে কি হয়েছিল, তা জানে না। জানলেও হয়ত মনে নাই। জয় বাংলা, এটা তো সত্যি যে আওয়ামি লীগ এটাকে নিজেদের স্লোগান করে নিয়েছে। আওয়ামি লীগের তো কোনও রাইট নাই জয় বাংলা..’

আমি মাথা নেড়ে বলি, ‘আওয়ামি লীগ একে নিজের সম্পত্তি মনে করলেই তো হবে না। জয় বাংলা কোনও দলের সম্পত্তি না। আমি তো জয় বাংলা সেই একাত্তর থেকে বলে আসছি। আমি তো কোনওদিন আওয়ামি লীগে নাম লেখাই নাই। আমি তো নিরপেক্ষ মানুষ। রাজনীতি করি না। আওয়ামি লীগের অনেক কিছুই আমার পছন্দ না।’ প্রশ্নোত্তর পর্ব শেষ হলে তখনও সন্তুষ্ট না হওয়া হাসান বা হাবিব বা হাফিজ বা হামিদের সঙ্গে খোকার আরেক দফা বৈঠক হয়। খোকা না চাইলেও মুখে মধুর হাসি টেনে সব জুলুম সহ্য করছেন কারণ তিনি যে করেই হোক অন্তত একুশে ফেব্রুয়ারির দিনটিতে আমাকে নিয়ে যেতে চান মেলায়। বইমেলায় বই বিক্রি তাঁর জন্য বড় কোনও বিষয় নয়, আমার মেলায় যাওয়ার অধিকার প্রতিষ্ঠা করাই তাঁর কাছে এখন সবকিছুর চাইতে জরুরি। কিন্তু এভাবে কি স্বস্তি মেলে? সারাক্ষণই একটি উৎকণ্ঠা কি পায়ে পায়ে হাঁটে না! পেষণ কমিটির সভাপতি কথা দিয়েছে যে আক্রমণ আপাতত তার দল করছে না, কিন্তু ভবিষ্যতে আমি যেন খুব সাবধানে লিখি, যদি অশ্লীল লেখা লিখি, যদি মা বোনের ক্ষতি করার জন্য লিখি, যদি সমাজের অনিষ্ট করার জন্য লিখি, তবে পেষণ কমিটির কর্মকাণ্ড অনেকদূর এগোবে। বলেছে দলের একজন, কিন্তু দলের বাকিরা কি এই সিদ্ধান্ত মেনে নিয়েছে যে আপাতত আমার ওপর হামলা করবে না! খোকা আমাকে জানান যে নিয়েছে। কিন্তু তারপরও খোকা জানি না কোত্থেকে কিছু পেশীবহুল লোক যোগাড় করলেন, যাদের কাজ আমাকে মেলায় নিয়ে যাওয়া আর মেলা শেষ হলে আমাকে বাড়ি পৌঁছে দেওয়া। অচেনা পেশী পরিবেষ্টিত হয়ে একুশে ফেব্রুয়ারির দিন মেলায় যাই বটে আমি, আগের সেই স্বতস্ফূর্ত আনন্দ জোটে না কিছুতে তবে খোকার প্রতি কৃতজ্ঞতায় আমার মন ভরে থাকে। কোনও লেখক তো এগিয়ে আসেনি কোনও সাহায্য করতে, মেলা কমিটি মুখ ফিরিয়ে রেখেছে, এ সময় খোকা এই মীমাংসাটি না করলে আমাকে এক ঘোর হতাশার মধ্যে ঘরে বসে থাকতে হত। যে দুটো দিন মেলায় গিয়েছি, বিদ্যাপ্রকাশের স্টলেই বসে ছিলাম। মেলার মাঠে হাঁটাহাঁটি বা চায়ের স্টলে গিয়ে চা খাওয়ার ইচ্ছে প্রবল হলেও যেতে পারিনি। স্টলেও বেশিক্ষণ বসা হয়নি, ঘণ্টা দুঘণ্টা পর বাড়ি ফিরতে হয়েছে। তবে আমি যে যে করেই হোক গিয়েছি মেলায়, সেটিই ছিল বড় ঘটনা। যদিও আশঙ্কা নামের কুৎসিত একটি জিনিসকে কোনও আবর্জনার স্তূপে ফেলে দিতে পারিনি, যদিও খোকার চোখ সারাক্ষণই অস্থির ছিল উদ্বেগে তবু বিজয়ের প্রশান্তি অল্প হলেও কিছু ছিল তাঁর মনে। ফজলুল আলম উৎকণ্ঠা এবং উচ্ছঅ!স দুটো নিয়েই নিরাপদ একটি দূরত্বে হাঁটাহাঁটি করেন। বইমেলা কমিটির লোকেরা আমাকে ভ্রু কুঁচকে দেখেছেন। জ্বলজ্যান্ত উপদ্রুবটিকে দেখতে তাঁদের ভাল লাগেনি। আমার মত আস্ত একটি সমস্যা মেলায় উপস্থিত হলে কী না কী অঘটন ঘটে কে জানে! মেলায় যদি জ্বালাও পোড়াও শুরু হয়ে যায়, তবে! তার চেয়ে একা আমাকে কোথাও নিয়ে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দিলে মেলাটা অন্তত বাঁচে। মেলার স্টলগুলোয় আমার বই নেই। বেশির ভাগই ছিনিয়ে নিয়েছে পেষণ কমিটির লোকেরা। বেশির ভাগই পুড়িয়ে দিয়েছে। কোনও কোনও স্টলে বই আছে, সেসব বই লুকিয়ে রাখা হয়েছে টেবিলের তলায়।

প্রতি বছরের মত বাংলা একাডেমি কবিতা পড়ার অনুষ্ঠান করছে। আগের বছরের অনুষ্ঠানগুলোয় কবিতা পড়ার আমন্ত্রণ পেয়েছিলাম, এবার আমি আমন্ত্রিত নই।

আমাকে ছুঁড়ে ফেলে দেবার, পিষে মারার ষড়যন্ত্র যেমন একদিকে চলছে, অন্যদিকে আবার অনেক পাঠকই একবার আমাকে চোখের দেখা দেখতে মেলায় আসেন। কাছে এসে মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে থেকে বলেন, ‘আপনাকে একবার ছুঁয়ে দেখতে ইচ্ছে করে।’ কেউ বলতে বলতে যে আমার লেখা যেন লেখা নয়, সত্যিকার জীবন, কেঁদে ফেলে। কেউ বলে, ‘যে কথা আমি সবসময় বলতে চেয়েছি, পারিনি, আপনি বলছেন।’ কোনও মা আসেন মেয়ে নিয়ে, মেয়েকে পাঠান আমার পায়ের ধুলো মাথায় নিতে। কেউ কেউ সিলেট চট্টগ্রাম রাজশাহী বগুড়া এসব দূর দূর শহর থেকে ঢাকার বইমেলায় আসেন একটি উদ্দেশ্য নিয়েই, কাছ থেকে যদি সম্ভব না হয়, দূর থেকে হলেও আমাকে একটিবার দেখে স্বপ্ন পুরণ করবেন।

আমার জন্য মানুষের ভালবাসা এবং ঘৃণা দুটোই আমাকে কাঁদায়।
 
১৫. আনন্দধারা


শুভাকাঙ্খীদের আনাগোনা বাড়ে শান্তিবাগের বাড়িতে। অনেকের মত রাকা আর আলতাফ ভক্ত হিসেবে আমার সঙ্গে দেখা করতে এসে অচিরে বন্ধু বনে যান। দুজনেই শখের রবীন্দ্রসঙ্গীত গান, আলতাফ নিজে কবিও। দুজনে বেশি বয়সে বিয়ে করে বাচ্চাকাচ্চাহীন জীবন যাপন করছেন। আগে বিয়ে হয়েছিল দুজনের, আলাদা আলাদা করে ছেলে মেয়ে আছে, ছমাসে কি বছরে ছেলে মেয়েদের সঙ্গে দেখা করা ছাড়া তাঁদের বিশেষ কোনও কর্তব্য নেই। দশটা পাঁচটা চাকরি করেও অখণ্ড সময় পড়ে থাকে হাতে, বিশেষ করে সন্ধ্যেগুলো। সন্ধ্যেগুলোয় প্রায়ই আমার বাড়িতে চলে আসেন দুজন। গানে কবিতায় মুখরিত শান্তিবাগের বাড়িটিতে বসেই রবীন্দ্রসঙ্গীতের ঘোরে একদিন বলি ‘চলুন শান্তিনিকেতনে বসন্তউৎসবে যাই।’ জীবনে কখনও শান্তিনিকেতন যাননি, অথচ রবীন্দ্রঅন্ত প্রাণ, খুশিতে লাফিয়ে ওঠেন রাকা আর আলতাফ। শান্তিবাগে বসেই শান্তিনিকেতনের জন্য আবেগ আমাদের উথলে ওঠে। এবার আর টাকা ধার করতে হয় না, প্রকাশকদের কল্যাণে পকেটে আমার যথেষ্ট টাকা। দুদিনের মধ্যেই রাকা আর আলতাফ টাকা যত খরচ হওয়ার কথা, তার চেয়ে দু হাজার বেশি পকেটে নিয়ে, সুটকেস গুছিয়ে তৈরি। দলের নেতা হলে দায়িত্ব অনেক। বেলাল চৌধুরীকে দিয়ে ভারতের ভিসা করিয়ে নিই তিনটি পাসপোর্টে। বেলাল চৌধুরী ভারতীয় দূতাবাসে ভারত বিচিত্রা পত্রিকাটি সম্পাদনার কাজ করেন। ভারত বিচিত্রায় আমার বেশ কিছু কবিতা তিনি ছেপেছেন। দেখা হলেই লেখা চান। দেখা প্রায়ই হয়, আরমানিটোলায় থাকা কালীন মাঝে মাঝে যখন করার কিছু থাকত না, তাঁর আপিসে গিয়ে গল্প শুনে সময় কেটেছে আমার। শান্তিবাগে অশান্তির সময়গুলোতেও অনেক সময় গিয়েছি ভারত বিচিত্রায়। বেলাল চৌধুরী আড্ডা দিতে পছন্দ করেন। ঝুড়ি ঝুড়ি গল্প আছে তাঁর, পছন্দের কোনও শ্রোতা পেলে ঝুড়ি উপুড় করেন। পুরোনো আমলের সাহিত্য-জগতের কথা, কলকাতার সাহিত্যরথীদের ছোট খাটো ব্যক্তিগত গল্প খুব রসিয়ে মজিয়ে পরিবেশন করেন। সুস্বাদু গল্প সব। দীর্ঘকাল কলকাতা ছিলেন বলে কলকাতার সাহিত্যিকদের সঙ্গে তাঁর বেশ বন্ধুত্ব। কলকাতার কে কেমন, কে পাগল, কে ছাপল, কে উদার, কে উদাস জানতে জানতে , কলকাতার এ গলি ও গলির নানারকম গল্প শুনতে শুনতে মনে মনে কতবার যে কলকাতায় পৌঁছে গিয়েছি! বেলাল চৌধুরী কবিতা লেখেন কিন্তু তাঁর কবিতার চেয়ে বেশি ভাল লাগে তাঁর কথা। যে কোনও আড্ডা জমিয়ে তোলার অসম্ভব ক্ষমতা রাখেন তিনি। খুব একাকী মানুষ বেলাল চৌধুরী। খুব প্রাণখোলা। খুব আন্তরিক। খুব উদাসীন। খুব কবি। তিনি আমার দাদা- দাদা-বন্ধু হয়ে গেছেন অল্প কদিনের মধ্যেই। তিনিই একদিন আমাকে বলেছিলেন গিরিন্দ্রশেখর বসুর লাল কালো বইটির কথা। বাচ্চাদের জন্য এমন চমৎকার বই বাংলা সাহিত্যে দ্বিতীয়টি নেই। দুঃখ করে বলেছেন যে বইটি এখন কোথাও আর পাওয়া যায় না, কোনও প্রকাশকই বইটির পুনর্মুদ্রণ করছে না। লাল কালোর গল্প শুনে বইটি পড়ার ইচ্ছে জাগে। বেলাল চৌধুরীর কাছেই একটি জীর্ণ পুরোনো পোকা খাওয়া লাল কালো বইটি পাতা উল্টো উল্টো দেখি। একদিন বইটি বাড়ি নিয়ে এসে পড়ে মুগ্ধ হয়ে বইটির পূনর্মুদ্রণের সংকল্প করি। মুদ্রণ ব্যপারটির জন্য খোকার শরণাপন্ন হই। খোকা আমার অনুরোধ রাখেন। তিনি লাল কালো বইটি ছাপার কাজে হাত দেন। আমি নিজে প্রুফ দেখে দিই। বেলাল চৌধুরীকে দিয়ে একটি ভূমিকা লিখিয়ে নিই। আজ দেবেন কাল দেবেন বলে তিনি দীর্ঘ সময় পার করেছিলেন ভূমিকাটি লিখতে। ভেতরে পিঁপড়ের রঙিন ছবিগুলো দেখে খোকা বলেছিলেন, ‘লেখাগুলো গেলেই তো চলবে, ছবির কি দরকার আছে?’ আমি বলেছি, ‘আছে, বাচ্চাদের বইতে ছবি থাকবে না, এ কেমন কথা? লেখা পড়ার চেয়ে বাচ্চারা তো বেশি পড়ে ছবি!’ খোকা ছবিসহ হুবুহু লাল কালো বইটি ছেপে দিলেন। একটি কাজের কাজ বটে। কাজটি করে আমার বেশ আনন্দ হয়, নিজের বই বেরোলে যেমন আনন্দ হয়, তেমন আনন্দ। নাহ, নিজের বই বেরোনোর আনন্দর চেয়ে বেশি এ আনন্দ। নিজের বই বেরোলে উচাটন মন আমার আনন্দকে নাশ করে ফেলে। বই হাতে পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পাতা উল্টো খুঁজতে থাকি ভুল। পাতায় পাতায় বাক্যের ভুল আর শব্দের ভুল গুনতে বসি, সংখ্যার পরিমাণ যত বাড়ে, তত আমার মন খারাপ বাড়ে। মন খারাপ বাড়লে আমার দ্বারা আর যাই হোক লেখালেখি যে হবে না এ ব্যপারে মোটামোটি নিশ্চিত হই।

