What's new
Nirjonmela Desi Forum

Talk about the things that matter to you! Wanting to join the rest of our members? Feel free to sign up today and gain full access!

Collected নেই কিছু নেই (আত্মজিবনী) (1 Viewer)

তুমি লক্ষ করছিলে যে তোমাকে আর কোনও ওষুধ দেওয়া হচ্ছে না। সব চিকিৎসা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। তুমি চাইলেও সেটি তোমাকে দিচ্ছি না কেউ। যে আমি তোমার চিকিৎসার জন্য দূর আমেরিকায় তোমাকে নিয়ে গিয়েছি, সেই আমিই এখন চিকিৎসা বন্ধ করে দিয়েছি। নিশ্চয়ই চিকিৎসার আর কিছু নেই বলেই বন্ধ করেছি। মনে মনে লৌকিকে আশা ছেড়ে অলৌকিকের কথা ভাবছিলে কী! বৈঠকঘরে মিলাদেরপর যখন মোনাজাত হচ্ছে, তুমি শুনছিলে, দেখলাম তোমার মাথায় কোনও কাপড় নেই। তুমি সাধারণত এসব সময় আলগোছে মাথায় একটু কাপড় উঠিয়ে দাও। অভ্যেস অনেকদিনের। অভ্যেস থেকে তুমি বেরিয়ে আসছে। নিউইয়র্কে আর শান্তিনগরে দেখেছি তুমি বিছানায় বসে নামাজ পড়তে। যখন বসতে অসুবিধে হতো, শুয়ে পড়তে। অবকাশে এসেও মাথায় একটু কাপড় তুলে দিয়ে, শুয়ে থেকেই চোখ বুজে বিড়বিড় করছে। কয়েকদিন করেছে। তারপর লক্ষ করছি, নামাজ তোমার আর শুয়েও পড়া হয় না। নামাজের সময় চলে যায়, তুমি ঘুমিয়ে থাকো। দিন আর রাত তোমার একাকার হয়ে যাচ্ছে। কারও অসুখ হলে আমরা বিশ্রাম নিতে বলি, শুয়ে থাকা বা ঘুমিয়ে থাকাটাইতাদের জন্য স্বাভাবিক বলে মনে করি। কিন্তু তোমার ঘুম স্বাভাবিকতার আওতা থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে। চিরকালের অভ্যেস থেকে বেরিয়ে যাচ্ছো তুমি। তুমি জানো না যে বেরিয়ে যাচ্ছো। জগৎ থেকে সরে যাচ্ছো তুমি। একটু একটু করে হারিয়ে যাচ্ছো। তুমি আগের চেয়ে অনেক বেশি ঘুমিয়ে কাটাচ্ছো। তুমি জানো না যে তুমি ঘুমোচ্ছা। আমি জানি। আমি টের পাচ্ছি যে এই ঘুম প্রয়োজনের ঘুম নয়। এ অপ্রয়োজনের ঘুম। এ ঘুম তোমাকে জাগতিক সব কিছু থেকে ধীরে ধীরে দূরে সরিয়ে নেওয়ার ঘুম। এই ঘুম ভালো ঘুম নয়। এই ঘুম চেতন থেকে ধীরে ধীরে তোমাকে অচেতনের দিকে টেনে নেওয়ার ঘুম। কিন্তু সেও কি তখন আর বুঝতে পেরেছিলাম অত! এখন পেছন ফিরে তাকালে অনেক ধোঁয়াই কেটে যায়।

.

ধীরে ধীরে, সামান্য যা খেতে, তাও বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, টের পাচ্ছি। খুব কষ্ট করে গিলতে হয় যা কিছুই খাও। সুপ খেলেও, জল খেলেও। কিছু পেটে পড়লেই পেটের ভেতর তোমার সেই ভিসুভিয়াস ফুঁসে ওঠে। তারপরও যুদ্ধ করে যাচ্ছিলে, তোমার ওই একার যুদ্ধ। তোমার জন্য স্যালাইন এনে রেখেছি, অক্সিজেন এনেছি, ব্যথা কমানোর পেথিডিন এনেছি। ধীরে ধীরে তুমি যে কী কঙ্কালের মতো হয়ে যাচ্ছিলে মা! আমি জানি না তোমার সামনে আয়না ধরেছিলাম কিনা দেখতে। তুমি নিজেই হয়তো বুঝতে পাচ্ছিলে। আমার আবার কী রোগ হয়েছিলো জানিনা, প্রায়ই ক্যামেরা নিয়ে দাঁড়াতাম তোমার ছবি তুলতে। বাবাকে পাশে বসিয়ে ছবি তুলছি, তোমার একার ছবি, তোমার রুগ্ন পাণ্ডুর মুখের ছবি, তোমার কঙ্কালসার শরীরের ছবি। কেন তুলছিলাম মা? তুমি চাইতে না ছবি তুলতে। তুমি বাধা দিতে। একবার জিজ্ঞেস করেছিলাম কেন চাইছো না? তুমি করুণ কণ্ঠে বলতে, এখন তো দেখতে আমি ভালো না, এখন ছবি তোলোনা। সম্ভবত চাইতে না তোমার ওই চেহারার মাকে আমরা দেখি। আমি বুঝিনি তখন। ঠিকই বলতে, তোমার ওসব ছবির দিকে এখন তাকাতে পারি না। ও তো তুমি নও, অন্য কেউ। যখন সুস্থ ছিলে, হৃষ্টপুষ্ট ছিলে, যুবতী ছিলে, বাড়ির সবার ছবি তুললেও তোমার ছবি আমরা কেউই তুলিনি। হঠাৎ করে মৃত্যুশয্যায় রুগ্ন মায়ের ছবি তুলতে উগ্রীব। সারাজীবন ভুল করে শেষ দিনে এসে শোধরাতে চাইলে সব ভুল শোধরানো যায় না! বড় দেরি হয়ে যায়। যখন সুস্থ ছিলে, হাতে গোনা। তখনকার দুএকটা ছবি ছাড়া তোমার আর কোনও ছবি নেই কোনও অ্যালবামে। যা আছে, তাও তোমার একার ছবি নয়। অনেকের সঙ্গে তুমি। সুহৃদকে গোসল করাচ্ছো, বা পড়াচ্ছো। আসলে ও ছবি তোমার জন্য তোলা হয়নি, সুহৃদের জন্য হয়েছিল। বা ওর জন্মদিনের কেক কাটার সময় আর সবার মধ্যে তুমিও আছে। সবসময়ই দূরে, কিনারে, অর্ধেক কাটা পড়েছে, ইনসিগনিফিকেন্ট ক্যারেকটারের মতো। তোমাকে ওঠানো হতো না, তুমি অ্যাক্সিডেন্টালি উঠে যেতে।

.

হাশেম মামাকে ভালোবাসতে তুমি খুব। কাকে ভালো বাসতে না বলল। হাশেম মামার ক্যানসার ধরা পড়ার পর তুমি পাগলের মতো কেঁদেছো। তোমার মতো এত তো কেউ কাঁদেনি। তোমার ছোট ভাই, তার ক্যানসার তুমি মেনে নিতে পারোনি। হাশেম মামা আমাকে খুব স্নেহ করতো, আমি ঢাকা থেকে এলেই চলে আসতো আমার কাছে আমার নতুন কী বই বেরিয়েছে, নিতে। হাশেম মামা তুমি নিউইয়র্কে থাকাকালীনই মারা গেছে, খবরটা তোমার কাছে আমরা সবাই ইচ্ছে করেই লুকিয়েছি, জানলে তুমি কষ্ট পাবে তাই। কী দরকার কষ্টের এক দুঃসহ বোঝার ওপর নতুন কষ্টের বোঝা উপুড় করার। জেনে কী লাভ তোমার! এমন তো নয় যে, একদিন সুস্থ হয়ে উঠবে, আর নানিবাড়ি গিয়ে আবিষ্কার করবে হাশেম মামা নেই। আমরা তো সবাই জানি যে এরকম কোনও ঘটনা আদৌ ঘটবে না। আমরা তো সবাই জানি দিন দিন তুমি শরীরের সব শক্তি হারিয়ে ফেলছো, তুমি মিশে যাচ্ছো বিছানায়, উঠে বসারও শক্তি তোমার নেই, তুমি একটু একটু করে চলে যাচ্ছো, একটু একটু করে তোমার চেতন হারাচ্ছে, তুমি তলিয়ে যাচ্ছো, তুমি ফিরছো না। তুমি যে ফিরবে না, সে তো সবাই জানি। তোমাকে যদি না জানানো হয় হাশেম মামার মৃত্যুর খবর, তাতে তোমার কোনও ক্ষতি হওয়ার নেই কিছু। মৃত্যুর সঙ্গে যুদ্ধ তুমি করছো, তোমার প্রিয়জনের মৃত্যুর খবর তোমাকে দিয়ে তোমাকে কি আরও শক্তিময়ী করতে পারবো! কী করবে তুমি হাশেম মামার মৃত্যুর খবর জেনে? কী লাভ হবে তোমার! রুনু খালার স্বামী রাসু খালু একদিন এসে বসেছিলো তোমার সামনে। দিব্যি বলতে লাগলো, হাশেম ভাই যেদিন মারা গেল, সেদিন তো আমি.. কোনও দরকার ছিল না তোমাকে ওই গল্প শোনানোর। আসলে কারও মৃত্যুতে এই টুপি দাড়িঅলা মানুষগুলোর কোনও কষ্ট হয় না। তারা বিশ্বাস করে মৃত্যু মানে আল্লাহর কাছে যাওয়া। হাশেম মামা মারা গেছে এই খবরটা শোনার সঙ্গে সঙ্গে তুমি চমকে তাকালে আমার দিকে। কী যে অসহায় তুমি তখন! কী যে বোবা দৃষ্টি তোমার। মুহূর্তে আচমকা এক গাদা অন্ধকার তোমার ক্রমশ অন্ধকার হতে থাকা জগৎকে কোথাও ভাসিয়ে নিয়ে গেল। আমি আর বলতে পারিনি যে রাসু খালু মিথ্যে কথা বলছে। বলতে পারিনি হাশেম মামা বেঁচে আছে এবং ভালো আছে। কারণ মিথ্যে হলে রাসু খালু ওভাবে বলতো না। আমি তোমার বিছানার পাশে হাঁটু গেড়ে বসে বললাম, মা, হাশেম মামা খুব কষ্ট পাচ্ছিল, হয়তো এ তার জন্য ভালোই হল যে ওই ভয়ংকর কষ্ট আর তাকে পেতে হচ্ছেনা। কষ্ট থেকে মুক্তি পাক হাশেম মামা, তুমি তো চাও, তাই না মা? অত কষ্ট মামা আর সইতে পারছিলো না। কী আর বলবো মা, কী বলে সান্ত্বনা তোমাকে দেব। আমি জানি না কতটুকু কী বুঝলে তুমি, তুমি শান্ত মেয়ের মতো শুয়ে পড়লে, ভেতরে কী হচ্ছিল তোমার, কী রকম যন্ত্রণা, জানি না। তোমার চোখের কিনার বেয়ে গড়িয়ে পড়ছিল অবিরল জল। তুমি কি তখন ভাবছিলে যে, তোমার কষ্ট থেকে তোমার মুক্তি হোক, সেও আমি মনে মনে চাইছি! মানুষ ঠিক ওরকম অবস্থায় মনে মনে কী ভাবে, আমার পক্ষে সম্ভব নয় অনুমান করা। মৃত্যুর নিশ্বাসের কাছে বসে দেখতে হবে কী ভাবছি আমি। জানি না, মা, তখন কি অন্য কারও মৃত্যুর জন্য কান্না পাবে আমার? নিজেই যখন যাচ্ছি, কে গেছে বা যাচ্ছে, তার কথা ভেবে আমি কি কাঁদবো! আমি কি বাঁচবো যে সে ছাড়া আমার খালি খালি লাগবে। কেন কাঁদছিলে মা? হাশেম মামার মৃত্যু তুমি সইতে পারছিলে না কেন মা? তোমার নিজের মৃত্যুর চেয়ে অন্যের মৃত্যু তোমাকে কাঁদায় কেন বেশি মা? কেন তুমি আমাকে বিরক্ত করার চেয়ে নিজের মৃত্যুকেই বেছে নিলে, মা? বাবা বিরক্ত হত, দাদা বিরক্ত হত, নিজের চিকিৎসার জন্য সামান্য সাহায্য চেয়ে তাই ওদের বিরক্ত করতে চাওনি আর। তাই আমার কাছে গিয়েছিলে, দেখলে তোমার অসুখের কথা শুনে আমিও বিরক্ত হচ্ছি। তাই আমাকেও চাওনি বিরক্ত করতে। নিজের অসুখ নিয়ে নিজেই একা পড়ে রইলে। বিরক্ত হওয়া থেকে আমাদের বাকি জীবনের জন্য বাঁচালে। পারো কি করে? জীবন তো তুমি জানতে একবারই আসে। যত ধর্মকর্মই তুমি করো না কেন, ভেতরে ভেতরে তো বুঝতে এই জীবনের পরে আসলে আর কোনও জীবন নেই।

অবকাশের কালো ফটকে তালা দিয়ে বাবাকে আটকে রাখতে চেয়েছিলাম বাড়িতে। আমার ধমক, ভয় দেখানো, রাগ হওয়া কিছুই কাজ করেনি। যে করেই হোক বাবা যাবেই। তালাবন্ধ করে আর যাকেই যায়, বাবাকে আটকে রাখা যায় না। নিউইয়র্কে আর ঢাকায় তোমার পাশে যে বাবা ছিল দিন রাত, মনে হয় না এই বাবাই সেই বাবা। সব ভুলে আগের দিনের মতো বাবা চেম্বারে রোগী দেখায় ব্যস্ত হয়ে পড়লো। আমি শত চেষ্টা করেও বাবাকে থামাতে পারিনি। তোমাকে বলিওনি বাবা সেই আগের মতো দিব্যি সুটেড বুটেড হয়ে চিরকালের মতো বাইরে যাচ্ছে। তুমি কি খেয়াল করেছো বাবা এসে কাছে আর খুব একটা বসছেনা। উঁকি দিয়ে তোমাকে দেখে চলে যাচ্ছে। কী আশ্চর্য, দুদিন সাহেব হয়ে বসে তোমার সঙ্গে কিছু ছবি তুললো। বিশ্বাস হয়নি এই বাবাকেই নিউইয়র্কের হাসপাতালে ভর্তি করিয়েছিলাম প্রায় ধরে বেঁধে। ডাক্তার সব পরীক্ষা করে ওষুধ লিখে দিলেন। রক্তচাপ কমিয়ে রাখার ঠিকঠাক ওষুধ বাবা কোনওদিন খায়নি। আমি যা হাতে দিতাম, শিশুর মতো তাই খেয়ে নিত। আমি যে কত ভুল ওষুধ দিয়েছি। ডাক্তার লিখে দিয়েছে ওষুধ, কিন্তু কখন খাবে তার সময় লিখে দেয়নি। আমি সেগুলো একসঙ্গে বাবাকে খেতে দিতাম, বাবা খেয়ে নিত, জিজ্ঞেসও করতো না কী দিচ্ছি, কেন দিচ্ছি। আমাকে এত বিশ্বাস ছিল বাবার। এত অসহায় ছিল মানুষটা। ঢাকায় পর্যন্ত অসহায় ছিল। আর ময়মনসিংহে এসেই দিব্যি পূর্ণ তেজ ফিরে পেয়েছে। নিজের রক্তচাপ, ডায়বেটিস আর তোমার অসুস্থতা সব ভুলে বাবা এখন শহরের ব্যস্ত ডাক্তার, আগের মতো। মানুষের মনের শক্তিই বোধহয় সব চেয়ে বড় শক্তি। অন্তত বাবার বেলায়। তোমার মনে যত জোর আনছো, কোনও কাজেই তা লাগছে না। দিন দিন তুমি আরও বেশি দুর্বল হয়ে পড়ছে। বাবার কি এ কদিনেই ক্লান্তি এসে গেছে তোমার সেবা করতে করতে, তোমাকে সময় দিতে দিতে! তা না হলে ময়মনসিংহে ফিরে এসে বাবা কেন এভাবে বদলে গেল। মা, সত্যি কথা বলতে কী, সবাই কেমন যেন ক্লান্তই হয়ে পড়ছিলো। ছুতোনাতায় নিজের জীবনে ফিরতে চাইছিলো। তুমি চলেই যাবে যখন, না হয় চলেই যাও। তোমার জন্য যে সময় নির্ধারিত ছিল, সে সময়ের চেয়ে খানিকটা বেশি বেঁচে ফেলছো তুমি, মানুষ হতাশ হবে না কেন। চারপাশের মানুষগুলোর ক্লান্তি আমি টের পাই। আমারও কি ক্লান্তি আসেনি মা! এসেছে। আমারও মনে হয়েছে, অনেক হল, যে যাবার সে যাক। আমরা, সে যত আপনই হোক, খুব বেশি সময় খরচ করতে চাই না কারও জন্য। ভালোবাসায় আমাদের ক্লান্তি চলে আসে। তুমি কি টের পেয়েছিলে? টের পেয়েছিলে যে আমরা কেউ আর তুমি আরও দীর্ঘদিন বেঁচে থাকো, চাইছিলাম না! টের না পাওয়ার কিছু তো ছিলো না। ধীরে ধীরে তুমিও লক্ষ করছিলে, দূর থেকে যারা এসেছে, তারা তোমাকে শেষ বিদায় জানিয়ে গেছে। কাছে যারা ছিল, তাদের উপস্থিতির ঘনত্ব দিন দিন কমছে। তুমি কি আমার মুখেও টের পেয়েছিলে, ক্লান্তি! তোমার কাছ থেকে বারবার আমি উঠে চলে গিয়ে অন্য কোথাও বসে গল্প করছি। আমারও আর ভালো লাগছেনা এভাবে মৃত্যুর সঙ্গে গায়ে গা লাগিয়ে বসে থাকতে, মৃত্যুর মতো নির্মম কিছুকে এত পলকহীন চোখে বেশিদিন দেখা যায় না। আমারও ইচ্ছে করছে নিজের জীবনে, জীবনের উৎসবে, উচ্ছলতায় ফিরে যেতে। এক বিকেলে বাড়ির কয়েকজনকে নিয়ে যেদিকে দুচোখ যায়, সেদিকে চলে যেতে যেতে দিব্যি হালুয়াঘাট থেকে ঘুরে এলাম। মুক্তি তো চাইছিলামই। বিদেশ থেকে আমন্ত্রণ এলে, ভেতরে ভেতরে আমার খুব লোভ হচ্ছিল যাওয়ার। ফ্রান্সের জাতীয় সংসদে বক্তৃতা করার আমন্ত্রণ। অনেকগুলো ফোন পেয়েছিফ্রান্সের রাষ্ট্রদূতের। ফরাসি সরকারের এই আমন্ত্রণ রক্ষা করার জন্য আমাকে ক্রমাগতই অনুরোধ জানানো হচ্ছে। আমি বলে দিয়েছিলাম, আমার মার অসুখ, কোথাও এ সময় আমি যেতে পারবো না। পরে আবার একদিন মনে হয়েছে, দুদিনের জন্য ঘুরে এলে কী এমন ক্ষতি। না, মা, এই লোভ আমি সামলাতে পারিনি। এমনকী বাবাও অবাক হয়েছে আমার গোপন পরিকল্পনার কথা জেনে, যে বাবা সবসময় চাইতো বিদেশের সম্মানগুলো নিতে যেন কোনও আলস্য না করি। যেদিন তোমাকে বললাম, খুব বড় আমন্ত্রণ এসেছে ফ্রান্স থেকে, না গেলেই নয়, কদিন পরই ফিরে আসবো। তুমি করুণ চোখে তাকিয়েছিলে আমার দিকে। সেই চোখে বিস্ময়ও ছিল। তুমি হয়তো বুঝে পাওনি কী করে আমি তোমাকে ছেড়ে চলে যেতে চাইছি। কী করে অন্য কোনও কিছু, সে যত বড় আমন্ত্রণই হোক না কেন, মত্যুশয্যায় পড়ে থাকা মায়ের চেয়ে বড় হল। মাঝে মাঝে ভাবি কেন আমি তোমাকে ছেড়ে চলে যেতে চাইছিলাম, বড় বড় আমন্ত্রণে কি আমি এ যাবৎ কম রক্ষা করেছি! জীবনে কি বিশাল সব মঞ্চে আমি কম বক্তৃতা দিয়েছি! কেন আমি তোমাকে ওই আজ আছে কাল নেই অবস্থায় ফেলে অন্য কোথাও বেড়াতে যাওয়ার কথা মনে এনেছিলাম। নিজেকে ক্ষমা করতে পারি না। নিজেকে ক্ষমা করা আমার সম্ভব নয়। তোমাকে যে আঘাত দিয়েছিলাম, সে আঘাত তুমি নিভে যেতে থাকা জীবনে ধারণ করতে বাধ্য হয়েছিলে, প্রকাশ করোনি কিন্তু বিস্ময় বোধটা তুমি লুকোতেও পারোনি। অবশ্য তারপরই মাথা নেড়ে বলেছিলে যেতে, যেন যাই, বড় আমন্ত্রণে যেন যাই আমি। আমাকে সুখ দিয়েছিলে মা। যতটুকু উদার তুমি হতে পেরেছিলে, আমি কেন তার ছিটেফোঁটাও হতে পারিনি। শেষ অবদি আমি যাইনি কোথাও, কিন্তু যেতে তো চেয়েছিলাম, যেতে চাওয়ায় এবং যাওয়ায় কতই আর পার্থক্য!

যে তুমি বাঁচতে ভালোবাসতে, সেই তুমিই চাওনি আমার কোনও কষ্ট হোক তোমার জন্য। তুমি এমনকী যে মৃত্যুর সঙ্গে যুদ্ধ করছিলে প্রাণপণে, আমার ক্লান্তি বা কষ্টের কথা ভেবে তুমি তোমার নিজের মৃত্যু কামনা করলে। আমাকে মুক্তি দিতে চাইলে তোমার নিরন্তর সেবা থেকে। আমার ক্লান্তি থেকে। অবকাশেও যখন তোমাকে আমার সাহায্য করতে হলো মলত্যাগে, তুমি ভেবেছো আমার নিশ্চয়ই ঘেন্না হচ্ছে এসবে। তুমি সইতে পারোনি। একদিন শুধু বলেছো, তোমার এই কষ্ট আমি আর সইতে পারছি না। আল্লাহর কাছে বলে আমাকে যেন নিয়ে যান। না, মা। ও কারণে আমার কোনও কষ্ট হয়নি। সম্ভবত কষ্ট হয়নি এই ভেবে যে, এ তো আর দীর্ঘদিনের জন্য নয়। নিজের পাপের প্রায়শ্চিত্ত আমি করছিলাম, নাকি যা কিছু করছিলাম, করছিলাম তোমাকে ভালোবাসি বলে! মাঝে মাঝে ভাবি, বোধহয় প্রায়শ্চিত্তই করছিলাম। প্রায়শ্চিত্ত করতে বেশিদিন মানুষের ভালো লাগেনা। ভালোবাসলে কোনও ক্লান্তি আসতো না, ভালোবাসলে গোপনে গোপনে নিস্তার চাইতাম না। কত মানুষ এই পৃথিবীতেই আছে, যারা মাথা নষ্ট হওয়া, শরীর স্থবির হওয়া, বিছানায় পড়ে থাকা মাকে বছরের পর বছর, যুগেরপর যুগ সেবা করে যাচ্ছে, কোনও ক্লান্তি নেই, কোনও অভিযোগ নেই। তারা ভালোবাসে বলেই পারে। আমি সেই ভালোবাসা কোথায় পাবো মা! তোমার জন্য জন্ম থেকেই তা ছিলো না। হঠাৎ করে জন্মাবে কী করে, আমার দোষে তোমার অসুখ হয়েছে বলে! করুণা হয়েছে, মায়া হয়েছে, মমতা বোধ করেছি, আহা আহা করেছি। কিন্তু ভালোবাসা তীব্র ছিলো না বলে ওই অল্প সময়টুকুকেই দীর্ঘ দীর্ঘ বলে মনে হয়েছে। দিন হিসেব করেছি। ডাক্তারের দেওয়া তিন মাস পার হয়ে গেলে বিস্মিত হয়েছি। একটি দিনের বেশি হওয়াও হিসেবে রেখেছি। এসব অজান্তে ঘটেছে মা। আমার নিজেরই অজান্তে। আমার উদার ব্যক্তিত্বের ভেতরে বসে থাকা অনুদার স্বার্থপর আমিটিকে আমি ফাঁকি দিতে পারিনি। তোমার মহানুভবতার সামনে আমি অতি তুচ্ছ, অতি ক্ষুদ্র এক জীব। যেটুকু ভালো আমার, সেটুকু তোমার কারণে, যেটুকু মন্দ আমি, আমার কারণে।

তোমার শরীরের শক্তি দ্রুত ফুরোচ্ছিল। আজ তুমি পা নাড়াতে পারছো, কাল পারছে না। দুপুরে এপাশ ওপাশ করলে, বিকেলে আর সেটা পারলে না। তোমাকে দেখছিলাম আমি। লক্ষ করছিলাম তোমার শক্তি ফুরোনো। এ নিয়ে বাবার সঙ্গে কথা বলেছি, দাদা আর হাসিনার সঙ্গেও বলেছি। কাউকে সামান্য উদ্বিগ্ন হতে দেখলাম না। সম্ভবত তারা উদ্বিগ্ন তুমি এত সময় নিচ্ছো কেন মরতে, সম্ভবত তাদের আশংকা এভাবেই তোমার আবার আরও কয়েক মাস, আরও কয়েক বছর কেটে যায় কিনা। এরাই তো সেই মানুষ, যাদের সেবায় তুমি জীবন উজাড় করে দিয়েছিলে। তোমাকে দেখার আর কেউ ছিল না। তোমার মাথার কাছে বসে থাকতো নানি, বসে বসে কোরান পড়তো। কোরান পড়ে কোনও লাভ নেই জানি, তুমি সুস্থ হবে না। তারপরও আমি বাধা দিইনি। তুমি তো জীবনের অনেকটা সময় কোরান পড়েছো মা, নানি তার ভালোবাসা কী করে প্রকাশ করবে, নানি তো অন্য কিছু শেখেনি। কোরানইশিখেছে, তাই কোরানই পড়ছে। বাকি যারা আসতো তোমাকে দেখতে, টুটু মামা, আর মাঝে মাঝে শরাফ মামা। টুটু মামা তো শেষ দিকে রাত জেগে তোমার বিছানার সামনে বসে নামাজ পড়তো, দোয়া দরুদ পড়তো। মিলাদপড়ার মতোও দাঁড়িয়ে ইয়া নবি সালাম আলায়কা, ইয়া রসুল সালাম আলায়কা বলতো। আমিও দাঁড়াতাম ওদের সঙ্গে, তোমার সঙ্গে যেমন ছোটবেলায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে, হাত দুটো পেটের কাছে মুড়ে রেখে জোরে জোরে বলতাম ওগুলো, যে কথাগুলো কোনওদিন বুঝিনি। নাস্তিক হয়েও কেন আমি দাঁড়াতাম মা! তুমি যেন আমাকে দেখে খুশি হও? তুমি কি খুশি হতে মা? কতটুকু চোখ মেলতে পারতে আর তুমি, কতটুকু দেখতে পারতে, কতটুকু সুখের অনুভব তোমার তখন আছে? তারপরও আমার মনে হত, যদি থাকে, সামান্যও যদি থাকে, তুমি খুশি হও, একবার জীবনে তোমার নাস্তিক কন্যার বোধোদয় হয়েছে ভেবেও সুখপাও। সে সুখ মিথ্যে হলেও পাও। জীবনের শেষ মুহূর্তে অন্তত কিছুসুখ তুমি পাও। মাঝে মাঝে আসতো ছটকু, ফেলু মামা। ফেলু মামাকে দিয়ে তো তোমার স্টিলের আলমারিটা রং করিয়ে আনলাম। তোমাকে দেখতে বললাম আলমারির গোলাপি গোলাপি রংটা চমৎকার হয়েছে কীনা। একটু ঘাড় পেছনে নিয়ে দেখেছিলে মা। ওটিও তোমাকে সুখ দেওয়ার জন্য। তোমাকে বললামও, এই আলমারিতে এখন থেকে তোমার সবকিছু সুন্দর করে সাজিয়ে রাখবে মা, ঠিক আছে?

তুমি মাথা নেড়ে বললে, হ্যাঁ ঠিক আছে।

তুমি তো সুস্থ হয়ে উঠবে মা।

এ কথা শুনে তোমার ওই ক্লান্ত চোখ দুটোকেও স্বপ্নের জল এসে উজ্জ্বল করে তুলতে। জানি না তুমি বিশ্বাস করতে কী না। বিশ্বাস হয়তো হতে চাইতো না, কিন্তু তারপরও বিশ্বাস করতে হয়তো ভালো লাগতো। আমি ঠিক জানিনা ঠিক কী ভাবতে তুমি। মৃত্যুর অত কাছাকাছি চলে এলে কী রকম ভাবনা মানুষের মনে আসে, তা আমার জানা নেই। অসুখ ধরা পড়ার পর তুমি তো মৃত্যু শব্দটির নাম গন্ধ সইতে পারতে না, উচ্চারণ করতে না। সচেতন ভাবেই হয়তো করতে না। তুমি কি বিশ্বাস করতে চাইতে না তুমি যে সত্যি সত্যি মারা যাচ্ছো, নাকি তুমি প্রচণ্ড মনের শক্তি দিয়ে বেঁচে উঠতে চাইতে বলে অলক্ষুণে মৃত্যুর নামোচ্চারণ করতে না, নাকি মারা যাচ্ছো জেনেও তোমার প্রিয়জনকে বোঝাতে চাইতে না যে তুমি বুঝতে পারছো যে মরছে, ভাবতে প্রিয়জনেরা কষ্ট পাবে ভেবে যে তুমি জেনে গেছো গোপন ব্যাপারটি, জেনে তোমার কষ্ট হচ্ছে। আমার মনে হয় না তোমাকে অত কেউ কোনওদিন ভালোবাসতো যে তোমার কষ্টের কথা ভেবে কষ্ট পাবে। সারাজীবন কেউ বাসেনি জানেনা। হয়তো ভেবেছিলে, মরে যাচ্ছে বলে বুঝি ভালোবাসা জাগবে। না মা, যে সারাজীবনে ভালোবাসেনি, চোখের সামনে মরছো দেখলে তোমার জন্য তাদের ভালোবাসা উথলে ওঠার কোনও কারণ নেই। বেঁচে থাকলেও তোমার মৃত্যু চেয়েছে, মরতে থাকলে তো আরও চাইছে, দেরি সইতে পারছে না। তোমার কি কষ্ট হচ্ছে শুনতে? তুমি তো সব কিছুর ঊর্ধ্বে এখন মা, কষ্ট যন্ত্রণা এগুলো তোমাকে আর স্পর্শ করতে পারে না। পারবে কেন, তোমার নাগালই কেউ এখন আর পাবে না, পাবে না কারণ জলে স্থলে অন্তরীক্ষে তুমি আর নেই এখন। কোথাও নেই তুমি না থাকা মানুষের আবার দুঃখ কী। আমিও তো তোমার মতো না-থাকা হয়ে যাবো, দিন তো আসবেই কোনও না কোনও দিন। দিন তো সবারই আসে, আমার কেন নয়! তোমার অন্তত এইটুকু সান্ত্বনা হোক মা, তোমার মৃত্যু দেখে দেখে যাদের মনে হয়েছে, তুমি অভাগা তাই মরছে, তাদেরও মৃত্যুর সময় হবে মা। তারাও যাবে, তারাও চোখ বুজবে। মাঝে মাঝে মনে হয় কেন আমি তোমাকে ওই অবকাশে নিয়ে গিয়েছিলাম, অবকাশ নামের বাড়িটিতে তোমার মৃত্যু হোক, কেন চেয়েছিলাম আমি? ওই বাড়িতে তিরিশ বছরের স্মৃতি তোমার। কিন্তু তোমার সেই স্মৃতি তো মধুর নয়, মা। যে বাড়িতে তোমাকে অপমান করেছে তোমার স্বামী, বছরের পর বছর, প্রতি দিন, যে বাড়িতে তোমার পুত্র কন্যারা তোমাকে অবজ্ঞা করেছে, তোমার পুত্রবধূরা তোমাকে লাঞ্ছিত করেছে, সেই বাড়ির কোনও একটি ঘরের কোনও একটি বিছানায় শুয়ে তোমার মৃত্যু হোক, এই বা আমি চেয়েছিলাম কেন? আমি যে কথাটা ভেবে তোমাকে ময়মনসিংহেনিয়েছিলাম, সেটি হল, তোমার এতকালের পরিচিত চেনা মানুষগুলোর সঙ্গে তোমার দেখা হবে। বাকি আত্মীয়দের সঙ্গে দেখা হবে। তোমাদের বাড়ির পাশের বস্তি থেকে তইতই, তেঁতুর মা, আর আরও আরও তোমার চেনা বান্ধবীদের ডেকে ওদের তোমার বালিকাবেলার গান গাইতে বলেছি, ওরা গেয়েছে, তুমি শুনেছো, শুনে তোমার মুখে হাসি ফুটেছে, ওই হাসিটুকু তুমি হাসো, তোমার একটুখানি ভালো লাগুক চেয়েছি। আমি নিজেই বলেছি ওদের সবার হাতে টাকা দিয়ে দাও। গুনে তোমার হাতেই দিয়েছি টাকা, যেন তোমার হাতেই ওদের দাও। কারও কারও জন্য বলেছি, আরও কিছু দাও মা। একটুও দ্বিধা করো না। যত ইচ্ছে করে দিতে, দাও। কোনওদিন তো চাইলেও দিতে পারোনি। মানুষের দারিদ্র্য দেখে তোমার হৃদয় কাঁদতো, তোমার নিজের দারিদ্র্যের চেয়েও অন্যের দারিদ্র্য তোমাকে কাঁদাতো বেশি। সাহায্য করতে চাইতে। কিন্তু কী করে কোত্থেকে তুমি কাকে পয়সা দেবে। তোমাকেই কে দেয়! তোমাকে তো উপার্জন করতেও কেউ দেয়নি। নিজের পায়ে দাঁড়াবার ইচ্ছে তোমার মতো আর কাউকে দেখিনি। তবুও নিজের অনিষ্ট করে হাতে যা কিছুই ছিল তোমার, আটআনা বা একটাকা, একটাকা বা দুটাকা, হয়তো রিক্সাভাড়াই ছিল, দিয়ে দিয়েছে। হেঁটে বাড়ি ফিরেছো। রোদ্দুরে ভিজতে ভিজতে ক্ষিধে তৃষ্ণায় ভুগতে ভুগতে মাইলের পর মাইল হেঁটেছে। আর জীবনে প্রথম পাঁচশ টাকা হাজার টাকা ওই গরিব দুঃখী সইসাথীদের দিতে পেরে তোমার কি একটু, সামান্য একটু শান্তি হয়েছিল মা! ওটুকুই চেয়েছিলাম। বাড়ির অন্যরা, বাবা দাদা আর হাসিনা তিনজন তো কানে কানে কথা বলে আর কটাক্ষ করে আর মুখ টিপে হাসে, বাড়িতে করছি কী আমি! কিসের হাট বসিয়েছি! গরিব গরিব লোক ডেকে আনছি বস্তি থেকে, মাথা টাথা নিশ্চয়ই আমার মায়ের মতোই আমার গেছে। কদিন আর? এই একটিই সান্ত্বনা তাদের, বেশিদিন নয়। কালো ফটক পেরিয়ে গরিবগুলো রীতিমত ঘরের ভেতর ঢুকে মার বিছানার কাছে পেতে দেওয়া শীতল পাটিতে বসে পুরোনো দিনের সুখের স্মৃতিচারণ, গান গাওয়া, হাসি আনন্দ-কদিন আর? এই তো শেষ নিঃশ্বাসের সময় হল বলে। বাবা কি হাসিনাকে খুশি করতে হাতের আঙুল গুনে দিন বলে দেয়, আর কদিন! বাবা তো বোঝে কদিন। আমার চেয়েও বেশি বোঝে, কদিন। আমার চেয়েও হাজারগুণ অভিজ্ঞ ডাক্তার আমার বাবা। নাড়ি না টিপেও বলে দিতে পারে নাড়ির খবর।

.

মা, জগৎটা যে কী নিষ্ঠুর, তা নিজেই তো দেখেছো। তোমার আদরের ধন কামালকে পাওনি খুব বেশি বছর, অল্প বয়সে বিয়ে করে গীতার সম্পত্তি হয়ে গিয়েছিল, সেই আদরের ধনকে প্রাণ ভরে সেবা করার জন্য হাতের কাছে জীবনের শেষ কটা বছর পেয়েছিলে তুমি। কী ভালোই না বাসতে। অথচ মা, আমি তোমার সেই আদরের ধনকে চেয়েছি তোমার কাছে এসে বসুক, একটু তোমার সুখ হোক। ঢাকায় যখন শয্যাশায়ী তুমি, ছোটদাকে শত বলেও বসাতে পারিনি কাছে। ছোটবেলা থেকে ছোটদার টাকা পয়সার প্রতি প্রবল আকর্ষণের কথা আমরা সবাই জানি। জানা জিনিসকে মুখে বললে এত বিচ্ছিরি শোনায় কেন জানি না! একবার শান্তিনগরের বাড়িতে তোমার জন্য একটা ওষুধ আনতে বলেছিলাম, দু তিন টাকা বোধহয় দাম। সেই টাকাও সে বললো আমাকে দিতে। আমি অবাক হয়ে ভাবলাম, নিজের মায়ের ওষুধের জন্য নিজের পকেট থেকে দুটো টাকাও সে খরচ করতে চাইছে না! সেই ছোটদা কেন আসবে তোমাকে দেখতে ময়মনসিংহে। একবার খুব হাতে পায়ে ধরে অনুরোধ করে আনলাম বটে, এসেই বলে দিল তার প্রচণ্ড ব্যস্ততা, তার ফ্লাইট, তার নানা কিছু। তার সময় নেই ময়মনসিংহে আসার, তার সময় নেই সময় নষ্ট করার। বলেছিলাম, তুমি এসেছো দেখলে মা তো খুশি হয়, মাকে শেষ সময়ে কিছু খুশি দাও। ছোটদার কথা, তোমার জন্য সব সে করেছে, কিছুই করিনি আমি। সব টাকা সে খরচা করেছে, কয়েক লক্ষ টাকা এর মধ্যে তার খরচ হয়েছে, কিছুই করিনি আমি। তোমার স্বপ্ন পূরণ সে করেছে, আরব দেশে নিয়ে উমরাহ করিয়ে এনেছে। না, এর বেশি তোমার জন্য ছোটদার করার কিছু নেইও, ইচ্ছেও নেই। এই তার শেষ কথা। শেষ কথা সে চিৎকার করে জানিয়ে দিল, অবকাশের দেয়াল ফাটিয়ে জানিয়ে দিল। সব পাশের ঘর থেকে শুনলে তুমি। ছোটদা হিংস্র জানোয়ারের মতো চেঁচায়, যখন চেঁচায়। কিছু কিছু মানুষ মনে করে চেঁচিয়ে কিছু কথা বললে, সেই কথা সত্য বলে প্রমাণিত হয়। আসলে জঘন্য মিথ্যেও যে জোর গলায় চেঁচিয়ে বলা যায়, আর তা যে মাথায় যাদের ঘিলু বলে পদার্থ আছে তা জানে, তা তারা জানে না। সময় ছোটদার অঢেল আছে মা, সময় নেই শুধু তাদের জন্য, যাদের জন্য সময় কাটাতে তার ভালো লাগে না। ভালো লাগে মদের আড্ডা, ভালো লাগে মেয়ে পটানো। গীতার বশংবদ ভত্যের এই হাল। ছোটদার জন্য সেই ছোটবেলা থেকে আমার মায়া। শুধু আমার কেন, তোমার, ইয়াসমিনের, সবারই মায়া। বাড়িতে আমরা, বিশেষ করে আমি সবচেয়ে বেশি ভালোবাসতাম ছোটদাকে। লেখাপড়া শেষ না করে বিয়ে করে প্রথম দিকে খুব টাকাপয়সা ছিল না বলে মন খারাপ থাকতো ছোটদার, সেই মন খারাপ ছোটদা এখন বিরাট টাকা পয়সার মালিক হয়েছে, কিন্তু আমাদের সবার সেই আদর এখনও তার ওপর একই রকম বর্ষিত হয়। বাবাও ছোটদা বলতে পাগল। চোখের আড়ালে বেশি থাকলে বা দূরের শহরে বাস করলে যা হয়, আদরটা বেশি জোটে। ছোটদার তাই জুটতো। এখনও তাই জোটে। আমি হয়তো অত সহজে অন্তরীণ থাকা অবস্থায় যেভাবে ছোটদাকে ব্যাংকের যাবতীয় টাকা তোলার অধিকার দিয়েছিলাম, অমন আর কাউকে দিতেপারতাম না। কেন যে বিশ্বাস করতাম এই ছোটদাকে, বিশ্বাস বারবার ভেঙেছে, তারপরও। আসলে যে বিশ্বাস ভাঙে তার দোষ নয়, যে বিশ্বাস করে তার দোষ। ছোটদার ব্যবহারে জানিনা তুমি কষ্ট পেয়েছিলে কি না। শেষের দিকে কষ্টের বোধ তোমার হয়তো আর ছিল না। ছোটদা এক বিকেলে, ওই একটি বিকেলেই তোমারপাশে বসেছিল, মাথায় টুপিপরে সে কোরানপড়ছিল। সে যে কোরান পড়তে জানে তা আমার জানা ছিল না। ইদানিং জুইয়ের সঙ্গে মিশে সম্ভবত শিখেছে। জুই খুব ধার্মিক শুনেছি। ওই একদিনই ছোটদাকে পেরেছিলাম তোমার পাশে বসাতে। কোরান থেকে জানি না কী পাঠ করলো জোরে জোরে, কী যে সেদিন ভালো লেগেছিলো ছোটদা তোমার কাছে বসেছে বলে। ছোটদার মতো ছোটলোককে সেদিন আমি ক্ষমা করে দিয়েছি, যেহেতু তার ওইটুকুপাশে বসা দিয়ে তোমাকে ভালো লাগা দিয়েছিলো। ছোটদার জুইকে বিয়ে করা, কোরানপড়া, এসবের পেছনে আছে একরাতের এক দুর্ঘটনা। সে রাতে ছোটদা গাড়ি চালাচ্ছিলো, গাড়িতে বসেছিলো জুই আর জুই-এর মা। গাড়ি একসময় কোনও এক রেললাইনের ঠিক ওপরে এসে বন্ধ হয়ে গেল। গাড়ি আর চলছে না, না সামনে, না পেছনে। ঠিক তখনই ট্রেনের শব্দ, তিরের মতো ছুটে আসছে ট্রেন। ছোটদা শুধু চিৎকার করে বললো সবাইকে বেরোতে। জুই বেরিয়ে দৌড়। ছোটদাও। কিন্তু পেছন ফিরে দেখলো গাড়িতে আটকে আছে জুই-এর মা। ছোটদা ছুটে গেল গাড়ির ভেতর থেকে জুই-এর মাকে বের করতে। ট্রেন তখন নাকের ডগায়। টেনে সে বের করে নিয়ে আসে বটে জুইয়ের মাকে, কিন্তু ট্রেনের ধাক্কয় নিজে ছিটকে পড়ে। ছোটদার গাড়ি গুঁড়ো করে দিয়ে ট্রেন চলে যায়। গায়ের হাড়গোড় কিছু ভাঙ্গলেও ছোটদা বেঁচে যায় শেষ পর্যন্ত। জুইয়ের মা ট্রেনের আঘাতে নয় কিন্তু, হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মারা যায় হাসপাতালে। এই মৃত্যু ছোটদাকে আমূল বদলে ফেলে। এত অপরাধবোধে ভোগায় যে জুইয়ের এতদিনকার স্বপ্ন সে পূরণ করে, জুইকে বিয়ে করে। জুইয়ের মার মৃত্যুর জন্য কেন ছোটদা নিজেকে দায়ী করে! যদি সে টেনে তাঁকে বের না করতো গাড়ি থেকে, দুমুহূর্ত পরই নিশ্চিহ্ন হয়ে যেতেন তিনি। আমার মনে হয় না ছোটদা ছাড়া পৃথিবীর অন্য কেউ ট্রেনের ওইছুটে আসার দিকে ঝাঁপিয়ে পড়ে প্রেমিকার মা কেন, নিজের মাকেও বাঁচাতে যেতো।

ছোটদা পরদিনই চলে যায়। তোমার শরীর দ্রুত খারাপ হচ্ছে, ছোটদা যেন আরও পাশে থাকে, যেন চলে না যায়, আমার অনুরোধ ছোটদাকে অবকাশে রাখতে পারে না। আমার টয়োটা গাড়ি নিয়ে আসে, ওই গাড়ি নিয়েই বেরিয়ে যায় ঢাকার পথে। সবাই ভুলে গেছে, এমন কী ছোটদাও, যে, গাড়িটা আমার, ভুলে গেছে শান্তিনগরের বাড়িটাও আমার। সবাই কথাই বলে এভাবে, ‘কামাল তোর গাড়ি কোথায় পার্ক করলি? ’ বা ‘তুমি কি তোমার ঢাকার বাড়িতে সেদিন ছিলে?’ না আমার আড়ালে নয়, বাক্যগুলো আমার সামনেই উচ্চারিত হয়। আমি বুঝি, সময় অনেক কিছু পাল্টে দিয়েছে। আমি এ দেশে এ বাড়িতে, এ পরিবারে অনেকটাই অবাঞ্ছিত। কেবল তোমার কাছেই বাঞ্ছিত, কেবল তুমিই আমাকে সমস্ত জীবন দিয়ে চাইছ, সমস্ত জীবনের বিনিময়ে চাইছ। এই চাওয়ার মধ্যে এক ফোঁটা ফাঁকি নেই।

.

রোজার সময় তখন। টুটু মামা রোজা রাখতো। সারারাত সে নাকি আল্লাহনাম জপ করে। শুনে আমিই তাকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলাম তোমার পাশে রাতভর যেন তাই করে। সন্ধেবেলায় এসে টুটু মামা সারারাত জেগে থাকতো, সকালে বাড়ি চলে যেত ঘুমোতে। টুটু মামার বাড়িতে আসা দাদা পছন্দ করতো না। দাদার কাছ থেকে কবে নাকি টুটু মামা টাকা ধার করেছিলো, সে টাকা আর ফেরত দেয়নি। সে কারণেই টুটু মামার ছায়াও সহ্য হত না দাদার। টুটু মামা টাকা ফেরত দেয়নি। তাতে কী! পারেনি ফেরত দিতে, তাই ফেরত দেয়নি। বাবার কানে টুটু মামা সম্পর্কে যত রাজ্যির মন্দ কথা আছে, দাদা দেয়। বাবার মনও টুটু মামা থেকে সরিয়েছে দাদা। বাবা, আমি লক্ষ করেছি, আগে যেমন মামাদের সঙ্গে গল্প করতো, তেমন আর করে না। হাশেম মামা শুনেছি লিভারের ক্যানসার নিয়ে বাবার চেম্বারে বসে থাকতো। একটু যেন ওষুধ বাবা দেয়। জানি না বাবা কতটুকু সাহায্য হাশেম মামাকে করতো। মামাদের সম্পর্কে বাবার অভিযোগ যত থাক, নিজের কোনও দুর্যোগ এলে মামাদেরই বাবা সবসময় কাছে ডাকতো। হাশেম মামা তোমাকে বলেছিলো আমি যেন তার জন্য কিছু টাকা পাঠাই। আশ্চর্য, মা, কোনও টাকা আমি পাঠাইনি। পরে অবশ্য তার ছেলে সুমনকে পঞ্চাশ হাজার টাকা পাঠিয়েছিলাম, তখন হাশেম মামা আর বেঁচে নেই। হাশেম মামাকে সুইডেনে এনে চিকিৎসা করার জন্য ভিসার ব্যবস্থাও করেছিলাম। হাশেম মামার আর আসা হয়নি। মামার কথা ভাবলে এখনও বুকের ভেতরে একটা চিনচিন কষ্ট হয় আমার। মুক্তিযোদ্ধা ছিল হাশেম মামা। কী সুন্দর দেখতে ছিল। কী রকম সুঠাম সুদর্শন যুবক। টুটু মামার সঙ্গে তার সুন্দরী বউএর কোনও একদিন প্রেম হচ্ছে ধরা পড়ার পর সেই যে হাশেম মামা দাড়ি কাড়ি রেখে উদাস হয়ে গেল, আর ফিরে এলো না হৈ চৈ এ। টুটু মামাকে তুমিও চাইতে থাকুক। সারারাত সে সুর করে করে সুরা পড়ে, সে সুর বড় মধুর লাগে। টুটু মামাকে রাতের শেহরি খাওয়ার ব্যবস্থা নিজের উদ্যোগে করি। তোমাকে যে মনে শান্তি দিতে পারছে, তাকে খুশি করতে আমি তখন সব করতে রাজি। বাবা আর দাদার ধারণা টুটু মামা কোনও বদ উদ্দেশ্য নিয়ে এখানে আসে। ঝুনু খালাও একদিন কানে কানে বলে গেল, টুটু মামা নাকি অসুস্থ হাশেম মামাকে একদিনের বেশি দেখতে যায়নি। তোমার অসুখে তার মতো পাষণ্ডর দুঃখ হওয়ার তো কিছু নেই। এই দুঃখটা নাকি বানানো, এখানে ভেড়ার উদ্দেশ্য, আমার কাছ থেকে বড় অংকের একটা টাকা দাবি করা। না, মা। এসব আমার বিশ্বাসহয়নি। তোমার এগারো জন ভাইবোনদের মধ্যে একজনের সঙ্গে আরেকজনের যেমন বন্ধুত্ব ছিল, শত্রুতাও ছিল, তোমার সঙ্গে কারওরশত্রুতা ছিল না। তুমি সবাইকে ভালোবাসতে। সবাই তোমাকে ভালোবাসতো। টুটু মামার যে উদ্দেশ্যই থাকুক, তার প্রতি কৃতজ্ঞতায় আমার মন ভরে থাকে। তার কাছ থেকে যা পেয়েছি, সে পাওয়া অমূল্য। কোনও টাকায় আমি তার ঋণ শোধ করতে পারবো না। কোনও লক্ষ টাকা দিয়েও না।

.

