০৯. চিকিৎসাবিদ্যা
মেডিকেল ভর্তি হওয়ার জন্য এ বছর কোনও পরীক্ষার ব্যবস্থা হয়নি। মেট্রিক ইন্টারমিডিয়েটের পরীক্ষার ফল দেখে ভতির্, বারোশ নম্বরের ওপর যাদের আছে, তাদেরই নেওয়া হয়েছে। দু পরীক্ষায় বারোশর কিছু বেশি ছিল আমার, ময়মনসিংহ যদিও আমার প্রথম পছন্দ, নম্বর যেহেতু তেরোশ-চৌদ্দশ নয়, পছন্দ বাতিল করে আমাকে পাঠানো হয়েছে সিলেট মেডিকেলে। মুহূর্তে তৎপর হয়ে ওঠেন বাবা, নানা রকম দরখাসে ্ত আমার সই নেন। দাদাকে বললেন তৈরি হতে। দাদা আমাকে নিয়ে শেষরাতের ট্রেনে চড়লেন। আখাউড়া ইস্টিশনে সকালে ট্রেন থামল, এখান থেকে ট্রেন বদলে সিলেটের ট্রেনে উঠতে হবে আমাদের। ইস্টিশনে পানিঅলা, বিড়িঅলা, বাদামঅলা, ঝালমুড়িঅলা কলাঅলা পানঅলা বিস্কুটঅলার ভিড়ে আমি হারিয়ে যাই, দাদা আমাকে টেনে নিয়ে বসিয়ে দেন মেয়েদের অপেক্ষা করার একখানা ঘর আছে, সেখানে। কিছু বোরখাঅলা, কিছু বোরখাহীন, কিছু ট্যাঁ ট্যাঁ, কিছু আ আ, কিছু গু, কিছু মুত, কিছু বমি, সবকিছুর মধ্যিখানে ভদ্রলোকের মেয়ে ইস্ত্রি করা জামা পাজামা, বসে থাকি। আখাউড়া ইস্টিশন থেকে ট্রেন ছাড়ছে সিলেটের, নাগারে লোক উঠছে, লুঙ্গি, পাজামা, প্যান্ট, খালি পা, জুতো পা, টুপিমাথা, টুপিছাড়া—সুটকেস, ট্রাংক, বস্তা, ঠেলাঠেলি ভিড়। মেয়েমানুষ বলে আমাকে বসার একখানা জায়গা দেওয়া হয়েছে, মেয়ের ভাই বলে দাদাও ঠেলেঠুলে বসার একটি জায়গা করে নিলেন আমার পাশে, পরপুরুষের গায়ে যেন আমার গা না লাগে। সেকেন্ড ক্লাসে ওঠা থার্ড ক্লাস লোকগুলো সিট দখলে যায় না, মেঝেতেই পাছা পেতে বসে থাকে, কারও সামনে বস্তা, কারও সামনে খোলা দরজা গলে আসা লু হাওয়া। কোণে জড়সড় জবুথবু কটি মেয়েমানুষ, নাকে নথ, মুখে খিল। বুক পকেটে টিকিট রেখে ,সেকেন্ড ক্লাস পুরুষেরা খলবল করে কথা বলে যাচ্ছে, কান পেতে থেকেও বুঝতে পারি না একটি শব্দও।
ও দাদা কি ভাষায় কথা কয় এরা?
সিলেটি ভাষা সিলেটি ছাড়া আর কারও বাপের সাধ্য নাই যে বোঝে বলে নিরুদ্বেগে দরদাম করে এক ঠোঙা বাদাম কিনে, সঙ্গে এক চিমটি ঝালমশলা, দাদা বেশ মন দিয়ে খেতে লাগলেন। ভিড়ে গরমে চেঁচামেচিতেও আমার আনন্দ হতে থাকে নতুন একটি শহরে যাচ্ছি বলে। দাদা আমাকে জানলা থেকে দূরের একটি মাঠ দেখিয়ে বললেন ওই যে মাঠটা দেখতাছস, ওই মাঠটার ওইপারেই হইল ভারত। ইচ্ছে হয় দৌড়ে মাঠটি পেরিয়ে যাই, দেখে আসি ভারত দেখতে কেমন, ভারতের আকাশ দেখতে কেমন। ট্রেন যায় পাহাড়ের গা বেয়ে ঝরনার জলে ভিজতে ভিজতে, চা বাগানের কিনার ধরে, অন্ধকার অন্ধকার অরণ্য ডিঙিয়ে। হাত বাড়িয়ে দিই জানলার বাইরে, আঙুল ছুঁয়ে ছুঁয়ে যায় ঝুলে পড়া ডালে, পাতায়।
নতুন একটি শহরে পা দিয়ে খুশির ফোয়ারা ওঠে মনে। এটি ময়মনসিংহ নয়, অন্য একটি শহর, এই শহরের অন্য একটি নাম, নিজেকে বোঝাতে বারবার পড়ি দোকানের সাইনবোডর্। স্টেশন রোড, সিলেট। পুরান বাজার, সিলেট। দরগা রোড, সিলেট। এ শহরে দাদা আগে এসেছেন বলে জানেন কি করে কি করতে হয়, এখানকার রিক্সাঅলাদের ডাকতে হয় ড্রাইভার, রিক্সাঅলা বলে ডাকলে বিষম রাগ করে। একটি চৌকোনা রিক্সায় চড়ে আমরা শহরে ঢুকে পড়ি, ছোট একটি রেস্তোরাঁয় অসম্ভব ঝাল খাবার খেয়ে একটি হোটেলে শুতে যাই। জীবনে প্রথম কোনও হোটেলে রাত কাটানো আমার। দাদা বেঘোরে ঘুমোন। পাশের ঘর বা বারান্দা থেকে আসা খরখরে কথা আর হাসির শব্দে আমার হাত পা পেটের ভেতর সেঁধিয়ে যায়। এক্ষুনি বুঝি লোকগুলো দরজা ভেঙে এ ঘরে ঢুকবে, এক্ষুণি বুঝি আমাকে কেটে টুকরো করবে, ছিঁড়ে খাবে, আমার সর্বনাশ করবে। দাদাকে আমি কাপাঁ গলায় নিচু স্বরে, উঁচু স্বরে, কান্না স্বরে ডেকে যাই। দাদার ঘুম ভাঙে না। এক লাফে দাদার বিছানায় গিয়ে ধাক্কা দিয়ে জাগাই, ঘুমচোখে কি হইছে বলে পাশ ফিরে আবার ঘুমিয়ে পড়েন। ধড়ফড় বুক নিয়ে দাদার বিছানার এক কিনারে গুটি মেরে শুয়ে থাকি, সারারাত ঘুমোতে পারি না। ভোরের আলো ঘরে এলে, ঘরের বাইরের খরখরে গলা থেমে এলে আমার ধড়ফড় থামে।
তুই রাইতে ডরাইছিলি নাকি?
হ।
আরে ধুর! এত ডরাস কেন!
সকালে মেডিকেল কলেজে ভর্তি হয়ে, বদলির চিঠি জমা দিয়ে আমরা ট্রেন ধরলাম, ট্রেন সারারাত ধরে অন্ধকার অরণ্য পেরোলো, আর আমার গা ছমছম করল সারারাত।
সিলেট থেকে ফিরে আসার পর শাদা টেট্রনের কাপড় কিনে দুটো এপ্রোন বানিয়ে দিলেন বাবা, এপ্রোন পরে কলেজে যেতে হবে। নিজের শহরের কলেজে, বাপের কলেজ, বাড়ি থেকে দুদিনের পথ পাড়ি দিয়ে নয়, গাঙ্গিনার পাড় পেরিয়ে রেললাইন পেরিয়ে পুরোনো আবাসিক ইশকুল পেরিয়ে চড়পাড়ার মোড় ছাড়িয়ে যে কলেজ, সে কলেজে। জোয়ান রিক্সাঅলা হলে পনেরো মিনিট, বুড়ো হলে পঁচিশ। সিলেটের পাট চুকিয়ে ময়মনসিংহে। আদেশ মত এপ্রোন পরে কলেজে যাই, এপ্রোনের তলে জামা পাজামা, ওড়না পরার ঝামেলা নেই, এপ্রোনের তলে ওড়না আছে কি নেই তার খোঁজ কেউ নেয় না। এই ঘটনাটি আমাকে আনন্দ দেয় বেশ। ওড়নার বাধ্যবাধকতা নেই। যে কেউ, ছেলে বা মেয়ে, যে পোশাকই পরুক না কেন, ওপরে চাপাতে হবে শাদা এপ্রোন। এপ্রোনে কোটের কলারের মত কলার আছে, পকেট আছে, কোমরে বেল্ট আছে—পরে পুলক লাগে আমার। কলেজে সব অচেনা মখু । বেশির ভাগের বাড়ি ঢাকায়, থাকে হোস্টেলে, আমি আর হাতে গোনা দএু কজন কেবল শহরের। মেয়েদের ইশকুল কলেজে পড়ে আসা মেয়ে আমি, ছেলেছোকরা দেখে অভ্যস্ত নই, আর এখানে ক্লাসে, করিডোরে, মাঠে, সিঁড়িতে বাঁকা চোখের, হাসি চোখের, তেরচা চোখের, হাঁ হয়ে থাকা চোখের সামনে নিয়ে আমাকে হাঁটতে হয়, ভয় ভয় লাগে। জড়তা আমাকে নিবিড় করে জড়িয়ে রাখে। যে কক্ষটিতে আমাদের, নতুন ভর্তি হওয়া ছাত্রছাত্রীদের, প্রথম নিয়ে যাওয়া হল, সে কক্ষের দরজার মাথায় শাদা কালিতে লেখা শব ব্যবচ্ছেদ কক্ষ। কক্ষটিতে ঢুকতেই বিশ্রি একটি গন্ধে আমার চোখ নাক কুঁচকে থাকে,নাড়ি পাক খেতে থাকে, মুখে থুতু জমতে থাকে, বমি ঠেকাতে শ্বাস বন্ধ করে রাখি, কিন্তু শ্বাসেরও তো বন্ধ হয়ে থাকার একটা সীমা আছে, সীমা ছাড়ালেই গন্ধটি ছোবল দেয় নাকে, আর নাক থেকে পেটে পিঠে পায়ে, এমনকি পায়ের আঙুলেও ছড়িয়ে পড়ে। মরা মানুষগুলো টেবিলে শোয়া, টেবিল ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে শাদা এপ্রোন পরা ছেলেমেয়ে, কেবল দাঁড়িয়ে নয়, রীতিমত ঝুঁকে, যেন মরা মানুষের গায়ে দোলনচাপাঁর ঘ্রাণ, শুঁকছে। মানুষগুলো একসময় হাসত, কাঁদত, কাউকে ভালবাসত, আঙুলে সুঁই ফুটলে চিৎকার করত, আর এখন এই যে কাটা হচ্ছে, ছেঁড়া হচ্ছে, বুকের মাংস সরিয়ে ভেতরের হৃদপিণ্ড তুলে আনা হচ্ছে, এতটুকু টের পাচ্ছে না। শিরদাঁড়া বেয়ে এক শীতল মৃত্যু নামতে থাকে, ছড়িয়ে যেতে থাকে আমার সমস্ত শরীরে। একদিন সবাই আমরা এক এক করে মরে যাব, মরে এরকম অনুভূতিহীন এক একটি ববস্তু হয়ে উঠব। দল ফেলে রেখে দু্রত বেরিয়ে আসি কক্ষটি থেকে, সঙ্গে মৃত্যু আসে গায়ে গায়ে লেগে। করিডোরে হাঁটি, মৃত্যুও হাঁটে। বাইরে ইউকেলিপটাস গাছের তলায় বসি, মৃত্যুও বসে।
