What's new
Nirjonmela Desi Forum

Talk about the things that matter to you! Wanting to join the rest of our members? Feel free to sign up today and gain full access!

Collected আমার মেয়েবেলা (আত্মজিবনী) (1 Viewer)

০৯. পীরবাড়ি ২


পীরবাড়িতে ঢুকলে আমার গা ছমছম করে। এ বাড়ির সবগুলো গাছই, আমার আশংকা হয়, জ্বিন ভূত পেত্নীর বাসা। কখন কোন গাছের তল দিয়ে যাওয়ার সময় জ্বিন লাফিয়ে পড়বে ঘাড়ে কে জানে, মা’র আঙুল শক্ত করে ধরে পীরের ঘরের দিকে হাঁটি। আসলে আমি হাঁটি না, মা হাঁটেন, আমাকে হাঁটতে হয়। মা মুরিদ হয়েছেন পীরের। শাড়ি ছেড়ে জামা পাজামা ধরেছেন। মা’কে মা বলে মনে হয় না।

পীরের ঘরে বসে আছেন ছ’সাতটি মেয়ে, পরনে ওদের পায়ের পাতা অবদি ঝুলে থাকা লম্বা জামা, মাথায় ওড়না। জামাগুলো শরীরের সঙ্গে এমন মিশে থাকে যে দূর থেকে দেখলে মনে হয় উদোম গায়ে বুঝি ওরা। একজনের পরনে কেবল শাড়ি। গলায় তাবিজ ঝুলছে চারটে। মাথায় ঘোমটা টানা। খুব বিমর্ষ মুখ তাঁর। পীরের পায়ের ওপর দু’হাত রেখে তিনি বলেন

— পুলা না হইলে স্বামী আমারে তালাক দিব হুজুর।

খুব ধীরে কথা বলেন পীর আমিরুল্লাহ, কথা যখন বলেন পাঁচ আঙুলে দাড়ি আঁচড়ান। ছাদের কড়িকাঠের দিকে চোখ তুলে, চোখে অপার মায়া, বলেন– আল্লাহর নাম লও, আল্লাহ ছাড়া দেওয়ার মালিক কেউ নেই, আমি তো উছিলা মাত্র। মাঝরাতে জিকির করবে। তিনি পরওয়ার দেগার, দো জাহানের মালিক, তার কাছে কাঁদো আলেয়া। না কাঁদলে তার মন নরম হবে কেন, বল! বান্দা যদি হাত পাতে, সেই হাত আল্লাহ ফেরান না। তার অসীম দয়া।

আলেয়া উপুড় হয়ে পায়ের ওপর, যেন সেজদা করছেন, ডুকরে কেঁদে ওঠেন। ছেলে হওয়ার শর্তে তিনি মাঝরাত কেন, সারারাতই জিকির করবেন। আমিরুল্লাহ দাড়ি থেকে হাত সরিয়ে আলেয়ার পিঠে রাখেন, কড়িকাঠ থেকে নামিয়ে আলেয়ার ঘোমটা খসে বেরিয়ে আসা চুলে চোখ রেখে বলেন আল্লাহ এক, অদ্বিতীয়, নিরাকার, সর্বশক্তিমান। তার আদি নেই, অন্ত নেই। তার পিতামাতা পুত্রকন্যা নেই। তিনিই সবকিছু দেখেন অথচ তার আমাদের মত চক্ষু নেই। তিনি সবই শোনেন, অথচ তার কর্ণ নেই। তিনি সবকিছুই করতে পারেন অথচ আমাদের মত তার হাত নেই। তিনি সর্বত্র সর্বদা বিরাজিত। তিনি আহার করেন না, নিদ্রা যান না। তার কোনও আকৃতি নেই। তার তুলনা দেওয়া যেতে পারে এমন কোনও বস্তু নেই। তিনি চিরদিনই আছেন এবং চিরদিনই থাকবেন। তিনি সকলের অভাব পূরণ করেন, তার নিজের কোনও অভাব নেই। তিনি চিরজীবিত, তার মৃত্যু নেই, ধ্বংসও নেই। তিনি পরম দাতা, অসীম দয়ালু। তিনি সর্বশ্রেষ্ঠ ইজ্জতের মালিক, মানুষকে তিনি ইজ্জত দান করেন। তুমি তার দরবারে হাত ওঠাও, তোমার নিশ্চয় ছেলে হবে, সমাজে তোমার ইজ্জত রক্ষা হবে।

মা’র পেছনে জড়সড় দাঁড়িয়ে আল্লাহর নিরাকার শরীরটির কথা ভাবি। ‌এ অনেকটা আমাদের ইস্কুলে যাদু দেখাতে আসা লোকটির মত, কালো কাপড় দিয়ে তাঁকে ঢেকে ফেলা হল, পরে কাপড় সরালে যাদুকর আর নেই ওতে। হাওয়ায় মিলিয়ে গেছেন। আমারও যদি নিরাকার শরীর থাকত, সারা শহর ঘুরে বেড়াতাম, ব্রহ্মপুত্রের পাড়ে একা একা চলে যেতাম, কেউ আমার ঘাড় খুঁজে পেত না ঘরে ঠেলার।

নতজানু আলেয়ার উপুড় হওয়া শরীরের তল থেকে পীরসাব পা সরিয়ে নেন। যুবতীদের ভিড় থেকে হুমায়রা ছুটে এসে আলেয়াকে ধরে উঠোনে নিয়ে যায়। জবা গাছ তলে দাঁড়িয়ে আঁচলের গিঁট খুলে ভাঁজ করা নোট বার করে হুমায়রার হাতে দেন আলেয়া। হুমায়রা মুঠোর ভেতর নোটটি নিয়ে পীরসাবের হাতে গুঁজে দেয়, অভিজ্ঞ হাত। টাকা এক হাত থেকে আরেক হাতে যায়। অনেকটা রিলে রেসের মত। পীরসাব তাঁর আলখাল্লার পকেটে ঢুকিয়ে দেন টাকার হাতটি, ওটিই আপাতত চলমান ক্যাশবাক্স। পকেটে ঢোকানো হাতটির ওপর চোখ গেঁথে থাকে আমার। আমার চোখের পাতায় তীক্ষ্ণ চোখ রেখে–হামিমা, সঙ্গে কে তোমার, মেয়ে নাকি! পীর বলেন।

মা আমার বাহু টেনে সামনে এনে বলেন–জ্বি হুজুর। এই মেয়ে জন্মাইছে বারই রবিউল আওয়ালে। মেয়ে আমার সাথে দাড়ায়া নামাজ পড়ে। কায়দা সিফারা পইড়া সাইরা কোরান শরিফ ধরছে। এরে এট্টু দুয়া কইরা দিবেন হুজুর, যেন মেয়ে আমার ঈমানদার হয়।

মা আমার পিঠ ঠেলে বলেন–যা হুজুরকে কদমবুসি কর।

আমি গা শক্ত করে দাঁড়িয়ে থাকি। কদমবুসি করার জন্য এক পাও এগোতে ইচ্ছে করে না আমার। মা গা ঠেলেন আমার, আবারও। আমি এক পা দু’পা করে পেছোতে থাকি। মুখে শাদা লম্বা দাড়ি, পায়ের গোড়ালি অবদি আলখাল্লা, মাথায় আল্লাহু লেখা গোল টুপি লাগানো পীর থাবা বাড়িয়ে খপ করে ধরেন আমাকে, যেন গাছ থেকে টুপ করে পড়া একটি চালতা ধরছেন মুঠোয়। আমাকে তাঁর গায়ের সঙ্গে লেপটে ফেলেন এত যে আলখাল্লার ভেতর হারিয়ে যায় আমার শরীর। শ্বাস বন্ধ হয়ে আসতে থাকে। চোখ বুজে বিড় বিড় করে কিছু বলে পীরসাব ফুঁ দেন আমার সারা মুখে। ফুঁএর সঙ্গে থুতু ছিটকে পড়ে মুখে আমার।

আলখাল্লা থেকে বেরিয়ে দৌড়ে গিয়ে লুকোই মোহাবিষ্ট মা’র পেছনে। জামার হাতায় থুতু মুছতে মুছতে শুনি পীর বলছেন–তুমার মেয়ে কি দুনিয়াদারির পড়া পড়ছে নাকি! মা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন–হ। আমার ত কোনও হাত নাই হুজুর ছেলেমেয়ের ওপর। এর বাপে সেই পড়াই পড়াইতেছে। এই মেয়ের আবার আল্লাহ রসুল সম্পর্কে খুব জানার ইচ্ছা। তাই ভাবছি এহানে নিয়া আসলে ওর ভাল লাগবে। মনটা ফিরবে আল্লাহর দিকে আরও।

হুজুর চুক চুক দুঃখ করেন জিহবায়। বিছানায় শরীর এলিয়ে বলেন–মুশকিল কি জানো! দুনিয়াদারির লেখাপড়ায় মনে শয়তান ঢুকে যায়, পরে শয়তানের কবল থেকে নিজেকে মুক্ত করে আল্লাহর পথে আসা কঠিন হয়ে পড়ে। এই যে দেখ নাজিয়া, নাফিসা, মুনাজ্জেবা, মতিয়া এরা সবাই কলেজে পড়ত, সবাই পড়া ছেড়ে দিয়েছে। দিয়ে এখন আল্লাহর পথের পড়াশুনা করছে। আখেরাতের সম্বল করছে। ওরা এখন বুঝতে পারে, ওইসব পড়ালেখা আসলে মিথ্যা। ওরা ঢাকা ছিল ভয়ংকর অন্ধকারে। সত্যিকার জ্ঞানের আলো ওরা পায়নি।

মা আমাকে ইঙ্গিতে উঠোনে যেতে বলে হুজুরকে তালপাতার পাখায় বাতাস করেন। ঘর থেকে বেরিয়ে সিঁড়ি পেরিয়ে যেই না উঠোনে পা দেব, চিলের মত ছোঁ মেরে আমাকে তুলে নেয় হুমায়রা, নিয়ে সোজা উত্তরের ঘরে। এ ঘরটির তোষকগুলো গুটোনো থাকে দিনের বেলা, চৌকির ওপর বিছানো থাকে কেবল শীতল পাটি। পাটির ওপর বসে ফজলিখালার মেয়েরা তসবিহ জপে, নামাজ পড়ে। তারা কেউ ইস্কুলে যায় না, তারা আল্লাহর পথের লেখাপড়া করে বাড়িতে।

হুমায়রা আমার চেয়ে বছর পাঁচেক বড়। মুখখানা গোল চালতার মত ওর।

— তুমি বড় খালার মেয়ে, তুমি আমার খালাতো বোন হও, তা জানো! হুমায়রা আমার কাঁধে টোকা মেরে বলেন।

— দুনিয়াদারির লেখাপড়া কর কেন? এই লেখাপড়া করলে আল্লাহ নারাজ হবেন। আল্লাহ অনেক গুনাহ দেবেন তোমাকে।

বলে আমাকে পাটির ওপর বসিয়ে হুমায়রা পাশে বসে আমার।

— তোমার বাবা হচ্ছে একটা কাফের। কাফেরের কথা শুনলে তোমাকেও দোযখে পাঠাবেন আল্লাহতায়ালা।

চোখ বুজে দোযখের কল্পনা করতে গিয়ে গায়ে কাঁপুনি ওঠে হুমায়রার। আমার হাতদু’খানা হঠাৎ চেপে ধরে সে কি কারণে, ঠিক বুঝতে পারি না। গা হিম হতে থাকে আমার। বড় একটি গর্তে আগুন জ্বলছে, ফুটন্ত পানির ওপর ভাসতে ভাসতে কাতরাচ্ছে অগুনতি মানুষ। মানুষগুলোর মধ্যে দেখি আমিও কাতরাচ্ছি। আমাদের সামনে ততক্ষণে এসে দাঁড়ায় একজন একজন করে সাতজন মেয়ে, ওদের দৃষ্টির হুল ফোঁটে আমার শরীরে। দুনিয়াদারির লেখাপড়া করা অদ্ভুত এক জীব যেন আমি। চোখে ওদের খলসে মাছের মত লাফ দিয়ে ওঠে এক ঝাঁক করুণা, ওরা যেন বেহেসতের বাগানে বসে দেখতে পাচ্ছে আমি দোযখের আগুনে পুড়ছি। আমাকে দেখে আহা আহা করে ওরা। লম্বা মত এক মেয়ে বলে–হুমায়রা, ও কি আল্লাহর পথে আসতে চায়!

— হ্যাঁ, কিন্তু ওর বাবা ওরে দিতে চায় না। হুমায়রা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে। আমি খালাতো বোন বলেই বোধহয় ওর দীর্ঘশ্বাস অতি দীর্ঘ।

লম্বা মত জিভে চুক চুক শব্দ করে। বাকিরাও করে চুক চুক। চুক চুক। চুক চুক। যেন অনেকগুলো বেড়াল দুধ খাচ্ছে শব্দ করে। শব্দ শুনি আর ঋষি-মূষিকের মত বসে গুণি ওদের, সাত ছয় পাঁচ চার তিন দুই এক। লম্বা, খাটো, মাঝারি, খাটো, খাটো, খাটো, মাঝারি। ওদের মনে মনে ইস্কুলের এসেম্বলিতে দাঁড় করাই। খাটো, খাটো, খাটো, মাঝারি, মাঝারি, লম্বা। ওদের দিয়ে গাওয়াই, ও সাত ভাই চম্পা জাগোরে!

আমার মগ্নতা ভাঙে হুমায়রার গুঁতোয়–দেখ এদের বাবা এদেরকে, সাতজনকে থুতনি তুলে দেখিয়ে বলে সে, আল্লাহর পথে দিয়ে গেছে। এরা এইখানেই থাকে। কোরান হাদিস শেখে।

হুমায়রা আবারও অতি দীর্ঘ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে–খালুকে নছিহত করলে তিনি নিশ্চয় আল্লাহর পথে আসতেন। ছেলেমেয়েদেরও আল্লাহর পথে দিতেন।

বাবাকে করলে কাজ হত কি না আমার সংশয় আছে, তবে জজ সাহেবকে নছিহত করে কাজ হয়েছিল। জজ তাঁর ষোল বছরের মেয়ে মুনাজ্জেবাকে আল্লাহর পথে উৎসর্গ করে গেছেন, লম্বা মেয়েটি, হুমায়রা বলে, মুনাজ্জেবা, জজের মেয়ে। কোথাকার জজ? ঢাকার। ঢাকা শব্দটি এমন স্বরে হুমায়রা উচ্চারণ করে যে ঢাকার জজ মানে বুঝতে হবে বড় জজ। ঘটনাটি এরকম ছিল, ষোল বছরের মেয়ে লেখাপড়ায় ভাল হলেও গোল্লায় যেতে শুরু করে, বখাটে এক ছেলের সঙ্গে প্রেম করে। জজ সাহেবের মেয়েকে নাকি পাড়ার মাঠে বখাটেটির সঙ্গে অন্ধকারে শুয়ে থাকতে দেখেছে কারা। পাড়ায় ঢি ঢি পড়ে গেল। মেয়েকে ইস্কুল বন্ধ করে বাড়িতে বসিয়ে রাখলেন জজ সাহেব। তখন কেউ একজন তাঁকে বললেন আমিরুল্লাহ পীরের নাম, তিনি মেয়েদের বাড়িতে রেখে কোরান হাদিস শেখান, মেয়েরা নামাজি হয়, ঈমানদার হয়, অন্দরমহলের বাইরে পা দেওয়া নিষেধ তাদের, কঠোর পর্দার মধ্যে তাদের জীবন যাপন করতে হয়। শুনে ঢাকার জজ একবার মজলিশ শুনতে আসেন পীরের বাড়ি। পীরের ব্যাবহারে তাঁর মন গলে। তিনি তাঁর উচ্ছন্নে যাওয়া মেয়েকে হুজুরের হাতে সঁপে দিয়ে যান ক’দিন পরেই। রুবিনা পাল্টে পীরসাব মেয়ের নাম দিয়েছেন মুনাজ্জেবা। মুনাজ্জেবা লম্বা লম্বা জামা গায়ে মাথায় ওড়না জড়িয়ে পর্দা পুশিদা মত অন্দরমহলে থাকে, কোরান হাদিস পড়ে, মজলিশে হুজুরের দোযখের বর্ণনা শুনে কেঁদে বুক ভাসায়, হুজুরের গা হাত পা টেপে। সেই থেকে শুরু এ বাড়িতে বড় বড় ঘরের মেয়ে আসার, পুলিশের মেয়ে, উকিলের মেয়ে, সরকারি কর্তাদের মেয়ে। হযরত ইব্রাহিম আল্লাহর হুকুম মত নিজের ছেলেকে কোরবানি দিয়েছিলেন, আর আজকালকার বাবারা কেন পারবেন না নিজের মেয়েকে আল্লাহর পথে দিতে! হুমায়রা ভাবে। এ বাড়িতে মেয়েদের আল্লাহর প্রেমে দিওয়ানা হতে বলা হয়, মেয়েরা হয়। নিরাকার আল্লাহর সঙ্গে মেয়েদের প্রেম ভীষণ জমে ওঠে এ বাড়িতে আসা মাত্র। পীর আমিরুল্লাহ স্বস্তির নিশ্বাস ফেলেন দেখে, তাঁর মনে হয় এরা মুনাজ্জেবা নাজিয়া নাসিমা নয়, এরা শ্রেফ বেহেসতের বাগানের ফুল।

আমিরুল্লাহ পীর জঙ্গল সাফ করা আঙিনায় ঘর তুলে দেন মেয়েদের। কারও ঘরে টিনের চাল, কারও ঘরে সিমেন্টের। ঘরগুলোয় জানালা নেই, গরমে হাঁসফাঁস করে মেয়েরা। পীরসাব বলেছেন–আরবে এইরকম ঘর ছিল, যে ঘরে আমাদের নবী জীবন যাপন করতেন। এরকম ঘরে থাকলে সওয়াব হয়। নবীজি যে কষ্ট করেছেন, সে কষ্ট যদি তোমরা করতে পার, তবে নবীজি নিজে তোমাদের জন্য হাশরের ময়দানে সাক্ষী দেবেন।

মেয়েরা আবেগমথিত কণ্ঠে বলে আহা আহা। তাদের জানালার দরকার নেই। দরজাও, যদি এমন হত যে নবীজির ঘর ছিল না, তবে সেটিও ত্যাগ করতে সম্ভবত ওরা আপত্তি করত না।

দু’তিন বছর পার হলে বাবারা ফেরত নিতে আসেন ঈমানদার মেয়েদের। মেয়েরা ঘাড় শক্ত করে বলেন–যাব না। মুনাজ্জেবার বাবা শয্যাশায়ী বলে তার মা এসেছিলেন নিতে। মুনাজ্জেবা যায়নি। কলুষিত দুনিয়ায় তার আর ফেরার ইচ্ছে নেই। এ বাড়ির আঙিনা থেকে বেরোলেই তার বিশ্বাস গায়ে তার পাপের ফোসকা পড়বে।

কেবল মুনাজ্জেবা নয়, অন্যরাও, বিয়ের বয়স হলে বাবারা পাত্র ঠিক ক’রে যখন নিতে আসেন, ওরা যেতে রাজি হয় না। সাফ সাফ জানিয়ে দেয়, ওরা আল্লাহর পথে থাকবে। এই শেষ জমানায় বিয়ে করা উচিত নয়, হুজুর বলেছেন। ওরা তাই অনুচিত কোনও কাজে আকৃষ্ট হয় না। বাবাদের ফিরে যেতে হয় মেয়েরা পীরবাড়ির পবিত্র মাটি কামড়ে রাখে বলে।

বিয়ে করা উচিত নয় কেন, প্রশ্ন জাগে মনে। উত্তর ওদের জিভের ডগায়, হুজুর মোরাকাবায় বসে কথা বলেছেন আল্লাহতায়ালার সঙ্গে। বেহেসতের বাগানে হাঁটতে হাঁটতে দু’জনের কথা হয়। মুনাজ্জেবা চোখ বুজে বেহেসতের বাগানে পাখি হয়ে ওড়েন। আল্লাহ নিজমুখে হুজুরকে বলেছেন–শেষ জমানা শুরু হয়ে গেছে। ইসরাফিলের শিঙ্গা ফুকার সময় হয়ে গেছে। কেয়ামত খুব সামনে। শেষ জমানায় সমাজ সংসার সব বাদ দাও, সময় নেই, তাড়াতাড়ি আখেরাতের সম্বল কর।

মেয়েদের বিশ্বাস, হুজুর নিজে ওদের পুলসেরাত পার করে দেবেন। হুজুর বলেছেন তিনি তাঁর প্রিয় মুরিদদের হাত ধরে বেহেসতে যাবেন, তাদের না নিয়ে তিনি বেহেসতের দরজায় ঢুকবেন না। মেয়েরা তাই শেষ জমানায় আর হুজুরের চোখের আড়াল হতে চায় না। হুজুর বলেছেন, মুরিদদের নিয়ে শীঘ্র তিনি মক্কা চলে যাবেন, কেয়ামতের আগ অবদি নবীজির দেশেই থাকার ইচ্ছে তাঁর।

মুনাজ্জেবা বলে, আল্লাহতায়ালা বাহন পাঠাবেন মক্কা যাওয়ার।

বাহন কি রকম, সাত জনের সঙ্গে হুমায়রা গভীর মগ্ন অনুমান করতে, সম্ভবত বোররাখ। আল্লাহতায়ালার বাহনটি সম্পর্কে তাদের এখনও স্পষ্ট ধারণা নেই। কিন্তু যে কোনওদিন যে বাহনটি এসে পৌঁছবে এ বাড়িতে, এ সম্পর্কে কারও কোনও দ্বিধা নেই। লিস্টিও তৈরি হয়ে গেছে কে কোন ব্যাচে যাবে। মুনাজ্জেবার নাম প্রথম ব্যাচে, খোঁজ নিয়ে জেনেছে সে। লিস্টি পীরসাবের বালিশের নিচে।

মেয়েদের মুখে আতঙ্ক, যেন আজ বাদে কালই কেয়ামত আসছে।

আমার ভেতরেও একটু একটু করে কেয়ামতের ভয় ঢোকে। তাহলে বাবা যে ইচ্ছে করছেন আমাকে লেখাপড়া করে বড় হতে! বড় হওয়ার আগেই তো কেয়ামত চলে আসবে! পৃথিবী ধ্বংস হয়ে ঢুকে যাবে পৃথিবীর পেটে। বিচার হবে হাশরের ময়দানে, যেখানে আল্লাহ নিজে বসবেন দাঁড়িপাল্লা নিয়ে নেক মাপতে।

বুক ঢিপঢিপ করে। সামনে দাঁড়ালে নিশ্চয় আল্লাহ জিজ্ঞেস করবেন, নিয়মিত নামাজ রোজা করেছি কি না, তসবিহ জপেছি কি না, কোরান পড়েছি কি না! আল্লাহর আদেশ মত চলেছি কি না। উত্তর কি দেব! যদি বলি হ্যাঁ সব করেছি, তাহলে নির্ঘাত ধরা পড়ে যাব। কারণ আল্লাহ তো লিখেই রেখেছেন সবার ভবিষ্যত। ভবিষ্যত যদি সব লেখাই থাকে, তবে ময়দানে আবার দুনিয়ায় কি করেছি না করেছি খামোকা জিজ্ঞেস করার কি মানে হয়! আমার কেন জানি না বিশ্বাস হয় হাশরের মাঠে, দুনিয়ার সব লোক জড়ো হবে যে মাঠে, যে মাঠের কথা ভাবলে কেবল ঢাকায় বড় মামার বাড়ি বেড়াতে গিয়ে লালমাটিয়ার যে মাঠ দেখেছিলাম, সে মাঠের ছবি মনে ভাসে–সেটির পুলসেরাত, আমার বিশ্বাস, যাদুকর লোকটি হাওয়া হয়ে গিয়ে নির্বিঘ্নে পার হয়ে যেতে পারবেন। ইস্কুলে যাদু দেখাতে এসে যেমন করে কালো কাপড়ের মধ্য থেকে নেই হয়ে গিয়েছিলেন হঠাৎ!

আমি বিভোর ছিলাম যাদুকরের পুলসেরাত পার হওয়ার দৃশ্যতে। চোখের সামনে আর কিছু নেই, কেবল একটি সুতো। সুতোর ওপর হাঁটতে গিয়ে টলমল করছে আমার পা। কিন্তু দিব্যি হেঁটে যাচ্ছেন, এক চুল নড়ছে না যাদুকরের শরীর। যাদুকর লোকটি হিন্দু, নাম সমীর চন্দ্র। কোনও হিন্দু লোক যদি পুলসেরাত পার হতে পারে, তবে আল্লাহ তাকে পাঠাবেন কোথায়, যেহেতু সে হিন্দু, দোযখে, নাকি বেহেসতে যেহেতু সে পুলসেরাত পার হয়েছে! আমি বিচারক হলে, ভাবি, বেহেসতেই পাঠাতাম। কিন্তু শুনেছি কেউ যদি হিন্দু হয়, সে যা কিছুই পার হোক, নেকের বোঝা তার যত ভারি হোক না কেন, দোযখেই যেতে হবে তাকে, কারণ তার জন্য দোযখ লিখে রেখেছেন স্বয়ং আল্লাহতায়ালা। আগে থেকেই লিখে রাখার ব্যাপারটি আমার মোটেও মনে ধরে না। লেখালেখির ব্যবস্থা থাকলে আর বিচারের আয়োজন করা কেন! হাশরের ময়দানে যা হবে, তা নেহাত নাটক ছাড়া আর কিছু নয়। আর সেই নাটকের শরিক হওয়ার জন্য সে কি ভীষণ উত্তেজিত মানুষ!

লক্ষ করি নি, কি কারণে এক এক করে মেয়েরা উত্তরের ঘর খালি করে হুজুরের ঘরের দিকে চলে গেল, হুমায়রাও। আমি একা বসে অপেক্ষা করতে থাকি মা’র জন্য। কখন মা’র এ বাড়ির কাজ ফুরোবে আমার পক্ষে সম্ভব নয় অনুমান করা। এর আগে যতবার এসেছি বিকেলে ফিরবেন বলে সন্ধে আর সন্ধেয় ফিরবেন বললে রীতিমত রাত করেছেন। কখনও আবার এমন হয়েছে যে ফিরতে দেরি হবে বললেন, কিন্তু কি রহস্যজনক কারণে বোরখা পরে নিয়ে তাড়া লাগিয়েছেন চল শিগরি চল। আমি উত্তরের ঘরে একা বসে আছি, মা’র সেদিকে মন নেই। তিনি ছুটে ছুটে এর ওর সঙ্গে কানাকানি করছেন। কানাকানি কথা, সে যারই হোক, বড় শুনতে ইচ্ছে করে। কানাকানি শেষ হলে আমি অনুমান করি তিনি হুজুরকে বাতাস করবেন, হুজুরের পা টিপবেন, শরবত বানিয়ে দেবেন, পান সেজে দেবেন, চিলুমচি ধরবেন মুখের সামনে। চিলমচি থেকে তুলে হুজুরের কফ থুতু খেয়ে বা মুখে মাথায় ডলে মা’র এ বাড়ির কাজ আপাতত ফুরোবে।

মা যার সঙ্গে কানে কানে কথা বলছিলেন তার মুখ খানা আমি চেষ্টা করছিলাম দেখতে, কলসির তলার মত দেখতে এক নিতম্ব ছাড়া আর কিছু সম্ভব হচ্ছিল না দেখা । হঠাৎ, আমার গায়ের ওপর দিয়ে ঝড়ো বাতাসের মত দৌড়ে গেল দুটো মেয়ে জানালার দিকে। তারা, আমার মনে হয় না খেয়াল করেছে যে আমি, একটি প্রাণী বসে আছি ঘরে। এ দুটো আগের সাতজনে ছিল না। আনকোরা, অন্তত আমার চোখে। গায়ের পোশাক আগের সাতজনের মতই। মাথা থেকে পা অবদি ঢাকা। জানালায় দাঁড়িয়ে দুটো মেয়ের কে বলছে আমি ধরতে পারি না, যে, দেখ দেখ ওই হইল মহাম্মদ, ফাতেমা আপার ছেলে।

আরেকটি কণ্ঠ, আমি এও অনুমান করতে পারি না, ডান বা বামের জনের, এই যে ঘাড়ে হাত দিল, সে হাজেরাখালার ছেলে, মহাম্মদ।

দুূ’টো মেয়ের পশ্চাতদেশ ছাড়া আর কিছু নেই চোখের সামনে।

আমাকে ডিঙিয়ে আরও ক’টি মেয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল জানালায়। আরও পশ্চাতদেশ। জানালা থেকে দেখা যাচ্ছে বাহিরবাড়ির আঙিনা। আঙিনায় পুরুষেরা যারা মজলিশে শরিক হবে, পুকুর ঘাটে দাঁড়িয়ে আছে। অন্দরমহলে কেবল মেয়েরা ছাড়া আছে হাতে গোণা কিছু ছেলের প্রবেশাধিকার আছে। হাতে গোনাদের মধ্যে বেশির ভাগই হুজুরের আত্মীয়। আঙিনায় দাঁড়িয়ে থাকারা হাতে গোণা নয়।

— আর ওই যে মহাম্মদ, নুরুননবী ভায়ের ছেলে। নতুন একটি কণ্ঠস্বর।

মেয়েরা হাসছে। হাসতে হাসতে, মুখে ওড়না চেপে কারও ঘাড়ের ওপর দিয়ে, বগলের তল দিয়ে, দু’মাথার ষিনকোণ দিয়ে, গলার ফাঁক দিয়ে, দেখছে। সামনের মেয়েরা পেছনের মেয়েদের জন্য জায়গা ছাড়ছে না, পেছনের মেয়েগুলো মাছের মত পিছলে সামনে যেতে চাইছে। পেছনের পেছনের মেয়েরা বলছে, এইবার সর, দেখলা তো! আমাদেরে দেখতে দেও। আমি পেছনের পেছনের পেছনে দাঁড়িয়ে এক পলক দেখি, কিছু যুবক শাদা পাজামা পাঞ্জাবি আর টুপি মাথায় দাঁড়িয়ে আছে, কারও কোমরে হাত, কারও ঘাড়ে, কেউ পাছা চুলকোচ্ছে, কেউ হাই তুলছে, কেউ অযু করছে, কেউ মশা তাড়াচ্ছে গা থেকে। এত দেখার কি আছে এসব, আমি ঠিক বুঝে পাই না।

আরও কিছু মেয়ে হুড়মুড়িয়ে জানালায় ভিড় করে, এরা সাতজনের অংশ। সবাই মহাম্মদদের দেখে। এত ছেলের নাম মহাম্মদ কেন, মনে প্রশ্ন জাগে। প্রশ্নটি তেঁতুলের কালো বিচির মত গলায় আটকে থাকে। একটিই কেবল জানালা এ ঘরে, তাও পুরোনো ঘর বলে এটি। নতুন ঘরগুলোয় জানালা হবার নিয়ম নেই। নতুন ঘর থেকে মেয়েদের কোনও মহাম্মদকে দেখার সুযোগ নেই।

ফজলিখালার এক ছেলের নামও মহাম্মদ, এটিই প্রথম ছেলে, মহাম্মদের আগে জন্মেছে হুমায়রা, সুফায়রা, মুবাশ্বেরা। তিন মেয়ে হওয়ার পর ফজলিখালাকে ঘন ঘন জ্বিনে ধরত। মুবাশ্বেরার পর মহাম্মদ জন্মানোর পর জিনে ধরা কমেছিল। মহাম্মদের পর এক এক করে আরও তিনটে মেয়ে জন্মেছে, জিনে ধরা বেড়ে গেছে আগের চেয়ে অনেক বেশি। হুমায়রাকে শুনেছি ক’দিন আগে জিনে ধরেছে। তিনদিন তিনরাত পর জিন ছেড়েছে ওকে। এ বাড়িতে এমনই, আজ এ মেয়েকে, কাল ও মেয়েকে জিনে ধরছে, আর ঘর অন্ধকার করে, দরজা জানালা বন্ধ করে পীরসাব নিজে জিন তাড়ান। আমি নিজে দেখেছিলাম যূথির জিন তাড়ানো। যূথি আমার এক ক্লাস ওপরে পড়ত। মেয়েটি চমৎকার দেখতে ছিল। ইস্কুলের বট গাছের নিচে একা একা বসে ও গান গাইছিল একদিন, ঘন্টা পড়লে মেয়েরা ক্লাসে চলে গেল সব, যূথি গানই গাইছিল, পরের ক্লাসের ঘন্টাও পড়ল, যূথি তখনও গান গাইছে একা একা, চুল হাওয়ায় উড়ছে। খবর পেয়ে এক মৌলভি ছিলেন, উর্দু পরাতেন আমাদের, আমরা উর্দু স্যার বলে ডাকতাম, যূথিকে বটতলা থেকে টেনে এনে মাস্টারদের জানালেন যে ওকে জিনে ধরেছে। যূথি গলা ছেড়ে চিল্লাচ্ছিষ আমারে ছাইড়া দেন ছাইড়া দেন বলে। ওকে শক্ত মুঠোয় ধরে উর্দু স্যার জিন তাড়ানোর আয়োজন করলেন। পাক পানিতে আল হামদু সুরা, আয়াতুল কুরসি, আর সুরা জিনের প্রথম পাঁচ আয়াত পড়ে পানি ছিটোলেন যূথির মুখে, আর মুখের সামনে আগুন ধরে নিমের ডাল দিয়ে পেটালেন। পেটালেন যূথি মুখ থুবড়ে পড়া অবদি। যূথির জিন তাড়ানো দেখেছিলাম দু’চোখে জগতের সকল বিস্ময় নিয়ে, ইস্কুলের আর সব মেয়ের সঙ্গে দাঁড়িয়ে। ওর জন্য বড় মায়া হচ্ছিল আমার।

উত্তরের ঘরে বসে আমার অস্থির লাগে, গা ছমছম করে। এ বাড়িতে, ভয় হয় আবার আমাকেও না জ্বিনে ধরে। আমাকেও না অন্ধকার ঘরে জিন তাড়াতে হাতে ছড়ি নিয়ে ঢোকেন পীর আমিরুল্লাহ।

আমি যখন কুঁকড়ে আছি ভয়ে, মেয়েরা ততক্ষণে জানালা থেকে সরে গেছে, মা এসে দ্রুত বলে যান, মজলিশ শেষ করে তিনি বাড়ি ফিরবেন। মজলিশের অভিজ্ঞতা আমার কিঞ্চিত আছে, এটি আমাকে মোটেও উৎফুল্ল করে না। মজলিশ বসে বড় এক ঘরে, অন্দরমহল থেকে মেয়েরা সরাসরি ঢুকে যেতে পারে মেয়েদের জন্য পর্দা ঢাকা জায়গায়। মেঝেয় ফরাস পাতা, ওতেই হাঁটু মুড়ে বসতে হয় সবাইকে। সামনে উচু চৌকিতে গদি পাতা, ওখানে বসেন পীরসাব। লোবানের গন্ধঅলা মজলিশ-ঘরে যখন ঢোকেন তিনি, ডানহাতখানা উঁচু করে, গম্ভীর মুখে। সকলে দাঁড়িয়ে বলেন আসসালামু আলায়কুম ইয়া রহমতুল্লাহ। শব্দে গমগম করে ঘর। পীর সাব ভারি গলায়–ওয়ালায়কুম আসসালাম বলে হাত নেড়ে বান্দাদের বসতে ইঙ্গিত করেন। মেয়েদের গা থেকে পাউডারের গন্ধ বেরোতে থাকে, চোখে সুরমা পরা মেয়েরা, পর্দা ফাঁক করে হুজুরকে দেখেন, আড়চোখে দেখেন বাকি পুরুষদের।

হুজুর দাড়িতে হাত বুলিয়ে বললেন বুঝলেন কি না আবু বকর, এই দুনিয়া মিছে দুনিয়া। এই দুনিয়ায় টাকা কড়ি করে কী লাভ, কেউ কি সঙ্গে নিয়ে যাবে কিছু! বলুন, কেউ সঙ্গে নেবে কিছু কবরে!

আবু বকর, কালো মুখে কালো দাঁড়ি বেটে এক লোক, সামনের সারিতে বসা, উত্তর দেন–জী না হুজুর।

— তো আল্লাহর প্রেমে নিজেকে সমপ্পন কব্বেন নাকি ধন দৌলতের প্রেমে! হুজুর প্রশ্নটি আবু বকরকে করেন, কিন্তু দৃষ্টি ছুঁড়ে দেন মজলিশের শাদা মাথাগুলোয়।

— আল্লাহর প্রেমে হুজুর। ঘোর লাগা গলায় বলেন আবু বকর।

মেয়েরা পর্দার আড়াল থেকে আবু বকর লোকটিকে পলকহীন দেখে। সে দিনের জন্য আবু বকরের নাম মুখে মুখে ফিরবে। ্‌হুজুর যেচে কথা বলেছেন তাঁর সঙ্গে। এ কম সম্মান নয় আবু বকরের! কেউ কেউ এও মন্তব্য করবে আবু বকরের ভাগ্য ভাল, হুজুর তাঁর বেহেসত নসীবের জন্য আল্লাহর কাছে তদবির করবেন।

মজলিশের সময় ঘড়ি ধরে এক ঘন্টা। আজকের ঘন্টা তিনি পার করেছেন নবীজির দারিদ্রের বর্ণনায়, ছেঁড়া একটি কম্বল সম্বল ছিল তাঁর। নবীজির দুঃখে মজলিশের লোকেরা হাউমাউ করে কেঁদেছেন। যে যত কাঁদতে পারে, তার সুনাম বাড়ে এ বাড়িতে। সুনাম অবশ্য স্বপ্ন দেখলেও বাড়ে। ফজলিখালা স্বপ্ন দেখেছেন তিনি নবীজির সঙ্গে এক চমৎকার ফোয়ারার ধারে বসে কথা বলছেন, শাদা শাদা পাখি উড়ছে, বাতাস বইছে ঝিরিঝিরি, কী কথা বলছেন তা খেয়াল করতে যদিও পারেননি, হুজুর বলেছেন ফজলিখালার বেহেসত নিশ্চিত। পীরবাড়িতে ফজলিখালার মূল্য অনেকখানি বেড়ে গেছে এরপর, অনেকে আলাদা করে জানতে চেয়েছে ফোয়ারার পাশে বসা নবীজিকে ঠিক কেমন দেখতে লাগছিল, কেমন তাঁর চেহারা। মুখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে স্বপ্নের বর্ণনাটি যখন তিনি দেন, কী যে নূর তাঁর মুখে, কী যে অপূর্ব সুন্দর তিনি, কী যে আশ্চর্য সুন্দর কোমল তাঁর হাত! ফজলিখালা যখন বলেন চোখ ধীরে ধীরে মুদে আসে যেন তিনি এখনও সে হাতের স্পর্শ পাচ্ছেন। হাত ধরে দু’জন ফোয়ারার দিকে গিয়েছেন গোসল করতে, গোসল করছেন, ঘুম ভেঙে গেল। ফজলিখালার এই স্বপ্নের কথা শোনার পর এ বাড়ির অনেকেই নবীজিকে স্বপ্ন দেখতে লাগলেন। তাঁদেরও সুনাম হল। মা বড় আক্ষেপ করেন কখনও তিনি নবীজিকে স্বপ্ন দেখেননি বলে। ঘুমোনোর আগে খুব করে নবীজিকে ভেবে ঘুমোন, যেন স্বপ্নে তাঁর সাক্ষাৎ পান। পাননি। নিজেকে বড় গুনাহগার মনে হয় মা’র।

মজলিশ শেষ হতেই এক এক করে লাইন ধরে পুরুষেরা কদমবুসি সেরে পীরের হাতে টাকা গুঁজে দেন। হাদিয়া যে কোনও অঙ্কের হতে পারে, আল্লাহর উদ্দেশ্যে যে যা পারে তাই দেবেন হুজুর এ রকমই বলে দিয়েছেন।

আবু বকর পরম শ্রদ্ধায় হুজুরকে কদমবুসি সেরে বলেন–হুজুর বড় ভয় হয়, শেষ জমানা চইলা আসছে, কেয়ামত আইসা যাইতেছে। ব্যবসা বাণিজ্যে আর মন দিই না। খালি হাতেই তো দাড়াইতে হইব পরকালে। কী আছে কে জানে কপালে। সারাজীবন তো আমলই করা হয় নাই। দোয়া করুইন হুজুর, আপনের দোয়া ছাড়া কপালে দুর্গতি আছে। হুজুর কথা দেন, দোয়া তিনি করবেন।

পুরুষের হাদিয়া এবং কদমবুসি গ্রহণ করার পর অন্দরমহলে ঢোকেন হুজুর। বাইরে থেকে আসা মেয়ে মহিলা এখন এক এক করে কদমবুসি করে হাদিয়া দেবেন। এইপর্ব শেষ হলে হুজুর গা এলিয়ে দেবেন বিছানায়, তখন যুবতীরা ঝাঁপিয়ে পড়বেন গা টিপতে। আমি মা’র ওড়না টেনে নাকি সূরে বলি–ও মা। চল। বাসায় যাইতে হইব। বাবা বাসায় ফিইরা যদি দেখে আমি নাই, মারব ত!

এক ঝটকায় আমার মুঠো থেকে ওড়না ছাড়িয়ে মা বলেন–বিরক্ত করিস না।

আমি একা দাঁড়িয়ে থাকি উঠোনের অন্ধকারে, জবা গাছের তলায়। চুল খোলা থাকলে জ্বিনে ধরে শুনেছি। চুল ঢেকে রাখি ওড়নায়। ওড়না পাজামা পরার অভ্যেস নেই আমার, ওগুলো মেয়েরা আরও বড় হয়ে পরে। এখনও বাড়িতে ফ্রক পরি আমি। কিন্তু পীর বাড়িতে যে বয়সেরই হও না কেন, হুজুর অনুমোদিত পোশাক ছাড়া ফটকের ভেতরে ঢোকা যাবে না। দুনিয়ার ভেতরে এ এক আজব দুনিয়া।

রিক্সায় বাড়ি ফিরতে ফিরতে মা’কে জিজ্ঞেস করি–এই যে লক্ষ লক্ষ বছর ধইরা আল্লাহ তায়ালা ইসরাফিলরে মুখে শিঙ্গা দিয়া বসাইয়া রাখছেন, এর দরকারটা কি ছিল? আল্লাহ ত জানেন কখন কেয়ামত হইব, তখনই তিনি ইসরাফিলরে কইতে পারতেন শিঙ্গা মুখে লইতে। বেচারা ইসরাফিল! কোনও নড়ন চড়ন নাই।

মা বোরখার তল থেকে বলেন–আল্লাহ ইহকাল পরকালের সৃষ্টিকর্তা। ইসরাফিল এক ফেরেসতা মাত্র। ইসরাফিলরে আল্লাহ যেভাবে বলছেন সেভাবেই আল্লাহর হুকুম মাইনা চলতে হয় তাঁর। সব ফেরেসতাদের চলতে হয়। আল্লাহর ইচ্ছা নিয়া প্রশ্ন করবি না। আল্লাহরে ভয় পাইতে হইব।

আমি বলি–তুমার হুজুর তো বলছেন আল্লাহর প্রেমে পড়তে হইব। ভয় পাইলে কি প্রেমে পড়ন যায় নাকি!

প্রেম শব্দটি উচ্চারণ করতে আমার বরাবরই জিভে জড়তা ছিল, শব্দটি উচ্চারণে এক অলিখিত নিষেধাজ্ঞা আছে। সে নিষেধ নর নারীর প্রেমের বেলায় কেবল। কারণ এ রকমই শুনেছি প্রেমে পড়ে মন্দ লোকে, ঝুনু খালাকে দেখেছি লুকিয়ে প্রেম করতে। দাদাও লুকিয়ে কবিতা লিখতেন অনিতার জন্য। ঝুনু খালার সঙ্গে রাসু খালুর ইয়ে ছিল, দাদা বলেন। ইস্কুলে মেয়েরাও প্রেম শব্দটি উচ্চারণ করে না, বলে ওই মেয়ের সঙ্গে ওই ছেলেটির ইয়ে আছে। ইয়ে শব্দটির মানে বুঝতে প্রথম প্রথম আমার অসুবিধে হত। পরে বুঝে, নিজেও, ইয়ে বলতে অভ্যেস করেছি। এটিই, লক্ষ করেছি, বাড়ি এবং বাড়ির বাইরে, যেখানে আমার এবং আমার পরিচিতদের চলাচল, চলে। আল্লাহর সঙ্গে পীরসাবের ইয়ে আছে, এ ধরনের বাক্য আমি শুনিনি পীর বাড়িতে। আল্লাহর প্রসঙ্গে প্রেম শব্দটি অবাধে উচ্চারণ করা হয়। হুমায়রার সঙ্গে আতিক নামে ওর এক ফুফাতো ভাইয়ের প্রেম চলছে না বলে, শুনেছি বলা হয়, ইয়ে চলছে, তাও বলা হয় ফিসফিসিয়ে, কেউ যেন না শোনে, কিন্তু কারও কোনও অস্বস্তি হয় না বলতে যে হুমায়রা আল্লাহর প্রেমে মগ্ন, সেটি সজোরেই বলা হয়, যেন একশ লোকে শোনে।

মা বলেন–আল্লাহরে যায়।

— তুমি ত বলছ, আল্লাহ সব লিইখা রাখছেন খাতায়, প্রত্যেকটা মানুষের জন্ম মৃত্যু, কার সাথে কার কখন বিয়া হবে তাও। এমন কি কে বেহেসতে যাইব, কে দোযখে যাইব তাও লেখা আছে। তা যদি লেখাই থাকে, ধর আবু বকর, তার যদি বেহেসত আল্লাহ লিইখাই রাখেন, তাইলে কি সে গুনাহ করলেও বেহেস্তে যাইব! আর ধর আমিই, আমার জন্য যদি আল্লাহ আগে থেইকাই দোযখ লেইখা রাখেন, তাইলে আমারই বা কি লাভ আল্লাহরে ডাইকা! আল্লাহ কি পরে তাইলে নিজের লেখা সংশোধন করেন! এক দমে বলে আমি থামি।

— এমনে ত বোবা হইয়া থাকস মানষের সামনে। আমার সামনেই তর খই ফুডে মুহে। মা রুষ্ট-স্বরে বলেন।

— আল্লাহ ত সব পারেন করতে, ঠিক না! কণ্ঠে প্রচন্ড কৌতূহল নিয়ে জিজ্ঞেস করি।

মা বলেন–হ। আল্লাহ যা ইচ্ছা করেন, সবই হয়। আল্লাহ হও বললে হয়। আল্লাহ হও না বললে কারও শক্তি নাই কিছু হওয়াইতে। আল্লাহর আদেশ ছাড়া গাছের একটা পাতাও নড়ে না।

মা’র সারা শরীর কালো বোরখায় ঢাকা, কপাল থেকে নেমে এসেছে পাতলা কালো কাপড়, যেন হাঁটতে গিয়ে সামনে কোনও গর্ত পড়লে পা ফেলার আগে অন্তত দেখেন। পাতলা আবরণটির দিকে, যার তলে মা’র চোখ থেকে হলকা বেরোচ্ছে আগুনের, তাকিয়ে বলি–ধর, কিছু নাই, খালি হাত, আল্লাহ কি কিছু নাই থাইকা ফুল বানাইতে পারেন!

— হ। মা বলেন।

— ধর, আল্লাহর হাতে একখান রুমাল। রুমালের মধ্য থেইকা আল্লাহ কি একটা কবুতর বানাইতে পারবেন! আবারও প্রশ্ন করি।

মা নিশ্চিত স্বরে বলেন–হ।

— আমগোর ইস্কুলে যাদু দেখাইতে আইছিল যে লোকটা, সেও পারে। সেও পারে বাতাসে আল্লাহর মত মিলাইয়া থাকতে। আমি ঠোঁট উল্টে বলি।

— কি কইলি তুই! তর ত ঈমান নষ্ট হইয়া গেছে। তুই আল্লাহর সাথে তুলনা করলি যাদুকররে! কত সাহস তর! পাজি ছেড়ি, পাজ্যামি করস। আমি কি আশায় লইয়া যাই তরে হুজুরের কথাবার্তা শুনতে! দিন দিন আস্তা শয়তান হইতাছস। এইসব তর বাপের কাছে শিখছস! তর ঠোঁট আমি সিলাই কইরা দিয়াম, আরেকবার এইসব কইলে। মা’র রুখে ওঠায় আমি দমে যাই।

মা একবার বলেছিলেন আবদুল কাদের জিলানি আল্লাহর আদেশ পেয়ে কবর থেকে জ্যান্ত হয়ে বেরিয়েছিলেন। আমার বিশ্বাস হয়, যাদুকর লোকটিও তা পারবেন। মা’কে আর সে কথা বলতে যাই না। এত গাল খাওয়ার ইচ্ছে হয় না আমার। তবে মাথার ভেতর আরেকটি প্রশ্ন খুব আঁকু পাঁকু করে, সেটি মুখ ফসকে বেরিয়ে যায়–পীরবাড়ির মানুষদেরে এত জ্বিনে ধরে ক্যান? আমাদেরে ত জ্বিনে ধরে না! ওই বাড়িতে তুমি কইছ আল্লাহ নাইমা আসেন, তাইলে আল্লাহর এরিয়ায় জ্বিন আসার সাহস পায় ক্যান!

মা আমার পেটে কনুইএর গুঁতো দিয়ে বলেন–আর একটা কথা না। বাসাত গিয়া তওবা কইরা নামাজ পইড়া আল্লাহর কাছে মাপ চা। আল্লাহরে ডরাস না, ডরাস না দেইখাই ত শয়তানি চিন্তা মাথাত আয়ে।

আমার প্রশ্নের কোনও উত্তর জোটে না।

ইস্কুলের বিজ্ঞান বই সামনে নিয়ে মা’কে বলি–আল্লাহ ত আদম হাওয়া প্রথম সৃষ্টি করছে, ঠিক না?

— করছে না, করছেন। মা আমার বেয়াদবি শুধরে দেন।

— এই যে দেখ, বিজ্ঞান বইয়ে আদিম মানুষের ছবি দেখিয়ে বলি, এক কোষি প্রাণী থেকে বহুকোষী প্রাণী, তারপর বানর থেইকা বিবর্তন ঘইটা এইরকম আদিম মানুষ হইছে। তারা গুহায় থাকত, মারামারি করত, ফল মুল খাইত, কাচা মাংস খাইত। অনেক পরে পাথরে পাথর ঘইষা আগুন জ্বালাইতে শিইখা তারপরে তারা অনেক কিছু করতে শিখে। ধীরে ধীরে মানুষ সভ্য হইছে। আল্লাহর বানানো হযরত আদম আলায়েসসাল্লাম কি এরম লোমঅলা ল্যাংটা বান্দরের মত দেখতে ছিল নাকি, যারে আল্লাহ মাটি দিয়া বানাইয়া বেহেসতের বাগানে হাঁটতে দিছিলেন!

