What's new
Nirjonmela Desi Forum

Talk about the things that matter to you! Wanting to join the rest of our members? Feel free to sign up today and gain full access!

Collected নির্বাসন (আত্মজিবনী) (1 Viewer)

Kaptan Jacksparoow

Community Team
Elite Leader
Joined
Apr 6, 2019
Threads
334
Messages
6,315
Credits
49,031
T-Shirt
Profile Music
Recipe sushi
Rocket
Euro Banknote
Butterfly
nirbasonf915d6534c3862c4.jpg

নির্বাসন – আত্মজীবনী সপ্তম খণ্ড
তসলিমা নাসরিন
প্রথম প্রকাশ জানুয়ারী ২০১২
 
০১. নিষিদ্ধ মত, দ্বিখণ্ডিত পথ


হারভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে একটা অদ্ভুতও নয়-চমৎকারও নয়-খুব যাচ্ছে তাই নয়-আবার খুব ঝলমলেও নয় জীবন পার করেছি। টানা এক বছর। হারভার্ড ল’ ইস্কুলের উল্টোদিকে পঞ্চাশ ল্যাঙ্গডন স্ট্রিটের সাদা তিনতলা বাড়ির তিনতলাটি ভাড়া নিয়ে নিই হঠাৎ একদিন। বাড়ি থেকে হেঁটে হেঁটে হারভার্ডের কেনেডি ইস্কুলএ যাই। কেনেডি ইস্কুল অব গভর্মেন্ট। হারভার্ডের এই ইস্কুলটিই শুনেছি সবচেয়ে নামি-দামি। নামি, দামি, বিখ্যাত, বিরাট এসব শব্দ আমাকে আকষ্ট করে না। মানুষগুলো ভালো কি না, সৎ কি না, মনে যা, মুখে তা-ই কি না সেটাই আমি আগে দেখি। কেনেডি ইস্কুলের হিউম্যান রাইটস সেন্টারে আমার জন্য অফিস, ডেস্ক, কমপিউটার, ইন্টারনেট, প্রিন্টার, কাগজ, কলম, স্টেপলার, আলপিন খুঁটিনাটি। অফিসের দরজা খুলে বেরোলেই করিডরে চা কফি বিস্কুট। নিচের ক্যাফেটেরিয়ায় সুস্বাদু স্বাস্থ্যকর খাবার। গলায় আমার হারভার্ডের আইডি ঝোলে। ‘রিসার্চ স্কলার’, কেনেডি ইস্কুল, হারভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়। এই আইডি জাদুর মতো কাজ করে। হারভার্ডের অলি গলি চষে বেড়ানো যায়। অত বড় লাইব্রেরি থেকে যখন তখন দুষ্প্রাপ্য বই নিতে পারা, রাতে যতক্ষণ খুশি অফিসে কাটাতে পারা, দু’মিনিটে ব্যাংকের অ্যাকাউন্ট হয়ে যাওয়া, মুহূর্তে চিকিৎসা হয়ে যাওয়া যে কোনও অসুখের! কী নয়।

দিনে প্রায় সারাদিন অফিসেই থাকি। কাছের কোনো রেস্তোরাঁয় খেতে যাই দুপুরে। কখনও ভারতীয় রেস্তোরাঁ, কখনও সাদামাটা আমেরিকান, কখনও সী ফুড। বিকেলে সাঁতার কাটি নয়তো মানুষের গোছানোবা এলোমেলো জীবন দেখতে দেখতে অনেকটা পথ অবধি আনমনে হাঁটি। ওজন পঞ্চাশ কিলো। জিনস, টপস। দেখতে কিশোরী কিশোরী। সুদর্শন হারভার্ড ফেলো গ্রেগ কারের সঙ্গে বন্ধুত্ব হতে হতে হয় না, স্টেডিয়ামে পাশে বসিয়ে হারভার্ড আর ব্রাউনের ফুটবল খেলা বোঝালো, সুইটি টুইটি বলে বেশ ই-মেইল করলো অনেকদিন, ফেরারিতে চড়ে চলে এলো বাড়িতে, নেমন্তন্নও করলো তার পেন্টহাউজে। কিন্তু হঠাৎ কী কারণে জানি না, আমেরিকার ইরাকে বোমা ফেলাকে পছন্দ করিনি বলে নাকি এ নিয়ে বেজায় তর্ক করেছি বলে, যোগাযোগ দুম করে প্রায় বন্ধ করে দিল। অত প্রেম নিমেষে উড়ে গেল! বড়লোকদের শখ আর রকম সকমে আমার উৎসাহ চিরকালই কম। তবে গ্রেগ কারকে আমি শ্রদ্ধা করি এবং করবো, হারভার্ডে হিউমেন রাইটসের সেন্টার খুলেছেন বলে। টাকা তো অনেকের হাতেই আছে, ক’জন আর মানবাধিকারের সেবায় কোটি কোটি টাকা ঢালে! হারভার্ডের ফেলো আর প্রফেসরের সঙ্গে মাঝে মাঝেই জগতের একশ’ বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়। কবিতা লিখি। আত্মজীবনী লিখি। প্রবন্ধ লিখি। দূরের কোনো অচেনা মানুষের জন্য প্রেমের চিঠি লিখি। আবার হারভার্ডের জন্য সেকুলারিজম এর ওপর একটা বড় লেখাও লিখতে হয়। মাঝে মাঝে এদিক ওদিক যাওয়া হয়, দেশে, দেশের বাইরে, ইউরোপে, কিছু না কিছুতে, পুরস্কার আনতে, নয়তো কবিতা

পড়তে, বক্তৃতা দিতে। বক্তৃতাটা বিশ্ববিদ্যালয়ে, বস্টন বিশ্ববিদ্যালয়ে, বক্তৃতা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের জেনারেল অ্যাসেম্বলিতে, সঙ্গে জাতিসঙ্ঘের মানবাধিকার নেত্রী মেরি রবিনসন, বস্টনের কেমব্রিজ সেন্টারে কবিতা পাঠ, সঙ্গে ভ্যাজাইনা মনোলগ-এর ইভ এন্সলার, হারভার্ডের উইমেন স্টাডিস ডিপার্টমেন্টের ফাণ্ড রেইজেংএ সাহায্য করা, মাইকেল ইগনাটিফ বা স্যামুয়েল হান্টিংটঙের ক্লাস বা হারভার্ডে আসাবিখ্যাত অতিথিদের বক্তৃতা শোনা, নোয়াম চমস্কির সঙ্গে তাঁর এমআইটির ঘরে আড্ডা আর ইমেইলে ইরাক যুদ্ধ নিয়ে আলোচনা, যুদ্ধের প্রতিবাদে আমার লেখালেখি, দল বেঁধে বস্টনের ফেনওয়ে স্টেডিয়ামে গিয়ে রেড সক্সএর বিখ্যাত বেইসবল দেখা, হঠাৎ ক্যান্সারে আক্রান্ত দীর্ঘদিনের বন্ধু স্টিভ লেসিকে দেখতে যাওয়া, হারভার্ড চ্যাপলেন্সিতে মানববাদীদের সঙ্গে মানববাদ নিয়ে আলোচনা, সুয়ানি হান্টের বাড়িতে পাঁচমিশেলি অনুষ্ঠানে অংশ গ্রহণ করা, মাঝে মাঝে কিছুদিন নিউইয়র্ক, হঠাৎ আবার কলকাতা ঘুরে আসা বইমেলায়। আবার হারভার্ড।

.

এর মধ্যে খবর পাই বাংলাদেশ তেতে উঠেছে। বিবিসি খবরটা দেয়। কলকাতায় প্রকাশিত আমার আত্মজীবনীর তৃতীয় খণ্ড ‘দ্বিখণ্ডিত’র বাংলাদেশ সংস্করণের নাম ‘ক’। প্রথমে ‘ক’ ই ছিল নাম। পশ্চিমবঙ্গের প্রকাশক ‘ক’ নামটায় আপত্তি করায় নাম দিয়েছি”দ্বিখণ্ডিত। ‘ক’ বেরোবার সঙ্গে সঙ্গেই নাকি আগুন জ্বলছে। আমাকে যাচ্ছেতাই ভাষায় গালাগালি করা হচ্ছে সব পত্রিকায়। লেখক-শিল্পী-সাহিত্যিক আমার বিরুদ্ধে ক্লান্তিহীন নিন্দায় মেতে আছেন। কার কার সঙ্গে শুয়েছি তাই নাকি লিখেছি আমি বইয়ে, আমার মতো নির্লজ্জ বেশ্যা’ আর জগতে নেই। বইয়ের যে পাতায় লেখা আছে আমার ‘শোয়াশুয়ি’র ঘটনা, সেই পাতা ফটোকপি করে ছড়ানো হচ্ছে সবখানে। সৈয়দ শামসুল হক একবার আমাকে বেড়াতে নিয়ে গিয়েছিলেন দুরে। সেখানে গিয়ে আমার যে ধারণা জন্মেছে তাঁর সম্পর্কে, নিতান্তই তার নিটোল বর্ণনা ছিল এক জায়গায়। এ নিয়ে তাঁর রাগ করার কিছু আমি দেখি না। কিন্তু শুনেছি তিনি রাগে নাকি হায়েনার মতো করছেন। এ কথা প্রথম জানিয়েছিলেন মেজবাহউদ্দিন, বইয়ের প্রকাশক। তাঁর শ্যালিকার সঙ্গে তাঁর যে একটা গোপন সম্পর্ক আছে, তা আমার লুকোনো উচিত ছিল, কিন্তু আমি লুকোইনি। সৈয়দ হকের রাগের কারণ এটিই। শ্যালিকা নিয়ে লেখা বইয়ে একটিই বাক্য সম্ভবত আছে, ওই বাক্যটি পড়েই তিনি উত্তেজিত। আমি নাকি যা লিখেছি সব মিথ্যে, মামলা ঠুকে দিলেন ১০ কোটি টাকার। সাক্ষাৎকার দিচ্ছেন সবখানে, ‘তসলিমা আমার চরিত্র হনন করেছে। মান-সম্মান ধুলোয় মিশিয়ে দিয়েছে। ৫২ বছরে লেখক হিসেবে আমি যে সম্মান কুড়িয়েছিলাম তা আজ ধুলোয় ধূলিস্যাৎ। নিশ্চয়ই এর পিছনে কিছু রহস্য আছে। না হলে তিনি দেশের এত সম্মানিত লেখক ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের বিরুদ্ধে লিখতে সাহস পেতেন না। আমার মনে হয়েছে, প্রতিবাদ করা দরকার। তাই মামলা ঠুকে প্রতিবাদ জানালাম। তসলিমার বইয়ে এ ধরনের আরও যাদের নাম রয়েছে, আমি আশা করবো তারাও কোনো না কোনো পদক্ষেপ নেবেন। আমারটা আমি ভেবেছি, আইনের আশ্রয় নিয়ে করবো।’

বিবিসি থেকে আমার মন্তব্য চাইতে ফোন করলো, শুনিয়েও দিল সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় আর সৈয়দ হক আমার বিরুদ্ধে কী নিন্দা করেছেন সেসব। ক্রোধ,ঘৃণা, বিদ্রূপ, কটাক্ষ দুজনের কণ্ঠেই। সৈয়দ শামসুল হক না হয় তার গোপন সত্য প্রকাশ হওয়ায় হিতাহিত জ্ঞানশূন্য, চেঁচিয়ে, লাফিয়ে, হম্বিতম্বি করে, গালি দিয়ে, থুতু ছুঁড়ে, মামলা করে বোঝাতে চাইছেন যে তাঁর সম্পর্কে যা লিখেছি আমি তা ভুল। কিন্তু সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় নিয়ে বইয়ে তেমন কোনো কথা নেই। তার এত রাগ কেন! তিনি তো কোনো ‘পুরুষ রক্ষা সমিতি’র সদস্যও নন। তিনি বারবারই বলেছেন, দুটো মানুষের মধ্যে দরজা বন্ধ করে। যা ঘটে, তা কখনো বাইরে প্রকাশ করতে হয় না। বাইরে প্রকাশ করা যাবে না, এমন কাজ অপরাধীরাই করে। আর অপরাধীদের বাঁচানোর দায়িত্ব কে বলেছে সব মেয়েকেই নিতে হবে। আগুন যেমন এক অরণ্য থেকে আরেক অরণ্যে বাতাসের আগে ছুটে যায়, তেমন গেল, কলকাতাতেও সাহিত্য মহলের একাংশে নিন্দার ঝড় বইছে, এই ঝড়ের দেবতা, কেউ কেউ বললো, স্বয়ং সুনীল। যদিও তাঁর কিছুই আমি ফাঁস করিনি, কিন্তু কিছু যদি করি পরের বইগুলোতে, এই ভয়। আমাকে বাতিল করে, ব্যান করে, ত্যাগ করে, ত্যাজ্য করে পাঠকের কাছে আমাকে মিথ্যুক, অযোগ্য, কাণ্ডজ্ঞানহীন, ভারসাম্যহীন লেখক হিসেবে দাঁড় করাতে পারলে কেউ আমার কথা আর বিশ্বাস করবে না, আমার লেখা আর পড়বে না। এই নিন্দার ঝড়তুফান শান্ত হওয়ার আগেই খবর ছাপা হয়, পশ্চিমবঙ্গ সরকার ‘দ্বিখণ্ডিত’ নিষিদ্ধ করেছেন। পঁচিশ জন লেখক, বুদ্ধিজীবী পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর কাছে আবেদন জানিয়েছিলেন আমার ‘দ্বিখণ্ডিত’ নিষিদ্ধ করার জন্য। মুখ্যমন্ত্রী সবার কথা শুনেছেন, নিজেও বইটি কয়েকবার পড়েছেন। পড়ে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন নিষিদ্ধ করার। নিষিদ্ধ করা হয়েছে অবশ্য অন্য কারণ দেখিয়ে, আমি নাকি মানুষের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দিয়েছি। ওদিকে বাংলাদেশে ‘ক’ নিষিদ্ধ। হাইকোর্টে সৈয়দ শামসুল হক আমার বিরুদ্ধে দশ কোটি টাকার মামলা করেছেন মানহানির, বই নিষিদ্ধ করার আকুল আবেদন জানিয়েছেন সরকারের কাছে। সরকার বই নিষিদ্ধ করার আগেই হাইকোর্ট নিষিদ্ধ করেছে। এসবে অনুপ্রাণিত হয়ে কী না জানি না, কলকাতায় প্রায় অচেনা এক কবি মানহানির মামলা ঠুকে দেয়, এ আবার এগারো কোটির। লেখকরা বই নিষিদ্ধ করছেন, লেখকরা লেখকের বিরুদ্ধে মামলা করছেন। জগতের কোথাও এমন ঘটনা ঘটে না। সভ্য লেখকরা লেখকের বাক স্বাধীনতার পক্ষে দাঁড়ান, বই নিষেধাজ্ঞার বিরুদ্ধে কথা বলেন। বাংলার লেখকদের যত দেখি, তত অবাক হই। বেশির ভাগই স্বার্থপর, সুযোগসন্ধানী, সরকারী আনুকূল্য ছাড়া বাঁচতে জানেন না। আদর্শ! নীতি! ওসব মুখে বা বইয়ে। অন্তরে নেই, বিশ্বাসে নেই, জীবন যাপনে নেই।

.

পশ্চিমবঙ্গ আর বাংলাদেশের বিখ্যাত সাহিত্যিকরা আমার নিন্দায় বিষম মেতে আছেন। নিন্দা কী রকম বীভৎস হতে পারে, কুৎসা কী রকম নির্মম হতে পারে, ঘৃণা কী রকম ভয়ংকর হতে পারে, তা অনুমান করতে হলে শুনতে হয় ওঁরা কী বলছেন, কী লিখছেন আমাকে নিয়ে। বাংলাদেশের লেখক হুমায়ুন আজাদ লিখলেন, “আমি ‘ক’ বইটি পড়ার উপযুক্ত মনে করিনি বলেই পড়িনি। এই বইয়ে আমাকেও নানারকম গালাগালি করা হয়েছে, মিথ্যে কথা লেখা হয়েছে। কিন্তু আমার সম্পর্কে কোনও যৌনতার অভিযোগ আনতে পারেনি। কারণ আমি কখনই তসলিমার ডাকে সাড়া দিইনি। সম্প্রতি প্রকাশিত ‘ক’ বইটি সম্পর্কে বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় পড়ে আমার মনে হয়েছে, এটি একটি পতিতার নগ্ন আত্মকথন অথবা একজন নিকৃষ্টতম জীবনের কুরুচিপূর্ণ বর্ণনা।’

হুমায়ুন আজাদ প্রায়ই ধর্মের সমালোচনা করেন। আমি নারীর অধিকার নিয়ে লিখতে শুরু করার পর তিনিও একই বিষয় নিয়ে একটি বই লিখতে শুরু করেন। বই লিখেছেন কিন্তু মেয়েদের প্রতি কখনও তার কোনও শ্রদ্ধাবোধ দেখিনি। একসময় নারী বিরোধী প্রবচন লিখেছেন। নারীর পক্ষে লিখলে জনপ্রিয়তা অর্জন সম্ভব হতে পারে, তা আমার ‘নির্বাচিত কলাম’এর জনপ্রিয়তা দেখেই ‘নারী’ নামে বই লিখেছেন, কিন্তু নারীকে যৌনবস্তু ভাবার মন বই লেখার আগে যেমন ছিল, তেমনই রয়ে গেছে। কোনও পরিবর্তন হয়নি। আমার সম্পর্কে মিথ্যে উচ্চারণে হুমায়ুন আজাদের কোনও অসুবিধে হয় না। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর তিনি, বলে ফেললেন তসলিমার ডাকে আমি সাড়া দিইনি। যেন আমি তাঁকে ডেকেছিলাম কোনওদিন! একজন ডাক্তার, তার ওপর জনপ্রিয় লেখক, সাহিত্য পুরস্কার সহ প্রচুর মানবাধিকার পুরস্কার পাওয়া প্রচণ্ড ব্যক্তিত্বসম্পন্ন একজন নারীর আত্মজীবনীকে তিনি বলে দিলেন ‘পতিতার নগ্ন আত্মকথন এবং নিকৃষ্টতম জীবনের কুরুচিপূর্ণ বর্ণনা’। প্রচণ্ড নারীঘৃণাকারী বদমাশও কোনো নারী সম্পর্কে না জেনে না বুঝে এই মন্তব্য করতে না। হুমায়ুন আজাদের মতো দুশ্চরিত্র, মিথ্যুক, ঈর্ষাকাতর, ছোট-লোক যদি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হন, তবে নতুন প্রজন্ম কী শিক্ষা পেয়ে বড় হবে, ভেবে আমি শংকিত হই, সত্যি। নারী বিরোধী সমাজে নারী বিরোধী হুমায়ুন আজাদকে ঘিরে থাকার জন্য নারী বিরোধী বালককুলের অভাব হয় না।

নিমা হক বলেছেন, ‘স্বাধীনতা ভোগের একটা সীমা আছে। তসলিমা সে সীমা লঙ্ঘন করেছেন। সাহিত্যের নামে এই ধৃষ্টতার জন্য তার শুধু তিরস্কারই প্রাপ্য নয়, প্রাপ্য শাস্তিও’। আসাদ চৌধুরীকে বহুকাল চিনি, খুব প্রশংসা করতেন আমার লেখার। তিনি বলেছেন, ‘ব্যক্তি সমাজ বিশাল জনগোষ্ঠী নিয়েই সাহিত্য, কোনও লাম্পট্যের নির্লজ্জ বর্ণনা কখনো সাহিত্য হতে পারে না’।

এদিকে পশ্চিমবঙ্গের বিখ্যাত লেখকরা শকুনের মতো খামছে ধরেছেন আমাকে। সমরেশ মজুমদার লিখলেন, ‘প্রায় ৯০ বছর আগে কলকাতার সোনাগাছিতে খ্যাতনামা বেশ্যা থাকতেন। তাঁর নাম ছিল নন্দরানী। কলকাতার প্রায় সমস্ত খ্যাতনামা ব্যক্তিদের যাতায়াত ছিল তাঁর কাছে। অবশ্যই খদ্দের হিসেবে। তিনি যদি এঁদের নিয়ে উপন্যাস রচনা করার কথা ভাবতেন তাহলে তিনি তা অনেকদিন আগেই করতে পারতেন। কিন্তু তিনি তাঁর ব্যক্তিগত জীবনে সমাজে চুপচাপ থাকার ভদ্রতা ও সৌজন্যের পরিচয় দিয়েছিলেন। কিন্তু তসলিমা নাসরিন নন্দরানীর সেই আত্মসম্মানবোধের অংশীদার হতে পারেননি। তসলিমা শাড়ি বদলাবার মতো করে পুরুষ বদলেছেন। মানসিক সম্পর্কের চেয়ে শারীরিক সম্পর্কের ওপর জোর দিয়ে এসেছেন। সাধারণ মেয়েরা তাঁর এই দ্বিচারিতার কথা জানতে পারেনি। তবে সবারই বাক স্বাধীনতা আছে। তসলিমা বলেছেন, আমরা শুনেছি। বিচার করার ক্ষমতা নিজেদের ওপর নির্ভর করছে। ঘরের ভিতর বন্ধুবান্ধবের মধ্যে খিস্তি খেউর করা যায় কিন্তু প্রকাশ্যে তা করলেই তাকে অশ্লীলতা বলে। এখন যা তিনি প্রকাশ্যে বলছেন, একসময় সেই কাজে নিজেই সহযোগিতা করেছেন। আসলে ওঁর উদ্দেশ্য ছিল বই বিক্রি করা এবং প্রচার পাওয়া। পশ্চিমবঙ্গের কবি সুবোধ সরকার লিখেছেন, তিনি সুইডেন থেকে ‘ক’ নামে একটি যৌন বোমা পাঠিয়েছেন ঢাকায় এবং ঢাকায় সেটি ফেটেছে। বইটিতে নাকি সমাজ নিয়ে, পরিবার নিয়ে, ধর্ম নিয়ে কথা আছে, কিন্তু কে শোনে ওদের কথা, যখন একই মোড়কে রয়েছে বেশ কয়েকটি রগরগে বেড সিন। বেডসিনের কাছে এই মর পৃথিবীতে ইরাক-আমেরিকাও তুচ্ছ সেটা আবার বোঝা গেল। ..হায়রে, যৌনতা কি তসলিমার ভেতরের কোনো দুরারোগ্য ব্যাধি, যা তার বাবাকে ছাড়ে না, বাবার বয়সীদেরও ছাড়ে না! শুনেছি আপনার যৌনকেচ্ছার তালিকা নাকি আরও বেরোবে। কলকাতার লেখকরাও দিন গুনছেন। নিশ্চয়ই আপনার স্টকে ফরাসি ইতালিয়ানরাও আছেন। অচিরেই আপনার নাম বিখ্যাত বাঈজির তালিকায় উঠবে। দু’একজন বাঙালি স্কলার আপনাকে নিয়ে বই লিখবে, একজন লেখিকা কোন আর্থ সামাজিক চাপে বাঈজি হয়ে গেলেন। ভাগ্যিস, আপনি সুইডেনে থাকেন। খারাপ পাড়ার লোকেরা এরপর জানতে চাইবেন, কীসে আপনার পেমেন্ট হয়, ডলারে, সুইডিশ ক্রোনারে, টাকায় না রুপিতে? ভাষাহীন মেয়েদের ভাষা দিতে চেয়েছিলেন আপনি, সেই মহৎ ইমেজ আর থাকলো না। এবার মেয়েরাও আপনাকে ছুলে ডেটল দিয়ে হাত ধোবেন। আরবের আতরও আপনার ছোট্ট দুটো হাতের গন্ধ দূর করতে পারবে না কোনোদিন’।

আরেক বিখ্যাত লেখক শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় বলেছেন, ‘শুনেছি বুদ্ধিজীবীদের সঙ্গে তার যৌনসম্পর্কের নানা বর্ণনা তিনি দিয়েছেন। আমি এটাকে অশ্লীল বলে মনে করি না। তিনি যদি তার বিবেক মুক্তির জন্য লিখে থাকতেন তাহলে বলার কিছু ছিল না। কিন্তু চমক সৃষ্টির উদ্দেশ্য নিয়ে লিখেছেন। এটাকে আমি মেনে নিতে পারি না। সাহিত্য ও অশ্লীলতার মধ্যে সীমারেখা টানতে জানাই সাহিত্যিকদের দায়িত্ববোধের পরিচয়’।

নবনীতা দেব সেনও বলেছেন মন্দ। বাণী বসুও মন্দ। বাণী বসু বলেছেন, ‘আত্মজীবনী পড়ে যদি গিমিক মনে হয় তাহলে তার সততা নিয়ে সকলে প্রশ্ন তোলে। পাঠকের এই কৌতূহল সাময়িক। সাহিত্য বিচারে তার লেখা নিম্নমানের। এই ধরনের লেখার কোনো সাহিত্যমূল্য নেই। এই বাণী বসুও অবশ্য পরে দৈনিক স্টেটসম্যানএ ছাপা হওয়া আমার কলাম পড়ে ফোন করেছিলেন আমাকে, বলেছিলেন আমার লেখা নাকি খুব ভালো লাগে তাঁর। অবশ্য আমি জানি না আমি ছাড়া বাইরের কাউকে তিনি তার মুগ্ধতার কথা জানতে দিয়েছেন কি না।

মল্লিকা সেনগুপ্ত, নতুন নারীবাদী কবি, লিখলেন, এখানে শুধু শোওয়ার জন্য শোওয়া। একের পর এক তালিকা। এটা কোনো আত্মজীবনী হতে পারে না। এর মধ্যে কতটা সত্যি আছে জানি না, কারণ অতীতেও তার সততায় সংশয় ছিল। এর সাহিত্যিক সততা এবং নারীবাদী সততা আমার কাছে স্বচ্ছ নয়। প্রতিটি সম্পর্ক তসলিমা নিজেই তৈরি করেছেন। সেখানে কার সঙ্গে শুয়েছেন, কার সঙ্গে কি করেছেন সেটা চমক তো বটে। এর মধ্যে কোনো বিশেষত্ব নেই। তসলিমার এই জীবনলেখ মানুষের আস্থা হারিয়েছে।… শোবার ঘরের অন্য গল্প আছে, কিন্তু তাঁর মতো রগরগে ভাষায় লেখার রুচি সকলের হয় না। হয় না বলেই সাহিত্য টিকে আছে। তসলিমার শোবার ঘরের চেয়ে অনেক বড় জায়গায় নারীবাদের লড়াই বেঁচে আছে।

গৌতম ঘোষ দস্তিদারকে বন্ধু-কবি বলেই জানতাম। তিনি দ্বিখণ্ডিত সম্পর্কে লিখলেন, ‘এই স্ববিরোধিতা, এইসব সচেতন যুক্তিহীনতা, অর্ধসত্য, ক্লেদ আর নির্লজ্জতাই তসলিমার চরিত্র। মূল্যবোধ জাতীয় কোনো শব্দ তসলিমার অভিধানে নেই। খ্যাতি, খ্যাতি আর খ্যাতি ছাড়া কোনো লক্ষ্য নেই। অখ্যাতিকেও তিনি খ্যাতি বলে ভাবেন। ফলে, সত্যের অছিলায় নিজের জীবনকাহিনী লিখতে গিয়ে নিজেকেই কেবল নগ্ন করে দেখান না, অন্যকেও নগ্ন করেন। এখানেই তার মূল্যবোধহীনতা প্রকট হয়ে ওঠে। আমরা যদি তার এইসব যৌনগাথাগুলিকে সত্যি বলেও ধরে নিই, তাহলেও প্রশ্ন ওঠে, এই গোপন তিনি প্রকাশ্যে করতে পারেন কি না, তাতে সম্পর্কের (হোক তাজৈব) শর্ত ভাঙে কি না। অবশ্য, তসলিমার কাছে এইসব স্বাভাবিক বৃত্তি আশা করা বৃথা। প্রথমাবধিই তাঁর এই জাতীয় মূল্যবোধ গড়ে ওঠেনি’।

আর কমিউনিস্ট লেখক আজিজুল হক লিখলেন, ‘শারীরিক এবং মানসিকভাবে দেউলিয়া লেখিকা লজ্জা বিসর্জন দিয়ে রাস্তায় নেমেছেন। পোশাক পরে আছেন নেহাত অভ্যাসবশত। ..এটা নাকি বাক স্বাধীনতা। ভাদুরে কুকুর রক্ষা সমিতির দাবি, পাগলা কুকুরদের খ্যাক খ্যাক করে তেড়ে আসার অধিকারটাও হিউম্যান ফ্যাসিজমের বিরুদ্ধে কুকুরীয় স্বাধীনতা। কারুর যদি যা খুশি বলার স্বাধীনতা থাকে, অন্য কারুর হাতের স্বাধীনতা থাকতেই পারে। গলাটা টিপে দেওয়ার স্বাধীনতাই বা থাকবে না কেন! কোনো মহিলা যদি নিজের দেহকে পাবলিক ইউরিনাল করে সাজিয়ে তুলে ধরেন, কী বলবেন? সুলভ কমপ্লেক্স হলে পে এণ্ড ইউজ। এতে হইচই করার কী আছে? .. নিষিদ্ধ নয়, বর্জন করুন এই বর্জ্য পদার্থ। রাস্তায় বর্জ্য পদার্থ পড়ে থাকলে কেউ লাথি মারে না। হয় ডিঙিয়ে যায়, না হয় সাফাইকর্মী ডাকে। সাফাইকর্মীরা সাফ করুক। প্রতিরোধ গড়ে উঠুক ছাপাখানায়। বাইণ্ডারদের কারখানায়। জবাব এটাই। ..সুস্থ সংস্কৃতির জন্য যারা গলা ফাটান, তাঁরা কোথায়? কোথায় গেলেন সেই কর্মী বাহিনী, যারা প্রকাশক, মুদ্রক, এবং বাঁধাইখানার সামনে পিকেট করে আমাদের সংহতি বিনষ্টকারী বর্জ্য পদার্থটিকে (বই বলতে ঘৃণা হয়) বর্জনের জন্য আন্দোলন গড়ে তুলবেন?’

আজকাল পত্রিকার সম্পাদক অশোক দাশগুপ্ত লিখেছেন, ‘তসলিমার দ্বিখণ্ডিত দুটি কারণে জঘন্য, বর্জনীয়। প্রথমত রুচি, অশালীনতা, অবাধ চরিত্রহনন। মামলা হয়েছে ঢাকায়, কলকাতায়। রাজ্য সরকার সে জন্য নিষিদ্ধ ঘোষণা করেনি। কিন্তু আমরা এই প্রথম কারণটিও একটু দেখব। ক. সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় বলেছেন, প্রাপ্ত বয়স্ক পুরুষ ও প্রাপ্ত বয়স্ক নারী যদি স্বেচ্ছায় কোনও সম্পর্ক স্থাপন করেন, তা একধরনের চুক্তি, যে কোনও একজন নিজের স্বার্থে তা প্রচার করতে পারেন না। অন্তত, উচিত নয়। খ. ফুটপাতের হলুদ মলাটের বইয়ে হয়তো আরও রগরগে বর্ণনা থাকে, কিন্তু সেখানে সব চরিত্র কাল্পনিক, জীবিত, পরিচিত ব্যক্তিদের টেনে আনা হয় না। গ. কোনো লেখক বা লেখিকা তার পরিচিত ব্যক্তিদের নাম করে যা খুশি লিখেছেন, কেন মানতে হবে সে সব সত্যি? কী করে বলা যাবে যে অতিরঞ্জিত বা বিকৃতি নেই? ঘ. তসলিমা নিজে না হয় চালচুলোহীন, সামাজিক দায়দায়িত্বের ধার ধারেন না, যাঁদের সম্পর্কে লিখেছেন, সত্যি অথবা মিথ্যে, তাঁদের সামাজিক সম্মান নেই? তাঁদের সন্তান নেই? পারিবারিক বৃত্ত নেই? .. তসলিমার ৩৯৩ পাতার আবর্জনাকে যদি বা উপেক্ষা করা যায়, ২ পাতার প্ররোচনামূলক অসভ্যতাকে ক্ষমা করা যায় না। শঙ্খ ঘোষ বা সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় কোনো বই নিষিদ্ধ ঘোষণার পক্ষে নন। কিন্তু এই একটি বইকে ওঁরা ব্যতিক্রম মনে করছেন।’

.

বিষ মাখানো নিন্দা আর ঘৃণার তীর যখন দুই বাংলা থেকে ছোঁড়া হচ্ছিল, তখনই দেশ পত্রিকা থেকে আমাকে অনুরোধ করা হয়েছিলো প্রতিক্রিয়া লিখতে। লিখেছিলাম, নিউইয়র্কে বসে, এক মধ্যরাতে। ঠিক এভাবেই লিখেছিলাম —

‘Freedom is always and exclusively freedom for the one who thinks differ ently.’ –Rosa Luxemburg

জীবনের অনেকগুলো বছর পেরিয়ে যখন দেখি পিছনের দিনগুলো ধূসর ধূসর, আর সেই ধূসরতার শরীর থেকে হঠাৎ হঠাৎ কোনো ভুলে যাওয়া স্বপ্ন এসে আচমকা সামনে দাঁড়ায় বা কোনো স্মৃতি টুপ করে ঢুকে পড়ে আমার একাকী নির্জন ঘরে, আমাকে কাঁপায়, আমাকে কাঁদায়, আমাকে টেনে নিয়ে যায় সেই দিনগুলোর দিকে –তখন কী জীবনের সেই অলিগলির অন্ধকার সরিয়ে সরিয়ে কিছু শীতার্ত স্মৃতি কুড়িয়ে আনতে আমি না হেঁটে পারি! কী লাভ হেঁটে! কী লাভ স্মৃতি কুড়িয়ে এনে! যা গেছে তা তো গেছেই! যে স্বপ্নগুলো অনেককাল মৃত, যে স্বপ্নগুলোকে এখন আর স্বপ্ন বলে চেনা যায় না, মাকড়সার জাল সরিয়ে ধুলোর আস্তর ভেঙে কী লাভ সেগুলোকে আর নরম আঙুলে তুলে এনে! যা গেছে, তা তো গেছেই। জানি সব, তবুও আমার নির্বাসনের জীবন আমাকে বারবার পিছনে ফিরিয়েছে, আমি আমার অতীত জুড়ে মোহগ্রস্তের মতো হেঁটেছি। দুঃস্বপ্নের রাতের মতো এক একটি রাত আমাকে ঘোর বিষাদে আচ্ছন্ন করে রেখেছে। তখনই মেয়েটির গল্প বলতে শুরু করেছি আমি।

একটি ভীরু লাজুক মেয়ে, যে মেয়ে সাত চড়েও রা করেনি, পারিবারিক কড়া শাসন এবংশোষণে ছোট্ট একটি গণ্ডির মধ্যে বড় হয়ে উঠেছে, যে-মেয়ের সাধ-আহ্লাদ প্রতিদিনই ছুঁড়ে ফেলা হয়েছে আবর্জনার স্তূপে, যে-মেয়েটির ছোট্ট শরীরের দিকে লোমশ লোমশ লোভী হাত এগিয়ে এসেছে বারবার, আমি সেই মেয়ের গল্প বলেছি। যে-মেয়েটি কিশোর বয়সে ছোট ছোট কিছু স্বপ্ন লালন করতে শুরু করেছে, যে-মেয়েটি হঠাৎ একদিন প্রেমে পড়েছে, যৌবনের শুরুতে বিয়ের মতো একটি কাণ্ড গোপনে ঘটিয়ে আর দশটি সাধারণ মেয়ের মতো জীবন যাপন করতে চেয়েছে, আমি সেই সাধারণ মেয়েটির গল্প বলেছি। যে-মেয়েটির সঙ্গে প্রতারণা করেছে তার স্বামী তার সবচেয়ে ভালোবাসার মানুষ, যে মেয়েটির বিশ্বাসের দালানকোঠা ভেঙে পড়েছে খড়ের ঘরের মতো, যে-মেয়েটি শোকে, সন্তাপে, বেদনায়, বিষাদে কুঁকড়ে থেকেছে। চরম লজ্জা আর লাঞ্ছনা যাকে আত্মহত্যা করার মতো একটি ভয়ংকর পথে নিয়ে যেতে চেয়েছে, চুরমার হয়ে ভেঙে পড়া স্বপ্নগুলো জড়ো করে যে-মেয়েটি আবার বাঁচতে চেয়েছে, নিষ্ঠুর নির্দয় সমাজে নিজের জন্য সামান্য একটু জায়গা চেয়েছে, যে-মেয়েটি বাধ্য হয়েছে সমাজের রীতিনীতি মেনে পুরুষ নামক অভিভাবকের কাছে নিজেকে সমর্পণ করতে, আর তার পরও যে মেয়েটির ওপর আবার নেমে এসেছে একের পর এক আঘাত, যে-আঘাত গর্ভের জ্বণটিকে নষ্ট করে দেয়, যে আঘাত প্রতি রাতে তাকে রক্তাক্ত করে, যে-আঘাত তার, কুটিলতার, অবিশ্বাসের আর, অসহ্য অপমানের আমি সেই দলিত দংশিত দুঃখিতার গল্প বলেছি মাত্র। দুঃখিতাটি তার শরীরে আর মনে যেটুকু জোর ছিল অবশিষ্ট, সেটুকু নিয়ে আবার উঠে দাঁড়িয়েছে, দাঁড়াবার জন্য সামান্য জায়গা পেতে কারও দ্বারস্থ হয়নি এবার, একাই লড়েছে সে, একাই বেঁচেছে, নিজেই নিজের আশ্রয় হয়েছে, এবার আর কারও কাছে নিজেকে সমর্পণ করেনি, বঞ্চিত হয়েছে বলে যোগিনী সাজেনি, কারও ছিঃ ছিঃর দিকে ফিরে তাকায়নি এই ফিরে না তাকানোর গল্প আমি বলেছি। সমাজের সাত রকম সংস্কারের ধার ধারেনি মেয়ে, বারবার তার পতনই তাকে দাঁড়াতে শিখিয়েছে, বারবার তার হোঁচট খাওয়াই তাকে হাঁটতে শিখিয়েছে, বারবার তার পথ হারানোই তাকে পথ খুঁজে দিয়েছে। ধীরে ধীরে নিজের ভেতরে যে-নতুন একটি বোধ আর বিশ্বাসকে সে জন্ম নিতে দেখেছে, তা হল, তার নিজের জীবনটি কেবল তারই, অন্য কারও নয়। এই জীবনটির কর্তৃত্ব করার অধিকার কেবল তারই। আমি মেয়েটির সেই গড়ে ওঠার গল্প বলেছি যে পরিবেশ প্রতিবেশ তাকে বিবর্তিত করেছে, তাকে নির্মাণ করেছে, পিতৃতন্ত্রের আগুনে পুড়ে যে-মেয়ে শেষ পর্যন্ত দগ্ধ হল না, পরিণত হল ইস্পাতে, সেই গল্প।

আমি কি অন্যায় কিছু করেছি? আমার কাছে অন্যায় বলে মনে না হলেও আজ অনেকের কাছে এটি ঘোরতর অন্যায়। আমি ভয়াবহ রকম অপরাধ করেছি গল্পটি বলে। অপরাধ করেছি বলে জনতার আদালতের কাঠগড়ায় আমাকে দাঁড়াতে হচ্ছে। অপরাধ হয়তো হতো না যদি না আমি প্রকাশ করতাম যে, যে-মেয়েটির গল্প আমি বলেছি সে মেয়েটি আমি, আমি তসলিমা। কল্পনায় আমি যথেচ্ছাচার করতে পারি, মিথ্যে মিথ্যে আমি লিখতে পারি কোনো সাধারণ মেয়ের আর দশটি মেয়ে থেকে ভিন্ন হওয়ার গল্প, ও না হয় ক্ষমা করে দেওয়া যায়। কিন্তু এই বাস্তব জগৎটিতে দাঁড়িয়ে রক্তমাংসের মেয়ে হয়ে কোন স্পর্ধায় আমি ঘোষণা করছি যে, ওই মেয়েটি আমি, আমি দুঃখ ঝেড়ে উঠে দাঁড়িয়েছি, আমার যেমন ইচ্ছে তেমন করে নিজের জীবনটি যাপন করবো বলে পণ করেছি, আমার এই দুর্বিনীত আচরণ লোকে মানবে কেন! এরকম স্পর্ধা কোনো মেয়েকেই মানায় না। বড় বেমানান আমি পুরো পিতৃতান্ত্রিক পরিবেশে।

আমার প্রিয় দেশটিতে, প্রিয় পশ্চিমবঙ্গে আজ আমি একটি নিষিদ্ধ নাম, একটি নিষিদ্ধ মানুষ, একটি নিষিদ্ধ বই। আমাকে উচ্চারণ করা যাবে না, আমাকে ছোঁয়া যাবে না, আমাকে পড়া যাবে না। উচ্চারণ করলে জিভ নষ্ট হবে, চুলে হাত নোংরা হবে, পড়লে গা রি রি করবে।

এরকমই তো আমি। সে কি আজ থেকে!