শান্তিনিকেতনের বসন্তউৎসবে যাচ্ছি শুনে বেলাল চৌধুরী নিজের দেখা বসন্ত উৎসবের সুখদ বর্ণনা করলেন। বর্ণনা শেষে আমাকে বললেন একটি লাল কালো যেন শ্রীপান্থর জন্য নিয়ে যাই। শ্রীপান্থ আনন্দবাজারের কলকাতার কড়চায় বইটির একটি খবর দিয়ে দেবেন। লেখক শ্রীপান্থর নাম ঠিকানা বলে দিলেন। নাম নিখিল সরকার। শ্রীপান্থ তাঁর ছদ্মনাম। ঠিকানা আনন্দবাজার পত্রিকা, ৬ প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিট। শান্তিনিকেতনে সুবর্ণরেখা নামে একটি বইয়ের দোকান আছে, দোকানের মালিক ইন্দ্রনাথ মজুমদারের সঙ্গেও দেখা করতে বললেন। ইন্দ্রনাথের মত মানুষ নাকি পৃথিবীতে আর হয় না। শ্রীপান্থকে লাল কালো দেওয়া আর ইন্দ্রনাথের মত অসাধারণ মানুষটির সঙ্গে পরিচিত হওয়া, বেলাল চৌধুরীর দুটো আদেশ বা অনুরোধ আমি রক্ষা করব বলে কথা দিই।

তিনজনের দলটি মহানন্দে কলকাতা পৌঁছোই। প্রথমেই আমি সৌমিত্র মিত্রর খোঁজ করি পশ্চিমবঙ্গ তথ্যকেন্দ্রে। শাহরিয়ার একবার বলেছিল সৌমিত্র মিত্র হলেন কলকাতার ঈশ্বর। যে কোনও জটিল কাজই তিনি মুহূর্তে সরল করে দিতে পারেন। সৌমিত্র মিত্রই আমাদের বাসস্থান ঠিক করে দিলেন। কিডস স্ট্রিটের সরকারি অতিথিশালা। মাগনা থাকা নয়, তবে যে কোনও হোটেলের চেয়ে অর্ধেকের অর্ধেক টাকায় থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা ওখানে। সৌমিত্র মিত্রকে আমাদের আগমনের হেতুটি জানাই যে শান্তিনিকেতনের বসন্তউৎসব আমাদের দেখা হয়নি, তাই দেখতে আসা। দলবল নিয়ে সৌমিত্র মিত্রও যাচ্ছেন শান্তিনিকেতনে, বললেন এক সঙ্গেই যাওয়ার ব্যবস্থা করবেন তিনি। বসন্ত উৎসবে শান্তিনিকেতন চললাম সবাই। শান্তিনিকেতন এক্সপ্রেসে রাজকীয় একটি কামরায় আমরা উঠে বসি। জানালায় পর্দা, চেয়ারে গদি, কাঠের আসবাবে নিপুণ কারুকাজ! রেলগাড়ির কোনও কামরা যে এমন সুন্দর হতে পারে তা আমার জানা ছিল না। সৌমিত্র জানালেন এই কামরায় বসে স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ কলকাতা বোলপুর যাওয়া আসা করতেন। আনন্দ ধরার জায়গা নেই আর, রবীন্দ্রনাথ সারা হৃদয় জুড়ে। সৌমিত্র মিত্রর দলে অশেষ, মোনা আর নাচের মেয়ে রেখা মৈত্র। অশেষ আর মোনা আমার কাছাকাছি বয়সের। রেখা মৈত্র কিছুটা বয়সে বড়। আমার দলে রাকা আর আলতাফ, আলতাফ লোকটি লাজুক, ভাবুক, উদাসীন হলেও রাকা খুব চটপটে, বুদ্ধিমতি, সাহসী, হিসেবী। রাকা রাজশাহীর মেয়ে, কথায় পাকা। আলতাফ ধীরে হাঁটেন, দাঁড়ালে ত্রিভঙ্গ দাঁড়ান, ধীরে বলেন,কম বলেন কিন্তু যখন বলেন ভাল বলেন। দুজনেরই আমার চেয়ে দশ বারো বছর বেশি বয়স। বয়স আসলে কোনও ব্যপার নয়। ছোট বড়তে বেশ ভাল বন্ধুত্ব হতে পারে। ভেবেছিলাম সাত জন মিলে আড্ডা দিয়ে পথ পার হব। কিন্তু কি করে কি করে যেন আমরা আলাদা হয়ে গেলাম, আমরা বাঙালরা একদিকে, ঘটিরা আরেকদিকে। নিরীহ তিনটি বাঙাল বেশির ভাগ সময় চুপচাপ বসে থেকে সৌমিত্র মিত্রর দলটির হৈ হল্লা দেখি। বাঙালরা খুব তাড়াতাড়ি ধরতে পারে না ঘটিদের সব আচরণ। ধরেন, বলেন, শোনেন, করেন, হাঁটেন বলে অভ্যস্ত আমরা, দমদমে নেমেই এ কারকে ঝেঁটিয়ে বিদেয় করে হ্রস্ব উকারের কাঁধে সওয়ার হই বটে, তবে জিভ সবসময় কথা শোনে না। দু একটি হ্রস্ব উকারের পর আবার এ কার উড়ে এসে বসে। আমাদের উচ্চারণ নিয়ে, গ্রাম্যতা নিয়ে, অজ্ঞতা নিয়ে কসমোপলিটন শহরের আলট্রামডার্ন ক্যালকেসিয়ানদের সঙ্গে ঠিক খাপ খাওয়াতে পারি না। আমাদের জড়তা, কুণ্ঠা সবই ঘটিদের কাছে মজার জিনিস। মুখ খুললেই মজার জিনিস হয়ে উঠি বলে মুখ যথাসম্ভব বন্ধ করেই রাখা ভাল। যদি খুলতেই হয় মুখ, নিজেদের মধ্যেই খুলি। শান্তিনিকেতনে নেমে যেহেতু আমি আগে এসেছি এখানে, আমি অনেকটা বিশেষরি মত রাকা আর আলতাফকে রবীন্দ্রনাথের চারদিক দেখাই। রবীন্দ্রনাথের বাড়িঘর উঠোন আম্রকাননে হেঁটে বেড়াই। রাতে সৌমিত্র মিত্র আমাদের থাকার ব্যবস্থা করেন। পাশাপাশি ঘরগুলোর একটিতে আলতাফ আর রাকা, একটিতে মোনা আর অশেষ, একটিতে রেখা মৈত্র আর আমি, আরেকটিতে একা সৌমিত্র মিত্র। গানের সূরে ঘুম ভাঙে ভোরবেলা। ‘ওরে গৃহবাসী, খোল দ্বার খোল লাগল যে দোল,জলে স্থলে বনতলে লাগল যে দোলঞ্চ শুনে হৃদয়ে দোল লাগে। বিছানা থেকে লাফিয়ে নেমে হলুদ রঙের একটি শাড়ি পরে নিই। রাকা অনেক আগেই তৈরি হয়ে বসে আছেন। ঘটিরা তখনও ঘুমে। অনেক রাত অবদি অতিথিশালার ছাদে মদ্যপানের আসরে বসে ছিলেন, ঘুম থেকে উঠতে দেরি তো হবেই কিন্তু বাঙালদের তা সইবে কেন, আমরা তো শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত উৎসবের একটি কণাও অদেখা রাখতে চাই না। অস্থির হয়ে হাঁটাহাঁটি করি বারান্দায়। ডাকাডাকিতে সৌমিত্র মিত্র ওঠেন। স্নান সেরে কাপড় পরে নাস্তা খেয়ে বেরোন তিনি আমাদের নিয়ে। এই দেরীটুকু সয় না আমার। মন ভাল হয়ে যায় উৎসবের আনন্দ দেখে। বাসন্তী রঙের শাড়ি পরে মেয়েরা সব উৎসবে মেতে আছে। মঞ্চে মঞ্চে রবীন্দ্রসঙ্গীত গাওয়া চলছে, এদিকে রবীন্দ্রনাথের নৃতনাট্য তো ওদিকে কবিতা পাঠ। চারদিক ছুটে বেড়াই। গান হচ্ছে, গায়ে গায়ে আবীর ছড়ানো হচ্ছে। আমার মুগ্ধ চোখ কোনও গানে ও আবীরে উচ্ছ্বসিত মানুষ থেকে সরেনি। এত গভীর করে এর আগে বসন্তকে গ্রহণ করিনি আমি। এর আগে বসন্তের উতল হাওয়া এমন লাগেনি গায়ে। এমন বাসিনি ভাল পৃথিবীর আলো, হাওয়া, মাটি ও মানুষ। গা পেতে সকলে সকলের আবীর নিয়েছে। মাঠে, আম্রকুঞ্জে, কলাভবনে, সঙ্গীত ভবনে আবীর ছড়ানোর উৎসবে সকলের কণ্ঠে ছিল গান, সকলের শরীরে ছিল নৃত্য। শান্তিনিকেতনের আলাদা একটি ঘ্রাণ আছে, জানি না কোত্থেকে এক ঘ্রাণ এসে প্রাণ ভরিয়ে দেয়। আমি রবীন্দ্রনাথে ডুবে থাকি, আবীরে ডুবি। এত কাছ থেকে রবীন্দ্রনাথকে দেখলে আশ্চর্য এক অনুভূতি হয়। আমার অনুভবগুলোর আবীর আমাকে রাঙিয়ে তোলে। রঙ খেলায় অভ্যস্ত নই, কাউকে রঙ না ছিটোলেও আমার গায়ে অচেনা অচেনা মানুষেরা রঙ ছিটিয়ে দেয়। অন্য দিন হলে ভীষণ রাগ করতাম, সেদিন রাগ করিনি। দেখি আরও আরও কবিরা রঙে ডুবে আছেন। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ও। কখন যে রাকা আর আলতাফকে হারিয়ে ফেলেছি ভিড়ে জানি না। তবে একা হয়ে যাই না। অনেকে যেচে আমার সঙ্গে আলাপ করতে এসে আন্তরিক হয়ে ওঠে। রাতে গানের উৎসবে দেখা হয় তিন তরুণ কবি সৈয়দ হাসমত জালাল, গৌতম ঘোষ দস্তিদার আর চৈতালি চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে। চৈতালির কবিতা আমি সেই কতকাল আগে সেঁজুতিতে ছাপতাম। অনেক রাত অবদি আমরা রিক্সা করে ঘুরে বেড়াই শান্তিনিকেতনের আশেপাশে। কোপাই নদীর ধারে বসে পূর্ণিমা রাতের মোহন রূপ দেখি। ঢাকা শহরে থেকে পূর্ণিমা কখন যায়, কখন আসে তার কিছুই টের পাই না। ঢাকার বাইরে সুদূর বোলপুরে আমি যেন আমার কৈশোরটি ফিরে পাই। জালাল, গৌতম, গৌতমের প্রেমিকা উর্মিলা আর আমি যখন ঘুরে বেড়াচ্ছি, সৌমিত্র মিত্র তাঁর দল নিয়ে তারাপীঠের মন্দির ঘুরে এসেছেন। আমার ভাবতে অবাক লাগে সৌমিত্র মিত্র ধর্মে বিশ্বাস করেন। আমি হয়ত ভেবেই নিয়েছিলাম আমার কলকাতার বন্ধুরা কেউই আস্তিক নয়। অবশ্য আস্তিক না হলে যে উপাসনালয় দেখতে যাওয়া যায় না, তার কোনও কথা নেই। আমি নিজেই তো কত মন্দির মসজিদ দেখতে গিয়েছি, অবশ্য গিয়েছি ভেতরের কাণ্ড কারখানা দেখতে। কে কী উদ্দেশ্য নিয়ে মন্দির মসজিদে যায় সেটি বোঝা দায়। গোপনে গোপনে কার মনে কি আছে কে জানে! ঢাকাতেও এরকম, মাঝে মাঝে কারও কারও ধর্ম বিশ্বাসের খবর শুনে আঁতকে আঁতকে উঠি। আল মাহমুদের মত শক্তিশালী কবিও একদিন শুনি পাঁড় ধার্মিক। পান্না কায়সার মৌলবাদ বিরোধী আন্দোলনে জড়িত, তিনিও ভক্তিভরে কোরান পড়েন। বুদ্ধিজীবী মুনতাসির মামুন শুক্রবার মসজিদে যান জুম্মাহর নামাজ পড়তে।