পুরো ক্লাসের ছেলেমেয়েদের চারভাগ করে দেওয়া হল দ্বিতীয় দিন। মাথা, বুক, হাতপা, তলপেট। আমার ভাগে তলপেট পড়ল, অথবা তলপেটের ভাগে আমি। ব্যস, এখন মরা মানুষ কেটে কেটে তলপেট শেখো, তলপেটে যা যা আছে, ট্রেতে নিয়ে, সঙ্গীসহ একটি নিরিবিলি কোণ বেছে নাও,কানিংহামের বই আছে, একজন পড়বে,আরেকজন শুনবে, একজন বুঝবে, আরেকজন প্রশ্ন করবে, একজন সায় দেবে, আরেকজন আপত্তি তুলবে। সদলবলে পড়া আর যাকে দিয়ে হোক আমাকে দিয়ে হবে না। হোস্টেলের ছেলেমেয়েরা স্থায়ী সঙ্গী বেছে নিয়েছে পড়ার জন্য, আমার স্থায়ী অস্থায়ী কিছুই নেই, আমি একা। বাড়ি থেকে রিক্সা করে একা আসি, ক্লাস শেষে একা বাড়ি চলে যাই, একা পড়ি। বাবা ঢাউস ঢাউস কিছু বই কিনে দিয়েছেন, বড় বড় রঙিন ছবি আছে ওতে, পাতা উল্টো যখন বইয়ের ছবি দেখি, ইয়াসমিন বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে থাকে। পড়তে গেলে ষাট ভাগই মাথায় ঢোকে না, পনেরো ভাগ ঢুকেই আবার বেরিয়ে যায়, আর পঁচিশ ভাগ মাথা তো মাথা, আমার ত্রিসীমানায় ঘেষে না। গ্রে -র এনাটমি বইটি দেখে সবচেয়ে খুশি হন মা। মা এসব বইয়ের নাম আগেই জানেন, বাবা যখন ডাক্তারি পড়তেন, তিনি গুছিয়ে রাখতেন, চাইলে এগিয়ে দিতেন। বাবার আমলে দৈর্ঘ্যে প্রস্থে এত বিশাল ছিল না বই, আমার আমলে এসে সব আজদাহা পাথর আর গাছের গুঁড়ির আকার ধারণ করেছে। যখন বইয়ের ওপর ঝুঁকে থাকি, পড়ি কি না পড়ি, মা লেবুর শরবত, নয়ত মুড়িভাজা, নয়ত আদা চা রেখে যান টেবিলে, নিঃশব্দে। বাড়িতে আদর উপচে পড়ছে আমার জন্য, কলেজে যাবার আগে মা চুল আঁচড়ে দেন, ইস্ত্রি করে দেন জামা কাপড় এপ্রোন, সেন্ডেল এগিয়ে দেন পায়ের কাছে। আর কলেজে ঢুকেই আমার দশা রীতিমত করুণ হয়ে ওঠে – না বলতে পারি পড়া, না কাটতে পারি মড়া। ঢাকার মেয়েরা হোস্টেলে থেকে থেকে নিজেদের মধ্যে বন্ধু পেতে নিয়েছে, দল বেঁধে হাটেঁ, দল বেঁধে হাসে, দল বেঁধে উত্তর দেয় মাস্টারের রাশি রাশি প্রশ্নের। এমন দুর্দশায় সুজিত কুমার অপু নামের এক চশমা পরা, গাল বসা, তেলে চপচপ চুলের ছেলে আমাকে উদ্ধার করল, বলল চল একলগে পড়ি, তুমার বাসার লগে দিয়াই ত আমার বাসা। কি কও, বিকালে যামুনে! অপুর সঙ্গে পড়া শুরু হল আমার, তলপেট। প্রথম দিনই পড়তে হল যৌনাঙ্গ, কানিংহামের বইয়ে হাঁ হয়ে থাকা এক বেশরম যৌনাঙ্গ সামনে নিয়ে আমাকে বসতে হয়, অপু বিস্তারিত বর্ণনা করে যৌনাঙ্গের কোন মাংসের কোন তল দিয়ে কোন স্নায়ু কতদূর যায়, রক্তের নালিগুলো কোন পথে ভ্রমণ শেষে কোথায় পৌঁছয়। মা আমাদের জন্য চা বিস্কুট নিয়ে আসেন। বাবা রাতে ফিরে আরাম কেদারায় গা ফেলে আমাকে ডাকেন কি পড়তাছ দেখি, বইডা আন তো! বাবার সামনে কানিংহামের যৌনাঙ্গ মেলে ধরি, এই পড়ছি, এই পড়ানো হচ্ছে ক্লাসে। বাবা অপ্রতিভ হয়েও হন না, ইংরেজির আশ্রয় নিয়ে দুচার কথায় যৌনাঙ্গ জ্ঞান দিয়েই তিনি প্রসঙ্গ পাল্টান। কলেজ থেকে ফিরে প্রায় বিকেলে অপু পড়তে চলে আসে, যৌনাঙ্গের পুঙ্খানপুুঙ্খ বর্ণণায় যেই না মাতে অপু তাকে থামিয়ে আমি ভিন্ন প্রসঙ্গে উঁকি দিই, আচ্ছা কলেজ থেকে একটা সাহিত্য পত্রিকা বের করলে কেমন হয়! অপুর কাকা প্রণব সাহা শহরের নামকরা ছড়াকার, অপু নিজেও ছড়া লেখে, প্রস্তাব শুনে সে লাফিয়ে ওঠে। ব্যস, দলীয় পড়াশুনায় ইতি টেনে আমি নেমে পড়ি সাহিত্যচর্চায়। কলেজে টাঙানো দেখেছি কবিতা গল্প ছড়া লেখা দেয়াল পত্রিকা, আপাতত একটি দেয়াল পত্রিকাই না হয় করি! পরীক্ষা আসার আগে যেমন মন দিই পড়াশোনায়, তেমন মন দিয়ে করি কৃশানু। কিন্তু কে টাঙাবে কলেজে এটি! অপুর নিজের একটি ছড়া নিয়েছি বলে এমনই কৃতার্থ যে সে একদিন আটটার কলেজে সাড়ে সাতটায় গিয়ে দেয়ালে কৃশানু টাঙিয়ে আসে। ছাত্র ছাত্রীরা করিডোরে হাঁটতে গিয়ে পত্রিকাটির সামনে দাঁড়ায়, লেখাগুলো পড়ে—দূর থেকে দেখি। কলেজে সাংস্কৃতিক সপ্তাহ শুরু হয়ে গেছে, দেয়াল পত্রিকাও প্রতিযোগিতায় দাঁড়াবে। অপুকে বলি ক্লাসের ছেলেমেয়েদের কাছ থেকে লেখা যোগাড় করতে। ঢিমেতালে কিছু লেখা পৌঁছল হাতে; না কবিতা না ছড়া না গল্প না প্রবন্ধ – ওগুলোকেই খানিকটা মানুষ বানিয়ে, বাবার পকেট থেকে আলগোছে টাকা সরিয়ে কাগজ কলম রং তুলি কিনে বসে গেলাম অমৃত নামে আরও একটি দেয়াল পত্রিকা বানাতে। বৈঠকঘরের মেঝে জুড়ে অমৃতর কাজ করি সারারাত। আমার তখন সাতখুন মাপ, শত হলেও ডাক্তারি পড়ে মেয়ে, কবিতা টবিতা লেখার শখ আছে, নাহয় থাকুক। এসব ছেলেমি একদিন কেটে যাবে।
আমার অনেক কিছু কাটে, ছেলেমি কাটে না। অপু যাচ্ছে নেত্রকোনায়,তার বাড়িতে,রেলগাড়ি করে, যেহেতু রেলগাড়ি আমাকে চুম্বকের মত টানে, কিছু হালকা বন্ধুত্ব হওয়া মেয়েদের নিয়ে অপুর সঙ্গে নেত্রকোনা যাওয়ার মতলব করি। অপু কথা দেয়, বিকেলেই ফিরে আসবে। কলেজ থেকে বাড়ির পথ বাঁয়ে রেখে ডানে ইস্টিশনের দিকে যাই, কয়লার গাড়ি কালো ধোঁয়া ছেড়ে ঝিকির ঝিকির করে চলতে শুরু করে, গাড়ি যখন চলে আমার খুব আনন্দ হয়, যখনই কোথাও থামে, মন খারাপ হয়ে যায়, জানালায় গলা বাড়িয়ে ইঞ্জিনের দিকে আকুল তাকিয়ে প্রাথর্ণা করি পুনঃ ঝিকির ঝিকিরের। নেত্রকোনা নেমে অপুর বাড়িতে খেয়ে দেয়ে, শহরের নদীমাঠ ইত্যাদি দেখে যখন রেল ইস্টিশনে পৌঁছোই ময়মনসিংহের গাড়ি ধরার জন্য, গাড়ি মুহুর্মুহু আসছে, কিন্তু যাচ্ছে মোহনগঞ্জের দিকে, ময়মনসিংহের দিকে নয়। সন্ধে নেমে আসে, আকাশ থেকে অন্ধকারের পাথর পড়ে বুকে। বাড়িতে কি হচ্ছে তা অনুমান করারও দুঃসাহস হারিয়ে ফেলতে থাকি। হোস্টেলের মেয়েদের নিশ্চিন্তি দেখে আমার ইচ্ছে করে ওদের মত ভাগ্য পেতে, বাড়িছাড়া রক্তচোখছাড়া স্বাধীন জীবন যাপন করতে। শেষ অবদি গাড়ি এল। সেই গাড়ি চলে কি চলে না করে রাত দশটার দিকে পৌঁছল ময়মনসিংহ শহরে। সারা পথই আমি নানারকম উত্তর সাজিয়েছি বাড়িতে বলার জন্য, কোনও উত্তরই জুৎসুই হয় না, সারা পথই আমার মখু গলা পেটের পানি তলপেটের দিকে নামতে থাকে। আমি একা অপরাগ বলে বাকিরা এগিয়ে আসে সমস্যা সমাধানে। অপু আমাকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে আসবে, বলবে সে আমাকে এবং আরও কজনকে নেত্রকোনা বেড়াতে নিয়ে গিয়েছিল, যত দোষ অপু ঘোষ। সমাধানটি মনঃপূত হয় না। শেষে সকলকেই ধরে নিয়ে আসি অবকাশে, এক দঙ্গল মেয়েকে দেখিয়ে বাড়িতে বলি, এরাও ছিল আমার সঙ্গে। একা একটি পুরুষের সঙ্গে দূরে কোথাও ফূর্তি করতে যাওয়া নয়, এক দল মেয়ে নিয়ে পিকনিক পিকনিক ঘুরে আসা,বোধবুদ্ধিহীন রেলগাড়ির জন্যই দেরি হওয়াটি ঘটেছে, অপু ছিল সঙ্গে সেটিই সান্ত্বনা—মা বুঝে নেন। সে যাত্রা বেঁচে যাই। রক্ষে যে বাবা বাড়িতে ফেরেননি তখনও। ফিরলেও সম্ভবত খুব বিস্ফোরণ ঘটাতেন না, কারণ সে রাতে তিনি খবর পেয়েছেন তাঁর মা মারা গেছেন। বাবার মা, আমার দাদি। দাদি মাঝে মাঝে বড়দাদার সঙ্গে আসতেন অবকাশে বেড়াতে। দাদি দেখতে কালো, কিন্তু সুন্দরী। নাক চোখ মখু সব ধারালো। মার ধারণা এই দাদি বাবার আপন মা নন। বাবা আর বাবার বড় বোনের আপন মা ছিলেন এই দাদির বড় বোন। বড়দাদাকে, দাদিকে, বড় ফুপুকে এই গোপন কথাটি অনেকদিন জিজ্ঞেস করেও কোনও উত্তর পাইনি। আপন মা না হলেও এই মার জন্য বাবার আদর কম ছিল না। আদর বলতে শাড়ি কাপড় পাঠানো, অসখু ব্যাধিতে ওষধু পাঠানো, একেবারে শয্যাশায়ী হলে নিজে মাদারিনগর গিয়ে দেখে আসা। এবার বাবা ঠিক করলেন দাদির চল্লিশায় তিনি যাবেন গ্রামের বাড়িতে। আমাকে আর ইয়াসমিনকে চোখ নাচিয়ে বললেন, কি যাবা নাকি কান্ট্রিসাইডে? আমন্ত্রণের আভাস পেয়ে লাফিয়ে উঠি খুশিতে। আমার আর ইয়াসমিনের কখনও যাওয়া হয়নি গ্রামের বাড়িতে। দাদা ছোটদা গিয়েছিলেন যুদ্ধের সময়। দাদার ক্যামেরাটি হাতে নিয়ে বাবার সঙ্গে গ্রামের পথে রওনা হই ভোরবেলা। নৌকো, বাস, রিক্সা, পায়ে হাঁটা এসবের ধকলের পর বাড়ি পৌঁছি। ধকলকে ধকল মনে হয়নি। ঘরের বাইরে বের হতে পারার মত আনন্দ আর কি আছে! যে কোনও নতুন জায়গা, সে গ্রাম হোক শহর হোক, দেখতে ভাল লাগে আমার। ঢাকা শহরে যাওয়ার যে আনন্দ, নান্দাইলের মাদারিনগর গ্রামে যাওয়ার আনন্দ তার চেয়ে কম নয়। দুপুরবেলা প্রচুর লোক এল খেতে, গ্রামের গরিব লোক, বাবার গরিব আত্মীয়। সবাইকে উঠোনে বসিয়ে কলাপাতায় খাওয়া দেওয়া হল। বাবা নিজে পাতে পাতে বেড়ে দিলেন। ক্যামেরায় বাবার নানা ঢংএর ছবি তুলে রাখি। আমাদের দেখতে গ্রামের বাচ্চা কাচ্চা পুরুষমহিলা সব জড়ো হন ও বাড়িতে। শহর থেকে আসা যে কোনও প্রাণীই তাদের কাছে এক থোকা বিস্ময়!