০৪. ছোট ছোট দুঃখ কথা
মার কোনও কিছু বাবার পছন্দ না হলেও মার বলা একটি ছড়া বাবার খুব পছন্দ। মন ভাল থাকলে মাকে তিনি ছড়াটি বলতে বলেন। মা হেসে দুলে দুলে বলেন,
এক পয়সার তৈল,
কিসে খরচ হৈল,
তোমার দাড়ি আমার পায়,
আরও দিলাম ছেলের গায়,
ছেলেমেয়ের বিয়ে হল,
সাতরাত গান হল,
কোনও অভাগী ঘরে গেল,
বাকি তেলটুক নিয়ে গেল।
মার উড়োখুড়ো চুল, তেল সাবান পড়ে না চুলে। ফিনফিনে চুলগুলো পেছনে দড়ি দিয়ে বেঁধে রাখেন, ফিতে জোটে না সবসময়। আমাদের, আমার আর ইয়াসমিনের চুলের ফিতে পুরোনো হয়ে গেলে তা দিয়ে বাঁধেন, তাও না থাকলে দড়ি। গোসল করে ভেজা চুলও পেছনে বেঁধে রাখেন, চুল ঝরে পড়ে আরও। মার ঘন দীর্ঘ কেশ ছিল এককালে, এখন নেই। নেই বলে আফসোস করেন, কিন্তু যা আছে তা হেলাফেলায় ঝরে, তিনি ফিরে তাকান না। মা যখন আমাকে আমার চুলের যত্ন নিতে বলেন, আমি বলি, আর যত্ন কইরা কি হইব, চুল ত তোমার চুলের মত হইছে, পাতলা। নিজের ছোট চোখ নিয়েও দুঃখ করে বলি, ইয়াসমিনের চোখ কত সুন্দর, বাবার চোখ পাইছে। আমার গুলা হইছে তোমার চোখের মত। নাক নিয়েও কথা, নাকটা খাড়া হইল না। হইব কেমনে, তোমার নাক পাইছি ত! যেটুকু ফর্সা হয়েছি তা বাবার কারণে, যেটুকু কালো তা মার কারণে। শরীরের যা কিছু খুঁত, তা সব মার কাছ থেকে পাওয়া, এরকমই এক বিশ্বাস আমার গভীরে ক্রমশ প্রবেশ করতে থাকে। ভাগ্য ভাল যে বাবার থুতনি পাইছি। থুতনির মধ্যে একটা ভাঁজ আছে, মেয়েরা কয় এইডা আছে বইলা আমারে সুন্দর লাগে দেখতে। বাবার কিছু পাইছি বইলা মাইনষের মত দেখতে লাগে। একদিন মার দিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে বলি, মা তোমার গলা কই?
গলা কই মানে?
তোমার ত গলা নাই। তোমার থুতনি সোজা নাইমা গেছে বুকে। আর তোমার কাধঁ ও ত নাই, ব্লাউজও তাই পিছলাইয়া পইরা যায়।
শরীরের অঙ্গ প্রত্যঙ্গ সম্পর্কে মন্তব্য সংসারে নতুন নয়। বুদ্ধি হওয়ার পর থেকে দেখে আসছি শরীরের কোন অঙ্গ দেখতে কেমন, চোখ নাক কান ঠোঁট, শরীরের দৈর্ঘ্য প্রস্থ, ত্বকের রং ইত্যাদি নিয়ে আত্মীয়দের গভীর আলোচনা এবং তুলনা। বাড়িতে কেউ বেড়াতে এলেও তা্ই হয়, অনেকদিন পর হয়ত আমাকে কেউ দেখলেন, দেখেই বলেন বাহ মেয়ে তো বেশ লম্বা হইতাছে। বাপের মত গড়ন পাইছে। অথবা কি ব্যাপার এত কালা হইতাছে কেন ও! চোখ নাক কানের দিকেও তীক্ষ ্ন দৃষ্টি ছুঁড়ে মন্তব্য করেন কোনটি ভাল কোনটি মন্দ, বাবার মত নাকি মার মত, নাকি মার বংশের বা বাবার বংশের কারও মত। মাও বলেন, ইয়াসমিনের হাত পাগুলা ওর ফুপুদের মত হইছে। রুনুখালা ঢাকা থেকে বেড়াতে এসে আমার দিকে তাকিয়ে বলেন ইস চোখগুলা এক্বেবারে বড়বু। চুলগুলা তো বড়বুই। মা নিঃশব্দে অনেকক্ষণ শরীরের খুঁত নিয়ে আমাদের খুঁতখুঁতুনি আর অভিযোগ শুনে বলেন, হ আমি ত পচা। আমি কালা। দেখতে খারাপ। তরা ত সুন্দর। তরা সুন্দর হইয়া থাক।
বাড়িতে গোসলের সাবান এলে মা তা ছেলেমেয়েদের জন্য রাখেন, নিজের জন্য জোটে না। গা থেকে গন্ধ বেরোলে কাপড় ধোয়ার সাবান দিয়ে গোসল সারেন। মাস চলে যায়, বাবা নারকেল তেল পাঠান না। খড়ি নেই, মা চুলো ধরান নারকেলের পাতা আর ডাল শুকিয়ে। এগুলোতে আগুন ভাল ধরে না কিন্তু বাবা সাফ সাফ বলে দিয়েছেন, নারকেলের ডাউগ্যা আর পাতা পুতা দিয়াই রানতে হবে। খড়ির দাম অনেক। খড়ির দাম অনেক বলে মাকে গাছ থেকে পড়া পাতা জড়ো করে রাখতে হয়। ডাবঅলা রশিদ এসে তাড়া খাওয়া কাঠবেড়ালির মত দ্রুত উঠে যায় নারকেল গাছে, দড়ি বেঁধে ডাব নারকেল মাটিতে ফেলার পর গাছগুলো সাফ করে দেয় বিনে পয়সায়। বাড়ির ডাব কিনে নিয়ে বাজারে লাভে বিক্রি করার কাজ রশিদের। রশিদ তিন চার মাস পর পর আসে এ বাড়িতে ডাব কিনতে। উঠোনে মাঠে নারকেল পাতার সপ্তূ হয়ে থাকে রশিদ গাছ পরিষ্কার করে যাওয়ার পর। সেইসব বিশাল বিশাল নারকেলের ডাউগ্যার কিনারে বটি নিয়ে বসে মা একটি একটি করে শলা বের করে উঠোন ঝাঁট দেবার, পায়খানা পরিষ্কার করবার, বিছানার ময়লা তাড়াবার ঝাঁটা বানিয়ে শলাহীন পাতা আর ডাউগ্যা কেটে জড়ো করে রাখেন। বৃষ্টি এলে উঠোনে শুকোতে দেওয়া নারকেলের ডাল পাতা, কাঁঠাল পাতা,আমপাতা, জামপাতা সব দৌড়ে দৌড়ে রান্নাঘরের বারান্দায় তোলেন। মার ছেঁড়া শাড়ি আরও ছিঁড়তে থাকে। মার বিছানার পুরোনো তোশক ছিঁড়ে শক্ত শক্ত জমা তুলো বেরিয়ে গেছে, তোশকের একদিকে ভারি, আরেক দিকে হালকা, শুলে মনে হয় রেললাইনের পাথরের ওপর শুয়েছি। একটি নতুন তোশকের কথা অনেকদিন ধরে বলছেন মা, কিন্তু মার বলায় কার কি আসে যায়! মার মশারির ছিদ্রগুলো বড়, আমাদের মশারিতে ছিদ্র নেই বললে ঠিক হবে না, আছে, তবে ছোট। আমাদের মশারির ছিদ্রগুলো বুজে দিয়েছেন মা। বড় ছিদ্র বোজা সম্ভব হয় না, মার গায়ে মশার কামড়ের দাগ ফুটে থাকে প্রতিদিন। মা একটি নতুন মশারির কথা কয়েক বছর ধরে বলেন, বাবা রা করেন না। মশারি যখন আসে শেষ অবদি, সেটি আমাদের খাটে টাঙিয়ে নিজে তিনি পুরোনো ছিদ্রঅলা মশারি টাঙান নিজের খাটে।
বাড়িতে রান্না হচ্ছে, একদিন নুন আছে তো আরেকদিন পেঁয়াজ নেই, পেঁয়াজ আছে হলুদ নেই, হলুদ আছে তো তেল নেই। নেই শুনলেই বাবা ধমকে ওঠেন, পরশুদিন না তেল কিইন্যা দিলাম, তেল গেছে কই?
রান্ধায় লাগছে।
দুইদিনের রান্ধায় এক বোতল তেল শেষ হইয়া যাইব?
দুইদিন না, দুই সপ্তাহ আগে তেল কিনা হইছিল।
দুই সপ্তাহেই বা এক বোতল শেষ হইল কেমনে?
কম রান্ধা?
রান্ধা বন্ধ কইরা দেও। দরকার নাই রান্ধার আর।
আমার লাইগা চিন্তা করি না। পুলাপান কি খাইব?