‘দ্বিখণ্ডিত’ লেখার কারণে যদি সহস্র খণ্ড হতে হয় আমাকে, তবু আমি স্বীকার করতে চাই না যে আমি কোনো অপরাধ করেছি। আত্মজীবনী লেখা কি অপরাধ? জীবনের গভীর গোপন সত্যগুলো প্রকাশ করা কি অপরাধ? আত্মজীবনীর প্রধান শর্ত তো এই যে, জীবনের সব কিছু খুলে মেলে ধরবো, কোনো গোপন কথা কোনো কিছুর তলায় লুকিয়ে রাখবো না। যা-কিছু গোপন, যা-কিছু অজানা, তা বলার জন্যই তো আত্মজীবনী। এই শর্তটিই সতোর সঙ্গে পালন করতে চেষ্টা করেছি। আত্মজীবনীর প্রথম দুই খণ্ড ‘আমার মেয়েবেলা’ আর ‘উতল হাওয়া’ নিয়ে কোনোরকম বিতর্ক না হলেও তৃতীয় খণ্ডটি নিয়ে পশ্চিমবঙ্গে বিতর্ক শুরু হয়েছে। এই বিতর্ক কিন্তু আমি সৃষ্টি করিনি, করেছে অন্যরা। বিতর্ক হওয়ার মতো উত্তেজক বিষয়, অনেকেই বলেছেন, আমি বেছে নিয়েছি। এই প্রশ্ন আর যখনইউঠুক, আত্মজীবনীর ক্ষেত্রে ওঠা উচিত নয়। কারণ সব রকম অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে আমার বড় হওয়া বা বেড়ে ওঠার ঘটনাগুলোই আমি বর্ণনা করেছি। আমার দর্শন অদর্শন, আমার হতাশা-আশা, আমার সুন্দর, আমার কুৎসিত, আমার শোক সুখ, আমার ক্রোধ আর কান্নাগুলোর কথাই বলেছি। কোনো স্পর্শকাতর বা উত্তেজক বিষয় শখ করে বেছে নিইনি, আমার জীবনটিই আমি বেছে নিয়েছি জীবনী লেখার জন্য। এই জীবনটা যদি স্পর্শকাতর আর উত্তেজক হয়, তবে এই জীবনের কথা লিখতে গিয়ে আমি অস্পর্শকাতর আর অনুত্তেজক বিষয় কোত্থেকে পাবো? বিতর্ক তৈরি করার জন্য বা চমক সৃষ্টি করার জন্য আমি নাকি বই লিখেছি। যেন বদ একটি কারণ থাকতেই হবে বই লেখার পিছনে। যেন সততা আর সরলতা কোনও কারণ হতে পারে না। যেন সাহস, যে-সাহসের প্রশংসা করা হত যে, আমি সাহস করে নাকি অনেক কিছুই বলি বাকরি, সেই সাহসটিও এখন আর কোনও কারণ হতে পারে না। আমার লেখা নিয়ে বিতর্ক নতুন কিছু নয়। লেখালেখির শুরু থেকেই তা হচ্ছে। এটিই কি মোদ্দা কথা নয় যে পুরুষতান্ত্রিক এই সমাজের সঙ্গে আপোস না করলেই বিতর্ক হয়।

আত্মজীবনীর সংজ্ঞা অনেকের কাছে অনেক রকম। বেশির ভাগ মানুষই সেই জীবনীকে গ্রহণ করতে অভ্যস্ত, যে জীবনীটি ভূরি ভূরি ভালো কথা আর চমৎকার সব আদর্শ উপস্থাপন করে। সাধারণত মনীষীরাই আত্মজীবনী লিখে যান অন্যকে নিজের জীবনাদর্শে আলোকিত করতে, সত্যের সন্ধান দিতে, পথ দেখাতে। আমি কোনও জ্ঞানী গুণী মানুষ নই, কোনও মনীষী নই, কোনও মহামানব নই, কিছু নই, অন্ধজনে আলো দেওয়ার মহান উদ্দেশ্য নিয়ে আমি জীবনী লিখছি না। আমি কেবল ক্ষুদ্র একটি মানুষের ক্ষতগুলো ক্ষোভগুলো খুলে দেখাচ্ছি।

কোনও বড় সাহিত্যিক বা বড় কোনো ব্যক্তিত্ব না হলেও এ কথা তো অস্বীকার করার উপায় নেই যে, খুব বড় বড় ঘটনা ঘটে গেছে আমার জীবনটিতে। আমার বিশ্বাস এবং আদর্শের কারণে লক্ষ লক্ষ মানুষ যদি পথে নামে আমার ফাঁসির দাবি নিয়ে, যদি ভিন্ন মতের কারণে একের পর এক আমার বই নিষিদ্ধ করা হয়, যদি সত্য কথা বলার অপরাধে একটি রাষ্ট্রযন্ত্র আমার নিজের দেশে বাস করার অধিকার হরণ করে নেয়, তবে নিশ্চয়ই জীবনটি একটি সাদামাটা জীবন নয়। এই জীবনের কাহিনী অন্যের মুখে নানা ঢঙে নানা রঙে প্রচারিত যখন হচ্ছেই, তখন আমি কেন দায়িত্ব নেব না জীবনের আদ্যোপান্ত বর্ণনা করতে। আমার এই জীবনটিকে আমি যত বেশি জানি, তত তোআর অন্য কেউ জানে না।

নিজেকে যদি উন্মুক্তনাকরি, নিজের সবটুকু যদি প্রকাশ না করি, বিশেষ করে জীবনের সেইসব কথা বা ঘটনা, যা আমাকে আলোড়িত করেছে, যদি প্রকাশ না করি নিজের ভালো মন্দ, দোষ গুণ, শুভ অশুভ, আনন্দ বেদনা, উদারতা ক্রুরতা, তবে আর যাই হোক সেটি আত্মজীবনী নয়, অন্তত আমার কাছে নয়। কেবল সাহিত্যের জন্যই সাহিত্যই আমার কাছে শেষ কথা নয়, সততা বলে একটি জিনিস আছে, সেটিকে আমি খুব মূল্য দিই।

যে-রকমই জীবন হোক আমার, যে-রকমই নিকৃষ্ট, যে-রকমই নিন্দা, নিজের জীবন কাহিনী লিখতে বসে আমি কিন্তু প্রতারণা করছি না নিজের সঙ্গে। পাঠক আমার গল্প শুনে আমাকে ঘৃণা করুক কী আমাকে ছুঁড়ে ফেলুক, এটুকুই আমার সন্তুষ্টি যে, আমার পাঠকের সঙ্গে আমি প্রতারণা করছি না। আত্মজীবনী নাম দিয়ে পাঠককে কোনো বানানো গল্প উপহার দিচ্ছি না। জীবনের সব সত্য, সত্য সবসময় শোভন বা সুন্দর না হলেও, সঙ্কোচহীন বলে যাচ্ছি। জীবনে যা কিছু ঘটে গেছে, তা তো ঘটেই গেছে, তা তো আমি বদলে দিতে পারবো না, আর অস্বীকারও করতে পারবো না এই বলে যে, যা ঘটেছে তা আসলে ঘটেনি। সুন্দরকে যেমন পারি, অসুন্দরকেও তেমন আমি স্বীকার করতে পারি।

চারদিক থেকে এখন বিদ্রুপের তির ছোঁড়া হচ্ছে আমাকে লক্ষ্য করে, অপমান আর অপবাদের কাদায় আমাকে ডুবিয়ে দেওয়া হচ্ছে এর কারণ একটিই, আমি সত্য কথা বলেছি। সত্য সবসময় সবার সয় না। আমার মেয়েবেলা’ আর ‘উতল হাওয়া’র সত্য সইলেও দ্বিখণ্ডিত’র সত্য সবার সইছে না। আমার মেয়েবেলায় আমাকে অপদস্থ করার কাহিনী যখন বর্ণনা করেছি, সেটি পড়ে লোকে চুকচুক করে দুঃখ করেছে আমার জন্য, উতল হাওয়ায় যখন স্বামী দ্বারা প্রতারিত হয়েছি, তখনও আহা আহা করেছে আমার জন্য, আর দ্বিখণ্ডিত’য় যখন বর্ণনা করেছি পর পর একের অধিক পুরুষের সঙ্গে আমার। সম্পর্কের কথা, তখন ছিঃ ছিঃ করতে শুরু করেছে। এর অর্থ তো একটিই, যে, যতক্ষণ একটি মেয়ে অত্যাচারিত এবং অসহায়, যখনই সে দুর্বল, এবং যখন তার দুঃসময়, ততক্ষণই তার জন্য মায়া জাগে, ততক্ষণই তাকে ভালো লাগে। আর যখনই মেয়েটি আর অসহায় নয়, যখনই সে মেরুদণ্ড শক্ত করে দাঁড়ায়, নিজের অধিকার প্রতিষ্ঠা করে,নিজের শরীরের এবং মনের স্বাধীনতার জন্য সমাজের নষ্ট নিয়মগুলো ভাঙে, তখন তাকে আর ভালো লাগে না, বরং তার প্রতি ঘৃণা জন্মে। আমাদের সমাজের এই চরিত্র আমি জানি, জেনেও কোনও দ্বিধা করিনি নিজেকে জানাতে।

দ্বিখণ্ডিত বইটি নিয়ে বিতর্কের একটি বড় কারণ, যৌন স্বাধীনতা। আমাদের এই সমাজের বেশির ভাগ মানুষ যেহেতু পুরুষতান্ত্রিক সংস্কারে আকণ্ঠ নিমজ্জিত, তাই একজন। নারীর যৌন স্বাধীনতার অকপট ঘোষণায় বিরক্ত, ক্ষুব্ধ, ক্রুদ্ধ। যে যৌন স্বাধীনতার কথা আমি বলি, তা কেবল আমার বিশ্বাসের কথাই নয়, নিজের জীবন দিয়ে সেই স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠা করেছি, অথচ যে-কোনও পুরুষ আমাকে কামনা করলেই পাবে না। এই সমাজ এখনও কোনও নারীর এমন স্বাধীনতার জন্য প্রস্তুত নয়। প্রস্তুত নয় এটা শিরোধার্য করতে যে, কোনও নারী তার ইচ্ছেমতো পুরুষকে সম্ভোগ করতে পারে এবং তা করেও কঠোরভাবে যৌন-সতীত্ব বজায় রাখতে পারে।

আমাদের নামি-দামি পুরুষ লেখকেরা আমাকে এখন মহানন্দে পতিতা বলে গালি দিচ্ছেন। গালি দিয়ে নিজেরাই প্রমাণ করছেন কী ভীষণ নোংরা পিতৃতান্ত্রিক সমাজের সুবিধেভোগী পুরুষ-কর্তা তাঁরা। পতিতাকে তাঁরা ভোগের জন্য ব্যবহার করেন, আবার পতিতা শব্দটিকে তারা সময় সুযোগমতো গালি হিসেবেও ব্যবহার করেন। নারীকে যৌনদাসী হিসেবে ব্যবহার করার নিয়ম আজকের নয়। যদিও দ্বিখণ্ডিত বইটিতে পুরুষতান্ত্রিকতার বিরুদ্ধে আমার লড়াইএর কথা বলেছি, বলেছি নারী আর ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপর সমাজের নির্যাতনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের কথা, কেউ কিন্তু সে নিয়ে একটি কথাও বলছেন না, যারাই বলছেন, বলছেন যৌনতার কথা। আমার কোনও কষ্টের দিকে, কান্নার দিকে কারও চোখ গেল না, চোখ গেল শুধু যৌনতার দিকে। চোখ গেল আমার সঙ্গে পুরুষের সম্পর্কগুলোর দিকে। যৌনতার মতো গভীর গোপন কুৎসিত আর কদর্য বিষয় নিয়ে আমার মুখ খোলার স্পর্ধার দিকে চোখ।

পৃথিবীর ইতিহাসে, কোনো অন্ধকার সমাজে যখনই কোনও নারী পুরুষতন্ত্রের বিরুদ্ধে রুখে উঠেছে, নিজের স্বাধীনতার কথা বলেছে, ভাঙতে চেয়েছে পরাধীনতার শেকল, তাকেই গাল দেওয়া হয়েছে পতিতা বলে। অনেক আগে নষ্ট মেয়ের নষ্ট গদ্য বইটর ভূমিকায় আমি লিখেছিলাম, নিজেকে এই সমাজের চোখে আমি নষ্ট বলতে ভালোবাসি। কারণ এ কথা সত্য যে, যদি কোনো নারী নিজের দুঃখ দুর্দশা মোচন করতে চায়, যদি কোনও নারী কোনও ধর্ম, সমাজ ও রাষ্ট্রের নোংরানিয়মের বিপক্ষে রুখে দাঁড়ায়, তাকে অবদমনের সকল পদ্ধতির প্রতিবাদ করে, যদি কোনও নারী নিজের অধিকার সম্পর্কে সজাগ হয়, তবে তাকে নষ্ট বলে সমাজের ভদ্রলোকেরা। নারীর শুদ্ধ হওয়ার প্রথম শর্ত নষ্ট হওয়া। নষ্ট না হলে এই সমাজের নাগপাশ থেকে কোনও নারীর মুক্তি নেই। সেই নারী সত্যিকার সুস্থ ও শুদ্ধ মানুষ, লোকে যাকে নষ্ট বলে। আজও এ কথা আমি বিশ্বাস করি যে, কোনও নারী যদি তার সত্যিকার স্বাধীনতা অর্জন করতে চায়, তবে এই সমাজের চোখে তাকে নষ্ট হতে হয়। এই নষ্ট সমাজ থেকে নষ্ট বা পতিতা আখ্যা উপহার পাওয়া একজন নারীর জন্য কম সৌভাগ্যের ব্যাপার নয়। এ যাবৎ যত পুরস্কার আমি পেয়েছি, পতিতা উপাধির পুরস্কারটিকেই আমি সর্বোত্তম বলে বিচার করছি। পুরুষতন্ত্রের নষ্টামির শরীরে সত্যিকার আঘাত করতে পেরেছি বলেই এই উপাধিটি আমি অর্জন করেছি। এ আমার লেখকজীবনের, আমার নারীজীবনের, আমার দীর্ঘকালের সংগ্রামের সার্থকতা।

বইটি লিখেছি বলে বাংলাদেশের একজন লেখক আমার বিরুদ্ধে মানহানির মামলা করেছেন, কলকাতাতেও একজন বাংলাদেশি লেখকটির পদাঙ্ক অনুসরণ করেছেন। কেবল মানহানির মামলা করেই ক্ষান্ত হননি, দুজনই আমার বইটি নিষিদ্ধ করার দাবি জানিয়েছেন। আমি ঠিক বুঝি না, কী করে একজন লেখক আর একজন লেখকের বই। নিষিদ্ধ করার দাবি করতে পারেন। কী করে সমাজের সেই শ্রেণীর মানুষ, যাঁদের দায়িত্ব মুক্তচিন্তা আর বাক স্বাধীনতার জন্য লড়াই করা, মৌলবাদীদের মতো আচরণ করেন। আমাকে নিয়ে এ যাবৎ অনেক মিথ্যে, অনেক কল্পকাহিনী লেখা হয়েছে, আমি তো তাদের কোনও লেখা নিষিদ্ধ করার দাবি নিয়ে আদালতে দৌড়ইনি। আমি বিশ্বাস করি, এভলিন বিয়াট্রিস হল যা বলেছিলেন, ”I disapprove of what you say, but I will defend to the death your right to say it” –আমি তোমার মতের সঙ্গে একমত না হতে পারি, কিন্তু আমি আমৃত্যু তোমার কথা বলার অধিকারের জন্য লড়ে যাবো। কেন আমাদের বিদগ্ধ লেখকগণ বাক-স্বাধীনতার পক্ষে এই চরম সত্যটি অস্বীকার করতে চান!

পৃথিবীর কত লেখকই তোলিখে গেছেন নিজেদের জীবনের কথা। জীবন থেকে কেবল পরিশুদ্ধ জিনিস ঘেঁকে নিয়ে তারা পরিবেশন করেননি। জীবনে ভ্রান্তি থাকে, ভুল থাকে, জীবনে কালি থাকে, কাঁটা থাকে, কিছুনা কিছু থাকেই, সে যদি মানুষের জীবন হয়। যাদের মহামানব বলে শ্রদ্ধা করা হয়, তাঁদেরও থাকে। ক্রিস্টান ধর্মগুরু অগুস্ত (৩৩৫-৪৩০ খ্রি.) নিজেই লিখে গেছেন তার জীবনকাহিনী, আলজেরিয়ায় তিনি যেভাবে জীবন কাটাতেন, যে রকম অসামাজিক অনৈতিক বাধনহীন জীবন কিছুই প্রকাশ করতে দ্বিধা করেননি। তার যৌন স্বেচ্ছাচারিতা, উচ্ছংখলতা, জারজ সন্তানের জন্ম দেওয়ার কোনও কাহিনীই গোপন করেননি। মহাত্মা গান্ধীও তো স্বীকার করেছেন কী করে তিনি তার বিছানায় মেয়েদের শুইয়ে নিজের ব্রহ্মচারিতার পরীক্ষা করতেন। ফরাসি লেখক জ জ্যাক রুশোর (১৭১২-১৭৭৮ খ্রি.) কথাই ধরি, তার স্বীকারোক্তি গ্রন্থটিতে স্বীকার করে গেছেন জীবনে কী কী করেছেন তিনি। কোনও গোপন কৌটোয় কোনও মন্দ কথা নিজের জন্য তুলে রাখেননি। সেই আমলে রুশোর আদর্শ মেনে নেওয়ার মানসিকতা খুব কম মানুষেরই ছিল। তাতে কী! তিনি তার পরোয়া না করে অকাতরে বর্ণনা করেছেন নিজের কুকীর্তির কাহিনী। মাদমাজোল গতোঁ তো আছেই, আরও অনেক রমণীকে দেখে, এমনকী মাদাম দ্য ওয়ারেন, যাঁকে মা বলে ডাকতেন, তাঁকে দেখেও বলেন যে তার যৌনাকাঙ্ক্ষা জাগতো। বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিন (১৭০৯-১৭৯০ খ্রি.) তাঁর আত্মকথায় যৌবনের উতল উন্মাতাল সময়গুলোর বর্ণনা করেছেন, জারজ পুত্র উইলিয়ামকে নিজের সংসারে তুলে এনেছিলেন, তাও বলেছেন। বার্সাণ্ড রাসেল তাঁর জীবনীগ্রন্থে লিখে গেছেন বিভিন্ন রমণীর সঙ্গে তাঁর অবৈধ সম্পর্কের কথা। টিএস এলিয়টের স্ত্রী ভিভিয়ানের সঙ্গে, লেডি অটোলিন মোমেলের সঙ্গে তার সম্পর্কের কথা কে না জানে! লিও তলস্তয় লিখেছেন চৌদ্দ বছর বয়সেই তাঁর গণিকাগমনের কাহিনী, সমাজের নিচুতলার মেয়ে, এমনকী পরস্ত্রীদের সঙ্গে তার যৌন সম্পর্ক, এমনকী তার যৌনরোগে ভোগার কথাও গোপন করেননি। এখন প্রশ্ন উঠতে পারে, কেন তাঁরা, সমাজ যা মেনে নিতে পারে না, এমন তথ্য পাঠককে শোনাতে গেলেন! শোনানোর নিশ্চয়ই কোনও কারণ আছে। নিজেদের আসল পরিচয়টি তারা লুকোতে চাননি অথবা এই অভিজ্ঞতাগুলো তাদের জীবনে খুব গুরুত্বপূর্ণ, তাই শুনিয়েছেন। এতে কি তাঁদের জাত গিয়েছে নাকি তাদের মন্দ বলে কেউ? কেউই তাদের মন্দ বলে না, যে অবস্থানে ছিলেন তাঁরা সে অবস্থানে আছেনই, বরং সত্য প্রকাশ করে নিজেদের আরও মহিমান্বিত করেছেন। পশ্চিমি দেশগুলোয় নারী পুরুষ সম্পর্কটি বহুকাল হল আর আড়াল করার ব্যাপার নয়। হালের ফরাসি মেয়ে ক্যাথারিন মিলে তার নিজের কথাই লিখেছেন La Vie Sexuelle de Catherine M বইটিতে। পুরো বই জুড়ে আছে ষাটের দশকে অবাধ যৌনতার যুগে তার বহু পুরুষ-ভোগের রোমাঞ্চকর কাহিনী। মৈথুনের নিখুঁত বর্ণনা। এ কারণে বইটিকে কি সাহিত্যের বইয়ের তাকে রাখা হয়নি? হয়েছে। গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেও Vivir para contara বইটিতে পরনারীদের সঙ্গে আঁর লীলাখেলার কিছুই বলতে বাদ রাখেননি। মার্কেজকে কি কেউ মন্দ বলবে তাঁর জীবনটির জন্য, নাকি কেউ আদালতে যাবে বইটি নিষিদ্ধ করতে?

পৃথিবীর প্রতিটি দেশেই বিখ্যাত মানুষদের জীবনী প্রকাশ হচ্ছে। বছরের পর বছর ধরে গবেষণা করে সেসব জীবনী লিখছেন জীবনীকাররা। খুঁড়ে খুঁড়ে বের করা হচ্ছে সব গোপন খবর। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গোপন কথাটিও তো রইছে না গোপনে। বাল্যবিবাহের বিরুদ্ধে কথা বলেও তিনি কেন নিজের বালিকা-কন্যাটির বিয়ের আয়োজন করেছিলেন, সেই কারণটি মানুষ আজ জানছে। প্রশ্ন হল, এইসব তথ্য কী আদৌ পাঠকের জানা প্রয়োজন? কে কবে কোথায় কী করেছিলেন, কী বলেছিলেন, জীবনাচরণ ঠিক কেমন ছিল কার, তা জানা যদি নিতান্তই অবান্তর হত, তবে তা নিয়ে গবেষণা হয় কেন? জীবনীকার গবেষকরা যেসব মানুষ সম্পর্কে অজানা তথ্য জানাচ্ছেন, সেসব তথ্যের আলোয় শুধু মানুষটি নন, তাঁর সৃষ্টিরও নতুন করে বিচার ও বিশ্লেষণ সম্ভব হচ্ছে।

বাঙালি পুরুষ লেখকদের অনেকেই গোপনে গোপনে বহু নারীর সঙ্গে শরীরী প্রেমের খেলা খেলতে কুণ্ঠিত নন, নিজেদের জীবনকাহিনীতে সেসব ঘটনা আলগোছে বাদ দিয়ে গেলেও উপন্যাসের চরিত্রদের দিয়ে সেসব ঘটাতে মোটেও সংকোচ বোধ করেন না। কেউ কিন্তু এ নিয়ে প্রশ্ন তোলে না। প্রশ্ন ওঠে, কোনও মেয়ে যদি যৌনতা নিয়ে কথা বলে। সে গল্প উপন্যাসে হোক, সে আত্মজীবনীতে হোক। যৌনতা তো পুরুষের ‘বাপের সম্পত্তি’। আমার তো পুরুষ-লেখকদের মতো লিখলে চলবে না। আমার তো রয়ে সয়ে লিখতে হবে। রেখে ঢেকে লিখতে হবে। কারণ আমি তো নারী। নারীর শরীর, তার নিতম্ব, স্তন, উরু, যোনি এসব নিয়ে খেলা বা লেখার অধিকার তো কেবল পুরুষেরই আছে। নারীর থাকবে কেন? এই অধিকার পুরুষতান্ত্রিক সমাজ আমাকে দেয়নি, দেয়নি বলে তোয়াক্কা না করে আমি যে লিখে ফেলেছি, যত করুণ হোক, যত মর্মান্তিক হোক, আমার সে কাহিনী, আমি যে অনধিকার চর্চা করেছি, তাতেই আপত্তি।

পুরুষের জন্য একাধিক প্রেম বা একাধিক নারীসম্ভোগ চিরকালই গৌরবের ব্যাপার। আর একটি মেয়ে সতোর সঙ্গে কাগজকলমে নিজের প্রেম বা যৌনতা নিয়ে যেই না লিখেছে, অমনি সেই মেয়ে বিশ্বাসঘাতিনী, সেই মেয়ে অসতী, সেই মেয়ে দুশ্চরিত্র। আমার আত্মজীবনীতে আমি এমন কথা বলেছি, যা বলতে নেই। আমি সীমা লঙ্ঘন করেছি, আমি বাড়াবাড়ি করেছি, আমি অশ্লীলতা করেছি, নোংরা কুৎসিত ব্যাপার ঘেঁটেছি। দরজা বন্ধ করে যে ঘটনাগুলো ঘটানো হয়, পারস্পরিক বোঝাঁপড়ায় যে সম্পর্কগুলো হয়, সেসব নাকি বলা অনুচিত। সেসব নাকি বলা জরুরি নয়। কিন্তু আমি তো মনে করি উচিত, আমি তো মনে করি জরুরি। কারণ আমার সংস্কার সংস্কৃতি, ধ্যান, ধারণা, বিশ্বাস অবিশ্বাস নিয়ে আজ এই যে আমি, এই তসলিমার নির্মাণ কাজে জীবনের সেইসব ঘটনা বা দুর্ঘটনাই অন্যতম মৌলিক উপাদান। আমি যে ভূঁইফোড় নই, তিল তিল করে চারপাশের সমাজ নির্মাণ করেছে তিলোত্তমার বিপরীত এই অবাধ্য কন্যার। নিজেকে বোঝার জন্য, আমি মনে করি, জরুরি এই আত্মবিশ্লেষণ।

নিজের সম্মান না হয় নষ্ট করেছি, অন্যের সম্মান কেন নষ্ট করতে গেলাম। যদিও অন্যের জীবনী আমি লিখছিনা, লিখছি নিজের জীবনী, কিন্তু অন্যের পারিবারিক সামাজিক ইত্যাদি সম্মানহানির বিষয়ে অনেকে প্রশ্ন তুলেছেন। আমি ঠিক বুঝি না, নিজের মান সম্মানের ব্যাপারে যারা এত সচেতন, তাঁরা এমন কাণ্ড জীবনে ঘটান কেন, যে কাণ্ডে তাঁরা ভালো করে জানেন যে তাঁদের মানের হানি হবে। আমি বিশ্বাসভঙ্গ করেছি? কিন্তু, আমি তো কাউকে প্রতিশ্রুতি দিইনি যে এসব কথা কোনওদিন প্রকাশ করবো না! অলিখিত চুক্তি নাকি থাকে। আসলে এই চুক্তির অজুহাত তাঁরাই তুলছেন, গোপন কথা ফাঁস হয়ে গেলে নিজেদের দেবতা চরিত্রটিতে দাগ পড়বে বলে যাঁরা আশংকা করছেন। আর তাই চোখ রাঙিয়ে শাসিয়ে দিতে চান যে সীমানা লঘন করলে চুক্তিভঙ্গের অপরাধে আমার শাস্তি হবে।

আমি যা প্রকাশ করতে চাই তা যদি আমার কাছে উচিত বলে মনে হয়–তবে? উচিত অনুচিতের সংজ্ঞা কে কাকে শেখাবে? আমার কাছে যদি অশ্লীল মনে না হয় সে কথাটি, যে কথাটি আমি উচ্চারণ করেছি তবে? শ্লীল অশ্লীল হিসেব করার মাতব্বরটি কে? সীমা মেপে দেওয়ার দায়িত্বটি কার? আত্মজীবনীতে আমি কী লিখবো, বা লিখবো না, তার সিদ্ধান্ত তো আমিই নেব! নাকি অন্য কেউ, কোনও মকসুদ আলী, কোনও কেরামত মিয়া বা পরিতোষ বা হরিদাস পাল বলে দেবে কী লিখবো, কতটুকু লিখবো!

সমালোচকরা আমার স্বাধীনতাকে চিহ্নিত করতে চাইছেন স্বেচ্ছাচারিতা বলে। আসলে আমাদের সুরুচি কুরুচি বোধ, পাপ পুণ্য বোধ, সুন্দর অসুন্দর বোধ, সবই যুগ যুগান্ত ধরে পিতৃতন্ত্রের শিক্ষার পরিণাম। নারীর নম্রতা, নতমস্তকতা, সতীত্ব, সৌন্দর্য, সহিষ্ণুতা সেই শিক্ষার ফলেই নারীর বৈশিষ্ট্য হিসেবে স্বীকৃত। আমাদের সুনিয়ন্ত্রিত চেতনা কোনও রূঢ় সত্যের মুখোমুখি হতে তাই আতঙ্ক বোধ করে। কোনও নিষ্ঠুর বাক্য শুনলে কানে আঙুল দিতেইচ্ছে করে, ঘৃণায় ঘিনঘিন করে গা, অনেক সমালোচকেরও বাস্তবে তাই হচ্ছে। আমি লেখক কি না, আমার আত্মজীবনী তাও আবার ধারাবাহিকভাবে লেখার অধিকার আছে কি না, এমন প্রশ্নও তুলেছেন। বস্তুত সবার, যে কোনও মানুষেরই আত্মকথা লেখার অধিকার আছে। এমনকী আত্মম্ভর সেই সাংবাদিকদেরও সেই অধিকার আছে যিনি মনে করেন আমার হাতে কলম থাকাই একটি ঘোর অলুক্ষণে ব্যাপার। আমাকে দোষ দেওয়া হচ্ছে এই বলে যে, আমি চরম দায়িত্বহীনতার কাজ করেছি। আমি দায়িত্বহীন হতে পারি, যুক্তিহীন হতে পারি, তবু কিন্তু আমার অধিকারটি তাগ করতে আমি রাজি নই। জর্জ বার্নার্ড শ বলেছিলেন, A reasonable man adapts himself to the world. An unreasoble man persists in trying to adapt the world to himself. Therefore, all progress depends upon the unreasonable man. বুদ্ধিমান বা যুক্তিবাদী লোকেরা পৃথিবীর সঙ্গে মানিয়ে চলে। নির্বোধ বা যুক্তিহীনরা চেষ্টা করে পৃথিবীকে তার সঙ্গে মানিয়ে চলতে। অতএব সব প্রগতি নির্ভর করে এই যুক্তিহীনদের ওপর। আমি তসলিমা সেই যুক্তিহীনদেরই একজন। আমি তুচ্ছ একজন লেখক, এত বড় দাবি আমি করছি না যে পৃথিবীর প্রগতি আমার ওপর সামান্যতম নির্ভর করে আছে। তবে বিজ্ঞদের বিচারে আমি নির্বোধ বা যুক্তিহীন হতে সানন্দে রাজি। নির্বোধ বলেই পিতৃতন্ত্রের রাঘব বোয়ালরা আমাকে পিষে মারতে আসছে দেখেও দৃঢ় দাঁড়িয়ে থেকেছি। আমার মূর্খতাই, আমার নির্বুদ্ধিতাই, আমার যুক্তিহীনতাই সম্ভবত আমার জীবনের সবচেয়ে বড় সম্পদ।

ধর্মের কথাও উঠেছে। আমি, যারা আমাকে জানেন, জানেন যে, সব ধরনের ধর্মীয় দুঃশাসনের বিরুদ্ধে কথা বলি। ধর্ম তো আগাগোড়াই পুরুষতান্ত্রিক। ধর্মীয় পুরুষ ও পুঁথির অবমাননা করলে সইবে কেন পুরুষতান্ত্রিক ধারক এবং বাহকগণ। ওই মহাপুরুষরাই তো আমাকে দেশছাড়া করেছেন। সত্যের মূল্য আমি আমার জীবন দিয়ে দিয়েছি। আর কত মূল্য আমাকে দিতে হবে।

দাঙ্গার অজুহাত দেখিয়ে পশ্চিমবঙ্গে প্রথম নয়, এর আগে বাংলাদেশেও আমার বই নিষিদ্ধ হয়েছে। এই যে নিরন্তর দাঙ্গা হচ্ছে উপমহাদেশে, আমার বই বা বক্তব্য কিন্তু দাঙ্গার কোনও কারণ নয়। কারণ অন্য। বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের ওপর অত্যাচারে, গুজরাতের মুসলমান নিধনে, অসমে বিহারি নিগ্রহে, খ্রিস্টানদের ওপর হামলায়, পাকিস্তানে সিয়া সুন্নি হানাহানিতে আমি আদৌ কোনও ঘটনা নই। অকিঞ্চিৎকর লেখক হলেও আমি মানবতার জন্যই লিখি। ধর্ম, বর্ণ, লিঙ্গ নির্বিশেষে সকল মানুষই যে সমান, সকলেরই যে সমান অধিকার মানুষ হিসেবে বেঁচে থাকার, সে কথাটিই হৃদয় দিয়ে লিখি। না, আমার লেখার কারণে দাঙ্গার মতো ভয়াবহ কোনও দুর্ঘটনা কোথাও ঘটে না। যদি কিছু ঘটে, সে আমার জীবনেই ঘটে। আমার লেখার কারণে শাস্তি এক আমাকেই পেতে হয়, অন্য কাউকে নয়। আগুন আমার ঘরেই লাগে। সকল গৃহ হারাতে হয় এক আমাকেই।

চারদিকের এত ভয়ংকর নিন্দার বিরুদ্ধে আনন্দবাজার পাশে দাঁড়ালোআমার। দেশ পত্রিকায় আমাকেই প্রচ্ছদ কাহিনী করা হল। শিবনারায়ণ রায়, আমার, এবং আরও ক’জনের লেখা নিয়ে বেরোলো দেশ। দেশ এর সম্পাদকীয় ছিল অসাধারণ। না স্মরণ করে পারছি না!

‘সে কালে মধ্যরাতে কলকাতা শাসন করতে চার জন যুবক। সে ছিল কবিতার কাল, কল্পনার সাম্রাজ্য। যুগ বদলেছে। এখন, মধ্যরাতে নয়, দিনে দুপুরে, কবির কল্পনায় নয়, আমজনতার চাক্ষুষ বাস্তবে, কলকাতা শাসন করেন দু’ডজন বুদ্ধিজীবী। না, কেবল কলকাতা নয়, তামাম পশ্চিমবঙ্গ। বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যর পশ্চিমবঙ্গ। নাট্যকার, অনুবাদক, সংস্কৃতিমনস্ক, নন্দনপ্রেমী আমাদের মুখ্যমন্ত্রী তসলিমা নাসরিনের আত্মজীবনীর তৃতীয় পর্ব ‘দ্বিখণ্ডিত’র ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছেন। কেন এই নিষেধাজ্ঞা? এ বইয়ের কিছু অংশ নাকি সাম্প্রদায়িক অশান্তি সৃষ্টি করতে পারে, তাই। বইটির কয়েক হাজার কপিইতিমধ্যেই ক্রেতার হাতে পৌঁছে গেছে। তসলিমার অন্য সব লেখার মতোই এই লেখা নিয়েও তর্কবিতর্ক, বাদপ্রতিবাদ হয়েছে, এমনকী মামলা-মোকদ্দমাও। কিন্তু কোথাও সাম্প্রদায়িক অশান্তির কোনো লক্ষণ দেখা যায়নি। সেটা এই সমাজের বড় হয়ে ওঠার লক্ষণ। মস্ত সুলক্ষণ। তা হলে পশ্চিমবঙ্গের উন্নততর বামফ্রন্ট সরকারের গণতন্ত্র-অন্ত-প্রাণ কর্তারা এমন দমননীতি জারি করলেন কেন? পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন, ২৫ জনের মত নিয়েছি। তাদের পড়িয়েছি। তার পরেই এই সিদ্ধান্ত। অর্থাৎ, ওই কতিপয় বুদ্ধিজীবীর সুপারিশ অনুসারেই এত বড় একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছে তিন দশকের প্রবীণ বামফ্রন্ট সরকার। লেখকের স্বাধীনতা, নিজের কথা নিজের মতো করে লেখার স্বাধীনতা কেড়ে নেওয়া হয়েছে তাঁদের সুপরামর্শে। সত্য সেলুকাস। পরাধীন ভারতে ব্রিটিশ সরকার হামেশাই বইপত্র নিষিদ্ধ করতো, কিন্তু তার দায়িত্ব নিতো নিজেরাই। জরুরি অবস্থার কালো দিনগুলোতেও এমন অনেক নিষেধ জারি হয়েছে, কিন্তু সে জন্য ইন্দিরা গান্ধী বা সিদ্ধার্থশংকর রায়কে বুদ্ধিজীবীদের দোহাই পাড়তে শোনা যায়নি। উন্নততর বামফ্রন্টের মুখ্যমন্ত্রী এ এক নতুন মডেল চালু করলেন বটে। সেই মডেলের সার কথাটি হল, হুকুম জারি করবো, কিন্তু তার দায় নেব না। অবশ্য নেবেনই বা কোন দুঃখে? হাত বাড়ালেই যদি এক ঝাঁক গণ্যমান্য স্বনামধন্যের হাত মিলে যায়, যারা মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশে (মাপ করবেন, অনুরোধে) রাত জেগে তসলিমা নাসরিনের আত্মজীবনী পড়ে ফেলে চটপট সুপারিশ জানিয়ে দিতে প্রস্তুত, তবে তো প্রশাসনের পৌষমাস–সংস্কৃতির ঘাড়ে বন্দুক রেখে সংস্কৃতি শাসনের এমন সুযোগ রাজপুরুষরা ছাড়বেন কেন? বিশেষত, সেই রাজপুরুষদের যদি আবার সংস্কৃতির নন্দনকাননে বিহারের বাসনা থাকে?

কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী এবং তার পরামর্শদাতারা কী ভেবে দেখেছেন, তাদের এই যৌথ উদ্যোগের তাড়নায় দেশে ও বিদেশে এই রাজ্যের গণতান্ত্রিকতার মর্যাদা কোন ধুলোয় লুটোলো? গোটা দুনিয়া জেনে গেল, পশ্চিমবঙ্গে একটি স্তালিন-রাজ জারি রয়েছে, যেখানে রাষ্ট্র শক্তি সম্পূর্ণ খেয়ালখুশি মতো আপনার কণ্ঠরোধ করতে পারে এবং সেই চণ্ডনীতিতে সাহিত্য, শিল্প সংস্কৃতির জগৎ থেকে নামজাদা কিছু নাগরিকের সমর্থন যোগাড় করে নিতে পারে। এ যদি সাংস্কৃতিক ফ্যাসিবাদের লক্ষণ না হয়, তবে সাংস্কৃতিক ফ্যাসিবাদ কাকে বলে, মাননীয় বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য মহাশয় বলে দেবেন কি? কে জানে হয়তো বা তসলিমা নাসরিনের বই নিষিদ্ধ করা এবং করানোর জন্য এই উদগ্র তৎপরতার পিছনে আসলে অন্য কারণ আছে। যে মেয়ে নিজের জীবনের বৃত্তান্ত লিখতে গিয়ে ক্রমাগত আরও অনেকের জীবনের বৃত্তান্ত জনসমক্ষে মেলে ধরে, তাকে আত্মপ্রকাশের অধিকার দেওয়াটা বোধহয় এ বার অতিমাত্রায় বিপজ্জনক হয়ে উঠছে। তা না হলে, পঁচিশ জন বুদ্ধিজীবী বললেন, তাই বই নিষিদ্ধ করলাম –এমন হাস্যকর নাবালকোচিত কৈফিয়ৎ, আস্তে কন, ঘুড়ায় হাসব।

বাংলার, দুই বাংলার সবচেয়ে বড় মনীষী শিবনারায়ণ রায় লিখেছেন ‘.. এ কথা নিশ্চয় করে বলতে পারি সমকালীন দুই বাংলা মিলিয়ে মেরি ওলস্টনক্রাফটের যোগ্যতমা উত্তরসাধিকা হচ্ছেন স্বদেশ থেকে নির্বাসিতা তসলিমা নাসরিন। দ্বিখণ্ডিত’ নামে তসলিমা নাসরিনের আত্মজীবনীর যে তৃতীয় খণ্ডটি প্রথমে বাংলাদেশে এবং সম্প্রতি পশ্চিমবঙ্গ সরকারের দ্বারা নিষিদ্ধ হয়েছে, আমার বিবেচনায় সেটি একটি অসামান্য গ্রন্থ। মাতৃগর্ভে আমাদের চেহারা নানা রূপের ভিতর দিয়ে মনুষ্য রূপ ধারণ করে। কিন্তু জন্মের পর থেকেই নানাভাবে চেষ্টা চলে শিশুকে সমাজ-স্বীকৃত একটি ধাঁচে গড়ে তুলবার। বিভিন্ন সমাজে, বিভিন্ন যুগে ধাঁচটির অদলবদল ঘটে, কিন্তু উদ্দেশ্যের অদলবদল ঘটে না। সেই উদ্দেশ্যটি হল সমষ্টিস্বীকৃত একটি ধাঁচের মধ্যে ফেলে ব্যক্তির স্বকীয় স্বাধীন বিকাশের সম্ভাবনাকে বিলুপ্ত করা। সমাজে যারা ক্ষমতার দখলদার তারা ধর্ম, ঐতিহ্য, শাস্ত্র, লোকাঁচার ইত্যাদির নামে এই ধাঁচে ফেলবার প্রক্রিয়াটি চালু করে। কিন্তু প্রতি শিশুর মধ্যে নিহিত থাকে নিজস্ব একটি অস্মিতা অর্জনের সামর্থ্য। তবে সেই অর্জনের জন্য লাগে ইচ্ছাশক্তি ও প্রয়াস, যুক্তিশীলতা এবং সততা, একনিষ্ঠ সাধনা ও অনুশীলন। এখনও পর্যন্ত দেখা যায় অধিকাংশ মানুষ সমাজ স্বীকৃত ছাঁচেই গড়ে ওঠে। কিন্তু কেউ কেউ তাঁদের প্রাজাতিক সামর্থ্যকে নিজের চেষ্টায় শত বাধাবিপত্তির সঙ্গে লড়াই করেই ক্রমে বাস্তবায়িত করেন তাঁদের স্বোপার্জিত অস্মিতা তাঁদের জীবনযাত্রায়, চিন্তায়, কার্যকলাপে ভাবনায়, এবং রচনায় প্রকাশিত হয়। এইভাবেই আমরা পাই সক্রেটিস থেকে বিদ্যাসাগর, জ্যোদানো ব্রুনো থেকে মানবেন্দ্রনাথ রায়। কিন্তু কীভাবে তারা নিজেদের এই অনন্যতন্ত্র, অস্মিতা গড়ে তুলেছিলেন তার বিবরণ কচিৎ মেলে। এ ক্ষেত্রে ফরাসি দার্শনিক সিমোন দ্য বোভায়ার-এর মতো তসলিমা নাসরিনকেও ব্যতিক্রমী মনে করি। খণ্ডে খণ্ডে প্রকাশিত তাঁর আত্মজীবনীর, এবং বিশেষ করে দ্বিখণ্ডিত’ নামে তাঁর তৃতীয় খণ্ডটির সবচাইতে বড় মূল্য এবং আকর্ষণ এটির ভিতর দিয়ে আমরা অনেকটা জানতে পারি কীভাবে বহু বাধাবিপত্তি, আঘাত, অপমান আর ব্যর্থতার ভিতর দিয়ে মুসলমান মধ্যবিত্ত ঘরের একটি সাধারণ মেয়ে তাঁর আত্মশক্তি আবিষ্কার করেন, অপ্রতিম তসলিমা নাসরিন হয়ে ওঠেন। প্রথম দুটি খণ্ডে যে ভূমিকা রচিত হয়েছিল তৃতীয় খণ্ডে তা পরিণতি পায়। এই গ্রন্থের যেমন ঐতিহাসিক তেমনি সাহিত্যিক মূল্য প্রচুর। দুই বাংলার সরকারি নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও এই বই অনেকে পড়বেন, এর ঢাকঢাক গুড়গুড়হীন স্পষ্টতা অনেকের অপছন্দ হবে। আবার অনেকেই এ বই থেকে আত্মরূপান্তরের প্রেরণা পাবেন। পশ্চিমবঙ্গে এখন যেসব বই জনপ্রিয় তাদের বেশির ভাগই অবক্ষয় এবং আপজাত্যের কাহিনী, অথবা লঘু রম্যরচনা। তসলিমার কষ্টের অন্ত নেই, কিন্তু তিনি পারিপার্শ্বিক চাপের কাছে হার মানেননি, নারী এবং পুরুষ উভয়েরই ভিতরে মনুষ্যত্বের উজ্জীবনে তার প্রয়াস আজও ক্লান্তিহীন।… তসলিমা তাঁর আত্মজীবনীর প্রথম দুটি খণ্ডে তাঁর বাল্যকাল এবং বয়ঃপ্রাপ্তির বিচিত্র অভিজ্ঞতার কথা লিখেছিলেন। কিছুই রেখেঢেকে লেখেননি। ফলে দুই বাংলার শিক্ষিত মধ্যবিত্ত সমাজের অধিকাংশ স্ত্রী-পুরুষ–যাঁরা সমস্ত অপ্রিয় সত্যকে ধামাচাপা দিয়ে রাখাকেই সভ্যতার আবশ্যিক শর্ত বিবেচনা করেন –স্বভাবতই খুব বিচলিত হয়েছিলেন। ..

এখন থেকে প্রায় একশো বছর আগে বেগম রোকেয়া লিখেছিলেন, আমাদের যথাসম্ভব অবনতি হওয়ার পর দাসত্বের বিরুদ্ধে কখনও মাথা তুলিতে পারি নাই, তাহার প্রধান কারণ এই বোধ হয় যে যখনই কোনো ভগ্নী মস্তক উত্তোলনের চেষ্টা করিয়াছেন, তখনই ধর্মের দোহাই অথবা শাস্ত্রের বচন রূপ অস্ত্রাঘাতে তাহার মস্তক চূর্ণ হইয়াছে। আমাদের অন্ধকারে রাখিবার জন্য পুরুষগণ ওই ধর্মগ্রন্থগুলিকে ঈশ্বরের আদেশপত্র বলিয়া প্রকাশ করিয়াছেন। এই দুঃসাহসী সত্যঘোষণার জন্য তাকে যথেষ্টনিগ্রহ সইতে হয়, এবং গ্রন্থাকারে প্রকাশের সময়ে নবনূর এ প্রকাশিত মূল প্রবন্ধটির কিছু অংশ বাদ দিতে হয়। একশো বছর পরেও প্রস্তাব শুনছি তসলিমার বইটি থেকেও কিছু অংশ বাদ দিলে সেটির ওপরে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহৃত হতে পারে। একশো বছর পরেও কি আমরা অতীত সময়ের সেই দুঃসহ বিন্দুটিতে দাঁড়িয়ে?

পশ্চিমবঙ্গের অনেক কাগজেই বই নিষিদ্ধ করার প্রতিবাদ বেরিয়েছে। অনেক কাগজের সম্পাদকীয় বা কলামে অনেকে বই নিষিদ্ধের বিরুদ্ধে মুখর হয়েছেন, যদিও বড় কিছু লেখক এবং শিল্পী সরকারি নিষেধাজ্ঞাকে সমর্থন করেছেন। ঢাকার কোনো কাগজেই বই নিষিদ্ধ করার বিরুদ্ধে খুব বেশি কেউ টু শব্দ করেননি বরং প্রায় সবাই সায় দিয়েছেন বই নিষিদ্ধের মতো নিষিদ্ধ কাজে। ঘৃণার মতো সংক্রামক আর কিছু নেই। কেউ যদি একবার কারও বিরুদ্ধে ঘৃণা প্রচার করে, সেই ঘৃণা সম্পূর্ণই মিথ্যের কাঁধে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা হলেও আলোর গতিরও আগে ছোটে সেই ঘৃণা।

কত কিছু ঘটে গেল ‘দ্বিখণ্ডিত’ নিয়ে। নিষিদ্ধ হল একটি মত, ‘দ্বিখণ্ডিত’ হল পাঠকের পথ। কেউ বলছে নিষিদ্ধ হোক, কেউ বলছে না হোক। কেউ বলছে ধর্ম নিয়ে নিজের মত প্রকাশ করা যাবে না, কেউ বলছে যাবে। কেউ ভয়ে কেঁপে উঠে বলছে, দাঙ্গা লেগে যাবে। কেউ ঠোঁট উল্টে বলছে, দাঙ্গার কোনোআভাসই কখনো দেখা দেয়নি। কেউ বলছে, মুসলমানের ভোট পাওয়ার জন্য সরকারের এই নিষিদ্ধকরণ। কেউ বলছে, পয়গম্বরকে অশ্রদ্ধা করা হয়েছে সুতরাং নিষিদ্ধ হওয়াই বাঞ্ছনীয়। যে যাই বলুক, আমি মত প্রকাশের স্বাধীনতার পক্ষে। কেবল নিজের মত নয়, অন্যের মতও, সে মত আমার মতের যতই বিপরীত হোক। এ বিষয়ে আমার নিজের বিশ্বাস সামান্যও খণ্ডিত হয়নি। আমি অখণ্ডই থেকে গেছি যেমন ছিলাম।

বাংলাদেশ আমার পাঁচটি বই নিষিদ্ধ করেছে। সে তুলনায় পশ্চিমবঙ্গ কম করেছে। একটি। কিন্তু নিষিদ্ধ করার কারণ দু সরকারই একই দেখিয়েছে, মানুষের ধর্মীয় মূল্যবোধে আঘাত করেছি। ধর্মীয় মূল্যবোধ রক্ষার অজুহাতে চিরকালই শাসককুল মানুষের কণ্ঠরোধ করেছে। আমরা তো এখনও সেই যুগকেই ‘অন্ধকার যুগ’ বলি, যে যুগে ধর্ম দ্বারা রাষ্ট্র পরিচালিত হত!

