What's new
Nirjonmela Desi Forum

Talk about the things that matter to you! Wanting to join the rest of our members? Feel free to sign up today and gain full access!

Collected উতল হাওয়া (আত্মজিবনী) (2 Viewers)

০৯. চিকিৎসাবিদ্যা



মেডিকেল ভর্তি হওয়ার জন্য এ বছর কোনও পরীক্ষার ব্যবস্থা হয়নি। মেট্রিক ইন্টারমিডিয়েটের পরীক্ষার ফল দেখে ভতির্, বারোশ নম্বরের ওপর যাদের আছে, তাদেরই নেওয়া হয়েছে। দু পরীক্ষায় বারোশর কিছু বেশি ছিল আমার, ময়মনসিংহ যদিও আমার প্রথম পছন্দ, নম্বর যেহেতু তেরোশ-চৌদ্দশ নয়, পছন্দ বাতিল করে আমাকে পাঠানো হয়েছে সিলেট মেডিকেলে। মুহূর্তে তৎপর হয়ে ওঠেন বাবা, নানা রকম দরখাসে ্ত আমার সই নেন। দাদাকে বললেন তৈরি হতে। দাদা আমাকে নিয়ে শেষরাতের ট্রেনে চড়লেন। আখাউড়া ইস্টিশনে সকালে ট্রেন থামল, এখান থেকে ট্রেন বদলে সিলেটের ট্রেনে উঠতে হবে আমাদের। ইস্টিশনে পানিঅলা, বিড়িঅলা, বাদামঅলা, ঝালমুড়িঅলা কলাঅলা পানঅলা বিস্কুটঅলার ভিড়ে আমি হারিয়ে যাই, দাদা আমাকে টেনে নিয়ে বসিয়ে দেন মেয়েদের অপেক্ষা করার একখানা ঘর আছে, সেখানে। কিছু বোরখাঅলা, কিছু বোরখাহীন, কিছু ট্যাঁ ট্যাঁ, কিছু আ আ, কিছু গু, কিছু মুত, কিছু বমি, সবকিছুর মধ্যিখানে ভদ্রলোকের মেয়ে ইস্ত্রি করা জামা পাজামা, বসে থাকি। আখাউড়া ইস্টিশন থেকে ট্রেন ছাড়ছে সিলেটের, নাগারে লোক উঠছে, লুঙ্গি, পাজামা, প্যান্ট, খালি পা, জুতো পা, টুপিমাথা, টুপিছাড়া—সুটকেস, ট্রাংক, বস্তা, ঠেলাঠেলি ভিড়। মেয়েমানুষ বলে আমাকে বসার একখানা জায়গা দেওয়া হয়েছে, মেয়ের ভাই বলে দাদাও ঠেলেঠুলে বসার একটি জায়গা করে নিলেন আমার পাশে, পরপুরুষের গায়ে যেন আমার গা না লাগে। সেকেন্ড ক্লাসে ওঠা থার্ড ক্লাস লোকগুলো সিট দখলে যায় না, মেঝেতেই পাছা পেতে বসে থাকে, কারও সামনে বস্তা, কারও সামনে খোলা দরজা গলে আসা লু হাওয়া। কোণে জড়সড় জবুথবু কটি মেয়েমানুষ, নাকে নথ, মুখে খিল। বুক পকেটে টিকিট রেখে ,সেকেন্ড ক্লাস পুরুষেরা খলবল করে কথা বলে যাচ্ছে, কান পেতে থেকেও বুঝতে পারি না একটি শব্দও।

ও দাদা কি ভাষায় কথা কয় এরা?

সিলেটি ভাষা সিলেটি ছাড়া আর কারও বাপের সাধ্য নাই যে বোঝে বলে নিরুদ্বেগে দরদাম করে এক ঠোঙা বাদাম কিনে, সঙ্গে এক চিমটি ঝালমশলা, দাদা বেশ মন দিয়ে খেতে লাগলেন। ভিড়ে গরমে চেঁচামেচিতেও আমার আনন্দ হতে থাকে নতুন একটি শহরে যাচ্ছি বলে। দাদা আমাকে জানলা থেকে দূরের একটি মাঠ দেখিয়ে বললেন ওই যে মাঠটা দেখতাছস, ওই মাঠটার ওইপারেই হইল ভারত। ইচ্ছে হয় দৌড়ে মাঠটি পেরিয়ে যাই, দেখে আসি ভারত দেখতে কেমন, ভারতের আকাশ দেখতে কেমন। ট্রেন যায় পাহাড়ের গা বেয়ে ঝরনার জলে ভিজতে ভিজতে, চা বাগানের কিনার ধরে, অন্ধকার অন্ধকার অরণ্য ডিঙিয়ে। হাত বাড়িয়ে দিই জানলার বাইরে, আঙুল ছুঁয়ে ছুঁয়ে যায় ঝুলে পড়া ডালে, পাতায়।



নতুন একটি শহরে পা দিয়ে খুশির ফোয়ারা ওঠে মনে। এটি ময়মনসিংহ নয়, অন্য একটি শহর, এই শহরের অন্য একটি নাম, নিজেকে বোঝাতে বারবার পড়ি দোকানের সাইনবোডর্। স্টেশন রোড, সিলেট। পুরান বাজার, সিলেট। দরগা রোড, সিলেট। এ শহরে দাদা আগে এসেছেন বলে জানেন কি করে কি করতে হয়, এখানকার রিক্সাঅলাদের ডাকতে হয় ড্রাইভার, রিক্সাঅলা বলে ডাকলে বিষম রাগ করে। একটি চৌকোনা রিক্সায় চড়ে আমরা শহরে ঢুকে পড়ি, ছোট একটি রেস্তোরাঁয় অসম্ভব ঝাল খাবার খেয়ে একটি হোটেলে শুতে যাই। জীবনে প্রথম কোনও হোটেলে রাত কাটানো আমার। দাদা বেঘোরে ঘুমোন। পাশের ঘর বা বারান্দা থেকে আসা খরখরে কথা আর হাসির শব্দে আমার হাত পা পেটের ভেতর সেঁধিয়ে যায়। এক্ষুনি বুঝি লোকগুলো দরজা ভেঙে এ ঘরে ঢুকবে, এক্ষুণি বুঝি আমাকে কেটে টুকরো করবে, ছিঁড়ে খাবে, আমার সর্বনাশ করবে। দাদাকে আমি কাপাঁ গলায় নিচু স্বরে, উঁচু স্বরে, কান্না স্বরে ডেকে যাই। দাদার ঘুম ভাঙে না। এক লাফে দাদার বিছানায় গিয়ে ধাক্কা দিয়ে জাগাই, ঘুমচোখে কি হইছে বলে পাশ ফিরে আবার ঘুমিয়ে পড়েন। ধড়ফড় বুক নিয়ে দাদার বিছানার এক কিনারে গুটি মেরে শুয়ে থাকি, সারারাত ঘুমোতে পারি না। ভোরের আলো ঘরে এলে, ঘরের বাইরের খরখরে গলা থেমে এলে আমার ধড়ফড় থামে।

তুই রাইতে ডরাইছিলি নাকি?

হ।

আরে ধুর! এত ডরাস কেন!

সকালে মেডিকেল কলেজে ভর্তি হয়ে, বদলির চিঠি জমা দিয়ে আমরা ট্রেন ধরলাম, ট্রেন সারারাত ধরে অন্ধকার অরণ্য পেরোলো, আর আমার গা ছমছম করল সারারাত।



সিলেট থেকে ফিরে আসার পর শাদা টেট্রনের কাপড় কিনে দুটো এপ্রোন বানিয়ে দিলেন বাবা, এপ্রোন পরে কলেজে যেতে হবে। নিজের শহরের কলেজে, বাপের কলেজ, বাড়ি থেকে দুদিনের পথ পাড়ি দিয়ে নয়, গাঙ্গিনার পাড় পেরিয়ে রেললাইন পেরিয়ে পুরোনো আবাসিক ইশকুল পেরিয়ে চড়পাড়ার মোড় ছাড়িয়ে যে কলেজ, সে কলেজে। জোয়ান রিক্সাঅলা হলে পনেরো মিনিট, বুড়ো হলে পঁচিশ। সিলেটের পাট চুকিয়ে ময়মনসিংহে। আদেশ মত এপ্রোন পরে কলেজে যাই, এপ্রোনের তলে জামা পাজামা, ওড়না পরার ঝামেলা নেই, এপ্রোনের তলে ওড়না আছে কি নেই তার খোঁজ কেউ নেয় না। এই ঘটনাটি আমাকে আনন্দ দেয় বেশ। ওড়নার বাধ্যবাধকতা নেই। যে কেউ, ছেলে বা মেয়ে, যে পোশাকই পরুক না কেন, ওপরে চাপাতে হবে শাদা এপ্রোন। এপ্রোনে কোটের কলারের মত কলার আছে, পকেট আছে, কোমরে বেল্ট আছে—পরে পুলক লাগে আমার। কলেজে সব অচেনা মখু । বেশির ভাগের বাড়ি ঢাকায়, থাকে হোস্টেলে, আমি আর হাতে গোনা দএু কজন কেবল শহরের। মেয়েদের ইশকুল কলেজে পড়ে আসা মেয়ে আমি, ছেলেছোকরা দেখে অভ্যস্ত নই, আর এখানে ক্লাসে, করিডোরে, মাঠে, সিঁড়িতে বাঁকা চোখের, হাসি চোখের, তেরচা চোখের, হাঁ হয়ে থাকা চোখের সামনে নিয়ে আমাকে হাঁটতে হয়, ভয় ভয় লাগে। জড়তা আমাকে নিবিড় করে জড়িয়ে রাখে। যে কক্ষটিতে আমাদের, নতুন ভর্তি হওয়া ছাত্রছাত্রীদের, প্রথম নিয়ে যাওয়া হল, সে কক্ষের দরজার মাথায় শাদা কালিতে লেখা শব ব্যবচ্ছেদ কক্ষ। কক্ষটিতে ঢুকতেই বিশ্রি একটি গন্ধে আমার চোখ নাক কুঁচকে থাকে,নাড়ি পাক খেতে থাকে, মুখে থুতু জমতে থাকে, বমি ঠেকাতে শ্বাস বন্ধ করে রাখি, কিন্তু শ্বাসেরও তো বন্ধ হয়ে থাকার একটা সীমা আছে, সীমা ছাড়ালেই গন্ধটি ছোবল দেয় নাকে, আর নাক থেকে পেটে পিঠে পায়ে, এমনকি পায়ের আঙুলেও ছড়িয়ে পড়ে। মরা মানুষগুলো টেবিলে শোয়া, টেবিল ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে শাদা এপ্রোন পরা ছেলেমেয়ে, কেবল দাঁড়িয়ে নয়, রীতিমত ঝুঁকে, যেন মরা মানুষের গায়ে দোলনচাপাঁর ঘ্রাণ, শুঁকছে। মানুষগুলো একসময় হাসত, কাঁদত, কাউকে ভালবাসত, আঙুলে সুঁই ফুটলে চিৎকার করত, আর এখন এই যে কাটা হচ্ছে, ছেঁড়া হচ্ছে, বুকের মাংস সরিয়ে ভেতরের হৃদপিণ্ড তুলে আনা হচ্ছে, এতটুকু টের পাচ্ছে না। শিরদাঁড়া বেয়ে এক শীতল মৃত্যু নামতে থাকে, ছড়িয়ে যেতে থাকে আমার সমস্ত শরীরে। একদিন সবাই আমরা এক এক করে মরে যাব, মরে এরকম অনুভূতিহীন এক একটি ববস্তু হয়ে উঠব। দল ফেলে রেখে দু্রত বেরিয়ে আসি কক্ষটি থেকে, সঙ্গে মৃত্যু আসে গায়ে গায়ে লেগে। করিডোরে হাঁটি, মৃত্যুও হাঁটে। বাইরে ইউকেলিপটাস গাছের তলায় বসি, মৃত্যুও বসে।

পুরো ক্লাসের ছেলেমেয়েদের চারভাগ করে দেওয়া হল দ্বিতীয় দিন। মাথা, বুক, হাতপা, তলপেট। আমার ভাগে তলপেট পড়ল, অথবা তলপেটের ভাগে আমি। ব্যস, এখন মরা মানুষ কেটে কেটে তলপেট শেখো, তলপেটে যা যা আছে, ট্রেতে নিয়ে, সঙ্গীসহ একটি নিরিবিলি কোণ বেছে নাও,কানিংহামের বই আছে, একজন পড়বে,আরেকজন শুনবে, একজন বুঝবে, আরেকজন প্রশ্ন করবে, একজন সায় দেবে, আরেকজন আপত্তি তুলবে। সদলবলে পড়া আর যাকে দিয়ে হোক আমাকে দিয়ে হবে না। হোস্টেলের ছেলেমেয়েরা স্থায়ী সঙ্গী বেছে নিয়েছে পড়ার জন্য, আমার স্থায়ী অস্থায়ী কিছুই নেই, আমি একা। বাড়ি থেকে রিক্সা করে একা আসি, ক্লাস শেষে একা বাড়ি চলে যাই, একা পড়ি। বাবা ঢাউস ঢাউস কিছু বই কিনে দিয়েছেন, বড় বড় রঙিন ছবি আছে ওতে, পাতা উল্টো যখন বইয়ের ছবি দেখি, ইয়াসমিন বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে থাকে। পড়তে গেলে ষাট ভাগই মাথায় ঢোকে না, পনেরো ভাগ ঢুকেই আবার বেরিয়ে যায়, আর পঁচিশ ভাগ মাথা তো মাথা, আমার ত্রিসীমানায় ঘেষে না। গ্রে -র এনাটমি বইটি দেখে সবচেয়ে খুশি হন মা। মা এসব বইয়ের নাম আগেই জানেন, বাবা যখন ডাক্তারি পড়তেন, তিনি গুছিয়ে রাখতেন, চাইলে এগিয়ে দিতেন। বাবার আমলে দৈর্ঘ্যে প্রস্থে এত বিশাল ছিল না বই, আমার আমলে এসে সব আজদাহা পাথর আর গাছের গুঁড়ির আকার ধারণ করেছে। যখন বইয়ের ওপর ঝুঁকে থাকি, পড়ি কি না পড়ি, মা লেবুর শরবত, নয়ত মুড়িভাজা, নয়ত আদা চা রেখে যান টেবিলে, নিঃশব্দে। বাড়িতে আদর উপচে পড়ছে আমার জন্য, কলেজে যাবার আগে মা চুল আঁচড়ে দেন, ইস্ত্রি করে দেন জামা কাপড় এপ্রোন, সেন্ডেল এগিয়ে দেন পায়ের কাছে। আর কলেজে ঢুকেই আমার দশা রীতিমত করুণ হয়ে ওঠে – না বলতে পারি পড়া, না কাটতে পারি মড়া। ঢাকার মেয়েরা হোস্টেলে থেকে থেকে নিজেদের মধ্যে বন্ধু পেতে নিয়েছে, দল বেঁধে হাটেঁ, দল বেঁধে হাসে, দল বেঁধে উত্তর দেয় মাস্টারের রাশি রাশি প্রশ্নের। এমন দুর্দশায় সুজিত কুমার অপু নামের এক চশমা পরা, গাল বসা, তেলে চপচপ চুলের ছেলে আমাকে উদ্ধার করল, বলল চল একলগে পড়ি, তুমার বাসার লগে দিয়াই ত আমার বাসা। কি কও, বিকালে যামুনে! অপুর সঙ্গে পড়া শুরু হল আমার, তলপেট। প্রথম দিনই পড়তে হল যৌনাঙ্গ, কানিংহামের বইয়ে হাঁ হয়ে থাকা এক বেশরম যৌনাঙ্গ সামনে নিয়ে আমাকে বসতে হয়, অপু বিস্তারিত বর্ণনা করে যৌনাঙ্গের কোন মাংসের কোন তল দিয়ে কোন স্নায়ু কতদূর যায়, রক্তের নালিগুলো কোন পথে ভ্রমণ শেষে কোথায় পৌঁছয়। মা আমাদের জন্য চা বিস্কুট নিয়ে আসেন। বাবা রাতে ফিরে আরাম কেদারায় গা ফেলে আমাকে ডাকেন কি পড়তাছ দেখি, বইডা আন তো! বাবার সামনে কানিংহামের যৌনাঙ্গ মেলে ধরি, এই পড়ছি, এই পড়ানো হচ্ছে ক্লাসে। বাবা অপ্রতিভ হয়েও হন না, ইংরেজির আশ্রয় নিয়ে দুচার কথায় যৌনাঙ্গ জ্ঞান দিয়েই তিনি প্রসঙ্গ পাল্টান। কলেজ থেকে ফিরে প্রায় বিকেলে অপু পড়তে চলে আসে, যৌনাঙ্গের পুঙ্খানপুুঙ্খ বর্ণণায় যেই না মাতে অপু তাকে থামিয়ে আমি ভিন্ন প্রসঙ্গে উঁকি দিই, আচ্ছা কলেজ থেকে একটা সাহিত্য পত্রিকা বের করলে কেমন হয়! অপুর কাকা প্রণব সাহা শহরের নামকরা ছড়াকার, অপু নিজেও ছড়া লেখে, প্রস্তাব শুনে সে লাফিয়ে ওঠে। ব্যস, দলীয় পড়াশুনায় ইতি টেনে আমি নেমে পড়ি সাহিত্যচর্চায়। কলেজে টাঙানো দেখেছি কবিতা গল্প ছড়া লেখা দেয়াল পত্রিকা, আপাতত একটি দেয়াল পত্রিকাই না হয় করি! পরীক্ষা আসার আগে যেমন মন দিই পড়াশোনায়, তেমন মন দিয়ে করি কৃশানু। কিন্তু কে টাঙাবে কলেজে এটি! অপুর নিজের একটি ছড়া নিয়েছি বলে এমনই কৃতার্থ যে সে একদিন আটটার কলেজে সাড়ে সাতটায় গিয়ে দেয়ালে কৃশানু টাঙিয়ে আসে। ছাত্র ছাত্রীরা করিডোরে হাঁটতে গিয়ে পত্রিকাটির সামনে দাঁড়ায়, লেখাগুলো পড়ে—দূর থেকে দেখি। কলেজে সাংস্কৃতিক সপ্তাহ শুরু হয়ে গেছে, দেয়াল পত্রিকাও প্রতিযোগিতায় দাঁড়াবে। অপুকে বলি ক্লাসের ছেলেমেয়েদের কাছ থেকে লেখা যোগাড় করতে। ঢিমেতালে কিছু লেখা পৌঁছল হাতে; না কবিতা না ছড়া না গল্প না প্রবন্ধ – ওগুলোকেই খানিকটা মানুষ বানিয়ে, বাবার পকেট থেকে আলগোছে টাকা সরিয়ে কাগজ কলম রং তুলি কিনে বসে গেলাম অমৃত নামে আরও একটি দেয়াল পত্রিকা বানাতে। বৈঠকঘরের মেঝে জুড়ে অমৃতর কাজ করি সারারাত। আমার তখন সাতখুন মাপ, শত হলেও ডাক্তারি পড়ে মেয়ে, কবিতা টবিতা লেখার শখ আছে, নাহয় থাকুক। এসব ছেলেমি একদিন কেটে যাবে।

আমার অনেক কিছু কাটে, ছেলেমি কাটে না। অপু যাচ্ছে নেত্রকোনায়,তার বাড়িতে,রেলগাড়ি করে, যেহেতু রেলগাড়ি আমাকে চুম্বকের মত টানে, কিছু হালকা বন্ধুত্ব হওয়া মেয়েদের নিয়ে অপুর সঙ্গে নেত্রকোনা যাওয়ার মতলব করি। অপু কথা দেয়, বিকেলেই ফিরে আসবে। কলেজ থেকে বাড়ির পথ বাঁয়ে রেখে ডানে ইস্টিশনের দিকে যাই, কয়লার গাড়ি কালো ধোঁয়া ছেড়ে ঝিকির ঝিকির করে চলতে শুরু করে, গাড়ি যখন চলে আমার খুব আনন্দ হয়, যখনই কোথাও থামে, মন খারাপ হয়ে যায়, জানালায় গলা বাড়িয়ে ইঞ্জিনের দিকে আকুল তাকিয়ে প্রাথর্ণা করি পুনঃ ঝিকির ঝিকিরের। নেত্রকোনা নেমে অপুর বাড়িতে খেয়ে দেয়ে, শহরের নদীমাঠ ইত্যাদি দেখে যখন রেল ইস্টিশনে পৌঁছোই ময়মনসিংহের গাড়ি ধরার জন্য, গাড়ি মুহুর্মুহু আসছে, কিন্তু যাচ্ছে মোহনগঞ্জের দিকে, ময়মনসিংহের দিকে নয়। সন্ধে নেমে আসে, আকাশ থেকে অন্ধকারের পাথর পড়ে বুকে। বাড়িতে কি হচ্ছে তা অনুমান করারও দুঃসাহস হারিয়ে ফেলতে থাকি। হোস্টেলের মেয়েদের নিশ্চিন্তি দেখে আমার ইচ্ছে করে ওদের মত ভাগ্য পেতে, বাড়িছাড়া রক্তচোখছাড়া স্বাধীন জীবন যাপন করতে। শেষ অবদি গাড়ি এল। সেই গাড়ি চলে কি চলে না করে রাত দশটার দিকে পৌঁছল ময়মনসিংহ শহরে। সারা পথই আমি নানারকম উত্তর সাজিয়েছি বাড়িতে বলার জন্য, কোনও উত্তরই জুৎসুই হয় না, সারা পথই আমার মখু গলা পেটের পানি তলপেটের দিকে নামতে থাকে। আমি একা অপরাগ বলে বাকিরা এগিয়ে আসে সমস্যা সমাধানে। অপু আমাকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে আসবে, বলবে সে আমাকে এবং আরও কজনকে নেত্রকোনা বেড়াতে নিয়ে গিয়েছিল, যত দোষ অপু ঘোষ। সমাধানটি মনঃপূত হয় না। শেষে সকলকেই ধরে নিয়ে আসি অবকাশে, এক দঙ্গল মেয়েকে দেখিয়ে বাড়িতে বলি, এরাও ছিল আমার সঙ্গে। একা একটি পুরুষের সঙ্গে দূরে কোথাও ফূর্তি করতে যাওয়া নয়, এক দল মেয়ে নিয়ে পিকনিক পিকনিক ঘুরে আসা,বোধবুদ্ধিহীন রেলগাড়ির জন্যই দেরি হওয়াটি ঘটেছে, অপু ছিল সঙ্গে সেটিই সান্ত্বনা—মা বুঝে নেন। সে যাত্রা বেঁচে যাই। রক্ষে যে বাবা বাড়িতে ফেরেননি তখনও। ফিরলেও সম্ভবত খুব বিস্ফোরণ ঘটাতেন না, কারণ সে রাতে তিনি খবর পেয়েছেন তাঁর মা মারা গেছেন। বাবার মা, আমার দাদি। দাদি মাঝে মাঝে বড়দাদার সঙ্গে আসতেন অবকাশে বেড়াতে। দাদি দেখতে কালো, কিন্তু সুন্দরী। নাক চোখ মখু সব ধারালো। মার ধারণা এই দাদি বাবার আপন মা নন। বাবা আর বাবার বড় বোনের আপন মা ছিলেন এই দাদির বড় বোন। বড়দাদাকে, দাদিকে, বড় ফুপুকে এই গোপন কথাটি অনেকদিন জিজ্ঞেস করেও কোনও উত্তর পাইনি। আপন মা না হলেও এই মার জন্য বাবার আদর কম ছিল না। আদর বলতে শাড়ি কাপড় পাঠানো, অসখু ব্যাধিতে ওষধু পাঠানো, একেবারে শয্যাশায়ী হলে নিজে মাদারিনগর গিয়ে দেখে আসা। এবার বাবা ঠিক করলেন দাদির চল্লিশায় তিনি যাবেন গ্রামের বাড়িতে। আমাকে আর ইয়াসমিনকে চোখ নাচিয়ে বললেন, কি যাবা নাকি কান্ট্রিসাইডে? আমন্ত্রণের আভাস পেয়ে লাফিয়ে উঠি খুশিতে। আমার আর ইয়াসমিনের কখনও যাওয়া হয়নি গ্রামের বাড়িতে। দাদা ছোটদা গিয়েছিলেন যুদ্ধের সময়। দাদার ক্যামেরাটি হাতে নিয়ে বাবার সঙ্গে গ্রামের পথে রওনা হই ভোরবেলা। নৌকো, বাস, রিক্সা, পায়ে হাঁটা এসবের ধকলের পর বাড়ি পৌঁছি। ধকলকে ধকল মনে হয়নি। ঘরের বাইরে বের হতে পারার মত আনন্দ আর কি আছে! যে কোনও নতুন জায়গা, সে গ্রাম হোক শহর হোক, দেখতে ভাল লাগে আমার। ঢাকা শহরে যাওয়ার যে আনন্দ, নান্দাইলের মাদারিনগর গ্রামে যাওয়ার আনন্দ তার চেয়ে কম নয়। দুপুরবেলা প্রচুর লোক এল খেতে, গ্রামের গরিব লোক, বাবার গরিব আত্মীয়। সবাইকে উঠোনে বসিয়ে কলাপাতায় খাওয়া দেওয়া হল। বাবা নিজে পাতে পাতে বেড়ে দিলেন। ক্যামেরায় বাবার নানা ঢংএর ছবি তুলে রাখি। আমাদের দেখতে গ্রামের বাচ্চা কাচ্চা পুরুষমহিলা সব জড়ো হন ও বাড়িতে। শহর থেকে আসা যে কোনও প্রাণীই তাদের কাছে এক থোকা বিস্ময়!বাড়ির সবগুলো ঘর বাঁশের বেড়ায় বানানো, খড়ের ছাউনি,মাটির মেঝে। বড়দাদার বড় ঘরটির চারপাশ ঘিরে ঈমান আলী, রিয়াজউদ্দিন, আবদুল মতিনের ঘর তোলা হয়েছে। তাঁরা বউ ছেলেমেয়ে নিয়ে খেয়ে পরে বেঁচে আছেন। বড়দাদার ঘরে একটি বড় সিন্দুক, সিন্দুকের ওপর বিছানা পেতে ঘুমোন তিনি। সারাদিন বসে বসে মাছ ধরার জাল বোনেন। চোখে ভাল দেখতে পান না। কিন্তু অসখু বিসুখে যে যাবেন শহরে, থাকবেন অবকাশে, তা নয়, তাঁকে টেনে হিঁচড়েও শহরে নেওয়া যায় না আজকাল। নিজের ভিটে ছেড়ে কোথাও তাঁর এ বয়সে যেতে ইচ্ছে করে না। বাবা দিগন্ত অবদি বিস্তৃত সবুজ ধানি জমি দেখালেন আমাদের। সব তিনি নিজে কিনেছেন। এত জমি, এত গরু, এত গোলা ভরা ধান বাড়িতে, কিন্তু কারও জীবন যাপনে চাকচিক্য নেই। পরনে মাদারিনগর বাজারের সস্তা নীল লুঙ্গি। কুঁড়েঘরের তক্তপোষে ঘুমোন, বেগুন পোড়া আর পাইন্যা ডাল দিয়ে ভাত খেয়ে হুঁকো টানেন দাওয়ায় বসে, দুশ্চিন্তার সুরুজ যেন মাথার এক হাত ওপরে বসে আছে, মখু গুলো তাই তিতিবিরক্তিতে বাঁকা। বউদের পরনেও মোটা সুতির কাপড়। পনেরোকে পঁচিশ লাগে দেখতে। পঁচিশকে পঞ্চাশ। তবু গ্রামের অন্য বাড়ির চেয়ে এ বাড়ির লোকদের ভাবা হয় ধনী। ধন তাঁরা জীবন যাপনে ব্যয় করেন না, ধন জমিয়ে রেখে নতুন জমি কেনা আর এর ওর বিরুদ্ধে মামলা করার নেশায় বুঁদ হয়ে থাকেন। এ বাড়ির জন্য বাবা হলেন ভগবান। যে যতটুক যক্ষরাজ কূবের বনেছেন, বাবার টাকাতেই বনেছেন। বাবা যেভাবে আদেশ করেন, সেভাবে সকলে চলে। কার ছেলে ইশকুলে যাবে, কার মেয়ের বিয়ের পাত্র খুঁজতে হবে, সবই বাবা বলে দেন, ইশকুলে পড়ার খরচাও বাবা দেন, বিয়ের খরচাও। গ্রামের ইশকুল শেষ হলে রিয়াজউদ্দিনের ছেলেকে শহরের ইশকুলে ভর্তি করাবেন বলে দেন। শহরের ইশকুলে ভর্তি হওয়া মানে অবকাশের উঠোনে টিনের ঘরে ওদের জায়গা হওয়া। রিয়াজউদ্দিনের বড় ছেলে সিরাজ, যখন অবকাশে থেকে শহরের ইশকুলে পড়ত, একদিন কাঠফাটা গরমের শুনশান দুপুরে ইয়াসমিনকে, বয়স কত হবে আর, নয় কি দশ, ন্যাংটো করেছিল। রুনুখালা বেড়াতে এসে উঠোনে হাঁটতে হাঁটতে টিনের ঘরের দিকে উঁকি দিয়ে ন্যাংটো দৃশ্যটি দেখে ফেলেন, খবর পেয়ে বাড়ি এসে সিরাজ আর ইয়াসমিনের পিঠে উঠোনে যত খড়ি ছিল ভেঙে, সিরাজকে সেদিনই বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিয়েছিলেন বাবা। সিরাজ শহরের অন্য জায়গায় ঘর ভাড়া করে থেকে ইশকুল পাশ দিয়ে এখন কলেজে ঢুকেছে। দাদির চল্লিশায় সিরাজ এ বাড়িতে এসেছে, কিন্তু ঘটনার এত বছর পরও বাবার মুখোমুখি হওয়ার সাহস তার নেই। বাড়ির পাশেই কবর দেওয়া দাদির মাথার কাছে একটি চারাগাছ পুঁতে বাবা আমাদের সঙ্গে নিয়ে বিকেল বিকেল শহরে ফিরে আসেন। পথে তিনি নিঃসংকোচে বর্ণনা করেন তাঁর গত জীবনের দুঃসহ দারিদ্রের কথা। কোন বাড়িতে জন্ম হয়ে আজ তিনি কোথায় এসে পৌঁছেছেন, তা আমাদের বুঝতে বলেন। বলেন আমরাও যেন ওপরের দিকে তাকাই, যেন বড় হই শিক্ষাদীক্ষায় কাজেকমের্, যেন মানুষের মত মানুষ হই। আরাম আয়েশ আলসেমিতে যেন বথৃা উড়িয়ে না দিই সময়।

এদিকে কলেজে ছাত্রলীগ, ছাত্রইউনিয়ন, জাসদ-ছাত্রলীগ, ছাত্রদল ইত্যাদি রাজনৈতিক দল ঢাকা থেকে গানের শিল্পীদের এনে চমৎকার চমৎকার নবীন বরণ অনুষ্ঠান করে আমাদের বরণ করছে। এক দল আরেক দলের চেয়ে জমকালো অনুষ্ঠান করার প্রতিযোগিতায় ব্যস্ত এক দল খুরশিদ আলমকে নিয়ে এলো, আরেক দল ফেরদৌস ওয়াহিদকে। কেবল গানের অনুষ্ঠানই নয়, লম্বা লম্বা রাজনৈতিক বক্তৃতা দেওয়ার জন্যও ঢাকা থেকে রাজনৈতিক নেতা আনা হয়। মাহমুদুর রাহমান মান্না জাসদের অনুষ্ঠানে এসে নাগারে দুঘন্টা বক্তৃতা করেন, তন্ময় হয়ে শুনি। যে দলের যে নেতাই যে কথাই বলেন, মগ্ধু হই। এত ভাল ভাল নেতা থাকতে দেশ কেন পড়ে থাকবে জিয়াউর রহমানের মত এক সেনানায়কের হাতে, ভাবি। আবার ছাত্রদলের ভাষণ শুনে মনে হয় দেশ বুঝি ঠিকই চলছে, এর চেয়ে ভাল চলার আর কোনও ব্যবস্থা নেই। নবীন বরণ উৎসব শেষ হতে না হতেই নির্বাচনের হাওয়া লাগে কলেজে। ছাত্র সংসদ নির্বাচন। কলেজে নানারকম মানুষ ভোট চায়, সবাইকে মাথা নেড়ে কথা দিতে হয় ভোট দেব। বাড়িতেও আসতে শুরু করে প্রার্থীরা। বাড়ি এসে বলে গেলে নাকি সে বলা পোক্ত হয়। বাড়িতে ভোটের জন্য অথবা যে কোনও কারণেই হোক, আমাকে খুঁজতে হরদম ছেলেপিলে আসছে, ব্যাপারটি সম্পণূর্ নতুন আমার জন্য। প্রথম বর্ষের ক্লাস গড়িমসি করে চলে, এই সুযোগে তৃতীয় সংখ্যা সেঁজুতি প্রকাশ করার উদ্যোগ নিই। কলেজে যত না সময় কাটে, তার চেয়ে বেশি কাটে জমান প্রিন্টার্সে। আগের চেয়ে আরও হৃষ্টপুষ্ট এই সেঁজুতি। এ সংখ্যা সেঁজুতিতে একটি জিনিস উল্লেখযোগ্য, প্রথম পাতার সম্পাদিকা তসলিমা নাসরিন চলে গেছে ছোট অক্ষরে শেষ পাতার শেষে। সম্পাদিকার বদলে সম্পাদক। সেঁজুতি হাতে নিয়ে দাদা প্রথম থেকে শেষ অবদি পড়ে শেষে থমকে যান, বানান ভুল রইয়া গেছে। সম্পাদিকার জায়গায় সম্পাদক ছাপা হইছে। হেসে বলি, এইটা ভুল না। এইটা আমি ইচ্ছা কইরা দিছি।

কস কি? তুই কি ছেড়া নাকি?

ছেড়া হইতাম কেন?

তুই কি লিঙ্গ বিশ্বাস করস না?

করি।

পুংলিঙ্গ স্ত্রীলিঙ্গ বইলা যে একটা ব্যাপার আছে, তা জানস?

জানি। কিন্তু সম্পাদিকা প্রকাশিকা এইসব ইকা টিকা আমি পছন্দ করি না। ছেলে মেয়ে দুইজনই সম্পাদক হইতে পারে। শব্দের মধ্যে অহেতুক কিছু লিঙ্গের আমদানি হইছে, যা আমি ব্যবহার করতে চাই না। যে মেয়ে কবিতা লেখে তারে আমি কবি কইতে চাই, মহিলাকবি না।

দাদা সেঁজুতি ছুঁড়ে দিয়ে বলেন, মাইনষে তরে পাগল কইব।



ক্লাসে যাদের সঙ্গে আলাপ হয় এক দুকথার পরই বলি শতাব্দী চক্র নামে একটা সাহিত্যগোষ্ঠী করি, চল। হালকা হালকা বন্ধুত্বের মেয়েগুলোকেও বলি। বইপোকাগুলো মোটেও ভিড়তে চায়নি, আর পোকা যাদের ধারে কাছে ভেড়ে না, ওরা লাফিয়ে উঠল, ব্যস, চাঁদা তোলো, খামোকা লাফালে তো কাজের কাজ কিস্যু হবে না। ছোটখাট একটি কমিটি বানিয়ে ফেলে, এবার, আমার প্রস্তাব, কিছু একটা করা চাই। অমৃত দ্বিতীয় পুরস্কার পাওয়ার পর ঝোঁক চাপে শতাব্দী থেকে সেঁজুতির মত একটি কবিতাপত্রিকা করার। মনে কিছু উদয় হয় তো ঝাঁপিয়ে পড়ি, অবশ্য আমার সব ঝাপাঁনোই নিঃশব্দে। বাংলা শব্দ শুদ্ধ করে লিখতে জানে, এমন যাকেই পাচ্ছি, বলছি, কবিতা লেখো। কবিতা তো আসে না বাবা! আরে আসবে। জীবনই তো কবিতা! যাপন করছ, অথচ লিখছ না! যে কটি কবিতা পাওয়া গেল, কড়া সম্পাদনা করে ছোট্ট একটা কবিতাপত্রিকা বের করি, নিজেই সি কে ঘোষ রোডের লিফা প্রিন্টাসের্ গিয়ে ছেপে আনি। ছোটদার বন্ধুর ছাপাখানা এই লিফা। লিফা দাম রাখে কম, কিন্তু রাখে। পত্রিকার নাম দিই রোদ। রোদ প্রেসে যাও, প্রুফ দেখ, রোদে ভিজে বাড়ি ফেরো। রোদ হয়ে যাওয়ার পর অপুর আবদার, দুপাতা লম্বা একটি ছড়া নিয়ে এসে, শতাব্দী থেইকা একটা ছড়াপত্রিকা হইলে কিন্তু মন্দ হয় না। তাও হবে, ছড়ার কি দোষ যে বাদ থাকবে! ঝনঝন নামে ছড়াপত্রিকাও কদিনের মধ্যে হয়ে গেল। তবে অপুর ছড়াটি কেটে আধপাতা করতে হয়েছিল, অত টাকা নেই যে এক হাত লম্বা লম্বা ছড়া ঢুকিয়ে ঢাউস কোনও পত্রিকা করা যাবে, কলেজ থেকে পাওয়া বৃত্তির টাকা শতাব্দির পেছনে খরচা করি, সদস্যরা এমাসে চাঁদা দেয় তো ও মাসে বাদ থাকে। কাঁচা কবিতা পাকা-মত করে, ছেপে, পত্রিকা করার উৎসাহ তখনও ঘোচেনি, এর ওপর উথলে উঠল নতুন উচ্ছঅ!স, নাটক। ছোটদা তখন নাটকের দলের সঙ্গে অর্ধেক রাত, আর বেশি অর্ধেক দিন কাটাচ্ছেন। ময়মনসিংহ থিয়েটার শহরে নতুন নতুন নাটক করছে, ছোটদা আমাকে মহড়া দেখাতে নিয়ে যান মাঝে মধ্যে। যখন আমার মাথায় নাটকের এক পোকা থেকে লক্ষ পোকা জন্ম নিচ্ছে, পাথর্, আমার সঙ্গেই পড়ে, একদিন সিসিম ফাঁকের মত ফাঁক করল তার ট্রাংক, বেরোল সমরেশ বসুর একটি নাটক, আবতর্। কলেজের ছেলেমেয়েদের দিয়ে এ নাটক হবে না, সত্যিকার নাট্যশিল্পী দরকার। পাণ্ডুলিপিটি আমি বাড়ি নিয়ে এসে ছোটদাকে বললাম এই নাটকটা থিয়েটারকে দাও করতে। তখন আমার পড়া হয়ে গেছে আবতর্, পড়তে পড়তে ছেলেচরিত্রে, মেয়ে চরিত্রে থিয়েটারের সদস্যদের কল্পনা করেছি, বিশাল একটি মঞ্চের সামনে থেকে পর্দা সরে যাচ্ছে, মঞ্চে আবছা আলো, সন্ধে হয়ে আসছের আলো, ঘর থেকে বেরিয়ে আসছে গীতা, গীতাকেই মানাবে মংলার মা চরিত্রে, ডাকছে উৎকণ্ঠায়, মংলা ও মংলা। থিয়েটার দল লুফে নিল নাটকটি, মহড়া শুরু হল। প্রায় বিকেলে মহড়ার দিন থিয়েটার-ঘরে উহু হচ্ছে না, আরেকটু পেছনে যান, মাথাটা চুলকাতে চুলকাতে বলেন, কারণ মংলার বাবা এখন কনফিউসড, আচ্ছা আঞ্চলিক টানটা আরও আনতে হবে কিন্তু সংলাপে, যখন বলি, নাটকের জলে আকন্ঠ ডুবে, যে কেউ ভেবে বসবে আমিই বুঝি নাটকের পরিচালক। একদিন ফরিদ আহমদ দুলাল, দলের প্রায় সব নাটকের পরিচালক, যখন বলল, পরিচালনা কিন্তু যা দেখতাছি তুমিই করতাছ, সুতরাং, কি কও, নাটকটার পরিচালকই অফিসিয়ালি হইয়া যাও।

আমি?

হ্যাঁ তুমি।

লজ্জায় মখু লুকিয়ে বলি, পাগল নাকি! আমার কোনও অভিজ্ঞতাই নাই নাটকের। জীবনে প্রথম।

টেলিভিশনে কিছু নাটক আর ছোটদার সঙ্গে ঝুলে ময়মনসিংহের মঞ্চে কিছু নাটক দেখে আর কিছু নাটকের বই পড়ে নাটক পরিচালনা করার বিদ্যে অর্জন হয় বলে আমার জানা নেই। কিন্তু আমার ওপর যখন সত্যি সত্যি ভার পড়ল নাটক পরিচালনার, ছোটদা পার্থকেও বললেন ডেকে আনতে। পাথর্ তুমুল উৎসাহে নেমে গেল। প্রায় রাতে ময়মনসিংহ থিয়েটারের ভাঙা বাড়িতে মহড়া চলে। গ্রামের গরিব পরিবারের গল্প। গীতা নায়িকার ভূমিকায়, নায়িকার ভূমিকায় গীতা অবশ্য মঞ্চে প্রথম নয়, এর আগেও নানারকম নাচের দল থেকে সে নকশি কাথাঁর মেয়ে, চণ্ডালিকা, চিত্রাঙ্গদা করেছে। নায়কের ভূমিকায় ময়মনসিংহ থিয়েটারে নতুন যোগ দেওয়া গানের ছেলে সোহানকে নেওয়া হল। মংলা চরিত্রের জন্য ছোট একটি বাচ্চা ছেলে যোগাড় করা হল। প্রচণ্ড উদ্যম এক একজনের মধ্যে, উৎসাহ আর উদ্দীপনায় টগবগ করা মানুষগুলো পারলে দিন রাতের যে কোনও সময় এক পায়ে খাড়া মহড়া দিতে। রাতে মহড়া শেষে পাথর্ হোস্টেলে ফিরে যায়, কোনও কোনও রাত আবার অবকাশেও কাটায়। আবর্তর শো শুরু হল টাউনহলে, মঞ্চ সজ্জায় যার দায়িত্ব ছিল, চোখকাড়া মঞ্চ সাজিয়েছে সত্যিকার কুঁড়েঘর বানিয়ে, সত্যিকার মাটিতে সত্যিকার গাছ পুঁতে, সত্যিকার মাছ ধরার জাল উঠোনে, দেখে আমি অভিভূত। তিন রাত ধরে শো। টিকিট কিনে লোক এল নাটক দেখতে, তিনশ লোকের হল ধীরে ধীরে, আশ্চর্য, ভরে গেল। যেন চোখের পলকে ঘটে গেল এত বড় ব্যাপারটি। ময়মনসিংহ থিয়েটার শহরের নামি দল নাটকের, আর তাদের সবচেয়ে ভাল এবং সফল নাটক আবতর্। নাটকের পোস্টারে ছাপা আবর্তর দুজন পরিচালকের নাম, ঈশিতা হোসেন পাথর্ আর তসলিমা নাসরিন।

নাটক আরও দীর্ঘ দীর্ঘ দিন এভাবেই চলতে পারত, কিন ্তু গীতার ডাক পড়ল ঢাকায়। টেলিভিশনে নাচের অনুষ্ঠান হবে, রাহিজা খানম তাকে ডেকেছেন নাচতে। বুলবুল একাডেমিতে নাচের মেয়ে কম পড়েছে, ডাক ডাক গীতাকে ডাক বলে রাহিজা খানম গীতা যেখানেই থাক ডেকে নিয়ে যান। গীতা নেচে বেড়ায় ঢাকায়। টেলিভিশনে গীতার নাচ থাকলে বাড়ির সবাই বসে সে নাচ দেখি। মা আর গীতাকে নর্তকী বলে গাল দেন না। গীতার জীবনটি রহস্যে ভরা। এক্ষুনি জীবন উজাড় করে দিল, পরক্ষণেই কেড়ে নিল। মঞ্চে চমৎকার অভিনয় করে গীতা, কী জানি জীবনের মঞ্চে সে যা করছে সবই অভিনয় কি না। গীতার জীবনের অনেকটাই গীতার ট্রাংকে লুকোনো। নানারকম জিনিস ওতে, গোপন করার মত অনেক জিনিস। যখন সে বাড়ির বাইরে যায়, ট্রাংকে তালা লাগিয়ে যায়। আমার খুব দেখতে ইচ্ছে করে কী কী আছে ট্রাংকের ভেতর। গোপন করার মত তখনও আমার কিছু নেই। সবই খোলা, সবই মেলা, ইচ্ছে করে আমারও গোপন কিছু থাক, আমার একার কিছু ছোটদার সঙ্গে গীতার প্রেম বা বিয়ে যখনও কিছু হয়নি, তাদের বাড়িতে গিয়েছিলাম, মূলত হেনামাসির কাছে যাওয়া যে মাসিটি আমাদের পড়াতেন, তখন গীতার ট্রাংকটি দেখেছিলাম, সরু চৌকিতে, যে চৌকিতে সে শুত, তার ওপরই বালিশের কাছে রাখা। বিয়ের পর সে বাপের বাড়ি থেকে আর কিছু না আনুক, তার যক্ষের ধন ট্রাংকটি এনেছে। ট্রাংকটি একদিন তালাহীন পেয়ে দেখি ওতে রাজ্যির জিনিস, ছোটদার লেখা তিরিশ চল্লিশ পাতার চিঠি, ছোট ছোট গয়না, পয়সার থলে, আমার দৃষ্টি কাড়ে তুলো লাগানো ব্রেসিয়ারগুলো। সতেরো পার হয়েছে, কিন্তু ও জিনিসটি কখনও পরে দেখিনি। মার ব্রেসিয়ারও মা সবসময় লুকিয়ে রাখেন, শাড়ি নয়ত শায়ার আড়ালে, উঠোনের দড়িতে কখনও ব্রেসিয়ার শুকোতেও দেন না, টিনের ঘরের পেছনে, যেখানে কুকুর বেড়ালও যায় না, রোদে ফেলে শুকিয়ে আনেন, যেন সাংঘাতিক নিষিদ্ধ জিনিস এগুলো। ইয়াসমিনকে আড়ালে ডেকে, কেউ যেন না দেখে না শোনে, নিষিদ্ধ জিনিস সম্পর্কে যা জ্ঞান আছে আমার, ঝেড়ে, বললাম, যা তো গাঙিনার পাড় থেইকা এইরকম একটা জিনিস কিন্যা নিয়া আয়, রিক্সা কইরা যাইবি আর আসবি। আমি ওর হাতে টাকা ধরিয়ে দিয়ে বারান্দায় বসে রইলাম, যেন ও এলেই জিনিসটি কারও চোখে পড়ার আগে আমি আড়াল করতে পারি। সেই বিকেলে ইয়াসমিনের কিনে নিয়ে আসা ব্রেসিয়ার পরে দিব্যি চপু চাপ বসে রইলাম, নিষিদ্ধ জিনিসে আনন্দ যেমন আছে, ভয়ও আছে, চাইছিলাম না কেউ আমার আশেপাশে আসুক, বুঝুক যে আমি নতুন একটি জিনিস পরেছি আজ। কিন্তু ছোটদার সঙ্গে সখ্য তখন এমন যে, ছোটদা বাড়ি ঢুকেই হৈ চৈ করে আমাকে ডাকেন, কোনও একটি গল্পের বই আমাকে পড়তে হবে, আর তিনি খেতে খেতে শুয়ে বিশ্রাম নিতে নিতে প্রায় ঘুমোতে ঘুমোতে শুনবেন। আমি যখন জড়সড়, বারবার জামা টানছি কাঁধের দিকে, যেন কিছুতেই উঁকি না দেয় নিষিদ্ধের ফিতে, ছোটদা এসে পিঠে এক চাপড় দিয়ে বললেন কিরে কি হইছে তর, একলা একলা বইসা রইছস কেন?

পিঠের চাপড়টিই বিপদ যা ডাকার, ডাকল। ছোটদা তুমুল হেসে বললেন কি রে তুই দেখি ব্রেসিয়ার পরছস!

গলা ফাটিয়ে সারাবাড়ি জানিয়ে দিলেন, নাসরিন ব্রেসিয়ার পরছে।

পরার পর পনেরো মিনিটও যায়নি, বাড়ির সবাই জেনে গেল, আমি কি পরেছি।

টেবিলের দিকে গা ঠেসে থাকলাম, আমার মাথা ক্রমে নুয়ে আসতে থাকল বইয়ের ওপর, গোপন জিনিসটি গোপন না থাকার কষ্টে বইয়ের পাতা ভিজতে লাগল। মা এসে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললেন ব্রেসিয়ার পরার ইচ্ছা হইছে, আমারে কইবা না? আমি তো তোমার সাইজের কিন্যা দিতে পারতাম।

আমার মখু মাথা কান শরমে গরম হতে থাকল। ব্রেসিয়ারের ঘটনা স্বাভাবিক হওয়ার পর মা বলেছিলেন, বিয়ের বছর দুই পর মা যখন প্রথম ব্রেসিয়ার পরলেন, বাবা এমন ক্ষেপেছিলেন যে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে ঝংকার দিয়ে উঠেছিলেন, খারাপ মেয়েছেলের মত ঢং এর জিনিস পর ! শখে বাঁচ না! এই জিনিসটি পরা মানে ঢং করা ফ্যাশন করা এরকমই ভাবে অনেকে। গ্রামের মেয়েরা সারাজীবন ব্রেসিয়ার কাকে বলে না জেনেই জীবন কাটিয়ে যায়। বাবা গ্রামের ছেলে, তাঁর দেখে অভ্যেস নেই কাপড়ের তলের বাড়তি কাপড়।
 
কলেজে একটি জিনিস আমাকে নিষিদ্ধ গন্ধমের মত টানে। সেটি কলেজ ক্যান্টিন। ক্যান্টিনে আর সব ছেলেদের মত চা খেতে খেতে গল্প করতে ইচ্ছে হয় আমার। ইচ্ছে হয় যদিও, ইচ্ছেকে পণূর্ করতে অনেক সময় আমি নিজেই এর বড় প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়াই। উপকণ্ঠের সম্পাদক, আবার চমৎকার কবিতাও লেখে, হারুন রশিদ, যার কবিতার মগ্ধু পাঠক আমি, আমার সঙ্গে দেখা করতে ঢাকা থেকে ময়মনসিংহে এসে এই ক্যান্টিনে অপেক্ষা করছিল, আমার সাহস হয়নি ভেতরে যেতে, সাহস হয়নি কোনও অসহ্য সুন্দরের সামনে দাঁড়াতে। ইতঃস্তত দাঁড়িয়ে থাকা আমার সামনে দিয়ে একটি মিষ্টি মুখের ছেলে বেরিয়ে গেল ক্যান্টিন থেকে, পেছন থেকে তাকে ডেকে থামানোর সাহসও হাত ফসকে পড়ে চৌচির হয়ে গিয়েছিল। নিজের এই অপারগতাগুলো আমি ভেতরে একা একাই লালন করি। নিজেকে আমার অপদার্থ ভীরু কা-নারী ছাড়া আর কিছু মনে হয় না। মূলত ছেলেরাই যায় ক্যান্টিনে তা জানি, দিব্যি ক্লাস ফাঁকি দিয়ে নয়ত দুটো ক্লাসের মাঝের অবসরটাতে, নয়ত ক্লাস কোনও কারণে না হলে। অবসর পেলে মেয়েরা হোস্টেলে গিয়ে কিছুক্ষণ গড়িয়ে আসে, নয়ত জুটি বেঁধে নিরালায় চলে যায় মোটা বই মেলে পড়তে। মেয়েরা যায় কদাচিৎ ক্যান্টিনে, বড় ক্লাসের মেয়েরা কেবল, ছেলেবন্ধুদের নিয়ে, নয়ত দল বেঁধে। ক্যান্টিনে যাওয়ার ইচ্ছে করে আমার, ইচ্ছে করে আর সব ছেলেদের মত যখন তখন ক্যান্টিনে ঢুকে হাঁক দেব চায়ের জন্য, চা এলে পায়ের ওপর পা তুলে আরাম করে বসে চা খাবো, ইচ্ছের পণূর্ তা যেহেতু আমার পক্ষে ঘটানো সম্ভব হয় না, আমি সঙ্গী খুঁজতে থাকি। ক্লাসের যে মেয়েকেই সাধি, পিছলে যায়। শেষ অবদি হালিদা রাজি হল, সুন্দরী এক মেয়ে, উদাস উদাস চোখ, ঢাকার ইন্দিরা রোডে বাড়ি, শুদ্ধ বাংলায় কথা বলে, ওকে নিয়ে ক্যান্টিনে ঢুকেই দেখি জোড়া জোড়া ছেলে-চোখ আমাদের গিলছে, প্রথম বর্ষের মেয়ে হয়ে গটগট করে চলে এলাম ছেলেদের আড্ড াখানায়, আমাদের বুকের পাটা অনুমান করে ওরা খানিকটা চেঁচিয়েই কথা বলতে শুরু করল যেন ওদের প্রতিটি শব্দ আমাদের প্রতি লোমকপূ নাড়ায়। সেই শুরু। পরে, হাবিবুল্লাহর সঙ্গে বন্ধুত্ব হবার পর ক্যান্টিন আমার ঠিকানা হয়ে উঠল প্রায়। হাবিবুল্লাহরও বাড়ি ঢাকায়, আমার এক ক্লাস ওপরে পড়ে, দীর্ঘদিন আমাকে আড়ে আড়ে লক্ষ করে হঠাৎ একদিন পথ আগলে বলল সে আমার বন্ধু হতে চায়। বন্ধু হতে চাও ভাল কথা, তবে বন্ধু মানে বন্ধু তুই তোকারি বন্ধু। হাবিবুল্লাহকে পরদিনই তুই বলে সম্বোধন করলাম, সে চমকাল যদিও, শতর্ মত তাকেও বলতে হল তুই। হাবিবুল্লাহ এরপর আঠার মত লেগে রইল আমার পেছনে। ক্লাসে ঢুকতে বেরোতে দেখি সে, দাঁড়িয়ে আছে আমার অপেক্ষায়।

কী ব্যাপার তোর ক্লাস নাই?

আছে।

ক্লাসে যা।

ধৎু ভাল্লাগছে না। ক্লাস করব না।

কি করবি?

চল চা খাই গিয়া।

আমার ত ক্লাস আছে।

হাই স্যারের ক্লাস তো। ওই ক্লাস না করলেও চলবে।

কি কস!

আরে চল তো।

এমনিতে নাচুনে বুড়ি, তার ওপর ঢোলের বাড়ি। ক্যান্টিনে গিয়ে বসি। ক্যান্টিনে চা সিঙ্গারা আসছে, হাবিবুল্লাহর বন্ধুরা আসছে, এনাটমি থেকে শুরু হয়, রাজনীতিতে গিয়ে শেষ হয় আড্ডা। আমরা সদপের্ সগবের্ হেঁটে বেড়াই কলেজ চত্বর। ক্লাসের ফাঁকে অথবা অজরুরি ক্লাস ফাঁকি দিয়ে যেখানেই আমি, সেখানেই হাবিবুল্লাহ। হাবিবুল্লাহ বাড়িতেও আসতে শুরু করল বিকেলের দিকে। বাবা বাড়ি এলে হাবিবুল্লাহ দাঁড়িয়ে স্লামালেকুম স্যার বলে। গম্ভীর মুখে বাবা ভেতরের ঘরে ঢুকে যান। ভেতরে গিয়ে মাকে প্রশ্ন করে উত্তর পান, ছেলেটি আমার বন্ধু। কলেজের শিক্ষক হয়ে বাবা এই একটি জায়গায় আটকে গেছেন, কলেজের কোনও ছাত্রকে দূর দূর করে তাড়িয়ে দেওয়া তাঁর পক্ষে সম্ভব হয় না।



কলেজে খেলার মরশুম শুরু হয়েছে, ক্যারম আর দাবা খেলায় নাম লিখিয়ে দিব্যি খেলতে লেগে গেলাম। ক্যারমে হেরে গেলাম, জেতার কোনও কারণ ছিল না, সেই কতকাল আগে, নানিবাড়িতে খেলেছিলাম! আর দাবায়, এক তুখোড় দাবারু, গত বছরের চ্যম্পিয়ানকে হারিয়ে দিয়ে এগিয়ে যেতে যেতে শেষ অবধি জিতে যাওয়া খেলা, অধৈর্যের কারণে ছেড়ে দিয়ে রানাসর্ আপ হলাম। অধৈর্য আমার লাগে গ্যালারির ক্লাসগুলোতেও, শিক্ষকরা কী বলেন বা কী বলতে চান, তার আশি ভাগই বুঝি না। প্রস্থানচর্চা বেশ চলে এখানে, যা ইশকুল কলেজে আগে দেখিনি, প্রক্সি দিয়ে বেরিয়ে যাওয়া, ক্লাস ভাল লাগল না তো পেছনের দরজা দিয়ে বেরিয়ে যাও। আমি বেরিয়ে পড়তে শুরু করলাম, তখন অবদি মেয়েরা পাছায় আঠা লাগিয়ে সামনের সারিতে বসে শিক্ষকদের প্রতিটি বাক্য গোগ্রাসে গেলে, দুষ্টু ছেলেরাই নাকি কেবল বেরিয়ে যায়, আমি দুষ্টুর তালিকায় পড়লাম, তবে ছেলে নই, মেয়ে। বেরিয়ে যাওয়ার এই স্বাধীনতাও বেশ উপভোগ করতে শুরু করি, মুমিনুন্নিসা কলেজ থেকে বিকেল পাঁচটার আগে গগন দারোয়ান আমাদের বেরোতে দিত না, এখানে আর যাই থাক, সেই দমবন্ধ করা খাঁচাটি নেই। ইচ্ছে হল ক্লাসে গেলাম, ইচ্ছে হল গেলাম না। এরকম নিয়ম নেই যে সকাল আটটা বা নটায় কলেজে ঢুকতেই হবে। মেডিকেলের এই ব্যাপারটি বোঝার পর আমি কখনও কখনও দুপুরে বাড়ি থেকে রওনা হই, মা অবাক হন, এই অসময়ে কই যাইতাছস?

কলেজে।

এখন আবার কলেজ কি?

ক্লাস আছে।

তর তো সকাল আটটায় কলেজ শুরু হইছে।

হ হইছে। তাতে কি! আটটার সময় যে ক্লাস ছিল করি নাই।

এখন কলেজে যাইয়া কি করবি?