পুলাপানের খাওন লাগব না। পুলাপান আমারে সুখ দিয়া উল্ডাইয়া দিতাছে। এমন পুলাপান থাকার চেয়ে না থাকা ভাল।
মার জীবন আমাকে কোনও রকম আকর্ষণ করে না, করে বাবার জীবন। বাবার ক্ষমতা অনেক, বাবা ইচ্ছে করলে আমাদের সবকটাকে উপোস রাখতে পারেন, ইচ্ছে করলে সবকটাকে ভরপেট সখু দিতে পারেন। ইচ্ছে করলে সারা বাড়িকে ভয়ে তটস্থ করে রাখতে পারেন, ইচ্ছে করলে হেসে কথা বলে সবাইকে অমল আনন্দ দিতে পারেন। মার ইচ্ছেতে সংসারের কিছুই হয় না। মার জগতটি খুব ছোট। ছেঁড়া শাড়ি ছেঁড়া মশারি ছেঁড়া লেপ ছেঁড়া তোশক আর মাটির চুলোয় ফুঁকনি ফোঁকা তেল হীন সাবানহীন জীবন মার। এই জীবন নিয়ে তিনি দৌড়োন পীর বাড়ি, কখনও কখনও নানির বাড়ি। এ দুটো বাড়ি ছাড়া মার আর কোনও বাড়ি নেই যাওয়ার। বাড়িতে মার নিয়মিত অতিথি বলতে এক নানা। নানা যখন দুপুরবেলার দিকে আসেন, মা নানাকে গা মেজে গোসল করিয়ে ভাত খাইয়ে বিছানায় শুইয়ে দেন। বাবা বাড়ি আসার আশংকা না থাকলেই নানাকে খেতে বসান মা। আমরাও যদি দেখে ফেলি নানা খাচ্ছেন, মা অপ্রস্তুত হন, কিছু বলার আগেই তিনি বলেন, আমার ভাগেরটা বাজানরে খাওয়াইতাছি। বাড়িতে তো পীরবাড়ির কেউ আসেই না আর, ওরা আর যে বাড়িতেই যাক, কোনও কাফেরের বাড়িতে যাবে না। বাড়িতে কোনও মামা খালা এলে বাবা কটমট করে তাকান। বাবা যে ওদের কারও আসা পছন্দ করেন না, সে মা কেন, আমরা সবাই বুঝি। মার আত্মীয় কেউ বাড়ি এলে বাবা কাজের মানুষকে আড়ালে ডেকে নিয়ে জানতে চান, মা কিছু দিয়েছেন কি না ওদের হাতে। কিছু খাইয়েছেন কি না, খাওয়ালে কি খাইয়েছেন, এসব। কাজের মানুষও বোঝে, এ বাড়িতে মার আত্মীয়রা অনাকাঙ্খিত ছটকু পীর বাড়িতে ঢুকে নতুন মুন্সি হয়েছে। ইয়া লম্বা পাঞ্জাবি আর টুপি পরে একদিন এসেছিল অবকাশে, বাবা ঘাড় ধাককা দিয়ে বের করে দিয়েছেন। মার জগতের মানুষেরা যখন এ বাড়িতে নিগৃহীত হতে থাকে, মা একা হয়ে যান। তিনি তাঁর জগত বাড়াতে থাকেন পশুপাখিতে। মার শখ হয় মুরগি পালার। বাবার কাছে মার আবদার প্রতিদিনই চলতে থাকে, বাবার হাত পা পিঠ সর্ষের তেল মেখে টিপে দিতে দিতে। বাবা অবশ্য একে আবদার বলেন না, বলেন ঘ্যানর ঘ্যানর। কেন, মুরগি দিয়া কি হইব? মুরগি ডিম পাড়ব, সেই ডিম পুলাপান খাইতে পারব, ডিম ফুইটা বাচ্চা হইব, সেই বাচ্চা বড় হইব। মার স্বপ্ন শেষ অবদি সফল হয়, এক মুরগি থেকে দশ মুরগি হলে যে বাবারই লাভ, তা যখন তিনি বুঝলেন, চারটে মুরগি কিনে দিলেন মাকে। মা সেই মুরগিগুলোর জন্য নিজে হাতে খোঁয়াড় বানালেন। সকালে উঠে খোঁয়াড় খুলে মুরগিদের খুদ কুঁড়ো খেতে দেন। উঠোন জুড়ে মুরগি হেঁটে বেড়ায়, হেগে বেড়ায়। মা অপেক্ষা করেন, মুরগি একদিন ডিম দিতে বসবে। বাবার খাটের তলায় চটের ওপর বিছানো পেঁয়াজ থাকে, আলু থাকে। সেই পেঁয়াজ আলুর পাশে মা একটি ডালা পেতে দিলেন, খড় বিছানো সেই ডালায় লাল একটি মুরগি সারাদিন বসে থাকে। একদিন দেখি ঘর বারান্দা উঠোন জুড়ে একটি মা মুরগির পেছনে অনেকগুলো বাচ্চা মুরগি হাঁটছে। বাচ্চাগুলো দেখতে এত সুন্দর, হাতে নিতে ইচ্ছে করে। হাতে নিলে মা বলেন বাচ্চা বড় হবে না। মার খুশি উপচে পড়ে মুরগির বাচ্চাগুলো দেখে। কিন্তু বারোটা বাচ্চা মা গুনে গুনে খোঁয়াড়ে তোলেন, দেখা যায় পরদিন দুটো বাচ্চা নেই। উঠোনে মা মুরগির পেছনে যখন হাঁটছিল, এক ফাঁকে চতুর বেজি ধরে নিয়ে খেয়েছে। টিনের ঘরের পেছনে কোনও এক গর্তে বেজি থাকে, হঠাৎ হঠাৎ ওদের দৌড়োতে দেখি। মার ইচ্ছে হয় হাঁস পালতে। বাবা হাঁসের বেলাতেও দাঁত খিঁচিয়ে বলেন, আবার হাঁস কেন? হাঁস যে কেন, মাকে তাও বোঝাতে হয় অনেক সময় নিয়ে। বাবা নাকচ করে দিলেন মার প্রস্তাব। মা নানার কাছে পাড়লেন। নানা দুটো হাঁস কিনে নিয়ে এলেন। শাদা হাঁস, বাদামি হাঁসি। বাড়িতে যখন হাঁস এল, বারোটি মুরগির বাচ্চার মধ্যে দুটি কেবল বেঁচে আছে। বাকিগুলো অসুখে, কুকুরে আর বেজিতে ফুরিয়েছে। হাঁসি ডিম দিল। সে ডিমের ওপর মা লাল মুরগিটিকে বসিয়ে দিলেন। ডিম ফুটে বাচ্চা বেরোলো হাঁসের। হাঁস যায় বিলে সাঁতার কাটতে। রান্নাঘরের পেছন দিকে বাড়িঘেরা দেয়ালে মেথর আসার ছোট্ট কাঠের দরজাটি পেরোলেই বাঁদিকে প্রফুল্লর বাড়ির পায়খানা, ডানে কচুরিপানায় ঠাসা ঘোলা জলাশয়, একে পুকুর বললেও অতিরিক্ত হয়, বিল বললেও আসলে ঠিক মানায় না কিন্তু এটি বিলই, একধরণের বিল, মাছহীন ময়লা কাদা সাপ জোঁকের বিল। হাঁসের বাচ্চাগুলো মুরগির বাচ্চার সঙ্গে সঙ্গে হাঁটে, একরকম দেখতে, রংও একই রকম হলুদ। কোনটি হাঁসের, কোনটি মুরগির ঠিক ঠাহর করা যায় না। হাঁস মুরগি বেশি দিন টেকেনি মার।ডিম ভেজে দিতে হয় বাড়ির মানুষকে। মুরগির বাচ্চা খানিকটা বড় হলেই দাদা বলেন, বেজিই তো খাইয়া ফেলব, তার চেয়ে বেশি কইরা পিঁয়াজ দিয়া আমার লাইগা একটা মুরগি ভুনা কইরা দেন মা। মা মুরগি রাঁধেন আর আড়ালে চোখের জল মোছেন। বাড়িতে অতিথি এল, কি খাওয়ানো যায়? কিছুই তো নাই, ঠিক আছে, মুরগি জবো করা হোক। মা উঠোনে খেলতে থাকা মুরগিরগুলোর দিকে স্বপ্ন-চোখে তাকিয়ে বলেন,পালা মুরগি আবার জবো করে কেমনে? দাদা বলেন, গলাডার মধ্যে আল্লাহু আকবর কইয়া বটির পুচ মাইরা জবো করে মা। এক্কেবারে সোজা। শেষ অবদি মার পালা মুরগি দাদার রসনা তৃপ্ত করতে, আমাদের পেট ভরাতে আর অতিথি আপ্যায়নে ব্যবহার হতে থাকে। মা পালা মুরগি বা হাঁসের একটি টুকরোও মুখে দেন না, আলু ভর্তা করে খেয়ে ওঠেন। হাঁস মুরগির খোঁয়াড় খাঁ খাঁ করে মাস না যেতেই। কেবল হাঁস মুরগি নয়, মার গাছের লাউ, সীম, কুমড়ো, ফুলকপি বাধাঁকপি, টমেটো, পুঁইশাক খেতে থাকি আমরা। চাল ডাল তেল নুন ছাড়া বাজার থেকে মাস যায় বছর যায় তেমন কিছু আনার প্রয়োজন হয় না। বাবার খরচ বাঁচান মা। ছেঁড়া শাড়ি, উড়ো চুল, রুখো ত্বকের মা সংসারে আয়ের পথ খোলা রেখেছেন। বাবা বাড়িতে যে ফলই নিয়ে আসেন, মা সে ফলের বিচি মাটিতে পুঁতে রাখেন। পোঁতা বিচি থেকে ডালিম গাছ, ফজলি আমের গাছ, জামরুল গাছ, লাল পেয়ারার গাছ, লিচু গাছ সবই গজাতে থাকে। হাঁস মুরগির শোক থেকে একদিন গা ঝাড়া দিয়ে উঠে দুটো ছাগলের বাচ্চা আনলেন মা, মানুষের বাচ্চার মত ছাগলের বাচ্চাদুটোকে বোতলে দধু খাইয়ে বড় করে তুললেন। বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ছাগলদুটো মার ফলের গাছ গুঁড়িসুদ্ধ খেয়ে ফেলতে লাগল, মা বেড়া দেন, বেড়া ডিঙিয়ে ছাগল তাদের আধিপত্য বিস্তার করে। মা মরিয়া হয়ে ওঠেন গাছ বাঁচাতে, আবার ছাগলদেরও সুখী রাখতে। ছাগলদুটোর নাম রাখা হল, লতা আর পাতা। লতা আর পাতা লতা-পাতা খেয়ে চমৎকার জীবন যাপন করছে। এমন আদর মার লতা আর পাতার জন্য, রাতে উঠোনে বা বারান্দায় ঘুমোলে কে আবার কামড় দেয় ওদের, নিজের ঘরে এনে রাখেন। ছাগলের ভ্যা ভ্যা গু মুতে মার ঘর ভেসে থাকে। কাঁঠাল গাছে উঠে লতা পাতার জন্য কাঁঠাল পাতা পেড়ে দেওয়ার কাজ আমি নিজে চেয়ে নিই। কাঁঠাল পাতা লতা খায় তো পাতা খায় না। ওর মখু টি বড় উদাসীন দেখতে লাগে। ওর পাতা নাম ঘুচে যায় আমি যখন ওকে বৈরাগি বলে ডাকতে শুরু করি। বৈরাগি একদিন হারিয়ে যায়। মাঠে ঘাস খাচ্ছিল, ফটক খুলে বাড়িতে কেউ এসে খোলাই রেখেছে ফটক, ফাঁক পেয়ে বৈরাগি সত্যিকার বৈরাগি হয়ে ঘর সংসারের মায়া ত্যাগ করে চলে গেছে। পাড়াসুদ্ধ খোঁজা হয়। নেই। আকুয়ার গরুর খোঁয়াড়ে, যেখানে ছাড়া-গরু ছাড়া-ছাগল রাস্তাঘাটে পেলে জমিয়ে রাখা হয়, খুঁজে এলেন মা, নেই। মা চোখের জলে নাকের জলে ডুবে নদীর পাড়ে বুড়া পীরের মাজারে গিয়ে টাকা পয়সা ঢেলে মোমবাতি জ্বেলে পীরের দোয়া চেয়ে এসেছেন যেন বৈরাগি বৈরাগ্য ভুলে ঘরে ফিরে আসে। এই বুড়া পীরের মাজারটি অদ্ভুত এক মাজার। ব্রহ্মপুত্রের পাড়ে একটি খোলা ঘরের প্রায় সবটা জুড়ে লাল কাপড়ে মোড়া বিশাল একটি বাঁধানো কবর, সকাল সন্ধ্যা মানতকারীদের ভিড়। বুড়া পীর কে ছিলেন, কি করতেন, কবে মরেছেন, কেন তার কবরে লোকে মোম আর আগরবাতি জ্বেলে নিজের ইচ্ছের কথা শুনিয়ে আসে, মাকে জিজ্ঞেস করি। বুড়া পীর লোকটি কি মৃত্যুর ওপার থেকে কারও সাধ আহলাদ মেটাতে পারেন, যদি পারেন কি করে পারেন? আমার এই কঠিন প্রশ্নটির খুব সরল একটি উত্তর দেন মা, নিশ্চয়ই পারেন, আল্লাহ নিশ্চয়ই উনারে ক্ষমতা দিছেন পারার, না পারলে এত লোক যায় কেন মাজারে! হিন্দু মুসলমান বৌদ্ধ খ্রিস্টান সবাই যায়। পীর মুসলমান ছিলেন, কিন্তু হিন্দুর ভিড় ওখানে মুসলমানের চেয়ে কম নয়।