‘দ্বিখণ্ডিত’ নিষিদ্ধ করায় যে অন্ধকার কেঁপে নেমেছিল, সে থেকে মানুষকে বাঁচাবার দায়িত্ব প্রথম নিয়েছিলেন সুজাত ভদ্র। তিনিই আদালতে গেলেন জরুরি একটি প্রশ্ন নিয়ে, ‘আমি এ দেশের নাগরিক, এ দেশে প্রকাশিত ‘দ্বিখণ্ডিত’ নামের বইটি আমি পড়তে চাই। কে আমার পড়ার অধিকার খর্ব করছে? তাঁকেই সাহায্য করতে গিয়ে মত প্রকাশের স্বাধীনতার পক্ষে জয়মাল্য বাগচি তাঁর অসাধারণ যুক্তি পেশ করে আদালত মুগ্ধ করলেন। ব্যক্তিগতভাবে কৃতজ্ঞতা আমি সুজাত ভদ্র বা জয়মাল্য বাগচিকে জানাইনি। জানাইনি মহামান্য বিচারকদেরও, যারা দ্বিখণ্ডিত’ নিষিদ্ধ হওয়ার বিপক্ষে রায় দিয়েছেন। জানাইনি, কারণ যদিও বইটি আমার লেখা, আপাতদৃষ্টিতে এ আমার ব্যক্তিগত বটে, কিন্তু নিষিদ্ধ হওয়ার পর ব্যাপারটি মোটেই আমার ব্যক্তিগত নয়। নিষিদ্ধ হলে আপনাতেই লেখক আড়ালে চলে যান, সামনে এসে দাঁড়ায় বড় প্রশ্নবোধক চিহ্নের মতো লেখার অধিকার। কেবল তার নয়, সবার। সবার ন্যায্য অধিকারের পক্ষে চিরকালই লড়াই করেন গুটিকয় মানুষ। তারা অলক্ষ্যে অজান্তে ইতিহাস রচনা করেন। সভ্যতার ইতিহাস। সুজাত ভদ্র এই ভারতবর্ষে এক আকাশ আলো ছড়িয়ে সেই ইতিহাসটিই রচনা করলেন। দু’বছর নিষিদ্ধ থাকার পর ‘দ্বিখণ্ডিত’ মুক্তি পেল। আদালতের রায়ে নিষিদ্ধ ‘দ্বিখণ্ডিত’র মুক্তি পাওয়া আমার ব্যক্তিগত কোনো জয় নয়, এ জয় মুক্তচিন্তার জয়, বাক স্বাধীনতার জয়, এ মত প্রকাশের অধিকারের জয়। অনেকেই যোদ্ধা ছিলেন। লেখক আর প্রকাশক তো ছিলেনই, আদালতে শুনানির দিন নিষিদ্ধের বিপক্ষে, অনেকে আবার বাক স্বাধীনতার পক্ষে উপস্থিত থাকতেন। যত দুরাশাই দেখা দিক, একটি সান্ত্বনা এই, অধিকাংশ মানুষ বই নিষিদ্ধ হোক চায় না, সে যে মতের বইই হোক না কেন। তবে একই সঙ্গে একটি আশংকা এই, অধিকাংশ এই মানুষ মুখ বুজে থাকে।
 
০২. হঠাৎ একদিন


হারভার্ডের জীবন শেষ হওয়ার পর ভাবি এবার কোথায়! কোন দেশ? কোন শহর! কোথাও দাঁড়াতে চাই, পায়ের তলায় মাটি চাই। যাযাবর জীবনের ইতি বারবার টানতে গিয়েও ব্যর্থ হয়েছি, আর যেন ব্যর্থ না হই। বাংলার মেয়ে বাংলায় ফিরবো। দীর্ঘদিনের এই স্বপ্ন আমায় তাড়া করে, আমার পায়ে পায়ে হাঁটে, সেঁটে থাকে গায়ে। এত কিছু ঘটে গেল বাংলায়! বই নিষিদ্ধ, অবান্তর কুৎসা, নিন্দা, তারপরও বাংলায় ফেরার ইচ্ছে। বিশুদ্ধ জল হাওয়া, ঝলমলে নগর, নিরাপদ জীবন ফেলে কলকাতায় ফিরি। বিদেশ থেকেই ট্রায়াংগুলার পার্কে একটি আসবাবওয়ালা বাড়ি এক মাসের জন্য ভাড়া নেওয়ার ব্যাপারটা পাকা করে, তবে। হোটেলে থাকার আর একদমই ইচ্ছে নেই। ইচ্ছে কি কোনওকালে ছিল। উপায় ছিল না বলে থাকতে হয়েছে। ট্রায়াংগুলার পার্কের বাড়িতে মানুষে, কোলাহলে, বন্ধুতে, ব্যস্ততায়, বিস্ময়ে, কৌতূহলে পুরো একমাস কাটাই। খোঁজ করতে থাকি একটি বাড়ির যেখানে অস্থায়ী নয়, রীতিমত স্থায়ী বাস করব, যতদিন বেঁচে থাকি, ততদিন। স্বপ্নগুলো পাখা মেলতে থাকে, সেইসব অচিন দেশের অচিন পাখির অচিন পাখা। অতিকায় সব পাখা আমাকে অদৃশ্য করে ফেলে।

সুইডেনের ভারতীয় দূতাবাসে আমার লেখা পছন্দ করেন এমন একজন হৃদয়বান মানুষ ছিলেন, কেন ছিলেন কে জানে! ভিসা করতে গেলে দিব্যি আমাকে ‘এক্স ভিসা দিয়ে দিলেন, যেটির, পরে জেনেছি, মেয়াদ ছমাস অন্তর অন্তর বাড়িয়ে অনন্ত কাল ভারতে থাকা যায়। এখন থেকে আর পর্যটক নই, রীতিমত বাসিন্দা আমি। কত শত স্বপ্ন মনের উঠোনে এক্কা দোক্কা খেলে, হঠাৎ যে কখন কোন্ ঘরটা কেনা হয়ে যায়, কোন্ স্বপ্নটা পূরণ হয়ে যায় নিজের অজান্তেই।

এক সকালে কলকাতা বিমান বন্দরে নেমেই কোনো একটা নম্বরে ফোন করে বাড়ি ভাড়া নেব, এক্ষুণি এই মুহূর্তে বললে ওপারের অচেনা এক কণ্ঠস্বর থেকে এক থোকা বিস্ময় ঝরে পড়ে। এভাবে বাড়ির কিছুই না দেখে বাড়ি ভাড়া কেউ নিয়েছে বলে তার জানা নেই। ধুলোধূসরিত খালি বাড়িতে খালি হাতে উঠে তোশক বালিশ খাট সোফা বাসন কিনে নিয়ে আসি, হ্যাঁ সেই সকালেই, সেদিনই। কোথায় বাড়ি ভাড়া পাওয়া যাবে, কোথায় আসবাব পত্র, কোথায় চাল ডাল, সে ধারণা দেওয়ারও অবশ্য লোক ছিল না। প্রশ্ন করলে, যারা ঘিরে থাকে, আমি নামী বলে, বা আমি আমি বলে সবাই অপ্রস্তুত হয়, উত্তর নেই, অথবা ভুল উত্তর। সংসার ওই ভুল দিয়েই শুরু হয় আমার। আমার কলকাতার সংসার।

দু’দিনেই বাড়ি বাসযোগ্য করে ফেলি। চারদিনে সাজানো। সাতদিনে ঝলমলে। ছ’মাসে মনে হয় তিরিশ বছরের সংসার। বারান্দায় শৈশবের সব ফুল। নানা রঙের ফুল ফুটে সুবাস ছড়াতে থাকে বাড়িময়। রাতে হাসনুহেনার গন্ধে বাড়ি ভেসে যায়। প্রায়ই একটি হাসনুহেনার টব শিয়রের কাছে এনে রাখি। ঘ্রাণ শুকতে শুকতে শৈশবে যেমন ঘুমোতাম, তেমন ঘুমোই। শহরের মধ্যিখানে চমৎকার বাড়ি। নিরাপদ বাড়ি। ঠিক রাস্তার ওপরে নয়। দুদুটো লোহার ফটক পেরিয়ে, দারোয়ান পেরিয়ে তবে ভেতরে ঢুকতে হয়। খোলা বারান্দা। মশলার সুগন্ধ ভেসে আসে রান্নাঘর থেকে, বারান্দায় অল্প অল্প উড়তে থাকে শুকোতে দেওয়া কাপড়। কী আশ্চর্য সুন্দর এই দৃশ্য! কতকাল আমি আমার শৈশব কৈশোরকে এত কাছ থেকে দেখি না। আলোয়, হাওয়ায় বাড়িটি সত্যিকার বাড়ি হয়ে ওঠে। আমার সাত নম্বর রাওডন স্ট্রিটের বাড়ি।

শহর আগের মতোই, তবে দীর্ঘদিনের বন্ধুটি নেই শহরে। যে বন্ধু সুসময়ে দুঃসময়ে ঠিক একই রকম পাশে থাকতেন, যাঁর সঙ্গে যে কোনো বিষয়ে যে কোনো সময় কথা বলা যেত, সেই নিখিল সরকার, নেই। সেই অথৈ সমুদ্র, সেই নিমগ্ন সাধক, সেই জ্ঞানের ভাণ্ডার নেই। জগৎ আমার, টের পাই, ঠিক বুঝে ওঠার আগেই কী রকম খালি হয়ে যাচ্ছে। মাও নেই, বাবাও নেই, নিখিল সরকারও নেই। আত্মীয় স্বজন থেকেও নেই, চেনা পরিচিত লোকদের বন্ধু বলে ডাকি। ঘন ঘন দেখা করতে আসা ভক্তদেরও বন্ধু বলি। তাড়াহুড়ো করে একটা তাসের ঘরের মতো কিছু গড়ে তুলছি কি! মাঝে মাঝে সবকিছুকে অদ্ভুত এক মায়া, রহস্যের জালের মতো মায়াবি এক জাল অথবা জীবন নিয়ে নিতান্তই বালখিল্য রসিকতা বলে মনে হয়।

রাওডন স্ট্রিটের বাড়ির দুয়ার সবার জন্য খোলা। সবার জন্য, এমন কী অচেনা মানুষের জন্যও আপ্যায়নের অন্ত নেই। আতিথেয়তা আমার অন্তরে। কত ঠিক-মানুষ, কত বেঠিক মানুষ, কত ভুল, কত ধূর্ত আমার ঘরের চৌকাঠ পেরিয়েছে। কাউকেই বেঠিক বা ভুল ভাবতে আমার ইচ্ছে করেনি। আজও করে না। এরকমই আমি। এরকমই সাদাসিধে আর নিরীহ। ঘরের পোশাকে আর হাওয়াই চপ্পলে হেঁটে হেঁটে দিব্যি ঘুরে বেড়াই শহর। ফুটপাত থেকে সস্তা জিনিস পত্তর কিনি। গড়িয়াহাটের বাজার থেকে বেড়ালছানা তুলে এনে আদরে আহ্লাদে বড় করি। সাদামাটা ধুলোবালির জীবন। আবার এই জীবনই মুহূর্তে ঝলমলে হয়ে উঠতে পারে। বই মেলায় স্টলের দরজা বন্ধ করে রাখতে হয় ভিড় ঠেকাতে। পুলিশের লাঠিচার্জের দরকার হয় ভক্তদের উন্মাদনা দূর করতে। তারপরও পাঠকদের সঙ্গেই সম্পর্ক গড়ে ওঠে। সাহিত্যজগতের মাতব্বরদের সঙ্গে ওঠা বসা নেই মোটেই। কাউকে দাক্ষিণ্য দেওয়া বা গুরু মানা আমার স্বভাবে নেই। সত্য কথা কোনও রাখঢাক না। করে বলে দেওয়া, মাতব্বরদের, শুনেছি, একেবারেই পছন্দ নয়। নিভৃতে আমি বাস করি আমার মতো। দেশি জীবনের বাইরেও আরেক জীবন আছে। পশ্চিমের দেশে যেতে হয় ঘন ঘন। অনুষ্ঠানে কবিতা পড়তে বা বক্তৃতা দিতে, বা পুরস্কার নিতে। কোনও না কোনও আমন্ত্রণ থাকেই। শুধু পশ্চিমের দেশেই ভালো ঘটনা ঘটছে, তা বলবো না। ভালো কিছু কলকাতাতেও ঘটে। ব্যাগ ফিল্মস আমার ‘ফরাসি প্রেমিক’-এর গল্প অবলম্বনে চলচ্চিত্র তৈরি করার জন্য চুক্তিপত্রে সই নিয়ে যায়, কণিমাইটের টাকাও দিয়ে যায়। খুব ঘটা করে আমার লেখা ভূমিকা সম্বলিত শত বছরের রবিবাসরীয় গল্পগুলোর নির্বাচিত একটি সংকলন বের হয় ‘আনন্দ’ পাবলিশার্স থেকে। ‘আনন্দ’ আমার লেখা বইগুলোর সমগ্র করার জন্যও উদ্যোগ নেয়। আমার ‘শোধ’ গল্পটি নিয়ে টেলিভিশনে এক মাসের একটি সিরিয়াল দেখানো হয়। অন্য সব সিরিয়ালের চেয়েও জনপ্রিয় হয় এটি। মেগা সিরিয়ালের গল্প লেখার জন্য আমন্ত্রণ জোটে। লিখতে থাকি মেগাসিরিয়ালের গল্প। গল্পের নাম দিই ‘দুঃসহবাস’। ওদিকে সুটিংও হতে থাকে। ‘ফেরা’ গল্প নিয়ে অনেকদিন হল নাটক হচ্ছে। বিভিন্ন মঞ্চে। গিরিশ মঞ্চে, মধুসূদন মঞ্চে, রবীন্দ্র সদনে সেই নাটক দেখি। তা ছাড়া বিভিন্ন গ্রুপ থিয়েটারের অসাধারণ সব নাটক দেখাও হয়। একবার নান্দীকার আয়োজন করলো নাট্যসপ্তাহের, সেইসব নাটক শেষ হলে রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্ত আমাকে মঞ্চে ডাকতেন যেন বিজয়ী কলা কুশলীদের মাল্যদান করি। নিজেকে কলকাতার সাহিত্যিক সাংস্কৃতিক জগতের একজন মনে হয়। কখনও মনে হয় না আমি কলকাতার লোক নই, আমি অন্য দেশ থেকে এসেছি। সেই কিশোরী বয়স থেকেই তো কলকাতার সঙ্গে সখ্য আমার। সেকালে সেঁজুতিতে যাদের কবিতা ছাপাতাম, অথবা যাদের লিটল ম্যাগে আমার কবিতা ছাপা হত, একদিন ওদের যে ক’জনেরই খোঁজ পাওয়া যায়, সবাইকেই আ আর রাতের খাবারের নেমন্তন্ন করি বাড়িতে। কেউ এখনও লিখছে, কিন্তু যে জায়গায় ছিল সেই জায়গাতেই দাঁড়িয়ে আছে, কেউ তান্ত্রিক হয়ে গেছে, কেউ ব্যবসায়ী, তারপরও পুরোনো দিনগুলো ফিরে পেতে চাওয়ার আকুলতা আমি টের পাই আমার ভেতর। দেশ থেকে দাদা আসে। ঝুনু খালা আসে। দাদার ছেলে শুভও বেড়াতে আসে। সবাইকেই আদরে ডুবিয়ে রাখি। আর কলকাতা দিতে থাকে আমাকে দুহাত ভরে। সকালে বাংলা খবরের কাগজ পড়ার সুযোগ কোথায় আর পেতাম জগতে। বিকেলে কোনও একটা বাংলা ম্যাগাজিন, বা বই হাতে নিয়ে শুয়ে পড়া। সন্ধেয় বাংলায় আড্ডা আর রাতে এক গুচ্ছ বাঙালি মিলে হৈ হৈ করে বাঙালি খাবার! তাছাড়া তো আছেই টেলিভিশনে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে, বিভিন্ন বিষয়ে মত প্রকাশ করার আমন্ত্রণ। আর আছে বিভিন্ন চিত্র প্রদর্শনী উদ্বোধন করা। নানা লেখক কবির বইএর ফিতে কাটা। বিভিন্ন মঞ্চে কবিতা পড়া। আর ‘ধর্ম মুক্ত মানববাদী মঞ্চ’ নিয়ে স্বপ্ন দেখা। বাঙালি মুসলমান পরিবারে জন্ম কিন্তু ধর্মমুক্ত মানুষদের জড়ো করে একটি মানববাদী সংগঠন গড়ে তুলি, নিজেকে ইচ্ছে করেই রাখি নেপথ্যে। সংগঠনের উদ্দেশ্য সত্যিকার ধর্মমুক্ত রাষ্ট্র, সমাজ, শিক্ষা এবং আইন প্রতিষ্ঠা করা, মেয়েদের শিক্ষিত আর স্বাধীন করা, মসজিদ মাদ্রাসার উৎপাত বন্ধ করা। পশ্চিমবঙ্গের আনাচ কানাচ থেকে আগ্রহীরা জড়ো হতে থাকে। অন্ধকারে পড়ে থাকা মুসলমান সমাজকে আলোকিত করার উদ্যোগ নিই, খুব ছোট বটে দল, কিন্তু স্বপ্ন ছোট নয়। বাতি খুব উজ্জ্বল, কিন্তু সব আঁধার ঘরে, সব অন্ধকার গলিতে পৌঁছে দেবার লোকবল নেই। না থাকুক, কলকাতার বিভিন্ন মঞ্চে অনুষ্ঠান করা, লিফলেট বিতরণ, মিটিং মিছিল চলতে থাকে।

দৈনিক স্টেটসম্যানে নিয়মিত কলাম লিখি। এক একটি কলাম হাজার বছরের সংস্কার ভেঙে নতুন সময়ের দিকে, নারী পুরুষের সমতার দিকে, একটি সুস্থ সুন্দর সমাজের স্বপ্ন দেখাতে দেখাতে হাত ধরে নিয়ে চলে। নিখিল সরকার নেই, তবে শিবনারায়ণ রায়, অম্লান দত্ত আর প্রশান্ত রায়-এর সঙ্গে হয় সাহিত্যিক সাংস্কৃতিক বৌদ্ধিক আলোচনা। একদিন ঘটা করে মরণোত্তর দেহদানও করে ফেলি। মরে গেলে কলকাতা মেডিক্যাল কলেজের ছাত্র ছাত্রীরা পড়বে শরীর। দুটো চোখ আর দুটো কিডনি চলে যাবে যাদের প্রয়োজন, তাদের কাছে। দেশের নানা রাজ্য থেকে আমন্ত্রণ এলে ঘুরে আসি, বইয়ের উদ্বোধন, নয়তো ভাষণ। যেখানেই যাই একদিকে ভক্তের ভিড়, আরেকদিকে মৌলবাদী বিক্ষোভ। কেরালা, মধ্যপ্রদেশ, বিহার, উড়িষ্যা, আসাম, মহারাষ্ট্র, দিল্লি। বাকি জীবন কলকাতায় থাকবো, এতে কোনো দ্বিধা নেই বলে একটা গাড়ি কিনে ফেলি একদিনের নোটিশে। বাড়িও কিনি, চমৎকার একটা দোতলা বাড়ি।

এক উঠতি কবির সঙ্গে বন্ধুত্ব গাঢ় হয়। এক ডাক্তারের সঙ্গেও অদ্ভুত একটাঅমীমাংসিত সম্পর্ক গড়াতে থাকে। এমন সময় সেই দিনটি আসে, কালো সেই দিনটি।

বাড়ি থেকে অনেকদিন বেরোই না। অনেকদিন একটানা বসে থেকে ভালোও লাগছিল না। ডক্টর ইনাইয়া বলছিলেন হায়দারাবাদে আমার ‘শোধ’ বইটা বেরোচ্ছে, তাঁর স্ত্রী অনুবাদ করেছেন, যেন যাই একবার ওখানে, বই উদ্বোধনের আনুষ্ঠানিকতায়। এর আগে দুবার তিনি আমাকে সম্বর্ধনা দেওয়া বা আমার বক্তৃতা শোনা ইত্যাদি অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিলেন, যেতে রাজি হইনি। এবার রাজি হয়েছি। রাজি হওয়ার কারণ বোধহয় নতুন জায়গা, আমার একটু হাওয়া পাল্টানো, একটুখানি কলকাতার একঘেয়েমি কাটানো। সকালে গিয়ে বিকেলে ফিরবো, কোনও সুটকেস, কোনও টুথব্রাস, কোনও কাপড় চোপড় নেওয়ার প্রশ্ন ওঠে না। নীল শিফনের একটা শাড়ি পরে নিলাম। ইস্ত্রিও করা নেই। দলামোচা হলেও খুব একটা বোঝা যায় না। আর গেলেই বা কী! কাপড় চোপড় নিয়ে মাথা আমি ঘামাই না। সাজগোজ নিয়েও না। একসময় তো লিপস্টিক পরাও বাদ দিয়েছিলাম। এখন চুলটা এলোমেলো হলে একটুখানি আঁচড়াই আর ঠোঁটে হালকা লিপস্টিক পরি, এতে শুকিয়ে চড়চড় হওয়া থেকে ঠোঁটের বাঁচা হয়।

হায়দারাবাদ বিমান বন্দরে নেমে ডক্টর ইনাইয়াকে একা দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে আমি একটু অবাক হই। নিরাপত্তা-পুলিশ কোথায়! ভেবে নিই, পুলিশ অনুষ্ঠানে থাকবে, বিমান বন্দরে আসেনি। ঝকঝকে একখানা গাড়িতে আমাকে উঠিয়ে হোটেলে নিয়ে গেলেন ইনাইয়া। পাঁচতারা হোটেলের একটা ঘর তিনি ভাড়া নিয়েছেন অনুষ্ঠানের আগে আমার বিশ্রামের জন্য। ঘরটা সুন্দর। বিছানায় শুয়ে একটুখানি টেলিভিশন দেখি। উঠে চা বানিয়ে খাই। এরমধ্যেই ফোন। কী, নিচে নামতে হবে। অনুষ্ঠানে যাওয়ার সময় হয়ে গেছে। অনুষ্ঠান কোথায়, কী ধরনের অনুষ্ঠান, তার কিছু আমি জানি না। ইনাইয়াকে জিজ্ঞেস করলে কড়া অস্ত্রের উচ্চারণে তিনি ঠিক কী বলেন বা বলতে চান, তার বেশির ভাগই বুঝতে পারি না। জিজ্ঞেস করলাম, পুলিশ প্রোটেকশন রাখেন নি?

ইনাইয়া এর উত্তরে কী বললেন, আমার পক্ষে বোঝা সম্ভব হল না।

‘যে রাজ্যেই যাই, আমার জন্য তো নিরাপত্তা রক্ষীর ব্যবস্থা করা হয়। আপনি করেননি?’

এবার যা বললেন, তা খুব কান পেতে শুনে বোঝার চেষ্টা করে যেটুকু উদ্ধার করতে পারলাম, তা হলো–‘করিনি.. হে হে। ছোটখাটো অনুষ্ঠান। তেমন প্রচার হয়নি। খামোক পুলিশের ঝামেলা করার দরকার কী!’

‘ও। আসলে ঝামেলা করতে নয়, পুলিশ প্রোটেকশন বরং ঝামেলা এড়াতেই রাখতে হয়।‘

‘হে হে।‘

আমি জানিনা ইনাইয়াকে কেন স্মরণ করিয়ে দিলাম না যে এই হায়দারাবাদে আমি গত দু’দুবার আমন্ত্রণ পেয়েও আসা বাতিল করেছি, তার একমাত্র কারণ এ শহরকে আমি নিরাপদ বলে ভাবিনি। কারণ মুসলমানরা এ শহরে আমার বিরুদ্ধে এর আগে কিছু হৈ চৈ করেছে, কাগজে পড়েছি বইয়ের দোকান ভাংচুর করেছে আমার লজ্জা বিক্রি করছিলো বলে। আমার ভুলো মন। ভুলেই হয়তো গিয়েছিলাম এ শহরে মুসলমানের সংখ্যা অন্য অনেক শহরের তুলনায় বেশি। মুসলমানের সংখ্যা বেশি হলেই মুসলমান মৌলবাদীর সংখ্যা বেশি হওয়ার আশংকা থাকে। মৌলবাদীরা আমাকে বহুবছর ইসলাম-বিরোধী খেতাব দিয়ে বসে আছে। সব মোছা যায়, এই খেতাব মোছা যায় না। আমার নাস্তিকতা, আমার মানববাদ, আমার বিজ্ঞানমনস্কতা, আমার মানবতা কিছুই মানুষের মস্তিষ্কে গভীর করে গেঁথে যাওয়া ‘আমি ইসলাম-বিরোধী এই বিশ্বাসের কাঁটাটি উপড়ে ফেলতে পারেনি।

অনুষ্ঠান হায়দারাবাদের প্রেসক্লাবে। উদ্বোধন হলোবইয়ের। আমার ‘শোধ’ উপন্যাসের তেলুগু অনুবাদ। একজন তেলুগু লেখক এবং একজন অনুবাদক নিজেদের লেখা এবং অনুবাদ সম্পর্কে নিজেদের অভিজ্ঞতার কথা বললেন। আমি বললাম মানবাধিকার বিষয়ে। ‘শোধ’ নারীবাদী বই। শোধের প্রধান চরিত্র ঝুমুর নিজেকে পুরুষের সম্পত্তি হতে দেয়নি, প্রতিবাদ করেছে। নারী যে পুরুষের বা সমাজের সম্পত্তি নয়, এ কথাই চিরাচরিত কোমল কণ্ঠে বললাম। আমার কণ্ঠস্বর কিছুতেই ‘মিছিলের ভেঙে দাও গুঁড়িয়ে দাও’ বলা মেয়েদের মতো হয়ে ওঠে না। শান্ত, শিষ্ট, নম্র, নরমই রয়ে যায় যতই ক্রুদ্ধই হই না কেন, যত কঠিন কথাই বলি না কেন!

অনুষ্ঠান শেষে বেরোবো দুপুরের খাবার খেতে, তখনই ঘটনাটি ঘটে। প্রেস ক্লাবের সামনের দরজা দিয়ে কিছু লোক ভিতরে ঢুকে তেলুগু ভাষায় চিৎকার করতে করতে আমার দিকে এগোতে থাকে। চিৎকার করে কী বলছে তা বোঝার সাধ্য আমার নেই। আমার দিকেই বা এগোচ্ছে কেন, তাও জানি না। হঠাৎ দেখি, হাতের কাছে যা পাচ্ছে, ফুলের তোড়া, বই, ব্যাগ, চেয়ার–সব ছুঁড়ে ছুঁড়ে মারছে আমাকে লক্ষ্য করে। ঠেকাতে গিয়ে ক’জন আহত হলেন। সাংবাদিকরা ব্যস্ত ক্যামেরায় ছবি তুলতে। আমি ওদের পেছনে নিজেকে আড়াল করার ব্যর্থ চেষ্টা করছি। আমার গায়ে কী এসে লাগল, নিয়ে ভাবছিলাম না। ভাবছিলাম, ক্রমশ এগিয়ে আসতে থাকা মৃত্যু থেকে কী করে বাঁচবো আমি। কেউ একজন আমাকে টেনে পেছনের দরজার কাছে নিয়ে গেল, ক্লাবঘর থেকে আমাকে বের করে নেবে, গাড়িতে ওঠাবে। আক্রমণকারীরা তখন পেছনের দরজার দিকে দৌড়ে আসছে। বুঝে যাই, গাড়িতে ওঠা আমার পক্ষে সম্ভব হবে না। পেছনের দরজাটি আমি দ্রুত বন্ধ করে দিলাম। সঙ্গে সঙ্গে জোরে লাথি মেরে দরজার কাঁচ ভেঙে ফেললো ওরা। কী করে বাঁচবো, এই ভাবনা মাথায়, অন্য সব ভাবনার লেশমাত্র কিছু নেই কোথাও। দৌড়ে যাই সামনের দরজায়। না, ওদিক দিয়েও বেরোনোর কোনও উপায় নেই। প্রেস ক্লাব ঘিরে ফেলেছে আক্রমণকারীরা। সামনের দরজাও ভেতর থেকে বন্ধ করে দেওয়া হল। ক্লাব ঘরটার ভেতর আমি আর কিছু নিরীহ নারী। দু’একজন পুরুষও সম্ভবত ছিলেন। ওঁরা ভাঙা দরজার সামনে চেয়ার ফেলে উঁচু বাঁধ তৈরি করে দাঁড়িয়ে থাকলেন। আমাকে বললেন থামের আড়ালে লুকোতে। কেউ বললেন টেবিলের তলায় ঢুকে যেতে। কিন্তু ফাঁকা ঘরটার মধ্যে যেখানেই লুকোই আমি, বাঁধ ভেঙে ঢুকে পড়লে আমাকে হাতের মুঠোয় পেয়েই যাবে ওরা। বাইরে বিকট শব্দে তখন জানি না ক’জন লোকের স্লোগান চলছে, ‘ নাসরিন মুর্দাবাদ’। স্লোগান ছাড়াও অন্য চিৎকারের শব্দ। এমন সময় মঞ্চের নীল পর্দার পেছনে যে একটি গোপন দরজা ছিল, শুনি সেটি খোলার চেষ্টা চলছে বাইরে থেকে। দরজা ভেঙে ঢুকে পড়লে থামের আড়ালে দাঁড়িয়ে থাকা আমাকে পেয়ে যাবে চোখের সামনে। আবার থামের আড়াল থেকে অন্য আড়ালে দাঁড়ালে বাঁধ দেওয়া দরজা ভেঙে ঠিকই খপ করে ধরে ফেলবে আমাকে। বাঁধের দরজা ভাঙতে বাইরে থেকে বাধা দিচ্ছিলেন সাংবাদিকরা। নিজেরা আহত হয়েও ঠেকাতে চাইছিলেন ওই ভয়ংকর মারমুখো লোকদের। ছবি তোলা বাদ দিয়ে অনেকে তখন আমাকে বাঁচানোর চেষ্টা করছিলেন। মৃত্যু যে কোনও মুহূর্তে আমার খুব কাছে এসে দাঁড়াবে। মুহূর্তগুলো আমার বুকের ভেতর ঢং ঢং করে বাজছিল। যে কোনও সময় শেষ মুহূর্তের ঘণ্টা বাজবে। অসহায় আমি ঘরটির মধ্যে এক আড়াল থেকে আরেক আড়ালে যাচ্ছি। শখ করে পরা গলার মঙ্গলসূত্ৰ কখন ছিঁড়ে পড়ে গেছে, খেয়াল করিনি। কেউ জানে না, কী করে বাঁচানো যাবে আমাকে। দরজার বাঁধের কাছে দাঁড়িয়ে বাইরের ভীষণ, বিকট আওয়াজের দিকে ভয়ার্ত চোখে তাকিয়ে আছেন ঘরের কয়েকজন। যে কোনও মুহূর্তে ধাক্কা খেয়ে ওঁরা উল্টে পড়বেন। বাইরের চিৎকার আর স্লোগানের তীব্রতা বেড়েই চলেছে। বুকের ভেতরে ঢং ঢং ঘণ্টা বেজেই চলেছে। অনুরোধ করে যাচ্ছি কেউ যেন একবার পুলিশে খবর দেয়। কিন্তু কে দেবে? সকলেই উদভ্রান্ত। এমন ঘটনা কোনোদিন তাঁরা চোখের সামনে ঘটতে দেখেননি। ছুটোছুটি। কারও কারও আর্ত চিৎকার। যখন প্রাণে মারা হবে আমাকে, কিছু বুলেট ছিটকে গিয়ে বা ছুরির কোনো অংশ বেকায়দায় ওদের পেটে পিঠে লেগে গিয়ে ওঁরা আবার আহত হন কি না, এ নিয়ে কী ওঁরা দুশ্চিন্তাগ্রস্ত। কে জানে। প্রথম দিকে কিংকর্তব্যবিমূঢ়ের মতো দৃশ্যগুলো দেখতে থাকলেও বিস্ফোরণের আশংকা করে আয়োজক এবং দর্শকের মধ্য থেকেও অনেকে পালিয়ে যাচ্ছেন। আমি একা পড়ে যাচ্ছি। ক্রমশ দেয়ালের দিকে যাচ্ছি। আর কোনও আড়াল নেই সামনে। আমার মনে হতে থাকে ডানদিকের দরজা ভাঙা প্রায় বুঝি সারা, মনে হতে থাকে বাঁ দিকের দরজায় বাঁধের কাছাকাছি এগিয়ে আসছে হত্যাকারীরা। কয়েকটা লাথি, কয়েকটা ধাক্কা, তাহলেই উল্টে পড়বে উঁচু করে রাখা চেয়ারগুলো। পা পা করে এগিয়ে আসতে থাকা মৃত্যুর পায়ের আওয়াজ পাচ্ছি আমি। আর অস্থির হয়ে অপেক্ষা করছি পুলিশের আওয়াজ পেতে। না, পুলিশ ত্রিভুবনে নেই। কেউ জানে না কী ঘটছে হায়দারাবাদের প্রেসক্লাবে। আমার যে চোখ ফেটে জল আসবে তাও আসছিল না। শরীর শিথিল হয়ে মেঝেয় লুটিয়ে পড়বে, তাও পড়ছিল না। হত্যাকারীদের সঙ্গে যদি পিস্তল থাকে। গুলি ছুড়বে। যদি ছুরি থাকে, কুপিয়ে মারবে। আর, কিছু যদি না থাকে, মাথায় আঘাত করবে লোহার চেয়ারগুলো দিয়ে। নয়তো পিষে মারবে পায়ের তলায়। এরা তো অনেকজন। আমি একা। ক্রমশ একা হচ্ছিলাম। ঢং ঢং শব্দ আরও বিকট স্বরে বাজছিল। আমি তো জানি এরাই ফতোয়া দেয় আমার বিরুদ্ধে। এরাই মাথার দাম ঘোষণা করে, এরাই চিৎকার করে মুন্ডু চায়, এরাই ফাঁসির দাবিতে পথে নামে, এরাই ক’দিন পরপর আমার কুশপুত্তলিকা পোড়ায়, বই পোড়ায়। এর আগে কোনোদিনই এরা এতটা হাতের কাছে আমাকে পায়নি। এরা এখন যা ইচ্ছে তাই করতে পারে আমাকে। যে কোনও মুহূর্তেই এখন আমি দেখতে পাবো জীবনের শেষ মুহূর্তকে। মৃত্যু ঠিক কী রকম। খুব কষ্ট হবে কী! এরা কি বুকে বা মাথায় গুলি করবে, নাকি কেটে কেটে কষ্ট দিয়ে দিয়ে ধর্ষণ করে করে পিষে পিষে মারবে।

হঠাৎ পুলিশ এলো। ওই ভাঙা দরজার বাঁধ ভেঙে পুলিশ ঢুকলো, হত্যাকারী ঢোকার আগে। আমার নিচ্ছিদ্র নিরাপত্তার ব্যবস্থা ওরাই করলো। দেয়ালে সেঁটে থাকা আমার পাথর শরীর অথবা অস্থির শরীর ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হল, মুষ্ঠি আলগা হল হাতের। শুনলাম মৌলবাদীদের ভোলা হচ্ছে পুলিশের ট্রাকে। তারপর আমাকেও নিরাপত্তার শক্ত বেষ্টনীতে নিয়ে পুলিশের গাড়িতে তোলা হল, দ্রুত আড়াল করা হল। শুভাকাঙ্খীরা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন।

এর মধ্যে মৃত্যুর মুখটি তো আমার দেখা হয়ে গেছে। ওরা যখন হত্যা করে, ওভাবেই করে। সব তছনছ করে। জানিয়ে শুনিয়ে দেখিয়ে। পয়গম্বরের নাম নিতে নিতে। পতাকা ওড়াতে ওড়াতে। আজ আমার অলৌকিক বেঁচে যাওয়া। জীবন আর মৃত্যুর ব্যবধান ছিল এক সুতোর। আমার আশংকা মৃত্যু আমার ওভাবেই হবে কোনও একদিন। কোথাও যখন আমি কবিতা পড়ছি, কোথাও যখন আমি মানবতার কথা বলছি, অতর্কিতে কেউ আমার হৎপিন্ড ফুটো করবে।

কী দোষ করেছি আমি? ধর্মান্ধতা, কুসংস্কার, নির্যাতন, আর নিষ্পেষণের বিরুদ্ধে কথা বলা কি অন্যায়? মানবাধিকার আর মানববাদের পক্ষে দাঁড়ানো কি অন্যায়? ঘৃণার আগুনে আমাকে যে করেই হোক তারা পুড়িয়ে মারবে। কেন, কার কী ক্ষতি আমি করেছি?

আমাকে জীবন দিয়েছে মানুষের ভালোবাসা। শুধু ভারতবর্ষ থেকেই নয়, ভারতবর্ষের বাইরে থেকেও পেয়ে যাচ্ছি যুক্তিবাদী, মুক্তবুদ্ধি আর শুভবুদ্ধির মানুষের সমর্থন। চোখে আমার জল এসেছে মৌলবাদীদের আক্রোশ আর তাদের বিষ দাঁত দেখে নয়। যখন বিধ্বস্ত আমি, যখন মৃত্যুর গুহা থেকে আমাকে বাঁচিয়ে আনা হল, যখন শুনছিলাম কারও উদ্বিগ্ন কণ্ঠ, ‘ভালো আছো তো? বা আমি তোমার সঙ্গে আছি, বা আমরা তোমার পাশে আছি, তখন এসেছে চোখে জল।

আমার আর একা লাগে না। জানি আমরা সংখ্যায় বেশি, আমরা, যারা গণতন্ত্রে আর মত প্রকাশের অধিকারে বিশ্বাস করি। আর তারা চিরকালই সংখ্যায় কম, যারা বাক স্বাধীনতা বিরোধী, মানবতাবিরোধী, অসহিষ্ণু, মৌলবাদী। যুদ্ধ কি আমার একার সঙ্গে তাদের? যুদ্ধ তো আমাদের সবার সঙ্গে তাদের! একটি সুস্থ সমাজ গড়ার জন্য, একটি সুন্দর দেশ গড়ার জন্য, একটি বাসযোগ্য জগৎ গড়ার জন্য আমরা ওই ভয়ংকর অথচ ক্ষুদ্র শক্তির বিরুদ্ধে আপোসহীন ভাবে লড়তে পারি। আমরা সবাই। পারি না?

আমার ভাবনাগুলোকে থামিয়ে দিয়ে গাড়ি সশব্দে থামে খোদ পুলিশ হেডকোয়ার্টারে। প্রকৃতির কাছে তখন আমার প্রার্থনা শুরু হয়, যেন হিন্দু বেষ্টিত হয়ে থাকি, যেন কোনও মুসলমান পুলিশের মুখোমুখি না হই। দোতলায় উঠিয়ে পুলিশের বড় বড় লোকদের সঙ্গে পরিচয় করানো হচ্ছে। ধর্ম বড় ভয়ংকর। বড়কর্তাদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হলে আড়চোখে বুকে লাগানো নামখানা পড়ে নিশ্চিন্ত হয়ে নিই। পুলিশের সবাই খুব অমায়িক আর আন্তরিক। আক্রমণকারী মৌলবাদীদের সবাইকেই চেনেন পুলিশের লোকেরা। ঘরের টিভিতে প্রেসক্লাবের কুৎসিত আক্রমণের ঘটনাই দেখানো হচ্ছে। থেকে থেকে বড়কর্তা মন্তব্য করছেন। আমাকে দিয়ে ওদের বিরুদ্ধে দুটো অভিযোগপত্র লিখিয়ে নিয়ে আমাকেও বলছেন, ‘সব কটাকে হাজতে নেওয়া হচ্ছে, একটুও ভাববেন না। আমার আর ভাবনার কী! আমি তো শহর ছেড়ে চলেই যাচ্ছি। এ শহরে কখনও আর আসা হবে বলেও মনে হয় না।

সন্ধ্যেয় ফেরার কথা ছিল কলকাতায়, এয়ারলাইনসে ফোন করে সময়টা এগিয়ে আনলেন বড়কর্তা। বিকেলে আমাকে বিমানবন্দরে নিয়ে গেলেন পুলিশ কর্তারা। কোনও সাংবাদিকের জানার কথা নয় আমি কখন বিমান বন্দরে পৌঁছোবো। তারপরও সাংবাদিকের ভিড়। সম্ভবত সারাদিন বসে থেকে অপেক্ষা করারই উদ্দেশ্য ওদের। স্পষ্ট জানিয়ে দিলাম, সাক্ষাৎকার দেব না। কিন্তু কেউই বন্দর থেকে সরে যায় না। ভিড় করেই থাকে। কলকাতায় পৌঁছেও ওই একই অবস্থা দেখি। বন্দর ছেয়ে আছে সাংবাদিকে। কী করে লোক জানলো কখন আসছি আমি, কে জানে! বাড়িতে দেখি আঙিনা ভরে আছে। টিভি ক্যামেরায়, সাংবাদিকে। কাউকে বাড়িতে ঢুকতে দিইনি। কারও সঙ্গেই কথা বলিনি। ঘটনা যা ঘটেছে, তার প্রতিবাদ অন্যরা করুক। আমাকে করতে হবে কেন প্রতিবাদ! সেই কতকাল থেকে লড়ছি মত প্রকাশের স্বাধীনতার পক্ষে। আমার মলিন মুখখানাই, আমার সন্ত্রস্ত দেহখানাই টিভিতে দেখিয়ে বলতে হবে কেন যে আমি মত প্রকাশের স্বাধীনতা চাই। মানুষ মুখ খুলুক। সারা দেশ দেখেছে কী ঘটেছে। নিজের ওপর হামলার ঘটনা নিজে আর কত বর্ণনা করবো। যথেষ্ট কি হয়নি। আমার কি ক্লান্তি বলতে কিছু নেই! আমার কি রাগ হওয়া উচিত নয়। আমি কি লেখক হয়েছি লেখার জন্য নাকি লেখার অধিকারের জন্য লড়াই করার জন্য। আর কত আমাকে মার খেতে হবে, অনুযোগ করতে হবে, তাড়া খেতে হবে, কাঁদতে হবে।

বাড়িতে উদ্বিগ্ন বন্ধুরা, আমার ফেরার অপেক্ষা করছিলো। ভেতরের অসহ্য আগুন বা শীতলতা আমাকে স্তব্ধ করে রাখছিলো। সবাই জানতে চাইছিল কী ঘটেছে, কেন ঘটেছে, আদ্যোপান্ত। কাউকেই আমার কিছু বলতে ইচ্ছে করছিল না। শুধু বেড়ালটাকে খুঁজছিলাম। ফোন বেজে চলেছে। কারও সঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছে করেনি। শুধু বেড়ালটাকে কোলে নিয়ে আদর করতে ইচ্ছে করেছে। চাইছিলাম বন্ধুরা সবাই বাড়ি থেকে চলে যাক। আমাকে একা থাকতে দিক। আমার ঘুম পেয়েছিলো। খুব ঘুম। যেন হাজার বছর ঘুমোইনি। কিন্তু ঘুমোতে কি পেরেছি! বারবারই সেই মুখগুলো ভাসছিল চোখের সামনে, আততায়ীদের ভয়ংকর ক্রুদ্ধ মুখ, হিংস্র শরীর। মৃত্যু একেবারে দু’হাত দূরে এসে দাঁড়ালে মানুষের ঠিক যেমন লাগে, আমারও তেমন লেগেছিলো। আমাকে মেরে ফেলার উদ্দেশ্য হয়তো ওদের ছিল না। কিন্তু সেসময় তো আমার জানা ছিল না ওরা বিধায়ক, দলের জনপ্রিয়তা কমে গেছে বলে এসেছিলো আমাকে আক্রমণ করে এলাকায় নিজেদের জনপ্রিয়তা বাড়াতে। আমি তো ভেবেছিলাম ধর্মান্ধ ফতোয়াবাজ মৌলবাদী গোষ্ঠী এতদিনে আমাকে হাতের কাছে পেয়েছে। নিরাপত্তাহীন, নিরস্ত্র আমাকে হত্যা করে বেহেসতে যাবার এমন মোক্ষম সুযোগ ওরা হাতছাড়া করবে না। অনেক ছোটখাটো মৃত্যুর ফাঁদ থেকে বেঁচে বেরিয়েছি। এবার আর কোনও উপায় নেই। ওদের থাবা থেকে আমার বাঁচার এবার আর উপায় নেই। প্রাণে আমাকে মারেনি। পারেনি বলবো না। ইচ্ছে করলেই পারতো। ইচ্ছে না করলেও ক্রোধ মানুষকে এমন অমানুষ করে ফেলে যে মেরে ফেলা তখন খুব কঠিন হয় না। তখন বরং মারাটাই কঠিন হয়ে দাঁড়ায়।

মৃত্যু থেকে উঠে আসা আমি। পুনরুত্থিত আমি। দ্বিতীয় জীবন আমি।
 
০৩. গৃহবন্দি


ইসলাম সম্পর্কে একটি শব্দ উচ্চারণ না করেও হায়দারাবাদে আমাকে মৌলবাদীদের আচমকা আক্রমণের রাজনীতির শিকার হতে হয়েছে। আমাকে আক্রমণের পিছনে, যা শুনলাম, ছিল এলাকায় জনপ্রিয় হওয়ার বাসনা। হামলা চালিয়েছিল হায়দারাবাদের মজলিস ইত্তেহাদুল মুসলিমিন নামের এক রাজনৈতিক দল। অন্ধ্র প্রদেশের বিধানসভায় এই দলের এক বড় নেতা বলেছেন, ‘ধর্মদ্রোহী কথাবার্তা যারা বলে, তাদের কোতল করাই উচিত।‘ প্রেসক্লাবে গতকালের হামলার পূর্ণ সমর্থন জানিয়ে তাঁর বক্তব্য, আমাদের বিধায়করা যা করেছেন, তার জন্য মুসলিমরা গর্বিত। তাঁদের সাধুবাদ পাওয়া উচিত। মোহম্মদের প্রতি কোনও অসম্মান আমরা বরদাস্ত করবো না।

অন্য একটি ইসলামি গোষ্ঠী উঠে এসেছে। মজলিস বাঁচাও তেহেরিক। এই গোষ্ঠী বলছে, আমাকে নাকি মেরে ফেলারই পরিকল্পনা করা হয়েছিল, এমআইএম (মজলিস ইত্তেহাদুল মুসলিমিন) বরং আমাকে প্রাণে বাঁচিয়ে দিয়েছে। এমআইএমের তিন বিধায়ককে পুলিশ গ্রেফতার করেছিল, জামিনে ওরা ছাড়াও পেয়ে গেছে। দলের নেতা সাফ সাফ জানিয়ে দিয়েছেন, নির্ভুল উচ্চারণে নির্মেদ ভাষায় ঘোষণা করে দিয়েছেন, হায়দারাবাদে ফের যদি যাই কখনও, আমাকে মেরে ফেলা হবে। হ্যাঁ, আমাকে মেরে ফেলবেন ওঁরা। কী কারণ এসবের? এই প্রশ্নের উত্তর চারদিক থেকে যা পাই তা হল, পুরসভা নির্বাচনের আগে ইসলামি গোষ্ঠীগুলো নিজেদের গুরুত্ব বাড়িয়ে নিতে চাইছে। আমাকে যারা আক্রমণ করবে, আঘাত করবে, তারা ইসলামকে বাঁচাবে। ইসলামকে যারা বাঁচাতে পারবে, তাদেরই মুসলমানরা চোখ বুজে সমর্থন করবে, ভোট দেবে। তসলিমা নামের এক মেয়ে ইসলামকে ধ্বংস করে ফেলছে, সুতরাং তসলিমার হাত থেকেইসলামকে বাঁচাতে হলে ওকে মেরে ফেলতে হবে, ওকে মারলে এপারে ফতোয়ার অগাধ টাকা পাওয়া যাবে, ওপারে বেহেস্তলাভ হবে। ধর্মনিরপেক্ষ ভারতে আজ মুসলিম মৌলবাদীরা ঠিক এভাবেই দরিদ্র অশিক্ষিত অজ্ঞান মুসলমানদের উস্কানি দিচ্ছে এবং তাদের ভোটও ছলে বলে কৌশলে বাগিয়ে নেওয়ার ব্যবস্থাও পাকা করছে। দেশের প্রায় পঁচিশ ভাগ লোক মুসলমান, এবং মৌলবাদীরা এই বিশাল সম্প্রদায়ের প্রতিনিধি। কোনো সুসভ্য, সুশিক্ষিত সেকুলার, যুক্তিবাদী বিজ্ঞানমনস্ক লোককে এই সম্প্রদায়ের প্রতিনিধি ভাবা হয় না। এর চেয়ে বড় দুঃখ আর কী আছে!

সংসদে আমার প্রসঙ্গ ওঠে, ঘটনার নিন্দা করা হয়। টিভিতে আলোচনার আসর বসে। বাক স্বাধীনতা নিয়ে তর্ক তুঙ্গে ওঠে। হায়দারাবাদের মৌলবাদীরাও সেই আসরে বসে রীতিমত বাক স্বাধীনতা নিয়ে নিজেদের মত প্রকাশ করে। আমি ইসলামের বিরুদ্ধে কথা বলেছি, মোহাম্মদকে অপমান করেছি, মুসলমানদের অনুভূতিতে আঘাত দিয়েছি, সুতরাং আমাকে মারা হয়েছে, মারটাকম হয়েছে, আরোমারা উচিত ছিল। কেবলবে, যে, সেদিনের আমার ভাষণে ইসলাম শব্দটিই ছিল না! ওদের মূল বক্তব্য, আমাকে ভারত থেকে তাড়িয়ে দিতে হবে। আমি বিদেশি, আমার কোনো অধিকার নেই এ দেশের মুসলমানের মনে আঘাত দেওয়ার। মনে মনে বলি, ‘বিদেশিদের অধিকার নেই, তবে কি তোমাদের মনে আঘাত দেওয়ার অধিকার দেশিদের আছে?’ সোজা কথা বললেই তো হয় যে ‘জগতের কারও অধিকার নেই মুসলমানের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেওয়ার’! বললেই তো হয়, যে, ‘আমরা বাক স্বাধীনতায়, মত প্রকাশের অধিকারে এক ফোঁটাও বিশ্বাস করি না!’

জীবনে অনেক দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছে। অনেক যন্ত্রণা সয়েছি। কিন্তু মাঝে মাঝে যন্ত্রণার ওপর পরশ বুলিয়ে যায় কারও কিছু কথা। সকালবেলাতেই আনন্দবাজারের সম্পাদকীয়টি পড়ে মন ভালো হয়ে যায়।

‘স্বাধীনতার হীরকজয়ন্তি পূর্তির অব্যবহিত আগে তসলিমা নাসরিনের উপর ব্যক্তিগত আক্রমণের ঘটনা এ দেশের সাংস্কৃতিক অশক্ত, দুর্বল অবয়বটি আবার চিনাইয়া দিল। হায়দরাবাদের প্রেস ক্লাবে এই সুখ্যাত ও বিতর্কিত লেখকের উপর শারীরিক-মানসিক নিগ্রহের যে প্রয়াস দেখা গেল, তাহা এক কথায়, বর্বরতা। এমন একটি ঘটনার নেতৃত্ব দিলেন তিন বিধায়ক, ইহা প্রমাণ করে যে এ দেশের সাংস্কৃতিক অসহিষ্ণুতা কোনও প্রান্তিক বা বিক্ষিপ্ত ঘটনা নয়, মূলস্রোতের রাজনীতির উপর-পরতেও তাহা যথেষ্ট দৃশ্যমান। এবং এই অসহিষ্ণুতার প্রকাশ যথেষ্ট পরিকল্পিত ও সংগঠিত। তসলিমা নাসরিন তাঁহার বিতর্ক ফুলিঙ্গ-বিধৃত রচনার জন্য স্বদেশ এবং অন্যান্য দেশে মুসলিম মৌলবাদীদের আক্রমণের মুখে পড়িয়াছেন, কিন্তু দুনিয়ার অন্যতম বৃহৎ গণতন্ত্র ধর্মনিরপেক্ষ, বহু-সংস্কৃতিবাদী ভারতবর্ষে তাঁহার এই অভিজ্ঞতার স্বাদ নিশ্চয় অনেকাংশে আলাদা। তিনিও নিশ্চয় এখন এ দেশের মধ্যে বিভিন্ন স্থানে স্বাধীন যাতায়াতের আগে পুনর্বিবেচনা করিবেন, হয়তো এখন হইতে অতিরিক্ত নিরাপত্তার ঘেরাটোপে আশ্রয় লইয়া গণতন্ত্রের আওতা হইতে খানিক দূরত্বে বসবাস করিবেন। দুর্ভাগ্য এই আত্মগর্বিত দেশেরও –-ব্যক্তিগত মতামত ও সামাজিক সহিষ্ণুতার ভিতরে সীমারেখাঁটি কী ও কেমন, ষাট বৎসরের স্বাধীনতা ও গণতন্ত্র যাহাকে শিখাইয়া উঠিতে পারে নাই।

সমস্যার মূলটি এইখানেই। এই দুর্ভাগ্যজনক ঘটনার তীব্র সমালোচনা সর্বত্র, এমনকী রাজনৈতিক দলগুলিও প্রতিবাদ জানাইয়াছে।

ব্যক্তিগত মতামত ও সামাজিক সহিষ্ণুতার এই প্রথম পাঠ বিভেদরেখার সকল দিকের মানুষকেই গ্রহণ করিতে হইবে, গত্যন্তর নাই। আদিমতা হইতে আধুনিকতার যাত্রাপথে একটি বিষয় স্পষ্ট হইয়া গিয়াছে, ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর বিশ্বাস ও মতামতকে শ্রদ্ধা করা না গেলেও সহ্য করিতেই হইবে, ইহা সভ্যতার মৌলিক ভিত্তি। অর্থাৎ ইহা কেবল বাঞ্ছনীয় নয়, ইহা একেবারে আবশ্যিকএর পর্যায়ে। প্রয়োজনে অধৈর্য ও অসহিষ্ণুতার অপরাধের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রয়োজন। দেব দেবীর প্রেমলীলাঅঙ্কন করিয়াছেন বলিয়াশিল্পীকে যাহারা। লাঞ্ছনা করেন, কিংবা ধর্মপুরুষের অবমাননা রচনা হইয়াছে বলিয়া যাহারা লেখকের দিকে আক্রমণার্থে ধাবিত হন, তাহাদের সকলেরই কঠিন শাস্তি পাওয়া উচিত। সমাজ যদি নিজে হইতে সভ্যতা ও সুশীলতার সংস্কৃতি গড়িয়া তুলিতে না পারে, পরস্পর-সহনের বোধটিতে পৌঁছাইতে না পারে, তবে রাষ্ট্রেরই আগাইয়া আসিতে হইবে, উপায় কী!

