তুমি লক্ষ করছিলে যে তোমাকে আর কোনও ওষুধ দেওয়া হচ্ছে না। সব চিকিৎসা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। তুমি চাইলেও সেটি তোমাকে দিচ্ছি না কেউ। যে আমি তোমার চিকিৎসার জন্য দূর আমেরিকায় তোমাকে নিয়ে গিয়েছি, সেই আমিই এখন চিকিৎসা বন্ধ করে দিয়েছি। নিশ্চয়ই চিকিৎসার আর কিছু নেই বলেই বন্ধ করেছি। মনে মনে লৌকিকে আশা ছেড়ে অলৌকিকের কথা ভাবছিলে কী! বৈঠকঘরে মিলাদেরপর যখন মোনাজাত হচ্ছে, তুমি শুনছিলে, দেখলাম তোমার মাথায় কোনও কাপড় নেই। তুমি সাধারণত এসব সময় আলগোছে মাথায় একটু কাপড় উঠিয়ে দাও। অভ্যেস অনেকদিনের। অভ্যেস থেকে তুমি বেরিয়ে আসছে। নিউইয়র্কে আর শান্তিনগরে দেখেছি তুমি বিছানায় বসে নামাজ পড়তে। যখন বসতে অসুবিধে হতো, শুয়ে পড়তে। অবকাশে এসেও মাথায় একটু কাপড় তুলে দিয়ে, শুয়ে থেকেই চোখ বুজে বিড়বিড় করছে। কয়েকদিন করেছে। তারপর লক্ষ করছি, নামাজ তোমার আর শুয়েও পড়া হয় না। নামাজের সময় চলে যায়, তুমি ঘুমিয়ে থাকো। দিন আর রাত তোমার একাকার হয়ে যাচ্ছে। কারও অসুখ হলে আমরা বিশ্রাম নিতে বলি, শুয়ে থাকা বা ঘুমিয়ে থাকাটাইতাদের জন্য স্বাভাবিক বলে মনে করি। কিন্তু তোমার ঘুম স্বাভাবিকতার আওতা থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে। চিরকালের অভ্যেস থেকে বেরিয়ে যাচ্ছো তুমি। তুমি জানো না যে বেরিয়ে যাচ্ছো। জগৎ থেকে সরে যাচ্ছো তুমি। একটু একটু করে হারিয়ে যাচ্ছো। তুমি আগের চেয়ে অনেক বেশি ঘুমিয়ে কাটাচ্ছো। তুমি জানো না যে তুমি ঘুমোচ্ছা। আমি জানি। আমি টের পাচ্ছি যে এই ঘুম প্রয়োজনের ঘুম নয়। এ অপ্রয়োজনের ঘুম। এ ঘুম তোমাকে জাগতিক সব কিছু থেকে ধীরে ধীরে দূরে সরিয়ে নেওয়ার ঘুম। এই ঘুম ভালো ঘুম নয়। এই ঘুম চেতন থেকে ধীরে ধীরে তোমাকে অচেতনের দিকে টেনে নেওয়ার ঘুম। কিন্তু সেও কি তখন আর বুঝতে পেরেছিলাম অত! এখন পেছন ফিরে তাকালে অনেক ধোঁয়াই কেটে যায়।
.
ধীরে ধীরে, সামান্য যা খেতে, তাও বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, টের পাচ্ছি। খুব কষ্ট করে গিলতে হয় যা কিছুই খাও। সুপ খেলেও, জল খেলেও। কিছু পেটে পড়লেই পেটের ভেতর তোমার সেই ভিসুভিয়াস ফুঁসে ওঠে। তারপরও যুদ্ধ করে যাচ্ছিলে, তোমার ওই একার যুদ্ধ। তোমার জন্য স্যালাইন এনে রেখেছি, অক্সিজেন এনেছি, ব্যথা কমানোর পেথিডিন এনেছি। ধীরে ধীরে তুমি যে কী কঙ্কালের মতো হয়ে যাচ্ছিলে মা! আমি জানি না তোমার সামনে আয়না ধরেছিলাম কিনা দেখতে। তুমি নিজেই হয়তো বুঝতে পাচ্ছিলে। আমার আবার কী রোগ হয়েছিলো জানিনা, প্রায়ই ক্যামেরা নিয়ে দাঁড়াতাম তোমার ছবি তুলতে। বাবাকে পাশে বসিয়ে ছবি তুলছি, তোমার একার ছবি, তোমার রুগ্ন পাণ্ডুর মুখের ছবি, তোমার কঙ্কালসার শরীরের ছবি। কেন তুলছিলাম মা? তুমি চাইতে না ছবি তুলতে। তুমি বাধা দিতে। একবার জিজ্ঞেস করেছিলাম কেন চাইছো না? তুমি করুণ কণ্ঠে বলতে, এখন তো দেখতে আমি ভালো না, এখন ছবি তোলোনা। সম্ভবত চাইতে না তোমার ওই চেহারার মাকে আমরা দেখি। আমি বুঝিনি তখন। ঠিকই বলতে, তোমার ওসব ছবির দিকে এখন তাকাতে পারি না। ও তো তুমি নও, অন্য কেউ। যখন সুস্থ ছিলে, হৃষ্টপুষ্ট ছিলে, যুবতী ছিলে, বাড়ির সবার ছবি তুললেও তোমার ছবি আমরা কেউই তুলিনি। হঠাৎ করে মৃত্যুশয্যায় রুগ্ন মায়ের ছবি তুলতে উগ্রীব। সারাজীবন ভুল করে শেষ দিনে এসে শোধরাতে চাইলে সব ভুল শোধরানো যায় না! বড় দেরি হয়ে যায়। যখন সুস্থ ছিলে, হাতে গোনা। তখনকার দুএকটা ছবি ছাড়া তোমার আর কোনও ছবি নেই কোনও অ্যালবামে। যা আছে, তাও তোমার একার ছবি নয়। অনেকের সঙ্গে তুমি। সুহৃদকে গোসল করাচ্ছো, বা পড়াচ্ছো। আসলে ও ছবি তোমার জন্য তোলা হয়নি, সুহৃদের জন্য হয়েছিল। বা ওর জন্মদিনের কেক কাটার সময় আর সবার মধ্যে তুমিও আছে। সবসময়ই দূরে, কিনারে, অর্ধেক কাটা পড়েছে, ইনসিগনিফিকেন্ট ক্যারেকটারের মতো। তোমাকে ওঠানো হতো না, তুমি অ্যাক্সিডেন্টালি উঠে যেতে।
.
হাশেম মামাকে ভালোবাসতে তুমি খুব। কাকে ভালো বাসতে না বলল। হাশেম মামার ক্যানসার ধরা পড়ার পর তুমি পাগলের মতো কেঁদেছো। তোমার মতো এত তো কেউ কাঁদেনি। তোমার ছোট ভাই, তার ক্যানসার তুমি মেনে নিতে পারোনি। হাশেম মামা আমাকে খুব স্নেহ করতো, আমি ঢাকা থেকে এলেই চলে আসতো আমার কাছে আমার নতুন কী বই বেরিয়েছে, নিতে। হাশেম মামা তুমি নিউইয়র্কে থাকাকালীনই মারা গেছে, খবরটা তোমার কাছে আমরা সবাই ইচ্ছে করেই লুকিয়েছি, জানলে তুমি কষ্ট পাবে তাই। কী দরকার কষ্টের এক দুঃসহ বোঝার ওপর নতুন কষ্টের বোঝা উপুড় করার। জেনে কী লাভ তোমার! এমন তো নয় যে, একদিন সুস্থ হয়ে উঠবে, আর নানিবাড়ি গিয়ে আবিষ্কার করবে হাশেম মামা নেই। আমরা তো সবাই জানি যে এরকম কোনও ঘটনা আদৌ ঘটবে না। আমরা তো সবাই জানি দিন দিন তুমি শরীরের সব শক্তি হারিয়ে ফেলছো, তুমি মিশে যাচ্ছো বিছানায়, উঠে বসারও শক্তি তোমার নেই, তুমি একটু একটু করে চলে যাচ্ছো, একটু একটু করে তোমার চেতন হারাচ্ছে, তুমি তলিয়ে যাচ্ছো, তুমি ফিরছো না। তুমি যে ফিরবে না, সে তো সবাই জানি। তোমাকে যদি না জানানো হয় হাশেম মামার মৃত্যুর খবর, তাতে তোমার কোনও ক্ষতি হওয়ার নেই কিছু। মৃত্যুর সঙ্গে যুদ্ধ তুমি করছো, তোমার প্রিয়জনের মৃত্যুর খবর তোমাকে দিয়ে তোমাকে কি আরও শক্তিময়ী করতে পারবো! কী করবে তুমি হাশেম মামার মৃত্যুর খবর জেনে? কী লাভ হবে তোমার! রুনু খালার স্বামী রাসু খালু একদিন এসে বসেছিলো তোমার সামনে। দিব্যি বলতে লাগলো, হাশেম ভাই যেদিন মারা গেল, সেদিন তো আমি.. কোনও দরকার ছিল না তোমাকে ওই গল্প শোনানোর। আসলে কারও মৃত্যুতে এই টুপি দাড়িঅলা মানুষগুলোর কোনও কষ্ট হয় না। তারা বিশ্বাস করে মৃত্যু মানে আল্লাহর কাছে যাওয়া। হাশেম মামা মারা গেছে এই খবরটা শোনার সঙ্গে সঙ্গে তুমি চমকে তাকালে আমার দিকে। কী যে অসহায় তুমি তখন! কী যে বোবা দৃষ্টি তোমার। মুহূর্তে আচমকা এক গাদা অন্ধকার তোমার ক্রমশ অন্ধকার হতে থাকা জগৎকে কোথাও ভাসিয়ে নিয়ে গেল। আমি আর বলতে পারিনি যে রাসু খালু মিথ্যে কথা বলছে। বলতে পারিনি হাশেম মামা বেঁচে আছে এবং ভালো আছে। কারণ মিথ্যে হলে রাসু খালু ওভাবে বলতো না। আমি তোমার বিছানার পাশে হাঁটু গেড়ে বসে বললাম, মা, হাশেম মামা খুব কষ্ট পাচ্ছিল, হয়তো এ তার জন্য ভালোই হল যে ওই ভয়ংকর কষ্ট আর তাকে পেতে হচ্ছেনা। কষ্ট থেকে মুক্তি পাক হাশেম মামা, তুমি তো চাও, তাই না মা? অত কষ্ট মামা আর সইতে পারছিলো না। কী আর বলবো মা, কী বলে সান্ত্বনা তোমাকে দেব। আমি জানি না কতটুকু কী বুঝলে তুমি, তুমি শান্ত মেয়ের মতো শুয়ে পড়লে, ভেতরে কী হচ্ছিল তোমার, কী রকম যন্ত্রণা, জানি না। তোমার চোখের কিনার বেয়ে গড়িয়ে পড়ছিল অবিরল জল। তুমি কি তখন ভাবছিলে যে, তোমার কষ্ট থেকে তোমার মুক্তি হোক, সেও আমি মনে মনে চাইছি! মানুষ ঠিক ওরকম অবস্থায় মনে মনে কী ভাবে, আমার পক্ষে সম্ভব নয় অনুমান করা। মৃত্যুর নিশ্বাসের কাছে বসে দেখতে হবে কী ভাবছি আমি। জানি না, মা, তখন কি অন্য কারও মৃত্যুর জন্য কান্না পাবে আমার? নিজেই যখন যাচ্ছি, কে গেছে বা যাচ্ছে, তার কথা ভেবে আমি কি কাঁদবো! আমি কি বাঁচবো যে সে ছাড়া আমার খালি খালি লাগবে। কেন কাঁদছিলে মা? হাশেম মামার মৃত্যু তুমি সইতে পারছিলে না কেন মা? তোমার নিজের মৃত্যুর চেয়ে অন্যের মৃত্যু তোমাকে কাঁদায় কেন বেশি মা? কেন তুমি আমাকে বিরক্ত করার চেয়ে নিজের মৃত্যুকেই বেছে নিলে, মা? বাবা বিরক্ত হত, দাদা বিরক্ত হত, নিজের চিকিৎসার জন্য সামান্য সাহায্য চেয়ে তাই ওদের বিরক্ত করতে চাওনি আর। তাই আমার কাছে গিয়েছিলে, দেখলে তোমার অসুখের কথা শুনে আমিও বিরক্ত হচ্ছি। তাই আমাকেও চাওনি বিরক্ত করতে। নিজের অসুখ নিয়ে নিজেই একা পড়ে রইলে। বিরক্ত হওয়া থেকে আমাদের বাকি জীবনের জন্য বাঁচালে। পারো কি করে? জীবন তো তুমি জানতে একবারই আসে। যত ধর্মকর্মই তুমি করো না কেন, ভেতরে ভেতরে তো বুঝতে এই জীবনের পরে আসলে আর কোনও জীবন নেই।
অবকাশের কালো ফটকে তালা দিয়ে বাবাকে আটকে রাখতে চেয়েছিলাম বাড়িতে। আমার ধমক, ভয় দেখানো, রাগ হওয়া কিছুই কাজ করেনি। যে করেই হোক বাবা যাবেই। তালাবন্ধ করে আর যাকেই যায়, বাবাকে আটকে রাখা যায় না। নিউইয়র্কে আর ঢাকায় তোমার পাশে যে বাবা ছিল দিন রাত, মনে হয় না এই বাবাই সেই বাবা। সব ভুলে আগের দিনের মতো বাবা চেম্বারে রোগী দেখায় ব্যস্ত হয়ে পড়লো। আমি শত চেষ্টা করেও বাবাকে থামাতে পারিনি। তোমাকে বলিওনি বাবা সেই আগের মতো দিব্যি সুটেড বুটেড হয়ে চিরকালের মতো বাইরে যাচ্ছে। তুমি কি খেয়াল করেছো বাবা এসে কাছে আর খুব একটা বসছেনা। উঁকি দিয়ে তোমাকে দেখে চলে যাচ্ছে। কী আশ্চর্য, দুদিন সাহেব হয়ে বসে তোমার সঙ্গে কিছু ছবি তুললো। বিশ্বাস হয়নি এই বাবাকেই নিউইয়র্কের হাসপাতালে ভর্তি করিয়েছিলাম প্রায় ধরে বেঁধে। ডাক্তার সব পরীক্ষা করে ওষুধ লিখে দিলেন। রক্তচাপ কমিয়ে রাখার ঠিকঠাক ওষুধ বাবা কোনওদিন খায়নি। আমি যা হাতে দিতাম, শিশুর মতো তাই খেয়ে নিত। আমি যে কত ভুল ওষুধ দিয়েছি। ডাক্তার লিখে দিয়েছে ওষুধ, কিন্তু কখন খাবে তার সময় লিখে দেয়নি। আমি সেগুলো একসঙ্গে বাবাকে খেতে দিতাম, বাবা খেয়ে নিত, জিজ্ঞেসও করতো না কী দিচ্ছি, কেন দিচ্ছি। আমাকে এত বিশ্বাস ছিল বাবার। এত অসহায় ছিল মানুষটা। ঢাকায় পর্যন্ত অসহায় ছিল। আর ময়মনসিংহে এসেই দিব্যি পূর্ণ তেজ ফিরে পেয়েছে। নিজের রক্তচাপ, ডায়বেটিস আর তোমার অসুস্থতা সব ভুলে বাবা এখন শহরের ব্যস্ত ডাক্তার, আগের মতো। মানুষের মনের শক্তিই বোধহয় সব চেয়ে বড় শক্তি। অন্তত বাবার বেলায়। তোমার মনে যত জোর আনছো, কোনও কাজেই তা লাগছে না। দিন দিন তুমি আরও বেশি দুর্বল হয়ে পড়ছে। বাবার কি এ কদিনেই ক্লান্তি এসে গেছে তোমার সেবা করতে করতে, তোমাকে সময় দিতে দিতে! তা না হলে ময়মনসিংহে ফিরে এসে বাবা কেন এভাবে বদলে গেল। মা, সত্যি কথা বলতে কী, সবাই কেমন যেন ক্লান্তই হয়ে পড়ছিলো। ছুতোনাতায় নিজের জীবনে ফিরতে চাইছিলো। তুমি চলেই যাবে যখন, না হয় চলেই যাও। তোমার জন্য যে সময় নির্ধারিত ছিল, সে সময়ের চেয়ে খানিকটা বেশি বেঁচে ফেলছো তুমি, মানুষ হতাশ হবে না কেন। চারপাশের মানুষগুলোর ক্লান্তি আমি টের পাই। আমারও কি ক্লান্তি আসেনি মা! এসেছে। আমারও মনে হয়েছে, অনেক হল, যে যাবার সে যাক। আমরা, সে যত আপনই হোক, খুব বেশি সময় খরচ করতে চাই না কারও জন্য। ভালোবাসায় আমাদের ক্লান্তি চলে আসে। তুমি কি টের পেয়েছিলে? টের পেয়েছিলে যে আমরা কেউ আর তুমি আরও দীর্ঘদিন বেঁচে থাকো, চাইছিলাম না! টের না পাওয়ার কিছু তো ছিলো না। ধীরে ধীরে তুমিও লক্ষ করছিলে, দূর থেকে যারা এসেছে, তারা তোমাকে শেষ বিদায় জানিয়ে গেছে। কাছে যারা ছিল, তাদের উপস্থিতির ঘনত্ব দিন দিন কমছে। তুমি কি আমার মুখেও টের পেয়েছিলে, ক্লান্তি! তোমার কাছ থেকে বারবার আমি উঠে চলে গিয়ে অন্য কোথাও বসে গল্প করছি। আমারও আর ভালো লাগছেনা এভাবে মৃত্যুর সঙ্গে গায়ে গা লাগিয়ে বসে থাকতে, মৃত্যুর মতো নির্মম কিছুকে এত পলকহীন চোখে বেশিদিন দেখা যায় না। আমারও ইচ্ছে করছে নিজের জীবনে, জীবনের উৎসবে, উচ্ছলতায় ফিরে যেতে। এক বিকেলে বাড়ির কয়েকজনকে নিয়ে যেদিকে দুচোখ যায়, সেদিকে চলে যেতে যেতে দিব্যি হালুয়াঘাট থেকে ঘুরে এলাম। মুক্তি তো চাইছিলামই। বিদেশ থেকে আমন্ত্রণ এলে, ভেতরে ভেতরে আমার খুব লোভ হচ্ছিল যাওয়ার। ফ্রান্সের জাতীয় সংসদে বক্তৃতা করার আমন্ত্রণ। অনেকগুলো ফোন পেয়েছিফ্রান্সের রাষ্ট্রদূতের। ফরাসি সরকারের এই আমন্ত্রণ রক্ষা করার জন্য আমাকে ক্রমাগতই অনুরোধ জানানো হচ্ছে। আমি বলে দিয়েছিলাম, আমার মার অসুখ, কোথাও এ সময় আমি যেতে পারবো না। পরে আবার একদিন মনে হয়েছে, দুদিনের জন্য ঘুরে এলে কী এমন ক্ষতি। না, মা, এই লোভ আমি সামলাতে পারিনি। এমনকী বাবাও অবাক হয়েছে আমার গোপন পরিকল্পনার কথা জেনে, যে বাবা সবসময় চাইতো বিদেশের সম্মানগুলো নিতে যেন কোনও আলস্য না করি। যেদিন তোমাকে বললাম, খুব বড় আমন্ত্রণ এসেছে ফ্রান্স থেকে, না গেলেই নয়, কদিন পরই ফিরে আসবো। তুমি করুণ চোখে তাকিয়েছিলে আমার দিকে। সেই চোখে বিস্ময়ও ছিল। তুমি হয়তো বুঝে পাওনি কী করে আমি তোমাকে ছেড়ে চলে যেতে চাইছি। কী করে অন্য কোনও কিছু, সে যত বড় আমন্ত্রণই হোক না কেন, মত্যুশয্যায় পড়ে থাকা মায়ের চেয়ে বড় হল। মাঝে মাঝে ভাবি কেন আমি তোমাকে ছেড়ে চলে যেতে চাইছিলাম, বড় বড় আমন্ত্রণে কি আমি এ যাবৎ কম রক্ষা করেছি! জীবনে কি বিশাল সব মঞ্চে আমি কম বক্তৃতা দিয়েছি! কেন আমি তোমাকে ওই আজ আছে কাল নেই অবস্থায় ফেলে অন্য কোথাও বেড়াতে যাওয়ার কথা মনে এনেছিলাম। নিজেকে ক্ষমা করতে পারি না। নিজেকে ক্ষমা করা আমার সম্ভব নয়। তোমাকে যে আঘাত দিয়েছিলাম, সে আঘাত তুমি নিভে যেতে থাকা জীবনে ধারণ করতে বাধ্য হয়েছিলে, প্রকাশ করোনি কিন্তু বিস্ময় বোধটা তুমি লুকোতেও পারোনি। অবশ্য তারপরই মাথা নেড়ে বলেছিলে যেতে, যেন যাই, বড় আমন্ত্রণে যেন যাই আমি। আমাকে সুখ দিয়েছিলে মা। যতটুকু উদার তুমি হতে পেরেছিলে, আমি কেন তার ছিটেফোঁটাও হতে পারিনি। শেষ অবদি আমি যাইনি কোথাও, কিন্তু যেতে তো চেয়েছিলাম, যেতে চাওয়ায় এবং যাওয়ায় কতই আর পার্থক্য!
