What's new
Nirjonmela Desi Forum

Talk about the things that matter to you! Wanting to join the rest of our members? Feel free to sign up today and gain full access!

Collected দ্বিখণ্ডিত (আত্মজিবনী) (2 Viewers)

dwikhondito-360x57080578f7807d2642f.jpg


দ্বিখণ্ডিত, ২০০৩ সালে প্রকাশিত তসলিমা নাসরিনের আত্মজীবনীর তৃতীয় খণ্ড। পশ্চিমবঙ্গে এটি “ক” নামে প্রকাশিত হয়।
 
১৬. পক্ষে বিপক্ষে



আনন্দ পুরষ্কার পাওয়ার পর লেখক বুদ্ধিজীবিদের মধ্যে অনেকে আমাকে অভিনন্দন জানান। কেউ কেউ জানান ঘৃণা। মৌলবাদী গোষ্ঠী প্রচার করছে যেহেতু আমি ইসলামের বিরুদ্ধে লিখি তাই বড় আনন্দে হিন্দু মৌলবাদী গোষ্ঠী আনন্দবাজার আমাকে পুরষ্কার দিয়েছে। আনন্দবাজার পত্রিকা হিন্দু মৌলবাদী গোষ্ঠীর পত্রিকা এ আমি আগে শুনিনি। এ যাবৎ যত লেখা আনন্দবাজার এবং দেশ পত্রিকায় পড়েছি, কখনও কোনও লেখা পাইনি যেখানে হিন্দু মৌলবাদীর পক্ষে কোনও কথা আছে বরং হিন্দু মৌলবাদীর বিপক্ষেই লেখা ছাপা হয় পত্রিকাগুলোয়। কেউ কেউ বলেছে, কোনও এক কালে আনন্দবাজারের ভূমিকা ছিল মুসলমানবিরোধী, সেই কোনও কালে আমার জন্মও সম্ভবত হয়নি, আমি এর দায় নিই কী করে! সম্পাদক বদলায়, প্রকাশক বদলায়, নতুন নতুন সাংবাদিক যোগ হন, পত্রিকার চরিত্র আদর্শও সেই সঙ্গে বদলায়। বাংলাদেশে যে পত্রিকা এক সময় দেশ স্বাধীনের বিরুদ্ধে লিখত, সেই পত্রিকাই এখন পক্ষে লিখছে, এর কারণ পুরোনো কালের মানুষ সরে গিয়ে নতুন কালের মানুষ এসেছে পত্রিকায়, পত্রিকার নাম ঠিকানা একই আছে, কিন্তু লেখা আগের চেয়ে আলাদা, মূল্যবোধ ভিন্ন। দ্বিতীয় অভিযোগটি হল আমি র এর এজেন্ট। গুজবের মত সংক্রামক আর কিছু নেই বোধহয়। ইনকিলাব আজ লিখল আমি র এর এজেন্ট, পরদিন দশটি পত্রিকায় লিখে ফেলে আমি র এর এজেন্ট।

রি কি?’ এই প্রশ্নটি মনে উঁকি দেয়। মিলনের কাছে জিজ্ঞেস করি, ‘মিলন র কি?’

মিলন বলে, ‘বুবু আপনে র মানে কি বুঝেন না! র তো হইল .. ‘

‘র তো হইল কি?’

‘মানে ধরেন র চা। দুধ না মিশাইয়া চা বানাইলে তো র চা -ই হয়। ধরেন আমগর কম্পানিতে র মাল আমদানি করে, পরে এই র মাল গুলা দিয়া প্রসেস কইরা কেমিকেল প্রডাক্ট বানানি হয়।’

‘কিন্তু র এর এজেন্ট মানে কি?’

‘মনে হয় বিদেশ থেইকা র মাল টাল আনার এজেন্ট।’

‘কিন্তু আমি তো কোনও র মাল আনার এজেন্ট না!’

‘লেখছে আর কী! আপনেরে নিয়া আজাইরা কত কথাই ত লেকতাছে ওরা।’

‘কিন্তু মিলনরে এর এজেন্ট বইলা আমারে গালি দিব কেন? মানুষ তো বিদেশি কত জিনিস পত্র আনে, তারা ত গালি খায় না!’

‘দিছে আপনেরে গালি। মনে করছে নিষিদ্ধ কোনও র মাল আনেন।’

‘নিষিদ্ধ মাল?’

‘এইটা বুঝেন না বুবু!’ মিলন বিজ্ঞের মত মাথা নাড়ে। ‘বাংলাদেশে কি বিদেশের সব র মাল আসা লিগাল নাকি? কিছু ত নিষিদ্ধ মাল আছেই!’

‘যেমন?’

‘ধরেন ফেনসিডিল, কাশির ওষুধ। ফেনসিডিল খাইয়া পুলাপান নেশা করে। ইণ্ডিয়া থেইকা ফেনসিডিল আনে চুরাকারবারিরা। এহন যদি আপনি ফেনসিডিল আনেন, তাইলে কি তা নিষিদ্ধ না?’

‘কিন্তু ফেনসিডিল তো কোনও র জিনিস না। ওষুধ। বোতলের ওষুধ।’

‘ওই ফেনসিডিল বানানির মাল যদি আনেন হেইডা ত র ই। ঘরে বইয়া বানাইলেন।’

‘তাইলে আমারে চুরাকারবারি বা ইললিগাল ব্যবসায়ী কইতে পারত। র এর এজেন্ট কয় কেন?’

‘মনে করছে আপনের কোনও গ্রুপ আছে। গ্রুপটা র মাল আনে। আপনে জড়িত আছেন গ্রুপ এর সাথে।’

‘কিন্তু আমি ত এইরকম কোনও গ্রুপের সাথে জড়িত না।’

‘জড়িত থাকতে হইব নাকি! ওরা আপনের বিরুদ্ধে লিখতে চায়। এহন যেইডা লিখলে জনগণের মন আপনের দিকে বিষাক্ত হইয়া উডে, সেইডা লিখতাছে।’

মন থেকে র যায় না। র এর এজেন্ট আমি। আমার সঙ্গে যাদের ওঠা বসা, তারা কেউ এ ধরণের ব্যবসা করে না। তবে কেন আমাকে র এর এজেন্ট বলবে! অনেকদিন আমি মীমাংসাহীন র র মন নিয়ে বিষণ্ন বসে থাকি। মাস গেলে পর একদিন খসরু এলে তাকেই জিজ্ঞেস করি, ‘আচ্ছ! খসরু ভাাই, র কি?’ খসরুর সঙ্গে আমার পরিচয় শিপ্রার মাধ্যমে। লোকটি ব্যবসায়ী, দুটো ইঞ্জিনিয়ার বন্ধু নিয়ে এনার্জি প্যাক নামে একটি জেনারেটর তৈরির কারখানা দিয়েছে। মতিঝিলে অফিস। প্রায়ই আমার বাড়িতে আসেন। কেমন আছি না আছি জানতে চান।

রি মানে? কি ব্যাপারে র?’ খসরু জানতে চান।

‘আমারে বলে আমি নাকি র এর এজেন্ট।’

খসরু অট্টহাসি হাসেন।

‘তোমারে র এর এজেন্ট বলতাছে, আর তুমি নিজে জানো না র কি? এইটা কোনও কথা হইল?’

মিলনের সংজ্ঞাটি গলগল করে মুখে এসে যায়। তার আগেই খসরু বলেন, ‘র হইল ইন্ডিয়ার ইণ্টেলিজেন্স এজেন্সি ! আমেরিকার যেমন সিআইএ। ভারতের তেমন র।’

আমি তাজ্জব হয়ে বসে থাকি। ‘তাই নাকি!’

‘তুমি নিশ্চয়ই জানো।’

‘না আমি জানতাম না।’

‘বল কি? তোমার পেছনে যে স্পেশাল ব্রাঞ্চের লোক ঘুরে, তা জানো? তুমি যেইখানে যাও, তোমারে ফলো করে।’

‘নাহ! ক্‌ই। আমি তো দেখি নাই! মানে পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চ! কন কি!’

‘দেখ গিয়া বাড়ির সামনে একজন হাঁটতেছে। তোমার বাসায় কে আসতেছে, বাসা থেকে কে কোথায় যাচ্ছে, সব খবর রাখতেছে।’

আমার শরীর ঠাণ্ডা হয়ে যায়। কি অন্যায় করেছি আমি যে আমাকে র এর এজেন্ট বলবে। পুলিশের গোয়েন্দা বাহিনী আমার পেছনে লেগে থাকবে! অন্যায়টি খুঁজতে থাকি। অন্যায় খুঁজে পাই না। এ দেশের রাজনীতি হয় ভারত বিদ্বেষ দিয়ে, যে যত বেশি ভারত বিদ্বেষ দেখাতে পারবে, সে তত ভোট পাবে। দেশের মানুষের কথা ভাবার জন্য রাজনীতিবিদ নেই বললেই চলে। আমার পেছনে যে চর লাগা, তা ভারতীয় দূতাবাসের এক অনুষ্ঠানে যাওয়ার সময়ই লক্ষ করি। একটি সাদা গাড়ি আমার রিক্সার পেছন পেছন সারা পথ গেল। আমার গতিবিধি সরকারি নথিভুক্ত হচ্ছে। আমি শান্তিনগর বাজারে গিয়ে ফুলকপি আর পুঁটিমাছ কিনলেও পেছনে সরকারি বাহিনী যাবে। ঘাড়ের কাছে আমি টের পাই কারও কারও নিঃশ্বাস। আমার ভয় হতে নিয়েও হয় না। আমি জানি আমি কোনও মূল্যবান মানুষ নই। ডাক্তারি করি, অবসরে লিখি। এমন কোনও ডাক্তারি নয়, এমন কোনও লেখা নয়। ভাল ডাক্তার হতে গেলে এফসিপিএস পাশ করতে হয়। ভাল লেখক হতে গেলে বাংলা সাহিত্যে অঢেল জ্ঞান থাকা চাই। আমার এফসিপিএসও হয়নি। সাহিত্যের অঢেল জ্ঞানও নেই।

বিচিন্তা পত্রিকাটি ফলাও করে ছেপেছে সুকুমারী থেকে চুরি। আমার বইয়ের লেখাগুলো আমার নয়, অন্যের। সুকুমারী থেকে চুরির জন্য যে শাস্তি আমার পাওনা, সে আমি মাথা পেতে গ্রহণ করতে রাজি আছি। কিন্তু চুরি বিশারদরা বলতে শুরু করেছেন নির্বাচিত কলাম বইটিতে ইসলামকে গাল দিয়েছি আমি, পুরস্কার পাওয়া তো আমার উচিত হয়ইনি, আমার শাস্তি পাওয়া উচিত। যে লেখা আমার নয়, অন্যের, সে লেখার জন্য আমি শাস্তি পেতে যাবো কেন! কিন্তু শাস্তির দাবি তারা করে এবং তখন কিন্তু একটুও অনুমান করে না যে যেসব লেখার কারণে তারা আমার শাস্তি দাবি করছে, সেসব আমার নিজের না হয়ে অন্যের হতে পারে। আমার শাস্তির দাবি না করে তো সেই অন্যের শাস্তির দাবি তাদের করা উচিত! কিন্তু না, তারা আমাকেই শাস্তি দেবে। গ্লানির গভীরে ডুবে থাকা আমাকে কে যেন ডেকে তোলে। কে যেন আমার কানে কানে বলতে থাকে, বেদ সম্পর্কে মন্তব্য তোমার নিজের না হলেও ইসলাম সম্পর্কে মন্তব্য তো তোমার নিজের! মূলত বইটি কি বেদ নিয়ে, নাকি মুসলমান সমাজে নারীর অবস্থা নিয়ে লেখা? আমি ক্লান্ত কণ্ঠে বলি, লেখাগুলো তো আমার এবং আমার চারপাশের জীবনের কথা। কানে কানের কেউ বলে, শাস্তি সে কারণে তোমাকেই দিতে চাইছে, সুকুমারীকে নয়। যদিও ডাক শুনে উঠেছি, আমার বিস্মিত চোখ লক্ষ করে আমার আগের উচ্ছঅল উজ্জ্বল পরিবেশটি কোথায় যেন হাওয়া হয়ে গেছে। আগে যারা আমার লেখা নিয়ে বলত যে আমি ভাল লিখছি, চমৎকার লিখছি, তারাই এখন দোষ ত্রুটি ধরছে আমার লেখায়। দোষ ত্রুটি ধরছে কারণ আমি পুরস্কার পেয়েছি। পুরস্কার পাওয়ার লেখকের লেখার মান যে উঁচুতে থাকে, সেই উঁচুতে আদৌ আমার লেখা আছে কি না তা তারা বিচার করে দেখছে। বিচারে হার হচ্ছে আমার। আনন্দ পুরস্কার আমাকে একটি অদ্ভুত অচেনা জগতে টুপ করে ফেলে দিয়েছে। বড় একা লাগে নিজেকে। যেন একটি সিন্দুকের ভেতর আমাকে আর আনন্দ পুরস্কারটিকে পুরে সিন্দুকটি বন্ধ করে দিয়েছে কেউ, আমার নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হতে থাকে।

কলকাতায় যখন আমাকে নিয়ে উচ্ছঅ!স খুব প্রচণ্ড, নির্বাচিত কলাম বেরোনোর সঙ্গে সঙ্গে আশাতীত রকম বিক্রি হতে শুরু করেছে। তখনই খবর বেরোলো যে আমি চুরি করে বই লিখেছি। চৌর্যবৃত্তির খবর এক দেশ থেকে ঝড়ো হাওয়ায় উড়ে আরেক দেশে খুব দ্রুত চলে যায়। বিচিন্তার খবর হুবুহু ছাপা হয়ে যায় কলকাতার পত্রিকায়। আনন্দবাজার বিরোধী পত্রিকাগুলোর জন্য এ চমৎকার এক খবর বটে।সুকুমারী থেকে চুরি নিয়ে কলকাতায় খুব বেশি না হলেও কিছু কাণ্ড ঘটে গেছে। নারীবাদী লেখিকা মৈত্রেয়ী চট্টে াপাধ্যায় আমার এই চুরি নিয়ে মুখর হয়ে উঠলেন। কেন আমি চুরি করতে গেলাম, কেন তথ্য স্বীকার করিনি সুকুমারীর বইয়ের সে নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। পণ্ডিত শিব নারায়ণ রায় মৈত্রেয়ীর প্রতিবাদ করে লিখলেন, দৈনিক পত্রিকার কলামে তথ্য স্বীকারের প্রয়োজন হয় না, হত গবেষণামূলক কোনও গ্রন্থ, কথা ছিল। শিব নারায়ণ রায় আনন্দ বাজার পত্রিকায় বড় একটি লেখাও লিখলেন, মিথ্যে কলংক রটিয়ে এই তীক্ষ্ণ কলমকে ভোঁতা করা যাবে না। কলকাতায় না হয় একটি রফা হল। কিন্তু বাংলাদেশে চোর চোর বলে কিছুদিন গালাগাল করে বইয়ের কোথায় কোথায় কোরান হাদিস সম্পর্কে আমি কী বলেছি তা নিয়ে পড়ল। মামলা ঠুকে দিল আমার বইয়ের প্রকাশকদের বিরুদ্ধে। যেসব পত্রিকায় লিখি, সেসব পত্রিকার সম্পাদক প্রকাশকদের বিরুদ্ধেও মামলা। প্রকাশ্যে বই পোড়ানো হল। বইয়ের দোকানগুলোয় হুমকি দিয়ে এল আমার বই বিক্রি করলে মাথা ফাটিয়ে দেবে। ইনকিলাব পত্রিকায় একজন লিখলেন, আমার ফাঁসি হওয়া উচিত। ফাঁসি! এ আর এমন কী নতুন দাবি! সাধারণত রাজনৈতিক জঙ্গী মিছিলে অসৎ রাজনৈতিক নেতাদের ফাঁসি চাওয়া হয়। ফাঁসি তো আর সত্যিকার হয় না। মনের রাগ প্রকাশ ফাঁসি চাই বলেই প্রকাশ করার অভ্যেস মানুষের।— প্রবোধ দিই নিজেকে। কিন্তু কোথায় যেন কিসের একটা কাঁটা বিঁধে থাকে।

নারীর ওপর নির্যাতন নিয়ে লিখছিলাম, লোকে বাহবা দিচ্ছিল। কিন্তু যখনই নারীর ওপর নির্যাতন কেন হয়, তা তলিয়ে দেখতে গিয়ে ধর্মের কথা বলেছি, তখন দেখি আমি আর বাহবা পাচ্ছি না। মৌলবাদিদের কথা বলছি না, যাঁরা পাঁচ বেলা নামাজ পড়েন না, রোজা করেন না, দাড়ি কামিয়ে, সুটেড বুটেড হয়ে নিজেদের প্রগ্রেসিভ আখ্যা দিয়ে ঘুরে বেড়ান, যে মেয়েরা বেআব্রু চলাফেরা করেন, পরপুরুষের সঙ্গে মেলামেশাও করেন অনায়াসে, গানবাজনা কালচার ইত্যাদি নিয়ে আছেন, এবং সবচেয়ে বড় কথা, যে মেয়েরা নারীমুক্তির আন্দোলন করছেন যুগ যুগ ধরে, সংস্থা খুলেছেন, সমিতি বানিয়েছেন, তাঁরাও ভুরু কপালে তুলে বলেন, ‘মেয়ের সাহস কত দেখ! ধর্মের বদনাম করছে। মৌলবাদিদের কার্যকলাপ নিয়ে লিখছিল, সে না হয় ভাল, কিন্তু ধর্মকে টানা কেন! ধর্ম দোষটা কি করেছে!’ আমার সমর্থকরাও আমার বিরোধী হয়ে উঠল। কোনও ধর্ম বিশ্বাসের বালাই যেন যাঁদের, নারী পুরুষের সমতায় যাঁরা বিশ্বাস করেন, কেবল বিশ্বাস করলেই হয় না, যাঁরা সংষ্কারমুক্ত, অসাম্প্রদায়িক—তাঁরাই কেবল আমাকে সমর্থন করছেন। অবশ্য সকলে নয়। আহমদ ছফা, লেখক বুদ্ধিজীবী ইত্যাদি নানা নামে ভুষিত তিনি, দিব্যি জাঁকিয়ে বসেছেন আমার বদনাম করার জন্য। কাগজে নিরবধি লিখে যাচ্ছেন আমার বিরুদ্ধে। আহমদ ছফাকে আমি রুদ্রর মাধ্যমে চিনি, রুদ্র বেশ ভক্ত ছিল ছফার। ছফা দেখতে অনেকটা মামদো ভুতের মত। মামদো ভুত আমি কখনও দেখিনি। কিন্তু ছোটবেলায় মামদোভুতের গল্প যখন শুনতাম, ঠিক এরকম একটি মানুষের মত দেখতে অথচ মানুষ নয় কিছুর আমি অনুমান করতাম। প্রথম যেদিন আমি ছফাকে দেখি, সেদিনই রুদ্রকে বলেছিলাম, তোমার এই ছফা ভাই দেখতে এমন কেন? দেখতে কেমন? রুদ্র বলেছিল। বলেছিলাম, দেখতে কেমন যেন মামদো ভুতের মত। রুদ্র আমার এই বেফাঁস মন্তব্যের উত্তরে বলেছে, ছফার মত জ্ঞানী লোক খুব কমই আছেন এ দেশে। ছফার প্রতি রুদ্রর শ্রদ্ধার একটি কারণ ছিল, রুদ্রর প্রথম বই ছাপতে ছফা সাহায্য করেছিলেন। রুদ্র ছফাভক্ত, ছফা যেমনই দেখতে হোক না কেন। ছফা লিবিয়ার টাকা খেয়ে ইসলাম ইসলাম জপ করছেন বলে বাজারে গুঞ্জন ছিল। রুদ্র ওসব কথায় কান দেয়নি। আমাদের রাজাবাজারের বাড়িতে ছফা এসেছেন দুদিন, রাতে থেকেওছেন। বিকট সুরে যখন এক রাতে গান গাইতে শুরু করলেন, আমি ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। ভয় পেলেও ভক্তি জিনিসটি সংক্রামক। রুদ্রর ছফাভক্তি আমার ভেতরেও খুব দ্রুত ছড়িয়ে গেল। আমিও, যেমনই যেখতে হোন তিনি, তাঁকে ভক্তি করতে শুরু করলাম। কোনওকালেও বিয়ে না করা লোকটি নানারকম মেয়েদের নিয়ে গল্প করতেন। কলকাতার এক সুন্দরী মেয়ে ইন্দিরা ছফার প্রেমে পাগল হয়ে গিয়েছে, ছফা তাঁর মামদোভুতো মুখে প্রেমের সব বিচিত্র কাহিনী বর্ণনা করেন তাঁর ভক্ত শ্রোতার উপস্থিতিতে। পরে এই ইন্দিরাকেই একসময় বিয়ে করে নিয়ে আসেন মৃদুল চক্রবর্তী, ইত্যাদির আড্ডায় মাঝে মাঝে আসা গানের ছেলে মৃদুল। কেবল গানের ছেলেই নয়, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছেলেও বটে, মাস্টারি করেন। ছফার সঙ্গে বিভিন্ন দূতাবাসের মাখামাখি আছে, বিশেষ করে জার্মান দূতাবাসের। গ্যাটের ফাউস্ট বইটি অনুবাদ করে ফেললেন একদিন। রুদ্রর সঙ্গে বিচ্ছেদের পরও আমার সঙ্গে মাঝে মাঝে ছফার দেখা হত। দেখা হত মূলত ইত্যাদিতে। একসময় আমার কবিতা অনুবাদ শুরু করলেন তিনি। আমাকে তাঁর বাড়িতে নেমন্তন্নও করেছেন। ফাউস্টের অনুবাদক করছেন আমার কবিতার অনুবাদ! কবিতার ভূয়সী প্রশংসা করে আমাকে রীতিমত ভয় পাইয়ে দেন ছফা। এমন কবিতা নাকি লেখা হয়নি বাংলা সাহিত্যে। আমার কবিতা সারা বিশ্বে অনুবাদ হওয়া উচিত। তাঁর ইচ্ছে আমার কবিতার একটি ইংরেজি অনুবাদের বই তিনি ছাপবেন। এমন যাঁর আবেগ তিনি কি করে এমন হঠাৎ বদলে গেলেন, সুনামের সমুদ্র থেকে বদনামের বিলে ঝাঁপ দিলেন! এটি একটি প্রশ্ন বটে। আমি আনন্দ পুরষ্কার পেলাম, তাতে তাঁর এত মনোকষ্ট হওয়ার কারণ কি! ছফাকে একদিন আমি আমার আরমানিটোলার বাড়িতে রাতের খাবারের আমন্ত্রণ জানিয়েছিলাম। মিটফোর্ড হাসপাতাল থেকে বাড়ি ফিরে দেখি লিলি নেই। দরজা হাঁ হয়ে আছে, ভেতরে সব আছে, কেবল তিন ফুট তিন ইঞ্চি, গোলগাল মুখ, গায়ের রং কালো, পরনে সবুজ হাফপ্যান্ট, লাল জামাটি নেই। নেই তো নেই, কোথাও নেই। দক্ষিণা হাওয়ায় কোথায় হারিয়ে গেছে কে জানে। পাতিপাতি করে পাড়া খুঁজে, আত্মীয় বন্ধুদের বাড়ি খুঁজে, রাস্তাঘাটনদীরপাড় খুঁজে থানায় ডায়রি করে রাতে যখন বাড়ি ফিরলাম, এর মধ্যে দুঘন্টা দারোয়ানের ঘরে বসে অপেক্ষা করে চলে গেছেন আহমদ ছফা। সে রাতে অবশ্য আরমানিটোলার রাস্তায় উদাসীন দাঁড়িয়ে থাকা লিলিকে পাওয়া যায়। আহমদ ছফার কাছে সেদিনের ঘটনাটি বলব, ক্ষমা চাইব, তার আগেই তিনি পত্রিকায় লিখে ফেললেন আমার নিন্দা করে একটি কলাম। আনন্দ পুরষ্কার পাওয়ার পর নিন্দা লাগামছাড়া হয়ে উঠল। আনন্দবাজার আর দেশ থেকে প্রথম বাংলা একাডেমিকে পুরষ্কার দিতে চেয়েছিল, বাংলা একাডেমি সে পুরষ্কার নেবে না জানিয়ে দিয়েছিল। এরপর আমাকে যখন নির্বাচন করা হল পুরষ্কারের জন্য, আহমদ ছফা লিখলেন, ‘আসলে তসলিমা নাসরিন কিছুই না। সবটাই ছ্যাবলামো আর চৌর্যবৃত্তিতে ভরপুর। যেহেতু সে মুসলিম সমাজের বিরুদ্ধে লিখেছে সে জন্যে আনন্দবাজার তাকে লাইম লাইটে নিয়ে এসেছে।.. গ্রামের দুই মাতবর প্রতিবছর একজন আরেকজনের বিরুদ্ধে ভোটে দাঁড়ায়। একবার হল কি, এক মাতবর প্রতিদ্বন্দ্বীর ভাবমূর্তি নষ্ট করার জন্য বাড়ির কাজের মেয়েটিকে অন্য মাতবরের বিরুদ্ধে নির্বাচনে দাঁড় করিয়ে দেয়। আনন্দবাজারের কর্মটিকে আমার সেরকম মনে হয়েছিল। যেহেতু বাংলা একাডেমি পুরষ্কারটি প্রত্যাখ্যান করল, সেজন্য ক্ষুব্ধ ব্যথিত হয়ে বাংলা একাডেমির মুখে একটি চপেটাঘাত করার জন্য তাঁরা তসলিমাকে বেছে নিলেন।’

কী ছফা কী হয়ে গেলেন! পত্রিকায় তসলিমাবিরোধী কলাম লিখে আহমদ ছফার শান্তি হল না, পুরো একটি বই লিখে ফেললেন তিনি। আহমদ ছফার লেখার প্রতিবাদ করে একদিন বিরুপাক্ষ পাল লিখলেন একটি কলাম। ‘আহমদ ছফার মত প্রাজ্ঞ সাহিত্যিকের দ্বারা এ ধরনের রূপকের ব্যবহার তাঁর ধৈর্যচ্যূতি ও ঈর্ষামূলক ক্ষোভকে প্রকট করে তুলেছে সর্বসমক্ষে। যৌবনে পুরষ্কৃত বা নন্দিত হওয়ার বিপদ অনেক, কিন্তু এ ধরনের অপবাদমূলক বিপদের জন্য বোধহয় কেউ বোধহয় প্রস্তুত থাকেন না। পুরষ্কার উত্তর পর্বে তসলিমা সংবাদপত্রে অনেক কথা বলেছেন। আহমদ ছফার মতে—আমি মনে করি না তসলিমা এসব কথাবার্তায় যথেষ্ট কাণ্ডজ্ঞানের পরিচয় দিতে পেরেছেন। শুধু তসলিমার দোষ দিয়ে লাভ কি! তথাকথিত অনেক প্রাজ্ঞ ব্যক্তিই তো সংবাদপত্রের কলামে এন্তার আজেবাজে বকে থাকেন। ছফা সাহেব একটু ভেবে দেখবেন কি কথাগুলো তাঁর জন্যও প্রয়োগ করা যায়। তসলিমা নাসরিনের কথাবার্তায় আহমদ ছফা কাণ্ডজ্ঞানের পরিচয় পান না, তার কারণ হল, তসলিমা নাসরিন যা ভাবেন, সেটাই বলেন সাহসের সাথে। অন্য দশজন কচ্ছপসদৃশ বুদ্ধিজীবীর মতো তিনি তাল বুঝে মাথা বের করেন না, তিনি অনর্গল মাথা বের করেই আছেন। এ জন্যেই বোধহয় অনেক মৌসুমী সাহিত্যিকের মনে হয়, তাঁর কাণ্ডজ্ঞান কম। .’ কানে আসে নানারকম খবর। কবি রফিক আজাদ নাকি আমার মত তুচ্ছ লেখকের আনন্দ পাওয়ায় খুব ক্ষুব্ধ। রফিক আজাদ আমাকে খুব স্নেহ করতেন এরকমই আমার মনে হত। তাঁর প্রথম স্ত্রী আদিলা বকুল আমার কাছে মাঝে মধ্যে এসে মনের কথা বলে হালকা হন জেনে তিনি স্বস্তিবোধ করেছিলেন। আদিলা মেয়েটি বড় ভাল, অনুরোধ করেছিলেন আমি যেন তাঁকে সঙ্গ দিই, মনের জোর দিই। আদিলা আমাকে তাঁর কষ্টের কথা অনেক বলেছেন। কবিতা লিখলে আদিলা বকুল রফিক আজাদের চেয়েও বড় কবি হতে পারতেন কিন্তু সরল সোজা সহিষ্ণু মানুষটি সারাজীবন কেবল দিয়েই গেছেন তাঁর স্বামীকে, নিজেকে নিঃস্ব করে একসময় দেখলেন স্বামী তাঁকে ছেড়ে চলে গেছেন। আদিলাকে তিনি ছেড়ে যান বা যাই করুন, এ কথা ঠিক যে রফিক আজাদ খুব বড় কবি। আমার মত ছোট কবি যদি ভুল করে একটি পুরস্কার পেয়েই যায়, তবে তো তাঁর বড়ত্ব কিছু কমে যায় না!

চারদিক থেকে মৌলবাদী আর দুর্মুখ লেখকদের বাক্যবাণে আমি যখন নাস্তানাবুদ তখন একদিন রফিক আজাদের চেয়ে অনেক বড়, আক্ষরিক অর্থে দেশের সবচেয়ে বড় কবি শামসুর রাহমান লিখলেন ‘তসলিমার কলমের মুখে ফুলচন্দন পড়ুক। লিখলেন,ইতিমধ্যে আমাদের সংষ্কৃতির ক্ষেত্রে তসলিমা নাসরিন একটি সাড়া জাগানো নাম। কলামিস্ট হিসেবে তিনি বিখ্যাত, তাঁর খ্যাতি দেশের সীমানা অতিক্রম করেছে। কলামের জন্য তিনি পুরষ্কৃত হয়েছেন বিদেশে। তিনি অনেক প্রথাবিরোধী কথা বলেছেন, তাঁর কলামগুলো সাহসী উচ্চারণে ভরপুর। তসলিমা নাসরিনের সাহসের তারিফ করতে হয়। তিনি আমাদের পুরুষশাসিত,পশ্চাৎপদ, ঘুণেধরা সমাজকে চাবকেছেন বার বার, অচলায়তনকে দিয়েছেন ধাককা। ধর্মীয় গোঁড়ামি, সংকীর্ণতা এবং অমানবিকতার বিরুদ্ধে ঠোঁটকাটা মন্তব্য করতে বিন্দুমাত্র দ্বিধাবোধ করেননি। কোনো রাখঢাক নেই তাঁর উচ্চারণে। কবুল করতে দ্বিধা নেই, আমি অন্তত তসলিমা নাসরিনের মত সাহসী নই। আমার এমন অনেক কথা বলতে ইচ্ছে হয় যা আমি সর্বান্তকরণে বিশ্বাস করি, কিন্তু জন্মান্ধ সমাজপতি এবং তিমিরবিলাসী, মধ্যযুগে বসবাসকারী ঘাতকদের ভয়ে সেসব কথা বলা থেকে বিরত থাকি। এতে আমার ব্যক্তিত্ব সংকুচিত হয়, নিজের অক্ষমতার জন্য লজ্জাবোধ করি আর তসলিমা নাসরিনকে মনে মনে সাধুবাদ জানাই।’

কবিতার বইগুলো নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে তিনি লিখেছেন, ‘আমাদের সমাজের অনেকেই নারীর ব্যক্তিসত্তাকে বিকশিত হতে দিতে চায় না। চারদিক থেকে নিষেধের তর্জনী এবং ছিঃ ছিঃ রব ওঠে। নারী যে একজন মানুষ, এই বোধ জাগ্রত নেই সমাজের মনে। এই পরিস্থিতির সঙ্গে মানিয়ে চলতে পারেন না বলেই তসলিমা দ্রোহী হয়ে ওঠেন, নিজের পায়ের বেড়ি ভেঙে ফেলেন, অন্যদেরও ভেঙে ফেলার আহবান জানান।’

কেবল শামসুর রাহমান নন, এপার বাংলার জাহানারা ইমাম, রশীদ করীম, নাজিম মাহমুদ, মযহারুল ইসলামের মত বিদগ্ধ ব্যক্তি লিখেছেন আমাকে নিয়ে। ওপার বাংলার শঙ্খ ঘোষ, ভবতোষ দত্ত, কেতকি কুশারি ডাইসন, শিব নারায়ণ রায়, আনন্দ বাগচি, মৈত্রেয়ী চট্টোপাধ্যায়, বিজয়া মুখোপাধ্যায়, সুতপা ভট্রাচার্যের মত বড় বড় লেখক ওখানকার কাগজে আমার লেখা নিয়ে আলোচনা করেছেন। কেউ বলছেন দুর্দান্ত, কেউ বলছেন দুঃসাহসী, দুর্বিনীত, এমন প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর বড় দুস্প্রাপ্য। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সনৎ কুমার সাহা লিখেছেন, ‘তসলিমা নাসরিন আজ আমাদের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য লেখক। তাঁর নির্বাচিত কলাম এই মুহূর্তে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বই, সমাজের পাইক পেয়াদা ঠেঙারে বরকন্দাজদের গাঁজলা ওঠা হল্লারও প্রধান কারণ এই বই।’ —এ সবই অপ্রত্যাশিত। আমার জন্য অতিপ্রাপ্তি। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বনন আবৃত্তি সংঘ আমাকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিল। স্বননের সঙ্গে জড়িত রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক লেখক বুদ্ধিজীবিদের তালিকায় সনৎ কুমার সাহা একজন। আমাকে স্বম্বর্ধনা দেওয়া হয় স্বননের পক্ষ থেকে। বিখ্যাত লেখক হাসান আজিজুল হক আমাকে ফুলের তোড়া দিয়ে আমাকে অভিনন্দন জানান, আমার সম্পর্কে স্তূতিবাক্য আওড়ান। আমি তো মঞ্চে বসে স্তূতির তোড়ে ভেসে যেতে থাকি। আমাকে যখন বলতে বলা হল, দুটো কী একটি ধন্যবাদ জাতীয় বাক্য বলার পর দেখি মাথা ফাঁকা। ফাঁকা মাথা থেকে আর কোনও শব্দ আমার জিভের দিকে আসছে না। সাহিত্য সংস্কৃতি যেমন আসে না, রাজনীতি, সমাজ ইত্যাদিও আসে না। জানি শ্রোতারা অপেক্ষা করছেন কড়া কড়া কিছু কথা শোনার জন্য কিন্তু সকলকে হতাশ করে আমাকে বিমূঢ় দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। কিন্তু কবিতা যেদিন পড়ি বিশ্ববিদ্যালয়ের মাঠে, সাবাস বাংলাদেশ নামের বিশাল মুক্তিযোদ্ধা-মূর্তির সামনে, আমার কণ্ঠে কোনও জড়তা ছিল না। কবিতা পড়তে দাও, সারারাত ক্লান্তিহীন পড়ে যাবো। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে বুদ্ধিজীবীর অভাব নেই, আবার ইসলামী ছাত্র শিবিরেরও অভাব নেই। শিবিরের পাণ্ডারা প্রগতিশীল ছাত্র শিক্ষকদের দিব্যি ঠাণ্ডা মাথায় খুন করছে, হাত পায়ের রগ কেটে দিচ্ছে। হিশহিশ শব্দ সারাক্ষণ ঘাড়ের পেছনে, আশঙ্কারা ঘাপটি মেরে বসে থাকে লোমকূপে। সনৎ কুমারই লিখেছেন, যখন আমি কবিতা পড়তে মঞ্চে উঠেছি, ‘কবিতা শোনার আগ্রহের সঙ্গে মেশে এক অরুচিকর অস্থিরতা, আজকের বাংলাদেশে যার পৌনঃপুনিক আক্রমণে আমরা এখন প্রায় অভ্যস্ত। বুকের ভেতর শুনতে পাই চাপা ধুকপুকুনি, যেন বিশ্রী একটা কিছু ঘটে যেতে পারে যে কোনও মুহূর্তে। .. পেছনে ঘাড় ফিরিয়ে দেখি শ্রোতাদের ভেতর কোনও কোনও অংশে মূর্তিমান বীভৎসতা থোকায় থোকায় কুণ্ডুলি পাকিয়ে তার সমস্ত কদর্যতা উগরে দিতে চাইছে। সেখানে হামলে পড়া মুখগুলো থেকে জান্তব লালসার লাম্পট্য গলে পড়তে থাকে। চোখের তারায় ফিনকি ছোটে ঘৃণার আর প্রত্যাখ্যানের। যেন এক মূর্তিমান আপত্তিকে হিংস্র আক্রমণে ছিন্নভিন্ন করতে পারলেই তাদের নিশ্চিন্তি।’ নাহ, ছিন্নভিন্ন আমাকে হতে হয়নি। কবিতা পড়ে আস্ত আমি মঞ্চ থেকে নেমেছি[ রাজশাহীতে নাজিম মাহমুদের বাড়িতে ছিলাম, যে কদিন ছিলাম। খুব প্রাণোচ্ছল মানুষ নাজিম মাহমুদ, আমাকে নিয়ে, আমার লেখা নিয়ে উচ্ছ!সের তাঁর শেষ নেই। এমনিতেও হৈহুল্লোড় করা মানুষ তিনি। কিছু কিছু মানুষের বয়স হয় না। কিছু কিছু মানুষ সজীব কিশোর থেকে যেতে পারেন বৃদ্ধ বয়সেও। পুরো বিশ্ববিদ্যালয়ে ঘুরে ঘুরে দেখালেন আমাকে। অনেকের বাড়িতে নেমন্তন্ন খেতে নিলেন। অভিনন্দনের ঢল নামে কিন্তু এতেও তুষ্ট হন না সনৎ। লেখেন, ‘যে সুস্থতার স্বপ্ন তসলিমার চোখে, যার জন্যে আমাদের সবার কৃতজ্ঞ হওয়া উচিত, তাকে আমরা প্রাণ খুলে অভিনন্দন জানাতে পারি না। মলিন মুখে কুণ্ঠিত হাত তুলে চুপিচুপি সহমর্মিতা আর একাত্মতা জানিয়ে বিদায় হই। বুঝতে পারি, এর বেশি এগুনো যাবে না।’ আমার কিন্তু মোটেও মনে হয়নি আমাকে কিছু কম ভালবাসা হচ্ছে। বরং বার বারই বলেছি মনে মনে, এত আমার কাম্য ছিল না তো! এটা ঠিক যে আমাকে যখন ঝেড়ে গাল দেওয়া হয়, আমি অনেকটা প্রস্তুত থাকি গাল খাবার জন্য, যেন এই গালই আমার প্রাপ্য ছিল। কেউ প্রশংসা করলেই চমকে উঠি, বুকের ভেতর কেমন জানি লাগে। আমি বুঝি যে প্রশংসা আমাকে লজ্জা দিচ্ছে, কুণ্ঠা দিচ্ছে, অস্বস্তি দিচ্ছে। প্রশংসা পাওয়ার জন্য মনে মনেও প্রস্তুত থাকি না।

লেখালেখি চলছে। পক্ষে বিপক্ষে। তবে পক্ষের লেখার তুলনায় বিপক্ষের লেখাই বেশি, বিপক্ষের কলমে ধার বেশি, তেজ বেশি, ক্ষোভ বেশি। আমার নামের সামনে থেকে, লক্ষ্য করি, জনপ্রিয় শব্দটি তুলে দিয়ে বিতর্কিত শব্দটি বসানো হচ্ছে। আমার লেখা নিয়ে বিতর্ক হয়, এত বিতর্ক নাকি অন্য কোনও লেখক নিয়ে হয় না। আমি যা-ই লিখি না কেন, লেখাগুলো মানুষকে হাসায়, কাঁদায়, ভাবায়, রাগায়, কিছু না কিছু করেই। লেখাগুলো নিয়ে কেউ না কেউ কিছু বলেই। লেখার সীমানা ছাড়িয়ে আমার শরীরের দিকে ধেয়ে আসে অনেকের লম্বা লম্বা জিভ, ধার ধার নখ। বাংলার বাণী পত্রিকায় মীর নূরুল ইসলাম আমার প্রসঙ্গে লিখেছেন ভিন্ন দৃষ্টির অন্যরকম একজন কবি শিরোনাম দিয়ে একটি কলাম। ‘যাঁকে নিয়ে এত কথা, তাঁকে আমি কখনো দেখিনি। তাঁর বিপক্ষে শুনেছি অনেক অশ্রাব্য কথা। সেসব কথায় শ্লেষ আছে, বিদ্রুপের বিষাক্ত বাক্যবাণ আছে। শুধু নেই কাব্য প্রতিভার আলোচনা কিংবা সমালোচনা। শারীরিক তত্ত্ব ও তথ্যের কথা বলা হয় মজাদার মশলার মিশ্রণে। যেন একটা নারীদেহ কেটে হাঁড়িকাবাব বা বটিকাবাব বানিয়ে মাংসলোভীদের সাজানো টেবিলে পরিবেশন করা হল। অথচ এই মানসিকতার বিরুদ্ধেই তিনি সোচ্চারকণ্ঠ। এই হিংস্রতা আর পাশবিকতার বিরুদ্ধেই প্রতিপক্ষকে জাগ্রত করার দুর্বার সাধনায় পরিচালিত তাঁর কালি কলম।’

পক্ষের লেখাগুলো চেয়ে বিপক্ষের লেখাগুলো আমি মন দিয়ে পড়ি। দৈনিক সংগ্রাম, ইনকিলাব, দিনকাল, মিল্লাত, বাংলাবাজার পত্রিকা আমার বিরুদ্ধে কোমর বেঁধে নেমেছে। সংগ্রাম, ইনকিলাব, মিল্লাত মৌলবাদিদের পত্রিকা। বাংলাবাজার পত্রিকার প্রকাশক সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরি যদিও মৌলবাদী নন, কিন্তু আমার প্রসঙ্গ এলে মৌলবাদীদের পক্ষ নিতে দ্বিধা করেন না। মতিউর রহমান চৌধুরির সঙ্গে আমার কখনও কোনও বিরোধ ছিল না, বিরোধ শুরু হল যখন তিনি কলকাতার দেশ পত্রিকা বাংলাদেশে নিষিদ্ধ করার জন্য মরিয়া হয়ে ওঠেন। দেশে নীরদ চৌধুরীর একটি লেখা ছিল যেখানে তিনি বাংলাদেশকে তথাকথিত বাংলাদেশ বলেছেন। নীরদ চৌধুরীর সঙ্গে কয়েক বছর পর এ নিয়ে কথা হয়েছে আমার, আমি যখন জিজ্ঞেস করেছি কেন তিনি বাংলাদেশকে তথাকথিত বাংলাদেশ বলেছেন, তিনি উত্তরে, হেসে, বলেছেন, পূর্ব পশ্চিম উত্তর দক্ষিণ বাংলা অঞ্চল মিলিয়ে বংলাদেশ। পূর্ববঙ্গের কোনও অধিকার নেই বাংলাদেশ নামটিকে দখল করার। পশ্চিমবঙ্গ আজও পশ্চিমবঙ্গ রয়ে গেছে। নীরদ চৌধুরীর যুক্তি আমি শুনেছি। যে যুক্তি মতিউর রহমান চৌধুরি দিয়েছিলেন, তাও শুনেছি। মতিউরের বক্তব্য তথাকথিত বাংলাদেশ বলে বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব অস্বীকার করা হয়েছে। তা মেনেছিলাম। কিন্তু তারপর যে কাণ্ডটি তিনি করতে শুরু করলেন, তা মানতে পারিনি। কলকাতা থেকে বাংলাদেশে দেশ আসা চিরকালের জন্য বন্ধ করতে হবে, এই দাবি নিয়ে তুমুল হৈ চৈ শুরু করলেন। দেশ পত্রিকার প্রকাশক তথাকথিত শব্দটির জন্য ক্ষমা চাওয়ার পরও। সরকারের সঙ্গে মতিউরের মাখামাখি থাকার কারণে সরকার থেকে হঠাৎ একদিন দেশ পত্রিকার সবগুলো কপি বাজেয়াপ্ত করা হল, বাংলাদেশে দেশ আসা বন্ধও করে দেওয়া হল। দেশের পাঠকেরা মুখ চুন করে বসে রইল। দেশ উন্নত মানের সাহিত্য পত্রিকা। এটি বন্ধ হওয়ার পর প্রতি সপ্তাহে আমাদের পড়ার মত তেমন কোনও কাগজ রইল না। বাংলা ভাগ হয়ে গেছে, এ দেশের রাজনীতি এখন ভারত বিরোধী রাজনীতি, যে যত বেশি ভারতকে গাল দিতে পারে, তার তত জনপ্রিয়তা বাড়ে। এক দল অন্য দলকে দোষ দিয়ে যাচ্ছে, অন্য দল নাকি ভারতের কাছে এ দেশটি বিক্রি করে দেবে। প্রতিবেশী দেশের বিরুদ্ধে এরকম লাগাতার লেগে থাকলে এ দেশের কি সত্যিকার কোনও লাভ হয়! কোথায় ভারত, কোথায় বাংলাদেশ। হাতির সঙ্গে মশা লেগেছে ঝগড়া করতে। দুই বাংলা মিলে যদি না যেতে পারে না যাক, অন্তত সাহিত্যিক সাংস্কৃতিক যোগাযোগটি তো থাকতে পারে। এতে দুই বাংলার মানুষেরই তো উপকার হয়! তথাকথিত শব্দের তথাকথিত অপরাধে দেশ নিষিদ্ধ হয়ে গেলে এ দেশের কার কতটা কী অর্জন করা হয় বুঝতে পারি না। দেশ নিষিদ্ধ হওয়ায় এমনই রাগ হয়েছিল যে প্রতিবাদ করে একটি কলাম লিখলাম পত্রিকায়। দেশের বিরুদ্ধে মতিউর রহমানের এমন ক্ষিপ্ত হওয়ার মূল কারণটি কী তা উদ্ধার করে জানিয়ে দিলাম যে তিনি বাংলাবাজার পত্রিকায় শারদীয়া দেশের বিজ্ঞাপন চেয়েছিলেন, কিন্তু তাঁকে দেওয়া হয়নি বিজ্ঞাপন, দেওয়া হয়েছে ইত্তেফাক আর ইনকিলাবে, তাই তিনি আগুন হয়ে আছেন রাগে। মূল কারণ বিজ্ঞাপন, তথাকথিত শব্দটি কোনও কারণ নয়। আমার লেখাটি ছাপার পর মতিউউরের বিষধর ফণা আমার দিকে তাক করা। বাংলাবাজার পত্রিকাটিতে দিনে দুবার করে আমাকে কোপানো হয়। চরিত্র সামান্য পাল্টালো বাংলাবাজার পত্রিকার যখন মতিউর দেউলিয়া হয়ে পত্রিকা বিক্রি করে দিলেন ইয়াহিয়া খানের কাছে। মিনারের বদৌলতে সাহিত্য রসিক বস্ত্রকল ব্যবসায়ী ইয়াহিয়ার সঙ্গে আমার পরিচয় হয়েছিল। ইয়াহিয়ার সঙ্গে আমার একটি হঠাৎ হঠাৎ দেখা সম্পর্ক রয়ে গেছে। ইয়াহিয়া আমার লেখার অনুরাগী তিনি। লেখার অনুরাগী হলে মাঝে মাঝে কেউ কেউ এক পায়ে দাঁড়িয়ে থাকেন যে কোনও কাজে ব্যবহৃত হবার জন্য। আমার নিজের জন্য দরকার না হলেও নির্মলেন্দু গুণের জন্য বাংলাবাজার পত্রিকায় সাহিত্য সম্পাদক পদে একটি চাকরির জন্য ইয়াহিয়া খানকে ব্যবহার করেছি। পত্রিকাটির মালিক প্রকাশ্যে জাকারিয়া খান অপ্রকাশ্যে ইয়াহিয়া খান হলেও সম্পাদক তখনও মতিউর রহমান চৌধুরি। সম্পাদকের ঘরে বসে চা খেতে খেতে মতিউরের সঙ্গে গুণকে দুহাজার নয় তিন হাজার নয় পাঁচ হাজার টাকা মায়নের ব্যবস্থা পাকা করে তবে আমি কাপের শেষ চা টুকু তৃপ্তি করে পান করেছি। নির্মলেন্দু গুণের মত বড় কবিকে সাহিত্য সম্পাদক হিসেবে পাওয়া ভাগ্যের ব্যপার। আমি কোনও অন্যায় আবদার করিনি। ইয়াহিয়া খানকে বলে তাঁর গার্মেন্টস ফ্যাক্টরির শ্রমিকের কাজে গুণের পরিবারের সদস্য গীতার এক বোনকে ঢুকিয়ে দিয়েছিলাম, কিছু কাজের কাজ করে মনে প্রশান্তি আসে। ইসলামরক্ষকেরা ওদিকে একজন একজন করে লিখে যাচ্ছেন আমার বিরুদ্ধে। তবে তাঁরা যুক্তি খণ্ডনে না গিয়ে সোজা কোরান হাদিসের ধ্রুব সত্যকে সামনে খাড়া করেন। কোরান হাদিসের বক্তব্যে যুক্তি না থাকলেও আবু ফয়সল লিখলেন, ‘পরিবারকে রক্ষা করার জন্য ইসলামের ব্যতিক্রমী বিধানকে ভিত্তি করে নারীর প্রতি ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি কি তা ব্যাখ্যা করা একাডেমিক অনেস্টি নয়। নাসরিন এই একাডেমিক ডিসঅনেস্টি প্রায় সবখানেই করেছেন। নাসরিন তাঁর লেখা দ্বারা বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছেন। তাঁর লেখা দ্বারা আলটিমেটলি ইসলামের কোনও ক্ষতিই হবে না। ইসলামের উপর এর চেয়ে অনেক ঘোরতর আক্রমণ যা বিভিন্ন কর্নার থেকে এসেছে যা ইসলামের পণ্ডিতগণ মোকাবিলা করেছেন এবং করতে সম্ভব।’ যদিও ইসলামের কোনও ক্ষতিই হবে না বলা হয়েছে, কিন্তু ইসলামপন্থীরা মোটেও আমাকে ভুলে থাকতে পারছে না, এমন ভাবে আক্রমণ করছে যেন আমি ইসলামের কল্লা কেটে ফেলে দিচ্ছি কোথাও। আমাকে রোধ করতে না পারলে, আশঙ্কা, ইসলাম নির্ঘাত মরবে।

ইনকিলাবে ছাপা হল ডাঃ গোলাম মোয়াযযমএর কোরআন পড়লে যাদের মাথা ঘোরে তাদের উদ্দেশে। লোকটি কোরানের যুগোপযোগী ব্যাখ্যায় বেশ ওস্তাদ। আধুনিক বিজ্ঞানের সবকিছুর তথ্যই তিনি কোরআন ঘেঁটে বের করে দিতে পারেন। বিজ্ঞানে আজ নতুন কিছু আবিস্কার হল, কালই তিনি সেটি খুঁজে পাবেন কোরআনে। বলবেন, আল্লাহ তো এই তথ্য কবেই দিয়ে বসে আছেন। তবে মজার ব্যপার হল, বৈজ্ঞানিক আবিস্কারের আগে কোরআনীয় আবিস্কারটি হয় না। বিজ্ঞানীরা ব্ল্যাক হোলের কথা আগে বলেছেন, পরে কোরআনবিদরা ব্ল্যাক হোলের কথা খুঁজে পাবেন কোরানে। না পেলেও কোনও একটি আয়াতের ব্যাখ্যা এমন ভাবে করবেন যেন ব্ল্যাক হোলের কথাই আকারে ইঙ্গিতে আল্লাহ বলেছেন। কোরআনে লেখা আছে, সূর্য পৃথিবীর চারদিকে ঘুরছে, পাহাড়গুলো কিলক হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে যেন পৃথিবী পড়ে না যায়। এতকাল এসব কথা মেনে এলেও এখন বিজ্ঞান-জানা মুসলমানরা স্বীকার করবেন না যে কোরআনে তা লেখা আছে। পরিস্কার আরবীর অপরিস্কার অনুবাদ করে বোঝাবেন, পৃথিবী স্থির বলতে আল্লাহ আসলে অন্য কিছু বোঝাতে চেয়েছেন। আল্লাহ কোথায় কি বোঝাতে চেয়েছেন তা আল্লাহর চেয়ে আজকাল ধুরন্দর জ্ঞানীরা বেশি বোঝে। গোলাম মোয়াযযম লিখেছেন, ‘পৃথিবী স্থির এ কথা কোরআনে কখনও বলেনি। কোরআন বিজ্ঞানের পাঠ্যপুস্তক নয়। মানুষকে দ্বীন বোঝাবার জন্য আল্লাহ প্রাকৃতিক বহু বিষয়ের উদাহরণ দিয়েছেন এবং তাতে যা বলা হয়েছে সেগুলো বিজ্ঞানের সীমায় পড়ে। বাইবেল মানুষের লেখা বলে তাতে বহু বৈজ্ঞানিক ভুল তথ্য পাওয়া যায়। সম্প্রতি মরিস বুকাইলি তার বিখ্যাত গ্রান্থে স্পষ্ট বলেছেন, কোরআনে কোনও ভুল তথ্য পাওয়া যায় না কারণ এটা মানুষের রচিত নয়। কোরআনে আছে আল্লাহর হুকুমে চন্দ্র সূর্য তাদের কক্ষপথে ঘোরার বা আবর্তনের কথা। যা বৈজ্ঞানিক সত্য। পৃথিবীকে আন্দোলিত না করার জন্য পাহাড়কে কিলকের মত স্থাপন করেছেন বলায় লেখিকা কোরআনে ভুল রয়েছে বলার ধৃষ্টতা দেখিয়েছেন। ..পৃথিবী পতনের কথা কোরআনে বলা হয়নি। লেখিকার চপলতা নেহাতই মূর্খতার পরিচয়। তার বালিকাসুলভ অজ্ঞতাজনিত উক্তি নিতান্তই হাস্যকর। সুতরাং স্বল্প জ্ঞান নিয়ে বিজ্ঞান আলোচনা না করাই উত্তম।..হুরকে কোরআনের এক জায়গায় আজওয়াজে মুতাহহারাত বলা হয়েছে অর্থাৎ পবিত্র সঙ্গিনী। সুতরাং পবিত্রের সঙ্গ যারা অপবিত্র কোনও কল্পনা করে, তারা তাদের নিজের কলুষিত মনেরই প্রকাশ করে থাকে। যারা কার্লমার্ক্সকে দেবতার মত মানে তাদের পিছে ঘুরলে শুধু মাথাই ঘুরবে কোনও লাভ হবে না। মার্কসবাদ কাল্পনিক মতবাদ তাই আজ আস্তাকুঁড়ে নিক্ষিপ্ত। এদের পত্রিকায় ইসলাম বিরোধী মিথ্যা প্রবন্ধ ছাপানো সম্ভব হলেও এতে ইসলামের পবিত্র অঙ্গে কোনও দাগ পড়বে না। মুসলমানরা ঠিকমত কোরআন হাদিস মেনে চলছে না বলে পৃথিবীতে পিছিয়ে আছে। কিন্তু ইসলাম তথা আল্লাহর সর্বশেষ কিতাবে কোনও ভূল নেই, এটা অমুসলিমরাও মানতে বাধ্য হচ্ছে। যারা মানে না তারা আর যাই হোক মুসলমান নয় এবং ইসলাম তথা কোরআনের বিরুদ্ধে লিখার আগে আরও একটু পড়াশোনা করার দরকার নতুবা শুধু হাসির পাত্র হতে হবে। এ ধরনের অবিশ্বাসী মুসলমানরা মুসলিম নাম রেখে এদেশের যাবতীয় সুবিধা ভোগ করছে এটাও একটা বিরাট প্রতারণা ও ধোঁকা।’ যেহেতু আমি লিখেছিলাম যে আমাদের সৌরজগতের সঙ্গে আল্লাহতায়ালার সৌরজগতের কোনও মিল নেই, গোলাম মোয়াযযম উত্তরে বলছেন, ‘বিংশ শতাব্দীর শেষ দশকে বাংলাদেশে এ ধরনের অবৈজ্ঞানিক প্রবন্ধ ছাপা হয় জেনে খুব দুঃখ হচ্ছে এবং বোঝা যাচ্ছে এ দেশের শিক্ষার মান বিশেষ করে বিজ্ঞান শিক্ষার মান কত নিম্নস্তরের ও মধ্যযুগীয়।’

মিল্লাত পত্রিকায় ফারিশতা তাঁর রোজনামচা লিখেছেন, ‘আমাদের দেশের এক নারী কলামিস্টের ধারণা পুরুষের হাতে গড়া এই পুরুষ প্রধান সমাজের স্বার্থের প্রয়োজনেই ধর্ম সৃষ্টি করে সুচতুর পুরুষ আর সেখানে স্বয়ং বিধাতাও নাকি নারী বিদ্বেষী। ধর্মগ্রন্থ বাইবেল, ত্রিপিটক, বেদ, উপনিষদ এমনকী পবিত্র কোরআন শরীফ থেকে কিছু কিছু অসংলগ্ন শ্লোক ও আয়াতসমূহের উদ্ধৃতি হাজির করে অতি সম্প্রতি অকাল কুষ্মাণ্ড একটি দৈনিকের কলামে তিনি একটি প্রবন্ধ ফেঁদে তাঁর এই উদ্ভট ও বিকৃত চিন্তার ফসল বিষবৃক্ষে পানি সিঞ্চন করে ধর্মের সকল বন্ধন থেকে নারীকে মুক্ত করার অপচেষ্টা করেছেন। অবশ্য এর আগে পাগলে কি না বলে, ছাগলে কি না খায় পর্যায়ের এই লেখিকা সর্বভুক কাকের মত বহুবার সমাজ দেহের পরিত্যক্ত ও পরিত্যজ্য ময়লা ঠুকরিয়ে বের করে সমস্ত পরিবেশকেই দুর্গন্ধযুক্ত করার অপপ্রয়াস করেছেন। ধর্মীয় নিয়ম কানুনের প্রতি তাঁর প্রবল বিদ্বেষ এবং পুরুষের প্রতি তাঁর সীমাহীন আক্রোশ আমি তখন থেকেই লক্ষ্য করে এসেছি। আমি শুনে এসেছি যে, তিনি নাকি একজন সুশিক্ষিতা নারী এবং পেশায় একজন ডাক্তার। তাছাড়া তিনি নাকি একজন কবিও বটে। ধর্মবিরোধী ও পুরুষ বিদ্বেষী এই মহিলা কবির সাম্প্রতিক লেখা একটি তথাকথিত কবিতার প্রতি আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করেন আমার এক আত্মীয়া। তাঁর কবিতা নামধারী এই পংক্তিমালার একাংশে লিখেছেন যে হাত ধরলেই মরণ। মনে হয় সেই ছেলেবেলা নাকি মেলাবেলা থেকেই কারও হাত ধরার প্রবল আকাঙ্খা ছিল তাঁর। কিন্তু বেশ কয়েকবার বেশ কয়েকজনের হাত ধরে যে অভিজ্ঞতা তাঁর সঞ্চিত হয়েছে, তাতে আর নতুন করে কারও হাত ধরার শখ তাঁর ফুরিয়ে গেছে। কি জানি! কিন্তু বাপু, যতদিন ওই পোড়া দেহটি আছে ততদিন যে কারও না কারও হাত ধরতেই হবে। তাছাড়া কাদায় বা গর্তে পড়লে কারও হাত ধরেই তো উঠতে হয়। কলামিস্ট সাহেবার অবস্থা দেখে আমার দৃঢ় বিশ্বাস জন্মেছে যে, তিনি এখন সত্যিই নাক অবধি দুর্গন্ধযুক্ত কাদায় নিমজ্জিত হয়ে পড়েছেন। আর এ অবস্থা থেকে উদ্ধার পেতে হলে তাঁকে কারও হাত ধরেই উপরে উঠতে হবে। হাত ধরাকে তিনি যতই মন্দ বলুন না কেন, সঠিক হাত ধরতে পারলে সে হাত তাঁকে কেবল কর্দমামুক্ত করবে না তাঁকে বাঁচিয়েও তুলবে। ….নারীমুক্তি আন্দোলনে আপনার লেখা আরও সমৃদ্ধি আনবে যদি সঠিক হাত সত্যিই ধরতে পারেন। আমার ধারণা এ সমাজে নারীর দুর্গতি দেখে আপনি প্রতিনিয়ত আহত হচ্ছেন। আপনার অবলোকন পদ্ধতি সঠিক এবং আপনি লেখেনও আকর্ষণীয় পদ্ধতিতে। আপনি একজন ভাল লেখিকা। আহা আরও কত ভালই না হত, আপনি যদি ধর্মীয় বিষয়েও কেবলই একপেশে চিন্তা না করতেন।..’

কলকাতার মুসলমান মৌলবাদীরাও বসে নেই। সাপ্তাহিক কলম, মীযানে লেখা চলছে আমাকে আক্রমণ করে। নারী স্বাধীনতার ব্যপারটি ওদের পছন্দ নয়। প্রকৃতির উদাহরণ দিয়ে একজন লিখেছেন, পুরুষ হল সূর্য আর নারী হল চাঁদ। ‘আল্লাহ নারীকে দিয়েছেন কমনীয়তা আর পুরুষকে দিয়েছেন কঠোরতা। এ দুয়ের পরিপূরণে সার্থক ও সৌন্দর্যমণ্ডিত হয় সমাজ ও পরিবার। এ দুয়ের প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জন্ম নেয় দ্বন্দ্ব সংঘাত, অশান্তি, অকল্যাণ। তসলিমারা নারী পুরুষের পরিপূরণ চায় না। চায় প্রতিদ্বন্দ্বিতা। ফলে পদে পদে ঘটছে বিপর্যয়। মৌলবাদীদের ঘাড়ে দোষ চাপিয়ে লেখনীতে বক্তব্য রাখা যায়। কিন্তু মৌলবাদীদের মত নির্মল চরিত্র ও নীতি নৈতিকতার দৃষ্টান্ত স্থাপন করা যায় না। মৌলবাদীরা ইসলামের দর্শনে অনুপ্রাণিত। যৌগবাদীরা প্রবৃত্তির তাড়নায় উন্মাদ।’ আমার নিন্দা করে ওসব পত্রিকায় যে লেখাই ছাপা হয়, বাংলাদেশের মৌলবাদীরা নিজেদের কাগজে সগৌরবে তার পূনর্মুদ্রণ করে।

ভারতবর্ষের বাইরে বসেও আমার লেখা অনেকে পড়ছেন। দেশের বাইরেও দেশের মত আমার লেখা নিয়ে তর্ক বিতর্ক চলে। লণ্ডন থেকে লেখক গোলাম মুরশিদ তাঁর ভিডিও ক্যামেরা নিয়ে চলে এলেন আমার সাক্ষাৎকার নিতে। শফিক আহমেদ এবং তাঁর স্ত্রীও লণ্ডন থাকেন, সাহিত্য সংস্কৃতির জ্ঞান প্রচুর, আমার সঙ্গে দেখা করলেন দেশে এসেই। বোস্টনের মেঘনা দেশে বেড়াতে এসে আমার খোঁজ করে আমার জন্য ঝুড়ি ভরে আনা ভালবাসা রেখে গেলেন। একদিকে ভালবাসা। আরেকদিকে ঘৃণা। মাঝখানে আমি। ভালবাসা ঘৃণা দুটোই আমাকে নাড়ায়। তবে ভালবাসা আমাকে কাবু করে ফেলে না। ঘৃণাও না। আমি যেন ধীরে ধীরে দুটোই অন্তস্থ করার জন্য অথবা দুটো থেকেই মুক্ত হবার জন্য নিজেকে নির্মাণ করছি। আমার লেখা নিয়ে যাদের অতি আবেগ সে ভালবাসা বা ঘৃণা যেটিই হোক, আমাকে মাঝে মাঝে বড় অপ্রতিভ করে তোলে। একবার টাঙ্গাইল থেকে এক মেয়ে এল আমার বাড়িতে। মেয়েটি কলেজ পাশ করেছে, এখন চাইছে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে কিন্তু বাড়ি থেকে কিছুতেই তাকে পড়তে দেবে না। মেয়ে চলে এসেছে পালিয়ে আমার কাছে। আমিই যেন এখন আশ্রয় তার। যেন আমিই জানি এখন তার কী করতে হবে। আমার লেখা পছন্দ করে বলে বাড়িতে মেয়েটি চড় থাপ্পড় খেয়েছে। গালিগালাজ শুনেছে। তারপরও সে দমে যায়নি। জোর গলায় বলেছে যে তার জীবনে আমার চেয়ে বড় অন্য কেউ নেই। না বাবা মা, না ভাই বোন, আত্মীয় স্বজন। ভগবান বা আল্লাহ বলে কোথাও কিছু থেকেও থাকে, সেও এত বড় নয়। কেবল অল্প বয়সী মেয়েই নয়, মধ্যবয়সীদেরও ভিড় হয়। পনেরো থেকে পঁচাত্তর সব বয়সীই সব পেশার সব শ্রেণীর মেয়ে মহিলা আমার দরজায় কড়া নাড়ে। সকলেই নিজের জীবনের সব কথা অকপটে বলে আমাকে। আমি কষ্টের বিভিন্ন রূপ দেখি, বিভিন্ন রঙ দেখি। অনেকে আমার কাছে শক্তি চায়, সাহস চায়। আমি কি যোগাতে পারি কোনও শক্তি বা সাহস! আমার মনে হয় না। অনেকে হতাশা নিয়ে ফিরে যায়। কেউ কেউ আঠার মত লেগে থাকে, জানি না কী পায় আমার মধ্যে। নাহিদ নামের এক মেয়ে, বিশ্ববিদ্যালয়ে আইনের ছাত্রী, দেখা করতে এল। দেখা করতে এলে কথাবার্তা বলে বিদেয় হওয়ার কথা। কিন্তু বিদেয় হতে চায় না। বিদেয় হলেও কদিন পর আবার দরজায় চেহারাটি উঁকি দেয়। ঝুনু নামের এক মেয়ে, রাজনীতি করে, দেখা করতে এল। বসতে দেওয়া হল। চা বিস্কুট দেওয়া হল। এরপরও বসে থাকে। একটু ছুঁয়ে দেখতে চায় আমাকে। মিতুল এল, নিপা এল, দুই বুদ্ধিদীপ্ত রূপসী কিশোরী, ভিখারুন্নেসা ইস্কুলের ছাত্রী। এদের আসা ক্রমশ নিয়মিত হয়ে উঠল আমার শান্তিবাগের বাড়িতে। মামুন আর আনু, অল্প বয়সী দম্পতি, এদের আসাও নিয়মিত, আনু একটি দোকানে জিনিসপত্র বিক্রি করার কাজ নিয়েছে, মামুনের চাকরি নেই। অভাবের সংসার ওদের। একদিন ভোরের কাগজের সম্পাদকের কাছে চিঠি লিখে মামুনকে পাঠিয়ে দিই সম্ভব হলে একটি চাকরি যেন ছেলেটিকে দেওয়া হয়। মামুনের লেখা কিছু চিঠি পড়েই বুঝেছি ছেলেটির লেখার হাত খুব ভাল। ভোরের কাগজে মামুনের চাকরি হয়। আমার দিন যেতে থাকে হাসপাতালের কাজে, সংসারে, লেখায়, আড্ডায় আর ভক্তকূল সামলানোয়। গুরুর আচরণ যেহেতু আমার স্বভাবে চরিত্রে নেই, ভক্তকূল অচিরে বন্ধুর মত হয়ে ওঠে, বাড়ির লোকের মত। অবাধ বিচরণ তাদের আমার বাড়িতে।

আজকাল মোল্লা মুন্সি দেখলে দ্রুত পাশ কাটিয়ে যাই। এদের আস্ফালন দেখে মনে হয় আমাকে বুঝি কাঁচা খেয়ে ফেলবে। কিন্তু তারপরও হঠাৎ হঠাৎ অবিশ্বাস্য সব কাণ্ড ঘটে। একদিন দাড়িঅলা লুঙ্গি পাঞ্জাবি পরা এক লোক সোজা ঢুকে গেল আমার বাড়িতে। বাড়িতে আসা যাওয়ার সময় কেউ হয়ত বাইরের দরজাখানা খুলে রেখেছিল। বাড়ির সবাই আমার শোবার ঘরে বসে আড্ডা দিচ্ছে। হঠাৎ অচেনা একটি লোককে শোবার ঘরে ঢুকতে দেখে আমি আর্তনাদ করতেও ভুলে যাই ভয়ে। কী চায় এই লোক! এখানে কেন! আমার হতভম্ব মুখের দিকে চেয়ে লোকটি বলল, ‘ভয় পাবেন না, আমি কোনও খারাপ উদ্দেশ্য নিয়া আসি নাই। আপনাকে এক পলক দেখতে এসেছিলাম। বহুদিনের ইচ্ছ! ছিল আপনাকে একবার দেখব। আজ আমার জীবন সার্থক হল।’

অনাকাঙ্খিত অতিথিকে খুব দ্রুত বাড়ির বাইরে বের করে দেওয়া হল। লোকটি কি সত্যিই জীবন সার্থক করতে ওভাবে বেড়ালের মত ঢুকেছিল বাড়িতে!
 
১৭. যেমন খুশি তেমন সাজো



সত্যিই কি কোনও প্রেম করেছি আমি নাকি প্রেমের ধারণাট্‌ি বয়ে বেরিয়েছি কেবল? এই একটি অদ্ভুত প্রশ্ন আমি করতে শুরু করি নিজেকে। রুদ্রর সঙ্গে আমার যে সম্পর্কটি ছিল, তাকে কী কী কারণে প্রেম বলা যায় এবং কী কী কারণে বলা যায় না, তার একটি হিসেব কষে দেখি রুদ্রর জন্য আমার আকর্ষণ তীব্র ছিল বটে, রুদ্রর অনাচার আমাকে রুদ্র থেকে দীর্ঘদিন ফেরায়নি বটে, এর পেছনের কারণ প্রেম নয়, অন্যকিছু। অন্যকিছুতে আছে নিঃসঙ্গতা, আছে প্রেম করার আগ্রহ এবং প্রেমের ধারণা। প্রেম করলে সামাজিক যে আচরণটি মানুষ করে সেটি আমি জেনেছিলাম বলে আচরণটি আমি করে গেছি। আচরণটি শেখা। আচরণটি নিজস্ব নয়। রুদ্রর কিছু কবিতা আমি সাপ্তাহিক পত্রিকায় পড়েছিলাম, এইমাত্রই। এরপর একদিন রুদ্রর চিঠি পাই আমি, যখন সে আমার সম্পাদিক কবিতা পত্রিকা সেঁজুতির জন্য কবিতা পাঠায়। উত্তরে আমিও চিঠি লিখি। এভাবেই চিঠির যোগাযোগ। যাকে কোনওদিন দেখিনি, যার সম্পর্কে জানি না কিছু তার প্রেমে পড়ে গেলাম! দেখতে রুদ্র কোনও অর্থেই সুপুরুষ ছিল না, তাকে প্রথম দেখে আমার বিবমিষা ছাড়া আর কিছুর উদ্রেক হয়নি। রুদ্রর কবিতা আমার ভাল লাগত, এরকম তো কত কারও কবিতাই আমার ভাল লাগে। প্রেমে আসলে আমি পড়েছিলাম প্রেম ব্যপারটির।

কৈশোরে আমি আর চন্দনা প্রেমে পড়েছিলাম সিনেমার নায়ক জাফর ইকবালের। জাফর ইকবালের রূপ আমাদের আকর্ষণ করেছিল। আকর্ষণের জন্য কিছু না কিছু থাকতে হয়। রূপ নয় গুণ। কিন্তু সেটিও সত্যিকার প্রেম নয়। কিশোর বয়সে এমন হয়ই। জাফর ইকবালের সঙ্গে চিঠিতে বন্ধুত্ব হয়েছিল আমাদের। জাফর এমনকী চন্দনার সঙ্গে দেখা হওয়ার পর তাকে বিয়ের প্রস্তাবও দিয়েছিল। জাফরের সঙ্গে কোনও একদিন সত্যিকার দেখা হবে, এরকম একটি স্বপ্ন ছিল আমার। স্বপ্নটি আমি লালন করেছি দীর্ঘকাল। ঢাকায় জাফর ইকবালের পাঁচ নয়াপল্টনের বাড়ির সামনে দিয়েই ছোটদার বাড়িতে গিয়েছি, কোনওদিন ঢুকিনি তার বাড়িতে। হবে একদিন দেখা, কোথাও একদিন দেখা হবে। নাহ, দেখা হয়নি। দেখা হবেও না কোনওদিন। দেশের সবচেয়ে সুদর্শন নায়কটি অল্প বয়সে হঠাৎ একদিন ভোরবেলা মরে গেল। কোনও অসুখ নেই, বিসুখ নেই। সুস্থ সবল একটি মানুষ মরে গেল! কী অবিশ্বাস্য গা অবশ করা খবর! সোনিয়া নামের এক মেয়েকে জাফর বিয়ে করেছিল, সোনিয়ার সঙ্গে তার মনের মিল হয়নি, সোনিয়া চলে গিয়েছিল জাফরকে ছেড়ে, সে কারণেই কি না জানি না বিরহে একাকীত্বে অতিরিক্ত মদ্যপানে নিজের মৃত্যু ঘটিয়েছে সে।

যখন থেকে হিন্দি ছবি দেখতে শুরু করি, অমিতাভ বচ্চনের জন্য কি রকম পাগল পাগল লাগত। আবার অমিতাভ যখন রেখার সঙ্গে প্রেম করত, তা দেখতেও ভাল লাগত। রেখার সঙ্গে মানাত খুব অমিতাভকে। নিজে মনে মনে রেখা হয়ে অমিতাভের প্রেম গ্রহণ করতাম। কিন্তু রেখা তো আমি নই। আমি আমিই। আমাকে ভালবাসার জন্য কোনও সুদর্শন যুবক কোথাও অপেক্ষা করে নেই। আমিই কেবল বসে বসে সুদর্শন সুপুরুষের অপেক্ষা করি। কৈশোর কাটলে আফজাল হোসেনের সঙ্গে আমার খুব প্রেম করতে ইচ্ছে হত। সত্যি বলতে কী, এই ইচ্ছেটি আমার কোনওদিনই চলে যায়নি। আফজাল অতি সুদর্শন ছেলে। নাটকের ছেলে। টেলিভিশন আর মঞ্চের জনপ্রিয় অভিনেতা আফজাল। নিজে নাটক লেখে। চমৎকার সব প্রেমের গল্প। নতুন উপন্যাসও লিখছে। প্রকাশক বিদ্যাপ্রকাশ। খোকাই তাগাদা দিয়ে দিয়ে আফজালকে লেখাচ্ছেন। আফজালকে আমি প্রথম দেখি দশ আগে ফেব্রুয়ারির বইমেলায়। এত লম্বা যে কোনও কেনা প্যাণ্ট তার আঁটে না, গোঁড়ালির ওপর প্যান্ট উঠে আছে, সেটি পরেই সে ঘুরে বেড়াচ্ছে মেলায়। রুদ্রর সঙ্গে পরিচয় ছিল আফজালের। আফজালকে ডেকে রুদ্র কথা বলল। এরপর আরও দুএকদিন এখানে সেখানে টুকরো টুকরো দেখা হয়েছে। নাটকের মেয়ে সুবর্ণার সঙ্গে আফজালের প্রেম ছিল। কিন্তু সে প্রেম একসময় ভেঙে যায়। আফজাল একা হয়ে গেল। মাত্রা নামে নয়াপল্টনে, ঠিক ছোটদার বাড়ির পেছনে একটি বিজ্ঞাপনী সংস্থা খুলে বসল। ছোটদার বাড়িতে যেতে আসতে দেখি মাত্রার আপিস। রুদ্রর সঙ্গে আমার সম্পর্ক থাকাকালীন আফজাল-মোহটি সংস্কার-চাপা ছিল। সম্পর্ক ভেঙে যাওয়ার পর কতবার যে মাত্রা ছাড়া আবেগ উথলে উঠে আমাকে মাত্রায় ঢোকাতে চেয়েছে, ঢুকিয়ে বলাতে চেয়েছে ভালবাসার কথা। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের সৌন্দর্যের পাশে মনে মনে আফজালকে দাঁড় করিয়ে দেখেছি চমৎকার মানাচ্ছে। তারপরও মাত্রায় আমার ঢোকা হয়নি, বলা হয়নি কিছু। আবেগের লাগাম টেনে ধরেছি প্রতিবারই। অনেক বছর আগে, ময়মনসিংহের দুই কবি শফিকুল ইসলাম সেলিম আর আতাউল করিম সফিক আফজাল হোসেন আর ইমদাদুল হক মিলনকে ময়মনসিংহে নিয়ে ছিল অনুষ্ঠান করতে। মহাকালি ইশকুলে অনুষ্ঠান। সেলিম আর সফিকের অনুরোধে সেই অনুষ্ঠানে আমার গল্প পড়তে যেতে হল। তখন আমি কয়েকটি গল্প লিখেছি সংবাদ পত্রিকার মেয়েদের পাতায়। মাধবীর জীবন কথা গল্পটি সাধু ভাষায় লেখা। এটি আমার গল্পগুলোর মধ্যে আমার বিচারে সবচেয়ে ভাল। অনেকের গল্প পড়ার পর একেবারে শেষে অতিথিদের গল্প পড়ার আগে ছিল আমার গল্প পড়া। কিন্তু পড়তে উঠে বিচ্ছিরি কাণ্ড শুরু হল। দর্শকরা হৈ হৈ করতে শুরু করল। কেউ আমার গল্প পড়া শুনতে চায় না। হৈ হৈ এর মধ্যে গল্পের সামান্য অংশ পড়ে আমাকে মঞ্চ থেকে নেমে পড়তে হয়েছে। বাধ্য হয়েছি নেমে পড়তে। আমার জানা হয়নি হৈ হৈ কি আমাকে অপছন্দ করার কারণে নাকি অতিথিদের গল্প শোনার জন্য অধৈর্য হয়ে যাচ্ছিল শ্রোতারা, সে কারণে। যে কারণেই হোক আমার আর সে রাতে আফজাল বা মিলন কারও সঙ্গে কথা বলার মুখ ছিল না! ওই হৈ হৈ ঘটনার কথা মনে পড়লেই মাত্রায় নেমে আফজালকে ভালবাসার কথাটি বলার যে কল্পনাটি হঠাৎ হঠাৎ করি, সেটিকে হাওয়ায় উড়িয়ে দিই। আফজালের মাত্রায় আমি গিয়েছি ঠিকই একদিন, তবে আফজালের জন্য নয়, মিলনের জন্য। তখন আমি আর মিলন ভারতে বেড়াতে যাবো। মিলনের বিকেল কাটত মাত্রায় আড্ডা দিয়ে। মিলন বলেছিল তার সঙ্গে মাত্রায় দেখা করতে। মাত্রায় মিলন নেই এ কথাটি আফজাল আমাকে জানিয়ে দিলেই পারত। কিন্তু আমাকে সাদর অভ্যর্থনা জানিয়ে দরজা থেকে নিয়ে গেল তার ঘরে। বসালো। চা খাওয়ালো। অনেকক্ষণ বিজ্ঞাপন নিয়ে নাটক উপন্যাস নিয়ে কথা বলল। একটি মোটা ইংরেজি উপন্যাস আমাকে উপহার দিল। যাবার সময় দরজা পর্যন্ত এল বিদায় দিতে। আবার যেতে বলল। এমন আদর আমার প্রত্যাশিত ছিল না। সেদিন সারাদিন তিরতির করা একটি সুখ আমার হৃদয়ের শীতল য়চ্ছ জলে সাঁতার কেটে বেড়ালো। আফজালের সঙ্গে আমার শেষ দেখাটি এই সেদিন, খোকার বাড়িতে। খোকা আমাকে নেমন্তন্ন করলেন তাঁর বাড়িতে। সন্ধেবেলায় হঠাৎ ফোন তাঁর, এক্ষুনি চলে আসেন। কেন? রাতে খাবেন, আমার বউ রান্না করেছে। তখনই যে শাড়ি সামনে ছিল সেটি পরে সোজা চলে যাই খোকার বাড়িতে রিক্সা নিয়ে। খানিকটা আলু থালু, খানিকটা ঘরোয়া বেশে খোকার বাড়িতে ঢুকি। ভেবেছিলাম আমাকেই কেবল খেতে বলেছেন খোকা। কিন্তু ঘরে ঢুকে চমকে উঠি। দেখি আফজাল বসে আছে, সঙ্গে তার স্ত্রী। নতুন বিয়ে করেছে, বউকে সঙ্গে নিয়ে এসেছে। বিয়ে করেছে বলে, বউ আছে বলে সঙ্গে আফজাল-মোহ আমার দূর হয়নি মোটেও। কিন্তু সমস্ত আবেগ আমি কিছু একটার তলে চাপা দিয়ে রাখি। প্রকাশক তাঁর দুই লেখককে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। লেখক আফজালের সঙ্গে লেখক তসলিমার যে রকম সৌজন্য কথাবার্তা হওয়া মানায় সেরকমই কথা হয়েছে। তখন আমি আর সেই হৈ হৈ করা দর্শক শ্রোতার সামনে গল্প পাঠ না করতে পেরে মঞ্চ থেকে নেমে যেতে বাধ্য হওয়া তসলিমা নই, দেশের জনপ্রিয় লেখক, আনন্দ পুরস্কার পাওয়া তসলিমা। তবে কোনও অহংকার আমার চিবুক উঁচু করায়নি। যে মানুষের জন্য গোপনে গোপনে তৃষ্ণা থাকে, তার সামনে এলে সব অহংকার কাঁচের বাসনের মত ভেঙে পড়ে।

স্বপ্নের পুরুষ স্বপ্নেই থেকে যাওয়াটা হয়ত ভাল। নিত্যদিনের সংসারযাপনে স্বপ্নকে এনে ধুলো না লাগানোই হয়ত ভাল। স্বপ্ন চিরকাল নাগালের বাইরে থাক, পরিচ্ছত থাক, ঝকঝকে সুন্দর থাক। ধরা ছোঁয়ার বাইরে থাক স্বপ্ন। জীবন ভর স্বপ্নের ঘুড়ি ওড়াবো আকাশে, কোনওদিন ভোঁ কাট্টা না হোক সেই ঘুড়ি। আনন্দ থাক স্বপ্ন নিয়ে। এই ভেবে ভেবে স্বপ্নকে দূরে রেখেছি নিজের দুঃখ শোক থেকে, নিজের কালি কালিমা থেকে। নিজেকে বরং ধুলো কাদায় মাখিয়েছি। শরীরের প্রয়োজনে শরীর বিনিময় হয়েছে কিছু পুরুষের সঙ্গে। প্রথম শরীরী সুখ আবিস্কারের উত্তেজনা ছিল রুদ্রর সঙ্গে। রুদ্র যখন জীবনে নেই, তখন এক এক করে মিলন, নাইম, মিনারের সঙ্গে হল শরীরের ছোঁয়াছুঁয়ি খেলা। এ খেলায় আমার সুখ হলেও তাদের সুখই ছিল প্রধান। কলকাতায় জালালের সঙ্গেও তিনটে রাত কেটেছে বিচিত্র সম্ভোগে। এক সন্ধেবেলায় এসে জীবনের গল্প বলেছিল সে। সারারাত তার গল্প শুনেছি, কী করে তার প্রেম হয়েছিল, বিয়ে হয়েছিল, কী করে সেই বিয়ে ভেঙেছে, কি করে একাকীত্ব তাকে নাশ করে দিচ্ছে। মদ্যপান করতে করতে কথা বলছিল সে, ভোর হবার আগে আগে মদ্য পান শেষ হলে হঠাৎ আমাকেই আমূল পান করতে শুরু করে। আমি না বলি না। না বলি না এই কারণে যে, আমি না বলতে পারি না তা নয়, না বলার কোনও প্রয়োজন মনে করি না, তাই না বলি না। জালাল আমার প্রেমে পড়েনি, সে তখন প্রেম করছিল চিত্রা লাহিড়ী নামের এক উঠতি কবির সঙ্গে। শরীর তো হল, কিন্তু শরীরই তো শেষ কথা নয়। বাঁশির সঙ্গে প্রেম না হলে বাঁশি দীর্ঘদিন বাজে না। আমার আনন্দ পুরস্কার পাওয়ার খবরে জালাল খুশি হয়েছিল, কিন্তু খুশিটি কি তেমন খুশি ছিল! একটি চিকন ঈর্ষা দেখেছি তার চোখের তারায়। পুরস্কার অনুষ্ঠান থেকে ফিরে এসে বলেছিল, আমি নাকি যৌন শব্দটি খুব বেশি ব্যবহার করেছি। অবশ্য বলেছে এটি তার নিজের মন্তব্য নয়, অনুষ্ঠানে তার পাশের চেয়ারে বসা একটি লোকের মন্তব্য। কিন্তু কেন জালাল এটি শোনাতে গেল আমাকে! তার নিজেরও হয়ত তাই মনে হয়েছে। জালাল যৌনতাকে গোপনে রাতের জন্য রেখে দিতে চায়, যৌনতার উদ্দেশ্য নিয়ে কোনও মেয়ের একলা ঘরে গিয়ে নিজের করুণ গল্প শুনিয়ে মেয়েকে কাতর করে মেয়ের ওপর ঝাঁপিয়ে নিজের যৌনক্ষুধা মেটাতে চায়, কিন্তু দিনের আলো ফুটলে জনসমক্ষে যৌনতার কোনও প্রসঙ্গ সে প্রসঙ্গ শ্লীল হলেও জিভে আনা তার কাছে অশ্লীলতা। মুসলমান ঘটিদের মুসলমানের শহর ঢাকায় বেড়ানোর খুব শখ। জালাল ঢাকায় বেড়াতে এসে আমার বাড়িতে উঠেছে। অবশ্য আমি কোনও সঙ্গ দিতে পারিনি, নিজেই সে ঘুরে বেড়িয়েছে একা, চেনা পরিচিতদের সঙ্গে দেখা করেছে। জালালের কোনও গল্প আমাকে আর কাতর করেনি। আসলে আমার সময়ই ছিল না তার গল্প শোনার। বাড়িতে সে স্নান করছে, খাচ্ছে, বেরিয়ে যাচ্ছে, ফিরে আসছে। আতিথেয়তার কোনও ত্রুটি হয়নি। ত্রুটি হয়ত ছিল না, কিন্তু শীতলতা ছিল। জালাল যদি ভেবে থাকে যে আমার শরীরটি সে হাত বাড়ালেই পাবে, তবে তার ভাবনার ঘাড়ে একটি হাতুড়ির আঘাত পড়েছে এই যা। রাতে আমি আমার ঘরের দরজা ভাল করে সেঁটে ঘুমিয়েছি। জালাল মিলনের ঘরে গিয়ে কখন ঘুমিয়েছে, কখন উঠেছে তার কোনও খবর রাখা আমার হয়ে ওঠেনি। আমার তো ভোরবেলা হাসপাতালে চলে যেতে হয়। আমার তো গোটা দিন বা রাতের অবসর নেই যে সময় দেব! কলকাতা আর ঢাকা এক নয়। কলকাতায় আমি ছুটি কাটাই। ঢাকায় আমার আকণ্ঠ ব্যস্ততা। শরীরে পুরুষের স্পর্শ না থাকলেই শরীর যে কোনও পুরুষের জন্য জেগে ওঠে না। এ শরীরের অভ্যেস আছে পুরুষস্পর্শহীন দীর্ঘবছর কাটিয়ে দেওয়ার। তাছাড়া খানিকটা হলেও মন চাই। অতি রাতে অতি আবেগে কিছু অতিউর্বর শুক্রাণুর আক্রমণে ঋতুস্রাব বন্ধ করে বসে থাকব, আর নাইম এসে নিজের কীর্তি ভেবে গর্ভপাতে সাহায্য করবে, এতে নাইমের ওপর শোধ নেওয়া হয়ত হয়, আমার শরীরে বা মনে কোনও সুখ হয় না। জালাল বলে আমি নাকি খুব পাল্টো গেছি। পাল্টো হয়ত কিছুটা গেছিই, পাল্টাবো না কেন, মন তখন আমার কায়সারে।

আমার যদিও বিশ্বাস ছিল, পুরুষের সঙ্গে প্রেম এ জীবনে আমি আর করছি না অথবা কোনও পুরুষের সঙ্গে নিজের এই জীবনটি আমি আর জড়াচ্ছি না, কিন্তু খানিকটা জড়িয়ে পড়ি আমি, অনেকটা ইচ্ছে করেই পড়ি। ভেবেছিলাম নিজের সংসার নিয়ে, ডাক্তারি নিয়ে,সাহিত্য সংস্কৃতি নিয়ে চমৎকার বাকি জীবন কাটিয়ে দেব, পুরুষের কোনও প্রয়োজন আমার জীবনে নেই। কিন্তু একদিন ঠিকই আশ্চর্য সুন্দর এক যুবককে দেখে চোখ ফেরাতে পারি না। বার বার চোখ যায় যুবকের দৈর্ঘে প্রস্থে, ডাগর দুটো চোখে, খাড়া নাকে, যুবকের গোলাপি ঠোঁটে, মিষ্টি হাসিতে। যে তৃষ্ণাতুর চোখে পুরুষেরা দেখে কোনও রূপবতী রমণীকে, সে চোখে আমি কায়সারের রূপ দেখি। সুদর্শন যুবকের জন্য আকাঙ্খা আমার সারা জীবনের। জীবনে সাধ মেটেনি। সাধ না মেটা হৃদয়টি কায়সারকে কামনা করে। অবশ্য মনে মনে। কিন্তু মনের কথাটি খুব বেশিদিন মনের মধ্যে বসে থাকেনি। শেরাটনের স্ক্রু ড্রাইভার এক রাতে হাট করে খুলে দিল বন্ধ অর্গল। কায়সার কোনও ডাক্তার নয়, লেখক নয়। কায়সার আমার কোনও বই পড়েনি। কলকাতার আজকাল পত্রিকার সাংবাদিক বাহারউদ্দিন আমার বাড়িতে বেড়াতে এসেছিলেন তাঁর জয়দেবপুরের বন্ধু কায়সারকে নিয়ে। তখনই কায়সারকে আমি প্রথম দেখি। বাহারউদ্দিন কলকাতা ফিরে যান, কিন্তু কায়সার ফিরে ফিরে আসে আমার বাড়িতে। কায়সারের জগত আর আমার জগতে কোনও মিল নেই। এক জগতের মানুষের সঙ্গে তো অনেক হয়েছে, এবার অন্য জগতে ঢুকে দেখি না কেন, কেমন সে জগতের চেহারা! টেলিফোনের জন্য আবেদন করে রেখেছি বছর আগে, এখনও টেলিফোন পাওয়ার খবর নেই। কায়সার আগ বাড়িয়ে বলে, সে চেষ্টা করবে টেলিফোন পেতে, তবে আমাকে যেতে হবে টেলিফোন মন্ত্রীর বাড়ি। আমাকে সে টেলিফোন মন্ত্রীর বাড়িতে নিয়ে যায় একদিন। বাড়ি যাওয়া মানে চা বিস্কুট খাওয়া আর মন্ত্রী যা বলবে, মন দিয়ে শোনা আর হেসে বিদেয় নেওয়া। কায়সারের অনুরোধে মন্ত্রী আমার টেলিফোনের আবেদনে নজর দেন। সে কারণেই আমার টেলিফোন পাওয়া হল। তা না হলে টেলিফোনের দেখা কখনও মিলত কী না সন্দেহ। ময়মনসিংহের বাড়িতে আমি নিজে টেলিফোন নিয়েছিলাম, আমাকে কোনও মন্ত্রীর বাড়ি দৌড়োতে হয়নি, আবেদন করেছি, মিলেছে। কিন্তু ঢাকা যেহেতু ময়মনসিংহ নয়, তাই শুধূ আবেদনে চিড়ে ভেজে না। আজকাল দুর্নীতি এমনই বেড়েছে দেশটিতে যে কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা ঘুষ না দিয়ে কোনও আবেদনের কাগজ এক টেবিল থেকে আরেক টেবিলে সরানো যায় না। ওপরতলায় খাতির থাকলেই কাগজের পা গজায়। কায়সারের কল্যাণে বাড়িতে টেলিফোন আসায় তার কদর বেড়ে যায় আমার বাড়িতে। এরশাদ আমলে কায়সার ছিল গাজিপুর উপজেলার চেয়ারম্যান। এ নিয়ে তার অহংকারের শেষ নেই। কায়সারের জগত সম্পর্কে যখন আরও জানা হয় আমার, দেখি সেই জগতটি ক্ষমতার রাজনীতির আর দুর্বোধ্য ব্যবসা বাণিজ্যের। কায়সার কোনও বড় রুই কাতলা নয়, নিতান্তই পুঁটি মাছ এই ঘোলা পুকুরে। রুই কাতলা হওয়ার শখ তার খুব। কায়সার যখন বীরদর্পে তার সম্পর্কে যেন উচ্চ ধারণা লালন করি, বলতে থাকে যে তার সঙ্গে এই মন্ত্রীর চেনা আছে, ওই মন্ত্রী তার বন্ধু, এই নেতা তার আত্মীয়, ওই নেতা তাকে মান্য করে, শুনতে বড় জঘন্য লাগে। আমি বুঝি যে কায়সারের জীবন আর আমার জীবন সম্পূর্ণই আলাদা। তার ওপর কায়সার বিবাহিত, ঘরে দুটো মেয়ে আছে। একজনের নাম অনন্যা আরেকজনের নাম সুখ। সুখ নামটি, কী অদ্ভুত, আমি ভেবেছিলাম নিজের যদি কখনও মেয়ে হয়, রাখব। কায়সারের বউ হেনু, বেটে, ধবধবে ফর্সা গোলগাল মেয়েমানুষ। হেনুর সঙ্গে একবারই মাত্র আমার দেখা হয়েছে। তাও নির্মলেন্দু গুণের কারণে। গাড়িতে হেনুকে রেখে কায়সার আমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছিল। গুণ তখন আমার বাড়িতে ঢুকতে গিয়ে গাড়িটি দেখেন। ঘরে ঢুকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কে বসা গাড়িতে, কায়সারের বউ নাকি!’ কায়সারের মুখ মুহূর্তে ফ্যাকাসে হয়ে ওঠে। এরপর আমিই কায়সার আর গুণকে নিয়ে নিচে যাই বউটিকে দেখতে। হেনুর কথা কায়সার পারতপক্ষে আমার কাছে বলে না, আমি জানতে চাইলে দ্রুত প্রসঙ্গ পাল্টো ফেলে। হেনুকে নিয়ে এমন কী নিজের দুটো মেয়ে নিয়েও তার অস্বস্তির শেষ নেই। যদি প্রমাণ করতে পারত যে বাড়িতে তার কেবল মা আছে, ভাই আছে, কোনও বউ বাচ্চা নেই, তাহলে যেন সে আরাম পেত। কিন্তু কায়সারের বউ বাচ্চা নিয়ে আমার কোনও অস্বস্তি হয় না যখন সে মুগ্ধ চোখে আমার দিকে তাকায় বা আমার একটি হাত সে ছুঁতে চায় নিঃশব্দে। আমি আমার হাতটিকে দূরে সরিয়ে রাখি না। যখন ঠোঁট বাড়ায় ঠোঁটের দিকে, খুব সহজেই আমার ঠোঁট কায়সারের ঠোঁটের নাগালে চলে আসে। এটি যত না কায়সারের প্রয়োজনে, তার চেয়ে বেশি আমার নিজের প্রয়োজনে। কায়সার চুপসে থাকে প্রথম দিন, আমার উথলিত উষ্ণ শরীরটির ওপর তার আশঙ্কার আঙুল কাঁপে। ধীরে ধীরে তার সংকোচের বরফ গলে যায় আমার উষ্ণতায়। আমার ছিল শরীরের প্রয়োজন, তার ছিল মনের। কায়সারের শরীর আমাকে দেয় আনন্দ, আমার দ্যূতি তাকে দেয় তৃপ্তি। কায়সারের সঙ্গে আমার কোনও বাঁধন গড়ে ওঠে না। মুক্ত একটি সম্পর্ক আমাদের। যে সম্পর্কে কারও ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে কারও নাক গলানো নেই। সম্পর্কটি নিরেট প্রয়োজনের জন্য, অথবা ঠিক তার জন্যও নয়। সম্পর্কটি কিছুর জন্যই নয়, যদি কিছুর জন্য হয়ও, ঠিক কিসের জন্য তা নিয়ে কেউই আমরা প্রশ্ন করি না, সম্পর্কটি টিকে থাকে, সম্পর্কটিতে কোনও ক্ষতি নেই বলে সম্পর্কটি টিকে থাকে। কায়সার এমন যে তাকে না হলেও চলে, আবার তাকে না হলেও চলে না। পর পর চারদিন এল কায়সার, এরপর পাঁচ দিনের না এলে মনে হয় কী যেন কি হয়নি আজ। এ বাড়িতে সে অনেকটা অভ্যেসের মত। দু সপ্তাহ আসেনি, দুসপ্তাহ পর হঠাৎ তার উপস্থিতি খানিকটা চমক আনে।

‘কী কায়সার ভাই। আপনে ত লাপাত্তা হইয়া গেছেন। এই বাড়ির রাস্তা ভুইলা গেছেন নাকি! খিরাজ টিরাজ আজকাল কেমন জুটতাছে কন!’