গভীর রাতে শান্তিনিকেতনের সেই অতিথিশালায় আমার ঘুম ভেঙে যায়। একটি পুরুষকণ্ঠ শুনি রেখা মৈত্রর সঙ্গে চাপা স্বরে কথা বলছে। বিছানায় ধস্তাধস্তির মত একটি শব্দ পেতে থাকি। আমি চোখ বুজে পড়ে থাকি, কাউকেই বুঝতে দিই না আমি যে জেগে আছি, আমার জেগে থাকা, আমার টের পাওয়া যেন কাউকে বিব্রত না করে। একসময় দুটি প্রাণীর ঘর থেকে বেরিয়ে যাওয়ার শব্দ শুনি। নিঃশব্দে উঠে ভেজানো দরজাটি বন্ধ করে দিই ভেতর থেকে। বাকি রাত আমি ঘুমোতে পারি না। কি অদ্ভুত রহস্যে মোড়া এই জগত! দিনের আলো ফুটলে সব আবার পরিস্কার হয়ে ওঠে। মানুষগুলোকে অনেক চেনা লাগে। নতুন হওয়া বন্ধুদের আরও প্রাণবান মনে হয়। শান্তিনিকেতন থেকে কলকাতা ফিরে যাওয়ার পর জালালের সঙ্গে আমার দেখা হয়ে বেশ কয়েকবার। জালাল আমাকে এত সহজে আপন করে নেয় যে মনে হয় তার সঙ্গে আমার অনেককালের বন্ধুত্ব। কলকাতার মানুষগুলো দ্রুত তুমি করে সম্বোধন করে ফেলে, তাইতেই এমন মনে হয়। তুমি সম্বোধনটির কাঁধে চড়ে এক লাফে দুশ কিলোমিটার দূরত্ব পার হওয়া যায়। কিডস স্ট্রিট থেকে খুব বেশি দূরে থাকে না জালাল। এসি মার্কেটের মাথায় একটি ছোট্ট ঘরে থাকে, মার্কেটের সিকিউরিটি অফিসারের চাকরি করে। আমাকে নিয়ে একদিন সে বেরোয় ময়দানে হাঁটতে। তার দাদার বাড়িতে বেড়াতে নিয়ে যায়। পার্ক সার্কাসের ঘিঞ্জি এলাকায় যাওয়া হয়নি আগে কখনও, কলকাতার এক অন্য রূপ দেখা হয় আমার। জালাল মুসলমান ছেলে, মুসলমান ধর্মে নয়, নামে। মুসলমান নামের কারণে কি করে ভুগতে হয় জালালকে, তার দাদাকে, তার আত্মীয় স্বজনকে তার করুণ কাহিনী সে বর্ণনা করে। তার দাদা সৈয়দ মুস্তফা সিরাজ বড় লেখক, কিন্তু তাঁকে যেমন করে ওপরে ওঠানো হয়েছিল, তেমন করেই নাকি ভূতলে ফেলেও দেওয়া হয়েছে। যে কোনও একজন মুসলমান লেখক হলেই চলে আনন্দবাজারের, তাই মুস্তফা সিরাজকে বাদ দিয়ে আবুল বাশারকে নিয়ে চলছে হৈ চৈ। ফুলবউ নামে একটি উপন্যাস লিখেছেন তিনি। বইয়ের প্রচারও হচ্ছে খুব। জালাল আমাকে ভেতরের কথা শোনায়, মুস্তফা সিরাজকে সরিয়ে দেওয়ার উদ্দেশেই নাকি আবুল বাশারকে তোলা হচ্ছে। কদিন পর বাশারকে পছন্দ না হলে তাঁকেও বসিয়ে দেওয়া হবে। বাংলা সাহিত্যের আকাশে কোন নক্ষত্র জ্বলজ্বল করবে, আলো নিবিয়ে দিয়ে কোন নক্ষত্রকে চুপসে ফেলা হবে তা নির্ধারণ করার মালিক হচ্ছে দেশ আর আনন্দবাজার গোষ্ঠী। জালালের হতাশার গহ্বর থেকে ছিটকে বেরোতে থাকে ক্ষোভ। শামসের আনোয়ারের বাড়ি গিয়েছিলাম একবার, শামসের আনোয়ার নামী কবি, তাঁরও দেখেছি রাগ হিন্দু বুদ্ধিজীবিদের ওপর। যত হিন্দু আর মুসলমান নামের সাহিত্যিকদের আমি দেখি কলকাতায়, কেউই ধর্ম মানেন না। কিন্তু তারপরও হিন্দু সাহিত্যিকদের প্রতাপে মুসলমান সাহিত্যিকরা কোণঠাসা বোধ করেন। এ কেবল সাহিত্যের জগতে নয়, সমাজের সাধারণ মানুষের মধ্যেও এই একই চিত্র। সংখ্যাগুরু হিন্দু সংখ্যালঘু মুসলমানকে মোটেও সভ্য মানুষ বলে গণ্য করে না। জালালের বর্ণনা শুনি আর বাংলাদেশের হিন্দুদের কথা মনে হতে থাকে আমার। এখানে মুসলমান আর ওখানে হিন্দু একইরকম যন্ত্রণা ভোগ করছে। আমার কাছে কে হিন্দু, কে মুসলমান সে কখনই কোনও বিষয় নয়। কোনও শিশু যখন জন্মগ্রহণ করে, সে কোনও ধর্ম নিয়ে জন্মগ্রহণ করে না। পিতামাতার ধর্মকে নিজের ধর্ম হিসেবে মেনে নিতে বাধ্য হয় যে কোনও মানুষই। কোনও এক কালে মুত্যুভয়ে, অনিশ্চয়তার আশঙ্কায়, ক্ষমতার লোভে কিছু বুদ্ধিহীন এবং কিছু কুবুদ্ধির লোক ধর্ম নামক একটি জিনিস তৈরি করেছে। ধর্ম ছড়িয়েছে এক গোত্র থেকে আরেক গোত্রে, এক সমাজ থেকে আরেক সমাজে, এক দেশ থেকে আরেক দেশে। মানুষ সব সময় যে য়েচ্ছ!য় কোনও ধর্ম গ্রহণ করেছে তা নয়, জোর জবরদস্তি করে ধর্ম চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে মানুষের ওপর। ধর্মের কারণে যুদ্ধ বেঁধেছে, লক্ষ লক্ষ মানুষের মৃত্যু হয়েছে । ভারতবর্ষে হিন্দুত্ব, ইসলাম, ক্রিশ্চান ধর্ম সবই ভারতবর্ষের বাইরে থেকে এসেছে। সেই কত কাল আগে কিছু লোক ভারতবর্ষে ঢুকেছিল, বেদ রচনা করেছিল! বসে বসে এরপর অসভ্য কিছু নিয়ম তৈরি করেছে, শ্রেণী ভেদ করেছে, জাত বর্ণ ভাগ করেছে, মানুষের মনে ঘৃণার সৃষ্টি করেছে, মেয়েদের নিকৃষ্ট আখ্যা দিয়ে পুঁথি রচনা করেছে। কত সহস্র বছর কেটে গেছে, আজও সেই নিয়ম ভারতবর্ষের অধিকাংশ লোক পরম শ্রদ্ধাভরে পালন করছে। কত নির্বোধ হলে উঁচু জাত আর নিচু জাতের সংজ্ঞায় মানুষ বিশ্বাস করতে পারে! এই জাত ভেদের আবর্জনায় ধর্মের ব্যাধি আরও জেঁকে বসেছে। একসময় নিম্নবর্ণ হিন্দুরা উচ্চবণগ হিন্দুর অত্যাচারে অতিষ্ট হয়ে নিজ ধর্ম ত্যাগ করে ইসলাম ধর্ম বা খ্রিস্টান ধর্ম গ্রহণ করেছে। মুসলমান বাঙালিদের মধ্যে বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গে কেউ কেউ দাবি করে তারা আশরাফ, তারা আতরাফ নয়। আতরাফ হল নিচু জাত। আশরাফ বড় জাত, মধ্যএশিয়া থেকে আগত মুসলমানের উত্তরসুরি। আশরাফদের অনেকে সে কারণে উর্দু চর্চা করে। যেসব মুসলমান বাংলা বলে, তারা নিম্নবর্ণ হিন্দু থেকে ধর্মান্তরিত হওয়া। বাংলা বলতে তাই উঁচু মুসলমান জাতের বড় আপত্তি। আমার বলতে কোনও সংকোচ হয় না যে আমি উঁচু শ্রেণীর নই, আমি আতরাফ, নিম্নবর্ণ হিন্দু, হিন্দু জমিদার বা হিন্দু রাজার অত্যাচারে কোনও এক কালে হিন্দুধর্ম ছেড়ে আমার পূর্বনারী বা পূর্বপুরুষ ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছিল। বাংলা আমার ভাষা, আমার সংস্কৃতি। আমি গৌরব বোধ করি আমার বাঙালিত্ব নিয়ে। ভারতবর্ষের বেশির ভাগ মানুষই ইতিহাস ঘাঁটে না। ঘাঁটলে মানুষে মানুষে ধর্মের বিভেদ, জাত বর্ণের বিভেদের মত বর্বরতা অনেক আগেই নিশ্চিহ্ন হয়ে যেত। এই ভারতবর্ষের মুক্তচিন্তার মানুষেরা বলে গেছেন সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই। দুশ বছর আগে লেখাপড়া না জানা লালন ফকির নামের এক লোক জাতের বিভেদকে তুচ্ছ করে মানবতার গান গেয়ে গেছেন। আর আজ কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় পাশ করা লোক জাত নিয়ে মাথা ঘামায়! দেখলে অবাক লাগে। মানুষ তো জানি সামনের দিকে এগোয়, আলোর দিকে। পেছনের অশিক্ষা অজ্ঞতা আর অন্ধকার আঁকড়ে রেখে কী সুখ পায় তারা!

জালালের ক্ষোভের সঙ্গে যে কোনও অত্যাচারিতের ক্ষোভই মেলে। কিডস স্ট্রিটের বাড়িটির বারান্দায় বসে অন্ধকার কলকাতার দিকে কালো চোখ মেলে তাকিয়ে থাকি। ভোর হলেই কলকাতা আড়মোড়া ভেঙে জেগে উঠবে। কলকাতা এত সুন্দর, এত আন্তরিকতা মানুষের, এত প্রাণের ছোঁয়াচ চারদিকে, এত ভালবাসি কলকাতাকে কিন্তু একটি তথ্য শুনে আমার মন খারাপ হয়ে যায় যে এ শহরে হিন্দু আর মুসলমান পাশাপাশি বাড়িতে বাস করে না। বেশির ভাগ মুসলমানই একটি নির্দিষ্ট এলাকায় থাকে। বাড়িঅলা হিন্দু হলে কোনও মুসলমানকে বাড়িভাড়া দেয় না। বাংলাদেশে এরকম কোনও নিয়ম নেই। হিন্দু মুসলমানের জন্য আলাদা আলাদা এলাকা নেই। যে কারও অধিকার আছে যে কোনও এলাকায় বাস করার। বড় বড় দালান উঠছে ঢাকা শহরে। দোতলায় হিন্দু, তিনতলায় মুসলমান, চারতলায় বৌদ্ধ, পাঁচতলায় খ্রিস্টান বাস করছে। এতে কারও কোনও আপত্তি করার কিছু নেই। বাংলাদেশে যে কোনও হিন্দুর কাছে মুসলমানের ধর্মানুষ্ঠান, রীতি নীতি কিছুই অপরিচিত নয়। মুসলমানের কাছে হিন্দুর বারো মাসে তেরো পুজোর কিছুই অজ্ঞাত নয়। অজ্ঞাত নয় কারণ তারা একজন আরেকজনের প্রতিবেশী। কলকাতার মুসলমানরা হিন্দুর পরব অনুষ্ঠান সম্পর্কে জ্ঞান রাখলেও হিন্দুরা জানে না মুসলমানের সব আচার অনুষ্ঠানাদির খবর। কলকাতায় একটি প্রশ্ন অনেকে করে, তুমি মুসলমান না বাঙালি? যেন মুসলমান হলেই অবাঙালি হতে হবে, যেন বাঙালি মানেই হিন্দু! কলকাতায় অনেক অবাঙালি মুসলমান বাস করে, তা ঠিক। কিন্তু বাঙালি মুসলমানের সংখ্যা তো কম নয়। মুসলমান নাম দেখেই তাকে অবাঙালি ভাবার রেওয়াজ অশিক্ষিত হিন্দুদের মধ্যে খুব বেশি। মেলামেলা না থাকলে এ-ই হয়। বাংলাদেশে যাদের আনাগোণা আছে, বাঙালি হিন্দু যারা বাঙালি মুসলমানদের সংস্পর্শে এসেছে, তারা এই ভুলটি সহসা করে না। তারপরও আমি দেখেছি কলকাতার বাঙালি মুসলমানের ক্ষোভের শেষ নেই। ক্ষোভের কারণটি আমি বুঝি। সংখ্যালঘু হিসেবে বেঁচে থাকার হাজারো সমস্যা। বাংলাদেশের সংখ্যালঘু হিন্দুরা কি কম নির্যাতন ভোগ করছে! যদি আমি তুলনা করি, বলব, পশ্চিমবঙ্গের বাঙালি মুসলমানরা অনেক আরামে আছে বাংলাদেশের বাঙালি হিন্দুদের চেয়ে। দীর্ঘবছর যাবৎ বামপন্থী সরকারের শাসন চলছে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যে। এই সরকার সংখ্যালঘু মুসলমানের সবরকম নিরাপত্তার ব্যবস্থা করছে। মুসলমানের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রীয় নির্যাতনের কোনও ব্যবস্থা নেই ভারতে, কিন্তু বাংলাদেশে রাষ্ট্রই সংখ্যালঘুদের দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক হিসেবে গণ্য করে। রাষ্ট্র থেকেই সংখ্যালঘুদের জন্য কোনও নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা হয় না। বাংলাদেশ হতে পারত একটি সাম্প্রদায়িক কলহমুক্ত দেশ। কারণ দেশটিতে হিন্দু মুসলমান পাশাপাশি বাস করছে, কারণ মুসলমানের ধর্মগ্রন্থ কোরানে কি লেখা আছে তা নিরানব্বই ভাগ মুসলমানই জানে না যেহেতু তাদের ভাষা আরবি নয়, জানে না বলেই তারা জানে না বিধর্র্মীদের উপেক্ষা করার কথা, জানে না বলেই জানে না বিধর্মীদের কচুকাটা করার কথা, কারণ পাশাপাশি বাস করলে সহমর্মিতা গড়ে ওঠে পরষ্পরের মধ্যে, কারণ হিন্দু মুসলমানের জন্য কোনও ইশকুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় আলাদা নয়, কারণ হিন্দু মুসলমানে বিয়ে হয়, কারণ হিন্দু মুসলমানে বন্ধুত্ব হয়, কারণ তারা বাঙালি, কারণ তাদের ভাষা এক, কারণ তাদের সংস্কৃতি এক, কারণ কোনও অবাঙালি মুসলমানের সংষ্কৃতি বাঙালি মুসলমানের ওপর বর্ষিত হয়নি, কারণ বাঙালি মুসলমানের পুর্বপুরুষ নিম্নবর্ণ হিন্দু, কারণ দেশভাগের পর পূর্ববঙ্গে রয়ে যাওয়া হিন্দু বেশির ভাগই জমিদার নয়, জমিদারের প্রজা, প্রজায় প্রজায় মিল হয় রাজায় প্রজায় মিলের চেয়ে বেশি, কারণ বেশির ভাগ হিন্দুই ওদেশে দরিদ্র অথবা হিন্দু মুসলমানের ভেদ না মানা আদর্শবাদী মানুষ। এত সব কারণ থাকা সত্ত্বেও থেকে থেকে মুসলমান নামের মানুষেরা ঝাঁপিয়ে পড়ে হিন্দুদের ওপর, লুটপাট, ধর্ষণ ইত্যাদি চলে অবাধে। এর কারণ কি? কারণ নিশ্চয়ই আছে। কারণ সাপ বেরিয়েছে গর্ত থেকে। ধর্মান্ধ সাপ। একাত্তরে যুদ্ধের সময় যে সাপেরা পাকিস্তান কায়েম করতে চেয়েছিল, যে সাপগুলোর পূর্বপুরুষ ধর্মের নামে ভারতের ভাগ চেয়েছিল; সেইসব বিষাক্ত সাপ। একটি সাপই পারে একশ মানুষকে পিছু হটাতে। সংখ্যায় কত তারা! খুব বেশি নয়। কিন্তু সংখ্যা বাড়ছে, সংখ্যা বাড়ার শব্দ পাই, হিশহিশ শব্দ শুনি বাতাসে।