তোমার চৈতন্য ফিকে হচ্ছে খুব দ্রুত। আগের চেয়ে অনেক বেশি ঝিমোচ্ছো, অথবা ঘুমোচ্ছো। তোমাকে শারীরিক কোনও সুস্থতা দিতে আমি পারছি না। শারীরিক কোনও সুস্থতা দিতে কোনওদিনই পারিনি। তোমার অসুখের দিকে তোমার মৃত্যু হবে জানারপর শুধু ফিরে চেয়েছি। আমি মরিয়া হয়ে উঠছি, যতটুকুসুখী করতে তোমাকেপারা যায়, করতে। জিজ্ঞেস করছি তোমাকে, কাকে কাকে তোমার দেখতে ইচ্ছে করে বলল, কার সঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছে করে, কে কাছে এলে তোমার ভালো লাগবো। তুমি যাদের নাম বলেছে, সবাই দরিদ্র, বস্তির লোক, গ্রামের অভাবী লোক। জ্যোৎস্নাকেতুমি দেখতে চাইলে। জ্যোত্সা একসময় কাজ করতো অবকাশে। ইয়াসমিনের মেয়ে ভালোবাসাকে যখন লালন পালন করতে তুমি, জ্যোৎস্না তোমাকে সাহায্য করতো। জ্যোৎস্নাকে ইয়াসমিনের শ্বশুর বাড়ির কেউ দিয়েছিলো। সানকিপাড়া থেকে ইয়াসমিনের শ্বশুরবাড়ির আত্মীয়দের ডেকে এনে অনুরোধ করলাম, জ্যোৎস্নাকে নিয়ে আসতে। ওরা বললো, সম্ভব নয়। জ্যোৎস্না গ্রামে চলে গেছে, ওর ঠিকানা কেউ জানে না। কিন্তু আমার উপর্যুপরি অনুরোধ যে করেই হোক খুঁজে আনতেই হবে জ্যোৎস্নাকে। লোককে গাড়ি দিয়ে, টাকা দিয়ে একদিন নয়, দিনেরপর দিনপাঠাচ্ছি। গ্রামের বাড়ি বাড়ি গিয়ে জ্যোৎস্নাকে খুঁজতে হবে। জগতের যেখান থেকে হোক, জ্যোৎস্না নামের মেয়েকে নিয়ে আসতে হবে। শেষপর্যন্ত জ্যোৎস্নার খোঁজ মেলে। কোনও এক গহন গ্রাম থেকে ওকে নিয়ে আসা হল। একই রকম কোনও ঠিকানা না জানা ঠিকানায় পাঠিয়ে দিলাম ফকরুলকে, লিলি বা লিলির মাকে খুঁজে আনতে। দুতিন গ্রাম তন্ন তন্ন করেও লিলির মার খোঁজ পাওয়া যায়নি। তুমি জ্যোৎস্নাকে দেখে ঝরঝর করে কাঁদলে। ওকে কাছে ডেকে বুকে জড়িয়ে রাখলে। কোনও একদিন কী কারণে জ্যোৎস্নাকে তুমি মেরেছিলে, তাই তার কাছে আকুল হয়ে ক্ষমা চাইলে। চোখের জলে নিজের মুখ বুক ভিজিয়ে ক্ষমা চাইলে তুমি। জ্যোৎস্নাকে শাড়ি দিলে, টাকা দিলে, যা ওর পাওনা ছিল, তার চেয়েও অনেক বেশি দিলে। জ্যোৎস্নার হাত ধরে জানতে চেয়েছো, ও তোমাকে ক্ষমা করেছে কি না। জ্যোৎস্না খুব অবাক হয়েছে কিসের ক্ষমা, কেন ক্ষমা। লোকের বাড়িতে কাজ করতে গিয়ে লাথিঝাঁটা খেয়েই জীবন কাটে। কেউ তাদের কাছে কোনও অন্যায়ের জন্য ক্ষমা চায় না। ক্ষমা তো আছেই, তারপর না চাইতেই এত টাকা পেয়ে যাওয়া! সবই ছিল জ্যোৎস্নার জন্য অবিশ্বাস্য। ওকে রাতের খাবার খাইয়ে দিতে বললে। বাড়িতে আমি এমন ব্যবস্থাই করেছি। কেউ যেন না খেয়ে না যায়। তোমার আত্মীয় স্বজনের এ বাড়িতে খাওয়ার চল খুব ছিল না। আমি কাউকে না খেয়ে দুপুর বা রাতে যেতে দিচ্ছি না। তোমার ভাই বোন, তোমার যে আত্মীয়ই আসছে, সবাইকে খাওয়াচ্ছি। তোমাকে বলছি, সবাইকে খাইয়ে দিচ্ছি। একদিন শরাফ মামার গোটা পরিবারকেই তোমার বিছানার সামনে শীতল পাটিয়ে বসিয়ে তুমি যেন দেখ, যত্ন করে খাইয়েছি। আমার টাকায় মাছ মাংসের বাজারও তাই করছি, যেন অধিকার থাকে যাকে ইচ্ছে খাওয়ানোর। আসলে মা, খাওয়া তো সবার বাড়িতে আছে। তোমার ভাই বোনেরা বাড়ি গিয়ে এ বাড়ির খাবারের চেয়ে ভালো খাবার খেতে পারবে, কিন্তু ওই আপ্যায়ন, ওই যে বসিয়ে খাওয়ানো, ও করেই আমরা আদর বোঝাই, বোঝাই যে ভালোবাসি। তুমি যেমন অতিথিপরায়ণ, আমিও তেমন। তাই ওদের যখন আদর করে ডেকে খেতে বলি, আমি অভিনয় করি না। মামাদের সঙ্গেই আমার শৈশব কৈশোর কেটেছে। ওদের সঙ্গে হাজার বছর পর দেখা হলেও মনে হয় যেন প্রতিদিনই দেখা হয়। শরাফ মামার ওপর আমার যে রাগ নেই, তা তোমাকে বোঝানোর প্রবল ইচ্ছে আমার। তুমি যে থালায়, বা বাটিতে, বা কাপে খাচ্ছিলে, অতিথিরা যেসবেখাচ্ছিল, চেয়েছিলাম সেগুলো খুব সুন্দর দেখতে হোক। যে তালাবন্ধ আলমারিতে থালাবাটি থাকে, সেগুলোর চাবি চেয়েছি, ওগুলো বের করবো বলে। যা কিছু সুন্দর ওখানে, ওই আলমারিতে, তার প্রায় সবই আমি কিনে দিয়েছিলাম দাদাকে, যখন জার্মানি গিয়েছিলো। সেগুলোই সাজিয়ে রাখা। কিন্তু হাসিনা আমাকে চাবিও দেয়নি, নিজেও সব বের করে দেয়নি। দুটো বাটি বের করে আলমারি বন্ধ করে বললো, এত নাড়াচাড়ায় ভেঙে যেতে পারে। মানুষ কী করে এত কুৎসিত হতে পারে, আমি বুঝি না। মানুষ যে এই তুচ্ছ বিষয় আশয় ছেড়ে, পার্থিব সব কিছু ফেলে চিরতরে চলে যায়, তা চোখের সামনে দেখেও তারা কেন এসবই আঁকড়ে পড়ে থাকে, কিছু বুঝি না এর।

.

লিলি আর লিলির মার কাছেও ক্ষমা চাওয়ার ইচ্ছে ছিল তোমার। পাওনা টাকাগুলো দিতে চেয়েছে ওদের। পারোনি। তোমার এই একটি চাওয়া আমি মেটাতে পারিনি। দুলুর মাকেও পারিনি, আনুর মাকেও পারিনি আনতে। অবশ্য ওদের দেখা পাওয়া গেছে, তখন খুব দেরি হয়ে গেছে। আহা, মা, যদি একবার ওদেরও নিজের হাতে কিছু টাকা দিতে পারতে। তোমার যে দেওয়ার হাত ছিল, কিন্তু হাতে কিছু ছিল না, সেই তোমার হাতে জীবনে প্রথম টাকা এলো। প্রচুর টাকা। তুমি গুনেও দেখতে পারোনি। এত টাকা তুমি বোধহয় গুনতেও জানতে না। জীবনে একটি টাকা, একটি মাত্র টাকার জন্য হাত পেতেছো স্বামী সন্তানদের কাছে। বেশির ভাগ সময়ই পাওনি। এখন তুমি ভুলে যাও তোমার নিজের হাতব্যাগে অগুনতি টাকা। তুমি মুঠোর মধ্যে সে টাকা তোলো। কিন্তু লক্ষ করেছি তুমি ওই টাকার কিছুআর অনুভব করো না। টাকা আর আবর্জনার বাক্সের কোনও বাতিল কাগজের মধ্যে কোনও পার্থক্য করতে পারো না। ওই টাকা তোমাকে সুখ দেয় না। নিজের জন্য কিছু তো চাওনি কোনওদিন। অন্যের জন্য চেয়েছিলে। প্রতিরাতে ঘুমিয়ে পড়ছো মাথার কাছে কয়েক লক্ষ টাকার ব্যাগ রেখে। টাকা তোমাকে আর আকর্ষণ করে না। ও টাকা দুর্বল দুটো হাতে ঠেলে সরিয়ে দাও। ডিম, দুধ, কলা এই তিনটি জিনিস খেতে চাইতে তুমি স্বাস্থ্যের জন্য। পেতে না। আর এই তিনটি তোমার সামনে অঢেল এখন, খেতে পারো না তুমি মা। কিছুই তুমি মুখে নিতে পারো না। দুর্গন্ধ সবকিছুতে। তোমার প্রিয় ডিম, প্রিয় দুধ মুখের কাছে ধরছি। তুমি মুখ সরিয়ে নাও। লিভারে যার ক্যান্সার ছড়িয়েছে, তার তো খাওয়া ফুরোলো মা, সে কি আমি বুঝি না! কিন্তু তারপরও প্রথম দিকে খেতে চাইতে তুমি। ক্যানসারের সঙ্গে যুদ্ধ করতে চাইতে। বাঁচতে চাইতে। এত মনোবল তোমার কোথায় ছিল! ছিল সব সময়, কিন্তু ওই মনোবল নিয়ে কোথাও পোঁছোতে পারোনি। যে মানুষগুলো তোমাকে তোমার নিজের পায়ে দাঁড়াতে দেয়নি, তারা তোমার চেয়েও অনেক শক্তিমান। তুমি নিরীহ নিরুপদ্রব নারী। তুমি পারোনি শক্তিমানদের সঙ্গে একা যুদ্ধ করে জিততে। তোমার এই হাঁমুখো অসুখের বিরুদ্ধে তুমি একাই দাঁড়িয়েছে।

একদিন, হঠাৎই একদিন, ঝিমিয়ে থাকা তুমি হঠাৎ জেগে উঠলে। তোমার ক্ষিধে পেলো প্রচণ্ড। তুমি ভাত খেতে চাইলে। মাছ মাংস যা আছে সব দিয়ে ভাত। যে তুমি সামান্য তরল পদার্থও মুখে নিতে পারছে না, সে তুমি ভাত খাবে। প্রায় প্রতিদিনই লোক পাঠিয়ে বাজার করছি আমি। একদিন শুভ আর সৌখিনের জন্য বাবা কিনে আনলো এক ডজন বাচ্চা মুরগি। বাবার কাছ থেকে নিয়ে মুরগিগুলো দেখালাম তোমাকে, বললাম বাবা তোমার জন্য কিনেছে। দেখালাম এই জন্য যে যেন তুমি ভাবো কেবল আমি নই, বাবাও তোমার জন্য ভাবছে, তোমাকে ভালোবেসে তোমাকে ভালো স্যুপ খাওয়ানোর জন্য বাজার করছে বাবা। একটু যেন তুমি খুশি হও। কোনওদিন তো বাবা তোমার জন্য কিছু কেনেনি। কোনওদিন চায়নি তুমি ভালো কিছু খাও। কখনও কি মুরগির কোনও ভালো টুকরো নিজে তুমি নিজের পাতে নিতে পেরেছো! বাবার ভয়েই পারোনি কোনওদিন। তুমি নিজে খাবে না, অন্যকে খাওয়াবে, তাইতো সবাই চাইতো। মিথ্যে করে হলেও তুমি জানলে যে বাবা চাইছে তুমি ভালো খেয়ে নেতিয়ে পড়া শরীরে শক্তি অর্জন করো, সুস্থ হয়ে ওঠো। বাবার ভালোবাসা তুমি সারাজীবন প্রার্থনা করেছো, পাওনি। অন্তত একবার জেনে স্বস্তি পাও, শুধু আমি নই, বাড়ির সবাই তোমাকে ভালোবাসে। মিথ্যে করে হলেও জানো, মা। বৈঠক ঘরে বসে বাবা আর দাদা দুজন পা নাড়িয়ে নাড়িয়ে কানা কানি করছে, আমার আদিখ্যেতার নিন্দে করছে। তারপরও আমি বাবাকে আর দাদাকে অনুরোধ করেছি টেলিভিশনের সামনে না বসে তোমার সামনে বসতে। টেলিভিশন তারা অনেকপাবে, তোমাকে পাবে না। বলি তোমাকে পুরোনো দিনের কথা বলতে, কোনও সুখের স্মৃতি যদি তোমাকে নিয়ে তাদের থাকে, বলতে। বলতে, যে, তুমি সুস্থ হয়ে উঠবে, বলতে যে, তোমাকেতারা ভালোবাসে। হোক না মিথ্যে, তারপরও। অন্তত হাতে গোনা যে কটা দিন তোমার আছে, তুমি সুখ পাও। কিন্তু অত কি সহজ এই সহজ কাজটি। কারও সময় নেই। বাবা চেম্বারে যাবে, রোগী দেখার নেশা। তোমার অসুখের কথা বলে বাবাকে থামানো যায়নি। বাবার নিজের শরীর ভালো নয় বলেও বাধা দিয়েছি। কিন্তু কোনও বাধাই কাজে লাগেনি। যে গাড়িটি বাবার জন্য কিনেছিলাম, সেই গাড়ি বাবা কোনওদিন চড়েও দেখেনি। শত বলেও বাবাকে ও গাড়ি দিয়ে চেম্বারে নেওয়াতে পারিনি। বাবাকে কিনে দেওয়া গাড়িটি এখন দাদার। সবাই বলে, দাদার গাড়ি। দাবি করতে ওদের কারও লজ্জা হয় না, বরং প্রতিবাদ করতে লজ্জা হয় আমার। যেদিন তোমার ক্ষিধে পেলো প্রচণ্ড, রান্নাঘরে গিয়ে কাজের লোকদের বারবারই তাগাদা দিলাম যেন রুই মাছের একটি টুকরো হলেও তোমার জন্য তাড়াতাড়ি রান্না করে দেওয়া হয়। কোথায় পাবো মাছ! মাছ রান্না হতে দেরি হবে হাসিনা জানিয়ে দিল। এখন শুভ আর সৌখিনের জন্য মুরগি রান্না হচ্ছে। মুরগি তো চিরকালই রান্না হবে, তোমার জন্য মাছটা আগে করে দিক। ভাত রান্না হয়েছে? হয়নি। ডাল? না, তখনও না। শুভ আর সৌখিনের জন্য আলাদা যে খাবার, সেগুলো আগে রান্না হচ্ছে। তারপর অন্য সবার রান্না শুরু হবে। রান্নার লোককে বললাম, সব বন্ধ করে মার জন্য ভাত, ডাল, আর রুইমাছের তরকারি তাড়াতাড়ি যেন রান্না করে দেয়। কিন্তু আমার নির্দেশ মানার কোনও লক্ষণ আমি কারও মধ্যে দেখি না। রান্নার লোকের কথায় এবং আচরণে বুঝি যে হাসিনা যা আদেশ করবে, তাই পালন করবে ওরা। আমার বা তোমার, অবকাশ নামের বাড়িতে কোনও অধিকার নেই। একসময় দেখি, হাসিনা তোমাকে মুখে তুলে খাওয়াচ্ছে, বাসি কাঁচকি মাছ, বাসি ডাল আর বাসি ভাত। আমি হতবাক দাঁড়িয়ে রইলাম, যদি আমি তখন বলি যে হাসিনা তোমাকে বাসি জিনিস খাওয়াচ্ছে, তুমি মনে কষ্ট পাবে বাসি জিনিস তোমাকে খাওয়ানো হচ্ছে বলে, তাই চুপ করে জানালার দিকে তাকিয়ে আমি বসে রইলাম। ক্ষুধার্ত তোমার দিকে, একটু ভাত খাওয়ার জন্য তোমার ব্যগ্রতার দিকে আমি তাকাতে পারছিলাম না। আমি তোমাকে বলিনি যে হাসিনা ইচ্ছে করলেই আজকের রুই মাছটা রান্না করার জন্য বলতে পারতো, বলেনি। মা, ওই খাওয়াই তোমার শেষ খাওয়া ছিল। তোমার জীবনের শেষ ভাত, শেষ মাছ, শেষ ডাল। খাবার সময় যখন রুইমাছ আমার থালায় এলো, গরম ভাত এলো, নতুন রান্না করা ডাল এলো, আমি খেতে পারিনি। কেউ লক্ষ করেনি আমার ওই ভাত, ডাল আর মাছের টুকরোর ওপর আমার চোখের জল টুপটুপ করে পড়েছে। কে লক্ষ করবে, সবাই তো পা নাচিয়ে গল্প করছে নয়তো টেলিভিশন দেখছে। টেলিভিশনের শব্দ শুনলে আমার খুব রাগ হতো। আমার রাগ দেখে শুভ, হাসিনা, দাদা-সবাই রাগে ফুঁসতো। আমি তোমার ঘরের দরজা বন্ধ করে রাখতাম, যেন শব্দ কম আসে। দেখ তোমরা নাচ নাটক যা কিছু, শব্দটা কমিয়ে রাখো, মা যেন না বোঝে যে পাশের ঘরে উৎসব চলছে। মা যেন বোঝে বাড়ির সবাই মার জন্য কাঁদছে। অবশ্য আমার রাগ হওয়ায় বা দুঃখপাওয়ায় কারও কিছু যায় আসেনি। তুমি এক ঘরে দিন দিন একটু একটু করে মরে যাচ্ছো, পাশের ঘরে টেলিভিশন চলেছে, যে কোনও দিনের মতোই চলেছে। ভাবলে এখনও আমার বুকের ভেতরটা কাঁপে। আমার বেলায় যদি এরকম হত মা! আমি চাইনা এরকম কোনও কদর্য দৃশ্য দেখতে। তার চেয়ে পাশের ঘরে টেলিভিশনের শব্দ, আর হৈ হুল্লোড় আনন্দের শব্দ শুনতে শুনতে আমি একা একা নিঃশব্দে মরেও শান্তি পাবো, যদি জানি যারা আনন্দ করছে তাদের কাউকে আমি চিনি না, তারা কেউ আমার আত্মীয় নয়, তারা কেউ স্বজন নয়, কাউকে আমি কোনওদিন ভালোবাসিনি। আপন নয় তারা, যদি আপন হতো, দৃশ্য অন্যরকম হতো।
 
০৬.


কাকারা এলো একদিন। গ্রাম থেকে আরও কয়েকজন এসেছিলো তোমাকে দেখতে। তোমার চেয়ে বয়সে বড়রা দিব্যি সুস্থ বেঁচে আছে। অতিথিদের বসার জন্য যে চেয়ার রেখেছিলাম তোমার সামনে, সেখানে বসে রিয়াজউদ্দিন কাকা বললো, ভাবী, মাফ সাফ করে দিয়েন। শুনে আমার কী যে রাগ হল। তোমাকে বুঝিয়ে দিতে চাইছে যে তুমি মারা যাচ্ছে। তাই মাফ চাইতে এসেছে। সারাজীবন তুমি এদের মাটির চুলোয় কুঁকনি ফুকে, গায়ে কাপড়ে কালি ঝুলি লেগেছে খেয়াল করোনি, রান্না করে খাইয়েছে। বিনিময়ে কারও কাছ থেকে কোনওদিন কিছু পাওনি। রিয়াজউদ্দিন কাকা যাওয়ার সময় তার শুকনো চোখদুটো অযথাই ডলতে শুরু করলো, আর একটা দীর্ঘশ্বাসও ফেললে আমাকে দেখিয়ে, দীর্ঘশ্বাসটা নকল, বুঝি। তোমাকে যেন কেউ বুঝতে না দেয় যে

তুমি মারা যাচ্ছো, আমি সতর্ক করে দিতাম সবাইকেই যারাই তোমাকে দেখতে আসতো। কিন্তু কে শোনে কার কথা! আমাকে নিতান্তই অবুঝ একটা মেয়েমানুষ বলে ভাবে। যে মেয়েমানুষ মত্যুর আগে আগে কী করতে হয় জানে না। জানে না, মত্যুপথযাত্রীর কাছে নিজেরা যত অপকর্ম এ যাবৎকরেছে, সব কিছুর জন্য মাফ সাফ চেয়ে সাফসুফ হয়ে থাকতে হয়। এখন তুমি ওপরে যাচ্ছো, ওপরে তুমি আল্লাহর কাছে তাদের বেহেসতের জন্য তদবির করবে, তাদের সালাম পৌঁছে দেবে পয়গম্বরকে! স্বজনপ্রীতিটা ভালো চলে পরকালে, তাই তোমার কাছে ধর্না দেওয়া। আমি অবুঝ মেয়েমানুষ, আমি চাই না তুমি একটুও টের পাও যে তোমার দিন ফুরোচ্ছে।

একদিন আমানুদ্দৌলার বউ এসেছিলো ছেলেমেয়ে নিয়ে। আমাণুদ্দৌলার বউএর নজর আমার দিকে। তুমি কেমন আছো, কেমন বোধ করছো, এ নিয়ে তার কোনও উৎসাহ নেই। ইনিয়ে বিনিয়ে বলতে শুরু করলো তার সংসারের নানা সমস্যার কথা। তার মেয়ে জুয়েল কলেজ পাশ করেছে, এখন ওর জন্য একটা চাকরির ব্যবস্থা আমার না করে দিলেই নয়। আমাণুদ্দৌলার বউ ক্রমাগত বলেই চললো এক কথা। আমি তাকে আমি কী করে চাকরির ব্যবস্থা করবো, আমার তো এই ক্ষমতা নেই’ বলার পরও সে থামলো না। ‘ঠিক আছে চেষ্টা করবো’ বলেও থামাতে পারি না তাকে। তুমি তখন বউএর দিকে তাকিয়ে বললে, ‘এত চাই চাই কেন তোমাদের! একটু মানবিক হও, একটু নিঃস্বার্থ হও।‘ না, মা। তোমার এই উপদেশের মর্মার্থ বোঝা তার পক্ষে সম্ভব নয়। আমি খসরুকে চিঠি লিখে দিয়েছিলাম জুয়েলকে একটা চাকরি দেওয়ার জন্য। খসরু তাকে চাকরি দিয়েছে। জুয়েল ঢাকা শহরে বহাল তবিয়তে আছে। নিঃস্বার্থ ওরা কেউ হয়নি মা। চাকরি পাওয়ার পর আমাকে ওরা খবরটাও দেয়নি যে চাকরি পেয়েছে। বছর কয়েক পর দাদা কথায় কথায় বলেছিলো যে জুয়েল খসরুর বিশাল অফিসে বেশ ভালো মাইনের চাকরি করছে।

একদিন আমাণুদ্দৌলা এলো। তোমাকে আগে জিজ্ঞেস করে নিলাম, তুমি ওর সঙ্গে দেখা করতে চাও কিনা। কাছের আত্মীয় ছাড়া অন্য কেউ এলে জিজ্ঞেস করে নিই তোমাকে। আমাণুদ্দৌলার সঙ্গে আদৌ দেখা করতে না চাইলে তাকে দেখা করতে দেব না, সে যত বড় প্রেমিকই হোক না কেন। তুমি মাথা নেড়ে বললে, হ্যাঁ। আমাণুদ্দৌলাকে ঘরে ঢুকিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এলাম। খুব বেশিক্ষণ সে থাকেনি তোমার ঘরে। আমি চেয়েছিলাম আরও কিছুক্ষণ থাকুক, আরও কিছুক্ষণ তোমার হাত ধরে সে বসে থাকুক, আরও কিছুক্ষণ সে দীর্ঘশ্বাস ফেলুক, আরও কিছুক্ষণ সে, যদি ভালোবাসে, বলুক ভালোবাসে।

.

তুমি যেহেতু এক ফোঁটা জলও আর খেতে পারছিলে না, তোমার নাকে নল ঢোকালাম তরল খাদ্য খাওয়ানোর জন্য। তোমার অসহ্য লাগতো ওই নাকের নল। কিন্তু তোমাকে আদর করে পেটে কিছুনাপড়লে তুমি যে শরীরে শক্তি পাবে না বলে বলে রাজি করালাম। রাজি তুমি তোমার জন্য নয়, আমার জন্যই হলে। একসময় শরীরে জল শুকিয়ে এলো এত যে স্যালাইন দিতে হল। তোমার চোখ লক্ষ করছি হলুদ হয়ে উঠছে। শরীরের ভেতর কী যে হচ্ছে তোমার, ভাবলে আমার মাথা বনবন করে ঘুরতে থাকে। সারারাত জেগে থাকি, তোমার অসহ্য ব্যথা হলে পেথিডিন দেবো। সারাদিন জেগে থাকি, তাকিয়ে থাকি তোমার দিকে। তুমি পাশ ফিরতে চাইতে। কিন্তু ফিরতে গেলেই বলতে তুমি পড়ে যাচ্ছো, যেন একটু ধরি। পেট এত ফুলে উঠেছিল যে, ধীরে ধীরে এপাশ ওপাশ ফেরার শক্তিও হারিয়ে ফেলেছিলে। তোমার গা মুছে গায়ে যে জামা পরিয়ে দিতাম, প্রয়োজনে তা আর পাল্টে দেওয়াও সম্ভব হচ্ছিল না। একদিন কেটে বের করে নিলাম জামা, তুমি জামা ছাড়াই রয়ে গেলে। শুধু লেপ বা কাঁথায় ঢেকে রাখলাম পেট ফুলে ওঠা তোমার কংকালসার শরীর।

এর মধ্যেই যেদিন সকালে তোমার শ্বাসকষ্ট শুরু হলো, সুহৃদকেপাঠিয়ে দিলাম নানিবাড়িতে, মামাদের সবাইকে ডেকে আনতে। সুহৃদ রিক্সা করে গিয়ে খবর দিয়ে এলো। এক এক করে মামারা সবাই এলো। তোমাকে অক্সিজেন দিলাম মা। অক্সিজেন আনিয়েছিলাম, প্রয়োজন হলে ব্যবহার করবো বলে। সেদিন প্রয়োজন হল মা। তোমার শ্বাসকষ্ট ওই অক্সিজেনে কিছুই কমলো না। ডাক্তার ডেকে আনালাম। কাছাকাছি আমার যে ডাক্তার বন্ধুরা থাকে, সবাইকেই ডেকে পাঠালাম। আমার ওপরের ক্লাসে পড়তো সেলিম, খুব ভালো ছাত্র ছিল, তাকে ডাকিয়ে আনলাম ছটকুকে দিয়ে। সবাই দেখলো, কেউ কোনও আশার কথা শোনালোনা। সবাই দীর্ঘশ্বাস ফেললো। তারপরও আরও বড় ডাক্তার এলো। বললো, বাড়ির সবাই উনার কাছে বসে থাকো। সারাদিন তুমি শ্বাসকষ্টে ভুগলে। ধীরে ধীরে তুমি চেতন হারালে। ওই অচেতন অবস্থাতেও তুমি শুধু প্রাণপণে শ্বাস নিতে চাইছো। স্যালাইনে দিতে লাগলাম জীবন বাঁচানোর স্টেরোয়েড। স্টেরোয়েডেরপর স্টেরোয়েড। রাতের দিকে স্টেরোয়েড শেষ হয়ে গেল। সুহৃদকে পাঠালাম চড়পাড়ার ওষুধের দোকান থেকে আরও কিছু নিয়ে আসতে। কেন আনতে পাঠালাম মা, আমি কি বুঝতে পারছিলাম না কী হতে যাচ্ছে? পারছিলাম মা।

সকালেই যখন তোমার শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে দেখলাম, চিৎকার করে বাড়ির সবাইকে জানিয়েছিলাম সে কথা। শুনে দাদা ছুটে এসেছিলো, বিছানায় তোমার পাশে কিছুক্ষণ বসে থাকার পর নেমে গিয়ে অযু করে পাজামা পাঞ্জাবি আর মাথায় একটা টুপি পরে এলো, হঠাৎ করে তার পোশাক পাল্টাবার কী হল, বুঝলাম না। তাহলে কি দাদা ধরেই নিয়েছে যে তুমি মারা যাচ্ছো? খানিকপর দাদা আবার নেমে গেল বিছানা থেকে। সম্ভবত যে কারণে বিছানায় তোমার মাথার কাছে বসে ছিলো দাদা, যে শেষ নিশ্বাস একেবারে নিজের চোখের সামনে দেখবে বলে, সেই শেষ নিশ্বাসটিই তুমি তাকে দেখতে দিলে না সারা সকাল। নানি সেই আগের মতোই তোমার শিয়রের কাছে বসেপড়ে যাচ্ছে কোরান। নানির চোখ থেকে জলপড়েপড়ে কোরানের লেখাগুলো ঝাঁপসা হয়ে যাচ্ছে। মামারা জোরে জোরে আসোলামু আলায়কুম ইয়া রহমতুল্লাহ না কী কী সব বলে যাচ্ছে। আমার ভয় করছিল মা, খুব ভয় করছিল আমার। যারাই দেখতে আসছিল তোমাকে, বলে যাচ্ছিল তুমি যেন তাদের সালাম পৌঁছে দাও নবীজিকে। এর চেয়ে বীভৎস কোনও দৃশ্য আমি দেখিনি কোনওদিন মা। আমি চেষ্টা করছিলাম তোমাকে আরও জীবন বাঁচানো ওষুধ দিয়ে বাঁচিয়ে রাখতে। আমি কোনও ভগবান আল্লাহ বা কোনও রকম ঈশ্বরে বিশ্বাস করি না। বিজ্ঞানে বিশ্বাস করা আমি একটি অলৌকিক কিছু চাইছিলাম, অনেকে তো মৃত্যুর দুয়ার থেকেও বেঁচে ওঠে মা। কত কেউ তো বেঁচেছে। তুমিও এরকম হঠাৎ কোমা থেকে ফিরে আসতে পারো না জগতে? সবাইকে অবাক করে দিয়ে চোখ মেলে তাকাও যদি আবার! আমি প্রকৃতির কাছে ভিক্ষে চাইছিলাম তোমাকে ফিরিয়ে দিতে, তোমার অচেতনতাকে ভেঙে দিতে। তোমার মাথা থেকে আগুন বেরোচ্ছিল, ছোট একটা ফ্যান চালিয়ে মাথা ঠাণ্ডা করতে চাইছিলাম। তোমার পায়ের পাতা দুটো বরফের মতো ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছিল। তোমার পায়ের কাছে বসে আমি ইস্ত্রিতে কাপড় গরম করে করে সে কাপড় চেপে ধরে তোমার পা দুটো থেকে ঠান্ডা সরাচ্ছিলাম। লাভ নেই, তারপরও। তুমি কী আর বুঝতে পারছিলে তোমার শরীরের কোথাও তাপমাত্রা কমে যাচ্ছে! বাইরের তাপ দিয়ে আমি আর কতটুকু কী উষ্ণ করতে পারবো! আমার ভয় হচ্ছিল। খুব কথা বলতে ইচ্ছে করছিল তোমার সঙ্গে আমার। শেফালিকে পা গরম করতে দিয়ে আমি তোমার হাত দুটো ধরে শুধু বসে রইলাম। সেই হাতে তাপ ছিল, সেই হাতে তুমি ছিলে না মা। তুমি কিছু টের পাচ্ছিলে না। হাতে তোমার কোনও জোর ছিল না। আমার খুব ভয় হচ্ছিল। খুব ভয়। সবাই ভাবছিল এই বুঝি তুমি আর নিঃশ্বাস নেবে না। কিন্তু তুমি নিচ্ছিলে। প্রাণপণে তুমি বাঁচতে চাইছিলে। শ্বাসে কোনও ছন্দ ছিল না, কিন্তু নিচ্ছিলে। তোমার শরীর কোনও আর অক্সিজেন চাইছিল না নিতে, তোমার ফুসফুস বাধা দিচ্ছিলো, কিন্তু নিচ্ছিলে তুমি। তোমার হৃৎপিণ্ড বাধা দিচ্ছিল, কিন্তু তুমি শুনছিলে না। যে করেই হোক নিচ্ছিলে। তোমার ভেতরের সব ঝাঁঝরা হয়ে গিয়েছিল, সবপচে গিয়েছিল, তোমার অন্ত্র, তোমার পাকস্থলী, তোমার যকৃত, তোমার কিডনি, কিন্তু শ্বাস নিচ্ছিলে। মানুষ তোমাকে বিদায় দিচ্ছে, তোমারই স্বামী, পুত্র, নাতি, তোমারই ভাই বোন তোমাকে বিদায় দিচ্ছে, তুমি বিদায় নিতে চাইছে না। তুমি এই পৃথিবী ছেড়ে তোমার সংসার তোমার স্বজন ছেড়ে কোথাও যেতে চাইছিলে না, মা। কার জন্য থাকতে চাইছিলে মা? এই জগৎ সংসারে তোমার কে ছিলো যে তুমি ছেড়ে যেতে চাইছিলে না? তোমার জায়গায় আমি হলে সম্ভবত মরে শান্তি পেতাম, মরে বাঁচতাম। ভালোবাসা বুঝি তোমার দেবার কিছু বাকি ছিল আমাদের যে থেকে যেতে চাইছিলে?

আমি তোমার কাছে বসছি, একবার বারান্দায় যাচ্ছি, একবার ঘরে ঢুকছি। মামারাও এক এক করে যাচ্ছে, আবার আসছে। কে ঠিক কী করবে বুঝতে পারছে না। ওই সকালেই নাকি দুপুরের দিকটায় হাসু খালু বলতে শুরু করলো আমরা তো তৈরি হয়েই এসেছি, লাশ নিয়ে যাবার জন্য যারা যারা আসার কথা, সবাই এসে গেছে জাতীয় কথা। আমার কানে যেন গরম লাভা পড়লো মা। বাবাকে বলি তোমার কাছে বসার জন্য। বাবাকে খুব ধীর স্থির লাগছিলো, বাবা কি সত্যিই নিস্পৃহ ছিল, নাকি বাবারও আমার মতো ভীষণ ভয় হচ্ছিল, বাবাও ভীষণ একা হয়ে যাচ্ছিল, যে কথা আমার মতো বাবাও কাউকে বুঝতে দিতে চাইছিলো না! দাদাকেও বলেছি যেন কাছে এসে বসে, যেন ধরে থাকে তোমার শরীর! কী যে কষ্ট করছো তুমি প্রতিটি নিঃশ্বাস নিতে। জীবন বেরিয়ে যাচ্ছে তোমার জীবন বাঁচাতে। ওদিকে দুপুর থেকেই আবার বৈঠক ঘরে দাদা আর বাবার চিরাচরিত বৈঠক। বাবা দাদাকে, অথবা দাদা বাবাকে ক্রমাগত বলে যাচ্ছে কবর, কোদাল, জানাজা, কাফন এসব কুৎসিত আর অশ্লীল শব্দযুক্ত বাক্য। তার চেয়ে বধির হয়ে যেতাম, তার চেয়ে অন্ধ হয়ে যেতাম। আমাকে দেখতে হত না এই ভয়ংকর দৃশ্য, শুনতে হত না নোংরা শব্দগুলো। তুমি এখনও শ্বাস নিচ্ছ মা, তুমি এখনও মরে যাওনি। কারও চোখে এক ফোঁটা জল নেই। হাসিনা তার ছেলেদের নাওয়া খাওয়া বিশ্রাম ইত্যাদির তদারকি করছে, যেমন করে প্রতিদিন। বাড়িতে একটি মানুষ যে কোনও মুহূর্তে আর নিশ্বাস নিতে পারবে না, কে বিশ্বাস করবে! ঠিক কী করবো বুঝতে পারছি না। কোথায় যাবো, কার সঙ্গে কথা বলবো কিছুই জানি না। মা, মা, মা বলে তোমাকে ডাকছি, যেন তুমি অন্তত কথা শোনো আমার। তুমি ছাড়া আর কেউ নেই আমার তখন। আমার সেদিন অনেকবার মনে হয়েছে, তার চেয়ে এই যন্ত্রণাটা তুমি না পাও, তার চেয়ে নিশ্বাস তুমি আর না নাও। কার জন্য নিতে চাইছো, এই সংসারে কে আছে তোমার! আমিই বা কী করেছি তোমার জন্য সারাজীবন! জীবনে যা করা উচিত ছিল করিনি, এখন উজাড় করে দিচ্ছি মত্যুর সঙ্গে রোজ যখন তোমার পাঁচবেলা দেখা হচ্ছে। যখন জীবন বলে সত্যিকার কিছু নেই, তখন। তুমি বিছানায় মিশে যাচ্ছো। বসার, হাঁটার, চলার, খাওয়ার কিছুরই উপায় তোমার নেই যখন, তখন। মা, তখন তুমি সবই মেনে নিচ্ছো। তোমার জীবন তুমি ছেড়ে দিয়েছো আমার হাতে। যেন আমার এই হাতই, এই অভিজ্ঞ এবং আন্তরিক হাতই মৃত্যুর মুখ থেকে ছিনিয়ে আনবে তোমাকে। এরকম তো কত গল্প শুনেছো কত বাঁচার। ডাক্তার আসছে, কিছুক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে থেকে চলে যাচ্ছে। অন্য ঘরে কবরের গল্প হচ্ছে। তুমি একা পড়ে আছো, চোখ বোজা, নাকে অক্সিজেন, হাতে স্যালাইন। নিশ্বাস নেওয়ার জন্য যুদ্ধ করেই যাচ্ছে। সকাল গড়িয়ে দুপুর হচ্ছে। দুপুর গড়িয়ে বিকেল। সকালের দিকে একটা ভিড় হয়েছিল তোমার পাশে, সেই ভিড় হালকা হয়ে গেল। কার সময় আছে মৃত্যু দেখার জন্য অত সময় অপেক্ষা করার। তুমি মরে গিয়ে ওদের সময় যদি বাঁচাতে, খুশি হত ওরা। আমি স্তব্ধ বসে আছিমা। তোমাকে খাওয়াবার, পেচ্ছাব পায়খানা করাবার, গা মুছিয়ে দেবার, কাপড় পাল্টে দেবার কোনও কাজ আমার নেই। কাউকে ডেকে এনে তোমার সঙ্গে দেখা করাবার নেই। তোমার মন ভালো করার জন্য নানারকম আয়োজন করারও কিছু নেই। আমি শুধু স্তব্ধ বসে আছি। স্তব্ধ বসে আছি শুধু। মা, তুমি একা একা কষ্ট পেয়ে যাচ্ছো। তুমি হারিয়ে যাচ্ছো। সন্ধে হলে টেলিভিশন ছাড়া হল। শুভ আর সৌখিন দেখবে। বাবাও বোধহয়। নাকি বাবা তোমার দাফন কাফন নিয়ে দাদার সঙ্গে ক্রমাগতপরামর্শ করে যাচ্ছে কে জানে। টেলিভিশনের নাচ গান বিজ্ঞাপনের শব্দের নিচে হারিয়ে যাচ্ছে তোমার শ্বাস কষ্টের শব্দ। জানি না কেন বারান্দায় গিয়ে স্তব্ধ রাত্তিরের দিকে তাকিয়ে আমি মা মা মা বলে চিৎকার করলাম। ওই বারান্দায় দাঁড়িয়ে সেই শৈশব থেকে মা মা বলে ডেকেছি, আর যেখানেই ছিলে তুমি, রান্নাঘরে, শোবার ঘরে, ছাদে বা উঠোনে, ডাক শুনে ছুটে এসেছে। আর যে বারান্দায় দাঁড়িয়ে আমি চিৎকার করে তোমাকে ডাকছি, বাড়ির সবাই শুনছে, পাড়াপড়শি শুনছে, পথচারি শুনছে, একেবারে কাছের ঘরটায় শুয়ে আছো তুমি, শুধু তুমিই শুনছে না।

বাবা তখনও বৈঠক ঘরে ব্যস্ত দাদার সঙ্গে প্রতিদিনের মতো খুঁটিনাটি আলোচনায়। কাকে কাকে খবর দিতে হবে, কী করতে হবে। বাড়ির কারও চোখে জল নেই মা, না, আমার চোখেও নেই। সত্যি বলছি মা, আমি চাইছিলামও তুমি ওই শ্বাস আর না নাও। কারণ ওই শ্বাস তোমাকে শ্বাস ফিরিয়ে দেবে না। অক্সিজেন কি খুলে দেব? স্যালাইনের নলে আর কি ধীরে ধীরে ঢালবো না ওষুধগুলো! ভাবি ঢালবো না, কিন্তু না ঢেলেপারি না। যতক্ষণ বেঁচে থাকতেপারো, যেভাবেই পারো, বাঁচো। জীবন তো একটাই মা, পরকাল বলে কিছু আছে বলে যদিবিশ্বাস করতাম, তোমাকে বিদায় দিতে কোনও কষ্ট হত না।

বাবা তোমার দশ বছর বয়স থেকে তোমার সঙ্গে। এত বছর মানুষটার সঙ্গে এক বাড়িতে কাটিয়েছে বাবা, কোনওদিন ভালোবাসেনি বরং সারাজীবন কষ্ট দিয়েছে। যে অসুখটা সারাতে চাইতে, সেই অসুখের কথায় বাবা মুখ ভেংচে টিটকিরি দিয়েছে তোমাকে, সেই অসুখে চিকিৎসাহীন অবস্থায় আজকে তুমি মারা যাচ্ছ, আর একটু পরেই সব কষ্ট সব যন্ত্রণার অবসান হবে। বাবা আজ কী করে স্থির থাকছে, তোমাকে মাটিতে পুঁতে দেওয়ার পরিকল্পনা করে যাচ্ছে, আমি ভাবতে পারি না। মানুষের দীর্ঘ বছরের সম্পর্ক কি এমনই ঠুনকো হয় নাকি হতে পারে! সম্পর্ক নামের জিনিসটা তবে কী! দাদার চোখেও তো একফোঁটা জল নেই। এই দাদাকে শিশু ছিলে যখন, বা অল্প বয়সি কিশোরী ছিলে, জন্ম দিয়েছিলে, এই দাদার কারণে তুমি তোমার শৈশব কৈশোর কিছুই উপভোগ করতেপারোনি। দাদাকে আনাড়ি হাতে একা একা মানুষ করেছো। সেই তুমি চলে যাচ্ছ, অভাগা তুমি। দাদার চোখে জল নেই, দাদা ব্যস্ত তোমাকে মাটিতে পুঁতে ফেলার আয়োজনে, কাকে কাকে জানাজায় খবর দেবে তার তালিকা তৈরি করছে। ফকরুল মামা ঢাকা থেকো এলো রাতে, এসেই শ্বাসকষ্ট হতে থাকা অচেতন তোমাকে দেখলো। দাদার ঘরে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে কেঁদেছে কেন সে দেরি করলো, কেন আগে সে এলো না, বলে বলে। এ বাড়িতে প্রথম একজন কেউ কাঁদলো। অন্তত একজন মানুষের কান্নার শব্দ আমাকে স্বস্তি দেয় মা। আসার তো ফকরুল মামার কথাই ছিল, তাকে পাঁচশ টাকা তোমার হাত দিয়েই গাড়িভাড়ার কথা বলে দিয়েছিলাম, যেন আসে তোমাকে দেখতে। এলো, সে যে এলো তুমি দেখতে পেলে না। ফকরুল মামার টাকার অভাব নেই, তারপরও আমি ভেবেছিলাম যদি কখনও আবার ভেবে বসে যে আসবে না, গাড়িভাড়াটা হাতে থাকলে অন্তত একটা তাগাদা থাকবে আসার জন্য, তাই দেওয়া। ঝুনু খালা আসেনি। বড় মামাও না। তোমাকে এখন দেখতে এসেই বা কী লাভ! তোমার মৃত্যু দেখতে কি মানুষকে আসতে বলেছিলাম! তখনই তোমার প্রয়োজন মানুষের উপস্থিতর, যখন কথা বলতে পারতে, কাছের মানুষদের কাছে পেয়ে ভালো লাগা পেতে পারতে। এখন কী দরকার! সারাজীবন তো মানুষ তোমার অনেকটা বেঁচে-না-থাকার মতো বেঁচে থাকা দেখেছে। মৃত্যুময় জীবন দেখেছে। এখন তাকিয়ে তাকিয়ে তোমার মৃত্যু উপভোগ করার প্রয়োজন কেন তাদের! মারা যখন যাচ্ছোই, একা একাই যাও। সবাইকে এত দুঃসহ দুর্ভোগ দেখাবে কেন! সারা জীবন ধরে তারা তো দেখেইছে যা দেখার। একটা সময়, মা, আমি কিছু আর উপলব্ধি করি না। আমি তাকিয়ে থাকি তোমার দিকে। মানুষগুলোর দিকে। বাইরের কালো উঠোনের দিকে। বাবা আর দাদার আলোচনার দিকে। হাসিনার হাসি হাসি মুখের দিকে। শুভ আর সৌখিনের প্রতিদিনের রুটিনের দিকে।

জানিনা কেন সবাইকে আবারও কাছে আসতে বললাম। তখন শ্বাস নেওয়ায় ছন্দপতন হচ্ছিল, যখন বিরতি বেড়ে উঠছিলো, প্রথম নিঃশ্বাস থেকে দ্বিতীয় নিঃশ্বাসের মধ্যে। যখন ভেঙে ভেঙে যাচ্ছিল শ্বাস, আবার দীর্ঘ হয়ে উঠছিলো, যখন খুব সময় নিয়ে শ্বাস নিচ্ছিলে; এভাবে নিতে নিতে আর নেবেনা শ্বাস, জানি। সবাই এলো, দাদা তোমার শিয়রের কাছে গিয়ে বসলো। না, আমি বিছানায় উঠিনি। বাবা দূরে দাঁড়িয়ে রইলো ঘরে। ঘরে একটু একটু করে ভিড় বাড়তে শুরু হল। এবার নিশ্চয়ই তুমি মরতে সময় নেবে না। না সময় নাওনি, মা। সারাদিন নিয়েছে, রাতে আর নাওনি। রাতে তো সবাই রাতের খাবার শেষে যার যার শুভ্র বিছানায় শুতে যাবে, সেসবে আর ব্যাঘাত ঘটাওনি। দাদা হঠাৎ চিৎকার করে উঠলো, নাসরিন, কী হইব। মা নাই! দাদার চিৎকারে সামান্যও চমকে উঠি না। তোমার হাতের আঙুলগুলো খুব মন দিয়ে নাড়ছিলাম আমি। নেড়ে যাচ্ছিলাম। তোমার নখগুলো অনেকদিন কাটা হয়নি দেখছিলাম, আঙুলগুলোয় কয়েকদিন লোশন পড়েনি, দেখছিলাম। সুহৃদ ওষুধ নিয়ে ঢুকলো তখন। এসেই সে তোমাকে দুহাতে জড়িয়ে জোরে কেঁদে উঠলো। কান্নার সুহৃদকে সঙ্গে সঙ্গে ফকরুল মামা তুলে নিয়ে থামাতে চেষ্টা করলো। আমি বুঝতেপারিনা সুহৃদের কান্না থামানোর তার কী প্রয়োজন! তোমার দেবশিশু যদি আজ না কাঁদে কবে কাঁদবে? সুহৃদের জীবনের সবচেয়ে বেশি ঋণ তত তোমার কাছেই। সেই তুমি মারা যাবে, আর সুহৃদ কাঁদতে পারবে না! কারও কাঁদা উচিত নয়, কে এই নিয়ম তৈরি করেছে? সমাজ, নাকি ধর্ম। মনে আছে ফজলি খালা কারও মৃত্যুতে কাঁদতে বারণ করতো। বলতো, আল্লাহর জিনিস আল্লাহর কাছে যাচ্ছে, এতে দুঃখ করার কিছু নেই। কাঁদলে নীরবে চোখেরপানি ফেল, কিন্তু শব্দ করো না। শব্দ করে কাঁদলে, বুক থাপড়ালে, কপাল চাপড়ালে আল্লাহ খুব অখুশি হবেন। কিন্তু ফকরুল মামা তো ধর্ম মানে না। সুহৃদের সশব্দ ক্রন্দন তাকে পীড়া দিল কেন! নাকি সে ভাবছিলো, কেঁদে আবার সুহৃদনিজের কোনও ক্ষতি না করে ফেলে। কত আর ক্ষতি হয় কাঁদলে! বাকিজীবন যে ভেতরে বাইরে আমি কেঁদে চলেছি, কী ক্ষতি আমার হচ্ছে! মানুষকে কাঁদতে হয়, অন্যের প্রতি নিজের এবং অন্যান্যের নীচতা, নিষ্ঠুরতা, তঞ্চকতা দেখে কাঁদতে হয়। না কাঁদলে মানুষ মানুষ হবে কী করে!

.