দেড়টার ক্লাস করতে যাইতাছি।

যখন ইচ্ছা তখন গেলে ত হয় না।

তোমার তো দৌড় ইশকুল পর্যন,্ত এই সব বুঝবা না।

নিয়মটি আমার খুব ভাল লাগে, যখন ইচ্ছে ক্লাসে যাও, ক্লাস করতে ইচ্ছে না হলে প্রক্সি দিয়ে বেরিয়ে পড়। প্রক্সি শব্দটির চল খুব বেশি কলেজে। ক্লাস না করতে পারি, কিন্তু উপস্থিতির সংখ্যা কম থাকলে পরীক্ষায় বসা যাবে না। বন্ধুৃরা নকল উপস্থিতি দিয়ে দেয়। প্রতিটি ক্লাসে নাম ডাকার সময় ইয়েস স্যার বলে দিলেই হয়। এখন কে বলছে ইয়েস স্যার, তোফাজ্জলেরটা মোজাম্মেল বলছে কি না, তা কে তলিয়ে দেখে! মাথা নিচু করে ইয়েস স্যার বলে উপস্থিত বন্ধুর অনপুস্থিত বন্ধুকে একরকম বাঁচায়। এই উপস্থিত আবার যখন অনপুস্থিত হবে, তখন আগের সেই অনপু স্থিত উপস্থিত থেকে নতনু অনপুস্থিতকে বাঁচাবে।

সেঁজুতির চতথুর্ সংখ্যা নিয়ে পড়েছি। কলকাতা থেকে চিঠি, কবিতা,সাহিত্যপত্রিকা, বই ইত্যাদি আসে। নির্মল বসাক সময়ের খেলনা পাঠিয়েছেন, অভিজিৎ ঘোষের নিঃসঙ্গ মানুষ এসে দাঁড়ায় সামনে। তাঁদের কবিতাপত্রিকা সৈনিকের ডায়রি, ইন্দ্রাণী নিয়মিত পাচ্ছি। মোহিনী মোহন গঙ্গোপাধ্যায়, ক্ষিতিশ সাঁতরা, চিত্রভানু সরকার, শান্তি রায়, বিপ্লব ভট্টাচার্য, বীরেন্দ্র কুমার দেব, প্রণব মুখোপাধ্যায় কবিতা পাঠিয়েছেন। বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে কবিতা পৌঁছতে থাকে হাতে। আলমগীর রেজা চৌধুরী, আহমদ আজিজ, খালিদ আহসান, জাহাঙ্গির ফিরোজ, মিনার মনসুর, মোহন রায়হান, রবীন্দ্রনাথ অধিকারী, রমেশ রায়, হারুন রশিদ, সাজ্জাদ হোসেন এরকম আরও অনেকের লেখা পরপর সাজিয়ে নিই। চন্দনার কবিতা হার্দিক রাইফেল নামে। আমারটির নাম দিয়েছি বুর্জোয়া কষ্টরা এসে আমার হৃদয় ধর্ষণ করছে। দুই বাংলার সাহিত্য পত্রিকা প্রতিদিন দশ বারোটি করে আসে। জমিয়ে রাখি টুকিটাকি খবরের জন্য। দশ পৃষ্ঠাই চলে যায় টুকিটাকিতে। চতুর্থ সংখ্যা সেঁজুতিতে, ছোটদাকে জানিয়ে দিই, বিজ্ঞাপন দরকার। এটি বই আকারে বের করছি, বৃহৎ কলেবরে যাকে বলে। ছোটদা পিপুলস টেইলাসর্, আর টিপটপ কনফিকশনারির দুটো বিজ্ঞাপন যোগাড় করে আনেন। বেঙ্গল এন্টারপ্রাইজের জিঙ্ক লোগো দিয়ে শেষ পাতায় একটি বিজ্ঞাপন দেওয়ার ব্যবস্থা করে দেন ধন। বই আকারে হবে তো বোঝা গেল, কিন্তু পঈচ্ছদ করবে কে? পঈচ্ছদ করার জন্য ছোটদাকে বলি শিল্পী যোগাড় করতে। গোলপুকুর পাড়ে পোড়ামাটি-শিল্পী অলক রায়ের ভাই পুলক রায় আড্ডা দিতে আসে, তার কাছে ছোটদা খবর পান অলক রায় শহরে নেই। সুতরাং অলক রায়ের ফিরে আসার জন্য অপেক্ষা করা ছাড়া আর উপায় নেই, ছোটদার হাতে আর কোনও শিল্পী নেই। অতএব আমি নিজেই একটি মেয়ের মখু এঁকে ছোটদাকে পাঠাই ব্লক করে আনতে। এরপর তো তাগাদা, কই এত দেরি হইতাছে কেন, আইনা দেও। কিছুতেই দেরি সয় না আমার। সবকিছু ইচ্ছে করে আজই করে ফেলি। এক্ষুনি। এই এক্ষুনি করে ফেলার স্বভাবটি মার মধ্যেও আছে। মা শাদা টেট্রনের কাপড় পেলেন একগজ বাড়ির ছেলেদের টুপি বানানোর জন্য, ঈদের আগে আগে। কাঁচিতে দুটো টুপির কাপড় কাটা হয়েছে, এবার তৃতীয় টুপির কাপড়টি কাটার জন্য হাতের কাছে মা আর কাঁচি পাচ্ছেন না, কাঁচি পাচ্ছেন না, আশেপাশে খুঁজলেন, এঘর ওঘর খুঁজলেন খানিক, এরপর বটি হাতে নিলেন, বটি দিয়েই কাটলেন কাপড়। ছোটদাও বলেন আমার ধৈর্য নেই। জমান প্রিন্টার্সের লোকরাও। আমার কিন্তু মনে হয় না আমার ধৈর্য কিছু কম, বরং মনে হয় মানুষগুলো বড় ঢিলে, যে কাজটি পাঁচ মিনিটে হয়ে যায়, সে কাজটি করতে পাঁচ দিন লাগায়। আমার বসে থাকতে ইচ্ছে হয় না। কবিতা লিখতে গেলেও দীর্ঘক্ষণ সময় নিতে ইচ্ছে করে না। সময় নিলেই মনে হতে থাকে কবিতা আমাকে শেকলে জড়িয়ে ফেলেছে। আমার দম বন্ধ লাগে। একটি কবিতার পর নতুন একটি কবিতা শুরু করতে ভাল লাগে। কিন্তু একটি নিয়ে রাত দিন পড়ে থাকা আমার পক্ষে সম্ভব হয় না। ঘষা মাজাও অত পোষায় না। যা লিখেছি লিখেছি। একজনের ধৈর্য দেখেছি, সে বড়মামার শ্বশুরমশাই। বেঁটে ফর্সা ভদ্রলোক, হিমালয়ের গুহা থেকে মাত্র বেরোনো কোনও সন্ন্যাসীর মত দেখতে। তিনি স্ত্রী মারা যাবার পর বিরহ যাতনা বলে একটি কবিতা লিখেছিলেন, দিয়েছিলেন দাদার পাতা পত্রিকায় ছাপতে। তিনশ একচল্লিশটি শব্দের কবিতায় দুশ ছিয়াশিটি শব্দই ছিল হয় যুক্তাক্ষর, নয় রফলা যফলা রেফঅলা শব্দ। তিনি গোটা একটি বছর নিয়েছেন কবিতা লিখতে। দাদা পাতায় সেটি ছাপার পর দ্বিতীয় সংখ্যায় আবার একই কবিতা খানিক সংশোধন করে তিনি ছাপতে দিয়েছিলেন। দ্বিতীয় সংখ্যায় সংশোধিত কবিতা বের হওয়ার পর তিনি তৃতীয় সংখ্যার জন্য যখন একই কবিতার তৃতীয় সংশোধনী নিয়ে দাদার কাছে সকাল বিকাল ধরনা দিতে শুরু করলেন, একসময় এমন হল যে বড়মামার শ্বশুরমশাইএর শ্রীমখু খানা কালো ফটকের কাছে দেখলেই দাদা গোসলখানায় ঘন্টাখানিকের জন্য অদৃশ্য হয়ে যেতেন।

ক্লাস শেষে আমি বেশির ভাগ বাড়ির দিকে না ফিরে যেতে থাকি জমান প্রিন্টার্সের দিকে। জমান প্রিন্টাসর্ রাজবাড়ির ইশকুলের উল্টোদিকে একটি য়চ্ছ সরোবরের পাশে। ছাপাখানার লাগোয়া বাড়িটি উঁচু দেয়াল ঘেরা। খুরশিদ খানের বাড়ি। খুরশিদ খানেরই ছেলে মন, ধন, জন। ধনের বড় ভাই মন দাদার পাতার আমলে ছিলেন। পরে দায়িত্ব চলে গেছে ধনের হাতে। অসম্ভব অমায়িক রসিক ভদ্রলোক ধন। ধোপদুরস্ত জামা কাপড় গায়ে। আমি ছাপাখানায় ঢুকলেই তিনি তাঁর ঘরে ডেকে আমাকে বসান। চায়ের কথা বলেন। বসিয়ে রাজ্যির গল্প করেন। খুরশিদ খান পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর মোনায়েম খানের ছোট ভাই, জাত মুসলিম লীগ। অথচ ধনকে দেখে মোটেও বোঝার উপায় নেই যে বংশের রাজনীতির মোটেও তিনি বাহক। এমন কোনও প্রসঙ্গ নেই, যা নিয়ে তিনি অনর্গল কথা বলতে পারেন না। মূলত আমি শ্রোতা, ধন মাঝে মাঝেই বলেন, কি ব্যাপার আপনি সাহিত্য করেন, অথচ মখু দিয়া কোনও কথাই বার হয় না আপনার। আমি অনেক কবি লেখকের কাছেই ঘেঁষতে চাই না ওদের কথার জ্বালায়। ঠোঁটের স্মিত হাসিটুকু সম্বল করে আমি ধনের ধনচর্চা মনচর্চা জনচর্চা শ্রবণ করে সেঁজুতির যেটকুু ছাপা হয়েছে তা নিয়ে চলে আসি বাড়িতে, প্রুফ দেখে আবার পরদিন দিয়ে আসি। ছাপাখানার শ্রমিকদের সঙ্গে আমার ভাব হতে থাকে। ছাপাখানায় ঢুকলে, লক্ষ করি, ওদের মুখে প্রশান্তির ছাপ।কি আপা কেমন আছেন? আমাকে প্রতিবারই জিজ্ঞেস করেন কালিঝুলিমাখা শ্রমিকেরা। ধন না থাকলেও আমাকে বসতে দিয়ে চা নিয়ে আসে আমার জন্য। কাছ থেকে শ্রমিকদের কাজকর্ম দেখি, মেশিনগুলো কি করে চালাতে হয় শিখে নিয়ে নিজের হাতে চালাই। শ্রমিকেরা আমার কাণ্ড দেখে হাসে। কালি আমার গায়েও লাগে। ছাপাখানার বিষয়টি আমার কাছে আর দুবোর্ধ ্য বলে মনে হয় না। সেঁজুতি যেদিন ছাপা হল, মস্ত প্যাকেট গুলো রিক্সায় তোলার আগে ধনকে ছাপার খরচ দিতে গেলে তিনি বললেন, আপনার মনে হয় টাকা বেশি হইয়া গেছে। যান যান। ওই কয়টা টাকা না নিলে আমি না খাইয়া মরব না। চতুথর্ সংখ্যা সেঁজুতি ছাপা হয়ে বেরোলো, পঈচ্ছদ শাদা, ভেতরে সবুজ। পঈচ্ছদের কাগজ বাড়তি যা ছিল তা দিয়ে সেঁজুতির প্যাড বানিয়ে নিয়ে আসি। কাগজের ওপরে ডানপাশে তসলিমা নাসরিন, অবকাশ, ১৮, টি এন রায় রোড, আমলাপাড়া আবাসিক এলাকা, ময়মনসিংহ। আমলাপাড়ার লেজে এখানকার কোনও বাসিন্দা আবাসিক এলাকা জুড়ে দেয় না, এটি সম্পণূর্ ই দাদার তৈরি। ঢাকার ধানমণ্ডির মত বড়লোকদের এলাকাকে আবাসিক এলাকা বলা হয়, আমলাপাড়ায় দোকান পাট নেই, লোক বসতি কেবল, এটিকে কেন আবাসিক এলাকা বলা হবে না! যুক্তি আছে বটে।

সেঁজুতি দিকে দিকে বিলি হয়ে যাওয়ার পর আবার অস্থির হই। কিছু একটা না করলে চলে কি করে। শতাব্দী চত্রে²র সদস্যদের ডেকে বলি, চল এবার একটা অনুষ্ঠান করি, নবীন বরণ অনুষ্ঠান। নতুন ছাত্র ছাত্রীরা ঢুকছে কলেজে, তাদের বরণ করব। কি হবে অনুষ্ঠানে? সব হবে, নাচ হবে, গান হবে, কবিতা হবে, নাটক হবে। কাজ ভাগ করে দেওয়া হল সদস্যদের, মঞ্চ সাজাও, মাইক ভাড়া কর, নিমনণ্ত্র পত্র ছাপাও, বিলি কর, প্রচণ্ড উৎসাহে ওরা নেমে পড়ল কাজে। অনুপম মাহমুদ টিপু বিচিত্রায় ব্যক্তিগত বিজ্ঞাপন দিত, সিনেপত্রিকায় লিখত, মিষ্টি মিষ্টি হাসে, হাতের লেখাও চমৎকার, ছবি আঁকেও ভাল, নামল মঞ্চ সাজাতে। আমার সঙ্গে মুমিনুন্নিসায় পড়ত উজ্জ্বলা সাহা, গান গাওয়ার অভ্যেস আছে, ওকে ধরলাম উদ্বোধনী সঙ্গীত শোনাতে। অনুষ্ঠানের মহড়া শুরু হয়ে গেল, কেউ নাটক করছে, কেউ কবিতা, কেউ আবৃত্তি, কেউ গান। ছাত্র সংসদের সভাপতি আমাকে ডেকে নিয়ে বললেন, ছাত্র সংসদের আগে কোনও দল নবীন বরণ করতে পারবে না। আগে সংসদ করবে, তারপর অন্যরা। এমন ক্ষুদ্র একটি দলকে ভয় পাওয়ার তো কিছু নেই! দুচারটে তর্কসুরে বাক্য বিনিময়ের পর শেষ পর্যন্ত রণে ভঙ্গ দিয়ে সংসদকে পা বাড়াতে দিই আগে। দ্বিতীয় নবীণ বরণ অনুষ্ঠানের দায়িত্ব শতাব্দির। অনুষ্ঠানের আমনণ্ত্র পত্র ছেপে আনি। এনাটমির অধ্যাপক হারুণ আহমেদকে বলা হল সভাপতি হতে, তিনি এক পায়ে খাড়া, তাঁরও নাকি কবিতা লেখার অভ্যেস আছে, অনুষ্ঠানে কবিতাও পড়তে চাইলেন একটি। শুনেছি নির্মলেন্দু গুণ এ শহরেই আজকাল থাকেন, নীরা লাহিড়ী, গুণের বউ, আমাদের এক ক্লাস ওপরে পড়েন, কলেজের কাছাকাছি বাড়ি ভাড়া নিয়েছেন। সেওড়াতলায় আঁতিপাঁতি করে খুঁজে গুণের বাড়ি পাওয়া গেল, বর্ষার জলে ঘর ডুবে আছে, বারান্দায় একটি চেয়ারে পা তুলে বসে কানে ছোট্ট একটি রেডিও চেপে ক্রিকেট শুনছিলেন তিনি। ঘরময় জল, আমন্ত্রণপত্রখানা তাঁর হাতে ধরিয়ে, শতাব্দির অনুষ্ঠানে কবিতা পড়ার অনুরোধ করে চলে এলাম। নির্মলেন্দু গুণ থাকতে ঢাকা থেকে কবি আনার কোনও প্রয়োজন নেই। নাটকের জন্য ছোটদার বন্ধু ফরিদ আহমদ দুলালকে ধরলাম, তিনি কথা দিলেন একটি একক নাটক করে দেবেন অনুষ্ঠানে। অস্থির লাগছিল কী হয় কী হয়, আদৌ কোনও দর্শক আসে কি না। কিন্তু বেশ দর্শক এল, অনুষ্ঠান হয়ে গেল, কেউ বলল চমৎকার, কেউ বলল কবিতা আরও কমিয়ে দিলে পারতে, নাটকটা শেষে না রেখে মাঝখানে রাখলেই হত, কেউ কেউ বিষম উত্তেজিত, শতাব্দির পরের অনুষ্ঠান কবে হচ্ছে? সে জানি না কবে, ভাসছি তখন উতল হাওয়ায়, শরতের মেঘের মত হৃদয়ের সবটা আকাশ জুড়ে উজ্জ্বলার গাওয়া আনন্দধারা বহিছে ভুবনে র সুর।



ঢাকা থেকে গীতা চিঠি লিখল ছোটদাকে ঢাকা যেতে। ছোটদার নাকি কোথায় চাকরির ইন্টারভিউ আছে। ছোটদা আথিবিথি দৌড়ে ঢাকা গিয়ে সাতদিন পর ফিরলেন অবকাশে। ইন্টারভিউ দেওয়ার পর তাঁর চাকরি হয়ে গেছে। আমানুল্লাহ চৌধুরির অবদান এই চাকরি। তিনি বিমানের কর্তাব্যক্তিদের না ধরলে এ চাকরি হত না। ছোটদার মুখে আমানুল্লাহ চৌধুরির মত লোক হয় না ফুটতে থাকে খইএর মত। বাংলাদেশ বিমানে স্টুয়ার্ট হওয়ার ট্রেনিং নিতে তিনি ঢাকা চলে যাবেন, ওখানে বাড়ি ভাড়া নেবেন, ওখানেই থাকবেন। বিদায় অবকাশ, বিদায় বাবা মা, বিদায় ভাই বোন। বিদায় বলতে ছোটদার কণ্ঠ কাঁপে না, কিন্তু বিদায় শব্দটি শুনলে মাথা ঝিমঝিম করে আমার, বুকের ওপর দিয়ে এমন বোধ হয় যে একশ ঘোড়া দৌড়োচ্ছে, শব্দটি শুনলে একটি দৃশ্যের মধ্যে আমি নিজেকে আবিষ্কার করি, ধু ধু মরুভূুমি জুড়ে কোথাও কেউ নেই, কেবল একা আমি। এক গণ্ডূষ পানি পেতে চাইছি, একটি গাছের ছায়া চাইছি, একটি কোনও মানুষ দেখতে চাইছি, কিন্তু পাচ্ছি না কিছুই। কিন্তু ছোটদার মুখে হাসি লেগে থাকে। তিনি নিরলস বর্ণনা করতে থাকেন স্টুয়ার্টের মাহাত্ম্য।

বাবাকে খবর দেন মা, কামাল চাকরি পাইছে।

চাকরি আবার ও পায় কি কইরা? ও ত অশিক্ষিত। লেখাপড়া করে নাই। বাবা বললেন।

লেখাপড়া ওর কপালে নাই। ছোট বয়সে বিয়া করছে। এখন সংসার করতে চায়। চেষ্টা ত অনেক করছেন, ওর ত লেখাপড়ায় মন বইল না।

চাকরিডা কিয়ের শুনি? বাবা উৎসুক।

বিমানের ক্রু খুব নাকি ভাল চাকরি, বিদেশ টিদেশ যাইতে পারব।

হায় রে ভাগ্য আমার, বাবা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন, এক ছেলেরে মেডিকেলে পড়াইতে চাইলাম, চান্স পাইল না। ইউনিভার্সিটিতে মাস্টাসর্ পড়তে গেল, মাস্টার্স পরীক্ষা না দিয়া বাড়িত ফিইরা আইল। আরেক ছেলে মেট্রিকে স্টার পাওয়া, সে লেখাপড়া ছাইড়া দিয়া অহন মানুষেরা ভাত খাওয়ানোর চাকরি লইছে, প্লেনে বইয়া মাইনষে হাগব, মুতব, বমি করবে, আমার ছেলে ওইগুলা পরিষ্কার করব। এই চাকরি করার জন্য আমি তারে পাঁচটা মাস্টার রাইখা পড়াইছি? এই চাকরি করার জন্য সে মেট্রিকে স্টার পাইছিল? ভালই, ডাক্তার রজব আলী, মানুষে জিগাস করবে, তোমার দুই ছেলে কি করে, বলতে হবে এক ছেলে ঘুইরা বেড়ায়, আরেক ছেলে উইড়া বেড়ায়।

ছোটদার সঙ্গে আমার সখ্য যখন খুব, ছোটদা বিদায় নিচ্ছেন, চন্দনাও নিয়েছিল যখন চন্দনাই ছিল আমার এক এবং অদ্বিতীয় জগত। আমিই একা পড়ে থাকি যেখানে ছিলাম, সবাই আসে আর যায়। ছোটদা কথা দেন তিনি প্রায়ই ময়মনসিংহে আসবেন, প্রায়ই আমাকে ঢাকা বেড়াতে নিয়ে যাবেন। ঢাকা যাওয়ার সুযোগটি হয়েছে জেনেও আমার মন কেমন করা দূর হয় না। আমি মার মত হয়ত চিৎকার করে কাঁদি না, কিন্তু কাঁদি, গোপনে গোপনে কাঁদি।ছোটদার সঙ্গে আমার এমন নিবিড় সম্পর্কের কারণ,সাহিত্য। দাদার সাহিত্যজ্ঞান রবীন্দ্রনাথ আর নজরুলে সীমাবদ্ধ, সাহিত্যাঙ্গনে নাটকাঙ্গনে সঙ্গীতাঙ্গনে ছোটদার টই টই ঘোরাঘুরির কারণে বা অন্য যে কারণেই হোক ছোটদার সাহিত্যজ্ঞান বিস্তৃতি পেয়েছিল, তাই তাঁর সঙ্গই আমাকে আনন্দ দিয়েছে বেশি। থানইটের মত মোটা উপন্যাসও দুজন পড়েছি একসঙ্গে। আমি পড়েছি ছোটদা শুনেছেন, ছোটদা পড়েছেন আমি শুনেছি। আমি শ্রোতাও যেমন হারাতে যাচ্ছি, পড়ুয়াও। হারাতে যাচ্ছি ছোটদার সঙ্গে গানের নাচের নাটকের কবিতার সাহিত্যের নানা অনুষ্ঠান দেখার সুযোগ। ছোটদার, লক্ষ করি, কোনও হারানোর ব্যথা নেই, বরং পাওয়ার আনন্দ। তিনি পেতে যাচ্ছেন ঢাকায় চাকরি, ভাল চাকরি, সচ্ছল সংসার,আলাদা সংসার। এতকাল অনিশ্চিতের সঙ্গে বসবাসের পর তিনি পেতে যাচ্ছেন নিটোলনিপাটনিশ্চিতি।



হাবিবুল্লাহর মত আরেকজন আমার পথ আটকাল একদিন, তবে বন্ধু হতে নয়, উদ্দেশ্য অন্য। কলেজ চত্বরেই, শ্যামগঞ্জীয় উচ্চারণে জানাল সে শফিকুল ইসলামের ভাই, ভাইয়ের মত সেও কবিতা লেখে, কলেজের নতুন ছাত্র সংসদ নির্বাচনে দাঁড়াচ্ছে, আমাকেও চাচ্ছে দাঁড়াই।

আমি?

হ্যাঁ তুমি।

আমি রাজনীতি করি না।

রাজনীতির কোনও প্রশ্ন নাই। তুমি সাহিত্য সদস্য পদে দাঁড়াইবা, কলেজ ম্যাগাজিন সম্পাদনার দায়িত্বে থাকবা, ফাংশান টাংশান করবা, এইসব। তুমি হইলা যোগ্য। ভোট চাইতে হয় তো! আমি ওগুলা পারব না।

ভোট চাইতে হইব না তোমার। তুমি এমনিতেই জিতবা। আরে পুরা প্যানেল, চোখ বন্ধ কইরা কইয়া দিতে পারি, জিতব।

ভোট চাইতে হবে না তো?

না মোটেও না।

ঠিক আছে।

আমি চত্বর থেকেই বাড়ির উদ্দেশে রিক্সা নিই, পেছনে ঝলকাতে থাকে হেলিমের আকর্ণবিস্তৃত হাসি, কালো মুখে শাদা দাঁত।

পরদিন হাবিবুল্লাহ আমাকে খপ করে ধরল, থমথমে মুখ, কি ব্যাপার, তুই বি এন পি করস জানতাম না তো!

আমি বি এন পি করি, কে বলল?

সবাই বলতেছে।

সবাই কারা?

সবাই কারা জানস না? তুই নির্বাচন করতেছিস বি এন পি থেকে? ঠিক কি না? ওই কথা! হ্যাঁ ঠিক, কিন্তু আমি কোনও দল করি না।

বিএনপির মত খারাপ দল আর আছে কোনও! ছাত্ররা সরকারি দল করে, সুবিধা আদায়ের তালে থাকে।

কী সুবিধা?

কী আর! পরীক্ষা পাশ। হাবিবুল্লাহ এপ্রোন খুলে ঘাড়ে ঝুলিয়ে বলল, তুই আজকেই নাম কাটা, দাঁড়াবি, জাসদ থেকে দাঁড়া।

হাবিবুল্লাহ নিজে জাসদ-ছাত্রলীগ করে, হাবিবুল্লারই ঘনিষ্ঠ বন্ধু তাহমিদ, সেও জাসদ, চশমা চোখের ভাল ছেলে, ছুটে এল, হাবিবুল্লাহকে নাকি বলেওছিল যদিও আমি কোনও দল করি না, জাসদ থেকে সাহিত্য সদস্য কেন, সাহিত্য সম্পাদক পদে দাঁড়াব কি না, যদিও নিচের ক্লাসের ছাত্রছাত্রীদের করলে সদস্যই করা হয়, কিন্তু আমার বেলায় জাসদ উদার হবে। তাহমিদ জাসদ করা ছাত্রদের একটা তালিকা দেখাল, বলল এরা সব স্ট্যান্ড করা ছাত্র। আর বিএনপির আনিস-রফিক? চার পাঁচ বছর ধরে এক ক্লাসেই পড়ে আছে। জাসদ করা মানে তখন জাতে ওঠা। ছাত্রলীগেও দেখি এক পাল ফেল করা ছাত্রের ভিড়। ভাল ছাত্র ছাত্রীরা হয় জাসদ-ছাত্রলীগ অথবা ছাত্র ইউনিয়ন করে, নয়ত কোনও দলই করে না।

আমি সেদিনই হেলিমকে খুঁজে বের করে বলি আমার নামটা কেটে দেন, আমি নির্বাচন করব না।

কেন কি হইছে?

আমি রাজনীতির কিসু বুঝি না। ছেলেরা বলতেছে আমি নাকি বিএনপি করি।

আরে বোকা মেয়ে, জাসদের পোলাপানরা তোমার মাথাটা বিগড়াইয়া দিতাছে। বিএনপি কর না। কিন্তু বিএনপি থেকে দাঁড়াইতেছ যেহেতু বিএনপি জিতবে এইবার, দাঁড়াইতেছ কলেজের স্বাথের্, পার্টির স্বাথের্ না। সোজা কথাটা কেন বুঝতে পারতেছ না? আর যদি এখন ছাত্রলীগ বা জাসদ থেকে কনটেস্ট কর, জেতার কোনও প্রশ্ন আসে না।

আমি চপু হয়ে থাকি। গলায় স্বর ওঠে না, স্পষ্ট বুঝতে পারি, বড় একটি শক্ত না ছুঁড়ে দিলে হেলিমের মন খারাপ হবে, কারও মন খারাপ করে দিতে আমার অস্বস্তি হয় খুব। আমি হেলিম হয়ে নিজের দিকে তাকাই।

আর তাছাড়া লিফলেট ছাপা হয়ে গেছে। এখন কোনওমতেই কিসু ক্যানসেল করা সম্ভব না। স্ক্যান্ডাল হইয়া যাবে।

আমাকে আরও চুপ হয়ে যেতে হয়। রফিক চৌধুরী আর আনিসুর রহমান ছাত্রদলের বড় দুজন নেতা আমার বাড়ি গিয়ে মিষ্টি মিষ্টি কথা বলে বুঝিয়ে আসেন, আমি নির্বাচনে দাঁড়ানো মানে রাজনীতি করা নয়, কলেজের সাহিত্যসেবা করা।

নতুন নির্বাচনের মরশুম শুরু হল। সারা কলেজের দেয়ালে পোস্টার। মঞ্চে গরম গরম বক্তৃতা, ক্লাসের বেঞ্চে লিফলেটের ছড়াছড়ি, একটু পর পর বিভিন্ন দলের প্রতিযোগিরা ক্লাসে করিডোরে ক্যান্টিনে দেখা করছে, হেসে কথা বলছে, ভোট চাইছে। প্রতিটি দলের প্রতিটি ভোটপ্রার্থীকেই মনে হয় ভোট দিই। ছাত্রদলের সভাপতি আনিসুর রহমান আমাকে চা খাইয়ে, এক গাল হেসে বলেন, চল নির্বাচনী প্রচারণায়।

অসম্ভব।

রফিক চৌধুরি বললেন পার্টির মেয়ে, এত লাজুক হলে চলবে!

পার্টির মেয়ে আমি! অন্যরাও বলাবলি করে। এ রইল আমার গায়ে সেঁটে। যাই হোক, নির্বাচনের দিন কলেজে গিয়ে ছাত্র ইউনিয়ন, ছাত্রলীগ আর জাসদের ভাল ভাল ছেলেমেয়েদের, যাদের যোগ্য মনে হয়েছে, বিভিন্ন পদে, ভোট দিয়ে বাড়ি ফিরলাম। পরদিন খবর পেলাম, ছাত্রদল মানে আনিস রফিক পরিষদ পুরো প্যানেল জিতেছে। গতবার জিতেছিল ছাত্রলীগ, এবার ছাত্রদল। এখন কি কাজ? ঢাকায় যেতে হবে, দেশের প্রেসিডেন্টর সঙ্গে দেখা করতে হবে।

নিস্প্রভ ছিলাম। ঢাকা যাওয়ার কথায় প্রাণ ফিরে পাই। দল বেঁধে ঢাকা যাওয়া হল বাসে। দল বেঁধে একই বাসে ফেরাও হবে। ঢাকা আমাকে কাপাঁয় তীব্র উত্তেজনায়। রুদ্রর সঙ্গে দেখা হওয়ার উত্তেজনা। জিয়াউর রহমানের সঙ্গে দেখা হওয়ার পর হেলিম আমাকে ছোটদার বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে যায় রাতে। মুহম্মদপুরের আজম রোডে একতলা হলুদ বাড়িতে থাকেন ছোটদা। ফকরুল মামার সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে বাড়িটি ভাড়া নিয়েছেন তিনি। ফকরুল মামা ঢাকার গ্রাফিকস আর্টসে লেখাপড়া করে ছোটখাটো চাকরি করছেন। ছোটদার ঘর সংসার দেখে আমার ভালও লাগে, আবার কষ্টও হয়। কষ্ট হয় ছোটদা অবকাশ ছেড়ে অত দূরে থাকেন বলে। ভাল লাগে, ছোটদার স্বপ্ন সফল হয়েছে বলে, একটি ভাল চাকরি পাওয়ার স্বপ্ন। চাকরিটি নিয়ে ছোটদার উচ্ছঅ!স খুব, এমন ভাল চাকরি নাকি আর হয় না। তিনি যখন তখন বিদেশ যেতে পারবেন, টাকাও নাকি প্রচুর। আমাকে তিনি পরদিন দাঁতের ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেলেন, ডাক্তারটি আবার ছোটদার বন্ধু ময়মনসিংহের অলি গলিতে যেমন ছোটদার বন্ধু ঢাকার অলিগলিতেও। ভীষণ কষ্ট দিয়ে আমার একটি দাঁত তুলে ফেলল বন্ধুটি।। দাঁত নিয়ে ছোটদা সবসময়ই বড় সচেতন। তিনি যখন প্রথম জ্যামিতিবক্স পেয়েছিলেন ইশকুলের বড় ক্লাসে পড়ার সময়, কাঁটা কম্পাসে ঢুকিয়ে আমার দাঁতের ফাঁকে লুকিয়ে থাকা মাংস এনে দিতেন আর বলতেন, দাঁত পরিষ্কার না করলে দাঁত সব পইরা যাইব কইলাম। সেই দাঁত সচেতন ছোটদার চাপে আমার ভাল দাঁতও মনে হয় দাঁতের ডাক্তার তুলে ফেলার প্রেরণা পায়। পচা দাঁত থাকার চেয়ে না থাকাই ভাল, ছোটদা নাক কুঁচকে বলেন। তুলে ফেলা দাঁতের গোড়ায় তুলো চেপে বাড়ি ফিরি। ঢাকা এসেছি অথচ রুদ্রর সঙ্গে দেখা হবে না—দাঁতের কষ্টের চেয়ে এই কষ্টটি আমাকে ভোগায় বেশি।

ঢাকা থেকে ময়মনসিংহে ফিরে বাড়ির সবাইকে তারস্বরে জানিয়ে দিলাম, জিয়াউর রহমানের সাথে হ্যান্ডসেক কইরা আইছি, আমার হাতের হাড্ডিা ভাইঙ্গাই যাইতাছিল, এমন জোরে চাপ দিছে হাতে।

আর্মি মানুষ তো! শইলে জোর বেশি। মা বললেন।

মা সরে যান, মার নিস্পৃহ মখু টি চোখের সামনে স্থির হয়ে থাকে, মার নিরুত্তাপ শব্দগুলোও। মনে মনে ভাবি জোর নিশ্চয়ই বেশি। জোর বেশি বলেই তিনি জোর খাটিয়ে ক্ষমতায় এসেছেন। বিমান বাহিনীতে জিয়ার ওপর অসন্তোষ গোপনে গোপনে বেড়েছিল, যে কোনও সময় একটি ক্যু হতে পারে আঁচ করে হাজার হাজার বিমানবাহিনীর লোককে নির্বিচারে হত্যা করেছেন। গর্তে লুকিয়ে থাকা স্বাধীনতার শত্রুদের পুনর্বাসন দিয়েছেন। শাহ আজিজের মত দেশের শত্রুকে প্রধানমন্ত্রী করেছেন। ধর্মীয় রাজনীতি নিষিদ্ধ ছিল এদেশে, সেই নিষেধাজ্ঞা তুলে দিয়েছেন। এখন গতর্ থেকে বেরিয়ে এসেছে সাপগুলো আবার ছোবল দেবে বলে যেভাবে দিয়েছিল একাত্তরে, যেভাবে পাকিস্তানি বাহিনীর পক্ষ হয়ে লক্ষ লক্ষ বাঙালিকে হত্যা করেছিল। সংবিধানকে বাপের সম্পত্তি মনে করে নিজে হাজম হয়ে মুসলমানি ঘটিয়েছেন সংবিধানের। কোরান পড়তে গেলে যে বিসমিল্লাহির রাহমান ইররাহিম অর্থাৎ আল্লাহর নামে শুরু করিতেছি বলতে হয়, তা বসিয়েছেন সংবিধানের শুরুতে। দেশে হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান সব ধর্মের মানুষকে জুতো পেটা করলেও বুঝি এর চেয়ে বেশি অপমান করা হত না। সংবিধান থেকে ধর্মনিরপেক্ষতা এক ফুঁয়ে উড়িয়ে দিয়েছেন। জোর তো তার বেশিই। হাতটি আমি গোসলখানায় গিয়ে সাবান দিয়ে ধুই, যেন যায়, যেন একটি কালো স্পর্শ আমার হাত থেকে মুছে যায়।

রুদ্র ময়মনসিংহে আমার সঙ্গে দেখা করতে এসে বলল, তোমার মাথামুণ্ডু আমি বুঝি না, তুমি নাকি বিএনপি থেকে নির্বাচন করেছ? আমাকে আগে জানাওনি কেন?

জানাইনি।

কেন জানাওনি?

সব কথা জানাতে হবে নাকি!

জানাতে হবে না?

না।

ঠিক আছে, যা ইচ্ছে তাই কর। মান সম্মান তুমি আর রাখলে না!



নির্বাচনের হল্লা শেষ হতে না হতেই ক্লাস শুরু হয়ে গেল পুরোদমে। তলপেট থেকে আমার বুকে উত্তরণ ঘটেছে। মরা মানুষ কাটতে হচ্ছে একদিকে। আরেকদিকে ট্রেতে করে ফরমালিনে ভেজা হৃদপিণ্ডের আগাগোড়া পড়তে হচ্ছে। মরা মানুষ কেটে বাড়ি ফিরে যখন খেতে বসি, হাতে গন্ধ লেগে থাকে, আস্ত সাবান খরচ করে হাত ধুলেও হাত থেকে গন্ধ যায় না। গন্ধের সঙ্গে বসবাসের অভ্যেস হয়ে যাচ্ছে ধীরে ধীরে। একদিন তো খাওয়া প্রায় শেষ হয়ে যাওয়ার পর দেখি হাতের কিনারে মরা মানুষের মাংস লেগে আছে, হাত ধুতেই ভুলে গিয়েছিলাম খাবার আগে। আর পকেটে করে যেদিন হৃদপিণ্ড বাড়ি আনলাম পড়তে, বাড়ির সবাই জিনিসটি দেখল, নাক চেপে, মুখ চেপে, বিস্ফারিত চোখে। আমি দিব্যি হৃদপিণ্ডটি টেবিলের ওপর রেখে কানিংহামের বই খুলে পড়তে শুরু করলাম, ওদেরও দেখাতে থাকি এই হচ্ছে এট্রিয়াম, আর এই হচ্ছে ভেন্ট্রিকেল, এই এখান দিয়ে রক্ত আসে, ওপর থেকে নিচে, তারপর নিচ থেকে রক্ত চলে যায় ওপরে, চলে যায় সারা শরীরে। মার দু চোখে অপার আনন্দ।

এই তো মা আমার ডাক্তার হইয়া গেল, আমার আর চিন্তা কি, আমার চিকিৎসা আমার মেয়েই করবে। মা বলেন।

দাদার প্রশ্ন, এইটা পুরুষের হার্ট নাকি মেয়েমানুষের?

তা জানি না।

দেইখা ত ছোট মনে হইতাছে,মনে হয় কোনও মেয়ের হার্ট।

মেয়েদের হার্ট ছোট হয় তোমারে কে কইল!

একটু ডিফারেন্ট থাকবে না!

না, ডিফারেন্ট থাকবে না।

ইয়াসমিন হৃদপিণ্ডকে নিরাপদ দূরত্বে দাঁড়িয়ে দেখতে দেখতে বলে, বুবু এইটারেই কি হৃদয় কয়?

হৃদয় হয়ত কয়। কিন্তু এইটা হৃদপিণ্ড, হৃদয় না। হৃদপিণ্ডের কাজ রক্ত পাম্প করা, সারা শরীরে রক্ত সরবরাহ করা।

তাইলে হৃদয় কোনটা?

হৃদয় হইল মাথা। ধর আমার কাউরে ভাল লাগল, আমার স্নায়ুতন্ত্রে খবর হবে প্রথম। স্নায়ুর ঘর বাড়ি হইল মাথায়, বুকে না। বুকে যে ধ্বক শব্দ হয়, সেইটা মাথার স্নায়ুতে নড়চড় হয় বইলা।

ইয়াসমিন অবিশ্বাসী চোখে তাকায় পিণ্ডটির দিকে।

হাবিবুল্লাহর সঙ্গে জড়তা ঝেড়ে ঘন্টার পর ঘন্টা যে কোনও বিষয় নিয়ে কথা বলে,একটি সহজ এবং য়চ্ছন্দ সম্পর্কে গড়ে তুলে, ছেলে মেয়েতে যে বন্ধুত্ব হতে পারে এবং তা যে কেবল চিঠিতে নয়, তা প্রমাণ করে আমার আনন্দ হয়। অবকাশে হাবিবুল্লাহর অবাধ যাতায়াত ক্রমে চোখ-সওয়া হয়ে গেছে। এই সম্পর্কটি ভবিষ্যতে স্বামী স্ত্রী পর্যন্ত গড়াবে এরকম একটি চিন্তা মাথায় এনে মা যখনই কোনও রকম স্বস্তি পেতে চান, মার অলীক কল্পনা ভেঙে দিয়ে বলি, হাবিবুল্লাহ হইল আমার বন্ধু জাস্ট বন্ধু আর কিছু না। চন্দনার সাথে আমার যেরকম বন্ধুত্ব, ঠিক সেইরকম বন্ধুত্ব, বুঝলা! আমার উত্তর মাকে খুব সুখী করে বলে মনে হয় না। হাবিবুল্লাহ দেখতে সুন্দর, নম্র ভদ্র, দুজনই আমরা ডাক্তার হতে যাচ্ছি, এর চেয়ে ভাল জুটি আর হয় না এধরনের কথা মা আমার কাছে না হলেও মিনমিন করে বাড়ির অন্যদের বলেন। আমার কানে সেসব শব্দের কণামাত্র এলে মাকে আমি ধমকে থামিয়ে দিই। আমি নিশ্চিত সম্পর্কটি কেবল নির্মল বন্ধুত্বের। হাবিবুল্লাহও নিশ্চিত। তার সঙ্গে এক রিক্সায় বসে কোথাও যেতে আসতে আমার কোনও রকম গা কাঁপে না। দাদার সঙ্গে বা ইয়াসমিনের সঙ্গে বা চন্দনার সঙ্গে রিক্সায় বসার মত। হাবিবুল্লাহ জানে যে রুদ্রর সঙ্গে একটি সম্পর্কে গড়ে উঠছে আমার, ফাঁক পেলেই রুদ্রর কবিতা তাকে শোনাই। কিন্তু আমাকে স্তম্ভিত করে হাবিবুল্লাহ একদিন সন্ধেয় বাড়িতে এসে আমাকে তুমি বলে সম্বোধন শুরু করে।তুই সম্বোধন নাকি তার ভাল লাগে না! কেন ভাল লাগে না এই প্রশ্ন করে কোনও উত্তর নয়, একটি সলজ্জ হাসি জোটে। হাসিটির কোনও অনুবাদ করা আমার সম্ভব হয় না। হাসিটি আমাকে অস্বস্তি দেয়, একই সঙ্গে আতঙ্কও। সামনে থেকে উঠে যাই, শোবার ঘর অন্ধকার করে শুয়ে থাকি বিষণ্নতাকে দুহোতে জড়িয়ে। বৈঠক ঘরের সোফায় বসেই থাকে হাবিবুল্লাহ, দীর্ঘ একটি চিঠি লিখে ইয়াসমিনের হাতে দেয়। ইয়াসমিন ঘরে আলো জ্বেলে চিঠিটি আমাকে দিয়ে যায় পড়তে। ইংরেজিতে লেখা চিঠিটির সারমর্ম এই, আমাদের এমন চমৎকার বন্ধুত্ব যে কোনও সময় হারিয়ে যেতে পারে, কিন্তু যদি একটি স্থায়ী সম্পর্কে আসা যায়, তবে হারানোর প্রশ্ন ওঠে না। আর নিজেও সে ভেবে দেখেছে, নিজেকে বহুবার প্রশ্ন করে দেখেছে, উত্তর একটিই আমাকে সে ভালবাসে। বন্ধুত্বের উর্ধে এই সম্পর্কটি কি আমি নিয়ে যেতে পারি না! চিঠিটি পড়ে আমি স্বপ্নভঙ্গের বেদনায় কুঁকড়ে যাই। অপমান আর লজ্জা আমাকে ছিঁড়ে খেতে থাকে। নিজেকে ওই বেদনা থেকে টেনে নিয়ে একটি ত্রে²াধের পেছন পেছন আমি হেঁটে যাই বৈঠক ঘরে। চিঠিটি টুকরো টুকরো করে ছিঁড়ে হাবিবুল্লাহর মুখের ওপর ছুঁড়ে চিৎকার করে বলি, এক্ষুনি এ বাড়ি থেকে বার হয়ে যা। এক্ষুণি। আমি যেন কোনওদিন তোর মখু না দেখি।

হাবিবুল্লাহ, নদ্র ভদ্র সুদর্শন, ডাক্তার হতে যাওয়া হীরের টুকরো ছেলে অনেকক্ষণ একা দাঁড়িয়ে থেকে বেরিয়ে যায়। এরপর কলেজে আমার সঙ্গে অনেক কথা বলতে চেয়েছে সে,কোনও সুযোগ তাকে দিইনি। অনেকদিন বাড়ির দরজায় কড়া নেড়েছে, দরজা খুলিনি।



আবু হাসান শাহরিয়ার, ছড়া লিখে নাম করেছে, সেও আমার সঙ্গেই পড়ে মেডিকেলে। ওর সঙ্গে কখনও কথা হয়নি আমার। আমার এপ্রোনের পকেটে একদিন ও মরা মানুষের একখণ্ড মাংসের সঙ্গে একটি চিরকুট আমার অজান্তে ফেলে রাখে, চিরকুটে ছড়া। ভীষণ বিরক্ত আমি শাহরিয়ারের ব্যবহারে, সাহিত্যের জগতের কেউ যে এত বদ হতে পারে আমার ধারণা ছিল না। বদ ছেলেটি এর কদিন পরেই মরা কাটায় অতিষ্ঠ হয়ে ডাক্তারি পড়া ছেড়ে দিয়ে ঢাকায় চলে যায়। ছেলে বদ হোক আর যা-ই হোক, ডাক্তারি বিদ্যা ছেড়েও যে অন্য কোথাও চলে যাওয়া যায় তা আমার বিশ্বাস হয়। কিন্তু বাবা বেঁচে থাকতে তা আমার পক্ষে সম্ভব হবে না, সে আমি ভাল জানি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলায় পড়ার যে স্বপ্ন ছিল, সেই স্বপ্ন সুব্রত চাকমার কারণে পূরণ হয়নি চন্দনার। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হবে বলে ও প্রয়োজনীয় কাগজপত্র যখন যোগাড় করছিল, ওর মেট্রিকের মার্কসিট তোলা ছিল না বলে আবাসিক আদর্শ বালিকা বিদ্যায়তনে, যেটি সম্প্রতি ময়মনসিংহ গার্লস ক্যাডেট কলেজে রূপ নিয়েছে, গিয়ে মার্কসিট যোগাড় করে ওকে পাঠিয়েছিলাম। বিশ্ববিদ্যালয়ে চন্দনা এ মাসে ভর্তি না হলেও আগামী মাসে হবে এরকম যখন খবর, ওকে উপজাতির কোটায় চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজে ভর্তি করে দিয়েছেন সুব্রত চাকমা, নিজের স্বপ্ন পূরণ করতে। চন্দনা চট্টগ্রাম থেকে লিখছে, ওর মড়া কাটতে ভাল লাগে না। কুমিল্লায় ফেলে যাওয়া কোনও এক সুদর্শনএর কথা ও গভীর করে ভাবছে, সেই সুদর্শন চিঠি লিখেই যাচ্ছে চন্দনাকে, চন্দনাকে ছাড়া সে বাঁচবে না জাতীয় চিঠি। মড়ার গন্ধে অতিষ্ঠ হয়ে জীবিতর ঘ্রাণ নিতে চন্দনাও এক রাতের সিদ্ধান্তে চট্টগ্রাম ছেড়ে কুমিল্লা চলে যায়। কুমিল্লা থেকে হঠাৎ একদিন জানায় ও বিয়ে করেছে ওই বাঁচবে নাকে। এর চেয়ে যদি খবর পেতাম, চন্দনা মরে গেছে, আমার বিশ্বাস হত। বিয়ে আর যে কাউকে করা মানায়, চন্দনাকে নয়। এর চেয়ে বড় কোনও দুঃসংবাদ পৃথিবীতে আর কিছু আছে বলে আমার মনে হয় না। নিঃসঙ্গতার বিকট লোমশ হাত আমার কন্ঠ এমন সজোরে চেপে ধরে যে শ্বাস বন্ধ হয়ে আসতে থাকে। দৌড়ে ছাদে গিয়ে সকলের আড়াল করি নিজেকে। চন্দনাকে নিয়ে এক আকাশ স্বপ্ন ছিল আমার, সেই স্বপ্নের ওপর পুরো জগতটিকে দেখি ভেঙে পড়তে। ভাঙনের স্তুপে আমি শূন্য হাতে একা দাঁড়িয়ে আছি, একা, এত একা যে হঠাৎ নিজের কোনও অস্তিত্ব আমি অনুভব করি না, মাথার ওপর অন্ধকার আর শিশির ঝরে পড়ে ঝপু ঝপু করে, তারপরও না। মাস গেলে চন্দনার বাবা ডাক্তার সুব্রত চাকমার একটি চিঠি আসে আমার কাছে, আমাকেই লিখেছেন তিনি। চন্দনা তাঁকে যে অপমান করেছে, তার প্রতিশোধ তিনি যে করেই হোক নেবেন। চন্দনাকে এ পৃথিবীতে বাঁচতে দিতে তাঁর অন্তত কোনও ইচ্ছে নেই। আমি দুদিন ভয়ে কাঠ হয়ে থেকে সুব্রত চাকমাকে লিখি চন্দনাকে যেন তিনি ক্ষমা করেন, ও ভুল করেছে এ স্বীকার করেই বলি, নিশ্চয়ই একদিন বুঝতে পারবে নিজের ভুল। সুব্রত চাকমা আমার চিঠির কোনও উত্তর দেন না। কিন্তু আবারও মাস গেলে তাঁর একটি চিঠি পাই, তিনি আমাকে নেমন্তন্ন করেছেন রাঙামাটিতে, চন্দনার শ্রাদ্ধের অনুষ্ঠানে। নিজের মেয়ের শ্রাদ্ধ করছেন তিনি। জাতচ্যুত মেয়েকে তিনি মেয়ে বলে স্বীকার করেন না, বৌদ্ধ মেয়ে পালিয়ে গিয়ে মুসলমান ছেলেকে বিয়ে করেছে, এই মেয়ে মরে গেছে বলেই তিনি বিশ্বাস করেন। সুব্রত চাকমার এই ভয়াবহ সিদ্ধান্ত শুনে চন্দনার জন্য আমার বড় মায়া হতে থাকে। ইচ্ছে করে নিজের সমস্ত শক্তি দিয়ে ওকে সেই সুদর্শন দুর্বৃত্তের কবল থেকে বাঁচিয়ে নিয়ে আসি। মন বলে চন্দনা ভাল নেই। কষ্ট পাচ্ছে, কাঁদছে। আমারও ভাল লাগে না সারাদিন লাশের গন্ধ আর ফরমালিনে ঝাঁজের মধ্যে মোটা মোটা বইয়ে ঝুঁকে থাকতে। কলেজে খারাপ ছাত্রী হিসেবে আমার নাম ছড়াতে দেরি হয় না।

বিপর্যস্ত আমি কলেজে যাই, আসি। একদিন কলেজের অধ্যক্ষ ফর্সা লম্বা হাসি মখু মোফাখখারুল ইসলাম আমাকে তাঁর ঘরে ডেকে নিয়ে মুখের হাসিটি গিলে চোখের জ্যোতিটি নিভিয়ে খাম খুলে একটি টাইপ করা চিঠি হাতে নেন। চিঠিটি আমি চিনি। এ চিঠির একটি কপি আমি কদিন আগে পেয়েছি।

তুমি তো ডাক্তার রজব আলীর মেয়ে, তাই না?

আমার কণ্ঠে কোনও স্বর ওঠে না। মাথা নাড়ি।

আমার স্বর না ওঠা কণ্ঠের দিকে, আমার ভয়-লজ্জার নতচোখে তাকিয়ে মোফাখখারুল ইসলাম তাঁর নিজের কণ্ঠস্বর যতটা সম্ভব কর্কশ করা যায় করে বলেন, তোমার ভাই এর নাম কি নোমান?

আমি মাথা নাড়ি।

আরেক ভাইএর নাম কি কামাল?

এবারও মাথা নাড়ি।

কামালের বউএর নাম কি গীতা?

এবারও মাথা।

তোমার ছোট বোনের নাম ইয়াসমিন?

মাথা।

মাথা মোফাখখারুলও নাড়েন। এর অর্থ হাতে ধরে রাখা চিঠিটির সত্যতা তিনি যাচাই করতে পেরেছেন। চিঠিটি, মোফাখখারুল ইসলাম জানেন না, যে আমি আগেই পড়েছি। আবদুর রহমান চিশতি নামের মাথা খারাপ একটি লোক আমাকে নিজেই এই চিঠির কপি পাঠিয়েছে। লোকটি দিস্তা দিস্তা চিঠি পাঠাতো আমাকে। শখের পত্রমিতা হয়েছিল কদিনের জন্য। ওসব দিস্তা দিস্তা পাতার চিঠিতে রূপকথা থেকে শুরু করে পৃথিবীর বাণিজ্যনীতি সম্পর্কে কঠিন কঠিন রচনা থাকত। বেশির ভাগই আমার পড়া হত না। সেই লোক হঠাৎ একদিন প্রেম নিবেদন করে বসার পর আমি চিঠি লেখা বন্ধ করে দিই। তারপরই এই হুমকি। আমি যদি সাড়া না দিই, তবে আমার ক্ষতি করবে সে এভাবে। ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষকে সরাসরি চিঠি লিখে জানাবে যে আমার বংশের সকলের চরিত্র থেকে দগুর্ ন্ধ বেরোয়। আমার বাবা শুয়েছে গীতার সঙ্গে, আমার বোন শুয়ে বেড়ায় এদিক ওদিক। আমি তো আছিই। আমি তো শুয়েছিই চিশতির সঙ্গে, কেবল তার সঙ্গে নয়, তার সব বন্ধর সঙ্গেও। আমার দুভাইএরও একই অবস্থা। মেয়ে দেখলেই ঝাঁপিয়ে পড়ে। শোয়। ইত্যাদি। কেবল শোয়াশোয়ির গল্প। মোফাখখারুল ইসলাম, আমি অনুমান করি, বিশ্বাস করছেন চিঠিটির প্রতিটি শব্দ।

বড় একটি শ্বাস ছেড়ে বলি, এটি একটি উড়ো চিঠি। এ চিঠির কথা আমি জানি। চিশতি নামের এক লোক এই চিঠি লিখেছে। লোকটিকে প্রস্তাবে আমি রাজি হইনি বলে শোধ নিয়েছে।

মাননীয় অধ্যক্ষের সারা মুখে বিদ্রূপ ঝলসাচ্ছে। ঠোঁটে বাঁকা একটি হাসি।

তুমি নিজেকে খুব চালাক মনে কর তাই না? প্রশ্ন করেন।

আমি উত্তর দিই না।

তুমি কি মনে কর আমি কিছু বুঝি না?

আমি নিরুত্তর।

তোমার মত বাজে মেয়েকে আমি এই কলেজে রাখব না। টিসি দিয়ে দেব। শিগগিরি।

এবার আমি আমূল কেঁপে উঠি। সামনে দুলে ওঠে অধ্যক্ষের ঘর, অধ্যক্ষ, চিঠি। আমার সরল সত্য অধ্যক্ষ মেনে নেননি। মেনে নিয়েছেন একটি উড়ো চিঠি, যে চিঠিতে চিঠির লেখকের কোনও নাম নেই, কারও কোনও স্বাক্ষর নেই। যে চিঠির লেখককে অধ্যক্ষ চেনেন না, চেনেননা লোকটির কথাই তাঁর কাছে সত্য, চেনেন মেয়েটির কথা সত্য নয়। অধ্যক্ষের ঘর থেকে বেরিয়ে লক্ষ করি কারও সঙ্গে আমি কথা বলতে পারছি না, আমি আড়াল করতে পারছি না চোখের সজল যনণ্ত্রা। বাকি কোনও ক্লাস না করে সোজা বাড়ি ফিরি। শুয়ে থাকি দেয়ালের দিকে মখু করে বিছানায়। ইয়াসমিন এলে পুরো ঘটনা বলি। মোফাখখারুল ইসলামের মেয়ে শারমিন ইয়াসমিনের ক্লাসে পড়ে বিদ্যাময়ী ইশকুলে। খুব সহজ শারমিনের কাছ থেকে ওদের পরিবারের সবার নাম যোগাড় করা। এরপর খুব সহজ একটি চিঠি লেখা। খুব সহজ চরিত্রে কালিমা লেপা। খুব সহজ চিঠিটি ময়মনসিংহ চিকিৎসা মহাবিদ্যালয়ের অধ্যক্ষের ঠিকানায় পাঠিয়ে দেওয়া। এতে অন্তত উড়ো চিঠি কাকে বলে, এই শিক্ষাটি তিনি পাবেন। শিক্ষাটি দিতে কেবল হাত নয়, মন নিশপিশ করে। কিন্তু নাম যোগাড় হওয়ার পর চিঠিটি লিখতে গিয়েও আমি লিখি না। আমার রুচি হয় না লিখতে। কুকুরের কাজ কুকুর করেছে, কামড় দিয়েছে পায়.. বলে লিখতে যাওয়া চিঠিটি ছিঁড়ে ফেলি।

কলেজে যাই যদিও, ক্লাসে মন বসে না। করিডোরে হাঁটতে গেলে মোফাখখারুল ইসলাম সামনে পড়লে যেন সামনে কোনও মানুষ পড়েনি, যেন ফাঁকা, এভাবে হেঁটে যাই। সাধারণত সামনে কোনও শিক্ষক পড়লে হাত তুলে সালাম দিতে হয়। নিয়মটি আমার কোনওদিনই ভাল লাগে না। আমি এমনিতেও ব্যাপারটি এড়িয়ে চলি। এড়িয়ে চলি বলে অভদ্র বলে আমার দুর্নাম রটে। সেই দুর্নামকেও পরোয়া করি না বলে আমি আপাদমস্তক একটি হাস্যকর বস্তু হিসেবে পরিচিত হই। পরীক্ষায় পাশ করতে হলে সালাম ছাড়া নাকি গতি নেই, এরকম ফিসফিস শুনি। ফিসফিস থেকে আমার নাক কান মখু মন সব সরিয়ে রাখি। জরুরি ক্লাস যা আছে করেই কলেজ থেকে বেরিয়ে যাই। বইয়ের দোকান থেকে রাজনীতি সমাজ সাহিত্য ইত্যাদি বিষয়ের বই কিনে বাড়ি ফিরতে থাকি। বিকেলে ইয়াসমিনকে নিয়ে এদিক ওদিক বেড়াতে যেতে থাকি, পাবলিক লাইব্রেরিতে ভাল ভাল আলোচনা অনুষ্ঠানে যাই। কিছু না কিছু থাকে প্রায়ই। আর কোথাও যাবার না থাকলে পদ্মরাগমণির বাড়ি গিয়ে কবিতা নিয়ে গল্প করি, নয়ত নাটকঘরলেনে ইশকুলের বান্ধবী মাহবুবার বাড়িতে উঠোনের রোদে শীতল পাটিতে বসে চা মুড়ি খেতে খেতে সহজ সরল জীবনের খুঁটিনাটি নিয়ে কথা বলি, নয়ত নানিবাড়িতে রেললাইনের ওপারে সেই কতকাল আগে ফেলে আসা ছোট্ট চড়ুই ছানা, ছেঁড়া ঘুড়ি, নীল বেলুন, পানা পুকুর, পুঁতির মালার নিভৃত জগত থেকে ঘুরে আসি। মা বলেন, এইযে দুইটা মেয়ে এইরকম একলা একলা বাইরে যাস, মাইনষে কি কইব?

যা ইচ্ছা তাই কউক।

তগোর সাহস বেশি বাইড়া গেছে।

দোষ ত কিছু করতাছি না।

তর বাপ যদি জানে। ঠ্যাং ভাইঙা বাড়িত বওয়াইয়া রাখব।

ভাঙুক। বলে আমি মার সামনে থেকে সরে যাই। মার এই ঘ্যানঘ্যানে বড় বিরক্তি ধরে আমার।



চন্দনা আর আগের মত ঘন ঘন চিঠি লেখে না। যা লেখে তা শ্বশুর বাড়ির গল্প। আগের মত চন্দনা আর স্বপ্নের কথা বলে না। আর কবিতাও লেখে না। অনেক বদলে গেছে ও।

হালকা হালকা বন্ধুত্ব হওয়া ক্লাসের ছেলেমেয়েরা আসে বেড়াতে, আড্ডা দিতে, খেতে। ঢাকায় বাড়িঘর ফেলে পারিবারিক পরিবেশ থেকে দূরে হোস্টেলে থেকে লেখাপড়া করা এরা স্বাদ পেতে চায় কোথাও ছায়া সুনিবিড় শান্তির নীড়ের, মায়ের হাতের রান্নার মত রান্নার। এদের সঙ্গে সময় উড়তে থাকে আমার।

আবারও কবিতায় পায় আমাকে। সেঁজুতি ছাপার নেশা দপদপ করে জ্বলে। অগুনতি সাহিত্য পত্রিকা, কবিতার খাতা আর সেঁজুতির পাণ্ডুলিপির ওপর বাবা একদিন বস্তা উপুড় করে এক শরীর হাড়গোড় ঢেলে বললেন যা দেখতাছি, দশ বছরেও তর মেডিকেল পাশ হইব না।
 
১০. কনে দেখা


চাকরি নেওয়ার পর থেকে দাদা অবকাশের চেহারা ধীরে ধীরে পাল্টো ফেলতে শুরু করেছেন। বৈঠকঘর থেকে বেতের সোফা বিদেয় করে নরম গদিঅলা কাঠের সোফা বসিয়েছেন। চার পাঅলা একটি টেলিভিশন কিনে বৈঠকঘরে বসিয়েছেন। বিশাল সেগুন কাঠের পালঙ্ক বানিয়ে আনলেন অভিনব এক হেডবোর্ড সহ, আঙুর গাছের তলে পুরুষ রমণী উলঙ্গ শুয়ে আছে। হেডবোর্ডের দুপাশে আবার ছোটছোট নকশাকাটা ড্রয়ার। এক একটি আসবাব আসে বাড়িতে আর আমরা দূর থেকে কাছ থেকে ছুঁয়ে না ছুঁয়ে দেখি। আয়নার টেবিলও আনলেন, সেটিও বিশাল, নানারকম নকশা অলা। সিংহের পা অলা দশজনে বসে খাবার এক খাবার টেবিল আনলেন। আবার থালবাসন রাখার জন্য আলমারি আনলেন, সেও বিশাল, সামনে কাচ লাগানো। এতসব আজদাহা আসবাবে এমন হল, যে, ঘরে হাঁটার জায়গা রইল না। দাদা খুব গর্ব করে জানিয়ে দিলেন, সব ফার্নিচার সেগুন কাঠের, আর আমার দেওয়া ডিজাইন। লোকেরা, যারাই বাড়িতে আসে, চোখে বিস্ময় নিয়ে দাদার আসবাব দেখে যায়। এরকম আসবাব আর কোথাও তারা দেখেনি। নিজে নকশা এঁকে একটি সবুজ রঙের ইস্পাতি আলমারিও বানালেন, তাঁর সবচেয়ে আনন্দ, এরকম আর অন্য কারও বাড়িতে নেই।

তা ঠিকই, নেই। বৈঠকঘরের সামনের ঘরটি দাদা বানালেন তাঁর আপিসঘর, একটি ড্রয়ারঅলা টেবিল পাতলেন;ফাইসন্স কোম্পানির যাবতীয় কাগজপত্র, ওষুধের ব্যাগ, সব সাজিয়ে রাখলেন সে টেবিলে।

এত আসবাব বানানোর মূল কারণটি হল দাদা বিয়ে করবেন। বউ আসবে, একটি গোছানো বাড়ি পাবে অর্থাৎ তৈরি সংসার পাবে। দামি দামি কাচের বাসনপত্র কিনে আলমারিতে সাজিয়ে রেখেছেন, চাবি তাঁর পকেটে।

আত্মীয় স্বজনরা ঘুরে ঘুরে দাদার সাজানো ঘরদোর দেখে বলে যান নোমানের তো সবই হইল, এইবার একটা বউ হইলেই হয়।



বিয়ে করবেন বলে প্রায় কয়েক বছর থেকে মেয়ে দেখে বেড়াচ্ছেন দাদা। মেয়ে দেখানো হচ্ছে, কিন্তু কোনও মেয়েকে পছন্দ হচ্ছে না। বিভিন্ন বাড়ি থেকে প্রস্তাব আসে, অথবা প্রস্তাব পাঠানো হয়, তিনি আত্মীয় বা বন্ধু সঙ্গে নিয়ে মেয়ে দেখে আসেন, যাবার সময় প্রতিবারই এলাহি কাণ্ড ঘটান, ঘন্টাখানিক সময় নিয়ে পুরো-সাবান খর্চা করে স্নান করেন, স্নান সেরে অসম্ভব বেসুরো গলায় গান গাইতে গাইতে মুখে পনডস ক্রিম আর পাউডার মাখেন, হাতে পায়ে জলপাই-তেল আর শরীরের আনাচ কানাচে তো আছেই, বুকে পেটে পিঠে, হাতের নাগালে শরীরের যা কিছু পান, মোটেও কাপর্ণ্য না করে সগু ন্ধী ঢালেন। এমনিতে সগু ন্ধীর ব্যাপারে দাদা বেশ হিশেব করে চলেন, বাড়িতে এক দাদারই সগু ন্ধীর আড়ত, মাঝে মাঝে কোথাও বেড়াতে যাবার আগে, দাদা একটু সেন্ট দিবা? যদি বলি, প্রথম বলে দেন, নাই। গাঁই গুঁই করলে কোথায় যাচ্ছি কেন যাচ্ছি ইত্যাদি সব প্রশ্ন করেন, উত্তর পছন্দ হলে তিনি তার ঘরের গোপন এক জায়গা থেকে সগু ন্ধীর শিশি বের করে বারবার বলেন এইটা হইল আর্থমেটিক, বা এইটা হইল ইন্টিমেট, মেইড ইন ফ্রান্স, মেইড ইনটা দাদা বলবেনই, তারপর এক ফোঁটা মত কিছু দিয়ে বলবেন ইস অনেকটা পইড়া গেল!

কি দিলা দেখলামই না তো!

আরে ওইটুকুর মধ্যেই তো দুইশ টাকা চইলা গেছে।

দাদা বাড়ি না থাকলে খুঁজে ওই গোপন জায়গায়, জুতোর ভেতর, সুগন্ধীর শিশি আর পাইনি, নতুন জায়গায় শিশি রেখেছেন লুকিয়ে, মা-বেড়াল যেমন বাচ্চা-বেড়ালের ঘাড়ে কামড় দিয়ে জায়গা বদলায়, দাদাও তেমন সগু ন্ধীর শিশির জায়গা বদলান। যাই হোক, প্রচুর সময় নিয়ে সাজগোজ করে, আয়নার সামনে নানা ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে নিজেকে দেখেন দাদা। আমাদের জিজ্ঞেস করেন কী, সুন্দর লাগতাছে না! আমরা একবাক্যে বলি, নিশ্চয়ই। নিঃসন্দেহে সুন্দর দেখতে দাদা, চুল যেমন ঘন কালো, নাক টিকলো, বড় বড় চোখ, চোখের পাপড়ি, দৈঘের্ প্রস্থে রীতিমত সপুুরুষ। চকচকে জুতো পায়ে, গরমকালেও স্যুট টাইপরা দাদা চমৎকার হাসি নিয়ে বাড়ি থেকে বেরোন মেয়ে দেখতে আর প্রতিবারই ফেরেন মলিন মখু করে। প্রতিবারই পকেটের সোনার আংটি পকেটেই থাকে, কাউকে আর দেওয়া হয় না।

কী দাদা, মেয়ে কেমন দেখলা? জিজ্ঞেস করি।

দাদা নাক কুঁচকে বলেন আরে ধুর!

প্রতিবারই তিনি বাড়ির সবাইকে বৈঠকখানায় বসিয়ে দেখে আসা মেয়ের খুঁত বর্ণনা করেন।



বাবা একবার দাদাকে পাঠালেন তাঁর এক চেনা লোকের মেয়েকে দেখে আসতে। দাদা দেখেও এলেন। বাবা বাড়ি ফিরে দাদাকে নিয়ে বসলেন, মেয়ে পছন্দ হইছে?

দাদা সঙ্গে সঙ্গে মুখের যা কিছু কোঁচকানোর আছে কুঁচকে বললেন না।

কারণ কি? মেয়ে ত শিক্ষিত !

হ শিক্ষিত।

বি এ পাশ করছে!

তা করছে।

মেয়ে ফর্সা না দেখতে?

হ ফর্সা।

চুল লম্বা না?

হ।

মেয়ে তো খাটো না!

না খাটো না।

বাবা এডভোকেট।

হ।

বার কাউন্সিলের প্রেসিডেন্ট ছিল ত অনেকদিন।

হ।

শহরে দুইডা বাড়ি!

হ।

ভাল বংশ।

হ।

মেয়ের কাকারা তো সব ভাল চাকরি করে। একজন সোনালী ব্যাংকের ম্যানেজার।

হ।

মেয়ের ফুপাতো একটা ভাই ত লন্ডনে থাকে।

হ।

মুরব্বি কারা কারা ছিল?

মেয়ের ভাই ছিল, বাবা ছিল।

বড় ভাই না ছোট ভাই?

বড় ভাই।

বড় ভাই তো বিয়া করছে কয়দিন আগে, খুব বড়লোকের মেয়েরে বিয়া করছে।

মেয়ের বাবা ডিস্ট্রিক জাজ ছিল।

হ।

ওদের বাড়িঘরের অবস্থা নিশ্চয়ই ভাল।

হ ভাল। ড্রইংরুমে দামি সোফা টোফা আছে।

টেলিভিশন আছে তো!

হ।

কি খাওয়াইল?

তিন রকমের মিষ্টি খাওয়াইল, চা খাওয়াইল।

মেয়ের কথাবার্তা কেমন? আচার ব্যবহার?

তা ভাল।

ভদ্র তো!

হ ভদ্র।

শান্তশিষ্ট মেয়ে!

হ।

তাইলে পছন্দ হইল না কেন?

সবই ঠিক ছিল, কিন্তু

কিন্তু কি?

ঠোঁটটা…

ঠোঁটটা মানে?

নিচের ঠোঁটটা চ্যাপ্টা না, উঁচা। উঁচা ঠোঁটের মেয়েদের আমার দুইচোখখে দেখতে ইচ্ছা করে না।

হুম।



দাদার জন্য চ্যাপ্টা ঠোঁটের মেয়ে দেখা শুরু হল। একটি মেয়ের খবর এল, টাঙ্গাইলে বাড়ি, তার বোনের বাড়ি ময়মনসিংহ, আমাদের পাড়াতেই। মেয়েকে টাঙ্গাইল থেকে বোনের বাড়ি আনানো হল। কনে দেখার দিন তারিখ ঠিক হল। দাদা যথারীতি সেজে গুজে আমাকে আর ইয়াসমিনকে নিয়ে ও বাড়িতে গেলেন। মেয়ের বোন দরজা খুলে দিয়ে আমাদের ভেতরে বসালেন। কিছু টুকটাক কথাও বললেন, যেমন, তুমি তো এবার মেডিকেলে ভর্তি হলে, তাই না?

তোমার নাম কি?

ইয়াসমিন! আমার ভাইঝির নামও ইয়াসমিন।

আমার মেয়েও তো বিদ্যাময়ী ইশকুলে পড়ে,ও আজকে ওর মামার বাড়ি গেছে।

আজকাল গরমও পড়েছে খুব, এই গরমে রাত্রে আবার ইলেকট্রিসিটি চলে যাচ্ছে!

আচ্ছা কী খাবেন বলেন, চা না ঠাণ্ডা?

এধরনের অপ্রয়োজনীয় কথাবার্তার মধ্যে প্রয়োজনীয় ব্যাপারটি ঘটল, ট্রেতে চা বিস্কুট নিয়ে ডানো ঢুকল ঘরে। অপলক তিনজোড়া চোখ ডানোর দিকে। ডানো অপ্রস্তুত হেসে বসল একটি চেয়ারে। চা খাওয়া হচ্ছে, এবং সঙ্গে চলছে অপ্রয়োজনীয় কথা।

টাঙ্গাইলের বিন্দুবাসিনী কলেজ আর আগের মত নাই, একসময় খুব নাম ছিল।

পোড়াবাড়ির চমচমএর সাইজ আগের চেয়ে ছোট করে ফেলল, আবার দামও বাড়ায়ে দিল!

ডানো খুব কাজের মেয়ে, আমার বাসায় আসলে তো ও-ই সব কাজ করে।

বাড়িঘর গোছানো, রান্নাবান্না, সব ও করে, আবার বাগান করারও শখ আছে। নিজের জামাকাপড় নিজেই শেলাই করে, দরজির কাছে দেয় না।

টাঙাইলে কাদের সিদ্দিকীর বাড়িটা চেনেন, কাছেই নাথবাবুর বাড়ি, ওইখানে আমি মাসে একবার যাই।

ও বাড়ি থেকে হেসে বিদায় নিয়ে বাইরে বেরোতেই দাদাকে জিজ্ঞেস করলাম, কী, পছন্দ হইছে?

দাদার নাক চোখ ঠোঁটের দিকে দুজোড়া চোখ।

চোখগুলা সুন্দর। ইয়াসমিন বলল।

ঠোঁট তো চ্যাপ্টাই। আমি বললাম।

দাদার নাক কুঁচকোলো এবার, বেশি চ্যাপ্টা।

বাড়িতে জানিয়ে দেওয়া হল, ঠোঁট বেশি চ্যাপ্টার কারণে ডানোকে দাদার পছন্দ হয়নি।

মাস কয় পর খবর এল, ডানোর সঙ্গে টাঙ্গাইলের নামী মুক্তিযোদ্ধা কাদের সিদ্দিকীর বিয়ে হয়ে গেছে।

শুনে দাদাকে বললাম, ইস কি মিসটা করলা, ওরে বিয়া করলেই পারতা!

দাদা বললেন ভাগ্যিস করি নাই। ওর সাথে নিশ্চয় কাদের সিদ্দিকীর প্রেম ট্রেম ছিল।



এমনিতে কোনও সুন্দরী মেয়ের বিয়ের খবর শুনলে দাদার মন খারাপ হয়ে যায়, আহা আহা করেন, যেন হাতের নাগাল থেকে চমৎকার লেজঅলা পাখিটি চকিতে উড়ে গেল। দিলরুবার বিয়ে হয়ে যাওয়ার পর দাদা প্রায় কাঁদো কাঁদো গলায় বলেছিলেন, মেয়েডা একেবারে শীলার ট্রু কপি ছিল।

ছিল কি !এখনও তো শীলার ট্রু কপি।

বিয়া হইয়া গেছে তো!এখন থাকলেই কি ..

হুম।

ওর একটা বইন আছে না? লতা! লতাও কিন্তু সুন্দরী ছিল।

ছিল কি এখনও সুন্দরী।

আচ্ছা লতারে প্রস্তাব পাঠানো যায় না?

কিন্তু ও তো তোমার অনেক ছোট।

তা অবশ্য ঠিক।

আর লতার সাথে শুনছি কার নাকি প্রেমও আছে।

তাইলে বাদ দে!

ময়মনসিংহ শহরে যত সুন্দরী আছে, কলেজে পড়ছে বা আইএ বিএ পাশ করেছে, সবাইকে এক এক করে দাদার দেখা হয়ে গেছে, কিন্তু কাউকে পছন্দ হয়নি। এবার ঝুনু খালা বললেন চল ঢাকায় মেয়ে দেখাই, একটা সুন্দরী মেয়ে আছে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হইল এইবার।

ওর বাড়ি কুমিল্লা, বাবা কলেজের প্রফেসর। রুনুখালা আরও খবর দেন।

মেয়েটা আমার খুব ভক্ত, সারাক্ষণই ঝুনু আপা ঝুনু আপা করে। রোকেয়া হলে, আমার পাশের রুমে থাকে।

দেঁতো হেসে রুনুখালা বললেন।

সুন্দরী কি না কও। দাদার প্রশ্ন।

খুব সুন্দরী।

দাদার পা ডানে বামে নড়তে থাকে দ্রুত।

ঠোঁট চ্যাপ্টা তো!