আমি ভারত ভাগ দেখিনি, ভারত ভাগের কষ্ট আমার ভেতরে গভীর করে বাসা বাঁধার কথা নয়। কিন্তু বাসা বাঁধে। ধর্ম নামক একটি মিথ্যের জন্য বিশাল একটি দেশের বিভক্ত হওয়ার কষ্ট আমি লালন করি, কষ্ট আরও ঘন হয় যখন পশ্চিমবঙ্গের বাঙালিদের দেখি, বেশির ভাগই পূর্ববঙ্গে সহায় সম্পত্তি বাড়িঘর ফেলে চলে আসা উদ্বাস্তু। শূন্য থেকে গড়ে তুলেছে আবার সব। অনেকে সেই যে সাতচল্লিশ সালে দেশভাগের সময় চলে এসেছিল পশ্চিমবঙ্গে, ফিরে আর যায়নি পূবে। কেবল স্মৃতি রয়ে গেছে পুকুর ভরা মাছের, গোলা ভরা ধানের, দিগন্ত অবদি যত দূর চোখ যায় আম কাঁঠালের বনের। কলকাতার শহুরে বস্তিতে গাদাগাদি করে বাস করে পূর্ববঙ্গের স্মৃতি মধূর ঠেকে নিশ্চয়ই। কিন্তু কজন ভাবে ওদেশে যারা রয়ে গেছে, দারিদ্র বা আদর্শের কারণে যারা ওপার থেকে এপারে আসেনি, তারা কেমন আছে! এই ভাবার দায়িত্বটি বাংলাদেশ নামের নতুন একটি দেশের নতুন মানুষের। কেবল ভাবা নয়, প্রচুর কাজও আছে করার। প্রথম ভারত ভ্রমণের পরই উথলে পড়া আবেগ থেকেই কয়েকটি কবিতা লিখেছিলাম দুই বাংলার অভিন্নতা নিয়ে, কাঁটাতারের নির্মমতা নিয়ে, ভারত ভাগের মিথ্যে নিয়ে। ধর্ম ধর্ম করে যে ভারত ভাগ হল, মুসলমানের জন্য পাকিস্তান নামে দুই খণ্ডের একটি দেশ হল, কই মুসলমানরা তো এক দেশে বাস করতে পারেনি! একাত্তরের যুদ্ধে পাকিস্তান ভেঙে বাংলাদেশ হওয়াই তো প্রমাণ করেছে ভারত ভাগের সিদ্ধান্ত ভুল ছিল। আমার কবিতাগুলো ছাপা হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বিষাক্ত সাপের দল আমাকে অবলীলায় দেশদ্রোহী হিসেবে আখ্যা দিয়েছে। মৌলবাদিদের পত্রিকায় আমাকে গালাগাল করে প্রায়ই লেখা বেরোয়। কখনও পড়া হয়, কখনও হয় না। যার যা ইচ্ছে লিখুক, আমার কিছু যায় আসে না। আমি আমার অনুভবের কথা লিখে যাবো। আমি আমার অন্তর্গত বিষাদের কথা, বেদনার কথা লিখে যাবো। আমি আমার স্বপ্নের কথা অসংকোচে লিখে যাবো। একটি অখণ্ড ভারতবর্ষের স্বপ্ন আমি গোপনে গোপনে দেখি, না হলেও অখণ্ড একটি বাংলার স্বপ্ন আমার হৃদয় যমুনায় সাঁতার কাটে।

কলকাতায় এসেই চেনা পরিচিত বন্ধুদের জন্য আনা উপহার বাড়ি বাড়ি গিয়ে দিয়ে আসি। খুব ভাল লাগে উপহার দিতে মানুষকে। সুভাষ মুখোপাধ্যায় যখন শিশুর মত খুশি হয়ে ওঠেন ফতুয়া পেয়ে, দেখে খুব আনন্দ হয়। উপহার দেওয়ার স্বভাবটি, আমার বিশ্বাস, আমি মার কাছ থেকে পেয়েছি। মাকে যতই অপছন্দ করি আমি, রক্ত বলে একটি ব্যপার আছে, রক্তের মধ্যে তিনি খানিকটা হলেও আছেন। মা এরকম নিজের যা কিছু আছে অন্যকে বিলিয়ে দিয়ে সুখ পান। নিজের খুব বেশি কিছু নেই মার। না টাকা পয়সা, না গয়নাগাটি, না শাড়ি কাপড়। নিঃস্ব মাকে বারবারই দেখি আরও নিঃস্ব হতে। মার এই বেহিসেবী উদার হওয়া দেখে মার ওপর সময় সময় রাগ করি আমি। একটি শাড়ি হয়ত দিলাম মাকে, মা দুদিন খুব খুশি হয়ে শাড়িটি পরলেন, কদিন পরই দেখি সেই শাড়ি গদার মার গায়ে। গদার মার শাড়ি নেই, ত্যানা পরে ভিক্ষে করতে আসে, দেখে মা দিয়ে দিয়েছেন শাড়িটি। ইয়াসমিনেরও দেখি হাত হয়েছে দেওয়ার। কিন্তু মার মত এমন নিজেকে নিঃস্ব করে নিঃস্বার্থ হতে আমি বা ইয়াসমিন কেউই পারি না। দাদা আর ছোটদা পেয়েছেন বাবার স্বভাব, পাই পয়সার হিসেব করেন। তাঁরা বাবার চেয়েও কয়েক কাঠি ওপরে। বাবা অন্তত গরিব রোগীদের বিনে পয়সায় চিকিৎসা করেন। আসলে চিকিৎসা করা বাবার নেশা। পয়সা পাবেন না বা কম পাবেন বলে তিনি প্রেসক্রিপশন লেখা থেকে নিজেকে বিরত রাখেন না। শহরের ধনী গরিব সকলেই বাবার চিকিৎসায় ভাল ফল পেতেন, এখনও পান, কিন্তু বাবার চেম্বারে ভিড় এখন আগের চেয়ে অনেক কম, বেশির ভাগই দূর দূরান্ত থেকে আসা চেম্বারের বারান্দায় পাতা চেয়ারগুলোয় চামড়া- ফাটা পা তুলে বসে থাকা গরিব রোগী। ময়মনসিংহে নতুন নতুন বিশেষজ্ঞ ডাক্তার আসার পর ধনী রোগীরা এখন তাঁদের কাছেই যান। পুরোনো অভিজ্ঞ ডাক্তার বাবার কাছে অবশ্য আসেন কেউ কেউ, বিশেষজ্ঞের চিকিৎসায় সুস্থ না হলে তবে আসেন। দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতার মূল্য অনেক, চেহারা দেখেই বলে দিতে পারেন যক্ষা হয়েছে, এক্সরে করার দরকার পড়ে না। বাবার মেডিকেল কলেজে অধ্যাপনার চাকরি, চেম্বারে রাত বারোটা পর্যন্ত রোগী দেখার ব্যস্ততা, তারপরও ফাঁক পেলেই তিনি তাঁর পুরোনো ডাক্তারি বই পড়েন। যেদিন ক্লাস থাকে, তার আগের রাতে বাড়িতে রাত দুটো তিনটে পর্যন্ত লেখাপড়া করেন। বাবার ব্যস্ত জীবনটি আমাকে বরাবরই মুগ্ধ করেছে। আমার নিজের জীবনটিকে বসে থাকা শুয়ে থাকার আলস্য না দিয়ে এই যে ব্যস্ত করে তুলেছি, ব্যস্ততায় বাবার মত আনন্দ পাচ্ছি, সেটি তো বাবার কাছ থেকেই পাওয়া। বাবা মার কত রকম স্বভাব যে আমাদের রক্তে আর মস্তিস্কে ঘাঁপটি মেরে থাকে, ধীরে ধীরে সেই স্বভাবগুলো আমাদেরই অজান্তে আমাদের চরিত্রের অন্তর্গত হয়ে যায়। আমার নিজের চরিত্রটির ব্যাখ্যা আমি অনেকসময় করতে পারি না। একসময়ের লাজুক মেয়ে, যে মেয়ে অচেনা মানুষ দেখলে লুকোতো, দিব্যি সে নতুন নতুন মানুষের সঙ্গে পরিচিত হচ্ছে, কথা কম বলা মানুষটি মুখে খই না ফোটাতে পারলেও দিব্যি গড়গড় করে কথা বলছে। আগের আমি আর এই আমিকে মোটেও মেলাতে পারি না। কলকাতায় চেনা পরিচিতদের সংখ্যা বাড়ছে। কলকাতাকেও ঢাকার মত আপন মনে হয়। বড় বড় লেখক শিল্পীদের সঙ্গে পরিচয় হয়েছে, কিন্তু সাধারণ মানুষের সঙ্গে কথা বলে আমি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করি বেশি। বিশেষ করে যদি হৃদয়বান কেউ হয়। ইন্দ্রনাথ মজুমদারের মুখের সরল হাসিটি দেখে তাঁকে বড় আপন মনে হয় আমার। চমৎকার আলাভোলা মানুষ এই ইন্দ্রনাথ। সুবর্ণরেখা নামে কলকাতার কলেজ স্ট্রিটেও একটি বইয়ের দোকান আছে তাঁর। দোকানটি খুঁজে পেতেই আমার সময় লেগেছে অনেক। দোকান পাওয়া গেল কিন্তু সেটি এত ছোট যে দাঁড়াবার জায়গা নেই। পুরোনো বইয়ে ঠাসা ঘরটি। পুরোনো বই বিক্রি করেন ইন্দ্রনাথ, নতুন বইও ছাপেন, তবে আলতু ফালতু কোনও বই নয়, বইএর মত বই হলেই ছাপেন। ব্যবসার চেয়ে আদর্শই বেশি কাজ করে বই ছাপার পেছনে। একটি ভাল বই পেলে সে বই হয়ত বিক্রি হবে না খুব, তবু আর কেউ না ছাপলেও তিনি ছাপেন। যেদিন দুপুরে গেলাম ইন্দ্রনাথ মজুমদারের সঙ্গে দেখা করতে, তিনি বেরিয়ে পড়লেন আমাকে নিয়ে কড়া রোদ্দুরে। বললেন ‘খাচ্ছেন তো বড় বড় জায়গায়, আজ চলুন আপনাকে একটা খুব ভাল জায়গায় নিয়ে যাই।’ ভাল জায়গাটি কোথায়? ভাল জায়গাটি হল এক এক উড়ের দোকান। উড়ের দোকানে বসে কলাপাতায় মাছভাত খাই দুজন। খুব অল্প পয়সায় খাওয়া। এই খাওয়াতে যে আনন্দ পেয়েছি, তা ঝকঝকে দামি রেস্তোরাঁয় বসে পাইনি।
 
কলকাতায় অনুষ্ঠান লেগেই থাকে। রবীন্দ্র সদনে, শিশির মঞ্চে, কলা মন্দিরে, একাডেমিতে কিছু না কিছু হচ্ছেই। রবীন্দ্রসদনে কবিদের কবিতা পাঠের অনুষ্ঠান হল একদিন। সৌমিত্র মিত্র আলতাফ হোসেন আর আমাকে ঢুকিয়ে দিলেন কলকাতার কবিদের সঙ্গে মঞ্চে বসে কবিতা পড়ার জন্য। কলকাতার মঞ্চে আগে কবিতা পড়েছি, আড়ষ্টতা তাই কমই ছিল এবার। আলতাফ হোসেনের জন্য প্রথম পড়া কলকাতায়, লাজুক মানুষটি স্বর ওঠাতে পারলেন না তেমন, গালে আর গলায় ওঠানো আঙুলকেও নামাতে পারলেন না কবিতা পড়ার সময়। বাংলাদেশের কবিদের কলকাতায় বেশ খাতির করা হয়। মুসলমান নামের মানুষগুলো অন্য দেশ থেকে এসে বাংলায় কথা বলছে, বাংলায় কবিতা পড়ছে, দেখতে হয়ত অনেকে মজা পায়। কারও কারও আছে করুণার চোখ। বেচারা বাংলাদেশিদের পিঠে দাদাগিরির কয়েকটি চালিয়ে যাও, মন্দ হচ্ছে না জাতীয় স্নেহের চাপড় পড়ে। কেউ কেউ আবার বাংলাদেশের যে কোনও ব্যপারে অতিমাত্রায় উচ্ছ্বসিত। বাংলাদেশের ধুলো বালি জল কাদা এনে দিলেও গায়ে মাখবে। পশ্চিমবঙ্গের কিছুই ভাল নয়, যত ভাল সব ওই বাংলাদেশ নামের দেশটিতে, আবেগের তাড়নায় এমন কথাও বলে ফেলে। বাঙালদের খানিকটা চিড়িয়া, খানিকটা মানুষ, সরল সহজ, আন্তরিক, অতিথিপরায়ণ, দুহাতে খরচ করতে পারা, বেহিসেবী, অলস, আরামপ্রিয়,খানেঅলা, দানেঅলা, পকেট ভারিঅলা, কিছু কম জানেঅলা, কিছু কম বুঝনেঅলা বলে মনে করা হয়। অনুষ্ঠানে নতুন অনেক কবি আর আবৃত্তিকারের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন সৌমিত্র মিত্র। জয় গোস্বামীর মত প্রতিভাবান কবির সঙ্গে সামান্য হলেও কথা হয়। গায়ে মেদ মাংস নেই আধা সন্ন্যাসী গোছের মানুষটি আজকাল কী চমৎকার কবিতা লিখছেন! শরীরে প্রতিভা থাকে না। প্রতিভা মস্তিস্কের কোষে কোষে জন্ম থেকেই বাস করে। আমার অনুর্বর মস্তিস্কে যতই জল সার ঢালি না কেন, জয়ের প্রতিভার শতভাগের একভাগও গজাবে না। যার হয় তার হয়। সকলের হয় না। সকলের হলে সকলেই কবি হত। প্রতিভা থাকলে শরীরে মাংস কমাবার বা বাড়াবার দরকার পড়ে না। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের মত বিশাল বপুর লোকও প্রতিভার কারণে সুদর্শন হয়ে ওঠেন। হাড়গিলে জয়কে হাড়গিলে বলে মনে হয় না। নিজের পেচ্ছ!বের অসুখ নিয়ে যতই তিনি দুঃখ করুন, তাঁকেই মনে হয় একশ লোকের মধ্যে সবচেয়ে স্বাস্থ্যবান।