বাড়ির সবগুলো ঘর বাঁশের বেড়ায় বানানো, খড়ের ছাউনি,মাটির মেঝে। বড়দাদার বড় ঘরটির চারপাশ ঘিরে ঈমান আলী, রিয়াজউদ্দিন, আবদুল মতিনের ঘর তোলা হয়েছে। তাঁরা বউ ছেলেমেয়ে নিয়ে খেয়ে পরে বেঁচে আছেন। বড়দাদার ঘরে একটি বড় সিন্দুক, সিন্দুকের ওপর বিছানা পেতে ঘুমোন তিনি। সারাদিন বসে বসে মাছ ধরার জাল বোনেন। চোখে ভাল দেখতে পান না। কিন্তু অসখু বিসুখে যে যাবেন শহরে, থাকবেন অবকাশে, তা নয়, তাঁকে টেনে হিঁচড়েও শহরে নেওয়া যায় না আজকাল। নিজের ভিটে ছেড়ে কোথাও তাঁর এ বয়সে যেতে ইচ্ছে করে না। বাবা দিগন্ত অবদি বিস্তৃত সবুজ ধানি জমি দেখালেন আমাদের। সব তিনি নিজে কিনেছেন। এত জমি, এত গরু, এত গোলা ভরা ধান বাড়িতে, কিন্তু কারও জীবন যাপনে চাকচিক্য নেই। পরনে মাদারিনগর বাজারের সস্তা নীল লুঙ্গি। কুঁড়েঘরের তক্তপোষে ঘুমোন, বেগুন পোড়া আর পাইন্যা ডাল দিয়ে ভাত খেয়ে হুঁকো টানেন দাওয়ায় বসে, দুশ্চিন্তার সুরুজ যেন মাথার এক হাত ওপরে বসে আছে, মখু গুলো তাই তিতিবিরক্তিতে বাঁকা। বউদের পরনেও মোটা সুতির কাপড়। পনেরোকে পঁচিশ লাগে দেখতে। পঁচিশকে পঞ্চাশ। তবু গ্রামের অন্য বাড়ির চেয়ে এ বাড়ির লোকদের ভাবা হয় ধনী। ধন তাঁরা জীবন যাপনে ব্যয় করেন না, ধন জমিয়ে রেখে নতুন জমি কেনা আর এর ওর বিরুদ্ধে মামলা করার নেশায় বুঁদ হয়ে থাকেন। এ বাড়ির জন্য বাবা হলেন ভগবান। যে যতটুক যক্ষরাজ কূবের বনেছেন, বাবার টাকাতেই বনেছেন। বাবা যেভাবে আদেশ করেন, সেভাবে সকলে চলে। কার ছেলে ইশকুলে যাবে, কার মেয়ের বিয়ের পাত্র খুঁজতে হবে, সবই বাবা বলে দেন, ইশকুলে পড়ার খরচাও বাবা দেন, বিয়ের খরচাও। গ্রামের ইশকুল শেষ হলে রিয়াজউদ্দিনের ছেলেকে শহরের ইশকুলে ভর্তি করাবেন বলে দেন। শহরের ইশকুলে ভর্তি হওয়া মানে অবকাশের উঠোনে টিনের ঘরে ওদের জায়গা হওয়া। রিয়াজউদ্দিনের বড় ছেলে সিরাজ, যখন অবকাশে থেকে শহরের ইশকুলে পড়ত, একদিন কাঠফাটা গরমের শুনশান দুপুরে ইয়াসমিনকে, বয়স কত হবে আর, নয় কি দশ, ন্যাংটো করেছিল। রুনুখালা বেড়াতে এসে উঠোনে হাঁটতে হাঁটতে টিনের ঘরের দিকে উঁকি দিয়ে ন্যাংটো দৃশ্যটি দেখে ফেলেন, খবর পেয়ে বাড়ি এসে সিরাজ আর ইয়াসমিনের পিঠে উঠোনে যত খড়ি ছিল ভেঙে, সিরাজকে সেদিনই বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিয়েছিলেন বাবা। সিরাজ শহরের অন্য জায়গায় ঘর ভাড়া করে থেকে ইশকুল পাশ দিয়ে এখন কলেজে ঢুকেছে। দাদির চল্লিশায় সিরাজ এ বাড়িতে এসেছে, কিন্তু ঘটনার এত বছর পরও বাবার মুখোমুখি হওয়ার সাহস তার নেই। বাড়ির পাশেই কবর দেওয়া দাদির মাথার কাছে একটি চারাগাছ পুঁতে বাবা আমাদের সঙ্গে নিয়ে বিকেল বিকেল শহরে ফিরে আসেন। পথে তিনি নিঃসংকোচে বর্ণনা করেন তাঁর গত জীবনের দুঃসহ দারিদ্রের কথা। কোন বাড়িতে জন্ম হয়ে আজ তিনি কোথায় এসে পৌঁছেছেন, তা আমাদের বুঝতে বলেন। বলেন আমরাও যেন ওপরের দিকে তাকাই, যেন বড় হই শিক্ষাদীক্ষায় কাজেকমের্, যেন মানুষের মত মানুষ হই। আরাম আয়েশ আলসেমিতে যেন বথৃা উড়িয়ে না দিই সময়।
এদিকে কলেজে ছাত্রলীগ, ছাত্রইউনিয়ন, জাসদ-ছাত্রলীগ, ছাত্রদল ইত্যাদি রাজনৈতিক দল ঢাকা থেকে গানের শিল্পীদের এনে চমৎকার চমৎকার নবীন বরণ অনুষ্ঠান করে আমাদের বরণ করছে। এক দল আরেক দলের চেয়ে জমকালো অনুষ্ঠান করার প্রতিযোগিতায় ব্যস্ত এক দল খুরশিদ আলমকে নিয়ে এলো, আরেক দল ফেরদৌস ওয়াহিদকে। কেবল গানের অনুষ্ঠানই নয়, লম্বা লম্বা রাজনৈতিক বক্তৃতা দেওয়ার জন্যও ঢাকা থেকে রাজনৈতিক নেতা আনা হয়। মাহমুদুর রাহমান মান্না জাসদের অনুষ্ঠানে এসে নাগারে দুঘন্টা বক্তৃতা করেন, তন্ময় হয়ে শুনি। যে দলের যে নেতাই যে কথাই বলেন, মগ্ধু হই। এত ভাল ভাল নেতা থাকতে দেশ কেন পড়ে থাকবে জিয়াউর রহমানের মত এক সেনানায়কের হাতে, ভাবি। আবার ছাত্রদলের ভাষণ শুনে মনে হয় দেশ বুঝি ঠিকই চলছে, এর চেয়ে ভাল চলার আর কোনও ব্যবস্থা নেই। নবীন বরণ উৎসব শেষ হতে না হতেই নির্বাচনের হাওয়া লাগে কলেজে। ছাত্র সংসদ নির্বাচন। কলেজে নানারকম মানুষ ভোট চায়, সবাইকে মাথা নেড়ে কথা দিতে হয় ভোট দেব। বাড়িতেও আসতে শুরু করে প্রার্থীরা। বাড়ি এসে বলে গেলে নাকি সে বলা পোক্ত হয়। বাড়িতে ভোটের জন্য অথবা যে কোনও কারণেই হোক, আমাকে খুঁজতে হরদম ছেলেপিলে আসছে, ব্যাপারটি সম্পণূর্ নতুন আমার জন্য। প্রথম বর্ষের ক্লাস গড়িমসি করে চলে, এই সুযোগে তৃতীয় সংখ্যা সেঁজুতি প্রকাশ করার উদ্যোগ নিই। কলেজে যত না সময় কাটে, তার চেয়ে বেশি কাটে জমান প্রিন্টার্সে। আগের চেয়ে আরও হৃষ্টপুষ্ট এই সেঁজুতি। এ সংখ্যা সেঁজুতিতে একটি জিনিস উল্লেখযোগ্য, প্রথম পাতার সম্পাদিকা তসলিমা নাসরিন চলে গেছে ছোট অক্ষরে শেষ পাতার শেষে। সম্পাদিকার বদলে সম্পাদক। সেঁজুতি হাতে নিয়ে দাদা প্রথম থেকে শেষ অবদি পড়ে শেষে থমকে যান, বানান ভুল রইয়া গেছে। সম্পাদিকার জায়গায় সম্পাদক ছাপা হইছে। হেসে বলি, এইটা ভুল না। এইটা আমি ইচ্ছা কইরা দিছি।
কস কি? তুই কি ছেড়া নাকি?
ছেড়া হইতাম কেন?
তুই কি লিঙ্গ বিশ্বাস করস না?
করি।
পুংলিঙ্গ স্ত্রীলিঙ্গ বইলা যে একটা ব্যাপার আছে, তা জানস?
জানি। কিন্তু সম্পাদিকা প্রকাশিকা এইসব ইকা টিকা আমি পছন্দ করি না। ছেলে মেয়ে দুইজনই সম্পাদক হইতে পারে। শব্দের মধ্যে অহেতুক কিছু লিঙ্গের আমদানি হইছে, যা আমি ব্যবহার করতে চাই না। যে মেয়ে কবিতা লেখে তারে আমি কবি কইতে চাই, মহিলাকবি না।
দাদা সেঁজুতি ছুঁড়ে দিয়ে বলেন, মাইনষে তরে পাগল কইব।
ক্লাসে যাদের সঙ্গে আলাপ হয় এক দুকথার পরই বলি শতাব্দী চক্র নামে একটা সাহিত্যগোষ্ঠী করি, চল। হালকা হালকা বন্ধুত্বের মেয়েগুলোকেও বলি। বইপোকাগুলো মোটেও ভিড়তে চায়নি, আর পোকা যাদের ধারে কাছে ভেড়ে না, ওরা লাফিয়ে উঠল, ব্যস, চাঁদা তোলো, খামোকা লাফালে তো কাজের কাজ কিস্যু হবে না। ছোটখাট একটি কমিটি বানিয়ে ফেলে, এবার, আমার প্রস্তাব, কিছু একটা করা চাই। অমৃত দ্বিতীয় পুরস্কার পাওয়ার পর ঝোঁক চাপে শতাব্দী থেকে সেঁজুতির মত একটি কবিতাপত্রিকা করার। মনে কিছু উদয় হয় তো ঝাঁপিয়ে পড়ি, অবশ্য আমার সব ঝাপাঁনোই নিঃশব্দে। বাংলা শব্দ শুদ্ধ করে লিখতে জানে, এমন যাকেই পাচ্ছি, বলছি, কবিতা লেখো। কবিতা তো আসে না বাবা! আরে আসবে। জীবনই তো কবিতা! যাপন করছ, অথচ লিখছ না! যে কটি কবিতা পাওয়া গেল, কড়া সম্পাদনা করে ছোট্ট একটা কবিতাপত্রিকা বের করি, নিজেই সি কে ঘোষ রোডের লিফা প্রিন্টাসের্ গিয়ে ছেপে আনি। ছোটদার বন্ধুর ছাপাখানা এই লিফা। লিফা দাম রাখে কম, কিন্তু রাখে। পত্রিকার নাম দিই রোদ। রোদ প্রেসে যাও, প্রুফ দেখ, রোদে ভিজে বাড়ি ফেরো। রোদ হয়ে যাওয়ার পর অপুর আবদার, দুপাতা লম্বা একটি ছড়া নিয়ে এসে, শতাব্দী থেইকা একটা ছড়াপত্রিকা হইলে কিন্তু মন্দ হয় না। তাও হবে, ছড়ার কি দোষ যে বাদ থাকবে! ঝনঝন নামে ছড়াপত্রিকাও কদিনের মধ্যে হয়ে গেল। তবে অপুর ছড়াটি কেটে আধপাতা করতে হয়েছিল, অত টাকা নেই যে এক হাত লম্বা লম্বা ছড়া ঢুকিয়ে ঢাউস কোনও পত্রিকা করা যাবে, কলেজ থেকে পাওয়া বৃত্তির টাকা শতাব্দির পেছনে খরচা করি, সদস্যরা এমাসে চাঁদা দেয় তো ও মাসে বাদ থাকে। কাঁচা কবিতা পাকা-মত করে, ছেপে, পত্রিকা করার উৎসাহ তখনও ঘোচেনি, এর ওপর উথলে উঠল নতুন উচ্ছঅ!স, নাটক। ছোটদা তখন নাটকের দলের সঙ্গে অর্ধেক রাত, আর বেশি অর্ধেক দিন কাটাচ্ছেন। ময়মনসিংহ থিয়েটার শহরে নতুন নতুন নাটক করছে, ছোটদা আমাকে মহড়া দেখাতে নিয়ে যান মাঝে মধ্যে। যখন আমার মাথায় নাটকের এক পোকা থেকে লক্ষ পোকা জন্ম নিচ্ছে, পাথর্, আমার সঙ্গেই পড়ে, একদিন সিসিম ফাঁকের মত ফাঁক করল তার ট্রাংক, বেরোল সমরেশ বসুর একটি নাটক, আবতর্। কলেজের ছেলেমেয়েদের দিয়ে এ নাটক হবে না, সত্যিকার নাট্যশিল্পী দরকার। পাণ্ডুলিপিটি আমি বাড়ি নিয়ে এসে ছোটদাকে বললাম এই নাটকটা থিয়েটারকে দাও করতে। তখন আমার পড়া হয়ে গেছে আবতর্, পড়তে পড়তে ছেলেচরিত্রে, মেয়ে চরিত্রে থিয়েটারের সদস্যদের কল্পনা করেছি, বিশাল একটি মঞ্চের সামনে থেকে পর্দা সরে যাচ্ছে, মঞ্চে আবছা আলো, সন্ধে হয়ে আসছের আলো, ঘর থেকে বেরিয়ে আসছে গীতা, গীতাকেই মানাবে মংলার মা চরিত্রে, ডাকছে উৎকণ্ঠায়, মংলা ও মংলা। থিয়েটার দল লুফে নিল নাটকটি, মহড়া শুরু হল। প্রায় বিকেলে মহড়ার দিন থিয়েটার-ঘরে উহু হচ্ছে না, আরেকটু পেছনে যান, মাথাটা চুলকাতে চুলকাতে বলেন, কারণ মংলার বাবা এখন কনফিউসড, আচ্ছা আঞ্চলিক টানটা আরও আনতে হবে কিন্তু সংলাপে, যখন বলি, নাটকের জলে আকন্ঠ ডুবে, যে কেউ ভেবে বসবে আমিই বুঝি নাটকের পরিচালক। একদিন ফরিদ আহমদ দুলাল, দলের প্রায় সব নাটকের পরিচালক, যখন বলল, পরিচালনা কিন্তু যা দেখতাছি তুমিই করতাছ, সুতরাং, কি কও, নাটকটার পরিচালকই অফিসিয়ালি হইয়া যাও।
আমি?