মা চোখ নাক কুঁচকে, যেন দুর্গন্ধ বেরোচ্ছে বই থেকে, বলেন–সর, সর, সর। দূর হ সামনে থেইকা। এই বইএ যা লেহা সব মিছা কতা। আল্লাহ যা বলছেন, তাই একমাত্র সত্য। আল্লাহর উপরে আর কুনো সত্য নাই।

মা’র সামনে থেকে আমাকে সরে আসতে হয়। বাবার কাছে ব্যাপারটি তুলব, তা সম্ভব নয়। তাঁর সামনে দাঁড়ালে গলায় স্বর ফোটে না। আল্লাহ সত্য নাকি বিজ্ঞান সত্য– কে আমাকে উত্তর দেবে। আল্লাহ যা বলেছেন তার ভেতরে যুক্তি কম দেখি। যুক্তি শব্দটি নতুন শিখেছি আমি, বাবা তাঁর বাণীতে ইদানীং প্রায়ই বলছেন, যুক্তি ছাড়া কোনও কাজ করবি না, যা কিছুই করস নিজের বিবেকরে জিগাস করবি, বিবেকে যদি কয় কাজটা করতে তাইলেই করবি। সব মানুষেরই বিবেক বইলা একটা জিনিস থাকে। মানুষ হইল এনিমেল, কিন্তু র‌্যাশনাল অ্যানিমেল। যুক্তিবুদ্ধি না থাকলে মানুষ আর জন্তুতে কোনও তফাৎ নাই।

বাবা অবশ্য বাণীটি দিতে শুরু করেছেন উঠোনে রাখা খড়ির স্তুপে দেশলাই জ্বেলে খেলতে গিয়ে আগুন প্রায় ধরিয়ে দিয়েছিলাম বলে। আগুন যদি ছড়াতো, বাবার বিশ্বাস বাড়িঘর পুড়ে ছাই হয়ে যেত।

বিজ্ঞানের কথায় আমি যুক্তি দেখি বেশি। আল্লাহ আদম হাওয়াকে ধাম করে বেহেসত থেকে ফেলে দিলেন পৃথিবীতে, কেমন যেন গপ্প গপ্প মনে হয়। রূপকথার বইয়ের মত। মা’কে বললে মা বলেন আল্লাহ সম্পর্কে বাজে কথা কইলে তর জিব খইসা পড়ব। আমি জিভ খসে কি না দেখতে ঘরের দরজা বন্ধ করে আল্লাহ তুই পচা, আল্লাহ তুই শয়তান, আল্লাহ তুই একটা আস্তা বদমাইশ, আল্লাহ তুই শুয়োরের বাচ্চা বলেছিলাম। জিভের জায়গায় জিভ রইল, আমিও নিশ্চিত হলাম আল্লাহকে গালাগাল করলে আসলে জিভ খসে না, মা ভুল বলেন। আর আল্লাহর কাছে চাইলেই যে আল্লাহ কিছু দেন না, তারও প্রমাণ পেয়েছি। নামাজ সেরে আল্লাহর কাছে মোনাজাতের হাত তুলে পোড়াবাড়ির চমচম চেয়েছিলাম, শরাফ মামারা যেমন ঠান্ডার বাপের দোকানের লুচিবুন্দি নাস্তা খায়, তা চেয়েছিলাম, জোটেনি। একটা কাঠের ঘোড়া চেয়েছিলাম, রাজবাড়ি ইস্কুলে চমৎকার রঙিন একটি কাঠের ঘোড়া দেখে লোভ হয়েছিল, কেউ আমাকে কাঠের ঘোড়া দেয়নি, আরও কত কী চেয়েছিলাম—- আমান কাকা আর শরাফ মামা কুষ্ঠ হয়ে মারা যান চেয়েছিলাম, ওঁদের কুষ্ঠও হয়নি, ওঁরা মরেনও নি। মা প্রায়ই আল্লাহর কাছে প্রার্থণা করেন বাবা যেন কুষ্ঠ হয়ে শিগরি মরে যান। অথচ বাবা দিব্যি সুস্থ, দিন দিন পেশীতে শক্তি বাড়ছে। জ্বরেও যে একদিন বিছানায় পড়বেন, তাও নয়। আমার প্রায়ই জ্বর হয়, সে কি খুশি হই জ্বর হলে, তখন আর লেখাপড়া করতে হয় না, বাবা তখন বেশ নরম গলায় কথা বলেন, মাথায় হাত বুলিয়ে দেন। ওই একটি সময়, যখন বাবার আদর বড় সুলভ। থোকা থোকা আঙুর, কমলালেবু এনে শিয়রে রাখেন, শুয়ে শুয়ে ভাইবোনকে দেখিয়ে দেখিয়ে খাই। ওরা হাত পেতে প্যান প্যান করে চাইলে সামান্য দিই। মা আদা কেটে নুন মেখে দেন খেতে। কিন্তু ওষুধ খেতে গেলেই বিরক্তি ধরে, জ্বর হওয়ার আনন্দ সব উবে যায়। বড় বড় ট্যাবলেট গিলতে বললে মনে হয় অসুখ হওয়াটা বড় বাজে এক ব্যাপার। পাঁচ ছ’রকম ওষুধ ঘন্টায় ঘন্টায় গিলতে বলেন বাবা। খাচ্ছি খাব বলে টুপ করে জানালার বাইরে ওষুধ ফেলে দেওয়ার অভ্যেস আমার। জ্বর সাত আটদিনেও যখন ছাড়ে না, বাবার সন্দোহ হয়। তিনি নিজে আমার মুখের ভেতর পানি ঢেলে বলেন হা কর, হাঁ করলে ট্যাবলেট বা ক্যাপসুল ঢুকিয়ে দেন মুখে। গলায় ওসব আটকে যায়, ওয়াক করে মেঝে ভাসিয়ে ফেলি। বাবা আবার বলেন হাঁ কর। এ ঠিক একবার না পারিলে দেখ শতবার এর মত। বাবা হাল ছাড়েন না যতক্ষণ না ওষুধ আমার পেটে ঢুকছে। বাবা ঘরে না থাকলে মা সুরা পড়ে ফুঁ দিয়ে দেন বুকে। ফুঁ দেওয়াতে ভালই লাগে। ফুঁ তো আর তেতো ওষুধ নয় যে গিলতে হয়। গ্লাস ভরে ময়লা পড়া পড়া পানি খাওয়ান। অসুখ সারলে মা বলেন মা’র ফুঁয়ে আর পীরের পড়া পানিতে অসুখ সেরেছে, বাবা বলেন ওষুধে সেরেছে।

বাবার সঙ্গে আমার হৃদ্যতা নেই মোটে, তিনি সামনে দাঁড়ালে মনে হয় এক দৈত্য এসে দাঁড়াল, প্রাণ যায় যায়, তবু বাবা যখন বলেন জ্বর হচ্ছে অসুখের উপসর্গ, শরীরে জীবাণু ঢুকে অসুখ তৈরি করে, ওষুধে জীবাণু নাশক জিনিস আছে, তা শরীরে গিয়ে জীবাণু ধ্বংস করলে তবেই অসুখ সারে–বাবার কথাকেই আমার যৌক্তিক মনে হয়। নানিবাড়ির পেছনের বস্তিগুলোয় কারও অসুখ হলে ফুঁ দেওয়ার চল ছিল। ক’দিন পর পরই সুরা টুরা পড়ে রোগে ভোগা গেঁতুকে ফুঁ দিয়ে যেত এক মৌলবি, পানিতে ফুঁ দিয়ে রেখে যেত, পড়া পানি খেলে নাকি অসুখ সারবে। ফুলে ঢোল হয়ে, শেষে গেঁতু, ছ’বছর বয়স মাত্র, মরেই গেল। ঝুনু খালার পাগলামি কমাতেও মৌলবি ফুঁ দিয়েছিলেন, কমেনি। বাবাকে ফুঁ দিতে গোপনে এক মৌলবি যোগাড় করেছিলেন মা, যেন রাজিয়া বেগমের কবল থেকে মুক্ত হন বাবা। বাবার গায়ে তো ফুঁ দেওয়া সম্ভব নয়, ফুঁ দিয়েছিলেন বাবা যে ঘরে ঘুমোতেন, সুতোয় গিঁট দিয়ে চার টুকরো সুতো পুঁতে রেখেছিলেন সে ঘরের চার কিনারে, গোপনে। মৌলবি বলে গিয়েছিলেন, এখন আপনের স্বামীর মন ফিরব। মা আর নানিকে ফিসফিস কথা বলতে শুনেছিলাম এ নিয়ে। বাবার মন তো ফেরেনি, মা’র চেয়ে বেশি আর এ কথা কে জানে! তবু ঝাড় ফুঁকে অন্ধ বিশ্বাস মা’র।

মা বলেন সব মিথ্যে যা লেখা ইস্কুলের বইয়ে। আমার বিশ্বাস হতে চায় না। পীরবাড়িতে যাওয়া শুরু করার আগে ইস্কুলের লেখাপড়াকে মা দোষ দেন নি, বরং তিনি নিজে আরও লেখাপড়া করতে পারেননি বলে দুঃখ করতেন। দুঃখ হঠাৎ হঠাৎ এখনও করেন, সে জ্ঞানার্জনের জন্য নয়, লেখাপড়া না করাতে তিনি কোনও চাকরি জুটিয়ে বাবার সংসারে ঝাড়ু মেরে মহানন্দো বিদায় নিয়ে নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারছেন না বলে। চোখের সামনে কী ভীষণ পাল্টে গেলেন মা। মা কি ভূল পথে যাচ্ছেন, নাকি সত্য পথে। আমি ঠিক বুঝে পাই না, মা না হয় যুক্তি ছাড়া কথা বলেন কিন্তু লেখাপড়া জানা, রীতিমত বিএ এমএ পাশ করা লোকেরাও তো কখনও মানুষ বা জগতের উৎপত্তি বিষয়ে কোনও তর্কে মাতেন না, আল্লাহ যা বলেছেন তা দিব্যি মেনে নেন, নিশ্চয় মেনে নেন, মেনে না নিলে নামাজ রোজা করেন কেন! নানিবাড়ির পেছনে বস্তি, সামনে ছিল শিক্ষিত লোকদের বাড়ি। সেসব বাড়ির এত লোক যখন আল্লাহকে মানেন, আল্লাহ ব্যাপারটি নেহাত ফেলনা নয়। বাবা নিজেই রোজা করেন, রমজান এলে। ছোটবেলায় আমার শখ হত রোজা রাখতে, শেষ রাতে উঠে আমিও সবার সঙ্গে বসে প্রথম মাছ মাংস পরে দুধ কলা মেখে ভাত খেতাম। দুপুর বেলা বাবা বলতেন এখন তুমাকে কিছু খেতে হবে।

আমি মাথা নেড়ে বলতাম–আমি রোজা রাখছি।

— উহুঁ, ছোটদের রোজায় এখন খাইয়া পরে আবার ইফতারি করতে হয় সন্ধ্যার সময়। তাইলে রোজা হইব দুইটা। বাবা বলতেন।

আসলে দুটো রোজার মানেটি হচ্ছে আমাকে খেতে হবে, সারাদিন না খেয়ে থাকলে আমার কষ্ট হবে, আমি কষ্ট পাই বাবা চাইতেন না। শেষ রাতে সাইরেন বাজার সময় বেশির ভাগ দিনই আমাকে ডাকা হত না, কিন্তু ঘরে থাল বাসনের শব্দ পেয়ে লাফিয়ে উঠে শেষ রাতের খাবার খেতাম, রোজা রাখব। আল্লাহ বলেছেন উপোস করতে, তাই উপোস করতে চাইতাম তা নয়। ছোটরা রোজা রাখলে বাড়িতে বেশ আদর পাওয়া যায়, লক্ষ করেছি। আদর পাওয়াই ছিল মূল উদ্দেশ্য, সম্ভবত। আদরের বাইরেও এ অনেকটা খেলার মত ছিল, উপোস উপোস খেলা, খেলা শেষে মুড়ি, ছোলা, ডালের বড়া, বেগুন বড়া, গরম গরম জিলিপির সামনে বসে থেকে সাইরেন বাজলে খাওয়া শুরু করা। সাইরেন সাইরেন, খাওয়া খাওয়া।

পুরো মাস রোজা রেখে বাবা ঈদের উৎসবও করেন জাঁক করে। ছেলেমেয়েদের জন্য জামা কেনেন, মা’র জন্য শাড়ি, বড় ঈদে কোরবানি দিতে গরু কেনেন, নয়ত খাসি। সারাবছরে বাবার এটুকুই ধর্ম পালন। অবশ্য মাঝে একবার ্‌এক মৌলবি রাখলেন প্রতি সকালে এসে যেন তাঁকে কায়দা পড়িয়ে যান। হঠাৎ এ শখ কেন হয়েছিল তাঁর, কাউকে বলেননি। তবে শখটি হওয়ার ক’দিন আগে তিনি, আমি মনে করতে পারি, রাতে বাড়ি ফিরে খাবার টেবিলে বসে মা’র কাছে বলেছিলেন যে এক রোগীর বাড়িতে অদ্ভুত এক লোক দেখেছেন তিনি, লম্বা চুলদাড়ি লোকটির, ছেঁড়া জামা জুতো, কাগজে আল্লাহ লিখলেন আরবিতে, আর সে লেখা থেকে স্পষ্ট আওয়াজ বেরোতে লাগল আল্লাহু আল্লাহু। কাগজটি হাতে নিয়ে বাবা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখেছেন কোনও চালাকি আছে কি না, নেই। জামার পকেটে কোনও যন্ত্র লুকোনো আছে কি না, নেই। লোকটি নিজে শব্দ করছে কি না মুখে, না। কাগজের অক্ষর এমন জিকির কী করে তোলে বাবা বুঝে পান না। মা আহা আহা করলেন বাবার গল্প শুনে। বাবা লাটিমের মত ঝিম ধরে বসে রইলেন। মুখে খাবার উঠল না। ভাত নেড়ে চেড়ে ক্ষিধে নেই বলে থাল সরিয়ে রাখলেন। রক্তচাপ বাড়লে বাবা সকাল সকাল ঘুমোতে চলে যান যেমন, সে রাতেও গেলেন। বাবা কখনও, কী করলেন তিনি বাড়ির বাইরে, কী রোগী দেখলেন, কোথায় কী ঘটল কিছু বলেন না কাউকে, আমাদের তো নয়ই, মা’কেও না। কিন্তু সেদিন বাবা অদ্ভুত ব্যবহার করলেন। তার সপ্তাহ খানিক পর সকাল বেলা রাতকানা মৌলবি, রাতে লোকটি পথ চেনেন না বলে লোকে ডাকে তাই, নতুন একটি কায়দা হাতে নিয়ে দরজায় কড়া নাড়লেন, বাবা খবর দিয়েছেন। অবশ্য বাবার এসব সয়নি বেশিদিন। দুদিন আলিফ জবর আ বে জবর বা পড়েই মৌলবি এলে বলতেন, মৌলবি সাব চা টা খান, আজ আর পড়তে ইচ্ছা করতাছে না। আগামী কাল পড়ব। চা নাস্তা দেওয়া হত মৌলবিকে বাইরের ঘরে, ও খেয়ে তিনি বিদেয় হতেন। আগামীকাল আসে, পরশু আসে, ছাত্রের টিকিটির আর দেখা পাওয়া যায় না। দিন পাঁচেক পর মৌলবিকে পুরো মাসের বেতন দিয়ে একেবারই বিদেয় করে দিলেন। এই হচ্ছে ধর্মের গ্রাস বাবার ওপর, কেবল দু’দিনের জন্যই ছিল তার থাবা। এরপরই বাবা আবার আগের বাবা, অহংকারি, নীতিবান, কর্মঠ, ব্যাকব্রাশ, প্যান্টের ভেতরে শার্ট, শার্টের ওপর টাই, টাইয়ের ওপর কোট। শীতকালে ওভারকোট। ছয় ঋতুতেই জুতোর মচমচ।

বড় মামা ঢাকা থেকে প্রতিমাসে অবকাশের ঠিকানায় উদয়ন নামে একটি পষিনকা পাঠান। এটি আমাদের কাজে লাগে বই খাতার মলাট বাঁধায়। উদয়ন এল, ছবি টবি দেখে ব্যস মলাট। বইখাতায় মলাট বাঁধা সেই লেখাপড়া শুরু করা অবদি শেখা। প্রথম প্রথম মলাট বেঁধে দিতেন মা, বিস্কুটের ঠোঙা, বাবা টোস্ট বিস্কুট কিনে আনতেন ভরে, কেটে। পরে সৌন্দর্যজ্ঞান বাড়লে নিজেই মলাট বাঁধি ক্যালেন্ডারের রঙিন পাতায়, গ্লাক্সোর ক্যালেন্ডারই বেশি, এরপর শুরু হল মাসিক উদয়নের পাতা ছিঁড়ে। উদয়ন পষিনকাটি সোভিয়েত ইওনিয়নের দূতাবাস থেকে বেরোয়, বড় মামা দূতাবাসের সাংস্কৃতিক কেন্দ্রে পষিনকাটির যুগ্ম সম্পাদকের চাকরি করেন। ময়মনসিংহে বেড়াতে এলে সঙ্গে করে বেশ বই আনেন, কিছু বই আবার রেখে যান আমাদের বাড়িতে। কী মনে করে কে জানে, সম্ভবত দাদারা যেন পড়েন। আদৌ ওসব বই খুলে দেখেন না দাদা কিংবা ছোটদা। আমি অলস বিকেলগুলোয় মাঝে মাঝে নেড়ে চেড়ে দেখি ছোটদের লেনিন, দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের ইতিহাস, সমাজতন্ত্র কি ও কেন, ম্যাক্সিম গোর্কির মা, আমার ছেলেবেলা, পৃথিবীর পাঠশালা এসব।

বড়মামা বাড়ি এলে বেশ ভাল ভাল রেঁধে খাওয়ান মা, চলে গেলে বলেন–মেবাই কি যে হইয়া গেল, মাদ্রাসায় পড়া ছাত্র, হইল কি না কমুনিস্ট। ছি ছি। মা’র ছি ছি শব্দ আমাকে সজাগ করে। জিজ্ঞেস করি, কমুনিস্ট কি, মা?

— আর কী, আল্লাহ খোদা মানে না। মা মন-মরা স্বরে বলেন।

এই প্রথম বিস্ময় আমার, তাহলে আল্লাহ খোদা না মানা লোকও জগতে আছে! বড় মামা চাঁদে নীল আর্মস্ট্রং মুতে এসেছেন বলেন, আরবি ভাষাটি যে কোনও ভাষার মত একটি ভাষা, এ ভাষাতেও অশ্লীল কথা লেখা হয়, অবলীলায় বলেন, কিন্তু তিনি আল্লাহ খোদা মানেন না এ আমাকে আগে কেউ বলেননি। বড় মামা কেন তা মানেন না আমার খুব জানতে ইচ্ছে করে। কিন্তু কোনও উপায় নেই জানার, বড় মামা থাকেন দূরের শহরে, যখন আসেন, তাঁর রাজকন্যাটিকে তিনি একটি ছোট খাট শিশুই ভাবেন, রাজকন্যা যে দেখতে দেখতে বড় হচ্ছে, কতরকম প্রশ্ন জমছে মনে, তা তিনি মোটেও দেখতে পান না। বোকা সোকা লাজুক মেয়ের হাতে দু’টো লজেন্স তুলে দেয়াই ভাবেন যথেষ্ট। বড় মামার রেখে যাওয়া বইগুলো প্রথম নেড়ে চেড়ে এরপর পড়ে পড়ে আমার ধারণা জন্মেছে সেই ফ্রক পরা বয়সেই যে পৃথিবীটা কেবল ঝাড়ফুঁকের জগত নয়, এসবের বাইরে বড় একটি জগত আছে, যুক্তির জগত। নামাজ রোজা সবাই করে না, কোরান হাদিস সবাই পড়ে না। সবাই বারো মাসে তেরো পূজার আয়োজন করে না। মাটির মূর্তি বানিয়ে মাথা ঠোকে না। মিলাদ হয় না, কীর্তন হয় না। খ্রিস্টান মানেই মিশনারির কালো আলখাল্লা পরা নান আর ফাদার নয়। এর বাইরে অন্যরকম কিছু আছে। আমার সেই টলমল সময়ে বাড়িতে সাজ সাজ রব পড়ে যায় একদিন। বড় মামা খবর পাঠিয়েছেন তিনি এক বিদেশি লোক নিয়ে বাড়িতে আসবেন। বাড়ি ঝাড়া মোছা হল, মুছে মেঝে চকচক করা হল, বিছানাগুলোয় ধোয়া চাদর বিছানো হল, খাবার টেবিলের ওপর কাপড় বিছিয়ে দেওয়া হল। জানালা দরজায় নতুন পর্দা টাঙানো হল। দুপুরের আগেই আমাদের সবাইকে গোসল করে সবচেয়ে ভাল জামাটি পরে শান্ত হয়ে বসে থাকতে বলা হল বৈঠকঘরে। ভিক্তর ই পিরোইকো যখন বাড়ি ঢুকে সবার দিকে হাত বাড়িয়ে দেবেন, আমাদেরও হাত বাড়াতে হবে, আমাদের মুখস্ত করানো হল বলতে হাউ ডু ইউ ডু। ব্যস এটুকুই, এরপর আমাদের ঢুকে যেতে হবে ভেতরের ঘরে। ঠিক হল, দাদাই ঠিক করলেন, তিনি যেহেতু ইংরেজি বলতে জানেন, তিনিই খাবার টেবিলে বড় মামা আর ভিক্তরের সঙ্গে বসবেন খেতে। সব ঠিক। ভিক্তর এলেন, হাত মেলানো হল, কিন্তু হাউ ডু ইউ ডু, শেখানো বাক্যটি আমার মুখ থেকে কিছুতেই বেরোল না। বাক্যটিতে বড় হাডুডু হাডুডু গন্ধ আছে।

শেখানো জিনিসে, আজকাল এই হয়েছে আমার, মন সায় দেয় না। বাড়িতে প্রচুর খাবার রান্না হয়েছিল। খেয়ে দেয়ে ভিক্তর বাড়ি ঘুরে দেখতে বেরোলেন। উঠোনে আলম থাকত যে ঘরটিতে, সে ঘরের পেছনে জংলায় গিয়ে দাঁড়িয়ে পেচ্ছাব করলেন।

ওই প্রথম আমার কোনও শাদা লোক দেখা।

কী শাদা রে কী শাদা! জীবনে অনেক শাদা ইংরেজ দেখা মা’র চোখও বিস্ময়ে অভিভূত হল।

ভিক্তর চলে গেলে, যেন এ বাড়ি ভিক্তরের পদধুলোয় ধন্য হয়েছে, বিগলিত হেসে দাদা বারান্দার চেয়ারে বসে পা দোলাতে লাগলেন। তাঁর পরনে ইস্ত্রি করা শার্ট প্যান্ট, পালিশ করা জুতো।

মা পরদিন পীরবাড়ি থেকে ঘুরে আসার পর বললেন–শাদা হইলে কী হইব! দেখলাম ত খাড়োয়া পেশাব করছে বেডা। পেশাব কইরা পানিও লইছে না। শয়তানরা খাড়োয়া পেশাব করে। কম্যুনিস্ট ত, করত না! আল্লাহ রসুল বিশ্বাস করে না, আগে জানলে আমি রান্ধা বাড়া করতাম না।

শয়তানে, মা’র বিশ্বাস, জগত ভরে গেছে।
 
১০. ফেভারিট



বিদ্যাময়ী ইস্কুল শহরের নামকরা মেয়েদের ইস্কুল। বিদ্যাময়ী দেবী নামে শশিকান্ত নাকি সূর্যকান্ত মহারাজার বোন ইস্কুলটি বানিয়েছিলেন। দেয়াল ঘেরা বিশাল সবুজ মাঠের ওপর লাল দোতলা দালান। বট অশ্বত্থ গাছে ছাওয়া। মাঠের একপাশে পদ্মপুকুর। ইস্কুলের ভর্তি পরীক্ষায় আমি টিকে গেলে, ঝুনুখালা, এ ইস্কুলে লেখাপড়া করেছেন যেহেতু, কোনটি কোন ক্লাসঘর, কোনটি মাস্টারদের বসার ঘর, কোনখানে এসেম্বলি হয় আমাকে চিনিয়ে বসিয়ে দেন চতুর্থ শ্রেণীকক্ষের প্রথম সারিতে। বসিয়ে, কানে কানে বলেন, মুচকি হেসে, তরে কিন্তু বড় ক্লাসের মেয়েরা আইসা একটা জিনিস কইতে পারে।

— কি কইতে পারে ঝুনুখালা?

আমার ভয় ধরা মুখে তাকিয়ে খালা হেসেছেন, রহস্য ভাঙেননি।

ঘটনা প্রথমদিন ঘটেনি, ঘটেছে দ্বিতীয়দিন। দুপুরবেলা টিফিনের একঘন্টা ছুটি হয় ইস্কুলে, টিফিন খেয়ে সিঁড়ির কাছে দাঁড়িয়ে মেয়েরা মাঠে বৌচি খেলছে, দেখছি, একা দাঁড়িয়ে দেখছি, হঠাৎ চোখে পড়ে এক মেয়ে স্পষ্টতই ওপরের ক্লাসের, আমি চিনি না, রেলিংএ ভর দিয়ে আমাকে দেখছে, মুখে হাসি। আমি চোখ সরিয়ে নিয়ে ক্লাসঘরের দিকে দু’পা যেই বাড়াই, মেয়েটি পেছন থেকে ডাকে, এই মেয়ে শোনো।

আমি থমকে দাঁড়াই।

মেয়েটি কাছে এসে জিজ্ঞেস করে–তোমার নাম কি?

আমি বলি–নাম জিগাস করেন ক্যান?

লম্বা, শ্যামলা, চুল বেনি করা মেয়েটি হেসে বলে–তুমি তো খুব সুন্দর, সেজন্য।

মেয়েটি আমার হাত টেনে নেয় মুঠোয়, হাতের আঙুলে অল্প অল্প চাপ দেয়। ছাড়িয়ে নিয়ে আমি গা কাঠ করে দাঁড়িয়ে থাকি।

মেয়েটি, কি নাম জানি না, বলে–ভয় পাওয়ার কিছু নাই। আমি তোমারে কিচ্ছু করব না।

চোখ আমার মাটিতে, বুক ধুকপুক করে। মেয়েটি আরও কাছ ঘেঁসে কেউ যেন শুনতে না পায়, বলে–তুমি আমার ফেভারিট হবা?

ফেভারিট হওয়া কাকে বলে আমি জানি না। চোখ উপচে জল নামে আমার। মেয়েটি আমার চোখের জল আঙুলে মুছে দিয়ে বলে–কি বোকা মেয়ে, কাঁদো কেন!

একদল মেয়েকে সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠতে দেখে মেয়েটি দ্রুত সরে যায়।

ক্লাসঘরের সিলিং জুড়ে লম্বা রঙিন কাপড়ের পাখা, ঘরের বাইরে বসে আয়ারা টানে, পাখা দোলে, ওই টানা পাখার নিচে বসেও ভেতরে ঘামতে থাকি ভেবে যে একটি ওপরের ক্লাসের মেয়ে নিশ্চয় আমাকে ফুঁসলিয়ে কোথাও নিয়ে যেতে চেয়েছিল, কোথায় কে জানে!

মেয়েটি পরদিন টিফিনের সময়, সেদিনও আমি সিঁড়ির কাছে একা দাঁড়িয়ে, হাতে একটি পাকা পেয়ারা দিয়ে বলল–এই লাজুক মেয়ে, ফেভারিট হবা না আমার? বল, হবা। আমি তোমারে অনেক অনেক আদর করব।

বুজে আসা স্বরে বলি–না।

মেয়েটি মিষ্টি হেসে আমার হাত ধরে, আমি মুঠি করে রাখি হাত।

ক্লাসের কিছু মেয়ে, আমি তাদের নামও তখন জানি না, ইস্কুল ছুটির পর গায়ে পড়ে জিজ্ঞেস করে–তোমার ফেভারিট কে? ওইযে লম্বা আপাটা তোমার ফেভারিট, না?

আমি কিছু বুঝে পাই না ফেভারিট ব্যাপারটি কি! মেয়েরা কার ফেভারিট কে, এই নিয়ে কানাকানি করে। কেউ তার ফেভারিটের নাম বলে না, সব যেন বড় গোপন এক ব্যাপার।

ঝুনু খালার কাছে গোটা ব্যাপারটি পরে জানা হয় আমার। বিদ্যাময়ী ইস্কুলে এ খুব পুরোনো নিয়ম যে ওপরের ক্লাসের মেয়েরা নিচের ক্লাসের সুন্দরী মেয়েদের সঙ্গে ফেভারিট পাতে। একধরনের সই পাতার মত। ঘটনাটি আর সবার কাছে গোপন থাকা চাই। কেউ যেন না দেখে তারা ইস্কুল ছুটির পর নয়ত খেলার ঘন্টায়, নয়ত টিফিনের সময় গাছের তলে, পুকুরঘাটে, দেয়ালের আড়ালে দেখা করে, হাতে হাত রেখে গল্প করে, বড় মেয়েটি ছোট মেয়েটিকে এটা ওটা উপহার দেয়। ঝুনু খালার ফেভারিটের নাম ছিল বিউটি। অসম্ভব সুন্দর একটি মেয়ে। ঝুনুখালা যখন বিউটির কথা বলেন, মিষ্টি হাসেন, সেরকম মিষ্টি হাসি লম্বা মেয়েটিও হেসেছিল।

দিন যেতে থাকে, আর আমার মনে হতে থাকে ফেভারিট ব্যাপারটি বিষম এক রোমাঞ্চকর ব্যাপার। ইচ্ছে করে আবার কেউ এসে একবার ফেভারিট হতে বলুক আমাকে। একবার কেউ ডাকলেই আমি চলে যাব, চলে যাব সুতোর ওপারে। ক্লাসের সুন্দর মেয়েগুলো টিফিনের ঘন্টা পড়লে পাখির মত উড়াল দিয়ে কোথায় যে যায়! কান পাতলে মেয়েদের কানাকানি শুনি যে মমতার গলার নতুন মালাটি ওর ফেভারিট দিয়েছে। শাহানার ফেভারিটের নাম বন্যা। কেউ বলে বন্যা নয়, কেউ বলে না বন্যাই, বন্যার সঙ্গে বট গাছের আড়ালে কেউ ওকে ঘনিষ্ট দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছে।

আমি এক বোকাচন্দ, লজ্জাবতী লতা। ফেভারিট নেই, ক্লাসেও কোনও বন্ধু নেই, কেউ আমাকে খেলায় নেয় না, ক্লাসে পড়া ধরলে হাঁ করে দাঁড়িয়ে থাকি। গানের, নাচের, খেলার ক্লাসেও আমার মত লাড্ডু আর একজনও নেই। বাংলা ক্লাসে আমাকে প্রশ্ন করা হয়েছিল–একটা ফুলের নাম বল তো দেখি! আমি ভাবছিলাম, ফুল তো অনেকই আছে, কিন্তু খুব সুগন্ধ ছড়ায় কোন ফুল, গোলাপ না কি দোলন চাঁপা নাকি শিউলি নাকি বেলি, নাকি রজনীগন্ধা।

মাস্টার আমার নৈঃশব্দ্য দেখে রাগ করে বললেন–মেয়েটা কি বোবা নাকি!

বোবাই। বোবা বলে, সে, যেহেতু ক্লাসে দাঁড়িয়ে বলতে হবে মাস্টারকে মে আই গো টু দ্য বাথরুম? এরকমই বলার নিয়ম, ইংরেজিতে, আর মাস্টার ইচ্ছে করলে বলতে পারেন, হ্যাঁ অথবা না, না বললে বসে থাকতে হবে শ্বাস বন্ধ করে, যা যে কেউ দেখলেই বুঝবে কেন, আর হ্যাঁ বললে সবার চোখের সামনে দিয়ে আমাকে দৌড়ে নয়ত ঠ্যাং চেপে হাঁটতে হবে–সকলে ভাবতে বসবে আমি বড়টির জন্য যাচ্ছি নাকি ছোটটির জন্য, এসব জিনিস যে জনসমক্ষে চাপা বড় লজ্জা, তাই আমি মে আই গো টু জাতীয় কোনও বাক্যে না গিয়ে বোবা হয়ে ছিলাম। শক্তি দিয়ে ঠেকাচ্ছিলাম। ঠেকিয়েছিলাম, মাস্টার চলে গেলে, কেউ যেন না বোঝে কোথায় যাচ্ছি, গিয়ে মাঠের যে কোণাটিতে পায়খানা, সে কোণায় ভিড়ে দাঁড়িয়ে ছিলাম, ঠেকিয়ে। পরে আসা মেয়েগুলো আমাকে ডিঙিয়ে এক এক করে সেরে আসে। আমার আর সারা হয় না। বেগবান জিনিস শরীর থেকে বেরোতে হাত পা ছুঁড়ে রীতিমত যুদ্ধ শুরু করে ক্রমে ক্রমে নিস্তেজ হওয়া নিরস্ত্র হওয়া আমার সঙ্গে। মনে মনে বলি আর একটু সবুর কর বাবা। সবুর কার এত সয়! শেষ অবদি মাথা ফুঁড়ে বেরিয়ে আসে যোদ্ধার দল। শাদা পাজামা মুহূর্তে রঙিন হয়ে ওঠে। আমি দাঁড়িয়ে থাকি লজ্জায় মুখ নিচু করে, দেয়ালে শরীর সেটে, একা। আমি জানি না কে আমাকে ওই বিপদ থেকে উদ্ধার করবে। উদ্ধার করতে অবশ্য একজন এগিয়ে আসে, যে মেয়েটি আমার সামনে এসে মিষ্টি হেসে বলে কি হয়েছে, এখানে একা একা দাড়ায়া আছ কেন? সে ওই লম্বা মেয়েটি, চোখের জল মুছে দেওয়ার, পাকা পেয়ারার। ধরণী আসলে দ্বিধা হয় না কখনও, যত তাকে হতে বলা হোক না কেন। অথবা হয়, সীতা হলেই হয়, আমি কি আর সীতা হতে পেরেছি! আমার মাথা ঘাড় থেকে ঝুলে থাকে, যেন এক্ষুণি ছিঁড়ে পড়বে, মেয়েটি বুঝে আমার করুণ দশা, হেড মিস্ট্রেসের সঙ্গে শলা পরামর্শ করে আমার বই খাতা ক্লাস থেকে নিজেই নিয়ে এসে ইস্কুলের মেথরানি রামরতিয়াকে সঙ্গে দেয় আমাকে বাড়ি পৌঁছে দিতে। এ কাজটি যদি অন্য কেউ করত, সইত।

বাড়িতে খবরটি গোপন করার যথাসাধ্য চেষ্টা করেছিলাম। সম্ভব হয়নি। অসময়ে ইস্কুল থেকে হলুদ পাজামার ফেরা, সঙ্গে মেথরানি। বাড়ির বড়রা মুখ টিপে হাসে, ছোটরা গলা ফাটিয়ে। দাদার নিজের একার দুর্নাম ঘুচল এবার, সাত পাক নেচে বলে–

বিদ্যাময়ীর হাগড়া গাড়ি শাদা পাজামা হলুদ করল
অসময়ে ইস্কুল থেইকা রামরতিয়ায় নিয়া আইল।

পুরো মাস আমাকে গুয়ের চারি, রামরতিয়ার সই বলে ডাকা হল বাড়িতে। মা অবশ্য মাঝে মধ্যে ধমকে সরান দাদাকে, বলেন ওর পেটটা খারাপ আছিল।

মা’র আস্কারা পেয়ে আমি দাদাকে ভেংচি কেটে বলি–তুমিও তো ইস্কুলে হাগ্যা দিতা!

দাদা বলে–ইহিরি, তর মত বড় হইয়া হাগছি নাকি, আমি তহন ছোট্ট, ওয়ানে পড়ি মাত্র।

দাদাকে নিতে এক্সপেরিমেন্টাল ইস্কুলের রিক্সা আসত, বাচ্চারা যেন সিট থেকে পড়ে না যায় সামনে বেল্ট বাঁধা থাকত। প্রায়ই ইস্কুল ছুটির আগেই দাদাকে বাড়ি দিয়ে যেত রিক্সাঅলা। দু’আঙুলে ধরা থাকত দাদার গুয়ে মাখা হাফপ্যান্ট। একদিন রেগেমেগে রিক্সাঅলা বলল ছেলের পেট ভালা কইরা পরে ইস্কুলে পাঠাইয়েন।

মা বলেন–একবার এক কৌটার দুধ খাওয়ানোর পরে নোমানের পেট যে খারাপ হইল তো হইলই। আইজও ওর পেটটা ভালা না।

এটি হচ্ছে দাদার জন্মের দোষে নাকি কৌটোর দুধের দোষে, মা নিশ্চিত নন।

দাদার হেগে দেওয়া প্রসঙ্গ এলে আমি স্বস্তি বোধ করি। অন্তত আমি যে একা একটি বিশ্রি কান্ড ঘটাইনি, তা ভেবে। কিন্তু ইস্কুলে সে স্বস্তি জোটে না আমার।

ইস্কুলে কারও ফেভারিট হওয়ার সম্ভাবনা, আমি বুঝি, আমার আর নেই। লম্বা মেয়েটিকে দূর থেকে দেখেই উল্টো হাঁটি। যে কেউ আমার দিকে তাকালে মনে হয় সে বুঝি আমার পাজামা হলুদ করার ঘটনাটি জানে। লজ্জায় আমার কান নাক লাল হয়ে থাকে।

যুদ্ধ শেষ হলে যখন ইস্কুল খোলে, বার্ষিক পরীক্ষা ছাড়াই আমাদের ওপরের ক্লাসে তুলে দেওয়া হয়। পাক সর জমিনের বদলে ইস্কুলের এসেম্বলিতে নতুন পতাকার নিচে দাঁড়িয়ে গাইতে হয় আমার সোনার বাংলা। মানুষের দৈর্ঘ প্রস্থ বদলে গেছে, ভাবনা ভাষা আরও সতেজ, দীপ্ত, আরও প্রাণময়। যেন বয়স ন’ মাসের বদলে বেড়ে গেছে ন’ বছর। যেন বালিকারা এখন আর বালিকা নয়, তরুণী। কারও বাড়ি পুড়েছে, কারও ভাই হারিয়েছে, কারও বাবা, কারও ধর্ষিতা বোনের জরায়ুতে ফুলে ফেঁপে বড় হচ্ছে অনাকাংখিত শিশু। এরকম অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে সকলে আমরা হেঁটে এসেছি, লাশ দেখতে দেখতে, আর্ত চিৎকার শুনতে শুনতে।

তখন কোনও এক বালিকা-বেলায় শাদা পাজামা হলুদ করে বাড়ি ফিরেছিলাম এ নিতান্তই বিস্মৃত হওয়ার মত তুচ্ছ।

অপেনটো বায়োস্কোপ
নাইন টেন তেইসকোপ
সুলতানা বিবিয়ানা
সাহেব বাবুর বৈঠকখানা

বলে মেয়েদের গলায় মালা পরিয়ে নিজের দলে নিয়ে গোলাপ পদ্ম খেলতে, আমার আর কান গরম হয় না শরমে। খেলার ঘন্টা বাজলে জিমনেসিয়ামে দৌড়োনো, টিফিনের সময় দৌড়ে দাঁড়িয়াবান্ধার কোট দখল করায় আমি আর আড়ষ্ট হই না। বৈাচি খেলতে আর সবার মত আমিও নামি। অবশ্য বার্ষিক খেলা প্রতিযোগিতায় আমি যে লাড্ডু, সে লাড্ডুই থাকি। শাহানা আর তার চার বোন, হীরা, পান্না, মুক্তা, ঝর্ণা লেখাপড়ায় লাড্ডু হয়েও খরগোসের মত ছোট দৌড়, বড় দৌড়, বিস্কুট দৌড়, ব্যাঙ দৌড় এরকম একশ রকম দৌড়ে সবকটি পুরষস্কার জিতে নিয়ে যায়। শাহানার দিকে বিস্মিত মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে থাকি আমি। ইস্কুলের সেই দুর্দান্ত মেয়ে শাহানার সঙ্গেও আমার বিষম ভাব হয়ে গেল একদিন।

এতসবের মধ্যেও, আমার কিন্তু বুক ধুপপুক করেছিল আরও একবার, চোখ নত হয়েছিল, লজ্জায় লাল হয়েছিল নাকের ডগা, আমার হাতখানা সে ছুঁয়েছিল বলে সারা গা কেঁপেছিল আমার, তাকে স্বপ্ন দেখে জেগে উঠতাম, সারাদিন তাকে মনে করে আমার ঠোঁটে খেলত মিষ্টি হাসি। ঘুমোতে গেলে চোখে ভাসত মেয়েটির মুখ, তার হাসি, তার কথা বলা, তার হেঁটে আসা, তার হাত নাড়া, তার পিঠের ওপর কোঁকড়া চুলের বেণি। আমার মনে হত জগতে আমি এত আশ্চর্য সুন্দর কাউকে দেখিনি। জগতে আর কারও চোখ এত সুন্দর নয়। মেয়েটির চোখের দিকে তাকিয়ে, আমি জগত ভুলে যাই। আমার সারা গায়ে অদ্ভুত, অদ্ভুত শিহরণ হয়।

ঘটনাটির শুরু এরকম, ইস্কুলে যাচ্ছি, ছোটদা আর তাঁর এক বন্ধু, মিলু, পথে আমাকে থামিয়ে একটি চিঠি দিলেন হাতে, রুনি নামের এক মেয়েকে, মেট্রিক পরীক্ষা দিচ্ছে, হোস্টেলে থাকে, দিতে। চিঠিটি মিলুর লেখা। বলা হল, ব্যাপারটি যেন বাড়ির কেউ না জানে, ইস্কুলের কোনও মেয়েও। এ আর এমন কি, রুনিকে খুঁজে বের করে চিঠিটি দিই। চিঠিটি রুনি তখন পড়ে না, জামা সরিয়ে বুকের ভেতরে কোথাও রেখে দেয়। আমি অপলক তাকিয়ে ছিলাম রুনির চোখে। সেই আশ্চর্য সুন্দর দুটো চোখে। আমার ইচ্ছে করেছিল রুনি দাঁড়িয়ে থাকুক আমার সামনে আরও আরও, আমি তার চোখদুটোর দিকে আরও আরও তাকিয়ে থাকি। রুনি সেদিন চিঠি নিয়ে চলে যাওয়ার পর আমি দাঁড়িয়েই ছিলাম হোস্টেলের দেয়ালে পিঠ রেখে, ক্লাসের ঘন্টা আমাকে সচল করার আগ অবদি। সেই থেকে আমার তৃষ্ণার্ত চোখ খোঁজে তাকে হাজার মেয়ের ভিড়ে। ক্লাসঘরের জানালায় বসে তাকিয়ে থাকি বাইরের মাঠে, যদি তাকে হাঁটতে দেখি, যদি একপলক দেখা হয় আবার হঠাৎ কখনও।

দু’দিন পর ইস্কুল ছুটি হলে পদ্মপুকুর পাড় থেকে দৌড়ে এসে আমাকে একটি চিঠি দেয় রুনি, মিলুকে দিতে। চিঠিটি হাতে নিয়ে আমি দাঁড়িয়ে থাকি। রুনি মিষ্টি হেসে বলে–কিছু বলবে?

আমি মাথা নাড়ি। আমার আর কি বলার ছিল!

— তুমি খুব লাজুক মেয়ে। এত কম কথা বল। হোস্টেলে এসো, তোমার সঙ্গে গল্প করবখন। বলে রুনি আমার হাত ধরে কাছে টানে তার, রুনির শরীরে ফুলের গন্ধ। রুনি যেন রূপকথার দোলনচাপা, প্রাণ পেয়ে রাজকুমারি হয়েছে। আমার সারা শরীর কাঁপে ভাল লাগায়। বুক ধুকপুক করে। আমার ভেতরে কোথাও কোনও পুকুরে একশ পদ্ম ফোটে। মিলু আরও চিঠি দিক, রুনি তার উত্তর দিক প্রতিদিন, তাহলেই আমি রুনির আরও আরও কাছে যাব, রুনি আমার চিবুকে আঙুল রাখবে, চমৎকার ভাঙা কণ্ঠে কথা বলবে, কপালের চুলগুলো উড়বে হাওয়ায়। আমি তার বুকে মুখ রেখে দোলনচাপার গন্ধ নেব।

পড়ালেখায় মন বসে না, খাতায় শতবার করে নাম লিখি রুনির। অঙ্ক করতে করতে, কখন বুঝি না মার্জিনের বাঁপাশে রুনির কালো দুটো চোখ আঁকি। হোমওয়ার্কে গোল্লা পেতে থাকি দিনদিন। রুনি আমার জীবন জগত, জানি সে ক্ষুদ্র, গ্রাস করে নেয়। খেলার মাঠ আমাকে আর আগের মত টানে না, পুকুর ঘাটে একা বসে থেকে রুনিকে ভাবি, পুকুরের কালো জলে রুনির চোখ দেখি। যে বাহুতে আমার স্পর্শ করেছিল রুনি, সে বাহুতে হাত বুলিয়ে মনে মনে আবার তার স্পর্শ নিই। আমার পুতুল খেলা, গোল্লাছুট, অপেনটো বায়োস্কোপ তুচ্ছ করে উদাস বসে থাকি কদম গাছের তলে, রুনির স্পর্শ পাওয়ার তৃষ্ণায় গোপনে আকুল হই।

রুনির সঙ্গে আসলে দীর্ঘ দীর্ঘ ক্ষণ বসে কখনও আমার গল্প করা হয়নি। আমার সাধ না মেটা যেটুকু অল্প সময় রুনির জুটত, ও নিজে গল্প বলেছে, আমি মুগ্ধ হয়ে কেবল শুনেছিই, হোস্টেলের সিঁড়িতে বসে, ওর বিছানায় পা ঝুলিয়ে বসে। যেন রূপকথার বইএর ছবি থেকে নেমে আসা দোলনচাপা-রাজকুমারি এক নিবিড় বনে চুল খুলে গান গাইছে। ওকে কেবল ভীষণ রকম ভালবাসতে ইচ্ছে করত আমার, খুব গোপনে ভীষণ রকম। ওর চোখের দিকে একবার তাকালে আমার সারা জীবনের গল্প ওকে বলা হয়ে যায়। ওকে একবার স্পর্শ করলেই জগতের সব সুখ আমার হাতের মুঠোয় চলে আসে। রুনি আমার হাতে রেশমি চুড়ি পরিয়ে দেয়, গলায় মালা। রুনির শরীর ঘনিষ্ঠ হতে থাকে আমার শরীরের সঙ্গে, আর আমি গন্ধ পেতে থাকি দোলন চাঁপার। আমি ওকে আরও আরও ভালবাসতে থাকি। শরমে চোখের পাতা নুয়ে আসে আমার।

সেই চুড়ি মালা অবশ্য বাড়ি এসে খুলে রাখতে হয়। বাবা জামা জুতো ছাড়া শরীরে বাড়তি কোনও জিনিস পছন্দ করেন না। অলংকার পরাবেন আশায় আমার দু’কান ছিদ্র করেছিলেন মা, দেখে মা’কে যা তা গাল দিয়েছেন বাবা। কখনও চুড়ি মালা দুল পরতে দেননি, ইস্কুল থেকে ফেরার পথে ফুটপাতের চুড়িঅলার কাছ থেকে একবার এক হাত কাচের চুড়ি কিনে বাড়ি ফিরেছিলাম, দেখে ভেঙে টুকরো টুকরো করে সবকটা চুড়ি, গালে চড় কষিয়ে বাবা বলেছিলেন–ফের যদি দেখি এইসব পরছস, তর হাড় গুঁড়া কইরা দিব।

পায়ে একবার আলতা পরেছিলাম, বাবা খামচে ধরে বলেছিলেন–কি ব্যাপার, রক্ত কেন তর পায়ে, কাইটা গেছে নাকি!

মা প্রশ্রয়ের হাসি হেসে বলেছিলেন–রক্ত হইব কেন, মেয়েরা লাগায়, শখ হইছে, লাগাইছে।

রুনির দেওয়া চুড়ি মালা আমার পরার দরকার হয় না, ওর ভালবাসা আমি অন্তরে অনুভব করি। রুনির সঙ্গে গভীর গোপন ভালবাসায় আমি যখন মগ্ন, সে সময় এক রাতে, আমার শরীর জেগে ওঠে শুভ্র বিছানায়। কে যেন আমাকে নিজের বিছানা থেকে নামিয়ে নিঃশব্দে হাঁটায়, হাঁটিয়ে মেঝেয় পাতা ছোটলোকের মলিন বিছানায়, অন্ধকারের কাঁথায় ঢেকে শরীর, শোয়ায়। মণি আবার ফেরত এসেছে এ বাড়িতে, এসেছে ডাঙর হয়ে। দুপুররাতে বাবার সঙ্গে হাতে নাতে ধরা পড়ার পর রেনুর মা’কে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিয়েছিলেন মা, এরপর আকুয়ার বস্তি থেকে এক এক করে অনেককেই এনে গতর খাটিয়েছেন, শেষে পুকুরপাড়ে একা বসে থাকা, না খাওয়া মণিকেই তুলে আনেন। মণির শরীর নিয়ে আমি খেলি, ওকে উলঙ্গ করে, ওর বুকে হঠাৎ কবে বড় হওয়া দুটো পেয়ারা দু’হাতের মুঠোয় নিয়ে। মণির জামার তলে লুকিয়ে এত সুন্দর স্তন কেউ ছোঁয়নি; আমি কেবল ছুঁই, আমি কেবল দু’হাতে, ঠোঁটে, নাকে ছুঁয়ে দিই, যেন কতকালের পুরোনো সইএর সঙ্গে নতুন করে ছোঁয়াছুঁয়ি খেলা। রথের মেলা থেকে কিনে আনা মণি আমার শখের পুতুল, আমার জ্যান্ত পুতুল। আমার বুকে তখন কেবল গোলাপ ফুটছে, কুঁড়ির ভেতর থেকে উঁকি দেওয়া গোলাপের ঘুমঘুম চোখ শরমে বুজে আসে আলোয়। অন্ধকারে সেই চোখ চুমু খায় মণির পাকা পেয়ারায়।

মধ্যরাতের গোপন খেলা
খেলেই চলি সইয়ের সনে,
কেউ জানে না।

এ যেন বালিকার গোল্লাছুট। গোল্লা থেকে ছুটতে ছুটতে, ভুলে ধুলোকাদার ঘর, মিছিমিছির রান্নাবাড়ি, পুতুল বিয়ে, টগবগ করা জীবনের সামনে হাঁটু গেড়ে বসে দু’চোখে রাজ্যির বিস্ময় নিয়ে খুলে খুলে শরীর দেখি, শরীরের ভেতরে দেখি লুকোনো আরও এক গোপন শরীর।

বোকাচন্দ মেয়েটি গোপনে গোপনে এমন কান্ড ঘটিয়ে ফেলতে পারে! রুনিকে, মিলুর চিঠি আর সে দেয় না, এখন নিজেই সে ফুলপাখিপাতার আল্পনা আঁকা কাগজে চিঠি লেখে, দাদার ড্রয়ার থেকে চুরি করা কাগজে, বুকের বাগান থেকে একটি একটি করে শব্দের ফুল তুলে সে মালা গাঁথে। রুনি উত্তর লেখে। রুনির চিঠিতে সে দোলনচাঁপার ঘ্রাণ পায়। তার নিরাভরণ নিস্পন্দ জীবন দুলে ওঠে ফুলের দোলনায়। কে জানে বাড়ির! কেউ না। একই সঙ্গে দুটো জীবন যাপন করি আমি, বাবা মা’র গাল, চড় থাপড় খাওয়া বাইরের আমি, আর ভেতরের অন্য আমি, গোল্লা থেকে ছোটা আমি, প্রেমের জলের ডুবুরি।

ছাত্রাণাম অধ্যয়নং তপঃ। ছাত্রদের তপস্যাই হওয়া উচিত অধ্যায়ন। জ্ঞানের চেয়ে মূল্যবান আর কিছু নাই। বড় বড় মনীষীরা বলে গেছেন। কী বলে গেছেন? আমার উত্তর দেবার দরকার হয় না, কারণ বাবাই বলবেন কি বলে গেছেন মনীষীরা। বলে গেছেন কষ্ট করিলে কেষ্ট মেলে। সুতরাং তুমাকে আদা জল খেয়ে লাগতে হবে। খেলাধুলা বাদ, আরাম আয়েশ বাদ। শুধু বিদ্যা অর্জন কর। বিদ্বান হও। তুমাকে দশটা লোকে সম্মান করবে, সমাজে মাথা উঁচু করে থাকতে পারবা। আমারে দেখাইয়া লেখাপড়া কইর না, নিজের জন্য কর। পাগলেও নিজের বুঝ বুঝে।আর যদি লেখাপড়া না কইরা ভাদাইম্যা হও, ভাব বাপের হোটেলে থাকি, গায়ে ফুঁ দিয়া বেড়াব, তাইলে কী হবে ভবিষ্যত? রাস্তায় রাস্তায় ভিক্ষা করতে হবে। সুতরাং জ্ঞানী হও। বিদ্যা অর্জন কর। মানুষের মত মানুষ হও। কষ্ট কর, তাইলেই কেষ্ট মিলবে। কষ্ট কইরা চাষাবাদ করার পর চাষীরা ফসল ঘরে তুলে। কষ্ট না কইরা তুমি খেলা নিয়া থাকলে, আড্ডা মারলে, তামাশা করলে কেষ্ট মিলবে না। কষ্ট কইরা রাইত দিন খাইটা লেখাপড়া কইরা মানুষ ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার হয়, জজ ব্যারিস্টার হয়। রাত দশটার আগে ঘুমানি চলবে না। টিউটর আসে ঠিকমত?