সৌমিত্র নিজে আপাদমস্তক ঘটি হয়েও বাঙালদের জন্য সময় না থাকলেও সময় তৈরি করে সময় দেন। সৌমিত্রর সঙ্গে মিত্রতা না থাকলে কলকাতায় স্বচ্ছন্দে চলাফেরা সহজ হত না। আমাদের সারাক্ষণের সঙ্গী না হলেও অন্তত তিনি বলে দেন কী প্রয়োজন হলে কোথায় যেতে হবে। একা একা ঘুরে ঘুরে পথ হারাতে হারাতে আর খুঁজে পেতে পেতে শহর চেনা যায়, গাড়ির জানালা দিয়ে তাকিয়ে শহর সত্যিকার চেনা যায় না। আমার ভাল লাগে ভিড় ভাট্টায় হেঁটে বেড়াতে, সরু সরু পুরোনো গলিতে ঢুকে মানুষের জীবন দেখতে, রাস্তার কলের জলে স্নান করা মানুষ দেখতে, ভাল লাগে ফুটপাতে দাঁড়িয়ে মাটির ভাঁড়ে চা খেতে, কলেজ স্ট্রিটের বই পাড়ায় হেঁটে হেঁটে বই কিনতে, গড়িয়াহাটের ফুটপাত থেকে শাড়ি কিনতে। কত কী যে করার আছে কলকাতায়! সাধ মেটার আগে সময় ফুরিয়ে যায়। কেবল তো শান্তিনিকেতনের বসন্ত উৎসব দেখতে আর রবীন্দ্র সদনে কবিতা পাঠ উপভোগ করতে পশ্চিমবঙ্গে আসিনি। কিছু দায়িতও্ব আছে কাঁধে। লাল কালো বইটি পৌঁছে দিতে হবে শ্রী শ্রীপান্থকে, বেলাল চৌধুরী বলে দিয়েছেন। কাঁধের দায়িত্বটি নিয়ে প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিটে আনন্দবাজার আপিসে রাকা আর আলতাফকে নিয়ে ঢুকি, উদ্দেশ্য দুটো, শ্রীপান্থকে লাল কালো বইটি দেওয়া আর শংকর লাল ভট্ট াচার্যকে একটি নির্বাচিত কলাম দেওয়া। শংকর লাল ভট্টাচার্য সানন্দা পত্রিকায় চাকরি করেন, একবার ঢাকা গিয়েছিলেন, তখন পরিচয় হয়েছিল, কলকাতাতেও দেখা হয়েছিল আগের বার। তিনি আনন্দবাজারর ছাদে বসে সাহিত্যিক অনেক বিষয় নিয়ে অনর্গল বলছিলেন, যার বেশির ভাগই আমার মাথায় ঢোকেনি। তবে একটি জিনিস ঢুকেছিল, তা হল মানুষটি বিদেশি সাহিত্য বেশ পড়েছেন, মাথায় কিলবিল করছে বিদ্যে। পড়ুয়া লোক যত দেখি কলকাতায়, তত কিন্তু ঢাকায় দেখি না। বাঙালি হিন্দুর পড়ার অভ্যেস অনেককালের। বিদ্যাচর্চায় বাঙালি হিন্দু বাঙালি মুসলমানের চেয়ে একশ বছর এগিয়ে আছে। মেঘচ্ছদের ভাষা পড়ব না বলে বাঙালি মুসলমান অহংকার করেছিল, বাঙালি হিন্দু করেনি। সেটির প্রভাব তো কিছুটা থাকবেই। শ্রীপান্থ কোন ঘরে বসেন, বারান্দায় হাঁটতে থাকা একজনকে জিজ্ঞেস করে জেনে নিই। ঘরের দরজা ঠেলি ভয়ে ভয়ে, ভয়ে ভয়ে এ কারণে যে ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা ঘরগুলোয় জ্ঞানের ভাণ্ডারগুলো গম্ভীর গম্ভীর মুখ করে বসে থাকেন, আবালের মত ঢুকে কোনও গভীর কিছুতে কারও তন্ময় হয়ে থাকাকে নষ্ট করে দিই যদি! ঘরে ঢুকে দেখি গোল মুখের একটি ছোটখাটো লোক আর দুজন গোল মুখের চেয়ে অল্প বয়সের, বসা। তিনজনই লিখছেন।

‘এখানে কি শ্রীপান্থ বলে কেউ আছেন?’ জিজ্ঞেস করতেই গোল মুখের মধ্যবয়ষ্ক লোকটি কাগজ থেকে মাথা তুলে কলম থামিয়ে বললেন, আমি শ্রীপান্থ।’

‘আমি ঢাকা থেকে এসেছি। বেলাল চৌধুরী আপনার জন্য একটা বই পাঠিয়েছেন।’

‘কি বই?’

‘লাল কালো।’

‘লাল কালো?’

বইটি তাঁর হাতে দিলে তিনি আমাকে বসতে বললেন। ভেবেছিলাম, বই পেয়ে ‘ঠিক আছে, ধন্যবাদঞ্চ বলে তিনি আমাকে বিদায় দেবেন। সে তো দিলেনই না, রাকা আর আলতাফকেও বসতে বললেন তিনি। বইটি হাতে নিয়ে শ্রীপান্থ বেশ খুশি। পাতা উল্টো ছবিগুলো দেখে মুখে হাসি ফুটছে তাঁর। বললেন ‘কলকাতায় তো লাল কালোর রিপ্রিন্ট নেই, বাংলাদেশ থেকেই শেষ অবদি বইটি বেরোলো। কলকাতার কড়চায় আমি এর একটি খবর করে দেব।’ আনন্দবাজার পত্রিকায় কলকাতার কড়চা বিভাগটি শ্রীপান্থই দেখেন। তাছাড়া তিনি পত্রিকার সম্পাদকীয় লেখেন প্রায়ই। ঘরের টলটল করা প্রতিভা অনির্বাণ চট্টোপাধ্যায় আর গৌতম রায়কে শিখিয়ে পড়িয়ে তুখোড় সাংবাদিক বানাচ্ছেন। কি নাম আপনার, কোথায় বাড়ি, কি করেন ইত্যাদি প্রশ্নের উত্তর তসলিমা, ময়মনসিংহ, ডাক্তারি সবিনয়ে উল্লেখ করি। রাকা আর আলতাফের পরিচয়ও দেওয়া হয়।

চা আসে। দুধ চা। খেতে খেতে শ্রীপান্থ বললেন তাঁর বাড়িও ময়মনসিংহে। দেশভাগের সময় চলে এসেছেন এপারে।

‘ময়মনসিংহের কোথায়?’ আমার কণ্ঠে সিংহের আগ্রহ।

‘ধোবাউড়া।’

ধোবাউড়া ছেড়ে সেই যে চলে এসেছেন আর ফিরে যাননি কোনওদিন। পূর্ববঙ্গ থেকে ভারত ভাগের পর যারা চলে এসেছিলেন এদেশে, তাদের অনেকের মত শ্রীপান্থেরও আর ফিরে যাওয়া হয়নি দেশের মাটিতে। ইচ্ছে করেন যাবেন একবার, দেখে আসবেন কেমন আছে দেশটি। ইচ্ছে থাকলেও সকলের হয় না যাওয়া। বাাংলাদেশ থেকে এলে পূর্ববঙ্গের কিছু লোক বেশ খাতির করেন। শ্রীপান্থও আমাকে খাতির করলেন। খাতির করা মানে বসতে বলা, নাম ধাম জিজ্ঞেস করা। বাড়ি কোথায়, কি করি, জিজ্ঞেস করা, চা খাওয়ানো। সবই করেছেন তিনি। এবার বিদায় নেবার পালা। যখন বিদায় নেব, জিজ্ঞেস করলেন, ‘আপনি কি লেখেন টেখেন নাকি?’

শুনে আমার কান লাল হয়ে উঠল। যৎসামান্য লিখি বটে, কিন্তু তা নিশ্চয়ই উল্লেখ করার মত নয়, বিশেষ করে এমন পণ্ডিত ব্যক্তির সামনে। আমার পক্ষে বলা সম্ভব হয় না যে আমি লিখি। আলতাফ বলেন, ‘ও লেখে। ও তো বেশ বিখ্যাত হয়ে উঠেছে বাংলাদেশে।’ ‘তাই নাকি!’

শ্রীপান্থ ওরফে নিখিল সরকার মুচকি হাসলেন।

আমি লজ্জায় নখ খুঁটতে থাকি।

‘হাতে কোনও বই টই আছে?’

‘বই!’

‘আপনার লেখা কোনও বই আছে আপনার কাছে?’

ব্যাগের ভেতর একটি নির্বাচিত কলাম আছে। বইটি শংকরলাল ভট্টাচার্যের জন্য। বড় সংকোচে ব্যাগ থেকে বইটি দেখতে দিই নিখিল সরকারকে। তিনি হাতে নিয়ে উল্টো পাল্টো বললেন, ‘আমার কাছে থাকুক এটা।’

মৃদু স্বরে বলি, ‘শংকরলাল ভট্টাচার্যের জন্য এনেছিলাম।’

‘আমাদের সানন্দার শংকর তো! ওকে পরে একটা দিয়ে দেবেন।’

ফটো তোলার এক লোককে ডেকে তিনি বললেন, ‘মেয়েটার একটা ছবি তুলে দাও তো! বাংলাদেশের মেয়ে, ওর বইয়ের একটা খবর করে দেব কড়চায়।’

সাদা আবার সাদাও নয়, সুতোয় আঁকা ছোট ছোট লাল কালো ফুলের তসরের শাড়ি পরা, কপালে একটি লাল টিপ, মুখে মলিন হাসি, ওভাবেই— ক্লিক। কলকাতার আনন্দবাজার পত্রিকায় আমার বইয়ের খবর ছাপা হবে, তাও আবার ছবি সহ! আনন্দ করব কি, বিস্ময়ে বোবা হয়ে থাকি। বাংলাদেশের কবি সাহিত্যিকদের জন্য দেশ আনন্দবাজারে চিরকালই নাগালের বাইরে। কখনও দেশ পত্রিকায় কারও কবিতা ছাপা হলে নাক এমন উঁচুতে ওঠে, যে বছর পার হলেও সে নাক স্বাভাবিক অবস্থায় ফেরে না। এই যখন অবস্থা, তখন আমার মত পুঁচকে নতুন লেখক বিস্ময়ে বোবা হবে না কেন!

বিস্ময়ে বোবা কত আর হয়েছি সেদিন! আমার জন্য সহস্রগুণ বিস্ময় অপেক্ষা করছিল কলকাতা থেকে ঢাকায় ফিরে আসার কিছুদিন পর। ফিরে এসে হাসপাতালের ডিউটি, ফাঁকে চার পাঁচটে পত্রিকায় নিয়মিত কলাম লেখা, মাঝে মাঝে প্রকাশকের তাগাদার উপন্যাস রচনা করা, এসব নিয়ে চলছিল। হঠাৎ চিঠি। চিঠি আনন্দবাজার পত্রিকা থেকে। নির্বাচিত কলাম বইটির জন্য দেশ আনন্দবাজারের ১৯৯২ সালের আনন্দ পুরষ্কার আমাকে দেওয়া হচ্ছে। নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারি নি। আবার পড়ি চিঠি। আবারও। চিঠি কি ভুল করে আমার কাছে এসেছে! কিন্তু আমার নামটিই তো লেখা চিঠির ওপর। স্বপ্ন দেখছি না তো! না, স্বপ্নেরও তো সীমা আছে, আমার স্বপ্ন এত সীমা ছাড়িয়ে কখনও যায়নি। আমি যে আনন্দ-চিৎকারে বাড়ি ফাটাবো, সে জিনিসটিও করতে পারি না। বোবা হয়ে আছি। রক্ত চলাচল থেমে আছে বিস্ময়ে। বাংলা সাহিত্যে আনন্দ পুরষ্কার হচ্ছে সবচেয়ে বড় পুরষ্কার। সবচেয়ে নামী। সবচেয়ে দামী। বাংলাদেশের কেউই এ পর্যন্ত এ পুরষ্কার পায়নি। আর আমি সেদিনের এক লেখক, তাও শখের লেখক, শখে কবিতা লিখি, প্রয়োজনে কলাম লিখি, আমি কি না পাচ্ছি এই পুরষ্কার! কী করে সম্ভব এটি! অসম্ভব অবিশ্বাস্য একটি ঘটনা। আমি ঠিক বুঝে পাই না আমি কি করব। একবার বসি, একবার দাঁড়াই। একবার আয়নার সামনে গিয়ে নিজেকে অবাক চোখে দেখি, এ ঠিক আমি তো! পেচ্ছ!ব চাপে। মাথা ঘুরতে থাকে। বোবা হয়ে থাকার পাট চুকলে বাড়িতে এক মিলনই ছিল, তাকেই হাঁপাতে হাঁপাতে বলি, ‘মিলন আমি আনন্দ পুরস্কার পাইছি।’ আনন্দ পুরস্কার ঠিক কি জিনিস, মিলন জানে না। এটি যে যায় যায় দিনের রচনা পুরস্কার জেতার মত নয়, এ যে অন্য কিছু খুব বড় কিছু অসম্ভব রকমের বড় তা বুঝিয়ে বলার পর মিলন হাঁ হয়ে থাকে। মিলন বোনের স্বামী হলেও আমার কাছে ঠিক বোনের স্বামী নয়, ছোট ভাই গোছের কিছু। চিঠিটি হাতে নিয়ে মিলনকে বলি, ‘তাড়াতাড়ি রেডি হও।’ মিলন দ্রুত লুঙ্গি ছেড়ে প্যান্ট পরে নেয়। প্রথমেই খোকার বাড়িতে যাই। খোকা ডাকাডাকি শুনে বাইরে বেরোলে চিঠিটি হাতে দিয়ে উল্লসিত কণ্ঠে বলি, ‘আনন্দ পুরষ্কার, খোকা ভাই। আমি আনন্দ পুরষ্কার পাচ্ছি।’ খোকা মলিন হাসেন। কেন হাসিতে মালিন্য, বুঝি না। খোকার তো খুশিতে উন্মাদ হয়ে যাওয়ার কথা। আমার যে কোনও সাফল্যে সবচেয়ে বেশি খুশি হতেন খোকা। সেই খোকার কেন এই অখুশি মুখ! কেন প্রাণহীন একটি হাসি তিনি উপহার দিলেন আমাকে! খোকা কি তবে ভাবছেন, আমি আকাশ ছুঁয়ে ফেলছি, এত বেশি উঁচুতে ওঠায় তাঁকে খুব ক্ষুদ্র লাগছে দেখতে! খোকা কি ভাবছেন তিনি আর কখনও আমার নাগাল পাবেন না! জানি না কেন। খোকার নির্লিপ্তি আমার মন খারাপ করে দেয়। সুখবরটি বেলাল চৌধুরীকে জানানোর জন্য আগামীকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করা আমার সইছিল না। রাত হয়ে গেছে, তবুও খুঁজে খুঁজে বেলাল চৌধুরীর বাড়ি বের করে ঢুকি। আমাকে দেখে চমকালেন তিনি, আগে কখনও তাঁর বাড়ি যাইনি। এত রাতে হন্তদন্ত হয়ে তাঁর বাড়ি যাওয়ার কারণ তিনি বুঝতে পারছেন না। ‘বেলাল ভাই, আমাকে আনন্দ পুরস্কার দেওয়া হচ্ছে। চিঠি এসেছে। আমার বিশ্বাসই হচ্ছে না। কি রকম যেন লাগছে।’

চিঠিটি বেলাল চৌধুরীর হাতে দিই। তিনি পড়ে উচ্ছঅ!স প্রকাশ করেন। বউকে বলেন আমাকে মিষ্টি মুখ করাতে। ব্‌উ মিষ্টি খেতে দেন। আমার কি আর মিষ্টিতে মন! বেলাল চৌধুরীর হাতে আমার এই বিস্ময় আর আনন্দ ভাগ করে দিয়ে আমি হালকা হই। কখনও কোনও কোনও আনন্দের বোঝা একা আমার পক্ষে বহন করা দুঃসহ হয়ে ওঠে।

‘আমি কি এত বড় পুরস্কার পাওয়ার যোগ্য বেলাল ভাই?’