যে তুমি বাঁচতে ভালোবাসতে, সেই তুমিই চাওনি আমার কোনও কষ্ট হোক তোমার জন্য। তুমি এমনকী যে মৃত্যুর সঙ্গে যুদ্ধ করছিলে প্রাণপণে, আমার ক্লান্তি বা কষ্টের কথা ভেবে তুমি তোমার নিজের মৃত্যু কামনা করলে। আমাকে মুক্তি দিতে চাইলে তোমার নিরন্তর সেবা থেকে। আমার ক্লান্তি থেকে। অবকাশেও যখন তোমাকে আমার সাহায্য করতে হলো মলত্যাগে, তুমি ভেবেছো আমার নিশ্চয়ই ঘেন্না হচ্ছে এসবে। তুমি সইতে পারোনি। একদিন শুধু বলেছো, তোমার এই কষ্ট আমি আর সইতে পারছি না। আল্লাহর কাছে বলে আমাকে যেন নিয়ে যান। না, মা। ও কারণে আমার কোনও কষ্ট হয়নি। সম্ভবত কষ্ট হয়নি এই ভেবে যে, এ তো আর দীর্ঘদিনের জন্য নয়। নিজের পাপের প্রায়শ্চিত্ত আমি করছিলাম, নাকি যা কিছু করছিলাম, করছিলাম তোমাকে ভালোবাসি বলে! মাঝে মাঝে ভাবি, বোধহয় প্রায়শ্চিত্তই করছিলাম। প্রায়শ্চিত্ত করতে বেশিদিন মানুষের ভালো লাগেনা। ভালোবাসলে কোনও ক্লান্তি আসতো না, ভালোবাসলে গোপনে গোপনে নিস্তার চাইতাম না। কত মানুষ এই পৃথিবীতেই আছে, যারা মাথা নষ্ট হওয়া, শরীর স্থবির হওয়া, বিছানায় পড়ে থাকা মাকে বছরের পর বছর, যুগেরপর যুগ সেবা করে যাচ্ছে, কোনও ক্লান্তি নেই, কোনও অভিযোগ নেই। তারা ভালোবাসে বলেই পারে। আমি সেই ভালোবাসা কোথায় পাবো মা! তোমার জন্য জন্ম থেকেই তা ছিলো না। হঠাৎ করে জন্মাবে কী করে, আমার দোষে তোমার অসুখ হয়েছে বলে! করুণা হয়েছে, মায়া হয়েছে, মমতা বোধ করেছি, আহা আহা করেছি। কিন্তু ভালোবাসা তীব্র ছিলো না বলে ওই অল্প সময়টুকুকেই দীর্ঘ দীর্ঘ বলে মনে হয়েছে। দিন হিসেব করেছি। ডাক্তারের দেওয়া তিন মাস পার হয়ে গেলে বিস্মিত হয়েছি। একটি দিনের বেশি হওয়াও হিসেবে রেখেছি। এসব অজান্তে ঘটেছে মা। আমার নিজেরই অজান্তে। আমার উদার ব্যক্তিত্বের ভেতরে বসে থাকা অনুদার স্বার্থপর আমিটিকে আমি ফাঁকি দিতে পারিনি। তোমার মহানুভবতার সামনে আমি অতি তুচ্ছ, অতি ক্ষুদ্র এক জীব। যেটুকু ভালো আমার, সেটুকু তোমার কারণে, যেটুকু মন্দ আমি, আমার কারণে।
তোমার শরীরের শক্তি দ্রুত ফুরোচ্ছিল। আজ তুমি পা নাড়াতে পারছো, কাল পারছে না। দুপুরে এপাশ ওপাশ করলে, বিকেলে আর সেটা পারলে না। তোমাকে দেখছিলাম আমি। লক্ষ করছিলাম তোমার শক্তি ফুরোনো। এ নিয়ে বাবার সঙ্গে কথা বলেছি, দাদা আর হাসিনার সঙ্গেও বলেছি। কাউকে সামান্য উদ্বিগ্ন হতে দেখলাম না। সম্ভবত তারা উদ্বিগ্ন তুমি এত সময় নিচ্ছো কেন মরতে, সম্ভবত তাদের আশংকা এভাবেই তোমার আবার আরও কয়েক মাস, আরও কয়েক বছর কেটে যায় কিনা। এরাই তো সেই মানুষ, যাদের সেবায় তুমি জীবন উজাড় করে দিয়েছিলে। তোমাকে দেখার আর কেউ ছিল না। তোমার মাথার কাছে বসে থাকতো নানি, বসে বসে কোরান পড়তো। কোরান পড়ে কোনও লাভ নেই জানি, তুমি সুস্থ হবে না। তারপরও আমি বাধা দিইনি। তুমি তো জীবনের অনেকটা সময় কোরান পড়েছো মা, নানি তার ভালোবাসা কী করে প্রকাশ করবে, নানি তো অন্য কিছু শেখেনি। কোরানইশিখেছে, তাই কোরানই পড়ছে। বাকি যারা আসতো তোমাকে দেখতে, টুটু মামা, আর মাঝে মাঝে শরাফ মামা। টুটু মামা তো শেষ দিকে রাত জেগে তোমার বিছানার সামনে বসে নামাজ পড়তো, দোয়া দরুদ পড়তো। মিলাদপড়ার মতোও দাঁড়িয়ে ইয়া নবি সালাম আলায়কা, ইয়া রসুল সালাম আলায়কা বলতো। আমিও দাঁড়াতাম ওদের সঙ্গে, তোমার সঙ্গে যেমন ছোটবেলায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে, হাত দুটো পেটের কাছে মুড়ে রেখে জোরে জোরে বলতাম ওগুলো, যে কথাগুলো কোনওদিন বুঝিনি। নাস্তিক হয়েও কেন আমি দাঁড়াতাম মা! তুমি যেন আমাকে দেখে খুশি হও? তুমি কি খুশি হতে মা? কতটুকু চোখ মেলতে পারতে আর তুমি, কতটুকু দেখতে পারতে, কতটুকু সুখের অনুভব তোমার তখন আছে? তারপরও আমার মনে হত, যদি থাকে, সামান্যও যদি থাকে, তুমি খুশি হও, একবার জীবনে তোমার নাস্তিক কন্যার বোধোদয় হয়েছে ভেবেও সুখপাও। সে সুখ মিথ্যে হলেও পাও। জীবনের শেষ মুহূর্তে অন্তত কিছুসুখ তুমি পাও। মাঝে মাঝে আসতো ছটকু, ফেলু মামা। ফেলু মামাকে দিয়ে তো তোমার স্টিলের আলমারিটা রং করিয়ে আনলাম। তোমাকে দেখতে বললাম আলমারির গোলাপি গোলাপি রংটা চমৎকার হয়েছে কীনা। একটু ঘাড় পেছনে নিয়ে দেখেছিলে মা। ওটিও তোমাকে সুখ দেওয়ার জন্য। তোমাকে বললামও, এই আলমারিতে এখন থেকে তোমার সবকিছু সুন্দর করে সাজিয়ে রাখবে মা, ঠিক আছে?
তুমি মাথা নেড়ে বললে, হ্যাঁ ঠিক আছে।
তুমি তো সুস্থ হয়ে উঠবে মা।
এ কথা শুনে তোমার ওই ক্লান্ত চোখ দুটোকেও স্বপ্নের জল এসে উজ্জ্বল করে তুলতে। জানি না তুমি বিশ্বাস করতে কী না। বিশ্বাস হয়তো হতে চাইতো না, কিন্তু তারপরও বিশ্বাস করতে হয়তো ভালো লাগতো। আমি ঠিক জানিনা ঠিক কী ভাবতে তুমি। মৃত্যুর অত কাছাকাছি চলে এলে কী রকম ভাবনা মানুষের মনে আসে, তা আমার জানা নেই। অসুখ ধরা পড়ার পর তুমি তো মৃত্যু শব্দটির নাম গন্ধ সইতে পারতে না, উচ্চারণ করতে না। সচেতন ভাবেই হয়তো করতে না। তুমি কি বিশ্বাস করতে চাইতে না তুমি যে সত্যি সত্যি মারা যাচ্ছো, নাকি তুমি প্রচণ্ড মনের শক্তি দিয়ে বেঁচে উঠতে চাইতে বলে অলক্ষুণে মৃত্যুর নামোচ্চারণ করতে না, নাকি মারা যাচ্ছো জেনেও তোমার প্রিয়জনকে বোঝাতে চাইতে না যে তুমি বুঝতে পারছো যে মরছে, ভাবতে প্রিয়জনেরা কষ্ট পাবে ভেবে যে তুমি জেনে গেছো গোপন ব্যাপারটি, জেনে তোমার কষ্ট হচ্ছে। আমার মনে হয় না তোমাকে অত কেউ কোনওদিন ভালোবাসতো যে তোমার কষ্টের কথা ভেবে কষ্ট পাবে। সারাজীবন কেউ বাসেনি জানেনা। হয়তো ভেবেছিলে, মরে যাচ্ছে বলে বুঝি ভালোবাসা জাগবে। না মা, যে সারাজীবনে ভালোবাসেনি, চোখের সামনে মরছো দেখলে তোমার জন্য তাদের ভালোবাসা উথলে ওঠার কোনও কারণ নেই। বেঁচে থাকলেও তোমার মৃত্যু চেয়েছে, মরতে থাকলে তো আরও চাইছে, দেরি সইতে পারছে না। তোমার কি কষ্ট হচ্ছে শুনতে? তুমি তো সব কিছুর ঊর্ধ্বে এখন মা, কষ্ট যন্ত্রণা এগুলো তোমাকে আর স্পর্শ করতে পারে না। পারবে কেন, তোমার নাগালই কেউ এখন আর পাবে না, পাবে না কারণ জলে স্থলে অন্তরীক্ষে তুমি আর নেই এখন। কোথাও নেই তুমি না থাকা মানুষের আবার দুঃখ কী। আমিও তো তোমার মতো না-থাকা হয়ে যাবো, দিন তো আসবেই কোনও না কোনও দিন। দিন তো সবারই আসে, আমার কেন নয়! তোমার অন্তত এইটুকু সান্ত্বনা হোক মা, তোমার মৃত্যু দেখে দেখে যাদের মনে হয়েছে, তুমি অভাগা তাই মরছে, তাদেরও মৃত্যুর সময় হবে মা। তারাও যাবে, তারাও চোখ বুজবে। মাঝে মাঝে মনে হয় কেন আমি তোমাকে ওই অবকাশে নিয়ে গিয়েছিলাম, অবকাশ নামের বাড়িটিতে তোমার মৃত্যু হোক, কেন চেয়েছিলাম আমি? ওই বাড়িতে তিরিশ বছরের স্মৃতি তোমার। কিন্তু তোমার সেই স্মৃতি তো মধুর নয়, মা। যে বাড়িতে তোমাকে অপমান করেছে তোমার স্বামী, বছরের পর বছর, প্রতি দিন, যে বাড়িতে তোমার পুত্র কন্যারা তোমাকে অবজ্ঞা করেছে, তোমার পুত্রবধূরা তোমাকে লাঞ্ছিত করেছে, সেই বাড়ির কোনও একটি ঘরের কোনও একটি বিছানায় শুয়ে তোমার মৃত্যু হোক, এই বা আমি চেয়েছিলাম কেন? আমি যে কথাটা ভেবে তোমাকে ময়মনসিংহেনিয়েছিলাম, সেটি হল, তোমার এতকালের পরিচিত চেনা মানুষগুলোর সঙ্গে তোমার দেখা হবে। বাকি আত্মীয়দের সঙ্গে দেখা হবে। তোমাদের বাড়ির পাশের বস্তি থেকে তইতই, তেঁতুর মা, আর আরও আরও তোমার চেনা বান্ধবীদের ডেকে ওদের তোমার বালিকাবেলার গান গাইতে বলেছি, ওরা গেয়েছে, তুমি শুনেছো, শুনে তোমার মুখে হাসি ফুটেছে, ওই হাসিটুকু তুমি হাসো, তোমার একটুখানি ভালো লাগুক চেয়েছি। আমি নিজেই বলেছি ওদের সবার হাতে টাকা দিয়ে দাও। গুনে তোমার হাতেই দিয়েছি টাকা, যেন তোমার হাতেই ওদের দাও। কারও কারও জন্য বলেছি, আরও কিছু দাও মা। একটুও দ্বিধা করো না। যত ইচ্ছে করে দিতে, দাও। কোনওদিন তো চাইলেও দিতে পারোনি। মানুষের দারিদ্র্য দেখে তোমার হৃদয় কাঁদতো, তোমার নিজের দারিদ্র্যের চেয়েও অন্যের দারিদ্র্য তোমাকে কাঁদাতো বেশি। সাহায্য করতে চাইতে। কিন্তু কী করে কোত্থেকে তুমি কাকে পয়সা দেবে। তোমাকেই কে দেয়! তোমাকে তো উপার্জন করতেও কেউ দেয়নি। নিজের পায়ে দাঁড়াবার ইচ্ছে তোমার মতো আর কাউকে দেখিনি। তবুও নিজের অনিষ্ট করে হাতে যা কিছুই ছিল তোমার, আটআনা বা একটাকা, একটাকা বা দুটাকা, হয়তো রিক্সাভাড়াই ছিল, দিয়ে দিয়েছে। হেঁটে বাড়ি ফিরেছো। রোদ্দুরে ভিজতে ভিজতে ক্ষিধে তৃষ্ণায় ভুগতে ভুগতে মাইলের পর মাইল হেঁটেছে। আর জীবনে প্রথম পাঁচশ টাকা হাজার টাকা ওই গরিব দুঃখী সইসাথীদের দিতে পেরে তোমার কি একটু, সামান্য একটু শান্তি হয়েছিল মা! ওটুকুই চেয়েছিলাম। বাড়ির অন্যরা, বাবা দাদা আর হাসিনা তিনজন তো কানে কানে কথা বলে আর কটাক্ষ করে আর মুখ টিপে হাসে, বাড়িতে করছি কী আমি! কিসের হাট বসিয়েছি! গরিব গরিব লোক ডেকে আনছি বস্তি থেকে, মাথা টাথা নিশ্চয়ই আমার মায়ের মতোই আমার গেছে। কদিন আর? এই একটিই সান্ত্বনা তাদের, বেশিদিন নয়। কালো ফটক পেরিয়ে গরিবগুলো রীতিমত ঘরের ভেতর ঢুকে মার বিছানার কাছে পেতে দেওয়া শীতল পাটিতে বসে পুরোনো দিনের সুখের স্মৃতিচারণ, গান গাওয়া, হাসি আনন্দ-কদিন আর? এই তো শেষ নিঃশ্বাসের সময় হল বলে। বাবা কি হাসিনাকে খুশি করতে হাতের আঙুল গুনে দিন বলে দেয়, আর কদিন! বাবা তো বোঝে কদিন। আমার চেয়েও বেশি বোঝে, কদিন। আমার চেয়েও হাজারগুণ অভিজ্ঞ ডাক্তার আমার বাবা। নাড়ি না টিপেও বলে দিতে পারে নাড়ির খবর।
.