হ চ্যাপ্টা।

বেশি চ্যাপ্টা না তো আবার?

না বেশি চ্যাপ্টা না।

ঠিক হল, ঢাকার নিউমার্কেটে এক আইসক্রিমের দোকানে লাভলি আর তার এক বান্ধবী বসে থাকবে, দাদা দূর থেকে দেখবেন। দাদার পছন্দ হলে পরে আরও এগোনো হবে। দাদা ঢাকা গিয়ে নিউমার্কেটে হাঁটাহাঁটি করে সময় মত আইসক্রিমের দোকানের সামনে গেলেন, মেয়ে দেখলেন। ঝুনু খালাকে চোখটা ট্যারা মনে হইল বলে ময়মনসিংহে ফিরে এলেন।

ময়মনসিংহের আশেপাশের শহর, টাঙ্গাইল, জামালপুর, নেত্রকোনা সবখানেই দাদা মেয়ে দেখতে গিয়েছেন। মুখ মলিন করে ফিরে এসেছেন। এরপর সিলেট! সিলেটে যাবেন মেয়ে দেখতে। প্রস্তাবটি এসেছে দাদার সঙ্গে এক লোক চাকরি করে, তার থেকে। সিলেটে আমিও যাব বলে গোঁ ধরলাম, গোঁ এ কাজ হল। দাদা আমাকে নিয়ে সিলেট রওনা হলেন। সারা ট্রেনে বলতে বলতে গেলেন, সিলেটের মেয়েরা কিন্তু খুব সুন্দরী হয়।

আমি বললাম, ফটোতে তো মেয়েরে সুন্দরীই মনে হইতাছে।

তা মনে হইতাছে। ফটোতে সব খুঁত কিন্তু ধরা পড়ে না।



সিলেটের দরগা রোডে ফাইসন্স কোম্পানীর সপুারভাইজার মুনির আহমেদএর বাড়ি উঠলাম রাতে। বিশাল বাগানঅলা সুন্দর বাড়ি। বাড়িতে ঢুকেই আমাকে অস্থিরতায় পায়। দাদা চল শহরটা ঘুইরা দেখি।

দাদার তখন শহর ঘুরে দেখায় মন নেই। মেয়ের ফটোটি বারবারই বুক পকেট থেকে বের করে কড়া আলোর তলে ফেলে দেখেন, আমাকেও দেখতে দেন ফটো, বলেন তর কি মনে হয়, আবার ভাল কইরা দেখ তো!

বলি দেখছিই তো কত বার!

আবার দেখ। বারে বারে দেখলে কিছু একটা ধরা পড়ে।

ধৎু । সিলেটে আইলাম কি বাসায় বইসা থাকতে! চল না একটু ঘরু তে যাই!

তর ধৈর্যশক্তিটা একটু কমই নাসরিন। দাদা বেজার হয়ে বলেন।

এত দূর জানির্ কইরা আইছি। শরীরে ধূলাবালি ভর্তি। গোসল টোসল করতে হইব।

কি হইব গোসল না করলে? আইসা কইর।

নাক টাক তো ঠিকই আছে কি কস! ফটোর দিকে চোখ দাদার।

আমি জানালায় বসে যতটুকু দেখা যায় বাইরেটা, দেখতে থাকি।একাই যদি বেরিয়ে পড়তে পারতাম শহরটিতে! রিক্সা নিয়ে ঘুরে ঘুরে একাই যদি দেখতে পারতাম সব!

পরদিন মেয়ে দেখা হল। মেয়ের বাবা পুলিশ অফিসার, মেয়ে বিএ পাশ।

সবই ভাল,হেভি ফর্সা মেয়ে, কিন্তু…সামনের দাঁত দুইটা একটু উঁচা। ব্যস। মেয়ে নাকচ করে দিয়ে দাদা আমাকে নিয়ে শাহজালালের মাজার দেখতে গেলেন। মাজার দেখার কোনও ইচ্ছে আমার ইচ্ছে ছিল না, তারচেয়ে শহরময় হুডফেলা রিক্সায় ঘুরে শহরের স্বভাব চরিত্র জানতে পারলে আমার আনন্দ হত।

মাজারে হাজার হাজার লোক গিজগিজ করছে। পুকুরের কিনারে দাঁড়িয়ে লোকেরা কালো কালো মাছকে খাবার দিচ্ছে, মাছগুলো শরীর ভাসিয়ে খাবারগুলো মুখে নিয়ে জলে ডুব দিচ্ছে আবার! বাহ! দাদা বললেন এই মাছগুলারে খাবার দেয় কেন মানুষ জানস? খাবার দিলে নাকি সওয়ার হয়। হযরত শাহজালাল নিজে আল্লাহর কাছে খাবারদেনেঅলা লোকদের জন্য বেহেসতের তদবির করেন।

এরপর দাদা তাঁর জুতো খুলে আমার হাতে দিয়ে বললেন জুতাগুলা লইয়া এইখানে দাঁড়া, আমি মাজারের ভেতরটায় যাইয়া দেইখা আসি। শাহজালালের কবর ওইখানটায়। আমারেও নিয়া যাও।

না, ওইখানে মেয়েদের যাওয়া নিষেধ।

উঁচু সেই কবরঘরে দাদা একা গেলেন, আমি ঘরটির দিকে খুব অবাক হয়ে তাকিয়ে ভাবতে থাকি, মেয়েরা ওখানে গেলে অসুবিধেটা কোথায় হয়, কার হয়!

ট্রেনে করে ময়মনসিংহে ফেরার সময়, দাদাকে বললাম তাইলে সিলেটের মেয়েরেও তোমার পছন্দ হইল না।

দাদা বললেন সিলেটের মেয়েরা এমনিতে সুন্দরই হয়।

তাইলে পছন্দ হইল না কেন?

পছন্দ হইছে।

তাইলে যে কইলা দাঁত উঁচা।

আরে ওই দাঁতালরে না তো!

তাইলে কারে?

মুনির ভাইএর বউরে।

কও কি!

ঠোঁটগুলা দেখছস! ওই রকমের ঠোঁট চাইতাছিলাম আমি।

তারে তুমি বিয়া করবা? চোখ কপালে তুলে বলি।

বিয়া করব কেমনে? সে ত অলরেডি ম্যারেড!

দাদা অনেকক্ষণ জানালায় উদাস তাকিয়ে থেকে ফস করে বললেন, ঠোঁটের ওপরের তিলটা দেখছস?

কার ঠোঁটের ওপরে?

মুনির ভাইএর বউএর।

তুমি তো দেখতে আইছিলা পুলিশ অফিসারের মেয়েটারে। তার তিলের কথা কও।

তার ত একটা তিল আছে গালে।

দেখিও নাই তার গালের তিল। উঁচা দাঁতের মেয়েদের দিকে আসলে বেশিক্ষণ তাকাইতে হয় না। চোখ টনটন করে।



নামের ব্যাপারেও দাদার আসক্তি কাজ করে। একবার এক মেয়েকে প্রস্তাব পাঠানো হল, কারণ দাদা জেনেছেন মেয়ের নাম নীলাঞ্জনা। নীলাঞ্জনাকে দেখার জন্য তিনি ব্যাকুল।

এই মেয়ে সুন্দরী না হইয়া যায় না।

কি কইরা বুঝলা যে সে সুন্দরী?

এত সুন্দর নাম যার, সে কি দেখতে খারাপ হইতে পারে!

নীলাঞ্জনাকে দেখে এসে অবশ্য দাদা সারাদিন ছি ছি ই করলেন। মাজেদা নামের এক মেয়ে, যদিও খুবই সুন্দরী, দাদা নাম শুনেই নাকচ করে দিলেন, দেখতে যাওয়া তো দূরের কথা। তাঁর বক্তব্য, মাজেদা নাম শুনলেই আমার বমি আসে। এত বাজে নামের মেয়েদের সুন্দরী হওয়ার কোনও কারণই নাই।

আমরা,বাড়ির লোকেরা, দাদার বিয়ের আশা অনেকটা ছেড়েই দিই। একজনই আশা ছাড়েন নি, তিনি দাদা নিজে। তাঁর গভীর বিশ্বাস, দেশের সবচেয়ে সুন্দরী মেয়েকে তিনি অচিরে বিয়ে করছেন।

বিশ্বাসটুকু আছে বলেই তিনি দিব্যি স্ফূর্তিতে জীবন কাটাতে থাকেন। গানের একটি যন ্ত্র কিনেছেন। আগের গানের যন্ত্রটি মেইড ইন রাশিয়া, যেটি তিনি উদয়ন প্রতিযোগিতায় দ্বিতীয় পুরস্কার হিসেবে পেয়েছিলেন, বাবার ঘরে ছিল, সে ঘর থেকে, এক রাতে বাবা ছিলেন না বাড়িতে, ঘর বাইরে থেকে তালাবন্ধ ছিল, তাই করতেন তিনি, দরজায় তালা লাগিয়ে বাইরে বেরোতেন, জানালার শিক ভেঙে ঢুকে যা যন্ত্রপাতি ছিল চোর নিয়ে গেছে, সেই বিশাল গানের যন ্ত্র মেইড ইন জার্মানি, ছোটদা সারাই করতে নিয়ে পরে যেটি সারাই ছাড়াই ফেরত দিয়েছিলেন, সেটিও। বড়মামা বলেছিলেন দাদাকে উদয়ন প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে, প্রতিযোগিতায় যে প্রশ্ন তার উত্তরও তিনি একরকম বলে দিয়েছিলেন দাদাকে, বলেছিলেন ঘুণাক্ষরেও প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠানের কাউকে না জানাতে যে দাদা তাঁর কেউ হন। প্রথম পুরস্কার মস্কো ভ্রমণ, দ্বিতীয় পুরস্কার গানের যন,্ত্র তৃতীয় পুরস্কার ক্যামেরা। বড়মামার প্রভাব কতটুকু খেটেছিল তা কেউ জানে না, কিন্তু দাদা দ্বিতীয় পুরস্কার পেয়ে মহানন্দে গানের যন্ত্রটি বগলদাবা করে বাড়ি এনে রাজ্যির গানের ক্যাসেট কিনে সেসব শুনতে শুরু করে দিলেন। তখনও দাদা হেমন,্ত মান্না, সন্ধ্যা, সতীনাথ থেকে বের না হওয়া মানুষ। চুরি হওয়ার পর অনেকদিন গানহীন ছিল বাড়ি। নতুন যন ্ত্র কেনার পর দাদা ঢাকা থেকে পছন্দ করে গানের ক্যাসেট নিয়ে এলেন। এবার ফিরোজা বেগমের গাওয়া নজরুল গীতি। ফিরোজার প্রেমে উতলা হয়ে তিনি নিজে ফিরোজার আরও গানে মন দিলেন। গানের যন্ত্রের শব্দ বাড়িয়ে দিয়ে আমাদের কাছে ডাকেন, বেসুরো গলায় ফিরোজার সঙ্গে গাইতে থাকেন নিজে আর থেকে থেকেই আবেগের আহা আহা। কমল দাশগুপ্তর জন্য ফিরোজার ভালবাসার ব্যাখ্যা দিয়ে বলেন, এই কি গো শেষ দান, বিরহ দিয়ে গেলে ….বইলা কি টানটা দিছে দেখ। কমল দাশগুপ্ত যেদিন মারা গেল, তার কফিনের সামনে বইসা এই গানটা গাইছিল ফিরোজা। গানটি শুনতে শুনতে দাদার চোখ বারবার ভিজে ওঠে।

গানের মোহ দাদার সামান্য দূর হয় যখন তিনি ভিসিআর নামের একটি যন ্ত্র অমৃতর দোকান থেকে ভাড়া আনলেন। এরপর প্রায়ই এক রাত কি দুরাতের জন্য ভিসিআর ভাড়া এনে যত হিন্দি ছবি আছে বাজারে, দেখতে শুরু করে দেন দাদা। অমৃত গোলপুকুরপাড়ে নতুন একটি ভিডিও ক্যাসেটের দোকান শুরু করেছে, বড় দেখতে-সুন্দর ছেলে, জ্যোতির্ময় দত্তের সুন্দরী কন্যাকে বিয়ে করবে করবে করছে। ব্যবসায় কড়া সবুজ বাতি জ্বলছে অমৃতর। ময়মনসিংহে যখন প্রথম দুএকটি ভিসিআর এসেছিল, বিষয়টি ছিল আহামরি উত্তেজনার, কোনও কোনও অন্ধকার সিঁড়ি আর দরজাজানলাবন্ধকরা বাড়িতে মোটা টাকায় টিকিট বিক্রি করে সারারাত হিন্দি ছবি দেখানো হত। ছোটদা আমাকে একবার তাঁর এক বন্ধুর বাড়িতে নিয়ে গিয়েছিলেন ভিসিআরএ ছবি দেখাতে। ঝিরঝির করা ছবি চোখের সামনে নিয়ে বেশিক্ষণ বসে থাকা আমার সম্ভব হয়নি। ছবি শেষ না করেই বাড়ি ফিরেছি। সেই আমার প্রথম ভিসিআরএ চোখে-খড়ি। এরপর যন্ত্র ভাড়া করে ছবি দেখতে দেখতে দাদা যখন হিন্দি ছবির উত্তেজনায় একটি যন্ত্র কিনেই ফেলেন আর রাত জেগে দিন জেগে দেখা কেবল নয় ছবি গিলতে শুরু করেন, প্রথম প্রথম সামনে বসেছি। কিন্তু দিন দিন আশ্চর্য ধর্মেন্দ্রর জন্য ঘোড়া কে রাখল এই ফাঁকা মাঠে? একটু আগে তো কোনও ঘোড়া ছিল না! হেমামালিনী হঠাৎ লাফ দিয়া গান শুরু কইরা দিল কেন? গান কি কোনও মানুষ এইভাবে রাস্তায় নাচতে নাচতে গায়? মন্তব্যের মাছি বাড়ির অন্য দর্শকদের নিমগ্নতার দিকে ভনভন করে উড়ে যেতে থাকে। আজগুবি মারদাঙ্গা ছবি দেখার কোনও রুচি আমার হয়নি। কিন্তু দাদা,ছবি যেরকমই হোক, পাছায় জিগাইরা আঠা লাগাইয়া বসে থাকেন সামনে। বরং বেছে বেছে যেখানে মারামারি নেই, আজগুবি গল্প নেই, হাস্যকর অবাস্তবতা নেই সেরকম ছবি আমি দেখি। অমিতাভ রেখা আমার প্রিয় হয়ে ওঠে। তারও চেয়ে বেশি প্রিয় হয়ে ওঠে শাবানা আজমি স্মিতা পাতিল নাসিরুদ্দিন শাহ। দাদা আমার রুচির দিকে অবজ্ঞা ছুঁড়ে বলেন, আইন্ধার ছবিগুলা আর আনিস না। বস্তির জীবন আমরা প্রত্যেকদিনই দেখতাছি, পর্দায় দেহনের কোনও মানে নাই। আন্ধাইর ছবি ছাড়া অন্য যে কোনও গল্পের যে কোনও পরিচালকের যে কোনও শিল্পীর যে কোনও ছবি দেখতে দেখতে দাদা একদিন একটি ছবির জালে পুঁটি মাছের মত আটকা পড়লেন। ছবিটির নাম মোগল ই আযম। মোগল ই আযমের প্রেমে অনেকটা উন্মাদ হয়ে গেলেন তিনি। ছবিটি ননস্টপ চলতে লাগল। সংলাপ তিনি মখু স্থ আওড়াতে লাগলেন। বাড়িসুদ্ধ সবাইকে ছবিটি একাধিক বার দেখালেন, নানিবাড়ি থেকে নানিকে, হাশেমমামাকে, পারুলমামিকে, এমনকি টুটুমামা আর শরাফমামাকে ডেকে এনেও দেখালেন। ছবি চলাকালীন দাদা বাংলায় বর্ণনা করেন কি ঘটছে, কে কি বলছে, যদিও হিন্দি সকলেই জানে, তারপরও দাদা অনুবাদ করেন, আর থেকে থেকে আহা আহা উহ উহ। হাশেমমামা পুরোনো ছবির খুব ভক্ত। ছোটবেলার দেখা হিন্দি আর উদর্ু ছবির গান তিনি ফাঁক পেলেই গেয়ে বেড়ান। টেনে হিঁচড়েও ফজলিখালাকে ছবিটির সামনে বসাতে পারেননি দাদা। ফজলিখালা টেলিভিশনের দিকে তাকান না গুনাহ হবে বলে। মা ছবি পেলে গুনাহর কথা ভুলে যান। মোগল ই আযম দেখার লোভ সংবরণ করা মার জন্য অসম্ভব হয়ে ওঠে বলে তিনি আল্লাহ এবং তাঁর আদেশ নির্দেশ আপাতত বালিশের তলে চাপা দিয়ে এসে ছবি দেখে নিয়ে আসর বা এশার নামাজের পর মোনাজাতের হাত তুলে নিজের গুনাহর জন্য ক্ষমা চেয়ে নিয়েছেন। আল্লাহর অসীম দয়া, তিনি ক্ষমা করেন তাঁর সন্তপ্ত বান্দাদের, মা জানেন।

বাড়িতে যে অতিথিই আসে, চা বিস্কুটএর বদলে দাদা মোগল ই আযম দিয়ে আপ্যায়ন করা শুরু করলেন।
 
১১. কবোষ্ণ জীবন


রুদ্রর সঙ্গে যখন জীবন দেওয়া নেওয়া ইত্যাদি সব সারা তখনও তার সঙ্গে আমার দেখা হয়নি। চিঠিতেই আলাপ, চিঠিতেই প্রেম, চিঠিতেই যা কিছু খেলার ছলে ওই জীবন দেওয়া নেওয়ার ব্যাপারটি ঘটেছে। রুদ্র জানাল, ২৯ আশ্বিন তার জন্মদিন।

জন্মদিনে কি চাও বল। তুমি যা চাও, তাই দেব তোমাকে।

যা চাই তা দেওয়া কি তোমার পক্ষে সম্ভব হবে?

কেন হবে না?

হবে না আমি জানি।

বলেই দেখ না।

রুদ্র জানাল তার চাওয়া হবে খুবই কঠিন, কষ্টকর এবং দুঃসাধ্য কিছু।

পরের চিঠিতে তার প্রশ্ন, যা চাই তা কি তুমি সত্যিই দিতে পারবে?

আমি কাধঁ ঝাঁকিয়ে,বাহ পারব না কেন? বলেছি যখন দেব, দেবই বলি। চড়ুই পাখির মত দেখতে একটি অহঙ্কার আমার কাধঁ থেকে উড়ে নাকের ডগায় এসে বসে।

ধর আমি যদি তোমাকে চাই?

এ আর এমন কি! এইসব খুঁটিনাটি খুনসুঁটিতে ঠিক আছে যাও, এই আমাকেই আমি দিলাম।

আমার সঙ্গে প্রেম রুদ্রের শব্দের সঙ্গে, উপদ্রুত উপকূলের কবিতার সঙ্গে, তার চিঠির অক্ষরের সঙ্গে। পেছনের মানুষকে আমি চিনিনা, দেখিনি কোনওদিন কিন্তু কল্পনা করে নিই অপূর্ব এক সুদর্শন পুরুষ ওপারে আছে, যে পুরুষ কোনওদিন মিথ্যে বলে না, মানুষের সঙ্গে কোনও অন্যায় আচরণ করে না, যে উদার, অমায়িক, প্রাণবান, যে পুরুষ কোনও মেয়ের দিকে এ যাবৎ চোখ তুলে তাকায়নি ইত্যাদি একশ রকম গুণ। রুদ্র যখন জানাল ময়মনসিংহে আসছে আমার সঙ্গে দেখা করতে, আমাকে বারবারই গেলাস গেলাস ঠাণ্ডা জল খেতে হচ্ছিল, গলা বুক শুকিয়ে আসছিল। তা দেখা হবে কোথায়! মাসুদের বাড়ি, মাসুদও কবিতা লেখে, এমনিতে গানের ছেলে মাসুদ, ছোটদার বয়সে ছোট-বড় বিশাল বন্ধুমহলে সেও একজন, তার সঙ্গে রুদ্রর আলাপ ঢাকায়, টিএসসির আড্ডায়,তার বাড়িতেই উঠবে রুদ্র, সানকিপাড়ায়, আমাকে সকাল এগারোটায় ওখানে যেতে হবে। সকাল সাতটা থেকে ঘড়ি দেখছি, ঘড়ির কাঁটা যত এগারোটার দিকে এগোয়, তত আমার বুকের ধুকপুক ঘন হয়, দ্রুত হয়।

চোখে একটি কায়দার রোদচশমা পরা, যত না আধুনিক, দেখতে তার চেয়ে।জামা পাজামা পরনে, তখনও ওড়না পরি না, কলেজের ইউনিফর্মের লাল ওড়না ছাড়া আর কোনও ওড়নাও নেই বাড়িতে, চন্দনার মত ওড়নার ওপর আমারও বড় রাগ বলে ওড়না পরার বয়স হওয়ার পরও ওড়না না পরে ঘরেও থাকি, বাইরেও যাই। মাকে নানিবাড়ির কথা বলে লম্বা চুলের মেয়ে, চিকন চাকন মেয়ে, মেদ-নেই-মাংস-নেই-মেয়ে, পুকুরঅলা মাঠের ওপর ছোট্ট টিনের বাড়ির দিকে, মাসুদের বাড়ির দিকে। ছোট্ট বাড়ির ছোট্ট ঘরে ছোট্ট মেয়ের ছোট্ট বুকের সব ধুকপুক অকস্মাৎ থেমে গেল, যখন এক দাড়িঅলা, লম্বা চুলঅলা, লুঙ্গিপরা ছেলে বলল এসে যে সে রুদ্র। প্রেমিকার সঙ্গে প্রথম দেখা লুঙ্গিতে! রুদ্র দেখতে তখন গাঁ থেকে আসা রিয়াজউদ্দিনের শালাগোছের কেউ। কালো চশমার আড়ালেও নামিয়ে ফেলি চোখ।

চশমাটা খোল। আমি তোমার চোখ দেখতে পাচ্ছি না।

যার সঙ্গে জীবন বিনিময় হয়ে গেছে সহস্র লিখিত বাক্যে, তার প্রথম বাক্য, মুখোমুখি প্রথম বসে।

রুদ্রর ভারি স্বর আমাকে চমকায়, চশমা খুলি, কিন্তু তাকিয়ে থাকি মাসুদের ঘরের আসবাবে।

নৈঃশব্দ।

কী কথা বলছ না যে!

চপ্পলে পায়ের আঙুল ঘসতে থাকি। বাঁ হাতের নখের কিনারে দেখার কিছু নেই, তবু চোখ ফেলে রাখি ওতে, যেন এ মুহূর্তে শুশ্রূষা না করলে নখটি পচে গলে খসে যাবে। রুদ্রর দিকে না তাকালেও স্পষ্ট বুঝি সে আমাকে দেখছে, আমার চুল চোখ নাক চিবুক সব দেখছে। একঘর অস্বস্তির মধ্যে মাসুদ চা বিস্কুট নিয়ে ঘরে ঢোকে। আমি চায়ের কাপে, সোফার রং উঠে যাওয়া হাতলে, শোকেসের পুতুলে আর মাঝে মাঝে মাসুদে তাকিয়ে চা শেষ করেই উঠে দাঁড়াই।

কী ব্যাপার অস্থির হচ্ছ কেন? রুদ্র বলে। আবারও সেই ভারি স্বর।

আমার চোখ তখন জানালায়। গাছের পাতাগুলো কড়া সূর্যের তলে ঝিমোচ্ছে। পুকুরটিও ঝিমোচ্ছে, জলপোকারা গায়ে বসতেই মৃদু তরঙ্গ তুলে নেচে উঠছে জল।

রুদ্রও দাঁড়ায়, একটু একটু করে এগিয়ে আসে আমার দিকে, শরীরটির দিকে এক পলক চেয়ে বুঝি, লম্বায় আমার চেয়ে দু বিঘৎ খাটো সে। জাহাঙ্গীর নামে তাঁর এক বেটে বন্ধুর সঙ্গে ঝগড়া হওয়ার পর দাদা প্রায়ই আস্ফালন করতেন, পুইট্যা লোক হইল খোদার দুশমন! বেঁটে তো বেঁটেই,তার ওপর রুদ্রর মখু ভর্তি দাড়ি মোচ, মোচ জিনিসটি দেখলেই আমার ঘেন্না হয়, দাড়ি দেখলে তো আরও।

আমি শরমে নাকি ভয়ে জানি না, খানিকটা সরে দাঁড়াই।

রুদ্র বলল এক্ষূনি যাবার কি হল?

নৈঃশব্দ।

চিঠিতে তো খুব কথা বল। এখন বলছ না যে!

নৈঃশব্দ।

ইস কী মুশকিল। তুমি কি বোবা নাকি!

বোবা মেয়ে জল আর জলপোকাদের প্রায় গা ঘেঁষে মাসুদের বাড়ির মাঠ পেরিয়ে চলে গেল।

যাবার আগে, দরজায় দাঁড়িয়ে, কাল আসছ তো! প্রশ্নের উত্তরে কেবল মাথা নেড়েছে হ্যাঁ আসছে।

গিয়েছি পরদিনও। পরদিনও ওর দিকে চোখ তুলে তাকাইনি, আমার সমস্ত শরীরে, চুল থেকে পায়ের নখ অবদি, শরম। নিজেকে বারবার বলছি, কথা বল মেয়ে, কথা বল, ও তোর প্রেমিক। ওর সবকিছু তুই জানিস, ওর উপদ্রুত উপকূল পড়ে মখু স্ত করে ফেলেছিস, এবার দুটো তিনটে বাক্য বল। পারিনি। হয়নি।

রুদ্র চলে গেল। ঢাকা থেকে চিঠি লিখল, সে নাকি এমন মেয়ে দেখেনি। এমন লাজুক।

লাজুক মেয়ে উত্তরে বারো পাতার চিঠি পাঠাল। এই হয় আমার, লিখতে বল, আমার মত বাচাল আর কেউ নেই। কাছে এসো, এমন গুটিয়ে যাব যে ভাববে চিঠির মানুষটি নিশ্চয়ই অন্য কেউ! আমারও মাঝে মাঝে মনে হয়, লেখার আমি আর রক্তমাংসের আমি যে আমি নানিবাড়ি আর অবকাশের চৌহদ্দির মধ্যে বেড়ে ওঠা, দুজন। একজন পেখম মেলে পাখনা মেলে আকাশে ওড়ে, আরেকজনের মাটির পৃথিবীতে, অন্ধকারে, বন্ধ ঘরে বাস, গায়ে পায়ে শেকল, মস্তিষ্কেও।



রুদ্র এরপর আরও দুবার এল ময়মনসিংহে। মাসুদের দু একজন বন্ধুর সঙ্গে দিব্যি জমিয়ে নিয়েছে, এ শহরে সময় মন্দ কাটে না তার। রুদ্রর সঙ্গে দেখা হলে আমার কিন্তু সেই একই হাল, বুকের ধুকপুক এত দেখাতেও এমন হয়নি যে কিছু কমেছে। ভাই বন্ধুদের সঙ্গে আমি চুটিয়ে আড্ডা দিতে পারি, কিন্তু প্রেমিকের সামনে পড়লে গা হাত পা সব ঠাণ্ডা হয়ে থাকে। মুখে তালা, চাবি অদৃশ্য।

রুদ্রর তো আসা হচ্ছে, কিন্তু দেখাটা হবে কোথায়, বসব কোথায় দুজন! মাসুদের বাড়িতে তার দাদারা আপত্তি তুলেছে, ও বাড়িতে আর নয়। শহরের রাস্তায় হাঁটাহাঁটি করলে চেনা লোক কেউ দেখে ফেলবে আর মুহূর্তে বাবার কানে খবর চলে যাবে, সর্বনাশ! কোথায় তবে, ইশকুলের বান্ধবী নাদিরা আর মাহবুবার বাড়ি যাই, ওরা চা বিস্কুট খেতে দেয়, কিন্তু ফিসফিস করে বলে বাড়িতে নাকি জিজ্ঞেস করছে কে এই লোক! তখনও আমার বয়সী মেয়েদের কোনও প্রেমিক নিয়ে কারও বাড়িতে যাওয়া অশালীন একটি ব্যাপার, প্রেম করা ব্যাপারটিই যখন অশালীন! মেয়ে বড় হলে বাবা মা পাত্র খুঁজে মেয়েকে বিয়ের পিঁড়িতে বসাবে, মেয়ে মখু বুজে জানা নেই শোনা নেই লোককে দিব্যি স্বামী মেনে নিয়ে শ্বশুরবাড়ি ঘর করতে যাবে—এ নিয়মের বাইরে মেয়েরা যে প্রেম করে না তা নয়, কিন্তু গোপনে, এত গোপনে যে কাক পক্ষী জানতে না পারে। কাকপক্ষী তো বটেই দএু কজন বন্ধুকে ব্যাপারটি জানাতে আমার আপত্তি ছিল না। চন্দনা আদ্যোপান্ত জানিয়েছি, রুদ্রকেও জানিয়েছি চন্দনার সমস্ত দুজনকেই সনির্বন্ধ অনুরোধ করেছি, পরস্পরকে লিখতে। লেখালেখি চলছে দুজনে। রুদ্রকে লেখা আমার চিঠির অনেকটা জুড়েই থাকে চন্দনা। চন্দনা যে আমার প্রাণের সঙ্গে কতটুকু জড়িয়ে আছে, তা বোঝে রুদ্র। মাঝে মাঝে অভিমান করে বলে, কেবল চন্দনা চন্দনা চন্দনা। তোমার তো একজন বন্ধু হলেই চলে, আমার কি আর প্রয়োজন আছে তোমার জীবনে! রুদ্রকে নিয়ে কোথাও যাওয়ার, কোথাও বসার জায়গা না পেয়ে একদিন নানিবাড়ি বেড়াতে যাই। নানি আমাদের জন্য চা করে নিয়ে আসেন, মখু টিপে হেসে রুদ্রকে বলেন, এই মেয়েকে পাইতে হলে আগে প্রতিষ্ঠিত হইতে হবে, বুঝলা! আমি শরমে মুখ নিচু করি। তবু নানিবাড়িতে যা সম্ভব, অবকাশে তা নয়। রুদ্রকে নিয়ে এ বাড়ি ও বাড়ি নানা বাড়ি যাওয়ার কথা ভাবি, কিন্তু কখনও অবকাশে নিয়ে যাওয়ার কথা ভাবতে পারি না। সুতরাং, পার্কে বসে থাকো, বোটানিক্যাল গার্ডেনে বস গিয়ে, গাছের ছায়ায় বসে কথা বল। বোটানিক্যাল গার্ডেন শহর থেকে খানিকটা দূরে, কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায়, ওখানে ব্রহ্মপুত্রের শুকিয়ে যাওয়া জলের দিকে মুখ করে ঘাসে বসে থাকি, দএু কটি বালু টানা নৌকা যায়, তাই দেখি বসে আর হ্যাঁ বা না জাতীয় কিছু শব্দ উচ্চারণ করি রুদ্রর অসংখ্য প্রশ্নের জবাবে। বাগানে হাঁটতে আসা লোকেরা অদ্ভুত চোখে আমাদের দেখে।

মেডিকেল কলেজে ঢোকার পর একটি নিয়মিত জায়গার ব্যবস্থা হল, কলেজ ক্যান্টিন। ক্যান্টিনে প্রথমদিন হাবিবুল্লাহকে নিয়ে রুদ্রর সঙ্গে দেখা করতে যাই, হাবিবুল্লাহ যেহেতু বন্ধু যেহেতু আমার গভীর বিশ্বাস, ছেলেতে মেয়েতেও বন্ধুত্ব হতে পারে, ঠিক ছেলেতে ছেলেতে বা মেয়েতে মেয়েতে যেমন, হাবিবুল্লাহ আর চন্দনাতে যেহেতু আমি কোনও তফাৎ দেখি না, রুদ্রর মুখোমুখি বসে আমি যে কটা বাক্য ব্যয় করি, তা হাবিবুল্লাহর সঙ্গেই। আর কিছু শব্দ কেবল কাপের ভেতর চা আর দধু চিনির মিশেলের রঙ খুঁজতে খুঁজতে, যখন রুদ্র জিজ্ঞেস করে ক্লাস শেষ হয়েছে?

হয়েছে।

আরও ক্লাস আছে?

আছে।

করতে হবে?

হু।

হু মানে কি? না করলে চলে না?

চলে।

ক্লাস ফাঁকি দিয়ে রুদ্রর সঙ্গে বসে থাকি। দুপুরের পর ক্যাম্পাস খালি হয়ে যায়, ক্যান্টিন বন্ধ হয়ে যায়, চত্বরে ঘাসের ওপর, নয়ত কলেজের সিঁড়িতে বসে আমাদের প্রেমালাপ চলে, প্রেমালাপ এরকম,

চিঠি পাচ্ছ ঠিকমত?

পাচ্ছি।

আমাকে প্রতিদিন চিঠি লিখবে,বুঝেছ?

আচ্ছা।

কবিতা লিখছ?

এই একটু আধটু।

পারলে মাত্রাবৃত্তে লিখবে।

মাত্রাবৃত্ত তো ছয় ছয় করে। তাই না?

হ্যাঁ। শেষে দুই যোগ করতে পারো। ছয় ছয় দুই।

অক্ষরবৃত্তটা বুঝতে পারি, মাত্রাবৃত্তটা কঠিন লাগে..

লিখতে লিখতেই ঠিক হবে। অক্ষরবৃত্ততেই প্রথম প্রথম লিখতে থাকো।

আট চার ছয়ে?

তাও করতে পারো, আবার আট চার দুই, ছয় চার দুই, ছয় চার দুই করলে অবশ্য মাত্রাবৃত্তের ছন্দটা চলে আসে..

উপদ্রুত উপকূলের কবিতাগুলো তো বেশির ভাগ অক্ষরবৃত্ত ছন্দে, তাই না?

হ্যাঁ তাই।

আমি তো লিখি আর অক্ষর গুনি, কী যে ঝামেলা লাগে..

ঝামেলার কি আছে, ছন্দটা হচ্ছে শোনায়. কানটা সজাগ রাখবে.. .

মাঝে মাঝে মনে হয় আমার এসব কবিতাই হয় না।

হয় হয়, লিখতে থাকো। তোমার কবিতার খাতাটা কাল এনো তো দেখব!

ভাল কবিতা লিখে নিই, পরে দেখাবো।

এনো তো বাবা! যা বলছি শোনো।. আচ্ছা একটা কথা…

কী?

তুমি আমাকে কোনও সম্বোধন কর না কেন?

কি রকম?

না ডাকো রুদ্র, না বল তুমি।

বলি তো!

কই বল!

চিঠিতে।

সে তো চিঠিতে। চিঠিই তো জীবন নয়। সামনে ডাকো না কেন?

লজ্জা আগুনের শলা ছোঁয়ালো সারা মুখে। প্রতিবারই রুদ্রর সঙ্গে দেখা করার আগে আমি আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে অথবা মনে মনে রুদ্র তুমি রুদ্র তুমির মহড়া দিই। রুদ্র তুমি কি খাবে বল, রুদ্র তুমি কি আজই চলে যাবে, এসব বাক্যের চর্চাও চলে। কিন্তু তার সামনে এলেই, মূল মঞ্চেই, আমার মহড়া মখু থুবড়ে পড়ে। প্রাণপণ চেষ্টা করেও আমার ভাববাচ্যের শেকল থেকে নিজেকে মুক্ত করতে পারি না।

তোমাকে এত দূরের মনে হয় কেন! একটওু তোমাকে স্পর্শ করতে দাও না। কত বলছি, হাতটা দাও। দিচ্ছ না। এত ভয় কিসের, আমি কি বাঘ ভালুক নাকি!

রুদ্র বাঘ ভালুক নয় তা জানি। রুদ্র সত্তর দশকের উজ্জ্বল তরুণ। সত্তর দশক যুদ্ধের মৃত্যুর ভাঙনের দশক, সত্তর দশক কবিতার দশক, কবিতায় লাশের গন্ধ, চিৎকার, প্রতিবাদ। রুদ্র তার কবিতায় এই দশকটির চিত্র চমৎকার এঁকেছে। যখন সে তার ঢাকার জীবনযাপনের গল্প করে, মগ্ধু হয়ে শুনি। তার ওই জীবনটি বড় দেখতে ইচ্ছে করে। ইচ্ছে করে পুলিশের গুলিতে আহত মানুষ নিয়ে শহরে মিছিল করি, ইচ্ছে করে প্রতিবাদের লিফলেট ছেপে দেয়ালে দেয়ালে সেঁটে দিই। ইচ্ছে করে রুদ্রর মত আমিও টিএসসির মাঠে বসে চা খেতে খেতে লাকি আখন্দের গান শুনি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে সারা বিকেল ঝালমুড়ি খেতে খেতে সাহিত্যের আড্ডায় মেতে উঠি। মহিলা সমিতিতে সেলিম আল দীনের নাটক হচ্ছে, দেখি। কদিন পর পরই কবিতার অনুষ্ঠান হচ্ছে, অনুষ্ঠানগুলোয় যাই, কবিতা শুনি। রুদ্র যেন আমার অল্প অল্প করে জাগা কবিতার চারার আশপাশ থেকে আগাছা সরিয়ে জল ঢালে, অথবা বলা যায় ছিল বারুদ, সে আগুন জ্বালে। প্রবল তৃষ্ণা জাগে কোনও এক অদেখা অচেনা কবোষ্ণ জীবনের জন্য। না মেটা তৃষ্ণা নিয়ে আমাকে বিকেল বিকেল উঠতে হয়, যেতে হয় বাড়িতে, হিশেব দিতে হয় দেরি হওয়ার, মিথ্যে বলতে হয়, বলতে হয় যে ক্লাসের পর মেয়েদের হোস্টেলে ছিলাম, মিথ্যে বলার সময় আমার গলা কাঁপে, দুচোখ হয় মাটিতে নয় বইপত্রে। ঢাকায় রুদ্রর ওই জীবনটিও পরে দেখা হয়েছে আমার। বেহিসেবি, বেপরোয়া, উদ্দাম, উত্তাল জীবন। বিশ্ববিদ্যালয়ের মাঠে, টি এস সি চত্বরে, চা সিগারেট খেতে খেতে কতরকম মানুষের সঙ্গে যে রুদ্র কথা বলে! রাজনীতির কথা। সাহিত্যের কথা।ঠা ঠা করে হাসে। তার বন্ধুদের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিয়েছে, বন্ধুরা হয় কবি নয় গল্পকার, নয় গায়ক, নয় নায়ক। তখনও আমি অচেনা কারও সঙ্গে কথা বলতে না পারা লাজুকলতা, পাতাকাঠির মত শরীর আর ফিনফিনে চুলের মেয়ে। রুদ্রর জীবনের দিকে আমি আকন্ঠ বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে থাকি। চমৎকার এক মুক্ত জীবন, কারও কাছে কৈফিয়ত দিতে হয় না কোথায় যাচ্ছে কী করছে, ঘরে ফিরতে দেরি হচ্ছে কেন। ঢাকাতেও আমার সময় বাঁধা থাকে রুদ্রর সঙ্গে সময় কাটানোর, রুনুখালা এক ঘন্টা কি দেড়ঘন্টা সময়ের জন্য আমাকে হাতছাড়া করেন। রুদ্রর সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছি জেনেই করেন। ঝুনু খালার নিজের প্রেমের গল্প আমাকে নিদ্বির্ধায় শুনিয়ে যান, আমারটি বলতেও আমি ঝুনুখালার কাছে দ্বিধাহীন হই। তিনি রক্তচক্ষু অভিভাবকের মত আমাকে এ ব্যাপারে শাসন করেন না মোটেও। অনেক আগেই বড়মামার বাড়ি থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের মেয়েদের ছাত্রীনিবাস রোকেয়া হলে উঠেছেন রুনুখালা,প্রেম করছেন বিশ্ববিদ্যালয় পাশ করে বিশ্ববিদ্যালয়েরই এক আপিসে চাকরি করা মতিউর রহমান নামের এক বরিশালির সঙ্গে। বরিশালির সঙ্গে যখন তিনি দেখা করতে যান, বগলদাবা করে নিয়ে যান আমাকে। সোহরাওয়ার্দি উদ্যানের ঘাসে বসে তিনি বরিশালিকে নিজের বাড়ির আর আত্মীয় স্বজনের গল্প করেন, শুনে এত চেনা রুনুখালাকেই আমার বড় অচেনা লাগে। যে কেউ ধারণা করবে ধনে মানে রুনুখালার আত্মীয়রা সাংঘাতিক কিছু লাখপতি কোটিপতির নিচে কোনও আত্মীয়ই নেই তাঁর, এমন। রুনুখালার গা ঘেঁষে বসে বরিশালির চিকচিক চোখদুটো দেখি। ঝুনুখালার সবকিছু আমার খুব ভাল লাগে, তিনি একা যেখানে খুশি যাচ্ছেন, ঢাকা থেকে ছুটিছাটায় একা একা ময়মনসিংহ চলে যাচ্ছেন, এমনিতে তাঁর মাথা বোঝাই বুদ্ধি, কেবল একটি সময়ই তাঁকে খুব বোকা বোকা লাগে যখন তিনি বরিশালির সঙ্গে দেখা করেন। একেবারে ছোট্ট খুকির মত হয়ে যান তিনি, আমি যে বোকা, আমার চেয়েও বোকা তখন বুদ্ধির ঢেকিটি। একবার ঢাকা থেকে ট্রেনে ময়মনসিংহ আসার সময় স্মৃতিময় বন্দোপাধ্যায় নামে এক গল্পলেখকের সঙ্গে কথা হল, কথা হল আর তিনি লোকটিকে অবকাশে নিয়ে উঠলেন। চা বিস্কুট দেওয়া হল অতিথিকে। স্মৃতিময়ের সামনেও রুনুখালাকে বড় বোকা লাগছিল, মুখে একটি লাজরাঙা হাসি ছিল রুনুখালার, যেন স্মৃতিময় ঝুনুখালার দীর্ঘ দীর্ঘ বছরের প্রেমিক গোছের কিছু ঝুনুখালা ময়মনসিংহ এলে অবকাশে সারাদিন আমাদের সঙ্গে কাটিয়ে সন্ধেয় বাড়ি ফিরে যান। আমার আবদারে তিনি মার অনুমতি নিয়ে আমাকে ঢাকা বেড়াতে নিয়ে যান একদিন বা দুদিনের জন্য, আমার তৃষ্ণা না ফুরোতে দিয়েও যান আমাকে মার হাতে বুঝিয়ে। ঝুনুখালার সঙ্গে আমাকে যেতে দিতে খুব আপত্তি ওঠে না। বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ডিগ্রিধারি মেয়ে রুনুখালা, বাবাও রুনুখালাকে অবজ্ঞা না করে কথা বলেন।

রুদ্রর সঙ্গে মুখোমুখি প্রেম না হলেও চিঠির প্রেমটি মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে। তার দাবি, প্রতিদিন তাকে চিঠি লিখতে হবে। প্রতিদিন সে নিজেও চিঠি লেখে। একদিন যদি বাদ পড়ে আমার চিঠি, রুদ্র চরম উৎকন্ঠা নিয়ে লেখে, কি হয়েছে কি তোমার, আমাকে কি ভুলে যাচ্ছা না, রুদ্রকে আমি ভুলে থাকি না। কিন্তু তাকে চিঠি লেখার জন্য আমার যে খানিকটা আড়াল চাই, বাড়ির লোকেরা আমার গায়ে পায়ে জড়িয়ে থাকলে আমার পক্ষে যে সম্ভব নয়, তা তাকে বোঝাতে পারি না। রুদ্রর আশংকা ধরে বেঁধে খুব শিগগির আমাকে বিয়ে দিয়ে দেবেন আমার বাবা। আমি স্পষ্ট করে জানিয়ে দিই যে এ কাজটি আমার বাবা কোনওদিনই করবেন না, আমাকে খুন করে ব্রহ্মপুত্রের জলে ভাসিয়ে দিতে পারেন, কিন্তু ডাক্তারি পাশ করার আগে তিনি আমার বিয়ে সম্পর্কে কোনও শব্দ উচ্চারণ করতে দেবেন না কাউকে। রুদ্র অবিশ্বাসে আশংকায় উদ্বেগে দিন যাপন করতে থাকে। মোংলা আর মিঠেখালিতে অঢেল সময় কাটিয়ে সে ঢাকা ফেরে, ঢাকা থেকে একদিন বা দুদিনের জন্য ময়মনসিংহে আসে। নৈঃশব্দকে সঙ্গী করে আমরা আগের মত বসে থাকি মুখোমুখি। রুদ্র একদিন নৈঃশব্দের শরীরে সুচ ফুটিয়ে বলে,চল বিয়ে করি।

বিয়ে?

হ্যাঁ বিয়ে।

আমি হেসে উঠি। চল মঙ্গলগ্রহে যাই, বা চল সমুদ্রে ডুবে মরি, এধরনের অদ্ভুতুড়ে প্রস্তাব শুনছি বলে মনে হয়। না হেসে আমার উপায় থাকে না। রুদ্র ভুরু কুঁচকে বলে, কি হাসছ যে!

হাসি আসছে।

হাসি আসে কেন?

আসে।

আমরা কি বিয়ে করব না নাকি?

বিয়ের কথা উঠছে কেন?

কেন উঠবে না!

পাগল নাকি?

পাগল হব কেন?

পাগল না হলে বিয়ে বিয়ে করে কেউ!

বাজে কথা বোলো না।

এ বুঝি বাজে কথা।

হ্যাঁ বাজে কথাই।

রুদ্র বিষণ্ন বসে থাকে। বিষণ্নতা আমার দিকেও হামাগুড়ি দিয়ে এগোয়। অনেকক্ষণ নখ খুঁটি, অনেকক্ষণ বইয়ের পাতায় চোখ ফেলে রাখি অহেতুক। কণ্ঠে না-বোঝা বিষাদ।

বাবা মেরে ফেলবে।

বাবার সঙ্গে চল দুজন দেখা করি। রুদ্র গম্ভীর গলায় বলে। গাম্ভীর্যের গলা মুচড়ে দিয়ে আমার অট্টহাসি স্ফূতর্ হয়।

হাসছ যে!

আমার আবারও হাসি পায়। কিছু কিছু অস্বাভাবিক দৃশ্যও কষ্টেসৃষ্টে কল্পনা করা যায় হয়ত কিন্তু এই দৃশ্যটি, যে, আমি আর রুদ্র বাবার সামনে দাঁড়িয়েছি, বলছি যে আমরা বিয়ে করব, অনুমতি দিন বা কিছ-ু -কল্পনাতেও আনা আমার পক্ষে সম্ভব হয় না। আমি অন্যমনে ঘাস ছিঁড়ি।

কি, তুমি হাসছ কেন, বল। বিয়ের কথা ভাববে না কোনওদিন?

বিয়ে আবার এখনই কি? আমি ডাক্তারি পাশ করে নিই। তারপর দেখা যাবে। আমার উদাসীন উত্তর। শব্দগুলো উত্তাপহীন, শীতল।

সে অনেক দেরি। উৎকণ্ঠা গেড়ে বসেছে রুদ্রর কণ্ঠে।

দেরি, তাতে কি?

রুদ্রর দেরি সয় না। এক্ষুনি সে কিছু একটা করে ফেলতে চায়। এক্ষুনি বিয়ে করে সংসার করার মত স্বপ্নও সে দেখে ফেলছে। রুদ্রর দিকে তাকিয়ে আমার মনে হতে থাকে, মানুষটিকে আমি চিনি না। খুব দূরের মানুষ। মামার বাড়ির আবদার করা জ্বালিয়ে মারা বুড়ো খোকা।পরীক্ষা দাও, এমএ টা পাশ কর, তারপর তো বিয়ের প্রসঙ্গ, এক্ষুনি কিসের তাড়া! চিঠিতে জানাই। রুদ্র লেখে, পরীক্ষা দেওয়া না দেওয়া সমান কথা তার কাছে। ওসব ফালতু ডিগ্রিতে তার কোনও উৎসাহ নেই। উৎসাহ তার না থাক, আমি তো জানি, আমার বাড়ির লোকের আছে। আর এমএ পাশ করা কোনও ছেলেকেও যে আদৌ আমার যোগ্য মনে করা হবে, তা আমার বিশ্বাস হয় না। তার ওপর রুদ্র কবি, কবিদের ভাত নেই, কবিরা টুডাইল্যা জাতীয় লোক হয়, বাবার বদ্ধ ধারণা। রুদ্র বলে দেয় সে কবি, এই তার পরিচয়, সে কখনও কোনওদিন কোনও চাকরি বাকরি করবে না, সুতরাং বিশ্ববিদ্যালয় পাশ করার কোনও যুক্তি নেই।

না তবু..

কিসের তবু?

বাবার ভয়ে ওষ্ঠে প্রাণ আমার। রুদ্রকে বোঝানো সম্ভব হয় না বাবার হৃদয় কী ধাতু দিয়ে গড়া।



বাবা ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজের জুরিসপ্রুডেন্স বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক। কোনও অধ্যাপক না থাকায় তিনিই বিভাগটির হর্তা কর্তা। সকালবেলা প্রায়ই বাবার সঙ্গে রিক্সা করে কলেজে যাই। অর্ধেক পথ তিনি উদার হসে ্ত উপদেশ বিতরণ করেন। এক চান্সে মেডিকেলটা পাশ করতে যেন পারো, সেইভাবে লেখাপড়া কর। ভাল যে বাবা বলছেন না পরীক্ষায় তারকাখচিত কিছু না পেলে তিনি বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেবেন। মেডিকেলে একবার ঢোকা মানে একদিন না একদিন ডাক্তার হয়ে বেরোনো, এ জিনিসটি তিনি বিশ্বাস করেন, তাই বেশ নিশ্চিন্ত দেখায় তাঁকে। মেডিকেলের পরীক্ষাগুলো শাদামাটা পাশ করে যাওয়াই অনেকটা ভাগ্যের ব্যাপার, ভাল ছাত্রছাত্রীদের দ্বারাও সবসময় এ কাজটি সম্ভব হয় না। এনাটমি ফিজিওলজির জটিল জিনিসগুলো নিয়ে, যেগুলো মাথায় ঢুকেও ঢুকতে চায় না, কোনও প্রশ্ন করলে বাবা এমন সহজ সরল করে উত্তর দেন যে সুড়সুড় করে সব মগজে প্রবেশ করে। এমন কোনও প্রশ্ন নেই, যার উত্তর তিনি জানেন না। তিনি এখনও রাত জেগে পড়াশোনা করেন। যেদিন তিনি ক্লাস নেবেন, তার আগের রাতে প্রায় দুটো পর্যন্ত পড়ে তবে বিছানায় যান। একসময় তিনি লিটন মেডিকেল ইশকুলে এনাটমির শিক্ষক ছিলেন। সেই লিটন তো কবেই উঠে গেছে, এখন আর বিদ্যালয় নেই, এখন মহাবিদ্যালয়, লাগোয়া মহা-হাসপাতাল, মহা-ক্যাম্পাস, আর আর মহা-শিক্ষকমণ্ডলির বেশির ভাগই, বাবা বলেন বাবার ছাত্র ছিলেন। একধরনের সুখ হয় শুনে, আমি যত না নিজের নামে চেনা, তার চেয়ে বেশি চেনা রজবআলীস্যারের মেয়ে হিসেবে, অন্তত কলেজে।

জটিল চিকিৎসাশাস্ত্রের জট খুলে দিতে থাকা বাবাকে আমার বড় আপন বলে মনে হয়। এ এক নতুন বাবা। বাড়ি ফিরেই আমাকে তিনি কাছে ডাকেন। সঙ্গে নিয়ে খেতে বসেন। খেতে খেতে গল্প করেন। নতুন কোনও বিদ্যা অর্জন হয়েছে কি না জানতে চান। যদি বলি না কিচ্ছু হয়নি, মোটেও বিরক্ত হন না, বরং পরম আগ্রহে তিনি কোনও একটি বিষয়ে উত্থাপন করেন। ধরা যাক লিভার, ফস করে বলে দিই, লিভারের কিচ্ছু আমি বুঝতাছি না। তিনি, হেসে, আমাকে পাশে বসিয়ে, আমার হাতখানি টেনে নিজের বুকের ওপর রেখে, বাংলা ইংরেজি মিশিয়ে লিভার দেখতে কেমন, লিভার কোথায় থাকে, লিভার কি করে, লিভারে কি কি অসখু হয়, সেই অসুখের ওষুধ কি করে দিতে হয় সব গল্পের মত করে বলে যান। এই যে আমি নিদ্বির্ধায় বলে দিই যে আমি লিভার সম্পর্কে কিছু জানি না, তিনি কিন্তু একবারও দাঁত খিঁচিয়ে বলেন না, কেন জানস না? বইএর প্রথম পৃষ্ঠা থেইকা শেষ পৃষ্ঠা পর্যন্ত মখু স,্থ ঠোঁটস্থ, অনঃ্ত স্থ কইরা ফালা। আমার লেখাপড়ার ব্যাপারে এরকম দুশ্চিন্তা না করা বাবাকে আমি আর আগে দেখিনি। আমাকে তিনি পড়ার টেবিলে দেখতে চান, এরকম কোনও দাবিও আর জানান না। আমি আড্ডা দিলে বা পড়ে পড়ে ঘুমোলে বাবা রাগ করেন না। বাবার দৃষ্টি ইয়াসমিনে। ওকে টেনে ঘুম থেকে ওঠানো, ঘাড় ধরে পড়তে বসানো, খেলা থেকে তাড়ানো, মনীষীদের বাণী শোনানো, মেট্রিকে তারকাখচিত নম্বর না পেলে ওকে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেওয়ার হুমকি শোনানোর কর্তব্য নিরলস ভাবে পালন করে যান। আমাকে নিয়ে বাবার নিশ্চিন্তি দেখে ছোটবাজারের হরিপদ মল্লিকের বাদ্যয−ন্ত্র্রর দোকান সুর তরঙ্গ থেকে দেখে শুনে একটি গিটার কিনে গিটারে টুং টাং শব্দ তুলি, গিটারে গান বাজানোর স্বপ্নটি টুং টাং করে হৃদয়ে সুর তোলে সারাদিন। ভাল গিটারবাদক হিসেবে নাম আছে শাহাদাত হোসেন খান হিলুর, কেবল গিটারবাদক হিসেবে নয় হিলুকে এক ডাকে শহরের সবাই চেনে, সাংস্কৃতিক অঙ্গনে হিলু সর্বদা বিরাজমান, তাঁকে গুরু বলে মানার লোকেরও অভাব নেই, মাসুদের গুরু তিনি, রুদ্রর সঙ্গে আলাপ হওয়ার পর রুদ্ররও গুরু মত হয়ে গেলেন, মোহাম্মদ আলী মিনার বলে একটি লম্বামত নবীন গল্পলেখককে নিয়ে রুদ্র একবার ময়মনসিংহ এসেছিল, সেই মিনারও শিষ্য হয়ে গেল হিলুর, হিলু এমনই সম্মোহনী শক্তি ধারণ করেন। ছোটদা আর গীতার সঙ্গেও হিলুর ঘনিষ্ঠতা ছিল, দাদারও নাকি বন্ধু। একদিন আকুয়ায়, নানিবাড়ির খুব দূরে নয়, তাঁর বিশাল পুকুরঅলা বাড়িতে গিয়ে অনুরোধ করি আমাকে যেন তিনি গিটার শেখান। শুনেছিলাম তিনি কাউকে শেখান না গিটার, গীতা বলেছে মেয়েমানুষদের নাকি দুচোক্ষে দেখতে পারেন না, সেই হিলু যখন রাজি হয়ে যান আমাকে শেখাবেন গিটার, আমি হাতে কি পেয়ে যাই, তা ঠিক তক্ষুনি ঠাহর করতে পারি না। অসম্ভবকে সম্ভব করলে যেমন আনন্দ হয়, তেমন হয় আমার। হঠাৎ যেন সোনার মোহরের কলস পেয়ে গেছি, কলসের গলা পেঁচিয়ে থাকা সাপ চলে গেছে কোথাও কামিনীর গন্ধ শুঁকতে। সপ্তাহে তিন সন্ধেয় তিনি আসেন গিটার শেখাতে, তিনি এলে আর সব গৃহশিক্ষককে যেমন চা বিস্কুট দেওয়া হয়, তাঁকেও দেওয়া হয়। মাও হিলুকে চেনেন, হিলুর বড় ভাই হাশেমমামার বন্ধু। হিলুর জন্য মা বেশি করে মিষ্টি দিয়ে পায়েশ বানান। হিলু আমাকে উদারা মুদারা তারা ইত্যাদি শিখিয়ে মার হাতের চা আর পায়েশ খেয়ে উঠে যান। দাদা এক সন্ধেয় মুখোমুখি হন হিলুর। দাদার মখু টি হিলুকে দেখেই ফ্যাকাসে হয়ে ওঠে, ফ্যাকাসে মখু টিতে ম্লান একটি হাসি ধরে রাখেন তিনি। হিলু চলে যাওয়ার পর ফ্যাকাসে মখু থেকে হাসিটি বিদেয় করে বলেন, হিলুরে কইছস কেন গিটার শিখাইতে?

তাতে কি হইছে?

কি হয়েছে তা তিনি বলেন না। কেবল জিভে অপছন্দের চুক চুক শব্দ করেন।

মাস গেলে হিলুকে শাদা খামে দুশ টাকা পুরে দিতে যাই সম্মানী।

জিজ্ঞেস করেন, এইটা কি?

টাকা।

টাকা কেন?

টাকা কেন, তা না বোঝার কথা নয় হিলুর। ঠোঁটে বাঁকা একটি হাসি, বলেন, তোমারে গিটার শিখাই বইলা তুমি কি আমারে বেতন দিতাছ নাকি?

আমি চপু হয়ে থাকি। হিলু টাকা নেননি। শত অনুনয়েও না। হিলু ধনীর ছেলে, টাকার তাঁর প্রয়োজন নেই সে জানি। কিন্তু মাগনা শিখতে আমার যে অস্বস্তি হয়! আমার অস্বস্তি থাকে, সেই সঙ্গে আমার জন্য হিলুর এই ত্যাগ, সন্ধের অনুষ্ঠানাদি ফেলে আমাকে সময় দেওয়ার জন্য থাকে হিলুর প্রতি প্রচণ্ড শ্রদ্ধাবোধ এই বোধের মধ্যে একদিন সামনে দাঁড়ালেন বাবা। হিলু বৈঠকঘরে বসে আমাকে গিটার শেখাচ্ছেন দৃশ্যটি দেখে তিনি এমন চমকে উঠলেন যেন ভূত দেখছেন। বাবাকে দেখি দাঁড়িয়ে সালাম দিলেন হিলু। সালামের প্রত্যুত্তর ঘণৃ ্য কটাক্ষ। বাবা ভেতর ঘরে গিয়ে বাড়ি ফাটিয়ে আমাকে ডাকেন। সামনে আমি আর আমার হৃদকম্প দাঁড়ায়।

হিলু আইছে কেন?

গিটার শিখায় আমারে।

গিটার শিখা তর পুটকি বাইর করাম হারামজাদি। বেডারে এক্ষুনি এই মুহূর্তে ভাগা।একটা বদমাইস আমার বাড়িতে আইছে। কত বড় সাহস!

হিলু নিশ্চয়ই শুনতে পাচ্ছেন বাবার বাক্যগুলো, আমি না পারছি শ্বাস ফেলতে না পারছি নিতে। না এটি ঘটছে না, বাবা কিছুই বলছেন না, হিলু ওঘরে হতভম্ব দাঁড়িয়ে নেই, তাঁর কানে কোনও মালকোষ রাগের সুর ছাড়া আর কিছু প্রবেশ করছে না, আমি প্রাণপণে নিজেকে বোঝাতে চাইছি, কোনও অঘটন ঘটছে না বাড়িতে, এ আমার দুঃস্বপ্ন কেবল। একঘর অন্ধকার নিয়ে স্থবির দাঁড়িয়ে থাকি, মাথাটি গ্যাস বেলুনের মত আমাকে ছেড়ে উড়ে যেতে থাকে আকাশে,মেঘের আড়ালে অদৃশ্য হতে। শরীর, আমি লক্ষ করি, চলৎশক্তিহীন। পাথর চাপা পড়া হলদে ঘাসের মত মরা শরীর, ব্যাঙের ছাতা গজিয়ে যাওয়া স্যাঁতসেঁতে শরীর। হিলুকে সে রাতে অপমান করে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেন বাবা। তাড়িয়ে দেবার পর আস্ফালন করতে থাকেন বাড়িময়।

হিলুরে কে না চেনে! শহরের নামকরা গুণ্ডা। এই নোমান, নোমান, দাদাকে চিল্লিয়ে কাছে এনে হাপাঁতে হাপাঁতে বলেন,তুই কি জানতি হিলু এই বাড়িতে আসে?

দাদা হ্যাঁ সূচক না সূচক দুরকমই মাথা নাড়েন।

লেলিহান আগুনের পাশে এক আঁজলা ঠাণ্ডা জল নিয়ে দাঁড়ান মা, হিলু তো এই বাড়িতে কোনও গুণ্ডামি করতে আসে নাই!