‘নিশ্চয়ই নিশ্চয়ই। তুমি ভাল লিখছো। নিশ্চয়ই তুমি যোগ্য। ওরা তো আর তোমার মুখ দেখে পুরষ্কার দেয়নি! বুঝলে, আনন্দ পুরষ্কার হচ্ছে বাঙালি সাহিত্যিকদের জন্য স্বপ্নের বিষয়। আনন্দ পুরষ্কার হচ্ছে গিয়ে বাংলার নোবেল প্রাইজ।’

খোকার নির্লিপ্তি যতটা আমাকে যে কষ্টটুকু দিয়েছিল, বেলাল চৌধুরীর উচ্ছঅ!সে সেই কষ্ট মুছে যায়। কিন্তু বাড়ি ফিরে সারারাত আমার ঘুম হয় না। অনেক রাত্তির পর্যন্ত একা একা জেগে বসে থাকি। আজ যদি রুদ্র বেঁচে থাকত! রুদ্র নিশ্চয়ই আমার জন্য গর্ববোধ করত। পূর্বাভাসে আমার কলাম পড়ে রুদ্র একবার চিঠি লিখেছিল , সে চিঠি ছাপাও হয়েছিল পূর্বাভাসের চিঠিপত্র কলামে। লিখেছিল তার সঙ্গে যা হয়েছে আমার তার দায় সে বহন করছে, আমি যেন তাকে ক্ষমা করে দিই এবং সমস্ত পুরুষজাতিকে আমি যেন নিস্তার দিই এমন হেনস্থা থেকে। আহা রুদ্র! আমি তোমার ওপর রাগ করে একটি বাক্যও লিখছি না। সমস্ত পুরুষজাতির বিরুদ্ধে আমি লড়ছি না। আমি কেবল সমাজের নষ্ট নিয়মের বিরুদ্ধে লড়ছি, যে নিয়ম নারীকে দাসী করে, পণ্য করে, যৌনসামগ্রী হিসেবে ব্যবহার করে, নারীকে মানুষ হিসেবে মর্যাদা না দেওয়ার জন্য সমাজ, রাষ্ট্র আর ধর্মের ষড়যন্ত্রের আমি প্রতিবাদ করছি। যখন লিখি আমি কাঁদি, আমার জন্য নয়, কাঁদি ওই সুফিয়া খাতুনের জন্য, যাকে ধর্ষণ করে মাটির তলায় জ্যান্ত পুতে ফেলেছে কিছু লোক, ফরিদার জন্য, যে মেয়ে প্রেমের প্রস্তাবে রাজি হয়নি বলে পাড়ার এক ছেলে ফরিদার মুখে এসিড ছুঁড়ে পুড়িয়ে দিয়েছে মুখ, সখিনা বানুর জন্য যার বাবা বিয়েতে যথেষ্ট যৌতুক দিতে পারেনি বলে স্বামী তাকে মেরে হাত পা ভেঙে তালাক দিয়েছে, শরিফা খাতুনের জন্য, কন্যা সন্তান জন্ম দেওয়ার অপরাধে যাকে দা দিয়ে কুপিয়ে মেরেছে স্বামী, কাঁদি নুরজাহানের জন্য, যে মেয়ে এক পরপুরুষের সঙ্গে কথা বলেছে বলে পাথর ছুঁড়ে মেরেছে লোকেরা, ফুলমতির জন্য, যে মেয়েকে প্রেম করার অপরাধে লোকেরা আগুনে পুড়িয়ে মেরেছে। আমি তো ভালই আছি, শহরের বড় হাসপাতালে ডাক্তারি করি, নিজের পায়ে দাঁড়িয়েছি, জীবনের যে কোনও সিদ্ধান্ত আমি নিজেই নিই, নিজে যেমন পছন্দ করি, তেমন জীবন যাপন করি। আমার মত কজন মেয়ে এমন প্রচণ্ড বেঁচে আছে! কিন্তু আমি কখনও ভুলে যাই না যে আমি সুফিয়া খাতুনের মত, নুরজাহানের মত, সখিনা বানুর মত একজন। আমারও হতে পারত যা হয়েছে ওদের।

পুরস্কার আনতে এবারের আমন্ত্রণ অন্যরকম। যাওয়া আসার টিকিট, কলকাতায় থাকা সবই এখন আনন্দবাজারের দায়িত্ব। আহলাদে মাটিতে পা পড়ে না আমার। মুই যেন কি হনুরে জাতীয় একটি ভাব যখন আমাকে গ্রাস করছে,তখনই বইটির দুটো কলামের কথা মনে করে আঁতকে উঠি। কেউ যেন ধারালো একটি সুই দিয়ে খোঁচা দিয়ে আমার ফুলে ওঠা অহংকারকে চুপসে দিল। বেদ সম্পর্কে লিখতে গিয়ে, যদিও আমার কাছে সব কটি বেদ এর খণ্ড ছিল তারপরও বেদ বিশেষজ্ঞ সুকুমারী ভট্টাচার্যের প্রাচীন ভারত ও বৈদিক সমাজ বই থেকে না টুকে পারিনি। কী এক ঘোরের মধ্যে বাক্যের পর বাক্য টুকে নিয়েছি। বইটি আমাকে এমনই প্রভাবিত করেছে যে আমি পারিনি নিজেকে সুকুমারী থেকে মুক্ত করে নিজের আলাদা কোনও মত প্রকাশ করতে। সুকুমারী থেকে বেদের অনুবাদটুকুই নিতে পারতাম, কিন্তু তাঁর মন্তব্যও চুরি করতে গেলাম কেন! চুরি করতে গেলাম এই জন্য যে তাঁর মতের সঙ্গে আমার মত হুবুহু মিলে যায়। এমন সুন্দর ব্যাখ্যা দিয়েছেন তিনি বেদএর শ্লোকের যে বইটি না পড়লেও ঠিক এমনই ব্যাখ্যা আমার মনে উদয় হত। আমার কথাই যেন তিনি আমার বলার আগে বলে দিয়েছেন। কলাম দুটো পত্রিকায় ছাপা হওয়ার পর ক্ষীণ একটি গ্লানি আমাকে নিস্তার দেয়নি। ব্যপারটি এক বালতি খাঁটি দুধের মধ্যে দুফোঁটা চোনা মিশিয়ে পুরো দুধকেই নষ্ট করে দেওয়ার মত। আনন্দ পুরস্কারের খবর পেয়ে প্রথম আমার মনে পড়েনি আমার এই চুরির কথা। হঠাৎ যখন মনে পড়ে, গ্লানি আর লজ্জা আমাকে কেঁচোর মত নিজের গর্তে ঢুকিয়ে রাখে। ঘৃণায় নিজের দিকে তাকাতে ইচ্ছে করে না। সে রাতেই বেরিয়ে পড়ি টেলিফোন আপিসে গিয়ে কলকাতায় জরুরি একটি ফোন করার জন্য। নিখিল সরকারকে ফোনে জানাই যে আমার এই নির্বাচিত কলাম পুরস্কার পাওয়ার যোগ্য নয়, কারণ বইটির ভেতরে দুটো কলাম আছে, যেখানে সুকুমারী ভট্টাচার্যের বই থেকে অনেক কিছু নেওয়া হয়েছে। আমার এই স্বীকারোক্তি শোনার পর যদি তিনি বলতেন যে তিনি পুরস্কার কমিটিকে ব্যপারটি অবগত করে আনন্দ পুরস্কারটি আমাকে যেন না দেওয়া হয় তার জন্য তদবির করবেন, হালকা হতে পারতাম। তাঁকে মনে হল না তিনি আদৌ আমার এই চুরি নিয়ে দুশ্চিন্তা করছেন। জানি চুরি অনেকেই করে। সৈয়দ শামসুল হকের প্রথম লেখাটি, তিনি নিজেই বলেছেন, চুরি করে লেখা। দাঁড়ি কমাও বাদ দেননি চুরিতে। কিন্তু আমার তো এটি প্রথম লেখা নয়। রীতিমত যখন নাম করে ফেলেছি লিখে, তখন চুরি করা। আমাকে আমিই ক্ষমা করতে পারছি না, অন্যরা কি করে করবে! পুরস্কার পেলে মানুষের আনন্দ হয়, আমার হচ্ছে লজ্জা। নিখিল সরকারকে সুকুমারী-তথ্যটি জানিয়ে তাঁর কোনও প্রতিক্রিয়া না দেখে লজ্জার ওপর ভয় এসে ভর করে। তবে কি পুরস্কারটি আমাকে নিতেই হবে! কী করে মুখ দেখাবো আমি! কী করে এই লজ্জা আমি ঢাকবো! চেতনার জানালা দরজায় শব্দ হতে থাকে প্রচণ্ড, আমি কী এমন লেখক যে এত বড় একটি পুরস্কার পাবো! এতকাল যাঁরা আনন্দ পুরস্কার পেয়েছেন তাঁরা আমার চেয়ে কয়েক লক্ষ গুণ ভাল সাহিত্যিক। তাঁরা জ্ঞানের সমুদ্র, আমার জ্ঞান নেই, গুণ নেই, তুলনায় আমি এক বিন্দু জল। বাংলাদেশের কাউকে যদি পুরস্কার দিতে হয়, তবে আর যাকেই হোক, আমাকে তো দেওয়ার প্রশ্ন ওঠার কথা নয়। এত বড় মাপের সাহিত্যিক এ দেশে আছেন, এত বড় কবি আছেন, তাঁদের সাহিত্যের সঙ্গে আমার কোনও গদ্য পদ্যের কোনও তুলনা করাও হাস্যকর। শওকত ওসমান, রশীদ করীম, সৈয়দ শামসুল হক, হাসান আজিজুল হক, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, সেলিনা হোসেন, রাহাত খান, বশীর আল হেলাল —-এঁদের পায়ের ধূলার যোগ্য নই আমি। শামসুর রাহমান, আল মাহমুদ, মহাদেব সাহা, নির্মলেন্দু গুণ, রফিক আজাদ, আবু জাফর ওবায়দুল্লাহর কবিতার ধারে কাছে কি আমার কবিতা স্থান পেতে পারে! নিঃসন্দেহে বলতে পারি, না। তবে আমি কেন নির্বাচিত হলাম! পুরস্কার কমিটির মাথাটি নিশ্চয়ই খারাপ হয়ে গেছে, অথবা বাংলাদেশের লেখকদের সম্পর্কে কোনও ধারণা নেই, তা না হলে পুরস্কারের জন্য আমাকে নির্বাচন করতেন না। কমিটিতে খুব বড় বড় লেখক বুদ্ধিজীবী আছেন, এ কেমন বুদ্ধির নমুনা! জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী, আনিসুজ্জামান, সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, রফিকুল ইসলাম, হুমায়ুন আজাদের মত বড় প্রাবন্ধিক যদি এই পুরস্কার না পান, তবে কী যোগ্যতা বলে আমি এই পুরস্কার পাই! কিছু শখের কবিতা লিখেছি, পত্র পত্রিকায় কিছু কলাম লিখেছি, এরকম তো কত কেউ লেখে, সাহিত্যিক জগতের অনেকের সঙ্গে ব্যক্তিগত পরিচয় আছে আমার, তাই বলে তো আমি সাহিত্যিক হয়ে যাইনি! সে স্পর্ধাও আমি করি না। কলকাতার কত বড় বড় লেখকও এখন পুরস্কারের মুখ দেখেন নি, আর আমাকে কি না নিজে উপস্থিত থেকে নিজে হাতে নিতে হবে পুরস্কার! পুরস্কারের ঘোষণাটি আমাকে হঠাৎ যেন চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল কত ক্ষুদ্র আমি, কত অযোগ্য আমি, লেখক হিসেবে কত তুচ্ছ আমি, কত অপাংক্তেয় আমি! মেয়েদের স্বাধীনতার জন্য লিখি, কিন্তু আমি তো নতুন লিখছি না, অনেকেই মেয়েদের অধিকারের পক্ষে লিখেছেন, লিখছেন। আমাকে তো কোনও স্বার্থত্যাগ করতে হয়নি, আমাকে ভুগতে হয়নি, পথে নামতে হয়নি, সংগ্রাম করতে হয়নি, অনেকে তো কত রকম সংগঠন করেছেন নির্যাতিত মেয়েদের সাহায্য করার জন্য। এনজিও খুলেছেন, ইশকুল বানিয়েছেন, নিজের যা কিছু আছে সবই বিসর্জন দিয়েছেন নারী উন্নয়নের জন্য। আমি কিছুই করিনি। এখনও পরিবেশ প্রতিবেশ থেকে শেখা বাড়ির কাজের মেয়েদের গালে চড় কষানোর, পিঠে ধুমাধুম কিল দেওয়ার বদভ্যাস ছাড়তে পারিনি। সুফির দেড়বছর বয়সী মেয়েটি প্যানপ্যান করে কাঁদত বলে, চতুর হাসি হাসত বলে সুফির আড়ালে আমি একদিন তার হাতদুটো মুচড়ে দিয়েছিলাম। আমার এই হাত কলুষিত হাত, এই হাতে এত বড় সম্মানের প্রতীক ওঠা মানায় না। যে সব আদর্শের কথা শুনে আমি মুগ্ধ হয়েছি বার বার, সেইসব আদর্শের কতটুকু জীবনে চর্চা করেছি! সমাজতন্ত্রের রূপরেখা পড়ে আমি উৎসাহিত হই, কিন্তু নিজের জীবনে তা প্রয়োগ করার উৎসাহ কোনওদিন পাইনি। দেশের আশি ভাগ মানুষ মানবেতর জীবন যাপন করছে জেনেও নিজের আরাম আয়েশের কিছু ছাড় দিই না। হাজার হাজার মানুষ ফুটপাতে বা তক্তপোষে ঘুমোচ্ছে জেনেও তো আমি নিজে নরম গদিতে ঘুমোবার লোভ ছাড়তে পারি না। কেউ না খেয়ে আছে বলে নিজেকে তিনবেলা খাওয়া থেকে বঞ্চিত করি না। সমাজতন্ত্র নিয়ে যা কিছু আমার মনে, সবই মধ্যবিত্তের রোমান্টিকতা। মেয়েদের নিয়ে যা কিছু এ যাবৎ লিখেছি, নিজের দিকে থুতু ছিটিয়ে বলি, হয় টাকা কামাবার জন্য, নয় নাম কামাবার জন্য! লেখক হিসেবে যেমন নিকৃষ্ট আমি, মানুষ হিসেবেও তেমন।