তুমি আর শ্বাস নিলে না মা। রাত তখন দশটা অথবা সাড়ে দশটা কিছু বাজে। ঘরের ভিড় কমলে আমি তোমাকে জড়িয়ে ধরে শুয়ে থাকি। তুমি তখন ঠাণ্ডা হয়ে গেছ। আর কোনও কষ্ট নেই। শ্বাস নেবার দায় নেই। তোমাকে ক্লান্ত কিন্তু ভারমুক্ত বলে মনে হচ্ছিল। বিশ্বাস হচ্ছিল না তুমি আর জেগে উঠবে না, তুমি আর কথা বলবে না বা হাসবে না। তোমার নরম শরীরটা আর নরম নেই। শুয়ে হয়তো ঘুমিয়ে পড়েছিলাম মা। প্রায় চার মাসের একটানা অবসাদশরীরে। হঠাৎ কিছুর শব্দ পেয়ে চমকে উঠি। কী! ফজলি খালা ঘরে এসেছে, চেয়ারে বসে বিছানায় নিথর নিস্তব্ধ তোমার দিকে তাকিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। আমি চিৎকার করি, চিৎকার আমি করবো এই পরিকল্পনা করে চিৎকার করিনি, ভেতর থেকে বেরিয়ে এসেছে চিৎকার, ওই চিৎকার, বাড়ি কাঁপানো চিৎকার, জানালার কাঁচে ঝিনঝিন শব্দ হতে থাকা চিৎকার, আকাশ বাতাস কাঁপানো চিৎকার। যে গালি আমি দিই না, সেই গালি, যে ঘৃণা আমি ছুড়ি না, সেই ঘৃণা আমার ভেতর থেকে বোমার মতো বেরিয়েছে। যে বোনকেতুমি ভালোবাসতে, যে বোনেরপায়ের শব্দ শোনার জন্য তুমি কান পেতে ছিলে, সেই প্রিয় তোমার বোনকে উদ্দেশ্য করে কেন এসেছে শুয়োরের বাচ্চা এখানে, কী দেখতে এসেছে। বেরিয়ে যা, এক্ষুনি। এক্ষুনি বেরিয়ে যা। এক্ষুণি বেরো এই বাড়ি থেকে। হারামজাদি আজকে এসেছে, মড়া দেখতে এসেছে। শুয়োরের বাচ্চা মজা করতে এসেছে। বেরো এক্ষুনি এই মুহূর্তে। আমি আমি ছিলাম না মা। আমার সহ্য হয়নি ফজলি খালার এই উপস্থিত। কত যে তাকে তোমাকে দেখতে আসার জন্য ডেকেছি। ফজলি খালা ছিল তোমার সবচেয়ে আদরের বোন। অসুস্থ জেনেও, মরে যাবে জেনেও একদিনও সে দেখতে আসেনি নিজের বোনকে। কারণ হচ্ছি আমি। আমি নাস্তিক, তাই যে বাড়িতে নাস্তিক আছে, সে বাড়িতে তার মতো পবিত্র আস্তিক পা রাখতে পারে না। ছটকুকে দিয়ে, শরাফ মামাকে দিয়ে, টুটু মামাকে দিয়ে, ফেলু মামাকে দিয়ে, রুনু খালাকে দিয়ে দিনের পর দিন অনুরোধ করেছি। বলেছিনাস্তিক তোমার চোখের সামনে থাকবেনা, তুমি শুধু তোমার বড়বুকে দেখতে এসো, শেষ দেখা দেখতে এসো, তোমাকে দেখে শান্তি পাবে তোমার বড়বু। না, ফজলি খালা আসেনি। এলো ঠিকই, তুমি জানলে না যে এসেছে। এই আসার কী দরকার। তার এই আসা, তোমার স্থবিরশরীর, তোমার বরফের মতো ঠাণ্ডা কঠিন শরীর দেখতে আসা আমার সইবে কেন! আমার সমস্ত ক্রোধ, রাগ, সমস্ত অভিমান, দুঃখ, আমার শত শোক সে রাতে আগুন হয়ে ঝরলো। তুমি শুয়ে আছে। কিছুই তোমাকে আর স্পর্শ করছে না। জগতের নিষ্ঠুরতা অনেক দেখেছো। বেঁচে থাকতে আমার নিষ্ঠুরতাও দেখেছো অনেক। তুমি দিব্যি মরে রইলে, আর আমি অবাধে নিষ্ঠুরতা করলাম। তবে এই প্রথম তোমাকে ভালোবেসে একটি কুৎসিত নিষ্ঠুরতা করলাম, মা। ফজলি খালাকে আমি ক্ষমা করতে পারিনি। তুমি পারো ক্ষমা করতে অনেক কিছু। আমিও কি কম করেছি ক্ষমা এ জীবনে! সে রাতে পারিনি। ফজলি খালা আমার চিৎকারে বেরিয়ে যেতে বাধ্য হল। এরপর তোমার শরীর নিয়ে কত যে কাণ্ড শুরু হল। সেই রাতেই তোমাকে কলের পাড়ে নিয়ে গিয়ে গোসল করিয়ে গায়ে সাদা কাপড় পেঁচিয়ে দেওয়া হল। কাপড়ে রক্ত লেগে রইলো। তা লাগুক। আমি গোসলেরপূতপবিত্রতায় বিশ্বাস করিনা। যারা মনে করে তুমি এখন আল্লাহ বাপয়গম্বরের কাছে যাচ্ছে তারা হয়তো এসব গোসল, সাদা কাপড়, সুরমা বা আতরে বিশ্বাস করে। গোসল করাবার জন্য কোত্থেকে সব মেয়ে ভাড়া করে আনা হয়েছে। হাসিনা মহা উৎসাহে ছুটোছুটি করছে, একবারদাদা বা বাবার কাছেআরেকবার কলপাড়ের লোকদের কাছে। মনে আছে তুমি একবার বলেছিলে, তুমি মারা যাওয়ারপরফজলি খালারননদ জোহরা, তুমি চাও, যেন তোমাকে গোসল করায়। জোহরার মধ্যে সততা আর সারল্যের সন্ধান পেয়েছিলে হয়তো। আমি ও নাম নিইনি। বেচে থাকতে তোমার কোনও ইচ্ছেপূরণ হয়নি। মরে গেলে তোমার ধর্মবিশ্বাস থেকে প্রসূত ইচ্ছেগুলোর কী হল, তা আমার জানতে ইচ্ছে করে না। তোমার ওই প্রাণহীন শরীরটি তুমিনও হাসিনা, দাদা, বাবা এরা তো তোমার জীবন নিয়ে কিছুভাবেনি, মৃত্যু নিয়ে ভেবেছে। মধ্য রাত্তিরে কী করে এত কিছুঘটে যাচ্ছে জানিনা। ব্যবস্থাপনায় কেছিল, কারা ছিল জানি না। যা কিছু হয়েছে, আমার আড়ালেই হয়েছে। সবকিছুর ব্যবস্থাপক যে বাবা, অনুমান করতে পারি। কী সুন্দর আগরবাতির গন্ধ চারদিকে। আগরবাতি আগে থেকে ঠিক করা ছিল তবে! কাফনের কাপড়টিও আগে থেকেই কেনা ছিল! আমার শুধু সারারাত মনেপড়েছে, সারাদিন মনেপড়েছে তোমার দুঃসহ জীবনের কথা। বাড়িতে এখন উৎসব লেগেছে। উঠোনে আলো। কোত্থেকে একটি কাঠের সস্তা খাঁটিয়া না কী নিয়ে এসেছে কে জানে, সাদা কাপড়ে মোড়ানো তোমাকে ওতে শুইয়ে বৈঠকঘরে এনে রাখা হল। এখন তুমি বাবার আর দাদার সম্পত্তি। আমার কিছু নও। তোমার শরীর নিয়ে এখন কী করা হবে, কী করা উচিত, তা আমার কাছে কেউ আর জানতে চাইছেনা। যখন শ্বাস নিয়েছে, আমার পাপের প্রায়শ্চিত্ত আমি করতে চেয়েছি, তোমাকে ভালোবেসেছি, পাশে থেকেছি, তোমারশরীর ভালো করার কোনও উপায় আমারছিল না, তোমার মন ভালো করার জন্য, তোমার মনে সামান্য সুখ দেওয়ার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করেছি। শ্বাস আর নিচ্ছেনা, আমার ছুটি, হ্যাঁ মা, ছুটিই। তোমাকে বৈঠকঘরের মেঝেয় শুইয়ে দেবার পর কি ওরা টেলিভিশন চালিয়েছিল! মনে নেই। চালালেও অবাক হওয়ার আমার কিছুছিলনা। আমার সব অবাক হওয়া, সব দুঃখ পাওয়া, কষ্ট পাওয়া তোমার মতোই স্থবির পড়ে আছে, প্রাণহীন। সকালে অদ্ভুত সব কাণ্ড হতে লাগলো। সবই বাবার মস্তিষ্ক প্রসূত। রিক্সা করে কে যেন বাইরে মাইকে ঘোষণা করছে, ডাক্তার রজব আলীর স্ত্রী গতকাল রাত সাড়ে দশ ঘটিকায় ইন্তেকাল করেছেন, ইন্নালিল্লাহে কিছুএকটা রাজেউন। দুনিয়ার লোককে তোমার মৃত্যু সংবাদ জানিয়ে দেওয়ার কী প্রয়োজন আমি কিছুই বুঝতে পারলাম না। আমার খুব অস্বস্তি হয় ওই ঘোষণা শুনতে। তোমার নিঃশব্দেচলে যাওয়া সশব্দে প্রচারিত হচ্ছে। মানুষ যার যার জীবন নিয়ে সবাই ব্যস্ত। তারা তোমার মৃত্যুর খবর জেনে কী করবে, উৎসব করবে, নাকি কাঁদতে বসবে? কজন আর চিনতো তোমাকে! তুমি বোরখা পরেই চিরকাল বাইরে বেরিয়েছে। কেউ তোমারমুখটাও কোনওদিন দেখেনি। পাড়ার কারও সঙ্গে তোমার তো খুব সখ্য ছিল না। কিন্তু বাবার এসব কার্যকলাপে বাধা দেওয়ার ক্ষমতা আমার নেই। তুমি যেই না চোখ বুজলে, এ বাড়িতে আমি মুহূর্তে অস্পৃশ্য হয়ে উঠলাম। মূল্যহীন হয়ে উঠলাম। আমার কোনও পরামর্শ বা চাওয়া না চাওয়ার কোনও দাম নেই তখন।

আমি লাশ শব্দটা উচ্চারণ করি না, কবর শব্দটাও আমি উচ্চারণ করি না। মরে গেছে শব্দটা আমি লক্ষ করি আমি উচ্চারণ করি না। আমি শুধু বাবাকে বলি, মা অবকাশে থাকবে, অবকাশ থেকে মাকে বাইরে বের যেন না করা হয়। অবকাশে মা মার হাতের লাগানো কোনও গাছের তলায় থাকুক। আমি পাগলের প্রলাপ বকছি বাবা ভেবেছে। বাবা ব্যস্ত। অবকাশে প্রথম কেউ মারা গেল। কত দায়িত্ব, কত কর্তব্য তার। তোমাকে নাকি আকুয়ার কবরখানায় রেখে আসা হবে। কী রকম যেন অদ্ভুত লাগে সমস্ত ব্যাপারটা। তোমার মরে যাওয়া, ওদের ছুটোছুটি, ওদের মাইকের ঘোষণা, ওদের কাফনের কাপড় কেনা, ওদের মাটি খোঁড়া, তোমাকে বাড়ি থেকে নিয়ে যাওয়া, তোমাকেপুঁতে দেওয়া, তোমাকে ফেলে আসা, তোমাকে একা ফেলে আসা, অন্ধকারে, গর্তে-সবকিছুকেই চরম নিষ্ঠুরতা ছাড়া আর কিছু মনে হয় না। মা। আমি তাকাতে পারি না ওসবের দিকে। মানুষগুলোকে আমার মনে হয় আমি চিনি না। শুধু তোমাকে চিনি, শুয়ে থাকা তুমি, যদিও শ্বাস ফেলছো না, যদিও চোখ খুলছে না, তোমাকেই চিনি।

যে বিছানায় যে চাঁদরে শুয়েছিল, সেই বিছানায় তোমার স্পর্শ লাগা চাঁদরে আমি শুয়ে থাকি। ওদিকে তোমারশরীর নিয়ে উৎসব চলছেই। ছোটদাকে ফোন করে আগেইমৃত্যুর খবর জানিয়েছে বাবা। ছোটদা বলে গিয়েছিল, ‘কিছু হলে’ তাকে যেন ফোন করা হয়। কিছুটা এতদিনে হয়েছে। কিছুটার জন্য এখন ছোটদা আসবে অবকাশে, কিছু হলে যে জিনিসগুলো করতে হয়, সে জিনিসগুলো করবে ছোটদা। এই আড়ম্বর, এই অভিনয় আমার খুব হাস্যকর লাগে। যে ছোটদার কোনওদিন সময় হয়নি তোমার চেতন থাকা অবস্থায় তোমাকে সঙ্গ দিতে, এখন অচেতন তোমাকে, ঠাণ্ডা পাথর তোমাকে, মৃত তোমাকে হিরোর মতো দেখতে আসবে সে। সে হিরো। হিরোরা সবসময় দূর থেকে আসে, হিরোদের কাছাকাছি কোথাও থাকতে নেই। হিরোর জন্য তোমাকে শুইয়ে রাখা হল। জানাজাপড়ানোরজন্য শুনলাম মামারা আর দাদা মসজিদেমসজিদে ইমাম বা মৌলবী খুঁজেছে। শহরের কোনও মসজিদ থেকে কোনও ইমাম আসবে না জানিয়ে দিয়েছে। দাদা বললো, ‘তোর জন্য। যত ইমাম আছে সবাই একবাক্যে একটা কথাই বলেছে, নাস্তিকের মার জানাজা তারা পড়বে না।‘

.
 
আমার ইচ্ছে করে তোমাকে বরফে ডুবিয়ে রাখি, কোনওদিন যদিমানুষ বাঁচানোরপদ্ধতি আবিষ্কার হয়, বাঁচাবো তোমাকে। কিন্তু কে শুনবে আমার কথা! তোমার শরীর ওরা আমার কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়ে গেছে। বৈঠক ঘরে তুমি শুয়ে আছে, আর ওদিকে কালো ফটক খুলে দেওয়া হয়েছে, তোমাকে পাড়ার স্ত্রী পুরুষ যার ইচ্ছে হচ্ছে দেখে যাচ্ছে। যে কেউ এসে দেখে যেতে পারছে। সবার জন্য আজ বন্ধ দুয়ার খুলে গেছে। মৃত্যু যে দেখার বিষয় হয় কোনওদিন, জানা ছিল না। বেঁচে যখন ছিলে, কজন দেখতে এসেছে? প্রতিবেশীরা বেশির ভাগই হিন্দু। বাবা বড় পাঁচিল তুলে দিয়েছিলো বাড়ির সামনে, প্রতিবেশী থেকে বিচ্ছিন্ন থাকার জন্য। রাস্তার অচেনা লোকেরই বা বাড়ি ঢুকে প্রাণহীন একটি মানুষকে দেখার প্রয়োজনটা কী? তুমি তো আর কোনও রাজনীতির লোক ছিলে না। তুমি ছিলে বোরখা পরা একটি মেয়ে। আজ অনাবৃত করা হয়েছে তোমার মুখ। আজ আর তোমার বোরখার প্রয়োজন নেই। জীবিত থাকলে তোমাকে ঢেকে রাখতে হবে, তোমাকে লুকোতে হবে, মরলেই তোমার সব বন্ধন মুক্ত, মরলেই তোমার মুক্তি। না মরে তোমার বোধহয় মুক্তি ছিল না, কোনও মেয়েরই কি আছে! আমার ভালো লাগে না বাড়ির আয়োজন। হাসিনাকে কেউ একজন বলে গেছে যেদিন কেউ মারা যায়, সেদিন বাড়িতে রান্না চড়াতে হয় না। রান্না না চড়ানোটাও উৎসবের ব্যাপার। পিকনিক পিকনিক আনন্দ। আমি ঠিক জানি না বাইরে থেকে কারা খাবার দিয়েছিলো, আমি খাইনি কিছু। খাওয়ার কোনও রুচি হয়নি। উঠোনের পেছন দিকটায় হেঁটেছি। তোমার হাতে লাগানো ফুল ফলের গাছগুলো দেখেছি। ফলের গাছগুলো ফল দিচ্ছে, সব ফুলগাছে ফুল। কী ভালোই না বাসতে এই অবকাশের সব কিছু। অথচ এবাড়িতেই তোমার থাকা হয়নি। তোমাকে থাকতে দেওয়া হয়নি। হাসিনার হাতে সর্বময় ক্ষমতা দিয়ে তোমাকে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করেছিল বাবা। তারপরও তুমি এ বাড়িতে অনাহুতের মতো আসতে। আঘাত পেতে সবার ব্যবহারে কাঁদতে। তারপরও মায়া যায়নি। এই গাছগুলোই ছিল তোমার আপন। গাছগুলোয় জল সার দিতে। গাছগুলোর সঙ্গে মনে মনে কথা। বলতে। সেই গাছগুলোর কাছে গিয়ে যেন কেউ না দেখে, কাঁদলাম। কান্না এলো মা। তোমার জন্য তো তোমার অসুখ ধরা পড়ার পর থেকে কাঁদছি। আগে কাঁদিনি। আগে একা কেঁদেছো তুমি। আর অসুখেরপর? একটুও কাঁদোনি। যেন তোমার মতো সুস্থ আর কেউ নয়। সুস্থ মানুষের অভিনয় করেছে, একই সঙ্গে একা যুদ্ধ করেছো। তুমি তো হেরে গেছো যুদ্ধে। তুমি হেরেছো, নাকি আমরা হেরেছি, মা? আমার মাঝে মাঝে মনে হয় আমাকে আর বাবাকে তুমি চরম হারিয়ে দিয়েছে। আমাদের ডাক্তারি বিদ্যে দিয়ে যে আশংকাটি আমরা করতে পারিনি, কোনও ডাক্তারি বিদ্যে ছাড়াইতুমি সেই আশংকা করেছে। আমাদের কোনও সাহায্য ছাড়াইতুমি বলেছো, তোমার বড় একটা অসুখ হয়েছে। আমাদের জ্ঞানকেই শুধু তুমি হারাওনি, আমাদের মনুষ্যত্বকেও হারিয়েছে। আমাদের মতো নির্মম নিষ্ঠুর মানুষেরা তোমার মহত্বের কাছে হেরেছি। কী ভীষণ স্বার্থপর চারদিকের মানুষগুলো। বলছে তোমাকে নাকি এখন নিয়ে যাওয়া হবে বাড়ি থেকে। ওই বৈঠকঘরের ভিড়ের মধ্যে তোমাকে ঘিরে সার্কাস চলছে। সার্কাসে বড় বিরক্তি আমার। খাঁটিয়ায় শুয়ে থাকা তুমি অথচ তুমি-নওকে দেখার মোটে ইচ্ছে নেই আমার। কিন্তু কারা যেন আমাকে টেনে নিয়ে গেল ওঘরে, তোমার কাছে। তোমাকে শেষ দেখা দেখার জন্য। বড় মামাই বোধহয়। আমি শুধু হাঁটু গেড়ে বসে তোমার মুখে, তোমার গালে, বুজে থাকা চোখে, তোমার কপালে আলতো হাত বুলোলাম। ঠাণ্ডা পাথর হয়ে থাকা তোমার মুখ। জলে উপচে উঠেছে চোখ, যতটা পেরেছি আড়াল করেছি। বড় মামা পাশে দাঁড়িয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠেপকেট থেকে রুমাল বের করে বললো যে ওই রুমালটা তুমি তাকে দিয়েছিলে। ওই রুমালে বড়মামা নিজের চোখের জল মুছলো মা। তোমার দেওয়া রুমালে। তুমি তো তাকে মিয়াভাই বলে আর ডাকবে না। হঠাৎ তোমাকে কারা যেন উঠিয়ে নিয়ে চলে গেল। সম্ভবত মামারা। আমি হতবাক দাঁড়িয়ে রইলাম দরজায়। এই অবকাশে, এই বাড়িতে তুমি আর ফিরবে না মা। তুমি আর কোনওদিন আবদার করবে না এক বাটি দুধ, দুটো কলা আর একটা ডিমের জন্য, তোমার ভেঙে যাওয়া স্বাস্থ্যের জন্য বাবার কাছে আর কোনও আবদার করবে না। দাদার কাছে আর আবদার করবেনা কোনও একটা ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবার জন্য, বা গাড়িটা একটু চড়তে দেওয়ার জন্য। তোমার ছেঁড়া লেপ আর নষ্ট হয়ে যাওয়া তোশক পাল্টানোর জন্য কাউকে অনুরোধ করবে না। ভেঙে যাওয়া খাটটি সারাবার জন্যও আর কাউকে না। ডাব বিক্রি করতে এসে আর তুমি দেখবে না হাসিনা সব বিক্রি করে ফেলেছে। আর তোমাকে মশার কামড়ে বাইরের বারান্দার মেঝেতে রাত কাটাতে হবে না। এই অবকাশ থেকে আর অপমানিত হতে হতে প্রত্যাখ্যাত হতে হতে তোমাকে চোখের জলে বিদেয় নিতে হবে না। তুমি মুক্তি দিয়ে গেলে সবাইকে। সবাই এখন সুখে শান্তিতে বেঁচে থাক। সবাই এখন হাসি আনন্দে জীবনের গান গেয়ে যাক।

.

অবকাশ দেখে কেউ বুঝবে না আজ এ বাড়ি থেকে মা নামের একজন চলে গেল, এই চলে যাওয়া মানে কখনও আর ফিরে আসা নয়। সন্ধেবেলায় যথারীতি টেলিভিশন চালালো কেউ। নাচের গানের অনুষ্ঠান হচ্ছে। নাটক হচ্ছে। বড় মামা তার মেয়েকে নিয়ে এসেছিল, থেকে যেতে বললাম। ফকরুল মামাও থাকলো। নানিও সেদিনটা রইলো। আমার জন্যই বোধহয় রইলো। আমি না থাকলে তোমার যে কী করুণ অবস্থা হত, তাই বললো সবাই। আমি ছিলাম বলে জীবনের শেষ কটা দিন তুমি আমার সেবা পেয়েছ। আমি তো জানি, এসব সেবার কোনও মূল্য নেই। সত্যিকার সেবা করা হত, যদি আমি সময় মতো তোমার চিকিৎসা করতে পারতাম। যখন দুরারোগ্য ব্যাধি বাসা বেঁধেই ফেলেছে তোমার শরীরে, তখন যে সেবাআমি করেছি, সেই সেবার কী মানে, বলো? চেয়ে চেয়ে তোমার মরে যাওয়া দেখা ছাড়া আর কিছু নয়। না, মা, আমি ক্ষমা চাইনি তোমার কাছে। ক্ষমা আমি চাইবো না কোনওদিন। আমাকে তুমি ক্ষমা কোরো না। বাবা তোমার চিকিৎসা করেনি, বাবা তোমাকে কোনওদিন ভালো বাসেনি। আমি তো তোমার কন্যা ছিলাম মা, আমাকে তুমি প্রচণ্ড ভালোবাসতে। কত শত মানুষের চিকিৎসা করেছি। রাত জেগে জেগে হাসপাতালের কঠিন কঠিন রোগের চিকিৎসা করে সুস্থ করে তুলেছি কত অসুস্থ মানুষকে। তোমাকে কেন করিনি মা। তুমি যে অভিযোগগুলো করতে, ওই রক্তপাতের অভিযোগ, তা অন্য কেউ করলে আমি তো অবহেলা করিনি। নানারকম পরীক্ষা করিয়েছি। কেবল তোমার বেলায় গা করিনি। আর সবাইকেই ক্ষমা করে দিলেও আমাকে কোরো না মা।

.

পরদিন মুন্নি এসেছিল অবকাশে। আমার সঙ্গে অনেকক্ষণ গল্প করে গেল। বললো, মার কথা সারাজীবনই মনে পড়বে। মাকে কখনও ভোলা হয় না। মুন্নি ঠিক কথা বলেছিলো মা, এই দেখ, আজ দশ বছর তুমি নেই। তোমাকে তো একটি দিনের জন্যও ভুলে থাকিনি। এখনও দেখ, চিঠি লিখতে গিয়ে চোখের জল রোধ করতে পারছি না। মানুষের কষ্টে কষ্ট পাওয়া, উজাড় করে কেবল দেওয়া আর দেওয়া, নিজে নিঃস্ব হয়ে যাওয়া–তোমার এই জীবনবোধ, বাকিটা জীবন, অবচেতনেই আমি চর্চা করবো জানি। তোমার বোধের এই উত্তরাধিকার, আমি অহংকার করে বলি, আমার।

শুনেছি তোমাকেআকুয়ারকবরখানায় কবর দেওয়া হয়েছে। শুনেছি তোমার জানাজা হয়েছে, জানাজা শেষ পর্যন্ত পড়িয়েছে ফজলিখালার ছেলে মোহাম্মদ, যে মোহাম্মদ তোমাকে দেখতে এসে পীরের মতো তোমাকে তোমার মেয়ের বিরুদ্ধে, মেয়ে কী করে দোযখের আগুনে পুড়বে, আর তার সঙ্গে সম্পর্ক রাখলে তুমিও যেপুড়বে দোযখের আগুনে, সেসব ভয়াবহ কথা সুর করে করে বলে গিয়েছিলো। শুনে তোমার খুব মন খারাপ হয়েছিল। ধর্মের নিষ্ঠুরতা দেখতে দেখতে আমার বিশ্বাস, ধর্মে তোমার বিশ্বাস হারিয়েছিল। তোমার মতো ভালোবাসা আর দয়া আর করুণা আর স্নেহ শ্রদ্ধায় যার হৃদয়পূর্ণ সে কী করে পারে নিষ্ঠুরতা মেনে নিতে! মোহাম্মদ চলে যাওয়ার পর আমি ছুটে এসেছিলাম তোমার কাছে, ভেবেছিলাম তোমার মুখে দেখবো তৃপ্তির হাসি। পীর আমিরুল্লাহর মৃত্যু হওয়ার পর, আমিরুল্লাহরসবেধনপুত্ররও মৃত্যু হবারপর, তারপুত্র মোহাম্মদ এখনপীর বাড়িরনতুনপীর। এই নতুনপীরের নছিহত পেয়ে তোমার তো খুশি হওয়ার কথা, কিন্তু বিষঃ তুমি বললে, এই এখনকার ছেলেরা আসলে কিছু জানে না।

আমি না হয় সারাজীবন তোমার সঙ্গে অন্যায় করেও জীবনের শেষ কটা দিন তোমাকে একটু শান্তি দিতে চেয়েছিলাম। বাবা করলো তুমি অবকাশ থেকে জন্মের মতো চলে যাওয়ার পর। বাইরের মাঠে বড় সামিয়ানা টাঙিয়ে কী সব মিলাদটিলাদপড়া হল। প্রচুর খাওয়া দাওয়ার আয়োজন হল। ভিখিরিদের খাওয়ানো হল। খরচ বাবাই করলো। তাঁর মতো পাঁড় নাস্তিকের হঠাৎ ধর্মীয় অনুষ্ঠানের আয়োজন করার কারণ কী আমি জানিনা। বাবা যেভাবে বলছে, দাদা সব করছে। আমিও দাদাকে যা আদেশ করেছিলাম, পালন করেছিলো। তোমার সামনে বসে একদিন অনেক হাসির গল্প শোনাতে বলেছি। দাদা শুনিয়েছে, প্রচুর হেসেছো তুমি। আমিও হেসেছি। হাসতে হাসতে, তোমার নির্মল হাসি দেখতে দেখতে চোখে জল এসেছে আমার। যেন নিজেরহাসিরকারণে চোখেজল এসেছে, এমনকরে চোখের জল মুছেছি। আমার ফুটফরমাশ দাদা বাধ্য ছেলের মতো শুধু ঢাকায় নয়, ময়মনসিংহেও খেটেছে। দাদাকে দিয়ে শীতলপাটি, এটাসেটা, গুলকিবাড়িরপীর আর তার মুরিদদের জন্য প্রেসক্লাবের বিরিয়ানি, অক্সিজেন সিলিণ্ডার, স্যালাইন, ওষুধপত্র সব আনিয়েছি। ছোটদাকে দিয়ে এসব কাজ সম্ভব হত না। সে উড়ে এসেছে। তোমাকে মাটি দেওয়ার জন্য, জানাজা পড়ার জন্য। তখন তার ছুটি, এমনকী অবকাশেও দুটো দিন বেশ কাটিয়ে দিল। তুমি বেঁচে থাকতে দেয়নি। আর আমি যখন তোমার কবরে একটি শ্বেত পাথরের এপিটাফ আর তোমার শিয়রের কাছে একটি শিউলি ফুলের গাছ পুঁতে দেওয়ার আয়োজন করছি, এত আদিখ্যেতা ছোটদা মোটেও পছন্দ করেনি। বিশেষ করে পছন্দ করেনি আমি যখন শরাফ মামাকে দিয়ে স্বদেশী বাজারে পাঠিয়ে সত্যি সত্যি তোমার এপিটাফ লিখিয়ে আনলাম, যেখানে লেখা ছিল–অনাহারে, অবহেলায়, অপমানে, অনাদরে যার সারা জীবন কেটেছে সেই দুঃখবতী নারী শুয়ে আছে এখানে। বেগম ঈদুল ওয়ারা। বয়স ষাট। শরাফ মামা লিখিয়ে আনলো, তবে ওপরে আরবিতে কিছু একটা জুড়ে দিয়ে। কী? না, কবরের ফেরেসতাকে সালাম জানানো, ওটা নাকি দিতেই হয়, সব এপিটাফেই দেওয়া থাকে। শরাফ মামার এ কাজটা সংগত কারণেই আমার ভালো লাগেনি। বড় মামারও লাগেনি। শরাফ মামাকে বললোও বড় মামা ‘তোকে তো আরবিতে সালাম জানানোর কথা লিখতে বলা হয়নি। এটা তো বিশ্বাস ভঙ্গ করা।’ শরাফ মামার নিজের বিশ্বাস শ্বেতপাথরে চাপিয়ে দেওয়া হল। ছোটদার বক্তব্য আমি পরিবারের মাথা নিচু করে দিতে চাইছি, মা অনাহারে ছিলো না, মাকে অবহেলা কেউ করেনি, মা সারাজীবন খুব সুখে কাটিয়েছে। এত বড় মিথ্যে আমি লিখেছি কেন, এই এপিটাফ কোথাও যাবে না। আমি বললাম, যাবে। ছোটদার প্রচণ্ড বিরোধিতা সত্বেও টুটু মামা, শরাফ মামা আর ছটকুর সহযোগিতায় কাজটা করি আমি। ওই এপিটাফই একটি স্তম্ভ বানিয়ে লাগানোহল। একটু হলেও স্বস্তি পাই। বড় মামা এপিটাফে তোমার ষাট বছর বয়স দেখে চমকে উঠেছে। বয়সতিন বছর বাড়িয়ে দিয়েছি আমি। বয়স তখনও বড়মামারইষাট হয়নি। বড় মামার আর তোমার জন্ম সাল লেখাপুরোনো নথি বের করে দেখালেন, বয়স তোমার সবে সাতান্ন হয়েছিলো। মামাদের বলেছিলাম, শ্বেতপাথরে লেখার লোক এনে ষাটকে সাতান্ন করে দিতে। জানিনা দিয়েছে কী না। জানি না তোমার শিয়রেপুঁতে দেওয়া গাছটিতে ফুল ফুটেছে কিনা। কবরে আমার আকর্ষণ নেই। তুমি ওখানে নেই মা। ওই মাটির নিচে কবেই তোমার ঠান্ডা শরীরটাপচে গেছে। তোমার হাতপামুখ, তোমার পা, পায়ের আঙুল, জন্ম থেকে চেনা তোমার ওই শরীর আমিশত চাইলেও দেখতে পাবো না। তুমি কোথাও নেই মা। বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের কোথাও নেই মা। এপিটাফ, শিউলি ফুলের গাছ সবই আমার জন্য, আমার শান্তির জন্য। আমার প্রায়শ্চিত্তের জন্য।

.

দুদিন পর নানি বাড়ি গিয়েছিলাম। নানির সঙ্গে বিছানায় শুয়ে শুয়ে বলেছি তোমার কথা। নানি ক্রমাগত কেঁদেই চলেছে। কেঁদে কেঁদেনানি একটাই কথা বলে, ঈদুন তো নাই, আমারে দেখার কেউনাই। নানিবাড়িতে সবাই আমাকে খুব আদর করলো। আদর করলোকারণআমি নিরন্তর তোমাকে সঙ্গ দিয়েছি, সবার কাছে অভাবনীয় যে সেবা, সে সেবা করেছি। কেউ কেউ বললো, তুমি নাকি খুব ভাগ্যবতী, আমার সেবা পেয়েছে। এসব শুনলে আরও অপরাধ বোধ জাগে, আর কেউ না জানলেও আমি তো জানি, এই সেবা অর্থহীন। নানিবাড়ি থেকে তোমার লেখা আরবি গ্রামারের বড় বড় খাতা নিয়ে এলাম। অবকাশে তোমার নতুন রং করা আলমারিতে তোমার সব জিনিসপত্র গুছিয়ে রাখলাম, তোমার বই খাতা, তোমার কাপড়চোপড়, তোমার ব্যবহারের জিনিসপত্র। তোমার লেখা চিঠিপত্র। চিরকুট। মৌলবাদীদের বিরুদ্ধে লেখা পত্রিকায় পাঠানো চিঠির খসড়া। তুমি চিঠি লিখতে, আমার মা হিসেবে নয়, পাঠক হিসেবে, একজন সচেতন মানুষ হিসেবে লিখতে, তসলিমার ফাঁসি যারা চেয়েছে, তারা ইসলামের কিছুই জানে না। তারা মুসলমান নামের কলংক। একজন সংবেদনশীল সৎ লেখককে আজ বাধ্য হয়ে দেশ ছাড়তে হয়েছে। আর দেশের ভেতর ইসলামের নামে যে অসহিষ্ণু মোল্লাতন্ত্র মাথা চাড়া দিয়ে উঠছে, তারাই ইসলামের ক্ষতি সবচেয়ে বেশি করছে। ইসলামকে তসলিমা বিপন্ন করেনি, মোল্লাতন্ত্র করছে। সরকারের কাছে আমরা দাবি জানাচ্ছিতসলিমাকে দেশেফিরিয়ে আনুন। তসলিমাকে তার মায়ের কোলে ফিরিয়ে দিন। …এসব পড়ে চোখ আমার বারবার জলে ভিজেছে। কেউ কি ভালোবেসেছে আমাকে অমন করে, সংসারের কেউ? তুমি ছাড়া আমার কেউ ছিলো না। এ কথা আমি কোনওদিন জানিনি, যে, তুমি ছাড়া আমাকে ভালোবাসার কেউ ছিল না। কী যে খালি খালি লাগছিল আমার। কী যে শূন্য লাগছিল জগৎ। কী যে অন্ধকার লাগছিলো চারদিক, কী করে বোঝাবো তোমাকে। এখনও লাগে মা, এখনও। আমি আমার শূন্যতার কথা ভেবে কাঁদি না। যখন কাঁদি, জীবনে যে কষ্ট তুমি করেছে, সে কথা ভেবেই কাঁদি। তোমার কষ্ট লাঘব করার কত সুযোগ আমার ছিল, লাঘব করিনি। সেই বেদনায় কাঁদি আমি।

মা, অবকাশ থেকে তুমি চলে যাওয়ার পর দুলুর মা এসেছিল। এই দুলুর মাকে সারা শহর লোক দিয়ে খুঁজিয়েছি। কোথাও তাকে পাওয়া যায়নি। আশেপাশের যত বস্তি আছে, সব বস্তিতে শুধু দুলুর মাকে কেন, আনুরমাকেও খুঁজিয়েছি। আনুর মা, তুমি বলেছিলে, নদীর পাড়ের কোনও এক বস্তিতে থাকে। কত জনকে বস্তি খোঁজ করতে পাঠিয়েছিলাম। খোঁজ করে ওদের পাওয়া যায়নি। ওরা এমনিতেই তোমার সঙ্গে দেখা করতে অবকাশে এসে শোনে যেতুমি নেই। দুলুর মা, আনুর মা দুজনই আকুল হয়ে কেঁদেছে তোমার জন্য। লোক দেখানো কান্না নয়, সত্যিকারের কান্না। মা, তোমার অনেক আত্মীয়র চোখে ওই জল দেখিনি, দেখেছি ওই দীন দরিদ্রর চোখে। ওরাই তোমার সত্যিকারের আপন ছিল, মা। ওরাই হয়তো তোমাকে বুঝতো। হয়তো তুমি দরিদ্র ছিলে, তাই।

.

মা, তুমি ফিরিয়ে নিয়েছিলে আমাকে দেশে। আর কারও পক্ষে সম্ভব হয়নি। এক তুমিই পেরেছিলে। কিন্তু তুমি জানোনা, যে, দেশ থেকে আমাকে দ্রুত বেরিয়ে যেতে হয়েছে। তুমি জানো, এখনও আমি দেশেই আছি। এটুকুই তো জেনে ছিলে। জীবন দিয়ে আমাকে আগলে রেখেছিলে। যেন কারও স্বার্থপরতা আমাকে স্পর্শ না করতে পারে। না, মা। দেশে থাকা আমার সম্ভব হয়নি। আমার নিরাপত্তার জন্য যেসব রক্ষী সরকার থেকে দেওয়া হয়েছিল, তাদের ঠেলে সরিয়ে যে কেউ আমাকে হত্যা করতেপারত। ময়মনসিংহের বারান্দার ঘরটার সোফায় বসেওরা ঘুমোতো। পায়ের কাছে পড়ে থাকতো ওদের লম্বা লম্বা পুরোনো রাইফেল। যে কেউ এসে রাইফেল তুলে নিয়ে দৌড় দিলে বোঝার ওদের কোনও উপায় ছিলো না। আমার মনে হয় না ওরা ঠিক জানত, ওরা ঠিক কী করতে এ বাড়িতে এসেছে। বাবা ওদের যত্ন করতো খুব, চা নাস্তা দিত। যখন ঢাকা যাবো, পুলিশের কারও সঙ্গে যাবার নিয়ম নেই। আমার তো কাজ নেই আর ময়মনসিংহে। তুমি নেই। অবকাশেআমার ঘরটি এখন শুভরঘর। ইয়াসমিনের ঘরটি সৌখিনের ঘর। বাবারঘরটিতেই হয়তো থাকা যেত। কিন্তু কদিন! অবকাশের সর্বময় কী এখন হাসিনা। বাবা হাসিনার হাতে সংসার ছেড়ে দিয়েছে, এ সংসারে আমি নিতান্তই ক্ষণিকের এক অতিথি। কিছুই আমার নয়। আমি এ বাড়িতে তোমার মতোই বাড়তি লোক। বড় একটি গাড়ি ভাড়া করে ওতে মামাদের নিয়ে, দাদা আর বাবাকে তুলে ঢাকা চলে গেলাম একদিন। টুটু মামা নিজ দায়িত্বে এনেছে লোহার ডাণ্ডা টাণ্ডা, তার ভাষায় অস্ত্র, সস্ত্র, মেঝেয় ঢাকা দেওয়া কালো কাপড়ে। আমার নিরাপত্তা রক্ষীর কাজ তারাই করছে। এতে নিরাপদ বোধ করেছি কিছুটা, বাকিটা স্বস্তি। স্বজনদের সতেজ সমর্থন আমাকে সবটাই স্বস্তি দেয়। মামারা আমাকে কাছের মানুষ বলে বেশি মনে করছে। যেশরাফ মামাকে মালোয়েশিয়া থেকে আমার বাড়িতে একদিন আশ্রয় দিয়েছিলে বলে হেন কটু কথা নেই তোমাকে বলিনি, সেই শরাফ মামাকে তোমার সামনে আমি যত্ন করে খাইয়েছি। ওই পাপের প্রায়শ্চিত্ত করেছি, মা। তোমার মনে কষ্ট দেওয়ার প্রায়শ্চিত্ত। তুমি যে তোমার আদরের বাবা মা ভাই বোনের চেয়েও আমাকে বেশি ভালোবাসতে, তা আমার বোঝা হয়েছে তুমি যখন কাউকেই আর কাছে ভিড়তে দিতে চাওনি। এমন কি নানিকে, ঝুনু খালাকেও। ওরা তো তোমার আপন ছিল খুব। তুমি ভেবেছিলে, ওরা বোধহয় ওদের স্বার্থের কারণে, ।আমার কাছ থেকে টাকা পয়সা নেবার কারণে তোমাকে দেখতে আসছে। আর আমি যেহেতু খুব দরদী, আমার যা আছে সব উজাড় করে দেব ওদের জন্য। না, মা। ওই আশংকাতুমি না করলেও পারতে মা। তোমার মা বা বোন কেউ অত স্বার্থান্ধ নয়, যত তোমার নাড়িছেঁড়াপুত্রধন কামাল, আমার ছোটদা। তোমার মা, বোন কেউ আমার কাছে কিছু চায়নি।

আমি তো দেশে ফিরেছিলাম মা। তুমি আমাকে ফিরিয়েছিলে। দেশেই থাকতে চেয়েছিলাম। কিন্তু তুমি জানো না কী ভীষণ কাণ্ড ঘটেছে হঠাৎ একদিন। ভালো যে, ঘটনাটা তুমি দেখোনি। দ্বিতীয়বারের দেশ ছাড়াটা তোমাকে যে দেখতে হয়নি, তা একদিক থেকে ভালো। কবি শামসুর রাহমানের বাড়িতে কে বা কারা রাতের অন্ধকারে ঢুকে অতর্কিতে কুড়োল টুড়োল নিয়ে আক্রমণ করেছিল, মেরে ফেলা উদ্দেশ্য ছিল, উনি অল্পের জন্য বেঁচে গিয়েছেন। কিন্তু পুলিশ ওই আততায়ীদের ধরে হাজতে নিয়েছে, এবং যা আবিষ্কার করেছে, তা শুনে তুমি চমকে উঠবে। আততায়ীরা হরকাতুল জেহাদ নামের একটি ধর্মীয় সংগঠনের লোক। নতুন এইইসলাম-বাঁচাও দল গড়ে উঠেছিল সেইনব্বই দশকের প্রথম দিকে। এই হুজির সন্ত্রাসীদের পেটের খবর পুলিশ নিয়েছে, এবং পকেটে যে ওদের সেই কাগজটা পাওয়া গেছে, যাদের হত্যা করার আদেশ ওদের নেতারা দিয়েছে। যাদের হত্যা করতে হবে, তারা হল, ১. তসলিমা নাসরিন, ২. শামসুর রাহমান, ৩. কবীর চৌধুরী আর ৪. ইসলামিক ফাউণ্ডেশনের একজন, মাওলানা আবদুল আওয়াল। তুমি বলতে পারো আমাদের মধ্যে আবার মাওলানা কেন। হতেই পারে। এই মাওলানার সঙ্গে হুজির ইসলামপন্থীদের মতপার্থক্য আছে, তাই। আমার নাম একনম্বরে। পত্রিকাগুলোর সবচেয়ে বড় সংবাদ এটি। আমি সত্যি বলতে কী মা, ভয় পেলাম। যদি হুজির সন্ত্রাসীরা আমার বাড়িতে এসে আমাকে মেরে ফেলে! কে আটকাবে? কোনও পুলিশ নেই বাড়ির সামনে বা দরজার সামনে। আর থাকলেই বা কী! যে কেউ ঢুকতেপারে বাড়িতে পুলিশ কাউকে কোনও বাধা দেয় না। তারা ঠিক জানেও না কী কারণে তাদের বসানো হয়। আগে যখন পুলিশ ছিলো, ওদের বলেছিলাম, দিব্যি ঘুমোচ্ছিল, ঘুম থেকে ডেকে তুলে, কী কারণে আপনারা এখানে বসেছেন? ওরা সরল মুখে বললো, থানা থেকেপাঠিয়েছে। কী কারণে পাঠিয়েছে, জিজ্ঞেস করায় বললো, তারা জানে না। যারা এ বাড়িতে ঢুকতে চায় তাদের তল্লাশি করার কোনও কথা কি বলেছে? ভালো মানুষ পুলিশেরা ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে বললো, না। আমার নাম বললাম, এই নামের কারও কথা কি তারা শুনেছে? তাও বললো, না। এমনই আতংক এসে নাছোড়বান্দার মতো বসেছিলো যে কবীর চৌধুরীকে ফোনে জিজ্ঞেস করলাম, তাঁর বাড়িতে আমি চলে যাব কী না। আমার বাড়িতে মোটেও স্বস্তি বোধ করছি না। কবীর চৌধুরীর বাড়িতে পুলিশ পাহারা বসেছে। এদিকে দূতাবাস থেকে আমাকে ক্রমাগতই জানোনো হচ্ছে যে এক্ষুনি আমাকে দেশের বাইরে চলে যেতে হবে, কারণ তাদের কাছেও খবর এসেছে যে আমাকে মেরে ফেলারসবরকমপরিকল্পনা করা হয়ে গেছে।

.

ফরাসি রাষ্ট্রদূত বাড়িতে এসে বলে গেলেন দেশ ছাড়তে। কী একটা আমন্ত্রণপত্রও দিয়ে গেলেন। ফ্রান্সের ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলি থেকে আসা আমন্ত্রণপত্র, যার কথা আগেই বলে তাগাদা দিয়েছিলেন আমাকে। এর মধ্যেই হঠাৎ নতুন একটি মামলা উঠলো আমার বিরুদ্ধে। নির্বাচিত কলাম বইটা লেখার অপরাধে, গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হল। ওই একই মামলা, ২৯৫ এ। লোকের ধর্মীয় অনুভূতিতে আমি আঘাত দিয়েছি। মত প্রকাশের বিরুদ্ধে একটি গণতান্ত্রিক দেশে এই আইন কী বিচারে থাকে, জানি না। আমাকে আবারও কোর্টে যেতে হল জামিন নিতে। আবারও সেই হুড়োহুড়ি করে জীবনের প্রচণ্ড ঝুঁকি নিয়ে কোর্ট থেকে দৌড়ে পেছনের দরজা দিয়ে গাড়িতে ওঠা। মিডিয়া আর মৌলবাদীর হাত থেকে বাঁচা। বই লেখার অপরাধে আমার বিরুদ্ধে অনেক মামলাই অনেক মৌলবাদী করেছে। কিন্তু হুলিয়া জারি হয়নি খালেদা সরকারের করা মামলা ছাড়া। এই আইন খাঁটিয়ে যখন মামলা করা হয়, অদ্ভুত জিনিস হল, সরকারি অনুমতি ছাড়া এই মামলা করার অধিকার কারও নেই। শেখ হাসিনার অনুমতি নিয়ে মামলা করা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী এ দেশে আমাকে বাস করতে দেবেন না। বুঝি না, ক্ষমতায় এলেই কেন এঁরা দেশটাকে নিজের সম্পত্তি বলে মনে করেন। দেখমা, মানুষ খালেদা জিয়ারশাসনে এবং শোষণে অতিষ্ঠ হয়ে শেখ হাসিনাকে চাইছিলো। কী পার্থক্য হাসিনা আর খালেদায়! তাঁদের নিজেদের মধ্যে মতবিরোধ থাকতে পারে, একজন আরেকজনের দুচোক্ষের বিষ হতে পারেন, নিরবধি চুলোচুলি করতে পারেন, একজনের পান থেকে চুন খসলে আরেকজন লাফিয়ে উঠে আরেকজনের গলা টিপে ধরতে পারেন, কিন্তু আমার ব্যাপারে তাঁরা একশভাগ একমত। আমাকে মেরে কেটে আমার সর্বনাশ করে তবে তাঁদের শান্তি। রাজনীতির লোক না হয়েও কী করে আমাকে রাজনৈতিক সন্ত্রাসের শিকার হতে হলে আমি ভাবি। ভেবেছিলাম এভাবেই থেকে যাবো দেশে। কিন্তু হুজির গোপন খুনের তালিকায় আমার নাম প্রথমে থাকা আর দূতাবাসগুলোর একই সঙ্গে বাংলাদেশ সরকারের চাপ সবই আমাকে আবার ঘরছাড়া করলো। ভালো যে তুমি এই ভয়ংকর ঘটনাটি দেখার আগেই চোখ বুজেছো। দেখলে তুমি যে কী ভয়ংকর কষ্ট পেতে, ভেবে আমি শিউরে উঠি।

দেশ ছাড়ার সিদ্ধান্তটি নিতে আমি শেষপর্যন্ত বাধ্য হই। যাবার দিন সন্ধেয় শরাফ মামা আর টুটু মামাকে কুড়ি হাজার টাকা দিই। আর বাকি কজনের জন্য সামান্য পাঁচ হাজার টাকা করে উপহার। আমি জানি, এই টাকাটা তাদের অনেক কাজে লাগবে। বিদেশের ভালো কোনও রেস্তোরাঁয় একবেলা খেলেই তো আমার দশ হাজার টাকা খরচ হয়ে যায়। বাবা আর দাদারা অসন্তুষ্ট মামাদের আমি টাকা দিয়েছি বলে। যত টাকা বাড়তি ছিলো হাতে, তা বাবার পকেটে ঢুকিয়ে দিয়েছি। মামাদের সব মিলিয়ে যা দিয়েছি, তার চেয়েও বেশি বাবাকে। বাবা তো টাকা পয়সা খরচ করে না। বাবাকে যা দিই, সবই হয় দাদা নয়তো ছোটদার পকেটে চলে যায়।

আমি তখন না জানলেও এখন তো জানি যেতুমি সবচেয়ে বেশি আপন ছিলে। তুমি নেই। বাবাকে আপন যত ভাবি, বাবা হয়তো তত ভাবে না। তারপরও, বাবার অমঙ্গল আমি কিছুতেই কামনা করতে পারিনি। চেয়েছি বাবা সুস্থ থাকুক, ভালো থাকুক, আনন্দে থাকুক। যেভাবেই থাকুক, খুশি থাকুক।

.

আবার সেই আগের মতো। ঢাকা থেকে স্টকহোম। চুরানব্বই সালের আগস্ট মাসে এভাবেই দেশ থেকে বেরোতে হয়েছিল। যেসুইডেনে তুমি ছিলে, আমারপক্ষে সেই সুইডেনে, সুয়েনসনের যে বাড়িতে তুমি ছিলে, আমার পক্ষে সেই বাড়িতে বাসা করা অসম্ভব হয়ে উঠলো। তোমার স্মৃতি, তোমার অসুখ, তোমার চিকিৎসা না হওয়া, তোমাকে বড় চিকিৎসকের কাছে না দেখিয়ে বাড়িতে বসিয়ে রাখা, গ্রামেরপথেপথে অনর্থক ঘোরাঘুরি করা, তোমাকে কষ্ট দেওয়া সব মাকড়শার জালের মতো আমাকে আঁকড়ে ধরে আমাকে খেয়ে ফেলতে লাগলো। ওই জালে তড়পাচ্ছি, আর তখন আমন্ত্রণ এলো ফ্রান্স থেকে। ক্লদ ভাইজ নামের এক ফরাসি চলচ্চিত্র পরিচালক তাঁর সিনেমা-পরিচালক সংস্থার পক্ষ থেকে আমাকে আমার শোধ বইয়ের চিত্রনাট্য লেখার জন্য ফ্রান্সের নরমাণ্ডির মুলাঁ দন্দেতে আমন্ত্রণ জানালেন তিন মাসের জন্য। ওখানে বসে আমাকে চিত্রনাট্য লিখতে হবে সিনেমার জন্য। জীবনে কোনওদিন চিত্রনাট্য লিখিনি, কিন্তু রাজি হয়ে গেলাম, রাজি হলাম সুইডেন নামের নিষ্ঠুর দেশটাকেআর সইতে পারছিলাম না বলে। সুইডেনের ওই বাড়িতে তোমার স্পর্শ লেগে থাকা তোমার বিছানা বালিশ, তোমার গুছিয়ে রাখা কাপড়চোপড় দেখে আমার দম বন্ধ দম বন্ধ লাগছিলো। মনে হচ্ছিল ওই বাড়িটাকে আগুনে পুড়িয়ে দিই। নিজের বাড়ি হলে হয়তো তাই করতাম। একবার তোমার স্মৃতির জন্য ইচ্ছে করে থেকে যাই ওই বাড়িতে। আবার ওই একই স্মৃতির জন্য ইচ্ছে করে পালাই। আনন্দ বেদনা দুইই দেয় স্মৃতি। কাছে আসতে চাই, আবার দূরেও সরতে চাই। যেটুকু সুখ পেয়েছিলে সেটুকুই নিয়ে, ইচ্ছে করে, থেকে যাই। আবার বেদনার স্মৃতিগুলো আমাকে দূরে, অনেক দূরে সরে যেতে বলে। মনে হয় পৃথিবীর অন্য পারে গেলে হয়তো স্বস্তি মিলবে। ইচ্ছে করে সুয়েনসনকে কুড়োল দিয়ে কুপিয়ে মেরে ফেলি, আবার মনে হয় কী লাভ মেরে ফেলে! দোষ তো আমারই। আমি কেন তার সাহায্যের আশায় বসে ছিলাম। দোষ আমার নির্বুদ্ধিতার। আমি না হয় নির্বোধ, লোকটা যদি ওই সময় সামান্য সহযোগিতা করতো, তুমি আজ বেঁচে থাকতে পারতে। সুয়েনসনের চেহারা দেখতে শুধু রাগ নয়, আমার ঘেন্না হচ্ছিল। আমি ফ্রান্সে চলে গেলাম।

.