মার বিশ্বাস যত গভীরই হোক, বুড়া পীরে কাজ হয় না, বৈরাগি আর ফেরে না। লতা তার সঙ্গী হারিয়ে নিজেও উদাস হতে থাকে দিন দিন। বারান্দায় লতার গু মুত দেখে বাড়ির সবাই বিরক্ত কিন্তু মার কিছুতে বিরক্তি নেই। নিজে হাতে তিনি গু মুত সাফ করেন, লতাকে উঠোনে বেঁধে রাখেন, মাঠে বাধঁ লে আবার যদি খোলা ফটক পেয়ে বৈরাগির মত সেও বৈরাগ্য বরণ করে! হরিণের রঙের মত রঙ লতার, শিং আরও পেঁচিয়ে ওপরে উঠলে হরিণ বলেই মনে হত, মা বলেন। মাকে বলি, আবার হরিণ পালার শখ কইর না যেন। মা বড় শ্বাস ছেড়ে বলেন, হরিণ কি আর পোষ মানার প্রাণী! মার এত আদরের লতা, পুত্রবৎ স্নেহে যে বাচ্চাকে ছাগল করে তুলেছিলেন, সেও বৈরাগির মত একদিন নেই হয়ে গেল। মা লতার দুধের বোতল, লতার দড়ি, খুঁটি, আধখাওয়া কাঁঠাল পাতা সামনে নিয়ে চোখের পানি ফেলতে লাগলেন। মার শোক তখনও সম্পূণর্ ফুরোয়নি, বাড়িতে দেখি একটি লাল রঙের গরু। মা এনেছেন। গরু কোত্থেকে এল, গরু কেন এল বাবা এসব কোনও প্রশ্নে গেলেন না। সম্ভবত গরুর প্রতি মায়া বাবার সেই ছোটবেলা থেকেই ছিল বলে গরুর এ বাড়ি থাকা চলবে না এরকম কোনও আইন জারি করলেন না। এই গরু কোনও একদিন বাছুর বিয়োবে, সের সের দধু দেবে, অথবা বড় হলে এটিকে ভাল দামে বিক্রি করা যাবে বাবা সম্ভবত এরকমও ভেবেছিলেন। মা মহা উৎসাহে গরুকে গোসল করানো, খাওয়ানো, গরুর গা থেকে মাছি তাড়ানো, এমনকি গরুর যেন ঠাণ্ডা না লাগে পিঠে পুরোনো একটি কম্বল বিছানো—সবই করতে লাগলেন। দধু ওয়ালি ভাগীরথীর মাকে ডেকে প্রতিদিন এক খাঁচা করে ঘাস আনার ব্যবস্থা করলেন। গরুর জন্য ভাল একটি খুঁটি নিজেই বানিয়ে নিলেন। গরুর নাম মা রাখলেন ঝুমুরি। ঝুমুরিকে তিনি কিছুতেই হারিয়ে যেতে দেবেন না। কিন্তু দিন যায়, ভাগীরথীর মার খাঁচায় ঘাস কমতে থাকে। ঝুমুরির খাদ্য যোগাতে মা অস্থির হয়ে পড়েন। মাঠে যা ঘাস ছিল, সবজির বাগান করে ফেলার পর ঘাস বলতে কিছু নেই। ঝুমুরিকে শেষ অবদি ঘাগডহরে আবদুস সালামের বাড়িতে লালন পালনের জন্য দিলেন মা। গ্রামের মাঠে অঢেল ঘাস আছে, সালামের বাড়ির অন্য গরুর সঙ্গে ঝুমুরিও মনের আনন্দে ঘুরে বেড়াতে বেড়াতে খাবে, হৃষ্টপুষ্ট হবে। ঝুমুরিকে রাখার জন্য মা সালামের হাতে কিছু টাকা পয়সাও মাসে মাসে দিতে থাকেন, নিজেও ঘাগডহরে প্রায়ই তাঁর আদরিণীকে দেখে আসেন, গায়ে হাত বুলিয়ে আসেন। দিন যায়, সালাম একদিন মখু মলিন করে বলে, গরু চুরি হইয়া গেছে। মার কিছুই থাকে না, সব চলে যায়। গরু চুরির পর মা কবুতর নিয়ে পড়লেন। প্রথম শাদামাটা বাজারের কবুতর নিয়ে এলেন। মা তো আর ইচ্ছে করলেই কিছু নিয়ে আসতে পারেন না। মাসের পর মাস স্বপ্ন দেখেন, বাবার কাছে আবদার করেন, বাবা আবদার ফিরিয়ে দিলে তিনি তাঁর নিজের আত্মীয়দের কাছে আবদার করেন, তাতেও ব্যথর্ হলে শেষ অবদি ধারই করেন। ধার শোধ করাও মার পক্ষে চাট্টিখানি কথা নয়। নিজের গাছে যে কটি ডাব হয় তা রশিদের কাছে বিক্রি করে মার টাকা শোধ করতে হয়। মা যে ডাবগাছগুলো লাগিয়েছিলেন এ বাড়িতে আসার পর, সেসব গাছ বড় হয়ে ডাব ধরার পর বাবাই অন্য গাছগুলোর ডাবের মত মার লাগানো গাছের ডাব বিক্রি করে নিজের পকেটে পয়সা ঢোকাতেন। মা মুরগি পালার পর থেকে নিজের লাগানো গাছগুলোর ডাব তিনি নিজে বিক্রি করতে পারবেন, এই অধিকারটি দিনরাত লেগে থেকে নেন। শাদামাটা কবুতরদুটো পরদিনই উড়ে চলে গেল, মা উন্মুক্ত আকাশটির দিকে সারাদিন উন্মখু তাকিয়ে ছিলেন হাতে খাবার নিয়ে, বাকবাকুম বাকবাকুম বলে ওদের ডেকেছেন অনেক, কেবল তাই নয়, অনেক রাত অবদি বারান্দায় বসে ছিলেন, পাখিরা রাত হলে নীড়ে ফেরে, যদি ফেরে এই আশায়। যদি বাড়ির পথ চিনতে ওদের ভুল হয়ে থাকে, রাত বিরেতে চিনে আবার ফিরতেও তো পারে, মা আশা ছেড়ে দেওয়ার মানুষ নন। ওরা ফেরেনি। বাইরের বারান্দার ওপর ঢেউ খেলানো খোপে জালালি কবুতরের বাসা। কবুতরের গুয়ে শাদা হয়ে থাকে বারান্দা। অনেকদিন কবুতরগুলোকে তাড়াতে চেয়েছি, মা বলেছেন, জালালি কবুতর থাকলে সংসারে শান্তি থাকে, ওদেরে তাড়াইবি না। হাতের নাগালে ওদের একটিকে পেয়ে খপ করে ধরে দাদা মাকে ডেকে একদিন বললেন, জালালি কবুতরেরা বড় জালাইতাছে মা,এইটা রোস্ট কইরা দেন, খাই। মা দাদার হাত থেকে কবুতর কেড়ে নিয়ে আকাশে উড়িয়ে দিয়ে বলে দিলেন, জালালি কবুতর খাইতে হয় না। তর লাইগা অন্য কবুতর রাইন্ধা দিব নে, এদেরে খাইস না কোনওদিন। জালালি কবুতরের মনে কষ্ট দিলে সংসারের শান্তি জন্মের মত চইলা যায়। শাদামাটা কবুতরগুলো চলে যাওয়ার পর মোজাপরা টোপর পরা চমৎকার এক জোড়া কবুতর নিয়ে এলেন মা। এ জাতের কবুতর পাওয়া যায় না, মা মুল্লুক ঘুরে এদের এনেছেন। কবুতরের জন্য রান্নাঘরের চালের তলে কাঠের একটি ঘর বানিয়ে দিলেন মা, ঘরে ছোট্ট একটি দরজা, দরজা খুলে বেরোলে এক চিলতে বারান্দা। বারান্দায় ছোট একটি বাটিতে খাবার থাকে, কবুতরদুটো বাক বাকুম বলে ঘর থেকে বেরিয়ে খাবার খায়। এবারেরগুলোয় মা পাখনা বেঁধে দিয়েছেন যেন খুব বেশিদূর উড়তে না পারে। কবুতরগুলোকে ওড়া থেকে বঞ্চিত করার কোনও ইচ্ছে মার নেই, মা চান ওরা মার হাত থেকে খাবার খাক, উঠোনের গাছ গাছালিতে বসুক, উঠোন শাদা করে হাঁটুক, উড়ুক, উড়ুক কিন্তু বেশিদূর না যাক, বেশিদূর গেলেও বাড়ির পথ চিনে সন্ধের আগে আগে কাঠের ঘরটিতে ফিরে আসুক। কবুতরদুটো ডিম পাড়ল, বাচ্চাও ফোটালো, বাচ্চাগুলোকে বেজি নিয়ে গেল, কাকে খেলো, তারপর মোজা পরা টোপর পরা ভাল জাতের দুটো কবুতর মনের দুঃখে বসে থেকে থেকে অসখু বাঁধালো শরীরে। মা অসখু সারাতে পারেননি। কবুতর মরে যাবার পর বাবা বললেন, এই অলক্ষুণ্যা মাগির কাছে কিছুই থাকে না। সব যায় গা। তা ঠিক, মার কাছে কিছু থাকে না, সব মাকে ছেড়ে চলে যায়। বারান্দার খোপে জালালি কবুতর তখনও বাকুম বাকুম দিন কাটায়। ওদের দেখলে দাদার মত আমারও খেতে ইচ্ছে করে। বাবা বাড়িতে মাস যায় কোনও মাছ মাংস পাঠান না। শাক সবজি আর শুটকি খেতে খেতে রীতিমত বিরক্ত আমি, মাকে জানাই এখন জালালি কবুতর রাঁধা ছাড়া আর উপায় নেই। ছেলেমেয়ের কিছু খেতে ইচ্ছে হলে মা যে করেই হোক সে জিনিস খাওয়ানোর ব্যবস্থা করেন। একদিন পেয়ারা খেতে ইচ্ছে করছিল, পেয়ারার দিন নয় তখন অথচ মা শহর ছাড়িয়ে কোন এক গ্রামে এক সামান্য চেনা মহিলার বাড়ি গিয়ে, শুনেছিলেন সে মহিলার বাড়ির গাছে অসময়ের পেয়ারা জন্মায়, কিছু পেয়ারা নিয়ে এসেছিলেন আমার জন্য। কিন্তু আমার কবুতর খাওয়ার ইচ্ছের গোড়ায় মা মোটেও জল ঢালেন না। আমার ইচ্ছের পাশ কাটিয়ে তিনি চলে যান। সংসারের শান্তি তিনি কিছুতেই নষ্ট হতে দেবেন না।