মার মন্তব্যের দিকে বাবা ফিরেও তাকান না। আগুন আগুনের মত জ্বলে, জল মার আঁজলা থেকে পড়ে মেঝে ভিজিয়ে দেয়। সারারাতই কড়িকাঠের দিকে মেলা আমার অনড় দুই চোখ থেকে বাবার প্রতি ঘণৃা আর ক্ষোভ চুইয়ে পড়ে। মা দীর্ঘশ্বাস ফেলতে ফেলতে বিছানায় আমার পাশে এসে বসেন।

এত দেমাগ তর বাপের! কিয়ের এত দেমাগ, বুঝি না! মাইনষে অভিশাপ দিব। মাইনষের সাথে অন্যায় আচরণ করলে মাইনসে অভিশাপ দিব না কেন? নিশ্চয়ই দিব।

গিটার শেখা জন্মের মত বন্ধ হল। ঘরের এক কোণে জিনিসটি পড়ে থাকে, পড়ে থেকে থেকে ধুলো আর মাকড়সার বাসা হয়ে ওঠে। অনেকদিন ভেবেছি হিলুর কাছে গিয়ে একদিন করজোড়ে ক্ষমা ভিক্ষা চাইব, কিন্তু এত ছোট মুখ নিয়ে অত বড় মানুষটির সামনে দাঁড়াতে আমার সঙ্কোচ হয়েছে।



এর পরপরই মিতু এল, সাজ সাজ রব পড়ে গেল বাড়িতে। বাড়ির আগাপাস্তলা সাজানো গোছানো হল। দাদার কোম্পানীর বড় কর্তার মেয়ে মিতু। ময়মনসিংহ মেডিকেলে ভর্তি হবে, এ বাড়িতেই থাকবে, যদ্দিন না হোস্টেলের ব্যবস্থা হয়। যেদিন তার বাবা মা সহ গাড়ি করে মিতু এল, গালে ব্রণ ভরা, হাসিতে মুক্তো ঝরা,কোকঁড়া চুলের ফর্সা ত্বকের মেয়ে মিতু এল, সেদিনই বাড়ির সবার সঙ্গে ও ভাব করে নিল। আমি ওর এক ক্লাস ওপরে হলেও নিদ্বির্ধায় আমাকে তুমি বলে সম্বোধন করল, ইয়াসমিনকে বলল, কোনও আপনি টাপনি নয়, তুমি। বাড়িতে পোলাও মাংস রান্না হয়েছে, মিতুর জন্য বাড়ির সবচেয়ে ভাল ঘরটি, ভাল ঘরটি মানে দাদার ঘরটি গুছিয়ে দেওয়া হয়েছে। মিতু চটপট ঝটপট উচ্ছঅল উজ্জ্বল মেয়ে, রাজ্যির গল্প করে ফেলল ঘন্টাখানিকের মধ্যেই। মিতুর মাও তাই, যেন আমরা ওদের জন্ম জন্ম চেনা। মিতুর মত গুছিয়ে গল্প বলা আমার হয় না। বলতে নিলে সব তালগোল পাকিয়ে যায়। আমি নৈঃশব্দের হাতে নিজেকে সমপর্ণ করে কেবল দেখে যাই, শুনে যাই। মিতুর মত অনর্গল ইংরেজি বলা আমার হয় না। এত শীঘ্র মানুষের আপন হয়ে ওঠার ক্ষমতা অর্জন করা আমার হয় না। মিতুকে রেখে তার বাবা মা ফেরত যান ঢাকায়। কলেজে ভর্তি হল মিতু। বাড়ির সবাই ওর সেবায় চব্বিশ ঘন্টা ব্যস্ত মিতুর কখন কি চাই, এগিয়ে দাও। মিতু গোসল করবে, দৌড়ে যাও, গোসলখানায় পানি আছে কি না দেখ, না থাকলে কল চেপে দু বালতি পানি ভরে গোসলখানায় দিয়ে এসো। বাড়ির সবচেয়ে ভাল তোয়ালেটি, সাবানটি হাতে দাও। মিতু এখন খাবে, সব চেয়ে ভাল থালাটি ওকে দাও, মাছ মাংসের সবচেয়ে ভাল টুকরো তুলে দাও। মিতু এখন টেলিভিশন দেখবে, সোফার সবচেয়ে ভাল জায়গাটি ওকে দাও। মিতু ঘুমোবে, দৌড়ে যাও বিছানা ঝেড়ে মশারি ফেলে দিয়ে এসো। মিতু ঘুমোচ্ছে, কোনও টুঁ শব্দ যেন কোথাও না হয়। বাবাও বাদ পড়েন না মিতুর সেবা থেকে। অঢেল মাছ মাংস পাঠিয়ে দিচ্ছেন বাড়িতে, মিতুর জন্য রান্না হবে। ইংরেজি জানা মেয়ে শার্ট প্যান্ট পরা মেয়ে প্রতিরাতে টেলিভিশনের ইংরেজি ছবি দেখে, অবসরে ইংরেজি গল্পের বই পড়ে, ইংরেজি গান শোনে, মিতু ঘরেই থাকে ঘরের মেয়ের মত, অথচ প্রচণ্ড বাইরের মেয়ে ও। গলাগলি করলেও আমাদের সঙ্গে ওর বিস্তর তফাত থেকে যায়। ধনীর কোনও মেয়ের সঙ্গে আমার কোনও বন্ধুত্ব হয় না। আমি ঠিক কি বলতে হয় ওদের সঙ্গে বুঝে পাই না। ওদের ফ্যাশনের গল্পে, বিদেশ ভ্রমণের গল্পে, বিদেশি সংস্কৃতির গল্পে আমি এক মাথা অজ্ঞতা নিয়ে নিরেট শ্রোতা হয়ে বসে থাকি। ইশকুলের চশমা পরা বড়লোকের মেয়ে বড়লোকি কায়দায় কথা বলা চলা আসমা আহমেদের সঙ্গেও কখনও ঘনিষ্ঠ হতে পারিনি, যদিও আসমার বাড়িতে গেছি, যদিও আসমা আমার কবিতার খাতা প্রায়ই পড়তে নিয়ে যেত, যদিও আসমা আমার কবিতাকে খুব ভাল খুব ভাল বলে প্রশংসা করত। মুন্নি যখন মাঝে মাঝেই এ বাড়িতে আসত ওর মার সঙ্গে বেড়াতে, মা অবলীলায় বসে যেতেন মুন্নির মার সঙ্গে গল্প করতে, মুন্নি যেহেতু আমার সঙ্গে একই ক্লাসে পড়ত, আমারই যাওয়া উচিত ওর সঙ্গে কথা বলার জন্য, কিন্তু আমি ঠিক বুঝে পেতাম না কি কথা বলব ওর সঙ্গে। কেমন আছো দুশব্দের এই বাক্যটি আওড়ে আমি আর কোনও বাক্য খুঁজে পাইনি বলার। মেট্রিকে তৃতীয় বিভাগে পাশ করার পর মুন্নির বিয়ে হয়ে গেল গোবরে পদ্মফুলের সঙ্গে, ফুলটি কোনও এক অজ পাড়াগাঁর লেখাপড়া না জানা এক দরিদ্র কৃষকের ইঞ্জিনিয়ার ছেলে। স্বামী নিয়েও মুন্নি বেড়াতে এসেছিল এ বাড়িতে, বৈঠকঘরে একটু শুধু উঁকি দিয়েই ঠেলে সামনে পাঠিয়েছি ইয়াসমিনকে, মাকে। মা আর ইয়াসমিন যে কারও সঙ্গে দৈনন্দিন জীবনের গল্পগাছায় পটু না হলেও কায়ক্লেশে চালিয়ে নিতে পারেন। আমারই হয় না। অথচ এই মুন্নি যার সঙ্গে রিক্সা করে ঢিল ছোঁড়া দূরত্বের ইশকুলে যেতাম। চতুথর্ থেকে পঞ্চম শ্রেণীতে উঠেছি,নতুন ক্লাসে ওঠার উত্তেজনা তখনও আমাকে ছেড়ে এক পা কোথাও যায়নি। নতুন বই কিনে দিয়েছেন বাবা, রঙিন কাগজে বইগুলোর মলাট বেঁধেছি, পড়ে ফেলেছি বাংলা গদ্য পদ্য দুটো বই-ই। আড়াআড়ি দাগ টানা বাংলা খাতা, চার দাগঅলা ইংরেজি,আর দাগহীন অঙ্ক খাতাও সাজিয়ে রেখেছি টেবিলের ওপর। সাড়ে নটা বাজার আগেই আমি তৈরি হয়ে নিই ইশকুলের পোশাক পরে, ঘি চিনি মেখে গরম ভাত খেয়ে, কালো একটি ছোট সুটকেসে বইখাতা ঢুকিয়ে। হেঁটেই যাওয়া যায় ইশকুলে, মোড়ের সরস্বতী মণ্ডপ পেরিয়ে সের পুকুর পাড় ধরে হেঁটে মনোরঞ্জন ধরের বাড়ির সামনে দিয়ে বড় রাস্তায় উঠলেই রাস্তার ওপারে লাল দালানের বিদ্যাময়ী ইশকুল। কিন্তু হেঁটে ইশকুলে যাওয়ার অনুমতি বাড়ি থেকে পাইনি। হাঁটতে গেলে গাড়ি গরুর তলে পড়ে হাত পা ভাঙব, এ ব্যাপারে বাড়ির সবাই নিশ্চিত। বাবা সকালে চার আনা পয়সা দেন, সেই চারআনা নিয়ে অবকাশ থেকে বেরিয়ে বাঁ রাস্তায় তিন বাড়ি পর এম এ কাহহারের বাড়ির বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াই, আমাকে দেখে ভেতর ঘরে ইস্ত্রি করা পোশাক পরে, দামি জুতো পরে মোটা মেয়ে, ফর্সা মেয়ে, ধনীর মেয়ে, লেখাপড়ায় গোল্লা পাওয়া মেয়ে মুন্নি তৈরি হয়। কুঁচি কেটে শাড়ি পরা মুন্নির মার আঁচলে চাবির গোছা। হাঁটলে চাবিতে চাবিতে লেগে টিং টিং শব্দ হয়। আমাকে দেখে মুন্নির মা পান খাওয়া দাঁতে হেসে বলেন, কি মেয়ে, তোমার মা কেমন আছে? আমি মাথা নাড়ি, ভাল। আমার মা ভাল আছেন, রান্নাঘরের বারান্দায় বসে মাটির চুলোয় নারকেলের শুকনো পাতা গুঁজে আগুন ধরাতে চাইছেন, ফুঁকনি ফুঁকছেন, ধোঁয়ায় ঢাকা মা, ধোঁয়ায় ঢাকা মাঞ্চর মলিন শাড়ি। মার শাড়ির আঁচলে কোনও চাবির গোছা থাকে না, চাবির গোছা বাবার কাছে, বাড়ির কোনও দরজা কিংবা আলমারিতে তালা দিতে হলে বাবাই দেন, ভাঁড়ার ঘরেও সময় সময় তালা দেন, চাবি থাকে বাবার পকেটে, সে পকেট ছোঁয়ার সাধ্য অবকাশে কারও নেই। মার সঙ্গে মুন্নির মার তফাত অনেক। মুন্নির মার গা ভরা সোনার অলংকার, খোপাঁ করে রাখা চুল, পায়ে রঙিন ফিতের চটি, মার কাদা পা খালি পা, মার এলো চুল, মার ধোঁয়া মখু , মার শুকিয়ে চড়চড় ঠোঁট। মুন্নির সঙ্গে আমারও তফাত অনেক। মুন্নি দেখতে পুতুলের মত, ঝকঝকে। আমি সেরকম নই, না হলেও আমরা এক রিক্সায় বসে ইশকুলে যাই, ইশকুলে যাওয়ার রিক্সাভাড়া আমি দিই, ইশকুল থেকে বাড়ি ফেরারটি দেয় মুন্নি। মুন্নির মা প্রতিদিন আঁচলে বাঁধা বড় চাবি দিয়ে শোবার ঘরের আলমারি খোলেন, খুলে আরেক চাবি দিয়ে আলমারির ড্রয়ার, সেই ড্রয়ার থেকে বের করেন সোনালি রঙের কৌটো, কৌটোর ভেতর আরেক কৌটো, সেই কৌটোর ভেতর থেকে চার আনা পয়সা বের করে মুন্নির হাতে দেন। ইশকুলে যাওয়ার পথে মুন্নি অনর্গল কথা বলে, আমি কেবল শুনি। প্রায় বিকেলে ওর ছোট ভাই পাপলুকে নিয়ে যখন আমাদের বাড়ির উঠোনে লাল ফিতেয় চুলে দুবেণী গেঁথে খেলতে আসে, তখনও ও একাই কথা বলে, আমি শুনি।

সেই মুন্নির হাস্যোজ্জ্বল ঝলমলে মার পায়ের আঙুলের ডগা একদিন লাল হতে থাকে, লাল হতেই থাকে, লাল ছড়াতে থাকে, বাবা নানা রকম ওষধু দিয়ে আঙুলের লাল সারাতে না পেরে একদিন কেটেই ফেললেন বুড়ো আঙুল। আঙুলহীন মুন্নির মা ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে উঠে আবার বিকেলে সন্ধেয় পাড়া পড়শির বাড়িতে গল্প করতে যেতে লাগলেন। মাস কয় পর আবার তাঁর আঙুলের ডগা লাল হতে শুরু করে। আবার সেই লাল ছড়াতে থাকে। ছড়াতে ছড়াতে ঠ্যাং বেয়ে ওপরে উঠতে থাকে, বাবা বললেন ত্বকের ক্যান্সার এটি, পুরো পা কেটে ফেললে ক্যান্সার রোধ করা যাবে। পা কাটতে ও বাড়ির কেউ রাজি হয়নি। বাবা নিয়মিত মুন্নির মাকে দেখতে যান। মাও যান দেখতে। গিয়ে নিজে পানি গরম করে মুন্নির মার পা-টি পানিতে ডুবিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে ফেলে তাঁকে সুস্থ হয়ে যাওয়ার স্বপ্ন দেখাতে থাকেন। শেষে এমন অবস্থা হয়, মুন্নির মার সারা শরীর থেকে গন্ধ বেরোতে থাকে, মশারির তলে তাঁকে শুইয়ে রাখা হয়। শিশি শিশি আতর ঢেলেও গন্ধ দূর করা যায় না। বাড়ির লোকেরাই মুন্নির মার ঘরে ঢুকতে চায় না, অথচ বাইরের মানুষ হয়ে মা গিয়ে সেই গন্ধের ভেতর ঢোকেন, ঢুকে তাঁর গায়ে হাত বুলিয়ে দেন, চোখের পানি আঁচলে মুছতে মুছতে বলেন আল্লাহ আপনেরে সুস্থ কইরা তুলবেন, আল্লাহর ওপর ভরসা রাখেন। মার দরদ সবার জন্য। মা বস্তিতে গিয়েও বস্তির নোংরা মেয়েমানুষের গায়ে হাত বুলোতে পারেন, বড়লোকের বাড়ি গিয়েও বড়লোকের বউএর গায়ে পারেন। মা অনেকদিন আমাকে সেধেছেন, চল যাই মুন্নির মারে দেইখা আসিগা, মানুষটা খুব কষ্ট পাইতাছে। আমি না বলে দিই। মা একা যান। মা পারেন, আমিই পারি না। কণ্ঠুা, ভয়, লজ্জা আমাকে আমার হাড়গোড়ের ভেতর সেঁধিয়ে ফেলে। তাঁর মলিন কাপড়চোপড়, মলিন শরীর বা মলিন জীবনটি লোকে কি চোখে দেখবে, এ নিয়ে মা আর ভাবেন না। মুন্নির মাকে দেখে এসে মা বলেন, বড়লোকের বউ হইলে কি হইব, অসুখ হইছে, শরীরে গন্ধ বইলা কেউ আর তার কাছ ঘেঁষে না। কাজের মানুষ রাখছে, সে-ই কাছে থাকে। মেয়েমানুষের, সে দরিদ্রের কি ধনীর বউ হোক, কষ্টের সীমা নেই, মার ধারণা। মাকে বস্তির লোকেরা, ভিক্ষে নিতে আসা মানুষেরা বড়লোকের বউ বলে জানে। মা শুধরে দেন ওদের,বড়লোকের বউ হওয়া আর বড়লোক হওয়া আলাদা কথা। আমার স্বামী বড়লোক হইতে পারে, আমি কিন্তু গরিব মানুষ। আমার কোনও পয়সাকড়ি নাই। মা মাঝে মাঝে বলেন, মানুষের বাড়িতে কাজ কইরা পাঁচটা টাকাও যদি কামাইতে পারি, সেইডা ত আমার রোজগার হয়। পাঁচটা টাকাই কি কেউ আমারে দেয়? বাড়ির কামের বেডিগোরও আমার চেয়ে ভাগ্য ভাল। বড়লোকের বউ হয়ে মা যা পেয়েছেন, তার চেয়ে হারিয়েছেন অনেক। অনেক সুযোগ থেকে বঞ্চিত তিনি, এদিক ওদিক সেলাইএর কাজ পাওয়ার জন্যও ঘুরেছেন, কাজ পাননি। মাকে বড় কাজ কেউ দেয় না মার লেখাপড়া নেই বলে, ছোট কাজও দেয় না মা বড়লোকের বউ বলে। মার এই সংসারের কাজ ছাড়া আর কোনও কাজ জোটে না। ইয়াসমিনের মেট্রিক পরীক্ষা দেওয়ার সময় এসেছে। ইয়াসমিনকেও মা ধরেন,আমারে একটু প্রাইভেটে মেট্রিকটা দেওয়ার ব্যবস্থা কইরা দিবা? তুমি যদি অঙ্কটা একটু দেখাইয়া দেও, আমি ঠিক পাশ কইরা যাব। ইয়াসমিনের বইগুলো মা ঘাঁটেন। খুব যতে ্ন পাতা ওল্টান, গড়গড় করে পড়ে ফেলেন কোনও কোনও পাতা, বলেন এ তো এমন কিছু কঠিন না! মার মেট্রিক পরীক্ষা দেবার শখের কথা শুনে বাড়ির সবাই মখু টিপে নয়, সশব্দেই হো হো করে হাসে, এমনকি আমেনাও।

এর মধ্যে ঝুনু খালা সেই বরিশালিকে বিয়ে করে ময়মনসিংহে নিয়ে এসেছেন। বরিশালিকে নিয়ে আসার আগে রুনুখালা নিজে একা এসে কি করে বাড়িঘর আগাগোড়া গোছাতে হবে, কে কি পোশাক পরে থাকবে, বাড়িতে কে কেমন আচরণ করবে, কি জিজ্ঞেস করলে কি বলতে হবে, কি কিই বা রান্না হবে ইত্যাদি নানা কিছ বুঝিয়ে দিয়ে গেছেন সবাইকে। আমাদের বাড়ি এসেও বরবউকে নেমন্তন্ন করার কথা বলে গেছেন। রুনুখালা আর তাঁর বরিশালি স্বামীকে দেখতে নানিবাড়ি গিয়ে দেখি সবাই গলা নামিয়ে কথা বলছে, নানি নানা পদের রান্না করছেন, রুনুখালা এ ঘর ও ঘর ছুটোছুটি করছেন, আর নতুন চাদর পাতা বিছানায় নতুন কড়কড়ে লুঙ্গি আর শাদা আদ্দির পাঞ্জাবি পরে মখু চুন করে বসে আছেন বরিশালি। বরিশালি অবকাশে যেদিন এলেন সেদিন মুখের চুনটি দূর হল। জুতোর মচমচ শব্দ তুলে হাঁটা বাবাকেও বেশ পছন্দ হল তাঁর। রুনুখালার বোনের স্বামী ডাক্তার, তাও আবার মেডিকেল কলেজের অধ্যাপক-ডাক্তার, বরিশালি পলকহীন চোখে বাবাকে দেখেন আর বলেন, আত্মীয় বলতে তো আপনারাই। রুনুখালা চলে যাওয়ার পর মা বলেন, ঝুনু অত তোয়াজ করে কেন জামাইরে? নিজে সে এমএ পাশ করা মেয়ে। সে এখন বড় চাকরি বাকরি করবে। তার তো ঠেকা পড়ে নাই জামাইরে মানাইয়া চলার!

মার সুযোগ নেই বলে লেখাপড়া করতে পারেননি। মাঝে মাঝে ভাবি, আবার সুযোগ থাকলেও কেউ হেলায় সে সুযোগ নষ্ট করে। বিশ্ববিদ্যালয়ের খাতায় রুদ্রর নাম আছে, ওটুকুই। ক্লাসও করে না, পরীক্ষাও দেয় না, আমি তাকে অন্তত মাস্টারডিগ্রিটা পাশ করতে বলি, তার নিজের জন্যই বলি। তার দ্বারা হবে না এসব, কারণ, স্পষ্ট বলে দেয়, এসব একাডেমিক কোয়ালিফিকেশনের সে থোড়াই কেয়ার করে। সে সারাজীবন কবিতা লিখবে, কবিতাই তার নেশা পেশা যা কিছু। রুদ্র ট্রেনে করে পাঁচ ঘন্টায় ঢাকা থেকে ময়মনসিংহ আসে, বাসেও এলেও ওই একই সময়। একবার ভিড়ের ট্রেনে ঝুলতে থাকা নির্মলেন্দু গুণের সঙ্গে দেখা হওয়ার পর সে ঝুলে পড়ল গুণের ঘাড়ে। গুণের বাড়ি আমাদের দেখা করার নতুন একটা জায়গা হল। কিন্তু ঠায় কতক্ষণই বা বসে থাকা যায় অন্যের বাড়িতে! ওদেরও তো ঝগড়াঝাটি আছে, চিৎকার চেঁচামেচি আছে! সুতরাং রিক্সা করে চল ঘুরে বেড়াই! শহরের কেউ যেন না দেখে ফেলে আমাদের, শহরের ভেতর দুজন দুটো আলাদা রিক্সা নিই, শহর থেকে দূরে গিয়ে একটি রিক্সা ছেড়ে দিয়ে দুজন এক রিক্সায় পাশাপাশি বসি। রুদ্রর স্পর্শ বিষম পুলক জাগায় মনে! শহরের বাইরে যাবার মত জায়গা এক মুক্তাগাছা, নির্জন গ্রামের রাস্তায় রিক্সা খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে, সারি বেঁধে দাঁড়ানো কড়ইগাছের তল দিলে, ছোট ছোট নদীর ওপর ছোট ছোট সেতু পার হয়ে চলে। আমার চোখ পড়ে থাকে সবুজ শস্যে, বিলের জলে ন্যাংটো ছেলেদের দাপাদাপিতে, শীণর্ গরুর নির্বিকার রাস্তা পারে, আর মন পড়ে থাকে রুদ্রে। রুদ্রর চুমু খাওয়ার নিরন্তর চেষ্টাকে শরমে সরিয়ে সরিয়ে মুক্তাগাছা পোঁছি। সাপে শ্যাওলায় আগাছায় পরগাছায় আর মাকড়শার জালে ছেয়ে থাকা জমিদারবাড়ির আঙিনা ঘুরি ফিরি, রাস্তায় পাশাপাশি হাঁটলেও ভয় নেই, এ শহরে ঢিঢি ফেলার মত চেনা লোক নেই।

রুদ্র সেবার ঢাকা ফিরে যাবার পর, কদিন পর আর, সাতদিন, ক্লাসে ঢুকতে যাব, ওপরের ক্লাসের এক মেয়ে এসে জানাল নীরা লাহিড়ী খবর পাঠিয়েছে, এক্ষুনি যেন তার বাড়ি যাই।

ক্লাস ফেলে দৌড়োলাম গুণের বাড়ি।

দেখি রুদ্র বসে আছে গুণের বসার ঘরে। ঘরে দুটো কাঠের চেয়ার, একটি চৌকি। চৌকিতে। দেখে মন নেচে ওঠে। রুদ্রকে দেখলে এই হয় আমার, মন নাচে।

কী ব্যাপার হঠাৎ!

হ্যাঁ হঠাৎ। চিঠিতে জানাবার সময় পাইনি।

ও।

এরপর মুখোমুখি বসে থাকা নৈঃশব্দের সঙ্গে দুজনের। নৈঃশব্দের নীলিমা জুড়ে রুদ্রর স্টার সিগারেটের ধোঁয়া।

রুদ্র তার কাঁধের কালো ব্যাগ থেকে একখানা কাগজ বের করে বলল, এই কাগজে একটা সই করতে হবে তোমার।

কিসের কাগজ এটা?

পরে বলব। আগে সই কর।

কেন?

এত কথা বোলো না।

কাগজটা কিসের?

প্রশ্ন করি, কিন্তু আমি নিশ্চিত রুদ্র কোনও স্মারকলিপিতে অথবা নতুন কোনও কবিসংগঠন তৈরি করেছে, আমাকে সেই সংগঠনের সদস্য করতে সই চাইছে। আমার নিশ্চিত চোখদুটোয় ভোরের স্নিগ্ধ আলো। আমার নিদ্বির্ধ ঠোঁটে এক ঝাঁক পাখির ওড়াওড়ি। কাগজটি নিতে হাত বাড়ালে রুদ্র সরিয়ে নেয় কাগজ।দ্বন্দ্বে পড়ি, ধন্ধে পড়ি।

কিসের কাগজ এটি? না পড়ে তো সই করব না!

রুদ্রর শ্যাওলা পড়া চোখ স্থির হয়ে থাকে আমার চোখে।

বিয়ের কাগজ। রুদ্রর ভারি কণ্ঠ, ভাঙা কণ্ঠ।

কান ঝাঁ ঝাঁ করে। ঝাঁ ঝাঁর ঝঞ্ঝাট ঝেড়ে ঝরঝরে হই।

বিয়ের কাগজ?

হ্যাঁ বিয়ের কাগজ।

কেন?

কেন মানে?

বিয়ের কাগজ কেন?

কেন তা বোঝো না?

না।

সই করবে কি করবে না বল।

আশ্চর্য, এভাবে, এরকম করে বিয়ে করব কেন?

তাহলে তুমি সই করবে না?

কী লেখা আছে দেখি!

আমি কাগজটি হাতে নিতেই রুদ্র হাঁ হাঁ করে উঠল, বৌদি আসছে, লুকোও।

লুকোবো কেন?

বুঝে ফেলবে।

কি বুঝবে?

বুঝবে যে বিয়ের কাগজ।

কি করে?

আরে বুঝবে বললাম তো!

বুঝলে কি ক্ষতি?

ক্ষতি আছে।

কি ক্ষতি, শুনি!

রুদ্র টেনে নিল কাগজখানা হাত থেকে। পাথুরে গলায় বলল তুমি সই করবে কি না বল, হ্যাঁ বা না।

এ কি আশ্চর্য! বিয়ের কথা উঠছে কেন হঠাৎ!

উঠছে।

কে উঠিয়েছে?

আমি।

আমি তো বলিনি আমি বিয়ে করব!

আমি বলছি।

এক হাতে তালি বাজে?

সই করবে?

না।

কাগজটি ব্যাগে ঢুকিয়ে উঠে দাঁড়াল রুদ্র, বলল ঠিক আছে, চললাম।

বিস্ময় আমার জগত ধোঁয়াটে করে আনে, কোথায়?

ঢাকায়।

এক্ষুনি?

হ্যাঁ।

কেন, কি হয়েছে?

থাকার আর প্রয়োজন নেই।

প্রয়োজন নেই?

রুদ্রর নিরুত্তাপ কন্ঠ। না।

কাগজে সই করিনি বলে সব প্রয়োজন ফুরিয়ে গেল?

কোনও উত্তর না দিয়ে দরজা হাট করে খুলে বেরিয়ে যায় রুদ্র। বেরিয়ে যাচ্ছে। যাচ্ছে। ভালবাসায় উপচে ওঠা আমার হৃদয়খানা সে পায়ে মাড়িয়ে যাচ্ছে। সত্যি সত্যি সে চলে যাচ্ছে। যাচ্ছে। পেছনে আমি একা, রুদ্র ফিরে তাকাচ্ছে না। আমি আর তার কেউ নই। সে ফিরছে না।

তীব্র এক বেদনা আমাকে উঠিয়ে বারান্দায় নিল, তার চলে যাওয়ার দিকে নিল, তার চলে যাওয়াকে দুহাতে থামাল।

কই দেখি, কাগজটা দেখি তো!

কেন?

কেন আবার, সই করব!

রুদ্র কাগজ বের করে দিল।

বারান্দায় দাঁড়িয়ে খচখচ করে কি লেখা না পড়ে না দেখে সই করে, কাগজটি রুদ্রর হাতে দিয়ে, মুহূর্তে উজ্জ্বল হয়ে ওঠা তার চোখের দিকে আমার বেদনাতর্ দৃষ্টি ছুঁড়ে বললাম এই সইএর যে এত মূল্য তা আগে বুঝতে পারিনি। সই হল। এবার খুশি তো! চলি।

গুণের বাড়ির আঙিনা পার হয়ে রাস্তায় উঠলাম। দ্রুত।

পেছন থেকে রুদ্র শোনো, দাঁড়াও বলে ডাকছে।

আমি পেছন ফিরিনি।

রিক্সা নিয়ে সোজা কলেজে। পরের ক্লাসগুলো খুব মন দিয়ে করলাম।

তখনও আমার ভেতর এই বোধটিই আসেনি, যে, অভিমানের ওই সইটিই আমার বিয়ে ঘটিয়ে দিয়েছে। তখনও আমি রুদ্রকে রুদ্র বলে ডাকি না, তুমি বলে সম্বোধন করি না। তখনও কোনও চুমু খাইনি আমরা, স্পর্শের মধ্যে কেবল হাতের আঙুল। তখন সবে আমার উনিশ বছর বয়স।
 
১২. হৃদয়ের একূল ওকূল


কাগজে সই নিয়ে যাবার মাস দুই পর রুদ্র চিঠি লেখে, বউ সম্বোধন করে। সম্বোধনটি পড়ে গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে। কেমন অদ্ভুত আর অচেনা এই ডাকটি। আমি তবে কারও বউ! ওই সইটি তবে কি সত্যি সত্যি বিয়ে ঘটিয়ে দিয়েছে! অবিশ্বাস্য একটি কাণ্ড। নিজের বিয়ে, কোনওদিন কল্পনাও করিনি ওভাবে হবে, হবে যে কোনওদিন, সে বিশ্বাসই ছিল না। জানুয়ারির ছাব্বিশ তারিখে কাগজে সই করলাম, আর কাগজটি উকিলের কাছে দিয়ে আসার পর উকিল তাঁর নিজের সই আর সীল বসালেন উনত্রিশ তারিখে। শাদামাটা চিঠিতে রুদ্র জানিয়েছে, উনত্রিশ তারিখটি আমাদের বিয়ের তারিখ। উনত্রিশ তারিখে আমি কি করছিলাম, ভাবি, সারাদিন কি একবারও রুদ্রর কথা ভেবেছি? না ভাবিনি, সময় পাইনি, মরা মানুষ কেটেছি, ছোটখাট একটি পরীক্ষা ছিল, প্রচুর পড়তে হয়েছে, পরীক্ষা শেষে বাড়ি ফিরে আর দিনের মতই টেলিভিশন দেখেছি, ভাই বোনের সঙ্গে খুনসুটিতে মেতেছি, আর দিনের মতই কবিতা পড়েছি, গান শুনেছি, খেয়ে দেয়ে ঘুমিয়েছি। রুদ্রর চিঠি পেয়ে যতই আমি নিজেকে বলি, দেখ তুই এখন আর অবিবাহিত নস, রীতিমত এক লোকের বউ। বিয়ে করলে তো বউই হতে হয়। এরকমই তো নিয়ম, তুই চাস বা না চাস কাগজের ওই সইটিই তোর বিয়ে ঘটিয়েছে, ওই বলাই সার, ব্যাপারটিকে আমার বোধ ও বিশ্বাসের অনগ্তর্ ত করতে পারি না। আমি সত্যি করে অনুভব করতে পারি না যে আমি আর আগের আমি নই, আমি এখন নানি,মা, ফজলিখালা,রুনখুালার মত বিবাহিতা। চন্দনাও বিবাহিতা। বিয়ের পর চন্দনা লিখেছে আমি এখন ভয়শূন্য এক মানুষ। জীবন বাজি রেখে স্বপ্নের হাত ছুঁয়েছি। আমি খুব গভীর করে স্বপ্ন দেখতে জানি এখন। জীবন তো আমার একটাই। আমি ভুল করিনি। আমি এখন হাত বাড়ালেই ছুঁতে পারি রক্তগোলাপ। বিবাহিতা চন্দনার আবেগ চাইলেও আমার ভেতর সঞ্চারিত হচ্ছে না। আমার বোধের সীমানায় নেই পুরুষের স্পর্শ নারীর শরীরে কিরকম কাপঁ ন তোলে, আর সেই কাপঁ ন কি রকম তৃষ্ণা জাগায়। কলেজে পুরুষ বন্ধু যা আছে, তা কেবলই বন্ধু। চন্দনা যেমন। কোনও পুরুষকে আজও আমার চুমু খাওয়া হয়নি। কারও জন্য শরীরে কোনও তৃষ্ণা অনুভব করি না। তৃষ্ণা বলে যে একটি জিনিস আছে তা আমার নেহাতই জলের বা চায়ের বা খুব গরমে লেবুর শরবতের।

বউ সম্বোধন করে লেখা রুদ্রর দ্বিতীয় চিঠিটি বাবার হাতে পড়ে। ডাকপিয়ন বাড়িতে চিঠি দিয়ে গেছে, আর পড়বি পড় মালির ঘাড়ে, বাবার হাতে। বাবার যেহেতু অন্যের চিঠি খুলে পড়ার প্রচণ্ড শখ, তিনি পড়েন। তার মেয়েকে কেউ বউ বলে ডাকছে, তিনি তা খালি চোখে, চশমা চোখে সব চোখেই দেখেন। ঘরময় পায়চারি শুরু হয় বাবার, আমার পড়ার টেবিলের বইখাতা তছনছ করেন আরও তথ্য পেতে। ঘন ঘন তিনি চশমা খুলতে থাকেন, চেয়ারে বসতে থাকেন, চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াতে থাকেন, একসময় বাড়ি থেকে বেরিয়ে যান, রোগী দেখায় মন বসে না, আবার বাড়ি ফেরেন। এবার মাকে ডাকেন। যখনই ছেলে মেয়ে সংক্রান্ত কোনও দুর্ভাবনা, তখনই বাবা মার খোঁজ করেন, অথবা বাড়িতে অতিথি আসবে, তখনই মার খোঁজ, কই গেলা ঈদুন, এদিকে আসো তো! বাবা হিশেব দেন, কজন আসবে, কতজনের জন্য রান্না করতে হবে, এমনকি কি কি রাধঁ তে হবে তাও। মা মন দিয়ে শোনেন সব। শোনেন কারণ মার এসময় নিজেকে খুব মূল্যবান মানুষ বলে মনে হয়। এ সংসারে তাঁর যে প্রয়োজন আছে, তা উপলব্ধি করেন মা এবং বিচিত্র এক আনন্দ মাকে লেপ্টে থাকে মার ঘামের মত। এবার ডাকার পর হন্তদন্ত হয়ে মা সামনে দাঁড়ালে বাবা বলেন, নাসরিনরে বউ ডাকে কেডা জানো নাকি? কার এত সাহস ওরে বউ ডাকে?

কি জানি, আমি ত এইসব কিছু জানি না।

কোনও ছেলের সাথে জড়াইল নাকি?

এইরকম তো কিছু দেখি নাই। হাবিবুল্লাহরে ত বাড়ি থেইকা ভাগাইল। তেমন কোনও ছেলেও ত বাড়িত আসে না। কারও সাথে জড়াইছে বইলা মনে হয় না।

না জড়াইলে বউ নামে চিঠি তারে কোন বেডায় লেখে?

তা তো জানি না।

খবর তো কিছু রাখো না। কি কর সারাদিন বাড়িতে? মেয়ে কি করতাছে না করতাছে, তার খবর যদি না রাখতে পারো, তাইলে কি লাভ? আমি বাউণ্ডারি ওয়াল উঁচা করলাম। বাইরের কোনও ছেলেপিলে মেয়েদেরে যেন না দেখতে পারে সেই ব্যবস্থা করলাম। এখন কোথাকার কোন ছেলে ওরে বউ কইয়া ডাকে!

চিঠি লেখে তা জানি। পত্রিকা ছাপায়। এদিকে ওদিকে চিঠি লিখতে হয় কয়।

এই চিঠি কোনও পত্রিকার চিঠি না। এইটা অন্যরকম চিঠি।

আমি বাড়ি ফিরি কলেজ থেকে। মা দৌড়ে রান্নাঘরে গিয়ে আমার জন্য খাবার নিয়ে আসেন অন্যদিন। সেদিন তিনি মোটেও নড়েন না।

কি, ভাত কই?

ভাত পাতিলে। মা বলেন।

আমেনাও নড়ে কি নড়ে না চলে কি চলে না। অসম্ভব শথ্ল গতিতে ভাত বেড়ে নিয়ে আসে। সঙ্গে ডাল।

কি!ডাল দিয়া ভাত দিলা যে! মাছ মাংস নাই।

প্রত্যেকদিন মাছ মাংস লাগব না। মার রুক্ষ কণ্ঠ।

মাছ মাংস ছাড়া আবার ভাত খাওয়া যায় নাকি?

আমি দুমুঠো খেয়ে থালা ঠেলে উঠে চেঁচাই, পানি কই?

মা বলেন, পানি কলে।

পানি কলে সে তো আমিই জানি, কিন্তু দিতে হবে তো।

কে দেবে আমাকে পানি! গজগজ শুরু করলে গজেন্দ্রগামিনী আমেনাই একসময় কল থেকে গেলাসে পানি ভরে নিয়ে আসে। বাড়ি থমথম। অনুমান করি কিছু একটা হয়েছে। কি হয়েছে তা বোঝাবার জন্য মা বেশিক্ষণ অপেক্ষা করেন না। বিছানায় টান টান হয়ে একটি বই হাতে নিয়ে যখন শুয়েছি, গম্ভীর মুখে কাছে এসে গম্ভীর মুখেই জিজ্ঞেস করেন, রুদ্র কেডা?

রুদ্র?

হ রুদ্র।

কেন?

সে তরে বউ ডাকে কেন?

বুকের মধ্যে ঠাণ্ডা জলের গেলাস উপুড় হয়ে পড়ে। বোঁ বোঁ পাখার তলে আমি ঘেমে উঠি। দিনের ঝলমল আলো চোখের সামনে অমাবস্যার রাতের মত লাগে। কী কস না কেন, রুদ্র কেডা?

আমার আর বলার দরকার নেই রুদ্র কে! আমার শুধু জানার দরকার, চিঠি মার হাতে পড়েছে না অন্য কারও হাতে। বাবার হাতে হলে জীবনের এখানে এ মুহূর্তে সমাপ্তি। ডাল ভাত তো জুটেছে আজ, কাল কিছুই হয়ত জুটবে না। খানিকটা নরম হলে মা নিজেই বলেন, চিঠি বাবার হাতে পড়েছে। এটি জানার পর নিষ্প্রাণ শরীরটি নিচ্ছিত নিরালায় ফেলে ফেলে রাখি, বাড়িতে সবাই ঘুমিয়ে গেলে অপ্রকৃতিস্থের মত উঠে রুদ্রকে লিখি যেন বউ সম্বোধন করে আর একটি চিঠিও সে না লেখে। রুদ্রকে চিঠি আমার এভাবেই লিখতে হয়, বাড়িতে কেউ না থাকলে, অথবা সবাই ঘুমিয়ে গেলে। তা না হলে যে কেউ লেখাটির ওপর ঝুঁকে পড়বে, যে কারও এ বাড়িতে অধিকার আছে দেখার আমি কি লিখছি, আড়াল করতে চাইলে আগ্রহ অপ্রতিরোধ্য হয়ে ওঠে।



প্রতিদিন সকালে বাবা বেরিয়ে যাবার আগে আমার আর ইয়াসমিনের চাইতে হয় ইশকুল কলেজে যাওয়ার রিক্সাভাড়ার টাকা। বাবা গুনে টাকা দিয়ে যান। পরদিন সকাল হয়, বাবার গোসল সারার শব্দ হয়, জুতোর মচমচও শুনি, বাবার নাস্তা খাওয়ার এমনকি পানি গেলার শব্দও পাই, কিন্তু ধড়ে প্রাণ নিয়ে সামনে গিয়ে অন্যদিনের মত নতমুখে দাঁড়িয়ে রিক্সাভাড়ার টাকা চাওয়ার মত কলজের জোর আমার থাকে না। নিজের অস্তিত্বটিই এক বড় বোঝা আমার কাছে। আমি যদি এক তুড়িতে হাওয়ায় হাওয়া হয়ে যেতে পারতাম। আমাকে যদি কেউ দেখতে না পেত! টেলিভিশনে ইনভিজবল ম্যান সিরিজটি দেখে মাঝে মাঝে অদৃশ্য হওয়ার প্রয়োজনীয়তা আমি হাড়ে মাংসে অনুভব করি। বাবার কাছ থেকে নিরুদ্বেগে টাকা চেয়ে নিয়ে এসেছে ইয়াসমিন। নিরুদ্যম আমি ঘরের ভেতর দমবন্ধমখু বন্ধ পেটেরতলপেটেরচাপ সব বন্ধ করে বসে থাকি, বাবার মুখোমুখি হতে যেন আমাকে না হয়। বেরিয়ে যাওয়ার আগে তিনি ভেতর বারান্দায় দাঁড়িয়ে চেঁচিয়ে যেন বাড়ির প্রত্যেকে শোনে, মাকে বলেন,ওর লেখাপড়া বন্ধ। ওরে আর কলেজে যাইতে হইব না। সব বন্ধ। ওর খাওয়া দাওয়া বন্ধ কইরা দাও। ভাত দিবা না!

বাবা চলে গেলেন। আমি দশটা অবদি ডাকপিয়নের জন্য অপেক্ষা করে রুদ্রর কোনও চিঠি নেই নিশ্চিত হয়ে মার তোশকের তল থেকে টাকা নিয়ে কলেজে যাই। আটটা থেকে কলেজে ক্লাস শুরু হয়। এভাবে ফাঁকি দিলে ভবিষ্যতের বারোটা কেন, তেরোটা বেজে যাবে তা অনুমান করি। পরদিনও একই অবস্থা। ভেবেছিলাম, দিন গেলে বাবা নরম হবেন!নরমের কোনও লক্ষণ নেই। দাদার কাছে হাত পেতে রিক্সাভাড়ার টাকা নিয়ে পরদিন যেতে হয় কলেজে। বাবা নির্বিকার। আমি যে বাড়িতে একটি প্রাণী, তা একেবারে তিনি ভুলে গেছেন। মা উঠতে বসতে ধমকাচ্ছেন আমাকে। মাকে বাবা যা-ই বুঝিয়ে গেছেন, মা তা-ই বুঝেছেন। মা এরকমই, যে যা বোঝায়, তাই বোঝেন, নির্বিবাদে মেনে নেন যে কোনও মানুষের যে কোনও যুক্তি। কেউ যদি বলে এসে, জানো কচু গাছ থেকে পড়ে একজন মারা গেল, মা বললেন আহা, মইরা গেল! মা সবাইকে বলবেনও, জানো কচু গাছ থেকে পইড়া পাড়ার এক লোক একেবারে মইরাই গেল! মা একটুও ভাববেন না যে কচু গাছ থেকে পড়ে কেউ মরে না, আর কচু গাছে কেউ উঠতেও পারে না। মা পৃথিবীর সব লোককে বিশ্বাস করেন, সব লোকের সব কথাকেও করেন।

রুদ্র বউ সম্বোধন বন্ধ করেছে। কিন্তু চিঠি বেহাত হয়ে যাচ্ছে, বুঝি। চিঠি কেবল বাবা সরিয়ে নিচ্ছেন না, দাদাও সরাচ্ছেন। মাও। শেষ অবদি ডালিয়ার শরণাপন্ন হতে হয় আমাকে, খুলনার মেয়ে ডালিয়া, মোটা মোটা বইয়ে সারাদিন ডুবে থাকা ডালিয়া, তোমার হোস্টেলের ঠিকানায় কি আমার চিঠি আসতে পারে ডালিয়া? কাতরোক্তি শুনে খুব পারে বলে দিল। কবিতা লেখার অভ্যেস আছে তার, যেচে শতাব্দী চত্রে²র সদস্যও হয়েছে, তা না হলে এ কাজটি করতে এক কথায় রাজি হত কি না কে জানে, হয়ত সাত রকম প্রশ্ন করত। রুদ্র আবার মাস চার পর ময়মনসিংহে আসে, কলেজ ক্যান্টিনে বসে থাকা রুদ্রর সঙ্গে দেখা করতে যাই ডালিয়াকে নিয়ে। আসলে যখনই যাই, বেশির ভাগ সময়ই কাউকে না কাউকে নিয়েই যাই, হয় হালিদা, নয় মদিরা, নয় ডালিয়া। একা রুদ্রর মুখোমুখি বসে থেকে আমার কোনও কথা বলা হয় না। কেবল মুখোমুখিই বসে থাকা হয়। অনেকদিন সে বলেছে, একা আসতে পারো না? আমি যে পারি না, সে কথাও বলা হয় না তাকে। কেউ থাকলে সেই কেউএর সঙ্গে কলকল কথা বলে আমার একরকম বোঝানো হয় যে আমি যে কথা বলতে পারি না তা নয়, পারি, আমার শব্দসম্ভার নেহাত মন্দ নয়। অবশ্য শব্দ যা উচ্চাজ্ঞরত হয় তা বেশির ভাগই ডাক্তারিবিদ্যা সম্পর্কিত। রুদ্রকে তখন নীরব শ্রোতা হতে হয়। ফাঁক পেয়ে রুদ্র আমাকে বলে, এবার বিষয়টি জানাও তোমার বাবাকে। আমি সশব্দে হেসে উঠি, এ সত্যিই একটি হাস্যকর প্রস্তাব তার। পাঁচ বছর অপেক্ষা করা ছাড়া কোনও রকম উপায় নেই। ডাক্তার হওয়ার পর যদি বাবাকে কিছু জানানো সম্ভব, জানাবো, তার আগে কোনও প্রশ্ন ওঠে না। রুদ্র মন খারাপ করে বসে থাকে। সে বারবারই আমাকে বোঝাতে চায় যে প্রথম বাবা মা একটু রাগ করবেনই, পরে ঠিক হয়ে যাবে। পরে যে কিছুতেই কিছু ঠিক হবে না, সে আমি রুদ্রকে বোঝাতে চেষ্টা করি। মাঝখান থেকে, বলি যে, আমার ডাক্তারি পড়াই জন্মের মত বন্ধ হবে। রুদ্র মখু শুকনো করে চলে যাওয়ার পর আমি বুঝিয়ে চিঠি লিখি, পাঁচটা বছর দেখতে দেখতে কেটে যাবে, ভেবো না। রুদ্র লেখে, পাঁচটা বছর আসলেই খুব বেশিদিন নয়। দেখতে দেখতেই কেটে যাবে। কিন্তু পাঁচ বছর আমার জন্য অনেক অনেক দিন, অনেক বছর। আমি তোমাকে ঠিক বোঝাতে পারব না। তোমার সব কিছুই আমি বুঝি, তবু বলছি। সব কিছু বুঝতে পেরেও বলছি। তুমি একটু বুঝতে চেষ্টা কর। মানসিক পীড়ন কেন? আমার কালো অতীতের দিকে তাকালে বুঝতে পারবে। বুঝতে পারবে, আমার এই পীড়ন কেন। তোমাকে আমি বোঝাতে পারছি না। তুমি জানো না, আমার কোনও বন্ধু নেই। অনেক শুভাকাংখি, অনুরাগী, স্বজনেরা আছে, তারা কেউ আমাকে বুঝতে পারে না। আমার এখন তোমাকে প্রয়োজন, শুধু তোমাকে। অবলম্বনহীন হৃদয়কে আমি বেশিদিন ভাল রাখতে পারব না। রুদ্রর কোনও কালো অতীতের কথা আমি জানি না। কালো অতীত বলতে ঠিক কি বোঝাতে চায় সে তা আমার বোঝা হয় না। আমি এর অর্থ করি, অযথা ঘুরে বেড়ানো, লেখাপড়া না করা, পরীক্ষা না দেওয়া। রুদ্রকে আমি আমার দৈনন্দিন জীবনের কথা, আমার স্বপ্নের কথা জানাতে থাকি। রুদ্র লেখে, তোমার স্বপ্নের সাথে আমার স্বপ্ন একদম মেলে না। যেখানে তোমার স্বপ্ন খুব শুভ্র, কমনীয় ফুলের মত সেখানে আমি একেবারেই ইটপাথর। জীবনকে আমি অত্যন্ত নির্মম চোখে দেখি। এতটা নির্মমতা হয়ত ভাল নয় তবু কেন জানি এরোমই আমার হয়। এক কাজ করলে কেমন হয়, স্মৃুতি বন্টনের মত শুভ্রতা আর শ্যামলিমার স্বপ্ন তোমার হোক, আমার হোক গ্লানি আর নির্মমতার স্বপ্ন। ভাল মন্দ মিলিয়েই তো জীবন। আমরা এইভাবে ভাগাভাগি করে নেব কেমন! আমার বোঝা হয় না মানুষ কি করে স্বপ্ন দেখতে পারে অসুন্দরের। অসুন্দরের সঙ্গে তো আমার নিত্য বসবাস, তাই স্বপ্ন দেখি সুন্দরের। রুদ্রকে যে করেই হোক পরীক্ষা দিতে বলি, এমএ পাশ হলে ভবিষ্যতে হয়ত রুদ্রর কথা কখনও কোনওদিন বাড়িতে উচ্চারণ করা যাবে, কিন্তু রুদ্র বলে বোধহয় কোথাও একটা ভুল থেকে যাচ্ছে, একটা ফাঁকি, খুব সূক্ষ্ম যার ফাটল, না বোঝার তীক্ষ্ম আর মিহি ফাঁক থেকে যাচ্ছে। আমি ঠিকই বুঝতে পারছি। এই সূক্ষ্ম ফাঁক দিয়ে একদিন লক্ষিন্দরের বাসরে যে ভাবে কালনাগিনী ঢুকেছিল, ঠিক সেভাবেই অবিশ্বাসের সাপ ঢুকবে, ঢুকবে না পাওয়ার আক্ষেপ আর ব্যথর্ আকাঙক্ষার ক্লান্তি। আমাদের সতর্কে হওয়া উচিত, আমাদের আরও সতর্ক হওয়া উচিত। কৈশোর শেষ হবার সাথে সাথেই আমি খুব ধীরে ধীরে আমার জীবন যাপন, আমার বিশ্বাস পরিবর্তন করছি একটি বিশেষ লক্ষে। একাডেমিক ক্যারিয়ার বলতে যা বোঝায়, তা প্রায় সম্পূর্ণই ধ্বংস করে ফেলেছি। হ্যাঁ অনেকটা ইচ্ছে করেই। আমাদের এই সমাজ, এই জীবনের অনেক অন্ধকার, অনেক আলো, অনেক ঘৃণা অনেক অবিশ্বাস, প্রতারণা, আর অনেক বিশ্বাস আর ভালবাসা আমি দেখেছি। হয়ত সারা জীবন এইভাবে পুড়ে পুড়ে দেখব। দেখব দুরারোগ্য অসুখের জীবাণু দেহে নিয়ে কতটা তার যন্ত্রণা দেবার ক্ষমতা। আমার ঘরের উঠোনে হয়ত কোনওদিন রজনীগন্ধা ফুটবে না। হয়ত আমার টেবিলের ফুলদানির পরিবর্তে থাকবে একটা মস্ত বড় মাটির অ্যাশট্রে। হয়ত আমার প্রিয় সঞ্চয় হবে একজন নিহত মুক্তিযোদ্ধার হেলমেট। কিংবা একটা মানুষের খুলি। কোথাও নিশ্চয়ই কোনও ভুল হচ্ছে, এত ফুল, এত পাখি আর এত সুখের স্বপ্ন তো আমি দেখি না। তুমি কেন দেখ? আমি তো দুটি পরিশ্রমী আর কর্মব্যস্ত মানুষের স্বপ্ন দেখি। দিনে রাতে খুব কমই অবসর তাদের।

বাড়িতে রুদ্রর চিঠি না আসতে থাকায় কোনও এক মাথা-পাগল কবি কোনও এক ভুল আবেগে আমাকে কোনও একদিন বউ বলে সম্বোধন করেছিল, বেটার দুঃসাহস এখন কমেছে ভেবে সকলে শান্ত হন, ঘটনা চাপা পড়ে। চাপা পড়ার আরও একটি কারণ হল, বউ বলে সত্যি সত্যি কেউ আমাকে ডাকতে পারে, সত্যি সত্যি আমি কারও বউ হতে পারি এ কল্পনা করা এ বাড়ির কারও পক্ষে সম্ভব নয়। তার ওপর আমি সময়মত কলেজ থেকে ফিরছি, কোথাও কোনও সন্দেহজনক বিলম্ব হচ্ছে না, এনাটমি ফিজিওলজি বইয়ের ওপর মখু গোঁজা থাকে বেশির ভাগ সময়, বাবা মা দাদার তিনজোড়া ভুরুর কঞ্চু ন বন্ধ হয়। বাবা তাঁর রাগটি কলের জলে গুলে ফেলেন, কারণ সামনে পরীক্ষা আমার। পরীক্ষার নাম ফার্স্ট প্রফেশনাল, সংক্ষেপে ফার্স্ট প্রফ। তিনটে পরীক্ষা হয় মেডিকেলে, দ্বিতীয় বর্ষ থেকে তৃতীয় বষের্ ওঠার পরীক্ষাকে বলা হয় ফার্স্ট প্রফ, তৃতীয় থেকে চতুথর্ বষের্ ওঠারটি সেকেন্ড প্রফ, আর চতথুর্ থেকে পঞ্চম বষের্ উঠতে হয় থার্ড প্রফ দিয়ে। পঞ্চম বর্ষের যে পরীক্ষা, সেটি ফাইনাল। ফাইনালের পর ডাক্তার। একবছর প্রশিক্ষণ। তারপর চাকরি। প্রশিক্ষণের সময় ভাতা দেওয়া হয়, মন্দ ভাতা নয়। চাকরি করলে বেতনও মন্দ নয়, তবে বদলির চাকরি, সরকারি ইচ্ছেয় বদলি হতে হবে, এখানে নিজের ইচ্ছে বলে কিছু থাকে না। অবশ্য মামা চাচা থাকলে থাকে। মামা চাচা বলতে, লোক থাকলে, মন্ত্রণালয়ে নিজেদের আত্মীয় লোক, অথবা বিএমএতে খাতিরের লোক। ফার্স্ট প্রফ পরীক্ষায় আমার পাশ হবে বলে আমার মনে হয় না। এতকাল গৃহশিক্ষকেরা আমাকে পড়া গিলিয়ে দিয়ে গেছেন, মেডিকেলে কোনও গৃহশিক্ষক নেই, থাকার কোনও নিয়ম নেই, আমাকে গেলাবার কেউ নেই, নিজেকে গিলতেই হয় যা কিছু য়েচ্ছা গলাধঃকরণে অভ্যেস কম আমার, তাই উদ্বেগ আমাকে মাথার উকুনের মত কামড়ায়। তার ওপর বইয়ের ভাষা ইংরেজি, কোনও দেবনাথ পণ্ডিত নেই যে বলবেন এরে ইংরেজি মিডিয়ামে না দিয়া বাংলা মিডিয়ামে দিয়া দেন, এর দ্বারা ইংরেজি পোষাবে না। বাংলায় চিকিৎসাবিদ্যার কোনও বই নেই। ইংরেজিতে লেখাপড়া ছাড়া গতি নেই কোনও।কিন্তু বাঁচা যে এ ইংরেজি সাহিত্য নয়। ইংরেজি লিখতে গিয়ে বা বলতে গিয়ে ব্যাকরণ কি বানান ভুল হোক ক্ষতি নেই, কিন্তু শরীরের মাথা থেকে পা পর্যন্ত কোথায় কি আছে, কি কাজ তাদের, অনপুুঙ্খ জানা চাই। এতে কোনওরকম ক্ষমা নেই। এসবের বর্ণনা ইংরেজিতে লিখতে বা বলতে গিয়ে ব্যাকরণের কথা কেউ ভাবেও না। একটি জিনিস মনে উদয় হয় আমার, ফরাসি দেশ বা জার্মানি বা স্পেন বা ইতালি বা রাশিয়া, যেসব দেশের ভাষা ইংরেজি নয়, সেসব দেশে তাদের নিজেদের ভাষায় চিকিৎসাবিদ্যা শিখছে ছাত্রছাত্রীরা, তবে এ দেশে কেন বাংলায় বই হয় না? অন্য একটি ভাষায় কোনও বিদ্যা অর্জন করার চেয়ে নিজের মাতৃভাষায় বিদ্যা অর্জন করলে সে বিদ্যা রপ্ত হয় ভাল বলে আমার বিশ্বাস। কিন্তু আমার বিশ্বাসের তোয়াক্কা কেউ করে না। একটি ভিনদেশি ভাষার ওপর নির্ভর করে সকলে এই বিশেষ বিদ্যাটি অর্জন করে। পড়াশোনার চাপে আমার যাবতীয় আউটবই, সেজুঁতির নতুন পাণ্ডুলিপি বা প্রতি সপ্তাহের না পড়া রোববার সন্ধানী বিচিত্রা কোথায় কোন তলে পড়ে থাকে, তার খোঁজ রাখার সময়ও আমার জোটে না। বই পড়ে মখু স্থ করে যখন প্রশ্নের বড় বড় উত্তর লিখছি খাতায়, দেখে বাবা বললেন রিটেনে কেউ ফেল করে না,করে ভাইবায়। বাইরে থেকে এক্সটারনাল এক্সামিনার আইব, একটা প্রশ্নের উত্তর দিতে পারবি না তো ফেল। আমার গভীর বিশ্বাস, পরীক্ষায় আমার পাশ হবে না। লিখতে দিলে হয়ত কায়ক্লেশে কিছু একটা কিছু দাঁড় করানো যায়, অবশ্য বানিয়ে লেখার ব্যাপারটি এখানে একদমই নেই, যদি প্রশ্ন করা হয় প্যানক্রিয়াসের পজিশন কি? এ সম্ভব নয় লেখা শরতের আকাশের তুলো তুলো মেঘ থেকে একটুকরো মেঘ দুহাতের মুঠোয় নিয়ে দেখলে যেমন দেখায়, প্যানক্রিয়াস তেমন দেখতে। এটি শরীরের কোথায় যে কী করে লুকিয়ে থাকে! একে না খুঁজে পাওয়া যায়, না একে ভুলে থাকা যায়। অগ্নাশয় নিঃসঙ্গ পড়ে থাকে ক্ষুদ্রান্ত্রের পাশে, প্লীহার তলে, হৃদপিণ্ড থেকেও খুব দূরে নয়, বুঝি হৃদপিণ্ডের ধুকপুক শব্দ ওকেও আলোড়িত করে। এর শরীরের দুরকম কোষ থেকে জল প্রপাতের মত বয়ে যায় দুরকম নির্যাস…. ,হবে না, লিখলে জিরো, লিখতে হবে প্যানক্রিয়াস ইজ এন ইলোংগেটেড অরগান, লোকেটেড এক্রস দ্যা ব্যাক অব দা এবডোমেন, বিহাইন্ড দা স্টমাক, দ্যা রাইট সাইড অব দ্যা অরগান লাইস ইন দ্যা কাভর্ অব ডিওডেনাম, লেফট সাইড এক্সটেন্ডস স্লাইটটি আপওয়ার্ডস বিহাইন্ড দ্যা স্পলীন, ইট ইজ মেইড আপ অফ টু টাইপস অব টিস্যুস, এক্সোক্রাইন এন্ড এন্ডোক্রাইন। রস বলে এখানে কোনও ব্যপার থাকতে নেই, যত বেশি কাঠখোট্টা, যত বেশি টু দ্যা পয়েন্ট, তত বেশি নম্বর, আর নম্বরের পরোয়া না করলে, ভাল কসাই হওয়া যাবে হয়ত, ভাল ডাক্তার নয়। অধ্যাপকদের সঙ্গে তেরিমেরি করলে জীবনেও পাশ হবে না, ওঁদের দেখলে, সে ক্লাসে করিডোরে, রাস্তায় বাজারে যেখানেই হোক, আসসালামু আলায়কুম বলতে হবে। এই আসসালামু আলায়কুম টি আমার একেবারেই আসে না, কদমবুসি যেমন আসে না। আরবি ভাষায় শুভেচ্ছা জানানো ছাড়া আর কি উপায় নেই! বাংলায় তো জানানো সম্ভব, কী কেমন আছেন, ভাল তো! অথবা নমস্কার। নমস্কার শব্দটি বাঙালি হিন্দুদের নিজস্ব সম্পত্তি হয়ে গেছে, কোনও শব্দ কি হয় না যে শব্দের কোনও ধর্ম নেই? নাহ! হয় না। যাকেই জিজ্ঞেস করি, বলে, আর কোনও উপায়ই নেই। আমি অসহায় বসে থাকি। আমার ওটুকুই হয়, স্মিত হাসি, এটিই সম্ভাষণ, এটিই শুভেচ্ছা। এ দিয়ে পরীক্ষায় পাশ নাকি হয় না। আরেকটি উপায় বের করি, করিডোরে অধ্যাপকরা হাঁটলে এমন ভাব করে পাশ কাটি, যেন বাইরে তাকিয়ে আছি, অথবা মাটির দিকে, অথবা অন্যমন আমার, অথবা হাতের বইটির দিকে দেখছি, যেন অধ্যাপক নামক বিরাট মানুষটিকে দেখিনি, দেখলে তো কপালে হাত ঠুকে আসসালামু আলায়কুম স্যার বলতামই। বাড়িতে ইয়াসমিনকে জিজ্ঞেস করলাম, তোর অস্বস্তি লাগে না আসসালামু আলায়কুম বলতে? ইয়াসমিন নিঃসংকোচে না বলল, ওর লাগে না। আমার লাগে কেন! মাকে জিজ্ঞেস করলাম এই আসসালামু আলায়কুমের মানেটা কি? মা বললেন আপনার উপর শান্তি বর্ষিত হোক। কোত্থেকে বর্ষিত হবে? আকাশ থেকে? মা খানিক ভেবে বললেন আল্লাহ বষর্ণ করবেন। তাহলে তো আকাশ থেকেই, আল্লাহ যেহেতু আকাশেই থাকেন। মা আপত্তি করতে পারলেন না আমার আকাশ বিষয়ক ধারণার। খানিক বাদে মা বললেন, আকাশ বিষয়ে ভাবতে ভাবতে মোক্ষম উত্তরটি মার মনে পড়ল, বললেন আল্লাহ কি শুধু আকাশেই থাকেন! আল্লাহ সর্বত্র বিরাজমান। আল্লাহ বিষয়ে কথা বলতে গেলে মা সাধারণত বইয়ের ভাষা ব্যবহার করেন, কঠিন কঠিন শব্দ, আল্লাহ প্রসঙ্গে না হলে মা সর্বত্র শব্দটি না বলে সব জায়গায় বলতেন, আর বিরাজমান না ব্যবহার করে আছেন বলতেন। আল্লাহ ব্যাপারটি মার কাছেও সম্ভবত কঠিন একটি ব্যাপার। আকাশ থেকে জল ছাড়া সখু বা শান্তি কখনও বর্ষিত হতে আমি দেখিনি। সুতরাং আরবি বাক্যটির যে সরাসরি কোনও বাংলা অনুবাদ চালিয়ে দেব, তাতেও মন সায় দেয় না! সালাম ঠোকার অভ্যেস নেই বলে বেয়াদব, উদাসীন, অভদ্র এসব খেতাব পেয়ে গেছি ইতিমধ্যে।

রাত জেগে পড়তে হয়, পরীক্ষা, বাবা বলেন, নাকের ডগায়। কড়া রোদে দাঁড়ালেও নাকের ডগায় এক বিন্দু ঘাম জমে না আমার, এমন নিঝর্ঞ্ঝাট ঝটু ঝামেলাহীন নাকটিকে পরীক্ষার বোঝা এসে প্রায় থেতলে দিচ্ছে। পরীক্ষা কাছে এলে বাবা তাঁর আগের রূপটি ধারণ করেন, উপদেশের ঝড় বইয়ে দিচ্ছেন বলতে বলতে যে মেডিকেলের পড়া দিন রাইত চব্বিশ ঘন্টা না পড়লে হয় না। রাত জাইগা পড়, চোখে ঘুম আসলে, চোখে সরিষার তেল ঢালো। যত পরীক্ষা এগোয়, তত আমার ঘুম বাড়ে, ভয়ের সঙ্গে ঘুমও বাড়ে। বাবা সাত সকালে উঠে ঘরের পাখা বন্ধ করে বাতি জ্বেলে দেন, গরমে আর আলোয় ঘুম ভেঙে যায়। তিরিক্ষি মেজাজ নিয়ে বিছানা ছাড়তে হয়। এক রাতে চোখে ঢালার জন্য এক শিশি সর্ষের তেল কিনে এনে আমার টেবিলে রেখে গেলেন বাবা। কী করতে হবে তেল?

যখনই ঘুম পাইব, চোখে ঢালবা, ঘুম বাপ বাপ কইরা পলাইব!

বাবার আড়ালে আমি সর্ষের তেল দিয়ে মুড়ি মেখে খেতে লাগলাম দিব্যি, আর রাত দশটার আগেই ঘুমের রাজ্যে ঢুকে ঘুমপরীদের সঙ্গে বিস্তর গল্প করে বেড়াচ্ছি। বাবা ফিরে এসে চিৎকার করে বাড়ি জাগান, আরে পরীক্ষার আর তিনদিনও বাকি নাই আর তিনি কি না নাকে তেল দিয়া ঘুমাচ্ছেন! বাবার সম্ভবত ধারণা, চোখে দেওয়ার বদলে বাবার আনা তেল আমি ভুল করে নাকে ঢেলেছি। চোখে আমার ঠিকই সর্ষের তেল ঢেলে রাত জাগতে হয়েছে, ঠিকই এনাটমি আর ফিজিওলজির আগা থেকে মাথা জানতে হয়েছে পড়ে পড়ে। রাত জাগলে বাবা পাশে এসে বসেন আমার। বাবা বসেন, সঙ্গ দেন। যেন আমি ভূতের ভয়ে চোরের ভয়ে নিঃসঙ্গতার ভয়ে আবার মশারির তলে না ঢুকি। মা ফ্লাস্ক ভরে চা দিয়ে যান টেবিলে, আর আমার থেতলে যাওয়া নাকের সামনে তখন ্‌আমি কারুকে দেখি না, অধ্যাপকদের রক্তচোখ ছাড়া।

লিখিত পরীক্ষা হয়ে গেল, এবার মৌখিক। বাবা বললেন তোমার হারুন স্যাররে একবার বাসায় দাওয়াত করতে হবে। বাবার উদ্দেশ্যটি স্পষ্ট, খাতির। খাতিরে যদি মৌখিক পাশ হয়। হারুন আহমেদ সপরিবার আমাদের বাড়ি এলেন, মা সারাদিন রান্না করলেন, শিক্ষিত লোক বাড়িতে এলে মার সামনে যাবার রীতি নেই, রান্নাঘর থেকে তিনি বাসন পত্রে খাবার সাজিয়ে দিলেন, আমি দাদা আর ইয়াসমিন সেগুলো নিয়ে বৈঠক ঘরে খাবার টেবিলে রাখলাম। হারুন আহমেদ খেলেন গল্প করলেন, গল্প পুরোটাই কবিতা নিয়ে। তিনি কবিতা লেখেন, আমি যদি তাঁর কবিতা কোথাও ছেপে দিতে পারি ভাল হয়। তিনি নিয়েও এসেছেন সঙ্গে দিস্তা দিস্তা কবিতা, একবার চোখ বুলিয়ে আমি অনুমান করি কবিতাগুলো মম জীবনে তব আগমন ঘটার পর অবশেষে কোনও আঁধারে করিবে প্রস্থান। হারুন আহমেদ বাবার ছাত্র ছিলেন। বাবার ছাত্ররা অনেকে অধ্যাপক হয়ে গেছেন। বাবা এখনও পুরো অধ্যাপক হননি, সহযোগীতেই পড়ে আছেন, কিভাবে হব, তোমাদের জন্য পয়সা কামাই করতে করতে তো বড় কোনও পরীক্ষা দেওয়া হয় নাই, তা না হইলে ছাত্র তো খারাপ ছিলাম না। তা ঠিক বাবা ছাত্র ভাল ছিলেন, মেডিকেলে পড়তে এসে এমন হয়েছে যে তাঁর বই কেনার পয়সা নেই, এক ছাত্রের সঙ্গে বাবা তখন এক চুক্তিতে এলেন, রাত দশটার পর, ছেলেটি যখন ঘুমিয়ে যাবে, বই ধার নেবেন তিনি, তাই করতেন, ধার করা বই সারারাত পড়ে, সকালে সেই বই ফেরত দিতেন ছেলেকে, রাত জাগা বাবা সকালে ক্লাস করতে যেতেন।ওভাবে পড়ে, রাত জেগে, ধার করা বইয়ে, বাবা সবচেয়ে বেশি নম্বর পেতেন মেডিকেলে। যেমন পেতেন চণ্ডিপাশা হাইইশকুলে।

বাবার মত মেধা আমার নেই। মৌখিক পরীক্ষায় হারুন আহমেদ আমাকে ইচ্ছে করলেই কঠিন প্রশ্ন করতে পারেন, খাতিরে করেননি। অন্য কলেজ থেকে যে পরীক্ষকরা এসেছিলেন, তাঁরা কঠিন প্রশ্নের দিকে গেলে হারুন আহমেদ কায়দা করে উত্তর ঠিক কোনদিকে যাবে বা যেতে পারে এরকম একটি ইঙ্গিত দিতে চেষ্টা করেছেন। টেবিলে রাখা হাড়গুলো অন্য পরীক্ষক ছুঁতে যাওয়ার আগেই হারুন আহমেদ আমার দিকে ঠেলে দিয়েছেন ফিমার নামের সহজ হাড়টি। এটি হাতে নিয়ে কোন অংশের কি নাম, কোন জায়গায় কোন পেশি এসে লেগেছে, কোন পেশিতে কোন নালি রক্ত সরবরাহ করছে, স্নায়ুই বা কোত্থেকে এসে কি করে কোথায় যাচ্ছে, এসব রকমারি প্রশ্নের উত্তর দিতে হয়। ফিজিওলজি পরীক্ষাতেও খাতির জোটে, এই কলেজেরই সহযোগী অধ্যাপকের কন্যাটিকে জটিলতার মধ্যে নিয়ে নাস্তানাবুদ না করাটিই খাতির। প্রশ্নের উত্তর দিতে প্রায় সকলেই জানে, এখানে ভাগ্যই বড় কথা, কারও ভাগ্যে জটিল প্রশ্ন, কারও ভাগ্যে পড়ে অজটিল। জটিলতা অজটিলতা অনেকটা নির্ভর করে পরীক্ষকদের মন মেজাজের ওপর। পরীক্ষকরা যখন দুপুরের খাওয়ার পর চা খেতে খেতে চেয়ারে হেলান দিয়ে প্রশ্ন করেন, সহজ প্রশ্ন করেন। যাই হোক, খানিকটা বিদ্যায়, খানিকটা খাতিরে আমি ফার্স্ট প্রফ পাশ করি।

ছোটদা ময়মনসিংহে ছুটিছাটায় চলে আসেন বউ নিয়ে। ঈদ আর পুজোর ছুটিতেই আসেন বেশি। বারো মাসে তেরো পুজো লেগে আছে, সব পুজোয় ছুটি না পেলে ছুটি নিয়ে তবে আসেন। গীতা ঈদের উৎসবে আছে, পুজোর উৎসবেও। এ বাড়িতে ঈদ পুজোর উৎসবের চেয়ে বড় উৎসব ছোটদার অবকাশ-আগমন উৎসব। বাড়িতে সত্যিকার উৎসব শুরু হয় ছোটদা এলে। মা ছুটে যান রান্নাঘরে, ছেলের জন্য পোলাও কোর্মা রাধঁ তে, রেঁধে বেড়ে ছেলে আর ছেলের বউকে সামনে বসিয়ে খাওয়ান। পেট পুরে খাচ্ছে কি না তার ওপর কড়া নজর মার। ছোটদার পাতে বড় মাংস তুলে দেন, গীতার পাতেও। মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে ছোটদাকে বলেন, ঠিক মত খাওয়া দাওয়া কর তো বাবা! কত কষ্ট না জানি হইতাছে চাকরি করতে!

আরে না মা কি যে কন, আরামের চাকরি। ভাল বেতন পাই। এইতো ডমেস্টিক ফ্লাইট শেষ হইল, এখন ইন্টারন্যাশনাল শুরু করছি।

মা ডমেস্টিক ইন্টারন্যাশনালের প্যাঁচ বোঝেন না। মাটির পৃথিবী ছেড়ে অতদূর আকাশের ওপর কারও কি কষ্ট না হয়ে পারে, বিরুই চালের ভাত খেতে ইচ্ছে করল পাবে না, টাটকা শাক সবজি, তাও না। না পারবে ভাল করে শুতে, না হাঁটতে, পায়ের তলায় মাটিই যদি না থাকে, তবে সে হাঁটা আর কেমন হাঁটা!