প্রতিবাদ এমন অনেক হয়েছে। না, শাস্তি ওই হায়দারাবাদি মৌলবাদীদের কারওরই হয়নি। গ্রেফতার করে থানায় নিয়ে গেছে, থানায় কিছুক্ষণ রেখে, সম্ভবত চা বিস্কুট খাইয়ে, ছেড়ে দিয়েছে। সরকারি দলের জোটশক্তি ওরা। সুতরাং সত্যিকার শাস্তি, অনেকে বলছে, ওদের কেউ দেবে না। এমনিতে পার পেয়ে যাবে।

মানুষ কেন এত মূর্খ হয়, কেন এত নিষ্ঠুর হয়, আমি বুঝতে পারি না। ধর্মবিশ্বাসের সঙ্গে মুখতা আর নিষ্ঠুরতার সম্পর্ক খুব গভীর। নিষ্ঠুরতা খুব সংক্রামক। হায়দারাবাদে আমাকে আক্রমণ করা হলো, কিন্তু যে শহরে থাকি সে শহরে কোনও জুৎসই আক্রমণ এখনও হলো না, এ নিয়ে কলকাতার মৌলবাদীরা দুঃখ প্রকাশ করতে শুরু করলো। দুঃখ ঝেড়ে একদিন সোজা নেমে পড়লো আমার মাথার দাম ঘোষণা করতে বা কুশপুতুল পোড়াতে। মাঠে নামানো হল মাদ্রাসার ছাত্রদের, যারা জানেই না আমার নাম,বা কিছু। মাদ্রাসার এক পাল ছেলে আমার কুশপুতুল পোড়াচ্ছে, অথচ কোনওদিন পড়েনি আমার একটিও বই। কেন পোড়াচ্ছে, কারণ তাদের মৌলবাদী নেতা বলেছে, আমি নাকি ইসলামের বারোটা বাজিয়েছি, ইসলামকে প্রায় ধ্বংসই করে ফেলেছি, এখন তাদের সবার দায়িত্ব ইসলামের যেটুকু অবশিষ্ট আছে, সেটুকু বাঁচানো। মাদ্রাসা-মসজিদে এভাবেই আমার বিরুদ্ধে মগজ ধোলাই চলে। আমার সম্পর্কে না হয় তারা না জানলো, ইসলামকে পুঁজি করে মিটিং মিছিলের আয়োজন করতে গেলে ইসলাম সম্পর্কে তো সামান্য কিছু জানতে হয়। ধর্মতলার জনসভায় হায়দারাবাদ থেকে মৌলবাদীদের আমন্ত্রণ জানিয়ে আনা হয়েছে। সবাই মিলে মহাসমারোহে আমার মাথার দাম ঘোষণা করলো। দামটা কত জানতে চাইলো মৌলবাদী দর্শক শ্রোতা। মঞ্চ থেকে একজন নেতা বললো, পাঁচ লাখ। হায়দারাবাদের বড় নেতা সঙ্গে সঙ্গে পাঁচ লাখকে শুধরে দিয়ে বললো ‘আনলিমিটেড। মঞ্চের বাকিরা চেঁচিয়ে বললো। ‘আনলিমিটেড। শত শত টুপি মাথার লোক উল্লাসে উচ্ছাসে ফতোয়াকে স্বাগত জানালো। জনসভায় পুলিশের বড়কর্তারা উপস্থিত ছিলেন। তাঁদের সামনেই আমার মাথার দাম ঘোষণা হল। সব মৌলবাদীই বুক ফুলিয়ে ফতোয়া দিল, বুক ফুলিয়ে পুলিশের নাকের ডগায় হেঁটেও গেল। এই অবৈধ ফতোয়া জারিতে কারো বিন্দুমাত্র কোনো অসুবিধে হলো না। কী চমৎকার জীবনই না এরা যাপন করে ভারতবর্ষে।

হায়দারাবাদ থেকে কলকাতায় ফেরার পর দুটো ব্যাপার লক্ষ্য করলাম। কড়া নিরাপত্তার ব্যবস্থা আমার জন্য। দরজার কাছে বেশ কয়েকজন নতুন পুলিশ বসেছে। কেউ আমার সঙ্গে দেখা করতে এলে পুলিশের কাছে নাম ঠিকানা লিখে ঢুকতে হয় ভেতরে। দুনম্বর, আমাকে বাড়ি থেকে কোথাও বেরোতে দেওয়া হয় না। যেখানেই যেতে চাই, পুলিশ বলে দেয়, বড়বাবুর অনুমতি নিতে হবে। অনুমতির জন্য ওরা ছোটবাবুকে ফোন করে। ছোটবাবু করে বড়বাবুকে। অনুমতি মেলে না। বেশ কিছুদিন এরকম হবার পর আমি বুঝে নিলাম, আমাকে গৃহবন্দি করা হয়েছে। বাড়িতে বন্ধুরা আসছে বটে, কিন্তু কোথাও আমার বেরোনো নিষেধ। বাজারে যাবো, না যেতে দেওয়া হবে না। বন্ধুর বাড়ি, না। অসুস্থ বন্ধুকে দেখতে, না কোথাও না। এরকম গৃহবন্দি জীবন আগে কাটাইনি। ভেবেছিলাম, কিছুদিন পর বোধহয় অবস্থা স্বাভাবিক হয়ে আসবে। কিন্তু তার কোনও লক্ষণ দেখি না। এদিকে তাইওয়ান থেকে আমাকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। আমি তাইওয়ান যাবো। সুতরাং ট্রাভেল এজেন্সিতে আমাকে যেতে হবে। বড়বাবু এবার যেতে দেবেন। অবশ্য তাইপেই-এ কবিতা উৎসবে যাওয়ার জন্য কোনো ট্রাভেল এজেন্সিতে যাওয়ার কোনো প্রয়োজন ছিল না আমার। ইলেকট্রনিক টিকিট ইমেইল করে দিলেই হয়। শুধু শহরটা দেখার জন্য, বাইরের হাওয়াটা নেওয়ার জন্য ফুসফুসে, স্বাধীনতার স্বাদটা নেওয়ার জন্য অন্তরে, আমার বের হতে চাওয়া। স্বাধীনতা কাকে বলে আমি জানি। স্বাধীনতার রূপ রস গন্ধ আমি চিনি। স্বাধীনতা ফিরে পেতে আমার প্রতি বিন্দু রক্ত টগবগ করে, ফুঁসে ওঠে, ফুলে ওঠে। সমুদ্রে বাঁধ দিয়ে দেখুক কেউ, কী হয়। ঘরের বাইরে কোথাও যেতে না দেওয়া, শুধু ট্রাভেল এজেন্সিতে যেতে দেওয়ার অর্থ আমি টের পাই, শুধু দেশের বাইরে বেরোনোর অনুমতি পেতে পারি, দেশের ভেতরে আমার চলাফেরা নিষিদ্ধ।

বাড়ির সামনে বসা পুলিশদের সকাল বিকেল চা দেওয়া হচ্ছে। ওদের জন্য বিস্কুট আনাচ্ছি। মিঠাই থেকে মিষ্টি আনাচ্ছি, দই আনাচ্ছি। চিড়ে ভাজা, মুড়ি ভাজা। নিজে নুডলস বেঁধে দিচ্ছি। দিনে কয়েকবার চা। কয়েকবার আমপোড়া শরবত, অরেঞ্জ স্কোয়াশ। নিচে যারা বসেছে বাইরের গেইটের কাছে, ওপরে যারা ফ্ল্যাটের দরজার কাছে, কেউ যেন শুকনো মুখে বসে না থাকে, সেদিকে কড়া নজর আমার। অনেকগুলো শারদীয়া, ম্যাগাজিন, বই দেওয়া আছে, যার পড়তে ইচ্ছে করে পড়বে। ফ্যান দুদুটো কিনেছি। যেন হাওয়া খেতে পারে। চেয়ার তো প্রথম দিনই বেশ অনেকগুলো কিনে দেওয়া হয়েছিল। সবাইকেই অতিথির মতোই আপ্যায়ন করি। মাঝে মাঝে পুলিশেরা এসে বসে ঘরে। টেলিভিশনে খেলা দেখে। একজন তো সোফায় লম্বা হয়ে ঘুমোয় দুপুরের খাবারের পর। পুলিশের মধ্যে এমনিতেই একটা কাড়াকাড়ি চুলোচুলি আছে আমার ডিউটি করার। কেউ বদলি হলো তো রীতিমত কেঁদে কেটে বুক ভাসাবে। আমার ওপর চিঠি লেখার চাপ আসে, ”দিদি, লিখে দিন আমি খুব ভালো দেহরক্ষী, আমাকে ছাড়া আপনার অসুবিধে হচ্ছে, আমাকে ছাড়া চলবে না।

শুধু বোঝার জন্য সরকারের সিদ্ধান্তের পরিবর্তন হয়েছে কি না, দেড় বা দু’সপ্তাহ পর পর পুলিশকে বলি, যে, বাইরে যেতে চাই। শংকরকেই বলি এক মন কেমন করা বিকেলে, আজ বাইরে যাবো, শংকর বললো, –কোথায় যাবেন? এরকম কখনও আগে আমাকে জিজ্ঞেস করা হতো না। আমিই যখন খুশি বেরিয়ে গাড়িতে উঠে তবে শংকর বা তপনকে বলতাম কোথায় যেতে চাই। দিন হঠাৎ করে পাল্টে গেছে। একটু চমকাই, কিন্তু সামলে নিই। শান্ত কণ্ঠে বলি, –দীপংকরদা’র বাড়ি যাবো, বেহালায়। শংকর আর তপন রীতিমত আত্মীয়র মতোই হয়ে গিয়েছিল। দু’জনের বাড়িতে আমাকে নিয়ে গেছে, আদর করে খাইয়েছে। আমার বাড়িকেও নিজের বাড়ির মতোই অনেকটা মনে করতো। হঠাৎ ওলোট পালোট হয়ে গেছে সবকিছু, সব সম্পর্ক, সব চলাফেরা, সব নিয়ম, সব বিশ্বাস। একটা বড় প্রশ্ন বোধক চিহ্ন ঝুলে থাকে মাথার ওপর সারাক্ষণ। চিহ্নটি দিন দিন অতিকায় হচ্ছে। শংকর নিঃশব্দে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। অপেক্ষা করতে থাকি আমি। পনেরো মিনিট বা আধঘণ্টা পর শংকর এসে রবোটের গলায় বলে, –ওখানে যাওয়ার অনুমতি নেই।

–কেন নেই?

–সে তো জানি না।

–আপনার তো জানা উচিত। কেন আমি আজ বেহালায় যাওয়ার অনুমতি পাবো?

–আমি অফিসারকে জানালাম। অফিসার বড়বাবুকে জানালেন। বড়বাবু কিছুক্ষণ পর ফোনে জানিয়ে দিলেন, যাওয়া যাবে না।

–কেন? কেন যাওয়া যাবে না?

–সে সম্পর্কে কিছু বলেননি।

–কেন বলেননি? জিজ্ঞেস করুন। আমার খুব জানতে ইচ্ছে করছে, কেন যাওয়া যাবে না, কী অসুবিধে।

শংকর ঘর থেকে বেরোয় তবে না মানুষের গলায়, না রবোটের গলায় আমাকে আর সে জানাতে আসে না আমার বেহালায় যাওয়ার অনুমতি না পাওয়ার কোনও কারণ।

এরপর আরেকদিন সল্টলেক যাবো, তৈরি হয়ে নিই। শিবনারায়ণ রায়ের বাড়ি আমাকে যেতেই হবে। উনি অসুস্থ।

বড়বাবুর আদেশ জানিয়ে দেওয়া হল আমাকে, –না, হচ্ছে না।

–না কেন?

–না, কারণ কলকাতা জুরিসডিকশনের বাইরে সল্টলেক।

–সারা বছর তো কত বারই সল্টলেক গেলাম, জুরিসডিকশনের প্রশ্ন তো ওঠেনি।

শংকর বা তপন চুপ। ওদের মুখেও ভয় আর একধরণের কী-হচ্ছে-কিছু-বুঝতে-না পারা থমথম করে।

অনেকদিন বিরাটি যাইনি। যাওয়া খুব জরুরি।

ওই একই উত্তর, বড়বাবু জানিয়ে দিয়েছেন, সম্ভব নয়।

এর কদিন পর আবারও আমার ইচ্ছের কথা জানাই, হাওড়া যাবো।

–না হবে না।

এরপর আরও কাছাকাছি কোথাও যাবো। জুরিসডিকশনের মধ্যে কোথাও যাবো। ভবানীপুর যাবো, যদুবাবুর বাজারে।

–সম্ভব নয়।

–এখন তো কলকাতা শহরের মধ্যেই, সম্ভব নয় কেন?

–সে সম্পর্কে কিছু জানায়নি আমাকে।

–কে বাজার করবে? না খেয়ে থাকবো?

–তা জানি না। শুধু জানি, যে, হবে না যাওয়া।

–এতকাল নিজে বাজার করেছি। এখন বাজারটাও করতে পারবো না!

–বড়বাবু বলে দিয়েছেন, সম্ভব নয়।

–কেন?

–কেন, তা বলেননি।

–সিদ্ধান্ত কি বড়বাবুর?

–হ্যাঁ।

আমার ধারণা হয়, সিদ্ধান্ত আরও ওপরের।

বাড়িতেই শুধু নয়, পরিবর্তন লক্ষ করি অন্যত্র। এলাহাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসররা আমাকে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন বক্তৃতা করতে। প্রায় বছর হল চেষ্টা করছেন আমাকে রাজি করাতে। শেষ রাজি হয়েছিলাম। বিশ্ববিদ্যালয় উচ্ছ্বসিত। কিন্তু হায়দারাবাদের ঘটনার পর আমাকে সংক্ষিপ্ত চিঠিতে ওঁরা জানিয়ে দিলেন, আমার অনুষ্ঠান বাতিল করতে ওঁরা বাধ্য হচ্ছেন। কেন বাতিল করেছেন, তা অবশ্য জানালেন না। জানানোর প্রয়োজন মনে করেননি। অনুষ্ঠান বাতিল করার পেছনের কারণ, ওঁরা নিশ্চিত যে, আমি বুঝবো। তবে একটা সত্য ওঁরা হয়তো জানেন না, যে, আমি মৌলবাদীদের আস্ফালন খুব ভালো বুঝি, ওদের চেঁচামেচির আসল কারণটাও আমার জানা, কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের লোক, বা সাহিত্য সংস্কৃতির লোক, বা সরকারের লোক বা রাজনীতির লোক –এঁদের ভয় বা কুঁকড়ে থাকাটা আমি ঠিক বুঝি না। অথবা বুঝি কিন্তু মানতে পারি না।

এক ফতোয়ায় জীবন অতিষ্ঠ। তার ওপর আরেক ফতোয়া জারি করে বসলেন জনপ্রিয় গায়ক কবীর সুমন, এককালের সুমন চট্টোপাধ্যায়। টিভিতে আমার ‘দ্বিখণ্ডিত বইটি খুলে মুহম্মদ সম্পর্কে কোথায় কী লিখেছি তা শুধু পড়ে শুনিয়ে শান্ত হননি সুমন, বইয়ের কোন পৃষ্ঠায় কী আছে, তাও বলে দিয়েছেন, এবং এও বলেছেন আমার বিরুদ্ধে মৌলবাদীদের জারি করা ফতোয়াকে তিনি সমর্থন করেন। ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করার পর, সত্যি বলতে কী, অতিরিক্ত মুসলমান হয়েছেন তিনি। এমনিতে নব্য মুসলমানদের সম্পর্কে কথাই আছে যে পারলে মৌলবাদীদের চেয়েও দু’কাঠি বেশি মৌলবাদী। সত্যি কথা বলতে কী, মৌলবাদীদের অত ভয়ংকর ফতোয়াকেও আমি অত বেশি ভয়ংকর মনে করিনি, যত করেছি সুমনের ফতোয়াকে। বারবারই সুমন বলেছেন, তাঁর পয়গম্বর সম্পর্কে আমি জঘন্য কথা লিখেছি–ক্রুদ্ধ, ভয়ংকর সুমন, যে সুমন এতকাল নাস্তিক বলেই পরিচিত ছিলেন, গানও লিখেছেন ভগবানকে অপমান করে। আমার বিশ্বাস হয় না সুমন মুহম্মদকে পয়গম্বর মানেন, বা ইসলামে বিশ্বাস করেন। আগাগোড়াই ধর্মের রাজনীতি তাঁর। সে রাতে ভয়ে আমার বুক কেঁপেছে। সে রাতেই আমি প্রথম জানালা দরজাগুলো ভালো করে লাগানো হয়েছে কী না তা পরখ করে শুয়েছি। সে রাতে আমি সারারাত ঘুমোত পারিনি। সে রাতেই আমার মনে হয়েছে, মৌলবাদীরা আমাকে সত্যিকার ফতোয়া দেয়নি, দিয়েছেন সুমন। মৌলবাদীরা কোনোদিনই স্পষ্ট করে বলতে পারেনি ইসলাম সম্পর্কে ঠিক কী লিখেছি, প্রমাণ দেখাতে পারেনি আমি ইসলামের অবমাননা করেছি, কিন্তু সুমন আমার বই হাতে নিয়ে ক্যামেরার সামনে বসেছেন, পড়েছেন সেই সব লেখা, যুক্তি দিয়ে ধর্ম খণ্ডন করা। দর্শক-শ্রোতাদের উদ্দেশে বলেছেন, বিশ্বাস না হয় আপনারই পড়ুন, দেখুন কী লিখেছে। ক্যামেরা তখন ‘দ্বিখণ্ডিত’ বইয়ের সেইসব পৃষ্ঠায়। যে কোনও জঙ্গি মুসলমান সে রাতে ভাবতে পারতো, ‘মরি তো মরবো, ওকে মেরে মরবো’। এই কাজটা কে করলো! না কোনও মৌলবাদী নয়, সাংস্কৃতিক জগতের নামি দামি প্রগতিশীল বলে খ্যাত এক শিল্পী। অবিশ্বাস্য লাগে সবকিছু। কেমন যেন স্বাসকষ্ট হতে থাকে। যেন সুস্থ স্নিগ্ধ খোলা হাওয়া নেই আর কোথাও। মৌলবাদীদের আক্রমণের পর যাদের আমার পাশে থাকার কথা, তাঁদেরই দেখি দূরে চলে যেতে, শুধু দুরেই চলে যান না, মৌলবাদীদের চেয়েও দ্বিগুণ আক্রমণ করে আমাকে স্থবির করে দেন। আমি একা হতে থাকি। ভীষণ একা। পায়ের তল থেকে মাটি সরে যেতে থাকে। বুঝি। টের পাই। যাঁদের কাছে আমার লেখা, আমার আদর্শ, আমার নীতি মোটেও দোষের নয়, তাঁরাও আমার দোষ ধরতে থাকেন। যারা ধর্মের সমালোচনা করে অভ্যস্ত, তাঁরাও আমার ধর্ম নিয়ে কথা বলাকে সইতে পারেন না।

পায়ে আমার অদৃশ্য শেকল। চলতে গেলেই বাজে এই শেকল। শেকলই বলে দেয়, কোথায় এবং কতদূর যেতে পারি আমি। অন্যায় মেনে নেওয়ার মানুষ তো আমি নই। বিনা অপরাধে আমাকে বন্দি করা হবে কেন? আমার মনে আর শরীরে লক্ষ করি প্রতিবাদের বুদবুদ। অস্থির আমি কেবল ঘর-বারান্দা করি। এত প্রিয় ঘর, এটিকেই মনে হতে থাকে কারাগার। বন্ধুরা যারাই আসে, এই বন্দিত্বের কথা শোনে, চুক চুক করে দুঃখ করে চলে যায়। হয়তো কারওরই কিছু করার নেই। অথবা করার থাকলেও করা উচিত হবে কী না ঠিক বুঝে পায় না। একদিন হঠাৎই দেখতে চাই সরকারি নিষেধাজ্ঞা কত দূর গেছে, বা যেতে পারে। পুলিশদের জানিয়ে দিই, জ্যোতি বসুর সঙ্গে দেখা করবো। সঙ্গে সঙ্গে ওপরতলায় খবর চলে গেল। জ্যোতি বসুর বাড়ি যেতে চাইছি আমি। সত্যি বলতে কী, জ্যোতি বসুর সঙ্গে দেখা করা জরুরি ছিল না আমার। মনে হয়েছিল, উনিই হয়তো একমাত্র মানুষ এ শহরে, যার সঙ্গে দেখা করতে চাইলে আমার পায়ের শেকল খুলে দেওয়া হবে। জ্যোতি বসু প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রীই শুধু নন, ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা। শুরু থেকেই আছেন এই পার্টির সঙ্গে। সাতাত্তর থেকে দু’হাজার সাল, সবচেয়ে দীর্ঘ সময় তিনি ছিলেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী। জ্যোতি বসুকে ফোন করে দেখা করতে চাই’ বলার সঙ্গে সঙ্গে তিনি রাজি হয়েছেন। মানুষটি অসাধারণ। একবারও ভাবলেন না, তাঁর পার্টির সরকার আমার বই নিষিদ্ধ করেছে, আর এখন হায়দারাবাদে আমার ওপর হামলা হওয়ার পর কোথায় আমাকে পাশে দাঁড়াবে, তা নয়, আমাকে গৃহবন্দি করেছে, আমার সঙ্গে দেখা করাটা তার উচিত হবে না। একবারও জিজ্ঞেস করেননি, কী কারণে দেখা করতে চাই, কী কথা বলতে চাই বা এ জাতীয় কোনও প্রশ্ন।

বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী এখন অনুমতি দেন কী না প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে, সেটিই দেখার বিষয়। আমাকে বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হয়নি। মুহূর্তে খবর চলে এলো, দেবেন দেখা করতে। হাসি ফুটলো শংকরের মুখে। পুলিশগুলো ভালোবাসে আমাকে। আমার বন্দিত্ব এদেরও পীড়া দেয়। ছোট সরকারি চাকুরে, সরকারি সিদ্ধান্ত বদল করার শক্তি এদের নেই। ফুলের বড় একটা তোড়া নিয়ে, মিঠাই থেকে অনেক দই আর রসগোল্লা নিয়ে রওনা হই মহান নেতার ইন্দিরা ভবনে। কী আনন্দ যে হয়! আনন্দ হয় মুক্তির স্বাদ পেয়েছি বলে। স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম করছি বলে বারবারই বিপদের মুখে পড়ছি। বারবার পরাধীনতার শৃংখলে জড়িয়ে পড়ছি। সে আমি জানি। তারপরও আপোস করার কথা মুহূর্তের জন্যও মনে আনি না।

ইন্দিরা ভবনে পৌঁছোনোর পর জয়কৃষ্ণ, জ্যোতি বসুর দেখাশোনা করার ভার যার ওপর, জানিয়ে দিলেন, কোনও মিষ্টিই ঘরে আনার দরকার নেই, তিনি খাবেন না। কী কাণ্ড! খাবেন না, অতিথিদের তো খাওয়াতে পারেন! জয়কৃষ্ণের তীব্র সতর্কতার অথবা কঠিন আদেশের সঙ্গে তর্ক করতে ইচ্ছে করেনি। ঘরে ঢুকে তাঁর জন্য অপেক্ষা করি। তিনি এসে মুখে সেই রহস্যের হাসি, হাত জোড় করে নমস্কার জানালেন। উঠে দাঁড়িয়ে আমিও। খুব বেশি কারও সঙ্গে আজকাল দেখা করেন না। অসুস্থ। পরনে সবুজ একখানা লুঙ্গি আর সাদা ফতুয়া। তাঁর সঙ্গে আগে আরও দুবার আমার দেখা হয়েছে, এই ইন্দিরা ভবনেই। এত বড় একজন মানুষ, অথচ আমার সঙ্গে বসে কী সহজে কথা বলেন। কথা বলতে বলতে আমি ভুলে যেতে থাকি তার সঙ্গে বসে গল্প করার যোগ্য আমি নই। সম্ভবত রাজনীতির খুব বেশি কিছু আমি বুঝি না বলেই কোনওদিনই রাজনীতিবিদদের সঙ্গে ভালো কথা বলতে জানি না আমি।

খুব বড় মানুষদের সঙ্গে যেচে কোনোদিন পরিচিত হতে বা খাতির জমাতে যাই না। এ আমার স্বভাবের বাইরে। বড়রা যদি আমার ব্যাপারে অত্যন্ত আগ্রহ দেখান, তাহলেই সশরীরে উপস্থিত থেকে বড়দের আগ্রহ যথাসম্ভব মেটাতে অথবাদূর করতে তেমন আপত্তি করি না। বড়দের কাছে আমার না যাওয়ার কারণ কিন্তু অহংকার নয়, নিতান্তই সংকোচ। বড়রা ব্যস্ত মানুষ, অযথা তাদের বিরক্ত না করে দুর থেকে তাদের সরবে নীরবে শ্রদ্ধা করে যাওয়াই স্বাস্থ্যসম্মত। কিন্তু আমারই তৈরি এই নিয়ম অনিচ্ছাসত্ত্বেও কখনো কখনো আমাকে ভাঙতে হয়েছে। ফ্রাঁসোয়া মিতেরোঁর সঙ্গে দেখা করতে হবে, জ্যাক শিরাখের সঙ্গেও। লিওনেল জসপা তোমাকে ডেকেছেন, সিমোন ভেইল অপেক্ষা করছেন, গুন্টার গ্রাসের সঙ্গে দেখা করবে এসো, অ্যালেন গিন্সবার্গ কথা বলবেন। বাধ্য হয়েছি দেখা করতে। বড়দের সঙ্গে সত্যি বলতে কী কখনো কোনো সম্পর্ক গড়ে ওঠে না আমার। ওঁদের সঙ্গে দেখা হয়, ওঁরা চমৎকার কথা বলেন, কেউ কেউ বেশ আদর যত্নও করেন। কিন্তু বিদেয়টা শেষ বিদেয়ই হয়। যোগাযোগে আলসেমি আছে বলে ও পথ মাড়াই না, আর বড়রা বড় বলে খুব স্বাভাবিক, যে, কোনো খোঁজ খবরও আর করেন না। জ্যোতি বসুর সঙ্গে বছর সাত আগে এভাবেই আমার দেখা হয়েছে। প্রথম দেখা। কারও কাছে কোনো আবদার করিনি, কোনো ইচ্ছে প্রকাশ করিনি দেখা করতে চাওয়ার, হঠাৎ শুনি তাঁর সঙ্গে আমার দেখা করার দিন তারিখ সব ঠিক। ঘটনাটি ঘটিয়েছিলেন আমার এক শুভাকাঙ্খী, সম্ভবত তিনি আমাকে বড় জাতের কিছু বলে ধারণা করেছিলেন। জ্যোতি বসুর মতো বিশাল এক মানুষের সঙ্গে আমার মতো ক্ষুদ্র লেখক রাজনীতির মাথামুণ্ডু যে কিচ্ছু জানে না, কী কথা বলবে! নিজের মুখতা আর অজ্ঞতা নিয়ে আশংকায় কুঁকড়ে ছিলাম। আমি ক্ষুদ্র জেনেও আমার সঙ্গে দেখা করতে কোনো অনীহা ছিল না জ্যোতি বসুর। তিনি তো এলেনই, তাঁর স্ত্রীও এলেন, এমনভাবে কথা বলছিলেন যেন আমাকে কতকাল চেনেন, যেন আমি তাঁদের কতকালের চেনা বা আত্মীয়। মানুষ খুব বড় হলে সম্ভবত অচেনা অজানা লোক আর নিজের মাঝখানে কোনো দেয়াল রাখেন না। এই প্রথম আমি কোনো বড় মানুষের কাছাকাছি এসে বোধ করলাম যে মানুষটির সঙ্গে আবার কখনও আমার দেখা হতে পারে। তাঁর সঙ্গে রাজনীতির সাদা কালো, মন্দ ভালোর গল্প করার আমার কোনো দরকার নেই। আমি শুধু তার শৈশব কৈশোরের গল্প, তার দুঃখ সুখের, আনন্দ বেদনার ছোট ছোট কথা কাহিনী শুনেই মুগ্ধ।

যখন পশ্চিমবঙ্গ সরকার আমার বই নিষিদ্ধ করেছিলো, সিদ্ধান্তটি যদিও অগণতান্ত্রিক এবং বাক স্বাধীনতা বিরোধী, দলের সিদ্ধান্ত বলেই আশংকা করেছিলাম জ্যোতি বসুও বই নিষিদ্ধের পক্ষে। কিন্তু আমাকে বিস্মিত করে দলের একজনই, তিনি, বই নিষিদ্ধ করার বিপক্ষে মত দিয়েছিলেন। কখনও কারওর পায়ের ধুলো নিইনা আমি। জ্যোতি বসুরও নিইনি। যখনই দেখা হয়েছে, শ্রদ্ধা ভরে নমস্কার করেছি। কৃতজ্ঞতা প্রকাশে চিরকালই আমি খুব আনাড়ি। জানি না তিনি বুঝতে পেরেছেন কি না তাঁর দলের সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে হলেও মত প্রকাশের অধিকারের পক্ষে কথা বলে শুধু নিজেকেই মহান করেননি, আমরা যারা লড়াই করছি এই অধিকারের পক্ষে, আমাদের প্রচুর শক্তি আর সাহস জুগিয়েছেন। জ্যোতি বসু সম্পর্কে মন্দ কথা বলার লোকের অভাব নেই। উন্নাসিক ছিলেন? হয়তো ছিলেন। কিন্তু বই নিষিদ্ধের বিপক্ষে তাঁর বক্তব্য শুনে, তাঁকে উন্নাসিক তো নয়ই, বরং বড় বিচক্ষণ, বড় বুদ্ধিদীপ্ত মানুষ বলে আমার মনে হয়েছে। অন্য কোনো কমিউনিস্ট নেতা, দলের সিদ্ধান্ত, সে সিদ্ধান্ত ভুল হলেও, আদর্শগত কারণে তা মানতে না পারলেও মুখ ফুটে কিছু বলেননি। এর চেয়ে মর্মান্তিক আর কী হতে পারে কোনো দলে নাম লেখাতে হলে যদি নিজস্ব বোধবুদ্ধিবিবেক বিসর্জন দিয়ে তবে লেখাতে হয়। যদিও কমিউনিজমে ধর্ম মানা নেই, তারপরও ধর্মের সমালোচনা করেছি এই দোষে আমাকে দোষী করে পশ্চিমবঙ্গের ক্ষমতাসীন কমিউনিস্টরা আমার বই নিষিদ্ধ করে মত প্রকাশের স্বাধীনতার চিতার ওপর ধর্মীয় মৌলবাদীদের বিজয় পতাকা উড়িয়ে দিলেন। এই বিজয় মৌলবাদীদের এত উৎসাহ দিয়েছে যে প্রকাশ্যে তারা একের পর এক আমার মাথার দাম ঘোষণা করতে কোনো দ্বিধা করেনি, রাস্তায় আগুন জ্বালানোর সাহসও তাদের হয়েছে।

যে সময় পশ্চিমবঙ্গের কমিউনিস্ট নেতাদের কেউই আমার সঙ্গে দেখা করেন না, আমি একটা ভয়ংকর নিষিদ্ধ নাম, আমাকে সমর্থন করা মানে, তাদের বদ্ধ বিশ্বাস, জেনেশুনে মুসলমানের ভোট হারানো সে সময় জ্যোতি বসু আমার সঙ্গে দেখা করেছেন। কারও বিরুদ্ধে আমি কোনো অভিযোগ করতে যাইনি তাঁর কাছে। দুজন আমরা গল্প করছিলাম সেই আগের দিনের মতো। তিনি তাঁর দেশের বাড়ি, তাঁর পাড়া পড়শি, তাঁর শৈশব কৈশোরের কথা বলছিলেন। বলছিলেন দেশভাগ, ধর্মান্ধতা, মুক্তিযুদ্ধ আর স্বাধীনতার কথা। আমার লেখালেখি আর এর ঐতিহাসিক গুরুত্বের কথা।

দিন যায়। যেতে থাকে। জ্যোতি বসু ছাড়া আর কারও সঙ্গে আমাকে দেখা করতে দেওয়া হয়নি দেশের ভেতর। দেশের বাইরে যেতে দেওয়া হয়েছে। তাইপেই কবিতা উৎসব থেকে ফিরে আসি। প্যারিসে গিয়েও অনুষ্ঠান শেষে ফিরি। আমার ফিরে আসাটি যে কাঙ্ক্ষিত নয়, টের পাই। ফেরার সঙ্গে সঙ্গে, যে জীবন যাপন করছিলাম, সেই জীবন আবার যাপন করতে বাধ্য হই। নীরবে নিভৃতে গৃহবন্দি জীবন। আমার খুব জানতে ইচ্ছে করে, কতদিন, ঠিক কত মাস বা বছর আমার স্বাধীনতা আমি ফিরে পাবো না। কেউ নেই আমার এই প্রশ্নের উত্তর দেবে। অনেকটা চোখ বুজে, মুখ বুজে, দাঁত কামড়ে পড়ে থাকি। পায়ে অদৃশ্য শেকল। যাঁরা শেকল পরিয়েছেন তাঁরা জানেন, আর যার পায়ে শেকল সে জানে, এ ছাড়া খুব বেশি মানুষের জানা সম্ভব হয় না শেকলের কাহিনী।
 
০৪. কথোপকথন


বন্দি আমি। ঘরের বাইরে বেরোনো নিষেধ। গায়ে শ্যাওলা পড়ছে। মনে ভুতুড়ে বাড়ির উঠোনের বড় বড় ঘাসের মতো ঘাস। এর মধ্যেই তিনি এলেন। সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি সময় এক সন্ধ্যায়। আসার দশ মিনিট আগে ডিজি এসবি বিনীত গোয়েল ফোনে বলে দিলেন সিপিআসছেন। পুলিশ কমিশনারকে সংক্ষেপে সিপি বলা হয়। মুখ্যমন্ত্রীকে বলা হয় সিএম। চিফ এর প্রথম বর্ণ সি আর মিনিস্টারের প্রথম বর্ণ এম নিয়ে সিএম। পশ্চিমবঙ্গের সিএম বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। সিপি প্রসূন মুখোপাধ্যায়। প্রসূন মুখোপাধ্যায় আমার বাড়ি আসবেন। কী কান্ড, এত বড় একজন মানুষ আমার বাড়ি আসছেন কেন? এই প্রশ্নের আমি কোনও উত্তর জানি না। উত্তর খোঁজারও চেষ্টা করিনি। হতে পারে এমনি সৌজন্য সাক্ষাৎ! আমাকে নিরাপত্তা দিচ্ছেন, আমি তো আর হাবিজাবি কোনও মানুষ নই। দেখা করার ইচ্ছে ওঁর হতেই পারে। পুলিশের বড় দু’জন অফিসার এর আগে একবার সৌজন্য সাক্ষাৎ করে গেছেন। বলেছেন, আমি যেন কোনও দুশ্চিন্তা না করি, আমার নিরাপত্তার জন্য সবরকম ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। অফিসার দুজনের মধ্যে একজন ছিলেন জাভেদ শামীম, রীতিমত সুদর্শন। কথায় কথায় বললেন, ‘হায়দারাবাদে যারা আপনার ওপর হামলা চালিয়েছিলো, তারা হেলা করার মতো লোক নয় কিন্তু। সবাই উচ্চশিক্ষিত। লেখাপড়া করতে বিলেত পর্যন্ত গেছে ওরা। চমৎকার ইংরেজি বলে। ওদের ইংরেজি শুনলে বোঝাই যায় না ওরা ভারতীয়। জাভেদ শামীমের চোখে ছিল হায়দারাবাদের ওয়াইসি বংশের লোকদের জন্য সমীহ আর মুগ্ধতা! প্রসূন মুখোপাধ্যায় এলে মিষ্টি, বিস্কুট, চা, চানাচুর ইত্যাদি নানা কিছু দিয়ে আপ্যায়ন করা হয়। এর আগে ফোনে ওঁর সঙ্গে কথা হয়েছে। দেখা যদি হয়েও থাকে কোথাও, কেমন আছেন, ভালো জাতীয় মামুলী কথা ছাড়া বেশি কিছু কথা হয়নি। কথোপকথন মোট দুঘণ্টার। মোদ্দা কথাগুলো এরকম।

প্র– অবস্থা তো খুব খারাপ।

ত–কী রকম খারাপ?

প্র—কিছু নন-বেঙ্গলি মুসলিম তো আপনাকে মেরে ফেলার সব প্ল্যান করে ফেলেছে।

ত–তাই নাকি?

প্র–যা তাই। আমি তো আপনাকে সিকিউরিটি দিচ্ছি। আমার ছেলেরা তো সব আছে এখানে। সিকিউরিটি বাড়িয়েছি তো অনেক। জানেন তো?

ত–হা নিশ্চয়ই। অনেক ধন্যবাদ। আমি খুব নিরাপদ বোধ করছি এখন।

প্র–কিন্তু আপনি হায়দারাবাদে না গেলেই পারতেন। হায়দারাবাদে যাওয়াটা উচিত হয়নি আপনার।

ত–আসলে কয়েক বছর থেকেই যেতে বলছিলো। বারবারই না বলে দিয়েছি। কিন্তু এবার আমার বই এর প্রকাশনা উৎসবের আয়োজন করে এমন করুণভাবে ডাকাডাকি করলো যে, মনে হল, না হয় ঘুরেই আসি। শহরটায় আগে যাইনি কখনও, যাওয়াও হল।

প্র–যাওয়া উচিত হয়নি।

ত–ওখানে যে সিকিউরিটির ব্যবস্থা ছিল না, আমি জানতামই না। আমাকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিল যারা, বুঝতে পারেনি এরকম কিছু ঘটতে পারে।

প্র–হুম। খুব ভুল করেছেন।

ত–ভুল করবো কেন? হায়দারাবাদে যে অমন ঘটনা ঘটবে, তা তো আর আমি আগে থেকে জানি না!

প্র–হায়দারাবাদে কেন গিয়েছিলেন?

ত–আমার একটা বই তেলুগু ভাষায় বেরিয়েছে। বইটার উদ্বোধন করতে আমাকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন হায়দারাবাদের প্রকাশক।

প্র–আপনার বই? হায়দারাবাদে? কেন? কেন ওরা তেলুগু ভাষায় বের করেছে? কী কারণে?

ত–আমি তো বই লিখি বাংলা ভাষায়।

প্র–সেটা জানি।

ত–বাংলা ভাষায় বই বেরোলে সে বই বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হয়। তেলুগু ভাষায়ও হয়েছে।

প্র–তাই নাকি?

ত–হ্যাঁ। তেলুগু ভাষা ছাড়াও অন্য ভাষাতেও আছে বই।

প্র–সত্যি বলছেন?

ত–মিথ্যে বলবো কেন?

প্র–আর কোন ভাষায় বই বেরিয়েছে?

ত–মারাঠি, হিন্দি, উড়িয়া, অসমীয়া, পাঞ্জাবি, মালায়ালাম..

প্র–তাই নাকি? কেন? কেন ওসব ভাষায় বেরিয়েছে?

ত–বেরিয়েছে কারণ ওসব ভাষার মানুষ আমার বই পড়তে চেয়েছে। তাই পাবলিশাররা ছাপিয়েছে।

প্র–যাই হোক। আপনার হায়দারাবাদে যাওয়াটা উচিত হয়নি।

ত–গিয়েছি তো ভারতের অনেকগুলো রাজ্যে। ওসব জায়গায় সংবর্ধনা দিয়েছে। আমার ভালোও লাগে বিভিন্ন সংস্কৃতির মানুষের সঙ্গে মিশতে। আর পাঠকের সঙ্গে কথোপকথন তো ভালো লাগারই কথা।

প্র–হায়দারাবাদ ছাড়াও অন্য জায়গায় গিয়েছেন?

ত–তা তো গিয়েছিই। দেশের বিভিন্ন রাজ্য থেকেই আমাকে ডাকা হয়।

প্র–কেন ডাকে আপনাকে? কে ডাকে?

ত–প্রকাশক আমন্ত্রণ জানান। সাহিত্য সংগঠন থেকেও আমন্ত্রণ জানানো হয়। সব সময় যাওয়া হয় না। মাঝে মাঝে যাই। কখনও তো কোথাও ভালো ছাড়া মন্দ কিছু ঘটে না। সব রাজ্যেই অবশ্য নিরাপত্তার একটা ব্যবস্থা থাকে। দিল্লিতে দুবার গিয়েছি। একবার উইমেনস ওয়ার্ল্ডের আমন্ত্রণে। আরেকবার রাডিক্যাল হিউম্যানিস্টদের আমন্ত্রণে। তখন কোনও সিকিউরিটিই ছিল না। কিছু তোবিপদ হয়নি।

প্র–তাই নাকি? কেন ডেকেছিল ওরা?

ত–মানবাধিকার নিয়ে বা নারীর অধিকার নিয়ে কিছু বলার জন্য, অথবা নিজের লেখা থেকে পড়ার জন্য, এরকম আমন্ত্রণ তো জানানোই হয়।

প্র–কারা শোনে?

ত–মানুষ।

প্র–ও।

ত–(দীর্ঘশ্বাস)

প্র–কী বলেছিলেন আপনি হায়দরাবাদে? কেন আপনাকে অ্যাটাক করলো?

ত–শোধ বইটার অনুবাদ হয়েছে ওখানে, একটা মেয়ের জীবনকাহিনী। আমার বক্তব্যে আমি শুধু মেয়েদের নিজের ডিগনিটি নিয়ে, সম্মান নিয়ে বাঁচার অধিকারের কথা বলেছি।

প্র–ধর্ম নিয়ে কিছু বলেছিলেন?

ত–ধর্মের ধ-ও উচ্চারণ করিনি। ইসলামের ই-ও উচ্চারণ করিনি।

প্র–তাহলে ওরা ক্ষেপলো কেন?

ত–আমার সম্পর্কে একটা প্রচার হয়েছে চারদিকে, আমি নাকি অ্যান্টি ইসলাম, সে কারণেই অ্যাটাক। অবশ্য পরে নানা লেখালেখি থেকে যা জানলাম তা হল, মুসলমানদের ভোট পাওয়ার জন্য আমাকে আক্রমণ করে বোঝাতে চেয়েছে ওরা ইসলামকে আমার হাত থেকে বাঁচাচ্ছে।

প্র–আপনার বিরুদ্ধে কলকাতায় ফতোয়াও জারি হয়েছে।

ত–ফতোয়া তো অনেক জারি হয়েছে। এখন তো ফতোয়া নিয়ে তেমন কিছু আর হচ্ছে না। আর আপনি তো টিপু সুলতান মসজিদের ইমামকে ডেকে এনে একবার বোঝাতে পারেন। আগের বার ফতোয়া দেওয়ার পর আপনি তাকে ঘরে ডেকে নিয়ে কথা বলার পর সে বলেছিল, ফতোয়াই নাকি দেয়নি। ওরকম করে এবার তো তাকে ডাকতে পারেন।

প্র–ওই ইমামের কথা বাদ দিন। ইমাম কোনও ভয়ংকর লোক নয়। যারা সামনে আসছে, ফতোয়া দিচ্ছে, ওরা ভালো। খারাপ লোক নয়। খারাপ লোক সব দল পাকাচ্ছে। তারা ডেনজারাস। গোপনে গোপনে সব তৈরি হয়ে আছে। আমাদের কাছে খবর আছে, ওদের প্ল্যান প্রোগ্রাম হয়ে গেছে আপনাকে মারার।

ত–আপনি জানেন কারা ওরা?

প্র–জানি।

ত–সব খবর যদি জানেন কারা এসব করছে, তাহলে তো অ্যারেস্ট করতে পারেন।

প্র–না, সেটা সম্ভব না।

ত–আমার মনে হয়না কিছু হবে। আমার সঙ্গে তোসিকিউরিটির লোক আছে। মনে হয়না ওরা এই কলকাতায় একজনকে প্রাণে মেরে ফেলার সাহস পাবে।

প্র–কী করে জানেন আপনি? আমি কি খবর না জেনে বলছি?

ত–কিছু তো ঘটছে না। সিদ্দিকুল্লাহ চৌধুরীরা বলেছিলো মহাকরণ ঘেরাও করবে। সেই প্রোগ্রামও তত বাদ দিয়েছে।

প্র–(ধমক মেরে, জোরে) আপনি আমাকে ইনফরমেশন দেবেন নাকি আমি আপনাকে ইনফরমেশন দেব?

ত–কাগজে পড়লাম বলে বলছি।

প্র–খবরের কাগজ কিচ্ছু জানে না। আমরা সব জানি। গোপনে কী হচ্ছে শহরে, তা জার্নালিস্টরা কী করে জানবে! (ধমক)

ত—তা অবশ্য ঠিক। কিন্তু, যারা মেরে ফেলার প্ল্যান করছে, তাদেরকে অ্যারেস্টকরা যায় না? কারণ মেরে ফেলার প্ল্যান করা তো আইনের চোখে অপরাধ, তাই না?

প্র–না, অ্যারেস্ট করা যায় না। বিশেষ করে যখন মাইনরিটির ব্যাপার, তখন যায় না।

ত–এটা কোনও কথা হল? আইন তো সবার জন্য এক হওয়া উচিত।

প্ৰ–রিলিজিয়াস সেন্টিমেন্ট আলাদা জিনিস।

ত–তা ঠিক। কিন্তু এই টেরোরিস্ট, যাদের কথা আপনি বলছেন, তারা কি আমার বই পড়েছে? মনে তো হয় না।

প্ৰ–তা জানি না। তবে ওরা তৈরি আপনাকে মারার জন্য। সব আয়োজন কমপ্লিট। এখন শুধু টাইমের অপেক্ষা। আর নভেম্বরের মাঝামাঝি তো বিরাট করে বন্ধ ডাকা হচ্ছে আপনার বিরুদ্ধে। খুব বিচ্ছিরি কান্ড হতে যাচ্ছে।

ত–কী রকম?

প্র–মব চলে আসতে পারে আপনার বাড়িতে।

ত–তাই নাকি? বাড়ি অবদি চলে আসার আগে নিশ্চয়ই বাধা দেওয়া হবে।

প্র–আমি তো আপনাকে প্রোটেকশান দিচ্ছি। নিশ্চয়ই লক্ষ্য করেছেন প্রোটেকশান বাড়িয়েছি অনেক। কিন্তু মব চলে এলে যদি আমার ছেলেরা ওদের একটাকে গুলি করে, তাহলেই তো রায়ট লেগে যাবে।

ত–বলছেন কী?