মাকে ছেড়ে সবাই চলে যায়। মা একা বসে থাকেন ছেঁড়া শাড়ি, উড়ো চুল রুখো ত্বক নিয়ে। ছেঁড়া তোশকের ওপর ছেঁড়া মশারির তলে সারারাত এপাশ ওপাশ করেন। মার ফুসফুস জুড়ে কফ জমে, মা কফ থুতু ঘরের মেঝেতেই ফেলেন, দেখে আমার ঘেন্না লাগে। মা নিজের জন্য কাউকে চেয়েছিলেন, মানুষ নয়ত পশু পাখি। মানুষ তো থাকেই নি, পশু পাখিও থাকেনি। ভোর বেলা থেকে রাত অবদি মা আমাদের জন্য রান্না করবেন, আমাদের খাওয়াবেন, বাড়ি ঘর গোছাবেন, কাপড় চোপড় ধোবেন, আমরা খাব দাব, হৈ হুল্লোড় করব, আমরা আমাদের লেখাপড়া খেলাধুলা গান বাজনা ইত্যাদি নিয়ে থাকব। মার জন্য কেউ থাকবে না, কিছু থাকবে না। এরকমই নিয়ম। মার কর্তব্য মা পালন করবেন। মা করেনও। সংসারের কাজ কর্ম সেরে মা একা বসে দরুদ পড়েন, আল্লাহর কালামে মন ঢালতে চেষ্টা করেন। আর থেকে থেকে বাবা যে রাজিয়া বেগমকে বিয়ে করেছেন, এ যে মিথ্যে কথা নয় তা বলেন। পীর বাড়ি যেতে আসতে মা নাকি প্রায়ই বাবাকে দেখেন নওমহলের রাস্তায়। আমি ধারণা করি বাবার বিরুদ্ধে মা কথা যা বলেন, বানিয়ে বলেন। বাবা যত দূরের মানুষই হন, বাবার প্রতাপ আর প্রভাবে আমি যতই নুয়ে থাকি, যতই কিল ঘুসি চড় চাপড় খাই, যতই সন্ধিবেতের আর চাবুকের মার পিঠে এসে পড়ে, বাবার প্রতি এক ধরণের শ্রদ্ধা আমার থেকে যায়, সেটি ঘোর দুর্যোগের সময়ও মরে না। মার অভিযোগ শুনেও আমরা রা করি না। যা চোখের সামনে ঘটে না, তা বিশ্বাস করার অভ্যেস অন্তত আমার নেই। মাকে ছিঁচকাঁদুনে অবুঝ একটি মেয়েমানুষ ছাড়া আমার কিছু মনে হয়না। মার বুদ্ধি সুদ্ধি কিছু আছে বলেও মনে হয় না, থাকলে তিনি কেন আল্লাহ রসুলে বিশ্বাস করেন! থাকলে তিনি কেন আমান কাকার সঙ্গে ওরকম একলা ঘরে নসিহতের নাম করে বসে ফিসফিস কথা বলতেন! এবাড়িতে আমান কাকার আসা বন্ধ করে দিয়েছেন বাবা। আমান কাকার বউ এসে একদিন মাকে জানিয়ে যান, তাঁর স্বামী গফরগাওঁ এ চাকরি করছিলেন, ওখানে এক মহিলাকে সম্প্রতি বিয়ে করেছেন। মা শুনে নিরুত্তাপ কণ্ঠে বলেছেন, বেডার জাত তো, করবই। কোনও বেডার জাতের প্রতি মার কোনও রকম শ্রদ্ধা নেই সম্ভবত। কিন্তু বাবা তু তু করলেই মা যে কেমন মুরগির মত দৌড়ে যান বাবার কাছে!মার বসে থাকা, শুয়ে থাকা, হাঁটা চলা, দৌড়ে যাওয়া সবই বড় বিচ্ছিজ্ঞর লাগে দেখতে।
বাড়িতে সবাই ব্যস্ত বাবা ব্যস্ত রোগী নিয়ে, গ্রামের জমিজমা নিয়ে। দাদা ব্যস্ত চাকরি নিয়ে। ছোটদা ব্যস্ত গীতা নিয়ে, গীতা পদার্থবিজ্ঞান বিভাগে কিছুদিন ঘোরাঘুরি করে পদার্থবিদ হওয়ার স্বপ্ন বিদেয় করে নৃত্যকলায় মন শরীর সব ঢেলে দিয়েছে। নাচের দলের সঙ্গে বার্মা যাচ্ছে। আমি ব্যস্ত লেখাপড়া নিয়ে। ইয়াসমিনও। মা পড়ে থাকেন একা। কালো কুচ্ছিত হতদরিদ্র মা। কিছু না থাকা মাকে একরকম মানিয়ে যায়। মার যে সায়া থাকলে শাড়ি নেই, শাড়ি থাকলে ব্লাউজ নেই এসব দেখে আমরা অভ্যস্ত মার ফিনফিনে তেলহীন চুল বাতাসে উড়বে, ফিতে না পেয়ে মা পাজামার দড়ি খুলে বা চটের দড়িতে চুল বাঁধবেন, দেখে আমরা মখু টিপে হাসব, আমাদের ওই হাসিতেও অনেকটা অভ্যস্ত আমরা। মা বাড়িতে অনেকটা হাস্যকর পদার্থ। মাকে নিয়ে সবচেয়ে বেশি হাসেন বাবা। চাকরি পাওয়ার পর দাদা মাকে শাড়ি সায়া কিনে দিয়েছেন, কিন্তু বিয়ের কথা ভেবে ভেবে নিজের সংসারের আসবাবপত্র বানাতে বানাতে আর নিজের জামা কাপড় সুটবুট কেনায় দাদাও এমন ব্যস্ত যে মাঝে মাঝেই ভুলে যান যে মার গত ঈদের শাড়িটা ছিঁড়ে গেছে। মা তাঁর ছেঁড়া শাড়িগুলো নিয়ে গিয়ে নানিবাড়ির পেছনের বস্তি থেকে কাথাঁ বানিয়ে এনেছেন। একটু শীত নামলেই মা কাথাঁ বের করে প্রত্যেকের বিছানায় দিয়ে আসেন। মার কাথাঁর উষ্ণতায় আমাদের এত আরাম হয় যে আমরা সময়ের চেয়ে বেশি ঘুমোই, আর মা তুলো বেরিয়ে আসা ছেঁড়া লেপের তলায়, গা অর্ধেক ঢাকে তো অর্ধেক বেরিয়ে আসে, এপাশ থেকে ওপাশ ফিরলে খাট নড়বড় করে, শুয়ে থাকেন। মা স্বপ্ন দেখতে থাকেন একটি নকশি কাথাঁর, কাঁথাটি বানিয়ে যদি কোনও এক রাতে বাবার শীত শীত লাগা গায়ের ওপর আলগোছে বিছিয়ে বাবাকে চমকে দিতে পারতেন! বাবা অবশ্য মার কোনও কিছুতে চমকান না। মা খুব চমৎকার খিচুড়ি রাধঁলেও না, মাথায় তেল দিয়ে ভাল একটি শাড়ি পরে, পান খেয়ে ঠোঁট লাল করে মিষ্টি হেসে সামনে এলেও না। চাঁদনি রাতে জানালায় বসে ঘুম ঘুম চাঁদ ঝিকিমিকি তারা এই মাধবী রাত, আসে নি তো বুঝি আর জীবনে আমার! গাইলেও না। বাবার মন মায়ে নেই। মা বোঝেন তা। আমরাও বুঝি। সংসারের হাড়ভাঙা খাটুনির মাঝখানে কখনও কখনও ক্লান্ত শুয়ে থাকেন তিনি। মার শুয়ে থাকা দেখলে বাবা চিৎকার করে বাড়ি মাথায় করেন। এভাবে শুয়ে থাকলে সংসার উচ্ছন্নে যাবে বাবার ধারণা। বাড়িতে চোর ঢুকে সব নিয়ে যাবে। কাজের মানুষগুলো কাজে ফাঁকি দেবে, চুরি করে মাছ মাংস খেয়ে ফেলবে। মেয়েরা পড়াশোনা রেখে আড্ডা পেটাবে। বাবার অমন বাড়ি মাথায় করা চিৎকারের দিনে মা একদিন শুয়ে থাকা থেকে নিজের শরীরটি টেনে তুলে বলেন,পাইলসের রক্ত গেছে অনেক। শইল কাহিল হইয়া গেছে। বাবা শুনে বলেন, ঢং দেইখা বাচি না।
মা অনেকদিন বাবাকে খুব নরম স্বরে জিজ্ঞেস করেছেন, পাইলসের কি কোনও চিকিৎসা নাই?
বাবা বলেছেন, না।
এই যে এত্ত এত্ত রক্ত যায়। পায়খানা ভইরা রক্ত যায়। এইভাবে রক্ত যাওয়া খারাপ না?
গম্ভীর কণ্ঠে বাবা উত্তর দেন, না।
মার চটি ছিঁড়ে পড়ে আছে অনেকদিন, বাবাকে চটি কেনার কথা বলা হয়, বাবা শুনেও শুনলেন না। আমার বা ইয়াসমিনের চটি পরে কোথাও যাবার হলে মা যান, আর ঘরে বারান্দায় উঠোনে তো খালি পায়েই। বাড়ির লোকের খুব একটা চোখে পড়ে না আজকাল মার কি নেই, মার কি প্রয়োজন। নানার মত বেহিসেবি বাউণ্ডুলে মানুষের নজরে পড়ে মার পাদুকাহীন জীবন। তিনি একদিন মার জন্য একজোড়া শাদা কাপড়ের জুতো কিনে নিয়ে এলেন। এরকম জুতো যে মেয়েরা কখনও পরে না সে ধারণা নানার নেই। কিন্তু মা জুতো জোড়া পেয়েই খুশিতে আটখানা, বাড়ির সবাইকে দেখালেন যে তাঁর বাজান তাঁর জন্য জুতো এনেছেন। সেদিন মা নানার জন্য বেশি মিষ্টি দিয়ে,নানার চিনি খাওয়া বারণ জেনেও,পায়েশ রাঁধেন। নানা খেয়ে দেয়ে মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে মেয়ের জন্য দোয়া করেন, মেয়ের যেন বেহেসত নসীব হয়। বেহেসতের খাবার দাবারের বর্ণনা করেন নানা, বেহেসতে এমন খানা একবার খাইব তো চল্লিশ হাজার বছর খাইতেই থাকব, ঢেকুর একটা আইব তো মেসকাম্বর। নানার বর্ণনা শুনে আমার ধারণা হয় বেহেসতের ভাল ভাল খানা খাওয়ার লোভেই নানা বুঝি নামাজ রোজা করেন। নওমহলে পীরের প্রতাপ এমনই বেড়েছে যে, এখন আর রিক্সাঅলাকে বলতে হয় না, নওমহল চান্দুর দোকানের পিছনে যাইবা? নওমহলের পীর বাড়ি বললে রিক্সাঅলা চেনে। আগে মা চারআনা করে যেতেন, দাম বেড়ে পরে আট আনা হল, আট আনা থেকেও লাফিয়ে এক টাকা। মার হাতে অত পয়সা নেই যে ঘন ঘন তিনি বাপের বাড়ি বা পীর বাড়ি ছুটবেন। অনেক সময় যেতে ইচ্ছে করলেও মাকে ইচ্ছের লাগাম টেনে ধরতে হয়। সেদিন সকালে আমি ইশকুলে যাব, এক প্যাঁচে শাড়ি পরে, তার ওপর রংচটা বোরখাটি পরে, পায়ে নানার দেওয়া কাপড়ের জুতো, বললেন আমারে নামাইয়া দিবা রেললাইনের মোড়টায়? মার আপাদমস্তক দেখে আমি নাক কুঁচকে বলি, তুমি আরেকটা রিক্সা নিয়া গেলেই তো পারো!
রিক্সাভাড়া নাই যে।
নাই তো কারও কাছ থেইকা নেও।
কেউ ত দিল না।
আজকে যাইও না তাইলে,বাদ দেও। অন্যদিন যাও।
মা আমার উপদেশ মানেন না। মার কাছে আজ এবং অন্যদিনে কোনও পার্থক্য নেই। অগত্যা সঙ্গে নিতে হয় মাকে। মনে মনে প্রার্থণা করতে হয় যেন রাস্তায় চেনা কেউ না পড়ে, রংচটা বোরখা আর মোজাহীন কাপড়ের জুতো পরা কারও সঙ্গে আমাকে যেন কেউ না দেখে। সি কে ঘোষ রোড পার হয়ে রেললাইনের সামনে মা নেমে যান। বেশির ভাগ রাস্তাই সামনে পড়ে আছে, পীর বাড়ি যেতে আরও দুমাইল পথ, তিনি হেঁটে পার হবেন। ইশকুলে পৌঁছলে আশরাফুন্নেসা সগৌরবে জানায় ,তরে দেখলাম রিক্সা কইরা আইতাছস। আমি হাত নাড়লাম, তর খবর নাই।
আমি ত তরে দেখলাম না।
দেখবি কেমনে। মাটির দিকে তাকাইয়া ছিলি ত। মনে হইতাছিল লজ্জাশীলা কুলবধূ। যাহ!
মহাকালির মোড়ে আমার রিক্সা তর রিক্সারে ক্রস করল। তর সাথে তোদের কাজের বেটি ছিল।
নিজের বুকের ধ্বক শব্দটি নিজেই শুনি। জিভের কাছে চলে আসা বাক্যটি যে না কোনও কাজের বেটি না, আমার সঙ্গে আমার মা ছিলেন নিঃশব্দে গিলে ফেলি। জানি না কে আমার ঠোঁট জোড়া শক্ত সুতোয় সেলাই করে রাখে। সারাদিন আশরাফুন্নেসার ভুলটি শুধরে দিতে চেয়েও আমি পারিনি।
ইশকুল থেকে ফিরে আমার কানে কানে একটি গোপন খবর বলে ইয়াসমিন, কোন এক মেয়ে নাকি তাকে বলেছে তোমার বাবা ত দুইটা বিয়া করছে।
কি কইলি তারপর?
ইয়াসমিন বলে, কইলাম দুইটা বিয়া আমার বাবা করে নাই, মিছা কথা।
আমিও ফিসফিস করে বলি, আমারেও সেদিন ক্লাসের এক মেয়ে কইল এই কথা।
মা একদিন মন খারাপ করে বসেছিলেন বারান্দায়। আমাকে কাছে পেয়ে বলেন, তর বাবা ত চাকলাদারের বউরে বিয়া কইরা ফেলছে।
আমি বললাম কি যে কও মা!
হ। নওমহলের সবাই কইল।
সবাই কারা? তারা জানে কি কইরা?