হ্যাঁ তুমি।
লজ্জায় মখু লুকিয়ে বলি, পাগল নাকি! আমার কোনও অভিজ্ঞতাই নাই নাটকের। জীবনে প্রথম।
টেলিভিশনে কিছু নাটক আর ছোটদার সঙ্গে ঝুলে ময়মনসিংহের মঞ্চে কিছু নাটক দেখে আর কিছু নাটকের বই পড়ে নাটক পরিচালনা করার বিদ্যে অর্জন হয় বলে আমার জানা নেই। কিন্তু আমার ওপর যখন সত্যি সত্যি ভার পড়ল নাটক পরিচালনার, ছোটদা পার্থকেও বললেন ডেকে আনতে। পাথর্ তুমুল উৎসাহে নেমে গেল। প্রায় রাতে ময়মনসিংহ থিয়েটারের ভাঙা বাড়িতে মহড়া চলে। গ্রামের গরিব পরিবারের গল্প। গীতা নায়িকার ভূমিকায়, নায়িকার ভূমিকায় গীতা অবশ্য মঞ্চে প্রথম নয়, এর আগেও নানারকম নাচের দল থেকে সে নকশি কাথাঁর মেয়ে, চণ্ডালিকা, চিত্রাঙ্গদা করেছে। নায়কের ভূমিকায় ময়মনসিংহ থিয়েটারে নতুন যোগ দেওয়া গানের ছেলে সোহানকে নেওয়া হল। মংলা চরিত্রের জন্য ছোট একটি বাচ্চা ছেলে যোগাড় করা হল। প্রচণ্ড উদ্যম এক একজনের মধ্যে, উৎসাহ আর উদ্দীপনায় টগবগ করা মানুষগুলো পারলে দিন রাতের যে কোনও সময় এক পায়ে খাড়া মহড়া দিতে। রাতে মহড়া শেষে পাথর্ হোস্টেলে ফিরে যায়, কোনও কোনও রাত আবার অবকাশেও কাটায়। আবর্তর শো শুরু হল টাউনহলে, মঞ্চ সজ্জায় যার দায়িত্ব ছিল, চোখকাড়া মঞ্চ সাজিয়েছে সত্যিকার কুঁড়েঘর বানিয়ে, সত্যিকার মাটিতে সত্যিকার গাছ পুঁতে, সত্যিকার মাছ ধরার জাল উঠোনে, দেখে আমি অভিভূত। তিন রাত ধরে শো। টিকিট কিনে লোক এল নাটক দেখতে, তিনশ লোকের হল ধীরে ধীরে, আশ্চর্য, ভরে গেল। যেন চোখের পলকে ঘটে গেল এত বড় ব্যাপারটি। ময়মনসিংহ থিয়েটার শহরের নামি দল নাটকের, আর তাদের সবচেয়ে ভাল এবং সফল নাটক আবতর্। নাটকের পোস্টারে ছাপা আবর্তর দুজন পরিচালকের নাম, ঈশিতা হোসেন পাথর্ আর তসলিমা নাসরিন।
নাটক আরও দীর্ঘ দীর্ঘ দিন এভাবেই চলতে পারত, কিন ্তু গীতার ডাক পড়ল ঢাকায়। টেলিভিশনে নাচের অনুষ্ঠান হবে, রাহিজা খানম তাকে ডেকেছেন নাচতে। বুলবুল একাডেমিতে নাচের মেয়ে কম পড়েছে, ডাক ডাক গীতাকে ডাক বলে রাহিজা খানম গীতা যেখানেই থাক ডেকে নিয়ে যান। গীতা নেচে বেড়ায় ঢাকায়। টেলিভিশনে গীতার নাচ থাকলে বাড়ির সবাই বসে সে নাচ দেখি। মা আর গীতাকে নর্তকী বলে গাল দেন না। গীতার জীবনটি রহস্যে ভরা। এক্ষুনি জীবন উজাড় করে দিল, পরক্ষণেই কেড়ে নিল। মঞ্চে চমৎকার অভিনয় করে গীতা, কী জানি জীবনের মঞ্চে সে যা করছে সবই অভিনয় কি না। গীতার জীবনের অনেকটাই গীতার ট্রাংকে লুকোনো। নানারকম জিনিস ওতে, গোপন করার মত অনেক জিনিস। যখন সে বাড়ির বাইরে যায়, ট্রাংকে তালা লাগিয়ে যায়। আমার খুব দেখতে ইচ্ছে করে কী কী আছে ট্রাংকের ভেতর। গোপন করার মত তখনও আমার কিছু নেই। সবই খোলা, সবই মেলা, ইচ্ছে করে আমারও গোপন কিছু থাক, আমার একার কিছু ছোটদার সঙ্গে গীতার প্রেম বা বিয়ে যখনও কিছু হয়নি, তাদের বাড়িতে গিয়েছিলাম, মূলত হেনামাসির কাছে যাওয়া যে মাসিটি আমাদের পড়াতেন, তখন গীতার ট্রাংকটি দেখেছিলাম, সরু চৌকিতে, যে চৌকিতে সে শুত, তার ওপরই বালিশের কাছে রাখা। বিয়ের পর সে বাপের বাড়ি থেকে আর কিছু না আনুক, তার যক্ষের ধন ট্রাংকটি এনেছে। ট্রাংকটি একদিন তালাহীন পেয়ে দেখি ওতে রাজ্যির জিনিস, ছোটদার লেখা তিরিশ চল্লিশ পাতার চিঠি, ছোট ছোট গয়না, পয়সার থলে, আমার দৃষ্টি কাড়ে তুলো লাগানো ব্রেসিয়ারগুলো। সতেরো পার হয়েছে, কিন্তু ও জিনিসটি কখনও পরে দেখিনি। মার ব্রেসিয়ারও মা সবসময় লুকিয়ে রাখেন, শাড়ি নয়ত শায়ার আড়ালে, উঠোনের দড়িতে কখনও ব্রেসিয়ার শুকোতেও দেন না, টিনের ঘরের পেছনে, যেখানে কুকুর বেড়ালও যায় না, রোদে ফেলে শুকিয়ে আনেন, যেন সাংঘাতিক নিষিদ্ধ জিনিস এগুলো। ইয়াসমিনকে আড়ালে ডেকে, কেউ যেন না দেখে না শোনে, নিষিদ্ধ জিনিস সম্পর্কে যা জ্ঞান আছে আমার, ঝেড়ে, বললাম, যা তো গাঙিনার পাড় থেইকা এইরকম একটা জিনিস কিন্যা নিয়া আয়, রিক্সা কইরা যাইবি আর আসবি। আমি ওর হাতে টাকা ধরিয়ে দিয়ে বারান্দায় বসে রইলাম, যেন ও এলেই জিনিসটি কারও চোখে পড়ার আগে আমি আড়াল করতে পারি। সেই বিকেলে ইয়াসমিনের কিনে নিয়ে আসা ব্রেসিয়ার পরে দিব্যি চপু চাপ বসে রইলাম, নিষিদ্ধ জিনিসে আনন্দ যেমন আছে, ভয়ও আছে, চাইছিলাম না কেউ আমার আশেপাশে আসুক, বুঝুক যে আমি নতুন একটি জিনিস পরেছি আজ। কিন্তু ছোটদার সঙ্গে সখ্য তখন এমন যে, ছোটদা বাড়ি ঢুকেই হৈ চৈ করে আমাকে ডাকেন, কোনও একটি গল্পের বই আমাকে পড়তে হবে, আর তিনি খেতে খেতে শুয়ে বিশ্রাম নিতে নিতে প্রায় ঘুমোতে ঘুমোতে শুনবেন। আমি যখন জড়সড়, বারবার জামা টানছি কাঁধের দিকে, যেন কিছুতেই উঁকি না দেয় নিষিদ্ধের ফিতে, ছোটদা এসে পিঠে এক চাপড় দিয়ে বললেন কিরে কি হইছে তর, একলা একলা বইসা রইছস কেন?
পিঠের চাপড়টিই বিপদ যা ডাকার, ডাকল। ছোটদা তুমুল হেসে বললেন কি রে তুই দেখি ব্রেসিয়ার পরছস!