‘দূর মিলন, বাজে কথা বলবা না ত!’

কায়সার গম্ভীর হওয়ার চেষ্টা করে।

কায়সারের চেয়ারম্যানি এখন নেই আর। জয়দেবপুর থেকে প্রতিদিন ঢাকা এসে মতিঝিলের বিভিন্ন আপিসে ঢুঁ মারে। আমি অনুমান করতে পারি না তার জীবিকার উৎস। বলে তার ব্যবসা আছে, পার্টনার আছে, পার্টনারদের সঙ্গে ব্যবসার কথাবার্তা বলতে সে ঢাকা আসে। কায়সারের জীবিকা নিয়ে যখন প্রশ্ন জাগে, মিলন বলে, ‘আরে বুবু, বুঝেন না কেন, কায়সার ভাই খিরাজ খায়।’

‘খিরাজ!’

‘হ খিরাজ খায়।’

খিরাজ শব্দটি আমার কাছে সম্পূর্ণ নতুন। খিরাজ মানে কি জিজ্ঞেস করলে মিলন বলে ‘এই আর কি! তোমার ইন্ডাস্ট্রি আমার এলাকায় আছে, তা আমারে কিছু টাকা পয়সা দেও, আমি তোমার ইন্ডাস্ট্রি সামলানোর চেষ্টা করব, কোনও বদলোক তোমার ইন্ডাস্ট্রির ক্ষতি করতে পারবে না। চেয়ারম্যান থাকাকালীন কাউরে বোধহয় ব্যবসায় হেল্প করছিল ক্ষমতা খাডাইয়া, তাদের কাছ থেকে এহন আদায় করে।’

কায়সার এলে জিজ্ঞেস করি, ‘কিরে তুই নাকি খিরাজ খাস?’ খুব অল্পদিনেই সম্বোধন তুইএ চলে এসেছে। আপনি থেকে তুমির সিঁড়িতে পা না দিয়েই লম্ফ দিয়ে তুই এ।

কায়সার মুচকি হাসে। খিরাজ শব্দটি তাকেও হাসায়। এই যে আমি ভাবছি তাকে নিয়ে, তার খিরাজ নিয়ে হলেও তাকে নিয়েই তো ভাবছি, এটুকুই তাকে আনন্দ দেয়। কায়সারের মুচকি হাসিটি সহজে সরতে চায় না।

আমাদের সম্পর্কটি কোনও অর্থেই প্রেমিক প্রেমিকার সম্পর্ক নয়, যদিও কায়সার মনে প্রাণে তাই কামনা করে, কিন্তু কায়সারকে প্রেমিক ভাবা আমার পক্ষে সম্ভব হয় না। কায়সার বন্ধুর মত। ঘরের লোকের মত। কুলসুম নেই বাড়িতে, ঘর মোছা হচ্ছে না কদিন, কায়সারই জামা জুতো খুলে নেমে পড়ে ঘর মুছতে। প্রতিটি আদেশ অনুরোধ অক্ষরে অক্ষরে পালন করে। কায়সার বোঝে যে তার প্রেমে আমি পড়িনি। আমার প্রেমিক হওয়ার জন্য সে মরিয়া হয়ে ওঠে। আমি তাকে সুন্দর বললে সে এমনি আহ্লাদে আটখানা হয় যে সারা মুখ ঝিলমিল করে, মাত্র ছমাস বা বছর খানিক আগে, গর্বিত গ্রীবা নেড়ে বলে, যে, সে আরও সুন্দর ছিল। কায়সারকে দুবছর বয়সী শিশুর মত মনে হয় আমার মাঝে মাঝে। কেবল যে শিশুসুলভ আচরণই সে করে তা নয়। হিংসুটে প্রেমিকের মতও তার আচরণ। আমার বাড়িতে যে লোকই আসে, তার দিকে সন্দেহের চোখে তাকায়। সন্দেহ, কারও সঙ্গে বুঝি গোপনে গোপনে আমার প্রেম হচ্ছে। কায়সারের সন্দেহ দেখে হাসি পায় আবার রাগও ধরে। তার হীনমন্যতার আমি পরোয়া করি না। তাকে পাত্তা দিলেই সে খুশিতে নাচে। পাত্তা না পেলে পাগল হয়ে ওঠে, এই বুঝি তাকে আমি ছুঁড়ে ফেলে দিচ্ছি! না, কায়সারকে ছুঁড়ে ফেলার আদপেই কোনও ইচ্ছে আমার নেই। তবে আমাকে সে কোনও কারণে বিরক্ত করুক তা আমি চাই না। বিরক্ত আমি নিজেকে হতে দিই না। যখনই সে তার কুটকচালের মুখ খোলে, সোজা তাকে বাড়ি থেকে বের করে দিই। আমার জীবনে কোনও হর্তাকর্তা রাখতে আমি রাজি নই। ‘খসরু কে? কেন আসে? কী চায়? আলমগীর লোকটিকে কেন আমি ঢুকতে দিচ্ছি বাড়িতে? রশীদের সঙ্গে কি সম্পর্ক!’ এসব প্রশ্ন করতে গিয়ে সে দেখেছে যে আমি কিছুতেই তার ঘোঁট পাকানো ঘোঁৎ ঘোঁৎ সহ্য করি না। ঔদ্ধত্য আর যেখানেই সে দেখাক, আমার কাছে নয। আমার বাড়িতে কে আসবে না আসবে, আমার জীবন কি করে কি ভাবে চলবে সে আমি বুঝব।

কায়সার নিজের ধনদৌলতের গল্প প্রায়ই করে। তার অঢেল সম্পদ। অঢেল টাকা পয়সা। ঢাকায় বাড়ি বানাচ্ছে সে। নতুন একটি গাড়ি কিনছে। একদিন মিলন, ইয়াসমিন আর আমি কায়সারের বাড়িতে বেড়াতে যাবার জন্য তৈরি হলাম। মহা উৎসাহে যাত্রা শুরু হল। বাড়িতে কায়সারের মা আর অন্য আত্মীয়রা ছিল, কিন্তু হেনু ছিল না, সে কারণেই সম্ভবত সে আমাদের নিয়ে গেছে তার বাড়িতে। জয়দেবপুরে ছোট একটি দোতলা বাড়ি কায়সারের। তার নিজের বাড়ি নয়, তার বাপের বাড়ি। বাড়িটিতে ধন দৌলতের কোনও চিহ্ন দেখা যায়নি। আমাদের নিয়ে কায়সারের কোথায় বসাই কী খাওয়াইএর ব্যস্ততা থাকার পরও মিলনের মন ভরেনি, হতাশ হয়ে বলে, ‘কী বুবু, এত না গপ্প করছিল কায়সার ভাই। ভাবছিলাম সাতমহলা বাড়ি বোধহয় তার। অহন ত দেহি ছাল উডা বাড়ি। ভাঙ্গা চেয়ার টেবিল। তার ওই গাড়িডাই আছে বেডাগিরি দেহানোর লাইগ্যা। গাড়িডা বোধহয় কিনছে খিরাজের পইসা দিয়া।’ নিজেকে ধনকুবের প্রমাণ করতে চেয়ে কায়সার যতই চেষ্টা করে সম্মান পেতে, তত সে আমাদের কাছে সম্মান হারায়। দিন দিন সে একটি হাস্যকর বস্তুতে পরিণত হয়। তার কথা, তার অঙ্গভঙ্গি সবই আমাদের বিকেলের চায়ের সঙ্গে ভাজা মুড়ির মত আনন্দ দেয়। যেন আমরা সার্কাসের জোকার দেখছি, সারাক্ষণই। তবে আমি যখন কায়সারকে নিয়ে আমার শোবার ঘরের দরজা বন্ধ করি, তখন তাকে আমি ভালবাসি। আমাকে সে আনন্দ দেয়। গভীর গোপন আনন্দ। পুরুষকে সুখ দেবার জন্য তাদের শরীরের তলে একটি বস্তু বা মাংসপিণ্ড হিসেবে আমি আর ব্যবহৃত হতে দিই না নিজেকে। আমার অঙ্গে কোনও জোয়ার এসেছে কি না তার খবর কোনও পুরুষই আগে নেয়নি, না নিয়েই ঝাঁপ দিয়েছে স্নান করতে। কায়সারও সে খবর নিত না, যেহেতু পুরুষের অভ্যেস নেই নেওয়ার। কিন্তু তাকে আমি বলি খবর নিতে, চাঁদ হয়ে আমাকে জোয়ার দিতে। বলি আমাকে জাগাতে, বাজাতে। শরীরের প্রতি রোমকূপ স্পর্শ করে করে শরীরকে ভালবাসতে বলি। মগ্ন হতে বলি। কায়সার হয়। আমাকে সে আনন্দ দিয়ে আনন্দ পায়। ধীরে ধীরে এমন হয় যে আমার আনন্দই প্রধান হয়ে ওঠে। আমার সুখের জন্যই সব আয়োজন। কায়সারকে আমিই ভোগ করি। আমার যখন ইচ্ছে তখন। যেভাবে ইচ্ছে সেভাবে। আমার যে তাকে প্রয়োজন, এই ব্যপারটিই তাকে অহংকারী করে তোলে। কায়সার আমাকে আরও নানাভাবে আনন্দ দিতে চায়। আমাকে নিয়ে দূরে কোথাও চলে যায়। আমার জন্য হঠাৎ হঠাৎ কিছু উপহার নিয়ে আসে। আমাকে খুশি করার জন্য সে প্রাণ ঢেলে দেয়। সাধ্য তো আছেই, সাধ্যের বাইরেও অনেক কিছু করতে সে প্রস্তুত হয়। যখন আমাকে মিটফোর্ড হাসপাতাল থেকে বলা নেই কওয়া নেই হঠাৎ বদলি করে দেওয়া হল জামালপুরে, তখন কায়সারের গাড়িতে জামালপুর যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিই। মহানন্দে সে রওনা হয় আমাকে নিয়ে। জামালপুরের সিভিল সার্জন আপিসে গিয়ে চাকরিতে যোগদান করে ছুটি নিয়ে চলে আসব পরদিন, এই কথা। জামালপুরের যাত্রাটি চমৎকার যাত্রা। পথে ময়মনসিংহে থেমেছি, অবকাশে রাত কাটিয়ে পরদিন আবার জামালপুরের দিকে রওনা হয়েছি। ঢাকার ব্যস্ততা ছেড়ে দূরে কোথাও আমার এমন বেরিয়ে পড়া হয় না অনেকদিন। কায়সার গাড়ি চালাতে চালাতে আমাকে তার জীবনের অনেক কথা বলে। তার শৈশব কৈশোরের কথা। তার বাল্যকালের সঙ্গীদের কথা, খেলাধুলার কথা। শেশবগুলো আমাদের এত মেলে যে কায়সার আমার চেয়ে বছর দশেকের বড় হলেও তাকে আমার সমবয়সী বলে মনে হয়। তাকে দেখতেও বয়স কম লাগে, চপলতা তার বয়স কমিয়ে রাখে। ইট পাথরের শহর ছেড়ে ট্রাকের বাসের তীব্র চিৎকার থেকে দূরে গাছগাছালি ঘেরা মাটির বাড়িঘর দেখতে দেখতে দিগন্ত বিস্তৃত ফসলের জমি দেখতে দেখতে শান্ত শান্ত গ্রাম পার হই। দূরে কোথাও যেতে পারলে আমার সবসময়ই ভাল লাগে। জামালপুরের সার্কিটহাউজে আমাদের থাকার ব্যবস্থা হয়। সিভিল সার্জন দুটো ঘরের ব্যবস্থা করতে চেয়েছিলেন, বলেছি একটি ঘরেই আমাদের চলবে। প্রশ্ন করেন, উনি কি আপনার স্বামী?

না।

তাহলে দুটি ঘর..

না, একটা ঘরেই আমাদের চলবে।

আমাদের বয়স সেদিন কমে গিয়ে ষোলোয় পৌঁচেছিল! উত্তেজিত উন্মত্ত উচ্ছঅল শরীর সপ্তম আকাশেই ঘুরে বেরিয়েছে সারারাত। কায়সারকে এত আনন্দ পেতে আগে দেখিনি। আমাকে একা করে পাওয়া তার হয় না এমন। ঢাকার ব্যস্ততা থেকে বহু দূরে দুজনের কেবল দুজনের জন্য সময় কাটানোর এমন একটি সুযোগ তার জন্য স্বর্গ পাওয়া। ঢাকায় আমার সময় হয় না তেমন কায়সারকে সময় দেবার। কিন্তু যেটুকু সময়ই আমার জোটে তার জন্য, তার মন না ভরলেও আমার মন ভরে। কায়সারের সঙ্গে ঘন ঘন কদিন দেখা হয়, আবার অনেকদিনের জন্য সে উধাও, তখন মন কেমন কেমন করে। কায়সার কেবল খুঁিটনাটি খুনসুটির জন্য নয়, গভীর গম্ভীর আলোচনার জন্যও। ‘কি রে তোর কাছে কোনও চাকরি টাকরি আছে নাকি, একটা চাকরি দে তো আমার এক ফুপাতো ভাইয়ের জন্য।’ তার একটি অভ্যেস, কোনও কিছুতে কখনও সে না বলে না। তার ক্ষমতা না থাকলেও সে কথা দেবে সে চাকরির ব্যবস্থা করবে। চেষ্টা করে সে। অনেক কিছু করারই চেষ্টা করে। বেশির ভাগ কথাই সে রাখতে পারে না। ফুপাতো ভাই মোতালেব অনেকদিন বেকার বসে আছে। আমার কাছে প্রায়ই আসে একটি চাকরির জন্য। এই অভাবের অনিয়মের দেশে কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে পাশ করলেও চাকরি পাওয়া যায় না। কারও অর্থনৈতিক অবস্থা মোটামুটি রকম চলনসই হলেই অভাবী আত্মীয়দের ভিড় বাড়ে। কেউ আসে টাকা পয়সার সাহায্যের জন্য, কেউ চাকরি বাকরির জন্য। আমার নিজের তো ক্ষমতা নেই কাউকে চাকরি দেবার। সুতরাং আমার অনুরোধে কায়সারই রুটি বানানোর কারখানার মালিক বন্ধুকে ধরে বিএসসি পাশ মোতালেবকে একটি কাজ দিল। ছোট কাজ। তবু তো কাজ! বেকার যুবকেরা যে কোনও কাজ পেয়েই বর্তে যায়। কায়সারের এই কৃতিত্বে তার প্রতি আমার কৃতজ্ঞতা বাড়ে। এটিই চায় সে, সে যে নিতান্তই তুচ্ছ কোনও বস্তু নয়, তারও যে কিছু হলেও ক্ষমতা আছে, সেটি সে ব্যগ্র হয়ে বোঝাতে চায়। কায়সার তার লাল গাড়িটিতে আমাকে পাশে বসিয়ে তার ধনী বন্ধুদের আপিস বা বাড়িতে নিয়ে গিয়ে আমাকে মুগ্ধ করতে চায়। কিন্তু সে দেখে এসব আমাকে মুগ্ধ করে না। একবার কাকরাইলের মোড়ে তার গাড়ির সঙ্গে একটি রিক্সার ধাককা লাগল, গাড়ি থামিয়ে ছুটে গিয়ে সে রিক্সাঅলাকে বেদম মার দিতে লাগল। গাড়ির ভেতর থেকে চেঁচিয়ে তাকে থামতে বলেও পারি না থামাতে, শেষ পর্যন্ত গাড়ি থেকে নেমে মোড় ভর্তি মানুষের সামনে তাকে টেনে এনে গাড়িতে ওঠাতে হয়। কায়সার গজরাতে থাকে তার গাড়িতে দাগ পড়েছে বলে। তার অমানুষিক কাণ্ড দেখে এমনই আমার রাগ হয়েছিল যে তাকে আমি আমার বাড়িতে ঢুকতে দিইনি কয়েকদিন। ধীরে ধীরে কায়সার বোঝে যে আমি তার গায়ের শক্তি আর তার চেয়ারম্যানি শক্তিকে মোটেও পছন্দ করছি না। সে আমার পছন্দ পেতে এরপর মানবিকতার গল্প শোনাতে থাকে। জয়দেবপুরের অনেক গরিব লোক তার কাছে আসে সাহায্য পেতে এবং সে তাদের এই দিয়ে ওই দিয়ে সাহায্য করে। কায়সার আমার আড়ালে কেমন তা আমার জানা হয় না, আমার কাছে এসে তাকে মানবিক হতেই হয়। আবেগে একদিন সে কবিতা লিখতে শুরু করে। কবিতাগুলো সবই আমাকে উদ্দেশ্য করে। আমি যখন সাংবাদিক বা সাহিত্যিকদের সঙ্গে ব্যস্ত কথা বলায়, কায়সার ঘণ্টা দুঘণ্টা আমার জন্য অপেক্ষা করে আর কবিতা লেখে। কখনও ‘কিরে তুই তো ভালই লিখতে পারসঞ্চ বললে সে রঙিন হয়ে ওঠে সলজ্জ অহংকারে। লেখায় আরও মন দেয়। সেও যে লিখতে পারে, কেবল আমি নই, সেটি সে আমাকে দেখাতে চায়। জীবনে যে লোক কোনও বই পড়েনি, সে বই পড়তে শুরু করে। কায়সারের সঙ্গে আমার অতিসহজ অতিসরল অনিয়মিত কিন্তু বাঁধা সম্পর্কটি থেকে যায়। সম্পর্কটি কোনও পীড়নের সৃষ্টি করে না। সম্পর্কটি আমার সময় নষ্ট করে না। সম্পর্কটিকে জল সার দিয়ে বড় করার চেষ্টা করতে হয় না। সম্পর্কের কোনও পরিণতি নিয়ে ভাবতে হয় না। সম্পর্কটি আমার দুশ্চিন্তা ঘোচায়। পুরুষহীন-একাকীত্বের যন্ত্রণা ঘোচায়। কায়সার আমার কাছে কখনও যুবক, কখনও শিশু। কখনও সে দৃশ্যমান, কখনও সে অদৃশ্য। তবে সে যতক্ষণ আমার সামনে থাকে, সে আমার, সম্পর্ণই সে আমার। সে মানুষ কিম্বা অমানুষ সে আমার। সে শত্রু কিংবা বন্ধু, সে আমার। আমার রাগ, দুঃখ, আমার কষ্ট, সুখ সব তার ওপর বর্ষণ করতে পারি আমি। রাগ হলে ছিঁড়ে রক্তাক্ত করলাম, কষ্ট হলে কাঁদলাম, সুখ হলে হৈ চৈ করলাম, নিঃশব্দে কিন্তু সাদরে সে বরণ করে সব। কখনও তাকে বুকের কাছে নিয়ে আদর করছি, কখনও ধমকে বিদেয় করছি। কায়সার রাগ করে না কোনও চড়, ঘুষি, লাথিতে। সে জানে আবার তাকে আমি বুকে নেব। হয়ত সে বোঝে, যে, তার জন্য আমার একধরনের ভালবাসা আছে। আসলে, আছে। ভালবাসা আমার প্রিয় পুতুলটির জন্যও তো আমার আছে। বাইরের হাজার রকম কাজের পর সারা দিনের শেষে একটি নিজের কিছু সে মানুষ হোক, সে বস্তু হোক, মানুষ চায়। কায়সার আমার সেরকম। কায়সার আমাকে ভালবাসে, এটি আমাকে স্বস্তি দেয়, এটি আমাকে সুখ দেয়, আমাকে নিরাপত্তা দেয়, আমাকে মুক্তি দেয়, আমাকে ব্যস্ত হতে দেয় কাজে। কায়সারকে, আমি না অনুভব করলেও, এটা ঠিক, যে আমার ভীষণ রকম প্রয়োজন। তাকে নিয়ে আমি যে কোনও কোথাও যেতে পারি। কোনও কুণ্ঠা আমার ত্রিসীমানায় ঘেঁসে না। আমার সাহিত্যিক বন্ধুদের বাড়িতে তাকে নিয়ে যাই অথবা তারা আমার বাড়িতে এসে কায়সারকে দেখে, আমাদের আড্ডায় এক কিনারে সে যখন চুপচাপ বসে থাকে। কেউ আমাকে জিজ্ঞেস করে না, এ কে, এর সঙ্গে কী আমার সম্পর্ক। আমি অনুমান করি যে তারা অনুমান করে নিচ্ছে সম্পর্কটি কি! এতে কারও কারও চোখ হয়ত কপালে ওঠে। কারও কপালের চোখের দিকে আমি মোটেও ফিরে তাকাই না। ফিরে না তাকালেই কপালের চোখ ধীরে ধীরে চোখের জায়গায় ফিরে আসে।

বাড়িতে বোন আছে, বোনজামাই আছে, কুলসুম আছে, এমন কী মা আছেন, আর আমি কায়সারকে আমার শোবার ঘরে নিয়ে দরজা বন্ধ করছি। কেউ এ নিয়ে কোনও কথা বলে না, এমন কী মাও নন। আমি ঘর থেকে বেরিয়ে এলে আমি নই, মা বরং নিজেকে লুকিয়ে রাখেন অন্য ঘরে যেন মাকে দেখে আমার কোনও সংকোচ না হয়। আমার সুখে তিনি বাধা হয়ে দাঁড়ান না। মা আমাকে সুখী দেখতে চান, আমাকে তৃপ্ত দেখতে চান।

মা এত বেশি আমাকে নিয়ে ভাবেন যে আমার অর্থনৈতিক কোনও দুরবস্থা না থাকলেও তিনি আমার খরচ নিয়ে দুশ্চিন্তা করেন। তিনি থাকলে তাঁর জন্য বাড়তি খাবার দরকার হয়, তাই তিনি চলে যান ময়মনসিংহে। ময়মনসিংহ থেকে চাল ডাল আনাজপাতি যখনই যা তিনি সংগ্রহ করতে পারেন, নিয়ে উদয় হন। বসে বসে দীর্ঘদিন সেই অন্ন ধ্বংস করতে তিনি রাজি নন বলে আবার উধাও হন। উধাও হওয়ার আগে অবশ্য কুলসুমকে শিখিয়ে দিয়ে যান আমাকে যত্ন করার সকল রকম পদ্ধতি। আমি কি অনেকটা বাবার মত হয়ে যাচ্ছি! বাবার মত প্রতাপ আমার। সংসার চলে আমার টাকায়, সম্পূর্ণই আমার নির্দেশে। শান্তিবাগের বাড়িতে যেমন সবাই আমাকে সমীহ করে চলে, আমার কখন কী প্রয়োজন, তা আমি না চাইতেই হাতের কাছে এগিয়ে দেয়, অবকাশের লোকেরাও বুঝে শুনে কথা বলে। বাবাও আমার দিকে আর কড়া চোখে মুখ খিঁচিয়ে তাকান না বরং তিনি আমাকে স্বর নরম করে বলেন, ‘তোমার কি কোনও পরিচিত কেউ আছে কোনও কোনও চাকরি টাকরি দেওয়ার! থাকলে মঞ্জুরে কোনও রকম একটা চাকরির যোগাড় কইরা দিও।’ মঞ্জু ঈমান কাকার ছেলে। লেখাপড়া করেনি বেশি। বাবা যেমন তার নান্দাইলের বাড়ির সবার লেখাপড়া চাকরি বাকরির দেখাশোনা করেন, আমাকেও ওরকম করতে হয় অনেকটা। খসরুকে বলে মঞ্জুকে একটি চাকরি জুটিয়ে দিই। সাভারে খসরুর জেনারেটর তৈরির কারখানা আছে, সেই কারখানায় অল্প বেতনে শ্রমিকের একটি চাকরি। আমাদের কোনও বড় বড় মামা কাকা নেই কোনও উঁচু পদে, যাদের কাছে বিপদে আপদে সাহায্যের জন্য যাওয়া যায়। আত্মীয় স্বজনদের মধ্যে যদি কারও যশ খ্যাতি প্রতিপত্তি থাকে, সে বাবার। এরপর যতটুকু যা আছে, আমার। মঞ্জুকে আর মোতালেবকে খসরু আর কায়সারকে বলে চাকরি দুটো দিয়ে সংসারে বাবার মত একটি অবস্থান হয় আমার। কায়সারকে নিয়ে আমি অবকাশে গিয়েছি, বাবা একবারও প্রশ্ন করেননি কে এই ছেলে কী পরিচয়, কেন তার সঙ্গে আমি মিশছি। আসলে এসব প্রশ্নের অনেক উর্ধে আমি। এ কী কেবলই আমি স্বনির্ভর বলে! তা ঠিক নয়। আমি তো আরমানিটোলায় থাকাকালীনও স্বনির্ভর ছিলাম। এ তবে কী কারণে! আমি দায়িত্ববান বলে! ইয়াসমিন আর মিলনের দায়িত্ব নিয়েছি বলে! অন্তত আমার বাড়িতে তাদের থাকা খাওয়ার! নাকি আমি বড় হয়েছি বলে। অর্থাৎ বয়স হয়েছে বলে! কত আর বয়স, তিরিশও তো হয়নি। নাকি আগের চেয়ে আমার য়চ্ছলত! বেশি বলে! নাকি আমাকে বলে কোনও লাভ হয় না বলে, আমি কারও উপদেশের তোয়াককা করি না বলে! নাকি আমার নাম হয়েছে বলে! নাম তো তখনও আমার ছিল, যখন আমাকে আমার সুখের সংসার ভেঙে ঘাড় ধরে বাবা আমাকে ময়মনসিংহে নিয়ে এসেছিলেন বন্দি করার জন্য! নাকি এখন আমার বেশি নাম হয়েছে বলে! যে কারণেই হোক আমার ভাল লাগে যে আমার কোনো কাজে আমাকে কেউ বাধা দেবার নেই। স্বাধীনতার সত্যিকার স্বাদ আমি উপভোগ করি।

বন্ধু, শুভাকাঙ্খী, কবি সাহিত্যিক কেউ না কেউ আমার বাড়িতে প্রায় প্রতিদিনই আসছেন। সাহিত্য সংস্কৃতি রাজনীতি সমাজ নিয়ে ধুম আড্ডা হচ্ছে। ঘন ঘন চা পান হচ্ছে। দুপুর বা রাতের খাবার সময় হলে খাবার দেওয়া হচ্ছে টেবিলে। যার যখন ইচ্ছে খেয়ে নিচ্ছে। অতিথি আপ্যায়নেও আমি মার স্বভাব পেয়েছি। কলকাতা থেকে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় এলেন, শরৎ মুখোপাধ্যায় আর বিজয়া মুখোপাধ্যায় ঢাকায় বেড়াতে এসে দেখা করে গেলেন। যে কারুকে আমি আপ্যায়ন করতে পারি, বন্ধুদের যে কেউ আমার বাড়িতে যে কদিন ইচ্ছে কাটাতে পারে, এমনই সুস্থ সুন্দর মুক্ত একটি পরিবেশ আমি ধীরে ধীরে তৈরি করে নিয়েছি। ঠিক যেরকম আমি চাই, সেরকম করে আমার সংসার, আমার জগত এবং জীবন সাজিয়েছি। আত্মীয় স্বজনের চেয়ে বন্ধুরাই আমার কাছে বেশি বড়, বেশি আপন। অবসর বলে যদি কিছু থেকে থাকে আমার, বন্ধুদের জন্যই রাখি। কালো পাহাড়ের মত মানুষটি যার মুখে কখনও হাসি ফুটতে দেখিনি সেই বাদল বসু এলেন আনন্দ থেকে নতুন প্রকাশিত বই নষ্ট মেয়ের নষ্ট গদ্য নিয়ে। বাদল বসুকে কাছ থেকে জানলে তিনি যে মোটেও বেরসিক মানুষ নন, তা বোঝা যায়। তাঁর মুখে হাসি তো ফোটেই, খুব ভাল ফোটে। ফুটলে কি হবে, আমার মুখের হাসিটি নিবে গেল যখন নষ্ট মেয়ের নষ্ট গদ্যের পাতায় পাতায় মারাত্মক মারাত্মক ভুল দেখলাম। ‘এ কি! বইটির কি প্রুফ দেখা হয়নি!’ বাদল বসু বই ঘেঁটে বিষণ্ন মুখে বললেন, ‘সব্বনাশ হয়ে গেছে, প্রুফ দেখা হয়নি।’

‘বই বিক্রি করা তাহলে বন্ধ করুন।’

বাদল বসুর মত ডাকসাইটে লোকের মুখের ওপর বলে দিতে পারি ছাপা হওয়া পাঁচ হাজার বইয়ের বিক্রি বন্ধ করে দিতে। একটি ঝকঝকে সুন্দর পঈচ্ছদের নতুন বই হাতে নিয়ে মন ভালর বদলে মন খারাপ হয়ে থাকে। বাদল বসু বললেন ‘ছাপা যখন হয়ে গেছে তখন বিক্রি হয়ে যাক। এর পরের সংস্করণে ভুল সংশোধন করা যাবে।’ কিন্তু যে পাঠকেরা এই বইটি কিনবে তারা তো ঠকে যাচ্ছে, একটি শুদ্ধ বাক্যও পাবে না বইটিতে! ভাববে আমিই বুঝি এরকম ভুল ভাল লিখেছি। এত বড় প্রকাশনীটি নিজেদের ভুলের প্রায়শ্চিত্য করেনি, লেখকের অনুরোধের পরও বই বিক্রি বন্ধ হয়নি। বাংলাদেশের প্রকাশনীগুলো আনন্দ পাবলিশার্স থেকে অনেক ছোট। কিন্তু আমি যদি ছোট প্রকাশনীর ছোট প্রকাশকদের বলতাম প্রুফ না দেখা বই বাজারে না ছাড়তে, আমার বিশ্বাস তারা আমার কথা রাখতেন। আনন্দ আমাকে দীর্ঘদিন বিষাদে ভরিয়ে রাখে।

কিন্তু কতদিন আর বিষাদ পুষে রাখা যায়! জীবনে মনস্তাপ, সন্তাপ, বিষাদ, বিধুর, পীড়া পরিতাপের তো শেষ নেই। বিষাদকে একপাশে সরিয়ে রেখে নতুন কাজে নতুন উদ্যমে ঝাঁপিয়ে পড়তে হয়। চারদিকের কুৎসা রটনা, নিগ্রহ নৃশংসতা, ঈর্ষা পরশ্রীকাতরতার থিকথিকে কাদার ওপর আমি জানি আমাকে মেরুদণ্ড শক্ত করে চলতে হবে, না চললে যে কোনও মুহূর্তেই আমি হোঁচট খাবো। ভেঙে যাবো। আমাকে ভেঙে ফেলার জন্য হাতে হাতে হাতুড়ি। জনপ্রিয়তার যত ভাল দিক আছে, তত মন্দ দিকও আছে। ভাল দিকগুলোর মধ্যে আমাকে আর পত্রিকা আপিসে যেতে হয় না লেখা দিতে, পত্রিকা থেকেই লেখা নিয়ে যেতে লোক পাঠানো হয়। যাই লিখি না কেন, যেমনই লিখি না কেন, ছাপা হয়। প্রকাশকরা টাকা রেখে যান বাড়িতে। জীবনে যে টাকা নিজের জন্য কখনও কল্পনা করতে পারিনি, সে সব অংকের টাকা আমার টেবিলে যে কোনও ঠোঙার কাগজের মত পড়ে থাকে। মন্দ দিক অনেক আছে। ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি। একাধিক বিয়ে করেছি এর অর্থ একাধিক পুরুষের সঙ্গে শুয়েছি (আমার স্বামী তালিকায় এমন অনেক লোকের নাম আছে, যাদের নাম আমি জীবনে শুনিনি)। আমি বেলাজ, বেহায়া, চরিত্রহীন। সুনীলের সঙ্গে খাতির ছিল তাই সুনীল আমাকে আনন্দ পুরস্কার দিয়েছেন (আনন্দ পুরস্কার কমিটিতে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় ছিলেন, শুনেছি তিনিই একমাত্র কমিটির সদস্য যিনি আমার পুরস্কার পাওয়ায় আপত্তি করেছিলেন)। আমি পুরুষ বিদ্বেষী। আমি ধর্ম বিদ্বেষী। আমি র এর এজেন্ট। আমার লেখা লেখা নয়, পিওর পর্নোগ্রাফি। ইত্যাদি ইত্যাদি। বন্ধু যত বাড়ে, আমার শত্রু বাড়ে দ্বিগুণ।

শত্রু বাড়ে, কতরকম মানুষ যে তবু আমার কাছে আসে! নানা বয়সের মেয়ে নানা রকম সমস্যার কথা শোনাতে আসে। এমন ছেলের সঙ্গে বিয়ে ঠিক করেছে তার পরিবারের লোকেরা যে ছেলেকে তার পছন্দ নয়। স্বামীর সঙ্গে অন্য মেয়ের সম্পর্ক। স্বামী মারধোর করে। স্বামী তালাক দিয়েছে। বাবা লেখাপড়া করতে দেয় না। স্বামী চাকরি করতে দেয় না। আপিসের বস শরীর চায়। যে কথা আর কাউকে বলতে পারে না, আমার কাছে বলে, দেখেছি, তারা ভারমুক্ত হয়। নিমন্ত্রণ নামে একটি উপন্যাস বেরোলো। গল্পটি ছোট, শীলা নামের এক ষোল সতেরো বছর বয়সের মেয়ে একটি সুদর্শনের যুবকের প্রেমে পড়ে। কিন্তু প্রেমে পড়লে কী হবে, সুদর্শনের মনে তো কোনও প্রেম নেই। যুবকটি একদিন নিমন্ত্রণ করে শীলাকে, শীলা ভেবেছিল যুবকটি তাকে ভালবাসে। শীলা নিমন্ত্রণে যায়, নিমন্ত্রণ না ছাই, শীলাকে একটি খালি বাড়িতে নিয়ে কয়েকটি বন্ধু মিলে ধর্ষণ করে সেই যুবক। এমন মর্মান্তিক করুণ কাহিনীটিকে লোকে বলতে লাগল অশ্লীল অশ্লীল। পড়া যায় না। ছোঁয়া যায় না। যেহেতু ধর্ষণের নৃশংস বর্ণনা দিয়েছি বইটিতে, তাই এটি অশ্লীল, তাই এটি পর্নোগ্রাফি। সমাজে এমন ঘটনা ঘটতে পারে, কিন্তু লেখা যাবে না। লিখলে ঢি ঢি পড়ে যাবে। সমাজচ্যূত হব, একঘরে হব। লোকে আমাকে থুতু ছিটোবে। ছিটোয় থুতু। থুতু ছিটোনো যখন চলছে, এক বিকেলে অচেনা এক ভদ্রমহিলা এলেন আমার বাড়িতে নিমন্ত্রণ বইটি সম্পর্কে বলতে। বইটি তিনি একাধিকবার পড়েছেন এবং তাঁর দুই মেয়েকে পড়িয়েছেন। যে বইটি এমন নোংরা যে স্পর্শ করলে গা ধুতে হয়, যে বইটির অশ্লীল শব্দ পড়ে ঘেন্না হয় লোকের, সেই বইটি তিনি তাঁর কিশোরী মেয়েদের পড়িয়েছেন, তাও নাকি রীতিমত আদেশ করে! ভদ্রমহিলা বলেন, এই বইটি প্রতিটি কিশোরীর পড়া অবশ্য কর্তব্য। তিনি মনে করেন তাঁর মেয়েরা এখন অনেক বেশি সাবধানে চলাফেরা করার চেষ্টা করবে, ভুলিয়ে ভালিয়ে কেউ তাদের কোনও খালি ঘরে নিয়ে যেতে পারবে না। এই বইটি লেখার জন্য আমাকে অসংখ্য ধন্যবাদ জানিয়ে এরকম বই যেন আরও লিখি সেই অনুরোধ করলেন তিনি। বাইরের একশ থুতুর ছিটে ঘরের একটি ছোট্ট রুমালে মুছে নিই।

আমাকে ঢাকা থেকে সরিয়ে দেওয়ার কারণ কি? অনেকে অনুমান করেন, আমার লেখা। আমার লেখা পছন্দ হচ্ছে না কিছু কিছু সরকারি কর্তার। বিএনপির নিজস্ব পত্রিকা দৈনিক দিনকালে আপন মনের মাধুরি মিশায়ে আমাকে অপবাদ দেওয়া হয়, আমার বড় বাড় বেড়েছে, অশ্লীলতা আর অধর্মে ডুবে আমি আবোল তাবোল বকছি। আমাকে আমার জায়গা থেকে তুলে এখন দূরে কোথাও ছুঁড়ে ফেলে দেওয়াই তো বুদ্ধিমানের কাজ। সাপ খোপের কামড় থেকে নিজেকে বাঁচাতে বাঁচাতেই আমার জীবন যাবে, হাতে আর কলম তোলার শক্তি পাবো না। জামালপুরের গহীন গ্রামে গিয়ে আমার চাকরি করা সম্ভব নয়, আমাকে ঢাকার কোনও জায়গায় বদলি করা হোক, ঢাকায় না হলে ঢাকার আশেপাশে হলেও চলবে এই অনুরোধ জানিয়ে লেখা আমার দরখাস্তে স্বাস্থ্য সচিব মঞ্জুরুল করিমের সই নিয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে দিই। মঞ্জুরুল করিমের আরেকটি পরিচয় তিনি কবি, কবি ইমরান নূর। কবি বলেই সইটি দিয়েছেন তিনি। ইমরান নূরের পরামর্শে নির্মলেন্দু গুণ কিছু একটা হবে এই আশা নিয়ে আমাকে নিয়ে যান শেখ হাসিনার কাছে। আমার বিশ্বাস না হলেও নির্মলেন্দু গুণের বিশ্বাস হাসিনা চাইলে আমার বদলি পাল্টাতে সাহায্য করতে পারেন। হাসিনার সঙ্গে গুণের জানাশোনা অনেকদিনের। দুজনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে একই সঙ্গে পড়েছেন। হাসিনার উদ্দেশে ছাত্রাবস্থায় তিনি সম্ভবত কিছু প্রেমের কবিতা লিখেছিলেন, যেমন লিখেছিলেন বিউটি কুইন পূরবী বসুকে নিয়ে।

হাসিনার মিন্টো রোডের বাসভবনে এর আগে দুবার আমি গিয়েছি। প্রথম তো রোজার সময় ইফতারির দাওয়াত খেতে, সেদিনই গুণ হাসিনার সঙ্গে আমার পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন। এরপর হাসিনার সঙ্গে দেখা হয়েছিল শেখ মুজিবর রহমানের জন্মদিনে ধানমণ্ডির বত্রিশ নম্বর বাড়িতে। হাসিনা অতিথিদের স্বাগত জানাচ্ছিলেন। বত্রিশ নম্বর বাড়িতে ওই প্রথম আমি গিয়েছি। বুক ছিঁড়ে যায় কষ্টে যখন দেখি সিঁড়ির সেই জায়গাটি যেখানে শেখ মুজিব দাঁড়িয়েছিলেন আর বুক তাঁর গুলিতে ঝাঁঝড়া হয়ে গেল। পনেরোই আগস্ট উনিশশ পঁচাত্তর সাল। কী ভয়ংকর একটি দিন। শেখ মুজিবের পুরো পরিবারের ষোলো জনকে খুন করা হয়েছিল সেদিন। ভাল যে শেখ হাসিনা আর তাঁর বোন শেখ রেহানা দেশে ছিলেন না পনেরোই আগস্টে, তাহলেও তাঁদেরও খুন করা হত। আজ বীর দর্পে শেখ মুজিবের খুনীরা রাস্তায় হেঁটে বেড়ায়। খুনীগুলো ফ্রিডম পার্টি নামে একটি রাজনৈতিক দলও শুরু করেছে, এর ছাত্র সংগঠনের নাম যুব কমাণ্ড। জামাতে ইসলামির মতই অবলীলায় সন্ত্রাস চালাচ্ছে সারা দেশে। আজ শেখ হাসিনার মুখে আমরা শেখ মুজিবরের মুখটি দেখি। ঘোর আঁধারে একটি ক্ষীণ আলোর রশ্মি আমাদের আমাদের হৃদয়ে স্বপ্ন রচনা করে। হাসিনার সঙ্গে মিন্টো রোডে আরেকবার আমার দেখা হয়, কয়েকজন কবিকে যখন ডেকেছিলেন দুপুরের খাবার খেতে। শামসুর রাহমান, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, সৈয়দ শামসুল হক, বেলাল চৌধুরী আর আমি। হাসিনা অনেকক্ষণ তাঁর স্বামীর কথা বললেন, স্বামীটি যে কী নচ্ছ!র, তারই নিখুঁত বর্ণনা। স্বামী ওয়াজেদ মিয়া নাকি ফাঁক পেলেই খালেদা জিয়াকে ফোন করে রসের গপ্প মারেন। রাজনীতি বা সাহিত্য নিয়ে কোনও গভীর আলোচনায় হাসিনা যাননি। খাওয়া দাওয়া ঘর সংসার এসব বিষয় নিয়ে বেশির ভাগ সময় একাই কথা বলেছেন। আমি চুপচাপ বসে দেখছিলাম শেখ হাসিনাকে, তাঁর কথাবার্তা আমাকে মোটেও মুগ্ধ করেনি। আমি আওয়ামী লীগের কোনও সদস্য নই, কিছু নই, আওয়ামি-চক্ষু খুলে রাখি না যখন নেষনীকে দেখি। হজ্ব করে আসার পর হাসিনা কালো পট্টি বেঁধেছেন মাথায়, একটি চুলও যেন কারও নজরে না পড়ে। মেয়েদের চুলের মত অসভ্য নোংরা জিনিস যেন আর কিছু নেই, যে করেই হোক চুল ঢাকার জন্য তাই এত আকুলিবিকুলি। হাসিনার কালো পট্টির ঢং দেখলে আমার সত্যিই রাগ হয়। ধর্ম নিয়ে হাসিনা ঘরে সেদিন কোনও কথা বলেননি। ধর্ম নিয়ে বলেন বাইরে। তারপরও জানি, তাঁর দিকেই আজ তাকিয়ে আছে দেশের প্রগতিবাদী মানুষেরা। তিনিই যদি স্বাধীনতার শত্রুদের হাত থেকে, মৌলবাদীর হাত থেকে, সাম্প্রদায়িকতার কামড় থেকে দেশকে রক্ষা করেন।

শেখ হাসিনা যখন আমাদের সামনে এসে বসলেন, নির্মলেন্দু গুণই বললেন, ‘তসলিমাকে তো বদলি করে দিয়েছে, আপনি এখন ওকে ঢাকায় আনার ব্যবস্থা করেন।’

হাসিনা বললেন, ‘আমি তো ক্ষমতায় নেই। ক্ষমতায় থাকলে সম্ভব হত। আমি তো কিছু করতে পারবো না।’

‘তারপরও দেখেন। খালেদা সরকার তো ওকে খুব ভোগাচ্ছে। পাসপোর্ট এখনও দিচ্ছে না। আর ওরকম জায়গায় বদলি..। ওর লেখালেখি ওরা পছন্দ করে না বলেই এসব করছে।’

হাসিনা শ্লেষের সঙ্গে বললেন, ‘ওর লেখা তো আমারও পছন্দ হয় না।’

নির্মলেন্দু গুণের সঙ্গে আমার চোখাচোখি হয়। গুণ ম্যাড়ম্যাড়ে কণ্ঠে বলেন, ‘কেন, পছন্দ হয় না কেন?’

‘ধর্ম সম্পর্কে ও কিছু না জেনে লেখে। ইসলামে যে নারী পুরুষের অধিকার সমান, ইসলামে মেয়েদের মর্যাদা যে সবচেয়ে বেশি —এইগুলো তো ও অস্বীকার করে।’

হাসিনা বিরোধীদলের নেত্রী। চব্বিশ ঘন্টা তাঁর ব্যস্ততা। আমাদের জন্য সামান্য সময় ব্যয় করে ব্যস্ততা অথবা অন্য যে কারণেই হোক তিনি উঠে গেলেন। যাবার আগে তাঁর দলের এক সদস্যকে বলে দিলেন, আমার ব্যপারটি দেখার জন্য। সদস্যটি টুকে নিলেন কোথায় ছিলাম, কোথায় আমাকে বদলি করেছে এ দুটো তথ্য। আমার ব্যপারটি দেখার জন্য মিন্টো রোডের কারও তেমন আগ্রহ লক্ষ করিনি।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে প্রতিদিন খবর নিতে যাই বদলি পাল্টানোর কতটুকু কি হল অথবা আদৌ কিছু হবে কি না। দুর্ধর্ষ ডাকাতের মত চেহারার মানু নামের বাংলাদেশ মেডিকেল এসোসিয়েশনের ডাক্তার নেতার হাতে তখন ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে ঢাকা থেকে লোক সরিয়ে লোক ঢোকানোর। মানু আমার দিকে যেভাবে আগ্রহ নিয়ে তাকায়, তার চোখ দেখেই বুঝি সে আমাকে নামে চেনে, আমার লেখা পড়ে সে, পছন্দ করে কি করে না সে আমার জানা হয় না। মানু যে বিকেলে লিস্টিটি ফাইনাল করবে, সেদিন যেতে বলে আমাকে অধিদপ্তরে। নিরীহ প্রাণীটি গিয়ে হাজির হই আদৌ আমার যাবার কোনও প্রয়োজন আছে কী না কিছুই না জেনে। মানু একা ঘরে আমাকে নিয়ে লিস্টিটি দেখায়। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে একটি খালি পদ আছে, সেই পদটিতে আমাকে ঢোকানো যায় কি না মানু ভাবছে। মানু বসে আছে, তার চেয়ারের পাশে দাঁড়িয়ে আমি খুশিতে রঙিন হয়ে উঠি। কিন্তু রঙিন হওয়া মুখ ফ্যাকাসে হতে থাকে যখন কোথায় আমার পোস্টিং হবে সম্পূর্ণই তার ওপর নির্ভর করছে এই বলে চেয়ার ছেড়ে উঠে আমার দিকে পা পা করে এগোতে থাকে। সে এগোচ্ছে, আমি পিছোচ্ছি। পিছোতে পিছোতে আমি দেয়ালে। মানু আমাকে দেয়ালের কোণে বেঁধে ফেলেছে। কী তার উদ্দেশ্য! এই খালি আপিসে আমাকে সে কি ভোগ করতে চায়! ভাল জায়গায় পোস্টিং দেওয়ার লোভ দেখিয়ে! ভয়ে আমার অন্তরাত্মা শুকিয়ে তখন কাঠ নয়, লোহা হয়ে আছে। ঘৃণায় আমার থুতু ছিটোতে ইচ্ছে করে মানুর মুখে। কিন্তু থুতু ছিটোলে কী লাভ। তার উদ্দেশ্য হয়ত সে যে করেই হোক সফল করতে চাইবে! আমার চেয়ে দ্বিগুণ কেন, চতুর্গুণ বেশি শক্তি ধারণ করে সে শরীরে। তার সঙ্গে লড়াইয়ে গিয়ে আমি সফল হব না। এ মুহূর্তে একটিই পথ আছে লাঞ্ছনা থেকে বাঁচার, তা মানুর নাগালের বাইরে চলে যাওয়া। দেয়ালের কোণটির কাছেই দরজা। পেছনে আমার স্পর্ধা দেখে ক্রোধে দাঁতে দাঁত পেষা মানুকে ফেলে আমি দ্রুত দরজা খুলে বের হয়ে যাই। দৌড়ে পার হই স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের বারান্দা। দৌড়ে নিচের তলায় নামি। দৌড়ে জনতার মধ্যে। দৌড়ে রিক্সায়। বুকের ধুকপুক থামে কিন্তু চোখ জলে ভরে ওঠে অপমানে। না হয় হোক ঢাকার কোথাও চাকরি। ভাল পোস্টিংএর দরকার নেই আমার।

যৌনতার রানী আমি, আমি জরায়ুর স্বাধীনতা চাই আমার সম্পর্কে এরকম প্রচারের কোনও কমতি নেই। এতে হয়ত অনেকে ভাবে হাত বাড়ালেই বুঝি আমাকে পাওয়া যায়। না ভাবলেও ধারণা তো আছেই যে মেয়েমানুষকে দেয়ালের কোণ পর্যন্ত নিয়ে যেতে পারলেই সাধ মেটানো যায়। কোনও ঝাড় জঙ্গলে আমাকে ছুঁড়ে দেওয়া হবে চাকরি করতে, এমন আশঙ্কার একশ পোকা নিশিদিন আমাকে কুট কুট করে কাটে। পোকার সংখ্যা দিন দিন বাড়তে থাকে। পোকাময় ডাক্তারের হাতে বদলির কাগজ এল একদিন। বদলি ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। বিস্ময়ের ভেলা আমাকে নিয়ে আনন্দ সাগরে ভাসে।
 
১৮. কবন্ধের যুগ


৬ই ডিসেম্বর দুপুরবেলা আমি ঢাকা মেডিকেলের অপারেশন থিয়েটারে রোগীদের অজ্ঞান করছি। কিন্তু মন উচাটন। সেই সকাল থেকেই ভাবছি কাউকে আমার কাজের দায়িত্ব দিয়ে হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে পড়ব, দুপুর পেরিয়ে গেছে তবু সুযোগ হচ্ছে না। খুব বেশিদিন হয়নি ঢাকা মেডিকেলে চাকরি করছি, এখনও কারও সঙ্গে তেমন ঘনিষ্ঠতা হয়নি। চাকরির প্রথম দিন থেকে কাঁটায় কাঁটায় হাসপাতালে আসা, মুখ বুজে অপারেশন থিয়েটারে ঢুকে যাওয়া, একটির পর একটি রোগীকে অজ্ঞান করা, অপারেশনের পর জ্ঞান ফেরানো —- বিরতিহীন চলছে। দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়, বিকেলগুলো খোঁড়াতে খোঁড়াতে গিয়ে সন্ধের গায়ে ঢলে পড়ে, অজ্ঞানের কাজ তখনও চলতেই থাকে। কাঁটায় কাঁটায় কাজ শুরু করলেও কাঁটায় কাঁটায় কাজ শেষ করা যায় না। শেষ কখন হবে তার ঠিক নেই। বাঁধা রোগী তো আছেই, অবাঁধা রোগীও উপচে পড়ে। ইমার্জেন্সির রোগী। এক্ষুনি এসেছে, এক্ষুনি অপারেশন না করলে বাঁচবে না জাতীয় রোগী। আটটা থেকে দুটো পর্যন্ত কাজ করে মুক্তি পাবো এমন অবস্থা নেই, বিকেলেও ডিউটি আছে, রাতেও আছে। দম ফেলার ফুরসত নেই। মিটফোর্ডে এত রোগীর অপারেশন হত না, মাঝে মাঝে একটু ফাঁক পাওয়া যেত। কিন্তু শহরের মধ্যিখানে ঢাকা মেডিকেল, এখানে ফাঁক বলে কোনও ব্যপার নেই। ঢাকা মেডিকেলে চাকরি করার সুযোগ খুব কম ডাক্তারের হয় বলে নিজের সৌভাগ্যকে আমি মোটেও ছোট করে দেখি না, দেখি না বলেই আমাকে সদা সতর্ক থাকতে হয়, ঘড়ির কাঁটা আটটার ঘরে পৌঁছোনোর আগে হাসপাতালে ঢোকা চাই, পাঁচটার ঘর পেরিয়ে যদি যায় তবু বেরোনো হয় না, সে না হয় না হোক। মানুষটি আমি চেনা বলে অন্য যে কোনও ডাক্তারের চেয়েও বেশি সতর্ক থাকতে হয় আমাকে, আমার ভক্ত সংখ্যার চেয়ে অভক্ত সংখ্যা নেহাত কম নয়। লেখালেখি করি বলে নিশ্চয়ই আমি ডাক্তারিতে ফাঁকি দিই এরকম একটি অলিখিত ধারণা এই হাসপাতালটিতেও যেন চালু না হয় সেটির চেষ্টা শুরু থেকে করে আসছি। ফাঁকি যে আমি দিই না, তা প্রমাণ করতে অন্য ডাক্তারদের চেয়ে দ্বিগুণ কেন ত্রিগুণ কাজ করতে হয় আমাকে। অন্য ডাক্তাররা ঘড়ির কাঁটাকে না মেনে চললেও কথা হয় না, আমার বেলায় আমি বেশ জানি যে কথা হবে। অভিজ্ঞতাগুলো মিটফোর্ড হাসপাতাল থেকে অর্জন করেছি। অভিজ্ঞতার সদ্ব্যবহার করছি বলে এত সজাগ আমি, কিন্তু আজ আমাকে নিয়ম না ভাঙলেই নয়। আজ মন উচাটন। কিন্তু কার কাছে অনুমতি চাইব মুক্তি পেতে! কার কাছে প্রস্তাবটি পাড়ব! ডাক্তারদের কঠিন কঠিন মুখগুলোয় বড় নরম চোখে তাকিয়েও কোনও মুখের কাঠিন্য দূর করতে পারি না। ঘড়ি দেখছি, কিন্তু ঘড়ি দেখেই বা কী লাভ, এক রোগী টেবিল থেকে নামে তো আরেক রোগী ওঠে। অ্যানেসথেসিওলজিতে ডিপ্লোমা পাওয়া ঘন কালো মোচ আর মাথায় দলা পাকিয়ে থাকা কালো কোঁকড়া চুলের ডাক্তারটির সঙ্গে দুতিনদিন কথা হওয়ার পর মুখটি যদিও তাঁর কঠিনের কঠিন, মনটিকে খুব কঠিন বলে মনে হয়নি। মনে হয়নি বলেই তাঁকে বলি খুলে আমার আজ যে না গেলেই নয়, ফাঁকি আমার না দিলেই নয়, নিয়ম আমার না ভাঙলেই নয়। বলি যে আমার বোন হাসপাতালে, বাচ্চা হচ্ছে। বোনের বাচ্চা হচ্ছে তাতে কি! বাচ্চা সুরুৎ করে পেটে ঢোকে, ফুরুৎ করে বেরোয়। এ কারণে যেতে হয় নাকি! জানি এ কোনও যুক্তি নয় অপারেশন থিয়েটার ত্যাগ করার। তাই উচাটন মন যা নয় তাই বলে, বাড়িয়ে বলে। কণ্ঠ কাঁপে বাড়াতে গিয়ে। কোথায় তোমার বোন জিজ্ঞেস করেন তিনি। ময়মনসিংহে বললে যদি তিনি বলেন যে না অত দূর যেতে হবে না, বলি পিজিতে। ঢোক গিলে কণ্ঠের কাঁপন বন্ধ করে বলি, ‘যাবো, গিয়ে দেখেই ফিরে আসবো। এক ঘন্টাও লাগবে না।’

ডাক্তার রশীদ চুপ করে আছেন দেখে আবার বলি, এবারও বাড়িয়ে, ‘সিজারিয়ান হচ্ছে, কিন্তু বোনের নাকি অবস্থা তেমন ভাল নয়।’ কণ্ঠ এবারও কাঁপে।

চোখে কাতর অনুরোধ আমার ভাগের দায়িত্বটি তিনি যদি কিছুক্ষণের জন্য পালন করে আমাকে কৃতার্থ করেন। ডাক্তার রশীদ একবার না বলে দিলেই আমি জানি, কোনওউপায় থাকবে না আমার যাওয়ার। কালো মোচের তল থেকে বেরোলো একটি শান্তির বাণী, ‘ঠিক আছে যাও।’ বাক্যটি উচ্চারিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমি দৌড়। দৌড়ে রাস্তায় নেমে হাতের কাছে যে রিক্সাই পেয়েছি নিয়ে সোজা শান্তিবাগ। শান্তিবাগে শান্তি নেই, কারণ কায়সার নেই। কায়সারকে বলে রেখেছিলাম সে যেন আমার বাড়িতে সকালেই চলে আসে। বেচারা এসে ঘুরে গেছে। বেচারা না হয় ঘুরে গেছে, আমি বেচারা এখন যাই কি করে ময়মনসিংহে! কায়সারের অপেক্ষা করে বসে থাকলে চলবে না, আমাকে বেরোতে হবে। বাসে বা ট্রেনে যে করেই হোক যেতে হবে। সিঁড়ি দিয়ে নামছি, এমন সময় দেখি কায়সার ওপরে উঠছে। কায়সারের বাহু ধরে লাফিয়ে নিচে নামি। সোজা গাড়ি। সোজা ময়মনসিংহ। সোজা হাসপাতাল। সোজা প্রসুতি বিভাগ। ইয়াসমিন নেই। কোথায়? পোস্টঅপারেটিভ রুমে। ঠাণ্ডা হয়ে যায় শরীর। ভেবেছিলাম লেবার রুমে বাচ্চা হবে, আমি থাকব পাশে। ভেবেছিলাম ইয়াসমিনের গায়ে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে মনে সাহস দেব। যদি কারও হাত ধরে রাখতে চায় শক্ত করে, আমার হাতদুটো দেব। কিন্তু সে সুযোগ আমার হল না। বাচ্চা হয়ে গেছে আমি এসে পৌছোনোর এক ঘণ্টা আগেই। সিজারিয়ান হয়েছে। অবস্থা আসলেই ভাল নয়। খুব চেষ্টা হয়েছিল নরমাল ডেলিভারির, সম্ভব হয়নি, ফরসেপের চেষ্টা হয়েছে কিন্তু বাচ্চার অবস্থা ভেতরে আশঙ্কাজনক অবস্থায় পৌঁছোতে থাকলে অপারেশনের জন্য নিয়ে যাওয়া হয়। সিজারিয়ানেও অনেক সময় নিয়েছে। বাচ্চার ওজন পনেরো পাউণ্ড। বাচ্চাকে ইনকিউবেটরে রাখা হয়েছে। ইয়াসমিনের জ্ঞান এখনও ফেরেনি। এক হাতে রক্ত চলছে, আরেক হাতে স্যালাইন। পোস্ট অপারেটিভ রুমের পাশে বিষণ্ন দাঁড়িয়ে থাকা মিলনের কাছে শুনি সব। ভেতরে গিয়ে জ্ঞান না ফেরা ইয়াসমিনকে দেখি। কিরকম থমথমে চারদিক। কি লাভ হল দৌড়ে এসে, যদি কিছুতেই আমি থাকতে পারলাম না। এরকম আসার কি দরকার ছিল! আমি তো দূরের কোনও মানুষ নই! কথা দিয়েছিলাম আমি থাকবো শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত। ইয়াসমিন খুব চেয়েছিল আমি যেন পাশে থাকি। থাকা হল না। মেডিকেলের এমন বিদঘুটে কড়াকড়ি না থাকলে একদিনের ছুটি নেওয়ার সাহস করতে পারতাম। নিজের ওপর রাগ হয়, কেন ছুটি নিইনি একদিনের জন্য! রাগ হয় ডাক্তার রশীদের কাছে এত কৌশল করে, যা আমি পারতপক্ষে বলি না, মিথ্যে, বলার কী দরকার ছিল! না কোনও দরকার ছিল না। দরকার ছিল আমার এখানে থাকা। হয়নি। সামান্য একটি চেনা মানুষের মত ইয়াসমিনের বাচ্চা হয়ে যাওয়ার পর দেখতে এসেছি। বোনের মত আসিনি। বোন না ছাই!

হাসপাতাল থেকেই ফিরে যাই ঢাকায়। রাতের ঢাকাকে কেমন যেন গুমোট লাগে। লোকজন জটলা পাকিয়ে আছে কোথাও কোথাও। মগবাজারের কাছে একটি জঙ্গী মিছিল দেখি। কেন মিছিল কিসের মিছিল কিছু বুঝতে পারি না। ট্রাফিক পুলিশ গাড়ি থামিয়ে অন্য রাস্তা ধরতে বলে। বড় রাস্তাগুলোয় গাড়ি চলতে দিচ্ছে না। গাড়ি থেকে গলা বাড়িয়ে ট্রাফিকের লোককে জিজ্ঞেস করি, ‘কি হয়েছে কি? মিছিল কেন?’ কোনও উত্তর জোটে না প্রশ্নের। কায়সারকে জিজ্ঞেস করি, ‘তোর কি মনে হয়, কি হয়েছে শহরে?’ কায়সার কিছুই অনুমান করতে পারে না। আমার পক্ষেও অনুমান করা সম্ভব নয়। দ্বিতীয় মিছিলটি দেখে আমি বুঝতে পারি কি হয়েছে। গগন ফাটানো চিৎকার থেকে দুটো শব্দ আমি কায়ক্লেশে উদ্ধার করি, ‘বাবরি মসজিদঞ্চ। বাবরি মসজিদ নিয়ে আবারও কি হল, নব্বই সালে যেভাবে বাবরি মসজিদ ভেঙেছে খবর রটিয়ে হামলা করা হয়েছিল হিন্দুদের ওপর, এবারও কি তেমন হচ্ছে নাকি!

আমাকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে চলে যায় কায়সার। আমি টেলিভিশন খুলে বসি। সিএনএন খুলতেই দেখি ভয়ংকর দৃশ্য। বাবরি মসজিদের ওপর ঝাাঁপিয়ে পড়ছে গেরুয়াপোশাক পরা হিন্দু মৌলবাদীরা। খবরে বলছে, বাবরি মসজিদ নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। বুকের দেয়াল কেউ যেন হাতুড়ি দিয়ে ভেঙে দিল, আর স্রোতের মত দরজা জানালা সজোরে খুলে বেরিয়ে এল হৃদপিণ্ডের সব রক্ত। কী হবে এখন? কি হবে এখন তা অনুমান করার সাধ্য আমার নেই। এই হল আমার ছয়ই ডিসেম্বরের রোজনামচা।

তারপর সাতই ডিসেম্বর। সাতের পর আসবে আটই ডিসেম্বর। তারপর নয়। দশ। কেমন সেই দিনগুলি! দিনগুলি কেমন তা ভাল গল্পকার হলে নিখূঁত বর্ণনা করতে পারতাম। কিন্তু আমি ভাল গল্পকার নই। আমি কেবল ভেতরে অনুভব করি, বোঝাতে পারি না। সাতই ডিসেম্বর তারিখে সকালে সংবাদপত্রগুলোর প্রথম পাতা জুড়ে বড় একটিই খবর, বাবরি মসজিদ ধ্বংস, বিধ্বস্ত। নব্বইএর অক্টোবরে বাবরি মসজিদ ধ্বংস হয়নি, তখনই ইনকিলাবের একটি ভুল খবরের কারণে দেখেছি পুরোনো ঢাকায় কি করে হিন্দুদের মন্দিরগুলো ভেঙে চুরমার করা হয়েছে, হিন্দুদের বাড়িগুলো, দোকানগুলো লুঠ করে পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। সেদিনও আমি ময়মনসিংহ থেকে রাতে ফিরেছিলাম ঢাকায়। আরমানিটোলায় থাকি তখন, সারারাত বারান্দায় দাঁড়িয়ে ভাঙনের শব্দ শুনেছি। চিৎকার আর কান্নার শব্দ সারা রাত। বাড়িঘরে মন্দিরে দোকানপাটে লাগানো আগুন লক লক করে বাড়তে বাড়তে আকাশে উঠল, দেখেছি। দেখেছি আর বেদনায় হতাশায় ক্রোধে ক্ষোভে একা একাই ফেটে পড়েছি। আমার পক্ষে সম্ভব ছিল না কোথাও গিয়ে কিছু থামাই। থামাই কোনও মর্মঘাতি করুণ বিনাশ। পরদিন হাসপাতালে যাওয়ার পথে দেখেছি ভাঙা পোড়া দালানকোঠো। হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে শাঁখারি বাজার, সুত্রাপুর, নবাবপুর, নয়াবাজার, বাবু বাজার, ইসলামপুর, ঠাঁটারি বাজার, সদরঘাট ঘুরে ঘুরে অগুনতি পোড়া বাড়িঘর, দোকানপাট, মন্দির দেখতে দেখতে আমি হতবুদ্ধি বসেছিলাম। পুড়ে যাওয়া ঢাকেশ্বরী মন্দিরটি থেকে চোখ ফিরিয়ে নিতে হয়েছে। আমি কোনও নাম দিতে পারি নি ওই বর্বরতার। মানুষ কি করে পারে জন্ম থেকে দেখা প্রতিবেশির ঘরে আগুন দিতে! কী করে পারে এমন ধ্বংসের খেলা খেলতে! কী করে পারে পাশের দোকানটি লুঠ করে, যে দোকানের আয়ে সংসার চালাতো দোকানের লোকটি, ভেঙে দিতে, পুড়িয়ে দিতে! নৃশংসতার একটা সীমা আছে, সীমা কেন ছাড়িয়ে যাচ্ছে এ দেশের মানুষ! কি ঢুকেছে মানুষের মগজে! এ দেশের হিন্দুরা বাবরি মসজিদ কোথায়, মসজিদটি কেমন দেখতে তাও তো জানে না, কী করে ভাঙবে তারা সেই মসজিদ! যদি না ই ভাঙে, তবে কেন মসজিদ ভাঙার দোষ পরে তাদের ওপর! পোড়া ভিটের ওপর মাথায় হাত দিয়ে বসে থাকা উন্মুল উদ্বাস্তু মানুষের কান্না কেবল দেখেছিই, কিছুই করতে পারিনি। কি করে সাহায্য করব আমি দুর্গতদের! আমার সে সাধ্য ছিল না। গোপনে কেবল চোখের জল ফেলেছি।

মিথ্যে খবরেই যদি ওরকম কাণ্ড ঘটতে পারে, তবে আজ সত্যি সত্যিই যখন হিন্দু মৌলবাদীরা ভেঙে গুঁিড়য়ে দিয়েছে বাবরি মসজিদ, কি হবে আজ! আশঙ্কা আমাকে জ্বালিয়ে মারে। সকালে হাসপাতালে যাওয়ার পথে দেখি মালিবাগের জলখাবার পুড়ছে, রাস্তায় ছড়িয়ে আছে দোকানের চেয়ার টেবিল, ভাঙা। জলখাবারে আমি অনেকদিন খেয়েছি। বাড়িতে নাস্তার আয়োজন যেদিন না হত, অথবা মন খুব খুশি খুশি, ভাল কিছু খেতে ইচ্ছে হত, জলখাবারে চলে যেতাম খেতে, নয়ত ঠোঙায় করে বাড়ি নিয়ে আসতাম লুচি, নিরামিশ, হালুয়া। পথে আরও দোকান দেখি পুড়ে ছাই হয়ে আছে। লুঠ হওয়া, ভাঙা পোড়া দোকানগুলো দেখে বুঝি যে ওগুলো হিন্দুর দোকান ছিল। কোন দোকানটি হিন্দুর, কোনটি মুসলমানের তার খবর আমি বা আমার মত অনেকে না রাখলেও কেউ কেউ রাখত। হাসপাতালে পৌঁছে অপারেশন থিয়েটারে নিঃশব্দে গিয়ে নিঃশব্দে অজ্ঞান করতে থাকি রোগীদের। আশঙ্কা আমাকে ছেড়ে এক পা কোথাও যাচ্ছে না। কি হয় কি হয় কি জানি কি হয় আশঙ্কা। এখনও কি সরকার কোনও নিরাপত্তার ব্যবস্থা করছে না হিন্দুদের! যদি না করে থাকে! শীততাপ নিয়ন্ত্রিত ঘরের মধ্যে দাঁড়িয়ে আমি ঘেমে উঠি।

দুপুরের দিকে ডক্টরস ক্যান্টিনে চা খেতে গিয়ে শুনি বলাবলি হচ্ছে, ইমারজেন্সিতে ক্যাসুয়ালটির রোগীর ভিড় হচ্ছে খুব, সামাল দেওয়া যাচ্ছে না। আচমকা একটি আশঙ্কা ঝড়ের ঝাপটা দিয়ে আমার হাত কাঁপিয়ে কাপ নাড়িয়ে জিভ পুড়িয়ে দেয় গরম চায়ে। চা পান শেষ হয় না। ছুটি ইমারজেন্সিতে। মাথা ফাটা, পা কাটা, পিঠ ভাঙা রোগীর ভিড়। স্ট্রেচারে করে রোগী ঢোকানো হচ্ছে রুমে। রুমে জায়গা হচ্ছে না, বারান্দায় রাখতে হচ্ছে রোগীদের। বারান্দার কয়েকজন রোগীর নাম জেনে নিই, বিশ্বনাথ, সুধীর, গোপাল, করুণা, পার্বতী। ইমারজেন্সি রুমে ঢুকে তিনজন ডাক্তারদের একজনকে বলি, ‘এখানে তো আরও ডাক্তার লাগবে, এত পেশেন্ট কি করে ম্যানেজ করবেন!’ ডাক্তার বললেন, ‘কি আর করা যাবে! এক্সট্রা ডাক্তার তো আর পাওয়া যাবে না এখানে। সবারই তো ডিউটি আছে।’

‘ওটিতে আমার দুটো পেশেন্ট বাকি আছে, সেরে আমি চলে আসছি এখানে।’ আমি দ্রুত চলে যাই দোতলায়। বাকি দুটো রোগীকে অজ্ঞান করি, জ্ঞান ফেরাই। ততক্ষণে ইমারজেন্সি থেকে সার্জারি ওয়ার্ডে হয়ে নতুন রোগী আসতে শুরু করেছে অপারেশন থিয়েটারে। অ্যানেসথেসিয়া দিতে বিকেলের ডিউটির ডাক্তার এসে গেছেন অপারেশন থিয়েটারে। আমার বিদায় নেবার পালা। বলি একা সামাল দিতে না পারলে, আমি ইমারজেন্সিতে আছি, আমাকে যেন তিনি ডেকে পাঠান। ইমারজেন্সিতে আগের চেয়ে রোগীর ভিড় এখন আরও বেশি। বাড়তি ডাক্তার হয়ে রোগীর চিকিৎসা করতে থাকি। হাতে হাতে স্যালাইন দিতে থাকি, রক্ত লাগবে, দৌড়ে যাচ্ছি রক্ত আনতে। কারও গায়ে কুড়ুলের কোপ, কারও মাথা ফেটে রক্ত ঝরছে, কেউ মাথায় লাঠি বা কিছুর আঘাতে অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে, কেউ গুলিবিদ্ধ, কারও মেরুদণ্ড ভেঙে গেছে মারের চোটে। সন্ধে হতে থাকে, রোগীর ভিড় আরও বেশি বাড়ে। ডাক্তারদের দম ফেলার সময় নেই। ঘড়ির দিকে তাকাবো, সে সময়ও নেই আমার। সারাদিন না খাওয়া, ক্যান্টিনে গিয়ে যে চা সিঙ্গারা খেয়ে আসবো, সে সময়ও পাওয়া হয় না। অপারেশন থিয়েটারেও রোগী নিয়ে যেতে হয়, ওখানে অ্যানেসথেসিয়া দিতে বাড়তি ডাক্তার হিসেবে কাজে লেগে যাই। অপারেশন করতে করতে সার্জন বলছেন, আজ সারারাতই রায়টের রোগী আসবে।

‘রায়টের? রায়ট কোথায় বাঁধলো?’ আমি প্রশ্ন করি।

‘দেখছেন না! সব তো রায়টের রোগি আসছে ইমারজেন্সিতে।’

‘কিন্তু সব তো হিন্দু! রায়ট হলে তো কিছু মুসলমানও পাওয়া যেত। হিন্দুতে হিন্দুতে তো কোনও মারামারি বাঁধেনি। মুসলমানরা হিন্দুদের মারছে।’

সার্জন কোনও কথা বলেন না।

যখন হাসপাতাল থেকে বেরোই, রাত দশটা বাজে। বাড়ি পৌঁছে ক্লান্ত আমি আজকের কাগজের শিরোনামগুলোয় চোখ বুলোই শুধু। উগ্র হিন্দু মৌলবাদীদের হাতে বাবরি মসজিদ ক্ষতিগ্রস্ত। উত্তর প্রদেশ সরকার ও রাজ্যসভা বাতিল। ভারতে প্রতিবাদের ঝড়। সমগ্র ভারতে নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার। মসজিদ প্রাঙ্গণে অতিরিক্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা। পশ্চিমবঙ্গে বামফ্রণ্টের ২৪ ঘণ্টা বনধ। বাবরি মসজিদ ঘটনায় বাংলাদেশের উদ্বেগ প্রকাশ। প্রধানমন্ত্রীর উদ্বেগ। হাসিনার নিন্দা ও প্রতিবাদ। পাঁচ দলের নিন্দা ও প্রতিবাদ। সিপিবির নিন্দা। হিন্দু সাধুদের মন্দির নির্মাণের প্রচেষ্টাঃ নয়া রাজনৈতিক সংকটে রাও সরকার।

পরদিন আটই ডিসেম্বর, ভোরবেলা উঠে উঠে চা খেতে খেতে পত্রিকার খবরগুলো দেখি, বাবরিমসজিদ ভেঙে ফেলার পর অশান্ত ভারতে রক্তক্ষয়ী দাঙ্গা। হত দুশতাধিক, আহত কয়েক হাজার। আরএসএস শিবসেনাসহ মৌলবাদী সংগঠনগুলো নিষিদ্ধ। লোকসভার বিরোধী নেতার পদ থেকে আদভানীর পদত্যাগ। বর্তমান স্থানেই মসজিদটি আবার গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত। বাবরি মসজিদ হামলার প্রতিবাদে ও ৪ দফা দাবিতে সমন্বয় কমিটির আহবানে আজ সারাদেশে সকাল সন্ধ্যা হরতাল। শান্তি ভাঙার চেষ্টার পরিণাম শুভ হবে না। বাবরি মসজিদ বিধ্বস্ত হওয়ার ঘটনায় রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশে বিক্ষোভ ও ভাঙচুর সংঘর্ষ। আহত তিন শতাধিক। ২৫ জন বুলেট বিদ্ধ। যে কোনও মুল্যে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ও শান্তি বজায় রাখুন–শেখ হাসিনা। মন্ত্রি পরিষদের বিশেষ বৈঠক—দেশবাসীকে শান্ত থাকার আহবান। বাববি মসজিদ ভাঙার প্রতিবাদে চট্টগ্রামে জামাত শিবির বিভিন্ন মন্দির ভাঙচুর লুটপাট অগ্নিসংযোগ করেছেঃ পরিস্থিতি উত্তেজনাকর। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষার আহবান জানাচ্ছে বামদলগুলো। পুরো খবর পড়ার সময় নেই, হাসপাতালে দৌড়োতে হয়। আজ সারা দেশে হরতাল হচ্ছে বাবরি মসজিদে হামলার প্রতিবাদে। হরতাল, কিন্তু কিছু রিক্সা চলছে, শান্তিবাগ থেকে হেঁটে মালিবাগে এসে একটি রিক্সা নিই, এত সকালে পিকেটাররা রাস্তায় নামেনি বলে চলে যেতে পারি অনায়াসে। হাসপাতালের ইমারজেন্সিতে গতকালের চেয়ে আজকে বেশি ভিড় মার খাওয়া গুলি খাওয়া কোপ খাওয়া ছুরি খাওয়া পুড়ে যাওয়া মানুষের। হরতালের মধ্যেও ভিড়ের কোনও কমতি নেই। মানুষ আসছে পায়ে হেঁটে, রোগী কাঁধে নিয়ে। আজও অপারেশন থিয়েটারের কাজ শেষ করে ইমারজেন্সিতে ঢুকে যাই। এক একজন মানুষ, এক একটি গল্প। এক একটি জীবন। যাদের কথা বলার মত অবস্থা আছে, জিজ্ঞেস করে জেনে নিই কিকরে আক্রমণ হয়েছে তাদের ওপর। কি করে নিরীহ মানুষগুলোর ওপর সন্ত্রাসীরা ঝাঁপিয়ে পড়েছে আচমকা লাঠি হাতে, কুড়ুল হাতে, ছুরি হাতে। সুবোধ মণ্ডলের হুঁশ ছিল না কথা বলার। কাতরাচ্ছিল লোকটি। ফিনকি দিয়ে রক্ত বেরোচ্ছে মাথা থেকে, কুড়ুলের কোপে মাথার খুলি কেটে ঢুকে গেছে ভেতরে।

‘কারা এই অবস্থা করেছে, কারা?’ সুবোধ মণ্ডলের মাথার ক্ষত এন্টিসেপটিক দিয়ে মুছে ব্যাণ্ডেজ লাগিয়ে দ্রুত একটি এন্টিটিটেনাস ইনজেকশান দিয়ে দুই হাতে স্যালাইন আর রক্ত চালিয়ে নাকে অক্সিজেন দিয়ে স্ট্রেচারে তুলতে তুলতে জিজ্ঞেস করি। পাশে দাঁড়িয়ে আছে সুবোধের স্ত্রী গায়ত্রী।

‘কারা ওরা? চেনেন?’ বিন্দু বিন্দু ঘাম আমার কপালে।

গায়ত্রী বলল, ‘চিনুম না কেন, ওরা তো আমাগো পাড়ার লোকই, আবুল, রফিক, হালিম, শহিদুল।’

‘কেন মারলো আপনাদের? কি অভিযোগ করল?’

গায়ত্রী গলা চেপে ‘কইল আমরা নাকি মসজিদ ভাঙছি।’ বলেই ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠে আমার হাতদুটো চেপে ধরে বলতে থাকে ‘দিদিগো, আমরা কোনও মসজিদ ভাঙ্গি নাই। বিশ্বাস করেন দিদি, মা কালির দিব্যি দিয়া কইতাছি আমরা ভাঙ্গি নাই।’

‘কোন মসজিদ ভাঙার কথা কইছে, জানেন?’

‘কী জানি কোন মসজিদ! জানি না। রিক্সা কইরা যখন আইতাছি সীতার বাপরে লইয়া, তখন ত অনেকগুলা মসজিদ দেখলাম, কোনওটাই তো ভাঙ্গা দেখলাম না।’

‘বাবরি মসজিদের নাম শুনেন নাই?’

গায়ত্রী মাথা নাড়ে। নাম শোনেনি।

বাবরি মসজিদ কোথায় তা জানে কি না জিজ্ঞেস করি, গায়ত্রী জানে না। গায়ত্রীর একটিই জোড় হাত প্রার্থণা, তার স্বামীকে যেন বাঁচিয়ে তুলি। স্বামী তার বাবুবাজারে আলু তরকারি বিক্রি করে। স্বামী না বেঁচে উঠলে দুটো ছেলে মেয়ে নিয়ে গায়ত্রীর উপোস করে মরতে হবে। ডাক্তাররা চেষ্টা করেও পারেননি গায়ত্রীর স্বামীকে বাঁচাতে। আমার চোখের সামনে গায়ত্রী তার স্বামীর দেহটি নিয়ে বারান্দায় নিথর বসে রইল। বেশিক্ষণ বসে থাকতে পারেনি। আরও রোগী আসছে, বারান্দা খালি করে দিতে হয়েছে গায়ত্রীকে।

রোগীদের কাউকে কাউকে প্রাথমিক চিকিৎসার পর ছেড়ে দিচ্ছি, কাউকে মেডিসিন ওয়ার্ডে পাঠিয়ে দিচ্ছি, কাউকে সার্জারি ওয়ার্ডে। ব্লাড ব্যাংক থেকে এনে রক্ত চালু করে দিচ্ছি। সব ওষুধ হাসপাতালে নেই, গরিব রোগীদের আত্মীয় স্বজনের কাছে টাকা পয়সাও নেই। অ্যাপ্রোনের পকেটে যে কটা টাকা ছিল, ঝেড়ে দিয়ে দিই দুতিনজন গরিবকে ওষুধ কিনে আনতে। সন্ধানীতে গিয়ে বিনে পয়সার ওষুধ মুঠো ভরে ভরে নিয়ে এসে যাদের ওষুধ কেনার পয়সা নেই, দিই। রোগীদের কাছে কি করে কি হল তার বর্ণনা শোনার সময় নেই আমার। আমার জানা হয়ে গেছে কি করে হয়েছে এইসব কাণ্ড। আমার আর জানার দরকার নেই মন্ত্রিসভার বৈঠকে কোন কোন মন্ত্রী কি কি সব চমৎকার চমৎকার কথা বলছেন। জানার দরকার নেই খালেদা কি বলছেন, হাসিনা কি বলছেন, বা তাঁদের দলই বা কি করছে। রাজনীতির মুখে মনে হয় মানুষের গা থেকে ঝরতে থাকা রক্ত লেপে দিই। আজ আমার ডিউটি রাতে, রাতের ডিউটি শুরু হয় আটটা থেকে। ডিউটি থাকলে সাধারণত দুপুরে বাড়ি গিয়ে বিশ্রাম নিয়ে রাত আটটায় চলে আসি হাসপাতালে। আজ আমার আর বাড়ি যাওয়া হয়নি। সেই সকাল আটটা থেকে কাজ শুরু করেছি, বিকেল শেষ হয়েছে, রাত নেমে এসেছে, সারারাত কখন কেটে গেছে টের পাইনি। সারা রাতই বানের জলের মত রোগী এসেছে, সারা রাতই ইমারজেন্সির ডাক্তারদের হিমশিম খেতে হয়েছে। ভোরবেলায় ইমারজেন্সির এক অচেনা ডাক্তার আমাকে প্রশ্ন করে, ‘আপনি কি হিন্দু?’ ইমারজেন্সিতে আমার ডিউটি নেই, কিন্তু তারপরও এখানে বাড়তি কাজ করছি, রোগীদের বাঁচাবার চেষ্টা করছি, আমি নিশ্চয়ই হিন্দু, তাই আমার এত আবেগ, ডাক্তারের ধারণা।

ডাক্তারটির প্রশ্নের আমি প্রথম আমি কোনও জবাব দিইনি। পরে আবার যখন জিজ্ঞেস করল, তখন দাঁতে দাঁত চেপে বলি, আমি মানুষ।

রাতে ডিউটি থাকলে পরদিন ছুটি থাকে। ক্লান্ত শরীর আর বিধ্বস্ত মন নিয়ে সকালে ফিরে আসি বাড়িতে। বাবরি মসজিদে হামলার নিন্দা আর প্রতিবাদ চলছে সারা দেশে। সেই সঙ্গে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির আহবান জানানো হচ্ছে। সম্প্রীতি রক্ষার জন্য ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহবান জানিয়েছে বাম দলগুলো। আওয়ামি লীগ থেকেও বলা হচ্ছে, বাংলাদেশে উগ্র সাম্প্রদায়িক রাজনীতির স্থান নেই, মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় দেশ পরিচালিত হতে হবে। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের দলগুলোকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার জন্য বলা হচ্ছে। ছাত্র সংগঠনগুলো আজ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষার জন্য শান্তি মিছিল করবে শহরে। হচ্ছে অনেক কিছুই, তারপরও হিন্দুর ওপর নির্যাতন চলছেই সারা দেশে। ক্ষিধেয় পেট জ্বলছে আমার, খেয়ে একটু ঘুমোবো আশা করেছিলাম। খাওয়া হয়, ঘুম হয় না। বেরিয়ে পড়ি রিক্সা নিয়ে। রিক্সা শান্তিনগর পার হয়ে পল্টনের দিকে যায়, পল্টন থেকে মতিঝিলের দিকে যেতে যেতে দেখি কমিউনিস্ট পার্টির অফিস পুড়ে ছাই হয়ে আছে, আরেকটু এগোলে শাপলা চত্ত্বরের কাছে ইণ্ডিয়ান এয়ারলাইন্সের অফিসটিও পোড়া। রাস্তায় ইট পাটকেল, পোড়া কাঠ পড়ে আছে। আরও দোকানপাট ভাঙা, পোড়া। পুরোনো ঢাকার দিকে গেলে ওখানে আরও দেখতে পাবো বাড়িঘর জ্বলছে পুড়ছে। যাবো! দেখবো! কিন্তু দেখে কী লাভ! জানিই তো কি হচ্ছে দেশে! কি দরকার আর আহত নিহত মানুষ আর ভাঙা পোড়া বাড়ি আর মন্দির দেখে! বড় একটি মিছিল চলে গেল টুপিওয়ালাদের, ‘বাবরি মসজিদ ধ্বংস কেন, ভারত সরকার জবাব দাওঞ্চ বলে চিৎকার করতে করতে। এরাই নিশ্চয়ই বাড়িঘরে মন্দিরে দোকানপাটে আগুন ধরাচ্ছে, এরাই নিশ্চয়ই যেখানে যে হিন্দু পাচ্ছে আক্রমণ করছে। এই লোকগুলোকে আমার মানুষ বলে মনে হয় না। মানুষের রূপ ধরে যেন এক একটি মানুষখেকো জন্তু। রিক্সাকে পলাশির দিকে যেতে বলি। পলাশির বস্তিতে নেমে রিক্সা ছেড়ে দিয়ে বস্তির যে ঘরটিতে নির্মলেন্দু গুণ থাকেন, সেটির দরজায় টোকা দিই। ঘরের দরজাটি নড়বড়ে। কেউ একটি লাথি দিলেই ভেঙে পড়ে যাবে দরজা। রাস্তার ওপরেই দাঁড়িয়ে আছে মলিন ঘরটি। আমার ভয় হয়, এই ঘরটিও সম্ভবত পুড়িয়ে দেবে। দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় কবি নির্মলেন্দু গুণকে যে কোনও মুহূর্তে হয়ত পুড়ে ছাই হয়ে যেতে হবে। গুণ ঘরে ছিলেন, বিছানার ওপর পা তুলে বসে আছেন। আমি বিছানায় বসে গুণের দিকে চেয়ে অনেকক্ষণ কোনও কথা বলতে পারিনি। কেন এসেছি আমি! সান্ত্বনা দিতে! কি বলে সান্ত্বনা দেব গুণকে! রাস্তায় চিৎকার করছে একপাল ছেলে, ‘একটা দুইটা হিন্দু ধর, সকাল বিকাল নাস্তা কর।’ চিৎকারের শব্দ কমে এলে গুণ বললেন, ‘পা নামাই না বিছানা থেকে, মনে হয় পা নামাইলেই বুঝি ওরা ধইরা ফেলবে।’ রসবোধ গুণের খুব বেশি। এই ভয়ংকর দুর্যোগের সময়েও তিনি লোক হাসাতে চান। আসলে কি হাসাতে চান নাকি এটি গুণের মনের কথা! মাটিতে পা রাখতে আসলেই তাঁর ভয় হয়! আমার বিশ্বাস, হয়। নির্মলেন্দু গুণের মত কিছুকে পরোয়া না করা শক্ত সমর্থ সাহসী মানুষটির চোখে আমি থোকা থোকা অনিশ্চয়তা আর আতঙ্ক দেখতে পাই, যতই তিনি তা লুকোনোর চেষ্টা করুন না কেন। এই সমাজে মেয়েদের কোনও নিরাপত্তা নেই, তারপরও আজ আমি নিরাপদ বোধ করছি, যেহেতু আমার নামটি মুসলমান নাম। আর দেশের বড় কবি হয়েও, পুরুষ হয়েও, সাহসী হয়েও, রাজনীতিবিদ হয়েও নির্মলেন্দু গুণ নিরাপদ বোধ করছেন না। আমার চেয়েও এখন অনেক অসহায় তিনি।

‘গুণদা, আমার বাসায় চলেন।’ দীর্ঘশ্বাসের সঙ্গে বাক্যটি বেরিয়ে আসে।

না তিনি যাবেন না। বাড়িভর্তি গুণের পোষ্য, গীতাসহ গীতার কয়েকটি বোন। তিনি সবাইকে ছেড়ে একা নিজের জন্য নিরাপত্তা নেবেন না।

অসীম সাহা কেমন আছেন, মহাদেব সাহা কেমন আছেন, জিজ্ঞেস করি। গুণ জানেন না কে কেমন আছেন। তিনি কেবল জানেন যে তিনি বেঁচে আছেন, এই বেঁচে থাকার কারণটি সম্ভবত, তাঁর ধারণা, দেখতে তাঁকে মুসলমান মৌলবির মত লাগে। লম্বা দাড়িঅলা, পাজামা পাঞ্জাবি পরা মানুষটি মৌলবী না হয়ে যান না, বস্তির লোকদের এমনই ধারণা। কিন্তু এভাবে কিছু লোকের চোখ হয়ত ফাঁকি দেওয়া যায়, সব লোকের চোখ নয়। ঘরের মেঝেয় বসে আছে চারবছর বয়সী একটি বাচ্চা ছেলে, ছেলেটি গীতার বোন কল্যাণীর পুত্রধন। কল্যাণীর বিয়ে হয়েছিল এক মুসলমান লোকের সঙ্গে, তখন সুমন জন্মায়। সুমনকে দেখিয়ে গুণ বলেন, ‘ও তো হাফ মুসলমান। ও আছে বলেই আমরা সবাই ভরসা পাই। সুমনরে বলছি এই ঘরে বইসা থাকতে। কেউ যদি আত্রমণ করতে আসে, সোজা বলে দেব যে এই বাড়িতে একজন মুসলমান আছে, সুতরাং সাবধান, কোনও রকম আক্রমণ যেন না হয়।’

আমি হেসে উঠি। নির্মলেন্দু গুণ হাসেন না। মনে হয় তিনি সত্যিই মনে করছেন, চার বছরের মুসলমান বাচ্চাটির কারণে তিনি বাঁচবেন, গীতা আর গীতার আত্মীয়রা বাঁচবে। গুণ বললেন, ‘সুমনকে তো এখন ভাল খাওয়ানো দাওয়ানো হচ্ছে। বেশ আদর যত্ন করা হচ্ছে। ও হইল আমাদের সবার রক্ষাকর্তা। সুমনও বুইঝা গেছে সেইটা। আমারেও মাঝে মাঝে ধমক দিয়া কথা বলে।’

আমি জোরে হেসে উঠি। গুণ গম্ভীর হয়ে বলেন, ‘ভাবছি অসীম কেমন আছে তা দেখতে ওর বাসায় যাবো একবার। সুমনকে নেবো। সুমনে আগে আগে হাঁটবে, আমি সুমনের পেছন পেছন। সঙ্গে একজন মুসলমান থাকলে ভয় ডর কম থাকবে।’

এবার আমার আর হাসি পায় না। মাথায় একটি চিনচিনে যন্ত্রণা টের পাই। একটি বিচ্ছিরি রকম অসহায়বোধ আমাকে ছাড়পোকার মত কামড়াতে থাকে। নিজেকে সান্ত্বনা দিতে চেষ্টা করি, সেই সঙ্গে গুণকেও। বলতে থাকি, কাল সাম্প্রদায়িক শক্তির বিরুদ্ধে মানববন্ধন হচ্ছে। বাহাদুর শাহ পার্ক থেকে সংসদ ভবন পর্যন্ত লম্বা। আওয়ামি লীগ শান্তিমিছিল বের করবে। বিএনপিও করবে। আজও তো ছাত্রঐক্যের শান্তিমিছিল হচ্ছে। জামাত শিবিরকে যে কোনও ভাবে ঠেকানোর চেষ্টা চলছে। গুণ শোনেন। কোনও প্রতিক্রিয়া নেই তাঁর। সাধারণত রাজনীতির প্রসঙ্গে গুণ মুখর হয়ে ওঠেন। আজ সব মুখরতা আকাশের ওপারে চলে গেছে। জিজ্ঞেস করি কোনও পত্রিকা তিনি পড়ছেন কি না। না, কোনও পত্রিকাই তিনি পড়ছেন না, টেলিভিশনও দেখছেন না। তিনি কিছুই করছেন না। শুধু বসে থাকছেন বিছানার ওপর। খাবার খাচ্ছেন বিছানায় বসে, পেচ্ছ!ব পায়খানায় যেতে হলে দৌড়ে যাচ্ছেন, সেরে দৌড়ে এসে আবার বিছানার ওপর উঠে গুটিসুটি বসে থাকছেন। রাতে ঘুমোন না, বসে থাকেন। শুতে ভয় করে, শুলে যদি ঘুম এসে যায়, আর ঘুমোলে যদি ঘুমের মধ্যে কেউ মেরে রেখে যায়! ঘুমোন না, কারণ ঘুমিয়ে থাকলে চার বছরের মুসলমান বাচ্চাটির দায় দায়িত্ব যে তিনি নিয়েছেন, তা ব্যাখ্যা করে বেঁচে থাকার যদি একটি সুযোগ পাওয়া যায়, সেই সুযোগটি কেন হারাবেন! একটি ন্যাংটো বাচ্চা, নাক দিয়ে সর্দি ঝরছে, গা ধুলোয় মাখা, অথচ এই বাচ্চাটিকেই এ বাড়ির সবার চেয়ে শক্তিমান মনে করছেন নির্মলেন্দু গুণ। আমারও হঠাৎ মনে হয়, সুমনই এ বাড়ির গায়ে গতরে শক্তিধর, মেধায় বুদ্ধিতে শক্তিধর যে কোনও প্রাপ্ত বয়স্কদের চেয়েও বেশি শক্তি ধারণ করছে। সুমনই এ বাড়িতে সবচেয়ে মূল্যবান একটি প্রাণী।

বিষাদ আমাকে আচ্ছত করে রাখে যখন বেরোই গুণের বাড়ি থেকে। বেরিয়ে অসীম সাহার বাড়িতে যাই, মহাদেব সাহার বাড়িতেও। গুণের মত ভাঙা ঘরে তাঁরা থাকেন না।কিন্তু ভয় একই রকম সবার। নিস্তেজ পড়ে আছেন, সর্বাঙ্গে আতঙ্ক। দরজায় শক্ত করে খিল এঁটে বড় বড় ছেলে মেয়ে নিয়ে বসে আছেন ঘরে। কবে বাইরে বেরোবেন, আদৌ বেরোতে পারবেন কি না কিছুই জানেন না। অসীম সাহার ইত্যাদি প্রেসটি বন্ধ। মহাদেব সাহা ইত্তেফাকে চাকরি করেন, এখন আর চাকরি করতে যাচ্ছেন না। আমি কাউকে কোনও সান্ত্বনার বাণী শোনাতে পারি না। আগামীকাল মানববন্ধন হচ্ছে সাম্প্রদায়িক শক্তির বিরুদ্ধে, এই সংবাদ কারও আতঙ্ক দূর করে না। বাড়ি ফিরে আসার পথে আমি ভাবি, দেশের বড় বড় কবিদেরই যদি আজ এমন করে ঘরের কোণে লুকিয়ে থাকতে হয়, তবে সাধারণ হিন্দুরা কি অবস্থায় দিন কাটাচ্ছে এ দেশে! নির্মলেন্দু গুণ, মহাদেব সাহা, অসীম সাহা সকলেই আপাদমস্তক নাস্তিক। আজ তাঁদেরকেও ভয়ে গুটিয়ে থাকতে হচ্ছে, যেহেতু তাঁরা হিন্দু নাম ধারণ করে আছেন। আমার নামটিও হিন্দু নাম হতে পারত, আমার জন্মও হতে পারতো কোনও হিন্দুর ঘরে। কি হত আমার তবে আজ! আমি কি পারতাম রাস্তায় বেরোতে! হয়ত ধর্ষিতা হতে হত। হয়ত পুড়িয়ে ফেলা হত আমাকে, আমার বাড়িঘর ভেঙে ফেলা হত, আমাকে সর্বস্বান্ত করা হত!