সব জেনে বুঝেও কলকাতা রওনা হই। পুরস্কারের চিঠি পাওয়ার পর পরই পুরস্কার গ্রহণ করার সম্মতি জানিয়ে চিঠি পাঠিয়েছিলাম আনন্দ বাজারে। পাঠিয়েছিলাম বলে যে আমার করার কিছু ছিল না তা নয়। আমি ইচ্ছে করলেই কি বলতে পারতাম না যে না আমি যোগ্য নই এই পুরস্কারের, আমি নেব না পুরস্কার! পুরস্কার নিতে অস্বীকার করার জন্যও যে স্পর্ধা দরকার হয়, সেই স্পর্ধাটি আমার নেই কেন! জীবনে স্পর্ধা করে তো অনেক কিছুই করেছি। ভেতরে ভেতরে কি একটি লোভ কাজ করছে না আমার! আমি যত নিজেকে বলতে চাই, না করছে না, কিন্তু নিজের খুব গভীরে কোথাও সূক্ষ্ম সুপ্ত বাসনার গন্ধ পাই। লজ্জা ভয় সব কিছুর তলে খুব গোপন একটি লোভ আমাকে নিভৃতে কামড়ায়। অপরাধীর মত একটি অন্যায়ের দিকে আমি যেতে থাকি, চোখ কান বন্ধ করে একটি সর্বনাশা নদীতে আমি ঝাঁপ দিই, নিজেকে সংবরণ করার কোনও শক্তি আমার মনেতে নেই। নিঃশক্তি, নিঃসহায় আমিটি সজোরে নিঃশ্বাস নেয় নির্লোভ হতে। আমি অশ্লীল শব্দ লিখি, আমি যৌন-লেখিকা, নগণ্য লেখিকা, লেখালেখির কিছুই জানি না, আমি কিছু না, আমি কিμছু না শুনে শুনে, অবমাননা আর অসম্ভ্রম পেয়ে পেয়ে নিজে ভুগতে ভুগতে আত্মীয় স্বজনকে ভোগাতে ভোগাতে যদি হঠাৎ শক্ত কিছু মাটি পাই মাথাটি, যে মাথাটি বার বার নুয়ে নুয়ে যায় লোকের ভৎসর্না আর বিদ্রূপে, উঁচু করে দাঁড়াবার, অসম্মাননা ছুঁড়ে ছুঁড়ে যারা আমাকে অμছুত করেছে, তাদের যদি দেখানোর সুযোগ হয় নিজের সামান্যও সম্মান, তবে আমি সুযোগটি কেন ছেড়ে দেব! পায়ের তলার মাটি যতটা শক্ত হলে দাঁড়ানো যায়, তার চেয়েও বেশি শক্ত করে মেয়েমানুষকে দাঁড়াতে হয়, নিজের যোগ্যতার প্রমাণ পুরুষকে যতটা দিতে হয়, তার চেয়ে বেশি দিয়েই মেয়েমানুষকে কাতারে দাঁড়াতে হয়— আমার মেয়েমানুষ পরিচয়টিতে তাই আমি একটি অহংকার জুড়ে দিতে চাই, যে অহংকারটি আমাকে কারও ধাককা দিয়ে ফেলে দেওয়া থেকে, দূর দূর করে তাড়ানো থেকে, চোখ মুখ নাচিয়ে কৌতুক করা থেকে বাঁচাবে, বাঁচাবে আর সাহিত্যের জগতে, যে জগতে আমার বিচরণ, যে জগতটি মূলত পুরুষের, স্থান দিতে বাধ্য হবে। আমি নির্লোভ হতে পারি না।

কলকাতায় পৌঁছে দেখি আমার জন্য একটি সুন্দর হোটেল ঠিক করা আছে। সুন্দর হোটেলে সুন্দর একটি ঘর। আনন্দ পাবলিশার্সে আমাকে ডাকলেন বাদল বসু। আনন্দ থেকে আমার নির্বাচিত কলাম বইটি ছাপা হবে। এত কিছু কি সইবে আমার! এত প্রাপ্তি! কালো পাহাড়ের মত শরীর বাদল বসুর; তাঁর হাসিহীন গম্ভীর মুখটি দেখলেই অন্তরাত্মা শুকিয়ে যায়। বাদল বসু কঠিন কঠিন মুখে কঠিন কণ্ঠে আমাকে বই প্রকাশের নানা রকম কাগজে সই করতে বললেন। এসব সইয়ে আমার অভ্যেস নেই। ঢাকায় বই ছাপা হয়, কোনও লিখিত ব্যপার থাকে না, সবই মৌখিক। কত পারসেন্ট রয়্যালটি দেওয়া হবে লেখককে, কত পারসেন্ট প্রকাশক নেবে, কখনও উল্লেখ করা হয় না। কাগজে টাকার অংকের কোনও ঘরের দিকে তাকাই না আমি। যেখানে যেখানে সই করতে বলা হয়, মুখ বুজে সই করি। সবকিছু আনুষ্ঠানিক এখানে। সবকিছুতেই একশ রকম নিয়ম। আমার বই ছাপা হতে যাচ্ছে বাংলা সাহিত্যের সব চেয়ে বড় প্রকাশনী থেকে, এই সুখেই তো আমি বগল বাজাবো। আমার কাছে পারসেন্ট কোনও বিষয় হবে কেন! আনন্দপুরষ্কারের টাকা ছিল এর আগে পঞ্চাশ হাজার, এ বছর বেড়ে এক লাখ হয়েছে। সেই টাকার জন্যও কয়েকটি সই নিলেন আনন্দবাজার পত্রিকা থেকে সুবীর মিত্র। এক লক্ষ টাকার চেক পাব আমি, যে আমি জীবনে এত টাকা একসঙ্গে দেখিনি কোনওদিন। তবু এক লক্ষ টাকা আমার কাছে নিতান্তই গৌণ। পুরস্কারের মূল্যই সবচেয়ে বেশি। টাকার অংক দিয়ে এই পুরষ্কারের বিচার করা যায় না। টাকা পড়ে থাকে টাকার মত। যখন শেষ সইটি করি বই প্রকাশনার কাগজে, তখনই খবর আসে সত্যজিৎ রায় মারা গেছেন। বাদল বসু বেরিয়ে যান তক্ষুনি। আমার সারা শরীর শোকে অবশ হতে থাকে। ছবি দেখা আমার নেশা, যত ছবি সারা জীবনে দেখেছি আমি, সবচেয়ে ভাল লেগেছে সত্যজিৎ রায়ের ছবি। এক পথের পাঁচালিই আমি দেখেছি পনেরোবার। তবু সাধ মেটেনা। যতবার দেখি ততবারই দুর্গার জন্য কাঁদি, ততবারই অপুর জন্য মায়া হয়, ততবারই ইন্দির ঠাকুরণের জন্য হৃদয় ভেঙে যায়। ঢাকার অনেক লেখক কবিই সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে দেখা করেছেন কলকাতায় এসে। নিজে যেচে আজ অবদি বড় কোনও লেখক শিল্পীর সঙ্গে পরিচিত হতে যাইনি। সাহস বা স্পর্ধা কোনওটাই হয়নি। সত্যজিৎ রায়কে দেখা হয় আমার স্বচক্ষে, নন্দনে যখন তিনি শুয়েছিলেন ফুলের বিছানায়, তখন। আর তিনি ছবি বানাবেন না, আর তিনি ক্যামেরায় লুক থ্রো করবেন না। আর তিনি ছবি আঁকবেন না, গল্প লিখবেন না। মৃত্যু জিনিসটির মত ভয়ংকর কিছু আর নেই পৃথিবীতে। জীবনের কী অর্থ যদি একদিন হঠাৎ করে মরেই যেতে হয়! সত্যজিৎ রায়ের মৃত্যুর কারণে আনন্দ পুরস্কার অনুষ্ঠান পিছিয়ে দেওয়া হল একদিন।

কলকাতার গ্র্যাণ্ড হোটেলের বলরুমে আনন্দ পুরষ্কারের অনুষ্ঠানের আয়োজন হচ্ছে। মঞ্চ সাজানো জুঁই ফুল দিয়ে, দেয়ালের কালো পর্দায় জুঁই ফুলে আঁকা মস্ত বড় কলম। এমন সুন্দর মঞ্চ আগে আমি কোথাও দেখিনি কখনও। ফুলের ঘ্রাণে ভরে আছে পুরো ঘর। আমন্ত্রিত রথী মহারথীরা আসন গ্রহণ করেছেন। ঘর ভরে আছে পণ্ডিতে, বিদ্যানে, বিশাল বিশাল লেখকে, কবিতে, শিল্পীতে। আনন্দ পুরষ্কার প্রতিবছর তিনজন পান। এবার দুজন কেবল। লেখক বিমল কর আর আমি। মঞ্চে আনন্দবাজারের সম্পাদক প্রকাশক অভীক সরকার, দেশ এর সম্পাদক সাগরময় ঘোষ এবং কবি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী বসে আছেন। আরেকদিকে বসেছেন বিমল কর, আমাকেও বসতে হল তাঁর পাশে। অযোগ্য আমি কুণ্ঠিত আমি লজ্জিত আমি না পারছি চোখ তুলে মঞ্চ দেখতে, না পারছি দর্শকের দিকে তাকাতে। পুরষ্কার নেবার পর কিছু বলতে হবে আমাকে, ছেঁড়া একটি কাগজ আমার হাতের মুঠোয়, কাগজটি ঘামে ভিজে উঠছে, কাগজটিতে কাটাছেঁড়া লেখা, আগের রাতে লিখেছি পুরস্কার পাওয়ার পর বলার জন্য যা হোক কিছু। মঞ্চের বড় বড়রা এক এক করে বলছেন। ছোটটির বলার সময় যত ঘনিয়ে আসে, তত তার বুকের মধ্যে শব্দ করে বাজতে থাকে বিপদঘণ্টি। মাইকের সামনে দাঁড়ালে পা ঠকঠক করে কাঁপবে না তো! গলা কাঁপবে না তো কিছু বলতে নিলে! ভয়ে আবার মুর্ছা যাই কি না কে জানে। যখন ডাকা হল আমাকে, হাতের ঘামে ভেজা দলামোচা করা ছেঁড়া কাগজটি খুলে পড়ি, প্রথম নমস্কার শব্দটিও আমাকে কাগজের দিকে তাকিয়ে পড়তে হয়। গলা কাঁপা থামাতে গিয়ে উচ্চারণের ভুলগুলোকে থামাবার আমার উপায় থাকে না। পায়ের ঠকঠক বন্ধ করতে গিয়ে ছেঁড়া কাগজের শব্দগুলো একটি আরেকটিকে ঠোকরাতে থাকে। পড়ছি, যেন আল্লাহতায়ালার আদেশে পুলসেরাতে দাঁড়িয়ে বেহেস্ত বাসীর উদ্দেশ্যে ভাষণ দিচ্ছি। .. আমাকে অনেকেই বলে আমি নাকি খুব আকাশ কুসুম কল্পনা করি। অলীক সব স্বপ্ন দেখি। গরম সইতে পারি না বলে নেপচুন গ্রহে চলে যাবার কথা ভাবি। ঘরে বসে পিঠে ডানা মেলে আকাশে উড়ে বেড়াবার স্বপ্ন দেখি। ধরা ছোয়াাঁর বাইরে আমার এরকম নানা স্বপ্ন আছে। কিন্তু আমি কখনও এই স্বপ্ন দেখবার স্পর্ধা করিনি যে আমি হঠাৎ একদিন আনন্দ পুরস্কার পাবো। সুধীবৃন্দ, আমি আনন্দিত আমি অভিভূত। যে গ্রন্থটি আনন্দ পুরস্কারের জন্য নির্বাচিত হয়েছে সেটি মূলত নারীর ওপর ধর্ম, সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থার অসভ্যতা আর অশালীনতা সম্পর্কে রাখঢাকহীন সরল উচ্চারণ। শাস্ত্র এবং সমাজ আমাদের এমন শিক্ষাই দেয় যে নারীর কোনও স্বাধীনতা থাকতে নেই। কিন্তু সেই নারী অবশ্যই মানুষ হিসেবে সম্পূর্ণ স্বাধীন নয় যে নারী মনে এবং শরীরে সম্পূর্ণ স্বাধীন নয়। মানুষের প্রধান প্রয়োজন স্বাধীনতা। নারীর এই স্বাধীনতাকে রাষ্ট্র অবরোধ করছে, নারীর স্বাভাবিক বিকাশে ধর্ম এখন প্রধান অন্তরায়। ধর্মের শৃঙ্খল আছে বলেই অধিকাংশ নারী আজ নিরক্ষর, উত্তরাধিকার বঞ্চিত, অধিকাংশ বাল্যবিবাহ, বহুবিবাহ, তালাক ও বৈধব্যের নির্যাতনের শিকার। পুরুষ নিজের স্বার্থসিদ্ধির জন্য নারীত্ব, সতীত্ব, মাতৃত্ব ইত্যাদির সংজ্ঞা এবং মাহাত্ম্য তৈরি করেছে। এগুলো টিকিয়ে রাখতে পারলে সমাজে নারীর মূল্য বেশি। মূল্য এই অর্থে যে লোকে তাকে অপাংক্তেয় বা অস্পৃশ্য ঘোষণা করবে না। পৃথিবীতে প্রচলিত প্রতিটি ধর্মেই নারীর সতীত্ব রক্ষা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় কিন্তু কোনও ধর্মেই পুরুষের জন্য কোনও সতীত্বের ব্যবস্থা করেনি। এর অর্থ এই, একগামিতা শুধু নারীর জন্য অবশ্য পালনীয়, পুরুষের জন্য নয়। তার জন্য আছে গণিকালয়ে যাবার অবাধ সুযোগ, তার জন্য চার বিয়ে হালাল করা হয়েছে ইসলাম ধর্মে, তার ভোগের জন্য ঘরের দাসিকেও বৈধ করা হয়েছে। পুরুষ নারীকে সাজিয়েছে অসংখ্য কুৎসিত অভিধায়। তাকে বন্দি করবার জন্য তৈরি করেছে পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্র, উদ্ভাবন করেছে ঈশ্বর, নিয়ে এসেছে প্রেরিত পুরুষ, লিখেছে ধর্মগ্রন্থ, অজস্র দর্শন, কাব্য, মহাকাব্য, সৃষ্টি করেছে সমাজতত্ত্ব, মনোবিজ্ঞান ও আরও অসংখ্য শাস্ত্র। উনিশ শতকের দ্বিতীয় ভাগ থেকে বাংলায় নারীশিক্ষার যে ধারা শুরু হয়েছে, এর উদ্দেশ্য নারীকে স্বাধীন ও স্বায়ত্তশাসিত করা নয়, এর লক্ষ উন্নত জাতের স্ত্রী বা শয্যাসঙ্গিনী উৎপাদন। নারী শিক্ষাও প্রভু পুরুষেরই স্বার্থে। বিবাহ এখানে নারীদের পেশা। মনে করা হয় নারীর কল্যাণ শুভবিবাহে, সুখী গৃহে, স্বামীর একটি মাংসল পুতুল হওয়াকেই তারা মনে করে নারী জীবনের স্বার্থকতা। ইহুদি খিস্টান ও মুসলমানের মতে নারীর জন্ম পুরুষের পাঁজরের বাঁকা হাড় থেকে। মুসলমান মেয়েরা জানে স্বামীর পায়ের নিচে স্ত্রীর বেহেস্ত। জানে স্বামীকে তুষ্ট রাখতে পারলে স্বয়ং আল্লাহ তায়ালা খুশি হন তাই বেহেস্তের লোভ দেখিয়ে স্বামীর পদসেবায় স্ত্রীদের নিয়োজিত রাখা একধরনের কৌশল, ধর্মের এবং সমাজের। বাঙালি মেয়েরা স্বামীর এঁটোকাঁটা খেয়ে ধর্মীয় পূণ্য অর্জন করে, এতে স্বামী সেবাও হয়, ধর্ম রক্ষাও হয়, কিন্তু যা হয় না তা হচ্ছে পুষ্টি রক্ষা। পুষ্টির অভাবে বাঙালি মেয়েরা অধিকাংশই স্বাস্থ্যহীন, শ্রীহীন এবং কিছুটা মেধাহীনও বটে। নারী কেবল পুরুষের যৌনসামগ্রী হিসেবে বিবেচিত হয়। ইসলাম ধর্মে নারীর যৌন অঙ্গ হিফাজত করবার কথা বলা হয়েছে। এও বলা হয়েছে নারী হচ্ছে পুরুষের শস্যক্ষেত্র, এই শস্যক্ষেত্রে পুরুষেরা যেন যেমন ইচ্ছে গমন করে। নারীকে অবাধ ভোগের কথা সকল ধর্মই বলেছে। নারীকে মূল্যবান সামগ্রী হিসেবে উপঢৌকন দেবার কথা, যুদ্ধক্ষেত্রে পরাজিত অঞ্চলের নারীকে ভোগের বস্তু করা সকল ধর্মেই স্বীকৃত। বাঙালি নারী কপালে ও সিঁথিতে সিঁদুর পরে, হাতে চুরি বা শাঁখা পরে এয়োতির চিহ্ন বহন করে। যদিও পুরুষের শরীর বিবাহের কোনও চিহ্ন বহন করে না। বৈধব্যের চিহ্নও নারী একা লালন করে। বিধবা নারীকে নানা রকম ব্রত পালন করতে হয়। পোশাক ও আহারে আমূল পরিবর্তন আনতে হয় কিন্তু বিপত্নীক কোনও পুরুষকে সঙ্গীহীনতার কোনও গ্লানি ভোগ করতে হয় না। নিরামিষ আহারের মূল কারণ বিধবা মেয়ের স্বাস্থ্যহীনতা ও শ্রীহীনতার পাশাপাশি যৌনাকাঙক্ষা নিবারণ করা, যদিও বিপত্নীকের জন্য এই সব অনাচার জরুরি নয়। সভ্যতার শুরু থেকে সমাজ ও ধর্ম মানুষকে পরিচালিত করেছে। সমাজ ও ধর্মের পরিচালক হিসেবে যুগে যুগে পুরুষেরাই কর্তৃত্ব করেছে। সমাজ ও রাষ্ট্র তো বটেই, নারীকে সবচেয়ে বেশি অমর্যাদা করেছে ধর্ম। সামাজিক, অর্থতৈনিক ও রাজনৈতিক ভাবে যে হারে নারী নির্যাতিত হচ্ছে তাতে পুরো সমাজ ব্যবস্থা, রাষ্ট্রীয় কাঠামো পরিবর্তন ছাড়া যেমন নারীর মুক্তি নেই, তেমনি ধর্মের শৃঙ্খল ছিঁড়ে বেরিয়ে আসা ছাড়াও নারীর মুক্তি অসম্ভব। মূলত এসবই আমার লেখার বিষয়। সমাজের পীড়িত, নিগৃহীত, দলিত, দংশিত নারীর জন্য লিখি। আমার এই ক্ষীণ কণ্ঠস্বর সীমান্ত পেরিয়ে এই বাংলায় কিছু মানুষের কানে পৌঁচেছে দেখে আমি উদ্বুব্ধ বোধ করছি। কারণ নারীর উক্তি সাধারণত কারও কানে পৌঁছতে চায় না, এমনকী নারীর কানেও নয়। সে কারণেই আমি চমকিত এবং অভিভূত। পশ্চিমবঙ্গকে কখনও আমার পৃথক একটি দেশ বলে মনে হয়না। একই ভাষা ও সংস্কৃতির মানুষ আমরা, আমরা একই জল হাওয়ার মানুষ, একই নদীর পাড়ে আমরা ঘরবাড়ি গড়েছি। এখানে এলেই আমার বুকের মধ্যে তীব্র এক যন্ত্রণা হয়, দেশ ভাগের যন্ত্রণা। আমার হৃদয়ে কোনও কাঁটাতার নেই। আমরা বাঙালি। বাংলা আমাদের ভাষা। আমরা আমাদের স্বজন আত্মীয়।
আজ এই আনন্দের দিনে আপনাদের জন্য নিবেদন করছি আমার ছোট্ট একটি কবিতা–
সাত সকালে খড় কুড়োতে গিয়ে আমার ঝুড়ি উপচে গেছে ফুলে
এত আমার কাম্য ছিল না তো!
এখন আমি কোথায় রাখি, কোথায় বসি, কোথায় গিয়ে কাঁদি!
পুরো জীবন শূন্য ছিল, ছিল!
কারও তো আর দায় পড়েনি দেবে।
তুমি এমন ঢেলে দিচ্ছ ভরে দিচ্ছ কাছে নিচ্ছ টেনে
এত আমার প্রাপ্য ছিল না তো!