আরব দেশে গেছিলাম মা। মক্কায় গিয়া কাবা শরিফ দেইখা আইছি।

আরব দেশে যাওয়া এত যে সহজ মা ধারণা করতে পারেন না।

উফ এত গরম। অবশ্য গাড়িতে এসি থাকলে অসুবিধা নাই।

ছোটদা আরব দেশ নিয়ে আর যা যা বলেন, মা স্থবির বসে থেকে শোনেন। মার কল্পনার আরবের সঙ্গে ছোটদার বর্ণিত আরব যে একেবারেই মেলে না, মার ম্রিয়মান মখু টি দেখলেই স্পষ্ট হয়। ছোটদা আরোগ্য বিতানে বাবার সঙ্গে দেখা করে শহরে ঘুরতে বেরোন, হাতে গোনা দু একজন পুরোনো বন্ধুকে খোঁজেন। বিকেলে গীতাকে নিয়ে বেরিয়ে যান, অনুমান করি এখন পিয়নপাড়ায় গীতার বাপের বাড়ি যাওয়া হচ্ছে। বাড়িতে এখন সবাই জানে যে গীতা পুজোতে পিয়ন পাড়ায় তার বাপের বাড়ি যায়, কেউ কোনও প্রতিবাদ করে না। না করলেও কখনও সে ফলাও করে জানায় না যে সে বাপের বাড়ি যাচ্ছে।

ছোটদার দুনিয়া দেখা হতে থাকে, আর ছোটদাকে ঘিরে দুনিয়ার গল্প শোনাও হতে থাকে আমাদের।

আমস্টারডাম শহর থেইকা সমুদ্র অনেক উপরে।

কও কি? শহরটা তাইলে পানির নিচে ডুইবা যায় না?

বাধঁ দেওয়া আছে। ডুবে না।

আর লন্ডন?

লন্ডন ত বিশাল বড়।

ব্রিটিশ মিউজিয়াম দেখছ?

হ, দেখছি।

পিকাডেলি সার্কাসএ গেছিলা?

হ।

প্যারিস গেছ?

হ।

আইফেল টাওয়ার দেখছ?

দেখছি।

ছোটদাকে আইফেল টাওয়ারের মত উঁচু মনে হয়। এত কাছ ঘেঁষে বসে আছি, অথচ ছোটদাকে অনেক দূরের মনে হয়, হাত বাড়ালে যাঁর নাগাল পাওয়া যায় না। সকাল বিকাল দিবি রে, দিবি রে দুইডা টাকা দিবি? বলে হাত পাতার করুণ মুখের ছোটদাকে বেশি আপন মনে হত, এখন ছোটদার ব্যস্ততা বিষম, এখন টাকা পয়সাও অনেক। বাড়ি এসেই বলেন, আজকে নয়ত কালকেই চইলা যাইতে হবে, ফ্লাইট আছে। ছোটদার সঙ্গে অলস দুপুরে এক বিছানায় শুয়ে শুয়ে, মাথার কাছে পা, পায়ের কাছে মাথা, রাজনীতি, সাহিত্য.. গোল্লায় গেছে।—ছোটদা, ময়মনসিংহে আসলা, তোমার নাটকের দলটার সাথে দেখা করছ?

আরে না, সময় কই?

নজরুল, রুহুল, মিলু শফিক এদের সাথে দেখা করছ?

সময় কই!

বাংলার দর্পণে গেছিলা? মঞ্জু ভাইদের সাথে দেখা করব না।

সময় থাকলে তো যাইতেই পারতাম।

প্রথম প্রথম যখন ময়মনসিংহে আসতেন, বন্ধুদের সঙ্গে দেখা করা তাঁর ফুরোতো না, আগের মত আড্ডায় বসে যেতেন। এখন সময় নেই সময় নেই। কোনও কারণে তিনি যদি গোলপুকুর পাড়ের দিকে যান, আড্ডার পুরোনো বন্ধুরা ছোটদাকে দেখেই হৈ চৈ করে ডাকেন। ওরা আছে ওদের মতই, ওরা এখনও আড্ডা দেয়, কেবল ছোটদাই নেই। ছোটদার মুখে এখন বিদেশি সিগারেট, একসময় তিনি বন্ধুদের কাছ থেকে দিশি স্টার সিগারেট চেয়ে খেতেন।

কি রে কামাল, এই সিগারেটের নাম কি রে?

কার্টিয়ে।

বাহ বাহ কামাল এখন ফিল্টার অলা সিগারেট খায়! দে না খাইয়া দেখি তর বিদেশি সিগারেট।

ছোটদাকে পুরো গোলপুকুর পাড় চোখ গোল করে দেখে। ছোটদা প্যাকেট থেকে সিগারেট বের করে দেন বন্ধুদের। বাড়ি ফেরার পর অবশ্য মখু ধুয়ে সিগারেটের গন্ধ আগে দূর করে নেন ছোটদা। বাবা মার সামনে তিনি সিগারেট খান না, সিগারেট যে খান তার প্রমাণও রাখেন না। ছোটদার পায়ে বিদেশি জুতো, গায়ে নতুন শার্ট প্যান্ট, তাঁর নিজের। টুডাইল্যা বন্ধুদের কাছ থেকে ছোটদার দূরত্ব বাড়তে থাকে, কেবল তিনি আরও কাছে আসতে থাকেন গীতার। সুন্দরী মেয়ে গীতা, কালো মেয়ে গীতা, ফর্সা হতে থাকা গীতা, যার টিকলো নাক টিকলোই আছে, যার পাতলা ঠোঁট পাতলাই, এখন চায়ে যে চিনি নেয় না, মাংস থেকে আলগোছে চর্বি সরিয়ে রাখে।



ছোট ঈদে ছোটদা আমাদের জন্য নানারকম উপহার আনেন। দুবাই থেকে একটি লিপস্টিক, একটি শ্যাম্পু। দুটো সাবান। কলকাতা থেকে আমার আর ইয়াসমিনের জন্য থ্রিপিস, রং মিলিয়ে তো বটেই ছিট মিলিয়ে জামা পাজামা ওড়না। মার জন্য জায়নামাজ, তসবিহ। বাবা ছুঁয়েও দেখেন না তাঁর জন্য আনা কিছু বাবার জন্য একজোড়া চকচকে জুতো এনে বললেন,মেইড ইন ইতালি। ইতালির জুতো হলে কি হবে,বাবা স্পষ্ট বলে দিলেন, তাঁর জুতোর দরকার নেই। জুতোর দিকে গোল গোল চোখে তাকিয়ে দাদা বললেন, একেবারে আমার পায়ের মাপের জুতা। জুতোজোড়া দাদার জুটল। মার জন্য একখানা টাঙ্গাইলের সুতি শাড়ি গীতাই তুলে দেয় হাতে,মা ধরেন আপনের লাইগা ঈদের শাড়ি আনলাম। আমাদের উপহারও আমাদের হাতে দেয় গীতা, যেন সে নিজের কামানো টাকা দিয়ে আমাদের জন্য কিনে এনেছে এসব। আসলে ছোটদাই গীতাকে দিতে বলেন সবার হাতে, গীতা তুমি কি কি আনছ কার লাইগা, দিয়া দেও। ছোটদা বললেই যে গীতা বাক্স খুলবে তা নয়, তার যখন ইচ্ছে হবে,তখন খুলবে। ইচ্ছে না হলে বন্ধ বাক্সই ফেরত নেবে ঢাকায়।

গীতার পরনে চমৎকার চমৎকার শাড়ি, গা ভর্তি চাক্কা সোনার গয়না, সব গয়না, ছোটদা বলেন, সৌদি আরব থেকে কেনা। গীতার জৌলুস বাড়ছে, ছোটদারও। সন্ধে হলেই পুরোনো পুরোনো বন্ধুর বাড়ি যাচ্ছেন বলে গীতাকে সঙ্গে নিয়ে বেরোন তিনি। ইয়াসমিন বলে, আসলে পিয়নপাড়ায় যায়, তার আত্মীয়ের লাইগা নানান জিনিসপাতি নিয়া যাইতাছে।

মা বলেন, আমার ছেলে সুখে থাকলেই হইল।

খানিক থেমে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন মায়ের সখু বইলা একটা কথা আছে না, কামাল যদি নিজের হাতে শাড়িডা আমারে দিত, ভাল লাগত। কামালই কিনে, কিন্তু বউএর হাত দিয়া দেওয়ায়।

ছোটদাকে সুখী সুখী লাগে দেখতে। দেখে আমাদেরও সখু হয়। আমি আমার বিছানা ছেড়ে দিই ছোটদা আর গীতাকে। অনেক রাত অবদি সেই বিছানায় আমাদের তাস খেলার হৈ হৈ চলে। স্পেডট্রাম খেলায় আমি আর ইয়াসমিন এক দল, ছোটদা আর গীতা আরেক দল। মা মধ্যরাতে আমাদের খেলার ভেতর ঢুকে বলেন, বাবা কামাল, তুমি তো রাত্রে ভাল কইরা খাও নাই, এখন একটু ভাত মাংস আনি, খাইয়া লও।

পাগল হইছেন। পারলে চা দেন।

মা দৌড়ে রান্নাঘরে ঢোকেন, ওই অত রাতে চা বানাতে।

আমি গলা তুলে বলি, মা আমার জন্যও এক কাপ।

ইয়াসমিন বলে আমার জন্যও।

আমরা আদা চা খেতে খেতে তাসের আনন্দে ডুবে থাকি। মা ছেঁড়া মশারির তলে, গায়ে বসা মশা দুহাতে তাড়াতে তাড়াতে ভাবেন,কাল সকালে উঠেই পরোটা মাংস করতে হবে সকালের নাস্তা, কামালটা পরোটা মাংস খাইতে খুব ভালবাসে।



যেহেতু সবে পরীক্ষা শেষ হয়েছে, ছোটদার সঙ্গে ঢাকা যাব, ঢাকা যাব বায়না ধরে ঢাকায় আসি বেড়াতে। এখন আর মুহম্মদপুরের বাড়িতে থাকেন না তিনি। সেগুন বাগিচায় রাহাত খানের বাড়ির ওপরতলায় একটি ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়েছেন। গীতার মুখে আগে যেমন চৌধুরি বাড়ির গল্প শোনা যেত, এখন তেমন আর শোনা যায় না। এখন রাহাত খান আর নীনা মামির গল্প। ছেলেমেয়ে অপু তপু কান্তা শুভ্রর গল্প। মুহম্মদপুরের বাড়িতে যখন ছিলেন তখন নাচের লোক গানের লোক সবার সঙ্গে ওঠাবসার ব্যস্ততা ছিল তার, ওদের কথাও ইদানিং আর বলেন না। ফকরুল মামার সঙ্গে বাড়ি ভাড়া নিয়েছিলেন ছোটদা,দুজনে অর্ধেক অর্ধেক ভাড়া দিতেন। তিনি ওড়াওড়ি করলে গীতাকে বাড়িতে একা থাকতে হবে না, ফকরুল মামা রইলেন, একজন পুরুষমানুষ রইল আর কী! মাস তিন পর গীতা জানিয়ে দিল, সে একাই থাকতে পারে, একাই একশ সে। ফকরুল মামাকে পাততাড়ি গুটিয়ে নিতে হল। গীতা আরও জানাল, সে নিজেও চাকরি করবে। তারও চাকরি হল। তেমন বড় চাকরি নয়, বিমান অফিসের রিসেপশনিস্ট। ওই কাজেই সে প্রতিদিন সেজেগুজে যেতে থাকে। এখনও করছে সেই একই চাকরি। গীতা আমাকে বিমান আপিসে নিয়ে যায়, ঘন্টার পর ঘন্টা খামোকা বসিয়ে রাখে। তার এই ভাই সেই ভাইএর সঙ্গে তার ননদকে পরিচয় করিয়ে দেয়। খামোকা বসে থাকতে আমার ভাল লাগে না, রুদ্রর সঙ্গে দেখা করার জন্য ছটফট করি। ময়মনসিংহ থেকেই তাকে চিঠি লিখে দিয়েছি সকাল এগারোটায় যেন সে থাকে রোকেয়া হলের সামনে। আমাকে নিয়ে গীতা এখানে যাবে, ওখানে যাবে এরকম পরিকল্পনা করতে নিলেই আমি ক্ষমা চেয়ে ঝুনু খালার সঙ্গে জরুরি দেখা করতে যাচ্ছি বলে একটি রিক্সা নিই।

কহন আইবি?

এইত কিছুক্ষণ পরেই।

বলি কারণ রুদ্রর সঙ্গে দেখা না হলে তো আমাকে কিছুক্ষণের মধ্যে ফিরতেই হবে। দেখা হওয়ার বিষয়টি সম্পণূর্ ভাগ্য। ঢাকায় সে আদৌ আছে কি না, নাকি হুট করে গ্রামের বাড়িতে চলে গেছে কে জানে।

কিছুক্ষণ কতক্ষণ?

আধ ঘন্টা। বড়জোর এক ঘন্টা।

অফিসে আইয়া পড়িস। আমি আজকে তাড়াতাড়ি ছুটি নিয়া নিব।

সময়ের দেড়ঘন্টা দেরি করে গিয়েও দেখি রুদ্র অপেক্ষা করছে। আমাকে নিয়ে ঘুরে বেড়ালো রুদ্র। হুডতোলা রিক্সায় রুদ্রর সঙ্গে ঘুরে বেড়াতে আমার এত ভাল লাগে! চাই সময় যেন না ফুরোয়। কিন্তু ফুরিয়ে যায় সময়। রুদ্র আমাকে তার দুটো বান্ধবীর বাড়ি বেড়াতে নিয়ে চা বিস্কুট খেতে খেতে গল্প করে এসেছে। এক ঘন্টার জায়গায় চারঘন্টা হয়ে যায়। গীতার অফিস ছুটি হয়ে গেছে, বাড়ি ফিরতে হয় আমাকে। আমাকে গীতার সামনে দাঁড়াতে হয় না, কারণ সে ঘরের দরজা বন্ধ করে শুয়ে থাকে। আমি রাতে একা শুয়ে থাকি, আমাকে কেউ খেতেও ডাকে না, আমার সঙ্গে কেউ গল্প করতেও আসে না। গীতার বন্ধ দরজায় দাঁড়িয়ে দুবার ডেকেছি, দরজা খোলেনি। পরদিনও আমাকে রুদ্রর সঙ্গে দেখা করতে বেরোতে হয়। গীতাকে আমার বেরোবার কথা জানাতে গেলে পরদিনও শুকনো মুখে জিজ্ঞেস করে, কই যাবি? ঝুনু খালা আজও যেতে বলেছেন, বলি। মিথ্যে বলতে আমার ইচ্ছে হয় না, কিন্তু তার অভিভাবকীয় আচরণে আমার গলা শুকিয়ে আসে, বলতে বাধ্য হই। পরদিনও জিজ্ঞেস করে, কালকে তো দেখা করলি, আজকে আবার কী!

আজকে ইউনিভার্সিটির রেজিস্টার বিল্ডিং এ আমার রেজাল্ট পাওয়া যাবে। যাইতে হবে।

আমি ত তরে নিয়া যাইতে পারি ওইখানে।

রুনুখালার পরিচিত মানুষ আছে, সে অফিস থেইকা রেজাল্ট দেখার ব্যবস্থা করতে পারবে।

মানুষ কি আমার নাই?

এত কইরা বইলা দিছে। আমার যাইতেই হইব। আমার জন্য ত অপেক্ষা করতাছে। পরদিনও গীতা জিজ্ঞেস করে—কহন আইবি। পরদিনও আমি বলি, দেরি হবে না, আজকে তাড়াতাড়ি চইলা আসব। গীতা আজ ছুটি নিয়েছে অফিস থেকে, আমাকে নিয়ে সে বেড়াবে। সুতরাং যেতে চাচ্ছি, ঠিক আছে, কিন্তু দুপুরের আগেই যেন ফিরি। রুদ্র আমার জন্য অপেক্ষা করছিল বিশ্ববিদ্যালয়ে-লাইব্রেরির বারান্দায়,আমি পৌঁছতেই আমাকে রিক্সায় তুলে বাসাবোয় তার ঘরে নিয়ে যায়। শাদামাটা ঘরটিতে একটি বিছানা পাতা। বসে আপন মনে ঘরটির জিনিসপত্র আর বইখাতা দেখি। রুদ্র পাশে বসে আমাকে নিবিড় করে ধরে চুমু খায় ঠোঁটে। ঠোঁট থেকে চুমু বুকের দিকে নামে, তার শরীরের ভার দিয়ে আমাকে শুইয়ে দেয় বিছানায়,বুক থেকে আরও নিচের দিকে নামতে থাকে তার ঠোঁট, তার শরীরের তলে পড়ে হাঁসফাঁস করি, যেই না আমার পাজামার ফিতেয় তার হাত পড়ে, ছিটকে সরে যাই। তাকে ঠেলে সরিয়ে আমি লাফিয়ে নামি বিছানা থেকে। ভয় আমার অন্তরাত্মা শুকিয়ে ফেলে। বলি, এখন যাবো। ঠোঁট জোড়া ভারি ঠেকছিল, আয়নায় নিজের চেহারা চিনতে পারি না, ফুলে ঢোল হয়ে আছে ঠোঁট। রুদ্র উপুড় হয়ে শুয়ে থাকে, কোনও কথা বলেনা। অনেকক্ষণ ওভাবেই শুয়ে থাকে, জিজ্ঞেস করি, ঠোঁটের ফোলা আড়াল করে, কি হয়েছে, ওভাবে তার শুয়ে থাকার কারণ কি? বার বার বলি, আমার দেরি হয়ে যাচ্ছে, আমার যেতে হবে। ওভাবেই অনেকক্ষণ শুয়ে থেকে রুদ্র গোসলখানায় চলে যায়। ওখানে মেলা সময় ব্যয় করে ফিরে বলে, শুয়ে ছিলাম কারণ তলপেটে ব্যথা হচ্ছিল।

ব্যথা? কেন?

রুদ্র কোনও উত্তর দেয়নি। দরদ ফোটে আমার গলায়, নিয়মিত খাওয়া দাওয়া না করলে এসিডিটি হয়। নিয়মিত খাওয়া উচিত। বেশি ঝাল খাওয়া উচিত না। স্টমাক যদি এম্পটি থাকে, তবে যে এসিড সিত্রে²শান হয়, তা কোনও ফুড না পেয়ে স্টমাককেই খেতে থাকে। এ কারণে এক সময় আলসার হয়ে যায় পেটে। পেপটিক আলসার বলে একে। এন্টাসিড খেলে ঠিক হয়ে যাবে।

রাখো তোমার ডাক্তারি বিদ্যা, চল।

রুদ্র আমাকে নিয়ে বেরোয়। তার কোনও এক বন্ধুর বাড়ি যাবে।

অসম্ভব, আমাকে এখন সেগুন বাগিচা যেতে হবে।

এক্ষুনি যাওয়ার কি হল?

যেতে হবে। বৌদি কাল রাগ করেছে দেরিতে ফিরেছি বলে। আজ আমাকে নিয়ে সে বাইরে যাবে।

রুষ্ট রুদ্র বিকেলের দিকে আমাকে নামিয়ে দিয়ে যায় সেগুন বাগিচায়। বাড়ি ফেরার পর গীতার সঙ্গে কথা বলতে গেলে দেখি সে মখু ফিরেয়ে নিচ্ছে। বৈঠকঘরে বসে থাকি একা। আমার সঙ্গে কোনও কথা বলে না গীতা। সন্ধেয় বাড়ি ফিরে ছোটদা ভিসিআরএ একটি হিন্দি ছবি চালিয়ে গীতা গীতা বলে ডেকে যান, গীতা আসে না। ছোটদা শেষ অবদি ছবি দেখা বন্ধ করে গীতার মাথার কাছে বসে গীতার গায়ে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে ও গীতা ও গীতা গীতা গীতা জপ করে যান। আমার সঙ্গে গীতার এমন আচরণ আমি আগে দেখিনি কখনও। ছোটদা গীতাকে খেতে ডাকেন খাবার টেবিলে, গীতা আসে না। গীতা আসেনি বলে ছোটদাও না খেয়ে থাকেন। এ বাড়িতে আমার উপস্থিতিই আমার মনে হতে থাকে, অশোভন। অপমান আমাকে মিশিয়ে ফেলে মেঝের ধুলোয়। না পারি রুদ্রকে ফেরাতে, না পারি প্রিয় স্বজনদের। দুটোতে প্রচণ্ড বিরোধ, আমি কোনদিকে যাই। পরদিন ভোরবেলা ছোটদাকে বলি আমি চলে যাবো ময়মনসিংহে। ছোটদা বলেন আরও কয়টা দিন থাক। আমি দীর্ঘশ্বাস গোপন করে বলি, আমার ক্লাস শুরু হয়ে যাচ্ছে। ছোটদা মখু শুকনো করে আমাকে ট্রেনে পৌঁছে দিয়ে আসেন ময়মনসিংহ। একাই যেতে পারব বলেছিলাম, তিনি তবু নিজে এসেছেন। সারাটা পথ জানালায় মখু রেখে রুদ্রকে ভেবেছি। রুদ্র নিশ্চয়ই তার বাসাবোর ঘরে অপেক্ষা করছে আমার জন্য, অপেক্ষা করতে করতে যখন দেখবে যে আমি আসছি না, তখন নিশ্চয়ই কষ্ট হবে খুব ওর। রুদ্রর কষ্টের কথা ভেবে আমার এত কষ্ট হতে থাকে যে চোখ ভিজতে থাকে, বারে বারেই ভিজতে থাকে। বাড়ি ফিরে রুদ্রকে লিখি আমার চলে আসতে বাধ্য হওয়ার কথা। লিখি চলে আসা ছাড়া আমার আর কিছু করার ছিল না।

রুদ্র লেখে, তোমার কিছুই করার ছিল না—এটাই তোমার দোষ। কেন তোমার কিছু করার থাকে না? কেন তোমার ইচ্ছা অনিচ্ছার মূল্য থাকে না? কেন তুমি বার বার ভুলে যাও যে তুমি একজনের খুব কাছের মানুষ? কেন ভুলে যাও যে আর একটি জীবনের সাথে তোমার জীবন জড়ানো রয়েছে। তুমি কেন ভুলে যাও যে তুমি একজনের স্ত্রী? কামাল থাকতে অনুরোধ করেছিল। বাড়ি থেকেও আরও বহুদিন থাকার অনুমতি ছিল, এর পরেও কী করে বিশ্বাস করি যে বাধ্য হয়েই তোমাকে যেতে হয়েছে? কী করে আমাকে বিশ্বাস করতে বলো তোমার কোনও দোষ নেই? তুমি কি এখনো শিশু রয়েছো যে তোমার ইচ্ছা অনিচ্ছার কোনও মূল্য থাকবে না? আজ এই সামান্য থাকার ব্যাপারে তোমার ইচ্ছা অনিচ্ছাকে তুমি প্রতিষ্ঠা করতে পারো না! অনিচ্ছার তোয়াককা না করে তোমাকে যদি আবার বিয়ে দিতে চায়, তখনও কি তুমি লিখবে আমার কোনও দোষ নেই! আশ্চর্য! কেন তোমার ইচ্ছা তুমি প্রকাশ করতে পারো না? প্রতিষ্ঠা করতে পারো না? আমার রাগ করা বা না করায় তোমার তেমন কিছু আসে যায় না। সেদিন সারাটা দুপুর ধরে তুমি তা প্রকাশ করেছো। এতোখানি কাছে আসার পরও তুমি এখনো বোকার মত দুজনের সম্পর্কের মধ্যে হার জিতের কথা ভাবো। কবে তোমার ম্যাচিউরিটি আসবে? স্বামীর অধিকার আমি কখনো জোর করে আদায় করতে চাইনি, এখনো চাই না। আর চাই না বোলেই আমি সব সময় তোমাকে সুযোগ দিয়েছি নিজে থেকে তোমার দায়িত্বটুকু বুঝে নেবার জন্যে। কতো ভাবে বুঝিয়েছি। কিন্তু তুমি ভাবো স্ত্রীর দায়িত্ব পালন করা মানে পরাজিত হওয়া। আর দশটা দম্পতির দিকে তাকিয়ে দেখ তো? আমি তো কখনো তোমাকে সেরকম ভাবে চাইনি। তোমাকে আমি সম্পণূর্ মুক্ত মানুষ হিসেবে চেয়েছি। সামাজিক শৃঙ্খল আর পুরুষের দাসত্বের উধের্ তোমাকে রাখতে চেয়েছি। কিন্তু তাই বলে তুমি তোমার দায়িত্ব নেবে না কেন? বিয়ের পর আট মাস কেটে গেল এখনো তোমার সঙ্কোচ কাটে না। এখনো তুমি যুক্তিহীন জেদ করে নষ্ট করো স্বাভাবিক জীবন। বিয়ের দিনটির কথা সারা জীবনেও আমার পক্ষে ভোলা সম্ভব হবে না।

জীবনের সহজাত কিছু নিয়ম আছে, কিছু শৃঙ্খলা আছে। তাকে কখনোই অস্বীকার করা চলে না। তোমার সমস্যা আমি বুঝি। খুব পষ্ট করে বুঝি। তোমাকে এতখানি বোধহয় কেউই বোঝে না। আর বুঝি বলেই আমি প্রথম থেকেই খুব যুক্তিসংগত ভাবে তোমাকে গ্রহণ করার চেষ্টা করেছি। যেটা আমি ভাল জানি বা বুঝেছি, চেষ্টা করেছি তোমাকেও তা বোঝাতে। না হলে ২৬/১ এর পর আমাদের সম্পর্ক শেষ হতে বাধ্য ছিল। তোমার সেন্টিমেন্টগুলো আমি বুঝি বলেই তার অমর্যাদা করি না। কিন্তু সেই সেন্টিমেন্ট যদি আমাকে অমর্যাদা করে? যাতে না করে সে দায়িত্বটি তোমার। কখনো ভাবিনি এসব নিয়েও লিখতে হবে। সব সময় চেয়েছি তুমি বুঝে নেবে। আর বুঝতে শিখলে যুক্তিহীন ভাবে কিছু আর করবে না।

যদি তুমি শুধু আমার ভালোবাসার মানুষ হতে, যদি বউ না হতে, তবে হয়তো তোমার এই চলে যাওয়াটা আমার এতখানি লাগত না। তখন শুধু বুকে বাজত, কিন্তু এখন আত্মসম্মানেও বাজে।

নিজের সাথে এমন প্রতারণা করো কেন? নিজের ইচ্ছার সাথে কেউ প্রতারণা করে? রুদ্রর চিঠি পড়ে আমার এত মন খারাপ হয়ে যায়। এত মন খারাপ যে লিখি আমাকে যদি তোমার এতই অপছন্দ, আমার যুক্তিহীন কার্যকলাপ যদি তোমার আত্মসম্মানে এতই বাধে, তবে আর দ্বিধা করছ কেন? পছন্দসই মেয়ের অভাব তো নেই! তারা নিশ্চয়ই আমার মত বাজে ধরণের সেন্টিমেন্ট নিয়ে চলে না, যুক্তিহীন জেদ করে নষ্ট করেনা স্বাভাবিক জীবন, জীবনের সহজাত নিয়মকে, শৃঙ্খলাকে কখনই অস্বীকার করে না, তারা নিশ্চয়ই বোকার মত হারজিতের কথা ভাবে না, স্ত্রীর দায়িত্ব তারা সুন্দর নিয়ে নেবে, বিয়ের আট মাস হবার বহু আগেই তাদের সঙ্কোচ কাটবে। তাদের কাউকে পছন্দ করে ফেলো। তোমার সুখের ব্যাপারে আমার আপত্তি থাকবে না। ছোটবেলা থেকে আমি খুব বেশি একটা সুখে মানুষ হইনি—যে কোনও দুঃখকে আমি সহজে গ্রহণ করতে শিখেছি। তোমার সুখের জন্য তোমার নতুন জীবন বেছে নেবার ঘটনা শুনলে আমি অবাক হব না। আমি তোমার সুখের পথে কোনওদিন বাধা হয়ে দাঁড়াতে চাই না। এই অসহ্য জীবন থেকে তুমি যদি মুক্তি পেতে চাও, নিয়ে নাও। আমার বলার কিছু নেই। আমি তোমাকে কোনওদিন দোষ দেব না। আমার অক্ষমতাটুকু আমার থাকবে। আমার একাকীত্ব আমার থাকবে। জীবন আর ক দিনের! দেখতে দেখতেই শেষ হয়ে যাবে, দুম করে একদিন মরে যাবো। এতদিনে আমি বুঝে গেছি কোনও পুরুষকে তৃপ্তি দেবার ক্ষমতা আমার নেই। দাম্পত্যজীবনকে সুখী করার ক্ষমতা আমার সত্যিই নেই। আমি একটা আপাদমস্তক অহেতুক মানুষ। তুমি আমাকে ক্ষমা করো। কোনওদিন ভাবিনি এরকম চিঠি তোমাকে লিখব। কিন্তু মূর্খের মত জীবনে আমি সুখের প্রত্যাশা করেছিলাম, যতসব আজগুবি স্বপ্ন দেখেছিলাম, বাস্তবতা আমাকে বুঝিয়ে দিয়ে গেল, জীবনের সীমানা এত বিশাল নয়, বরং শ্বাস বন্ধ হয়ে আসে কিছু একটা পেতে হলে হারাতে হয় লক্ষগুণ। অথচ নিবোর্ধ আমি হারাতে না চেয়েই পেতে চেয়েছিলাম। তাইতো হেরে গেলাম নিজেই। তাইতো বিয়ের পর বছর না পেরোতেই আমাকে লিখতে হয় এমন কষ্টের চিঠি। আমার অক্ষমতার জন্য আমাকে তুমি ক্ষমা করে দিও। তোমার উদারতার কথা কোনওদিন ভুলব না।

আমার চিঠি পেয়ে রুদ্র লেখে, তোমার সমস্ত অক্ষমতা নিয়েই তুমি সারাজীবন আমার সাথে থাকবে। প্রায় তিন বছর ধরে আমি তিল তিল করে আমার জীবনে যে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে এনেছি তাকে তুমি নষ্ট করতে পারো না। আমার শৃঙ্খলা আর স্থিরতা এখন তোমাতে। যথেষ্ট হয়েছে, যথেষ্ট করেছো—এই সব পাগলামি আর চলবে না। আমি তোমার সুখের পথে কোনওদিন বাধা হয়ে দাঁড়াতে চাই না, এই কথাটি আরও সহস্রবার নিজেকে শোনাও। যখনি তুমি আমাকে এই কথাটি বলো, ঠিক তখনই তুমি আমার জীবনে সুখের পথে বাধা হয়ে দাঁড়াও। দ্বিতীয়বার এই কথাটি আমাকে তুমি শোনাবে না। তোমার জীবনটির সম্পণূর্ দায়িত্ব আমার। তার ভাল মন্দ নিয়ে তোমাকে ভাবতে হবে না। এই কথাটি ভুলে যাও কেন? আর শোনো শখ করে আর কখনই আমাকে কষ্ট দিও না। আমি খুব ভাল নেই, আর এই ভাল না থাকা তোমার কারণে। ছোট্ট চিঠি, কিন্তু অমল এক আনন্দ আমাকে ঘিরে থাকে সারাদিন। আমি বুঝি, খুব ভাল করে বুঝি, রুদ্রকে আমি ভালবাসি। রুদ্র তার বাসাবোর ঘরে আমাকে চুমু খেতে খেতে হয়ত আরও অন্য কিছু করতে চেয়েছিল, সেই অন্য কিছুর একটি ভয় আমাকে আমূল কাপাঁয়। রুদ্রকে আমি বোঝাতে পারি না এসবের কিছু।
 
১৩. শুভবিবাহ


চট্টগ্রাম থেকে ময়মনসিংহে তার মেয়ে বিনিকে নিয়ে বেড়াতে আসে শীলা। শীলা এসেছে খবর পেয়ে দাদা অস্থির হয়ে ওঠেন। বান্ধবী নিলমের বাড়িতে শীলা উঠেছে। শহরের কাচিঝুলির বাড়িটি বিক্রি করে দিয়ে গফরগাঁওএ গ্রামের বাড়িতে চলে গেছে শীলার মা, ভাই বোন। গফরগাওঁ য়ে যাওয়ার পথে ময়মনসিংহ শহরে থেমেছে শীলা, নিলমের সঙ্গেও দেখা হল,জন্মের শহরটিও দেখা হল। কিন্তু দেখতে গিয়ে দেখা হয়ে যায় দাদার সঙ্গে। দাদার সঙ্গে দেখা হোক শীলা চেয়েছিলই বলে দেখা হয়। সে দেখা থমকে দাঁড়িয়ে থাকা মুখোমুখি। সে দেখা বুকের মধ্যে একশ কথা জমা থাকার পর একটি কথাও উচ্চাজ্ঞরত না হওয়ার দেখা। সে দেখা অপলক তাকিয়ে থেকে ভিজে ওঠা চোখ আড়াল করতে ডানে বা বামে কোথাও তাকানো। শীলাকে দাদা বাড়িতে আসতে বলেন। নিজে বাজার করেন রুই মাছ, কই মাছ, চিংড়ি মাছ, চিতল মাছ, কিন্তু শীলা যদি মাছ খেতে পছন্দ না করে, তাই সঙ্গে খাসির মাংস, মুরগির মাংস, এমন কি কবুতরের মাংসও—মা সারাদিন ধরে সব রান্না করেন। সন্ধের দিকে বিনিকে সঙ্গে নিয়ে শীলা অবকাশে আসে। সেই আগের মতই আছে শীলা, আগের সেই পানপাতার মত মখু টি আছে, আগের সেই চোখ, চোখের হাসি, গালে শুধু মেচেতার কিছু কালো দাগ পড়েছে। সবার সঙ্গে হেসে কথা বলে শীলা। তার মাথায় হাত বুলিয়ে মা বলেন, ভাল আছ শীলা? আহা কতদিন পর তোমারে দেখলাম। কি সুন্দর একটা ফুটফুটে মেয়ে তোমার! খেতে বসে শীলা বারবারই বলে, কি দরকার ছিল এত কিছুর! শীলার পাতে মাছ মাংস তুলে দিতে দিতে মা বলেন, নোমান শখ কইরা কিনছে, খাও। খাওয়ার পর বিনিকে বারান্দায় খেলতে পাঠিয়ে দাদার ঘরে বসে দাদাকে তার দুঃসহ জীবনের কথা বলে সে। নিজের ভেজা চোখ হাতের তেলোয় মুছে দাদা শীলার চোখের জল মুছিয়ে দেন। শীলা চলে যাওয়ার পর দাদা উদাস শুয়ে থাকেন বিছানায়, চোখ খোলা জানালায়। বাইরের হাওয়া এসে দাদার ভিজে চোখ শুকিয়ে নেয় বারবার। দাদার গালে মেচেতার নয়, চোখের জল শুকোনোর দাগ লেগে থাকে। এভাবে অনেকদিন উদাস মন নিয়ে থেকে বাড়িতে তিনি বলে দিলেন, কেউ যেন তার বিয়ের জন্য আর পাষনী খুঁজে না বেড়ায়। তিনি সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তিনি বিয়ে করবেন না। সবাই থ। থ হওয়া সবাইকে সপ্তাহ খানিক পর তিনি জানালেন, যদি বিয়ে করতেই হয় তবে তিনি শীলাকে করবেন। শীলাকে বিয়ে! সবাই আরও থ। বিয়ে হওয়া বাচ্চাঅলা শীলাকে কি করে দাদা বিয়ে করবেন! শীলা স্বামী ছেড়ে দেবে শিগগির। তারপর শীলাকে বিয়ে করে নিয়ে আসবেন, বিনি আছে তো ক্ষতি কি, বিনি তো শীলারই মেয়ে। দাদা বড় বড় চিঠি লিখতে থাকেন শীলাকে। চিঠিগুলো নিলমের হাতে দিয়ে আসেন,নিলম নিজের চিঠির খামে পুরে দাদার চিঠি ডাকে পাঠিয়ে দেয় চট্টগ্রামে। একদিন খুব ভোরবেলা নিলম এল বাড়িতে, দাদা সারারাত না ঘুমিয়ে নিলম আসার আগেই কাপড়চোপড় পরে তৈরি ছিলেন। দুজন যাচ্ছেন চট্টগ্রামে শীলার কাছে। দাদার পথ আগলাবে এমন শক্তি নেই কারও। দাদা উদভ্রান্তের মত নিলমের সঙ্গে চট্টগ্রাম চলে গেলেন।

চট্টগ্রামে এক সপ্তাহ কাটিয়ে দাদা ফিরে এলেন। এ সম্পণূর্ নতুন এক দাদা। তিনি আর খোলা জানালা সামনে নিয়ে উদাস শুয়ে থাকেন না, বরং শীলা ছাড়া অন্য যে কাউকে বিয়ে করার শখ সীমা ছাড়িয়ে যাওয়ার মত বেড়ে যায়। চট্টগ্রামে কি ঘটনা ঘটেছে, তা তিনি বাড়ির কাউকে বলেন না। কেবল তাই নয়, শীলা নামটি তিনি মুখে নেন না, যেন শীলা বলে পৃথিবীতে কেউ নেই কিছু নেই। কেউ জানতে চাইলে তিনি পাথরের ওপর বসা পতেঙ্গা সমুদ্র বন্দরে তোলা নিজের কয়েকটি ফটো দেখান আর বলেন চট্টগ্রাম জায়গাটা খারাপ না, ভালই।

দাদার বন্ধুবান্ধবদের বিয়ে তো বিয়ে, বাচ্চা কাচ্চাও হয়ে গেছে, এমন কি যে আদুভাই ফরহাদের ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার আগে বিয়ের নামগন্ধ নেওয়া নিষেধ ছিল, তিনিও ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ দিয়ে বিয়ে করে ফেলেছেন। দাদার তো আর কিছু পাশ দেওয়ার নেই। দীর্ঘদিন ধরে চাকরি করছেন, এখনও যদি বিয়ে না করেন, তবে বাকি জীবনে আর বিয়ে করতে পারবেন বলে, দাদার অনেক বন্ধুরাই ধারণা দিয়েছে,মনে হয় না। দাদা প্রতি সপ্তাহেই মেয়ে দেখছেন, কিন্তু মুশকিল হচ্ছে, আবার সেই একই মুশকিল, পছন্দ হচ্ছে না কাউকে। ফাইসন্স কোম্পানীর নতুন প্রতিনিধি ফজলুল করিম দাদার চেয়ে বছর চারেকের ছোট, এ শহরে নতুন এসে শহরের আচার ব্যবহার বুঝে ওঠার আগেই বিয়ে করে ফেলেছেন, বউ ইয়াসমিনের ক্লাসের এক মেয়েকে। ফজলুল করিমের বউ দেখে এসে দাদা ইয়াসমিনকে ধমকের সুরে বললেন তর ক্লাসে এত সুন্দর মেয়ে ছিল, আগে কস নাই ত!

মেয়ে ত আছেই, কিন্তু তোমার মত বুড়ারে বিয়া করব নাকি আমার ক্লাসের মেয়েরা!

কয়েক বছরের বছরের ছোট হওয়া এমন কিছু না।

দাদা শার্ট প্যাণ্টের বোতাম খুলে বসে থাকেন সোফায়। তিনি যে শরীরটিকে বয়ে নিয়ে ঘরে নিয়ে শার্ট প্যান্ট খুলে লুঙ্গি পরে আসবেন, তাঁর সেই উদ্যমটুকওু হারিয়ে গেছে।

ইয়াসমিনের ক্লাসের মেয়েরা তোমার চেয়ে পনর বছরের ছোট দাদা। আমি বলি।

তাইলে তর ক্লাসের কোনও মেয়ে টেয়ে দেখ না!

মেডিকেলের মেয়ে?

না মেডিকেলের মেয়ে বিয়া করা যাবে না।

কেন?

মেয়ে কয়েক বছর পর ডাক্তার হইয়া যাইব। সাবমিসিভ হইব না।

সাবমিসিভ চাও কেন?

আরে মেয়ের উপরে থাকতে হইব না আমার? বউ আমারে মাইনা না চললে ত চলবে না।

ও তোমার ত আবার ডাক্তারদেরে স্যার ডাকতে হয়। মেডিকেলের মেয়েরা ওষুধ কোম্পানীর রিপ্রেজেনটেটিভরে বিয়া করে না, ওই স্বপ্ন বাদ দেও।

মেডিকেল ত বাদই। মেডিকেলে সুন্দরী মেয়েরা পড়ে না।

দাদার আদেশ নিষেধ মেনে চলবে এমন এক মেয়ে চাই, মেয়ে এমএ পাশ হলেও চলবে না, কারণ দাদার এম এ পাশ হয় নি, দাদার চেয়ে বেশি শিক্ষিত মেয়ে হলে বিপদ। দাদা আমার ইশকুল বা মুমিনুন্নিসা কলেজের পুরোনো বান্ধবীদের কথা জিজ্ঞেস করেন।

কেউ কি ছিল না সুন্দরী?

আমি বলি, মমতা ছিল কিন্তু ওর তো বিয়া হইয়া গেছে।

আরেকটা মমতা ছিল তো তর ইশকুলে, বাঘমারা থাকত। ভাল ছাত্রী, হেভি সুন্দরী।

ওরও বিয়া হইয়া গেছে।

এই মুশকিল সুন্দরী মেয়েগুলার ইশকুলে থাকতেই বিয়া হইয়া যায়। আইএ বিএ যারা পাশ কইরা ফালায়, অথচ বিয়া হয় না, তারা দেখবি, দুনিয়ার পচা দেখতে। হয় দাঁত উঁচা, নয় ঠোঁট উঁচা। কিছু একটা উঁচাই।

মা বলেন, নোমান, কত ভাল ভাল মেয়ে দেখলি, তর কাউরে পছন্দ হইল না, না জানি শেষ পর্যন্ত তর কপালে কী আছে।

কপালের কথায় দাদা সামান্য উদ্যম ফিরে পান, তিনি শার্ট প্যান্ট খুলে লুঙ্গি আর গেঞ্জি পরে বারান্দার চেয়ারে বসে গা চুলকোতে চুলকোতে বলেন, সুন্দরী মেয়ে না পাইলে বিয়াই করতাম না ইনশাল্লাহ। অসুন্দরী মেয়েরে বিয়া করার চেয়ে সারাজীবন আনম্যারেড থাকা ভাল।

সেবনিরে দেইখা আইলাম, কি সুন্দর মেয়ে, তর পছন্দ হইল না। মেয়েটা খুব নামাজি, পর্দা করে। আদব কায়দা জানে, বিএ পাশ করছে।

বেশি নামাজি আবার ভালা না মা। দাদা একগাল হেসে বলেন।

ওই সেবনিরে বিয়া না কইরা ভালই হইছে। মার বোরখার জ্বালায় বাঁচি না। বাড়ির মধ্যে দুই বোরখাউলি থাকলে বিপদ আছে। আমি ফোড়ন কাটি।

মা ধমকে ওঠেন, সাবধানে কথা ক নাসরিন।

মার ধমক আমার কানে পৌঁছয় না। পৌঁছয় না কারণ আমি মুমিনুন্নিসার মেয়েদের মুখের ছবি চোখ্যে ভাসাচ্ছি। সুন্দরী কে ছিল দেখতে। বিড়বিড় করি, মুমিনুন্নিসা কলেজে আর্টসে একটা সুন্দরী মেয়ে পড়ত। ও আবার নাফিসার বান্ধবী।

নাফিসা কেডা?

নাফিসা আমার সাথে মডেলেও পড়ছে, মুমিনুন্নিসায় পড়ছে।

ওই নাফিসা! উফ, ভুটকি। তর বান্ধবীগুলাও যা না! এক তো চন্দনা চাকমারে বন্ধু বানাইলি, নাক বোঁচা চাকমা। তর চয়েস দেখলে আমার .. কি কইতাম।

নাফিসাকে দাদা চেনেন। এ বাড়িতে এসেছেও ও। ওর বড় ভাই আবার দাদার সঙ্গে একই কলেজে একই ক্লাসে কোনও এক কালে পড়ত। এখন রাশভারি ভদ্রলোক, ঢাকায় চাকরি বাকরি করেন।

নাফিসা তো মেডিকেলে ভর্তি হইছে।

তা সুন্দরী মেয়েডা কেডা, ক।

নাম হাসিনা। আর্টস এ পড়ত, মুমিনুন্নিসায়, কথাবার্তা বেশি হয় নাই। নাফিসার সাথে খাতির ছিল খুব।

দাদা সিদ্ধান্ত নেন, এই মেয়ে তিনি দেখবেন।



নাফিসার কাছ থেকে হাসিনার একটা ফটো এনে দেখালাম দাদাকে। দাদা বললেন, এই মেয়ে তিনি দেখতে যাবেন। ব্যস, আয়োজন হল মেয়ে দেখার, দাদা মেয়ে দেখে এসে বললেন, চলে।

চলে মানে? বিয়া করবা?

আহামরি কিছু না দেখতে, তবে করা যায় বিয়া।

দাদার মুখে করা যায় বিয়া, এই বাক্যটি আমাদের বিস্মিত করে,আনন্দিতও। কারণ দীর্ঘ দীর্ঘ কাল বিয়ের জন্য ঝুলে থাকতে থাকতে দাদার জন্য কন্যাদায়গ্রস্ত পিতার মত পাত্রদায়গ্রস্ত আত্মীয় আমরা ভুগেছি। দাদার পছন্দের কথা শুনে বাবা বললেন, মেয়ের বাবা কি করে, বাড়ির অবস্থা কিরকম, ভাইয়েরা কি করে, এইসব না জাইনা বিয়া করার জন্য লাফাইলে চলবে?

হাসিনা তার বোনের বাড়িতে থেকে লেখাপড়া করত, তার বোনের স্বামী ছিল রেলওয়ে ইস্কুলের মাস্টার। সেই রেলওয়ে ইস্কুলে ছোটবেলায় হাসিনাও পড়ত, নাফিসাও পড়ত। মুমিনুন্নিসায় হাসিনা মানবিক বিভাগে, নাফিসা অমানবিকে অর্থাৎ বিজ্ঞানে, আমার সঙ্গে। নাফিসাই একদিন দূরে টিনের চালায় ক্লাস করা হাসিনার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল, মানবিকে পড়া মেয়েদের সঙ্গে অমানবিকের মেয়েদের দেখা হয় না বড়। হাসিনার সঙ্গেও দেখা হত না। সেই হাসিনা, ডাগর চোখের হাসিনা আমার দাদার বউ হবে! বাহ! যা আমার জানা ছিল না, নাফিসার কাছ থেকেই জানি, হাসিনার বাপ নেই, মা আছে। কিছু ভাই আছে, কিছু বোনও। এটুকু ছাড়া আর বেশি তথ্য আমি বাড়িতে জানাতে পারি না। দাদা খবর নিয়ে আরও তথ্য যোগাড় করে জানালেন, ফুলপুর শহর থেকে মাইল দশেক ভেতরে অর্জুনখিলা গ্রামে মেয়ের মা থাকেন, ভাই একজন চাকরি করে ফুলপুর শহরে, আরেকজন ময়মনসিংহ শহরে, খুব বড় কোনও চাকরি নয়, কিন্তু চাকরি। খেয়ে পরে চলে যায়। আরেক ভাই টুডাইল্যা, গ্রামে বসে আছে, বড় বোন যার বাড়িতে মেয়ে থাকত,তার নাম কুসুম। কুসুমের দু ছেলে। সম্প্রতি স্বামী ত্যাগ করে এক বিবাহিত লোকের সঙ্গে ভেগে গেছে, বিয়েও হয়েছে সে লোকের সঙ্গে। দ্বিতীয় বোন, পারভিন। অবশ্য পারভিনকে ছোটবেলায় পালক দেওয়া হয়েছিল ওর নিজের ফুফুর কাছে। ফুফুকেই মা বলে ডাকে পারভিন, আর নিজের মাকে ডাকে মামি বলে। পারভিনের ভাসুর হচ্ছেন স্বয়ং আমানুল্লাহ চৌধুরি, ছোটদার চাকরির মামাচাচা। তথ্য বাবা শোনেন, কিন্তু তথ্য পছন্দ হয় না। মেয়ে সুন্দরী, মেয়ে মুমিনুন্নেসায় বিএ পড়ে, এ জেনেও বাবা মখু ভার করে থাকেন। মেয়ের বাবাভাই ধন সম্পদ করেনি, নামও নেই শহরে, ঠিক আছে, কিন্তু মেয়ের বড় বোন স্বামী ছেড়ে দিয়ে অন্য লোকের সঙ্গে চলে গেছে, এই জিনিসটি বাবাকে খোঁচাতে থাকে। এই জিনিসটি যে দাদাকে খোঁচায় না তা নয়, কিন্তু সুন্দরী মেয়ের যে আকাল দেশে, এ মেয়ে নাকচ করে দিলে তিনি আশংকা করেন পৃথিবীতে সুন্দরী বলতে আর কিছু অবশিষ্ট থাকবে না।

দাদাই যা আছে কপালে বলে ঠায় বসে রইলেন, বিয়ে এ মেয়েকেই করবেন তিনি। বাবাকে অহর্নিশি বলতে থাকেন মা, রাজি হইয়া যান, এহন যদি বিয়া না হয় নোমানের, জীবনে হয়ত আর হইবই না। বাবাকে বলে কয়ে না থেকে নিমরাজি করার পর পর ই দাদা তারিখ নিয়ে বসলেন। ডিসেম্বর মাসের চার তারিখে বিয়ে। নাওয়া খাওয়া ছেড়ে তিনি দৌড়ে দৌড়ে কেনাকাটা শুরু করলেন। বাড়ি সাজানোর যা বাকি ছিল, সেরে ফেললেন। আমার জন্য হলুদ, ইয়াসমিনের নীল আর গীতার জন্য সবুজ রঙের কাতান শাড়ি কিনলেন, বিয়েতে পরার জন্য। গায়ে হলুদ এ পরার জন্যও সবাইকে লাল পাড় হলুদ শাড়ি দিলেন। সাজানো কুলো থেকে শুরু করে, মেয়ের জন্য শাড়ি কাপড় প্রসাধন, কেবল মেয়ের জন্যই শাড়ি নয়, মেয়ের মা নানি দাদি ইত্যাদি সবার জন্যই সব কেনা হল। সবকিছুর টাকা অবশ্য বাবা দিচ্ছেন। বিয়ের অনুষ্ঠানের যাবতীয় খরচ বাবাকেই পোষাতে হবে, যেহেতু তিনি বাবা। শখের জিনিসপাতির খরচ দাদার পকেট থেকে। যেমন পৃথিবীতে সব চেয়ে সুন্দর বউভাতের নিমনণ্ত্র পত্র করার ইচ্ছেয় তিনি মখমলের লাল কাপড়ে নিমন্ত্রণপত্র নয় নিমনণ্ত্র কাব্য লিখে আনলেন, শিল্পী দিয়ে হাতে লিখিয়ে। একটি লাল সুসজ্জিত সুঅঙ্কিত লম্বা কৌটোয় মখমলের কাপড়টি থাকবে, কাপড়ের দুদিকে ঝুনঝুনিঅলা রুপোর কাঠি। নিমনণ্ত্র কাব্যটি পড়তেও হয় রাজাবাদশাদের কাছে পাঠানো ফরমান পড়ার মত। দাদার মাথা থেকে আরও নানা সুড়সুড় করে আরও শিল্প বেরোচ্ছে, নিজের ঘরখানা রাজাবাদশাহদের ঘরের মত সাজিয়েছেন। বিয়ের খাট সাজানোর জন্য শহরের সেরা শিল্পীদের বলে রেখেছেন। কয়েকহাজার গোলাপ আর চন্দ্রমল্লিকায় খাট সাজানো হবে। লাল কার্পেট পেতে দিতে হবে কালো ফটক থেকে ঘর অবদি। বাবার কাছ থেকে মোটা টাকা নিয়ে বউএর জন্য লাল বেনারসি আর প্রচুর সোনার গয়না দাদা নিজে ঢাকা গিয়ে কিনে আনেন। বিয়ের বাজার সারতেই মাস কেটে যায়।

গায়ে হলুদের দিন আমরা, আমি, রুনুখালা, ইয়াসমিন, ছোটদা, গীতা ফুলপুরের অর্জুনখিলা গ্রামে গিয়ে হাসিনার গায়ে হলুদ লাগিয়ে আসি। সাজানো কুলোয় সাজিয়ে নিই হাসিনার জন্য হলুদ শাড়ি, আর মুখে মাখার সপ্তবণর্ রং। কুলোর পেছনে বত্রিশ রকমের মিষ্টির প্যাকেট। পরদিন দাদার গায়েও হলুদ। দাদা শীতল পাটিতে বসে থাকেন বারান্দায়। আত্মীয়রা দাদার মুখে হলুদ লাগান। সেই শীতল পাটিটি আবার চারজনে ধরে বিছাতে হয়। চারজনের একজন হয়ে প্রচণ্ড উৎসাহে যখন আমি পাটির এক কোণ ধরি, রুনুখালা দৌড়ে এসে আমার হাত থেকে কোণ কেড়ে নিয়ে বললেন, তর ধরা যাবে না।

কেন ধরা যাবে না?

কারণ আছে। পরে বলব।

আমি পাটি ছেড়ে দিয়ে ঘরে ম্রিয়মান বসে থাকি। কেন শীতল পাটিটি আমার ধরা যাবে না,এই প্রশ্ন মন থেকে দূর হয় না। রুনুখালা পরে বললেন, তর তো মিনস হইছে, তাই।

কে কইছে হইছে? হয় নাই ত!

ও আমি ভাবছিলাম, হইছে।

হইলেই বা কি? যদি হইত!

ওইসময় শরীর পবিত্র থাকে না। আর বিয়ে শাদির সময় খুব পবিত্র হাতে সবকিছু ধরতে হয়।

শুভ কাজে অশুভ জিনিস দূরে রাখতে হয়।

ও এই কথা!

মাকে ডেকে বলি, মা ওইগুলা হইলে নাকি গায়ে হলুদের পাটি ছোঁয়া যায় না?

মা বললেন, নাপাক শইলে না ছোঁয়াই ভাল।

না ছোঁয়াই ভাল কেন? ছুঁইলে কি হয়?

কি হয় ছুঁইলে মা তা বলেন না, মার ব্যস্ততা বিষম। ঝুনুখালা বলেন, অমঙ্গল হয়। কি রকম অমঙ্গল তা জানতে চেয়েছি, উত্তর পাইনি। বাড়ির পেছনে বাড়ি জীবনদের, জীবনের বিয়ের সময় দেখেছি শীতলপাটির তলে পান সপুারি রাখছেন জীবনের মা, পান সপুারির প্রয়োজন কি তা আমার বোঝা হয়নি। জীবনের বিয়ের পুরো অনুষ্ঠানটিই আমার দেখা হয়েছে, বরের সামনে আয়না ধরে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল কি দেখছেন, আয়নায় জীবনের সুন্দর মুখটি, বরের মখু থেকে কথা বেরোয় না, একজন বলে দিল বলতে চাঁদমখু । এরকমই নাকি নিয়ম। নিয়মগুলো আমার অদ্ভুত লাগে। ডলি পালের বোনের বিয়েতে গিয়েছিলাম, ওখানে আগুনের চারদিকে পোতা হয়েছিল চারটি কলাগাছ, কলাগাছের চারপাশ দিয়ে বরবউকে সাত পাক দিতে হল, সারাদিন উপোস থাকা মেয়ে ক্লান্ত শরীরে পাক দিচ্ছিল। জীবনের গায়ে হলুদের দিন রং খেলা হয়েছিল, খেলা শুরুর সঙ্গে সঙ্গে আমি পালিয়ে বাড়ি চলে এসেছি, রঙ খেলার সময় ছুটোছুটি দাপাদাপি আমার স্নায়ুকে বিকল করে দেয়। একইরকম মাহবুবার বোনের গায়ে হলুদের দিন, ওখানেও বরের এক বন্ধু আমাকে রঙ দিতে নিয়েছিল, আমি ছিটকে সরে আসি, দৌড়ে বেরিয়ে যাই বাড়ি থেকে, আমার কেবলই মনে হয় রঙের উদ্দেশ্য বুঝি গায়ে হাত দেওয়া। মাহবুবা আমার চলে যাওয়া দেখে অবাক হয়েছে। নিজেকে আলগোছে বাঁচিয়ে চলি আমি, ছুটোছুটি দাপাদাপি কাড়াকাড়ি এসবে আমার বড় ভয়।

দাদার গায়ে হলুদে বাড়ির মেয়েরা সব হলুদ শাড়ি পরি। যারাই এসেছে বাড়িতে, এসেছে হলুদ শাড়ি পরে। নানি অবশ্য হলুদ শাড়ি পরেননি। তিনি শাদা শাড়িতেই দাদার মুখে হলুদ লাগিয়ে মাথায় হাত দিয়ে বলেছেন, সুখী হইও দোয়া করি। নানির কাছে সখু জিনিসটির মূল্য অনেক, মার কাছেও। ছোটদা দূরে আছেন কিন্তু সুখে আছেন এই জিনিসটি ভেবে মা ছোটদার না থাকার কষ্টকে সান্ত্বনা দেন। বাড়ি ভরে গেল হলুদে, হলুদ শাড়িতে, মিষ্টিতে, উৎসবে। নানিবাড়ির সবাই এল, সবাই দাদার শরীরে হলুদ মেখে দিল। হাসিনার বাড়ি থেকে লোক এসে হলুদ দিয়ে গেল দাদার গালে কপালে। দাদাকে বড় নিরীহ দেখতে লাগছিল। হাসিনার আত্মীয়রা পেট পুরে পোলাও মাংস খেয়ে বিদেয় হল। শ্বশুরবাড়ির লোক না হলে ঠিক ঠিকই দাদা চাষাভুষো লোকগুলোকে আনকুথ বলে গাল দিতেন।



এরপর তো বিয়ের ধুম। কালো ফটকের সামনে গাছপাতা ফুলপাতায় চমৎকার একটি প্রবেশদ্বার বানানো হয়েছে। বাবার বন্ধুদের গাড়ি ধার করে বাবা, আমরা ছোটরা, দাদার বন্ধুরা গেলাম অর্জুনখিলায়। দাদার মত নিলাজ লোক মুখে রুমাল চেপে বসে রইলেন, মাথায় টোপর, পরনে শাদা শেরওয়ানি, শাদা পাজামা, শাদা নাগরা। বাইরে শামিয়ানার তলে বসে কাজীকে কবুল বললেন, ভেতর ঘরে হাসিনা কাজীর সামনে একই কথা বলল, কবুল। মেয়েদের অবশ্য অমুক লোকের অমুক পুত্রের সঙ্গে এত টাকা দেনমোহরে বিবাহ করিতে রাজি আছ কি না জিজ্ঞেস করার সঙ্গে সঙ্গে কবুল বলা শোভন দেখায় না, কিছুক্ষণ হু হু করে কাঁদতে হয়, কেঁদে কেটে ক্লান্ত হলে মা খালাদের কিছু ঠেলা গুঁতো খেয়ে শব্দটি উচ্চারণ করতে হয়। হাসিনা খুব একটা সময় নেয়নি কবুল বলতে। হাসিনার কবুল বলা মানে বিয়ে ঘটে যাওয়া। এবার বিদায় নেবার পালা। হাসিনার মা বাবার হাতে মেয়ে সমপর্ণ করলেন। আমি অবাক হয়ে সব কাণ্ড দেখছিলাম, বিয়ের এমন সব কাণ্ড এত কাছ থেকে আমার আগে দেখা হয় নি। ফুলে সাজানো গাড়িতে দাদা বউ নিয়ে বসলেন, দুপাশে আমি আমি ইয়াসমিন, পেছনের গাড়িতে বরযাষনী। দাদা সব কিছুর নীল নকশা আগে থেকেই এঁকে রেখেছিলেন। নীল নকশা অনুযায়ী আমরা গাড়ি থেকে নেমে দৌড়ে ঢুকলাম বাড়িতে বরবধূর গৃহপ্রবেশ অনুষ্ঠান জমকালো করতে, কুলো থেকে ফুলের পাপড়ি ছিটোতে বরবধূর গায়ে। কুলো হাতে নিয়ে ফুল ছিটোচ্ছি লাল কাপের্টের কিনারে দাঁড়িয়ে। ওদিকে বাবা লোক খুঁজছেন বউ বরণ করার জন্য। মা দাঁড়িয়ে ছিলেন খোলা দরজার সামনে বরবধূ বরণ করতে। সারাদিন বাড়িতে বসে অপেক্ষা করছিলেন তিনি এই ক্ষণটির। মার পাশে দাঁড়িয়েছিলেন বাবার বন্ধুদের বউ। মাকে দরজার সামনে থেকে তুমি সর, দূরে যাও, দূরে যাও বলে কনুইয়ের ধাক্কায় সরিয়ে বাবা এম এ কাহারের ছোটভাই আবদুল মোমিনের বউকে বিগলিত হেসে বললেন, ভাবী আসেন আপনে, আমার ছেলে আর ছেলের বউরে বরণ করেন। মা পেছনে পড়ে রইলেন, ধনী আবদুল মোমিনের সোনার গয়নায় মোড়া বউটি ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে দাদার আর লাল ঘোমটা মাথার নতমখু হাসিনার গলায় ফুলের মালা পরিয়ে বরণ করলেন। রুনুখালা অবাক তাকিয়ে বললেন, আশ্চর্য, বাড়িতে মা তার ছেলে আর ছেলের বউরে ঢোকালো না! ঢোকালো অন্য কেউ! রুনুখালা সরে যান দৃশ্য থেকে। দাদার কিনে দেওয়া না-কাতান শাড়ি পরে পুত্রবধূসহ পুত্রের গৃহপ্রবেশ অনুষ্ঠানে ভিড়ের পেছনে দাঁড়িয়ে মা বিড়বিড় করে দোয়া পড়েন দাদা আর দাদার বউএর সুখী জীবনের জন্য।

দাদার সাজানো ঘর, বিছানায় ছড়ানো লাল গোলাপের পাপড়ি, ওর মাধ্যে লাল বেনারসি পরা বউ বসেছে। দাদা এঘর ওঘর করেন। দাদাকে দেখে আগের দাদাই মনে হয়, কিন্তু আবার ভাবি এ দাদা আগের দাদা নয়, এ বিবাহিত দাদা। ঠোটেঁ একটি কাঁপা কাপাঁ বিব্রত হাসি লেগে থাকে দাদার। রাতে সোফায় বসে পা নাড়ছিলেন তিনি, বাবা অন্যদিনের মতই বললেন, অনেক রাত হইছে, যাও শুইয়া পড় গিয়া। দাদা শুতে যাবেন তাঁর ঘরে, আগের রাতেও একা শুয়েছেন, আজ তাঁর বিছানায় আরেকজন, যার সঙ্গে তাঁর আলাপ হয়নি, প্রেম হয়নি। আমি ভাবছিলাম কি কথা বলবে দুজন! দুটো অচেনা মানুষ! ইচ্ছে করে দাদার ঘরের দরজায় কান পেতে শুনি কী হচ্ছে ভেতরে! দাদা যদি বউএর কোনও খুঁত আবিষ্কার করেন এই রাতে, তবে আবার রাতেই সোফায় এসে বসে থাকেন কি না। অনেক রাত অবদি বিষম কৌতূুহলের যনণ্ত্রায় আমার ঘুম হয় না।

সকালে দাদা বেরোলেন আগে, পেছন পেছন হাসিনা। দাদার লজ্জা লজ্জা মখু , পেছনে হাসিনার নির্লজ্জ হাসি। বাড়ির সবার চোখ দুজনের মুখে।

ছোটদা চোখ নাচিয়ে বললেন কী বৌদি, নাকের ফুল খুলছিলা রাতে?

হাসিনা খসখসে গলায় বলল কিছু হয় নাই তো।

জিজ্ঞেস করি, নাকের ফুল খুলতে হয় কেন?

হাসিনা আমার পিঠে খোঁচা মেরে বলল, বিয়ের রাতে খুলতে হয়।

কেন খুলতে হয়?

জানো না?

না তো!

ওইগুলা হওয়া মানেই নাকের ফুল খোলা।

ওইগুলা কোনগুলা?

হাসিনা জোরে হাসল।

নিজেকে খুব বোকা মনে হয় আমার। হাসিনা খুব সহজে সহজ হয়ে যায়। ছোটদা বয়সে অনেক বড় হলেও ছোটদাকে দিব্যি নাম ধরে ডাকতে শুরু করেছে। গীতাকেও। অবলীলায় তুমি সম্বোধন করছে। সে বড় বউ বলেই নাকি দাদার যারা ছোট, তাদের তার ছোট হিসেবে বিবেচনা করতে হবে। হাসিনাকে অবাক হয়ে দেখি, আমার মনে হয় না মুমিনুন্নিসা কলেজে পড়া এটি সেই মেয়ে, যে মেয়েটিকে দূর থেকে দেখতাম হাঁটছে চত্বরে, নাফিসার সঙ্গে হাতে হাত ধরে।

আনুর মা, বাড়ির নতুন কাজের মহিলা, বালতিতে পানি নিয়ে ঘর মুছতে এল, বললাম, দেখছ নতুন বউরে?

বউএর শইলে তো গোসত নাই।

তা ঠিক, হাসিনার শরীরে মেদমাংসের অভাব, আমার যেমন।

আর বউ তো সকালে গোসলও করল না, কাপড়ও লাড়ল না !

কেন, এই শীতের সময় সকালের ঠাণ্ডা পানিতে কেউ কি গোসল করে নাকি!

হ। সকালে ঘুম থেইকা উইঠাই গোসল কইরা,শইলের কাপড় ধইয়া পরে ঘরে যাইতে হয়।

কেন, দুপুরে গোসল করলে হয় না? আর কাপড় না ধইলে হয় না?

আনুর মা সজোরে মাথা নাড়ে, নিশ্চিত কণ্ঠে বলে, না।

কৌতূুহল আমাকে গ্রাস করছে। হাসিনাকে বলি, কী নাকি গোসল করতে হয়, আর কাপড় ভিজাইতে?

হাসিনা বলল, ওইগুলা হইলে হয়।

ওইগুলা কোনগুলা?