দশ তারিখে সকাল সকাল হাসপাতাল পৌঁছোই। তখন রোগী আনা হয়নি অপারেশন থিয়েটারে। ক্যান্টিনে চা সিঙ্গারা খেতে খেতে দেখি টেবিলের ওপর পড়ে আছে দুদিন আগের ইনকিলাব পত্রিকাটি। ব্যানার হেডলাইন, বাবরি মসজিদের স্থানে হিন্দু মন্দির নির্মাণ, উগ্র হিন্দুদের উল্লাস, আহত ১০০০ নিহত দুই শতাধিক। পত্রিকাটি আলগোছে উল্টো রেখে দিই। এই পত্রিকাটি হিন্দুর ওপর হামলা করার জন্য এ দেশে মহান ভুমিকা রাখছে, এ বিষয়ে আমার সন্দেহ নেই। পাশের টেবিলে কজন ডাক্তারের আলোচনা কানে আসে,ভারতে বিজেপির সভাপতি যোশি আর আদভানীসহ মোট আটজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। উত্তর প্রদেশের মূল্যমন্ত্রী কল্যাণ সিংএর বিচারের দাবি উঠেছে। উগ্রবাদী সাতশ হিন্দুকে গ্রেফতার করা হয়েছে। লোকসভা বিধানসভা স্থগিত। বিশ্ব হিন্দু পরিষদ, আর এসএস, বজরং দল, জামাতে ইসলামি দলগুলোকে ভারতে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এ দেশে কি হচ্ছে? হিন্দুর বাড়িঘরে মন্দিরে দোকানপাটে লুটতরাজ চলছে, আগুন লাগানো চলছে। হিন্দুর জমি জমা কেড়ে নেওয়া হচ্ছে। পুলিশ গ্রেফতার করেছে বেশ কিছুজনকে। কোথাও কোথাও ১৪৪ ধারা জারি করা হয়েছে। বাম দল, আওয়ামি লীগ, সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্য ঘোষণা দিচ্ছে, বিবৃতি দিচ্ছে, বৈঠক করছে, মিছিল করছে সাম্প্রদায়িক শক্তিকে প্রতিহত করার জন্য। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির জন্য মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তিগুলোকে এক হতে বলা হচ্ছে। জামাত শিবিরকে মূলত দোষী করা হচ্ছে সাম্প্রদায়িকতা ছড়ানোর জন্য। বাংলাদেশ টেলিভিশনে বাবরি মসজিদ ভাঙার দৃশ্য দেখানো বন্ধ করা হয়েছে। রাস্তায় বিরোধী দল আর সরকারি দলের লোকেরা ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা পরিদর্শন করতে গিয়েছেন। অনেক কিছুই হচ্ছে কিন্তু তারপরও নিরাপত্তা নেই হিন্দুদের, তারপরও কোনও সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাস বন্ধ হচ্ছে না।

মানববন্ধনে যোগ দেওয়ার সময় আমার নেই। আমার দিন কেটে যায় রোগীর চিকিৎসায়। ইমারজেন্সিতে ক্যাসুয়ালটির সংখ্যা কমছে না। খবর আসে পুরোনো ঢাকার মিটফোর্ড হাসপাতালে অতিরিক্ত ভিড় রোগীর, অনেককে পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে ঢাকা মেডিকেলে।

সে রাতে আমি অবকাশে ফোন করে জিজ্ঞেস করি প্রতিবেশিদের ওপর কোনও আক্রমণ হচ্ছে কি না। আমলাপাড়া এলাকাটি হিন্দু অধ্যুষিত এলাকা। আমাদের বাড়িটিই ছিল প্রথম একটি মুসলমানের বাড়ি, এরপর ধীরে ধীরে আরও কিছু মুসলমান এসে বসত শুরু করেছে, একাত্তর সালের আগে আরও হিন্দুর বাস ছিল, অনেকে ভারতে আশ্রয় নিতে গিয়ে আর ফিরে আসেনি, সে সব বাড়িতে মুসলমান উঠেছে এখন। কিন্তু এখনও সংখ্যায় হিন্দুরাই বেশি এলাকাটিতে। মা আমাকে বলেন যে হিন্দুদের অনেকে বাড়ি ছেড়ে চলে গেছে অন্য কোথাও, অনেকে আছে, তবে তিনি কোনও আক্রমণের কথা শোনেননি। পাড়া থমথম করছে। কেউ বেরোচ্ছে না বাইরে তেমন। আমি মাকে বলি পাড়ার কেউ যদি আশ্রয় চায় অবকাশে, মা যেন কাউকে ফিরিয়ে না দেন। মা আরেকটি খবর আমাকে জানালেন যেটি আমাকে কষ্ট দেয় আবার স্বস্তিও দেয়, ছটকুর এক বন্ধু আছে ভুলন নামে, ছেলেটি ভয়াবহ ধরণের ছেলে, যে কাউকে খুন করতে দ্বিধা করে না রকমের ছেলে, ছেলেটি পৌরসভা থেকে কমিশনার পদে নির্বাচনে দাঁড়াচ্ছে, তাই ভোটের আশায় সে হিন্দুদের নিরাপত্তার ব্যবস্থা করেছে, হিন্দুরা কথা দিয়েছে ভুলনকে ভোট দেবে, ভুলনের মত সন্ত্রাসীর ওপর আজ আমলাপাড়ার অসহায় লোকেরা নির্ভর করছে।

হঠাৎ নিজেকে আমার ডলি পালের মত, গায়ত্রী মন্ডলের মত, গৌতম বিশ্বাসের মত মনে হয়। নিজেকে আমার হিন্দু বলে মনে হতে থাকে। একটি ভয় শিরদাঁড়া বেড়ে ছড়িয়ে পড়ে সমস্ত শরীরে। একটি ক্রোধ উঠে আসে আমার হাতের মুঠিদুটোয়, উত্তপ্ত নিঃশ্বাস আমার। এক ঘর থেকে আরেক ঘরে অস্থির হাঁটি। শেষে নির্মলেন্দু গুণের মত পা গুটিয়ে বসে থাকি বিছানায়। আমার মনে হতে থাকে আমি হিন্দু বলে আমাকে মেরে ফেলা হবে। পরদিন হাসপাতালে বসেই খবর পাই চট্টগ্রামে সাতশ বাড়ি ভস্মীভুত। খবর পাই ভোলার অবস্থার। ভোলার হিন্দু এলাকাগুলো এখন ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। হাজার হাজার বাড়িঘর পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। দশ হাজার পরিবার গৃহহারা হয়ে খোলা আকাশের নিচে বসে আছে। ভোলার এমপি আওয়ামি লীগের তোফায়েল আহমেদ বসে আছেন ঢাকায়! কেন! তাঁর কি দায়িত্ব ছিল না তাঁর এলাকায় থাকা, আগে থেকেই মৌলবাদী সাম্প্রদায়িক শক্তিকে প্রতিরোধ করা! আমার মনে হতে থাকে বিএনপি সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করার সুবিধের জন্য আওয়ামি লীগও চাইছে হিন্দুর ওপর নির্যাতন হোক। এই ইস্যু নিয়ে সরকার বিরোধী আন্দোলন করতে চমৎকার মাঠে নামা যাবে। আমার রাগ হয় রাজনৈতিক দলগুলোর ওপর। আমার ঘৃণা হয় নেতাদের কীর্তিকলাপে। ইচ্ছে করলেই ঠেকানো যেতে পারত এই সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাস। ভারত সরকার দ্রুত পদক্ষেপ নিয়ে দাঙ্গা দমন করেছে অনেক। ভারতে দাঙ্গা হয়, ওখানে মুসলমানও হিন্দুর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ার ক্ষমতা রাখে। কিন্তু বাংলাদেশে দাঙ্গা হয় না, হয় সন্ত্রাস। মুসলমানরা হিন্দুর ওপর নির্যাতন করে। হাসপাতালের ডিউটি সেরে বেরিয়ে পড়ি পুরোনো ঢাকার দিকে। জামাতে ইসলামির মিছিল ভারতীয় দূতাবাসের দিকে যাচ্ছে স্মারকলিপি দিতে। সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী ছাত্ররা মিছিলে স্লোগান দিচ্ছে ‘গোলাম আযম আদভানী ভাই ভাই, এক দড়িতে ফাঁসি চাই।’ মৌলবাদীদের চরিত্র প্রতিটি দেশেই এক। এখন মৌলবাদী দুই নেতাকে ফাঁসি দিলেই সমস্যার সমাধান হবে কি! মন বলে, হবে না। হবে না কারণ নতুন নেতা গজাবে। ধর্মীয় শিক্ষা ব্যবস্থা, পচা পুরোনো সমাজ ব্যবস্থা মৌলবাদ গজাতে চিরকালই সাহায্য করবে। মৌলবাদীরা যখন মাথা ফুঁড়ে বেরোয়, তখন কেবল দুএকটি শান্তিমিছিল আর সম্প্রীতি ভ্রাতৃত্বের কথা চিৎকার করে বললে কাজ হয় না। তাই একদিকে মানববন্ধন হচ্ছে, অন্যদিকে মানবনির্যাতন চলছে। পুরোনো ঢাকার প্রতিটি অঞ্চল ঘুরে ঘুরে দেখি। ঢাকেশ্বরী মন্দিরে নিয়ে এসেছিলাম তারাপদ রায় আর তাঁর স্ত্রীকে, যখন কলকাতা থেকে ঢাকায় বেড়াতে এসে একদিন মন্দিরটি দেখতে চেয়েছিলেন — আজ সেই মন্দির ভাঙা, পোড়া, ধ্বংসস্তূপের পাশে কয়েকটি পুলিশ বসে আছে। পুলিশ যদি বসানোই হল, পুলিশ কেন ছয় তারিখ রাতেই বসানো হয়নি! আমার প্রশ্নের উত্তর কে দেবে! যতগুলো মন্দির আছে এলাকায় সব মন্দিরেই হামলা চলেছে, হিন্দুদের দোকান পাট একটিও অক্ষত নেই। বাড়িঘর ধ্বংস। তাঁতিবাজারে নেমে আমি হাঁটতে থাকি। হাঁটতে হাঁটতে একটি সরু গলিতে ঢুকে দেখি একটি পোড়া বাড়ির স্তূপের ওপর বসে আছে এক লোক। উঠোন জুড়ে ছড়িয়ে আছে পোড়া কাঠ, পোড়া বই, পোড়া কাপড়চোপড়। কাছে গিয়ে লোকটির নাম জিজ্ঞেস করলে লোকটি কোনও উত্তর দিল না। আমি কে, আমি কেন, ইত্যাদি কোনও কিছুতে তার কোনও আকর্ষণ নেই। পোড়া কাঠের মত বসে পোড়া ভিটের দিকে চেয়ে আছে লোকটি। সব হারাবার পর যে শূন্যতা থাকে, সে শূন্যতাও আর তার চোখে আর নেই। অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকি ধ্বংসস্তূপের কাছে। গলি ছেড়ে এসে একটি লোক আমার দিকে উৎসুক তাকায়। তাকেই জিজ্ঞেস করি, ‘ওই যে লোকটি বসে আছে, ওর নাম কি জানেন?’

‘ও তো সতীপদ। সতীপদ দাস।’

আলো নিভে আসছে বিকেলের। হাঁটতে হাঁটতে গলি পেরিয়ে বড় রাস্তায় উঠি। ইচ্ছে হয়েছিল সতীপদর কাঁধে একটি হাত রেখে তাকে সান্ত্বনা দিই, বলি যে ‘মানববন্ধন হচ্ছে, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির মিছিল হচ্ছে, মহল্লায় মহল্লায় শান্তি ব্রিগেড গড়ে তোলার কথা হচ্ছে। পত্রিকায় বুদ্ধিজীবীরা সাম্প্রদায়িক শক্তির বিরুদ্ধে কড়া কড়া কলাম লিখছেন, বাংলাদেশ রুখে দাঁড়াবে ধর্মীয় সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে, আপনি মোটেও দুশ্চিন্তা করবেন না, আর কেউ আপনার কোনও অনিষ্ট করবে না কোনওদিন,’ কিন্তু পারিনি বলতে। আমি অনুভব করি, একটি লজ্জা আমাকে গ্রাস করছে। আমার মুসলমান নামটি নিয়ে আমি লজ্জায় মাথা নুয়ে আছি। মানুষের ওপর মানুষের এই হিংস্রতা আমাকে লজ্জা দিচ্ছে। বিংশ শতাব্দির শেষ প্রান্তে এসে, যখন সভ্যতা জ্ঞান বিজ্ঞান প্রযুক্তি আর একই সঙ্গে মানবতার অকল্পনীয় বিকাশে ব্যস্ত, তখন এক মানুষ ঝাঁপিয়ে পড়ছে প্রচণ্ড নিষ্ঠুর বিবেকহীন জল্লাদের মত আরেক মানুষেরই ওপর, কারণ সেই মানুষ ভিন্ন ধর্মে বিশ্বাসী। সে রাতে আমি এক ফোঁটা ঘুমোতে পারিনি। সারারাত জেগে থাকি আমি আর আমার দীর্ঘশ্বাস। ভোরের দিকে শুয়ে শুয়ে লিখি আমার লজ্জার কথা। সতীপদকে স্পর্শ করতে না পারার লজ্জা।

আমার লজ্জা যায় না। লজ্জা নিয়েই আমি আরও দুদিন নির্মলেন্দু গুণের বাড়িতে যাই, কেমন আছেন তিনি দেখতে যাই। দেখি ছেঁড়া কাঁথায় মুখ মাথা ঢেকে তিনি শুয়ে আছেন। মুখ ঢেকেছেন কেন জিজ্ঞেস করলে বললেন, ‘কিছু যেন দেখতে না হয়।’ নির্মলেন্দু গুণকে এ অবস্থায় দেখতে আমার ভাল লাগে না। তিনি সেই আগের মত শহরে ঘুরে বেড়াবেন। আজিমপুরে নিজের একটি ছাপাখানা না হলেও কম্পোজখানা দিয়েছেন, সেখানে বসে লিখবেন নিজের লেখা, অবসরে দাবা খেলবেন, বিকেলে ইত্যাদিতে বসে আড্ডা দেবেন, অনুষ্ঠানে কবিতাপাঠের আমন্ত্রণ পেলে কবিতা পড়ে আসবেন ঋজু দাঁড়িয়ে। যে কথা কখনও ভাবিনি নির্মলেন্দু গুণ উচ্চারণ করবেন, সে কথা শুনি তাঁর কণ্ঠে, মৃত্তিকাকে তিনি কলকাতায় পাঠিয়ে দেবেন। গুণকে বলি, ‘এসব কি ভাবছেন, মৃত্তিকা চলে গেলে আপনি এখানে একা থাকবেন কি করে?’

গুণের সঙ্গে নীরা লাহিড়ির বিচ্ছেদ হয়ে যাওয়ার পর তাঁদের একটি মাত্র সন্তান মৃত্তিকা, যদিও সে তার দিদিমার বাড়িতে থাকে, গুণই দেখাশোনা করেন তার। তাঁর জীবন বলতে এই মৃত্তিকা—প্রচণ্ড ভালবাসেন মেয়েকে। মেয়েটিকে একদিন না দেখলে তিনি অস্থির হয়ে পড়েন। প্রতিদিন মেয়েকে ইশকুলে দিয়ে আসা, ইশকুল থেকে নিয়ে আসার কাজ তিনিই করেন। নীরা লাহিড়ি কুমিল্লায় চাকরি করেন, কালেভদ্রে মেয়েকে দেখতে আসেন। গুণ মেয়ের কাছাকাছি আছেন, আছেন মেয়ের প্রতিদিনকার প্রতিটি আবদার মেটাতে। এক বাড়িতে না থাকলেও পিতা কন্যার সম্পর্ক অত্যন্ত গভীর। গুণ যে টাকা রোজগার করেন, তার সিংহভাগ খরচ করেন মৃত্তিকার জন্য, বাকিটা দিয়ে নিজেকে এবং গীতার পরিবারকে কায়ক্লেশে চালান। মৃত্তিকাকে স্নেহে আদরে শিক্ষায় সংস্কৃতিতে বড় করে তোলাই তাঁর জীবনের লক্ষ্য। আর এখন তিনি ভাবছেন কলকাতা পাঠিয়ে দেবেন! আমি চমকে উঠি। বিস্ময় আমাকে অনেকক্ষণ নির্জীব করে রাখে।

‘না গুণ দা, মুত্তিকাকে কোথাও পাঠাবেন না। কেন পাঠাবেন? এটা আপনার দেশ, এই দেশ মৃত্তিকার। দেশ ছেড়ে ও যাবে কেন!’ শব্দগুলো একটি শোকার্ত হাওয়ায় ধাককা লেগে ক্ষীণ হয়ে আসে।

আমার লজ্জা যায় না। খবর পাই সিলেটে চৈতন্যদেবের বাড়ি পুড়িয়ে দিয়েছে মৌলবাদীরা। চারশ বছরের পুরোনো লাইব্রেরীটিও রোষ থেকে রক্ষা পায়নি। ইচ্ছে হয় চিৎকার করে কাঁদি। মানুষের মনুষ্যহীনতার জন্য নিজের মানুষ পরিচয়টিই আমাকে ব্যঙ্গ করতে থাকে। আমার চেনা জানা অনেকে ভোলায় দুর্গতদের অবস্থা দেখে ফিরে বর্ণনা করেছে বীভৎস বর্বরতার কাহিনী, সহস্র নির্যাতিতের হাহাকার, ক্রন্দন। আমি ছটফট করি। যেন আমি নিজেই ভোলার খোলা মাঠে বসে থাকা একজন উদ্বাস্তু, জীবনের যা কিছু সহায় সম্পদ ছিল সব লুট হয়ে যাওয়া, পুড়ে যাওয়া, সর্বস্বান্ত একজন কেউ। এই অনুভবটি আমার থেকে যায় সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাস কমে আসার পরও। হিন্দুদের দেশ ত্যাগ করার খবর শুনছি। কেউ কেউ বলে, ‘ওদের এটা উচিত হচ্ছে না, দেশে থেকে লড়াই করা উচিত ছিল।’ আমি নিজেকে একজন হিন্দুর জায়গায় বসিয়ে বুঝতে চেষ্টা করি নিরাপত্তাহীনতার বোধ কতটা তীব্র হলে মানুষ দেশ ত্যাগের মত একটি ভয়ংকর সিদ্ধান্ত নেয় বা নিতে পারে। নিজেকে আমার মনে হতে থাকে আমি তাঁতিবাজারে বাস করা এক হিন্দু নামের যুবক, সুরঞ্জন দত্ত, আমি ধর্ম মানি না, আমি প্রগতিশীল আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত, আমার বন্ধুরা বেশির ভাগই ধর্মহীন, আমার দেশটিকে আমি ভীষণ ভালবাসি, দেশের মঙ্গলের জন্য দিন রাত ভাবি আমি, কিন্তু এই সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাস আমাকে চূর্ণ করে দিচ্ছে, আমার আদর্শ ধ্বসে পড়ছে, দেশের জন্য আমার ভালবাসা আমার আবেগ সব নিবে যাচ্ছে, সকলের দিকে আমি সন্দেহের চোখে তাকাচ্ছি, আমার ভয় হচ্ছে মুসলমানরা বুঝি এই আমাকে মারতে এল, সন্তা্রাস থেমে যায় কিন্তু আমার নিরাপত্তাহীনতা যায় না কোথাও, আমার ভয় হতে থাকে যে কোনও একদিন যে কোনও অজুহাতে আমার ওপর আক্রমণ হবে, শেষ পর্যন্ত, যদিও আমি চাই না, নিজের সঙ্গে যুদ্ধ করি, কিন্তু হেরে যাই, নিরাপত্তহীনতা আমাকে দেশ ছাড়ার সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য করে। আমি চোখ বুজে ভাবছি দৃশ্য, তাঁতিবাজারের একটি দু ঘরের ছোট বাড়ি, বাবা মা বোন নিয়ে সংসার.. ভাবছি.. ভাবনা শেষ হয় না আমি কাগজ কলম নিয়ে বিছানায় উপুড় হয়ে শুয়ে লিখি, ‘সুরঞ্জন শুয়ে আছে। মায়া বারবার তাড়া দিচেছ, দাদা ওঠ, কিছু একটা ব্যবস্থা কর।’ সাত তারিখ থেকে তেরো তারিখ পর্যন্ত সুরঞ্জনের দিনগুলো আমার ভাবনার ঢেউএ উথালপাথাল করে। ঘরে বসে লেখার সময় আমার নেই। দৌড়োতে হয় হাসপাতালে। অপারেশন থিয়েটারে রোগীর শিরায় থাইয়োপেন্টাল সোডিয়াম আর সাকসামেথোনিয়াম ঢুকিয়ে, নাকে নাইট্রাস অক্সাইড আর অক্সিজেনের ঘ্রাণ দিয়ে রোগীকে ঘুম পাড়িয়ে রোগীর নাড়ি আর রক্তচাপ দেখে নিয়ে সার্জনকে ইঙ্গিত দিই অপারেশন শুরু করার। কৃত্রিম শ্বাস প্রশ্বাসের জন্য মিটফোর্ড হাসপাতালের অপারেশন থিয়েটারে আধুনিক যন্ত্রপাতি ছিল না। ওখানে রোগীর মাথার কাছে বসে রোগীর ফুসফুসে অক্সিজেন পাঠাতে হত যন্ত্রের বেলুন চেপে চেপে। এখানে হাতে কিছু চাপার দরকার হয় না, যন্ত্রই চেপে দেয়। আমার তাই জ্ঞানহীন রোগীর পাশে তেমন কিছু করার থাকে না, মাঝে মাঝে নাড়ি আর রক্তচাপ আর শ্বাসপ্রশ্বাসের ঘনত্ব দেখা ছাড়া আর দীর্ঘ অপারেশনের সময় উঠে উঠে শরীর অবশ করার ইনজেকশন দেওয়া ছাড়া। রোগীর কাছাকাছি বসে লিখে যেতে থাকি সুরঞ্জনের গল্প। সার্জন যখন বলেন অপারেশন শেষ, তখন উঠতে হয়, ইনজেকশন দিয়ে রোগীকে জাগাতে হয়। চোখ খোলা রোগীকে নামিয়ে নতুন রোগী টেবিলে তোলা হবে। কাগজ কলম আমার পকেটেই থাকে। অপারেশন চলাকালীন জ্ঞান হারানো আর জ্ঞান ফিরে পাওয়ার মাঝখানের সময়টুকু সুরঞ্জনের জন্য ব্যয় করতে থাকি।

পূরবী বসু আমাকে একদিন ফোনে বললেন, ‘সকলে কলাম লিখছে, তুমি এই সাম্প্রদায়িকতা নিয়ে কিছু লিখছ না যে!’ বড় বিব্রত বোধ করি আমি। কোনও কলাম লেখা হয়নি আমার। বিপর্যস্ত মন নিয়ে কি লিখব কিছুই পারিনি ঠিক করতে, যে কথাই লিখতে চেয়েছি দেখেছি অন্যরা লিখে ফেলেছেন।

‘পূরবী দি, আমি কলাম লিখিনি, তবে বড় একটা কিছু লেখার চেষ্টা করছি। তথ্যভিত্তিক লেখা।’

তথ্য ভিত্তিক, কিন্তু তথ্য পাই কোথায়! পুরোনো ঢাকার অলিগলি ঘুরে একতা পত্রিকার আপিসে গিয়ে কোথায় কোন জায়গায় হিন্দুদের ওপর অত্যাচার হয়েছে, তার সরেজমিনে তদন্তের তথ্যগুলো নিয়ে আসি। একতা কমিউনিস্ট পার্টির কাগজ, এতে বিস্তারিত খবর ছাপা হয়েছে দেশের কোথায় কি ঘটেছে। সংবাদ, আজকের কাগজ, ভোরের কাগজও যথেষ্ট খবর ছেপেছে। এই হল আমার তথ্য সামগ্রী আর আছে নিজের চোখে দেখা ঢাকা এবং ঢাকার আশে পাশের এলাকায় ঘটা তাণ্ডব।

খুব অল্প কথায়, অল্প বর্ণনায় মূলত তথ্য দিয়ে হিন্দুদের অবস্থার বর্ণনা করে লেখা এটিকে না বলা যায় গল্প, না বলা যায় উপন্যাস। বইটির নাম দিই লজ্জা। ফেব্রুয়ারি মাস চলে আসছে, বই ছাপাতে ব্যস্ত বাংলাবাজারের সব প্রকাশক। পার্ল পাবলিকেশন্সের মালিক আলতাফ হোসেন মিনু অগ্রিম টাকা দিয়ে গেছেন। তিনি একটি বই পাবেনই ফেব্রুয়ারিতে নিশ্চিত। ভাল একটি রমারমা উপন্যাস পাওয়ার উত্তেজনায় লাফানো মিনুকে বড় দ্বিধায় বড় সংকোচে বড় লজ্জায় দিই লজ্জার পাণ্ডুলিপি। পাণ্ডুলিপি হাতে পেয়ে মিনুর মুখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। জিজ্ঞেস করলেন, ‘এইটা কী দিলেন? উপন্যাস তো?’

‘না, ঠিক উপন্যাস না।’

‘তাইলে কি? গল্প সংকলন?’

‘না। তাও না।’

‘তাইলে কী এইটা?’

‘সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে লেখা একটা বই।’

‘প্রবন্ধের বই?’

‘না, ঠিক প্রবন্ধও না।’

‘তাইলে কী এইটা।’

‘এইটা এমন কিছু না। খুব তাড়াতাড়ি কইরা একটা লেখা লিইখা ফেলছি। হিন্দুদের উপর যে অত্যাচার হইল ডিসেম্বরে, সেই সম্পর্কে।’

মিনুর উজ্জ্বল মুখটি মুহূর্তে কালো হয়ে যায়। তিনি মন খারাপ করে বললেন, ‘এই বই তো চলবে না।’

বড় সংকোচে বলি, ‘জানি বইটা চলবে না। কিন্তু এটা ছাপেন আপাতত, যেহেতু অন্য কোনও লেখা হাতে নাই। আমি কথা দিচ্ছি, আপনাকে আমি একটা উপন্যাস লিখে দেব।’

মিনু খুশি হয়ে ওঠেন উপন্যাসের কথায় এবং কথা দেওয়ায়।

লাল ঝরা জিভখানি নড়ে ওঠে, ‘কবে দিবেন?’

‘যত তাড়াতাড়ি পারি।’

‘বইমেলায় ধরতে পারবো?’

‘চেষ্টা করব।’

‘সত্যি কইতাছেন?’

‘সত্যি।’

লজ্জার পাণ্ডুলিপি হাতে নিয়ে মিনু যখন যাচ্ছেন, তাঁর ব্যবসায় ক্ষতির কথা ভেবে আমার মায়া হয় খুব। বড় বিমর্ষ বিষণ্ন কণ্ঠ আমার, ‘এই বইটার ওপর আশা করবেন না। এই বই চলার মত না। বেশি ছাপানোর দরকার নাই। অল্প করে ছাপেন। আপনার যেন কোনও লস না হয়।’

মিনু আমাকে সান্ত্বনা দিয়ে বলেন, ‘লস হইলে হোক, আপনে যহন লেইখ্যাই ফেলছেন, আমি ছাপবো। পরে আপনের একটা উপন্যাস ছাইপা এইটার লস পুষাইয়া নিব।’
 
১৯. নিষিদ্ধ গন্ধম


কলকাতা যেতে হবে। আবৃত্তিলোকের কবি সম্মেলনে কবিতা পাঠের আমন্ত্রণ। সৌমিত্র মিত্র ঢাকায় চলে এসেছেন ঢাকার কয়েকজন কবিকে নিজমুখে আমন্ত্রণ জানাতে। আমার বাড়িতে বসেই ঠিক হল কাদের কাদের আমন্ত্রণ জানানো হবে। সৌমিত্র মিত্র নিজে কজন কবিকে আমন্ত্রণ পত্র দিয়েছেন, বাকিগুলো বিলি করার ভার আমার ওপর। আমার কানে কানে তিনি বলে যান, ‘এবারের অনুষ্ঠানে মূল আকর্ষণ কিন্তু তুমি।’ মূল আকর্ষণের জন্য যত না, তার চেয়ে বেশি আনন্দ প্রিয় কলকাতাটি দেখার। উত্তেজনায় আমি স্থির হয়ে দাঁড়াতে পারছি না কোথাও। কলকাতার অনুষ্ঠান শেষ হলে দার্জিলিং চলে যাব, শান্তিনিকেতন ঘুরে আসব, থাকব পুরো দু সপ্তাহ, এ হল গোপন ইচ্ছে। দু সপ্তাহের জন্য ক্যাজুয়াল লিভ নেওয়া যায় না। ডাক্তার রশীদ পরামর্শ দিলেন আর্ন লিভ নেওয়ার। আর্ন লিভের জন্য দরখাস্ত করে দিই।

নির্মলেন্দু গুণ দেশে নেই। কায়েস নামে গুণের এক ভক্ত গুণকে আমেরিকায় বেড়াতে নিয়ে গেছে। অসীম সাহা কোনও এক অজ্ঞাত কারণে প্রথমে রাজি হয়েও পরে আর রাজি হলেন না কলকাতায় যেতে। আমি শামসুর রাহমানএর বাড়ি থেকে তাঁর পাসপোর্ট আর ভিসার কাগজে তাঁর সই নিয়ে নিজেই দৌড়ে দৌড়ে ভিসা করিয়ে টিকিট করে আনি। নিজের ভিসা টিকিটও করি। টানা এক সপ্তাহ বেইলি রোডের দোকান থেকে প্রিয় প্রিয় মানুষের জন্য জামদানি শাড়ি আর আদ্দির পাঞ্জাবি কিনেছি, বইপাড়া থেকে কারও জন্য বই, শান্তিনগর বাজার খুঁজে কারও জন্য শুঁটকি মাছ, কারও জন্য মুক্তাগাছার মণ্ডা, নকশি কাঁথা, বড় ভালবেসে কারও জন্য বয়াম ভরে আমের আচার আর পুরো কলকাতার জন্য নিয়েছি থোকা থোকা ভালবাসা, সে অবশ্য কোনও সুটকেসে আঁটেনি। যাবার দিন কায়সারের গাড়িতে করে শামসুর রাহমানকে তাঁর বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে বিমান বন্দরে গিয়েছি। যেন সৌমিত্র মিত্রর কোনও অনুষ্ঠান নয়, আবৃত্তিলোকের কোনও ব্যপার নয়, যেন অনুষ্ঠানটি আমার, যেখানে যাচ্ছি। যেন কলকাতা আমার শহর, যে শহরে সকল কবিকে আমি পরম পুলকে সাদরে সগৌরবে নিয়ে যাচ্ছি। আমার উচ্ছলত!ই সবচেয়ে বেশি। বিমান বন্দরে বেলাল চৌধুরী আর স্থপতি-কবি রবিউল হুসাইন আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিলেন। সুটকেসগুলো চেক ইন পার করে দিয়ে বোর্ডিং কার্ড নিয়ে মহাআনন্দে এগোতে থাকি সামনে। মহানন্দেই পাসপোর্ট দিই ইমিগ্রেশনের লোকের হাতে। শামসুর রাহমান আর আমি সামনে, আমাদের পেছনে বাকি সব কবি। আমার তখন কখন দমদম পৌঁছবো, কখন চৌরঙ্গি, পার্ক স্ট্রিট, কলেজ স্টিট, গড়িয়াহাট, চিৎপুরে টই টই করে ঘুরে বেড়াব, কখন প্রিয় প্রিয় কবিদের সঙ্গে কলকাতায় জমিয়ে আড্ডা দেব, এই তাড়া। লোকটি আমার পাসপোর্ট থেকে মুখ তুলে আমার দিকে তাকান। আবার পাসপোর্টে চোখ, আবার আমার মুখে। এরপর পকেট থেকে একটি ছোট কাগজ বের করে একবার কাগজে চোখ, আরেকবার পাসপোর্ট। লোকটি আমাকে পাসপোর্ট হাতে নিয়ে দ্রুত এগিয়ে যান ইমিগ্রেশনের কোনও বড় কর্তার ঘরের দিকে। বড় কর্তা আর লোকটি ঘরের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে নিচু স্বরে কিছু কথা বলেন। কি কথা বলেন কে জানে! আমার পাসপোর্ট নিয়ে কি কথা বলার থাকতে পারে! পাসপোর্টে যে ছবি, সে তো আমারই ছবি। পাসপোর্টে যে নাম ঠিকানা সে তো আমারই নাম ঠিকানা। তবে কিসের এত কানাকানি কথা! লোকটি ফিরে এসে আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, আপনি কি চাকরি করেন?

হ্যাঁ করি।

কোথায়?

ঢাকা মেডিকেলে।

বিদেশে যাওয়ার পারমিশান আছে আপনার?

বিদেশে যেতে আবার কারও পারমিশান লাগে নাকি!

লোকটি আমাকে বলেন না কার পারমিশান লাগে। কেবল বলেন, অনুমতি না থাকলে আপনার যাওয়া হবে না। আমরা বড় কর্তার ঘরে গিয়ে জিজ্ঞেস করি ঘটনা কি। ঘটনা কি তিনিও বুঝিয়ে বলেন না। বড় কর্তার সামনের তিনটে চেয়ারে আমরা বসি। আমি, শামসুর রাহমান, বেলাল চৌধুরী। পেছনে দাঁড়িয়ে রবিউল হুসাইন। দরজার বাইরে বাকি কবিরা। বড় কর্তার বোধহয় মায়া হয় আমাদের দেখে। কত চোর ছেঁচড় গুণ্ডা বদমাশকে পার করে দিচ্ছেন তিনি, অথচ যে মানুষ দল বেঁধে কবি সম্মেলনে যাচ্ছে, তাকে আটকাতে হচ্ছে। তিনি আমাদের দিকে একটি টেলিফোন এগিয়ে দিয়ে বললেন, ‘ওপর থেকে কেউ ফোনে অর্ডার করলে আমরা ছেড়ে দেব।’ টেবিলে দুটো টেলিফোন ছিল। আরেকটি টেলিফোন ঘন ঘন বাজছে, বড় কর্তা রিসিভার কানে নিয়ে ঘন ঘনই বলছেন, ‘জি সার উনি এখানেই, জি স্যার আমার সামনেই বসে আছে, জি স্যার যেতে দেওয়া হচ্ছে না, জি স্যার ঠিক আছে।’ বড় কর্তা কি আমার কথা বলছেন ফোনের ওপারের স্যারকে! আমার সন্দেহ হয়, তিনি আমার কথাই বলছেন। ওই স্যারটি নিশ্চয়ই আগে থেকেই কোনও আদেশ দিয়ে রেখেছেন যেন আমাকে যেতে বাধা দেওয়া হয়।

এদিকে বেলাল চৌধুরী আর শামসুর রাহমান ওপরের মানুষগুলোকে এক এক করে খুঁজছেন মরিয়া হয়ে। সে যে কী শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থা। বেলাল চৌধুরী বললেন, ‘হেলথ সেক্রেটারি আমাদের বন্ধু, তাঁকে একবার পাওয়া গেলে কোনও সমস্যা নেই।’ বার বার ফোন করেও তাঁকে পাওয়া যাচ্ছে না। বেলাল চৌধুরী আইজির নম্বরে ফোন করেন, আইজি নেই। শামসুর রাহমান তাঁর এক মন্ত্রী বন্ধুকে ফোন করেন, তিনি ঢাকার বাইরে। সময় দ্রুত এগোচ্ছে। উড়োজাহাজে উঠে গেছে সব যাত্রী। কবির দলটি কেবল বাকি। মনকে বলছি, স্থির হও, দুর্যোগ কেটে যাবে। কিন্তু মন কিছুতে স্থির হচ্ছে না। সময় যাচ্ছে, নির্দয় সময় সামান্য করুণা করছে না আমাদের। টেলিফোনে আঙুলের অনবরত সঞ্চালনের পর শেষ পর্যন্ত পাওয়া গেল কবি ইমরান নূরকে। তিনিই স্বাস্থ্য সচিব। ওপরের লোক। স্বস্তির একটি শ্বাস ফেলি আমরা। আমাদের ঠোঁট থেকে উড়ে যাওয়া হাসিটি চকিতে ফিরে আসে। শামসুর রাহমান বললেন, ‘আমরা কলকাতা যাচ্ছি, কিন্তু তসলিমাকে যেতে দিচ্ছে না, আপনি এদের বলে দিন যেন ওকে যেতে দেয়। আপনি বলে দিলেই হবে।’

ইমরান নূর কথা বলতে চাইলেন বড় কর্তার সঙ্গে। সাংকেতিক কথা কি না জানি না, আমাদের কারও পক্ষে বোঝা সম্ভব হয় না কি কথা তাঁরা বলেন। বড় কর্তা কথা শেষ করে শামসুর রাহমানকে দিলেন রিসিভার। ইমরান নূর জানিয়ে দিলেন, ‘তসলিমার যাওয়া হচ্ছে না।’

‘কেন যাওয়া হচ্ছে না?’

‘দেশের বাইরে যেতে গেলে পারমিশান লাগবে সরকারের।’

‘সেটা আপনি ব্যবস্থা করে দিন। আপনি এখন এদের বলে দিলে কি হয় না?’

‘না হয় না।’

‘কিছুতেই কি হবে না? দেখুন একটু চেষ্টা করে হয় কি না।’

‘হয় না।’

শামসুর রাহমানের মুখ ফ্যাকাসে হয়ে যায়। বেলাল চৌধুরী মাথায় হাত দিয়ে বসে থাকেন। আমার সামনে দুলে উঠলো ইমিগ্রেশন অফিসারের ঘরটি, ঘরের দেয়াল, দুলে উঠলো পুরো বিমান বন্দর, দুলে উঠল স্বপ্ন সুখ। আমাকে আর সামনে পা বাড়াতে দেওয়া হয় না। উড়োজাহাজ তখন ছাড়ছে ছাড়ছে প্রায়। ঘোষণা দেওয়া হচ্ছে বাকি যাত্রীরা এখনই যেন জাহাজে উঠে যান। বেলাল চৌধুরী বিষণ্ন মুখে বললেন, ‘আমি থেকে যাই, আমি আর তসলিমা পরে আসছি। শামসুর রাহমান বললেন, না আপনি যান, আমি থেকে যাই, ঝামেলা মিটিয়ে আজ বিকেলের ফ্লাইটে না হয় আমরা যাবো।’ ওঁদের কথায় আমার চোখে জল চলে আসে। আমি বাস্পরূদ্ধ কণ্ঠে বলি, ‘আমার জন্য দেরি করবেন কেন? আপনারা চলে যান। আমি আসছি পরে।’

অধৈর্য হয়ে উঠছে বাকি কবিরা। কবিদের কারও কারও বিষণ্ন মুখ, কারও বা প্রসন্ন মুখ। সরকারি চাকরি করা আর কোনও কবিকে এই হাঙ্গামা পোহাতে হচ্ছে না। কারও জন্য সরকারি অনুমতির প্রয়োজন হয়নি। কেবল আমার জন্য প্রয়োজন। দলের মধ্য থেকে রফিক আজাদ শামসুর রাহমানের হাত ধরে ‘আসুন তো, প্লেন ছেড়ে দিচ্ছেঞ্চ বলে টেনে নিয়ে যান সামনে। বেলাল চৌধুরী বলে গেলেন, ‘এক্ষুনি তুমি ইমরান নূরের অফিসে চলে যাও, দেখ কি করতে বলে, করে, আজ বিকেলের ফ্লাইটেই চলে এসো। আজ যদি সম্ভব না হয়, তবে কাল সকালের ফ্লাইটে যে করেই হোক এসো।’

আমাকে পেছনে রেখে দলের সবাই উড়োজাহাজের দিকে এগোতে লাগলেন। শামসুর রাহমান বার বার করুণ চোখে তাকাচ্ছিলেন পেছনে অসহায় দাঁড়িয়ে থাকা আমার দিকে। আমি একা দাঁড়িয়ে। দলের শেষ মানুষটি যখন অদৃশ্য হয়ে যায়, এক বন্দর মানুষের সামনে আমি হু হু করে কেঁদে উঠি। ওঁদের চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে আমার যে এমন ঝড় বইবে বুকে, এমন যে উথলে উঠবে কষ্ট, তা আমি তখন বুঝিনি। কাচের ঘরের মত ভেঙে গেল আমার স্বপ্নের দালানকোঠা। পুরো বন্দর শুনল সেই ভাঙনের শব্দ, পুরো বন্দর শুনল আমার বুক ছেঁড়া আর্তনাদ।

আমাকে পাসপোর্ট ফেরত দেওয়া হল না। হাতে একটি কাগজ ধরিয়ে দিয়ে বলা হল, ‘এই কাগজটি দেখিয়ে এসবি অফিস থেকে আপনার পাসপোর্ট নিয়ে নেবেন।’

‘কখন দেবে পাসপোর্ট?’

‘আজকে বিকালে গেলে বিকালেই পাবেন। যদি না হয়, কালকে সকালে তো পাবেনই।’ উড়োজাহাজের পেটের ভেতর থেকে ফেরত এসেছে নম্বর সাঁটা আমার দুটো সুটকেস। সুটকেসদুটো সামনে নিয়ে অনেকক্ষণ অবশ বসে থাকি। হঠাৎ কি করে কি হয়ে গেল, পুরোটাই যেন আস্ত একটি দুঃস্বপ্ন। এখনও আমার ঠিক বিশ্বাস হতে চাইছে না সত্যি সত্যিই ঘটে গেছে এমন মর্মান্তিক একটি ব্যপার।

কায়সার প্রায় সকালে বিজয়নগরে তার এক বন্ধুর আপিসে গিয়ে বসে। সেখানে ফোন করে কায়সারকে পেয়ে তাকে বিমান বন্দরে আসতে বলি। কায়সার এলে বাড়িতে না গিয়ে সোজা সচিবালয়ে যাই ইমরান নূরের সঙ্গে দেখা করতে। তিনি আমাকে আলাদা ঘরে নিয়ে মুখোমুখি বসে বললেন তাঁর কোনও ক্ষমতাই নেই আমার জন্য কিছু করার। কেন তাঁর ক্ষমতা নেই তা তিনি বলতে চাইলেন না। বহির্বাংলাদেশ ছুটির জন্য আবেদন করার উপদেশ দিলেন কলকাতা যেতে হলে আমার বর্হিবাংলাদেশ ছুটি চাই। এরকম যে একটি ছুটি নেবার নিয়ম আছে তা আমার জানা ছিল না। হরদম দেখছি ডাক্তাররা দেশের বাইরে যাচ্ছেন, কাউকে এরকম ছুটি নিতে হয়নি। আমার বেলায় আইনের সাত রকম মারপ্যাঁচ। আইন মানতে আমার তো কোনও অসুবিধে নেই। সচিবালয় থেকে ছুটে যাই হাসপাতালে। দরখাস্ত লিখে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে অগ্রায়ন নিয়ে সোজা স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালককে দরখাস্তটি দেওয়ার পর তিনি দেখলেন, পড়লেন, বললেন আমি যেন কাল আসি। কাল কেন? আজই সই দিয়ে দিন। না, আজ সই হচ্ছে না। কেন হচ্ছে না? এটি আমার আজই দরকার। আজই দরকার হোক, কিন্তু হচ্ছে না।

বাড়ি ফিরে আসি। সৌমিত্র মিত্র ফোন করছেন বিকেলের ফ্লাইটে আসা হচ্ছে কি না আমার জানতে। বলে দিই হচ্ছে না।

‘কাল হবে?’

‘চেষ্টা করবো।’

পরদিন সকালে মালিবাগের স্পেশাল ব্রাঞ্চ অফিসে পাসপোর্ট আনতে যাই। পাসপোর্ট ফেরত দেওয়া হয় না আমকে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে বহির্বাংলাদেশ ছুটির কি হল দেখতে যাই, কিছুই হয়নি জেনে আবার ক্লান্ত বিপর্যস্ত আশাহত আমি ফিরে আসি। কলকাতা থেকে সৌমিত্র মিত্র বার বারই ফোন করে জানতে চাইছেন কতদূর এগিয়েছে যাওয়ার ব্যপারটি। বলছেন আমার জন্য সবাই ওখানে অপেক্ষা করছেন, আমি না গেলে কেলেঙ্কারি হয়ে যাবে। কেলেঙ্কারি হবে তো আমি কি করব, আমাকে তো পাসপোর্টই ফেরত দেওয়া হচ্ছে না। তার পরদিনও দেখি, তার পরদিনও। আমাকে কিছুই দেওয়া হয়না। না পাসপোর্ট। না ছুটি।

আমার কলকাতা যাওয়া হয় না।

কবিরা ফিরে এলে জিজ্ঞেস করি, কেমন হল সম্মেলন, কারা কারা কবিতা পড়ল, কেমন আছে কলকাতা, নন্দনে কী চলছে, রবীন্দ্রসদনে কী হচ্ছে, শিশির মঞ্চেই বা কী.. । ওঁরা বলেন, যতটুকু বলেন, শুনে আমার সাধ মেটে না।

বইমেলা এসে যায়। এর আগের বছরের মেলায় তসলিমা নাসরিন পেষণ কমিটির মিছিল বেরিয়েছে, মেলায় আমার বই পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে, মেলা কর্তৃপক্ষ আমাকে মেলায় যেতে নিষেধ করেছেন। এ বছরের মেলায় অন্য সব কবি লেখকরা যাচ্ছেন, আমিই কেবল বসে আছি ঘরে। ঘরে মন বসে না। মন খেলায় মেতে ভেলায় ভেসে মেলায় যায়। একদিন আমার দুর্দমনীয় ইচ্ছে আমাকে খাঁচা ভেঙে বের করে আনে, যে করেই হোক যাবই আমি মেলায়। কিসের ভয় আমার! আমি তো কোনও অপরাধ করিনি। যে কোনও মানুষেরই অধিকার আছে মেলায় যাওয়ার। আমার কেন থাকবে না! আমি কেন নিজের ন্যূনতম স্বাধীনতাটুকু কর্তৃপক্ষের অন্যায় আদেশে বিসর্জন দেব! মেলায় যাওয়ার সিদ্ধান্তটি খসরুকে জানালে তিনি তাঁর দুজন বন্ধু সঙ্গে নেবেন বললেন। একা যাওয়ার তো প্রশ্ন ওঠে না, যেতে হবে সদলবলে। টাক-মাথা ছিপছিপে চশমা চোখের দার্শনিক চেহারার শহিদুল হক খান আমার নিরাপত্তা রক্ষক হিসেবে এগিয়ে এলেন। শহিদুল হক খান টেলিভিশনে অনুষ্ঠান করেন, প্রচুর কথা বলেন কিন্তু সুন্দর কথা বলেন। তাঁর অনুষ্ঠানে আমাকে একবার আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। আমন্ত্রণ প্রত্যাখ্যান করেছিলাম কিন্তু তাঁর দেওয়া নাট্যসভা পুরস্কারটি গ্রহণ করেছিলাম। তাঁর সঙ্গে একরকম বন্ধুতা গড়ে ওঠে আমার। আমার বাড়িতে দেখা হতে হতে খসরু আর শহিদুলের মধ্যেও জমে ওঠে। খসরু দেখতে যেমনই হোক, খুব হৃদয়বান মানুষ তিনি। বন্ধুদের জন্য যতটুকু করা উচিত তার চেয়েও বেশি করেন। ইত্তেফাকের সাংবাদিক আলমগীরের সঙ্গে পরিচয় হল আমার বাড়িতে, কদিন পরই তিনি আলমগীরকে তাঁর ব্যবসার অংশীদার করে নিলেন। আমার কখনও গাড়ি প্রয়োজন হলে তিনি নিজে যদি ব্যস্ত থাকেন, তাঁর গাড়িটি পাঠিয়ে দেন। হঠাৎ একদিন আমাকে তাক লাগিয়ে দিয়েছেন আমার জন্য আস্ত একটি নতুন কমপিউটার নিয়ে এসে। খসরু ধনী হয়েছেন ঠিকই, কিন্তু দেশের আর ধনীদের মত তাঁর আচরণ নয়। কত মুক্তিযোদ্ধাকেই দেখেছি নিজের আখের গুছিয়ে নিয়ে আরাম করছেন, দেশকে শকুনে ঠোকরাচ্ছে কি শেয়ালে খাচ্ছে এ নিয়ে কোনও দুশ্চিন্তা করেন না। খসরু মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন, তাঁর আদর্শ তিনি কারও কাছে বিক্রি করেননি। মুক্তিযদ্ধের পক্ষের শক্তিকে তিনি সাধ্যাতীত সাহায্য করেন। আওয়ামি লীগের নেতারা তাঁর কাছে গিয়ে বসে থাকেন দলের চাঁদার জন্য, কাউকে তিনি ফিরিয়ে দেন না। আমার একদিকে খসরু, আরেকদিকে শহিদুল হক, আমি হেঁটে যাই বইমেলার দিকে। আনন্দ আর আশঙ্কা দুটোই আমাকে কাঁপায়। মেলায় হাঁটাহাঁটি ঘোরাঘুরি চলবে না। কোনও একটি স্টলে কিছুক্ষণ বসে মেলার স্বাদ নিয়ে সাধ মিটিয়ে দু পাশে নিরাপত্তা নিয়ে ফিরে যেতে হবে, এই হল শুভাকাঙ্খীদের সিদ্ধান্ত। পার্ল পাবলিকেশন্সের স্টলে ঢুকতেই মিনু আমাকে দেখে উল্লাসে ফেটে পড়েন। প্রচুর লোক নাকি আমার বই কিনছে, আমার অটোগ্রাফের জন্য বার বার ঘুরে যাচ্ছে। মেলার এই আলোকিত প্রাঙ্গন, লেখক পাঠকের এই মিলনকেন্দ্রটির উৎসব উৎসব পরিবেশ দেখে, গানের সুরে, কবিতার শব্দে কোলাহলে কলরোলে মুখরিত বইমেলাটি দেখে মুহূর্তের মধ্যে আমি ভুলে যাই আমার কোনও বিপদ আছে এখানে, যেন আর সব লেখকের মত বইমেলায় থাকার, ঘূরে বেড়াবার সব অধিকার আমার আছে। পুরো দেশটির সবচেয়ে সভ্য, শিক্ষিত, সবচেয়ে সচ্চরিত্র, সৎ সদাচারী, সুজন সজ্জন, স্বাধীনচেতা সাহিত্যিক সাংস্কৃতিক মানুষেরা যে জায়গাটিতে জড়ো হন, নিরাপত্তা যদি সেখানে না থাকে তবে আর আছে কোথায়! আমার জন্য মসজিদ নিরাপদ নয়, কোনও রক্ষণশীল লোকদের আঙিনা নিরাপদ নয়, কোনও অন্ধকার গলি, কোনও নির্জন পথ নিরাপদ নয়, কোনও সন্ত্রাসীর আড্ডাখানা, মাতালের আস্তানা নিরাপদ নয়, কোনও ধর্মীয় জলসা নয়, কোনও জামাত শিবিরের আখড়া নয়, খল পুরুষের এলাকা নয়। নিজের ঘরের বাইরে যদি কোনও নিরাপদ কিছু আমার জন্য থেকে থাকে, তবে তো এই মেলাই। বড় চেনা এই মেলা আমার, বড় অন্তরে এই মেলা আমার,হৃদয়ের রক্তস্রোতে এই মেলা, প্রতিটি হৃদস্পন্দনে মেলা, এই মেলা আমার দীর্ঘ শোকের পরের অমল আনন্দ, সারা বছরের প্রাণপাত পরিশ্রমের পর এই মেলা যেন হাত পা ছড়িয়ে শুয়ে আবেশে চোখ বোজার প্রশান্তি। মিনু জানান, লজ্জা খুব বিক্রি হচ্ছে, কয়েকদিনেই প্রথম মুদ্রণ শেষ হয়ে গেছে, এখন দ্বিতীয় মুদ্রণ চলছে, তিনি নিশ্চিত তাঁকে অচিরে তৃতীয় মুদ্রণে যেতে হবে। এ কদিনেই কয়েক হাজার লজ্জা শেষ হয়ে যাচ্ছে। বিস্ময়ের ঘোর কাটে না আমার। লজ্জা কেন লোকে কিনবে! লজ্জায় কী আছে! এটি কোনও প্রেমের উপন্যাস নয়, চমকপ্রদ কোনও কাহিনী নেই এতে, যে কথা সকলে জানে, সে কথাই গল্প আকারে লেখা, তথ্য ভারাক্রান্ত। পাঠক সাধারণত এসব বই পছন্দ করে না। পার্ল পাবলিকেশন্সের স্টলে বসার সঙ্গে সঙ্গেই মানুষ লাইন ধরে বই কিনতে শুরু করে। সবাই যে লজ্জার জন্য লজ্জা কেনে তা নয়। নতুন বই কেনার আগ্রহে কেনে। স্টলে এসে জিজ্ঞেস করে, তসলিমা নাসরিনের নতুন বই কী বেরিয়েছে? নতুন বই লজ্জা। একটা লজ্জা দিন। দু টা লজ্জা দিন। তিনটে লজ্জা দিন। অন্যান্য স্টলের লোক আসে নিতে, পঞ্চাশটা লজ্জা দিন, একশটা লজ্জা দিন। প্রথম ভেবেছিলাম সম্ভবত হিন্দুরা বইটি কিনছে। কিন্তু অটোগ্রাফ দেওয়ার সময় অনেকেই তাদের নাম লিখতে বলে, নামগুলো হিন্দু নাম নয়। লজ্জা বিক্রি হয় আর আমার মনে ভয় জন্মাতে থাকে, যারা এই বই কিনছে, দু পাতা পড়ার পরই নিশ্চয়ই তাদের আর ভাল লাগবে না। তসলিমার লেখার ভক্ত বলে বইটি কিনছে, নাকি বিশেষ করেই লজ্জা কিনছে, জেনেই কিনছে কী আছে এতে, আমার বোঝা হয় না। সুযোগও হয় না ক্রেতাদের কাউকে জিজ্ঞেস করার। লজ্জার জন্য ভিড় বাড়তে থাকে। অটোগ্রাফের জন্য ভিড়। এক মুহূর্তের জন্য কলমকে অবসর দিতে পারি না। শহিদুল বসে আছেন পাশে। খসরু দাঁড়িয়ে আছেন দরজায়, তাঁর বলশালী বন্ধুরা আশে পাশে কোথাও আছে। এত লোক আমাকে ভালবাসে, আমার বই পড়ে, আমার কেন নিরাপত্তার অভাব হবে এই মেলায়! তা সম্ভবত খসরুও অনুমান করেন, তিনি একটু ঘুরে আসি বলে জনারণ্যে হাওয়া খেতে যান। এর খানিক বাদেই ঘটনা ঘটে। ঘটনাটি প্রথম আঁচ করতে পারিনি কেউই। স্টলের সামনের খোলা অংশটি ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে মানুষ। স্টলের বসে থাকা দাঁড়িয়ে থাকা সবাই লক্ষ করছি কয়েক মুহূর্তের মধ্যে ঘিরে থাকা মানুষগুলোর পেছনে শ তিনেক মানুষ দাঁড়িয়ে গেল। স্টল ঘিরে প্রচণ্ড ভিড়, কিন্তু কেউ বই কিনতে চাইছে না, কেউ সরছেও না। ভিড়ের লোকগুলো কি চায়, কেন এখানে খামোকা দাঁড়িয়ে আছে, কেন জায়গা দিচ্ছে না যারা বই কিনতে আসছে তাদের, তা স্টলের একজন চেঁচিয়ে জানতে চায়। তার জানতে চাওয়ার কোনও উত্তর মেলে না, কেবল একটি হৈ হৈ শব্দ ছাড়া। হৈ হৈ কিছুক্ষণ চলল। শব্দটি কোনও শোভন শব্দ নয়। মিনু আমাকে আস্তে করে আমার চেয়ারটি পিছিয়ে নিতে বললেন। ভিড় আর আমাদের মধ্যে মাত্র দেড় হাত দূরত্ব, দেড়হাতের মধ্যে লম্বা টেবিলের মত পাতা। আমি চেয়ার পিছিয়ে নিয়ে বসলাম। সঙ্গে সঙ্গে সমস্বরে উদ্ভট সব শব্দ করা শুরু করল ভিড়ের লোকেরা। উদ্ভট শব্দ রূপান্তরিত হয় ‘ধর এরে মার এরেঞ্চশব্দে। ‘মাথা ফাটাইয়া দে, কাপড় খুইল্যা নে, হাত ভাইঙ্গা ফেলঞ্চশব্দে। স্টলের একজন ‘পুলিশ, পুলিশ কোথায়ঞ্চ বলে চেঁচাচ্ছে, মিনু তাকে দৌড়ে পুলিশ ডেকে আনতে বলেন। পুলিশ ডাকতে যাওয়ার পথ নেই কোনও। স্টল থেকে বেরোবার জন্য সূতো পরিমাণ জায়গা নেই। হঠাৎ ঢিল। একটির পর একটি ঢিল এসে পড়ছে আমার গায়ে। কানের পাশ দিয়ে চলে যাচ্ছে, ঘাড়ে পড়ছে, বুকে এসে লাগছে, হাতে লাগছে। আমাকে আড়াল করে ততক্ষণে দাঁড়িয়ে গেছেন শহিদুল আর মিনু। আমি স্তব্ধ বিস্ময়ে হতবাক আর বিবর্ণ হয়ে আছি। বড় বড় ঢিল ছোঁড়া হচ্ছে স্টলের বইয়ের তাকে, বই হুড়মুড় করে পড়ছে নিচে, পাথর পড়ল বাল্বের ওপর, বাল্বের কাচ ছিঁটকে পড়ল আমাদের গায়ে। অন্ধকার হয়ে গেল পুরো স্টল। অনুচ্চ স্বরে স্টলের লোকেরা নিজেদের মধ্যে দ্রুত কিছু বলে নিল। কুলকুল করে ঘামছে এক একজন। এরপর তিনশ লোকের ধাককা স্টলের দিকে। ধাককার চোটে সামনের যে টেবিলের বাধাটি ছিল সেটি ভেঙে পড়ল। পুলিশ থামের মত দূরে দাঁড়িয়ে আছে। এ পা ও এগোচ্ছে না। পুলিশের জন্য অপেক্ষা করার আর সময় নেই। আমার দিকে ধেয়ে আসা লোকেরা যে কোনও মুহূর্তে আমাকে নিশ্চিহ্ন করে ফেলবে। আমাকে প্রাণে বাঁচাতে গেলে এই মুহূর্তে কিছু একটা করতেই হবে স্টলের লোকদের। মুহুর্তের মধ্যে যে যা পারেন, মেঝেয় মোটা মোটা কাঠ ছিল, বাঁশ ছিল, স্টল বানিয়ে বাড়তি জিনিসগুলো স্টলের ভেতরেই ছিল, সেগুলো দুহাতে তুলে নিয়ে একযোগে ভাঙা টেবিলের ওপর দাঁড়িয়ে ধর ধর বলে ধাওয়া দিল। এক ধাওয়ায় ভিড় পিছিয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দুটো পুলিশ দৌড়ে এসে আমার চিলের মত ছোঁ মেরে স্টল থেকে বের করে নিল, দুদিকে দুটো পুলিশ আমার দু বাহু শক্ত করে ধরে দৌড়োতে লাগল। পেছন থেকে আরও কিছু পুলিশ আমাকে সামনের দিকে ধাককা দিয়ে নিয়ে যেতে লাগল। আমার হাতব্যাগ কোথাও পড়ে গেছে, পায়ের জুতোও কোথাও খুলে গেছে, শাড়ি ঝুলছে খুলে, ওই অবস্থাতেই দৌড়ে আমাকে নিয়ে তুলল একাডেমির দোতলায়। আমাকে ভেতরে ঢুকিয়েই পুলিশ বন্ধ করে দিল লোহার দরজাটি। স্টল থেকে একাডেমির মূল দালানটিতে আসার পথের দু পাশে পুরো মেলার লোক ভিড় করে দেখছিল দৃশ্য। দৃশ্যটি নিশ্চয়ই দেখার মত ছিল। দোতলায় তখন আমার গা থরথর করে কাঁপছে। পুলিশেরা কথা বলছেন বাংলা একাডেমির মহাপরিচালকের সঙ্গে। মহাপরিচালক আমাকে ডেকে নিয়ে কড়া স্বরে বলে দিলেন, আমি যেন আর কখনও ভুলেও বইমেলায় না আসি। বাংলা একাডেমির বইমেলায় সারাজীবনের জন্য আমি নিষিদ্ধ।

যেরকম কালো গাড়ি করে চোর গুণ্ডাদের পাকড়াও করে পুলিশ থানায় নিয়ে যায়, সেরকম গাড়িতে তুলে পুলিশেরা আমাকে শান্তিবাগের বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে এল। পথে একজন পুলিশ বলল, ‘ধর্ম নিয়ে লেখেন কেন? ধর্ম নিয়ে লিখলে এইরকম কাণ্ড তো হবেই।’ আরেকজন বললেন, ‘আমরা না বাঁচালে আপনাকে আর বেঁচে ফিরতে হত না আজকে।’

খানিক পর শান্তিবাগে খসরু এলেন। শহিদুল হক খান এলেন। মিনু এলেন। সকলেই ঘটনার আকস্মিকতায় স্তম্ভিত। সকলে ফ্রিজ থেকে নিয়ে ঠাণ্ডা পানি খেলেন। মিনু জানালেন তাঁর স্টল পুরো ভেঙে ফেলেছে। বই সব লুট হয়ে গেছে। শহিদুল হক পায়চারি করতে করতে বললেন যে তিনি দেখেছেন হুমায়ুন আজাদ এবং আরও কিছু লেখক দূরে দাঁড়িয়ে ওইসময় চা খাচ্ছিলেন আর কাণ্ড দেখছিলেন। খসরু বললেন যে তিনি ভিড়ের জন্য নিজে তিনি স্টলের দিতে যেতে পারছিলেন না। পুলিশদের তাগাদা দিচ্ছিলেন কিছু একটা ব্যবস্থা করতে কিন্তু তারা মোটেও নড়তে চাইছিল না।

আমি স্তব্ধ বসেছিলাম। চোখের সামনে বারবারই ভয়ংকর দৃশ্যগুলো ভেসে উঠছে আর ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছে শরীর। স্টল থেকে ওই হঠাৎ ধাওয়াটি না দিলে কী হত অবস্থা, জিজ্ঞেস করি। কারও মুখে কোনও উত্তর নেই। কী হত, তা তাঁরাও নিশ্চয়ই অনুমান করতে পারেন।

একুশে ফেব্রুয়ারির আগের রাতে শহীদ মিনার লাল সূর্য আঁকা একটি কাপড় দিয়ে সাজানো হয়। আমার ওপর আক্রমণ হওয়ার ঘণ্টাখানিক আগে মিনারের লাল সূর্যটি পুড়িয়ে দিয়েছে কারা যেন! শহীদ মিনারের সূর্য পুড়িয়ে দেওয়া লোকগুলোই কি ভিড় করেছিল বইমেলার স্টলে, আলো নিভিয়ে দিয়েছিল স্টলের! অন্ধকার করে দিয়েছিল আমার স্বাধীনতার জগতটি!
 
২০. লজ্জাহীনতা


তসলিমা নাসরিনের লজ্জা উপন্যাস বাজেয়াপ্ত

গতকাল শনিবার এক তথ্য বিবরণীতে বলা হয়, জনমনে বিভ্রান্তি ও বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি অঙ্গনে বিঘ্ন ঘটানো এবং রাষ্ট্রবিরোধী উস্কানিমূলক বক্তব্য প্রকাশিত হওয়ায় তসলিমা নাসরিন রচিত লজ্জা (প্রথম প্রকাশ ফেব্রুয়ারি ৯৩ পার্ল পাবলিকেশন্স, ৩৮/২, বাংলাবাজার, ঢাকা-১১০০ হতে প্রকাশিত) বইটি ফৌজদারি কার্যবিধির ৯৯- ক (৯৯-অ) ধারার ক্ষমতাবলে সরকার কর্তৃক বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে এবং এর সকল কপি বিক্রয়, বিতরণ ও সংরক্ষণ নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। ১১ই জুলাই, ১৯৯৩

রবিবারের পত্রিকায় প্রথম পাতায় খবরটি ছাপা হয়। খবরটি আমাকে বিস্মিত করে, আমাকে চমকিত করে, আমাকে স্থবির করে আবার চঞ্চলও করে। লজ্জা বইটি সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির বিঘ্ন ঘটিয়েছে, এরকম অপবাদ কখনও কোথাও শুনিনি। বইটির গদ্য ভাল নয়, বইটি উপন্যাস হয়নি, তথ্যে ঠাসা বইটি বার বারই মনোযোগ নষ্ট করে, এসব শুনেছি। মানিও। বইটিতে ত্রুটি আছে, অবশ্যই। খুব অল্প সময়ের মধ্যে লেখা। প্রকাশকের চাপে বইয়ের গুণগত মানগত ব্যপারগুলো নিয়ে ভাবার জন্য মোটেও সময় পাইনি। কিন্তু যত দোষই দাও, বইটি সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিতে বিঘ্ন ঘটাবে এই দোষ তুমি দিতে পারো না মাননীয় সরকার। দেশে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির অভাব বলেই বইটি লেখা, যেন সম্প্রীতি সৃষ্টি হয়, যেন কোনও মানুষের ওপর তার ভিন্ন ধর্ম বিশ্বাসের কারণে কোনও রকম নির্যাতন না হয়। শরীরে একটি মস্ত ঘা হয়েছে, এই ঘাটি খুলে দেখানোর উদ্দেশ্য একটিই, যেন চিকিৎসা পাওয়া যায়। এর মানে কি এই যে ঘাএর কথা বলে আমি শরীরের অপমান করেছি! যদি আমার নির্বাচিত কলাম আজ বাজেয়াপ্ত করা হত, আমি এত অবাক হতাম না। যদি নষ্ট মেয়ের নষ্ট গদ্যকে নিষিদ্ধ করা হত, অবাক হতাম না। কারণ এই বইগুলোয় আমি ধর্ম সম্পর্কে আমার নিজস্ব মত ব্যক্ত করেছি, যে মত এ দেশের বেশির ভাগ লোকেরই সয় না। লজ্জায় আমি ধর্ম নিয়ে কোনওরকম মন্তব্য করিনি। বরং সব ধর্মের মানুষের ধর্ম বিশ্বাসের অধিকার আছে, এবং তা থাকা উচিত, সে কথাই বলেছি। হিন্দুরা নির্যাতিত হচ্ছে, কোথায় কী করে নির্যাতিত হচ্ছে, কেন তারা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে, কেন তারা নিজের দেশ ছেড়ে চলে যাচ্ছে অন্য দেশে, তাদের কষ্টের কথা, তাদের গভীর গোপন যন্ত্রণার কথা তাদের হয়ে অনুভব করতে চেষ্টা করেছি।

লজ্জা বাজেয়াপ্ত হওয়ার কদিন পর একটি দীর্ঘ চিঠি আমার হাতে আসে। চিঠির শুরুতে লেখা গোপনীয়। চিঠিটি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং তথ্য মন্ত্রণালয়ের সচিবের কাছে পাঠানো, পাঠানো হয়েছে ঢাকা সেনানিবাস থেকে। সেনাবাহিনীর মহাপরিচালকের পক্ষে ব্রিগেডিয়ার এম.এ.হালিম চিঠিটি লিখেছেন। সেনাবাহিনীতে, শুনেছি, দুটো দল আছে। এক দল ধর্মীয় চরমপন্থী, আরেক দল নরমপন্থী। চরমপন্থীরাই এই আদেশটি পাঠিয়েছে সরকারের কাছে। লিখিত ভাষাটিকে আদেশ বলে মনে না হলেও এটি আদেশ। সেনাবাহিনীর সীমাহীন ক্ষমতা সম্পর্কে আমাদের কোনও দ্বিধা থাকা উচিত নয়। সেনাবাহিনীর নিতম্বই এই স্বাধীন বাংলাদেশের গদি সবচেয়ে বেশিকাল স্পর্শ করেছে। অ-সেনা কিছু সরকারের মাথার পেছনে বন্দুকের নল ছিল, সে কথাও আমরা জানি। সেনাবাহিনী জানে, যে কোনও সময় তারা বন্দুক হাতে নিয়ে চলে আসতে পারে দেশ শাসন এবং শোত্র করতে। যে প্রধানমন্ত্রী এখন মহাসমারোহে ক্ষমতায় বসেছেন, তাঁর গাড়ির বহরও সেনানিবাস থেকেই যাত্রা করে। তিনি সেনা-স্ত্রী। সেনা থেকে নিস্তার নেই জনগণের। আমার থাকবে কেন! সেনাবাহিনী থেকে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে লজ্জা নিষিদ্ধ করার, সুতরাং লজ্জাকে নিষিদ্ধ হতেই হবে। বন্দুকের সামনে মাথা নুয়ে আছে দেশের যাবতীয় বিষয়ে সিদ্ধান্তনেলেওয়ালাগণ।

চিঠিটির শুরুতে লজ্জার গল্পটি সংক্ষেপে বর্ণনা করে এবং লজ্জা থেকে কিছু উদ্ধৃতি দিয়ে শেষদিকে, শেষপৃষ্ঠায় লেখা, ‘এতদাঞ্চলের দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি সবচেয়ে অটুট। ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতপ্রাপ্ত হলে দুএকটি বিচ্ছিত ঘটনায় সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট হবার ঘটনা এই নয় যে, দেশে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নেই। সংখ্যালঘু হিন্দুরা চাকুরিতে সর্বক্ষেত্রে আনুপাতিক হারে এবং কতক ক্ষেত্রে অধিকতর সুযোগ সুবিধা পাচ্ছে। ব্যবসা বাণিজ্যে হিন্দুদের অবস্থান সুসংহত। কিন্তু জনাবা তসলিমা নাসরিন বইটিতে হিন্দু নির্যাতনের কাল্পনিক চিত্র ফুটিয়ে তুলেছেন। চাকুরি সংক্রান্ত ব্যপারে ভুল তথ্য পরিবেশন করেছেন। বইটির মাধ্যমে লেখিকা হিন্দুদের দারুণভাবে উসকে দিয়েছেন। আর একজন মুসলমান লেখিকার এহেন লেখা থেকে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়, বাংলাদেশে হিন্দুদের নাগরিক অধিকার হরণ ও তাদের উপর নির্যাতনের অলীক ধারণাকে সত্য বলে ধরে নেবে। এছাড়া বাংলাদেশের বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি হয়ে সহাবস্থানের মনোভাব ক্ষতিগ্রস্থ হবে।

কারও লিখিত বই দ্বারা দেশের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট ও বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টির অবকাশ থাকলে সে সকল বই বাজারে প্রকাশিত হতে না দেয়াই শ্রেয়। জনাবা তসলিমা নাসরিন বাংলাদেশের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিকে কটাক্ষ করে লজ্জা বইটি লিখে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের লোকজনের মধ্যে ভুল বোঝাবুঝি সৃষ্টিতে ইন্ধন যুগিয়েছে বিধায় বইটি নিষিদ্ধ করণ ও বাজার হতে এর সকল কপি বাজেয়াপ্ত করার ব্যবস্থা করা যেতে পারে।

আপনার সদয় অবগতি এবং যথাসমীচীন কার্যক্রমের জন্য প্রেরিত হল।

কোত্থেকে প্রেরিত হল? প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা মহাপরিদপ্তর থেকে। ১৩০০/১৬৪/ডি/সি.আই.বি। তারিখ, আষাঢ় ১৪০০/ ০৩ জুলাই,১৯৯৩

এ চিঠি লেখার পর সাতদিনের মধ্যেই লজ্জা নিষিদ্ধ। নিষিদ্ধ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ঢাকার বইয়ের বাজারে যত লজ্জা পাওয়া গেছে, সব তুলে নিয়ে গেছে পুলিশ। কেবল তাই নয়, স্পেশাল ব্রাঞ্চের বিশেষ দল বাংলাবাজার এলাকায় অভিযান চালিয়ে যত লজ্জা ছিল, সব লজ্জা ট্রাক ভরে নিয়ে গেছে, এমনকী ৬ নম্বর ওয়াল্টার রোডে বই বাঁধাই এর দোকানে গিয়ে আধ-বাঁধানো আর না বাঁধানো বইগুলোকেও রেহাই দেয়নি। কেবল ঢাকায় নয়, দেশের সমস্ত বইয়ের দোকানে আচমকা ঝাঁপিয়ে পড়ে যত লজ্জা ছিল, পুলিশ সবই বাজেয়াপ্ত করেছে। বই বেরিয়েছে সেই ফেব্রুয়ারি মাসে। প্রকাশের পাঁচ মাস পর বই নিষিদ্ধ। এর মধ্যে ষাট হাজার বিক্রি হয়ে গেছে। সপ্তম সংষ্করণ চলছিল। আর এখন কী না বইটি নিষিদ্ধ হল! এই সরকার কাকে পড়তে দিতে চায় না বইটি। স্বৈরাচারী সরকারের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে মানুষ বছরের পর বছর রক্তক্ষয়ী আন্দোলন করে স্বৈরাচার উৎখাত করে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করল, আর এই কি না গণতন্ত্রের চেহারা!

কবি শামসুর রাহমান লজ্জা বাজেয়াপ্তের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করলেন। পত্রিকায় কেবল বিবৃতি দিয়েই তিনি দায়িত্ব শেষ হয়েছে বলে মনে করেননি, ভোরের কাগজে লিখলেন, ‘তসলিমা নাসরিন প্রতিক্রিয়াশীলদের আক্রমণের লক্ষবস্তুতে পরিণত হয়েছেন। তাঁকে আক্রমণ করা হচ্ছে বহুদিন থেকে। একটি কি দুটি ইসলামী সংগঠন তাঁর ফাঁসির দাবি জানিয়েছে। সরকারকে বলেছে তাঁকে গ্রেফতার করার জন্যে। সরকার তাঁকে গ্রেফতার করেনি কিন্তু বাজেয়াপ্ত হয়েছে তাঁর লোকপ্রিয় উপন্যাস লজ্জা। উপন্যাসটি আমি আদ্যেপান্ত পড়েছি। নান্দনিক দিক থেকে কিছু ত্রুটি লক্ষ্য করলেও আমার কাছে এই উপন্যাসের কোনও কিছুই আপত্তিকর মনে হয়নি। তসলিমা নিদ্বির্ধায় সত্য প্রকাশ করেছেন এবং সত্য প্রকাশ করাই একজন লেখকের প্রধান কর্তব্য। তসলিমা নাসরিন একজন মুক্তমতি, অসাম্প্রদায়িক লেখক। কোনও ধরনের সাম্প্রদায়িকতাকে উসকে দেওয়ার প্রবণতা তাঁর মধ্যে থাকতেই পারে না, পাঠকদের বিভ্রান্ত করার অপচেষ্টা থেকেই নিজেকে তিনি বিরত রেখেছেন সবসময়। কোদালকে কোদাল বলতেই পছন্দ করেন তিনি। যা বলেন, সাফ সাফ বলেন, রেখে ঢেকে কিছু বলেন না। এক যুবক আমাকে কিছুদিন আগে জানিয়েছেন যে লজ্জা উপন্যাসটি পড়ে তাঁর মনে হয়েছে যেন তিনি নিজেই উপন্যাসটির নায়ক সুরঞ্জন। এ রকম একটি বই বাজেয়াপ্ত করার যৌক্তিকতা কোথায়? যৌক্তিকতা খুঁজে পাননি ডক্টর আহমদ শরীফ। তিনি বলেছেন, লজ্জায় তথ্যের কোনও বিকৃতি নেই।

জনগণের রায়ে নির্বাচিত সরকার দেশে একটি গণতান্ত্রিক কাঠামো গড়ে তোলার কথা প্রায়শই বলে। কে না জানে, বাক স্বাধীনতা গণতন্ত্রের প্রধান শর্ত। অথচ সরকার একজন সৃজনশীল লেখকের বই বাজেয়াপ্ত করে বাক স্বাধীনতা হরণ করেছে। অথচ একটি বই, যা তসলিমা নাসরিনকে হত্যা করার জন্যে সাধারণ মানুষকে প্ররোচিত করছে, বাজারে অবাধে বিক্রি হচ্ছে। কাউকে হত্যার প্ররোচনা দেওয়া মস্ত অপরাধ। এই বইয়ের দিকে সরকার নজর দিচ্ছে না কেন? মৌলবাদীদের বই বলে?

ব্যক্তিগত ভাবে আমি কোনও বই নিষিদ্ধ ঘোষণা করার পক্ষপাতি নই। কারণ, আমি মনে করি না কোনও বইই সমাজের ক্ষতি করতে পারে। যে বই মানুষকে হত্যা করতে প্ররোচণা এবং উৎসাহ জোগায়, ফ্যাসিবাদের গুণ গায়, সে বইয়ের কথা আলাদা। যে দেশে ওষুধেও ভেজাল দেওয়া হয়, চোরাচালান কায়েম রয়েছে, খাদ্যদ্রব্য বিষাক্ত করা হয় ভেজাল মিশিয়ে, যে দেশে ক্ষতিকর লোকদের অবাধ বিচরণ, সে দেশে একজন সত্যান্বেষী মুক্তমতি লেখকের বই নিষিদ্ধ করা হয় কেন? একজন লেখক নিরীহ বলেই কি? তসলিমা নাসরিনর লজ্জা উপন্যাসটিকে মুক্ত ঘোষণা করার জন্য আমরা যারা লেখকের স্বাধীনতায় বিশ্বাসী তাঁরা সরকারের কাছে দাবি জানাই। আশা করি, সরকার লজ্জার ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে প্রমাণ করবেন যে প্রকৃতই তারা বাকস্বাধীনতা এবং গণতন্ত্রে বিশ্বাসী।’

১৯ জুলাই তারিখে লেখাটি ছাপা হয় ভোরের কাগজে। তার পরদিনই ছাপা হল প্রাক্তন বিচারপতি কে এম সোবহানের লেখা। বাজার থেকে লজ্জা তুলে নেওয়ার জন্য সরকার যে বিপুল পুলিশবাহিনী নামিয়েছে দেশে, তা দেখে তিনি মন্তব্য করেছেন ..‘এই পুলিশী তৎপরতা যদি চালানো হত গত ডিসেম্বরের সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে তা হলে হয়ত বইটি লেখার দরকারই হত না। বইটিতে যেসব বক্তব্য আছে তা বিভিন্ন ধর্ম সম্পর্কে উস্কানিমূলক বলে কোনও পাঠক মনে করবেন না যদি না সেই পাঠক ঐ সন্ত্রাসীদেরই একজন বা তাদের প্রতি সহানূভূতিসম্পণ্ন হয়।’

কে এম সোবহান ‘সরকারের লজ্জা ধর্মীয় চরমপন্থীরাঞ্চ এই শিরোনামে আরও একটি কলাম লিখেছেন। স্বৈরাচারী এরশাদ সরকারের সঙ্গে ক্ষমতাসীন জাতীয়তাবাদী দলের যে গলায় গলায় মিল আছে একটি ব্যপারে, তা বলেছেন। জ্ঞস্বৈরাচারী সরকারের ওপর মৌলবাদী চরমপন্থীদের প্রভাবের কারণে ও তাদের উস্কানিতে সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাস চালানো হয়েছিল। স্বৈরাচারী সরকারের অন্যান্য কাজের প্রতি সরকারি দলের অসন্তুষ্টি থাকলেও ঐ কাজটি তাদের পছন্দসই ছিল কেন না স্বৈরাচারীর সঙ্গে এখানে তাদের মতের সম্পূর্ণ মিল। তাই গ্লানি নামের সংকলনটি নিষিদ্ধ হয়ে গেছে। তাই লজ্জা নিষিদ্ধ।’ বর্তমান সরকার নিজেদের গণতান্ত্রিক বলে মুখে ফেনা তুলে ফেলেছে। কিন্তু গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত হলেই, কে এম সোবহান বলেছেন, ‘গণতান্ত্রিক হওয়া যায় না।’

এই যে ধুম করে বইটি নিষিদ্ধ করে দিল সরকার আর এই যে গতমাসেই পররাষ্ট্রমন্ত্রী বিশ্ব মানবাধিকার সম্মেলনে গিয়ে বলে এলেন, যে ‘আমাদের রাষ্ট্র জাতিসংঘ সনদের প্রতি আনুগত্য পোষণ করে এবং সেই কারণে এর অংশ হিসেবে মানবাধিকারের নীতিগুলোর প্রতিও সরকার অনুগত। এটা আমাদের সংস্কৃতি ও সংবিধানের অংশ। আমাদের দেশে গণতন্ত্র কার্যকরী হয়েছে এবং আমাদের কাজে আছে পূর্ণ য়চ্ছত!। সরকার জনগণ ও সংসদের কাছে দায়বদ্ধ। প্রেস সম্পূর্ণভাবে স্বাধীন এবং বিরোধী দল তাদের অবস্থানে দৃঢ়। সেই কারণে আমরা নীতিগতভাবে মানবাধিকার পালন করব। ..’ এই কি পালন করার নমুনা! কথা এবং কাজের মধ্যে আদৌ কি কোনও মিল আছে এই সরকারের! সংবিধানে যে বেশ স্পষ্ট করে লেখা আছে প্রত্যেক নাগরিকের জন্য চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতার নিশ্চয়তার কথা, প্রত্যেক নাগরিকের বাক ও ভাব প্রকাশের স্বাধীনতার অধিকারের কথা! তা কে মানে! কে দেখে সংবিধান। সরকারি দল মনে করে রাষ্ট্র তারা দখল করে নিয়েছে। ইচ্ছে করলেই তারা ডাংগুলি খেলতে পারে রাষ্ট্রের নীতি নিয়ে। সংবিধানকে সঙ সাজিয়ে রাস্তায় ন্যংটো করে দাঁড় করিয়ে দিতে পারে ইচ্ছে করলেই। কে এম সোবহান ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন এই বলে যে, ‘দেশের সবোগচ্চ আইনের সংবিধানে এই বিধান থাকা সত্ত্বেও সরকারের একটি বিভাগ মৌলবাদী ও চরমপন্থীদের প্ররোচনায় বইটি বাজেয়াপ্ত করেছে। এই মৌলবাদী দলটি ও ধর্মীয় চরমপন্থীরা সরকারি দলের কাঁধে সিন্দাবাদের ভূতের মত চেপে বসেছে। বিশ্বের প্রতিটি দেশ আজ এই মৌলবাদী ও ধর্মীয় চরমপন্থীদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নিচ্ছে। তা থেকে মুসলিম রাষ্ট্রগুলোও দূরে নেই। মিশর, তুরস্ক, আলজেরিয়া, তিউনেশিয়া, মরককো সর্বত্রই এদের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। কেবল বাংলাদেশের সরকারি দল ক্ষমতায় আসার জন্য তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশের জন্যই তাদের কথামত কাজ করছে। মৌলবাদী এই দলটি গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে ব্যবহার করছে গণতন্ত্রকে ধ্বংস করার জন্য। সরকারকে এটা বুঝে এই মৌলবাদী দলকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহার নিষিদ্ধ করতে হবে। সরকারগুলোর দূর্বলতার কারণেই সম্ভব হয়েছিল গত ডিসেম্বরে সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাস করা। তসলিমা নাসরিনকে তাঁর পাঠকবর্গ অভিনন্দন জানাবেন এই মৌলবাদী ও চরমপন্থী ও তাদের ধারককে জনগণের সামনে চিহ্নিত করার জন্য।’

অভিনন্দন আমার জোটে কিছু। তার চেয়েও বেশি জোটে অভিসম্পাত। অভিযোগের শেষ নেই। মুসলমানদের বারোটা বাজিয়েছি, মুসলমান হয়ে মুসলমানের দুর্নাম করেছি, বাংলাদেশে কোনও সাম্প্রদায়িকতা নেই, যা লিখেছি মিথ্যে লিখেছি, হিন্দুরাই তাদের অবস্থার জন্য দায়ী, সামান্য ধমকেই কোঁচা তুলে ভারতে পালায়, আমার কাণ্ডজ্ঞান নেই, হিন্দুদের হাতের পুতুল হয়েছি, হিন্দু মৌলবাদীরা আমাকে পুরস্কার দিয়েছে, তারা আমাকে দিয়ে লজ্জা লিখিয়েছে ইত্যাদি ইত্যাদি। মৌলবাদীরা তো বলেই কিন্তু বুদ্ধিজীবী বলে পরিচিত আহমদ ছফা বললেন, ‘লজ্জা একটি ইতরশ্রেণীর উপন্যাস।’ এই বইটি ভারতে তাঁর জাতভাই মুসলমানদের বিপদ ঘটাবে বলে তাঁর বিশ্বাস, সুতরাং তিনি জাতভাইদের যেন কোনও বিপদ না ঘটে তাই আল্লাহর কাছে প্রার্থণা করছেন। লিখেছেন ‘তসলিমা সবসময় মন্দ অংশটাকেই বড় করে দেখে। তসলিমার লজ্জাকে নর্দমার জরিপকারী রিপোর্ট মনে হয়েছে। তার বাকি উপন্যাসগুলো ইতর শ্রেণীর রচনা। ভদ্রলোকের স্পর্শের অযোগ্য।’ হুমায়ুন আজাদ লিখেছেন, ‘তসলিমার লেখা অত্যন্ত নিম্নমানের.। তার লেখা অনেকাংশে অসততাপূর্ণ পুনরাবৃত্তিতে ভরা এবং বাজারের মুখ চেয়ে লেখা।’

কিন্তু সবকিছুর পরও স্বস্তি হয় যে অনেক লেখকই প্রতিবাদ করছেন বই নিষিদ্ধ করার বিরুদ্ধে। আবদুল গাফফার চৌধুরীর সঙ্গে আমার কখনও দেখা হয়নি, আলাপ হয়নি। লন্ডনে বসে কলাম লেখেন তিনি। ভোরের কাগজে কলাম লিখলেন ‘তসলিমার সাহিত্য, বক্তব্য ও মতামতের সমালোচনা নয় বরং ব্যক্তি তসলিমাই সবার আলোচনার বিষয়ঞ্চ, এই শিরোনাম দিয়ে। আমার ব্যক্তিজীবন, আনন্দ পুরস্কার পাওয়া, লজ্জা লেখা ইত্যাদি বিষয় নিয়ে যা ঘটেছে দেশে, সেসব নিয়ে নিজের মত প্রকাশ করেছেন, ‘..তসলিমা নাসরিনের লেখা নিয়ে কোনও বিতর্ক নয়, বিতর্কের নামে আসলে যা শুরু হয়েছে, তা তসলিমার বিচার সভা। এই বিচারসভার স্ব-নিযুক্ত বিচারক হিংস্র এবং ঘাতক মৌলবাদীরা। পেছনে তাদের মদদদাতা ক্ষমতাসীন সরকার। আর জুরির আসনে বসা আমাদের সেক্যুলার ও প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবীদের একাংশও দ্বিধান্বিত এবং দ্বিধাবিভক্ত। তাঁদের কারও লেখা পড়ে মনে হয়, তসলিমার প্রতি তাঁদের কারও রয়েছে ব্যক্তিগত অসূয়া, কারও রয়েছে আনন্দ পুরস্কার না পাওয়ার অব্যক্ত হতাশা ও ক্ষোভ, কারও রয়েছে তসলিমাকে হেয় করে নিজেকে প্রতিষ্ঠা দানের চতুর বাসনা। তাই তাঁদের লেখায় বিষয়ের চাইতে ব্যক্তি বড় হয়ে উঠেছে, একটি সুস্থ বিতর্কের বদলে গ্রাম্য বিচারসভার মোড়লপনাই বেশি প্রকট হয়ে পড়েছে।

আনন্দবাজার পত্রিকার বর্তমান ভূমিকা সাম্প্রদায়িক নয়, এদের বর্তমান ভূমিকা গণতান্ত্রিক ও বাণিজ্যিক মুনাফার। বাংলাদেশের একটি জাতীয় সংস্থা হিসেবে বাংলা একাডেমি কলকাতার একটি ব্যক্তিগত প্রকাশনা সংস্থার অর্থ সাহায্য গ্রহণ না করে ভাল করেছেন, তাই বলে ঢাকার কোনও শিল্পী বা সাহিত্যিকের এই পুরস্কার গ্রহণ না করার কোনও অর্থ হয় না। আনন্দ পুরস্কার প্রদানে পক্ষপাতিত্ব থাকতে পারে, কিন্তু সাম্প্রদায়িক উদ্দেশ্য নেই। তসলিমার নির্বাচিত কলামে নারীর অধিকার ও মর্যাদা সম্পর্কে মুসলমান ও হিন্দু উভয় ধর্মের বিধানকেই আক্রমণ করা হয়েছে। আনন্দ পুরস্কার সম্ভবত এই অসাম্প্রদায়িক সাহসিকতাকেই পুরস্কৃত করেছে, কেবল বইটির সাহিত্য মূল্যকে নয়।

যে সাহিত্যকর্মের উদ্দেশ্য কোনও আন্দোলন, সংস্কার বা বিপ্লবকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া তাতে সবসময় চিরায়ত সাহিত্যের কাঙ্ক্ষিত শিল্পগুণটি থাকে না। যে নাজিম হিকমত বা মায়াকভস্কিকে নিয়ে আমরা এত হৈ চৈ করি, তাদের অধিকাংশ রাজনৈতিক কবিতার শিল্প মূল্য আছে কি?.তসলিমা নাসরিনের লজ্জা উপন্যাস সমাজের একটি বিশেষ সময়ের বিশেষ প্রয়োজনের তাৎক্ষণিক সাহসী সাহিত্য কর্ম। তাতে বনেদী সাহিত্যের স্থায়ী প্রসাদগুণ আমাদের বুদ্ধিজীবীরা আশা করেন কিভাবে? বিজেপি তসলিমা নাসরিনের লজ্জা উপন্যাসকে তাদের রাজনৈতিক প্রচারণার স্বার্থে ব্যবহার করেছে, এটাও নাকি তসলিমার অপরাধ। সম্প্রতি লন্ডনে বিজেপির একটি ছোট প্রচার পুস্তিকা আমার হাতে এসেছে । নাম বাংলাদেশে সংখ্যালঘু নির্যাতন, তাতে বিজেপির কোনও নিজস্ব বক্তব্য নেই। ঢাকা ও চট্টগ্রামের বিভিন্ন দৈনিক পত্রিকা থেকে সংখ্যালঘু নির্যাতন ও মন্দির ভাঙার ছোট বড় পঁচিশটি খবর হুবুহু পূণর্মুদ্রণ করা হয়েছে। এই পত্রিকাগুলোর মধ্যে মাওলানা মান্নানের ইনকিলাবও রয়েছে। তাহলে কি ধরে নিতে হবে এই পত্রিকাগুলো বিজেপির প্রচারপত্র অথবা বিজেপির টাকা খেয়ে এই খবরগুলো ছেপেছে! বাংলাদেশে সংখ্যালঘু নির্যাতন রোধে বর্তমান সরকারের ইচ্ছ!কৃত ব্যর্থতায় আমাদের বুদ্ধিজীবীদের একটা অংশ যত না লজ্জিত ও ক্ষুব্ধ, তার চাইতে বেশি লজ্জিত ও ক্ষুব্ধ তসলিমা লজ্জা উপন্যাস লেখায়। সেলুক্যাস, কি বিচিত্র এ বঙ্গ দেশ।’

বিরানব্বই সালের আগস্ট মাসে চট্টগ্রাম থেকে বেরিয়েছিল গ্লানি নামের একটি সংকলন। গ্লানিতে ছিল নব্বইয়ের সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসের কিছু চিত্র, ভাঙা মন্দিরের ছবি আর হিন্দুদের ওপর মৌলবাদীদের নির্যাতনের কিছু তথ্য। সেই গ্লানি নিষিদ্ধ করল সরকার। লজ্জাও নিষিদ্ধ হল। সেলিনা হোসেন, নামী লেখক, লিখেছেন গ্লানি এবং লজ্জা নিয়ে। ‘দুটো বইয়ের ক্ষেত্রেই বলা হয়েছে এগুলো পাঠকের মনে সাম্প্রদায়িক উস্কানিতে ইন্ধন যোগাবে। অতএব, বই দুটো পাঠকের চোখের সামনে থেকে সরিয়ে ফেল। ভাবখানা এই যে, এই বইদুটো লুকিয়ে রাখলেই দেশের অস্থিতিশীল সাম্প্রদায়িক পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে যাবে।

জাতীয় কবিতা উৎসব ৮৯ এর শ্লোগান ছিল সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে কবিতা। ঘোষণায় বলা হয়েছিল, আমরা বিশ্বাস করি কবিতার জন্ম ঘটে প্রীতি আর মানবিকতা থেকে, কবিতা কোনও সম্প্রদায় স্বীকার করে না। .. এখন মানবিকতার, অসাম্প্রদায়িকতার কাল। আমরা আমাদের প্রতিটি পর্ব ও পংক্তি, প্রতিটি উপমা উৎপ্রেক্ষা, চিত্রকল্প, আমাদের স্বর, আমাদের প্রতিটি কাব্যগ্রন্থ উৎসর্গ করি অসাম্প্রদায়িক মানুষের নামে, যাঁরা রাষ্ট্রীয় সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে মানবিকতার অস্ত্র হাতে রুখে দাঁড়াবেন।

এই সাম্প্রদায়িক মানবিক চেতনাই এই ভূখণ্ডের মানুষের অহংকার। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির প্রশ্নে বর্তমান বাংলাদেশের সরকারের যা ভূমিকা তা একদিকে যেমন গ্লানিকর, তেমনি লজ্জাজনক। সরকার নিজের অজান্তেই গ্লানি এবং লজ্জা শব্দদুটো নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছে। সরকার চাইলেই এই গ্লানি এবং লজ্জা হতে মুক্ত হতে পারবে কি?’

