০৯. ডায়রির পাতা
২৪ নভেম্বর
করন থাপর লিখেছেন হিন্দুস্থান টাইমস। ‘ডু উই পাস দ্য তসলিমা টেস্ট?’ ‘The India I would be proud of would welcome Taslima Nasreen and grant her sanctuary. The India I’m embarrassed by wreaks violence on the streets of Calcutta, van dalises art schools in Baroda and threatens peaceful worshippers in Sirsa. Alas, that is the India I live in.’
চমৎকার লেখা। কিন্তু লেখাটির শুরুতে লিখেছেন, ‘Taslima Nasreen may not be a great novelist. She may even be motivated by a quest for publicity. And many say she deliberately and calculatedly compromises other people by revealing their personal secrets. But those are literary or moral judgements. No doubt each of us will accept or reject them as we deem fit. The question is, do we have a right to silence her voice because of them?’
করন থাপর আমার লেখা পড়েননি, তা অনুমান করতে পারি। লেখা না পড়েও লেখকের মত প্রকাশের অধিকারের পক্ষে দাঁড়িয়েছেন। লেখা যারা বুঝে পড়েছেন, আমাকে যাঁরা ব্যক্তিগতভাবে সঠিক চিনেছেন, তাঁরা জানেন আমি কী লিখি, কেন লিখি। পাবলিসিটি পাওয়ার জন্য লিখি, ভালো কোনও সাহিত্যিক নই, বিতর্ক তৈরি করার জন্য লিখি –ইত্যাদি কথা বাতাসে ভাসতে শুরু করেছে সে অনেক বছর। সেই বাংলাদেশের আমল থেকেই। বাংলাদেশ আর ভারতে পার্থক্য তো খুব বেশি নেই, থাকলেও বাতাসের পার্থক্যটা নেই বললেই চলে। এই হাওয়ার মন্ত্র থেকে মন সরিয়ে অন্য একটি বিশ্বাস এবং ধারণা তৈরি করা কম কঠিন নয়। অনেকে কঠিন কাজটি করেন। অনেকে বাতাসে ভর দিয়েই চলেন। যদি একটুও নিজের প্রতি যত্ন নিতাম, তবে লেখার প্রতিও যত্ন নিতাম, ইংরেজি এবং অন্যান্য ভাষায় অনুবাদ বার করার চেষ্টা করতাম। কিন্তু এ ব্যাপারে আমার চিরকালের উদাসীনতা। লিটারেরি এজেন্টদের তাড়িয়েছি। জাল বইয়ে ভারত আর বাংলাদেশ ছেয়ে গেছে। বই নিয়ে যা ইচ্ছে তাই হয়েছে। জগতের কত লোক বই পড়তে চেয়েছে, সুযোগই হয়নি।
.
২৭ নভেম্বর
‘..তসলিমা নাসরিনকে পশ্চিমবঙ্গ হইতে সরাইয়া দিবার সিদ্ধান্ত আগেই পাকা হইয়া গিয়াছিল। এই সিদ্ধান্ত, এবং যে ভাবে তাহা কার্যকর হইয়াছে, তাহা সম্পূর্ণ অবাঞ্ছিত এবং অনৈতিক। প্রথমত, তসলিমা নাসরিনের নিরাপত্তার জন্য তাঁহাকে অন্য রাজ্যে প্রেরণের কোনও প্রয়োজন ছিল না, এই শহরেই তাহার সুবন্দোবস্ত করা সরকারের অসাধ্য ছিল না। সঙ্গত কারণেই সন্দেহ হয়, নিরাপত্তার যুক্তিটি অজুহাত মাত্র, তাঁহার মৌলবাদী বিরোধীদের সন্তুষ্ট করিবার বাসনাতেই তাঁহাকে অপসারণ করা হইয়াছিল। দ্বিতীয়ত, যে প্রক্রিয়ায় এই স্থানান্তর তথা অপসারণ ঘটানো হইয়াছে, তাহা অত্যন্ত আপত্তিকর। প্রশাসন, দল, এবং উভয়ের ঘনিষ্ঠ প্রতিপত্তিশালী ব্যক্তিবর্গের এই যোগসাজসের পরম্পরা একটি সামগ্রিকভাবে অসুস্থ পরিবেশের সংকেত দেয়, যাহা একটি উদার আধুনিক শাসনতন্ত্রের পরিপন্থী। তৃতীয়ত, ইহা মৌলবাদীদের অন্যায় দাবির নিকট আত্মসমর্পণ। এবং ইহাই সর্বাপেক্ষা উদ্বেগজনক। পশ্চিমবঙ্গের শাসকরা উঠিতে বসিতে নিজেদের ধর্মনিরপেক্ষতার বড়াই করেন, কিন্তু কার্যক্ষেত্রে বার বার দেখা যায়, মুসলিম মৌলবাদীদের তোষণে তাঁহারা অতীব তৎপর। তসলিমা নাসরিন সম্পর্কিত ঘটনাবলি তাহার প্রমাণ এবং প্রতীক। …পশ্চিমবঙ্গের ধর্মনিরপেক্ষ শাসকরা মুসলমান তোষণ করিতেছেন না, মুসলিম মৌলবাদীদের তোষণ করিতেছেন। দলের মন্ত্রণাদাতারা হয়তো বিশ্বাস করেন, এই তোষণের ফলে সংখ্যালঘু ভোটব্যাংক সুরক্ষিত থাকিবে। কিন্তু ভোটব্যাংক রাজনীতির তাড়নায় এমন ভয়ানক অন্যায়কে তোষণ করিলে তাহার পরিণাম অশুভ হইতে বাধ্য।‘ –আনন্দবাজার পত্রিকা।
আনন্দবাজার অন্য সময় সঙ্গে থাক বা না থাক, কলকাতা থেকে আমাকে তাড়াবার শুরু থেকে পাশে আছে। স্টার আনন্দতে এ নিয়ে খবর হচ্ছে, আলোচনা হচ্ছে। আমার সাক্ষাৎকারও নিলেন সুমন দে। আনন্দবাজার থেকে মিলন দত্ত বড় একটা সাক্ষাৎকার নেবেন। হায়দারাবাদ থেকে ফেরার পর আমাকে কী করে আটকে রাখা হয়েছিলো বাড়িতে, কী বলেছিলো কে, কীভাবে আমাকে কলকাতা থেকে বিদেয় করা হল, শুরু থেকে সব শুনতে চান তিনি। প্রশ্ন করা হচ্ছে, আমি উত্তর দিয়ে যাচ্ছি। হঠাৎ একটা গুঞ্জন। ফোনেই শুনতে পাচ্ছি মিলন দত্তকে কেউ ডাকছেন। কথা বলছেন। আলোচনা করছেন। শেষ পর্যন্ত আমাকে মিলন দত্ত জানিয়ে দিলেন, অভীক বাবু বলেছেন সাক্ষাৎকার বন্ধ করতে, কারণ প্রণব বাবুর সঙ্গে তার কথা হয়েছে, প্রণব বাবু বলেছেন এখন যেন আমার কোনও খবর, সাক্ষাৎকার ইত্যাদি মোটেও প্রচার করা না হয়, তিনি কথা দিয়েছেন দিন পনেরোর মধ্যে আমাকে কলকাতায় ফিরিয়ে আনছেন।
ওদিকে স্টার আনন্দও সব আলোচনা বন্ধ করে দিল। আমার পক্ষে জনমত গড়ে ওঠার সম্ভাবনার এখানেই ইতি টানা হল।
.
২৮ নভেম্বর
‘তসলিমা নাসরিন প্রসঙ্গে সকলকে, বিশেষত মুসলমান বুদ্ধিজীবীদের, একটা কথা ভেবে দেখতে অনুরোধ করবো। ভদ্রমহিলা তার মতবিরোধীদের ইট মারেননি, গাড়ি পোড়াননি, খুন করে দেওয়ার কথাও বলেননি। তবে বিশেষত মুসলমান মেয়েদের ওপর নির্যাতন প্রসঙ্গে তিনি যা লিখেছেন তা বুদ্ধিজীবীদের একাংশের মতে ইসলামবিরোধী। কিন্তু তাঁকে তাঁর কথা বলতে না দিলে তসলিমার সমালোচকরাও অনুচ্চারিত ইসলাম বিরোধী বক্তব্যের সমুচিত জবাব দিতে পারবেন না। এতে গণতন্ত্র বিপন্ন হবে। গণতন্ত্র না থাকলে সবার আগে, এবং সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে ধর্মীয় সংখ্যালঘুরাই। তাই তসলিমার স্বাধীনভাবে এবং অকপটে লেখার অধিকার রক্ষার দাবি শেষ বিচারে গণতন্ত্র রক্ষারই সংগ্রাম।‘ –সুনন্দ সান্যাল
প্রণব মুখার্জি লোকসভায় আমার প্রসঙ্গে বলবেন। সে গতকাল থেকেই জানা। বসে আছি অপেক্ষায়। বারোটায় বলবেন। সাড়ে বারোটায় বলবেন। এরকম শুনছিলাম। যা বললেন তা হল –“Throughout history, India has never refused shelter to those who have come and sought our protection. This civilisational heritage which is now a government policy, will continue and India will provide shelter to Ms Nasreen. Those who have been granted shelter here have always undertaken to eschew political activities in India or any action, which may harm India’s relation with friendly countries. It is also expected that the guest will refrain from activities and expressions that may hurt the sentiments of our people. While these guests are in India the Union and the state governments provide them protection –this policy will also apply in Ms Taslima Nasreen’s case”
দাদা বললো, ‘একেবারে রিয়েল ডিপ্লোমেট’।
যে ডুবছে, সে একটা খড়কুটো চায়। আমাকে যে তাড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে না এ দেশ থেকে, আমাকে যে থাকতে দেওয়া হবে, এই খবরটিই আমার কাছে সবচেয়ে বড় খবর। . আমি আশা করেছিলাম অন্য এক বিবৃতির যার বাংলা করলে এরকম দাঁড়ায় –‘ভারত এমন একটি দেশ, যে উদার, অতিথিপরায়ণ, পৃথিবীর নানা দেশের নানা সংস্কৃতির মানুষকে বিভিন্ন সময়ে বরণ করে নিয়েছে এবং ঋদ্ধ হয়েছে। তসলিমা একজন নির্যাতিত এবং নির্বাসিত লেখক, বাংলা তাঁর মাতুভুমি। পুর্ব বাংলায় না হলেও পশ্চিম বাংলায় বাস করার তাঁর এই ইচ্ছেকে আমরা স্বাগত জানাই। ভারত একটি ধর্মনিরপেক্ষ দেশ, ভারত পৃথিবীর সবচেয়ে বড় গণতন্ত্র। এখানে যারা বাস করছে, সবারই গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে নিজের মত প্রকাশের অধিকার আছে। কিন্তু ২১শে নভেম্বর কলকাতার রাস্তায় যা ঘটেছে, তা বর্বরতা ছাড়া আর কিছু নয়। সেকুলার গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের প্রথম এবং প্রধান শর্ত, মত প্রকাশের স্বাধীনতা। মত প্রকাশের অধিকার এবং বাক স্বাধীনতা আর সবার মতো তসলিমা নাসরিনের আছে। সুতরাং তাঁর মত প্রকাশের অধিকার ছিনিয়ে নেবার উদ্দেশ্যে যারা রাস্তায় নেমেছে এবং লুঠপাট, আগুন জ্বালানো এবং জনগণের জীবন নিরাপত্তাহীন করে তুলেছিল, তাদের অগণতান্ত্রিক আচরণের কারণে তাদের বিরুদ্ধে সরকার অবশ্যই ব্যবস্থা নেবে এবং ভবিষ্যতে যেন এ ধরনের অশুভ কাজ থেকে বিরত থাকে সে ব্যাপারে প্রশাসন সতর্ক থাকবে। সেকুলার গণতন্ত্রের ভাবমূর্তি নষ্ট না হয়, এ ব্যাপারে প্রত্যেককে সচেতন থাকতে হবে। তসলিমা নাসরিনকে পশ্চিমবঙ্গ থেকে কেন তার ইচ্ছের বিরুদ্ধে জোর করে অন্য রাজ্যে স্থানান্তর করা হল, সে ব্যাপারে তদন্ত চলবে। এবং দোষী ব্যক্তিদের শাস্তির ব্যবস্থা হবে। এবং ২১ নভেম্বরের তান্ডবকারীদেরও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা হবে। তসলিমাকে আগামীকাল কেন্দ্র থেকে কলকাতায় পাঠানো হবে। কেন্দ্র চাইছে পশ্চিমবঙ্গে তসলিমার পূর্ণ নিরাপত্তা। শুধু তাই নয়, পশ্চিমবঙ্গের বাইরেও তাঁর পূর্ণ নিরাপত্তা তাঁকে দেবে ভারত সরকার এবং রাজ্য সরকার। শুধু তসলিমা নয়, এদেশের সব নাগরিকের, অতিথিদের, এবং আশ্রয়প্রার্থীদের ক্ষেত্রে ভারতের নিয়ম একই, ভিন্ন নয়।’
হ্যাঁ এরকম হবে মনে মনে ভেবেছিলাম। কিন্তু যা হল তা ঠিক কী হল, বুঝে পাচ্ছি না। একটাই স্বস্তি পাচ্ছি তা হল রেসিডেন্স পারমিটই আর দেওয়া হবে না–এমন কিছু বলা হয়নি।
.
৩০ নভেম্বর
‘সিঙ্গুর, নন্দীগ্রাম পুলিশ আর পার্টির ভাড়াটেদের বন্দুকনির্ভর নির্মম দখলদারির পর্ব পেরিয়ে তসলিমা ইস্যুতে এসে একটা দমকা হাওয়াতে উড়ে গিয়েছে সিপিএম-এর এতদিনের সযত্ন লালিত ধর্মনিরপেক্ষতার মুখোশটা।
.. তসলিমা দেশে দেশে, রাজ্যে রাজ্যে এভাবেই ছিন্নমূল ঘুরতে থাকুন, আর আমরা কড়ায় গণ্ডায় ভোটের হিসেব করি। নিক্তিতে মেপে দেখি, তসলিমা এখানে থাকলে তাদের লাভ বেশি,
বিদেয় হলে। কী করলে, কী বললে মুসলিম ভোট টানা যাবে। কোন ইস্যুতে মৌলবাদের কথায়। ঘাড় নাড়তে হবে, কোন ইস্যুতে রাস্তায় নেমে মৌলবাদের বিরুদ্ধে মিছিল করে চেঁচাতে হবে, সবই ভোটের নিক্তিতে ওজন করা।‘–আশিস ঘোষ
সকালে এনামুল কবীর ফোন করলেন বীরভূম থেকে। না, এখন অবধি কোনও রাজনৈতিক দল বলেনি সিপিএম যা করেছে ভুল করেছে, এভাবে কোনও লেখিকাকে তাড়িয়ে দেওয়াটা অন্যায়।
আজ দ্বিখণ্ডিত থেকে কিছু বাক্য বাদ দিয়ে দিলাম। সারা দেশে এই চরম দুঃখের খবরটি হৈ হৈ করে ছাপা হল।
.
২ ডিসেম্বর
ক্যান্টনমেন্টের প্রধান একদিন দেখা করে গেছেন। সম্মান দেখিয়ে গেছেন। সজ্জন শিক্ষিত ভদ্রলোক। বললেন, লজ্জার লেখকের সঙ্গে দেখা হবে কোনোদিন, এ কল্পনাও করেননি। সবাই আমার নাম জানেন লজ্জা’র লেখক হিসেবে। লজ্জা পড়েননি, ভারতবর্ষের শিক্ষিত শ্রেণীর মধ্যে এমন লোক কমই আছে। পেঙ্গুইন ঘোষণা করেছে, লজ্জা ভারতবর্ষের মুদ্রণশিল্পের ইতিহাসে সবচেয়ে বিক্রিত বই।
ভদ্রলোকের নামের পদবী, সেন। বাঙালি ভেবে কী খুশিই না হয়েছিলাম। পরে শুনলাম, উনি বাঙালি নন।
.
৪ ডিসেম্বর
‘She does not have any choices. She is just like a person who has now got the protection of the mafia which is the state in some way. She has nowhere to go. She has no protection. She just has to blunder her way through this kind of humiliation and I really feel for her’. –Arundhati Roy
আজ দাদার বিয়ের পঁচিশ বছর পূর্তি উৎসব। প্রতিবছর এই দিনটি দাদা উদযাপন করে। কিন্তু দিল্লির এই অজ্ঞাতবাসে উদযাপনের কিছু নেই। আজ সকালে দাদা স্নান করে তৈরি হয়ে রইলো। দুপুরের খাবার খেয়েই রওনা হয়ে গেল। দিল্লি থেকে কলকাতা গেল। বিকেল পাঁচটায় কলকাতায় নামবে। আমরা একসঙ্গে কলকাতা থেকে এসেছিলাম, দাদা একা ফিরে গেল। আমি যেতে পারলাম না। আমার যাওয়া সম্ভব নয়। দাদার চলে যাওয়ার দিকে তাকাতে ইচ্ছে করেনি। বুক ফেটে যাচ্ছিল। দাদাও কষ্ট পাচ্ছিল হয়তো। কিন্তু এখানে থেকেই বা কী করবে! ভালো লাগে এভাবে লুকিয়ে থাকতে!
.
৫ ডিসেম্বর
‘Secularism is not appeasing fundamentalism and terrorism. The November 21 incidents could have led to communal riots in Kolkata. Fundamentalism, whether Muslim or Hindu is a challenge which must be taken very seriously. The Taslima Nasreen issue is no longer about Taslima Nasreen the writer. It has revealed a much larger conspiracy in the making.
It was a test case, and the CPM’s decision has conveyed to the Islamic fundamentalists that they have won the round one!’ -Bhaskar Roy.
আজ উল্লেখ করার মতো তিনটে জিনিস পেলাম, দ্য হিন্দুর সম্পাদকীয়, আনন্দবাজারের উপসম্পাদকীয় আর একটি ঘটনা, সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণণের বইয়ে মুহম্মদ নবীর একটি ছবি ছাপানো হয়েছে বলে কলকাতায় বিক্ষোভ শুরু হতেই দিল্লির প্রকাশককে ক্ষমা চাইতে হয়েছে। হিন্দু লিখেছে, এই ২৯৫(ক)ই তো বাংলাদেশে আমার বিরুদ্ধে প্রয়োগ করেছিল সরকার। সেই পনেরো ষোলো বছর থেকে বাক স্বাধীনতাবিরোধী আইনটিকে বাদ দেওয়ার কথা বলছি। আমার এবং আমার মতো দু’একজনের কথা কে শোনে।
আজকের আনন্দবাজার পত্রিকার লেখাটি দেখে হ্যাঁ হয়ে গেলাম। কদিন আগেই আমাকে সমর্থন করেছে, আর আজ একশ’ আশি ডিগ্রি ঘুরে গেল! হতবাক হতে হয় আমাকে। বাকরুদ্ধ বসে থাকি। কল্যাণ সান্যাল আমার বিরুদ্ধে একটি উপসম্পাদকীয় লিখেছেন। বিতর্কের জন্য যদি ছাপানো হয়ে থাকে লেখাটি তাহলে কোনও আপত্তি নেই। সুস্থ বিতর্ক সবসময়ই ভালো। কিন্তু যদি এ বাক-স্বাধীনতার বিপক্ষে অবস্থান হিসেবে হয়, তাহলে নিশ্চিতই আশংকার কারণ বৈকি। আমি অনুমান করি, আমার পক্ষে লেখা কোনও নিবন্ধ বা চিঠি এখন আনন্দবাজার ছাপাবে না বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কল্যাণ সান্যালের বক্তব্য শিল্প মানেই শুদ্ধ নয়, রাজনীতি মানেই দূষিত নয়। সিপিএমের রাজনীতি দূষিত নয়, আমার লেখা শুদ্ধ নয়। আমার লেখা যেহেতু শুদ্ধ নয়, আমাকে রাজনীতিকরা বা ক্ষমতাবানরা তাড়িয়ে দিতেই পারে, এতে কোনও অসুবিধে নেই। আরও লিখেছেন, আমার লেখার ধরন এবং মর্মবস্তু কোনওটাই তিনি পছন্দ করেন না। পছন্দ করেন না, সুতরাং যেন তাড়িয়ে দেওয়াটায় অন্যায় কিছু নেই। তিনি সিপিএমের বিরোধিতা করছেন নন্দীগ্রামের ব্যাপারে। কিন্তু আমার ব্যাপারে তিনি সরকারের পক্ষ নিচ্ছেন। আমার একটা ধারণা হয়. কল্যাণ সান্যালের মতের পক্ষে বেশির ভাগ শিল্পী সাহিত্যিক বুদ্ধিজীবী, তা না হলে আমার বিরুদ্ধে যে অন্যায় সিপিএম সরকার করেছে, তার কোনও প্রতিবাদ নেই কেন?
.
৬ ডিসেম্বর
আজ বাবরি মসজিদ আক্রমণের পনেরো বছর পূর্তি। লজ্জা লিখেছিলাম পনেরো বছর আগে। দিন যে কীভাবে উড়ে যায়! মনে হয় এই সেদিন। ভালোবাসা জন্মেছিল ঠিক পনেরো বছর আগে, ৬ ডিসেম্বর তারিখে, ১৯৯২ সালে। আজ নাকি হরকাতুল জিহাদি দলের সদস্যরা একটা সাদা গাড়ি করে উত্তরপ্রদেশের দেওবন্দ থেকে দিল্লিতে ঢুকেছে, ইচ্ছে কিছু জনবহুল জায়গায় বোমা মেরে মানুষকে সন্ত্রস্ত করা। যদুর মনে পড়ে এই হরকাতুল জিহাদি দলটি বাংলাদেশে গড়ে উঠেছিল, আমার বিরুদ্ধে ধর্মবাদীদের আন্দোলন যখন তুঙ্গে, তখন। কী লাভ হচ্ছে তাদের মানুষ মেরে, আমি জানি না।
আজ প্রশান্ত রায়ের সঙ্গে কথা বললাম ফোনে সকালে, অনেকক্ষণ। উনি আশাবাদী কলকাতায় কিছু একটা আন্দোলন হবে আমার পক্ষে। আমি বললাম আন্দোলন হলে শুরুতেই হত। চোখের সামনে মানুষ দেখলো আমাকে কী করে বের করে দেওয়া হল পশ্চিমবঙ্গ থেকে। কী ভয়ংকর অন্যায়ভাবে বের করা হল। দিনের পর দিন মনের ওপর অত্যাচার চালিয়ে তারপর বের করলো। তারপরও কোনও একটি মিছিল বেরোলো না কলকাতার রাস্তায়! নিজেদের হাতে লেখা প্ল্যাকার্ড হাতে দাঁড়াতে হল আমার চার পাঁচজন বন্ধুকে। কেউ নেই আমার জন্য? আমার জন্য কেউ না থাকুক, অন্তত বর্বর একটি ঘটনার বিরুদ্ধে কি কারও দাঁড়াবার নেই? হ্যাঁ কিছু লেখা হচ্ছে বটে এদিক ওদিক কিন্তু জনগণকে ততটুকু ক্ষুব্ধ করছে না, যতটুকু ক্ষুব্ধ হলে মিছিলে যেতে হয়।
পাগলের মতোকাঁদলাম। তপন রায় চৌধুরী ফোন করেছিলেন। বললাম যেন আমাকে কলকাতা নিয়ে যান। যদি কলকাতা না-ই যেতে পারি, যদি পশ্চিমবঙ্গ আমাকে না-ই নেয়, আমাকে যেন বাংলাদেশেই পাঠিয়ে দেয়। ওখানে হুজি ফুজিরা কখনও মেরে ফেলে রাখবে। তাই ভালো। তবু পরের দেশকে নিজের দেশ ভেবে ভুল যে করেছিলাম, মানুষকে ভালোবাসলেও মানুষ যে শেষ অবধি ভালোবাসে না, বরং দূরে বসে মজা দেখে, তা তো আর নিজের চোখে দেখতে হবে না।
আমার ছিঁড়ে যাচ্ছে মাথা। আর পারছি না সইতে। প্রভুকে বললাম, আমাকে বাংলাদেশে ফেলে আসুন। ওখানেই যা হবার হোক। প্রভু শুনলেন। কণ্ঠে তার আগ্রহ আরও কিছু শোনার। এরকম কিছু শোনার জন্য যেন অনেকদিন অপেক্ষা করছেন। মনে আছে প্রভুর মতোই আরও একজন সরকারি বড় অফিসার বলেছিলেন, রাজস্থান হাউজে বসে, আমি যেখানে নিরাপদ, সেখানেই থাকা উচিত আমার।
জিজ্ঞেস করেছিলাম, কোথায় নিরাপদ?