দেখছে।
কি দেখছে?
দেখছে যে বেডি নওমহলেই এক বাসায় থাকে। আর তর বাবা সবসময়ই ওই বাসায় যায়।
এইটা ত নতুন না। এই সন্দেহ ত তুমি বহুদিন ধইরা করতাছ।
নিজের চোখে ত ঢুকতে দেখছে তর বাপেরে। বেডির সাথে কথাও কইছে। বেডি নিজে কইছে যে বিয়া হইছে।
হুদাই।
হুদাই হইলে তর বাপে ওই বাড়িত যায় কেন?
যাইতেই পারে। তার মানে কি বিয়া করা?
কারও বাড়িতে বেড়াতে যাওয়া মানে যে বিয়ে করা নয়, তা আমি যুক্তি দিয়ে বোঝাতে চেষ্টা করি। কেন করি, মা যেন মন খারাপ না করেন, নাকি বাবার প্রতি আমার গভীর বিশ্বাস যে এমন মন্দ কাজ তিনি কিছুতেই করতে পারেন না, নাকি বাবা দুটো বিয়ে করেছেন এ আমার জন্যও এত লজ্জার যে আমি প্রাণপণে এই লজ্জার বোঝা বইতে অস্বীকার করি, বুঝি না।
সেইদিন আকুয়া গেছিলাম, সোহেলির মার সাথে দেখা, কইল তর বাবারে আর চাকলাদারের বউরে নাকি দেখছে সিনেমায় যাইতে। আমারে নিয়া তো কোনওদিন সিনেমায় যায় না তর বাপ!
সিনেমায় কি তুমি যাইবা নাকি! তুমি না আল্লার পথে গেছ ! বলে আমি মার সামনে থেকে সরে যাই।
রাজিয়া বেগম নিয়ে মার ঘ্যানর ঘ্যানরের পরও মা মন দিয়ে রান্নাবাড়া করেন, স্বামী ছেলেমেয়েদের খাওয়ান, তেল পেঁয়াজ না থাকলে, বিরস মুখে ওসব ছাড়াই রাঁধেন আর খেতে বসিয়ে বলেন তেল ছাড়া পিঁয়াজ ছাড়া কি আর রান্ধা ভাল হয়! কোনওমতে খাইয়া নে আজকে। দেখি কালকে যদি …
কাল তেল আসে তো পেঁয়াজ আসে না। পেঁয়াজের সঙ্গে বাজারের পচা কই মাছ থলে ভরে পাঠিয়ে দিয়েছেন বাবা। থলে খুলেই মা দেখেন পচা মাছের গন্ধ বেরোচ্ছে। তাই বলে কি ছেলেমেয়ে উপোস থাকবে। লেবগুাছ থেকে মুঠো ভরে লেবপুাতা ছিঁড়ে এনে মাছের ঝোলে দেন। লেবুপাতার গন্ধের তলে যেন মাছের গন্ধ চাপা পড়ে। শাক দিয়ে মাছ ঢাকা যায় না, লেবপুাতার গন্ধ দিয়ে মাছের পচা গন্ধ হয়ত ঢাকা যায় কিন্তু লেবপুাতার উপস্থিতিই আমাকে সন্দিহান করে, খেতে বসেই নাক সিটকোই, লেবুপাতা দিছ কেন মা? মাছ নিশ্চয়ই পচা ছিল? এক চিলতে হাসি মার ঠোঁটের কোণে ঝিলিক দিয়েই মিলিয়ে যায়। মা আমার পাতে একটি না-ভাঙা মাছ তুলে দিয়ে বলেন, মাছগুলা জেতা ছিল। আল্লাহর কসম কইরা কও তো জেতা ছিল!
কথায় কথায় আল্লার কসম কাটতে হয় না। মা নরম ধমক লাগান।
দাদা একটি খেয়ে আরেকটি মাছ নেন। আমি থাল সরিয়ে বলি মাছ পচা, খাইতাম না।
মাছ আবার পচা কোত্থেকা হইল! মা রান্নাঘর থেকে জরির মাকে ডেকে আনেন, এই কও,কাটার সময় মাছ লাফাইতাছিল না?
জরির মা মাথা নেড়ে বলে, হ লাফাইতাছিল।
লাফাক। আমি মাছ খাইতাম না। অন্য কিছু থাকলে দেও।
দাদা মাকে বুদ্ধি দেন, মাছটা একটু নরম হইয়া গেলে ভাইজা ফেলবেন, ভাজলে আর গন্ধ থাকে না।
নাসরিনের ত শকুনের নাক। মা বলেন।
বাবা রাতে ফিরে যখন প্যান্ট খুলে লুঙ্গি পরতে থাকেন, মা বলেন পয়সা যে জমাইতাছুইন, কার লাইগা জমাইতাছুইন?
কার লাইগা জমাইতাছি মানে? এতগুলা মানুষ খাওয়াইতাছি, পরাইতাছি। চোক্ষে দেহ না?
আমি আমার কথা কই না। আমি ত ডাইল দিয়া খাইয়া উঠতে পারি। কইতাছি ছেলেমেয়েদের কথা!পচা মাছ পাঠান কেন? ইশকুল থেইকা ক্ষিদা পেটে আসে, ভাত খাইতে পারে না।
মাছ পচা ছিল নাকি?
পচা ছিল না মানে? গন্ধে তো বাড়ি উজাড় হইয়া যাইতাছিল।
হুম।
আর পিঁয়াজ যে নাই এক মাস হইয়া গেল। পিঁয়াজ কিননেরও কি পয়সা নাই?
পিঁয়াজ না পাঠাইলাম কয়দিন আগে। শেষ হইয়া গেল?
কয়দিন আগে? মা খানিকটা সময় নিয়ে হাতের কড়া গুনে বলেন, আজকে হইল রোববার, গত রোববারের আগের রোববারও পিঁয়াজ ছাড়া রান্ধা হইছে। তার আগের মঙ্গলবারে না পিঁয়াজ পাঠাইছেন!
এত তাড়াতাড়ি শেষ হইয়া যায় কেন? হিশাব কইরা খর্চা কর না কেন? বাজারে পিঁয়াজের দাম কত খবর রাখো? কামাই ত কর না, কামাই করলে বুঝতা।
মা দীর্ঘশ্বাস ফেলেন। কামাই কি তিনি শখে করেন না!
বাবার ওষুধের দোকানের কর্মচারি আবদুস সালাম বাজার-সদাই নিয়ে বাড়ি এলে মা তাকে আড়ালে ডেকে নিয়ে কথা বলেন। এক বিকেলে দেখি সালামকে মাছ ভাত খাওয়াচ্ছেন রান্নাঘরে বসিয়ে। সালাম ভাল কইরা খাইয়া লও, সেই সকাল বেলা কি মুখে দিয়া যে আসো, তারপর ত সারাদিন খাওয়া নাই!
মার এমন একে ওকে খাওয়ানো নতুন কিছু নয়। বাড়িতে শুকনো মুখের কোনও ভিখিরি এলে মা ওদের বসিয়ে খাওয়ান। বাসি তরকারি পান্তা ভাত শুকনো মরিচ। ওসবই ওরা পরম সুখে খেয়ে নেয়। কারও জমিজিরেত ছিল, হঠাৎ অভাবে পড়ে ভিক্ষে করছে শুনলে পাতিল থেকে দুটুকরো নতুন রান্না করা মাংসও তুলে দেন। মার দয়ার শরীর। সালাম খেয়ে দেয়ে হাসিমুখে বিদেয় নেওয়ার পর মা আমাকে ডাকলেন, দাদাকে ডাকলেন,বললেন এই যে তর বাপ পচা মাছ কেন পাঠায়, জানস? কেন বাড়িত তেল আনেনা, পিঁয়াজ আনেনা?
কেন মা? দাদা জিজ্ঞেস করেন।
কিরীটি রায়ের মত বহুকালের রোমহর্ষক রহস্য উদঘাটন করার ভঙ্গিতে মা বলেন, কারণ দুই জায়গায় বাজার পাঠাইতে হয় ত! এত কুলাইব কেমনে! ওই বেড়ি তার কাজের লোক পাঠাইয়া দেয় ফার্মেসিতে আর তর বাপে নিজে বাজারে হাইটা যাইয়া বাজার কইরা পাঠায় বেড়ির বাড়িত। ওই বেডিরে ত বিয়া করছে। বেডির ছোট ছেলেডাও ফার্মেসিতে আইসা বইসা থাকে। ওরে লেখাপড়ার খরচ দেয়। ও ত আসলে তর বাপের ছেলে, চাকলাদারের না।
আমার অস্বস্তি হয় মার অভিযোগ শুনতে। দাদারও হয়। দাদা বলেন কী যে কন না কন, কার কাছে কি শোনেন আর চিল্লাচিল্লি করেন।
কার কাছে শুনি? আচ্ছা যা না, নওমহলেই ত থাকে বেডি, বেডির বাড়িত যাইয়া দেইখা আয়, জাইনা আয় তর বাপ বিয়া করছে কিনা, প্রত্যেকদিন বাজার-সদাই পাঠায় কি না।
হ। আমার আর কাম নাই বেডির বাড়িত যাইয়াম! দাদা সরে যান মার সামনে থেকে। আমিও যাই। মার অভিযোগ অনুযোগ সবই আমাদের চেনা। মার বিলাপ প্রলাপ সব চেনা। মার চিল্লাচিল্লিতে কোনও করুণার উদ্রেক আমাদের হয় না, যদি হয় কিছু সে বিবমিষা।
মা একা বসে থাকেন। তাঁর দুঃখ শোনার বাড়িতে আর কেউ নেই। তিনি জরির মাকে ডাকেন, বলেন, দেখ জরির মা, এই সংসারে আমার শান্তি নাই। আমার ত কপাল পুড়ছে, লেখাাপড়াডা যেদিন বন্ধ করল, সেইদিনই। আইজ যদি লেখাপড়া জানতাম, তাইলে কি আর নিজের সংসারে নিজে বান্দিগিরি করি! ছেলেমেয়েগুলাও হইছে বাপের ভক্ত। আমারে মা বইলা গ্রাহ্যই করে না।
জরির মা মার দুঃখ বোঝে না। তার নিজের দুঃখের সঙ্গে তুলনা করলে মার দুঃখ তার কাছে কিছুই মনে হয় না। তার বিয়ে হয়েছিল তিন সতিনের সংসারে, সতিনের জ্বালায় সে জ্বলেছে অনেক। স্বামীও তাকে কম জ্বালায়নি। জরি জন্ম নেওয়ার পর জরির মাকে ভাত দেওয়া বন্ধ করে দিল। শেষে তো লাত্থি গুঁতা দিয়ে বাড়ি থেকে তাড়িয়েই দিল। আর এ সংসারে মা তো অন্তত ভাত পাচ্ছেন। সতিন? সে তো অন্য বাড়িতে থাকে, এক বাড়িতে নয়। জরির মার কাছে মার সংসারকে সোনার সংসার বলে মনে হয়। জরির মা মার কথায় দীর্ঘশ্বাস ফেলে, আমি নিশ্চিত, দীর্ঘশ্বাসটি নকল।
এত দুঃখ নিয়েও মা বাড়িঘর সাজান, খাট আলমারি টেবিল চেয়ার আলনা সরিয়ে নতুন জায়গায় ফেলেন। দেয়ালের কাছে খাট ছিল, সেটি একেবারে উল্টোদিকে জানালার কাছে নিয়ে যান, আলমারি ডানদিক থেকে সরে বাম দিকে আসে। মার এ কাজটি আমার খুব পছন্দ হয়। ঘর একেবারে নতুন নতুন লাগে। মনে হয় নতুন জীবন শুরু হল। কেবল ঘর সাজানোই নয়, মা উঠোন মাঠ ফলগাছে ফুলগাছে শাকে সবজিতে সাজিয়ে রাখেন। এক এক ঋতুতে এক একরকম। হেলে পড়া গাছগুলোর কিনার দিয়ে বাঁশের কঞ্চির বেড়া দেওয়া, আগাছা পরিষ্কার করা, মাটি কাটা মাটি ফেলা নিজেই করেন। শাক সবজি মা খুব ভালবাসেন। ছড়া বলে বলে হলেও তিনি আমাদের তাজা ফল, টাটকা শাক সবজি খাওয়াতে চেষ্টা করেন। মার ধারণা ছড়া শুনলে খুশিতে নাচতে নাচতে শাক খাব আমরা। মার আরও ধারণা মার হাতে লাগানো শাক সবজির প্রতি মার মত আমাদেরও আলাদা দরদ আছে। সারাবছরই পাতে সবজি তুলে দিয়ে বলেন,গাছের লাউ, গাছের সিম, গাছের টমেটো, গাছের এটা, গাছের সেটা।
একদিন খেতে গিয়ে মার মুখে গাছের লাউ উচ্চাজ্ঞরত হতেই আমি খপ করে ধরি।
গাছের লাউ মানে? লাউ তো গাছেই ধরে। গাছ ছাড়া লাউ হয় নাকি!