মা, জগৎটা যে কী নিষ্ঠুর, তা নিজেই তো দেখেছো। তোমার আদরের ধন কামালকে পাওনি খুব বেশি বছর, অল্প বয়সে বিয়ে করে গীতার সম্পত্তি হয়ে গিয়েছিল, সেই আদরের ধনকে প্রাণ ভরে সেবা করার জন্য হাতের কাছে জীবনের শেষ কটা বছর পেয়েছিলে তুমি। কী ভালোই না বাসতে। অথচ মা, আমি তোমার সেই আদরের ধনকে চেয়েছি তোমার কাছে এসে বসুক, একটু তোমার সুখ হোক। ঢাকায় যখন শয্যাশায়ী তুমি, ছোটদাকে শত বলেও বসাতে পারিনি কাছে। ছোটবেলা থেকে ছোটদার টাকা পয়সার প্রতি প্রবল আকর্ষণের কথা আমরা সবাই জানি। জানা জিনিসকে মুখে বললে এত বিচ্ছিরি শোনায় কেন জানি না! একবার শান্তিনগরের বাড়িতে তোমার জন্য একটা ওষুধ আনতে বলেছিলাম, দু তিন টাকা বোধহয় দাম। সেই টাকাও সে বললো আমাকে দিতে। আমি অবাক হয়ে ভাবলাম, নিজের মায়ের ওষুধের জন্য নিজের পকেট থেকে দুটো টাকাও সে খরচ করতে চাইছে না! সেই ছোটদা কেন আসবে তোমাকে দেখতে ময়মনসিংহে। একবার খুব হাতে পায়ে ধরে অনুরোধ করে আনলাম বটে, এসেই বলে দিল তার প্রচণ্ড ব্যস্ততা, তার ফ্লাইট, তার নানা কিছু। তার সময় নেই ময়মনসিংহে আসার, তার সময় নেই সময় নষ্ট করার। বলেছিলাম, তুমি এসেছো দেখলে মা তো খুশি হয়, মাকে শেষ সময়ে কিছু খুশি দাও। ছোটদার কথা, তোমার জন্য সব সে করেছে, কিছুই করিনি আমি। সব টাকা সে খরচা করেছে, কয়েক লক্ষ টাকা এর মধ্যে তার খরচ হয়েছে, কিছুই করিনি আমি। তোমার স্বপ্ন পূরণ সে করেছে, আরব দেশে নিয়ে উমরাহ করিয়ে এনেছে। না, এর বেশি তোমার জন্য ছোটদার করার কিছু নেইও, ইচ্ছেও নেই। এই তার শেষ কথা। শেষ কথা সে চিৎকার করে জানিয়ে দিল, অবকাশের দেয়াল ফাটিয়ে জানিয়ে দিল। সব পাশের ঘর থেকে শুনলে তুমি। ছোটদা হিংস্র জানোয়ারের মতো চেঁচায়, যখন চেঁচায়। কিছু কিছু মানুষ মনে করে চেঁচিয়ে কিছু কথা বললে, সেই কথা সত্য বলে প্রমাণিত হয়। আসলে জঘন্য মিথ্যেও যে জোর গলায় চেঁচিয়ে বলা যায়, আর তা যে মাথায় যাদের ঘিলু বলে পদার্থ আছে তা জানে, তা তারা জানে না। সময় ছোটদার অঢেল আছে মা, সময় নেই শুধু তাদের জন্য, যাদের জন্য সময় কাটাতে তার ভালো লাগে না। ভালো লাগে মদের আড্ডা, ভালো লাগে মেয়ে পটানো। গীতার বশংবদ ভত্যের এই হাল। ছোটদার জন্য সেই ছোটবেলা থেকে আমার মায়া। শুধু আমার কেন, তোমার, ইয়াসমিনের, সবারই মায়া। বাড়িতে আমরা, বিশেষ করে আমি সবচেয়ে বেশি ভালোবাসতাম ছোটদাকে। লেখাপড়া শেষ না করে বিয়ে করে প্রথম দিকে খুব টাকাপয়সা ছিল না বলে মন খারাপ থাকতো ছোটদার, সেই মন খারাপ ছোটদা এখন বিরাট টাকা পয়সার মালিক হয়েছে, কিন্তু আমাদের সবার সেই আদর এখনও তার ওপর একই রকম বর্ষিত হয়। বাবাও ছোটদা বলতে পাগল। চোখের আড়ালে বেশি থাকলে বা দূরের শহরে বাস করলে যা হয়, আদরটা বেশি জোটে। ছোটদার তাই জুটতো। এখনও তাই জোটে। আমি হয়তো অত সহজে অন্তরীণ থাকা অবস্থায় যেভাবে ছোটদাকে ব্যাংকের যাবতীয় টাকা তোলার অধিকার দিয়েছিলাম, অমন আর কাউকে দিতেপারতাম না। কেন যে বিশ্বাস করতাম এই ছোটদাকে, বিশ্বাস বারবার ভেঙেছে, তারপরও। আসলে যে বিশ্বাস ভাঙে তার দোষ নয়, যে বিশ্বাস করে তার দোষ। ছোটদার ব্যবহারে জানিনা তুমি কষ্ট পেয়েছিলে কি না। শেষের দিকে কষ্টের বোধ তোমার হয়তো আর ছিল না। ছোটদা এক বিকেলে, ওই একটি বিকেলেই তোমারপাশে বসেছিল, মাথায় টুপিপরে সে কোরানপড়ছিল। সে যে কোরান পড়তে জানে তা আমার জানা ছিল না। ইদানিং জুইয়ের সঙ্গে মিশে সম্ভবত শিখেছে। জুই খুব ধার্মিক শুনেছি। ওই একদিনই ছোটদাকে পেরেছিলাম তোমার পাশে বসাতে। কোরান থেকে জানি না কী পাঠ করলো জোরে জোরে, কী যে সেদিন ভালো লেগেছিলো ছোটদা তোমার কাছে বসেছে বলে। ছোটদার মতো ছোটলোককে সেদিন আমি ক্ষমা করে দিয়েছি, যেহেতু তার ওইটুকুপাশে বসা দিয়ে তোমাকে ভালো লাগা দিয়েছিলো। ছোটদার জুইকে বিয়ে করা, কোরানপড়া, এসবের পেছনে আছে একরাতের এক দুর্ঘটনা। সে রাতে ছোটদা গাড়ি চালাচ্ছিলো, গাড়িতে বসেছিলো জুই আর জুই-এর মা। গাড়ি একসময় কোনও এক রেললাইনের ঠিক ওপরে এসে বন্ধ হয়ে গেল। গাড়ি আর চলছে না, না সামনে, না পেছনে। ঠিক তখনই ট্রেনের শব্দ, তিরের মতো ছুটে আসছে ট্রেন। ছোটদা শুধু চিৎকার করে বললো সবাইকে বেরোতে। জুই বেরিয়ে দৌড়। ছোটদাও। কিন্তু পেছন ফিরে দেখলো গাড়িতে আটকে আছে জুই-এর মা। ছোটদা ছুটে গেল গাড়ির ভেতর থেকে জুই-এর মাকে বের করতে। ট্রেন তখন নাকের ডগায়। টেনে সে বের করে নিয়ে আসে বটে জুইয়ের মাকে, কিন্তু ট্রেনের ধাক্কয় নিজে ছিটকে পড়ে। ছোটদার গাড়ি গুঁড়ো করে দিয়ে ট্রেন চলে যায়। গায়ের হাড়গোড় কিছু ভাঙ্গলেও ছোটদা বেঁচে যায় শেষ পর্যন্ত। জুইয়ের মা ট্রেনের আঘাতে নয় কিন্তু, হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মারা যায় হাসপাতালে। এই মৃত্যু ছোটদাকে আমূল বদলে ফেলে। এত অপরাধবোধে ভোগায় যে জুইয়ের এতদিনকার স্বপ্ন সে পূরণ করে, জুইকে বিয়ে করে। জুইয়ের মার মৃত্যুর জন্য কেন ছোটদা নিজেকে দায়ী করে! যদি সে টেনে তাঁকে বের না করতো গাড়ি থেকে, দুমুহূর্ত পরই নিশ্চিহ্ন হয়ে যেতেন তিনি। আমার মনে হয় না ছোটদা ছাড়া পৃথিবীর অন্য কেউ ট্রেনের ওইছুটে আসার দিকে ঝাঁপিয়ে পড়ে প্রেমিকার মা কেন, নিজের মাকেও বাঁচাতে যেতো।
ছোটদা পরদিনই চলে যায়। তোমার শরীর দ্রুত খারাপ হচ্ছে, ছোটদা যেন আরও পাশে থাকে, যেন চলে না যায়, আমার অনুরোধ ছোটদাকে অবকাশে রাখতে পারে না। আমার টয়োটা গাড়ি নিয়ে আসে, ওই গাড়ি নিয়েই বেরিয়ে যায় ঢাকার পথে। সবাই ভুলে গেছে, এমন কী ছোটদাও, যে, গাড়িটা আমার, ভুলে গেছে শান্তিনগরের বাড়িটাও আমার। সবাই কথাই বলে এভাবে, ‘কামাল তোর গাড়ি কোথায় পার্ক করলি? ’ বা ‘তুমি কি তোমার ঢাকার বাড়িতে সেদিন ছিলে?’ না আমার আড়ালে নয়, বাক্যগুলো আমার সামনেই উচ্চারিত হয়। আমি বুঝি, সময় অনেক কিছু পাল্টে দিয়েছে। আমি এ দেশে এ বাড়িতে, এ পরিবারে অনেকটাই অবাঞ্ছিত। কেবল তোমার কাছেই বাঞ্ছিত, কেবল তুমিই আমাকে সমস্ত জীবন দিয়ে চাইছ, সমস্ত জীবনের বিনিময়ে চাইছ। এই চাওয়ার মধ্যে এক ফোঁটা ফাঁকি নেই।
.
রোজার সময় তখন। টুটু মামা রোজা রাখতো। সারারাত সে নাকি আল্লাহনাম জপ করে। শুনে আমিই তাকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলাম তোমার পাশে রাতভর যেন তাই করে। সন্ধেবেলায় এসে টুটু মামা সারারাত জেগে থাকতো, সকালে বাড়ি চলে যেত ঘুমোতে। টুটু মামার বাড়িতে আসা দাদা পছন্দ করতো না। দাদার কাছ থেকে কবে নাকি টুটু মামা টাকা ধার করেছিলো, সে টাকা আর ফেরত দেয়নি। সে কারণেই টুটু মামার ছায়াও সহ্য হত না দাদার। টুটু মামা টাকা ফেরত দেয়নি। তাতে কী! পারেনি ফেরত দিতে, তাই ফেরত দেয়নি। বাবার কানে টুটু মামা সম্পর্কে যত রাজ্যির মন্দ কথা আছে, দাদা দেয়। বাবার মনও টুটু মামা থেকে সরিয়েছে দাদা। বাবা, আমি লক্ষ করেছি, আগে যেমন মামাদের সঙ্গে গল্প করতো, তেমন আর করে না। হাশেম মামা শুনেছি লিভারের ক্যানসার নিয়ে বাবার চেম্বারে বসে থাকতো। একটু যেন ওষুধ বাবা দেয়। জানি না বাবা কতটুকু সাহায্য হাশেম মামাকে করতো। মামাদের সম্পর্কে বাবার অভিযোগ যত থাক, নিজের কোনও দুর্যোগ এলে মামাদেরই বাবা সবসময় কাছে ডাকতো। হাশেম মামা তোমাকে বলেছিলো আমি যেন তার জন্য কিছু টাকা পাঠাই। আশ্চর্য, মা, কোনও টাকা আমি পাঠাইনি। পরে অবশ্য তার ছেলে সুমনকে পঞ্চাশ হাজার টাকা পাঠিয়েছিলাম, তখন হাশেম মামা আর বেঁচে নেই। হাশেম মামাকে সুইডেনে এনে চিকিৎসা করার জন্য ভিসার ব্যবস্থাও করেছিলাম। হাশেম মামার আর আসা হয়নি। মামার কথা ভাবলে এখনও বুকের ভেতরে একটা চিনচিন কষ্ট হয় আমার। মুক্তিযোদ্ধা ছিল হাশেম মামা। কী সুন্দর দেখতে ছিল। কী রকম সুঠাম সুদর্শন যুবক। টুটু মামার সঙ্গে তার সুন্দরী বউএর কোনও একদিন প্রেম হচ্ছে ধরা পড়ার পর সেই যে হাশেম মামা দাড়ি কাড়ি রেখে উদাস হয়ে গেল, আর ফিরে এলো না হৈ চৈ এ। টুটু মামাকে তুমিও চাইতে থাকুক। সারারাত সে সুর করে করে সুরা পড়ে, সে সুর বড় মধুর লাগে। টুটু মামাকে রাতের শেহরি খাওয়ার ব্যবস্থা নিজের উদ্যোগে করি। তোমাকে যে মনে শান্তি দিতে পারছে, তাকে খুশি করতে আমি তখন সব করতে রাজি। বাবা আর দাদার ধারণা টুটু মামা কোনও বদ উদ্দেশ্য নিয়ে এখানে আসে। ঝুনু খালাও একদিন কানে কানে বলে গেল, টুটু মামা নাকি অসুস্থ হাশেম মামাকে একদিনের বেশি দেখতে যায়নি। তোমার অসুখে তার মতো পাষণ্ডর দুঃখ হওয়ার তো কিছু নেই। এই দুঃখটা নাকি বানানো, এখানে ভেড়ার উদ্দেশ্য, আমার কাছ থেকে বড় অংকের একটা টাকা দাবি করা। না, মা। এসব আমার বিশ্বাসহয়নি। তোমার এগারো জন ভাইবোনদের মধ্যে একজনের সঙ্গে আরেকজনের যেমন বন্ধুত্ব ছিল, শত্রুতাও ছিল, তোমার সঙ্গে কারওরশত্রুতা ছিল না। তুমি সবাইকে ভালোবাসতে। সবাই তোমাকে ভালোবাসতো। টুটু মামার যে উদ্দেশ্যই থাকুক, তার প্রতি কৃতজ্ঞতায় আমার মন ভরে থাকে। তার কাছ থেকে যা পেয়েছি, সে পাওয়া অমূল্য। কোনও টাকায় আমি তার ঋণ শোধ করতে পারবো না। কোনও লক্ষ টাকা দিয়েও না।
.