গলা ফাটিয়ে সারাবাড়ি জানিয়ে দিলেন, নাসরিন ব্রেসিয়ার পরছে।
পরার পর পনেরো মিনিটও যায়নি, বাড়ির সবাই জেনে গেল, আমি কি পরেছি।
টেবিলের দিকে গা ঠেসে থাকলাম, আমার মাথা ক্রমে নুয়ে আসতে থাকল বইয়ের ওপর, গোপন জিনিসটি গোপন না থাকার কষ্টে বইয়ের পাতা ভিজতে লাগল। মা এসে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললেন ব্রেসিয়ার পরার ইচ্ছা হইছে, আমারে কইবা না? আমি তো তোমার সাইজের কিন্যা দিতে পারতাম।
আমার মখু মাথা কান শরমে গরম হতে থাকল। ব্রেসিয়ারের ঘটনা স্বাভাবিক হওয়ার পর মা বলেছিলেন, বিয়ের বছর দুই পর মা যখন প্রথম ব্রেসিয়ার পরলেন, বাবা এমন ক্ষেপেছিলেন যে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে ঝংকার দিয়ে উঠেছিলেন, খারাপ মেয়েছেলের মত ঢং এর জিনিস পর ! শখে বাঁচ না! এই জিনিসটি পরা মানে ঢং করা ফ্যাশন করা এরকমই ভাবে অনেকে। গ্রামের মেয়েরা সারাজীবন ব্রেসিয়ার কাকে বলে না জেনেই জীবন কাটিয়ে যায়। বাবা গ্রামের ছেলে, তাঁর দেখে অভ্যেস নেই কাপড়ের তলের বাড়তি কাপড়।
মেডিকেল ভর্তি হওয়ার জন্য এ বছর কোনও পরীক্ষার ব্যবস্থা হয়নি। মেট্রিক ইন্টারমিডিয়েটের পরীক্ষার ফল দেখে ভতির্, বারোশ নম্বরের ওপর যাদের আছে, তাদেরই নেওয়া হয়েছে। দু পরীক্ষায় বারোশর কিছু বেশি ছিল আমার, ময়মনসিংহ যদিও আমার প্রথম পছন্দ, নম্বর যেহেতু তেরোশ-চৌদ্দশ নয়, পছন্দ বাতিল করে আমাকে পাঠানো হয়েছে সিলেট মেডিকেলে। মুহূর্তে তৎপর হয়ে ওঠেন বাবা, নানা রকম দরখাসে ্ত আমার সই নেন। দাদাকে বললেন তৈরি হতে। দাদা আমাকে নিয়ে শেষরাতের ট্রেনে চড়লেন। আখাউড়া ইস্টিশনে সকালে ট্রেন থামল, এখান থেকে ট্রেন বদলে সিলেটের ট্রেনে উঠতে হবে আমাদের। ইস্টিশনে পানিঅলা, বিড়িঅলা, বাদামঅলা, ঝালমুড়িঅলা কলাঅলা পানঅলা বিস্কুটঅলার ভিড়ে আমি হারিয়ে যাই, দাদা আমাকে টেনে নিয়ে বসিয়ে দেন মেয়েদের অপেক্ষা করার একখানা ঘর আছে, সেখানে। কিছু বোরখাঅলা, কিছু বোরখাহীন, কিছু ট্যাঁ ট্যাঁ, কিছু আ আ, কিছু গু, কিছু মুত, কিছু বমি, সবকিছুর মধ্যিখানে ভদ্রলোকের মেয়ে ইস্ত্রি করা জামা পাজামা, বসে থাকি। আখাউড়া ইস্টিশন থেকে ট্রেন ছাড়ছে সিলেটের, নাগারে লোক উঠছে, লুঙ্গি, পাজামা, প্যান্ট, খালি পা, জুতো পা, টুপিমাথা, টুপিছাড়া—সুটকেস, ট্রাংক, বস্তা, ঠেলাঠেলি ভিড়। মেয়েমানুষ বলে আমাকে বসার একখানা জায়গা দেওয়া হয়েছে, মেয়ের ভাই বলে দাদাও ঠেলেঠুলে বসার একটি জায়গা করে নিলেন আমার পাশে, পরপুরুষের গায়ে যেন আমার গা না লাগে। সেকেন্ড ক্লাসে ওঠা থার্ড ক্লাস লোকগুলো সিট দখলে যায় না, মেঝেতেই পাছা পেতে বসে থাকে, কারও সামনে বস্তা, কারও সামনে খোলা দরজা গলে আসা লু হাওয়া। কোণে জড়সড় জবুথবু কটি মেয়েমানুষ, নাকে নথ, মুখে খিল। বুক পকেটে টিকিট রেখে ,সেকেন্ড ক্লাস পুরুষেরা খলবল করে কথা বলে যাচ্ছে, কান পেতে থেকেও বুঝতে পারি না একটি শব্দও।
ও দাদা কি ভাষায় কথা কয় এরা?
সিলেটি ভাষা সিলেটি ছাড়া আর কারও বাপের সাধ্য নাই যে বোঝে বলে নিরুদ্বেগে দরদাম করে এক ঠোঙা বাদাম কিনে, সঙ্গে এক চিমটি ঝালমশলা, দাদা বেশ মন দিয়ে খেতে লাগলেন। ভিড়ে গরমে চেঁচামেচিতেও আমার আনন্দ হতে থাকে নতুন একটি শহরে যাচ্ছি বলে। দাদা আমাকে জানলা থেকে দূরের একটি মাঠ দেখিয়ে বললেন ওই যে মাঠটা দেখতাছস, ওই মাঠটার ওইপারেই হইল ভারত। ইচ্ছে হয় দৌড়ে মাঠটি পেরিয়ে যাই, দেখে আসি ভারত দেখতে কেমন, ভারতের আকাশ দেখতে কেমন। ট্রেন যায় পাহাড়ের গা বেয়ে ঝরনার জলে ভিজতে ভিজতে, চা বাগানের কিনার ধরে, অন্ধকার অন্ধকার অরণ্য ডিঙিয়ে। হাত বাড়িয়ে দিই জানলার বাইরে, আঙুল ছুঁয়ে ছুঁয়ে যায় ঝুলে পড়া ডালে, পাতায়।
নতুন একটি শহরে পা দিয়ে খুশির ফোয়ারা ওঠে মনে। এটি ময়মনসিংহ নয়, অন্য একটি শহর, এই শহরের অন্য একটি নাম, নিজেকে বোঝাতে বারবার পড়ি দোকানের সাইনবোডর্। স্টেশন রোড, সিলেট। পুরান বাজার, সিলেট। দরগা রোড, সিলেট। এ শহরে দাদা আগে এসেছেন বলে জানেন কি করে কি করতে হয়, এখানকার রিক্সাঅলাদের ডাকতে হয় ড্রাইভার, রিক্সাঅলা বলে ডাকলে বিষম রাগ করে। একটি চৌকোনা রিক্সায় চড়ে আমরা শহরে ঢুকে পড়ি, ছোট একটি রেস্তোরাঁয় অসম্ভব ঝাল খাবার খেয়ে একটি হোটেলে শুতে যাই। জীবনে প্রথম কোনও হোটেলে রাত কাটানো আমার। দাদা বেঘোরে ঘুমোন। পাশের ঘর বা বারান্দা থেকে আসা খরখরে কথা আর হাসির শব্দে আমার হাত পা পেটের ভেতর সেঁধিয়ে যায়। এক্ষুনি বুঝি লোকগুলো দরজা ভেঙে এ ঘরে ঢুকবে, এক্ষুণি বুঝি আমাকে কেটে টুকরো করবে, ছিঁড়ে খাবে, আমার সর্বনাশ করবে। দাদাকে আমি কাপাঁ গলায় নিচু স্বরে, উঁচু স্বরে, কান্না স্বরে ডেকে যাই। দাদার ঘুম ভাঙে না। এক লাফে দাদার বিছানায় গিয়ে ধাক্কা দিয়ে জাগাই, ঘুমচোখে কি হইছে বলে পাশ ফিরে আবার ঘুমিয়ে পড়েন। ধড়ফড় বুক নিয়ে দাদার বিছানার এক কিনারে গুটি মেরে শুয়ে থাকি, সারারাত ঘুমোতে পারি না। ভোরের আলো ঘরে এলে, ঘরের বাইরের খরখরে গলা থেমে এলে আমার ধড়ফড় থামে।
তুই রাইতে ডরাইছিলি নাকি?
হ।
আরে ধুর! এত ডরাস কেন!
সকালে মেডিকেল কলেজে ভর্তি হয়ে, বদলির চিঠি জমা দিয়ে আমরা ট্রেন ধরলাম, ট্রেন সারারাত ধরে অন্ধকার অরণ্য পেরোলো, আর আমার গা ছমছম করল সারারাত।
সিলেট থেকে ফিরে আসার পর শাদা টেট্রনের কাপড় কিনে দুটো এপ্রোন বানিয়ে দিলেন বাবা, এপ্রোন পরে কলেজে যেতে হবে। নিজের শহরের কলেজে, বাপের কলেজ, বাড়ি থেকে দুদিনের পথ পাড়ি দিয়ে নয়, গাঙ্গিনার পাড় পেরিয়ে রেললাইন পেরিয়ে পুরোনো আবাসিক ইশকুল পেরিয়ে চড়পাড়ার মোড় ছাড়িয়ে যে কলেজ, সে কলেজে। জোয়ান রিক্সাঅলা হলে পনেরো মিনিট, বুড়ো হলে পঁচিশ। সিলেটের পাট চুকিয়ে ময়মনসিংহে। আদেশ মত এপ্রোন পরে কলেজে যাই, এপ্রোনের তলে জামা পাজামা, ওড়না পরার ঝামেলা নেই, এপ্রোনের তলে ওড়না আছে কি নেই তার খোঁজ কেউ নেয় না। এই ঘটনাটি আমাকে আনন্দ দেয় বেশ। ওড়নার বাধ্যবাধকতা নেই। যে কেউ, ছেলে বা মেয়ে, যে পোশাকই পরুক না কেন, ওপরে চাপাতে হবে শাদা এপ্রোন। এপ্রোনে কোটের কলারের মত কলার আছে, পকেট আছে, কোমরে বেল্ট আছে—পরে পুলক লাগে আমার। কলেজে সব অচেনা মখু । বেশির ভাগের বাড়ি ঢাকায়, থাকে হোস্টেলে, আমি আর হাতে গোনা দএু কজন কেবল শহরের। মেয়েদের ইশকুল কলেজে পড়ে আসা মেয়ে আমি, ছেলেছোকরা দেখে অভ্যস্ত নই, আর এখানে ক্লাসে, করিডোরে, মাঠে, সিঁড়িতে বাঁকা চোখের, হাসি চোখের, তেরচা চোখের, হাঁ হয়ে থাকা চোখের সামনে নিয়ে আমাকে হাঁটতে হয়, ভয় ভয় লাগে। জড়তা আমাকে নিবিড় করে জড়িয়ে রাখে। যে কক্ষটিতে আমাদের, নতুন ভর্তি হওয়া ছাত্রছাত্রীদের, প্রথম নিয়ে যাওয়া হল, সে কক্ষের দরজার মাথায় শাদা কালিতে লেখা শব ব্যবচ্ছেদ কক্ষ। কক্ষটিতে ঢুকতেই বিশ্রি একটি গন্ধে আমার চোখ নাক কুঁচকে থাকে,নাড়ি পাক খেতে থাকে, মুখে থুতু জমতে থাকে, বমি ঠেকাতে শ্বাস বন্ধ করে রাখি, কিন্তু শ্বাসেরও তো বন্ধ হয়ে থাকার একটা সীমা আছে, সীমা ছাড়ালেই গন্ধটি ছোবল দেয় নাকে, আর নাক থেকে পেটে পিঠে পায়ে, এমনকি পায়ের আঙুলেও ছড়িয়ে পড়ে। মরা মানুষগুলো টেবিলে শোয়া, টেবিল ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে শাদা এপ্রোন পরা ছেলেমেয়ে, কেবল দাঁড়িয়ে নয়, রীতিমত ঝুঁকে, যেন মরা মানুষের গায়ে দোলনচাপাঁর ঘ্রাণ, শুঁকছে। মানুষগুলো একসময় হাসত, কাঁদত, কাউকে ভালবাসত, আঙুলে সুঁই ফুটলে চিৎকার করত, আর এখন এই যে কাটা হচ্ছে, ছেঁড়া হচ্ছে, বুকের মাংস সরিয়ে ভেতরের হৃদপিণ্ড তুলে আনা হচ্ছে, এতটুকু টের পাচ্ছে না। শিরদাঁড়া বেয়ে এক শীতল মৃত্যু নামতে থাকে, ছড়িয়ে যেতে থাকে আমার সমস্ত শরীরে। একদিন সবাই আমরা এক এক করে মরে যাব, মরে এরকম অনুভূতিহীন এক একটি ববস্তু হয়ে উঠব। দল ফেলে রেখে দু্রত বেরিয়ে আসি কক্ষটি থেকে, সঙ্গে মৃত্যু আসে গায়ে গায়ে লেগে। করিডোরে হাঁটি, মৃত্যুও হাঁটে। বাইরে ইউকেলিপটাস গাছের তলায় বসি, মৃত্যুও বসে।