এই উত্তরটি বাবা দেবেন না, আমাকেই দিতে হবে, হ, আসে।

সামনের পরীক্ষায় রেজাল্ট খারাপ হইলে, বাবা চিবিয়ে চিবিয়ে বলেন, পিঠের চামড়া তুইলা ফেলব, বইলা দিলাম।

জুতোর মচমচ শব্দ শুনে বুঝি বাবা এখন সরেছেন দরজা থেকে। দরজায় দাঁড়িয়ে এরকম বাণী বর্ষণ করা তাঁর প্রতিদিনের স্বভাব। ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া করিয়ে যে করেই হোক মস্ত কিছু বানাবেন তিনি, এরকমই তাঁর পণ। মেট্রিকে খারাপ ফল করার পর দাদা বাড়ি ফেরেননি তিনদিন ভয়ে। বাবা সন্ধি বেত হাতে নিয়ে দাদার অপেক্ষায় বসেছিলেন, মাথায় লোটা লোটা ঠান্ডা পানি ঢেলেছিলেন। দাদার বন্ধুরা যারা একই রকম পাশ করেছিল, তাদের বাবারা মিষ্টি নিয়ে বাড়ি ফিরেছে, আত্মীয় স্বজনকে ছেলে-পাশের মিষ্টি খাইয়েছে। তিনদিন পর দাদাকে খুঁজে বার করে কান টেনে বাড়ি নিয়ে আসেন বাবা। সাফ সাফ বলে দেন, আইএসসিতে ভাল ফল না পেলে এ বাড়ি থেকে তাকে তাড়িয়ে দেওয়া হবে। দাদার জন্য তিনটে মাস্টার রেখে দিলেন। পরীক্ষায় তারপরও দাদা দ্বিতীয় বিভাগ। দাদা নিজে অবশ্য বলেন হায়ার সেকেন্ড ডিভিশন। তাঁর ওই হায়ার দিয়ে কাজ হয় না। মেডিকেল কলেজে দু’দুবার ভর্তি পরীক্ষায় বসেও পাশের লিস্টিতে নাম পাওয়া যায় না তাঁর। দাদার এ অবস্থায় বাবার রক্তচাপ বাড়তে থাকে। মুড়ির মত ওষুধ ছুঁড়তে থাকেন মুখে। অক্ষমাযোগ্য অপরাধ করে দাদা লক্ষ করেন সংসারে তাঁর আদর কমছে, তিনি দিন দিন উদাস হতে থাকেন। খেতে বসে বাবা ছোটদার পাতে মাংসের ভাল টুকরোগুলো তুলে দেন, দাদা ঝোল মেখে ভাত ডলতে থাকেন, পাতে একখানা কেবল চোষা হাড়।

ছোটদার জন্য চারটে মাস্টার, অঙ্কের, পদার্থ বিদ্যার, রসায়নের, ইংরেজির। ছোটদা মাস্টারদের বাড়িতে পড়তে যান বিকেলে। আমার মাস্টার আসেন বাড়িতে। ইয়াসমিনের মাস্টারও। ইস্কুল থেকে ফিরে জিরোতে না জিরোতে মাস্টার আসেন। যত ওপরের ক্লাসে উঠছি, তত গৃহশিক্ষক বাড়ছে। দাদা আর ছোটদার জন্য সন্ধে থেকে রাত বারোটা অবদি পড়া, আমার জন্য দশ, ইয়াসমিনের জন্য রাত আট, বাবা এরকম নিয়ম করে দেন। দাদারা বড় বলে শব্দ করে না পড়লেও চলবে, কিনতু আমাদের, আমার আর ইয়াসমিনের শব্দ করে পড়তে হবে, বাবা যেন তাঁর ঘরে বসে শুনতে পান আমরা ঘুমোচ্ছি না, পড়ছি। এদিকে ঘড়ির কাঁটা আটের ঘরে এলে আমার চোখ ঢুলে আসে, বাবা পা পা করে এসে আমাকে হাতে নাতে ধরে বলেন যাও চোখ্যে সরিষার তেল দিয়া আসো, তাইলে ঘুম আসবে না। চোখের রোগীরা যেমন করে চোখে ওষুধ দেয়, আমাকে ঠিক ওরকম করে ঘাড় পিঠের দিকে ঝুলিয়ে শিশি থেকে ঢালতে হয় চোখে সর্ষের তেল, চোখ জ্বালা করে বিষম কিন্তু বাবা স্বস্তি পান ভেবে যে ঘুম এখন বাপ বাপ করে পালাবে। পড়তে বসে সন্ধে থেকে টেবিলের ওপর মাথা রেখে ঘুমোতে থাকেন ছোটদা। কালো ফটকের শব্দ শুনলে ধাক্কা দিয়ে ছোটদাকে জাগিয়ে দিই, উঠ উঠ বাবা আইছে। ছোটদা ধড়ফড়িয়ে মাথা তোলেন, মুখের লালায় বই ভেজা, লালার শাদাটে দাগ নেমে গেছে ঠোঁটের কিনার থেকে গালে, চোখদুটোয় শুকনো মরিচের লাল। পা নাড়তে নাড়তে তিনি পড়তে শুরু করেন। আসলে তিনি কিছু পড়েন না, গাঁগোঁগাঁগোঁ ধরনের শব্দ করেন। দূর থেকে বাবা সম্ভবত ভাবেন তাঁর পুত্রধন এবারও স্টার পেয়ে বাবার মান রক্ষা করবেন।

বাবা যতক্ষণ বাড়ি থাকেন, সকলে গলা নিচু করে কথা বলে। বাড়িতে কবরের স্তব্ধতা, যেন চারটে লক্ষ্মী ছেলেমেয়ে একেকজন বড় বড় দার্শনিক বা বিজ্ঞানী হতে যাচ্ছে। দাদার বেলা বাবার বাণী এরকম–এই গাধারে দিয়া কিচ্ছু অইল না। মেডিকেলে পড়াইতে চাইলাম। চান্স পায় নাই কোথাও। বি এস সি পরীক্ষা দিয়া এখন কেরানিগিরি ছাড়া তর ভাগ্যে আর কি জুটব! দেখ কুনো ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হইতে পারস কি না। তরই বন্ধু জাহাঙ্গীর ডাক্তারি পড়তাছে। ফয়সল পড়তাছে। তর কি মগজ কিছু কম ছিল ওদের চেয়ে! ওরা ভাত খাইছে, তুই খাস নাই? এত এত মাস্টার রাইখা পড়াইলাম, তাও পরীক্ষায় একটা ফার্স্ট ডিভিশন পাইলে না। লজ্জা করে না মুখ দেখাইতে। আমি হইলে কচুগাছে ফাঁসি নিয়া মরতাম।

ছোটদার বেলায়–দুনিয়া ভুইলা যাও কামাল। এখনই তুমার জীবনের সবচেয়ে মূল্যবান সময়। তুমি মেট্রিকে স্টার পাওয়া ছাত্র। তোমার ভবিষ্যত এখন ইন্টারমিডিয়েটের রেজাল্টের ওপর নির্ভর করতাছে। এই রেজাল্ট আরও ভাল না করলে কমপিটিশনে টিকতে পারবা না বাবা। ডাক্তারি পড়তে হইব। ডাক্তারের ছেলে ডাক্তার হইতে হবে। বন্ধুদের নিয়া আড্ডা বাদ। খাইটা পইড়া মেডিকেলে ভর্তি হও। আমার খুব আশা ছিল বড় ছেলে ডাক্তার হইব। পারল না। এখন তুমিই আমার ভরসা। পড়ায় মন দাও বাবা। দিনে আঠারো ঘন্টা কইরা পড়। ভাল রেজাল্ট কইরা বাপের মুখ রাখো। আমি চাষীর ছেলে ডাক্তার হইছি। তুমি আমার চেয়ে বড় ডাক্তার হইয়া দেখাইয়া দেও।

সকাল বেলা ঘরে ঘরে বাণী বিতরণ করে বাবা বাড়ি থেকে বেরোন। তখনই এক সঙ্গে চারটে চেয়ার সরার শব্দ হয়, সরিয়ে কেউ মাঠে যায় দৌড়ে, কেউ রেডিওর নব ঘোরায়, কেউ গলা ছেড়ে গান গায়, এক লাফে বিছানায় শোয়। কালো ফটকটি আমাদের একধরনের জীবন বাঁচায়, খটাস করে শব্দ হয়ে সংকেত দেয় বাবার আসার, অথবা যাওয়ার। বাবার শব্দটির একটি আলাদা ধরন আছে, বাবা ফটক খুললে যে ধরনের শব্দ হয়, তা বাবা খুললেই হয়। চোখ বুজে আমরা বলে দিতে পারি এ বাবা নাকি বাবা নয়। বাবা অবশ্য রূপকথার দৈত্যদের মত নানারকম চালাকি করেন। রাতে বাড়ি ফিরবেন বলে বেরিয়ে দুপুরে ফেরেন, দুপুরে ফিরছেন বলেন, ফেরেন রাত করে। বাবার বলাকথায় আমাদের খুব একটা আস্থা নেই। চব্বিশ ঘন্টা আমরা সতর্ক থাকার চেষ্টা করি। মাঝে মাঝে ফটকও বেশ নিঃশব্দে খোলার চেষ্টা করেন তিনি যেন হাতে নাতে সবাইকে ধরতে পারেন। কখনও সখনও যে তিনি আচমকা পেছনে এসে দাঁড়াননি আমাদের সতর্ক হবার আগে, তা নয়। আমাকে রান্নাঘরের বারান্দায় বসে সজনে বাছতে দেখে সেই সজনে দিয়ে পেটাতে পেটাতে পড়ার টেবিলে এনে বসিয়েছিলেন, পাড়ার মেয়েদের নিয়ে মাঠে খেলতে দেখে চড়িয়ে ভেতরে এনেছেন, সব ক’টি মেয়েকে ধমকে বাড়ির বার করেছেন। বাবার হাতে মার খেয়ে মনে মনে কত যে বাবার মৃত্যু কামনা করেছি, যেন বাবা আজই ভীষণ অসুখ হয়ে মরে যান। বাবা এমন শক্ত শরীরের মানুষ, সামান্য জ্বরজারিও হত না কখনও। এদিকে আমাকে জ্বরে ধরত বেশ, জ্বর হয় হোক, কিন্তু ওষুধ নৈব নৈব চ। আর টিকার নাম শুনলে তো গায়ে জ্বর চলে আসে। ইস্কুলে গুটিবসন্তের টিকা দেওয়ার লোক যখনই আসত, পায়খানায় লুকোতাম। বাড়িতেও লোক আসত, ব্যস, বাড়ি থেকে সারাদিনের জন্য হাওয়া। শুকনো মুখে রাস্তায় ঘুরঘুর করতাম যতক্ষণ না দেখছি ওরা বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেছে। টিকা নিইনি, বাবার কাছে ধরা পড়ে গিয়ে এমন কান্ড হয়েছিল যে বাবা নিজেই আমার হাতে জন্মের যন্ত্রণা দিয়ে টিকা দিলেন। আর যার হাত থেকেই বাঁচি, বাবার হাত থেকে বাঁচার আমার কোনও সাধ্য ছিল না।

বছরে এক ক্লাসে তিনবার পরীক্ষা হয়, প্রথম ষৈনমাসিক, দ্বিতীয় ষৈনমাসিক, তৃতীয়টি হচ্ছে বার্ষিক, বার্ষিকে উতরে গেলে ওপরের ক্লাসে বসতে হয়। প্রথম ষৈনমাসিক পরীক্ষায় ইংরেজিতে তেত্রিশ পেয়ে ঘরে ফিরেছি। তেত্রিশ হচ্ছে পাশ নম্বর, এর নিচে পেলে আর কালো কালিতে নম্বর লেখা হয় না, হয় লাল কালিতে। মানে সব্বনাশ। তেত্রিশ পেয়ে সেদিন আমার সারাদিন মন খারাপ। ভয়ে জিভ শুকিয়ে আসছে। বারবার জল খাচ্ছি। মা’র শরীর ঘেঁসে বসে থাকি যেন মা আমার সহায় হন। মা’কে বলিও যে মা ঠিকই বলেন দুনিয়াদারির লেখাপড়ার মত বাজে ব্যাপার আর নেই। বাবাকে দেখাতেই হবে প্রগেস রিপোর্ট, এটি দেখলে পিঠে কি রকম বেত পড়বে, তা অনুমান করতে কষ্ট হয় না। মা বলেন মোটা জামা পইরা ল, পিঠে লাগব কম। গায়ে মোটা জামা পরে গরমে সেদ্ধ হতে থাকি কিন্তু বাবা ফিরে আমাকে মারধোর না করে শান্ত গলায় বলেন আজ থেইকা আমি তরে ইংরেজি পড়াব। এর চেয়ে যদি পিটিয়ে আমার পিঠের চামড়া তুলতেন, খুশি হতাম। এ যেন বাঘমামা আমার পিঠে হাত বুলিয়ে বলছেন আজ থেকে প্রতিদিন আমি তোকে খাব। বাবা যা বলেছেন তাই, হাকিম নড়ে তো হুকুম নড়ে না। রাত আটটায় রোগী দেখে বাড়ি ফিরে শার্ট প্যান্ট খুলে পেটের ওপর লুঙ্গির গিঁট দিয়ে, চোখে চশমা পরে, তোষকের তলে রাখা সন্ধি বেতটি নিয়ে আমার পড়ার টেবিলে এসে বসেন নতুন কানাই মাস্টার। আমার এক চোখ থাকে সন্ধি বেতে, আরেক চোখ বইয়ে। ইংরেজি গ্রামার শেখান বাবা আমাকে। পড়তে পড়তে হাই উঠলে ঘুমের, সপাং করে বেত পড়ে পিঠে, গা কেঁপে ওঠে আমার। পাস্ট, প্রেজেন্ট, ফিউচার টেন্স, নানারকম তার শাখা প্রশাখা, বাবা আমার মগজ খুলে মগজে নিজ হাতে ঢুকিয়ে দেন, ঢুকিয়ে বেত মেরে খুলি জোড়া দেন, যেন জীবনে কখনও আর এগুলো বেরিয়ে না আসে। জীবনের কথা দূরে থাক, পরদিনই ভুল করি, প্রতিদিনকার মত এক চোখ টেবিলের চকচকে বেতে, আরেক চোখ বইয়ে, টান টান করা পিঠ, বাবা বলেছেন সোজা হয়ে বসতে, বাঁকা হয়ে বসে অলস লোকেরা। ভুল যখনই হল, সপাং সপাং। যত সপাং সপাং তত ভুল। চোখে জল আসে। চোখে জল আসলে সপাং সপাং। যত সপাং সপাং তত জল। চোখে জল নিয়ে বলেছিলাম পানি খাইয়াম, বাবা বলে দিলেন পানি খাওন লাগব না। বাবা পড়াতে বসলে আমার পেশাব পায়খানা পাওয়া নিষেধ, তেষ্টা পাওয়া, ক্ষিধে পাওয়া নিষেধ। বাবা বলেন ওসব পাওয়া নাকি পড়ায় ফাঁকি দেওয়ার কায়দা।

পড়া শেষ হলে মা পিঠের দাগের ওপর মলম লাগাতে লাগাতে বলেন–এইভাবে গরুর মত পিটাইয়া কুনো লাভ আছে? যার হয়, তার নয়ে হয়; যার হয় না, তার নব্বইয়েও হয় না। সারাদিন গপ্পের বই পড়লে কি কইরা পরীক্ষায় ভালা করব! বাপে বাড়িত থাকলে বেহেই পড়ার টেবিলে, না থাকলে বাড়িটা মাছের বাজার হইয়া যায়। আর এইডা হইল মিরমিরা শয়তান। নাটের গুরু। কারে কুন দিয়া খুচাইব, এই তালে থাকে। এহন ভাল হইছে না! মাইর খাইয়া উপুড় অইয়া পইরা থাহস!

প্রতি রাতে মার খেতে খেতে এমন হয় যে, ইস্কুলের পড়া বাদ দিয়ে ইংরেজি ব্যাকরণ মুখস্ত করি দিনরাত। ওদিকে হোমওয়ার্কে গোল্লা জোটে। অঙ্কের খিটখিটে শিক্ষক ক্লাসে নিল ডাউন করিয়ে রাখেন। বেঞ্চের ওপর দু’ কান ধরে দাঁড়িয়ে থাকতে হয় বিজ্ঞান ক্লাসে, আবার কোনও কোনও শিক্ষক ব্ল্যাকবোর্ডের সামনে এনে ক্লাসের সবাই যেন দেখতে পায় বকের মত এক পায়ে কান ধরে দাঁড়িয়ে থাকতে বলেন, ইস্কুলে গবেট ছাত্রী হিসেবে রাতারাতি আমার নাম উঠে আসে এক নম্বরে। এদিকে বাড়িতে মুখস্ত করা ব্যাকরণও সব গুলিয়ে যায় বাবার গর্জন শুনে, পিঠে বেতের সপাং সপাং চলতেই থাকে। দ্বিতীয় ষৈনমাসিক পরীক্ষায় ইংরেজিতে আমার নম্বর ওঠে বারো। নম্বর দেখে মা বাঁকা হেসে বলেন–ক্লাস সেভেনে যহন পড়তাম, ক্লাসের টিচার জিগাস করল মেয়েরা তুমরা কেউ গোবর ইংরাজি জান? কেউ জানে না, আমি ছাড়া। কইলাম, সারা ক্লাস শুনাইয়া, কাউ ডাং। পড়ালেখাডা চালাইয়া যাইতে পারলে আমি আইজ ইংরেজির মাস্টার হইতাম। নম্বর দেখে বাবার রক্তচাপ এমনই বাড়ে যে হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়।

বাবা হাসপাতালে, বাড়ি আবার মাছের বাজার। হই চই হুল্লোড়। পড়ার টেবিলে ধুলো জমতে থাকে। কে আর ছায়া মাড়ায় ওসবের! গল্পে, আড্ডায়, গানে মজে থাকি সারাদিন, নিষিদ্ধ ছাদে কাটে বিকেল, রাত কাটে গল্পের বইএ, লুকোছাপার দরকার হয় না, ঠ্যাংএর ওপর ঠ্যাং তুলে, প্রকাশ্যে। বই জোটে ইস্কুলের মমতা নামের এক মেয়ের কাছ থেকে। মমতাকে বলা হত বইয়ের পোকা। ওই পোকার সঙ্গে আমার আবার হঠাৎ খাতির হয়ে যায়। ক্লাসের পেছনের বেঞ্চে বসে সে মাস্টারদের চোখ ফাঁকি দিয়ে কেবল বই পড়ত। ইস্কুল ছুটির পরও একদিন পড়ছিল ক্লাসঘরে, একা। দফতরি এসে দরজায় তালা দিয়ে যায় বাইরে থেকে। সে মেয়ে আটকা পড়ে যায় পরদিন সকাল হওয়াতক। খবরটি প্রথম জানতে পাই আমি, কারণ পরদিন আমিই সকালবেলা সবার আগে ক্লাসে ঢুকেছিলাম। মমতা ঘুমোচ্ছিল বেঞ্চে শুয়ে। কি ব্যাপার! বলল কাল বিকেলে ক্লাস থেকে বেরোতে গিয়ে দেখে দরজা বন্ধ। ডাকাডাকি করে কাউকে সে পায়নি, সারা ইস্কুল ফাঁকা। আমি আঁতকে উঠি। তারপর? তারপর আর কি করি, মমতা হেসে বলল, বইটা পড়া শেষ করে অনেক রাতে শুয়েছি। কী সে বই! মমতা দেখালো নীহাররঞ্জন গুপ্তেরর কিরীটি অমনিবাস। ও এতটুকু ভাবছিল না বাড়িতে ওর মা কি করছে ওর না ফেরায়। ও দিব্যি ক্ষিধে লেগেছে বলে বেরিয়ে গেল। বইটি রয়েই গেল আমার কাছে। মমতাকে এরপর দু’দিন ইস্কুলে আসতে দেয়নি ওর মা। বইটি পড়ে ওকে যেদিন ফেরত দিলাম, ও বিষম খুশি হল, ভেবেছিল ওর বই হারিয়ে গেছে। এরপর থেকে ও যে বইই পড়ত, আমাকে দিত। কেবল আমাকেই দিত।

যাই হোক, বাবা হাসপাতালে। প্রতি বিকেলে টিফিন ক্যারিয়ারে খাবার ভরে নিয়ে হাসপাতালে যান মা। বাবা এক বিকেলে মা’কে বলে দিলেন তাঁর দু’মেয়েকে তিনি দেখতে চান। কেন দেখতে চান, দেখতে চাওয়ার হঠাৎ কি হল ইত্যাদি প্যাঁচালের পর ভাঙা গলায় বললাম আমার জ্বর জ্বর লাগতাছে, তাছাড়া আমার মাস্টার আইব। ইয়াসমিনরে নিয়া যাও। যে যুক্তিই দিই না কেন, খাটে না, মা আমাকে নিয়ে যাবেনই। আমাদের গিয়ে দাঁড়াতেই হয় হাসপাতালের কেবিনে, যেখানে বাবা ডেটলের গন্ধের সঙ্গে শুয়েছিলেন। বাবার মুখে দাড়ি গজিয়ে গেছে। দাড়ি গজানো বাবাকে কখনও দেখিনি আগে। বয়স মনে হল বছর কয়েক বেড়ে গেছে বাবার। আমাকে কাছে ডেকে, একেবারে নাগালের মধ্যে, মলিন কণ্ঠে বললেন–

এখন নিশ্চয় তুমারা বলতাছ
যম গেছে যমের বাড়ি
আমরা হইলাম স্বাধীন নারী।

বাবা তবে জেনে গেছেন তাঁর নাম দিয়েছি আমি যম। বাবাকে বাবা সম্বোধন করা বাদ দিয়েছি সে অনেক বছর, আর আড়ালে যে বাবা বলি, তাও বাদ দিয়েছি তিনি আমার মাস্টার হওয়ার পর। শ্রেফ যম। নামটি তোফা হয়েছে ছোটদা মন্তব্য করেছিলেন যেদিন তিনি জুতো কেনার টাকা চেয়েও বাবার কাছ থেকে পাননি। আমি আশংকা করছিলাম হাসপাতালের শাদা বিছানা থেকে লাফিয়ে উঠে এই বুঝি তিনি আমার হাড় গুঁড়ো করবেন, তাঁকে যম নাম দেওয়ার অপরাধের শাস্তি। তা না করে আমাকে অবাক করে তিনি বললেন–মা গো কি দিয়া খাইছ আজ?

বাবার কোমল স্বরে স্বস্তি পেয়ে বলি–ডিম দিয়া।

— আমি বাড়ি গিয়াই তোমাদের জন্য বড় বড় রুইমাছ নিয়া আসব, মুরগি নিয়া আসব। বাজারে ফজলি আম উঠছে, আম নিয়া আসব ঝুড়ি ভইরা।

আমি মাথা নেড়ে আচ্ছা বলে।

বাবার যে কোনও কথায় হুঁ হ্যাঁ আচ্ছা ঠিক আছে বলে যত শীঘ্র হাসপাতাল থেকে বিদেয় হওয়া যায়, ততই মঙ্গল। কিন্তু আমাকে আরও অবাক করে দিয়ে বাবা তাঁর বুকের ওপর আমার মাথা টেনে এনে চুলে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলেন–চুলে তেল দেও নাই কেন? চুলে তেল দিয়া আচড়াইয়া ফিতা দিয়া বাইন্ধা রাখবা। তাইলে তো সুন্দর দেখা যায়।

আমি শ্বাস বন্ধ করে রাখি। বাবা তাঁর খড়খড়ে গাল আমার গালে ঘসে বলেন– তুমার যে মেধা আছে তা আমি জানি মা। তুমাকে পড়াতে গিয়া সেইটা বুঝছি। বল ত মা, মাই ফাদার হ্যাজ বিন ক্রাইং ফর মোর দেন টু আওয়ারস কি টেনস?

— প্রেজেন্ট পারফেক্ট কনটিনিউয়াস। মিনমিন করে বলি।

— এই তো আমার লক্ষ্মী মা, এই তো সব পারে আমার মা।

বাবা আমার পিঠে হাত বোলান, বেতে-কাটা ঘাএ স্পর্শ রেগে যন্ত্রণায় ধনুকের মত বেঁকে ওঠে পিঠ। তবু অসাড় শুয়ে থাকি। বাবার জন্য হঠাৎ আমার মায়া হতে শুরু করে।

হাসপাতাল থেকে বাবা সুস্থ হয়ে ফিরে এলে মাছের বাজারে নেমে আসে মাঝরাতের ঠান্ডা স্তব্ধতা। আমার জীবনেও। আমাকে ইস্কুল বদলাতে হবে। বিদ্যাময়ী ভাল ইস্কুল, এতে কোনও দ্বিমত নেই বাবার, কিন্তু আরও একটি ভাল ইস্কুল খুলেছে, রেসিডেনসিয়াল মডেল ইস্কুল, ওতে আমাকে পড়তে হবে। ততদিনে বিদ্যাময়ীতে আমার বান্ধবী বেড়েছে, রুনির সঙ্গে আমার গোপন আত্মীয়তা হয়েছে, আর আমাকে কি না সবার মধ্য থেকে বলা নেই কওয়া নেই, বাজপাখি এসে ঝাঁ করে তুলে নিয়ে যাবে! বলি, উদ্বাস্তু হওয়ার আগে মাটি আঁকড়ে ধরার মত–আমি বিদ্যাময়ী ছাইড়া কুথাও পড়তে চাই না।

বাবা ধমকে বলেন–তুই চাওয়ার কে? আমি চাই তরে মডেলে পড়াইতে।

আমি ফুঁপিয়ে বলি–বিদ্যাময়ী ভাল ইস্কুল।

বাবা কেশে বলেন–মডেল আরও ভাল।

যত সাহস আছে শরীরে, সবটুকু ঢেলে, চোখ শক্ত করে বুজে, দাঁতে দাঁত চেপে বলি — আমি অন্য ইস্কুলে পড়ব না।

বাবা আয়নার সামনে গলায় টাই বাঁধতে বাঁধতে বলেন–তুই পড়বি, তর ঘাড়ে পড়বে।

নতুন ইস্কুলের ভর্তি পরীক্ষায় প্রশ্নপত্রে এইম ইন লাইফ বলে একটি রচনা লিখতে বলা হয়েছিল। ওই একটি কাজই পরীক্ষার খাতা জুড়ে করি, রচনা লিখি, লিখতে লিখতে লক্ষ করি ইংরেজি ভাষাটি কড়া কথা বলার জন্য, রাগ করার জন্য, গাল দেবার জন্য বেশ চমৎকার। ঝড়ের মত আবেগ নামে বাংলায়, মায়ামমতা বুকের দরজা খুলে হুড়মুড় বেরিয়ে আসে বাংলায় তাই ভাষাটিকে অন্তত সেদিনের জন্য এড়িয়ে চলি। আমি স্পষ্ট জানিয়ে দিই আমার জীবনের এইম নয় এই ইস্কুলে পড়া। ইস্কুলটি একটি ভূতুড়ে বাড়ির মত। আমি একটি ইস্কুলে পড়ছি, সেটি খুবই ভাল, এবং আমি সেটিতেই পড়তে চাই। আমার ইচ্ছের বাইরে বাবা আমাকে দিয়ে তাঁর যা ইচ্ছে তা করাতে চান, এ আমার সয় না। তিনি যদি চান আমাকে ব্রহ্মপুত্রে ভাসিয়ে দেবেন, তিনি দেবেন কারণ তিনি চেয়েছেন ভাসিয়ে দিতে। আমি ভাসতে চাই কি না চাই, তা তিনি পরোয়া করেন না। আমার জীবনটি কি আমার, না তাঁর? যদি আমার হয়, যা আসলে আমারই, তবে আপনাদের কাছে সর্নিবদ্ধ অনুরোধ, আমাকে এই ইস্কুলে ভর্তি করাবেন না। আমার জীবনের এত বড় ক্ষতি আপনারা করবেন না আমার বিশ্বাস।

প্রশ্নপত্রের আর কোনও প্রশ্নের দিকে ফিরে তাকাই না। বাবাকে বেশ জব্দ করা গেল বলে একধরনের সুখ হয় আমার।প রীক্ষার শেষ ঘন্টা পর্যন্ত খামোকা বসে থেকে যখন বেরিয়ে আসি, করিডোরে দাঁড়িয়ে ছিলেন বাবা, উড়ে এসে জিজ্ঞেস করেন–পরীক্ষা কেমন হইছে?

বলি, শুকনো মুখে–ভাল।

বাবা হেসে বলেন–সব প্রশ্নের উত্তর দিছ তো!

— হ। সুবোধ কন্যার মত মাথা নেড়ে বলি।

— খুব কড়াকড়ি। পরীক্ষা দিল দুইশ জন। নিবে মাত্র তিরিশ জন। বাবার কপাল ঘামে দুশ্চিন্তায়।

মিথ্যে কথা বলার অভ্যেস নেই, কিন্তু এই মিথ্যেটি আমি চোখ বুজে অনেকক্ষণ আওড়েছিলাম যেন চোখ কান নাক সব বন্ধ করে একবার বলে ফেলতে পারি কোনওরকম।

বাবা আমাকে সোজা নিয়ে গেলেন নতুন বাজারে বাবার ওষুধের দোকানে, দোকানের ভেতরে রোগী দেখার কোঠা তাঁর। অন্যের ফার্মেসিতে বসার দরকার হয় না বাবার আর, যুদ্ধের পর নানার দোকানের দু’কদম দূরে দোকান কিনে নাম দিয়েছেন, আরোগ্য বিতান। ভেতরে তাঁর গদির চেয়ারটিতে আমাকে বসিয়ে পোড়াবাড়ির চমচম কিনে এনে মুখে তুলে খাইয়ে দিতে দিতে বললেন–ভাল কইরা লেখাপড়া করবা। প্রত্যেক ক্লাসে তুমার ফার্স্ট হওয়া চাই। আদা জল খাইয়া এহন থেইকা লাগো। বাবার স্বপ্ন যে ক’দিন পরেই মরা পাতার মত ঝরে পড়বে, তা তিনি না জানলেও আমি জানি। আমার এই জানা, মণিকে গভীর রাতে ন্যাংটো করার ঘটনার মত গোপন।

ক’দিন পর বাবা সুখবর আনলেন নতুন ইস্কুলের ভর্তি পরীক্ষায় আমি পাশ করেছি। মাথা চক্কর দিয়ে উঠল। এ কী করে সম্ভব! হ্যাঁ, বাবা যা ইচ্ছে করেন, তাই সম্ভব হয়। অন্তত অন্য কোথাও না হলেও, আমার জীবনে। সেই প্রায় বিস্তীর্ণ মরুভূমির ওপর দাঁড়িয়ে থাকা নির্জন নিরব ইস্কুল নামের বাড়িটিতে এনে বাবা বললেন ব্রহ্মপুত্রে তুমারে আমি ভাসাইয়া দিতে চাই না। তুমি আমার মেয়ে। আমার আত্মজা। আমি ছাড়া তুমার ভাল কেউ চায় না। ব্রহ্মপুত্রে যদি তুমি ডুবতে থাকো, তুমারে বাচাইয়া আনতে যদি কেউ ঝাঁপ দেয়, সে আমিই।

সারা ইস্কুলে হাতে গোণা ক’জন ছাত্রী মাত্র। পাঁচ ছ’জন মাস্টার। চোখের জল দু’হাতের তালুতে ঘন ঘন মুছে আমাকে বসতে হয় ক্লাসঘরে। ওদিকে বন্ধুরা বিদ্যাময়ীতে বিক্ষোভ করছে বাজ পাখির বিরুদ্ধে, যুদ্ধ-দেখা যুদ্ধংদেহি বন্ধুরা।

নতুন ইস্কুলে আমার মন বসে না। ইয়াসমিনেরও মন বসে না রাজবাড়ি ইস্কুলে। যুদ্ধের পর খিস্টান মিশনারিদের চালানো মরিয়ম ইস্কুল বন্ধ হয়ে গেলে ওকে রাজবাড়িতে ভর্তি করা হয়। টুইংকল টুইংকল লিটল স্টার বা হামটি ডামটি স্যাট অন এ ওয়াল এর বদলে ওকে এখন পড়তে হয় তালগাছ এক পায়ে দাঁড়িয়ে সব গাছ ছাড়িয়ে। ইস্কুলের মাদার ওকে কোলে নিয়ে আদর করত বলেই কিনা নাকি বেশিদিন এক জায়গায় কাটানোর পর একধরনের মমতা জন্মায় বলে ও ফাঁক পেলেই বিকেল বেলা বাড়ি থেকে পাঁচ মিনিটের হাঁটা-পথ মরিয়ম ইস্কুল, গিয়ে তালা বন্ধ লোহার গেটের কাছে দাঁড়িয়ে থাকে। ইস্কুলের দালান ফেটে বটগাছের চারা বেরোচ্ছে দেখে দীর্ঘশ্বাস ফেলে। ওর এত মমতা বাড়িটির জন্য, বাড়িটি ভাঙা হোক কি মলিন হোক; বাড়ির পাশের গাছটির জন্য, গাছের পাশে মাঠটির জন্য, মাঠের পাশে পুকুরটির জন্য, ইস্কুলের দোলনাটির জন্য ও এত মন খারাপ করে থাকে যে বাবা ওর জন্য বাড়ির মাঠে একটি দোলনা বসিয়ে দিলেন। দোলনায় দুলতে দুলতে ও চোখ বুজে, মনে নিয়ে এটি ওর পুরোনো ইস্কুলের মাঠ, গায়– হাউ আই ওয়ান্ডা হোয়াট ইউ আর। পেছনে আমি কি ফেলে এসেছি ভাবি। কোনও দোলনা বা দালানের জন্য আমার মন কেমন করে কি আদৌ! না। রুনির জন্য করে, টের পাই। কেবল রুনির জন্যই কি! না। রুনি অনেকটা ধ্রুবতারার মত, তীব্র আলো ওর, কিন্তু বড় দূরের। ওকে অবশ্য দূরেই থাকা মানায়। ধুলো কাদায় আমার সঙ্গে প্রতিদিনকার লুটোপুটিতে ওই রূপসীকে আমি টানি না। যাদের নাকে সর্দি, দাঁতে ময়লা, চুলে উকুন, তাদের সঙ্গে আমার অভ্যস্ত জীবনের জন্যও মন কেমন করে। অভ্যস্ত জীবন এমনই, যে, মানুষ, বিশেষ করে সে যদি অন্তর্মুখি হয়, বোধহয় ভয় পায় সে জীবন থেকে দূরে এসে আবার নতুন কিছুতে অভ্যস্ত হতে। তৃণের সঙ্গে তৃণের দৈনন্দিন প্রীতি গড়ে উঠতে সময় নেয় না হয়ত, কিন্তু, তৃণ বটে আমি, ভিন্ন জাতের তৃণ, কুঁকড়ে থাকা।

নতুন ইস্কুলে আবার টিফিন নিজেদের নিয়ে আসার নিয়ম। বাবা প্রতিরাতে চাক চাক করে কাটা বড় ফ্রুট কেক নিয়ে আসেন বাড়িতে, ইস্কুলের টিফিন। টিফিন নিয়ে আসি ঠিকই, খেতে ইচ্ছে করে না। তার চেয়ে মনে হয় পুরোনো ছেঁড়া জুতো বেচে যে কটকটি পাওয়া যায়, খেতে আরাম হত। স্বাদ বদলাতে ইচ্ছে করে আমার। ফ্রুট কেক জগতে সবচেয়ে সুস্বাদু খাবার বলে বাবা বিশ্বাস করতে পারেন, আমি করি না। অন্তত এইটুকু স্বাধীনতা আমার তো আছে, এ জিনিস আমার পছন্দ না করার এবং না খাওয়ার। সেদিন, টিফিন টিফিনের মত ফেলে রেখে বারান্দার রেলিং ধরে একা দাঁড়িয়ে ছিলাম, সামনে দেখার কিছু ছিল না পচা ডোবা বুজে মাঠ-মত বানানো ঊষড় জমি ছাড়া, আমাকে বিষম চমকে দিয়ে পিঠে হাত রেখেছিল রুনি। রুনিকে দেখে পেছোতে থাকি একপা দু’পা করে। ও আমার বেশি কাছে এলে যদি বুকের ধুকপুক আর রোমকূপের রিনরিন শুনে ফেলে, তাই পেঁছোই। রুনি পা পা করে সামনে এগোতে এগোতে বলতে থাকে, তেমনই মিষ্টি হেসে, আমি এখন এ ইস্কুলের টিচার্স কোয়ার্টারে থাকব। কী মজা তাই না! রেবেকা আপাকে চেনো? ইস্কুলের ডাক্তার। সে আমার বড় বোন।

আমি একটি নিরাপদ দূরত্বে দাঁড়িয়ে রুনিকে দু’চোখ ভরে দেখতে থাকি। রেবেকা আপাকে আমি চিনি কি চিনি না তার উত্তর দিতে ভুলে যাই। আমাকে মূক করে ফেলে ধূমকেতুর মত রুনির পতন আমার নিঃসঙ্গ আঙিনায়। ভালবাসা, ভাবি, খুব গভীর হলেই সম্ভবত পারে কাংখিত মানুষকে চোখের সামনে এনে দাঁড় করাতে। রুনি আমার দিকে এগোতে থাকে হাত বাড়িয়ে, পেছোতে পেছোতে আমি দেয়ালে সেঁটে যাই।

— এই এত লজ্জা কেন তোমার! বলে সে কাঁধে হাত রাখে আমার। শরীরের ভেতর জাগে সেই অদ্ভুত শিহরণ, আমি যার অনুবাদ জানি না। দ্রুত শ্বাস পড়ে আমার, এত দ্রুত যে শ্বাস আড়াল করতে আমি দু’হাতে মুখ ঢাকি।

— বনভোজনে যাবে না? ইস্কুল থেকে সবাইকে বনভোজনে নিচ্ছে ধনবাড়ির জমিদার বাড়িতে। আমি যাব। সেই কতদূরে ধনবাড়ি। আমার খুব দূরে যেতে ইচ্ছে করে। রুনির দু’চোখে অল্প অল্প করে চোখ রাখি, দু’চোখে তার আকাশের সবটুকু নীল। ইচ্ছে করে পাখা মেলে উড়ি। রুনির নিটোল শরীর হেসে ওঠে আমার আধফোটা চোখে চেয়ে। এমন করে হাসতে পারে রুনি ছাড়া আর কে! রুনিকে আমি ভালবাসতেই পারি, ওকে যে কেউ যে কোনও দূরত্ব থেকে ভালবাসতে পারে। কিন্তু আমার প্রতি ওর ভালবাসা, জানি না এর নাম ভালবাসা কি না, সম্ভবত স্নেহ অথবা একধরনের প্রশ্রয় আমাকে বড় অপ্রতিভ করে। ও আমাকে যত কাছে টানে, তত আমি ক্ষুদ্র হতে থাকি। মহিরূহ যদি কোনও তুচ্ছ তৃণের দিকে ঝুঁকে থাকে, তবে তৃণ যে তৃণই তা বিষম প্রকট হয়ে ওঠে! আমি নিজের কোনও অস্তিত্ব অনুভব করি না রুনি যখন আমাকে ভালবাসে, বুঝি।

গাঢ় অমাবস্যায় যদি হঠাৎ চাঁদ উঠে জ্যোৎস্নায় ভিজেয়ে ফেলে চারদিক আর সেই জ্যোৎস্না যদি আমাকে ভাসিয়ে নেয় দোলন চাঁপার বাগানে, তবে! রুনি চলে যাওয়ার পরও আমি দাঁড়িয়েই থাকি সেখানে, যেন এটিই আমার একমাত্র গন্তব্য যেখানে পৌঁছব বলে স্বপ্ন দেখছি সহস্র বছর। হঠাৎ নতুন ইস্কুলের মরা গাছপালাকেও বড় জীবন্ত মনে হয়। ইস্কুলের দালানগুলোকে বড় প্রাণবান মনে হয়। ধুলো ওড়ানো হু হু হাওয়াকেও মনে হয় চমৎকার দখিনা বাতাস। ধুসর মাটিও রুনির পা পড়ার সঙ্গে সঙ্গে সবুজ হয়ে উঠেছে। ইচ্ছে করে খালি পায়ে দৌড়ে যাই ঘাসে।

বনভোজনে যেতে হলে দশ টাকা চাঁদা দিতে হবে ইস্কুলে। বাবার কাছে দশ টাকা চাইলে শান্ত কণ্ঠে বললেন–যাওয়ার দরকার নাই।

এও কি হয়! আমি বলি–যাইতেই হইব।

বাবা খেঁকিয়ে ওঠেন–যাইতেই হইব! কে তরে জোর করবে! বনভোজন কি কোনও সাবজেক্ট? না গেলে নম্বর কম ওঠে!

বাবা টাকা দিলেন না।

এদিকে ইস্কুলে মেয়েরা বনভোজনে যাওয়ার খুশিতে বুঁদ হয়ে আছে। আমি কেবল একা আহত পাখির মত তড়পাচ্ছি। আমাকে বাঁচায় আয়শা নামের এক মেয়ে, বলে তুমার টাকা না থাকলে আমার কাছ থেইকা কর্জ নেও। সে দিব্যি দশ টাকা কর্জ দিয়ে দিল। বনভোজনে যাওয়ার লিস্টিতে নাম উঠল আমার। ভোরবেলা ট্রাকে করে আমাদের নিয়ে যাওয়া হল ধনবাড়ি। রুনি বসেছিল মাস্টারদের আর বড় ক্লাসের মেয়েদের সঙ্গে বাসে। বড় বড় ডেকচি পাতিল, চাল ডাল, থালবাসন বাসের ছাদে তুলে মাইকে গান বাজিয়ে রওনা হয়ে গেল আমাদের যন্ত্রযান। ধনবাড়িতে রুনির সৌন্দর্য আমি দূর থেকে দেখি, ও বামে গেলে আমি ডানে ফিরি, ও ডানে গেলে আমি বামে। ও চোখের আড়াল হলে আমি অস্থির হয়ে খুঁজি ওকে। ওকে দৃষ্টির নাগালে রেখে আমি বসে থাকি চুপচাপ গাছের ছায়ায় কিম্বা সিঁড়িতে, একা। বনভোজন থেকে ফিরতে ফিরতে সন্ধে পার হয়ে যায়, বাড়ি ফিরে দেখি বাবা দাঁড়িয়ে আছেন বারান্দায় আমার অপেক্ষায়।

— এত দেরি হইল ক্যান ইস্কুল থেইকা ফিরতে? বাবা খপ করে ধরলেন আমাকে।

নখ খুঁটতে খুঁটতে জবাব দিলাম–বনভোজনে গেছিলাম।

বাবা টেনে আমাকে উঠোনে নিয়ে কাঁঠাল গাছের ডাল ভেঙে এনে পেটান। বাবা মা পেটালে পিঠ পেতে রাখতে হয়, এরকমই নিয়ম। পিঠ পেতে রাখি আমি। মনের ঝাল মিটিয়ে পিটিয়ে বাবা জিজ্ঞেস করেন–টেকা কেডা দিছে বনভোজনে যাওয়ার? স্বর ফুটতে চায় না গলায়, তবু বলি, যেহেতু বাবা মা কোনও প্রশ্ন করলে উত্তর দিতেই হয়, যে ক্লাসের এক মেয়ে কর্জ দিছে।

বাবা এবার জোরে এক থাপ্পড় কষান গালে। কর্জ কইরা বনভোজন করস। এত শখ ক্যান? তর শখ আমি পুটকি দিয়া বাইর করাম।

পরদিন সকালে বাবা বেরিয়ে যাওয়ার আগে ইস্কুলে যাওয়া আসার রিক্সা ভাড়ার জন্য বরাদ্দ এক টাকার সঙ্গে দশ টাকার একটি নোট ছুঁড়ে দিয়ে বলেন–এরপর থেইকা যদি কথা না শুনস, যেইভাবে কই সেইভাবে না চলস, তাইলে তর পিঠে উঠানে যত খড়ি আছে, সব ভাঙবাম।

বনভোজন পার হওয়ার পর, রব ওঠে ইস্কুলে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হবে, যে যা জানে নাচ, গান, আবৃত্তি তাই নিয়ে মঞ্চে দাঁড়াতে হবে। কমন রুমে হারমোনিয়াম বাজিয়ে মেয়েরা গান মকশো করে। রবীন্দ্রনাথের পূজারিণী কবিতার ওপর ছোট একটা নাটকমতও। আজি ধানের ক্ষেতে রৌদ্র ছায়ায় লুকোচুরি খেলা গানটির সঙ্গে সঙ্গে নাচ আর চকখড়িতে ধানের ক্ষেত, শাদা মেঘের ছবি আঁকার আয়োজন হয়। এসব দেখতে দেখতে একটি হাওয়াইন গিটার হাতের কাছে পেয়ে এক ফাঁকে ছোটদার গানের খাতা দেখে গোপনে শেখা ‘এত সুর আর এত গান যদি কোনওদিন থেমে যায়, সেইদিন তুমিও তো ওগো, জানি ভুলে যাবে যে আমায়’ বাজিয়ে বসি। শুনে মেয়েরা ধরল অনুষ্ঠানে আমাকে গিটার বাজাতে হবে। বাজাতেই হল। আঙুল কাঁপছিল, পা কাঁপছিল, ওই কাঁপাকাঁপির মধ্যেই যেটুকু বেরিয়ে এল তাতে শুনেছি, অনেকে বলেছে বাহ। নতুন ইস্কুলে ততদিনে ভাল ছাত্রী বলে আমার বেশ নাম হয়েছে। ড্রইং ক্লাসে আমাকে বলা হয় জিনিয়াস, ইংরেজি ক্লাসে বলা হয়, এক্সেলেন্ট, এক্সেলেন্ট রচনা নাকি লিখেছি ভর্তি পরীক্ষায়। বাংলার মাস্টার বলেন–তুমি তো দেখছি কবি হে।

ইস্কুলে সাংষ্কৃতিক অনুষ্ঠান শেষ হওয়ার পর শুরু হল গার্লস গাইডে মেয়ে নেওয়া। শারীরিক কসরত শুরু হল। গলায় ড্রাম বেঁধে ড্রাম বাজানো শিখছি। সার্কিট হাউজের মাঠে বিজয় দিবসে গার্লস হাইডের দল গিয়ে কাঠি নাচ নেচে এলাম। যা কিছুই করি, মুখ থাকে নিচু, চোখ লজ্জায় আনত। নাচের মাস্টার যোগেশ চন্দ্র আসেন ইস্কুলে মেয়েদের নৃত্যনাট্য শেখাতে, রবীন্দ্রনাথের চিত্রাঙ্গদা। লজ্জাবতী লতাকে খপ করে ধরে বলেন–এই, চিত্রাঙ্গদা হবি? লজ্জাবতী যোগেশ চন্দ্রের ঠ্যাংএর ফাঁক গলে পালায়। চিত্রাঙ্গদার মহড়া শুরু হয়। মহড়া দেখে উত্তেজিত আমি বাড়ি ফিরে ইয়াসমিনকে সখী বানিয়ে বাড়ির মাঠ জুড়ে নেচে নেচে গাই গুরু গুরু গুরু গুরু ঘন মেঘ গরজে, পর্বত শিখরে অরণ্যে তমস ছায়ায়। আমিই হই চিত্রাঙ্গদা, আমিই হই অর্জুন, মদন। ইস্কুলে মহড়া চলে, আর বাড়িতে চলে আমার মঞ্চায়ন। দর্শকের সারিতে মা, মণি, দাদা, ছোটদা, পপি।
 
১১. প্রেম


ছোটদা কলেজের দ্বিতীয় বর্ষে ওঠার পর বাড়িতে আবদার করলেন আনন্দ মোহন কলেজে বেবি নাম, নেত্রকোণা বাড়ি, তাঁর এক সহপাঠী মেয়েকে এ বাড়িতে থাকতে দেওয়া হোক, যেহেতু বেবির থাকার জন্য কোনও ভাল জায়গা নেই। ছোটদার আবদার মঞ্জুর হল। বেবি সুটকেস নিয়ে উঠল অবকাশে, আমার বিছানায় শোবার জায়গা হল তার। টেবিল চেয়ার দেওয়া হল তাকে পড়াশুনা করার। বেবি, দেখতে লম্বা, শ্যামলা, চমৎকার মায়াবি চোখ, দু’দিনেই খাতির জমিয়ে ফেলল বাড়ির সবার সঙ্গে। আত্মীয় স্বজনের বাইরে কারও মুখ দেখে ঘুমোতে যাওয়ার, বা ঘুম থেকে ওঠার আমার সুযোগ ঘটেনি এর আগে। বাইরের জগত থেকে আমাদের সংসারে একটি জলজ্যান্ত মানুষের প্রবেশ ঢেউ তোলে আমার নিস্তরঙ্গ জীবনে। বেবি যখন গল্প করে তার বোন মঞ্জুরি কী করে গাছের মগডাল থেকে পড়ে গিয়ে পা ভেঙেছিল, সে ই বা কী করে একা একা নেত্রকোণা থেকে চলে এল ময়মনসিংহে লেখাপড়া করতে, কী করে তার পাগল এক ভাই কংসের জলে পা ডুবিয়ে বসে থাকত সারাদিন, একদিন তাকে আর কোথাও খুঁজে পাওয়া যায়নি–কংস হয়ে দাঁড়ায় আমারই নদী, ব্রহ্মপুত্র যেমন। মঞ্জুরিকে মনে হয় আমার জন্ম জন্ম চেনা। মা’র সঙ্গে চুলোর পাড়ে বসে বেবি গল্প করে কী করে তার পাগল ভাইটিকে আর খুঁজে না পাওয়ার পর মা তার নাওয়া খাওয়া ছেড়ে দিয়ে বিছানায় পড়ল, শুকিয়ে পাতাকাঠির মত হয়ে বেবিকে বলল তাকে পুকুরে নিয়ে স্নান করিয়ে আনতে, বেবি তাই করল, পুকুর থেকে নেয়ে এসে শাদা একটি শাড়ি পরে বেবির মা শুল, সেই শোয়াই তার শেষ শোয়া। মা গল্প শুনে আহা আহা করে বলেন তুমি হইলা আমার মেয়ে। আমার এখন তিন মেয়ে।

বাবা বাড়ি ফিরে বেবিকে ডেকে জিজ্ঞেস করেন, পড়াশুনা কেমন চলছে? ফার্স্ট ডিভিশন পাইবা ত!

বেবি মাথা নুয়ে বলে–জী খালুজান, আশা রাখি।

সাড়ে তিন মাস পর বেবিকে অবশ্য পাততাড়ি গুটিয়ে চলে যেতে হল। কারণ মা হঠাৎ এক দুপুরে আবিষ্কার করেছিলেন ছোটদা বিছানায় শুয়ে আছেন, খাটের কিনারে বসে ছোটদার চুলে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে বেবি। মা ফেটে পড়লেন বেবি, এত শয়তানি তুমার মনে মনে ছিল! আমারে বুঝাইছ তুমাদের ভাই বোনের সম্পর্ক। দুধ কলা দিয়া কালসাপ পুষতাছি আমি। আমার ছেলের সাথে ফস্টি নস্টি করার উদ্দেশ্য তুমার! এত বড় সাহস!

বেবি কেঁদে পড়ল মা’র পায়ে। ছোটদার মাথা ধরেছিল বলে বেবি কেবল স্পর্শ করেছিল কপালে, এই যা। আর কোনওদিন এমন ভুল হবে না বলে সে জোড় হাতে ক্ষমা চাইল। মা ক্ষমা করার মানুষ নন। বলে দেন, মন যখন ভাঙে মা’র, একেবারেই ভাঙে। বেবির চলে যাওয়াতে বাড়িতে সবচেয়ে যে মানুষটি নির্বিকার ছিলেন, তিনি ছোটদা।

ছোটদার পরীক্ষা সামনে, আইএসসি, যে পরীক্ষায় পাশ করে ভর্তি হবেন তিনি মেডিকেল কলেজে। বাবার অনেকদিনের স্বপ্ন, তাঁর একটি ছেলে ডাক্তার হবে। সেই ছোটদা হঠাৎ বাড়ি ফেরেন না। একদিন দু’দিন, সপ্তাহ চলে যায়, তাঁর টিকিটি নেই। বাবা উন্মাদ হয়ে সারা শহরে খোঁজ করেন। বাবা তখন টাঙ্গাইলের সিভিল সার্জন, ভোররাতে বাসে করে টাঙ্গাইল যান চাকরি করতে, অবশ্য যত না চাকরি করতে চাকরি বাঁচাতেই বেশি, রাতে বাড়ি ফিরে আসেন। আপিসে ছুটির দরখাস্ত ফেলে তিনি ছেলের খোঁজ করেন। ময়মনসিংহ ছোট শহর, ছেলে মেলে, তবে ছেলে আর সেই আগের ছেলে নেই। ছেলে বিবাহিত। কি ঘটনা, ক্লাসের এক হিন্দু মেয়ের সঙ্গে প্রেম করে তাকে বিয়ে অবদি করে ফেলেছেন গোপনে, এক বন্ধুকে উকিল বাপ বানিয়ে। এখন বউ নিয়ে সেই বন্ধুর বাড়িতে আছেন।

বাবা কপালের শিরা চেপে বলেন–সব্বনাশ হইয়া গেছে। আমার সব আশা ভরসা শেষ। ছেলে আমার এ কি কান্ড করল! কে তারে এইসব করতে বুদ্ধি দিল। পরীক্ষার আর মাত্র কয়েক মাস আছে। ছেলে আমার ডাক্তারি পড়বে। ছেলে আমার মানুষের মত মানুষ হবে। ছেলে এ কি পাগলামি করল! ওর ভবিষ্যত নষ্ট হইয়া গেল! কত কইছি বন্ধুদের সাথে মিশবি না। মিশছে। কত বুঝাইছি লেখাপড়া কইরা মানুষ হইতে!