লজ্জা নিয়ে আমার যে লজ্জা আর গ্লানি ছিল, ছিল এই কারণে যে উপন্যাস বলতে এটি কিμছু হয়নি, সেটি খানিকটা দূর হয় বুদ্ধিজীবিরা যখন কলম ধরলেন বইটির পক্ষে। ডঃ মুহম্মদ আনিসুল হক লিখেছেন, ‘তসলিমা নাসরিনের লজ্জা বইটি আমাদের দেশে সাম্প্রতিককালে সৃষ্ট সাম্প্রদায়িক পাশবিকতার বিরুদ্ধে একটি বলিষ্ঠ প্রতিবাদ। .. এই বই স্বভাবতই এদেশে কারও কারও গাত্রদাহ সৃষ্টি করতে পারে। বিশেষত যারা সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ট করার জঘন্যতম ভুমিকায় লিপ্ত হয়েছে তারা তো ক্ষেপবেই। প্রকৃতপক্ষে সত্য চিরকালই সত্য। সত্যকে ধামাচাপা দিয়ে রাখার চেষ্টা করলেই সত্য মিথ্যে হয়ে যায় না।’ নিজে তিনি একদিন বাড়িতে এসে তৃতীয় ধারা দিয়ে গেলেন, যে পত্রিকাটিতে লেখাটি ছাপা হয়েছে। যাবার সময় বললেন, ‘আজ বসনিয়ায় সার্বরা মসজিদ ভাঙাছে, আমাদের মৌলবাদিরা এখন কি এদেশের কোনও গির্জা ভাঙতে যাবে? যাবে না। সরকারও দেবে না গির্জা ভাঙতে, কারণ তাহলে তো ইঙ্গ মার্কিন সাম্রাজ্যবাদীরা নাখোশ হবে।’

হাসান ফেরদৌস একজন সাহসী সাংবাদিক। আমেরিকায় থাকেন। নিয়মিত বাংলাদেশের কাগজে লেখেন তিনি। তিনিও লিখলেন, ‘বইকে গলা টিপে হত্যা করা যায় না। কিন্তু নিষিদ্ধ করা যায়, পুড়িয়ে ফেলা যায়। বই যে সত্যকে উদ্ধার করে, তা নিয়ে যখন সন্ত্রস্ত হয় কেউ, তাকে নিষিদ্ধ করার, তাকে পাঠকের দৃষ্টিসীমার বাইরে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করা হয়। সত্যের মুখোমুখি হবার চাইতে তার টুঁটি টিপে রাখা, তাকে লুকিয়ে রাখার চেষ্টা অনেক সহজ, তাই। ক্ষমতাধর মানুষ ও তাদের সমাজ এই চেষ্টা করেছে চিরকাল। চেষ্টা করেছে, পারেনি। সক্রেটিসকে হত্যা করা গেছে, কিন্তু যে সত্য তিনি উচ্চারণ করেছিলেন, তাকে লুকিয়ে রাখা গেছে কি? বইএর বহ্নুৎসব করেছে হিটলার, কিন্তু শেষ পর্যন্ত ইতিহাসের আঁস্তাকুড়ে নিক্ষিপ্ত হয়েছে সে নিজে। লজ্জা কেবল বিরানব্বই এর দাঙ্গার কাহিনী নয়। এটি বাংলাদেশে সুপ্ত সাম্প্রদায়িকতার একটি প্রামাণ্য দলিল।’

যতীন সরকার আজকের কাগজ পত্রিকায় কলাম দীর্ঘ কলাম লিখলেন লজ্জার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি নিয়ে। লিখেছেন, ‘লজ্জা বাজেয়াপ্ত করে তাঁরা নিজেদের লজ্জাহীনতার অকুণ্ঠ প্রমাণ রাখলেন। লিখেছেন বে আইনি কাজ তাঁরা করেননি। বই বাজেয়াপ্ত করার আইন তাদের আছে। এই আইন তাঁরা উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়েছেন ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রব্যবস্থার কাছ থেকে। সেই ঔপনিবেশিক ব্যবস্থার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতে গিয়ে দেশের মানুষ প্রাণ দিয়েছে, মান দিয়েছে এবং এ রকম বহু ত্যাগের বিনিময়ে ঔপনিবেশিকতা দূর করে স্বাধীনতা অর্জন করেছে। আবার সেই স্বাধীনতাও যখন স্বৈরাচারিতার নিগড়ে বন্দী হয়ে গেছে, তখন তার হাত থেকে মুক্তিলাভের জন্যও মানুষকে রক্ত দিতে হয়েছে। এরপর স্বৈরাচারমুক্ত দেশে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে গণসমর্থন নিয়ে যাঁরা ক্ষমতায় এলেন, তাঁদের হাতেও শাসনের হাতিয়ার রূপে সেই স্বৈরাচারীদের আইনগুলোরই ব্যবহার ঘটে। বলা উচিত, অপব্যবহার ঘটে। এখানেই দেশের জনগণের লজ্জা। অথচ, জনগণের মাথার ওপর শাসক হয়ে বসে আছেন যাঁরা, তাঁদের কোনও লজ্জা নেই। লজ্জা যদি থাকতো, তবে ঘৃণ্য উপনিবেশবাদী ও স্বৈরাচারীদের তৈরি আইনের প্রতি তাঁদের ঘৃণাও থাকতো। এবং থাকতো জনমতের প্রতি ভয়ও।’

লজ্জা ঘৃণা ভয়, তিন থাকতে নয়— এই মন্ত্রটি শাসকেরা ঠিক ঠিক রপ্ত করে নিয়েছেন। তাই ‘সেই মানবিক লজ্জা, পবিত্র ঘৃণা ও মহৎ ভয় অন্তরে জাগ্রত থাকলে ঔপনিবেশিক পূর্বসুরিদের অন্যায় আইন ব্যবহার করে কোনও লেখকের বই বাজেয়াপ্ত তো তাঁরা করতেনই না, বরং সে সব আইনেরই উচ্ছেদ ঘটিয়ে বিবেকী লেখকের লেখার স্বাধীনতাকে নিশ্চিত করতেন কিন্তু তেমনটি করা তাঁদের পক্ষে সম্ভব নয়। কারণ লজ্জার মানবিকতা, ঘৃণার পবিত্রতা ও ভয়ের মহত্ত্বকে ধারণ করার মত হৃদয় তাঁদের নেই। আমরা আগেই দেখেছি, লজ্জা ঘৃণা ও ভয়কে তাঁরা বহু পূর্বেই জলাঞ্জলি দিয়েছেন। তাই, অপরের লজ্জাও তাঁরা সহ্য করতে পারেন না।

লজ্জা আমার লজ্জা নয়, এটি আসলে জাতির লজ্জারই ভাষারূপ। এত বড় একটি কথাও তিনি লিখেছেন। যতীন সরকার বিশ্বাস করেন না বাঙালি কোনওকালেই সাম্প্রদায়িক কোনও জাতি। সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র পাকিস্তানের বিরুদ্ধে মরণপণ সংগ্রাম করে বাঙালিরা অসাম্প্রদায়িকতাকে জাতীয়সত্তার অবিচ্ছেদউ অঙ্গে পরিণত করে নিয়েছে। কিন্তু সকল জাতির মধ্যে চাঁদের কলংকের মত কিছু কুলাঙ্গার থাকে, বাঙালি জাতির মধ্যেও এরা ছিল ও আছে। এই কুলাঙ্গাররা স্বাধীনতা সংগ্রামেও জাতির বিরোধিতা করেছিল। স্বাধীনতার পরও এরা প্রতিনিয়ত জাতির মুখে কলঙ্ক লেপন করতে ব্যস্ত। এরা সংখ্যায় নগণ্য। এই সংখ্যালঘু দুর্জনদের ঘৃণ্য কার্যকলাপই সংখ্যাগুরু সজ্জনদের তথা সমগ্র জাতিকে কলঙ্কিত ও লজ্জিত করেছে।’

লজ্জা লিখে সেই কলঙ্ক ও লজ্জা মোচন আমি কতটুকু করতে পেরেছি! ভাবি। যে গল্প আমি লিখেছি, সে গল্প তো সকলেই জানে। এ তো নতুন কিছু নয়। অনেক বলা অনেক জানা কথাগুলোই আমি বলেছি। যে ভাবনাগুলো প্রতিদিন ভাবি, যে কথাগুলো আত্মীয় বন্ধুদের সঙ্গে সকাল সন্ধে বলছি, যে প্রতিবাদগুলো ব্যক্ত করছি, যে ক্ষোভগুলো প্রকাশ করছি প্রতিদিন, যে প্রতিরোধের আগুনগুলো ঝরছে আমাদের হৃদয় থেকে, লজ্জাতে তার অতি সামান্যই প্রকাশ পেয়েছে। আমি জানি, আমার প্রগতিশীল বন্ধুরা জানেন, আমাদের সামনের পথটি কণ্টকাকীর্ণ, কিন্তু জানি আমরা থেমে থাকলে পথে আরও কাঁটা জমা হবে, পথ আরও বন্ধুর হবে। জানি ও পথে আমাদের যেতেই হবে, যে পথে সাহস নেই সবার যাবার। কারও সঙ্গে বা কিছুর সঙ্গে আমাদের আপোস করলে চলবে না। এখন স্পষ্টতই দুটি পক্ষ। একদিকে প্রতিক্রিয়াশীল, আরেকদিকে প্রগতিশীল। প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠী সমাজকে পিছিয়ে দিতে চায় হাজার বছর। অন্ধতা কুসংষ্কার, হিংসা,বিদ্বেষ, ভয় ভীতি ছড়িয়ে দিতে চায় মানুষের মধ্যে। প্রতিক্রিয়াশীলদের হাত শক্তিশালি করতে সাহায্য করছে আমাদের গণতান্ত্রিক সরকার। তাদের হাতে আছে অস্ত্র আর অর্থ। আমাদের শূন্য হাত। কিন্তু বিশ্বাসে পূর্ণ হৃদয়। সমতা আর সাম্যের বিশ্বাস।

এদিকে প্রতিদিনই মৌলবাদিদের পত্রিকায় আমাকে দেশদ্রোহী, ধর্মদ্রোহী বলে গাল দেওয়া হচ্ছে। মৌলবাদিরা গাল দেবেই জানি, কিন্তু মৌলবাদি নয় বলে যারা দাবি করে, প্রগতিশীল মুখোশ পড়ে আমাদের মধ্যেই ঘোরাঘুরি করে, তাদের কিছু কিছু মুখকে আমরা চিনতে পারছি, নতুন করে, আরও গভীর করে চিনছি। ফরহাদ মজহার আর আমহদ ছফা দিব্যি লজ্জাকে দোষ দিয়ে লিখেছেন, ‘লজ্জা দুইবাংলার মানুষদের মিলনের মধ্যে বাঁধা। খোঁচা দিয়ে দাঙ্গা বাঁধাবার মত পরিবেশ সৃষ্টি করছে।’ আর ফরহাদ মজহার তো আরও কয়েককাঠি এগিয়ে গিয়ে বলে দিলেন, ‘কলমের এক খোঁচায় বাংলাদেশকে সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র বানিয়ে ফেললাম, আর আজ আমরাই হিন্দু ভারত নিয়ে উদ্বিগ্ন। যদি খতিয়ে দেখি তাহলে দেখবো বাবরি মসজিদ ভাঙার শর্ত তৈরি করে দেবার পেছনে অনেকাংশে আমরাই দায়ি।’ বিজেপি, ভারতের হিন্দুবাদী দল, তাঁর ধারণা ‘কিছ কিছু বাংলাদেশীদের দিয়ে বাবরি মসজিদ ভাঙার প্রতিক্রিয়ার ফোলানো ফাঁপানো বিবরণ দিয়ে উপন্যাস কাহিনী গল্প গুজব রচনা করাচ্ছে।’ ঠিক এই দোষটিই আমাকে দিচ্ছে মৌলবাদিরা। বিজেপি নাকি আমাকে টাকা দিয়ে লিখিয়েছে লজ্জা। ফরহাদ মজহারের মত লোকের অভাব নেই দেশে, তাঁর আবার কিছু উচ্চশিক্ষিত ভক্তবৃন্দ বিরাজ করছে। মাশআল্লা। শিবনারায়ণ রায় বলেছেন, ‘মুখোশের আড়ালে আমরা সবাই নিজ সম্প্রদায়ভুক্ত স্বধর্মপ্রাণ। শিক্ষিত বাঙালি নিজেকে আধুনিক বলে দাবী করলেও তার জীবন ও ইতিহাসে এই স্বীকৃতির চিহ্ন দুর্লভ। বাঙালি আজও তার হিন্দুত্ব ও মুসলমানিত্ব অতিক্রম করে মনুষ্যত্বের পরিজ্ঞান অর্জন করেনি।’ কথাটি সফি আহমেদও মানেন। কী আশ্চর্য স্বীকারোক্তি সফি আহমেদের, তিনি দ্বিধাহীন কণ্ঠে বলেন, ‘সাম্প্রদায়িকতার এই গলদ আমাদের প্রায় সবার। এই দগদগে ঘা কে ঢেকে রাখলেই অথবা নেই বললেই তাকে অনস্তিত্বে আনা যায় না। তাকে স্বীকার করার সৎ সাহস থাকা চাই। অসুখকে জেনে নিয়েই তবে চিকিৎসা। সাম্প্রদায়িকতার মধ্যে আমাদের জন্ম। তারপর আজ ছেচল্লিশ বছর আমরা তারই ভেতর দিয়ে চলেছি, চেতনে অচেতনে তার ভেতরেই বহমান। শুধু ক্ষমতাশীল শোষকের শোষণের হাতিয়ার হিসেবেই নয়, মুখোশের আড়ালে আমরা প্রায় সবাই একে পোষণ করি, লালন করি।’

এরপরই লজ্জা প্রসঙ্গে বললেন, ‘কখনও যদি একে ধরে টান দেয়, খুলে দেয়, কোনও অকুতোভয় প্রাণ যদি বন্ধ অর্গল মুক্ত করে তাকে স্বাগত জানাই। উন্মোচন করেই লুকোনো লজ্জাকে নির্ভার নির্মল করতে হবে। লজ্জা দাঙ্গা আনবে না, বরং লজ্জাই আমাদের মেলাবে।’

যখন সরকারের খড়গ আমার ওপর খাড়া, তখন আমার পক্ষে বা লজ্জার পক্ষে লেখালেখি করা খুব সহজ কথা নয়। তারপরও সাহস করে অনেকে লিখছেন, যাঁরা লিখছেন না, হয় তাদের আমাকে পছন্দ নয়, নয়ত আমার লেখা পছন্দ নয়, নয়ত লজ্জার বক্তব্য পছন্দ নয়। তা হতেই পারে। আমার নিজের কাছেই আমার অনেক লেখা পছন্দ হয় না। লজ্জার বক্তব্য পছন্দ হলেও লজ্জা লেখার ধরণ আমার নিজেরই পছন্দ নয়। ঠিক এই কাহিনী নিয়ে খুব হৃদয়স্পর্শী একটি উপন্যাস লেখার সুযোগ ছিল। চরিত্রগুলোকে আরও মানবিক করা যেত। উপন্যাসের কোনও গভীরতা, কোনও বিপুলতা এই বইটিতে নিয়ে সে আমি জানি। জানি বলেই বইটি নিয়ে কারও কারও অতীব প্রশংসা আমাকে যেমন লজ্জা দেয়, তেমনি প্রেরণাও দেয়। নিজের শক্তি আর সাহসকে হারিয়ে না ফেলে আরও ভাল কিছু লেখার প্রেরণা। যদি দম্ভ আমাকে বিবেকহীন বানাতো, যদি আত্মম্ভরিতা আমাকে অন্ধও করে দিত, তবুও আমার মনে হয় না আমি কখনও ভাবতে পারতাম যে আমার এই সামান্য বইটি একদিন সাহিত্যের ইতিহাস লিখতে গিয়ে খোঁজ করবে কেউ বা এই বইটি মানরক্ষা করবে জাতির। আমার বিশ্বাস আমার সম্পর্কে বা আমার বইটি সম্পর্কে অনেকে বাড়িয়ে লিখছেন, সম্ভবত বইটি নিষিদ্ধ করা হয়েছে বলে অথবা আমার ওপর প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠীর আক্রমণ খুব তীব্র বলে। বশীর আল হেলালের সঙ্গে আমার পরিচয় হয়নি। তিনি দেশের একজন প্রথিতদশা সাহিত্যিক। তাঁর একটি লেখা আমাকে সত্যিই চমকে দেয়। ‘হিন্দু মুসলমানের, মুসলমান হিন্দুর কথা লিখবে, এই তো স্বাভাবিক। সরকার কি মনে করেছেন এতে রাষ্ট্রের ক্ষতি হয়? না, ক্ষতি হয় না, লাভ হয়। ভারতে মুসলিম নির্যাতন হলে তখন আমরা দেখাতে পারব, দেখ, আমাদের লেখক আমাদের হিন্দুদের নিয়ে এই উপন্যাসখানা লিখেছেন। এই তো গৌরব, এই তো মনুষ্যত্ব। শাক দিয়ে মাছ তো ঢাকা যায় না, কিছুতেই যায় না। সাহিত্যের ইতিহাস লেখার সময় এই রকম বইয়েরই তো খোঁজ পড়বে। তসলিমা নাসরিন এ উপন্যাসখানা লিখেছেন বলেই না সেদিন মানরক্ষা হবে। নিষেধের সব অন্ধকার ভেদ করে এই উপন্যাসখানাই সেদিন মুখ উজ্জ্বল করে বেরিয়ে আসবে। আমি বলব, তসলিমা নাসরিন অসাধারণ একখানা উপন্যাস লিখেছেন এই লজ্জা। এ রকম আর এ দেশে লেখা হয়নি। বড় তীব্র এই উপন্যাস। আঘাত করে, কঠিন আঘাত করে। তবে, সত্য যা তাই তিনি লিখেছেন। কারো পছন্দ না হতে পারে, কিন্তু এ সত্য, নিষ্ঠুর সত্য। সত্যপ্রীতির জন্য এই লেখকের ভোগান্তি হবে বলেই মনে হয়।’

ওদিকে লজ্জা নিয়ে পশ্চিমবঙ্গে তুলকালাম কাণ্ড ঘটে যাচ্ছে। লজ্জার নকল বই বেরিয়ে গেছে। হাটে বাজারে ট্রেনে বাসে দেদারসে বিক্রি হচ্ছে। ওখানেও লেখালেখি হচ্ছে লজ্জা নিয়ে। মৈত্রেয়ী চট্টোপাধ্যায় ভারতের সংখ্যালঘু মুসলমানের বিরুদ্ধে হিন্দুর যে নির্যাতন চলে তার বর্ণনা দিয়ে প্রশ্ন করেছেন কেন ভারতবর্ষে লজ্জার মত বই ভারতের সংখ্যালঘু মুসলমানদের নিয়ে রচিত হয়নি। তাই লজ্জা তসলিমার নয়, লজ্জা ভারতবাসীর। পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকারের এক মন্ত্রী বলেছেন, ‘তসলিমার লজ্জাকে কোনও অবস্থাতেই বাংলাদেশের বাস্তব অবস্থার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ ভাবা ঠিক হবে না।’ পশ্চিবঙ্গের কমিউনিস্টরা ওখানকার সংখ্যালঘু মুসলমানের ওপর যেন কোনও বিপদ না হয়, সে ব্যপারে সতর্ক। মুসলমান-প্রেম তাদের যত না আছে, তার চেয়ে বেশি আছে মুসলমান- ভোটের মোহ। লজ্জা বইটিকে মিথ্যে বলেও যদি পশ্চিমবঙ্গে সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যায়, আমি বরং খুশীই হব। কমিউনিস্টদের মন্তব্যে আমার মন খারাপ হয় না। আমার মন খারাপ হয় যখন তাঁরা বলেন যে আনন্দবাজার গোষ্ঠী নয়ত বিজেপি আমাকে দিয়ে মুসলমান বিরোধী বই লিখিয়েছে। বইটি আমি বুদ্ধদেব গুহকে উৎসর্গ করেছি, এ নিয়েও আমাকে নিন্দা করা হচ্ছে। বুদ্ধদেব গুহ নাকি বিজেপির লোক, বিজেপির মেনিফেস্টো তিনি লিখেছেন। বুদ্ধদেব গুহর সঙ্গে আমার আলাপ আনন্দ পুরস্কার অনুষ্ঠানে। এমন প্রাণচঞ্চল পুরুষ, এমন রঙ্গপ্রিয় রসরাজ, এমন সপ্রতিভ সৌখিন মানুষ খুব চোখে পড়ে না। বুদ্ধদেব আমাকে, তিনি যেখানেই থাকুন, যে নগরে বা যে জঙ্গলেই, নিয়মিত চিঠি লেখেন। চিঠিতে তাঁর জঙ্গল ঘুরে বেড়ানোর অভিজ্ঞতার কথা থাকে, বাংলাদেশ এবং বাংলাদেশের মানুষের জন্য তাঁর মমতার কথা থাকে। তিনি বিজেপির সমর্থক নাকি সিপিবির, তিনি ধর্মের পুজারি নাকি অধর্মের, কিছুই আমার জানা নেই। তাঁর একটি বই আমাকে উৎসর্গ করেছেন। কোনও লেখক তাঁর কোনও বই আমাকে উৎসর্গ করলেই যে বিনিময়ে আমার বই তাঁকে উৎসর্গ করতে হবে, এরকম কোনও কথা নেই। বুদ্ধদেব গুহর আমি মুগ্ধ পাঠক বলে, তাঁকে আমি শ্রদ্ধা করি বলেই তাঁকে আমার একটি বই উৎসর্গ করেছি।

লজ্জার প্রকাশক এসে মুখ চুন করে বসে থাকেন। তাঁর ব্যবসা হচ্ছে না। সপ্তম মুদ্রণ চলছিল লজ্জার। নিষিদ্ধ হওয়ার আগে ষাট হাজারের মত বিক্রি হয়েছিল। কিন্তু তাতেও আলতাফ হোসেন ওরফে মিনুর দুঃখ যায় না। তিনি এখন এ বঙ্গেও বিক্রি করতে পারছেন না, ও বঙ্গেও রফতানি করতে পারছেন না। লজ্জার পাণ্ডুলিপি পেয়ে মিনুর মুখে হাসি ফোটেনি। মিনুর চুন মুখে আকর্ণবিস্তৃত হাসি ফুটেছিল মেলায় বই বিক্রি দেখে। সেই আকর্ণ হাসিটি উবে গিয়ে মিনুর মুখটি যথারীতি চুনে ফিরে এসেছে। তিনি বলছেন, ‘বই ত ব্যাণ্ড হইয়া গেল। আমার তো ব্যবসা পাতি কিছুই হইল না। এখন নতুন একটা বই দেন।’

আমি তখন বই দেব কী করে। আমি লজ্জা লিখছি। নতুন করে লিখছি। ঘটনা একই। তথ্য একই। কেবল ভাষার ভুলগুলো সংশোধন করা, আর চরিত্রগুলোকে আরও চলাফেরা করানো, কথা বলানো। কোনও উপন্যাস লিখে আজ পর্যন্ত আমি স্বস্তি পাইনি। লিখেছি, ছাপা হয়েছে। কিন্তু পাতা উল্টোলেই বানান ভুল, বাক্যের ভুল ভাষার ভুল, বর্ণনার ভুল সব দাঁতকপাটি মেলে ধরেছে। মন খারাপ হয়ে যায়। প্রকাশক যখন ছাপাখানা থেকে বাঁধাই হওয়া তাজা বই খুশিতে নাচতে নাচতে আমার কাছে নিয়ে আসেন, সেই নাচ থেমে যায় আমি দুইএটি পাতায় চোখ বুলোনোর পরই। কারণ আমার তখন চুক চুক লেগেই আছে জিভে। প্রকাশক বলেন, ‘কি কি ভুল আছে, তা সংশোধন করে দেন, নেক্সট এডিশনে ঠিক করে দেব।’

আলতাফ হোসেন মিনু তাঁর চুন-মুখ খানিক পর পর খুলছেন, ‘আজকে খবর পাইলাম নিউমার্কেটের বইয়ের দোকানে লজ্জা বিক্রি হইতাছে। শুধু নিউমার্কেটে না।

বিজ্ঞানমেলায়, রাস্তাঘাটে, নিউজপেপার স্টলে, এমন কী ফুলের দোকানেও। কভার ছাড়া আশি টাকা, কভার নিয়া একশ টাকা।’

‘চল্লিশ টাকার বই একশ টাকায় বিক্রি হচ্ছে! তার মানে পাঠক ষাট টাকা বেশি দিয়া বই কিনছে? বই ব্যাণ্ড করে তো পাঠকের ক্ষতি হল, আর কিছু না।’ আমি বলি।

‘আপনে আছেন পাঠকের ক্ষতি নিয়া। আমার ক্ষতির কথা ভাবতাছেন না। কলকাতা থেইকা দশ হাজার কপির অর্ডার ছিল। পাঠাইতে পারলাম কই!’

‘এই যে বললেন বই বিক্রি হচ্ছে এইখানে। এরা বই পাইল কি কইরা? আপনে তো বিক্রি করছেন না।’

‘আমি বিক্রি করব? আমার দোকানে দিনে দুইবার কইরা পুলিশ আসতাছে। সব বই তো নিয়াই গেছে। গোডাউন থেইকা নিছে। বুক বাউণ্ডারের কাছে যা ছিল নিয়া গেছে। এখন ত পাইরেট হইয়া গেছে বই।’

‘কলকাতায় শুনলাম পাইরেট হয়েছে। এইখানেও নাকি? ব্যাণ্ড করে তাইলে সরকারের লাভ কি হইল?’

‘যেইদিন ব্যাণ্ড করল বই, তার দুইদিন পরেই পাইরেট কপি বাজারে আইসা গেছে। বাংলাবাজারেই কেউ কেউ পাইরেট ব্যবসা করে। তাদের মধ্যেই কেউ করল কি না! এখনও কিছু খবর পাই নাই।’

‘পুলিশ এখন কি বলে? সরকার তো বই ব্যাণ্ড করল। কিন্তু বই যে ঠিকই বিক্রি হচ্ছে তা এখন দেখে না কেন?’

‘ওরা তো বই সামনে রাইখা বিক্রি করতাছে না। লুকাইয়া রাখে। আস্তে কইরা কানের কাছে মুখ নিয়া চাইলে পরে দেয়। কাগজে মুড়াইয়া দেয়। আমার লোক গিয়া তিনটা পাইরেট কপি কিনে আনছে।’

‘কেউ কেউ বলছে লজ্জার প্রকাশক কেন ব্যানের বিরুদ্ধে মামলা করছে না!’

‘মামলা?’ মিনুর মুখখানা হঠাৎ ছোট হয়ে যায়। পিটপিট করে এদিক ওদিক তাকান। বুঝি, এ মামলা করতে হলে বুকের পাটা যত বড় থাকতে হয়, তত বড় তাঁর নয়।

‘মামলা কইরা কি কোনও কাজ হইব?’ মিনু মিনমিন করেন।

‘হতেও পারে। আর যদি ব্যান না তোলে, তারপরও তো একটা জিনিস ভাল যে আমরা মেনে নেই নাই সরকারের এই আচরণ। কারণ এই আচরণ বাকস্বাধীনতার বিরুদ্ধে, মানুষের মত প্রকাশের বিরুদ্ধে।’

মিনু অনেকক্ষণ চুপ হয়ে বসে থাকেন। শব্দ করে চায়ে চুমুক দেন। পরে চা টাও রেখে দেন ঠাণ্ডা হয়ে গেছে বলে। এরপর নরম সুরে বলেন, ‘নতুন একটা বই লেইখা দেন।’ ‘নতুন বই? এখন? এখন তো লজ্জার কারেকশন নিয়া ব্যস্ত। এইতো আর দুএকদিনের মধ্যে শেষ হয়ে যাবে।’

‘কয়দিন আর লাগে একটা বই লিখতে! বইবেন, শেষ কইরা উঠবেন। হুমায়ুন আহমেদ কত বই এক রাত্রে লিখছে!’

‘মিনু ভাই, আমি হুমায়ুন আহমেদের মত লিখতে পারি না। এক রাতে আবার বই লেখা যায় নাকি। তাছাড়া লজ্জাটা সংশোধনের কাজ এই তো শেষ হয়ে যাবে। তারপর অন্য বইয়ের কথা ভাবব!’

‘এক বই কতবার লিখবেন! তার ওপর ব্যান্ড বই। লিখতাছেন যে, আমি ত আর ছাপতে পারব না। জানেন ত আমি বই আমদানি রফতানির ব্যবসা বাদ দিয়া প্রকাশনায় নামছি। আমারে ডুবাইয়েন না।’

না, তাঁকে ডোবানোর কোনও ইচ্ছে আমার নেই। আমি কথা দিই নতুন বই লিখব। কেবল কি আলতাফ হোসেন ওরফে মিনু তাড়া দিচ্ছেন! এখন প্রকাশকের চেহারা দেখলে প্রমাদ গুনি। মইনুল আহসান সাবের, ভাল গল্পলেখক, তিনিও দিব্যপ্রকাশ নামে একটি প্রকাশনী দিয়েছেন। বাড়িতে এসেছেন কদিন বই চাইতে।

‘নাসরিন তুমি যদি আমাকে কয়েকদিনের মধ্যে একটা উপন্যাস লিখে না দাও, আমি মারা যাবো।’

এতজনকে কি করে রক্ষা করি। প্রকাশকদের ভিড় দিন দিন বাড়ছে। আমার তো কেবল লেখাই কাজ নয়। সকাল সন্ধে চাকরি। সংসারের সাত রকম ঝামেলা। সাত পত্রিকায় কলাম লেখা। সাপ্তাহিক বৈঠক। অবশ্য এটিকে সাপ্তাহিক বললে ভুল হবে। বৈঠকটি যে কোনও দিন যে কোনও সময় হতে পারে। আমাদের এই আড্ডায় নারী পুরুষ সকলেই আছেন, বয়সের তারতম্য কোনও ব্যপার নয়, সাহিত্যিক অসাহিত্যিক কোনও ঘটনা নয়, পেশা কোনও ঘটনা নয়, কোনও বিশেষ রাজনৈতিক দলের প্রতি পক্ষপাত থাকতে পারে, সেও কোনও বিষয় নয়, কে কোন ধর্মের মানুষ সে তো কোনও বিষয়ই নয়, আসলে ধর্মে বিশ্বাসী কেউ আমাদের এই বৈঠক বা আড্ডায় নেই। একটি ব্যপারে আমাদের পরিষ্কার হতে হয় আমরা মৌলিক কিছু বিষয়ে একমত কি না। আমাদের বিশ্বাস আছে কি না গণতন্ত্রে অথবা সমাজতন্ত্রে, ধর্মনিরপেক্ষতায় অথবা সেক্যুলারিজমে, ব্যক্তি স্বাধীনতায়, বাক স্বাধীনতায়, মুক্তচিন্তায়, মুক্ত প্রচারমাধ্যমে, সবার জন্য অন্ন বস্ত্র খাদ্য শিক্ষা স্বাস্থের সুযোগ প্রদানে, সেক্যুলার শিক্ষা প্রসারে, নারী মুক্তিতে, নারী পুরুষের সমানাধিকারে, বৈষম্যহীন আইনে, দারিদ্র দূরীকরণে, দুর্নীতি এবং সন্ত্রাস দূরীকরণে, সবার জন্য নিরাপত্তা বিধানে, বাঙালিত্বে, বাঙালি সংস্কৃতিতে, সুষ্ঠু রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থ নৈতিক ব্যবস্থায়, অন্ধত্ব, গোঁড়ামি কুসংস্কার আর মৌলবাদ নির্মূলে, সাম্প্রদায়িকতা উচ্ছেদে। আমাদের আলোচনার বিষয় সবই, রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজ, ধর্ম, কখনও কখনও শিল্প সাহিত্য। আমরা কোনও দিন ক্ষণ ঠিক করে রাখি না কখন বৈঠক হবে, আমরা কোনও বিষয় ঠিক করে রাখি না কোন বিষয়ে কথা হবে। যে কোনও বিষয়ে, যখন যার ইচ্ছে আলোচনার ডাক দিতে পারে। কোথায় বসবে এই বৈঠক, তাও নির্দিষ্ট করা নেই। যে কোথাও হতে পারে। আমার যেহেতু স্বামী সন্তানের ঝামেলা নেই, আমার বাড়িটিই একটি চমৎকার জায়গা। আমাদের মধ্যে প্রচণ্ড উদ্দীপনা। আমাদের চোখে সুন্দরের স্বপ্ন। আমরা শঙ্কিত মৌলবাদী সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীর ধীরে ধীরে শক্তিমান হতে থাকায়। আমরা জানি এই অপশক্তিটি আমাদের সর্বনাশ করতে এগিয়ে আসছে। আমরা জানি আমাদের রুখে দাঁড়াতে হবে। পূরবী বসু আমেরিকার বড় পদের চাকরি ছেড়ে দিয়ে প্রাণের টানে চলে এসেছেন নিজের দেশে। এখানে বেক্সিমকো কোম্পানিতে বিজ্ঞানী হিসেবে কাজ করছেন। অবসরে গল্প লেখেন। আর এখন এই নৈরাজ্যের সময় গল্প লেখক, কী ঔপন্যাসিক কী কবি সকলেই যখন রাজনৈতিক কলাম লিখছেন, তিনিও লিখছেন। বাঙালি সত্ত্বাটি মানুষের যায় যায় করছে বলে তিনি বাঙালি নামে একটি প্রবন্ধের বই সম্পাদনা করলেন, সঙ্গে সাংবাদিক হারুন হাবীব ছিলেন। বাঙালি বেরোনোর পর জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সফি আহমেদ কে নিয়ে এখনও গেল না আঁধার নামে একটি বিশাল বই সম্পাদনা করছেন। বাবরি মসজিদ ভাঙার পর দেশে যে কটা দিন ভয়াবহ সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাস চলেছে, সে বিষয়ে পত্রিকার খবর আর নিবন্ধগুলোর একটি সংকলন। সফি আহমেদ ছায়ার মত থাকেন পূরবী বসুর সঙ্গে। অনেকটা জ্যাঁ পল সাষর্ন আর সিমোন দ্য বোভোয়ার কথা মনে হয় ওঁদের দেখলে। অসাধারণ দার্শনিক বন্ধুতা। ফরহাদ মজহার, যাঁকে একজন বুদ্ধিজীবী হিসেবে ধরা হয়, তিনিই যখন হিন্দুদের ওপর মুসলমানের অত্যাচারকে অত্যাচার বলতে রাজি নন এবং দাবি করেন, এই বাংলার সংষ্কৃতি ইসলাম, এটিকে আমাদের রক্ষা করতে হবে, তখন আমাদের পিলে চমকে ওঠে। মূর্খ দেখলে আমরা ততটা আতঙ্কগ্রস্ত হই না, ধূর্ত দেখলে যত হই। আমরা আরও বেশি তাগিদ অনুভব করি দলবদ্ধ ভাবে প্রতিবাদ করার, শক্তিগুলোকে একত্রিত করার। পূরবী বসু জরুরি তলব করলেন আমাকে। এসবের প্রতিবাদ করতে হবে, চল এক কাজ করি, আজ আমি লিখব, কাল হারুন লিখবে, পরশু তুমি লিখবে, তরশু সফি লিখবেন। আমরা তাই করি। বসে নেই আমরা কেউই, তারপরও মনে হয়, যথেষ্ট যেন কিছু হচ্ছে না। চোখের সামনে সকলেই দেখছে দেশটির গায়ে পচন ধরছে, দেখেও খুব বেশি কেউ পচন সারাবার জন্য উদ্যোগ নিচ্ছে না। আমরা আসলে সংখ্যায় কম। মুখ বুজে থাকা মানুষের সংখ্যা অনেক বেশি।

লজ্জার সংশোধন শেষ হল খুব দ্রুত। কাজটি হল সম্পূর্ণ শুয়ে থেকে, বিছানায় নয়, মেঝেয় শুয়ে। মেরুদণ্ডে তীব্র ব্যথা হয়েছিল কদিন। হাড়ের ডাক্তার আমার মেরুদণ্ড পরীক্ষা করে পিঠের এক্সরে করিয়ে বলে দিলেন হাঁটাহাঁটি করা নিষেধ, পেচ্ছাব পায়খানায় যাওয়া নিষেধ, তিন মাস মেঝেয় চিৎ হয়ে শুয়ে থাকতে হবে, এমনকী ডানে বামে কাত হওয়া নিষেধ। এই হল চিকিৎসা। অসুখটি কি জানতে চাই। অসুখটি হল, আমার মেরুদণ্ড খুব সোজা। এটিই হল অসুখ। এ আমার জন্ম থেকেই। সোজা মেরুদণ্ড নিয়ে জন্মেছি। মেরুদণ্ড সোজা হওয়ার কারণে যখনই আমি উপুড় হই বা মেরুদণ্ড বাঁকা করি, তখনই চাপ লেগে হাড় বেরিয়ে আসতে চায় বাইরে, একটির তল থেকে আরেকটি। মেরুদণ্ডের হাড় কখনও কারও একটি সরল রেখায় থাকে না, পিঠের নিচদিকে ঢেউএর মত খেলে যায়। কিন্তু আমার মেরুদণ্ডে ঢেউ বলে কোনও ব্যপার নেই। সোজা মেরুদণ্ডের চিকিৎসা চলতে থাকে, চিকিৎসা করে এটিকে অন্য সবার মেরুদণ্ডের মত করার কোনও উপায় নেই। কিন্তু বেরিয়ে আসতে থাকা হাড়টিকে ভেতরের সরলরেখায় পাঠিয়ে দেওয়ার জন্য শুয়ে থাকা। তিন মাস এই চিকিৎসার পর যখন দাঁড়াবো, হাঁটবো, সারাজীবনের জন্য আমার উপুড় হওয়া চলবে না, হাতে ভারী কিছু বহন করা চলবে না, শুতে হলে শক্ত বিছানায় শুতে হবে। সোজা মেরুদণ্ডকে সোজাই রাখতে হবে। টানা তিনমাস শুয়ে থাকার চিকিৎসা মেনে চলা আমার দ্বারা সম্ভব যে হবে না, সে আমি ভাল করে জানি। তবু হাসপাতাল থেকে দু সপ্তাহের ছুটি নিয়ে শোবার ঘরের মেঝেয় শুয়ে থাকি। কমপিউটার মেঝেয় নামিয়ে, উপুড় হয়ে (লেখার অবসরে চিৎ) কীবোর্ড টিপেছি, মেরুদণ্ড বাঁকা হচ্ছে না এটি ছিল সান্ত্বনা। লেখা শেষ হলে কমপিউটার থেকে ছেপে নিলাম পুরো লজ্জা। আগের চেয়ে দ্বিগুণ। লিখে উঠে আমার এক বদঅভ্যেস, পুরো লেখাটা একবারও পড়ে দেখি না। পড়লে একশ একটা ভুল বেরোবে, বিশেষ করে বাক্য গঠনের ত্রুটি, বেরোলেই আবার নতুন করে পুরোটা লিখতে ইচ্ছে হবে। জীবনেও আর কোনও বই শেষ হবে না। লজ্জাকে একটু টেনে লম্বা করে আমার অন্তত একটি স্বস্তি হয়, যে, কিছু তথ্য বিস্তারিত বর্ণনা করা গেল। কিন্তু কলকাতায় পাণ্ডুলিপি পাঠাবো কী করে আমি! আমার বাড়ির সামনে স্পেশাল ব্রাঞ্চের দুতিনটে লোক দাঁড়িয়েই থাকে। পোস্টাপিসে গেলে পিছু নেবে এরা, নিষিদ্ধ জিনিস পাচার করার অপরাধে জেলে ভরে রাখবে। কলকাতায় কেউ কি নিয়ে যেতে পারে পাণ্ডুলিপিটি! আমার তো দেশ থেকে বেরোনোর কোনও উপায় নেই। পাসপোর্ট আটকে রেখেছে। কে যাচ্ছে কলকাতায়, কে যাবে খোঁজ নিয়ে দেখেছি যে-ই যাচ্ছে লজ্জার পাণ্ডুলিপি নেওয়ার কোনও সাহস কারওরই নেই। এই দুঃসময়ে একজন আমাকে উদ্ধার করলেন, তার নাম মোস্তফা কামাল। মোস্তফা কামাল লোকটি সাদাসিধে। বিস্তর কথা বলেন। তাঁর ভাই ফেরদৌস ওয়াহিদ একজন নামকরা গায়ক। ভাই নাম করলেও মোস্তফা কামাল নাম করেননি কিছুতে। তাঁকে আমি প্রথম দেখি কলকাতায়। আবৃত্তিলোকের অনুষ্ঠানের পর খাওয়া দাওয়ার উৎসব হচ্ছিল কেনিলওয়ার্থ হোটেলে, সেখানে। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন। সেই প্রথম দেখা কোট টাই পরা কামাল আমার বাড়িতে টিশার্ট স্যাণ্ডেল পরে একদিন চলে এলেন। এসেই হৈ রৈ করে বলতে শুরু করলেন, ‘দেখতে আসলাম কেমন আছ (কোনও আপনি টাপনির বালাই নেই।) খবর কি, বল। আমি ত কলকাতা থেকে আসলাম পরশুদিন। জানো তো আমি কলকাতায় গেলে সুনীলের বাড়িতেই থাকি। সুনীল আর স্বাতী তো আমারে অন্য কোথাও থাকতেই দেয় না। সুনীল বলছিল তোমার কথা। তো আমি সুনীলকে বললাম, যাবো দেখি একবার তসলিমার বাসায়। নবনীতার সাথে তোমার আলাপ আছে? নবনীতা দেব সেন! চিনো তো নিশ্চয়ই। আমারে বলছিল তার বাড়িতে যেতে, কিন্তু আর হইল না। তা তোমার খবর কি বল। কবে যাচ্ছ কলকাতায়। ওইখানে তো তোমার নাম বললেই সবাই চেনে। বাদলের কাছ থেকে তোমার একটা বই নিয়া আসার কথা ভাবছিলাম। সময়ই পাই নাই।’ একাই দীর্ঘক্ষণ বকতে পারেন মোস্তফা কামাল। ‘সুনীল তো আমাকে নিয়া একটা বই লিখছে, বইটা পড়ছ? আমি যা যা বলছি সুনীল রেকর্ড কইরা নিছে। তার পর তো পুরা একটা বইই লিইখ্যা ফেলল।’ বকবক বকবক। ‘ফেরদৌসের সাথে ত আমার মুখ দেখাদেখি বন্ধ। ভাই হইলে কী হইব, আমি কেয়ার করি না।’ বকবক। হঠাৎ হঠাৎ মোস্তফা কামাল আমার বাড়িতে এরকম উদয় হয়ে যতক্ষণ থাকেন মাতিয়ে রাখেন বাড়ি। যেন আমার সঙ্গে তাঁর হাজার বছরের বন্ধুত্ব, যেন আমি তাঁর চারপাশের সবাইকে চিনি, এমন ভাবে বলতে থাকেন তাঁর আত্মীয়রা, পাড়া পড়শিরা, বন্ধুরা কে কী করল, কে কী বলল। নিজের পাঁকে পড়া, পাকে পড়া আর ডুবে যাওয়ার গল্পও অনায়াসে করতে পারেন। ‘ডোরারে বিয়া করলাম, কানাডায় নিয়া গেলাম, পরে ডোরা তো আমারে ছাইড়া চইলা গেল। আমি পোড়া কপাল নিয়া জন্মাইছি বুঝছ! যে ব্যবসাই ধরি, সব ব্যবসায় ফেল মারি। দেখি আরেকটার কথা চিন্তা ভাবনা করতাছি। মালোশিয়ায় চাকরানি সাপ্লাই দিব। এইটার ডিমাণ্ড আছে। .. আমার ত বাড়ি নাই গাড়ি নাই। টাকা পয়সা আজ আছে, কাল নাই। ..আমার ভাইগুলা সব ভাল অবস্থায় আছে, থাকুক। আসলে কি জানো, আমরে কেউ পছন্দ করে না, একটু পাগল পাগল আছি ত তাই।’ তিনি একদিকে গর্ব করছেন যে নামি দামি লোকের সঙ্গে তার খাতির আছে, আবার নিজে যে কিছুই না, নিজে যে একটি ঘোড়ার ডিম সেকথাও দ্বিধাহীন বলে যান। এই মোস্তফা কামালই আমার নিরূপায় অবস্থার মাঝখানে দাঁড়িয়ে বলেন, ‘পাণ্ডুলিপি দিতে চাও, ঠিক আছে আমি নিয়া যাবো।’

‘ঠিক তো!’

‘ঠিক।’

‘কোনও অসুবিধা হবে না তো!’

‘কেন, কী হবে, কে কি করবে?’

ডাক্তার রশীদ ছিলেন পাশে। বললেন এ বাড়িতে যারাই আসে, এ বাড়ি থেকে যারাই বেরোয়, সবার পেছনে স্পেশাল ব্রাঞ্চের লোক ঘোরে। লজ্জার পাণ্ডুলিপি হাতে ধরা পড়লে সর্বনাশ হয়ে যাবে। লজ্জা তো শুধু বিক্রিই নিষিদ্ধ নয়, লজ্জার সংরক্ষণও এ দেশে নিষিদ্ধ। মোস্তফা কামালের মুখটি সাদা হয়ে যায় মুহূর্তে। তিনি পাণ্ডুলিপি কলকাতায় বাদল বসুর হাতে পৌঁছে দেবেন, এ কথা যখন বুক ফুলিয়ে বলেছেন, এটি তিনি ফেলে দেন না, তবে এ বাড়ি থেকে পাণ্ডুলিপি তিনি বেরোবেন না, তাঁকে কাল ভোর ছটায় বিমান বন্দরের রাস্তায় পাণ্ডুলিপি যেন দেওয়া হয়। কে এই দায়িত্ব নেবে! পাণ্ডুলিপি নিয়ে বাড়ি থেকে বেরোবে কে? ডাক্তার রশীদ বললেন, তিনি। কোন রাস্তা, কোন মোড়, কী পোশাক, কী থেকে নামা, ডানে না বামে, কালো ব্রিফকেস, কালো চশমা ইত্যাদি ব্যপার স্যপারগুলো দুজন বসে সেরে নেন। ফিসফিস। দেওয়ালেরও কান আছে। পাণ্ডুলিপি থেকে বইএর নাম লেখকের নাম সব বিদেয় করা হল। রাতের অন্ধকারে ধড়ফড় বুক কম্পমান পা ঘর্মাক্ত গা আর ধুসর পাণ্ডুলিপিখানি নিয়ে রশীদ বেরোলেন, আল্লাহ বিশ্বাস করলে আল্লাহর নাম জপতেন। রাতে ডাক্তার রশীদ পাণ্ডুলিপিখানি তাঁর বালিশের তলে রেখে নির্ঘুম রাত পার করে ভোর পাঁচটায় বেরিয়ে গেছেন। মহাখালির সাত রাস্তার মোড় পার হয়ে যে বিন্দুতে তাঁর দাঁড়ানোর কথা ছিল সেই বিন্দুতে দাঁড়িয়ে, কোত্থেকে যাদুমন্ত্রে অনেকটা অন্য গ্রহ থেকে আসা কারও মত কালো চশমার আচম্বিতে উদয় হলে, তাঁর কাঁধে ঝোলানো ব্যাগের ভেতরের বাদামি প্যাকেটটি যেন এক ঠোঙা টোস্ট বিস্কুট নয়ত নতুন শুরু করা কোনও গার্মেন্টসের স্যাম্পল—চলে যায় কালো ব্রিফকেসে। নিঃশব্দে কাঁধে ঝোলা দক্ষিণে যান, কালো চশমা উত্তরে। দুজনের জন্যই অপেক্ষারত দ্রুত যানে অদৃশ্য হয়ে যান দুজন, কারও অনুসরণের শিকার হওয়ার আগেই।

লজ্জা চলে গেল সীমানা পেরিয়ে।
 
পশ্চিমবঙ্গে ছাপার উদ্দেশে আমি লজ্জা লিখিনি। লজ্জা বাংলাদেশের জন্য। লজ্জা নামে যে একটি বই লিখেছি তা আনন্দ পাবলিশার্সের গোচরে এসেছে ওখানে বাংলাদেশের লজ্জা সংস্করণটি নকল হওয়ার পর। শেষ অবদি পুলিশ লাগিয়ে আনন্দ পাবলিশার্সের কর্মকর্তারা কয়েকজন নকলবাজকে জেলে পুরেছেন। তাঁরা কতটা নীতির কারণে করেছেন, কতটা ব্যবসার কারণে তার খোঁজ নিইনি। মোস্তফা কামালের নিয়ে যাওয়া পাণ্ডুলিপিটি কলকাতায় পাঠানো লজ্জার প্রথম পাণ্ডুলিপি। লজ্জা ছাপা হচ্ছে কলকাতায়। নিষিদ্ধ ব্যপারটি বোধহয় সংক্রামক। খবর ছাপা হয়েছে শ্রীলঙ্কায় লজ্জা বইটি নিষিদ্ধ করা হয়েছে। ওখানে বইটি নিষিদ্ধ করার কী কারণ থাকতে পারে তা আমি জানি না। লজ্জা সম্পর্কে আলোচনার কোনও শেষ নেই। আলোচনা চলছেই। আলোচনা রাস্তা ঘাটে, ট্রেনে বাসে, ঘরে বারান্দায়, আপিসে আদালতে, দোকানে ময়দানে…।

আমার বাড়িতে শামসুর রাহমান, নির্মলেন্দু গুণ বেলাল চৌধুরীরা বসে যখন কথা বলছিলেন, কথা গড়াতে গড়াতে লজ্জার দিকে গেল।

‘বিজেপি নাকি লজ্জা ছেপেছে। অনুবাদও করেছে।’ বেলাল চৌধুরী বললেন ইনকিলাব পত্রিকাটি চোখের সামনে মেলে ধরে।

নির্মলেন্দু গুণ বললেন, ‘বিজেপি ছেপেছে বা অনুবাদ করেছে বলে যে মোল্লাগুলো তসলিমার দোষ দিচ্ছে, এটা কি তসলিমার দোষ? আমার কবিতা যদি গোলাম আযমের খুব পছন্দ হয়, সে কি আমার দোষ?’

আমি বলি, ‘বিজেপি পুরো বই অনুবাদ করবে কি করে? বইয়ে বিজেপির বিরুদ্ধে অনেক কথা লেখা আছে। জামাতে ইসলামি আর বিজেপিকে এক কাতারে ফেলা হয়েছে।’

শামসুর রাহমানের মতে লজ্জায় সব ঠিক আছে কেবল সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে দেশে যে আন্দোলন হয়েছে তার পুরো চিত্রটি নেই, এ দেশে যে অসাম্প্রদায়িক মানুষ আছেন, তা লজ্জা পড়ে বোঝা যায় না। আমি শামসুর রাহমানের অভিযোগ স্বীকার করে নিয়ে বলেছি যে আমি একজন ক্ষুব্ধ হিন্দু যুবকের দৃষ্টিকোণ থেকে ঘটনা বর্ণনা করতে চেয়েছি, তার চোখে তখন অসাম্প্রদায়িক কোনও কিছু পড়ছে না।

শামসুর রাহমান বিজেপির প্রসঙ্গে বললেন, ‘একটি অসাম্প্রদায়িক বইকে সাম্প্রদায়িক বানানোর চেষ্টা হচ্ছে কি রকম দেখ! কলকাতায় দেবেশ রায় ওখানকার সংখ্যালঘু মুসলমানদের পক্ষে উপন্যাস লিখেছেন, সেটি কি এদেশের মুসলমানদের চোখে পড়ে না!’

নির্মলেন্দু গুণ জোরে হেসে উঠে বললেন, ‘মোল্লারা প্রচার করছে, লজ্জা লেখার জন্য তসলিমাকে নাকি পঁয়তাল্লিশ লাখ টাকা দিয়েছে বিজেপি। তা কই? আমাদেরও কিছু ভাগ দাও তসলিমা। একা একা সব টাকা খাবে নাকি!’

আমি হেসে বলি, ‘ইনকিলাবে লেখা হচ্ছে এই টাকার কথা। এখন সাধারণ মানুষও বিশ্বাস করে যে সত্যি সত্যিই আমাকে বিজেপি টাকা দিয়েছে।’

শামসুর রাহমান বললেন, ‘টাকা দিয়েছে, বলেই খালাশ! প্রমাণ করছে না কেন? নির্বাচনের আগে বিএনপি বলেছিল হাসিনাকে নাকি ভারত পাঁচশ কোটি টাকা দিয়েছে। আওয়ামী লীগও বলেছিল খালেদাকে পাকিস্তান থেকে ছশ কোটি টাকা দেওয়া হয়েছে। টাকা নেওয়ার প্রমাণ কেউ কিন্তু এখনও হাজির করতে পারেনি।’

আমি বলি, ‘একই রকম লজ্জা লেখার জন্য আমাকে টাকা দিয়েছে বলে যারা প্রচার করছে, তারা প্রমাণ করতে পারবে না এর সামান্য সত্যতা। কিন্তু প্রশ্ন হল, তারা অপপ্রচার করছে কেন? তারা কি তবে কংগ্রেসের টাকা খেয়েছে? নাকি সিপিএমএর?’

বেলাল চৌধুরী ইনকিলাব পত্রিকাটি ধুত্তুরি বলে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে বললেন, ‘লজ্জা লিখে হিন্দুদের যতটা উপকার করেছে তসলিমা, তার চেয়ে বেশি করেছে মুসলমানের উপকার। মুসলমান কত মানবিক হতে পারে তার একটি উদাহরণ লজ্জা। মেজরিটি কমিউনিটি থেকে মাইনরিটির পক্ষে কথা বলা, তাও আবার এমন জোরে সোরে, সে খুব একটা দেখা যায় না। মুসলমানরা এটি সময় সুযোগ পেলে কাজে লাগাতে পারে, বলবে, দেখ দেখ, মুসলমান কত উদার হতে পারে।’

আমি হেসে উঠি, ‘বেলাল ভাই, নাস্তিক মানুষটিকে খুব যে মুসলমান বানিয়ে ফেলছেন।’

‘নাস্তিক তো আমরা সবাই। কিন্তু যেহেতু মুসলমান নাম ধারণ করছ, তাই মুসলমানের গোত্রেই তোমাকে ফেলবে। এখানে নাস্তিক বলে কাউকে তো ধরা হয় না। হয় তুমি মুসলমান, হয় তুমি হিন্দু। নয় বৌদ্ধ, নয় খ্রিস্টান। যেন ধর্ম থাকতেই হবে।’

‘অশিক্ষিত মানুষের সংস্কৃতি হচ্ছে ধর্ম আর শিক্ষিত মানুষের ধর্ম হচ্ছে সংষ্কৃতি। কি বলেন রাহমান ভাই! ঠিক না!’ তাকাই শামসুর রাহমানের দিকে।

শামসুর রাহমান বললেন, ‘শিক্ষিত কারা? গোলাম আযমও তো শিক্ষিত, ফরহাদ মজহারও শিক্ষিত। দুজনেরই ইউনিভার্সিটির ডিগ্রি আছে।’

‘না, না, একাডেমিক শিক্ষার কথা বলছি না। কোনও দিন ইশকুল কলেজে যায়নি, এমন মানুষও তো শিক্ষিত হতে পারে। আরজ আলী মাতব্বুরের কথাই ধরুন না।’

বেলাল চৌধুরী উত্তেজিত আরজ আলীর প্রসঙ্গে। ‘আরজ আলী গ্রামের এক দরিদ্র কৃষক। অথচ কী আশ্চর্য সুন্দর বই লিখেছেন তিনি। তাঁর বই ইশকুলের পাঠ্য হওয়া উচিত।’

শামসুর রাহমান সায় দিলেন, আরও খানিকটা যোগ করে, ‘কেবল ইশকুলেই নয়, কলেজ ইউনিভার্সিটির সিলেবাসেও থাকা উচিত। এ বই পড়লে ধর্ম সম্পর্কে মানুষের মনে প্রশ্ন জাগবে। অনেককেই নাস্তিক হওয়ার প্রেরণা পাবে।’

ট্রেতে চা দিয়ে যায় কুলসুম। সকলের হাতে চায়ের কাপ। এর মধ্যে নিঃশব্দে ডাক্তার রশীদ এসে আসন গ্রহণ করেন। ডাক্তার রশীদ এককালে জাসদের সক্রিয় সদস্য ছিলেন, এখন অক্রিয়। সাম্প্রদায়িকতা ধর্মান্ধতা কুসংস্কার এসবের প্রচণ্ড বিরোধী। চিন্তা ভাবনা তুখোড়। চায়ে চুমুক দিয়ে একটি প্রশ্ন আমার মনে উঁকি দেয়, মুসলমানরা যদি সব নাস্তিক হয়ে যায়, তবে কি সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে! আমার মন বলে, হবে না। আমার দৃঢ় বিশ্বাস গোলাম আযম একজন নাস্তিক। জামাতের সবগুলো নেতাকেই আমার নাস্তিক মনে হয়, আস্তিক হল তারা যারা গোলাম আযমের অনুসারী, বোকা, বুদ্ধু। যাদের নাকে ধর্মের রশি লাগিয়ে গোলাম আযম রাজনীতির খেলা দেখাচ্ছেন। আমি চা রেখে শামসুর রাহমানকে বলি, ‘আমার কিন্তু মনে হয় গোলাম আযম একজন নাস্তিক। এরশাদের কথাই ধরেন, এরশাদ কি ধর্ম মানত নাকি? এই যে হুট করে সংবিধান পাল্টো রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম করে দিল, এটা কি ইসলামের প্রতি ভালবাসায় করেছে? মোটেই তো তা নয়। ক্ষমতার লোভে ধর্মকে ব্যবহার করেছে।’

‘হ্যাঁ পলিটিক্যাল ইসলাম তো এরকমই। আমারও বিশ্বাস ধর্মকে যারা রাজনীতিতে ব্যবহার করে, তারা খুব ভাল করেই জানে ধর্ম হচ্ছে মানুষকে বোকা বানিয়ে রাখার আর মুর্খ বানিয়ে রাখার অস্ত্র। অস্ত্রটি যারা ব্যবহার করে নিজেদের স্বার্থে, তারা আসলে আদৌ ধর্মে বিশ্বাস করে কি না সন্দেহ আছে।’

‘ধরেন যদি করেই বিশ্বাস, তারপরও কিন্তু তারা ইসলামের আদর্শই মানছে। কারণ ইসলামে আছে পৃথিবী দুই ভাগে বিভক্ত, একটি হচ্ছে দারুল ইসলাম আরেকটি দারুল হারব। দারুল হারব মানে বিধর্মীদের অঞ্চল, দারুল ইসলাম মানে ইসলামের অঞ্চল। মুসলমানের কাজ হল দারুল হারবের বাড়িঘর ভেঙে চুড়ে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে অমুসলমানদের যেমন করে সম্ভব মুসলমান বানিয়ে, অথবা সম্ভব না হলে ওদের খুন করে দারুল হারবকে দারুল ইসলাম বানানো। তার মানে টার্ণেট হচ্ছে পুরো পৃথিবীটাকে দারুল ইসলাম বানানো। তাহলে বাংলাদেশে মুসলমানরা যা করছে, এ তো কোনও ইসলামনীতিবিরুদ্ধ কাজ নয়। ইসলাম তো এ কাজটি সমর্থনই করে।’

‘এ তো কেবল ইসলামের নীতি নয়। খ্রিস্টানদেরও তো ও একই নীতি ছিল, তা না হলে ওই ধর্ম কোথায় শুরু হয়েছিল, আর কতদূর বিস্তৃত হয়েছে, দেখ।’

‘তা ঠিক। একেশ্বরবাদগুলোর অতীত ইতিহাস বড় জঘন্য। কিন্তু রাহমান ভাই, এখনও কেন? এই বিংশ শতাব্দির শেষে এসে এখনও কেন দেখতে হচ্ছে মধ্য যুগের সেই নির্মমতা!’

‘মানুষ এখনো মানুষ হয়নি বলে!’

‘কিন্তু ক্রিশ্চানদের মধ্যে তো বিধর্মীকে মেরে ফেলো, এই ব্যপারগুলো আর নেই। মুসলমানদের মধ্যে রয়ে গেছে কেন!’

‘কারণ মুসলমান রাষ্ট্রগুলো সেভাবে সেকুলার হয়নি, যেভাবে ক্রিশ্চানদের দেশগুলো হয়েছে।’

‘কিন্তু মুভমেন্ট তো ছিল। প্যান আরব মুভমেন্টএর কথাই ধরেন। এ তো সেকুলার দলের আন্দোলন। এর মধ্যে প্রায় সবাই তো আরবদেশগুলোর মুসলমান।’

‘আরব দেশের সেকুলার মুভমেন্ট নষ্ট হওয়ার পেছনে কিছু কিছু বদ আরব নেতার অবদান আছে, অবশ্য তারাও ঔপনিবেশিক শক্তির চক্রান্তের শিকার। ঔপনিবেশিক শক্তিগুলো বড় কোনও মুভমেন্ট তাদের কলোনিগুলোতে বরদাস্ত করেনি, বিশেষ করে যে মুভমেন্ট ওই শক্তির বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছে।’

‘কিন্তু রাহমান ভাই, প্যান আরব মুভমেন্ট তো কলোনিয়লিস্টরা চলে যাওয়ার পর হয়েছে।’

ডাক্তার রশীদ বললেন, ‘ইমপেরিয়ালিস্টরা আর কতদূর গেছে! তেলের লোভে যে করেই হোক থেকে গেছে মিডল ইস্টে। তেল কারা কন্ট্রোল করেছে? সে তো ব্রিটিশই। পরে আমেরিকা ব্রিটিশের ভূমিকা নিল। প্যান ন্যাশনালিজমের নেতারা তেলের ইন্ডাস্ট্রি ন্যাশনালাইজ করার জন্য কম আন্দোলন করেছে!..’

‘ইসলামিক ব্রাদার হুড এই জাতীয় মৌলবাদী আন্দোলনও তো গড়ে উঠল ইমপেরিয়ালিস্টদের বিরুদ্ধে। এদেরও একটা ভুমিকা আছে সেকুলার আন্দোলন নষ্ট করার।’ আমি বলি।

‘আরব নেতাগুলোর পরষ্পরের প্রতি বিরোধ থাকার কারণেই তারা এক হতে পারেনি। মিশরের নাসের চেয়েছিল সব আরবদেশগুলোকে এক করে ফেলতে। কিন্তু অন্য ন্যাশনালিস্টরা আবার তা চায়নি। আজ আরব দেশগুলোর মধ্যে যদি ইউনিটি থাকত, তবে কোনও আমেরিকান বা ব্রিটিশের ক্ষমতা থাকত না ওখানে কোনও পাপেট বসিয়ে কলকাঠি নাড়ার।’ ডাক্তার রশীদ মন্তব্য করেন। তিনি উত্তেজিত। ঢক ঢক করে ঠাণ্ডা চা গিললেন।

‘এখন যে ইসলামি মৌলবাদ বাড়ছে মধ্যপ্রাচ্যে, এর কারণ কি আরব মুল্লুকে ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে ইজরাইলি সন্ত্রাস? নাকি বার্লিন ওয়াল? বার্লিন ওয়াল ভেঙে গেছে, ধর্মহীন সোভিয়েতের পতন হয়েছে, এর মানে ধর্মহীনতার পতন হয়েছে। সুতরাং হে ধর্ম জেগে ওঠো। ওহে ইসলাম ..।’

বেলাল চৌধুরী আমাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, ‘ইণ্ডিয়ান সাবকণ্টিনেণ্টের ইতিহাস আলাদা, এখানে মৌলবাদ শক্তিশালী হওয়ার পেছনে সরকারি মদদটাই বেশি।’

‘তা তো অবশ্যই। কিন্তু মৌলবাদ সংক্রামকও বটে। এক জায়গায় বাড়লে আরেক জায়গায় বাড়ে। …’

শামসুর রাহমান রাগী মুখে বললেন, ‘বাংলাদেশের হারামজাদা জামাতিগুলো পাকিস্তানের দিকে মুখ করে.. .’

হঠাৎ দরজায় শব্দ হয়। শামসুর রাহমান তাঁর অসম্পূর্ণ বাক্যটি শেষ না করেই দরজার দিকে তাকিয়ে থাকেন। ডাক্তার রশীদ উঠে গেলেন দরজায়। আমাদের চোখ নাক কান দরজায়। কোনও অচেনা আগন্তুকের এ বাড়িতে ঢোকা উচিত নয়, এ কথা সকলে জানেন। প্রতি শুক্রবারে মসজিদের খুতবায় আমার বিরুদ্ধে গালিগালাজ চলছে। তসলিমার ফাঁসি চাই বলে মিছিল বেরোচ্ছে। এ সময়, যে কোনও ধর্মপ্রাণ মুসলমান আমার বাড়িতে ঢুকে আমাকে নির্মম কোনও আশীর্বাদ করতে পারেন। সে রকম কেউ দরজায় কি? তা না হলে রশীদ কেন ঢুকতে দিচ্ছেন না আগন্তুককে! দরজা আগলে দাঁড়িয়ে তিনি কথা বলছেন আগন্তুকের সঙ্গে। কিছুক্ষণ কথা বলে দরজা খোলা রেখেই রশীদ দু পা এগিয়ে এলেন আমার দিকে, বললেন, ‘শনির আখড়া থেকে চারটে ছেলে এসেছে তোমার সঙ্গে দেখা করতে।’

‘কি নাম? কেন এসেছে?’

‘তুমি চিনবে না, একজনের নাম শংকর রায়।’

গুণ বলে উঠলেন, ‘ঢুকতে দেবেন না। দরজা বন্ধ করে দেন। কে না কে হিন্দু নাম নিয়ে এখানে অন্য মতলবে এসেছে হয়ত।’ বলে আবার হেসে উঠলেন বলতে বলতে, ‘হিন্দুদেরই বা বিশ্বাস কি?’

রশীদ এবারও দু পা ফিরে গিয়ে ওদের সঙ্গে মৃদু কণ্ঠে কী কথা বলে নিয়ে আমাকে বললেন, ‘শোনো, এরা খুব সাধারণ মানুষ। একবার তোমাকে প্রণাম করতে এসেছে। করেই চলে যাবে।’

আমি প্রণামের লোভে নয়, কেন এসেছে, কে তারা, এই উৎসাহেই, অথবা এতগুলো মানুষ এখানে বসে আছে, কোনও দুর্ঘটনা ঘটলে এরা ঠেকাবেন এই সাহসেই বললাম, ‘ঠিক আছে, আসতে বলেন।’

চার যুবক ঢুকল ঘরে। কুড়ি থেকে পঁচিশের মধ্যে বয়স। সাদাসিধে কাপড় পরনে, স্যাণ্ডেল পায়ে। দরজার কাছে স্যাণ্ডেলগুলো খুলে চারদিক একবার দেখে নিয়ে আমার দিকে এগিয়ে হাত বাড়ালো আমার পায়ের দিকে। আমি দ্রুত পা সরিয়ে নিয়ে উঠে দাঁড়ালাম। কোনও প্রশ্ন করার আগেই শংকর নামের ছেলেটি করজোড়ে আমার সামনে দাঁড়িয়ে বলল, ‘দিদি, আপনি আমাদের দেবী। আপনাকে দেখতে পেয়ে জীবন আমাদের সার্থক হল। অনেক কষ্ট করে আপনাকে খুঁজে পেয়েছি, দিদি। আপনাকে একবার প্রণাম করতে দেন।’ পা ছুঁতে গেলে আবার আমি সরিয়ে নিই পা। শংকর তিনজনের মধ্যে দুজনকে দেখিয়ে বলে, ‘এরা দুজন আমার কাজিন,’ বাকি লাল শার্ট পরা একজনকে দেখিয়ে, ঞ্চআর এ হল আমার বন্ধু। আমরা কলেজে পড়ি দিদি।’

আবারও মাথা আমার আমার পায়ের দিকে নাবাতেই বলি, ‘না না প্রণাম করতে হবে না। আমি এসব পছন্দ করি না। কিছু বলার থাকলে বলেন।’

‘দিদি, আপনার লজ্জা বইটা আমরা পড়েছি দিদি। আমাদের কথা আগে কেউ এমন করে বলে নাই দিদি। দিদি আপনি যা করেছেন, তা যে কত বড়.. আমাদের মনের কথাটা আপনি লিখেছেন।’

‘শোনেন, হিন্দু মুসলমান এখানে বড় ব্যপার না। আমি মানষ হয়ে মানুষের কষ্টের কথা বলেছি। এই যে এখানে দেখছেন যাঁরা বসে আছেন, তাঁরা সবাই লেখেন, সবাই অন্যায়ের প্রতিবাদ করেন।’

‘দিদি আমার কাজিনদের বাড়ি ভেঙে ফেলেছে জামাতিরা। আর আমার এই বন্ধু, সমীরণ, সমীরণের এক ভাইকে খুন করেছে ওরা।’

বলতে বলতে চার যুবক আমি বাধা দেওয়ার পরও আমার পা জড়িয়ে ধরে ডুকরে কেঁদে ওঠে। মহা সমস্যায় পড়ি। না পারছি ওদের টেনে তুলতে, না পারছি পা সরাতে। এক শরীর অস্বস্তি নিয়ে অসহায় দাঁড়িয়ে থাকি।

কেঁদে, চোখ মুছে, শংকর তার ভাই বন্ধু সহ বিদায় হল।

ওরা চলে গেলে নির্মলেন্দু গুণ খুব ধীরে খুব গাঢ় স্বরে বললেন, ‘লজ্জা লিখে আসলে তসলিমা বাংলাদেশের হিন্দুদের অপকার করেছে, উপকার নয়।’

‘মানে?’ আমার বিস্মিত চোখ গুণের নির্বিকার মুখে।

আর সকলের চোখেও দেখি একই রকম বিস্ময়।

‘অপকারটা কিরকম শুনি!’ আমি উদগ্রীব শুনতে।

গুণ খুব ধীরে ধীরে বললেন, ‘হিন্দুদের মনে যে তীব্র আগুন জ্বলছিল, সেটিকে তসলিমা নিভিয়ে দিয়েছে। যে ক্ষোভ তাদের জমা ছিল বুকে, যে ক্ষোভের কারণে তারা ভয়ংকর কিছু করতে পারত, সেটিকে কমিয়ে দিয়েছে। তারা এখন ভাবতে পারছে তাদের পক্ষ হয়ে লড়বার মানুষ আছে, তারা একা নয়। দুর্বলের পাশে সবলের পক্ষ থেকে কেউ দাঁড়ালে দুর্বল কিন্তু দমে আসে। তারা যে আগুন লাগাতে চায়, সে আগুন তারা আর লাগায় না।’

আমরা আমাদের শূন্য চায়ের কাপ সামনে নিয়ে বসে থাকি। অনেকক্ষণ একটি বিষণ্ন নিস্তব্ধতা আমাদের দখল করে রাখে।

শান্তিবাগের বাড়িতে এরপর খুব বেশিদিন থাকা সম্ভব হয় না। কারণ বাড়িঅলা আমার দিকে অন্যরকম চোখে তাকাতে শুরু করেছেন। পাঁচবেলা নামাজ পড়া লোক বাড়িঅলা, বাড়িতে ইনকিলাব পত্রিকা রাখেন। জুম্মাহর নামাজ পড়তে মসজিদে যান, যে মসজিদে নামাজের পর ইমাম খুৎবা পড়েন, খুৎবা না তো, মিলন বলেন, আপনের গিবৎ পড়ে। মিলনও মাঝে মাঝে শুক্রবারে শান্তিবাগের মসজিদে গিয়ে নামাজ পড়ে আসে আর শুনে আসে ইমামের গালি। ‘তসলিমা নামে এক কুলাঙ্গার জন্ম নিয়েছে এদেশে, ভাইয়েরা আমার, এই তসলিমা ইসলামবিদ্বেষী, মুসলমান হয়ে মুসলমানের সর্বনাশ করছে। হিন্দুদের ঘুষ খেয়ে এই পাপীনি একটা বই লিখেছে। বই টা আপনারা যদি না পড়ে থাকেন, ভাল কাজ করেছেন, সওয়াবের কাজ করেছেন। ওই বইএ লিখেছে মুসলমান জাতি নাকি জঘন্য জাতি। মুসলমান নাকি হিন্দুদের খুন করে রাস্তা ঘাট ভাসিয়ে দিয়েছে রক্তের বন্যায়। এই মহিলা নারীজাতির লজ্জা। নারীজাতিকে প্ররোচনা দিচ্ছে পরপুরুষের সঙ্গে মেলামেলা করতে। স্বামীদেরে ত্যাগ করতে। এই মহিলা ধর্ম বিশ্বাস করে না। বলে আল্লাহ বলতে কিছু নাই। বলে, মুহম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইসসালাম, আল্লাহর পেয়ারা নবী, তিনি নাকি কামুক, তিনি নাকি বদমাইশ লোক। তওবা তওবা। ভাইয়েরা আমার, সরকারের কাছে দাবি করেন, এই কুলাঙ্গার পাপীনির যেন একটা বই না, যতগুলা বই সে লিখেছে, সব যেন আগুনে পোড়ায়, সব যেন নিষিদ্ধ করে। তার ফাঁসির দাবি করেন। এই পাপীনির ফাঁসি হলে এই দেশ বাঁচবে, ইসলাম বাঁচবে।’

আল্লাহর কাছে দুহাত তুলে মোনাজাত হয়, মোনাজাতে তসলিমার ফাঁসি দিয়ে দেশ ও মুসলমান জাতিকে রক্ষা করার অনুরোধ জানানো হয়। কোনও কোনওদিন লিফলেট বিলি হয় এসব কথার। এ সবও শোনেন বাড়িঅলা। রাস্তায় মিছিল বেরোয় তার ভাড়াটের ফাঁসির দাবিতে, তাও তিনি দেখেন, না দেখলেও পত্রিকায় পড়েন। হাসপাতালে যাওয়ার পথে আমি নিজেই দুদিন পড়েছি মিছিলের সামনে। একদিন পাশ কাটিয়ে অন্য রাস্তায় চলে গেছি। আরেকদিন সে সুযোগ পাইনি। রিক্সা থেমে আছে, রাস্তায় বিশাল মিছিল যাচ্ছে। আমার রিক্সার পাশ দিয়েই চলে যাচ্ছে টুপিঅলারা চিৎকার করতে করতে তসলিমার ফাঁসি চাই, দিতে হবে। আমার ওড়না নেই যে ওড়নায় মুখ লুকোনো। জামা পাজামার ওপর এপ্রোন পরা। আমি প্রাণ হাতে নিয়ে বসে থাকি রিক্সায়। যেন ধুলো এড়াতে নাক মুখ ঢাকছি, এভাবে হাত দিয়ে ঢেকে রাখি মুখের অর্ধাংশ, চোখ নামিয়ে রাখি রিক্সার পাদানিতে। যেন লজ্জাশীলা মেয়েমানুষ আমি পর পুরুষের দিকে চোখ তুলে তাকাই না। মিছিলের কেউ একজন যদি আমাকে চিনে ফেলে, সে যদি চেঁচিয়ে তার সগোত্রীয়দের জানিয়ে দেয় যে আমাকে হাতে নাতে পাওয়া গেছে, তখন আমার ছিন্নভিন্ন অস্থি মজ্জা মাংস এই রাস্তার ধুলোয় গড়াগড়ি খাবে, সে ব্যপারে আমার কোনও সন্দেহ থাকে না। মিছিল শেষ হলে রিক্সাঅলা যখন চালাতে শুরু করে, খানিকটা পথ গেলে আমি জিজ্ঞেস করি, কিসের মিছিল গেল?

তসলিমার মিছিল।

তসলিমার মিছিল মানে?

তসলিমার ফাঁসি চাইতাছে লোকেরা।

কেন ফাঁসি চায়? তসলিমা কি করছে?

তসলিমা মসজিদ ভাইঙ্গা দিছে।

কোন মসজিদ, জানেন?

বাবরি মসজিদ।

একটা মেয়েমানুষ কি কইরা একটা মসজিদ ভাঙল?

তা জানিনা কি কইরা ভাঙছে।

কোথায় শুনলেন এই সব।

আমরা শুনি। দেলোয়ার হোসেন সাইদির ক্যাসেট বাজে রাস্তাঘাটে। মিছিল দেখছি।

আপনিও চান তসলিমার ফাঁসি।

হ। চামু না কেন? সবাই যখন চায়, আমিও চাই।

শান্তিবাগে বাড়ির গেটের কাছে থেমে রিক্সাভাড়া মিটিয়ে দিই। ভাল যে গেটে ঝোলানো সাইনবোর্ডটি আগেই তুলে নিয়েছি।

যেদিন মিছিলের সামনে পড়ি, সেদিনই ছোটদা আসেন তাঁর এক বন্ধুকে নিয়ে আমার সঙ্গে দেখা করতে। আমার খুব ভাল লাগে ছোটদাকে দেখে। ছোটদা সাধারণত আমার বাড়িতে আসেন না। তাঁর বাড়িতে গীতার দুর্ব্যবহার সইতে আর সুহৃদের ওপর অবর্ণনীয় অত্যাচার দেখতে যেতে ইচ্ছে করে না বলে যাই না। ছোটদা যে বন্ধুটি নিয়ে আমার বাড়িতে আসেন, তাঁর নাম শফিক। তিনি ছোটদার সঙ্গেই বিমানে চাকরি করেন। তিনি একটি অনুরোধ নিয়ে এসেছেন আমার কাছে। অনুরোধটি হল বিমানবালাদের যে পঁয়ত্রিশ বছর পর চাকরি থেকে বিদায় দিয়ে দেওয়া হয়, তারা যে গর্ভবতী হওয়ার পর ন মাস ছুটি পাওয়ার কথা, তা পায় না, এবং কোনও কোনও পেনশন থেকেও বঞ্চিত হয় সে বিষয়ে আমি যেন কিছু লিখি। কথায় কথায় যখন ছোটদা জানালেন যে শফিক গাড়ির ব্যবসা করে, জাপান থেকে ব্যবহৃত গাড়ি এনে এখানে বিক্রি করে, আমি বললাম, আমি কিনব গাড়ি। আজই। তুই চাইলে তো তরে শফিক অনেক কম টাকায় দিতে পারব। তবে আগে কিছু টাকা দিতে হইব। ঠিক হল, আজই আমি কিছু আগাম টাকা দিয়ে দেব, গাড়ি এসে যাবে দু সপ্তাহের মধ্যে। গুণে গুণে পঞ্চাশ হাজার টাকা দিই। বাকি তিন লক্ষ টাকা দেব গাড়ি পাওয়ার পর। টাকাটা কাকলী পাবলিশার্সের মালিক সেলিম আগের দিন দিয়ে গেছেন বইয়ের অগ্রিম, যে বই এখনও লেখা হয়নি, এখনও ভাবা হয়নি, সে বইয়ের অগ্রিম। সেটাকা নিয়ে শফিক চলে গেলেন। গাড়ি ছাড়া আমার চলাফেরা যে নিরাপদ নয়, সে আমি নিশ্চিত। তাই এই ব্যবস্থা। বিমানবালাদের নিয়ে আমার লেখা ঠিকই হয়, যায় যায় দিন পত্রিকায় তা ছাপাও হয়। কিন্তুৃ সেই গাড়িটি আমার কখনও পাওয়া হয় না এবং সেই টাকাটিও আমাকে আর ফেরত দেওয়া হয় না। বাড়ি থেকে বেরোনোই মানে মৃত্যুর ঝুঁকি নিয়ে বেরোনো। কিন্তু বাড়িতে বসে থাকলে তো আমার চলবে না। আমাকে বেরোতেই হবে। বাড়ির বাইরে যেমন অসন্তোষ বাড়ছে, বাড়ির ভেতরেও তেমন। বাড়িঅলা যে আমাকে তাড়ানোর জন্য মনস্থির করে ফেলেছেন তা আমি টের পাই। বাড়িঅলা এবং তাঁর স্ত্রীর ভ্রূকুঞ্চন, তাঁদের মুখ ফিরিয়ে নেওয়া, আমাকে দেখেও না দেখে চলে যাওয়া আমাকে বুঝিয়ে দেয় তাঁরা আমার সঙ্গে আর খাতির জমাতে চাইছেন না। বুঝি তাঁরা আশঙ্কা করছেন যে কোনও একটি মিছিল যে কোনও একদিন এ বাড়ির দিকেই আসবে এবং বাড়িটির ওপর পেট্রোল ঢেলে আগুন জ্বালিয়ে দেবে মিছিলের লোকেরা। এই ঝুঁকিটি যে বাড়িঅলা নিতে চান না, তা আমি অনুভব করি সকাল বিকাল। দুশ্চিন্তায় ছটফট করি। বাড়িঅলা আজ আমাকে তাড়িয়ে দিলে আমি যাবো কোথায়! কোনও আশ্রয় নেই আমার। কোথাও কোনও নিরাপত্তা নেই। নিশ্চয়তা নেই। আমাকে কোনও বাড়িঅলাই বাড়িভাড়া দেবে না। আমার এই নামটি এখন ভয়ংকর একটি নাম। ভদ্রলোকেরা নাম শুনে আঁতকে ওঠেন। ইশকুল কলেজের যে মেয়েরা ছেলেদের ধমক দিয়ে কথা বলে, মাথা উঁচু করে গট গট করে হাঁটে, বেহায়া বেপরোয়া, তাদের তসলিমা বলে ডেকে টিটকিরি দেওয়া হয়। আমি বুঝে ওঠার আগেই তসলিমা নামটি সাধারণের সমাজে একটি পাপের কলঙ্কের ব্যাভিচারের স্বেচ্ছাচারিতার অনৈতিকতার বিপথগামিতার প্রতীক হয়ে উঠেছে। শান্তিবাগের রাস্তা ছেড়ে মালিবাগ পাড় হয়ে শান্তিনগরের মোড়ে যে দশ তলা দালান উঠছে ইস্টার্ন হাউজিংএর, সেদিকে যেদিন চোখ পড়ে, সেদিনই বাড়ি কেনার সিদ্ধান্ত নিয়ে ইস্টার্ন হাউজিং এসটেটের মতিঝিল আপিসে গিয়ে বাড়ি না দেখে, কারও সঙ্গে না বুঝে, কত দাম এত দাম, কোনটা তৈরি আছে, ন তলা, এক নম্বর বিল্ডিং, কত দিতে হবে এখন, এত দিতে হবে, এই নিন চেক, এই নিন বাড়ির দলিল করে একটি বাড়ি কিনে ফেলি। ব্যাংক থেকে কিছু টাকা ধার নিতে হল, সে ব্যবস্থা ওরাই করে দিল, বাকি কিছু টাকা শোধ করতে হবে কিস্তিতে। বাড়ি কিনলে বাড়ির মালিকরা জিজ্ঞেস করে না আমি কাকে নিয়ে থাকব, আমার স্বামী আছে কি না। জানতে চায় না আমি করি কি, খবর নেয় না আমার নামে মিছিল বেরোচ্ছে কি না। ওরা কেবল দেখতে চায় আমার টাকা আছে কি না বাড়ি কেনার, টাকা থাকলে আমার স্বামীহীন জীবন, আমার লেখালেখি, আমার বিরুদ্ধে কুৎসা গিবৎ, আমার বই বাজেয়াপ্ত, আমার বিরুদ্ধে ফাঁসির মিছিল নিয়ে ভাবে না। বাড়ি কেনা ছাড়া আমার উপায় কিছু ছিল না। প্রকাশকদের দিয়ে যাওয়া টাকা, যা ভেবেছিলাম ব্যাংকে রেখে ইন্টারেস্ট যা পাবো মাসে মাসে, তা দিয়ে সংসারের খরচ চালাবো, চাকরির টাকা আর কত! সেই নিরাপত্তা নির্বাসনে দিয়ে যা টাকা দিয়েছেন প্রকাশকরা আর যা ছিল জমা, সব ঝেড়ে ঝুড়ে দিয়ে আমার বাড়ি কেনা হল। বাড়ির দাম সাতাশ লক্ষ টাকা। বারো লক্ষ টাকা নগদ দেওয়া হল। ব্যংকের ঋণ যত দেরিতে শোধ করব, তত দিতে হবে সুদ। বাড়ি কেনার খবর পেয়ে প্রকাশকরা হুড়মুড় করে আরও অগ্রিম রয়্যালটি ঢালতে শুরু করলেন। কাকলী প্রকাশনী তিন লক্ষ টাকা দিয়ে গেছেন খবর পেয়ে পার্ল পাবলিকেশন্সএর মিনু পাঁচ লক্ষ টাকা নিয়ে এলেন। ব্যাংকের টাকা খুব দেরি হয়নি শোধ করতে। এক লক্ষ টাকার জন্য বাবার কাছে হাত পাততে হয়েছিল। অবশ্য ধার হিসেবে নিয়েছি। তিনি দিয়েছেন। জমি কেনা বাড়ি কেনা বিষয়ে বাবা বরাবরই খুব উৎসাহী। দলিল পাওয়ার পরই ঠেলাগাড়ি ডেকে এনে শান্তিবাগ থেকে শান্তিনগরে জিনিসপত্র উঠিয়ে নিলাম। আমার কষ্ট হচ্ছিল শান্তিবাগের বাড়িটি ছেড়ে যেতে। স্মৃতিগুলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে সর্বত্র। আমি আর আমার দীর্ঘশ্বাস কালো গেটটি পেরিয়ে যাই।

লজ্জা নিয়ে হৈ চৈ মাসের পর মাস চলে যাচ্ছে, কমছে না। পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতির মাঝমাঠে গিয়ে পড়েছে লজ্জা। লেখালেখি হচ্ছে, বাম দলের লোকেরা বলছে, এ একটা বাজে বই। এমন কী বামপন্থী চিত্রপরিচালক মৃণাল সেন বললেন, লজ্জাকে বই না বলে দুর্গন্ধ-আবর্জনা বলা ভাল। আবার চরমপন্থী হিন্দুরা বলছে এ হচ্ছে পবিত্র গ্রন্থের মত। বাংলাদেশের চিত্রের ঠিক উল্টো চিত্র ভারতে। এদেশে বামপন্থী উদারপন্থী সেকুলারিস্টরা বলছেন, এটি একটি মূল্যবান বই (অবশ্য বদরুদ্দিন ওমর ছাড়া)। ওদিকের একই মানসিকতার মানুষ বলছেন এটি আবর্জনা ছাড়া কিছুই নহে। পশ্চিমবঙ্গের খুব অল্প কিছু মানুষ, হাতে গোণা, বাম ঘেষাঁ হয়েও বইয়ের পক্ষে বলছেন। একটি উপন্যাস কী করে রাজনীতির গুটি হয়ে যায়, আমাকে সবিস্ময়ে তা দেখতে হল। কিন্তু ভাল যে আমাকে আরও কাছ থেকে তা দেখতে হচ্ছে না। কিন্তু আচমকা একদিন কলকাতার আজকাল পত্রিকা থেকে বাহারউদ্দিন এসে উপস্থিত। বাহারউদ্দিনের আগের সেই গদগদ ভঙ্গিটি, সেই গলে যাচ্ছি গলে যাচ্ছি হাসিটি নেই। বরং তীক্ষ্ণ দৃষ্টি আমার আপদমস্তককে এমন হানে যে মনে হয় এ বুঝি বায়তুল মোকররম মসজিদ থেকে গোলাম আযমের সাক্ষাৎ পুত্রটি এসে সামনে দাঁড়িয়েছে। আজকাল পত্রিকাটি বামপন্থীর পত্রিকা। আমি আনন্দপুরষ্কার পাওয়ার পর আজকাল আমাকে নিয়ে প্রশংসায় মেতেছিল। বুঝি, মুসলমান মেয়ে বলেই মেতেছিল। আর যেই না দেখল মুসলমান মেয়েটি মুসলমানদের গাল দিয়ে একটি বই লিখেছে, তখনই বেজার হয়ে গেল আজকাল। তবে তো এখন আর আমার গুণ গাওয়া চলবে না। গুণ গাওয়া বাদ দিয়ে বরং তসলিমাকে যত পারে ছি ছি দিয়ে যাচ্ছে বিশেষ করে লজ্জা যখন বিজেপির লোকেরা ব্যবহার করতে শুরু করেছে। বাহারউদ্দিন এসেছেন আমার কাছে জবাব চাইতে, কেন আমি লজ্জা লিখেছি। বাহারউদ্দিন আসামের লোক, ওখানের এক কলেজে আরবির শিক্ষক ছিলেন। একসময় সব ছেড়ে ছুড়ে দিয়ে কলকাতায় এসে স্বাতী নামের এক হিন্দু মেয়েকে বিয়ে করে লালন নামের একটি পুত্রের জন্ম দিয়ে সুখের অথবা অসুখের সংসার করছেন। নিজে তিনি গদ্য পদ্য রচনা করেন। বইও বেরিয়েছে কিছু। বলতে দ্বিধা নেই যে বাহারউদ্দিন বেশ চমৎকার গদ্য লেখেন। তিনি ধর্ম মানেন না। ধর্মকে মুখে বেশ আচ্ছ! করে গাল দেন। ধর্ম নিয়ে যারা মাতম করে, তাদেরও। ওখানে হিন্দুদের অবহেলা অবজ্ঞা পাওয়া সংখ্যালঘু মুসলমানের জন্য আবার মায়া আছে তাঁর। আমার সঙ্গে তাঁর বিরোধ থাকার কথা নয়। কিন্তু বিরোধ সৃষ্টি হয়, যখন দেখেন হিন্দু ধর্মবাদী দল আমাকে দেবী করে তুলছে এবং এ কারণে দোষটি তিনি আমাকে দেন। যে কথাটি বাহারের বোঝা সম্ভব হয় না, তা হল, আমি কোন দেশে বসে কাদের কথা লিখেছি, এবং কেন লিখেছি। বাহারউদ্দিন যত বামপন্থী হন, যত নাস্তিক হন, তিনি সংখ্যালঘুদের একজন। তিনি অত্যাচারী হিন্দু দেখেছেন, অত্যাচারিত হিন্দু দেখেননি। যা দেখে অভ্যেস নেই, তার চিত্র কল্পনা করা সবার জন্য সহজ হয় না। তিনি কলকাতা থেকে উড়ে এসেছেন বলে এই করুণায় নয়, লজ্জা নিয়ে ভুল ভাবনাগুলো শুধরে দেওয়ার জন্য বাহারের সঙ্গে আমি কথা বলতে রাজি হই। আজকাল পত্রিকায় লজ্জা নিয়ে বেশ বিতর্ক চলছে। বাদ প্রতিবাদ তুঙ্গে। মুসলমান মৌলবাদিরা নয়, প্রগতিশীল শিবিরের এমনকী স্বনামধন্য বামপন্থী লেখক এবং নেতারা মন্তব্য করেছেন, ক. আমি উস্কানিমূলক লেখা লিখেছি। খ. আমি সচেতন বা অসচেতনভাবে বিজেপি- আরএসএস মার্কা হিন্দু মৌলবাদের স্রোতে ভেসেছি। এমনকী দক্ষিণ পূর্ব এশিয়া জুড়ে যে আন্তর্জাতিক চক্রান্ত তার শিকার হয়েছি। গ. উপন্যাস হিসেবে লজ্জা দুর্বল। পলায়নবাদী দৃষ্টিকোণে সমগ্র রচনাটি আচ্ছন্ন।

বাহার আমাকে প্রশ্ন করেন, ‘লজ্জা নিয়ে আপনি তো নিশ্চয়ই এখন বিব্রত। তাই না?’