লোকটি বলেছিলেন, ‘পৃথিবীতে কি নিরাপদ জায়গার অভাব আছে?’
‘কোথায় সেই নিরাপদ জায়গা, শুনি!’
‘কেন, ইওরোপ বা আমেরিকা!’
‘না। আমি বিদেশ যাবো না।‘
কী রকম যেন ভয় লাগছিল আমার।
.
৭ ডিসেম্বর
সকালে কলকাতা থেকে শর্মিলা ফোনে শোনালো আজকের প্রতিদিনের উইকএন্ডে বের হওয়া জয় গোস্বামীর একটা লেখা। ‘কোনও লেখককে যদি তার কোনও লেখা প্রত্যাহার করে নিতে হয়, তখন কী অনুভূতি হয় তাঁর? কী অপরিসীম কষ্টের মধ্য দিয়ে তসলিমাকে যেতে হয়েছে এই প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত নিতে, তা, আমরা অনুমান মাত্র করতে পারি। কারণ, আমাদের কাউকেই নিজের দেশ থেকে নির্বাসিত অবস্থায় দিনের পর দিন, দেশের পর দেশে, নিরাপত্তা রক্ষী পরিবৃত হয়ে ঘুরে বেড়াতে হয়নি। আমাদের কারোরই নিজের দেশে ফেরার পথ বন্ধ নয়। আমাদের কারো বই বেরোনো মাত্র নিজের দেশে পর পর নিষিদ্ধ হয়ে আসছে না। আর আমরা কেউই জানি না, নিজের মাথার উপর মৃত্যুদণ্ডের ফতোয়া ঝুলে থাকলে কেমন লাগে।
আমরা শুধু তসলিমার সমালোচনা করতে পারি। এটা লেখা তসলিমার উচিত হয়নি। ওটা বলা তসলিমার ঠিক হল না। এমনকী, আমরা এতটাও বলেছি কখনো যে, এসবই তসলিমা প্রচার পাওয়ার জন্য করেছেন। হয়াঁ, নিজের জীবন শেষ হয়ে যেতে পারে কোনও উন্মাদ ধর্মান্ধ ঘাতকের হাতে এটা জানার পরেও হয়তো প্রচারের জন্যই করেছেন। এতটাও বলেছি আমরা।’
শুধু এটুকুই নয়, আমার অবস্থা বোঝাতে বোঝাতে গ্যালিলিওর প্রসঙ্গও এনেছেন জয়। গ্যালিলিকেও পুড়িয়ে মারার ভয় দেখানো হয়েছিল। অসম্ভব চাপের সামনে শেষ ম্যে ভেঙে পড়লেন গ্যালিলিও। প্রত্যাহার করে নিলেন নিজের মতবাদ। বললেন, ‘চার্চই ঠিক, সূর্য পৃথিবীর চারদিকে ঘুরছে।‘ চোখ রাঙালে না হয় গ্যালিলিও বলে দিলেন পৃথিবী ঘুরছে না, পৃথিবী তবু ঘুরছে, ঘুরবেও যতই তাকে চোখ রাঙাও না।
শিবনারায়ণ রায়কে ফোন করেছিলাম, ওঁর শরীর মন কোনওটাই ভালো নেই। লিখতেও, বললেন, পারছেন না। বললাম ‘ব্লাড প্রেশার হয়তো খুব বেশি, ডাক্তার দেখান। নাহ, ডাক্তার দেখানোর খুব আগ্রহ নেই। বয়স বাড়লে, সবাই যেন কেমন কুঁকড়ে যান, ‘বেঁচে না থাকলেও চলে, অনেক তো হল’ ধরনের বাক্য আওড়ান।
বয়স ছিয়াশি। বললাম ‘জ্যোতিবাবুর বয়স তো পঁচানব্বই। আপনার চেয়ে তো অনেক বেশি বয়স।‘
কী অন্যায় করেছি যে আমাকে শাস্তি পেতে হবে? শিবনারায়ণ রায় বললেন, ‘কে বলেছে মানুষ শাস্তি পায় অন্যায় করলেই? তুমি একটা ক্ষমতাসীন শক্তির স্বার্থে আঘাত দিয়েছে, সে কারণে শাস্তি পাচ্ছো।
আজ ‘নিউ ইয়র্ক টাইমস’এ একটা লেখা পড়ে খুব ভালো লাগলো। মনের সঙ্গে মিলে যাওয়া কথা। সৌদি আরবের এক মেয়ে অপহরণ আর গণধর্ষণের শিকার। ইসলামের বিচারে ধর্ষকদের কোনও শাস্তি হল না। শাস্তি হল মেয়েটির। জেল হল। চাবুক হল। সুদানে এক ইস্কুল শিক্ষিকাকেও শাস্তি পেতে হল, কারণ পড়াতে গিয়ে টেডি বেয়ারের নাম রেখেছিল মুহম্মদ। এদিকে আমাকে পেতে হল শাস্তি। কবে কোন বইএ কী লিখেছি তা তাদের পছন্দ হয়নি বলে। তো ইসলামে নাকি বেশির ভাগ মুসলমানই অমৌলবাদী। ইসলামকে নাকি কিছু মৌলবাদীরা হাইজ্যাক করেছে। তাছাড়া ইসলাম খুব ভালো, ভালোর অন্ত নেই। লেখকের মতো আমারও প্রশ্ন, সেই মডারেটরা বা নরমপন্থীরা বা আধুনিক মুসলমানরা এখন কোথায়? তাঁরা মৌলবাদীদের কোনও দাঙ্গা হাঙ্গামা, কোনও শঠতা শয়তানি, কোনও ধর্ষণ লুঠের বিরুদ্ধে কিছু বলেন না তো, তাঁরা তো পথে নামেন না দল বেঁধে! অল্প কিছু মুসলমান এত বড় জঘন্য কান্ড ঘটাচ্ছে, আর বেশির ভাগই চুপ করে বসে দেখছে, তা কি হয়? মাঝে মাঝে আমার কিন্তু মনে হয় মডারেট’ বলে কিছু নেই। মুসলমান সমাজে দু’ধরনের মানুষ আছে, এক ইসলাম-বিশ্বাসী, আরেক ইসলামে অবিশ্বাসী। ইসলামে অবিশ্বাসীর সংখ্যা তুলনায় খুব কম, খুবই কম। বাদবাকি পুরোটাই ইসলাম-বিশ্বাসী। এই ইসলাম-বিশ্বাসীদের কেউ কেউ টুপি পরে, জোব্বা পরে, দাড়ি রাখে। কেউ কেউ এই পোশাকের বাইরে অন্য পোশাক পরে। বিশ্বাসীদের কেউ কেউ নামাজ রোজা ইত্যাদি করে, কেউ কেউ করে না। এই হল ঘটনা। বিশ্বাসীদের কেউ কেউ যখন মানবতার বিরুদ্ধে নামে, তার প্রতিবাদ বিশ্বাসীদের মধ্য থেকে আসে না। মডারেটদের তাই চোখে পড়ে না। মডারেট বা নরমপন্থী বলতে কিছু নেই বলেই চোখে পড়ে না।
সারাদিন কিছু ফোন। পাটনা থেকে কেয়া। বীরভুম থেকে এনামুল। ২৪ পরগণা থেকে মোজাফফর। আর একটি চিঠি পেয়ে মন ভরে গেল আজ। পাচুর চিঠি। চিঠি বলতে ই মেইলকেই বুঝি। অনেকমাস ধরে যোগাযোগ নেই পাঁচর সঙ্গে। এমন ভালো বন্ধুর সঙ্গে যোগাযোগ না থাকার পিছনে কারণ ছিল, অভিমান। পাচু লিখেছে, ‘নিরাপদে আছিস এটা বুঝি। কিন্তু তোর মন যে একেবারে তছনছ, সেটা ভেবে বড় ব্যাকুল লাগে। আমাদের এই সময় কি তাহলে শাসিত হবে শুধুই ধর্ম, শুধুই মৌলবাদ, শুধুই ভোট কেন্দ্রিকতার যাঁতাকলে? কী ভয়ানক রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের মুখোমুখি হয়ে তুমি তিনটি পাতা প্রত্যাহার করেছো বুঝে শরীর মন হিম হয়ে যায়। আশা রাখবো এই দুর্দিন আবার কাটবে, তুমি আবার ফিরে আসবে তোমাতে, আবার ঝলসাবে তোমার কলম অনির্বাণ! ভালো থাকিস। এই অবস্থায় যতটুকু ভালো থাকা যায়। উত্তরে আমি লিখলাম, ‘পাচু তোর চিঠি পেয়ে ভালো লাগলো এই অসহ্য কষ্টের মধ্যেও। জানি না কী করবো আমি। কলকাতা যেতে চাই। কিন্তু প্রগতিশীল কলকাতা তো আমাকে নিচ্ছে না। আমি একটা অন্ধকার ঘরে হতাশা আর অনিশ্চয়তায় ডুবে আছি। এরা হয়তো চাইছে মানসিক যন্ত্রণায় ভুগে একদিন আমি আত্মহত্যা করি নয়তো এদেশ ছেড়ে চলে যাই। উত্তর লিখলো পাচু। তসলিমা, কাকেই প্রগতিশীল কলকাতা বলিস জানি না। যে কলকাতায়, আমরা জানি, মৌলবাদকে নির্লজ্জ ব্যবহার করে লাল ঝান্ডাওলা একটি দল স্রেফ মুসলিম ভোটের কারণে যার বিরুদ্ধে প্রতিবাদে গর্জে উঠতে গিয়ে অন্য ঝাল্ডাধারীরা সুতীব্র ধিক্কারে এককাট্টা হয়ে গলা ফাটিয়ে সর্বব্যাপী আওয়াজ তুলতে পারে না–যারা বোঝে না কোন অসহনীয় রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের মুখে অসহায় একজন লড়াকু লেখককে তার সাধের তিনটি পাতা ছিঁড়ে ফেলতে হয়–সেই কলকাতাকে তুই প্রগতিশীল কলকাতা বলবি? এই চরম অন্যায়ের শোধ তুই একদিন না একদিন নিতে পারবি। এত অন্ধকারেও আমি বিশ্বাস করি, মৌলবার শেষ কথা বলে না।
বলে না? বাংলাদেশে তো আজও মৌলবাদই শেষ কথা বলে তেরো বছর হয়ে, গেল, ফিরতে পারি না। আর কী কথা বাকি আছে বাংলাদেশের বলার? চুপ করে আছে পশ্চিমবঙ্গ, আর কী কথাই বা তার শেষ কথা। নীরবতা, প্রত্যাখ্যান, অবজ্ঞা, অপমান, মৌলবাদই তো শেষ কথা।
যেখানে আছি আমি, একটি ঘর, সামনে একচিলতে বারান্দা, বারান্দার লাগোয়া একটা ছাদ। ছাদে দাঁড়ালে বা হাঁটলে আবার কেউ না কেউ কোথাও থেকে দেখে ফেললে আবার কী না কী হয়, তাই ওদিকটায় যাই-ই না। যেন না যাই, আমাকে বলে দেওয়া হল। এ আর কী, ঘরবন্দি হয়ে থাকতে তো পারিই আমি। মাসের পর মাস তো কাটিয়েছি, দেশে, বিদেশে। নিরাপত্তার নামে যন্ত্রণা ভোগ কী কম করেছি। শেকল ভাঙার কথা বলতে গিয়ে নিজের পায়ে শেকল পরতে হয়েছে, সে কী আজ থেকে!
.
৮ ডিসেম্বর
‘I think the Taslima Nasreen case has tested, and will test, the integrity of the Left intelligentsia even more than Nandigram’–Ramachandra Guha.
৬ ডিসেম্বরে কলকাতায় বাবরি মসজিদ ধ্বংসের পনেরো বছর উপলক্ষে একটা অনুষ্ঠানে গিয়েছিলেন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। তিনি বললেন, রাম হচ্ছে কবির কল্পনা। রামসেতুটা প্রাকৃতিক সেতু। রামসেতু নিয়ে যা হচ্ছে তা ধর্মীয় উন্মাদনা। টেলিভিশনে কাল এই খবরটি দেখে আমি তাজ্জব। কদিন আগে মুসলিম মৌলবাদীদের দাবি মেনে নিলেন, শহরে ওদের বর্বরতা আর উন্মাদনার বিরুদ্ধে একটা শব্দ খরচ করলেন না, বরং বললেন, কারওর অধিকার নেই ওদের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেওয়ার। আর এদিকে দোষীকে শাস্তি দেবার বদলে নির্দোষকে রাজ্যছাড়া করলেন, তারপর আজ কি না তিনি হিন্দুর ধর্মীয় অনুভূতিতে নিজেই আঘাত দিচ্ছেন।
.
৯ ডিসেম্বর ‘অধিকাংশের মতামতের সঙ্গে একমত না হওয়ার অধিকার চিন্তাশীল মানুষের প্রাথমিক, মৌলিক, সর্বশ্রেষ্ঠ অধিকার। এক লেখককে ‘তুমি এত দূর অবধি লিখতে পারো, কিন্তু তার বেশি এগোবে না’ বলা আর ‘তুমি কিছুই লিখবে না’ বলার মধ্যে কোনও পার্থক্য নেই। কারণ আসলে বলা হচ্ছে ‘তুমি বাপু বাক পরাধীন, তবে আমার ন্যাজে পা না-দেওয়া অবধি বাকস্বাধীন’। এই থ্রেট-সহ ছাড় স্বাধীনতা নয়। খাঁচার মধ্যে পায়চারি করার অনুমতি।
বাক স্বাধীনতার কোনও চৌকাঠ হয় না। সীমা হয় না। কারণ তা হলে যে কোনও ক্ষমতাশীল গোষ্ঠী (রাষ্ট্র। মৌলবাদী/ফাটাকেষ্ট ও চ্যালারা) যখন খুশি ইচ্ছেমতো চৌকাঠ নির্মাণ করবে, এবং পৃথিবীর যে কোনও শিল্পকেই নিজের সুবিধেমত কারও না কারও ভাবাবেগ-আঘাতকারী হিসেবে চিহ্নিত করবে, তার পর গুলি’। –চন্দ্রিল ভট্টাচার্য
একটা চিঠি লিখলাম তাঁকে। চিঠি তাঁকে পাঠানো হয়তো সম্ভব নয়, তবু লিখতে ইচ্ছে হল একটি চিঠি
মাননীয় বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য,
আমার অশেষ শ্রদ্ধা জানবেন। আপনার সঙ্গে একসময় আমার আলাপছিল, বেশ কয়েকদিন কথাও হয়েছে। আপনাকে একজন আন্তরিক মানুষ হিসেবেই তো আমি জানতাম। মনে আছে নন্দনে বসে আপনি একবার আমার বম্বে হয়ে প্যারিস যাবার বদলে দিল্লি হয়ে প্যারিস যাওয়ার প্রস্তাব দিয়েছিলেন, কারণ বোম্বের মৌলবাদী মুসলিমরাবিক্ষোভ দেখাচ্ছিল আমার বোম্বে যাওয়ার বিরুদ্ধে, বিমানবন্দর নাকি জ্বালিয়ে দেবে, আমাকে জ্যান্ত পুড়িয়ে মারবে। আমি আপনার প্রস্তাব মেনে নিচ্ছিলাম, কিন্তু শাবানা আজমি, জাভেদ আখতার, জাভেদ আনন্দ আর তিস্তা শীতলবাদীরা যখন বারবার আমাকে ফোন করছিলেন, বলছিলেন আমাকে যেতেই হবে বোম্বে, আমাকে বোঝাতেই হবে যে মৌলবাদীরা যা দাবি করে, তা হতে দেওয়া যায় না, বোম্বে যেতে হবেই, না যাওয়া মানে মৌলবাদীর কাছে নতি স্বীকার করা, না যাওয়া মানে তাদের অন্যায্য দাবি মেনে নিয়ে তাদের বিজয়ী করা। আমি আপনার উপদেশ মেনে চলছিলাম বলে তাঁরা আপনার শরণাপন্ন হলেন। আপনাকেই বোঝালেন কত যে জরুরি আমার বোম্বে যাওয়া। আপনি বুঝলেন এবং মেনে নিলেন আমার বোম্বে হয়ে প্যারিস যাওয়া।
তারপরও ওই নন্দনেই দু’একবার দেখা হয়েছে। আমজাদ আলী খানের সরোদ শুনতে গিয়েও একবার দেখা হল, সম্ভাষণ বিনিময় হল। শ্রদ্ধেয় আমজাদ আলী খান আপনাকে এবং আমাকে নমস্কার জানিয়ে বাজনা শুরু করলেন। তখন ২০০২ সাল, কলকাতায় পাকাঁপাকিভাবে বাস করার ইচ্ছে মনে, মনে আছে চারদিকে ফ্ল্যাট খুঁজে বেড়াচ্ছি কেনার জন্য। আপনি আমাকে সাহায্য করছিলেন একটা ফ্ল্যাট কিনতে। মন্ত্রী গৌতম দেবএর জন্য যে একটা ফ্ল্যাট বরাদ্দ ছিল উদিতায়, বলেছিলেন সেই ফ্ল্যাটটি আমার কিনে নিতে কোনও অসুবিধে নেই। আমি তৈরি ছিলাম। কাগজপত্র পাঠানো হয়েছে দিল্লি নাকি বোম্বেতে। রিজার্ভ ব্যাংক থেকে নাকি অনুমতি চলে আসছে। না, সেই অনুমতি অবশ্য আমার কোনওদিন পাওয়া হয়নি। কোনও কাগজপত্র ফেরত পাইনি। ফ্ল্যাট কেনাও হয়নি। কিছুই হয়নি। আপনার সঙ্গেও আর কোনও সৌজন্য সাক্ষাৎ হয়নি। সম্ভব হয়নি আপনার আর নাগাল পাওয়া। আপনার বন্ধুরা, যারা আমারও বন্ধু ছিল, হঠাৎ আমার পর হয়ে উঠলো।
মনে হচ্ছে এই সেদিনের কথা এসব। কী থেকে কী হয়ে গেল, অবিশ্বাস্য সব ওলোটপালোট।