পুরো ক্লাসের ছেলেমেয়েদের চারভাগ করে দেওয়া হল দ্বিতীয় দিন। মাথা, বুক, হাতপা, তলপেট। আমার ভাগে তলপেট পড়ল, অথবা তলপেটের ভাগে আমি। ব্যস, এখন মরা মানুষ কেটে কেটে তলপেট শেখো, তলপেটে যা যা আছে, ট্রেতে নিয়ে, সঙ্গীসহ একটি নিরিবিলি কোণ বেছে নাও,কানিংহামের বই আছে, একজন পড়বে,আরেকজন শুনবে, একজন বুঝবে, আরেকজন প্রশ্ন করবে, একজন সায় দেবে, আরেকজন আপত্তি তুলবে। সদলবলে পড়া আর যাকে দিয়ে হোক আমাকে দিয়ে হবে না। হোস্টেলের ছেলেমেয়েরা স্থায়ী সঙ্গী বেছে নিয়েছে পড়ার জন্য, আমার স্থায়ী অস্থায়ী কিছুই নেই, আমি একা। বাড়ি থেকে রিক্সা করে একা আসি, ক্লাস শেষে একা বাড়ি চলে যাই, একা পড়ি। বাবা ঢাউস ঢাউস কিছু বই কিনে দিয়েছেন, বড় বড় রঙিন ছবি আছে ওতে, পাতা উল্টো যখন বইয়ের ছবি দেখি, ইয়াসমিন বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে থাকে। পড়তে গেলে ষাট ভাগই মাথায় ঢোকে না, পনেরো ভাগ ঢুকেই আবার বেরিয়ে যায়, আর পঁচিশ ভাগ মাথা তো মাথা, আমার ত্রিসীমানায় ঘেষে না। গ্রে -র এনাটমি বইটি দেখে সবচেয়ে খুশি হন মা। মা এসব বইয়ের নাম আগেই জানেন, বাবা যখন ডাক্তারি পড়তেন, তিনি গুছিয়ে রাখতেন, চাইলে এগিয়ে দিতেন। বাবার আমলে দৈর্ঘ্যে প্রস্থে এত বিশাল ছিল না বই, আমার আমলে এসে সব আজদাহা পাথর আর গাছের গুঁড়ির আকার ধারণ করেছে। যখন বইয়ের ওপর ঝুঁকে থাকি, পড়ি কি না পড়ি, মা লেবুর শরবত, নয়ত মুড়িভাজা, নয়ত আদা চা রেখে যান টেবিলে, নিঃশব্দে। বাড়িতে আদর উপচে পড়ছে আমার জন্য, কলেজে যাবার আগে মা চুল আঁচড়ে দেন, ইস্ত্রি করে দেন জামা কাপড় এপ্রোন, সেন্ডেল এগিয়ে দেন পায়ের কাছে। আর কলেজে ঢুকেই আমার দশা রীতিমত করুণ হয়ে ওঠে – না বলতে পারি পড়া, না কাটতে পারি মড়া। ঢাকার মেয়েরা হোস্টেলে থেকে থেকে নিজেদের মধ্যে বন্ধু পেতে নিয়েছে, দল বেঁধে হাটেঁ, দল বেঁধে হাসে, দল বেঁধে উত্তর দেয় মাস্টারের রাশি রাশি প্রশ্নের। এমন দুর্দশায় সুজিত কুমার অপু নামের এক চশমা পরা, গাল বসা, তেলে চপচপ চুলের ছেলে আমাকে উদ্ধার করল, বলল চল একলগে পড়ি, তুমার বাসার লগে দিয়াই ত আমার বাসা। কি কও, বিকালে যামুনে! অপুর সঙ্গে পড়া শুরু হল আমার, তলপেট। প্রথম দিনই পড়তে হল যৌনাঙ্গ, কানিংহামের বইয়ে হাঁ হয়ে থাকা এক বেশরম যৌনাঙ্গ সামনে নিয়ে আমাকে বসতে হয়, অপু বিস্তারিত বর্ণনা করে যৌনাঙ্গের কোন মাংসের কোন তল দিয়ে কোন স্নায়ু কতদূর যায়, রক্তের নালিগুলো কোন পথে ভ্রমণ শেষে কোথায় পৌঁছয়। মা আমাদের জন্য চা বিস্কুট নিয়ে আসেন। বাবা রাতে ফিরে আরাম কেদারায় গা ফেলে আমাকে ডাকেন কি পড়তাছ দেখি, বইডা আন তো! বাবার সামনে কানিংহামের যৌনাঙ্গ মেলে ধরি, এই পড়ছি, এই পড়ানো হচ্ছে ক্লাসে। বাবা অপ্রতিভ হয়েও হন না, ইংরেজির আশ্রয় নিয়ে দুচার কথায় যৌনাঙ্গ জ্ঞান দিয়েই তিনি প্রসঙ্গ পাল্টান। কলেজ থেকে ফিরে প্রায় বিকেলে অপু পড়তে চলে আসে, যৌনাঙ্গের পুঙ্খানপুুঙ্খ বর্ণণায় যেই না মাতে অপু তাকে থামিয়ে আমি ভিন্ন প্রসঙ্গে উঁকি দিই, আচ্ছা কলেজ থেকে একটা সাহিত্য পত্রিকা বের করলে কেমন হয়! অপুর কাকা প্রণব সাহা শহরের নামকরা ছড়াকার, অপু নিজেও ছড়া লেখে, প্রস্তাব শুনে সে লাফিয়ে ওঠে। ব্যস, দলীয় পড়াশুনায় ইতি টেনে আমি নেমে পড়ি সাহিত্যচর্চায়। কলেজে টাঙানো দেখেছি কবিতা গল্প ছড়া লেখা দেয়াল পত্রিকা, আপাতত একটি দেয়াল পত্রিকাই না হয় করি! পরীক্ষা আসার আগে যেমন মন দিই পড়াশোনায়, তেমন মন দিয়ে করি কৃশানু। কিন্তু কে টাঙাবে কলেজে এটি! অপুর নিজের একটি ছড়া নিয়েছি বলে এমনই কৃতার্থ যে সে একদিন আটটার কলেজে সাড়ে সাতটায় গিয়ে দেয়ালে কৃশানু টাঙিয়ে আসে। ছাত্র ছাত্রীরা করিডোরে হাঁটতে গিয়ে পত্রিকাটির সামনে দাঁড়ায়, লেখাগুলো পড়ে—দূর থেকে দেখি। কলেজে সাংস্কৃতিক সপ্তাহ শুরু হয়ে গেছে, দেয়াল পত্রিকাও প্রতিযোগিতায় দাঁড়াবে। অপুকে বলি ক্লাসের ছেলেমেয়েদের কাছ থেকে লেখা যোগাড় করতে। ঢিমেতালে কিছু লেখা পৌঁছল হাতে; না কবিতা না ছড়া না গল্প না প্রবন্ধ – ওগুলোকেই খানিকটা মানুষ বানিয়ে, বাবার পকেট থেকে আলগোছে টাকা সরিয়ে কাগজ কলম রং তুলি কিনে বসে গেলাম অমৃত নামে আরও একটি দেয়াল পত্রিকা বানাতে। বৈঠকঘরের মেঝে জুড়ে অমৃতর কাজ করি সারারাত। আমার তখন সাতখুন মাপ, শত হলেও ডাক্তারি পড়ে মেয়ে, কবিতা টবিতা লেখার শখ আছে, নাহয় থাকুক। এসব ছেলেমি একদিন কেটে যাবে।
আমার অনেক কিছু কাটে, ছেলেমি কাটে না। অপু যাচ্ছে নেত্রকোনায়,তার বাড়িতে,রেলগাড়ি করে, যেহেতু রেলগাড়ি আমাকে চুম্বকের মত টানে, কিছু হালকা বন্ধুত্ব হওয়া মেয়েদের নিয়ে অপুর সঙ্গে নেত্রকোনা যাওয়ার মতলব করি। অপু কথা দেয়, বিকেলেই ফিরে আসবে। কলেজ থেকে বাড়ির পথ বাঁয়ে রেখে ডানে ইস্টিশনের দিকে যাই, কয়লার গাড়ি কালো ধোঁয়া ছেড়ে ঝিকির ঝিকির করে চলতে শুরু করে, গাড়ি যখন চলে আমার খুব আনন্দ হয়, যখনই কোথাও থামে, মন খারাপ হয়ে যায়, জানালায় গলা বাড়িয়ে ইঞ্জিনের দিকে আকুল তাকিয়ে প্রাথর্ণা করি পুনঃ ঝিকির ঝিকিরের। নেত্রকোনা নেমে অপুর বাড়িতে খেয়ে দেয়ে, শহরের নদীমাঠ ইত্যাদি দেখে যখন রেল ইস্টিশনে পৌঁছোই ময়মনসিংহের গাড়ি ধরার জন্য, গাড়ি মুহুর্মুহু আসছে, কিন্তু যাচ্ছে মোহনগঞ্জের দিকে, ময়মনসিংহের দিকে নয়। সন্ধে নেমে আসে, আকাশ থেকে অন্ধকারের পাথর পড়ে বুকে। বাড়িতে কি হচ্ছে তা অনুমান করারও দুঃসাহস হারিয়ে ফেলতে থাকি। হোস্টেলের মেয়েদের নিশ্চিন্তি দেখে আমার ইচ্ছে করে ওদের মত ভাগ্য পেতে, বাড়িছাড়া রক্তচোখছাড়া স্বাধীন জীবন যাপন করতে। শেষ অবদি গাড়ি এল। সেই গাড়ি চলে কি চলে না করে রাত দশটার দিকে পৌঁছল ময়মনসিংহ শহরে। সারা পথই আমি নানারকম উত্তর সাজিয়েছি বাড়িতে বলার জন্য, কোনও উত্তরই জুৎসুই হয় না, সারা পথই আমার মখু গলা পেটের পানি তলপেটের দিকে নামতে থাকে। আমি একা অপরাগ বলে বাকিরা এগিয়ে আসে সমস্যা সমাধানে। অপু আমাকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে আসবে, বলবে সে আমাকে এবং আরও কজনকে নেত্রকোনা বেড়াতে নিয়ে গিয়েছিল, যত দোষ অপু ঘোষ। সমাধানটি মনঃপূত হয় না। শেষে সকলকেই ধরে নিয়ে আসি অবকাশে, এক দঙ্গল মেয়েকে দেখিয়ে বাড়িতে বলি, এরাও ছিল আমার সঙ্গে। একা একটি পুরুষের সঙ্গে দূরে কোথাও ফূর্তি করতে যাওয়া নয়, এক দল মেয়ে নিয়ে পিকনিক পিকনিক ঘুরে আসা,বোধবুদ্ধিহীন রেলগাড়ির জন্যই দেরি হওয়াটি ঘটেছে, অপু ছিল সঙ্গে সেটিই সান্ত্বনা—মা বুঝে নেন। সে যাত্রা বেঁচে যাই। রক্ষে যে বাবা বাড়িতে ফেরেননি তখনও। ফিরলেও সম্ভবত খুব বিস্ফোরণ ঘটাতেন না, কারণ সে রাতে তিনি খবর পেয়েছেন তাঁর মা মারা গেছেন। বাবার মা, আমার দাদি। দাদি মাঝে মাঝে বড়দাদার সঙ্গে আসতেন অবকাশে বেড়াতে। দাদি দেখতে কালো, কিন্তু সুন্দরী। নাক চোখ মখু সব ধারালো। মার ধারণা এই দাদি বাবার আপন মা নন। বাবা আর বাবার বড় বোনের আপন মা ছিলেন এই দাদির বড় বোন। বড়দাদাকে, দাদিকে, বড় ফুপুকে এই গোপন কথাটি অনেকদিন জিজ্ঞেস করেও কোনও উত্তর পাইনি। আপন মা না হলেও এই মার জন্য বাবার আদর কম ছিল না। আদর বলতে শাড়ি কাপড় পাঠানো, অসখু ব্যাধিতে ওষধু পাঠানো, একেবারে শয্যাশায়ী হলে নিজে মাদারিনগর গিয়ে দেখে আসা। এবার বাবা ঠিক করলেন দাদির চল্লিশায় তিনি যাবেন গ্রামের বাড়িতে। আমাকে আর ইয়াসমিনকে চোখ নাচিয়ে বললেন, কি যাবা নাকি কান্ট্রিসাইডে? আমন্ত্রণের আভাস পেয়ে লাফিয়ে উঠি খুশিতে। আমার আর ইয়াসমিনের কখনও যাওয়া হয়নি গ্রামের বাড়িতে। দাদা ছোটদা গিয়েছিলেন যুদ্ধের সময়। দাদার ক্যামেরাটি হাতে নিয়ে বাবার সঙ্গে গ্রামের পথে রওনা হই ভোরবেলা। নৌকো, বাস, রিক্সা, পায়ে হাঁটা এসবের ধকলের পর বাড়ি পৌঁছি। ধকলকে ধকল মনে হয়নি। ঘরের বাইরে বের হতে পারার মত আনন্দ আর কি আছে! যে কোনও নতুন জায়গা, সে গ্রাম হোক শহর হোক, দেখতে ভাল লাগে আমার। ঢাকা শহরে যাওয়ার যে আনন্দ, নান্দাইলের মাদারিনগর গ্রামে যাওয়ার আনন্দ তার চেয়ে কম নয়। দুপুরবেলা প্রচুর লোক এল খেতে, গ্রামের গরিব লোক, বাবার গরিব আত্মীয়। সবাইকে উঠোনে বসিয়ে কলাপাতায় খাওয়া দেওয়া হল। বাবা নিজে পাতে পাতে বেড়ে দিলেন। ক্যামেরায় বাবার নানা ঢংএর ছবি তুলে রাখি। আমাদের দেখতে গ্রামের বাচ্চা কাচ্চা পুরুষমহিলা সব জড়ো হন ও বাড়িতে। শহর থেকে আসা যে কোনও প্রাণীই তাদের কাছে এক থোকা বিস্ময়!