কপালে আমার বিরক্তির ভাঁজ পড়ে প্রথম প্রশ্নটি শুনেই।

‘আশ্চর্য তো! কেন বিব্রত হব। মোটেও আমি বিব্রত নই।’

‘লজ্জা কিংবা আপনার কোনও লেখা নিয়েই কি আপনি বিব্রত নন, বলতে চান?’

‘হ্যাঁ বলতে চাই। আমার লেখার বিষয় নিয়ে আমি কখনও বিব্রত হই না। আমার দুর্বল বর্ণনা নিয়ে, ভাষা ব্যবহারের অপরিপককতা নিয়ে, চরিত্রের গভীরে যথেষ্ট না পৌঁছোনো নিয়ে অবশ্য বিব্রত হই।’

‘লজ্জাকে বাংলাদেশে ইসু করেছে মোল্লারা, সরকারও। পশ্চিম বাংলায় এবং ভারতের আরও অন্যান্য রাজ্যগুলোয় আপনার অসতর্কতার ফায়দা তুলেছে বিজেপি। আপনার কি মনে হয় না সংঘ পরিবারের হাতে আপনি বিপজ্জনক অস্ত্রটি তুলে দিয়েছেন?’

‘প্রথমেই আপনার অসতর্ক শব্দ নিয়ে আমি আপত্তি করছি। লজ্জা লিখবার সময় আমি মোটেও অসতর্ক ছিলাম না। লজ্জায় আমি স্বীকার করছি কাঠামোগত দুর্বলতা, শিল্পগুণের অভাব প্রচুর আছে কিন্তু লজ্জার বিষয় বা বক্তব্যে কোনও ত্রুটি নেই। আমি অকপটে সত্য কথা লিখেছি। বাংলাদেশ সরকার লজ্জা নিষিদ্ধ করতে গিয়ে একবারও কিন্তু বলেনি বইয়ের কোনও তথ্য ভুল। বিজিপি যদি ফায়দা তোলে সেটি বিজিপির অসততা, সেটি নিশ্চয়ই লজ্জার কোনও ত্রুটি নয়। সঙ্ঘ পরিবারের হাতে আমি অস্ত্র তুলে দিয়েছি বলে যারা প্রচার করছে, তারা আসলে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির পক্ষের একটি বই নিয়ে জনমনে বিভ্রান্তি ছড়াতে চায়। তারা বিজেপি আর সঙ্ঘ পরিবারের নিন্দা না করে সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে লেখা একটি বই এবং বইয়ের লেখকের নিন্দা যখন করে, আমার সন্দেহ হয় আদৌ তারা আমার বইটি পড়েছে কী না। ধর্মীয় মৌলবাদীর পক্ষে একটি শব্দও কি ওই বইয়ে আছে? নেই। আবারও বলছি, সঙ্ঘ পরিবার যদি আমার বইটি তাদের স্বার্থে ব্যবহার করে, এটি তাদের অসততা। লজ্জার বা তার লেখকের নয়। তারা নিশ্চয়ই জানে যে লজ্জার বক্তব্য তাদের পক্ষে যায় না। ধর্মের অপর নাম মনুষ্যত্ব হোক, এই কথাটি লজ্জার প্রথম পাতায় লেখা।’

‘আর এসএসের পাঞ্চজন এবং অর্গানাইজারে আপনার উপন্যাসের বিশেষ বিশেষ অংশ ছাপা হচ্ছে। বিজেপি ও বিশ্ব হিন্দু পরিষদ সেই উপন্যাসটিকে ঘরে ঘরে পৌঁছে দেবার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করল, পরদিনই দেখা গেল, কলকাতার রাস্তায়, ফুটপাতে, পানের দোকানে দোকানে লজ্জা বিক্রি হতে শুরু হল। কেউ কি আপনার উপন্যাস ছাপার অনুমতি নিয়েছে?’

‘অবশ্যই না। কোনও ধর্মীয় রাজনৈতিক দলকে আমি দিই নি লজ্জা ছাপতে, দেওয়ার প্রশ্ন ওঠে না। কেবল লজ্জা কেন, আমার কোনও বই ছাপার কোনও অধিকার তাদের নেই।’

‘তাহলে আপনি পাঞ্চজন্য আার অর্গানাইজারের বিরুদ্ধে মামলা করছেন না কেন?’

‘মামলা করবে আমার পশ্চিমবঙ্গের প্রকাশক, যারা লজ্জার সত্ত্ব কিনে নিয়েছেন। তাদেরই দায়িত্ব অন্য ভাষায় অনুবাদ করার আর ছাপার অনুমতি দেওয়া। এতে যদি কোনও রকম সমস্যা হয়, তবে তারা মামলা করবেন। করেছেনও তো এর মধ্যে। যারা অবৈধভাবে লজ্জা ছেপেছিল, তাদের পুলিশে ধরে নিয়ে গেছে।’

‘আমাদের মনে হয় আপনার উপন্যাস এখানকার হিন্দু আর ওখানকার মুসলমানদের অসুবিধেয় ফেলছে।’

‘আপনাদের মনে হওয়ার পেছনে কিছু গণ্ডগোল আছে। আমি এ দেশের এক প্রগতিবাদী শিক্ষিত পরিবারের গল্প বলেছি লজ্জায়। যে পরিবারটি সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসের শিকার এবং যে পরিবারের একটি নাস্তিক যুক্তিবাদী ছেলে ক্রমে ক্রমে হিন্দু হয়ে ওঠে, সাম্প্রদায়িক হয়ে ওঠে, নষ্ট হয়ে ওঠে। রাষ্ট্র তাকে নষ্ট করে, সরকার নষ্ট করে, দিনে দিনে বেড়ে ওঠা ধর্মীয় মৌলবাদ তাকে নষ্ট করে। সে পরাজিত হয়। এ দেশের অনেক হিন্দুই ধীরে ধীরে মানুষ থেকে হিন্দু হয়ে উঠছে, তারা পরাজিত হচ্ছে রাষ্ট্রধর্মের কাছে, তারা পরাজিত হচ্ছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে, কর্মক্ষেত্রে, ব্যবসা বাণিজ্যের ধর্মীয় বৈষম্যের কাছে। তারা এ দেশের দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক হিসেবে চিহ্নিত হচ্ছে। সত্য কথা বলব না কেন? সত্য চিরকালই সম্মানিত হবে। সত্য নিয়ে অঘটন যারা ঘটায়, দোষ তাদের, দোষ সত্যের নয়। যারা সত্যকে দোষ দেয়, তারাই ওই অঘটনঘটানেওয়ালাদের সমর্থন করে। এখানকার হিন্দু অসুবিধেয় পড়বে, এটি একটি বাজে এক্সকিউজ। যারা সুবিধের জন্য মুখ বুজে থাকা মঙ্গল বলে মনে করে, তারা মানুষের শক্তি ও সাহসকে ধ্বংস করে দেয়। তারা ভীতু,ভোগী। তারাই সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সবচেয়ে ক্ষতির কারণ। তারা ভাবে ভুলগুলো আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলে বিপদ হবে। ওখানকার মুসলমানদের অসুবিধের প্রসঙ্গে একই কথা খাটে।’

‘অদূর ভবিষ্যতে আপনার লেখাকে কেন্দ্র করে কোনও অঘটন যদি ঘটে, কী করবেন? লজ্জার দায় মেনে নেবেন?’

‘লজ্জার কারণে অঘটন ঘটবে কেন? অঘটন ঘটবে অঘটন যারা অহরহ ঘটায় তাদের দ্বারা। লজ্জা হচ্ছে একটি মানবিক আবেদন, আর যেন অঘটন না ঘটে। মানুষের প্রতি মানুষের শ্রদ্ধাবোধ যেন থাকে। ধর্মের অপর নাম যেন মনুষ্যত্ব হয়।’

‘আপনার উপন্যাস একদর্শী। আপনি দাঙ্গা, ধর্ষণ, হত্যা ও উপাসনাগৃহের ভাঙচুরের বিস্তর বিবরণ দিয়েছেন।’

‘হ্যাঁ দিয়েছি। ওগুলো ঘটেছে বলে দিয়েছি। আমি তো কিছু বানিয়ে দিইনি।’

‘দাঙ্গার বিরুদ্ধে সুস্থ মানুষের প্রতিরোধের বয়ান নেই কেন? এটি কি ইচ্ছাকৃত?’

‘একটি পরিবারের স্মৃতি স্বপ্ন আনন্দ বেদনার কথা লজ্জায়। সেই পরিবারের লোকেরা যেভাবে ঘটনাগুলো দেখেছে, সেভাবেই বর্ণনা করেছি। তারা যেটুকু প্রতিরোধ দেখেছে, নিশ্চয়ই সেসব প্রতিরোধের কথা আছে লজ্জায়। মানববন্ধনের কথা আছে। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির মিছিল হচ্ছে, সে কথা আছে। মুসলমান ছেলেরা সুরঞ্জনকে নানাভাবে সাহায্য করে এসবও আছে। সুধাময় তাঁর ছেলে সুরঞ্জনকে বলেন, এ দেশের মানুষ কি রাস্তায় নামছে না? প্রতিবাদ করছে না? কাগজে তো বিস্তর লেখা হচ্ছে। এখনও তো অন্যায় অত্যাচারের বিরুদ্ধে মানুষ কথা বলছে। এই শক্তিটি কি সব দেশে আছে? প্রতিবাদ করার অধিকার কি সবাই পায়। এখানে তো হচ্ছেই প্রতিবাদ।

আসলে কী জানেন, এ দেশে সাতই ডিসেম্বর থেকে শুরু করে একটানা সাতদিন যে ভয়ংকর সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাস ঘটে গেছে তার তুলানায় সুস্থ মানুষের প্রতিরোধ খুবই সামান্য। যদি সন্ত্রাস যেটুকু ঘটেছে, ঠিক সেটুকুই যদি প্রতিরোধের বয়ান করতাম, তবে মিথ্যাচার হত। জিজ্ঞেস করেছেন, এটি ইচ্ছ!কৃত কী না। হ্যাঁ ইচ্ছ!কৃত। আমি সত্য বয়ান করতে খুব ইচ্ছ! করি। আমি ভেবে দেখি না, কারা এই সত্য নিজ স্বার্থে ব্যবহার করবে, কারা অনুবাদ করবে, কারাই বা অন্যের ব্যবহারের সুযোগ নিয়ে কুৎসা রটাবে।’

‘শুনেছি, আমরা খবরও করেছি, আপনি উপন্যাসটিকে আরও বড় করে লিখেছেন। এতে কি ঘটনা ও চরিত্রের রদবদল ঘটেছে? দাঙ্গার বিরুদ্ধে প্রতিবাদের নিখুঁত ছবিটি কি আশা করব?’

‘লজ্জাকে খানিকটা বড় করেছি। এতে মূল ঘটনায় কোনও পরিবর্তন হয়নি। কিন্তু চরিত্র বেড়েছে। চরিত্রগুলোর সংলাপ বেড়েছে। সন্ত্রাসের খবর আরও আছে, আরও কষ্ট, আরও বেদনা আছে। প্রতিবাদও আছে, যেটুকু হয়েছে প্রতিবাদ সেটুকই আছে।’

‘নতুন করে লেখার কারণটি কি?

‘আমি খুব কম সময় নিয়ে লজ্জা লিখেছিলাম। ভেতরের কষ্টগুলো যেন বুক ছিঁড়ে বেরিয়েছিল। পরে, যখন বই হয়ে বেরোবার পর পড়ে দেখলাম, দেখলাম অনেক জায়গায় ভাষার দুর্বলতা রয়ে গেছে। ভাষায় কি আর সব প্রকাশ করা যায়। সব ক্রন্দন? তো, বাক্যগুলো সংশোধন করতে গিয়ে ভাবলাম, আরও কিছু চরিত্র ঢোকালে মন্দ কী!’

‘আপনার উদ্দেশ্য মহৎ আমরা বিশ্বাস করি। আপনার কি কখনও মনে হয় না, তাৎক্ষণিক আবেগ ও তাড়াহুড়োয় আপনি ভুল কৌশলের শিকার হয়েছেন! যেমন অহিন্দু সুরঞ্জন হিন্দু হয়ে উঠল, বাংলাদেশকে গালি দিল,দেশ থেকে পালিয়ে যেতে চাইল, ধর্ষণের মত অপরাধ করে বসল। আপনার লেখায় আগে এমন পরাজয়মনস্কতা দেখিনি। আপনিও কি হার মানছেন?’

‘আমি কৌশলে বিশ্বাসী নই। ডিসেম্বরের সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাস আমি নিজ চোখে দেখেছি। লজ্জা আমার তাৎক্ষণিক আবেগের ফসল নয়। এটি আমাদের সকলের পরাজয়ের ইতিহাস। এটি আমাদের সবার লজ্জা। সবার গ্লানি। যে কোনও সুস্থ সচেতন মানুষের জন্য এই পরাজয় অত্যন্ত মর্মান্তিক। মানুষ সুরঞ্জন হিন্দু হয়ে উঠছে, মানুষ হায়দার মুসলমান হয়ে উঠছে, দুটোই একই রকম গ্লানিকর। মনুষ্যত্বের চেয়ে ধর্ম যখন প্রধান হয়ে উঠছে, আমি তখনই দায়িত্ব অনুভব করেছি প্রতিবাদের। লজ্জা লেখার অনেক আগে থেকেই আমি প্রতিবাদ করছি এসবের। ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতা আর সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে লজ্জা হচ্ছে তীব্র প্রতিবাদ। লজ্জায় সুরঞ্জনের বাংলাদেশকে গালি দেওয়া মানে ভাষা আন্দোলন করা, মুক্তিযুদ্ধ করা সাহসী প্রত্যয়ী সেকুলার বাংলাদেশের ধীরে ধীরে ইসলামি হয়ে ওঠা, সাম্প্রদায়িক হয়ে ওঠাকে গালাগাল। রাষ্ট্রের কাঠামো থেকে সত্যিকার গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা আর বাঙালি জাতীয়তাবাদ ঝরে গেলে সুস্থ সচেতন যে কোনও মানুষ সে কায়সার হোক, সুরঞ্জন হোক বাংলাদেশকে গালি দিতেই পারে। তারা দেশকে ভালবেসেই দেশের সমালোচনা করছে। তারা দেশকে গড়বে, আর দেশ যদি নষ্ট হয়ে যেতে থাকে, তবে গালি দেবে না! আসলে দেশ তো আর আপনাতেই নষ্ট হয় না, কিছু লোক নষ্ট করে দেশকে। কিন্তু সেই কিছু লোক যখন দেশের বেশির ভাগ মানুষকে প্ররোচিত করে নষ্ট করতে, তখন দেশের সৌন্দর্য বলে কিছু আর থাকে না। দেশ আর দেশ থাকে না। সুরঞ্জন তার দেশকে ভালবাসে বলেই কষ্ট পায়, গাল দেয়। এ তার মাতৃভূমি বলেই সে দাবি করে নিরাপত্তা, মান সম্মান। সুরঞ্জনের ব্যর্থতা, পালিয়ে যাওয়া, মুসলমান মেয়ে ধর্ষণ করা, এগুলো কি আমি চাই? চাই না। চাই না বলেই আমি তার অধঃপতনের, তার সর্বনাশের প্রতিবাদ করি। চাই না বলেই আমাকে লজ্জা লিখতে হয়। আমারও তো প্রশ্ন, সুরঞ্জনরা যাচ্ছে কেন? বাংলাদেশকে অনেক হিন্দু ভারতে চলে গিয়ে হিন্দু মৌলবাদী দলে নাম লেখাচ্ছে। কেন? সুরঞ্জনের মত প্রতিভাবান দেশপ্রেমিক ছেলে কেন দেশ ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য হয়? ্‌দেশে থেকে লড়াই করবার মনোবল সুরঞ্জনরা হারাচ্ছে কোথায়? আমার জিজ্ঞাসা তো এটিই। এই প্রশ্নের কোনও উত্তর সরকারের কাছে নেই বলে লজ্জা নিষিদ্ধ করতে হয়। ছাই দিয়ে ঢাকতে হয় আগুন।

আমি পরাজয় মানিনা। মানিনা বলেই আমাকে লজ্জা লিখি। লজ্জা আমার সমাধান নয়। লজ্জা আমার প্রতিবাদ। পরাজয়মনস্ক কখনও ছিলাম না। এখনও নই। বৈষম্য তুলে ধরবার কারণ, এই বৈষম্য আমি মানতে চাই না। মানব না।’

‘সত্যি কি এভাবে হিন্দুরা বাংলাদেশকে গালি পাড়ে? কথায় কথায় অভিশাপ দেয়?’ ‘সুরঞ্জন আর সাধারণ হিন্দুর মত ছিল না। সুরঞ্জনের কোনও ধর্ম বিশ্বাস ছিল না। নাস্তিক ছিল সে। কিন্তু সুরঞ্জনকেই হিন্দু বলে চিহ্নিত করেছে তার আশেপাশের সাম্প্রদায়িক লোকেরা। দেশ নিয়ে সুরঞ্জনের অনেক স্বপ্ন ছিল। সেই স্বপ্ন ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যায়। সুরঞ্জনের মন এমনই বিষাক্ত হয়ে ওঠে যে সে দেশকে গাল দেয়। সুরঞ্জন কোনও বৈষম্য মানতে চায় নি বলে গাল দিয়েছে। অনেক হিন্দুই আছে, বৈষম্য দেখেও মুখ বুজে থাকে। মনে মনেও দেশকে গাল দেওয়ার সাহস নেই। হয়ত প্রশ্ন করতে পারেন, গাল দেওয়াকে আমি পছন্দ করি কী না। না অবশ্যই না। কিন্তু সুরঞ্জন দেয় কেন গালি, যে সুরঞ্জন তার দেশকে খুব ভালবাসত! এর পেছনে নিশ্চয়ই কারণ আছে, কারণগুলো আলোচনা না করে একটি বিভ্রান্ত শোকে দুঃখে ক্ষোভে উন্মাদ হয়ে যাওয়া এক প্রতারিত ছেলে মুখে কি উচ্চারণ করল, সেটি বড় বিষয় হয় কেন!’

‘আমাদের মনে হয় গোটা উপমহাদেশ আজ ভয়ংকর অসুখে আক্রান্ত। বিবেক কোথাও কোথাও স্তব্ধ। বিভ্রান্ত। বিভ্রান্তির হাত থেকে আপনারও কি রেহাই নেই?’

‘লজ্জায় আমার বিবেক সবচেয়ে বেশি শুদ্ধ। পরিষ্ফুট। স্পষ্ট।’

মাত্র সাতদিন আগে সিলেটের সাহাবা সৈনিক পরিষদ একটি ফতোয়া দিয়েছে আমার বিরুদ্ধে। ফতোয়া প্রসঙ্গও তোলেন বাহারউদ্দিন।

‘রুশদি নিজের লেখার পক্ষে দাঁড়ান নি। ক্ষমা চাইলেন। কলমা পড়ে মুসলমান হলেন। আপনার অবস্থা রুশদির চেয়ে করুণ। আপনার পাশে সরকার নেই। বিরোধীরাও নেই। লেখকরাও মুখটি সেলাই করে বসে আছে। আপনি এত একা কেন? একাকীত্ব, ভেতর বাইরের চাপ আপনাকে যদি ক্ষমা চাইতে বাধ্য করে, কী করবেন?’

‘আমি একা নই। হাজার হাজার পাঠক আছে আমার। আমি যে কথা লিখি, তা সরকারের কাছে যেরকম অগ্রহণযোগ্য, বিরোধীদলের কাছেও সেরকম। দু দলের কেউই ধর্ম বিসর্জন দেবে না। ধর্ম তাদের খুব বড় হাতিয়ার। প্রগতির পক্ষের লেখকরা মুখ সেলাই করে বসে আছেন, এ কথা সত্য নয়। লেখক শিবির, সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট সিলেটের ফতোয়াবাজ মৌলানাদের তীব্র নিন্দা করেছে। লজ্জা নিষিদ্ধ হওয়ার পর অনেক লেখকই সরকারের সাম্প্রদায়িক আচরণের প্রতিবাদ করেছেন। যারা মুখ খোলে না, তারা কোনও কিছুতেই মুখ খোলে না। কোনও ঝুঁকিই নেয় না। উজানে চলবার মন সবার থাকে না। যেদিকে হাওয়া সেদিকে ছুটবার প্রবণতা বেশির ভাগ মানুষের। ক্ষমা আমি কোনওদিনই চাইব না। রুশদি চেয়েছেন, সে রুশদির নির্বুদ্ধিতা। আমি মরে যাবো, কিন্তু কখনও ক্ষমা চাইব না।’

‘বিপদ এলে দেশ ছেড়ে পালাবেন, অন্য কোনও দেশে আশ্রয় খুঁজবেন?’

‘আমি কি কম বিপদের মধ্যে আছি! যত বিপদই আসুক, আমি কখনও দেশ ছেড়ে পালাবো না। আমার ফাঁসির জন্য মোল্লারা একজোট হচ্ছে। আমি তবু শক্ত পায়ে দাঁড়িয়ে আছি। আমার আদর্শে আমি চিরদিনই অটল থাকব।’

‘আপনার কি মনে হয় বাংলাদেশে লড়াইয়ের শক্ত জমিটি নড়বড়ে হয়ে উঠছে? ঘাতক জামাতের হাতে আপনার কি মনে হয় না তুলে দিলেন নৃশংস একটি অস্ত্র?’

‘শক্ত জমিটি খুব নড়বড়ে হয়ে গেছে — এ কথা আমি মানি না। চারদিকে যখন বিরুদ্ধ পরিবেশ, একটি বিন্দু থেকেও তখন লড়াই হয়। হতে পারে। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ তা-ই প্রমাণ করে। আমরা যারা মুক্তবুদ্ধি, যুক্তিবাদ ও মানববাদে বিশ্বাসী, তারা লড়াই করছি। লড়াই আমাদের থামবে না। জামাতে ইসলামির হাতে অস্ত্র তুলে দিয়েছি, এ কথা এখানকার কোনও শত্রুও বলে না। আপনারাই বলছেন। একই রকম লজ্জা সম্পর্কে এখানকার মৌলবাদিরা যা বলছে, ঠিক একই কথা ওখানে আপনারা বলছেন। স্বাধীনতার শত্রু জামাতিদের বিরুদ্ধে আমরা লড়াই করছি। লজ্জা তাদের মাথা তুলে দাঁড়াবার অস্ত্র নয়, লজ্জা তাদের মাথা নুইয়ে দেবার অস্ত্র। দেশ জুড়ে জামাতে ইসলামির রাজনীতি নিষিদ্ধের দাবি উঠছে। এই ধর্মব্যবসায়ীদের হাতে মধ্যপ্রাচ্যের টাকা আর অস্ত্র, তারা নতুন প্রজন্মের হাতেও অস্ত্র আর টাকা দিচ্ছে অঢেল, বিভ্রান্ত করছে আমাদের যুব সমাজকে। দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় জামাতে ইসলামির ছাত্র সংগঠন শিবিরের সন্ত্রাস ভয়ংকর হয়ে উঠছে। আমরা বাহান্নর ভাষা আন্দোলন আর একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ করা জাতি, আমরা কিছুতেই এই মাটিকে অপবিত্র হতে দেব না।’

এ তো গেল। কিন্তু তারপরও পশ্চিমবঙ্গের কিছু কিছু বামপন্থী লজ্জা উপন্যাসটির নিন্দা এতটুকু কমাননি। কিন্তু এঁদের মুখই হাঁ হয়ে থাকে, যখন কমিউনিস্টদের গুরু, স্বয়ং নাম্বুদ্রিপাদ লজ্জাকে একটি খুব মূল্যবান বই বলে উল্লেখ করেন। সংখ্যাগুরুর মানুষ হয়ে সংখ্যালঘুর পক্ষে দাঁড়িয়েছি, এই ব্যপারটিকে তিনি অভিনন্দন জানান। এবং নান্দনিক বিচারে যারা বলছিল বইটি নিকৃষ্ট, তাদের গালেও তিনি একটি শক্ত চড় কষিয়ে দেন। (নাম্বুদ্রিপাদ নান্দনিক বিষয় আমার চেয়ে ভাল বোঝেন হয়ত, কিন্তু আমার যতটুকু জ্ঞান আছে, তাতে আমি স্পষ্ট বুঝি যে বইটি নান্দনিক বিচারে সত্যিই নিকৃষ্ট।)

আনন্দবাজার পত্রিকা এবং আজকাল এদুটো পশ্চিমবঙ্গের বড় পত্রিকা। আজকাল পত্রিকাটি বামঘেঁষা, আনন্দবাজার ঠিক কী ঘেঁষা আমার পক্ষে বোঝা সম্ভব হয় না। তবে একটি জিনিস টের পাই, আনন্দবাজারের নাক খানিকটা উঁচু। আজকালের চেয়ে বেশি চলে বলে সম্ভবত। আনন্দবাজার লেখক তৈরি করে না, তৈরি হওয়া লেখকদের ছাপে।

এদিকে বাংলাদেশের মৌলবাদী দল, কেবল মৌলবাদী নয়, আহমদ ছফা এবং ফরহাদ মজহারের যৌগবাদী দলও যাঁরা আনন্দবাজার গোষ্ঠীকে হিন্দু মৌলবাদী গোষ্ঠী বলে বিশ্বাস করে, এবং আমি আনন্দ পুরষ্কার পেয়েছি বলে আমাকে হেন কুকথা নেই যে বলেননি, তাঁরা নিশ্চয়ই পড়ার সুযোগ পাননি আনন্দবাজার পত্রিকার ১৫ অক্টোবর তারিখের সম্পাদকীয়। শিরোনাম তসলিমা ও সঙ্ঘ পরিবার। ‘বাবরি মসজিদের পর ভারতীয় জনতা পার্টি এবার আর এক খেলায় মাতিয়াছে। শুধু ভারতীয় জনতা পার্টি নয়, সঙ্ঘ পরিবার এবার বাংলাদেশের প্রতিবাদী লেখক তসলিমা নাসরিনকে লইয়া এক হীন চক্রান্ত শুরু করিয়াছে। তসলিমা নাসরিনের লজ্জা নামক উপন্যাসটি সরকারি হুকুমে বাংলাদেশে নিষিদ্ধ বই। ভারতীয় জনতা পার্টি সম্পূর্ণ বেআইনিভাবে, লেখকের অনুমোদন না লইয়া এই বইটি হিন্দিতে অনুবাদ করিয়া নিজেদের এক পত্রিকায় প্রকাশ করিতেছে। এই চৌর্যবৃত্তিতে তাহাদের বিন্দুমাত্র লজ্জাবোধ নাই। বরং আগাম জানাইয়া দেওয়া হইয়াছে, বইটির ইংরাজি অনুবাদও তাহারা দলীয় পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ করিবে। শুধু তাহাই নহে, এই দল এবং তাহার অনুগামী বা পুরোগামী হিন্দু মৌলবাদী গোষ্ঠীগুলি নাকি চারটি রাজ্যের আসন্ন অন্তর্বর্তী নির্বাচনে তসলিমা নাসরিনের উপন্যাসটিকে কাজে লাগাইতে পারে। গান্ধী যুগের পর ভারতীয় রাজনীতিতে নীতিবোধ আদর্শনিষ্ঠা, সততা বা শুদ্ধাচার অবশ্যই ক্রমশ বিলুপ্তির পথে। নীতিহীন রাজনীতি কোন পর্যায়ে নামিতে পারে তাহার নতুন প্রমাণ রচনা করিল হিন্দু মৌলবাদীদের এই সব গোষ্ঠী এবং দল। যে সাহসী লেখক মৌলবাদীদের বিরুদ্ধে বেপরোয়া লড়াই চালাইতে গিয়া কার্যত গৃহবন্দী, মুসলিম মৌলবাদী গোষ্ঠী যাঁহার প্রাণদণ্ডের দাবিতে সরব, যাঁহার দেশের সরকার এ ব্যপারে নির্বাক দর্শকের ভূমিকায়, তাঁহাকে প্রতিবেশী দেশের হিন্দু মৌলবাদীরা যখন নিজেদের হীন মতলব হাসিল করিবার জন্য কাজে লাগাইতে উদ্যত তখন বুঝিতে হয়, কপটতা এবং মিথ্যাচার ভারতে একটি প্রধান রাজনৈতিক দলকে কীভাবে গ্রাস করিয়াছে। এই উপমহাদেশে এবং দেশের বাহিরে তসলিমা নাসরিনের লক্ষ লক্ষ পাঠক জানেন, তাঁহার দুঃসাহসিকতার লড়াই শুধু নারীর মর্যাদা প্রতিষ্ঠার জন্য নয়, মানবতার মহত্তম আদর্শে অনুপ্রাণিত এই লেখক সর্বপ্রকার সংকীর্ণতা, ধর্মীয় গোড়ামি ও কুসংস্কার এবং হিন্দু মুসলিম নির্বিশেষে সমস্ত মৌলবাদের বিরুদ্ধে এক আপসহীন সংগ্রামী। বাবরি মসজিদ ধ্বংসের পর বাংলাদেশে যাহারা ধ্বনি তুলিয়াছিলেন, আযম আডবাণী ভাই ভাই, তসলিমা নাসরিন সেই মুক্তদৃষ্টি, সাম্প্রদায়িক মৈত্রীকামী এবং ফ্যাসিবাদবিরোধী প্রগতিশীল বাংলাদেশিদেরই একজন। সঙ্ঘ পরিবার কোন নৈতিকতার বলে তাঁহার রচনাকে নিজেদের সংকীর্ণ স্বার্থসিদ্ধির কাজে ব্যবহার করিতে দুঃসাহসী? এই নির্লজ্জ আচরণের তুলনা নাই। অথচ আশ্চর্য ঘটনা এই, তসলিমা নাসরিনের উপন্যাস লইয়া বিজেপি ও সঙ্ঘ পরিবার যখন অভিসন্ধিমূলক যদৃচ্ছ অপকর্মে ব্যস্ত, এ দেশের গণতন্ত্রী, ধর্মনিরপেক্ষ রাজনৈতিক দলগুলি তখন সম্পূর্ণ নীরব। তসলিমা নাসরিনের মাথার দাম ঘোষিত হইবার পর এ দেশের অনেক মহিলা সংগঠন এবং লেখক বুদ্ধিজীবীদের একাংশ তাহার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাইয়াছেন। কিছু কিছু বিক্ষোভ বিবৃতিও দেখা গিয়াছে। তাহা যথেষ্ট কি না সে প্রশ্ন অবশ্য থাকিয়াই যায়। কিন্তু সঙ্ঘ পরিবার তাঁহার বইটিকে লইয়া যে কদর্য কাণ্ড চালাইতাছে, এ যাবৎ তাহার বিরুদ্ধে কোনও প্রতিবাদ হইয়াছে বলিয়া শোনা যায় নাই। অথচ ভারতীয় জনতা পাটিং এবং সঙ্ঘ পরিবারের বিরুদ্ধে নাকি আমাদের দেশের ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক দলগুলি খুবই তৎপর! সঙ্ঘ পরিবারের এই কৌশলটি তাঁহাদের দৃষ্টি এড়াইয়া গেল, কোনও প্রতিবাদ বা প্রতিকারের কথা কোনও মহল হইতে উচ্চারিত হইল না, ইহা কি বিস্ময়কর নয়? তসলিমা নাসরিন অযোধ্যাকাণ্ডের পর যদি কিছু সত্য উচ্চারণ করিয়া থাকেন, তবে সঙ্গে সঙ্গে এ প্রশ্নও অবশ্যই উঠিতে পারে, সেদিনের বাংলাদেশের ওই পরিস্থিতির জন্য সঙ্ঘ পরিবারের যে স্থূল হাত বাবরি মসজিদ ধ্বংস করিয়াছে তাহাও কি দায়ী নয়? শুধু বাংলাদেশ কেন, বাবরি মসজিদ ধ্বংসের পর এই দেশে যত কিছু কাণ্ড ঘটিয়াছে তাহার দায়ই বা হিন্দু মৌলবাদীরা অস্বীকার করিবে কেমন করিয়া? অথচ এই ভণ্ডদের এমনই ঔদ্ধত্য যে বাংলাদেশের সংখ্যালঘুদের তরফে তসলিমা নাসরিনের সাহসী, মানবিক দলিলটি আজ তাহারা এ দেশের তথাকথিত হিন্দু জাগরণের সপক্ষে ইস্তাহার হিসাবে ব্যবহার করিতে চায়? তসলিমা নাসরিন স্পষ্ট ভাষায় ওই বইয়ের প্রথম পৃষ্ঠা হইতে শুরু করিয়া শেষ পৃষ্ঠা পর্যন্ত জানাইয়া গিয়াছেন, লজ্জার বলিষ্ঠ প্রতিবাদ সব ধর্মের মৌলবাদীদের অধার্মিক এবং অমানবিক আচরণের বিরুদ্ধে। দুঃখের বিষয়, কিছু তথাকথিত বুদ্ধিজীবী এবং বিজ্ঞ কলমধারী এই পরিণতির জন্য দায়ী করিতেছেন লজ্জার লেখক তসলিমা নাসরিনকেই। তাঁহাদের একটি বক্তব্য, তসলিমা নাসরিন কি এ সময়ে এ বই না লিখিলেই ভাল করিতেন না? আমাদের বুদ্ধিজীবীরা আজ কোন পর্যায়ের জীবে পরিণত, এই একটি ধারণা হইতেই তাহার ইঙ্গিত মেলে। বুদ্ধিজীবীদের একাংশের এই পরামর্শ যদি সর্বদেশে সর্বকালে অতি অসাবধানী লেখকরা মানিয়া লইতেন, তবে পৃথিবী হয়ত অনেক যুগান্তকারী রচনা হইতেই বঞ্চিত হইত। তাঁহাদের আর এক বক্তব্য, তসলিমা নাসরিন বাংলাদেশের প্রগতিশীল, ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক শক্তিগুলিকে তাঁহার গ্রন্থে পরোক্ষে অপমান করিয়াছে। ইহাও অসত্য। সত্য ঘটনা এই, তাঁহাদের সদিচ্ছা, আন্তরিকতা, সাহসিকতা থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশের সংখ্যালঘুদের একাংশ বাবরি মসজিদের ঘটনার পর অপমানিত, অত্যাচারিত। প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবীদের আপৎকালে যে সীমাবদ্ধতা বারবার দেখা যায়, তসলিমা নাসরিনের রচনা সে দিকেই অঙ্গুলি নির্দেশ করে। বস্তুত, তাঁহার বিরুদ্ধে বি জে পির পৃষ্ঠপোষণার অভিযোগ না আনিয়া আমাদের অতিবুদ্ধিমান বুদ্ধিজীবীদের বোধহয় উচিত ছিল সন্ধানী আলোটি একবার নিজেদের দিকে ঘোরানো। তসলিমা বাংলাদেশের সংখ্যালঘুদের পরিস্থিতি উদঘাটন করিয়াছেন। আমরা কি এ দেশে সেই উদ্যোগ গ্রহণ করিতে পারিতাম না? দাঙ্গার সময় এ দেশের সংখ্যালঘুদের মানসিক অনুভূতি কী, সে কথা আমরা কয়জন বুঝিবার চেষ্টা করিয়াছি? সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির নামে আমরা মিছিল করি, বিবৃতি দিই, পোস্টার ছাপাই, ইস্তাহার বিলি করি – সবই ঠিক। প্রগতিশীল সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী মানুষের সংখ্যা অগণ্য, ইহাও ঠিক। তাহা সত্ত্বেও বামপন্থী রাজত্বের মধ্যেও সেদিন কি এই রাজ্যেই বেশ কিছু মানুষ দাঙ্গায় প্রাণ হারান নাই? এই প্রশ্ন তুলিলে যদি আমাদের দেশের প্রগতিশীল শক্তি এবং বুদ্ধিজীবী মহলের অবমাননা না হয়, তবে তসলিমা নাসরিনের বেলাতেই বা তাহা অপরাধ হইবে কেন? তসলিমা নাসরিন অতএব আমাদের লজ্জা নয়, আমাদের প্রকৃত লজ্জা বুদ্ধি এবং কপট যুক্তির ছলে ভাবের ঘরে এই চুরি।’
 
২১. মানবরূপী শয়তান



নির্বাচিত কলাম বেরিয়েছে একানব্বই সালে ফেব্রুয়ারিতে। আটানব্বই আর নব্বই সালে লেখা কলামগুলো নিয়ে। কলামগুলো নির্বাচিত না বলে প্রাপ্ত বলা যায়। খোকা যে কটি কলাম সংগ্রহ করতে পেরেছিলেন, সেগুলোই বইয়ে দিয়েছেন। অনেক লেখাই হারিয়ে গিয়েছে। আমি লেখাগুলো জমিয়েও রাখিনি, কারণ বই হয়ে কখনও বেরোবে এই স্বপ্নও তো কোনওদিন দেখিনি। বইটি বেরোবার পর যারা বইএর লেখার সঙ্গে এক মত হতে পারেননি, তাঁরা পত্রিকায় বিস্তর লেখালেখি করেছেন। কেউ কেউ আবার অতি উৎসাহে গোটা বই লিখে ফেলেছেন। বইগুলোর কিছু কিছু হাতে আসে, কিছু আসে না। তিরানব্বইএর ফেব্রুয়ারিতে জ্ঞানকোষের প্রকাশক উচিত জবাব নামে একটি বই আমাকে দিলেন। লেখকের নাম মোঃ মোকাদ্দেস হোসাইন। নির্বাচিত কলাম পুরোটাই ছেপে, আমার প্রতিটি রচনার নিচে তাঁর নিজের মন্তব্য সেঁটে মোকাদ্দেস হোসেন বই বের করেছেন। নির্বাচিত কলাম তো বিক্রি হচ্ছেই, উচিত জবাবও নাকি কম নয়। নির্বাচিত কলামের চেয়ে উচিত জবাব দশ টাকা কম, বিক্রি না হবার কোনও কারণ নেই, পাঠক কম দামে আমার লেখাগুলো পাচ্ছে, বাড়তি একটি জিনিসও পাচ্ছে, সে মন্তব্য। এ বই যে কিনবে, তার আর নির্বাচিত কলাম কেনার দরকার নেই, কারণ এই বইএর ভেতরেই আমার পুরো বইটিই আছে, প্রকাশক বললেন। প্রকাশক ব্যবসার কথা ভাবলেন। আমি ব্যবসার কথা নয়, ভাবলাম মোকাদ্দেস হোসাইনের অসততার কথা। গ্রন্থসত্ত্র আইন বলে কোনও আইন এ দেশে আছে কি না সে ব্যাপারে আমার জানতে আগ্রহ হয়। নাহিদের কাছে জানতে চাই ও জানে কি না এ বিষয়ে। মেয়েটি আইন নিয়ে লেখাপড়া করেছে, আমার বাড়িতে প্রায়ই আসে। এমনি আসে। আমার লেখা ভাল লাগে বলে আসে। ওই নাহিদই একদিন অতি উৎসাহে বলল মামলা করার কথা। মামলা সম্পর্কে আমার চেয়ে কম জানোয়া আর কেউ আছে বলে আমার মনে হয় না। ব্যপারটিতে জড়াতে আমি গড়িমসি করি, কিন্তু নাহিদ বলে যে আমার কোনও সাতে পাঁচে না থাকলেও চলবে, সে নিজে রাবেয়া ভূঁইয়াকে দিয়ে মামলা করাবে। কিন্তু! কিন্তু কি! শুনেছি মামলায় নাকি কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা যায়! নাহিদ রাবেয়া ভূঁইয়ার সঙ্গে দেখা করে এসে আমাকে জানিয়ে দিল, ব্যারিস্টার কোনও টাকা নেবেনই না। রাবেয়া ভূঁইয়াকে লোকে চেনে। তিনি একসময় আইন মন্ত্রী ছিলেন। এমন নামী ব্যারিস্টার গ্রন্থস্বত্ত্ব আইন ভাঙার অপরাধে উচিত জবাবের প্রকাশকের বিরুদ্ধে লড়বেন, টাকা পয়সা ছাড়া লড়বেন, আর আমার মোটে কিμছু করতে হবে না, হোক না! রাজি হই। রাজি হওয়ার পর পরই অবশ্য নাহিদের অনুরোধ একটু একটু করে তীব্র হতে থাকে, একদিন দেখা অন্তত করুন, এ কাজে ও কাজে কেরানিকে টাকা পয়সা দিতে হবে, দিন। আমাকে নিয়ে রাবেয়া ভূঁইয়ার সঙ্গে একদিন দেখা করিয়েও আনল। গ্রন্থস্বত্ত্ব আইনের কথা তখন তাঁর মুখেই শুনি যে বই এর স্বত্ত্ব নিয়ে এ দেশে এ অবদি কেউ মামলা করেনি। হয়ত ইট কাঠ আম কাঁঠাল এমনকি আমস্বত্ত্বেরও স্বত্ত্ব থাকে, কিন্তু গ্রন্থের থাকে না। আইনত, বইএর প্রথম পৃষ্ঠায় যার নামই থাক গ্রন্থসত্ত্বাধিকারী হিসেবে, রচয়িতার রয়্যালটি সেই সত্ত্বাধিকারির হাতে কেউ পৌঁছোবে না যতক্ষণ না সত্ত্ব্বাধিকার নিবন্ধিভূক্তি হচ্ছে। রাবেয়া ভূঁইয়া আমাকে পাঠালেন শেরে বাংলা নগরের গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের সত্ত্বাধিকার আপিসে স্বত্ত্বাধিকার নিবন্ধিকরণের জন্য। মার্চের ষোল তারিখে আবেদন করলাম, নথিভুক্ত হয়ে বেরোল মে মাসের পনেরো তারিখে। রাবেয়া ভূঁইয়া এরপর মামলার আরজি লিখে নিজেই পুরোনো ঢাকার দায়রা জজ আদালতে যাতায়ত শুরু করলেন। আরজির বিষয়, নকল বইটির প্রকাশনা, পরিবেশনা, মুদ্রণ ও বাজারজাতকরণ নিষিদ্ধ করা হোক। যুক্তির কথা, কারণ ওই লোককে আমি অনুমতি দিই নি নির্বাচিত কলামের অ থেকে চন্দ্রবিন্দু পর্যন্ত নতুন করে তাঁর বইয়ে ছাপতে। লেখা থেকে উদ্ধৃতি দিতে চাও দাও, সমালোচনা করতে চাইলে থান ইটের আকারে পুরো সমালোচনার বই বের করা যায়, আহমদ ছফা এবং অন্যরা যেমন করেছেন। সমালোচনার নামে যে গালাগাল করা হয়েছে আমাকে, সেটি আমাকে আহত করেনি, অহরহই এমন গালাগাল ইনকিলাব জাতীয় পত্রিকার পাতা জুড়ে প্রকাশ হয়, এ নতুন কিছু নয়। আর গাল কারা দিচ্ছে, কেন দিচ্ছে সে ব্যাপারে আমার ধারণা আছে বলেই আমার গায়ে পায়ে কোথাও কোনও দাগ পড়ে না, মনে তো নয়ই। কিন্তু আমার বইটি চুরি করবে কেন! মামলা নিয়ে নাহিদের উত্তেজনা এমনই লাগামছাড়া হয়ে ওঠে যে মামলার শুনানির দিন একবার আমাকে তার জোর জবরদস্তিতে যেতেই হল আদালতে। আদালত জুড়ে মহাদাপটে বিচরণ করছেন অসংখ্য টুপি দাড়িঅলা লোক। মোকাদ্দেস হোসাইন তাঁর সাঙ্গ পাঙ্গ নিয়ে আদালতে উপস্থিত। বিবাদির পক্ষে ব্যারিস্টার কোরবান আলী লড়ছেন। ব্যারিস্টার কোরবান আলী তাঁর জীবনটি ইতিমধ্যে কোরবান করে দিতে চাইছেন আমার বিরুদ্ধে লড়ে। পত্রিকায় আমার বিরুদ্ধে বক্তব্য বিবৃতি যখনই বেরোয়, ব্যারিস্টার কোরবান আলীর নামটি জ্বলজ্বল করে। যোগ্য ব্যারিস্টার বটে উচিত জবাবের জন্য। আমাকে উচিত শাস্তি না দিয়ে তিনি ছাড়বেন না। শেষ পর্যন্ত যা হল তা দুঃখজনক। মামলা আমার পক্ষে যায়নি। আমার আরজিই বাতিল বলে ঘোষণা করা হল। এরপর মোকাদ্দেস হোসাইন কেবল উচিত জবাব বইটি বাজারে পূনর্মুদ্রণ করে ক্ষান্ত হননি, দুপক্ষের আরজি আর আরজির জবাব ছেপে লিফলেটও বিলি করতে লাগলেন। একটি লিফলেটে লেখা, ‘ প্রিয় মুসলমান ভাই ও বোনেরা! মানবরূপী শয়তান হতে সাবধান!! উচিৎ জবাবের লেখক মুহম্মদ মোকাদ্দেস হোসাইন কী এমন জবাব দিলেন যে বিজাতীয় বিধর্মীদের কর্তৃক আনন্দ পুরষ্কৃত চরম ইসলাম ও পরম পুরুষবিদ্বেষী তসলিমা নাসরিনের সোঁচালো কলম এমনই ভোঁতা হয়ে গেছে যে তিনি লেখার জবাব লেখনীর মাধ্যমে না দিতে পেরে শেষে বাধ্য হয়েছেন উচিৎ জবাবের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলার আশ্রয় নিতে। উচিৎ জবাব এখন ফটোকম্পোজের চেয়েও নিখুঁত ঝকঝকে ও তকতকে টাইপে পরিবর্ধিত, পরিমার্জিত ও আরো অকাট্য যুক্তি নির্ভর জবাবে প্রকাশিত হয়েছে — যাতে পাবেন নির্বাচিত কলাম নামের বিতর্কিত বইটির প্রতিটি কলামের নিচে তার দাঁত ভাঙা উচিৎ জবাব..!!’ আমার আরজির জবাবে বিবাদিগণেরও পক্ষ থেকে ব্যারিস্টার কোরবান আলী বলেছেন, ‘বিবাদিগণ বাদিনীর অশ্লীল, অশ্রাব্য, অসামাজিক, নোংরা, ধর্ম-বিরুদ্ধ, দেশদ্রোহী ও কুরুচিপূর্ণ যৌন আবেদনে ঠাসা ভরপুর এহেন জঘন্য পুস্তক নকল করার হীন উদ্দেশ্যে কোনও গ্রন্থ রচনা করেন নাই, বরং এ জাতীয় ধৃষ্টতাপূর্ণ লেখার তীব্র সমালোচনা করিয়া চিরাচরিত রীতিতে জবাব দিয়াছেন। বাদিনী কপিরাইট অফিসকে ভুল বুঝাইয়া এই কুরুচিপূর্ণ পুস্তক এর কপিরাইট নিবন্ধন করিয়াছেন। এই ধরনের পুস্তক প্রকাশনা ও বিতরণ বাংলাদেশ দন্ডবিধির ২৯২ ধারা অনুযায়ী শাস্তিযোগ্য অপরাধ। সাহিত্য চর্চার মাধ্যমে অসৎ উদ্দেশ্যে সমাজে বিশৃংখলা সৃষ্টির লক্ষ্যে সভ্য সমাজকে বাদিনী অসভ্যতার দিকে নিয়া যাইতেছে। বিবাদির পরিচয়, ১ নং বিবাদি একজন প্রথিতযশা লেখক ও প্রকাশক, তিনি ছাত্র জীবনে একজন মেধাবী ছাত্র হিসাবে সুখ্যাতি লাভ করেন। তিনি জীবনের শুরুতেই মেধাবী ছাত্র হিসাবে বরাবরই সরকারি বৃত্তি লাভ করিয়া আসিয়াছেন। তিনি মাধ্যমিক স্কুল সার্টিফিকেট পরীক্ষায় ৫ টি লেটার সহ স্টারমার্ক ও স্কলারশিপ পাইয়া খ্যাতি অর্জন করিয়াছিলেন। তিনি দেশের খ্যাতনামা বিদ্যাপীঠ ঢাকা কলেজ থেকে ১ম বিভাগে আই.এস.সি পাশ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নের পাশাপাশি লেখালেখি ও প্রকাশনা শিল্পের সঙ্গে জড়াইয়া পড়েন। ১৯৮৭ ইং সন থেকেই বই লেখায় তিনি মনোনিবেশ করেন। বর্তমানে ৯ম ও ১০ম শ্রেণীর নীহারিকা মাধ্যমিক ভূগোল গাইড, নীহারিকা মাধ্যমিক সাধারণ বিজ্ঞান গাইড ১ম পত্র ও ২য় পত্র ইত্যাদি পুস্তক সমূহের তিনি সফলকাম রচয়িতা ও প্রকাশক। তাহার প্রকাশিত ৬ষ্ঠ শ্রেণী থেকে ৮ম শ্রেণীর বাংলা ও ইংরেজি সাহিত্যের গাইড বই জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড কর্তৃক অনুমোদল লাভ করিয়াছে। তিনি জাতি গঠনে গঠনমূলক ও সৃজনশীল লেখার দ্বারা কিশোর ও তরুণদের দিক নির্দেশনা দিয়া জাতির খেদমতে ব্যাপৃত আছেন। তিনি বর্তমানে বাংলাদেশ সৃজনশীল লেখক পরিষদের সহকারী সম্পাদকের পদে অধিষ্ঠিত থেকে বাংলাদেশের সৃজনশীল লেখক লেখিকাদের কল্যাণে নিয়োজিত আছেন।’

বাকি বিবাদিগণও বেশ সম্মানীয় বটে। তাঁদের বক্তব্য, ‘বাদিনী বিভিন্ন কলামে ইসলাম ধর্মকে কটাক্ষ করিয়া কথা বলিতে দ্বিধা করেননি, এমনকি পবিত্র কোরান শরিফ ও হাদীস শরিফের বিকৃত ব্যাখ্যা পর্যন্ত করিয়াছেন। পবিত্র কোরান শরিফকে কটাক্ষ করিয়া ইহাকে স্বামীদলভুক্ত পুরুষ রচিত বলিয়াছেন, ইহার পাঠক ও অনুসারীকে তিনি বর্বর ও মূর্খ বলিয়া গালি দিয়াছেন। বাদিনীর হঠাকারিতার মাত্রা এতই ভয়ানক যে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের বর্তমান সরকার সম্প্রতি বাধ্য হইয়াছেন তাহার লজ্জা নামক বইটি বাজেয়াপ্ত করিতে। পাশাপাশি সমাজ সচেতন বিভিন্ন মহলের জনগণের নিকট হইতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করিয়া বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় দাবী উঠিয়াছে বাদিনীর নির্বাচিত কলাম ও শোধ গ্রন্থ দুইখানি বাজেয়াপ্ত করিবার জন্য। সাম্প্রতিক সিলেট শহরে তথা দেশের সকল সচেতন জনগণের পক্ষ থেকে সাত দিনের মধ্যে তাকে বন্দী করার ও তার সমস্ত কর্ম বাজেয়াপ্ত করার জন্য জোর দাবী উঠেছে। অন্যথায় সিলেট শহর সহ দেশের বিভিন্ন শহরে এর প্রতিবাদে হরতালের ডাক পড়িয়াছে। বাদিনী তাহার বিভিন্ন কলামে নারী স্বাধীনতার নামে পুরুষের বিরুদ্ধে অযথা কটুক্তি ও লাগামহীন অশ্রাব্য ভাষা ব্যাবহার করিয়া শ্রেণী বিদ্বেষ সৃষ্টি করার যথেষ্ট প্রয়াস চালাইয়াছেন। শুধু তাহাই নহে, নারীদেরকে কোন অংশেই বা কোন কলামেই সম্মান না দেখাইয়া তাহাদেরকে কলুষিত করার চেষ্টা করিয়াছেন। বাদিনী তাহার লেখায় মুসলিম পরিবার, সমাজ ও ব্যক্তিবর্গকে অসম্মান করিবার এক জঘন্য ও হীন চেষ্টা চালাইয়াছেন। বাদিনী তাহার লেখায় দেশিয় প্রচলিত স্বাভাবিক নিয়ম নীতি ভঙ্গ করিয়া শালীনতা, ভদ্রতা লংঘন করিয়া কুরুচিপূর্ণ ও নগ্ন যৌন বিষয়ে আলোচনা করিয়া পাঠক সমাজকে বিভ্রান্তির দিকে ঠেলিয়া দিয়াছেন। নির্বাচিত কলামের শুরু হইতে শেষ পর্যন্ত দীর্ঘদিনের সমাদৃত মুসলিম সমাজ ব্যাবস্থার বিরুদ্ধে বিষোদগার করিয়াছেন বটে এবং যে কোন দিক নির্দেশনা না দিয়া কল্পিত নারী ঘটিত এক উলঙ্গপনা, বেহায়াপনা ও বেলেল্লাপনায় ভরপুর অসভ্য সমাজ রূপায়নের জন্য যথেষ্ট প্রয়াস চালাইয়াছেন। পুরুষের ধর্মীয় বিধান মোতাবেক একাধিক স্ত্রী অনুমতির প্রতি বাদিনী জঘন্যভাবে আক্রমণ করিয়াছেন। বিকল্প ব্যবস্থা হিসাবে একজন স্ত্রীর একাধিক স্বামীর উপস্থিতিও সমাজ ব্যবস্থার অংশ হিসেবে থাকার দাবী করিয়াছেন। যাহা ধর্মের দৃষ্টিকোণ থেকে স্ত্রীর জন্য জেনা এবং সামাজিক দৃষ্টিকোণ থেকে সকল মানুষের পিতৃ পরিচয় নিশ্চিহ্ন হইয়া যাইবে তদোপরি সুন্দর মানব জীবন ও স্মরাণাতীতকাল হইতে প্রতিষ্ঠিত মানব সভ্যতা ধুলায় মিশিয়া যাইবে। যে ষড়যন্ত্রের হোতা বাদিনী নিজে। বাদিনী তাহার উক্ত গ্রন্থে জরায়ুর স্বাধীনতার উপরও জোরালো বক্তব্য রাখিয়াছেন। জরায়ু নেহায়েতই নারীদের শরীরে একটি বিশেষ অংশ যার মাধ্যমে মানব জনম ও মানব সমাজের অস্তিত্ব টিকিয়া আছে। উক্ত তথাকথিত স্বাধীনতার সাথে বাদিনী আল্লাহর স্বাভাবিক সৃষ্টির প্রতি সরাসরি চ্যালেঞ্জ করিয়াছেন। যার মাধ্যমে বাদিনীর ধর্মচ্যূতি ঘটিয়াছে বিধায় কোরানের আলোকে মুরতাদ হিসাবে অভিশপ্ত সালমান রুশদির ন্যায় মৃত্যুদন্ডের শাস্তি পাওয়ার যোগ্যতা অর্জন করিয়াছে।’

উচিত জবাবের বিরুদ্ধে কোনও পদক্ষেপ নেওয়া আমার পক্ষে সম্ভব হয় না। উচিত জবাব বহাল তবিয়তে বিরাজ করে বাজারে। আদালতের মুরব্বীগণ আমার পক্ষে রায় দিয়ে উচিত জবাবকে একটি উচিত জবাব দেবার পক্ষে নন। আমি মানবরূপী শয়তান, তাঁরা আল্লাহর বান্দা, সৃষ্টির সেরা জীব। আমি কেন পেরে উঠব আল্লাহর দয়া যাদের ওপর, তাদের ব্যবসা নষ্ট করতে! আমার ওপর তো আল্লাহ তায়ালার করুণা বর্ষিত হয়নি।

উচিত জবাব হামেশাই দেওয়া হচ্ছে আমাকে। উচিত অনুচিত নিয়ে দুঃখ করে সময় নষ্ট করতে আমার আর ইচ্ছে হয় না। আমার সময়গুলো অন্যভাবে ব্যয় হতে থাকে। কারও জন্য কিছু করে। যা করতে চাই, যেমন করে করতে চাই তা করতে পারি না বলে লিখতে হয়। আমাকে আমূল তোলপাড় করা ভাবনা গুলোর কতটুকুই আর প্রকাশ করতে পারি লিখে! ভাবনা হবে না কেন, প্রতিনিয়তই মেয়েরা লাঞ্ছিতা হচ্ছে, ধর্ষিতা হচ্ছে, খুন হচ্ছে। দেশের ঘটতে থাকা ঘটনাগুলো যেগুলো আমাকে নাড়ায়, কাঁদায়, ভাবায়, ক্ষুব্ধ করে, ব্যথিত করে সেসব নিয়ে লিখি। কোনও গভীর তত্ত্ব কথা নয়। তথ্যবহুলও কোনও প্রবন্ধ নয়। লেখাগুলো একধরনের তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া। গবেষণা করে কিছু বার করা নয়। দৈনিক পত্রিকায় ছাপা হয়, পরদিন সে পত্রিকার পাতা বাদামের ঠোঙা হয়ে যায়। সাপ্তাহিকী গুলোয় ছাপা হয়, সপ্তাহ গেলে সেসব কাগজ চলে যায় ময়লা ফেলার বাক্সে। পচা পুরোনো জিনিসের সঙ্গে মিশে যায়। আমার প্রতিদিনকার কলামের টুকরো টুকরো কিছু বাক্য.. .

‘শাহিদা নামের এক ম্যাজিস্ট্রেটকে খুন করে ফেলল লিয়াকত ম্যাজিস্ট্রেট কারণ শাহিদা লিয়াকতের বিয়ের প্রস্তাবে রাজি হয়নি। লিয়াকতের সঙ্গে হয়ত শাহিদার বন্ধুত্ব ছিল, এই সম্পর্কের ছুতোয় লিয়াকত জোর খাটিয়েছে। লিয়াকত ভেবেই নিয়েছে সে পুরুষ, সে যা বলবে শাহিদাকে তা-ই শুনতে হবে। শাহিদা শোনেনি সম্ভবত শোনেনি এই জন্য যে সে একজন শিক্ষিত স্বনির্ভর মেয়ে, তার নিজের ইচ্ছে অনিচ্ছের দাম সে দিতে চায়। কিন্তু তা মানবে কেন লিয়াকত, সে পুরুষ, সে তার গায়ের জোর তার ছুরির জোর তার পুরুষঅঙ্গের জোর না খাটালে সে আর পুরুষ কেন! পুরুষ এমনই জন্তু বিশেষ যে দাঁত নখ চোখের হিংস্রতা দিয়ে সে তার পুরুষত্ব জাহির করতে চায়। মনুষ্যত্ব, আমি সবসময়ই দেখেছি পুরুষের মধ্যে খুব কম। মনুষ্যত্বের সঙ্গে পুরুষত্বের বোধহয় চিরকালীন এক বিরোধ আছেই। লিয়াকত যদি বিয়ে করত শাহিদাকে, এরকম আঘাতে আঘাতে শাহিদাকে তিল তিল করে মরতে হত, কেউ দেখতে পেত না তার ভেতরের ক্ষরণ, লোকে ভাবত — কী চমৎকার জুটি! লোকে এখনও চোখে কালি পড়া নিরন্তর মার খাওয়া স্ত্রীদের নির্দ্বিধায় সুখী বলে বিবেচনা করে। লিয়াকত পুরুষের মত পুরুষ। সে পুরুষের যোগ্য কাজই করেছে। নারীকে ঠাণ্ডা মাথায় হত্যা করেছে।

প্রেম প্রেমই। এর আগে পরে পরকিয়া বা আপনকিয়া শব্দ ব্যবহার করলে প্রেমের মহিমাই নষ্ট হয়। ম্যাজিস্ট্রেট শাহিদা পরকিয়া প্রেম করত এবং সন্তানটি তার স্বামীর ঔরসজাত নয়, এ নিয়ে পত্রিকাগুলো এখন মুখর। প্রেম সে করতেই পারে, স্বামীর যদি স্পার্মলেস সিমেন থাকে অথবা সে উত্থানরহিত হয়, স্ত্রী তার প্রেমিকের সন্তান গর্ভে নিতেই পারে, মানুষ তার মনে এবং শরীরে কাকে বহন করবে বা না করবে সে একান্তই তার ব্যপার। শাহিদার প্রেম নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করা মানে তার ব্যক্তিস্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ শুধু নয়, পদক্ষেপ করাও। অবশ্য জীবিত মেয়েদেরই যেখানে স্বাধীনতা নেই, সেখানে মৃত মেয়ের আবার স্বাধীনতা কি!

বাসাবোয় নিলুফার নামের এক মেয়েকে খুন করেছে তার স্বামী। সেই স্বামী এখন বহাল তবিয়তে আছে। ঘুরে বেড়াচ্ছে। তাকে কে আটকায়! তার আছে পয়সার জোর, সবচেয়ে বেশি আছে সরকারের জোর। সরকারের জোর যার আছে, সে যত বড় চোর ডাকাত বদমাশ খুনী হোক পার পেয়ে যায়। সরকার তার পেয়ারা বান্দাদের জন্য বড় শক্ত করে একটি সাঁকো বানিয়েছেন। আল্লাহতায়ালার পুলসেরাতের চেয়ে সরকারের সাঁকো বেশি মজবুত।

মহিলা পরিষদের সদস্যরা উন্মাদ হয়ে গিয়েছে খুকুর ফাঁসি দেবার জন্য। মুনির তার স্ত্রীকে খুন করেছে। মুনিরের ফাঁসি হবে। কিন্তু মহিলা পরিষদের দাবি, খুকুকেও ফাঁসি দিতে হবে। কেন, খুকুকে কেন ফাঁসি দিতে হবে! কারণ খুকু নাকি চরিত্রহীনা ছিল। নিজে বিবাহিতা হয়েও খুকু মুনিরের সঙ্গে প্রেম করেছে, এই তার দোষ। মহিলা পরিষদএর মিছিল যখন আদালত প্রাঙ্গনে গিয়ে খুকুর ফাঁসির জন্য গলা ফাটাচ্ছে, আমি লজ্জায় মুখ ঢেকেছি। খুকুর কেন শাস্তি হবে, খুকুর অন্যায়টি কি? খুকু তো এই খুনের সঙ্গে জড়িত ছিল না! অক্ষম অথর্ব স্বামী নিয়ে জীবন কাটাতো খুকু, স্বামী দ্বারা লাঞ্ছিত, প্রেমিক দ্বারা প্রতারিত এই অসহায় মেয়েটিকে সারাদেশের মানুষ গাল দিল, জেলে ভরল, খুকু নামটিকে একটি নষ্ট মেয়ের নাম হিসেবে চিহ্নিত করল। খুকুর সঙ্গে মুনিরের ভালবাসার সম্পর্ক ছিল, থাকতেই পারে। এটি খুকুর দোষ নয়। ভালবাসা কি দোষের জিনিস!

পটুয়াখালির এক লঞ্চযাত্রীকে ধর্ষণ করা হয়েছে। কোনও ডাকাত নয়, লঞ্চের মস্তান ছেলেরা নয়, মদ্যপ বদমাশরা নয়, ধর্ষণ করেছে ওই লঞ্চে যাত্রীদের নিরাপত্তার জন্য যে আনসারদের রাখা হয়েছিল, তারা। তারা পাঁচজন। কুড়ি বছর বয়সী মোসাম্মত বেগমকে জোর করে তাদের কেবিনে নিয়ে ধর্ষণ করে। লঞ্চ ভর্তি লোক, কিন্তু আনসারগুলো এই কাজটি করতে এতটুকু দ্বিধা করেনি। সেবকদের পুরুষাঙ্গ লঞ্চের ভিড়ের মধ্যে একটি যাত্রীর জন্য উত্থিত হয়েছে। উত্থিত হওয়ায় আমি কোনও আপত্তি করছি না। তারা সেবক হলেও পুরুষ তো, উত্থিত হবেই। মেয়েটি যদি তাদের উত্থানে সাড়া দিত, যদি এমন হত যে পাঁচজনের সঙ্গে সঙ্গমে মোসাম্মত বেগমের আপত্তি নেই তবে এ নিয়ে সারাদেশে কারওরই আপত্তি করবার প্রশ্ন ওঠে না। যে কারও অধিকার আছে যে কোনও সম্পর্কের গভীরে যাওয়া, অবশ্য পরস্পরের যদি সম্মতি থাকে। কিন্তু জোর করে কোনও সম্পর্ক স্থাপন হতে পারে না। হওয়া উচিত নয় যদি এই সমাজকে সভ্য বলা হয়। সভ্য বলেই তো দাবি করছে সবাই, তবে জোর করে সম্পর্ক সম্ভব হয় কী করে? কী করে একজন যাত্রীকে ধর্ষণের জন্য সেদিন রাষ্ট্র কতৃক নিয়োজিত কিছু আনসার, যে আনসার শব্দের অর্থ য়েচ্ছ!সেবক, উদ্যত হয়? কী করে যাত্রীদের সেবকরাই যাত্রীদের নিরাপত্তার সবচেয়ে অন্তরায় হয়? আনসারদের অপরাধের কোনও শাস্তি হয়নি। আমার ভাবতে অবাক লাগে দেশের প্রধানমন্ত্রী একজন নারী, ভেবে আশ্চর্য হই এই দেশের বিরোধীদলের নেত্রী একজন নারী। তাঁরা কি এইসব ঘরে বাইরের ধর্ষণের কোনও সংবাদ পান না? নাকি পেলেও তাঁদের অন্তরে কোনও জ্বালা ধরে না, তাঁদের কাছে ধর্ষণ অত্যন্ত উপাদেয় জিনিস বলে মনে হয়, ধর্ষণের জন্য তেমন রুষ্ট হওয়ার তাঁরা দেখেন না কিছু! দেশের প্রধানমন্ত্রী একজন নারী হওয়ার পরও দেশে অবাধে চলছে বধুহত্যা, ধর্ষণ, অপহরণ, এসিড ছোঁড়া, যৌতুকের অত্যাচার, বাল্যবিবাহ। এখনও নারীর বিরুদ্ধে নানা জাতের আইন খড়গ উঁচিয়ে আছে। নারী হয়ে নারীর বেদনা বুঝবার ক্ষমতা যার বা যাদের নেই তাঁরা মানুষের আর কী সেবা করতে পারেন! তাঁরা যদি অত্যাচারিতের পক্ষেই না দাঁড়াতে পারেন, তবে তাঁরা কার পক্ষ নেবার জন্য মহান সেবকের দায়িত্ব নিয়েছেন? ধনীর, অত্যাচারীর, সুবিধাভোগীর, পাপীর? পাঁচ সেবকের ধর্ষণ এমন কোনও অস্বাভাবিক ঘটনা নয়। এমন ধর্ষণ হচ্ছেই গ্রামে গঞ্জে শহরে ফুটপাতে লঞ্চে ট্রেনে নৌকোয় জাহাজে। এসবের জন্য শাস্তি হবে না কারওর। এই দেশে ধর্ষণ কোনও শাস্তিযোগ্য অপরাধ নয়। মহান সেবকের বন্ধুরা নারীর বিরুদ্ধে ফতোয়া দেবে, সেই ফতোয়া মহাসমারোহে পালন করা হবে। যে দেশে নারীর পক্ষে লেখার অপরাধে পাসপোর্ট কেড়ে নেওয়া হয়, সেই দেশে ফতোয়ার রাজনীতিই বিরাজ করবে, এ আর আশ্চর্য কী! কিছুই অবাক করে না আমাদের। কিছুই আর হতবাক করে না আমাদের। খবরের কাগজে আমরা এইসব চমকপ্রদ সংবাদ দেখি পড়ি ভুলে যাই। কিছুই আমাদের আর কাতর করে না। আমাদের পিঠে কোনও চেতনার চাবুক পড়ে না। কারণ আমরা জেনেই গিয়েছি জনগণের সেবকেরা যখন ধর্ষকের ভূমিকায় নামে, মানুষের সাধ্য থাকে না তাদের শাস্তি দেবার। এদেশে সেবক পাল্টায়, সেবকের চরিত্র পাল্টায় না। সে নারী হোক কী পুরুষ হোক।

কলকাতার ফুলবাগানে ঘুমন্ত এক ফুটপাতবাসিনীকে জোর করে পুলিশ ভ্যানে তুলে থানার ব্যারাকে নিয়ে পুলিশ কনস্টেবল নীলকমল সনাতন আর ভোলানাথ ধর্ষণ করেছিল। নীলকমলের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়েছে। কিন্তু এ দেশে কোনও ধর্ষকের এরকম শাস্তি কল্পনা করা যায় না। পটুয়াখালির লঞ্চের যে মেয়েটিকে ধর্ষণ করেছিল আনসাররা, বলা হচ্ছে সে নাকি পতিতা ছিল। যেন পতিতা ছিল বলে আনসাররা তাকে ধর্ষণ করবার দাবি রাখে। পতিতা ছিল বলে আনসারদের সাতখুন মাপ। এখানে ফুটপাতবাসি হলে এরকমই অবস্থা হত, বলা হত ফুটপাতে পড়ে থাকা মেয়েকে ধর্ষণ করা এমন কোনও অন্যায় নয়। ধর্ষণ ঘটলে এখনও এদেশে ধর্ষিতাকেই দোষী ভাবা হয়। বলা হয় মেয়েটি প্রভোক করেছিল ধর্ষণ করতে, তার মিটিমিটি চোখের চাওয়া, অকারণ হাসি, উগ্র পোশাক সবই ধর্ষণের অনুকূলে ছিল। এসব যুক্তিকে সমাজে বেশ কদর করা হয়। একজন মেয়ে, তার যদি ইচ্ছে করে সে হাসবে, যেমন ইচ্ছে চলবে, যেমন খুশি তার পোশাক পরবে — এ কারণে তাকে ধর্ষিতা হতে হবে কেন?

আমি যৌন স্বাধীনতায় বিশ্বাসী। আর সব স্বাধীনতার মত মানুষের এই স্বাধীনতাও প্রয়োজন। কিন্তু মানুষের শরীরে জোর জবরদস্তি চলবে কেন? সে ভিখিরি হোক কি পতিতা হোক কি স্ত্রী হোক — সে যদি অনুমতি না দেয় কারও কি অধিকার আছে তাকে স্পর্শ করবার? আমার বিচারে নেই। রাষ্ট্রের বিচারে বরাবরই ধর্ষকরা পার পেয়ে যায়। এতে রাষ্ট্রই নারীর নাগরিক অধিকারে থুতু ছিটোয়। এরপরও এ দেশের নারীরা যদি মুখ ফুটে ধর্ষণের বিচার যাবজ্জীবন করবার জন্য আন্দোলন না করে, আমি তবে সেই নির্বোধ নারীদের বলতে বাধ্য হব, তারা বোধহয় মনে মনে ধর্ষিতা হতেই চায়।

যায় যায় দিন পত্রিকায় আমার নিয়মিত কলামটির নাম আমার মেয়েবেলা। ওতে একবার লিখেছিলাম .. বাসে উঠলেও একটি একলা মেয়ে দেখলে কনডাকটর কোনও মেয়েকে পাশে বসায়, মেয়ে না পাওয়া গেলে বুড়ো পুরুষের পাশে, বড় জোর বাচ্চা কোনও ছেলের পাশে। কনডাকটর নিজে পুরুষ, সেও জানে পুরুষের স্বভাব। তাই সে অথর্ব বা অপ্রাপ্তবয়স্ক পুরুষের পাশে মেয়েদের বসিয়ে স্বস্তি পায়। পুরোনো লেখা নতুন করে স্মরণ করবার কারণ হচ্ছে একটি চিঠি। চিঠি তো দিনে কয়েক শ আসে। সব চিঠি পড়বার সময়ও হয় না। হঠাৎ হঠাৎ কিছু চিঠি চমকে দেয়, কিছু চিঠি ভাবায়, কিছু আবার কাঁদায়ও। মৌ নামের এক মেয়ে কুমিল্লা থেকে আমাকে লিখেছে.. ‘আপনার চলতি সংখ্যার কলামের এক কোণে লেখা ছিল বুড়োরা অথর্ব। এতে আমারও কোনও সন্দেহ নেই। কিন্তু এ প্রসঙ্গে আমার অবুঝ বেলার ছোট্ট একটা ঘটনা আপনাকে জানাতে ইচ্ছে করছে। প্রতিকারের আশায় নয় — শুধু বলবার জন্য মানুষের কেউ না কেউ তো থাকতেই হয়। আমি তখন ক্লাস সিক্সে পড়ি। বুড়ো মতন এক লোক এলেন আমাদের মফস্বলে, শেক্সপিয়রের গল্প থেকে নৃত্যনাট্য করে ডোনেশন তুলতে। আমি ওতে একটা গানে অংশ নিয়েছিলাম। একদিন রিহার্সেলের পর রাতে জীপে করে সবাইকে পৌঁছে দিতে গিয়ে সবচেয়ে শেষে পৌঁছোলেন আমাকে — সর্বকণিষ্ঠ বলে এবং সেই সুযোগে উনি আঙুল দিয়ে আমার যৌনাঙ্গে চাপ দিতে লাগলেন। আরও বেশি কিছু হবার আশঙ্কায় সে রাতে শুধু মুহূর্ত গুনেছি কখন বাসার গেটটা চোখে পড়বে। পরের দিন বাসায় চলে এলেন ভাল করে গান শেখাতে। আমার মা ডিসটার্ব হবে ভেবে সে ঘরে আর এলেন না। উনি কিছুক্ষণ পর আমাকে বললেন, দাদু তোমার কাছে একটা ছোট্ট জিনিস চাইব, আমাকে ফিরিয়ে দিও না। এবং তারও অনেক পরে আতঙ্কিত আমার পা ফাঁক করে যৌনাঙ্গে একটা চুমু দিলেন। তারপর অনেকগুলো দিন আমার শুধু পানিতে ডুবিয়ে রাখতে ইচ্ছে করত নিজেকে। একথা আমি কাউকে বলিনি, বাবা মা বন্ধু বান্ধবী কাউকে না, পাছে আমাকে সবাই অপবিত্র মনে করে। এবং আজও পাকা দাড়ি দেখলে আমার বমি আসে, আমি সব সময় তাদের ছোঁয়া বাঁচাতে ব্যস্ত থাকি, পাছে আশীর্বাদ করার ছলে ওরা আমার মনে আরও ঘৃণার জন্ম দেয়। মনে মনে ভাবি যেন আমার শুধু শাশুড়ি থাকে, কোনও ভদ্রবেশি শ্বশুর না থাকে। যখন বাসে চেপে কোথাও যাই, শুধুই খুঁজি একজন যুবককে, কোনও বৃদ্ধকে নয়। আমি লক্ষ্য করেছি যুবকেরা কিছুক্ষণ গল্প জমাবার চেষ্টা করে শেষে ক্ষান্ত দেয়, কিন্তু বুড়োরা কখনও ঘুমিয়ে, কখনও জেগে কেবলই শরীর চেপে বসে থাকে। আপনি সেইসব ছোট্ট কিশোরীদের নিয়েও কিছু লিখুন, যারা নিজেদের বাঁচাতে শেখেনি তথাকথিত দাদুদের কবল থেকে।’

চিঠিটি পড়ে মনে মনে ক্ষমা চাইলাম মৌ এর কাছে। বুড়োদের অথর্ব বলা আমার উচিত হয়নি। আসলে পুরুষ পুরুষই, সে খোকা হোক কি বুড়ো হোক। কয়লা ধুলে যেমন ময়লা ওঠে না, পুরুষের চরিত্রও তেমন, থুত্থুড়ে হলেও এটি শুদ্ধ হয় না।

এদেশে উত্তরাধিকার আইনগুলো করা হয়েছে ধর্মমতে। মুসলমানদের উত্তরাধিকারের বৈষম্য দেখে আমরা নিশ্চয় ভাবতে পারি মাতা ও পিতা সমান নয়। কন্যা ও পুত্র সমান নয়, স্ত্রী ও স্বামী সমান নয়। বৈষম্য আছে। কিন্তু বৈষম্য কেন? কেন মাতা কন্যা ও স্ত্রী পিতা পুত্র ও কন্যার সমান মর্যাদা পাবে না? এই বৈষম্য জলজ্যান্ত রেখে যে পুরুষ বা নারী ভাবে যে তারা তৃপ্ত,তারা সুখী, তারা সন্তুষ্ট তবে তারা নিজেরাই নিজের কবর খুঁড়ছে আর চতুর দর্শক দাঁড়িয়ে তালি দিয়ে তাদের অভিনন্দিত করছে। আমি চতুর নই বলে সম্পত্তি বন্টনের নমুনা দেখে আর সব পুরুষের মত সুখে ও স্বস্তিতে গা এলাতে পারছি না। আমি সমাজের ধিকৃত, বঞ্চিত, ধর্ষিত, নিরীহ, নিরূপায় নারী। উত্তরাধিকারের এই আইন আমি মানি না। সম্পত্তি বন্টনের সুস্থ আইন চাই। আজ থেকে চাই। এই মুহূর্ত থেকে। দেশের প্রথম মহিলা প্রধানমন্ত্রীর গায়ে কি এই চরম বৈষম্যের কোনও ছ্যাঁকা লাগে না? আমার তো লাগে, তাঁর লাগে না কেন? তিনি যদি মানুষ হন, নারী হন, বিবেকবান হন, বুদ্ধিমান হন, তিনি যদি সৎ হন, নিষ্ঠ হন, এই অসম ব্যবস্থার চাবুক তাঁর হৃদয়ে পড়বেই।

লোকে বলে বাবার সম্পত্তি যদি কন্যা নেয়, তবে কন্যার তা সয় না। ও কেবল পুত্রের সয়। যেন সব সওয়ার কাজ শিশ্ন করে। শিশ্ন যাদের নেই, তাদের গায়ে সম্পত্তির কাঁটা ফোটে, সে মারা পড়ে। এইসব বলে কন্যাকে বিমুখ করতে চায় ধূর্ত লোকেরা। শেষ অবদি কন্যাকে বঞ্চিত করে তারা।

মাতৃকূলের চেয়ে পিতৃকুল বেশি লাভবান হয় সম্পত্তি ভোগের ক্ষেত্রে। ঠকাবার নিয়ম তৈরি করেছে শরিয়া বিধি। শরিয়া বিধির নখ দাঁত উত্তরাধিকারের শরীর কামড়ে ধরেছে।

নারী কখনও কোনও সম্পত্তিরঅংশীদার নয়। সে অবশিষ্টাংশভোগী। অবশিষ্টাংশভোগীরা দ্বিতীয় শ্রেণীর বৈধ উত্তরাধিকারী। অবশিষ্ট যা থাকে, তা পায়। বাড়ির পুরুষেরা খেয়ে দেয়ে যা থাকে, তা যেমন নারীরা খায়। তেমন সম্পত্তিও পুরুষ অংশীদাররা নিয়ে টিয়ে তলাঝাড়া যা থাকে, নারী পায়। স্ত্রী, কন্যা, মা, বোন, বৈপিত্রেয় বোন, সকলেই সম্পত্তির অবশিষ্টাংশ পায়। কেউই অংশীদার নয়। কেউই প্রথম শ্রেণীর উত্তরাধিকারী নয়। এই অবশিষ্টাংশ ভোগ করবার বেলায়ও সমাজের সাত রকম বাধা, বলা হয়, মেয়েরা সম্পত্তি নিলে সম্পত্তি সয় না।

সম্পত্তি সওয়াবার ব্যবস্থা করতে হবে। সয় না বলে সেগুলো পুরুষের মধ্যে ভাগবাটোয়ারা করা চলবে না। পিতার সমান মাতাকে, পুত্রের সমান কন্যাকে, স্বামীর সমান স্ত্রীকে সমান উত্তরাধিকার দেবার ব্যবস্থা করা হলে সব সইবে। আর তা না হলে যে সরকার আমাদের আইনের মাথা, তাঁকে কিন্তু আমরা বেশিদিন সইব না।

হিন্দুর উত্তরাধিকার আইনটি আরও ভয়াবহ। কোনও নারীর চিহ্ন নেই উত্তরাধিকার তালিকায়। নারী কিছু পাবার বেলায় নেই, কেবল দেবার বেলায় আছে। লোকে ভাবে, নারীর আর কী দরকার সম্পদ সম্পত্তির! তাকে পিতা স্বামী ও পুত্রের অধীনে বেঁচে থাকতে হয়। তাকে পরাশ্রয়ী লতার মত আঁকড়ে থাকতে হয় পুরুষের শরীর। নারীকে স্বাধীন ও স্বাবলম্বী হতে দিতে সমাজ বড় নারাজ। সমাজ তাকে নিঃস্ব করেছে সর্বার্থে, তাকে অচল করেছে, অনাথ করেছে। হিন্দুরা এ দেশে আজও শাস্ত্র মতো চলে। মুসলমানরা খুব যে শাস্ত্রের বাইরে চলে তা কিন্তু নয়। . আসলে আইন কখনও হিন্দু মুসলমান বিচার করে হওয়া উচিত নয়। ধর্মের সঙ্গে সভ্যতার বিরোধ চিরকালীন। আইন যদি সভ্য না হয়, মানুষ সভ্য হবে না। আইনের হিন্দুত্ব আর মুসলমানিত্ব মানা অসভ্যতা ছাড়া কিছু নয়। মানুষকে সভ্য করতে হলে একটি আধুনিক সভ্য আইনের প্রয়োজন। আর এদেশের অসভ্য, অসংস্কৃত, অনাধুনিক, অধম মানুষদের জন্য যত শীঘ্র সম্ভব কঠোর কঠিন আইন করা প্রয়োজন যে উত্তরাধিকার হোক, বিবাহ হোক, তালাক হোক, সন্তানের অধিকার হোক কোথাও নারী পুরুষে কোনও বৈষম্য থাকবে না। মানুষ হিসেবে সকলেই সমান হবে, সে বিশ্বাসে হিন্দু হোক, মুসলমান হোক, বৌদ্ধ কি খ্রিস্টান হোক।

হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান মুসলমানের উত্তরাধিকার আইন নিয়ে আমার লেখাগুলো পড়ে অনেকে বলেছে আমি নাকি খুব কঠিন জিনিস নিয়ে লিখছি। কঠিন কেন জিজ্ঞেস করলে কিছু মেয়ে বলল এসব বুঝিটুঝি না। বললাম, তা বুঝবে কেন, বুঝলে কি আর সব পেয়েছির হাসি ঝোলে ঠোঁটে! এত তৃপ্ত থাকে হৃদয়! ওরা আমার তিরস্কারও বুঝল কি না জানি না তবে ওরা অনুরোধ করে গেল উত্তরাধিকারের কাঠখোট্টা আলোচনা বাদ দিয়ে পুরুষদের কি করে পেটানো যায় তা যেন লিখি। উত্তরাধিকারের ঝামেলায় কেউ যেতে চায় না। এটি ঝামেলা ছাড়া আর কী! গজ ফিতে নিয়ে শতাংশ মাপা, আর নিজের ভাইদের সঙ্গে কাড়াকাড়ি করা ঠিক শোভন মনে হয় না। আপন ভাই ই তো, না হয় নিলই সব। আর বাপের বাড়ির জমি, এটির ভাগ চাইলে লোকে লোভী ভাববে। বাপ তো বিয়ের আগ অবধি খাওয়ালো পরালো, এখন স্বামী খাওয়াচ্ছে পরাচ্ছে, অসুবিধে তো কিছুতে নেই। খামোকা অসভ্যের মত বাপের দুকানি জমির ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়তে হবে কেন! এই হল আমাদের মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্ত নারীদের মানসিকতা। আর নিম্নবিত্তের তো জমিই নেই, যদিও বা থাকে তার ভাগ চাইতে এলে ভাইয়েরা ঠেঙিয়ে বিদেয় করে। কিন্তু এই ঘটনাগুলো আর কদিন ঘটবে? কদিন আমাদের নিরীহ, নির্বোধ, প্রতারিত মেয়েরা ভাববে যে পিতার সম্পত্তি কেবল পুত্রদের জন্য, কন্যাদের জন্য নয়, আর কন্যাদের জন্য হলেও তা ছিটেফোঁটা। কবে তাদের বোধ হবে যে পিতার সম্পত্তিতে পুত্র ও কন্যার সমান অধিকার থাকা উচিত! কারণ কন্যা একজন পূর্ণাঙ্গ মানুষ, সে পুত্রের তুলনায় কিছু কম সন্তান নয়, কিছু কম মূল্যবান নয়, কিছু কম মেধাবী নয়। এই বোধ যখন হবে তখন সে নিজে উত্তরাধিকার আইনের মা বাপের হাতে গজফিতে দেবে এবং বলবে আমার যা কিছু প্রাপ্য তার সবই দাও, আমি কড়ায় গণ্ডায় সব হিসেব চাই। আমি এই জগতে একে ওকে দান দক্ষিণা করতে আসিনি। আমার যা, আমি তা একশ ভাগ চাই। আর পুত্র তৈরিতে একটি শুক্রাণু আর ডিম্বাণু যেখানে লাগে, কন্যা তৈরিতে সেখানে আধা শুক্রাণু বা আধা ডিম্বাণু লাগে না। তবে সম্পত্তির বেলায় আধা কেন! পুরুষ প্রগতিবাদীরা নানারকম আন্দোলন করে। কিন্তু উত্তরাধিকার আইন নিয়ে তারা কখনও রা শব্দ করে না। এ নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি তাদের একদম অপছন্দ। আমি অনেক বিপ্লবী সমাজতান্ত্রিককে জানি যারা মেপে মেপে জমি নিয়েছে বোনদের অর্ধেক দিয়ে অর্থাৎ ঠকিয়ে। রাষ্ট্রব্যবস্থায় কোনও হেরফের দেখলে তারা উত্তেজিত হন, কিন্তু জমি বন্টনে কোনও হেরফের বা বৈষম্য দেখলে তারা খুব শান্ত থাকেন, মোটেও উত্তেজিত হন না। যেন শরিয়ত মত আর কিছু না চলুক, উত্তরাধিকার আইন চলছে চলুক। বিয়ের ব্যবস্থাও চলুক। যেহেতু বহুবিবাহের সুবিধাদি আছে।

যা করবার তা নারীকেই করতে হবে। নারীর জন্য সুযোগ সুবিধা তৈরি করতে হবে নারীকেই। প্রতিবন্ধক সরাতে হবে তাকেই, তার পথ মসৃণ করবার দায়িত্ব তারই। আমাদের সমাজে সহজেই গোলাম আযম জন্মায়, ঈশ্বরচন্ত্র বিদ্যাসাগর জন্মায় না। তাই বহুবিবাহও দূর হয় না। সম্পত্তির সমান অধিকারও জোটে না। মেয়েদেরই তাই এক একজন প্রীতিলতা, লীলা নাগ, বেগম রোকেয়া হতে হবে। মেয়েদের জলের মত হৃদয় শত বারুদে এবার দাউ দাউ জ্বলে ওঠা প্রয়োজন।

নতুন একটি কথা উঠছে যে পুরুষের দ্বিতীয় বা তৃতীয় বা চতুর্থ বিবাহ করতে হলে আদালতের অনুমতি লাগবে। আগে স্ত্রীর অনুমতি লাগত আর এখন আদালত থেকে অনুমতি নিতে হবে। এতে নারীর কী লাভ হল শুনি! পুরুষের জন্য কি আদালত থেকে অনুমতি নেওয়া খুব দুরূহ কোনও কাজ যে এ কাজে তারা ভয় পাবে! আদালতও দুর্লভ নয়, আদালতের অনুমতিও দুর্লভ নয় এদেশে। কথা যখন উঠেছেই, পুরুষের শখের বহু বিবাহ বন্ধ করবার কথা কেন ওঠে না! নাকি সাহস হয় না! পুরুষকে খানিকটা খুশি করে বিল পাশ না করলে বুঝি চলে না? যদি বিল পাশ করতেই হয়, তবে অনুমতির ফাজলামো বাদ দিয়ে বহু বিবাহ নিষিদ্ধ করবার বিলই পাশ করতে হবে। এইসব খুচরো সংশোধন আমরা মানব না, আমূল সংশোধন চাই। আমূল বদল চাই এই ঘুণে ধরা সমাজের। সভ্য আইন চাই, মানুষের আইন চাই; ধর্মের নয়, অসত্যের নয়, অপমানের আইন আর নয়। ভাতের ক্ষিধেকে একমুঠ মুড়ি মুড়কি দিয়ে মেটাতে চাইলে আমরা অনশন করব বলে দিচ্ছি। অল্পে সন্তুষ্ট হওয়ার দিন চলে গেছে, এবার প্রাপ্যটুকু চাই, এবার অধিকার সবটুকু চাই।

এই পৃথিবীতে এককালে পুরুষেরা নারীর সতীত্ব রক্ষার জন্য লোহার বেড়ি বানিয়েছিল। এই পুরুষেরা নারীর সতীত্ব প্রমাণ করবার জন্য নারীকে মরা স্বামীর চিতায় তুলেছে। এই পুরুষেরা এখনও বীভৎস সব পন্থায় নারীর সতীত্ব রক্ষা করে চলেছে। নানা নিয়ম কানুন নারীর ওপর চাপিয়ে নারীর সতীত্বের মজা তারা উপভোগ করছে। আগে লোহার বর্ম ব্যবহার করা হত, এখন সামাজিক অঙ্গুলী নির্দেশেই কাজ হয়। সমাজ নারীকে বলছে ঘরে থাকো, স্বামীর আদেশ ছাড়া ঘর-বার হয়ো না, পুরপুরুষের সঙ্গে মেশো না, মিশলে তালাক, মিশলে মরণ। .. নারীর দেহে গায়ে তালা লাগিয়ে চাবিটি কোনও পুরুষের নেবার অধিকার নেই, নারীর দেহের চাবি নারীর কাছেই থাকতে হবে। অর্থনৈতিক স্বাধীনতা যেমন নারীর প্রয়োজন, যৌন স্বাধীনতাও নারীর প্রয়োজন, যৌন স্বাধীনতা না থাকলে অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক-সামাজিক যত স্বাধীনতাই নারীর থাকুক, সত্যিকার স্বাধীন সে নয়। নারীর যৌন স্বাধীনতার কথা শুনলে অনেকে নাক সিটকোবে, বলবে, ছিঃ ছিঃ নারীর আবার যৌন স্বাধীনতা কী? তাহলে তো সে বেশ্যা হয়ে গেল। নারীর সবটুকু স্বাধীনতা অর্জন করতে হলে সমাজ যদি তাকে বেশ্যা বলে, তবু বেশ্যা হওয়া ভাল পুরুষের দাসি হওয়ার চেয়ে। আসলে যৌন স্বাধীনতা নারীর আর সব স্বাধীনতার মত একটি স্বাধীনতা। নারী যে কোনও স্বাধীনতা পেলেই তাকে বেশ্যা বা নষ্ট বলা হবে এই ভয় দেখানো হয়। এসব পৌরুষিক চক্রান্ত ছুঁড়ে ফেলে নারীকে যদি মানুষ হতে হয়, তার শরীর ও মনের সবটুকু স্বাধীনতা তাকে অর্জন করতেই হবে।

কথায় কথায় ইনশআল্লাহ, মাশাআল্লাহ, সোবহানআল্লাহ বলার চল শুরু হয়েছে। বুদ্ধি হবার পর থেকে এই শব্দগুলো কখনও উচ্চারণ করিনি আমি। আসসালামু আলায়কুম বলে কাউকে আমি সম্ভাষণ জানাই না, খোদা হাফেজও বলি না বিদায় নেবার সময়। এসব বিদেশি শব্দের পরিবর্তে আমি বাংলা শব্দ ব্যবহার করি। আল্লাহ খোদার নাম লোকের মুখে মুখে ফেরে আজকাল। এতে আল্লাহর কোনও মঙ্গল হয় না। মঙ্গল হয় না তাদেরও, যারা বলে। আসলে সৎ হতে হয়, বিবেকবান হতে হয়, উদার, সহনশীল, যুক্তিবাদী হতে হয়, তবেই সত্যিকার মঙ্গল হয় মানুষের আর মানুষের মঙ্গল মানে মানবজাতির মঙ্গল।

যারা এই রাষ্ট্রকে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র বলে, তাদের ধিককার দিই আমি। ধর্মহীনতা গণতন্ত্রের প্রথম শর্ত। এই শর্ত পূরণ না হলে গণতন্ত্রের নাম ধারণ করবার অর্থ জাতিকে বোকা বানানো। স্বৈরাচারের একটা সীমা আছে। এই সরকার সেই সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছে। এক স্বৈরাচারীর বিরুদ্ধে নব্বইএ যে গণ জাগরণ হয়েছিল, তেমন একটি জাগরণের প্রয়োজন এখন। একটি সেক্যুলার রাষ্ট্রের জন্য আমাদের সবার এখন পথে নামা জরুরি। পঙ্গপাল যেমন শস্য নষ্ট করে, মাওলানারা তেমন সোনার বাংলার গ্রামগুলো নষ্ট করে ফেলছে। তাদের যদি এখনও নির্মূল করা না হয় তবে একদিন ধ্বংসস্তূপে পরিণত হবে গোটা বাংলাদেশ। তখন হাহাকার করে লাভ কিছু হবে না। তাই এখনই সতর্ক হতে হবে সবার।

ফতোয়াবাজেরা গ্রামে গ্রামে মেয়েদের, যে মেয়েরা স্বনির্ভর হওয়ার চেষ্টা করছে, ফতোয়া দিয়ে সমাজচ্যুত করছে। সারাদেশে যত ফতোয়াবাজ মাওলানা আছে তাদের সমাজচ্যূত করার দৃপ্ত শপথ গ্রহণ করুক নতুন প্রজন্ম। ফতোয়াবাজরা একদিন নির্মূল হবে এই বিশ্বাস আছে বলেই এখনও সম্ভবত বেঁচে আছি এবং এখনও এই দেশ নিয়ে গৌরব করি।

আমাদের প্রগতিবাদীরা বলেন, মৌলবাদ গেলেই সব সমস্যা ঘুচবে। তাঁরা এও বলেন, ধর্ম নিয়ে কোনও সমস্যা নেই, মানুষ নীরবে নির্ভতে ধর্ম পালন করুক, রাষ্ট্রধর্মেও ইসলামটা বহাল থাকুক, কিন্তু দেশ থেকে যে করেই হোক মৌলবাদটা দূর করতে হবে। তাঁদের এই কথা আমি মানি না। আমি মনে করি, ধর্ম যতদিন থাকবে, মৌলবাদ থাকবেই। ঘরে সাপ ছেড়ে দিয়ে ঘরের লোককে যদি কেউ সান্ত্বনা দেয় যে সাপকে বুঝিয়েছে সাপ ছোবল দেবে না সে কথা কি বিশ্বাসযোগ্য? সাপ আজ ছোবল দিচ্ছে না, কাল দেবে। সাপকে বুঝিয়ে শান্ত করার কিছু নেই। সাপের কাজই ছোবল দেওয়া। বিষবৃক্ষ শরীরে বাড়ছে বলে ডাল পালা কেটে দিলে বৃক্ষ কি ডাল ছড়াবে না আর? বিষ ফলাবে না তার শত শাখায় পাতায়? ফলাবে। সুতরাং আমরা আশা করতে পারি না মৌলবাদ নামক বৃক্ষটি কেটে দিয়ে মৌলবাদ ঘোচাতে পারব। মৌলবাদের শেকড় যতদিন আছে, ততদিন মৌলবাদ গজাবেই। মৌলবাদের শেকড়টির নাম ধর্ম। যদি মৌলবাদ নির্মূল করতে গিয়ে মৌলবাদের শেকড়টি উপড়ে না ফেলি, তবে মৌলবাদ কোনওদিনই নির্মূল হবে না।’

ইদানীং বড় মামা প্রায়ই আসেন আমার বাড়িতে। সোভিয়েত দূতাবাসের চাকরিটি বড় মামার গেছে। অনেকদিন ভোরের কাগজ পত্রিকার আন্তর্জাতিক পাতাটি দেখার দায়িত্বে ছিলেন। এখন সেই দায়িত্বটিও নেই। আন্তর্জাতিক ঘটনাবলি যেভাবে বড় মামা ব্যাখ্যা করতে চান, পত্রিকার অন্যরা সেভাবে চান না। মার্কসবাদে বিশ্বাসী কট্টর কমিউনিস্টএর মতের সঙ্গে কাগজের লোকদের মত মেলে না। বড়মামা অনেকটা ফ্রিল্যান্স সাংবাদিকের মত এখন। বেশির ভাগ লেখাই তিনি ছদ্মনামে লেখেন। আমার লেখার ঘরে একদিন তিনি একটি বই দেখেন, ব্‌ইয়ের নাম তসলিমা নাসরিনের ইসলাম বিদ্বেষ ও অপব্যাখ্যা। বইটির লেখক দুজন ইসলাম-বিশেষজ্ঞ। বইয়ের পেছনের পঈচ্ছদে বড় বড় করে মুসলমান হয়ে আল্লাহ এবং রসুলের নিন্দা করলে যে শাস্তির বিধানটি আছে সেটির বর্ণনা, পেছন দিক থেকে তলোয়ার দিয়ে অপরাধীর ডান হাত এবং বাঁ পা কেটে নিতে হবে, তারপর বাঁ হাত আর ডান পা। বড়মামা বইয়ের কয়েক পৃষ্ঠা পড়েই আগ্রহ প্রকাশ করলেন পুরো বইটি পড়ার। বইটি একদিন নিয়ে যান তিনি, যখন ফেরত দিতে আসেন, সঙ্গে একটি দৈনিক সংবাদ পত্রিকা আনেন, যে পত্রিকায় ছাপা হয়েছে বড়মামার নিজের নামে লেখা বইটির সমালোচনা। বড়মামা নিজে ইসলামের পণ্ডিত। ইসলাম ব্যবহার করেই তিনি আক্রমণ করেছেন ইসলাম বিশেষজ্ঞদের, কেবল ইসলাম বিশেষজ্ঞদের নয়, সব ধরনের ধার্মিকদের, যারা কুরআন হাদিস মাথায় তুলে রাখছেন কিন্তু নিজেরা কুরআন হাদিসের আদেশ মেনে চলছেন না। বড়মামা দেশের রাজনৈতিক নেতা আর উপনেতাদের প্রসঙ্গে লিখেছেন যে তাঁরা প্রায়ই বলেন, ইসলাম একটি পূর্নাঙ্গ জীবন বিধান, ধর্মীয় জলসায় প্রধান অতিথি হিসেবে গিয়ে তাঁরা জনগণকে কুরআন হাদিস অনুসরণ করে চলার উপদেশ দেন কিন্তু তাঁদের দৈনন্দিন চালচলনে, চিন্তাভাবনায় ও কাজকর্মে তার প্রমাণ তাঁরা দিচ্ছেন না। এমনিতে সার্ট প্যান্ট পরছেন অর্থাৎ বিধর্মীদের পোশাক পরছেন কিন্তু ইসলামি জলসায় গেলে তড়িঘড়ি ইসলামি পোশাক পরে নিচ্ছেন, মাথায় একটি টুপিও পরে নিচ্ছেন, কিন্তু গালটি কামানো। কেন গো! বুখারি হাদিস আর মুসলিম হাদিসে তো স্পষ্ট লেখাই আছে ‘দাড়ি রাখা ওয়াজিব আর কেটে ফেলা হারাম।’ তবে হারাম কাজটি করছেন কেন তাঁরা, এতই যদি ইসলাম পছন্দ তাঁদের!