বাবার মাথায় লোটা লোটা ঠান্ডা পানি ঢালেন মা। বাবার রক্তচাপ বাড়ছে। মা টের পান না, বাবার হৃদপিন্ডের ওপর কালো এক থাবা বসিয়ে যায় ফুঁসে ওঠা রক্তচাপ।

মা ফুঁপিয়ে কাদেন আর বলেন – আমার হীরার টুকরা ছেলে। কই আছে, কী খায় কেডা জানে! বদমাইশেরা ওরে নিশ্চয় তাবিজ করছে! এইডা কি তার বিয়ার বয়স হইল যে বিয়া করে। আল্লাহগো আমার ছেলেরে আমার কাছে ফিরাইয়া দাও।

চোখের পানি মুছে বাবার ঝিম ধরে থাকাকে ঠেলে ভাঙেন মা, নাকি গুজব?

বাবা ডানে বামে মাথা নাড়েন।

গুজব নয়। ঘটনা সত্য। মেয়ের নাম গীতা মিত্র। হিন্দু।

চুলোয় হাঁড়ি চড়ে না। শুয়ে থেকে থেকে সারাদিন কড়িকাঠ গুনি। দাদা ঢাকা চলে গেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে। আমার বড় একা লাগে। দাদা নেই, ছোটদাও যদি আর এ বাড়িতে না থাকেন, বাড়িটি বিষম খাঁ খাঁ করবে। মণি ঝিমোয় বারান্দায়, রোদ সিঁড়ি বেয়ে নামতে থাকে নিচে, উঠোনে। রোদের গায়ে কারও পা পড়ে না। রোদে দাঁড় করিয়ে মা তাঁর ছেলেমেয়েদের গা মেজে গোসল করিয়ে সারা গায়ে মেখে দিতেন সর্ষের তেল, মেখে দু’কানের ছিদ্রে দু’ফোঁটা করে তেল আর নাভির ছিদ্রে একফোঁটা। বড় হয়ে যাওয়া ছোটদাকেও তাই করতেন। ছোটদা কপালের ওপর ঢেউ করে চুল আঁচড়াতেন, চোখা জুতো পরতেন, পাশের বাড়ির ডলি পালের দিকে চেয়ে দুষ্টু দুষ্টু হাসতেন আর বাড়ির ভেতর ঢুকেই তিনি মা’র তোতলা শিশু, মুখে লোকমা তুলে খাওয়াতেন তাঁকে মা।

বাবার শিয়রের কাছে বসে দীর্ঘশ্বাস ফেলে মা বলেন–একটা হিন্দু মেয়েরে, কী কইরা একটা হিন্দু মেয়েরে বিয়া করল কামাল! মেয়েটা কয়দিন আইছে এই বাড়িতে। ওর আচার ব্যবহার আমার ভালা লাগে নাই। আইসা নোমানরে সিনেমায় লইয়া যাইতে চায়। নোমান না যাইতে চাইলে কামালরে সাধে। ছেড়াগোর পিছে পিছে ঘুরার স্বভাব। বড় চতুর মেয়ে, আমার শাদাসিধা ছেলেটারে পটাইছে। কামালের কয়দিন ধইরা দেখতাছিলাম বড় উড়া উড়া মন। ওই মেয়ের পাল্লায় পড়ছে এইটা যদি জানতাম আগে! তাইলে ওরে আমি সাবধান কইরা দিতাম।

খাটের রেলিংএ কুনই রেখে গালে হাত রেখে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে মা বলেন–আল্লাহই পারেন ছেলের মন ফিরাইতে। আল্লাগো ছেলেরে আমার ফিরাইয়া আনো। হিন্দু বাড়িত বিয়া হইত ক্যা আমার ছেলের! আমার হীরার টুকরা ছেলের লাইগা কত বড় বড় ঘরের মেয়ের বাপেরা ভিড় করত অইলে! কত জাঁক জমক কইরা বউ ঘরে আনতাম! লেখাপড়া শেষ কইরা চাকরি বাকরি করতে থাকব, তারপরে না বিয়া! মন ঠিকই ফিরব আমার ছেলের, ফিইরা আইব। ভুল ত মাইনষেই করে!

গীতা মিত্র বিদ্যাময়ীতে পড়ত, মুখখানা গোল, তেঁতুলের গুলির মত, মায়া মায়া কালো মুখে হরিণের চোখ। ইস্কুলে নানা পরবে অনুষ্ঠানে নাচত মেয়ে। ছোটদার সঙ্গে তাঁর পরিচয় আনন্দ মোহন কলেজে পড়তে গিয়ে। আবার তাঁর খোঁড়া মাসির কারণে, খোঁড়া মাসি পড়াত আমাদের, সে সূত্রে এ বাড়িতেও ক’দিন এসেছে সে, এসে আমাদের দু’বোনের সঙ্গে রসিয়ে গল্প করেছে, বলেছে আমাদের সে লুকিয়ে সিনেমায় নিয়ে যাবে, নাচ শেখাবে, গাছ থেকে আতাফল পাড়তে গিয়ে তরতর করে গাছের মগডালে গিয়ে বসেছে, অমন এক দস্যি মেয়ে দেখে আমরা তখন খুশিতে বাঁচি না। বেবি ছিল অন্যরকম, সেলাই জানা রান্না জানা ঘরকুনো মেয়ে। বেবির দাপিয়ে বেড়ানোর স্বভাব ছিল না, গীতার যেমন। দস্যি মেয়েটি খুব অল্পতেই আমাদের হৃদয় দখল করে ফেলে। অবশ্য হৃদয়ের কপাট তখন এমন খোলা যে কেউ পা রাখলেই দখল হয়ে যায়। ঈদের জামা বানাতে শাদা সার্টিনের জামার কাপড় কিনে আনা হল, গীতা বাড়ি এসে ছোঁ মেরে নিয়ে গেল কাপড়, বলল আমি খুব ভাল শিলাই জানি, আমি শিলাইয়া দিব। ব্যস, বাড়িতে দিনে দু’বার করে আসতে লাগল গজফিতায় গায়ের মাপ নিতে আমাদের। তিন দিনে সেলাই হবে বলেছিল, লাগিয়েছে তের দিন। তাও জামা জোটে ঈদের সকালে। পরতে গিয়ে দেখি বুক এমন আঁটো যে প্রায় ফেটে যায়, ঝুল এত বড় যে মনে হয় পীরবাড়ির আলখাল্লা। এমন অদ্ভুত জামা এর আগে কখনও পরিনি। ঈদটিও গিয়েছিল মাঠে মারা। ঈদের সকালে বাড়ি এসে জামা পরিয়ে দিয়ে সে হাততালি দিয়ে ইঁদুর-দেতো হাসি দিয়ে বলল–ইস কি যে সুন্দর লাগতাছে তুমারে! দারুন! দারুন।

বলল–চল তুমারে দারুন এক জায়গায় নিয়া যাব বেড়াইতে।

দারুন এক জায়গায় যাওয়ার জন্য আমার তর সয় না। রিক্সা করে গীতার সঙ্গে দিব্যি রওনা হয়ে গেলাম। উঠলাম গিয়ে সাহেব কোয়ার্টারে জজের বাড়িতে। বড়লোকের বাড়ি। রুহি নামের এক মেয়ে গীতার বান্ধবী, তাকে নিয়ে তার বেরোতে হবে কোথাও। রুহি, চ্যাপ্টা দেখতে মেয়ে, বেজায় ফর্সা, তার মা’কে পটাতে লাগল বাইরে বেরোবে বলে। মা’র পটতে যত দেরি হয় গীতা আর রুহি তত ফিসফিস কথা বলে নিজেদের মধ্যে, আর আমি বসে থাকি খেলনার মত সোফায়। ঘন্টা দুই পর রুহির মা পটল, রুহি মুখে লাল পাউডারের আস্তর মেখে চোখে কাজল ফাজল লাগিয়ে বের হল, তিনজন এক রিক্সায় বসে রওনা হলাম সেই দারুন জায়গায়। আমার তখন দারুন জায়গাটি ঠিক কোথায়, জানা হয়নি। ওরা রিক্সায় বসে খিলখিল হাসে, আর আমি কাঠের ঘোড়ার মত বসে থাকি গীতার কোলে। গুলকিবাড়ির এক বাড়িতে রিক্সা থামে, বাড়ির এক শিয়াল-মুখো লোক আমাদের ভেতরে ঢুকিয়ে গেটে তালা দিয়ে দেয়। লোকটিকে আমি কখনও দেখিনি এর আগে। নিঝুম একটি বাড়ি, বড় মাঠঅলা। ঘরের ভেতর ঢুকে দেখি সারা বাড়িতে আর কোনও লোক নেই, শিয়াল-মুখো ছাড়া। দুটো ঘর পাশাপাশি। ভেতরে শোবার ঘরে রুহি ঢুকে যায় লোকটির সঙ্গে। পাশের ঘরের সোফায় খেলনার মত নাকি কাঠের ঘোড়ার মত নাকি জানি না, বসে আমি দেখতে থাকি লোকটি রুহির সঙ্গে ঘন হয়ে বিছানায় বসল। এত ঘন হয়ে যে আমার পলক পড়ে না। শিয়াল-মুখো শুয়ে পড়ল বিছানায় রুহিকে বুকের ওপর টেনে। হঠাৎই এক লাফে রুহিকে সরিয়ে বিছানা থেকে উঠে এসে লোকটি আমাদের হাতে ফানটার বোতল ধরিয়ে দিয়ে গীতা যাও, লনে বস গিয়া বলে শোবার ঘরের দরজা বন্ধ করে দিয়ে ভেতরে ঢুকে গেল।

মাঠে গিয়ে আমি কাঁপা গলায় জিজ্ঞেস করি–লোকটা কে?

মিটিমিটি হেসে গীতা বলল–খুররম ভাই। অনেক বড়লোক। গাড়ি আছে।

— রুহিরে নিয়া যে লোকটা দরজা বন্ধ কইরা দিল। ঢোঁক গিলে বলি, এহন কি হইব। আমার ডর লাগতাছে। চল যাইগা।

গীতা তার কালো মুখে শাদা হাসি ফুটিয়ে বলে, আরে বস, এহনি যাইয়া কি করবা!

দুপুর পার হয়ে বিকেল হয়ে গেল চল যাইগা চল যাইগা করে করে। আমি ছটফট করি, প্রতিটি মুহূর্ত কাটে আমার অস্বস্তিতে। শিয়াল-মুখো ঘন্টায় ঘন্টায় ফানটার বোতল দিয়ে যায় এদিকে। ফানটা খেয়ে তখন আর আমার পোষাচ্ছে না। ক্ষিধেয় চিনচিন করছে পেট। গেটের কাছে গিয়ে কান্না-গলায় বলি–গেট খুইলা দেও। আমি যাইগা। আমার আর ভাল লাগতাছে না।

গীতার মুখও শুকনো হয়ে ছিল। শোবার ঘরের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে বলল–ও খুররম ভাই। ও থাকতে চাইতাছে না। আমরা না হয় যাই গা।

বেরিয়ে এল শেয়াল-মুখো, পাকানো মোচ পুরু ঠোঁটের ওপর, আঙুলে সিগারেট, খালি গা, খালি পা।

— গীতা, ফটো তুইলা দেও তো কিছু। আসো। বলে লোকটি গীতাকে নিয়ে ভেতরে ঢুকে গেল। আমি দাঁড়িয়ে রইলাম দরজায়।

রুহি মাথা নিচু করে বিছানার মধ্যিখানে বসেছিল। বাঁধা ছিল চুল ঘোড়ার লেজের মত, এখন খোলা, এলোমেলো। ঠোঁটে লিপস্টিক ছিল, নেই। চোখের কাজল ছতড়ে গেছে। বড় মায়া হতে থাকে রুহির জন্য। লোকটি কি ওকে ন্যাংটো করেছিল! ও কি চেয়েছিল ন্যাংটো হতে নাকি চায়নি! লোকটি কি ভয় দেখিয়ে, জোর করে রুহিকে আটকে রেখেছে ঘরে! কিছু ঠিক বুঝে উঠতে পারি না। গীতার হাতে ক্যামেরা দিয়ে লোকটি রুহিকে দু’হাতে জাপটে ধরল, গীতা মিটিমিটি হেসে টিপ দিল বোতামে। লোকটি শুয়ে পড়ল রুহির কোলে। গীতা টিপল আবার। রুহির গালে গাল লাগাল লোকটি, গীতা টিপল।

আমাদের ছাড়া পেতে পেতে সন্ধে পার হয়ে গিয়েছিল। গীতা প্রথম রুহিকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে পরে আমাকে দিল, বলল কাউরে কইবা না কই গেছিলা। সারাদিনের নিখোঁজ কন্যার জন্য দুশ্চিন্তায় বাবা মা’র ঈদ মাটি হয়েছে। আমি পাংশু মুখে বাবা মা’র রক্তচোখের সামনে দাঁড়িয়ে পিঠ পেতে বরণ করেছি যা আমার প্রাপ্য ছিল। সেই রহস্যে মোড়া গীতা, যে আমাকে একটি দারুন দিন উপহার দিয়েছিল, সে এখন ছোটদার বউ! শহরের নামকরা গিটার বাজিয়ে ছোটদা, কলেজে তাঁর গিটারের সুরের সঙ্গে ও আমার দেশের মাটি তোমার পরে ঠেকাই মাথা নেচেই গীতা মিত্রের মাথা ঠেকানো শুরু হয়েছিল ছোটদার কাঁধে, বুকে। সেই গীতা মিত্র! বেবি বলত, ও একটা জঘন্য মেয়ে। ওর সাথে মিশবা না। গীতাও বলত বেবি খারাপ। দেইখ ও যেন আর তুমাদের বাসায় না আসে।

গলা ফাটে বাবার,–অরে আমি ত্যাজ্যা পুত্র করাম। আমার খাইয়া আমার পইরা আমাকে গলায় ছুরি বসাইল।

ফোঁপানো বন্ধ হয়ে এবার গলা চড়ছে মা’র–
শেষ পর্যন্ত একটা চাড়ালনিরে বিয়া করল!
খড়িউলার ঝিয়েরে বিয়া করল!
ওই হিন্দু খড়িউলা হইব এম বি বি এস ডাক্তারের বেয়াই!
অর মা মাসিরা রাস্তার কলপারো গিয়া গোসল করে। ছুটোলুকের জাত। কাউট্যা খাউরা জাত। মালাউনের জাত।
সমাজে মুখ দেহানো আর গেল না! মান ইজ্জত সব গেছে!
গুষ্ঠির মুহে চুনকালি দিল ছেলে!
একটা নর্তকীরে বিয়া করল, ছি ছি ছি।
এমন ছেলেরে ক্যান আমি জন্ম দিছিলাম!

মা’র বিলাপ ক্লান্তি হীন ঢেউ, সংসার সমুদ্রে। এমন বিপর্যয় এ সংসারে ঘটেনি আর। নানি নানা রুনু খালা হাশেম মামাকে ডেকে পাঠান বাবা। ঢাকা থেকে বড় মামা আসেন, ঝুনু খালা আসেন, দাদা আসেন। সকলে বিষম উদ্বিগ্ন, ঘরে মূল্যবান বৈঠক চলছে, ওতে ছোটদের, আমার আর ইয়াসমিনের উঁকি দেওয়া মানা। মধ্যরাত অবদি কথাবার্তা চলে, স্বর এত নিচে নামিয়ে কথা বলেন ওঁরা যে আমি কান পেতে থেকেও কিছু বুঝে উঠতে পারি না। শিমুল তুলোর মত ওড়ে দু’একটি শব্দ, ঠিক অনুমান করতে পারি না, হাওয়া কোন দিকে বইছে।

বৈঠকের পরদিন এক ভয়ংকর ঘটনা ঘটে। ছোটদাকে ধরে এনে বৈঠকঘরে মোটা শেকলে বাঁধেন বাবা আর হাশেম মামা। পায়ে শেকল, হাতে শেকলে, শেকলে তালা। চাবি বাবার বুক পকেটে। বাবার গর্জনে বাড়ি কাঁপে, গাছপালা কাঁপে। জানালার ফাঁকে চোখ রেখে দৃশ্য দেখে গা ঘামতে থাকে আমার। ইয়াসমিন বিছানায় শুয়ে বালিশে মুখ রেখে কাঁদতে থাকে। মা বারান্দায় অস্থির হাঁটেন, বিড় বিড় করতে করতে দ্রুত সরাতে থাকেন তসবিহর গোটা।

— গীতারে ছাড়বি কি না ক! না ছাড়লে তরে আমি ত্যাজ্য পুত্র করাম। থেকে থেকে বাবার গর্জন।

ছোটদা বলেন নিরুত্তাপ কণ্ঠে–ত্যাজ্য পুত্র করেন, আমি গীতারে ছাড়তাম না। বাবার চোখ বেরিয়ে আসতে থাকে কোটর থেকে, শার্ট ঘামে ভিজে লেপ্টে আছে শরীরে। কোমরে দু’হাত রেখে হাঁপাতে থাকেন, রক্তচাপ বাড়ছে বাবার।

— তুই বাড়ি থেইকা কুথাও যাইতে পারবি না। কুথাও না। কলেজে পড়বি। পরীক্ষা দিবি।

ছোটদা চড়া গলায় বলেন–আমি এই বাড়িতে আইতে চাই নাই। মিছা কথা কইয়া আমারে আপনেরা নিয়া আইছেন। আমি গীতারে বিয়া করছি। আমারে ছাইড়া দেন। আমি গীতার কাছে যাইয়াম। আপনাগোর কাছে আমি কিচ্ছু চাই না। আমারে ছাইড়া দেন।

— গীতারে ছাড়। নাইলে তর মরন আমার হাতে। আমি তরে চাবকাইয়া একেবারে মাইরা ফালাব। বাবার দু’চোখ থেকে আগুন ঝরে।

ছোটদাকে বাবা দু’ঘন্টা সময় দিয়েছেন ভাবার, ওই দুঘন্টা সময় জুড়ে ছোটদা দেয়ালে হেলান দিয়ে চোয়াল শক্ত করে বসে থেকেছেন। আর দফায় দফায় গিয়ে নানি, রুনু খালা, মা বলেছেন– বাবারে তুমি ভাল ছেলে। তুমার বাবা যা কয় মাইনা লও। এই বয়সে ছেলেরা অনেক ভুল করে, তুমার বাবা তুমারে মাপ কইরা দিব যদি বাড়িত ফিইরা আইসা লেখাপড়া কর, পরীক্ষা দেও। তুমি ডাক্তারি পইড়া বড় ডাক্তার হইবা। হ বিয়া করছ করছ। মেয়েও তার বাবার বাড়ি ফিইরা যাক। লেখাপড়া শেষ কর দুইজনেই। পরে তুমার বাবা বড় অনুষ্ঠান কইরা মানুষরে জানাইয়া এই মেয়েরেই ঘরে তুলব তুমার বউ কইরা। তুমি ছাত্র মানুষ, এই যে বিয়া কইরা বাড়ি ছাইড়া গেলা গা, খাইবা কি, বউরে খাওয়াইবা কি? যেটুক লেহাপড়া করছ এটুক দিয়া ত কুনো চাকরিই পাওয়া যাইত না। তুমি কি কুলিগিরি করবার চাও? তুমি কি রিক্সা চালাইবা? তুমার বাবা বড় ডাক্তার, শহরে তারে এক নামে সবাই চিনে। বাপের কথা মাইনা লও। ত্যাজ্য পুত্র করলে তুমি বাপের সম্পত্তির কানাকড়িও পাইবা না। বাবা, তুমার ত বুদ্ধি আছে, মেয়েরে গিয়া কও তার বাড়িত ফিইরা যাইতে। তুমার বাপ কথা দিছে বিয়া করার সময় অইলে যারেই তুমি বিয়া করতে চাও, তুমার বাপ তারে দিয়াই বিয়া করাইব।

ছোটদার চোয়াল শক্তই থাকে। তাঁর একটিই কথা, শেকল খুলে দেওয়া হোক। শক্ত চোয়ালকে বাবা পরোয়া করেন না, গরু পিটিয়ে মানুষ করার খ্যাতি আছে তাঁর। জীবন নিয়ে জুয়ো খেলছে ছেলে, এ তিনি বাবা হয়ে সহ্য করতে পারেন না। চোখের সামনে ছেলে তাঁর আগুনে ঝাপ দিচ্ছে, কেন তিনি তা হতে দেবেন! এ তাঁর নিজের ছেলে, এ ছেলের শরীরে তাঁর রক্ত, ছেলের মুখে তাঁর মুখের আদল। ছেলেকে মানুষ করতে তিনি মাথার ঘাম পায়ে ফেলে টাকা রোজগার করেছেন, খাইয়ে পরিয়ে বড় করেছেন, ছেলে তাঁর বংশের বাতি, ছেলে তাঁর, ছেলেকে তিনি যে করেই হোক ফেরাবেনই। দু’ঘন্টা পর বাবা আসেন বৈঠক ঘরে শক্ত শেকলে বাঁধা চোয়াল শক্ত ছেলের সামনে। হাতে তাঁর চাবুক।

— কি তর সিদ্ধান্ত কি? আমার কথা মত চলবি কি চলবি না। বাবা না নরম না গরম কণ্ঠে বলেন।

ছোটদার চোয়াল আরও শক্ত হয়। বলেন–আমারে ছাইড়া দেন।

— হ তরে ত ছাড়বই। আমার কথা ছাড়া কুথাও এক পাও লড়বি না। গীতার কাছে যাওয়া তর চলবে না।

দাঁতে দাঁত চেপে ছোটদা বলেন–আমার কথা একটাই, এর কুনো নড়চড় নাই। আমি এই বাড়িতে থাকতাম না। আমি গীতার কাছে যাইয়ামই।

— গীতারে খাওয়াইবি কি, নিজে খাইবি কি? চাবুক নাড়তে নাড়তে বলেন বাবা।

— সেইডা কারও চিন্তা করার দরকার নাই। চোয়াল তখনও শক্ত ছোটদার, দাঁতে দাঁত।

ছোটদার জায়গায় আমি হলে, সব শর্ত সম্ভবত মেনে নিতাম। বাঘের থাবায় এসে বাঘের সঙ্গে রাগ দেখানো বোকামো ছাড়া আর কী!

চোয়াল এবার শক্ত হয় বাবার। চোখ হয় করমচার মত লাল।

চাবুক চালান ছোটদার ওপর, ক্ষুধার্ত বাঘের মুখে এতদিনে আস্ত হরিণ। চাবুক যেন আমার পিঠে পড়ছে। আমারই সারা গা থেকে রক্ত ঝরছে। চামড়া কেটে মাংস বেরিয়ে গেছে পিঠের, মাংস কেটে হাড়। চোখ বুজে থাকি। চোখ বুজে অপেক্ষা করি চাবুক থামার। চাবুক থামে না। বৈঠক ঘর থেকে নিঃশব্দে বেরিয়ে আসেন মা, নানি, বড় মামা, রুনু খালা। কেউ বারান্দার থামে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে সামনে তাকিয়ে থাকেন জানেন না কিছু দেখছেন কিনা সামনে, কেউ ধীরে হাঁটতে থাকে, জানেন না হাঁটছেন কি না, কেউ নিজের চুল খামচে ধরে থাকেন, জানেন না তাঁর চুলে তিনি হাত দিয়েছেন কি না। একেকজন যেন মৃত মানুষ, কবর থেকে উঠে এসে হাঁটছেন গন্তব্যহীন, তাঁরা কেউ কাউকে দেখতে পাচ্ছেন না, সামনে নিশ্ছিদ্র অন্ধকার, অন্ধকারে শুয়ে আছে অরণ্য আর অরণ্য থেকে একটি কেবল শব্দ আসছে, সে চাবুকের।

মা দৌড়ে যান বৈঠক ঘরে, গিয়ে চাবুকের আর মা মা চিৎকারের তলে যেন না হারায় তাঁর নিজের শব্দ, চিৎকার করে বলেন–ছেলেটা ত মইরা যাইব। মাইরা ফেলতে চাও নাকি! আমার ছেলেরে তুমি মাইরা ফেলতে চাও!

চাবুকে ছোটদাকে রক্তাক্ত করতে করতে বাবা বলেন–এরে আমি মাইরাই ফেলব আজ। এরম ছেলের বাইচা থাইকা কুনো দরকার নাই।

–ছাইড়া দেও যাকগা যেহানে যাইতে চায়। মা ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠে বলেন, এরে মাইরা কুনো লাভ নাই। এর রগ ছুডোবেলা থেইকা ত্যাড়া । আইজকা বাপ মা ভাই বোনের চেয়ে তার কাছে বড় হইয়া গেছে এক মালাউনের ছেড়ি। যাক, ও সেহানেই যাক। ওরে ছাইড়া দেও।

ছোটদাকে ছাড়া হয় না। বন্দি করা হয় ওঁর নিজের ঘরে। ঘরের দরজায় নতুন তালা পড়ে, তালার চাবি বাবার বুক পকেটে। বাড়িতে ঘোষণা করে দেন বাবা, ছোটদাকে কোনওরকম খাবার দেওয়া চলবে না। পায়খানা পেশাব তিনি ওঘরেই করবেন, যতদিনে না তাঁর সুমতি হয়। আটকা পড়ে ছোটদা দরজা ভাঙার চেষ্টা করেন, জানলা ভাঙার। কোনওটিই ভাঙে না। ভাঙবে কেন, লোহা গলিয়ে কাঠ বানানো হয় যদি! দৈর্ঘে নফুট, প্রস্থে পাঁচ।

সারারাত গোঙরান তিনি। অনেকগুলো প্রাণী প্রাচীন কোনও প্রেত পুরীর মত বাড়িটির বালিশে মাথা রেখে গোপনে জেগে থাকে। আমিও জেগে থাকি। অনেক রাতে, সে কত জানি না, ইয়াসমিন ভাঙা গলায় বলে–বুবু, আমার ঘুম আয়ে না। আমি পাশ ফিরে বলি–আমারও না।

দীর্ঘশ্বাস ছড়াতে ছড়াতে ঘরে কুয়াশা-মত জমে, চোখে ঝাপসা লাগে সব। ঝাপসা হয়ে আসে দরজা জানালা বারান্দার আলো পড়া ঘরের আসবাব, সব। অন্ধকার আমার চুলে এসে বসে, চোখে, চিবুকে।

ছোটদা চারদিন উপোস থাকার পর মা জানালার লোহার শিকের ফাঁক গলে লুকিয়ে খাবার চালান করেন। ছোটদাকে খাইয়ে চারদিন পর নিজে তিনি খাবার মুখে তোলেন। বাবা ঘরে বসে কান পেতে থাকেন বন্ধ ঘর থেকে কোনও সমর্পনের শব্দ আসে কি না, কষ্ট পেতে পেতে, ক্ষিধের বন্দিত্বের। শব্দ আসে না। বাড়ির চুলোয় যেন আগুন ধরানো না হয়, বাবার কড়া হুকুম।

কি করে বাঁচবে তবে বাড়ির বাকি মানুষ!

মুড়ি চিবিয়ে পানি গিলবে, ব্যস।

আর ও ঘরে কেউ কোনও খাবার পাচার চেষ্টা করলে তাঁকেও চাবকানো হবে। তবু বাবার চোখ ফাঁকি দিয়ে কিছু না কিছু জানলা গলে ও ঘরে যায়ই। আমার স্পষ্ট ধারণা হয় বাবা টের পান যে ছোটদাকে খাবার দেওয়া হচ্ছে এবং তিনি ঘটনাটি না জানার ভান করছেন। বাবা তাঁর ছুটি আবার বাড়িয়ে বাড়িতে বসে থাকেন আর অপেক্ষা করেন ছোটদার আত্মসমর্পনের। এদিকে শুকিয়ে ছোটদার হাড় বেরিয়ে আসে বুকের, গলার, গালের। আস্ত একটি কঙ্কাল দাঁড়িয়ে গোঙরায় জানালার শিক ধরে।

বাঘে বাঘে লড়াই চলছে, আমরা অসহায় দর্শক মাত্র। লড়াই শেষ হয় পনেরোদিন পার হলে ‘পর।

লড়াইয়ে হেরে যান বাবা। ছোটদাকে শেষ অবদি ছেড়ে দিতে হয়।

ছোটদা চলে যাওয়ার পর বাবা আমাদের দু’বোনকে বুকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরেন। এত শক্ত করে যে মনে হয় বুকের হাড় সব ঢুকে যাবে মাংসের ভেতর। জড়িয়ে বাবা বলেন, তুমরা আমারে কথা দেও পড়ালেখা কইরা মানুষ হবা তুমরা, কও!

আমরা মাথা নাড়ি হব।

— দুইটা মেয়েই এখন আমার স্বপ্ন। কও, তুমরা কেও তুমরার ভাইয়ের মত হইবা না। কও! বাবা বলেন।

আমরা মাথা নাড়ি হব না।

— ছেলেমেয়েদের মানুষ করার জন্য আমি সব করছিলাম। আমার কত স্বপ্ন ছিল কামালরে নিয়া। ও কী অসভব ব্রিলিয়ান্ট ছাত্র ছিল, মেট্রিকে স্টার পাওয়া ছাত্র। ও আমার কত গর্ব ছিল। আমার সব গর্ব, সব স্বপ্ন এখন শ্যাষ। তুমরা আমার শ্যাষ ভরসা। তুমাদের মুখের দিকে চাইয়া এখন আমার বাঁচতে হইব। কও আমারে বাঁচতে দিবা! লেখাপড়া করবা, কও! বলতে বলতে বাবার গলা বুজে আসে।

আমরা মাথা নেড়ে বলি করব।

— আমি আমার ছেলেরে মারতে চাই নাই। আমার কি কম কষ্ট হইছে ছেলেরে মারতে! না খাওয়াইয়া রাখতে! শেষ চেষ্টা করছি ছেলের মত যেন পাল্টায়। আদর কইরা বুঝাইছি, শুনে নাই। মাইরা কইছি, তাও শুনে নাই। তুমরা শুনবা আমার কথা, কও! আমরা মাথা নেড়ে বলি শুনব।

বাবার চোখের পানি আমাদের জামা ভিজিয়ে ফেলে। বাবাকে এই প্রথম আমরা কাঁদতে দেখি।

কিন্তু আমরা মাথা নেড়ে কথা দিয়ে দিলাম আর বাবাও তা মেনে নিয়ে মনে সুখ পাবেন, বাবা আমার এমন ধাঁচের নয়। তিনি মা’কে বলেন–পরিবেশ নষ্ট হইয়া গেছে বাড়ির। এই এত বড় বাড়ি আমি কিনছিলাম, আমার ছেলেমেয়েদের জন্য,যেন তারা একটা ভাল পরিবেশে লেখাপড়া করতে পারে। সবার জন্য আলাদা ঘর, ক্যাচর ম্যাচর নাই, গণ্ডগোল নাই। পাড়ার কারও সাথে মিশতে দেই নাই ছেলেমেয়েদের। নিরিবিলি থাইকা যেন লেখাপড়ায় মন দেয়। হইল না। বাবা দীর্ঘশ্বাস ফেলে শরীরখানা বিছানায় এলিয়ে বলেন–এই বাড়ি দিয়া আমি এখন করব কি! আমি বাড়ি বেইচা দিব। আমার চোখ ফাঁকি দিয়া নুমানে বন্ধু বান্ধব লইয়া আড্ডা দিয়া পরীক্ষায় খারাপ করছে, কামালে চইলা গেল এক ছেড়ির লাইগা নিজের জীবনটা নষ্ট করতে। এই বাড়িতে থাকলে মেয়েদুইটাও মানুষ হইব না।

মা নীরবে দেখেন সাফল্যের সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠতে উঠতে হঠাৎ পা পিছলে পড়ে যাওয়া মানুষের কাতরানো। নামাজ শেষে মা প্রতিদিন প্রার্থনা করেছেন ছেলের মন যেন ফেরে বিধর্মী মেয়ে থেকে। ছেলে যেন তওবা করে নামাজ শুরু করে। ছেলে যেন ঈমান আনে। মা’র প্রার্থনায় কাজ হয়নি। ছোটদা চলে যাওয়ার সময় একবারও পেছন ফেরেননি।

ছোটদা চলে যাওয়ার দু’দিনের মাথায় বাবা দুটো সুটকেসে বইখাতা কাপড় চোপড় ভরে আমাকে রেখে আসেন মডেল ইস্কুলের ছাত্রীনিবাসে, আর ইয়াসমিনেকে মির্জাপুরের ভারতেশ্বরী হোমসএ। রুখে দাঁড়ানোর সাহস আমাদের কারও ছিল না। কালো ফটকের সামনে পাথরের মূর্তির মত দাঁড়িয়ে ছিলেন মা। টোকা দিলে বুড়ো গোলাপের পাপড়ির মত ঝরে পড়ত পাথর, জানি।

তের বছরে তখনও আমি পা দিইনি। মা’কে ছেড়ে কখনও কোথাও থাকার অভ্যেস নেই আমার। মা চুল বেঁধে দেন, মুখে তুলে খাইয়ে দেন, জ্বর হলে মাথার কাছে বসে থেকে রাত জেগে জলপট্টি দেন কপালে, গাছের বড় পেয়ারা, বড় আম, বড় ডাব, বড় আতা, বড় মেয়ের জন্য তোলা থাকে। ফুল তোলা ঘটি হাতা জামা বানিয়ে দেন নিজে হাতে। রাতে ঘুম না আসলে পিঠে তাল দিতে দিতে গান ঘুমপাড়ানি মাসিপিসি মোদের বাড়ি এসো, খাট নাই পালঙ্ক নাই, রাজুর চোখে বসো। মা আমাকে মাঝে মধ্যে আদর করে রাজু বলে ডাকেন। সেই মা’কে ছেড়ে, নিজের বিছানা বালিশ ছেড়ে, এক্কা দোক্কার উঠোন আর গোল্লাছুটের মাঠ ছেড়ে এক তক্তপোশে আমাকে বসে থাকতে হয়, যেহেতু এখানে আমাকে ফেলে রেখে গেছেন বাবা। ছাত্রীনিবাসের মেয়েরা আমাকে দেখে অবাক হয়ে বলে– তুমি হোস্টেলে এসছো কেন? তোমাদের বাড়ি তো এ শহরেই!

কোনও উত্তর নেই ফ্যালফ্যাল তাকিয়ে থাকা ছাড়া। যেন চিড়িয়াখানায় আজব এক প্রাণী এসেছে, তার পায়ে শিং, পেটে শিং দেখতে এসে মেয়েরা ঠোঁট চেপে হাসে। আমার কাউকে বলতে ইচ্ছে করে না আমার ছোটদা, ঈশ্বরগঞ্জে, ইয়াসমিন যে বাড়িতে জন্মেছিল, সে বাড়ির দেয়ালে পিঁপড়ের পেছনে পিঁপড়ে হাঁটত কালো আর লাল, লাল গুলোকে আঙুলে টিপে মারতেন আর বলতেন–লাল পিঁপড়া হিন্দু।

আমি একটি কালো পিঁপড়ে মেরেছিলাম বলে সে কি রাগ ছোটদার! পিঠে দুমাদুম কিলিয়ে বলেছিলেন–কালা পিঁপড়া মারছ ক্যা? কালা পিঁপড়া ত মুসলমান। লালগুলারে বাইছা বাইছা মারবি।

হ্যাঁ সেই ছোটদাই, হিন্দু পিঁপড়ে মারা ছোটদা এক হিন্দু মেয়েকে বিয়ে করে বাড়ি ছাড়লেন। লেখাপড়া ছাড়লেন। বাবা মা ভাই বোন ছাড়লেন। ছত্রখান হয়ে গেল সংসার।

দিন সাত পর মা এলেন হোস্টেলে। হোস্টেলের সুপারের কাছে দরখাস্ত করলেন আমাকে বাড়ি নিয়ে যেতে। মা’র দরখাস্ত মঞ্জুর হয়নি, যেহেতু আমার অভিভাবক হিসেবে খাতায় নাম আছে কেবল বাবার। মা কাঁদতে কাঁদতে বিদেয় হলেন। ইস্কুলের প্রিন্সিপাল ওবায়দা সাদ থাকেন ওপর তলায়, নিচ তলায় হাতে গোনা কজন মেয়ে নিয়ে নামকাওয়াস্তে ছাত্রীনিবাস সাজানো হয়েছে।

প্রায় বিকেলেই বাবা আসেন আমাকে দেখতে, বিস্কুট, চানাচুর, মালাইকারি, মন্ডা নিয়ে। ওগুলো হাতে দিয়ে প্রথমেই জিজ্ঞেস করেন–লেখাপড়া কেমন করতাছ মা?

চোখ মাটিতে। মাথা নেড়ে বলি ভাল।

বাবা মোলায়েম স্বরে বলেন–হোস্টেলে ত আরও মেয়েরা থাকে, তোমার বয়সী মেয়েরা, থাকে না?

মাথা নেড়ে বলি থাকে।

— এইখানে থাইকা ক্লাস করবা, আর ছুটির পরে হোস্টেলে ফিইরা গোসল কইরা খাইয়া দাইয়া পড়তে বসবা। আর ত কোনও কাজ নাই। হোস্টেলে তুমারে দিছি তুমার ভালর জন্য। এহন না বুঝলেও তুমি যহন বড় হইবা, বুঝবা। বাবা সবসময় ছেলেমেয়ের ভাল চায় মা। চায় না?

মাথা নেড়ে বলি হ চায়।

চোখ ফেটে জল আসে আমার। চোখের জল আড়াল করতে আকাশের তীব্র লাল আলোর দিকে তাকিয়ে থাকি, যেন বাবা ভাবেন সূর্য্যর দিকে ড্যাবড্যাব করে তাকালে জ্বালা করে চোখ জল কিছু আসে, এ কান্না নয়।

বাড়ি ফেরার জন্য কতটা অস্থির হয়ে আছি, বাবাকে বুঝতে দিই না। বাবা ছাড়া আর কোনও অতিথি আসা নিষেধ আমার কাছে। এমনকি মা এলেও মা’র সঙ্গে দেখা করা যাবে না। ইচ্ছে করে দৌড়ে পালাই। কিন্তু মোচঅলা তাগড়া দারোয়ান বসে থাকে গেটে, গেট পার হয়ে কারও বাইরে যাওয়ার সাধ্য নেই। ডাক্তার রেবেকা চলে গেছেন মেডিকেল কলেজের টিচার্স কোয়ার্টারে, রুনিকেও তাই চলে যেতে হয়েছে। ওকে পেলে হয়ত যন্ত্রণা কিছু উপসম হত। আসলে হত কী! আমি নিশ্চিত করে বলতে পারি না।

বিকেলে ইস্কুল ছুটির পর খেয়ে ঘুমিয়ে জিরিয়ে কিছু মেয়ে নামে ব্যাডমিন্টন খেলতে, কিছু মেয়ে আড্ডায় বসে মাস্টারদের কার স্বামী আছে কার স্ত্রী, কার তালাক হয়েছে, কে একা থাকে, কার সঙ্গে কার প্রেম চলছে এসব। আমি আধেক বুঝি, আধেক বুঝি না। আমি ঠিক বুঝে পাই না ওরা কি করে মাস্টারদের ঘরের খবর, মনের খবর রাখে। আমি পারি না। ব্যাডমিন্টনের দর্শক আর আড্ডার শ্রোতা হয়ে আমার সময় কাটে। সন্ধেবেলা বই সামনে নিয়ে বসে থাকতে হয়, সুপার ঘুরে ঘুরে দেখেন মেয়েরা পড়ছে কি না। বইয়ের পাতায় ফোঁটা ফোঁটা জল পড়ে আমার। অক্ষরগুলো ঝাপসা হতে থাকে, প্রতিরাতে। প্রতিরাতে আমাকে বিছানায় শুতে হয় একা, কোনও ঘুম পাড়ানি মাসি বা পিসি এসে বসে না আমার চেখে।

কী দোষ করেছিলাম, যে আমাকে ঘরবাড়ি ফেলে নির্বাসনে জীবন কাটাতে হচ্ছে! প্রেম করলেন ছোটদা, প্রায়শ্চিত্ত করতে হচ্ছে আমাকে। আমার কোনও দ্বিধা হয় না ভাবতে যে বাবা অন্যায় করছেন।

প্রেম দাদাকেও করতে দেখেছি, নীরবে। অবকাশে আসার তিনদিনের মাথায় পাড়ার অনিতা নামের এক মেয়ের প্রেমে পড়েছিলেন। রাস্তায় হাঁটতে গিয়ে দীঘল ঘন চুলের এক উজ্জ্বল মেয়েকে দেখলেন ছাদে দাঁড়িয়ে আছে। ব্যস প্রেমে পড়ে গেলেন। অনিতারা মাস ছয় পর চলে যায় কলকাতা। দাদা চোখের জল ফেলতে ফেলতে কবিতা লেখা ধরলেন। শীলাকে দেখার পর কবিতা লেখায় অবশ্য ভাঁটা পড়ে। ফরহাদ নামে দু’জন বন্ধু ছিল দাদার। একজনকে ডাকা হত মুডা ফরহাদ, আরেকজনকে চিকন ফরহাদ। চিকন ফরহাদের বোনই হচ্ছে শীলা। লম্বা মেয়ে, পানপাতার মত মুখ। দাদা বলতেন শীলা দেখতে অবিকল অলিভিয়ার মত, অলিভিয়া ছিল ফিল্মের নায়িকা। সিনেমা পত্রিকা থেকে অলিভিয়ার ছবি কেটে কেটে দাদা ঘর ভরে ফেললেন। বইয়ের ভেতর, খাতার ভেতর, টেবিলক্লথের নিচে, বালিশের নিচে, তোষকের তলায় কেবল অলিভিয়া। আমি আর ইয়াসমিন কোথাও অলিভিয়ার কোনও ছবি দেখলে এনে দাদার হাতে দিতাম। ওসব ছবির দিকে দাদাকে দেখেছি ঘন্টার পর ঘন্টা তাকিয়ে থাকতে, তাকিয়ে থেকে বলতে শীলার থুতনিটা ঠিক এইরকম, নাকটা এক্কেবারে শীলার, চোখ দুইটা ত মনে হয় ওরগুলাই বসাইয়া দিছে। হাসলে শীলারও বাম গালে টোল পড়ে।

পুরোনো খাতা ফেলে নতুন খাতা ভরে দাদা নতুন উদ্যমে কবিতা লিখতে শুরু করেন আবার, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের প্রেমের গান শোনেন একা একা। কলেজে যাওয়ার রিক্সাভাড়া আর টিফিনের পয়সা জমিয়ে বেহালা কেনেন, যামিনী রায়ের কাছে বেহালা বাজানো শিখে এসে শীলাকে ভেবে বেহালায় করুণ সূর তোলেন। শীলা তখনও প্রেমে পড়েনি দাদার, দাদাই একা। দাদার বেহালা শুনে মন গলবে না শীলার, গলবে কোনও এক দিন, কবিতায়। বলদের ডাগর চোখে চোখ রেখে হরিণী বলবে, কবিতা লেখা শিখলেন কোত্থেইকা? ভালই লেখেন।

বলদ লাজুক হাসবে।

হরিণী বলবে–আপনে আমার দিকে এত তাকায়ে থাকেন কেন।

বলদ লাজুক হাসবে।

হরিণী বলবে–আপনে যে এত ঘন ঘন সামনের রাস্তা দিয়া হাঁটেন, আমার ভাই কিন্তু দেইখা বলে নোমান কাঁচিঝুলিতে এত আসে কেন!

বলদ লাজুক হাসবে।

হরিণী বলবে–আপনে আসেন তাতে কার কী, এই রাস্তা কি ফরহাদের কেনা!

আপনে হাঁটেন, আপনের আরও বন্ধু ত কাঁচিঝুলিতে থাকে, তাদের বাসায় যান।

বলদ লাজুক হাসবে।

হরিণী বলবে–আপনে না আপনের দুই বোনের জামা বানাইতে দিবেন, কই নিয়া আসেন একদিন, আমি জামা ভালই শিলাই করতে জানি।

বলদ মাথা নাড়বে।

হরিণী বলবে–ইস কী গরম পড়ছে, ছাদে গিয়া বসলে একটু বাতাস লাগবে।

আপনেরও নিশ্চয় গরম লাগতাছে?

বলদ মাথা নাড়বে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মনোবিজ্ঞানের এম এ ক্লাসের ছাত্র দাদা। তাঁর মন পড়ে থাকবে ময়মনসিংহ শহরের কাঁচিঝুলিতে। আর বিজ্ঞান ঝুলে থাকবে বিশ্ববিদ্যালয়ের চত্বরের অশ্বত্থ গাছে, বাঁদরের অথবা বাদুরের মত। দাদা ছুটির নামে ঘন ঘন বাড়ি ফিরবেন। বিষন্ন হরিণীর সঙ্গে দেখা হবে কাঁচিঝুলির শিমুলতলায়।

হরিণী বলবে, বাবা আমার বিয়ে ঠিক করতেছে।

বলদ বলবে, কার সাথে?

হরিণী বলবে, যার সাথেই হোক, তুমার সাথে না।

বলদ বলবে,ও।

হরিণী বলবে, বাবার অসুখ, ভাবতেছেন মরে টরে যাবেন, মেয়ের বিয়ে দিলে নিশ্চিন্তে মরবেন।

বলদ বলবে, কী অসুখ?

হরিণী বলবে, যে অসুখই হোক, বিয়ে দিবেন আমার।

বলদ বলবে, ও।

হরিণী বলবে, তুমার বাবা যদি প্রস্তাব নিয়া আসে আমার বাবার কাছে, বাবা মনে হয় না করবেন না।

বলদ বলবে, ও।

হরিণী কাঁদবে।

বলদ বলবে, কাঁদো কেন?

হরিণী বলবে, কাঁদি কেন, তুমি বোঝ না!

বলদ মাথা নাড়বে, সে বোঝে না।

হরিণী বলবে, তুমি না মনোবিজ্ঞান পড়? অথচ মনের কিছুই বোঝ না!

বলদ বিব্রত, অপ্রতিভ।

দাদা বাড়িতে মা’কে প্রথম পাড়বেন কথাটি যে শীলা খুব লক্ষ্মী একটি মেয়ে, ওর বিয়ে হয়ে যাচ্ছে শিগরি, ওকে লাল শাড়িতে খুব সুন্দর দেখাবে, ও চমৎকার রান্না করতে জানে, চমৎকার শেলাই জানে, শীলা তাঁর শ্বশুর শাশুড়িদের খুব যত্ন করবে, ওর ফুটফুটে সব বাচ্চা হবে।

মা বলবেন, তর বন্ধুর একটা বইন সুন্দরী, সংসারি। ভাল খবর। তা আসল কথাটা কি, ক!

আসল কথাটি বলতে দাদা সময় নেবেন। এক কাঠি দু’কাঠি এগোতে এগোতে একদিন বলবেন শীলাকে তিনি বিয়ে করতে চান। বাবার কানে কথাটি মা মিছরির গুঁড়োর সঙ্গে মিশিয়ে ঢালবেন। মিছরির গুঁড়োর স্বাদও খুব তেতো লাগবে বাবার। এক কাঠি দু’কাঠি পেছোতে পেছোতে বাবা একদিন বলবেন ঠিক আছে মেয়েকে দেখতে চাই আমি।

বলদ বলবে, চল, আমাদের বাড়িতে তোমার দাওয়াত। তোমারে বাবা দেখতে চাইছেন।

হরিণী লাজুক হাসবে।

বলদ বলবে, আমার যে কি খুশি লাগতাছে। তুমি আমার বউ হবা।

হরিণী লাজুক হাসবে।

বলদ বলবে, তুমারে দেখার পর বাবা বিয়ের প্রস্তাব নিয়া তুমাদের বাসায় আসবে।

হরিণী লাজুক হাসবে।

বলদ বলবে, তুমি চুড়ি পইও না আবার হাতে, কানের দুলও না। মুখে রঙ লাগাইও না। বাবা পছন্দ করে না। আর, কইবা মেট্রিকে ফাস্ট ডিভিশন পাইছ, স্টার আছে কইবা। থাক ধরা পইরা যাইতে পার, দরকার নাই। আই এ পড়, খুব পড়াশুনা করতাছ যাতে ফাস্ট ডিভিশন পাও আর বিয়ার পরও লেখাপড়া চালাইয়া যাইবা। এইম কি জিগাস করলে বলবা কলেজের টিচার হওয়া।

হরিণী লাজুক হাসবে।

শীলা আসবে বাড়িতে। বৈঠক ঘরে শীলার সামনে বসে থাকবেন বাবা, দাদা বসে থাকবেন নিজের ঘরে, দাদার পা নড়তে থাকবে দেয়াল ঘড়ির পেন্ডুলামের মত, হাঁটুতে হাঁটুতে লেগে ঠক ঠক শব্দ হবে। বৈঠক ঘরে যেতে তাঁর লজ্জা হবে। মা দুধ শেমাই রান্না করে, ট্রেতে চা, বিস্কুট, মিষ্টি, শেমাই সাজিয়ে সোফার সামনের টেবিলে রাখবেন। খেতে খেতে শীলার সঙ্গে গল্প করবেন বাবা। বাবার ঠোঁটে হাসি ঝিলিক দেবে।

শীলার যাওয়ার সময় হলে নিজে তিনি রিক্সা ডেকে ওকে তুলে দেবেন। কালো ফটকের কাছে দাঁড়িয়ে হাত নাড়বেন হেসে।

নতুন শাড়ি পরা মা, পান খেয়ে ঠোঁট লাল করা মা, খুশির দোলনায় দোলা মা দৌড়ে যাবেন বাবার সামনে। বলবেন, দেখতে মধুবালার মত।

বাবা বলবেন, ঠিকই।

মা বলবেন, মেয়েটা খুব লক্ষ্মী।

বাবা বলবেন, তা ঠিক।

মা বলবেন, ছেলের বিয়ার বয়স হইছে। তাড়াতাড়িই বিয়াটা হইয়া যাওয়া ভাল।

শার্ট পরা, প্যান্ট পরা, টাই পরা, জুতো পরা, চশমা চোখের, কোঁকড়া চুলের বাবা বলবেন, এই মেয়ের সাথে আমার ছেলের বিয়া দিব না।

হাকিম নড়বে তো হুকুম নড়বে না।

দু’মাস পর তেইশ বছরের ফারাক নিয়ে এক ভুঁড়িঅলা, মোচঅলা, পাঁচ ফুট দু’ইঞ্চি লোকের সঙ্গে শীলার বিয়ে হয়ে যাবে।

হরিণী আটকা পড়বে খাঁচায়।

ঝুনু খালা কেঁদেছিলেন দাদার মত নিরালায় বসে নিঃশব্দে নয়। পাড়া কাঁপিয়ে। নাওয়া খাওয়া ছেড়েছিলেন। বাড়ির কাচের বাসন কোসন ছুঁড়ে ছুঁড়ে ভেঙেছিলেন। গলার ওড়না পেচিয়ে কড়িকাঠে ফাঁসি নিতে গিয়েও নেওয়া হয়নি, আগেই দরজা ভেঙে হাশেম মামা ঢুকে নামিয়ে আনেন। ঝুনু খালাকে কবিরাজ দেখানো হয়, মাথায় মাথা ঠান্ডা হওয়ার তেল মাখা হয়, মৌলবি ডেকে এনে ফুঁ দেওয়ানো হয় মুখে।

ঝুনু খালা তবু সারেননি, শেষ পর্যন্ত তাঁকে পাঠিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয় বড় মামার বাড়িতে, ঢাকায়।

রুনু ঝুনু পিঠাপিঠি বোন, দু’বোনের সখ্য পাড়ার লোকও জানে। চানাচুর অলাও বাড়ির সামনে গান ধরে ও আমার রুনু ভাই, ঝুনু ভাই কই গেলারে, গরম চানাচুর যায় খাইবা নাকি রে। হেই চানাচুর গরম। রুনু ঝুনু কাঁদেন একসঙ্গে, হাসেন একসঙ্গে। গান, নাচেন, বরই কুড়োন, শিউলি ফুল তোলেন, মালা গাঁথেন, সব এক সঙ্গে। ঝুনু তাঁর পেটের খবর রুনুকে বলেন, রুনু তাঁর পেটের খবর ঝুনুকে। দু’বোন পাশাপাশি শোন এক বিছানায়। লোকে বলে আহা যেন যমজ বইন। সেই রুনু হঠাৎ একদিন বাড়ি থেকে হাওয়া। হাওয়া তো হাওয়াই। নেই নেই, শহর জুড়ে নেই। খবর পাওয়া গেল, বাড়ি থেকে পালিয়ে তিনি বিয়ে করেছেন রাসুকে, আছেন এখন রাসুর গ্রামের বাড়িতে, বেগুন বাড়ি। শুনে ঝুনু পাড়া কাঁপিয়ে কাঁদেন। উঠোনের ধুলোয় গড়িয়ে কাঁদেন, বুক থাপড়ে কাঁদেন। কেন কাঁদেন! রাসু ছিলেন ঝুনুর গৃহশিক্ষক। রাসু রুনুর কেউ ছিলেন না। রাসুর সামনে বসে রাসুর চোখের ভাষা পড়েননি রুনু, বুকের ধুকপুক শব্দ শোনেনি। এক ঝুনু জানেন কি করে টেবিলের তলে ঝুনুর পায়ের ওপর এগিয়ে আসতো রাসুর পায়ের আঙুল। কি করে ঝুনুর আঙুল নিয়ে খেলত গোপন এক হাত। ঝুনু জানেন শিউলি ফুলের মালা তিনি কার জন্য গাঁথতেন। কার জন্য তিনি বিকেল হতেই আয়নায় দাঁড়িয়ে নিজেকে দেখতেন বারবার। চোখে কাজল পরতেন কার জন্য! সকলে জানত, ঝুনুকে পড়াতে মাস্টার আসেন, কেউ জানে না কয় ভাগ পড়া আর কয় ভাগ অপড়ায় সময় কাটে ছাত্রী আর শিক্ষকের। ছাত্রী পড়ানোর সময় কারও ঘরে ঢোকা মানা, কারও গণ্ডগোল করা মানা, শিক্ষকের জন্য এক ফাঁকে চা বিস্কুট দিয়ে যেতেন রুনু, ওটুকুই ছিল কেবল পড়া বা অপড়ার মধ্যে সামান্য বিশৃঙ্খলা।

সেই ঝুনুর সঙ্গে যদি রাসুর বিয়ে না হয়ে রুনুর হয়, তবে অপমানে লজ্জায় ঝুনু মরতে চাইবেন না কেন!