ফ্রান্সের নরমান্ডিতে জীবন শুরু হল আমার। সে অন্যরকম জীবন। আমি মুলাঁ দন্দেতে এলাম বটে, কিন্তু আর যা কিছুই লিখি, চিত্রনাট্য লেখা আমার আর হয়ে ওঠে না। বিশাল এলাকা জুড়ে সুজান লিপনস্কি নামের এক সুন্দরী ফরাসি মহিলা মুলাঁ বা মিল বা কারখানার মালিক। আমাদের দেশে না হলেও ইওরোপের সভ্য দেশগুলোয়পুরোনো বাড়িঘর বা ইতিহাসের মূল্য হীরের চেয়েও বেশি। পুরোনো আমলে জলের ওপর বড় কাঠের চাকা বসানো হত, সেই চাকা জলের স্রোতে ঘুরলে, চাকার সঙ্গে লাগানো কাঠের গুঁড়িতে স্রোতেরশক্তিটা এসে বসতো, সেই শক্তি কাজে লাগিয়ে গম ভাঙিয়ে আটা করতে লোকে। আরও অনেক কাজে ওই শক্তি ব্যবহার করা হত। মেশিন আবিষ্কার হওয়ার পর ওই মিলগুলোপুরোনো দিনের ইতিহাস হয়ে রয়ে গেছে। জলের ওপর সেই চাকাগুলো ছবির মতো স্থির হয়ে আছে। এক একটি মিলই এখন এক একটি জাদুঘর। প্যারিস শহরে মুলাঁ রুজ বলে একটি বিখ্যাত ক্যাবারে আছে। সেই ক্যাবারে বাড়ির মাথার ওপর মাথা উঁচিয়ে আছে লাল চাকা। নরমাণ্ডির মিলটি উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়েছেন সুজান। কিন্তু এলাকা জুড়ে প্রচুর ঘরবাড়ি উনি নিজের কাজে ব্যবহার না করে, বিক্রি না করে শিল্পীদের বাড়ি বানিয়েছেন। ঘরবাড়িগুলো এখন শিল্পী সাহিত্যিকদের বাসভবন। তিন মাস থেকে শুরু করে এক বা দু বছর এখানে সঙ্গীতশিল্পী, চলচ্চিত্র পরিচালক, চিত্রনাট্যকার, লেখক বাস করবেন। থাকা খাওয়ার জন্য খরচ দিতে হয়, দিতে পারলেই যে তোমাকে নির্বাচন করা হবে তা নয়। অনেকে আবেদন জানায়, কেউ কেউ নির্বাচিত হয়। আমার খরচ পোষাবেদ ভাইজের সিনেমা পরিচালক সংস্থা। আমাকে মুলাঁ দন্দেতে চমৎকার একটা ঘর দেওয়া হয়। ঘরে যা কিছু দরকার লেখালেখির জন্য, সবই দেওয়া হয়। কমপিউটার, প্রিন্টার। টেবিল চেয়ার তো আছেই, বিছানা বালিশ সব। কাজের লোক আছে, অনেকটা হোটেলের মতো। ঘর দোর সাফ করে দিয়ে যায়, বিছানার চাঁদর পাল্টেদিয়ে যায়, স্নানঘরে তোয়ালে দিয়ে যায়। সেইন নদীর পাড়ে বাড়িগুলো। বাড়িগুলোর মাঝখানে বিশাল খাবার ঘর, ওখানে দিনে তিনবেলা সবাই বসে এক সঙ্গে খায়। কড়িকাঠ বসানোপুরোনো বাড়িগুলো দেখতে পর্যটকের ভিড় জমে যায়। লোকে দেখতে আসে মিল। বিখ্যাত ফরাসিপরিচালক ফ্রাসোয়া তুফোর বিখ্যাত ছবি জুলি এণ্ড জিমের সুটিংও এখানে হয়েছিল। ছবিটি মিলে বসেই দেখেছি। মিলে সিনেমা দেখার ঘরও আছে। প্রচুর ভিডিও ক্যাসেট আছে সিনেমার। সিনেমার সঙ্গে জড়িত লোকদের মধ্যে অনেকেই সত্যজিৎ রায়ের কথা জানে। উচ্চারণ করে শেতাজিত রায়। জেনেছি সত্যজিতের জলসাঘর ছবিটা ওদের সবচেয়ে পছন্দের ছবি। আধুনিক একটি অডিটোরিয়াম আছে, ওখানে ধ্রুপদী সঙ্গীতের আসর বসে। নানা দেশ থেকে সঙ্গীত বিশারদরা আসেন। সেইন নদীর পাড়ে গাছগাছালিতে ছাওয়া এইপুরোনো মিলের বাড়িগুলোয় নিশ্চিন্তে নিরাপদে নির্ভাবনায় নিরিবিলিতে শিল্পীরা কাজ করে যাচ্ছেন, আর দেখ এমন সুন্দর জায়গায় বসে আমার লেখা হয় না। আমার শুধু তোমার কথা মনে পড়ে। রাশিয়ার শিল্পী ম্লাদিমির এর সঙ্গে আলাপহল, ও ওখানেইঅনেক বছর ধরেআছে। কেউ কেউ সারাজীবনের জন্য থেকে যায়। মরিস নামের ফরাসি এক লেখক আমি যে দোতলার ঘরে থাকি, তাঁর নিচের তলাতেই থাকেন। ওঁর এটাই বাড়িঘর, এখানেই বাকি জীবন কাটাবেন। যারা এখানে জীবনভর থাকবেন বলেপণ করেছেন, এই শিল্পী-বাড়ির পরিচালনার দায়িত্বও তাদের কিছুনা কিছু দেওয়া হয়েছে। ব্লাদিমিরকে দিয়ে তোমার একটি বড় পোট্রট করিয়েছি মা। তেল রঙের ছবি। পাঁচ হাজার ফ্রাঁ নিয়েছে। তুমি তো আর নেই। তোমাকে সামনে বসিয়ে ছবি আঁকার সৌভাগ্য ম্লাদিমিরের হয়নি। তোমার একটা ছবি দিয়েছিলাম ওকে, সেই ছবিটাই ছিলো শিল্পীর সম্বল। তোমার ছবির দিকে অপলক তাকিয়ে থাকতে থাকতে ভাবি, কী সুন্দর ছিলে তুমি। মা, তুমি কি এখন শুধুই ছবি!

মিলে যে শিল্পীরা থাকেন, তাঁরাই যে খাবার খান তা নয়। প্যারিস থেকেও অনেক শিল্পীরা আসেন দুপুর বা রাতের খাবার মিলের শিল্পীদের সবার সঙ্গে বসে খাওয়ার জন্য। এই মিলেই প্রতি খাবারের সময় ফরাসিদের মতো ওয়াইন আর পনির খাওয়া আমার শেখা হয়। ফরাসি খাবারের প্রতি ভালোবাসা এই মিলেই জন্ম নেয়। ফরাসি অনেকের সঙ্গে বন্ধুত্ব হয়। আমি ফরাসি দেশে এক জনপ্রিয় লেখক। জনপ্রিয়তাটা টের পাই। আমার সঙ্গে কথা বলার জন্য ফরাসিরা উন্মুখ হয়ে থাকে। কিন্তু ওদের যেমন ভাষা সমস্যা, আমারও। ওরা শুধু ফরাসি জানে, এদিকে আমি ফরাসির কিছুই জানি না। আমাকে ফরাসি ভাষা শেখানোর গুরু দায়িত্ব মিরিয়াম মর্তু, শিল্পী-বাড়ির পরিচালক, সুজানের সহকর্মী নিজেই নিয়েছে। আমার বেশ সখ্যও গড়ে ওঠে মিরিয়ামের সঙ্গে। এই গড়ে ওঠার পেছনে পরিশ্রম একা মিরিয়ামের। সারাক্ষণ, দিন রাত, সে আমাকে নিয়ে ব্যস্ত। পরিচালকের কাজ, সে কী কম কাজ! কিন্তু কিছুই সে করবে না। আমার অনেকগুলো বই কিনে এনেছে, সেগুলোপড়ছে। বাকিটা সময় আমাকে নিয়ে বেড়াতে বেরোচ্ছে, ফ্রান্সের উত্তরে যে শহর বা গ্রাম আছে, সব দেখাচ্ছে। আর আমার সঙ্গেই তার দিন রাত। আমার মতো সিগারেট ফোঁকে সে। তবে আমার চেয়ে দ্বিগুণ ফোঁকে। এর মধ্যে এই মেয়ে আবার আমার গভীর প্রেমে পড়ে বসে আছে। এদিকে কানাডার এক লেখক পিয়ের লরু, অসাধারণ সুন্দর দেখতে যুবক, তার দিকে চোখ পড়ে আমার। সে যুবকেরও চোখ পড়ে আমার দিকে। দুজন আমরা এক সঙ্গে হাঁটতে বেরোই। ফাঁক পেলেই গল্প করি। মিরিয়ামের কিছুতে সহ্য হয় না এসব। পিয়ের আমার ঘরে একদিন শ্যাম্পেন নিয়ে এলো, আমার জন্মদিন নাকি ওর জন্মদিন পালন করবে, মিরিয়াম এসে পিয়েরকে তাড়ালো। সে কিছুতেই আমার আশে পাশে নিজেকে ছাড়া অন্য কাউকে সহ্য করে না। দিন দিন অবাক হতে থাকি মিরিয়ামের অতিপ্রেমের নির্লজ্জ প্রকাশ দেখে। কিন্তু পিয়ের ছাড়া আর কারও জন্য আমার প্রেমের উদ্রেক হয় না। ইমানুয়েল নামের এক ফরাসি সঙ্গীতরসিক ভদ্রমহিলা আমাকে তার বাড়িতে নেমন্তন্ন করতে ব্যস্ত হয়ে উঠলেন। ইমানুয়েলের সঙ্গেও আমার বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। মিরিয়ামের তাও পছন্দ হয় না। কারও সঙ্গে মিশলেই তার সম্পর্কে মিরিয়াম আমাকে মন্দ কথা বলবেই বলবে। এরকম চরিত্র বাংলাদেশে মেলে জানতাম, এমন চরিত্র যে সুসভ্য দেশের ততোধিক সুসভ্য শিক্ষিত শিল্পী-বাড়িতেও মেলে, তা জানতাম না!

শিল্পী-বাড়িতে আমার খেয়ে দেয়ে গল্প করে গান শুনে সিনেমা দেখে আর ঘুরে বেড়িয়েই কাটে। যেখানেই যাই, যে কোনও সুন্দর জায়গায়, মনে হয়, আহ তুমি যদি দেখতে। যা-ই দেখি, মনে মনে তোমার চোখ দিয়ে দেখি। সমুদ্রের পাড়ে গেলাম একদিন। মন হু হু করে উঠলো। তোমাকে চেয়েছিলাম সমুদ্র দেখাতে, নিউইয়র্কে যখন ছিলে, ওয়ারেন অ্যালেন স্মিথকে বলেছিলাম আমার মাকে সমুদ্র দেখাতে চাই। শুনেই একটা গাড়ি যোগাড় করে নিয়ে এলো, প্রায় আশি বছর বয়স, ওই বয়সে নিজেই গাড়ি চালালো। কিন্তু মাইলের পর মাইল পাড়ি দিয়ে সমুদ্র নামের যে জায়গাটায় নিয়ে এলো, দেখেই আমার মন খারাপ হয়ে গেল। ঘিঞ্জি কনি আইল্যান্ড, বাচ্চারা চেঁচিয়ে খেলছে, রোলার কোস্টার চড়ছে, সমুদ্র অনেক দূরে। ওই সমুদ্রের কিনারে হেঁটে যাওয়াও তোমার পক্ষে সম্ভব ছিল না। দূর থেকে এক চিলতে সমুদ্র দেখার কী মানে! আসলে ওয়ারেন সমুদ্র বলতে ওই জায়গাটা কেন বেছে নিয়েছিলো কে জানে, তুমি তো আর রোলার কোস্টার চড়বে না। ওয়ারেনের বুদ্ধিতে যা কুলিয়েছে, তাই করেছে সে। খুব বুদ্ধি করে সে আবার একখানা হুইল চেয়ার নিয়ে এসেছিলো, যেন তোমাকে ওই চেয়ারে বসিয়ে আমরা সমুদ্রের পাড়ে নিয়ে যেতে পারি। বালির ওপর দিয়ে ওই চেয়ার চালানো সম্ভব হবে না, তাছাড়া তুমিও চাওনি যেতে। হয়তো বিরক্ত হয়েছিলে হই চইএর বাজার দেখে। আমি ওয়ারেনকেও যে ধমকে বলবো ভুল জায়গায় এনেছো কেন। বলিনি। ওর আন্তরিকতা ছিল, এতে কোনও সন্দেহ নেই। কিন্তু যেরকম চেয়েছিলাম, একটা উদার একটা উতল, অথৈ জলে যেন জগৎ ডুবে আছে, যেখানে স্নান করতে নেমে সূর্য তার আগুন নিবিয়ে ফেলে সন্ধেবেলা, এমন কিছু দেখাতে। আমার সেই সাধ অতলান্তিকের পাড়ের আমেরিকায় বসেও পূরণ হয়নি। ফ্রান্সের উত্তরে এত্ৰেতেত এর সমুদ্র দেখে তোমার কথা বড় মনে পড়ে। জল দেখতে দেখতে চোখ ভরে ওঠে জলে। চোখের জলের এক একটি কণায় তোমাকে হারানোর কষ্ট। নরমাণ্ডির অনেক জায়গায় চরকির মতো ঘুরি মিরিয়মের সঙ্গে। রুয়োঁয় গিয়ে জোয়ান অব আর্কের সেই গির্জা, যে গির্জার আঙিনায় ওকে পুড়িয়ে মারা হয়েছিল, দেখে অবাক দাঁড়িয়ে থাকি। ধর্মের লোকেরা শতাব্দীরপর শতাব্দী এভাবেই মেয়েদের অত্যাচার করেছে, পুড়িয়ে মেরেছে। আজ না হয় এসব দেশে ধর্মের অত্যাচারের অবসান হয়েছে। কিন্তু আমাদের দেশে, শুধু আমাদের দেশে নয়, যে দেশগুলোয় মুসলমানের বাস, এখনও ভয়ংকর নিষ্ঠুরতা বহাল তবিয়তে বেঁচে আছে। জোয়ান অব আর্ক ছেলেদের পোশাক পরেছিলো বলে ওকে জেলে ভরেছে লোকে। সেদিনও সুদানে এই একবিংশ শতাব্দীতে লুবনা আহমেদ নামের এক মেয়ে ট্রাউজার পরেছিলো বলে ওকে জেল খাটতে হয়েছে। ওকে জোয়ানের মতো পোড়ানো হয়নি, তবে ওকে চাবুক মারার আদেশ দেওয়া হয়েছে।

নরমাণ্ডিতে জিভারনি নামের গ্রামে ফ্রান্সের বিখ্যাত শিল্পী ক্লদমনের বাড়ি দেখতেও ভালো লাগতো, ওটি এখন জাদুঘর, সেসব দৃশ্য এখনও আছে, শুধু ক্লদ মনে নেই, সেই বাগান, সেই লেক, সেই পদ্মপাতা, সেই মাঠ, সেই নদী দেখতে দেখতে মনে হচ্ছিল, মানুষ থাকে না, কিন্তু মানুষের কাজ থেকে যায়। আমার লেখা, আমি মরে যাওয়ার পর টিকে থাকবেকী থাকবে না, অনেকে এ নিয়ে জল্পনা কল্পনা করে। এসবে আমার আগ্রহ একেবারেই নেই। বেঁচে থাকলে থাকবে, না থাকলে থাকবেনা। আমি অমরত্বে বিশ্বাস করি না। জীবনে যা দেখবো, জীবনে যা পাবো, তার মূল্যই আমার কাছে বেশি। মৃত্যুর পর কী হবে না হবে, তা নিয়ে আমার ভাবতেও ইচ্ছে করে না। বরং এই পৃথিবীর, এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের কোথায় কী ঘটবে, বিবর্তন মানুষকেই বা কতদূর নেবে, এসব জানতেইচ্ছে করে। অনেকেতৃপ্তি পায় ভেবে তার শিল্প বেঁচে থাকবে হাজার বছর। এইপৃথিবীটাইকদিন বেঁচে থাকে দেখ। পৃথিবীর সবুজ যেহারে বিনাশ করা হচ্ছে, যেভাবে দূষণ ছড়াচ্ছে সবখানে, পাঁচ বিলিয়ন বছর আর অপেক্ষা করতে হবে না সূর্যের আলো ফুরিয়ে যাওয়ার জন্য। তার আগেই পৃথিবী ধ্বংস হবে। পৃথিবীতে এপর্যন্ত যত প্রজাতি জন্মেছে, তার নিরানব্বই ভাগই নিমূল হয়ে গেছে। নিয়ানডারথাল নামে একধরনের মানুষও ছিলোপৃথিবীতেও। আড়াইলক্ষ বছর বেঁচে থেকেওরাও জাতসুদ্ধ নেই হয়ে গেছে। মানুষ বলতে হোমোসাপিয়ানই আছে। এই মানুষই সভ্যতা গড়ে তুলেছে, অন্য সব প্রাণীর চেয়ে বুদ্ধি ধারণ করে বেশি, এই মানুষই মানুষ ভালোবাসে, আবার এই মানুষই মানুষ ধ্বংস করে। তুমি তো আফগানিস্তান বা ইরাকের যুদ্ধ দেখে যাওনি মা। যদি দেখতে, মানুষগুলোর জন্য কাঁদতে, যারা মরেছে, বা যুদ্ধে যারা সব হারিয়েছে। তুমি খুব অবাক হতে যারা দেশে দেশে বোমা ফেলে তাদের নিষ্ঠুরতা দেখে। তুমি তো মাটির মানুষ ছিলে। মানুষের এত নির্মমতা দেখেছো, তবু মানুষের নির্মমতা তোমাকে কাঁদায়। তুমি যেমন শক্ত হতে পারোনি, পাথর হতে পারোনি, আমিও পারিনি।
 
০৭.

তিন মাস পর নরমাণ্ডির মুলাঁ দন্দের পাট চুকলো আমার। এবার কোথায় ফিরবো? ভাবতে আমার খারাপ লাগে যেসুইডেনে ফিরতে হবে, আবার দেখতে হবে সুয়েনসনের মুখ। সুইডেনে কোনও বাড়ি ভাড়া নিতেপারি। কিন্তু ওই দেশটার ওপরই ভীষণ একঅভিমান আমার। আসলে সুইডেন নামের দেশটাও আমার কাছে অসহ্য হয়ে উঠেছে। যে দেশে আমার একটিও বন্ধু নেই, শুভাকাঙ্ক্ষী নেই, যে দেশে অসহায় আমাকে সাহায্য করার একটিও প্রাণী নেই, যে দেশের ডাক্তারেরা তোমাকে হত্যা করেছে, সে দেশে কেন থাকবো আমি! ইওরোপে এক ফ্রান্সেই আমার সবচেয়ে বেশি বই ছাপা হয়েছে। ওখানেই মানুষ আমাকে সবচেয়ে বেশি চেনে, শ্রদ্ধা করে, ভালোবাসে। ফ্রান্স সুইডেনেরমতো দেশনয়, যেখানে আমাকে ব্যবহার করে বিশ্বে বাহবা জুটিয়ে ব্যস দিব্যি ভুলে গেছে, আমি মরে আছি না বেঁচে আছি, কোনও রাজনীতিকই আর জানতে চায়নি। লেখকগোষ্ঠীর ভেতরে দলাদলি, মারামারি এসব তো আছেই, নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্যই সকলে ব্যস্ত। কেউ যদি লিখে নাম করে, ব্যস আলাদা হয়ে গিয়ে নিজের লেখালেখিতে মন দেয়, আর লিখে নাম না করতে পারলে তো যাতে নাম হবে, বিভিন্ন সমিতি সংগঠনে আঠার মতো লেগে থেকে, তার চেষ্টাই অহর্নিশি করে যায়। এখন আমার কোনও কিছুতে নাম লিখিয়ে নাম করার কিছু নেই। ওসবের রুচি কোনওদিন ছিল না আমার, এখনও নেই। নামের কাঙাল আমি কোনওদিনই ছিলাম না, না চাইতেই নাম বলো, দুর্নাম বলোসর পেয়েছি।

সুয়েনসন একটা কাঠের বা লোহার তৈরি মানুষের মতো। নিজের স্বার্থ ছাড়া একবিন্দু কিছু বোঝে না। কোনও সহমর্মিতা বা সহানুভূতি বলে কিছু নেই কারও জন্য। হীনম্মন্যতা তার সর্বক্ষণিক সঙ্গী। তার সারাক্ষণই সংশয়, তাকে না আবার কেউ কোনওদিক দিয়ে মন্দ বলছে। এধরনের লোকের সঙ্গে এক ছাদের নিচে বাস করা মানে নিজের সর্বনাশ করা, আর কিছুনয়। তাছাড়া সুইডেনের ওই বাড়িতে বাস করা, যেখানে তোমার কষ্টের স্মৃতি আমাকে তাড়া করে, সম্ভব নয়। নরমাণ্ডিতে থাকাকালীনই সিদ্ধান্ত নিই, সুইডেনে থাকার যেহেতু কোনও ইচ্ছে নেই আমার, প্যারিসে থাকবো।

.

ক্রিশ্চান বেসকে বললামপ্যারিসে থাকবো। সুজানকেও বললাম। সুজান বললো প্যারিসে তার বাড়িতে অ্যাপার্টমেন্ট আছে। সেই অ্যাপার্টমেন্ট দেখেও এলাম। মিরিয়ামের প্রচণ্ড উৎসাহ যেন সুজানের বাড়ির ওই অ্যাপার্টমেন্টটি ভাড়া নিই। কিন্তু বাধ সাধলো ক্রিশ্চান। তার ঠিক করা অ্যাপার্টমেন্ট ভাড়া নিতে হবে, তার আবদার। সুজানের অ্যাপার্টমেন্টটি সুন্দর হলেও, কম ভাড়ার হলেও, ভালো এলাকায় হলেও ক্রিশ্চানের অনুরোধে তার কোনও একডাক্তার বান্ধবীর ফেলে রাখা অ্যাপার্টমেন্টটিই ভাড়া নিতে হল। ভাবতে পারো মা, নিজের অত বড় বাড়ি ফেলে ছোট একটা ঘরে বাস করা! সুইডেনে গিয়ে আমার বই পত্র, কাপড় চোপড় সব প্যারিসে নিয়ে চলে আসি। এক দেশ থেকে আরেক দেশে এক বাড়ি জিনিসপত্র আনা খুব সহজ ব্যাপার নয়। খরচ যেমন, খাটনিও তেমন। সব একাই করি। সুয়েনসন তার স্বভাবের বদগুণে আমাকে কোনও সাহায্য করে না। তোমার জন্য টেলিফোন ডাইরেক্টরি খুঁজে ডাক্তার বের করতে না পারলেও মালামাল সরবরাহের আন্তর্জাতিক কোম্পানি খুঁজে বের করি। আসবাবপত্র কিছুআনিনি, আরও অনেক কিছুআনিনি। ওগুলো সুয়েনসনকে দান করে দিই। আসবাব এবং সংসারের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কিনে নিয়েছিপ্যারিস থেকে। আমার নতুন সংসার শুরু হয় প্যারিসের পনেরো রুদ্য ভুইয়ে ঠিকানায়।

.

আমার রয়্যালটি জমা ছিল ক্রিশ্চানের কাছে। ক্রিশ্চান ধনীর মেয়ে। নিজেই ক্লিনিং কোম্পানির লোক ডেকে আমার রয়্যালটি থেকে পাঁচ হাজার ফ্রাঁ দিয়ে কার্পেট পরিষ্কার করালেন। কল্পনা করতে পারো, কেউ একজন পাঁচ মিনিটে দশ বাই বারো ফুট কার্পেট ভ্যাকুয়াম করে পাঁচ হাজার ফ্রাঁ অর্থাৎ প্রায় চল্লিশ হাজার টাকা নিয়ে চলে যায়! রয়্যালটির টাকা ওভাবেইনাশ হতে থাকে। অ্যাপার্টমেন্টে নাকি নতুন লাগানো হয়েছে ওভেন, ওই ওভেনের টাকা আমাকে দিতে হবে। প্রতিটি অ্যাপার্টমেন্টেই রেফ্রিজারেটর, হিটার, ওভেন, ডিশ ওয়াশার বা ওয়াশিং মেশিন এসব লাগানোই থাকে। ভাড়াটেদের কিছু কিনতে হয় না। কিন্তু এমন মন্দ কপালের ভাড়াটে সারা ফ্রান্সেপাওয়া যাবেনা। প্যারিসে থিতুহয়ে বসার পরপরই একদিন রাস্তায় হাঁটতে গিয়ে পা মচকে গেল আমার। হাসপাতালে সেই পায়ে প্লাস্টার লাগানো, ফিজিওথেরাপি দেওয়া ইত্যাদি কাণ্ডতে আরও গেল টাকা। আমার হেলথ ইনসুরেন্স আছে সুইডেনে, আর তখনও আমার পাসপোর্ট রাষ্ট্রপুঞ্জের বা জাতিসংঘের, যে পাসপোর্ট ফেলে দিয়েছিলাম দেশে যাওয়ার আগে, সেটা ওরা নিজেরাই দেশ থেকে আমি ফেরার পর দিব্যি ফেরত দিয়েছে। এখানে ফ্রান্সে চিকিৎসায় যা খরচ হয়েছে, তা সুইডেনে নিয়ে দেখালে ওরা টাকা ফেরত দেবে, এরকম একটা আভাস পেয়েছিলাম। কিন্তু শেষ অবদি ওসব করাও হয়নি, টাকাও ফেরত পাওয়া হয়নি। টাকা যদি কেউ একবার নেয়, সেটা ফেরত নেওয়ার জন্য চেষ্টা করা কোনওদিন অন্তত আমার পক্ষে সম্ভব হয় না। ব্যক্তিগত ধারের টাকা ফেরত নেওয়ার চেষ্টা করার তো প্রশ্নই ওঠে না। দেড় দুবছরের পাওনা বেতনই তুলতে পারিনি মেডিকেল কলেজ থেকে। অফিস কাছারিতে টাকার জন্য, এমনকী পাওনা টাকার জন্য দৌড়োতে কোনওদিনই আমার ইচ্ছে করেনি। যা গেছে গেছে ভেবে অন্য কাজে মন দিই। এই টাকা জিনিসটা খুব চমৎকার, আবার খুবই বিচ্ছিরি। এটি আমার তীরে জলের মতো এসেছে, জলের মতো চলেও গেছে। আমার তো আবার খাল কাটায় জুড়ি নেই। খাল কেটে কেটে যথেষ্টই কুমীর এনেছি প্যারিসে থাকাকালীন।

.

ক্রিশ্চান বেস আমার জন্য ফরাসি সংস্কৃতি দপ্তর থেকে একটা চমৎকার স্কলারশিপ জুটিয়ে ফেললেন, দেড় লাখ ফ্রেঞ্চ ফ্রাঁ। প্যারিসের একটা ব্যাংকে অ্যাকাউন্ট খুলে সে টাকা জমা রাখা হল। টাকাটা উড়িয়ে ফেলতে বেশিদিন অবশ্য সময় যায় না। সুইডেনের বড় বাড়ি ফেলেপ্যারিসে ছোট একটা অ্যাপার্টমেন্টে থাকা, তাতে কী! ওখানেই শান্তি পেতাম। আমার যেমন ইচ্ছের জীবনে কেউ বাধা দেওয়ার নেই। এর চেয়ে আনন্দ আর কী আছে মা! যেদিন প্যারিসের অ্যাপার্টমেন্টে ঢুকেছি সেদিনই আমার ইন্টারনেট চাই। ১৯৯৮ সাল। তখনও প্যারিসে লোকের ঘরে ঘরে কম্পিউটার ছিল না। ইন্টারনেটে আমি অভ্যস্ত অনেককাল আগে থেকেই। মোবাইল ফোনও তখন এত হাতে হাতে ছিল না। কিন্তু যে কোনও নতুন প্রযুক্তি শুরু হওয়ার শুরু থেকে তাআমার চাই। বিজ্ঞানের লোকশুধু নই, বিজ্ঞানে অগাধ বিশ্বাস থেকেই প্রযুক্তিরওপর কোনওদিন আস্থা হারাইনি। কমপিউটারকে এত বিশ্বাস করি, সম্ভবত মানুষের চেয়ে বেশি, তাই ব্যাক আপ রাখা বলে যে একটা কথা আছে, ওটাও রাখিনা। সারাদিন মগ্ন হয়ে থাকতাম কমপিউটারেতাস খেলায়। সারারাত আমার সময় সিগারেটের ধোঁয়ার সঙ্গে উড়ে যেতো। আমি আমি ছিলাম না মা। একসময় শরীর শরীর করে ব্যস্ত হয়ে উঠলাম। হাহাকারকে আর নেবার ক্ষমতা থাকে না মনের, তখন শরীরে সুখ দিয়ে সেই হাহাকারকে আপাতত দাবিয়ে রাখা জরুরি হয়ে ওঠে। হরমোনের হইচই আচমকা বেড়ে যায়, হয়তো শরীরই এভাবে নিজগুণে সামলাতে চায় কষ্টের বানে ভাসিয়ে নিতে থাকা জীবন। তাই মনে হয় আমার। সম্ভবত ভেতরের কষ্টগুলোকে লাঘব করার জন্য, অথবা ভুলে থাকার জন্য আমি নই, আমার শরীরই শরীরের বর্ম ভেঙে বেরিয়ে আসে। হঠাৎ খুব পুরুষের জন্য শরীর কাতর হতে শুরু করলো। ব্যস্ত থাকতাম নেটের চ্যাট সাইটগুলোয়। অচেনা কারুর সঙ্গে বিছানায় যেতে চাওয়ায় আমার একটুও দ্বিধা হত না, ঘেন্না হত না। এরকম আগে কখনও দেখিনি। তোমার অসুখের পর থেকেই আমার ভেতরের সুশৃঙ্খল সুসভ্য মানুষটি যেন নীতি দুমড়ে রীতি ভেঙে বেরিয়ে গেল। আমিই, অবাক হয়ে দেখলাম, ক্রমশ নয়, আকস্মিকভাবে আমার অবাধ্য হয়ে উঠলাম আমি। আমারই অচেনা আমি। ভেতরের হাহাকার আর বিশাল এক শূন্যতাপূরণ করার জন্যই সম্ভবত এই তীব্র যৌনকাতরতা হাঁমুখ করে বসে থাকে। তোমাকে নিয়ে যে আমার প্রচণ্ড অপরাধবোধ ছিল, ব্যথা বেদনা ক্ৰোধ কান্না ছিল, তা থেকে মুক্তি পেতেই কি এই করি? নিজের বিরুদ্ধে নিজেই প্রতিশোধ নিই! কিন্তু নিজের পাপের প্রায়শ্চিত্তকি ওভাবে করা যায়! আমার বোধহয় আর কোনও উপায় ছিল না। নিজের ভেতরটা ভেঙে গেলে বোধহয় নিজের বাহিরটাও ভেঙে ফেলতে ইচ্ছে হয়। অথবা আপনাতেই সব ভেঙে পড়ে। নিজেকে প্রবোধ দেওয়ার কোনও শক্তি আমার মধ্যে ছিল না।

কিন্তু চিন্তাশক্তি লোপ পেয়ে যাওয়া, শরীরে উত্তপ্ত হতে থাকা, মন পাথরের মতো শীতল হয়ে ওঠা এ সবই সাময়িক। ভোগবাদী দেশে বাস করলেও ভোগে আমার রুচি হয় না অল্প কিছুদিন পরই। ভেতরের সভ্য সুন্দর মানুষটি আমাকে একটা সময়ে আমারই সামনে এসে অনড় দাঁড়ায়। খুব বেশি উজ্জ্বল হওয়া আমার পক্ষে সম্ভব হয়ে ওঠেনা। আমার যখন চূড়ান্ত ডিপ্রেশন চলছে, প্যারিসে অনেকে আসতো আমার সঙ্গে দেখা করতে, অবশ্য সেপ্যারিস বলেই আসতো। শহর দেখানোর দায়িত্ব ছিল আমার। ম্যাট চেরি এসেছিলো। ম্যাট আমার একটি ইংরেজ বন্ধু, মানববাদী, হিউম্যানিস্ট এণ্ড এথিক্যাল ইউনিয়নের কর্মকর্তা। আমাকে এই সংগঠন শ্রেষ্ঠ মানববাদী হিসেবে পুরস্কারও দিয়েছে। ম্যাট তার ম্যানচেস্টারের বাড়ি ছেড়ে আমেরিকায় পাড়ি দিয়েছে, ওখানে সেন্টার ফর ইনকোয়ারিতে চাকরি করে। সেই আমেরিকার বাফেলো থেকে চলে এলো আমার সঙ্গে দেখা করতে। দুজনে মানববাদ নিয়ে, নাস্তিকতা নিয়ে সিরিয়াস সিরিয়াস কথা বলি। কিন্তু কোথায় থাকতে দিই বলল, একটি মাত্র ঘর। ভেতরের অতিথিপরায়ণ বাঙালি জেগে ওঠে। অতিথি নারায়ণতুল্য। অতিথিকে তাই বিছানা দিয়ে নিজে আমি মেঝেয় বিছানা করে শুই। কিন্তু দুরাত ওভাবে কাটাবারপর চেনা একজন ফরাসিমানববাদীর বাড়িতে ম্যাটকে রেখে এলাম, আমার পক্ষে ওভাবে কষ্ট করে ঘুমোনো সম্ভবনয়। সম্ভব হত, যদি ম্যাট কোনও সমবেদনা দেখাতো, যদি নিজেই বলত, তুমি বিছানায় শোও, আমি মাটিতে শুই বা কোনও হোটেলে চলে যাই। অথবা আমরা দুজনেই শুতে পারতাম বিছানায়। জানিনা ম্যাটের ওভাবে আমার কাছে আমেরিকা থেকে প্যারিস চলে আসার কারণ কী ছিল! একটি ঘর জেনেও তার কেন ইচ্ছে হয়েছিল, আমার সঙ্গে ওই একটি ঘরেই থাকার! ম্যাটের কি গোপনে প্রেম করার ইচ্ছে ছিল আমার সঙ্গে! ম্যাট দেখতে এমন কোনও সুদর্শন নয় যে ম্যাটের প্রেমে আমি পড়তে পিরবো। গুণে জ্ঞানে ম্যাট টইটম্বুর তাঠিক, কিন্তু দেখতে ভালো না হলে আমার পক্ষে প্রেম করা সম্ভব হয় না। যদি জনমনুষ্যিবিহীন কোনও মরুভূমিতে বাস করতে বাধ্য হতাম, তাহলেই হয়তো প্রেম করতে বাধ্য হতাম। শখের প্রেম চারদিকের সুন্দরের ভিড়ে কোনও এক অসুন্দরের সঙ্গে হয় না। ঢাকার প্রকাশক মেজবাহউদ্দিন এসেছিলেন প্যারিসে, উনি মেঝেয়বিছানা পেতে ঘুমিয়েছেন। আমি ভুলেও তাকে বলিনি বিছানায় শুতে। বাড়তি লেপ ছিল না, বড় জোর তার জন্য একটি লেপ কিনে দিয়েছি। অতিথিকে খাওয়াচ্ছি দাওয়াচ্ছি, নিজের পয়সায় প্যারিস দেখাচ্ছি, আর রাতে ঘরে ফিরে কিনা মাটিতে শোবো! এত ত্যাগ পোষায় না। তাছাড়া আরও একটা কারণে আমি ত্যাগ করিনা, কারণ মেয়েরাই পুরুষের জন্য নিজের আরাম আয়েশত্যাগ করবে, এটাই যেন জগতের নিয়ম। এই নিয়মকে আমি ভাঙি। অতিথিকে আপ্যায়ন করি, সাধ্যের বাইরেও তাদের জন্য করি, তাদের প্রাণের আরাম দিই। কিন্তু অতিথিকে নারায়ণ জ্ঞান করার ইচ্ছে আমার নেই। অতিথিকেনারায়ণের আরাম দেওয়া থেকে নিজেকে বিরত রাখি। কে আমার জন্য করে বলো! মেজবাহ আমার বই যে ছাপাচ্ছেন, কোনও রয়্যালটি দেওয়ার নামগন্ধ নেই। সব সমর্থন কেবল কথায়, কাজে নয়। মেজবাহ বলেন আমার বই নাকি এখন বাংলাদেশে মোটেও চলে না। আমার অবাক লাগে ভাবতে, একসময় পাগলের মতো লোকে বই কিনতো, পড়তো। আর যেই না দেশ থেকে দূর করে দিল সরকার, অমনি পাঠক মুখ ঘুরিয়ে নিল, বই পড়া বন্ধ করে দিলে! মৌলবাদীরা যখন বিরুদ্ধে ছিল, পাঠক তো আমার বইপড়া থেকে বিরত থাকেনি। সরকার আমার বিরুদ্ধে গেলে বইপড়া বন্ধ করে দেবার কারণ কী! এসবের কোনও উত্তর মেজবাহউদ্দিনের জানা নেই। শুধু পাঠক নয়, পত্রিকার সম্পাদকরাও শত্রু হয়ে যায়। যখনই সরকার আমাকে পিষে মারতে শুরু করলো বা দেশ থেকে তাড়িয়ে দিল, সব কাগজেই একযোগে আমার লেখা ছাপানো বন্ধ হয়ে গেল। কলকাতা থেকে শিবনারায়ণ রায় বেড়াতে এসেছিলেন। তাঁকে হোটেলে থাকার ব্যবস্থা করে দিয়েছি। যত জাদুঘর আছে, সব দেখিয়েছি। সুইডেন থেকে সুয়েনসন এসেছিল, তাকেও শহর দেখিয়েছি। এত কাল বিদেশে আমি অর্ধেক-তুমি অর্ধেক সংস্কৃতি দেখেও আমার শেখা হয়নি। আমিই একা ঢেলে দিই। ফরাসি বন্ধুরাও জানে বন্ধুদের নিয়ে রেস্তোরাঁয় বা ক্যাফেতে খেলে আমি একাই বিল মেটাই। গুনে গুনে নিজের পয়সা বের করে নিজের ভাগটুকু আলাদা করে দেওয়া আমার একেবারে পছন্দ হয় না। আমি একদিন খাওয়ালাম সবাইকে। পরের বার নিশ্চয়ই আমাকে সবাই খাওয়াবে। খাওয়ালাম বলে ধন্যবাদ বলে গালে চুমু খেয়ে খেয়ে সবাই চলে যায়। কিন্তু তারপর আবার যখন রেস্তোরাঁয় গেলাম, যাদের খাইয়েছিলাম, তারা যার যার পয়সা মেটায়, আমারটা আমাকেই মেটাতে হয়। কত হাবিজাবি লোককে যে খাইয়েছি মা, কী বলবো। এসব তোমার চরিত্র থেকে পাওয়া। টাকা ফুরিয়ে তলানিতে এসে গেলেও এই স্বভাব আমার যায় না। চেষ্টা করেছি, এবার থেকে নিজেকে আর বোকা বনতে দেব না। পণ করি বটে, কিন্তু রক্তে যদি স্বভাবটা থাকে, কী করে বদলাবো বলো। আসলে কী জানো মা, যারা আমার জন্য ত্যাগ করে, তাদের বেশির ভাগের জন্য আমার কিছু করা হয় না। দেখেছি, যাদের জন্য করি, তাদের জন্য শুধু করেই যাই ত্যাগ। তারা কোনওদিন বিন্দুমাত্র ত্যাগ তো করেইনি, বরং ফাঁক ফোকর পেলেই ঠকিয়েছে। বন্ধু ভাগ্য আমার খুব ভালো নয়। আমি লক্ষ করেছি, যারা আমার বন্ধু হয়, তারা আমাকে বন্ধু হিসেবে নির্বাচন করে। এখানেই ভুলটি আমি করি। আসলে তার সঙ্গেই আমার মেশা উচিত, যাকে আমার ভালো লাগে। প্রেমিক বলো, বন্ধু বলো কাউকেই আমি নির্বাচন করি না। এ কি কোনও কমপ্লেক্স থেকে, কে জানে? সুপিরিওরিটি অথবা ইনফিরিওরিটি। কিছু একটা হবে। আমার অনেক সময় মনে হয় আত্মবিশ্বাস কম থাকার কারণে যাকে আমার পছন্দ, তার কাছে আমার যাওয়া হয় না। আমাকে যদি তার পছন্দ না হয়, আমাকে যদি সে ভালো না বাসে এই অনিশ্চয়তা থেকেই। অপমানিত হওয়ার ঝুঁকি আমি নিতে চাই না। তার চেয়ে যারা আমার সঙ্গে বন্ধুত্ব করার জন্য উন্মাদ হয়ে ওঠে, দিনরাত যারা জপ করে নাম, লেগে থাকে জোঁকের মতো, তাদের সঙ্গেই ধীরে ধীরে বন্ধুত্ব হয়। উন্মাদের দলে সত্যিকারের উন্মাদও বেশ কিছু জুটে যায়।

.

আর প্রেমের জন্য যেরকম পুরুষ আমার পছন্দ, সেরকম পুরুষ কি চাইলেই আমি পেতে পারি। অনেকেপায়। আমার পাওয়া হয়নি কোনওদিন। তুমি তো সারাজীবন পাওনি। বাবাকেইপাওনি। আর কাউকে তো পেতে চাওনি। বাবাকেই এক চেয়েছিলে। আর বাবা, তোমাকে ছাড়া পৃথিবীর সব মেয়েকেই চেয়েছিল। কতটা পেয়েছে কী পেয়েছে কে জানে, যাদের পেয়েছিল, তারা কি কেউ তোমার চেয়ে ভালো ছিল! তোমার প্রতি জানি না কী কারণে বাবার অনাসক্তি ছিল। একটা ভালোবাসাহীন সংসারে জীবনের শেষদিন পর্যন্ত থেকে গেলে। তোমার মতো জীবন আমি যাপন করিনি। ভালোবাসাহীন কোনও সংসারে আমি থাকিনি। তার চেয়ে বরং একা থাকাটাকেই মেনেছি। এর মতো স্বস্তির কিছু আর নেই। কোনও পুরুষের সঙ্গে বাস করা কোনও সচেতন মেয়ের পক্ষে সম্ভব নয়, সে পুরুষ যদিনা মনে প্রাণে নারীর স্বাধীনতা একশ ভাগবিশ্বাস করে, এবং সেই বিশ্বাসকে নিজের জীবনে প্রমাণ না করে। কিন্তু খুব বেশি পুরুষের মধ্যে এই গুণটি আমি দেখিনি। অনেককাল আগে যেসব দেশে নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠিত, সেসব দেশের অনেক পুরুষের মধ্যে এই গুণটি আছে, কিন্তু মনের মতো বিদেশি কোনও পুরুষ পাওয়া একটি দেশি মেয়ের পক্ষে খুব কি সম্ভব! প্রথম কথা, আমি তো খুঁজতে বসিনি কোনওদিন। ওসব আমার স্বভাবের বাইরে। স্বভাবের বাইরে বেরোনো আমার পক্ষে কোনওকালেই সম্ভব নয়। বিশেষ করে যে স্বভাবগুলো ভেতরে পুঁতে দেওয়া। এই স্বভাব বোধহয় তোমার কাছ থেকে পেয়েছিমা। তুমিও কোনও পুরুষের দিকে ফিরে তাকাতে না। যদিও বোরখার আড়ালে জীবনের প্রায় সবটা সময়ই কাটিয়ে দিয়েছে, কিন্তু আড়াল থেকে কাউকে হয়তো দেখেছো, কিন্তু তোমাকে তো দেখেনি কেউ। ’তোমাকে ভালোবাসি’ এই কথাটা তুমি কোনওদিন কারও কাছ থেকে শোনোনি। ভাবলে আমার খুব কান্না পায়। বাবা তো বলেইনি তোমাকে কোনওদিন। জানিনা কোনওদিন আমাণুদ্দৌলা বলেছিলো কিনা। আমার কেন যেন মনে হয়, বলেনি। আমাণুদ্দৌলার বিয়ে করার রোগছিলো। একইসঙ্গে কয়েকটা শহরে কয়েকটা বউ রাখতো। যেখানে বিয়ে করার সম্ভাবনা আছে, সেখানেই ভিড়তো। তোমার কাছে ভিড়তে চেয়েছিলো, সে তো বিয়ের জন্য নয় নিশ্চয়ই। আহ, জীবনে যদি তুমি কোনও সৎ পুরুষের দেখা পেতে মা! যদি জানতে, কেউ তোমাকে ভালোবাসে! ভালোবাসি শব্দটা আমি অনেক শুনেছিমা, আমার কোনও অতৃপ্তি নেই। তোমার শরীরটাকেও তুমি তৃপ্ত করতে পারোনি। চারটে সন্তান জন্মেছে বটে তোমার। সে খুব। সুখের মিলনে জন্মেছে বলে আমার মনে হয় না। জন্মানোর দরকার ছিল বলেই হয়তো জন্মেছে। সমাজের বাধা তো আছেই, মনের বাধাও কি কম? আমি সমাজের আর মনের সব বাধাই ডিঙিয়েছি। কিন্তু তারপরও কোথায় যেন হেরে যাই। জীবনের অনেকটা পথ পেরিয়ে এসে দেখি, আমি হয় নোবডি নয় সেলিব্রিটি। নোবড়ি আর সেলিব্রিটির প্রেমে সাধারণত কেউ পড়ে না। নোবডিকে লোকে তুচ্ছ করে, আর সেলিব্রিটির কাছ ঘেঁষতে দ্বিধা করে, ভেবেই নেয় যে ও নিশ্চয়ই যে কারও প্রেমে পড়বে না। যত মনের জোর আর সাহস থাকুক না কেন আমার, লক্ষ করেছি, কোনও পুরুষকে আগ বাড়িয়ে আমি বলতে পারি না, না দেশে না বিদেশে, তোমাকে ভালো লাগে বা এধরনের কিছু। জগতে বোধহয় আর কোনও আধুনিক মেয়ে নেই, যে কিনা এত দীর্ঘদীর্ঘদিন যৌনগন্ধহীন সন্ন্যাস জীবন কাটায়। আমাদের বোধহয় সমস্যা একইরকম ছিলো, সত্যিকার প্রেম আমরা পাইনি। পাইনি বলে যেন তেন কাউকে মেনে নিতেও পারিনি। এ নিয়ে তুমি কি আফশোস করো নীরবে, নিভৃতে? আমি করি। মাঝে মাঝে মনে হয়, আমার এই জীবন যদি আবার শুরু থেকে পেতাম, অন্য রকম করে যাপন করতাম। আসলে অনেকেরই এই ইচ্ছেটা হয়, শুধু আমার নয়। সংবেদনশীল মানুষ হলে অতৃপ্তিটা মৃত্যু অবধি থাকে।

.