আমি তখন হারভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে সেকুলারিজমের ওপর একটা ফেলোশিপ করছি। ওখানেই শুনি আপনি আমার দ্বিখন্ডিত বইটিকে নিষিদ্ধ করে দিয়েছেন। সত্যি, যেন আকাশ থেকে পড়লাম। এও কি সম্ভব? কলকাতার বন্ধুরা জানালো, সম্ভব। ছোটবেলা থেকে বামপন্থায় বিশ্বাস আমার। বামপন্থী রুশ লেখকদের লেখা পড়ে বড় হয়েছি। আমি তো ‘দ্বিখন্ডিত’তে মৌলবাদের বিরুদ্ধে আমার লড়াইএর কথা লিখেছি, নারীর স্বাধীনতা আর অধিকারের কথা লিখেছি, আমি তো সমতার কথা লিখেছি! কোথায় তবে বামপন্থার সঙ্গে সংঘাত হল আমার? আমি শুনলাম আপনি বলছেন, কয়েকজন বুদ্ধিজীবী আপনাকে বলেছেন বইটাকে নিষিদ্ধ করতে, এবং আপনিও একাধিকবার পড়ে দেখেছেন ওটা, ওটা নাকি নিষিদ্ধ হওয়ার মতোই বই। তাই কি? আপনি কি মন থেকে বলেছেন ওসব কথা, আপনি কি সত্যিই মনে করেন যে আমি যা লিখেছি, একটি শব্দ বা বাক্য ভুল লিখেছি? যদি মনে করেন লিখিনি, তবে কি আশংকা জন্মেছিল আপনার, যে, শহরে কোনও সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা লেগে যাবে বইয়ের কারণে? কোথাও তো দাঙ্গার আভাস মেলেনি। হাইকোর্ট বইটাকে মুক্ত করে দেওয়ার পর তো বই চলেছে মাসের পর মাস, বছরের পর বছর। কোথাও তো দাঙ্গা লাগেনি। কোনও একজন মুসলমানও তো আপত্তি করেনি। বইটি নিষিদ্ধ করার কারণ দেখাতে গিয়ে বলা হয়েছিল, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ট হবে। দুটো সম্প্রদায়ে নাকি দাঙ্গা লাগবে। পরে হাইকোর্টে এই কারণটি উড়িয়ে দেওয়া হয় এই বলে যে, দুটো সম্প্রদায় এখানে জড়িত নয়। তখন নিষিদ্ধ করার পক্ষে আপনি নতুন কারণ দেখালেন যে, বইটি মানুষের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেবে। তিনজন বিচারক রায় দিলেন বইয়ের নিষেধাজ্ঞার বিপক্ষে। না, বুদ্ধবাবু, সবিনয়ে জানাই, রায় আমার দেওয়া নয়। নিষেধাজ্ঞার বিরুদ্ধে মামলাও, আমার নয়, কলকাতার একজন মানবাধিকার কর্মীর রুজু করা। আপনি আমার বই নিষিদ্ধ করেছেন, তারপরও আপনার প্রতি আমার শ্রদ্ধা কিছু কমেনি। চেষ্টা করেছি আপনার সঙ্গে দেখা করতে, সম্ভব হয়নি। আপনার কাছে পৌঁছোনোর সব দরজা জানালা আপনি বন্ধ করে রেখেছেন। আপনার যাঁরা কাছের মানুষ, যাঁদের সঙ্গে আমারও যোগাযোগ ছিল, তারাও দূরে সরে গেলেন হঠাৎ। তারপরও বিশ্বাস হারাইনি আপনার ওপর থেকে। ‘ভালো ছবি’ নামে একটা সিনে ক্লাব গড়ে তুলেছিলাম, ইচ্ছে ছিল বিদেশ থেকে সংগ্রহ করা আমার ভালো ভালো সব ছবি কলকাতার মানুষকে দেখাবো। নন্দনে দেখাতে পারবো, এরকম একটি আশ্বস অংশু সূরের কাছ থেকে পেয়ে পৃথিবীর প্রায় দু’হাজার শ্রেষ্ঠ ছবি যোগাড় করে দেখলাম, নন্দনে আমি নিষিদ্ধ। আমি বোকার হদ্দ, অনেক পরে ধীরে ধীরে বুঝেছি আমি মানুষটাই আসলে নিষিদ্ধ সব সরকারি জায়গায়। সরকার আয়োজিত কোনও উৎসব অনুষ্ঠানে যাওয়ার অধিকার আমার নেই, অংশ নেওয়ার তো প্রশ্ন ওঠে না। কী ভীষণ একা হয়ে গেলাম।
এত ঘৃণা কেন আমার প্রতি আপনার? আমি ইসলাম ধর্ম নিয়ে লিখেছি বলে? আপনি সত্যি করে বলুন তো আপনি ইসলাম ধর্মে বিশ্বাস করেন? ইসলাম গেল ইসলাম গেল বলে যারা চেঁচাচ্ছে, আমার মুন্ডু চাইছে, কুশপুত্তলিকা পোড়াচ্ছে, আমাকে রাজ্য থেকে তাড়িয়ে দেবার কথা বলছে, তাদের কি ভালো লোক বা সৎ লোক বলে আপনার মনে হয়? তাদের দাবিকে ন্যায্য দাবি বলে আপনি মনে করেন? যদি তা না মনে করেন, তা হলে বলছেন না কেন? হিন্দু মৌলবাদীরা অন্যায্য দাবি করলে, রামসেতু নিয়ে লাফালে আপনি তো পছন্দ করেন না। ওদের চেঁচামেচিকে নির্দ্বিধায় বলেন, ধর্মীয় উন্মাদনা। মুসলমান মৌলবাদীদের সামনে আপনি নাকি আমাকে ‘বাজে মহিলা’, ‘হরেবল উওম্যান’ বলেছেন, এবং আমাকে রাজ্য ছাড়া করবেন বলে ওদের কথা দিয়েছেন। বিশ্বাসে, আদর্শে, চেতনায় আমি তো ভেবেছিলাম আমি আপনার কাছের মানুষ, কিন্তু আশ্চর্য আপনি তাদের আপন মনে করেছেন, যারা সমাজটাকে অন্ধকারে ছুঁড়ে ফেলতে চায়, যে অন্ধকারে মেয়েরা নির্যাতিত হচ্ছে দিনের পর দিন, যেখানে সত্য এবং সাম্যের পক্ষে মুখ খোলা নিষেধ।
কী অন্যায় করেছি আমি, আমার কী অপরাধের শাস্তি আপনি আমাকে দিলেন, খুব জানতে ইচ্ছে করে আমার। আপনার দলের পত্রিকা এবং বন্ধুর পত্রিকায় আমাকে বছরের পর বছর যা তা ভাষায় গালি দেওয়া হচ্ছে। আমার সম্পর্কে বানিয়ে বানিয়ে মিথ্যে কথা লেখা হচ্ছে। দেখেও বছরের পর বছর মুখ বুজে থেকেছি। পথে প্রান্তরে সিঙ্গুর নিয়ে, নন্দীগ্রাম নিয়ে, রিজওয়ান নিয়ে মানুষ প্রতিবাদ করছে, কোনওদিনও কিছু বলতে পারিনি, লিখতে পারিনি। এদেশি লোক নই, এদেশি রাজনীতি নিয়ে আমার মুখ খোলা নাকি উচিত নয়। বন্ধুরা বলেছে, আমি পথে নামলেই আপনি আমার ওপর প্রতিশোধ নেবেন, পশ্চিমবঙ্গে আমাকে আর থাকতে দেবেন না। অন্যায়ের প্রতিবাদ না করা আমার স্বভাববিরুদ্ধ, তারপরও আমি নির্লজ্জের মতো মুখ বুজে থেকেছি। হাঁ, পশ্চিমবঙ্গে থাকাটা আমার জন্য ভীষণ জরুরি বলে মুখ বুজে থেকেছি। আজ যদি বাংলাদেশ আমাকে দেশান্তরী না করতো, বাংলাদেশে বাস করা আমার পক্ষে সম্ভব হত, তাহলে ওখানেই থাকতাম। এখানে বাস করতে চাইতাম না। এগারো বছর আমি ইওরোপের এক দেশ থেকে আরেক দেশে ঘুরেছি। কোথাও মন বসাতে পারিনি। কোনও দেশকেই নিজের দেশ বলে মনে হয়নি আমার। ওসব দেশে আমাকে যথেষ্ট সম্মান করা হয়েছে, বাক স্বাধীনতা নিয়ে কোনওদিন কোনও শর্ত দেওয়া হয়নি, আশ্রিত বলে আমাকে সংযত হয়ে কথা বলতে বলেনি কেউ, তারপরও আমি আমার নিজের দেশে চলে যেতে চেয়েছি, নিজের বাবা মা, ভাইবোনের কাছে ফিরতে চেয়েছি, বন্ধুদের কাছে ফিরতে চেয়েছি। নির্বাসন জীবন শুরুর পর ইওরোপে বসে বসে হতাশায় ভুগতে ভুগতে বাংলাদেশের দরজায় কড়া নেড়ে বিফল হয়ে ভারতের দরজায় কড়া নেড়েছি। ভারত খুলেছে দরজা, তবে ছ’ছটি বছর নিয়েছে দরজা খুলতে। অল্প যে-কদিনের জন্য অনুমতি দেওয়া হত ভারত ভ্রমণের, সে কদিনই এসে থেকে যেতাম পশ্চিমবঙ্গে। প্রাণ ভরে দেশের স্বাদ নিতাম। ওপার থেকে আত্মীয়স্বজন আসতো এপারে আমার সঙ্গে দেখা করতে। ভারতে বাস করার অনুমতি বছর তিন আগে মিলেছে, মেলার পর এক মুহূর্ত দেরি করিনি, থাকতে শুরু করেছি। পশ্চিমবঙ্গে বাস করা আমার কাছে পশ্চিমবঙ্গে বাস করা কখনও ছিল না।
বছর তিনেক কলকাতায় বাস করছি। কারও তো অনিষ্ট করিনি। নিজের ঘরে বসে নিজের লেখালেখি করি, কিছু বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে দেখা হয়, কথা হয়। কারও সাতে নেই, পাঁচে নেই। রাজনীতি বুঝিও না। রাজনীতি থেকে সহস্র মাইল দূরে থাকি। আমার শান্তশিষ্ট জীবন কার বাড়া ভাতে ছাই দিল? পশ্চিমবঙ্গের ঘরটি আমার কাছে শুধু ঘর ছিল না। ঘরের চেয়েও অনেক বড়। আমার নিজের যে একটি ঘর ছিল বাংলাদেশে, যে ঘরটি ছেড়ে আমাকে নির্বাসিত হতে হয়েছিল, সেই ঘরটি আমি প্রাণপণে ফিরে পেতে চেয়েছিলাম। অপেক্ষার প্রহর গেছে কেবল সেই স্বপ্নের কাছে যেতে। সেই ঘর, সেই স্বপ্ন, ভিন্ন ভাষা আর ভিন্ন সংস্কৃতির মধ্যে পাওয়া যায় না। সেই ঘরটি, নিজের সেই ঘরটি, আমার দীর্ঘ এগারো বছরের পথে পথে ঘোরার ক্লান্তির পর পেয়েছিলাম কলকাতায়, পশ্চিমবঙ্গে, আমার বাংলায়। বাংলাকে আমি কোনওদিনই ভাগ করে দেখিনি, তাই পেরেছিলাম অত দ্রুত পশ্চিমবঙ্গকে নিজের দেশ করে নিতে, কলকাতাকে নিজের শহর করে নিতে। পশ্চিমবঙ্গের ঘর শুধু ঘর ছিল না, বহুকালের হারানো স্বপ্ন ফিরে পাওয়া ছিল। নিজের যে ঘরটি যে স্বপ্নটি আমাকে ত্যাগ করতে হয়েছিলো, সে ঘরটি ফিরে পাওয়া, সেই স্বপ্নকে ফিরে পাওয়া, সেই নিশ্চিন্তিটি, আমার জীবনের সবচেয়ে বড় পাওয়া। দীর্ঘ বছরের সাধনার পর সাধের ধন ফিরে পাওয়া। আমার মা খুব চেয়েছিলেন দেশের মেয়ে দেশে ফিরে আসি। বিদেশে আমার বিষণ্ণ পড়ে থাকা দেখে তিনি কাঁদতেন। চেয়েছিলেন যে করেই হোক যেন নিজের বাড়িঘরে, নিজের আত্মীয় বন্ধুদের নিয়ে থাকি। মার সেই স্বপ্ন সফল হয়নি, শত চেষ্টা করেও আমি দেশে ফিরতে পারিনি। কিন্তু বেঁচে থাকলে মা নিশ্চয়ই অন্তত স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতেন এই ভেবে যে, অন্তত বাঙালির মধ্যে আছি, দেশ না হলেও দেশের মতো জায়গায় আছি।
নিশ্চিন্তে নির্বিয় ছিলাম কলকাতায়। হঠাৎ হায়দারাবাদে আমার ওপর মৌলবাদীদের আক্রমণ হল। সাধারণ মানুষ সহানুভূতি প্রকাশ করলো। না, বুদ্ধবাবু, আপনি ফিরেও তাকালেন না। আমি মার খাই, কী মরে যাই, তাতে আপনার কিছু যায় আসে না। একটিবার বললেন না হায়দারাবাদে যা হয়েছে, তা হওয়া উচিত হয়নি। না, বুদ্ধবাবু, হায়দারাবাদের অনুষ্ঠানে ধর্ম নিয়ে আমি একটি শব্দও উচ্চারণ করিনি। তারপরও অসভ্য ঘটনাটি ঘটেছে। ঘটিয়েছে মৌলবাদীরা। এই ঘটনার পর কোথায় আমি সহানুভূতি পাবো, তা নয়, এই আপনারই শহরে, ধর্মতলার মোড়ে আমার মাথার দাম ঘোষণা করলো ক’জন মৌলবাদী। না, তাদের কাউকে আইন অমান্যের দোষে গ্রেফতার করা হয়নি। ওরকম ফতোয়া পেয়ে আমার অভ্যেস আছে। জীবন তো আমার কখনও কোনওদিন মসৃণ ছিল না। সইতে হয়েছে মৌলবাদীদের অনেক হুমকি, অনেক ফতোয়া, অনেক নির্যাতন, অনেক নিষেধাজ্ঞা। জীবন আমার এরকমই। ফতোয়ায় ভয় পাইনি। আপনি অনুগ্রহ করে নিরাপত্তার ব্যবস্থা করেছেন, তাই দুশ্চিন্তা কখনও ছিল না। আর, সত্যি কথা কী, আমার মনে হয়নি কলকাতায় আমাকে কেউ মেরে ফেলবে। নিরাপত্তা রক্ষীদের বিদেয় করে কত আমি গড়িয়াহাটে, যদুবাবুর বাজারে একা একা বাজার করেছি, ভিড়ের রাস্তায় একা একা হেঁটেছি। কই, কখনও তো কেউ মারতে আসেনি। যারা এসেছে, ভালোবেসে কাছে এসেছে।
এমন জীবনে হঠাৎ দেখি আমাকে বলা হচ্ছে ঘরের বাইরে আর বেরোনো চলবে না। কেন, বাইরে কী? নিরাপত্তা রক্ষীরা বলেন, ওপর থেকে অর্ডার পেয়েছেন ওরা, আমার বাইরে যাওয়া সম্পূর্ণই বন্ধ। রাস্তাঘাটে বাজার হাটে তো নয়ই, কারও বাড়িতেও নয়। নিভৃতে, কেউ জানবে না, তাও নয়। এমনকী দু’গাড়ি নিরাপত্তা রক্ষী নিয়েও বেরোনো যাবে না। পায়ে যে আসলে শেকল পরানো হচ্ছে, বুঝিনি। ভেবেছিলাম, সত্যি বুঝি ঘরের বাইরে আমাকে মেরে ফেলার ফাঁদ পাতা আছে। প্রসূন মুখার্জি যেদিন বাড়ি এসে দু’ঘণ্টা কথা বলেছেন, বুঝিয়েছেন, আমি বাইরে বেরোলেই আমাকে মেরে ফেলা হবে, উন্মত্ত ধর্মান্ধরা সব ধেয়ে আসবে আমার বাড়িতে আমাকে মেরে ফেলতে, এবং আমার জন্য কিছুতেই এই কলকাতায়, এই পশ্চিমবঙ্গে থাকা নিরাপদ নয়, আমি যেন চনে যাই, চলে যাই ইওরোপ আমেরিকায়, চলে যাই সিঙ্গাপুর থাইল্যান্ডে, চলে যাই কেরালা বা মধ্যপ্রদেশ, কোথাও, যেন কিছুতেই পশ্চিমবঙ্গে না থাকি, থাকলে রায়ট লেগে যাবে–সেদিনও বুঝিনি আসলে আতঙ্ক সৃষ্টি করে আমাকে দেশ থেকে বা রাজ্য থেকে বের করাই আসল উদ্দেশ্য। আমার নিরাপত্তার কথা ভেবে কিছুই করা হচ্ছে না। এরপরও প্রসূনবাবু ফোন করে করে চলে যাবার কথা বলতেন। হুমকির মতো শোনাতো তার কথা। শেষ ফোনটি যেদিন করেছিলেন আমাকে, নিজেই বললেন, সিএম বলেছেন আপনাকে অ্যাজ সুন অ্যাজ পসিবল চলে যেতে। উনি কেরালায় সব ঠিকঠাক করে ফেলেছেন। ওখানে সরকারের সঙ্গে কথাও হয়েছে সিএমের। ওখানে আপনাকে সিকিউরিটি দেওয়া হবে।
আমি, বিশ্বাস করুন বুদ্ধবাবু, বিশ্বাস করতে পারিনি আপনি প্রসূন মুখার্জিকে পাঠাতেন, আমাকে বুঝিয়ে, না বুঝলে ভয় দেখিয়ে, নানা কায়দায় আতংক সৃষ্টি করে, আমাকে দেশ ছাড়া, নয়তো রাজ্য ছাড়া করতে। আমি বলেছিলাম আমাকে যে এই পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য নিরাপত্তা দিতে পারছে না, আমাকে যে অন্য রাজ্যে চলে যেতে বলা হচ্ছে, মানুষ জানুক তা, কারণ কেরালায় গেলে ওখানেও তো হানা দিতে পারে আততায়ীরা। কী ভরসা আছে বাঁচবো আমি! আমি যে কেরালায় নিজের ইচ্ছেয় মরতে যাইনি, তা আমি তাহলে বলি সবাইকে। প্রসূন মুখার্জি বললেন, না, যেন গোপনে চলে যাই, যেন ঘুণাক্ষরেও কাউকে এসব না জানাই। শুধু প্রসূনবাবুকে দিয়ে নয়, আপনি আপনার দু’একজন ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের দিয়েও, যাদের আমি শ্রদ্ধা করি, বলিয়েছেন চলে যেতে। অন্যায় করেছি আমি, আপনার আদেশ আমি মানিনি, আমি কলকাতা ছেড়ে কোথাও যাইনি। যাইনি কারণ আমি ভেবেছিলাম আপনি আমার নিরাপত্তা নিয়ে চিন্তিত, তাই আমাকে চলে যেতে বলছেন। শহর শান্ত, নিরাপত্তার অভাব কী করে হবে, ভেবে পাইনি। তারপর তো শহর একদিন অশান্ত হল। অশান্ত হওয়ার কথা ছিল না, কিন্তু হল।
আপনি আমাকে কলকাতাতেই শাস্তি দিয়েছেন। ঘর থেকে এক পা বার হওয়াও নিষেধ আমার জন্য। পাগল হয়ে যেতাম। বিশ্বাস করুন বুদ্ধবাবু, আমি পাগল হয়ে যেতাম। ঠিক আমার জায়গায় নিজেকে ফেলে দেখেছেন কেমন লাগে? ধরুন আপনাকে যদি ওভাবে বন্দি করে রাখা হত, যে বন্ধুদের আপনি কাছে পেতে চাইতেন, দেখতেন তারা আর আসছে আপনার কাছে, কারণ আপনার দরজায় যে পুলিশেরা বসে, সেই পুলিশেরা যারাই আসতো আপনার সঙ্গে দেখা করতে তাদের নাম ঠিকানা লিখে রাখতো, কবে আবার কী না কী হয়, এই ভয়ে যদি বন্ধুদের আসা বন্ধ হয়ে যেত এবং আপনি একা বসে থাকতেন ঘরে দিনের পর দিন, মাসের পর মাস, কেমন লাগতো? আপনার নিশ্চয়ই শ্বাসকষ্ট হত। একটা ঘরের দরজা যখন বাইরে থেকে বন্ধ থাকে, এবং কোনও শক্তি থাকে না, উপায় থাকে নাসেই দরজা খোলার, তখন নিশ্চয়ই মৃত্যুময় নিস্তব্ধতা ঘিরে থাকে চারদিক, অসহায়তা আর হতাশা ডুবিয়ে নিতে থাকে অদ্ভুত অন্ধকারে। আমার জন্য খুব গোপনেও কি আপনার একবার দুঃখ হয়নি?