প্র–ঠিকই বলছি।

ত–রায়ট লাগবে কেন?

প্র–যা রায়ট লেগে যাবে। আপনি চান গুলি চলুক? আপনি চান আপনার কারণে কাউকে গুলি করা হোক?

ত–না আমি চাই না।

প্র–ওদের কারও গায়ে গুলি করলেই রায়ট বাধবেই। মুসলমানদের পাড়ায় খবর হয়ে যাবে। ব্যস।

ত–রায়ট কেন? এখানে কোনও তো হিন্দু মুসলমানের ব্যাপার নেই। এটা ক্রিমিনালিটির ব্যাপার। আইন কি হিন্দু মুসলমান বিচার করে?

প্র–করতে হয়। আইনের কথা বলছেন? আপনি দেখছেন না আপনার বেলায় কী হচ্ছে। কোনও সাপোর্ট পেয়েছেন কারওর? এই যে হায়দারাবাদে মার খেলেন, কেউ কি আপনাকে সাপোর্ট করেছে? কোনও পলিটিক্যাল পার্টি? সবারই মুসলিম ভোট দরকার। সুতরাং এগুলোআপনাকে বুঝতে হবে। আপনার কিন্তু সোসাইটিতে কোনও সাপোর্ট নেই।

ত–আমি তো সাধারণ মানুষের সাপোর্ট পাই।

প্র–কে বলেছে আপনাকে?

ত–আমি বলছি। মানুষ আমাকে ফোন করছে। চিঠি লিখছে। বলছে, আমার লেখা তাদের ভালো লাগে।

প্র–ওসবে কিস্যু হবে না। কোনও পলিটিক্যাল পার্টি আপনাকে সাপোর্ট করছে না, সেটা বড় কথা। খুব বাজে অবস্থা আপনার। চা বিস্কুট খেতে খেতে প্রসূন মুখার্জি কথা বলতে থাকেন।

প্র–মাইনরিটি লিডাররা দেখা করবে সিএম-এর সঙ্গে। ওরা তো আপনাকে ডিপোর্টেশনের দাবিতে পথে নামছে। ওরা প্ল্যান করছে সিএমএর কনভয় আটকাবে। আটকালে আমাদের তো লাঠিচার্জ করতে হবে। আর লাঠিচার্জ করার মানে জানেন? খবর হয়ে যাবে। বিরাট রায়ট লেগে যাবে। লাগবেই।

ত–অবিশ্বাস্য ব্যাপার।

প্র–অবিশ্বাস্য নয়। আপনার জন্য তো রায়ট লাগবে কলকাতায়। আপনি থাকলে রায়ট লাগবেই।

ত–কলকাতায় আমি থাকলে রায়ট লেগে যাবে। এত বছর কলকাতায় আছি আমি, কোনওদিন কিছু হয়নি। আর হঠাৎ করে রায়টের মতো কাণ্ড ঘটবে, এ আমার বিশ্বাস হয় না।

প্র–বিশ্বাস না হলে সেটা আপনার প্রবলেম। তবে ঘটনাটা তাই ঘটতে যাচ্ছে। এখন আপনাকে ডিসিশান নিতে হবে।

ত–কী ডিসিশান?

প্র–আপনি কিছুদিনের জন্য কোথাও চলে যান। ত মানে? প্র মানে আপনাকে কিছুদিনের জন্য কলকাতার বাইরে কোথাও যেতে হবে। ত কোথায়?

প্ৰ–ইওরোপে চলে যান না।

ত–ইওরোপে? কিন্তু ওখানে তো আমার বাড়িঘর নেই।

প্র–দেখুন, কোথাও থাকার বন্দোবস্ত করুন।

ত–ফিরবো কবে?

প্র–পরিস্থিতি শান্ত হলে ফিরবেন।

ত–(হেসে) মনে পড়ছে বাংলাদেশ থেকে যখন চুরানব্বই সালে আমাকে প্লেনে তুলে দেওয়া হয়, আমাকেও বলা হয়েছিল, পরিস্থিতি শান্ত হলে ফিরবেন। আজ তেরো বছর হয়ে গেল, পরিস্থিতি এখনও শান্ত হয়নি।

প্র–আপনি ফিরে আসতে চাইলে নিশ্চয়ই ফিরে আসবেন।

ত–কিন্তু আমি তোইওরোপে যেতে পারবোনা। ওখানে সব গুটিয়ে আমি এসেছি। গেলে ওখানে আমাকে হোটেলে থাকতে হবে। সে আমার পক্ষে সম্ভব নয়। আর আমার কাছে আমার বোন আসছে দুদিন পর। অনেকদিন থাকবে।

প্র–বোনকে নিয়ে চলে যান।

ত–কোথায় যাবো?

প্র–আমেরিকায় চলে যান।

ত–আমেরিকা থেকেই তো আসছে আমার কাছে। ওকে নিয়ে আমি আমেরিকা যাবো কেন?

প্র–তবে অন্য কোথাও চলে যান।

ত–আমি তো বললাম আপনাকে, ইওরোপ বা আমেরিকায় যাওয়া আমার পক্ষে সম্ভব হবে না। আমি অত খরচ কুলোতে পারবো না।

প্র–তাহলে ভারতের কোথাও যান।

ত–কোথায় যাবো?

প্ৰ–সে আপনি খুঁজে দেখুন কোথায় যাবেন। কেউ নেই আপনার চেনা পরিচিত কোথাও ভারতের কোনও রাজ্যে?

ত–আমার চেনা আছে তোঅনেকে। আমার পাবলিশার আছে কেরালায়, মহারাষ্ট্রে, উড়িষ্যায়। কেরালার সরকার আমাকে বেশ ভালোবাসে। এডুকেশন মিনিস্টিার এমএ বেবি আমাকে তার বাড়িতে নেমন্তন্ন করেছেন। ফরেস্ট মিনিস্টারের বাড়িতেও ব্রেকফাস্টের জন্য ডেকেছিলেন। ওঁরা বেশ চমৎকার মানুষ।

প্ৰ–কেরালায় চলে যান। আপনার পাবলিশারকে বলুন আপনার থাকার ব্যবস্থা করতে।

ত–কিন্তু ওখানে তো মানুষ জেনে যাবে যে আমি গেছি। গতবার কেরালায় কিছু মুসলিম মৌলবাদী আবার আমার বিরুদ্ধে বিক্ষোভ দেখিয়েছিল।

প্র–কেরালায় জানিয়ে দিন আপনি আসছেন। ওখানে প্রোটেকশনের ব্যবস্থা করবে, সে নিয়ে চিন্তা করবেন না। আর কোথায় বললেন, মহারাষ্ট্র?

ত–ওখানে আমার মারাঠী পাবলিশার আছেন। অনিল মেহতা। উনিও খুব ভালো।

প্র–মধ্যপ্রদেশে চলে যান না, ওখানে তো বিশাল জঙ্গল আছে।

ত–আপনি আমাকে জঙ্গলে পাঠিয়ে দিতে চান?

প্র–(অপ্রস্তুত হেসে) না, আসলে আমি তো জঙ্গল খুব ভালোবাসি, তাই বলছি।

ত–আমার জঙ্গল ভালো লাগে না।

প্র–তাহলে কী ভালো লাগে?

ত–সমুদ্র, পাহাড় এসব ভালো লাগে।

প্র–তাহলে কেরালায় চলে যান। ওখানে এনজয় করুন সমুদ্র।

ত–ফিরবো কবে?

প্র–তিনচার মাস থাকুন। এদিকের আগুনটা কমলে ফিরবেন।

ত–আগুনের তো কিছু দেখছি না।

প্র–আপনি দেখছেন না, আমরা তো দেখছি।

ত–ও।

প্র–আর ফিরে এসে আপনি এই ফ্ল্যাটটা পাল্টে নেবেন। সাউথের দিকে কোথাও ফ্ল্যাট নিন। বালিগঞ্জের দিকে নিন। এটা মুসলিম এরিয়ার খুব কাছে।

ত–ফ্ল্যাট খুঁজে পাওয়া এত কষ্টের। প্রচুর ফ্ল্যাট দেখেছি। ভালো জায়গায় ভালো ফ্ল্যাট এখনও পাওয়া হয়নি। এই ফ্ল্যাটটা খুব তাড়াহুড়ো করে নিয়েছিলাম। কোনও উপায় ছিল না। ভাড়া খুব বেশি। একটু কম ভাড়ার ফ্ল্যাট পেলে ভালো হয়।

প্র–কোনও চিন্তা করবেন না। আমরাই খুঁজে দেব।

ত–এই বাড়ি ফেলে এতদিনের জন্য কী করে আমি দূরে থাকবো? আমার তো খুব দরকারি জিনিসপত্র আছে এ বাড়িতে। কত বই। কত সার্টিফিকেট, ডকুমেন্টস! সব কি এভাবে ফেলে চলে যাওয়া ঠিক হবে?

প্র–দামি কী আছে?

ত–সোনার মেডেল টেডেল আছে…

প্র–শুনুন, ভ্যালুবল জিনিস বরং নিয়ে যান।

ত–নিয়ে যাবো? ওগুলো নিয়ে পথে পথে ঘুরবো? আর ঘর বাড়ি এভাবেই পড়ে থাকবে? আমার বেড়ালটা কোথায় যাবে?

প্ৰ–একটুও চিন্তা করবেন না। আমার ছেলেরা দেখবে আপনার ফ্ল্যাট। বেড়াল নিয়েও দুশ্চিন্তার কিছু নেই।

ত–আপনি যে এভাবে বাইরে চলে যেতে বলছেন। কতদিনের জন্য বলছেন যেতে। ফিরবো কবে? ফেরার কথা ঠিক করে তো বলছেন না।

প্র–যান। দুতিন মাস পর ফিরে আসুন।

ত–দুতিন মাসে কি পরিস্থিতি শান্ত হবে বলে আপনার বিশ্বাস?

প্র–হ্যাঁ হয়ে যাবে। কত আর নেবে? কয়েক মাস পরেই সব ঠিক হয়ে যাবে। বছর। খানেকের মধ্যে তো হবেই মনে হচ্ছে।

ত পরিস্থিতি তত আমি মোটেও অশান্ত দেখছি না। কিন্তু আমি কলকাতায় থাকলে, যা আপনি বলছেন, পরিস্থিতি অশান্ত হয়। তাহলে তো আমি ফিরে এলে আবার পরিস্থিতি অশান্ত হবে। আমি ফিরে এলে ওরা কি চুপ করে বসে থাকবে? মেনে নেবে?

প্র–এ নিয়ে ভাববেন না। তখনেরটা তখন দেখা যাবে।

ত–তাহলে এখনেরটা এখন দেখাই ভালো। পালিয়ে গিয়ে কোনও সমস্যার কি সত্যিকার সমাধান হয়? ওরা যদি জানে যে আমি ওদের ভয়ে চলে গেছি, তাহলে বিরাট ভিকটরি হবে ওদের।

প্ৰ–আপনার এই ফ্ল্যাটটা কবে নিয়েছেন?

ত–এই তো বছর তিনেক আগে।

প্র–জায়গাটা ভালো না। মুসলিম এরিয়ার খুব কাছে। যে কোনও সময় অ্যাটাক হতে পারে। দেখি তো ফ্ল্যাটটা, কত স্কোয়ার ফুট?

ত–ঠিক জানি না, মনে হয় সতেরোশ। দুহাজারও হতে পারে। একেকজন একেকরকম বলে।

প্র–(উঠে ফ্ল্যাট দেখতে দেখতে) হা এরকমই একটা আমরা দেখে রাখবো। ওদিকে বাথরুম?

ত–হ্যাঁ ওদিকে বাথরুম।

প্র–(স্টাডিতে এসে) স্টাডি?

ত–হ্যাঁ। এখানেই বেশির ভাগ সময় থাকি।

প্র–এখানেই বেশির ভাগ সময়? কেন, এখানে কী করেন?

ত–লেখা পড়া করি।

প্র–(কমপিউটারের কাছে এসে) কমপিউটারে লেখেন?

ত–হ্যাঁ।

প্র–বাংলায় লেখেন?

ত–হ্যাঁ।

প্র–আশ্চর্য!

ত–আশ্চর্য কেন।

প্র–কী করে লেখেন, দেখান তো।

ত–(বাংলা একটি লাইন ‘আমার পক্ষে কোথাও যাওয়া অসম্ভব। না, এ হতে পারে না’ –লিখে) এভাবেই বাংলা লিখি।

প্ৰ–(মৃদু হেসে) কী করে জানেন কোন্‌ কী তে কোন্ বাংলা অক্ষর আছে?

ত–অনেক বছর ধরে লিখছি কমপিউটারে। কোন রোমান হরফের তলায় বাংলা কোন হরফ লুকিয়ে আছে, জানা হয়ে গেছে।

প্ৰ–(দরজার কাছে, চলে যেতে যেতে) আপনার বোন কবে আসছে যেন?

ত–এই তো দুদিন পর। ও অসুস্থ। কিছু ডাক্তার টাক্তার দেখাবে।

প্র–শুনুন। আপনি কিন্তু চলে যান অ্যাজ সুন আজ পসিবল। কবে যাচ্ছেন এটা আমাকে তাড়াতাড়ি ফোনে জানিয়ে দেন।

ত–আমাকে একটু ভাবতে হবে।

প্র–ভাবার কিছু নেই। অ্যাজ সুন আজ পসিবল চলে যেতে হবে।
 
প্রসূন মুখার্জি বেরিয়ে গেলেন। দরজার ওপারে দাঁড়িয়ে থাকা পুলিশগুলো সব মুহূর্তে চেয়ার ছেড়ে দাঁড়িয়ে পড়লো। অসম্ভব সমীহ করে এরা উঁচু পদের কর্মকর্তাদের। আমি দরজা বন্ধ করে স্টাডিতে এসে স্থবির বসে থাকি। কণ্ঠের কাছে থোক থোক কষ্ট এসে জমছে। উস্রি চলে গেল, আমি চরাচর জুড়ে একা। পায়ের তলায় যেন মাটি কাঁপছে। সবচেয়ে কাছের যে মানুষের সঙ্গে মনে হল এ বিষয় নিয়ে কথা বলতে পারি, তিনি মানস ঘোষ। তাঁর পত্রিকায় প্রতি বুধবার আমার কলাম বেরোয়। মানস ঘোষকে ফোনে খবরটা দেবার সঙ্গে সঙ্গে বললেন, সৌগত রায়কে খবরটা জানাবেন তিনি। আমার যে ক্ষুদ্র পরিচয়ের গন্ডি, এর মধ্যে রাজনীতি বোঝার লোক বাদুঃসময়ে উপদেশ দেওয়ার খুব বেশি কেউ নেই। হাতে গোনা ক’জন ছাড়া বাকি সব চেনা জানা সব আমার মতোই রাজনীতি না-বোঝা মানুষ। দু’জনই, মানস ঘোষ আর সৌগত রায় আমার বাড়ি পৌঁছোলন। প্রসূন মুখার্জি আমার বাড়িতে এসে ঘণ্টাদুয়েক ছিলেন, আমাকে কলকাতা ছাড়তে বলছেন, শুনে মানস ঘোষ ঠিক কী বলা উচিত কিছু বুঝতে পারছেন না। বারবারই এক কথা বলছেন, খুব খারাপ খুব খারাপ। খুব খারাপের পর যে ঠিক কী, তা অনেকক্ষণ তার মুখের দিকে তাকিয়ে থেকেও অনুমান করতে পারিনি। সৌগত রায় তো বলেই ফেলতে লাগলেন, ‘হা তুমি ছিলে, ভালোই লাগতো শহরটায়। তোমাকে খুব মিস করবো’।

শুনে বুক কেঁপে ওঠে। বাষ্পরুদ্ধ কণ্ঠ আমার। মিস করবেন মানে? আপনি কি সত্যি সত্যি ভাবছেন আমাকে চলে যেতে হবে?

‘প্রশাসন যখন বলছেন, তোমার নিরাপত্তার কথা ভেবেই বলছেন। এখন তো তুমি, জানি না কোথায় যাবে, ইওরোপে?’

‘না। আমি কোথাও যাবো না।‘

সৌগত রায় প্রিয়রঞ্জন দাশমুন্সিকে ফোন করলেন। ওপার থেকে যা ভেসে এলো তা হল, আমি হায়দারাবাদ থেকে ফেরার পর প্রিয়রঞ্জনবাবু আমার পক্ষে কথা বলেছিলেন। অপরাধীদের কঠিন শাস্তি দেওয়ার কথাও বলেছিলেন। ছাপাও হয়েছিলো কাগজে। সে কারণে তাঁকে অসুবিধে পোহাতে হয়েছে।

কী অসুবিধে?

উত্তর মেলে না। ধারণা করে নিতে হয় যে তাঁর দলের সদস্যরা অথবা দলের মুসলিমরা আপত্তি করেছেন। আপত্তির কারণে তিনি সিদ্ধান্ত বদল করেছেন।

প্রসূন মুখার্জি যখন বলেছেন, যখন নিজে আমার বাড়িতে এসে বলেছেন, শহর শান্ত থাকলেও, হয়তো কারওরই বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করছিল না যে শহর শান্ত। পুলিশ কমিশনার তো ফাজলামো করতে আসেননি, নিশ্চয়ই আমার নিরাপত্তার এমনই অভাব হয়ে দাঁড়াচ্ছে যে পুরো রাজ্যের পুলিশ বাহিনী, আমাকে, আমার মতো একলা প্রাণীকে কোনও নিরাপত্তা দিতে অপারগ। অপারগ বলেই তো চলে যাওয়ার কথা বলা। তাঁরা একরকম মেনে নিলেন। এবং মনে মনে আমার দুরবস্থার জন্য দুঃখ করা ছাড়া তাদের খুব বেশি উপায় আছে বলে তারা মনে করলেন না। আমাকে সান্ত্বনা দিতেই হয়তো, বললেন, যে, আজ তো বিশেষ আলোচনা হওয়ার সুযোগ নেই, অনেক রাত হয়ে গেছে, কাল, আগামিকাল, বিকেল তিনটেয় বসা যাবে এখানে, এই ঘরে, আমার লেখার ঘরে, বাঁচার কোনও উপায় আছে কী না তা নিয়ে কথা বলতে।

সারারাত অস্থিরতায় কাটে। পরদিন দুজন এলেন বটে, কিন্তু কোনও সমস্যার সমাধান হয় না। সিদ্ধান্ত নিই, নিজেই নিই, কোথাও যাবো না আমি।

এদিকে একটি ঘটনা আগুনের মতো বড় হচ্ছে কলকাতা শহরে। রিজওয়ান নামের এক গরিব মুসলমান ছেলের সঙ্গে প্রিয়াঙ্কা নামের এক ধনী হিন্দু মেয়ের প্রেম, স্পেশাল ম্যারেজ অ্যাক্টে বিয়ে, প্রিয়াঙ্কার বাপের বাড়ি চলে যাওয়া, রিজওয়ানের মৃত্যু। কেউ বলছে আত্মহত্যা। কেউ বলছে খুন। পুলিশের বড় কর্তারা নাক গলিয়েছিল প্রাপ্ত বয়স্ক রিজওয়ান আর প্রিয়াঙ্কার ব্যক্তিগত সম্পর্কে, বিয়েতে। লালবাজারে পুলিশ অফিসে ডেকে পাঠানো হয়েছিল দম্পতিকে। প্রচার মাধ্যম নিরবধি এই গল্পই পরিবেশন করে চলেছে। অভিযোগের আঙুল পুলিশের বড়কর্তাদের দিকে। অবস্থা খুব ভালো নয় প্রসূন মুখার্জিসহ দুজন বড় কর্তার। ভালো অবস্থা না থাকুক, তাতে কার কী! ফোন করলেন প্রসূন মুখার্জি। কী, আমাকে রাজ্য ছেড়ে চলে যেতে হবে।

এবারের কথোপকথন ফোনে।

প্র—হ্যাঁলো।

ত–নমস্কার। ভালো আছেন?

প্র–ভালো থাকার কোনও উপায় আছে? কী হচ্ছে এদিকে টিভিতে, দেখছেন তো! যত্তসব। তা আপনি এখনও যাচ্ছেন না যে!

ত–কোথায় যাবো?

প্ৰ–যে কোনও কোথাও চলে যান। আপনাকে কত বার বলবো যে কলকাতায় আপনি থাকলে গন্ডগোল হবে। রায়ট লাগবে। মুসলিম অরগাইনেজশনগুলো খুব বড় প্ল্যান করছে। বুঝতে পাচ্ছেন না আপনি..

ত–আমার তো যাওয়ার কোনও জায়গা নেই।

প্র–কিন্তু কোথাও না কোথাও তো আপনাকে যেতে হবে।

ত–জায়গা যদি না থাকে, তবে যাবো কোথায়?

প্র–কেরালা যাচ্ছেন না কেন?

ত–কেরালাতেও ওই একই ব্যাপার ঘটবে। কেরালা-সরকার আমাকে রাখতে চাইবেন না কেরালায়। ওখানে কিছু যদি একটা ঘটে যায়, সেই ভয় আপনাদের মতো ওঁরাও তো পাবেন। আপনারা নিরাপত্তা দিতে পারছেন না। ওঁরা কী করে দেবেন? আমি পশ্চিমবঙ্গে থাকি, কেরালা সরকার জানেন। কেরালায় কেন ওঁরা আমার নিরাপত্তার দায়িত্ব নেবেন! মাঝে মাঝে অনুষ্ঠানে দুতিনদিনের জন্য যাই, সেটা আলাদা কথা।

প্র–হুম। আপনাকে গোপন রাখতে হবে ব্যাপারটা।

ত–কী করে গোপন রাখবো। আমাকে গোপন রাখতে দেবে কে? অন্যরা রাখবে গোপন।

প্র–গোপন রাখা যাবে না কেন? কাউকে বলবেন না আপনি এসেছেন।

ত–আমি তো ঢোল পিটিয়ে কোথাও কিছু বলে বেড়াই না। কিছু কি আর সত্যি গোপন থাকে? জানাজানি হবেই। আমার মনে হয় না গোপনে গোপনে এত বড় একটা কাজ করা যাবে। গোপনে চলে যাওয়া কেরালায়। এসব তো কেরালা সরকার মানবেন না। আমার পক্ষে সিকিউরিটি ছাড়া কোথাও থাকা সম্ভব হবে না। এত বড় ঝুঁকি নেওয়ার প্রশ্ন ওঠে না।

প্র–আচ্ছা, আপনি থাইল্যান্ড বা সিঙ্গাপুরে কোথাও যেতে পারেন না?

ত–ওখানে কী করে যাবো? ওখানে কাউকে চিনি না আমি। আর কোথায় থাকবোই বা? আমার তো কাড়ি কাড়ি টাকা নেই হোটেলে গিয়ে থাকার!

প্র–আপনি বুঝতে পারছেন না, এখানে বিচ্ছিরি সব ব ট ডাকছে।

ত–আমার মনে হয় না খুব বড় কোনও দল ওরা..

প্র–আপনি না হয় শান্তিনিকেতনেই চলে যান।

ত–শান্তিনিকেতনে?

প্র–ওখানে কেউ নেই আপনার?

ত–না। কেউ নেই।

প্র–আপনার এত বন্ধু বান্ধর, তাদের বাড়ি টাড়ি নেই ওখানে?

ত–আছে কারও কারও। কিন্তু..কী করে বলবো। আপনারা বলুন না, সুনীলদার বাড়ি আছে, ওখানে থাকার ব্যবস্থা হলে হয়তো থাকতে পারি।

প্র–আপনার তো কলকাতা ছাড়তে হবে। কোথাও যান, বুঝলেন। আমাকে জানাবেন শিগরি। দেরি করাটা ঠিক হবে না।

ত–দেখি। আমি চেষ্টা করবো।

আমি সত্যি সত্যি ভাবতে বসি, কোথায় যাওয়া যায়। যদিও আমার মনে হচ্ছে না খুব মন্দ কিছু ঘটবে। কত কত দিন কলকাতার রাস্তায় নিরাপত্তা রক্ষী ছাড়াই ঘুরে বেরিয়েছি। শহরে অত শত্রু থাকলে কোনও না কোনও একদিন কিছু ঘটতোই। অন্তত আক্রমণের কোনও চেষ্টা হয়তো হতো। ঠিক বুঝে পাই না কী করবো। হাতের কাছে কোনও বন্ধু নেই যে কথা বলবো এ নিয়ে। দু একজন যাদের সঙ্গে কথা বলি, ওরা বোঝে না কী বলছি আমি। অথবা বুঝলেও এ নিয়ে কী মন্তব্য করবে, তা ঠিক জানে না।

কয়েকদিন পর আবার ফোন প্রসূনবাবুর। তিনি এবার প্রথম কথাটাই বললেন এভাবে–

প্র–শুনুন, সিএম বলেছেন আপনাকে কেরালা চলে যেতে। খুব শিগরি, পারলে আজই যান।

ত–কেরালা?

প্ৰ–হ্যাঁ কেরালা। ওখানে সরকারের সঙ্গে কথা বলে নিরাপত্তার সব ব্যবস্থা করে ফেলেছেন। আপনাকে চলে যেতে হবে।

ত–কেরালায় লোকে যখন জানবে আমি ওখানে? ওখানেও তো মুসলমান মৌলবাদী আছে। ওরা বসে থাকবে? কলকাতায় যারা আমাকে মেরে ফেলবে বলছিলেন, ওরা বসে থাকবে? ওরা তো কেরালায় গিয়ে আমাকে মেরে আসবে।

প্র–আপনাকে যেতে হবে যে করেই হোক, সিএম বলেছেন।

ত–হ্যাঁ বুঝতে পারছি। কিন্তু আমাকে তো আমার জীবনটার কথা ভাবতে হবে। আমি তো, আপনি বলবেন, আর, দিব্যি কোথাও মরতে যেতে পারি না। আপনারা যে আমাকে নির্দেশ দিচ্ছেন কলকাতা ছাড়ার জন্য, তা তো আমাকে জানাতে হবে। তা না হলে আমি যদি কেরালায় গিয়ে মরে যাই, মানে কেউ আমাকে মেরে ফেললে দোষ আমার হবে। লোকে বলবে, হঠাৎ আমার মাথা খারাপ হয়ে গিয়েছিলো, কলকাতা ছেড়ে কেরালায় চলে গেছি! কেন গেছি, কী কারণে গেছি তা না জেনে, লোকে আমাকেই দোষী করবে। গেলে আমাকে জানিয়ে যেতে হবে। লুকিয়ে পালিয়ে চুপিচুপি কোথাও যাবো না।

প্র–না না না এসব ব্যাপার খুব কনফিডেনশিয়ালি করতে হবে। কেউ যেন না জানতে পারে।

ত–গোপন রাখতে চাইলেই তো গোপন রাখা যায় না। আমার চেহারা তো মানুষ চিনে ফেলে, জানেন তো! চিনে ফেলবে। কোথাও গিয়ে নিজেকে লুকিয়ে রাখা যাবে না। আর, আমি কেন গোপন রাখবো, বলুন তো। আমি তো মিথ্যে বলি না। আর মুখ বুজে থাকলেও ওরা কারণ বের করে ফেলবে। গোপনে গোপনে রাজ্যের বাইরে যাবো। কেউ জানবে কী করতে আমি কেরালা গিয়েছি? সবাই ভাববে শখে গিয়েছি, শখে মরতে গিয়েছি। তা কেন, বলুন! তার চেয়ে জানাই সবাইকে যে যাচ্ছি।

প্ৰ–না না। গোপন রাখতে হবে।

ত–আমি তো গোপন রাখতে চাইছি না। আমি তো চাইছি জানাতে। হয় আপনি জানাবেন, নয়তো আমি জানাবো। যে কোনও একজনকে তো জানাতে হবে। আপনাকে বলতে হবে, আপনারা আমাকে কলকাতা থেকে চলে যেতে বলছেন, কারণ আমাকে নিরাপত্তা দিতে পারবেন না। অথবা আমি জানাবো। হয় আপনি প্রেস কনফারেন্স করুন, নয়তো আমি করবো।

প্র–হ্যাঁ আমিই করবো।

খটাশ করে ফোন রেখে দিলেন।

রেখে দিন। কিন্তু মনে আমার অদ্ভুত এক প্রশান্তি। যে কথাগুলো বলা উচিত, সে কথাগুলো বলেছি বলে, বলতে পেরেছি বলে। আমার আর হারানোর কী আছে! জীবনে তো সবই হারিয়েছি। কী দোষ করেছি আমি যে গোপনে আমাকে শহর ছাড়তে হবে, আরেক শহরের গর্তে গিয়ে লুকিয়ে থাকতে হবে!

এর ক’দিন পর ফোন করলেন লেখক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের সঙ্গে সবচেয়ে সুসম্পর্ক যে লেখকের। আমার সঙ্গেও ছিল দীর্ঘকালের বন্ধুত্ব।

সু–হ্যালো তসলিমা, আমি সুনীলদা বলছি।

ত–সুনীলদা, ভালো আছেন? কতদিন পর আপনার সঙ্গে কথা হচ্ছে। ভালো আছেন তো সুনীল দা?

সু–হ্যাঁ ভালো। তুমি কেমন আছ?

ত–নাহ, সুনীলদা, ভালো নেই। আমাকে কোথাও বেরোতে দিচ্ছে না।

সু–হুম।

ত–ঘর থেকে বেরোতে চাইলেই বলছে, না সম্ভব নয়। এভাবে ঘরে বসে থাকাটা ভালো লাগে? আপনি নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন, কী রকম দমবন্ধ লাগছে আমার।

সু–শোনো, তোমাকে যে জরুরি কারণে ফোন করেছি, তা হল, পুলিশের কাছে খবর আছে, এখানে কিছু অবাঙালি মুসলমান তোমাকে মেরে ফেলার জন্য তৈরি হয়ে আছে। এখন, সবচেয়ে ভালো, তুমি যদি বিদেশে কোথাও চলে যাও।

ত–আমি জানি। প্রসূনবাবু আমাকে বলেছেন। তিনিও বলেছেন বিদেশে চলে যাই যেন। কিন্তু সুনীলদা, পৃথিবীর সব জায়গায় মুসলিম মৌলবাদী আছে। ইওরোপে, আমেরিকায়, কোথায় মৌলবাদী নেই? জীবনের ঝুঁকি পৃথিবীর সব জায়গায় আছে। আর আমি এ দেশ ছেড়ে যাবো কোথায়? বাংলাদেশে যদি যাওয়া সম্ভব হত, আজই চলে যেতাম। এত অপমান সয়ে এ দেশে থাকতাম না। আর, সত্যি কথা বলতে কী, আমার যাওয়ার কোনও জায়গা নেই সুনীলদা। ইওরোপের পাট চুকিয়ে এদেশে এসেছি, কলকাতায় থাকবো বলে। ইওরোপ আমেরিকায় আমি তো থেকেছি। ওসব দেশে থাকার কোনও ইচ্ছে আমার নেই। আর, এই কলকাতায় যদি আমাকে মেরে ফেলে কেউ, মেরে ফেলুক। আমি কলকাতা ছেড়ে কোথাও যাবো না।

সু–আমার মনে হয় তুমি আরও ভেবে দেখো।

ত–আমি ভেবে দেখেছি সুনীল’দা। আমার কোথাও যাওয়ার নেই। মরলে এ শহরেই মরবো।

সু–আচ্ছা। কী আর বলবো তবে। রাখছি।

ত–ঠিক আছে। আপনি ভালো থাকবেন।

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ফোন আমাকে ভেতরে কাঁপায়। মুখ্যমন্ত্রী প্রসূন মুখোপাধ্যায়, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় সবাইকে দিয়ে আমাকে বলাচ্ছেন কলকাতা ছাড়ার জন্য!

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ফোনের বেশ কিছুদিন পরে এলো আরও একজন বড় লেখকের ফোন। বুদ্ধদেব গুহ। বললেন, ঐ একই কথা, চলে যাও। কী দরকার কলকাতায় থেকে? কী আছে এখানে। তিনি সরাসরিই বললেন, বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের সাথে কথা হয়েছে। তিনি চাইছেন আমি কলকাতা ছেড়ে অন্য কোথাও চলে যাই।

এর ক’দিন পর বাড়িওয়ালার বউ ফোন করলেন। বাড়িওয়ালা ডাক্তার দেবল সেন। কিন্তু যোগাযোগ আমার সঙ্গে রাখেন শর্মিলা সেন, দেবল সেন এর স্ত্রী। তিনি সবসময়ই খুব আন্তরিক। বাড়ি ভাড়া আঠারো হাজার ছিল, কিন্তু দু’মাস পর ওটাকে কুড়ি হাজার করেছিলেন, বলেই নিয়েছিলেন, কুড়ি হাজারের নিচে ও বাড়ি ভাড়া হয় না। আমি একফোঁটা আপত্তি করিনি। এদিকে আবার মেইনটেইনেন্স খরচ দিতে হয় আড়াই হাজারের মতো। সব মিলিয়ে সাড়ে বাইশ হাজারে চমৎকার চলছিলাম। যদিও বাড়িতে থাকার পর থেকে অন্য ভাড়াটেরা যা পায়, তা থেকে আমি বঞ্চিতই হয়েছি। ইন্টারকম ক’দিন কাজ করে আর করেনি। অভিযোগ করার পরও কেউ ও যন্ত্রটা সারাতেও আসেনি। বাড়িওয়ালার কিছু ছারপোকা-ওয়ালা চেয়ার টেবিল আমাকে পুষতে হয়েছে। আর পুজোর ঘর বলে একটা ঘর আছে, ও ঘরটায় বাড়িওয়ালার কাগজপত্র ঠাসা বাক্সও পুষেছি। না, ও নিয়েও আমি কখনও আপত্তি করিনি। শর্মিলা সেন বলেছিলেন, তাঁর বাড়িতে জায়গা। নেই বলে এখানেই রেখেছেন। বাড়িটিতে ঢোকার পর অবশ্য বাড়িটিকে বাসযোগ্য করার জন্য পকেটের টাকা খরচ করে বাড়ির ভাঙা অকেজোনানাকিছু সারাতে হয়েছে। এ নিয়েও অভিযোগ করিনি। দেবল সেন খুব বড় কার্ডিওলোজিস্ট, কিন্তু বড় একজন ফটোগ্রাফারও। একদিন তার ফটোগ্রাফির বই দিয়ে গেলেন। বন্য জন্তুর ফটো তোলা তার শখ। তবে একে ঠিক শখের ফটোগ্রাফি বলা যায় না, রীতিমত পাকা হাতের কাজ। সেই ভদ্র বিনীত দেবল সেন এর কণ্ঠস্বরও বছর তিন পর পাল্টে যেতে দেখলাম। তাঁর বাড়িতে আমি ভাড়া থাকি, এ কথাটা কাগজে লিখে দিতে হয়, ছ’ মাস পর পর যখন আমার রেসিডেন্স পারমিটের মেয়াদ বাড়ানোর সময় আসে। অ্যাড্রেস প্রুফ বলে একটা ব্যাপার আছে, আমি কোথায় থাকি, কোন ঠিকানায়, তা আমার কাছে যখন কোনও প্রমাণ নেই, বাড়ির ইলেকট্রিসিটি বিল যেহেতু দেবল সেন এর নামেই আসে, তাকেই সই করে দিতে হয় কাগজে যে হ্যাঁ ও বাড়িতে আমি থাকি। ওটাই প্রমাণ করে আমি রাস্তাঘাটের ঠিকানাহীন সন্ত্রাসী নই, আমার একটা ঠিকানা আছে। তবে এ বার তিনি কাগজ দেখে আকাশ থেকে পড়লেন, এ কীসের কাগজ তিনি চিনতে পারলেন না, এবং সই করলেন না। এদিকে শর্মিলা সেনও, যিনি আমার বাড়িতে এসে বাড়ি এত সুন্দর সাজানো, এত যত্ন করে রাখা, এত চমৎকার লাগছে –বলে প্রশংসা করে যেতেন, একদিন ফোন করে বলেন, এ বাড়ি আমাকে ছেড়ে দিতে হবে। অদ্ভুত শোনায় তাঁর এবারের কণ্ঠস্বর।

শ–আমার বাড়িটা কিন্তু আপনাকে ছাড়তে হবে। ত–মানে? বাড়ি ছাড়ার প্রশ্ন উঠছে কেন?

শ–আসলে কী জানেন, খুব বেশি ভাড়া দেবে, এমন একজনকে পেয়েছি। তাঁকে কথাও দিয়েছি। এখন সামনের মাসেই সেই ভাড়াটেকে দিতে হবে বাড়ি।

ত–এরকম বললে তো হয় না। আমার তো কোনও একটা অ্যাপার্টমেন্ট পেতে হবে আগে। তা না হলে কোথায় যাবো!

শ–আপনি যদি এ মাসের মধ্যেই বাড়িটা ছেড়ে দেন, ভালো হয়। আপনার অনেক বন্ধু আছে। তাদের খুঁজতে বলুন বাড়ি।

ত–ঠিক আছে, আমি বাড়ি খুঁজতে থাকি। পেলে আমি নিশ্চয়ই চলে যাবো।

শ–বুঝলেন তো, যে কম ভাড়ায় আপনি থাকছেন, এরকম ফ্ল্যাটে এত কম ভাড়ায় কেউ থাকে না।

ত–কত টাকা ভাড়া চাইছেন? যদি আমি দিই তত টাকা, তাহলে তো নিশ্চয়ই আমাকে বাড়ি ছাড়তে বলবেন না।

শ–এ বাড়ির ভাড়া পঞ্চাশ হাজার টাকা। তবে আপনার জন্য পঁয়তাল্লিশে রাজি হতে পারি।

চমকে উঠি। এত টাকা ভাড়া হয় নাকি! কুড়ি হাজার থেকে লাফিয়ে পঁয়তাল্লিশ হাজার! কখনও শুনিনি এমন।

ত–ভাড়া, যতদূর জানি, এক দু’হাজার করে বাড়ানো হয়। এভাবে দ্বিগুণের বেশি কেউ কি বাড়ায়?

শ–আমাকে বাড়াতে হবে। আর কোনও উপায় নেই আমার। একজন যখন অত টাকায় ভাড়া নেবে বলেছে, তখন তো বসে থাকতে পারি না। কালই দেখতে আসবে বাড়ি।

ত–তা দেখুন। কিন্তু আমাকে আপনার সময় দিতে হবে, যতক্ষণ না আমি কোনও জায়গা পাচ্ছি।

শ–খুব হারি। ঠিক আছে?

এর কিছুদিন পর আবারও শর্মিলার ফোন। ওই একই কথা। বাড়ি ছাড়ুন। আবারও ফোন। প্রায়ই ফোন। প্রায় প্রতিদিন ফোন। বাড়ি ছাড়ুন। বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য কি বাড়িওয়ালাকেও বলেছেন আমাকে বাড়ি থেকে তাড়াতে? কে যেন বলেছিল, দেবল সেন সরকারের খুব ঘনিষ্ঠ লোক।

বিনীত গোয়েল এক সময় খুব সমীহ করে কথা বলতেন। এখন ফোন করেন, তবে কণ্ঠস্বর বিনীত নয়, ভাষাও ভিন্ন, স্বর এবং সুর দুই-ই পাল্টে গেছে।

বি–আপনাকে কোথাও তো চলে যেতে হবে।

ত–মানে?

বি–শহরের অবস্থা খুব খারাপ। কিছুদিন বাইরে কোথাও থেকে আসুন।

ত–শহর তো ঠিক আগের মতোই। কিছুই তো দেখছি না অন্যরকম।

বি–বড় মিছিল বেরোবে আপনার বিরুদ্ধে।

ত–সেকারণে শহর ছাড়তে হবে কেন? অনেকের বিরুদ্ধে তোমিছিল বেরোয়, তারা কি তাই বলে শহর ছেড়ে চলে যায়?

বি–দেখুন, আপনার ভালোর জন্য বলছি। আপনি কি চান না আপনাকে আমরা নিরাপত্তা দিই? চারদিকে গণ্ডগোল শুরু হলে আমরা কিন্তু আপনাকে নিরাপত্তা দিতে পারবোনা। নিরাপত্তা ছাড়া শহরে কী করে থাকবেন।

.

অন্ধকার আমাকে গ্রাস করতে থাকে।
 
০৫. জানালার ওপারেই দাঁড়িয়ে আছে মৃত্যু


আমার চারদিকে মৃত্যু। আমি মরবো, আজনয়তোকাল। এই আতংক পুলিশের বড়কর্তারা আমার ভেতরে ঠেলে ধাক্কিয়ে ঢোকাতে চেয়েছেন। তাঁরা আমাকে সারাক্ষণের একটা সঙ্গী দিয়ে গেছেন বেঁচে থাকার। সঙ্গীর নাম মৃত্যু। আমার রক্তে ইনজেক্ট করে দিয়ে গেছেন মৃত্ম। আমার মস্তিষ্কের কোষের ভেতর সন্তর্পণে একটি দৃশ্য ঢুকিয়ে দিয়ে গেছেন, পাঁচ হাজার মুসলমান ঢুকে গেছে বাড়িতে, আমাকে গুলি করে মারছে, গুলি করছে সারা শরীরে। বড় বড় ছুরি বের করে মাথা কেটে নিচ্ছে, হাত পা কেটে নিচ্ছে। টুকরো টুকরো করছে আমাকে। করছে, আর উল্লাস করছে। এই দৃশ্যটি আমি সারাদিন দেখি, সারারাত দেখি। জানালায় চোখ রাখলে এখন আর আকাশ দেখি না, আমার মৃতমুখ দেখি। বারান্দায় হাসনুহানা গাছের কাছে এসে দাঁড়ালে আমি রক্তে ভেসে যাওয়া গাছ দেখি। চারদিকে কিছু আর সবুজ নয়, সব লাল। ঘোরের মধ্যে, গৃহবন্দি আমি, লিখতে থাকি মৃত্যুর কথা।

মৃত্যু


ঠিক জানালার ওপারেই দাঁড়িয়ে আছে মৃত্যু।
দরজা খুললেই চোখের দিকে কোনওরকম
সংকোচ না করে তাকাবে,
বসলে পাশের চেয়ারটায় এসে বসবে,
বলা যায় না হাতও রাখতে পারে হাতে,
তারপরই কি আমাকে হেঁচকা টান দিয়ে নিয়ে যাবে যেখানে নেওয়ার!
কোথাও বসতে, শুতে, দাঁড়াতে গেলেই আমার মনে হতে থাকে
মৃত্যু আড়াল থেকে আমাকে দেখে দেখে হাসছে।
স্নানঘরে জলের শব্দের মধ্যে মৃত্যুর শব্দ বাজতে থাকে,
চুপচাপ বিকেলে কানের কাছে মৃত্যু এসে তার নাম ঠিকানা জানিয়ে যায়,
গভীর রাতেও মৃত্যুর স্তব্ধতার শব্দে বারবার ঘুম ভেঙে যায়।

যেই না ঘর থেকে বার হই, পায়ে পায়ে মৃত্যু হাঁটে
যেখানেই যাই, যে রস্তি বা প্রাসাদে, মৃত্যু যায়,
ঘাড় যেদিকেই ঘোরাই, সে ঘোরায়,
আকাশ দেখি, সেও দেখে,
ভিড়ের বাজারে গায়ে সেঁটে থাকে,
শ্বাস নিই, মৃত্যু দ্রুত ঢুকে পড়ে ফুসফুসে
এত মৃত্যু নিয়ে কি বাঁচা যায়, কেউ বাঁচে?
মৃত্যু থেকে বাঁচতে আমাকে মৃত্যুরই আশ্রয় নিতে হবে,
এ ছাড়া উপায় কী?

.



আরও ক’দিন বাঁচতে দাও, কমাস দাও,
আরও ক’বছর দাও সোনা,
আর বছর দুয়েক, হাতের কাজগুলো সারা হলে আর না বলবো না।

যদি বছর পাঁচেক দাও, খুব ভালো হয়।
দেবে তো? কী এমন ক্ষতি তোমার করেছি,
মৃত্যুর বিরুদ্ধে কোনও শব্দ উচ্চারণ করিনি,
একটি অক্ষরও কোথাও লিখিনি কোনওদিন!
বছর পাঁচেকে কতটুকু আর পারবো জমে থাকা কাজের পাহাড় নামাতে!
সাত আট বছর পেলে হয়তো চলে
চলে বলবো না, চালিয়ে নেব। চালিয়ে তো নিতেই হয় কাউকে না কাউকে।
দশ হলে মোটামুটি হয়। দশ কি আর দেবে তুমি সোনা?
তোমারও তো জীবন আছে, তুমি আর কতদিন বসে বসে প্রহর গুনবে!
প্রহর যদি গোনোই কিছুটা, যদি রাজি হও,
তবে শেষ কথা বলি, শোনো, দশ যদি মানো, তবে
দু’বছর কী আর এমন বছর, দিলে বারো বছরই দিও,
জানি দেখতে না দেখতে ওটুকুও ফুরিয়ে যাবে।
জানি না কী! বছর বারো আগেই তো তার সাথে দেখা হল,
এখনও মনে হয় এই সেদিন, এখনও যেন চোখের পাতা ফেলিনি,
এখনও তাকিয়ে আছি, বারো বছর কী রকম মুহূর্তে কেটে যায়, দেখেছো?
ও মরণ, ও জাদু, ভালোবেসে পনেরো কুড়িও তো দিতে পারো,
ও-ও দেখতে না দেখতে কেটে যাবে দেখো।
বছর পেরোতে কি আর বছর লাগে?

আমাকে চারদিক থেকে ঘিরে ধরেছো,
কী থেকে কী হয় কে জানে!
স্বাধীনতা থাকলে কী আর ভিক্ষে করতাম দিন!
যত খুশি যাপন করা যেত।
এখন চাইলেই কেউ তো আর বাঁচতে দিতে রাজি নয়।
তুমিও ছড়ি উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে থাকো গায়ের ওপর,
এখন কিছুই আর আগের দিনের মতো নেই। তুমিও তো বাঁচতে চাও,
মরণও বাঁচতে চায়।

আর আমি? এখন এক একটি দিন বাঁচি তুমি যদি করুণা কর,
এক একটি মাস বছর বাঁচি, যদি বাঁচাও।
জীবনের কাছে নয়, ঋণী যদি থাকি কারও কাছে, সে তোমার কাছে,
তোমার অনুগ্রহের কাছে।
ক্ষমাঘেন্না করে আরও কটা বছর বাঁচাও সোনা।
মৃত্যুর বিপক্ষে মনের খায়েশ মিটিয়ে দু’কলম লিখে তবে মরি।

.



রামদা বল্লম নিয়ে নেমেছে ওরা,
তলোয়ার নিয়ে,
বিষাক্তসাপ নিয়ে
মাথায় ধর্মমন্ত্র
বুকে ঘৃণা,
কোমরে মারণাস্ত্র
আমাকে হত্যা করে ধর্ম বাচাবে।

কম নয়, হাজার বছর মানুষ হত্যা করে
ধর্মকে বাঁচিয়েছে মানুষ।
মানুষের রক্তে স্নান করে দেশে দেশে
এককালে ধর্ম ছড়িয়েছিল মানুষই,
মানবতার চেয়ে ধর্মকে চিরকালই মহান করেছে মানুষই।

ধর্মের পুঁথি মানুষই লিখেছে,
নিঃসাড় পুঁথিকে মানুষখেকো বানিয়েছে মানুষই।
ধর্মের হাত পা বাঁধা, মুখে সেলাই।
ছাড়া পেলে ধর্মও চেঁচিয়ে বলতো, পাষন্ডরা মর।
প্রাণ থাকলে লজ্জায় আত্মহত্যা করতো ধর্ম,
করতো দুহাজার বছর আগেই,
করতো মানুষের জন্য, মানুষের মঙ্গলের জন্য।

.