আমাকে ক্ষমা করবেন।

আমি ক্ষমা চেয়েছি নিতান্তই ক্ষুদ্র হয়ে আকাশ ছোঁয়া একটি সম্মান নেওয়ার মত সাহস দেখিয়েছি বলে। আমি ক্ষমা চেয়েছি আমার স্পর্ধার জন্য, যে স্পর্ধায় যোগ্য না হয়েও এত বড় পুরস্কার আমি গ্রহণ করেছি। জানি না আমাকে কেউ ক্ষমা করেছেন কি না। আনন্দ পুরস্কার অনুষ্ঠানে অনেক লেখক শিল্পী আমাকে অভিনন্দন জানান। অনেকের সঙ্গে কথা হয়, যাঁদের সঙ্গে কখনও কোনওদিন কথা বলার সুযোগ হবে, কল্পনাও করিনি আগে। পরদিন আনন্দবাজারের প্রথম পাতায় বেরোলো আনন্দ পুরষ্কার অনুষ্ঠানের খবর, অনুষ্ঠান মাতালেন তসলিমা ও ভীমসেন। চারদিকে আমাকে নিয়ে উৎসব শুরু হয়ে গেল। সৌমিত্র মিত্র খুবই আনন্দিত আমার আনন্দ প্রাপ্তিতে। তিনি আমাকে নিয়ে এদিক সেদিক যাচ্ছেন। একদিন চমকে দিলেন কণিকা বন্দোপাধ্যায়ের সামনে দাঁড় করিয়ে দিয়ে। কণিকার গানের পাগল আমি। চোখের সামনে কণিকাকে দেখে আনন্দধারা বইতে থাকে আমার ভূবনে। বসন্ত উৎসবের সঙ্গী অশেষ আর মোনা আমার সঙ্গে দেখা করতে এল হোটেলে। পটাপট কিছু ছবি তুলে নিয়ে গেল আমার সঙ্গে। আমি খুব মূল্যবান মানুষ হয়ে উঠলাম হঠাৎ। আনন্দবাজার পত্রিকার বারান্দায় আমাকে জড়সড় হয়ে হাঁটতে হয় না। দেখলেই লোকে চেনে আমি কে। সাগরময় ঘোষ দেশ পত্রিকায় আমাকে ধারাবাহিক উপন্যাস লেখার প্রস্তাব দিলেন। প্রস্তাবটি শুনে লজ্জায় মনে হয় মাটির সঙ্গে মিশে যাচ্ছি। আমি যে উপন্যাস লিখতে পারি না তা বললাম, তিনি হাসলেন। দাবিটি ছাড়লেন না। নিখিল সরকার তাঁর সল্টলেকের বাড়িতে আমাকে নেমন্তন্ন করলেন। আমাকে তিনি চিঠি দিয়ে পাঠালেন কিছু মূল্যবান মানুষের সঙ্গে দেখা করতে। বড় পুরস্কার পাওয়া ছোট লেখক চিঠি হাতে নিয়ে বড় সংকোচে বড় বড় মানুষের দ্বারস্থ হল। মহাশ্বেতা দেবী, মীরা মুখোপাধ্যায়….। আকাশে পৌঁছলে আকাশের নক্ষত্রদের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করা সম্ভবত ভদ্রতা। কিন্তু আমি কি সত্যিই আকাশে পৌঁছেছি, নাকি যে পাতালের আমি সে পাতালেই আছি! বেশ টের পাই আমি সেই পাতালেই আছি। নক্ষত্রদের সামনে আমি আমার তাবৎ অন্ধকার নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকি। কলকাতায় গুরুজনদের বিশেষ করে খুব বড় লেখক শিল্পীদের সকলে ঢিপঢিপ করে প্রণাম করে। আমি সামনে এসে বাঁশের মত দাঁড়িয়ে থাকি। প্রণামের অভ্যেস নেই বলে করতে পারি না। কদমবুসি নামে বাঙালি মুসলমানদের মধ্যে যে প্রণাম প্রচলিত, সেটিও আমি করতে অভ্যস্ত নই। অশেষ শ্রদ্ধা মনে, অথচ হাত বাড়াচিছ না পায়ের ধুলোর দিকে, বয়োজ্যেষ্ঠ গুরুরা আমাকে একটি বেয়াদব মেয়ে বলে মনে মনে গাল দেন হয়ত, কিন্তু আমি কী করতে পারি!হঠাৎ করে আমাকে যদি বলা হয় তুমি হাল চাষ কর, আমি তো স্থবির দাঁড়িয়েই থাকব। যে জিনিস আমার দ্বারা হয়নি, তা হবেও না জানি। হাল চাষ করতে না পারি, কিন্তু গ্রাম্যতা আমার চরিত্রের গভীরে। ঢাকা থেকে আনা ছোটখাটো উপহার কলকাতার অনেককে দিতে আমার ভাল লাগে। অভীক সরকার আনন্দ পুরস্কার দিলেন আমাকে, তাঁকে তো বিনিময়ে একটি উপহার আমাকে দিতে হয়, এই গ্রাম্য সৌজন্য রক্ষা করতে গিয়ে যে শাড়িটি পরে পুরস্কার নিয়েছিলাম, সেই নানাবর্ণের চমৎকার জামদানি শাড়িটির আঁচল কেটে পার্ক স্টিটের একটি ভাল বাঁধাইএর দোকান থেকে দ্য বেস্ট সোনালী ফ্রেমে বাঁধাই করে নিয়ে মহা উৎসাহে দ্য বেস্ট উপহারটি নিয়ে যেদিন আনন্দবাজারে পৌঁছই, নিখিল সরকার আমার স্পর্ধা দেখে জিভ কাটলেন। মাথায় আমার যে বুদ্ধিটি ধরেনি তা হল অভীক সরকারের মত উচ্চ রুচির শিল্পবোদ্ধার ঘরে ভারতবর্ষের কোনও শিল্পীর আঁকা চিত্র যদি স্থান পায়, সে বড়জোর মকবুল ফিদা হোসেন, তাছাড়া বাকি সব নামী দামী পশ্চিমি শিল্পীদের চিত্রকলা, জামদানি শাড়ির আঁচল সে আঁচল যত সুন্দরই হোক না কেন, এটি তাঁর ঘরে স্থান পাওয়ার যোগ্য নয়। মনে মনে বলি, যে মেয়েরা এই অপূর্ব সুতোর কাজগুলো করেছে, তারাও তো খুব বড় শিল্পী। শিল্পী হোক, ধনী এবং রুচিবানরা এসব তুচ্ছ জিনিসকে মূল্য দেন না। ভাল যে আমি অভীক সরকারের ঘরে উদ্ভট জামদানি চিত্রকলা নিয়ে উপস্থিত হইনি আগেই। নিখিল সরকার আমাকে বললেন, এটি যদি দিতেই চাই আমি তবে যেন অভীক সরকারের স্ত্রীকে দিই। শেষ অবদি লজ্জার মাথা খেয়ে তাঁর স্ত্রীর জন্য আমার অতিতুচ্ছ উপহারটি দিয়ে বিশাল আনন্দবাজারের বিশাল অভীক সরকারকে বিশাল অপমানের হাত থেকে বাঁচাই।

বাংলাদেশ দূতাবাসের এক কর্মকর্তা কিছু লেখককে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন তাঁর বাড়িতে, আমাকেও জানিয়েছেন। মূলত আমার সম্মানে। আমি উপস্থিত হবার পর আমাকে ঘিরে বসে পড়ল কলকাতার কবি লেখকরা। এক একজন প্রশ্ন করছে, নানা কিছু নিয়ে প্রশ্ন— রেনেসাঁস, রেভ্যুলুশান, ফেমিনিজম, ব্যাকল্যাশ, মডার্নিজম, পোস্ট মডার্নিজম, আমার সাহিত্যিক ভাবনা, রাজনৈতিক আদর্শ, শ্রেণী সংগ্রাম ইত্যাদি ইত্যাদি। মানুষগুলোর চোখ আমার দিকে আগ্রহে উত্তেজনায় অপেক্ষায় অপলক হয়ে আছে। ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকি জ্ঞানী জ্ঞানী মানুষগুলোর দিকে। প্রশ্নগুলো বড় কঠিন লাগে আমার কাছে। আমার ফ্যালফ্যাল দেখে এ ওর মুখ চাওয়াচাওয়ি করে। সংকোচে শামুকের মত গুটিয়ে যেতে থাকি। যদি অদৃশ্য হয়ে যেতে পারতাম এই সুধী সমাবেশ থেকে! যদি হঠাৎ নেই হয়ে যেতে পারতাম! আমাকে কোনও প্রশ্ন কোরো না, আমি কোনও প্রশ্নের উত্তর জানি না। মনে মনে বলি, তার চেয়ে আমাকে রহিমা বেগমের গল্প শোনাতে বল, কন্যাসন্তান জন্ম দিয়ে কি করে হতাশায়, বেদনায় ঘৃণায় আশঙ্কায় চিৎকার করে কেঁদেছিল রহিমা। আমাকে বল, আমি তেমন কেঁদে তোমাদের দেখাই। আমি বুদ্ধিজীবী নই। আমি মোটা মোটা বই পড়ে পৃথিবীর ইতিহাস ভুগোল, রাজনীতি, সমাজ, সাহিত্য সংস্কৃতির জ্ঞান অর্জন করিনি। আমি বক্তা নই। গুছিয়ে কিছু বলতে পারি না। কায়ক্লেশে কিছু লিখি, রহিমা বেগমের আর্তনাদ আমাকে কাঁদায় বলে লিখি। এমন বড় বড় আসরে বড় বড় বক্তৃতা দেওয়ার যোগ্য আমি নই। আমি ময়মনসিংহের সাধারণ ঘরে সাধারণ ভাবে বেড়ে ওঠা সাধারণ মেয়ে। আমি গভীর তত্ত্বকথা বুঝি কম। আমার ঘটে বুদ্ধি কিছু কম ধরে। চিরকালই।
 

Users who are viewing this thread

Back
Top