প্রসূনবাবু পুলিশ কমিশনারের পদ থেকে চলে যাবার পর আমাকে গৃহবন্দি করা, ভয় দেখানো, হুমকি দেওয়ার দায়িত্ব পড়লো নিরাপত্তা প্রধান বিনীত গোয়েল বাবুর ওপর। উনি প্রায়ই ফোন করতেন। কেরালা বা মধ্যপ্রদেশে বা বিদেশে অজানা কোথাও উনি আমাকে ফেলে দেননি। উনি প্রথম থেকেই বলেছেন জয়পুর যেতে। জয়পুরে আমার জন্য সব আয়োজন থাকবে, একটা চমৎকার রিসর্ট থাকবে, কুক থাকবে, আমি ওখানে দু’দিন যেন থেকে আসি, যাওয়ার ব্যবস্থা উনি নিজেই করবেন। কেন যাবো, কারণ এখানে এই কলকাতায় মুসলিম মৌলবাদীরা আমাকে মেরে ফেলবে। বাঁচার জন্য যেতে হবে জয়পুর। একে গৃহবন্দি, তার ওপর যারা আমার নিরাপত্তার ব্যবস্থা করছেন, তাঁরা বারবারই আমাকে জানাচ্ছেন যে আমি যদি সরকারের উপদেশ না মানি, নিজ দায়িত্বে কোথাও চলে যেতে পারি। জয়পুর কেন, পরে আমি বুঝতে পারলাম যখন সন্দীপ ভুটোরিয়া আমাকে ফোন করতে শুরু করলেন। বিনীত গোয়েলের হয়ে অতপর সন্দীপ ভুটোরিয়ার কাজ আমাকে বোঝানো, যেন জয়পুর চলে যাই। ওখানে থাকার সব বন্দোবস্ত তিনিই সব করে দেবেন। যেন একটুও দুশ্চিন্তা না করি। ক’দিন কাটিয়ে পরিস্থিতি একটু শান্ত হলেই ফিরে আসতে পারবো। প্রসূনবাবু আমার চেনা এমন কাউকে খুঁজে পাননি, যাকে বিশ্বাস করে অন্য রাজ্যে পাড়ি জমাতে পারি। বিনীত গোয়েল আগে লোক খুঁজেছেন, পেয়েছেন, তারপর আমাকে পার করতে নেমেছেন। অন্য রাজ্যে আমি কী করে যাবো, কোথায় থাকবো, নিরাপত্তার ব্যবস্থা কী, এসব ব্যাপারে নিশ্চয়তা দিতে বিনীত গোয়েল এবং তাঁর বন্ধু, আমার চেনা পরিচিত সন্দীপ ভুটোরিয়া লেগে রইলেন। আমি কী যে ভুল করছি, জীবনের ঝুঁকি নিয়ে পড়ে রয়েছি কলকাতায়। মাথায় এক ছটাক বুদ্ধি থাকলে, মোদ্দা কথা প্রাণে বাঁচতে চাইলে জয়পুরে চলে যেতাম, ক্রমাগতই বলে চলেছেন দুজন।
যে পনেরো নভেম্বর তারিখে সিদ্দিকুল্লাহ চৌধুরীদের ‘বনধ’ পালন হওয়ার কথা, এবং সেই ভয়ে আগে থেকেই পুলিশ কর্তারা আমাকে দেশ বা রাজ্য ছাড়ার জন্য বলতেন, সেই পনেরো নভেম্বরে বনধ তো হলই না, একটা মিছিল হল শুধু, অথচ ভোর পাঁচটায় আমাকে তড়িঘড়ি বের করে রাসবিহারী অ্যাভিয়ে ডলি রায়ের বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হল। ওখানে আমাকে একা রেখে পুলিশরা সবাই চলে গেল। কোথায় গেল? খবর নিয়ে দেখি সবাই পুলিশ অফিসে গিয়ে খামোকা বসে আছে। শেষ বিকেলে বিনীত গোয়েলকে ফোন করেছিলাম জানতে কখন বাড়ি ফিরবো। ভীষণ ক্রুদ্ধ তিনি আমার ওপর, বললেল, কখন বাড়ি ফিরবেন তার আমি কী জানি? তাঁর রাগ, আমি জয়পুর যাইনি, তার জয়পুরী দূতকে বারে বারেই ফিরিয়ে দিয়েছি। আতঙ্কে কেটেছে সারাদিন। আতঙ্ক তৈরি করার চেষ্টা ১৫ নভেম্বরের আগেই শুরু হয়েছিল যখন আমার বাড়িতে নিরাপত্তারক্ষী কমিয়ে দেওয়া হল। কী, না, যারা বাড়ির সামনে বসে, তারা এখন থেকে পুলিশ অফিসে বসবে। কেন পুলিশ অফিসে? না, এমনি। ১৫ নভেম্বরে মিল্লি ইত্তেহাদ পরিষদের অর্থাৎ সিদ্দিকুল্লাহ চৌধুরীদের পথ অবরোধ বিকেলে। ইস্যু নন্দীগ্রাম, রিজওয়ান, সাচার কমিটির রিপোর্ট, আমি। টেলিভিশনে দেখি আমার বাড়ি থেকে খুব বেশি দূরে নয় ধর্মান্ধগুলো আমার কুশ পুতুল পোড়াচ্ছে। উন্মত্ত ধর্মান্ধতা আমার বাড়ি পর্যন্ত পৌঁছে যেতে পারে, ভয় সত্যিই হল। সাদা পোশাকের যে পুলিশরা আগস্ট মাসের ন’তারিখ থেকে আমার বাড়ির সামনে ছিল, তারা তখন সবাই বসে আছে অফিসে। যে দিনটায় তাদের থাকার কথা সবচেয় জরুরি, সে দিনটাতেই ওরা নেই। আমি ওদের অনুরোধ করলাম আসতে। ওরা এলো। কিন্তু মিনিট পনেরো থেকে চলেও গেল। কুশ পুতুল পোড়ার আগুন নেভেনি তখনও।
একুশ তারিখে কিছু হওয়ার কথা ছিল না, কিন্তু হল। ভেবেছিলাম ইদ্রিস আলীর সংগঠন কী আর এমন করতে পারবে, যখন ১২টা সংগঠনই পনেরাই নভেম্বরে তেমন কিছু গন্ডগোল বাধাতে পারেনি। কিন্তু ২১ তারিখের ভয়াবহ কান্ড টেলিভিশনে দেখে স্তম্ভিত বসে রইলাম। স্তম্ভিত এইজন্য যে, এরা কারা, এরা তো আমার বই পড়ার ছেলে নয়, এরা আমাকে তাড়াতে চাইছে কেন, এদের তো ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত লাগার কোনও কারণ নেই। দীর্ঘদিন থেকে এদের কি ব্রেইনওয়াশ চলেছে, নাকি কেউ লেলিয়ে দিয়েছে আজ? পেছনে কোনও চক্রান্ত নিশ্চয়ই কাজ করছে। ছেলেরা লুঙ্গি তুলে পুলিশদের পুরুষাঙ্গ দেখাচ্ছে। বিভিন্ন অশ্লীল অঙ্গভঙ্গি করছে। পুলিশ মারার পুলকে একেকজন দিশেহারা। এরা তো আমাকে চেনে না জানে না, কোনওদিন পড়েওনি আমাকে। শুধু কি আমাকে, এরা তো মনে হয় না এদের ধর্মগ্রন্থও কোনওদিন পড়ে দেখেছে! যেহেতু ওরা শুনেছে যে আমি ইসলাম বিরোধী, তাই আমি ইসলাম-বিরোধী, তাই আমাকে দেশ থেকে তাড়াতে হবে, এই দাবি নিয়ে কি পুলিশের দিকে ঢিল ছুড়ছিল, গাড়ি পোড়াচ্ছিল? এদের মুখ দেখে আমার মনে হচ্ছিল, পুলিশের ওপর এদের রাগও প্রচন্ড, রিজওয়ান হত্যার শোধ যেন নিচ্ছিল এরা। না, নন্দীগ্রাম নিয়ে এদের কোনও মাথাব্যথা ছিল বলে মনে হয় না। আমি হিম হয়ে যাচ্ছিলাম দেখে যে পুলিশ নীরব দর্শক হয়ে বসে আছে। পুলিশদের গুলি চালালো না, র্যাফ নামলো, র্যাফও চালালো না, সেনা নামানো হল, সেনাদেরও বলা আছে। গুলি যেন না ছোঁড়ে কারও দিকে। আমার ধারণা, উন্মত্ত ছেলেগুলো যদি আমার বাড়ির দিকে আসে আমাকে খুন করতে, পুলিশ, র্যাফ, সেনা এভাবেই নিশ্ৰুপ বসে থাকবে। নড়বে চড়বে না। ওদের বলে দেওয়া আছে মার খাওয়ার, মার না দেওয়ার।
একুশ তারিখ রাতে বাড়ি এলেন সন্দীপ ভুটোরিয়া। ভক্ত হিসেব দেখা সাক্ষাৎ করেন মাঝে মাঝে। একবার দরিদ্র শিশুদের সাহায্যের জন্য জয়পুরের একটা অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন, গিয়েছিলাম। রাজভবনে অনুষ্ঠান হয়েছিল। প্রতিভা পাটেল ছিলেন সভানেত্রী, আমি প্রধান অতিথি। সন্দীপের সেই ওই একই কথা। আপনি তো জানেন জয়পুরে আমি সব ব্যবস্থা করে রেখেছি, আপনি নামবেন জয়পুরে, সরকারকে ওখানে সব বলে রাখা আছে, আপনাকে প্রটেকশন দেবার সব ব্যবস্থা পাকা, আপনি কদিন একটু বেড়াতে যাবেন। খাবেন, দাবেন, ঘুরবেন, একটু বেড়িয়ে আসুন। এখানে যে কোনও মুহূর্তে এরা মেরে ফেলবে। এত বোকার মতো কাজ কেন করছেন। সন্দীপকে সোজা বলে দিই, স্পষ্ট বলে দিই, আমি যাবো না কোথাও।
পরদিন টিভিতে সকাল থেকেই দেখাচ্ছে পার্কসার্কাস মোড়ের লোকদের। কেউ কেউ বলছে, ‘আমি তসলিমাকে খুন করবো, এতে যদি আমার প্রাণ যায় যাবে। কী ভীষণ বর্বরতা আর হিংস্রতা কণ্ঠস্বরে ওদের। দুপুরে কথা হল বিনীত গোয়েলের সঙ্গে। কাল শুক্রবার নামাজের পর আমার বাড়িতে আক্রমণ হবে, খবর দিলেন। এরকম হলে চলে যাই সল্ট লেক বা বেলঘরিয়া, বা বেহালা বা গোলপার্ক, বা এরকম কোনও জায়গায়, আমি বললাম। না, ওসব জায়গায় সিকিউরিটি ছাড়া থাকতে হবে। সিকিউরিটি থাকলে তোক জেনে যাবে। সিকিউরিটি ছাড়া থাকা তো নিরাপদ নয়, ইন কেইস। না সে দায়িত্ব আমরা নিতে পারবো না। বিনীতবাবুর সাফ কথা, আমাকে বাঁচতে হলে জয়পুর যেতে হবে। তিনি সব ব্যবস্থা পাকা করে রেখেছেন। জয়পুর না গেলে বাঁচবো না, আমার জন্য বাঁচার কোনও রাস্তা খোলা নেই এই শহরে। আগামিকাল জুম্মার নামাজ, নামাজ শেষে মুসলমান মৌলবাদীরা, একুশ তারিখের বিজয়ী উন্মত্তরা বেরিয়ে পড়বে, গত চারমাস ধরে ভয় আর আতঙ্ক আমার ভেতর জোর জবরদস্তি করে ঢোকানোর চেষ্টা করে অবশেষে সফল হলেন বিনীতবাবু। আতঙ্ক আমার সর্বশরীরে, বেঁচে থাকতে হবে, লিখতে হবে, তাহলে দুদিনের জন্য যাই জয়পুর। তক্ষুনি একটা সাদা অ্যামবাসাডার পাঠালেন তিনি, যেন ঝড়ের মতো উড়ে এলো গাড়ি। কেবল ল্যাপটপটা নিলাম, আর কিছু নেওয়ার সময় হল না। পুলিশের লোকেরা হাতে টিকিট দিলেন বিমান বন্দরে। এভাবেই কলকাতা আমাকে গুডবাই জানালো। স্টালিন বুঝি এভাবেই মানুষকে গুলাগ পাঠাতো। স্টালিন তাদেরই পাঠাতো, যারা কট্টর স্টালিন বিরোধী ছিল। কিন্তু আমি তো বুদ্ধবিরোধী ছিলাম না।
তারপর তোজয়পুরে পৌঁছে বুঝলাম, বিনীতবাবু এবং তার জয়পুরী দূত যা বলেছিলেন সব ভুল। জয়পুরের পুলিশদের বলা হয়েছে আমি কোনও এক সাহিত্য অনুষ্ঠানে যোগ দিতে এসেছি, আমাকে একটি সস্তা হোটেলে তোলা হল, ওই হোটেল বিনীত গোয়েল আর জয়পুরী দূত কলকাতা থেকেই ঠিক করে রেখেছেন। গভীর রাতে পুলিশ আমাকে জানিয়ে দিল যে আমাকে রাজস্থান থেকে চলে যেতে হবে, কারণ ল এন্ড অর্ডার প্রবলেম শুরু হবে বা শুরু হয়ে গিয়েছে। গা হিম হয়ে গেল। ঠিক আছে, কলকাতায় চলে যাবো। কিন্তু দেখি ভোরবেলা আমাকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে এয়ারপোর্টে নয়, কলকাতার পথে নয়, দিল্লির পথে। উড়োজাহাজে নয়, গাড়িতে। কেন, সে পরে জেনেছি, রাজস্থানে যেমন আমাকে লাথি দিয়ে ফেলা হয়েছিল পশ্চিমবঙ্গ থেকে, তেমনি রাজস্থান থেকেও একই রকম লাথি দিয়ে আমাকে পশ্চিমবঙ্গে ফেলতে চেয়েছিল রাজ্যসরকার। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গ জানিয়ে দিয়েছে, বল যেন তার এলাকায় এসে না পড়ে। বল তারা চায় না। অতএব ডাম্প করতে দিল্লি, কেন্দ্র। কোনও নো ম্যানস ল্যান্ডের দিকে, উদ্বাস্তু, রাজ্যহারা, এতিম, অনাথ, অসহায়কে নিয়ে চললো পুলিশ। বসে আছি পথ চেয়ে, কবে ফিরবো কলকাতা। আপনি যদিও জানিয়ে দিয়েছেন যে আপনি কিছু জানেন না আমার বিষয়ে, জানে কেন্দ্র, সিদ্ধান্ত নেবে কেন্দ্র। আসলে কিন্তু কেন্দ্রকে নিজের সিদ্ধান্তটি আপনি দিয়েই রেখেছেন, আপনি আমাকে চাননা কলকাতায়, চাননা পশ্চিমবঙ্গে।
লোকে বলে, আপনার ভয়, আমি পশ্চিমবঙ্গে বাস করলে আপনি মুসলমান ধর্মান্ধদের সমর্থন পাবেন না, না পেলে পুরো মুসলমান জাতটারই ভোট পাবেন না। তাই আমাকে তাড়িয়ে দিয়ে ভোট নিশ্চিত করেছেন। ধর্মান্ধতা ঘোচানোর জন্য আমি লিখি, আপনি আমাকে সমর্থন না করে সমর্থন করলেন উন্মত্ত ধর্মান্ধতাকে। ওদের জিতিয়ে দিলেন। ওরা কি আপনাকে ভালোবাসে বলে আপনি মনে করেন? ওরা কি নিজেরাই ফ্রাঙ্কেনস্টাইনের মতো আপনার মুণ্ডু চাইবে না একদিন?
কলকাতায় বাড়িঘর পড়ে আছে, আমার লেখালেখি সব পড়ে আছে। সবকিছু থেকে বিচ্ছিন্ন আমি, নিজের জীবন থেকে বিচ্ছিন্ন, আমি ঠিক কোথায় আমি জানি না। এখানে আপনার অনুমতির অপেক্ষায় কত দিন বসে থাকতে হবে আমি জানি না। আপনি কবে আমাকে বাড়ি ফিরতে অনুমতি দেবেন জানি না। হতাশায়, অনিশ্চয়তায়, অস্থিরতায় আমি পাগল হয়ে যাচ্ছি। আমার রক্তচাপ বাড়ছে, প্রচন্ড উদ্বেগ আর উৎকণ্ঠা আমাকে আত্মহত্যা করতে প্ররোচিত করছে। আপনি খুশি হবেন, তাই আমি আপনার চক্ষুশূল ওই ‘দ্বিখন্ডিত বইটির যে লাইনগুলোকে সহ্য করতে পারতেন না, তুলে নিয়েছি। না, মৌলবাদীদের ভয়ে আমি আমার লেখা তুলে নিইনি। আমি ভয় করেছি আপনাদের, ভয় করেছি সেকুলার এবং গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দলগুলোকে, ভয় পেয়েছি আশ্রিতের জন্য যে ধর্ম বেঁধে দেওয়া হয়েছে, সেটিকে। ভয় পেয়েছি অগুনতি শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষের ভয়াবহ মুখ বুজে থাকাকে। মত প্রকাশের স্বাধীনতা আমার নিজের দেশে ছিল না বলেই তো আমি আজ নিজের দেশের বাইরে, এখানে আমি সেই অধিকার পাবো বলেই তো আজ আমি এখানে। একটি গণতন্ত্র যদি আমাকে অধিকারটি না দেয়, কে দেবে? আমাকে যে মুখ বুজে থাকতে বলা হল, আমাকে যে বাধ্য করা হল নিজের লেখাকে অস্বীকার করতে, নিজের বই ছিঁড়ে ফেলতে, এ কার অপমান? আমার?
বুদ্ধবাবু, আমার বিশ্বাস হয় না আমার কারণে আপনার দলের ভোট পাওয়ায় কোনও হেরফের হবে। আপনার দল খুব শক্তিশালী দল। ভয় পাবেন না, আপনার দল যে কোনও নির্বাচনেই জিতে যাবে। তারপরও যদি আপনার বিশ্বাস হয়, যে, আমাকে তাড়িয়েছেন বলে দুটো ভোট আপনার বেশি হতে যাচ্ছে, তাহলে সেই ভোট আপনার নির্বিঘ্নে জুটুক, আপনার আরাম হোক। ভোট শেষ হলে, আপনি বিজয়ী হলে আমাকে আমার ঘরে ফিরতে দেবেন তো! অপেক্ষা করছি আপনার অনুমতির। কোনও ক্ষতি আমি আপনার করিনি। করতে চাই না। আমাকে শুধু নিরুপদ্রব নিজের লেখালেখি নিজের মতো করতে দিন। আমি আপনার শত্রু নই। শত্ৰু তারা, ওই মৌলবাদী, যাদের বন্ধু বলে জড়িয়ে ধরেছেন আপনি, সমাজকে অন্ধকার আর কুসংস্কার আর ভয়াবহ সংকীর্ণতা দিয়ে গ্রাস করতে চাইছে, এ আপনি জানেন না, আমি বিশ্বাস করি না।
আপনি যদি বিশ্বাস করেন সত্যিকার সেকুলারিজমে, সমতায়, সততায়, সাহসে, তবে আমাকে বন্ধু বলে মনে করতে আপনার তো অসুবিধে হওয়ার কথা নয়। ভোটই জগতের এবং জীবনের শেষ কথা নয়। মানবতা বলে একটি কথা আছে, আদর্শ বলেও একটি কথা আছে। সেসব খুইয়ে ফেললে কী আর থাকে। জেতে তো কত রাজাই। রাজারা সিংহাসন থেকে আবার কখনও কখনও খসেও পড়ে। রাজা কতদিন সিংহাসনে ছিল, তা দিয়ে রাজার চরিত্র বিচার হয় না। রাজার কাজ দিয়েই রাজার চরিত্র বিচার হয়।
তসলিমা
.
১০ ডিসেম্বর
‘তসলিমাকে এভাবে আটক করে রাখাটা ভারতের মতো একটি দেশের জন্য অত্যন্ত মর্যাদাহানিকর। সাম্প্রতিককালে যেসব ঘটনা ঘটেছে তার সঙ্গে তুলনা করলে বলা যায় এই ঘটনা আমাদের খুব ছোট করে দিয়েছে।.. Taslima has suffered too much and has gone through prolonged distress and agony. This must be brought to an end without delay. She should also, without much ado, be allowed to return to Kolkata, her preferred place for stay. Moreover, she should be granted Indian citizenship before her current visa expires so that her creative work does not suffer and she is never again rendered fugitive and stateless. The award of citizenship would also make it easier for her to protect her rights. In urging this, I am not alone; hundreds of millions of Indians desire likewise.’
-Muchkund Dubey
আজ মানবাধিকার দিবস। দীর্ঘ দীর্ঘ দীর্ঘশ্বাস ফেলছি জীবনের কথা ভেবে। দীর্ঘ তেরো বছরের নির্বাসন জীবন আমার। আজও নিজের দেশ বাংলাদেশে যাওয়ার এবং বাস করার কোনও অধিকার আমার নেই। কী কারণে বাংলাদেশ সরকার আমার নাগরিক অধিকার লঙ্ঘন করছে, তা কোনওদিনই আমাকে জানানোর প্রয়োজন মনে করেনি।
আজ মানবাধিকার দিবস। আমি পড়ে আছি প্রিয় বাংলা থেকে শত শত মাইল দূরে অজানা একটা ঠিকানায়। পূর্ববঙ্গও নির্বাসন দিল, পশ্চিমবঙ্গও পাঠালোনির্বাসনে। বাংলায় আমার ঠাঁই নেই। আমি কোথায় আছি তা কেউ জানবে না, তা কারও জানার নিয়ম নেই। কেউ আমার সঙ্গে দেখা করতে পারবে না। আমিও কারও সঙ্গে দেখা করতে পারবো না।
একা একা সকাল হয়। একা একা দুপুর, বিকেল। একা একা রাত হয়। মানবাধিকার দিবস জুড়ে বসে থাকি এক জীবন অধিকারহীনতা নিয়ে। অসহায়। অনাথ। অবলা। হ্যাঁ অবলাই তো। কথা বলার অধিকারও তো আমার নেই। আমি যেন কথা না বলি। কথা বলার অধিকার বা মত প্রকাশের অধিকারকেও তো মানবাধিকার বলে। কথা না বলতে বলতে, মত প্রকাশ না করতে করতে আমার মনে হচ্ছে, আমি ভুলে যাব কথা বলতে। আমি ভুলে যাবো ভাবতে। ভুলে যাবো নিজের কোনও মত যে থাকতে হয়, ভিন্ন মত হলেও যে থাকতে হয়, এবং তা প্রকাশ করতে হয়, তা। ভুলে যাবো মানবাধিকারের মূল অর্থ কী। প্রতি বছর দশই ডিসেম্বর যাবে, আসবে। আমার কিছু যাবে আসবে না।
আজ রাতেই এলেন প্রভু। প্রভু আসা মানে নতুন কোনো খবর আসা। মূলত যা বললেন, তা হল, সুদূর সুইডেন থেকে আমার সঙ্গে দেখা করতে আসছেন মিস্টার সুয়েনসন, তাঁকে আমার অজ্ঞাত ঠিকানায় আনার কোনও অধিকার আমার নেই, এমনকী আমারও অধিকার নেই তার হোটেলে গিয়ে তার সঙ্গে দেখা করার, যদি দেখা করার অনুমতি প্রার্থনা করে আমি দরখাস্ত করি, এবং যদি ওপরওয়ালা রাজি হন, তবে বড়জোর ঘণ্টাখানেকের জন্য তৃতীয় কোনও জায়গায় দু’জনকেই পৃথক পৃথক ভাবে নিয়ে গিয়ে দুজনের দেখা করাবার একটি ব্যবস্থা করা হবে। এর বেশি কিছু যেন আমি আশা না করি। ওপরওয়ালা এখানে ভগবান জাতীয় কিছু নন, সত্যি বলতে কী, ভগবানের চেয়েও শক্তিমান।
দুনিয়া জুড়ে মত প্রকাশের স্বাধীনতা আর ব্যক্তিগত স্বাধীনতার আবশ্যকতা নিয়ে বলছি সেই কতকাল, বিভিন্ন মঞ্চে, বিশ্ববিদ্যালয়ে। কত শত মানুষ কত শত দেশে অনুপ্রাণিত হচ্ছে। আর আমাকে কি না কোনো একটা ঘরে আটকে রেখে বলা হচ্ছে, এ করা যাবে না, ও করা যাবে না? যাঁরা আমাকে বন্দি করছেন এবং নানারকম নিষেধাজ্ঞা প্রয়োগ করছেন, শেকল পরাচ্ছেন পায়ে, চোখ বেঁধে রেখেছেন কাপড়ে, তাঁরা আদৌ জানেন না আমি কে, কোনোদিন শোনেননি আমার সামান্য ইতিহাস!
আমার তো কলকাতায় থাকার কথা ছিল, সুয়েনসনের কলকাতায় আমার কাছে বেড়াতে আসার কথা ছিল। আমি কলকাতায় থাকলে তো সুয়েনসন নিশ্চিন্তে নির্বিঘ্নে আমার কলকাতার বাড়িতে আমার সঙ্গে ক’দিন কাটাতে পারতো। স্টকহোম-কলকাতা টিকিট ছিল তার। তিন চার মাস আগেই করে রাখা টিকিট। আমি দিল্লিতে আছি শুনে কলকাতা বদলে গন্তব্য দিল্লি করে নিয়েছে শুধু। তাকে বলেছি ফোনে, দিল্লিতে আমি অনেকটা গৃহবন্দি অবস্থায় কাটাচ্ছি, তোমার সঙ্গে দেখা করা সম্ভব হবে কি না জানি না। সুয়েনসন খুশি নয় আমার কথায়। তার বক্তব্য, ওঁরা যা বলছেন, তা কেন আমি মেনে নিচ্ছি! কেন আমি যে করেই হোক তাকে আমার কাছে রাখায় যে বাধা তৈরি করা হচ্ছে, তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছি না! যুদ্ধ করা আমার পক্ষে সম্ভব নয় জেনেও সুয়েনসন টিকিট বাতিল করেনি। সস্তা টিকিট বাতিল করলে টাকা ফেরত পাওয়া যায় না। দিব্যি উড়ে চলে এলো।
আমার এই মানসিক অবস্থায় হাতে গোনা দু’একজন বন্ধুর সঙ্গে আমি যদি দেখা করতে না পারি, তাহলে কী ধরনের জীবন আমি যাপন করবো এখানে, এই অজ্ঞাতবাসে? আমি তো স্বাস বন্ধ হয়ে মারা পড়বো! অন্তত কলকাতার বন্দি জীবনে বন্ধুরা আসতে পারতো আমার বাড়িতে। এখানে তো জগৎ থেকে বিচ্ছিন্ন আমি। প্রভু একসময় যা বললেন, প্রসূন মুখার্জির কথার মতো লাগলো শুনতে, বললেন, ‘এত যখন উনার সঙ্গে দেখা করার আপনার প্রয়োজন, আপনি সুইডেনে গিয়ে দেখা করে আসুন না! তাহলে কি ওঁরা এই-ই চাইছেন যে আমি এ দেশ ছেড়ে চলে যাই?
আহ, আজ তো মানবাধিকার দিবস! প্রভু কি জানেন আজ মানবাধিকার দিবস!