পুরুষ হচ্ছে জানোয়ারের জাত, ঝুনু খালার ধারণা তাই।

পুরুষের কথায় মজছ কি মরছ, ঝুনু খালা ঘাটে বসে পুকুরের জলে পা ডুবিয়ে বলছিলেন, মৌলবির ফুঁ এর দু’দিন পর।

শুয়োরের চেয়ে অধম এরা। এরা যারে পায় তারে চাখে। এগোর কুনো নীতি নাই।

তুমারে আইজ কইল ভালবাসে, পরদিন আরেকজনরে একই কথা কইব।

ঝুনু খালার পিঠ পেরিয়ে পাছায় নামা ঘন চুল, সে চুলে জট, কালি পড়া কাজল না পরা চোখ,.গায়ের কাঁচা হলুদ রঙ দেখায় মরা ঘাসের মত।

নানির চার মেয়ের মধ্যে ফজলি খালা একশতে আশি, ঝুনু খালা একশতে পঞ্চাশ, রুনু খালা তিরিশ, আর মা .. . .

দাদা ইস্কুলের মাস্টারের মত রূপের নম্বর এভাবে দিতেন, — আর মা কত?

দাদা চেয়ারে বসে দু’পা নেড়ে নেড়ে, দাঁতে পেনসিল কামড়ে বলতেন, মা হইল রসগোল্লা।

— বুঝলা গেঁতুর মা, তুমিও যেরম আমিও তেমন। তুমারে এক লোকে কষ্ট দিছে, আমারেও দিছে। উপরে যদি আল্লাহ থাকে, আল্লাহ এইটা সইব না। ওগোর বিচার আল্লাহই করব। ঝুনুখালা, পঞ্চাশ পাওয়া রূপসী, নতুন সন্যাসিনী বলেন।

— গেতুঁর মার সাথে এত কি ফুসুর ফুসুর আলাপ ঝুনুর! জানালায় দাঁড়িয়ে দুজনের ঘনিষ্ঠ বসে থাকা দেখে নানি অসন্তুষ্ট স্বরে বলেন,–ঝুনু ত আবার পেডো কথা রাখতে পারে না, কী না কী কয় আবার!

গেঁতুর মা’র বুক কেঁপে দীর্ঘশ্বাস বেরোয়–আল্লাহ আসলে বিচার করে না। আল্লাহ বড় একচোখ্যাপনা করে। গেতুঁর বাপ আমারে মাইরা পুড়াইয়া খেদাইয়া, বিয়া করছে আরেকটা। হে ত সুহেই আছে। সুহে নাই আমি, বাপ নাই যে বাপের কাছে যাই, ভাই আছে দুইডা, ভাইয়েরা আমারে উঠতে বইতে গাইল্লায়, কয় আমারই দুষে আমারে খেদাইছে গেঁতুর বাপ।

গেঁতুর মা’র পোড়া হাত ভেসে থাকে ঝুনুখালা হাঁটুর ওপর থুতনি রেখে বলেন–এই দুনিয়ায় আমার বাঁচতে ইচ্ছা করে না। আবার ভাবি আমি মরতাম ক্যান একলা, ওই দুইটারে মাইরা নিজে মরবাম। আমি সুখে নাই, তরা সুখে থাকবি ক্যান!

এঁদো গলি থেকে পায়ে পায়ে হেঁটে এসে অন্ধকার ঢুকে পড়ে নানির বাড়ির উঠোনে। পুকুরের জলে আধখানা চাঁদ কচুরিপানার কম্বল মুড়ে ঘুমোয়। গেঁতুর মা’র পোড়া হাতখানা ঘুমোয় ছেঁড়া আঁচলের তলে। ঝুনু খালার ইচ্ছে করে না কোথাও যেতে। ইচ্ছে করে পুকুর ঘাটে, বাঁকা খেজুর গাছের এই তলায় তিনি বসে থাকবেন সারারাত আর টুপ টুপ করে তাঁর জটা চুলে শিশির পড়বে। শিশির ভেজা ঘাস থেকে তিনি আর আঁচল ভরে ভোরবেলা শিউলি কুড়োবেন না। আর কারও জন্য মালা গাঁথার তাঁর দরকার নেই। আর কারও জন্য বিকেলে লাল ফিতেয় কলাবেণি করে চোখে কাজল পরে অপেক্ষা করার দরকার নেই।

ঝুনু খালার বড় খালি খালি লাগে। তিনি এক দৌড়ে ঘর থেকে এক ঝুড়ি কাগজ নিয়ে আসেন, রাসুর লেখা চিঠি, নেপথলিনের গন্ধ অলা চিঠি, টিনের ট্রাংকে কাপড় চোপড়ের ভেতর চিঠিগুলো রেখে ছিলেন তিনি, সযতনে। আধখানা চাঁদ যখন ঘুমোচ্ছে আর খেঁজুর গাছে বাদুরের মত ঝুলছে অন্ধকার, ঝুনু খালা আগুন ধরান চিঠিগুলোয়।

— চল গেঁতুর মা, আগুন তাপাই। শীত পড়তাছে।

আগুনে পোড়া চিঠির ছাই উড়ে এসে ঝুনুখালার জটা চুলে পড়ে।

গেঁতুর মার মুখখানা লাল হতে থাকে আগুনে, আগুন দেখলে তার ইচ্ছে করে ভাত ফুটোতে, হাঁড়ির কাছে মুখ নিয়ে বলক পাড়া ভাতের গন্ধ শুঁকতে ইচ্ছে করে খুব। গেঁতুর মার মাথার ওপর অন্ধকারের বাদুরখানা ঝপ করে পড়ে।

— এক বাত কাপড়ের লাইগা, গেঁতুর মা বলে, বেডাইনের লাত্থি গুতা খাইয়া পইড়া থাহি। আমগো পেডো ক্ষিদা, পেডো ক্ষিদা থাকলে মন পক্কীর লাহান উইড়া যায়। মন দেওয়া নেওয়া করি নাই কুনোদিন। হেইতা বড়লুকেরেই মানায়। মন নাই, আমগোর খালি জ্বলাউরা পেট আছে। যে ভাত দেয়, হেরেই ভাতার কই।

ঝুনুখালার ভাল লাগে না গেঁতুর মা’র ক্ষিধের গপ্প শুনতে। তাঁর কদিন ধরে ক্ষিদেই পায় না। মুখে ভাতের লোকমা তুললেই বমি-মত লাগে। বুকের মধ্যে মনে হয় বিরান এক চর পড়েছে। রাসুর সঙ্গে গাছের তলায়ও তিনি জীবন কাটাতে পারতেন, রাসুর চোখের দিকে তাকালে ঝুনুখালা ক্ষিধে তৃষ্ণা সব ভুলে যেতেন, রাসুর সঙ্গে জলে ডুবে মরলেও তাঁর সুখ হত।

শেষ চিঠিটি, আধেক পুড়ে আগুন নিবে যায়। ঝুনু খালা আধপোড়া চিঠি হাতে নিয়ে বসে থাকেন অন্ধকারে। তাঁর খুব পড়তে ইচ্ছে করে চিঠিটি। এটি সম্ভবত সেই চিঠি, তিনি ভাবেন, যে চিঠিতে রাসু লিখেছিরেন ঝুনুখালাকে তিনি প্রাণের চেয়েও বেশি ভালবাসেন। ঢাকা চলে যাওয়ার আগে আগে ঝুনু খালা, আমি আর ঝুনুখালাই কেবল জানি, জুবলিঘাটের হলুদ একটি দোতলা বাড়ির সামনে, বাড়ির গায়ে ডাক বাংলো লেখা, রিক্সা থেকে নেমেছিলেন, পেছন পেছন আমি। ডাক বাংলোর বারো নম্বর ঘরে যখন টোকা দিচ্ছিলেন, ঝুনুখালার নাকের ডগায় দেখেছিলাম ফোঁটা ফোঁটা ঘাম। ঘর থেকে বেরিয়ে এসেছিল এক টিংটিঙে, চিবুক অবদি লম্বা মোচঅলা, দেখতে গেছো ভূত এর মত, নানির বাড়ির দু’বাড়ি পেছনের বাড়ির লোক, দু’একদিন দেখেছি, জাফর ইকবাল নাম। ঝুনুখালাকে ঘরটিতে ঢুকিয়ে দুয়োর এঁটেছিল সে লোক, আর আমি দাঁড়িয়েছিলাম বারান্দায়, ব্রহ্মপুত্রের দিকে তাকিয়ে, আমার বিকেল পার হয় ব্রহ্মপুত্রের ঢেউ ভাঙা ঝিলমিল জল দেখতে দেখতে আর সে জলের ওপর দেখতে দেখতে ভাটিয়ালি গান গেয়ে গেয়ে মাঝিদের নৌকো বাওয়া। পশ্চিমের আকাশ লাল করে ডিমের কুসুমের মত সূর্য যখন ডুবছিল ব্রহ্মপুত্রের জলে, আমি সম্মোহিতের মত, ওখানেই, যেখানে দাঁড়িয়ে থাকতে বলেছিলেন ঝুনুখালা, ছিলাম।

সূর্য ডুবল আর ঝুনু খালা দুয়োর আঁটা ঘর থেকে বেরিয়ে এসে আমার গালে হাতের তেলোয় আদর করে বললেন–শোন, কেউ যদি জিগায় কই গেছিলি, বলবি ঝুনুখালার এক বান্ধবীর বাসায়।

বাংলো থেকে বেরিয়ে রিক্সায় উঠতে উঠতে ঝুনু খালা আবার বলেন–যদি জিগায় কী নাম সেই বান্ধবীটার, বাড়ি কোন জায়গায়?

ঝুনুখালার মুখের দিকে ভাবলেশহীন তাকিয়ে উত্তরের অপেক্ষা করি। তিনি বলেন–কইবি ফাতেমা, থাকে হইতাছে কালিবাড়ি। না না কালিবাড়ি না, কইবি ব্রাহ্মপল্লী। ঠিক আছে?

ঠিক আছে কি ঠিক নেই কিছুই ঝুনুখালাকে আমি বলি না। সম্ভবত তিনি বুঝে নেন, তিনি বলুন আর না বলুন আমার মুখের কপাট সহজে যেহেতু খোলে না, খুলবে না।
 
১২. প্রত্যাবর্তন ১


চার মাস পর আমাকে হোস্টেল থেকে বাড়ি নিয়ে আসেন মা। সে এক কান্ড বটে। যে মা’র সঙ্গে আমার দেখা করাই মানা ছিল, সেই মা’র হাতে সঁপে দেওয়া হল নিষিদ্ধ গন্দম। মা প্রায়ই হোস্টেল সুপারের সঙ্গে দেখা করে কাঁদতেন, বলতেন ওর বাবা একটা বিয়ে করবে, তাই মেয়েকে হোস্টেলে পাঠায়ে দিছে। সবই হচ্ছে ষড়যন্ত্র। বাড়ি বিক্রি কইরা দিয়া নতুন বউ নিয়া সে আলাদা বাড়িতে থাকবে। এখন মেয়েকে আমার কাছে দিয়া দেন, দুই ছেলের কেউই কাছে নাই, মেয়ে বাড়িতে থাকবে, দেখি কী কইরা তার বাপ বাড়ি বিক্রি করে, কী কইরা বিয়ে করে আরেকটা।

সুপারের মন মা’র কান্নায় গলল। মেয়ে দিয়ে দিলেন মায়ের কাছে।

চার মাস পর বাড়ি ফেরে মেয়ে।

ইয়াসমিনকেও ফেরত আনা হয়েছে মির্জাপুর থেকে।

দু’মেয়েকে দু’পাশে নিয়ে বসে থাকেন মা। সন্ত্রস্ত।

বাবা বাড়ি ঢুকে আমাদের দেখে ভূত দেখার মত চমকে ওঠেন। বাবার চোখ লাল হতে থাকে। চোয়াল শক্ত হতে থাকে। দাঁতে লাগতে থাকে দাঁত। ভয়ে মিইয়ে থাকি আমি, ইয়াসমিন মা’র পিঠের পেছনে লুকোতে চেষ্টা করে মুখ।

মেয়েদেরে ত, মা মিনমিন করে বলেন, জন্ম আমি দিছি। এদের উপর আমার অধিকার নাই নাকি!

কথাটি মা ছুঁড়ে দেন বাতাসে, যার গায়ে লাগে লাগুক।

বাবা টুঁ শব্দ করলেন না। বাড়িতে খাবার পাঠানো বন্ধ করে দিলেন। নানার দোকান থেকে ঠোঙা করে খাবার এনে আমাদের খেতে দেন আর শব্দ ছুঁড়তে থাকেন প্রতিদিন বাতাসে–বিয়া করার খায়েশ হইছে। মেয়েদুইটারে দূর কইরা বিয়া করব। এই শয়তানি আমি বাঁইচা থাকতে হইতে দিব না। বেডা পুইল্যা খেতা লইয়া শহরে আইছিল, আমার বাপে বেডারে টেকা পইসা দিয়া বাচাইছে।

মা হাঁটতে হাঁটতে শব্দ ছোঁড়েন বাতাসে। বাতাসে, দেখে তাই মনে হয়, আসলে ছোঁড়েন বাবার উদ্দেশে। সামনে দাঁড়িয়ে চোখে চোখ রেখে নয়, বাবা যে ঘরে বসে আছেন, তার পাশের ঘর আর বারান্দা থেকে উঁচুস্বরে, এমন উঁচুস্বরে যেন কান খাড়া না করেই বাবা শুনতে পান।

ইস্কুলে যাওয়ার রিক্সা ভাড়া দেওয়াও বন্ধ করে দিলেন বাবা। বন্ধ রইল ইস্কুলে যাওয়া। মা বলেন দেখি কয়দিন লেখাপড়ার খরচ না দিয়া পারে!

মা’র বিশ্বাস এ ব্যাপারে অভিমান বা রাগ দেখিয়ে বেশিদিন থাকা সম্ভব নয় বাবার। তিনদিন ইস্কুলে না যাওয়া লক্ষ করে বাবা শেষ পর্যন্ত নিজেই তাঁর নীরবতা ভাঙেন। ভোরবেলা ঠান্ডা পানিতে গোসল করে কাপড় চোপড় পরে তৈরি হয়ে আমাকে ডেকে গলা কেশে, যেন গলার তলে কফ জমে আছে, বলেন–কি লেখাপড়া করার আর দরকার নাই!

আমি চুপ।

লেখাপড়া করার আমার দরকার আছে কি নেই, তা বাবাই সিদ্ধান্ত নেন। আমার সিদ্ধান্তের কোনও প্রায়োজন হয় না।

যদি দরকার না থাকে, বাবা বলেন চোখ কড়িকাঠে রেখে, তাইলে সোজাসুজি বইলা দেও। আমারও আর চিন্তা করার দরকার নাই। তুমার ভাইয়েরা ত বইলা দিছে আমারে। বইলা দিছে তারা লেখাপড়া করবে না। মাস মাস টাকা পাঠাই নোমানরে, ও কয় এইবার নাকি পরীক্ষা দিব না, দিব পরের বার। আর তুমার আরেক ভাই, তার জীবন ত শেষই। তুমরাও ওই পথে যাইতে চাইলে কও, তাইলে আর টাকা পয়সা খরচা কইরা তুমাদেরে ইস্কুলে পড়ানির কুনো মানে নাই।

আমি উদাস দৃষ্টি ছুঁড়ে দিই উঠোনের বড় হয়ে যাওয়া ঘাসে, শ্যাওলা পড়া কলতলায়, পেয়ারা গাছের ডালে বসে থাকা একটি পাতিকাকের লেজে। বাবার সামনে মুখ খুলে আমার অভ্যেস নেই। যত নির্বাক হই, তত মঙ্গল। যত নিশ্চল হই, তত বাবা নিশ্চিন্ত হন। এরকমই নিয়ম যে, বাবা যা খুশি বলে যাবেন, মাথা নিচু করে, চোখ নামিয়ে তা নিঃশব্দে শুনে যেতে হবে। ইচ্ছে করলে গায়ে হাত বুলিয়ে আদর করবেন অথবা চড় কষাবেন গালে, মাথা পেতে সবই গ্রহণ করতে হবে আমাকে। বাবা এই যে বললেন ছোটদার পথে যেতে চাইলে আমি যেন তাকে বলি, তিনি আমাকে যেতে দেবেন। আসলে এ নেহাতই কথার কথা। যদি সত্যিই বলি আমি ছোটদার মত হতে চাই, ইস্কুলে টিস্কুলে আর যাব না, তিনি কিছুতেই তা হতে দেবেন না, বরং পিটিয়ে পিঠের চামড়া তুলবেন আমার।

— ইস্কুলে যাস না ক্যান! বাবা ড্রাম পেটানো স্বরে বলেন। হঠাৎ এমন বিকট আওয়াজে আমার আপাদমস্তক কেঁপে ওঠে। চোখ নামিয়ে আনি পাতিকাকের লেজ থেকে। প্রশ্নটির উত্তর আসলেই বাবা জানতে চাইছেন, গর্জে উঠে বোঝান। উত্তরটি তিনি জানেন, তবু তাঁর জানা উত্তরটিই তাঁকে আবার নতুন করে জানাতে হবে আমাকে। আমি যে জানি আমার অন্যায়ের জন্য দায়ি তিনি, আমি নই, তা জানাবার জন্য তাঁকে বলি, যতটা স্বর তাঁর সামনে ওঠানো সম্ভব–রিক্সাভাড়া নাই।

— রিক্সাভাড়া নাই ক্যান? মায়ের অস্টকাডি হইছস! তর মায়ে মুখে তুইলা খাওয়াইতাছে। রিক্সাভাড়া যোগাড় করতে পারে না!

দুটো টাকা বাবা ছুঁড়ে দেন আমার মুখের ওপর, টাকা দুটো মেঝেয় উপুড় হয়ে পড়ে। পড়ুক, আমি ভাবি, এ ভাবেই পড়ে থাক। ভাবিই কেবল, আমার ভাবনা থেতো করে দিয়ে বাবা ফুঁসতে থাকেন আমার নির্লিপ্তির দিকে চেয়ে, ঠিকই উবু হয়ে টাকা দুটো তুলি। বাবাকে ছোটদার কাছেই কেবল একবার হেরে যেতে দেখেছি। তিনি এবার হেরেছেন কি না জানি না, তবে নিঃশব্দে নতি স্বীকার করলেন, মেনে নিলেন আমাদের প্রত্যাবর্তন, অবশ্য বুঝতে দিলেন না যে তিনি মেনে নিয়েছেন। তিনি আর চ্যাংদোলা করে আমাদের হোস্টেলে ফেরত পাঠান না। পাঠান না ঠিকই কিন্তু বাড়িটিকে অন্ধকার কারাগার বানিয়ে ফেলেন। রাস্তা দেখা যায় যে জানালাগুলোয় দাঁড়ালে, সেগুলো পাকাপাকি বন্ধ করে দেওয়ার ব্যবস্থা করলেন। গরুগাড়ি ভরে ইট বালু সিমেন্ট কিনে রাজমিস্ত্রি ডেকে বাড়ির চারদিক ঘিরে যে দেয়াল, তা দ্বিগুণ উঁচু করে তুলে দেন জেলের দেয়ালের মত, বাইরের সঙ্গে ভেতরের কোনও যোগাযোগ রইল না। ছাদে ওঠা নিষেধ। ছাদে উঠলে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে নামান ছাদ থেকে। ফের কখনও উঠলে পায়ের টেংরি ভেঙে ফেলবেন বলেন। যে ছাদ আমাদের বৃষ্টিতে ভিজে গান গেয়ে নাচার, মিছিমিছির রান্নাবাড়ির, রেলিংএ হেলান দিয়ে আউট বই পড়ার, দাঁড়িয়ে পাড়ার মানুষদের নাড়ি নক্ষত্র দেখার, চমৎকার জায়গা ছিল, সে ছাদ হয়ে উঠল নিষিদ্ধ। আমার চলাচলের সীমানা আকস্মিক হৃাস পাচ্ছে, বুঝি, কেন, ঠিক বুঝি না। ছাদ থেকে বাইরের জগতখানা আমার অল্প অল্প করে চেনা হয়ে উঠছিল। মিঠে হাওয়ায় ছাদে হাঁটতে হাঁটতে শব্দ এসে ভিড় করত মাথায়, গুঁড়ি গুঁড়ি ঝিরি ঝিরি শব্দ। বৃষ্টির মত। আমি সেই শব্দ দিয়ে মনে মনে মালা গাঁথতাম।

ছাদ নিষিদ্ধ হওয়ার পর ছাদের নেশা আমাকে আরও পেয়ে বসে। বাবা বাড়ি থেকে বেরোলেই দৌড়ে ছাদে উঠি। কালো ফটকে বাবা আসার শব্দ হলে ঝড়ো বাতাসের মত নিচে নেমে নিষ্পাপ শিশুর মত মুখ করে বসে থাকি পড়ার টেবিলে। সীমানা যত ক্ষুদ্র হয় আমার, বাঁধ ভাঙার প্রবল স্পৃহা তত আমাকে উন্মত্ত করে। ভেতরে এবং বাইরে দুটো আদল আমি টের পেতে থাকি আমার। একটি উৎসুক, আরেকটি নিস্পৃহ।

বাবা কেন ওসব করতেন, মাস কয় গেলে বুঝেছি যে বাবার ভয় ছিল আমার না আবার কারও সঙ্গে প্রেম হয়ে যায় আর লেখাপড়া ছেড়ে কোনও বখাটের হাত ধরে আমিও বাড়ি থেকে পালাই। ইস্কুল এবং বাড়ির বাঁধা গন্ডির ভেতরে আমার জীবন আটকা পড়ে রইল। ওই আটকা পড়া জীবনে রতন এসে খুশির স্রোতে আমাকে ভাসিয়েছিল ক’দিন। রতন আসত টাঙ্গাইলের এলেঙ্গা গ্রাম থেকে, দাদার ঘরে ঘুমোত, বিকেলে বসত চোর পুলিশ খেলতে আমাদের নিয়ে। চোর পুলিশ খেলাটি কাগজের খেলা। ছোট ছোট কাগজে চোর, পুলিশ, ডাকাত লিখে ভাঁজ করে ছুঁড়ে দিত, যে কোনও একটি তুলতে হত। পুলিশ লেখা কাগজ তুললে আমাকে অনুমান করে বলতে হত বাকি দুজনের কে চোর অথবা কে ডাকাত। ভুল হলে ঘর ফাটিয়ে বলত ডাব্বা। রতন ডাব্বাই বলত গোল্লা পাওয়াকে। রতন বাবার এক ডাক্তার বন্ধুর ছেলে, তার জন্য বাড়িটির দ্বার বরাবরই অবারিত ছিল, থাকারই কথা, বাবা যখন অর্থকষ্টে ছিলেন, ছিলেন একসময়, আমার জন্মের আগে কখনও, ডাক্তার বন্ধুটি তাঁকে দু’হাত খুলে টাকা দিয়ে বাঁচিয়েছিলেন। আমার চেয়ে বছর দুয়েকের বড় হবে রতন। মুখে দুষ্টু দুষ্টু হাসি নিয়ে চুল উড়িয়ে শার্ট উড়িয়ে সে দৌড়োত সারা বাড়ি, সে ছিল ঘরের লোকের মত অথবা না হলেও অন্তত ভাব করত। বাড়ি এসেই গামছা হাতে নিয়ে চলে যেত গোসলখানায়, গোসল সেরে ফর্সা চেহারাকে দ্বিগুণ ফর্সা বানিয়ে কায়দা করে চুল আঁচড়ে কী খালা কি রানছেন, খেতে দেন বলে রান্নাঘরে ঢুকে যেত। মা আবার রতনের মা বুলবুলকে বড় ভালবাসতেন, রতনকে খেতে বসিয়ে বুলবুল কি এখনও আগের মত দেখতে! জিজ্ঞেস করেন মা, প্রতিবারই করেন, রতন যখনই আসে। বুলবুল দেখতে অসম্ভব সুন্দরী ছিলেন, মা বলেন। মা’কে কারও সৌন্দর্য নিয়ে এত উচ্ছঅজ্ঞসত হতে আর দেখিনি। সেই রতন আমাদের নিয়ে চোর পুলিশ খেলে, লুডু খেলে, তাসের যাদু দেখিয়ে দেখিয়ে আমার ছাদে না উঠতে পারার কষ্টকে খানিকটা কমিয়েছিল। কিন্তু সেবার যাওয়ার দিন একটি ভাঁজ করা কাগজ টেবিলে রেখে মাথায় বরাবরের মত চাটি মেরে বলল–ভাল থাকিস। গেলাম।

রতন তো আর হাঁটে না, তার দুর্বার গতি তাকে উড়িয়ে নেয়। রতন হাওয়া হয়ে গেলে ভাঁজ করা কাগজটি খুলে দেখি চিঠি। লিখেছে, সে আমাকে ভীষণ ভালবাসে। লিখেছে আমি যদি তাকে না ভালবাসি তবে তার জীবন একেবারেই বৃথা। এবার ৮০, আদায় লিখে চিঠি শেষ করেছে। পড়ে আমার বুক দুরুদুরু কাঁপতে লাগল। জিভ গলা শুকিয়ে গেল ভয়ে। ভাঁজ করে হাতের মুঠোয় নিয়ে, হাতের ঘামে ভিজে যাওয়া কাগজ গোসলখানায় গিয়ে আবার খুলি। ভালবাসি শব্দটির দিকে হাভাতের মত তাকিয়ে থাকি। চিঠিটি আমাকে লেখা, ভাবলে গা শিউরে ওঠে। চিঠিটি যখন রতন দিয়েছে, কেউ কি দেখেছে আড়াল থেকে! কেউ দেখলে সব্বনাশ। চিঠিটি কারও হাতে কখনও পড়লে সব্বনাশ। আমার পায়ে পায়ে সব্বনাশ হাঁটে। আমার শ্বাসে শ্বাসে সব্বনাশ। চিঠিটি ছিঁড়ে ফেললে দুর্ভাবনা দূর হবে, কিন্তু ছিঁড়তে আমার ইচ্ছে করে না। থাকুক এটি। থাকুক ইতিহাস বইয়ের ভেতর, বালিশের তলায়, খুব গোপন জায়গায় চিঠিটি বেঁচে থাকুক। দোমড়ানো কাগজটিকে আগলে রাখি ঠিকই কিন্তু রতনের জন্য আমার কোনও ভালবাসা জন্মায় না, জন্মায় কেবল চিঠিটির জন্য।

চিঠিটি বাবা আবিষ্কার করেন অল্প কিছুদিন পরই। তিনি, আমি যখন ইস্কুলে, বাড়িতে আমার বইপত্র ঘেঁটে দেখেছেন লেখাপড়া কি রকম করছি আমি, বইয়ের কত পৃষ্ঠা অবদি পড়ার দাগ আছে, খাতায় কতদূর কি লেখা হয়েছে, অঙ্ক কষার নমুনাই বা কেমন, এসব। ঘাঁটতে গিয়ে চিঠিটি হাতে পড়ে তাঁর। আমাকে তিনি ভাল মন্দ কিছু বলেননি। কেবল টাঙ্গাইলে চিঠি লিখে জানিয়ে দিয়েছেন তাঁর ডাক্তার বন্ধুকে, রতন যেন কোনওদিন তাঁর বাড়ির ধারেকাছে না আসে।

রতন না এলে আমার বয়েই গেল। মনে মনে বলি।

বাবার বন্ধুটি অপমানিত হয়েছেন বলে বন্ধুটির জন্য, যাঁকে কোনওদিন চোখে দেখিনি, মায়া হতে লাগল। নিজেকেও দেখলাম কুণ্ঠিত হতে, যেন সকল অপরাধ আমার। যেন রতন যে আমাকে চিঠি লিখেছে এর সব দায়ভার আমার। সব পাপ আমার।

আমাকে আগলে রাখার নানা গভীর গোপন ষড়যন্ত্রে বাবা যখন ব্যস্ত, তখনই একদিন বাবা চোখে মুখে বিষম উৎকণ্ঠা নিয়ে বলেন–জিনিসপত্রের দাম বাইড়া গেছে, এখন থেইকা একবেলা ভাত, রাত্রে রুটি খাইতে হবে সবার।

রুটি? ভাতের বদলে? বাবা এ আবার নতুন কি তামাশা শুরু করলেন! মা গলায় ঝাঁজ মিশিয়ে বলেন–বিয়া করছে বুধয়, বউ খাওয়ানি লাগতাছে। এইদিকে শাতাইয়া ওই দিকে খাওয়াইব।

মা মনে হয় ভুল বোঝেন। রাস্তায় শয়ে শয়ে ভিখিরিদের হাঁটতে দেখে রিক্সাঅলাদের বলতে শুনি শহরে বানের পানির লাহান মানুষ আসতাছে গেরাম উজাড় কইরা, ফসল নাই, খাওন নাই। রিক্সার ভেতরে বসে অবাক তাকিয়ে থাকি উন্মূল উদ্বাস্তুদের দিকে। হাতে বাসন ওদের। শুকনো বাসন। দৌড়োচ্ছে গাঙিনার পাড় থেকে নতুন বাজারের দিকে। ভিখিরিদের চোখ বেরিয়ে আসছে কোটর থেকে, বুকের হাড়গুলো যেন চামড়া ফুঁড়ে বেরোবে, পেট মিশে যাচ্ছে পিঠে, যেন কঙ্কালের কাফেলা যাচ্ছে, কাফেলা থেকে পিছিয়ে পড়ে কেউ ধুঁকছে নর্দমার সামনে, কেউ ভাত ভাত বলে চেঁচাচ্ছে বড় বড় বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে। আমাদের কালো ফটকের সামনে দাঁড়িয়েও ওরা একমুঠো ভাত চায়। পান্তা হোক, পচা হোক, একমুঠো ভাত।

দেখে, ইস্কুল ফেরা ভরপেট আমি দৌড়ে যাই ভিক্ষে আনতে, দু’মুঠ করে চালই তো। দেখি চালের ড্রামে তালা ঝুলছে। বাবর তালা। বড় শক্ত তালা।

মা ভাত দেও, ভিক্ষা চাইতাছে মানুষ, ওরা মনে হয় অনেকদিন খায় না। প্রচন্ড উৎকণ্ঠায় আমি নামাজে ডুবে থাকা মা’কে বলি।

মা মোনাজাত শেষ করে সালাম ফিরিয়ে হাতে চুমু খেয়ে জায়নামাজ গুটিয়ে শুকনো মুখে বলেন, ভাত নাই।

ভিখিরিদের মা কখনও ফেরাননি আগে। দু’মুঠো করে চাল দেওয়ার নিয়ম বরাবরই এ বাড়িতে ছিল। বাড়তি ভাত ফেলে দেওয়া হয় পাতিল পাতিল, গরমে ভাত পচে যায় বলে এক রাতেই। মাঝে মাঝে ভিখিরিদের পান্তা খাওয়ানো হত। এখন পান্তাও নেই। দুপুরে থালার ভাত শেষ করে আঙুল চুষতে চুষতে বলেছিলাম–মা আরেকটু ভাত দেও।

যে আমাকে জোর করে ভাত খাওয়ানো হত, খেতে অরুচি হত, গল্প বলে বলে, থালের কিনারে মাছ মাখা ভাত নলা বানিয়ে মালার মত রেখে মা বলতেন, এইটা হইল বাঘ, এইটা সিংহ, এইটা হাতি, এইটা ভালুক–এইতো ভালুক টারে গিলে ফেল দেখি মা আমার, ওয়াও। ভালুক ভয় পাচ্ছে তোমাকে দেকে। এইবার হাতিটাকে খাও। গল্পের মজায় খেতাম। মা’র কত রকম কায়দা ছিল আমাকে খাওয়ানোর। মন দিয়ে পড়ছি হঠাৎ হা কর ত হা কর খুব মজার জিনিস বলে মুখে ঢকিয়ে দিতেন খাবার। পড়তে পড়তে হঠাৎ খেয়াল হলে যে আমাকে খাওয়াচ্ছেন অমনি আর না, সর সর, বলে মা’কে সরিয়ে দিয়েছি। মা আমাকে খাওয়াবেনই। আম, আনারস, তরমুজ কেটে থালে কাটা চামচ দিয়ে রেখে যান টেবিলে, যেন পড়তে পড়তে খাই। ভাত পাতে রেখে উঠে যাওয়া ছিল আমার চিরকালের স্বভাব। সেই আমি আঙুল চেটে ভাত খেয়ে বসে থাকি ১৯৭৪এ, মা বলেন– ভাত নাই আর।

আমরা কি গরিব হয়ে গেলাম হঠাৎ?

ভাত চাইলে ভাত দেওয়া হয় না, এ এক আজব ঘটনা, অন্তত এ বাড়িতে। ভিখিরিদের ভিক্ষে দেওয়া হয় না, এ ই বা কেন!

বাবা রুটি খান দু’বেলা। মাও। কাজের লোকের জন্যও রুটি। ভাত ফোটে কেবল দু’মেয়ের জন্য। ড্রামের চাল ফুরোচ্ছে।

বাবা কপালের দু’পাশের শিরা চেপে বলেন–দেশে দুর্ভিক্ষ।

রাস্তায় ভিক্ষুক বাড়তেই থাকে। ঘরে ঘরে গিয়ে ভাতের বদলে ফ্যান চায়।

একদিন আস্ত একটি জীবন্ত কঙ্কাল এসে দাঁড়াল দরজায়। বয়স বড়জোর সাত কী আট হবে ছেলেটির, দেখে আমি চোখ সরিয়ে নিয়েছিলাম। ছেলেটি কিছু চাইতে পারল না, ফ্যান কিংবা কিছু। গলা দিয়ে কোনও স্বর বেরোচ্ছিল না ওর। আমি মা’কে ডেকে শিগরি কিছু খাবার দিতে বলি, যা হোক কিছু, আমার ভাগেরটুকু, আমি না হয় না খাব। মা ছেলেটিকে ভাত খেতে দিলেন। হাড়ের হাতখানা তুলে ছেলেটি মুখে পুরছিল ভাত। আমরা, না খেতে পেয়ে প্রায় মরতে বসা ছেলেটির গিলতে কষ্ট হচ্ছিল ভাত, দেখছিলাম। অভাব দেখেছি মানুষের, কিন্তু ভাতের অভাবে কাউকে কঙ্কাল হতে দেখিনি। মনে হচ্ছিল কিছু না খেতে খেতে ওর গলার ছিদ্র বুঝি বুজে এসেছে। এত ভাত তরকারি ফেলে দেওয়া হয়, বেড়াল কুকুর খায়, কাকের দল খায়। আর মানুষ মরছে না খেতে পেয়ে!

মা রাতে রুটি চিবোতে চিবোতে বললেন–আমি ছুটু থাকতে একবার দুর্ভিক্ষ হইছিল, উড়োজাহাজ থেইকা ছাতু ফেলত, দৌড়াইয়া গিয়া ছাতু টুকাইয়া আইনা খাইতাম। ভাত পাই নাই।

বাবাও তাঁর খোলস থেকে বেরিয়ে এসে বলেন–ভাত খাইবা কি কইরা। চাল ছিল না ত। মানষের হাতে টাকা ছিল, কিন্তু বাজারে চাল নাই। লক্ষ লক্ষ মানুষ মারা গেছে না খাইতে পাইয়া। কলিকাতার রাস্তায় শুনছি লাশের উপর লাশ। কলাগাছের ভিতরে যে শাদা অংশটা থাকে, ওইটা খাইয়া বাইচা থাকছি। আমাদের গেরামের কত লোক নিজের মেয়েরে বেইচা দিছে, জামাই বউরে বেইচা দিছে, কেবল দুইটা ভাতের জন্য।

— কি জানি, এই দুর্ভিক্ষও পঞ্চাশের সেই মন্বন্তরের মত হয় কি না। বাবা দীর্ঘশ্বাস ফেলেন।

ঘরের চাল শেষ হয়ে গেলে কী হবে! আর কি আমরা ভাত পাব না! না খেয়ে খেয়ে ইসরাইলের মত কঙ্কাল হতে হবে আমাদের! ভেবে পেটের ভেতর হাত পা সেঁধিয়ে যায় আমার। এরকম হয়েছিল আল্লাহ দুনিয়াতে মানুষের ঈমান পরীক্ষা করার জন্য দজ্জাল পাঠাচ্ছেন বলে যখন খবর ছড়াল পীর বাড়ির লোকেরা। ভয়ংকর দেখতে দজ্জাল বিশাল রামদা দিয়ে তাদের, যাদের বিশ্বাস নেই আল্লাহর ওপর, গলা কাটবে। চোখ বুজলেই তখন চোখের সামনে ভাসত দজ্জাল তার কুৎসিত দাঁত মেলে পাহাড়ের মত উলঙ্গ শরীরখানা নিয়ে দাঁড়িয়ে রামদায়ের পোচ দিচ্ছে গলায়, গা কেটে পাঁচ টুকরো করছে, রক্তে ভেসে যাচ্ছে বাড়ির উঠোন, আমি চিৎকার করছি বাবা গো মা গো বলে। আমি মরে যাচ্ছি আর হো হো করে হাসছে দজ্জাল। আমি তখন চোখ বুজে সমস্ত শক্তি খাটিয়ে শরীর খিঁচিয়ে ঈমান আনতে চাইতাম। ঈমান, মা বলেছেন, আল্লাহ এক এবং অদ্বিতীয়, মুহম্মদ আল্লাহর রসুল, এ কথাটি কেবল বিশ্বাস করা। আমি ঈমান আনতে বাক্যটি বার বার আওড়াতাম। বিশ্বাস ব্যাপারটি তখন আমার কাছে খানিকটা রহস্যময়। মা যা বলেন তাই আমাকে বিশ্বাস করতে হয়। না দেখেও। না বুঝেও। জিন ভূত বিশ্বাস করার মত। অথবা ফটিং টিং, পায়ে কথা বলছে, তিনটে মাথা কাটা, যা আমি কখনও দেখিনি, কেবল শুনেছি, বিশ্বাস করা। ফটিং টিংএর ওপর ঈমান আনতে বললে আমাকে জপতে হত ফটিং টিং ফটিং টিং ফটিং টিং, যদি ফটিং টিংএর দজ্জাল পাঠিয়ে মানুষের গলা কাটার ক্ষমতা থাকত। মা বলেছিলেন যা তর নানির ঘরে শুইতে যা। তর মামারা তরে কত আদর করে। শরাফ মামা জোর করে আমাকে ন্যাংটো করেছিল, ব্যাপারটিকে আদর বলে আমার বিশ্বাস হয় নি। মা যা বলেন তা আমাকে বিশ্বাস করতে হয় বলেই সম্ভবত করা, আল্লাহ রসুল, জিন ভূত। আমাকে যদি অধিকার দেওয়া হত বিশ্বাসের, আমার ঠিক বিশ্বাস হয় না যা আমাকে বিশ্বাস করতে বলা হচ্ছে তা করতাম। ইস্কুলে বিশ্বাস করতে বলা হচ্ছে বাতাসে গ্যাস আছে। আমাকে করতে হয়। মাঝে মাঝে মনে হয় চোখে না দেখা জিনিসগুলো আসলে আমি চাপে পড়ে বিশ্বাস করছি। কেউ যদি ধমকে বলে একখানা ঘোড়া দেখ উড়ছে আকাশে। আমি সম্ভবত তাই দেখব। দুর্ভিক্ষের কঙ্কাল দেখছি নিজের আসন্ন শরীরে।

মা বলেন–এই যে তগোরে কত কই ভাত ফালাইছ না। ভাতের একটা দানা মাটিত ফেললে আল্লাহ বেজার হন। ভাতের দাম কি এহন দেখলিা! ভাত না পাইয়া মানুষ মরতাছে।

সোফার হাতলে কনুই রেখে গালে হাত দিয়ে বসে থাকেন মা ড্ডনা জানি আমার ছেলে দুইটা উপাস করতাছে।

— নোমানরে নিয়মিত টাকা পাঠাইতাছি, চিন্তা কইর না। বাবা সান্ত্বনা দেন। মা আসলে ভাবেন ছোটদার কথা। ছোটদাকে তো কেউ টাকা পাঠায় না। ছোটদা কোথায় আছেন, কেমন আছেন কেউ আমরা জানি না। মা তাঁর হারানো ছেলের জন্য ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠেন। বাবা অনেক রাত হইছে, যাও যাও ঘুমাইতে যাও বাক্যটি ছুঁড়ে দিয়ে নিজে শোবার ঘরে চলে যান।

রাত পোহালেই ভিড় কালো ফটকে। মা ভাতের ফ্যান জমিয়ে রেখে ওদের বিলোন। বিকেলে ইসরাইল এসে দাঁড়ায় দরজায়, তাকে ভাত দেওয়া হয় খেতে।

মিছিল যায় অন্ন চাই বস্ত্র চাই বাঁচার মত বাঁচার মত বাঁচতে চাই বলে।

কমুনিস্ট পার্টির মিছিল গান গেয়ে বাড়ি বাড়ি ঢুকে লাল কাপড় মেলে ধরছে — চাল দেন, গরিবরা মরছে। ওদের বাঁচান।

মিছিল আমাদের বাড়িতেও ঢোকে। মিছিলের লোকের মাথায় লাল কাপড় বাঁধা। আমাকে মিছিলের একজন বলে–যাও বাড়ির বড় কাউকে ডাক দাও। চাল দিতে বল। রোমকূপ দাঁড়িয়ে যায় আমার। আমি দৌড়ে গিয়ে মা’কে বলি–মা চাল দেও। লোক আইছে। চাল দিতেই হইব।

মা রুখে ওঠেন।– চাল চাইলেই চাল দিতে হইব নাকি! তরা খাইবি কি!

— অনেক লোকে চাল দিছে, কাপড়ের মধ্যে অনেক চাল, দেইখা যাও। তুমারে ডাকতাছে। হাত ধরে টানি মা’র।

মা দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে ওদের বলেন–কি চান?

যুবকের দল থেকে একজন এগিয়ে এসে বলে–চাল চাই মা চাল চাই। মানুষ মারা যাচ্ছে না খাইতে পাইয়া। তাই আমরা ছাত্ররা, চাল নিতাছি বাড়ি বাড়ি ঘুইরা, এইসব গরিবদের দেওয়া হবে খাইতে। চাল দেন। যেটুকু পারেন, সেটুকুই দেন।

বাকি যুবকেরা সমস্বরে বলে ওঠে–কেউ খাবে তো কেউ খাবে না, তা হবে না।

উত্তেজনায় আমি কাঁপছি তখন। মা’কে খোঁচা দিয়ে বলি–চাল দেও মা, তালা ভাইঙা চাল বার কর।

— তর বাবা মাইরা ফেলবে। মা গলা চেপে বলেন।

— মারুক মা, মারুক। তবু চাল দেও। চল তালা ভাঙি। আমি বেপরোয়া।

এত লোক মাঠে জমা হয়েছে দেখে মা খানিকটা ঘাবড়ে যান। বলেন–তর বাবারে একটা খবর দেওয়া গেলে ভাল অইত। এদেরে এহন আমি সামলাই কেমনে।

কালো ফটক হাঁ করে খোলা। পাড়ার ছেলেরা ভিড় করেছে দেখতে ফটকের বাইরে। মা ইতস্তত করেন কোনও কিছুর উদ্যোগ নিতে। উত্তেজিত আমি উঠোন থেকে আধখানা ইট এনে ড্রামে লাগানো তালার ওপর ধরাম করে মারি। তিন ধরাম, চার ধরাম। তালা ভাঙে। বাবর তালা। বড় শক্ত তালা।

অর্ধেক ড্রাম অবদি চাল। গামছা ভরে চাল তুলে দৌড়ে যাই মাঠে। মা হতবাক দাঁড়িয়ে আমার কান্ড দেখেন।

চাল নিয়ে গান গাইতে গাইতে ছেলের দল চলে যায়। মুগ্ধ চোখে মিছিলের দিকে তাকিয়ে থেকে অনুভব করি অসম্ভব এক অমল আনন্দ। ভেতর থেকে মাথা ফুঁড়ে বেরিয়ে আসতে থাকে এক উদ্ধত আমি, অনড় অটল আমি। বিষম সাহসী আমি। স্বপ্নবান আমি। এই আমাকে, আমি নিজেই আপাদমস্তক দেখি আর বিস্মিত হই। এ কি সত্যিকার আমি, নাকি হঠাৎ বিকেলে যুবকের দল দেখে বিহ্বল হওয়া উঠতি উৎসুক কিশোরী মাত্র!

মা ফ্যাকাসে মুখে খোলা ফটকের সিটকিনি বন্ধ করে আসেন ভেতর থেকে ।

তর বাবা, মা বলেন, তরে আইজকা আর আস্ত রাখত না।

আমি হেসে বলি–বাবার মাইর ত প্রত্যেকদিনই প্রায় খাইতে হয়। এইটা কি নতুন কিছু!

মা বলেছিলেন কমুনিস্টরা খারাপ। ওরা খারাপ হলে গরিবদের জন্য ওরা চাল যোগাড় করছে কেন! এ তো অন্যায় নয় গরিবকে মরণ থেকে বাঁচানো। ওরা আল্লাহ মানে না, কিন্তু ওরা তো কোনও পাপ করছে না বরং পীড়িত মানুষের ওরা শুশ্রুষা করছে। ইসরাইলের মত কত মানুষ যারা রাস্তায় ধুঁকছে ক্ষিধেয়, তাদের মুখে খাবার দিতে চাইছে। আমার ইচ্ছে করে ওদের দলে ভিড়ে আমিও গান গেয়ে চাল যোগাড় করি। আমার ইচ্ছে করে নিজে না খেয়ে থাকি, যতদিন না দূর্ভিক্ষ দূর হচ্ছে। কিন্তু আমার ইচ্ছেয় কিছু হবার নয়। চাইলেই সীমানা ডিঙোতে পারি না। আমাকে আপাতত অপেক্ষা করতে হয় বাবার চাবুক খাবার। ছোটদার জন্য কেনা চাবুকটি বাবার বিছানার তোষকের তলে এখনও রাখা।

বাবা বাড়ি ফিরে চালের ড্রামে চোখ ফেলেন, যা ফেলবেনই বলে আমার অনুমান ছিল। ভাঙা তালাটি ঝুলে থাকে ড্রামের গায়ে, বাবা যা হাতে নেবেন বলে অনুমান ছিল আমার। অনুমান ছিল ক্রুদ্ধ বাঘের মত বাবা সারা বাড়ি গর্জাবেন। বাবা তাই করেন। আমি শ্বাস বন্ধ করে বসে থাকি ঘরে। আশংকা করি বাবা তোষকের তল থেকে চাবুক খানা নিচ্ছেন হাতে, যেটি এক্ষুণি আমাকে রক্তাক্ত করবে। পিঠে অনুভব করতে থাকি যন্ত্রণা। ধনুকের মত বাঁকতে থাকে পিঠ। শিড়দাঁড়ায় তীব্র বাথা, যে ব্যথা আমার অচিরে হবে, তা আমি আগেই অনুভব করতে থাকি। বাবার হুংকারে বাড়ি কাঁপে। হিম হয়ে থাকে শরীর। কোটরে কোনও চোখ নয়, দুটো পাথর কেবল, সামনে এক ঘর অন্ধকার ছাড়া কিছু নেই। পালকের মত উড়ে যাচ্ছি কোথাও আমি, কোথায়, জানি না। রাজবাড়ি ইস্কুলের আঙিনায় মীরাবাঈএর শাদা মূর্তির মত নগ্ন হয়ে যাচ্ছি। আমি নিজেই নিজেকে নগ্ন করছি। আমার কোনও আত্মীয় নেই, বন্ধু নেই, একা আমি। এই জগত সংসার আমার জন্য নয়। আমি নির্বাণ লাভ করছি।

মুহূর্তে নিথর হয়ে যায় সারা বাড়ি, যেন এ বাড়িতে কখনও কেউ ছিল না, থাকে না। যে যার গুহায় গিয়ে সম্ভবত লুকিয়েছে হুংকার শুনে। আমি অপেক্ষা করতে থাকি আমার ডাক পড়ার পুলসেরাতের পুল পার হতে, কতখানি পাপ আমি করেছি তা প্রমাণ হবে আজ। আমার বিশ্বাস হতে থাকে আমি পাপ করিনি। এই প্রথম একটি বিশ্বাস আমি নিজে নির্মাণ করি। নিজের ওপর ঈমান আনতে থাকি ধনুকের মত বাঁকানো শরীরকে সিধে শক্ত করতে করতে। আওড়াতে থাকি যা বলব, বইয়ে লেখা ক্ষুধার্তদের খাবার দাও। তাই যখন লোকেরা আইসা চাল চাইল, আমি দিলাম।

মা, আমি স্পষ্ট শুনি, বলছেন–চিল্লাও কেন, আস্তে কথা কইলেই ত হয়। ড্রামের তালা আমি ভাঙছি। মেয়েরা ক্ষিদায় কানতেছিল, তাই।

— ক্ষিদায় কানব ক্যান। দুপুরে ভাত রান্ধো নাই! খায় নাই! বাবা বলেন।

মা রান্নাঘরের বারান্দা থেকে সরু গলায় বলেন–ওই ভাতে ওদের হয় নাই। মাইপা চাল দিয়া গেছ দুই মেয়ের লাইগা খালি, আমার ভাত খাইতে ইচ্ছা হইছিল, খালি রুটি খাইয়া মানুষ পারে! তাই আমি খাইয়া নিছিলাম ওদের ভাগের থেইকা।

— কত বড় সাহস তুমার তালা ভাঙছ। আমারে খবর দিলা না ক্যা! বাবার গলার স্বর তখনও নামেনি।

–কেমনে দিয়াম! বাড়িত কেউ আছে যে খবর পাঠানি যাইব! মা কণ্ঠে খানিকটা রাগ মিশিয়ে বলেন।

বাবার গর্জন থামে। আচমকা থামে।

নিথর বাড়িখানা যেন আড়মোড়া ভেঙে জাগে এখন। বেরিয়ে আসতে থাকে গুহাবাসিরা, আলোয়। থাল বাসনের শব্দ হয় রান্নাঘরে। মা’র পায়ের শব্দ বারান্দায়। থপথপ। থপথপ।

বাবা চলে গেলে বাইরে, মা বেল গাছের তল ধরে হেঁটে কালো ফটকের দিকে হাঁটেন। বোরখার তলে মা’র ফুলে ওঠা পেট।

এরকম প্রায়ই হচ্ছে। বোরখার নিচে ফুলে ওঠা পেট আর বেল গাছের তলে মা’র হাওয়া হয়ে যাওয়া। মা’র পেছনে ছায়ার মত হেঁটে দেখি মা কালো ফটক নিঃশব্দে খুলে রিক্সা চড়ে মোড় নিচ্ছেন বাঁয়ে। পীর বাড়ির রাস্তা ডানে, নানিবাড়িও ডানে। তবে বাঁয়ে আবার কোন বাড়ি!