তোমার চৈতন্য ফিকে হচ্ছে খুব দ্রুত। আগের চেয়ে অনেক বেশি ঝিমোচ্ছো, অথবা ঘুমোচ্ছো। তোমাকে শারীরিক কোনও সুস্থতা দিতে আমি পারছি না। শারীরিক কোনও সুস্থতা দিতে কোনওদিনই পারিনি। তোমার অসুখের দিকে তোমার মৃত্যু হবে জানারপর শুধু ফিরে চেয়েছি। আমি মরিয়া হয়ে উঠছি, যতটুকুসুখী করতে তোমাকেপারা যায়, করতে। জিজ্ঞেস করছি তোমাকে, কাকে কাকে তোমার দেখতে ইচ্ছে করে বলল, কার সঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছে করে, কে কাছে এলে তোমার ভালো লাগবো। তুমি যাদের নাম বলেছে, সবাই দরিদ্র, বস্তির লোক, গ্রামের অভাবী লোক। জ্যোৎস্নাকেতুমি দেখতে চাইলে। জ্যোত্সা একসময় কাজ করতো অবকাশে। ইয়াসমিনের মেয়ে ভালোবাসাকে যখন লালন পালন করতে তুমি, জ্যোৎস্না তোমাকে সাহায্য করতো। জ্যোৎস্নাকে ইয়াসমিনের শ্বশুর বাড়ির কেউ দিয়েছিলো। সানকিপাড়া থেকে ইয়াসমিনের শ্বশুরবাড়ির আত্মীয়দের ডেকে এনে অনুরোধ করলাম, জ্যোৎস্নাকে নিয়ে আসতে। ওরা বললো, সম্ভব নয়। জ্যোৎস্না গ্রামে চলে গেছে, ওর ঠিকানা কেউ জানে না। কিন্তু আমার উপর্যুপরি অনুরোধ যে করেই হোক খুঁজে আনতেই হবে জ্যোৎস্নাকে। লোককে গাড়ি দিয়ে, টাকা দিয়ে একদিন নয়, দিনেরপর দিনপাঠাচ্ছি। গ্রামের বাড়ি বাড়ি গিয়ে জ্যোৎস্নাকে খুঁজতে হবে। জগতের যেখান থেকে হোক, জ্যোৎস্না নামের মেয়েকে নিয়ে আসতে হবে। শেষপর্যন্ত জ্যোৎস্নার খোঁজ মেলে। কোনও এক গহন গ্রাম থেকে ওকে নিয়ে আসা হল। একই রকম কোনও ঠিকানা না জানা ঠিকানায় পাঠিয়ে দিলাম ফকরুলকে, লিলি বা লিলির মাকে খুঁজে আনতে। দুতিন গ্রাম তন্ন তন্ন করেও লিলির মার খোঁজ পাওয়া যায়নি। তুমি জ্যোৎস্নাকে দেখে ঝরঝর করে কাঁদলে। ওকে কাছে ডেকে বুকে জড়িয়ে রাখলে। কোনও একদিন কী কারণে জ্যোৎস্নাকে তুমি মেরেছিলে, তাই তার কাছে আকুল হয়ে ক্ষমা চাইলে। চোখের জলে নিজের মুখ বুক ভিজিয়ে ক্ষমা চাইলে তুমি। জ্যোৎস্নাকে শাড়ি দিলে, টাকা দিলে, যা ওর পাওনা ছিল, তার চেয়েও অনেক বেশি দিলে। জ্যোৎস্নার হাত ধরে জানতে চেয়েছো, ও তোমাকে ক্ষমা করেছে কি না। জ্যোৎস্না খুব অবাক হয়েছে কিসের ক্ষমা, কেন ক্ষমা। লোকের বাড়িতে কাজ করতে গিয়ে লাথিঝাঁটা খেয়েই জীবন কাটে। কেউ তাদের কাছে কোনও অন্যায়ের জন্য ক্ষমা চায় না। ক্ষমা তো আছেই, তারপর না চাইতেই এত টাকা পেয়ে যাওয়া! সবই ছিল জ্যোৎস্নার জন্য অবিশ্বাস্য। ওকে রাতের খাবার খাইয়ে দিতে বললে। বাড়িতে আমি এমন ব্যবস্থাই করেছি। কেউ যেন না খেয়ে না যায়। তোমার আত্মীয় স্বজনের এ বাড়িতে খাওয়ার চল খুব ছিল না। আমি কাউকে না খেয়ে দুপুর বা রাতে যেতে দিচ্ছি না। তোমার ভাই বোন, তোমার যে আত্মীয়ই আসছে, সবাইকে খাওয়াচ্ছি। তোমাকে বলছি, সবাইকে খাইয়ে দিচ্ছি। একদিন শরাফ মামার গোটা পরিবারকেই তোমার বিছানার সামনে শীতল পাটিয়ে বসিয়ে তুমি যেন দেখ, যত্ন করে খাইয়েছি। আমার টাকায় মাছ মাংসের বাজারও তাই করছি, যেন অধিকার থাকে যাকে ইচ্ছে খাওয়ানোর। আসলে মা, খাওয়া তো সবার বাড়িতে আছে। তোমার ভাই বোনেরা বাড়ি গিয়ে এ বাড়ির খাবারের চেয়ে ভালো খাবার খেতে পারবে, কিন্তু ওই আপ্যায়ন, ওই যে বসিয়ে খাওয়ানো, ও করেই আমরা আদর বোঝাই, বোঝাই যে ভালোবাসি। তুমি যেমন অতিথিপরায়ণ, আমিও তেমন। তাই ওদের যখন আদর করে ডেকে খেতে বলি, আমি অভিনয় করি না। মামাদের সঙ্গেই আমার শৈশব কৈশোর কেটেছে। ওদের সঙ্গে হাজার বছর পর দেখা হলেও মনে হয় যেন প্রতিদিনই দেখা হয়। শরাফ মামার ওপর আমার যে রাগ নেই, তা তোমাকে বোঝানোর প্রবল ইচ্ছে আমার। তুমি যে থালায়, বা বাটিতে, বা কাপে খাচ্ছিলে, অতিথিরা যেসবেখাচ্ছিল, চেয়েছিলাম সেগুলো খুব সুন্দর দেখতে হোক। যে তালাবন্ধ আলমারিতে থালাবাটি থাকে, সেগুলোর চাবি চেয়েছি, ওগুলো বের করবো বলে। যা কিছু সুন্দর ওখানে, ওই আলমারিতে, তার প্রায় সবই আমি কিনে দিয়েছিলাম দাদাকে, যখন জার্মানি গিয়েছিলো। সেগুলোই সাজিয়ে রাখা। কিন্তু হাসিনা আমাকে চাবিও দেয়নি, নিজেও সব বের করে দেয়নি। দুটো বাটি বের করে আলমারি বন্ধ করে বললো, এত নাড়াচাড়ায় ভেঙে যেতে পারে। মানুষ কী করে এত কুৎসিত হতে পারে, আমি বুঝি না। মানুষ যে এই তুচ্ছ বিষয় আশয় ছেড়ে, পার্থিব সব কিছু ফেলে চিরতরে চলে যায়, তা চোখের সামনে দেখেও তারা কেন এসবই আঁকড়ে পড়ে থাকে, কিছু বুঝি না এর।
.
লিলি আর লিলির মার কাছেও ক্ষমা চাওয়ার ইচ্ছে ছিল তোমার। পাওনা টাকাগুলো দিতে চেয়েছে ওদের। পারোনি। তোমার এই একটি চাওয়া আমি মেটাতে পারিনি। দুলুর মাকেও পারিনি, আনুর মাকেও পারিনি আনতে। অবশ্য ওদের দেখা পাওয়া গেছে, তখন খুব দেরি হয়ে গেছে। আহা, মা, যদি একবার ওদেরও নিজের হাতে কিছু টাকা দিতে পারতে। তোমার যে দেওয়ার হাত ছিল, কিন্তু হাতে কিছু ছিল না, সেই তোমার হাতে জীবনে প্রথম টাকা এলো। প্রচুর টাকা। তুমি গুনেও দেখতে পারোনি। এত টাকা তুমি বোধহয় গুনতেও জানতে না। জীবনে একটি টাকা, একটি মাত্র টাকার জন্য হাত পেতেছো স্বামী সন্তানদের কাছে। বেশির ভাগ সময়ই পাওনি। এখন তুমি ভুলে যাও তোমার নিজের হাতব্যাগে অগুনতি টাকা। তুমি মুঠোর মধ্যে সে টাকা তোলো। কিন্তু লক্ষ করেছি তুমি ওই টাকার কিছুআর অনুভব করো না। টাকা আর আবর্জনার বাক্সের কোনও বাতিল কাগজের মধ্যে কোনও পার্থক্য করতে পারো না। ওই টাকা তোমাকে সুখ দেয় না। নিজের জন্য কিছু তো চাওনি কোনওদিন। অন্যের জন্য চেয়েছিলে। প্রতিরাতে ঘুমিয়ে পড়ছো মাথার কাছে কয়েক লক্ষ টাকার ব্যাগ রেখে। টাকা তোমাকে আর আকর্ষণ করে না। ও টাকা দুর্বল দুটো হাতে ঠেলে সরিয়ে দাও। ডিম, দুধ, কলা এই তিনটি জিনিস খেতে চাইতে তুমি স্বাস্থ্যের জন্য। পেতে না। আর এই তিনটি তোমার সামনে অঢেল এখন, খেতে পারো না তুমি মা। কিছুই তুমি মুখে নিতে পারো না। দুর্গন্ধ সবকিছুতে। তোমার প্রিয় ডিম, প্রিয় দুধ মুখের কাছে ধরছি। তুমি মুখ সরিয়ে নাও। লিভারে যার ক্যান্সার ছড়িয়েছে, তার তো খাওয়া ফুরোলো মা, সে কি আমি বুঝি না! কিন্তু তারপরও প্রথম দিকে খেতে চাইতে তুমি। ক্যানসারের সঙ্গে যুদ্ধ করতে চাইতে। বাঁচতে চাইতে। এত মনোবল তোমার কোথায় ছিল! ছিল সব সময়, কিন্তু ওই মনোবল নিয়ে কোথাও পোঁছোতে পারোনি। যে মানুষগুলো তোমাকে তোমার নিজের পায়ে দাঁড়াতে দেয়নি, তারা তোমার চেয়েও অনেক শক্তিমান। তুমি নিরীহ নিরুপদ্রব নারী। তুমি পারোনি শক্তিমানদের সঙ্গে একা যুদ্ধ করে জিততে। তোমার এই হাঁমুখো অসুখের বিরুদ্ধে তুমি একাই দাঁড়িয়েছে।
একদিন, হঠাৎই একদিন, ঝিমিয়ে থাকা তুমি হঠাৎ জেগে উঠলে। তোমার ক্ষিধে পেলো প্রচণ্ড। তুমি ভাত খেতে চাইলে। মাছ মাংস যা আছে সব দিয়ে ভাত। যে তুমি সামান্য তরল পদার্থও মুখে নিতে পারছে না, সে তুমি ভাত খাবে। প্রায় প্রতিদিনই লোক পাঠিয়ে বাজার করছি আমি। একদিন শুভ আর সৌখিনের জন্য বাবা কিনে আনলো এক ডজন বাচ্চা মুরগি। বাবার কাছ থেকে নিয়ে মুরগিগুলো দেখালাম তোমাকে, বললাম বাবা তোমার জন্য কিনেছে। দেখালাম এই জন্য যে যেন তুমি ভাবো কেবল আমি নই, বাবাও তোমার জন্য ভাবছে, তোমাকে ভালোবেসে তোমাকে ভালো স্যুপ খাওয়ানোর জন্য বাজার করছে বাবা। একটু যেন তুমি খুশি হও। কোনওদিন তো বাবা তোমার জন্য কিছু কেনেনি। কোনওদিন চায়নি তুমি ভালো কিছু খাও। কখনও কি মুরগির কোনও ভালো টুকরো নিজে তুমি নিজের পাতে নিতে পেরেছো! বাবার ভয়েই পারোনি কোনওদিন। তুমি নিজে খাবে না, অন্যকে খাওয়াবে, তাইতো সবাই চাইতো। মিথ্যে করে হলেও তুমি জানলে যে বাবা চাইছে তুমি ভালো খেয়ে নেতিয়ে পড়া শরীরে শক্তি অর্জন করো, সুস্থ হয়ে ওঠো। বাবার ভালোবাসা তুমি সারাজীবন প্রার্থনা করেছো, পাওনি। অন্তত একবার জেনে স্বস্তি পাও, শুধু আমি নই, বাড়ির সবাই তোমাকে ভালোবাসে। মিথ্যে করে হলেও জানো, মা। বৈঠক ঘরে বসে বাবা আর দাদা দুজন পা নাড়িয়ে নাড়িয়ে কানা কানি করছে, আমার আদিখ্যেতার নিন্দে করছে। তারপরও আমি বাবাকে আর দাদাকে অনুরোধ করেছি টেলিভিশনের সামনে না বসে তোমার সামনে বসতে। টেলিভিশন তারা অনেকপাবে, তোমাকে পাবে না। বলি তোমাকে পুরোনো দিনের কথা বলতে, কোনও সুখের স্মৃতি যদি তোমাকে নিয়ে তাদের থাকে, বলতে। বলতে, যে, তুমি সুস্থ হয়ে উঠবে, বলতে যে, তোমাকেতারা ভালোবাসে। হোক না মিথ্যে, তারপরও। অন্তত হাতে গোনা যে কটা দিন তোমার আছে, তুমি সুখ পাও। কিন্তু অত কি সহজ এই সহজ কাজটি। কারও সময় নেই। বাবা চেম্বারে যাবে, রোগী দেখার নেশা। তোমার অসুখের কথা বলে বাবাকে থামানো যায়নি। বাবার নিজের শরীর ভালো নয় বলেও বাধা দিয়েছি। কিন্তু কোনও বাধাই কাজে লাগেনি। যে গাড়িটি বাবার জন্য কিনেছিলাম, সেই গাড়ি বাবা কোনওদিন চড়েও দেখেনি। শত বলেও বাবাকে ও গাড়ি দিয়ে চেম্বারে নেওয়াতে পারিনি। বাবাকে কিনে দেওয়া গাড়িটি এখন দাদার। সবাই বলে, দাদার গাড়ি। দাবি করতে ওদের কারও লজ্জা হয় না, বরং প্রতিবাদ করতে লজ্জা হয় আমার। যেদিন তোমার ক্ষিধে পেলো প্রচণ্ড, রান্নাঘরে গিয়ে কাজের লোকদের বারবারই তাগাদা দিলাম যেন রুই মাছের একটি টুকরো হলেও তোমার জন্য তাড়াতাড়ি রান্না করে দেওয়া হয়। কোথায় পাবো মাছ! মাছ রান্না হতে দেরি হবে হাসিনা জানিয়ে দিল। এখন শুভ আর সৌখিনের জন্য মুরগি রান্না হচ্ছে। মুরগি তো চিরকালই রান্না হবে, তোমার জন্য মাছটা আগে করে দিক। ভাত রান্না হয়েছে? হয়নি। ডাল? না, তখনও না। শুভ আর সৌখিনের জন্য আলাদা যে খাবার, সেগুলো আগে রান্না হচ্ছে। তারপর অন্য সবার রান্না শুরু হবে। রান্নার লোককে বললাম, সব বন্ধ করে মার জন্য ভাত, ডাল, আর রুইমাছের তরকারি তাড়াতাড়ি যেন রান্না করে দেয়। কিন্তু আমার নির্দেশ মানার কোনও লক্ষণ আমি কারও মধ্যে দেখি না। রান্নার লোকের কথায় এবং আচরণে বুঝি যে হাসিনা যা আদেশ করবে, তাই পালন করবে ওরা। আমার বা তোমার, অবকাশ নামের বাড়িতে কোনও অধিকার নেই। একসময় দেখি, হাসিনা তোমাকে মুখে তুলে খাওয়াচ্ছে, বাসি কাঁচকি মাছ, বাসি ডাল আর বাসি ভাত। আমি হতবাক দাঁড়িয়ে রইলাম, যদি আমি তখন বলি যে হাসিনা তোমাকে বাসি জিনিস খাওয়াচ্ছে, তুমি মনে কষ্ট পাবে বাসি জিনিস তোমাকে খাওয়ানো হচ্ছে বলে, তাই চুপ করে জানালার দিকে তাকিয়ে আমি বসে রইলাম। ক্ষুধার্ত তোমার দিকে, একটু ভাত খাওয়ার জন্য তোমার ব্যগ্রতার দিকে আমি তাকাতে পারছিলাম না। আমি তোমাকে বলিনি যে হাসিনা ইচ্ছে করলেই আজকের রুই মাছটা রান্না করার জন্য বলতে পারতো, বলেনি। মা, ওই খাওয়াই তোমার শেষ খাওয়া ছিল। তোমার জীবনের শেষ ভাত, শেষ মাছ, শেষ ডাল। খাবার সময় যখন রুইমাছ আমার থালায় এলো, গরম ভাত এলো, নতুন রান্না করা ডাল এলো, আমি খেতে পারিনি। কেউ লক্ষ করেনি আমার ওই ভাত, ডাল আর মাছের টুকরোর ওপর আমার চোখের জল টুপটুপ করে পড়েছে। কে লক্ষ করবে, সবাই তো পা নাচিয়ে গল্প করছে নয়তো টেলিভিশন দেখছে। টেলিভিশনের শব্দ শুনলে আমার খুব রাগ হতো। আমার রাগ দেখে শুভ, হাসিনা, দাদা-সবাই রাগে ফুঁসতো। আমি তোমার ঘরের দরজা বন্ধ করে রাখতাম, যেন শব্দ কম আসে। দেখ তোমরা নাচ নাটক যা কিছু, শব্দটা কমিয়ে রাখো, মা যেন না বোঝে যে পাশের ঘরে উৎসব চলছে। মা যেন বোঝে বাড়ির সবাই মার জন্য কাঁদছে। অবশ্য আমার রাগ হওয়ায় বা দুঃখপাওয়ায় কারও কিছু যায় আসেনি। তুমি এক ঘরে দিন দিন একটু একটু করে মরে যাচ্ছো, পাশের ঘরে টেলিভিশন চলেছে, যে কোনও দিনের মতোই চলেছে। ভাবলে এখনও আমার বুকের ভেতরটা কাঁপে। আমার বেলায় যদি এরকম হত মা! আমি চাইনা এরকম কোনও কদর্য দৃশ্য দেখতে। তার চেয়ে পাশের ঘরে টেলিভিশনের শব্দ, আর হৈ হুল্লোড় আনন্দের শব্দ শুনতে শুনতে আমি একা একা নিঃশব্দে মরেও শান্তি পাবো, যদি জানি যারা আনন্দ করছে তাদের কাউকে আমি চিনি না, তারা কেউ আমার আত্মীয় নয়, তারা কেউ স্বজন নয়, কাউকে আমি কোনওদিন ভালোবাসিনি। আপন নয় তারা, যদি আপন হতো, দৃশ্য অন্যরকম হতো।
.