‘রাষ্ট্রীয় পদাধিকার বলে তাঁরা আবার অন্য ধর্মের অনুষ্ঠানেও প্রধান অতিথি হিসেবে গিয়ে সেই ধর্মের প্রশংসা করেন। অথচ কুরআন হাদিস অনুসারে ইসলাম ছাড়া অন্য সব ধর্মই বাতিল ও কুফর। অন্য ধর্মের প্রতি দয়া দেখানোর জন্য কিংবা অন্য ধর্মের অনুসারীদের সঙ্গে বন্ধুত্ব করার জন্য তাদের ধর্মীয় অনুষ্ঠানে যাওয়া কি ইসলাম অনুসারে বৈধ? কুরআন ও হাদিস তো বলে ‘যারা যায় তারা তাদেরই অন্তর্ভুক্ত হবে এবং তাদের সাথেই তাদের হাশর কবে।’ কুরআনে আল্লাহ নিজে মুমিনদের বৈশিষ্ট বর্ণনা করতে গিয়ে বলেছেন, ‘মুহম্মদ আল্লাহর রসুল, যারা তাঁর সঙ্গে রয়েছে তারা অবিশ্বাসীদের প্রতি কঠোর, এবং নিজেদের মধ্যে পরষ্পরের প্রতি দয়াশীল(৪৮.২৯)ঞ্চ, অন্য আয়াতে বলেছেন, ‘তারা মুমিনদের প্রতি কোমল, কাফিরদের প্রতি কঠোর(৫.৫৪)’, আরও বলেছেন, ‘হে মুমিনগণ, তোমরা কাফিরদেরকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করিও না (৪.১৪৪)। সমালোচকরা এ ব্যপারে নীরব কেন?’

বইটির এক জায়গায় লেখা, ‘তসলিমা নাসরিন নামাজ বলে যে শব্দের কথা উল্লেখ করেছেন তা একটি ফার্সি শব্দ। সমগ্র কুরআন মজিদ ও হাদিস শরীফে এ ধরনের কোনও শব্দ নেই। আল কুরআন ও হাদিসে যে শব্দের উল্লেখ করা হয়েছে তা হচ্ছে সালাত। হযরত মুহম্মদ (সাঃ) মিরাজের পর থেকে দৈনিক পাঁচ ওয়াক্ত সালাত আদায় করতেন।’ বড়মামা এর উত্তরে লিখেছেন, ‘খুবই সত্য কথাটি বলেছেন সমালোচক। নামাজ অবশ্যই একটি বিদেশী, বিজাতীয় উদ্ভট ও বিভ্রান্তি সৃষ্টিকারী শব্দ। সালাত শব্দটির বদলে নামাজ শব্দটি ব্যবহার না করে মাঝে মাঝে কুরআন শব্দটি ব্যবহার করলেও অশুদ্ধ হত না, কারণ কুরআন মজিদে সালাত অর্থে একটি আয়াতে দুই দুই বার কুরআন শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে, ফজরের সালাত বোঝাতে ফজরের কুরআন বলা হয়েছে ১৭ নং সুরার ৭৮ নং আয়াতে। কিন্তু বিজ্ঞ সমালোচকরা এতদিন কোথায় ছিলেন? হাজার বছর ধরে উপমহাদেশে, ইরান, আফগানিস্তান ও মধ্য এশিয়ার মুসলমানরা তসলিমার মত ভুল করে সালাতকে নামাজ বলে আসছে, নামাজ শিক্ষা বই সহ ইসলাম ধর্ম সম্পর্কে লাখ লাখ বই পুস্তকে নামাজ শব্দ ব্যবহার হচ্ছে। টেলিভিশন ও রেডিওতে আজানের দোয়ায় প্রতিদিন কয়েকবার করে বলছে এই নামাজের তুমিই প্রভু, সাওমকে সাওম না বলে রোজা বলা হয় কেন? রোজা শব্দটি তো কুরআন বা হাদিসের কোথাও নেই। তাছাড়া কুলখানি, চেহলাম, ফাতেহায়ে দোয়াজদহম, ফাতেহাায়ে ইয়াজদহম, আখেরী চাহারশুম্বা ইত্যাদি কোথায় পেলেন? মুসলমান শব্দটিই কি কুরআন বা হাদিসে আছে? মুসলমান শব্দটি মুসলিম শব্দের বিকৃতি। মুসলিম শব্দটির অর্থ আত্মসমর্পিত, অনুগত, কিন্তু মুসলমান শব্দের অর্থ কি?’

বইটিতে এম এন রায়, এ জি আরবেরি, আর ও নিকলসন, ডঃ মরিস বুকাইলির খুব প্রশংসা করা হয়েছে, ওঁদের লেখা থেকে উদ্ধৃতি দেওয়া হয়েছে, এবং আমাকে উপদেশ দেওয়া হয়েছে যে ওঁদের বই যেন আমি পড়ি। বড়মামার মন্তব্য, ‘ইসলামের প্রশংসা করার পরও ওঁরা যে ইসলাম গ্রহণ না করে কাফেরই রয়ে গেছেন, বরং কথায় এক কাজে আরেক নীতি অবলম্বন করে ওঁরা যে দারুণ মুনাফেকিও করলেন, এ কথাটি তসলিমার বিজ্ঞ সমালোচকরা বেমালুম চেপে গেছেন।’

বইটিতে লেখা যে আমি আমার বইয়ে কিছু হাদিসের উল্লেখ করেছি কিন্তু হাদিসের রেফারেন্স দিইনি। এসব হাদিস সহি না জাল তার উল্লেখ করিনি। এসব কারণে আমার উদ্ধৃত হাদিস সম্পর্কে তাঁদের আলোচনা করা সম্ভব হল না। আরও লিখেছেন, হাদিস শাস্ত্র সম্পর্কে তেমন কোনও জ্ঞান আমার নেই। বড়মামা এর উত্তর দিয়েছেন এভাবে, ‘কিন্তু দুই ইসলাম বিশারদের যদি হাদিস সম্পর্কে কোনও জ্ঞান থাকত, তাহলে তসলিমার উল্লেখ করা কোন হাদিসগুলো জাল বা বানোয়াট হাদিস তা তাঁরা ধরতে পারতেন।’

আমি যখন বইটি পড়ি, এই ছোটখাটো ব্যপারগুলো আমার চোখে পড়েনি। কিন্তু বড়মামার নজর খুব কড়া। লিখেছেন —হাদিসের সূত্র উল্লেখ না করা যদি তসলিমার অ্যাকাডেমিক ডিসঅনেস্টি হয়, তবে বাংলাদেশের রেডিও টেলিভিশনে যে প্রতিদিন সনদ বা উৎস উল্লেখ ছাড়াই হাদিস সম্প্রচার করে যাচ্ছে, এই সমালোচকরা কি তার কখনও প্রতিবাদ করেছেন? প্রচার মাধ্যমে কেবল হাদিস নয়, কুরআনের বহু গুরুত্বপূর্ণ আয়াতকে পাকিস্তান আমল থেকে এ পর্যন্ত ব্ল্যাকআউট করে আসা হচ্ছে তারও কি কোনওদিন প্রতিবাদ করেছেন? রেডিও টিভিতে সাধারণ মানুষের কি করতে হবে না করতে হবে সে সম্পর্কিত আয়াতগুলো পুনঃ পুনঃ প্রচার করা হয়, কিন্তু রাষ্ট্রের ক্ষমতাসীনদের, আইনপ্রণেতাদের, শাসক এবং বিচারকদের কি করতে হবে না হবে সে সম্পর্কিত আয়াতগুলো প্রচার করা হয় না। যেমন, ‘চোর ও চোরণীর হাত কেটে ফেলো (৫.৩৮)’, ‘ব্যভিচারিণী ও ব্যভিচারী তাদের দুজনের প্রত্যেককে একশটি চাবুক মারবে, আল্লাহর বিধান কার্যকর করতে গিয়ে তাদের দুজনের প্রতি দয়া যেন তোমাদের প্রভাবিত না করে, যদি তোমরা আল্লাহ ও পরকালে বিশ্বাসী হও, আর মুমিনদের একটি দল যেন ওদের দুজনের শাস্তি প্রত্যক্ষ করে (২৮.২)ঞ্চ, ‘আল্লাহ যা নাজিল করেছেন তদনুযায়ী যারা হুকুম না করে তারা কাফির (৫.৪৪)ঞ্চ প্রভৃতি অনেক আয়াত কোনওদিন প্রচারিত হতে দেখি না এবং বাধ্যতামূলক হওয়া সত্ত্বেও রাষ্ট্র ও সমাজে আল্লাহর এসব বিধান কার্যকর করতেও দেখি না। এ সম্পর্কে অবশ্য আল্লাহ আগে থেকেই বলে রেখেছেন, ‘আমি যেসব স্পষ্ট বিধান ও পথনির্দেশ নাজিল করেছি মানুষের জন্য কিতাবে, তা স্পষ্টভাবে ব্যক্ত করার পরও যারা তা গোপন রাখে, আল্লাহ তাদেরকে লানত (অভিশাপ) দেন, এবং লানতকারীরাও তাদেরকে লানত দেয় (২.১৫১)।’

বইটির সমালোচনা করতে গিয়ে বড়মামা কেবল বইয়ের লেখকদের যুক্তি খণ্ডন করে এবং তাদের প্রশ্নের উত্তরে কঠিন প্রশ্ন করে ক্ষান্ত হননি। আজকের যুগে ধর্ম মানছি, কিন্তু আমি মৌলবাদী নই বলে অধিকাংশ মানুষ যে নিজেদের বেশ আধুনিক বলে দাবি করছে এবং কোরান থেকে ভাল ভাল কিছু বাক্যের উদাহরণ দিয়ে আল্লাহ যে কত ভাল কথা বলেছেন তার উদাহরণ দিচ্ছেন, তাদের উদ্দেশেও বেশ যুক্তিপূর্ণ কথা লিখেছেন বড়মামা। লিখেছেন, ‘কুরআনের কিছু কিছু অংশে বিশ্বাস করলে, মেনে চলতে বললে আজকাল কেউ মৌলবাদী হয় না, কিন্তু এই একই কুরআনের অপর কিছু অংশে বিশ্বাস করলে, মেনে চলতে ও কার্যকর করতে বললে সে মৌলবাদী হয়ে যায় এবং ইসলামের কোনও কোনও স্বঘোষিত রক্ষক আবার মৌলবাদী হতে রাজি নন, লজ্জা পান। অথচ ইসলামের ভেতর ভেজাল, নকল ও বিদআত আমদানি, প্রবর্তন ও লালন পালন করতে লজ্জা পান না, কারণ ওসব করলে কেউ মৌলবাদী বলবে না। কিন্তু কুরআনেই বলা হয়েছে, কুরআনের সমস্ত অংশই মানতে হবে। বলা হয়েছে, ‘তবে কি তোমরা কিতাবের কিছু অংশে বিশ্বাস কর এবং কিছু অংশকে প্রত্যাখ্যান কর? তাহলে তোমাদের যারা এরূপ করে তাদের একমাত্র প্রতিফল পার্থিব জীবনে হীনতা এবং কিয়ামতের দিন তারা কঠিনতম শাস্তির দিকে নিক্ষিপ্ত হবে(২.৮৫)।’ কুরআনের কোনও একটি অংশকে তুচ্ছ করা বা না মানা পুরোটাই তুচ্ছ করা ও না মানারই সামিল। কুরআনেই এদের সম্পর্কে বলা হয়েছে ‘এরাই তারা যারা তাদের আচরণ ও কাজকর্মের মাধ্যমে বলতে চায় আমরা কতক অংশে বিশ্বাস করি ও কতককে প্রত্যাখ্যান করি, এবং চায় মধ্যবর্তী কোনও পথ অবলম্বন করতে। প্রকৃতপক্ষে তারাই কাফির (৪.১৫০,৪.১৫১)।’

বড়মামার বক্তব্য যে কোনও মৌলবাদীরই পছন্দ হবে। কিন্তু বড়মামার উদ্দেশ্য মৌলবাদিদের খুশি করা নয়, যারা ধর্মেও আছে জিরাফেও আছে মূলত তাদের অখুশি করা। আজকের কিছু কিছু বুদ্ধিজীবী, রাজনীতিবিদ, সমাজবিদ যেভাবে ধর্মের গুণগান গাইছেন এবং ধর্মীয় সন্ত্রাসের জন্য দোষ দিচ্ছেন মৌলবাদীদের, তাদের জন্যই লেখা এটি। তাঁরা আমার এবং বড়মামার দুজনেরই বিশ্বাস মৌলবাদীদের চেয়েও বেশি ক্ষতিকর, বেশি ভয়ংকর। ‘মুসলমানদের ধর্মবিশ্বাস অনুসারে কুরআন তো অভ্রান্ত, অকাট্য ও সন্দেহাতীতভাবে হুবুহু আছে এবং চিরদিন থাকবে, কুরআন অপরিবর্তনীয়, এর সুস্পষ্ট বিধানগুলো অপরিবর্তনীয়। কুরআনের কিছু কিছু অংশ ব্ল্যাক আউট করলে কিংবা কুরআনে আল্লাহর দেয়া স্পষ্ট আইনগুলোর বদলে পাশ্চাত্যের দেয়া আধুনিক আইনের মাধ্যমে কেউ শাসন ও বিচার কাজ চালালে সে যে মুসলিম নয় এটাতো কুরআনেরই কথা। কুরআনই তো বলে, সে কাফির(৫.৪৪), জালিম (৫.৪৫) এবং ফাসিক(৫.৪৭)।’

লেখাটি শেষ করেছেন খুব গুরুত্বপূর্ণ কথা বলে, ‘পাকিস্তান আমলে ১৯৪৭ থেকে ১৯৭১ পর্যন্ত ২৪ বছর এবং বাংলাদেশের ধর্মনিরপেক্ষতা বাদ দেয়ার পর ১৯৭৫ থেকে এ যাবৎ ১৮ বছর নিয়ে মোট ৪২ বছরে ইসলামি বিধান চালু না করে শুধু বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম আর রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম এর নামে মুসলমানদের চোখে ধুলো দেওয়া হয়েছে। ইসলামি আইন ও ইসলামি বিধানের কথা যারা বলে তাদেরকে মৌলবাদী খেতাবে ভূষিত করা হয়েছে। রাষ্ট্রপতি এরশাদের শাসনকালে রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম বিল পাসের সময় সংসদে সমাপনী ভাষণে তখনকার প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, মৌলবাদকে ঠেকানোর জন্য এই বিল আনা হয়েছে। এরা কি মুমিন মুসলিম না কি মুসলিম নামধারী আধুনিক পশ্চিমা ভাবধারার অনুসারী মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ, স্যার সৈয়দ আহমদ, স্যার মোহাম্মদ ইকবাল প্রমুখের ভাবশিষ্য? তবে আর যাই হোক, এই আধুানতাকাবাদী ধর্মব্যবসায়ীরা মৌলবাদের আগা কেটে গোড়ায় পানি ঢালছেন, ফলে মৌলবাদের গাছটি কিন্তু ক্রমেই তরতাজা হয়েই বাড়ছে।’

বড়মামার সঙ্গে আমি সম্পূর্ণ একমত। তিনি নাস্তিক এ কথা আমি জানতাম, কিন্তু তাঁর আক্রমণ যে ধর্ম দিয়েই বকধার্মিকদের এমন আচ্ছ! করে পেটানো এবং হাতিয়ারটি যে বড়মামার এত ধারালো তা আমার জানা ছিল না। বড়মামার সঙ্গে আগে কখনও আমার ধর্ম নিয়ে কোনও বিস্তারিত আলোচনা হয়নি। ইদানীং আমার লেখা পড়ে বড়মামারও আগ্রহ জন্মেছে, বড়মামার লেখা পড়ে আমারও। বাড়িতে এলেই সোজা আমার লেখার ঘরে ঢুকে যান বড়মামা। কোরানের নারী নতুন একটি বই লিখছি আমি, কোরানে নারী সম্পর্কে যে সব আয়াত আছে, সেসবের উল্লেখ করে সেসব বিষয়ে মন্তব্য কেবল। লেখাটি, যেহেতু আরবি জানেন ভাল, তাঁকে দেখাই। কোরান বড়মামার নখদর্পনে। তিনি মুখস্ত আওড়ে যান কোরানের আয়াত এবং আয়াতের ব্যখ্যা। কোরানের প্রতিটি শব্দ ধরে ধরে অনুবাদ করেন। আমার পাণ্ডুলিপিতে চোখ বুলিয়ে বড়মামা কয়েকটি ভুল খুঁজে পেয়েছেন। ইসলামিক ফাউণ্ডেশনের বাংলা কোরান অনুবাদ, কলকাতা থেকে প্রকাশিত বাংলা ইসলামি ফাউণ্ডেশন ট্রাস্টের কোরান, মাওলানা মওদুদির অনুবাদ সব তুলনা করে মিলিয়ে আমি আরবির অনুবাদ উদ্ধার করেছি, কিন্তু এই উদ্ধারের পরও আরও উদ্ধার করা যায় যদি ভাষাটি জানা থাকে ভাল। বড়মামা ভাষাটি জানেন বলে তিনি কোন আরবি শব্দকে ভাবান্তর করে কোন অনুবাদক কোনও একটি মোলায়েম অর্থ দাঁড় করিয়েছেন কোনও আয়াতের, সেগুলোও ধরে ফেলতে পারেন। মেয়েদের যখন মারবে তখন খুব আস্তে করে মারবে, মুখমণ্ডলে মেরো না — এরকম একটি অনুবাদ পড়ে বড়মামা হেসে বললেন, কোরানে আস্তে করে মারার কথা লেখা নেই, আস্তে করে শব্দদুটি অনুবাদক যোগ করেছে। যত পুরোনোকালের বাংলা কোরান পাওয়া যায়, তত সঠিক অনুবাদও পাওয়া যায়। দিন যত যাচ্ছে, যত আধনিক হচ্ছে সমাজ, মেয়েদের অধিকারের কথা উঠছে, ইসলামে নারীর মর্যাদা দেওয়া হয়েছে এই দাবি করছেন ইসলামি পণ্ডিতরা, এই পণ্ডিতরাই কোরান অনুবাদের সময় নিজে থেকে আল্লাহর নিষ্ঠুরতা আড়াল করার দায়িত্ব নিয়েছেন। যেন আল্লাহ যদি আস্তে করে মারার কথা বলেন, আল্লাহকে খুব দরদী মনে হবে। আরবি ভাষাটি না জানলে আজকালকাল পণ্ডিতের আল্লাহর ওপর নাপতানিগুলো আবিস্কার করা যায় না। কোথাও কোন আয়াতের বাংলা অনুবাদে ভুল আছে কি না তা আরও সুক্ষ্ণভাবে দেখে দিতে বড়মামা আমার পুরো পাণ্ডুলিপি তাঁর বাড়িতে নিয়ে যান। কয়েকদিন পর কিছু কিছু শব্দের ভুল শুদ্ধ করে নিয়ে আসেন। পাণ্ডুলিপি হাতে নিতেই বুঝি তিনি বেশ পরিশ্রম করেছেন এর পেছনে।

শয়তানের আয়াত নিয়ে কথা হতে থাকে বড় মামার সঙ্গে। সুরা আল নাজলএর একুশ আর বাইশ নম্বর আয়াত দুটো কোরান থেকে উড়িয়ে দিয়ে নতুন আয়াত বসানো হয়েছে। কারণ মোহাম্মদ যে আয়াত উচ্চারণ করেছিলেন, সেগুলো তিনি পরে বলেছেন যে শয়তানের ছিল। মোহাম্মদের কানে কানে শয়তান উচ্চারণ করেছে আয়াত দুটো। মোহাম্মদ বুঝতে পারেননি কোন কণ্ঠস্বরটি আল্লাহর, কোনটি শয়তানের, অথবা তাঁর জিভে ভর করেছিল শয়তান, অথবা মাথায়, তাই কাবা শরীফের সামনে বসে তিনি উচ্চারণ করলেন..। কী উচ্চারণ করলেন, বড় মামাকে জিজ্ঞেস করি। বললেন, ‘তোমরা কি আল লাত, আল উযযা আর তিন নম্বর আল মানাতএর ব্যপারে চিন্তা ভাবনা করিয়াছো?’

‘এই টা কোরানে আছে, কিন্তু কোনটা বাদ দেওয়া হইছে?’

‘দিজ আর ইন্টারমিডিয়ারিস এক্সলটেড হুজ ইন্টারসেশন ইজ টু বি হোপড ফর। এইটা তো একুশ নম্বর, আর বাইশ নম্বরটা হচ্ছে, সাচ এস দে ডু নট ফরগেট। —এই আয়াত দুইটা পরে শয়তানের আয়াত বইলা বাদ দিয়া লেখা হইছে, আর ইওরস দ্যা মেইলস এণ্ড হিজ দ্যা ফিমেইলস? তোমাদের জন্য পুত্র সন্তান আর আল্লাহর জন্য কন্যা? এটা তো তবে প্রতারণা পূর্ণ বণ্টন!’

আমি জিভ কাটি লজ্জায়।

বড় মামা বলেন, ‘লাত, উযযা আর মানাত কে কোরাইশ বংশের লোকেরা আল্লাহর তিন কন্যা বলে বিশ্বাস করত। ওদের গডএর নাম তো আল্লাহ। আল্লাহ নামটা তো মোহাম্মদ ওদের কাছ থেকেই নিয়েছে, মানে মূর্তি পূজা যারা করত, যারা বহুঈশ্বরবাদী ছিল তাদের কাছ থেকে।’

‘মোহাম্মদের উদ্দেশ্যটা কী ছিল আল্লাহর তিন মেয়েরে সম্মান দেখানোর?’ প্রশ্ন করি।

বড় মামা বলেন, ‘সেই সময় মানে সেই আটশ খ্রিস্টাব্দে যে ইসলামিক স্কলাররা মোহাম্মদের জীবনী লিখে গেছে, ইবনে জারির আল তাবারি, আল ওয়াহিদি, ইবনে সাদ, ইবনে ইসাক, তাদের ভাষ্য, যে, ওই সময় মককায় মোহাম্মদের তেমন কোনও অনুসারী ছিল না, যারা ছিল তাদের বেশির ভাগই মোহাম্মদকে ছেড়ে চলে গেছে। তখন কোরাইশদের দলে টানার জন্য সে তাদের তিন দেবীর কাছে মাথা নোয়াইছে। মোহাম্মদ এইটা বলার পর কোরাইশরা খুশি ছিল তার ওপর।..’

‘আয়াতটা পাল্টাইল কখন?’

এমন সময় মা মা ঢোকেন ঘরে। আমরা চুপ হয়ে যাই। মা দুজনের মুখে চেয়ে জিজ্ঞেস করেন, ‘কী আলাপ করতাছ তোমরা?’

বড় মামা সঙ্গে সঙ্গেই বললেন, ‘এই তো ওর পিজিতে পড়ার কথা বলতেছি! পড়লে তো মেডিকেল কলেজের প্রফেসার হইতে পারতো!’

মার মুখটি মুহূর্তে প্রসন্ন হয়ে ওঠে, ‘চা খাইবা মেবাই?’

‘হ। এক কাপ চা দে।’

মা চা করতে চলে গেলেন।

ঘরে আবার শয়তানের আয়াত নিয়ে কথা চলতে থাকে।

‘সুরা হজ্জের বায়ান্ন আর তিপ্পান্ন আয়াতে তো আছে এই শয়তানের কথা। মোহাম্মদকে আল্লাহ বলতেছে, যে, আল্লাহ যত নবী রসুল পাঠাইছিল মোহাম্মদের আগে, সবাইরেই নাকি শয়তানে ধরছিল।’

হঠাৎ মার মুখটি দরজায়।

‘মেবাই তোমরা কী নিয়া কথা বলতাছ?’

আমি বলি, ‘না কিছু না, এমনি।’

‘আমি শুনলাম আল্লাহ মোহাম্মদ!’ বড়মামার দিকে তাকিয়ে মা ঝাঁঝালো কণ্ঠে বললেন, ‘তুমি নাসরিনরে কী শিখাইতাছ?’

বড় মামা ধীরে ধীরে বেরিয়ে যান ঘর থেকে, আমি পেছন পেছন যাই বলতে বলতে ‘আমারে আবার কি শিখাবে? এমনি আলাপ করতাছিলাম।’

‘মেবাই, কী নিয়া আলাপ করতাছিলা তুমরা? কী বুদ্ধি দিতাছ আমার মেয়েরে?’ মা আগুন-চোখে তাকান বড়মামার দিকে। বড়মামা মার চোখ থেকে চোখ সরিয়ে দেয়ালের চিত্রকর্মে, জানালার পর্দায়, দরজার হাতলে ফেলে রাখেন।

মার গলা চড়তে থাকে। ‘এত বড় সর্বনাশ করতাছ তুমি মেয়েটার? জানতাছ তো কী হইতাছে দেশে। অত বড় বড় মিছিল যায়, দেখতাছ না? পত্রিকায় পড়তাছ না কি হইতাছে? তারপরও তুমি ওরে আল্লাহর বিরুদ্ধে লেখার পরামর্শ দেও? মেয়েডা বাইচা থাকুক তা চাও না? যে কোনওদিন তো ওরে মাইরা ফেলবে! নিজে যা বিশ্বাস কর, কর। আমার মেয়েরে তুমি নষ্ট বানাইও না। ওরে কুবুদ্ধি দিয়া যাও, আর ও এইসব লেখে। তুমি ওরে কুবুদ্ধি দিয়া দিয়া কোরানের বিরুদ্ধে, আল্লাহর বিরুদ্ধে লেখাইছ।’

আমি বলি, ‘আমি নষ্ট হইয়াই রইছি। আমারে নতুন কইরা নষ্ট বানানির কিছু নাই।’

বড়মামা মলিন মুখে বলেন, ‘আমি তো আল্লাহ সম্পর্কে খারাপ কথা কই নাই। যারা আল্লাহ নিয়া ব্যবসা করে, তারা কয় খারাপ কথা। তারা আল্লাহরে অসৎ কাজে ব্যবহার করে।’

সেদিন বড়মামার চা খাওয়া হয়নি। কথা ছিল ভাত খাবেন, ভাতও খাওয়া হয়নি। কাজ আছে বলে ভর দুপুরে বেরিয়ে গেলেন। এরপর বড়মামা এলে মা আগেই সতর্ক করে দেন যেন আমার সঙ্গে কোরান হাদিস বিষয়ে কোনও কথা না বলেন তিনি। একদিন বড়মামা এলেন শুক্রবারে। মাথায় একটি টুপি ছিল, সেটি খুলে, মার সামনে পকেটে পুরতে পুরতে বললেন, ‘আজকাল মসজিদে নামাজ পরার জন্য জায়গাই পাওয়া যায় না। এত ভিড়।’

মা নরম গলায় জিজ্ঞেস করেন, ‘তুমি কি মসজিদ থেইকা আইলা?’

বড়মামা বলেন, ‘হ। জুম্মাহ পইরা আইলাম।’ শুনে মার মুখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। মুখে মধুর একটি হাসি।

আমি জোরে হেসে উঠি। বড়মামা গম্ভীর কণ্ঠে বলেন, ‘হাসস কেন? হাসির কি হইল? আমি তো পাঁচবেলা নামাজ পড়ি।’

এবার আরও জোরে হাসি।

মা বলেন, ‘নাসরিনডার যে কি হইব? ওর তো দোযখেও জাগা হইব না। মানুষ তো শুধরায়। মেবাইএর মত মানুষ যদি নিজের ভুল বুঝতে পাইরা তওবা কইরা নামাজ ধরতে পারে। তাইলে তুই কেন তওবা এখনও করস না?’

মা সেদিন বড়মামাকে বেশ আদর করে ভাত মাছ খাওয়ান। খাওয়ার পর ঢেঁকুর তুলতে তুলতে বড় মামা উঁকি দেন আমার লেখার ঘরে। ঢুকে জোরে জোরে বলেন, ‘কি, সারাক্ষণ লেখা নিয়া থাকলেই চলবে! স্পেশালাইজেশনের জন্য তো গাইনিটাই ভাল। ডাক্তারি বিদ্যাটা এমন একটা বিদ্যা যেইটা দিয়া মানুষের সেবা অনেক বেশি করতে পারবি!’

‘ওই লেখাপড়া আমার আর হবে না।’ বলে আমি উদয় হওয়া একটি প্রশ্ন প্রায় করতে নিচ্ছিল!ম যে, ‘মোহাম্মদ মককা জয় করার পর যে আবদুল্লাহ নামের একটা লোকরে কতল করছিল, সেইটা কি সেই আবদুল্লাহ যে আবদুল্লাহ মোহাম্মদের আয়াত সংশোধন করত? আল্লাহর বাণী আবার সংশোধনের দরকার পড়ে কেন, এই প্রশ্নটা তার মনে জাগছিল বইলা যে পরে ইসলাম ত্যাগ করছিল?’ প্রশ্ন করার সুযোগ হয় না আমার। মা ঢোকেন। উদ্ভাসিত মুখ মার। বলেন, ‘মেবাই তুমি একটু নাসরিনরে বোঝাও ও যেন নামাজ শুরু করে।’

বড়মামা বলেন, ‘হ। নামাজ ত পড়া উচিত। এখন তো হাঁটাচলা বেশি হয় না ওর। নামাজ পড়লে শরীরের ব্যয়ামটা তো অন্তত নিয়মিত হয়।’

কথাটি মার পছন্দ হয় না।

মা আমাকে নামাজ পড়তে বলেন, কিন্তু কোরান যখন পড়ি, তিনি আঁতকে ওঠেন। টেবিলে ওপরে কোরান খোলা, এই একটু উঠে ও ঘরে গেলাম তো ফিরে এসে দেখি কোরান নেই, বিছানায় শুয়ে কোরান পড়ছি, পড়তে পড়তে ঘুমিয়ে গেছি, ঘুম ভাঙলে দেখি বিছানায় কোরানটি নেই। শেষ পর্যন্ত কোরান উদ্ধার করি মার আলমারি থেকে। তিনি লুকিয়ে রেখেছিলেন।

‘কোরান শরীফ লুকাইয়া রাখো কেন?’

‘কোরান শরীফ পড়ছ কেন এত?’ সংশয়াপন্ন মার কপালে দুটো ভাঁজ।

‘বাহ, কোরান পড়া তো ভাল। সওয়াব হয়।’

‘তুই তো আর সওয়াবের জন্য পড়ছ না।’ মা বিরক্ত-কণ্ঠে বলেন।

হাসতে হাসতে বলি, ‘ছি ছি আর কইও না। আল্লাহ যদি জানেন যে তুমি কোরান পড়তে কাউরে বাধা দিতাছ তাইলে তোমারে হাবিয়া দোযখে নিক্ষেপ করবেন তিনি।’

মা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন, ‘না হয় আমি হাবিয়া দোযখে যাই, তুই বেহেসতে যাওয়ার চেষ্টা কর।’

‘ওইটা চিন্তা কইর না। আল্লাহর সাথে কনটাক্ট হইছে আমার। বেহেসতের ব্যবস্থা পাককা। সেইদিন আল্লাহ আমারে জানাইলেন যে জান্নাতুল ফেরদাউসের লিস্টে চার নম্বরে আমার নাম।’

‘তাইলে তো ভাল। বেহেসতে যদি নাম থাকে।’

‘হ। তুমি তো দোযখের আগুনে পুড়তে থাকবা, আর আমি বেহেসতে। আল্লাহর কাছে তোমারে বেহেসতে আনার জন্য আমার তদবির করতে হবে।’

মা ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠেন, বলেন, ‘নাসরিন তর পায়ে পড়ি কোরানের বিরুদ্ধে আর কিছু লিখিস না। কোরান তো তরে কিছু করে নাই। মোল্লারা করতাছে মোল্লাদের বিরুদ্ধে লেখ।’

আমি সরে যাই মার কান্নার কাছ থেকে।

মাকে প্রায়ই দেখি জায়নামাজে বসে মোনাজাতের হাত তুলে চোখ বুজে বিড়বিড় করতে করতে ফুঁপোচ্ছেন। একদিন বিড়বিড়ের কাছে কান পেতে শুনি, বলছেন, ‘আল্লাহ তুমি আমার মেয়েরে কাফের বানাইও না। আল্লাহ তুমি আমারে মেয়েটারে কাফেরের সঙ্গ থেকে মুক্ত কর। আল্লাহ তুমি আমার মেয়ের বেহেসত নসীব কর। আল্লাহ তুমি আমার মেয়েরে সুমতি দাও, জ্ঞান দাও। আল্লাহ তুমি আমার মেয়ের হৃদয় মোহর করে দিও না।’

মার জন্য মায়া হয় আমার।
 
২২. ইস্তফা


সেই যে বিমানবন্দরে আমার পাসপোর্ট নিয়ে নিল পুলিশের লোকেরা আর আমাকে বলে দিল পরদিন যেন পাসপোর্ট ফেরত নিই মালিবাগের স্পেশাল ব্রাঞ্চের আপিস থেকে, পরদিন সেই আপিসে গিয়ে যখন আমার পাসপোর্ট চাইলাম, লোকেরা কিসের পাসপোর্ট কোন পাসপোর্ট, বলে দিল, কিছুই জানে না। পরদিন আবার গেলাম। তখনও পাসপোর্টের খবর নেই। পরদিন আবার।

‘আমার পাসপোর্ট নিয়ে যাবার কথা এখান থেকে। আমার পাসপোর্টটা দিন।’

‘পাসপোর্ট ওপরে আছে। ওখান থেকে পাঠালেই আপনি নিয়ে যেতে পারবেন।’

‘ওপরে মানে? কোন ওপরে?’ মাথার ওপরে কাঠের তাকে কয়েক টন কাগজের দিকে তাকাই।

‘আরে না, এই ওপরে না, এই ওপরে না।’

‘তাহলে কোন ওপরে?’

লোকটি পাজামা পাঞ্জাবি পরা, এক গাল হেসে বললেন, ‘স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে।’

‘ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে বুঝি ওপর বলেন! তা ওপর থেকে কারা পাঠাবে পাসপোর্ট?’ ‘ওপরঅলারা।’

কয়েকদিন জুতোর সুকতলি খর্চা করে আমাকে এই শুনতে হল। পাসপোর্ট ওপরে আছে। ওপর থেকে আমার পাসপোর্টটি নিচে পাঠানোর অনুরোধ করে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে সরাসরি একটি আবেদনপত্র পাঠিয়ে দিই। আমার আবেদনে কোনও সাড়া কেউ দেয় না। পাসপোর্ট হাতে পেলেই বা কি লাভ! বহির্বাংলাদেশে ছুটিও তো পেতে হবে! ছুটি চেয়ে আবেদন করার পর স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে প্রতিদিন যাচ্ছি। মহাপরিচালক হয় ব্যস্ত, নয় এখনও আপিসে আসেননি। এরপরও ঘন্টার পর ঘন্টা অপেক্ষা করে যেদিন তাঁর দেখা মিলল, মুখোমুখি হই।

‘কি ব্যপার, কি চাই?’ মহাপরিচালক চশমার ফাঁক দিয়ে আমাকে দেখেন।

‘সই চাই।’

‘কিসের সই?’

‘অনেকদিন হল আমি একটা দরখাস্ত দিয়ে রেখেছি এক্সবাংলাদেশ লীভের জন্য। সই করে দেন।’

‘সই করা যাবে না।’

বুকে আমার একটি পাথর ছোঁড়ে কেউ। একটি যন্ত্রণা বুক বেয়ে কন্ঠদেশ বেয়ে চোখে উঠে আসে। তাহলে কলকাতার অনুষ্ঠানে যাওয়া আমার হচ্ছে না!

‘কেন যাবে না সই করা?’ প্রশ্নটি করি।

‘ওপর থেকে অনুমতি এলে সই করব।’

‘কোন ওপর থেকে?’

‘স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে।’

‘অন্য কোনও ডাক্তারের বেলায় কি সই দিতে ওপরের অনুমতি লাগে?’

মহাপরিচালক তাঁর কালো চশমাটি খুলে ফেললেন। আমি খুব বেয়াদবের মত এই প্রশ্নটি করেছি বলে তাঁর ধারনা। কঠিন কণ্ঠে বললেন, ‘না কারও জন্য ওপরের অনুমতির দরকার হয় না। কিন্তু আপনার জন্য দরকার হয়।’

কেন হয়? এই প্রশ্নও আমি করি।

তিনি এবার তাঁর টেবিলের একটি কাগজের দিকে ঝুঁকে বললেন, ‘নিজেই আপনি জানেন।’

‘না, আমি তো জানি না। আমার জন্য আলাদা নিয়ম কেন, তা আমার জানার ইচ্ছে।’ মহাপরিচালকের মুখের দিকে আমি তাকিয়ে থাকি উত্তরের আশায়।

তিনি তাঁর চিবুক উঁচু করে ধরেন।

‘তাহলে এক কাজ করেন। নিজেকে প্রশ্ন করতে থাকেন। উত্তর একসময় পাবেন।’

‘উত্তর আমাকে নিজে পেতে হবে কেন, যেহেতু এটা আপনাদের তৈরি করা নিয়ম, সেহেতু আপনাকেই জানাতে হবে উত্তর।’

যেন তিনি আমার কথা শোনেননি, এমনভাবে, বসে থাকা অন্যান্যদের দিকে তাকিয়ে হঠাৎ কথা বলতে শুরু করলেন, ‘কি খবর আপনার! ওদিকে এখন কেমন অবস্থা? গরম পড়েছে আজকাল খুব। হে হে হে হে।’

মহাপরিচালকের হেহেহে তখনও শেষ হয়নি, আমি প্রশ্ন করি, ‘হেলথ মিনিস্টি থেকে পারমিশান দেওয়া হচ্ছে না কেন? এর কারণ কি?’

এবার মুখ ফেরান আমার দিকে, চোয়ালভাঙা মহাপরিচালকের চোয়াল শক্ত হয়ে ওঠে টেবিলের ওপর তাঁর হাতের তলে যে ফাইলটি, সেটি খুলে আমার দরখাস্তের একটি কপি তুলে নিয়ে বললেন, ‘সই করে মিনিস্ট্রিতে আপনার দরখাস্ত পাঠালেই কি না পাঠালেই কি! আপনার ছুটি শুধু হেলথ মিনিস্ট্রির ব্যপার না। মেইনলি এটা হোম মিনিস্ট্রির ব্যপার। হোম মিনিস্ট্রি থেকে পারমিশান না পেলে আপনার ছুটি হবে না।’ টেবিলে আর কোনও ফাইল নেই, কেবল আমার ফাইলই। আশ্চর্য, আমার এই ফাইল কেন এত জরুরি এই অধিদপ্তরে! আমি ঘরে ঢোকার পর এই ফাইলটি তিনি খুঁজে বের করে টেবিলে রাখেননি। এটি রাখাই ছিল টেবিলে। অধিদপ্তরে সব ডাক্তারের একটি করে ফাইল থাকে। ফাইল খুললেই ডাক্তারের চাকরি এবং বদলি সংক্রান্ত কাগজ বেরোয়। যখন হৃষ্টপুষ্ট ফাইলটি খুলে আমার দরখাস্তটি দেখালেন, ফাইলের ভেতর পত্রিকার অনেকগুলো কাগজ চোখে পড়ল। পত্রিকার কাগজ আমার ফাইলে কেন!

এরপর আরও আরও দিন যেতে থাকি মহাখালির স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে। হাসপাতালের ডিউটি শেষ করে সোজা মহাখালি। প্রতিদিন বাড়ি ফিরি শেষ বিকেলে। মা আমার শুকনো মুখ দেখে জিজ্ঞেস করেন, ‘এত দেরি কইরা ফিরস কেন আজকাল। সেই যে সকালে দুইডা বিস্কুট খাইয়া গেছস। সারাদিন ত পেটে কিছু পড়ে নাই।’ মা রান্নাঘরে দৌড়ে যান, আমার জন্য ভাত তরকারি বেড়ে নিয়ে আসেন। ক্ষুধার্ত পেট কোনওরকম শান্ত করে লম্বা হয়ে শুয়ে পড়ি বিছানায়। পরদিন গিয়ে আমাকে আবারও শুনতে হয় ওপরের অনুমতি জোটেনি। ওপরের অনুমতি জোটাতে হলে ওপরে যেতে হয়। ওপরে গিয়েও দেখি আমাকে অনুমতি দেওয়া হচ্ছে না ভেতরে ঢোকার। না স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে। না স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ে।

এদিকে ইনকিলাবে আমার পাসপোর্টের ছবি ছেপে লিখেছে আমি ভুয়া পাসপোর্ট নিয়ে বিদেশ যেতে চেয়েছিলাম। সরকার যেন আমার জন্য একটি কড়া শাস্তির ব্যবস্থা করে। আমার পাসপোর্ট আমার নাগালে নেই, তা ইনকিলাবের নাগালে কি করে যায়! তাহলে কি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ের সঙ্গে ইনকিলাবের বেশ দহরম মহরম। স্বরাস্ত্রমন্ত্রী আবদুল মতিল চৌধুরী নিজে একজন রাজাকার ছিলেন একাত্তরে। পাকিস্তানি বাহিনীর হয়ে মুক্তিযুদ্ধের সময় কাঁচপুর সেতু পাহারা দিতেন তিনি। আজ তিনি মন্ত্রী হয়েছেন এ দেশের, যে দেশের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে তিনি একদা লড়েছিলেন। সেই যে জিয়াউর রহমান শুরু করেছিলেন রাজাকারদের ক্ষমতায় বসাতে, সেই থেকে চলছে রাজাকারের রাজত্ব। এখন মুক্তিযোদ্ধারা পড়ে থাকেন পঙ্গু হাসপাতালে, রাজাকাররা মন্ত্রণালয়ে। আশঙ্কারা পিলপিল করে আমার শরীর বেয়ে ওঠে, লোমকূপে বাসা বাঁধে। ইনকিলাবের লোকেরা ভাল জানে যে এটি কোনও ভুয়া পাসপোর্ট নয়। পেশা আমি ডাক্তারি না লিখে কেন সাংবাদিকতা লিখেছি, সেটি নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে। পাসপোর্টে আমার নাম, আমার বাবার নাম, আমার উচ্চত!, আমার ঠিকানা, বয়স, এমন কী আমার বাঁ চোখের ওপর আমার কালো তিলটির কথা লেখা। কিছুই অসত্য নয়। আমার পেশাতেও কিন্তু অসত্য কিছু নেই। সাংবাদিকতাও আমার পেশা। এটি আমার পছন্দের পেশা বলে পাসপোর্টে পেশার ঘরে ডাক্তারি না বসিয়ে সাংবাদিকতা বসিয়েছি। ইনকিলাবের লোকেরা, আমি যে শাস্তি পাওয়ার যোগ্য, তার কারণ হিসেবে কেবল আমার পাসপোর্টটি ভুয়া এই বলেই শেষ করেনি, আমার লেখার উদ্ধৃতিই দিয়েছে বেশি। ধর্ম নিয়ে, দুই বঙ্গ নিয়ে, সরকারের সাম্প্রদায়িকতা নিয়ে এ যাবৎ যা লিখেছি, সেসব থেকে উদ্ধৃতি। যেহেতু আমি এসব লিখি, তাই সরকার যেন অচিরে আমাকে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিয়ে দেশ ও জাতির সেবা করেন। দৃষ্টান্তমূলক শাস্তিটি কি হতে পারে, তাও ইনকিলাবের লোকেরা বলে দিয়েছেন, ফাঁসি। মাওলানা মান্নানের পত্রিকা ইনকিলাব, সেই মাওলানা মান্নান, একাত্তরে যিনি ছিলেন পাকিস্তানী বাহিনীর জানি দোস্ত। আজ তিনি প্রচার মাধ্যমের মোগল। আশঙ্কারা আমাকে টুকুস টুকুস করে কামড় দেয়। আশঙ্কারা আমার ত্বক কেটে ঢুকে পড়ে শরীরের ভেতর, আমার হৃদপিণ্ডে, ফুসফুসে, আমার রক্তে, আমার মস্তিস্কের কোষে কোষে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে তারপরও আমি যাই। না, ওপর থেকে আমার বহির্বাংলাদেশ ছুটি মঞ্জুর করার জন্য কোনও অনুমতি দেওয়া হয়নি। মহাপরিচালক সোজাসুজি বলে দিলেন, আপনার ছুটি মঞ্জুর হবে না। কেন হবে না? ইনকিলাবে লেখালেখি হচ্ছে, তাই হবে না। আশ্চর্য ইনকিলাব কি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের মা বাপ! আমার ব্যপারে সিদ্ধান্ত নেবে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। ডাক্তার হিসেবে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কোনও নিয়ম আমি মেনেছি কি মানিনি, যদি না মানি, তার শাস্তি কি হবে, তা দেখার দায়িত্ব স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের, ইনকিলাবের নয়। অবশ্য বহির্বাংলাদেশ ছুটির আর প্রয়োজন নেই ততদিনে। কলকাতার অনুষ্ঠান শেষ, দেশের কবিরা দেশে ফিরে এসেছেন।

অগত্যা পাসপোর্টটি ফেরত পেতে, অর্থাৎ আমার নাগরিক অধিকারটি ফেরত পেতে মালিবাগের স্পেশাল ব্রাঞ্চের আপিসে আবারও যাই। গিয়ে দেখি আবদুস সাত্তার লোকটি, যে লোকটি ওপর থেকে আমার পাসপোর্ট আসার কথা আমাকে বলেছিলেন, বই পড়ছেন খুব মন দিয়ে। বইয়ের বাক্যে বাক্যে লাল কালির দাগ। হাতে তাঁর একটি লাল কলম। টেবিলের এক কোনায় যত বই আমি লিখেছি এ যাবৎ, সবগুলো বই। আমাকে দেখে লোকটি বই গুটিয়ে রাখার প্রয়োজন মনে করলেন না। আমি একটি চেয়ার টেনে সামনে বসে জানতে চাইলাম ‘পাসপোর্টের খবর কি, ওপর থেকে এসেছে?’

তিনি ওপরের প্রসঙ্গে না গিয়ে বললেন, তদন্ত চলছে।

‘কিসের তদন্ত?’

‘আপনার বই পড়ার হুকুম এসেছে। কোথায় আপত্তিকর কি কি লিখেছেন, সেসব দেখতে হচ্ছে।’

‘পাসপোর্টের সঙ্গে আমার বইয়ের সম্পর্ক কি?’

তদন্তকারী অফিসারের ঠোঁটের কিনারে একটি হাসি ঝিলিক দিয়ে মিলিয়ে গেল। তিনি এর কোনও উত্তর দিলেন না। খানিকপর বললেন, ‘ধর্ম নিয়ে আপনি খুব বাড়াবাড়ি করে ফেলেছেন!’

‘মানে?’

‘খুব বাজে কথা লিখেছেন। এইসব লেখেন কেন?’

‘আমি যা বিশ্বাস করি, তা লিখি। কিন্তু আমার লেখার সঙ্গে তো পাসপোর্ট না দেওয়ার সম্পর্ক থাকতে পারে না। পারে কি?’

আবদুস সাত্তার আমার প্রশ্নের কোনও উত্তর দেবার প্রয়োজন মনে করেননি। কিন্তু স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে গিয়ে আমার প্রশ্নের উত্তর আমি পেয়েছি। মহাপরিচালক আমাকে দেখে মধুর হাসি উপহার দিয়ে বললেন, ‘এইতো বিখ্যাত লেখিকা এসে গেছে। বসেন বসেন।’

আমি মহাপরিচালকের রসিকতার ঝাঁজ সামলে নিয়ে চেয়ারে বসি।

‘আপনার কলাম তো পড়ি পত্রিকায়।’ মহাপরিচালক হাসলেন বলতে বলতে।

ও। ও শব্দটি উচ্চারণ করে আমি চুপ হয়ে থাকি।

‘আপনি যে পত্রিকায় লেখেন, কিভাবে লেখেন?’

‘কিভাবে লিখি মানে! আগে হাতে লিখতাম। এখন কমপিউটারে লিখি।’

‘বেশ ভাল কথা, এখন কমপিউটারে লেখেন। আপনি তো শুধু পত্রিকায় লেখেন না, বইও তো লেখেন।’

‘হ্যাঁ লিখি।’

‘সরকারের কাছ থেকে পারমিশান নিয়েছেন?’

‘তার মানে?’

‘এই যে লেখেন, পত্রিকায় কলাম লেখেন। সরকারের পারমিশান ছাড়া লেখেন?’

আমার কপালে ভাঁজ পড়তে থাকে। এ সব কী শুনছি!

‘সরকারের পারমিশান লাগবে নাকি লিখতে হলে?’

‘নিশ্চয়ই। সরকারি চাকরি করেন, সরকারি পারমিশান ছাড়া কী করে লিখবেন! হ্যাঁ লিখতে পারেন, ঘরে বসে লিখতে পারেন। কিন্তু কোথাও ছাপার অক্ষরে বেরোনোর আগে সরকারের পারমিশান লাগবে।’

‘এরকম নিয়ম নাকি?’

‘হ্যাঁ এরকম নিয়ম।’

‘কিন্তু এত যে লেখক আছেন, পত্রিকায় লিখছেন, বই লিখছেন, তাঁরা তো অনুমতি নিচ্ছেন না সরকারের!’

‘আপনি জানেন কি করে যে নিচ্ছেন না!’

‘আমি জানি।’

‘নিচ্ছেন নিচ্ছেন।’

একটি যন্ত্রণা আমার ঠোঁটে উঠে এলে বলি, ‘কি করে অনুমতি নিতে হয়, বলবেন!’

‘যা ছাপতে চান, আগে তা সরকারের কাছে জমা দেবেন, তারপর যখন সরকার বলবে যে হ্যাঁ এই লেখা ছাপার জন্য পারমিশান দেওয়া গেল, তখন ছাপতে দেবেন। ভেরি সিম্পল।’

‘এই নিয়মটা কি কেবল আমার জন্যই নাকি?’

মহাপরিচালক অপ্রতিভ একটি হাসি ছুঁড়ে দিয়ে বললেন, ‘আপনার জন্য হবে কেন! এই নিয়ম সবার জন্য!’

‘যদি আমি পারমিশান না নিয়ে ছাপি লেখা, তাহলে কি হবে?’

‘তাহলে আপনি আইন অমান্য করলেন। আইন অমান্য করলে কি হয়, তা তো নিশ্চয়ই জানেন!’

আমি স্পষ্ট বুঝি যে মহাপরিচালক এসব কথা আমাকে বলছেন ওপরের আদেশ পেয়ে। ওপরের সিদ্ধান্তই তিনি আমাকে জানাচ্ছেন। তাঁর সঙ্গে আর কোনও কথা বলতে আমার ইচ্ছে হয় না। মাথা বনবন করে ঘুরতে থাকে। আমি বেরিয়ে যাই। মহাখালির মোড় থেকে একটি রিক্সা নিয়ে সোজা বাড়িতে। বাড়িতে কারও সঙ্গে আমার কথা বলতে ইচ্ছে করে না। মা খাবার নিয়ে আসেন। খাবো না বলে দিয়ে শুয়ে থাকি। জানালার দিকে মুখ করে শুয়ে থাকি। জানালার ওপারে আকাশ, আকাশে মেঘ উড়ে যাচ্ছে। কোথায় যাচ্ছে কে জানে! কী চমৎকার ওরা উড়ে যায় ঠিকানাবিহীন। নাকি মনে মনে ওদেরও কোনও ঠিকানা থাকে। হঠাৎ আমি শোয়া থেকে উঠে পড়ি। বুকের ভেতরকার ধ্বক ধ্বক শব্দ আমি চাইলেও থামাতে পারছি না। অস্থির পায়ে এঘর ওঘর করতে থাকি। বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াই, এদিক ওদিক তাকাই, তাকাই কিন্তু কিছুই আমার চোখে পড়ে না। সব কিছুই শূন্য শূন্য লাগে, যেন এক আকাশ ছাড়া আর কিছু নেই কোথাও। বিশাল আকাশটির তলে আমি একলা পড়ে আছি। ইচ্ছে হচ্ছে চিৎকার করে কাঁদি, কিন্তু কাঁদতে পারছি না। এসব মার নজরে পড়ে, আর কারওর না পড়লেও।

‘নাসরিন, কি হইছে?’ মা জিজ্ঞেস করেন।

‘কিছু না।’

‘কিছু একটা নিশ্চয়ই হইছে। আমারে বল কি হইছে।’

আমি জোরে ধমক দিই, ‘প্যাঁচাল পাড়বা না তো। কিছু হয় নাই।’

মা চুপ হয়ে যান।

এক গেলাস লেবুর শরবত বানিয়ে আমার হাতে দেন। শরবত ঢক ঢক করে খেয়ে আবার আমি বিছানায় কুকুর কুণ্ডুলি হই। মা পাশে বসে একটি হাত রাখেন আমার মাথায়। চুলে বিলি কেটে দিতে দিতে নরম গলায় বলেন, ‘এত অস্থির অস্থির করতাছ কেন? ঘুম ধরলে কিছুক্ষণ ঘুমাও।’

দীর্ঘশ্বাস বেরোয় আমার কণ্ঠ থেকে। নিজের একটি ম্লান কণ্ঠস্বর নিজেই শুনি, ‘মা, আমার লেখালেখি ছাইড়া দিতে হইব।’

‘কেন ছাড়তে হইব?’

‘আমার ওপর আদেশ জারি হইছে। তারা আমার জন্য নিয়ম খুইঁজা বাইর করছে। আইন দেখায়। সরকারি চাকরি করলে লেখালেখি করা যাবে না।’

‘তরে কত কইছি ধর্ম নিয়া লেখিস না। নারী নির্যাতন নিয়া লেখতাছিলি, তা তো ভালই ছিল। কেন খালি খালি ধর্মের সমালোচনা করতে গেলি! কথা কইলে তো শুনস না। এখন কি করবি? তাদেরে জানাইয়া দে, ধর্ম নিয়া আর লিখবি না, সরকারের বিরুদ্ধে কিছু লিখবি না বইলা দে।’

আমার ঘুম পায়। মার কথাগুলো ধীরে ধীরে খুব দূরের মনে হতে থাকে।

আমার সামনে এখন দুটি পথ। এক হল লেখা, আরেক হল সরকারি চাকরি। যে কোনও একটি আমার বেছে নিতে হবে। আমি লেখাকে বেছে নিই। কাউকে কিছু না বলে, কারও সঙ্গে কিছু না বুঝে, দেশের দ্য বেস্ট মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চাকরি রত অবস্থায় আমি একটি কাণ্ড করি, একটি সাদা কাগজ নিয়ে তাতে লিখি, মাননীয় মহাপরিচালক, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, বাংলাদেশ জনাব, বিনীত নিবেদন এই যে আমি, তসলিমা নাসরিন, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের অ্যানেসথেসিয়া বিভাগে কর্মরত মেডিকেল অফিসার য়েচ্ছ!য় সজ্ঞানে সরকারি চাকরিতে ইস্তফা দিচ্ছি। আমার এই ইস্তফা পত্র গ্রহণ করে আমাকে বাধিত করবেন। আশা করি অতি সত্ত্বর আমার এই ইস্তফাপত্র গ্রহণ করে আমাকে সরকারি নাগপাশ চাকরি থেকে মুক্ত করা হবে।

লিখে, সই করে, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে নিজে গিয়ে আমার ইস্তফাপত্র দিয়ে আসি। ইস্তফাপত্র কেবল দিলেই তো চলবে না, এটি গ্রহণ করা হল কি না, তারও খোঁজ নিতে হবে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে দিনের পর দিন গিয়েও ইস্তফা পত্রটি সরকারিভাবে গ্রহণের কোনও কাগজ আমার পাওয়া হয় না। কাগজটি পেলে আমি যে সরকারি চাকরিতে আর নেই, সে প্রমাণ দেখিয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয় থেকে আমার পাসপোর্ট ফেরত চাওয়ার দাবি করতে পারব। আমার এই ইস্তফার খবর পেয়ে বাবার মাথায় হাত, এ কি কাণ্ড করেছে মেয়ে, এর মাথা টাথা খারাপ হয়ে গেছে নাকি! বাড়ির সকলের ধারণা আমার সত্যিই মাথার ঠিক নেই। যেই শোনে, থ মেরে যায়। বন্ধুরাও। অবিশ্বাস্য একটি কাণ্ড বটে। সরকারি চাকরি লোকে হাজার তপস্যা করেও পায় না, সরকারি চাকরি পাওয়া যেমন কঠিন এবং যাওয়াও তেমন কঠিন। লোকে কয়েক লক্ষ টাকা ঘুষ দিয়েও পাঁচশ টাকার সরকারি চাকরি যোগাড় করতে চায়। মাসের পর মাস, বছরের পর বছর অনুপস্থিত থাকলেও, কাজে অবহেলা করলেও আর যাই যাক, সরকারি চাকরি যায় না, সরকারি চাকরি একটি মানুষের জীবনে সবচেয়ে বড় নিরাপত্তা, আর আমি কি না জীবনের সবচেয়ে বড় নিরাপত্তা, তাও আবার ফার্স্ট ক্লাস গেজেটেড অফিসার পদের এত ভাল একটি চাকরিটি শখ করে ছেড়ে দিয়েছি! হ্যাঁ দিয়েছি ছেড়ে, দ্বিতীয়বার আমি ভেবে দেখি না।

এর মধ্যেই হঠাৎ দেখি ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আমার পদটিকে শূন্য পদ উল্লেখ করে সেই পদে অন্য এক ডাক্তারকে পোস্টিং দেওয়া হয়েছে। বেশ ভাল কথা, এর মানে আমার ইস্তফা পত্র তোমরা গ্রহণ করেছো। আমাকে সাদরে ইস্তফা দিয়েছো, তাই আমার পদটিকে শূন্য পদ বলছো, এর মানে আমি ওই পদটিতে নেই, আমি তবে কোথায়, আমাকে তো কোথাও বদলিও করোনি, কোনও ডাক্তার মরে গেলেই পদটি শূন্য হয়। আমি তোমাদের কাছে মৃত একজন মানুষ। ইস্তফা দিলে তো মৃতই হয়, কিন্তু আমাকে কেন বলছো না যে ‘তোমাকে ইস্তফা দেওয়া হইল, তুমি এখন আমাদের সকল বদমায়েশি, সকল ষড়যন্ত্র, নোংরামি, সকল কুটিলতা জটিলতা হইতে মুক্ত!’ না সেরকম কোনও চিঠি আমার কাছে আসে না। কয়েক মাসের বকেয়া মাইনেও আমাকে দেওয়া হয় না। সরকারি রেভিন্যূ আপিসে অনেকদিন ধর্না দিয়েও আমি আমার পাওনা টাকা আদায় করতে পারি না। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে দেওয়া আমার ইস্তফাপত্রের একটি অনুলিপি আর ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আমার জায়গায় অন্য ডাক্তারকে চাকরি দেওয়ার কাগজটি পাঠিয়ে দিই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে, সঙ্গে আমার পাসপোর্ট ফেরত চেয়ে আবেদন। আমি তো এখন সরকারি চাকরি করছি না, আমি সম্পূর্ণ বেসরকারি মানুষ। পাসপোর্টে আমার যে পেশাটি দেওয়া আছে, পুরোদস্তুর সে পেশায় আমি নিয়োজিত। সুতরাং অনুগ্রহপূর্বক আটককৃত ছাড়পত্রটি এই অধমকে ফিরত দিয়া বাধিত করিবেন। তারপরও কোনও সাড়াশব্দ নেই। আমার পাসপোর্টও ফেরত দেওয়া হয় না। পাসপোর্ট আমি ফেরত চাই, দেশের বাইরে কোথাও যাওয়ার জন্য নয়, এটি আমার নাগরিক অধিকার বলে চাই। অধিকার কেড়ে নিয়ে অন্যায়ভাবে আমার পাসপোর্ট আটক করা হয়েছে এবং ততোধিক অন্যায়ভাবে আমি সরকারি চাকরিতে ইস্তফা দেওয়ার পরও আমার পাসপোর্ট ফেরত দেওয়া হচ্ছে না, সে কারণেই চাই। কিন্তু আমার কথা কে শোনে! সাড়াশব্দ না পেয়ে পাসপোর্ট আপিসে গিয়ে নতুন একটি পাসপোর্টের জন্য আবেদন করি। নাহ, নতুন কোনও পাসপোর্টও আমাকে দেওয়া হয় না।

একদিন, তখনও সরকার লজ্জা নিষিদ্ধ করেনি, নাহিদ, আইনের মেয়েটি, আমাকে বলল যে তার এক চেনা লোক আছে, লোকটি জামাতপন্থী, আবার সরকারের লোকদের সঙ্গেও বেশ ওঠাবসা আছে, লোকটি তাকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বাড়িতে রাত আটটার দিকে নিয়ে যেতে পারবে। নাহিদই চেনা লোকটিকে অনুরোধ করেছে এই ব্যবস্থাটি করার জন্য। সুতরাং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে আমার পাসপোর্ট নিয়ে নাহিদ একটি মোক্ষম সুযোগ পেয়েছে কথা বলার। ভাল কথা। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে পাঠানো আমার আবেদপত্রটির একটি অনুলিপি নাহিদ নিয়ে গেল তাঁর বাড়িতে। ঘন্টা দুই পর মেয়ে তার বিষণ্ন মুখটি নিয়ে ফেরত আসে।

কি হল?

‘বস, আপনের আবেদনপত্র উনি ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছেন।’

‘তাই নাকি!’

‘হ্যাঁ, বললেন, এই মেয়ে ধর্মের বিরুদ্ধে লেখে। আমাদের রাসুলল্লার বিরুদ্ধে জঘন্য সব কথা লেখে। একে তো পাসপোর্ট দেবই না। এর লজ্জা ব্যান করব।’

‘এই কথা বললেন?’

‘হ্যাঁ এই কথা বলে খুব জোরে জোরে হাসলেন।’

‘তুমি কিছু বললে না?’

‘বললাম, লজ্জা ব্যান করবেন কেন? ওতে কি কোনও আপত্তিকর কথা আছে? বললেন, আছে আছে নিশ্চয়ই আছে। বললাম, কিছু তথ্য দেওয়া, তথ্য তো উনি বানিয়ে লেখেননি। বললেন, তা হয়ত বানাননি। কিন্তু এভাবে কোন হিন্দুকে চড় দেওয়া হল, কোথায় গাল দেওয়া হল, কার বাড়ির বেড়ায় আগুন লাগল, এসব সব জানানো উচিত? মালাউনের বাচ্চারা তো লাই পেয়ে মাথায় উঠবে।’

নাহিদ একটি সিগারেট ধরায়। আরেকটি বাড়ায় আমার দিকে।

‘নাহ, সিগারেট খাবো না।’

‘আরে বস, খান খান। আপনি খুব টেনশানে আছেন। খেলে টেনশান কমবে।’

আমার বাড়ির কেউই নাহিদকে পছন্দ করে না। কারণ নাহিদ সিগারেট খায়। সিগারেট জিনিসটি আমারও পছন্দ নয়। কিন্তু নাহিদ আমার ঘরে বসে সিগারেট ধরাবেই এবং আমাকে এক টান দু টান তিন টান দেওয়ার জন্য সাধাসাধি করবে। বস বলে ডাকা আমি পছন্দ না করলেও সে আমাকে বস বলে ডাকবে। নাহিদ খুব সাহসী মেয়ে। সাহসী মেয়েদের আমার খুব ভাল লাগে। রাত বিরেতে সে তার নারায়ণগঞ্জের বাড়িতে বাসে করে রওনা হয়। আমি জিজ্ঞেস করি, তুমি কি ভয় পাও না নাহিদ?

‘বস, আপনার মুখে ভয়ের কথা মানায় না। ভয় পাবো কেন? কেউ কিছু করলেঞ্চ, নাহিদ তার হাত মুষ্ঠিবদ্ধ করে, ‘ঘুসি দিয়ে ফেলে দেব না!’

নাহিদের ডান হাতের ছ নম্বর আঙুলটি মুঠির বাইরে অসহায় পড়ে থাকে।

নাহিদ কখনও শাড়ি পরে না। জামা পাজামা ওড়না। পায়ে সেণ্ডেল। এই হল তার চিরাচরিত পোশাক। মুখে কখনও কোনও রং মাখে না সে। ফাঁক পেলেই আমার বাড়িতে চলে আসবে, বলবে, ‘বস, কিছু কাজ আছে? থাকলে বলেন, করে দিই।’ কাজ থাকলে করবে, না থাকলে গলা ছেড়ে গান গাইবে।

ঠিক ঠিকই লজ্জা নিষিদ্ধ হল। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী খ্যাক খ্যাক করে হেসে বললেন, ‘ওর বাকি বইও ব্যাণ্ড করব।’ দেশের স্বাধীনতার শত্রুটি আমাদের দণ্ডমুণ্ডের কর্তা। আজ তাঁর ভারি নিতম্বের তলে লেখকের লেখার স্বাধীনতা, তার মত প্রকাশের অধিকার থেতলে যাচ্ছে।

ভেবেছিলাম সরকারি চাকরিতে ইস্তফা দিলেই সরকারের রোষ মুক্ত হয়ে স্বাধীন ভাবে লেখালেখি করতে পারব। কিন্তু এই স্বাধীনতা আমাকে দেওয়া হবে কেন! আমি আপাদমস্তক বেসরকারি হলেও আমার গতিবিধির ওপর সরকারের কড়া নজর। একদিন স্পেশাল ব্রাঞ্চের দুটো লোক আমার শান্তিনগরের বাড়িতে উপস্থিত। প্রথম দরজা খুলিনি। এরপর এমন জোরে ধাককা দিতে শুরু করল দরজা, চিৎকার করে বলতে লাগল, ‘পুলিশের লোক, দরজা খোলেন।’ ভয়ে ভয়ে দরজা খোলা হল। লোকদুটো সদর্পে ঘরে ঢুকলেন, যেন নিজেদের কোনও হরিহর আত্মার বাড়িতে ঢুকেছেন। দিব্যি হাঁটাহাঁটি করতে লাগলেন ঘর জুড়ে, বৈঠকঘরের পাখা চালিয়ে দিয়ে, জানালার পর্দা সরিয়ে দিয়ে সোফায় বসে গেলেন হাত পা ছড়িয়ে। একজনের মুখে মিটিমিটি হাসি, আরকজনের চোখের ভুরু যথাসম্ভব কোঁচকানো।

ভুরু প্রথম মুখ খুললেন, ‘লজ্জা বইটা আছে আপনার কাছে?’

বুকের মধ্যে একটি ঠাণ্ডা জলের গেলাস উপুড় হয়ে পড়ে। আমার কাছে লজ্জা বইটি আছে। কিন্তু এটির সংরক্ষণ যেহেতু নিষিদ্ধ, এটি আমার কাছে সংরক্ষিত দেখলে লোকদুটো আমাকে এই মুহূর্তে হাতকড়া পরিয়ে নিয়ে যেতে পারে। আমি হ্যাঁ বলব নাকি না বলব ঠিক বুঝে পাই না।

‘কেন? আপনার দরকার?’ উল্টো প্রশ্ন করি।

ভুরু বলেন, ‘হ্যাঁ একটা বই আমার দরকার।’

‘বইটার তো সংরক্ষণ নিষিদ্ধ!’ আমি বলি। আমি ভুরুর মুখোমুখি। মিটিমিটি আমার ডান পাশে।

‘আছে বই?

‘না।

‘ঠিক তো!’

‘ঠিক।’

নির্লিপ্ত স্বর। দুজনের দুজোড়া পায়ের দিকে চোখ আমার। এঁরা যদি এখন আমার লেখার ঘরটিতে যান, নিশ্চয়ই একটি লজ্জা কোথাও পাবেন। তখন কী হবে না ভেবেই আমি ঠিক শব্দটি বলেছি। কথোপকথন শুনে মা যদি কোথাও বইটি পেয়ে লুকিয়ে রাখেন তবেই বাঁচোয়া। হঠাৎ চেয়ার ছেড়ে উঠি, ভুরু আমাকে থামিয়ে বলেন, ‘কোথায় যাচ্ছেন, বসেন বসেন।’ উঠে দাঁড়িয়ে যাওয়া আমাকে বসতে হয়। এক গাদা অস্বস্তি আর অরুচি নিয়ে বসি। বুকের মধ্যে একটি ভয়ও কোত্থেকে যেন উড়ে এসে বসে।

এবার মধ্যবয়স্ক মিটিমিটি বলেন, ‘আপনার লজ্জা কেন বাজারে বিক্রি হচ্ছে?

‘আমার প্রকাশক বিক্রি করছে না লজ্জা। তার কাছে নেইও তো লজ্জা। সব তো পুলিশ নিয়ে গেছে।’

‘কিন্তু বিক্রি তো হচ্ছে! কেন হচ্ছে?’

‘তা আমি জানি না কেন হচ্ছে, কী করে হচ্ছে।’ গম্ভীর গলায় বলি।

‘আপনার তো জানার কথা।’

আমার চোয়াল শক্ত হয়ে ওঠে। বলি, ‘আমি বইটা লিখেছি। বইয়ের লেখক আমি। এই বই বিক্রি করার দায়িত্ব আমার না। যারা বিক্রি করছে তাদের গিয়ে জিজ্ঞেস করেন কেন তারা বিক্রি করছে।’

যে চিকন একটি ভয় ছিল, সেটি উবে যায়। কেবল অস্বস্তি আর অরুচিগুলো পড়ে থাকে। ভুরু মুখ খোলেন, ‘ফেরা.. .

শব্দটি খপ করে ধরে মিটিমিটি বলেন, ‘ফেরা বইটা কেন লিখেছেন?’

‘কেন লিখেছি মানে? ইচ্ছে হয়েছে লিখতে তাই লিখেছি।’

ফেরা নামের একটি গল্প লিখেছি নতুন। পত্রিকা শারদীয়া সংখ্যার জন্য দুলেন্দ্র ভৌমিক একটি উপন্যাস চেয়েছিলেন। কিন্তু উপন্যাস লেখা সম্ভব হয়নি, লিখেছি বড় গল্প, যদিও পত্রিকায় উপন্যাস হিসেবেই ফেরা ছাপা হয়েছে। ফেরা বই হয়ে বেরিয়ে গেছে দেশে, তবে পশ্চিমবঙ্গে বই হয়নি এখনও। আমার লেখার সঙ্গে সঙ্গেই বই ছাপা হয়ে যেতে পারে, কারণ আমি কমপিউটারে যে বাংলা লিপিতে লিখি সেই একই লিপি ব্যবহার করেন বাংলাদেশের প্রকাশকরা। আমি লিখে ডিসকেটে কপি করে দিলেই তাঁরা সোজা ছাপতে চলে যেতে পারেন প্রেসে। কম্পোজ করা, প্রুফ দেখা এসব ঝামেলা থেকে মুক্ত। কিন্তু আনন্দ পাবলিশার্সএর সব কিছুই শুরু থেকে করতে হয়, যেহেতু ওখানে বাংলা আদর্শলিপি ব্যবহার হয় না। ফেরার গল্পটি খুব ছোট, পূর্ববঙ্গের এক কিশোরী মেয়ে যাকে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল পশ্চিমবঙ্গে তার নিরাপত্তার জন্য, একদিন সে ফিরে আসে নিজের দেশটি দেখতে, তিরিশ বছর পর। সেই দেখাটি কেমন, তারই বর্ণনা। এখন পুলিশের লোক জানতে চাইছেন আমি কেন লিখেছি ফেরা। আমার ইচ্ছে হয়েছে বলে লিখেছি এই উত্তরটি তাঁদের মনঃপূত হচ্ছে না, বুঝতে পারি।

‘ফেরা আপনাকে কে লিখতে বলেছে?’ ভুরু।

‘মানে?’

‘কেউ তো নিশ্চয়ই বলেছে যে ফেরা নামে এরকম একটা গল্প নিয়ে একটা উপন্যাস লেখেন। কে বলেছে?’

‘প্রকাশকরা তো সবসময়ই বলছেন লিখতে। কিন্তু কি নাম হবে উপন্যাসের, কী গল্প আমি লিখব, তা আমাকে কেউ বলে দেন না। সে আমি নিজেই লিখি।’

‘ফেরার গল্পটা তো আর আপনার মাথা থেকে আসেনি। নিশ্চয়ই কেউ আপনাকে বলে দিয়েছে।’

‘না। কেউ বলে নাই। আমি তো বললামই, কি গল্প আমি লিখব সেটা আমিই ঠিক করি।’

‘ফেরার কোনও ক্যারেকটার কি আপনার চেনা? মানে আপনি কি চেনেন কল্যাণী নামের কোনও মহিলাকে?’

‘না।’

‘তাহলে কেন লিখেছেন যে কল্যাণী নামের একজন হিন্দু মহিলা কলকাতা থেকে এখানে এসেছে বাড়িঘর দেখতে!’

‘আশ্চর্য, এটা তো গল্প!’

‘বানিয়ে লিখেছেন তাহলে! এরকম কোনও ঘটনা ঘটে নাই।’

‘গল্প তো লেখকরা তাদের কল্পনা দিয়েই লেখেন।’

‘কিন্তু বাস্তবের সাথে তো কিছু মিল থাকতে হয়। তাই না? নাকি উদ্ভট উদ্ভট কল্পনা লিখে দিলেই হয়ে যায়!’

‘কলকাতায় বইটা বের হয়েছে?’ মিটিমিটি।

‘বই হয়ে বেরোয় নি।’

‘কি হয়ে বেরিয়েছে?’

‘পত্রিকায় গল্পটা ছাপা হয়েছে।’

‘কোন পত্রিকা?’

‘আনন্দলোক।’

‘হুম।’

‘আছে আপনার কাছে পত্রিকাটা?’

আমার গা জ্বলে। ইচ্ছে করে ঘাড় ধরে যদি লোকদুটোকে বের করে দিই। বাইরের লু হাওয়া এসে আমার জ্বলুনি আরও বাড়াচ্ছে।

‘পত্রিকাটা আছে?’ ভুরু।

‘না।’ একটু জোরেই এই না টা বলি।

‘আপনি মুসলমান হয়ে হিন্দুদের নিয়ে গল্প লেখেন কেন?’

‘আমি মুসলমান পরিবারে জন্ম নিয়েছি। কিন্তু আমি কোনও ধর্ম বিশ্বাস করি না।’ বলি, জোর দিয়ে। এটি বলে যে একগাদা অস্বস্তি আর অরুচি ছিল, সেটিও দেখি সরে যাচ্ছে আমার ভেতর থেকে। যেন অনেকক্ষণ সিন্দুকে বসে থাকার পর খোলা হাওয়ায় এসে বুক ভরে শ্বাস নিলাম।

‘ইসলাম ধর্মে বিশ্বাস নাই আপনার?’ ভুরু জিজ্ঞেস করেন।

‘না।’

‘অন্য কোনও ধর্মে আছে বিশ্বাস?’

‘না।’

‘হিন্দু ধর্মে আছে?’

‘না।’

‘তাহলে হিন্দুর পক্ষে এত কথা বলেন কেন?’ মিটিমিটির প্রশ্ন।

‘কথা বলি, কারণ ওরা মানুষ। আমি কোনও ধর্ম দেখি না। আমি দেখি মানুষ। কোনও মানুষের ওপর যদি অযথা অত্যাচার করা হয়, আমি সেই মানুষের পক্ষে দাঁড়াই। সোজা কথা। সাফ কথা।’

লোকদুটো চলে যাবার পর সশব্দে দরজা লাগিয়ে আমি ঘুরে দাঁড়াতেই দেখি মা দেয়ালের ওপাশে দাঁড়িয়ে আছেন বিবর্ণ মুখে। বললেন, ‘কেন কইলি যে ধর্ম বিশ্বাস করি না! এখন তো ওরা আরও অসুবিধা করব।’

‘করুক।’ বলে আমি সরে আসি।

বিছানার তিন তোশকের তল থেকে মা লজ্জা বইটি বের করে রান্নাঘরে নিয়ে কুটি কুটি করে ছিঁড়ে আবর্জনার ঝুড়িতে ফেলে দিতে দিতে বলতে লাগলেন, ‘কোনও দরকার নাই এই বই থাকার। কখন আবার এই বই আছে বইলা বাড়ির সবাইরে বাইন্ধা নিয়া যায়!’ আমার কমপিউটারে বইটি লেখা আছে। ছিঁড়ে ফেলা বইটির জন্য আমার মায়া হয় না। বরং একদিক দিয়ে ভাল। অযথা হয়রানি থেকে হয়ত বাঁচব।

আপদ বিদেয় হয় ঠিক কিন্তু সম্পূর্ণ বিদেয় হয় না। মিটিমিটি প্রায়ই ফোন করেন। আমি কেমন আছি, কেমন চলছে জীবন ইত্যাদি জিজ্ঞেস করেন। তিনি যে আমার মঙ্গল চান, এ কথাটি একবার একফাঁকে বললেন। মঙ্গল যেদিন চেয়েছেন সেদিনই জিজ্ঞেস করলেন, ‘আপনি কি আজকাল পত্রিকায় দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন ধর্ম নির্মূল হোক, বিবাহ নির্মূল হোক?’

‘হ্যাঁ বলেছি। তাতে কি হয়েছে?’আমার কঠিন কণ্ঠ।

‘হোম মিনিস্ট্রি থেকে ব্যপারটি তদন্ত করতে বলেছে।’

আমি দীর্ঘশ্বাস ফেলে ফোন রেখে দিই। আমি কোথায় কি বলেছি, তারও তদন্ত হয়! আমি কি বলব না বলব, কি লিখব না লিখব, সবকিছুর জন্য একটি সীমানা তৈরি করতে চাইছে তারা। সীমানার বাইরে বেরোলে তদন্ত হবে। মন্ত্রণালয়ে ফাইল খোলা হবে। ফাইলের পেট দিন দিন মোটা হতে থাকবে। পুলিশ আমাকে চোখে চোখে রাখে। সাদা পোশাকের পুলিশের লোক আর যে কোনও অপুলিশ আমার চোখে একই রকম দেখতে লাগে। কিন্তু আমি না বুঝলেও অন্যরা আমাকে বলে যে আমার বাড়ির আশেপাশে ঘুরঘুর করে টিকটিকিগুলো। কী চায় তারা, কী পায় তারা আমি জানি না।

শান্তিবাগ থেকে শান্তিনগরে এসে আমার মনে হয়েছিল একটু বোধহয় শান্তি জুটবে এবার। কিন্তু পুলিশের লোকেরা আমি যেখানেই যাই, সেখানেই ছায়ার মত আমাকে অনুসরণ করে। পুলিশই যদি কেবল সমস্যা হত, তাহলেও কথা ছিল। এ বাড়িতে ঢোকার পর থেকে নতুন নতুন সব উপদ্রব শুরু হয়েছে। কদিন পর পরই দরজার কড়া নড়ে, সমিতির টাকা দিতে হবে। আমি কোনও সমিতি করব না, জানিয়ে দিই, সুতরাং চাঁদা টাদা দেবার প্রশ্ন ওঠে না। মালিক-সমিতির লোকেরা জানান, সমিতির চাঁদা দিতেই হবে। এ থেকে মুক্তি নেই। বিশাল বড় চারটে দালান এই কমপ্লেক্সে। এক একটি দালান দশ তলা করে। চল্লিশটি করে আ্যপার্টমেন্ট এক দালানেই। একশ ষাটটি পরিবার, যা তা কথা নয়। সমিতির প্রয়োজন আছে। চুরি ডাকাতি বন্ধ করা, চব্বিশ ঘন্টা নিরাপত্তা প্রহরীর ব্যবস্থা করা, প্রহরীদের বেতন দেওয়া, আজ যদি লিফট নষ্ট হয়ে যায়, সারাবে কে? বাগানের মালি দরকার, কে যোগাবে? গাড়ির ড্রাইভারদের নাম ঠিকানা নথিভুক্ত করা, তেড়িবেড়ি করলে তাড়িয়ে দেওয়া, বারান্দাগুলো পরিষ্কার করা, ময়লা ফেলা ইত্যাদির জন্য লোক লাগানো, মাসে মাসে তাদের বেতন দেওয়ার ব্যবস্থা করা, ডিশ আ্যণ্টেনা লাগানো, নষ্ট হলে সারানো, বাড়ির চামড়া খসে গেলে চামড়া বসানো, রং পুরোনো হলে নতুন রং করা, কাজের শেষ নেই। এসব তো আর ইস্টার্ন হাউজিং এসটেটের এর মালিক জহিরুল ইসলাম করবেন না, জহিরুল ইসলাম তো সব বাড়ি বিক্রিই করে দিয়েছেন। এসব ব্যবস্থাপনায় এখন তাদের থাকবে হবে, বাড়ি যারা কিনেছে। কিছু উৎসাহী মালিক মিলে এই সমিতি গঠন করেছেন। বছর গেলে নির্বাচন হবে সমিতির দাঁয়িত্ব কার কার কাঁধে পড়বে এ নিয়ে। সমিতির কাজ কেবল এসব সামলানো নয়। ভবিষ্যতেরও নকশা আছে। নিচে গ্যারেজের সামনে দোকান বসবে, লণ্ড্রি বসবে, বেকারি বসবে। মূলত, আমি বুঝি, পুরো এলাকাটির অর্থাৎ একশ ষাটটি আ্যপার্টমেণ্টের মানুষদের সুবিধের জন্য এই সমিতি। আমি মাসে মাসে বাঁধা বারোশ টাকার ব্যবস্থাটি মেনে নিই। একদিন সমিতির ঘরে ঢুঁ দিয়ে সেক্রেটারি শফিক আহমেদএর সঙ্গে পরিচিত হয়েও আসি। পরিচয় দেওয়ার আগেই তিনি বলে উঠলেন, চিনি আপনাকে। দেখেছেন কখনও আমাকে? জিজ্ঞেস করি। না, দেখিনি, তবে পত্রিকায় তো ছবি টবি সবসময়ই দেখি। সামনাসামনি এই প্রথম দেখলাম। একটি স্মিত হাসি ঝুলে থাকে মুখে, হাসির তলে এক টুকরো আশঙ্কা। আমাকে, আজকাল লক্ষ করছি, কোথাও নিজের পরিচয় দেওয়ার প্রয়োজন হয় না। এটি কি ভাল, নাকি মন্দ! নিজেকে জিজ্ঞেস করি। মনে মনে নিজেকে উত্তর দিই, মন্দ।

এরপর সমিতি থেকে যে জিনিসটি করা হল, তা আমি সোজাসুজি বলে দিই, আমার দ্বারা হবে না। মসজিদের চাঁদা। মসজিদ বানানো হচ্ছে, এর জন্য আলাদা করে টাকা চাই। আমি বলি, আমার বাড়ি থেকে কেউ মসজিদে যাবে না, সুতরাং চাঁদা দেওয়ার প্রশ্ন ওঠে না। তারপরও চাঁদা দিতে হবে। শফিক আহমেদ নিজে আসেন। সাদা শার্ট, কালো প্যান্ট কালো জুতোর সাদাসিধে মাঝারি আকার ভদ্রলোক শফিক আহমেদ। একটি কলমের কোম্পানীর মালিক। কোম্পানির মালিক বলেই অঢেল সময় পান সমিতিতে ঢালার। মুক্তিযুদ্ধ করেছিলেন। আমার লেখাটেখা, বললেন, ভালই লিখি মাঝে মাঝে, বিশেষ করে দেশের স্বাধীনতা বিষয়ে যখন লিখি।

‘মসজিদের চাঁদা সবাই দিচ্ছে, আপনিও দিয়ে দেন। মসজিদ তৈরি হচ্ছে, এটা সম্পূর্ণ করতে টাকার দরকার।’

‘কমপ্লেক্সের ভেতরে মসজিদ করার দরকারটা কি? আশেপাশেই তো অনেক মসজিদ আছে। যারা নামাজ পরতে চায়, তারা ওইসব মসজিদে যেতে পারে।’

‘কিন্তু ভাই মসজিদ করার জন্য কমপ্লেক্সে আগে থেকেই প্ল্যান ছিল।’

‘অন্য যে কোনও কিছু তৈরি করতে টাকা লাগে নিয়ে যান। কিন্তু মসজিদ তৈরি করার জন্য আমি কোনও টাকা দেব না।

‘আপনার কী ক্ষতি, টাকা দিলে?’