.
২৪ নভেম্বর
করন থাপর লিখেছেন হিন্দুস্থান টাইমস। ‘ডু উই পাস দ্য তসলিমা টেস্ট?’ ‘The India I would be proud of would welcome Taslima Nasreen and grant her sanctuary. The India I’m embarrassed by wreaks violence on the streets of Calcutta, van dalises art schools in Baroda and threatens peaceful worshippers in Sirsa. Alas, that is the India I live in.’
চমৎকার লেখা। কিন্তু লেখাটির শুরুতে লিখেছেন, ‘Taslima Nasreen may not be a great novelist. She may even be motivated by a quest for publicity. And many say she deliberately and calculatedly compromises other people by revealing their personal secrets. But those are literary or moral judgements. No doubt each of us will accept or reject them as we deem fit. The question is, do we have a right to silence her voice because of them?’
করন থাপর আমার লেখা পড়েননি, তা অনুমান করতে পারি। লেখা না পড়েও লেখকের মত প্রকাশের অধিকারের পক্ষে দাঁড়িয়েছেন। লেখা যারা বুঝে পড়েছেন, আমাকে যাঁরা ব্যক্তিগতভাবে সঠিক চিনেছেন, তাঁরা জানেন আমি কী লিখি, কেন লিখি। পাবলিসিটি পাওয়ার জন্য লিখি, ভালো কোনও সাহিত্যিক নই, বিতর্ক তৈরি করার জন্য লিখি –ইত্যাদি কথা বাতাসে ভাসতে শুরু করেছে সে অনেক বছর। সেই বাংলাদেশের আমল থেকেই। বাংলাদেশ আর ভারতে পার্থক্য তো খুব বেশি নেই, থাকলেও বাতাসের পার্থক্যটা নেই বললেই চলে। এই হাওয়ার মন্ত্র থেকে মন সরিয়ে অন্য একটি বিশ্বাস এবং ধারণা তৈরি করা কম কঠিন নয়। অনেকে কঠিন কাজটি করেন। অনেকে বাতাসে ভর দিয়েই চলেন। যদি একটুও নিজের প্রতি যত্ন নিতাম, তবে লেখার প্রতিও যত্ন নিতাম, ইংরেজি এবং অন্যান্য ভাষায় অনুবাদ বার করার চেষ্টা করতাম। কিন্তু এ ব্যাপারে আমার চিরকালের উদাসীনতা। লিটারেরি এজেন্টদের তাড়িয়েছি। জাল বইয়ে ভারত আর বাংলাদেশ ছেয়ে গেছে। বই নিয়ে যা ইচ্ছে তাই হয়েছে। জগতের কত লোক বই পড়তে চেয়েছে, সুযোগই হয়নি।
.
২৭ নভেম্বর
‘..তসলিমা নাসরিনকে পশ্চিমবঙ্গ হইতে সরাইয়া দিবার সিদ্ধান্ত আগেই পাকা হইয়া গিয়াছিল। এই সিদ্ধান্ত, এবং যে ভাবে তাহা কার্যকর হইয়াছে, তাহা সম্পূর্ণ অবাঞ্ছিত এবং অনৈতিক। প্রথমত, তসলিমা নাসরিনের নিরাপত্তার জন্য তাঁহাকে অন্য রাজ্যে প্রেরণের কোনও প্রয়োজন ছিল না, এই শহরেই তাহার সুবন্দোবস্ত করা সরকারের অসাধ্য ছিল না। সঙ্গত কারণেই সন্দেহ হয়, নিরাপত্তার যুক্তিটি অজুহাত মাত্র, তাঁহার মৌলবাদী বিরোধীদের সন্তুষ্ট করিবার বাসনাতেই তাঁহাকে অপসারণ করা হইয়াছিল। দ্বিতীয়ত, যে প্রক্রিয়ায় এই স্থানান্তর তথা অপসারণ ঘটানো হইয়াছে, তাহা অত্যন্ত আপত্তিকর। প্রশাসন, দল, এবং উভয়ের ঘনিষ্ঠ প্রতিপত্তিশালী ব্যক্তিবর্গের এই যোগসাজসের পরম্পরা একটি সামগ্রিকভাবে অসুস্থ পরিবেশের সংকেত দেয়, যাহা একটি উদার আধুনিক শাসনতন্ত্রের পরিপন্থী। তৃতীয়ত, ইহা মৌলবাদীদের অন্যায় দাবির নিকট আত্মসমর্পণ। এবং ইহাই সর্বাপেক্ষা উদ্বেগজনক। পশ্চিমবঙ্গের শাসকরা উঠিতে বসিতে নিজেদের ধর্মনিরপেক্ষতার বড়াই করেন, কিন্তু কার্যক্ষেত্রে বার বার দেখা যায়, মুসলিম মৌলবাদীদের তোষণে তাঁহারা অতীব তৎপর। তসলিমা নাসরিন সম্পর্কিত ঘটনাবলি তাহার প্রমাণ এবং প্রতীক। …পশ্চিমবঙ্গের ধর্মনিরপেক্ষ শাসকরা মুসলমান তোষণ করিতেছেন না, মুসলিম মৌলবাদীদের তোষণ করিতেছেন। দলের মন্ত্রণাদাতারা হয়তো বিশ্বাস করেন, এই তোষণের ফলে সংখ্যালঘু ভোটব্যাংক সুরক্ষিত থাকিবে। কিন্তু ভোটব্যাংক রাজনীতির তাড়নায় এমন ভয়ানক অন্যায়কে তোষণ করিলে তাহার পরিণাম অশুভ হইতে বাধ্য।‘ –আনন্দবাজার পত্রিকা।
আনন্দবাজার অন্য সময় সঙ্গে থাক বা না থাক, কলকাতা থেকে আমাকে তাড়াবার শুরু থেকে পাশে আছে। স্টার আনন্দতে এ নিয়ে খবর হচ্ছে, আলোচনা হচ্ছে। আমার সাক্ষাৎকারও নিলেন সুমন দে। আনন্দবাজার থেকে মিলন দত্ত বড় একটা সাক্ষাৎকার নেবেন। হায়দারাবাদ থেকে ফেরার পর আমাকে কী করে আটকে রাখা হয়েছিলো বাড়িতে, কী বলেছিলো কে, কীভাবে আমাকে কলকাতা থেকে বিদেয় করা হল, শুরু থেকে সব শুনতে চান তিনি। প্রশ্ন করা হচ্ছে, আমি উত্তর দিয়ে যাচ্ছি। হঠাৎ একটা গুঞ্জন। ফোনেই শুনতে পাচ্ছি মিলন দত্তকে কেউ ডাকছেন। কথা বলছেন। আলোচনা করছেন। শেষ পর্যন্ত আমাকে মিলন দত্ত জানিয়ে দিলেন, অভীক বাবু বলেছেন সাক্ষাৎকার বন্ধ করতে, কারণ প্রণব বাবুর সঙ্গে তার কথা হয়েছে, প্রণব বাবু বলেছেন এখন যেন আমার কোনও খবর, সাক্ষাৎকার ইত্যাদি মোটেও প্রচার করা না হয়, তিনি কথা দিয়েছেন দিন পনেরোর মধ্যে আমাকে কলকাতায় ফিরিয়ে আনছেন।
ওদিকে স্টার আনন্দও সব আলোচনা বন্ধ করে দিল। আমার পক্ষে জনমত গড়ে ওঠার সম্ভাবনার এখানেই ইতি টানা হল।
.
২৮ নভেম্বর
‘তসলিমা নাসরিন প্রসঙ্গে সকলকে, বিশেষত মুসলমান বুদ্ধিজীবীদের, একটা কথা ভেবে দেখতে অনুরোধ করবো। ভদ্রমহিলা তার মতবিরোধীদের ইট মারেননি, গাড়ি পোড়াননি, খুন করে দেওয়ার কথাও বলেননি। তবে বিশেষত মুসলমান মেয়েদের ওপর নির্যাতন প্রসঙ্গে তিনি যা লিখেছেন তা বুদ্ধিজীবীদের একাংশের মতে ইসলামবিরোধী। কিন্তু তাঁকে তাঁর কথা বলতে না দিলে তসলিমার সমালোচকরাও অনুচ্চারিত ইসলাম বিরোধী বক্তব্যের সমুচিত জবাব দিতে পারবেন না। এতে গণতন্ত্র বিপন্ন হবে। গণতন্ত্র না থাকলে সবার আগে, এবং সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে ধর্মীয় সংখ্যালঘুরাই। তাই তসলিমার স্বাধীনভাবে এবং অকপটে লেখার অধিকার রক্ষার দাবি শেষ বিচারে গণতন্ত্র রক্ষারই সংগ্রাম।‘ –সুনন্দ সান্যাল
প্রণব মুখার্জি লোকসভায় আমার প্রসঙ্গে বলবেন। সে গতকাল থেকেই জানা। বসে আছি অপেক্ষায়। বারোটায় বলবেন। সাড়ে বারোটায় বলবেন। এরকম শুনছিলাম। যা বললেন তা হল –“Throughout history, India has never refused shelter to those who have come and sought our protection. This civilisational heritage which is now a government policy, will continue and India will provide shelter to Ms Nasreen. Those who have been granted shelter here have always undertaken to eschew political activities in India or any action, which may harm India’s relation with friendly countries. It is also expected that the guest will refrain from activities and expressions that may hurt the sentiments of our people. While these guests are in India the Union and the state governments provide them protection –this policy will also apply in Ms Taslima Nasreen’s case”
দাদা বললো, ‘একেবারে রিয়েল ডিপ্লোমেট’।
যে ডুবছে, সে একটা খড়কুটো চায়। আমাকে যে তাড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে না এ দেশ থেকে, আমাকে যে থাকতে দেওয়া হবে, এই খবরটিই আমার কাছে সবচেয়ে বড় খবর। . আমি আশা করেছিলাম অন্য এক বিবৃতির যার বাংলা করলে এরকম দাঁড়ায় –‘ভারত এমন একটি দেশ, যে উদার, অতিথিপরায়ণ, পৃথিবীর নানা দেশের নানা সংস্কৃতির মানুষকে বিভিন্ন সময়ে বরণ করে নিয়েছে এবং ঋদ্ধ হয়েছে। তসলিমা একজন নির্যাতিত এবং নির্বাসিত লেখক, বাংলা তাঁর মাতুভুমি। পুর্ব বাংলায় না হলেও পশ্চিম বাংলায় বাস করার তাঁর এই ইচ্ছেকে আমরা স্বাগত জানাই। ভারত একটি ধর্মনিরপেক্ষ দেশ, ভারত পৃথিবীর সবচেয়ে বড় গণতন্ত্র। এখানে যারা বাস করছে, সবারই গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে নিজের মত প্রকাশের অধিকার আছে। কিন্তু ২১শে নভেম্বর কলকাতার রাস্তায় যা ঘটেছে, তা বর্বরতা ছাড়া আর কিছু নয়। সেকুলার গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের প্রথম এবং প্রধান শর্ত, মত প্রকাশের স্বাধীনতা। মত প্রকাশের অধিকার এবং বাক স্বাধীনতা আর সবার মতো তসলিমা নাসরিনের আছে। সুতরাং তাঁর মত প্রকাশের অধিকার ছিনিয়ে নেবার উদ্দেশ্যে যারা রাস্তায় নেমেছে এবং লুঠপাট, আগুন জ্বালানো এবং জনগণের জীবন নিরাপত্তাহীন করে তুলেছিল, তাদের অগণতান্ত্রিক আচরণের কারণে তাদের বিরুদ্ধে সরকার অবশ্যই ব্যবস্থা নেবে এবং ভবিষ্যতে যেন এ ধরনের অশুভ কাজ থেকে বিরত থাকে সে ব্যাপারে প্রশাসন সতর্ক থাকবে। সেকুলার গণতন্ত্রের ভাবমূর্তি নষ্ট না হয়, এ ব্যাপারে প্রত্যেককে সচেতন থাকতে হবে। তসলিমা নাসরিনকে পশ্চিমবঙ্গ থেকে কেন তার ইচ্ছের বিরুদ্ধে জোর করে অন্য রাজ্যে স্থানান্তর করা হল, সে ব্যাপারে তদন্ত চলবে। এবং দোষী ব্যক্তিদের শাস্তির ব্যবস্থা হবে। এবং ২১ নভেম্বরের তান্ডবকারীদেরও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা হবে। তসলিমাকে আগামীকাল কেন্দ্র থেকে কলকাতায় পাঠানো হবে। কেন্দ্র চাইছে পশ্চিমবঙ্গে তসলিমার পূর্ণ নিরাপত্তা। শুধু তাই নয়, পশ্চিমবঙ্গের বাইরেও তাঁর পূর্ণ নিরাপত্তা তাঁকে দেবে ভারত সরকার এবং রাজ্য সরকার। শুধু তসলিমা নয়, এদেশের সব নাগরিকের, অতিথিদের, এবং আশ্রয়প্রার্থীদের ক্ষেত্রে ভারতের নিয়ম একই, ভিন্ন নয়।’
হ্যাঁ এরকম হবে মনে মনে ভেবেছিলাম। কিন্তু যা হল তা ঠিক কী হল, বুঝে পাচ্ছি না। একটাই স্বস্তি পাচ্ছি তা হল রেসিডেন্স পারমিটই আর দেওয়া হবে না–এমন কিছু বলা হয়নি।
.
৩০ নভেম্বর
‘সিঙ্গুর, নন্দীগ্রাম পুলিশ আর পার্টির ভাড়াটেদের বন্দুকনির্ভর নির্মম দখলদারির পর্ব পেরিয়ে তসলিমা ইস্যুতে এসে একটা দমকা হাওয়াতে উড়ে গিয়েছে সিপিএম-এর এতদিনের সযত্ন লালিত ধর্মনিরপেক্ষতার মুখোশটা।
.. তসলিমা দেশে দেশে, রাজ্যে রাজ্যে এভাবেই ছিন্নমূল ঘুরতে থাকুন, আর আমরা কড়ায় গণ্ডায় ভোটের হিসেব করি। নিক্তিতে মেপে দেখি, তসলিমা এখানে থাকলে তাদের লাভ বেশি,
বিদেয় হলে। কী করলে, কী বললে মুসলিম ভোট টানা যাবে। কোন ইস্যুতে মৌলবাদের কথায়। ঘাড় নাড়তে হবে, কোন ইস্যুতে রাস্তায় নেমে মৌলবাদের বিরুদ্ধে মিছিল করে চেঁচাতে হবে, সবই ভোটের নিক্তিতে ওজন করা।‘–আশিস ঘোষ
সকালে এনামুল কবীর ফোন করলেন বীরভূম থেকে। না, এখন অবধি কোনও রাজনৈতিক দল বলেনি সিপিএম যা করেছে ভুল করেছে, এভাবে কোনও লেখিকাকে তাড়িয়ে দেওয়াটা অন্যায়।
আজ দ্বিখণ্ডিত থেকে কিছু বাক্য বাদ দিয়ে দিলাম। সারা দেশে এই চরম দুঃখের খবরটি হৈ হৈ করে ছাপা হল।
.
২ ডিসেম্বর
ক্যান্টনমেন্টের প্রধান একদিন দেখা করে গেছেন। সম্মান দেখিয়ে গেছেন। সজ্জন শিক্ষিত ভদ্রলোক। বললেন, লজ্জার লেখকের সঙ্গে দেখা হবে কোনোদিন, এ কল্পনাও করেননি। সবাই আমার নাম জানেন লজ্জা’র লেখক হিসেবে। লজ্জা পড়েননি, ভারতবর্ষের শিক্ষিত শ্রেণীর মধ্যে এমন লোক কমই আছে। পেঙ্গুইন ঘোষণা করেছে, লজ্জা ভারতবর্ষের মুদ্রণশিল্পের ইতিহাসে সবচেয়ে বিক্রিত বই।
ভদ্রলোকের নামের পদবী, সেন। বাঙালি ভেবে কী খুশিই না হয়েছিলাম। পরে শুনলাম, উনি বাঙালি নন।
.
৪ ডিসেম্বর
‘She does not have any choices. She is just like a person who has now got the protection of the mafia which is the state in some way. She has nowhere to go. She has no protection. She just has to blunder her way through this kind of humiliation and I really feel for her’. –Arundhati Roy
আজ দাদার বিয়ের পঁচিশ বছর পূর্তি উৎসব। প্রতিবছর এই দিনটি দাদা উদযাপন করে। কিন্তু দিল্লির এই অজ্ঞাতবাসে উদযাপনের কিছু নেই। আজ সকালে দাদা স্নান করে তৈরি হয়ে রইলো। দুপুরের খাবার খেয়েই রওনা হয়ে গেল। দিল্লি থেকে কলকাতা গেল। বিকেল পাঁচটায় কলকাতায় নামবে। আমরা একসঙ্গে কলকাতা থেকে এসেছিলাম, দাদা একা ফিরে গেল। আমি যেতে পারলাম না। আমার যাওয়া সম্ভব নয়। দাদার চলে যাওয়ার দিকে তাকাতে ইচ্ছে করেনি। বুক ফেটে যাচ্ছিল। দাদাও কষ্ট পাচ্ছিল হয়তো। কিন্তু এখানে থেকেই বা কী করবে! ভালো লাগে এভাবে লুকিয়ে থাকতে!
.
৫ ডিসেম্বর
‘Secularism is not appeasing fundamentalism and terrorism. The November 21 incidents could have led to communal riots in Kolkata. Fundamentalism, whether Muslim or Hindu is a challenge which must be taken very seriously. The Taslima Nasreen issue is no longer about Taslima Nasreen the writer. It has revealed a much larger conspiracy in the making.
It was a test case, and the CPM’s decision has conveyed to the Islamic fundamentalists that they have won the round one!’ -Bhaskar Roy.
আজ উল্লেখ করার মতো তিনটে জিনিস পেলাম, দ্য হিন্দুর সম্পাদকীয়, আনন্দবাজারের উপসম্পাদকীয় আর একটি ঘটনা, সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণণের বইয়ে মুহম্মদ নবীর একটি ছবি ছাপানো হয়েছে বলে কলকাতায় বিক্ষোভ শুরু হতেই দিল্লির প্রকাশককে ক্ষমা চাইতে হয়েছে। হিন্দু লিখেছে, এই ২৯৫(ক)ই তো বাংলাদেশে আমার বিরুদ্ধে প্রয়োগ করেছিল সরকার। সেই পনেরো ষোলো বছর থেকে বাক স্বাধীনতাবিরোধী আইনটিকে বাদ দেওয়ার কথা বলছি। আমার এবং আমার মতো দু’একজনের কথা কে শোনে।
আজকের আনন্দবাজার পত্রিকার লেখাটি দেখে হ্যাঁ হয়ে গেলাম। কদিন আগেই আমাকে সমর্থন করেছে, আর আজ একশ’ আশি ডিগ্রি ঘুরে গেল! হতবাক হতে হয় আমাকে। বাকরুদ্ধ বসে থাকি। কল্যাণ সান্যাল আমার বিরুদ্ধে একটি উপসম্পাদকীয় লিখেছেন। বিতর্কের জন্য যদি ছাপানো হয়ে থাকে লেখাটি তাহলে কোনও আপত্তি নেই। সুস্থ বিতর্ক সবসময়ই ভালো। কিন্তু যদি এ বাক-স্বাধীনতার বিপক্ষে অবস্থান হিসেবে হয়, তাহলে নিশ্চিতই আশংকার কারণ বৈকি। আমি অনুমান করি, আমার পক্ষে লেখা কোনও নিবন্ধ বা চিঠি এখন আনন্দবাজার ছাপাবে না বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কল্যাণ সান্যালের বক্তব্য শিল্প মানেই শুদ্ধ নয়, রাজনীতি মানেই দূষিত নয়। সিপিএমের রাজনীতি দূষিত নয়, আমার লেখা শুদ্ধ নয়। আমার লেখা যেহেতু শুদ্ধ নয়, আমাকে রাজনীতিকরা বা ক্ষমতাবানরা তাড়িয়ে দিতেই পারে, এতে কোনও অসুবিধে নেই। আরও লিখেছেন, আমার লেখার ধরন এবং মর্মবস্তু কোনওটাই তিনি পছন্দ করেন না। পছন্দ করেন না, সুতরাং যেন তাড়িয়ে দেওয়াটায় অন্যায় কিছু নেই। তিনি সিপিএমের বিরোধিতা করছেন নন্দীগ্রামের ব্যাপারে। কিন্তু আমার ব্যাপারে তিনি সরকারের পক্ষ নিচ্ছেন। আমার একটা ধারণা হয়. কল্যাণ সান্যালের মতের পক্ষে বেশির ভাগ শিল্পী সাহিত্যিক বুদ্ধিজীবী, তা না হলে আমার বিরুদ্ধে যে অন্যায় সিপিএম সরকার করেছে, তার কোনও প্রতিবাদ নেই কেন?
.
৬ ডিসেম্বর
আজ বাবরি মসজিদ আক্রমণের পনেরো বছর পূর্তি। লজ্জা লিখেছিলাম পনেরো বছর আগে। দিন যে কীভাবে উড়ে যায়! মনে হয় এই সেদিন। ভালোবাসা জন্মেছিল ঠিক পনেরো বছর আগে, ৬ ডিসেম্বর তারিখে, ১৯৯২ সালে। আজ নাকি হরকাতুল জিহাদি দলের সদস্যরা একটা সাদা গাড়ি করে উত্তরপ্রদেশের দেওবন্দ থেকে দিল্লিতে ঢুকেছে, ইচ্ছে কিছু জনবহুল জায়গায় বোমা মেরে মানুষকে সন্ত্রস্ত করা। যদুর মনে পড়ে এই হরকাতুল জিহাদি দলটি বাংলাদেশে গড়ে উঠেছিল, আমার বিরুদ্ধে ধর্মবাদীদের আন্দোলন যখন তুঙ্গে, তখন। কী লাভ হচ্ছে তাদের মানুষ মেরে, আমি জানি না।
আজ প্রশান্ত রায়ের সঙ্গে কথা বললাম ফোনে সকালে, অনেকক্ষণ। উনি আশাবাদী কলকাতায় কিছু একটা আন্দোলন হবে আমার পক্ষে। আমি বললাম আন্দোলন হলে শুরুতেই হত। চোখের সামনে মানুষ দেখলো আমাকে কী করে বের করে দেওয়া হল পশ্চিমবঙ্গ থেকে। কী ভয়ংকর অন্যায়ভাবে বের করা হল। দিনের পর দিন মনের ওপর অত্যাচার চালিয়ে তারপর বের করলো। তারপরও কোনও একটি মিছিল বেরোলো না কলকাতার রাস্তায়! নিজেদের হাতে লেখা প্ল্যাকার্ড হাতে দাঁড়াতে হল আমার চার পাঁচজন বন্ধুকে। কেউ নেই আমার জন্য? আমার জন্য কেউ না থাকুক, অন্তত বর্বর একটি ঘটনার বিরুদ্ধে কি কারও দাঁড়াবার নেই? হ্যাঁ কিছু লেখা হচ্ছে বটে এদিক ওদিক কিন্তু জনগণকে ততটুকু ক্ষুব্ধ করছে না, যতটুকু ক্ষুব্ধ হলে মিছিলে যেতে হয়।
পাগলের মতোকাঁদলাম। তপন রায় চৌধুরী ফোন করেছিলেন। বললাম যেন আমাকে কলকাতা নিয়ে যান। যদি কলকাতা না-ই যেতে পারি, যদি পশ্চিমবঙ্গ আমাকে না-ই নেয়, আমাকে যেন বাংলাদেশেই পাঠিয়ে দেয়। ওখানে হুজি ফুজিরা কখনও মেরে ফেলে রাখবে। তাই ভালো। তবু পরের দেশকে নিজের দেশ ভেবে ভুল যে করেছিলাম, মানুষকে ভালোবাসলেও মানুষ যে শেষ অবধি ভালোবাসে না, বরং দূরে বসে মজা দেখে, তা তো আর নিজের চোখে দেখতে হবে না।
আমার ছিঁড়ে যাচ্ছে মাথা। আর পারছি না সইতে। প্রভুকে বললাম, আমাকে বাংলাদেশে ফেলে আসুন। ওখানেই যা হবার হোক। প্রভু শুনলেন। কণ্ঠে তার আগ্রহ আরও কিছু শোনার। এরকম কিছু শোনার জন্য যেন অনেকদিন অপেক্ষা করছেন। মনে আছে প্রভুর মতোই আরও একজন সরকারি বড় অফিসার বলেছিলেন, রাজস্থান হাউজে বসে, আমি যেখানে নিরাপদ, সেখানেই থাকা উচিত আমার।
জিজ্ঞেস করেছিলাম, কোথায় নিরাপদ?