বাড়ির সবগুলো ঘর বাঁশের বেড়ায় বানানো, খড়ের ছাউনি,মাটির মেঝে। বড়দাদার বড় ঘরটির চারপাশ ঘিরে ঈমান আলী, রিয়াজউদ্দিন, আবদুল মতিনের ঘর তোলা হয়েছে। তাঁরা বউ ছেলেমেয়ে নিয়ে খেয়ে পরে বেঁচে আছেন। বড়দাদার ঘরে একটি বড় সিন্দুক, সিন্দুকের ওপর বিছানা পেতে ঘুমোন তিনি। সারাদিন বসে বসে মাছ ধরার জাল বোনেন। চোখে ভাল দেখতে পান না। কিন্তু অসখু বিসুখে যে যাবেন শহরে, থাকবেন অবকাশে, তা নয়, তাঁকে টেনে হিঁচড়েও শহরে নেওয়া যায় না আজকাল। নিজের ভিটে ছেড়ে কোথাও তাঁর এ বয়সে যেতে ইচ্ছে করে না। বাবা দিগন্ত অবদি বিস্তৃত সবুজ ধানি জমি দেখালেন আমাদের। সব তিনি নিজে কিনেছেন। এত জমি, এত গরু, এত গোলা ভরা ধান বাড়িতে, কিন্তু কারও জীবন যাপনে চাকচিক্য নেই। পরনে মাদারিনগর বাজারের সস্তা নীল লুঙ্গি। কুঁড়েঘরের তক্তপোষে ঘুমোন, বেগুন পোড়া আর পাইন্যা ডাল দিয়ে ভাত খেয়ে হুঁকো টানেন দাওয়ায় বসে, দুশ্চিন্তার সুরুজ যেন মাথার এক হাত ওপরে বসে আছে, মখু গুলো তাই তিতিবিরক্তিতে বাঁকা। বউদের পরনেও মোটা সুতির কাপড়। পনেরোকে পঁচিশ লাগে দেখতে। পঁচিশকে পঞ্চাশ। তবু গ্রামের অন্য বাড়ির চেয়ে এ বাড়ির লোকদের ভাবা হয় ধনী। ধন তাঁরা জীবন যাপনে ব্যয় করেন না, ধন জমিয়ে রেখে নতুন জমি কেনা আর এর ওর বিরুদ্ধে মামলা করার নেশায় বুঁদ হয়ে থাকেন। এ বাড়ির জন্য বাবা হলেন ভগবান। যে যতটুক যক্ষরাজ কূবের বনেছেন, বাবার টাকাতেই বনেছেন। বাবা যেভাবে আদেশ করেন, সেভাবে সকলে চলে। কার ছেলে ইশকুলে যাবে, কার মেয়ের বিয়ের পাত্র খুঁজতে হবে, সবই বাবা বলে দেন, ইশকুলে পড়ার খরচাও বাবা দেন, বিয়ের খরচাও। গ্রামের ইশকুল শেষ হলে রিয়াজউদ্দিনের ছেলেকে শহরের ইশকুলে ভর্তি করাবেন বলে দেন। শহরের ইশকুলে ভর্তি হওয়া মানে অবকাশের উঠোনে টিনের ঘরে ওদের জায়গা হওয়া। রিয়াজউদ্দিনের বড় ছেলে সিরাজ, যখন অবকাশে থেকে শহরের ইশকুলে পড়ত, একদিন কাঠফাটা গরমের শুনশান দুপুরে ইয়াসমিনকে, বয়স কত হবে আর, নয় কি দশ, ন্যাংটো করেছিল। রুনুখালা বেড়াতে এসে উঠোনে হাঁটতে হাঁটতে টিনের ঘরের দিকে উঁকি দিয়ে ন্যাংটো দৃশ্যটি দেখে ফেলেন, খবর পেয়ে বাড়ি এসে সিরাজ আর ইয়াসমিনের পিঠে উঠোনে যত খড়ি ছিল ভেঙে, সিরাজকে সেদিনই বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিয়েছিলেন বাবা। সিরাজ শহরের অন্য জায়গায় ঘর ভাড়া করে থেকে ইশকুল পাশ দিয়ে এখন কলেজে ঢুকেছে। দাদির চল্লিশায় সিরাজ এ বাড়িতে এসেছে, কিন্তু ঘটনার এত বছর পরও বাবার মুখোমুখি হওয়ার সাহস তার নেই। বাড়ির পাশেই কবর দেওয়া দাদির মাথার কাছে একটি চারাগাছ পুঁতে বাবা আমাদের সঙ্গে নিয়ে বিকেল বিকেল শহরে ফিরে আসেন। পথে তিনি নিঃসংকোচে বর্ণনা করেন তাঁর গত জীবনের দুঃসহ দারিদ্রের কথা। কোন বাড়িতে জন্ম হয়ে আজ তিনি কোথায় এসে পৌঁছেছেন, তা আমাদের বুঝতে বলেন। বলেন আমরাও যেন ওপরের দিকে তাকাই, যেন বড় হই শিক্ষাদীক্ষায় কাজেকমের্, যেন মানুষের মত মানুষ হই। আরাম আয়েশ আলসেমিতে যেন বথৃা উড়িয়ে না দিই সময়।
এদিকে কলেজে ছাত্রলীগ, ছাত্রইউনিয়ন, জাসদ-ছাত্রলীগ, ছাত্রদল ইত্যাদি রাজনৈতিক দল ঢাকা থেকে গানের শিল্পীদের এনে চমৎকার চমৎকার নবীন বরণ অনুষ্ঠান করে আমাদের বরণ করছে। এক দল আরেক দলের চেয়ে জমকালো অনুষ্ঠান করার প্রতিযোগিতায় ব্যস্ত এক দল খুরশিদ আলমকে নিয়ে এলো, আরেক দল ফেরদৌস ওয়াহিদকে। কেবল গানের অনুষ্ঠানই নয়, লম্বা লম্বা রাজনৈতিক বক্তৃতা দেওয়ার জন্যও ঢাকা থেকে রাজনৈতিক নেতা আনা হয়। মাহমুদুর রাহমান মান্না জাসদের অনুষ্ঠানে এসে নাগারে দুঘন্টা বক্তৃতা করেন, তন্ময় হয়ে শুনি। যে দলের যে নেতাই যে কথাই বলেন, মগ্ধু হই। এত ভাল ভাল নেতা থাকতে দেশ কেন পড়ে থাকবে জিয়াউর রহমানের মত এক সেনানায়কের হাতে, ভাবি। আবার ছাত্রদলের ভাষণ শুনে মনে হয় দেশ বুঝি ঠিকই চলছে, এর চেয়ে ভাল চলার আর কোনও ব্যবস্থা নেই। নবীন বরণ উৎসব শেষ হতে না হতেই নির্বাচনের হাওয়া লাগে কলেজে। ছাত্র সংসদ নির্বাচন। কলেজে নানারকম মানুষ ভোট চায়, সবাইকে মাথা নেড়ে কথা দিতে হয় ভোট দেব। বাড়িতেও আসতে শুরু করে প্রার্থীরা। বাড়ি এসে বলে গেলে নাকি সে বলা পোক্ত হয়। বাড়িতে ভোটের জন্য অথবা যে কোনও কারণেই হোক, আমাকে খুঁজতে হরদম ছেলেপিলে আসছে, ব্যাপারটি সম্পণূর্ নতুন আমার জন্য। প্রথম বর্ষের ক্লাস গড়িমসি করে চলে, এই সুযোগে তৃতীয় সংখ্যা সেঁজুতি প্রকাশ করার উদ্যোগ নিই। কলেজে যত না সময় কাটে, তার চেয়ে বেশি কাটে জমান প্রিন্টার্সে। আগের চেয়ে আরও হৃষ্টপুষ্ট এই সেঁজুতি। এ সংখ্যা সেঁজুতিতে একটি জিনিস উল্লেখযোগ্য, প্রথম পাতার সম্পাদিকা তসলিমা নাসরিন চলে গেছে ছোট অক্ষরে শেষ পাতার শেষে। সম্পাদিকার বদলে সম্পাদক। সেঁজুতি হাতে নিয়ে দাদা প্রথম থেকে শেষ অবদি পড়ে শেষে থমকে যান, বানান ভুল রইয়া গেছে। সম্পাদিকার জায়গায় সম্পাদক ছাপা হইছে। হেসে বলি, এইটা ভুল না। এইটা আমি ইচ্ছা কইরা দিছি।
কস কি? তুই কি ছেড়া নাকি?
ছেড়া হইতাম কেন?
তুই কি লিঙ্গ বিশ্বাস করস না?
করি।
পুংলিঙ্গ স্ত্রীলিঙ্গ বইলা যে একটা ব্যাপার আছে, তা জানস?
জানি। কিন্তু সম্পাদিকা প্রকাশিকা এইসব ইকা টিকা আমি পছন্দ করি না। ছেলে মেয়ে দুইজনই সম্পাদক হইতে পারে। শব্দের মধ্যে অহেতুক কিছু লিঙ্গের আমদানি হইছে, যা আমি ব্যবহার করতে চাই না। যে মেয়ে কবিতা লেখে তারে আমি কবি কইতে চাই, মহিলাকবি না।
দাদা সেঁজুতি ছুঁড়ে দিয়ে বলেন, মাইনষে তরে পাগল কইব।
ক্লাসে যাদের সঙ্গে আলাপ হয় এক দুকথার পরই বলি শতাব্দী চক্র নামে একটা সাহিত্যগোষ্ঠী করি, চল। হালকা হালকা বন্ধুত্বের মেয়েগুলোকেও বলি। বইপোকাগুলো মোটেও ভিড়তে চায়নি, আর পোকা যাদের ধারে কাছে ভেড়ে না, ওরা লাফিয়ে উঠল, ব্যস, চাঁদা তোলো, খামোকা লাফালে তো কাজের কাজ কিস্যু হবে না। ছোটখাট একটি কমিটি বানিয়ে ফেলে, এবার, আমার প্রস্তাব, কিছু একটা করা চাই। অমৃত দ্বিতীয় পুরস্কার পাওয়ার পর ঝোঁক চাপে শতাব্দী থেকে সেঁজুতির মত একটি কবিতাপত্রিকা করার। মনে কিছু উদয় হয় তো ঝাঁপিয়ে পড়ি, অবশ্য আমার সব ঝাপাঁনোই নিঃশব্দে। বাংলা শব্দ শুদ্ধ করে লিখতে জানে, এমন যাকেই পাচ্ছি, বলছি, কবিতা লেখো। কবিতা তো আসে না বাবা! আরে আসবে। জীবনই তো কবিতা! যাপন করছ, অথচ লিখছ না! যে কটি কবিতা পাওয়া গেল, কড়া সম্পাদনা করে ছোট্ট একটা কবিতাপত্রিকা বের করি, নিজেই সি কে ঘোষ রোডের লিফা প্রিন্টাসের্ গিয়ে ছেপে আনি। ছোটদার বন্ধুর ছাপাখানা এই লিফা। লিফা দাম রাখে কম, কিন্তু রাখে। পত্রিকার নাম দিই রোদ। রোদ প্রেসে যাও, প্রুফ দেখ, রোদে ভিজে বাড়ি ফেরো। রোদ হয়ে যাওয়ার পর অপুর আবদার, দুপাতা লম্বা একটি ছড়া নিয়ে এসে, শতাব্দী থেইকা একটা ছড়াপত্রিকা হইলে কিন্তু মন্দ হয় না। তাও হবে, ছড়ার কি দোষ যে বাদ থাকবে! ঝনঝন নামে ছড়াপত্রিকাও কদিনের মধ্যে হয়ে গেল। তবে অপুর ছড়াটি কেটে আধপাতা করতে হয়েছিল, অত টাকা নেই যে এক হাত লম্বা লম্বা ছড়া ঢুকিয়ে ঢাউস কোনও পত্রিকা করা যাবে, কলেজ থেকে পাওয়া বৃত্তির টাকা শতাব্দির পেছনে খরচা করি, সদস্যরা এমাসে চাঁদা দেয় তো ও মাসে বাদ থাকে। কাঁচা কবিতা পাকা-মত করে, ছেপে, পত্রিকা করার উৎসাহ তখনও ঘোচেনি, এর ওপর উথলে উঠল নতুন উচ্ছঅ!স, নাটক। ছোটদা তখন নাটকের দলের সঙ্গে অর্ধেক রাত, আর বেশি অর্ধেক দিন কাটাচ্ছেন। ময়মনসিংহ থিয়েটার শহরে নতুন নতুন নাটক করছে, ছোটদা আমাকে মহড়া দেখাতে নিয়ে যান মাঝে মধ্যে। যখন আমার মাথায় নাটকের এক পোকা থেকে লক্ষ পোকা জন্ম নিচ্ছে, পাথর্, আমার সঙ্গেই পড়ে, একদিন সিসিম ফাঁকের মত ফাঁক করল তার ট্রাংক, বেরোল সমরেশ বসুর একটি নাটক, আবতর্। কলেজের ছেলেমেয়েদের দিয়ে এ নাটক হবে না, সত্যিকার নাট্যশিল্পী দরকার। পাণ্ডুলিপিটি আমি বাড়ি নিয়ে এসে ছোটদাকে বললাম এই নাটকটা থিয়েটারকে দাও করতে। তখন আমার পড়া হয়ে গেছে আবতর্, পড়তে পড়তে ছেলেচরিত্রে, মেয়ে চরিত্রে থিয়েটারের সদস্যদের কল্পনা করেছি, বিশাল একটি মঞ্চের সামনে থেকে পর্দা সরে যাচ্ছে, মঞ্চে আবছা আলো, সন্ধে হয়ে আসছের আলো, ঘর থেকে বেরিয়ে আসছে গীতা, গীতাকেই মানাবে মংলার মা চরিত্রে, ডাকছে উৎকণ্ঠায়, মংলা ও মংলা। থিয়েটার দল লুফে নিল নাটকটি, মহড়া শুরু হল। প্রায় বিকেলে মহড়ার দিন থিয়েটার-ঘরে উহু হচ্ছে না, আরেকটু পেছনে যান, মাথাটা চুলকাতে চুলকাতে বলেন, কারণ মংলার বাবা এখন কনফিউসড, আচ্ছা আঞ্চলিক টানটা আরও আনতে হবে কিন্তু সংলাপে, যখন বলি, নাটকের জলে আকন্ঠ ডুবে, যে কেউ ভেবে বসবে আমিই বুঝি নাটকের পরিচালক। একদিন ফরিদ আহমদ দুলাল, দলের প্রায় সব নাটকের পরিচালক, যখন বলল, পরিচালনা কিন্তু যা দেখতাছি তুমিই করতাছ, সুতরাং, কি কও, নাটকটার পরিচালকই অফিসিয়ালি হইয়া যাও।
আমি?