মা বলেন, এইডা গাছের, এইডা কিনা লাউ না।
কিনা লাউ কি মাটির নিচে হয়?
ধুর, লাউ মাটির নিচে হইব কেন?
তার মানে লাউ গাছেই ধরে।
গাছেই ত ধরে!
তাইলে কও কেন যে এইডা গাছের লাউ! বাজার থেইকা কিন্যা আনা লাউও তো গাছের লাউ।
আরে এইডা বাড়ির গাছের।
সেইটা কও, বাড়ির গাছের। কথাও ঠিকমত কইতে পারো না।
আমি মখূর্ মানুষ,লেখাপড়া শিখি নাই। তোমরা শিক্ষিত, তোমরা গুছাইয়া কথা কইবা। মা থেমে থেমে বলেন।
লেখাপড়া নিয়ে মার আক্ষেপ সারা জীবনের। আমার মেট্রিক পরীক্ষার আগে আগে, আমি যখন টেবিল ভরা বইখাতার ওপর উবু হয়ে আছি, মা মিনমিন করেন, প্রাইভেটে মেট্রিকটা যদি দিয়া দিতে পারতাম।
আমি হেসে উঠি, এই বয়সে তুমি মেট্রিক দিবা?
কত মানুষে তো দেয়। গণ্ডগোলের সময় আমার চেয়েও কত বয়ষস্ক মানুষেরা মেট্রিক দিয়া দিল, তখন তো সবাইরে পাশ করাইয়া দিছে সরকার। ওই চাকলাদারের বউতো গণ্ডগোলের সময়ই নকল কইরা মেট্রিকটা পাশ করল। তোমার বাপেই তারে প্রাইভেটে মেট্রিক দেওয়াইছে।
তা ঠিক, একাত্তরের ডিসেম্বরে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর প্রথম যে মেট্রিকের আয়োজন হয়েছিল, যে যেমন ইচ্ছে বয়সে যত বড়ই হোক, অ আ ক খ হয়ত লিখতে জানে কেবল, বসে গেছে প্রাইভেটে পরীক্ষা দিতে। গণহারে নকল। গণহারে পাশ। সেই গণহারে রাজিয়া বেগম পার হয়ে গেছেন।
এহন তো নকল চলে না, তুমি কেমনে পাশ করবা?
নকল করতাম কেন?
তাইলে পাশ করবা কেমনে?
আমি পইড়া পাশ করবাম।
এক পেট হাসিকে বুক-চাপা দিয়ে বলি, তোমার কি মনে থাকবে পড়া?
কেন মনে থাকবে না? থাকবে।
তুমি তো হাতের মধ্যে চাবি লইয়া সারা বাড়ি চাবি খুঁইজ্যা বেড়াও। মনে থাকবে কেমনে?
তুমি আমারে অঙ্কডা একটু দেখাইয়া দিলেই দেখবা আমি পাশ কইরা যাব। বাংলা ইংরেজি তো কোনও ব্যাপার না। ইতিহাস ভূগোল ঝাড়া মখু স্ত কইরা ফেলব।
মার দুচোখ চিকচিক করে স্বপ্নে। স্বপ্ন থাকে চোখে, স্বপ্ন চোখে রেখেই বলেন,পরীক্ষা দিলে ঠিকই পাশ করবাম। ক্লাসে আমি ফার্স্ট গার্ল ছিলাম, প্রত্যেক পরীক্ষায় ফার্স্ট হইতাম। বিয়া হইয়া যাওয়ার পরও ইস্কুলের মাস্টাররা কইছিল পড়াডা ছাড়িস না রে ঈদুন। মাকে নিঃসংশয়ে নিঃসংকোচে বলে দিই তুমি এই সব কঠিন জিনিস বুঝে উঠতে পারবে না। বলে দিই, তোমার ওই গণ্ডগোলের সময় এখন আর নেই, এখন আর যা ইচ্ছে তাই করা যায় না। বলে দিই তোমার বয়স অনেক, এত বেশি বয়সে মেট্রিক দিতে গেলে মানুষ হাসবে। মা দীর্ঘশ্বাস ফেলেন। কোনও এক কালে ইশকুলের সেরা ছাত্রী থাকার গৌরব বয়সের লজ্জার আড়ালে ঢেকে যায়। মা অন্য ঘরে গিয়ে একা বসে থাকেন। অন্য ঘরে হু হু হাওয়ার সঙ্গে মা একা বসে কথা বলেন।
বাবার কানে খবরটি যায় যে মা মেট্রিক পরীক্ষা দেওয়ার স্বপ্ন দেখছেন। বাবা হা হা করে হাসলেন, সঙ্গে আমরাও। অবকাশ জুড়ে তখন হা হা হো হো হি হি। মা চপু সে যেতে থাকেন, মার স্বপ্নগুলো গেলাস পড়ার মত, এবাড়ির মেঝে যেহেতু শক্ত ইটের, পড়ে ভেঙে যায়। মা শেষ অবদি লেখাপড়ার শখ মেটান অন্যভাবে। পীরবাড়িতে মেয়েরা আরবি শেখে, বয়সের কোনও ঝামেলা নেই, যে কোনও বয়সের মেয়েই শুরু করতে পারে। পীরবাড়ি থেকে আরবি ভাষাশিক্ষা বই খান তিনেক নিয়ে এলেন মা আর নানির কাছ থেকে টাকা নিয়ে কিনে আনলেন বড় বড় লম্বা খাতা। ওসব খাতায় গোটা গোটা অক্ষরে আরবি ব্যাকরণের বিধিবিধান অনুশীলন শুরু করলেন ঠিক যেভাবে আমরা ইংরেজি ভাষা শিখেছি—সে খেলা করে, সে খেলা করিতেছে, সে খেলা করিয়াছে, সে খেলা করিল, সে খেলা করিতেছিল, সে খেলা করিয়াছিল,সে খেলা করিবে। মার বাংলা হাতের লেখা যেমন সুন্দর, আরবিও তেমন।
আরবি পইড়া কি হইব মা? আমি জিজ্ঞেস করি।
মা মধুর হেসে বলেন,আল্লাহর কালাম পড়া যাবে। কোরান হাদিস বুইঝা পড়া যাবে।
আমাদের সামনে পরীক্ষা, আমরা যত না পড়ি, মা তার চেয়ে বেশি পড়েন, রাত জেগে পড়েন। মার চিঠি লেখা নেই। গপ্প মারা নেই। মার লেখাপড়া বাবার নজরে পড়ে। তিনি বাড়ি ফিরেই ডাকেন, ছাত্রীসকল এদিকে আসো।
আমি আর ইয়াসমিন বাবার সামনে দাঁড়াই। বাবা ধমক দিয়ে ওঠেন, বাড়ির বড় ছাত্রী কই?
আমি হতবাক, আমিই তো বাড়ির বড় ছাত্রী, বাবা কি আমাকে দেখতে পাচ্ছেন না! দরজার পর্দা আঙুলে পেঁচানো বাদ দিয়ে বাবার চোখের সামনে দাঁড়াই যেন স্পষ্ট দেখেন, এমনিতেও একেবারে চোখের সামনে না দাঁড়ালে তিনি কোনও দাঁড়ানোকেই ঠিক দাঁড়ানো মনে করেন না।
আমার দিকে চোখ রেখেই বলেন, বড় ছাত্রীরে ডাকো।
আমি তো এইখানে। আমি বলি।
বাবা বলেন, তুমি কি পি এইচ ডি দিতাছ?
না।
একজন যে পি এইচ ডি দিতাছে, তারে ডাইকা লইয়া আস।
আমার তখনও মাথায় খেলে না বাবা কার কথা বলছেন। ইয়াসমিন বুদ্ধিতে আমার চেয়ে পাকা। ও চৌকাঠে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে ডাকল, মা, তাড়াতাড়ি আসো। বাবা ডাকতাছে। মা খাতা কলম বন্ধ করে বাবার সামনে এলেন। মা যে বাজারের লিস্টি দিয়েছিলেন, সেই লিস্টিটি হাতে নিয়ে বাবা জিজ্ঞেস করলেন, লবণ শেষ হইল কেমনে?
মা শান্ত গলায় বললেন, রাইন্ধা।
কি এত রাজভোগ রান্ধ্যা যে আড়াই সের লবণ দুই দিনে শেষ হইয়া যায়?
এত জানার ইচ্ছা থাকলে পাকঘরে বইয়া থাইকা দেইখেন কেমনে শেষ হয়।
লবণের দাম সম্পর্কে কোনও ধারণা আছে?
মা কোনও উত্তর দেন না।
বাবা দাঁতে দাঁত চেপে বলেন, আমি পরের মাসে লবণ কিনবাম, এই মাস লবণ ছাড়া খাইতে হইব সবার।
আমি লবণ ছাড়াই খাইতে পারি, আপনের ছেলেমেয়েরা পারে না, সবার পাতে আলদা লবণ লাগে। বলে মা অন্য ঘরে চলে যান। বারান্দার টেবিলে মার বইখাতাগুলো পড়ে থাকে, হাওয়ায় উড়তে থাকে খাতার পাতা।
বাবা রাতে ফিরে জরির মাকে ডেকে গলা খাটো করে জিজ্ঞেস করেন, আইচ্ছা নোমানের মা কি পিঁয়াজ রসুন চাইল ডাইল তেল এইগুলা সরায়?
কি জানি আমি জানি না।
দেখ নাই কিছু নিয়া যাইতে?
কত কিছুই তো নেয়।
কি নেয়?
ব্যাগের মধ্যে ভইরা কি নেয়, তা কি আমি দেহি! আমি কামের মানুষ, কাম করি।
ব্যাগ লইয়া বাইর হয় নাকি?
তা কি আর বাইর হয় না! কুনুহানো গেলে তো হাতে ব্যাগ একটা থাহেই।
কত বড় ব্যাগ?
ব্যাগ কি আর ছোড হয়, ব্যাগ ত বড়ই।
জরির মা বাবার ঘর থেকে ফিরলে মা জিজ্ঞেস করেন, তোমারে ডাইকা কি জিগাইল?
জিগাইল আপনে চাইল তেল এইগুলা লইয়া বাপের বাড়ি যান কি না।
কি কইছ তুমি?