লোকটি বলেছিলেন, ‘পৃথিবীতে কি নিরাপদ জায়গার অভাব আছে?’
‘কোথায় সেই নিরাপদ জায়গা, শুনি!’
‘কেন, ইওরোপ বা আমেরিকা!’
‘না। আমি বিদেশ যাবো না।‘
কী রকম যেন ভয় লাগছিল আমার।
.
৭ ডিসেম্বর
সকালে কলকাতা থেকে শর্মিলা ফোনে শোনালো আজকের প্রতিদিনের উইকএন্ডে বের হওয়া জয় গোস্বামীর একটা লেখা। ‘কোনও লেখককে যদি তার কোনও লেখা প্রত্যাহার করে নিতে হয়, তখন কী অনুভূতি হয় তাঁর? কী অপরিসীম কষ্টের মধ্য দিয়ে তসলিমাকে যেতে হয়েছে এই প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত নিতে, তা, আমরা অনুমান মাত্র করতে পারি। কারণ, আমাদের কাউকেই নিজের দেশ থেকে নির্বাসিত অবস্থায় দিনের পর দিন, দেশের পর দেশে, নিরাপত্তা রক্ষী পরিবৃত হয়ে ঘুরে বেড়াতে হয়নি। আমাদের কারোরই নিজের দেশে ফেরার পথ বন্ধ নয়। আমাদের কারো বই বেরোনো মাত্র নিজের দেশে পর পর নিষিদ্ধ হয়ে আসছে না। আর আমরা কেউই জানি না, নিজের মাথার উপর মৃত্যুদণ্ডের ফতোয়া ঝুলে থাকলে কেমন লাগে।
আমরা শুধু তসলিমার সমালোচনা করতে পারি। এটা লেখা তসলিমার উচিত হয়নি। ওটা বলা তসলিমার ঠিক হল না। এমনকী, আমরা এতটাও বলেছি কখনো যে, এসবই তসলিমা প্রচার পাওয়ার জন্য করেছেন। হয়াঁ, নিজের জীবন শেষ হয়ে যেতে পারে কোনও উন্মাদ ধর্মান্ধ ঘাতকের হাতে এটা জানার পরেও হয়তো প্রচারের জন্যই করেছেন। এতটাও বলেছি আমরা।’
শুধু এটুকুই নয়, আমার অবস্থা বোঝাতে বোঝাতে গ্যালিলিওর প্রসঙ্গও এনেছেন জয়। গ্যালিলিকেও পুড়িয়ে মারার ভয় দেখানো হয়েছিল। অসম্ভব চাপের সামনে শেষ ম্যে ভেঙে পড়লেন গ্যালিলিও। প্রত্যাহার করে নিলেন নিজের মতবাদ। বললেন, ‘চার্চই ঠিক, সূর্য পৃথিবীর চারদিকে ঘুরছে।‘ চোখ রাঙালে না হয় গ্যালিলিও বলে দিলেন পৃথিবী ঘুরছে না, পৃথিবী তবু ঘুরছে, ঘুরবেও যতই তাকে চোখ রাঙাও না।
শিবনারায়ণ রায়কে ফোন করেছিলাম, ওঁর শরীর মন কোনওটাই ভালো নেই। লিখতেও, বললেন, পারছেন না। বললাম ‘ব্লাড প্রেশার হয়তো খুব বেশি, ডাক্তার দেখান। নাহ, ডাক্তার দেখানোর খুব আগ্রহ নেই। বয়স বাড়লে, সবাই যেন কেমন কুঁকড়ে যান, ‘বেঁচে না থাকলেও চলে, অনেক তো হল’ ধরনের বাক্য আওড়ান।
বয়স ছিয়াশি। বললাম ‘জ্যোতিবাবুর বয়স তো পঁচানব্বই। আপনার চেয়ে তো অনেক বেশি বয়স।‘
কী অন্যায় করেছি যে আমাকে শাস্তি পেতে হবে? শিবনারায়ণ রায় বললেন, ‘কে বলেছে মানুষ শাস্তি পায় অন্যায় করলেই? তুমি একটা ক্ষমতাসীন শক্তির স্বার্থে আঘাত দিয়েছে, সে কারণে শাস্তি পাচ্ছো।
আজ ‘নিউ ইয়র্ক টাইমস’এ একটা লেখা পড়ে খুব ভালো লাগলো। মনের সঙ্গে মিলে যাওয়া কথা। সৌদি আরবের এক মেয়ে অপহরণ আর গণধর্ষণের শিকার। ইসলামের বিচারে ধর্ষকদের কোনও শাস্তি হল না। শাস্তি হল মেয়েটির। জেল হল। চাবুক হল। সুদানে এক ইস্কুল শিক্ষিকাকেও শাস্তি পেতে হল, কারণ পড়াতে গিয়ে টেডি বেয়ারের নাম রেখেছিল মুহম্মদ। এদিকে আমাকে পেতে হল শাস্তি। কবে কোন বইএ কী লিখেছি তা তাদের পছন্দ হয়নি বলে। তো ইসলামে নাকি বেশির ভাগ মুসলমানই অমৌলবাদী। ইসলামকে নাকি কিছু মৌলবাদীরা হাইজ্যাক করেছে। তাছাড়া ইসলাম খুব ভালো, ভালোর অন্ত নেই। লেখকের মতো আমারও প্রশ্ন, সেই মডারেটরা বা নরমপন্থীরা বা আধুনিক মুসলমানরা এখন কোথায়? তাঁরা মৌলবাদীদের কোনও দাঙ্গা হাঙ্গামা, কোনও শঠতা শয়তানি, কোনও ধর্ষণ লুঠের বিরুদ্ধে কিছু বলেন না তো, তাঁরা তো পথে নামেন না দল বেঁধে! অল্প কিছু মুসলমান এত বড় জঘন্য কান্ড ঘটাচ্ছে, আর বেশির ভাগই চুপ করে বসে দেখছে, তা কি হয়? মাঝে মাঝে আমার কিন্তু মনে হয় মডারেট’ বলে কিছু নেই। মুসলমান সমাজে দু’ধরনের মানুষ আছে, এক ইসলাম-বিশ্বাসী, আরেক ইসলামে অবিশ্বাসী। ইসলামে অবিশ্বাসীর সংখ্যা তুলনায় খুব কম, খুবই কম। বাদবাকি পুরোটাই ইসলাম-বিশ্বাসী। এই ইসলাম-বিশ্বাসীদের কেউ কেউ টুপি পরে, জোব্বা পরে, দাড়ি রাখে। কেউ কেউ এই পোশাকের বাইরে অন্য পোশাক পরে। বিশ্বাসীদের কেউ কেউ নামাজ রোজা ইত্যাদি করে, কেউ কেউ করে না। এই হল ঘটনা। বিশ্বাসীদের কেউ কেউ যখন মানবতার বিরুদ্ধে নামে, তার প্রতিবাদ বিশ্বাসীদের মধ্য থেকে আসে না। মডারেটদের তাই চোখে পড়ে না। মডারেট বা নরমপন্থী বলতে কিছু নেই বলেই চোখে পড়ে না।
সারাদিন কিছু ফোন। পাটনা থেকে কেয়া। বীরভুম থেকে এনামুল। ২৪ পরগণা থেকে মোজাফফর। আর একটি চিঠি পেয়ে মন ভরে গেল আজ। পাচুর চিঠি। চিঠি বলতে ই মেইলকেই বুঝি। অনেকমাস ধরে যোগাযোগ নেই পাঁচর সঙ্গে। এমন ভালো বন্ধুর সঙ্গে যোগাযোগ না থাকার পিছনে কারণ ছিল, অভিমান। পাচু লিখেছে, ‘নিরাপদে আছিস এটা বুঝি। কিন্তু তোর মন যে একেবারে তছনছ, সেটা ভেবে বড় ব্যাকুল লাগে। আমাদের এই সময় কি তাহলে শাসিত হবে শুধুই ধর্ম, শুধুই মৌলবাদ, শুধুই ভোট কেন্দ্রিকতার যাঁতাকলে? কী ভয়ানক রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের মুখোমুখি হয়ে তুমি তিনটি পাতা প্রত্যাহার করেছো বুঝে শরীর মন হিম হয়ে যায়। আশা রাখবো এই দুর্দিন আবার কাটবে, তুমি আবার ফিরে আসবে তোমাতে, আবার ঝলসাবে তোমার কলম অনির্বাণ! ভালো থাকিস। এই অবস্থায় যতটুকু ভালো থাকা যায়। উত্তরে আমি লিখলাম, ‘পাচু তোর চিঠি পেয়ে ভালো লাগলো এই অসহ্য কষ্টের মধ্যেও। জানি না কী করবো আমি। কলকাতা যেতে চাই। কিন্তু প্রগতিশীল কলকাতা তো আমাকে নিচ্ছে না। আমি একটা অন্ধকার ঘরে হতাশা আর অনিশ্চয়তায় ডুবে আছি। এরা হয়তো চাইছে মানসিক যন্ত্রণায় ভুগে একদিন আমি আত্মহত্যা করি নয়তো এদেশ ছেড়ে চলে যাই। উত্তর লিখলো পাচু। তসলিমা, কাকেই প্রগতিশীল কলকাতা বলিস জানি না। যে কলকাতায়, আমরা জানি, মৌলবাদকে নির্লজ্জ ব্যবহার করে লাল ঝান্ডাওলা একটি দল স্রেফ মুসলিম ভোটের কারণে যার বিরুদ্ধে প্রতিবাদে গর্জে উঠতে গিয়ে অন্য ঝাল্ডাধারীরা সুতীব্র ধিক্কারে এককাট্টা হয়ে গলা ফাটিয়ে সর্বব্যাপী আওয়াজ তুলতে পারে না–যারা বোঝে না কোন অসহনীয় রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের মুখে অসহায় একজন লড়াকু লেখককে তার সাধের তিনটি পাতা ছিঁড়ে ফেলতে হয়–সেই কলকাতাকে তুই প্রগতিশীল কলকাতা বলবি? এই চরম অন্যায়ের শোধ তুই একদিন না একদিন নিতে পারবি। এত অন্ধকারেও আমি বিশ্বাস করি, মৌলবার শেষ কথা বলে না।
বলে না? বাংলাদেশে তো আজও মৌলবাদই শেষ কথা বলে তেরো বছর হয়ে, গেল, ফিরতে পারি না। আর কী কথা বাকি আছে বাংলাদেশের বলার? চুপ করে আছে পশ্চিমবঙ্গ, আর কী কথাই বা তার শেষ কথা। নীরবতা, প্রত্যাখ্যান, অবজ্ঞা, অপমান, মৌলবাদই তো শেষ কথা।
যেখানে আছি আমি, একটি ঘর, সামনে একচিলতে বারান্দা, বারান্দার লাগোয়া একটা ছাদ। ছাদে দাঁড়ালে বা হাঁটলে আবার কেউ না কেউ কোথাও থেকে দেখে ফেললে আবার কী না কী হয়, তাই ওদিকটায় যাই-ই না। যেন না যাই, আমাকে বলে দেওয়া হল। এ আর কী, ঘরবন্দি হয়ে থাকতে তো পারিই আমি। মাসের পর মাস তো কাটিয়েছি, দেশে, বিদেশে। নিরাপত্তার নামে যন্ত্রণা ভোগ কী কম করেছি। শেকল ভাঙার কথা বলতে গিয়ে নিজের পায়ে শেকল পরতে হয়েছে, সে কী আজ থেকে!
.
৮ ডিসেম্বর
‘I think the Taslima Nasreen case has tested, and will test, the integrity of the Left intelligentsia even more than Nandigram’–Ramachandra Guha.
৬ ডিসেম্বরে কলকাতায় বাবরি মসজিদ ধ্বংসের পনেরো বছর উপলক্ষে একটা অনুষ্ঠানে গিয়েছিলেন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। তিনি বললেন, রাম হচ্ছে কবির কল্পনা। রামসেতুটা প্রাকৃতিক সেতু। রামসেতু নিয়ে যা হচ্ছে তা ধর্মীয় উন্মাদনা। টেলিভিশনে কাল এই খবরটি দেখে আমি তাজ্জব। কদিন আগে মুসলিম মৌলবাদীদের দাবি মেনে নিলেন, শহরে ওদের বর্বরতা আর উন্মাদনার বিরুদ্ধে একটা শব্দ খরচ করলেন না, বরং বললেন, কারওর অধিকার নেই ওদের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেওয়ার। আর এদিকে দোষীকে শাস্তি দেবার বদলে নির্দোষকে রাজ্যছাড়া করলেন, তারপর আজ কি না তিনি হিন্দুর ধর্মীয় অনুভূতিতে নিজেই আঘাত দিচ্ছেন।
.
৯ ডিসেম্বর ‘অধিকাংশের মতামতের সঙ্গে একমত না হওয়ার অধিকার চিন্তাশীল মানুষের প্রাথমিক, মৌলিক, সর্বশ্রেষ্ঠ অধিকার। এক লেখককে ‘তুমি এত দূর অবধি লিখতে পারো, কিন্তু তার বেশি এগোবে না’ বলা আর ‘তুমি কিছুই লিখবে না’ বলার মধ্যে কোনও পার্থক্য নেই। কারণ আসলে বলা হচ্ছে ‘তুমি বাপু বাক পরাধীন, তবে আমার ন্যাজে পা না-দেওয়া অবধি বাকস্বাধীন’। এই থ্রেট-সহ ছাড় স্বাধীনতা নয়। খাঁচার মধ্যে পায়চারি করার অনুমতি।
বাক স্বাধীনতার কোনও চৌকাঠ হয় না। সীমা হয় না। কারণ তা হলে যে কোনও ক্ষমতাশীল গোষ্ঠী (রাষ্ট্র। মৌলবাদী/ফাটাকেষ্ট ও চ্যালারা) যখন খুশি ইচ্ছেমতো চৌকাঠ নির্মাণ করবে, এবং পৃথিবীর যে কোনও শিল্পকেই নিজের সুবিধেমত কারও না কারও ভাবাবেগ-আঘাতকারী হিসেবে চিহ্নিত করবে, তার পর গুলি’। –চন্দ্রিল ভট্টাচার্য
একটা চিঠি লিখলাম তাঁকে। চিঠি তাঁকে পাঠানো হয়তো সম্ভব নয়, তবু লিখতে ইচ্ছে হল একটি চিঠি
মাননীয় বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য,
আমার অশেষ শ্রদ্ধা জানবেন। আপনার সঙ্গে একসময় আমার আলাপছিল, বেশ কয়েকদিন কথাও হয়েছে। আপনাকে একজন আন্তরিক মানুষ হিসেবেই তো আমি জানতাম। মনে আছে নন্দনে বসে আপনি একবার আমার বম্বে হয়ে প্যারিস যাবার বদলে দিল্লি হয়ে প্যারিস যাওয়ার প্রস্তাব দিয়েছিলেন, কারণ বোম্বের মৌলবাদী মুসলিমরাবিক্ষোভ দেখাচ্ছিল আমার বোম্বে যাওয়ার বিরুদ্ধে, বিমানবন্দর নাকি জ্বালিয়ে দেবে, আমাকে জ্যান্ত পুড়িয়ে মারবে। আমি আপনার প্রস্তাব মেনে নিচ্ছিলাম, কিন্তু শাবানা আজমি, জাভেদ আখতার, জাভেদ আনন্দ আর তিস্তা শীতলবাদীরা যখন বারবার আমাকে ফোন করছিলেন, বলছিলেন আমাকে যেতেই হবে বোম্বে, আমাকে বোঝাতেই হবে যে মৌলবাদীরা যা দাবি করে, তা হতে দেওয়া যায় না, বোম্বে যেতে হবেই, না যাওয়া মানে মৌলবাদীর কাছে নতি স্বীকার করা, না যাওয়া মানে তাদের অন্যায্য দাবি মেনে নিয়ে তাদের বিজয়ী করা। আমি আপনার উপদেশ মেনে চলছিলাম বলে তাঁরা আপনার শরণাপন্ন হলেন। আপনাকেই বোঝালেন কত যে জরুরি আমার বোম্বে যাওয়া। আপনি বুঝলেন এবং মেনে নিলেন আমার বোম্বে হয়ে প্যারিস যাওয়া।
তারপরও ওই নন্দনেই দু’একবার দেখা হয়েছে। আমজাদ আলী খানের সরোদ শুনতে গিয়েও একবার দেখা হল, সম্ভাষণ বিনিময় হল। শ্রদ্ধেয় আমজাদ আলী খান আপনাকে এবং আমাকে নমস্কার জানিয়ে বাজনা শুরু করলেন। তখন ২০০২ সাল, কলকাতায় পাকাঁপাকিভাবে বাস করার ইচ্ছে মনে, মনে আছে চারদিকে ফ্ল্যাট খুঁজে বেড়াচ্ছি কেনার জন্য। আপনি আমাকে সাহায্য করছিলেন একটা ফ্ল্যাট কিনতে। মন্ত্রী গৌতম দেবএর জন্য যে একটা ফ্ল্যাট বরাদ্দ ছিল উদিতায়, বলেছিলেন সেই ফ্ল্যাটটি আমার কিনে নিতে কোনও অসুবিধে নেই। আমি তৈরি ছিলাম। কাগজপত্র পাঠানো হয়েছে দিল্লি নাকি বোম্বেতে। রিজার্ভ ব্যাংক থেকে নাকি অনুমতি চলে আসছে। না, সেই অনুমতি অবশ্য আমার কোনওদিন পাওয়া হয়নি। কোনও কাগজপত্র ফেরত পাইনি। ফ্ল্যাট কেনাও হয়নি। কিছুই হয়নি। আপনার সঙ্গেও আর কোনও সৌজন্য সাক্ষাৎ হয়নি। সম্ভব হয়নি আপনার আর নাগাল পাওয়া। আপনার বন্ধুরা, যারা আমারও বন্ধু ছিল, হঠাৎ আমার পর হয়ে উঠলো।
মনে হচ্ছে এই সেদিনের কথা এসব। কী থেকে কী হয়ে গেল, অবিশ্বাস্য সব ওলোটপালোট।