ফরাসি একটি ছেলের সঙ্গে আমার সম্পর্কহয়। সম্পর্কটা শুরু হয় শরীরের আকর্ষণের কারণে, একে প্রেম জানি না বলা যায় কি না। ছেলেটা সুন্দর দেখতে। সুদর্শন সুপুরুষ বলতে ঠিক যা বোঝায়, তা। বয়সে আমার চেয়ে ছ বছরের ছোট। একসময় ভাবতাম বয়সে ছোটর সঙ্গে বুঝি প্রেম হতে পারে না। ভাবতাম বাংলায় কথা যে না বলতে পারে, তার সঙ্গে কখনও প্রেম হতে পারে না। সম্পূর্ণ ভুল। যে কোনও ভাষাতেই প্রেম সম্ভব। ছেলেটা ইংরেজি জানে। ইংরেজিতেই কথা হয় আমার সঙ্গে। ফরাসি ভাষা যেটুকু শিখেছি তাতে বেশিক্ষণ কথা চালানো যায় না। যখন ফরাসিতে তার প্রেমের কথা শোনাতে থাকে, খুব ভালো লাগে শুনতে। ফরাসি ভাষা, অনেকে বলে, প্রেমের জন্য চমৎকার ভাষা। ছেলেটা সত্যি বলতে কী, মা, আমাকে শরীরের প্রেম শিখিয়েছে। কত যে অশিক্ষিত ছিলাম শরীরের ব্যাপারে। নিজের শরীর, অথচ এই শরীরই কত অচেনা ছিল আমার। ছেলেটা আমার প্রেম পাবার জন্য দিন দিন অস্থির হয়ে ওঠে। ছেলের বউ বাচ্চা আছে, কিন্তু বউএর সঙ্গে নাকি শারীরিক সম্পর্ক নেই। এসব আমি বিশ্বাস করি না। কারণ সব বিবাহিত পুরুষই অন্য মেয়ের সঙ্গে সম্পর্ক করতে গেলে এসব কথা বলে। আমার কোনও অসুবিধে নেই সে ছেলে আর কারও সঙ্গে শুলে। আমি আমার একলা জীবনে মাঝে মাঝে যদি শরীরের তৃষ্ণা মেটাতে কোনও এক চমৎকার সুপুরুষকে পাই, যে আমাকে প্রচণ্ড ভালোবাসছে বলছে, কেন নয়, বলো? ছেলে দূরের একটা শহর থেকে প্রায়ই চলে আসতো, দু টো তিনটে দিন আমার সঙ্গে কাটিয়ে যেত। বিমানবাহিনীর পাইলট। আমিই প্যারিস শহরে তাকে নিয়ে ঘুরে বেড়াতাম। মেট্রো সবাই চড়ছে। আমার আবার পাতালে যেতে ইচ্ছে করে না। ট্যাক্সিতে সব জায়গায় যাওয়া চাই আমার। টাকা পয়সার প্রতি কোনও আকর্ষণ নেই বলেই হয়তো ওভাবে খরচ করতাম। ছেলেটা আমার কাণ্ড অবাক হয়ে দেখতে।

দেশ থেকে নির্বাসিত হওয়ার পর ছ বছর ভারতীয় দূতাবাসের দ্বারে দ্বারে ঘুরেও ভারত যাওয়ার অনুমতি পাইনি। বাংলাদেশ তো আমাকে ঢুকতেই দেয় না দেশে, ভারতে যেতে চাইছি কতকাল, সেইভারতও আমাকে ভারতে ঢোকার অনুমতি দিচ্ছেনা। শেষঅবধি নিরানব্বইএর শেষ দিকে আমাকে ভারতের ভিসা দেওয়া হয়। কী যে আনন্দ হয়েছিলো তখন। অন্তত দেশে না হোক, দেশের কাছাকাছি কোনও দেশে তো পৌঁছোতে পারবো। কলকাতা তো শুধুই আর পাশের দেশের কোনওশহরনয়! কলকাতার কত মানুষই তো আমার বন্ধু, শুভাকাঙ্ক্ষী। অনেকে বলে বিজেপি ক্ষমতায় এসেছে বলেই ভিসা পেয়েছি। কোন দল সরকারে এলো, সে নিয়ে আমার ভাবনা নেই, আমার ভারত যাওয়া নিয়ে কথা। বিজেপি যদিছ বছরের নিষেধাজ্ঞা ঘোচায়, তবে বিজেপিকে ধন্যবাদ জানানোর কোনও কারণ নেই। আমার ভারত যাওয়া মানে, কলকাতায় যাওয়া। কলকাতায় যাবো, খুশিতে নাচছি আমি। ফরাসি প্রেমিক, লরোঁ নাম, বললো, সেও যেতে চায় সঙ্গে। আমার আপত্তি নেই। খুশিতে সেও নাচলো। কিন্তু নিজের টিকিট করার সময় ছেলে বললো তার টাকা নেই টিকিটের পেছনে খরচ করার! বলে কী! ফরাসি যুবক, বিমান বাহিনীতে পাইলটের কাজ করেছে, ওদিকে আবার তুলুজ নামের শহরের নামকরা কলেজে বৈমানিক প্রকৌশল বিদ্যা শিখছে, তার টাকা নেই? অবাক হলাম বটে, কিন্তু আমিই টিকিট করলাম দুজনের। এয়ার ফ্রান্সে বোম্বে হয়ে কলকাতা। আমি ছাড়া কে করবে এসব! আমার মতো আবেগ সর্বস্ব বুদ্ধিহীন মেয়েমানুষ ছাড়া! ওই তোমার মতোই। আমি ঠিক জানি, তুমি আমার জায়গায় হলে তাই করতে। ইয়াসমিনও করতো। আমরা এই তিনজন হয়তো আঘাত পাওয়ার জন্যই জন্মেছি। ছেলেকে বিশাল সম্মান জানিয়ে সবখানে আমার সঙ্গে রাখলাম। এমনকী জ্যোতি বসুর সঙ্গে যখন দেখা করলাম, যে ঘরে অন্য কারও ঢোকা নিষেধ ছিল, ফরাসিকে ঢোকালাম। ফরাসি মনের আনন্দে সব নেমন্তন্ন, সব সংবর্ধনা, সব আনন্দ, সব সুখ উপভোগ করলো। প্রচুর উপঢৌকনও পেয়েছিল শুধু আমার প্রেমিক হওয়ার কারণে।

শুধু ফরাসি যুবক নয়, ফরাসি ওয়াইন নিয়েও গিয়েছিলাম। তাজ বেঙ্গলে একটা সুইট ভাড়া নিয়েছিলাম। দিনে বারো হাজার টাকাই যার ভাড়া। আসলে কী জানো, প্রাণের টানে যে জায়গায় এসেছি, সেখানে আর যা কিছুরই হিসেব করি, টাকার করি না। আমি সবসময় বলি, আমাকে বলো লক্ষ টাকা দান করতে, করবো। কোনও আপত্তি নেই আমার। কিন্তু আমাকে ঠকিয়ে যদি দুপয়সা নিতে চাও, আমি মানবো না। বলি বটে, কিন্তু তাও মেনে নিতে বাধ্য হতে হয়। প্রথম রাতেই আমার হোটেলের ঘরে কলকাতার পুরোনো চার বন্ধু এসেছিল ওয়াইন খেতে। অনেক রাত পর্যন্ত আড্ডা হল, খাওয়া হল। ফ্রান্স থেকে আনা ওয়াইন শেষ হয়ে গেলে হোটেলের রিসিপশানে ফোন করে ফরাসি ওয়াইন থাকলে দিতে বলি। লোক এসে দুবোতল ওয়াইন খুলে দিয়ে যায়। পরদিন সকালে ওই ওয়াইনের বিল দেখালো এক লক্ষ টাকারও বেশি। অত দামি ওয়াইন দিতে গেলে তার দামটা তো আগে বলে নেবে! আমার প্রশ্নের কোনও উত্তর নেই। বলেছিলাম, যেন দাম কমিয়ে রাখে। রাখেনি। ওই টাকা আমাকে একাই দিতে হয়েছে। ওয়াইন খেয়ে অনেক রাতে যখন বন্ধুরা চলে যাচ্ছে, আমার দ্বিগুণ বয়সী একজন বিদায় আলিঙ্গন করার নামে অযথাই আমার স্তন টিপে গেল। কী সুখ পেলো কে জানে। আমি হতবাক দাঁড়িয়ে রইলাম। এসবেপুরুষের কোনও লজ্জা হয় না, লজ্জা আমার হয়। আমার শুধু লজ্জা হয় না, রাগও হয়। কিন্তু আমি জানি, সব মানুষ এক রকম নয়। ভালো লোক মন্দ লোক সব দেশেই আছে। তবে জানো তো, মন্দ লোক আমি সহজে চিনতেপারি না। স্বভাব-গুণে অথবা দোষে সবাইকে ভালো লোক বলেই ভাবি। যখন মুখোশ খুলে পড়ে ওদের, বিস্মিত হই, দুঃখ পাই। ছোট একটা কবিতা লিখেছিলাম সেদিনের সেই বিস্মিত বিষাদনিয়ে।

রাস্তার ছেলে আর কবি।
এ গল্প আগেই করেছি, ওই যে ছোটবেলায় একদিন নদীর ধারে হাঁটছিলাম
আর ধাঁ করে উড়ে এসে এক রাস্তার ছেলে আমার স্তন টিপে
দৌড়ে পালিয়ে গেল, অপমানে নীল হয়ে বাড়ি ফিরে সারারাত কেঁদেছিলাম।

এ গল্প এখনও করিনি যে বড় হয়ে, কবিতা লিখতে শুরু করে
কবিদের আড্ডায় যেই না বসি,
হাতির মতো কবিরা স্তন টিপে দিয়ে চলে যায়।
পরদিন দেখা হলে বলে, কাল খুব মদ পড়েছিল পেটে।
মদের দোহাই দিয়ে কবিরা বাঁচে,
কবিতার দোহাই দিয়েও পার পায় বটে।

মন খারাপ হয়ে যাওয়ার ঘটনা ঘটেছে তা ঠিক, কিন্তু মন ভালো হওয়ারও অনেক কিছু ঘটেছে। শান্তিনিকেতনেকণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে, যার গান শুনে আমার কৈশোর আর আমার যৌবন কেটেছে, যার গান আমাকে বিদেশ বিভুইয়ে বাঁচিয়ে রেখেছে, দেখা হল। মুগ্ধতা আমাকে নির্বাক করে রেখেছিলো। উনি গান শোনালেন। গান শুনে কী জানি কী কারণে আমার চোখ ভরে ওঠে জলে। আড়াল করি চোখের জল। আসলে কী জানো মা, তোমার বয়সি কেউ যদি আমাকে নিঃস্বার্থ ভাবে ভালোবাসে, আমাকে স্নেহ করে, আদর করে কথা বলে, চোখের জল রোধ করতে পারি না। সাংবাদিকদের ভয়াবহ ভিড়। কী বলবোমা, লেখক তো নই, যেন বোম্বে থেকে সিনেমার স্টার এসেছি। আমার এত আলো, এত সাংবাদিক, এত প্রশ্ন ভালো লাগে না। বার বার ওদের বলেছি, ক্যামেরা দূরে সরাতে। বারবার বলেছি সাক্ষাৎকার দেব না। কে শোনে আমার কথা। বুঝি ওরা ভালোবাসে। ভালোবাসার মূল্য আমি না দিয়ে পারি না। এই একটি ব্যাপারে আমি খুব বোকা হয়ে পড়ি। শুধু তোমার ভালোবাসারই মূল্য দিইনি, জানি।

.
 
কত কিছু যে ঘটে কলকাতায়। অন্নদাশংকর রায়, শিবনারায়ণ রায়, অম্লান দত্তের মতো বড় মনীষীরা আমাকে স্নেহ করছেন, ভালোবাসছেন, তাঁরা আমার লেখাকে, লেখার জন্য আমার নির্বাসনকে ঐতিহাসিক বলে মত দিচ্ছেন। নিজের সম্পর্কে এত বড় ধারণা আমার নিজেরই কোনওদিন ছিল না, বা নেই। কিন্তু বড় মানুষদের ঔদার্য দেখে ভালোও লাগে, কুণ্ঠিতও হই। নিজে আমি সাধারণ এক মানুষ। সাধারণের মধ্যে থেকেই আমি স্বস্তি বোধ করি। অসাধারণ মানুষের ভিড়ে আমি বুঝি যে আমি নিতান্তই ক্ষুদ্র তুচ্ছতৃণ। তারপরও বড় বড় মানুষেরা আমাকে ভালোবাসা বা প্রশ্রয় দিতে মোটেও কার্পণ্য করেন না। নিখিল সরকার বটবৃক্ষের মতো দাঁড়িয়ে থাকেন। তাঁর মহানুভবতার তুলনা হয় না। তিনি আমাকে পরমাত্মীয়র মতো কাছে টেনে নিজের দেশ, নিজের বাড়িঘর, নিজের আত্মীয় স্বজন সব হারিয়েছি বটে, কলকাতা আমাকে সব ফিরিয়ে দেয় কদিনেই।

আমি অবাক হয়ে লক্ষ করি, আমাকে এক পলক দেখার জন্য, আমার অটোগ্রাফ নেওয়ার জন্য, আমার সঙ্গে কথা বলার জন্য কলকাতায় শুভাকাঙ্ক্ষীর ভিড়। সেই যে চুরানব্বই সালের মে মাসে প্যারিস হয়ে ঢাকা ফেরার পথে কলকাতায় গিয়েছিলাম, তার পর এই প্রথম আমি কলকাতায়। কলকাতা আমাকে বুকে টেনে নিল ভালোবেসে। অথচ পাশেই নিজের দেশ। যে দেশে আমাকে মানুষ ঘৃণা করে, অথচ বাঙালি ওরাও, বাঙালি এরাও। পশ্চিমবঙ্গের মানুষের ভালোবাসা পেয়ে আমার দীর্ঘ নির্বাসনের কষ্ট অনেকটাই মোচন হয়। যারা ভালোবাসে, তাদেরই আমার স্বজন, আমার আত্মীয় বলে মনে হয়। এদিকে ফরাসিটা চারদিকে আমার জনপ্রিয়তা দেখে কই খুশি হবে না তো কালকেউটের মতো ফণা তুলছে। এক রাতে, সারাদিনের হৈ চৈ এর পর পরদিন আমার অনুষ্ঠান, অনেকদিন বাংলা না বলে না পড়ে অনেকটা ভুলে যাওয়ার মতো অবস্থা, তারপর কী পড়বো, কোন কবিতা, কী বলবো নতুন বই নিয়ে, কিছুই ঠিক নেই, একবার দেখে নিতে চাইছি, মনোযোগ লেখায়, পড়ায়। না, লরে আমাকে কিছুইপড়তে দেবে না, লিখতে দেবে না, ভাবতে দেবে না। তাকে সময় দিতে হবে, তার দিকে তাকিয়ে থাকতে হবে, তার সঙ্গে গল্প করতে হবে, তার সঙ্গে প্রেম করতে হবে, তার শরীরে সাঁতার কাটতে হবে। আমি সেদিনই সিদ্ধান্ত নিয়েছি এই আপদকে জীবন থেকে সরাতে হবে। যে প্রেমে শ্রদ্ধা থাকে না, সে প্রেমকে আমি প্রেম বলি না। এত স্বার্থপর, হিংসুক, হীনম্মন্য লোককে নিয়ে চলাফেরা করার কী প্রয়োজন আমার! শরীরে সুখ হয় তা ঠিক। কিন্তু অন্যের ইচ্ছের খাঁচায় বন্দি হয়ে সে সুখ নেওয়ার কোনও শখ নেই আমার। ফরাসির জায়গায় কোনও বাঙালি পুরুষহলেও সম্ভবত একইভাবেঈর্ষা করতো। পুরুষের ঈর্ষা যে কী ভয়ংকর, তা আমি হাড়ে মজ্জায় টের পেয়েছি। জীবনে যে কজন পুরুষের সঙ্গে আমি সম্পর্ক গড়েছি, ওই একটি কারণেই মূলত সে সম্পর্ক ভেঙেছে, ঈর্ষা। লোকে বলে, মেয়েরা নাকি ঈর্ষাকাতর। পুরুষের তুলনায় মেয়েরা সামান্যও তা নয়। দেশে দেশে যত অপরাধ ঘটছে, তার সিংহ ভাগপুরুষের ঈর্ষার কারণে। মেয়েদের শরীরে অ্যাসিড ছুঁড়ছে, মেয়েদের গুলি করে, কুপিয়ে, পিটিয়ে, গলা টিপে হত্যা করছে পুরুষেরা। ঈর্ষায়। কটা পুরুষকে মেয়েদের ঈর্ষার কারণে জীবন দিতে হয়, কটা পুরুষের সর্বনাশ মেয়েরা করেছে, বলো?

.

এতদিন পর কলকাতায় এলাম, যেন দেশে ফিরলাম, যেন বাড়ি ফিরলাম। মা তুমি কখনও দেখনি মানুষ আমাকে ভালোবাসে। জীবনভর তুমি দেখেছো মানুষ আমাকে ঘৃণা করে, কাগজে কাগজে আমার বিরুদ্ধে কুৎসা রটায়, আমাকে অতর্কিতে আক্রমণ করে মেলায়, আমার বিরুদ্ধে মিছিল করে শহরে, আমাকে মেরে ফেলতে চায়, মাথার দাম ঘোষণা করে। কলকাতায় মানুষের ভালোবাসা দেখে আমার খুব তোমার কথা মনে পড়ছিল। আরও অনেক দেশে যখনই মানুষের ভালোবাসা, মানুষের উচ্ছ্বাস, আর আবেগ দেখেছি, শুধু তোমার কথা মনে পড়েছে, মনে মনে বলেছি, দেখ মা, তোমার মেয়েকে কত মানুষ ভালোবাসে। দেখতে কি পেতে কিছু! আমার কেন যেন বিশ্বাস করতে ভালো লাগতো, হয়তো দেখছো, যে কোনও কোথাও থেকে হয়তো দেখছো, দেখে হয়তো তোমার মনে আনন্দ হচ্ছে, হয়তো তোমার চোখে জল চলে আসছে। শিশির মঞ্চে আবৃত্তিলোক আমাকে সংবর্ধনা দিয়েছিলো। একা আমারই কবিতা পাঠের অনুষ্ঠান ছিল। আমার এক পাশে বসেছিলেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, আরেক পাশে শঙ্খ ঘোষ। একসময় যখন আমার ‘মায়ের গল্প’ নামের কবিতাটা পড়তে শুরু করলাম, কণ্ঠ বুজে এল, কিছুতেই পারছিলাম না পড়ে যেতে। সুনীল সান্ত্বনার একটি হাত রাখলেন পিঠে। কোনও সান্ত্বনা আমার দুঃখ দূর করতে পারেনা, মা। কোনও সান্ত্বনা আমার গ্লানি থেকে আমাকে মুক্ত করতে পারে না। তুমি যদি জীবনে সুখে থাকতে একটুখানি, আনন্দে থাকতে, তুমি যদি সামান্য ভালোবাসা পেতে আমাদের, তবে এই কষ্ট আমার হত না মা। মরে তো কত মানুষ যায়। তোমার মতো এত কষ্ট পেয়েকজন যায় বলো! সেই জন্মেরপর থেকে কষ্ট করছে। ভেবেছিলে কষ্ট বুঝি দূর হবে কোনও একদিন। তোমার চেয়ে ওই দুলুর মা বা আনুর মাও অনেক ভালো ছিল। তুমিও বুঝতে যে ওরা ভালো আছে, কেউ না কেউ আছে ওদের ভালোবাসার। তোমার তো কেউ ছিল না। এই যে কেউ ছিল না তোমার, সেটি আমি সইতে পারি না। নিজেকে ক্ষমা করতে পারি না আমি। কোনওদিনই পারবো না।

.

তুমি আর জাগলে না, চোখ খুললে না, কথা বললে না সম্ভবত জানুয়ারির এগারো তারিখে। জানি না এই তারিখটা কেন আমার মনে আছে। আমি মনে রাখতে চাই না, তারপরও মন থেকে তারিখটা কেন উবে যায় না! কত কিছুই তো মনে রাখতে পারি না, এই তারিখটা কেন মনে রাখি, জানি না। না, বছর বছর এগারো জানুয়ারি এলে আমি কিছুই করি না, হয়তো তারিখটি এসে চলে গেলে মনে পড়ে তারিখটি এসেছিলো। তিনশ পঁয়ষট্টি দিনের মধ্যে একটি দিন ওই দিনটি। ওই দিনটিতে আলাদা করে তোমাকে মনে করার, দুঃখ পাওয়ার আমি কোনও কারণ দেখি না। তিনশ পঁয়ষট্টি দিনই আমি তোমাকে মনে রাখতে চাই। বছরে তিনশ পঁয়ষট্টি দিনই আমি তোমাকে ভালোবাসতে চাই, তোমার মতো হাজারো মাকে চাই, মানুষকে চাই। তিনশ পঁয়ষট্টি দিনই নির্যাতিত সব মেয়েদের জন্য দু ফোঁটা চোখের জল ফেলতে চাই। তাদের জন্য মুষ্টিবদ্ধ করতে চাই হাত অথবা তাদের দিকে বাড়িয়ে দিতে চাই নিজের দুহাত। যদি আলাদা করে কোনও দিন তারিখের কথা আমাকে মনে রাখতেই হয়, আমি শুধুমনে রাখতে চাই তোমার জন্মের তারিখ। কোনও সাল তারিখ জানা ছিল না জন্মের। শুধু জানতে কোনও এক ঈদে তুমি জন্মেছিলে। তাই তোমার নাম রাখা হয়েছিল ঈদুল। নানা, নানি বড়মামা আর বাবা তোমাকে ঈদুন বলে ডাকতো। ল কেন যেন হয়ে গিয়েছিল ডাকার বেলায়!

তোমাকে হারিয়ে আমি নিজেকে হারালাম, মা। আমার কাছে পৃথিবীটাকে আর মূল্যবান কিছু মনে হল না। জগৎ তার সৌন্দর্য, তার হৃদয় সব নিমেষে হারিয়ে ফেললো। পড়ে রইলো নোংরা নর্দমার মত, পুঁজ আর পচা রক্তের মতো প্রাণহীন, দুর্গন্ধ, কুৎসিত। এই জগতে আমি একা বসে করবোটা কী, বলো তো! অপরাধবোধ আমাকে দিনে সাত টুকরো করে, রাতে সাত টুকরো করে। আমিটুকরোহই, রক্তাক্ত হই, তারপরও দেখি বেঁচে আছি। এই বেঁচে থাকা আমিটার জন্য আমার কোনও ভালোবাসা জন্ম নেয় না। ঘৃণা জন্ম নেয়। নিজের জন্য এই ঘৃণাটা আমি পুষে রাখি নিজের ভেতর। ঘৃণাটা আগুনের মতো, একবার হাওয়া লাগলে নিজেকে পুড়িয়ে ফেলে। আমি পুড়তে থাকি। প্রতিদিন। প্রতিরাত। এরকম ভাবেই আমি বেঁচে থাকি, যেখানেই থাকি।

.

বইমেলায় ঝড় বৃষ্টির রাতেও রীতিমত লাইনে দাঁড়িয়ে ‘আমার মেয়েবেলা’ বইটা কিনেছে পাঠক। তুমি সুইডেনে আসার পর যে বইটা দিনভর, রাতভর আমি লিখতে শুরু করেছিলাম, সেই বই। যে বইটা লিখছি বলে তোমাকে সময় দেওয়ার সময় হয়নি আমার, সেই বই। তোমার সাহায্য না পেলে যে বইটা আমার লেখা হতো না, সেই বইয়ের জন্য আমি পেলাম আনন্দপুরস্কার। এই বইএর কিছু তথ্যপড়েও খুব দুঃখ করেছিলে। কিন্তু তোমার দুঃখ তো তোমার দুঃখ। ও আমার দুঃখ নয়। তাই কোনও তথ্য আমি বদলে দিইনি। তুমিও সুইডেন ছাড়লে, আমার লেখাও শেষ হলো। পাণ্ডুলিপি পড়ে ফ্রান্সের প্রকাশক ক্রিশ্চান বেস এত বেশি আপ্লুত যে অনুবাদ হয়ে যাওয়ার পর, অল্প কিছু জিনিস সংশোধন করার জন্য নিউইয়র্কে আমার কাছে পাঠিয়েছিলেন অনুবাদক ফিলিপ বেনোয়াকে। কিছু শব্দ, আর বাক্য বিশেষ করে আরবি ফারসি যে শব্দগুলো ব্যবহার করেছি, তাদের অর্থ জেনে নিয়ে সে শহর বেড়াতে বেরিয়ে পড়তো। সেই ফিলিপ বেনোয়া প্যারিসে ফিরে যাওয়ার পরপরই বই বেরোলো এডিশনস স্টক থেকে। ‘আমার মেয়েবেলা’ প্রথম বেরিয়েছে ফরাসি ভাষায়। বাংলায় বেরোলো অনেক পরে। মূল ভাষার পাণ্ডুলিপি যথারীতি আনন্দ পাবলিশার্সকে দেওয়া হয়েছিলো। যেহেতু আনন্দই আমার বই ছাপায়। কিন্তু পাণ্ডুলিপি পড়ে আনন্দ সিদ্ধান্ত নিল যে এ বই তাদের পক্ষে ছাপানো অসম্ভব। শুনেছি, দেশ, সানন্দাইত্যাদি পত্রিকা বাংলাদেশে যাচ্ছে, এখন আমার বই প্রকাশ করে বাংলাদেশ সরকারকে ক্ষেপিয়ে দেওয়ার ইচ্ছে আনন্দ পাবলিশার্সের নেই। কেউ চাইছেনা, দেশ আর সানন্দা বাংলাদেশে আমার কারণে নিষিদ্ধ হয়ে যাক। আর, ইসলাম নিয়ে যেসব কথা বইতে আছে, তাতে বাংলাদেশ সরকার আপত্তি করতেই পারে। যদি আনন্দ বই ছাপায়, তবে কিছুকিছু অংশ বিশেষ করে ধর্ম নিয়ে মন্তব্য বাদ দিতে হবে। আনন্দ এর আগে এমন আবদার করেনি, অবাক হই, কিন্তু কোনও কিছু বাদ দিতে আমি রাজি হই না। না রাজি হলে আনন্দ ছাপাবে না বই। ওরা এর আগে আমার কোনও বই ছাপাতে আপত্তি করেনি। এবার করেছে, এর পেছনে আরও এক কারণ আমি শুনেছি, ওরা ঢাকায় আনন্দ পাবলিশার্সের একটা শাখা খুলবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে এ নিয়ে কথাও হয়ে গেছে। ইসলাম সম্পর্কে সমালোচনা আছে আমার এমন কোনও বই যদি এখন ছাপায়, তাহলে ঢাকায় ওদের নতুন শাখার ওপর মৌলবাদী আক্রমণ হওয়ার আশংকা আছে।

নিখিল সরকার তখন চেষ্টা করলেন অন্য প্রকাশককে বই দিতে। স্ত্রী নামের একটি প্রকাশনী সংস্থা এগিয়ে এলো। লেখক অমিতাভ ঘোষের সঙ্গেও নিখিল সরকারের এ নিয়ে কথা হয়। তিনিই চেয়েছিলেন স্ত্রীকে দেওয়া হোকপাণ্ডুলিপি। কিন্তু নিখিল সরকার শেষ পর্যন্ত দিলেন না, বললেন স্ত্রীও পারবেনা বাদ না দিয়ে বই প্রকাশ করতে। তাঁর বন্ধুদের মাধ্যমেই পিবিএস নামের ছোটখাটো একটি প্রকাশনীর খোঁজপাওয়া গেল। ওই প্রকাশনীকেই নিখিল সরকার দিয়ে দিলেন বই। পিবিএস নিজেদের আদর্শের বাইরের কোনও বই ছাপায় না। আমার বই পরীক্ষা নিরীক্ষা করে তবে পিবিএস এর কর্তারা এক মত হয়েছেন যে এই বই তাঁদের আদর্শের পরিপন্থী নয়। পিবিএস ছোট প্রকাশক। আনন্দের মতো বড় প্রকাশকবই ছাপাতে নারাজ শুনে অন্য বড় প্রকাশকও ভয়ে পিছিয়ে গেছে। পিবিএসএর ভয় ডর কমই। ছোট বলে নয়। আদর্শের কারণে। সমাজতন্ত্র, সমতা, সততা, সমানাধিকার, এসআমারও যেমন বিষয়, তাদেরও। আজকাল তো আর সব থাক, এই আদর্শটাই নেই মানুষের। মানুষ ক্রমে ক্রমে বিচাত হচ্ছে মানবতাবোধ থেকে। নিখিল সরকার বই থেকে বেশ কিছু শব্দ বাক্য কেটে বাদ দিয়েছেন। তাঁর আশংকা, ওগুলো পড়ে মুসলমানরা আমাকে মেরে ফেলবে। আমি মৃত্যুর ভয় করি না। সেই বাদ দেওয়া শব্দ বাক্যগুলো যখন চোখেপড়ে, রীতিমত যুদ্ধ করেওগুলোআবার আমি ঢুকিয়ে দিয়েছিবইয়েরপরের সংস্করণে। পিবিএস এর কর্তারা নিজেরা ধর্মমুক্ত হওয়ায় কোনও ঝামেলা করেনি। নিখিল সরকার নিজে ধর্মমুক্ত হলেও আমার কোনও ক্ষতি হতে পারে আশংকায় আমার অতি-সাহসে অসন্তুষ্ট হয়েছিলেন। কিন্তু তাঁকে শ্রদ্ধা করলেও আমি কাটাছেঁড়ার ব্যাপারটি মেনে নিতে পারিনি। বিশাল এক প্রকাশনা উৎসব হয়েছিলো বইয়ের, সম্ভবত ওটাই আমার লেখা কোনও বইয়ের প্রথম প্রকাশনা উৎসব।

বইটি তোমার কারণেই লেখা হয়েছিল, মা। ছোটবেলার কত ঘটনা তুমি আমাকে বলেছো। অপ্রিয় কত সত্য কথাই তো তুমি বলেছো। তুমি যেরকম লুকোওনি, আমিও লুকোইনি। বই লিখছি জেনেও তো তুমি তোমার মেয়েবেলার সব দুঃখ সুখের কথা বলেছো, তোমার যৌবনের, তোমার সংসার জীবনের সব। তুমি না বললে আমি লিখতে পারতাম না আমার মেয়েবেলা, তুমিই শুরু করে দিয়ে গেলে আমার আত্মজীবনী লেখা। নির্বাসনের কারণে আমার লেখালেখি যেমন বন্ধ ছিল, তেমন বন্ধই থাকত। তুমি এলে, তোমার উপস্থিতিতে আমার আমিকে আমি নতুন করে যেন আবিষ্কার করলাম। তুমি আমাকে দেখতে না এলে আমার অতীতের দিকে আমি তাকাতাম না, বই লেখার কথা আমার ভাবনার মধ্যে আসতো না। তুমি যখন এসেছিলে, তুমি তোমার আঁচলে করে শিউলি ফুলের মতো আমার শৈশব কৈশোর নিয়ে এসেছিলে। তোমার গা থেকে শিউলির সেই ঘ্রাণই ভেসে আসতো। এখনও চোখ বুজে তোমাকে ভাবলে সেই ঘ্রাণ পাই আমি। বড় চেনা ঘ্রাণ। বড় হারিয়ে যাওয়া, আবার না যাওয়াও।

আমার মেয়েবেলা বইটা বাবাকে উৎসর্গ করেছিলাম, তোমার সম্পর্কে কম কুকথা ছিল ও বইটায়! তখনও তো তুমি ছিলে, বেঁচে ছিলে। দ্বিতীয় আর তৃতীয় খণ্ড উতল হাওয়া আর দ্বিখণ্ডিত বইদুটোতে তোমার দিকে অন্য চোখে তাকালাম। সত্যি বলতে কী, তাকালাম তোমার দিকে। এতকাল তো তাকাইনি। তোমাকে নিয়ে হাসি ঠাট্টা করেছি, মজা করেছি। তাকাইনি। আমার মেয়েবেলা যখন বাংলায় বের হলো, অনুতাপ আমাকে এমনই কাঁদাচ্ছিলো যে তোমাকেই বইটা উৎসর্গ করলাম। বইয়ের ফরাসি সংস্করণটি কিন্তু বাবাকে উৎসর্গ করা। কী নামে ডাকবে তুমি এই অস্থিরতাকে? আচমকা যেন আমার চেতনার কবাট খুলে গেছে। আচমকা যেন আমি নিজেকে আয়নার সামনে দাঁড় করিয়ে প্রথম নিজের আসল চেহারাটি দেখছি। নিজের ওপর কি কম ঘেন্না আমার হয়েছে! কিছুতেই নিজের গ্লানিকে একবিন্দুআমি মুছতে পারি না। আমার ভেঙে যাওয়া, সব ছেড়ে ছুঁড়ে আমার সন্ন্যাস বরণ দেখে বন্ধুরা বলেছিলো, গ্লানি থেকে মুক্ত হও, গ্লানি মানুষকে ধ্বংস করে ফেলে। ফেলুক, তাই তো চাইছিলাম। আমি তখন মরে গেলেও আমার কিছু যেতো আসতো না।

.

কলকাতা থেকে ভিসা ফুরোলে চলে যেতে হল প্যারিসে। প্যারিসে আমার কাজ কী বলো। শুধু বসে থাকাই তো। এইপ্যারিসেই আমাকেরানির মতো রেখেছিলো, আমার গাড়ির সামনে পেছনে প্যাঁপু বাজিয়ে গাড়ি যেতো। প্যারিসের অর্ধেক রাস্তা বন্ধ করে দেওয়া হত আমি রাস্তায় চলবো বলে। আর সেই একই আমিপ্যারিসের রাস্তায় হেঁটে বেড়াই, যে কোনও মানুষের মতো, বাদামি রঙের মেয়ে, এশিয়ার, ভারতীয় উপমহাদেশের, গরিব দেশের বাদামি মেয়ে, কেউ ফিরে তাকায় না। অথচ এই আমাকে দেখার জন্য এই শহরেই একসময় মানুষ উপচে পড়তো, বইয়ে সই নেওয়ার জন্য ভিড় বাড়তো। নিরাপত্তা পুলিশের বাধায় কত কত মানুষ আমাকে এক পলক। দেখারও সুযোগ পায়নি। যখন মনে পড়ে ওসব কথা, মা, হাসি পায়। ওই উত্থানটা সত্যি ছিল, না এই পতনটা সত্যি! আমার এসবকে উত্থান বা পতন বলে মনে হয় না। যেখানে ছিলাম আমি, সেখানেই আছি। আমি খুব সাধারণ মানুষ, তোমার মতোই সাধারণ, নিরীহ। মাঝে মাঝে আমাকে অসাধারণ বলে প্রদর্শন করা হয়, আমার জীবনের এই সংগ্রামের জন্য, আমার লেখার কারণে, আমার আদর্শের কারণে। যে মানুষটি আমি রাস্তায় একা হাঁটি, বাসে বা মেট্রোয় চড়ি, বা ট্যাক্সিতে, তাকে মানুষ চেনে না বলে ঘিরে ধরে না। যদি জানতো আমি কে, ছুটে আসতো। এই যে দেখলে চেনে না, তা আমার জন্য একরকম ভালো। আমি নিজের মতো করে জীবন যাপন করতে পারি। ওই অসাধারণ জীবন, ওই খ্যাতি আমাকে অস্বস্তি দেয়। ভীষণ চাপ ওই জীবনে। দেবীর ভূমিকায় বেশিক্ষণ তিষ্ঠোনো যায় না। ওই জীবনটা ক্ষণস্থায়ী, এই জীবনটাই আসল। প্যারিসে আমি একটা ভীষণ ভুল করি। ক্রিশ্চান বেস আমাকে ভালোবাসছেন, বলেছেন তিনি আমার মায়ের মতো। অমনি আমি তোমার গলার হারটি দিয়ে দিই ওকে। মা, মা কি সবাই হতে পারে, নাকি হয়? যেই না আদর দেখায়, খুব, আমার পা ভেঙেছে বলে আমার অ্যাপার্টমেন্টে এসে ঘর দোর পরিষ্কার করতে শুরু করে, তখনই খুব আপন ভাবতে শুরু করেছিলাম। কত মানুষকে যে আমি আপন ভাবি। পরে অবশ্য বোধোদয় হয়। তবে আমার বোধোদয় হতে সবসময়ই খুব দেরি হয়।

প্যারিস শহরে থাকতে থাকতেই আমি বুঝতে পারি, বেশির ভাগ মানুষ যাদের আমি বন্ধু বলছি, তারা আসলে আমার বন্ধু নয়। খুব সহজে কয়েকদিনের পরিচয়ের পর আমরা স্বচ্ছন্দে সবাইকে বন্ধু বলে ডাকি। আমার খ্যাতি, অর্থ আর উদারতা–এ তিনটেকে ভাঙিয়ে তাদের নিজেদের সুবিধে স্বার্থের জন্য যা কিছু পারে, দুহাত ভরে নেবে। এ ছাড়া আর কোনও উদ্দেশ্য নেই। মানুষের কৃত্রিমতাকে, বেশ কয়েক বছর, ধরে নাও, যে, আমি বুঝবো না। যে যত বড় অভিনেতা হবে, কৃত্রিমতা দিয়েই বছর পার করবে। অভিনয়ে কাঁচা হলে হয়তো কয়েক মাসেই ধরতেপারবো। মুলাঁ দন্দের মিরিয়াম অভিনয়ে খুব পাকা ছিল। যেই না দেখলো, আমাকে সে ভালোবাসছে আর আমি তার ভালোবাসায় সাড়া দিচ্ছি না, প্রতিশোধ নিল। কানাডার সেই লেখক পিয়ের লরুর সঙ্গে মুলাঁ দন্দে ছেড়ে চলে আসার পরও আমার যোগাযোগ আছে, এমিরিয়ামের সহ্য হয়নি। একদিন পিয়েরকে আমি নিয়ে গিয়েছিলাম রেস্তোরাঁয়। পিয়ের আমার কাছে দুহাজার ফ্রাঁ ধার চেয়েছে, এসব আমি নিজেই মিরিয়ামকে জানিয়েছিলাম। শুনে সে সোজা ক্রিশ্চান বেসের শরণাপন্ন হল, পিয়ের ভালো লোক নয়, পিয়ের আমাকে বোকা পেয়ে ধোঁকা দিচ্ছে। ক্রিশ্চান বেস মনে করেন আমি কোনও অঘটন ঘটিয়ে ফেলবো, বুদ্ধিমান কিছু লোকের সাহায্য ছাড়া আমি চলতে পারবো না। তিনি হামলে পড়লেন, না এসব চলবে না। কিছুতেই পিয়েরকে টাকা ধার দেবে না, ওর সঙ্গে আজই এখনই সম্পর্ক ছেদ করো। ওকে তোমার ধারে কাছে আসতে দেবে না। ঠিকমিরিয়াম যা চেয়েছিল, যেভাবে, ঠিক সেভাবেই সে ঘটনাটা ঘটালো। ক্রিশ্চানের অনুমতি নিয়ে পিয়েরকে সে আমার হয়ে গুডবাই জানিয়ে দিল। তখন পিয়ের আর আমি দুজনের কেউইমুলাঁ দন্দে নেই, দুজনইপ্যারিসে। পিয়েরের টাকার অভাব ছিল, চাইতেই পারে সে টাকা, আমি দিতেই পারি তাকে। মিরিয়ামের কেন এত জ্বালা। আমাকে সে খুব ভালোবাসে? আমার টাকা পয়সা সে খুব বাঁচাতে চায়? আসলে ওসব কাণ্ড করার মূল উদ্দেশ্য পিয়ের নামের হবু প্রেমিককে আমার ত্রিসীমানা থেকে বিদেয় করা। আমার ভাঙা পা দেখতে পিযের আসতো মাঝে মাঝে। দাবা নিয়ে আসতো, খেলতো আমার সঙ্গে। ক্রাচ নিয়ে এসেছিলো। প্যারিসের একলা ঘরে শুয়ে থাকা আমাকে সে সঙ্গ দিত। একদিন ওয়াইন নিয়ে এলো। ফ্রান্সের ক্লোদ লোলুর মতো চিত্রপরিচালক পিয়েরের গল্প নিয়ে ছবি করেছে। আমরা দুজনে সিনেমার গল্প লেখার পরিকল্পনা করি। খেতে খেতে গল্প। অমন আশ্চর্য সুন্দরের দিকে তাকিয়ে আমার মন জুড়োত। সেই পিয়েরকে কায়দা করে মিরিয়াম তাড়ালো। কারণ মিরিয়াম আমাকে চায়। আমি অবাক হয়ে দেখেছি এরা ভালোবাসতে যেমন পারে, প্রতিশোধ নিতেও পারে। ভালোবাসা এদের উদার করে না, হিংস্র করে তোলে। পিয়েরের সঙ্গে যখন মুলাঁ দন্দে থেকে যে রাতে চাঁদের আলোয় হাঁটতে গিয়েছিলাম, মিরিয়াম সারারাত কেঁদেছে আর মদ খেয়েছে। তার সহ্য হয়নি পিয়েরের প্রতি আমার আকর্ষণ। সে রাতেই চুরি হয়ে যায় আমার ঘরে রাখা কয়েক হাজার ডলার। আমার ঘরের একটা চাবি মিরিয়ামের কাছে থাকতো। মিরিয়াম ওই বিশাল মুলাঁ দন্দের পরিচালনার দায়িত্বে ছিল বলে অবাধ অধিকার ছিল সব কিছুতে। কে নিয়েছের প্রশ্ন উঠলে মিরিয়াম বলে হয়তো ঘর পরিষ্কার করতে আসা মেয়েরা। ওই মেয়েরা তিন মাসে কোনওদিন আমার ওই বাক্সে হাত দেয়নি, যে বাক্সে ডলার আর তোমার সোনার গয়নাগুলো ছিলো। মিরিয়ামকে আমার –কখনও সন্দেহ হয়নি। কিন্তু পরে একটি ঘটনা ঘটায় আমি বুঝি কে আসলে ছোটলোকি ওই প্রতিশোধটা নিয়েছে। মিরিয়ামের ঈর্ষা যেমন ভয়ংকর, প্রেমও ভয়ংকর। ব্রাজিলের সাও পাওলো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আমাকে আমন্ত্রণ জানানো হল বক্তৃতা দিতে। আমি রাজি হয়েছিলাম যেতে। ওরা টিকিটও পাঠিয়ে দিয়েছিল। মিরিয়াম বললো, সেও যাবে আমার সঙ্গে। মুলাঁ দন্দের কাজ ফেলে সে নিজের টিকিট করে ফেললো। তারপরআমারপামচকালো, আমি শুয়ে আছি। ব্রাজিলকে জানিয়ে দিলাম, যেতে পারছি না। মিরিয়াম একাই চলে গেল ব্রাজিল। একাই সে হোটেলে বসে বসে আমার কথা ভাবলো আর কাঁদলো। ফিরেই সে সোজা আমার কাছে। আমার সেবা করবে, আমাকে ভালোবাসবে। মুলায় তার মন বসে না। ওখানে গেলেও সে প্রতিরাতে চলে আসে প্যারিসে আমার বাড়িতে, ভোরে ঘুম থেকে উঠে চলে যায়। মুলাঁ থেকে গাড়ি চালিয়ে প্যারিস আসতে তিন ঘণ্টা সময় নেয়। এতার কাছে কিছুই নয়। আমার জন্য যত তার আবেগ, আমার তার জন্য কিছুই নেই। মাঝে মাঝে আমার নির্লিপ্তি দেখে সে ফুঁসে ওঠে। চেঁচায়। কাঁদে। আমার কী করার আছে বলো। মিরিয়ামের শরীরের প্রতি, সে শরীর যতই সুন্দর হোক, আমার কোনও আকর্ষণ জন্মায় না। আমার প্রেম পেতে মিরিয়াম মরিয়া হয়ে ওঠে। নিজেকে সে সমকামী বলে না। এর আগে যাদের সঙ্গে সে প্রেম করেছে, সকলেই পুরুষ ছিল। এই প্রথম সে নাকি এক মেয়ের প্রেমে পড়লো। হয়তো তাই। কিন্তু ও একা প্রেমে পড়লে তো হবেনা, আমাকেও পড়তে হবে। এক গভীর রাতে মুলাঁ দন্দের ঘরে আমার বিছানায় আচমকা এসে আমার শরীরের প্রতিটি রোমকূপে উষ্ণ নিঃশ্বাস ফেলছিলো। সেনা হয় অন্যরকম এক রাত দিয়েছিল আমাকে। কিন্তু প্রতি রাতে তার দাবি করলে চলবে কেন! আমার শরীর বা হৃদয় কোনওটাই আমি তাকে দিতে পারি না। বন্ধুত্বই শুধু পারি দিতে, কিন্তু শুধু বন্ধুত্বে তার চলে না। দিন দিন উন্মাদ হয়ে ওঠে মিরিয়াম। আমি তখন ঘর সাজাচ্ছি প্যারিসে, সে চলে আসতো নিজের কাজ ফেলে। আমাকে নিয়ে গাড়ি করে সেই ইকিয়ায় যাওয়া, আমার খাট চাই, সোফা চাই, বইয়ের আলমারি চাই, টেবিল চাই, চেয়ার চাই, খাবার টেবিল চাই, চেস্ট অব ড্রয়ার চাই, থালা বাসন চাই। আমি যে মিরিয়ামকে ডাকিতানয়। নিজেই সে গাড়ি করে আমাকে দোকানে নিয়ে যায়। নিজেই আসবাব পত্র টেনে ঘরে ওঠায়, জোড়া লাগিয়ে দেয়। এত সব তার করার কথা নয়, কিন্তু করে। মুলার কাজ ফাঁকি দিয়ে সে করে এসব। ঘরে জায়গা হয় না বলে, তার ওপর এত বিদেশ ভ্রমণ করতে হয় আমার, ঘরে দামি জিনিসপত্তর রাখা নিরাপদ নয় বলে লাল সুটকেসে সব ভরে মিরিয়াম নিজেই বলে সুটকেসটা তার বাড়িতেই রেখে দেবে সে। নিয়েও যায়। এই মিরিয়ামকে একদিন আমার দূরে সরাতে হল, তাকে বলে দিলাম আমার পক্ষে সম্ভব নয় তার সঙ্গে প্রেম করা, বা শরীর মেলানো। বহুঁকাল অভুক্ত থাকলে মেয়েদের স্পর্শে হয়ত জেগে উঠতে পারি। তার মানে এই নয় যে আমি সমকামী। মিরিয়াম ক্ষুব্ধ হতে লাগলো। আমার জন্য তার ক্রন্দন সীমা ছাড়াতে লাগলো। বিদেয় তাকে শেষপর্যন্ত হতেইহল। ফরাসি প্রেমিকের সঙ্গে প্রথম রাত কাটানোর দিন মিরিয়াম এসেছিলো আমার কাছে। তাকে আমি ঘরে ঢুকতে দিইনি। অনেকক্ষণ দরজায় বেল বাজিয়ে সেচলে যায়। চলে সেসম্পূর্ণ যায়নি। সারারাত সে রাস্তায় তার গাড়িতে বসেছিলো। এমনভাবে বসেছিলো, যেন গাড়ির জানালা দিয়ে সে ঘরের জানালা দেখতেপায়। আর বারবারই আমাকে ফোন করে অভিযোগ করছিল, চিৎকার করছিল, কাঁদছিলো। আমি বারবারই তাকে চলে যেতে বলি। বলি যে আমার এক বন্ধুর সঙ্গে সময় কাটাচ্ছি আমি, আজ তার সঙ্গে দেখা করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। আসলে আমি চাইনি যে সুদর্শন যুবকের সঙ্গে আমার আশ্চর্য সুন্দর একটা সম্পর্ক গড়ে উঠেছে, তাকেও মিরিয়াম তাড়াক, যেভাবে পিয়েরকে তাড়িয়েছিল। এরপর কয়েক মাস গেলে, একদিন সুটকেসে রাখা কোনও জিনিস খুঁজতে গিয়ে পাতিপাতি করে খুঁজে

পাওয়ার পর মনে পড়লো, লাল সুটকেসে ছিল ও জিনিস, আর সেই সুটকেস মিরিয়ামের বাড়িতে। ওকে ফোন করলাম, আমার সুটকেসটা চাই। মিরিয়াম বললো, কিসের সুটকেস? সেই যে আমার লাল সুটকেস, ঘরে জায়গা নেই বলে বা ঘর নিরাপদ নয় বলে যেটি তুমি নিয়ে গিয়েছিলে! মিরিয়াম বললে কোনও সুটকেস টুককেস তার কাছে নেই। সে কিছুই নেয়নি। আমি ভাবলাম, বোধহয় একটু মজা করছে আমার সঙ্গে। কিন্তু আবার বলাতে সে আবারও সাফ বলে দিল, কোনও সুটকেসই সে নেয়নি। তার কাছে আমার কিছু নেই। ফোন রেখে দিল। এভাবেই প্রতিশোধ সে নিল তার সঙ্গে প্রেম না করার। বড়লোক মানুষ এরা, অথচ দেখ কত নিচে নামতে পারে। ওর ভালোবাসা কি ভালোবাসা ছিল মা? আমি তো কাউকে একবার ভালোবাসলে, সেই ভালোবাসা উবে গেলেও এত নিষ্ঠুর হতে পারতাম না। আর ভালোবাসার দরকার কী, কোনও ঘোরশত্রুর সঙ্গেও কি এই অন্যায় করতে পারবো আমি! অসম্ভব। প্রতিশোধ নিতে গিয়ে লরোঁকে দেখেছি সে কী করেছে। লরোঁ বলতো আমাকে সে ভীষণ ভালবাসে। আমার বিশ্বাস হত না। কলকাতা থেকে ফিরে লরোঁকে বিদেয় করে দিই, কিন্তু তারপরও ঠিক বিদেয় করা হয় না। রাতদিন ফোন করে হু হু করে কাঁদতো, আমাকে ছাড়া নাকি বাঁচবেনা। ছুটি পেলেই ছুটে আসতো আমার কাছে। একবার তো আমাকে ওর বাবা মার বাড়ি আর বোনের বাড়িতে নিয়ে গেল। ওদের সঙ্গে আমাকে ওর প্রেমিকা হিসেবেই পরিচয় করালো। আমাকে ওরা নামে চিনতো, পেয়ে মহা খুশি। ওর বাবা মা আমাকে আর লরোঁকে এক ঘরে ঘুমোতে দিল রাতে। বাবামার বাড়িতে প্রেমিকা নিয়ে যাওয়া পশ্চিমের দেশগুলোতে খুব বড় ব্যাপার। সম্পর্ক অতীব গুরুত্বপূর্ণ না হলে এঘটনা ঘটে না। নিজের বউকে প্রথম দিনই আমাদের সম্পর্কের কথা জানিয়ে দিয়েছিলো। প্রয়োজনে ফোন করে লরোঁকেনা পেলে আমার বাড়িতেই ফোন করতে লরোঁর বউ। লরোঁ বউ বাচ্চা ছেড়ে আমার সঙ্গে বাকি জীবন থাকার স্বপ্ন দেখছিলো। বার বার আমাকে বলেছে আমি যেন প্যারিস ছেড়ে তুলুজ চলে গিয়ে ওর সঙ্গে জীবন যাপন শুরু করি। শহরে আলাদা একটা অ্যাপার্টমেন্টও সে ভাড়া নিয়ে নিয়েছে। কিন্তু কখনও মন সায় দেয়নি আমার। ওর বাড়িতে গিয়ে ওর সঙ্গে বাস করার ইচ্ছে আমার হয়নি। খুব যেতে বলায় একবার দিন পাঁচেকের জন্য বেড়াতে গিয়েছিলাম। লরোঁকে আমি ভালোবাসতাম কিনা জানি না, তবে ওর সুন্দর শরীরটার দিকে তাকালে তাকিয়েই থাকতে ইচ্ছে করতো। কলকাতার হোটেলে প্রথম ওকে আমি জীবন থেকে বিদেয় করার কথা ভাবি। দ্বিতীয়বার ভাবি লন্ডনের কমপিউটারের দোকানে। আমি একটা ল্যাপটপ দেখছি কেনার জন্য। আমি যেটাপছন্দকরছি, সেটা সে কিছুতেই আমাকে নিতে দেবে না। বলে, এত দাম দিয়ে এটা কিনো না। তোমাকে ঠকাচ্ছে এরা। কম দামে কমপিউটার কিনে সব হার্ডওয়্যার সফটওয়্যার লাগিয়ে নেবে। আমি বললাম, এটাই আমি কিনবো, এটাই আমারপছন্দ হয়েছে। শুনে সেফুসতে শুরু করলো। উপদেশনা শুনলে পুরুষদের আবারভীষণ রাগ হয়। রাগেফুসতে থাকে বুনো মোষের মতো, আর বলতেই থাকেআমি বোকার মতো কাজ করেছি। আমি ঠাণ্ডা গলায় বললাম, হ্যাঁ করেছি, আমারইচ্ছেহয়েছে করেছি। ডিনারেও যখন দেখলাম, তার আদেশ বা উপদেশ না মানার কারণে তার ফুঁসে থাকা বহাল রয়েছে, আমি শান্ত কণ্ঠে বললাম, এই সম্পর্কটা অনেক আগেই শেষ হয়ে যাওয়ার কথা ছিল, মনে হয় শেষ হয়ে যাওয়াই উচিত। রাতে হোটেলে ফিরে এলে লরোঁ বারবার জিজ্ঞেস করতে লাগলো, তুমি কি সত্যিই শেষ করে দেবে সম্পর্ক? সত্যিই আমাকে ছেড়ে চলে যাবে? বলি, হ্যাঁ। অমনি সে নমি কি ত্য পা, নমি কি ত্য পা বলে কাঁদতে লাগলো, এরপর দেয়ালে মাথা ঠুকতে লাগলো। মাথা ফেটে রক্ত বেরোবে এবার ছেলের। দেয়াল থেকে আমি টেনে আনলাম লরোঁকে। সে আমাকে জড়িয়ে ধরে বলতে লাগলো, নমি কি ত্য পা, ছেড়োনা আমায়। এরপর আমাকে আদর করলো বেঘোরে। শরীর চায় ওকে, শরীরই বলে। কিন্তু মন চায় না। পরদিন লণ্ডন থেকেপ্যারিসে ফেরার পথে ইংলিশ চ্যানেল পার হয়ে ওর বোনের বাড়িতে আমরা রাত কাটাই। রাতেও একই প্রশ্ন, তুমি কি সত্যিই ছেড়ে যাবে আমাকে? বললাম, হ্যাঁ যাবো। যতবার প্রশ্ন করে, একই উত্তর পায়। একসময় লরোঁর ভেতরের বুনো মোষটি ধারালো শিং বাগিয়ে তাড়া করে আমাকে। আমাকে সে বেরিয়ে যেতে বলে বাড়ি থেকে। আমি যত বলি, সকালে বেরোবো, এখন নয়। সে বলে, এক্ষুনি। কাপড়ের ব্যাগটা নিয়ে সে আমাকে বাড়ির বাইরে বের করে দিয়ে আসে। রাত তখন দেড়টা বোধহয়। রাস্তার মাতাল বদমাশ একলা মেয়েকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে কী করবে লরোঁ একবারও ভাবেনা। না, ও সময় কোথায় ট্রেন, কোথায় বাস, কোথায় ট্যাক্সি জানি না। প্যারিস অনেক দূর, কোনও পথেই প্যারিসে যাওয়ার উপায় নেই। শেষে বেল টিপলাম বাড়ির। অন্তত লরোঁর বোন এভলিন ঘুম থেকে উঠে তার দাদার কাণ্ড দেখুক। কিন্তু বেল বাজার সঙ্গে সঙ্গে দরজা খুলে দেয় লরোঁ। আমি বলি, আমাকে রাতটা এখানে থাকতেই হবে। সকালে বেরিয়ে যাবো। রাত কাটিয়ে সকালে একা বেরোতে নিলে লরো সঙ্গে যায়। পথে পাগলকে আমি আর ছেড়ে যাওয়ার কথা কিছু বলি না। শুধু স্তব্ধতার মধ্যে কাটে আমার দীর্ঘ সময়। আমার প্যারিসের অ্যাপার্টমেন্টে সেও ঢোকে। অপেক্ষা করি তার চলে যাওয়ার। লরোঁ বলে, আমাকে বিদেয় করার জন্য অস্থির হচ্ছো তাইনা! মনেমনে বলি, হচ্ছি। লরোঁ অস্থির পায়চারি করতে থাকে ঘরে, আর আমি ভয় পেতে থাকি। ভালোয় ভালোয় আপদ বিদেয় হলে বাঁচি। আবার যেন কোনও অঘটন না ঘটায়। তার সমস্ত রাগ গিয়ে আবার দেয়ালে পড়ে। প্রচণ্ড এক ঘুষি মেরে দেয়াল দাবিয়ে দেয়। আমি চোখ বুজে শুয়ে থাকি। একসময় বাথরুম থেকে অদ্ভুত শব্দ এলে গিয়ে দেখি লরোঁ বাথটাবের জলে শুয়ে আছে, হাতে তার ছুরি। সে হাতের শিরা কাটছে। আমি তড়িঘড়ি হাতে ব্যাণ্ডেজ করে লরোঁকে টেনে তুলে আনি জল থেকে। বিদেয় শেষ পর্যন্ত তাকে হতেই হবে। তাকে তুলুজ ফিরতে হবে। লরোঁ বেরিয়ে যাওয়ার পর দরজা বন্ধ করি। কী যে আমার স্বস্তি হয় মা, তোমাকে বোঝাতে পারবো না। মনে হয় দীর্ঘ সময় আমি এক বদ্ধ পাগলের সঙ্গে এক খাঁচায় বন্দি হয়ে ছিলাম। সবেমুক্তি পেলাম। মুক্তির আনন্দ অসীম। এরপর লরোঁ অনেক ফোন, ইমেইল, ইত্যাদিতে অনেক চেষ্টা করেছে যোগাযোগ করতে, আমি সাড়া দিইনি। যখন বুঝেছে কোনও আর উপায় নেই আমাকে পাওয়ার, তখনই সে চিঠি লিখতে শুরু করে। দেশে বিদেশে আমার যত বন্ধু আছে, যাদের সঙ্গে তার দেখা হয়েছে, অথবা হয়নি, ক্রিশ্চান বেস থেকে শুরু করে কলকাতার ছোটখাটো সাংবাদিক সবাইকেই। তার মূল উদ্দেশ্য, আমাকে ধ্বংস করা। ধ্বংস করতে গেলে আমার যারা চেনাপরিচিত বন্ধু, যারা আমাকে ভালোবাসে, শ্রদ্ধা করে, স্নেহ করে, তাদের মনে আমার সম্পর্কে বিরূপ ধারণা দিতে হবে, আমার সম্পর্কে মন্দ কথা বলতে হবে, যেন বন্ধুরা আমাকে ত্যাগ করে। লরোঁর স্বপ্ন সার্থক হয়নি। কেউ আমাকে ত্যাগ করেনি। চিঠির খবরটা আমার বন্ধুরাই আমাকে দিয়েছে। আমি জানি, মিরিয়ামের চেয়েও লরো অনেক বেশি ভয়ংকর। প্রতিশোধপ্রবণতা, কুৎসিত ঈর্ষা, হিংসে, মানুষকে আর মানুষ রাখে না।

প্রেম ও যৌনতা আমাকে প্রভূত আনন্দ দিতে পারে, কিন্তু নিজের স্বাধীনতায় কেউ নাক গলাতে এলে যত বড় প্রেমিক হোক, যত নিখুঁত যৌনসঙ্গী হোক, আমার কোনও দ্বিধা হয় না তাকে গেট আউট বলতে। এই সম্পর্কটি শেষ হবার পর আবার তুমি, জীবন জুড়ে তোমার না থাকা। যৌনতা তোমাকে ভুলিয়ে রাখে। যৌনতার ছুটি হয়ে গেলে তোমার মৃত্যু আমাকে হতাশার অতলে টেনে নিয়ে যায়। যেখানে শুধু নেই, নেই আর নেই। আমি কাতরাতে থাকি তোমার শোকে। এদিকে আরশোলায় বাড়ি ভরে ওঠে। অবাধে আমার গায়ে রাতে হাঁটাহাঁটি করে। আমার শরীরও তাদের উৎসবের চমৎকার ঘরবাড়ি হয়ে ওঠে। পরিবারের সবার প্রতি আমার অভিমানে নিজেকে সবার কাছ থেকে সরিয়ে এনে অদ্ভুত এক আঁধারে ডুবে যেতে থাকি। কারও সাধ্য নেই আমাকে সেই আঁধার থেকে তোলে। অদৃশ্য মাটি এসে জীবন্ত আমাকে কবর দিয়ে যায়।

.