কইছি আমি এইতা জানি না।
মা ফুঁসে ওঠেন, তুমি জান না? আমার বাপের কি চাইল ডাইল নাই নাকি? আমার বাপ কি পথের ফকির হইয়া গেছে? বাপের বাড়িতে এহনও বিরাট বিরাট পাতিলে রান্ধাবাড়া হয়, খাওনের অভাব নাই ওইহানে। আমগোর বাজান দালান তুলে নাই, কিন্তু খাওয়া দাওয়ায় কাপড় চোপড়ে অভাব রাখে নাই কোনওদিন। বড় বড় রুইমাছ, বড় বড় পাঙ্গাস মাছ,কাতল মাছ কিইনা আনে, পচা মাছ বাড়িত পাডায় না। আমিই উল্ডা মার কাছ থেইকা টাকা পয়সা আনি। আমারে এত মিথ্যা অপবাদ দিতাছে, আল্লার গজব পড়ব, ধং্ব স হইয়া যাইব এই দুষ্ট লোকের দেমাগ।
মা অর্ধেক রাত অবদি বিড়বিড় করেন। জরির মা মেঝেয় হাঁটু মুড়ে বসে বিড়বিড় শোনে।
পরদিন রান্নাঘরে গিয়ে আলমারি খুলে আনাজপাতি কি কি আছে, কবে কি কিনেছেন, কবে কি শেষ হল তার পই পই হিশেব নিলেন বাবা। হিসেবে গরমিল হচ্ছে বলে তিনি বড় একটি তালা কিনে এনে রান্নাঘরের আলমারিতে লাগিয়ে দিয়ে বললেন এখন থেকে চাল ডাল, পেঁয়াজ রসুন যা লাগবে, তিনি তালা খুলে বের করে দেবেন। চাবি প্যাণ্টের পকেটে নিয়ে বাবা বেরিয়ে গেলেন। পরদিন বাড়ি থেকে বেরোবার আগে আলমারির তালা খুলে মাকে ডেকে, আজকে দুপুরে মাগুর মাছ রান্না হবে, এই ধর একটা পিঁয়াজ। আর মসুরির ডাল এক কাপ রানলেই চলবে, ডালের জন্য এই নেও দুইটা কাঁচা মরিচ, একটা রসুন বলতে বলতে হাতে দেন আনাজপাতি, এক ছটাক তেলও দিয়ে যান মেপে।
বিকেলে ফিরে রাতের রান্নার আগে হিশেব করে বের করেন, কি লাগবে এবং কতটুকু। চাল লাগলে চাল, ডাল লাগলে ডাল, আর চামচে করে লবণ। এভাবেই চলে।
মা মার মত বেঁচে থাকেন। মাকে খুব নজরে পড়ে না। পড়ার টেবিলে বসে যখন মখু গুঁজে রাখি বইয়ে, মা টেবিলে গরম দধু রেখে যান এক গ্লাস, দুপুরবেলায় রেখে যান শরবত, শরবতের বা দুধের গেলাসেই নজর পড়ে, মাকে নয়। মা যখন পায়খানা থেকে বেরিয়ে সিঁড়ির কাছে বসে পড়েন, মাথা বনবন করে ঘুরছে বলে উঠে দাঁড়াতে পারেন না,কি হয়েছে জিজ্ঞেস করলে ভাঙা কণ্ঠে বলেন, পাইলসের রক্ত যাইতাছে খুব বেশি, শরীরটা দুর্বল লাগতাছে, মার শরীর বা শরীরের দুর্বলতার দিকে নজর পড়ে না, পড়ে পাইলস শব্দটির দিকে।
পাইলস কি মা?
পায়খানার রাস্তায় একটা গুটি মত হয়, তারপর পায়খানা কষা হইলে রক্ত যায়।
পাইলসের চিকিৎসা কি?
তর বাপরে কত কইলাম, পাইলসটার একটা চিকিৎসা করাইতে। কই কিছু তো করে না।
হুঁ।
তাই ত কই, বেলের শরবত খাও, শাক সবজি বেশি কইরা খাও। শাক সবজি তো মুখেই তুলতে চাও না। শাক না খাইলে পায়খানা নরম হইব কেমনে! তোমারও ত কষা পায়খানা। পায়খানা নরম থাকলে অর্শ রোগ হয় না।
অর্শ রোগ কি?
ওই পাইলসের আরেক নাম অর্শ।
তাইলে যে রাস্তার কিনারে গাছে টাঙানো সাইনবোর্ড থাকে, এইখানে অর্শ রোগের চিকিৎসা হয়, সেইটা কি এই রোগ?
হ।
মা ধীরে সিঁড়ির কাছ থেকে শরীরটি তুলে ঘরে এসে বিছানায় শুয়ে কড়িকাঠের দিকে মখু করে শুয়ে থাকেন। শরীর দুর্বল তাঁর। আমি পাশের ঘরে অর্শ শব্দটি নিয়ে ভাবতে থাকি, এত নোংরা একটি রোগের এত চমৎকার নাম কি করে হল!
মার এমনই জীবন। এই জীবন আমরা দেখে যেমন অভ্যস্ত, যাপন করেও অভ্যস্ত মা। একদিন কালো ফটকের শব্দ শুনে দৌড়ে গিয়ে দেখি, এক অচেনা লোকের সঙ্গে কথা বলে মা ফটক বন্ধ করলেন।
জিজেস করি কে এসেছিল।
কামালরে খুঁজতে আইছিল।
কে? কি নাম?
চিনি না, নাম কয় নাই।
কি ক্ইল?
জিগাইল, আপনে কে? আমি কইলাম আমি কেউ না, এই বাসায় কাজ করি।
এইটা কইলা কেন?
কামালের মা পরিচয় দিলে এই ছেলেই হয়ত অবাক হইত। ছিঁড়া ময়লা শাড়ি পিন্দা রইছি।
আমি চপু হয়ে যাই। মা হয়ত ঠিকই করেছেন মিথ্যে বলে, মনে হয়। ছোটদার ইজ্জত বাঁচিয়েছেন মা। মা যদি বলতেন তিনি কামালের মা, তবে আমার আশংকা হয় যে ছোটদার সঙ্গে দেখা হলে ওই ছেলে বলত, তোমার বাসায় দেখলাম একটা কাজের বেটি, বলল সে নাকি তোমার মা লাগে! কাজের বেটিদের আজকাল স্পর্ধা বাড়ছে অনেক।
মাকে রাখতেও পারি না, ফেলতেও পারি না। মা আমাদের জন্য রান্না করবেন, ক্ষিধে না লাগার আগে খেতে দেবেন, বাবা মারমুখি হলে বাবাকে সরিয়ে নেবেন বলে বলে যে, মেয়েরা হইল ঘরের লক্ষ্মী,ওদের গায়ে হাত তোলা ঠিক না, ওরা আর কয়দিন আছে, পরের ঘরে ত চইলা যাইব। মার হস্তক্ষেপে বাঁচি বটে, কিন্তু পরের ঘরে চইলা যাইব, বাক্যটি আমার গায়ে এত বেশি জ্বালা ধরায় যে হিংস্র বাবার চেয়ে দরদী মায়ের ওপরই আমার রাগ হয় বেশি।
পরের ঘরে চইলা যাইব মানেটা কি?
পরের ঘরে তো যাইতেই হইব! বিয়া শাদি হইলে যাইতে হইব না!
না যাইতে হইব না।
তা কি হয় নাকি?
হয়। অবশ্যই হয়।
সারাজীবন কেউ কি বাপের বাড়িতে থাকে?
থাকে। আমি থাকি। আমি থাকব।
বিয়ে শব্দটি শুনলে আমার গা রি রি করে ওঠে।
বিয়া হইয়া গেলেই তো মেয়েরা পর হইয়া যায় মা। মেয়েরা হ্ইল বাপের বাড়িতে একরকম অতিথি, যত পারো তাদেরে আদর যত্ন কর, পরে কপালে কি আছে সখু না দুঃখ,কে জানে!
নরম সুরে বলা হলেও মার শব্দগুলো বিষলাগানো তীরের মত বেঁধে আমার গায়ে। জন্মানো হল, শেকড় ছড়ানো হল, এতটা বছর গায়ে গায়ে লেগে থেকেও আমি কি না পর, আর বাইরে বাইরে থাকা, বিয়ে করে বাড়ি ছেড়ে চলে যাওয়া, বা বিয়ে করার স্বপ্নে বিভোর ছেলেরা আমার চেয়ে আপন মার! আমি তো বাবা সে যত পাষণ্ডই হোক, মা সে যত অসুন্দরী আর অশিক্ষিত হোক, ভাই সে যত হাড়কিপ্টে আর কুচুটে হোক, বোন সে যত বেয়াদপ আর বাচাল হোক, কাউকে পর ভাবতে পারি না। এরাই আমার সবথেকে আপন। অন্য এক অচেনা লোক আলটপকা এসে এদের চেয়ে বেশি আপন হয়ে উঠবে আমার! অসম্ভব! মাকে ইচ্ছে করে ঠেলে সরিয়ে দিই। ইচ্ছে করে মার মুখের ওপর ঠকাস করে দরজা বন্ধ করে দিই। মা খাবার দাও, মা আমার জামাটা কই, গোসলের সাবানটা আবার কই গেল মা, রিক্সাভাড়া হাতে না থাকার পরও মার ভরসায় রিক্সা চেপে বাড়ি এসে, মা তিনটা টাকা দাও তো অথবা মা গো, আমার জ্বর আসতাছে বললে মা কপাল ছোঁবেন, শুইয়ে দেবেন, শীতে হি হি করা শরীর ঢেকে দেবেন গরম লেপে,বাবাকে খবর পাঠাবেন জ্বর দেখে যেতে, ওষধু দিয়ে যেতে—এররকম ছোটখাট ব্যাপার ছাড়া মাকে জীবনের অন্য কিছুতে আমার মনে হয় না, কিছুমাত্র প্রয়োজন।
কালো ফটকের শব্দ হলে, বাবার ফটক খোলার শব্দ বাড়ির যে কোনও জায়গা থেকেই টের পাই যদিও, সামান্য সন্দেহ হলে আগে জানলা থেকে দেখি এল কে, সে যদি বাবা হয়, দৌড়, দৌড়ে যে যার নিজের জায়গায়।মুশকিল হল, দুপুর দুটো আড়াইটায় বই সামনে বসে আছি দেখতে পেলে ঠিক ধরে ফেলেন, তাঁর আসার শব্দ শুনে বসেছি, তখন উল্টোটা হয়,মনীষীদের বাণী ঝাড়ার আগে খিস্তি ঝেড়ে নেন। অবশ্য পরীক্ষার আগে আগে হলে দুপুর দুটো কী রাত দুটো হোক, ওখানেই বসে থাকা চাই। বাবা বলেন, চেয়ারে জিগাইরা আঠা লাগাইয়া বইয়া লেখাপড়া কর। আড়াইটায় বাবা এলেন। বাবা এলে কেবল নিজে সতর্ক হব তা নয়, বাড়ির সবাইকেই সতর্ক করতে হয়। কারণ আমি না হয়, যে সময়ে যেখানে থাকা দরকার সেখানে আছি, পড়ার ঘর থেকে সাদাসিধে ভালমানুষের মত বেরিয়ে কাঁধে গামছা নিয়ে গোসলখানায় যাচ্ছি, দপু রে নাওয়া বা খাওয়া ব্যাপারগুলো যেহেতু চলে বলে বাবা মনে করেন, কিন্তু ইয়াসমিন হয়ত আমগাছের মগডালে বসে আছে অথবা রান্নাঘরে অথবা ছাদে, যেসব, বাবা কিছুতেই মানেন না যে চলে, এবং যা চলে না তার কিছু কোথাও হতে দেখলে যেহেতু বাড়িতে হুলুস্থুল বাঁধিয়ে দেবেন—ইয়াসমিনের পিঠে তো পড়বেই কিছু আমার পিঠও বাদ যাবে না, তাই বাবাকে দেখে, আমি জানিয়ে দিই, আসলে যেই দেখে, তারই একরকম অলিখিত দায়িত্ব চেঁচিয়ে যত দ্রুত সম্ভব বাবার আগমন বার্তা ঘোষণা করে দেওয়া, সাধারণত ঘর থেকে বারান্দা অবদি দৌড়ে বাবা আইছে, বললেই বাড়ির প্রাণীগুলো যে যেখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে, ঊর্ধশ্বাসে ছুটে যাকে যেখানে বাবা ভাবেন যে মানায়, যায়, যেমন, বাড়ির কাজের মেয়েটি যদি বারান্দায় জিরোতে থাকে, সে ছুটে রান্নাঘরে সেধোঁয় বাসনপত্র মাজতে, নয়ত জল ভরতে কলপারে যায় কিছু একটা করতে, বাবা যেহেতু কারও বসে থাকা বা শুয়ে থাকা সইতে পারেন না। জানিয়ে দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ইয়াসমিন উঠোনে স্তূপ করে রাখা নারকেল পাতা ছিঁড়ে মাথার মুকুট বানাচ্ছিল, ফেলে দৌড়ে ঘরে ঢোকে, ঘোষণা কে শুনেছে না শুনেছে কে কোথায় অবস্থান নিল না নিল জানার আগে দ্রুত নিজের অবস্থান সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নিতে হয়, নিজের চরকায় তেল তো দিতে হবে না কি! ঘোষণা সেরে, গামছা কাঁধে যখন আমি গোসলখানার দিকে হাঁটছি, দেখি, মা খাচ্ছিলেন, বন্ধ করে ছুটে রান্নাঘরে ঢুকে আধখাওয়া থালা রেখে হাত ধুয়ে নিলেন। আমি গোসলখানায় ঢুকে গেলাম, ইয়াসমিন অঙ্ক করতে বসল, আর মা হাত ধুয়ে কুলোয় চাল নিলেন বাছতে, রাতের রান্নার প্রস্থুতি। গোসলখানা থেকে বেরিয়ে মাকে গলা চেপে জিজ্ঞেস করলাম, বাবা গেছে গা?