ওপারে কেউ নেই কিছু নেই, ফাঁকা,
আসলে ওপার বলে কিছু নেই কোথাও।
মৃত্যু আমাকে কোনও পারে নিয়ে যাবে না, কোনও বিচার সভায় না,
কোনও দরজার কাছে এনে দাঁড় করাবে না, যে দরজা পেরোলেই
হয় পুঁজ,রক্ত আর আগুন, নয় ঝরনার জল, না-ফুরোনো আমোদ প্রমোদ।

বিশ্বব্রহ্মা থেকে আমার বিদেয় হয়ে গেলে
শরীর পড়ে থাকবে কিছুদিন শব ব্যবচ্ছেদ কক্ষে কাঁটা ছেঁড়া হতে,
হয়ে গেলে হাড়গোড় সের দরে কারও কাছে বেচে দেবে কেউ
ওসবও একদিন গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে ঝরে পড়বে, ধুলো হবে,
ধুলোও নিশ্চিহ্ন হবে কোনও এক গোধূলিতে।

যাদের ওপারে বিশ্বাস, না হয় তারাই যাক, মৃত্যুকে চুম্বন করে
রত্নখচিত দরজায় কড়া নাড়ুক,
ভেতরে অপেক্ষা করছে অগাধ জৌলুস, অপেক্ষা করছে মদ মেয়েমানুষ।
আমাকে থাকতে দিক পৃথিবীতে, থাকতে দিক অরণ্যে, পর্বতে, উতল সমুদ্রে, আমাকে ঘুমোতে দিক ঘাসে, ঘাসফুলে, আমাকে জাগতে দিক পাখিদের গানে কোলাহলে, সর্বাঙ্গে মাখতে দিক সূর্যের কিরণ, হাসতে দিক, ভরা জ্যোৎস্নায় ভালোবাসতে দিক, মানুষের ভিড়ে রোদে বৃষ্টিতে ভিজে হাঁটতে দিক, বাঁচতে দিক।

যাদের ওপার নিয়ে সুখ, তারা সুখে থাক,
পৃথিবীতে আমাকে যদি দুঃখ পোহাতে হয় তোক,
পৃথিবীই আমার এপার, পৃথিবীই ওপার।

.



জীবন জীবন করে পাগল যে হই,
দরজায় দাঁড়িয়ে আছে বলেই তো সে,
তিনবেলা চোখাচোখি হয়, প্রেমিকের মতো মুচকি হাসেও,
জানি খুব ভালোবাসে সে আমাকে, জানি খুব কাছে পেতে চায়।

ওভাবে সে চুমু খেতে না চাইলে অত করে ভালোবাসতে চাইতাম বুঝি!
ওভাবে দাঁড়িয়ে না থাকলে আঁকড়ে ধরতাম বুঝি
অত শক্ত করে পায়ের আঙুলে মাটি?
ঠেকিয়ে রাখতাম পিঠ দেয়ালে? খামচে ধরতাম হাতের কাছে যা পাই?

ওভাবে আমাকে নাগাল পেতে বাড়িয়ে না দিলে হাত,
পাড়াপড়শি গ্রাম শহর নগর বন্দর জাগিয়ে উত্তরে দক্ষিণে
ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড়োতাম না জীবনের খোঁজে।
ওভাবে যদি না দাঁড়িয়ে থাকতো মৃত্যু দরজায়,
একবারও চাইতাম না তাকে ঠেলে সরাতে,
পালাতে চাইতাম না কোথাও, বরং চরাচর খুঁজে তাকেই বাড়ি নিয়ে এসে বসতে দিতাম।
 
০৬. নির্বাসিত বাহিরে অন্তরে


কী এক ঘোরের মধ্যে আমি নিজের সঙ্গে কথা বলতে থাকি। বলতে থাকি—

আমার জন্ম ভারতবর্ষে নয়। অথচ দেখতে শুনতে রুচিতে সংস্কৃতিতে আমি সামান্যও অভারতীয় নই। কিছু বছর এগিয়ে জন্মালেই আমি ভারতীয় হতে পারতাম। আমার বাবা জন্মেছিলো ভারতভাগের আগে। এই ভারতের ইতিহাস আমার বাবাকে তিনটে দেশের নাগরিক করেছে। আমাকে করেছে দুটো দেশের।

পূর্ববাংলার গ্রামে হারাধন সরকার নামে এক হিন্দু কৃষক ছিল। হারাধন সরকারের একটি ছেলে জানি না কী কারণে মুসলমান হয়ে গিয়েছিল, হয়তো সে ছেলের নাম ছিল যতীন্দ্র, হয়েছে জমির, অথবা কমল থেকে কামাল। সেই সরকার বংশের মেয়ে আমি। হারাধন সরকার আমার ছ’ পুরুষ আগের পূর্ব পুরুষ, তার অন্য সন্তানদের বংশধরেরা নিশ্চয়ই ভারতে চলে এসেছে দেশভাগের পর। তারা এখন ভারতের নাগরিক। আমার ঠাকুরদা জমির সরকার অথবা কামাল সরকার দেশ ত্যাগ করেননি কারণ তার নামটা ছিল মুসলমান নাম।

যখন ছোট, শুনেছিলাম, মুসলমানের একতা একটা অসম্ভব ঘটনা, মুসলমানে মুসলমানে যুদ্ধ হয়েছে, পূর্ব পাকিস্তানের মুসলমান পশ্চিম পাকিস্তানের মুসলমানের সঙ্গে যুদ্ধ করেছে বাঙালি জাতীয়তাবাদ আর ধর্মনিরপেক্ষতার জন্য। যদিও আমি ভারতভাগের পরে জন্মেছি, অবিভক্ত ভারতের জন্য শৈশব থেকেই আমার একটা আকর্ষণ ছিল। অল্প বয়সে অনেক গদ্য পদ্য লিখেছি অবিভক্ত বাংলা নিয়ে, অবিভক্ত ভারত নিয়ে। এসব লিখেছি আমার প্রথম ভারত ভ্রমণের অনেক আগেই। একই ভাষার এবং একই সংস্কৃতির মানুষের মাঝখানে, বন্ধু এবং আত্মীয়দের মাঝখানে কোনও কাঁটাতার আমি মানি না, আমি বিশ্বাস করি না। ছোটবেলা থেকেই বাংলা সাহিত্যের পাঠক আমি, দুই বাংলার গল্প, উপন্যাস, কবিতা প্রবন্ধ গোগ্রাসে পড়তে পড়তে বড় হয়েছি। খুব অবচেতনেই আমি বাঙালি লেখকদের সঙ্গে আত্মীয়তা অনুভব করেছি। লেখকতালিকার বেশির ভাগ লেখকেরই বাস পশ্চিমবঙ্গে।

শৈশব থেকেই আমি ধর্মমুক্ত। আমার সচেতন মন আমাকে মানববাদ আর নারীবাদে বিশ্বাসী করিয়েছে। আমার বাবা ছিলেন ধর্মমুক্ত মানুষ, সম্ভবত অবচেতনে তার দ্বারাই আমি প্রভাবিত। আমার বেড়ে ওঠা এভাবেই হয়েছে: নারীবিরোধী সংস্কার, ঐতিহ্য, রীতিনীতি ইত্যাদিকে ভাঙতে ভাঙতে। যখন ১৯৮৯ সালে আমি প্রথম ভারত ভ্রমণ করি, একবারের জন্যও অনুভব করিনি পশ্চিমবঙ্গ এবং ভারতের অন্যান্য রাজ্য বা অঞ্চল কোনও ভিন্ন দেশ। যেদিন প্রথম আমি পা দিই ভারতে, সেদিন থেকে এখন অবধি আমি বিশ্বাস করি আমি অখণ্ড ভারতের মেয়ে, ভারত থেকে আমি বাংলাদেশকে সত্যি বলতে কী, আলাদা করতে পারি না। আমার সেই হিন্দু পূর্বপুরুষের জন্য নয়, ভারতের অনেক সংস্কৃতির একটি সংস্কৃতি আমার বলে নয়, বা এর একটি ভাষায় আমি কথা বলি বলে নয় আমি দেখতে ভারতীয় বলে নয়, ভারতীয় সত্তা আমার ভেতর গভীরভাবে প্রোথিত বলে। এই সত্তা আমার ভেতর প্রোথিত করেছে ভারতের ইতিহাস। আমি ইতিহাসের শিকার একজন, অথবা ইতিহাস দ্বারা আমি সমৃদ্ধ, যতটুকুই সমৃদ্ধ। এর দারিদ্র, উপনিবেশিকতা, এর ধর্ম, এর ধর্মান্ধতা, এর হিংসে, হিন্দু মুসলমান, রক্তপাত, দেশভাগ, মাইগ্রেশন, একজোড়াস, এর দ্বিজাতিতত্ত্ব, বা টু নেশন থিউরি, এর অগণতন্ত্র, এর জাতপাত, রায়ট, যুদ্ধের শিকার আমি। এসব আমাকে ভারতীয় করেছে, যতটাই করেছে। এসবের ওপর বাংলাদেশ নামের এক মৌলবাদ, সন্ত্রাস, স্বৈরতন্ত্র, দুর্নীতি, দারিদ্র, দুর্ভিক্ষ পীড়িত দেশ আমাকে আরও বেশি অভিজ্ঞ করেছে।

মুসলিম মৌলবাদীদের অন্ধতা, অশিক্ষা, আর অসহিষ্ণুতা ভারতের ইতিহাসের একটি টুকরো বাংলাদেশ থেকে আমাকে নির্বাসন দিল। দেশের দরজা চিরকালের জন্য বন্ধ হল। আমি সেই তখন থেকেই ভারতের দরজায় কড়া নাড়ছি। যেদিন দরজা খোলা হল, আর আমি নির্বিঘ্নে ঢুকে গেলাম, মনে হয়নি কোনো বিদেশে ঢুকেছি। কেন মনে হয়নি? কেন আজ এশিয়ার অন্য দেশগুলোকে, ইউরোপ আর আমেরিকার দেশগুলোকে বিদেশ বলে মনে হয় আমার, কিন্তু ভারতবর্ষকে নয়। ইউরোপে বারো বছর কাটিয়েও ইউরোপকে নিজের দেশ বলে মনে করতে পারিনি। ভারতবর্ষে একটি বছরও কাটাতে হয়নি একে নিজের দেশ বলে মনে করার জন্য। একই ইতিহাস বহন করি বলেই তো! আজ যদি আদি ভারতের একটি টুকরোর, পূর্ববাংলার বা নতুন নাম ধারন করা বাংলাদেশের মানুষের (ভারতবর্ষের মাটিতে ইসলাম প্রচারকদের আসার কারণে ধর্মান্তরিত হওয়া মানুষের) ধর্মান্ধতা রাজনৈতিক নেতাদের ধর্মভীরুতা এবং দুরভিসন্ধির কারণে এমনই তুঙ্গে ওঠে যে গণতন্ত্র, বাক স্বাধীনতা এবং মুক্তচিন্তাকে সবলে অস্বীকার করে এবং মানবাধিকার, মানবতার পক্ষের আপাদমস্তক সেকুলার লেখিকাকে ফাঁসি দেওয়ার জন্য উন্মাদ হয়ে ওঠে, তবে সেই লেখিকাকে বাঁচাবার দায় কি সুদূর ইউরোপের নাকি আমেরিকার নাকি সেকুলার ভারতের?

আমার ওই দুঃসময়ে ভারতের দরজা ছিল বন্ধ। ইউরোপ নিয়েছিল আমাকে লুফে। সেই ইউরোপের সমাজে সবসময় নিজেকে মনে হয়েছে বহিরাগত। ইউরোপ ছেড়ে ভারতে এসেছি, ভারতে আসার পর মনে হয়েছে, বারো বছরের দীর্ঘ মৃত্যুময় নিস্তব্ধতা যেন শেষ হল। এই সমাজ যেহেতু আমার চেনা সমাজ, আমি যেহেতু এরকম সমাজেই বড় হয়েছি, তাই এত শান্তি স্বস্তি আর ভালো লাগা। সেই আগের মতো লেখালেখি নতুন উদ্যমে চালিয়ে যাচ্ছি। এই সমাজের জন্য ভালও কিছু করার সংকল্প আমার। মেয়েরা যেন নিজেদের শিক্ষা এবং স্বনির্ভরতা অর্জন করার জন্য সচেতন হয়, নিজেদের স্বাধীনতা এবং অধিকারের জন্য সংগ্রাম করার সাহস অর্জন করে। চিরকালের নতমুখ, নির্যাতিত, নিষ্পেষিত নারী ভয় কাটিয়ে সেই আত্মবিশ্বাসটাই, সেই সাহসটাই, সেই শক্তিটাই যেন আমার লেখা থেকে পায়।

এর চেয়ে বড় দুঃখ আর কী আছে যে বাংলাদেশে যে অবস্থা আমার হয়েছিল, প্রায় একই অবস্থা হতে যাচ্ছে এই প্রগতিশীল ভারতে, ততোধিক প্রগতিশীল পশ্চিমবঙ্গে। আমাকে গৃহবন্দি জীবন কাটাতে হচ্ছে। কোনও ‘পাবলিক প্লেস’-ই নাকি আমার জন্য আর নিরাপদ নয়। শুধু তাই নয়, কোনো বন্ধুর বাড়িও নিরাপদ নয়, আমি শুধু অন্ধকার ঘরে বন্দি জীবন কাটাবো। যারা প্রকাশ্যে খুনের হুমকি দিচ্ছে, তাদের জন্য এ রাজ্যের প্রতিটি ইঞ্চি নিরাপদ। যা ইচ্ছে তাই করার অধিকার তারা রাখে। রাস্তা অবরোধ করে মানুষকে ভোগাবার, ধর্মের নামে যাকে ইচ্ছে তাকে সর্বনাশ করার সব অধিকারই তাদের অলিখিত ভাবে দেওয়া হয়েছে। ওইসব সন্ত্রাসীদের সবরকম স্বাধীনতা আছে সন্ত্রাস করে যাওয়ার। আর যারা সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে, সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে, অসত্য আর অন্যায়ের বিরুদ্ধে কথা বলছে, তাদের মুখ বন্ধ করার ব্যবস্থা হচ্ছে। আমাকে মুহুর্মুহু উপদেশ দেওয়া হচ্ছে মৌলবাদীদের মিছিল মিটিং হবে, অতএব আমি যেন ঘর বাড়ি ছেড়ে, শহর ছেড়ে কোথাও চলে যাই। হাঁ, পরিস্থিতি শান্ত হলে ফিরে এসো। পরিস্থিতি কি কোনোদিন শান্ত হয়? বাংলাদেশ থেকেও একই কথা বলে আমাকে বের করা হয়েছিল। আজ তেরো বছর পরও পরিস্থিতি শান্ত হয়নি। আর এ কথাও আমার মনে হয়েছে, মৌলবাদীদের ভয়ে আমি যদি দূরে চলে যাই, তবে এ তাদের জন্য বিশাল এক বিজয় হবে। মুক্তচিন্তা, বাক স্বাধীনতা, গণতন্ত্র, ও সেকুলারিজম ধর্মমুক্ত পদ্ধতির বিপক্ষে বিরাট এক বিজয়। এই বিজয়টিই তাদের কিছুতেই দেওয়া উচিত নয়। যদি তারা জয়ী হয়, তাতে আমার যত ক্ষতি, তার চেয়ে বেশি ক্ষতি ভারতবর্ষের। আমাকে দেশছাড়া করিয়ে তাদের দাবি যদি পুরণ করা হয়, তবে তাদের দাবির অন্ত থাকবে না। একটার পর একটা দাবি তারা করতেই থাকবে, গণতন্ত্র বিরোধী আস্ফালন করতে দ্বিগুণ উৎসাহী হয়ে উঠবে। একে তাড়াও, ওকে বন্দি করো, তার বই নিষিদ্ধ করো, একে মারো, তাকে পোড়াও চলতেই থাকবে। আর বশংবদ ধর্মনিরপেক্ষগণ ধর্মীয় মৌলবাদীদের সব আদেশ নিষেধ মাথা পেতে বরণ করে নেবে। মৌলবাদীদের দাবির কাছে নতি স্বীকার করলে মৌলবাদীরা কখনও তুষ্ট হয়, তারা আরও ভয়ংকর গণতন্ত্রবিরোধী দাবি নিয়ে আরও ভয়ংকর রূপে উপস্থিত হয়।

আমার দুঃস্বপ্নের মধ্যে কখনও এমন ছিল না যে ভারতেও আমাকে বাংলাদেশের মতো ভুগতে হবে। এক দেশে মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ, আরেক দেশে সংখ্যালঘু, কিন্তু দাপট প্রায় একই। ধর্মান্ধতা, অসহিষ্ণুতা, মেরে ফেলা, কেটে ফেলা, মুণ্ডু চাওয়া, প্রগতি, বিজ্ঞান ইত্যদিকে বাজে কাগজের মতো উড়িয়ে দেওয়া সব এক। আমাকে মেরে তাদের লাভ কী হবে, মাঝে মাঝে জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে করে। মৌলবাদী নেতারা ভালো করে জানে যে এতে তাদের লাভ থাকলেও থাকতে পারে, ইসলামের কোনও লাভ নেই। ইসলাম যেমন আছে, তেমনই থাকবে। ইসলামকে স্পর্শ করার সাধ্য আমার কেন, কোনও প্রাণীরই নেই। ধর্ম ধর্মের মতো থাকে, মানুষ ধর্ম আঁকড়ে ধরে নয়তা ধর্ম থেকে দূরে সরে। মৌলবাদের চেহারা পৃথিবীর সব দেশে এক। তাদের ভাষা এক, তাদের ক্রুরতা এক, চরিত্র এক, তাদের স্বপ্ন এক। সমাজকে কয়েক হাজার বছর পেছনে ঠেলে দেওয়ার আরামটা পেতে চায়, ও থেকে বঞ্চিত হওয়ার আদৌ কোনোও ইচ্ছে নেই কারও।

ধীরে ধীরে ছোট হয়ে আসছে আমার পৃথিবী। শহর জুড়ে যেমন ইচ্ছে ঘুরে বেড়ানোর মানুষ আমি। এখন আমার হাতে পায়ে শেকল। সব বলে ফেলার মানুষ আমি, এখন আমার জিভে সেলাই। বাইরে নৃশংসতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ মিছিল, আমি অংশ নিতে পারছি না। বাইরে চলচ্চিত্রের, নাটকের, গানের উৎসব, আমি উপভোগ করতে পারছি না। আমাকে একটি দরজা জানালা সাঁটা ঘরে দমবন্ধ অবস্থায় বসে থাকতে হবে। না, একে আমি আমার নিয়তি মানছি না। আমি এখনও বিশ্বাস করছি, আমি স্বাভাবিক জীবন যাপন করতে পারবো। এখনও বিশ্বাস করছি, ভারত আমাকে সেই শাস্তি দেবে না, যে শাস্তি মৌলবাদ অধ্যুষিত বাংলাদেশ দিয়েছে। এখনও বিশ্বাস করছি, এ দেশই আমাকে নিরাপত্তা দেবে। মানুষের ভালোবাসাই আমার নিরাপত্তা হবে। আমি এ দেশেই বাকি জীবন নিশ্চিন্তে নির্বিঘ্নে কাটাতে পারবো। এই দেশকে আমি ভালোবাসি। এই মাটিকে আমি নিজের মাটি বলে ভাবি। এই দেশও যদি আমাকে ছুঁড়ে ফেলে দেয়, তবে আমার শেষ ভরসা, শেষ অবলম্বন, আমার শেষ স্বপ্নকে ঠাণ্ডা মাথায় খুন করা ছাড়া আর কিছু নয়।

আমার তো যাওয়ার কোনো জায়গা নেই। কোনো দেশ নেই, কোনো ঘর নেই, এক ভারতবর্ষই দেশ আমার। এখানেই আমার ঘর। সত্য বলার অপরাধে আমাকে আর কত শাস্তি দেবে ধর্মবাদীরা আর ধর্ম ব্যবহার করে ভোট পেতে চাওয়া রাজনীতিকরা? এই যে এত ভোগান্তি, এত লাথি, এত গুঁতো, এত ঘাড় ধাক্কা। এত কিছুর পরও আমার স্বপ্ন আমি সম্পূর্ণ ত্যাগ করতে পারি না। এখনও স্বপ্ন দেখি যে উপমহাদেশের একজন সৎ, সত্যবাদী, সেকুলার লেখকের জন্য ভারতবর্ষই দেশ, সবচেয়ে নিরাপদ দেশ।
 
০৭. ফেয়ারওয়েল, ২২ নভেম্বর, ২০০৭



গতকাল সকালে ছোট একটা মিছিল বেরিয়েছিল পার্কসার্কাসে। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের ‘নন্দীগ্রাম তাণ্ডব’, ‘রিজওয়ান হত্যা’, আর ‘তসলিমা হঠাও’ নিয়ে কিছু একটা হবে। গোটা পঞ্চাশেক মৌলবী রাস্তায় ঘোরাঘুরি করছিল। এরা কেউই আন্দোলনের মতলব নিয়ে এসেছে বলে মনে হয়নি। বাড়িতে ঘুমোচ্ছিল হয়তো, ঠেলে রাস্তায় নামানো হয়েছে। পুলিশ সবাইকে ভ্যানে উঠিয়ে নিয়ে চলে গেছে। এদের মাতব্বরটিকেও। মাতব্বরটি ‘অল ইণ্ডিয়া মাইনরিটি ফোরাম’এর নামে প্রায়ই এ ধরনের গণ্ডগোল সৃষ্টি করার উদ্যোগ নেয়।

কিন্তু এর পর পরই দেখা গেল পার্কসার্কাসের এক গলি থেকে অল্প বয়সের কিছু ছেলে বেরিয়ে পুলিশের দিকে ঢিল ছুঁড়তে লাগলো। ছুঁড়ে মারতে লাগলো কোক খেয়ে কোকের বোতল, আর হিহি হাসি। পুলিশেরা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ওদের মার খেলো আর মাঝে মাঝে কাঁদানে গ্যাস ছুড়লো। লুঙ্গি আর স্যাণ্ডো গেঞ্জি ছেলেরা হুল্লোড় করতে করতে গাড়ি পোড়াতে লাগলো, বাস ট্রাক পোড়াতে লাগলো, সাংবাদিকদের ক্যামেরা ভাঙতে লাগলো। এই ভাংচুর, এই জ্বালাও পোড়াও, এই হৈ-হল্লা অনেকটা সংক্রামক, এর পেছনে কোনও উদ্দেশ্য থাকার প্রয়োজন হয় না। অনেকটা পকেটমারকে পেটানোর মতো। পিটিয়ে আনন্দ। পার্কসার্কাসের রাস্তায় পুলিশ আর গাড়ি বা কিছু চলতে দিচ্ছে না। সারা শহরে ট্রাফিক জ্যাম শুরু হয়ে গেল। দুতিনটে ছেলে গলির ভেতর কাগজে ‘তসলিমা গো ব্যাক’ লিখে ক্যামেরার সামনে দাঁড়ালো। কলকাতার কয়েকজন বন্ধুকে ফোনে জিজ্ঞেস করি, ‘কারা ওরা?’ প্রায় সবাই বললো, ‘ওরা জানে না তসলিমা কে, কী জিনিস, তসলিমার বই কোনোদিন পড়েনি, উর্দুভাষী অশিক্ষিত বা অল্পশিক্ষিত মুসলমান, পকেটমার, ছিচকে চোর, মুদির দোকানি, ফেরিঅলা। ওদের নিয়ে দুশ্চিন্তা করার কিছু নেই। ওদের পথে নেমে ঠিক যা যা করতে বলা হয়েছে, সব করছে ওরা। আমি হতবাক বসে থাকি। টেলিভিশনে যা দেখলাম, নীল পোশাকের অভিজ্ঞ পুলিশ র‍্যাফ নামলো, সেনা নামলো। শহরময় টহল দিল। কাফু জারি হল। আর রাতে সিপিএমএর রাজ্য সম্পাদক বিমান বসু বললেন, ‘তসলিমাকে নিয়ে ঝামেলা হলে তসলিমার এ শহর ছেড়ে চলে যাওয়া উচিত।’

পুলিশের নিরাপত্তা প্রধান আগেও যেমন জানিয়েছিলেন, সেদিনও এবং পরদিনও জানালেন আমাকে মেরে ফেলার সিদ্ধান্ত একেবারে পাকা। মৌলবাদীরা আসছে আমার বাড়িতে, শুক্রবার নামাজের পর। আগেও জিজ্ঞেস করেছিলাম, এবারও করি, ওদের অ্যারেস্ট করছেন না কেন?

বি–অসুবিধে আছে।

ত–কী অসুবিধে? আপনারা আছেন, নিশ্চয়ই ওরা বাড়িতে আসার সাহস পাবে না।

বি–আমরা ওদের কিছু করতে পারবো না।

ত–কেন?

বি–মুসলমানদের গায়ে হাত দেওয়া যাবে না। রায়ট লেগে যাবে।

ত–হিন্দু মুসলমানের ব্যাপার নয়, টেরোরিস্ট হল টেরোরিস্ট। কেউ অন্যায় করলে তাকে শাস্তি দেবেন। রায়ট লেগে যাবে, এ কোনও যুক্তি হল কোনো পদক্ষেপ না নেওয়ার?

বি–রায়টের রিস্ক নিতে পারবো না। ত তাহলে কী করতে হবে?

বি–আপনাকে দু’দিনের জন্য জয়পুরে যেতেই হবে।

ত–দু’দিন?

বি–হাঁ, ঠিক দু’দিন।

ত–দু’দিনে সব ঠিক হয়ে যাবে?

বি–সিওর।

ত–জয়পুরে কেন?

বি–জয়পুরে লাক্সারি রিসর্ট আছে আমাদের। ওখানে দু’দিন একটু বিশ্রাম নিন। আমরা দুদিন পর আপনাকে ফেরত নিয়ে আসবো।

ত–আমি জয়পুর যাবোনা। আপনারা যদি আমার বাড়িতে আমাকে নিরাপত্তা দিতে পারেন, তাহলে আমি বাড়ি ছেড়ে অন্য কোথাও গিয়ে শুক্রবার দিনটা কাটাই।

বি–কোথায়?

ত–বেহালায়।

বি–না, বেহালায় সিকিউরিটি ছাড়া আপনাকে থাকতে হবে। যেখানেই যাবেন, নিজ দায়িত্বে।

ত–সল্টলেকে?

বি–আমাদের পক্ষে সিকিউরিটি দেওয়া সম্ভব নয় সল্টলেকে। আপনার নিজ দায়িত্বে থাকতে হবে।

ত–আমি বেলঘরিয়া যাবো। একদিনের তো ব্যাপার। আমার পাবলিশারের বাড়ি ওখানে।

বি–হবে না।

ত–দুর্গাপুরে, বোলপুরে?

বি–সবখানেই আপনার সিকিউরিটির দায়িত্ব আপনার।

ত–আপনারাই বলছেন আমাকে মেরে ফেলার জন্য দল তৈরি হয়ে গেছে। আবার বলছেন কোথাও সিকিউরিটি দেওয়া সম্ভব নয়! এতদিন যে নিরাপত্তা দিলেন, কেন দিলেন! হঠাৎ বিপদের সময় বন্ধ করে দেবেন কেন? বিপদের কথা তো আমার জানা ছিল না। আপনারাই জানাচ্ছেন, এখন সবচেয়ে বেশি বিপদ। আর আপনারাই এখন বলছেন, নিরাপত্তা দেবেন না। কী করবো আমি, কিছু তো বুঝতে পারছি না।

বি–আপনি আমাদের কথা শুনুন। আপনি জয়পুর যান। আপনার ভালোর জন্যই বলছি।

ত–আমি অবাক হচ্ছি, এত বড় পুলিশ বাহিনী গোটা কয় লোকের মার্ডার প্ল্যানএর বিরুদ্ধে কিছু করতে পারবে না। যদি আচমকা কিছু ঘটতো, সে না হয় বুঝতাম। এ তো আপনাদের নলেজের মধ্যে। কেন আমাকে বাঁচাতে পারবেন না?

বি–সরি। আমরা পারবো না।

সাফ সাফ জানিয়ে দেওয়া হয়েছে, আমাকে মেরে ফেলবে মৌলবাদীরা কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের পুলিশ কোনো নিরাপত্তা আমাকে দিতে পারবে না। আমি স্তম্ভিত বসে থাকি। এ কী ঘটছে! কোনোদিন নিরাপত্তা চাইনি সরকারের কাছে। কিন্তু ভারতে যখনই এসেছি বা থেকেছি, সেই তিরানব্বই সাল থেকে আমার নিরাপত্তার জন্য পুলিশ মোতায়েন করেছে সরকার। আমাকে একদিনের জন্যও নিরাপত্তাহীন অবস্থায় রাখেনি। আর আজ কি না আমাকে বলা হচ্ছে আমাকে আক্রমণ করা হবে, পুলিশ কোনো নিরাপত্তা আমাকে দেবে না, আমাকে পশ্চিমবঙ্গ ত্যাগ করতে হবে, তাহলেই সরকার আমার পাশে দাঁড়াবে, নয়তো দাঁড়াবে না। এমন অদ্ভুত যুক্তি আগে শুনিনি, এমন অদ্ভুত ব্যবহার আজ অবধি কোথাও পাইনি। কস্মিনকালেও নিরাপত্তাব্যবস্থা আমি চাইনি, সবসময় যা চেয়েছি, তা হলো, আর দশজন মুক্ত মানুষের মতো চলাফেরা করতে। আমি চাইনি আমার জন্য সরকারের কোনো টাকা খরচ হোক। আমি সাধারণ মানুষ, সাধারণ মানুষের মতো জীবন যাপন করতে চেয়েছি। প্রথম দিকে প্রচুর পুলিশ থাকতো ঠিকই, ধীরে ধীরে কমে গিয়ে মোটে দুজনে এসে দাঁড়িয়েছিল। বাড়ির বাইরে কোথাও যেতে হলে একজন সাদা পোশাকের কেউ যেত আমার সঙ্গে। আমি বাড়ি ফিরলে সেই সাদা পোশাক চলেও যেত নিজের বাড়ি। দু’শ থেকে দু’জন হওয়ার অর্থ এ শহরে আমার জীবনের ঝুঁকি নেই। আমিই চাইছিলাম রক্ষীর সংখ্যা কমে কমে যেন শূন্যতে চলে আসতে পারে। মানুষের ভালোবাসাই যেন আমার নিরাপত্তা হয়। কিন্তু আশ্চর্য! এই শহরই আজ আমার নিরাপত্তা ব্যবস্থা বন্ধ করে দিতে চাইছে, এই খবরটি দিয়ে, যে, আমাকে আজ বা কাল মেরে ফেলা হবে, মেরে ফেলার সব ব্যবস্থা পাকা হয়ে গেছে। আমাকে আমার আততায়ীদের খবরটা জানিয়ে নিরাপত্তা বন্ধ করা কেন? না জানিয়েই বন্ধ করলে আমি অন্তত দুশ্চিন্তামুক্ত থাকতে পারতাম!

দুপুরে পুলিশের লোক এসে আমাকে নিয়ে গেল কলকাতা বিমান বন্দরে। দাদা ছিল আমার সঙ্গে। আমার হাতে দুটো ওয়ান ওয়ে টিকিট দিল ওরা। কোথায় যেতে হবে? জয়পুর। একগাদা পুলিশ আমাকে এয়ারক্রাফটের ভেতর বসিয়ে দিয়ে দাঁড়িয়ে রইল বাইরে। উড়োজাহাজ উড়লো, তারপরও দাঁড়িয়ে রইল। কলকাতার আকাশে যতক্ষণ উড়োজাহাজের চিহ্ন দেখা যায়, রইল। ফেয়ারওয়েল ওরা এমন নিঃশব্দেই জানালো। আমি তখনও জানি না আর কলকাতায় ফিরতে দেওয়া হবে না আমাকে। তখনও জানি, আমাকে বাংলা থেকে চির জীবনের জন্য দূর করতে যে চক্রান্ত চলেছে, তা সেদিন সার্থক হল।

জয়পুর নামার পর দেখি পুলিশে ছেয়ে আছে বিমান বন্দর। তারা নাকি মাত্র কিছুক্ষণ আগে খবর পেয়েছে যে আমি আসছি। কলকাতার পুলিশ বলেছে, আমি নাকি এখানে কোন সাহিত্য অনুষ্ঠানে যোগ দিতে এসেছি। পুলিশ নিয়ে গেল আমাকে একটা সস্তা হোটেলে। এই হোটেলই নাকি আমার জন্য ঠিক করা হয়েছে কলকাতা থেকে। অথচ বলা হয়েছিল, লাক্সারি রিসর্ট। লাক্সারি তোদূরের কথা, এঅনেকটাময়মনসিংহের নদীর পাড়ের দেড়টাকা দামের চিৎ কাত হোটেলের মতো। এমন হোটেলে কখনও থাকিনি আগে। অভিজ্ঞতাও বটে। পুলিশেরা জিজ্ঞেস করতে লাগলো, তোমার প্রোগ্রাম কাল কখন?

ত–আমার কোনো প্রোগ্রাম নেই।

পু–তবে কেন এসেছো কেন?

ত–আমাকে পাঠানো হয়েছে কলকাতা থেকে।

পু–কে পাঠিয়েছে?

ত–কলকাতার পুলিশ।

পু–কেন পাঠিয়েছে?

ত–জানি না। বলেছে দু’দিনের জন্য জয়পুরে থাকতে।

পু–ওরা আমাদের মুখ্যমন্ত্রীকে জানিয়েছে, কী একটা নাকি অনুষ্ঠানে যোগ দিতে এসেছে।

ত–কোনো অনুষ্ঠানে যোগ দেওয়ার ব্যাপার নেই।’

পুলিশের মধ্যে রাজস্থানী ভাষায় আলোচনা চলতে থাকে। একটু পর পর একজন আসে, কাল আমার ক’টায় প্রোগ্রাম জানার জন্য মরিয়া ওরা। প্রোগ্রাম কিছু নেই, এমনি এসেছি –এ কথা বারবারই বলছি, বারবারই শুনছে, বারবারই বিষম খাচ্ছে। ভড়কে গেছে হোটেলের সামনে সাংবাদিক আর ক্যামেরার ভিড় দেখে। আমার জানা হতো না ক্যামেরার ভিড় সম্পর্কে, যদি না হোটেল-ঘরের টেলিভিশনটা চালাতাম। টেলিভিশনে দেখি আমার খবর দেখানো হচ্ছে, আমি জয়পুরের কোন হোটেলে এখন আছি, কত নম্বর রুমে আছি, সব। আমি নিজেই জানতাম না হোটেলের নাম আর রুম নম্বর। টেলিভিশন থেকে জানা হয়, জানালার পর্দা সামান্য ফাঁক করে দেখাও হয় রাস্তার সারি সারি ক্যামেরা কী করে তাক করে আছে ঘরের দিকে। বুক কাঁপে আমার। মৌলবাদী সন্ত্রাসীরা আমার রক্ত চায় জানার পরও কোনও সুস্থ সাংবাদিক কি জানাবে আমি কোথায় আছি না আছি, এভাবে? এরাকি তাহলে আমন্ত্রণ জানাচ্ছে সন্ত্রাসীদের যে তোদের শিকারের সন্ধান পাওয়া গেছে, আয় ছুটে আয়, এসে শিকারটাকে ইচ্ছে মতো ছিঁড়ে খা। ছিঁড়ে খা যেন আমরা সেটা ক্যামেরায় চমৎকার ধরে রাখতে পারি, আর সারাদিন ধরে প্রচার করতে পারি, আমাদের দর্শক বাড়বে, আমাদের চ্যানেলের নাম হবে!

ছটফট করি। একে ওকে ফোন করি। কলকাতার পুলিশেরা কেউ এখন আমার ফোন ধরছে না। জয়পুর পুলিশ না বোঝে ইংরেজি, না বোঝে হিন্দি। আমি প্রমাদ গুণতে থাকি। কী করে রাস্তায় ভিড় করা সাংবাদিকদের মিনতি করবো আমাকে প্রাণে মারার এই আয়োজন বন্ধ করতে! এক ফোঁটা ঘুম নেই। রাত একটার দিকে ঘরের দরজা ভেঙে ফেলছে এমন শব্দ। জিজ্ঞেস করি, কে?

পু–দরজা খুলুন।

ত–না, দরজা খুলবো না। কে আপনি?

পু–আমি পুলিশ সুপার। আপনাকে এক্ষুণি চলে যেতে হবে রাজ্য ছেড়ে।

ত–কিছু বুঝতে পারছি না কী বলছেন।

পু–দরজা খুলুন।

ত–আমি দুঃখিত, এত রাতে আমি দরজা খুলবো না। যা বলবেন সকালে বলবেন।

পু–সকালে বললে চলবে না। আপনাকে বেরিয়ে যেতে হবে। মুখ্যমন্ত্রীর অর্ডার।

ত–আপনি রিসেপশন থেকে ফোন করুন ঘরের ফোনে। আমি কথা বলছি।

রিসেপশান থেকে ফোনে আমাকে পুলিশের বড় কর্তা বললেন–আপনি এক্ষুণি। হোটেল ছাড়ুন।

ত–হোটেল ছেড়ে আমি যাবো কোথায় এত রাতে?

পু–সে আপনার ব্যাপার, আপনি কোথায় যাবেন।

ত–এখন তো কোনো ফ্লাইট নেই কলকাতায় যাওয়ার।

পু–আমরা অত কিছু জানি না। শুধু জানি আপনার রাজস্থানে থাকা চলবে না।

ত–কেন চলবে না?

পু–আমাদের এখানে মুসলমানরা অসন্তুষ্ট হতে পারে। ল এণ্ড অর্ডার প্রবলেম হতে। পারে। সে কারণে মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন আপনাকে রাজস্থান ছাড়তে।

ত–কিছু কি প্রবলেম হয়েছে এর মধ্যে?

পু–হয়নি। কিন্তু যে কোনও সময় হতে পারে।

ত–মানে ‘হতে পারে’ অনুমান করে আমাকে চলে যেতে বলছেন।

পু–হ্যাঁ।

ত–সে আমি ছাড়বো হোটেল। সকালটা হতে দিন। আমি এয়ারপোর্টে চলে যাবো কলকাতার ফ্লাইট ধরতে।

পু–সকাল হতে দিতে পারছি না। সকালের আগেই যেতে হবে। সূর্য ওঠার আগে।

ত–সূর্য ওঠার ঠিক কত আগে বলুন।

পু–আপনাকে পাঁচটার আগেই বেরিয়ে যেতে হবে।

ত–ঠিক আছে।

পু–পাঁচটার পাঁচ মিনিট আগেই আপনি রুম ছেড়ে নিচে নেমে আসবেন। গাড়ি অপেক্ষা করবে আপনাকে এয়ারপোর্টে নেওয়ার জন্য।

ঠিক আছে বলে ফোন রাখলাম। সত্যি বলতে কী, স্বস্তি পেলাম অনেক। এই রাষ্ট্র হয়ে যাওয়া ঠিকানা যত শীঘ্র সম্ভব ত্যাগ করা উচিত। রাজস্থান ছাড়তে হবে, কলকাতায় ফেরার জন্য এ চমৎকার একটি কারণ। আমি হয়তো একটুখানি ঘুমিয়ে নেওয়ার সময় পেলাম, দাদা একেবারে ঠায় বসে রইলো বিছানায়। দাদাও বাবার মতো, ভোরে কোথাও যাওয়ার থাকলে সারারাত বসে বসে ভোর হওয়ার অপেক্ষা করে। ভোর পাঁচটায় নিচে নেমে দেখি পুলিশ আর সাংবাদিকদের ভিড়ে গিজগিজ করছে রাস্তা। ক্যামেরা আর সাংবাদিক ঠেলে সরিয়ে পুলিশ আমাকে গাড়িতে ওঠালো। এক সারি গাড়ি চললো। আমার গাড়ির পেছনে আরও পুলিশের গাড়ি, পুলিশের গাড়ির পেছনে সাংবাদিকদের গাড়ি। গাড়ি চলছে তো চলছেই। একসময় আমার খটকা লাগে, গাড়ি এত চলছে কোথায়! বিমান বন্দরে পৌঁছোতে তো এত সময় লাগার কথা নয়। জিজ্ঞেস করলাম, ‘এত সময় লাগছে কেন এয়ারপোর্টে যেতে?’

গোঁফওয়ালা ডাকাত-ডাকাত দেখতে কয়েকজন পুলিশ গাড়িতে। পেছনের সিটে কিছু, সামনের সিটে কিছু, মাঝখানের সিটে আমি আর দাদা। আমার প্রশ্নের কেউ কোনও উত্তর দিল না। আমি আবারও জিজ্ঞেস করি। কোনও উত্তর নেই। আবারও।

ত–এয়ারপোর্টে যেতে এত দেরি হচ্ছে কেন? এয়ারপোর্ট তো এত দূরে নয়।

পু–যাচ্ছি না এয়ারপোর্টে।

ত–তবে কোথায় যাচ্ছেন?

পু–দিল্লি।

ত–দিল্লি কেন?

পুলিশ চুপ।

ত–দিল্লি কেন যাবো আমি? আমি কলকাতায় ফিরবো। আমাকে এয়ারপোর্টে নিয়ে যান।

পুলিশ চুপ।

ইংরেজি বোঝে না। দাদাকে বললাম, হিন্দিতে বলতে। দাদা হিন্দি আমার চেয়ে ভালো জানে। কিন্তু হিন্দিতে জিজ্ঞেস করা প্রশ্নেরও কোনও উত্তর নেই। ওরা নিজেদের মধ্যে রাজস্থানী ভাষায় কথা বলতে থাকে। যেন আমাদের কোনও প্রশ্নই ওরা শুনতে পায়নি অথবা আমরা যে আছি গাড়িতে, সে বেমালুম ভুলে গেছে।

অন্ধকার কেটে যাচ্ছে, আলো ফুটছে। ভোরের ঘুম ঘুম রাস্তায় গাড়ি হাওয়ার বেগে ছুটছে। পুলিশগুলো বারবার পেছনে তাকাচ্ছে, দেখছে এ গাড়ির কেউ পিছু নিচ্ছে কি না। পেছন ফিরে একজন হঠাৎ হিন্দিতে বললো, দিল্লিতে যাচ্ছি, কারণ আমাদের সেরকমই বলা হয়েছে।

ত–কে বলেছে?

পু–সেরকমই অর্ডার।

ত–কে অর্ডার দিয়েছে?

পুলিশ চুপ।

ত–আমি তো কলকাতা ফিরবো। আমাকে দিল্লি নিয়ে যাওয়া হচ্ছে কেন?

পু–আমরা অত সব জানি না।

ত–কলকাতায় না গিয়ে দিল্লি যাওয়ার কারণ কী?

পুলিশ চুপ।

ত–দিল্লিই যখন যাচ্ছেন, তখন দিল্লিতে প্লেনে না গিয়ে গাড়িতে যাচ্ছেন কেন?

এ কথাটা পাঁচবার জিজ্ঞেস করার পর উত্তর জোটে, সিকিউরিটি।

গাড়ি চলছে। এরমধ্যে ফোন। কলকাতা থেকে। খবর পেলাম, আমার গাড়িকে অনুসরণ করছে স্টার আনন্দের দিল্লি সংবাদদাতা। স্টার আনন্দতে সরাসরি প্রচার করা হচ্ছে অজানার উদ্দেশে আমার যাত্রা। গাড়ি জয়পুর ছাড়িয়ে যাচ্ছে, কোথাও না কোথাও যাচ্ছে, কোথায় যাচ্ছে জানি না। একসময় স্টার আনন্দর অনুসরণ করা সাংবাদিক ফোন করলো আমাকে, ‘দিদি, কোথায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে আপনাকে?’ উত্তেজিত কণ্ঠস্বর।

ত–জানি না। ওরা তো বলছে দিল্লি। কিছু বুঝতে পারছি না। দিল্লি কেন নেবে জানি না।

সা–এই আমার ফোন নম্বর। প্লিজ আমাকে জানাবেন কী হচ্ছে না হচ্ছে। আমরা আছি আপনার সঙ্গে। দিদি, কোনও চিন্তা করবেন না।

ত–কলকাতায় যাবো সকালের ফ্লাইটে। তাই কথা হল রাজস্থানের পুলিশের সঙ্গে। এখন আমাকে কি না দিল্লি নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। কী রকম ধন্দের মধ্যে পড়েছি, দেখুন তো!

সা–আমরা তো আছি। ঘটনাটা কোথায় গিয়ে গড়ায়, দেখিই না। শুধু আমি নই, আমার মতো লক্ষ লক্ষ লোক আপনাকে ভীষণ রেসপেক্ট করে, দিদি।

ওই দিদি ডাক, ওই বাংলায় কথা বলা, হোক না ভাঙা বাংলায়, আমাকে স্বস্তি দেয়। আমি একা নই, আমার এই ভয়াবহ নিরুদ্দেশ যাত্রায় কেউ পাশে আছে, এই ভাবনাটিই আমার দুশ্চিন্তা ঘুচিয়ে দেয়।

জানি না কতদূর গিয়ে একসময় গাড়ি ঢুকে পড়ে একটা মোটেলের পেছনের নির্জন কোণায়। এক পুলিশ গাড়িতে থাকে, বাকি পুলিশ নেমে যায়। কোথায় যায় কে জানে, আর ফিরে আসে না। নতুন কিছু পুলিশ গাড়িতে ওঠে আধঘণ্টা পর। গাড়ি চলতে শুরু করে রাজপথে। আবারও হাওয়ার বেগে। কিছুক্ষণ পর সেই স্টার আনন্দের সাংবাদিক, কণ্ঠে আতংক আর অস্থিরতা, বলে, আমাদের সব সাংবাদিককে গাড়ি থামিয়ে গাড়ি থেকে বের করে মেরেছে পুলিশেরা। এখন মোটেলের একটা রুমে ঢুকিয়ে বাইরে থেকে শেকল দিয়ে চলে গেছে।

ত–কী বলছেন এসব! ভয়ংকর কাণ্ড!

সা–ওরা আপনার গাড়িকে ফলো করতে দেবে না।

ত–তাই বলে মারবে?

সা–যাচ্ছেতাই ভাবে পিটিয়েছে।

ত–আহা। বেরোবেন কী করে এখন?

সা–জানি না। মনে হচ্ছে হোটেলের লোকদের বলে দিয়েছে শেকল না খুলতে।

একসময় পুলিশদের জিজ্ঞেস করলাম, দিল্লিতে আমাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন? দিল্লির কোথায়? কোনও জায়গা আছে নির্দিষ্ট? পুলিশদের মধ্যে একজনই আছেন, যিনি হিন্দিতে অন্তত প্রশ্নের উত্তর দিতে পারেন। যদিও উত্তর দেওয়ার ইচ্ছে তার আদৌ আছে বলে মনে হয় না। উত্তর দিতে পারা পুলিশটিও গোঁফওয়ালা, ডাকাত-ডাকাত।

পু–না। জায়গা আপনাকে বের করতে হবে। আমরা দিল্লি পর্যন্ত পৌঁছে দেব।

ত–দিল্লিতে পুলিশের হাতে দেবেন তো আমাকে? মানে সিকিউরিটি পুলিশের হাতে?

পু–দিল্লির যে ঠিকানায় যেতে চান, সে ঠিকানায় আমরা আপনাকে পৌঁছে দেবো৷ হোটেলের নাম টাম জানেন?

ত–আমার কোনও ঠিকানা নেই দিল্লিতে।

পু–কী নেই?