‘লাভটা কি বলেন?’

‘লাভ না হোক। তবু তো সবার ব্যপার। আমাদের তো এখানে মিলেমিশেই থাকতে হবে। সবাই দিয়ে ফেলেছে টাকা,শুধু আপনারটাই বাকি আছে।’

‘আমার টাকার জন্য আপনাদের মসজিদ আটকে থাকবে না। আপনারা মসজিদ করতে চান করেন। আমি তো আপনাদের বাধা দিতে পারব না। কিন্তু মসজিদে আমি বিশ্বাস করি না, আমি কোনও টাকা মসজিদের জন্য দেবই না।’

শফিক আহমেদ চা খেয়ে বিদায় নেন।

এ করে যে শান্তি জুটবে তা নয়। সমিতি আয়োজন করছে মিলাদ মাহফিলের, চাঁদা দাও। দরজা থেকে বলে দিই, মিলাদে যাবো না, সুতরাং চাঁদা দেব না।

এরপর আবার। রোজার সময় ইফতারির আয়োজন হবে, চাঁদা দাও। ইফতারি খেতে যাবো না। চাঁদা দেওয়ার প্রশ্ন ওঠে না।

এরপর আরেকদিন। শবে বরাতের অনুষ্ঠান হবে। সেটির জন্য চাঁদা চাই। বড় একটি না বলে বিদায় দিই।

একুশে ফেব্রুয়ারির অনুষ্ঠান হবে, বিজয় দিবসের অনুষ্ঠান হবে, চাঁদা দিয়ে দিই।

মসজিদের ঘটনার দু সপ্তাহ পর শফিক আহমেদের ফোন পেলাম। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, ‘আচ্ছ!, কায়সার কে?’

‘কায়সার? কেন? কায়সার আমার বন্ধু।’

‘আপনার বাড়িতে আসে নাকি প্রায়ই?’

‘হ্যাঁ আসে। কেন, কি হয়েছে?’

‘কথা হচ্ছে।’

‘কোথায় কথা হচ্ছে?’

‘সমিতিতে।’

‘কি কথা?’

‘বলছে আপনার সঙ্গে নাকি অবৈধ সম্পর্ক আছে কায়সারের।’

আমি জোরে হেসে উঠি। ‘আমার সঙ্গে কার কী সম্পর্ক , সম্পর্ক বৈধ না অবৈধ তা দেখার কাজ সমিতির? সমিতিকে আমার শোবার ঘরে ঢোকার অনুমতি কে দিয়েছে?’

শফিক আহমেদ বললেন, ‘এসব তো আর আমি করছি না ভাই। আমি শুভাকাঙ্খী হিসেবে আপনাকে জানাচ্ছি। এগুলো করছেন ইস্টানং হাউজিংএর চিফ ইঞ্জিনিয়ার জুবাইর হোসেন, দুই নম্বর বিল্ডিংএ তাঁর আ্যপার্টমেন্ট আছে। সমিতির সভাপতি তিনি।’

‘যা ইচ্ছে করুক। যা ইচ্ছে বলুক। আমি পরোয়া করি না।’

‘আপনাকে মনে হয় চিঠি দেবে।’

‘কিসের চিঠি?’

‘কোনও অবৈধ কাজ যেন আ্যাপার্টমেণ্টে না করেন এ ব্যপারে চিঠি।’

‘আমার বাড়িতে আমি কি করি না করি, সেটা আমার ব্যক্তিগত ব্যপার।’

আমি ফোন রেখে দিই। এসব বিষয়ে কথা বলার প্রবৃত্তি হয় না আমার।

এরপর আবারও এক রাতে ফোন। শফিক আহমেদ জানালেন সভাপতি উঠে পড়ে লেগেছেন আমার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে। তাঁর পক্ষে অনেকেই আছে। এও জানালেন, সমিতির অধিকার আছে কোথাও কোনও অবৈধ কাজ হচ্ছে কি হচ্ছে না তার খবর নেওয়া এবং উপযুক্ত ব্যবস্থা নেওয়া।

‘অবৈধ বলতে কি বোঝাচ্ছেন?’

‘ধরেন, কোনও বাড়ির মালিক যদি তার বাড়িটাকে প্রসটিটিউশনের কাজে ব্যবহার করে। এরকম তো হতে পারে। দেখা গেল বাড়িতে প্রসটিটিউট আর ক্লায়েন্ট এনে রীতিমত ব্যবসা করছে মালিক, তখন সমিতির দায়িত্ব সেই লোককে উচ্ছেদ করা।’

‘কি করে উচ্ছেদ করবেন বাড়ির মালিককে? বাড়ির মালিক তো তিনি।’

‘এরকম নিয়ম আছে। বাড়ি বিক্রি করে যেতে তিনি বাধ্য।’

‘আমি তো কোনও ব্যবসা করছি না আমার বাড়িতে। তবে আমার বিরুদ্ধে ব্যবস্থার কথা বলছেন কেন তিনি?’

‘অবৈধ কাজ করছেন বলে তারা ভাবছে। আমি আপনার শুভাকাঙ্খী। আমাকে ভুল বুঝবেন না। ‌আপনি কায়সারকে বলে দিন আপনার বাড়িতে না আসার জন্য।’

আমি রুখে উঠি। ‘না, আমি তা বলব না। এখানে কায়সার কোনও ব্যপার না। আমার বাড়িতে কে আসবে না আসবে, কে থাকবে না থাকবে, কে ঢুকবে বাড়িতে, কে বাড়ি থেকে বেরোবে, সেটা সম্পূর্ণ আমার সিদ্ধান্তে হবে। সমিতির সিদ্ধান্তে না। এ আমার শেষ কথা। এটা হচ্ছে মানুষের একটা মিনিমাম ফ্রিডম। এই ফ্রিডম আমি বিসর্জন দেব না।’

‘তাহলে চিঠি পাঠাবে।’

‘পাঠাক।’

‘প্রথম ওয়ার্নিং। তারপর সেকেণ্ড ওয়ার্নিং। থার্ড। তারপর বোধহয় বাড়িছাড়ার আদেশ।’

‘যা ইচ্ছে করুক। আমার বাড়ি থেকে আমাকে উচ্ছেদ কী করে করে আমি দেখব।’

খটাশ করে ফোন রেখে দিই। শ্বাস পড়ছে দ্রুত আমার। নিজের কেনা বাড়ি, এই বাড়ি থেকে আমাকে উচ্ছেদ করার ষড়যন্ত্র চলছে। কোনও ভাড়া বাড়িতে আমার স্থান হয় না, এখন যদি নিজের বাড়িতেও বাস করার অধিকার না থাকে আমার, তবে যাবো কোথায়! আমার তো পেছোতে পেছোতে পেছোবার আর কোনও পথ নেই। ঠেলতে ঠেলতে লাথি কষাতে কষাতে আর কোথায় আমাকে নিতে চায় মানুষ! আর কত সর্বনাশ ঘটাতে চায় আমার! অস্থির হাঁটাহাঁটি করি ঘরে বারান্দায়। বাড়িটি কেনার পর নিজে হাতে সাজিয়েছি। রান্নাঘরের দেয়ালগুলোয় নিজে পছন্দ করে টাইলস কিনে এনে লাগিয়েছি, পুরো আধুনিক কেবিনেটে সাজিয়ে দিয়েছি রান্নাঘরটি, বড় শ্বেত পাথর বসিয়েছি কাটা বাছা করার জায়গায়, ভারি পর্দা কিনে সবগুলো জানালায় টাঙিয়ে দিয়েছি, পর্দাগুলো দেয়ালের মাথা থেকে মেঝে পর্যন্ত, কাঠের সোফা কিনেছি বৈঠক ঘরের জন্য, শোবার ঘরে নতুন একটি খাট পেতেছি, নতুন একটি বড় সেগুন কাঠের আলমারি বসিয়েছি, লেখার ঘরটির চারদেয়াল জুড়ে রেখেছি বইয়ের আলমারি, আলমারি ভর্তি বই, টেবিলে কমপিউটার। নিজের বাড়ি, নিজের সাধ্য মত রুচি মত সাজিয়ে বন্ধু বান্ধব সবাইকে নিমন্ত্রণ করে গৃহপ্রবেশ অনুষ্ঠান করেছি। অস্থির জীবনটি শেষ পর্যন্ত একটি নিশ্চিন্তের জায়গায় এসে স্থির হয়েছে। স্বামী ছাড়া কোনও মেয়ের পক্ষে থাকা সম্ভব নয়, আমার পক্ষেও সম্ভব হবে না, একা কোনও মেয়ে পায়ের তলায় শক্ত মাটি পাওয়া অসম্ভব ইত্যাদি বাণীকে আমি মিথ্যে প্রমাণ করেছি। গুষ্ঠির মধ্যে কেউই যা করতে পারেনি, তা আমি করে দেখিয়েছি যে মেয়ে হয়ে আমি তা করতে পারি। প্রচণ্ড আত্মবিশ্বাস নিয়ে আমি যখন ঋজু হয়ে দাঁড়িয়েছি, তখন কি না আমাকে আমার বাড়ি থেকেই তাড়িয়ে দেবে! কোথায় কোন নর্দমায় আমাকে ফেলতে চাইছে মানুষ! আমার মরণ না দেখে কারও বুঝি স্বস্তি নেই! সমাজে বাঁচতে হলে সমস্ত স্বাধীনতার গলা টিপে ধরে বাঁচতে হবে! আমার নিজস্ব কোনও মূল্যবোধ নিয়ে আমার বেঁচে থাকার অধিকার নেই! ক্রোধ আমার সর্বাঙ্গে। হাত নিশপিশ করে, মুহূর্তের জন্য মনে হয় একটি যদি রিভলভার পেতাম কোথাও, নির্দ্বিধায় আমি খুন করতে পারতাম জুবায়ের নামের লোকটিকে।

জুবায়ের হোসেন আমাকে নিঃশব্দে নিরীক্ষণ করেন। তাঁর বাড়ি এক নম্বর দালানে নয়, তারপরও এক নম্বরের লিফটে চড়তে গেলেই ধোপ দুরস্ত ধবল শার্দূলটির শ্যেনচক্ষুদুটি দেখি সামনে। একদিন কায়সার আর আমি সেই একই লিফটে, তিনিও। আমাদের দেখে রোষে তাঁর নাকের পাটা ফুলে ফুলে উঠছিল। সেদিনই কায়সার তার গাড়ি রেখেছে অতিথির গাড়ি পার্কিংএ। জুবায়ের হোসেন দাঁড়িয়েছিলেন, কায়সারকে বললেন গাড়ি সরিয়ে নিতে, কারণ ওটি নাকি ঠিক জায়গা নয় গাড়ি রাখার। কায়সার বলল, ‘কেন, এইখানে তো জায়গা খালি আছে, গাড়ি রাখলে অসুবিধা কী?’

‘অসুবিধা আছে।’ নিরাপত্তা প্রহরীরা জুবায়েরের ইঙ্গিতে কায়সারকে জানিয়ে দেয়।

‘কি অসুবিধা, বলেন।’

জুবায়ের চেঁচিয়ে বললেন, ‘আপনার গাড়ি এইখানে পার্ক করা যাবে না।’

‘কেন যাবে না?’ কায়সারের স্বরও উঁচুতে ওঠে।

‘দেখে নেব, ঠিক আছে আমিও দেখে নেব’ ধরণের উত্তপ্ত বাক্য বিনিময় চলে দুজনের মধ্যে। কায়সারকে শেষ পর্যন্ত গাড়ি সরিয়ে রাস্তার কিনারে রেখে আসতে হয়।

কায়সারের চেয়ে অনেক বেশি ক্ষমতা ধারণ করেন জুবায়ের হোসেন। কায়সারকে অপমান করার অর্থ আমার অতিথিকে অপমান করা, আমার অতিথিকে অপমান করার অর্থ আমাকে অপমান করা। জুবায়ের হোসেন আমাকে আমার বাড়ি থেকে উচ্ছেদ করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। না, তারপরও মসজিদের চাঁদা আমি দিই না, কায়সারকে আমার বাড়ি আসতে আমি বারণও করি না।

মা আমাকে বলেন, ‘তুই যে এমন হুট কইরা চাকরি ছাইড়া দিলি, এখন কি হইব? টাকা পয়সা যা ছিল সব দিয়া ত বাড়ি গাড়ি কিনছস।’

‘বাড়ি গাড়ি কি সাধে কিনছি? উপায় ছিল না বইলাই ত কিনছি।’

‘এখন চাকরি না থাকলে চলবি কি কইরা?’

‘সেইডা তোমার চিন্তা করতে হবে না।’

মার উদ্বিগ্ন মুখের সামনে থেকে সরে আসি বটে, এই দুশ্চিন্তা কিন্তু আমাকে শকুনের ডানার মত ঢেকে ফেলেছে। কোনও প্রকাশক এখন আমাকে কোনও টাকা পয়সা দেবেন না। কারও কাছে কোনও রয়্যালটির টাকা বাকি পড়ে নেই। বরং আমিই দায়বদ্ধ সবার কাছে। বই লিখে তাঁদের টাকা শোধ করতেই আমার কয়েক বছর লেগে যাবে। বই তো আমি দুদিনে বসে লিখে ফেলতে পারি না। তার ওপর জোর করে নিজেকে দিয়ে আমি লেখাতেও পারি না। যদি না ভেতরে তোলপাড় হয়ে কিছু বেরিয়ে আসে। বসন্তের কুঁড়ি যেমন আপনিতেই ফুল হয়ে ফোটে, তেমন করে ফুটতে হয় আমার শব্দকে। আমি জোর করে ধমক দিয়ে কান মলে বাক্য রচনা করতে পারি না। আসলে আমি তো লেখক নই। যা লিখেছি এতদিন, তা না লিখে আমি পারিনি বলেই লিখেছি। লিখতে গিয়ে আমি কাঁদি। কোনও নারীর দুঃখের কথা লিখছি, লিখতে লিখতে দুঃখিতাটির জন্য অঝোরে কাঁদছি আমি, আমি অনুভব করতে থাকি সেই দুঃখিতা নারীটি আমি নিজে। ফেরা লিখতে গিয়ে চোখ আমার ঝাপসা হয়ে উঠেছে বার বার, নিজেকে আমার মনে হয়েছে আমিই কল্যাণী। কখনও কখনও কষ্ট এমন প্রবল হয়ে ওঠে যে আমি লেখা ছেড়ে উঠে যাই, বিছানায় গিয়ে বালিশে মুখ গুঁজে কাঁদি। যখন নিমন্ত্রণ নামের উপন্যাসটি লিখেছি, আমি অনুভব করেছি আমি সেই বালিকা, প্রেমিক যাকে নিমন্ত্রণ করেছিল, যাকে প্রেমিকসহ সাতজন পুরুষ উপুর্যুপরি ধর্ষণ করেছে। আমি কঁকাতে কঁকাতে, ফুঁপিয়ে কেঁদে কেঁদে সেই ধর্ষণের বর্ণনা করেছি, যেন আমাকেই ধর্ষণ করা হচ্ছে, যেন আমারই যৌনাঙ্গ ছিঁড়ে রক্তের ফিনকি ছুটছে। আমি সত্যি সত্যিই যন্ত্রণা অনুভব করেছি আমারই যৌনাঙ্গে। লিখে শেষ করে, যখন বালিকাটি তার বাড়ির দিকে যাচ্ছে, যাচ্ছে আর ভাবছে, বাড়ি ফিরলে যখন তার বাবা জিজ্ঞেস করবেন, কোথায় গিয়েছিলি? সে তখন একটুও মিথ্যে বলবে না, বলবে আমার নিমন্ত্রণ ছিল। এটুকু লিখে আমি হু হু করে লেখাটির ওপর উপুড় হয়ে কেঁদেছি। অপরপক্ষে যখন যমুনার গল্প লিখছি, লিখতে লিখতে আমি নিজেই যমুনার অস্তিত্ব অনুভব করি আমার ভেতর। যমুনা যখন সন্তান ধারণ করছে এবং ঘোষণা করছে এ তার সন্তান, অন্য কারও নয়, কোনও পুরুষের নয়, তখন আমারই মনে হয় যেন আমিই অন্তসত্ত্বা, আমারই ভেতর বেড়ে উঠছে আমার সন্তান, বিবাহবহির্ভূত সন্তান, যে সন্তানটিকে ভালবেসে বেড়ে উঠতে দিচ্ছি। শোধ গল্পটি লেখার সময় আমি নিজে ঝুমুর হয়ে স্বামী আফজালের ওপর শোধ নিই, গল্পটি লিখে একটি তৃপ্তির হাসি আমার ঠোঁটের কোণে অনেকক্ষণ লেগে থাকে, যে তৃপ্তি ঝুমুর পেয়েছিল, সেই তৃপ্তি। ভ্রমর কইও গিয়া বইএর গল্পটিতে নরাধম নপুংসক স্বামীর সংসার থেকে চলে গিয়ে সকলের ভ্রূকূটি তুচ্ছ করে একা একটি মেয়ে বেঁচে থাকার সংগ্রাম করে, নিজেকে আমার মনে হয়েছে আমি সেই মেয়ে। আমি লেখক নই। ছটা বারোটার নিয়ম করে আমি লিখতে পারি না। আমাকে বসতে হবে লিখতে, এমন কোনও অনুরোধ বা আদেশ আমাকে লেখার জন্য বসাতে পারেনি। অবশ্য অনেক কলাম লিখেছি যেন তেন করে, কিছু ফরমায়েসি লেখা, কিছু লেখা অভাবে পড়ে, না লিখে উপায় ছিল না বলে লেখা। প্রাণ খুঁজে পাইনি ওসব লেখায়। যেহেতু লেখক নই, আমার বাক্যগঠন সঠিক হয় না, আমার বানান গুলো শুদ্ধ হয় না, যেহেতু লেখক নই, গুছিয়ে কোনও ঘটনার বর্ণনা করতে পারি না। আমি জানি আমার সীমিত জ্ঞানের খবর। গ্রামের কোনও কৃষককে ধরে এনে কোনও লোহালককরের কারখানায় কাজ করার জন্য ছেড়ে দিলে যেমন অবস্থা হবে, আমার অবস্থা অনেকটা সেরকম মনে হয় লেখার জগতে। লেখক হওয়ার যোগ্য আমি নই তারপরও লেখক হিসেবে আমার পরিচয়। এই পরিচয়টি ধীরে ধীরে গৌণ থেকে মুখ্য হয়ে উঠেছে। এখন আর অবসরে শখের লেখা লেখার লেখক নই আমি। বিশেষ করে যখন লেখার জন্য এত বছরের চাকরিতে ইস্তফা দিয়েছি। লেখক পরিচয়টিকে ঝেঁটিয়ে বিদেয় করব, এখন তার আর উপায়ও নেই।

বাড়ি কিনেছি, বাড়িভাড়া দিতে হয় না, খরচ কমার কথা! কিন্তু হিসেব করে দেখি খরচ আরও বেড়েছে। বিদ্যুৎ বিল, টেলিফোন বিল, গ্যাসবিল, সমিতির বিল, ড্রাইভারের বেতন সব মিলিয়ে অনেক। দুশ্চিন্তার চাদরটি, আমি না চাইলেও আমাকে ঢেকে রাখে। মা সেই আগের মতই আমার খরচ বাঁচানোর চেষ্টা করে যাচ্ছেন। কী দরকার ওই সামান্য কিছু জিনিস ময়মনসিংহ থেকে এনে বাবার সাহায্য ছাড়া আমার গতি নেই ধরণের কোনও একটি মিথ্যেকে সুযোগ দেবার কখনও কারও মুখে উচ্চারিত হতে! মাকে বলেছি। বলেও মার এই স্বভাবটি দূর করতে পারিনি। সেদিনও দেখি ময়মনসিংহে গিয়ে বাবাকে অনুরোধ উপরোধ করে অনেকটা চেয়ে ভিক্ষে করে নিয়ে এসেছেন কিছু জিনিস। নান্দাইলের জমি থেকে যে চাল আসে অবকাশে, সেই কিছু চাল, এক বোতল সয়াবিন তেল, কিছু পেঁয়াজ, রসুন। গামছায় বেঁধে দু তিন সের মসুরির ডালও এসেছেন। দুটো লাউ, কিছু পটল, চারটে গাছের নারকেল। সেদ্ধ হওয়া গরমে বাসে করে যাওয়া আসা! ঘামে মার সারা শরীর আঠা আঠা হয়ে আছে। শাড়ি লেপটে আছে আঠার সঙ্গে। আমি দেখি, সেদিন আর বলি না, বলি না যে খামোকাই এনেছেন মা এগুলো। কোনও কোনও সময় সামান্য কিছুই খুব বড় কিছু বলে মনে হয়। কিন্তু কারও করুণায় আমার বাঁচবো কেন! অর্থনৈতিক মেরুদণ্ড ভাঙছে, টের পাচ্ছি। সরকারি চাকরিতে ইস্তফা দিলে তো আমার ডাক্তারি বিদ্যেটি সেই ইস্তফার সঙ্গে চলে যায়নি কোথাও। তাই প্রাইভেট ক্লিনিকগুলোয় ধর্না দিতে থাকি, কোনও ডাক্তার তাদের লাগবে কি না জিজ্ঞেস করি। ডাক্তার লাগবে। মাত্র পাশ করে বেরোচ্ছে এমন অদক্ষ ডাক্তারদেরও তারা নিচ্ছে। আমাকে লুফে নেওয়ার কথা। স্ত্রীরোগ ও প্রসূতিবিদ্যা বিভাগ এবং আ্যানেসথেসিয়া বিভাগে ঢাকা শহরের বড় দুই সরকারি হাসপাতাল মিটফোর্ড আর ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আমার দীর্ঘদিনের কাজের অভিজ্ঞতা শুনে প্রাইভেট ক্লিনিকের ব্যবস্থাপকদের চোখ সোনা পাওয়া খুশিতে নেচে ওঠে। এরপর যে কাজটি তাঁরা করেন, আমার নাম জিজ্ঞেস করেন। নাম শুনে সকলেই পাংশু মুখে বলেন, আপনার নাম ঠিকানা অভিজ্ঞতা ইত্যাদি কাগজে লিখে রেখে যান অথবা চাকরি চেয়ে লিখিত আবেদন করুন, কমিটির বাকি সদস্যের সঙ্গে কথা বলে আমরা আপনাকে খবর দেব। সে খবর পাওয়া আমার আর হয়ে ওঠে না। আমার নাম দেখেই বাতিল করা হয় আমাকে। ডাক্তারের প্রয়োজন হলেও আমাকে প্রয়োজন হয় না কারওর। আমি একটি বাতিল নাম। আমি একটি নিষিদ্ধ নাম।

ইয়াসমিন অনেকদিন থেকে বলছে ওর জন্য যেন একটি চাকরি যোগাড় করে দিই। শুধু বলছেই না, কাঁদছে। কি করে চাকরির যোগাড় করি ওর জন্য! উদ্ভিদ বিজ্ঞানে ভাল নম্বর পেয়ে অনার্স সহ মাস্টার্স পাশ করা মেয়ের কোনও চাকরি নেই এ দেশে। ঢাকার ইশকুল কলেজগুলোয় উদ্ভিদবিদ্যার শিক্ষিকা হওয়ার আবেদন করেছে, কাজ হয়নি। ওসব জায়গায় ঢুকতে হলে ওপরঅলাদের কৃপা থাকতে হয়। আমাদের ওপরঅলা নেই, মামা চাচা থাকতে হয়, তাও নেই। ইয়াসমিন মন খারাপ করে বসে থাকে। আমার সঙ্গে অনেক লোকের আলাপ আছে ভেবে আমার ওপর নির্ভর করে থাকে ওরা, ইয়াসমিন, মিলন। মিলনও বলছে আদমজী জুট মিলের ওরকম মাছি মারা কেরানির চাকরি ওর ভাল লাগে না। আমি যদি ওর জন্যও ভাল একটি চাকরির ব্যবস্থা করি। কিন্তু আমার নিজের চাকরি খেয়েই নিজে বসে আছি, ওদের জন্য আর কতটা কি করতে পারব! নিজের যেহেতু ক্ষমতা নেই, কাছের দুএকজন মানুষকেই বলি যদি কারও পক্ষে সম্ভব হয় কিছু করা।

দীর্ঘদিন বলার পর খিরাজখোর কায়সার শেষ পর্যন্ত ইয়াসমিনের জন্য একটি চাকরির খবর দেয়। কায়সার যে কখনও কোনও চাকরির খবর দিতে পারবে, তা আমার ধারণা ছিল না কারণ কথা সে যে কোনওকিছুতে দিয়ে দেয়, নিরানব্বইভাগ কথা সে রাখে না অথবা রাখতে পারে না। বলল কাল সকালে সে আসবেই আসবে, কাল সকাল গিয়ে পরশু সকাল পার হয়, তার দেখা নেই, সপ্তাহ পার হয়, নেই দেখা, দশদিন পর ভর সন্ধেয় হয়ত উদয় হয়। সুতরাং কায়সার কথা দিল যে সে চাকরির খোঁজ করবে, কিন্তু তার ওপর আমাদের কারওরই সত্যিকার ভরসা থাকে না। আর চাকরির খোঁজ দিলেও কেমন ধরণের চাকরি সেটি, তা মোতালেবের চাকরিটি দেখেই অনুমান করা গেছে। সেই যে রুটি বানানোর কারখানায় কাজ দিয়েছিল, মোতালেব সেখানে সাতদিনও টিকতে পারেনি। চোখের সামনে তাকে প্রতিরাতে দেখতে হত কারখানার মালিক মদ খেয়ে মাতাল হয়ে কোনও কারণ ছাড়াই শ্রমিকদের বেধড়ক পেটাচ্ছে। মোতালেব তল্পি তল্পা গুটিয়ে চাকরি ছেড়ে চলে এসেছে। কায়সারের ওপর ভরসা না করলেও সে ঠিক ঠিকই চাকরির খবরটি দেয়। অবশ্য খুব জোরে সোরে দেয় না, কারণ সে নিশ্চিত যে এই চাকরি কারওরই পছন্দ হবে না। বলার পরই নাকচ হয়ে যাবে। চাকরির বৃত্তান্ত শুনে আমি কায়সারকে বলে দিই, ‘অসম্ভব। এই চাকরি করা যাবে না। অন্য কোনও চাকরি পাওয়া যায় কি না দেখ, যেখানে ও তার বোটানির জ্ঞানটা কাজে লাগাতে পারে।’ চাকরিটি ইয়াসমিনেরও পছন্দ হওয়ার কথা নয়। একটি বস্ত্রকল ব্যবসায়ীর প্রাইভেট সেক্রেটারির চাকরি। কি কাজ ওখানে? ফোনে কথা বলবে, মালিক আপিসে আছে কি না নেই এই খবর দেবে লোককে, আর আপিসের কাগজপত্র গুছিয়ে রাখবে। এই করার জন্য এতগুলো বছর ও উদ্ভিদ বিজ্ঞান পড়েছে! কিন্তু আমাকে স্তম্ভিত করে দিয়ে ইয়াসমিন বলে, ‘যে রকমই হোক, আমি করব চাকরি।’ অসহায় তাকিয়ে থাকি বোনটির দিকে।

মিলনও বলে, ‘ও করুক চাকরি বুবু। আজকাল কি আর যে বিষয়ে পড়ালেখা করে মানুষ, সেই বিষয়ে চাকরি পায়? কেমেস্ট্রিতে মাস্টার্স কইরা ব্যাংকের একাউনটেন্ট হইতাছে না? ফিজিক্সে পড়ছে আমার এক বন্ধু, কোথাও চাকরি নাই। শেষ পর্যন্ত মাদ্রাসার টিচার হইছে। বাংলা সাহিত্যে এম এ পাশ পইড়া কারখানার সুপারভাইজারের পদে কাম লয়। মানুষ করবে কি বুবু? চাকরি ত নাই। তাই যেইডাই পায়, সেইডাই করে। আপাতত করতে থাকুক, পরে ভাল চাকরি পাইলে এইটা ছাইড়া দিবে।’

আমার চাকরি নেই। ইয়াসমিন তার স্বামী সন্তান নিয়ে আমার বাড়িতে থাকে। মিলন যে টাকা উপার্জন করে তার প্রায় সবটাই বাচ্চার খরচে চলে যায়। ওদের আর কোনও বাড়তি টাকা নেই যে সংসার খরচে সাহায্য করবে। এরকম জীবন ইয়াসমিনকে যন্ত্রণা দেয় তাই যেমনই চাকরিটি, এ সময় যে কোনও চাকরিই যেহেতু সোনার হরিণের মত, লুফে নেয়। চাকরিটি করতে ও সকালে বেরিয়ে যায়, বিকেলে ফেরে। দু হাজার টাকা মাসের শেষে। এ অনেক টাকা ওর কাছে। একদিন লক্ষ করি, ইয়াসমিন আপিসে যাওয়ার সময় খুব সাজে। কড়া কড়া রঙের শাড়ি পরে, চোখে খুব কালো করে কাজল পরে, ঠোঁটে কড়া লাল লিপস্টিক লাগায়। দেখে আমার ভাল লাগে না। বলি, ‘অত সাজস কেন?’

ইয়াসমিন উত্তর দেয়, ‘কেন, সাজলে অসুবিধা কি?’

‘না সাজলে অসুবিধা আছে তর?’

‘সবাই সাজে, তাই আমিও সাজি।’

‘তুই তো আগে এইরম ভূতের মত সাজতি না। এহন কি হইছে তর?’

‘কিছু হয় নাই। আমার সাজা নিয়া তোমার ভাবতে অইব না।’

ইয়াসমিন গটগট করে হেঁটে বেরিয়ে যায়। একটি দীর্ঘশ্বাসের সঙ্গে আমি দিশেহারার মত দাঁড়িয়ে থাকি। আমি বুঝি, ইয়াসমিন ওর চাকরিটি টিকিয়ে রাখতে চাইছে সেজে। প্রাইভেট সেক্রেটারির কাজে কোনও মেধার দরকার হয়না, যে মেধাটি ওর আছে। দরকার হয় রূপের। সেই রূপ যে ওর আছে অর্থাৎ প্রাইভেট সেক্রেটারি হওয়ার যোগ্যতা যে ওর আছে তা প্রকট করে ওর আপিসের লোকদের দেখাতে চাইছে। যেন আপিসের কেউ কুরূপা কুচ্ছিত বলে ওকে ছাটাই করার কথা ভাবতে না পারে।
 
২৩. ফতোয়া


দেশ জুড়ে চলছেই আমার মুণ্ডুপাত। এমন কী অবকাশের বাউণ্ডারি ওয়ালে পোস্টার পড়েছে, আরোগ্য বিতানের দেওয়ালেও। ‘তসলিমা নাম্নী এক কুলটা কুলাঙ্গার, যৌনাচারী পাপাচারী, ইসলামবিদ্বেষী নাস্তিকের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তুলুন।’ যেন মজার বিষয়। তসলিমাকে নিয়ে যেমন ইচ্ছে রঙ্গ করা যায়। এতে বাধা দেওয়ার কেউ নেই। বাধা কে দেবে, আমি তো কোনও দল করি না যে আমার দলের লোক গিয়ে ওদের মাথাটা ফাটিয়ে আসবে। এমন সময় খবরটি বেরোয়, প্রকাশ্য জনসভায় সিলেটের সাহাবা সৈনিক পরিষদের সভাপতি মাওলানা হাবীবুর রহমান আমার মাথার মূল্য ঘোষণা করেছেন। মূল্য পঞ্চাশ হাজার টাকা। আমার মাথাটি কেটে নিয়ে হাবীবুর রহমানের হাতে যে দেবে, সে পাবে এই টাকা। পঞ্চাশ হাজার টাকা নেহাত কম টাকা নয় বাংলাদেশে। প্রথম মোটেও আমি গা করিনি। প্রতিদিন তো কতই খবর বেরোচ্ছে আমার বিরুদ্ধে। বাংলাবাজার পত্রিকার এই খবর আর এমন কি সত্য! মতিউর রহমান চৌধুরী অনেকদিন থেকে লেগে আছেন আমার পেছনে। খবরটি নিশ্চয়ই তিনি বানিয়ে লিখেছেন। পত্রিকাটি পত্রিকার জায়গায় রেখে নিজের কাজে মন দিই। এর ঘণ্টাখানিক পর পত্রিকাটি নিয়ে আবার খবরটি পড়ি। সিলেটের লোক মতিউর রহমান চৌধুরী, সিলেটের খবরাখবর অন্যান্য সাংবাদিকদের চেয়ে তিনি বেশি জানেন। ফতোয়ার খবরটি তিনি প্রথম পাতায় একটি চারকোনা বাক্সের মধ্যে ছেপেছেন। না, এ কোনও উড়ো খবর নয়, প্রথম পাতায় ছাপা হওয়া গুরুত্বপূর্ণ খবর। হঠাৎ আমার বুকের মধ্যিখানটায় অনুভব করি হিম হিম কিছু। আন্দোলন হচ্ছে আমার বিরুদ্ধে, মসজিদে প্রতি শুক্রবার আমাকে গালিগালাজ করা হয়, লিফলেট বিতরণ হয়, পোস্টার ছাপা হয়, দেয়ালে সাঁটা হয়, মিছিল মিটিংএ আমাকে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করা হচ্ছে, ওয়াজ মাহফিলে, ইসলামি জলসায় আমার চিবিয়ে খাওয়া হচ্ছে, হচ্ছে হোক, সবারই গণতান্ত্রিক অধিকার যাকে খুশি গাল দেওয়া, কিন্তু মাথার মূল্য ধার্য হবে কেন! এ অধিকার কে কাকে দিয়েছে!

আমার ফাঁসির দাবিতে মাওলানা হাবীবুর রহমান সিলেট শহরে অর্ধ দিবস হরতাল ডেকেছেন। আমি নিশ্চিত ছিলাম, কোথাকার কোন সাহাবা সৈনিক পরিষদের ডাকে হরতাল হবে না। কোনও বড় রাজনৈতিক দল ছাড়া হরতালের ডাক দিলেই তো আর হরতাল হয় না! কিন্তু আমাকে অতিবিস্মিত হতে হয়, যখন খবর বেরোয় যে অতি শান্তিপূর্ণভাবে সিলেট শহরে অর্ধ দিবস হরতাল পালন হয়েছে। শহরে কোনও দোকান পাট খোলেনি, গাড়ির চাকা ঘোরেনি। কী কারণ হরতাল পালনের! কারণ সিলেটের মানুষ আমার ফাঁসি চায়। ফাঁসি যদি সরকার না কার্যকর করে, তাতে ওদের অসুবিধে নেই। মাথার মূল্য ঘোষণা করা আছে। যে কেউ মাথাটি কাটার ব্যবস্থা করতে পারে। ঘরের গা- কাঁপা আঁধারে আমি রুদ্ধশ্বাস বসে থাকি। জানালা দরজার পর্দা টেনে দেওয়া, যেন বাইরে থেকে কেউ আমাকে লক্ষ করে গুলি না ছোঁড়ে। এই ব্যবস্থায় যে কাজ হবে না, তা আহমদ শরীফ বলেন। তিনি আমাকে ফোন করে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কী করছেন?’

‘কিছু না, বসে আছি।’

আহমদ শরীফ ধমক লাগালেন, ‘বসে থাকলে হবে? কী কাণ্ড হচ্ছে, টের পাচ্ছেন না! এক্ষুনি পুলিশ পাহারার ব্যবস্থা করেন।’

‘পুলিশ পাহারা? কি করে করব?’

‘মতিঝিল থানায় একটি চিঠি লিখে দেন। লেখেন যে আপনার মাথার দাম পঞ্চাশ হাজার টাকা ঘোষণা করা হয়েছে। সুতরাং আপনার জন্য যেন নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা হয়। আমি লোক পাঠাচ্ছি, আমার লোক আপনার চিঠি নিয়ে থানায় দিয়ে আসবে।’

আহমদ শরীফ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, তাত্ত্বিক সাহিত্যিক, ধর্মের কঠোর সমালোচক, তাঁর ফাঁসির দাবিতেও মোল্লারা একসময় পথে নেমেছিল। আহমদ শরীফ জানেন যে মোল্লার দৌড় কেবল মসজিদ পর্যন্ত নয়। তাঁর বাড়িতে যে সাপ্তাহিক আলোচনার আসর বসে ধড়িবাজদের ধর্মের ধড় ধসিয়ে দেবার, ওতে অংশ নিতে আমাকে একবার আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। গিয়েছিলাম। কিছু কিছু বিজ্ঞ বিদগ্ধ মানুষ আছেন, যাঁদের বিরাটত্বের বিন্দুমাত্র ছোঁয়া পেলে, যাঁদের বিচ্ছ.রিত বিভায় স্নাত হতে পারলে সমস্ত বিভ্রান্তি বিদায় হয়। আহমদ শরীফের মত এমন প্রাজ্ঞ ব্যক্তির প্রশ্রয় আমাকে প্রসন্ন করে। গজনবী নামের এক লোককে পাঠালেন আহমদ শরীফ। গজনবী আমার নিরাপত্তা চাওয়ার চিঠি মতিঝিল থানায় দিয়ে এলেন। এরপর দুদিন যায়, তিনদিন যায়, সপ্তাহ চলে যায়, থানার লোকেরা মোটেও রা শব্দ করেন না। কোনও নিরাপত্তা রক্ষীর টিকিটি দেখতে পাওয়া যায় না। সকাল বিকাল হাত পা ঠাণ্ডা হচ্ছে। বাড়িতে বলে দিয়েছি কোনও অচেনা কেউ এলে যেন দরজা কেউ না খোলে। নিচে দারোয়ানদেরও বলা আছে ইন্টারকমে যেন কথা বলে নেয় কেউ আমার খোঁজে এলে। এখানকার নিয়মই এই, তারপরও বিশেষ ভাবে সচেতন থাকার জন্যও অনুরোধ করি। কি কারণ এই বাড়তি সতর্কতার তা অবশ্য ভেঙে বলি না। ভাল যে বাড়ি কেনার পর পরই একটি গাড়ি কিনে ফেলেছিলাম, এখন আর জীবনের ঝুঁকি নিয়ে খোলা রিক্সায় চড়তে হয় না। চড়ে অনেক ধেয়ে আসা লোকের তারস্বরে চিৎকার শুনেছি।
ওই দেখ দেখ তসলিমা যায়।
মাগীরে দেখ। মাগীরে দেখ।
ওই ধর ধর।
টাইন্যা নামা রিক্সা থেইকা। ধোলাই দে।
নাস্তিক যায় রে নাস্তিক যায়।
ওই খানকি!

এসব অনেক শোনা হয়েছে। আর কত! যে কোনও সময় আমাকে রিক্সা থেকে নামিয়ে শেয়াল শকুনের মত খুবলে খেয়ে ফেলতে দ্বিধা করত না ওরা। গাড়িতে চড়ে কোথায়ই বা আমার যাওয়া চলে! কোনও দোকানে! কোনও মেলায়! কোনও অনুষ্ঠানে! নাটক সিনেমা দেখতে! কোনও পার্কে! কোনও সভায়! না। কোথাও না। কোথাও আমার যাওয়া চলে না। আমি বুঝে ওঠার আগেই আমার চলাচলের সীমানা ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর হয়ে উঠল। আমি বুঝে ওঠার আগেই আমি ঘরবন্দী হলাম। কবিবন্ধুরাও আমাকে কোথাও আর আমন্ত্রণ জানান না। কবিতার অনুষ্ঠান থেকে কবিতা পড়ে এসে জানান অনুষ্ঠান চমৎকার হয়েছে। লেখকদের জন্য বিশেষ অনুষ্ঠান হচ্ছে, অনুষ্ঠান শেষে জানান কেমন হল, কী হল। শিল্পী সাহিত্যিকদের র‌্যালী হচ্ছে, র‌্যালী থেকে ফিরে এসে জানান কেমন জমজমাট হয়েছে সে র‌্যালি। সকলে ব্যস্ত উচ্ছল উৎসবে, মৌসুমি মেলায়, মঞ্চে। নাটক হচ্ছে, গান হচ্ছে। সপ্তাহব্যাপী সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান চলছে। কেউ একবার দুঃখ করেন না আমার জন্য, আমি যে যেতে পারিনি। আমি যে যেতে পারব না, এটি যেন চিরন্তন সত্য। হঠাৎ যদি কোনওদিন বলে বসি, আমার খুব যেতে ইচ্ছে করছে। তখন চমকে ওঠেন বন্ধুরা, বলেন, ‘বল কি বল কি, পাগল নাকি তুমি! বাইরে বের হয়ো না। কখন কি বিপদ হয় বলা যায় না।’ সুতরাং নিরাপদে থাকো। ঘরে বসে থাকো চুপটি করে। লক্ষ্মী মেয়ের মত। আমরা আনন্দ করে বেড়াবো। আমরা হৈ হল্লা করব। তোমার জন্য এসব নয়। নিরাপত্তা তোমার জন্য জরুরি। আনন্দ স্ফূর্তি নয়। উৎসব নয়। ঘরে বসে থাকতে মন খারাপ লাগে? কিন্তু বেঁচে তো আছো। বেঁচে থাকাটা প্রয়োজন। কথা ঠিক বটে। কিন্তু এভাবে বেঁচে থাকতে কেমন লাগে তা সম্ভবত কেউই অনুমান করতে পারেন না। তবে ওঁরা আসেন আমার বাড়িতে। আমিও যাই মাঝে মাঝে ওঁদের বাড়িতে। বাড়িতে বাড়িতে আমাদের দেখা হয়। ওঁরা যখন আসেন, খানিকটা ভয়ে ভয়েই আসেন, এসবির লোকদের ভয়। আমার বাড়িতে আসা মানে সরকারি খাতায় নথিভুক্ত হয়ে যাওয়া ওঁদের নাম ঠিকানা। নিচে নিরাপত্তা প্রহরীর ঘরে খাতায় নাম লিখে আসতে হয়, কারা আসছে। সেই খাতা থেকে এসবির লোকেরা প্রতিদিনই নাম টুকে নিচ্ছে। ওঁরা এলে অল্প সল্প গল্প হয়, খাওয়া হয় দাওয়া হয়। বিকেল গড়িয়ে সন্ধে হয়, রাত হয়। কিন্তু যা হয় সব ঘরে হয়। বাইরে নয়। বাহির আমার জন্য নয়। খোলা হাওয়া আমার জন্য নয়। মুক্তাঙ্গন আমার জন্য নয়। মৌলবাদিরা জোট বাঁধছে, খবর পাই। মসজিদ মাদ্রাসাগুলোয় ডাক দেওয়া হচ্ছে আন্দোলনের। সভার আয়োজন হচ্ছে। বড় সড় মিছিলের জন্য জল্পনা কল্পনা হচ্ছে। এক বিকেলে বাড়িতে কেউ নেই। ইয়াসমিন মিলন বাইরে, মা ময়মনসিংহে। আমি আর মিনু কেবল আছি। এমন সময় দরজায় শব্দ। দরজায় ছিদ্র দিয়ে দেখি ছ জন টুপিঅলা দাঁড়িয়ে আছে। কি চায় ওরা! মিনুকে বলি, দরজা না খুলে জিজ্ঞেস করতে, কাকে চায়। মিনু চেঁচিয়ে শুধায়, কারে চান?

দরজা খোলেন।

কারে চান কন?

দরজা খোলেন আগে। তারপরে বলি, কারে চাই।

মিনুকে আমি ইঙ্গিতে বলে দিই যেন দরজা না খোলে, যেন বলে দেয় কেউ নেই বাড়িতে। মিনু বলে। কিন্তু চলে যায় না ওরা, থাকে, থেকে দরজায় বিকট শব্দে ওরা লাথি দিতে শুরু করে। কলিং বেল চেপে ধরে রাখে। পনেরো মিনিট, কুড়ি মিনিট পার হয়ে যায়, দরজায় লাথি কষা কলিং বেল চেপে রাখা কিছুই থামছে না। আমি কুলকুল করে ঘামছি। ইন্টারকম কাজ করছে না। ফোন ডেড। এই ন তলা থেকে চিৎকার করে কাউকে ডাকলে কেউ শুনবে না। দরজায় যত রকম সিটকিনি আছে কব্জা আছে সব লাগিয়ে মিনুকে নিয়ে আমার লেখার ঘরটিতে গিয়ে দরজা বন্ধ করে বসে থাকি। ওদিকে সদর দরজাটি ভেঙে ফেলতে চাইছে ওরা। ভেঙে ফেলবে, তারপর যে ঘরে বসে আছি, সে ঘরের দরজাটিও ভেঙে ফেলবে, তারপর! তারপর পাঁচজন আমার হাত পা মাথা চেপে ধরে থাকবে, একজন তার পাঞ্জাবির তল থেকে রামদা বের করে আমার গলাটি কাটবে। আমি দুহাতে গলাটি আড়াল করে রাখি। শরীর শিথিল হতে থাকে। শিথিল হতে হতে নুয়ে পড়তে থাকে, কুঁকড়ে শুয়ে থাকি মেঝেয়ে। মিনু, কালো মিশমিশে হাড়গিলে দাঁতাল মেয়েটি (কাজের মেয়ে + আপন ফুপাতো বোন) আমার মাথার কাছে নিঃশব্দে বসে থাকে। আমরা কেউ কারও শ্বাস ফেলার শব্দ শুনতে পাই না। প্রচণ্ড ঘুম পেতে থাকে আমার।

ঘুম থেকে উঠে দেখি বাড়ি কলকল করছে। মিলন আর ইয়াসমিন ফিরে এসেছে। মিনু বলল, লোকগুলো আরও অনেকক্ষণ ছিল ওখানে। অনেকক্ষণ কতক্ষণ! আধঘন্টা? একঘন্টা? আমার জানতে ইচ্ছে করে না। মিলনকে পাঠিয়ে দিই দরজার জন্য শক্ত তালা কিনতে। নিচের নিরাপত্তা প্রহরীদের জিজ্ঞেস করি কেন তারা ছটি দাড়িটুপিঅলাকে আমার বাড়িতে ঢোকার অনুমতি দিল। প্রহরীরা জানিয়ে দেয় ছ জন লোক আমার সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছে তা বলেনি তাদের কাছে। দু নম্বর দালানের কোনও এক বাড়িতে যাচ্ছে বলেছে। এর মানে যে কেউই আবদুল জলিল বা মান্নান তরফদারের বাড়িতে যাচ্ছে বলে আমার বাড়ির দরজায় এসে দাঁড়াতে পারে। ইন্টারকমে তো নিচ থেকে খবর দিতে হয় আগে, কিন্তু যদি ইন্টারকম কাজ না করে, যেমন অকেজো হয়ে যায় মাঝে মধ্যে! প্রহরীদের বলে দিই, আমার বাড়িতে কেউ যদি আসতে চায়, যদি ইন্টারকম কাজ না করে, তবে প্রহরীদের কেউ যেন আগন্তুককে একা আসতে না দিয়ে সঙ্গে আসে। ‘ওপরে যাবে যে, আমাদের তো এত বাড়তি লোক নাই ম্যাডাম।’ নেতাগোছের এক প্রহরী আমাকে জানিয়ে দেয়।

‘এখনও সময় আছে, তওবা করে খাঁটি মুসলমান হয়ে যা, নয়ত ঘোষণা দিয়ে হিন্দু হয়ে যা। এ দুটোর কোনও একটি না হলে বিপদ হবে।’ চিঠির বাক্সে কেউ ফেলে রেখে গেছে কাগজটি। খোলা কাগজের হুমকি তো আছেই, উড়ো চিঠিও আসছে। ‘ধর্মের বিরুদ্ধে যদি আর একটি কথা লিখিস, তবে সেই দিন থেকে তোর বেঁচে থাকা হারাম হয়ে গেল মনে রাখিস।’ ফোনেও অচেনা কর্কশ কণ্ঠ মাথা ফাটাবো, হাত কেটে দেব, পা ভেঙে দেব, রগ কেটে দেব, রাস্তায় ফেলে গণধর্ষণ করব, মুন্ডু কেটে হাতে ধরিয়ে দেব বলে যাচ্ছে। আমি টের পাচ্ছি খুব কাছে কোথাও ওত পেতে আছে আততায়ী। আমার ঘরবন্দী জীবনে সুখের ঝরনা বইছে। বিপন্ন আমি বিমর্ষ হয়ে বিমূঢ় বসে থাকি। বিক্ষুব্ধ বিক্ষিপ্ত মন। কী করি! কায়সার এলে তার মুখে নয়, তার বগলের কালো ব্যাগটির দিকে চোখ যায়। ব্যাগটি থেকে বের করে নিই কালো পিস্তলটি। হাতে নিলেই গা শিরশির করে। ভেতরের বুলেট খুলে রাখে কায়সার, তারপরও শিরশির যায় না। আত্মরক্ষার জন্য যে কোনও একটি অস্ত্র প্রয়োজন আমার, হাড়ে মজ্জায় টের পাই। অন্নদাশংকর রায় লিখেছেন, তসলিমার ওপর যেরকম বিপদ আসছে, ওর কাছে একটি পিস্তল থাকা উচিত। যখন পড়েছিলাম লেখাটি, মর্ম বুঝিনি, বরং সঙ্গে সঙ্গেই খারিজ করে দিয়েছিলাম উদ্ভুট্টি প্রস্তাবটি। পিস্তলটি আমি রেখেছি কাউকে শখ করে খুন করার জন্য নয়, নিজেকে রক্ষা করার জন্য। খুন করতে যদি কেউ আসে তবে এটি হাতে থাকলে হয়ত নয় আবার হয়ত বা পার পাওয়া যাবে। কিছু কিছু দুঃসময় মানুষের জীবনে আসে, যখন কিছুরই নিশ্চয়তা থাকে না, হয়ত বার ওপরই ভরসা করতে হয়। কিন্তু যেদিন রাখি পিস্তলটি সেদিনই সন্ধার পর এক সাংবাদিক ফোনে খবর দিল যে মতিঝিল থানা থেকে পুলিশ আসছে আমার বাড়িতে তল্লাশি চালাতে। কেন তল্লাশি, কিসের তল্লাশি? মা ছটফট করছেন পাগলের মত। ‘এখন কি করবি? কই সরাইবি আপদটারে?’ মা আলমারির কাপড়ের তল থেকে পিস্তলের ব্যাগটি বের করে জায়গা খুঁজছেন লুকোনোর, বড় তোশকের তলে একবার রাখছেন, আবার দৌড়ে রান্নাঘরে গিয়ে হাঁড়িপাতিলের ভেতর রাখছেন। আমি করুণ কণ্ঠে বলি, ‘মা, তল্লাশি চালাইলে যেইখানেই রাখো, সেইখান থেইকাই বাইর করব। লুকাইয়া লাভ নাই।’ মনে মনে বলি, এবার বোধহয় ওরা পেয়েই গেল কোনও ছুতো!

সেসময় বিকেলের হাওয়া খাওয়া মেজাজে ডাক্তার রশীদ হেলে দুলে আসেন বাড়িতে। ঘটনা খুলে বলি, যা করার খুব দ্রুত করতে হবে, এক্ষুনি আপদ সরাতে হবে, পুলিশ আসছে। রশীদের কালো মুখটি হাসির ছটা মিলিয়ে দিয়ে আরও কালো হয়ে গেল। রশীদের ঘাড়ে এই আপদ বিদেয় করার ভারটি আমি কোনও রকম ভাবনা চিন্তা না করেই দিয়ে দিই। আসলে দিতে হয় না, নিজেই তিনি দায়িত্বটি নেন। পিস্তলটি এখন কোথায় লুকোবেন? শার্টের তলে, প্যাণ্টের ভেতর? ভাবার জন্য কয়েক মুহূর্ত সময় নিলেন। কী করে নেবেন তিনি এটি! এক একটি মুহূর্ত এক একটি ঘন্টার মত দীর্ঘ। শেষ পর্যন্ত হাতে নিলেন ব্যাগটি, যেন টাকা পয়সা কাগজ পত্তরের ব্যাগ। লুকোলেই মনে হবে লুকিয়েছেন কিছু, তার চেয়ে এই ভাল। হাতে থাকবে আপদ, কেউ আপদ বলে ভাববে না। আমি যেন পুলিশ দেখলেই দরজা না খুলি, তাদের পরিচয়পত্র যেন দেখতে চাই, হাতে কোনও তল্লাশির আদেশ আছে কী না যেন দেখতে চাই উপদেশটি দিয়ে রশীদ বেরিয়ে গেলেন দ্রুত, মিলনকে সঙ্গে নিলেন। খুব স্বাভাবিক ভাবে হেঁটে খুব স্বাভাবিক ভাবে মিলনের সঙ্গে কথা বলতে বলতে তিনি মিলনকে নিয়ে রিক্সায় ওঠেন। রিক্সায়, কারণ এসময় গাড়ি নিলে, পথে, আমার গাড়ি বলেই গাড়ি থামাতে পারে পুলিশ। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নামেন রিক্সা থেকে। নেমেই দেখেন হাসপাতালের আঙিনায় প্রচুর পুলিশ আর ছাত্র ডাক্তারের জটলা। এখন পিছু হটবেন, নাকি সামনে যাবেন! রশীদ মুহূর্তেই সিদ্ধান্ত নিলেন সামনে যাবেন। সামনে হেঁটে যাবার সময়ই এক চেনা ডাক্তার এসে দাঁড়ালেন, জানালেন ছাত্রদের মধ্যে মারামারি হয়েছে, একজন ছাত্র গুলি খেয়ে মারা গেছে। রশীদের ঘাম কপাল বেয়ে গাল বেয়ে বুকে নামছে। মিলনের দুরু দুরু বুক, জিভ শুকিয়ে কাঠ। ম্যাড়ম্যাড়ে স্বরেও সে যে কিছু বলবে, সে শক্তিও হারিয়েছে। পাঁচ হাত দূরে পুলিশ। ছাত্র মরার খবর দেওয়া ডাক্তারটি রশীদের হাতের ব্যাগের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘হাতে কি আপনার? মাল নাকি?’ ঘর্মাক্ত রশীদ মুখে জোর জবরদস্তি করে ‘আরে কী যে বলঞ্চ জাতীয় হাসি ফুটিয়ে রোগীর পাশে ডাক্তার যেমন করে হাঁটেন তেমন করে হেঁটে গেলেন। সোজা অপারেশন থিয়েটারে। থিয়েটারের ভেতরের আলমারিতে। সে রাতে আমার বাড়িতে পুলিশ আসেনি। না এলেও যে কোনওদিন আসতে পারে। লাইসেন্সহীন পিস্তলের ঝুঁকি আর নিচ্ছি না। যথাবিহীত আশঙ্কাপূর্বক ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি বলে এটির প্রকৃত মালিক কায়সারকে এটি দিয়ে উদ্ধার হই।

শেষ পর্যন্ত আমার নিরাপত্তার জন্য পুলিশ বসানো হয় বাড়ির দরজায়। মতিঝিল থানায় পুলিশ মোতায়েন করার জন্য অনুরোধ করেছিলাম, আমার শিমুল-তুলো অনুরোধ ফুঁ মেরে উড়িয়ে দিয়েছে থানার লোকেরা। জানিয়ে দিয়েছে মতিঝিল থানা আমাকে নিরাপত্তা দেবে না যতক্ষণ না থানায় তারা আদালতের আদেশ পায়। আদালতের আদেশ পেতে হলে একজন উকিলের প্রয়োজন। মানবাধিকারের জন্য দেশের দুজন বড় ব্যারিস্টার আদালতে লড়ছেন, ডক্টর কামাল হোসেন এবং আমীরুল ইসলাম। ডক্টর কামাল হোসেনের সঙ্গে সরাসরি আমার আলাপ না থাকলেও তাঁর কন্যা সারা হোসেনের সঙ্গে অতি সম্প্রতি আলাপ হয়েছে। তিনি আমার খোঁজ নিয়েছিলেন তাঁর চেনা দুজন বিদেশী মানবাধিকার কর্মী ঢাকায় এসে আমার সঙ্গে আলাপ করার ইচ্ছে প্রকাশ করেছিলেন বলে। সারা হোসেনই আমাদের কথা বলার ব্যবস্থা করে দেন মতিঝিলে ডক্টর কামাল হোসেনের আপিসে। সারা নিজে ব্যরিস্টার, অক্সফোর্ড থেকে ব্যারিস্টারি পাশ করে দেশে এসে তাঁর বিখ্যাত আইনজ্ঞ বাবার সহযোগী হিসেবে কাজ করছেন। অপূর্ব সুন্দরী মেয়ে সারা। সাদা সাদা সালোয়ার কামিজ পরেন। শরীরে একতিল মেদের চিহ্ন নেই। বাংলায় কথা বলেন, কিন্তু বাংলায় নয়, ইংরেজিতেই যে তিনি কথা বলতে বেশি অভ্যস্ত তা বোঝা যায় যখন তিনি খুব সচেতন ভাবে একটিও ইংরেজি শব্দ ব্যবহার না করে কথা বলেন। যে শব্দগুলো আমরা সচরাচর ইংরেজিতে বলি, তিনি সেসবের বাংলা বলেন, অপ্রচলিত যদিও। জাজকে বিচারক, হাই কোর্টকে উচ্চ আদলত, লোয়ার কোর্টকে নিম্ন আদালত, জাস্টিসকে ন্যায়-পরতা বলেন। আইনের সমস্ত শব্দের যদি বাংলা করতে হয়, তবে অনেক বাংলা শব্দই আমার বিশ্বাস সাধারণ মানুষের পক্ষে বোঝা অসম্ভব হবে। সারার অনেক বাংলা শব্দই আমার কানে অদ্ভুত ঠেকে। নিজেকে অনেকটা সেই রিক্সাঅলার মত মনে হয়, রিক্সারোহী বিশ্ববিদ্যালয়ে যেতে চাইলে যে বলেছিল যে সে চেনে না বিশ্ববিদ্যালয় কোথায়, আরোহী পথ দেখিয়ে নিয়ে যাওয়ার পর গন্তব্যে থেমে বলেছিল, ‘আরে ইনিভার্সিটি আইবেন, সেইটা তো কইবেন।’ সারাই ফতোয়ার বিরুদ্ধে একটি মামলা নথিবদ্ধ করেন। অবশ্য এতে কাজ হয় না, কারণ আদালত থেকে বলে দেয়, সিলেটের সাহাবা সৈনিক পরিষদের বিরুদ্ধে মামলা করতে হলে আমাকে সিলেটে যেতে হবে, ঢাকার আদালত এই মামলা নেবে না। মরতে যাবো আমি সিলেটে! শেষ পর্যন্ত সারা হোসেন আমার নিরাপত্তার ব্যবস্থার জন্য আদালতের দ্বারস্থ হন। আমার অনুপস্থিতিতে আদালত কিছুই করতে রাজি নয়। অগত্যা আমাকে যেতে হল পুরোনো ঢাকায় সারার নিম্ন-আদালতে। ঝুঁকি নিয়েই। সরকারের সামান্যও যদি নীতিবোধের বালাই থাকত, এ সময় সাহাবা সৈনিক পরিষদের বিরুদ্ধে আইন অমান্য করার মামলা ঠুকে দিত। কিন্তু সরকার এ ব্যপারে নীরব, যেন সাহাবা সৈনিক পরিষদ অন্যায় তেমন করেনি। অন্যায় আমিই করেছি, এই ফতোয়া প্রাপ্যই ছিল আমার। আদালতের আঙিনা গিজগিজ করছে লোকে। সকলের চোখ আমার দিকে। কে জানালো এই ভিড়ের লোকদের যে আমি আজ আদালতে যাবো! অদৃশ্য কোনও একটি শক্তি কাজ করছে, আমার চলাচল এই শক্তির নখদর্পণে। ভিড়ের লোকদের উদ্দেশ্য পরিষ্কার নয়। সুতরাং যত দ্রুত সম্ভব কাজ সেরে নিতে হয়। আদালতে বিচারকের চেয়ারে বসা ম্যাজিস্ট্রেট গম্ভীর গলায় বললেন, ‘এমন সব কথা লিখলে দেবেই তো ফতোয়া!’ ইচ্ছে তাঁর হয় না তবুও তাঁকে থানায় আদেশ দিতে হয় আমার বাড়িতে পুলিশ পাঠাতে। আদালত থেকে বাড়ি ফিরে পাহারা পুলিশের অপেক্ষা করতে থাকি। পুলিশের কোনও চিহ্ন নেই। অনেকদিন চলে গেল। আদালতের আদেশ পুলিশও যে অমান্য করতে পারে, তা আমার আগে জানা ছিল না, এখন জানা হয়। মতিঝিল থানা থেকে পুলিশ আসে শেষ পর্যন্ত, আসে অক্টোবরের ১৪ তারিখে। আগের দিন আমাকে নিরাপত্তা দেওয়ার জন্য বাংলাদেশ সরকারের কাছে লেখা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের একটি কড়া চিঠি পত্রিকায় ছাপা হয়েছে বলেই কী! কেবল অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল নয়, প্রায় সব আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা আমার নিরাপত্তার জন্য সরকারের কাছে অনুরোধ করছে। এদিকে ফতোয়ার বিরুদ্ধে দেশের ছত্রিশজন লেখক বুদ্ধিজীবী ফতোয়ার বিরুদ্ধে বিবৃতি দিয়েছেন। ফতোয়ার পক্ষে বিপক্ষে লেখালেখি চলছে। কৃশকায় দুটো পুলিশ আমার বাড়ির দরজার সামনে বসে বসে ঝিমোয়। ঝিমোয়, তবু বাড়ির সকলে স্বস্তির শ্বাস ফেলে। মা ঝিমোনো পুলিশদের চা বানিয়ে খাওয়ান। বলেন, ‘পুলিশগুলার জন্য মায়া হয়।’ বারান্দায় দুটো চেয়ার পাঠিয়ে দেন ওদের বসার জন্য। এপির ফটোগ্রাফার নাদুস নুদুস পাভেল এসে দাঁড়ানো পুলিশের ছবি তুলে নিয়ে গেল, মজার জিনিস সম্ভবত। আমার কাছে অবশ্য এসবকে মজা বলে মনে হয় না। বরং অস্বস্তি লাগে পুলিশের অমন বসে থাকা দেখে। পড়শিরা বলাবলি করছে পুলিশের উপস্থিতি তাদের মনে ভয় ধরিয়ে দিচ্ছে, যে কোনও সময় না আবার বাড়ি আক্রমণ হয়। ইয়াসমিন এক ক্রুদ্ধ বাসিন্দাকে বলে এল, পুলিশ থাকলে তো বরং নিরাপদ বোধ করার কথা! কিন্তু নিরাপদ কেউ বোধ করে না। দরজার বাইরে পা রাখলেই লক্ষ করি আমার দিকে চেয়ে আছে অনেকগুলো পলক না পড়া চোখ। বাড়িতে নিরাপত্তা, বাড়ির বাইরে টিকটিকি। যেখানেই যাই না কেন, টিকটিকি পিছু নেয়, কোথায় যাচ্ছি না যাচ্ছি তা সরকারি খাতায় লেখা হয়ে যায়।

উদ্ভট কিছু হতে চলেছে দেশে। টের পাই। গন্ধ পাই। মৌলবাদী নেতারা, যাদের ক্ষমতা অনেক, সব একজোট হচ্ছেন। বড় রাস্তায়, ছোট রাস্তায়, অলিতে গলিতে মৌলবাদীদের সভা হচ্ছে, বিষয় তসলিমা। নেতারা সাংবাদিক সম্মেলন করছেন, বিষয় তসলিমা। মাঠে ময়দানে সভা। তসলিমার জন্য একটি কড়া শাস্তির ব্যবস্থা করা। নেতারা দেশের সর্বস্তরের মানুষকে আহবান করছেন তাঁদের ডাকে সাড়া দিতে। মসজিদে মসজিদে ঘোষণা দেওয়া হচ্ছে তসলিমার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করার। শত সহস্র মাদ্রাসার ছাত্ররা প্রস্তুত মাঠে নামার জন্য। ঢাল প্রস্তুত। তলোয়ার প্রস্তুত। দেয়ালে দেয়ালে পোস্টার পড়ছে। যেন তসলিমাকে এক্ষুনি একটি শাস্তি না দিলে ইসলামের সর্বনাশ হবে, দেশ পুড়ে ছাই হয়ে যাবে। মিলন মাঝে মাঝে জুম্মাহর নামাজ পরতে শান্তিনগর মসজিদে যায়। মসজিদে বিলি করা লিফলেট হাতে বাড়ি ফেরে। কেবল মসজিদেই নয়, রাস্তাঘাটে বিলি হচ্ছে হরেক রকম তসলিমা বিরোধী লিফলেট। একদিন আমার হাতে মিছিলের একটি লিফলেট দিল মিলন। মিছিল হবে। বিশাল মিছিল।
নারায়ে তাকবীর = আল্লাহু আকবার
দ্বীন ইসলামের অবমাননা = মুসলমান সইবে না
রাসুলুল্লাহর অবমাননা = চলবেনা চলবেনা
বি.জে.পির তাবেদার = তসলিমা হুশিয়ার
রুশদীর সহযোগী = তসলিমা সাবধান
কুখ্যাত তসলিমার = বিচার চাই করতে হবে
নাস্তিক, মুর্তাদ বেঈমান = হুশিয়ার সাবধান

পবিত্র কোরআন, দ্বীন ইসলাম এবং মহানবী (সাঃ) এর বিরুদ্ধে জঘন্য কটাক্ষকারী, দেশের অব্যাহত সম্প্রীতি ও স্বাধীনতার বিরুদ্ধে গভীর ষড়যন্ত্রে লিপ্ত, কুখ্যাত মুর্তাদ খোদাদ্রোহী, রাসুলের দুশমন, শয়তান রুশদীর দোসর ভারতের উগ্র সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী বি,জে,পির দাবার গুটি, নারী সমাজের কুলাঙ্গার

মুর্তাদ নিলর্জ্জ তসলিমা নাসরিনের

০গ্রেফতার ০ কঠোর শাস্তি ০ এবং সব আপত্তিকর লিখনী বাজেয়াপ্তের দাবীতে
বিরাট জনসভা
স্থানঃ বায়তুল মোকাররম দক্ষিণ গেইট
আরিখঃ ১৮ই নভেম্বর, বৃহস্পতিবার ৯৩
সময়ঃ বেলা ২ ঘটিকা
ঈমানী চেতনা এবং দেশ, জাতি ও নবী প্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে মিছিল সহকারে দলে দলে যোগদান করুন।
আবেদনে ঃ
সর্বস্তরের ওলামা ও মাশায়েখগণের পক্ষে
(শাইখুল হাদীস মাওলানা ) আজিজুল হক
(মাওলানা গাজী ) ইসহাক
শায়খুল হাদীস, পটিয়া মাদ্রাসা, চট্টগ্রাম
(মাওলানা মুফতী) আব্দুর রহমান
মহাপরিচালক, ইসলামিক রিসার্চ সেন্টার,ঢাকা
(মাওলানা) মুহিউদ্দিন খান
সম্পাদক মাসিক মদীনা, ঢাকা
(মাওলানা কবি) রুহুল আমীন খান
(মাওলানা) আব্দুল গাফফার
মুফাসসিরে কোরআন, ঢাকা
(মাওলানা মুফতী) ওয়াহিদুজ্জামন
মোহাদ্দিস, বড়কাটরা মাদ্রাসা, ঢাকা
(মাওলানা) আব্দুল জব্বার,
মহাসচিব, বেফাকুল মাদারিস, বাংলাদেশ
(মাওলানা) নূর হোসাইন কাসেমী,
মুহতামিম, বারিধারা মাদ্রাসা, ঢাকা
(মাওলানা ক্বারী) ওবায়দুল্লাহ
খতিব, চকবাজার শাহী মসজিদ
(মাওলানা) মুহম্মদ হাবীবুর রহমান
আহবায়ক, বাংলাদেশ ছাহাবা সৈনিক পরিষদ

মত প্রকাশের অধিকারের পক্ষে কয়েকজন বুদ্ধিজীবী দাঁড়ালেন, মুস্তফা নূরুউল ইসলাম লিখেছেন, ‘কী এক উদ্ভট দেশে, অতি বৈরী পরিবেশে বসবাস আমাদের, যেখানে কাউকে তার আপন স্বাধীনতায় ভাবতে দেয়া হবে না, স্বপ্ন দেখতে দেয়া হবে না। ধিককার দিই নিজেদেরকেই, এই পাপকাণ্ড অবলীলায় এখন ঘটে যাচ্ছে মুক্তিযুদ্ধসম্ভূত আমাদের বাংলাদেশে। নইলে তসলিমা নাসরিন লেখেন, লিখে তাঁর ভাবনার কথা বলেন – কারা সেই বিকল্প হাকিম তাঁর বিরুদ্ধে চরম দণ্ড প্রদানের ফতোয়া জারি করার ধৃষ্ট সাহস যাদের? তসলিমার অপরাধ, তিনি অন্ধকারে, কুসংস্কারের জড়বুদ্ধির পাহাড়কে আঘাত করেছেন। মতলববাজদেরকে আঘাত করেছেন। তাঁর অপরাধ, তিনি নিজের মত করে লেখেন এবং তাঁর বিশ্বাসজাত উপলব্ধিসমূহ সৎমানুষের আন্তরিকতায় খোলামেলা করে বলেন। অনেক ক্ষেত্রে তাঁর সঙ্গে আমরা একমত নাও হতে পারি। তাই বলে বিংশ শতকের শেষ দশকে পৌঁছে, একটি স্বাধীন দেশে গণতান্ত্রিক সিভিল সমাজে বাস করে লেখকের অধিকারকে নিহত হতে দেব, এটা হতে পারে না।

মনে পড়ছে, নজরুলকে একদা কাফের বলা হয়েছিল, তাঁর বিরুদ্ধে শূলদণ্ডের ফরমান জারি হয়েছিল। বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলনের প্রবক্তা আবুল হুসেন আর কাজী আবদুল ওদুদকে দিয়ে একরারনামা সই করিয়ে নেয়া হয়েছিল। আশঙ্কা হয়, তবে কি সেই মধ্যযুগীয় ধর্মান্ধতার পূনরুত্থান ঘটছে?

কিন্তু শেষ সত্যটা এই যে, ইতিহাসের চাকা কদাপি পেছনের দিকে ঘোরে না। আমরা তসলিমা নাসরিনের আপন মত প্রকাশের অধিকারের পক্ষে।’

অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর বক্তব্য, ‘তসলিমাকে নিয়ে যা হচ্ছে, বিষয়টি এখন আর সাহিত্যিক নয়, রাজনৈতিক। এখানে সাহিত্য নিয়ে আলোচনা হচ্ছে না, আলোচনা হচ্ছে মৌলবাদীদের আক্রমণের বিষয় হিসেবে। মৌলবাদীদের দিক থেকে বিষয়টি রাজনৈতিক। বইয়ের ব্যপারে আগ্রহ তাদের নেই। অথচ তারা এ ধরনের বিষয়ের জন্যই ওৎ পেতে থাকে। পাল্টা বক্তব্য দিয়ে খণ্ডন করে না। এ ক্ষেত্রেও এটা ঘটেছে। এটা রাজনৈতিক। যখনই এ মৌলবাদী দলগুলো সুযোগ পায়, তখনই তারা এসব বিষয় নিজেদের দিকে টেনে নেয়। বক্তব্য যে জায়গায় আছে, সেটাকে তুলে নিয়ে নিজেদের মত করে ব্যাখ্যা করে। নিজের মতামত প্রকাশের স্বাধীনতা সবারই থাকা উচিত। এসব নিয়ে যারা আক্রমণ করছে তারা প্রগতির শত্রু।’ বদরুদ্দীন উমর, বামপন্থী তাত্ত্বিক আমার অধিকাংশ লেখার সঙ্গে একমত নন, তিনিও বললেন যে আমাকে কেন্দ্র করে ধর্মীয় প্রতিক্রিয়াশীলকাও সাম্প্রদায়িক শক্তি বৃদ্ধির চেষ্টা হচ্ছে, তিনি তাঁর ঘোর বিরোধী। ধর্মীয় বর্বরতা প্রতিহত করা দেশের সকল প্রগতিশীল শক্তিরই একটি জরুরী কর্তব্য বলে তিনি মনে করেন। কে এম সোবহান লিখেছেন, ‘প্রত্যেক নাগরিকের বাক ও ভাব প্রকাশের স্বাধীনতার অধিকার তার মৌলিক সাংবিধানিক অধিকার। নাগরিক নিরাপত্তা বিধান রাষ্ট্রের অন্যতম দায়িত্ব এবং নাগরিকের বিনা বাধায় চলাফেরা করার স্বাধীনতা আছে। নাগরিকের সাংবিধানিক মৌলিক অধিকার দেয়া আছে এই ভষায়, বিশেষত আইনানুযায়ী ব্যতীত এমন কোনও ব্যবস্থা গ্রহণ করা যাইবে না যাতে কোনও ব্যক্তির জীবন, স্বাধীনতা, দেহ, সুনাম বা সম্পত্তির হানি ঘটে। যে ভাষায় তসলিমা নাসরিনের ব্যক্তিগত জীবনের ওপর মৌলবাদী ও রক্ষণশীলরা আক্রমণ করেছে তাতে তার সুনাম নিঃসন্দেহে ক্ষুণ্ন হয়েছে। সরকারের দায়িত্ব পালনের ব্যর্থতাই আইন শৃঙ্খলার অবনতির অন্যতম কারণ। যারা তসলিমার মেধাকে সহ্য করতে পারে না, তিনি এই বয়সে সাহিত্য জগতে যে প্রতিষ্ঠা লাভ করেছেন, সে সম্পর্কে যারা ঈর্ষান্বিত তারাই তার বিরুদ্ধে অশালীন অপপ্রচার চালান। অপব্যাখ্যা দেন তাঁর মতামতের। সে মতামত সম্পর্কে যে অপব্যাখ্যাকারীরা সম্যকভাবে পরিচিত তাও বিশ্বাসযোগ্য নয়। তসলিমার প্রতিভার, তাঁর কৃতিত্বপূর্ণ সাহিত্য সৃষ্টি যাদের কাছে অসহনীয় তারাই তাঁকে হুমকি দেয়, দুর্নাম রটায়।’

ভোরের কাগজে সম্পাদকীয় লেখা হল। ঞ্ছসময় এগিয়ে যাচ্ছে, পৃথিবী এগিয়ে যাচ্ছে, কিন্তু এগুচ্ছে না বাংলাদেশের সমাজ। এই সমাজকে সব সময়ই পিছনে টানছে সাম্প্রদায়িক বিভেদ, মৌলবাদ, প্রতিক্রিয়াশীলতা। একাত্তরে এই মৌলবাদী শক্তি মুক্তিযোদ্ধাদের অভিহিত করেছিল কাফের বলে। এখানো তারা চালিয়ে যাচ্ছে ধর্মের অপব্যবহার, পবিত্র ধর্মকে ব্যবহার করে যাচ্ছে হীন রাজনৈতিক স্বার্থে, একের পর এক বুদ্ধিজীবী, প্রগতিশীল কর্মী হচ্ছে এদের আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু। এদের সাম্প্রতিকতম টার্ণেট তসলিমা নাসরিন। তসলিমা নাসরিনের লেখা এই ফতোয়াবাজদের উষ্মার কারণ। যে কোনও বই কারও কাছে আপত্তিকর মনে হতে পারে, এক লেখা সবার কাছে গ্রহণযোগ্য হবে, এমন কোনও কথা নেই। তসলিমা নাসরিনের লেখা নিয়েও আছে বিতর্ক, তার লেখার পক্ষে ও বিপক্ষে আছে নানা জোরালো মত। এসব লেখার প্রতিপাদ্য নিয়ে যে কেউ আপত্তি তুলতে পারেন, তবে আপত্তিটা আসা চাই গণতান্ত্রিক উপায়ে, সভ্য পন্থায়। কিন্তু সিলেটের তথাকথিত ছাহাবা সৈনিক পরিষদ দেশের প্রচলিত আইন ও সভ্য রীতির চরম অবমাননা ঘটিয়ে প্রকাশ্য জনসভায় তসলিমা নাসরিনকে হত্যার আহবান জানিয়েছে। হত্যাকারীকে নগদ ৫০,০০০ টাকা পুরস্কার দেবার ঘোষণাও দিয়েছে তারা। সিলেটে তারা তাদের কার্যক্রমের সমর্থনে হরতালও আহবানও করেছিল একদিন। সব মিলিয়ে বাংলাদেশে তারা প্রতিষ্ঠা করতে চায় একখণ্ড মধ্যযুগ। দেশে আইনানুগ সরকার, বিচার ব্যবস্থা, আইনের শাসন প্রচলিত থাকা অবস্থায় কি করে একদল মানুষ একজন লেখককে হত্যার জন্যে পুরস্কার ঘোষণা করতে পারে, তা বোঝা কঠিন।

এ বিষয়ে ইতিমধ্যেই উদ্বেগ প্রকাশ করেছে লণ্ডনভিত্তিক আ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল। আইনের আশ্রয় চেয়েছেন তসলিমা নাসরিন। আদালত তাঁর নিরাপত্তা নিশ্চিত করার নির্দেশ দিয়েছেন পুলিশকে। কিন্তু ওই ধর্মব্যবসায়ীরা বন্ধ করেনি তাদের কার্যক্রম। বরং তারা তসলিমা নাসরিনের বিরুদ্ধে দেশব্যাপী আন্দোলন সংগঠিত করে চলেছে, তারা নেমেছে আটঘাট বেঁধে। দেশের প্রচলিত আইনের ঘোরতর অবমাননা করে যারা দেশটিকে ঠেলে দিতে চায় নৈরাজ্যের দিকে, তারা কি করে এমন প্রকাশ্যে বিনাবাধায় চালিয়ে যেতে পারে তাদের কার্যক্রম? আমরা প্রতিটি নাগরিকের ধর্মীয় স্বাধীনতায় বিশ্বাসী। তেমনি লেখকের লেখার স্বাধীনতাও হওয়া উচিত আমাদের অঙ্গীকার। প্রকৃতপক্ষে গণতন্ত্র বলতে তাই বোঝায়। আমাদের সংবিধান বাক ব্যক্তি ও মত প্রকাশের স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দেয়।”

আজকাল ব্যালেন্স বলে একটি শব্দ খুব চলে পত্রিকা পাড়ায়। বিশেষ করে প্রগতিশীলদের পত্রিকায়। এই সম্পাদাকীয়টির লেজে খানিকটা ব্যালেন্স রক্ষা করার চেষ্টা করা হয়েছে এভাবে, ঞ্ছকোনও লেখককে হত্যার উস্কানি দেওয়া তাই কিছুতেই সুস্থতার লক্ষণ নয়। ইসলামের মূল নীতিও তাতে লঙ্ঘিত হয়। (হয় কি? ইসলাম কিন্তু বলে হয় না)পাশাপশি লেখকের স্বাধীনতা বলতে যে কেবল যা খুশি লেখার স্বাধীনতা বোঝায় না ( কার খুশি মত লিখতে হবে লেখককে?), তার সঙ্গে আপনা আপনিই যুক্ত হয় এক ধরনের দায়িত্ব ( আমি কি দায়িত্বহীনতার কাজ করেছি?), তা নিশ্চয়ই বলে দিতে হবে না কোনও প্রকৃত লেখককে ( আমি তবে প্রকৃত লেখক নই)। কোনও সচেতন লেখক (আমি তবে নিশ্চিতই অসচেতন লেখক) নিশ্চয়ই চাইবেন না, তার লেখা ব্যবহৃত হোক মতলববাজদের রাজনৈতিক স্বার্থে (লেখক যখন লেখেন, তখন কি করে জানবেন তাঁর লেখা মতলাববাজরা রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার করবে কি না)।”

নিঃসন্দেহে ভাল লেখা। ভাল লেখার আকালে এটিই ভাল লেখা। আকাল বলছি এই জন্য যে, ফতোয়ার পক্ষেই অধিক লেখা ছাপা হচ্ছে। ফতোয়ার বিপক্ষে কোনও যুক্তিবাদীর কলম হঠাৎ হঠাৎ ঝলসে ওঠে। শামসুর রাহমান দুঃখ করে লেখেন, ঞ্ছবাংলাদেশে বসবাস করব, অথচ প্রায়শই মন খারাপ হবে না, এরকম কথা বলা মুশকিল। মন খারাপ করার মত ঘটনা এখানে হরহামেশা ঘটছে। খবরের কাগজ পড়তে শুরু করলেই মন খারাপ হয়ে যায়। হবেই বা না কেন? সড়ক দুর্ঘটনা, হরতাল পালনকারীদের উপর পুলিশী জুলুম, শিক্ষাঙ্গণে সন্ত্রাস, লেখকের স্বাধীনতার ওপর হস্তক্ষেপ, ফতোয়াবাজদের দৌরাত্মে গ্রামাঞ্চলে নারী নির্যাতন, কোনও কোনও নারীর প্রাণনাশ, চুরি ডাকাতির হিড়িক, মৌলবাদীদের তর্জন গর্জন, মুক্তমতি মানুষের বিড়ম্বনা, এইসব কিছুই যুক্তিবাদী খোলা মনের ব্যক্তিদের ব্যথিত করে, বিষণ্ন করে, কখনো কখনো ক্ষুব্ধ করে। এই ক্ষোভ প্রকাশ করাও বিপজ্জনক হয়ে দাঁড়িয়েছে। যাঁরা মুখ খোলেন, তাঁরাই পড়েন বিপদে। অশিক্ষা যেখানে মুকুট পরে বেড়ায়, সংকীর্ণতা, কুসংস্কার এবং গোঁড়ামি যেখানে সুপ্রতিষ্ঠিত, সেখানে যুক্তিবাদী মানুষের কল্কে তো জোটেই না, বরং তাঁরা হয়ে পড়েন পশ্চাৎপদ, কূপমণ্ডুকদের আক্রমণের লক্ষ্য। আরো খারাপ লাগে, যখন দেখি একজন মুক্তমতি লেখক প্রতিক্রিয়াশীলদের, মৌলবাদীদের টার্ণেট হন তখন অধিকাংশ লেখক থাকেন উদাসীন, সেই লেখকের পক্ষে দাঁড়াবার কোনও প্রয়োজনীয়তা বোধ করেন না, যেন এটা কোনও ইস্যু নয়। মৌলবাদীদের আক্রোশের ঝড়ে বিপণ্ন লেখকের পক্ষ অবলম্বন করা দূরে থাক, কখনও কখনও তাঁর বিরুদ্ধে বাক্যাবলী খরচ করতে আগ্রহী হয়ে ওঠেন। তাঁরাও আক্রমণ করেন সেই লেখককে। আক্রান্ত লেখকের সব মতের সঙ্গে সবাই একমত হবেন, এটা আশা করা যায় না। কিন্তু মতের ভিন্নতা সত্ত্বেও একজন লেখকের স্বাধীনতার সপক্ষে লেখককুল কলম না ধরলে কারা ধরবে?”