আমি তখন হারভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে সেকুলারিজমের ওপর একটা ফেলোশিপ করছি। ওখানেই শুনি আপনি আমার দ্বিখন্ডিত বইটিকে নিষিদ্ধ করে দিয়েছেন। সত্যি, যেন আকাশ থেকে পড়লাম। এও কি সম্ভব? কলকাতার বন্ধুরা জানালো, সম্ভব। ছোটবেলা থেকে বামপন্থায় বিশ্বাস আমার। বামপন্থী রুশ লেখকদের লেখা পড়ে বড় হয়েছি। আমি তো ‘দ্বিখন্ডিত’তে মৌলবাদের বিরুদ্ধে আমার লড়াইএর কথা লিখেছি, নারীর স্বাধীনতা আর অধিকারের কথা লিখেছি, আমি তো সমতার কথা লিখেছি! কোথায় তবে বামপন্থার সঙ্গে সংঘাত হল আমার? আমি শুনলাম আপনি বলছেন, কয়েকজন বুদ্ধিজীবী আপনাকে বলেছেন বইটাকে নিষিদ্ধ করতে, এবং আপনিও একাধিকবার পড়ে দেখেছেন ওটা, ওটা নাকি নিষিদ্ধ হওয়ার মতোই বই। তাই কি? আপনি কি মন থেকে বলেছেন ওসব কথা, আপনি কি সত্যিই মনে করেন যে আমি যা লিখেছি, একটি শব্দ বা বাক্য ভুল লিখেছি? যদি মনে করেন লিখিনি, তবে কি আশংকা জন্মেছিল আপনার, যে, শহরে কোনও সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা লেগে যাবে বইয়ের কারণে? কোথাও তো দাঙ্গার আভাস মেলেনি। হাইকোর্ট বইটাকে মুক্ত করে দেওয়ার পর তো বই চলেছে মাসের পর মাস, বছরের পর বছর। কোথাও তো দাঙ্গা লাগেনি। কোনও একজন মুসলমানও তো আপত্তি করেনি। বইটি নিষিদ্ধ করার কারণ দেখাতে গিয়ে বলা হয়েছিল, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ট হবে। দুটো সম্প্রদায়ে নাকি দাঙ্গা লাগবে। পরে হাইকোর্টে এই কারণটি উড়িয়ে দেওয়া হয় এই বলে যে, দুটো সম্প্রদায় এখানে জড়িত নয়। তখন নিষিদ্ধ করার পক্ষে আপনি নতুন কারণ দেখালেন যে, বইটি মানুষের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেবে। তিনজন বিচারক রায় দিলেন বইয়ের নিষেধাজ্ঞার বিপক্ষে। না, বুদ্ধবাবু, সবিনয়ে জানাই, রায় আমার দেওয়া নয়। নিষেধাজ্ঞার বিরুদ্ধে মামলাও, আমার নয়, কলকাতার একজন মানবাধিকার কর্মীর রুজু করা। আপনি আমার বই নিষিদ্ধ করেছেন, তারপরও আপনার প্রতি আমার শ্রদ্ধা কিছু কমেনি। চেষ্টা করেছি আপনার সঙ্গে দেখা করতে, সম্ভব হয়নি। আপনার কাছে পৌঁছোনোর সব দরজা জানালা আপনি বন্ধ করে রেখেছেন। আপনার যাঁরা কাছের মানুষ, যাঁদের সঙ্গে আমারও যোগাযোগ ছিল, তারাও দূরে সরে গেলেন হঠাৎ। তারপরও বিশ্বাস হারাইনি আপনার ওপর থেকে। ‘ভালো ছবি’ নামে একটা সিনে ক্লাব গড়ে তুলেছিলাম, ইচ্ছে ছিল বিদেশ থেকে সংগ্রহ করা আমার ভালো ভালো সব ছবি কলকাতার মানুষকে দেখাবো। নন্দনে দেখাতে পারবো, এরকম একটি আশ্বস অংশু সূরের কাছ থেকে পেয়ে পৃথিবীর প্রায় দু’হাজার শ্রেষ্ঠ ছবি যোগাড় করে দেখলাম, নন্দনে আমি নিষিদ্ধ। আমি বোকার হদ্দ, অনেক পরে ধীরে ধীরে বুঝেছি আমি মানুষটাই আসলে নিষিদ্ধ সব সরকারি জায়গায়। সরকার আয়োজিত কোনও উৎসব অনুষ্ঠানে যাওয়ার অধিকার আমার নেই, অংশ নেওয়ার তো প্রশ্ন ওঠে না। কী ভীষণ একা হয়ে গেলাম।
এত ঘৃণা কেন আমার প্রতি আপনার? আমি ইসলাম ধর্ম নিয়ে লিখেছি বলে? আপনি সত্যি করে বলুন তো আপনি ইসলাম ধর্মে বিশ্বাস করেন? ইসলাম গেল ইসলাম গেল বলে যারা চেঁচাচ্ছে, আমার মুন্ডু চাইছে, কুশপুত্তলিকা পোড়াচ্ছে, আমাকে রাজ্য থেকে তাড়িয়ে দেবার কথা বলছে, তাদের কি ভালো লোক বা সৎ লোক বলে আপনার মনে হয়? তাদের দাবিকে ন্যায্য দাবি বলে আপনি মনে করেন? যদি তা না মনে করেন, তা হলে বলছেন না কেন? হিন্দু মৌলবাদীরা অন্যায্য দাবি করলে, রামসেতু নিয়ে লাফালে আপনি তো পছন্দ করেন না। ওদের চেঁচামেচিকে নির্দ্বিধায় বলেন, ধর্মীয় উন্মাদনা। মুসলমান মৌলবাদীদের সামনে আপনি নাকি আমাকে ‘বাজে মহিলা’, ‘হরেবল উওম্যান’ বলেছেন, এবং আমাকে রাজ্য ছাড়া করবেন বলে ওদের কথা দিয়েছেন। বিশ্বাসে, আদর্শে, চেতনায় আমি তো ভেবেছিলাম আমি আপনার কাছের মানুষ, কিন্তু আশ্চর্য আপনি তাদের আপন মনে করেছেন, যারা সমাজটাকে অন্ধকারে ছুঁড়ে ফেলতে চায়, যে অন্ধকারে মেয়েরা নির্যাতিত হচ্ছে দিনের পর দিন, যেখানে সত্য এবং সাম্যের পক্ষে মুখ খোলা নিষেধ।
কী অন্যায় করেছি আমি, আমার কী অপরাধের শাস্তি আপনি আমাকে দিলেন, খুব জানতে ইচ্ছে করে আমার। আপনার দলের পত্রিকা এবং বন্ধুর পত্রিকায় আমাকে বছরের পর বছর যা তা ভাষায় গালি দেওয়া হচ্ছে। আমার সম্পর্কে বানিয়ে বানিয়ে মিথ্যে কথা লেখা হচ্ছে। দেখেও বছরের পর বছর মুখ বুজে থেকেছি। পথে প্রান্তরে সিঙ্গুর নিয়ে, নন্দীগ্রাম নিয়ে, রিজওয়ান নিয়ে মানুষ প্রতিবাদ করছে, কোনওদিনও কিছু বলতে পারিনি, লিখতে পারিনি। এদেশি লোক নই, এদেশি রাজনীতি নিয়ে আমার মুখ খোলা নাকি উচিত নয়। বন্ধুরা বলেছে, আমি পথে নামলেই আপনি আমার ওপর প্রতিশোধ নেবেন, পশ্চিমবঙ্গে আমাকে আর থাকতে দেবেন না। অন্যায়ের প্রতিবাদ না করা আমার স্বভাববিরুদ্ধ, তারপরও আমি নির্লজ্জের মতো মুখ বুজে থেকেছি। হাঁ, পশ্চিমবঙ্গে থাকাটা আমার জন্য ভীষণ জরুরি বলে মুখ বুজে থেকেছি। আজ যদি বাংলাদেশ আমাকে দেশান্তরী না করতো, বাংলাদেশে বাস করা আমার পক্ষে সম্ভব হত, তাহলে ওখানেই থাকতাম। এখানে বাস করতে চাইতাম না। এগারো বছর আমি ইওরোপের এক দেশ থেকে আরেক দেশে ঘুরেছি। কোথাও মন বসাতে পারিনি। কোনও দেশকেই নিজের দেশ বলে মনে হয়নি আমার। ওসব দেশে আমাকে যথেষ্ট সম্মান করা হয়েছে, বাক স্বাধীনতা নিয়ে কোনওদিন কোনও শর্ত দেওয়া হয়নি, আশ্রিত বলে আমাকে সংযত হয়ে কথা বলতে বলেনি কেউ, তারপরও আমি আমার নিজের দেশে চলে যেতে চেয়েছি, নিজের বাবা মা, ভাইবোনের কাছে ফিরতে চেয়েছি, বন্ধুদের কাছে ফিরতে চেয়েছি। নির্বাসন জীবন শুরুর পর ইওরোপে বসে বসে হতাশায় ভুগতে ভুগতে বাংলাদেশের দরজায় কড়া নেড়ে বিফল হয়ে ভারতের দরজায় কড়া নেড়েছি। ভারত খুলেছে দরজা, তবে ছ’ছটি বছর নিয়েছে দরজা খুলতে। অল্প যে-কদিনের জন্য অনুমতি দেওয়া হত ভারত ভ্রমণের, সে কদিনই এসে থেকে যেতাম পশ্চিমবঙ্গে। প্রাণ ভরে দেশের স্বাদ নিতাম। ওপার থেকে আত্মীয়স্বজন আসতো এপারে আমার সঙ্গে দেখা করতে। ভারতে বাস করার অনুমতি বছর তিন আগে মিলেছে, মেলার পর এক মুহূর্ত দেরি করিনি, থাকতে শুরু করেছি। পশ্চিমবঙ্গে বাস করা আমার কাছে পশ্চিমবঙ্গে বাস করা কখনও ছিল না।
বছর তিনেক কলকাতায় বাস করছি। কারও তো অনিষ্ট করিনি। নিজের ঘরে বসে নিজের লেখালেখি করি, কিছু বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে দেখা হয়, কথা হয়। কারও সাতে নেই, পাঁচে নেই। রাজনীতি বুঝিও না। রাজনীতি থেকে সহস্র মাইল দূরে থাকি। আমার শান্তশিষ্ট জীবন কার বাড়া ভাতে ছাই দিল? পশ্চিমবঙ্গের ঘরটি আমার কাছে শুধু ঘর ছিল না। ঘরের চেয়েও অনেক বড়। আমার নিজের যে একটি ঘর ছিল বাংলাদেশে, যে ঘরটি ছেড়ে আমাকে নির্বাসিত হতে হয়েছিল, সেই ঘরটি আমি প্রাণপণে ফিরে পেতে চেয়েছিলাম। অপেক্ষার প্রহর গেছে কেবল সেই স্বপ্নের কাছে যেতে। সেই ঘর, সেই স্বপ্ন, ভিন্ন ভাষা আর ভিন্ন সংস্কৃতির মধ্যে পাওয়া যায় না। সেই ঘরটি, নিজের সেই ঘরটি, আমার দীর্ঘ এগারো বছরের পথে পথে ঘোরার ক্লান্তির পর পেয়েছিলাম কলকাতায়, পশ্চিমবঙ্গে, আমার বাংলায়। বাংলাকে আমি কোনওদিনই ভাগ করে দেখিনি, তাই পেরেছিলাম অত দ্রুত পশ্চিমবঙ্গকে নিজের দেশ করে নিতে, কলকাতাকে নিজের শহর করে নিতে। পশ্চিমবঙ্গের ঘর শুধু ঘর ছিল না, বহুকালের হারানো স্বপ্ন ফিরে পাওয়া ছিল। নিজের যে ঘরটি যে স্বপ্নটি আমাকে ত্যাগ করতে হয়েছিলো, সে ঘরটি ফিরে পাওয়া, সেই স্বপ্নকে ফিরে পাওয়া, সেই নিশ্চিন্তিটি, আমার জীবনের সবচেয়ে বড় পাওয়া। দীর্ঘ বছরের সাধনার পর সাধের ধন ফিরে পাওয়া। আমার মা খুব চেয়েছিলেন দেশের মেয়ে দেশে ফিরে আসি। বিদেশে আমার বিষণ্ণ পড়ে থাকা দেখে তিনি কাঁদতেন। চেয়েছিলেন যে করেই হোক যেন নিজের বাড়িঘরে, নিজের আত্মীয় বন্ধুদের নিয়ে থাকি। মার সেই স্বপ্ন সফল হয়নি, শত চেষ্টা করেও আমি দেশে ফিরতে পারিনি। কিন্তু বেঁচে থাকলে মা নিশ্চয়ই অন্তত স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতেন এই ভেবে যে, অন্তত বাঙালির মধ্যে আছি, দেশ না হলেও দেশের মতো জায়গায় আছি।
নিশ্চিন্তে নির্বিয় ছিলাম কলকাতায়। হঠাৎ হায়দারাবাদে আমার ওপর মৌলবাদীদের আক্রমণ হল। সাধারণ মানুষ সহানুভূতি প্রকাশ করলো। না, বুদ্ধবাবু, আপনি ফিরেও তাকালেন না। আমি মার খাই, কী মরে যাই, তাতে আপনার কিছু যায় আসে না। একটিবার বললেন না হায়দারাবাদে যা হয়েছে, তা হওয়া উচিত হয়নি। না, বুদ্ধবাবু, হায়দারাবাদের অনুষ্ঠানে ধর্ম নিয়ে আমি একটি শব্দও উচ্চারণ করিনি। তারপরও অসভ্য ঘটনাটি ঘটেছে। ঘটিয়েছে মৌলবাদীরা। এই ঘটনার পর কোথায় আমি সহানুভূতি পাবো, তা নয়, এই আপনারই শহরে, ধর্মতলার মোড়ে আমার মাথার দাম ঘোষণা করলো ক’জন মৌলবাদী। না, তাদের কাউকে আইন অমান্যের দোষে গ্রেফতার করা হয়নি। ওরকম ফতোয়া পেয়ে আমার অভ্যেস আছে। জীবন তো আমার কখনও কোনওদিন মসৃণ ছিল না। সইতে হয়েছে মৌলবাদীদের অনেক হুমকি, অনেক ফতোয়া, অনেক নির্যাতন, অনেক নিষেধাজ্ঞা। জীবন আমার এরকমই। ফতোয়ায় ভয় পাইনি। আপনি অনুগ্রহ করে নিরাপত্তার ব্যবস্থা করেছেন, তাই দুশ্চিন্তা কখনও ছিল না। আর, সত্যি কথা কী, আমার মনে হয়নি কলকাতায় আমাকে কেউ মেরে ফেলবে। নিরাপত্তা রক্ষীদের বিদেয় করে কত আমি গড়িয়াহাটে, যদুবাবুর বাজারে একা একা বাজার করেছি, ভিড়ের রাস্তায় একা একা হেঁটেছি। কই, কখনও তো কেউ মারতে আসেনি। যারা এসেছে, ভালোবেসে কাছে এসেছে।
এমন জীবনে হঠাৎ দেখি আমাকে বলা হচ্ছে ঘরের বাইরে আর বেরোনো চলবে না। কেন, বাইরে কী? নিরাপত্তা রক্ষীরা বলেন, ওপর থেকে অর্ডার পেয়েছেন ওরা, আমার বাইরে যাওয়া সম্পূর্ণই বন্ধ। রাস্তাঘাটে বাজার হাটে তো নয়ই, কারও বাড়িতেও নয়। নিভৃতে, কেউ জানবে না, তাও নয়। এমনকী দু’গাড়ি নিরাপত্তা রক্ষী নিয়েও বেরোনো যাবে না। পায়ে যে আসলে শেকল পরানো হচ্ছে, বুঝিনি। ভেবেছিলাম, সত্যি বুঝি ঘরের বাইরে আমাকে মেরে ফেলার ফাঁদ পাতা আছে। প্রসূন মুখার্জি যেদিন বাড়ি এসে দু’ঘণ্টা কথা বলেছেন, বুঝিয়েছেন, আমি বাইরে বেরোলেই আমাকে মেরে ফেলা হবে, উন্মত্ত ধর্মান্ধরা সব ধেয়ে আসবে আমার বাড়িতে আমাকে মেরে ফেলতে, এবং আমার জন্য কিছুতেই এই কলকাতায়, এই পশ্চিমবঙ্গে থাকা নিরাপদ নয়, আমি যেন চনে যাই, চলে যাই ইওরোপ আমেরিকায়, চলে যাই সিঙ্গাপুর থাইল্যান্ডে, চলে যাই কেরালা বা মধ্যপ্রদেশ, কোথাও, যেন কিছুতেই পশ্চিমবঙ্গে না থাকি, থাকলে রায়ট লেগে যাবে–সেদিনও বুঝিনি আসলে আতঙ্ক সৃষ্টি করে আমাকে দেশ থেকে বা রাজ্য থেকে বের করাই আসল উদ্দেশ্য। আমার নিরাপত্তার কথা ভেবে কিছুই করা হচ্ছে না। এরপরও প্রসূনবাবু ফোন করে করে চলে যাবার কথা বলতেন। হুমকির মতো শোনাতো তার কথা। শেষ ফোনটি যেদিন করেছিলেন আমাকে, নিজেই বললেন, সিএম বলেছেন আপনাকে অ্যাজ সুন অ্যাজ পসিবল চলে যেতে। উনি কেরালায় সব ঠিকঠাক করে ফেলেছেন। ওখানে সরকারের সঙ্গে কথাও হয়েছে সিএমের। ওখানে আপনাকে সিকিউরিটি দেওয়া হবে।
আমি, বিশ্বাস করুন বুদ্ধবাবু, বিশ্বাস করতে পারিনি আপনি প্রসূন মুখার্জিকে পাঠাতেন, আমাকে বুঝিয়ে, না বুঝলে ভয় দেখিয়ে, নানা কায়দায় আতংক সৃষ্টি করে, আমাকে দেশ ছাড়া, নয়তো রাজ্য ছাড়া করতে। আমি বলেছিলাম আমাকে যে এই পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য নিরাপত্তা দিতে পারছে না, আমাকে যে অন্য রাজ্যে চলে যেতে বলা হচ্ছে, মানুষ জানুক তা, কারণ কেরালায় গেলে ওখানেও তো হানা দিতে পারে আততায়ীরা। কী ভরসা আছে বাঁচবো আমি! আমি যে কেরালায় নিজের ইচ্ছেয় মরতে যাইনি, তা আমি তাহলে বলি সবাইকে। প্রসূন মুখার্জি বললেন, না, যেন গোপনে চলে যাই, যেন ঘুণাক্ষরেও কাউকে এসব না জানাই। শুধু প্রসূনবাবুকে দিয়ে নয়, আপনি আপনার দু’একজন ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের দিয়েও, যাদের আমি শ্রদ্ধা করি, বলিয়েছেন চলে যেতে। অন্যায় করেছি আমি, আপনার আদেশ আমি মানিনি, আমি কলকাতা ছেড়ে কোথাও যাইনি। যাইনি কারণ আমি ভেবেছিলাম আপনি আমার নিরাপত্তা নিয়ে চিন্তিত, তাই আমাকে চলে যেতে বলছেন। শহর শান্ত, নিরাপত্তার অভাব কী করে হবে, ভেবে পাইনি। তারপর তো শহর একদিন অশান্ত হল। অশান্ত হওয়ার কথা ছিল না, কিন্তু হল।
আপনি আমাকে কলকাতাতেই শাস্তি দিয়েছেন। ঘর থেকে এক পা বার হওয়াও নিষেধ আমার জন্য। পাগল হয়ে যেতাম। বিশ্বাস করুন বুদ্ধবাবু, আমি পাগল হয়ে যেতাম। ঠিক আমার জায়গায় নিজেকে ফেলে দেখেছেন কেমন লাগে? ধরুন আপনাকে যদি ওভাবে বন্দি করে রাখা হত, যে বন্ধুদের আপনি কাছে পেতে চাইতেন, দেখতেন তারা আর আসছে আপনার কাছে, কারণ আপনার দরজায় যে পুলিশেরা বসে, সেই পুলিশেরা যারাই আসতো আপনার সঙ্গে দেখা করতে তাদের নাম ঠিকানা লিখে রাখতো, কবে আবার কী না কী হয়, এই ভয়ে যদি বন্ধুদের আসা বন্ধ হয়ে যেত এবং আপনি একা বসে থাকতেন ঘরে দিনের পর দিন, মাসের পর মাস, কেমন লাগতো? আপনার নিশ্চয়ই শ্বাসকষ্ট হত। একটা ঘরের দরজা যখন বাইরে থেকে বন্ধ থাকে, এবং কোনও শক্তি থাকে না, উপায় থাকে নাসেই দরজা খোলার, তখন নিশ্চয়ই মৃত্যুময় নিস্তব্ধতা ঘিরে থাকে চারদিক, অসহায়তা আর হতাশা ডুবিয়ে নিতে থাকে অদ্ভুত অন্ধকারে। আমার জন্য খুব গোপনেও কি আপনার একবার দুঃখ হয়নি?