ত–ঠিকানা।

ভ’বাবুকে ফোন করি। সরকারের বড় পদে এই ভদ্রলোককেই আমি চিনি। খুব দ্রুত, খুব ব্যস্ত মানুষটিকে তথ্য জানিয়ে দিই, তিনি কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই।

ত–‘আমাকে কলকাতা থেকে জয়পুর পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে, কাল রাতে জয়পুর পৌঁচেছি। এখন ওখান থেকে কয়েক ঘণ্টা পরই আমাকে, সকাল হওয়ার আগেই পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে দিল্লি। কলকাতায় ফিরতে চাইলাম। কিন্তু না জানিয়ে দিল্লি পাঠানোর কোনও কারণ আমি জানি না। দিল্লিতে নাকি কোনো পুলিশের সঙ্গে ওদের কথা হয়নি। আমার কাছে জানতে চাইছে কোথায় যাবো আমি।

ভ’বাবু বললেন কেন আমাকে পাঠানো হচ্ছে দিল্লিতে, কী ঘটেছে রাজস্থানে, এসব খবর নিয়ে তিনি আমাকে জানাবেন। তিনি আর জানাননি। তার সেক্রেটারি ফোন করে বললেন, আমি যেন রাজস্থানী পুলিশদের বলি আমাকে দিল্লির পুলিশ-স্টেশনে নামিয়ে দিতে। ওখান থেকেই আমাকে তুলে নিতে আসবেন ভ’বাবুর লোক।

‘তাহলে সিকিউরিটির লোকেরা ওখান থেকে আমাকে এয়ারপোর্টে নিয়ে যাক। আমি চলে যাবো কলকাতায়।‘

ওদিকে ভ’বাবুর সেক্রেটারি। শুনছেন।

‘দেখুন তো, এর কোনও মানে হয়। আমাকে জয়পুরে থাকতে দেবে না দুদিন, তো আমাকে বাড়ি ফিরতে দাও। জয়পুর থেকে কলকাতা চলে গেলেই ঝামেলা চুকে যেতো। এখন জয়পুর থেকে দিল্লি, দিল্লি থেকে কলকাতা। এত ঘুরপথের দরকার কী ছিল, বুঝি না।

ভ’বাবুর সেক্রেটারি বললেন, হুম।

আমি বললাম, ”আচ্ছা বলুন তো, দিল্লি শহর থেকে এয়ারপোর্ট কি খুব দূর? ঠিক মনে পড়ছে না। আজকেই তো ফ্লাইট ধরা যাবে, তাই না।

সেক্রেটারি বললেন, ‘আগে দিল্লি পৌঁছোন তো। পরেরটা পরে দেখা যাবে।

হঠাৎ পথে একজায়গায় গাড়ি থামিয়ে পুলিশেরা আবার হাওয়া হয়ে গেল, পুলিশের সবগুলো গাড়ি থেকেই পুলিশ হাওয়া। অনেকক্ষণ বাদে ফিরে এলো সাদা পোশাকে। গা থেকে হঠাৎ ওরা পুলিশের ইউনিফর্ম খুলে ফেললো কেন! দাদা ফ্যাসফ্যাসে গলায় বললো, গাড়ির নম্বর প্লেটও খুলে ফেলেছে। লক্ষ্য করি, আমি যে গাড়িতে বসে আছি, সে গাড়ির তো বটেই, আমার গাড়ির সামনের এবং পেছনের গাড়িগুলোর নম্বর প্লেট নেই। দু’জন সাদা পোশাকের তাগড়া পুলিশ সব পুলিশকে বলছে রাইফেলগুলো সব লুকিয়ে ফেলতে। তার মানে কেউ যেন বুঝতে না পারে, আর্মস নিয়ে একদল লোক কোথাও যাচ্ছে! দাদা আর আমার দিকে চোখ রাঙিয়ে তাগড়া দুজন বললো, ‘মোবাইল ফোন অফ করো। মোবাইল ফোন অফ করবো, হচ্ছেটা কী? কেন করবো অফ?’ বলতে নিচ্ছি, অমনি বিরাট ধমক, ‘অফ করোনি এখনও, এক্ষুণি অফ করো।‘ যে পুলিশ গাড়ি চালাচ্ছিল, আমার দিকে কটমট করে তাকালো, দৃষ্টিটি লোলুপ, নাকি দৃষ্টিটি রাগে ঘৃণায় ফোলা, বুঝতে পারি না।

দুপুর পার হয়ে গেছে, তখনও দিল্লি পৌঁছোনোর তোনামইনেই বরং রাস্তার সাইনবোর্ডগুলো দেখে বুঝি দিল্লির উল্টো পথে চলছে আমাদের গাড়ি। দিল্লি পেছনে। বুক ধুকধুক করে। ভয়ে কণ্ঠ শুকিয়ে খরা। গাড়ি একসময় বড় রাস্তা থেকে নেমে যায় অলিতে গলিতে, মাঠে ময়দানে, ক্ষেতে। ক্ষেত মাড়িয়ে গাড়ি চলে, পারলে নর্দৰ্মায় নেমে যায়। আমার মনে হতে থাকে, এই লোকগুলো সত্যিকার পুলিশ নয়। এরা আমাকে অপহরণ করেছে। আইএসআই বলে কী যেন ভয়ংকর কী আছে, সম্ভবত এরাই। এরাই আমাকে জয়পুর থেকে ছলে বলে কৌশলে বের করে নিয়ে এসেছে। অজ পাড়া গাঁ’র কোনও ঝাড় জঙ্গলে নিয়ে মেরে ফেলে রাখবে। মরে পচে থাকবো, কেউ জানবেও না।

দিল্লির রাস্তা থেকে এরা অনেক আগেই গাড়ির বহর ঘুরিয়ে নিয়েছে। কোথায় যাচ্ছে, তা অনুমান করার সাধ্য আমার নেই। নিজেদের মধ্যে রাজস্থানী ভাষায় কথা বলছে, আর ফিরে ফিরে তাকাচ্ছে। ড্রাইভারের চোখে এখনও আমাকে গিলে খাওয়ার দৃষ্টি। দেখে নিচ্ছে আমি ঠিক আছি কি না, আমার পেছনের সিটে যারা আছে, তারা ঠিক কি না, এই গাড়ির পেছনের গাড়িটায় কোনও অসুবিধে হচ্ছে কি না, এবং পেছনের গাড়িটার পেছনে কোনও সন্দেহজনক গাড়ির চিহ্ন আছে কি না। আমি নিশ্চিত এরা পুলিশ নয়, এরা আমার আততায়ী। আমার ফোন বন্ধ, দাদাকাঠ, আমি বোবা, গাড়ির নম্বর প্লেট নেই, লোকগুলোর গায়ে পুলিশের পোশাক নেই, হাসছে হা হা। ওদের কোনও প্রশ্ন করবো বা মোবাইলে কাউকে চুপচুপ করে এসএমএসে জানাবো অবস্থা, সে সাহস নেই, দাদার সঙ্গে কানে কানে কথা বলবো সেই শক্তিও নেই। গাড়ি এসে থামলো একটা নির্জন এলাকায় এক একলা বাড়িতে। সেই বাড়িতে একটি প্রাণী নেই, সেখানে আমাদের একটা ঘরে বসতে বলা হল। আমার রক্তচাপ, আমি নিশ্চিত, বেড়ে আকাশে উঠেছে। বাথরুমে ঢুকে ফিসফিস করে, যেন আততায়ীরা টের না পায়, ফোনে কথা বলি ভ’বাবুর ঘনিষ্ঠ এক লোকের সঙ্গে। ‘আমার মনে হচ্ছে আমাকে কিডন্যাপ করা হয়েছে। এরা নিশ্চয়ই মুসলিম মৌলবাদী, আমাকে খুন করতে এতদুর নিয়ে এসেছে, দিল্লি না গিয়ে আমাকে একটা জঙ্গলের মধ্যে, লোকালয় থেকে দূরে একটা বাড়িতে ঢুকিয়েছে। আমার ভয় হচ্ছে। চেনা লোক ভ’বাবুর কাছ থেকে খবর নিয়ে খানিক বাদে আমাকে জানালো, যে, ভ’বাবু মনে করছেন না আমাকে অপহরণ করা হয়েছে। আমার দুশ্চিন্তা করার কিছু নেই। এর চেয়ে স্বস্তির আর কী হতে পারে! জোরে শ্বাস নিই। কয়েকটা ঘণ্টা প্রায় শ্বাস বন্ধ করে পড়েছিলাম গাড়িতে। কয়েকটা ঘণ্টা আমার রক্তে, নাড়িতে আতংকের তুফান বয়ে গেছে। জোরে শ্বাস নিয়ে বিধ্বস্ত সন্ত্রস্ত মনটাকে আরাম দিতে চেষ্টা করি।

একজন পুলিশ এসে জানান, জয়পুর থেকে কয়েকজন অফিসার আসছেন, আমার সঙ্গে কথা বলবেন। অফিসারদের দেখে যে মৃত্যুভয় আমার ঘাড়ের ওপর শকুনের মতো বসে মাথার খুলি ঠুকরে ঠুকরে খুলে অবশ করে দিচ্ছিলো মস্তিষ্ক, পালায় লেজ গুটিয়ে। রাতের খাওয়ার সময় আমাকে বললেন ওঁরা, যে, এত সাংবাদিকের গাড়ি আমার গাড়ির পিছু নিয়েছিলো যে ওঁদের এড়াতে পুলিশ আমার গাড়ির প্লেট খুলে নিয়েছে, নিজেদের পোশাক বদলে ফেলেছে, যেন আমার গাড়ির পিছু নিতে কেউ না পারে, যেন আমার গাড়ি বলে গাড়িকে চিনতে না পারে। যে সময়ে আমার পৌঁছানোর কথা দিল্লিতে, সে সময় না পৌঁছোনো নিরাপত্তার কারণেই। সাংবাদিক থেকে, খবর থেকে নিরাপদ দুরত্বে থাকা।

ঘটনাটি এত কেন গোপন রাখা হচ্ছে, বুঝি না। এ কথা বললেই হতো আমাকে যে সাংবাদিকদের এড়ানোর জন্য এসব করা হচ্ছে। এত রহস্যের জট তো আমি খুলতে পারি না।

নিশ্চিন্তে দিল্লি চলি। সঙ্গে চারজন অফিসার। পথে যেতে যেতেই শুনি রাজস্থানের সরকার বিজেপি সরকার, মুখ্যমন্ত্রীর নাম বসুন্ধরা রাজে, মহিলা। এসবের কিছুই আমার জানা ছিল না। অফিসারদের মধ্যে একজন বাঙালি। যেন প্রাণ ফিরে পাই। তার সঙ্গেই গল্প করি বেশি।

দিল্লির রাজস্থান হাউজে গাড়ি থামলো। এত যে সতর্কতা ছিল সাংবাদিকদের কবলে না পড়ার, কই সে তো পড়তেই হল। ক্যামেরার ঝলসানো আলোর মধ্য দিয়ে আমাকে গাড়ি থেকে দ্রুত নামিয়ে দোতলায় ওঠানো হল। একটা সুইট দেওয়া হল বিশ্রাম নিতে। আজ রাতটা এখানে কাটালে কাল সকালে আমাকে কোনও এক নিরাপদ বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হবে। এ কথা আমাকে ভ’বাবু ফোনে বললেন। এও বললেন, আমার জন্য কেউ একজন কাপড় চোপড় কিনে নিয়ে আসছে।

ত–কাপড় কেন?

ভ–কাপড় তো লাগবে। কিছু কি এনেছেন সঙ্গে?

ত–না। শুধু ল্যাপটপ।

ভ–কাপড়চোপড়, আর যা যা দরকার, সেসব দেওয়া হবে আপনাকে। অফিসাররা আপনার গছে পৌঁছে যাবে। ওরাই আপনার দেখাশোনা করবে।

ত–আমি তো কলকাতায় ফিরবো। আমার কাপড়ের দরকার নেই। কালই তো ফিরে যেতে পারি। যেটা পরে আছি, সেটা পরে রাতটা কাটিয়ে দিতে পারবো, কোনও অসুবিধে হবে না। এক রাতের জন্য কাপড় চোপড়ের দরকার নেই।

ভ–না। এখন কলকাতায় ফেরা যাবে না। আপনাকে অন্য একটা বাড়িতে কাল সিফট করা হবে। সেই বাড়ির ব্যবস্থা করছি আমরা।

ত–বাড়ি?

ভ–হাঁ, সেই হাউজ।

ত–কিন্তু..

ভ–আপনি থাকুন। খাওয়া দাওয়া ওখানে ভালোই দেবে আশা করি। কোনও প্রবলেম হবে না। কিছুর দরকার হলে আমাকে ফোন করবেন।

খাওয়ার আয়োজন ভালো। একসঙ্গে আমার জন্য বরাদ্দ সুইটের বৈঠকঘরে বসেই সবাই খেলেন।

পরদিন সকালে কেন্দ্রর অফিসার এলেন ক’জন। বেশি বয়সী, অল্প বয়সী। ওঁরা বসেই রইলেন। লক্ষ্য করি জয়পুরের অফিসাররা কেন্দ্রর অফিসারদের ঠিক পছন্দ করছেন না, একটু পর পর কিছু না কিছু নিয়ে তর্ক শুরু করছেন। দাদা টেলিভিশন নিয়ে ব্যস্ত। টেলিভিশনে, বিশেষ করে কলকাতার চ্যানেলগুলোয় আমার খবর দেখিয়ে যাচ্ছে। আমি

কোথায়, কিভাবে, কেন ইত্যাদি। আমার সঙ্গে কারও যোগাযোগ করার উপায় নেই। ভ’বাবুর পাঠানো অফিসাররা বলে দিয়েছেন, কোনও সাংবাদিকের সঙ্গে যেন কথা না বলি। বললেন, খুব বিপদ হবে সাংবাদিকের সঙ্গে কথা বললে। এদিকে জয়পুরের অফিসাররা আলাদা করে আমাকে বলছেন, যেন কথা বলি, খুব বাছাই করে হলেও। বাইরে প্রচুর সাংবাদিক ভিড় করে আছে। চব্বিশ ঘণ্টা ওরা বাইরেই দাঁড়িয়ে আছে। অন্তত কয়েকজনের সঙ্গে যেন কথা বলি। আমি ঠিক বুঝে পাই না কী করবো। দু’দিক থেকে দু’রকম চাপ। মাঝখানে আমি বিমূঢ়। তবে কেন্দ্রর অফিসাররা যা বলছেন তাই আমি মেনে নিই। ভ’বাবু ওঁদের পাঠিয়েছেন। ভ’বাবু আমার শুভাকাঙ্ক্ষী, নিশ্চয়ই যা বলছেন আমার ভালোর জন্যই বলছেন।

জয়পুরের অফিসাররা বললেন কাল আমাকে এখান থেকে সরিয়ে ফেলা হলে ওঁরা জয়পুরে ফিরে যাবেন। কিন্তু কাল আসে। দিল্লির অফিসাররা আসেন। গলার স্বর যথাসম্ভব নরম করে জানান, আরও একদিন সময় লাগবে নিরাপদ বাড়ি খুঁজতে। অতএব আমি রয়ে যাই। সাংবাদিকরাও দিন রাত রয়ে যায়। বাড়ি ঘিরে থাকা পুলিশও রয়ে যায়। দাদা টিভিতে ব্যস্ত। আমাকে দেখায় খানিক পর পর, আমি কোথায়, কী করে আমাকে তাড়ানো হয়েছে কলকাতা থেকে, এসব নিয়ে আলোচনা চলে। স্টার আনন্দ থেকে বাংলাদেশে পাঠানো হয়েছে লোক, ময়মনসিংহে আমার আত্মীয় স্বজনের সাক্ষাৎকার নেওয়া হচ্ছে। নিজের বউ বাচ্চার কথা শুনতে শুনতে খুশিতে দাদার চোখে জল।

কোনো সাংবাদিকের সঙ্গে যেন কথা না বলি, উপদেশ দিতেই থাকেন দিল্লির অফিসাররা। সাংবাদিকদের সঙ্গে যেন কথা বলি, উপদেশ দিতেই থাকেন জয়পুরের অফিসাররা। এর মধ্যে দিল্লির অফিসারদের অনুপস্থিতি এবং আমার অন্যমনস্কতার সুযোগে এক ফটোগ্রাফার আমার পটাপট বেশ কিছু ছবি তুলে ফেলে ঘরে ঢুকে। কে এই লোক প্রশ্ন করতেই জয়পুর বললেন, এই হাউজের নিজস্ব ফটোগ্রাফার। এক ফটোগ্রাফারকে রাজস্থান হাউজের নিজস্ব ফটোগ্রাফার বলে আমার ঘরে ঢুকিয়ে দিলেন জয়পুর। পরে ওই ছবি বিভিন্ন পত্রিকায় ছাপা হতে দেখেছি। গভীর রাতে হঠাৎ আমাকে বলা নেই কওয়া নেই, বরখা দত্তকে ঢোকালেন জয়পুর। যেখানে সাংবাদিকদের শত অনুরোধ সত্ত্বেও কারও সঙ্গে দেখা করছি না, সবাইকে এক বাক্যে ফিরিয়ে দিচ্ছি, চেনা অচেনা কারও ফোন ধরছি না, কারও আবেদনে অনুরোধে রাজি হচ্ছি না, তখন ঘরের ভেতর ক্যামেরা আর একজন সাংবাদিক। এভাবে একজনকে খাতির করবো কেন! জয়পুরের অফিসাররা আকাশ থেকে পড়েন, তুমি বরখাকে চেনোনা, ও ভারতের সবচেয়ে নামকরা সাংবাদিক। না, আমি বরখাকে চিনি না, আমি তো করন থাপরকেও চিনতাম না। সাক্ষাৎকার চাইলে মুখের ওপর না বলে দিয়েছিলাম। করন থাপরকেই কলকাতা যেতে হয়েছিল। সাক্ষাৎকার নেওয়ার সময়ও বুঝিনি তিনি নামকরা কোনোও লোক। আরও পরে লোকের মুখে করন থাপরের কথা শুনে বা সিএনএন-এ ডেভিলস এডভোকেট দেখে, হিন্দুস্থান টাইমসে কলাম পড়ে বুঝেছি উনি নামী লোক। বরখা সাক্ষাৎকার চাইছেন, নানাভাবে আমাকে রাজি করানোর চেষ্টা করছেন। আমার কথা বলা উচিত। আমি কথা বললে কী ঘটেছে তা লোকে জানতে পারবে, আমি জনতার সমর্থন পাবো। জয়পুর জোর করছেন। অপ্রস্তুত অবস্থা আমার। ভ’বাবুর কথা অমান্য করা আমার উচিত নয়। অনেক জোরাজুরির পর কথা বলতে রাজি হলাম, তবে সাক্ষাৎকার নয়। শুধু একটা বিবৃতি, ‘আমি কলকাতায় ফিরতে চাই’, এর বেশি একটিও কথা নয়।

বিজেপির এক নেতা এসেছিলেন। তেমন কোনও কোনও কথা হয়নি। উনি কিছুক্ষণ বসে থেকে চলে গেছেন। তবে মহাত্মা গান্ধির নাতনি তারা গান্ধি এসেছিলেন দেখা করতে, উপহার দিয়ে গেলেন নিজের হাতে বোনা একটি ব্যাগ, তাঁর সঙ্গেই গল্প করেছি। তারা গান্ধির সঙ্গে ওই আমার প্রথম আলাপ। বললেন, তিনি যোগাযোগ রাখবেন। তাঁর ভাই গোপালকৃষ্ণ গান্ধি তখন পশ্চিমবঙ্গের গভর্নর। রাজভবনে একবার কবিতা পড়েছিলাম, মন দিয়ে বাংলা কবিতা শুনেছিলেন, প্রশংসা করেছিলেন খুব। একবার কথাও হয়েছিলো ফোনে, যখন কলকাতায় আমাকে বাড়ি থেকে বেরোতে দিচ্ছিল না পশ্চিমবঙ্গ সরকার। আমি কী রকম ভাবে বেঁচে আছি শুনে উনি ক্ষুব্ধ হয়ে বলেছিলেন, আমি যেন কেন্দ্রকে কোনওরকম দেরি না করে খবরটা জানাই। কেন্দ্র বলতে আমি যা বুঝি, তিনি ভ। এক ভ’র সঙ্গেই কালে ভদ্রে আমার কথা হয়, যেটুকুই হয়। এক ভ’কেই আমি বলতে পারি কী ঘটছে। ভ’কে সম্ভবত বলেছিলাম। উনি ব্যাপারটা দেখবেন’ বলেছিলেন।

প্রথম দিনই মুখ্যমন্ত্রী বসুন্ধরা রাজে বলেছিলেন, ”যতদিন দরকার হয়, থাকুন রাজস্থান হাউজে’, অফিসাররাও বলেছিলেন। এই তাঁরাই তিন দিন পর বললেন, আজই আপনাকে বেরিয়ে যেতে হবে রাজস্থান হাউজ থেকে। হ্যাঁ আজই। মুখ্যমন্ত্রী আমাদের জানিয়ে দিয়েছেন, আজই। ভ’বাবুর লোকদের আমি ফোনে জানিয়ে দিলাম, আমাকে বেরিয়ে যেতে বলছে, আজই’। আমি হয়তো দুনিয়ার অনেক কিছু বুঝি, শুধু রাজনীতির মাথামুণ্ডু কিচ্ছু বুঝি না। যে অফিসাররা এত আন্তরিক ছিলেন, এত শ্রদ্ধাভরে কথা বলতেন, তাঁরাই কী ভীষণ ক্রুদ্ধ এখন, তাঁদের ভাষাই কী ভীষণ কঠিন এখন, তাঁদের আচরণে স্পষ্ট অশ্রদ্ধা এখন। আমি এটুকু বুঝেছিলাম, তারা আমার ওপর সন্তুষ্ট নন, যেহেতু আমি দিল্লির অফিসারদের উপদেশ রেখেছিলাম, কোনও সাংবাদিককে সাক্ষাৎকার দিইনি। জয়পুরীদের যুক্তি ছিল, তোমার এখন খারাপ সময়, মিডিয়া তোমার পক্ষে, তুমি মিডিয়াকে অ্যাভোয়েড করছো, মিডিয়াকে ক্ষেপিয়ে তুলছো, তুমি বুঝতে পারছে না মিডিয়াতে যতক্ষণ তুমি আছো, মিডিয়া যতক্ষণ তোমার পাশে আছে, ততক্ষণ কোনও সরকার, কোনও পলিটিক্যাল পার্টি তোমাকে কিছু করতে পারবে না। তুমি মিডিয়াতে নেই, যে কোনও খেলাই তোমাকে নিয়ে খেলতে পারবে যে কেউ। সিপিএম তোমাকে পশ্চিমবঙ্গ থেকে কীভাবে বের করেছে, জানাও সবাইকে। কেউ কিছু যদি না জানে, তা হলে মানুষের সাপোর্ট তুমি কী করে পাবে? এ দেশের মানুষ তোমাকে ভালোবাসে। তুমি এদের কাছ থেকে দূরে সরে থাকবে কেন? মিডিয়াকে ব্যবহার করো মানুষের কাছে পৌঁছোননার জন্য। সারাদিন জয়পুর বলেই চলেছেন, ‘তুমি ভুল করছো, বেছে বেছে হাতে গোনা দুতিনটে মিডিয়ার সঙ্গে তোমার কথা বলা উচিত। এত বলার পরও আমি রাজি হইনি। শীলা রেড্ডির সঙ্গে দেখা করতে রাজি হয়েছিলাম, সাক্ষাৎকার দিতে নয়, সৌজন্য সাক্ষাৎ করতে। আউটলুকের সাংবাদিক শীলা। আমাকে দিয়ে কয়েকটি লেখা লিখিয়েছিলেন আউটলুকের জন্য। শীলা রেডিও বলেছিলেন, যতক্ষণ মিডিয়া আছে সঙ্গে, ততক্ষণ সরকার আমার বিরুদ্ধে কিছুই করতে পারবে না।

কিন্তু সাক্ষাৎকার দিতে রাজি হইনি বলে একটি রাজ্যের একটি সরকারি বাড়ি থেকে অতিথি হিসেবে বরণ করে নিয়েও আমাকে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতে বলা হবে, এ আমার বিশ্বাস হয় না। হয়তো অন্য কোনও কারণ আছে। সে কারণ আমার কাছে চিরকাল অজানাই থেকে যাবে।

রাত বিরেতে পেছনের দরজা দিয়ে বের করা হল আমাকে। বের করার আগে দিল্লির অফিসাররা এক অফিসারকে তসলিমা সাজিয়ে বোরখা পরিয়ে রাজস্থান হাউজ থেকে বের করলো, গাড়িতে ওঠালো। সেই গাড়ির পেছনে যখন সাংবাদিকদের দল ছুটলো, সন্তর্পণে সত্যিকার আমাকে পেছনের দরজা দিয়ে বের করে নিয়ে সোজা ক্যান্টনমেন্ট। ওখানে দুদিন রেখে আমাকে আরেক ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে যাওয়া হল। ঠিকানা জানি না। আমার অজ্ঞাতবাস শুরু হল এখানেই। অনেক কিছুই দেওয়া হল আমাকে। মোবাইল। ইন্টারনেট। কাপড় চোপড়। সাবান শ্যাম্পু। যা খেতে চাই, সব। বিছানা, টেবিল চেয়ার, সোফা, টিভি আর আমাকে সঙ্গ দিতে, বা পাহারা দিতে, বা চোখে চোখে রাখতে দু’জন করে সরকারি অফিসার। সব আছে, একটি জিনিসই নেই অজ্ঞাতবাসে, কোথাও যাবার, ঘর থেকে বেরোবার বা কারও সঙ্গে দেখা করার অধিকার বা স্বাধীনতা।

অফিসাররা মাঝে মাঝেই বলেন, স্বাধীনতাহীন বেঁচে থাকাটা ভয়ংকর।

আমি চুপ হয়ে শুনি। ওঁরা আমার মুখে অপলক তাকিয়ে লক্ষ্য করতে থাকেন, ত্বকের কোন অঞ্চলে ভাঁজ পড়ছে, ক’টা শিরা দপদপ করছে, ক’টা স্নায়ু নড়ছে, পেশিগুলোর কী হাল।

দাদা অস্থির হয়ে পড়ে দেশে ফেরার জন্য। কিছুতেই তাকে আর রাখার উপায় নেই। বোনকে এই অবস্থায় ফেলে কেন যেতে চাইছো, তোমাদের কী কোনও মায়া নেই, কখন কী হয় কে জানে, যদি মরে যাই, এসব কথা বা আমার চোখের জল কিছুই দাদাকে রুখতে পারে না। দাদাও কি মনে মনে ফেয়ারওয়েল জানায় আমাকে! পরম আনন্দে কলকাতা হয়ে ঢাকায় ফিরে যায় দাদা। মুক্তি পায়। আমি একা। আমার সংগ্রাম চিরকালই আমার একার।
 
০৮. নিরাপদ বাড়ির কবিতা


অ.

সত্য বললে কিছু লোক আছে খুব রাগ করে, এখন থেকে আর সত্য বোলো না তসলিমা। গ্যালিলিওর যুগ নয় এই যুগ, কিন্তু এই একবিংশ শতাব্দীতেও সত্য বললে একঘরে করে সমাজ, দেশছাড়া করে দেশ। গৃহবন্দি করে রাষ্ট্র, রাষ্ট্র শাস্তি দেয়, সত্য বোলো না।

তার চেয়ে মিথ্যে বলো, বলো যে পৃথিবীর চারদিকে সূর্য ঘোরে, বলো যে সূর্যের যেমন নিজের আলোআছে, চাঁদেরও আছে,বলল যে পাহাড়গুলো পৃথিবীর গায়ে পেরেকের মতো পুঁতে দেওয়া, বলল যে পুরুষের পাঁজরের হাড় থেকে নারীকে বানানো, বলো যে নারীর ঘাড়ের কী যেন একটা হাড় খুব বাঁকা। বলল যে শেষ-বিচারের দিনে মানুষেরা সব কবর থেকে, ছাই থেকে, নষ্ট হাড়গোড় থেকে টাটকা যুবক যুবতী হয়ে আচমকা জেগে উঠবে, স্বর্গ বা নরকে অনন্তকালের জন্য জীবন কাটাতে যাবে। তুমি মিথ্যে বলো তসলিমা। বলো যে বিশ্ব ব্রহ্মারে অগুনতি গ্রহ, উপগ্রহ, নক্ষত্ররাজি মিথ্যে, মাধ্যাকর্ষণ শক্তি মিথ্যে, মানুষ চাঁদে গিয়েছিলো, মিথ্যে।

মিথ্যে বললে তুমি নির্বাসন থেকে মুক্তি পাবে, তুমি দেশ পাবে, প্রচুর বন্ধু পাবে, হাত পায়ের শেকল খুলে দেওয়া হবে, তুমি আলো দেখবে, আকাশ দেখবে। একা একা অন্ধকারে হমুখো মৃত্যুর মুখে ছুঁড়ে দেবে না তোমাকে কেউ।

তুমি সত্য বলো না তসলিমা, বাঁচো।

.

আ.

আমার শহর যাকে বলেছিলাম, সে শহর আমার নয়, সে শহর ধুরন্ধর রাজনীতিক, অসৎ ব্যবসায়ী, আর নারী-পাচারকারীর শহর। বেশ্যার দালালের শহর, লম্পটের শহর। ধর্ষকের শহর সে শহর। আমার শহর নয়, সে শহর কেউ খুন বা ধর্ষিতা হলে, অত্যাচারিত হলে কিছু যায়-আসে-না-দের শহর। আমার শহর নয়, সে শহর মুখে-এক-মনে-আরেকদের শহর। বস্তির না-খাওয়াদের পাশ দিয়ে নির্বিকার হেঁটে যাওয়াদের শহর, ফুটপাথে মরে থাকা-ভিখিরিকে আলগোছে ডিঙিয়ে যাওয়াদের শহর। বিপদের আঁচ পেলে তড়িঘড়ি গা-বাঁচানোদের শহর। অন্যায়ের স্তূপে বসে মুখ-বুজে-থাকাঁদের শহর। আমার নয়। ইহ আর-পরলোক নিয়ে-বঁদ-হয়ে-থাকাঁদের শহর, জ্যোতিষীর শহর, আখের-গুছোতে-ব্যস্ত থাকাঁদের শহর, সুযোগসন্ধানীর শহর।

সে শহর আমার শহর নয়। কিছুতেই। সে মিথুকের শহর। কূপমন্ডুকের শহর। ঠগ, জোচ্চোরের শহর, আমার নয়। সে শহর সুবিধেবাদীর, স্বার্থান্ধর, পাঁড় ধর্মান্ধদের শহর। তাদের শহরে আমরা গুটিকয় মুক্তচিন্তার মানুষ, কিছু যুক্তিবাদী, প্রতিবাদী, কিছু সৎ, সজ্জন বড় ভয়ে ভয়ে বাস করি।

.

ই.

রাত তিনটেয় ঘুম ভেঙে গেলে এখন আর বিরক্ত হই না। রাতে ভালো ঘুম না হলে দিনটা ভালো কাটে না–এরকম বলে লোকে। দিন যদি ভালো না কাটে, তাতে কি কিছু যায় আসে! আমার দিনই বা কেন, রাতই বা কেন। দিন দিনের মতো বসে থাকে দূরে, রাতও রাতের মতো, ঘুমিয়ে থাকার গায়ে মুখ গুঁজে গুটিশুটি শুয়ে থাকে জেগে থাকা। এসব দিন রাত, এসব সময়, এসব দিয়ে আমার করার কিছু নেই, জীবন আর মৃত্যু একাকার হয়ে গেলে কিছু আর করার থাকে না কিছু দিয়ে। আমি এখন মৃত্যু থেকে জীবনকে বলে কয়েও সরাতে পারি না, জীবন থেকে মৃত্যুকে আলগোছে তুলে নিয়ে রাখতেও পারি না কোথাও আপাতত।

.

ঈ.

বন্দুক হাতে সেনারা ঘুরছে চারদিকে, মাঝখানে নিরস্ত্র আমি। সেনারা কেউ আমাকে চেনে না , নিরস্ত্র নারীর দিকে মাঝে মাঝে অদ্ভুত চোখে তাকায়। কেউ জানে না এখানে হঠাৎ কী কারণে আমি! ময়লা শরীর, মলিন কাপড়চোপড়, মনমরা উড়ুক্কু চুল, গায়েপায়ে শেকল নেই আমার, কিন্তু কোথাও না কোথাও আছে, টের পায় ওরা, চাইলেও দু’পা এগোতে পারবো না টের পায়। ওদের চোখের তারায় বীভৎস এক টের পাওয়া দেখি। বন্দুকগুলো, জানে ওরা, ভয় দেখাতে, বেয়নেটগুলো, বুটজুতোগুলো ভয় দেখাতে। ভয় না পেলে ওরা আঘাত পাবে খুব, কাউকে আঘাত দেওয়ার অধিকার আমার আইনত নেই। ওরা যদি ওপরতলায় খবর পাঠিয়ে বলে, এর তো দেখি ডর ভয় নেই। শেকল ভাঙতে চাইছে প্রাণপণে। ওপরতলা আমাকে নির্ঘাত ফাঁসি দেবে। ফঁসির দিনক্ষণ ঠিক হলে, খেতে দেবে মাছের ঝোল, ইলিশ চিংড়ি ইত্যাদি।

যদি বলি, খাবো না! ফাঁসির মঞ্চে উঠে যদি একটাও দীর্ঘশ্বাস না ফেলি? গলায় দড়ি পরাবার পরও যদি ভয় না পাওয়ার দুঃসাহস আমার হয়?

.

উ.

কয়েকবছর ধরে আমি মৃত্যুর খুব কাছে, প্রায় মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছি। আমার মার সামনে, আমার বাবা, প্রিয় কিছু মানুষের সামনে বাকরুদ্ধ দাঁড়িয়ে আছি কয়েক বছর। কয়েক বছর ধরে আমি জানি না ঠিক বেঁচে আছি কি না, কয়েক বছর ধরে বেঁচে থাকা এবং না থাকার ব্যবধান কমে কমে শূন্যে এসে সুতোর মতো নড়ছে। কয়েক বছর ধরে আমার ভেতরে বাইরে যে মানুষটা বাস করে, সে বীভৎস বোবা একটা মানুষ, যার বৃক্ষ থেকে শেষ শুকনো পাতাটাও ঝরে গেছে, জীবন থেকে জন্মের মতো বিদেয় নিয়েছে বসন্ত। আমার যদি মৃত্যু হয় আজ রাতে, কেউ কিছু বোলো না, শুধু কোথাও কোনও শিউলি গাছের নিচে একটা এপিটাফ পুঁতে দিও, কয়েক বছর ধরে লেখা আমার এপিটাফ, সাদা কাগজের গায়ে সাদা। রঙে, সযত্নে লেখা এপিটাফ।

.

ঊ.

কোনও কবিকে কি কখনও গৃহবন্দি করা হয়েছিলো কখনও? কবি নিয়ে রাজনীতি অনেক হয়েছে হয়তো, কবি নিয়ে ইট পাটকেলও হয়েছে, আগুন হয়েছে, কবিকে কেউ গৃহবন্দি করেনি, কোনও দেশ। এই ভারতবর্ষ, এই সভ্যতা, এই একবিংশ শতাব্দী, কবিকে গ্রহণ করেছিলো, মুহূর্তেবর্জনও করেছে এর বালখিল্য ধর্ম, এর নিষ্ঠুর রাজনীতি। কোনও অপরাধ করেনি কবি, কবি আজ গৃহবন্দি। কবি এখন আকাশ না দেখে দেখে জানে না আকাশ কেমন দেখতে, মানুষ না দেখে দেখে জানে না মানুষ কেমন, কবির সামনে এক জগৎ অন্ধকার ফেলে চলে গেছে তারা, তারা আর এ পথ মাড়াবে না বলে গেছে। আজ একশ পঞ্চান্ন দিন কবি গৃহবন্দি, একশ পঞ্চান্ন দিন কবি জানেনা হৃদয় আছে এমন কেউ পৃথিবীতে আর বাস করে কি না, একশ পঞ্চান্ন দিন কবি জানে না, কবি বেঁচে আছে কি নেই। কার কাছে সে তার দিনগুলো ফেরত চাইবে, অন্ধকার সামনে নিয়ে বসে কবি ভাবে, কে তার জীবনে দেবে রোদ্দুর ফিরিয়ে, কে তাকে নিভৃতে জীবনের মন্ত্র দেবে কোনও একদিন। অন্তত সান্ত্বনা দিতে কবিকে তো বলুক মানুষ, এর আগে গৃহবন্দি ছিল যারা, অধিকাংশই কবি ছিল–নিঃসঙ্গতা থেকে মনে মনেও কিছুটা মুক্তি পাক সে।

.

ঋ.

চেয়েছিলাম মানুষের অন্ধত্ব দূর করতে, চেয়েছিলাম মানুষের মোহর করা হৃদয় থেকে বৈষম্যের, হিংসের, অন্ধকারের আর অসুস্থতার শেকড় উপড়ে ফেলে ভালোবাসা রোপণ করতে। আমার চাওয়ার শাস্তি আমাকে দিয়েছে প্রিয় ভারতবর্ষ।

.

এ.

কিন্তু কী করে দুশ্চিন্তামুক্ত হবে এই অজ্ঞাতবাসে, একটা স্বাধীনচেতা মানুষকে জন্মের মতো তুলে এনে আচমকা খাঁচায় বন্দি করলে কী করে দুশ্চিন্তামুক্ত হবে সে! খাঁচা থেকে আদৌ কোনওদিন মুক্তি পাবে কি না, মানুষের কোলাহলে মানুষের মতো কোনওদিন জীবনখানি যাপন করতে পারবে কি না, জানতে না পারলে দুশ্চিন্তামুক্ত কী করে হবে সে! আলোর মানুষেরা কতদিন পারে অন্ধকারে অন্ধের মতো সাঁতরাতে। আমার শরীরে তীরের মতো বিঁধে রয়েছে দুশ্চিন্তা, যতক্ষণ ওই খাঁচা থেকে মুক্তি নেই, ততক্ষণ তীর থেকেও নেই।

.

ঐ.

কাল রাতে দেখি একটি টিকটিকি কোত্থেকে লাফিয়ে গায়ে পড়ে বাহু বেয়ে আমার ঘাড়ের দিকে চলে গেল, ঘাড় পার হয়ে মাথার দিকে, চুলের জঙ্গলে শরীর আড়াল করে দ্বিতীয় টিকটিকির দিকে ঘণ্টা দুয়েক অপলক তাকিয়ে থেকে ভোররাত্তিরের দিকে কানের পাশ দিয়ে নেমে শিরদাঁড়ায় গিয়ে বসে রইল। দ্বিতীয়টি স্থির শুয়ে ছিল আমার ডান পায়ের ঘঁটু থেকে ইঞ্চি দুয়েক নিচে। সারারাত একচুলও নড়েনি। ওদের সরাতে চেয়ে ব্যর্থ হয়ে অগত্যা আমি যা করছিলাম, তাই করি, চোখ বুজে পড়ে থাকি। মনে মনে একশ থেকে এক অবধি বারবার করে গুনি। কোনও কারণ নেই গোনার, তারপরও গুনি।

যে বিছানায় আমি ঘুমোচ্ছি, দীর্ঘদিন হল সেটি আধোয়া কাপড়, এঁটো বাসন, হিজিবিজির খাতা, চায়ের দাগে বাদামি হয়ে থাকা পুরোনো পত্রিকা, চুল আটকে থাকা চিরুনি, মিইয়ে যাওয়া মুড়ি, খোলা ওষুধপত্র, কালি ফুরিয়ে যাওয়া কলম ইত্যাদির স্থূপ। দুশর মতো বড় বড় কালো পিঁপড়ে সারা বিছানা জুড়ে কদিন হল নোঙর ফেলেছে। আটঘাট বেঁধে লেগে গেছে নতুন বসত তৈরি করতে।

আমাকে দখল করে নিচ্ছে ওরা। ওরা খুব ক্ষুদ্র প্রাণী। কুঁকড়ে থেকে থেকে দিন দিন ওদের মতোই ক্ষুদ্র হয়ে যাচ্ছি আমি। এ অবধি একটি পিঁপড়েও, আশ্চর্য, আমার শরীর জুড়ে উৎসব করছে ধ্রুপদী নৃত্যের, ভুলেও কামড় দেয়নি। আমাকে, আমার বিশ্বাস, ওদেরই একজন মনে করে ওরা!!

সম্ভবত মানুষের জগতের চেয়েও এই পোকামাকড়ের জগতেই বেশি নিরাপদ আমি।

.

ও.

দিনের পর দিন যাচ্ছে, স্নান করি না। মাস পেরোচ্ছে, গা থেকে দুর্গন্ধ বেরোচ্ছে, স্নানের তবু কোনও ইচ্ছে জাগে না, কেনই বা স্নান করবো, কী লাভ স্নান করে। এক অদ্ভুত অনীহা আমাকে অধিকার করে রাখে।

তিনবেলা লোক আসে খাবার নিয়ে পছন্দ হোক বা না হোক, খেতে হয়। না খেয়ে যদি বাঁচা যেত–বলে দিতাম কাল থেকে যাই দিক, অন্তত খাবারটা যেন না দেয়।

ঘুমোতে যাবার আগে ভয় হয়, যদি কিছু হয়! যদি আর না জাগি! ঘুমোলে চমকে চমকে বার বার উঠে যাই, আশেপাশে তাকাই, আমার ঘর কি এ ঘর? না, এ আমার ঘর নয়।

নির্বাসন নেহাতই একটা দুঃস্বপ্ন, এ সত্যি নয়–এই স্বপ্নটি সারাদিন দেখি, ঘুমোলে স্বপ্ন যদি উবে যায়, ঘুমোতে ভয় হয়।

চার দেওয়াল ঘেরা ওই চতুষ্কোণ ঘরটির মধ্যেই হাঁটাচলা করো যদি নিতান্তই করতে হয়–

এরকমই আদেশ এসেছে। ঘর ঘরের মতো পড়ে থাকে, আমি এক কোণে আদেশে অবশ হয়ে, স্তব্ধ বসে ভাবি, বিশাল বিস্তৃত এই পৃথিবী, কবে থেকে এত কৃপণ হল!

জেলেও শুনেছি কিছু নিয়ম থাকে, দেখা সাক্ষাৎএর সময় ইত্যাদি নাকি থাকেই, আমারই কিছু নেই। স্বজন বন্ধু বলতে কিছু থাকতে নেই এক আমারই, জেলের সুবিধে চেয়ে আবেদন করি প্রতিদিন, নিরুত্তর সবাই।

.

ঔ.

এভাবেই, যেভাবে রেখেছে আমাকে, সেভাবেই থাকতে হবে, যদি থাকি, যদি নিতান্তই থাকতে চাই এদেশে। এভাবেই কারাগারে, বন্ধ ঘরে, একা। কতদিন, কত মাস বা বছর? তার কোনও ঠিক নেই। কোনওদিন কি জীবন ফিরে পাবো? ঠিক নেই।

কী কারণ এই বন্ধ ঘরের? বেরোলেই দেশের দশটা লোকের মৃত্যু হতে পারে।

চমকে উঠি। –আমার কারণে? চোখ নিচু করে লোক বলে, –হ্যাঁ। বলি, –একবার মুক্তি দিয়েই দেখুন, দেখুন কতটা যুক্তিহীন এই অভিযোগ। ওদিকে মানুষ তো ভেবে বসে আছে, আমার জন্য বুঝি সব আয়োজন, নিচ্ছিদ্র নিরাপত্তা আমার জন্য, আমি যেন না মরি! কাউকে না কাউকে নিরাপত্তা দিতে, হয়তো এ পৃথিবীরই নিয়ম, কাউকে না কাউকে হারিয়ে যেতে হয় অদ্ভুত আঁধারে। আমার বন্দিত্ব দশটা লোককে নিরাপত্তা দিচ্ছে, আমার বন্দিত্ব দশটা লোককে অভাবনীয় নিশ্চিন্তি দিচ্ছে,

খুব জানতে ইচ্ছে করে, কারা সেই দশজন? তারা কি রাস্তার লোক নাকি রঙিন দালানবাড়ির লোক! তারা কি আদপেই লোক, নাকি লোকেদের লোকাতীত লোকনীতি? কাঁদের বাঁচাতে আজ আমাকে প্রতিদিন দেখতে হচ্ছে মৃত্যুর বীভৎস মুখ!

.

ক.

এমন একটা নিরাপদ বাড়িতে আমাকে বাস করতে হচ্ছে যেখানে ভালো না লাগলে বলতে পারার আমার কোনও অধিকার নেই যে ভালো লাগছে না। এমন একটা নিরাপদ বাড়ি যেখানে কষ্ট পেতে থাকবো আমি, কিন্তু কাঁদতে পারবো না। চোখ নামিয়ে রাখতে হবে আমাকে, কেউ যেন দেখতে না পারে কোনও অমীমাংসিত যন্ত্রণা।

এমন একটা বাড়ি যেখানে ইচ্ছেগুলোকে প্রতিদিন ভোরবেলা খুন হয়ে যেতে হয়, আর সন্ধের আগে আগেই বাড়ির উঠোনে পুঁতে দিতে হয় ইচ্ছের মলিন মৃতদেহ।

দীর্ঘ দীর্ঘশ্বাস ফেলে নৈঃশব্দ্য ভাঙি নিরাপদ বাড়ির, দীর্ঘশ্বাসের শব্দ ছাড়া আর কোনও শব্দ নেই বাড়ির বাইরে বা ভেতরে। প্রতিদিন ভয়ে ভয়ে ঘুমোতে যাই, ভয়ে ভয়ে জাগি, নিজের ছায়ার সঙ্গে যতক্ষণ জেগে থাকি মনে মনে কথা বলি। জানি না কোত্থেকে বিষদাত সাপ এসে থিকথিকে ক্রোধ আর ঘৃণা ছড়াতে ছতে সারাদিন আমার শরীর বেয়ে হাঁটাহাঁটি করে, হিসহিস করে বলতে থাকে, চলে যাও, সীমান্ত পার হয়ে দূরে কোথাও, কাক পক্ষী না দেখে কোনও দুর্গম পর্বতের দিকে কোথাও চলে যাও। ছায়াটির শরীর বেয়েও সাপ বলতে বলতে যায়, যাও, জন্মের মতো যাও। বন্ধুরা, প্রার্থনা করো, নিরাপদ বাড়ি থেকে কোনও একদিন যেন নিরাপদে বেরোতে পারি বেঁচে। প্রার্থনা করো, যেন কোনও একদিন একটি অনিরাপদ বাড়িতে বাস করার সৌভাগ্য আমার হয়।

.

খ.

একটু মানুষ দেখতে দেবেন? রাস্তার মানুষ? মানুষ হাঁটছে, হাসছে, মানুষ ডানদিকে যেতে গিয়ে কী মনে হল বাঁদিকে হেঁটে গেল, মানুষ মাঠে, দোকানে, সিনেমায়, জলসায়, থিয়েটারে। মানুষ দৌড়োচ্ছে। মানুষ গাড়িতে, বাসে, ট্রামে, ট্রেনে, মানুষ চলছে, দেবেন?

একটু মানুষ দেখতে দেবেন? বাড়িঘরের মানুষ, ভালোবাসছে, স্বপ্ন-দেখছে মানুষ? ভাবছে। দেবেন দেখতে?

‘জানালার ফাঁক ফোকর দিয়ে যেটুকু ছিটেফোঁটা মেঘ বা রোদ্র দেখা যায়, তা দেখেই বাঁচতে হবে’, ‘মানুষ’, ওঁরা বলে দিয়েছেন ‘হবে না। আমার মানবজীবন এভাবেই পার করতে হবে মানুষবিহীন।

.

গ.