হাসিনা এবারও জোরে হাসল। আমার জানা হল না ওইগুলা কোনগুলা। হাসিনা আর আমি যদিও মুমিনুন্নিসা কলেজে এক বর্ষেই পড়েছি, তাকে আমার মোটেও বান্ধবী গোছের কিছু বলে মনে হয় না, বরং দাদার বউ বলেই মনে হয়। দুদিন পর বউভাতের অনুষ্ঠান। দাদা সকাল থেকে বিসমিল্লাহ খাঁর সানাই চালিয়ে দিয়েছেন ক্যাসেটে। এক পাশ শেষ হলে সঙ্গে সঙ্গে উল্টো দিয়ে যান ক্যাসেট, সানাই বেজে চলে সারাদিন। সপুুরুষ দাদা দামি স্যুট পরেছেন, পায়ে বিদেশি জুতো, মেইড ইন ইটালি। মাঠে বিশাল শামিয়ানার নিচে টেবিল চেয়ার পেতে দেওয়া হয়েছে। ভেতরের উঠোনেও। টিনের ঘরের পাশে বিশাল গতর্ খুঁড়ে বাবুর্চিরা বিশাল বিশাল পাতিলে বিশাল বিশাল চামচে নেড়ে নেড়ে পোলাও মাংস রান্না করছে। হাসিনা বউভাতের নতুন শাড়ি পরে বিছানায় মাথা নুইয়ে বসে আছে। অতিথি আসছে উপহার নিয়ে, অতিথি বলতে আত্মীয় স্বজন, দাদার বন্ধু বাবার বন্ধু ছোটদার বন্ধু, আমার আর ইয়াসমিনের কিছু বান্ধবী। কেউ একজন কাগজে লিখে রাখছে উপহারদাতা বা দাষনীর নাম উপহারগুলো এক কোণে জমিয়ে রাখছে। অতিথিরা বউএর মখু দেখে এক এক করে খেতে চলে যাচ্ছে; পুরুষেরা মাঠে, মেয়েমহিলা উঠোনে। দুপুর থেকে বিকেল অবদি এই চলে। ভিড়ের মধ্যে আমার হাঁসফাঁস লাগে। রাত্তিরে ভিড় কমে আসে। তখন উপহার খোলার পালা। কাচের বাসনপত্র, পিতলের কলস, ঘড়ি, শাড়ি, সোনার গয়না ইত্যাদি উপহারে ঘর ভরে ওঠে। দাদা উপহারগুলো নিয়ে নিজের ঘরে গুছিয়ে রাখেন।



মাস গেলে হাসিনা আমার কাছে তার একটি সমস্যার কথা বলতে আসে। সমস্যাটি এক আমার কাছে ছাড়া আর কারও কাছে বলা যাবে না। সমস্যাটি কি? হবু ডাক্তার কান পাতে।

বিয়ের প্রথম প্রথম স্বামী স্ত্রীর মিলনের সময় আমি একটা জিনিস পাইতাম, সেইটা আজকাল আর পাইনা।

মিলন শব্দটি শুনে কান লাল হয়ে ওঠে। কানকে আমি যথাসম্ভব বাদামিতে ফিরিয়ে বলি,—কি জিনিস পাইতা?

একটা তৃপ্তি।

আগে পাইতা এখন পাও না, কেন?

তাই তো আমার জিজ্ঞাসা, পাই না কেন?

ইন্টারকোসর্ হইলে তো মেইল অরগান থেকে মানে টেসটিসের পেছন দিকের কয়েল্ড টিউব এপিডিডাইমিস থেকে ভাস ডিফারেন্স হয়ে স্পার্ম চলে যায় ব্লাডারের ওপর দিয়ে ব্লাডারের পেছনেই সেমিনেল ভেসিক্যাল নামের গ্ল্যান্ডে, সেমিনেল ভেসিকেলে সেমিনেল ফ্লুইডএর সাথে মিক্সড হয়ে সিমেন ফর্ম কইরা স্পার্ম ইউরেথ্রা দিয়া পাস করে।

আমি একটি কলম নিয়ে শাদা কাগজে ছবি এঁকে স্পার্মের গতি প্রকৃতি বুঝিয়ে দিই হাসিনাকে। এই হল টেসটিস, এই সেমিনাল ভেসিক্যাল, ভাস ডিফারেন্স, এই হল ইউরিনারি ব্লাডার, এই প্রসটেট, এরপর তীর চিহ্ন দিই ইওরেথ্রার দিকে।

হাসিনার খসখসে কণ্ঠটি তেতে ওঠে, তা তো বুঝলাম, কিন্তু আমি বলতাছি তৃপ্তির কথা, পাই না কেন!

হাতে কলম আমার, কলমটি দ্রুত নড়ে, কলমটি একবার গালে, একবার চিবুকে, একবার চুলে।

ইজাকুলেশন কি হয়?

বিছানায় পা ঝুলিয়ে বসে পা নাড়তে নাড়তে নিজের কর্কশ কণ্ঠটি থেকে চেষ্টা করে ফিসফিস আওয়াজ বের করতে ,পারে না। যে কোনও শব্দই তার গলা থেকে ঢোল বাজিয়ে বের হয়। কেউ যেন আচমকা ঘরে না ঢুকে এই গোপন কথা না শোনে, শব্দও যেন ঘরের বাইরে কম যেতে পারে, ভেতর থেকে ছিটকিনি এটেঁ দিই দরজায়।

ইজাকুলেশন কি?

সিমেন সিক্রেশান।

সিমেন কি?

কও কি? সিমেন বুঝো না? মেইল অরগানের যে সিক্রেশান, সেইটারে সিমেন বলে।

ওইটা হয়।

তাইলে ত কোনও অসুবিধা দেখতাছি না।

হাসিনা হতাশার শ্বাস ফেলে চলে যায়। চিকিৎসাবিদ্যার বই ঘেঁটে হাসিনার প্রশ্নের কোথাও কোনও উত্তর আছে কি না খুঁজি। সেক্সুয়াল রিলেশান সম্পর্কে যত কথা আছে সব সারারাত ধরে পড়ে পরদিন বিনে পয়সায় ডাক্তারির উপদেশ দেওয়ার জন্য তাকে ডাকি। হাসিনা দৌড়ে আসে উপদেশ লুফে নিতে। যত লজ্জা ছিল ঝেঁটিয়ে বিদেয় করে আমি যেন দাদার বোন নই, হাসিনাার ননদ নই, একজন ডাক্তার কেবল, এভাবে জিজ্ঞেস করি,— আচ্ছা, তোমার স্বামীর কি ইরেকশান হয়?

তা হয়। হবে না কেন?

তোমার কি ভ্যাজাইনাল সিক্রেশান হয়?

ভ্যাজাইনাল সিক্রেশান মানে কি?

মানে তোমার ভ্যাজাইনা থেকে কি কিছু নির্গত হয়?

হ। সেইটা হয়।

প্রিম্যাচিয়র ইজাকুলেশন হয় কি? মানে ইরেকশানের পরই সিমেন বার হয় কি?

না না সেইরকম কিছু হয় না। টাইম তো অনেকক্ষণ নেয়। বরং আগের চেয়ে বেশি। কিন্তু তৃপ্তি পাই না।

তোমার কি ডিসপেরিনিয়া আছে? মানে কপুলেশানের সময় কি তোমার পেইন হয়? না।

ভ্যাজাইনিসমুস আছে কি? মাসল স্পাসম বেশি হওয়ার কারণে তা হয়। অথবা হাইপোথাইরোডিসম থাকলে সেক্সুয়াল ডিসফাংশান হইতে পারে।

তা তো জানি না, সব আগের মতই আছে, খালি এই দু সপ্তাহ হইল এই সমস্যা হইতাছে।

শুন, হাইপোথ্যালামাস নামে একটা জিনিস আছে, সেইটা ব্রেইন এর থার্ড ভেন্ট্রিক্যালের লোয়ার পাটের্ থাকে। এই হাইপোথ্যালামাসের সঙ্গে পিটিউটারি গ্ল্যান্ডের কানেকশান আছে। বাদ দেও, তোমারে সংক্ষেপে বলি, গোনাডোট্রপিন রিলিজিং হরমোন হাইপোথ্যালামাস থেইকা আইসা পিটিউটারি গ্ল্যান্ডরে স্টিমুলেট কইরা লিউটিনাইজিং হরমোন আর ফলিকল স্টিমুলেটিং হরমোন সিত্রে²ট করাচ্ছে। লিউটিনাইজিং হরমোন আবার টেসটিসের লেইডিগ সেলকে স্টিমুলেট করে টেস্টোস্টেরন রিলিজ করাচ্ছে। ওদিকে ফলিকল স্টিমুলেটিং হরমোন সেমিনিফেরাস টিবিউলসের সেলকে স্টিমুলেট করছে। এইভাবে স্পার্ম ডেভেলপ হচ্ছে। এসবের কোনও ফাংশানে যদি এবনরমালিটি দেখা দেয় তাইলে সেক্সুয়াল ডিসফাংশান হবে।

ডিসফাংশানের কিছু নাই। সব ফাংশান ঠিক আছে।

ঠিক থাকলে অসুবিধা কোথায়?

মিলনের সময় যে ফিলিংস, সেইটা পাইতাছি। কিন্তু একটা তৃপ্তি আসে একসময়, সেইটা আসতাছে না।

পার্থক্যটা কি?

মিলনের সময় একটা সুখ পাই। আর ওইটার সময় আরেক রকম। মিলন হওয়া আর ওইটা পাওয়া এক না।

তোমার পার্টনারও কি পায় না, যা পাওয়ার কথা বলতাছ?

আরে সে তো পায়ই।

সে পাইলে তুমি পাইবা না কেন?

তার পাওয়া আর আমার পাওয়া এক না।

এক হবে না কেন? জিনিসটা তো দুইজনের ব্যাপার।

এক না তো বললাম।

এইটা কোনও কথা হইল, এক হবে না কেন? ইরেকশান হইতাছে, এইদিকে ভ্যাজাইনাল সিক্রেশান ঠিক আছে। তার মানে হরমোনের একটিভিটিসগুলা ঠিক আছে। প্রিম্যাচুয়র ইজাকুলেশনও হয় না। তাইলে তো আমি কোনও সমস্যা দেখতাছি না।

আছে সমস্যা। কোথাও নিশ্চয় কোনও সমস্যা আছে। তা না হইলে আমি ওইটা পাইতাছি না কেন?

আবারও বই ঘেঁটে নতুন কিছু উদ্ধার করা আমার পক্ষে সম্ভব হয় না।

হাসিনা আশা ছেড়ে দিয়ে বলে, আমাকে গাইনির ডাক্তারের কাছে নিয়া চল।

হাসিনাকে গায়নোকলোজির অধ্যাপক, চরপাড়ায় নিজস্ব চেম্বারে রোগী দেখেন, আনোয়ারুল আজিমের কাছে নিয়ে যাই। ডাক্তারের সঙ্গে সে একা কথা বলে অনেকক্ষণ। বেরিয়ে আসে সমাধান-পাওয়া-হাসি মুখে নিয়ে।

জিজ্ঞেস করি, কি বলল ডাক্তার?

হাসিনা হাসল, দেঁতো হাসি সারা মুখে, রহস্যের এক পুকুর জলে টুপ করে ডুব দিয়ে বলল, তুমি বুঝবা না।
 
১৪. সুরতহাল রিপোর্ট


তৃতীয় বর্ষের ক্লাস শুরু হয়ে যায় আমার। এই বষের্ বিষয়গুলো তেমন কঠিন কিছু নয়। ফার্মাকোলজি আর জুরিসপ্রুডেন্স। তবে পাশাপাশি সার্জারি মেডিসিন গায়নোকলজির ক্লাসও হচ্ছে, কেবল ক্লাস নয়, হাতে ধরে শেখা, টিপে টুপে চেপে চুপে শেখা, ঘাঁটাঘাঁটি করে শেখা। বর্হিবিভাগেও রোগী পড়তে যেতে হচ্ছে। চক্ষু কণর্ নাসিকা দন্ত যৌন চর্ম ইত্যাদি নানা বিভাগে কেবল ঢুঁ নয়, ওখানেও ঘাঁটাঘাঁটি। একা থিওরেটিক্যাল নলেজ এ কচু হবে, প্র্যাকটিক্যাল নলেজই হল আসল। মেডিকেল কলেজের ল্যাবরটরি হচ্ছে হাসপাতাল, এই ল্যাবরটরির জিনিসগুলো হচ্ছে মানুষ,শবব্যবচ্ছেদ কক্ষের মরা-মানুষ নয়, জীবিত মানুষ। তোমার আমার মত মানুষ। সারি বেধে বিছানায় শুয়ে থাকা, বিছানা না পেলে মেঝেয় শুয়ে থাকা মানুষ, ককাতে থাকা, কাতরাতে থাকা,গোঙাতে থাকা চেঁচাতে থাকা, ঝিম মেরে থাকা, হাতে স্যালাইন পায়ে স্যালাইন মুখে অক্সিজেনের নল মাথার কাছটা উঁচু করে রাখা বিছানায় চোখ উল্টো পড়ে থাকা মানুষ। এদের কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করতে হবে, কি কষ্ট, কবে থেকে কষ্ট, কি রকম সেই কষ্টের চেহারা, ঠিক কোথা থেকে শুরু হয়, কখন শুরু হয়,কোথায় কখন শেষ হয়, আগে এরকম কোনও কষ্ট উদয় হয়েছে কি না, এই কষ্ট ছাড়া আর কোনও কষ্ট আছে কি না কোথাও, আত্মীয় স্বজনের কারও এই কষ্ট আছে কি না, কখনও ছিল কি না ইত্যাদি ইত্যাদি। ইত্যাদি তথ্য নথিবদ্ধ করার পর আমাকে খালি চোখে দেখতে হবে কষ্টের জায়গাটি দেখতে কেমন, হাত দিতে হবে জায়গাটিতে, হাত দেওয়ারও নিয়ম আছে, সবগুলো আঙুলের মাথা দিয়ে চেপে চেপে এক কোণ থেকে আরেক কোণে যেতে হবে,অনুভব করতে হবে ঠিক কি রকম এই কষ্টের জিনিসটি, একটি গোলআলুর মত নাকি একটি তরমুজের মত এর আকৃতি, আমাকে অনুভব করতে হবে আশে পাশে নড়ছে কি না নাকি জগদ্দল পাথরের মত স্থির হয়ে আছে জিনিসটি, হাতে চাপ দেওয়ার সময় আমার এক চোখ থাকা চাই পেটের দিকে, আরেক চোখ রোগীর চোখে, দেখতে হবে রোগী চোখ কুঁচকোচ্ছে কি না ব্যথায়, কি থেকে এই গোলআলু বা তরমুজের উৎপত্তি হল তা বুঝতে আমাকে পেটের সর্বত্র দেখতে হবে যে জিনিসগুলো আছে পেটে তা ঠিক ঠিক আছে কি না, ডানদিকে চেপে চেপে লিভার, পেটের দু কিনারে কিডনি। এরপর বাঁ হাত পেটের ওপর রেখে পেটের আগাপাস্তলা দেখতে হবে ডান আঙুলে সেই হাতের ওপর টোকা মেরে, কি রকম শব্দ আসছে, এ কি জলের শব্দ, না কি মনে হচ্ছে কোনও কাঠের ওপর বা পাথরের ওপর টোকা দিচ্ছি। এরপর পকেট থেকে স্টেথোসকোপ বের করে কানে শুনতে হবে কি রকম শব্দ আসছে, পেটের নালি থেকে ভুরুৎ ভুরুৎ শব্দ আসা মানে নালির কাজ নালি করে যাচ্ছে, শব্দ না আসা মানে কোথাও বাধা পড়েছে চলাচল, কোথায় বাধা পড়েছে, তাহলে কি এই রোগটির নাম ইনটেসটিনাল অবস্ট্রাকশান! গোলআলুর মত যে পিণ্ডটি সেটি কি নালি পেঁচিয়ে জড়ো হয়ে যাওয়া কিছু তা যদি না হয় নালির ভেতর কি মল জমে পিণ্ড তৈরি করেছে, নাকি কৃমি! কেবল এটুকু করে প্রশ্নবোধক চিহ্ন দিয়ে ডায়াগনোসিস লিখে দিলে হবে না। রোগীর মাথা থেকে পা পর্যন্ত পরীক্ষা করতে হবে। স্নায়ুতন ্ত্র ঠিক ঠিক আছে কি না, রোগীর ভেতরের সমস্ত প্রত্যঙ্গ এবং প্রণালি ঠিক কি না, হৃদপিণ্ড, ফুসফুস সব ঠিক ঠিক চলছে কি না সব। আঙুলে যনণ্ত্রা নিয়ে কোনও রোগী এলেও মাথা থেকে পা পর্যন্ত পরীক্ষা করতে হবে। সার্জারি বর্হি িবভাগে সার্জারি ক্লাস করতে প্রথমদিন ঢুকেই দেখি লুঙ্গি খোলা এক লোক বিছানায় শুয়ে আছে। বর্হিবিভাগের ডাক্তার লোকের নিম্নাঙ্গর অসখু সম্পর্কে আমাদের জ্ঞান দেবেন। অসখু টির নাম হাইড্রাসিল। পুরুষাঙ্গের নিচের থলেতে জল জমে কুমড়োর মত ফুলে উঠেছে। ডাক্তারের উপদেশ হচ্ছে ফুলে ওঠা জিনিসটিতে তাকিয়ে থাকো। আমার চোখ বার বার সরে আসে কুমড়ো থেকে। সরে আসে বলেই সম্ভবত তিনি আমাকেই ডাকেন জিনিসটি হাতে ধরে পরীক্ষা করতে, ডাক্তারের জিজ্ঞাসা কনসিসটিনসি দেখ। আমি এক পা যাই তো দু পা পেছোই। কিন্তু উপায় নেই গোলাম হোসেন! তোমাকে স্পর্শ করতেই হবে জিনিসটি। দুহাতে ধরে চেপে চুপে আমাকে বলতে হচ্ছে থলেটি নরম নাকি শক্ত বোধ হচ্ছে। এরপর হাত রেখে হাতের পিঠে টোকা দিয়ে ঢুপ্পুস ঢপ্পুুস শব্দ শুনে বলে দিচ্ছি ভেতরে জল আছে। লোকটি, বয়স ত্রিশ পঁয়ত্রিশ হবে এদিক ওদিক সরিয়ে নিচ্ছিল শরীর। একটি মেয়ে তার গোপনাঙ্গ ঘাটাছে, লোকটির জন্য ঘটনাটি অস্বস্তিকর বটে। কিন্তু লোকটিকে গা পেতে দিতেই হয়। ডাক্তার অথবা হতে-যাওয়া-ডাক্তারদের কাছে লজ্জার কিছু নেই। চর্ম ও যৌনবিভাগের বর্হিবিভাগে রোগীদেরও লজ্জা ভেঙ্গে জীবনের গোপন কাহিনী আর কারও কাছে না বলুক আমাদের কাছে বলতে হয়। যৌনবিভাগের ডাক্তার শিখিয়ে দিচ্ছেন রোগীর পেট থেকে কি করে কথা বের করতে হয়। পুরুষাঙ্গে ঘা নিয়ে রোগি এল, ডাক্তারের প্রশ্ন কি, বাইরের মেয়েমানুষের সাথে মেলামেশা করেন নাকি? রোগী প্রথম বলবে না। কোনওদিন না। মেলামেশা যা করার সে তার বউএর সঙ্গে করে, আর বউ যদি তার না থাকে তবে তো কোনওরকম মেলামেশার প্রশ্ন ওঠে না। এরপর সত্য কথা না বললে যে চিকিৎসা হবে না সে কথা স্পষ্ট জানিয়ে দিলে লোক অনেকক্ষণ সময় নেয়, মাথা চুলকোয়, ঠোঁটে একটি না হাসি না কান্না ঝুলিয়ে বড় একটি শ্বাস নিয়ে লজ্জার মাথা খেয়ে বলেই ফেলে যে সে মেলামেশা করে অর্থাৎ গণিকাসঙ্গমে অভ্যস্ত সে। ডাক্তার বলেন, লিখে দাও হিস্ট্রি অব এক্সপোজার আছে। রক্তের ভিডিআরএল করতে পাঠিয়ে দাও। লিখে দিলে লোক কাগজ হাতে নিয়ে চলে যায়। পরীক্ষার ফল নিয়ে আসার পর ওষধু লেখা হবে। যৌন বহির্বিভাগে বসে মেলামেশা শব্দটি আমাদের রপ্ত করতে হয়। এসব রোগী আমরা দূর থেকে দেখি, ছুঁতে নেই, নোংরা সংক্রামক জিনিস কখনো ছুঁতে নেই, তাই রোগীর হাওয়াও যেন শরীরে না লাগে এমন দূরে নিরাপদে দাঁড়াতে হয় আমাদের। ডাক্তার রোগীর শরীর স্পর্শ করার প্রয়োজন মনে করলে হাতে গ্লাবস পরে নেন। সিফিলিস গনোরিয়ার রোগীরা দেখতে কৎু সিত, দাঁতাল, চোখে শেয়ালের চাউনি, দেখেই বলে দেওয়া যায় যে লোকের পুরুষাঙ্গের ঘাটি সিফিলিসের ঘা। ঘরে বউ আছে এমন লোক এসে যখন চিকিৎসা নিয়ে যায়, ডাক্তার বলে দেন, বউকে নিয়ে এসে চিকিৎসা করিয়ে যেতে। তারা কথা দেয়, কিন্তু বেশিরভাগ রোগিই বউ নিয়ে দ্বিতীয়বার আসে না। তারা কথা দেয় কসম কেটে বলে জীবনে আর গণিকাসঙ্গমে যাবে না। কিন্তু এক রোগী আবারও আসে আবার সিফিলিসের ঘা নিয়ে। ঘরের নিরীহ বউদের কথা ভেবে এইসব দাঁতাল গুলোর ওপর আমার রাগ হয়। ডাক্তারকে একবার বলেও ফেলেছিলাম, এদেরকে জেলে পাঠানো যায় না? নিশ্চয়ই বউগুলো চিকিৎসাহীন থেকে থেকে নিউরোসিফিলিস বাধাঁচ্ছে। কে শোনে আমার কথা, ডাক্তারের কাজ ডাক্তারি করা। সিফিলিসের ঘা নিয়ে হঠাৎ হঠাৎ মেয়ে-রোগিও আসে। রোগ এসেছে স্বামীর কাছ থেকে। মেয়ের তো বটেই, কোলের বাচ্চার রক্ত পরীক্ষা করেও দেখা যায় ভিডিআরএল পজেটিভ। এই রোগীদের চিকিৎসা যখন দিই, সঙ্গে একটি উপদেশও জোর গলায় দিই, বদমাইশ স্বামীর সঙ্গে আপনি আর থাইকেন না। আপনের স্বামী আপনের সর্বনাশ করছে, স্বামীরে আপনি তালাক দেন। এরা আমার উপদেশ কতটা মানে তা আমার জানা হয় না, কিন্তু উপদেশটি না দিয়ে আমি পারি না।

জুরিসপ্রুডেনন্স বিভাগের বিভাগীয় প্রধান মানুষটি বাবা।তিনি ক্লাস নেন আমাদের। সকালে ক্লাস থাকলে প্রায়ই বাবা আর আমি এক রিক্সা করেই কলেজে যাই। নাম ডাকার সময় আর সবার মত বাবাকে আমিও ইয়েস স্যার বলি। আমার শিক্ষক-পিতা চমৎকার পড়ান। বাবার যে সহকারি অধ্যাপক আছেন, তিনি পড়াতে এলে অবশ্য ছাত্রছাত্রীসংখ্যা ক্লাসে থাকে হাতে গোনা। বাবাকে খুব সহজ সরল হাসিখুশি শিক্ষক হিসেবে বিবেচনা করে ছাত্রছাত্রীরা। কেউ কেউ অবশ্য বলে খুব কড়া। পরীক্ষার সময় বলা হয়, বাবা ইন্টারনাল হিসেবে খুব ভাল, নিজের কলেজের ছাত্রছাত্রীদের পাশ করাবার ব্যবস্থা করেন, কিন্তু এক্সটারনাল হিসেবে নাকি বাবা রজব আলী থাকেন না, গজব আলী হয়ে ওঠেন। বাবা রজব আলীর চেয়ে শিক্ষক রজব আলীকে আমার ভাল লাগে বেশি। বাবা প্রথম দিনই একটা কথা বললেন ক্লাসে, বললেন, পচা শামুকে পা কাটার মত লজ্জা আর নেই, জানো তো! ফরেনসিক মেডিসিনে ফেল করা মানে, পচা শামুকে পা কাটা। কাটো কাটো ইজ্জত থাকে এমন কিছুতে কাটো। সার্জারিতে ফেল কর, মেডিসিনে ফেল কর, কঠিন সাবজেক্ট, ঠিক আছে, ফেল করা মানায়। কিন্তু ফরেনসিক মেডিসিনে, মাথায় এক ছটাক ঘিলু থাকলে কেউ ফেল করে না। শিক্ষক রজব আলীর ঘরে গেলে তিনি আমাকে নির্মল একটি হাসি সহ স্বাগত জানান, বেল টিপে বেয়ারা ডেকে চা আনতে বলেন আমার জন্য। কি ক্লাস হল, কোন শিক্ষক কি পড়ালো ইত্যাদি জিজ্ঞেস করেন। আমারও চিকিৎসাবিদ্যার নানা বিষয়ে অজস্র প্রশ্ন থাকে, করি। এই বয়সেও বাবার বই পড়ার শখ মেটেনি, তিনি এনাটমি থেকে শুরু করেন মেডিসিন সার্জারি সব বইই কাছে রাখেন, সময় পেলেই পড়েন। চিকিৎসাবিদ্যার এমন কোনও বিষয় নেই যে তিনি গড়গড় করে উত্তর দিতে না পারেন। শিক্ষক বাবা পরিশ্রমী, নিষ্ঠ, শিষ্ট, মিষ্ট,বিনত, বিনম্র। শিক্ষক বাবার জন্য আমার গর্ব হয়। পোস্ট মর্টেম দেখার জন্য ক্লাসের ছাত্রছাত্রীদের যেতে হয় সূর্যকান্ত হাসপাতালের লাশকাটা এলাকায়। ওখানে ডোম লাশ কাটে, আর পাশে দাঁড়িয়ে বাবা লাশের শরীরের ভেতর বাহিরের কি কি পরীক্ষা করতে হয়, কি করে খুঁজতে হয় মৃত্যুর কারণ, ছাত্রছাত্রীদের বলে দেন। আমরা নাকে রুমাল চেপে পচে ফুলে ওঠা লাশ দেখি, বাবা আর ডোমের জন্য কোনও রুমাল দরকার হয় না। ডোম দেখলে আমার খলিলুল্লাহর কথা মনে পড়ে। খলিলুল্লাহ এরকমই ডোম ছিল, লাশ কেটে লাশের কলজে খেত সে, খবরটি ছড়িয়ে পড়ার পর মায়েরা ভূতের ভয় দেখানোর বদলে খলিলুল্লাহর ভয় দেখিয়ে বাচ্চাদের ঘুম পাড়াতে শুরু করেছে। ক্লাসের মেয়েরা যখন বলে,রজবআলী স্যার এত ভাল! আমার পুলক লাগে। পুলক লাগে যখন বাবার সঙ্গে কলেজ চত্বরে দেখা হয়, দুজনে মধুর বাক্য বিনিময় করি। অবকাশের হিংস্র বাঘ কলেজে এসে মাটির মানুষ। মুখে হাসি লেগেই থাকে, পচা শামুকের বিদ্যা বিতরণ করেন তিনি। বিদ্যা আর কি! খুনোখুনির কারবার, কী ধরণের অস ্ত্র আছে, কোন অস্ত্রে কেমন ধার, কোন দায়ে কেমন কোপ, কোন বুলেটে কেমন ক্ষত, কোনটি আত্মহত্যা, কোনটি খুন, কোনটি দুর্ঘটনা, এসব। একবার পঁচিশ বছরের এক মেয়ের দেহের পোস্ট মর্টেম দেখাচ্ছেন বাবা, খুন কি আত্মহত্যা, তা বের করতে হবে। ঘচঘচ করে দশ পনেরোদিনের মড়ার বুক চিরে ফেলল ডোম, বাবা অমন বমি আসা গন্ধের সামনে মড়ার ওপর ঝুঁকে, সামনে পেছনে ঘুরিয়ে, পরীক্ষা করে বলে দিলেন খুন করা হয়েছে। কী করে খুন? খুব সোজা। মাথায় কোপ, বাবা কোপের চিহ্ন দেখালেন। নিজের মাথার পেছনদিকে দায়ের কোপ দিতে পারে না কেউ, সুতরাং কোনও কারণেই এটি আত্মহত্যা নয়। আরেকটি মেয়েকেও, বলা হয়েছিল, গলায় দড়ি বেঁধে আমগাছে ঝুলে আত্মহত্যা করেছে, বাবা হাতে পায়ে পেটে বুকে নখের আঁচড় দেখে বললেন একে মেরে ঝুলিয়ে দেওয়া হয়েছিল। আমাদের লিখতে হয় এসবের সুরতহাল রিপোর্ট। ক্রমে পচা শামুকে আমার আগ্রহ বাড়তে থাকে। বাবা ্‌আমার এই উৎসাহে মোটেও ঘি ঢালেন না, বলেন, যেইডা কাজে লাগব সেইটা পড়, সার্জারি মেডিসিন পড়, গায়নোকলজি পড়। আমার মন পড়ে থাকে মেয়েদুটোয়, কে কোপ বসালো ওই পঁচিশ বছর বয়সী মেয়েটির মাথায়, কে-ই বা নিরীহ গ্রামের কিশোরীটিকে ফাঁসিতে ঝুলিয়েছে! দরজায় বিভাগীয় প্রধান লেখা বাবার ঘরটিতে ঢুকে মাঝে মধ্যে দেখি অল্প বয়সী মেয়েরা বসে আছে। বাবা এক এক করে পর্দার আড়ালে নিয়ে ওদের দেখছেন। মেয়েরা চলে গেলে মেয়েরা কেন এসেছিল, কী পরীক্ষা করতে জিজ্ঞেস করলে, বাবা বলেন রেপ কেইস। বাবা আগের চেয়ে অনেক সহজ আমার কাছে। খুব সহজে তিনি শরীর এবং যৌনতা বিষয়ে আমার সঙ্গে ডাক্তারি ভাষায় কথা বলেন, অবশ্য ইংরেজির আশ্রয় নিয়ে। আমার জানতে ইচ্ছে হয় কে ওই মেয়েদের ধষর্ণ করেছে, এসবের উত্তর তিনি দেন না। কারণ এসব মামলার বিষয়, ডাক্তারির বিষয় নয়।



বাবা প্রায়ই মামলার সাক্ষী হতে আদালতে যান। প্রায়ই বাবাকে খুঁজতে অচেনা অচেনা লোক আসে বাড়িতে। এরা কারা? মা বলেন,তর বাবা সাক্ষী দেয় তো। পোস্ট মর্টেমের ব্যাপারে আসে।

আমার উৎসাহ তিড়িংবিড়িং করে লাফায়। পোস্ট মর্টেমের ব্যাপারে লোকেরা বাবার কাছে আসবে কেন, বাবার সঙ্গে বারান্দার ঘরে বসে নিচু স্বরে কথা কি বলে ওরা, জানতে ইচ্ছে হয়। লক্ষ করি বাড়িতে নানা রকম জিনিস পৌঁছে দিচ্ছে অচেনা অচেনা লোকেরা। বাবা এক দুপুরে বাড়ি নেই, একটি লুঙ্গি পরা, মোচঅলা লোক এসে বলল, ডাক্তার সাইব আছে?

নাই।

আইচ্ছা, আমার পুকুরের মাছ চাইরটা রাখেন। বলে চারটে বড় রুই মাছ আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে এক অচেনা লোকটি চলে গেল।

আমি খুশিতে বাগ বাগ চারটে রুই মাছ নিয়ে দৌড়ে রান্নাঘর, মা ধর, এক বেটা মাছ দিয়া গেল।

কে দিল, চিনস?

না।

রাখলি কেন?

বাহ দিল যে।

দিলেই রাখবি?

কেন কি হইছে? মাঝে মাঝে বাবার রোগীরা ত দিয়া যায়।

আর মাছ টাছ রাখবি না। শত সাধলেও না।

মার মখু থমথম করে। মাছগুলো থেকে দুহাত দূরে সরে বলেন,এইসব মাছ খাওয়া অন্যায়।

অন্যায় কেন?

পোস্ট মর্টেমের রিপোর্ট পাল্টাইতে তর বাবার কাছে তদবির করতে আসে এইসব লোক।

আমার মাথার ভেতর ঘুরপাক খায় শতরকম ভাবনা।

কোন দল আসে? যারা অন্যায় করে, না যারা নির্দোষ?

তা জানি না।

মা কি কোনও কথা লুকিয়ে রাখছেন পেটে! মার তো লুকোনোর পেট না মোটে।

যারা নির্দোষ, তারা খুশি হইয়া কিছু দিলে ত ক্ষতি নাই, মা শ্লথবেশে শ্লথ পায়ে কলপারের দিকে যেতে যেতে শ্লেষকণ্ঠে বলেন, দুই দলই আসে।

বাবা কি মিথ্যা রিপোর্ট দেন?

তা আমি কি কইরা জানব? আমি কি কোটের্ যাই দেখতে?

মাছ শেষ পর্যন্ত রাধাঁ হয়েছে। মা ওসব ছুঁয়েও দেখেননি। বাবা খেতে বসে,পাতে মাছের বড় বড় টুকরো নিয়ে বললেন, মাছ কোথেকা পাইলা?

মা বললেন ,এক লোক আইসা দিয়া গেছে।

শুনে কেশে পরিষ্কার গলা আরও পরিষ্কার করে বাবা বলেন, মাছটায় ধইন্যা পাতা না দিলে স্বাদ হইত বেশি।

আমি তখনও ভাবছি, আত্মহত্যার পক্ষের লোকগুলো কি ঘুষ দিয়ে বাবাকে খুন বাদ দিয়ে আত্মহত্যা লিখে দিতে বলে? বাবা কি কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা ঘুষ খান। আমার কিছুতে বিশ্বাস হয় না, বাবা এমন অসৎ হতে পারেন।

কিন্তু শরাফ মামা যেদিন মার পরনে ছেঁড়া শাড়ি দেখে বললেন, এত ফকিরনির মত থাকো বড়বু। আর এইদিকে দুলাভাই ত হেভি টাকা কামাইতাছে। দেখলাম এক লোক টাকার বুন্দা দিয়া গেল। পোর্স্ট মর্টেম করে ত! এখন ত টাকার পাহাড় হইয়া গেছে। আর তোমারে একখান শাড়ি কিইন্যা দেয় না!

আমি বললাম, পোস্ট মর্টেমের রিপোর্ট মিথ্যা লেখা যায় না শরাফ মামা, হুদাই বাবারে দোষ দিও না।

শরাফ মামা কাষ্ঠহাসি ছড়িয়ে বললেন, আরে ঘুষ দিয়া ডাক্তারেরা এই চাকরি লয়, পোস্ট মর্টেম করা মানে কোটিপতি হইয়া যাওয়া। ডাক্তারের কলমের ডগায় মাইনষের জীবন মরণ।

টাকাটা দেয় কেডা?

টাকা দেয় দুই দলই। মামলায় ফাঁসছে যে, মামলা করছে যে। দুলাভাই নান্দাইল ত পুরাডাই কিনা ফেলল।

বাবার ওপর আমার ঘণৃা জন্মাতে থাকে। যে লোকটি একশ একটা মনীষীদের বাক্য আওড়ান সারাদিন, আর ছেলেমেয়েদের মানুষ করার জন্য হেন কাজ নেই যে না করছেন, আর তিনি বাদি বিবাদি দু পক্ষ থেকে টাকা নিয়ে আদালতে যাচ্ছেন!

দাদকে জিজ্ঞেস করলাম, তুমি জানো কিছু ?

দাদা বলে দিলেন, আজে বাজে কথায় কান দিস না। বাবা ঘুষ খায় না।

জানো কি কইরা ঘুষ খায় না? ওইদিন যে মাছ দিয়া গেল, মাছ ত ঘুষ ছিল।

কোন মাছ?

কোন মাছ জানো না? রুই মাছ। খাইলা ত মজা কইরা।

আহ খুব স্বাদ ছিল মাছটা। আসলে মাছটা ভুনা করলে ভাল হইত আরও।

বাবার ঘুষ খাওয়া না খাওয়ার ব্যাপারটি আমার কাছে রহস্য থেকে যায়। এত কাছের মানুষ, এক বাড়িতে জীবন যাপন, অথচ বাবাকে আমার সবচেয়ে বেশি দূরের মানুষ মনে হয়। আসলে বাবার কিছুই আমার জানা হয় না। জানি বা জেনেছি বলে মাঝে মাঝে ভুল করি। বাবা কখন কাকে কাছে টানবেন, কখন দূরে সরাবেন, আমি কেন, বাড়ির কেউ জানে না, মাও না। মা হয়ত কখনও কুঁচি কেটে শাড়ি পরে পানের রসে ঠোঁট লাল করে মিষ্টি মিষ্টি হেসে বাবার সামনে গেলেন, বাবা ধমকে মাকে সরিয়ে দিলেন। এমন অনেক হয়েছে, যে বাবার কাপড় চোপড় ধুয়ে, আলনায় ভাঁজ করে রাখলেন মা, সারাদিন ধরে ঘর ধুয়ে মুছে, বন্ধ দরজা জানালা খুলে আলো বাতাস ঢুকিয়ে, দেয়ালের কোণ থেকে খাট সরিয়ে জানালার কাছে রাখলেন, ধোয়া চাদর বিছিয়ে দিলেন বিছানায়, দিয়ে অপেক্ষা করতে লাগলেন বাবার, বাবা আসবেন, দেখবেন, ভাল লাগবে। বাবা বাড়ি ফিরে, ঘরের অবস্থা দেখে চেঁচিয়ে বলেন, আমার ঘর নষ্ট করছে কে? টেনে খাটখানা সরিয়ে আগের জায়গায় রাখেন। খটাশ খটাশ করে জানালাগুলো বন্ধ করে দেন। বিছানার চাদর একটানে সরিয়ে দেন।

আমার ঘর আমি যেমনে রাখি, ঠিক তেমন ভাবেই যেন থাকে।

মা দীর্ঘশ্বাস ফেলেন দেখে। মার কিছুই বাবার পছন্দ হয় না।

কখনও হয়ত তিরিক্ষি মেজাজ নিয়ে মা একে গাল দিচ্ছেন, ওকে গাল দিচ্ছেন। বাবা নরম গলায় ডাকলেন, ঈদুন আসো তো, কথা শুইনা যাও। ঈদুনের তখন কারও কথা শুনতে ভাল লাগছে না। বাবা আরও নরম গলায় ডাকেন ঈদুন ঈদুন।

বাবা আচমকা অসময়ে বাড়ি ঢুকে দেখলেন, আমি লেখাপড়া করছি, আর ইয়াসমিন ধুলোয় খেলছে। ইয়াসমিন তটস্থ হয়ে রইল, আমি দিব্যি নিশ্চিন্ত যে বাবা আমার মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করে দেবেন। কিন্তু বাবা আমাকেই দাঁত খিঁচিয়ে বললেন খালি বইয়ের দিকে গাধার মত চাইয়া থাকলে হইব না, মাথায় যেন ঢুকে যা পড়তাছস। আর ইয়াসমিনকে বলে গেলেন, লিচু খাইবা মা? তোমার জন্য এক্ষুনি লিচু পাঠাইয়া দিতাছি।

রহস্যে ঘেরা বাবা দূরেই থেকে যান, তাঁকে আমার চেনা হয় না, বোঝা হয় না। বাবার বিয়ের ব্যাপারটিও রহস্যময়। মা বলেন, লোকে বলে বাবা বিয়ে করেছেন রাজিয়া বেগমকে। বাবা কিন্তু কখনও রাজিয়া বেগমকে বাড়ি এনে বলেননি, এই আমার বউ। আর কখনও বাড়ি ছাড়া বাবা অন্য কোথাও রাতও কাটাননি, যখন ময়মনসিংহে থাকেন। কী করে বুঝি!

মাকে বলেছিলাম, মা এই যে কও বাবা বিয়া করছে, কই বাবা তো ওই রাজিয়া বেগমের বাড়িতে কখনও থাকে না।

রাইতে এই বাড়িতে থাকে, কারণ তর বাবা না থাকলে এই বাড়িতে চুরি হয়। যতবারই এই বাড়িতে চুরি হইছে, তর বাবা ছিল না বাড়িত। চোর খেদানোর লাইগা তর বাবা রাইতে বাড়িত ফিরে।

তাইলে রাজিয়া বেগমের বাড়িতে চোর খেদায় কে?

মা হেসে বলেন ওই বেটিরে দেখলে চোর নিজেই ডরাইব!

বাবার রহস্য যতই দেখি, ততই ইচ্ছে করে তাঁর ঘরের মতই অন্ধকার তাঁর রহস্যের চাদরখানা সরাই। মার ছোটখাট দুঃখগুলো, সখু গুলো এত চেনা, মার ঠোঁটের হাসি, বিরক্তি, এসবের কারণ এত স্পষ্ট, মা যেন পড়ে ফেলা বই, লিখে ফেলা খাতা। মা আমাকে কৌতূুহলি করে না, করে বাবা। মার ভালবাসা না চাইলেই পাওয়া যায়, বাবার ভালবাসা পেতে সাধনার প্রয়োজন। এরপরও নিশ্চিত হওয়া যায় না যে পাবই। জীবন নিয়ে অনেকটা জুয়ো খেলার মত। মার অঢেল ভালবাসা চোখে পড়ে না, বাবার দু মুহূর্তের নরম সুরের ডাক সারাদিনের জন্য মন ভাল করে দেয়।

মা বলেন মেয়েদের একটু বাবার দিকে টান বেশিই থাকে।

আমি জিজ্ঞেস করি, তাহলে কি ছেলেদের মায়ের দিকে বেশি?

মার মুখে আজকাল উত্তর নেই এর।

ছোটদা এ বাড়িতে বউ নিয়ে বেড়াতে এলে, বউ নিয়েই ঘরে শুয়ে থাকেন, অথবা বেরিয়ে যান একসঙ্গে। মার বড় শখ, ছোটদাকে পাশে বসিয়ে গল্প করেন, ছোটদার সময় নেই। বিয়ে করার পর দাদারও সময় হয় না।

বাবা যে বিষয়গুলোয় মন দেওয়ার জন্য বলেছেন, সে বিষয়গুলোর ক্লাস হয় রাতেও, হাসপাতালে। আমাকে প্রতি সন্ধেবেলা তিনি দিয়ে আসেন, আবার নিয়েও আসেন। রোগী বসে থাকে চেম্বারে, সেসব ফেলেই তিনি চলে আসেন এই কাজটি করতে। রহস্যে মোড়া বাবার ভালবাসা আমি টের পাই। তিনি আমাকে বলেন, আমি তাঁর স্বপ্ন পুরণ করছি, আমিই তাঁর মান সম্মান রাখছি, আমিই তাকে পিতা হিসেবে গৌরব দিচ্ছি। শুনে মন থেকে ঘুষের কারণে বাবার জন্য জন্মানো ঘৃণার পিণ্ডটি হৃদয় ফসকে পড়ে যায় ধুলোর রাস্তায়। আমার কষ্ট হতে থাকে বাবার জন্য। কষ্ট হতে থাকে কারণ একদিন তাঁকে বলতে হবে যে কাউকে না জানিয়ে আমি এক দাড়িঅলা লোককে বিয়ে করেছি, লোকটি লম্বায় আমার চেয়ে খাটো, লোকটি সাধারণ এমএও পাশ করেনি, কবিতা লেখা লোকটির পেশা, যে পেশায় মাসে দুশ টাকাও লোকটির আয় হয় না। কোন আবর্জনার স্তূপে ছুঁড়ে দেব বাবার মান সম্মান, বাবার গৌরব! আমি যত মনোযোগী হই লেখাপড়ায়, বাবার স্বপ্নের গোড়ায় তা জল সারের মত হয়ে চারা লকলক করে বড় হয়, বৃক্ষ হয়। যত বেশি বৃক্ষ হয়, তত আমার ভয় হয় যে নিজ হাতে এই বৃক্ষটি আমাকে উপড়ে ফেলতে হবে একদিন! দাদা বা ছোটদা কেউ বাবাকে সুখী করতে পারেনি। এক আমিই আছি সুখী করার। কিন্তু সুখের মাথায় পেছন থেকে যেদিন আমাকে কোপ বসাতে হবে! স্বস্তির গলা ফাঁস লাগিয়ে যেদিন ঝুলিয়ে রাখতে হবে! কি করে এই কাজটি আমি করব! নিজের ওপর বড় রাগ হয় আমার। বাবা যত আমাকে ভালবাসেন, তত নিজের ওপর ভালবাসা আমার উবে যেতে থাকে! বাবা আমাকে সারাপথ, মেডিসিনের লিভার সিরোসিস আজ যদি পড়ানো হয়, সেটি নিয়ে এমন চমৎকার বলতে থাকেন যে রিক্সায় বসে বাবার কাছ থেকে শুনে আমার যা শেখা হয়, সে শেখা বইপড়ে বা অধ্যাপকদের বড় বড় লেকচার শুনে হয় না। বাবার দোষগুলো আমি ছুঁড়ে দিতে থাকি গাঢ় অন্ধকারের দিকে যেন কেউ দেখতে না পায়। বাবাকে আমি বাবা বলে ডাকি না, তুমি বা আপনি কোনও সম্বোধনই করি না। তবু বাবাকেই মনে হতে থাকে আমার সবচেয়ে আপন। সম্বোধন না করার এই রোগটি বড় অদ্ভুত আমার। নানা নানি বড় মামা ফজলিখালা রুনখুালা রুনুখালা হাশেমমামা ফখরুল মামা কাউকে আমি কোনও সম্বোধন করি না। সবার সঙ্গেই কথা বলি, বলি ভাববাচ্যে। ভাববাচ্যে কথা বললে অনেক সময় কথা খোলসা করে বলা হয় না, সম্ভব নয়। আমি অনেক চেষ্টা করেছি ভাববাচ্য থেকে নিজেকে মুক্ত করতে, পারিনি। বড় হয়ে অনেকদিন ভেবেছি, কেন আমি ওঁদের সঙ্গে ভাববাচ্যে কথা বলি, কি কারণে! যখন ছোট ছিলাম, ওঁরা কি আমাকে ধমক দিতেন বা চড় কষাতেন, বা আড়ালে নিয়ে গিয়ে কান মলে দিতেন যে অভিমান করে কিছু ডাকিনি, আর না ডাকতে ডাকতে অভ্যেস হয়ে গিয়েছে না ডাকা! বড় হয়ে চাইলেও আর ডাক ফিরিয়ে আনতে পারিনি! মাকে দাদাকে ছোটদাকে সম্বোধন করি, তুমি বলি। বাবাকে চিরকালই দূরের মানুষ বলে মনে হত, বাবাকে সম্বোধন করি নি। কিন্তু নানিবাড়িতে বেড়ে ওঠা মেয়ে আমি, শরাফ মামাকে, ফেলু মামাকে ছটকুকে সম্বোধন করি, তুমি বলি। বাকিরা যাঁরা কাছে ছিলেন, তাদের কেন সম্বোধন করা হয়নি আমার, কাছে থাকলেও ওঁদের খুব দূরের মনে হত কি!

যে বিষয়গুলোকে জরুরি বলে বাবা আমাকে মন দিয়ে পড়তে বলেছেন, সেগুলোর জন্য সামনে আরও বছর পড়ে আছে বলে আমি রুদ্রে মন দিই। রুদ্র একটি নিষিদ্ধ ঘটনা আমার জীবনে, গভীর গোপন নিভৃত আনন্দ। রুদ্রর প্রতি আকর্ষণ এত তীব্র যে রুদ্রর চিঠি হাতে নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সুখের রিনরিন সুর বাজে প্রাণে, সেদিন আমি সারাদিন ভাল থাকি। ফিরে চাই স্বণর্গ ্রাম, রুদ্রর দ্বিতীয় বই, মুহম্মদ নুরুল হুদার দ্রাবিড় প্রকাশনী থেকে বের হওয়া বই। দ্রাবিড় থেকে আরও কয়েকটি বই বের হয়েছে। রুদ্রর সঙ্গে মুহম্মদ নুরুল হুদার সম্পর্কে বেশ ভাল, ভাল বলেই রুদ্র এখন হল ছেড়ে বাসাবোতে নূরুল হুদার বাড়িতে একটি ঘর ভাড়া নিয়ে থাকে। আগে ছিল সিদ্ধেশ্বরীতে তার এক বন্ধুর বাড়ি, সেটি ছেড়ে উঠেছিল ফজলুল হক হলে, হল থেকে এখন ঘরে। সিদ্ধেশ্বরীর বাড়িটি কেন ছেড়েছিল! ছাড়তে হয়েছিল কাজী রোজির কারণে। কাজী রোজি কবি সিকান্দর আবু জাফরের বউ, রুদ্রকে নাকি বিরক্ত করত। রুদ্রর মত প্রতিভাবান তরুণের সঙ্গে ওই মধ্যবয়সী কাজী রোজি আগ্রহী ছিলেন হয়ত, কিন্তু তাই বলে রুদ্রর বাড়ি ছাড়তে হবে কেন? ব্যাপারটি বুঝিনি।

রুদ্রর এই বইটি তার আগের বইটির চেয়ে আকারে ছোট, বইয়ের পঈμচ্ছদে একটি হাত, হাতের তলায় গাছের শেকড়। ভেতরে নিউজপ্রিণ্টে ছাপা কবিতা। দেখতে বইটি দরিদ্র, কিন্তু ভেতরে কবিতাগুলো ঘুমের মানুষকে সজাগ করে দেয়। গ্রন্থসত্তে ্ব আমার নামটি। দেখে পুলক লাগে। গ্রন্থসত্ত ্ব ব্যাপারটির আসলে কোনও মানে নেই, এ দেশে যে কোনও লেখকই গ্রন্থসত্ত্বের জায়গায় প্রিয় একটি নাম বসিয়ে দেয়, এর মানে এই নয় যে প্রকাশক কখনও সেই গ্রন্থসত্তের মানুষকে বই বিক্রির টাকা দিয়ে আসবে। যাই হোক, আমার পুলক লাগে। রুদ্রর কবিতাগুলো উচ্চয়রে বাড়িতে পড়ি, ইচ্ছে হয় মঞ্চে উঠে তার কবিতাগুলো পড়ি, একশ মানুষ শুনুক। একশ মানুষ শিখুক প্রতিবাদের ভাষা। ময়মনসিংহের বিভিন্ন কবিতা অনুষ্ঠানে আমাকে প্রায়ই কবিতা পড়ার জন্য ডাকা হয়, মাঝে মাঝে গিয়ে কবিতা পড়ে আসি। রুদ্রর কখনও শোনা হয়নি আমার কবিতা পড়া, রুদ্রর পড়া আমি শুনেছি, ময়মনসিংহের একুশে ফেব্রুয়ারির এক অনুষ্ঠানে। চমৎকার আবৃত্তি করে রুদ্র। অনেক সময় বিভিন্ন অনুষ্ঠানে কবিতা পড়ে এসে রুদ্র বলে, সবচেয়ে ভাল পড়েছি। আমার ভাল লাগে শুনে। বইটি ছাপা হওয়ার পর সে পুঁথি পড়ে বেড়াচ্ছে। গ্রামের লোকেরা যেভাবে সুর করে পুঁথি পড়ে, সেভাবে পড়ার জন্য সে লিখেছেও রাস্তার কবিতা। রুদ্র দরিদ্র বঞ্চিত নিপীড়িত লাঞ্ছিত মানুষদের নিয়ে কবিতা লেখে, শাসকের বিরুদ্ধে শোষনের বিরুদ্ধে কবিতা। শ্রমজীবি মানুষের জন্য কবিতা। আমাকে উদ্বুদ্ধ করে রুদ্রর বোধ।

মনে করো তুমি যাচ্ছে!, তুমি একা ..
তোমার হাতে আঙুলের মত শিকড়, যেন তা আঙুল
তোমার হাড়ে সঙ্গীতের মত ধ্বনি, যেন তা মজ্জা,
তোমার ত্বকে অনার্যের শোভা মসণৃ আর তামাটে
তুমি যাচ্ছে!, মনে করো তুমি দুই হাজার বছর ধরে হেঁটে যাচ্ছে!।
তোমার পিতার হত্যাকারী একজন আর্য
তোমার ভাইকে হত্যা করেছে একজন মোঘল
একজন ইংরেজ তোমার সর্বস্ব লুট করেছেড্ড
তুমি যাচ্ছে!, তুমি একা, তুমি দুই হাজার বছর ধরে হেঁটে যাচ্ছে!।
তোমার দক্ষিণে শবযাত্রা, তোমার উত্তরে মৃত্যুচিহ্ন,
তোমার পেছনে পরাজয় আর গ্লানি—তোমার সামনে?
তুমি যাচ্ছে!, না না তুমি একা নও, তুমি আর ইতিহাসড্ড
মনে করো তাম্রলিপ্তি থেকে নৌবহর ছাড়ছে তোমার,
মনে করো ঘরে ঘরে তাঁতকল, আর তার নির্মাণের শব্দ
শুনতে শুনতে তুমি যাচ্ছে! ভাটির এলাকা মহুয়ার দেশে,
মনে করো পালাগানের আসর, মনে করো সেই শ্যামল রমণী
তোমার বুকের কাছে নতচোখ, থরো থরো রক্তিম অধর—
তুমি যাচ্ছে!, দুই হাজার বছর ধরে হেঁটে যাচ্ছে! তুমি……।

বইটি আগাগোড়া পড়ি, একবার দুবার নয়, বার বার। ইয়াসমিনের গানের গলা যেমন ভাল, আবৃত্তিও করতে পারে ভাল। হাড়েরও ঘরখানি কবিতাটি আমার সঙ্গে ইয়াসমিনও আবৃত্তি করে।

বেশ্যাকে তবু বিশ্বাস করা চলে
রাজনীতিকের ধমনী শিরায় সুবিধাবাদের পাপ
বেশ্যাকে তবু বিশ্বাস করা চলে
বুদ্ধিজীবীর রক্তে স্নায়ুতে সচেতন অপরাধ
বেশ্যাকে তবু বিশ্বাস করা চলে
জাতির তরুণ রক্তে পুষেছে নিবীর্যের সাপ,
উদোম জীবন উল্টো রয়েছে মাঠে কাছিমের মত।
কোনো কথা নেই—কেউ বলে না, কোনো কথা নেই—কেউ চলে না,
কোনো কথা নেই—কেউ টলে না, কোনো কথা নেই—কেউ জ্বলে না—
কেউ বলে না, কেউ চলে না, কেউ টলে না, কেউ জ্বলে না।
যেন অন্ধ, চোখ বন্ধ, যেন খঞ্জ, হাত বান্ধা,
ভালোবাসাহীন, বুক ঘৃণাহীন, ভয়াবহ ঋণ
ঘাড়ে চাপানো—শুধু হাপাঁনো, শুধু ফাঁপানো কথা কপচায়—
জলে হাতড়ায়, শোকে কাতরায় অতিমাত্রায় তবু জ্বলে না।
লোহু ঝরাবে, সব হারাবে—জাল ছিঁড়বে না য়ড়যন্ত্রের?
বুক ফাটাবে, ক্ষত টাটাবে—জাল ছিঁড়বে না ষড়যন্ত্রের?
ঝোপে জঙ্গলে আসে দঙ্গলে আসে গেরিলার
দল, হাতিয়ার হাতে চমকায়। হাতে ঝলসায়
রোষ প্রতিশোধ। শোধ রক্তের নেবে,তখতের
নেবে অধিকার। নামে ঝনঝায়-যদি জান যায়
যাক ক্ষতি নেই, ওঠে গর্জন, করে অর্জন মহা ক্ষমতার,
দিন আসবেই, দিন আসবেই, দিন সমতার।

সমতার দিনের জন্যও আমার ভেতরেও স্বপ্ন জন্মে। রুদ্র শেখ মুজিবর রহমান কর্ণেল তাহের আর সিরাজ শিকদারকে উৎসগর্ করেছিল ওর প্রথম বইটি, হাড়েরও ঘরখানি কবিতায় লিখেছে হাজার সিরাজ মরে, হাজার মুজিব মরে, হাজার তাহের মরে, বেঁচে থাকে চাটুকার, পা চাটা কুকুর, বেঁচে থাকে ঘুণপোকা, বেঁচে থাকে সাপ। যদিও মুজিব তাহের আর সিরাজ শিকদার এক দলের লোক নন, মুজিবের সঙ্গে সর্বহারা পার্টির সিরাজ শিকদারের বিরোধ ছিল, তিনি খুনও হয়েছেন, বলা হয় মুজিবের ষড়যনে,্ত্র কিন্তু একটি জিনিস স্পষ্ট হয়ে ওঠে, রুদ্র যে কোনও মৃত্যুর বিরুদ্ধে, ঝড়ে বন্যায় ক্ষধুায় মন্বন্তরে পুষ্টিহীনতা জুলুমে জখমে দিতে তো হচ্ছেই প্রাণ, আর কত! এবার জাতির রক্তে ফের অনাবিল মমতা আসুক, জাতির রক্তে ফের সুকঠোর সততা আসুক।

অনেকদিন সেঁজুতি ছাপিনি। পড়া আর পরীক্ষার চাপে সম্ভব হয়নি। আবার উদ্যোগ নিই ছাপার। আবার রক্তে বান ডাকে। রুদ্র মানুষের মানচিত্র নামে সিরিজ কবিতা লিখে যাচ্ছে। ও থেকে কিছু নিয়ে আর নিজের কবিতা কিছু, কেবল দুজনের কবিতা দিয়ে সেঁজুতি। আগের সেঁজুতি, সেঁজুতির কাগজপত্র, লিটলম্যাগাজিনগুলো কোথায় কোন তলে পড়ে আছে, খবর নেই। টুকরো খবরের কিচ্ছু এবার আর থাকবে না, কারণ অনেক দূরে চলে এসেছি সেই জগত থেকে। কোথায় কে কোন লিটল ম্যাগ ছাপছে, কোন প্রত্যন্ত অঞ্চলে কার কি লেখা বেরোলো, কোথায় কবিতা অনুষ্ঠানে কি আলোচনা হল, এসব এখন আমার আর জানা নেই। লিটল ম্যাগ আন্দোলন থেকে চিকিৎসাবিদ্যা আমাকে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দিয়েছে। বাংলা ১৩৮৮র হেমন্তে দীর্ঘ দুবছর পর সেঁজুতি। বই আকারে নয়, আগের সেই জমাখরচের লম্বা খাতার আকারে, এর কারণ, হাতে অত টাকা নেই। এবার আর দাদা কোনও টাকা খরচ করছেন না। প্রশ্নই ওঠে না। লুকিয়ে আমাকে লেখা রুদ্রর প্রেমের চিঠি পড়ে রুদ্র এই নামটি তিনি আর সহ্য করতে পারেন না। পারেন না যে তার একটি প্রমাণও দেখিয়েছেন, আমার ঘরে ঢুকে আমার লাল ডায়রিটি, যেটি তিনি দিয়েছিলেন আমাকে কবিতা লিখতে, সেটি এবং আরও কবিতার খাতাপত্র ছুঁড়ে একদিন ফেলে দিলেন বৃষ্টি পড়ে কাদা হয়ে থাকা উঠোনে। প্রতিবাদ করতে গেলে এমন জোরে চড় কষিয়েছেন গালে যে গাল লাল হয়ে ছিল দুদিন। সুতরাং গাঁটের পয়সা খরচ কর। গাঁটে পয়সা এসেছে মেডিকেল কলেজ থেকে বৃত্তির টাকা পেয়ে। ইন্টারমিডিয়েটে ভাল ফলের কারণে এই বৃত্তি। কলেজে কোনও বেতন দেওয়ার দরকার হয় না, তার ওপর টাকাও জোটে। এই বৃত্তির টাকা কখন পাচ্ছি, টাকা দিয়েই বা কি করব, সে কথা বাবাকে জানাই না। মেট্রিকের ভাল ফলের কারণে ইন্টারমিডিয়েটে যে বুত্তি জুটেছিল, তাও বাবার হাতে লক্ষ্মী মেয়ের মত দিতে হয়েছে। এবার আর নয়। ঘটে বুদ্ধি এসেছে বলেই এখন বাড়ির সবার সামনে বৃত্তির টাকা পাওয়ার খবরটি ফলাও করে বলি, কেবল বাবার সামনে নয়। টাকা হাতে পেয়ে সেঁজুতি প্রেসে দিই। সি কে ঘোষ রোডের ছোটদার এক বন্ধুর প্রেস লিফা প্রিন্টাসের্ দিই। খালেককে বলে কয়ে পিপুলস টেইলার্সের একটি বিজ্ঞাপন আদায় করি। বিজ্ঞাপনের টাকা পেতে পিপুলসে যেতে রিক্সাভাড়া খরচ হতে থাকে, খালেকের দেখা পাওয়া যায় না। সেঁজুতিকে ভুলে থাকার স্পর্ধা করেছিলাম, আসলে তা ছিল নিজের ইচ্ছের সঙ্গে প্রতারণা করা। আর্থিক দৈন্যতায় কুষ্ঠরোগির মত কুঁকড়ে না থেকে প্রচণ্ড দাপটে প্রতিষ্ঠা করছি অনন্ত সুন্দর। বিক্ষোভের ভাষা না শিখে, দুমুঠোয় প্রতিবাদের শ্লোগান না তুলে যে কবি ভীরু কচ্ছপের মত নিজেকে আমূল গুটিয়ে নিয়ে সস্তা আবেগের মদ গিলে কবিতায় মাতলামি করে, আমি সেই স্বার্থলোভি সুবিধাভোগীকে আস্তাকুঁড় দেখিয়ে দেব, সেঁজুতি নয়। যে কবিতায় সাহসী উচ্চারণে লেখা শ্রমজীবী মানুষের জীবন যাপন, আমার নিদ্রার স্নায়ুতে লক্ষাধিক ঘণু ঢেলে প্রচণ্ড ক্ষধুায় গ্যাস্ট্রিক আলসার নিয়েও সংশোধন করব সেই কবিতার প্রুফ। দম্ভ আছে, তা ঠিক। আমার কবিতা, নিজেই লক্ষ করি বদলে গেছে অনেক, রুদ্রর অনুকরণ নয়, রুদ্রর কবিতার প্রখর প্রভাব। পরানের গপ্প নামে নিজের কয়েকটি কবিতা আছে এ সংখ্যায়, কবিতাগুলোয় শ্রমজীবি মানুষের ক্রন্দন, দরিদ্রের হাহাকার আর ধনী শোষকের বিরুদ্ধে তীব্র ঘণৃা থিকথিক করছে। রুদ্রর কটি মানুষের মানচিত্র আছে, আছে তার চৌকিদার।

বনের হরিণ নয়, বাঘ নয়, এত রাতে চৌকিদার চলে।
হোই কে যায়, কে যায়? গঞ্জের বাতাস ফেরে হিম নিরুত্তর,
কে যায়? কে যাবে আর!দশমির অন্ধকার একা একা যায়—
একা একা চৌকিদার আধাঁরের বাঁকে বাঁকে নিজেকে তাড়ায়।
নিজেকেই প্রশ্ন করে কে যায়? কী নাম তোর? কোথায় থাকিস?
কী তুই পাহারা দিবি, জীবনের কতটুকু আগলাবি তুই!
ছিঁচকে সিঁদেল চোর, আর যেই চোর থাকে দিনের আলোয়?
আর যেই চোর থাকে দেহের ভেতর, শরীরের অন্ধকারে?
রাতের আধাঁরে খুঁজে তারে তুই পাবি, চৌকিদার পাবি তারে?
যে চোর পাহারা দেয়, পাহারার নামে করে ভয়ানক চুরি,
চুরি করে মানুষের ঘিল.ু মাংশ.রক্ত.হাড়.বুকের বাসনা,
তারে পাবি, যে তোর জীবন থেকে চুরি করে পূর্ণিমার রাত?
যে তোর জীবন থেকে চুরি করে রৌদ্রময় দিনের খোয়াব,
যে তোর শিশুর স্বাস্থ্য ,দধু ভাত, চুরি করে বোনের সিঁদুর,
তারে পাবি, যে তোর গতর থেকে খুলে নেয় মানব-শরীর?
কিসের পাহারা তবে,কেন তবে রাতভর রাতকে তাড়ানো?
অন্ধকার পৃথিবীতে শুধু কিছু তারা জ্বলে দূরের নক্ষত্র
ঝিঁঝি ডাকে, পাটের পচানি থেকে গন্ধ আনে রাতের বাতাস।
নোতুন কবর খুঁড়ে শেয়ালেরা বের করে আধপচা লাশ
হোই কে যায়, কে যায়…পৃথিবীর অন্ধকারে চৌকিদার চলে।

জীবন এভাবেই যাচ্ছিল, কিছুটা রুদ্রে কিছুটা হাসপাতালে,বইপত্রে, রোগিতে কিছুটা অবকাশের কোলাহলে আর বিষণ্নতায়। এমন সময় একটি খবর আমাকে চমকে দেয়, রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানকে চট্টগ্রামের সার্কিট হাউজে হত্যা করা হয়েছে। হত্যা করেছেন চট্টগ্রাম সেনাবাহিনীর কমান্ডার অফিসার মেজর জেনারেল মঞ্জুর। সম্পূর্ণই একটি ব্যথর্ উদ্যোগ। মঞ্জুরের পক্ষে জিয়াকে হত্যা ছাড়া আর কিছু করা অর্জন হয় না। ঢাকা না হয়ে চট্টগ্রাম বলেই হয় না। জিয়া নিজে খাল কেটে কুমির এনেছিলেন প্রচুর, মঞ্জুর নিতান্তই একটি বাচ্চা কুমির। কামড় দিয়েছেন ঠিকই, তবে কিছু দুধের দাঁত ছিল বলে কামড় তেমন লাগেনি। তা না হলে মঞ্জুরই সে রাতে কিছু একটা হয়ে যেতে পারতেন, সামরিক আইন জারি করে দেশের হর্তাকর্তা। কিবস্তু তা না হয়ে ঘটনা ঘটল অন্যরকম, উপরাষ্ট্রপতি আবদুস সাত্তারকে রাষ্ট্রপতির ভার গ্রহণ করতে হয়। গ্রহণ করা আর দেশ চালানো এক নয়, বুড়োকে সামনে বসিয়ে পেছনে বন্দুকঅলা জোয়ানেরা চালাচ্ছেন দেশ। দেশ কি আর চলছে!দেশ ভাসছে রক্তে। লক্ষ লক্ষ মানুষের রক্তের বিনিময়ে অর্জন করা স্বাধীনতার গায়ে ছোপ ছোপ রক্তের দাগ, স্বাধীনতার শরীরে কেবল মৃত্যুর গন্ধ। বাবাকে যদি জিয়াউর রহমানের সুরতহাল রিপোর্ট দিতে হত, তিনি বুলেট কটি গায়ে, হিশেব নিতেন। কি ধরনের বন্দুকের কি ধরনের গুলিতে কতটা দূর থেকে কতবার গুলি ছোঁড়া হয়েছে বলতে পারতেন। বাবা নিজের মন্তব্যে লিখতেন, ইহা সুইসাইড নহে, ইহা হোমিসাইড। যদি এই দেশটির সুরতহাল রিপোর্ট লিখতে বলা হয়, তবেও তো এরকম হোমিসাইড জাতীয় কিছু লেখা যায়। লেখা যায় আততায়ীরা দেশটির বক্ষ লক্ষ করে গুলি ছুঁড়ছে, ঝাঁঝড়া হয়ে গেছে দেশটির পাঁজর। পাঁজরের হাড়গুলো ভেঙে গেছে, মাংস ছিদ্র হয়ে গুলি ঢুকে গেছে ভেতরে, হৃদপিণ্ড থেমে আছে। থেমে আছে অনেক অনেকদিন।