ধীরে ধীরে, সামান্য যা খেতে, তাও বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, টের পাচ্ছি। খুব কষ্ট করে গিলতে হয় যা কিছুই খাও। সুপ খেলেও, জল খেলেও। কিছু পেটে পড়লেই পেটের ভেতর তোমার সেই ভিসুভিয়াস ফুঁসে ওঠে। তারপরও যুদ্ধ করে যাচ্ছিলে, তোমার ওই একার যুদ্ধ। তোমার জন্য স্যালাইন এনে রেখেছি, অক্সিজেন এনেছি, ব্যথা কমানোর পেথিডিন এনেছি। ধীরে ধীরে তুমি যে কী কঙ্কালের মতো হয়ে যাচ্ছিলে মা! আমি জানি না তোমার সামনে আয়না ধরেছিলাম কিনা দেখতে। তুমি নিজেই হয়তো বুঝতে পাচ্ছিলে। আমার আবার কী রোগ হয়েছিলো জানিনা, প্রায়ই ক্যামেরা নিয়ে দাঁড়াতাম তোমার ছবি তুলতে। বাবাকে পাশে বসিয়ে ছবি তুলছি, তোমার একার ছবি, তোমার রুগ্ন পাণ্ডুর মুখের ছবি, তোমার কঙ্কালসার শরীরের ছবি। কেন তুলছিলাম মা? তুমি চাইতে না ছবি তুলতে। তুমি বাধা দিতে। একবার জিজ্ঞেস করেছিলাম কেন চাইছো না? তুমি করুণ কণ্ঠে বলতে, এখন তো দেখতে আমি ভালো না, এখন ছবি তোলোনা। সম্ভবত চাইতে না তোমার ওই চেহারার মাকে আমরা দেখি। আমি বুঝিনি তখন। ঠিকই বলতে, তোমার ওসব ছবির দিকে এখন তাকাতে পারি না। ও তো তুমি নও, অন্য কেউ। যখন সুস্থ ছিলে, হৃষ্টপুষ্ট ছিলে, যুবতী ছিলে, বাড়ির সবার ছবি তুললেও তোমার ছবি আমরা কেউই তুলিনি। হঠাৎ করে মৃত্যুশয্যায় রুগ্ন মায়ের ছবি তুলতে উগ্রীব। সারাজীবন ভুল করে শেষ দিনে এসে শোধরাতে চাইলে সব ভুল শোধরানো যায় না! বড় দেরি হয়ে যায়। যখন সুস্থ ছিলে, হাতে গোনা। তখনকার দুএকটা ছবি ছাড়া তোমার আর কোনও ছবি নেই কোনও অ্যালবামে। যা আছে, তাও তোমার একার ছবি নয়। অনেকের সঙ্গে তুমি। সুহৃদকে গোসল করাচ্ছো, বা পড়াচ্ছো। আসলে ও ছবি তোমার জন্য তোলা হয়নি, সুহৃদের জন্য হয়েছিল। বা ওর জন্মদিনের কেক কাটার সময় আর সবার মধ্যে তুমিও আছে। সবসময়ই দূরে, কিনারে, অর্ধেক কাটা পড়েছে, ইনসিগনিফিকেন্ট ক্যারেকটারের মতো। তোমাকে ওঠানো হতো না, তুমি অ্যাক্সিডেন্টালি উঠে যেতে।
.
হাশেম মামাকে ভালোবাসতে তুমি খুব। কাকে ভালো বাসতে না বলল। হাশেম মামার ক্যানসার ধরা পড়ার পর তুমি পাগলের মতো কেঁদেছো। তোমার মতো এত তো কেউ কাঁদেনি। তোমার ছোট ভাই, তার ক্যানসার তুমি মেনে নিতে পারোনি। হাশেম মামা আমাকে খুব স্নেহ করতো, আমি ঢাকা থেকে এলেই চলে আসতো আমার কাছে আমার নতুন কী বই বেরিয়েছে, নিতে। হাশেম মামা তুমি নিউইয়র্কে থাকাকালীনই মারা গেছে, খবরটা তোমার কাছে আমরা সবাই ইচ্ছে করেই লুকিয়েছি, জানলে তুমি কষ্ট পাবে তাই। কী দরকার কষ্টের এক দুঃসহ বোঝার ওপর নতুন কষ্টের বোঝা উপুড় করার। জেনে কী লাভ তোমার! এমন তো নয় যে, একদিন সুস্থ হয়ে উঠবে, আর নানিবাড়ি গিয়ে আবিষ্কার করবে হাশেম মামা নেই। আমরা তো সবাই জানি যে এরকম কোনও ঘটনা আদৌ ঘটবে না। আমরা তো সবাই জানি দিন দিন তুমি শরীরের সব শক্তি হারিয়ে ফেলছো, তুমি মিশে যাচ্ছো বিছানায়, উঠে বসারও শক্তি তোমার নেই, তুমি একটু একটু করে চলে যাচ্ছো, একটু একটু করে তোমার চেতন হারাচ্ছে, তুমি তলিয়ে যাচ্ছো, তুমি ফিরছো না। তুমি যে ফিরবে না, সে তো সবাই জানি। তোমাকে যদি না জানানো হয় হাশেম মামার মৃত্যুর খবর, তাতে তোমার কোনও ক্ষতি হওয়ার নেই কিছু। মৃত্যুর সঙ্গে যুদ্ধ তুমি করছো, তোমার প্রিয়জনের মৃত্যুর খবর তোমাকে দিয়ে তোমাকে কি আরও শক্তিময়ী করতে পারবো! কী করবে তুমি হাশেম মামার মৃত্যুর খবর জেনে? কী লাভ হবে তোমার! রুনু খালার স্বামী রাসু খালু একদিন এসে বসেছিলো তোমার সামনে। দিব্যি বলতে লাগলো, হাশেম ভাই যেদিন মারা গেল, সেদিন তো আমি.. কোনও দরকার ছিল না তোমাকে ওই গল্প শোনানোর। আসলে কারও মৃত্যুতে এই টুপি দাড়িঅলা মানুষগুলোর কোনও কষ্ট হয় না। তারা বিশ্বাস করে মৃত্যু মানে আল্লাহর কাছে যাওয়া। হাশেম মামা মারা গেছে এই খবরটা শোনার সঙ্গে সঙ্গে তুমি চমকে তাকালে আমার দিকে। কী যে অসহায় তুমি তখন! কী যে বোবা দৃষ্টি তোমার। মুহূর্তে আচমকা এক গাদা অন্ধকার তোমার ক্রমশ অন্ধকার হতে থাকা জগৎকে কোথাও ভাসিয়ে নিয়ে গেল। আমি আর বলতে পারিনি যে রাসু খালু মিথ্যে কথা বলছে। বলতে পারিনি হাশেম মামা বেঁচে আছে এবং ভালো আছে। কারণ মিথ্যে হলে রাসু খালু ওভাবে বলতো না। আমি তোমার বিছানার পাশে হাঁটু গেড়ে বসে বললাম, মা, হাশেম মামা খুব কষ্ট পাচ্ছিল, হয়তো এ তার জন্য ভালোই হল যে ওই ভয়ংকর কষ্ট আর তাকে পেতে হচ্ছেনা। কষ্ট থেকে মুক্তি পাক হাশেম মামা, তুমি তো চাও, তাই না মা? অত কষ্ট মামা আর সইতে পারছিলো না। কী আর বলবো মা, কী বলে সান্ত্বনা তোমাকে দেব। আমি জানি না কতটুকু কী বুঝলে তুমি, তুমি শান্ত মেয়ের মতো শুয়ে পড়লে, ভেতরে কী হচ্ছিল তোমার, কী রকম যন্ত্রণা, জানি না। তোমার চোখের কিনার বেয়ে গড়িয়ে পড়ছিল অবিরল জল। তুমি কি তখন ভাবছিলে যে, তোমার কষ্ট থেকে তোমার মুক্তি হোক, সেও আমি মনে মনে চাইছি! মানুষ ঠিক ওরকম অবস্থায় মনে মনে কী ভাবে, আমার পক্ষে সম্ভব নয় অনুমান করা। মৃত্যুর নিশ্বাসের কাছে বসে দেখতে হবে কী ভাবছি আমি। জানি না, মা, তখন কি অন্য কারও মৃত্যুর জন্য কান্না পাবে আমার? নিজেই যখন যাচ্ছি, কে গেছে বা যাচ্ছে, তার কথা ভেবে আমি কি কাঁদবো! আমি কি বাঁচবো যে সে ছাড়া আমার খালি খালি লাগবে। কেন কাঁদছিলে মা? হাশেম মামার মৃত্যু তুমি সইতে পারছিলে না কেন মা? তোমার নিজের মৃত্যুর চেয়ে অন্যের মৃত্যু তোমাকে কাঁদায় কেন বেশি মা? কেন তুমি আমাকে বিরক্ত করার চেয়ে নিজের মৃত্যুকেই বেছে নিলে, মা? বাবা বিরক্ত হত, দাদা বিরক্ত হত, নিজের চিকিৎসার জন্য সামান্য সাহায্য চেয়ে তাই ওদের বিরক্ত করতে চাওনি আর। তাই আমার কাছে গিয়েছিলে, দেখলে তোমার অসুখের কথা শুনে আমিও বিরক্ত হচ্ছি। তাই আমাকেও চাওনি বিরক্ত করতে। নিজের অসুখ নিয়ে নিজেই একা পড়ে রইলে। বিরক্ত হওয়া থেকে আমাদের বাকি জীবনের জন্য বাঁচালে। পারো কি করে? জীবন তো তুমি জানতে একবারই আসে। যত ধর্মকর্মই তুমি করো না কেন, ভেতরে ভেতরে তো বুঝতে এই জীবনের পরে আসলে আর কোনও জীবন নেই।
অবকাশের কালো ফটকে তালা দিয়ে বাবাকে আটকে রাখতে চেয়েছিলাম বাড়িতে। আমার ধমক, ভয় দেখানো, রাগ হওয়া কিছুই কাজ করেনি। যে করেই হোক বাবা যাবেই। তালাবন্ধ করে আর যাকেই যায়, বাবাকে আটকে রাখা যায় না। নিউইয়র্কে আর ঢাকায় তোমার পাশে যে বাবা ছিল দিন রাত, মনে হয় না এই বাবাই সেই বাবা। সব ভুলে আগের দিনের মতো বাবা চেম্বারে রোগী দেখায় ব্যস্ত হয়ে পড়লো। আমি শত চেষ্টা করেও বাবাকে থামাতে পারিনি। তোমাকে বলিওনি বাবা সেই আগের মতো দিব্যি সুটেড বুটেড হয়ে চিরকালের মতো বাইরে যাচ্ছে। তুমি কি খেয়াল করেছো বাবা এসে কাছে আর খুব একটা বসছেনা। উঁকি দিয়ে তোমাকে দেখে চলে যাচ্ছে। কী আশ্চর্য, দুদিন সাহেব হয়ে বসে তোমার সঙ্গে কিছু ছবি তুললো। বিশ্বাস হয়নি এই বাবাকেই নিউইয়র্কের হাসপাতালে ভর্তি করিয়েছিলাম প্রায় ধরে বেঁধে। ডাক্তার সব পরীক্ষা করে ওষুধ লিখে দিলেন। রক্তচাপ কমিয়ে রাখার ঠিকঠাক ওষুধ বাবা কোনওদিন খায়নি। আমি যা হাতে দিতাম, শিশুর মতো তাই খেয়ে নিত। আমি যে কত ভুল ওষুধ দিয়েছি। ডাক্তার লিখে দিয়েছে ওষুধ, কিন্তু কখন খাবে তার সময় লিখে দেয়নি। আমি সেগুলো একসঙ্গে বাবাকে খেতে দিতাম, বাবা খেয়ে নিত, জিজ্ঞেসও করতো না কী দিচ্ছি, কেন দিচ্ছি। আমাকে এত বিশ্বাস ছিল বাবার। এত অসহায় ছিল মানুষটা। ঢাকায় পর্যন্ত অসহায় ছিল। আর ময়মনসিংহে এসেই দিব্যি পূর্ণ তেজ ফিরে পেয়েছে। নিজের রক্তচাপ, ডায়বেটিস আর তোমার অসুস্থতা সব ভুলে বাবা এখন শহরের ব্যস্ত ডাক্তার, আগের মতো। মানুষের মনের শক্তিই বোধহয় সব চেয়ে বড় শক্তি। অন্তত বাবার বেলায়। তোমার মনে যত জোর আনছো, কোনও কাজেই তা লাগছে না। দিন দিন তুমি আরও বেশি দুর্বল হয়ে পড়ছে। বাবার কি এ কদিনেই ক্লান্তি এসে গেছে তোমার সেবা করতে করতে, তোমাকে সময় দিতে দিতে! তা না হলে ময়মনসিংহে ফিরে এসে বাবা কেন এভাবে বদলে গেল। মা, সত্যি কথা বলতে কী, সবাই কেমন যেন ক্লান্তই হয়ে পড়ছিলো। ছুতোনাতায় নিজের জীবনে ফিরতে চাইছিলো। তুমি চলেই যাবে যখন, না হয় চলেই যাও। তোমার জন্য যে সময় নির্ধারিত ছিল, সে সময়ের চেয়ে খানিকটা বেশি বেঁচে ফেলছো তুমি, মানুষ হতাশ হবে না কেন। চারপাশের মানুষগুলোর ক্লান্তি আমি টের পাই। আমারও কি ক্লান্তি আসেনি মা! এসেছে। আমারও মনে হয়েছে, অনেক হল, যে যাবার সে যাক। আমরা, সে যত আপনই হোক, খুব বেশি সময় খরচ করতে চাই না কারও জন্য। ভালোবাসায় আমাদের ক্লান্তি চলে আসে। তুমি কি টের পেয়েছিলে? টের পেয়েছিলে যে আমরা কেউ আর তুমি আরও দীর্ঘদিন বেঁচে থাকো, চাইছিলাম না! টের না পাওয়ার কিছু তো ছিলো না। ধীরে ধীরে তুমিও লক্ষ করছিলে, দূর থেকে যারা এসেছে, তারা তোমাকে শেষ বিদায় জানিয়ে গেছে। কাছে যারা ছিল, তাদের উপস্থিতির ঘনত্ব দিন দিন কমছে। তুমি কি আমার মুখেও টের পেয়েছিলে, ক্লান্তি! তোমার কাছ থেকে বারবার আমি উঠে চলে গিয়ে অন্য কোথাও বসে গল্প করছি। আমারও আর ভালো লাগছেনা এভাবে মৃত্যুর সঙ্গে গায়ে গা লাগিয়ে বসে থাকতে, মৃত্যুর মতো নির্মম কিছুকে এত পলকহীন চোখে বেশিদিন দেখা যায় না। আমারও ইচ্ছে করছে নিজের জীবনে, জীবনের উৎসবে, উচ্ছলতায় ফিরে যেতে। এক বিকেলে বাড়ির কয়েকজনকে নিয়ে যেদিকে দুচোখ যায়, সেদিকে চলে যেতে যেতে দিব্যি হালুয়াঘাট থেকে ঘুরে এলাম। মুক্তি তো চাইছিলামই। বিদেশ থেকে আমন্ত্রণ এলে, ভেতরে ভেতরে আমার খুব লোভ হচ্ছিল যাওয়ার। ফ্রান্সের জাতীয় সংসদে বক্তৃতা করার আমন্ত্রণ। অনেকগুলো ফোন পেয়েছিফ্রান্সের রাষ্ট্রদূতের। ফরাসি সরকারের এই আমন্ত্রণ রক্ষা করার জন্য আমাকে ক্রমাগতই অনুরোধ জানানো হচ্ছে। আমি বলে দিয়েছিলাম, আমার মার অসুখ, কোথাও এ সময় আমি যেতে পারবো না। পরে আবার একদিন মনে হয়েছে, দুদিনের জন্য ঘুরে এলে কী এমন ক্ষতি। না, মা, এই লোভ আমি সামলাতে পারিনি। এমনকী বাবাও অবাক হয়েছে আমার গোপন পরিকল্পনার কথা জেনে, যে বাবা সবসময় চাইতো বিদেশের সম্মানগুলো নিতে যেন কোনও আলস্য না করি। যেদিন তোমাকে বললাম, খুব বড় আমন্ত্রণ এসেছে ফ্রান্স থেকে, না গেলেই নয়, কদিন পরই ফিরে আসবো। তুমি করুণ চোখে তাকিয়েছিলে আমার দিকে। সেই চোখে বিস্ময়ও ছিল। তুমি হয়তো বুঝে পাওনি কী করে আমি তোমাকে ছেড়ে চলে যেতে চাইছি। কী করে অন্য কোনও কিছু, সে যত বড় আমন্ত্রণই হোক না কেন, মত্যুশয্যায় পড়ে থাকা মায়ের চেয়ে বড় হল। মাঝে মাঝে ভাবি কেন আমি তোমাকে ছেড়ে চলে যেতে চাইছিলাম, বড় বড় আমন্ত্রণে কি আমি এ যাবৎ কম রক্ষা করেছি! জীবনে কি বিশাল সব মঞ্চে আমি কম বক্তৃতা দিয়েছি! কেন আমি তোমাকে ওই আজ আছে কাল নেই অবস্থায় ফেলে অন্য কোথাও বেড়াতে যাওয়ার কথা মনে এনেছিলাম। নিজেকে ক্ষমা করতে পারি না। নিজেকে ক্ষমা করা আমার সম্ভব নয়। তোমাকে যে আঘাত দিয়েছিলাম, সে আঘাত তুমি নিভে যেতে থাকা জীবনে ধারণ করতে বাধ্য হয়েছিলে, প্রকাশ করোনি কিন্তু বিস্ময় বোধটা তুমি লুকোতেও পারোনি। অবশ্য তারপরই মাথা নেড়ে বলেছিলে যেতে, যেন যাই, বড় আমন্ত্রণে যেন যাই আমি। আমাকে সুখ দিয়েছিলে মা। যতটুকু উদার তুমি হতে পেরেছিলে, আমি কেন তার ছিটেফোঁটাও হতে পারিনি। শেষ অবদি আমি যাইনি কোথাও, কিন্তু যেতে তো চেয়েছিলাম, যেতে চাওয়ায় এবং যাওয়ায় কতই আর পার্থক্য!