–মা কই যাও তুমি! রিক্সা তুমারে নিয়া বাম দিকে যায়। বাম দিকে আবার কার বাড়ি! মা বাড়ি ফিরলে চোখ সরু করে বলি।

মা ঠোঁটে বিরক্তির কাঁপন তুলে বলেন–নিজের কাম কর। এত কথা কইস না। মা’র এই স্বভাব, প্রশ্ন পছন্দ না হলে রাগ করেন, সে যেমন তেমন রাগ নয়। একবার আমার গালে এমন ওজনদার চড় মেরেছিলেন পীরের বাড়িত সেইদিন পুটলা ভইরা কি দিয়া আইছ? জিজ্ঞেস করেছিলাম বলে, যে, মাথা ঘুরে আমি থুবড়ে পড়েছি জানালার লোহায়।

বাড়ির বাঁ রাস্তা ধরে কোন বাড়িতে যান মা তা সেদিন আমাকে বলেননি। ক’টা দিন গেলেই কিন্তু জিজ্ঞেস করেন, যাইবি দেখতে আমি কই যাই!

আমি লাফিয়ে উঠে বলি– হ।

মা আমাকে নিয়ে হেঁটে রওনা হন দেখাতে। হাঁটতে হাঁটতে গোলপুকুর পার পেরিয়ে মৃত্যুঞ্জয় ইস্কুলের সামনে এক গলি, সেই গলিতে এক বস্তি, সেই বস্তির এক ছ’ফুট বাই ছ’ফুট বেড়ার ঘর, ঢুকি দেখি বসে আছে ছোটদা আর গীতা মিত্র। মা বোরখার তল থেকে ক’টি কৌটো বার করলেন। বড় কৌটোটিতে চাল।

আমি থ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকি দৃশ্য দেখে।

–খবরদার এই কথা কুনো কাক পক্ষীও যেন না জানে। মা চোখ রাঙিয়ে বলেন। ঢোঁক গিলে বলি– আমি কাউরে কইতাম না।

–আফরোজা, রান্ধো। ঘরে ডাইল আছে ত, না! মা কৌটোগুলো গুছিয়ে রাখতে রাখতে বলেন।

–আফরোজা কার নাম! জিজ্ঞেস করি।

–ও মুসলমান হইছে ত। নাম আফরোজা। মা বেশ উচ্ছসিত গলায় বলেন।

ছোট্ট চৌকিতে আফরোজা বসে ছিল মাথায় ঘোমটা পরে। ছোটদা শুকনো মুখে তার পাশে। ঘরে ওই চৌকিটি ছাড়া আছে মাটির মেঝেতে একটি মাটির চুলো আর দু’তিনটে বাসন কোসন।

কোথায় সেই টেরি কাটা, শিস বাজানো বেলবটম যুবক! মুখ-শুকনো ছোটদাকে দেখে বিষম মায়া হয় আমার! এক জীর্ণ কুড়েঘরে দিন কাটাচ্ছেন! নিজেকে বড় অপরাধী মনে হয়, যে, তাঁকে যখন নির্যাতন সইতে হয়েছিল, হাত পা গুটিয়ে কেঁচোর মত বসেছিলাম। মুখখানাও সেলাই করে। আজকাল শেকলে বেঁধে মানুষ মানুষকে মারে! এক বাবাই পারেন এসব। ছোটদার জন্য কেউই কিছু করতে পারিনি কেবল আড়ালে চোখের জল ফেলা ছাড়া!

–ছোটদা, তুমার অনেকগুলা চিঠি আইছে।

চুলোয় আগুন ধরাতে ধরাতে ছোটদা বলেন–হুম।

— কটন দা দেখি সেইদিন বাসার সামনে দিয়া যাইতাছে। জিগাস করল কামাল কই। আমি কিছু কই নাই। গলার স্বর খানিকটা বাড়িয়ে এবার।

কোনও কথা না বলে ছোটদা চুলোয় পাতিল বসান। পাতিলে পানি ফোটে। অনভ্যস্ত হাতে চুলোয় খড়ি ঠেলেন তিনি। এরকম দৃশ্য সম্পূর্ণ নতুন আমার কাছে। ছোটদার, লক্ষ করি, কোনও আগ্রহ নেই গিটারের মাস্টার কটনদা বা তাঁর কাছে আসা চিঠিপত্তরের জন্য। তিনি, আমার ধারণা হয়, বদলে গেছেন এ ক’মাসে অনেক। মা’র কৌটোগুলো খুলে খুলে ঝুঁকে দেখছেন কী ওতে, চাল তেল, মশলা, রান্না করা মুরগির মাংস, দেখে দু’ঠোঁট চেপে আনন্দ আড়াল করে চুলোয় খড়ি ঠেলেন যেন খড়ি ঠেলার চেয়ে জরুরি কোনও কাজ জগতে আপাতত নেই। সম্ভবত খুব ক্ষিধে পেয়েছে ছোটদার। আগেও তো তাঁর ক্ষিধে পেত, তবু খাওয়ায় বড় অনিয়ম করতেন। সারা শহরে গুলতানি মেরে এসে বাড়া ভাত টেবিলে ফেলে আড্ডা পেটাতেন।

আমি অপলক তাকিয়ে থাকি ছোটদার লাজুক চোখের দিকে। কতদিন পর ছোটদাকে দেখছি। ভালবাসার জন্য অষ্টম এডওয়ার্ড সিংহাসন ছেড়েছিলেন, ছোটদা অনেকটা তাই, পুরু গদি য়েচ্ছায় ছেড়ে ধুলোয় বিছানা পেতেছেন। ওদের ভালবাসার কুটিরখানাও, আমার বিশ্বাস জন্মে, ঐশ্বর্য্য ঠাসা। জাগতিক কোনও বিষয়াদিতে না হোক, অন্য কিছুতে। সে অন্য কিছুর ঠিক ব্যাখ্যা হয় না, অনুভব করতে হয় কেবল। বিষয় বাসনা বিসর্জন দিতে যে কেউ পারে না। খুব কম লোকের পক্ষে সম্ভব বৈরাগ্য বরণ করা। ছোটদা ডলি পালকে চিঠি লিখেছিলেন তিনি নাকি ওকে নিয়ে গাছের তলে জীবন কাটাতে পারবেন। একই কথা গীতা মিত্রকেও লিখেছিলেন বত্রিশ পৃষ্ঠার এক চিঠিতে। কুড়েঘরে জীবন কাটানো অনেকটা গাছের তলায় জীবন কাটানোর মতই। ছোটদা পারেনও ঝুঁকি নিতে! বিত্ত বৈভব তোয়াক্কা করেন না। সব বাঁধন ছুটে এখন মুক্ত এক মানুষ তিনি, কেউ তাঁকে এখন শাসন বা শোষণ কিছুই করছে না, বলে দিচ্ছে না কখন ঘরে ফিরতে হবে, কখন পড়তে বসতে হবে, কিছু। আমারও মুক্তি পেতে ইচ্ছে করে শেকল ভেঙে। অদৃশ্য এক শেকল অনুভব করি আমার সারা গায়ে। ছোটদাকে বাঁধা শেকলটির মত শেকল।

মা’র সঙ্গে গোপন যোগাযোগটি হওয়ার পর ছোটদা, দুপুরে বাবা যখন হাসপাতালে থাকেন, চুপচুপ করে বাড়িতে আসেন, পেছনে গীতা মিত্র ঘোমটা মাথায় পা টিপে টিপে। মা তাঁদের ঘরে ঢুকিয়ে, দরজার খিল এঁটে যেন কাক পক্ষি না দেখে, খেতে দেন, যাওয়ার সময় থলে ভরে চাল ডাল তেল নুন দিয়ে দেন সঙ্গে। আমরা দু’বোন কান খোলা রাখি বাবার আসার কোনও শব্দ হয় কিনা, হঠাৎ আসার। ছোটদা ঘরে ঘরে বেড়ালের মত হাঁটেন আর রেডিও, ঘড়ি, গান শোনার যন্ত্র নেড়ে চেড়ে বলেন এইটা আমার দরকার আর কি যেন খোঁজেন সারা ঘরে। তোষকের তলে, আলমারির ড্রয়ারে, বই রাখার তাকে। ছোটদাকে এমন দেখায় যেন তিনি নতুন এসেছেন এ বাড়িতে। অপার বিস্ময় চোখে জিনিসপত্র হাতড়ান। ছোটদাকে বাড়িতে হাঁটাচলা করতে দেখে আমার চোখ জুড়িয়ে যায়, ইচ্ছে হয় তিনি আগের মত এখানে থাকুন, আগের মত টেবিলের ওপর মাথা রেখে ঘুমোন, লালায় ভরে যাক বইয়ের পাতা, উঠোনের রোদে কাঠের পিঁড়িতে দাঁড়িয়ে ধুন্দলের ছুবলায় গা মেজে গোসল করুন। আবার সেই আগের মত হাওয়ায় উড়িয়ে চুল, কাঁধে গিটার, শিস বাজাতে বাজাতে দরজার কড়া নাড়ুন রাতে, প্রতি রাতে।

ছোটদা তাঁর গিটার, জামা কাপড়, টিনের ট্রাংক ধীরে ধীরে সব সরাতে লাগলেন। দেখি একদিন রেডিও নেই ঘরে, আরেকদিন দেয়ালের ঘড়িটি নেই। লক্ষ করিনি, এমন ভাব করি। রেডিও যে টেবিলে ছিল, সেখানে খামোকা পুরোনো বই খাতা পত্রিকার স্তূপ করে রাখি, যেন কারও নজরে না পড়ে খালি টেবিল। দেয়ালে টাঙিয়ে রাখি রঙিন ক্যালেন্ডার। ইয়াসমিন ভাব করে তারও চোখে পড়ছে না বাড়ি থেকে কিছু কিছু জিনিস নেই হয়ে যাচ্ছে। মা সময় জিজ্ঞেস করেন এভাবে–দেখ ত তর হাতঘড়িতে কয়টা বাজে! ইচ্ছে করেই দেয়াল ঘড়িতে সময় দেখার অভ্যেসটি তিনি তুলে রাখেন কোথাও। তিনটে প্রাণী আমরা বাড়িতে অন্ধের অভিনয় করে যাই, কেউ কাউকে প্রশ্ন করি না কোনও আর মনে মনে আশা করি বাবা যেন খবর শুনতে রেডিও না খোঁজেন, আর সময় দেখতে চোখ না ফেলেন দেয়ালে। বাড়িতে ছিঁচকে চোর এসে এটা সেটা নিয়ে যেতে পারে, এরকম একটি আশংকা আমি প্রকাশ করব যে কোনও খোঁজাখুঁজির বেলায়, ভেবে রাখি। আমার ধারণা হয় মা এবং ইয়াসমিনের মনও এরকম কোনও উত্তর সাজাচ্ছে। ইস্কুল থেকে বিকেলে ফিরে যেদিন দেখি সোফার ঢাকনা দিয়ে ছোটদা বড় রেকর্ড প্লেয়ারটি জড়াচ্ছেন, আমি যেন দেখিনি তিনি কি করছেন, চোখ ফিরিয়ে নিয়ে গুন গুন করে অন্যমন যেন, ক্যালেন্ডারের তারিখ দেখতে থাকি। মা চকিতে ঘরে ঢুকে চাপা গলায় বলেন ছোটদাকে –এইটা নিস না, তর বাবা রাইগা আগুন হইয়া যাইব।

–এইটা ঠিকমত বাজে না। সারাই করতে হইব। মেকানিকের কাছে নিয়া যাই। ছোটদা পাথর ভাঙা গলায় বলেন।

অনুতাপ এবং মায়া দুটোই যদি গ্রাস করে থাকে তোমাকে, তবে তুমি অভিমান করতে পারো, ক্রুদ্ধ হতে পারো না, আমার এরকমই ধারণা হয়। আমি মা কিংবা ইয়াসমিন শেষ অবদি বাধা দিতে পারি না, ছোটদা রেকর্ড প্লেয়ারটি মেইড ইন জার্মানি, উঠিয়ে নিয়ে চলে গেলেন, নুয়ে, ঝুঁকে।

দিন যায়, সারাই কিছুরই হয় না। জিনিসপত্র কিছু আর ফেরত আসে না বাড়িতে। না আসুক, এখন শখের জিনিস সরিয়ে যদি তাঁর তৃপ্তি হয়, না হয় হোক। আমাদেরও খানিকটা প্রায়শ্চিত্ত হোক।

একদিন অসময়ে বাবা বাড়ি আসেন, যে আশংকাটি আমি অনেকদিন করছিলাম। আমার সারা শরীর হিমে জমে থাকে। বাবার পায়ের শব্দ শুনে ওঁরা সেঁধিয়ে যায় হাতের কাছে একটি ঘরে। ভেতর থেকে দরজা বন্ধের আওয়াজটি কানে বোম ফাটার মত লাগে। এই বুঝি বাবার কানে গেল কোনও অচেনা শব্দ। বাবা সেই শব্দের সুতো ধরে কতদূর যাবেন কে জানে। আমার জমে থাকা শরীরটি অবশ হতে থাকে। মা বন্ধ দরজার পাশে এমন ভঙিতে দাঁড়িয়ে কথা বলেন যে তিনিই নিতান্ত প্রয়োজনে দরজাটি ভেজিয়ে রেখেছেন, কেউ নেই ঘরে, কারও থাকার কথা নয়। মা’র কথাগুলো নিরর্থক, যেমন হাত মুখ ধইয়া খাইতে বইলি না এহনও! যদিও আমি ইস্কুল থেকে ফিরে খাওয়া দাওয়া সেরে অনেক আগেই বসে আছি। আমার মাগরেবের নামাজের সময় গেল গা। যদিও তখনও বিকেল ফুরোয়নি। বাবা অসময়ে বাড়ি এসে অন্যদিন কে কি করছে তাই দেখেন , আমরা পড়াশুনা করছি কি না, ছাদে কারও পায়ের শব্দ পাওয়া যাচ্ছে কি না, জানলাদরজা সব সাঁটা আছে কি না, সব ঠিকঠাক দেখলে আমার পড়ার টেবিলের কাছে দাঁড়িয়ে নানা মনীষীর বাণী আওড়ে চলে যান রোগি দেখতে। সেদিন যেন তিনি অযথাই লম্বা সময় কাটাচ্ছেন বাড়িতে। যেন খামোকা হাঁটছেন ঘরগুলোয়। এক একটি মুহূর্তকেও মনে হতে থাকে দীর্ঘ দীর্ঘ যুগ। ঘরগুলোয় জুতোর মচমচ শব্দ তুলে হেঁটে বন্ধ দরজাটির পাশে দাঁড়াতেই মা বলেন কিছু খাইবা, খাবার দিব? মা’র এ প্রশ্নটিরও কোনও মানে হয় না। এ সময় না দুপুরের খাবার সময়, না রাতের। বাবা কোনও উত্তর না দিয়ে দরজাটি ধাক্কা দেন। ভেতর থেকে বন্ধ, অথচ বাড়ির মানুষগুলো কেউ অনুপস্থিত নয়, তবে ভেতরে কে! প্রশ্নটি অবান্তর নয়। তবু প্রশ্নটি আমার মনে হতে থাকে নিতান্ত অনুচিত। যার ইচ্ছে সে ভেতরে, তা দিয়ে বাবার কি প্রয়োজন। ধরা যাক আমিই ভেতর থেকে দরজা বন্ধ করে যাদুমন্ত্রে বাইরে এসেছি। যাদু তো এমন আছেই। পিসি সরকার তাই করতেন। হুডিনিও তাই। বন্ধ বাক্সে নিজেকে বন্দি করে রেখেই বাক্সটি যেমন ছিল তেমনই থাকে, তিনি আচমকা বাক্সের বাইরে।

বাবা দরজায় আবারও ধাক্কা দিয়ে হাঁক ছাড়েন, ভেতরে কেডা? মা নিঃশব্দে সরে যান বাবার সামনে থেকে। কিছু আর তাঁর হাতে নেই পাহারা দেওয়ার। আমার ঠান্ডা শরীরটির হঠাৎ পেশাব পায়খানা চাপে। তরকারি পোড়া গন্ধ বেরোয় রান্নাঘর থেকে। ইয়াসমিন এমন ঝুঁকে থাকে বইয়ের ওপর, যেন পাথরের মূর্তি কোনও, নড়ন চড়ন নেই। বন্ধ দরজা থেকে বাবার অদম্য উৎসাহের আগুন এক ফুৎকারে নিবিয়ে দেওয়ার কোনও সম্ভাবনা আমরা কেউ দেখি না। বাবা এমনই, কোনও কিছুর শেষ না দেখে তাঁর শান্তি হয় না। সন্দোহ যদি একবার উঁকি দেয়, তিনি এসপার ওসপার করে ছাড়েন সবকিছুর। নাওয়া খাওয়া বন্ধ করে তিনি রহস্যের জট ছাড়ান। ভেতরে কে, বাবার এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার জন্য কেউ তৈরি নেই। ভেতরে কে প্রশ্নটি এর ওর দিকে, আবার বাতাসেও ছুঁড়তে থাকেন তিনি।

কী দরকার ছিল এত নিরীক্ষণের, কুকুর বেড়াল আর দুটো মেয়ে যে যার জায়গামত আছে, মেয়েরা পড়ার টেবিলে আর জন্তুদুটো বারান্দায়, ছাদে কেউ হাঁটছে না, দরজা জানালা সাঁটা আছে। মাও আছেন বাড়িতে, এমন নয় যে সংসার মাচায় তুলে চলে গেছেন পীরবাড়ি। যেমন চলে সংসার তেমনই, কোনও সুতো পড়ে নেই কোথাও সংশয়ের। তবু, অকারণেই বাবা হুংকার ছোড়েন ভেতরে কে?

আমি ঝুঁকে আছি একটি জ্যামিতির বইয়ে, যেন এক কঠিন জ্যামিতি বুঝতে আমার সমস্যা হচ্ছে খুব, আর কে কোথায় কিসের ভেতর এসব আমার জানার কথা নয়, আর আমার সময়ও নেই ওসবে ফিরে তাকানো, যেন হুংকারটি মোটেও আমার কানে যায়নি। জ্যামিতির সমস্যা মিমাংসায় আমি এতই ব্যস্ত যে কারও দিকে কোনও চোখ না ফেলে, কারও কোনও হুংকার কানে পৌঁছেনি এভাবে দ্রুত হেঁটে যাই গোসলখানার দিকে। যেন গোসলখানাটি এ মুহূর্তূ আমার বিষম প্রয়োজন, মাথায় যেহেতু জ্যামিতির জটিলতা, চাঁদিতে জল ঢেলে তার জট খুলতে হবে। দরজা এঁটে আমি বড় একটি শ্বাস ফেলি। বাড়িতে কী ঘটনা ঘটতে যাচ্ছে, তা কল্পনা করার সাহস বা শক্তি আমি অনুভব করি, নেই আমার। যা কিছু ঘটে, চোখের আড়ালে ঘটুক। কিন্তু পালিয়ে বাঁচা আমার পক্ষে সম্ভব হবে কেন! আমার দরজায়ও শাবলের কোপ পড়ে। দরজা খোল, দরজা খোল! বেরিয়ে এলেই চিতার মত চেপে ধরেন বাবা, ওই ঘরের ভেতরে কেডা?

বাবার রুদ্রমূর্তি দেখে শ্বাস বন্ধ করে দাঁড়িয়ে থাকি দাগি আসামির মত। যেন অপরাধ আমার। যেন বন্ধ ঘরটির সব দায়িত্ব একা আমার। বাবা আমাকে মুঠোর ভেতর নিয়ে দাপান সারা বারান্দা, জবাব তাঁর চাই। তা নইলে ভয়ংকর কোনও কান্ড ঘটাবেন এক্ষুণি। শেষ পর্যন্ত কালো মুখের, ফিনফিনে চুলের, ভোঁতা নাকের মা ত্রাতার ভূমিকায় নামেন। বাবার ছোবল থেকে আমাকে ছাড়িয়ে নিয়ে হিমে ডুবে থাকা গলায় বলেন–কামাল আইছে বউ নিয়া। বউ মুসলমান হইছে।

–কি? কি কইলা? কে আইছে? বাবা প্রশ্ন করেন খনখনে গলায়।

–কামাল। কামাল আইছে। মা আবার বলেন।

–কামাল কেডা? কোনও কামালরে আমি চিনি না। বলতে বলতে বাবা ছুটে আসেন বন্ধ দরজার সামনে। সারা বাড়ি কাঁপিয়ে গর্জন তোলেন–এক্ষুণি ওদেরে বাইর কর আমার বাসা থেইকা। এক্ষুণি। এক্ষুণি।

আমি বারান্দায় দাঁড়িয়ে তখনও। হাত পা আবার অবশ হতে শুরু করেছে।

বাবার তর্জনি তখনও কালো ফটকের দিকে উঁচু করে ধরা।

পেছনের দরজা খুলে ছোটদা বউএর হাত ধরে দৌড়োতে থাকেন কালো ফটকের দিকে।
 
১৩. ঋতুস্রাব



ইস্কুল থেকে ফিরে জামা কাপড় বদল করতে গিয়ে দেখি শাদা পাজামা রক্তে লাল। কেন! কাটল কিছুতে! কোথায় কেটেছে! কাটার তো কথা নয়! ব্যথা তো লাগছে না! কী হল! ভয়ে বুক কাঁপছে তখন আমার। এত রক্ত বেরোচ্ছে, আমি আবার মরে যাচ্ছি না তো!

দৌড়ে, মা ফুলকপি তুলছিলেন সবজির বাগান থেকে, তাঁর কোলের মধ্যে মুখ ডুবিয়ে গলা ছেড়ে কাঁদি।

–ও মাগো, আমার শরীর কাইটা গেছে। সমানে রক্ত বার হইতাছে।

–কই কাটছে! কই! মা কোল থেকে আলতো হাতে আমাকে তোলেন।

আমি তলপেটের নিচে আঙুল নামাতে থাকি।

মা বলেন, মাথায় হাত বুলিয়ে– কাইন্দ না।

আমি গালে নামা চোখের জল মুছে বলি, ডেটল তুলা নিয়া আসো তাড়াতাড়ি।

মা হেসে বলেন–কান্দার কিছু নাই। ঠিক হইয়া যাইব।

রক্ত বেরোচ্ছে আমার গা থেকে, আর মা’র মুখে দুশ্চিন্তার লেশ নেই। তিনি দুটো ফুলকপি হাতে নিয়ে ঘরে ঢুকলেন। আমার ক্ষত খুঁজে তুলোয় ডেটল মেখে, যা সচরাচর করেন, ব্যান্ডেজ করলেন না। বরং ঠোঁটের কোণে চাপা হাসি ঝুলিয়ে, ফুলকপির বালু ঝেড়ে বললে–তুমি এখন বড় হইছ। বড় মেয়েদের এইগুলা হয়।

–এইগুলা হয় মানে? কোনগুলা? মা’র চাপা হাসির দিকে ঘৃণা ছুঁড়ে বলি।

–এই রক্ত যাওয়া। এরে স্রাব কয়। হায়েজ কয়। প্রত্যেক মাসেই এইরকম হয় মেয়েদের। আমারও হয়। মা হেসে বলেন।

–ইয়াসমিনেরও হয়! উদ্বিগ্ন আমি, জিজ্ঞেস করি।

–ওর এখনও হয় না। তুমার মত বড় হইলে ওরও হইব।

হঠাৎ এক বিকেলে আমি, এভাবে, বড় হয়ে গেলাম। মা আমাকে বলেন–তুমি এখন আর ছোট না। তুমি এখন ছোটদের মত খেলাধুলা করা, বাইরে যাওয়া এইসব করতে পারবা না। বড় মেয়েদের মত ঘরে থাকবা। দৌড়াইবা না, শান্ত হইয়া থাকবা। পুরুষলোকের সামনে যাইবা না।

মা তাঁর পুরোনো একটি শাড়ি ছিঁড়ে টুকরো করে, টুকরোগুলো ভাঁজ করে আমার হাতে দিলেন, পাজামার একটি ফিতেও দিলেন। বললেন, গম্ভীর মুখে, চাপা হাসিটি নেমে গেছে ঠোঁট বেয়ে, পেটে ফিতাটা শক্ত কইরা বাইন্ধা তারপরে এই ভাঁজ করা কাপড়টা ফিতার দুইদিকে গুইঞ্জা রাখবা। রক্ত ঝরব তিন দিন, চাইর পাঁচ দিনও ঝরতে পারে। ডরের কিচ্ছু নাই। সবারই হয় মা। এইটা খুব স্বাভাবিক। এই কাপড় রক্তে ভিইজা গেলে এইটা ধইয়া লাইড়া দিবা, আরেকটা পরবা। খুব গোপনে সব করবা, কেউ যেন না দেখে। এইগুলা শরমের জিনিস। কাউরে কইতে হয় না।

আমার ভয় হতে থাকে। এ কেমন অদ্ভুত কান্ড যে রক্ত ঝরবে শরীর থেকে, তাও প্রতি মাসে! কেন ছেলেদের ঘটবে না ব্যপারটি। কেন মেয়েদের কেবল! কেনই বা আমার! আল্লাহতায়ালার মত প্রকৃতিও কি একচোখা! নিজেকে হঠাৎ মনে হয় আমি যেন এখন মা খালাদের মত বড় হয়ে গেছি, আমার আর পুতুল খেলার বয়স নেই। আমার আর খুনসুটি করার বয়স নেই, আমাকে এখন শাড়ি পরে রাঁধাবাড়া করতে হবে, মন্থরগতিতে চলতে হবে, নিচুগলায় কথা বলতে হবে। আমি এখন বড়। গোল্লাছুটের মাঠ থেকে, এক্কাদোক্কার ঘর থেকে কেউ যেন আমাকে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দিল। আমি আর আগের সেই আমি নই। আমি অন্য আমি, ভীষণ বিভৎস আমি। যেটুকু স্বাধীনতা অবিশিষ্ট ছিল, তাও উড়ে গেল নিমেষে তুলোর মত হাওয়ায়। আমি কি কোনও দুঃস্বপ্ন দেখছি! নাকি যা ঘটছে, মা যা বলছেন, সব সত্যি! যদি সবই দুঃস্বপ্ন হত, যদি ঘুম থেকে জেগে উঠে দেখতাম যেমন ছিলাম, তেমনই আছি! আহা, তেমন হয় না কেন! মনে মনে প্রবল ইচ্ছে করি যেন এই রক্তপাত মিথ্যে হয়! যেন এ স্রেফ দুর্ঘটনা হয়, শরীরের ভেতরে কোনও গোপন ক্ষত থেকে রক্তপাত হয়, এটিই প্রথম আর এটিই যেন শেষ হয়। যেন শাড়ির টুকেরোগুলো মা’কে ফিরিয়ে দিয়ে বলতে পারি, সেরে গেছে।

গোসলখানার দেয়ালে মাথা ঠুকে কোনও যন্ত্রণার বোধ হয় না। শরীর একটি বাহন মাত্র, রক্তাক্ত একটি হৃদয় বহন করে চলেছি এতে। বুকের ভেতর কষ্টের নুড়িপাথর জমে জমে পাহাড় হতে থাকে। হাতে ধরা মা’র দেওয়া শাড়ির টুকরো। আমার নিয়তি ধরে আছি আমি হাতে। একচোখা কুৎসিত নিয়তি।

মা গোসলখানার দরজায় টোকা দিয়ে চাপা স্বরে বলেন কী হইছে, দেরি কর ক্যান! যেমনে কইছি অমনে কইরা তাড়াতাড়ি বার হও।

মা’কি আমাকে কাঁদতে দিতেও চান না সাধ মিটিয়ে! লজ্জায় মুখ ঢেকে কাঁদতে, অপমনে বিবর্ণ হতে! যন্ত্রণায় কুঁকড়ে যেতে আশংকায়! মা’র ওপর রাগ হয় আমার। বাড়ির সবার ওপরই, যেন সবার এক গোপন ষড়যন্ত্রের শিকার আমি। আমাকেই বেছে নেওয়া হয় আস্তাকুঁড়ে ছুঁড়ে ফেলতে। গা থেকে দুর্গন্ধ বেরোয় আমারই। গায়ে পায়ে সর্বনাশ যদি কারও জড়িয়ে থাকে, সে আমারই। এই ছেঁড়াখোঁড়া আমার। কী করে এই গা রি রি করা ঘটনাটি আমি লুকিয়ে রাখব! কী করে আমি হাঁটব, দৌড়োব, যদি কেউ জেনে ফেলে আমার পাজামার তলে ত্যানা লুকিয়ে আছে, আর সেই ত্যানা চুপসে আছে রক্তে। নিজেকে বড় ঘেন্না লাগে। ঘেন্নায় থুথু ছুঁড়ি নিজের গায়ে। আমি এখন সার্কাসের ক্লাউন ছাড়া কিছু নই। আমি এখন আর আর সবার মত নই। অন্যরকম। বিশ্রিরকম। আমার ভেতর গোপন এক অসুখ আছে। যে অসুখ কখনও সারে না।

এ কে কি বড় হওয়া বলে! আমি লক্ষ করি আমি যেমন ছিলাম, তেমনই রয়ে গেছি। আমার তখনও দৌড়ে গোল্লাছুট খেলতে ভাল লাগে কিন্তু মা স্পষ্ট বলে দিয়েছেন–লাফ দিবি না, দৌড়াবি না, তুই এখন আর ছোট না। মাঠে দাঁড়ালে মা খেঁকিয়ে ওঠেন, ঘরের ভিতরে আয়, অন্য বাড়ির ছাদ থেইকা বেডারা তাকাইয়া রইছে।

–তাতে কি মা! কেউ তাকাইলে দোষ কি! ম্লান স্বরে বলি।

–তুই বড় হইয়া গেছস। অসুবিধা আছে।

কি অসুবিধা? তা কখনও মা’র কাছে জানতে পারিনি। বাইরের পুরুষ ক্রমশ আমার জন্য নিষিদ্ধ হয়ে যাচ্ছে। আমাকে আড়াল করার, আবৃত করার খেলায় মা বিষম মেতে ওঠেন। মামারা বন্ধু নিয়ে বেড়াতে এলে মা আমাকে ঠেলে পাঠান ভেতরের ঘরে। আমি যেন মামার বন্ধুদের চোখের সামনে না পড়ি। ক্রমশ অস্পৃশ্য হয়ে উঠতে থাকি।

মা’র আলমারিতে চাবি খুঁজতে গিয়ে হাত লেগেছিল কোরান শরিফের ওপর, মা ছুটে এলেন–নাপাক শইলে কোরান শরিফ ধরবি না।

–নাপাক শরীর মানে? তেতো গলায় বলি।

–হায়েজ হইলে শইল নাপাক থাকে। তখন আল্লাহর কালাম ছোঁয়া নিষেধ। নামাজ রোজা করা নিষেধ।

মা কুকুরকে বলেন নাপাক। তাহলে মেয়েরাও সময় সময় নাপাক হয়! অযু করলে সবাই পাক হতে পারে, ঋতুস্রাবের মেয়েরা ছাড়া। দুর্গন্ধ এক ডোবায় পড়েছি আমি, আমার চুলের ডগা থেকে পায়ের আঙুল অবদি নোংরা। ঘেন্নায় আমার বমি আসে। নিজের ওপর ঘেন্না। রক্তের ত্যানা ধুতে গিয়ে উগলে আসে পেটের নাড়ি। এর চেয়ে জ্বিনের বাতাস লাগলে বোধহয় ভাল ছিল, ভাবি। এই নোংরা, নষ্ট, নাপাক ব্যাপারটিকে পুষে রাখতে হয় মনের একটি কৌটোয়, কৌটাটিকে পুরে রাখতে হয় মাটির তলে, যে মাটিতে কারও পা পড়ে না।

আমার হাঁটতে ভয় হয়, দাঁড়াতে ভয় হয়। সারাক্ষণ আশংকা করি, এই বুঝি ত্যানা বেরিয়ে এল বাইরে। টুপ করে আলগোছে পড়ে গেল ঘরভর্তি মানুষের সামনে। এই বুঝি জেনে গেল সবাই। এই বুঝি মেঝে ভেসে গেল পচা রক্তে। এই বুঝি ঠা ঠা শব্দে হেসে উঠল মানুষ। এ আমার শরীর, এ শরীর আমাকেই অপমান করছে। আমাকেই দিনের আলোয় নর্দমায় চুবোচ্ছে।

দুপুরের কাঠ ফাটা রোদে দাঁড়িয়ে থেকেও পারি না জামা খুলে ফেলতে। বুকের মধ্যে বড় হচ্ছে কাজুবাদামের মত স্তন। শরীর থেকে কুলকুল করে স্রোত বইছে রক্তের। আমি বিমর্ষ শুয়ে থাকি বিছানায়।

তিনদিনের রক্তপাতে আমি যখন ক্লান্ত, বিধ্বস্ত, বিছানায় মৃতের মত শোয়া, বাবা দেখে, চোখ কপালে তুলে বুনো ষাঁড়ের মত তেড়ে আসেন, –কি ব্যাপার অবেলায় শুইয়া রইছস কেন! উঠলি এখনও! শিগরি পড়তে বস।

শরীর টেনে তুলে পড়ার টেবিলে বসি। বাবা ধমকে বলেন–এত আস্তে চলস ক্যান! শইলে জোর নাই। ভাত খাস না!

মা আবারও সেই ত্রাতার ভূমিকায়। বাবাকে ডেকে নিয়ে যান অন্য ঘরে, অন্য ঘরটি ঠিক আমার ঘরের বাঁপাশের ঘরটি। ঘরটি থেকে দেয়াল ফুঁড়ে হিস হিস ফিস ফিস শব্দ আসে, শব্দের আগায় বাঁধা অদৃশ্য আগুন। আমার কান পুড়ে যেতে থাকে সে আগুনে। মেলে রাখা বইয়ের অক্ষরগুলো ঝাপসা হতে থাকে। আগুনে পুড়তে থাকে আমার বই খাতা, পেনসিল সব। সারা মুখে হলকা লাগে আগুনের।

বাবা অন্য ঘর থেকে এসে নিঃশব্দে আমার কাঁধে হাত নাকি চাবুক জানি না, রেখে বলেন, বিশ্রাম নিতে চাইলে নেও। শুইয়া থাকো কিছুক্ষণ। পরে পড়তে বও। যাও, বিছানায় যাও। বিশ্রামেরও দরকার আছে শরীরের। নিশ্চয়ই আছে। এইজন্য কুম্ভকর্ণের মত সারাদিন ঘুমাইলে আর আইলসার মত শুইয়া থাকলে ত চলবে না। তুমার একটা আইলসা ভাই আছে না! নোমান। ওর আইলসামির জন্য ও লেখাপড়া করতে পারল না। দেখ না ছাইকলুজি পড়ে। কী ছাতা পড়ে আমার! পইড়া একেবারে রাজ্য শাসন করব! আমাকে চেয়ার থেকে টেনে তুলে বিছানায় শুইয়ে দেন বাবা। শিয়রে বসে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে–জান ত, বাবা বলেন, আমার এখন সন্তান বলতে দুইটা মেয়েই। তোমরাই আমার বুকের ধন। তোমরাই আমার ভরসা, আমার বাঁচার আশা। তোমাদেরে মানুষ কইরা যাইতে পারলেই আমার জীবনে শান্তি হইব। তুমরা যদি আমারে কষ্ট দেও, আমার আত্মহত্যা করা ছাড়া আর কোনও উপায় থাকবে না। শরীরটা ক্লান্ত লাগলে একটু বিশ্রাম নিবা। আবার ভাল বোধ করলে উইঠা পড়তে বসবা। কয় না, শরীরের নাম মহাশয়, যা সওয়াবা, তাই সয়! তুমাদের খাওয়া পরা কোনকিছুরই অভাব আমি রাখি নাই। কেন! যেন ঠাইস্যা লেখাপড়া কইরা মানুষ হইতে পার। ছাত্রজীবনে অধ্যয়নই একমাত্র তপস্যা। তারপরে ধর কর্মজীবন, তহন কর্ম করবা। আর কর্মজীবনের পরে আসে হইল অবসর জীবন, তহন অবসর নিবা, কর্ম থেইকা অবসর। সবকিছুরই একটা নিয়ম আছে। আছে না!

বাবা তাঁর খসখসে আঙুলে আমার চুল আঁচড়ে ঘাড়ের পেছনে জড়ো করেন। ব্যাকব্রাশের বাবা চুল কপালে আসা সইতে পারেন না, নিজের যেমন নয়, অন্যেরও নয়। আগেও দেখেছি, তাঁর আদর মানে চুল পেছনে সরিয়ে দেওয়া। আহ! এত রুক্ষ কারও হাত হতে পারে! খসখসে আঙুলগুলো আমার পিঠে দৌড়োয়। আদর নয় তো এ যেন ঝামা ঘসে আমার চামড়া তুলছেন গায়ের।

ঋতুস্রাব হল আর ধুলোখেলা ছেড়ে গম্ভীর মুখে বসে থাকব ঘরে, এ আমার মনে ধরে না। বড় শখ ছিল বড় হতে, তত বড় হতে যে দরজার সিটকিনির নাগাল পাব। এখন একাই আমি পায়ের আঙুলে ভর রেখে সিটকিনি খুলতে পারি। কিন্তু এই রক্তপাত আমাকে এত বড় করে দেয়, এত আড়াল করে দেয় সবার, যে, আমার ভয় হতে থাকে। মা আমাকে এগারো বছর বয়সে জন্মের মত হাফপ্যান্ট ছাড়িয়ে দিয়ে নিজে হাতে পাজামা বানিয়ে দিয়েছেন পরার। বারো বছরে এলে বলেছেন ওড়না পড়তে, আমার ঠ্যাং বড় হচ্ছে, বুক বড় হচ্ছে সুতরাং বড় হওয়া জিনিসগুলো আড়াল করে রাখতে হবে। আমি যদি এসব না পরি, লোকে আমাকে বেশরম বেলাজ বলবে। সমাজে কেউ বেশরম মেয়েদের পছন্দ করে না। যাদের লাজ লজ্জা আছে, তাদের ভাল বিয়ে হয়। আমারও, মা’র আশা, ভাল বিয়ে হবে। বইয়ের পোকা মমতার বিয়ে হয়ে গেছে ক’দিন আগে। ওকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, তুমি কি চেন, যার সাথে তুমার বিয়ে হইতাছে?

মমতা না বলেছে, চেনে না।

হাতি চড়ে সে লোক মমতার বিয়েতে এসেছিল। সারা শহর দেখেছে হাতিতে বসে বর যাচ্ছে বিয়ে করতে। যৌতুক নিয়েছে অঢেল, সাত ভরি সোনা, তিরিশ হাজার টাকা, রেডিও, হাতঘড়ি। হাতির পিঠে চড়িয়ে মমতাকে সে তার বাড়ি নিয়ে গেছে।

মমতা এখন থেকে শ্বশুরবাড়ির লোকদের দেখাশুনা করবে। লেখাপড়ার পাট চুকেছে ওর। ওর বই পড়ার শখকে ঝেঁটিয়ে বিদেয় করবে হাতি চড়া লোকটি।

ঋতুস্রাবের ধকল না পোহাতেই গ্রামের এক হাবিলদার লোক বড় এক রুই মাছ নিয়ে আমাদের বাড়ি এসে বাবাকে বললেন তিনি তাঁর ছেলের সঙ্গে বাবার বড় কন্যার বিয়ে দিতে চান। শুনে, লোকটির হাতে মাছটি ফেরত দিয়ে কালো ফটক দেখিয়ে দিয়েছেন বাবা, আর একটি শব্দ উচ্চারণ না করে যেন লোকটি বেরিয়ে যান বাড়ি থেকে।

মা অসন্তোষ স্বরে ঢেলে বাবাকে বলেছেন, এমন করলে চলব! মেয়েরে কি বিয়া দিবা না! মেয়ে ত বড় হইছে। এই বয়সেই বিয়া হইয়া যাওয়া ভালা।

মা’কে আর অগ্রসর হতে না দিয়ে বাবা বলেন–আমার মেয়েরে কহন বিয়া দিতে হইব, সেইডা আমি বুঝাম। তুমার মাতব্বরি করতে হইব না। মেয়ে আমার লেখাপড়া করতাছে। ডাক্তার হইব। আমার মত এম বি বি এস ডাক্তার না। এফ আর সি এস ডাক্তার। ওর বিয়া নিয়া আর কুনো কথা যেন আমি শুনি না।

কান পেতে বাবার কথাগুলো শুনে, বাবার ওপর আমার সব রাগ জল হয়ে যায়। বাবাকে ইচ্ছে করে নিজের হাতে এক গ্লাস লেবুর শরবত বানিয়ে দিই, বাবার নিশ্চয় তেষ্টা পেয়েছে। কিন্তু বাবা না ডাকলে তাঁর কাছে ভেড়ার, না চাইলে কিছু দেওয়ার অভ্যেস আমার নেই। আমি অভ্যেসের খোলস ফুঁড়ে বেরোতে পারি না।

মা, আমি লক্ষ করি, আমার বড় হওয়া বিষয়ে বিষম উচ্ছ্বসিত। বাজার থেকে একটি কালো বোরখা কিনে এনে আমাকে বললেন–দেখ তো মা, এই বোরখাটা কিইনা আনলাম তুমার জন্য। পইরা দেখ তো লাগে কি না।

অপমানে আমি লাল হয়ে উঠি। বলি–কি কও! আমারে বোরখা পরতে কও!

–তাই তো। বড় হইছস না। বড় হইলে মেয়েদেরে বোরখা পরতে হয়।

মা বোরখাটি হাতে নিয়ে তার দৈর্ঘপ্রস্থ মাপতে মাপতে বলেন।

–না আমি বোরখা পরব না। শক্ত গলায় বলি।

–তুই মুসলমান না! মুসলমান মেয়েদেরে পর্দা করার কথা আল্লাহ তায়ালা নিজে বলছেন। মা মোলায়েম কণ্ঠে বলেন।

–তা বলুক গিয়া। আমি বোরখা কিছুতেই পরব না। বলি।

–ফজলির সবগুলা মেয়ে কী সুন্দর বোরখা পরে। কত ভাল মেয়ে ওরা। তুমিও ত ভাল মেয়ে। বোরখা পরলে মানষে কইব মেয়েটা কত লক্ষ্মী।

পিঠে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলেন মা। পিঠে উষ্ণ স্পর্শ পড়লে আমি মোমের মত গলে যাই। কিন্তু আজ আমাাকে গললে চলবে না। আমাকে না বলা শিখতে হবে। মনে মনে আওড়াই শব্দটি–না।

–না।

–কি পরবি না? মা ক্ষেপে ওঠেন।

–না ত কইলাম। মা’র নাগাল থেকে ছিটকে সরে বলি।

মা যে হাতটি পিঠে বুলোচ্ছিলেন, সেটি দিয়েই থাপ্পড় কষে পিঠে বলেন–তুই জাহান্নামে যাইবি। আমি তরে কইয়া দিলাম তুই জাহান্নামে যাইবি। তর মতি গতি আমার ভালা ঠেকতাছে না। নওমহলে এত নিয়া গেলাম, তারপরও তর চোখ খুলল না। দেখলি না চোখের সামনে, তর বয়সী, এমন কি তর ছোটরাও বোরখা পরে। কী সুন্দর লাগে ওদেরে। নামাজ রোজা করে। তুই যত বড় হইতাছস, নামাজ রোযা সব ছাড়তাছস। তর কপালে জাহান্নাম লেখা আছে।

মা থাপড়ে আমার পিঠ লাল করে দিন, বোরখা আমি পড়ব না। ঘাড় গুঁজে বসি এসে পড়ার টেবিলে। বই সামনে নিয়ে বসে থাকা কেবল, অক্ষরগুলো শকুনির ডানার তলে ঢাকা।

মা থপথপ করে হাঁটেন বারান্দায়। আমার ঘরটি ভেতর-বারান্দার লাগোয়া। যেন শুনতে পাই, মা বলেন–আসলে ও হইছে একটা মিড়মিড়া শয়তান। দেখলে মনে হয় কিচ্ছু বুঝে না, মা বাপে যা কয়, তাই শোনে। আসলে না। এ আমার মুখে মুখে তর্ক করে। আর কেউ ত এমন করে না। এ এত সাহস পায় কোত্থেকা। বাপের মত মাইরা চামড়া তুলতাম যদি পিঠের, তাইলে সবই শুনত। সুজা আঙুলে ঘি উঠে না।

বাঁকা আঙুলে ঘি ওঠানোর সময় মা আর মা থাকেন না, ডাইনি হয়ে যান। এত বিচ্ছিজ্ঞর লাগে মা’কে দেখতে তখন। মনেই হয় না এই মা আমাকে মুখে তুলে আদর করে খাওয়াতেন, ছড়াগান শেখাতেন, এই মা রাত জেগে বসে থাকেন গায়ে জ্বর হলে। ধুলোর মত মিশে যেতে থাকি মাটিতে, আমার হাড়ে রক্তে মাংসে ক্রোধ জমা হতে থাকে হীরের কণার মত।

ইচ্ছে হয় বিষ খেয়ে মরে যাই। একেবারে মরে যাই। জগত বড় নিষ্ঠুর, এই জগতে মেয়ে হয়ে জন্ম নেওয়ার চেয়ে মরে যাওয়া ঢের ভাল। পত্রিকায় পড়েছি এক মেয়ে হঠাৎ সেদিন ছেলে হয়ে গেছে। বড় ইচ্ছে করে আমার, হঠাৎ একদিন ঘুম থেকে উঠে দেখতে ছেলে হয়ে গেছি। কোনও বেঢপ মাংস পিন্ড নেই বুকে। ফিনফিনে শার্ট পরে যেমন ইচ্ছে ঘুরে বেড়াব। টৈ টৈ করে শহর ঘুরে, সিনেমা দেখে, বিড়ি ফুঁকে বাড়ি ফিরব রাতে। মাছের সবচেয়ে বড় টুকরোটি মা তুলে দেবেন পাতে, আমি ছেলে বলে, বংশের বাতি বলে। ছেলেদের সাত খুন মাপ মা’র কাছে। কেউ আমাকে বুকের ওপর ওড়না ঝুলোতে বলবে না, বোরখা পরতে বলবে না, আমার ছাদে ওঠা, জানালায় দাঁড়ানো, বাড়িতে বন্ধু নিয়ে আড্ডা দেওয়া, যখন খুশি বেরিয়ে যাওয়ায় কারও কিছু বলার থাকবে না।

কিন্তু কে আমাকে ছেলে করে দেবে! আমার নিজের সাধ্য নেই নিজেকে ছেলে করার। কার কাছে প্রার্থনা করব, এক আল্লাহর কাছেই প্রার্থনা করে মানুষ! আল্লাহ ছাড়া আরও কেউ যদি থাকত প্রার্থনা করার! হিন্দুদের তিনকোটি দেবতার কাছে করব! দেবতারা আমার কথা শুনবেন কেন, আমি তো হিন্দু নই। আর আল্লাহর কাছে অনেক চেয়ে দেখেছি, আল্লাহ মোটেও তা দিতে জানেন না। আল্লাহ ব্যাপারটি নেহাত ফালতু। কারও কাছে প্রার্থনা না করে আমার ইচ্ছের কথাটি নিজেকে বলি। হয় মর না হয় ছেলে হয়ে যাও হঠাৎ, বারবার বলি। বাবা বলেন, ইচ্ছে করলেই নাকি সব হয়। আমি তাই হৃদয়ের সমস্ত শক্তি দিয়ে ইচ্ছে করি। আমার ভেতর বাহির, আমার পাপ পুণ্য, সব ঢেলে ইচ্ছে করি।
 
১৪. ফুলবাহারি



ছেলে হয়ে ওঠার ইচ্ছে আমার সেদিন মরে গিয়েছিল, যেদিন ইচ্ছেয় আচ্ছত আমি দেখলাম ফুলবাহারির মা এসেছে অবকাশে। হাড্ডিসার। কামেলা রোগে মরতে বসেছিল, পীরফকিরের দোয়ায় নাকি বেঁচেছে। কাহিলাকে কেউ আর কাজে রাখে না। এর ওর বাড়ি চাল ডাল ভিক্ষে করে সে চলে। ফুলবাহারির মা যখন পাকঘরের বারান্দায় ধপাস করে বসল, আর ওঠার সময় বারান্দার থামে ভর করে দাঁড়াল, এত ক্লান্ত যে জীবনের ভার আর সে বহন করতে পারছে না। আমার দেখে মনে হয় জীবন কাঁধে এসে বসে সময় সময়, একে পিঠে ঝুলিয়ে বহুদূর হাঁটতে শরীর মন সায় দেয় না।

সেই ফুলবাহারির মা, ঘসঘস ঘসসসস শব্দে মশলা বাটত নানিদের পাকঘরে। ঘসঘস ঘসসসস। ঘসঘস ঘসসসস। শব্দটি আমি যেন শুনি যখন পা টেনে টেনে বেলগাছের তল দিয়ে সে হেঁটে চলে যাচ্ছিল। কোথায় যাচ্ছিল কে জানে, তার পেছন পেছন দৌড়ে আমার দেখা হয়নি সে যাচ্ছে কোথায়, এ জগতের কোথায় তার যাওয়ার জায়গা। ঘসঘস শব্দটি আমাকে একটি ভাঙা চৌকাঠে এনে বসায়, যেখানে বসে চেয়ে থাকতাম শিলপাটার ওপর ঝুঁকে দুলে দুলে ফুলবাহারির মা’র মশলা বাটার দিকে। সাত সকালে এসে মশলা বাটতে বসত, দুপুরের আগে আগে বাটা শেষ হত। হলুদ, মরিচ, ধনে জিরা, পিঁয়াজ, রসুন, আদা সাতরকম মশলা তাকে পিষতে হত শিলপাটায়। বড় এক গামলায় করে নানার দোকানের কর্মচারি এসে নিয়ে যেত মশলা। বিকেলে আবার বাটতে বসত, সারা বিকেল বাটত। ইচ্ছে হত আমিও বাটি, ফুলবাহারির মা’র মত দুলে দুলে। বলেওছি, একটু খানি বাটতে দিবা মশলা আমারে?

ফুলবাহারির মা মশলা বাটা থামিয়ে আমার দিকে ফক করে পান খাওয়া কালো দাঁত হাসল, বলল আপনে মশলা বাটতে পারবাইন না আপা, এইডা খুব শক্ত কাম। ফুলবাহারির মা আমার মা’র বয়সী, আমাকে সে ডাকে আপা আর আপনি সম্বোধন করে, কারণ আমি মনিবের বাড়ির মেয়ে। আমাকে মশলা বাটা মানায় না, ছোটলোকেরা বাটে এসব। ছোটলোকের হাত ময়লা হয় শক্ত আর নোংরা কাজ করে। তিন বছর বয়স থেকেই আমি বুঝতে শিখেছি, কারা ছোট আর কারা বড়। ফুলবাহারির মা দেখতে বড় হলেও ছোটলোক, এদের কোলে উঠতে হয় না, এদের গা ধরতে হয় না, এদের হাতের রান্নাও খেতে হয় না। এদের চেয়ারে সোফায় বসার অধিকার নেই, হয় দাঁড়িয়ে থাকতে হয়, নেহাত বসতে হলে মাটিতে, শুলে মাটিতে শুতে হয়। ডাকার সঙ্গে সঙ্গে এদের দৌড়ে আসা চাই সামনে, যে হুকুমই করা হোক, সবই মুখ বুজে পালন করতে হয় এদের। ছোটলোকদের তাই করার নিয়ম।

ফুলবাহারির মা’র পান খাওয়া কালো দাঁতের দিকে তাকিয়ে আমি একটি প্রশ্ন, প্রশ্নটি হঠাৎই উদয় হয়, করি–তুমার নাম কি ফুলবাহারির মা?