এর পর খুব বেশিদিন সময় নেয়নি নেপথ্যের সেনাঅধিনায়কের চেহারামোবারক প্রদর্শন করতে। আরেকটি শান্তশিষ্ট লেজবিশিষ্ট ক্যু। দেশে সামরিক শাসন জারি হয়ে গেল। জিয়ার পদাঙ্ক অনুসরণ করে এরশাদের যাত্রা শুরু হল। এক সেনা আরেক সেনার পদাঙ্ক অনুসরণ করেই চলেন। মেজর জেনারেল মঞ্জুর এবং তার সঙ্গী সাথীকে ফাঁসিতে ঝোলানো হয়ে গেল। জিয়া যেমন জাতীয়তাবাদি দল তৈরি করে হ্যাঁ না ভোটের মাধ্যমে অবৈধ ক্ষমতা দখলকে বৈধ করেছিলেন, এরশাদও তেমন। এরশাদও একইরকম নিজের একটি দল গঠন করে রাজনীতিতে নেমে বৈধ করে নিলেন নিজের অবৈধ আগমন। উদ্ভট উটের পিঠে চলেছে স্বদেশ! সমাজতন ্ত্র না থাক,তাই বলে কি যৎসামান্য গণতনও্ত্র দেশটির ভাগ্যে নেই! দেশের জন্য মায়া হয় আমার, দুশ্চিন্তা বাড়ে। যেসব রাজনৈতিক নেতা এক দল থেকে আরেক দলে নাম লেখায়, তারা, ক্ষমতায় যেই আসে, তার প্রতিই আকৃষ্ট হয়। চরিত্রহীন ছাড়া এদের অন্য কিছু মনে হয় না আমার। একটি বিশ্বাস আমার ভেতর দিন দিন ঘনীভূত হয়, রাজনৈতিক নেতাদের এমন দুর্বল চরিত্রের কারণে সামরিক বাহিনীর স্পর্ধা হয় বন্দুকের নলের মুখে দেশের দখল নিতে।

রাজনীতি ভাবনা, কাব্য ভাবনা সব ভাবনা দূর করে আমাকে পরীক্ষার জন্য তৈরি হতে হয়। এ পরীক্ষায়, যেহেতু আমি পরীক্ষা দেব, বাবা পরীক্ষক হতে পারবেন না। পরীক্ষক হিসেবে তিনি অন্য কলেজে চলে গেলেন, এ কলেজে সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ থেকে আসা নতুন অধ্যাপক আবদুল্লাহ, যাঁর ক্লাসে ছেলেমেয়েরা বেশির ভাগই প্রক্সি মেরে কেটে পড়ে, সহকারি অধ্যাপককে নিয়ে ইন্টারনাল পরীক্ষক হিসেবে রইলেন। আমার ক্লাসের বন্ধুরা হায় হায় করছে খবর শুনে, আমাকে দেখেই বলছে, ধৎু , তোমার কারণে রজব আলী স্যাররে আমরা পাচ্ছি না। রজব আলী স্যার ইন্টারনাল হিসেবে ভাল, নিজের কলেজের ছাত্রছাত্রীদের পাশ করানোর জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করেন, এ কথা কলেজের প্রায় সবাই জানে। কিন্তু নিয়ম তো পাল্টানো যাবে না, পুত্র-কন্যা পরীক্ষাথীর্ হলে পিতা বা মাতা পরীক্ষক হতে পারেন না। অসন্তুষ্ট ছাত্রছাত্রীরা কড়া এক্সটারনাল আর মেন্দামারা ইন্টারনাল এর সামনে মৌখিক দিল ভয়ে কেঁপে কেঁপে। কারওরই তখন মনে হয়নি বিষয়টি নিতান্তই গৌণ, পচা শামুক।
 
১৫. কাগজের বউ




ডালিয়া জাহানের ঠিকানায় রুদ্রর চিঠি আসতে থাকে নিয়মিত। কখনও মোংলা বা মিঠেখালি থেকে, কখনও ঢাকা থেকে। রুদ্রর চিঠি হাতে নিয়ে টের পাই বুকের মধ্যে কেমন করা।চঠি যেদিন পাই, এক অমল আনন্দ আমাকে সারাদিন ঘিরে থাকে।

তুমিহীন একটি মুহূতর্ এখন যে কত দুঃসহ তা তোমাকে কোনো ভাবেই বোঝাতে পারলাম না। তোমাকে ছাড়া আমার দিনগুলো যে কি রকম বিশৃঙ্খল আর কি রকম অসংযত তুমি তো তা বুঝতেই চাও না। জানি, অনেক সমস্যা আছে, এ মুহূর্তে তোমাকে কাছে পেতে গেলে হাজার হাজার সমস্যা জেঁকে বসবে। পরেও কিন্তু এ সমস্যাগুলো আমাদের নিস্তার দেবে না। কাজেই যে সমস্যাকে একদিন না একদিন মোকাবেলা করতে হবে তাকে এখনই সামনে নিয়ে আসা উচিত। লুকোচুরি করে তো আর সমস্যার সমাধান করা যাবে না। এজন্যেই দাদার সাথে দেখা করতে চেয়েছিলাম। আমরা বিয়ে করেছি এটা জানাতে চেয়েছিলাম, তুমি শুনলে না। আমার দিন আর রাত্রিগুলোকে অসংযম আর অনিয়মের মধ্যে ছুঁড়ে দিয়ে তুমি খুব সুখে আছো। তোমার এই উদাসীন ভাল থাকা আমাকে ভীষণ ঈর্ষাকাতর করে তোলে। আমি পারি না। আমি কোনোভাবেই নিজেকে বাধ্য রাখতে পারি না।

আকাশে মেঘের মত প্রতিদিন স্বপ্ন জমে বৃষ্টি হয় না। তুমিহীন দিন যায়, রাত্রি যায়। তোমার স্পর্শহীন এই ঊষর প্রান্তর…। কতদিন তোমাকে দেখি না! কতদিন তোমার আনতচোখদুটিকে আদর করি না! ভীষণ কুয়াশাচ্ছত তোমার চোখ, ভীষণ মেঘলা আর ভীষণ সুদূরের। কবে আমি ওই কুয়াশা পার হয়ে তোমাকে ছোঁবো! কবে আমি ওই মেঘের মানে বুঝতে পারব! অপেক্ষায় ক্লান্ত হয়ে পড়ি। প্রতীক্ষা আর ফুরোয় না। প্রিয় স্পর্শ নেই, দিনগুলো প্রাণহীন! প্রিয় স্পর্শ নেই, রাত্রিগুলো কি শীতল আর ক্লান্তিময়! এই শীতল আধাঁরে তুমি রোদের উত্তাপ নিয়ে কবে আসবে? আজ মন ভাল নেই, নির্জন আর সেই খুব শান্ত কষ্টগুলো সারাদিন আজ আমার বুকের ভেতরে জমে উঠেছে। কোনও ভাষায় আমি এই কষ্টগুলো বোঝাতে পারি না। মেঘলা আকাশের মত ভারি, শীতল আর কি শান্ত এই কষ্ট আমার!আজ আমার মন ভাল নেই। আজ খুব শীতল কষ্ট।

রুদ্রর কষ্টগুলো উপলব্ধি করার চেষ্টা করি আমি। কিন্তু আমার পক্ষে তার ইচ্ছেকে পণূর্ তা দেওয়া সম্ভব হয় না। রুদ্র স্বামীর দাবি নিয়ে বলে, বাড়িতে বল যে বিয়ে করেছি, নিজে বলতে না পারো কাউকে দিয়ে বলাও। এও যে সম্ভব নয়, তা আমি বারবার বলি। কোনও কাউকে দিয়ে এ কথাটি উচ্চারণ করানো যাবে না, যে, আমি এক চালচুলোহীন কবি কে বিয়ে করে বসে আছি। রুদ্রর ধারণা বিয়ের কথা বাড়িতে জানালে বাবা আমাদের আড়ম্বর করে বিয়ে দেবেন, তারপর আমি রুদ্রর সঙ্গে সংসার করতে চলে যাব এ বাড়ি ছেড়ে অথবা রুদ্রই এ বাড়িতে জামাই আদরে থাকবে অথবা বাড়ি থেকে যদি আমাকে তাড়িয়েও দেয় তবে আমি হোস্টেলে থেকে লেখাপড়া চালিয়ে যাব, ছুটিছাটায় রুদ্রর কাছে ঢাকায় যাব অথবা এই কলেজ থেকে বদলি হয়ে অন্য কলেজে, যেন তার সঙ্গে সংসারও করতে পারি, কলেজেও যেতে পারি এমন অথবা অন্য কিছু অথবা লেখাপড়া ছেড়েই দেওয়া। সংসার করার জন্য রুদ্র উন্মাদ হলেও আমি হই না। রুদ্রই জীবনে একটি বড় অনিশ্চিতি, এরপর আরও একটি অনিশ্চিতিকে স্বাগত জানাতে আমার একবিন্দু সাহস হয় না।

রুদ্র ময়মনসিংহে আসে দেখা করতে। যেদিন আসার কথা থাকে আসতে পারে না। আমি দীর্ঘক্ষণ প্রেস ক্লাবের ক্যান্টিনে অপেক্ষা করে হতাশ হয়ে বাড়ি ফিরে আসি। কথা দেওয়া তারিখে সে যে সবসময় আসতে পারে, তা নয়। তবে যে করেই হোক, সে তারিখে না হোক, কাছাকাছি অন্য একটি তারিখ বেছে চলে আসে। কলেজ ক্যান্টিনে চা সিঙ্গারা ছাড়া অন্য কিছু পাওয়া যায় না তাছাড়া কলেজ ক্যান্টিন কলেজের ছাত্রছাত্রীর জন্য, ক্যান্টিনে রুদ্রর উপস্থিতি লোকে প্রথম প্রথম আড়চোখে দেখত, এখন বড় বড় চোখ করে দেখে। আসাদ আর আনোয়ারের সঙ্গে রুদ্রর জমে ওঠাটিও খুব ভাল চোখে দেখা হয় না। আসাদ আর আনোয়ারকে মেডিকেলের খারাপ ছাত্র তো বটেই গুণ্ডা ছাত্র বলে মনে করা হয়, মেডিকেলে ঘটা যে কোনও খারাপ কাজের জন্য ওদের দায়ি করা হয়। ওরা মদ খায় বলেও গুঞ্জন আছে। রুদ্রকে কলেজের ক্যান্টিনে দেখে একদিন কথা বলতে এল আসাদ, দুজন নাকি একই কলেজে লেখাপড়া করেছে, একই ক্লাসে। ব্যস, হয়ে গেল। জমে গেল। ত্রাস দুটিকে যথাসম্ভব এড়িয়ে চলে ছাত্রছাত্রীরা, এক পথে ওদের আসতে দেখলে, বিশেষ করে ছাত্রীরা, অন্য পথ ধরে। কিন্তু ত্রাসদুটি আমাকে রুদ্রর সঙ্গে জমে ওঠার পর খাতির করে, কি নাসরিন কেমন আছো বলে এগিয়ে আসে দুজনই। আমারও হেসে বলতে হয় ভাল। ধীরে ধীরে একটি জিনিস আমি উপলব্ধি করি, ওরা আমার জন্য ত্রাস নয়, আর যার জন্যই হোক। রুদ্র না থাকলেও ওদের সঙ্গে বসে ক্যান্টিনে চা খেয়েছি, আসাদের হাতের কব্জিতে ব্যান্ডেজ বা আনোয়ারের কপালে কাটা দাগ হয়ত থাকে, কিন্তু কখনও মনে হয়নি ওরা খারাপ লোক, বরং অনেকের চেয়ে অনেক আন্তরিক আর সৎ মনে হয় ওদের। মাঝে মাঝেই ওরা বুক ফুলিয়ে বলে কেউ তোমারে ডিসটার্ব করে কিনা জানাইও, নাকের হাড্ডি ভাইঙ্গা দেওয়ার জন্য আমরা রেডি আছি। আসাদ আর আনোয়ারের সঙ্গে রুদ্রর আড্ডা দেওয়া অন্য ছাত্রদের চোখ আরও বড় করে। দুপুরবেলা চা সিঙ্গারা খেয়ে আমাদের দুপুরের পেট কামড়ে ধরা ক্ষিধেও মরে না, একসময় উঠতেই হয়। কলেজে আসা যাওয়ার পথে সি কে ঘোষ রোডের প্রেস ক্লাবের ক্যান্টিনটি আবিস্কার করে ওতেই আজকাল দেখা করি রুদ্রর সঙ্গে। প্রেসক্লাবের ক্যান্টিনে যে হলুদ রঙের বিরানি পাওয়া যায়, তা রীতিমত বিখ্যাত। রামপ্রসাদ বাবু মারা যাওয়ার পর তার ফটো টাঙিয়ে ফটোর ওপর মালা ঝুলিয়ে বাবুর ছেলে হরিপ্রসাদ নিজেই এখন সেই বিখ্যাত বিরানিটি রাঁধে। দুপুরে গিজগিজ ভিড়ের মধ্যে খাওয়া হয়, খেয়ে দেয়ে সব চলে যায়, আমরা বসে থাকি, আমাদের কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই বলে। প্রেস ক্লাবের কর্মচারি আমাদের আড়ে আড়ে দেখে, দেখে যে আমরা যাচ্ছি না, একটু পর পর চা খেয়ে খেয়েও থেকে যেতে চাইছি। কোথাও কোনও নির্জন ঘরের ব্যবস্থা আমি করে রাখি না বলে রুদ্র অনুযোগ করে, মখু গোমড়া করে বসে থাকে। কর্মচারিরা ক্রমাগত আমাদের ইঙ্গিত করে উঠে যেতে, চেয়ারগুলোকে শব্দ করে করে টেবিলের ওপর উপুড় করে রাখে, ওতেও যখন কাজ হয় না, মুখেই বলে দেয় ক্যান্টিন বন্ধ এখন। আমাদের ক্যান্টিন থেকে বেরোতে হয়, কিন্তু যাওয়ার কোনও জায়গা নেই। একটু নির্জনতা খুঁজে বেড়াই সারা শহরে, জোটে না। অবশেষে মেডিকেল কলেজ চত্বর বিকেলে যখন নির্জন হয়ে আসে, বসি দুজন। দশ বছর বয়সী একটি পঙ্গু ছেলে পাশের বস্তি থেকে প্রায়ই হাঁটুতে হেঁটে এসে আমার পাশে বসে থাকে, ওর সঙ্গে কথা বলতে যত সহজ বোধ করি, রুদ্রর সঙ্গে নয়। ছেলেটির নাম দুলাল, বাবা নেই, মা আছে, অভাবের সংসার, নিজে ভিক্ষে করে সংসার চালায়, দুলালকে দু তিন টাকা যা থাকে পকেটে, দিই। জীবনের নানা রকম কথা রুদ্রর সঙ্গে বলি। চন্দনার কথা, চন্দনা ঢাকা এসেছে, স্বামীর বোনের বাড়ি উঠেছে, রুদ্রকে দেখা করতে বলি চন্দনার সঙ্গে, কেমন আছে ও, দেখে আসতে বলি, যদি দেখা করতে যায়, তবে তো কিছু আমি হাতে দিতে পারি, কি দিতে পারি, আমার ভাণ্ডারে যে একটি দামি জিনিস আছে, সেটিই দিই, দাদা তাঁর বিয়ের সময় যে হলুদ কাতান শাড়িটি দিয়েছিলেন, সেটি। চন্দনার জন্য মন কেমন করা, বিয়ের পর দাদার বদলে যাওয়া, ছোটদার না থাকার কারণে আমার একা হয়ে যাওয়া, পড়াশোনা ভাল না হওয়া ইত্যাদি কথা মৃদু স্বরে একটু একটু করে রুদ্রকে বলি। রুদ্র বার বার আমার কোমর জড়িয়ে ধরে কাছে টানে, চুমু খেতে চায়। বার বার তার হাত যায় বুকে। যে কোনও সময় যে কেউ দেখবে বলে রুদ্রর হাত সরিয়ে দিই। তাছাড়া নিজের লজ্জাটিও একটি বড় বাধা হয়ে দাঁড়ায়। দুজনের জন্য কোনও নির্জন ঘরের ব্যবস্থা করতে পারি না বলে সে অভিমান করে বসে থাকে, কথা না বলে। ইচ্ছে করে রুদ্রর ঠোঁটদুটো স্পর্শ করি আঙুলে, চোখের ওপর আলতো আঙুল রাখি। ইচ্ছে করে রুদ্রর উষ্ণ হাত ধরে হেঁটে বেড়াই খালি পায়ে। সবুজ ঘাসে খালি পায়ে হাঁটতে আমার বড় ভাল লাগে। ঘাসের ডগার স্পর্শ আর শিশিরের শীতলতা পেতে চায় পা। আমার সম্বোধনহীন আড়ষ্টতা, বিয়ের পরও এ রকম শুকনো দেখা হওয়ায় রুদ্র মন খারাপ করে ঢাকা ফিরে যায়। প্রতিদিন যেন চিঠি লিখি, বার বার অবশ্য বলে যায়। যেন লিখি রাত দশটার পর, ঠিক সে সময় সে আমাকে ভাববে, ভাববে যে আমি তাকে লিখছি, তাকে মনে করছি। রুদ্র চলে যাওয়ার পর আমি বাড়ি ফিরে লম্বা ঘুম দিই, পড়ে পড়ে আমার এমন ঘুমোনো দেখলে ইয়াসমিন সন্দেহ করে যে রুদ্র এসেছিল। ছোটদা ময়মনসিংহ ছাড়ার পর ইয়াসমিন ধীরে ধীরে আমার ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠছে বাড়িতে। ওর সঙ্গে সখ্য আমার খুব, চুলোচুলিও কম নয়। আমার চেয়ে গায়ের শক্তি ওর বেশি থাকায় আমাকে বরাবরই রণে ভঙ্গ দিতে হয়। ইয়াসমিনকে আমি পেটের সব কথা বলি, অথচ রুদ্রর যত কাছে আসছি, তত আমি নিভৃত হয়ে উঠছি। রুদ্রর জন্য বাড়তে থাকা আমার বেয়াড়া আবেগের কথা ইয়াসমিনকে বলতেও সঙ্কোচ হয়। বাৎসায়নের একটি ইংরেজি পকেট বই রুদ্র আমাকে পড়তে দিয়ে গেছে, বইটি পড়া তো হয়ই না, বরং কোথায় লুকোনো যায়, কোথায় লুকোলে ইয়াসমিনের চোখে পড়ার আশঙ্কা নেই, এ নিয়ে আমার দুশ্চিন্তার ঘোড়া লাগাম ছিঁড়ে ছুটতে থাকে। বইটি নিজের কাছে রাখার বরাদ্দ সময় ফুরিয়ে যায় বইটি লুকোতে লুকোতেই।



তুমি ব্যস্ত মানুষ। তোমাকে প্রতিদিন লিখতে বলবো, এমন সাহস আমার নেই। এই কথা বলে রোজ আমাকে লেখার হাত থেকে নিস্তার চাইছো! সেটি হচ্ছে না। যতো ব্যস্তই থাকি না কেন, রোজ তোমাকে লেখার মত সময় আমার আছে। কাছে থাকলে রাতে যেটুকু সময় আমি তোমাকে দিতে পারতাম, চিঠি লিখতে তার চেয়ে অনেক কম সময় নেয়। যেহেতু তুমি কাছে নেই, কাজেই আমি রোজই তোমাকে লিখতে পারি, এবং লিখব। তোমার অত রাতটা কোথায়? সাড়ে দশ কি রাত? সে তো সন্ধ্যা। এইটুকু রাত্রি জাগার অভ্যেস এখন থেকে না করলে পরে বিপদে পড়বে তো! একেবারে নির্ঘুম প্লাবনের রাত তো আসবে, সেই সব জলোচ্ছঅ!সের রাতে কি করবে? চন্দনাকে আমি একটি বণর্ও মিথ্যে লিখিনি, বরং অনেক কম করে বলেছি। কেন, আমি কথা না বল্লে কথা বলা যায় না? আমি মখু না তুল্লেও তুমি মখু তুলতে পারো না? সম্পর্কের সবটুকু দায়িত্বই কি আমার? ভাগাভাগি তো সবকিছুর আধাআধি করা হয়েছে। এখানে কেন তবে পুরোটা আমার হবে? তুমি গাল ফুলিয়ে রাখো, চোখ রাঙিয়ে রাখো, আমি আমার আদরের হাত সঙ্কুচিত করি। প্রশ্নই আসে না। তোমার আদরের হাত কি কখনো প্রসারিত থাকে? যে হাত প্রসারিত নয় তার আর সংকোচন কি? কেন, আমি তোমার অভিমান ভাঙাই না? তুমি না ডাকলেও আমি কাছে যাই না? তুমি কথা না কইলে আমি কথা কইনা? তুমি মুখ না তুল্লেও কি আমি আদরের ছোঁয়ায় তোমার মখু তুলি না? তোমার নিরুত্তাপ চোখ জোড়াকে আদরে ভেজাই না? তাহলে তুমি পারো না কেন? আজো আমি অভিমানের ভাষা বুঝতে পারি না। যে বুঝেও সবকিছু না বোঝার ভান করে পৃথিবীর কোন শক্তি আছে তাকে বোঝায়! আজ আশ্বিনের আট। পরিচয়ের আজ তিন বছর চার দিন। কি রকম মনে হয় জানো? মনে হয় হাজার বছর ধরে আমি তোমাকে চিনি। হাজার বছর আগে আমাদের দেখা হয়েছিল। কখন কি ভাবে দেখা হয়েছিল মনে নেই। শুধু মনে আছে এক রোদে পোড়া মন একখানি শ্যামল করতল পটে কোনও কথাহীন নিঃশব্দে এসে লিখেছিলো একখানি কথা—আমি। যেন আমরা অনন্ত সময় ধরে পরস্পরকে খুঁজে ফিরছিলাম। একদিন দেখা হল। আর প্রথম দেখায় আমরা চিনে ফেল্লাম একজন আরেকজনকে। কোনো ভূমিকার প্রয়োজন হল না। দুজনেই মিলিয়ে নিলাম ভেতরে যে ছবি ছিলো তার সাথে। হ্যাঁ এই তো সে। যাকে বেদনার রঙ দিয়ে এঁকেছি। হৃদয়ের রক্ত দিয়ে লিখেছি যার নাম। নিভৃত কষ্ট আর নির্জন স্বপ্ন দিয়ে যাকে নির্মাণ করেছি এই তো সে। কোনো কথাহীন তাই এসে আমরা পরষ্পরের করতলে একটি কথা লিখলাম, আমি। অর্থাৎ আমি সেই যাকে তুমি নির্মাণ করেছো নিজের ভেতর।

নির্জন একটি ঘর, যেটি ময়মনসিংহে পাওয়া সম্ভব হয় না, তা যে ঢাকায় আছে তা রুদ্র বার বার বলে। আমাকে ঢাকায় যেতে বলে। কিন্তু ঢাকা যাওয়া আমার পক্ষে সম্ভব হবে কি করে! একা একা ট্রেনে উঠে হয়ত ঢাকা যাওয়া সম্ভব হবে আমার, কিন্তু যেতে কে দেবে? শেষ অবদি ছোটদা ময়মনসিংহে এলে আমি গোঁ ধরি ঢাকা যাবো। ঢাকা কেন? ঢাকা থেকে সার্টিফিকেট আনতে হবে ফ্রার্স্ট প্রফ পরীক্ষার। ছোটদার সঙ্গে ঢাকা যাওয়া হয়, গিয়েই আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীনিবাসে ইশকুলের এক পুরোনো বান্ধবীর সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছি বলে বেরিয়ে যাই। বেরিয়ে সোজা রুদ্রর বাসাবোর ঘরে টোকা, ওরকমই কথা ছিল। রুদ্রর খুশির প্রকাশ নেই। আনন্দে লাফিয়ে ওঠা, কষ্ট পেয়ে চোখের জল ফেলা এসব রুদ্রকে দিয়ে হয় না। আপাদমস্তক একটি কাঠ। যা হচ্ছে যা ঘটছে ভেতরে। কাগজে তার প্রকাশ হয়। রুদ্র অবশ্য একই কথা বলে আমার সম্পকের্, আমি নাকি চিঠিতেই সহজসুন্দরস্বাভাবিক, সামনে নই। সামনে ওই একই, মরা কাঠ। রুদ্র আমাকে একটি শাড়ি দিল পরতে, শাদার ওপর ছোট ছোট ফুল পাতা প্রিন্ট শাড়ি, সঙ্গে সায়া ব্লাউজ, শাড়ি পরে বাইরে যেতে হবে। এ শাড়িটি রুদ্রর বোন বীথি পছন্দ করেছে। রুদ্র নিজে পছন্দ করে কখনও শাড়ি কেনেনি আমার জন্য, এর আগে সবুজ একটি সুতি শাড়ি কিনেছিল, সেটি কিনতেও সে তার বান্ধবী মুক্তিকে সঙ্গে নিয়েছে পছন্দ করতে। রুদ্রর জন্মদিনে আমি যা কিছু উপহার দিই, নিজে পছন্দ করে কিনি। কোন রঙের শার্টের সঙ্গে কোন রঙের প্যান্ট ভাল মানাবে, তা নিজেই বিচার করি। রুদ্র যখন অন্যকে আমার জন্য শাড়ি পছন্দ করতে বলে, আমার গায়ের রঙের কথা বলে, শ্যামলা রঙের মেয়েকে কোন রঙের শাড়ি ভাল মানাবে!মেয়েদের শাড়ি নাকি মেয়েরাই ভাল বোঝে। শাড়ির কথা জানাতে হয়েছে বলেই কি না জানি না রুদ্র বীথিকে জানিয়েছে আমাদের বিয়ের কথা, এমনকি মুক্তিকেও। সে রাতে আমাকে শাড়ি পরিয়ে একটি চিনে রেস্তোরাঁয় নিয়ে যায় সে। ওখানে রাতের খাবার খেয়ে ফিরে আসে বাসাবো। মুহম্মদ নূরুল হুদাকে সে আমাদের বিয়ের কথা জানিয়েছে, জানাতে হয়েছে, যেন রাতে ও বাড়িতে আমার থাকা অশোভন না দেখায়। আমার কাছ থেকে এ অবদি কেউ বিয়ের কথা জানেনি। রুদ্র জানাতে শুরু করেছে। এর আগেও দএু কজন বন্ধুকে সে জানিয়েছে। এই জানানোয় আমার উদ্বেগ হয় জেনেও জানিয়েছে। এ রাতটি রুদ্রর সঙ্গে থাকতে হবে। থাকতে হবেই। কিন্তু আমার তো যেতে হবে। যেতে হবে, ছোটদাকে বলে এসেছি ঘন্টাখানিক পর ফিরবো। গুল্লি মারো ছোটদা, তুমি আমার বউ, সেটিই তোমার সবচেয়ে বড় পরিচয়। কিন্তু এ পরিচয়ই নিয়ে, যে জীবন যাপন করছি আমি, তা করতে পারব না। বেশ পারবে। তবে কি আমি বাড়িতে বলব রুনুখালার ঘরে ছিলাম, যদি না ফিরি আজ রাতে! সে নিয়ে ভেবো না, আমি রুনুখালাকে বলে দেবক্ষণ ম্যানেজ করে নিতে। কিন্তু রুনুখালা কি মানবেন? মানবেন না কেন, তাকে জানিয়ে দেব যে বিয়ে করেছি। অসম্ভব। তোমার অসম্ভব নিয়ে পড়ে থাকো তুমি, আমি যা করার করব। আজ রাত রুদ্রর সঙ্গে কাটাতে হবে এ রুদ্রর আবদার অনুরোধ দাবি আদেশ সবই। রুদ্র বলে, আজ রাতে আমি তোমাকে সম্পণূর্ করে চাই। সম্পণূর্ মানে? সম্পণূর্ মানে সম্পণূ র্। কোনও বাকি রাখা নেই। এর অর্থ অনুমান করে আমার ভেতরে কোথাও কেঁপে ওঠে, সময় যত ঘনিয়ে আসে, তত আমার কোথাওএর কাপঁ নটি শরীরে ছড়াতে থাকে। দিন যত রাতের দিকে এগোয়, তত শ্বাস দ্রুত হয়। নিজেকে বোঝাই, আমি তো কোনও অন্যায় করছি না, আমি আমার স্বামীর সঙ্গে বৈধ ভাবে রাত কাটাবো, আমার বয়সী হয়ে হাসিনা যদি এ কাজটি পারে আমি কেন পারব না! আমার ক্লাসের মেয়ে মদিরা ক্লাসেরই এক ছেলে শওকতকে লুকিয়ে বিয়ে করেছে, অনেকে বলে লুকিয়ে নাকি মদিরা শওকতের হোস্টেলের ঘরে যায়, রাত কাটায়। ও যদি পারে, আমি কি এমন কচি খুকি রয়ে গেছি যে পারব না!

শেষ অবদি রাত এলো। বৈঠক ঘরে হুদা আর তাঁর বউ সাহানার সঙ্গে আমাকে পরিচয় করিয়ে দেয় রুদ্র বউ বলে। হুদার ছোট্ট মেয়েটি অবাক তাকিয়ে থাকে বউ নামক আমার দিকে। অনেক রাত না হলেও রুদ্র বলে, শুয়ে পড়ার সময় হয়েছে। শুয়ে পড়তে রুদ্র তার ঘরটিতে আমাকে নিয়ে যায়। শার্ট প্যান্ট খুলে কেবল একটি লুঙ্গি পরে বাতি নিবিয়ে চেয়ারে পাথর হয়ে বসে থাকা আমাকে শুইয়ে দেয় বিছানায়। নিজেকে বারবার বলি, তুই বিয়ে করেছিস, বিয়ে করলে স্বামীর সঙ্গে শুতে হয় বোকা মেয়ে। শুতে হয়!এরকম প্রতিটি মেয়েই শোয়। লজ্জা ঝেড়ে ফেল। আমি প্রাণপণে লজ্জা ঝেড়ে ফেলতে থাকি। জানালা দিয়ে আলো আসছে বাইরের ল্যাম্পপোস্টের, ভাবতে চাইছি এ চাঁদের আলো। রুদ্রকে আমি ভালবাসি, সে আমার স্বামী। আমার স্বামীর সঙ্গে আমার আমি প্রথম রাত কাটাবো। আজকের রাতে আমার যেন কোনওরকম আড়ষ্টতা না থাকে। আড়ষ্টতা না থাকার কথা নিজেকে সেই সকাল থেকে যদিও বলছি, তবওু রুদ্রকে রুদ্র বলা তুমি বলা আমার পক্ষে সারাদিনেও সম্ভব হয়নি। রুদ্রর দিকে পিঠ দিয়ে আমি এক কোণে জড়সড় পড়ে থাকি হাত পা গুটিয়ে। সেই গুটোনো আমাকে রুদ্র কাছে টানে। আমি নই, আমার শরীর রুদ্রর সেই আলিঙ্গনে জবুথবু পড়ে থাকে, বুকের ওপর আড়াআড়ি করে শক্ত হয়ে থাকা আমারই দুটি হাত, আমি সরিয়ে নিতে পারি না। ও থাকে। ওই হাতদুটিকে রুদ্র তার গায়ের শক্তি দিয়ে সরায়। আমি চাই না আমার ভেতরে কোনও কাঁপন, কিন্তু চাইলেও আমি থামতে পারি না ভেতরের কাঁপন, থামাতে পারি না সেই কাপঁ ন থেকে সঞ্চারিত সমস্ত শরীরের কাঁপন। ঠোঁটে গাঢ চুমু খায় রুদ্র। ঠোঁটজোড়া, আমি অনুভব করি ফুলে উঠছে, ভারি হয়ে উঠছে, আমি চাই না কিন্তু আমার হাত দুটো রুদ্রকে ঠেলে সরাতে চায়। ব্লাউজটির বোতাম খুলতে থাকে রুদ্র এক হাতে, অন্য হাতে শক্ত করে ধরে রাখে সরিয়ে দিতে চাওয়া আমার হাত। বোতাম খোলা ব্লাউজের ভেতরে রুদ্র মখু ডুবিয়ে দেয়, ভিজে জিভ ভেজাতে থাকে আমার স্তনজোড়া, চর্বচোষ্যলেহ্য স্তনজোড়া। আমি আলথুালু শাড়িতে রুদ্রর বন্ধনের ভেতর তড়পাচ্ছি। রুদ্র নিজের দুটো পা দিয়ে সরিয়ে দিতে থাকে আমার পা দুটো। আমার এক পা যত বেশি আরেক পার ঘনিষ্ট হতে চায়, ততই রুদ্র তার সমস্ত শক্তি খাটায় পা দুটোর ঘনিষ্ঠ হওয়ার বিরুদ্ধে। পা দুটো তোমার স্বামী যেমন করে বলেছে, তেমন করে রাখো মেয়ে, রাখতে হয়, এ নিয়ম, রুদ্র যা করছে সব জেনে বুঝেই করছে, এই করে স্বামীরা, এই করতে হয়, নিজেকে বলি। বলে আমি শরীরের ভেতর থেকে আপনাতেই উঠে আসা প্রতিরোধের শক্তিকে সমস্ত শক্তিবলে নিস্তেজ করি, যেন আমি অবশ পড়ে থাকতে পারি। তাই করি, সজোরে চক্ষুদুটো বুজে, দুহাতে বোজা চক্ষুদুটো ঢেকে, যেন এ আমি নই, এ আমার শরীর নয়, যেন আমি ঘুমিয়ে আছি বাড়িতে আমার ঘরে, আর এখানে যা কিছু ঘটছে, যে অশ্লীল কাণ্ড ঘটছে, এ কাণ্ডের সঙ্গে আমি মোটেও জড়িত নই, আমার শরীরের ওপর জীবনের ওপর কিছু ঘটছে না, এ অন্য কেউ, এ অন্য কারও শরীর, ভাবি। এরপর রুদ্র আমার পুরো শরীরের ওপর উঠে আসে, এবার শুধু চক্ষুবন্ধ নয়, এবার আমার শ্বাস বন্ধ হয়ে আসে। অবশ শরীরের দু পাও ঘনিষ্ঠ হতে চায়। আমার দুপাকে রুদ্র তার দু পা য়ের বাধঁ দিয়ে উরুসন্ধিস্থলে বাড়তি কিছু দিয়ে চাপ সৃষ্টি করে, আমি শ্বাস বন্ধ অবস্থায় চাপটিকে স্বামীর সৃষ্ট স্বাভাবিক চাপ বলে ভাবতে চেষ্টা করি, কিন্তু আমার ভাবনা ছিঁড়ে গিয়ে একটি আর্তচিৎকার আমি না চাইতেও আমার কন্ঠ থেকে বেরোয়। রুদ্র আমার মখু চেপে ধরে দু হাতে। চেপে ধরে, কিন্তু নিম্নচাপটি ওদিকে থেকে যায়। তীব্র যন্ত্রণায় আমি গোঙাতে থাকি, উর্ধচাপ নিম্নচাপ সমস্ত চাপ গ্রহণ করার ক্ষমতা আমার লোপ পায়। রুদ্রর লৌহশরীরটি আমার শরীরে শত ভালবেসেও শত যুক্তিতেও প্রবেশ করতে পারে না। সারারাত ধরে রুদ্র ক্রমাগত যুক্তিমত স্বাভাবিক নিয়ম শৃঙ্খলামত প্রবেশের চেষ্টা করে গেছে, প্রতিবারই আমার না বোঝাতে পারা যন্ত্রণা ও মাগো ও বাবাগো বলে রাতকে জাগিয়ে তুলেছে। প্রতিবারই রুদ্র আমার চিৎকারের ওপর ঢেলেছে আরও চাপ। সেই চাপ ফুঁড়ে বেরিয়ে গেছে চিৎকার। একটি ভয়াবহ রাত শেষ হলে ক্লিষ্ট ক্লান্ত মানুষটি শাড়ি পাল্টো সালোয়ার কামিজ পরে নিয়ে বলি, আমি যাই। আমার নতমখু , আমার নতচোখ, আমার পরাজিত অক্ষম শরীরকে আমি দূরে সরিয়ে নিতে চাই। রাতের কণ্ঠুা, লজ্জা,ভয় আর ঘণৃা আমাকে সকালেও আঁকড়ে থাকে। একই সঙ্গে অপরাধবোধ। রুদ্রকে রুদ্র বলে মনে হয়, স্বামী বলে মনে হয় না। সেগুন বাগিচায় যাওয়ার পথে কেবল বলে, রাতে ওই নাটকটা না করলেই পারতে। সারাপথ আর কোনও কথা বলে না। আমিও না। আমি নিশ্চপু বসে ভাবি রাতটির কথা, এর চেয়ে যদি সারারাত আমরা গল্প করে কাটিয়ে দিতে পারতাম, এর চেয়ে যদি কবিতা পড়ে পড়ে, শুধু দএু কটি খুনসুটি, দুএকটি নির্ভেজাল চুমুতে আমাদের সময় কাটত!

সেই সকালে সেগুন বাগিচায় ফিরে ছোটদাকে কাঁপা কণ্ঠে বলি, রোকেয়া হলে রুনুখালার রুমে ছিলাম।

রুনুখালা তো এখন আর হলে থাকে না। ছোটদা বলেন।

বিয়ে হয়ে যাওয়ার পর বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি বাড়িতে একটি ঘর ভাড়া নিয়ে স্বামী স্ত্রীতে থাকেন। এ ছোটদা জানেন।

কালকে ছিল।

রুম এখনো ছাড়ে নাই নাকি?

না।

হুম। তর বান্ধবীর সাথে না দেখা করতে গেছিলি? দেখা হইছিল?

হ।

কি নাম?

নাদিরা।

নাদিরা? ও ওইযে রামকৃষ্ণমিশন রোডের মেয়েটা না?

হ।

তুই না একদিন কইলি ও জাহাঙ্গীরনগরে ভর্তি হইছে।

কালকে আসমার সাথে দেখা করতে আইছিল রোকেয়া হলে। থাইকা গেছে।

আসমা কুনডা? হাশিমুদ্দিনের মেয়েডা না?

হ।

ও কি ঢাকা ইনিভার্সিটিতে পড়ে?

হ।

তর না সার্টিফিকেট তোলার কথা!

হ। তুলাম।

আমি আর কথা না বাড়িয়ে কম্পমান কণ্ঠটিকে বিশ্রাম দিতে ঘরে লম্বা হয়ে শুয়ে দুঃস্বপ্নের মত রাতটির কথা ভাবি। গত রাতটির কথা। রুদ্র বলেছে আমি নাটক করেছি। ও কি নাটক ছিল! অভিমান আমাকে নিঃশব্দে কাঁদাতে থাকে। সারা শরীরে যনণ্ত্রা, যেন এইমাত্র বাঘের গুহা থেকে ফিরেছি। হাঁটতে গেলে যন্ত্রনা হচ্ছে উরুসন্ধিতে। পেচ্ছাব করতে গিয়ে দেখি যন্ত্রণার এক ফোঁটা দু ফোঁটা পেচ্ছাব। বকু যেন বুক নয়, দুমণ পাথর, চুমুর লাল দাগগুলো টনটন করছে, আঙুল ছোঁয়ানো যায় না। একটি রাত কাটানোর কথা রুদ্র সেই কাগজে সই করার পর থেকে বলছে। সই করার আগেও সে কম কামড় দিতে আসেনি, ঝাঁপিয়ে পড়েছে চুমু খেতে, বুকে হাত দিতে, নিজেকে ছাড়িয়ে বাঁচিয়ে নিয়েছি। ধস্তাধস্তি আঁচ করে মাসুদের বাড়ি থেকে না বলে দেওয়া হয়েছে। সেটি না হওয়াতে অভিমান আর রাগ দুটোই সে কম দেখায়নি আমার সঙ্গে। রাতের মূল্য রুদ্রর কাছে এত বেশি কেন, বোঝা হয়নি আমার। আমি তাকে অনেক বলেছি, জীবনের সমস্ত রাত তো পরেই আছে সামনে, অপেক্ষা করি চল। অপেক্ষার যে কষ্ট, সে কষ্ট তো একরকম সখু দেয়। না রুদ্র অপেক্ষা করবে না। অপেক্ষায় কোনও সখু নেই, সে বলে। আমি যত বলি, চল ভালবাসি, রুদ্র বলে চল শুই, শুতে যাই। রুদ্র হাভাতের মত খাই খাই করছে। আজই তার চাই। এক্ষুনি চাই। এক্ষুনি না হলে তার আর চলছে না। ময়মনসিংহে যখন যায়, নির্জন একটি ঘর পেতে উন্মাদ হয়ে ওঠে। আমার পক্ষে নির্জন ঘর পাওয়া সম্ভব নয় জেনেও ঘর আমি কেন পাইনি এ নিয়ে অভিমান করে, কেবল অভিমান নয়, রাগ। একটি রাত তার কাটানোই চাই। একটি রাত তো শেষ অবদি কাটানোই হল, দুঃস্বপ্নের একটি রাত। আমি এমন করে নিজের জীবনকে ভাবিনি কখনও। আমারও তো অভিমান হয়, আমারও তো রাগ হতে পারে। রুদ্রকে ইচ্ছে করে ছুঁড়ে ফেলে দিই। কিন্তু ফেলতে গেলে দেখি হাত দুটো অচল হয়ে আছে আমার। যেন পঙ্গু আমি। কেবল ওই কাগজটির কাছে হার মেনেছি, আমার ওই সইটির কাছে, যেহেতু ওই কাগজে সইএর নাম বিয়ে! নাকি রুদ্রকে আমি ভালবাসি! ভাবি। ভাবনা আমাকে ছেড়ে কোথাও এক পা যায় না। ছোটদাকে বলা মিথ্যেটি নিয়েও ভাবি। ছোটদা তো ভাবতে পারেন এরকম যে ঝুনু খালার সঙ্গে দেখা হওয়ার পর আমার সেই ইশকুলের বান্ধবীর সঙ্গে অনেকদিন পর আমার গল্প করা গড়িয়ে গড়িয়ে মধ্যরাত ছুঁলে, অগত্যা রুনুখালার পুরোনো ঘরটিতে আমি বাকিরাতটুকু শেষ করেছি ঘুমিয়ে। ছোটদা কি রকম ভেবেছেন কে জানে, তবে আমাকে আগলে রেখে আর কোনও বান্ধবীর সঙ্গে দেখা করতে একা বেরোতে না দিয়ে, রেজিস্টার বিল্ডিংএ আমাকে নিজে নিয়ে গিয়ে সার্টিফিকেট তুলিয়ে, দুদিন পর আমাকে পৌঁছে দিয়ে আসেন ময়মনসিংহে।

রুদ্র পরে বলেছে, আমি তাকে সম্পর্ণ বিশ্বাস করি না। আমার এখনও সংশয় মনে। আমি আহত হয়েছি শুনে। বলেছি তাকে বিশ্বাস করি বলেই, তাকে আমি সম্পণূর্ বিশ্বাস করি বলেই ভালবাসি, ভালবাসতে হলে যে জিনিসটির সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন সে বিশ্বাস। এই বিশ্বাসের মধ্যে একসুতো ফাঁক থাকলে ভাল লাগা হয়ত হয়, ভালবাসা হয় না। রুদ্র লিখেছে, আমি কি এতটাই হতভাগ্য যে আমাকে সব কিছুই জোর করে নিতে হবে? সব কিছু আদায় করে নিতে হবে? জোর করে যতটুকু নেওয়া যায়, যতটুকু নেওয়া শোভন, আমি তা নিয়েছি। আমার আর যা একান্ত পাওয়ার, যা আমার নিভৃততম পাওয়া, যদি কোনোদিন নাও পাই, তবু আমি তা জোর করে নেবো না, আদায় করে নেবো না। বিশ্বাস আর ভালবাসা নিয়ে আমি কখনোই প্রশ্ন তুলি না। সম্পণূর্ বিশ্বাস বলতে আমি অন্য কিছু বোঝাতে চেয়েছি, সেটা বুঝতে না পারার তো কোনো কারণ নেই।

এই ঘটনার প্রায় দেড়বছর পর রুদ্র লেখে, বউসোনা, এবার কি হয়েছে জানো? শাড়ি পরা তোমাকে দেখে প্রথম মনে হল আজ যেন প্রথম তোমাকে দেখছি। যেন তুমি অন্য কেউ, যেন এক অন্য মানুষ, এক নোতুন মানুষ। গত দীর্ঘ সময়ে বিভিন্ন ভাবে, বিভিন্ন রকম ভালো লাগা পেয়েছি কিন্তু এ যেন তার সব কিছু থেকে আলাদা। একেবারে আলাদা এক ভালো লাগা। মনে হলো যেন আমাদের এইবারই ভালবাসার শুরু। যেন এতোদিন শুধু মহড়া হয়েছে। আজ একেবারে মঞ্চে।

দেড় বছরে দুমাস কি তিন মাস অন্তর অন্তর একবার এসেছে রুদ্র ময়মনসিংহে। সম্বোধন করি না বলে রাগ করে আমাকে সম্বোধন হীন চিঠি লিখেছে বেশ কয়েক মাস। প্রেসক্লাবের ক্যান্টিনে আমাদের সময় কেটেছে। ক্যান্টিন থেকে যখন উঠতে হয়েছে, এদিক ওদিক কোথাও বসে কথা বলার জন্য আগের মতই জায়গা খুঁজেছি। বরাবরের মতই জায়গা খুঁজে পাওয়া আমার জন্য দুঃসাধ্য হয়েছে। রুদ্রর অনুরোধে একদিন শাড়ি পরে দেখা করতে যাই। শাড়ি আমি ভাল পরতে জানি না, ইয়াসমিনের সাহায্য নিয়ে মার একটি শাড়ি পরে বান্ধবীর জন্মদিনে যাচ্ছি বলে বেরোই। সে দিনটিতে খানিকটা নির্জনতার সুযোগে দুটো তিনটে চুমু খাবার, বুকে হাত দেবার সুযোগ রুদ্র পেয়েছিল, ফিরে গিয়ে লিখেছে ওই চিঠি।

মনে মনে হাসছো, না?

আসলেই, সত্যি মনে হলো এতোদিনে আমাদের ভালবাসার শুরু। যেন এতোদিন আমরা শুধু পরস্পরকে ছুঁয়ে ছিলাম, আজ যেন আমরা পরষ্পরের শরীরের উত্তাপ পাচ্ছি। বুঝতে পারছি পরষ্পরের হৃদপিণ্ডের ধ্বনি। আজ মনে হচ্ছে কোনোবারই বুঝি এতোটা মন ভরেনি। তুমি একটু একটু করে সহজ হচ্ছে!, স্পষ্ট হয়ে উঠছো। আমি যেন এক অচেনা পৃথিবীকে চিনতে পারছি। আমি তো এতোদিন ধরে তোমার এই সহজ হয়ে ওঠার প্রতীক্ষায় ছিলাম। তুমি আরো, আরো বেশি সহজ আর স্বাভাবিক হয়ে উঠবে। তুমি আরো বেশি উ−ন্মাচিত হয়ে উঠবে। আমাদের মতো এতো সুন্দর আর কারো ভালোবাসার ঘর হবে না—-তুমি দেখে নিও। এবার একটু আদর করো না লক্ষ্মী। না. না. মখু টা ঘুরিও না।তাকাও, আমার চোখের দিকে তাকাও। এতো লজ্জার কি আছে। আমি তো তোমার সেই কতোদিনের চেনা। এই চোখ, এই ভুরু, এই কপাল, এই মখু , এই শরীর তুমি কতোবার ছুঁয়েছো। কতোবার আমরা আমাদের আলাদা কোরে চিনতে পারিনি। তবে? তবে এতো লজ্জা পাচ্ছে! কেন? ঠোঁটটা ছোঁয়াও। কই—ছোঁয়াও।

একটু একটু কোরে বশ করছি নিজেকে। এরোম কোরে আমায় যদি একটু ভালোবাসা দাও, দেখো আমি ঠিক তোমার মনের মতো হয়ে উঠবো। অথবা তুমি ঠিক আমার মনের মতো। আসলে ভালোবাসা মানে বোধহয় দুটি মনকে একটি মন বানিয়ে ফেলা। ইচ্ছে করছে চৌরাস্তায় দাঁড়িয়ে চিৎকার কোরে সবাইকে ডেকে বলি—তোমরা শোনো, আমি আমার ভালোবাসার মানুষ পেয়েছি, আমরা একটি হৃদয় হতে পেরেছি।

লক্ষ্মী থেকো, সোনা আমার। ভালো থেকো প্রাণ। আদর আদর আদর। তোমার রুদ্র।
 
১৬. বদলে যাচ্ছে


অবকাশের চেহারাটি খুব পাল্টো গেছে। ইয়াসমিন মেট্রিক পাশ করেছে। পাশ করেছে প্রথম বিভাগে। রসায়নে একটি লেটার আছে তার। এই লেটারের কারণে ইয়াসমিন আমার চেয়ে বেটার ট্রিটমেন্ট পাচ্ছে সংসারে। বাবা,ওকেও, স্বপ্ন দেখেন ডাক্তারি পড়াবেন। ওর আনন্দমোহনে ভর্তি হওয়ায় বাবা আপত্তি করেননি। ইয়াসমিন হঠাৎ করে যেন অনেক বড় হয়ে গেছে। আগের ছোট্ট বাচ্চাজ্ঞট নেই আর। আমরা দুবোন কোথাও গেলে, অনেকে, যারা ইয়াসমিনকে চেনে না, ভাবে যে ও আমার বড় বোন, গায়ে গতরে আমার চেয়ে বেশি বেড়ে উঠেছে বলেই। আমি যে বয়সে ওড়না পরতে শুরু করেছি, অবশ্য ঘরে নয়, বাইরে, ইয়াসমিনকে তার আগেই পরতে হয়েছে। বুকের বেঢপ বেড়ে ওঠার কারণে ও কুঁজো হয়ে হাঁটতে শুরু করেছে আমার মতই, ওড়না না পরার মাশুল এভাবেই দিতে হয় কি না। মা ওর কুঁজো পিঠেও কিল দিয়ে বলেন, সোজা হ। ওড়না পইরা আয়, তবু সোজা হইয়া হাঁট। বড় হইছে মেয়ে ওড়না পরতে শরম কেন? বয়সে না হয় বড় লাগে আমার চেয়ে ওকে, দুজনের মধ্যে দেখতে কে সুন্দর এই প্রশ্ন উঠলে, আমার দিকে পাল্লা ভারি হয়। ইয়াসমিন নিজের চেহারা, বয়সের চেয়ে বেশি বয়স দেখতে লাগা শরীরটি নিয়ে ভোগে মনে মনে। অথচ চোখের তুলনা করলে ও যদি হরিণ হয়, আমি হাতি,ওর ঘন কালো চুলের সামনে আমার চুল নিতান্তই ফিনফিনে, কিন্তু ছোট নাক, ছোট চিবুক, পুরু ঠোঁট নিয়ে ইয়াসমিনের খুঁতখুঁতুনির শেষ নেই। ওর ভেতরে গোপনে গোপনে একটি ঈর্ষার জন্ম হয়। আমার কোনও ঈর্ষা হয় না, বরং ওকে বাইরের সকল প্রলোভন থেকে, ভুল থেকে মিথ্যে থেকে সরিয়ে রাখতে ইচ্ছে হয়। আমি কিছুতেই চাই না আমি যে দুঃখ বাবাকে দেব, সেরকম কোনও দুঃখ ইয়াসমিনও দিক। আমার চোখের ওপর একটি স্বপ্নের প্রজাপতি এসে বসে, বলে, ইয়াসমিন মেডিকেল কলেজে পড়বে, আমি যত বড় ডাক্তার হব, তার চেয়ে বড় হবে ইয়াসমিন। ডাক্তারি পাশ করে হাবিবুল্লাহর মত কোনও সুদর্শন ডাক্তার ছেলেকে বিয়ে করবে। এতে যদি আমার দেওয়া দুঃখ খানিক লাঘব হয় বাবা মার। ইয়াসমিনের ঈর্ষা আমাকে ব্যথিত করে। লক্ষ করি ও দূরে সরছে। আমার গায়ে গায়ে লেগে থাকা ইয়াসমিন এখন দাদার বউএর গায়ে গায়ে বেশি লেগে থাকে। কলেজে যায় আসে, বাকিটা সময় দাদার বউএর সঙ্গে হাস্যরসের ঢলে সাঁতার কাটে। যদি ওর পড়াশোনার খবর নিতে যাই, ও এমন চোখ করে তাকায় আমার দিকে যেন আমি ওর সবচেয়ে বড় শত্রু। ছোটদা নেই অবকাশে। সাহিত্য সংস্কৃতি নিয়ে আমার মেতে থাকা নেই। ছোটদা যেহেতু লেখাপড়া না করা, অকালে বিয়ে করা, টইটই করে ঘুরে বেড়ানো বখাটে ছেলে ছিলেন, তার সঙ্গে, নাচ গান কবিতা নাটকের অনূষ্ঠানে বাবাকে লুকিয়ে মাকে নিমরাজি করিয়ে আমার আর যাওয়া হয় না। ছোটদাও এখন পাল্টো গেছেন। তাঁকে এখন এ বাড়িতে বড় পিঁড়িটি দেওয়া হয়, টুডাইল্যা নামটি তাঁর ঘুচেছে, তিনি আর খবর রাখেন না শহরে কোথায় কি হচ্ছে, কোথায় নাটক, কোথায় নাচ গান। দাদা আছেন, তবে থেকেও নেই। এ বাড়ির মানুষগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি বদলে গেছেন দাদা। তিনি আর সাহিত্য সংস্কৃতি নিয়ে মাথা ঘামান না। সেঁজুতির প্রসঙ্গ এলে তিনি আর বলেন না, যা আমি ছাপাইয়া দিয়াম নে। সংসারের অন্য কারও কিছু নিয়ে মাথা ঘামান না। গান শোনা, ছবি তোলা, নিজের সুটবুট কেনা, দামি সগু ন্ধি মাখা এসব ব্যাপারেও তাঁর আগ্রহ নেই আর। তিনি বউএর জন্য শাড়ি গয়না কেনায় ব্যস্ত। প্রায়ই শাড়ি কিনে নিয়ে আসেন, আমাদের দেখান শাড়ি কেমন হয়েছে, আমরা বলি খুব ভাল শাড়ি, খুব মানাবে বউকে। বউএর আত্মীয়ের বাড়িতে নিমনণ্ত্র খেতে ব্যস্ত দাদা। বাড়িতে অতিথি এখন বেশির ভাগই হাসিনার বোন, বোনজামাই, ভাই, ভাইবউ ইত্যাদি। আত্মীয়ের মধ্যে কে ভাল, কে মন্দ, কে বেশি কথা বলে, কে কম, কে দেখতে সুন্দর, কে নয়, কার কত ধন আছে, কার কত দারিদ্র এসব নিয়ে আলোচনা করতে তিনি পছন্দ করেন বেশি। বাঁশের কঞ্চির মত শরীর হাসিনার। মা প্রতিদিন ভাল ভাল রান্না করে তাকে খাওয়াচ্ছেন। হাসিনা দাদার সঙ্গে প্রায় বিকেলে বেড়াতে যায়, বাকিটা সময় মুখে কাঁচা হলুদ মেখে দুপুরবেলা বারান্দায় বসে থাকে, অনেকক্ষণ সময় নিয়ে গোসল করে, পাঁচ ছ বেলা খায়, আর ঘুমোয়। তবু সে একটি নতুন জিনিস বাড়িতে, আমাদের উৎসাহ কমে না। বিশেষ করে ইয়াসমিনের। ইয়াসমিন হাসিনার সঙ্গে লেপ্টে থাকে, এমনকি হাসিনার ব্লাউজ খুলে স্তন মুঠোয় নিয়ে মায়ের দুদু খাওয়া বাচ্চার মত শুয়ে থাকে। দেখে লজ্জায় সরে গিয়ে আমি দূর থেকে বলি হাসিনাকে, তোমার শরম করে না? সে বলে, বিয়া হইয়া গেলে আবার শরম থাকে নাকি? মারও তো বিয়ে হয়ে গেছে। মা কখনও স্তন উদোম করে রাখেন না। গীতাও কোনওদিন রাখেনি। গীতার অবশ্য স্তন জিনিসটি কম, ব্রেসিয়ারে তুলো ভরে পরতে হয় তাকে। হাসিনা যেহেতু ভাল শাড়ি পরতেও জানে না, ভাল সাজতেও জানে না, বেড়াতে যাওয়ার আগে ইয়াসমিন হাসিনাকে শাড়ি পরিয়ে দেয়, গীতার শাড়ি পরা দেখে দেখে এই জিনিসটি ভাল শিখেছে ও। হাসিনার মুখ সাজিয়ে দেয়, এও গীতার কাছ থেকে ওর শেখা। হাসিনাকে প্রথম প্রথম আমি হাসিনা বলেই ডাকতাম, কিন্তু এতে সে খুশি হয়নি, বৌদি ডাকার আদেশ দেয়। ইয়াসমিন দিব্যি বৌদি ডাকে। বৌদিকে নিয়ে সে বৌদির বোনের বাড়ি ভাইয়ের বাড়ি বেড়াতে যায়। বৌদি শাড়ি কিনতে যাবে, ইয়াসমিন সঙ্গে যাবে পছন্দ করে দিতে। বৌদি জুতো কিনবে, ইয়াসমিন বাজারের সবচেয়ে ভাল জুতোটি দাদাকে বলবে কিনে দিতে। আমার পক্ষে সম্ভব হয় না কলেজের চেনা একটি মেয়েকে বৌদি ডাকার। হাসিনা ডাকে আপত্তি তোলার পর এই হয় আমার, আমার হাসিনা ডাকটিও বন্ধ হয়ে যায়, এই শোনো, এই দাদার বউ শুনে যাও, এভাবে কাজ চালাই। হাসিনা নামটি দাদার খুব অপছন্দ, তিনি হাসিনা মমতাজ থেকে হাসিনা বাদ দিয়ে, মমতাজ থেকে মম নিয়ে, মমকে মুমু বানিয়ে হাসিনাকে মুমু বলে ডাকেন। দাদা এখন আর মার জন্য বা আমার আর ইয়াসমিনের জন্য কোনও জিনিস কেনার কথা ভাবেন না। ঈদ এলে হাসিনার জন্য বাজারের সবচেয়ে দামি শাড়িটি কিনে আনেন। মাকে একটি শাড়ি দেবার পুনঃ পুনঃ অনুরোধে তিনি চক্ষুলজ্জার খাতিরে ঈদের আগের রাতে মার জন্য হয়ত একটি সস্তা সুতির শাড়ি কিনে আনেন। মা টের পান, এই দেওয়ায় আগের সেই ভালবাসা নেই। আমরাও টের পাই। আমাদের, আমাকে আর ইয়াসমিনকে যে তিনি চক্ষুলজ্জার খাতিরেও কিছু দিচ্ছেন না এ নিয়ে কোনও প্রশ্ন বা অনুযোগ আমরা করি না। কারণ এরকমই নিয়ম বলে ভাবি যে দাদার এখন বউ হয়েছে দাদা বউকেই সব দেবেন। বউকে সুখী দেখলে আমাদের ভাল লাগে। বউএর মুখে হাসি ফুটলে দাদার মুখে হাসি ফোটে। দাদার পকেট থেকে আমাদের আর টাকা নেওয়া হয় না, ছোটদা চলে যাওয়ার পর আমি আর ইয়াসমিনই সে কাজ নিজ দায়িত্বে অনেকদিন চালিয়েছি, ঘরে এখন বউএর পাহারা আছে। দাদার হাত থেকে দপু য়সা খসলে সে পয়সা বাড়ির অন্য কারও জন্য খসতে দিতে রাজি নয় হাসিনা। দাদার টাকাকে দাদার জিনিসপত্রকে হাসিনা তার নিজের টাকা, নিজের জিনিসপত্র বলে মনে করে। আমাদের কাচের বাসনপত্র থেকে সে দাদার কেনা কাচের বাসনপত্র আলাদা করে সরিয়ে নিতে নিতে বলেছে, আমারগুলা তুইলা রাখতে হবে। এইগুলা যেন ইউজ না হয়। দাদার কেনা ফ্রিজে আনুর মা পানির বোতল রাখতে যায়, যেমন আগে রাখত, এখন আনুর মাকে থামিয়ে হাসিনা বলে আমার ফ্রিজে হাত দিতে হইলে আমারে আগে জিগাস কইরা নিবা। ফ্রিজটি নিজ হাতে মুছতে মুছতে সে বলে, আসলে ফ্রিজ একজনের হ্যান্ডেল করা উচিত, এত লোক ফ্রিজে হাত দিলে আমার এই ফ্রিজটা কয়দিন পরেই নষ্ট হইয়া যাইব। হাসিনার এই আমার শব্দটি শুনে মনে হয় আমরা যেন এ বাড়িতে দুটো দল, এক দলে আমরা, আমি বাবা মা ইয়াসমিন, অন্য দলে দাদা আর হাসিনা। রিয়াজউদ্দিনের ছেলে জয়নাল টিনের ঘরে থাকে, ইশকুলে পড়ছে শহরে। জয়নালকে দেখলে হাসিনা বলে, এই ছেড়া এক গ্লাস পানি দে তো অথবা এই ছেড়া দৌড়াইয়া একটা রিক্সা লইয়া আয়, যা। জয়নাল পানি নিয়ে দেয়। দৌড়ে রিক্সা ডেকে আনে। হাসিনা শাড়ি পরছে, আশেপাশেই ছিল জয়নাল,এই ছেড়া জুতাডা মুইছা দে তো। জয়নাল হাসিনার পায়ের কাছে বসে ছেঁড়া ত্যানায় তার জুতো মুছে দেয়। মা একদিন বললেন, জয়নালরে এইভাবে কইও না বৌমা। জয়নাল ত বাড়ির কাজের ছেলে না, নোমানের আপন চাচাতো ভাই লাগে। হাসিনা খসখসে গলায় বলে, ছেড়ারে কইতাম না তো কারে কইতাম? বেডি যে একটা আছে, ও তো পাকঘরেই পইড়া থাহে। ডাইকা পাওয়া যায় না।

আনুর মা তো সারাদিন কাম করে।

সারাদিন কি কাম করে যে এই দিকে আমার কাম করার সময় কেউ পায় না!

আনুর মার কাছে চাও কি চাইবা। সে কি না করছে যে করব না কাম?