প্রসূনবাবু পুলিশ কমিশনারের পদ থেকে চলে যাবার পর আমাকে গৃহবন্দি করা, ভয় দেখানো, হুমকি দেওয়ার দায়িত্ব পড়লো নিরাপত্তা প্রধান বিনীত গোয়েল বাবুর ওপর। উনি প্রায়ই ফোন করতেন। কেরালা বা মধ্যপ্রদেশে বা বিদেশে অজানা কোথাও উনি আমাকে ফেলে দেননি। উনি প্রথম থেকেই বলেছেন জয়পুর যেতে। জয়পুরে আমার জন্য সব আয়োজন থাকবে, একটা চমৎকার রিসর্ট থাকবে, কুক থাকবে, আমি ওখানে দু’দিন যেন থেকে আসি, যাওয়ার ব্যবস্থা উনি নিজেই করবেন। কেন যাবো, কারণ এখানে এই কলকাতায় মুসলিম মৌলবাদীরা আমাকে মেরে ফেলবে। বাঁচার জন্য যেতে হবে জয়পুর। একে গৃহবন্দি, তার ওপর যারা আমার নিরাপত্তার ব্যবস্থা করছেন, তাঁরা বারবারই আমাকে জানাচ্ছেন যে আমি যদি সরকারের উপদেশ না মানি, নিজ দায়িত্বে কোথাও চলে যেতে পারি। জয়পুর কেন, পরে আমি বুঝতে পারলাম যখন সন্দীপ ভুটোরিয়া আমাকে ফোন করতে শুরু করলেন। বিনীত গোয়েলের হয়ে অতপর সন্দীপ ভুটোরিয়ার কাজ আমাকে বোঝানো, যেন জয়পুর চলে যাই। ওখানে থাকার সব বন্দোবস্ত তিনিই সব করে দেবেন। যেন একটুও দুশ্চিন্তা না করি। ক’দিন কাটিয়ে পরিস্থিতি একটু শান্ত হলেই ফিরে আসতে পারবো। প্রসূনবাবু আমার চেনা এমন কাউকে খুঁজে পাননি, যাকে বিশ্বাস করে অন্য রাজ্যে পাড়ি জমাতে পারি। বিনীত গোয়েল আগে লোক খুঁজেছেন, পেয়েছেন, তারপর আমাকে পার করতে নেমেছেন। অন্য রাজ্যে আমি কী করে যাবো, কোথায় থাকবো, নিরাপত্তার ব্যবস্থা কী, এসব ব্যাপারে নিশ্চয়তা দিতে বিনীত গোয়েল এবং তাঁর বন্ধু, আমার চেনা পরিচিত সন্দীপ ভুটোরিয়া লেগে রইলেন। আমি কী যে ভুল করছি, জীবনের ঝুঁকি নিয়ে পড়ে রয়েছি কলকাতায়। মাথায় এক ছটাক বুদ্ধি থাকলে, মোদ্দা কথা প্রাণে বাঁচতে চাইলে জয়পুরে চলে যেতাম, ক্রমাগতই বলে চলেছেন দুজন।
যে পনেরো নভেম্বর তারিখে সিদ্দিকুল্লাহ চৌধুরীদের ‘বনধ’ পালন হওয়ার কথা, এবং সেই ভয়ে আগে থেকেই পুলিশ কর্তারা আমাকে দেশ বা রাজ্য ছাড়ার জন্য বলতেন, সেই পনেরো নভেম্বরে বনধ তো হলই না, একটা মিছিল হল শুধু, অথচ ভোর পাঁচটায় আমাকে তড়িঘড়ি বের করে রাসবিহারী অ্যাভিয়ে ডলি রায়ের বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হল। ওখানে আমাকে একা রেখে পুলিশরা সবাই চলে গেল। কোথায় গেল? খবর নিয়ে দেখি সবাই পুলিশ অফিসে গিয়ে খামোকা বসে আছে। শেষ বিকেলে বিনীত গোয়েলকে ফোন করেছিলাম জানতে কখন বাড়ি ফিরবো। ভীষণ ক্রুদ্ধ তিনি আমার ওপর, বললেল, কখন বাড়ি ফিরবেন তার আমি কী জানি? তাঁর রাগ, আমি জয়পুর যাইনি, তার জয়পুরী দূতকে বারে বারেই ফিরিয়ে দিয়েছি। আতঙ্কে কেটেছে সারাদিন। আতঙ্ক তৈরি করার চেষ্টা ১৫ নভেম্বরের আগেই শুরু হয়েছিল যখন আমার বাড়িতে নিরাপত্তারক্ষী কমিয়ে দেওয়া হল। কী, না, যারা বাড়ির সামনে বসে, তারা এখন থেকে পুলিশ অফিসে বসবে। কেন পুলিশ অফিসে? না, এমনি। ১৫ নভেম্বরে মিল্লি ইত্তেহাদ পরিষদের অর্থাৎ সিদ্দিকুল্লাহ চৌধুরীদের পথ অবরোধ বিকেলে। ইস্যু নন্দীগ্রাম, রিজওয়ান, সাচার কমিটির রিপোর্ট, আমি। টেলিভিশনে দেখি আমার বাড়ি থেকে খুব বেশি দূরে নয় ধর্মান্ধগুলো আমার কুশ পুতুল পোড়াচ্ছে। উন্মত্ত ধর্মান্ধতা আমার বাড়ি পর্যন্ত পৌঁছে যেতে পারে, ভয় সত্যিই হল। সাদা পোশাকের যে পুলিশরা আগস্ট মাসের ন’তারিখ থেকে আমার বাড়ির সামনে ছিল, তারা তখন সবাই বসে আছে অফিসে। যে দিনটায় তাদের থাকার কথা সবচেয় জরুরি, সে দিনটাতেই ওরা নেই। আমি ওদের অনুরোধ করলাম আসতে। ওরা এলো। কিন্তু মিনিট পনেরো থেকে চলেও গেল। কুশ পুতুল পোড়ার আগুন নেভেনি তখনও।
একুশ তারিখে কিছু হওয়ার কথা ছিল না, কিন্তু হল। ভেবেছিলাম ইদ্রিস আলীর সংগঠন কী আর এমন করতে পারবে, যখন ১২টা সংগঠনই পনেরাই নভেম্বরে তেমন কিছু গন্ডগোল বাধাতে পারেনি। কিন্তু ২১ তারিখের ভয়াবহ কান্ড টেলিভিশনে দেখে স্তম্ভিত বসে রইলাম। স্তম্ভিত এইজন্য যে, এরা কারা, এরা তো আমার বই পড়ার ছেলে নয়, এরা আমাকে তাড়াতে চাইছে কেন, এদের তো ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত লাগার কোনও কারণ নেই। দীর্ঘদিন থেকে এদের কি ব্রেইনওয়াশ চলেছে, নাকি কেউ লেলিয়ে দিয়েছে আজ? পেছনে কোনও চক্রান্ত নিশ্চয়ই কাজ করছে। ছেলেরা লুঙ্গি তুলে পুলিশদের পুরুষাঙ্গ দেখাচ্ছে। বিভিন্ন অশ্লীল অঙ্গভঙ্গি করছে। পুলিশ মারার পুলকে একেকজন দিশেহারা। এরা তো আমাকে চেনে না জানে না, কোনওদিন পড়েওনি আমাকে। শুধু কি আমাকে, এরা তো মনে হয় না এদের ধর্মগ্রন্থও কোনওদিন পড়ে দেখেছে! যেহেতু ওরা শুনেছে যে আমি ইসলাম বিরোধী, তাই আমি ইসলাম-বিরোধী, তাই আমাকে দেশ থেকে তাড়াতে হবে, এই দাবি নিয়ে কি পুলিশের দিকে ঢিল ছুড়ছিল, গাড়ি পোড়াচ্ছিল? এদের মুখ দেখে আমার মনে হচ্ছিল, পুলিশের ওপর এদের রাগও প্রচন্ড, রিজওয়ান হত্যার শোধ যেন নিচ্ছিল এরা। না, নন্দীগ্রাম নিয়ে এদের কোনও মাথাব্যথা ছিল বলে মনে হয় না। আমি হিম হয়ে যাচ্ছিলাম দেখে যে পুলিশ নীরব দর্শক হয়ে বসে আছে। পুলিশদের গুলি চালালো না, র্যাফ নামলো, র্যাফও চালালো না, সেনা নামানো হল, সেনাদেরও বলা আছে। গুলি যেন না ছোঁড়ে কারও দিকে। আমার ধারণা, উন্মত্ত ছেলেগুলো যদি আমার বাড়ির দিকে আসে আমাকে খুন করতে, পুলিশ, র্যাফ, সেনা এভাবেই নিশ্ৰুপ বসে থাকবে। নড়বে চড়বে না। ওদের বলে দেওয়া আছে মার খাওয়ার, মার না দেওয়ার।
একুশ তারিখ রাতে বাড়ি এলেন সন্দীপ ভুটোরিয়া। ভক্ত হিসেব দেখা সাক্ষাৎ করেন মাঝে মাঝে। একবার দরিদ্র শিশুদের সাহায্যের জন্য জয়পুরের একটা অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন, গিয়েছিলাম। রাজভবনে অনুষ্ঠান হয়েছিল। প্রতিভা পাটেল ছিলেন সভানেত্রী, আমি প্রধান অতিথি। সন্দীপের সেই ওই একই কথা। আপনি তো জানেন জয়পুরে আমি সব ব্যবস্থা করে রেখেছি, আপনি নামবেন জয়পুরে, সরকারকে ওখানে সব বলে রাখা আছে, আপনাকে প্রটেকশন দেবার সব ব্যবস্থা পাকা, আপনি কদিন একটু বেড়াতে যাবেন। খাবেন, দাবেন, ঘুরবেন, একটু বেড়িয়ে আসুন। এখানে যে কোনও মুহূর্তে এরা মেরে ফেলবে। এত বোকার মতো কাজ কেন করছেন। সন্দীপকে সোজা বলে দিই, স্পষ্ট বলে দিই, আমি যাবো না কোথাও।
পরদিন টিভিতে সকাল থেকেই দেখাচ্ছে পার্কসার্কাস মোড়ের লোকদের। কেউ কেউ বলছে, ‘আমি তসলিমাকে খুন করবো, এতে যদি আমার প্রাণ যায় যাবে। কী ভীষণ বর্বরতা আর হিংস্রতা কণ্ঠস্বরে ওদের। দুপুরে কথা হল বিনীত গোয়েলের সঙ্গে। কাল শুক্রবার নামাজের পর আমার বাড়িতে আক্রমণ হবে, খবর দিলেন। এরকম হলে চলে যাই সল্ট লেক বা বেলঘরিয়া, বা বেহালা বা গোলপার্ক, বা এরকম কোনও জায়গায়, আমি বললাম। না, ওসব জায়গায় সিকিউরিটি ছাড়া থাকতে হবে। সিকিউরিটি থাকলে তোক জেনে যাবে। সিকিউরিটি ছাড়া থাকা তো নিরাপদ নয়, ইন কেইস। না সে দায়িত্ব আমরা নিতে পারবো না। বিনীতবাবুর সাফ কথা, আমাকে বাঁচতে হলে জয়পুর যেতে হবে। তিনি সব ব্যবস্থা পাকা করে রেখেছেন। জয়পুর না গেলে বাঁচবো না, আমার জন্য বাঁচার কোনও রাস্তা খোলা নেই এই শহরে। আগামিকাল জুম্মার নামাজ, নামাজ শেষে মুসলমান মৌলবাদীরা, একুশ তারিখের বিজয়ী উন্মত্তরা বেরিয়ে পড়বে, গত চারমাস ধরে ভয় আর আতঙ্ক আমার ভেতর জোর জবরদস্তি করে ঢোকানোর চেষ্টা করে অবশেষে সফল হলেন বিনীতবাবু। আতঙ্ক আমার সর্বশরীরে, বেঁচে থাকতে হবে, লিখতে হবে, তাহলে দুদিনের জন্য যাই জয়পুর। তক্ষুনি একটা সাদা অ্যামবাসাডার পাঠালেন তিনি, যেন ঝড়ের মতো উড়ে এলো গাড়ি। কেবল ল্যাপটপটা নিলাম, আর কিছু নেওয়ার সময় হল না। পুলিশের লোকেরা হাতে টিকিট দিলেন বিমান বন্দরে। এভাবেই কলকাতা আমাকে গুডবাই জানালো। স্টালিন বুঝি এভাবেই মানুষকে গুলাগ পাঠাতো। স্টালিন তাদেরই পাঠাতো, যারা কট্টর স্টালিন বিরোধী ছিল। কিন্তু আমি তো বুদ্ধবিরোধী ছিলাম না।
তারপর তোজয়পুরে পৌঁছে বুঝলাম, বিনীতবাবু এবং তার জয়পুরী দূত যা বলেছিলেন সব ভুল। জয়পুরের পুলিশদের বলা হয়েছে আমি কোনও এক সাহিত্য অনুষ্ঠানে যোগ দিতে এসেছি, আমাকে একটি সস্তা হোটেলে তোলা হল, ওই হোটেল বিনীত গোয়েল আর জয়পুরী দূত কলকাতা থেকেই ঠিক করে রেখেছেন। গভীর রাতে পুলিশ আমাকে জানিয়ে দিল যে আমাকে রাজস্থান থেকে চলে যেতে হবে, কারণ ল এন্ড অর্ডার প্রবলেম শুরু হবে বা শুরু হয়ে গিয়েছে। গা হিম হয়ে গেল। ঠিক আছে, কলকাতায় চলে যাবো। কিন্তু দেখি ভোরবেলা আমাকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে এয়ারপোর্টে নয়, কলকাতার পথে নয়, দিল্লির পথে। উড়োজাহাজে নয়, গাড়িতে। কেন, সে পরে জেনেছি, রাজস্থানে যেমন আমাকে লাথি দিয়ে ফেলা হয়েছিল পশ্চিমবঙ্গ থেকে, তেমনি রাজস্থান থেকেও একই রকম লাথি দিয়ে আমাকে পশ্চিমবঙ্গে ফেলতে চেয়েছিল রাজ্যসরকার। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গ জানিয়ে দিয়েছে, বল যেন তার এলাকায় এসে না পড়ে। বল তারা চায় না। অতএব ডাম্প করতে দিল্লি, কেন্দ্র। কোনও নো ম্যানস ল্যান্ডের দিকে, উদ্বাস্তু, রাজ্যহারা, এতিম, অনাথ, অসহায়কে নিয়ে চললো পুলিশ। বসে আছি পথ চেয়ে, কবে ফিরবো কলকাতা। আপনি যদিও জানিয়ে দিয়েছেন যে আপনি কিছু জানেন না আমার বিষয়ে, জানে কেন্দ্র, সিদ্ধান্ত নেবে কেন্দ্র। আসলে কিন্তু কেন্দ্রকে নিজের সিদ্ধান্তটি আপনি দিয়েই রেখেছেন, আপনি আমাকে চাননা কলকাতায়, চাননা পশ্চিমবঙ্গে।
লোকে বলে, আপনার ভয়, আমি পশ্চিমবঙ্গে বাস করলে আপনি মুসলমান ধর্মান্ধদের সমর্থন পাবেন না, না পেলে পুরো মুসলমান জাতটারই ভোট পাবেন না। তাই আমাকে তাড়িয়ে দিয়ে ভোট নিশ্চিত করেছেন। ধর্মান্ধতা ঘোচানোর জন্য আমি লিখি, আপনি আমাকে সমর্থন না করে সমর্থন করলেন উন্মত্ত ধর্মান্ধতাকে। ওদের জিতিয়ে দিলেন। ওরা কি আপনাকে ভালোবাসে বলে আপনি মনে করেন? ওরা কি নিজেরাই ফ্রাঙ্কেনস্টাইনের মতো আপনার মুণ্ডু চাইবে না একদিন?
কলকাতায় বাড়িঘর পড়ে আছে, আমার লেখালেখি সব পড়ে আছে। সবকিছু থেকে বিচ্ছিন্ন আমি, নিজের জীবন থেকে বিচ্ছিন্ন, আমি ঠিক কোথায় আমি জানি না। এখানে আপনার অনুমতির অপেক্ষায় কত দিন বসে থাকতে হবে আমি জানি না। আপনি কবে আমাকে বাড়ি ফিরতে অনুমতি দেবেন জানি না। হতাশায়, অনিশ্চয়তায়, অস্থিরতায় আমি পাগল হয়ে যাচ্ছি। আমার রক্তচাপ বাড়ছে, প্রচন্ড উদ্বেগ আর উৎকণ্ঠা আমাকে আত্মহত্যা করতে প্ররোচিত করছে। আপনি খুশি হবেন, তাই আমি আপনার চক্ষুশূল ওই ‘দ্বিখন্ডিত বইটির যে লাইনগুলোকে সহ্য করতে পারতেন না, তুলে নিয়েছি। না, মৌলবাদীদের ভয়ে আমি আমার লেখা তুলে নিইনি। আমি ভয় করেছি আপনাদের, ভয় করেছি সেকুলার এবং গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দলগুলোকে, ভয় পেয়েছি আশ্রিতের জন্য যে ধর্ম বেঁধে দেওয়া হয়েছে, সেটিকে। ভয় পেয়েছি অগুনতি শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষের ভয়াবহ মুখ বুজে থাকাকে। মত প্রকাশের স্বাধীনতা আমার নিজের দেশে ছিল না বলেই তো আমি আজ নিজের দেশের বাইরে, এখানে আমি সেই অধিকার পাবো বলেই তো আজ আমি এখানে। একটি গণতন্ত্র যদি আমাকে অধিকারটি না দেয়, কে দেবে? আমাকে যে মুখ বুজে থাকতে বলা হল, আমাকে যে বাধ্য করা হল নিজের লেখাকে অস্বীকার করতে, নিজের বই ছিঁড়ে ফেলতে, এ কার অপমান? আমার?
বুদ্ধবাবু, আমার বিশ্বাস হয় না আমার কারণে আপনার দলের ভোট পাওয়ায় কোনও হেরফের হবে। আপনার দল খুব শক্তিশালী দল। ভয় পাবেন না, আপনার দল যে কোনও নির্বাচনেই জিতে যাবে। তারপরও যদি আপনার বিশ্বাস হয়, যে, আমাকে তাড়িয়েছেন বলে দুটো ভোট আপনার বেশি হতে যাচ্ছে, তাহলে সেই ভোট আপনার নির্বিঘ্নে জুটুক, আপনার আরাম হোক। ভোট শেষ হলে, আপনি বিজয়ী হলে আমাকে আমার ঘরে ফিরতে দেবেন তো! অপেক্ষা করছি আপনার অনুমতির। কোনও ক্ষতি আমি আপনার করিনি। করতে চাই না। আমাকে শুধু নিরুপদ্রব নিজের লেখালেখি নিজের মতো করতে দিন। আমি আপনার শত্রু নই। শত্ৰু তারা, ওই মৌলবাদী, যাদের বন্ধু বলে জড়িয়ে ধরেছেন আপনি, সমাজকে অন্ধকার আর কুসংস্কার আর ভয়াবহ সংকীর্ণতা দিয়ে গ্রাস করতে চাইছে, এ আপনি জানেন না, আমি বিশ্বাস করি না।
আপনি যদি বিশ্বাস করেন সত্যিকার সেকুলারিজমে, সমতায়, সততায়, সাহসে, তবে আমাকে বন্ধু বলে মনে করতে আপনার তো অসুবিধে হওয়ার কথা নয়। ভোটই জগতের এবং জীবনের শেষ কথা নয়। মানবতা বলে একটি কথা আছে, আদর্শ বলেও একটি কথা আছে। সেসব খুইয়ে ফেললে কী আর থাকে। জেতে তো কত রাজাই। রাজারা সিংহাসন থেকে আবার কখনও কখনও খসেও পড়ে। রাজা কতদিন সিংহাসনে ছিল, তা দিয়ে রাজার চরিত্র বিচার হয় না। রাজার কাজ দিয়েই রাজার চরিত্র বিচার হয়।
তসলিমা
.
১০ ডিসেম্বর
‘তসলিমাকে এভাবে আটক করে রাখাটা ভারতের মতো একটি দেশের জন্য অত্যন্ত মর্যাদাহানিকর। সাম্প্রতিককালে যেসব ঘটনা ঘটেছে তার সঙ্গে তুলনা করলে বলা যায় এই ঘটনা আমাদের খুব ছোট করে দিয়েছে।.. Taslima has suffered too much and has gone through prolonged distress and agony. This must be brought to an end without delay. She should also, without much ado, be allowed to return to Kolkata, her preferred place for stay. Moreover, she should be granted Indian citizenship before her current visa expires so that her creative work does not suffer and she is never again rendered fugitive and stateless. The award of citizenship would also make it easier for her to protect her rights. In urging this, I am not alone; hundreds of millions of Indians desire likewise.’
-Muchkund Dubey
আজ মানবাধিকার দিবস। দীর্ঘ দীর্ঘ দীর্ঘশ্বাস ফেলছি জীবনের কথা ভেবে। দীর্ঘ তেরো বছরের নির্বাসন জীবন আমার। আজও নিজের দেশ বাংলাদেশে যাওয়ার এবং বাস করার কোনও অধিকার আমার নেই। কী কারণে বাংলাদেশ সরকার আমার নাগরিক অধিকার লঙ্ঘন করছে, তা কোনওদিনই আমাকে জানানোর প্রয়োজন মনে করেনি।
আজ মানবাধিকার দিবস। আমি পড়ে আছি প্রিয় বাংলা থেকে শত শত মাইল দূরে অজানা একটা ঠিকানায়। পূর্ববঙ্গও নির্বাসন দিল, পশ্চিমবঙ্গও পাঠালোনির্বাসনে। বাংলায় আমার ঠাঁই নেই। আমি কোথায় আছি তা কেউ জানবে না, তা কারও জানার নিয়ম নেই। কেউ আমার সঙ্গে দেখা করতে পারবে না। আমিও কারও সঙ্গে দেখা করতে পারবো না।
একা একা সকাল হয়। একা একা দুপুর, বিকেল। একা একা রাত হয়। মানবাধিকার দিবস জুড়ে বসে থাকি এক জীবন অধিকারহীনতা নিয়ে। অসহায়। অনাথ। অবলা। হ্যাঁ অবলাই তো। কথা বলার অধিকারও তো আমার নেই। আমি যেন কথা না বলি। কথা বলার অধিকার বা মত প্রকাশের অধিকারকেও তো মানবাধিকার বলে। কথা না বলতে বলতে, মত প্রকাশ না করতে করতে আমার মনে হচ্ছে, আমি ভুলে যাব কথা বলতে। আমি ভুলে যাবো ভাবতে। ভুলে যাবো নিজের কোনও মত যে থাকতে হয়, ভিন্ন মত হলেও যে থাকতে হয়, এবং তা প্রকাশ করতে হয়, তা। ভুলে যাবো মানবাধিকারের মূল অর্থ কী। প্রতি বছর দশই ডিসেম্বর যাবে, আসবে। আমার কিছু যাবে আসবে না।
আজ রাতেই এলেন প্রভু। প্রভু আসা মানে নতুন কোনো খবর আসা। মূলত যা বললেন, তা হল, সুদূর সুইডেন থেকে আমার সঙ্গে দেখা করতে আসছেন মিস্টার সুয়েনসন, তাঁকে আমার অজ্ঞাত ঠিকানায় আনার কোনও অধিকার আমার নেই, এমনকী আমারও অধিকার নেই তার হোটেলে গিয়ে তার সঙ্গে দেখা করার, যদি দেখা করার অনুমতি প্রার্থনা করে আমি দরখাস্ত করি, এবং যদি ওপরওয়ালা রাজি হন, তবে বড়জোর ঘণ্টাখানেকের জন্য তৃতীয় কোনও জায়গায় দু’জনকেই পৃথক পৃথক ভাবে নিয়ে গিয়ে দুজনের দেখা করাবার একটি ব্যবস্থা করা হবে। এর বেশি কিছু যেন আমি আশা না করি। ওপরওয়ালা এখানে ভগবান জাতীয় কিছু নন, সত্যি বলতে কী, ভগবানের চেয়েও শক্তিমান।
দুনিয়া জুড়ে মত প্রকাশের স্বাধীনতা আর ব্যক্তিগত স্বাধীনতার আবশ্যকতা নিয়ে বলছি সেই কতকাল, বিভিন্ন মঞ্চে, বিশ্ববিদ্যালয়ে। কত শত মানুষ কত শত দেশে অনুপ্রাণিত হচ্ছে। আর আমাকে কি না কোনো একটা ঘরে আটকে রেখে বলা হচ্ছে, এ করা যাবে না, ও করা যাবে না? যাঁরা আমাকে বন্দি করছেন এবং নানারকম নিষেধাজ্ঞা প্রয়োগ করছেন, শেকল পরাচ্ছেন পায়ে, চোখ বেঁধে রেখেছেন কাপড়ে, তাঁরা আদৌ জানেন না আমি কে, কোনোদিন শোনেননি আমার সামান্য ইতিহাস!
আমার তো কলকাতায় থাকার কথা ছিল, সুয়েনসনের কলকাতায় আমার কাছে বেড়াতে আসার কথা ছিল। আমি কলকাতায় থাকলে তো সুয়েনসন নিশ্চিন্তে নির্বিঘ্নে আমার কলকাতার বাড়িতে আমার সঙ্গে ক’দিন কাটাতে পারতো। স্টকহোম-কলকাতা টিকিট ছিল তার। তিন চার মাস আগেই করে রাখা টিকিট। আমি দিল্লিতে আছি শুনে কলকাতা বদলে গন্তব্য দিল্লি করে নিয়েছে শুধু। তাকে বলেছি ফোনে, দিল্লিতে আমি অনেকটা গৃহবন্দি অবস্থায় কাটাচ্ছি, তোমার সঙ্গে দেখা করা সম্ভব হবে কি না জানি না। সুয়েনসন খুশি নয় আমার কথায়। তার বক্তব্য, ওঁরা যা বলছেন, তা কেন আমি মেনে নিচ্ছি! কেন আমি যে করেই হোক তাকে আমার কাছে রাখায় যে বাধা তৈরি করা হচ্ছে, তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছি না! যুদ্ধ করা আমার পক্ষে সম্ভব নয় জেনেও সুয়েনসন টিকিট বাতিল করেনি। সস্তা টিকিট বাতিল করলে টাকা ফেরত পাওয়া যায় না। দিব্যি উড়ে চলে এলো।
আমার এই মানসিক অবস্থায় হাতে গোনা দু’একজন বন্ধুর সঙ্গে আমি যদি দেখা করতে না পারি, তাহলে কী ধরনের জীবন আমি যাপন করবো এখানে, এই অজ্ঞাতবাসে? আমি তো স্বাস বন্ধ হয়ে মারা পড়বো! অন্তত কলকাতার বন্দি জীবনে বন্ধুরা আসতে পারতো আমার বাড়িতে। এখানে তো জগৎ থেকে বিচ্ছিন্ন আমি। প্রভু একসময় যা বললেন, প্রসূন মুখার্জির কথার মতো লাগলো শুনতে, বললেন, ‘এত যখন উনার সঙ্গে দেখা করার আপনার প্রয়োজন, আপনি সুইডেনে গিয়ে দেখা করে আসুন না! তাহলে কি ওঁরা এই-ই চাইছেন যে আমি এ দেশ ছেড়ে চলে যাই?
আহ, আজ তো মানবাধিকার দিবস! প্রভু কি জানেন আজ মানবাধিকার দিবস!
.