মৃত্যুময় নিস্তব্ধতার মধ্যে ভাসতে থাকি। খা খা করে বুকের ভেতর, বড় খালি খালি লাগে। কবিতা লিখতে থাকি। অদ্ভুত এক ঘোরের মধ্যে কবিতাগুলো লিখি! বাড়ি এলোমেলো পড়ে থাকে। ওর মধ্যেই আমি শুয়ে থাকি। ওর মধ্যেই আমার সারাদিন, ওর মধ্যেই সারারাত। কারও কোনও ফোন ধরি না। কারও সঙ্গে কথা বলি না। জগৎ একদিকে, আর তোমার না থাকা নিয়ে আমি অন্যদিকে। রান্না করি না। বাইরে থেকে তৈরি খাবার কিনে কমপিউটারে লিখতে লিখতেই খাই, এঁটো বাসনপত্র টেবিলে বিছানায়, মেঝেয়, রান্নাঘরে এলোমেলো পড়ে থাকে। কাগজের ঠোঙায় ঘর ভরে যায়। আরশোলারা অবাধে আনন্দ করে। তুমি কিভাবতেপারো তোমাকে নিয়ে কবিতা লিখেছি আমি। যেখানেই থাকো, কবিতাগুলো পড়োমা। তোমার নিশ্চয়ই বিশ্বাস হচ্ছে না মা। কবে যেন হঠাৎ রাস্তায় হাঁটতে গিয়ে দেখি এক মহিলা সামনে হাঁটছেন, ঠিক তুমি যেমন করে হাঁটতে, মুখের ডানদিকটা সামান্য এক ঝলক যেটুকু দেখা গেছে, মনে হল, ঠিক তোমার মুখের ডানদিকটার মতো। আমি জানি না কী কারণে দ্রুত হাঁটতে শুরু করলাম, যেন মহিলার কাছাকাছি পৌঁছোতে পারি। দ্রুত, প্রায় দৌড়ে, মহিলার সামনে গিয়ে মুখটা দেখতে চাইছিলাম। একসময় গতি শ্লথ হয়ে এলো আমার। হঠাৎ লক্ষ করি, চোখ উপচে জল বেরোচ্ছে আমার। হাতের তেলোয় সেই জল মুছে মুছে হেঁটেছি, তারপর যতটাই হেঁটেছি।

তোমাকে মনে করে আগে লিখিনি কোনওদিন কিছু। তোমাকে ভালোই তো বাসিনি কোনওদিন। তুমি না চলে গেলে তুমি কী ছিলে, কী যন্ত্রণা তুমি জীবনভর পেয়ে গেছে, তা আমি হয়তো টের পেতাম না। ওভাবেই তোমাকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে যেতাম। যেভাবে করছিলাম। তুমি কে ছিলে, মানুষ হিসেবে কত বড় ছিলে, হঠাৎ যেন টের পেলাম, হৃদয়ে, মস্তিষ্কে, টের পেলাম হাড়ে মজ্জায়। বোধাদয় হলো আমার। চোখের সামনে থেকে সরে গেছে ভারি একটা কালো পর্দা। এসব কবিতা নিয়ে জলপদ্য নামের যে বইটা বেরিয়েছিল, ওর ভূমিকায় লিখেছি, মা বলেছিলো বছরের প্রথম দিনে কাঁদিস না, কাঁদলে সারা বছর কাঁদতে হবে। মা নেই, সারা বছর আমি কাঁদলেই কার কী? মা, তোমার কেমন লাগছে জেনে যে তোমার জন্য দিনের পর দিন কেঁদেছি আমি! বিশ্বাস হচ্ছে না? মা, সত্যি অনেক কেঁদেছি। জীবন কেমন বীভৎস রকম শূন্য হয়ে গেলো হঠাৎ। তুমি ছিলে, মনে হতো চিরকালই তুমি থাকবে। তুমি তো কবিতা ভালোবাসতে খুব। এগুলোকে ঠিক কবিতা বলবো না। তোমার না থাকার দীর্ঘশ্বাস এসব, না থাকার হাহাকার।
 
০৮.


তোমার না থাকা

তুমি কি কোথাও আছ
মেঘ বা রঙধনুর আড়ালে!
হুহু বাতাসের পিঠে ভর করে মাঝে মধ্যে আসো, আমাকে ছুঁয়ে যাও!
তুমি কি দেখছ চা জুড়িয়ে জল হচ্ছে আমার
আর আমি তাকিয়ে আছি সামনে যে বাড়ি ঘর, মানুষ, যন্ত্রযান
দুপুরের আগুনে রাস্তা, ঝরে পড়া শুকনোপাতা, মরা ডাল
বুড়ো কুকুরের লালা ঝরা লাল জিভের দিকে
আর তোমার না থাকার দিকে!

তুমি কি খুব গোপনে দেখছ তাকিয়ে থাকতে থাকতে
চোখ কেমন জ্বালা করছে আমার–
তুমি কি কোনও বৃক্ষ হয়ে দাঁড়িয়ে আছ কোথাও,
কোনও পাখি বা প্রজাপতি!
কোনও নুড়ি কোনও অচিন দেশে!

মানুষগুলো খাচ্ছে পান করছে হাঁটছে হাসছে
দৌড়োচ্ছে, জিরোচ্ছে, ভালবাসছে
তোমার না থাকা মাঝখানে বসে আছে, একা।

.

একটি মৃত্যু, কয়েকটি জীবন

একটি মৃত্যুকে ঘিরে দাঁড়িয়ে ছিল কয়েকটি জীবন।

কয়েক মুহূর্ত পর জীবনগুলো চলে গেল
যার যার জীবনের দিকে।

মৃত্যুপড়ে রইল একা, অন্ধকারে
কেঁচো আর কাদায়–

জীবন ওদিকে হিসেব পত্তরে,
বাড়িঘরে,
সংসারে, সঙ্গমে।

.

আমার মায়ের গল্প

১.
চোখ হলুদ হচ্ছিল মা’র,
শেষে এমন, যেন আস্ত দুটো ডিমের কুসুম!
পেট এমন তেড়ে ফুলছিল, যেন জেঁকে বসা বিশাল পাথর
নাকি এক পুকুর জল–বুঝি ফেটে বেরোবে!
মা দাঁড়াতে পারছে না,
না বসতে,
না নাড়তে হাতের আঙুল,
না কিছু।
মা’কে মা বলে চেনা যাচ্ছিল না, শেষে এমন।
আত্মীয়রা সকাল সন্ধে শুনিয়ে যাচ্ছে
ভাল একটি শুক্রবার দেখে যেন তৈরি মা..
যেন লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ বলতে বলতে
যেন মুনকার নকির সওয়াল জবাবের জন্য এলে বিমুখ না হয়
যেন পাক পবিত্র থাকে ঘর দুয়োর, হাতের কাছে থাকে সুরমা আর আতর।

হামুখো অসুখ মা’র শরীরে লাফিয়ে বেড়াচ্ছে সেদিন,
গিলে ফেলছে দুফোঁটা যে শক্তি ছিল শেষের, সেটুকুও।
কোটর থেকে ছিটকে বেরোচ্ছে চোখ,
চড়চড় করছে জিভ শুকিয়ে,
ফুসফুসে বাতাস কমে আসছে মা’র,
শ্বাস নেবার জন্য কী অসম্ভব কাতরাচ্ছে–
যন্ত্রণায় কুঁচকে আছে কপাল, কালো ভুরু
গোটা বাড়ি তখন চেঁচিয়ে মাকে বলছে তাদের সালাম পৌঁছে দিতে নবীজিকে,
কারও কোনও সংশয় নেই যে মা জান্নাতুল ফিরদাউসে যাচ্ছে,
নবীজির হাত ধরে বিকেলে বাগানে হাঁটবে,
পাখির মাংস আর আঙুরের রস খাবে দুজন বসে,
অমনই তো স্বপ্ন ছিল, মা’র অমনই স্বপ্ন ছিল।
আশ্চর্য, মা তবু কোথাও এক পা যেতে চাইছিলো না।
চাইছিলো বিরুই চালের ভাত বেঁধে খাওয়াতে আমাকে,
টাকি মাছের ভর্তা আর ইলিশ ভাজা। নতুন ওঠা জাম-আলুর ঝোল।
একখানা কচি ডাব পেড়ে দিতে চাইছিলো দক্ষিণের গাছ থেকে,
চাইছিলো হাতপাখায় বাতাস করতে চুল সরিয়ে দিতে দিতে–
কপালের কটি এলো চুল।
নতুন চাঁদর বিছিয়ে দিতে চাইছিলো বিছানায়,
আর জামা বানিয়ে দিতে, ফুল তোলা..

চাইছিলো উঠোনে খালি পায়ে হাঁটতে,
হেলে পড়া কামরাঙা গাছটির গায়ে বাঁশের কঞ্চির ঠেস দিতে
চাইছিলো হাসনুহেনার বাগানে বসে গান গাইতে ওগো মায়াভরা চাঁদ আর
মায়াবিনী রাত, আসেনি তো বুঝি আর জীবনে আমার। ….

বিষম বাঁচতে চেয়েছিলো মা।

.

২.

আমি জানি পরকাল, পুলসেরাত বলে কিছু নেই।
আমি জানি ওসব ধর্মবাদীদের টোপ
ওসব বেহেসত, পাখির মাংস, মদ আর গোলাপি মেয়েমানুষ!

আমি জানি জান্নাতুল ফিরদাউস নামের কোনও বেহেসতে
যাবে না, কারও সঙ্গে বাগানে হাঁটবেনা মা!
কবর খুঁড়ে মা’র মাংস খেয়ে যাবেপাড়ার শেয়াল
শাদা হাড়গুলো বিচ্ছিরিরকম ছড়িয়ে–
গোরখাদক একদিন তাও তুলে ফেলে দেবে কোথাও,
জন্মের মত মা নিশ্চিহ্ন হবে।

তবু আমার বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হচ্ছে
সাত আসমানের ওপরে অথবা কোথাও
বেহেসত বলে কিছু আছে,
জান্নাতুল ফিরদাউস বলে কিছু,
চমৎকার কিছু,
চোখ ঝলসানো কিছু।
মা তরতর করে পুলসেরাতপার হয়ে গেছে
পলক ফেলা যায় না দেখলে এমন সুদর্শন, নবীজি,
বেহেসতের সদর দরজায় দাঁড়িয়ে মা’কে আলিঙ্গন করছেন;
মাখনের মত মা মিশে যাচ্ছে নবীজির লোমশ বুকে।
ঝরণার পানিতে মা’র স্নান করতে ইচ্ছে হচ্ছে
মা’র দৌড়োতে ইচ্ছে হচ্ছে
বেহেসতের এ মাথা থেকে ও মাথা–
মা স্নান করছে,
দৌড়োচ্ছে, লাফাচ্ছে।
রেকাবি ভরে পাখির মাংস এসে গেছে, মা খাচ্ছে।
মা’কে দেখতে স্বয়ং আল্লাহতায়ালা পায়ে হেঁটে
বাগান অবদি এসেছেন।
মা’র খোঁপায় গুঁজে দিচ্ছেন লাল একটি ফুল,
মা’কে চুমু খাচ্ছেন।
আদরে আহ্লাদে মা নাচছে, গাইছে।

মা ঘুমোত গেছে পালকের বিছানায়,
সাতশ হুর মা’কে বাতাস করছে,
রুপোর গেলাশ ভরে মা’র জন্য পানি আনছে গেলবান।
মা হাসছে, মা’র সারা শরীর হাসছে
আনন্দে।
পৃথিবীতে এক দুঃসহ জীবন ছিল মা’র, মা’র মনে নেই।

এত যে ঘোর নাস্তিক আমি,
আমার বিশ্বাস করতে ভাল লাগছে বেহেসত বলে কিছু আছে কোথাও।

.

দুঃখবতী মা

মা’র দুঃখগুলোর ওপর গোলাপ-জল ছিটিয়ে দেওয়ার ইচ্ছে ছিল,
যেন দুঃখগুলো সুগন্ধ পেতে পেতে ঘুমিয়ে পড়ে কোথাও
ঘুমটি ঘরের বারান্দায়, কুয়োর পাড়ে কিম্বা কড়ই তলায়।
সন্ধেবেলায় আলতো করে তুলে বাড়ির ছাদে রেখে এলে
দুঃখগুলো দুঃখ ভুলে চাঁদের সঙ্গে খেলত হয়ত বুড়িছোঁয়া খেলা।

দুঃখরা মা’কে ছেড়ে কলতলা অবদি যায়নি কোনওদিন।
যেন এরা পরম আত্মীয়, খানিকটা আড়াল হলে বিষম একা পড়ে যাবেন মা;
কাদায় পিছলে পড়বেন, বাঘে ভালুকে খাবে, দুষ্ট জ্বিনেরা গাছের মগডালে
বসিয়ে রাখবে মা’কে–
দুঃখগুলো মা’র সঙ্গে নিভৃতে কী সব কথা বলত…
কে জানে কী সব কথা

মা’কে দুঃখের হাতে সঁপে বাড়ির মানুষগুলো অসম্ভব স্বস্তি পেত।
দুঃখগুলোকে পিড়ি দিত বসতে,
লেবুর শরবত দিত, বাটায় পান দিত,
দুঃখগুলোর আঙুলের ডগায় চুন লেগে থাকত..
ওভাবেই পাতা বিছানায় দুঃখগুলো দুপুরের দিকে গড়িয়ে নিয়ে
বিকেলেই আবার আড়মোড়া ভেঙে অযুর পানি চাইত,
জায়নামাজও বিছিয়ে দেওয়া হত ঘরের মাঝখানে।
দুঃখগুলো মার কাছ থেকে একসুতো সরেনি কোনওদিন।

ইচ্ছে ছিল লোহার সিন্দুকে উই আর
তেলাপোকার সঙ্গে, তেলাপোকা আর
নেপথলিনের সঙ্গে ওদেরপুরে রাখি।
ইচ্ছে ছিল বেড়াতে নিয়ে গিয়ে ব্রহ্মপুত্রের জলে, কেউ জানবে না,
ভাসিয়ে দেব একদিন
কচুরিপানার মতো, খড়কুটোর মতো, মরা সাপের মতো ভাসতে ভাসতে দুঃখরা
চলে যাবে কুচবিহারের দিকে…
ইচ্ছে ছিল

দুঃখগুলো মা’র সঙ্গে শেষ অবদি কবর অবদি গেছে,
তুলে নিয়ে কোথাও পুতে রাখব অথবা ছেঁড়া পুঁতির মালার মত ছুড়ব রেললাইনে,
বাঁশঝাড়ে, পচা পুকুরে। হল কই!
মা ঘুমিয়ে আছেন, মা’র শিথানের কাছে মার দুঃখগুলো আছে,
নিশুত রাতেও জেগে আছে একা একা।

.

দেশ বলতে এখন দেশ

এখন আমার কাছে আস্ত একটি শ্মশান,
শ্মশানে দাঁড়িয়ে প্রতিরাতে একটি কুকুর কাঁদে,
আর এক কোণে নেশাগ্রস্ত পড়ে থাকে চিতা জ্বালানোর কজন তোক।
দেশ এখন আমার কাছে আর শস্যের সবুজ ক্ষেত নয়,
স্রোতস্বিনী নদী নয়, রোদে ঝিলমিল দীঘি নয়,
ঘাস নয়, ঘাসফুল নয় …

দেশ ছিল ‘র ধনেখালি শাড়ির আঁচল
যে আঁচলে ঘাম মুছে, চোখের জল মুছে দাঁড়িয়ে থাকতেন মা, দরজায়।
দেশ ছিল ‘র গভীর কালো চোখ,
যে চোখ ডানা মেলে উড়ে যেত রোদ্দুরে, রাত্তিরে
যেখানেই ভাসি, ডুবি, পাড় পাই–খুঁজত আমাকে।
দেশ ছিল ‘র এলো চুলের হাতখোঁপা,
ভেঙে পড়ত, হেলে পড়ত, রাজ্যির শরম ঢাকত আমার।

দেশ ছিল ‘র হাতে সর্ষের তেলে মাখা মুড়ি
মেঘলা দিনে ভাজা ইলিশ, ভুনো খিচুড়ি
দেশ ছিল মা’র হাতের ছ’জোড়া রঙিন চুড়ি।
দেশ ছিল বাড়ির আঙিনায় দাঁড়িয়ে মা মা বলে ডাকার আনন্দ।
কনকনে শীতে মা’র কাঁথার তলে গুটিসুটি শুয়ে পড়া,
ভোরবেলায় শিউলি ছাওয়া মাঠে বসে ঝাল-পিঠে খাওয়া..

অন্ধকারে মুড়ে,
দূরে,
নৈঃশব্দ্যের তলে মাটি খুঁড়ে
দেশটিকে পুরে,
পালিয়েছে কারা যেন,
দেশ বলে কেউ নেই এখন, কিছু নেই আমার।
খাঁ খাঁ একটি শ্মশান সামনে, একটি কুকুর, আর কজন নেশাগ্রস্ত লোক।

.

তুমি নেই বলে

তুমি নেই বলে ক’টি বিষাক্ত সাপ উঠে এসেছে উঠোনে, ফিরে যাচ্ছে না
জলায় বা জংলায়।

কাপড়ের ভাঁজে, টাকা পয়সার ড্রয়ারে, বালিশের নিচে, গ্লাসে-বাটিতে, ফুলদানিতে,
চৌবাচ্চায়, জলকলের মুখে
ইঁদুর আর তেলাপোকার বিশাল সংসার এখন,
তোমার সবকটি কবিতার বইএ এখন উই।
তুমি নেই বলে মাধবীলতাও আর ফোটে না
দেয়াল ঘেঁসে যে রজনীগন্ধার গাছ ছিল, কামিনীর,
ওরা মরে গেছে, হাসনুহানাও।
গোলাপ বাগানে গোলাপের বদলে শুধু কাঁটা আর পোকা খাওয়া পাতা।

বুড়ো জাম গাছের গায়ে বিচ্ছুদের বাসা, পেয়ারা গাছটি হঠাৎ একদিন
ঝড় নেই বাতাস নেই গুঁড়িসুদ্ধ উপড়ে পড়ল।
মিষ্টি আমের গাছে একটি আমও আর ধরে না, নারকেল গাছে
না একখানা নারকেল।
সুপুরি গাছেদের নাচের ইশকুল বন্ধ এখন।

তুমি নেই বলে সবজির বাগান পঙ্গপাল এসে খেয়ে গেছে
সবুজ মাঠটি ভরে গেছে খড়ে, আগাছায়।
তুমি নেই বলে মানুষগুলো এখন ঠাণ্ডা মাথায় খুন করতে পারে যে কাউকে।

তুমি নেই
তোমার না থাকা জুড়ে দাপট এখন অদ্ভুত অসুস্থতার,
আমার শ্বাসরোধ করে আনে দূষিত বাতাস..
আমিও তোমার মতো যে কোনও সময় নেই হয়ে যেতে চাই।

(তোমার না থাকার দৈত্য ঝাঁপিয়ে পড়ছে ঘাড়ে,
তোমার না থাকার শকুন ছিঁড়ে খাচ্ছে আমার সর্বাঙ্গ,
তোমার না থাকার উন্মত্ত আগুন পুড়িয়ে ছাই করছে
তোমার না থাকার সর্বগ্রাসী জল আমাকে ডুবিয়ে নিচ্ছে…)

.

ফেরা

মা একদিন ফিরে আসবেন বলে
মা’র ঘটিবাটি, দু’জোড়া চটি
বিছানার চাঁদর, লেপ কাঁথা,
ডালের ঘুটনি, হাতা
ক’টি কাপড়, ক’টি চুড়ি দুল
চিরুনিখানি, ওতে আটকা চুল
ফুল ফলের ছবি, মা’র আঁকা
যেখানে যা কিছু ছিল, তেমন করেই রাখা।

মা ফিরে আসবেন
ফিরে কলতলায় পায়ের কাদা ধুতে ধুতে বলবেন
খুব দূরে এক অরণ্যে গিয়েছিলাম!
তোরা সব ভাল ছিলি তো!
খাসনি বুঝি! আহা, মুখটা কেন শুকনো লাগছে এত!
বাঘ ভালুকের গল্প শোনাতে শোনাতে মা আমাদের খাওয়াবেন রাতে
অনেকদিন পর মাও খাবেন মাছের ঝোল মেখে ভাতে,
খেয়ে, নেপথলিনের গন্ধঅলা লালপাড় শাড়ি পরে একটি তবক দেওয়া পান
হেসে, আগের মত গাইবেন সেই চাঁদের দেশের গান।

একদিন ফিরে আসবেন মা
ফিরে আসবেন বলে আমি ঘর ছেড়ে দু’পা কোথাও বেরোই না
জানালায় এসে বসে দু একটি পাখি,
ওরাও জানে মা ফিরবেন, বিকেলের দুঃখী হাওয়াও, ..
আকাশের সবকটা নক্ষত্র জানে, আমি জানি।

.

একটি অকবিতা

।আমার মা যখন মারা যাচ্ছিলেন, সকালবেলা স্নান করে জামা জুতো পরে ঘরবার হলেন বাবা, চিরকেলে অভ্যেস। বড়দা সকালের নাস্তায় ছ’টি ঘিয়ে ভাজাপরোল নিলেন, সঙ্গে কষানো খাসির মাংস, এ না হলে নাকি জিভে রোচে না তাঁর। ছোড়দা এক মেয়েকে বুকে মুখে হাত বুলিয়ে সাধাসাধি করছিলেন বিছানায় নিতে। সারা গায়ে হলুদ মেখে বসেছিলেন বড়বৌদি, ফর্সা হবেন; গুনগুন করে হিন্দি ছবির গান গাইছিলেন, চাকরবাকরদের বলে দিয়েছেন ইলিশ ভাজতে, সঙ্গে ভুনা খিচুড়ি। ভাইয়ের ছেলেগুলো মাঠে ক্রিকেট খেলছিল, ছক্ক মেরেপাড়া ফাটিয়ে হাসছিল। মন ঢেলে সংসার করা বোন আমার স্বামী আর কন্যা নিয়ে বেড়াতে বেরোল শিশুপার্কে। মামারা ইতিউতি তাকিয়ে মা’র বালিশের তলায় হাত দিচ্ছিল সোনার চুড়ি বাপাঁচশ টাকার নোট পেতে। খালি ঘরে টেলিভিশন চলছিল, যেতে আসতে যে কেউ খানিক থেমে দেখে নেয় তিব্বত টুথপেস্ট নয়তপাকিজা শাড়ির বিজ্ঞাপন। আমি ছাদে বসে সিগারেট ফুঁকতে ফুঁকতে নারীবাদ নিয়ে চমৎকার একটি কবিতা লেখার শক্ত শক্ত শব্দ খুঁজছিলাম।

মা মারা গেলেন।

বাবা ঘরে ফিরে জামাকাপড় ছাড়লেন। বড়দা খেয়ে দেয়ে ঢেঁকুর তুললেন। ছোড়দা রতিকর্ম শেষ করে বিছানা ছেড়ে নামলেন। বড়বৌদি স্নান সেরে মাথায় তোয়ালে পেঁচিয়ে ইলিশ ভাজা দিয়ে গোগ্রাসে কিছুখিচুড়ি গিলে মুখ মুছলেন। ভাইয়ের ছেলেগুলো ব্যাট বল হাতে নিয়ে মাঠ ছাড়ল। স্বামী কন্যা নিয়ে বোনটি শিশুপার্ক থেকে ফিরল। মামারা হাত গুটিয়ে রাখলেন। আমি ছাদ থেকে নেমে এলাম। ছোটরা মেঝেয় আসন পেতে বসে গেল, টেলিভিশনে নাটক শুরু হয়েছে। বড়দের এক চোখ মায়ের দিকে, আরেক চোখ টেলিভিশনে। মায়ের দিকে তাকানো চোখটি শুকনো, নাটকের বিয়োগান্তক দৃশ্য দেখে অন্য চোখে জল।

.

যদি

কাউকে বাঁচতে দেখলে অসম্ভব রাগ হয় আমার।
পৃথিবীর সব গাছ যদি মরে কাঠ হয়ে যেত
পাহাড়গুলো ধসেপড়ত বাড়িঘরের ওপর,
নদী সমুদ্র শুকিয়ে চর হয়ে যেত, সেই চরে
পশুপাখি মানুষ এক বিষম অসুখে কাতরে কাতরে মরে যেত!
কদাকার পিন্ডটি যদি মহাকাশে ছিঁড়ে পড়ত হঠাৎ,
সুর্যের দুহাত কাছে গিয়ে ঝলসে যেত, ছাই হয়ে যেত!

এরকম স্বপ্ন নিয়ে আজকাল আমি বেঁচে থাকি
আর এই বেঁচে থাকার জন্য প্রতিদিন বিবমিষা, প্রতিদিন ঘৃণা..

.

মা কষ্ট পেলে আমাদের কিছু যেত আসত না

আমার একটি মা ছিল
চমৎকার দেখতে একটি মা,
একটি মা আমার ছিল

মা আমাদের খাওয়াত শোয়াত ঘুম পাড়াত,
গায়ে কোনও ধুলো লাগতে দিত, পিঁপড়ে উঠতে না,
মনে কোনও আঁচড় পড়তে দিত না
মাথায় কোনও চোট পেতে না।
অথচ
মাকে লোকেরা কালো পেঁচি বলত,
আমরাও।
বোকা বুদ্ধ বলে গাল দিতাম মা’কে।
মা কষ্ট পেত।
মা কষ্ট পেলে আমাদের কিছু যেত আসত না।

আমাদের কিছুতে কিছু যেত আসত না,
মা জ্বরে ভুগলেও না,
মা জলে পড়লেও না,
মা না খেয়ে শুকিয়ে কাঁটা হয়ে গেলেও না
পরনের শাড়ি ছিঁড়ে ত্যানা হয়ে গেলেও না,
মা’কে মা বলে মনে হত, মানুষ বলে না।
মা মানে সংসারের ঘানি টানে যে
মা মানে সবচেয়ে ভাল রাঁধে যে, বাড়ে যে,
কাপড় চোপড় ধুয়ে রাখে গুছিয়ে রাখে যে
মা মানে হাড় মাংস কালি করে সকাল সন্ধে খাটে যে
যার খেতে নেই, শুতে নেই, ঘুমোতে নেই
যার হাসতে নেই।

যাকে কেবল কাঁদলে মানায়
শোকের নদীতে যার নাক অবদি ডুবে থাকা মানায়
মা মানে যার নিজের কোনও জীবন থাকে না।
মা’দের নিজের কোনও জীবন থাকতে নেই!
মা ব্যথায় চেঁচাতে থাকলে বলি
ও কিছুনা, খামোকা আহ্লাদ!
মরে গেলে মাকে পুঁতে রাখে মাটির তলায়,
ভাবি যে বিষম এক কর্তব্য পালন হল

মা নেই।
আমাদের এতেও কিছু যায় আসে না।

.

সাধ

তোমাকে কখনও বেড়াতে নিইনি

যেখানে চাঁদের নাগাল পেতে পাহাড়ের কাঁখে চড়ে বসে থাকে একটি দুধু নদী, গায়ে-হলুদের দিনে একঝাঁকনক্ষত্রের চোখ ফাঁকি দিয়ে চুপ চুপ, টুপ করে জলে পড়ে নদীর সারা গায়ে চুমু খায় চাঁদ!

তোমাকে কি নিয়েছি

যেখানে সমুদ্র মন খারাপ করে বসে থাকে, আর তার জলতুতোপাখিগুলো অরণ্যের বিছানায় শুয়ে রাতভর কাঁদে। সমুদ্রের মন ভাল হলে নেমন্তন্ন করেপাখিদের, অঢেল খাবার আরপানীয়ের ছড়াছড়ি–পাখিরা বিষম খুশি, কিছু ফেলে, কিছু খায়। নাচে, গায়!

তোমাকে বড় নিতে ইচ্ছে করে

যেখানে বরফের চাঁইএর হাঁটুতে মাথা রেখে সুবোধ বালকেরমত ঘুমিয়ে আছে আগ্নেয়গিরি, আর দিগন্তের মাথায় ঠোকর খেয়ে কেঁদে কেটে চোখ লাল করে অভিমানে দৌড়ে বাড়ি ফেরে হাওয়ার কিশোরী, দেখে বরফের চোখেও জল জমে মায়ায়।

তোমাকে কত কোথাও নিতে ইচ্ছে।

যেখানে সাতরঙ জামা পরে প্রজাপতি চুমু খেতে যায় ঘাসফুলের ঠোঁটে, পাড়ার ন্যাংটো হরিণ তার জামা কেড়ে নিতে দৌড়ে আসে, দেখে প্রজাপতি লুকোয় রাধাচূড়া মাসির শাড়ির আঁচলে, ঘাসফুল ভেজা ঠোঁটে অপেক্ষা করে আরেকটি চুমুর।

তুমি নেই বলেই কি ইচ্ছেরা জড়ো হচ্ছে এমন ..

.

প্রায়শ্চিত্ত

একটি অসুখ চাইছি আমি, ঠিক সেই অসুখটি–
সেই বৃহদন্ত্রের অসুখ, হামাগুড়ি দিয়ে যকৃতে পৌঁছবে,
যকৃত থেকে হেঁটে হেঁটে হাড়ে, হাড় থেকে দৌড়ে ধরবে ফুসফুস
ফুসফুস পেরিয়ে রক্তনদী সাঁতরে মস্তিষ্ক।
ভুল কাটাছেঁড়া, ভুল ওষুধ, ভুল রক্তের চালান
অসুখের পেশিতে শক্তির যোগান দেবে, কুরুক্ষেত্রে বাড়তি সৈন্য, রণতরী।
সেরকম পড়ে থাকব বিষণ্ণ বিছানায় একা, যেরকম ছিলে তুমি
যেরকম আস্ত কঙ্কাল, যন্ত্রণায় কুঁকড়ে যাওয়া হাড়ের কঙ্কাল
মাংস খসে পড়ছে, রক্ত ঝরে যাচ্ছে
ধসে পড়ছে স্নায়ুর ঘরবারান্দা

ঠিক সেরকম হোক আমারও,
আমারও যেন চোখের তারা জন্মের মত অচল হয়
যেন তীব্র শ্বাসকষ্ট হয়, ফুসফুস
ফুলে ঢোল হয়ে থাকে জলে, নিশ্বাসের হাওয়া পেতে যেন কাতরাই,
যেন হাত পা ছুঁড়ি,
যেন না পাই।
যেন কারও স্পর্শ পেতে আকুল হই,
যেন কাতরাই, হাত বাড়াই,
যেন না পাই।
 
০৯.


প্যারিস থেকে আবার কলকাতা চলে যাই। বইমেলায় যাবো। বাঁচতে যাই কলকাতায়। তোমাকে সম্ভবত আবার ভুলে থাকতে যাই। কিন্তু সত্যি কি ভোলা হয়! তুমি কখনও কলকাতায় আসোনি মা। তোমাকে দেশের কোথাও নিয়ে যাইনি, কলকাতায় নিয়ে আসার কথা কল্পনার মধ্যেও কখনও ছিলো না। দেশে যখন ছিলাম, বন্ধুদের নিয়ে কলকাতা বেড়াতে আসতাম। তুমি যখন ছোট ছিলে, তোমার বাবা কলকাতা থেকে তোমার জন্য লাল একটা জামা কিনে নিয়ে গিয়েছিল। কলকাতার কথা শুনেছো শুধু, কোনওদিন দেখনি কলকাতা কেমন দেখতে। আমি যখন দেশে ফিরে কলকাতার গল্প করতাম, তুমি নিঃশব্দে শুনতে। কোনওদিন বলোনি আমাকে খুব দেখতে ইচ্ছে করে কলকাতা। বলার সাহস হয়তো পেতে না। তোমার স্বপ্নগুলো ঠিক কেমন ছিল মা? কখনও উড়তো কি? নাকি চিরকালই খাঁচায় বন্দি ছিল? তুমি যেমন ছিলে? এবার বাবাকে কলকাতায় আসতে বলি। আমি বললেই তো ঘটনা ঘটে যায় না। বাবাকে রাজি করানো মানে হিমালয় পর্বতকে নড়ানো। ময়মনসিংহ থেকে তাকে ঢাকায় আনা, ভিসা করা, টিকিট করা, বিমানে ওঠানো ছোটদাই করে এই কাজগুলো। বাবা আর সুহৃদ আসে কলকাতায় আমার সঙ্গে দেখা করতে। তবে বইমেলা শেষ হয়ে যাওয়ার পর, একেবারে ফেব্রুয়ারির শেষ দিকে মাত্র কয়েক দিনের জন্য আসে। তখন কলকাতায় একুশে ফেব্রুয়ারি পালন করা হচ্ছে। বাবাকে নিয়ে শহীদ মিনারে ফুল দিই। ঢাকার শহীদ মিনারে একুশে ফ্রেব্রুয়ারির ভোরে খালি পায়ে হেঁটে ফুল দিতাম, হাজার হাজার মানুষের ভিড়ে। সেই শহীদ মিনারের তুলনায় কলকাতার মিনার কিছু নয়। লোকও নেই বেশি। তারপরও তো শহীদ মিনার। পশ্চিমবঙ্গের বাঙালিরা স্মরণ করছে বাংলা ভাষার জন্য পূর্ববঙ্গের বাঙালির আত্মত্যাগ এ বড় ভালো লাগা দেয়। বাংলার পূর্ব আর পশ্চিমকে আমি আলাদা করে দেখি না। দেখিনা বলেই আমি কলকাতায় এলে মনে করি দেশে ফিরেছি। যে দেশে এলে নিজের দেশের মানুষের সঙ্গে দেখা হতে পারে, সে দেশ দেশ নয়তো কী!

তাজ বেঙ্গল হোটেলেই আমার সঙ্গে কদিন থাকে বাবা আর সুহৃদ। সুহৃদ সেই যে তোমার অসুখের সময় দেশে গিয়েছিলো, দেশেই থেকে গেছে। ওকে দেশেরইস্কুলে ভর্তি করিয়ে দেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশের পাসপোর্ট নিয়ে সে চাইলেও আর ফিরতে পারছে না আমেরিকায়। আমেরিকায় ফেরারই কী দরকার, আমি বুঝি না। আমার শান্তিনগরের বাড়িতে থাকে। ওকে নিয়মিত টাকা পাঠাই বিদেশ থেকে। বই, কমপিউটার, কাপড়চোপড়, বইপত্র, খাওয়া দাওয়া যা দরকার সবকিছুর জন্য। তার নাকি দেশের পড়াশোনা ভালো লাগে না। আসলে সত্যি বলতে কী, আমেরিকার ইস্কুলের তুলনায় দেশের ইস্কুলেরপড়াশোনার চাপ বেশি, তাই ভালো না লাগায় ধরেছে। ছোটদা ছেলেকে খুব মানুষ করতে পারছে আমার মনে হয় না। সুহৃদ, লক্ষ করলাম, বন্ধুদের জন্য আনা যে হুইস্কি আনিয়েছিলাম, তার থেকে খানিকটা খেয়ে নিয়েছে। খেয়ে ধরা পড়ারপরও মিথ্যে বলছে যে খায়নি। বিশ্বাস হয় না এই ছেলেকে কী ভীষণ আদর দিয়েই না বড় করেছিলে! ছোটদাতার অগুণতি প্রেমিকা নিয়ে ব্যস্ত থাকলে ছেলের দেখাশোনা করবে কখন, বলো! মাস্টার রেখে দিয়েছে, সে মাস্টারের কাছেও নাকি যায় না। আমেরিকার ক্লাস এইটের ছেলের বিদ্যে বাংলাদেশের ইস্কুলে ক্লাস ফাইভের ছেলের মতো। প্রাইভেটে পরীক্ষা দেবে ব্রিটিশ ইস্কুলের নিয়মে, ও লেভেল। কিন্তু পড়াশোনা করার ছেলে কি ও? এই অতি-চাপ থেকে বাঁচতে ওর এক চিন্তা আমেরিকায় ফিরে যাবে কী করে। আমেরিকার গ্রিন কার্ডও তখন ওর হয়নি। বাংলাদেশের পাসপোর্ট নিয়ে এবার আর ফিরে যাওয়া সম্ভব নয়। পড়াশোনা না করলেও টেনিস খেলাটা সে নিয়মিত খেলছে। টেনিসের দল নিয়ে এশিয়ায় কোন কোন দেশে নাকি খেলেও এসেছে। কলকাতায় আসার কয়েক মাস পর কয়েকজন টেনিস খেলোয়ারের সঙ্গে লন্ডন গেছে খেলতে, ওখান থেকেপরিকল্পনা কানাডাতে খেলতে যাবে, কানাডা থেকে আমেরিকায়। তখনও আমেরিকার ভিসাতার জোটেনি। ছোটদা লন্ডনে ফ্রি টিকিটে নিয়ে এলো সুহৃদকে। ওকে দিয়ে আমাকে ফোন করালোপ্যারিসে, চলে যাচ্ছে আমেরিকায়, দেখা কবে হয় কে জানে। আমি যেন এক্ষুণি চলে আসি লন্ডনে।

আমাকে একটিবার দেখতে চায়, যেহেতু কাছেই আছি। আমি খবর পেয়ে উড়ে চলে গেলাম লন্ডনে। ছোটদা আর সুহৃদকে পেয়ে আমার কী যে ভালো লাগলো। কিন্তু খানিক পরই ছোটদা সোজাসুজি বলে দিল, সে লন্ডন পর্যন্ত সুহৃদকে এনেছে। কালই সে ঢাকা ফিরে যাচ্ছে বিমানে, সুহৃদকে কানাডা বা আমেরিকার টিকিটের টাকা দেওয়া, ওখানে থাকা খাওয়ার খরচ দেওয়া তারপক্ষে সম্ভব নয়। তার মানে টাকা আমাকে দিতে হবে। আসলে আমি জানতাম না, আমাকে দেখার জন্য নয়, সুহৃদকে দিয়ে প্যারিস থেকে আমাকে লন্ডন ডেকে পাঠানোর মূল উদ্দেশ্য হল, আমার ঘাড়ে সুহৃদকে ফেলা। যে ছেলেকে তার জন্ম থেকে ভালোবাসছি, সে ছেলেকে তো মাঝপথে রেখে তার বাবা চলে গেলেও আমি চলে যেতে পারি না। তার জন্য আমি তো নিঃস্ব হয়ে গেলেও, জীবন দিয়ে হলেও যা কিছু করার করবো। কিন্তু আমি তো অঢেল টাকা আনিনি। ছোটদার সে নিয়ে ভাবনা নেই। সে জানেনা কী করে সমস্যার সমাধান হবে। চলে গেল ছোটদা। আমার ওপর সুহৃদের সব দায়িত্ব ওর কানাডায় যাওয়া, হোটেলে থাকা, কানাডা থেকে আমেরিকা, যদি আমেরিকায় ঢুকতে না দেয় তবে ঢাকায় ফেরত যাওয়া, তার ওপর আবার যদি কোনও অঘটন ঘটে, সেই অঘটন সামলান। লন্ডনের কোনও এক হোটেলে গিয়ে ক্রেডিট কার্ড থেকে যত ক্যাশ টাকা তোলা যায় তুলোম। কিন্তু ও টাকায় ওর যাত্রা হবেনা। ছোটদা দেখ আমাকে কী দুরবস্থার মধ্যে ফেলে চলে গেল। এখন কোত্থেকে আমি টাকা পাবো, লন্ডনে আমার কোনও ব্যাংক নেই যে আমি টাকা তুলবো। প্রত্যেকটা ক্রেডিট কার্ডের জন্য একটা নির্দিষ্ট টাকার অংক থাকে, যেটুকু তুমি তুলতে পারো। আশংকা আমাকে আঁকড়ে ধরে লন্ডনের ব্যাংক থেকে জার্মানির হামবুর্গেশহরের ব্যাংকের ফোন নম্বর যোগাড় করি, সেখানে ফোন করে ব্যাংকের লোকদের লন্ডনের ওই ব্যাংকে এক্ষুণি দশ হাজার ডয়েচে মার্কপাঠিয়ে দেওয়ার অনুরোধ করি। সাধারণত এ ধরনের অনুরোধ মানে না ব্যাংক, কিন্তু জানি না কেন, মানলো। যে কেউ তো এমন উড়ো ফোন করে টাকা চাইতে পারে। কী করে জার্মানির ব্যাংক জানবে যে ফোনটা আমিই করেছি! কিছুরই তো প্রমাণ নেই। হাতে তো আমার অ্যাকাউন্টের তথ্যাদিও কিছুই ছিল না যে ওদের জানাবো। কণ্ঠস্বরও চেনা হওয়ার খুব কোনও কারণ ছিল না। সুহৃদকে টিকিট করে দিলাম কানাডা যাওয়ার নানা দেশের টাকা আমার ওয়ালেটে থাকে, ওসব ভাঙিয়েও কানাডার টাকা করে দিলাম। জার্মানির ডয়েচে মার্ককে পাউণ্ড করা, পাউণ্ডকে ডলার করা। এভাবেই আব্দার আহ্লাদ যার ছোটবেলা থেকেইপূরণ করে আসছি, পূরণ করি। সুহৃদকে কানাডার উড়োজাহাজে তুলে দিয়েতবে আমি ফিরলাম প্যারিসে। সুহৃদ শেষ অবদি পৌঁছেছিল নিউইয়র্কে, বাংলাদেশের পাসপোর্ট নিয়েই। যে টাকা দিয়েছিলাম, তার অর্ধেকও তার দরকার পড়েনি। একদিন নাকি নিউইয়র্কের রাস্তায় কালো একদল গুণ্ডা তার বাকি টাকাগুলো কেড়ে নিয়েছে। এভাবেই আমার কষ্টের উপার্জন গেছে। বাবাকে কলকাতায় ডাক্তার দেখালাম। ওষুধপত্র যেভাবে খেতে বলেছে, সেভাবে বারবার অনুরোধ করলাম খেতে। চেয়েছিলাম বাবা আরও কটা দিন থাকুক। কিন্তু যে মানুষ ময়মনসিংহের বাড়ি আর চেম্বার ছেড়ে কোথাও যেতে চায় না, তাকে আর কতদিন রাখা যায়! শুধু তোমার অসুখের সময় বেরিয়েছিল। আমাকে দেখতে বেরোলো বটে, কলকাতায়, কিন্তু যেহেতু আমি আর দুদিন বাদে মরছি না, বাবার যাই যাইটা মাত্রা ছাড়া হয়ে উঠলো। জোর করে, ধমক দিয়ে, বুঝিয়ে, অনুরোধ করেও বাবাকে বেশিদিন রাখতে পারিনি। একটাই বিছানা ছিল বড় তাজের সুইটে। ওতে বাবা, সুহৃদ আর আমি একসঙ্গে ঘুমিয়েছি। অনেক রাত জেগে গল্প করেছি। বাবার বোনের ছেলে মোতালেব এসেছিলো। ওকে দিয়ে খাবারটাবার বাইরে থেকে আনিয়েছি। হোটেলের রেস্তোরাঁয় খেতে চাইনি, অকারণে অত্যধিক দাম, তাই। এখন আবার ভাবি, কেন আমি বাবাকে ভালো রেস্তোরাঁয় প্রতিদিন খাওয়াইনি। কেন বাবাকে যত সময় দিয়েছি তার চেয়েও বেশি দিইনি। নিখিল সরকারের বাড়িতে নিয়ে গিয়েছিলাম বাবাকে। বাবা অনেকটা যেন স্বস্তি পেলেন কেউ আমাকে বাবার মতো স্নেহ করছে দেখে। যে মেয়ে দেশে ফিরতে পারছে না, সেই মেয়েকে যারা ভালোবাসছে, তার ভালো মন্দ যারা দেখছে, তাদের সঙ্গে কথা বলে বাবা বিনয়ে গলে পড়েছে। সুইডেন থেকে দেশে ফিরে যাওয়ার আগের দিন মাইকেলকে জড়িয়ে ধরে ‘টেইক কেয়ার মাই ডটার, প্লিজ মাইলে, টেক কেয়ার মাই ডটার’ বলে জোরে জোরে কাঁদছিলে তুমি। নিখিল সরকারকে জড়িয়ে ধরে না কাঁদলেও বাবার চোখে মুখে তোমার সেই আকুতিই ছিলো। বুদ্ধদেব গুহ আমার হোটেলে এসেছিলেন। তাঁকে দেখে, তাঁর গান শুনে বাবা বিষম মুগ্ধ। দেশ থেকে জাদুকর জুয়েল আইচ এসেছিলেন। তাঁর জাদু দেখেও বাবা ভীষণ খুশি। এমনকী কোনও এক কালে বাবার চণ্ডিপাশা ইস্কুলের ছাত্র ছিলো দাবি করে এক বয়স্ক লোক বাবার সঙ্গে দেখা করার নাম করে মূলত আমাকেই দেখতে আসতো, তাঁর সঙ্গেও বাবা ঘণ্টা দুঘণ্টা বসে কী কথা বলতো কে জানে। বাবা একসময় কী কথায় যেন বাড়িঘর জমিজমা ভাগ করার পরিকল্পনা করছে বললো। আমি বলেছিলাম সব চারভাগেসমান ভাবে ভাগকরতে। পরে অবশ্য বলেছিলাম, আমার কিছুই চাইনা, শুধু অবকাশটা চাই। আমার বড় হয়ে ওঠা, আমার কৈশোর, যৌবন যে বাড়িতে, যে আঙিনায় কেটেছে, দাবি করেছি সেই স্মৃতিটুকুই। বাবা শুধু রহস্যের হাসি হাসলো। বাবার এই হাসি আমার জন্ম থেকে চেনা। বাবার রহস্য চিরকালই আমার কাছে রহস্যই থেকে যেত। যেদিন বাবাকে কলকাতার দমদম বিমান বন্দরে নামিয়ে দিতে গেলাম, বুক ফেটে যাচ্ছিল। শুধু মনে হচ্ছিল, বাবার সঙ্গে এই বোধহয় আমার শেষ দেখা! আমার সেই মনে হওয়াটা ভুল ছিল না মা। বাবার সঙ্গে ওই-ই ছিল আমার শেষ দেখা।