এরপর হাসিনা অর্জুনখিলা থেকে তার জুতো মোছা, তার জন্য গোসলের পানি তোলা, গোসলে যাওয়ার আগে তার তোয়ালে আর সাবান গোসলখানায় রেখে আসার জন্য, শুয়ে থাকলে তার মাথায় বিলি কেটে দেওয়ার জন্য ফুলেরা নামের একটি মেয়ে নিয়ে এল। এক বাড়িতে এক চুলোয় সবার জন্য খাবার রান্না হলেও ধীরে ধীরে দুটো সংসার গড়ে উঠছে। হাসিনার গলার স্বর, আমরা সবাই লক্ষ করি খসখসেই কেবল নয়, উঁচওু । এ বাড়িতে বাবার গলাই এমন উঁচুতে ওঠার স্পর্ধা রাখে।

হাসিনার এরকম ঘরে বসে থাকা সইতে না পেরে বাবা তাকে শিক্ষিকা প্রশিক্ষণ কলেজে ভর্তি করে দিয়েছেন। বইপত্র খাতা কলম যা দরকার কিনে দিয়েছেন, টেবিল সাজিয়ে দিয়েছেন ঘরে। বিয়ের পর আর লেখাপড়ার ঝামেলা নেই বলে দিব্যি ছিল হাসিনা। দাদারও আপত্তি ছিল না। কিন্তু বাবার আপত্তি। তিনি হাসিনাকে নিজের কন্যাদের যেমন মনোযোগ দিয়ে পড়াশোনা করার পরামর্শ দেন, নিজের পুত্রবধূকেও দেন। মনীষীদের বাণীর বষর্ণ এবার হাসিনার ওপর, যেন সে বাবার আরেক মেয়ে, তবে একটি সুবিধে তার, বাবার চড় থাপড়, সন্ধিবেত আর চাবুকের চেহারা তাকে দেখতে হয় না। মাও আমাদের যেমন যত্ন করে খাওয়ান, তার চেয়ে অধিক যত্ন করে হাসিনাকে খাওয়ান, হাসিনার এখানেও সুবিধে যে, মা মাঝে মাঝে আমাদের যে ধমক দেন গালাগাল দেন, তা হাসিনাকে দেন না। বাড়ির মানুষগুলো হাসিনার সেবায় নিয়োজিত, সবচেয়ে বেশি নিয়োজিত দাদা। মধুচন্দ্রিমা উদযাপন করতে বউ নিয়ে কক্সবাজার ঘুরে এসেছেন। রেলগাড়িতে নয়, উড়োজাহাজে। সমুদ্রের পাড়ে বড় হোটেলে ছিলেন, নরম বিছানায় শুয়েছেন, হোটেলের লোকেরা তিনবেলা খাবার দিয়ে গেছে ঘরে। হাসিনা সুখে আছে, বুঝি। এত সুখের কথা সে বিয়ের আগে কল্পনা করেছিল বলে মনে হয় না।

জীবন বদলে যাচ্ছে, একসময় রান্নাঘরে চুলোর পাড়ে পিঁড়িতে বসে ভাত খেতাম, পিঁড়ি থেকে পরে শোবার ঘরের মেঝেয় শীতল পাটিতে বসে, পরে খাবার ঘরে শাদামাটা চেয়ার টেবিলে, ধীরে ধীরে টেবিল বড় হল, মসৃণ হল আরও, চেয়ারের মাথা মানুষের মাথা পেরিয়ে ওপরে উঠল। বেতের সোফা সরে কাঠের সোফা এল। হারিকেন থেকে বিদ্যুৎ বাতি এল। হাতপাখা থেকে বৈদ্যুতিক পাখা।টিনের থালা থেকে চিনেমাটির থালা এল। মেঝেয় কয়লা গুঁড়ো করে সেই গুঁড়ো আঙুলে তুলে দাঁত মাজতাম—এরপর নিমের ডাল দিয়ে, ডালের মাথাটা দাঁতে কামড়ে নরম করে নিয়ে—এরপর এল টুথপেস্ট, তিব্বত কোম্পানি থেকে কোলগেট। ঋতুর রক্ত শুষে নেওয়ার জন্য পুরোনো শাড়ির টুকরো বা ত্যানাতুনোর বদলে বাজার থেকে কিনে তুলোর প্যাড ব্যবহার করি। কোরবানির ঈদের সময় আস্ত একটি গরু জবাই করা হল, এর মাংস রাখা হবে কোথায়, বড় বড় পাতিলে ওসব হলুদ আর লবণ মিশিয়ে সেদ্ধ করে রাখা হত, এরপর রান্না করতে হলে সেদ্ধ মাংস তেলে মশলায় নেড়ে রান্না হত, আর অনেকটাই চলে যেত রোদে শুকিয়ে শুটকি করায়। মাংসের টুকরোগুলোর মাঝখানে ফুটো করে দড়ির ভেতর ঢুকিয়ে রোদে টাঙিয়ে দেওয়া হত। সন্ধের আগে আগে রোদে শুকোনো কাপড় যেমন করে তোলা হয়, রোদে শুকোনো মাংসও তেমন তোলা হত। পরদিন সকালে আবার রোদে দেওয়া। ফ্রিজ আসার পর নিয়মগুলো পাল্টো গেছে। এখন আর হলুদ লবণ মিশিয়ে সেদ্ধ করে রাখা হয় না মাংস, শুটকি করাও হয় না খুব, মাংসগুলো ঢুকে যায় রেফ্রিজারেটরের হিমায়িত চেম্বারে। নানারকম যন ্ত্র এসেছে বাড়িতে, রেডিওই ছিল ভরসা, এখন টেলিভিশন, শাদা কালো থেকে রঙিন। আগে কেবল শোনা ছিল, এখন দেখা আর শোনা দুটোই। নাটক সিনেমা দেখার জন্য বাড়ির বাইরে যেতে হয় না, ঘরে বসেই দেখা যায়। নাচ গানও বোতাম টিপলেই। বড় বড় ক্রিকেট ফুটবল খেলা দেখার জন্য কোনও মাঠে দৌড়োতে হয় না, সেও বোতাম টিপলেই। ছবি তোলার জন্য কোনও ছবিঘরে যেতে হয় না আর, কেনা ক্যামেরা দিয়েই যত চাই যে ভঙ্গিমায়, তোলা যায়। জীবন অনেক পাল্টো গেছে। অনেক কিছুই আর আগের মত নয়। এভাবেই একটু একটু করে জীবন পাল্টো যাচ্ছে, সামনে এসে পেছনের দিকে খুব একটা তাকাই না, যেন ফেলে আসা জীবন ভুলে যাবার জীবন। একটি জিনিস কেবল সেই আগের মত রয়ে গেছে, বাড়িতে তিনবেলা ভাত রান্না হত, এখনও হয়। মাটির চুলোয় উঠোনের মাটিতে ঝরে পড়া ডাল পাতা জড়ো করে আগুন ধরাও, আগুন বার বার নিভে যাবে, যতবার নিভবে, ততবার ফুঁকনিতে ফুঁ, চোখ ভেসে যাবে ধোঁয়ায়, চুল ভেসে যাবে ধোঁয়ায়, মা নিজে গোটাটাই ভেসে যাবেন ধোঁয়ায়, আগুন জ্বললে ধোঁয়া উড়ে যাবে, ধোঁয়া উড়ে গেলে দেখতে পাবো মাকে, গালে কালি, হাতে কালি, কপালে কালি। কালিময় বিচ্ছিজ্ঞর মাকে দেখে আমার বা বাড়ির কারো কোনও অবাক লাগবে না, কারণ মা এমনই, মাকে এমনই দেখে এসেছে সবাই। চুলোর পাড়ে কালিঝুলি মাখা মা রান্না করবেন, ক্ষিধে লাগার আগেই মা ভাত বেড়ে দেবেন প্রত্যেকের থালায়। মা তো এ কারণেই। জীবন পাল্টো যাচ্ছে কিন্তু মার মাটির চুলো পাল্টাচ্ছে না, চুলোর পাড়ে বসে শুকনো পাতায় আগুন ধরিয়ে ফুঁকনি ফুঁকে চুলো ধরাতে মাকে জন্মের পর থেকেই দেখে আসছি, এর কোনও পরিবর্তন নেই।

গীতার বাচ্চা হওয়ার তারিখ পড়েছে, ছোটদা জানিয়ে দিলেন, মা যেন সময়মত ঢাকা চলে যান। মা ঢাকা চলে গেলেন বাসে করে, সঙ্গে নিয়ে গেলেন ছোট ছোট কাথাঁ, ছোট পাতলা কাপড়ের জামা। চামেলিবাগে ডাক্তার টি এ চৌধুরির ক্লিনিকে সতেরোই জুন গীতা নয় পাউন্ড ওজনের একটি ছেলের জন্ম দেয়। ক্লিনিক থেকে ফিরে সে হাত পা ছড়িয়ে বিশ্রাম নিতে থাকে, আর দাগ দূর করার মলম মাখতে থাকে পেটে। মা রেঁধে বেড়ে গীতাকে খাওয়ান, গীতার স্নানের জল গরম করে দেন,ম্যাজম্যাজ করা গা মালিশ করে দেন, বাচ্চাকে গীতার কোলে বসিয়ে মিনতি করেন, বাচ্চারে নিজের বুকের দধু খাওয়াইতে চেষ্টা কর আফরোজা। মায়ের দধু টা বাচ্চার জন্য বড় উপকারি। গীতা আগেও চেষ্টা করেছে, তার বুক থেকে বাচ্চার জন্য কোনও উপকারি দুগ্ধ নির্গত হয় না। এসব তো আছেই, প্রচণ্ড উদ্যমে বাচ্চাকে খাওয়ানো, গোসল করানো, ঘুম পাড়ানো, কাথাঁ বদলানোর কাজ করে যান মা। গীতার মা মাসি, বোন ভাই এসে বাচ্চা দেখতে এসে সপ্তাহ খানিক কাটিয়ে যায়। কড়া লাল সিঁদুর পরা, হাতে শাখা পরা গীতার মার সঙ্গে মা হেসে কথা বলেন, নিজেকে বোঝান, হিন্দু হোক তাতে কি, বাচ্চার তো সে নানি। তারও ত হক আছে বাচ্চা দেখার। মা একাই বাচ্চার যত্ন, বাচ্চার মার যত্ন, বাচ্চার দিদিমা, মামা মাসির যত্ন করে যান। তিনমাস অবদি এই চলল, তিন মাস পর ছেলেকে ছেলের বাবা মার হাতে বুঝিয়ে দিয়ে মা বলেন, এইবার তোমাদের ছেলেরে তোমরা পালো, আমি ময়মনসিংহে যাই। মা ব্যাগে যখন কাপড় গোছাচ্ছেন, গীতা আড়মোড়া ভেঙে তার দীর্ঘ বিশ্রাম সেরে উঠে ঘোষণা করল, সে চাকরি করতে যাবে আবার, ঘরে বসে থাকতে তার ভাল লাগছে না।

তাইলে বাচ্চা দেখবে কে?

গীতা নিস্পৃহ ভঙ্গিতে বলে,আমি কি জানি! তোমার বাচ্চা তুমি জানো!

ছোটদা মখু চুন করে ঘরে বসে রইলেন। গীতা যদি চাকরি করতে চলে যায়, বাচ্চা তবে কার কাছে থাকবে?

কাজের লোক রাইখা লও। বাচ্চা রাখুক। গীতার নিরাসক্ত স্বর।

ছোটদা গীতার শিয়রের কাছে বসে গীতার চুলে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে গীতা ও গীতা গীতা গীতা করে গেলেন সারা দুপুর, এরপর গীতার কানের কাছে মখু এনে অনেকক্ষণ ফিসফিস করলেন, মুখটি ঘুরিয়ে ঠোঁটে চুমু খাবার চেষ্টা করে গেলেন অনেকক্ষণ। বিকেলে গীতা শাড়ি পরল, ছোটদার সঙ্গে বাইরে বেরোল। ফেরত এল মার জন্য একটি শাড়ি নিয়ে। মার হাতে শাড়িটি দিয়ে বলল, অনেক খাটছেন ছেলের জন্য, এই নেন শাড়ি।

ছোটদা বললেন, শাড়িটা গীতা পছন্দ কইরা কিনছে। টাঙ্গাইলের বেস্ট শাড়ি।

মা শাড়ি হাতে নিয়ে, হ খুব ভাল শাড়ি বলে শাড়ি বিছানার ওপর রেখে কপালের উস্কোখুস্কো চুল সরিয়ে বললেন,বাবা কামাল, আমারে কালকে কি একটু বাসে তুইলা দিতে পারবা?

কই যাইবেন?

ময়মনসিং।

ময়মনসিং যে যাইবেন, বাচ্চা কার কাছে থাকব? গীতা ত অফিসে যাবে কালকে থেইকা।

ক্লান্তিতে নুয়ে আসা মা ভাঙা কণ্ঠে বলেন, আমি ত অনেকদিন থাকলাম। এইবার যাই।

তাইলে বাচ্চারে আপনে নিয়া যান মা। ময়মনসিংহে নিয়া যান।

মা চমকে ওঠেন প্রস্তাব শুনে। এ কি করে হয়। এ কদিনের মামলা! কদিনের তা ছোটদা বলেন না, গীতাও বলে না। গীতার সাফ কথা, চাকরি সে যে করেই হোক করবে, বাচ্চার জন্য চাকরি বাদ দেবে না। এখন, মা যদি এ বাড়িতে থেকে বাচ্চা লালন পালন করেন, তো ভাল, নয়ত ময়মনসিংহে নিয়ে করুন।

পরদিন মা বাচ্চা কোলে নিয়ে ময়মনসিংহে এলেন। গীতার হাঁড়িমুখে হাসি ফোটে। মা যখন অবকাশে এলেন বাচ্চা নিয়ে, মার রাতজাগা ক্লান্ত মুখের দিকে কারও নজর পড়েনি, নজর পড়েছে নজরফোঁটা লাগানো চমৎকার দেখতে বাচ্চাজ্ঞটর দিকে। অবকাশে এত ছোট শিশু কখনও জীবন যাপন করেনি, আমি আর ইয়াসমিন ঝাঁপিয়ে পড়ি বাচ্চাকে কোলে নিতে। ওকে ছোঁয়া সহজ কথা নয়, গোসল করে পরিষ্কার জামা গায়ে দিয়ে তবেই কোলে নেওয়া যাবে। এ বাচ্চা আমাদের মত ধুলো কাদায় বড় হওয়ার কপাল নিয়ে আসেনি, এর ব্যবহারের সমস্ত জিনিস, এখনও খেলার বয়স না হলেও, আগাম খেলনা, বিদেশ থেকে তো আনা বটেই, ছোটদা নাকের পাটা বুকের পাটা যত পাটা আছে ফুলিয়ে আরও বলেন, জনসন বেবি লোশন আর পাউডার লন্ডনের মাদার কেয়ার থাইকা আনি, দধু আনি সিঙ্গাপুর থাইকা, কাপড় চোপড় আনি দুবাই থেইকা।

বাচ্চার থাকার জায়গা হল বাবার ঘরে, বাবার বিছানায়। বাবা ঘরের কিনারে অন্য একটি খাট পেতে নিলেন নিজের জন্য। ঘরের বন্ধ জানালা খুলে দেওয়া হল, বাবার গায়ে প্রয়োজন না হলেও বাচ্চার গায়ে আলো বাতাস লাগার প্রয়োজন আছে। বাবার ঘরটি ধুয়ে মুছে ঝকঝক করে ঘরে টেবিল পেতে বাচ্চার খাবার সরঞ্জাম সাজিয়ে নিলেন মা, কমলার রস করার যন্ত্র, ভাত শাক সবজি মাছ মাংস মিহি করার যন্ত্র, বিদেশি দুধের কৌটো, বিদেশ আরও নানারকম গুঁড়ো খাবারের কৌটো, বিদেশি ফিডার, বিদেশি বাটি, চামচ। বাচ্চার খেলনা আর কাপড় চোপড় চলে গেল আলমারিতে। বাচ্চার জন্য প্রতিদিন মুরগির বাচ্চার সপু লাগবে,বাবা বারোটি মুরগির বাচ্চা কিনে পাঠিয়ে দিলেন। প্রথম নাতির জন্য বাবা দাতা হরিশচন্দ্র হয়ে উঠলেন।

দাদার আদরের মুমু চোখ বড় বড় করে বাচ্চার বিদেশি জিনিস দেখে। বিদেশি জিনিসে মার কোনও আগ্রহ নেই। কতদূর গেলে ঠিক বিদেশ যাওয়া হয়, মার কোনও ধারণা নেই, বিদেশ খুব সাংঘাতিক কিছু হবে হয়ত, সাত সমুদ্র তের নদী পার হয়ে যেতে হয়, কিন্তু বিদেশি সিল্কের জামা দূরে সরিয়ে দেশি সুতির জামা বাচ্চাকে পরান মা, গরমের দেশে সুতির মত আরাম আর কি আছে! সেরেলাক্স, ফেরেলাক্স ইত্যাদি নানারকম বিদেশি গুঁড়ো খাবার সরিয়ে নিজের হাতে তিনি টাটকা টমেটো, গাজর, পুই শাক পালং শাক নরম করে বাচ্চাকে খাওয়ান। প্যাকেটের ফলের রস ফেলে দিয়ে বাজারের টাটকা ফল থেকে নিজের হাতে রস করে খাওয়াতে লাগলেন। গুঁড়ো দুধে মার বিশ্বাস বাচ্চার পেট খারাপ হয়, ব্রহ্মপুত্রের ওপারে গিয়ে নিজে তিনি ভাগীরথীর মাকে বলে আসেন, তাঁর নাতির জন্য এখন থেকে প্রতিদিন খাঁটি গরুর দধু লাগবে। ভাগীরথীর মা পরদিন থেকে প্রতিদিন আধ সের করে দধু দিয়ে যায়। বাড়িতে বাচ্চাজ্ঞট রাজার বাচ্চার মত বড় হতে থাকে। মার ঘুম হারাম, বাবারও অনেকটা। আমি আর ইয়াসমিন ঘুম হারাম না করলেও বাচ্চা নিয়ে দিনের বেশির ভাগ সময় কাটাতে থাকি। বেশ তো চলছে, কিন্তু বাচ্চার নামের তো দরকার আছে, মণিটা সোনাটা বাবুটা এসব ডাকলে কি চলবে! বাবা আকিকার আয়োজন করলেন। আমরা যে যার বন্ধু বান্ধবকে নেমন্তন্ন করলাম, ছোটদা আর গীতাকেও নেমন্তন্ন করা হল। আকিকার দিন বিশাল এক ষাঁড় জবাই হল, বাবুচির্ আনা হল, বেল গাছের তলে বিশাল গতর্ করে, বড় বড় পাতিলে পোলাও মাংস রান্না চড়ানো হল। মহা আড়ম্বরে আকিকা অনুষ্ঠান হল। বাবা পাঞ্জাবির পকেট থেকে একটি কাগজ বের করে নাম পড়লেন বাচ্চার।

ডাক নাম হল সুহৃদ, আর আসল নাম আলিমুল রেজা।

কি? আলিমুল রেজা? ইয়াসমিন আর আমি পরষ্পরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করি। আমার ঠোঁট নাক ভুরু সব বেঁকে থাকে।

আলিমুল রেজা আবার কি? এইটা কোনও নাম হইল? আজকাল আরবি নাম কেউ রাখে?

বাবা কঠিন স্বরে বললেন, রাখে।

সুন্দর একটি বাংলা নাম রাখব ইচ্ছে ছিল। ইচ্ছে ছিল হৃদয় রাখব, হৃদয় সমুদ্র। আমার ইচ্ছের কোনও মূল্য নাম রাখার মত বড় ক্ষেত্রে নেই। মা বললেন, কোন এক পীরের কাছ থেইকা আলিমুল রেজা নামডা আনছে।

কোন পীর?

রাজিয়া বেগমের পীর। তর মাথার তাবিজও ওই বেডির কাছ থেইকা আনছিল।

মাস দুই পর ছোটদা গীতাকে নিয়ে এলেন সুহৃদকে দেখতে। সুহৃদের জন্য একগাদা বিদেশি জিনিসপাতি রেখে ক্যামেরায় সুহৃদকে কোলে নিয়ে তাঁদের বিভিন্ন কায়দার ছবি তুলে নিয়ে বিকেলেই চলে গেলেন ঢাকায়। অবশ্য পিয়নপাড়া হয়ে গেলেন। সুহৃদ মার কোলে কাখে বড় হচ্ছে। মার রাত দিন ব্যস্ততা। নাওয়া খাওয়ার সময় নেই। শাড়ি আলথুালু চুল না আঁচড়ানো। সুহৃদের কাজের জন্য নার্গিস নামের এক মেয়েকে রাখা হয়েছে, নার্গিস সুহৃদের থাল বাটি ধোয়, খাবার জল ফুটোয়, সুহৃদের কাথাঁ কাপড় কাচে, তবু মার এক ফোঁটা বিশ্রাম নেই। সুহৃদ মার য−ত্ন আদরে মোটা তাজা হতে থাকে। ক্যালেন্ডারের গ্লাক্সো কোম্পানীর বাচ্চাদের থেকেও সুন্দর হয়ে উঠতে থাকে ও। মা মা ডাকার আগে শেখে দা দা, দা দু। বাড়িতে সুহৃদের আদর হাসিনা আড়চোখে দেখে। দাদাও। বড় আদরে বড় হতে থাকলেও সুহৃদের একটি অসখু দেখা দেয়। পেচ্ছাব করার সময় ও চিৎকার করে কাঁদে। ডাক্তার দেখে বললেন, অপারেশন করতে হবে। সুহৃদকে নিয়ে আমি আর বাবা হাসপাতালে যাই। বাড়িতে মা গলা ছেড়ে কাঁদছেন দুশ্চিন্তায়। অপারেশন থিয়েটার ফেটে যায় সুহৃদের চিৎকারে, বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা আমারও চোখ ভেঙে জল নামে। পরের মাসে ছোটদা আর গীতা এলে সুহৃদের কষ্টের কথা শুনে দুজনের চোখই ভিজে থাকবে সারাক্ষণ, ভাবি। কিন্তু এলে, যেই না বিস্তারিত বর্ণনা করতে নিই কি করে এইটুকুন একটি বাচ্চা যনণ্ত্রায় ছটফট করেছে, ছোটদা মাঝপথে আমাকে থামিয়ে বলেন, মুসলমানি হইয়া গেছে ভালাই হইছে। এটুকুই, একটি আহা শব্দ শোনার সৌভাগ্য আমার হয় না। ভারি গলায় বলি, এইডা মুসলমানি না, ফাইমসিস হইলে এই অপারেশন করতে হয়।

চল তাস খেলি গা। ছোটদা এক হাতে আমাকে, আরেক হাতে গীতাকে ধরে শোবার ঘরের দিকে যেতে যেতে বলেন।

তাস যখন খেলছি এ ঘরে, ও ঘরে মা সুহৃদকে ঘুম পাড়ানি গান গাইয়ে ঘুম পাড়াচ্ছেন। ঘুম আসেনা ওর, ছটফট করে, গায়ে জ্বর আসছে ওর। মাথায় জলপট্টি দিচ্ছেন মা, জ্বর আসছে খবর পেয়ে আমি আর ইয়াসমিন দৌড়ে খেলা থেকে উঠে যাই। বাবাকে খবর পাঠানো হয়, বাবা এসে সুহৃদের জ্বর দেখেন। দ্রুত চলে যান ফার্মেসি থেকে ওষধু আনতে। ছোটদা আর গীতাকে বলি, সুহৃদের গা জ্বরে পুইড়া যাইতাছে। গীতা কপাল কুঁচকে বলে, জ্বর হইল কেন? বাসি কিছু খাওয়াইছিল নাকি?

বাসি? পাগল হইছ? মা দুধের বোতল ফুটানো পানিতে সাতবার ধইয়া নেয়।

চোখ কপালে তুলে গীতা বলে, সাতবার ধইয়া নেয়? যেন সাতবার যে কোনও জিনিস ধোয়া যায়, তা সে এই প্রথম শুনল। মা তাই করেন, মার ভয়, কখন আবার পেটের অসখু , জ্বরজ্বারি হয়ে যায়। সুহৃদের খুব অল্প কিছুতেই কিছু হয়ে যায়।

যাও, সুহৃদের কাছে যাও না একটু। যাও, দেইখা আসো। বলি গীতাকে। সে অগত্যা তাস ফেলে সুহৃদের কাছে বসতে যায়। কিন্তু বসার দুমিনিট পর শুয়ে পড়ে, শুয়েই ঘুম। শেষ অবধি অন্য বিছানায় এসে তাকে ঘুমোতে হল। মা সারারাত জেগে রইলেন জ্বর হওয়া সুহৃদকে নিয়ে।

সুহৃদ অবকাশে তিন মাস যাপনের পর হাসিনাকে হাসপাতালে যেতে হল। তার বাচ্চা হবে। দাদার বন্ধুরা ডাক্তার, বাবার বন্ধুরা অধ্যাপক, মহা সুবিধে হাসপাতালে, বাচ্চা হয়ে যাবার পর, ইঁদুরের মত ছোট্ট ছেলেটির জন্য হাসপাতালের কেবিনে সব ডাক্তারদের মিষ্টিমখু নয় কেবল, বিরানি-মখু করালেন দাদা। আমি ক্লাসের বন্ধুদের নিয়ে বিরানি খেয়ে এলাম। ইদুঁরটি নিয়ে অবকাশে ফেরা হল। সুহৃদের যেমন যত্ন হয়, ঠিক তেমন য−ত্নর আয়োজন করল হাসিনা তার নিজের বাচ্চার জন্য। অর্জুনখিলা থেকে বাচ্চার জন্য একটি কাজের মেয়ে নিয়ে আসা হল, নতুন মেয়ে নতুন বাচ্চাকে কোলে রাখে, নতুন বাচ্চার কাথাঁ কাপড় কাচে। বাড়িতে কাজের মানুষ এখন চারজন। নার্গিস আর ঝর্ণা, সুহৃদ আর নতুন বাচ্চা শুভর জন্য। বড়দের কাজ করার জন্য, রান্নাবান্নার, কাপড়চোপড় ধোবার, ঘর দোর পরিষ্কারের জন্য আনুর মা আর সুফি। আরেক জন ফুলেরা, অর্জুনখিলা থেকে আনা, হাসিনার ব্যক্তিগত কাজকর্ম করার জন্য। বাবা একদিন বাড়ির মানুষের মাথা গুনতে বসেন। গুনে বলেন, এতগুলা মানুষের খাওন একজনের যোগাড় করতে হয়! লোক বিদায় কর।

কারে বিদায় করতে কয় তোমার বাবা? ঝর্ণারে নাকি? হাসিনা কটাক্ষ করে।

দাদা বলেন, ঝর্নার কথা কয় নাই।

ঝর্নারে আনার আগে তো বাবা মাথা গুনে নাই!

বাবা মাথা প্রায়ই গোনে।

নার্গিস আসার পর গুনছিল?

তাও তো কথা! গুনে তো নাই।

দুনিয়াডা একটু বুঝার চেষ্টা কর।

দুনিয়া কি আমি বুঝি না নাকি?

না, মোটেও বুঝো না। বুঝলে তুমি মখু ফুইটা কিছু কইতে পারতা। সুহৃদই তাদের একমাত্র নাতি না। সুহৃদের জন্য যা করা হয়, তার কয়ভাগ শুভর জন্য করা হয়? হিশাব আছে।

দাদা চপু হয়ে থাকেন। সম্ভবত দুনিয়া বোঝার চেষ্টা করেন।

খসখসে কণ্ঠটি উঁচুতে ওঠে।

যাও,বাচ্চার পাউডার লাগবে, পাউডার নিয়া আস।

কি কও মুমু পাউডার না কালকে আনলাম!

বাজে পাউডার। মুখ খসখস করে। জনসন আনো।

জনসন বেবি পাউডার বাজারে যা পাওয়া যায়, তা নকল। ময়দা ঢুকাইয়া রাখে কৌটায়। তিব্বত পাউডারই ভাল।

আরে কি আশ্চর্য, দেশি জিনিস ব্যবহার করব নাকি শুভর জন্য? তোমার কি মাথা খারাপ? আরেকটা বাচ্চার যত্ন ত চোক্ষের সামনেই দেখতাছ? কোনও দেশি জিনিস ব্যবহার হইতাছে ওই ঘরে?

কামালের মত বিদেশ গেলে না হয় বিদেশি জিনিস আনতে পারতাম। সেদিন পয়জন সেন্ট কিনলাম, মেইড ইন ফ্রান্স, শালার বোতলের মধ্যে নুরানি আতর ভইরা রাখছে। এই যে ফেরিওলারা খালি শিশি বোতল কিনতে আসে, ওরা কি করে জানো, শিশি বোতল গুলা নিয়া না বেইচা দেয় জিঞ্জিরায়, জিঞ্জিরায় সব তো দুই নম্বর মাল জানো তো!

অর্ধেক খরচ হওয়া জনসন পাউডারের একটি কৌটো হাসিনার দিয়ে মা বললেন আমার চাইর পুলাপান বড় হইছে দেশি পাউডারে, শইলের চামড়া দেইখা পাড়ার মানুষে কইছে, কী মাখ যে চামড়া এত সুন্দর?

হাসিনা পাউডারের কৌটো নেয় না। অর্ধেক ছাড়া পুরো নেই, মা কথা দেন পরের বার ছোটদা এলে তিনি শুভর জন্য বিদেশি পাউডার আনতে বলবেনই। পাউডারের ঘটনার দিনই ইয়াসমিন কলেজ থেকে ফিরে হাতের কাছে ঝর্ণাকে পেয়ে বলল, এক গ্লাস পানি দে তো ঝর্ণা।

ঝর্ণা এদিক ওদিক হাঁটে, কিন্তু পানি দেয় না।

কী রে পানি আনলি না?

আমি বাচ্চার কামের লাইগা। অন্য কাম করতে না করছে মামী। আপনেগো নার্গিস আছে, নার্গিসরে কন।

বড়দের কাজ করার দুজনের জায়গায় এখন একজন কেবল। এ বাবার লোক কমানোর আওয়াজে কমেনি, আনুর মা য়েচ্ছায় হাওয়া হয়েছে, এরকম হাওয়া হওয়া খুব অস্বাভাবিক ঘটনা নয়। একজন হাওয়া হলে, আরেকজন উদয় হয়। এখন নার্গিসকে ছোটর কাজ শেষ করে এসে বড়র কাজে নামতে হয়। ভর সন্ধেয় ঘর মুছছে নার্গিস, তেরো বছর বয়স, ঠোঁট শুকিয়ে কাঠ, ত্বক শুকিয়ে কাঠ,গা থেকে বোঁটকা গন্ধ বেরোচ্ছে। ঘর মোছা রেখে বোঁটকা গন্ধ দৌড়ে গিয়ে কল চেপে গেলাসে পানি ভরে নিয়ে ইয়াসমিনকে দেয়। বোঁটকা গন্ধ ফিরে আসে ঘরে।

কি রে নার্গিস গোসল করস না নাকি?

করি তো।

খাওয়া গোসলের কথা জিজেস করলে ও শরমে মাথা নামিয়ে রাখে।

কি রে, খাইছস নার্গিস?

এই তো ঘরগুলা মুইছা গিয়াই খাইয়াম।

সন্ধ্যা হইয়া গেল, তর দুপুরের খাওয়া এখনও হয় নাই?

খিদা লাগে নাই তর? জিজ্ঞেস করি।

না খিদা লাগে নাই। খাইছি ত!

কখন খাইছস?

সকালে নাস্তা খাইছি তো।

প্রতিদিন কি সন্ধ্যার পর দুপুরের খাবার খাস?

না না। কী যে কন আপা। কাপড় ধোয়া হইছে তো। একটু দেরি হইয়া গেছে আজকে।

চোখে আমার করুণাধারা, মনে কণ্টকীর বেড়ে ওঠা।

চুলোয় পাশে দধু জ্বাল দিতে থাকা গরমে ঘামতে থাকা মাকে আমার রোষানলে আরও তপ্ত করি।

তুমি কি নার্গিসরে গোসল করার, খাওয়ার সময়ও দেও না নাকি?

মা ফুঁসে উঠলেন, ও কখন খায়, কখন গোসল করে, এইসব খবর তুই জানস নাকি! ছেড়িডা এত ধীর গতির, একটা বোতল ধুইতেই দশ মিনিট লাগায়। নিজেই কইছে ঘর মুইছা পরে খাইব।

সে সন্ধেয় নার্গিসের আর খাওয়া হয় নি। খেতে খেতে রাত বারোটা। মেয়েটির জন্য আমার বড় মায়া হতে থাকে। পরদিন সকালে রান্নাঘরে রুটি বেলছে। আমার চা চাই এর হাঁক শুনে, চা নিয়ে সামনে এসে দাঁড়াতেই ওর মুখে মুখে চেয়ে চমকে উঠি, সারা মুখে লাল ফুসকুড়ি।

কি রে তর কি হইছে, বসন্ত নাকি?

না, কিছু হয় নাই তো!

মুখে কিসের দাগ এত!

না কিছু না। নার্গিস হেসে হাতে মুখ ঢাকে।

ওর হাত সরিয়ে নিয়ে মুখের দাগগুলো দেখি। কয়েকশ ফুসকুড়ি মুখে, বীভৎস দেখাচ্ছে মখু টি। ফুসকুড়ি হাতেও আছে। পায়েও।

তর ত বসন্ত হইছে।

না, বসন্ত হইব কেন? কি যে কন আপা। মশার দুএকটা কামড়।

মশায় এইভাবে কামড়াইছে?

সুহৃদের গুমুতের কাথাঁ নার্গিসের হাতে দিতে এসেছেন মা, কলপারে নিয়ে ধুতে হবে, রুটি বেলবে সুফি।

নার্গিসরে একটা মশারি দিতে পারো না নাকি মা? ওর তো মুখের অবস্থা সাংঘাতিক খারাপ!

মশারি আছে তো। লাগায় না কেন? মার নিরুদ্বেগ স্বর।

মশারি লাগাই তো। ওই দুইএকটা ছিদ্র দিয়া মশা আসে। এমন কিছু না। নার্গিস তার গাল আড়াল করে রাখে দু হাত বোঝাই কাপড়ে।

ছিঁড়া মশারি শিলাই কইরা লইতে কইছি, ছেড়িডা আইলসার আইলসা। মা বলেন।
 
সেই রাতে মেঝেতে একটি ছেঁড়া কাথাঁ বিছিয়ে নার্গিস যখন শুয়েছে, রাত তখন অনেক। আমি ওকে টেনে তুলে বললাম, যা মশারি লাগাইয়া শ। ঘুমচোখে ও রান্নাঘরের খোপ থেকে মশারি নিয়ে এল। নার্গিস ছেঁড়া মশারিটিই টাঙাতে থাকে, এক ফিতে এক চেয়ারে, আরেক ফিতে এক ছিটকিনিতে। মশারিটিতে আমি গুনে দেখি, আটানব্বইটি ছিদ্র। ওই শত-ছিদ্র মশারি ব্যবহার করা না করা সমান কথা।

নার্গিসের মুখে আরও নতুন ফুসকুড়ি। পরদিনও আমি মশারি নিয়ে পড়ি।

মা, সুহৃদকে পায়ের ওপর শুইয়ে দধু খাওয়াচ্ছিলেন, কাছে গিয়ে সুহৃদের গালে আদর করে দিতে দিতে মাকে বলি, মা ওই ছেঁড়া মশারি ছাড়া আর কোনও মশারি নাই নাকি? নার্গিসের মুখটা দেখছ?

আর কোনও মশারি থাকলে কি আমি দেই না নাকি? তর বাপে কি কিছু কিনে? ছিঁড়া ছিঁড়া মশারি তো শিলাই কইরা চালাইতাছি। আমি যদি কই কামের মানুষের লাইগা মশারি লাগব, আমারে উল্ডা যা তা কথা কইব। সুহৃদের বিছানার লাইগা নতুন মশারি কিনছে। আমার ত নাইলে থাকতে হইত ছিঁড়া মশারি দিয়াই।

কও তাইলে যে আমার বিছানায় একটা মশারি লাগব, তারপর নতুনটা আমি লাগাইয়া আমারটা কাজের মানুষদের দিয়া দিই। সুফিরেও ত মশা কামড়ায়।

তর বাপেরে চিনস না! কিছুতেই কিছু কিনব না। টাকা পয়সা তো সব পাঠাইয়া দেয়। কাইলও রিয়াজউদ্দিন আইসা টাকা লইয়া গেছে।

সুহৃদ হঠাৎ ওয়াক করে উঠল, বমি।

মেজাজ খিঁচড়ে ওঠে মার। পেটে কিচ্ছু থাকে না ছেলেটার, যা খাওয়াই তাই বমি কইরা ভাসাইয়া দেয়।

মা দুধের বোতল ছুঁড়ে ফেলে দিলেন। নার্গিস সপু এনে নরম গলায় বলল, খালা, সপু টা কি এখন খাওয়াইবেন?

ফালাইয়া দে সপু । খাওয়াইয়া লাভ কি, সবই তো ভাসাইব।

জানি, মা যাই বলুন না কেন, নতুন উদ্যমে আবার সপু বা দধু খাওয়াতে শুরু করবেন, আবারও বমি করে ভাসাবে, আবারও খাওয়াবেন। মার অতি যত্নে ছেলেটি নাদুসনুদুস হচ্ছে।

ছোটদা গীতাকে নিয়ে যেদিন নাদুস নুদুসকে দেখতে এসে শহরে ঘুরে পিয়নপাড়া হয়ে সন্ধেয় বাড়ি ফিরে ফুরফুরে মন নিয়ে বলেন, কালকে চইলা যাইতে হইব, পরশুদিন ফ্লাইট আছে।

আইসাই যে যাই যাই করস, মা বলেন সুহৃদরে তো একটু কোলেও নিলি না।

কোলেই আসে না, কি আদর করাম!

মা, বাবা, আমার আর ইয়াসমিনের কোল ছাড়া আর কারও কোল সুহৃদের ভাল লাগে না। ওর নিজের বাবা মা এলে মুখ ফিরিয়ে রাখে। এতে ছোটদার আপত্তি না থাকলেও গীতার আপত্তি।

আমার পেটের ছেলে হইয়া আমার দিকে ফিরে না?

মা হেসে বলেন আমাদেরে দেখে তো চোখের সামনে, তাই। তুমি আরও ঘন ঘন আসবা, তাইলেই চিনব তোমারে।

সকালে ছোটদার নাস্তার জন্য ঘি এ ভাজা পরোটা আর খাসির মাংস করতে মা রান্নাঘরে ছোটেন।ছোটদারা বাড়ি এলে সখুাদ্যের আয়োজন হয়। যে ছোটদাকে বাবা ত্যাজ্যপুত্র করতে চেয়েছিলেন, সেই ছোটদাকে এখন কাছে বসিয়ে বাবা আমার, ছেলে আমার বলে আদর করে কাছে বসান। যে ছোটদা চুরি করে দাদার জামা পরতেন, সেই ছোটদার পরনের জামা দেখে দাদার চোখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে, বাহ! শার্টটা তো সুন্দর! আমার লাইগা এইরকম একটা শার্ট আইনা দিস তো! যে ছোটদা আমার কাছে এক টাকা দু টাকা ভিক্ষে চাইতেন, সেই ছোটদা বলেন, কী রে তর সেঁজুতির খবর কি!

খবর আর কী! ছাপানোর টাকা নাই।

দে তর পাণ্ডুলিপি দে। ঢাকা থেইকা ছাপাইয়া আইনা দিই।

সেই ছোটদা সেঁজুতির পাণ্ডুলিপি নিয়ে গেলেন ঢাকায়, ছাপতে। পাণ্ডুলিপি তৈরিই ছিল। এ সেঁজুতিতে রুদ্রর কবিতা তো আছেই, এখন যৌবন যার ,যুদ্ধে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময় এর নিভৃত নির্জন কবি হেলাল হাফিজের আর পশ্চিমবঙ্গের কিছু কবির কবিতা। রুদ্রর এক বন্ধু মইনুল আহসান সাবের, নতুন গল্প লিখতে শুরু করেছে, চমৎকার গল্প লেখে, ওর একটি গল্প আর নিজের একটি গল্পও, এই প্রথম সেঁজুতিতে আমার গল্প, আর আনন্দমোহন কলেজের বাংলার অধ্যাপক শরফউদ্দিন আহমেদের কবিতার একাল সেকাল নিয়ে একটি প্রবন্ধ। এবার নিজে পঈচ্ছদ করিনি। শিল্পী দিয়ে করা। ছোটদার হাতে পাণ্ডুলিপি দেওয়ার আগে তড়িঘড়ি সম্পাদকীয় লিখে দিই, একেবারে নিরুৎসাহ ছিলাম। সত্য ও সুন্দরের এমন আকাল পড়েছে দেশে, সৃষ্টিশীল কিছু একটা করতে এক পা এগোলে দু পা পেছোতে হয়। আমার বাবা বলেন সেঁজুতি করে করে আমি নাকি আমার ভবিষ্যতের বারোটা বাজাচ্ছি। মা দুঃখ করে বলেন, মেয়েটা নষ্ট হয়ে গেল। একেবারে নিরৎু সাহ ছিলাম, একজন বাড়িয়ে দিল সহযোগিতার হাত। আমার শৈশব আর কৈশোরের ভালবাসা। গোপনে গোপনে যার লেখা থেকে আমার কবিতার প্রেরণা। তার হাতে আমার শ্রম আর সাধনার ধন সেঁজুতি তুলে দিলাম আর আমার পরম বিশ্বাসটুকু দিলাম।

পরম বিশ্বাসের মর্যাদা ছোটদা রেখেছেন। দিব্যি সেঁজুতি ছেপে আনলেন। অবশ্য সে ঘরে আসতে আসতে তিন মাস পেরোলো। ছোটদা বললেন, ওই দাড়িঅলা বেডার কবিতা বাদ দিছি।

রুদ্রর কবিতাহীন সেঁজুতিটি দেখে মন খারাপ হয়ে যায়। প্রথম কাজ রুদ্রর ঠিকানায় দশ কপি পাঠিয়ে দেওয়া। পেয়ে সে জানাল, আরও পঁচিশ কপি পাঠাতে। পঁচিশ কপির পর আরও চাইল। ময়মনসিংহেও সেঁজুতি বিলি হল। স্টেশন রোডের পত্রপত্রিকার দোকানে বিক্রি করতে দিলে বেশ বিক্রিও হল। সেঁজুতির পাণ্ডুলিপি তৈরি করতে আবারও মন চায়। কিন্তু সময় কোথায়। লেখাপড়ার চাপ বাড়ছে। বাবা বললেন, এখন থেইকা যদি ফাইনালের জন্য প্রস্তুতি না নেস, তাইলে আর পাশ করা হইব না। বাবা কথা ভুল বলেন না। প্রতিবছর শেষ পরীক্ষায় আটকে যাচ্ছে ছাত্রছাত্রীরা। দুবারে গতি হচ্ছে না,এমন কি চারবারেও না। আমার এক ক্লাস ওপরের ছাত্র রাজিবকে বাবা বলেছেন আমাকে যেন তিনি তাঁর নোটখাতাগুলো পড়তে দেন। রাজিব মেডিকেলের সবগুলো পরীক্ষায় প্রথম হওয়া ছেলে, শিক্ষকদের আদরের ধন। এক কথায় চিকিৎসাবিদ্যার যে কথা বলা যায়, একশ কথায় তার নাড়ি নক্ষত্র তুলে ধরে লেখা খাতার সপ্তূ দিয়ে গেলেন আমাকে। নাড়ি নক্ষত্রে ঝুঁকে আমার বেলা ফুরোতে লাগল।

নানা আসছেন প্রায়ই দুপুরে। বারান্দার চেয়ারে বসে তিনি উঠোনের রোদের দিকে তাকিয়ে থাকেন। তাকিয়ে থাকেন যতক্ষণ না মা এসে বারান্দার বা উঠোনের রোদে পিড়ি পেতে বসিয়ে নানার ফর্সা শরীরটিকে মেজে গোসল করাতে ডাকেন। মার নাভিশ্বাস ওঠে সংসার সুহৃদ সামলাতে। তারপরও নানা এলে নানাকে রোদে বসিয়ে শরীর মেজে গোসল করিয়ে বাবার একটি ধোয়া লুঙ্গি পরিয়ে শুইয়ে রাখেন। নানা বাচ্চা ছেলের মত ঘুমিয়ে পড়েন। ঘুম থেকে উঠলে মা ভাত এনে দেবেন খেতে, ভাতের পর পায়েস। নানার পায়েস খাওয়ার মধ্যে বাবা চলে আসেন। মা অপ্রস্তুত হয়ে বলেন, বাজান তো এই বাড়িতে আসেই না, আসলেও তো কিছু খায় না। কত কইয়া একটু পায়েস খাইতে দিলাম।

বাবা ঠাণ্ডা গলায় বলেন, তোমার বাপেরে যে পায়েস খাওয়াইতাছ, তার ত ডায়বেটিস!

একটু খাইলে কিμছু হইব না। বাজান মিষ্টি খাইতে পছন্দ করে।

আমি নাড়ি নক্ষত্রে। নাড়ি নক্ষত্র থেকে উঠে যেই না মার শরবতের কিনারা করতে পেশাবখানায় যাচ্ছি, দেখি মা দরজা ধরে বসে আছেন।

কি? রক্ত গেছে পাইলসের।

হ।

মা ওই রক্ত যাওয়া শরীরেই উঠে সুহৃদের দুধের বোতল ফুটোনো পানিতে ধুতে শুরু করেন। বোতলে দুধ ভরে, সুহৃদকে ফুটফুটে এক রাজকুমারের গল্প বলতে বলতে দধু খাওয়াবেন মা। দুধ খাওয়ানো শেষ হলে বনবাসী এক রাজকুমারীর গান শোনাতে শোনাতে ঘুম পাড়াবেন। সে রাতে বাবা ফিরলে বলবেন, পাইলসের কোনও চিকিৎসা নাই? রক্ত যা আছে শইলে, সব তো গেল গা!

বাবা উত্তর দেবেন না। একবার আমার ঘরে উঁকি দিয়ে দেখে যাবেন নাড়িনক্ষত্র নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছি নাকি কবিতা লিখছি নাকি প্রেমপত্র!

মা কাতরকণ্ঠে বলতে থাকবেন, আমার তো একটু দুধ খাওয়া দরকার। একটা কলা অন্তত দিনে। একটা ডিম। এইভাবে রক্ত গেলে শইলে তো আর কিছু থাকব না। আমার জন্য এক পোয়া কইরা দধু দিতে কই ভাগীর মারে?

বাবা এসবের উত্তর দেবেন না।



সুহৃদ হামাগুড়ি দিতে শিখেছে। চারপাশে রাজ্যির খেলনা নিয়ে খেলতে শিখেছে। সুহৃদের প্রতিটি উত্তরণে আমার আর ইয়াসমিনের আনন্দ উপচে ওঠে। আমরা কাড়াকাড়ি করি ওকে কোলে নিতে। ওকে নিয়ে বেড়াতে। ওকে দোলাতে। সুহৃদকে কোলে নিয়ে বারান্দার দোলনায় দোলাচ্ছি।

দাদা বারান্দায় বসে গলা ছেড়ে গান গাইছেন, হাড়ের ঘরখানি চামড়ার ছাউনি বান্ধে বান্ধে জোড়া। টাঙ্গাইলের রাস্তায় এক ভিখিরিকে গানটি গাইতে দেখে শিখেছেন। হাসিনা ঘর থেকে বেরিয়ে এসে খেঁকিয়ে ওঠে, গান গাইলে চলব! শুভর মুরগি নিয়া আস।

দাদা গান থামিয়ে বলেন, মুরগি নাই?

না নাই। শুভর মুরগি নাই।

একদিন মুরগি না খাইলে কিছু হইব না মুমু।

হাসিনার গলা চড়ে, দাঁড়কাকের কর্কশতা গলায়, কিছু হইব না মানে! বাড়িত ত আরেকটা বাচ্চা আছে, কেমনে ফু পাইড়া পালা হইতাছে দেখতাছ না! তুমার বাচ্চার বেলায় এত অবহেলা কেন! নাতি কি একটাই নাকি? শুভ কি নাতি না?

মুরগি নাই কও কেন? ওই তো উঠানে মুরগি হাঁটতাছে।

হাসিনার চোখ থেকে আগুনের ফুলকি ওঠে।

বাচ্চা-মুরগি নাই।

ওই যে দেখ মুমু খাঁচার মধ্যে বাচ্চা মুরগি। জবো করতে কও।

ওইগুলা সুহৃদের, ভাল কইরাই ত জানো। তুমার ছেলের জন্য তো আর বাবা মুরগি কিন্যা রাখে নাই।

মা শব্দ শুনে বেরিয়ে এসে নাক গলান, বৌমা এই সব কি কও, সবসময় না তোমার শ্বশুর দুই বাচ্চার জন্য মুরগি কিনতাছে। সবসময় না দুইটা মুরগির সপু হইতাছে। সুহৃদের একটা, শুভর একটা। তোমার শ্বশুর তো দুই বাচ্চার জন্যই দধু ডিম সব কিনতাছে। শুভ সুহৃদ দুই জনই ত নাতি।

দুই জনই ত নাতি। তা ত জানি। কিন্তু এক নাতির দিকেই ত সবার নজর। শুভর দিকে কে ফিরা চায়! হাসিনা কড়মড়িয়ে ওঠে।

ফির‌্যা চায় না মানে! কি যে উল্ডা পাল্ডা কথা কইতাছ। সুহৃদের বাবা মা কাছে নাই। তাই ওরে দেখতে হয়।শুভ ত তার বাপ মার সাথেই আছে।

হাসিনা ঘরে গিয়ে শাড়ি পাল্টো, আমি পারভিন আপার বাসায় যাইতাছি, মা শুভরে দেইখা রাইখেন ত।

বলে গটগট করে পেছনে না ফিরে চলে যায়। মা তখন এক হাতে সুহৃদকে, আরেক হাতে শুভকে সামলাচ্ছেন।

দাদা বাকি গানটুকু গাইছেন।

হাসিনা প্রায়ই তার নকলে ফুপাতো বোন আসলে আপন বোন পারভিনের বাড়িতে যায়। কুসুমের বাড়িতেও যায়। কুসুম নিজের স্বামী, রেলওয়ে ইস্কুলের হেডমাস্টারকে ছেড়ে করিম নামের এক বিবাহিত ছেলেমেয়েঅলা লোককে বিয়ে করেছে। করিম দেখতে অনেকটা তরমুজের মত, গোলগোল। কুসুমও। গোলগাল তরমুজ দাদার বিয়ের পর প্রায়ই এ বাড়ি বেড়াতে এসে বলে যাইও, তোমরা বোটানিক্যাল গার্ডেনে বেড়াইয়া আইস। করিম কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের বোটানিক্যাল গার্ডেনটি একধরনের দেখাশোনার কাজ করে। একধরনের, কারণ না সে বোটানিস্ট, না মালি। বেড়াতে গিয়ে একদিন নানারকম ফুলের চারা নিয়ে এসে বাড়ির মাঠে মাটি কেটে পুঁতে দিয়েছি, হাজারি গোলাপ ফুটছে, তরতর করে বাড়ছে চেরি, এমন যে ছাদ ছুঁয়ে যাচ্ছে। বাগানের শখ আমার হঠাৎ হঠাৎ হয়। একবার টিনের ঘরের কিনার ঘেঁষা বাগানে ধনে পাতা লাগালাম, প্রতিদিন ভোরবেলা উঠে মাটিতে আঙুল বুলিয়ে হতাশ হয়ে যেতাম, এত দেরি করে যে এরা বড় হয়! গোলাপ গাছ লাগিয়ে প্রতি ঘন্টায় ঘন্টায় একবার দেখে আসি ফুল ফুটেছে কি না, সপ্তাহ পেরিয়ে যায়, গোলাপের কোনও চিহ্ন নেই, ব্যস উৎসাহ নিবে গেল। আর সব আগাছার মত গোলাপ গাছও বড় হতে লাগল, কলেজ থেকে একদিন ফিরে হঠাৎ চমকে উঠি দেখে ফুটে থাকা লাল গোলাপ। চেয়ে পাওয়ায় যত সখু , তার চেয়ে বেশি বুঝি না চেয়ে পাওয়ায়!

হাসিনা ফিরে এলে, বিকেলে, শুভকে তার মার হাতে বুঝিয়ে দিয়ে সুহৃদকে সাজিয়ে গুজিয়ে মা নিয়ে গেলেন নানি বাড়ি, অনেক দিন ও বাড়ি যান না তিনি। বারান্দার গা ঘেঁষেই আমার ঘর, বারান্দার যে কোনও ফিসফিসও কানে আসে আমার, ইয়াসমিন বারান্দায় হাঁটতে হাঁটতে যখন বলছে, কি রে শুভর গুঅলা পটটা সকাল থেইকা বারান্দায় পইড়া রইছে, সরায় না কেন কেউ!

হাসিনা বারান্দার চেয়ারে পা তুলে বসেছিল, বলল,তুমি সরাও না কেন?

কী কইলা?

কইলাম তুমি সরাও না কেন? দেখতাছই যহন যে পটটা পইড়া রইছে।

আমি সরাইতাম কেন?

সুহৃদের পট সরাও না?

সরাই।

তাইলে শুভর পট সরাইতে পারবা না কেন?

শুভর পট সরাইতাম ক্যা?

কেন শুভর পট সরাইতে পারো না?

পারি না।

পারি না কইলেই হইব নাকি? পারতে হইব।

পারতে হইব না।

পারতে হইবই।

পারতে হইবই কেন? শুভর কাজের ছেড়ি আছে না? ঝর্ণা কি করে?

সুহৃদের তো নার্গিস আছে। তাইলে তরাও ত সুহৃদের পট সরাস। তরা ত সুহৃদের চাকর।

হ চাকর। সুহৃদের চাকর হইছি ভালা হইছে।

শুভরও চাকর হইবি।

কেন হইতাম?

হইতে হইব।

তুই কইলেই হইতে হইব?

হ। আমি কইলেই হইতে হইব।

কি কইলি?

যা কইলাম, কইলাম।

আবার ক।

সুহৃদের গু খাইতে পারস, শুভর গু ও খাইতে হইব।

ইয়াসমিন এবার লাখি মেরে শুভর পটটিকে ফেলল উঠোনে।হাসিনা উড়ে এসে ইয়াসমিনের চুল টেনে বলল, যা পট তুইলা আন। ইয়াসমিনও হেঁচকা টান দিয়ে হাসিনার চুলে বলল, তুই আন।

আমি শব্দ শুনে নাড়ি নক্ষত্র থেকে উঠে দরজায় দাঁড়িয়ে এই চুলোচুলি দেখেই শরীর গলিয়ে ইয়াসমিনকে ছাড়িয়ে আনতে গেলাম। তিন জনে ধস্তাধস্তি। এর মধ্যে কোত্থেকে উড়ে এসে স্যুটেড বুটেড দাদা ঝাঁপিয়ে পড়লেন আমার আর ইয়াসমিনের ওপর, ইয়াসমিনের চুল শক্ত মুঠিতে ধরে হিড়হিড় করে টেনে নিয়ে ফেললেন উঠোনের মাঝখানে যেখানে শুভর পট উল্টো পড়ে আছে। হাসিনা দৌড়ে গিয়ে পড়ে থাকা ইয়াসমিনের মখু বুক খামচে পিঠে ধড়াম ধড়াম কিল বসাতে শুরু করেছে। ইয়াসমিন খোয়ার ওপর উপুড় হয়ে পড়ে নিজেকে ছাড়ানোর চেয়ে চাইছে হাসিনাকে ওই পটের ওপর ফেলতে। হাসিনা দুহাতে ওর মখু ঠেসে ধরে পটের ওপর, মখু সরিয়ে ইয়াসমিন খামচি দিয়ে ধরে হাসিনার পা, টেনে ফেলতে চায়, পারে না। দাদা এবার লাথি বসালেন ইয়াসমিনের ঘাড়ে। ক্রমাগত। লাথি ঘাড়ে পিঠে নিতম্বে, উঁরুতে। ইয়াসমিন হাত ছুটে যায় হাসিনার পা থেকে। লাথি খেয়ে কুণ্ডুলি পাকাতে থাকা ইয়াসমিনের মুখের ওপর হাসিনা উপুড় করে ধরে পট। ওর মুখে লেপ্টে থাকে শুভর গু। এই নৃশংস কাণ্ড দেখে আমি হাঁ হয়ে আছি। আমার বিশ্বাস হচ্ছে না এ আমাদের দাদা! এর মধ্যে আরোগ্য বিতান থেকে শুভর জন্য আলাদা করে বাবার পাঠিয়ে দেওয়া দশটি মুরগি হাতে সালাম দাঁড়িয়ে থাকে বারান্দায়, হতবাক সালাম উঠোনের নৃশংস দৃশ্যটি দেখে। দেখল। আমার পক্ষে হাঁ হয়ে দাঁড়িয়ে দেখা সম্ভব হয় না আর, ইয়াসমিনকে ছাড়িয়ে আনতে ছুটে যাই, পারি না, আমার পিঠেও কিল পড়ে, আমার চৃুলেও শক্ত টান পড়ে। ইয়াসমিনের সারা শরীরে তখন দাদা আর হাসিনার শক্ত শক্ত লাথি। ইয়াসমিন কাঁদে না। ওর চোয়াল শক্ত হতে থাকে। আমি অসহায় বসে থাকি ইয়াসমিনের পাশে। আমাদের দুজনের গা ধুলোয় গড়াতে থাকে।

এই ঘটনার পর দাদা আর হাসিনার সঙ্গে আমি কথা বলা বন্ধ করে দিই।

মা বাড়ি এলে সব শুনে এ ঘর ও ঘর হাঁটেন, খামোকা হাঁটেন, বলতে বলতে, এর শইলডা হিংসায় ভরা। সুহৃদরে সহ্য করতে পারে না। কবে যেন বিষ খাওয়াইয়া ছেড়াডারে মাইরা ফেলব।

বাবা ঘটনা শুনে কোনও রা করলেন না।

বাবার চপু হয়ে থাকায় মা চেঁচিয়ে বলেন,মেয়ে দুইডারে যে ছেলে তার বউরে নিয়া মাইরা শেষ কইরা রাখল, সব শুইনাও কোনও কিছু করতাছেন না! ইয়াসমিন তো শইল নড়াইতে পারে না, হাড্ডিগুড্ডি ভাইঙা থইছে মাইরা! আমি সুহৃদরে দিয়া দেই কামালের কাছে। এ হইল ওগোর শত্রু। ছেড়াডারে এই বাড়িতে পালা হইতাছে, এইডাই ওগোর সহ্য হয় না। আপনে থাকেন আপনার ছেলে আর ছেলের বউরে নিয়া। আমি কোথাও যাই গা। কী ছেলে জন্ম দিছিলাম রে খোদা, আপন বইনদেরে মারে, তাও আবার বউরে নিয়া।

বাবার নৈঃশব্দের মধ্যেও মা চেঁচান, নাসরিন ইয়াসমিন, তরা ছেলে দেখ, বিয়া টিয়া কইরা এই বাড়ি থেইকা তাড়াতাড়ি যা। বাপেও তার ছেলেরে আশকারা দিব তোদেরে মাইরা লুলা বানাইতে।

মার এসব কথার উত্তর কেউ দেয় না।

এর সাতদিন পর, গুমোট বাড়িটিতে দাদা জানিয়ে দিলেন যে তিনি বদলি হয়েছেন বগুড়ায়। বাবা দাদাকে ডেকে পাশে বসিয়ে বললেন, বগুড়ায় কেন?

আমি কি জানি! কোম্পানী বদলি করল। দাদার উদাস উত্তর।

বগুড়া কোনও একটা জায়গা হইল যাওয়ার? বগুড়ায় কি আছে?

মহাস্থান গড় আছে।

মহাস্থানগড় দিয়া তুমি কি করবা?

বগুড়ার দই তো ভাল।

তা কি দই এর লোভে যাইতাছ নাকি?

বদলি হইছি বইলা যাইতাছি।

বাড়িঘর ফালাইয়া দূর দেশে কই থাকবা, কী খাইবা!

দাদা উঠে যান, বাবা বসেই থাকেন। মা তাড়া দেন, ভাত বাড়া আছে, খাইয়া লন।

বাবার সে রাতে আর খেতে ইচ্ছে হয়নি। তিনি দুহাতে মাথার চুল খামচে ধরে বসে থাকেন।

দাদার বদলি হওয়াতে সবচেয়ে যে বেশি খুশি হয়েছে এ বাড়িতে, সে হল হাসিনা। হাসিনা গুনে গুনে কাচের বাসন, চামচ এসব বাক্সে ভরল। কালো ফটকের সামনে চেয়ার পেতে বসে পা নাড়তে নাড়তে, বাড়িতে যত আসবাব ছিল দাদার, হিশেব করে ট্রাকে তুলল। টেলিভিশনটিও।



দাদারা চলে যাবার পর ঘরগুলো হঠাৎ ন্যাংটো হয়ে গেল। এক কোণে পড়ে আছে রং ওঠা পুরোনো বেতের সোফা আর কয়েকটি ছালওঠা চেয়ার, দেয়ালে চৌকোনা দাগ, আর কটি বাঁকা তারকাঁটা।

প্রায়ই লক্ষ করি বারান্দায় একলা বসে থাকেন মা, সন্ধের দিকে। হু হু বাতাসের নাকি মার দীর্ঘশ্বাসের শব্দ ভেসে আসে ঘরে, ঠিক বুঝি না। সন্ধেয় বাতি জ্বলে ঘরে ঘরে, মা বসেই থাকেন একা অন্ধকারে, মার হাতে তসবিহটি ঝুলে থাকে, নড়ে। ঘর ছেড়ে জড়ত্ব ঝেড়ে উঠোনে নেমে কোনও কারণ ছাড়া হাঁটতে থাকি এক সন্ধেয়।

মা, বাইরে বইসা রইছ কেন? ঘরে যাও।

মা শব্দ করে শ্বাস ফেলে বলেন, নোমানডা রাগ কইরা বাড়ি থেইকা চইলা গেল! ঘরের ছেলে যদি ঘরে না থাকে তাইলে কি ঘরে থাকতে ইচ্ছা করে!

নোমান নোমান কর কেন? আমরা আছি না? নাকি আমরা কেউ হই না তোমার!

মেয়েরা তো বিয়া হইলে পরের বাড়ি চইলা যায়।

আমি তেতো গলায় বলি, তোমার ছেলেরাই তো পরের বাড়ি গেছে গা। মেয়েরাই রইছে।

মেয়েরা আইজ আছে, কাইল নাই। মা বলেন।

তোমার ছেলেরা তো আইজও নাই। কাইল তো নাই ই।

মা চপু হয়ে যান।

বারান্দার কাপড় শুকোনোর দড়িতে দুহাত রেখে সামনে পেছনে দুলতে দুলতে উঠোনের অন্ধকারের দিকে চেয়ে বলি, এত যে ছেলে ছেলে কর, দুইটা ছেলেই তো দূরে সইরা গেল।

হ সব গেল গা। এখন বউই তাদের কাছে আপন। বাপ মা ভাই বোন কিছু না। মা মিহি গলায় বলেন।

আমি ভেতরে ঢুকে যাই। শীতল নিস্তব্ধতা জুড়ে বসে থাকি। ইয়াসমিন পড়ে পড়ে ঘুমোয় কেবল। আনন্দমোহনে যাচ্ছে প্রতিদিন। কিন্তু বাড়িতে বই পত্তরের কোনও খোঁজ নেই। দেবনাথ পণ্ডিতকে বাড়ি এসে ইয়াসমিনকে পড়াতে বলেছিলেন বাবা, তিনি রাজি হননি। রাজি হননি কারণ ছাত্রছাত্রীসংখ্যা এত বেশি তাঁর যে একা কারও জন্য তাঁর সময় দেওয়া সম্ভব নয়। একমাত্র তিনি গ্রুপে পড়াতে পারবেন। ইয়াসমিন দেবনাথ পণ্ডিতের বাড়িতে গ্রুপে পড়তে যায়, ফিরে এসে খাতা বই ছুঁড়ে দিয়ে বলে, কি পড়ায় কিচ্ছু বুঝি না! বাড়িতে বই নিয়ে বসার নাম গন্ধ নেই। নিথর বাড়িটিকে চমকে দিয়ে আমি চেঁচাই, ইয়াসমিন পড়তে ব। ইয়াসমিন পাশ ফেরে শোয়। আবারও চেঁচাই, ওঠ, পড়তে ব। ইয়াসমিন চেঁচিয়ে থামায় আমার চেঁচানো। ওর কি করতে হবে না হবে, ও নিজে ভাল বোঝে, কারও পরামর্শ দেওয়ার দরকার নেই। আমাকেও ও দূরে সরিয়ে রাখে। আমার সঙ্গী হয় একটি শাদা বেড়াল। একটি শাদা বেড়াল আমার সঙ্গী।শাদা একটি বেড়াল আমার সঙ্গী। সঙ্গী শাদা বেড়াল। বেড়ালই ভাল। মানুষের চেয়ে সহস্রগুণ ভাল। বেড়ালটিকে আমি বুকে জড়িয়ে বসে থাকি। এ বাড়িতে নর্দমার ফাঁক গলে অথবা পাঁচিল পেরিয়ে বেড়াল আসে, বেড়ালেরা তক্কে তক্কে থাকে সুযোগ বুঝে রান্নাঘরে ঢুকে পাতিলে মখু দেয়। যে বেড়ালই আসে, মা তাড়িয়ে দেন। সব বেড়াল নাকি চোরা বিলাই। তাড়ালে চলে যায়, আবার আসে। এই শাদা বেড়ালটি যখন এসেছিল, একেও তাড়ানো হয়েছিল, কালো ফটকের ওপারে নর্দমায় ফেলে আসা হয়েছে, বেড়ালটি পরিষ্কার হয়ে এ বাড়িতে চলে এসেছে আবার। শেষে বেড়ালটিকে নিয়ে নতুনবাজারের কাঁচাবাজারের জটলায় ফেলে আসা হল, পরদিন দেখি উঠোনের রোদে বেড়ালটি শুয়ে আছে। এবার বাবার আদেশ, একে বস্তায় পুরে নদীর ওপারে ফেলে দিয়ে আসতে হবে। তাই করা হল। সালাম একটি বস্তায় বেড়ালটিকে পুরে বস্তার মখু দড়ি দিয়ে শক্ত করে বেঁধে নৌকো ভাড়া করে ব্রহ্মপুত্রের ওপারে গিয়ে কাঁটা ঝোপের মধ্যে ফেলে দিয়ে এল। বাড়িতে সকলে জানে, বেড়াল আর ফিরবে না, কোনও কারণ নেই ফেরার। সাতদিন পার হয়েছে, বেড়ালের কথা ভুলেই গেছে সবাই। কিন্তু হঠাৎ দেখি বেড়ালটি বিকেলবেলা কালো ফটকের সামনে সজল চোখে দাঁড়িয়ে আছে, আমি আয় আয় বলে ডাকতেই দৌড়ে ও চলে এল আমার কাছে। রান্নাঘরে নিয়ে পাতিলের তলায় যেটুকু ভাত ছিল দিই। হাভাতের মত খেয়ে বেড়ালটি আমার পেছন পেছন, যেখানেই যাই, যেতে লাগল। সেই থেকে এ বেড়ালটিকে আমি আর কাউকে দিই না কোথাও ফেলে আসতে। থেকে গেছে এ বাড়িতে, রাতে বিছানায় আমার পায়ের কাছে ঘুমোয়। চেয়ারে বসলে লাফিয়ে আমার কোলের ওপর এসে বসে। বেড়ালটি ভাত আর মাছের কাঁটাকুটো খেয়ে জীবন কাটাচ্ছে এ বাড়িতে। আমি খেয়ে পাতে সামান্য রেখে দিই বেড়ালটির জন্য। মাকে লুকিয়ে আমার নিজের ভাগের মাছের টুকরো থেকে কিছুটা ওর ভাতে মিশিয়ে দিয়ে দিই। বেড়ালটিকে বুকে জড়িয়ে আমি বসে আছি আমার ঘরে। অন্য ঘরে, যেটি একসময় ছোটদার ঘর ছিল, অসময়ে ইয়াসমিন ঘুমোচ্ছে। ঘুম থেকে উঠে ভাত খেয়ে আবার ঘুমোবে সে। যেন ঘুমের মত এত সুখের জিনিস পৃথিবীতে আর নেই। ওর ঘাড়ের হাড়ে ব্যথা, পিঠের হাড়ে ব্যথা, হাঁটুতে ব্যথা। দাদা আর হাসিনার নৃশংসতা ওকে এই অসখু গুলো দিয়েছে। ইয়াসমিনকে নিয়ে হাসপাতালের ডাক্তারের কাছে গিয়েছি। মেডিসিনের অধ্যাপক প্রভাকর পুরকায়স্থকে দেখিয়েছি, তিনি ওর বুকে স্টেথোসকোপ বসাতে গিয়ে বারবারই চাপ দিচ্ছিলেন স্তনে। ও প্রভাকরের ঘর থেকে মুখে বিরক্তি নিয়ে বেরিয়ে আসে। এরপর ওর হাঁটুর ব্যথা এমনই তীব্র হয়ে উংল যে হাঁটু নিয়ে ও আর উঠতে বসতে পারছিল না। সেই হাঁটু পরীক্ষা করতে দাড়িঅলা হারুনুর রশিদ খানের কাছে যাই, তিনি হাড়ের ডাক্তার, কেবল ডাক্তার নন, রীতিমত অস্থিবিদ্যা-বিভাগের প্রধান। ইয়া লম্বা দাড়ি মুখে, মাথায় টুপি, পরনে পাজামা পাঞ্জাবি। কোনও অধ্যাপককে এই লেবাসে দেখে অভ্যেস নেই আমার। লেবাস যেমনই হোক, ডাক্তার ভাল তিনি। আমাকে চেনেন তিনি, আমার বাবাকেও। বাবা যখন হাসপাতালে ছিলেন, বাবাকে একটি তাবিজ দিয়ে এসেছিলেন বালিশের নিচে রাখতে। ওটি নাকি অসখুৃ ভাল করার ওষধু ।সেই ফর্সা লম্বা দাড়িঅলা ভাল ডাক্তার অস্থিরোগ চিকিৎসায় এক নম্বর তাবিজ কবজে আল্লাহ রসুলে বিশ্বাসী ইয়াসমিনকে তাঁর চেম্বারের রোগি দেখার টেবিলে শুইয়ে দিয়ে পর্দা ঢেকে দিয়ে ওর হাঁটু টিপতে টিপতে হাঁটু থেকে হাত ওপরে নিতে নিতে তলপেট -পেট টিপে টিপে বুকে গেলেন। বুক টিপে বাইরে থেকে ফুসফুস বা হৃদপিণ্ডের অস্তিত্ব বুঝতে চাইলেন কি!ইয়াসমিন বের হয়ে আমাকে শুধু বলল, আমারে আর কোনওদিন কোনও ডাক্তারের কাছে নিও না। আমার অসখু ভাল হওয়ার দরকার নাই। আমার অনেকবার ইচ্ছে হয়েছে হারুনুর রশিদ খানের কাছে জিজ্ঞেস করি, আমার বোনের হাঁটু পরীক্ষা করার কথা ছিল আপনার, বুক পরীক্ষা করার নয়। বুকে কি ছিল পরীক্ষা করার? ইচ্ছে হয়েছে প্রভাকর পুরকায়স্থকে বলি, আপনার তো কোনও পারকিনসনস রোগ হয়নি যে বুকে স্টেথেসকোপ বসালে হাত বার বার সরে যায় চাকতি থেকে! ইচ্ছে হয়েছে, পারিনি। গলার কাছে শব্দগুলো কষ্ট হয়ে বিধঁ ছিল, বেরোতে পারেনি।



মা তখনও বাইরের অন্ধকারে, মার হাতের তসবিহ নড়ছে না।
 

Users who are viewing this thread

Back
Top