শামসুর রাহমানের এই আহবানে যে লেখককূল কলম হাতে বসে গেলেন তা নয়। কেউ কেউ বলছেন, আমি ধর্ম নিয়ে অতি বাড়াবাড়ি করি, আমার পক্ষে দাঁড়াবার কোনও মানে হয় না, কেউ বলছেন, ইচ্ছে করেই ধর্মের সমালোচনা করে আমি মৌলবাদীদের ক্ষেপিয়ে তুলেছি, তাদের হাতে ইস্যু ছিল না, ইস্যু দিয়েছি, তাদের শক্তি ছিল না, শক্তি দিয়েছি, আমার কারণেই দেশে মৌলবাদ বৃদ্ধি পাচ্ছে, নিজেকে বিতর্কিত করে তোলার জন্য আমি এসব করেছি, কেউ বলছেন, নারী স্বাধীনতার কথা বলতে গিয়ে আমি সীমা ছাড়িয়ে যাই, আমার পক্ষে মন্তব্য করা তাঁদের উচিত নয়। তারপরও কেউ কেউ কিছু লিখছেন। ওদিকে বিপক্ষে একশটি লেখা ছাপা হচ্ছে, এদিকে পক্ষে একটি। মৌলবাদিরা আঁটঘাট বেঁধে লেগেছে। জেহাদ ঘোষণা করেছে। ক্ষমতাসীনদের সহায়তা পেলে জেহাদে বিস্তর সুবিধে। সুবিধে পেয়ে পেয়েই এগোচ্ছে তারা। তাদের যত দৈনিক, সাপ্তাহিক, পাক্ষিক পত্রিকা আছে, নিজেদের মধ্যে মতের মিল না থাকলেও তারা আমার বিরুদ্ধে প্রতিদিন লিখে যাচ্ছে। মিথ্যে কথা। বানানো কথা। অসভ্য অশ্লীল কথা। উদ্দেশ্য পাঠকের মনে যেন ঘৃণা জন্মায়, যেন এই ঘৃণা গায়ে গতরে বড় হতে থাকে এবং বড় হতে হতে এমন অবস্থায় পৌঁছোয়, যে, পাঠক বলতে বাধ্য হয় যে আমার জন্য একটি মৃত্যুদণ্ড অতীব জরুরি। মৌলবাদী নয়, এমন পাঠকও যেন সেসব মিথ্যে পড়ে আঁতকে ওঠে এবং আমার ফাঁসির দাবি তোলে। অথচ সেই তুলনায় প্রগতিশীল পত্রিকাগুলো, যেসব পত্রিকায় মৌলবাদের বিপক্ষে সচরাচর লেখা হয়, সরব নয়। যেন আমার বিরুদ্ধে মৌলবাদিদের আন্দোলন একটি বিচ্ছিত ঘটনা, যেন এটি আমার ব্যক্তিগত ব্যপার। এখানে তাদের নাক গলানোর কিছু নেই। বড় রাস্তা বন্ধ করে সভা হচ্ছে মৌলবাদিদের, হাজার হাজার মৌলাবাদী মিছিল করছে, রাস্তায় ট্রাফিক থেমে আছে ঘন্টার পর ঘন্টা, এ তসলিমার ব্যক্তিগত ব্যপার। মৌলবাদিরা তো আমাদের ঘাড়ে কোপ বসাতে আসছে না, আমরা কেন লাফাবো তসলিমার পক্ষে! কিন্তু খুব বড় লেখক যখন প্রতিবাদ করে লেখেন, তখন সেসব লেখা ছাপতে হয় পত্রিকায়, বড় লেখক বলেই ছাপতে হয়, তসলিমার পক্ষে বলে নয়। তবু হঠাৎ হঠাৎ কোথাও কোথাও কোনও বিবেক চেঁচিয়ে ওঠে, দৈনিক সংবাদে শাকিনা হাসীন অনেকটা যাত্রার বিবেকের মত মঞ্চে ঢুকে চিৎকার করে বললেন যে ‘না এটি তসলিমার ব্যক্তিগত ব্যপার নয়, কারণ সারাদেশের মৌলবাদী ও সাম্প্রদায়িক শক্তি (চিহ্নিত ও ছদ্ম)- ব্যক্তি, দল ও পত্রপত্রিকা জেহাদে অংশ নিচ্ছে, সুতরাং সকল ক্ষুদ্র স্বার্থ, ব্যক্তি ও গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব, সংকীর্ণতা ও পরশ্রীকাতরতার উর্ধে উঠে এই হামলাকে যেন প্রগতিশীল লেখকরা নিজেদের ওপর আঘাত হিসেবে বিবেচনা করেন। প্রগতিশীল রাজনৈতিক শক্তি গা বাঁচানোর নীতি অনুসরণ করে চলতে চলতে ভোটের বাক্সের দিকে তাকিয়ে এই যে অন্ধত্বের অভিনয় করে চলেছেন, কিন্তৃ যতই অন্ধ আর বোকা তারা সাজুন না কেন প্রলয়ের তাণ্ডব তাঁরাও যে এড়াতে পারবেন না, তা এখনই বুঝতে হবে।’ এখন যদি না বোঝেন, তবে, শাকিনার আশঙ্কা, অনেক দেরী হয়ে যাবে। না এ বুঝতে কোনও রাজনৈতিক দলের কেউ চাইলেন না। ব্যপারটি অনেকটা আমার ব্যক্তিগতই থেকে গেল। সাধারণত মৌলবাদিদের যে কোনও উত্থানে আওয়ামি লীগ পথে নামে। এখন আওয়ামি লীগ মৌনব্রত পালন করছে। আরে বাবা! আমার পক্ষে কথা না বল, অন্তত ফতোয়ার বিপক্ষে কথা বল। সে কথা বলতেও যদি তসলিমা নামটি উচ্চারণ করতে হয়, তাই করা হচ্ছে না। তসলিমা নামের সঙ্গে নাস্তিকতা জড়িয়ে আছে, এই নামটি উচ্চারণ করলে আওয়ামী লীগের ধর্মের লেবাস যদি খুলে যায়, তাই ভয়। কমিউনিস্ট পার্টির কমরেড ফরহাদ মারা যাওয়ার পর মহাসমারোহে তাঁর জানাজা পালন হয়েছে, কোরান খতম কুলখানি কিছুরই অভাব ছিল না। বাম দলের সদস্যরা নাস্তিক হিসেবে নিজেদের পরিচয় দিতে লজ্জা বোধ করেন সে দীর্ঘদিন। সুতরাং তাঁদের দলের সঙ্গে আমার নামটি যোগ করলে যদি আবার ধর্মহীনতার কালি লাগে তাঁদের গায়েও! তবে তো যুগ পার হয়ে যাবে ওই কালি দূর করতে। সুতরাং কোন নাস্তিককে ফতোয়া দেওয়া হলে সে ফতোয়া নাস্তিক সামলাবে। আমাদের পূর্বনেতারা যেমনই ছিলেন, আমাদের দলকে ধরে বেঁধে আমরা অনেক আগেই আমরা মুসলমানি করিয়েছি, আল্লাহ রসুল মেনে চলি, আমাদের দিকে নজর দিও না। বাকি যে দল আছে, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য জাসদ, সত্তর দশকে শেখ মুজিবর রহমানের বিরোধিতা করার জন্যই যে দলের জন্ম হয়েছিল। শেষ মুজিবের মৃত্যুর পর দলটির বেঁচে থাকার কোনও অর্থ না থাকলেও বেঁচে আছে, এরকম বেঁচে থাকার কোনও মানে হয় না বলে দলের অনেক নেতাই এ দলে ও দলে এমনকী আওয়ামি লীগেও গিয়ে ভিড়েছেন। নির্বাচনের সময় আওয়ামী লীগের আট দলীয় জোটে জাসদ, জাসদ ভেঙে বেরিয়ে আসা বাসদও ছিল। বাকি যে দল আছে এর মধ্যে বড় হল জাতীয়তাবাদী দল, সংক্ষেপে বিএনপি। জাতীয়তাবাদী দলে আর মৌলবাদী দলে কোনও ফারাক নেই বললে চলে। বিশেষ করে একানব্বইএর নির্বাচনে জামাতের সাহায্য সহযোগিতায় করুণা কৃপায় বিএনপি ক্ষমতায় আসার পর অল্প যেটুক ফারাক ছিল, সেটিও প্রায় যাচ্ছে যাবে করছে। সংসদে এখন জামাতে ইসলামির আঠারোটি আসন। চল্লিশ লক্ষেরও বেশি ভোট পেয়েছে জামাতে ইসলামি। আমাদের কবি-এরশাদ এখন জেলের ভাত খাচ্ছেন, ছাড়া পেলে তিনিও যে দলবল সহ ভিড়তেন মৌলবাদীর দলে, এ নিশ্চিত। জাতীয় পার্টির কোনও চরিত্র ছিল না, এরশাদের জেল হয়ে যাওয়ার পর পরই জাতীয় পার্টির বড় বড় নেতা আওয়ামি লীগে আর বিএনপিতে ভিড়ে গিয়েই তা প্রমাণ করেছে। দল বদল এ দেশের রাজনীতিতে ডাল ভাতের মত ব্যপার। ধূর, আজ এ দলে সুবিধে হচ্ছে না, ও দলে চলে যাই, ও দলে সুবিধে না হলে আরেক দলে চলে যাবো। নীতি আদর্শের বালাই না থাকলে এই হয়। মৌলবাদীরা তাঁদের নীতি আর আদর্শে অটল, জামাতে ইসলামির কাউকে দেখা যায় না অন্য দলে নাম লেখাতে। আওয়ামি লীগ সবসময় ফাঁক ফোকর খোঁজে ক্ষমতাসীন বিএনপির বিরুদ্ধে আন্দোলনে নামার, ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি যখন গণআদালত বসিয়ে গোলাম আযমের বিরুদ্ধে রায় ঘোষণা করছিল, আওয়ামি লীগ উড়ে এসে জুড়ে বসে জনপ্রিয়তা পেতে নির্মূল কমিটির দোসর হয়ে গেল, অথচ লেখকের বিরুদ্ধে জামাতপন্থী মৌলবাদিদের ফতোয়া দেওয়ার অন্যায়টি যখন সরকার দেখেও দেখছে না, দেশব্যাপী মৌলবাদিরা আগ্নেয়গিরির লাভার মত বেরিয়ে আসছে দেখার পরও মুখে যখন কুলুপ এঁটে বসে আছে বিএনপি সরকার, এই আওয়ামি লীগই তখন আশ্চর্য রকম ভাবে নিশ্চুপ। সরকার বিরোধী একটি চরম আন্দোলন শুরু করার জন্য এ ছিল একটি মস্ত বড় সুযোগ কিন্তু এই চমৎকার সুযোগটির দিকে সুযোগ সন্ধানী আওয়ামি লীগ মোটেও হাত বাড়াচ্ছে না। কারণ একটিই। তসলিমা। এদিকে সারাদেশের আলেমরা বৃহত্তর আন্দোলনের কর্মসূচি গ্রহণ করেছে, তাদের মাঠ পর্যায়ে প্রস্তুতি প্রয় চূড়ান্ত। কোনও আলেম ওলামা ইমাম মাওলানা পীর মাশায়েখ কোথাও আর বসে নেই। মুসলিম ঐক্য ফ্রন্ট গঠন করা হয়েছে। ধর্ম ও দেশ বিরোধী কার্যকলাপ প্রতিরোধ কমিটিও হয়েছে। ধর্মীয় রাজনৈতিক এবং অরাজনৈতিক সব দল একত্র হয়ে ইসলামী ঐক্যজোট বানিয়েছে। আর কী চাই! নিজেদের মধ্যে মত পার্থক্য অন্তত এই ইস্যুতে নেই। পাঁচ দশ হাজার লোকের মিছিল হচ্ছে ঢাকা শহরে। রাজপথ দখল করে আছে মৌলবাদিরা। তারপরও যখন কোনও রাজনৈতিক দল মৌলবাদ বিরোধী আন্দোলনের প্রস্তুতি নিচ্ছে না, কোনও দলই, কোনও মানবাধিকার সংগঠন, কোনও লেখক সংগঠন, কোনও নারী সংগঠন পথে নামছে না তখন আমার ক্ষুদে বন্ধু নাহিদ ঝুনু মিতুল, নিপা তসলিমা সপক্ষ গোষ্ঠী নাম দিয়ে একটি গোষ্ঠী দাঁড় করিয়ে মৌলবাদী শক্তির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান লেখা একটি ব্যনার হাতে নিয়ে নেমে পড়ে মৌন মিছিলে। মিছিল টিএসসি থেকে প্রেসক্লাব পর্যন্ত যায়। তসলিমা সপক্ষ গোষ্ঠী একটি লিফলেটও ছেপেছে। মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার চেতনার পক্ষে প্রগতিশীল বিবেকবান সকল সচেতন মানুষের কাছে আবেদন জানিয়েছে, ‘আসুন দলমত নির্বিশেষে আমরা তসলিমা নাসরিনের পাশে দাঁড়াই। তাঁর পক্ষে সংগঠিত হয়ে সরকারের কাছে দাবি জানাই, তসলিমা নাসরিনসহ নারী ও মানবতার মুক্তি আন্দোলনের পক্ষে যারা আওয়াজ তুলছে তাদের সম্পূর্ণ নিরাপত্তাসহ তসলিমা নাসরিনের পূর্ণ নাগরিক অধিকার ফিরিয়ে দেয়া হোক এবং মৌলবাদী শক্তির বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হোক।’

সব মিলিয়ে কতজন ছিল সেই মৌন মিছিলে! একশ দেড়শ! বেশির ভাগই মেয়ে। গার্মেণ্টেসএর মেয়েরাও যোগ দিয়েছে। ঝুনু বক্তুতা করতে ভাল জানে, প্রেসক্লাবের সামনে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে লোক জমিয়ে ফেলে। ঝুনুর সাহস আছে বটে। শার্ট প্যাণ্ট জুতো পরে। ছোট চুল। মেয়ে হয়ে ছেলের পোশাক পরেছে বলে ঝুনুকে অনেক কটুকথা শুনতে হয় রাস্তাঘাটে। ও পরোয়া করে না। মৌন মিছিলের আকর্ষণীয় দিক ছিল, যা শুনেছি, শামীম সিকদার, বিখ্যাত ভাস্কর, টিএসসিএ মোড়ে মিছিলটি দেখে এগিয়ে আসেন এবং নিজে তিনি ব্যানার বহন করেন। বাংলাদেশে শামীম সিকদারের মত সাহসী কোনও মেয়ে আমার জানামতে নেই। আর্ট কলেজের অধ্যাপিকা তিনি। একসময় ওই কলেজের অধ্যাপকগণ শামীম সিকদারের অপসারণের দাবীতে দীর্ঘদিন আন্দোলন করেছিলেন। শামীম সিকদার কিন্তু হতাশ হয়ে কেঁদে কেটে আকুল হয়ে পিছু হটেননি। তিনি লড়াই করেছেন এবং সে লড়াইয়ে জিতেছেন। আন্দোলনকারী অধ্যাপকদের সামনে তিনি সশব্দে সদর্পে হেঁটে যান। শামীম সিকদারের বিশাল বিশাল ভাস্কর্য ঢাকা শহরের অনেক জায়গায় মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে, যেমন দাঁড়িয়ে আছেন শামীম শিকদার নিজের অবস্থানে। আত্মসম্মানবোধ তাঁর প্রবল। নিজের মর্যাদা এতটুকু ক্ষূণ্ন হতে তিনি দেন না। যেমন দেননি সেই ছোটবেলায়, যখন সাইকেল চালিয়ে ইশকুলে যাচ্ছিলেন, আর তার পরনের ওড়না টেনে নিয়ে গিয়েছিল এক ছেলে, সেই ছেলেকে ধরে তো পিটিয়েছেনই, আর কোনওদিন ওড়না পরেননি, কামিজ পাজামাও পরেননি, শাড়ি তো জীবনেও পরে দেখেননি। পরেন শার্ট প্যাণ্ট। পায়ে শক্ত জুতো। হাতে প্রয়োজন হলে রিভলভার রাখেন। সেই কিশোরী বয়স থেকেই শামীম সিকদারের কথা যত শুনেছি, শ্রদ্ধায় আমার তত মাথা নত হয়েছে। শামীম সিকদারের মত হতে ইচ্ছে করত আমার, কিন্তু পারিনি। লজ্জা, ভয় আমাকে গ্রাস করে ছিল সবসময়ই। সেই শামীম সিকদার, নির্মলেন্দু গুণ এবং গুণের কিছু সাঙ্গ পাঙ্গ মৌন মিছিল শেষ করে সাকুরায় গেলেন। ওখানে গিয়ে আমাকে ফোনে খবর দিলেন, যেন যাই। শামীম সিকদারের সঙ্গে কখনও আমার সুযোগ হয়নি ঘনিষ্ঠ বসে কথা বলার। তাঁকে দূর থেকে মুগ্ধ হয়ে দেখেছি যখন তিনি হাতে হাতুড়ি আর ছেনি নিয়ে টিএসসির সড়কদ্বীপে স্বোপার্জিত স্বাধীনতা নামের বিশাল ভাস্কর্যের কাজ করছিলেন। শামীম সিকদারের প্রতি আমার তীব্র আকর্ষণ আমাকে ঠেলে নেয় সাকুরার দিকে। আমি যাচ্ছি, এমন সময় দেখি ছোটদা আমার বাড়ির দিকে আসছেন, তাঁকে তুলে নিই গাড়িতে। সাকুরার পেছনের একটি টেবিল দখল করে বসেছে সবাই। শামীম সিকদারের পরনে শার্ট প্যান্ট, কোমরে শক্ত চামড়ার বেল্ট। পায়ে বুট। আমাকে দেখেই তিনি বললেন, ‘তোমার পক্ষে তো মিছিল করে আসলাম। খুব ভাল হইছে মিছিল।’ এরপর বিস্তারিত বিবরণ শুনতে হল মিছিলের। শামীম সিকদারের সাহচর্য পেয়ে আমি এমনই উত্তেজিত যে মিছিল তখন আমার কাছে কোনও বিষয় নয়। শামীম আমার কাঁধ চাপড়ে বললেন, ‘ভয় পাবা না। ভয় পাবা না। মোল্লা হারামজাদাগুলা কিμছু করতে পারবে না। অত সোজা নাকি? তুমি ভয় পাইলেই ওরা মাথায় উঠবে। যা লিখতাছ লেইখা যাও। আমরা আছি। কোনও অসুবিধা হইলে আমারে খবর দিবা। দেখি তোমারে কোন শালায় কি করে! পিটাইয়া হাড্ডিগুড্ডি ভাইঙ্গা দিব।’

শামীম তাঁর সিগারেটের প্যাকেট ঠেলে দিলেন আমার দিকে। মেয়েদের সিগারেট খাওয়া যে সমাজে কোনও মানুষ কল্পনাও করতে পারেন না, সেই সমাজে বাস করেই তিনি রাস্তা ঘাটে রেস্তোরাঁ বারে সবখানেই সিগারেট খান। এই একটি মানুষ, কোনওদিন পরোয়া করেননি লোকে কি বলবে তার। আমাকে মদও দেওয়া হয়। মদ খেয়ে অভ্যেস নেই আমার। দুতিন চুমুক খেয়েই দৌড়োতে হয় বমি করতে। বমির কথা চেপে রাখি। আবার না শামীম সিকদার বলে বসেন, ‘আরে মেয়ে, তুমি ওই সামান্য মদও খাইতে পারো না! এর মধ্যেই তিনি বলে বসেছেন, আমি ত ভাবছিলাম তুমি খুব শক্ত মেয়ে, কিন্তু না। তুমি একেবারে হাউজওয়াইফদের মত লজ্জাশীলা। আমি বুঝে পাচ্ছি না, তোমার মত নরম নিরীহ মেয়ের পিছনে মোল্লারা লাগল কেন!’

শাড়ি প্রসঙ্গেও বলেছেন, ‘শাড়ি পরো কেন? শাড়ি একটা পোশাক হইল? শাড়ি পইরা তুমি কি ফাইট করতে পারবা টুপিঅলাদের সাথে? শাড়ি ধইরা কেউ টান দিলেই তো শাড়ি খুইলা পড়ে। শাড়ি ছাড়তে হবে।’

আমি যখন মোল্লাদের মিছিল হবে এই নিয়ে দুশ্চিন্তা করছিলাম, সঙ্গে সঙ্গে শামীম সিকদার বলে উঠলেন, ‘তুমি একটা ভীতু। খুব ভীতু মেয়ে তুমি। স্বোপার্জিত স্বাধীনতা যখন ভাইঙ্গা ফেলতে চাইছিল, আমি একলা গিয়া দাঁড়াইছি টিএসসিতে। কোন বেটা আইবি এইটা ভাঙতে। সাহস থাকে তো আয়! কোনও শালা ধারে কাছে ঘেসার সাহস পায় নাই।’

শামীম সিকদার আমার দিকে ফেরেন। চোখে করুণা।

‘জুডো কারাতে কিছু জানো?’

‘না।’

‘কিছুই শিখো নাই জীবনে!’

‘ওইসব জানলেই কি! আমি তো মাঠে নেমে ওদের সঙ্গে যুদ্ধ করছি না।’

‘বুঝলাম। তোমার যুদ্ধ হইল ত তোমার কলম দিয়া। তারা তো শুধু কলম হাতে নেয় নাই। তারা আরও অনেক কিছু হাতে নিছে। পেশির জোর দেখাইতেছে। পুরুষের জোর দেখাইতাছে। রাস্তাঘাটে ভয়ে তুমি বার হইতে পারো না। এইটা কোনও কথা হইল! আরে দুই তিনটারে যদি ঘুসি দিয়া ফালাইয়া দিতে পারো, টুপি পাঞ্জাবি খুইলা ল্যাংটা কইরা ছাইড়া দিতে পারো, ওরা আর তোমার নাম মুখে নেবে না।’

শামীম সিকদারের মত সাহসী হওয়া আমি জানি আমার পক্ষে সম্ভব নয় কোনওদিন। সবাই শামীম সিকদার হতে পারে না। শামীম সিকদার বাংলাদেশে একজনই। ভয় ভীতি লজ্জা শরম, পাছে লোকে কিছু বলে এসবের তোয়াককা তিনি কোনওদিনই করেননি। অসম সাহসী মানুষটির পাশে বসার সুযেগ পেয়ে নিজেকে ধন্য মানি।
 
খবরের কাগজ, আজকের কাগজ, সমীক্ষণ, ভোরের কাগজ, অনন্যা, যায় যায় দিনে আমার কলাম নিয়মিত ছাপা হচ্ছে। ইস্তফার পর এখন দুহাতে লিখছি। যায় যায় দিন এখন সবচেয়ে জনপ্রিয় সাপ্তাহিক কাগজ। সম্পাদনা করেন শফিক রেহমান। শফিক রেহমান অনেককাল লণ্ডনে ছিলেন, সম্প্রতি দেশে ফিরে পত্রিকা বের করছেন। এরশাদ আমলে একবার তাঁকে দেশে ঢুকতে দেওয়া হয়নি। ঢাকা বিমানবন্দর থেকেই ফেরত পাঠানো হয়েছিল। এরশাদের পতন ঘটার পর তিনি দেশে এসে দিব্যি জাঁকিয়ে বসেছেন। যায় যায় দিনে শফিক রেহমানের অনুরোধে কলাম লিখি, কিন্তু লিখে স্বস্তি পাই না। কারণ ধর্ম নিয়ে কোনও বাক্য লিখলে তিনি দিব্যি তা উধাও করে দেন। আজকাল এরকম হচ্ছে প্রায় সব পত্রিকায়। মৌলবাদ নিয়ে লেখো, সে চলবে। কিন্তু ধর্মকে আক্রমণ কোরো না। আগে যেমন ইচ্ছে লিখতে পারতাম পত্রিকায়। কোনও রকম কাটছাট করা হত না। এখন দেখছি লেখার স্বাধীনতা অল্প অল্প করে লোপ পাচ্ছে। কোনওরকম অনুমতি না নিয়ে পত্রিকার সম্পাদকরা আমার লেখা থেকে বাক্য উড়িয়ে দেন, শব্দ ফেলে দেন। লেখাকে কেটে পঙ্গু বানিয়ে তারপর পাঠকের জন্য পরিবেশন করেন। ভোরের কাগজে বেদ বাইবেল ও কোরানের নারী বলে ধারাবাহিক একটি রচনা লিখছিলাম, সেটিও হঠাৎ বন্ধ করে দেওয়া হল। বন্ধ করার কারণ হল ধর্ম। ধর্ম ছাড়া অন্য যে কোনও বিষয় নিয়ে লিখতে পারি, এতে তাঁদের কোনও আপত্তি নেই। ধর্মের আক্রমণে দেশ ধ্বংস হচ্ছে, কিন্তু ধর্ম নিয়ে মন্তব্য করা যাবে না। আমার লেখা ছাপা হলে নাকি পত্রিকার কাটতি বেড়ে যায়, সে কারণেই লেখার জন্য চাপ অনুরোধ আসে। আমি জানিনা কতটুকু কে বিশ্বাস করে আমি যা লিখি তা, কিন্তু কাটতি বাড়ে বলে এখনও আমাকে বহিস্কার করার সাহস পাচ্ছেন না। একবার রোববার পত্রিকার সম্পাদক সাজু আহমেদ আমার কাছে একটি লেখা চাইলেন, দিলাম, বেশ যত্ন করে ছাপলেন। এরপর আবার লোক পাঠালেন চিঠি দিয়ে, তাঁর আবদার আমি যেন নিয়মিত লিখি তাঁর পত্রিকায়। নিয়মিত আমাকে অনেকগুলো পত্রিকায় লিখতে হয়, তাই আমি সবিনয়ে জানিয়ে দিলাম, আমার সময় হবে না। আশ্চর্য এর কিছুদিন পরই তিনি আমার ওপর একটি বিশেষ সংখ্যা রোববার বের করলেন। পঈচ্ছদে আমার ছবি, ভেতরে পাতায় পাতায় ছবি। পুরো রোববার জুড়ে যত লেখা আছে, তার প্রতি বাক্যে আমার বিরুদ্ধে কুৎসা। কুৎসা যে এত নোংরা হতে পারে, অবমাননা যে এত অকরুণ হতে পারে, অসম্মাননা যে এত ভয়ংকর হতে পারে, হিংসা যে এত মারাত্মক হতে পারে, আগে আমার তা জানা ছিল না। ইসহাক খান রুদ্রর সেই বন্ধুটি, লেখাটি লিখেছেন। লেখার বিষয় আমার লেখালেখি নয়, বিষয় আমার যৌনজীবন। এ যাবৎ কত পুরুষের সঙ্গে আমার যৌনসম্পর্ক হয়েছে, কবে কোথায় কিভাবে সেসবের বিস্তারিত বানানো বর্ণনা। রুদ্রর সঙ্গে সম্পর্ক হওয়ার আগেও নাকি ময়মনসিংহে আমার প্রেমিক ছিল, যার সঙ্গে যৌন সম্পর্ক ছিল আমার, ইত্যাদি গল্প। সেই যে কলেজ জীবনে কিছুদিন বিচিত্রায় ব্যক্তিগত বিজ্ঞাপন বিভাগটি চালু হওয়ার শুরুতে কিছু বিজ্ঞাপন দিয়েছিলাম, সে কথাও উল্লেখ করেছেন, কারণ আমার বিজ্ঞাপন বলে চালিয়ে দেওয়ার জন্য কিছু অশ্লীল বাক্য তিনি রচনা করবেন। করেছেনও। পাঠক তো আর ষোলো বছর আগের বিচিত্রা খুঁজে দেখতে যাবে না সত্যিই আমি ওরকম বিজ্ঞাপন লিখেছিলাম কি না। ইসহাক খানের মাথায় এত যে কুবুদ্ধি তা লোকটিকে দেখলে কেউ বিশ্বাস করবে না। গোবেচারা ধরনের চেহারা। জীবনে তাঁর স্বপ্ন ছিল গল্পকার হওয়ার, হতে পারেননি। এখন সাজু আহমেদের কল্যাণে গল্পকার হলেন বটে। চরিত্র হননের রগরগে গল্পখানা খুব বিকোলো। রোববারের সেই সংখ্যাটি তিনবার ছাপতে হয়েছে পাঠকের তাগাদায়। আমার ওপর প্রশংসা থাকলেও পত্রিকা চলে, নিন্দা থাকলেও চলে। দু হাজার বিক্রি হত রোববার, দুলক্ষ বিক্রি হয়ে গেল পলকে। সুতরাং প্রশংসার প্রয়োজন কী। নিন্দা দিয়েই ভরে ফেলা হোক না কাগজ! ব্যর্থ গল্পকার ইসহাক খান এই গল্পখানি লিখেই জীবনে প্রথম গল্পকার হিসেবে সাফল্য অর্জন করলেন। জীবন তাঁর সার্থক হল। কচুরিপানার মত অগুনতি পত্রিকা গজিয়েছে দেশে, দৈনিক, সাপ্তাহিক, পাক্ষিক, মাসিক, দ্বিমাসিক, ষৈনমাসিক। কম চলা পত্রিকাগুলো বেশি চলার লোভে তসলিমার গল্প তৈরি করে ছাপে। পঈচ্ছদে পঈচ্ছদে তসলিমার ছবি, ভেতরে কত গল্প কত কাহিনী। আমার সঙ্গে কোনও সাংবাদিকের সাক্ষাৎ ছাড়াই, কোনও বাক্যালাপ ছাড়াই আমার বড় বড় সাক্ষাৎকার ছেপে ছাপা হয়ে যায়। ফতোয়া নিয়েও কত রকম মজা করা হয়। হাবীবুর রহমান নাকি বলেছেন আমাকে বিয়ে করতে চান তিনি। উত্তরে আমি নাকি বলেছি হ্যাঁ আমি রাজি। এদিকে পঞ্চাশ হাজার টাকা মূল্যের মাথাটি নিয়ে মাথার ঠিক নেই। আর ওদিকে হা হা, ওদিকে হি হি।

মতিউর রহমান চৌধুরির উদ্দেশ্য ছিল আমাকে ঘৃণা করার পরিমাণ কত তীব্র এ দেশে, তা ফতোয়ার ঘটনাটি দিয়ে প্রমাণ করা। কিন্তু বুদ্ধিজীবিরা যখন বিবৃতি দিলেন আইনবিরুদ্ধ ফতোয়ার বিরুদ্ধে, প্রচুর লেখালেখি শুরু হল দেশে এবং বিদেশে, আমার পক্ষে জনমত গড়ে ওঠার ভাল একটি সম্ভাবনা তৈরি হচ্ছে আঁচ করে খানিক বিপাকে পড়েই হাবীবুর রহমান যে এরকম কোনও ফতোয়া দেননি অথবা দিলেও তিনি তা তুলে নিয়েছেন বলতে চেষ্টা করলেন। কিন্তু হাবীবুর রহমান ফতোয়া তুলে নেওয়ার লোক হবেন কেন! তাঁর ডাকে গোটা সিলেটে অত্যন্ত চমৎকার ধর্মঘট পালন হয়েছে। ফতোয়ার কথাটি আপাতত উহ্য রেখে হাবীবুর রহমান জোর আন্দোলনে নেমেছেন। বিশাল বিশাল জনসভায় গরম গরম বক্তৃতা করছেন। ‘কুখ্যাত তসলিমা নাসরিনের সকল লেখা বাজেয়াপ্ত, তাকে গ্রেফতার ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবিতেঞ্চ সর্বস্তরের উলামা- মাশায়েখগণের উদ্যোগে ঢাকার সিসিলি রেস্তোরাঁয় একুশে অক্টোবর একটি সাংবাদিক সম্মেলনের আয়োজন হয়। সম্মেলনে সাংবাদিকদের উদ্যেশে বলা হল, ঞ্ছতসলিমা নামটি দেখে মনে হয় সে মুসলমান-সন্তান। অথচ, তার আকীদা, বিশ্বাস, মন – মানসিকতা সম্পূর্ণ বিপরীত। সে পবিত্র কোরান, মহানবী (সাঃ) এবং ইসলামী শরিয়তের বিরুদ্ধে জঘন্য কটুক্তি করে খোদাদ্রোহিতায় লিপ্ত রয়েছে। … তসলিমার নির্লজ্জ, ঔদ্ধত্যপূর্ণ অত্যন্ত আপত্তিকর লেখনির ফলে সমাজে, রাষ্ট্রে, দেশ ও বিদেশে অশ্লীলতা, বেলেল্লাপনা ও নগ্নতা মহামারির মত ছড়িয়ে পড়ছে। এতে করে দ্বীন ইসলাম ও মহানবী (সাঃ) এর ভাবমূর্তি বিনষ্ট হচ্ছে। উক্ত মহিলা পবিত্র কোরানের সূরা আলে এমরান, সুরা নিসা, সুরা বাকারা, সুরা হুজরাত, সুরা ওয়াকিয়া, সুরা আররাহমান ইত্যাদি নাম ধরে ধরে আল্লাহর বিধানের প্রতি ব্যঙ্গ করেছে, কটুক্তি করেছে। অনুরূপভাবে মহানবী (সাঃ) এর প্রতি জঘন্য ভাষায় কটাক্ষ করেছে। পবিত্র ধর্ম বিশ্বাসকে সে ভুল বিশ্বাস বলে আখ্যায়িত করেছে। সে আরো উক্তি করেছে, ধর্ম মানুষকে অমানুষ করে। ধর্ম নারীকে অপমানিত ও কুৎসিত করেছে। সে নারী নির্যাতন, নারী পুরুষে বৈষম্য ও সমাজে অশান্তি সৃষ্টির জন্য মহান আল্লাহ ও তাঁর রাসুল কে দায়ী করেছে। ধর্ম বিশ্বাসীগণের প্রতি জঘন্য কটাক্ষ করে লিখেছে, যে সব নারী মহানবী (সাঃ) এর হাদীস মান্য করে আমি তাদের ধিককার না দিয়ে পারি না ইত্যাদি। যৌনাচার, ব্যাভিচার সকল ধর্মেই একটি ঘৃণ্য পাপ, অথচ তসলিমা নারী সমাজকে অবাধ যৌনতা ও ব্যাভিচারের প্রতি উৎসাহ প্রদানের উদ্দেশ্যে লিখেছে, আমার মনে হয় একটি নারী ১০টি পুরুষের সঙ্গে যৌন সম্পর্ক রেখেও সতী থাকতে পারে। এধরণের লাগামহীন বক্তব্য প্রকাশ এবং সমাজে এগুলি ব্যাপকভাবে প্রচার করার পরিণতি কত ভয়াবহ হতে পারে তা সহজেই অনুমেয়। একটি কথা সর্বজন বিদিত যে, যদি কোনও ব্যক্তি রাষ্ট্রদ্রোহি বলে প্রমাণিত হয়, সে যদি প্রকাশ্যে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয় তবে তার একমাত্র শাস্তি হচ্ছে মৃত্যুদন্ড। ঠিক তেমনিভাবে মুসলমান নামধারী কোনও ব্যক্তি যদি দ্বীন ইসলাম, পবিত্র কোরান এবং মহানবী (সাঃ) এর প্রতি কটাক্ষ করতঃ দুর্নাম রটনা করে সমাজে বিশৃংখলা সৃষ্টির প্রয়াস চালায় তবে সে ধর্মদ্রোহী, শরিয়তের বিধান মতে তার শাস্তি হচ্ছে মৃত্যুদন্ড।ঞ্জ সাংবাদিক সম্মেলনে বাংলাদেশ সাহাবা সৈনিক সমিতি অত্যন্ত গর্বের সঙ্গে ঘোষণা করে যে, সিলেটে তারা সমাবেশ, বিক্ষোভ মিছিল এবং অর্ধদিবস হরতাল পালনের মাধ্যমে সরকারের কাছে তিন দফা দাবি পেশ করেছে, ঞ্ছ১. অবিলম্বে তসলিমা নাসরিনকে গ্রেফতার, ২. তার সকল লেখা বাজেয়াপ্ত এবং ৩. তাকে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রদান। এ দাবি তওহিদি জনতার প্রাণের দাবি। সরকারকে এ সব ন্যায্য দাবি মানতেই হবে। তসলিমার লজ্জা বইটি সরকার বাজেয়াপ্ত করেছে, অথচ লজ্জার চেয়ে বহুগুণ আপত্তিকর অন্যান্য বইগুলো বাজেয়াপ্ত করে সাহাবা সৈনিক পরিষদের ন্যায্য দাবি যেন মেনে নেওয়া হয়। আর বাংলাদেশে দ্বীন ইসলাম, পবিত্র কোরান এবং মহানবী (সাঃ) এর বিরুদ্ধে কটুক্তি করার জন্য মৃত্যুদন্ডের বিধান চালু করার দাবিতে ব্যাপক গণ আন্দোলন গড়ে তোলা হবে।ঞ্জ হবে কেন, হচ্ছে। আমি ষ্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি, আন্দোলন কেবল দানা বাঁধছে না, বীভৎস রূপ ধারণ করছে।

মিছিল আসছে। একশ নয়, দুশ নয়, কয়েক হাজার লোকের মিছিল। কাকরাইলের মোড় থেকে মিছিল আসছে শান্তিনগরের দিকে। আমি জানালায় বসে দেখছি বড় বড় অক্ষরে ব্যানারের লেখা, তসলিমার ফাঁসি চাই। এগিয়ে আসছে মিছিল নারায়ে তকবির আল্লাহু আকবর বলতে বলতে। মিছিল আসছে। মা বিড়বিড় করে সুরা পড়ছেন। আমাকে জানালার কাছে দেখে সুরা উবে গেল মুখ থেকে। টেনে আমাকে সরালেন জানালা থেকে। সুরায় খুব কাজ হবে বলে মার বিশ্বাস হয় না, মা দৌড়ে গিয়ে জায়নামাজে আল্লাহর উদ্দেশ্যে মাথা ঠেকিয়ে রাখলেন, যদি মার প্রার্থণা আল্লাহতায়ালার কানে পৌঁছোয়। আল্লাহ তায়ালা এই জনরোষ থেকে আমাকে যেন রক্ষা করেন। মিছিল এসে থামল শান্তিনগরের মোড়ে। মোড়ে কিছু খাকি পোশাকের পুলিশ দাঁড়ানো। পুলিশ বাধা দিচ্ছে এগোতে। মোড় থেকে নারায়ে তকবীরের গর্জনে বাড়ি কেঁপে ওঠে।

এরকম প্রায়ই মিছিল আসে বায়তুল মোকাররম মসজিদ থেকে শান্তি নগরের দিকে। এরকম প্রায়ই প্রাণ হাতের মুঠোয় নিয়ে আমি দাঁড়িয়ে থাকি।

মানুষের এই ঢল যদি কখনও আমার ঘরে উঠে আসার সুযোগ পায়! দরজায় বসে থাকা দুটো পুলিশ কি আর রোধ করতে পারবে ঢল! দিন দিন বানের ফুঁসে ওঠা জলের মত এগোচ্ছে মিছিল।

শায়খুল হাদিস বিখ্যাত লোক। তিনি নতুন একটি কমিটি গঠন করেছেন। ধর্ম ও দেশ বিরোধী কার্যকলাপ প্রতিরোধ কমিটি। দলে দলে মুফতী মাওলানা যোগ দিচ্ছেন এই কমিটিতে। বিশাল ব্যানার নিয়ে বিশাল মিছিল করছে এই দল। বিশেষ করে শুক্রবার জুম্মাহর নামাজের পরই মিছিল শুরু হয়। কেবল মিছিল করেই বসে থাকে না এই দল। জাতীয় সংসদের স্পীকারের কাছে স্মারকলিপি দিয়েছে।

মাননীয় স্পীকার
বাংলাদেশ জাতীয় সংসদ
সংসদ ভবন
শেরে বাংলা নগর,
ঢাকা

জনাব,
যথাযথ সম্মানপূর্বক নিবেদন এই যে
১. বাংলাদেশের আপামর জনতা গভীর ভাবে ধর্মপ্রাণ এবং এ দেশের সকল সম্প্রদায়ের সাধারণ জনগণ যে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির ব্যপারে অত্যন্ত সচেতন ও যত্নশীল এ সত্য সর্বজনবিদিত। কিন্তু কতিপয় বিভ্রান্ত মহল জনগণের ধর্মানুভূতিতে আঘাত হানাকে প্রগতিশীলতার পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন মনে করে জনগণের ধর্মীয় চেতনা ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্টের হীন তৎপরতা অব্যাহতভাবে চালিয়ে যাচ্ছে। তাদের এ হেন দুষ্কর্মের পিছনে ইসলাম, বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সামাজিক সুস্থিতির প্রতি বৈরি মহল সমূহের মদদ ও যোগসাজস রয়েছে তা আজ আর প্রমাণের অপেক্ষা রাখে না।
২. তসলিমা নাসরিন নাম্নী এক কুখ্যাত লেখিকা ক্রমাগত বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় কলাম, বই ও উপন্যাস লিখে একাধারে বাংলাদেশের সকল ধর্ম বিশ্বাসীর ধর্মীয় চেতনায় আঘাত হেনে চলছে। অন্যদিকে অত্যন্ত সুচতুর ও সুপরিকল্পিত ভাবে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে পারষ্পরিক বিদ্বেষ ও দ্বন্দ্ব সৃষ্টির অপপ্রয়াসে লিপ্ত রয়েছে।
৩. মিথ্যা ও বানোয়াট তথ্যভিত্তিক অসৎ উদেবদশ্য প্রণোদিত উপন্যাস লজ্জা লিখার মাধ্যমে তসলিমা নাসরিন এ দেশের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির সর্বজন স্বীকৃত ঐতিহ্যে কালিমা লেপন করে আন্তর্জাতিক পরিসরে বাংলাদেশের ভাবমূর্তিকে ক্ষুণ্ন করেছে এবং দেশী বিদেশী কতিপয় সাম্প্রদায়িক মহলকে মুসলমানদের বিরুদ্ধে প্রতিহিংসা পরায়ণতার দিকে উস্কে দিয়েছে। অথচ সরকার শুধুমাত্র লজ্জা উপন্যাসকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে কোনরূপ আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করেননি। যদিও তসলিমা নাসরিনের বিভিন্ন লেখায় বাংলাদেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব এবং ভৌগলিক অখণ্ডতার বিরুদ্ধে বহু উস্কানিমূলক বক্তব্য রয়েছে যা সুষ্ঠুভাবে রাষ্ট্রদ্রোহিতার সামিল। সরকারের এহেন আচরণে দেশপ্রেমিক জনগণ দারুণভাবে ক্ষুব্ধ ও হতাশাগ্রস্থ।
৪. যদিও সাংবিধানিকভাবে এবং দেশের প্রচলিত আইনে বাংলাদেশে বসবাসকারী বিভিন্ন ধর্মাবলম্বী মানুষের ধর্মানুভূতিতে আঘাত হানা এবং তাদের মধ্যে পারষ্পরিক বিদ্বেষ ছড়ানো শাস্তিযোগ্য অপরাধ কিন্তু এ ধরনের দেশ ও ধর্মবিরোধী কার্যকলাপের বিরুদ্ধে দ্রুত ও কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের বিধান না থাকায় দেশদ্রোহী ও ধর্মবিরোধী মহল সমূহ বেপরোয়া ভাবে অপকীর্তি চালিয়ে যাচ্ছে এবং সামাজিক সংঘাত ও অস্থিরতার ইন্ধন যোগাচ্ছে।
৫. বাংলাদেশের শতকরা নব্বইভাগ মানুষ মুসলমান। লেখিকা তসলিমা নাসরিন তার বিভিন্ন বই ও লেখার মাধ্যমে মুসলমানের পবিত্র ধর্মগ্রন্থ কুরআন, নবী(দঃ)এর হাদিস এবং ইসলামী শরিয়তের বিভিন্ন বিধি বিধানের প্রতি অবমাননামূলক কটাক্ষ প্রতিনিয়তই করে চলেছে এবং তার এহেন ধর্মদ্রোহী আচরণের বিরুদ্ধে দেশের প্রতিনিধিত্বশীল সকল ধর্মীয় মহল থেকে জোর প্রতিবাদ করা সত্ত্বেও সরকার এ ব্যপারে দুর্বল আইনের আড়ালে আশ্রয় নিয়ে রহস্যজনক ভাবে নিষিক্রয়তার পথই অবলম্বন করে চলেছেন। ফলে এদেশের ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা অত্যন্ত যুক্তিসংগত কারণেই বর্তমান আইন কানুন ও সরকারের প্রতি আস্থাহীন হয়ে পড়েছেন।
৬. লেখিকা তসলিমা নাসরিন শুধু ধর্মের উপরেই আঘাত হানছে না, সমাজে প্রচলিত সার্বজনিন মূল্যবোধের বিপরীতে ব্যভিচার, অবাধ যৌন সম্পর্ক, বিবাহপূর্ব এবং বিবাহ বহির্ভূত যৌন সম্পর্ক, নারী পুরুষের সম্পর্কের ক্ষেত্রে তথাকথিত পুরুষতান্ত্রিক জুলুমের ফাঁপানো ফুলানো কল্পকাহিনী প্রচার করে সামাজিক সুস্থিতি বিনষ্টের অপপ্রায়াসেও লিপ্ত রয়েছে। তার লেখা যে পর্নোগ্রাফির পর্যায়ে পড়ে এবং তা এ দেশের যুব সমাজকে উμছৃঙ্খলতা ও নৈতিক অক্ষয়ের দিকে ঠেলে দেওয়ার ষড়যন্ত্র বৈ ত কিছুই নয়।
এমতাবস্থায় আমরা দেশ প্রেমিক ও ধর্মপ্রাণ মানুষের আবেগ অনুভূতির প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়ে জোর দাবী জানাচ্ছি যে ১. দেশদ্রোহী ও ধর্মদ্রোহী মুরতাদের বিরুদ্ধে মৃত্যুদণ্ড সহ কঠোর শাস্তি বিধানের ব্যবস্থা সম্বলিত আইন প্রণয়ন। ২. তসলিমা নাসরিনকে অবিলম্বে গ্রেফতার ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রদান এবং ৩. তার যাবতীয় আপত্তিকর লেখা বাজেয়াপ্ত করার ব্যবস্থা গ্রহণ করা হোক।
(শাইখুল হাদিস মাওলানা আজিজুল হক)
আহবায়ক
ধর্ম ও দেশ বিরোধী কার্যকলাপ প্রতিরোধ কমিটি
সাত মসজিদ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা

প্রায় একইরকম চিঠি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকেও দেওয়া হয়। ‘জনাব, আমরা অত্যন্ত হতাশা ও ক্ষোভের সাথে আপনার সমীপে নিবেদন করছি যে বাংলাদেশের বারো কোটি দেশপ্রেমিক ধর্মপ্রাণ মানুষের বিশ্বাস ও আবেগ অনুভূতিতে আবমাননাসূচক আঘাত হেনে তসলিমা নাসরিন নাম্নী এক কুখ্যাত লেখিকা….।’

লেখকের মাথার মূল্য ধার্য করা হয়েছে বাংলাদেশে। এ খবরটি বিশাল খবর, বিশেষ করে ইওরোপ আমেরিকায়। সালমান রুশদির ঘটনার পর এরকম একটি খবর লুফে নেবে বটে বিদেশের প্রচার মাধ্যম। একজন লেখক তাঁর লেখার কারণে ফতোয়ার শিকার হয়েছেন। মৃত্যুদণ্ডের দাবি তুলছে মুসলিম মৌলবাদীরা। রাজপথে মিছিল হচ্ছে। এমন সব খবর পড়ে লেখকের মত প্রকাশের স্বাধীনতার পক্ষে দাঁড়িয়ে যাচ্ছে বিদেশের মানুষ। ইওরোপে আমেরিকার বাংলাদেশ দূতাবাসগুলোর সামনে বিক্ষোভ প্রদর্শন করছে মানবাধিকার কর্র্মী, লেখক সমাজ, নারীবাদী দল। বিভিন্ন বিদেশী সংগঠন থেকে প্রধানমন্ত্রীর কাছে আবেদন জানানো হচ্ছে, আমাকে যেন নিরাপত্তা দেওয়া হয়, মৌলবাদীদের যেন দমিয়ে রাখা হয়। নিউ ইয়র্ক টাইমস পত্রিকায় উপ সম্পাদকীয় লেখার জন্য আমাকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। ইংরেজিতে দুটো কথা না হয় চলে, তাই বলে লেখা! বলে দিতে নিই আমার পক্ষে অসম্ভব। তখন অসম্ভব কে সম্ভব করার জন্য এপির সাংবাদিক ফরিদ হোসেন এগিয়ে আসেন। এর মধ্যে ফরিদ হোসেন বেশ অনেকবার যাওয়া আসা করেছেন আমার বাড়িতে, বিদেশি পত্রিকা থেকে তাঁকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল আমার খবরাখবর নেওয়ার জন্য। ফরিদ হোসেন সুশিক্ষিত সাংবাদিক, অত্যন্ত ভদ্র, অমায়িক, আন্তরিক। কেবল সাংবাদিক হিসেবে তিনি আমার সঙ্গে দেখা করতে আসেন না, দুঃসময়ে বন্ধুর মত পাশে দাঁড়াতেও আসেন। উপসম্পাদকীয়টি আমি বাংলায় লিখি, ফরিদ হোসেন আমার বাংলার ইংরেজি করে দেন। ডাক্তার রশীদ ঢাকা মেডিকেল থেকে সিলেটের মৌলভীবাজারে বদলি হয়ে যাওয়ার পর মাঝে মধ্যে ঢাকায় এলে আমার বাড়িতেই ওঠেন, আমার লেখার ঘরে তাঁর শোবার জায়গা করে দেওয়া হয়। তিনি দাদার মত উপদেশ বর্ষণ করে চলেন, দাদার মত বিদেশী সংগঠন থেকে আসা জরুরি চিঠিপত্রের উত্তর লিখে দেন। আন্তর্জাতিক লেখক সংগঠন পেন থেকে আমার খোঁজ করা হচ্ছে। খোঁজ করছেন মেরেডিথ ট্যাক্স। দিনে দশবার করে ফোন করছেন আমার বাড়িতে। প্রথম ফোন ধরে ইংরেজির আগা মাথা কিছু না বুঝে ফোন রেখে দিই। এরপর মেরেডিথ ট্যাক্সের ফোন এলে অন্য কাউকে ধরতে বলে আমি বাড়িতে নেই অথবা ঘুমোচ্ছি এই জাতীয় কিছু বলে দিতে বলি। মেরেডিথ কোত্থেকে আমার ফোন নম্বর যোগাড় করেছেন, তা সাধ্য নেই জানার। শেষ পর্যন্ত তিনি আমার উকিল কে সেই খোঁজ নিয়ে ডক্টর কামাল হোসেনের ওপর ফোন ফ্যাক্সের তুফান বইয়ে দেন। পেন এর লেখিকা শাখার সভানেত্রী মেরেডিথ, তাঁর দায়িত্ব পৃথিবীর কোথাও কোনও লেখিকার ওপর কোনওরকম আক্রমণ এলে তাঁকে সাহায্য করা! মেরেডিথ আমাকে আর কী সাহায্য করতে পারেন নিউ ইয়র্কে বসে! সরকারি দপ্তরে যত বিদেশি আবেদন অনুরোধ এসেছে, আমি নিশ্চিত, সবই ময়লা ফেলার ঝুড়িতে চলে গেছে। এসবের দিকে আমাদের পুতুলবিবি মোটেও ফিরে তাকান না। ফোন আসছে ফ্রান্স, জার্মানি, অস্ট্রেলিয়া, নরওয়ে, কানাডা, ইংলেণ্ড, ভারত নানা দেশ থেকে। আমি কেমন আছি, কী করছি, কী ভাবছি, নিরাপত্তার অভাব বোধ করছি কি না জানার জন্য। ফোনে আশ মেটে না তাঁদের। উড়ে আসেন দূর দূর দেশ থেকে। প্রথম বিশ্ব হুমড়ি খেয়ে পড়ে তৃতীয় বিশ্বে। টেলিভিশন, রেডিও আর পত্রপত্রিকার সাংবাদিকের ভিড় লেগে গেছে আমার বাড়িতে। বিবিসি থেকে সাক্ষাৎকার নিয়ে গেল। তথ্যচিত্রও বানাচ্ছে বিবিসি। জার্মানির টেলিভশন থেকে লোক এল, কেবল সাক্ষাৎকার নয়, আরও কিছু চাই। পুরো একটি তথ্যচিত্র বানানোর জন্য যা কিছু প্রয়োজন। ফ্রান্স থেকে এল দুঘণ্টার একটি তথ্যচিত্র বানাতে। সেদিন আমার বাড়িতে শিবনারায়ণ রায় ছিলেন, সালমান রুশদির সঙ্গে আমার তুলনার প্রসঙ্গ এলে শিবনারায়ণ দৃঢ় কণ্ঠে বলে দিলেন, ‘সালমান রুশদি আর তসলিমার মধ্যে বিস্তর তফাৎ। সালমান রুশদি সমাজ পরিবর্তনের জন্য কোনও আন্দোলন করছেন না। তসলিমা করছেন।’ তথ্যচিত্রের দলটি এর পর সিলেটের হাবীবুর রহমানের সাক্ষাৎকার নিতে যায়, নিতে যে যাচ্ছে সে কথাটি আমাকে পুরো গোপন করেছে। এমন সতর্কতা। কিন্তু দলটির ছবিসহ ছাপা হয়ে যায় ইনকিলাবে। পুরোনো ঢাকায় নাকি কোনও এক হিন্দু পরিবারের সাক্ষাৎকার নিতে যাচ্ছিল ওরা। গোয়েন্দা পুলিশের দল পিছু নিয়েছে ওদের। সরকারের ধারণা বিদেশীরা অসৎ উদ্দেশ্য নিয়ে তথ্যচিত্র করতে এসেছে। ইনকিলাবের আহবানে সরকার সেই দলের ওপর চিরুনি তল্লাশি চালিয়ে দলটিকে দেশ ছাড়তে বাধ্য করেছে। অতি সতর্কতায় তথ্যচিত্রের ক্যাসেটের একটি কপি ওরা আগে ভাগেই ফরাসি দূতাবাসের মাধ্যমে পাঠিয়ে দিয়েছিল প্যারিসে। কত কি যে ঘটে যায় আমার অজান্তে! আমার সাক্ষাৎকার নিতে আসা কোনও বিদেশীকেই এখন থেকে আর দেশে ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে না। বুদ্ধিমান সাংবাদিকরা অন্য কোনও কারণের কথা বলে দেশে ঢুকছে। ফ্রান্সের ল্য-মন্দ পত্রিকা থেকে ক্যাথারিন বেদারিদা এলেন। লিবারেশন পত্রিকার আন্তোয়ান দ্য গুডমার। গুডমারকে খুব ভাল লাগে আমার। ফরাসিদের ইংরেজি বুঝতে কোনও অসুবিধে হয় না, ধীরে ধীরে বলেন ওঁরা। ভাঙা ভাঙা ইংরেজি। আমি তো আপাদমস্তক বাঙালি, ফরাসির তো প্রশ্ন ওঠে না, ভাল করে ইংরেজি না জানা বাঙালি, আমার ইংরেজিও অমন ভাঙা ভাঙা। গুডমারকে নিয়ে একদিন গাড়ি করে ধলেশ্বরী নদীটি দেখিয়ে আনি। গুডমার বললেন, ‘এই যে বাইরে বেরোচ্ছে!, কোনও অসুবিধে হয় যদি!’ আমি বললাম, ‘ঘরে বসে থাকতে থাকতে দম বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, ইচ্ছে করে বাইরে বেরোতে।’ ফরাসি ফটো এজেন্সি থেকে যখন জিল সসেয়ার এলেন ছবি তুলতে, তাঁর অনুরোধে আমাকে ময়মনসিংহে যেতে হয়। জিলের খুব ইচ্ছে ময়মনসিংহের বাড়িতে যেখানে আমার শৈশব কৈশোর কেটেছে, যে ইশকুলে ছোটবেলায় পড়েছি, সেসবের ছবি নেওয়ার। এই যে হঠাৎ হঠাৎ বেরিয়ে পড়া, যদিও হেঁটে নয়, রিক্সায় নয়, যদিও রাস্তাঘাটে দোকানপাটে, লোকের ভিড়ে, বাজারে থামা নয়, তারপরও আমার ভাল লাগে বেরোতে। গাড়ির জানালা দিয়ে অন্তত মানুষ দেখা যায়। ঘরের চার দেওয়ালের ভেতর বন্দী থাকতে থাকতে মনে হয় আমার বুঝি কবর হয়ে গেল ওখানেই। মরে তো যাবই একদিন, তাই বলে কি কবরে বসে কবরের দিন গুনতে হবে! শামীম সিকদারের ভয় পাবা না উপদেশটি বারবারই নিজেকে বলি।

ভারতের সানডে ম্যাগাজিন, স্টেটসম্যান থেকে সাংবাদিক আসেন সাক্ষাৎকার নিতে। সারা ভারতেই ফতোয়ার বিরুদ্ধে নিন্দা জানিয়ে সভা হচ্ছে। বিবৃতি দেওয়া হচ্ছে। সচেতন লেখকরা প্রতিবাদ জানাচ্ছেন লিখে। পত্রিকায় সম্পাদকীয় যাচ্ছে। কলকাতায় অন্নদাশংকর রায়ের নেতৃত্বে লেখকরা গিয়েছেন বাংলাদেশ দূতাবাসে স্মারকলিপি নিয়ে। দূতাবাসের দুয়ার খটাশ করে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে ওঁদের মুখের ওপর। কলকাতা বিশ্বাবিদ্যালয়ে বাংলাদেশ ভারত মৈত্রী সমিতির আয়োজনে আমার জীবন ও লেখার স্বাধীনতা রক্ষার জন্য সভা হয়। বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবীরা অনুষ্ঠানে ছিলেন, অবশ্য বাংলাদেশের কেউ ছিলেন না। অন্নদাশংকর রায় ওখানেও ছিলেন। তাঁর মতে আমি একবিংশ শতকের কন্যা, ভুল করে বিংশ শতকে জন্মেছি। আমি ফ্রান্স বা ইংলেণ্ডের কন্যা, ভুল করে বাংলাদেশে জন্মেছি। আরেকটি কথা বলেছেন, ‘তসলিমা একজন আ্যংরি ইয়ং উওম্যান, মোল্লারা একদল অ্যাংরি ওল্ড ম্যান। এদের মধ্যে মিটমাট অসম্ভব। অনেক কথার মধ্যে আরেকটি কথা, বাংলাদেশের জনমত আমরা এখান থেকে বদলাতে পারব না, সেটা পারবে সেখানকার জননায়ক বুদ্ধিজীবীরা, আমরা তাঁদের সমর্থন করতে পারি শুধু।’

এদিকে পেঙ্গুইন ইণ্ডিয়া থেকে লজ্জার ইংরেজি সংষ্করণ বেরিয়ে গেছে। ফোন আসছে বিভিন্ন দেশ থেকে, প্রকাশকরা ফোন করছেন। তাঁরা লজ্জা বইটি অনুবাদ করে ছাপতে চান। ফতোয়ার খবরটি বিদেশের প্রচার মাধ্যমে প্রকাশ পাওয়ার পর ওখানকার মানুষের বদ্ধ ধারণা যেহেতু লেখক আমি, নিশ্চয়ই আমি এমন কোনও আপত্তিকর বই লিখেছি, যেটির কারণে মৌলবাদীরা আমার বিরুদ্ধে ফতোয়া জারি করেছে। সালমান রুশদিকে ফতোয়া দেওয়া হয়েছিল স্যাটানিক ভার্সেসএর কারণে। আমার ফতোয়াও নিশ্চয়ই কোনও না কোনও বইয়ের কারণেই। লজ্জা বইটি সরকার নিষিদ্ধ করেছে, সে অনেকদিন হয়ে গেল। কিন্তু সাংবাদিকরা পাকামো করে পাঠকের জানার তৃষ্ণা মেটাতে লজ্জাকে ফতোয়ার কারণ হিসেবে কোথাও কোথাও উল্লেখ করেছেন। কিন্তু লজ্জা কি মৌলবাদীদের ক্ষেপে ওঠার মূল কারণ? মোটেও না। ওরা তো ক্ষেপেই ছিল। ক্ষেপে আগুন হয়ে ছিল, সরকারের লজ্জা নিষিদ্ধের ঘি ওদের আগুনে গিয়ে পড়েছে। তাই ফতোয়া। আর ফতোয়ার বিরুদ্ধে সরকারের কিছু না করার ঘি ওদের আগুন আরও বেশি জ্বালিয়ে দিয়েছে। তাই দেশ জুড়ে আন্দোলন। পেঙ্গুইন লজ্জা ছেপেছে, সে চলে। কারণ লজ্জার কাহিনী যদিও সম্পূর্ণ বাংলাদেশের পটভূমিতে। কিন্তু ভারতীয় উপমহাদেশে হিন্দু মুসলিম সংঘর্ষ যেহেতু ঘটে, পাঠকের বুঝতে অসুবিধা হবে না গল্পটি। কিন্তু জার্মান পাঠক বা ফরাসি পাঠক লজ্জার কী বুঝবে! আমি বিরক্ত কণ্ঠে প্রকাশকদের প্রশ্ন করি, ‘আপনারা কি জানেন লজ্জা বইটি কি নিয়ে?’

‘না, তা জানি না।’

‘এটা সম্পূর্ণ বাংলাদেশের স্থানীয় ব্যপার। প্রচুর তথ্য আছে। আপনাদের পাঠকের এসব পড়তে ভাল লাগবে না। উপন্যাস হিসেবে এটি ভাল কোনও বই নয়।’

‘সে নিয়ে আপনি মোটেও ভাববেন না। অনুগ্রহ করে আমাদের অনুমতি দিন।’

‘আমি এমন কোনও বই এখনও লিখিনি যেটি বিদেশে অনুবাদ হতে পারে। এখানকার সমাজের সমস্যা নিয়ে লিখি। কোনও বই আন্তর্জাতিক মানের নয়। আমি ভাল কোনও বই লিখি আগে, তারপর দেব আপনাদের।’

‘সে না হয় ছাপব, যা লিখবেন ভবিষ্যতে। কিন্তু আমরা লজ্জা ছাপতে চাইছি।’

‘কেন, লজ্জা কেন?’

‘লজ্জা তো বাংলাদেশ সরকার নিষিদ্ধ করেছে। লজ্জার জন্যই তো ফতোয়া।’

‘না, লজ্জার জন্য আমাকে ফতোয়া দেওয়া হয়নি। লজ্জা বের হওয়ার আগে থেকেই আন্দোলন করছে মৌলবাদীরা। নিষিদ্ধ হওয়ার অনেক পরে ফতোয়া দিয়েছে। লজ্জা বের হওয়ার পর ছ মাস চলেছে এখানে। কোনও মৌলবাদী লজ্জা নিষিদ্ধ করার দাবি করেনি।’

‘তবুও আমরা লজ্জাই ছাপতে চাই।’

‘এ বই আপনাদের ওখানে চলবে না।’

‘সে আমরা বুঝব। লজ্জা বইটি ছাপার অনুমতি তো দিন। আমরা অগ্রিম রয়্যালটি দেব।’

রিয়্যালটি কোনও ব্যপার নয়। ব্যপার হচ্ছে পাঠকের আগ্রহ। এখানকার হিন্দু মুসলমানের সমস্যা নিয়ে ওখানে আগ্রহ থাকার কথা নয়।’

‘খুব আগ্রহ আছে। আপনি আমাদের ওপর ছেড়ে দিন। এসব আমরা দেখব।’

নাছোরবান্দা। ফ্রান্সের এডিশন দ্য ফামের মিশেল ইডেল দিনে তিনবেলা ফোন করেন, ‘তসলিমা আপনি তো নারী স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম করছেন। এখানে আমাদের সংগঠনও দীর্ঘবছর ধরে একই সংগ্রাম করে আসছি। আমরা আপনার জন্য এখানে আন্দোলন করছি। আপনি আমাদের লজ্জা বইটি ছাপার অনুমতি দিন। আমরা কনট্রাক্ট ফরম পাঠাচ্ছি। আপনি সই করে দিন।’

‘দেখুন, লজ্জা বইটি নারী স্বাধীনতার ব্যপার নয়। নারী বিষয়ে আমার কিছু বই আছে। আপনারা দেখুন, ওর মধ্যে একটি ছাপা যায় কি না। যদিও আমি নিশ্চিত নই, বাংলাদেশের মেয়েদের সমস্যাগুলো আদৌ ওখানে..’

‘সে নিয়ে ভাববেন না। আমরা অন্য দেশের মেয়েদের সমস্যা জানতে চাই খুব। কিন্তু ওগুলোও ছাপবো। লজ্জা আগে ছাপবো।’

‘লজ্জা ইংরেজিতে ছাপা হয়েছে। আগে পড়ে দেখুন ওটি, ছাপার যোগ্য কি না। আমি কিন্তু জানি যে আপনি পড়ার পর ছাপতে রাজি হবেন না।’

‘না বলব! বলছেন কি? আমরা লজ্জা বইটা পাওয়ার জন্য এমন আকুল হয়ে বসে আছি।’

‘কি আছে ওতে বলুন তো?’

‘ওতে ইসলামের সমালোচনা করেছেন। তাই তো মুসলমানরা ক্ষেপেছে।’

আমি তিক্ত গলায় বলি, ‘সম্পূর্ণ ভুল। কোনওরকম ইসলামের সমালোচনা নেই ওতে।’

‘দেখুন তসলিমা, আমরা ধর্ম বিশ্বাস করি না। আমাদের কাছে সব ধর্মই এক রকম। সব ধর্ম দ্বারাই মেয়েরা নির্যাতিত।’

‘সে কথা তো আমিও মনে করি।’

‘আপনি মনে করবেন না যে ইসলামের সমালোচনা বলে আমরা ছাপতে চাইছি বই। একজন নারীবাদী লেখিকা সুদূর বাংলাদেশে কি বই লিখেছে, যার জন্য তাঁর মৃত্যুদণ্ড ঘোষণা হয়েছে, সরকার সেই বই নিষিদ্ধ করেছে। আমরা সেই বই পড়তে চাই। আমাদের পাঠক চাইছে পড়তে।’

‘আবারও বলছি লজ্জার জন্য ফাঁসি চাইছে না কেন। ফাঁসি চাইছে ইসলাম বিষয়ে আমার মন্তব্যের জন্য।’

‘ওই হল। আপনার লেখার জন্য ফাঁসি তো চাইছে দিতে!’

চলছেই। যত চলছে তত আমি অপ্রতিভ বোধ করছি। ফরাসি দুই প্রকাশক, মিশেল ইডেল আর ক্রিশ্চান বেস দুজনই লজ্জা ছাপার জন্য আমার অনুমতি নেবেনই নেবেন। আমাকে নিয়ে কাড়াকাড়ি পড়ে গেছে দুজনের মধ্যে। দুজনেই কনট্রাক্ট ফরম পাঠিয়ে দিলেন। মিশেল ইডেল আমাকে দিতে চেয়েছিলেন পাঁচ হাজার ফ্রাঁ অগ্রিম। ক্রিশ্চান বেস বলছেন তিনি তিরিশ হাজার ফ্রাঁ দেবেন। প্রতিদিন ফোন আসে ফ্রান্স থেকে, আমি কণ্ঠ শুনেই পালাই। লজ্জা আমার জন্যই বড় একটি লজ্জা হয়ে দাঁড়িয়েছে। কী লাভ ফরাসি পাঠকদের এখানের ভোলার গ্রামে বা মানিকগঞ্জের কোনও এক অজপাড়াগাঁয়ে কি ঘটেছে তা জেনে! ক্রিশ্চান বেস হঠাৎ হঠাৎ পালিয়ে যাওয়া আমাকে খপ করে ধরে বলতে থাকেন ‘তসলিমা আপনি লেখক। অনেক প্রকাশক আছে ঝড় ওঠে যে বইটি নিয়ে সে বইটি ছেপে তারা লেখককে বেমালুম ভুলে যায়। কিন্তু আপনাকে আমরা সম্মান করি লেখক হিসেবে। আমরা ভাল লেখকের বই ছাপি, সে বই বিক্রি হোক বা না হোক। হঠাৎ নাম হওয়া কোনও লেখকের একটি বই হুজুগে ছাপা আমাদের উদ্দেশ্য নয়। পৃথিবীর বড় বড় লেখকের বই ফরাসিতে আমরা ছাপছি। আপনি যে অন্য ফরাসি প্রকাশকের কথা বলছেন, সেই প্রকাশক নারীবাদী বই ছাপে, আপনার লজ্জা তো নারীবাদী বই নয়। তবে কেন তারা ছাপতে চাইছে, চাইছে লজ্জা নিয়ে এখন পত্রিকায় লেখা হচ্ছে বলে।’

আমি বলি, ‘আমি যে ভাল লেখক, তা কি করে জানেন? আপনি তো আমার লেখা পড়েন নি! আসলে সত্যি কথা, আমি কিন্তু ভাল লিখতে পারি না। এ দেশে অনেক লেখক আছেন, আমার চেয়ে হাজার গুণ ভাল। আমি তো ডাক্তারি পড়েছি। বাংলা সাহিত্য আমার বিষয় ছিল না। উপন্যাস কি করে লিখতে হয় এখনও শিখিনি। মূলত দেশের সমস্যা টমস্যা নিয়ে লিখি। মাঝে মাঝে অন্যায় অত্যাচার বৈষম্য ইত্যাদি দেখে খুব রাগ করে লিখি, এই যা।’

ক্রিশ্চান বেস আপন আপন সুরে বলেন, ‘আপনি আপনার লেখাকে এত ছোট করে দেখবেন না। আপনি লিখতে পারেন না বলছেন, না পারলে এত লোক আপনার বিরুদ্ধে ক্ষেপেছে কেন? নিশ্চয় আপনি একটি আঘাত করেছেন। সেই আঘাতটি তো সকলে করতে পারে না। ভাল সাহিত্যের যেমন মূল্য আছে, তেমনি সমাজ পাল্টাবার জন্য খুব আঘাত করে লেখারও মূল্য আছে। আত্মবিশ্বাস রাখুন। আত্মবিশ্বাস থাকলে আপনি আরও ভাল লেখা লিখতে পারবেন। আপনার লেখক পরিচয়টি আপনি না চাইলেও এটিই আপনার পরিচয় এখন। আপনি লিখুন। আমরা প্রকাশকরা কেবল তো জনপ্রিয় আর বিখ্যাত লেখকের লেখা ছাপি না, আমরা লেখককে লেখার, আরও ভাল লেখার উৎসাহ দিই। এটিও আমাদের কাজ। আমরা লেখক তৈরিও করি। সম্ভাবনা যাদের মধ্যে আছে, তাদের আমরা প্রেরণা দিই। আপনার মধ্যে সম্ভাবনা আছে তসলিমা।’

বাংলাদেশের রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম। বাংলাদেশের আইনে ফতোয়া নিষিদ্ধ হলেও ইসলামে এটি নিষিদ্ধ নয়। ইসলাম দিয়েই দিয়েছে কিছু কিছু শাস্তির বিধান। অবৈধ সম্পর্কে করবে, পাথর ছুঁড়ে মারা হবে। অনৈসলামিক কাজ করবে, একশ একটা দুররা মারা হবে। মৌলবাদ জেগে উঠছে। হাওয়া এখন মৌলবাদিদের দিকে বইছে। গ্রামে গ্রামে ফতোয়াবাজ মাওলানাদের ফতোয়ার শিকার হচ্ছে মেয়েরা। সিলেটের ছাতকছড়া গ্রামে নূরজাহান নামের একটি মেয়ে দিতীয়বার বিয়ে করেছিল, যে বিয়ে, মাওলানা মান্নান বলেছেন ইসলামের নীতিবিরুদ্ধ, কারণ নূরজাহানের সঙ্গে তার প্রথম স্বামীর তালাক হয়নি (প্রথম স্বামী তাকে ফেলে চলে গেছে বহু বছর আগে। দ্বিতীয় বিয়ের আগে নূরজাহান নিজে তালাকনামা পাঠিয়েছিল প্রথম স্বামীর ঠিকানায়)। সুতরাং নূরজাহানকে পাথর ছোঁড়া হবে। নূরজাহানের বাড়ির উঠোনে মাওলানারা একটি গর্ত খুঁড়লেন, ওতে নূরজাহানকে দাঁড়াতে হল। তারপর আল্লাহর নাম নিয়ে মাওলানারা পাথর ছুঁড়লেন নূরজাহানের গায়ে। পুরো গ্রাম দাঁড়িয়ে দেখল এই দৃশ্য, কোনও প্রতিবাদ করেনি কেউ। রক্তাক্ত, লান্থিত নূরজাহান গর্ত থেকে উঠে ঘরে গিয়ে লজ্জায় অপমানে বিষ পান করে আত্মহত্যা করে। এর পরপরই আবার আরেকটি ঘটনা, ফরিদপুরের একটি মেয়ে, এই মেয়ের নামও নূরজাহান, ঘরে স্বামী রেখে অন্য লোকের সঙ্গে বাইরে বেড়াতে গিয়েছিল, পরপুরুষের সঙ্গে লীলা খেলা ইসলামে নিষিদ্ধ, সুতরাং মাওলানারা ফতোয়া দিলেন নূরজাহানের বিরুদ্ধে। নূরজাহানের হাত পা বেঁধে গায়ে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হল। পুড়ে ছাই হয়ে গেল নুরজাহান। এর পরই সাতক্ষীরার কালিগঞ্জ থানার কালিকাপুর গ্রামে আরেকটি ঘটনা ঘটে। খালেক মিস্ত্রির ষোল বছরের মেয়ে ফিরোজা নদীতে চিংড়ি মাছের পোনা ধরে তা বিক্রি করে সংসারে সাহায্য করত। এই পোনা ধরতে গিয়েই তার সঙ্গে পরিচয় হয় পাশের বন্দকাটি গ্রামের জেলে হরিপদ মণ্ডলের ছেলে উদয় মণ্ডলের। উদয়ের সঙ্গে ফিরোজার সম্পর্ক গড়ায়। সম্পর্ক গড়ায় বলে ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান শরিয়ত অনুযায়ী ফিরোজার বিচার করে। ফিরোজাকে একটি খুঁটির সঙ্গে বেঁধে একশ একবার ঝাঁটাপেটা করা হয়। ঝাঁটা পেটা শেষ হলে ফিরোজা তার বোনের কাঁধে ভর দিয়ে বাড়ি পৌঁছেই আত্মহত্যা করে। উদয়ের জন্যও শাস্তির ব্যবস্থা হয়। হিন্দু বলেই হয়। গ্রামের সব ফতোয়ার খবর পত্রিকায় ছাপা হয় না। কারণ আটষট্টি হাজার গ্রামের কোন কোণে কোন মেয়েকে ফতোয়ায় মরতে হচ্ছে তা সহজ নয় জানা। হঠাৎ হঠাৎ কোনও ফতোয়া গ্রাম জুড়ে আলোড়ন তুললে হয়ত গোচরে আসে কোনও মফস্বলের সাংবাদিকের। তারপরও দেখতে হবে সেই সাংবাদিক কোন পত্রিকায় খবরটি দেবে। ইনকিলাব গোষ্ঠীর পত্রিকার লোকেরা এ জাতীয় খবর ছেপে ফতোয়াবাজদের ওপর জনগণের রাগ করার কোনও সুযোগ দেবে না। বরং খবর যদি অন্য পত্রিকায় প্রকাশ পায় এবং সমালোচনার ঝড় বয়, তবে ফতোয়াবাজদের পক্ষে এবং সেই সব নিরীহ মেয়েদের বিপক্ষে শক্ত শক্ত যুক্তি দাঁড় করিয়ে ফতোয়াকে বৈধ করার চেষ্টা করবে। দেশের সর্বাধিক বিক্রিত এবং বিকৃত পত্রিকা ইনকিলাব। একসময় ইত্তেফাকের ছিল সবচেয়ে বেশি বিক্রি, ইত্তেফাককে ছাড়িয়ে মাড়িয়ে গেছে ইনকিলাব। এদিকে আরেকটি ভয়ংকর খবর যখন প্রকাশ পায় যে ব্র্যাক (এনজিও)এর তৈরি একশ বারোটি মেয়েদের ইশকুল মৌলবাদিরা পুড়িয়ে দিয়েছে এবং মেয়েদের বিরুদ্ধে ফতোয়া দিয়েছে যে এখন থেকে তাদের ইশকুলে যাওয়া বন্ধ, তখন ইনকিলাব দায়িত্ব নেয় ফতোয়াবাজদের পক্ষে গীত গাওয়ার। এনজিওর ইশকুলগুলো নাকি মেয়েদের খ্রিস্টান বানাবার চেষ্টা করছিল, যেহেতু ব্র্যাক খ্রিস্টানদের দেশ থেকে অর্থসাহায্য পায়। গ্রামের যে মেয়েরা এনজিওতে কাজ করছে, তাদের বিরুদ্ধেও ফতোয়া, ঘরের বাইরে বেরোনো চলবে না। যদি মেয়েরা এই ফতোয়া না মানে, তবে তাদের স্বামীদের বাধ্য করা হবে স্ত্রীদের তালাক দেওয়ার জন্য। কেবল ফতোয়াই নয়, সালিশের বর্বরতাও সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছে। গ্রামে সালিশ বসার নিয়ম চালু যুগ যুগ ধরে। মসজিদের ইমাম আর গ্রামের মাতব্বরের সালিশে সিরাজগঞ্জের বাদেকুশা গ্রামে পঁয়ত্রিশ জন মেয়েকে সমাজচ্যূত করা হয়েছে। তারা পরিবার পরিকল্পনা পদ্ধতি গ্রহণ করেছিল, এই তাদের অপরাধ। পরিবার পরিকল্পনা পদ্ধতি গ্রহণ করা মানে স্বয়ং আল্লাহ তায়ালার বিরোধিতা করা। সুতরাং পঁয়ত্রিশ জন মেয়েকে সমাজচ্যূত হয়ে বাকি জীবন বাস করতে হবে। ধর্মের কুঠার মেয়েদের মাথার ওপর, পঁয়ত্রিশ জন মেয়ের এখন আর সমাজে জায়গা নেই। নিঃশব্দে তাদের মেনে নিতে হয়েছে এই সালিশ। ধর্ম এখন মাওলানাদের বাপের সম্পত্তি। আলখাল্লা জোব্বা পরল, মাথায় টুপি লাগাল, নামাজ পড়ে পড়ে কপালে কালো দাগ করে ফেলল, তসবিহর গোটা নাড়ল চাড়ল, ধর্ম তাদের স্থাবর সম্পত্তি হয়ে গেল। ধর্মের ভয় দেখিয়ে তারা এখন পুরো দেশের মানুষকে নিয়ন্ত্রণ করছে। কোনও ফতোয়াবাজ মাওলানার বিরুদ্ধে, কোনও সালিশের ইমাম আর মাতববরের বিরুদ্ধে সরকারের পক্ষ থেকে আদালতে কোনও মামলা করা হয় না। তাদের অপকর্মের জন্য কোনও শাস্তির ব্যবস্থা নেই।

এদিকে বড় শহরে জুসমে জুলুসের মিছিল হচ্ছে। ঘটা করে হযরত মোহাম্মদের জন্মদিন পালন হচ্ছে। বিশাল বিশাল টুপিবাহিনীর ট্রাক-মিছিলে পুরো ঢাকা শহর ছেয়ে যায়। সাজ সাজ রব চারদিকে। আর যেদিন হিন্দুদের জন্মাস্টমীর মিছিল বেরোলো, মিছিলে বিএনপির লাঠিয়াল বাহিনী আর যুব কমাণ্ডের লোকেরা ঝাঁপিয়ে পড়েছে, মেয়েদের শাড়ি খুলে নিয়েছে, কৃষ্ণ সেজেছিল যে শিশুটি, তারও মাথা ফাটিয়ে দিয়েছে। মিছিল ছত্রভঙ্গ হয়ে গেছে। পুলিশ কোনও আক্রমণকারীকে একটি টোকা পর্যন্ত দেয়নি। দূরে দাঁড়িয়ে দেখেছে শুধু।

যখন দেশজুড়ে মৌলবাদিদের প্রলয়ঙ্করী নৃত্য চলছে, তখন সরকার বিষম বিচক্ষণতা দেখালেন মৌলবাদিদের নেতা গোলাম আযমকে নিরপরাধ প্রমাণের ব্যবস্থা করে তাঁকে জেল থেকে মুক্তি দিয়ে! ঘাতকের গলায় ফুলের মালা পরিয়ে দিয়ে সম্বর্ধনা জানানো হচ্ছে প্রকাশ্যে। যে দেশদ্রোহীর নাগরিকত্ব বাতিল হয়েছিল, সেই দেশদ্রোহীকে আজ সসন্মানে নাগরিকত্ব ফিরিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা হচ্ছে। কি জানি, সম্ভবত এই সরকার গোলাম আযম এবং তাঁর ঘাতক সঙ্গীদের, যাদের কারণে লক্ষ লক্ষ বাঙালির ঘর আগুনে পুড়েছে, লক্ষ লক্ষ বাঙালি নিহত হয়েছে, ধর্ষিতা হয়েছে, অচিরে মুক্তিযোদ্ধার সনদ দেবে। গোলাম আযমকে মুক্তি দেওয়া হয় আর ওদিকে রমনায় ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির গণআদালত এর সভা থেকে মাইক ছিঁড়ে নেওয়া হয়, গণসমাবেশে পুলিশ লাঠিচার্জ করে, মানুষ আহত হয়। এ দেশ যেন আমার নয়, আমাদের নয়, আমরা যারা গর্ব করি রফিক বরকত, সালামকে নিয়ে, যাঁরা বাংলা ভাষার জন্য বাহান্নর ফেব্রুয়ারিতে প্রাণ দিয়েছিলেন, আমরা যারা গর্ব করি অসংখ্য অগুনতি মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে, যাঁরা এ দেশ স্বাধীন করার স্বপ্ন নিয়ে যুদ্ধ করেছিলেন। এ দেশ হয়ে যাচ্ছে গোলাম আযমের দেশ। উদ্ভট উটের পিঠে চলেছে স্বদেশ। শহীদ মিনারের পাশের দেয়ালে রবীন্দ্রনাথ, জীবনানন্দ দাস, কাজী নজরুলের বাণীগুলো রঙ মেখে নষ্ট করে দিয়েছে স্বাধীনতার শত্রুরা। কালি লেপে দিয়েছে ‘বাংলার হিন্দু বাংলার বৌদ্ধ, বাংলার খ্রিস্টান, বাংলার মুসলমান, আমরা সবাই বাঙালি।’র ওপর। আর কত ধ্বংস দেখতে হবে আমাদের! তার চেয়ে অন্ধ হয়ে যাক আমাদের চোখ, আমরা বধির হয়ে যাই!

গ্রামের মেয়েদের ওপর ফতোয়া দেওয়ার প্রতিবাদ করতে মহিলা পরিষদ একটি মিছিল বের করে। প্রেস ক্লাবের সামনের রাস্তায় বসে যান গ্রামের মহিলারা, হাতে কঞ্চি, কঞ্চির আগায় মহিলা পরিষদের স্লোগান লেখা কাগজ। মহিলা পরিষদের সভায়, কোন কোন মেয়েকে ফতোয়া দেওয়া হয়েছে সবার নাম উল্লেখ করে গলা ফাটিয়ে বক্তৃতা দেন নেত্রীরা। কেউ কিন্তু একবারও উচ্চারণ করেননি আমার নাম। মহিলা পরিষদ বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় নারী সংগঠন, সভানেত্রী হিসেবে সুফিয়া কামালের নাম থাকলেও মূল নেত্রী মালেকা বেগম। মালেকা বেগম নারী বিষয়ে অনেকগুলো বইও লিখেছেন। বহু বছর ধরে তিনি নারী আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত এবং বলা যায় দেশের হাতে গোণা দুইএকজন নারীবাদী নেত্রীর মধ্যে তিনি অন্যতম। একদিন আমার বাড়িতে তিনি পদধূলি দেন। বিস্ময়াভিভূত আমি তাঁকে প্রায় আলিঙ্গণ করতে নিই। পত্রিকায় কলাম লেখা শুরু করার পর মালেকা বেগমের সঙ্গে আমার দেখা হয়েছে কয়েকবার, বলেছিলেন, ‘খুব ভাল হচ্ছে লেখা, লিখে যাও, লিখে যাও।’ মালেকা বেগমের স্বামী মতিউর রহমান কমিউনিস্ট পার্টির পত্রিকা একতার সম্পাদক। একতা থেকে বেরিয়ে এসে এখন অবশ্য ভোরের কাগজএর সম্পাদক হয়েছেন। দুজনই সমাজতন্ত্র বিশেষজ্ঞ। দুজনের প্রতিই আমার শ্রদ্ধা প্রবল। প্রবলই ছিল। তবে মাঝে মাঝে প্রবলের শরীরে চমকের ধাককা লেগেছে। আনন্দ পুরস্কার পাওয়ার পর অতি আনন্দে আনন্দর খবর দিতে যেদিন মালেকা বেগমের বাড়িতে গিয়েছিলাম, তিনি বক্রহাসি হেসে বলেছেন, ‘সুনীলের সঙ্গে খাতির থাকলে আনন্দ পুরস্কার পাওয়াই যায়, এ তো সবাই জানে!’ তিনি মোটেও পছন্দ করেননি আমার পুরস্কার পাওয়া। আমি যোগ্য নই পুরস্কারের, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় আমার জন্য এই পুরস্কারের ব্যবস্থা করেছেন, এই তাঁর বিশ্বাস। বড় একা বোধ করেছি। আনন্দ পুরস্কার এমনই একটি ধারালো কাঁটা, যে কাঁটাটি আমার শুভাকাঙ্খীদের বড় একটি সংখ্যার শরীরকে খোঁচা মেরে প্রায় শূন্যে নামিয়ে দিয়েছে। আমি মাথা নিচু করে মালেকা বেগমের বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসেছি। আরও একদিন অবাক লেগেছিল আমার, আমি বুঝে পাইনি মালেকা বেগম এ কী কাণ্ড করছেন, যখন তিনি তাঁর দলের লোক নিয়ে আদালত প্রাঙ্গনে খুকুর ফাঁসি চাইছিলেন। মুনিরের সঙ্গে খুকুর সম্পর্ক ছিল এবং সে সম্পর্ক ছিল অবৈধ, এ কথা পত্রিকায় প্রকাশ হওয়ার পর লোকেরা খুকুকে ছি ছি করল, দুয়ো দিল। আর কোথায় খুকুর পক্ষে দাঁড়াবে মহিলা পরিষদ, উল্টো আদালতের দরজায় গিয়ে খুকুর ফাঁসি চাই চিৎকার দিয়ে গলা ভাঙল। মহিলা পরিষদের বিখ্যাত নেত্রীটি এখন আমার বাড়িতে।

‘তোমাকে দেখতে আসলাম, কেমন আছ তুমি?’

আমি মলিন হাসি। আমি কেমন আছি তা নিশ্চয়ই তিনি অনুমান করতে পারেন।

‘তোমার কাছে আসলাম। ভাবলাম দেখে যাই। যে অবস্থা হচ্ছে দেশে, তোমার জন্য খুব চিন্তা হয় আমাদের। মোল্লারা খুব বাড়াবাড়ি শুরু করেছে।’

‘হ্যাঁ। কি যে হবে দেশের!’

মালেকা বেগম হঠাৎ হেসে ওঠেন, হাসির দিকে তাকিয়ে থাকি বিস্ময়ে। হাসি থামলে বলেন, ‘তিরিশ বছর ধরে নারী আন্দোলন করছি, আর দেশে বিদেশে নারীবাদী হিসেবে নাম হয় তোমার!’

নাম হওয়ার লজ্জায় আমি মুখ লুকোই। নাম হওয়ার মত অপমানকর ঘটনা যেন জগতে আর কিছু নেই। নাম হওয়াটিকে এই মুহূর্তে গলা টিপে হত্যা করতে পারলে আমার স্বস্তি হত। এ আমারই দোষ। আমার দোষেই আমার নাম লোকে জানে।

মালেকা বেগম খুব বুদ্ধিমতি, বুদ্ধিমতি না হলে আমার মনের কথা জানবেন কী করে! বললেন, ‘না, এতে তো তোমার দোষ নেই। মোল্লারাই তোমার নাম জানাচ্ছে।’

হেসে উঠলেন আবার, বললেন, ‘আসলে মনে মনে ওদের তোমার ধন্যবাদই দেওয়া উচিত।’

আমি আমার অস্বস্তি কাটাতে হঠাৎ চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াই বলতে বলতে, ‘চা খাবেন তো! আমি চায়ের কথা বলে আসি।

চা খাওয়া শেষে তিনি যা বললেন, তা হল, ‘তসলিমা এ সময় তোমাকে আমরা সমর্থন করতে পারব মানে তোমার পক্ষে দাঁড়াতে পারব, তুমি যদি আমাদের সংগঠনে যোগ দাও।’

‘সংগঠনে? মহিলা পরিষদের সদস্য হতে বলছেন?’

‘হ্যাঁ।’

আমি হাঁ হয়ে থাকি কিছুক্ষণ।

‘মালেকা আপা, আমি মহিলা পরিষদে যোগ না দিলে বুঝি আমাকে যে ফতোয়া দেওয়া হল, এই যে আমার বিরুদ্ধে মোল্লারা আন্দোলন করছে, এর প্রতিবাদ করতে পারেন না! আপনারা মেয়েদের পক্ষে আন্দোলন করছেন, আমি মেয়েদের পক্ষে লিখছি..

‘আসলে তুমি তো একটু কনট্রোভার্সিয়াল!

‘তাতে কি? আমার পক্ষে আপনারা যদি কিছু না বলতে চান বলবেন না, কিন্তু একটি অন্যায়ের প্রতিবাদ তো করা উচিত!’

মালেকা বেগম একসময় উঠে পড়েন তাঁর দেরি হয়ে যাচ্ছে বলে। আমি যে মহিলা পরিষদের সমর্থন পেতে মহিলা পরিষদে নাম লেখাবো না, তা তিনি একরকম বোঝেন। তারপরও আমাকে ভাবার জন্য সময় দিতে চান। মালেকা বেগমের লেখা বেশ কিছু বই আমি পড়েছি, বই পড়ে একটুও মনে হয়নি কখনও কখনও তিনি আপোস করতে পারেন বা কোথাও কোথাও তিনি নগ্নভাবে যুক্তিহীন হতে পারেন।

ফ্রান্স থেকে রিপোর্টার্স সাঁ ফ্রন্টিয়ার্স আর আর্তে টিভি আমাকে প্যারিসে যাওয়ার আমন্ত্রণ জানাল টেলিভিশনে প্রেস ফ্রিডমের ওপর একটি অনুষ্ঠানে যোগ দেওয়ার জন্য। প্যারিসের কথা কেবল লোকের মুখে শুনেছি, বইয়ে পড়েছি, কল্পনাও করিনি সত্যিকার প্যারিস যাওয়ার। লোকদের জানিয়ে দিই, আমার বাপু পাসপোর্টই নেই, আমার যাওয়া হবে না। যাওয়া হবে না এরকমই জানি। দেড় বছর হয়ে গেছে, আজও যখন পাসপোর্ট দেওয়া হয়নি আমাকে, কোনওদিনই দেওয়া হবে না। কিন্তু শেষ পর্যন্ত দেওয়া হয় আমাকে পাসপোর্ট। ফতোয়ার খবরটি বিদেশে প্রচার হওয়ার পর সবচেয়ে যে বিস্ময়কর ঘটনাটি ঘটেছে, তা হল আমার পাসপোর্ট ফেরত পাওয়া। আমার নাগরিক অধিকার এবং মত প্রকাশের অধিকারের পক্ষে যখন বিদেশিদের আন্দোলন হচ্ছে, তখন একদিন আমেরিকার দূতাবাস থেকে অ্যান্ড্রু নামের এক অফিসার আমার বাড়ি এলেন। কি করে আমার পাসপোর্ট নিল, কবে নিল, কারা নিল ইত্যাদি খবর টুকে নিয়ে চলে গেলেন। আবারও একদিন এসে পাসপোর্টের কথাই বললেন। এরপর দু সপ্তাহও পার হয়নি, অ্যান্ড্রু আমাকে ফোন করে বললেন, পাসপোর্ট আপিসে গিয়ে আমি যেন আমার পাসপোর্টটি নিয়ে আসি। এমনতরো জাদু আমার আগে দেখা হয়নি। দেড় বছরে যে জিনিসটি আমার পক্ষে করা সম্ভব হয়নি, সে জিনিসটি কি করে নিমিষে সম্ভব করে ফেলে একটি দূতাবাস! পাসপোর্টটি হাতে নিয়ে আত্মহারা হই, দেশের বাইরে কোথাও যাওয়ার আনন্দে নয়, আমার নাগরিক অধিকার ফিরে পেয়ে।

ফতোয়ার খবর নিয়ে হুলস্থুল পড়ে গেছে সবখানে। বিদেশের বড় বড় পত্রিকায় সম্পাদকীয় লেখা হচ্ছে এই ফতোয়া নিয়ে। লেখক, সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবীরা প্রতিবাদ করছেন। বিদেশের নারী সংগঠন, মানবাধিকার সংগঠন, লেখক সংগঠনের লোকেরা মরিয়া হয়ে উঠেছে আমাকে রক্ষা করতে। এক ফতোয়াই আমার নাম ফাটিয়ে দিল বিশ্বময়। কিন্তু যে ফতোয়ার খবরটি কেউ জানে না সেটি হল আমার মার ওপর ফতোয়া। পীরবাড়ি থেকে দেওয়া ফতোয়া। পীরবাড়ি ছিল মার আশ্রয়। খুব বড় আশ্রয়। দীর্ঘ দীর্ঘ বছর ধরে পীর বাড়িতে যান মা, আল্লাহ রসুলের কথা শুনে সংসারের দুঃখ কষ্ট খানিকটা ভুলে থাকতে যান। হাসিনার ওপর সংসারের দায়িত্ব অর্পিত হবার পর অবকাশে মা একটি বাড়তি মানুষ হিসেবে চিহ্নিত হলেন। আমি যখন একা থাকতে শুরু করি ঢাকার শান্তিবাগে, আমার কাছে চলে এসে অবকাশের দুঃখও ভুলতে চাইতেন। আমার কাছেও যে খুব সুখ পেতেন তা নয়। ঢাকা থেকেও প্রায়ই পীরবাড়ির দিকে ধাবিত হতেন। এরপর ভালবাসার জন্ম হওয়ার পর অবকাশে মাস কয় কাটিয়ে ইয়াসমিন যখন ভালবাসাকে নিয়ে ঢাকা চলে আসে, সঙ্গে মা আসেন। কারণ মার ওপরই দায়িত্ব ভালবাসার লালন পালনের। ঢাকায় আসার পর মা দেখলেন বাচ্চার ক্যাঁও ম্যাঁও আমার লেখার অসুবিধে করে, আমার ঘুম নষ্ট করে, তার ওপর থাকার জায়গার অভাব। এসব কারণ তো আছেই, সবচেয়ে বড় যে কারণটির জন্য মা চলে গেলেন ময়মনসিংহে, তা আবারও সেই একই কারণে, খরচ বাঁচাতে। আমার হোক, ইয়াসমিনের হোক খরচ তো কারও না কারও করতেই হবে, বাচ্চা পোষার খরচ তো আর সামান্য কিছু নয়! সুহৃদের জন্মের পর সুহৃদের দায়িত্ব মার ওপর ছিল, লালবাসার জন্মের পরও ভালবাসার দায়িত্ব মার ওপর। মা ভেবেছিলেন, সুহৃদের লালন পালনে বাবা যেভাবে সাহায্য করেছিলেন, খাঁটি দুধের ব্যবস্থা, প্রতিদিন মুরগির বাচ্চার সুপের ব্যবস্থা, ভালবাসার জন্যও বাবা তাই করবেন। অবকাশে মা অত গৌণ নন এখন, সংসারের দায়িত্ব তাঁর হাতছাড়া হয়ে গেলেও অন্য এক দায়িত্ব তাঁর আছে, নাতনি পালনের দায়িত্ব, সুতরাং সামান্য হলেও মর্যাদা তিনি পাবেন, এটি মা-ই কেবল ভেবেছিলেন। কিন্তু মাকে গৌণই করে রাখা হয়েছে অবকাশে, মাকে বাড়তি হিসেবেই চিহ্নিত করা হয়েছে আগের মত। বাবার কাছে ছেলের ছেলে যত মূল্যবান, মেয়ের মেয়ে তত মূল্যবান নয়। আর সংসারের কষর্নী হাসিনার কাছে তাঁর দুই সন্তান ছাড়া আর কারও কোনও সন্তানই মূল্যবান নয়, বরং চক্ষুশূল। স্বামী আর পুত্রবধূর অত্যাচার মাকে পীরবাড়ি নিয়ে যায় ঘন ঘন।

পীর বেশারাতুল্লাহ মারা যাবার পর তার পুত্র মুসা বনেছিলেন নতুন পীর। কিন্তু বেশিদিন পীর হওয়ার আনন্দ তিনি ভোগ করতে পারেন নি। হৃদপিণ্ডের অসুখে হঠাৎ মারা যান। এরপর পীর বেশারাতুল্লাহর নাতি, ফজলি খালার বড় ছেলে মোহাম্মদ হয়েছে পীর। এই মোহাম্মদই দিয়েছে ফতোয়া। এই ফতোয়া সমর্থন করেছে পীরবাড়ির সবাই। ফতোয়াঃ মা যেন পীরবাড়িতে আর না ঢোকেন।

মার অপরাধ? তসলিমা নাসরিন নাম্নী এক কাফেরকে জন্ম দিয়েছেন এবং এই কাফেরের সঙ্গে মার এখনও মা মেয়ে সম্পর্ক বজায় আছে।

এই মার অপরাধ। হয় আমাকে ত্যাগ করতে হবে, নয়ত পীরবাড়ি ত্যাগ করতে হবে। ফজলিখালাকে আড়ালে ডেকে নিয়ে মা বলেছেন, ‘ফজলি, আমি আমার নিজের মেয়েরে ত্যাগ করবো কেমনে? একটা কি হয়?’

‘ত্যাগ তোমাকে করতেই হবে বড়বু। তোমার মেয়ে হল কাফের। কাফেরের সঙ্গে তোমার কোনও সম্পর্ক থাকতে পারে না। যদি থাকে, তাহলে তুমিও কাফের।’

‘আমারে কাফের কইলি!’

‘এই দুনিয়ার ছেলে মেয়ে হিচ্ছে মিথ্যে মায়া। তোমাকে তো আল্লাহর কাছে ফিরে যেতে হবে। ছেলে মেয়ের মায়ায় পড়ে তুমি যদি একটা কাফেরকে নিজের মেয়ে বলে স্বীকার কর, তাহলে বলে দিচ্ছি আল্লাহ তোমাকে ক্ষমা করবেন না। কোরানে আছে, তাহাদের সঙ্গে সম্পর্ক রাখিবে তো তোমাকে দোযখের আগুনে নিক্ষেপ করিব।’

‘নাসরিন মানুষের অনেক উপকার করে। ও খুব উদার। মেয়েদের ওপর অন্যায় অত্যাচার হয়, এইসবের বিরুদ্ধে লেখে। কত গরিব মেয়েরে ও টাকা পয়সা দিয়া সাহায্য করে। ও কি আল্লাহর ক্ষমা পাইব না?’

ফজলিখালা কঠিন গলায় বলেন, ‘না। কোনও ক্ষমা নাই তাদের। ও দোযখে যাবে। ও আল্লাহ বিশ্বাস করে না। বড়বু, তুমি খুব ভাল করেই জানো নাসরিন কোরান সম্পর্কে বাজে কথা লিখেছে। কোরান নাকি মানুষের লেখা। আমাদের নবীজি নাকি কামুক লোক। আল্লাহর নাকি অস্তিত্ব নাই। আস্তাগফিরুল্লাহ, আস্তাগফিরুল্লা।’

‘দেখ ফজলি, তর দুলাভাই আমারে কোনও টাকা পয়সা দেয় না। ময়মনসিংহ থেইকা কয়দিন পরপরই আমারে দূর দূর কইরা তাড়ায়। এহন নাসরিনের কাছে গিয়া যদি আমি না থাকতে পারি, আমি থাকব কোথায়?’

‘সেইটা আমি কি জানি! সোজা কথা, এই বাড়িতে আসতে চাইলে কোনও কাফেরের মুখ দেখা তোমার জন্য হারাম। আর কাফেরের সঙ্গে কোনও রকম সম্পর্ক যদি তুমি রাখতে চাও, তবে এই বাড়ি তোমার জন্য হারাম।’

মা কাঁদেন। মা ফুঁপিয়ে কাঁদেন। হাউমাউ করে কাঁদেন। ফজলিখালা মার কান্নার দিকে ফিরে তাকান না।

মাকে তাড়িয়ে দেওয়া হয় পীরবাড়ি থেকে। বলে দেওয়া হয়, মা যেন কখনও আর পীরবাড়ির ত্রিসীমানায় না ঘেঁসেন।
 

Users who are viewing this thread

Back
Top