যায় নাই, শুইছে।
তুমি না খাইতাছিলা, খাওয়া থেইকা উইঠা পড়লা যে!
মা চাল থেকে কাঠপোকা সরাতে সরাতে বললেন তর বাবা কোনওদিনই আমার খাওয়া সহ্য করতে পারে না।
তুমি ত আর না খাইয়া বাঁইচা রইছ না! এইডা কি বাবা জানে না?
জানে। তবু চোখের সামনে দেখলে চিড়বিড় করে।
বাবার ভয়ে আমরা খেলা ছেড়ে যেমন উঠে যাই, মা তেমন খাওয়া ছেড়ে উঠে যান। বাড়ির সবাইকে খাইয়ে মা রান্নাঘরে অবেলায় খেতে বসেছেন, কাজের বেটি বা মেয়ে যেই থাকে বসেছে সঙ্গে, এররকম দৃশ্য দেখেই আমি অভ্যস্ত এর বাইরে, উৎসব পরবের দিন হলেও বাবা বা ছেলেমেয়েদের সঙ্গে মা খেতে বসেন না। কেন, এই প্রশ্ন কেউ কখনও করেনি, কারও মনে এই প্রশ্নটি নেই বলেই করেনি। আমরা যখন খাব, মা পাশে দাঁড়িয়ে আমাদের পাতে বেড়ে দেবেন খাবার, মা তাই করেন, এবং মাকে তাই করলে মানায় বলে বাবা যেমন জানেন, আমরাও জানি। মা চমৎকার রাঁধেন এবং বাড়েন বলে বাড়ির সবার বিশ্বাস।
ইশকুল থেকে বিকেলে ফিরে বেশ কদিন এমন হয়েছে যে ক্ষিধে পেটে খাচ্ছি, ওদিকে মা সারাদিন পর তখন দুপুরের খাবার খেতে বসেছেন, ভাত মাখছেন, মার মুখে চোখ পড়তেই দেখি ঠোঁটের কোণে অপ্রতিভ একটি হাসি, ভাতের থালা নিয়ে শেষ অবদি আমার আড়ালে চলে যান অথবা পরে খাবেন বলে হাত ধুয়ে ফেলেন।
হেসে বলি, কি উইঠা গেলা যে! তুমি শরম পাও নাকি!
মা কোনও উত্তর দেন না। মার হয় না, আড়াল ছাড়া খাওয়া ব্যাপারটি মার একেবারেই হয় না। মা আসলেই শরম পান কারও সামনে খেতে। বাবা বাড়ি এলে অবশ্য মা আড়ালেও খান না, বাবার যে আবার আনাচ কানাচের খবর নেওয়ার অভ্যেস আছে, আড়াল বলে কিছুই এ বাড়িতে তখন থাকে না। বাড়িতে, ধরা যাক বাবা শুয়ে রইলেন, শুয়ে রইলেন বলে যে আমরা খেলতে নামব বা গল্পের বইয়ে হাত দেব তা অসম্ভব কারণ শোয়া থেকে উঠে যে কোনও মুহূর্তে তিনি বেড়ালের মত পা ফেলে ফেলে সারা বাড়ি বিচরণ করতে পারেন, সুতরাং তিনি বাড়িতে, সে যে অবস্থাতেই তিনি থাকুন, এমনকি ঘুমিয়ে, কেউ এমন কিছু করার উদ্যোগ নেয় না, যা বাবা মনে করেন, উচিত নয়। হঠাৎ হঠাৎ বিকেলে বাড়িতে ঢুঁ মারেন বাবা। এমনই একদিন ঢুঁ মারতে গিয়ে, কালো ফটকের শব্দও কেউ সেদিন পায় নি, কোনও ঘোষণাও কেউ দেয়নি সতর্কে হবার, বাবা রান্নাঘরে ঢুকে পেলেন মাকে, খাচ্ছেন।
এত খাও কি? সারাদিন খালি খাওয়া আর খাওয়া। শইলে তেল বাইড়া যাইতাছে খাইতে খাইতে।
শুনে, মা থালা সরিয়ে হাত ধুয়ে নিলেন।
আমি শুনলাম, বাড়ির সবাই শুনল। আমাদের কাছে, এ অনেকটা, রাতে পড়ার টেবিলে বসে ঝিমোতে থাকলে বাবা যেমন বলেন, এত ঘুম আসে কেন! দিন রাইত খালি ঘুম আর ঘুম, শইলে এত আরাম কোত্থে আইল? পিঠে মাইর পড়লেই আরাম ছুইটা যাইব র মত।
ছোটদার সঙ্গে শিল্পসাহিত্য নিয়ে যেমন, রাজনীতি নিয়েও আলোচনা জমে ওঠে।
আচ্ছা ছোটদা ক্যুর পর কেন মেজর ডালিম, রশিদ, ফারুকরে দেশ ছাইড়া যাইতে হইল?
আরে তলে তলে ত একটা সেকেন্ড ক্যু হইয়া গেছে। তখন তো আর ডালিমদের পাওয়ার নাই।
আর সফিউল্লাহ? সে তো সেনাবাহিনী প্রধান ছিল। তারে কেন মাইরা ফেলল না? সে তো মুজিবের পক্ষের ছিল।
মুজিব ত তারে ফোনও করছিল রাতে, বত্রিশনম্বরে আর্মি পাঠাইতে। সফিউল্লাহ জিয়ারে ডাকল, ভোরবেলা জিয়া আইসা কইল দরকার নাই বত্রিশ নম্বরে যাওয়ার। সফিউল্লাহরও করার কিছু ছিল না।
তখন সফিউল্লাহ বুইঝা ফেলছে যে জিয়া তার অর্ডার মানতাছে না!
বুঝব না মানে! সফিউল্লাহ তহন একরকম হাউজ এরেস্ট। আর্মি চিফের অর্ডার কেউ মানতাছে না।
জিয়ারে কে সেনাবাহিনীর প্রধান বানাইল? মোশতাক, নাকি জিয়া নিজেই নিজেরে বানাইল!
কনসপিরেসিতে এরা সবাই ছিল।
খালেদ মোশাররফ যে জিয়ারে বন্দি কইরা ক্ষমতা নিয়া নিল, সেই খালেদ মোশাররফরে তো তিনদিন পরই কর্ণেল তাহের মাইরা ফেলল। তাইলে জিয়া কেন মারল কর্ণেল তাহেররে? জিয়ার ভালর জন্যই তো কর্ণেল তাহের বিদ্রোহডা করছিল।
তাহের তো খালেদ মোশাররফরে সরাইয়া দিয়া জাতীয় সরকার গঠন করতে চাইছিল। জিয়ারে চায় নাই।
কর্ণেল তাহের তো মুক্তিযোদ্ধা ছিল। আবার তো যুদ্ধে পা-ও হারাইছিল। যুদ্ধে আহত মুক্তিযোদ্ধারে কি ফাঁসি দেওয়া যায়? আইচ্ছা, কোনও রাজাকাররে কি ফাঁসি দেওয়া হইছে আজ পর্যন্ত?
না। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর প্রথম ফাঁসি একটা মুক্তিযোদ্ধার হইল।
জিয়ার সাথে মেজর ডালিমের বিরোধটা আমি ঠিক বুঝতে পারতাছি না।
তখন আর্মির ল এন্ড অর্ডার নষ্ট হইয়া গেছে। জিয়া সফিউল্লাহরে বঙ্গভবনে বাইন্ধা রাইখা নিজেরে জেনারেল ঘোষণা করল, কিছু লোক তার পক্ষে আইল, কিছু বিপক্ষে গেল।
ডালিম কি বিপক্ষে গেছিল?
না। ডালিমরে বিদেশ পাঠাইয়া দেওয়ার মূল কারণডা হ্ইল, জিয়া চায় নাই, একবার যারা ক্যু এ সরাসরি জড়িত ছিল, তারা তার আশেপাশে থাক। ক্যু কইরা একবার অভ্যাস হইলে যে বারবার ক্যু করতে ইচ্ছা করে।
তাইলে রিস্ক সরাইয়া দিল?
হ। কইতে পারস। যাওয়ার আগে জেলহত্যা কইরা গেল। চারনেতারে খুন কইরা গেল। ওদেরে দিলও তো ভাল ভাল চাকরি দিয়া পাঠাইয়া, এমবাসাডার কইরা দিল ডালিমরে। ডালিমও খুশি রইল, জিয়াও যা পাইতে চাইছিল,পাইল।
মা আমাদের আলোচনার মধ্যে আচমকা ঢুকে বলে বসলেন ডালিম? ডালিম তো পাকছে গাছে, একটা খাইয়া ল না!
আমি ঘর ফাটিয়ে হেসে উঠি।
আরে রাজনীতির কথা হইতাছে, গাছের ডালিমের কথা না।
রাজনীতির কি কথা?
বুঝবা না।
বুঝাইয়া কইলেই ত বুঝি।
ক্যু বুঝ? ক্যু?
ক্যু? রাইতের অন্ধকারে দেশের সরকাররে মাইরা ফেলারে তো ক্যু কয়, না?
মার কথায় এত বিরক্ত লাগে যে বলি, যাও তো মা! এইসব আলোচনা বুঝার ক্ষমতা তোমার নাই।
মা বেরিয়ে যান। বারান্দায় ভিখিরি বসা, ওদের সঙ্গে বসে দীর্ঘশ্বাস ফেলে ফেলে ওদের চালচুলোহীন জীবনের কথা শোনেন, মা ওদের কথা বোঝেন, ওরাও মার কথা। বন্যায় ভেসে গেছে কারও ঘর, কারও বাবা চলে গেছে আর ফেরেনি, কারও স্বামী মরে গেছে, কেউ অন্ধ, কেউ খোঁড়া, কারও জরায়ূ বেরিয়ে এসেছে বাইরে। জরায়ু বেরিয়ে আসা দুলুর মাকে মা আলাদা খাতির করেন। এক মুঠির বদলে এক পোয়া চাল ঢেলে দেন দুলুর মার টোনায়, আর শুকনো মখু দেখলে আগ বাড়িয়ে বলেন, দুলুর মা দুইডা খাইয়া যাও। সেদিনও, ছোটদার ঘরে বসে রাজনীতি নিয়ে যখন গভীর চিনতাভাবনা করছি, মা দুলুর মাকে খেতে দিয়েছেন। দুলুর মা বারান্দায় বসে মার দেওয়া ভাত তরকারি খেয়ে, হাত তুলে মার জন্য দোয়া করে আমার মাথায় যতগুলা চুল, ততগুলা বছর তারে তুমি পরমায়ু দিও আল্লাহ। আমারে যে খাওয়াইল, তারে তুমি সুখে রাইখ। আমার আত্মাডারে যে শান্তি দিল, তারে তুমি শান্তি দিও আল্লাহ। ঝি পুত লইয়া সে য্যান সারাজীবন সুখে শান্তিতে থাকতে পারে।
মা দুলুর মার দোয়া শোনেন ভাবলেশহীন মুখে।