মশলা পেষার ঘসঘসস শব্দে আমার প্রশ্ন সম্ভবত থেতলে যায় বলে সে কোনও উত্তর দেয় না। চৌকাঠে বসে আমি আবারও, বিকেলে, যখন বাড়ির মানুষগুলো দুপুরের খাওয়ার পর গা টান করে শুয়েছে, চোরা বেড়ালটি চুলোর পাড়ে ঘুমোচ্ছে, প্রশ্ন করি, এবার স্বর উঁচু করে, তুমার নাম কি?

পেষণ থামিয়ে ফুলবাহারির মা তাকায় আমার দিকে, ঘামে ভেজা তার কপাল, নাক, চিবুক। নাকের ডগায় ঘাম জমলে, রুনু খালা বলেন জামাইয়ে আদর করে। ফুলবাহারির মা’র জামাই মরে ভূত হয়ে গেছে কত আগে, তাকে আদর করবে কে! এবার আর কালো দাঁত বেরোয় না হাসিতে। হাসিতে নিচের পুরু ঠোঁট উল্টে থাকে, আর দু’গালে যেন দুটো আস্ত সুপুরি।

আমার উৎসুক চোখে শান্ত চোখ রেখে ফুলবাহারির মা বলে আমার কুনো নাম নাই বইন। মাইনষে ডাহে ফুলবাহারির মা।

এবার আমি হেসে, চোখ নাচিয়ে, মেয়েমানুষটির বোকামো ধরে ফেলেছি ভঙিতে বলি ফুলবাহারি জন্মানোর আগে তুমার নাম কি ছিল? আঁচলে মুখের ঘাম মুছে ফুলবাহারির মা বলে–আমার কুনো নাম আছিল না।

–তাইলে মাইনষে তুমারে কি কইয়া ডাকত? ধর তুমার মা বাপ কি ডাকত?

ফুলবাহারির মা বড় একটি দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে–মা বাপ কি আর আছে? কবেই মইরা গেছে।

–তা বুঝলাম, কিন্তু যহন তুমার বাপ মা মরে নাই, তুমারে নাম দেয় নাই? ধর আমার একটা নাম আছে। নাসরিন। ফুলবাহারির মা’কে আমি ইস্কুল মাস্টারের মত বোঝাই। মশলা পিষতে পিষতে বলে সে–না, আমার কুনো নাম আছিল না কুনোকালে।

আমারে এই ছেড়িডা, ছেমড়িডা, বান্দরডা, কইয়া বেহেই ডাকত।

আমি অবাক তাকিয়ে থাকি দুলতে থাকা শরীরের দিকে। যেন শিলপাটায় নয়, আমার মাথার ভেতর শব্দ হচ্ছে ঘসঘস ঘসসসস।

মা’কে, কলাগাছে কলা ধরার বা কড়ইএর ডাল ভেঙে পড়ার খবর যেমন দিই, তেমন করে এ খবরটিও দিই–জান মা, ফুলবাহারির মা’র নিজের কুনো নাম নাই।

মা শব্দ করলেন হু।

মা এতটুকু চমকান না শুনে মা’র বয়সী একজনের কোনও নাম নেই। এত নির্লিপ্তি মা’র, আমি বুঝি না, কেন।

–মা, নাম ছাড়া আবার মানুষ হয় নাকি? আমি বই থেকে চোখ সরিয়ে মনে জমে থাকা প্রশ্নটি করি।

–এত প্যাঁচাল পারিস না ত। বই পড়। জোরে জোরে পড়। মা খেঁকিয়ে ওঠেন। বাধ্য মেয়ের মত দুলে দুলে পড়ি–
আপনারে বড় বলে বড় সে নয়, লোকে যারে বড় বলে বড় সেই হয়।
লেখাপড়া করে যে, গাড়িঘোড়া চড়ে সে।
সদা সত্য কথা বলিবে।

–ফুলবাহারি, তুমার মার কুনো নাম নাই, জান? পড়ার ফাঁকে ফুলবাহারিকে বলি চাপা স্বরে।

ফুলবাহারিও একটুও অবাক হয় না শুনে যে তার মা’র কোনও নাম নেই। যেন এটিই স্বাভাবিক। যেন এটি হওয়ারই কথা ছিল। সে, বরং বাঁকা চোখে তাকিয়ে আমার চোখে, অনুমান করতে চায় কোনও লুকোনো কারণ আছে কি না তার মা’র যে কোনও নাম নেই সে নিয়ে আমার আগ্রহের।

–নাম নাই তো নাম নাই। নাম দিয়া কাম কি! গরিবের নাম থাকলেই কি না থাকলেই কি! ফুলবাহারি চোয়াল শক্ত করে বলে।

মা প্রায়ই বলেন ফুলবাহারির নাকি তেজ খুব বেশি। কথা বলে ব্যাডাগর লাহান, এক্কেরে ফাডা বাঁশ। তা ঠিক। ফুলবাহারির কথা আমাকে ভাবনায় ফেলে। তার মানে গরিবের কোনও নামের দরকার নেই! নাম দিয়ে কোনও কাজ নেই গরিবের! সম্ভবত ফুলবাহারি ঠিকই বলেছে। গরিবের ইস্কুলে যেতে হয় না, ইস্কুলের খাতায় নাম লেখানোর কোনও দরকার হয় না। গরিবের বাড়ি ঘর নেই, দলিলপত্রও তাই করতে হয় না, তাই নামেরও দরকার নেই। তাহলে নাম ছাড়াও বাঁচা যায়, অবশ্য গরিবেরাই বাঁচে কেবল। গরিবের কেবল নাম নয়, ওরা লেপ তোষক ছাড়াও বাঁচে, মাছ মাংস ছাড়াও, জুতো সেন্ডেল, জামা কাপড়, তেল সাবান, স্নো পাউডার ছাড়াও বাঁচে। ফুলবাহারির জন্য আমার খুব মায়া হতে থাকে, ওর নামহীন মা’র জন্যও। বালতির পানিতে ত্যানা ভিজিয়ে, চিপে, ফুলবাহারি উবু হয়ে মুছতে থাকে মেঝে। ওর কানে বিড়ি গোজা, কাজ কাম সেরে এই বিড়িটি ধরাবে সে। ফুলবাহারির বিড়ি খাওয়ায় বাড়ির কেউ আপত্তি করে না। ছোটলোকেরা বিড়ি তামাক খেতে পারে, কিন্তু ভদ্রঘরের মেয়েদের ওসব মুখে তোলা যাবে না। পুরুষ সে বড়লোক হোক, ছোটলোক হোক, যা ইচ্ছে করবে, যা ইচ্ছে খাবে, ফুঁকবে– বাধা নেই। ফুলবাহারির কালো লম্বা শরীরটি, বসন্তের দাগ-মুখ আর কানে গোঁজা বিড়িখানি আমার বড় চেনা। কাজের ফাঁকে মেঝেয় পাছা ঠেকিয়ে বিড়ি ধরায় ও, ফক ফক করে ধোঁয়া ছাড়ে। ফুলবাহারিকে তখনই, আমি লক্ষ করেছি সবচেয়ে খুশি খুশি দেখায়।

–তুমি স্বরে অ স্বরে আ ক খ পড়তে জান না! আমি ওর উবু হওয়া শরীরের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করি।

ফুলবাহারি মেঝে মুছতে মুছতে মাথা নেড়ে বলে– না।

কাগজে ঘসঘস করে স্বরে অ লিখে ফুলবাহারিকে বলি– এইটা হইল স্বরে অ। কও স্বরে অ।

ফুলবাহারি বলে–স্বরে অ।

মেঝে মোছা থামিয়ে, কৌতূহল চোখে।

— আর এই যে দেখ, এইটা তুমার নাম, ফুলবাহারি। নামটিও কাগজে লিখে মেলে ধরি ওর সামনে।

লেখাটির দিকে ও অবাক হয়ে তাকায় যেন এটি দূরের কোনও দেশের ছবি,, চিনতে পারছে না। ফুলবাহারি কাজে ফাঁকি দিচ্ছে, মা তাই বলবেন। মা ঘরে নেই বলেই ফুলবাহারি কাজ থামিয়ে মেঝেয় পাছা পেতে বসতে পারল, বসে বলতে পারল– এইটা বুঝি আমার নাম খালা?

তেজি মেয়ের মুখে তখন কচি খুকির হাসি।

ইচ্ছে করে ফুলবাহারিকে স্বরে অ স্বরে আ শেখাই, কখগঘ শেখাই, ফুলবাহারি নিজের নাম লিখতে পারবে নিজে।

–আইচ্ছা ফুলবাহারি, তুমি আমারে খালা কইয়া ডাক ক্যান? আমি ত তুমার অনেক ছোট।

আমার প্রশ্ন শুনে বোকা-চোখে তাকায় আমার দিকে ফুলবাহারি। বলে–ওরে বাবা, আপনেরে খালা কমু না ত কি! আপনেরা বড়লুক। বয়সে ছোট হইলান,তাতে কি! বড়লুক হইলে, এমন কি কুলের আবুরেও কুনোদিন নাম ধইরা ডাকতে নাই। আমরা গরিব, আমরা এই কপাল লইয়াই জন্মাইছি।

আমি হেসে নিজের কপালে হাত রেখে বলি–তুমার কপাল যেইরম দেখতে, আমার কপালও। গরিবের কপাল কি ব্যাকা হয়?

ফুলবাহারি হেসে ফেলে, কচি খুকির হাসি ওর মুখে, বলে– এইডা কি আর এই কপাল! কপাল বলতে বুঝাইছি, ভাইগ্য।

দীর্ঘশ্বাস ফেলে বালতির পানিতে ত্যানা ভিজিয়ে ঘরের বাকিটুকু চৌকাঠ সহ মুছে নিতে নিতে ফুলবাহারি আবার বলে–বাপ মরার পর কপাল আমগোর আরও পুড়ল। মাইনষের বাড়িত বান্দিগিরি কইরা খাইতে অয় অহন। লেহাপড়া কি আমগোর কপালে আছে!

জিজ্ঞেস করি–তুমার বাপ নাই!কবে মরছে! কেমনে?

ফুলবাহারি চোখ না তুলে বলে–বাতাস লাইগা মরছে।

–বাতাস? বাতাস লাগলে মাইনষে মরে নাকি? বকের মত গলা লম্বা হয়ে ওঠে বিস্ময়ে।

–জিনের বাতাস খালা। বাপে হাতপাও লুলা অইয়া বিছনাত পড়ল। পড়ল ত পড়লই। আর উঠল না। চৌকাঠ মুছে বড় একটি শ্বাস ছেড়ে বলে ফুলবাহারি। ওর পরনের মোটা বাইনের শাড়িটি হাঁটুর কাছে ছেঁড়া। ফুলবাহারির এটি ছাড়া আর একটি সবুজ রঙের শাড়ি আছে। ওটি আরও ছেঁড়া। ওর জন্য আমার আবারও বড় মায়া হতে থাকে।

ফুলবাহারি ঘর মুছে বেরিয়ে যায় ঘর থেকে। ওর প্রস্থানের দিকে নিষ্প্রাণ তাকিয়ে থাকি। ভেতরে তোলপাড় করে জিনের বাতাস রেগে মানুষ মরার খবর।

মা’কে জিজ্ঞেস করে পরে উত্তর পেয়েছি, জিনের বাতাস লাগলে হাত পা অবশ হইয়া যায়, কথাডা সত্য।

জিন ভূত ব্যাপারগুলো কেমন যেন অদ্ভুত ব্যাপার! কেবল শরাফ মামাই ভূত দেখে বাড়ি ফেরেন, আমার কখনও দেখা হয়নি। মাঝে মাঝে ইচ্ছে হয় পেত্নির বিজলি দেখতে, সেও দেখা হয়নি, সারাদিন জানালার ফুটো দিয়ে বাইরে বাঁশঝাড়ের অন্ধকারে তাকিয়ে থেকেও।

সেদিনের পর সপ্তাহ পার হয়নি, জিনের বাতাস লাগল গেঁতুর ওপর। গেঁতুর ডান পাখানা হঠাৎ অবশ হয়ে গেল। গেঁতুর মা ছেলের শোকে পাগল, নানির বাড়ি এসে সে গেঁতুর জন্য বিলাপ পেড়ে কাঁদে, দেখতে যাওয়ার তার অনুমতি মেলে না। গিয়েওছিল বাড়ির উঠোন অবদি, ঝাঁটা মেরে তাড়িয়েছে গেতুঁর বাবা। বাইন তালাকের পর গেঁতুর মা’র আর অধিকার নেই গেঁতুর ছায়া মাড়ানো, পেটের ছেলে, তা হোক। গেতুঁর মা’র বিলাপ নানির বাড়ির লোকেরা কেউ খাটে বসে, কেউ দরজায়, আমগাছতলায়, কলতলায় দাঁড়িয়ে দেখেন, ঝুনু খালা আহা আহা করে বেণি দুলিয়ে চলে যান ঘরের ভেতর। নানি পান সাজতে থাকেন নিশ্চুপ। হঠাৎ বিষম এক হুংকার ছুঁড়ে গেঁতুর মা’কে দূরে সরতে বলেন টুটু মামা। মেয়েমানুষের কান্নাকাটি তাঁর নাকি অসহ্য লাগে। মুখে আঁচল পুরে কান্না থামিয়ে চলে যেতে হয় গেঁতুর মাকে, আমাকে কেউ লক্ষ করে না যে আমিও যাচ্ছি তার পেছন পেছন। বাঁশঝাড়ের তলে আমার ভয় পাওয়ার কথা, পাই না। জিনের বাতাস লেগে আমারও যে হাত পা অবশ হয়ে যেতে পারে, ভুলে যাই। আমি বেখেয়ালি বেহিশেবি বেত্তমিজ বেয়াদ্দপ মেয়ে। গেঁতুর মা রেললাইনের দিকে হাঁটে, ছায়ার মত আমিও। লাইনের ওপর বসে গেঁতুর মা কাঁদে, আমি পাথর কুড়িয়ে ছুঁড়তে থাকি লোহার পাতে। ঠং ঠং, ঠং ঠং। গেঁতুর মা কান্না থামিয়ে দেখেন পেছনে দাঁড়িয়ে আছি আমি, আমার না আঁচড়ানো চূল, ধুলো মাখা পা, না মাজা দাঁত। বলি–কাইন্দ না গেঁতুর মা। সইরা বও, রেলগাড়ি আইয়া পড়ব। গেঁতু দেইখ্যা ওর বাপেরে বটি দিয়া কুপাইয়া মাইরা তুমার কাছে চইলা আইব একদিন।

বটি দিয়ে কুপিয়ে, মা বলেছিলেন ফুলবাহারিকে মারবেন, যেদিন শিংমাছের তরকারি চুলোয় রেখে সে ঘুমিয়ে পড়েছিল, ওদিকে তরকারি পুড়ে ছাই; আর বাবার বুক পকেট থেকে গোপন চিঠিটি পাওয়ার পর মা রাজিয়া বেগমকেও চেয়েছিলেন। বটি দিয়ে কুপিয়ে মা ফুলবাহারিকে মেরে ফেলছেন বা রাজিয়া বেগমকে, ভেবে, যদিও রাজিয়া বেগম মানুষটিকে দেখিনি কখনও, মনে হত দেখতে বোধহয় ঝুনু খালার মত, মায়া হত। গেঁতু হাতে বটি নিয়ে গেঁতুর বাবাকে মেরে ফেলছে দৃশ্যটি আমি খুব সহজে কল্পনা করতে পারি। রক্তে ভেসে যাচ্ছে গেঁতুদের বাড়ির উঠোন ভাবতে আমার গা কাঁপে না, বাঁশঝাড়ের তল দিয়ে সন্ধেয় আসার মত গেঁতুর মার পেছন পেছন, যেমন গা কাঁপেনি।

গেঁতু মরে যাওয়ার দিন পাঁচেক পর আবার জিনের বাতাস লাগল ঠান্ডার বাপের ওপর। জিলিপির দোকান বন্ধ করে ঠান্ডার বাপ পড়ে রইলেন বিছানায়। কাশির সঙ্গে বেরোতে লাগল দলা দলা রক্ত। মৌলবি এসে মাঝে সাঝে ফুঁ দিয়ে যায়, শর্ষিনার পীরের কাছ থেকে পড়া পানি এনে খাওয়ানো হল ঠান্ডার বাপকে। রক্ত ঝরা থামেনি তবুও। জিনের বাতাস লাগলে লোক বাঁচে না, তাই বাঁচার আশা ছেড়ে দিয়ে ঠান্ডা হয়ে বসে রইল ঠান্ডার বাপের আত্মীয়রা। খবর পেয়ে বাবা একদিন নিজে বস্তিতে গিয়ে হাজির, কি ব্যাপার দেখি কী হইছে বলে ঠান্ডার বাপের নাড়ি টিপে, চোখের পাতা টেনে নামিয়ে, জিভ বের করতে বলে কী সব দেখলেন, এরপর ঠান্ডাকে বললেন দোকান থেকে যক্ষার ওষুধ কিনে আনতে। ওষুধ খেয়ে সেরে গেলেন ঠান্ডার বাপ। এ কী কান্ড, জিনের বাতাস লাগা লোক দেখি দিব্যি তাজা। সপ্তাহও পেরোল না, ঠান্ডার বাপ আবার জিলিপির দোকান খুলে বিক্রিবাটা শুরু করলেন। চোখের সামনে এই ব্যাপারটি ঘটে যাওয়ার পর আমার জিনের বাতাসকে মোটেও মারাত্মক কিছু বলে মনে হল না। বাবাকেও দেখি ঠান্ডার বাপ বেঁচে উঠল বলে মোটে অবাক হলেন না, যেন তাঁর বাঁচারই কথা ছিল। বাবা, আমার বিশ্বাস হয়, চাইলে গেঁতুকেও বাঁচাতে পারতেন।

সম্পর্কে ফুলবাহারির লতায় পাতায় মামা হন ঠান্ডার বাপ। অবশ্য ফুলবাহারি বা তার মা সম্পর্কের দাবি করলে ঠান্ডার বাপ স্বীকার করেন না যে তিনি আদৌ এদের আত্মীয়। ফুলবাহারি নিজে বিড়ি খেতে খেতে আমাকে বলল একদিন–দুহান আছে তার, পইসা অইছে। অহন আর স্বীকার যায় না আমরা যে হের আত্মীয়, মাইনষের বাড়িত বান্দিগিরি করি যে, হেইলিগা। গরিবের মধ্যেও উচা নিচা আছে।

ঠান্ডার মা পাড়ায় বলে বেড়িয়েছে যে শর্ষিনার পীরের পড়া পানি খেয়ে জ্বিনের বাতাস ছেড়েছে তার খসমের। অবশ্য ফুলবাহারির বিশ্বাস–নানার ওষুধেই বালা হইছে মামু। মাইনষে কয়, বাতাস লাগলে নাহি বাচে না। কই বাচল ত।

ফুলবাহারি মানুষের কথায় তেমন আস্থা রাখে না। কালো ঘাড় সে টান টান করে রাখে যখন কথা বলে।

পঞ্চাশের মন্বন্তরে হাশেম মামা জন্মানোর পর নানির দুটো ছেলে পর পর জন্ম নিয়ে জ্বিনের বাতাস লেগে মরেছিল, মা সে কথা স্মরণ করেন ঠান্ডার বাপের বাতাস লাগার পর। ছেলে পাতলা পায়খানা করছে, বুকের দুধ খাওয়া ছেড়ে দিয়েছে, কবিরাজ এসে ফুঁ দিয়ে গেল, বলল সাহাবউদ্দিনের বাড়ির জামগাছটিতে যে জিন বসে থাকে, সেই জিনেরই বাতাস লেগেছে ছেলের গায়ে। নানিকে বলা হল চামড়া আর লোহা সঙ্গে রাখতে। চামড়া বা লোহা দেখলে জিন ভেড়ে না। নানি এক টুকরো চামড়া, ভাঙা এক লোহা হাতে নিয়ে ঘরের বাইরে বেরোন, রান্নাঘরে, পেশাবখানায় যেখানেই যান। জিন যদি আবার নানির কাধেঁ চড়ে ছেলের সামনে হাজির হয়, তাই ঘরের ভেতরে ঢুকেও নানিকে ডিঙোতে হত আগুন, মুড়া ঝারু দিয়ে গা ঝেড়ে নিতেন নিজের, যেন শরীরের আনাচ কানাচে লুকিয়ে থাকা দুষ্ট জিন বিদেয় হয়। এত করেও অবশ্য ছেলেদুটো বাঁচেনি। ছেলে জন্ম দেওয়ার পর মা’র জন্যও একইরকম আয়োজন করেছিলেন নানি, ঘরে আগুন জ্বেলে রাখতেন, মা পেশাব পায়খানা করতে ঘরের বাইরে গেলে মুড়া ঝাড়ু নিয়ে বসে থাকতেন ঘরে, ফিরে এলে মা’কে আগুন টপকে আসতে বলতেন, এলে হাতের ঝাড়ু দিয়ে গা ঝেড়ে দিতেন। একই আয়োজন জ্বিনের বাতাস থেকে সন্তান বাঁচানোর।

আমি জন্ম নিলে মা’র আগুন টপকে ঘরে ঢোকা দেখে বাবা বলেছিলেন এইগুলা আবার কি কর?

করতে হয়, মা বলেন বাচ্চার বাতাস লাগলে দুধ খাওয়া ছাইড়া দিব, আমাশা হইয়া মরব।

মা’র চার ছেলেমেয়ে আমরা দিব্যি বেঁচে আছি। কেউ আমরা দুধ ছাড়িনি, আমাশা হলেও, মরিনি। কারও গায়ে জিনের বাতাস লাগেনি। মা অবশ্য আলহামদু লিল্লাহিল্লাযি খালাকাস সামাওয়াতি ওয়াল আরদা ওয়া জায়ালাজ জুলুমাতে ওয়াননূর, ছুম্মাল্লাযীনা কাফারু বিরাব্বিহিম ইয়াদিলুন বলে বলে তাবৎ রোগ থেকে নিজেকে এবং ছেলেমেয়েদের বাঁচিয়েছেন বলে অনেককে বলেন, বাবাকেও। বাবা শুনেও শোনেননি ভাব করেন। ঠান্ডার বাপের রোগ সারার পর বস্তি থেকে বাতাস লাগার খবর কমে এল, আর মাঝে মাঝে যে সব বাতাস লাগা দু’চারজনকে দেখেন বাবা, সারিয়ে ফেলেন ওষুধে, কারু কারুকে আবার হাসপাতালে পাঠান। সুস্থ হয়ে ফিরে আসে ওরাও।

ফুলবাহারি এ বাড়ির কাজ ছেড়ে দেবার পর জ্বরে ধরল তাকে। এবার আর জিনের বাতাস কেউ বলল না। এতদিনে আল্লায় একটা কামের কাম করছে। লাজ শরম একদম আছিল না বেটির। ধপধপাইয়া হাঁটত। জ্বরে ভুইগা যেন এই বেটি মরে আল্লাহ। মসজিদের ইমাম সেরে যাওয়া ঠান্ডার বাপের বাহুতে তাবিজ লাগিয়ে দিয়ে বলে গেলেন। জ্বর হয়েছে খবর পেয়ে ফুলবাহারিকে দেখতে যাব বললে মা আমাকে কানের লতি টেনে বললেন ঠ্যাং লম্বা হইয়া গেছে, টই টই কইরা খালি ঘুরাঘুরির তাল!

আমার আর দেখতে যাওয়া হয়নি ফুলবাহারির জ্বর। জ্বর সারলে শুনি ফুলবাহারির বিয়ে হয়ে গেছে বস্তিরই এক ফোকলা দাঁতের বুড়ো, বয়স সত্তর মত, ঘরে তিনটে বউ আছে, তার সঙ্গে। ফুলবাহারির বিয়ের জন্য তার মা টাকা চাইতে এল নানির বাড়ি। নানি তাকে, দেখলাম, আঁচলের খুঁট খুলে পাঁচ টাকা বার করে দিলেন। আরও দুটো তিনটে বাড়ি থেকে টাকা যোগাড় করে ফুলবাহারির জন্য একটা লাল শাড়ি কেনা হল। বুড়োকে দেওয়া হল দু’শ টাকা যৌতুক। ফুলবাহারিকে আমার মনে হল, হঠাৎ যেন বড় দূরে সরে গেছে। তাকে আর আমাদের রান্নাঘরের বারান্দায় অলস বিকেলে বিড়ি ফুঁকতে দেখব না, তার সঙ্গে আমার গল্পও আর হবে না আগের মত। ফুলবাহারি এখন আর কারও বাড়িতে বান্দিগিরি করবে না। সে তার স্বামীর জন্য রাঁধবে বাড়বে, মাথায় ঘোমটা দিয়ে কলসি কাঁখে পুকুরে যাবে পানি আনতে। ফুলবাহারিকে এমন রূপে, আমার মনে হয় না, ঠিক মানায়। ওর ধপধপাইয়া হাঁটাটিই ছিল সুন্দর। রাস্তার ছোকরারা ওর পেছন পেছন নেচে নেচে চুতমারানির বেডি বলেছিল যেদিন, আমার চোখের সামনে ঘুরে দাঁড়িয়ে ফুলবাহারি চড় কষিয়েছিল এক ছোকরার গালে। আমি মুগ্ধ দাঁড়িয়ে দেখছিলাম, হাতে ধরা গ্যাস বেলুনটি কখন উড়ে গিয়েছিল আকাশে, টের পাইনি।

বেল গাছ তলা ধরে যেতে যেতে গোধূলির ধূলির মত আবছা আঁধারে মিশে যেতে যেতে ফুলবাহারির মা বলে–ফুলবাহারিডারে মাইরা ফেলছে হের জামাই, গলা টিইপা। কান্দি না। কাইন্দা কী লাভ। কানলে কি আমার ফুলবাহারি ফিইরা আইব! আল্লায়ই বিচার করব।

বেদেনির ঝুড়ি থেকে বের হয়ে এক বিশাল অজগর তার বিশাল হাঁ মুখে আমাকে গিলে ফেলে যেন। এক বোবা বিকট কষ্ট আমাকে আমি শতটুকরোয় ছিঁড়তে থাকে, আমার নিজের গুঁড়ো গুঁড়ো কষ্টকে থেতলে ফেলে বুকের পাটায়। ভেতরে শব্দ শুনি ঘসঘসসস ঘসসসস।
 
১৫. কবিতার অলিগলি


ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী গদ্যময়, পূর্ণিমা চাঁদ যেন ঝলসানো রুটি।

বড় মামা বলেছিলেন উঠোন ভরা জ্যোৎস্নার মধ্যিখানে দাঁড়িয়ে। পূর্ণিমার চাঁদকে রুটি বলাতে কানামামু জলচৌকিতে বসা কানামামু সোহরাব রুস্তমের গল্প থামিয়ে বড়মামার কথায় থেমে, হেসে–কে খাইতে চায় রুটি, কার পেটে এত ক্ষিদা! জিজ্ঞেস করেন।

–হাজার হাজার গরিব মরে না খাইয়া।

বড়মামা খড়ম পায়ে খট খট হেঁটে উঠোনে, বলেন।

কেউ যেন শুনতে না পায় বলেছিলাম

–পেড়ে দাও চাঁদরুটি, কিছু খাবো, বাকিটুকু বস্তিতে বিলাবো।

কানা মামুর কান খাড়া। বললেন–সবাই কবি হইয়া গেলি নাকি! কে কইল বস্তিতে বিলানোর কথা! কে!

আমি শব্দ না করে মুখ ঢেকেছিলাম হাতে।

নিজে নিজে ছড়া বানানো আমার বদঅভ্যেসগুলোর মধ্যে একটি। মা পড়াতেন তালগাছ এক পায়ে দাঁড়িয়ে, সব গাছ ছাড়িয়ে, আমি বলতাম বটগাছ পাঁচ পায়ে দাঁড়িয়ে, সাত হাত বাড়িয়ে!

ইস্কুলে ছড়া বলতে বললে আসল ছড়া ভুলে তামাশার ছড়া মাথায় ঘুরঘুর করত। মৌমাছি মৌমাছি কোথা যাও নাচি নাচি দাঁড়াও না একবার ভাই।

নানিবাড়ির উঠোনে সন্ধেবেলা শীতল পাটির ওপর হারিকেনের আলোয় বই মেলে শব্দ করে ছড়া পড়তে পড়তে কানামামুকে হেঁটে আসতে দেখে মৌমাছির বদলে বলেছিলাম–
কানামামু কানামামু কোথা যান হাঁটি হাঁটি দাঁড়ান না একবার ভাই।
কিচ্ছা শুনাতে হবে, পুলাপান খুঁজিতেছি, দাঁড়াবার সময় ত নাই।

মা ঘরের ভেতর থেকে চেঁচিয়ে বলেছিলেন–এইসব কি হইতাছে? বড় বদঅভ্যাস তর। ছড়া লইয়া তামাশা করস।

নববর্ষে ইস্কুলের মেয়েদের নাম দেয় ফাজিল মেয়েরা। ভোরবেলা নাম টাঙানো থাকে দেয়ালে। কে লিখেছে, কে টাঙিয়েছে, কেউ জানে না। সকলে ভিড় করে নাম পড়ে। আমার নাম এক দেয়ালে ফাডা বাঙ্গি, আরেক দেয়ালে–ভাজা মাছ উল্টে খেতে জানে না। দিলরুবা, ক্লাসের সবচেয়ে সুন্দরী মেয়েটির নাম দেওয়া হয়েছে–খানকি।

আমি ওকে জিজ্ঞেস করেছিলাম তোমার নাম দিয়েছে খানকি, খানকি মানে কি?

ওর চোখে মুহূর্তে জল চলে আসে। কোনও উত্তর দেয় না ও। ওকে দেখে এমন মায়া হয় আমার, আমি ওর পাশে এসে বসে নরম একটি হাত রাখি ওর পিঠে। শব্দটি আমি মা’র মুখে, যখন গাল দেন কাজের মেয়েদের, শুনেছি, কিন্তু অর্থ জানি না এর। দিলরুবার জন্য মায়া হওয়ার পর, ওর কাছে এসে বসার পর, একটু একটু করে অন্ধকার কাটতে কাটতে যেমন ভোর হয়, তেমন দিলরুবার আলোয় অল্প অল্প করে আমি পদ্ম ফুলের মত ফুটি। দিলরুবা আমার বন্ধু হয়ে ওঠে নতুন বছরের মন খারাপ করা দুপুরে। বন্ধু হওয়ার পর ও লতার গল্প, পাতার গল্প, টোনার গল্প, টুনির গল্প আমাকে করে। গল্প শুনতে শুনতে আমি লতাপাতাদের ঘর টোনাটুনির জীবন মনের ভেতর সাজিয়ে নিই, পরে ওর বাড়ি গিয়ে লতা পাতা টোনা টুনিকে দেখি, মামুলি কিছু কথাও হয়। কিন্তু সত্যিকার ওরা আর গল্পের ওরা ভিন্ন মনে হয় আমার কাছে। সত্যিকার ওদের চেয়ে গল্পের ওদের আমার আপন মনে হয় বেশি। লতার সঙ্গে দেখা হলে ওর অসুখ সেরেছে কি না জিজ্ঞেস না করে দিলরুবাকে জিজ্ঞেস করতাম, লতার তারপর কি হল! দিলরুবা বলে লতার তারপর অসুখ সারেনি, বৈদ্য এল, কবিরাজ এল, ডাকতার এল, লতা ধীরে ধীরে শুকিয়ে যেতে লাগল, শুকোতে শুকোতে চিকন একটি সুতো হতে লাগল, সুতোটি ঝুলতে লাগল ঘরে, সুতোটিকে কেউ বলল জলে ভাসিয়ে দাও, কেউ বলল বুকে জড়িয়ে রাখো। তারপর একজন বুকে জড়ালো লতাকে, চুমু খেল, লতা চোখ মেলল, হাসল, লতাকে দেখে মনে হল লতা বাঁচবে এবার। দিলরুবা যখন গল্প বলে, ও ঠিক এই জগতে দাঁড়িয়ে বলে না। ওর চোখে আমি তাকিয়ে দেখেছি, ও যখন আমার দিকে তাকায়, আমাকে দেখে না, দেখে অন্য কিছু।

লতার অসুখ নিয়ে আমার দুশ্চিন্তা যাওয়ার পর, দিলরুবা এক খাতা কবিতা আমাকে দেখালো, ওর লেখা। পড়তে পড়তে ঘাস নামে একটি কবিতায় আমি থমকালাম।

ঘাস,
তুমি আমাকে নেবে? ঘাসফুল, নেবে? খেলায়?
আমি দিন ফুরিয়েছি ঘুরে ঘুরে মেলায়,
আমার যা কিছু আছে নাও,
তবু একবার স্পর্শ কর আমাকে, ছুঁয়ে দাও।
এসেছি তোমার কাছে বড় অবেলায়।
তুমি যদি ছুঁড়ে ফেলো হেলায়,
ভাসিয়ে দাও নিরুদ্দেশে ভেলায়।
আমি ফিরে তোমার কাছেই যাব
শতবার নিজেকে হারাব।

–আমারে কবিতা লেখা শিখাবা, দিলরুবা?
ঘাস কবিতাটির ওপর ঝুঁকে বলি আমি।

দিলরুবার নিখুঁত মুখখানায় চিকন গোলাপি ঠোঁট, এক ঝাঁক কোঁকড়া চুল মাথায়, চুল পেছনে খোঁপার মত বাঁধা, বেরিয়ে আসে কিছু অবাধ্য চুল কপালে, ঘাড়ে, চিবুকে। ওকে কোথায় যেন দেখেছি এর আগে। ওর অবাধ্য চুলগুলো দেখেছি আগে কোথাও। এর আগে, মনে হয় এই যে আমি কবিতা শিখতে চাইছি, আর ও আমাকে বলছে না যে ও আমাকে শেখাবে, যেন দৃশ্যটির ভেতরে কখনও ছিলাম আমি, বড় চেনা একটি ছবি। আমি যেন এরকম একা এক মেয়ের পাশে বসেছিলাম কোথাও কবে। মেয়েটি দেখতে ঠিক এরকমই ছিল, আমাদের সামনে ছিল খোলা কবিতার খাতা, সামনে ছিল খোলা জানালা, জানালার ওপারে ছিল ধু ধু মাঠ, আকাশ এসে গড়াচ্ছে সে মাঠে।

আমার চেয়েও দিলরুবা কম কথার মেয়ে। আমার চেয়েও দু’কাঠি লাজুক। ইস্কুলের মাঠে যখন হৈ চৈএ মাতে মেয়েরা, ও দিব্যি জানালায় বসে তাকিয়ে থাকে দূরের আকাশে।

–কবিতা লেখা কাউকে শিখানো যায় না। আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকবে, দেখবে কান্না আসবে। তুমি যদি অনেক কাঁদতে পারো, লিখতে পারবা। দিলরুবা উষ্ণ গলায় বলে আমাকে।

দিলরুবা ক্লাসে মন দেয় না বলে কান ধরে দাঁড়িয়ে থাকতে হয় ওকে সারা ক্লাস। ক্লাস থেকে বেরও হয়ে যেতে হয় কখনও কখনও। ও ক্লাসের বাইরে দরজার কাছে দিব্যি এক পায়ে দাঁড়িয়ে আকাশ দেখে। আকাশের সঙ্গে অদ্ভুত এক ভালবাসা ওর। ওকে দেখলে আমার ঘোর লাগে। ঘোরের মধ্যে আমি ওর পাশে পাশে হাঁটি, কথা বলি, কাঁধে হাত রাখি।

আকাশে তাকিয়ে দিলরুবার মত আমার কান্নাও আসে না, কবিতা লেখাও হয় না। বরং দিলরুবার মুখটি মনে করে, একদিন হঠাৎ লিখি ইস্কুলের মাঠে ছেঁড়া একটি ঠোঙা পেয়ে, ওতে।

আমি তোমায় খেলায় নেব দিলরুবা,
গোল্লাছুট খেলতে জান?
গোল্লা থেকে এক বিকেলে হঠাৎ করে ছুটে
হারিয়ে যাব দূরে কোথাও, অনেক দূরে।
সাত সমুদ্দুর তের নদীর ওপার যাব, যাবে?

ঠোঙার লেখাটি পড়ে দিলরুবা মিষ্টি হাসে। এমন মিষ্টি হাসি আমি দেখিনি আগে। সম্ভবত রুনির ছিল এমন হাসি, অথবা এমন নয়, খানিকটা অন্যরকম। এমন হাসি যার, তার কথা বলার দরকার হয় না, রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, ঠিকই লিখেছিলেন। রুনির সামনে আমি ছিলাম লজ্জাবতী লতা। দিলরুবার সামনে নই। দিলরুবাকে নিয়ে আমার অন্যরকম এক জগত তৈরি হয়। শব্দ নিয়ে খেলার জগত। দিলরুবা লেখে ওর কবিতার খাতায়–

যেদিকেই যেতে বল যাব,
নিজেকে হারাব।
কাছে এসো,
একটিই শর্ত শুধু, ভালবেসো।

আমি তো ওই জানি শুধু, ভালবাসতে। আমাদের ভালবাসা গভীর হতে থাকে, গভীর। দু’জন আমরা হারিয়ে যাই যেদিকে দুচোখ যায়, সাত সমুদ্দুর তের নদীর ওপারে। সে কেবল মনে মনেই। দিলরুবার বা আমার কারও সত্যিকার হারানো হয় না সমাজ সংসার থেকে। দিলরুবা যে তার কবিতার মত, কবিতা তার শান্ত একটি পুকুরের মত, কোনও এক অরণ্যে একটি নিরালা নিভৃত পুকুর, আকাশের রঙের মত রঙ সে জলের, হঠাৎ হঠাৎ একটি দু’টি পাতা পড়ে টুপ করে সে জলে, যেন ভেলা, দিলরুবার জলে ভাসার ভেলা, একান্ত ওরই। সেই দিলরুবা একদিন আমাকে চমকে দিয়ে বলে, তার বিয়ে হয়ে যাবে শিগরি, তার বাবা বিয়ে ঠিক করেছে।

–না। দিলরুবার ম্লান মুখ আর ধূসর চোখের দিকে তাকিয়ে আমি বলি–তুই না করে দে। বল যে বিয়ে করবি না।

দিলরুবা আবারও ম্লান হাসে। গা পুড়ে যাওয়া জ্বরে পড়লে মানুষ এমন হাসে। পরদিন থেকে দিলরুবা আর আসে না ইস্কুলে। আমি এত একা হয়ে যাই। এত একা, যে, ক্লাসঘরে জানালার কাছে ওর না থাকা জুড়ে বসে থাকি, ছুটির পরও, অনেকক্ষণ। আকাশে তাকিয়ে ওকে খুঁজি। ও কি আকাশে চলে গেল অভিমান করে, কে জানে! এই প্রথম আকাশে তাকিয়ে থাকতে থাকতে আমার কান্না আসে।

বিয়ে হয়ে যাওয়ার দু’দিন আগে দিলরুবা এসেছিল অবকাশে। এসেছিল সত্যিকার হারিয়ে যেতে, সাত সমুদ্দুর তের নদীর ওপারে কোথাও! কোনও নিভৃত অরণ্যে। স্বপ্নলোকে। এই নিষ্ঠুর জগত সংসার থেকে অনেক দূরে, যেখানে পাখা মেলে দুঃখবতী মেয়েরা উড়ে উড়ে মেঘবালিকাদের সঙ্গে লুকোচুরি খেলে। কালো ফটক খুলে ও ঢুকেছিল। জানালায় দাঁড়িয়ে ওর নিখুঁত মুখটি আমি অপলক দেখছিলাম, দেখছিলাম স্বপ্নের বাগান ধরে ওর হেঁটে আসা, যেন ও হাঁটছে না, দুলছে। দিলরুবাকে জানালায় দাঁড়িয়েই আমি দেখলাম ফেরত যেতে। আমার সঙ্গে ওর দেখা হয়নি। দরজা থেকে ওকে তাড়িয়ে দিয়েছেন বাবা। তাড়িয়ে দিয়েছেন কারণ তিনি কোনও যুক্তি খুঁজে পাননি একটি কিশোরীর লেখাপড়া ফেলে বিকেলবেলা কারও বাড়িতে বেড়াতে যাওয়ার। তাই ওর নাম ধাম জিজ্ঞেস করে, বাড়ি কোথায়, কেন এসেছ, কী কারণ ইত্যাদির উত্তর নিয়ে রক্তাভ চোখ আর বা হাতের তর্জনি তুলেছেন কালো ফটকের দিকে।

এক্ষুনি বেরোও, গপ্প মারতে আসছ! বাজে মেয়ে কোথাকার!

বাজে মেয়ে বেরিয়ে গেছে। খানকি মেয়ে বেরিয়ে গেছে। আর কখনও ওর সঙ্গে আমার দেখা হবে না, আমি তখন জানিনি। কোনও এক বেশি বয়সের অচেনা এক লোকের সঙ্গে ওর বিয়ে হয়ে যাবে। কবিতার খাতা পুড়িয়ে দিয়ে, লেখাপড়ার পাট চুকিয়ে মশলাবাটার, পিঁয়াজ কাটার, রেঁধে বেড়ে কাউকে খাওয়ানোর আর বছর বছর পোয়াতি হওয়ার জীবনে ওকে ঢুকতে হবে, সত্যিই, আমি তখনও জানিনি।

আর আমি, দিলরুবার হয়ে আকাশ দেখতে থাকব, আমার কান্না আসতে থাকবে, আর আমি কবিতা লিখতে থাকব। ্‌আমি ঘৃণা করতে থাকব সমাজ সংসার। ঘৃণা করতে থাকব আমার এই অদৃশ্য বন্দিত্ব। আমি অনুভব করতে থাকব আমার হাত পায়ের শেকল। অনুভব করতে থাকব আমার ডানা দুটো কাটা, একটি শক্ত খাঁচার ভেতরে বসে আছি অনন্তকাল ধরে।

অথবা একটি খাঁচা আমার ভেতরে বসে আছে ঘাপটি মেরে, আমাকেই দলামোচা করে পোরে ভেতরে, যখন উড়াল দিতে চাই।
 
১৬. মুবাশ্বেরা ঠাণ্ডা হয়ে পড়ে ছিল শাদা বিছানায়


মুবাশ্বেরা, বলা নেই কওয়া নেই, হুট করে, বাড়ির মানুষদের তাজ্জব করে দিয়ে মরে গেল, বৃহষ্পতিবার রাতে। মুবাশ্বেরাকে আমি দেখেছি আমাদের বাড়ি ও বেড়াতে এলে অথবা পীর বাড়িতে আমি গেলে। ওর সঙ্গে মিছিমিছির চুলোপাতিও আমার খেলা হয়েছে আমাদের উঠোনে, ছাদে। আর ওর বাড়িতে চুলোপাতি খেলার নিয়ম যেহেতু নেই, ও খেলেছে কারবালা যুদ্ধ, মুবাশ্বেরা হাসান, মহাম্মদ হোসেন। এয়াজিদ আর মাবিয়াকে ওরা ঘুসি ছুঁড়ত, লাথি মারত, শূন্যে। কারণ কেউই এয়াজিদ বা মাবিয়া হতে চাইত না। আমি ছিলাম ওদের যুদ্ধ যুদ্ধ খেলার একমাত্র দর্শক।

ফজলিখালার ছেলেমেয়েদের সঙ্গে আমার সখ্য হয়নি কোনওদিন, খুব দূরের মনে হত ওদের। ওরা, আমরা যে স্বরে ও সুরে কথা বলি, বলে না, বলে অবাঙালির মত, উর্দু টানে। ওরা, পাঁচ বছর বয়সেই নামাজ রোজা শুরু করে, ন বা দশে পৌঁছে বোরখা পরে। ওরা ইস্কুলে যায় না, মাঠে দৌড়োয় না, বাড়ির বাইরে বেরোয় না একা, কারণ ওদের মুরব্বিরা বলে দিয়েছ ওসব করলে আল্লাহ নারাজ হবেন।

মুবাশ্বেরার যখন পনেরোর মত বয়স, আবু বকরের ইস্পাতের কারখানাটি তখন পীর বাড়ির সম্পত্তি। আবু বকর আল্লাহকে সাক্ষী রেখে কারখানাটি লিখে দিয়েছেন পীর আমিরুল্লাহর নামে। পিঁপড়ের মত লোক ভিড় করে পীরের মজলিশে, পীর নিজে পছন্দ করে, খাঁটি আল্লাহভক্ত লোক বেছে কারখানার চাকরিতে ঢোকান। টুটু আর শরাফমামা তখন লেখাপড়া আস্তাকুড়ে থুয়ে পীরবাড়িতে ঢুকেছেন। ফজলিখালা নিজের ভাইদের দুনিয়াদারি ছাড়িয়ে আল্লাহর পথে আনতে পেরে খুশিতে আটখানা। প্যান্ট শার্ট ছেড়ে টুটু আর শরাফ মামা পাজামা পাঞ্জাবি পরেন, মাথায় গোল টুপি পরেন, দাড়িমোচ চাছেন না। দুনিয়াদারির ছিঁটেফোঁটা শেকড় যা আছে উপড়ে ফেলতে ছোট ছোট ঘরগুলোয় বসে হুমায়রা, সুফায়রা, মুবাশ্বেরা ওঁদের নছিহত করে। হেদায়েতের মালিক আল্লাহ। হঠাৎ একটি নছিহতের ঘরে ঢুকে আমাকে টুটু মামার ধমক খেয়ে বেরিয়ে আসতে হয়েছিল। টুটু মামা শুয়েছিলেন, আর হুমায়রা পাশে বসে তাঁর বুকে হাত বুলিয়ে নছিহত করছিলেন। নছিহত করতে হয় অমন একলা ঘরে, বুকে হাত বুলিয়ে, ঘর অন্ধকার করে। মা অমনই বলেছিলেন। শরাফ মামাকে নছিহতের জন্য বরাদ্দ হয়েছিল মুবাশ্বেরা। এ তো আর পর পুরুষকে নছিহত করা নয়, নিজের মামাকে করা। ওই নছিহত করার কালেই মুবাশ্বেরাকে জিনে ধরল। এই জিন আবার অন্যরকম, গাছের তলায় বসে একা একা কাঁদে। কেন কাঁদে, কাউকে বলে না কিছু। খেতে রুচি নেই, বমি বমি লাগে, নামাজ রোজায় রুচি নেই, কেবল গাছের তল খোঁজে। নছিহতে ভাঁটা পড়ে। সেই খলবলে মেয়ে, যুদ্ধ যুদ্ধ খেলা মেয়ে মুবাশ্বেরা বিছানা নিল। জিন তাড়ানোর ব্যবস্থা করার আগেই তার গা পুড়ে যাওয়া জ্বর। পানি পড়া খাওয়ানো হয়, নানা রকম সুরা পড়ে ফুঁ দেওয়া হয় গায়ে, জ্বর তবু সারে না। ফজলিখালা মুবাশ্বেরার মাথা কোলে নিয়ে বসে থাকেন। কপালে জলপট্টি দেন, জলপট্টি থেকে ধোঁয়া বেরোতে থাকে গায়ের আগুনের। মুবাশ্বেরার শ্বাস কষ্ট হতে শুরু হয়।

ফজলিখালা বলেন–আর পারি না । এবার ডাক্তার ডাক।

— ডাক্তার!

— পানিপড়ায় জ্বর সারছে না, ডাক্তারের ওষুধে সারবে? মূসা, ফজলিখালার মেদেনিপুরি স্বামী বলেন।

— না সারুক, চেষ্টা করতে তো দোষ নেই! আল্লাহুসশাফি, ভাল করার মালিক আল্লাহ, ওষুধ উছিলা মাত্র।

ডাক পড়লে ডাক্তার রজব আলী তাঁর ডাক্তারি ব্যাগখানা হাতে নিয়ে রোগীর রোগ ভাল করতে যান পীরবাড়িতে, রাত তখন সাড়ে বারো।

রোগী শুয়ে আছে শাদা বিছানায়। সাত দিনের জ্বরে ভোগা শীর্ণ রোগী। জিভ শাদা, চোখ শাদা, নখ শাদা। ফ্যাকাসে। বিবর্ণ।

ডাক্তার নাড়ি টেপেন, রক্তচাপ মাপেন, হৃদপিণ্ডের শব্দ শোনেন। ডাক্তার ঘর খালি করতে বলেন দশ মিনিটের জন্য, দশ মিনিট পর ফিরে আসতে বলেন ঘরের লোকদের, ঘরে। ডাক্তার ইনজেকশন দেন রোগীকে। ডাক্তারের কপালে বাড়তে থাকে ভাঁজ। ভাঁজ নিয়েই ডাক্তার বলেন–দেখ, কি হয়।

ডাক্তার কোনও পারিশ্রমিক নেন না, তিনি আত্মীয়ের বাড়ির রোগী দেখলে রোগী মাগনাই দেখেন।

মুবাশ্বেরা সকালে ঠান্ডা হয়ে পড়ে ছিল বিছানায়, মরে। ফজলিখালা ফুঁপিয়ে কাঁদছিলেন। কেউ মরলে এ বাড়িতে চিৎকার করে কাঁদতে নেই। কারণ মরণ লেখা ছিল কপালে, মরেছে। আর মরে যাওয়া মানে আল্লাহর কাছে ফেরত যাওয়া। আল্লাহর কাছে যে গেছে, তার জন্য হাহাকার করলে আল্লাহ নারাজ হবেন। বরং তাকে হাসি মুখে বিদায় দাও। ফজলিখালা চিৎকার করে কাঁদতে যখনই শুরু করেছেন, জোহরা, হুজুরের বড় মেয়ে, লাফিয়ে এসে তাঁর মুখ চেপে ধরলেন — ছি ছি এইসব কি কর, তোমার মেয়ে আল্লাহর কাছে গেছে। তার জন্য দোয়া কর, ভাবী। দেখ, দেখ ওর মুখখানায় কী নূর, ও বেহেসতে যাবে। আল্লাহর জিনিস আল্লাহ নিয়ে গেছেন। কাঁদলে গুনাহ হবে। চোখের পানি যদি ফেলতে চাও, ফেল, কোনও শব্দ যেন বের না হয়।

কেউ মারা গেলে হাহাকার করা কবিরা গুনাহর সামিল। ফজলিখালাকে নিয়ম মেনে নিতে হয়। তিনি মুখে ওড়না ঠেলে শব্দের টুঁটি টিপে ধরেন।

মা বিকেলে বাড়ি ফিরে চোখের পানি ফেলছিলেন মুবাশ্বেরার জন্য। বাবা বাড়ি ফিরলে বললেন — মুবাশ্বেরা মারা গেছে।

— আরও আগে চিকিৎসা করলে বাঁচতে পারত। আমি যখন দেখলাম, তখন আর সময় নাই। বাবা বলেন।

মা বাঁ হাতে চোখের পানি নাকের পানি মুছে নিয়ে শব্দ করে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন — হায়াত না থাকলে বাঁচবে কেমনে? আল্লায় এর বেশি হায়াত দেন নাই। ও নিশ্চই বেহেসতে যাইব। মরার আগে ও আল্লাহ আল্লাহ বইলা ককাইতাছিল।

বাবা জুতো খুলে খাটের নিচে রাখেন। মুজো খুলে জুতোর পেটের মধ্যে। কপালে ভাঁজ। শার্টের বোতাম খুলতে খুলতে — ওর ত বাচ্চা পেটে আছিল।

— কার পেটে?

বাঁ পাশের ঘরের দিকে আমার পাতা কান ঝাঁ ঝাঁ করে ওঠে।

— কার পেটে আবার, তুমার বইনের মেয়ে, কী নাম ওর, মুবা, মুবাশ্বেরার!