যে তুমি বাঁচতে ভালোবাসতে, সেই তুমিই চাওনি আমার কোনও কষ্ট হোক তোমার জন্য। তুমি এমনকী যে মৃত্যুর সঙ্গে যুদ্ধ করছিলে প্রাণপণে, আমার ক্লান্তি বা কষ্টের কথা ভেবে তুমি তোমার নিজের মৃত্যু কামনা করলে। আমাকে মুক্তি দিতে চাইলে তোমার নিরন্তর সেবা থেকে। আমার ক্লান্তি থেকে। অবকাশেও যখন তোমাকে আমার সাহায্য করতে হলো মলত্যাগে, তুমি ভেবেছো আমার নিশ্চয়ই ঘেন্না হচ্ছে এসবে। তুমি সইতে পারোনি। একদিন শুধু বলেছো, তোমার এই কষ্ট আমি আর সইতে পারছি না। আল্লাহর কাছে বলে আমাকে যেন নিয়ে যান। না, মা। ও কারণে আমার কোনও কষ্ট হয়নি। সম্ভবত কষ্ট হয়নি এই ভেবে যে, এ তো আর দীর্ঘদিনের জন্য নয়। নিজের পাপের প্রায়শ্চিত্ত আমি করছিলাম, নাকি যা কিছু করছিলাম, করছিলাম তোমাকে ভালোবাসি বলে! মাঝে মাঝে ভাবি, বোধহয় প্রায়শ্চিত্তই করছিলাম। প্রায়শ্চিত্ত করতে বেশিদিন মানুষের ভালো লাগেনা। ভালোবাসলে কোনও ক্লান্তি আসতো না, ভালোবাসলে গোপনে গোপনে নিস্তার চাইতাম না। কত মানুষ এই পৃথিবীতেই আছে, যারা মাথা নষ্ট হওয়া, শরীর স্থবির হওয়া, বিছানায় পড়ে থাকা মাকে বছরের পর বছর, যুগেরপর যুগ সেবা করে যাচ্ছে, কোনও ক্লান্তি নেই, কোনও অভিযোগ নেই। তারা ভালোবাসে বলেই পারে। আমি সেই ভালোবাসা কোথায় পাবো মা! তোমার জন্য জন্ম থেকেই তা ছিলো না। হঠাৎ করে জন্মাবে কী করে, আমার দোষে তোমার অসুখ হয়েছে বলে! করুণা হয়েছে, মায়া হয়েছে, মমতা বোধ করেছি, আহা আহা করেছি। কিন্তু ভালোবাসা তীব্র ছিলো না বলে ওই অল্প সময়টুকুকেই দীর্ঘ দীর্ঘ বলে মনে হয়েছে। দিন হিসেব করেছি। ডাক্তারের দেওয়া তিন মাস পার হয়ে গেলে বিস্মিত হয়েছি। একটি দিনের বেশি হওয়াও হিসেবে রেখেছি। এসব অজান্তে ঘটেছে মা। আমার নিজেরই অজান্তে। আমার উদার ব্যক্তিত্বের ভেতরে বসে থাকা অনুদার স্বার্থপর আমিটিকে আমি ফাঁকি দিতে পারিনি। তোমার মহানুভবতার সামনে আমি অতি তুচ্ছ, অতি ক্ষুদ্র এক জীব। যেটুকু ভালো আমার, সেটুকু তোমার কারণে, যেটুকু মন্দ আমি, আমার কারণে।
তোমার শরীরের শক্তি দ্রুত ফুরোচ্ছিল। আজ তুমি পা নাড়াতে পারছো, কাল পারছে না। দুপুরে এপাশ ওপাশ করলে, বিকেলে আর সেটা পারলে না। তোমাকে দেখছিলাম আমি। লক্ষ করছিলাম তোমার শক্তি ফুরোনো। এ নিয়ে বাবার সঙ্গে কথা বলেছি, দাদা আর হাসিনার সঙ্গেও বলেছি। কাউকে সামান্য উদ্বিগ্ন হতে দেখলাম না। সম্ভবত তারা উদ্বিগ্ন তুমি এত সময় নিচ্ছো কেন মরতে, সম্ভবত তাদের আশংকা এভাবেই তোমার আবার আরও কয়েক মাস, আরও কয়েক বছর কেটে যায় কিনা। এরাই তো সেই মানুষ, যাদের সেবায় তুমি জীবন উজাড় করে দিয়েছিলে। তোমাকে দেখার আর কেউ ছিল না। তোমার মাথার কাছে বসে থাকতো নানি, বসে বসে কোরান পড়তো। কোরান পড়ে কোনও লাভ নেই জানি, তুমি সুস্থ হবে না। তারপরও আমি বাধা দিইনি। তুমি তো জীবনের অনেকটা সময় কোরান পড়েছো মা, নানি তার ভালোবাসা কী করে প্রকাশ করবে, নানি তো অন্য কিছু শেখেনি। কোরানইশিখেছে, তাই কোরানই পড়ছে। বাকি যারা আসতো তোমাকে দেখতে, টুটু মামা, আর মাঝে মাঝে শরাফ মামা। টুটু মামা তো শেষ দিকে রাত জেগে তোমার বিছানার সামনে বসে নামাজ পড়তো, দোয়া দরুদ পড়তো। মিলাদপড়ার মতোও দাঁড়িয়ে ইয়া নবি সালাম আলায়কা, ইয়া রসুল সালাম আলায়কা বলতো। আমিও দাঁড়াতাম ওদের সঙ্গে, তোমার সঙ্গে যেমন ছোটবেলায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে, হাত দুটো পেটের কাছে মুড়ে রেখে জোরে জোরে বলতাম ওগুলো, যে কথাগুলো কোনওদিন বুঝিনি। নাস্তিক হয়েও কেন আমি দাঁড়াতাম মা! তুমি যেন আমাকে দেখে খুশি হও? তুমি কি খুশি হতে মা? কতটুকু চোখ মেলতে পারতে আর তুমি, কতটুকু দেখতে পারতে, কতটুকু সুখের অনুভব তোমার তখন আছে? তারপরও আমার মনে হত, যদি থাকে, সামান্যও যদি থাকে, তুমি খুশি হও, একবার জীবনে তোমার নাস্তিক কন্যার বোধোদয় হয়েছে ভেবেও সুখপাও। সে সুখ মিথ্যে হলেও পাও। জীবনের শেষ মুহূর্তে অন্তত কিছুসুখ তুমি পাও। মাঝে মাঝে আসতো ছটকু, ফেলু মামা। ফেলু মামাকে দিয়ে তো তোমার স্টিলের আলমারিটা রং করিয়ে আনলাম। তোমাকে দেখতে বললাম আলমারির গোলাপি গোলাপি রংটা চমৎকার হয়েছে কীনা। একটু ঘাড় পেছনে নিয়ে দেখেছিলে মা। ওটিও তোমাকে সুখ দেওয়ার জন্য। তোমাকে বললামও, এই আলমারিতে এখন থেকে তোমার সবকিছু সুন্দর করে সাজিয়ে রাখবে মা, ঠিক আছে?
তুমি মাথা নেড়ে বললে, হ্যাঁ ঠিক আছে।
তুমি তো সুস্থ হয়ে উঠবে মা।
এ কথা শুনে তোমার ওই ক্লান্ত চোখ দুটোকেও স্বপ্নের জল এসে উজ্জ্বল করে তুলতে। জানি না তুমি বিশ্বাস করতে কী না। বিশ্বাস হয়তো হতে চাইতো না, কিন্তু তারপরও বিশ্বাস করতে হয়তো ভালো লাগতো। আমি ঠিক জানিনা ঠিক কী ভাবতে তুমি। মৃত্যুর অত কাছাকাছি চলে এলে কী রকম ভাবনা মানুষের মনে আসে, তা আমার জানা নেই। অসুখ ধরা পড়ার পর তুমি তো মৃত্যু শব্দটির নাম গন্ধ সইতে পারতে না, উচ্চারণ করতে না। সচেতন ভাবেই হয়তো করতে না। তুমি কি বিশ্বাস করতে চাইতে না তুমি যে সত্যি সত্যি মারা যাচ্ছো, নাকি তুমি প্রচণ্ড মনের শক্তি দিয়ে বেঁচে উঠতে চাইতে বলে অলক্ষুণে মৃত্যুর নামোচ্চারণ করতে না, নাকি মারা যাচ্ছো জেনেও তোমার প্রিয়জনকে বোঝাতে চাইতে না যে তুমি বুঝতে পারছো যে মরছে, ভাবতে প্রিয়জনেরা কষ্ট পাবে ভেবে যে তুমি জেনে গেছো গোপন ব্যাপারটি, জেনে তোমার কষ্ট হচ্ছে। আমার মনে হয় না তোমাকে অত কেউ কোনওদিন ভালোবাসতো যে তোমার কষ্টের কথা ভেবে কষ্ট পাবে। সারাজীবন কেউ বাসেনি জানেনা। হয়তো ভেবেছিলে, মরে যাচ্ছে বলে বুঝি ভালোবাসা জাগবে। না মা, যে সারাজীবনে ভালোবাসেনি, চোখের সামনে মরছো দেখলে তোমার জন্য তাদের ভালোবাসা উথলে ওঠার কোনও কারণ নেই। বেঁচে থাকলেও তোমার মৃত্যু চেয়েছে, মরতে থাকলে তো আরও চাইছে, দেরি সইতে পারছে না। তোমার কি কষ্ট হচ্ছে শুনতে? তুমি তো সব কিছুর ঊর্ধ্বে এখন মা, কষ্ট যন্ত্রণা এগুলো তোমাকে আর স্পর্শ করতে পারে না। পারবে কেন, তোমার নাগালই কেউ এখন আর পাবে না, পাবে না কারণ জলে স্থলে অন্তরীক্ষে তুমি আর নেই এখন। কোথাও নেই তুমি না থাকা মানুষের আবার দুঃখ কী। আমিও তো তোমার মতো না-থাকা হয়ে যাবো, দিন তো আসবেই কোনও না কোনও দিন। দিন তো সবারই আসে, আমার কেন নয়! তোমার অন্তত এইটুকু সান্ত্বনা হোক মা, তোমার মৃত্যু দেখে দেখে যাদের মনে হয়েছে, তুমি অভাগা তাই মরছে, তাদেরও মৃত্যুর সময় হবে মা। তারাও যাবে, তারাও চোখ বুজবে। মাঝে মাঝে মনে হয় কেন আমি তোমাকে ওই অবকাশে নিয়ে গিয়েছিলাম, অবকাশ নামের বাড়িটিতে তোমার মৃত্যু হোক, কেন চেয়েছিলাম আমি? ওই বাড়িতে তিরিশ বছরের স্মৃতি তোমার। কিন্তু তোমার সেই স্মৃতি তো মধুর নয়, মা। যে বাড়িতে তোমাকে অপমান করেছে তোমার স্বামী, বছরের পর বছর, প্রতি দিন, যে বাড়িতে তোমার পুত্র কন্যারা তোমাকে অবজ্ঞা করেছে, তোমার পুত্রবধূরা তোমাকে লাঞ্ছিত করেছে, সেই বাড়ির কোনও একটি ঘরের কোনও একটি বিছানায় শুয়ে তোমার মৃত্যু হোক, এই বা আমি চেয়েছিলাম কেন? আমি যে কথাটা ভেবে তোমাকে ময়মনসিংহেনিয়েছিলাম, সেটি হল, তোমার এতকালের পরিচিত চেনা মানুষগুলোর সঙ্গে তোমার দেখা হবে। বাকি আত্মীয়দের সঙ্গে দেখা হবে। তোমাদের বাড়ির পাশের বস্তি থেকে তইতই, তেঁতুর মা, আর আরও আরও তোমার চেনা বান্ধবীদের ডেকে ওদের তোমার বালিকাবেলার গান গাইতে বলেছি, ওরা গেয়েছে, তুমি শুনেছো, শুনে তোমার মুখে হাসি ফুটেছে, ওই হাসিটুকু তুমি হাসো, তোমার একটুখানি ভালো লাগুক চেয়েছি। আমি নিজেই বলেছি ওদের সবার হাতে টাকা দিয়ে দাও। গুনে তোমার হাতেই দিয়েছি টাকা, যেন তোমার হাতেই ওদের দাও। কারও কারও জন্য বলেছি, আরও কিছু দাও মা। একটুও দ্বিধা করো না। যত ইচ্ছে করে দিতে, দাও। কোনওদিন তো চাইলেও দিতে পারোনি। মানুষের দারিদ্র্য দেখে তোমার হৃদয় কাঁদতো, তোমার নিজের দারিদ্র্যের চেয়েও অন্যের দারিদ্র্য তোমাকে কাঁদাতো বেশি। সাহায্য করতে চাইতে। কিন্তু কী করে কোত্থেকে তুমি কাকে পয়সা দেবে। তোমাকেই কে দেয়! তোমাকে তো উপার্জন করতেও কেউ দেয়নি। নিজের পায়ে দাঁড়াবার ইচ্ছে তোমার মতো আর কাউকে দেখিনি। তবুও নিজের অনিষ্ট করে হাতে যা কিছুই ছিল তোমার, আটআনা বা একটাকা, একটাকা বা দুটাকা, হয়তো রিক্সাভাড়াই ছিল, দিয়ে দিয়েছে। হেঁটে বাড়ি ফিরেছো। রোদ্দুরে ভিজতে ভিজতে ক্ষিধে তৃষ্ণায় ভুগতে ভুগতে মাইলের পর মাইল হেঁটেছে। আর জীবনে প্রথম পাঁচশ টাকা হাজার টাকা ওই গরিব দুঃখী সইসাথীদের দিতে পেরে তোমার কি একটু, সামান্য একটু শান্তি হয়েছিল মা! ওটুকুই চেয়েছিলাম। বাড়ির অন্যরা, বাবা দাদা আর হাসিনা তিনজন তো কানে কানে কথা বলে আর কটাক্ষ করে আর মুখ টিপে হাসে, বাড়িতে করছি কী আমি! কিসের হাট বসিয়েছি! গরিব গরিব লোক ডেকে আনছি বস্তি থেকে, মাথা টাথা নিশ্চয়ই আমার মায়ের মতোই আমার গেছে। কদিন আর? এই একটিই সান্ত্বনা তাদের, বেশিদিন নয়। কালো ফটক পেরিয়ে গরিবগুলো রীতিমত ঘরের ভেতর ঢুকে মার বিছানার কাছে পেতে দেওয়া শীতল পাটিতে বসে পুরোনো দিনের সুখের স্মৃতিচারণ, গান গাওয়া, হাসি আনন্দ-কদিন আর? এই তো শেষ নিঃশ্বাসের সময় হল বলে। বাবা কি হাসিনাকে খুশি করতে হাতের আঙুল গুনে দিন বলে দেয়, আর কদিন! বাবা তো বোঝে কদিন। আমার চেয়েও বেশি বোঝে, কদিন। আমার চেয়েও হাজারগুণ অভিজ্ঞ ডাক্তার আমার বাবা। নাড়ি না টিপেও বলে দিতে পারে নাড়ির খবর।
.