হ্যাঁ তুমি।
লজ্জায় মখু লুকিয়ে বলি, পাগল নাকি! আমার কোনও অভিজ্ঞতাই নাই নাটকের। জীবনে প্রথম।
টেলিভিশনে কিছু নাটক আর ছোটদার সঙ্গে ঝুলে ময়মনসিংহের মঞ্চে কিছু নাটক দেখে আর কিছু নাটকের বই পড়ে নাটক পরিচালনা করার বিদ্যে অর্জন হয় বলে আমার জানা নেই। কিন্তু আমার ওপর যখন সত্যি সত্যি ভার পড়ল নাটক পরিচালনার, ছোটদা পার্থকেও বললেন ডেকে আনতে। পাথর্ তুমুল উৎসাহে নেমে গেল। প্রায় রাতে ময়মনসিংহ থিয়েটারের ভাঙা বাড়িতে মহড়া চলে। গ্রামের গরিব পরিবারের গল্প। গীতা নায়িকার ভূমিকায়, নায়িকার ভূমিকায় গীতা অবশ্য মঞ্চে প্রথম নয়, এর আগেও নানারকম নাচের দল থেকে সে নকশি কাথাঁর মেয়ে, চণ্ডালিকা, চিত্রাঙ্গদা করেছে। নায়কের ভূমিকায় ময়মনসিংহ থিয়েটারে নতুন যোগ দেওয়া গানের ছেলে সোহানকে নেওয়া হল। মংলা চরিত্রের জন্য ছোট একটি বাচ্চা ছেলে যোগাড় করা হল। প্রচণ্ড উদ্যম এক একজনের মধ্যে, উৎসাহ আর উদ্দীপনায় টগবগ করা মানুষগুলো পারলে দিন রাতের যে কোনও সময় এক পায়ে খাড়া মহড়া দিতে। রাতে মহড়া শেষে পাথর্ হোস্টেলে ফিরে যায়, কোনও কোনও রাত আবার অবকাশেও কাটায়। আবর্তর শো শুরু হল টাউনহলে, মঞ্চ সজ্জায় যার দায়িত্ব ছিল, চোখকাড়া মঞ্চ সাজিয়েছে সত্যিকার কুঁড়েঘর বানিয়ে, সত্যিকার মাটিতে সত্যিকার গাছ পুঁতে, সত্যিকার মাছ ধরার জাল উঠোনে, দেখে আমি অভিভূত। তিন রাত ধরে শো। টিকিট কিনে লোক এল নাটক দেখতে, তিনশ লোকের হল ধীরে ধীরে, আশ্চর্য, ভরে গেল। যেন চোখের পলকে ঘটে গেল এত বড় ব্যাপারটি। ময়মনসিংহ থিয়েটার শহরের নামি দল নাটকের, আর তাদের সবচেয়ে ভাল এবং সফল নাটক আবতর্। নাটকের পোস্টারে ছাপা আবর্তর দুজন পরিচালকের নাম, ঈশিতা হোসেন পাথর্ আর তসলিমা নাসরিন।
নাটক আরও দীর্ঘ দীর্ঘ দিন এভাবেই চলতে পারত, কিন ্তু গীতার ডাক পড়ল ঢাকায়। টেলিভিশনে নাচের অনুষ্ঠান হবে, রাহিজা খানম তাকে ডেকেছেন নাচতে। বুলবুল একাডেমিতে নাচের মেয়ে কম পড়েছে, ডাক ডাক গীতাকে ডাক বলে রাহিজা খানম গীতা যেখানেই থাক ডেকে নিয়ে যান। গীতা নেচে বেড়ায় ঢাকায়। টেলিভিশনে গীতার নাচ থাকলে বাড়ির সবাই বসে সে নাচ দেখি। মা আর গীতাকে নর্তকী বলে গাল দেন না। গীতার জীবনটি রহস্যে ভরা। এক্ষুনি জীবন উজাড় করে দিল, পরক্ষণেই কেড়ে নিল। মঞ্চে চমৎকার অভিনয় করে গীতা, কী জানি জীবনের মঞ্চে সে যা করছে সবই অভিনয় কি না। গীতার জীবনের অনেকটাই গীতার ট্রাংকে লুকোনো। নানারকম জিনিস ওতে, গোপন করার মত অনেক জিনিস। যখন সে বাড়ির বাইরে যায়, ট্রাংকে তালা লাগিয়ে যায়। আমার খুব দেখতে ইচ্ছে করে কী কী আছে ট্রাংকের ভেতর। গোপন করার মত তখনও আমার কিছু নেই। সবই খোলা, সবই মেলা, ইচ্ছে করে আমারও গোপন কিছু থাক, আমার একার কিছু ছোটদার সঙ্গে গীতার প্রেম বা বিয়ে যখনও কিছু হয়নি, তাদের বাড়িতে গিয়েছিলাম, মূলত হেনামাসির কাছে যাওয়া যে মাসিটি আমাদের পড়াতেন, তখন গীতার ট্রাংকটি দেখেছিলাম, সরু চৌকিতে, যে চৌকিতে সে শুত, তার ওপরই বালিশের কাছে রাখা। বিয়ের পর সে বাপের বাড়ি থেকে আর কিছু না আনুক, তার যক্ষের ধন ট্রাংকটি এনেছে। ট্রাংকটি একদিন তালাহীন পেয়ে দেখি ওতে রাজ্যির জিনিস, ছোটদার লেখা তিরিশ চল্লিশ পাতার চিঠি, ছোট ছোট গয়না, পয়সার থলে, আমার দৃষ্টি কাড়ে তুলো লাগানো ব্রেসিয়ারগুলো। সতেরো পার হয়েছে, কিন্তু ও জিনিসটি কখনও পরে দেখিনি। মার ব্রেসিয়ারও মা সবসময় লুকিয়ে রাখেন, শাড়ি নয়ত শায়ার আড়ালে, উঠোনের দড়িতে কখনও ব্রেসিয়ার শুকোতেও দেন না, টিনের ঘরের পেছনে, যেখানে কুকুর বেড়ালও যায় না, রোদে ফেলে শুকিয়ে আনেন, যেন সাংঘাতিক নিষিদ্ধ জিনিস এগুলো। ইয়াসমিনকে আড়ালে ডেকে, কেউ যেন না দেখে না শোনে, নিষিদ্ধ জিনিস সম্পর্কে যা জ্ঞান আছে আমার, ঝেড়ে, বললাম, যা তো গাঙিনার পাড় থেইকা এইরকম একটা জিনিস কিন্যা নিয়া আয়, রিক্সা কইরা যাইবি আর আসবি। আমি ওর হাতে টাকা ধরিয়ে দিয়ে বারান্দায় বসে রইলাম, যেন ও এলেই জিনিসটি কারও চোখে পড়ার আগে আমি আড়াল করতে পারি। সেই বিকেলে ইয়াসমিনের কিনে নিয়ে আসা ব্রেসিয়ার পরে দিব্যি চপু চাপ বসে রইলাম, নিষিদ্ধ জিনিসে আনন্দ যেমন আছে, ভয়ও আছে, চাইছিলাম না কেউ আমার আশেপাশে আসুক, বুঝুক যে আমি নতুন একটি জিনিস পরেছি আজ। কিন্তু ছোটদার সঙ্গে সখ্য তখন এমন যে, ছোটদা বাড়ি ঢুকেই হৈ চৈ করে আমাকে ডাকেন, কোনও একটি গল্পের বই আমাকে পড়তে হবে, আর তিনি খেতে খেতে শুয়ে বিশ্রাম নিতে নিতে প্রায় ঘুমোতে ঘুমোতে শুনবেন। আমি যখন জড়সড়, বারবার জামা টানছি কাঁধের দিকে, যেন কিছুতেই উঁকি না দেয় নিষিদ্ধের ফিতে, ছোটদা এসে পিঠে এক চাপড় দিয়ে বললেন কিরে কি হইছে তর, একলা একলা বইসা রইছস কেন?
পিঠের চাপড়টিই বিপদ যা ডাকার, ডাকল। ছোটদা তুমুল হেসে বললেন কি রে তুই দেখি ব্রেসিয়ার পরছস!
গলা ফাটিয়ে সারাবাড়ি জানিয়ে দিলেন, নাসরিন ব্রেসিয়ার পরছে।
পরার পর পনেরো মিনিটও যায়নি, বাড়ির সবাই জেনে গেল, আমি কি পরেছি।
টেবিলের দিকে গা ঠেসে থাকলাম, আমার মাথা ক্রমে নুয়ে আসতে থাকল বইয়ের ওপর, গোপন জিনিসটি গোপন না থাকার কষ্টে বইয়ের পাতা ভিজতে লাগল। মা এসে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললেন ব্রেসিয়ার পরার ইচ্ছা হইছে, আমারে কইবা না? আমি তো তোমার সাইজের কিন্যা দিতে পারতাম।
আমার মখু মাথা কান শরমে গরম হতে থাকল। ব্রেসিয়ারের ঘটনা স্বাভাবিক হওয়ার পর মা বলেছিলেন, বিয়ের বছর দুই পর মা যখন প্রথম ব্রেসিয়ার পরলেন, বাবা এমন ক্ষেপেছিলেন যে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে ঝংকার দিয়ে উঠেছিলেন, খারাপ মেয়েছেলের মত ঢং এর জিনিস পর ! শখে বাঁচ না! এই জিনিসটি পরা মানে ঢং করা ফ্যাশন করা এরকমই ভাবে অনেকে। গ্রামের মেয়েরা সারাজীবন ব্রেসিয়ার কাকে বলে না জেনেই জীবন কাটিয়ে যায়। বাবা গ্রামের ছেলে, তাঁর দেখে অভ্যেস নেই কাপড়ের তলের বাড়তি কাপড়।