বাবা দেশে ফিরে যাওয়ার কিছুদিন পর আমিও ফিরে যাই প্যারিসে। কেন যে যাই কে জানে। অবশ্য কলকাতায় বাড়ি নেই ঘর নেই, এক হোটেলে হোটেলে আর কদিন থাকবো। আর ভিসাও তো ফুরিয়ে যায় দেখতে দেখতে। কিন্তু সেবার কী হলো শোনেনা, বোম্বে থেকে আমার হোটেলে ফোন করলেন অশোক সাহানি, এক মারাঠি লোক, তিনি আমার শোধ উপন্যাসটা বাংলা থেকে মারাঠি ভাষায় অনুবাদ করেছেন। বইটা ছাপাও হয়েছে বোম্বেতে। অশোক সাহানির আবদার এবার যেন কলকাতা থেকেপ্যারিস ফেরারপথে বোম্বেতে আমি কয়েকঘণ্টার জন্য থামি, বইটার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকি। রাজি না হওয়ার কিছু নেই। কলকাতা থেকে সন্ধেয় বোম্বেতে পৌঁছেপ্যারিসের রাতের বিমান ধরার বদলে সকালে বোম্বে পৌঁছে শোধের অনুষ্ঠান শেষ করে রাতে প্যারিসের দিকে রওনা হবো, এতে ক্ষতি নেই কোনও কিন্তু বিশাল গণ্ডগোল বেধে গেল। অশোক সাহানি আমার বোম্বের অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকার খবর ছাপিয়ে দিয়েছেন ওখানকার পত্রিকায়। আর সঙ্গে সঙ্গে বোম্বের মুসলিম মৌলবাদীদের মিছিল শুরু হয়ে যায়। তারা ঘোষণা করে দেয় বোম্বের মাটিতে পা দেওয়ার কোনও অধিকার আমার নেই। আমি এলে বিমান বন্দরে ওরা আগুন জ্বালিয়ে দেবে। এদিকে এসবখবরে বোম্বের মৌলবাদবিরোধী দলগুলোর প্রতিবাদ শুরু হল। মুহুর্মুহু ফোন আসতে শুরু করলো তিস্তা শীতলবাদি, জাভেদ আনন্দ, এমনকী জাভেদ আখতারেরও। তাঁরা চান আমি যেন আবার ঘুণাক্ষরেও না সিদ্ধান্ত নিই বোম্বে না আসার। আসলে আমি সিদ্ধান্ত না নিলেও পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর উপদেশ ছিল বোম্বে হয়ে না গিয়ে দিল্লি হয়ে যেন প্যারিস যাই। ওতেই রাজি ছিলাম। কিন্তু যতবার ওঁদের বলি, বোম্বে হয়ে যাবো না, ততবারই ওঁরা বলেন, আমি না গেলে মৌলবাদীদের বিজয় ঘোষিত হবে, মৌলবাদীরাপার পেয়ে যাবে এই অবৈধ ফতোয়া দিয়ে। ওঁরা নাহয় আন্দোলন করছেন, কিন্তু মরতে তেহবে একা আমাকে, আমিই যখন টার্গেট। লেখার আরও বই আছে বাকি, জেনে শুনে জীবন হারাতে চাই না এখন। বোম্বের মাটিতেপা দিলে আমাকে মেরে ফেলবে, যারা ঘোষণা করেছে, তারা ছোটখাটো কোনও দল নয়। তারা যে কত ভয়ংকর, তা আমি বাংলাদেশে দেখে এসেছি। মূর্খ উন্মাদের সামনে বুক পেতে দাঁড়াবার কী প্রয়োজন। আর পাশ্চাত্যের নিচ্ছিদ্র নিরাপত্তার অভিজ্ঞতা যার আছে, তার কখনও এ দেশের নড়বড়ে নিরাপত্তার ওপর আস্থা রাখার প্রশ্ন ওঠে না। কিন্তু ওঁরা বলেই চলেছেন, সরকারের সঙ্গে কথা হয়েছে ওঁদের। নিরাপত্তার ব্যবস্থা কঠোর করা হবে। শেষে অন্তত এইটুকু বলে নিস্তার পেতে চাই যে মুখ্যমন্ত্রী চাইছেন না বোম্বেতে আমি যাই। ওঁরাও জোঁকের মতো লেগে থেকে মুখ্যমন্ত্রীকে রাজি করালেন। বোম্বে যেদিন নামলাম, আমি তো অবাক, মহেশ ভাট, আমার প্রিয়পরিচালক দাঁড়িয়ে আছেন আমার অপেক্ষায়, হাতে ফুল। দাঁড়িয়ে আছেন আমার প্রিয় গীতিকার জাভেদ আখতার, দাঁড়িয়ে আছেন শাবানা আজমি, আমার প্রিয় অভিনেত্রী। শাবানা আজমি দিল্লিতে ছিলেন। দিল্লি থেকে চলে এসেছেন বোম্বের বিমান বন্দরে আমাকে অভ্যর্থনা জানাতে। পুনে থেকে লজ্জার প্রকাশক এসেছেন। তিস্তা, জাভেদ ওঁরা তো ছিলেনই। ওঁরা হিন্দু মৌলবাদের বিপক্ষে যেমন লড়েন, মুসলিম মৌলবাদের বিপক্ষেও লড়েন। বিমান বন্দরের ভিআইপি রুম আমাকে বিশ্রামের জন্য দেওয়া হল। বিশ্রামের কোনও দরকার ছিল না। আমি রীতিমত উত্তেজিত। কী যে কথা বলবো ওঁদের সঙ্গে বুঝতে পারছিলাম না। সাংবাদিকদের ভীষণ ভিড়। বিমান বন্দর ঘিরে আছে শত শত পুলিশ। আয়োজকরাই বললেন, আমাকে নাকি জেড সিকিউরিটি দেওয়া হচ্ছে। একশ চুয়াল্লিশ ধারা জারি করা হয়েছে শহরে। বোম্বের রাস্তা থেকে জঙ্গিদের গ্রেফতার করাও হচ্ছে। আমাকে প্রথম জুহু বিচে জাভেদ আনন্দর বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হল। ওখানে দুপুরের খাওয়া। নিজে সে পারসি। কিন্তু ধর্মমুক্ত। কমব্যাট নামের একটা মৌলবাদ বিরোধী ম্যাগাজিন ছাপান তিস্তা আর জাভেদ। ওই বাড়ির উঠোনে বসেশাবানা, জাভেদ আখতার, তিস্তা–ওঁদের সবার সঙ্গে মৌলবাদের উত্থান নিয়ে আলোচনা হয়। মহেশ ভাট বলেন, আমার জীবন নিয়ে তিনি একটা সিনেমা বানাতে চান। কোথাও ঘোষণাও দিয়ে দেন। বিদেশে আমাকে ঘিরে অনেক উৎসব হয়। যত বড় আর জমকালোই হোক না কেন সেইসব উৎসব বা সংবর্ধনা, বোম্বের এই উৎসব আমাকে উত্তেজনা দেয়, কারণ এঁদের কাজের সঙ্গে আমি পরিচিত, আর এঁরা একই লড়াই করছেন, যে লড়াই আমি আমার লেখার মাধ্যমে করছি বহু বছর। আমরা একই উপমহাদেশের মানুষ। আমাদের ইতিহাসটাও যেমন এক, আমাদের লড়াইটাও প্রায় একইরকম। এর আগে জাভেদ আখতারের সঙ্গে আমার দেখা হয়েছিল স্টকহোমে। তিনি ভারতীয় অভিবাসীদের আমন্ত্রণে ওখানে গিয়েছিলেন, কবিতা শোনাচ্ছিলেন। আমাকে দেখে ডেকেপাশে বসালেন, পড়েছিলেনও আমাকে নিয়ে একটা কবিতা শব্দের জাদুকর তিনি। কিন্তু কাছে এলে বুঝি কী সাধারণ মানুষ এঁরা। শাবানাও। আমার মতোই সাধারণ। দুঃখ সুখ এঁদেরও আর সবার মতোই। আসলে দেশেবিদেশে যত বড় মানুষের সঙ্গেপরিচয় হয়েছে, কাউকে আমার খুব দুর্বোধ্য ঠেকেনি। রাতে অনুষ্ঠানেরপর জাভেদ আখতার বসে রইলেন টেলিভিশনের সামনে, কখন আমাদের অনুষ্ঠানের খবর বা আমার খবর দেখায় দেখতে। অনুষ্ঠানে সবাই বক্তৃতা করেছিলেন। শোধ বইয়ের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানটা প্রচুর পুলিশ পাহারায়হয়, মূলত মৌলবাদবিরোধী মূল্যবান একটা অনুষ্ঠান হয়ে ওঠে।

প্যারিসে পৌঁছোনোর পর খবর পাই, ‘আমার মেয়েবেলা’ বইএর জন্য আমি এবারের আনন্দ পুরস্কার পেয়েছি। কত তোপুরস্কার পেয়েছি বিদেশে। কিছুই আমাকে এত সুখ দিতেপারে না, যত সুখ আনন্দ পুরস্কারের খবরটি দেয়। খুব গোপন একটি তথ্য আমাকেপুরস্কার কমিটির একজন জানান, তা হল, বিরানব্বই সালে কমিটির একজনই আমার আনন্দ পুরস্কার পাওয়ার বিরুদ্ধে ছিলেন, এবার দুহাজার সালেও ওই একজনই বিরোধিতা করলেন, তিনি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। মানুষের মুখ ও মুখোশ আমি কখনও আলাদা করতে পারি না। মুখোশকেই মুখ বলে চিরকাল মনে করেছি। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের সঙ্গে আমার কোনওকালেই কিছু নিয়ে বিরোধ ছিল না। তাঁকে শ্রদ্ধা করি, লেখক হিসেবে তো বটেই, তাঁর নাস্তিকতা এবং বাংলা ভাষা নিয়ে তাঁর লড়াইএর ঘোর সমর্থকআমি। তিনিও সবসময় বলে আসছেন, আমাকে ভালোবাসেন, স্নেহ করেন। অনেক আগে, বাংলাদেশে লজ্জা নিষিদ্ধ করার পর বিবিসি একটা তথ্যচিত্র করেছিলো আমার ওপর। ওই তথ্যচিত্রেই দেখিয়েছে আমার সম্পর্কে কলকাতার কফি হাউজে বসে বুদ্ধদেব গুহ, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, নবনীতা দেব সেন–তিন বড় সাহিত্যিকের আলোচনা। তিনজনের মধ্যে একজনই আমার অকুণ্ঠ প্রশংসা করেছেন, তিনি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। তাঁকে সবসময় খুব কাছের মানুষ ভাবতাম। কখনও কল্পনাও করিনি আনন্দ পুরস্কার কমিটির সভায় বসে আমার বিরুদ্ধে বলেন তিনি। হতেই পারে যে তিনি মনে করছেন না পুরস্কার পাওয়ার যোগ্য আমি। হতেই পারে তিনি আমাকে লেখক বলেই মনে করছেন না। কিন্তু মুশকিল হল তাঁর সঙ্গে কথা বললে সেটা বোঝার কোনও উপায় থাকে না। বরং মনে হয়, আমাকে বিশাল গুরুত্বপূর্ণ লেখক ভাবেন আর আমার পক্ষে এইমাত্রই হয়তো কোথাও থেকে যুদ্ধ করে এলেন। এরপর তোমা, তুমি জানোনাপশ্চিমবঙ্গে আমার বই নিষিদ্ধ হয়, এবং যে কয়েকজন বুদ্ধিজীবী আমার বই নিষিদ্ধ করার জন্য সরকারের কাছে দাবি জানিয়েছেন, তার মধ্যে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় একজন। কিছু কিছু সত্যকে, আজও, সবকিছু জানার পরও, আমার অসম্ভব বলে মনে হয়।

দুদুবার বিজেপি সরকার আমাকে ভিসা দিয়েছে ভারত ভ্রমণের। কিন্তু আনন্দপুরস্কার নিতে কলকাতায় যাওয়ার জন্য ভারতের ভিসা নিতে গেলে দূতাবাস থেকে বলে দিলো ভিসা দেবে না। কী কারণ, বোম্বেয় আমার বিরুদ্ধে মুসলমানদের মিছিল হয়েছে, তাই। কলকাতায় জানিয়ে দিলাম খবর, আমাকে ভিসা দেওয়া হচ্ছে না। মহেশ ভাটের সঙ্গে যোগাযোগ ছিল, তাঁকেও জানালাম। কী কী সব মন্ত্রী টস্ত্রীর সঙ্গে নাকি কথা বলেছেন, তাতে কাজ হবে বলে মনে করেছিলেন। শেষে দেখলেন অসম্ভব। ওদিকে কলকাতা থেকে আনন্দবাজারের মালিক অভীক সরকার চেষ্টা করতে লাগলেন, শুনলাম তিনি দিল্লি অবধি গেছেন এ নিয়ে সরকারের বড় কারও সঙ্গে কথা বলতে। অবাক হই ভেবে বিজেপি নাকি মুসলমান বিরোধী। বিরোধীদলে বসে অনেক কিছুই হয়তো বলে, কিন্তু ক্ষমতায় বসে অন্য দল যেভাবে দেশ চালায়, বিজেপিও একইভাবে চালায়। মুসলমান মৌলবাদীদের অন্যায় আব্দার অন্য দলের মতো বিজিপিও মেনে নেয়। মুসলমানের ব্যক্তিগত আইন যেটি খুব উলঙ্গভাবে নারীবিরোধী, সেটি দূর করে অভিন্ন দেওয়ানি বিধির কথা বললেও ক্ষমতায় এসে সেই বিধি ভাবনা উড়িয়ে দেয় বিজেপি। অনেক চেষ্টা তদবিরের পর শেষ মুহূর্তে ভিসার অনুমতি জোটে। কিন্তু যারা আমাকে আগে রীতিমত আদর যত্ন করেছিলো দূতাবাসে, তারা আদর যত্ন তো দূরের কথা, বরং গম্ভীর মুখে আমাকে শর্তের একটি কাগজ দেয় সই করার জন্য। ভিসা পেতে হলে যা আমাকে মানতে হবে, তা হল, ভারতের রাজনীতি নিয়ে কোনও শব্দ উচ্চারণ করা চলবে না, কলকাতা ছাড়া আর কোনও শহরে পা দেওয়া চলবে না, পুরস্কার সম্পর্কিত অথবা সাহিত্য সম্পর্কিত বিষয় ছাড়া কোনও সাক্ষাৎকার দেওয়া চলবে না। ভিসা দেওয়ার আগে টিকিট দেখে নিয়েছে যে ফিরছিপাঁচদিনপর। না, পাঁচদিনের বেশি আমাকে ভিসা দেওয়া হয়নি।

টিকিট পড়ে রইলো টেবিলের কাগজপত্রে ডুবে। ভিসা পাসপোর্টও কিছুর তলায়। সেদিন আমি ভুলে গেছি যে আমার কলকাতায় যাওয়ার কথা। দিব্যি মগ্ন ছিলাম কবিতায়, ভাসছিলাম, ডুবছিলাম চিরাচরিত নিঃসঙ্গতায়। যারা আমার জন্য অপেক্ষা করছিল দমদম বিমান বন্দরে, তাদের ফোনে আমার গভীর রাতের ঘুম ভাঙে। তুমি আসোনি কলকাতায়? বললাম, কাল আমার ফ্লাইট। বলো কি, তোমার তো ফ্লাইট আজকে ছিলো! উঠে কাগজপত্রের জঙ্গল থেকে টিকিট বের করে দেখলাম ভুল আমিই করেছি। কলকাতা থেকে আবার জরুরি টিকিটের ব্যবস্থা করে দিল যেন পরদিন আমি ফ্লাইট ধরতে পারি। যেদিন আনন্দ পুরস্কার দেওয়া হবে সেদিন গিয়ে কলকাতা পৌঁছোলাম। বন্ধুরা আমার পুরস্কার পাওয়ায় রীতিমত উত্তেজিত। আমার দুএকটা সাদামাটা শাড়ি দেখে বিশ্ব রায় দৌড়ে গিয়ে গরদের একটা লাল পাড় শাড়ি কিনে নিয়ে এলো, ব্লাউজও বানিয়ে নিয়ে এলো অল্প সময়ে। বিশ্ব রায় গতবারের কলকাতা ভ্রমণে চমৎকার বন্ধু হয়ে উঠেছিলো। যত বেশি থাকা হয় কলকাতায়, তত বেশি বন্ধু গড়ে ওঠে। অনেকে নাম দেখে, যশ দেখে বন্ধু হতে চায়। কিন্তু সেই বন্ধুত্বে কোনও না কোনওসময় চিড় ধরেই। বাঙালিরা, লক্ষ করেছি খুব দ্রুত বন্ধু হতে পারে। বিদেশিরাও বন্ধু হয়, তবে এমন তুড়ি বাজিয়ে হয় না। বন্ধু হতে ওরা সময় নেয় অনেক। স্বতস্ফূর্ততা আমার রক্তে। বাঙালির ভালোবাসা আমার নির্জনতা নিমেষে ঘুচিয়ে দেয়। জানি না কী দেয় আমাকে, মনে হয় হারিয়ে যাওয়া গোটা একটা দেশ দেয়।

বাবার সঙ্গে আরেকবার দেখা হতে আমারপারতো। কলকাতার আনন্দপুরস্কার অনুষ্ঠানে বাবাকে অনেক বলেছিলাম আসতে, আসেনি। সম্ভবত আমার চেয়েও তখন তার প্রয়োজনীয় হয়ে উঠেছে দেশের বাড়ি, চেম্বার, তার সকাল সন্ধে রোগী দেখা, দাদার সংসারের দায়িত্ব নেওয়া। আনন্দ পুরস্কার দেওয়া হয়েছিলো আমার মেয়েবেলার জন্য, যে আনন্দ থেকে আমার বইটা ছাপানো হয়নি, সেই আনন্দই আমাকে পুরস্কার দিল! এই প্রথম পুরস্কার অনুষ্ঠান গ্র্যান্ড হোটেলের বদলে রবীন্দ্র সদনে করা হল। পুরস্কার অনুষ্ঠানের মঞ্চ অসাধারণ, যেন বনেদি একটি বৈঠক ঘর। সেই অনুষ্ঠানে বক্তৃতা দিতে গিয়ে তোমার কথা বলেছিলাম মা। বক্তৃতার পুরোটাই তোমাকে শোনাতে ইচ্ছে করছে, শোনো।

নমস্কার। এখানে আগেও এসেছিলাম আমি, এই মঞ্চে, এসেছিলাম পাশের দেশ থেকে, তখন ঢাকার হাসপাতালে চাকরি করি, পাশাপাশি লিখি, কটি মাত্র বই বেরিয়েছে। এবার এলাম, তবে আর পাশের দেশ থেকে নয়, বহু দূরের দেশ থেকে, এখন আর ডাক্তারি করা হয় না, কেবল লেখাই কাজ। তখনকার সেই বিরানব্বই সালের আমি আর আজকের আমির মধ্যে অনেক পার্থক্য। মাঝখানে আট বছর কেটে গেছে, আর এই আট বছরে অনেক কিছু ঘটে গেছে এই একটি জীবনে। যা ঘটেছে, সবই লেখার কারণে। লিখি বলে ডাক্তারি ছাড়তে হয়েছে, লিখি বলে মিছিল হয়েছে, হত্যার হুমকি এসেছে, মাথার মূল্য ধার্য হয়েছে, লিখি বলে মামলা জারি হয়েছে, হুলিয়া বেরিয়েছে, ধর্মঘট হয়েছে, মানুষ খুন হয়েছে, লিখি বলে এক বাড়ি থেকে আরেক বাড়ি পালাতে হয়েছে রাতের পর রাত। লিখি বলে স্বজন বন্ধু সব ছাড়তে হয়েছে, ছাড়তে হয়েছে ঘর বাড়ি, ব্রহ্মপুত্র, দেশ। লিখি বলে আবার পুরস্কারও জুটেছে।

জীবন এমনই! অনিশ্চিত। আজ সম্মান পাচ্ছি, কাল হয়ত অসম্মানের চূড়ান্ত হব। আজ ঢিল ছুঁড়ছে কেউ তো কাল বাহবা দেবে। আজ মনে রাখছে তো কাল ভুলে যাবে। আজ বেঁচে আছি, কাল মরে যাব। জীবনের কোনও তো অর্থ নেই আসলে, যদি না নিজেরা অর্থপূর্ণ করি জীবনকে। একটি ব্যাপার আমি বেশ বুঝতে পেরেছি, ধর্মান্ধ সন্ত্রাসীরা আমাকে তাড়া করতে করতে যেখানে নিয়ে ফেলেছে, অনাত্মীয় একটি পরিবেশে, অচেনা একটি জগতে, যেন আমি একা একা কষ্ট পেতে পেতে মরে যাই, যেন আমি হারিয়ে যাই বিষম বিরুদ্ধ স্রোতে, ভুলে যাই কী কারণে এই আমি, আমি সেখানে, এটা ঠিক, আমাকে রীতিমত যুদ্ধ করতে হচ্ছে, নিজের সঙ্গে নিজেকেই। এক আমি চাই সবার অলক্ষ্যে একটি বিন্দুর মত, ক্রমশ অদৃশ্য হয়ে যেতে, অভিমানে, বিষাদে। আরেক আমি হঠাৎ হঠাৎ বিষাদ ঝেড়ে উঠে দাঁড়াই বাঁচব বলে। বেঁচে থাকতে হলে আর এমন কিছু নেই আমার, যে, নিয়ে বাঁচি। এক লেখা ছাড়া।
 
বাংলা থেকে দূরে আমি, লিখি বাংলায়। বাঙালির জীবন থেকে হাজার মাইল দূরে বসে বাঙালির গল্প লিখি। এ যে কী রকম কঠিন কাজ, সে আমি বুঝি। আমার প্রতিদিনকার জীবন যাপনে বাংলার ছিটেফোঁটা নেই। স্মৃতি নির্ভর সব, যা কিছুই লিখি। ছ বছরপর কলকাতায় আসার সুযোগ হল, এ আমার জন্য পরম পাওয়া! এ সুযোগ আমি হারাতে চাই না। এর মধ্যেই সুযোগটি কেড়ে নেবার পাঁয়তারা চলছে, জানি না, ভারতে এই আমার শেষ আসা কিনা। আগেই বলেছি, জীবন অনিশ্চিত। আর আমার জীবনে অনিশ্চয়তা বরাবরই বড় বেশি।

.

যে বইটির জন্য আজ পুরস্কার দেওয়া হচ্ছে, সেই বইটিই, মাত্র আধঘণ্টার উড়ান দূরত্বে, পাশের দেশে, আমার নিজের দেশে, নিষিদ্ধ। ওখানে ছাপা হওয়ার আগেই এটি নিষিদ্ধ। বলা হয়েছে, এ অশ্লীল একটি বই, বলা হয়েছে, এটিপড়লে লোকের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত লাগবে। এরকম কথা আমার অন্য বই সম্পর্কেও বলা হয়, যা কিছুই উচ্চারণ করি আমি, ওই একই দোষ। ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করেছি এই অপরাধে আমাকে বারবার আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হয়েছে। এসব আমার অধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেয়। কিন্তু কারও অধর্মীয় অনুভূতিকে মোটে মূল্য দেওয়ার বিধান কোথাও নেই, কোনও আইন নেই যে আশ্রয় নেব। আমার জন্য এই দিনটি অবিশ্বাস্য একটি দিন, যখন বাংলা সাহিত্য থেকে দূরত্ব আমার ক্রমশ বাড়ছে, এবং আমি আশংকা করছি দিন দিন এই ভেবে যে লেখার শক্তি বুঝি আমার ফুরিয়ে গেছে, আমার বুঝি শুরুতেই সারা হল, তখনই এই আশ্চর্য সম্মান নাছোড়বান্দার মত একটি ইচ্ছে জাগাচ্ছে ভেতরে আমার, লেখার ইচ্ছে। …আজ যদি আমার মা বেঁচে থাকতেন, বিষম খুশি হতেন। স্বামী এবং কন্যা চিকিৎসক, আর তাঁকে মরে যেতে হয়েছে বিনা চিকিৎসায়। অভাবে, অনাহারে, অনাদরে, অবহেলায়, অসম্মানে, অত্যাচারে মার সারা জীবন কেটেছে। আমার মার একার গল্পই যথেষ্ট সমাজে নারীর অবস্থান জানতে। আমি যখন নারী পুরুষের বৈষম্যের বিরুদ্ধে লিখছিলাম, লিখে নাম করছিলাম, আমি কিন্তু নিজের মার দিকে ফিরে তাকাইনি। দেখিনি কতটা যন্ত্রণা তিনি সইছেন, দেখিনি পুরুষতন্ত্রের পাকে পড়ে কেমন একটি দাসী বনেছেন তিনি, যে দাসীর প্রধান এবং প্রথম কাজ স্বামী সন্তানের সেবা করা, তাদের সুখী করা। মা আমাদের সবাইকে সুখী করেছিলেন নিরন্তর সেবায়, তাঁর নিজের যে আলাদা একটি জীবন আছে, এবং সে জীবনটি যে কেবল তাঁরই, সে জীবনটি যেমন ইচ্ছে যাপন করার অধিকার তাঁর আছে, তা তাঁকে কখনই জানতে দেওয়া হয়নি। নারী যে সম্পূর্ণ মানুষ তা সেই আদিকাল থেকেই স্বীকার করা হয়নি, আজও হয় না। পুরুষের পাঁজর থেকে তৈরি নারী, পুরুষেরা যাহা বলিবে, নারীকে তাহাই করিতে হইবে, না করিলে তাহাকে আচ্ছা করিয়া পিটাইতে হইবে। নারীর ঘাড়ের একটি হাড় বাঁকা, তাই তারা বাঁকা পথে চলে। স্বাধীনতায়, আর যারই অধিকার থাকুক, কুকুর বেড়াল গরু ছাগল, নারীর অধিকার নৈব নৈব চ। এই আমিও, নারীবাদের জন্য দিনরাত আপোসহীন লড়াই করেও মাকে আমি মা ছাড়া আলাদা কোনও নারী হিসেবে দেখিনি, আর মা মানেই তো, সমাজ আমাদের যা শিখিয়েছে, সংসারের ঘানি টানে যে, সবচেয়ে ভাল রাঁধে যে, বাড়ে যে, কাপড় চোপড় ধুয়ে রাখে, গুছিয়ে রাখে যে; মা মানে হাড় মাংস কালি করে সকাল সন্ধে খাটে যে, যার হাসতে নেই, যাকে কেবল কাঁদলে মানায়, শোকের নদীতে যার নাক অবদি ডুবে থাকা মানায়। সমাজের অনেক কিছুই আমরা মেনে নিই না বটে, প্রতিবাদ করি, কিন্তু অজান্তে অনেক সংস্কারই গোপনে লুকিয়ে থাকে এই আমাদের ভেতরই। আসলে পিতৃতন্ত্র বা পুরুষতন্ত্র এত শক্ত হয়ে বসে আছে আমাদের ঘাড়ে, এত বেশি ছড়িয়ে আছে আমাদের রক্তে, মস্তিষ্কে, অনেক সময় এ থেকে দূরে এসেছি ভেবেও কিন্তু এরই বীর্যে খাবি খেতে থাকি।

ভাবলে আমার অবাক লাগে যে, যত বিজ্ঞান নির্ভর হচ্ছে মানুষ, ততই যেন ধর্মের বিস্তার হচ্ছে জগত্ময়। বিবর্তন তত্ত্বেষথেষ্ট প্রমাণ নেই, এই কারণ দেখিয়ে অলৌকিক সৃষ্টিতে বিশ্বাসী হওয়ার আন্দোলন চলছেতথাকথিত উন্নত বিশ্বেও। সভ্যতা কি শেষ অবদি পেছন দিকে হাঁটবে, মধ্যযুগের অন্ধকারই কি তবে মানুষের গন্তব্য! ধর্মের জালে সবচেয়ে বেশি আটকা পড়ে নারী, এ আমরা সবাই জানি। পুরুষের তৈরি এই ধর্ম, এই সমাজ এই জঞ্জাল থেকে নারী যদি বেরিয়ে না আসে, আগেও বহুবার বলেছি, আবারও বলছি, নারীর মুক্তি নেই। কেবল নারীর নয়, পুরুষেরও নেই। দারিদ্র্য, বন্যা, খরা পীড়িত দেশে পুংলিঙ্গের জয় জয়কার যেমন, পুঁজি-পীড়িত দেশেও তেমন। কোথাও আমি দেখিনি একটি সত্যিকার বৈষম্যহীন সুস্থ সমাজ। অর্থনৈতিক মুক্তিই সকল বৈষম্য থেকে মুক্তি দেবে মানুষকে, এ কেবলই তত্ত্বকথা। যুক্তি এবং মুক্তচিন্তার সুষ্ঠু চর্চাই অন্ধকার সরাতে পারে, পারে ক্ষুধা, অজ্ঞানতা, অশিক্ষা, অন্ধতা, বৈষম্য আর সন্ত্রাসের গ্রাস থেকে বাঁচাতে মানুষকে। আমার মেয়েবেলা বইটির অনেক চরিত্রই, আমার চারপাশের, দরিদ্র নয়, কিন্তু অতি নিচ, অন্ধ, অজ্ঞান। আমি জীবন যেমন দেখেছি, লিখেছি। ও কেবল আমার জীবন নয়, সমাজের অধিকাংশ মেয়ের জীবনই ওরকম। ভয়ে কুঁকড়ে থাকা, বিষাদে বিবর্ণ হয়ে থাকা। ওই বয়সেই মেয়েরা শিখে নিতে বাধ্য হয় যে মেয়েতে ছেলেতে তফাৎ অনেক, মেয়েদের অনেককিছু করতে নেই, ভাবতে নেই, অনেক কিছু বুঝতে নেই, বলতে নেই। আমিও তেমন শিখেছিলাম।

মাত্র দুশ কী আড়াইশ পাতায় পুরো শৈশব কৈশোর কি তুলে আনা সম্ভব! ছিটেফোঁটা যা মনে পড়েছে, আধখেচড়া, অনেকটা খসড়া মত, লেখা। ধোঁয়াটে, ধুলোটে; অস্পষ্ট, অপুষ্ট, অদক্ষ হাতের স্কেচ। সামান্য বইটির জন্য আজ যে অসামান্য সম্মান আমাকে দেওয়া হচ্ছে, তা আমাকে কুণ্ঠিত করছে, সেই সঙ্গে গর্বিতও। আমি ক্ষুদ্র তুচ্ছ মানুষ। ভালবাসা আমি ঢের পেয়েছি, এত ভালবাসা পাবার যোগ্য আমি নই। এ জীবনে দুঃখ সুখ দুটোই বড় প্রবল হয়ে আমার কাছে ভিড়েছে। মাঝে মাঝে মনে হয় এত দুঃখ পাবারও আমার মত সামান্য একজন মানুষের জন্য প্রয়োজন ছিল না। আমার বুঝি ওই ভাল ছিল, সূর্যাস্তের সবগুলো রঙ গায়ে মেখে কাশফুলে ছাওয়া ব্রহ্মপুত্রের পাড়ে ক্লান্তিহীন, বাতাসের উল্টোদিকে, কেবল দৌড়ে যাওয়া। আমার বুঝি ওই ভাল ছিল, জীবনভর জীবন দেখতে দেখতে যাওয়া। ছোট ছোট দুঃখ সুখে দোলা। বেশ ভাল করেই জানি আমি ভাল সাহিত্যিক নই, ভাল নারীবাদীও নই। জীবন যেহেতু অর্থহীন, আর এই জীবন যেহেতু বড় এক প্রাপ্তিও, তাই জীবনের যা কিছু, সবই ভোগ করতে চাই, আর এই ভোগে যা কিছুই বাধা হয়ে আসে, ডিঙোতে চাই, রীতি, নীতি, যন্ত্র, মন্ত্র, পুরুষতন্ত্র, ধর্ম, বর্ম সবই। মাত্র কদিনের এই জীবনকে খামোকো অদ্ভুত সব নিয়মের জালে জড়াবো কেন! কেনই বা শেকলে বাঁধব! স্বাধীনতা, এই শব্দটির মূল্য আমার কাছে অনেক। এটি পেতে গিয়ে বার বার আমি পরাধীন হয়েছি। বারবার শেকল ছিঁড়েছি। নারীমাংসের গন্ধ পেলে হাঁ-মুখোপরাধীনতা একশ দাঁত মেলে দৌড়ে আসে, কামড়ে খেতে চায়। নারীর জীবন চলে যায় কেবল জীবন বাঁচাতে।

আমি আর যাই করি, প্রতারণা করি না, না নিজের সঙ্গে, না অন্যের সঙ্গে। অকপটে সত্য বলতে আমার বেশ আনন্দ হয়। জীবনে এ নিয়ে অনেক ভুগতে হয়েছে আমাকে। নিজের দেশে যেমন, অন্য দেশেও তেমন। আর লেখার বেলাতেও, বানিয়ে গল্প লেখার চেয়ে সত্য ঘটনা লেখায় আমার আগ্রহ বেশি। চারপাশে কত গল্প ঘটছে আমাদের। কেন বানাতে যাব! আমার কল্পনাশক্তি সম্ভবত কম, আমার স্মরণশক্তির মত। আগাগোড়া দুর্বল মানুষ আমি, লোকে সবল বলে ভাবে, ভুল করে। যত যাই বলি না কেন, আমি নেহাতই সাদাসিধে মানুষ, যারাই আমার কাছে এসেছে, বুঝেছে। আমি খোলস বা মুখোশ এগুলো একেবারে গায়ে রাখতে পারি না, ওসব গায়ে আছে ভাবলেও হাঁসফাঁস লাগে। নিজের জীবনকাহিনী লিখছি, নিজেকে চিনি বলে। নিজের

জীবনের গল্প বলা শেষ হয়ে গেলে হয়ত অন্য কারও জীবন নিয়ে লিখব, যাকে চিনি, যার চরিত্রের গভীরে যেতে পারি অনায়াসে। মানুষ, এখনও আমার কাছে বড় চেনা, আবার বড় অচেনাও। কারও সঙ্গে বত্রিশ বছর কাটিয়েও মনে হয়, তাকে ঠিক চেনা হয়নি আমার। আবার নিজের কথাও মাঝে মাঝে ভাবি, এত যে চিনি বলে ভাবি, নিজেকে কি আসলেই আমি ভাল চিনি!

একসময় বলতাম সকলেরই দু একজন আত্মীয়, সংসার, ঘরে ফেরা, ইত্যাদি কিছু না কিছু থাকে, কেবল আমারই কিছু নেই, কেবল আমারই খরায় ফাটা বুকে বেশরম পড়ে থাকে শূন্য কলস। সকলেরই জল থাকে, দল থাকে, ফুল ফল থাকেই, আমারই কিছু নেই, সমস্ত জীবন জুড়ে ধুধু একপরবাস ছাড়া। এখন আর তেমন করে বলছি না। পরবাস আছে বটে জীবনে, এখন আপনারাও আছেন, যে ভালবাসা আমি পাচ্ছি আজ, তা সঙ্গে করে নিয়ে যাব দূরের দেশে। আমার আকাশ জুড়ে হাজার তারার মত ফুটে থাকবে এসব; অন্ধকারে, দুর্যোগে আমাকে আলো দেবে, আশা দেবে। আমি নিজেকে আরও আরও চিনতে শিখব। আমি লিখতে শিখব। আপনারা, সম্ভবত, প্রায় মরে যাওয়া লেখককে একটু একটু করে বাঁচিয়ে তুলছেন। কী দেব? শুভেচ্ছা, ভালবাসা, শ্রদ্ধা সবই গ্রহণ করুন, আমাকে ধন্য করুন। হোক না অন্য দেশে আমার জন্ম, না হয় থাকি দূরের কোনও দেশে, আমি তো আপনাদেরই মানুষ, আত্মীয়-মতো, আপন। আমার কি কোথাও আর আপন কেউ আছে? নমস্কার।

আনন্দ পুরস্কার আমি দ্বিতীয়বার পেলাম। আমি একাই পেলাম। পাঁচ লক্ষ টাকা পুরস্কার। টাকাটা আমাকে সত্যিই আকৃষ্ট করে না। এর আগে বিরানব্বই সালে যখন পেয়েছিলাম আনন্দ পুরস্কার, পঞ্চাশ হাজার থেকে এক লক্ষ টাকা হয়েছিলো পুরস্কার। আর এবার এক লক্ষ থেকে হলো পাঁচ লক্ষ। অনেকে ভাবতে পারে আমার লক্ষ্মী ভাগ্য বা লক্ষ ভাগ্য ভালো। আমি ভাগ্যে বিশ্বাস করি না। প্যারিসের ব্যাংকে ও টাকা জমা করে দেওয়ার পর আমারই অজান্তে দ্রুত উড়ে যায়। আমার লক্ষ টাকার পিঠে অদৃশ্য পাখা থাকে। উড়ে যায় বলে মনোকষ্ট নেই। মনোকষ্ট শুধু তোমার জন্য। যে টাকার অভাবে তুমি সারাজীবন ছিলে, সেই টাকা আমার কাছে যত কাড়ি কাড়ি আসে, তত সেই টাকাকে আমার তুচ্ছ মনে হয়, অপ্রয়োজনীয় মনে হয়, সেই টাকাকে আমার বড় ঘৃণা হয়, মা। সংসারে তুমি ছিলে একা, আর আমি একা। আমার স্বামী সন্তানের উপদ্রব নেই। আমার ধন সম্পদও কারও জন্য রেখে যাওয়ার নেই। এভাবেই জীবন উড়তে থাকে, যে জীবনের, মনে হয় কোনও অর্থ নেই। এভাবেই জীবন ভেসে যেতে থাকে, যে জীবনকে খড়কুটো বলেও মনে হয় না।

বুঝলে মাপ্যারিসহলোইওরোপের কেন্দ্র। আর আমার যত ভ্রমণ, সব এইপ্যারিস থেকেই। বিভিন্ন দেশে যাওয়া আসা হচ্ছেই। বিভিন্ন দেশ থেকে আমন্ত্রণ আসছে, নারীর অধিকার বা মানবাধিকার বিষয়ে কথা বলার জন্য আমন্ত্রণ। ইওনেস্কোতে আমি আন্তর্জাতিক ধর্মমুক্ত মানববাদী আইএইচইইউ এর ডেলেগেশন হয়ে যাই, ওখানে ধর্মমুক্ত রাষ্ট্র, আইন, সমাজ ও শিক্ষার পক্ষে কড়া বক্তব্য রাখি। ইউনেস্কোয় নাকি এমন কঠিন বক্তব্য আগে কেউ রাখেনি। সব নড়েচড়ে বসেছিলো। সবখানেই তাই হয়। ক্রিশ্চান, ইহুদি বা অন্য কোনও ধর্মীয় পরিবারে জন্ম নিয়ে যে কেউ ঠিক একই কথা, যা আমি বলেছি, বললে কেউ চমকায় না। কিন্তু মুসলিম পরিবারে জন্মে ধর্মের সমালোচনা, তাও আবার সব ধর্মের সমালোচনা করলে লোকে চমকে ওঠে। আসলে আমার সংগ্রাম তো আর ধর্ম নাশ করার সংগ্রাম নয়। আমার সংগ্রাম মানবতার জন্য মূলত, সমানাধিকারের জন্য। ধর্মের সঙ্গে নারীর সমানাধিকারের বিরোধ আজন্ম। যেখানেই যাই, যত কোলাহল বা কলরবের মধ্যেই যাই, ফিরে আসি নিজের নিঃসঙ্গতায়। ফোনটা হাতের কাছে, ইচ্ছে করে কেউ জিজ্ঞেস করুক, কেমন আছি, দেশে ফিরবো কবে, ইচ্ছে করে কেউ বলুক আমার জন্য কোথাও সে অপেক্ষা করছে। বলুক আমাকে ভালোবাসে, জিজ্ঞেস করুক, কেমন আছি, কী খাচ্ছি। তুমি নেই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের কোনও পারে যে তোমাকে বলবো কেমন আছি আমি, কেমন থাকি প্রতিদিন। তুমি কোনও দেশে নেই, কোনও শহরে বা গ্রামে নেই। কোনও বাড়িতে নেই। তোমার কোনও ঠিকানা নেই। তোমার কোনও টেলিফোন নম্বর নেই। তোমার কিচ্ছু নেই মা। তোমার এত নেই এর কাঁটা বুকের ভেতরটায় বিঁধে থাকে।

প্যারিসে বসে কবিতার একটি বই ছাড়া আর কিছুই লিখিনি। ফরাসি প্রকাশক, বুঝি, যে, অসন্তুষ্ট। ভালো ভালো উপন্যাস চাইছে প্রকাশক। আমি যে লেখক, আমি যে ভালো লেখক, সে কথা আরও প্রমাণ করি আমি, চাইছে। আমি যে কেবল ধর্মের বিপক্ষে লেখা, মৌলবাদীদের ফতোয়া পাওয়া কোনও নির্যাতিত নির্বাসিত বস্তু নই, তা ফরাসি প্রকাশকও প্রমাণ করতে চান। ফরাসি দেশে নাম আছে, কিন্তু নতুন বই নেই। বন্ধু বলে যাদের কাছে টানি, কিছুদিন পর তাদেরও ঠিক বন্ধু বলে আর মনে হয় না। ভালো না লাগা, হেথা নয়-হোথা নয়-অন্য কোথার বৈরাগ্য জীবন জুড়ে, ঝাঁক ঝাঁক দুশ্চিন্তা মস্তিষ্ক দখল করে নেয়। ঘোর বিষাদ আমাকে গ্রাস করে ফেলে। সুয়েনসনকে জানালাম এখানে আর আমার থাকা সম্ভব হচ্ছেনা। বললো, চলে এসো সুইডেনে। কী এক অদ্ভুত অভিমানে আমি প্যারিস ছাড়লাম। বড় অনিচ্ছায় আমি ফিরে গেলাম। ক্রিশ্চান বেসও আপত্তি করেননি। তিনি যদি বলতেন না যেতে, তাহলে জীবন অন্যরকম হতো। তিনি তো জানতেনই যে সুইডেনকেচিরবিদায় জানিয়ে এসেছিলাম। প্যারিস আমার জন্য শেষ অবধি কোনও আশ্রয় হলো না। নিজেই স্বপ্ন গড়েছিলাম, নিজেই সেই স্বপ্ন ভেঙে ফেলি। আসবাবপত্র যা কিনেছিলাম প্যারিসে, দিয়ে দিলাম যাকে তাকে। বাড়ির কনসিয়াজকে ডেকে এনে বলি, যা ইচ্ছে করে নিয়ে যান ঘর থেকে। ছুটে এসে নিয়ে গেলো, যা ভালো লাগেসব। শুধুবই, কাপড়চোপড়, আর কমপিউটার, প্রিন্টার এসব জরুরি জিনিস নিয়ে গেলাম। আবারও মুভার ডাকো। আবারও হাজার হাজার টাকা খরচ করো। কিন্তু ডিপ্রেশনের ডিপোর কাছে ফিরে গেলে কি আমার ডিপ্রেশন সারবে! সুয়েনসনের বাড়িটা সুন্দর করে সাজিয়ে নিজেকে গুছিয়ে নিলাম। কিন্তু অন্যের বাড়ি নিজের রুচিমতো নিজের টাকা খরচ করে সাজালেই বা কী, ও তো আর নিজের বাড়ি হয়ে যাবে না।

এর মধ্যে ভয়ংকর সব কাণ্ড ঘটে যাচ্ছে। একটা রক্তচাপ মাপার মেশিন কিনেছিলাম প্যারিস থেকে। ডাক্তারি পড়াকালীন সময় থেকেই মেশিন থাকে আমার কাছে। আগের মেশিনটা নষ্ট হয়ে যাওয়ার পর অনেক দিন কোনও নতুন মেশিন কেনা হয়নি বলে কিনেছি। বন্ধু বান্ধবদের অসুখ বিসুখ হলে মেপে দেখি রক্তচাপ নিজেরটাও বছরে দুবছরে হয়তো মাপি। ওই মেশিনটা কেনারপর মাস চলে গেলে প্রথম ব্যবহার করলাম, সুয়েনসনের রক্তচাপ মাপার জন্য। মেশিনেরও উদ্বোধন করার জন্য। সুয়েনসনের রক্তচাপ একেবারে স্বাভাবিক। এরপর নিজের রক্তচাপ দেখে তো আমি আকাশ থেকে পড়লাম। মেশিনের গণ্ডগোল হয়েছে বলে আবার মাপলাম। একই মাপ দেখাচ্ছে। ২৫০/১৫০। সুয়েনসনের রক্তচাপ আবার মেপে দেখি ১২০/৭৫। তার মানে মেশিন ঠিক আছে। ওর বেলায় যাচ্ছেতাই ব্যবহার করছে না, আমার বেলায় করছে। তার মানে। কি এই যে আমি এখন ব্লাড প্রেশারের রোগী? ব্যাপারটি মেনে নেওয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয়। শবাসনে অনেকক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে আবারও মাপলাম। কোনও দুশ্চিন্তা নেই, কিছু নিয়ে কোনও অস্থিরতা নেই, তবে এই ভয়ংকর রক্তচাপটা কেন! এ নিয়ে তো বসে থাকা খুব ঝুঁকিপূর্ণ, যে কোনও সময়ই দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পারে। সুয়েনসনকে বললাম ক্যারোলিন্সকা হাসপাতালে নিয়ে যেতে। কিছুতেই সে যাবে না। অনর্গল বলে যাচ্ছে এসব আমার ন্যাকামি। তোমার অসুখ হলে বাবা তোমাকে বলতো, তেমন। উল্টো দিকের বাড়িতে পিয়া নামের এক সুইডিশ মেয়ে থাকে, ও হাসপাতালের নার্স। মধ্যরাতে ওর কাছে দৌড়ে যাই, অন্তত যদি কোনও ওষুধ থাকে, অথবা ও যদি কোনও হাসপাতালে আমাকে নিয়ে যায়। না, পিয়া নেই বাড়িতে। আমার দুশ্চিন্তা বেড়ে তখন কী অবস্থায় গিয়েছিলো তোমাকে বোঝাতে পারবো না। অনেক অনুরোধের পর গজগজ করতে করতে গেলো সুয়েনসন আমার সঙ্গে হাসপাতালে। ক্যারোলিন্সকা হাসপাতালের ইমারজেন্সিতে গিয়ে তিন ঘণ্টা অপেক্ষা করার পরও দেখি ডাক্তার আসছেনা, রাগ করে বাড়ি চলে এলাম। এই হল বিদেশের বিপদ। আমি নিজে বলি না আমি কে বা আমি কী। বিদেশের ক্রিমিনাল, বাটপাড়, অ আ ক খরসঙ্গে এক সারিতে বসে আমাকে অপেক্ষা করতে হবে ডাক্তারের। ওই অপেক্ষার সময় এমন হতে পারে যে মাথায় রক্তক্ষরণ হলো অথবা হৃদপিণ্ড বন্ধ হয়ে গেলো। দেশে থাকলে নিজে ডাক্তার বলে, বা চেনা বলে আমাকে তড়িঘড়ি দেখা হত। বিদেশে বিশেষ করে সুইডেনে তা হবার জো নেই। সারারাত চরম অস্থিরতায় এক ফোঁটা ঘুমোত পারিনি। সাত সকালে উপসালা শহরে গিয়ে আগে এক বন্ধুর কাছ থেকে চেয়ে একটা নিফিকার্ডিন নিয়ে জিভের তলায় রেখে দুম করে স্বর্গ থেকে রক্তচাপকে নামিয়ে আনি মর্তে। বাবার পকেটে সবসময় ওই নিফিকার্ডিন নামের ওষুধ থাকে। ওভাবে দ্রুত রক্তচাপ কমানো অনুচিত জেনেও বাবা ওভাবেই কমায়। বন্ধুর বাড়িতে আগে গিয়েছি, জেনেই গিয়েছি যে তার নিজের একটা হৃত্যন্ত্রের অসুখ সম্প্রতি হয়েছিল বলে রক্তচাপ কমিয়ে রাখার ওষুধপত্র রাখছে বাড়িতে। বন্ধুটি শান্তনু দাশগুপ্ত, তুমি তো চেন, উপসালা বিশ্ববিদ্যালয়ে মাইক্রোবায়োলজির রিসার্চার। সুয়েনসনের বাড়িতে তোমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলো। ওর বাড়ি থেকে উপসালার অ্যাকাডেমিস্কা হাসপাতালের ইমারজেন্সিতে যাই। শান্তনুর সুইডিশ বান্ধবী লেনা সঙ্গে গেল। তখন অনেক কম রক্তচাপ, ওই ওষুধটা খাওয়াতে। কম হলেও স্বাভাবিক হয়নি। ডাক্তার রক্তচাপ কমানোর ওষুধ দিলেন। কিন্তু বিটা ব্লকার আমি খাবো কেন? আমি এ দেশের ডাক্তারদের বিশ্বাস করবো কেন? এ দেশে ডাক্তার দেখানোর কারণ হলো একটাই, এখানে ডাক্তারের প্রেসক্রিপশান ছাড়া কোনও ওষুধ কেনা যায় না। অ্যাকাডেমিস্কা থেকে দেওয়া ওষুধ আমার পছন্দ হয়নি। ইন্টারনেট ঘেঁটে নতুন মেডিক্যাল জার্নালগুলো পড়ে মনে হয়েছে যে এসিই ইনহিবিটর ওষুধটা ভালো। সুতরাং অন্য এক হাসপাতালে গিয়ে বললাম, আমার হার্ট দেখ, আমার ইসিজি দেখ, আমাকে এসিইইনহিবিটর লিখে দাও, আমাকে সোফিয়া হেমেটে রেফার করো। সোফিয়া হেমেট সুইডেনের সবচেয়ে নামকরা হাসপাতাল, সবচেয়ে দামি। আমার যেহেতু এখন সুইডিশ পাসপোর্ট, আমি বিনে পয়সায় ওখানে দেখাতে পারি। রেফার না করলে সোফিয়া হেমেটে কেউ দেখাতে পারে না। বাবার চোখের চিকিৎসা সোফিয়াতে করিয়েছিলাম, হাসপাতালগুলোর মধ্যে সবচেয়ে ভালোটায়। সুতরাং সবচেয়ে ভালো জায়গাতেই আমি যাবো। ছোটখাটো আনাড়ি ডাক্তারদের হাতে তোমাকে মরতে হয়েছে, আমাকে মারতে আমি ওদের দেব না। সোফিয়া হেমেটে গিয়েও আমি ওই ওষুধ দাবি করলাম যে ওষুধকে আমি মনে করছি ভালো। মা, তোমার জীবন দিয়ে তুমি আমাকে শিক্ষা দিয়ে গেলে। আমি মুখ খুলিনি, কথা বলিনি, আনাড়ি ডাক্তাররা যা বলেছিলো, তা অক্ষরে অক্ষরে পালন করে তোমাকে হত্যা করেছি আমি। কোনও চ্যালেঞ্জ করিনি, প্রতিবাদ করিনি, আপোস করেছি সারাক্ষণ। নিজের বেলায় যদি আমিনা হতে দিই, তাহলেও যদি অন্তত প্রতিশোধ নেওয়া যায়। জানি তোমার ভালো লাগছে আমার এই সচেতনতা দেখে। কিন্তু মা, আমার কি প্রতি প্রতিবাদে তোমাকে মনে পড়ছেনা, গায়ে আমার জ্বালা ধরছেনা, এখন যা করছি, অনুতাপ করছিনা এই বলে যে, তখন তা করিনি কেন? আমার শক্তি আমার সাহস কোথায় কোন গুহায় হারিয়ে গিয়েছিল? জানি ওরা আমাকে বোবা বানিয়ে রেখেছিলো, ওরা কোনও তৃতীয় বিশ্বের মেয়েকে জোর গলায় কথা বলতে দেখতে চায় না। কিন্তু নিজের আমিত্ব বিসর্জন দিয়ে ওদের সুখী করে কী পেলাম আমি? আমি তো সব হারালাম, যখন তোমাকেই হারালাম।