মা, জগৎটা যে কী নিষ্ঠুর, তা নিজেই তো দেখেছো। তোমার আদরের ধন কামালকে পাওনি খুব বেশি বছর, অল্প বয়সে বিয়ে করে গীতার সম্পত্তি হয়ে গিয়েছিল, সেই আদরের ধনকে প্রাণ ভরে সেবা করার জন্য হাতের কাছে জীবনের শেষ কটা বছর পেয়েছিলে তুমি। কী ভালোই না বাসতে। অথচ মা, আমি তোমার সেই আদরের ধনকে চেয়েছি তোমার কাছে এসে বসুক, একটু তোমার সুখ হোক। ঢাকায় যখন শয্যাশায়ী তুমি, ছোটদাকে শত বলেও বসাতে পারিনি কাছে। ছোটবেলা থেকে ছোটদার টাকা পয়সার প্রতি প্রবল আকর্ষণের কথা আমরা সবাই জানি। জানা জিনিসকে মুখে বললে এত বিচ্ছিরি শোনায় কেন জানি না! একবার শান্তিনগরের বাড়িতে তোমার জন্য একটা ওষুধ আনতে বলেছিলাম, দু তিন টাকা বোধহয় দাম। সেই টাকাও সে বললো আমাকে দিতে। আমি অবাক হয়ে ভাবলাম, নিজের মায়ের ওষুধের জন্য নিজের পকেট থেকে দুটো টাকাও সে খরচ করতে চাইছে না! সেই ছোটদা কেন আসবে তোমাকে দেখতে ময়মনসিংহে। একবার খুব হাতে পায়ে ধরে অনুরোধ করে আনলাম বটে, এসেই বলে দিল তার প্রচণ্ড ব্যস্ততা, তার ফ্লাইট, তার নানা কিছু। তার সময় নেই ময়মনসিংহে আসার, তার সময় নেই সময় নষ্ট করার। বলেছিলাম, তুমি এসেছো দেখলে মা তো খুশি হয়, মাকে শেষ সময়ে কিছু খুশি দাও। ছোটদার কথা, তোমার জন্য সব সে করেছে, কিছুই করিনি আমি। সব টাকা সে খরচা করেছে, কয়েক লক্ষ টাকা এর মধ্যে তার খরচ হয়েছে, কিছুই করিনি আমি। তোমার স্বপ্ন পূরণ সে করেছে, আরব দেশে নিয়ে উমরাহ করিয়ে এনেছে। না, এর বেশি তোমার জন্য ছোটদার করার কিছু নেইও, ইচ্ছেও নেই। এই তার শেষ কথা। শেষ কথা সে চিৎকার করে জানিয়ে দিল, অবকাশের দেয়াল ফাটিয়ে জানিয়ে দিল। সব পাশের ঘর থেকে শুনলে তুমি। ছোটদা হিংস্র জানোয়ারের মতো চেঁচায়, যখন চেঁচায়। কিছু কিছু মানুষ মনে করে চেঁচিয়ে কিছু কথা বললে, সেই কথা সত্য বলে প্রমাণিত হয়। আসলে জঘন্য মিথ্যেও যে জোর গলায় চেঁচিয়ে বলা যায়, আর তা যে মাথায় যাদের ঘিলু বলে পদার্থ আছে তা জানে, তা তারা জানে না। সময় ছোটদার অঢেল আছে মা, সময় নেই শুধু তাদের জন্য, যাদের জন্য সময় কাটাতে তার ভালো লাগে না। ভালো লাগে মদের আড্ডা, ভালো লাগে মেয়ে পটানো। গীতার বশংবদ ভত্যের এই হাল। ছোটদার জন্য সেই ছোটবেলা থেকে আমার মায়া। শুধু আমার কেন, তোমার, ইয়াসমিনের, সবারই মায়া। বাড়িতে আমরা, বিশেষ করে আমি সবচেয়ে বেশি ভালোবাসতাম ছোটদাকে। লেখাপড়া শেষ না করে বিয়ে করে প্রথম দিকে খুব টাকাপয়সা ছিল না বলে মন খারাপ থাকতো ছোটদার, সেই মন খারাপ ছোটদা এখন বিরাট টাকা পয়সার মালিক হয়েছে, কিন্তু আমাদের সবার সেই আদর এখনও তার ওপর একই রকম বর্ষিত হয়। বাবাও ছোটদা বলতে পাগল। চোখের আড়ালে বেশি থাকলে বা দূরের শহরে বাস করলে যা হয়, আদরটা বেশি জোটে। ছোটদার তাই জুটতো। এখনও তাই জোটে। আমি হয়তো অত সহজে অন্তরীণ থাকা অবস্থায় যেভাবে ছোটদাকে ব্যাংকের যাবতীয় টাকা তোলার অধিকার দিয়েছিলাম, অমন আর কাউকে দিতেপারতাম না। কেন যে বিশ্বাস করতাম এই ছোটদাকে, বিশ্বাস বারবার ভেঙেছে, তারপরও। আসলে যে বিশ্বাস ভাঙে তার দোষ নয়, যে বিশ্বাস করে তার দোষ। ছোটদার ব্যবহারে জানিনা তুমি কষ্ট পেয়েছিলে কি না। শেষের দিকে কষ্টের বোধ তোমার হয়তো আর ছিল না। ছোটদা এক বিকেলে, ওই একটি বিকেলেই তোমারপাশে বসেছিল, মাথায় টুপিপরে সে কোরানপড়ছিল। সে যে কোরান পড়তে জানে তা আমার জানা ছিল না। ইদানিং জুইয়ের সঙ্গে মিশে সম্ভবত শিখেছে। জুই খুব ধার্মিক শুনেছি। ওই একদিনই ছোটদাকে পেরেছিলাম তোমার পাশে বসাতে। কোরান থেকে জানি না কী পাঠ করলো জোরে জোরে, কী যে সেদিন ভালো লেগেছিলো ছোটদা তোমার কাছে বসেছে বলে। ছোটদার মতো ছোটলোককে সেদিন আমি ক্ষমা করে দিয়েছি, যেহেতু তার ওইটুকুপাশে বসা দিয়ে তোমাকে ভালো লাগা দিয়েছিলো। ছোটদার জুইকে বিয়ে করা, কোরানপড়া, এসবের পেছনে আছে একরাতের এক দুর্ঘটনা। সে রাতে ছোটদা গাড়ি চালাচ্ছিলো, গাড়িতে বসেছিলো জুই আর জুই-এর মা। গাড়ি একসময় কোনও এক রেললাইনের ঠিক ওপরে এসে বন্ধ হয়ে গেল। গাড়ি আর চলছে না, না সামনে, না পেছনে। ঠিক তখনই ট্রেনের শব্দ, তিরের মতো ছুটে আসছে ট্রেন। ছোটদা শুধু চিৎকার করে বললো সবাইকে বেরোতে। জুই বেরিয়ে দৌড়। ছোটদাও। কিন্তু পেছন ফিরে দেখলো গাড়িতে আটকে আছে জুই-এর মা। ছোটদা ছুটে গেল গাড়ির ভেতর থেকে জুই-এর মাকে বের করতে। ট্রেন তখন নাকের ডগায়। টেনে সে বের করে নিয়ে আসে বটে জুইয়ের মাকে, কিন্তু ট্রেনের ধাক্কয় নিজে ছিটকে পড়ে। ছোটদার গাড়ি গুঁড়ো করে দিয়ে ট্রেন চলে যায়। গায়ের হাড়গোড় কিছু ভাঙ্গলেও ছোটদা বেঁচে যায় শেষ পর্যন্ত। জুইয়ের মা ট্রেনের আঘাতে নয় কিন্তু, হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মারা যায় হাসপাতালে। এই মৃত্যু ছোটদাকে আমূল বদলে ফেলে। এত অপরাধবোধে ভোগায় যে জুইয়ের এতদিনকার স্বপ্ন সে পূরণ করে, জুইকে বিয়ে করে। জুইয়ের মার মৃত্যুর জন্য কেন ছোটদা নিজেকে দায়ী করে! যদি সে টেনে তাঁকে বের না করতো গাড়ি থেকে, দুমুহূর্ত পরই নিশ্চিহ্ন হয়ে যেতেন তিনি। আমার মনে হয় না ছোটদা ছাড়া পৃথিবীর অন্য কেউ ট্রেনের ওইছুটে আসার দিকে ঝাঁপিয়ে পড়ে প্রেমিকার মা কেন, নিজের মাকেও বাঁচাতে যেতো।
ছোটদা পরদিনই চলে যায়। তোমার শরীর দ্রুত খারাপ হচ্ছে, ছোটদা যেন আরও পাশে থাকে, যেন চলে না যায়, আমার অনুরোধ ছোটদাকে অবকাশে রাখতে পারে না। আমার টয়োটা গাড়ি নিয়ে আসে, ওই গাড়ি নিয়েই বেরিয়ে যায় ঢাকার পথে। সবাই ভুলে গেছে, এমন কী ছোটদাও, যে, গাড়িটা আমার, ভুলে গেছে শান্তিনগরের বাড়িটাও আমার। সবাই কথাই বলে এভাবে, ‘কামাল তোর গাড়ি কোথায় পার্ক করলি? ’ বা ‘তুমি কি তোমার ঢাকার বাড়িতে সেদিন ছিলে?’ না আমার আড়ালে নয়, বাক্যগুলো আমার সামনেই উচ্চারিত হয়। আমি বুঝি, সময় অনেক কিছু পাল্টে দিয়েছে। আমি এ দেশে এ বাড়িতে, এ পরিবারে অনেকটাই অবাঞ্ছিত। কেবল তোমার কাছেই বাঞ্ছিত, কেবল তুমিই আমাকে সমস্ত জীবন দিয়ে চাইছ, সমস্ত জীবনের বিনিময়ে চাইছ। এই চাওয়ার মধ্যে এক ফোঁটা ফাঁকি নেই।
.
রোজার সময় তখন। টুটু মামা রোজা রাখতো। সারারাত সে নাকি আল্লাহনাম জপ করে। শুনে আমিই তাকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলাম তোমার পাশে রাতভর যেন তাই করে। সন্ধেবেলায় এসে টুটু মামা সারারাত জেগে থাকতো, সকালে বাড়ি চলে যেত ঘুমোতে। টুটু মামার বাড়িতে আসা দাদা পছন্দ করতো না। দাদার কাছ থেকে কবে নাকি টুটু মামা টাকা ধার করেছিলো, সে টাকা আর ফেরত দেয়নি। সে কারণেই টুটু মামার ছায়াও সহ্য হত না দাদার। টুটু মামা টাকা ফেরত দেয়নি। তাতে কী! পারেনি ফেরত দিতে, তাই ফেরত দেয়নি। বাবার কানে টুটু মামা সম্পর্কে যত রাজ্যির মন্দ কথা আছে, দাদা দেয়। বাবার মনও টুটু মামা থেকে সরিয়েছে দাদা। বাবা, আমি লক্ষ করেছি, আগে যেমন মামাদের সঙ্গে গল্প করতো, তেমন আর করে না। হাশেম মামা শুনেছি লিভারের ক্যানসার নিয়ে বাবার চেম্বারে বসে থাকতো। একটু যেন ওষুধ বাবা দেয়। জানি না বাবা কতটুকু সাহায্য হাশেম মামাকে করতো। মামাদের সম্পর্কে বাবার অভিযোগ যত থাক, নিজের কোনও দুর্যোগ এলে মামাদেরই বাবা সবসময় কাছে ডাকতো। হাশেম মামা তোমাকে বলেছিলো আমি যেন তার জন্য কিছু টাকা পাঠাই। আশ্চর্য, মা, কোনও টাকা আমি পাঠাইনি। পরে অবশ্য তার ছেলে সুমনকে পঞ্চাশ হাজার টাকা পাঠিয়েছিলাম, তখন হাশেম মামা আর বেঁচে নেই। হাশেম মামাকে সুইডেনে এনে চিকিৎসা করার জন্য ভিসার ব্যবস্থাও করেছিলাম। হাশেম মামার আর আসা হয়নি। মামার কথা ভাবলে এখনও বুকের ভেতরে একটা চিনচিন কষ্ট হয় আমার। মুক্তিযোদ্ধা ছিল হাশেম মামা। কী সুন্দর দেখতে ছিল। কী রকম সুঠাম সুদর্শন যুবক। টুটু মামার সঙ্গে তার সুন্দরী বউএর কোনও একদিন প্রেম হচ্ছে ধরা পড়ার পর সেই যে হাশেম মামা দাড়ি কাড়ি রেখে উদাস হয়ে গেল, আর ফিরে এলো না হৈ চৈ এ। টুটু মামাকে তুমিও চাইতে থাকুক। সারারাত সে সুর করে করে সুরা পড়ে, সে সুর বড় মধুর লাগে। টুটু মামাকে রাতের শেহরি খাওয়ার ব্যবস্থা নিজের উদ্যোগে করি। তোমাকে যে মনে শান্তি দিতে পারছে, তাকে খুশি করতে আমি তখন সব করতে রাজি। বাবা আর দাদার ধারণা টুটু মামা কোনও বদ উদ্দেশ্য নিয়ে এখানে আসে। ঝুনু খালাও একদিন কানে কানে বলে গেল, টুটু মামা নাকি অসুস্থ হাশেম মামাকে একদিনের বেশি দেখতে যায়নি। তোমার অসুখে তার মতো পাষণ্ডর দুঃখ হওয়ার তো কিছু নেই। এই দুঃখটা নাকি বানানো, এখানে ভেড়ার উদ্দেশ্য, আমার কাছ থেকে বড় অংকের একটা টাকা দাবি করা। না, মা। এসব আমার বিশ্বাসহয়নি। তোমার এগারো জন ভাইবোনদের মধ্যে একজনের সঙ্গে আরেকজনের যেমন বন্ধুত্ব ছিল, শত্রুতাও ছিল, তোমার সঙ্গে কারওরশত্রুতা ছিল না। তুমি সবাইকে ভালোবাসতে। সবাই তোমাকে ভালোবাসতো। টুটু মামার যে উদ্দেশ্যই থাকুক, তার প্রতি কৃতজ্ঞতায় আমার মন ভরে থাকে। তার কাছ থেকে যা পেয়েছি, সে পাওয়া অমূল্য। কোনও টাকায় আমি তার ঋণ শোধ করতে পারবো না। কোনও লক্ষ টাকা দিয়েও না।
.