বাবা ঘামে ভেজা শার্টটি হ্যাঙারে ঝুলোতে ঝুলোতে বলেন।

— ওর বিয়া হয় নাই, বাচ্চা পেটে থাকব কেন? এই পবিত্র মেয়েটা সম্পর্কে এই বাজেকথাগুলা কিভাবে মুখে আনো? জিব্বা তুমার খইসা পড়ব কইলাম। মা ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠেন।

প্যান্টের ওপরে লুঙ্গি পরে লুঙ্গির একটি কোণা দাঁতে কামড়ে, ভেতরে হাত ঢুকিয়ে লুঙ্গির তল থেকে প্যান্ট খুলে আলনায় মেলে, দাঁত থেকে কোণা ছাড়িয়ে পেটের ওপর লুঙ্গির গিঁট দেন।

মা হাঁটেন সামনে পাঁচ পা, ঘুরে আবার পাঁচ পা। দরজার ফাঁক দিয়ে পা গুলো দেখতে পাচ্ছি দুজনের। মা সামনে পেছনে করে করে বাবার খালি পায়ের দিকে এগোলেন। মা’রও খালি পা, কালো পা, কোমল, বুড়ো আঙুলে অসুখ হয়ে নখ ওঠা, বাবার পা ফর্সা, মোজায় ঢাকা থেকে ফ্যাকাসে। চার পা কাছাকাছি। বাবার পায়ের আঙুলগুলো জোট বাঁধা, পা দুটো ঝুলে থাকে খাটের কিনারে, নখ ওঠা টলমল পা যায় জোট বাঁধা আঙুলের পা দুটোর পেছনে। ফিরে আসে আবার।

— বাচ্চা নষ্ট করছিল বোধয় শিকড় টিকড় দিয়া। ইনফেকশন হইয়া গেছিল, সেপটিসেমিয়া। বাবার ঠান্ডা গলার স্বর শুনি।

— না, মিছা কথা। জিভ খইসা পড়ব তুমার। আল্লায় বিচার করব এইসব বদনামের। মা’র গলায় আগুন। ধরাস করে দরজা বন্ধ হওয়ার শব্দ হয়।

ও ঘর থেকে শব্দগুলো শিলপাটায় গুঁড়ো হয়ে এ ঘরে আসে, আমি গুঁড়ো জোড়া দিয়ে পারি না একটি অক্ষরও দাঁড় করতে।

মরে যাওয়াটা আমার মনে হতে থাকে খুব সহজ একটি ঘটনা। এই আজ শ্বাস নিচ্ছি ফেলছি, কাল হয়ত ঠান্ডা হয়ে পড়ে থাকব শাদা বিছানায়। আজ হাত পা নড়ছে, কাল নড়বে না। আজ স্বপ্ন দেখছি, কাল দেখব না। মরে গেলেই সব ফুরুৎ। মা বলেন রুহু উড়ে যায় আল্লাহর কাছে, দেহটা পড়ে থাকে দুনিয়ায়। রুহুটাই সব। রুহু কি করে ওড়ে, শাদা কবুতরের মত? মা বলেছেন রুহু অদৃশ্য, দেখা যায় না। অদৃশ্য কত কি যে আছে দুনিয়ায়।

মুবাশ্বেরা মরে যাওয়ার পর শরাফ মামা আল্লাহর পথ থেকে সরে এলেন, তাঁকে নছিহতের কেউ নেই বলে আর। তিনি আবার প্যান্ট শার্ট পরে দুনিয়াদারিতে নামলেন। ঘরের ট্রাংকে তিনি কিছুদিন স্মৃতি তুলে রেখেছিলেন রক্তের দাগ পড়া ত্যানাতুনোর।
 
১৭. প্রত্যাবর্তন ২



দাদা ফিরে আসেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লেখাপড়া ছেড়ে দিয়ে বিদেশি এক ওষুধ কোম্পানির চাকরি নিয়ে ময়মনসিংহে।

দাদা বলেন, চাকরি নিছি মার লাইগা। মারে এই সংসারে কেউ দেখার নাই। কেউ মারে একটা পয়সা দেয় না। মা যেন আর কষ্ট না করে।

চাকরির প্রথম বেতন দিয়ে দাদা মা’র জন্য শাড়ি কিনে আনলেন চারটে। মা’র জন্য সোনার বালা গড়তে দিলেন।

শাড়ির ওপর উপুড় হয়ে পড়ে হু হু করে কাঁদলেন মা। শাড়ি পরা ছেড়ে দিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু দাদার আনা শাড়ি তিনি পরলেন, ফোঁপাতে ফোঁপাতে কুঁচি কাটলেন শাড়ির। মা’কে দেখতে অদ্ভুত সুন্দর লাগে। দাদাকে বুকে জড়িয়ে মা চোখের জলে ভেসে বললেন — আমার লাইগা আর কিছু কিননের দরকার নাই বাবা। আমার কিছু না হইলেই চলব। তুমি টাকা পয়সা জমাও। তুমার ভবিষ্যতে কাজে লাগব।

ন্যূজ্ব, নত মা এখন শিরদাঁড়া টান টান করে হাঁটেন। তাঁর পেটের ছেলে টাকা পয়সা কামাচ্ছে, তাঁর আর কোনও মাগীখোর লোকের কাছে হাত পাতার দরকার নেই। মা’কে এত উচ্ছ্বল, এত প্রাণবান আর কখনও হতে দেখিনি। কাফেরের সঙ্গে সম্পর্ক টিকিয়ে রাখলে পাপ হয়, ফজলিখালা তাই নিজে মা’কে নিয়ে কাচারিতে গিয়েছিলেন বাবার সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করাতে। মা তালাকনামার কাগজে সই করেছিলেন কাচারিতে বসে। বাবার হাতে কাগজ এলে তিনি ধুত্তুরি বলে ছিঁড়ে ফেলেছিলেন সে কাগজ। কাফেরের সঙ্গে এক ছাদের তলে বাস করতে মা’র গা জ্বলে, যেদিকে দুচোখ যায় চলে যাবেন বলে বলেও মা’র কখনও কোথাও চলে যাওয়া হয়নি এ বাড়ি ছেড়ে। মা কোথাও যান নি কখনও, কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই বলে, নাকি থেকে গেছেন বাড়িটির জন্য, নিজে হাতে লাগানো গাছপালাগুলোর জন্য, আর বাড়ির মানুষগুলোর জন্য এক অদ্ভুত মায়ায় — সে আমার বোঝা হয়নি।

— ইউনিভার্সিটি থেইকা গ্রাজুয়েট হইয়া ফিরছে আমার পুত্রধন। আমার আনন্দ আর ধরে না।

বাবা দাঁত কটমট করে চলছেন দাদা ঢাকা থেকে ফেরার পর থেকেই। গ্রাজুয়েট ছেলেকে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠিয়েছিলেন মাস্টার ডিগ্রি হাতে নিয়ে ফিরতে, আর দাদা বুক পকেটে আনন্দমোহনের বি এসসি পাশের কাগজ নিয়েই বছর দুই পর ফিরলেন। বাবা বলেন এর চেয়ে মইরা যাওয়া ভাল।

দাদা মাছের মত চোখ করে বসে থেকে বাবার টিপ্পনি শোনেন।

দাদা বাড়ি ফিরে নিজের ঘরে গুছিয়ে বসলেন। ছোটদার খাটটি ঘর থেকে সরিয়ে বাইরে বারান্দায় খাড়া করে রাখলেন।

খাটটি সরানোয়, আশ্চর্য, বাবা বিষম রাগ করলেন। তিনি চেঁচিয়ে বাড়ি মাথায় করলেন, বললেন — এই খাট যেইখানে ছিল, সেইখানে নিয়া রাখ। যার খাট সে ফিইরা আইলে থাকব কই! যেমন বিছানা পাতা ছিল, তেমন কইরা রাখ।

মা দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বলেন — কামাল কি আর ফিইরা আইব! শুনছি, শহর ছাইড়া চইলা গেছে। ইসলামপুর না কই যেন থাকে। কি খায় কেমনে থাকে কেডা জানে! বাবা তেলে বেগুনে জ্বলে ওঠেন শুনে।

— কী খায় না খায় তা জাইনা আমার কী! না খাইয়া মইরা যাক। ভুগুক। আমার কী! তুমি হইলা নষ্টের গোড়া। তুমি কথা কইও না। তুমার আসকারা পাইয়া ছেলেমেয়েগুলা নষ্ট হইছে।

মা শিরদাঁড়া টান টান করে হেঁটে এসে চিবুক উঁচিয়ে বলেন — কথা কইতাম না ক্যা! আমারে আর কতদিন বোবা বানাইয়া রাখবা! আমি কি কারও খাই না পরি! আমার ছেলেই এহন আমারে টাকা পয়সা দেয়, কাপড় চোপড় দেয়, তেল সাবান দেয়। আমার আর ঠেকা নাই কুনো বেডার। ছেড়াডারে কী পাষন্ডের মত মাইরা বাড়ি থেইকা ভাগাইছে। এহন খাট সাজাইয়া রাইখা কি লাভ। লাভ কী!

লাভ, বাবা বলেন, বাবা বুঝবেন, মা’র বোঝার কোনও প্রয়োজন নেই।

রবীন্দ্রনাথের কবিতার বই কিনে এনে ভারি গলায় দাদা নিজে পড়ছেন, আমাকে পড়তে বলছেন। কবিতা পড়তে থাকি একটির পর একটি, দাদা উচ্চারণ শুধরে দেন, কোথায় আবেগ কতখানি দরকার, কোথায় জোর, কোথায় না, কোথায় ধীরে, কোথায় দ্রুত বলে দেন। দাদা বলেন — হৃদয় না ঢাইলা পড়তে পারলে কবিতা পড়বি না।

দাদা আবৃত্তি সন্ধ্যার আয়োজন করেন দু’জনের। আমরা দু’জনই শ্রোতা, দু’জনই আবৃত্তিকার। দাদা বিচারক। আমার এক নতুন জীবন শুরু হয় দাদার চৌহদ্দিতে। ওষুধ কোম্পানীর একটি লাল নোটবুক আমাকে দেন, প্রতিদিন দুটো তিনটে করে কবিতা লিখে দাদাকে দেখাতে থাকি। কোনওটিকে ভাল বলেন, কোনওটিকে খুব ভাল, কোনওটি সম্পর্কে বলেন — এইডা গু হইছে, কবিতা হয় নাই।

কবিতার খাতাটি ইস্কুলের মেয়েদের হাতে হাতে ঘুরতে থাকে। একজনের পড়া শেষ হলে আরেকজন বাড়ি নিয়ে যায়। খাতাটি আমার হাতে ফিরতে ফিরতে মাস শেষ হয়ে যায়। কাড়াকাড়ি পড়ে যায় মেয়েদের মধ্যে। দাদা মুক্ত বিহঙ্গ নামে আমার একটি কবিতা পড়ে বলেন — ইস, পাতা পত্রিকাডা থাকলে, তর এই কবিতাডা আমি ছাপাইতাম।

কেবল কবিতা নয়, গল্পেরও আসর বসান দাদা। দাদা একটি পড়েন, আমি একটি। কোনও কোনও লাইন আহা আহা বলে দু’তিনবার পড়েন, শিখে আমিও তা করি। বাবা বাড়ি ফেরা অবদি আসর রীতিমত গতিময় থাকে।

কখনও গানের আসরও বসে। আমাকে গাইতে বললে হেঁড়ে গলায় দু’লাইন গেয়ে ছেড়ে দিই। দাদা গাইতে বসে সুরহীন গলায় গরুর মত চেঁচান। গানের আসরে ইয়াসমিনকে নেওয়া হয়, তার গলায় বেশ সুর ওঠে বলে। ইয়াসমিনকে, দাদা বলেন একটি হারমোনিয়াম কিনে দেবেন।

গান শোনার একটি যন্ত্র কিনেছেন দাদা। কোনও কোনও বিকেল কেবল গান শুনেই কাটিয়ে দেন। মুছে যাওয়া দিনগুলি আমারে যে পিছু ডাকে, গানটি শুনতে শুনতে, একদিন আবিষ্কার করি দাদা কাঁদছেন, আমাকে লক্ষ করেননি তিনি আমি যে নিঃশব্দে ঢুকেছি ঘরে।

–দাদা, তুমি কানতেছিলা! জিজ্ঞেস করি।

দাদা জল মুছে ফেলে বলেন — না, না, কানতাম ক্যান! কান্দি না। এমনি।

দাদা আসলে কাঁদছিলেন। দাদা কি শীলার জন্য কাঁদছিলেন!

ঘটনাটি আমি মনে মনে রাখি। মনে মনে রাখি দাদার একটি গোপন কষ্ট আছে। দাদা নিরালায় বসে খুব আপন কারও জন্য, মুছে যাওয়া কোনও দিনের জন্য কাঁদেন।

দাদার পাশে জানালায় এসে বসি। বাগানে লিলি ফুল ফুটে চমৎকার গন্ধ ছড়াচ্ছে। বাইরে দুলাল যাচ্ছে মাউথ অর্গান বাজিয়ে। এত দ্রুত হাঁটে সে, দেখে মনে হয় দৌড়োচ্ছে, সকাল, দুপুর, বিকেল, মধ্যরাত, মাউথ অর্গানের শব্দ শুনে যে কেউ বলে দিতে পারে, এ দুলাল। ও কারও সঙ্গে কথা বলে না, কারও জন্য পথে দাঁড়ায় না। ও কেবল দৌড়ে যেতে থাকে, যেন কোথাও ওর খুব জরুরি কোনও কাজ। আসলে ওর কোনও কাজ নেই। লোকে বলে, দুলাল পাগল।

দুলাল কি আসলেই পাগল? দাদাকে জিজ্ঞেস করি।

দাদা বলেন — আমার মনে হয় না।

হঠাৎ দীর্ঘশ্বাস ফেলে দাদা উঠে দাঁড়ান, মেঘ কেটে সূর্য ওঠার মত হাসি দাদার মুখে, বলেন — যা, দাবার গুটি সাজা। দেখি আইজকা কেডা জিতে।

আমার মন ভাল হয়ে যায় দেখে যে দাদা হাসছেন। গুটি সাজিয়ে বসে যাই। দাদার কাছ থেকে খেলা শিখে অবদি দাদাকেই হারাচ্ছি খেলায়। আমার চোখ ফাঁকি দিয়ে তিনি দেদার গুটি চুরি করেন। খেলতে গিয়ে বলে নিই, চুরি করা চলবে না।

অথচ চুরি করতে যেয়ে দু’বার ধরা পড়েন দাদা। ঘন্টা খানেকের মধ্যে তাঁর রাজাকে কিস্তি দিলে ব্যস, দাবার ছক উল্টে ফেলেন ইচ্ছে করে, আমি গলা ছেড়ে চেঁচাতে থাকি, তুমি হারছ, তুমি হারছ।

দাদা একেবারে যেন কিছুই জানেন না, অবোধ শিশুর মত বলেন, কী আমি হারছি। কই! দেখা কই হারছি! তুই না হারলি!

মুখখানা দিব্যি নিষ্পাপ বানিয়ে তিনি অস্বীকার করেন তাঁর পরাজয়ের কাহিনী। আমি ভুল চাল দিয়েছিলাম বলে তিনি সহ্য করতে পারেননি, তাই ছক উল্টেছেন এই তাঁর বক্তব্য। আমি জিতেছি, আমি ভাল খেলি, তিনি কোনওদিন মানেন না।

ইস্কুলে ভাল ছাত্রী হিশেবে আমার নাম হয়। প্রথম তিনজনের মধ্যে আমি আছিই। বাবা তবু স্বীকার করেন না আমি ভাল ছাত্রী। তাঁর বদ্ধ ধারণা, আমি ফাঁকি দিচ্ছি লেখাপড়ায়, তা না হলে আমি প্রথম হই না কেন। মেজাজ খিঁচড়ে থাকে।

মা দেখি দাদার মনতুষ্টিতে বিষম ব্যস্ত। দাদা গরুর শুটকির ঝুরঝুরি খেতে চান, মা রাঁধেন। দাদা ঝাল পিঠা খেতে চান, মা আয়োজন করেন। আকাশ মেঘ করলেই বা দুফোঁটা বৃষ্টি ঝরলেই দাদা বলেন — মা ভুনা খিচুড়ি আর ইলিশ মাছ ভাজেন।

মা দিব্যি রেগে যান চাল ডাল মেশাতে।

মা’র পীরবাড়ি যাওয়া বাদ পড়তে থাকে।

টাকা পয়সা অলা দাদা হয়ে উঠতে থাকেন বাড়ির গণ্যমান্য একজন। তিনি চিত্ররূপা স্টুডিওতে আমাদের নিয়ে গিয়ে গ্রুপছবি তুলে আনেন। নিজে নানা ভঙ্গিতে ছবি তুলে এলবামে সাঁটতে থাকেন। কিছু ছবি বড় করে কাঠের ফ্রেমে বাঁধাতে বাঁধাতে বলেন — কী, দেখলি কেরম নায়কের মত লাগে আমারে!

আমি স্বীকার করি দাদাকে দেখতে ছবির নায়কের মত লাগে। দাদা আসলেই খেয়াল করে দেখেছি, সুন্দর।

আমার আঁকা দুটো ছবিও, রবীন্দ্রনাথ আর নজরুলের, বাঁধিয়ে ঝুলেয়ে রাখেন ঘরে, যে ই আসে বাড়িতে, ছবি দুটো দেখিয়ে বলেন — আমার বোনের আঁকা।

ছবি আঁকার রং তুলি কিনে দিয়ে দাদা আমাকে বলেন আরও ছবি আঁকতে। আঁকতে আঁকতে ভাবি বড় হয়ে আমি ছবি আঁকার ইস্কুলে ভর্তি হব। পিটিআই ইস্কুলে গান গাওয়া মাস্টার বলেছিলেন, আমি খুব বড় শিল্পী হব। যে ছবিই আঁকি না কেন, দেখে মুগ্ধ দাদা বলেন — ছুটোবেলায় তরে ছবি আঁকা শিখাইছিলাম বইলা! নাইলে কি আর এত ভাল আঁকতে পারতি!

দাদাকে গোপন ইচ্ছের কথা বলি যে একদিন ছবি আঁকার ইস্কুলে লেখাপড়া করে আমি আরও ভাল ছবি আঁকব।

দাদা ঠোঁট উল্টে বলেন — বাবা শুনলে তরে মাইরাই ফালব। কিছুতেই তরে শিল্পী হইতে দিব না। কইব শিল্পীগোর ভাত নাই।

দাদা কেবল মা’কেই নয়, আমাদেরও জামা জুতো কিনে দেন, সিনেমা দেখাতে নেন। সিনেমার নেশায় পায় আমাকে। আবদার করে করে অতিষ্ঠ করে ফেলি তাঁকে। মাঝে মাঝে বলেন — ঠিক আছে, দরখাস্ত লেখ আমার কাছে। ভাইবা দেখতে হইব মঞ্জুর করা যায় কি না।

দরখাস্ত লিখি, ডিয়ার স্যার সম্বোধন করে। ইতিতে লিখি ইয়োর ওবেডিয়েন্ট সারভেন্ট। বই দেখে টুকি আসলে। টাকা চাহিয়া ম্যানেজারের কাছে ইংরেজিতে একটি দরখাস্ত লেখ যে পৃষ্ঠায় আছে, সেটি বার করে, টাকা চাইএর বদলে সিনেমা দেখতে চাই বসিয়ে।

দরখাস্ত পাওয়ার পরও দাদা কোনও সিদ্ধান্তে পৌঁছোন না। আমি অস্থির হতে থাকি বিষম। তিনি বলেন — ধৈর্যশক্তি নাই তর। ধৈর্যশক্তি না থাকা আমার একদম পছন্দ না। একবার আমার এক বন্ধুরে লইয়া সিনেমা দেখতে গেছি। ইকবাল নাম। আমরা ডাকতাম শাদা হাত্তি কইয়া। ইয়া শাদা আর ইয়া মুডা আছিল। হলে গিয়া দেখি সিনেমার টিকিট নাই। হে কয় দেখবামই ছবি যেমনেই হোক। ব্ল্যাকে টিকিট কাইটাও দেখবাম। ব্ল্যাকে টিকিট তিন ডবল দাম। কইলাম চল কাইলকা দেখি। সে কয় ওইদিনই দেখব সে। ওই ম্যাটিনি শো। আমি ঘুরাইয়া একখান চড় মারলাম। ওই চড় খাওনের পর আমার সামনে সে আর অস্থিরতা দেহায় না কোনও কিছু লইয়া। তুই হইলি ইকবালের মত, তরও ধৈর্যশক্তি নাই।

দাদাকে ভালবাসি, ঈর্ষাও করি। দাদা যেখানে খুশি যেতে পারেন, যা ইচ্ছে করতে পারেন। মোটর সাইকেল কিনে ওতে করে সারা শহর ঘুরে বেড়ান। নানান শহরে যান, টাঙ্গাইল, জামালপুর, নেত্রকোণা। আমার বড় ইচ্ছে করে যেতে। বড় ইচ্ছে করে সীমানার বাইরে পা বাড়াতে। দাদা বলেছেন তরে একদিন জয়রামকুরায় পাহাড় দেখাতে নিয়া যাইয়াম, গারো পাহাড়।

অপেক্ষায় অস্থির হতে থাকি। দাদা দিন পেছোতে থাকেন, এ মাসে না পরের মাসে করে করে। আমি তবু আশায় আশায় বাঁচি, একদিন খুব ভোরবেলা কারও জাগার আগে, পাহাড় দেখতে যাব, দূরে –অনেক দূরে, নির্জনতার পিঠে মাথা রেখে টিপটিপ টিপটিপ শিশিরের ঝরে পড়া দেখব।

দাদার ফিরে আসার ক’মাস পর বাবা ঢাকার মিটফোর্ড হাসপাতালে বদলি হন। বদলির খবর এলেই বাবার মেজাজ তিরিক্ষি হয়ে থাকে। তিনি দাদার ওপর বাড়িঘর দেখাশোনার ভার দিয়ে চলে যান মিটফোর্ডে। দু’দিন পর পর গভীর রাতে ট্রেনে করে ঢাকা থেকে চলে আসেন, রাতটুকু কাটিয়ে আবার খুব ভোরবেলা রওনা হয়ে যান ঢাকায়। মিটফোর্ডে তিনি জুরিসপ্রুডেন্স বিভাগে অধ্যাপকের পদ পেয়েছেন। ছাত্র পড়ান। মর্গের লাশ কাটেন। বাবার বদলি হওয়ায় বাড়িতে সবচেয়ে বেশি যে খুশি হয়, সে আমি। আমার তখন পাখনা মেলার বয়স।

এক বিকেলে বড় শখ হয় ব্রহ্মপুত্রের তীরে পা ভিজিয়ে হাঁটতে। বাড়ি থেকে এত কাছে ব্রহ্মপুত্র অথচ এটি দেখতে যাওয়ার অনুমতি জোটে না। যখন ছোট ছিলাম, বলা হত, এত ছোট আমি, আমার একা একা দূরে যাওয়া ঠিক না, ছেলেধরারা বস্তায় ভরে আমাকে নিয়ে পালিয়ে যাবে। ফটিং টিং দাঁড়িয়ে আছে নদীর পাড়ে, পায়ে কথা কয়, হাউমাউখাউ বলে খাবে আমাকে। আর যেই না বড় হয়েছি, শুনতে হচ্ছে, বড় মেয়েদের রাস্তায় বেরোনো ঠিক না। চুপচুপ করে বাড়িতে কাউকে না জানিয়ে বেরিয়ে পড়ি বাইরে, সঙ্গে ইয়াসমিনকে নিই। মা ঘুমোচ্ছেন, দাদা বাইরে, বাবা ঢাকায়, আর আমাদের পায় কে। আমার ফটিং টিঙের ভয় নেই। যাব না কেন? যাব। সেই কত কাল থেকে বিন্দু বিন্দু করে জমিয়ে পুরো এক নদীর সমান দীর্ঘ করেছি স্বপ্ন, আমার মত করে ব্রহ্মপুত্রের তীরে হাঁটার, তার জলে পা ডুবিয়ে বসে থাকার স্বপ্ন।

ব্রহ্মপুত্রের তীরে হাঁটছি, আমার চুল উড়ছে, জামার ঝুল উড়ছে, কানে সাঁ সাঁ শব্দ পাচ্ছি বাতাসের। বিকেলের মিঠে রোদে বালু চিকচিক করছে। এমন সময়, এমন সময়ই, আমার প্রচন্ড আনন্দের বুকে বিষের তীর বেঁধাল এক যুবক। উল্টো দিক থেকে আসছিল, আমি দোষ করিনি কিছু, বাড়া ভাতে ছাই দিই নি তার, আমার দু’স্তনে আর পাছায় আমি কিছু বুঝে ওঠার আগে বিষম জোরে টিপে দিয়ে চলে গেল হাসতে হাসতে, যুবকের সঙ্গী আরও কিছু যুবক হাততালি দিয়ে হাসতে লাগল দূরে দাঁড়িয়ে। আমার শরীর, যেন এ আমার নয়, ওদের মজা করার জিনিস। ব্রহ্মপুত্র সবার নদী, আমারও। আমার অধিকার আছে এ নদীর পাড়ে আসার। কিন্তু কি অধিকারে আমাকে ওরা অপমান করে! দু’হাত আমি মুঠোবন্দি করি। ইচ্ছে হয় সবকটিকে চাবকাই। চাবকে পিঠের ছাল তুলে ফেলি। পারি না। এগোতে পারি না দু’কদম।

ইয়াসমিন কাঁপা গলায় বলে, বুবু চল বাসাত যাইগা। আমার ডর করতাছে।

ব্রহ্মপুত্রের তীর থেকে প্রচন্ড ক্রোধ নিয়ে বাড়ি ফিরে দেখি মা’র সঙ্গে ঘনিষ্ঠ বসে কথা বলছেন আমান কাকা।

— কি খবর কেমন আছো মা? আমান কাকা জিজ্ঞেস করেন।

আমি শ্যেন দৃষ্টি ফেলে লোকটির দিকে, একটি শব্দ উচ্চারণ না করে নিজের ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করি। প্রাণ খুলে কাঁদি আমি, আমার সকল অক্ষমতার জন্য কাঁদি। কাউকে বুঝতে দিই না যে আমি কাঁদছি। কাউকে বুঝতে দিই না যে যন্ত্রণার গভীর গহন জল আমাকে পাকে ফেলে নিয়ে যাচ্ছে আরও অতলে।

মা’কে জিজ্ঞেস করেছিলাম — আমান কাকা কেন আইছিল?

মা মধুর হেসে বলেছেন — ও আল্লাহর পথে আইব। ওরে নছিহত করতাছি।

আমি বলি — বেশি নছিহত করতে যাইও না। নছিহত করতে গিয়া মুবাশ্বেরা মরল, দেখলা না!

আমার স্বর এত ক্ষীণ ছিল, মা শুনতে পাননি। অথবা মা বুঁদ ছিলেন কিছুতে যে শোনার চেষ্টা করেননি।

আমান কাকা প্রতিদিন সন্ধেয় বাড়ি এসে মা’র ঘরে ঢুকে ফিসফিস কথা বলেন। মা দরজা ভেজিয়ে রাখেন সে সময়। একদিন ভেজানো দরজা ঢেলে ঢুকেছি, আমান কাকা লাফিয়ে বিছানা থেকে নামলেন, মশারির নিচে মা।

— মা এই অন্ধকারে বইসা কি কর! আমি জিজ্ঞেস করি।

মা বলেন — না, আমানের ত ওর বউএর সাথে গন্ডগোল হইছে। ওর মনডা খারাপ। তাই আমার কাছে আইসা দুঃখের কথা কইয়া একটু শান্তি পায়। ওরে বুঝাইতাছি, আল্লাহর পথে আইতে।

— আমার ক্ষিদা লাগছে। ভাত দেও।

খামোকাই বলি। ক্ষিধে পেলে মণিই আমাকে ভাত দিয়ে যায়।

মা বলেন, বিরক্ত হয়ে — আমার মাথা বেদনা করতাছে। একটু শুইছি। তগোর জ্বালায় কি একটু শুইয়াও শান্তি পাইতাম না!

ঘর ছেড়ে বেরিয়ে আসি। বারান্দার বাতাসে এসে শ্বাস নিই ফুসফুস ভরে। আমার শ্বাস কষ্ট হয়, আমান কাকার সঙ্গে মা’কে গা রেগে বসে থাকতে দেখে। যে লোক সাত বছর বয়সী আমাকে ন্যাংটো করেছিল, সে লোক অন্ধকারে মা’কেও ন্যাংটো করছে বলে আমার আশংকা হয়।

দাদারও চোখ এড়ায় না আমান কাকার অসময়ে বাড়ি ঢোকা, কেমন কেমন চোখে ইতিউতি তাকানো।
 
১৮. উইপোকার ঘরবাড়ি


মা’র কাঠের আলমারির এক তাকে কেবল বই, বাকি তাকগুলোয় কাপড় চোপড়, ভাঁজহীন, ঠাসা। বইয়ের তাকটিতে হাদিসের বই, মকসুদুল মোমেনিন, নেয়ামুল কোরআন, পীর আমিরুল্লাহর লেখা কবিতার বই মিনার, তাজকেরাতুল আওলিয়া, আর হু এম আই বলে একটি ইংরেজি বইও। আমিরুল্লাহ আবার ইংরেজিও জানেন। মা অনেকদিন আমাকে বলেছেন হুজুর খুব জ্ঞানী, ফটফট কইরা ইংরেজি কন। যখন বলেন মা, চোখদুটো উজ্জ্বল হয়ে ওঠে।

তিনি নিশ্চয় দুনিয়াদারির লেখাপড়া করেছেন! এরকম একটি প্রশ্ন আমি করতে চেয়েছি মা’কে। আবার বেয়াদবি হবে বলে পেটের ভেতর ঢুকিয়ে ফেলেছি আস্ত বাক্য। আল্লাহ রসুল নিয়ে মা আসলে কোনও যুক্তিতে যেতে চান না। পীর আমিরুল্লাহ নিয়েও নয়। যা বলবেন, তা আমি হ্যাঁ হুঁ করে শুনে গেলে মা বেজায় খুশি। মা’র যেহেতু সন্তান আমি, মা’কে খুশি করার দায়িত্ব আমার, এ রকমই জ্ঞান আমাকে দেওয়া হয়েছে। মা’কে খুশি রাখলে চড় চাপড় কিল ঘুসি থেকে বাঁচা যায়, বরং খেতে বসলে মা খাতির করে মাছ মাংসের টুকরো পাতে তুলে দেন। মা’র আদর পাওয়ার লোভের চেয়ে কিল চড় না খাওয়ার ইচ্ছেতেই ঠোঁট সেলাই করে রাখি অদৃশ্য সুতোয়। কোরান হাদিস যারা না মানে, মা স্পষ্ট বলেন, তারা মুসলমান নয়। তারা দোযখের আগুনে পুড়বে। খাতির নেই। ব্যস, সহজ হিশেব। আল্লাহর হিশেব বরাবরই বড় সহজ। নামাজ নেই রোজা নেই, তো দোযখের আগুন। বোরখা পরা নেই, দোযখের আগুন। বেগানা পুরুষের সঙ্গে মেশা, দোযখের আগুন। পেশাব করে পানি না নিলে দোযখের আগুন। জোরে হাসলে দোযখের আগুন। জোরে কাঁদলেও দোযখের আগুন। কেবল আগুন। মা’কে বলতে ইচ্ছে করে আগুনে কেন লোকের এত ভয়! আজকাল আগুন কোনও ব্যাপার হল! শীতের দেশে তো ঘরে ঘরে আগুন জ্বেলে রাখে। আগুন নিয়ে সার্কাসের লোকেরা চমৎকার খেলা খেলে। আগুনে পুড়লে চিকিৎসা আছে, সেরে যায়। আর আল্লাহই বা মানুষকে আগুনের ভয় এত দেখান কেন! আরও কত কত ভয়ংকর পদ্ধতি আছে কষ্ট দেবার, সে পথ আল্লাহ একেবারেই মাড়াননি। বদ লোকেরা শরীরে কষ্ট দিতে ভালবাসে আর চতুর লোকেরা মনে কষ্ট দেয়। শরীরের কষ্টের চেয়ে মনের কষ্টে মানুষ ভোগে বেশি। আল্লাহকে চতুর না মনে হয়ে বরং মনে হয় বড় বদ। গেতুঁর মার স্বামীর মত। সময় সময় বাবার মত, বাবা চান তিনি যা বলেন তাই যেন অক্ষরে অক্ষরে পালন করি। না পালন করলে শরীরে কষ্ট দেন আচ্ছামত পিটিয়ে। বাবার সঙ্গে আল্লাহর তফাৎ হল বাবা চান দুনিয়াদারির লেখাপড়া করে মানুষ বানাতে, আর আল্লাহর ইচ্ছে হাদিস কোরান পড়ানো। বাবার সঙ্গে আমি যেমন দূরত্ব অনুভব করি, আল্লাহর সঙ্গেও। বাবা এ বাড়িতে অনুপস্থিত থাকলে আমি খুশি হই, আবার আল্লাহর যেহেতু আকার নেই, বেচারা, আমি অপ্রস্তুত হই তাঁর প্রসঙ্গ এলেও। আসলে দু’জনের অনুপস্থিতিই আমার কাম্য। দু’জনই আমাকে দু’রকম দু’টি দিকে এমন ঠেলে দেন যে আমার নিজের কোনও অস্তিত্ব থাকে না, থাকে কেবল দ্বিখন্ডিত মর্গের লাশ। আমার ওপর খুশি হলে বাবা আমার জন্য খাঁচা ভরে মিষ্টি কিনে আনেন, বড় বড় রুই কাতলা কিনে এনে বড় পেটিগুলো খেতে বলেন। আল্লাহও তো যাকে খাওয়াবেন, তাকে নাকি একেবারে ঠেসে। পাখির মাংস, আঙুর, মদ, কত কিছু। সুন্দরী গোলাপী শরীরের মেয়েরা পুরুষের পাত্রে মদ ঢেলে দেবে। নানা বিষম খুশি যে বেহেসতের খাবার খেয়ে সুগন্ধি ঢেকুর উঠবে। আমার আবার কারও ঢেকুর তোলা দেখতে বিচ্ছিজ্ঞর লাগে। সে সুগন্ধি হোক কি দুর্গন্ধি হোক। এরকম কি হবে যে কোনও ঢেকুর তোলা লোকের সামনে নাক পেতে রইল আরেকজন ঢেকুরের সুগন্ধ নিতে। ধরা যাক সুগন্ধ ঢেকুর শোঁকা চরিত্রে গেঁতুর বাবা আর ঢেকুর ছাড়া চরিত্রে নানা। হাদিসের বইটি ডানে নিয়ে আমি চরিত্রদুটোকে আমার বাঁ পাশে বসাই। তারা ঢেকুর ছাড়ে আর ঢেকুর শোঁকে। আমি উইপোকায়, অক্ষরে, ঢেকুর ছাড়া-শোঁকায়। আমি আছি, অথচ নেই। ঢেকুর ছাড়া-শোঁকা নেই, অথচ আছে। উইপোকা আর অক্ষর থেকে যায় আমার সঙ্গেও, ঢেকুরের সঙ্গেও। তাদের বিলীন করতে মনে মনেও, আমার ইচ্ছে নেই। হাদিসের বইটির ভেতর উইপোকা বাসা বেঁধেছে। বাড়িটি স্যাঁতসেঁতে, কিছুদিন বইয়ের পাতা না ওল্টালেই উই ধরে। উইএর পেট মোটা শরীর দেখে গা রি রি করে আমার। বইটির ওপর বাবার একটি পুরোনো জুতো ঠেসে কিছু উই থেতলে ফেলি। এক চোখ উইএর থেতলে যাওয়া শরীরে, আরেক চোখ বইয়ের অক্ষরে। অক্ষর গুলো থরে থরে সাজানো আছে এরকম– দুনিয়ায় সবকিছু ভোগের সামগ্রী আর দুনিয়ার সর্বোত্তম সামগ্রী হচ্ছে নেক চরিত্রের স্ত্রী।

মেঝেয় আধ শোয়া হয়ে আমার এক হাতে জুতো, আরেক হাতে হাদিসের বই, উইএর পাছার তলে পবিত্র হাদিসের বাণী — যদি আমি কাহাকেও সেজদা করিতে হুকুম করিতাম, তবে নিশ্চয় সকল নারীকে হুকুম করিতাম তাহারা যেন তাহাদের স্বামীকে সেজদা করে।

যখন কোনও স্ত্রী তাহার স্বামীকে বলিবে যে তোমার কোনও কার্যই আমার পছন্দ হইতেছে না, তখনই তাহার সত্তর বছরের এবাদত বরবাদ হইয়া যাইবে। যদিও সে দিবসে রোজা রাখিয়া, ও রাত্রে নামাজ পড়িয়া সত্তর বছরের পুণ্য কামাই করিয়া ছিল। স্বামী স্ত্রীকে চারটি কারণে প্রহার করিতে পারে, স্ত্রীকে সাজসজ্জা করিয়া তাহার নিকট আসিতে বলার পর স্ত্রী তাহা অমান্য করিলে, সঙ্গমের উদ্দেশ্যে স্বামীর আহবান পাওয়ার পর প্রত্যাখ্যান করিলে, স্ত্রী ফরজ গোসল ও নামাজ পরিত্যাগ করিলে, স্বামীর বিনা অনুমতিতে কাহারো বাড়ি বেড়াইতে গেলে।

যে সমস্ত স্ত্রীলোক স্বামীর দ্বিতীয় বিবাহে হিংসা না করিয়া ছবর করিয়া থাকে, তাহাদিগকে আল্লাহ শহীদের তুল্য সওয়াব দান করিবেন।

পোকাগুলো বই ছেড়ে আমার গায়ের দিকে হাঁটতে থাকে। আমাকেই বুঝি এখন খেতে চায় এরা! বাড়িটি ভরে গেল ঘুণপোকায়! উইপোকায়। রাতে কুট কুট করে ঘুণপোকা কাঠ খায়, আর নিঃশব্দে উই খায় বইয়ের পাতা। মহানবী হযরত মহাম্মদের বাণীগুলোও দিব্যি খেয়ে ফেলতে থাকে। উই কি মুসলমান! উইএর নিশ্চয় ধর্ম থাকে না। এরা শরদিন্দু অমনিবাসও খায়, হাদিস কোরানও খায়।

দিলরুবা ইস্কুল ছেড়ে দেওয়ার পর আমার সঙ্গী হয়েছিল বই। লাইব্রেরির বইগুলো দ্রুত শেষ হতে থাকে। বঙ্কিম, শরৎচন্দ্র, বিভূতিভূষণ, রবীন্দ্রনাথ যা পাই ছাদে বসে, ছাদের সিঁড়িতে, পড়ার টেবিলে, বিছানায় শুয়ে, পড়ি। বাবা বাড়ি এলেই অপাঠ্য লুকিয়ে পাঠ্য বই ধরি, মূলত মেলে বসে থাকি। বাড়ির সবাই ঘুমিয়ে গেলে, চুপি চুপি বাতি জ্বেলে মশারির নিচে শুয়ে অপাঠ্য পড়ি। পাশে শুয়ে বেঘোরে ঘুমোয় ইয়াসমিন। মা মাঝে মাঝে বলেন — সারাদিন কি এত ছাইপাশ পড়স! মুবাশ্বেরা মইরা গেল। একটু আল্লাহর নাম ল এহন। সবারই ত মরতে হইব। মা’র কথার আমি কোনও উত্তর করি না। মা’র আদেশ উপদেশ আমার মাথার ওপর জৈষ্ঠ্যের সূর্য হয়ে বসে থাকে যেন আমাকে পুড়িয়ে ছাই করে দেবে।

কোরান হাদিসের কথা না মানলে আখেরাতে আর রক্ষে নেই এরকম হুমকি আমাকে অনেক শুনতে হয়েছে। তবে এ যাবৎ হাদিস কাকে বলে আমার ঠিক জানা ছিল না। এখন জানার পর আর ইচ্ছে নেই তলিয়ে জানার। গুয়ের চারিতে জানি গু-ই থাকে, ওতে ঝাঁপ দিয়ে মণি মুক্তা খুঁজে পাওয়ার কোনও কারণ নেই। উইএ খাওয়া বইটিকে দু’হাতে বন্ধ করে রাখি। বইটি থেকে বেরোতে থাকে ঢেকুর, যেন এও গিলেছে বেহেসতের খানা। মা’র পায়ের শব্দে আমি তড়িতে বইটি তুলে তাকে রেখে দিই যেমন ছিল। উইপোকা নিঃশব্দে হাদিসের বই খাচ্ছে, মা জানেন না। মা ব্যস্ত আমান কাকাকে নছিহত করতে। প্রতিরাতে, মা’র অন্ধকার ঘর থেকে ফিসফিস খিলখিল শব্দ শুনি নছিহতের। মা’কে উইপোকার খবর কিছু বলি না। ওদের ক্ষিধে লেগেছে, খাক। আমার কি দায় পড়েছে পোকা মারতে যাওয়ার!

মুবাশ্বেরা মরে গেছে বলে আমি বুঝি না আমাকে কেন আল্লাহর নাম নিতে হবে। আল্লাহর নাম আমার নিতে ইচ্ছে করে না। আমার মনে হয় আল্লাহ ফাল্লাহ সব বানানো জিনিস। কোরান এক অশিক্ষিত লোভী কামুক পুরুষের লেখা, শরাফ মামার মত কোনও লোকের। অথবা ব্রহ্মপুত্রের তীরে যে লোকটি আমার বুক পাছা চেপে ধরেছিল, সে লোকের মত। হাদিস যদি মহাম্মদের বাণী হয়, তবে মহাম্মদ লোকটি নিশ্চয় গেঁতুর মা’র স্বামীর মত, কুৎসিত, কদাকার, নিষ্ঠুর। আল্লাহ আর মহাম্মদে আমি কোনও তফাৎ দেখতে পাই না।

বইটি তাকে তুলে রাখি ঠিকই, কিন্তু মনে আমার রয়ে যায় লক্ষ উই। ভেতরে নিঃশব্দে আমার অক্ষর শব্দ বাক্য জানি না কী কী সব আরও খেয়ে যায়।

বিকেলে গেতুঁর মা আসে। গেঁতুর মা’কে দেখে আমি প্রথম চিনতে পারিনি যদিও ভাঙা গলায় আগের মতই কথা বলে যাচ্ছিল। মা বসে ছিলেন বারান্দার চেয়ারে, হাতে তসবিহর গোটা নড়ছিল, গেঁতুর মা’র কথাও মা শুনছিলেন মন দিয়ে। তসবিহ নড়াতে হলে চাই মন দিয়ে দরুদ পড়া। দুটো কি করে একই সঙ্গে পারেন মা! মা’র সম্ভবত দুটো মন। একটি মন আল্লায়, আরেকটি মন জগতে। মা’র জগতটি আবার বেশ ছোট। দিনে দু’বার সে জগতে ভ্রমণ সারা যায়। গেঁতুর মা হঠাৎ কথা থামিয়ে কাপড় সরাতে শুরু করল। মা’র আঙুল তখন নীল তসবিহর গোটা আগের চেয়ে আরও দ্রুত সরাচ্ছে। তসবিহর গোটা সরে, গেঁতুর মা’র কাপড় সরে। তালে তালে। কাপড় সরিয়ে উরু, পা, পায়ের পাতা উন্মুক্ত করল সে, পোড়া। মা আহা আহা করে উঠলেন। গেঁতুর বাবা নয়, এবারের কান্ডটি করেছেন আরেক লোক, সফর আলি। সফর আলির সঙ্গে বিয়ে হয়েছিল বছর দুই হল গেঁতুর মার। সে লোকই চেলা কাঠে আগুন লাগিয়ে পুড়েছে তাকে। কেন? যেহেতু স্বামী সে, স্বামী মাত্রই অধিকার রাখে স্ত্রীকে যা ইচ্ছে তাই করার। আমি এরকম একটি উত্তর দাঁড় করাই মনে মনে। কিন্তু মা এবং গেঁতুর মা’র জবাব ছিল সফর আলি লোকটি একটি ইতর, বদমাশ।

বলতে ইচ্ছে করে মা’কে, সফর আলি কোরান হাদিস মেনে চলে তাই বউ মেরেছে। ঠোঁটের মধ্যে অক্ষরগুলো নাড়াচাড়া করি। শেষ অবদি গিলে ফেলি। অক্ষরগুলো কি সবই উইএ খাচ্ছে! কে জানে!

গেঁতুর মা এ বাড়িতে ঝি-গিরি করতে এসেছে। পোড়া শরীর নিয়ে তার আর বিয়ে হওয়ারও জো নেই। কোনও পুরুষ তাকে আর ভাত কাপড় দেওয়ার জন্য বসে নেই। মা বলেন, তসবিহর গোটা তখন ধীরে ধীরে পার হয়, আমার তো বান্ধা কামের ছেড়ি একটা আছে। আমার আর লাগব না।

মা’র পা দুটো নড়ে। কিসের তালে কে জানে। অন্তরে তাঁর কোনও গোপন সঙ্গীত বাজে সম্ভবত। ময়ুর নাচের তাল। মা পেখম গুটিয়ে রাখেন দিনে, রাতে মেলেন। মা’র দু’পায়ের ফাকে চোখ রেখে আমি গেঁতুর মা’র সন্ধে নামা মুখখানা দেখি ঘরের চৌকাঠে বসে। আবছা অন্ধকারে মা’র হাতের তসবিহর নীল গোটাগুলো জ্বলতে থাকে বেড়ালের চোখের মত।

গেঁতুর মা’কে মা কাজ দিচ্ছেন না, কিন্তু বললেন খালি মুখে যাইও না। ডাইল ভাত কিছু খাইয়া যাইও।

আমি ফোঁস করে বলি, চৌকাঠে বসেই, পোড়া শরীর থেকে চোখ সরিয়ে — গেঁতুর মারে কামে রাখলে কি মহাভারত অশুদ্ধ হইয়া যাইত!

মা নিরুত্তাপ স্বরে বলেন — মহাভারত ত অশুদ্ধই।

গেঁতুর মা বসে থাকে বারান্দায় কাটা গাছের গুঁড়ির মত। গাছের গুঁড়ির মাথার ওপর একশ মশা চরকির মত ঘুরছে, হাতে পায়ে কালো হয়ে মশারা লঙ্গরখানার খাবার খেতে বসেছে। পোড়া ত্বক থেকে সম্ভবত অনভূতিটুকুও উবে গেছে। কেবল পেটের ক্ষিধেটুকু রয়ে গেছে পেটেই। গরিবের এই হয়, সব যায়, সংসার সমাজ স্বজন সম্পদ, কেবল ক্ষিধে যায় না। আমি যদি গেঁতুর মা হতাম, নিজেকে তার জায়গায় বসিয়ে দেখি, দুটো ডাল ভাতের জন্য আমি অপেক্ষা না করে উঠে যাচ্ছি, পেছন ফিরছি না। হেঁটে যাচ্ছি বেল গাছের তল দিয়ে কালো ফটকের বাইরে। হাঁটছি, বাতাসের আগে আগে, পাগলা দুলালের মত হাঁটছি, কোথাও কারও দিকে না ফিরে। দুলাল মাউথ অর্গান বাজিয়ে হাঁটে, আমার মাউথ অর্গান নেই, আমার বুকের ভেতর বহুকাল থেকে জমা আর্তনাদ আছে, আর কোনও বাজনার দরকার নেই আমার। ভেতর থেকে হলকা বেরোচ্ছে আগুনের, এ আগুন আমাকে আর পোড়াচ্ছে না, মন পুড়ে সেই কবেই ছাই হয়ে গেছে, শরীরে আর কোনও বাকি ত্বক নেই আমার না পোড়া — এ আগুন আমার পোড়া ত্বক থেকে ফুলকি ছড়াতে ছড়াতে যাচ্ছে। আমি যখন সফর আলীর বাড়িতে গিয়ে পৌঁছব, আমাকে দেখে সে চমকাবে, চুলো থেকে খড়ি হাতে নিয়ে তেড়ে আসবে, আমাকে স্পর্শ করার আগেই তার গায়ে আগুন ধরবে, ফুঁসে ওঠা ফুঁড়ে ওঠা আগুন, অন্ধ উদ্বাহু আগুন। আগুন ধেই ধেই নাচবে সফর আলীর শরীরে, তার হাতের জ্বলন্ত খড়িতে। তার খাঁক হওয়া অবদি আমি দাঁড়িয়ে থাকব। আমার ক্ষিধে মিটবে।

যে আগুন এতকাল ওরা আমার ভেতর পুরেছে, সেই আগুনই চতুর্গুণ ফুঁসে উঠছে আমার ভেতরে। আমি বাতাসের আগে আগে আবার পাগলা দুলালের মত হাঁটছি। আগুনই আমাকে সফর আলীর বাড়ি থেকে আলো হয়ে পথ দেখিয়ে নেবে গেঁতুর বাবার উঠোনে, সে উঠোনের বাতাসে আমি আমার কাতরানোর শব্দ পাব। সেই কাতরানো, এক উঠোন মানুষের সামনে, তালাক হয়ে যাওয়া আমার কাতরানো।

এটুকু ভেবে, আমি শ্বাস নিই। গেঁতুর মা গাছের গুঁড়ির মত বসে আছে বারান্দায়। মশা চরকির মত ঘুরছে তার মাথার ওপর। তার কুঁকড়ে থাকা শরীরটির দিকে চেয়ে আমি আর তার জায়গায় নিজেকে না বসিয়ে নিজের জায়গায়, চৌকাঠে, নিজেকে এভাবেই বসিয়ে রেখে গেঁতুর বাবার কুতকুত খেলার বয়সী বউ হই নিজে, গেঁতুর বাবার দায়ের কোপ আমাকে ফালি ফালি করে কাটে। রক্তাক্ত আমি উঠোন পড়ে কাতরাচ্ছি আর উঠোনে জড়ো হওয়া মানুষ আমাকে নিঃশব্দে দেখছে হাতে কনুইয়ের ভর রেখে, মাথার পেছনে হাত রেখে, দেখছে বায়োস্কোপের শেষ দৃশ্য। আমি তাবৎ দর্শককে চমকে দিয়ে গেঁতুর বাবার হাত থেকে দা ছিনিয়ে নিয়ে চামড়া কাটছি তার গায়ের, কেটে লবণ ছিটিয়ে দিচ্ছি। উঠোনের লোকেরা পাড়া কাঁপিয়ে চেঁচাচ্ছে, বলছে আমি পাগল, বদ্ধ পাগল।

হা পাগল!

মণির গায়ের চামড়া ছিলে মা লবণ মাখবেন বলেছিলেন ও চিংড়ি মাছের মাথা থেকে গু ফেলেনি বলে। আমান কাকা চিংড়ির মালাইকারি খেতে চেয়েছিলেন, খেতে গিয়ে তাঁর বমি হয়ে যায়। মা ক্ষেপে একেবারে ভূত হয়ে যান মণির ওপর। মণি সত্যি সত্যি ভাবছিল ওর চামড়া ছিলে লবণ মাখা হবে। আমিও। মণিকে জিজ্ঞেস করেছিলাম চামড়া ছিইলা লবণ মাখলে কি হয়রে মণি?

–যন্ত্রণা হয় খুব। মণি বলেছিল, আতংকে নীল হয়ে ছিল ওর সারা মুখ।

ওর চোখের পানি মুছে দিতে দিতে, ক’টি নিশুত রাতে ওর সঙ্গে শরীর শরীর খেলা খেলেছিলাম, মনে পড়ে। আলগোছে সরিয়ে নিই হাত। মনে মনে বলি, মণি তুই ভুলে যা ওইসব দিনের কথা, এ বাড়ি থেকে চলে গিয়ে তোর স্বপ্নের একটা ঘর তোল, তোর মা’কে আর চিনিকে নিয়ে সুখে থাক, কোনও ভরা শস্যের মাঠের কাছে থাক। যদি নদী থাকে ধারে কাছে, জলের মধ্যে কি করে সূর্য ডোবে দেখিস, আকাশে যে কি চমৎকার রং ফোটে তখন মণি! দেখিস তোর মন ভাল হবে।

মণির গায়ের চামড়া শেষঅবদি তোলেননি মা, লবণও মাখেননি। তবে কাউকে কাউকে এভাবে আমি মনে মনে যন্ত্রণা দিই। শরাফ মামাকে, আমান কাকাকে। আজ ইচ্ছে করছে গেঁতুর বাবাকে। কেবল ইচ্ছেই সার, মাঝে মাঝে ভাবি, কতটা আর পারি আসলে আমি! লিকলিকে এক মেয়ে, ঝড়ো হাওয়ায় হেলে পড়ি, আমার কি সাধ্য আছে রুখে দাঁড়াতে! মাঝে মাঝে এও ভাবি, না থাক, ইচ্ছেটুকু আছে তো!
 

Users who are viewing this thread

Back
Top