বাবাকে জানিয়েছি আমার রক্তচাপ বাড়ার কথা। এত অল্প বয়সে রক্তচাপ বাড়লো বলে বাবাও অবাক। আমার রক্তে ছিল এই রোগ, উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া। কিন্তু দুশ্চিন্তা ত্বরান্বিত করেছে রোগটি। চল্লিশে পড়িনি এখনও, উচ্চ রক্তচাপের রোগী হলাম। দায়ী কে মা, দুশ্চিন্তা কে দিচ্ছে আমাকে! মানুষগুলোই তো, যারা আমাকে নিয়ে বছরের পর বছর ধরে রাজনীতির নোংরা খেলা খেলছে! তোমার না থাকা দিচ্ছে, ভাই বোনের নির্লিপ্তি দিচ্ছে। যাদের ভালোবাসি, তারা যদি দূর থেকে ক্রমশ দূরেই যেতে থাকে, তবে হতাশার কোলে বসে আমি দিন রাত দোল খাবো না কেন, বলো। সুইডেনে বসে এক লেখা ছাড়া আর করার কিছু থাকে না। সামাজিকতা মাচায় তুলে যে সুইডেনের মতো দেশে থাকতে হয়, তা তো দেখেছেই। তবে তুমি একেবারে নির্মম অবস্থাটাই দেখে গেছে। একটা অন্য গ্রহে যেন বসবাস। মানুষের সঙ্গে কোনও সম্পর্ক নেই। কারও যাওয়া আসা নেই বাড়িতে। শুধু ভূতের মতো বসে থাকো, যেখানে বসে আছো। প্যারিসে আমার কাছে বন্ধুবান্ধব দেশ বিদেশ থেকে ছুটে আসতো, আমাকে দেখার নাম করে প্যারিসকেই দেখতো তারা। আর সুইডেনে থাকলে কেউ আমাকে দেখতে আসতে চায় না। এই অন্ধকার দেশে কে আসবে বলো। অন্ধকার ঠিক কেমন অন্ধকার, তো তুমি দেখেইছে। তবে গ্রীষ্মকালের দিন রাতের ঝকঝকে আলো, এই মধ্যরাতের সূর্যের দেশটায় প্যারিসের পাট চুকিয়ে ফিরে এসে ঘরদোর ভীষণভাবে সাজিয়ে লেখালেখিতে মনও দিলাম। বাড়ি সাজানোয় তো আমার কোনও লাভ নেই, আপাতত না বুঝলেও কিছুদিন পর তো হাড়ে হাড়ে টের পাবো, ওতে শরীর, মন, অর্থ ঢেলে লাভ কিছু নেই। বিদেশ বিভুইএ থাকারইচ্ছেও আমার নেই, তাছাড়া অন্যের বাড়ি সাজালে অন্যের লাভ হয়, নিজের কিছু হয় না, বিশেষ করে সেই অন্যের সঙ্গে যদি হৃদয়ের কোনও সম্পর্ক না হয়। ওসব ফালতু কাজ। ভালো কাজের মধ্যে যা করেছি, তা চারটে বই লিখেছি, ফরাসি প্রেমিক নামের একটি উপন্যাস, খালি খালি লাগে নামের একটি কবিতার বই, উতল হাওয়া আর দ্বিখণ্ডিত, আত্মজীবনীর দ্বিতীয় খন্ড আর তৃতীয় খন্ড।

অভিমান আমাকে কুঁকড়ে রেখেছিলো। আমি তো সেই যে দেশ ছাড়লাম, পরিবারের সবাইকেই ছাড়লাম। দাদা, ছোটদার কাছে কোনও কোনও করিনি, এমনকী ইয়াসমিনের সঙ্গেও যোগাযোগ পুরোটাই বন্ধ করে দিয়েছি। কারও স্বার্থপরতাকে ক্ষমা করতে আমি পারিনি। আমার কেনা গাড়ির মালিক হয়ে বসে আছে দাদা, যে মালিক তোমার ওই অসুস্থ অবস্থাতেও সে গাড়িটা চড়তে দেয়নি তোমাকে। তার বউ ছেলে মিলে তোমাকে জ্বালিয়েছে। তারা মশারির নিচে নরম বিছানায় ঘুমিয়েছে। আর তুমি বারান্দার মেঝেয় মশার কামড় খেতে খেতে রাত পার করেছে। যে টাকা তোমার সম্বল ছিলো অবকাশের নারকেল ডাব বিক্রি করে কিছু টাকা পেতে, সেটিও হাসিনা নিজে বিক্রি করে দেয় তোমার অনুপস্থিতিতে। শুভও জেনে গেছে, তুমি এ বাড়ির সবচেয়ে অবহেলা পাওয়া, অবজ্ঞা পাওয়া একটা তুচ্ছক্ষুদ্র মেয়ে মানুষ, আদরে আহ্লাদে বড় হওয়া লাটসাব হওয়া, নবাব হওয়া শুভও তোমাকে মানুষ বলে মনে করে না। গ্লানি আমাকে কুরে খাচ্ছে, আমি আর তোমাকে অবজ্ঞা করা মানুষদের সঙ্গে সম্পর্ক রেখে গ্লানির ভার বাড়াতে চাই না। তুমি যদি একটুখানি ভালোবাসা পেতে, উজাড় করে দিতে, আসলে তোমার টাকা পয়সা ছিলো না বলে হয়তো তুমি ভালোবাসা পাওনি। ভালোবাসার সঙ্গে তো আজকাল অর্থকড়ির সম্পর্ক বেশ আছে। তুমি যা পারতে, যেভাবেই পারতে, সেভাবে মানুষের জন্য করেছে। ভিক্ষে করতে যারা আসতো, তুমি বাড়ির গৃহিণী বলে মনে করতো তুমিও বুঝি ধনী। তুমি ওদের কাছে ডেকে বলে দিতে, তুমি ধনীর বাড়িতে থাকে, কিন্তু তুমিও ওদের মতো দরিদ্র, বলতে, আসলে ওদের চেয়েও বেশি দরিদ্র, ওদের তোভিক্ষে করে যা হোক কিছু উপার্জনের সামর্থ্য আছে, ওদেরও একধরনের স্বাধীনতা আছে যা তোমার নেই। একটা সময়, আমার মনে আছে, তোমাকে যখন পড়াশোনা কেউ করতে দিলোই না, তোমার যখন কোনও চাকরি বাকরি করার অধিকারও নেই, তখন বলতে তোমার মানুষের বাড়িতে কাজ করে জীবন চালাতে ইচ্ছে করে। মানুষের বাড়িতে কাজ করলে খাবারও জোটে, মাস গেলে বেতনও জোটে। স্বনির্ভর হতে চাইতে। দারিদ্রে তোমার আপত্তি ছিলো না, কিন্তু অত কুৎসিত ভাবে অপমানিত হতে চাইতে না। অপমান তোমাকে করেছি সবাই, মানুষ বলে মনে করিনি। বাবার কাছ থেকেই সম্ভবত সবাই শিখেছি। কিন্তু বাবার অনেক কিছুই তো আমি মানিনি। কিন্তু তোমাকে অপমান করাটাই শুধু মেনেছি। বাকি আর যা কিছুমানি বা না মানি। বাবার সঙ্গে তোমার যে কোনও দ্বন্দ্বে আমি তো চিরকালই বাবার পক্ষই নিয়েছি। বিদেশ থেকে বাবাকে টাকা পাঠিয়েছি। বাবা তার অ্যাকাউন্ট নম্বর কোনওদিন দেয়নি আমাকে। তখন টাকা তোমার অ্যাকাউন্টে পাঠিয়েছি, বলেছিপুরো টাকা তুলে নিয়ে গিয়ে বাবাকে দিয়ে আসতে। হ্যাঁ তুমি তাই করেছে। বাবাকে কেন আমি টাকা পাঠাতাম? বাবার কি টাকার অভাব ছিলো? ছিলো না। বাবা ভালো জামা কাপড় কেনে না, ভালো জুতো কেনে না, ভালো সেইভিং কিটস কেনে না, সে তো অভাবের জন্য নয়, সে তো স্বভাবের জন্য। সারা জীবন তা জেনেও আমি জানিনি। বাবার প্রতি ভালোবাসা বোঝাবার আর বোধহয় অন্য কোনও পথ আমার ছিলো না। যাকে বাবা বলে, যাকে তুমি বলে কোনওদিন ডাকতে পারিনি, তাকে কী করে বলবো ভালোবাসার কথা। তোমাকেও তো একসময় তুমি বলা আমি ছেড়ে দিয়েছিলাম, তোমার সঙ্গে ভাববাচ্যে কথা বলতাম। বোধহয় ভাববাচ্যেই কয়েক বছর কাটিয়েছিলাম। সুইডেনে ফের সম্বোধন করতে শুরু করেছি। ওটাই বোধহয় তোমার জন্য ছিল সুখের ঘটনা। একদিনই তোমার বাথটাবে স্নান করতে দিয়েছিলাম, ফেনা বানিয়ে ফেনার মধ্যে তোমাকে ডুবিয়ে। তুমি বাচ্চা মেয়ের মতো খুশি হয়েছিলে। কী অল্পতে তুমি খুশি হতে মা, অথচ তোমাকে খুশি করতে কেউ আমরা সামান্য চেষ্টাও করিনি। কী কঠিন ছিল হৃদয় আমার। তোমারই সন্তান, তোমার মতো মাটির মানুষের, তোমার মতো বিরাট মনের। অথচ স্বার্থপরতা, হীনতা, নীচতা সব আমাদের সম্বল ছিল। তুমি আমার জীবন বদলে দিয়েছে। টাকা পয়সা এখন আমার কাছে তুচ্ছ একটি জিনিস। তোমার চলে যাওয়া, হারিয়ে যাওয়া আমাকে জীবনের নতুন অর্থ দিয়েছে, একইসঙ্গে অর্থহীনতাও। যদি কিছুর মূল্য আমি দিই জীবনে, সে ভালোবাসার, আর কিছুর নয়। পরিবার পরিজন, বন্ধু, স্বজন, নাম যশ খ্যাতি সব অর্থহীন আমার কাছে। যেখানে ভালোবাসা, সেখানেই দৌড়ে যাই। যাকে ভালোবাসি, তাকে উজাড় করে দিই, তাকেই বোঝাই যে ভালোবাসি। ভালোবাসার জন্য মাইল মাইল পাড়ি দিই। জীবন বাজি রাখি।

যে মানুষ আর যে বাড়ি ছেড়ে আমি একবার বেরিয়ে গেছি, সেখানে তার কাছে ফিরে আসা ঠিক কী রকম, তুমি নিশ্চয়ই বোঝে। বুঝবে না কেন, তুমি তো সব বুঝতে। ভাবতাম, কিছুই বোধহয় বোঝে না, তুমি যে কত সংবেদনশীল মানুষ ছিলে, সহজ এবং সরল, সহৃদয় এবং সহিষ্ণু, তোমার আশেপাশের মানুষদের কেউ তো তেমন ছিল না। ভেতরে ভেতরে এত যে বুঝতে, জগৎ এবং জীবন তুমি কী চোখে দেখতে, কী গভীর চোখে, তা বোঝার সাধ্য আমার কেন, কারওরই ছিল না। তোমাকে আমি চিনতে শুরু করলাম তোমার অসুখের পর, তোমার মতো আপন মানুষটিকে হারানোর যে ক্ষত এবং ক্ষতি তা আমি জীবন দিয়ে এখন অনুভব করি।
 
১০.

মা, ‘খালি খালি লাগে’ বইটিও উৎসর্গ করেছি তোমাকে। উৎসর্গ পাতায় লিখেছি। তাকে, যাকে ভালবাসার কথা ছিল, অথচ বাসিনি। এই বইতেও লিখেছি কিছু কবিতা, তোমাকে মনে করে। কিছুক্ষণ থাকো’ নামে আরও একটি কবিতার বইপরে লিখেছি, ওতেও আছে কিছু তোমাকে নিয়ে। কবিতা পড়তে তুমি তো খুব ভালোবাসতে। জানি না, কী করে তোমার সময় কাটে, চিঠি যদি পড়তে না চাও, পড়ো না, সম্ভব হলে শুধু কবিতাগুলো পড়ো।

.

যদি হত

এরকম যদি হত তুমি আছ কোথাও, কোথাও না কোথাও আছ, একদিন দেখা হবে,
একদিন চাঁদের আলোয় ভিজে ভিজে গল্প হবে অনেক, যে কথাটি বলা হয়নি, হবে
যে কোনও একদিন দেখা হবে, যে স্পর্শটি করা হয়নি, হবে
আজ হতে পারে, পরশু, অথবা কুড়ি বছর পর, যে চুমুটি খাওয়া হয়নি, হবে

অথবা দেখা হবে না, কুড়ি কেটে যাচ্ছে, দু কুড়িও
তুমি আছ কোথাও, ভাবা যেত তুমি হাঁটছ বাগানে, গন্ধরাজের গন্ধ নিচ্ছ
গোলাপের গোড়ায় জল দিচ্ছ, কামিনীর গা থেকে আলগোছে সরিয়ে নিচ্ছ মাধবীলতা,
অথবা স্নান করছ, খোঁপা করছ, দু এক কলি গাইছ কিছু
অথবা শুয়ে আছ, দক্ষিণের জানালায় এক ঝাঁক হাওয়া নিয়ে বসেছে লাল-ঠোঁট পাখি,
অথবা ভাবছ আমাকে, পুরোনো চিঠিগুলো ছুঁয়ে দেখছ, ছবিগুলো।

গা পোড়া রোদ্দুর আর কোথাকার কোন ঘন মেঘ চোখে বৃষ্টি ঝরাচ্ছে তোমার ..
অথবা ভাবা যেত আমি বলে কেউ কোনওদিন কোথাও ছিলাম তুমি ভুলে গেছ,
তবু ভাবা তো যেত।

.

বেঁচে থাকা

।একটি কফিনের ভেতর যাপন করছি আমি জীবন
আমার সঙ্গে একশ তেলাপোকা
আর কিছু কেঁচো।

যাপন করছি জীবন, যেহেতু যাপন ছাড়া কোনও পরিত্রাণ নেই
যেহেতু তেলাপোকাঁদেরও যাপন করতে হবে, কেঁচোগুলোকেও
যেহেতু শ্বাস নিচ্ছি আমি, তেলাপোকা আর কেঁচো
যেহেতু শ্বাস ফেলছি, বেঁচে থাকছি
বেঁচে থাকছি যেহেতু বেঁচে থাকছি।

একটি কফিনের ভেতর কিছু প্রাণী
পরস্পরের দিকে বড় করুণ চোখে তাকিয়ে আছি
আমরা পরস্পরকে খাচ্ছিপান করছি
এবং নিজেদের জিজ্ঞেস করছি, কী লাভ বেঁচে!

না আমি না তেলাপোকা না কেঁচো কেউ এর উত্তর জানি না।

.

স্মৃতিরা পোহায় রোদ্দুর

।কেউ আর রোদে দিচ্ছে না লেপ কাঁথা তোষক বালিশ
পোকা ধরা চাল ডাল, আমের আচার
দড়িতে ঝুলছে না কারও ভেজা শাড়ি, শায়া
একটি শাদা বেড়াল বাদামি রঙের কুকুরের পাশে শুয়ে মোজা পরা
কবুতরের ওড়াওড়ি দেখছে না, কেউ স্নান করছে না জলচৌকিতে বসে তোলা জলে।
কোনও কিশোরী জিভে শব্দ করে খাচ্ছে না নুন লংকা মাখা তেঁতুল
চুলোর পাড়ে বসে কেউ ফুঁকনি ফুঁকছে না,
টগবগ শব্দে বিরুই চালের ভাত ফুটছে না,
কেউ ঝালপিঠে খাবার বায়না ধরছে না কারো কাছে,
উঠোনে কেবল দুই পা মেলে স্মৃতিরা পোহাচ্ছে রোদ্দুর।

ঘাসগুলো বড় হতে হতে সিঁড়ির মাথা ছুঁয়েছে,
একটি পেয়ারাও নেই, একটি ডালিমও, নারকেলের শুকনো ফুল ঝরে গেছে,
লেবু তলায় কালো কালো মৈসাপের বাসা,
জামগাছের বাকল জুড়ে বসে আছে লক্ষ বিচ্ছু
কেউ নেই, স্মৃতিরাই কেবল পোহায় রোদ্দুর।

.

তোমার শরীর, তুমি নেই

একটু সরে শোও, পাশে একটু জায়গা দাও আমাকে শোবার
কত কথা জমে আছে
কত স্পর্শ
কত মৌনতা, মুগ্ধতা।
সেই সব সুদূর পারের কথা শোনাব তোমাকে
শুনতে শুনতে দীর্ঘশ্বাস ফেলবে,
কয়েক ফোঁটা কষ্ট তোমার উদাস দুচোখে বসবে
শুনতে শুনতে হাসবে, হাসতে হাসতে চোখে জল।
ভেবেছিলাম রোদেলা দুপুরে সাঁতার কাটবহাঁসপুকুরে,
পূর্ণিমায় ভিজব, নাচব গাইব।
ভেবেছিলাম যে কথা কোনওদিন বলিনি তোমাকে, বলব।

এখন ডাকলেও চোখ খোলো না
স্পর্শ করলেও কাঁপো না,
এখন এপার ওপার কোনও পারের গল্পই তোমাকে ফেরায় না
নাগালের ভেতর তোমার শরীর, তুমি নেই।

.

খালি খালি লাগে

সেই যে গেলে, জন্মের মত গেলে
ঘর দোর ফেলে।
আমাকে একলা রেখে বিজন বনবাসে
কে এখন ভাল বাসে,
তুমি নেই, কেউ নেই পাশে।

কে এখন দেখে রাখে তোমার বাগান
তুমিহীন রোদ্দুরে গা কারা পোহায়
কে গায় গান পূর্ণিমায়
তুমিহীন ঘরটিতে কি জানি কে ঘুমোয় কে জাগে।
জীবন যায়, যেতে থাকে,
যেখানেই যাই যে পথে বা যে বাঁকে দাঁড়াই
যে ঘাটে বা যে হাটে, বড় খালি খালি লাগে।

.

ঠিক তাই তাই চাই

একটি চমৎকার বাগানঅলা বাড়ির বড় শখ ছিল আমার,
ব্যক্তিগত গাড়ির, এমনকি জাহাজেরও, জলে ভাসার-ওড়ার।
ভালবাসার কারও সঙ্গে নিত্য সংসারের,
আমার সাধ্যের মধ্যে যদিও এখন সব,
আমার সাধ্যের মধ্যে এখন আমার সুখী হওয়া
সুখকে বিষম ঘেন্না এখন
আমি এখন আমার জন্য এমন কিছু চাই না যা দেখলে আনন্দ হত তোমার–
আমার আর ইচ্ছে করে না সমুদ্রের সামনে দাঁড়াতে,
তুমি ইচ্ছে করেছিলে একদিন দাঁড়াবে।

তুমি কিছু হারাচ্ছ না, এই দেখ আমার সারা গায়ে ক্ষত,
স্মৃতির তল থেকে তুলে আনছি মুঠো মুঠো অচেতন মন,
অমল বৃষ্টি থেকে রামধনু থেকে চোখ সরিয়ে রাখি, এই স্যাঁতস্যাঁতে ঘরে বসে
ঠিক তাই তাই চাই, যা দেখলে কষ্ট পেতে, বেঁচে থাকায় ছোবল দিত কালনাগিনী,
আমি অসুস্থ হতে চাই প্রতিদিনই।

.

শিউলি বিছানো পথ

শিউলি বিছানো পথে প্রতিদিন সকালে হাঁটতে হটিতে মনে পড়ে তোমাকে
কী ভীষণ ভালোবাসতে তুমি শিউলি!
একটি ফুলও এখন আর হাতে নিই না আমি, বড় দুর্গন্ধ ফুলে।
আমি হাঁটছি, হেঁটে যাচ্ছি, কিন্তু হেঁটে কোথাও পোঁছোচ্ছি না।
কোথাও পৌঁছব বলে আমি আর পথ চলি না। কোনও গন্তব্য, আগে যেমন ছিল, নেই। অপ্রকতন্থের মত দক্ষিণে উত্তরে পুবেপশ্চিমে হাঁটি,
হাঁটতে হাঁটতে অবশেষে কোথাও ফিরি না আমি।
এখন তো কোথাও কেউ আর আমার জন্য অপেক্ষা করে নেই।
এখন তো এমন কোনও কড়া নেই যে নাড়ব
আর ভেতর থেকে তুমি খুলে দেবে দরজা।
এখন তো কেউ আমাকে বুকে টেনে নেবে না সে আমি যেখান থেকেই ফিরি

শিউলি বিছানো পথে প্রতিদিন বিকেলে হাঁটতে হাঁটতে মনে পড়ে তোমাকে
কী ভীষণ ভালবাসতে তুমি শিউলি।
ফুলগুলো আমি পায়ে পিষে পিষে হাঁটি। তুমি ভালবাসতে এমন কিছু ফুটে আছে কোথাও
দেখলে বড় রাগ হয় আমার।
গোলাপ কী রজনীগন্ধা কী দোলনচাঁপা কী আমি।
এদের আমি দশ নখে ছিঁড়ি,
দাঁতে কাটি, আগুনে পোড়াই। তুমিই যদি নেই, এদের আর থাকা কেন!
তুমি ছিলে বলেইনা গোলাপে সুগন্ধ হত,
তুমি ছিলে বলেই এক একটি সূর্যোদয় থেকে কণা কণা স্বপ্ন বিচ্ছুরিত হত,
তুমি ছিলে বলেই বৃষ্টির বিকেলগুলোয় প্রকৃতির আঙুলে সেতার এত চমৎকার বাজত।
তুমি নেই, বৃষ্টি আর পায়ে কোনও নূপুর পরে না,
স্নান সেরে রুপোলি চাঁদরে গা ঢেকে আকাশে চুল মেলে দিয়ে আগের মত চাঁদও আর গল্প
শোনায় না।

তুমি নেই, কোনও গন্তব্যও নেই আমার। কোনও কড়া নেই, কোনও দরজা।
হেঁটে হেঁটে জীবন পার করি। কাঁধের ওপর বিশাল পাহাড়ের মত তোমার না থাকা।
গায়ে পেঁচিয়ে আছে তোমার না থাকার হাঁ-মুখো অজগর
পায়ের তলায় তোমার না থাকার সাহারা,
পুবে পশ্চিমে দক্ষিণে উত্তরে হাঁটছি আমি, আমার সঙ্গে হাঁটছে বিকট তোমার না থাকা।

যত হাঁটি দেখি পথগুলো তত শিউলি ছাওয়া
তুমি সে যে কি ভালবাসতে শিউলি
কী দরকার আর শিউলি ফুটে, যদি তুমিই নেই!
কী দরকার আর ফুলের সুগন্ধের, তুমিই যদি নেই!

কী দরকার আমার!

.

ঈদুল আরা

ঈদুল আরার বইখাতা ছিঁড়ে নর্দমায় ফেলেছে ঈদুল আরার স্বামী
ঈদুল আরা এখন রাঁধবে বাড়বে, সন্তান জন্ম দেবে।

ঈদুল আরা রাঁধে বাড়ে সন্তান জন্ম দেয়,
তবু ঈদুল আরার মন পড়ে থাকে বইয়ে, ঈদুল আরার দীর্ঘশ্বাস বাতাসে ওড়ে,

কেউ দেখে না
দীর্ঘশ্বাস তো দেখার জিনিস নয়।
ঈদুল আরার স্বামী দীর্ঘশ্বাসও দেখে তৃতীয় নয়নে
ছিঁড়ে দুটুকরো করে নর্দমায় ছুঁড়ে দেয় দীর্ঘশ্বাস
ঈদুল আরা এখন সন্তানকে খাওয়াবে গোসল করাবে ঘুম পাড়াবে।

ঈদুল আরা সন্তানকে খাওয়ায়, গোসল করায়, ঘুম পাড়ায়,
তবু ঈদুল আরার মন পড়ে থাকে দীর্ঘশ্বাসে, ঈদুল আরার দুঃখ বাতাসে ওড়ে,

কেউ দেখে না
দুঃখ তো দেখার জিনিস নয়।
ঈদুল আরার স্বামী তৃতীয় নয়নে এই দুঃখ দেখে না,
নারীর দুঃখ ঈদুল আরার স্বামীর চোখে কেন, দেবতাদের চোখেও পড়ে না।

.

আমার মনুষ্যত্ব

নিজের মাকে কখনও বলিনি ভালবাসি,
অন্যের মাকে বলেছি,
নিজের মার কোনও অসুখ কোনওদিন সারাইনি,
অন্যের মার সারিয়েছি।
নিজের মার জন্য কাঁদিনি, অন্যের মার কষ্টে কেঁদেছি
এই করে করে জগতের কাছে উদার হয়েছি।
তার পাশে কখনও বসিনি, যে ডাকত
একটি হাত ভুলেও কখনও রাখিনি তার হাতে,
একটি চোখ কখনও ফেলিনি সেই চোখে।
সবচেয়ে বেশি যে ভালবাসত, তাকেই বাসিনি
যে বাসেনি, তাকেই দিয়েছি সব, যা ছিল যা না ছিল
এই করে করে মহান হয়েছি,
মানুষের চোখে মানুষ হয়েছি।

.

তুমি একটা কবরে শুয়ে আছো

মা কাঁপছে শীতে, কেউ একটি লেপ পৌঁছে দিচ্ছে না মাকে,
মা’র ক্ষিদে পাচ্ছে, কেউ কোনও খাবারও খেতে দিচ্ছে না,
অন্ধকার গর্তে শ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে মার
একটু আলো পেতে, হাওয়া পেতে, শুকনো জিভে একফোঁটা জল পেতে
কাতরাচ্ছে মা, বেরোতে চাইছে,
কেউ তাকে দিচ্ছে না।
মা ছিল মাটির,
জ্যান্ত মানুষগুলো পাথর।

মা তুমি একটি পাখি হয়ে এই পাথুরে পৃথিবী ছেড়ে
অন্য কোনও গ্রহে কোনও পাখির দেশে চলে যাচ্ছ না কেন!
তোমার সঙ্গে দেখা হবে না আমার, নাহোক।
জানব ভাল আছ।

.
 
পূর্বপশ্চিম

মারগটের বাগান দেখলে আমার মায়ের বাগানটির কথা মনে পড়ে,
আমার মায়ের বাগানও ছিল এরকম
সুগন্ধী ফুলের গাছ, সুস্বাদু ফলের, সবজির
আমার মা যেমন গাছের গোড়ায় জল ঢালতেন, মারগটও ঢালে তেমন।
মারগটের বাগানে চারটে আপেল গাছ, ছোট্ট একটি পুকুর-মত, ওতে পদ্ম ফোটে
আরও একটি বাড়তি জিনিস আমার মার বাগানে ছিল না,
সূর্যঘড়ি।
মার কখনও সময় দেখা হয়নি, মার সময় উড়ে গেছে হাওয়ায়
মার দিনগুলো গেছে, এভাবেই বছরগুলো।
মারগট বাগান করে মারগটের জন্য
আমার মা বাগান করতেন অন্যের জন্য
একটি ফুলের ঘ্রাণও তিনি নিতেন না, একটি ফলের স্বাদও
একটি সবজিও মুখে তুলতেন না।
আমার মা অন্যের জন্য নিজের জীবন যাপন করতেন, নিজের জন্য নয়।
মারগট নিজের জন্য ঘর করে, নিজের জন্য বাগান, নিজের জন্য পদ্ম ফোঁটায় ও,
মারগটের স্বামী সন্তান সব আছে, মার যেমন ছিল।
মারগট নিজের জন্য বাঁচে, মা নিজের জন্য বাঁচেননি।

.

মায়ের কাছে চিঠি

কেমন আছ তুমি? কতদিন, কত সহস্র দিন তোমাকে দেখি না মা, কত সহস্র দিন তোমার
কণ্ঠ শুনি না, কত সহস্র দিন কোনও স্পর্শ নেই তোমার।
তুমি ছিলে, কখনও বুঝিনি ছিলে।
যেন তুমি থাকবেই, যতদিন আমি থাকি ততদিন তুমি–যেন এরকমই কথা ছিল।

আমার সব ইচ্ছে মেটাতে যাদুকরের মত। কখন আমার ক্ষিধে পাচ্ছে, কখন তেষ্টা পাচ্ছে,
কি পড়তে চাই, কী পরতে, কখন খেলতে চাই, ফেলতে চাই, মেলতে চাই হৃদয়, আমি বোঝার
আগেই বুঝতে তুমি।
সব দিতে হাতের কাছে, পায়ের কাছে, মুখের কাছে। থাকতে নেপথ্যে।
তোমাকে চোখের আড়ালে রেখে, মনের আড়ালে রেখে যত সুখ আছে নিয়েছি নিজের
জন্য।
তোমাকে দেয়নি কিছু কেউ, ভালবাসেনি, আমিও দিইনি, বাসিনি।
তুমি ছিলে নেপথ্যের মানুষ। তুমি কি মানুষ ছিলে? মানুষ বলে তো ভাবিনি কোনওদিন,
দাসী ছিলে, দাসীর মত সুখের যোগান দিতে।
যাদুকরের মত হাতের কাছে, পায়ের কাছে, মুখের কাছে যা কিছু চাই দিতে, না চাইতেই
দিতে।
একটি মিষ্টি হাসিও তুমি পাওনি বিনিময়ে, ছিলে নেপথ্যে, ছিলে জাঁকালো উৎসবের বাইরে
নিমগাছতলে অন্ধকারে, একা। তুমি কি মানুষ ছিলে! তুমি ছিলে সংসারের খুঁটি, দাবার ঘুটি,
মানুষ ছিলে না।
তুমি ফুঁকনি ফোঁকা মেয়ে, ধোঁয়ার আড়ালে ছিলে, তোমার বেদনার ভার একাই বইতে
তুমি, তোমার কষ্টে তুমি একাই কেঁদেছ। কেউ ছিল না তোমাকে স্পর্শ করার, আমিও না।
যাদুকরের মত সারিয়ে তুলতে অন্যের অসুখ বিসুখ, তোমার নিজের অসুখ সারায়নি কেউ,
আমি তো নইই, বরং তোমাকে, তুমি বোঝার আগেই হত্যা করেছি।

তুমি নেই, হঠাৎ আমি হাড়েমাংসেমজ্জায় টের পাচ্ছি তুমি নেই। যখন ছিলে, বুঝিনি ছিলে।
যখন ছিলে, কেমন ছিলে জানতে চাইনি। তোমার না থাকার বিশাল পাথরের তলে চাপা পড়ে
আছে আমার দম্ভ।
যে কষ্ট তোমাকে দিয়েছি, সে কষ্ট আমাকেও চেয়েছি দিতে, পারিনি। কি করে পারব বল!
আমি তো তোমার মত অত নিঃস্বার্থ নই, আমি তো তোমার মত অত বড় মানুষ নই।

.

ছিল, নেই

মানুষটি শ্বাস নিত, এখন নিচ্ছে না।
মানুষটি কথা বলত, এখন বলছে না।
মানুষটি হাসত, এখন হাসছে না।
মানুষটি কাঁদত, এখন কাঁদছে না।
মানুষটি জাগত, এখন জাগছে না।
মানুষটি স্নান করত, এখন করছে না।
মানুষটি খেত, এখন খাচ্ছে না।
মানুষটি হাঁটত, এখন হাঁটছে না।
মানুষটি দৌড়োত, এখন দৌড়োচ্ছে না।
মানুষটি বসত, এখন বসছে না।
মানুষটি ভালবাসত, এখন বাসছে না।
মানুষটি রাগ করত, এখন করছে না।
মানুষটি শ্বাস ফেলত, এখন ফেলছে না। .

মানুষটি ছিল, মানুষটি নেই।

দিন পেরোতে থাকে, মানুষটি ফিরে আসে না।
রাত পেরোতে থাকে, মানুষটি ফিরে আসে না।
মানুষটি আর মানুষের মধ্যে ফিরে আসে না।
মানুষ ধীরে ধীরে ভুলে যেতে থাকে যে মানুষটি নেই,
মানুষ ধীরে ধীরে ভুলে যেতে থাকে যে মানুষটি ছিল।

মানুষটি কখনও আর মানুষের মধ্যে ফিরে আসবে না।
মানুষটি কখনও আর আকাশ দেখবে না, উদাস হবে না।
মানুষটি কখনও আর কবিতা পড়বে না, গান গাইবে না।
মানুষটি কখনও আর ফুলের ঘ্রাণ শুঁকবে না।
মানুষটি কখনও আর স্বপ্ন দেখবে না।
মানুষটি নেই।
মানুষটি মাটির সঙ্গে মিশে গেছে, মানুষটি ছাই হয়ে গেছে, মানুষটি জল হয়ে গেছে।
কেউ বলে মানুষটি আকাশের নক্ষত্র হয়ে গেছে।
যে যাই বলুক, মানুষটি নেই।
কোথাও নেই। কোনও অরণ্যে নেই, কোনও সমুদ্রে নেই।
কোনও মরুভূমিতে নেই, লোকালয়ে নেই, দূরে বহুদূরে একলা একটি দ্বীপ, মানুষটি ওতেও
নেই।
পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্ত তন্ন তন্ন করে খুঁজলেও আর যাকে পাওয়া যাক,
মানুষটিকে পাওয়া যাবে না।
মানুষটি নেই।

মানুষটি ছিল, ছিল যখন, মানুষটিকে মানুষেরা দুঃখ দিত অনেক।
মানুষটি ছিল, ছিল যখন, মানুষটির দিকে মানুষেরা ছুঁড়ে দিত ঘৃণা।
মানুষটি ছিল, ছিল যখন, মানুষটিকে ভালবাসার কথা কোনও মানুষ ভাবেনি।
মানুষটি যে মানুষদের লালন করেছিল, তারা আছে, কেবল মানুষটি নেই।
বৃক্ষগুলোও আছে, যা সে রোপণ করেছিল, কেবল মানুষটি নেই।
যে বাড়িতে তার জন্ম হয়েছিল, সে বাড়িটি আছে।
যে বাড়িতে তার শৈশব কেটেছিল, সে বাড়িটি আছে।
যে বাড়িতে তার কৈশোর কেটেছিল, সে বাড়িটি আছে।
যে বাড়িতে তার যৌবন কেটেছিল, সে বাড়িটি আছে।
যে মাঠে সে খেলা খেলেছিল, সে মাঠটি আছে।
যে পুকুরে সে স্নান করেছিল, সেপুকুরটি আছে।
যে গলিতে সে হেঁটেছিল, সে গলিটি আছে।
যে রাস্তায় সে হেঁটেছিল, সে রাস্তাটি আছে।
যে গাছের ফল সে পেড়ে খেয়েছিল, সে গাছটি আছে।
যে বিছানায় সে ঘুমোতো, সে বিছানাটি আছে।
যে বালিশে সে মাথা রাখত, বালিশটি আছে।
যে কাঁথাটি সে গায়ে দিত, সে কাঁথাটি আছে।
যে গেলাসে সে জল পান করত, সে গেলাসটি আছে।
যে চটিজোড়া সে পরত, সে চটিজোড়াও আছে।
যে পোশাক সেপরত, সে পোশাকও আছে।
যে সুগন্ধী সে গায়ে মাখত, সে সুগন্ধীও আছে।
কেবল সে নেই।
যে আকাশে সে তাকাত, সে আকাশটি আছে
কেবল সে নেই।
যে বাড়ি ঘর যে মাঠ যে গাছ যে ঘাস যে ঘাসফুলের দিকে সে তাকাত, সব আছে
কেবল সে নেই।

মানুষটি ছিল, মানুষটি নেই।

.

না-থাকা

একটি ভীষণ না-থাকাকে সঙ্গে নিয়ে আমি প্রতি রাত্তিরে ঘুমোতে যাই;
ঘুমোই, ঘুম থেকে উঠি, কলঘরে যাই-না-থাকাটি সঙ্গে থাকে।

দিনের হই চই শুরু হয়ে যায় দিনের শুরুতেই,
একশ একটা লোকের সঙ্গে ওঠাবসা–
এই কর সেই করব দৌড়োদৌড়ি–
লেখালেখি–
এ কাগজ পাচ্ছি তো ও কাগজ গেল কই!
হাটবাজার, খাওয়াখাদ্যি, সব কিছুর মধ্যে ওই না-থাকাটি থাকে।

সন্ধেবেলা থিয়েটারে
রেস্তোরাঁ বা ক্যাফের আড্ডার হুল্লোড়ে, হাসিতে
এ বাড়িতে ও বাড়িতে অভিনন্দনে, আনন্দে
ছাদে বসে থাকায়, বসে চাঁদ দেখায়
দেখে চুমু খাওয়ায়,
নিভৃতে থাকে, না-থাকাটি থাকে।

যখন ভেঙে আসি,
বই গড়িয়ে পড়েছে, চশমাটিও–
হেলে পড়াশরীরটিকে আলতো ছুঁয়ে
মাঝরাত্তিরে চুলে বিলি কেটে কেটে না-থাকাটি বলে,
‘মা গো, বড় ক্লান্ত তুমি, এবার ঘুমোতে যাও।’

.

যেও না

যেও না। আমাকে ছেড়ে তুমি এক পাও কোথাও আর যেও না।
গিয়েছো জানি, এখন উঠে এসো। যেখানে শুয়ে আছো,
যেখানে তোমাকে শুইয়ে দেওয়া হয়েছে।
সেখান থেকে লক্ষ্মী মেয়ের মত উঠে এসো।
থাকো আমার কাছে, যেও না। কোথাও আর কোনওদিন যেও না।
কেউ নিতে চাইলেও যেও না।
রঙিন রঙিন লোভ দেখিয়ে কত কেউ বলবে, এসো। সোজা বলে দেবে যাবো না।
সারাক্ষণ আমার হাতদুটো ধরে রাখো,
সারাক্ষণ শরীর স্পর্শ করে রাখো,
কাছে থাকো, চোখের সামনে থাকো,
নিঃশ্বাসের সঙ্গে থাকো,
মিশে থাকো।
আর কোনওদিন কেউ ডাকলেও যেও না।
কেউ ভয় দেখালেও না।
হেঁচকা টানলেও না।
ছিঁড়ে ফেললেও না।
যেও না।
আমি যেখানে থাকি, সেখানে থাকো, সারাক্ষণ থাকো।
আবার যাপন করো জীবন,
যেরকম চেয়েছিলে সেরকম জীবন তুমি যাপন করো আবার।
হাত ধরো, এই হাত থেকে কাঁড়ি কাঁড়ি সুখ তুলে নাও।
আমাকে বুকে রাখো, আমাকে ছুঁয়ে থাকো, যেও না।
তোমাকে ভালোবাসবো আমি, যেও না।
তোমাকে খুব খুব ভালোবাসবো, যেও না।
কোনওদিন আর কষ্ট দেব না, যেও না।
চোখের আড়াল করবো না কোনওদিন, তুমি যেও না।
তুমি উঠে এসো, যেখানে ওরা তোমাকে শুইয়ে দিয়েছে,
সেখানে আর তুমি শুয়ে থেকো না,
তুমি এসো, আমি অপেক্ষা করছি, তুমি এসো।
তোমার মুখের ওপর চেপে দেওয়া মাটি সরিয়ে তুমি উঠে এসো,
একবার উঠে এসো, একবার শুধু।
আমি আর কোনওদিন কোথাও তোমাকে একা একা যেতে দেব না।
কথা দিচ্ছি, দেব না।
তুমি উঠে এসো।
তোমাকে ভালোবাসবো, উঠে এসো।

.

ছিলে

একটু আগে তুমি ছিলে, ভীষণরকম ছিলে, নদীটার মত ছিলে, নদীটা তো আছে,
পুকুরটা আছে, খালটা আছে।
এই শহরটার মত, ওই গ্রামটার মত ছিলে। ঘাসগুলোর মত, গাছগুলোর মত।
ছিলে তুমি, হাসছিলে, কথা বলছিলে, ধরা যাক কাঁদছিলেই,
কিন্তু কাঁদছিলে তো, কিছু একটা তো করছিলে, যা কিছুই করো না কেন, ছিলে তো!
ছিলে তো তুমি, একটু আগেই ছিলে।

কিছু ঘটলো না কোথাও, কিছু হলো না, হঠাৎ যদি এখন বলো যে তুমি নেই!
কেউ এসে আমাকে ঘুম থেকে ডেকে তুলে বলে যে তুমি নেই,
বসে আছি, লিখছি বা কিছু, রান্নাঘরে লবঙ্গ আছে কি না খুঁজছি,
আর অমনি শুনতে হল
তুমি নেই। তুমি নেই, কোথাও নেই, তুমি নাকি একেবারে নেইই,
তোমাকে নাকি চাইলেই আর কোনওদিন দেখতে পাবো না!
আর কোনওদিন নাকি কথা বলবে না, হাসবে না, কাঁদবে না, খাবে না, দাবে না,
ঘুমোবে না, জাগবে না, কিছুই নাকি আর করবে না!

যত ইচ্ছে বলে যাও যে তুমি নেই, যত ইচ্ছে যে যার খুশি বলুক,
কোনও আপত্তি নেই আমার, কেন থাকবে, আমার কী! তোমাদের বলা না বলায়
কী যায় আসে আমার! আমার শুধু একটাই অনুরোধ,
করজোড়ে একটা অনুরোধই করি,
আমাকে শুধু বিশ্বাস করতে বোলো না যে তুমি নেই।

.

ফিরে এসো

কোনও একদিন ফিরে এসো, যে কোনও একদিন, যেদিন খুশি
আমি কোনও দিন দিচ্ছি না, কোনও সময় বলে দিচ্ছি না, যে কোনও সময়।
তুমি ফিরে না এলে এই যে কী করে কাটাচ্ছি দিন
কী সব কাণ্ড করছি,
কোথায় গেলাম, কী দেখলাম
কী ভালো লেগেছে, কী না লেগেছে–কাকে বলবো!
তুমি ফিরে এলে বলবো বলে আমি সব গল্পগুলো রেখে দিচ্ছি।
চোখের পুকুরটা সেচে সেচে খালি করে দিচ্ছি, তুমি ফিরে এলে যেন
এই জগৎসংসারে দুঃখ বলে কিছু না থাকে।
তুমি ফিরে আসবে বলে বেঁচে আছি, বেঁচে থেকে যেখানেই যা কিছু সুন্দর পাচ্ছি, দেখে
রাখছি,
তুমি এলেই সব যেন তোমাকে দেখাতে পারি।
যে কোনও একদিন ফিরে এসো, ভর দুপুরে হোক, মধ্যরাত্তিরে হোক–
তোমার ফিরে আসার চেয়ে সুন্দর এই পৃথিবীতে আর কিছু নেই।
বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডের সমস্ত সুন্দর জড়ো করলেও
তোমার এক ফিরে আসার সুন্দরের সমান হবে না।
ফিরে এসো,
যখন খুশি।
নাও যদি ইচ্ছে করে ফিরে আসতে,
তবু একদিন এসো, আমার জন্যই না হয় এসো,
আমি চাইছি বলে এসো,
আমি খুব বেশি চাইছি বলে।
আমি কিছু চাইলে কখনও তো তুমি না দিয়ে থাকোনি!

মা, বিশ্বাস করো, একটি কবিতাও বানিয়ে লেখা নয়। প্রতিটি কবিতা লিখতে লিখতে চোখের জল ঝরেছে। তুমি দেখনি অনুতাপের ভয়াবহ আগুনে কী ভীষণ পুড়ছি আমি, এখনও পুড়ি। তোমার কথা আমি কোথাও, আত্মীয় স্বজনের সঙ্গে, বা বন্ধুদের সঙ্গে উচ্চারণ করি না। তুমি বুকের ভেতরে থাকো। অপরাধবোধ থেকে, পশ্চিমের অনেক বন্ধুই বলেছে মুক্তি পাওয়া উচিত আমার। কারণ এই বোধটি খুব ক্ষতিকর। তুমি জানো না, চোখে আমার জল কত ছিল তোমার জন্য। জগৎটাই এখন বড় খালি খালি লাগে। একটু যদি কোথাও থেকে দেখতে পেতে, একটুও যদি ভালো লাগতো তোমার, একটু যদি শান্তি পেতে, যে শান্তি তোমার কোনওদিন পাওয়া হয়নি! আমার চোখে তোমার জন্য কোনওদিন তো জল দেখোনি। একবার শুধু দেখেছিলে মা, নাকি দুবার। জল তো কত এখন চোখে, তুমি কি দেখতে পাও!

এগুলোর পর আর কি কোনও কবিতা তোমাকে নিয়ে লিখেছি! নতুন কবিতার বইয়ে মাত্র একটি কবিতা। সম্ভবত ধীরে ধীরে তোমাকে ভুলে যাচ্ছি মা। হয়তো তোমাকে এখন আগের চেয়ে কম মনে পড়ে। আগের চেয়ে চোখের জলও ফেলি কম। আগে যেমন প্রতিরাতে স্বপ্ন দেখতাম তোমাকে, একটি স্বপ্নই দেখতাম, স্বপ্নটি অনেকদিন আর দেখি না। নতুন বইয়ের কবিতাটাও লিখে দিলাম, পড়ো।

আশ্চর্য একটা গাছ দেখি পথে যেতে যেতে, যে গাছে সারা বছর শিউলি ফোটে।
গাছটার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে চোখে জল উপচে ওঠে,
শিউলি পড়ে শীত গ্রীষ্ম বর্ষা সাদা হয়ে থাকে মাঠ।
তার কথা মনে পড়ে, শিউলির মালা গেঁথে গেঁথে
শীতের সকালগুলোয় দিত,
দুহাতে শিউলি এনে পড়ার টেবিলে রেখে চলে যেত।
শীত ফুরিয়ে গেলে দীর্ঘ দীর্ঘ শ্বাস ফেলতে, তাকে মনে পড়ে।
একবার যদি দুনিয়াটা এরকম হতে পারতো যে নেই সে আসলে আছে,
একবার যদি তাকে আমি কোথাও পেতাম, কোনওখানে,
তার সেই হাত, যে হাতে শিউলির ঘ্রাণ এখনও লেগে আছে,
এখনও হলুদ জাফরান রং আঙুলের ফাঁকে, ছুঁয়ে থাকতাম,
মুখ গুঁজে রাখতাম সেই হাতে।
সেই হাত ধরে তাকে নিয়ে যেতাম নতুন গাছটার কাছে,
মালা গেঁথে গেঁথে তাকে পরাতাম, যত ফুল আছে তুলে
বৃষ্টির মতো ছড়াতাম তার গায়ে।

দুনিয়াটা যদি এরকম হয় আসলে সে আছে,
শিউলির ঋতু এলে কোনও একটা গাছের কাছে সে যাবে,
মালা গেঁথে মনে মনে কাউকে পরাবে, দুহাতে শিউলি নিয়ে
কারও পড়ার টেবিলে চুপচাপ রেখে দেবে,
তাহলে পথে যেতে যেতে যে গাছটা দেখি, সেটায়
হেলান দিয়ে আমি দাঁড়িয়ে থাকবো, যতদিন ফুল ফোটে ততদিন।

তুমি শিউলি ভালোবাসতে খুব মা। শিউলি ফুল দেখলেই তাই তোমাকে মনে পড়ে। বুক ফেটে যায়। এই বোবা কষ্টের কোনও নাম নেই মা। আমি এই কষ্টের হাত থেকে নিজেকে বাঁচাতে পারি না। আমি আত্মায় বিশ্বাস করি না, তুমি তো জানো। আমি পরকালে বিশ্বাস করি না। যে হাশরের ময়দানের কথা ভেবে তুমি শিউরে উঠতে, সেই হাশরের ময়দানেও আমার বিশ্বাস নেই। কিন্তু প্রাণপণে আমি এখন বিশ্বাস করতে চাই ওসবে। আমার মতো সুখী আর কেউ হবে না যদি আমি দেখি যে আসলে আল্লাহ বলে কেউ কোথাও আছেন, আমার মতো সুখী আর কেউ হবে না যদি দেখি আখেরাত বলে, পুলসেরাত বলে কিছু আছে। যদিও জানি ওসবের অস্তিত্ব নেই, যদিও আমি ভীষণ ভাবে বিবর্তনে, বিজ্ঞানে বিশ্বাসী, তারপরও আমি চাই বিজ্ঞান মিথ্যে হোক, ধর্ম সত্যি হোক। আমি আমার সমস্ত জীবন দিয়ে চাই, আমার সমস্ত লেখা আমার সমস্ত বিশ্বাস, আমার দর্শন ধসে যাক ভূমিকম্পে যেমন ধসে যায় ইমারত। আমি চাই, তুমি সুখী হও, তুমি বেহেস্তবাসী হও, আমি চাই তুমি সুখভোগ করো। এই কামনাই এখন আমার জীবনের সবচেয়ে বড় সত্য। আমি চাই আমি মিথ্যে হই, আমি ভুল হই, তুমি সত্য হও, তোমার এতদিনকার ইবাদত সত্য হোক, তোমার স্বস্তি হোক। আমি চাই অনন্তকাল তুমি আনন্দ করো।

.

মা

অনেকে আমার মা হতে চেয়েছে, অনেকে বাবা
অনেকে মামা কাকা খালা ফুপু
অনেকে সেসব বন্ধু, যাদের হারিয়েছি।

চেষ্টা চরিত্তির করে অনেকে বাবা হয়েছে অনেকটাই
কষ্টেসৃষ্টে মামা কাকা খালা ফুপু।
অনেকে বন্ধু হয়েছে নিমেষেই, কায়ক্লেশে নয়।
মা হতে অনেকে চেষ্টা করেছিল, মা হতে সেই অনেকের পর
আরও অনেকে চেষ্টা করেছিল
সেই আরও অনেকেরপর আরও অনেকে। দিনের পর দিন অকথ্য পরিশ্রম
করেছিল মা হতে তবু কেউ মা হতে পারেনি
ছিটেফোঁটা মা কেউ হতে পারেনি
এক ফোঁটা মা কেউ হতে পারেনি।
এক বিন্দু মা হতে পারেনি।
 

Users who are viewing this thread

Back
Top