তোমার চৈতন্য ফিকে হচ্ছে খুব দ্রুত। আগের চেয়ে অনেক বেশি ঝিমোচ্ছো, অথবা ঘুমোচ্ছো। তোমাকে শারীরিক কোনও সুস্থতা দিতে আমি পারছি না। শারীরিক কোনও সুস্থতা দিতে কোনওদিনই পারিনি। তোমার অসুখের দিকে তোমার মৃত্যু হবে জানারপর শুধু ফিরে চেয়েছি। আমি মরিয়া হয়ে উঠছি, যতটুকুসুখী করতে তোমাকেপারা যায়, করতে। জিজ্ঞেস করছি তোমাকে, কাকে কাকে তোমার দেখতে ইচ্ছে করে বলল, কার সঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছে করে, কে কাছে এলে তোমার ভালো লাগবো। তুমি যাদের নাম বলেছে, সবাই দরিদ্র, বস্তির লোক, গ্রামের অভাবী লোক। জ্যোৎস্নাকেতুমি দেখতে চাইলে। জ্যোত্সা একসময় কাজ করতো অবকাশে। ইয়াসমিনের মেয়ে ভালোবাসাকে যখন লালন পালন করতে তুমি, জ্যোৎস্না তোমাকে সাহায্য করতো। জ্যোৎস্নাকে ইয়াসমিনের শ্বশুর বাড়ির কেউ দিয়েছিলো। সানকিপাড়া থেকে ইয়াসমিনের শ্বশুরবাড়ির আত্মীয়দের ডেকে এনে অনুরোধ করলাম, জ্যোৎস্নাকে নিয়ে আসতে। ওরা বললো, সম্ভব নয়। জ্যোৎস্না গ্রামে চলে গেছে, ওর ঠিকানা কেউ জানে না। কিন্তু আমার উপর্যুপরি অনুরোধ যে করেই হোক খুঁজে আনতেই হবে জ্যোৎস্নাকে। লোককে গাড়ি দিয়ে, টাকা দিয়ে একদিন নয়, দিনেরপর দিনপাঠাচ্ছি। গ্রামের বাড়ি বাড়ি গিয়ে জ্যোৎস্নাকে খুঁজতে হবে। জগতের যেখান থেকে হোক, জ্যোৎস্না নামের মেয়েকে নিয়ে আসতে হবে। শেষপর্যন্ত জ্যোৎস্নার খোঁজ মেলে। কোনও এক গহন গ্রাম থেকে ওকে নিয়ে আসা হল। একই রকম কোনও ঠিকানা না জানা ঠিকানায় পাঠিয়ে দিলাম ফকরুলকে, লিলি বা লিলির মাকে খুঁজে আনতে। দুতিন গ্রাম তন্ন তন্ন করেও লিলির মার খোঁজ পাওয়া যায়নি। তুমি জ্যোৎস্নাকে দেখে ঝরঝর করে কাঁদলে। ওকে কাছে ডেকে বুকে জড়িয়ে রাখলে। কোনও একদিন কী কারণে জ্যোৎস্নাকে তুমি মেরেছিলে, তাই তার কাছে আকুল হয়ে ক্ষমা চাইলে। চোখের জলে নিজের মুখ বুক ভিজিয়ে ক্ষমা চাইলে তুমি। জ্যোৎস্নাকে শাড়ি দিলে, টাকা দিলে, যা ওর পাওনা ছিল, তার চেয়েও অনেক বেশি দিলে। জ্যোৎস্নার হাত ধরে জানতে চেয়েছো, ও তোমাকে ক্ষমা করেছে কি না। জ্যোৎস্না খুব অবাক হয়েছে কিসের ক্ষমা, কেন ক্ষমা। লোকের বাড়িতে কাজ করতে গিয়ে লাথিঝাঁটা খেয়েই জীবন কাটে। কেউ তাদের কাছে কোনও অন্যায়ের জন্য ক্ষমা চায় না। ক্ষমা তো আছেই, তারপর না চাইতেই এত টাকা পেয়ে যাওয়া! সবই ছিল জ্যোৎস্নার জন্য অবিশ্বাস্য। ওকে রাতের খাবার খাইয়ে দিতে বললে। বাড়িতে আমি এমন ব্যবস্থাই করেছি। কেউ যেন না খেয়ে না যায়। তোমার আত্মীয় স্বজনের এ বাড়িতে খাওয়ার চল খুব ছিল না। আমি কাউকে না খেয়ে দুপুর বা রাতে যেতে দিচ্ছি না। তোমার ভাই বোন, তোমার যে আত্মীয়ই আসছে, সবাইকে খাওয়াচ্ছি। তোমাকে বলছি, সবাইকে খাইয়ে দিচ্ছি। একদিন শরাফ মামার গোটা পরিবারকেই তোমার বিছানার সামনে শীতল পাটিয়ে বসিয়ে তুমি যেন দেখ, যত্ন করে খাইয়েছি। আমার টাকায় মাছ মাংসের বাজারও তাই করছি, যেন অধিকার থাকে যাকে ইচ্ছে খাওয়ানোর। আসলে মা, খাওয়া তো সবার বাড়িতে আছে। তোমার ভাই বোনেরা বাড়ি গিয়ে এ বাড়ির খাবারের চেয়ে ভালো খাবার খেতে পারবে, কিন্তু ওই আপ্যায়ন, ওই যে বসিয়ে খাওয়ানো, ও করেই আমরা আদর বোঝাই, বোঝাই যে ভালোবাসি। তুমি যেমন অতিথিপরায়ণ, আমিও তেমন। তাই ওদের যখন আদর করে ডেকে খেতে বলি, আমি অভিনয় করি না। মামাদের সঙ্গেই আমার শৈশব কৈশোর কেটেছে। ওদের সঙ্গে হাজার বছর পর দেখা হলেও মনে হয় যেন প্রতিদিনই দেখা হয়। শরাফ মামার ওপর আমার যে রাগ নেই, তা তোমাকে বোঝানোর প্রবল ইচ্ছে আমার। তুমি যে থালায়, বা বাটিতে, বা কাপে খাচ্ছিলে, অতিথিরা যেসবেখাচ্ছিল, চেয়েছিলাম সেগুলো খুব সুন্দর দেখতে হোক। যে তালাবন্ধ আলমারিতে থালাবাটি থাকে, সেগুলোর চাবি চেয়েছি, ওগুলো বের করবো বলে। যা কিছু সুন্দর ওখানে, ওই আলমারিতে, তার প্রায় সবই আমি কিনে দিয়েছিলাম দাদাকে, যখন জার্মানি গিয়েছিলো। সেগুলোই সাজিয়ে রাখা। কিন্তু হাসিনা আমাকে চাবিও দেয়নি, নিজেও সব বের করে দেয়নি। দুটো বাটি বের করে আলমারি বন্ধ করে বললো, এত নাড়াচাড়ায় ভেঙে যেতে পারে। মানুষ কী করে এত কুৎসিত হতে পারে, আমি বুঝি না। মানুষ যে এই তুচ্ছ বিষয় আশয় ছেড়ে, পার্থিব সব কিছু ফেলে চিরতরে চলে যায়, তা চোখের সামনে দেখেও তারা কেন এসবই আঁকড়ে পড়ে থাকে, কিছু বুঝি না এর।
.
লিলি আর লিলির মার কাছেও ক্ষমা চাওয়ার ইচ্ছে ছিল তোমার। পাওনা টাকাগুলো দিতে চেয়েছে ওদের। পারোনি। তোমার এই একটি চাওয়া আমি মেটাতে পারিনি। দুলুর মাকেও পারিনি, আনুর মাকেও পারিনি আনতে। অবশ্য ওদের দেখা পাওয়া গেছে, তখন খুব দেরি হয়ে গেছে। আহা, মা, যদি একবার ওদেরও নিজের হাতে কিছু টাকা দিতে পারতে। তোমার যে দেওয়ার হাত ছিল, কিন্তু হাতে কিছু ছিল না, সেই তোমার হাতে জীবনে প্রথম টাকা এলো। প্রচুর টাকা। তুমি গুনেও দেখতে পারোনি। এত টাকা তুমি বোধহয় গুনতেও জানতে না। জীবনে একটি টাকা, একটি মাত্র টাকার জন্য হাত পেতেছো স্বামী সন্তানদের কাছে। বেশির ভাগ সময়ই পাওনি। এখন তুমি ভুলে যাও তোমার নিজের হাতব্যাগে অগুনতি টাকা। তুমি মুঠোর মধ্যে সে টাকা তোলো। কিন্তু লক্ষ করেছি তুমি ওই টাকার কিছুআর অনুভব করো না। টাকা আর আবর্জনার বাক্সের কোনও বাতিল কাগজের মধ্যে কোনও পার্থক্য করতে পারো না। ওই টাকা তোমাকে সুখ দেয় না। নিজের জন্য কিছু তো চাওনি কোনওদিন। অন্যের জন্য চেয়েছিলে। প্রতিরাতে ঘুমিয়ে পড়ছো মাথার কাছে কয়েক লক্ষ টাকার ব্যাগ রেখে। টাকা তোমাকে আর আকর্ষণ করে না। ও টাকা দুর্বল দুটো হাতে ঠেলে সরিয়ে দাও। ডিম, দুধ, কলা এই তিনটি জিনিস খেতে চাইতে তুমি স্বাস্থ্যের জন্য। পেতে না। আর এই তিনটি তোমার সামনে অঢেল এখন, খেতে পারো না তুমি মা। কিছুই তুমি মুখে নিতে পারো না। দুর্গন্ধ সবকিছুতে। তোমার প্রিয় ডিম, প্রিয় দুধ মুখের কাছে ধরছি। তুমি মুখ সরিয়ে নাও। লিভারে যার ক্যান্সার ছড়িয়েছে, তার তো খাওয়া ফুরোলো মা, সে কি আমি বুঝি না! কিন্তু তারপরও প্রথম দিকে খেতে চাইতে তুমি। ক্যানসারের সঙ্গে যুদ্ধ করতে চাইতে। বাঁচতে চাইতে। এত মনোবল তোমার কোথায় ছিল! ছিল সব সময়, কিন্তু ওই মনোবল নিয়ে কোথাও পোঁছোতে পারোনি। যে মানুষগুলো তোমাকে তোমার নিজের পায়ে দাঁড়াতে দেয়নি, তারা তোমার চেয়েও অনেক শক্তিমান। তুমি নিরীহ নিরুপদ্রব নারী। তুমি পারোনি শক্তিমানদের সঙ্গে একা যুদ্ধ করে জিততে। তোমার এই হাঁমুখো অসুখের বিরুদ্ধে তুমি একাই দাঁড়িয়েছে।
একদিন, হঠাৎই একদিন, ঝিমিয়ে থাকা তুমি হঠাৎ জেগে উঠলে। তোমার ক্ষিধে পেলো প্রচণ্ড। তুমি ভাত খেতে চাইলে। মাছ মাংস যা আছে সব দিয়ে ভাত। যে তুমি সামান্য তরল পদার্থও মুখে নিতে পারছে না, সে তুমি ভাত খাবে। প্রায় প্রতিদিনই লোক পাঠিয়ে বাজার করছি আমি। একদিন শুভ আর সৌখিনের জন্য বাবা কিনে আনলো এক ডজন বাচ্চা মুরগি। বাবার কাছ থেকে নিয়ে মুরগিগুলো দেখালাম তোমাকে, বললাম বাবা তোমার জন্য কিনেছে। দেখালাম এই জন্য যে যেন তুমি ভাবো কেবল আমি নই, বাবাও তোমার জন্য ভাবছে, তোমাকে ভালোবেসে তোমাকে ভালো স্যুপ খাওয়ানোর জন্য বাজার করছে বাবা। একটু যেন তুমি খুশি হও। কোনওদিন তো বাবা তোমার জন্য কিছু কেনেনি। কোনওদিন চায়নি তুমি ভালো কিছু খাও। কখনও কি মুরগির কোনও ভালো টুকরো নিজে তুমি নিজের পাতে নিতে পেরেছো! বাবার ভয়েই পারোনি কোনওদিন। তুমি নিজে খাবে না, অন্যকে খাওয়াবে, তাইতো সবাই চাইতো। মিথ্যে করে হলেও তুমি জানলে যে বাবা চাইছে তুমি ভালো খেয়ে নেতিয়ে পড়া শরীরে শক্তি অর্জন করো, সুস্থ হয়ে ওঠো। বাবার ভালোবাসা তুমি সারাজীবন প্রার্থনা করেছো, পাওনি। অন্তত একবার জেনে স্বস্তি পাও, শুধু আমি নই, বাড়ির সবাই তোমাকে ভালোবাসে। মিথ্যে করে হলেও জানো, মা। বৈঠক ঘরে বসে বাবা আর দাদা দুজন পা নাড়িয়ে নাড়িয়ে কানা কানি করছে, আমার আদিখ্যেতার নিন্দে করছে। তারপরও আমি বাবাকে আর দাদাকে অনুরোধ করেছি টেলিভিশনের সামনে না বসে তোমার সামনে বসতে। টেলিভিশন তারা অনেকপাবে, তোমাকে পাবে না। বলি তোমাকে পুরোনো দিনের কথা বলতে, কোনও সুখের স্মৃতি যদি তোমাকে নিয়ে তাদের থাকে, বলতে। বলতে, যে, তুমি সুস্থ হয়ে উঠবে, বলতে যে, তোমাকেতারা ভালোবাসে। হোক না মিথ্যে, তারপরও। অন্তত হাতে গোনা যে কটা দিন তোমার আছে, তুমি সুখ পাও। কিন্তু অত কি সহজ এই সহজ কাজটি। কারও সময় নেই। বাবা চেম্বারে যাবে, রোগী দেখার নেশা। তোমার অসুখের কথা বলে বাবাকে থামানো যায়নি। বাবার নিজের শরীর ভালো নয় বলেও বাধা দিয়েছি। কিন্তু কোনও বাধাই কাজে লাগেনি। যে গাড়িটি বাবার জন্য কিনেছিলাম, সেই গাড়ি বাবা কোনওদিন চড়েও দেখেনি। শত বলেও বাবাকে ও গাড়ি দিয়ে চেম্বারে নেওয়াতে পারিনি। বাবাকে কিনে দেওয়া গাড়িটি এখন দাদার। সবাই বলে, দাদার গাড়ি। দাবি করতে ওদের কারও লজ্জা হয় না, বরং প্রতিবাদ করতে লজ্জা হয় আমার। যেদিন তোমার ক্ষিধে পেলো প্রচণ্ড, রান্নাঘরে গিয়ে কাজের লোকদের বারবারই তাগাদা দিলাম যেন রুই মাছের একটি টুকরো হলেও তোমার জন্য তাড়াতাড়ি রান্না করে দেওয়া হয়। কোথায় পাবো মাছ! মাছ রান্না হতে দেরি হবে হাসিনা জানিয়ে দিল। এখন শুভ আর সৌখিনের জন্য মুরগি রান্না হচ্ছে। মুরগি তো চিরকালই রান্না হবে, তোমার জন্য মাছটা আগে করে দিক। ভাত রান্না হয়েছে? হয়নি। ডাল? না, তখনও না। শুভ আর সৌখিনের জন্য আলাদা যে খাবার, সেগুলো আগে রান্না হচ্ছে। তারপর অন্য সবার রান্না শুরু হবে। রান্নার লোককে বললাম, সব বন্ধ করে মার জন্য ভাত, ডাল, আর রুইমাছের তরকারি তাড়াতাড়ি যেন রান্না করে দেয়। কিন্তু আমার নির্দেশ মানার কোনও লক্ষণ আমি কারও মধ্যে দেখি না। রান্নার লোকের কথায় এবং আচরণে বুঝি যে হাসিনা যা আদেশ করবে, তাই পালন করবে ওরা। আমার বা তোমার, অবকাশ নামের বাড়িতে কোনও অধিকার নেই। একসময় দেখি, হাসিনা তোমাকে মুখে তুলে খাওয়াচ্ছে, বাসি কাঁচকি মাছ, বাসি ডাল আর বাসি ভাত। আমি হতবাক দাঁড়িয়ে রইলাম, যদি আমি তখন বলি যে হাসিনা তোমাকে বাসি জিনিস খাওয়াচ্ছে, তুমি মনে কষ্ট পাবে বাসি জিনিস তোমাকে খাওয়ানো হচ্ছে বলে, তাই চুপ করে জানালার দিকে তাকিয়ে আমি বসে রইলাম। ক্ষুধার্ত তোমার দিকে, একটু ভাত খাওয়ার জন্য তোমার ব্যগ্রতার দিকে আমি তাকাতে পারছিলাম না। আমি তোমাকে বলিনি যে হাসিনা ইচ্ছে করলেই আজকের রুই মাছটা রান্না করার জন্য বলতে পারতো, বলেনি। মা, ওই খাওয়াই তোমার শেষ খাওয়া ছিল। তোমার জীবনের শেষ ভাত, শেষ মাছ, শেষ ডাল। খাবার সময় যখন রুইমাছ আমার থালায় এলো, গরম ভাত এলো, নতুন রান্না করা ডাল এলো, আমি খেতে পারিনি। কেউ লক্ষ করেনি আমার ওই ভাত, ডাল আর মাছের টুকরোর ওপর আমার চোখের জল টুপটুপ করে পড়েছে। কে লক্ষ করবে, সবাই তো পা নাচিয়ে গল্প করছে নয়তো টেলিভিশন দেখছে। টেলিভিশনের শব্দ শুনলে আমার খুব রাগ হতো। আমার রাগ দেখে শুভ, হাসিনা, দাদা-সবাই রাগে ফুঁসতো। আমি তোমার ঘরের দরজা বন্ধ করে রাখতাম, যেন শব্দ কম আসে। দেখ তোমরা নাচ নাটক যা কিছু, শব্দটা কমিয়ে রাখো, মা যেন না বোঝে যে পাশের ঘরে উৎসব চলছে। মা যেন বোঝে বাড়ির সবাই মার জন্য কাঁদছে। অবশ্য আমার রাগ হওয়ায় বা দুঃখপাওয়ায় কারও কিছু যায় আসেনি। তুমি এক ঘরে দিন দিন একটু একটু করে মরে যাচ্ছো, পাশের ঘরে টেলিভিশন চলেছে, যে কোনও দিনের মতোই চলেছে। ভাবলে এখনও আমার বুকের ভেতরটা কাঁপে। আমার বেলায় যদি এরকম হত মা! আমি চাইনা এরকম কোনও কদর্য দৃশ্য দেখতে। তার চেয়ে পাশের ঘরে টেলিভিশনের শব্দ, আর হৈ হুল্লোড় আনন্দের শব্দ শুনতে শুনতে আমি একা একা নিঃশব্দে মরেও শান্তি পাবো, যদি জানি যারা আনন্দ করছে তাদের কাউকে আমি চিনি না, তারা কেউ আমার আত্মীয় নয়, তারা কেউ স্বজন নয়, কাউকে আমি কোনওদিন ভালোবাসিনি। আপন নয় তারা, যদি আপন হতো, দৃশ্য অন্যরকম হতো।