নিজের দেশই যদি তোমাকে দেশ না দেয়, তবে পৃথিবীতে কোন দেশ আছে তোমাকে দেশ দেবে, বলো! ঘুরে ফিরে দেশগুলো তো অনেকটা একইরকম, শাসকের চেহারা চরিত্র একইরকম। কষ্ট দিতে চাইলে একইরকম করে তোমাকে কষ্ট দেবে, একইরকম আহাদে সুঁই ফোঁটাবে, তোমার কান্নার সামনে পাথর-মুখে বসে মনে মনে নৃত্য করবে। নাম ধাম ভিন্ন হতে পারে, অন্ধকারেও ঠিকই চিনবে ওদের চিৎকার, ফিসফিস, হাঁটাচলার শব্দ শুনে বুঝবে কারা ওরা, যেদিকে হাওয়া, সেদিকে ওদের দৌড়ে যাওয়ার সময় হাওয়াই তোমাকে বলবে কারা ওরা। শাসকেরা শেষ অবধি শাসকই।

যতই তুমি নিজেকে বোঝাও কোনও শাসকের সম্পত্তি নয় দেশ, দেশ মানুষের, যারা ভালোবাসে দেশ, দেশ তাদের। যতই তুমি যাকে বোঝাও এ তোমার দেশ, তুমি একে নির্মাণ করেছো তোমার হৃদয়ে, তোমার শ্রম আর স্বপ্নের তুলিতে এঁকেছো এর মানচিত্র। শাসকেরা তোমাকে দূর দূর করে তাড়ালে কোথায় যাবে! কোন দেশ আর দরজা খুলে দাঁড়ায় তাড়া খাওয়া কাউকে আশ্রয় দিতে! কোন দেশ তোমাকে আর কোন মুখে দেশ দেবে বলো!

তুমি কেউ নও এখন আর, মানুষও বোধহয় নও। হারাবার তোমার বাকিই বা কী আছে! এখনই সময় জগৎকে টেনে বাইরে এনে বলে দাও, তোমাকে ওখানেই দাঁড়াবার জায়গা দিক, ওখানেই ঠাঁই দিক, দেশের সীমানা ফুরোলে ‘কারও মাটি নয়’ অথবা নো ম্যানস ল্যান্ড বলে যেটুকু মাটি থাকে, সেই অবাঞ্ছিত মাটিই, সেটুকুই না হয় আজ থেকে তোমার দেশ হোক।

.

ঘ.

ভারতবর্ষ শুধু ভারতবর্ষ নয়, আমার জন্মের আগে থেকেই ভারতবর্ষ আমার ইতিহাস। বিরোধ আর বিদ্বেষের ছুরিতে দ্বিখন্ডিত হওয়া, ভয়াবহ ভাঙন বুকে নিয়ে উধ্বশ্বাস ছোটা অনিশ্চিত সম্ভাবনার দিকে আমার ইতিহাস। রক্তাক্ত হওয়া ইতিহাস, মৃত্যু ইতিহাস। এই ভারতবর্ষ আমাকে ভাষা দিয়েছে, আমাকে সমৃদ্ধ করেছে সংস্কৃতিতে। শক্তিময়ী করেছে। স্বপ্নে। এই ভারতবর্ষ এখন ইচ্ছে করলেই কেড়ে নিতে পারে সব ইতিহাস, আমার জীবন থেকে আমার অস্তিত্ব, আমার স্বপ্ন থেকে আমার স্বদেশ।

নিঃশেষ করতে চাইছে বলে আমি আজ নিঃস্ব হব কেন! ভারতবর্ষ তো জন্ম দিয়েছে। মহাত্মাদের। আজ তাঁরা হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন আমার দিকে, এই অসহায়, এই অনাথ, এই অনাকাঙ্খিত আমার দিকে। দেশের চেয়েও দীর্ঘ এই হাত, দেশ কাল ছাপিয়ে এই গোটা কয় হাত আমাকে জাগতিক সব নিষ্ঠুরতা থেকে বড় মমতায় নিরাপত্তা দেয়। তাদেরই আমি দেশ বলে আজ ডাকি, তাঁদের হৃদয়ই আজ আমার সত্যিকার স্বদেশ।

.

ঙ.

আমার দেশটি তাকিয়ে তাকিয়ে আমার যন্ত্রণা দেখছে আজ এক যুগেরও বেশি। আমার দেশটি দেশে দেশে আমার বন্দিত্ব দেখছে, দূরত্ব বেড়ে গেলে দূরবীন লাগিয়ে দেখছে, বেজায় হাসছে,পনেরো কোটি মানুষ তারিয়ে তারিয়ে ভোগ করছে আমার সর্বনাশ।

আমার দেশ এমন ছিল না আগে, দেশের হৃদয় বলে কিছু ছিল, দেশে মানুষ বলে কিছু ছিল। দেশ এখন আর দেশ নেই। কতগুলো স্থবির নদী শুধু, কতগুলো গ্রাম আর শহর। এখানে ওখানে কিছু গাছপালা, কিছু ঘরবাড়ি, দোকানপাট। আর, ধূসর চরাচরে মানুষের মতো দেখতে কিছু মানুষ।

আমার দেশে এককালে প্রাণ ছিল খুব, এককালে কবিতা আওড়াতে খুব মানুষ, এখন কবিকে নির্বাসন দিতে কেউ দু’বার ভাবে না, এখন কবিকে মাঝরাত্তিরে নিশ্চিন্তে ফাঁসি দিয়ে ফেলে গোটা দেশ, পনেরো কোটি মানুষ তারিয়ে তারিয়ে ভোগ করে মর্মন্তুদ মৃত্যু।

দেশটি ভালোবাসতে জানতো আগে, দেশ এখন হিংসে শিখেছে, চোখ রাঙানো শিখেছে। দেশের হাতে এখন ধারালো সব তলোয়ার থাকে, দেশের কোমরে গোঁজা মারণাস্ত্র, মারাত্মক সব বোমা, দেশ এখন আর গান গাইতে জানে না।

দুনিয়া তছনছ করে দেশ-খুঁজছি এক যুগেরও বেশি, এক যুগেরও বেশি ঘুম নেই, উন্মাদের মতো দেশ দেশ করে দেশের কিনারে এসে দেশকে স্পর্শ করতে দু হাত বাড়িয়ে আছি। আর শুনি কিনা, হাতের কাছে দেশ যদি একবার পায় আমাকে, তবে নাকি আমার রক্ষে নেই।

.

চ.

আমার বাংলা আর বাংলা নেই, সোনার বাংলা এখন ক্ষয়ে যাওয়া, আমার রুপোলি বাংলার গায়ে মরচে, পূর্ব পশ্চিম আজ একাকার। ধর্মান্ধরা ছড়ি ঘোরায়, ভীতুরা মাথা নত করে হাঁটে, নিশ্চিতই কবন্ধের যুগ এই যুগ। সাহস আর সতোর নির্বাসন হয়ে গেছে, বাংলা এখন কুচক্রী শাসক আর তাঁবেদারে ঠাসা, বাকিরা নির্লিপ্ত, জীবনযাপনকারী, হয় জড়, নয় জঞ্জাল।

এই বাংলার জন্য যত জল আমার দুচোখে আছে দিলাম, কোনওদিন একদিন যেন উর্বর হয় মাটি, যেন জন্ম নেয় মানুষ, যেন দুর্ভাগা-বাংলা মানুষের বাসযোগ্য হয় কোনওদিন একদিন।

.

ছ.

মরে গেলে লাশখানা রেখে এসো ওখানে, মেডিক্যালের শব-ব্যবচ্ছেদ কক্ষে, মরণোত্তর দেহদান ওখানেই করেছি, রেখে এসো কলকাতা শহরে লাশ। জীবিত নেবে না আমাকে ও শহর। মরলে নেবে তো? প্রিয় কলকাতা!

.

জ.

মিনু নেহাত বেড়াল নয়। আমার কন্যা। কন্যাটিকে ফেলে আসতে হয়েছে কলকাতায়, নাওয়া খাওয়া বন্ধ করে বসেছিল দীর্ঘদিন, এখনও মলিন মুখে জানালায় বসে থাকে, দিন গোনে। শীত কাটাতে হল একা একা, নরম লেপের তলায় আমার উষ্ণতা পেতে পেতে এ বছর আর ঘুমোনো হল না ওর। আমার অপেক্ষা করে ওর শীত গেল, ছুটির গরমকাল যেন না যায়! যে-করেই হোক আমাকে ও চায়, ফিরে পেতে চায় নির্ভাবনার সেইসব দিন।

গড়িয়াহাট থেকে তুলে আনা শিশুটি কয়েকবছরে ধীরে ধীরে বুকের ধন হয়ে উঠেছিল। স্বজন বলতে এক আমিই ছিলাম ওর, জগৎ বলতে এক আমিই। আমার কিশোরী কন্যাটি তার ঘর বাড়ি, তার বিছানা বালিশ ছেড়ে রোদ্দুরে ভেসে যাওয়া প্রিয় বারান্দাটি ছেড়ে, খেলনা-ইঁদুর ছেড়ে মন-মরা বসে আছে স্যাঁতসেঁতে অন্ধকারে, দিনশেষে চোখ ভেসে যেতে থাকে চোখের জলে। কলকাতা, আমাকে দাওনি, আমার নিরাশ্রয় কন্যাটিকে আশ্রয় দিও, আমাকে রাখোনি, আমার অনাথ কন্যাটিকে দেখে রেখো।

.

ঝ.

কূপমন্ডুকের দল বিপক্ষে গেলেও, কট্টরপন্থীরা আস্ফালন করলেও, কবন্ধরাঘিরে ধরলেও, মানুষ থাকে পাশে, শুভাকাঙ্ক্ষীরা থাকে। যখন রাজ্য তাড়ায়, যখন ক্ষমতা বিপক্ষে যায়, যখন রাষ্ট্রযন্ত্র বিরুদ্ধে দাঁড়ায়, মানুষ সরতে থাকে, মানুষ পালায়। শুভাকাঙ্ক্ষী বলে পরিচিতরাও নিরাপদ আড়াল খোঁজে, প্রতিষ্ঠান সরে যায়, বেসরকারি ক্ষুদ্র দলও ক্ষুদ্র গর্তে লুকোয়, স্বনামধন্যরা চোখ বুজে থাকে। বন্ধু বলে যাদের চিনি, তারাও আচমকা অন্যত্র ব্যস্ত হয়ে পড়ে।

হাতে গোনা কিছু মানুষ শুধু পাশে থাকে, নির্ভেজাল কিছু মানুষ। সাহস আর সততা সম্বল করে সত্যিকার কিছু স্বার্থহীন বন্ধু থাকে পাশে।

ওরা আজ মিছিল করছে, ওরা মোমবাতি হাতে হাঁটছে সন্ধের শহরে, জোট বেঁধে বিচার চাইছে অবিচারের। কে বলেছে এই সংগ্রাম একার আমার? বাক স্বাধীনতা রক্ষা হলে এদেশের মানুষেরই হবে, এ আমার একার নয়, স্বপ্নবান মানুষের সবার সংগ্রাম। এই দুঃসময় আমার একার নয়, আমাদের সবার দুঃসময়। যদি কোনওদিন জয় হয় মুক্তচিন্তার–ব্যক্তি আমার চেয়ে শতগুণ হবে ভারতবর্ষের জয়।

এ আমার একার কিছু নয়, আমার পাশে ওরা নয়, বরং ওদেরই পাশে, ওই অবস্থান ধর্মঘটের পাশে, অনশনের পাশে, ওই মিছিলের মানুষের পাশে, ভারতবর্ষের পাশে, আমি আছি, দূর কারাবাস থেকেও আছি, ঘোর অনিশ্চয়তা আর অন্ধকার থেকেও আছি পাশে।

ঞ.

বেঁচে আছি!

.

ট.

তোমাকে তোমার বাড়ি থেকে ছিনতাই করে নিয়ে গেছে ওরা, তোমার জীবন থেকে তোমাকে কেড়ে নিয়ে বন্দি করেছে ব্যালটবাক্সে। কোনও স্বজনের একটি হাতও, সামান্য সুযোগ নেই, একবার স্পর্শ করো, তোমারই জীবনের কণামাত্র তোমার অধিকারে নিয়ে তোমার সুযোগ নেই একবার যাপন করো। মানো বা নাই মানো, অন্যের সম্পত্তি এখন তুমি, তোমার কিছুই আর তোমার নেই, একঘর হাহাকার ছাড়া তোমার জন্য বরাদ্দ একফোঁটা কিছু নেই। স্বাধীনতা সাত সমুদ্র তের নদীর ওপারের ভুতুড়ে জিনিস।

ওদের ইচ্ছে তুমি উন্মাদ হও, স্নায়ুতন্ত্রে যদি খুব শক্তি ধরো, উন্মাদ হতে যদি না-ই পারো, তবে দেশ ছাড়ো, যে করেই হোক ছাড়ো, এ দেশ তোমার নয়। মাটি কামড়ে কতদিন কে-ই বা পড়ে থাকতে পারে! এত ঘৃণা, এত থুতু, এত লাথি কতদিন সইতে পারে মাথা উঁচু করে বাঁচতে শেখা মানুষ। ওরা চাইছে, উন্মাদ যদি না-ই হও, দেশ যদি না-ই ছাড়ো, অন্তত মরো।

তুমি সাফ কথা জানিয়ে দিয়েছে গতকাল, যা হয় তা হোক, আপাতত কোনওটিরই সম্ভাবনা নেই। কৃতজ্ঞতা জানিয়ে বিনীত কণ্ঠে বলেছে, দিনে দিনে তোমাকে অসম্ভব সহিষ্ণু করে গড়ে তোলার পেছনে অবদান ওদেরই। এখন আগুনে পোড়ালেও তুমি পুড়ে পুড়ে আর দগ্ধ হবে না, বড়জোর যদি কিছু হও ইস্পাত হবে।

.

ঠ.

আমি তো মানুষ ছিলাম, সমাজ সংসার ছিল, স্বপ্ন ছিল। বারান্দার ফুলগাছ, বাজার হাট, বিকেলবেলার থিয়েটার, বন্ধুর বাড়ি–আর সবার মতো আমারও ছিল। হঠাৎ কিছু লোক তুড়ি মেরে মুহূর্তে আমাকে নিষিদ্ধ বস্তু বানিয়ে দিল!

কার কী নষ্ট করেছিলাম আমি? কিছুই তো ছিল না আমার, শুধু ওই স্বপ্নটুকু ছিল, ওই স্বপ্ন সম্বল করে বেঁচে ছিলাম সুখে দুখে, নিজের মতো। ব্যস্ত শহরের ভিড়ে, রোদে ভিজে, আর সব মানুষের মতো আমার ওই সামান্য বেঁচে থাকাটুকু–কেন কেড়ে নিতে হবে কারও!

নিষিদ্ধ বস্তুকে গর্তে পুরে রেখেছে রাজার লোকেরা। ধর্ম-ধ্বংস-করা ডাইনিকে অবশেষে পাকড়াও করা গেছে ঢাড়া পিটিয়ে পুরো বিশ্বকে জানিয়ে দিচ্ছে খবর, ধর্মান্ধদের হ্যাঁ করা মুখে ঢেলে দিচ্ছে সুস্বাদু খাদ্য, সন্ত্রাসীদের জিভ থেকে ঝরানো হচ্ছে গনগনে লাভা।

কারও খেলার জিনিস তো নয়। আমার জীবন তো জীবন! জনতার আদালত বলে কোনও আদালত কোথাও কি নেই?

.

ড.

বাড়িটা তুই, আছিস কেমন? তোর বুঝি খুব একলা লাগে? আমারও তো, আমারও খুব। রাত্তিরে কি ভয় করে না? জানলাগুলো হঠাৎ করে ধড়াস করে খুলে গেলে? কেউ এসে কি দরজা নাড়ে? ধুলোয় ধূসর ঘরবারান্দায় কেউ ঢোকে কি, ভয় জাগে যে? চোর ডাকাতের বাড় বেড়েছে। নাকি হাওয়াই ঢোকে, ঝড়ো হাওয়া! হাওয়াই বা কোথায় এখন, সম্ভবত আমিই ঢুকি, মনে মনে আমিই বোধহয়। হেঁটে বেড়াই ঘরগুলোতে, অন্ধকারে চিনতে পারিস। পায়ের আওয়াজ বুঝিস কিছু? বাড়িটা তুই, লেখার ঘরটা দেখে রাখিস, সবকিছুই তো ওই ঘরে রে, জীবনটাই লেখার জীবন, ন-আলমারি বইপত্তর, লেখাপড়ার দুনিয়াটা, ওসব ছেড়ে ভালো থাকি! মনে মনে আমিই বোধহয় অশরীরী ঘুরি ফিরি ফেলে আসা ঘরদুয়ারে চোখের জল ফেলে আসি! বারান্দার গাছগুলোতে জল যে দেবে, কেউ তো নেই! চোখের জলে বাঁচবে না গাছ? চোখে আমার এক নদী জল, এক সমুদ্র চাস যদি বল, পাঠিয়ে দেব, বাড়িটা তুই, বেঁচে থাকিস। তোকে ছাড়া নির্বাসনে এক মুহূর্ত মন বসে না, বেড়ালটাও বাড়িতে নেই, খাঁ খাঁ করছে বাড়ির ভেতর, ধুলোয় তুই ডুবে আছিস, আঁচল দিয়ে মুছে দেব, চোখের জলে ধুয়ে দেব, অপেক্ষা কর, বাড়িট। তুই। তুই কি আর শুধুই বাড়ি। তুই তো আমার হারানো দেশ। তুই তো আমার মাতৃভাষা। তুই কি আর শুধুই বাড়ি! এক যুগেরও বেশি সময় বুকের ভেতর তোকে লালন করেছি তুই জানিস তো সব। দীর্ঘকালের স্বপ্ন তুই, স্বপ্ন বলেই তোকে ডাকি, বাড়িটা তুই, বেঁচে থাকিস, আমায় একটু বাঁচিয়ে রাখিস।

.

ঢ.

আশাগুলো একটু একটু করে চোখের জলের মতো টুপটাপ ঝরে পড়ছে, আশাগুলোকে উড়িয়ে নিচ্ছে নিরাশার লু হাওয়া। এই কঠোর নির্বাসনে স্বজন বন্ধু থেকে বিচ্ছিন্ন। কোনও অপরাধ না করে আমি অপরাধী, যে কোনও মুহূর্তে মৃত্যুদন্ড ঘোষিত হবে। একটু আশার আশায় সারাদিন বসে থাকি, কোনও ফাঁক ফোকর দিয়ে যদি ভুল করেও ঢোকে। সারারাত জেগে থাকি, ধুলোর ওপরও উপুড় হয়ে আশা বলে কিছু যদি আচমকা চিকচিক করে, খুঁজি। কিছু নেই। জীবন পেতে আছি, পারো তো কিছু আশা দিও, সামান্য হলেও ক্ষতি নেই, দিও। মিথ্যে করে হলেও দিও, তবু দিও।

.

ণ.

অপরাধীরা বড় নিশ্চিন্তে যাপন করছে তাদের জীবন, ধাপ্পাবাজি, ধর্মব্যবসা, সবকিছুই দেদার চলছে, বুক ফুলিয়ে পাড়ায় হাঁটছে, আরও কী কী অপরাধ করা যায়, তার মতলব আঁটছে, অপরাধীরা চমৎকার আছে ভারতবর্ষে, তাদের গায়ে টোকা দেওয়ার দুঃসাহস কারও নেই।

তারা অন্যায় করেছে বলে, শাস্তি তারা নয়, আমি পাচ্ছি, আমি শাস্তি পাচ্ছি যেহেতু তারা আমার বিরুদ্ধে অন্যায় করেছে। তারা আমাকে দেশ ছাড়ার হুমকি দিয়েছে বলে,আমাকে দেশ ছাড়তে বাধ্য করার ব্যবস্থা চলছে সাতমাস ধরে। আমাকে হত্যা করার বেআইনি ফতোয়া জারি করেছে বলে, দেশের আইন ভেঙেছে বলে, তারা নয়, শাস্তি পাচ্ছি আমি।

অপরাধ করিনি বলে এখনও অপেক্ষা করছি। দেখছি হেঁচকা টান দিয়ে নিরপরাধের গোটা জীবনটা তুলে কোথাও কোনও অজ্ঞাতস্থানে ঝুলিয়ে রাখতে কতদিন পারে দেশ। দেখছি একশ কোটি মানুষের দেশের কতদিন লাগে অবশেষে মানবিক হতে!

এ দেশ আমার পূর্বপুরুষ বা পূর্বনারীর মাতৃভূমি বলে নয়, এরই জল-হাওয়ায় আমার বেড়ে ওঠা বলে নয়, এরই সংস্কৃতি আমাকে সমৃদ্ধ করেছে বলে নয়। আমি মানুষ বলে দাবি, মানুষের হয়ে দাবি –ভারতবর্ষকে ভালোবেসে এই দাবি–অপরাধীকে শাস্তি -দেওয়া যদি নীতি হয়, তোক, নিরপরাধকে নির্যাতন করার নীতি যেন না হয় এ-দেশের।

.

ত.

অথৈ অন্ধকারে, অদ্ভুত অজ্ঞাতবাসে পড়ে থাকা অসার আমার কাছে কেউ নেই আসে। চাঁদের দিকে চাতক পাখির মতো চেয়ে থাকি, মানুষের কাছে, আশ্চর্য, চাঁদও শিখেছে ফাঁকি। জীবনে অমাবস্যা ঢেলে দিয়ে পূর্ণিমা পালায়,পেছনে দৌড়ে দৌড়ে কত ডাকি, আয়, ফিরে আয়। চাঁদের কী আসে যায়! মানুষের কাছে দুদন্ড ইদানীং মানুষই থাকে না, দূরত্ব খোঁজে আত্মার আত্মীয়, জন্ম জন্ম চেনা।

দক্ষিণ থেকে উতল হাওয়ারা ছুটে ছুটে ছুঁতে আসে, হাওয়াই ভরসা ছিল অতপর অজ্ঞাতবাসে। হা কপাল! হাওয়াও উজাড় করে হাহাকার দিল, জীবনে যা কিছু ছিল বা না-ছিল, নিল। আকাশের কাছে কিছুই চাই না, ও আর কী দেবে? দিলে এক শূন্যতা দেবে। ও আমার যথেষ্ট আছে, ও নিয়েই আছি, ও নিয়েই ভারতবর্ষের অজ্ঞাতবাসে বাঁচি।

.

থ.

তোমরা সবাই মিলে কিছু একটা দোষ আমার বার করো, কিছু একটা দোষ তোমরা সবাই মিলে বার করো, না হলে অকল্যাণ হবে তোমাদের। সবাই মিলে তোমরা বলো কী কারণে আমাকে নির্বাসন দিয়েছে। আমার জন্য কোথাও মড়ক লেগেছে। কোথাও শিশুমৃত্যু, ধর্ষণ বা গণহত্যার মতো কোনও অপরাধ আমি করেছি, এরকম কিছু একটা বলল, নির্বাসনের পক্ষে অন্তত দুটো তিনটে যুক্তি হলেও দাঁড় করাও। যতদিন না জুৎসই কোনও দোষ ধরতে পারছো, যতদিন না কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে ঘৃণার আঙুল তুলে দেখাতে পারছে কুলাঙ্গারকে, ততদিন কী করে ক্ষমা করবে নিজেদের! কিছু একটা দোষ পেলে আমিও স্বস্তি পেতাম। নির্বাসনকে অতটা নির্বাসন বলে মনে হত না। কিছু একটা দোষ বার হোক আমিও চাই, শুভাকাঙ্ক্ষী ভেবে তোমাদের ফের আলিঙ্গন করতে আমিও চাই।

কী দোষে আমাকে সমাজচ্যুত করেছে, বলো। কিছু একটা দোষ বার করো, দোষ বার করে দোষ-স্থলন করো নিজেদের। ইতিহাসকে কেন সুযোগ দেবে কুটি করার! একখন্ড মধ্যযুগ এনে সভ্যতাকে কেন কলঙ্কিত করেছে, কিছু কারণ বার করো এর। না যদি পারো, আমাকে বাঁচাতে নয়, তোমাদের বাঁচাতেই আমাকে মুক্তি দাও..

.

দ.

অন্নদাশংকর রায় একবার বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশ তসলিমার মা, পশ্চিমবঙ্গ তসলিমার মাসি’। মায়ের চেয়ে মাসির দরদ বেশি ছিল, একটা সময় এমন কথাও বলতো লোকে।

বন বাদাড় আর নদ পেরিয়ে, মাসির কোলে এসেছিলাম কাঁদতে আমি মায়ের শোকে।

মাসিই কিনা কোল দিল না, কাঁদার জন্য কাঁধ দিল না, মাসির প্রিয় বুনো ফুল, হঠাৎ হল চক্ষুশূল। সকাল সন্ধে মাসিই তাড়ায়, মাসিই বলে মর গে যা, কোথায় যাবে অনাথ মেয়ে, কোন মুলুকে খুঁজবে মা?

.

ধ.

আমি ভালো নেই, তুমি ভালো থেকো প্রিয় কলকাতা। ভালো নেই আমি, এভাবে কেউ কোনওদিন ভালো থাকেনি কোথাও। এভাবেই তুমি আমাকে রেখেছো কলকাতা, এভাবেই নির্বাসনে, এভাবেই একঘরে করে। এভাবেই অন্ধ কূপে। পায়ের তলায় পিষছে প্রতিদিন, প্রতিদিন পিষছো পায়ের তলায়। গলাটিপে ধরেছো কথা বলেছি বলে, হাত কেটে নিয়েছো লিখেছি বলে। কাউকে হত্যা করিনি, কারও অনিষ্ট করিনি, কারও দিকে পাথর ছুঁড়িনি, মানবতার পক্ষে কিছু অপ্রিয় সত্য উচ্চারণ করেছি বলে আমাকে তোমার পছন্দ নয়। আমাকে উৎখাত করেছে আমার মাতৃভাষা থেকে, উৎখাত করেছে আমার মাটি ও মানুষ থেকে, উৎখাত করেছো জন্ম-জন্মান্তরের ইতিহাস থেকে, উৎখাত করেছো ঘর বাড়ি বাসস্থান থেকে, পৃথিবীতে আমার সর্বশেষ আশ্রয় থেকে। আমি ভালো নেই তাতে কী! তুমি ভালো থেকো, তুমি বড় বড় কবির শহর, সাহিত্যিকের শহর, দার্শনিক শুভবুদ্ধির শহর, ভারতবর্ষের সবচেয়ে প্রগতিশীল শহর তুমি, কলকাতা, তুমি তো সংস্কৃতির পীঠস্থান, কলকাতা, তুমি ভালো থেকো। তুমি সুখে থেকো প্রিয় কলকাতা, নাচে গানে থেকো, উৎসবে আনন্দে, মেলায় খেলায় থেকো সুখে। তুমি তো মহান, তুমি বিরাট, তুমি অট্টহাসি হাসো, জগৎ দেখুক।

.

ন.

একজন স্বাধীনতা সংগ্রামী প্রতিদিন এক থোকা গোলাপ পাঠাতেন আমার কলকাতার বাড়িতে। তিনি এদেশের স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম করেছিলেন, গণতন্ত্রের জন্য করেছিলেন, বাক স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম করেছিলেন তিনি, তাঁর কাছ থেকে আমি গোলাপ পেয়েছি প্রতিদিন। ক্ষমতার চাবুক মেরে যারা আমার মনকে রক্তাক্ত করছে, জীবনকে, জীবনের সব স্বপ্নকে প্রতিদিন রক্তাক্ত করছে, তারা শুধু আমাকে নয়, ওই স্বাধীনতা সংগ্রামীকেও রক্তাক্ত করছে চাবুক মেরে, প্রতিদিন। তারা জানেনা স্বাধীনতা সংগ্রামীর ওই গোলাপের রঙ রক্তের চেয়েও লাল। এখন আর গোলাপ নয়, এখন এক ঠিকানাহীন ঠিকানায় প্রতিদিন আমার জন্য মনে মনে চোখের জল পাঠান তিনি, এই জল দিয়ে আমার ক্ষতগুলোর শুশ্রূষা করি। গোলাপের স্মৃতি থেকে বিশুদ্ধ সুগন্ধ বাতাস নিয়ে এই স্বাসরোধ করা পরিবেশে খাস নিই। এই স্বাধীন দেশের গোপন কুঠুরিতে পরাধীনতার শক্ত-শেকলে বাঁধা নির্বাসিত নিঃস্ব নারী, তাকে আজ মুক্ত করার শক্তি নেই কোনও স্বাধীনতা সংগ্রামীরও। স্বাধীনতা হয়তো এ জীবনে আমার দুরূহই হবে পাওয়া। ওই গোলাপগুলোকে ডাকবো স্বাধীনতা বলে, ওই চোখের জলগুলোই আমার স্বাধীনতা।

.

প.

সারা বছর বসে থাকি এই মেলাটি আসবে বলে। এই মেলাটির অলি গলির ভিড়ের মধ্যে নতুন বইয়ের গন্ধে ঘ্রাণে, ধুলোবালির ধূসর হাওয়ায়, হারিয়ে যাওয়ার স্বপ্ন দেখি। এই মেলাটি আসবে বলে আকাশপারের উতল হাওয়ায় ইচ্ছে মতো ঘুড়ি ওড়াই। বছর বছর এই মেলাটি আসে বলেই স্যাঁতসেঁতে এক ঘরের কোণেও খুব গোপনে ভীষণ সুখে, স্বপ্নসহ বেঁচে থাকি। আমার তো আর পুজো-আচ্চা, ঈদ-বড়োদিন নেই, আমার একটি মেলাই আছে, প্রাণের মেলা,এই একটি মেলায় মানুষ দেখি কাছের মানুষ, সাত-নদী-জল সাঁতরে তবু একটুখানি ছুঁতে আসে। এই মেলাটিই ধর্মকর্ম, ধূপের কাঠি, ধানদুব্বো। এই একটি পরব, একটি সুখ-ই, নিজের জন্য তুলে রাখি। শিল্প-মেলায় আগ্রহ নেই, জুয়োর মাঠ, ব্যবসা পাতি, সন্ধে হলে উৎসবে নেই, ককটেলে নেই। এই একটি মেলাই একমাত্র। এই মেলাটিই শৈশব দেয়, কৈশোর দেয়, ব্রহ্মপুত্র পাড়ের সেসব এঁটেল মাটির আনন্দ দেয়। এই মেলাটির সারা গায়ে মাতৃভাষা, মাথার ওপর স্নেহসিক্ত মায়ের আঁচল। এই মেলাকেই অন্য অর্থে জীবন বলি।

এটিও তুমি কেড়ে নিলে? স্বদেশহারা স্বজনহারা সামান্য এই সর্বহারার সবটুকু সুখ বুকের ওপর হামলে পড়ে আঁচড়ে কামড়ে এক থাবাতে ছিনিয়ে নিতে পারলে তুমি ভারতবর্ষ? দাঁত বসিয়ে কামড় মেরে ছিঁড়েই নিলে যা-ছিল-সব? হৃদয় বলতে কিছুই কি নেই ভারতবর্ষ? হৃদয় তবে কোথায় থাকে ভারতবর্ষ?

.

ফ.

আজ যদি বেঁচে থাকতেন গান্ধিজী, যে করেই হোক বন্দি শিবির থেকে আমাকে উদ্ধার করতেন। নিরাপদে বাড়ি পৌঁছে দিতেন। এ আমি হলফ করে বলতে পারি, দিতেন। হৃদয় বলে যেহেতু তার কিছু ছিল, তিনি দিতেন। বাড়ির ঘর দোর উঠোন আঙিনায় নিশ্চিন্তে হাঁটাহাঁটি, উছলে পড়া খুশি, বিন্দু বিন্দু স্বপ্ন দিয়ে সাজানো সংসার-সমুদ্রে আমার সঞ্জীবনী সাঁতার দেখে বড় সস্নেহে হাসতেন তিনি। হৃদয় বলে যেহেতু কিছু ছিল তাঁর, হাসতেন। আমাকে আমার মতো যাপন করতে দিয়ে আমার জীবন, আমি নিশ্চিত, তিনি স্বস্তি পেতেন। গান্ধিজী যদি বেঁচে থাকতেন আজ, দেশের দুর্দশা দেখে তার দুঃখ হত। কালসাপের মতো ফঁসে ওঠা অসহিষ্ণুতার সন্ত্রাস বন্ধ করতে দেশব্যাপী অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দিতেন তিনি। নিশ্চয়ই দিতেন। আমাকে আর কতটুকু, মূলত দেশটাকেই বাঁচাতেন।

.

ব.

বরং বাঘ টাঘ নিয়ে বলো, কৃষ্ণসার হরিণ নিয়ে কথা বলে। মানুষের কথা বলোনা, মানুষ খুব ভয়ংকর। বাঘকে খাঁচাবে তো রক্ষে নেই। হরিণের গায়ে হাত তুলেছো কী মরেছো। মানুষকে খোঁচালে চলে, বোমা মেরে উড়িয়ে দিলেও ঠিক আছে। যে মানুষ যুক্তি দেখায়, তর্ক করে, ভাবে, ভাবনাটা ছড়ায়, তারা মানুষ তো নয়, আগুন।

আগুন যে করেই হোক নেভাতে হয়। যে মানুষগুলো জন্তুর মতো, ভাবনা নেই, বেশ আছে, খায় দায় ঘুমোয়, যেভাবে অন্যরা চলে, সেভাবে চলে। ওদের বাঁচিয়ে রাখো। জন্তুরা খায় দায় ঘুমোয়, আর জঙ্গলের শোভাবর্ধন করে। এই চিন্তাশক্তিহীন লোকগুলোও লোকালয় শোভিত করে আছে বহুকাল। এরাই থাকুক বেঁচে। দুধে ভাতে। চিন্তকদের কথা ছাড়ো, কৌশলে বন্দি করো ওদের, পারলে মেরে ফেলো!

ওদের কথা নয়, বরং অন্য কথা বলল। হরিণ টরিণ।

.

ভ.

একটা কথা আমার মুখ থেকে শুনবে বলে সবাই বসে আছে। একটা বাক্য শুনবে বলে বসে আছে, দুটো শব্দ শুনবে বলে, দুটো মাত্র শব্দ। আতঙ্কে,ভয়ে, বিবর্ণ হয়ে, কাঠ হয়ে, যেন বলে ফেলি একদিন, গুডবাই ইন্ডিয়া। দিন যাচ্ছে, সপ্তাহ শেষ হচ্ছে, মাস পেরোচ্ছে, মাসের পর মাস। আমার মুখের দিকে কয়েকশ রক্তচক্ষু, কয়েকশ বছর আগে বন্ধ হয়ে থাকা পুরোনো ঘড়ির কাঁটার মতো স্থির, ডানে বামে ওপরে নিচে সর্বত্র বাদুরের কানের মতো উৎসুক কান, জগতের সবচেয়ে মধুর শব্দদ্বয় শুনবে বলে, গুডবাই ইন্ডিয়া। আমি এখনও উচ্চারণ করছি না শব্দদুটো, এখনও বিশ্বাস করছি সত্যে। সততায়। বিশ্বাস করছি সৌন্দর্যে। শিল্পে। সহমর্মিতায়।

যেদিন আমাকে উচ্চারণ করতে হবে শব্দদুটো, যদি আমাকে করতেই হয়–দু’চারটে ঘৃণাই যেদিন উথলে উঠে সুনামি ঘটাবে, যদি ঘটায়ই মনুষ্যত্ব পায়ে পিষে ধর্মান্ধতার নিশান ওড়াবে মানুষ শহর নগর জুড়ে যেদিন –যেদিন আমারই রক্তের ওপর আমি লাশ হয়ে ভেসে থাকবো, ঠুকরে খাবে একপাল শকুন আমার ফুসফুস যেদিন আমাকে উচ্চারণ করতেই হবে শব্দদুটো, সেদিন যেন গভীর রাত্তির হয়, আমাকে যেন দেখতে না হয় দেশটির মুখ, দেখতে না হয় দুপুরের শান্ত পুকুর, আমগাছতলা, উঠোনের রোদ্দুর, যেন ভুলে যাই দেশটির সঙ্গে কখনও আমার কোনও আত্মীয়তা ছিল। আমি এখনও উচ্চারণ করছি না শব্দদুটো, এখনও প্রাণপণে পাথর করে রেখেছি জিভ। আমি উচ্চারণ করতে চাইছি না–এখনও চাইছি ভালোবাসার জয় হোক।

.

ম.

যাদের সঙ্গে বাস করবে বলে আমি অন্ধকূপে পড়ে আছি, অপেক্ষা করছি, এক একটা মুহূর্ত এক একটা যুগের মতো যদিও দীর্ঘ, করছি। যাদের সঙ্গে বাস করবো বলে ত্যাগ করছি আনন্দ উৎসব, জীবন যাপন, সমাজ সংসার, স্বাধীনতা, যাদের সঙ্গে বাস করবো বলে শরীর ক্ষয় করছি, ভেঙে গুঁড়ো হতে দিচ্ছি মন। যাদের সঙ্গে বাস করবো বলে প্রতিদিন জল ফেলছি চোখের, নিঃসঙ্গতার গায়ে সারারাত ধরে টুপটুপ ঝরে পড়ছে সে জল, ভেসে যাচ্ছে বয়স, যাদের সঙ্গে বাস করবো বলে বুকের মধ্যে বিশাল এক প্রত্যাশার প্রাসাদ গড়েছি, তারা কারা? তারা কি আমাকে মনে করে একবারও? কখনও হঠাৎ? কোনও দিন? কাঁদের সঙ্গে বাস করবো বলে ভয়ংকর দাতালের বিরুদ্ধে এক বিন্দু পিঁপড়ে হয়েও লড়াই এ নেমেছি? তারা কি আমার মতো ভালোবাসা জানে? আদৌ কি তারা ভালোবাসে?

.

য.

আমাকে কোনও একদিন কোনও বরফের দেশে, নির্বাসনে পাঠাবে ভারতবর্ষ। জমে যেতে যেতে একটু তাপ চাইবো, সামান্য উত্তাপ, দূর পরবাসে কে আছে যে দেবে কিছু স্মৃতিই যদি একমাত্র বাঁচায় আমাকে। সেইসব দিনই যদি উত্তাপ দেয়, দেবে।

আমার মধ্য কলকাতার আকাশ ছাওয়া বেড়াল-বেড়াল-বাড়িটাতে, বিকেল বেলা সুস্মিতা আসতেন কিছু না কিছু নিয়ে, কোনওদিন রাবড়ি, কোনওদিন ধনে পাতার আচার। গল্প বলতেন জীবনের, পাহাড় পর্বত ডিঙিয়ে কী করে তিনি তিনি হলেন। স্বাতী আর স্বপ্নার তুমুল তারুণ্য, উরি উচ্ছ্বাস, ঢোলের মতো বাজতো ঘরদোরে। শর্মিষ্ঠা নামের মেয়ে কত কত কবিতা আওড়ে সন্ধেগুলো উজ্জ্বল করেছে। বড় ভালোবেসেছিল শিবানী, বড় স্বজন ছিল শর্মিলা। বর্ধমান থেকে জয়প্রকাশ চলে আসতেন, হাতে সীলভোগ, হাতে মিহিদানা, মুখে সলজ্জ সম্ভাষণ। হঠাৎ উদয় হয়ে সকৌতুকে জীবন বলতো রঞ্জন। সুমিতাভে মগ্ন হওয়া সেই তীব্র বর্ষাগুলো। আর সেইসব সুব্রতময় দিন!

বরফে জমতে থাকা আমার শীতার্ত নির্বাসনে সেইসব দিনই যদি উত্তাপ দেয় দেবে। জঙ্গিপুর থেকে গিয়াসউদ্দিন আসতেন, চব্বিশ পরগনা থেকে মোজাফফর, আমাদের চোখের সরোবরে স্বপ্ন সাঁতার কাটতো,অবিশ্বাস্য সব সুন্দরের স্বপ্ন।

দেশ থেকে দাদা আসতো একতাল শৈশব নিয়ে, কাঁধে করে উঠিয়ে আনতো দেশের বাড়ি, দাদার গা থেকে গন্ধ বেরোতো হাসনুহানার। হাসনুহানার ওই গন্ধই যদি উত্তাপ দেয়, দেবে। দূর পরবাসে জমে জমে বরফ হতে থাকা আমাকে কে বাঁচাবে আর, যদি স্মৃতিই না বাঁচায়।

.

র.

বিখ্যাতদের সঙ্গে ওঠাবসা আমার কখনও ছিল না। নামী নামী লোকেরা আমার আশেপাশে খুব একটা ঘেঁসেনি কোনওদিন, অথবা সন্তর্পণে আমিই দূরে দূরে থেকেছি ভয়ে বা সংকোচে। আমার মতো করে তাই বাস করতে পারতাম শহরে, আমার মতো করে মাটিতে মাটির মানুষের সাথে। সহজ সাধারণরাই সাধারণত আমার স্বজন, বাজারের ঝকাওয়ালা, তরকারিওয়ালা, মাছ কাটার টগবগে ছেলেরা, মাছওয়ালা, চায়ের দোকানের বেজায় ভদ্রলোকটি, ধনঞ্জয় ধোপা, আর সেই মল্লিকপুর থেকে আসা মঙ্গলা, সোনারপুরের সপ্তমী, এদের ছেড়ে কোথায় কার কাছে যাবো? ওদিকে দুর্গা প্রতিমার মতো মুনা, কল্যাণী থেকে ছুটে আসা গার্গী, মানসী মেয়েটির ওই একবার ছুঁয়ে দেখতে চাওয়া, ছেড়ে কোথায় কোন নির্বাসনে যাবো আমি? উঠোনের ঘাসে ফুটে থাকা মনকাড়া ফুল, ‘মালিদা মালিদা, ও ফুলের নাম কী?’ একগাল হেসে মালিদা কতদিন বলেছে, ‘ও ফুলের তো দিদি কোনও নাম নেই।

দিগন্ত অবধি কত মাঠ জুড়ে কত সুগন্ধ ছড়ানো কত নামহীন ফুল,ছেড়ে কোথায় কার কাছে যাবো?

.

ল.

যারা দিচ্ছে কারাগারে আমাকে পাহারা, তাকায় বিস্ময় নিয়ে মাঝে মধ্যে তারা, কী কারণে পড়ে আছি একা একা জেলে জগৎ সংসার দূরে বহুদূরে ফেলে! বুঝতে পারেনা তারা, চোখের তারায় হয়তো কফোঁটা জল কাঁপে করুণায়! কানে কানে বারবারই প্রশ্ন করে যায় কে বাঁচে এভাবে স্বাধীনতাহীনতায়? আমি কি বুঝিনা বুঝি? একা অন্ধকারে বসে থেকে দুরারোগ্য ব্যাধি বাড়ে হাড়ে। কী করে এতটা ধৈর্য কোথায় পেলাম? ধৈর্যের পরীক্ষা হলে কার বদনাম! কে কার পরীক্ষা নেবে, মানবে কে হার! আমাকে করেছে বন্দি ক্ষুব্ধ সরকার। পরীক্ষা আমার নয়, তাদের এবার, কতদিনে করে দেখি বিষফোঁড়া পার। ধৈর্যের যা কিছু বাঁধ, ভেঙে সর্বনাশ, লাভ নেই টেনে ধরে ইস্পাতের রাশ! আপাতত করে নিচ্ছে ধর্মবাদ চাষ! পরেরটা পরে হবে, পরে রাজহাঁস। চুনোপুটি ধৈর্য ধরে বছর যাওয়াবে, তিমিরা সইবে কেন! আস্ত গিলে খাবে। আমার না হয় আশা আজকাল ক্ষীণ। ধর্মবাদের ফসল কোনও একদিন তাদের তুলতে হবে নিজেদের ঘরে, ভরে যাবে সবকটা ঘর বিষধরে। কালসাপগুলো পোষা দুধ কলা দিয়ে, একেকজনকে খাবে গিলে বা চিবিয়ে। সেদিনের কিন্তু খুব বেশি নেই বাকি, যেদিন জানবে তারা নিজেদেরই ফাঁকি দিয়ে গেছে দিন দিন, মনোবলহীন, তুখোড় রাজনীতিক, দূরদৃষ্টিহীন।

.

ষ.

আমি জেলে থাকি তাতে কার কী! এরকম কত লোক জেলে আছে! অন্যায় করিনি তাতেই বা কী! কত নিরপরাধ মরে পড়ে আছে কতখানে! ফাঁসি হয়ে যায় কত নির্দোষের, যাবজ্জীবনও হচ্ছে তো প্রতিদিনই। আমি কারাগারে এ আর এমন কী! এ তথ্য নতুন নয়। অনেক লেখককে শাসকেরা ভুগিয়েছে বিভিন্ন দেশে। খুব কিছু অভিনব নয় কারাগার-বাস। এরকম বলে দায়িত্ব এড়ান বড় বড় লোক। হঠাৎ কখনও রহস্যময় মৃত্যুটি এসে গেলে খবর বেরোবে, আপদ মরেছে অবশেষে। তাতেই বা কারও কিছুই কি যায় আসে। কজন দাঁড়াবে জানতে মৃত্যুর কারণ, প্রতিবাদ মিছিলে সাকুল্যে কুড়িজন হবে তোক? অভিজ্ঞতা আমাকে সমৃদ্ধ করেছে বটে, ক্ষমতাকে কম বেশি সবাই আমরা চিনি। নির্বাসনে না গেলে মানুষ কি চেনা যায়। এই মেরুদন্ডহীনের দেশে ভাবতে লজ্জা হয় ভালোবেসে বাস করি। হাতে গোনা কিছু সৎ ও সাহসী মানুষ হৃদয়ে রয়ে যাবে যতদিন বাঁচি, এই দেশ থেকে আর প্রাপ্তির কিছু নেই।

.

স.

অভিজ্ঞতার জন্য সবার অন্তত এক বার নির্বাসনের জীবন ভোগের প্রচন্ড দরকার।

পরাধীনতার কিছু না পোহালে স্বাধীনতা কী জিনিস কী করে বুঝবে, কেই বা বুঝবে। মর্যাদা দেবে কেন! স্বাধীনতা পেতে লড়াই করছি শৈশব থেকে প্রায়, আমি বুঝি এর গভীর অর্থ, আবশ্যকতা কত। জীবন দেখেছি বলে প্রাণপণে জীবন ফেরত চাই অনেকের মতো নাহলে নিতাম পরাধীনতায় ঠাই। স্বাধীনতা ভোগ যারা প্রতিদিনই করছে জানেনা এর আসল মানেটা আসলে খুবই সামান্য কিছু কি না। পরাধীনরাও গৃহস্থঘরে মরে পচে গলে যায়, সারাজীবনেও জানতে পারেনা কী যে তারা অসহায়।

যুদ্ধ করেই বোঝাতে চাইছি যুদ্ধ করতে হয়, স্বাধীনতা চাই সবাইকে দিতে, কেবল আমাকে নয়, নিজে না ভাঙলে, নিজের শেকল কেউই ভাঙেনা এসে, প্রয়োজনে পাশে মানুষ কোথায় দাঁড়াবে যে ভালোবেসে! ধর্মতন্ত্র আমাকে ফাঁসিয়ে মিথ্যেকে দিল জয়। লক্ষ নারীকে পুরুষতন্ত্র বন্দি করেছে ঘরে, বিক্রি হচ্ছে শত শত লোক ধর্মান্ধের কাছে। স্বাধীনতা আজ দুর্লভ খুব দুর্ভাগাদের দেশে।

.

হ.

একটা সরল সোজামানুষকে নিয়ে রাজনীতিকরছো তোমরা, তার সত্য কথাবলা তোমাদের সহ্য হচ্ছে না, তার সততা তোমাদের আর পছন্দ হচ্ছে না। তাকে রাজ্য ছাড়া করেছে, আচমকা তাকে তার ঘর থেকে উঠিয়ে নিয়ে গেছে মিথ্যে ভয় দেখিয়ে বিমান বন্দরে, ঘর বাড়ি যেমন ছিল, ওভাবেই এখনও পড়ে আছে, যে বইটা পড়ছিলাম, সেটা ওভাবেই খোলা, লেখার খাতাটাও ওভাবে, কলমের নিব খোলা থেকে থেকে কালি শুকিয়ে গেছে সম্ভবত, লেখকের কলমের কালি শুকিয়ে ফেলতে চাইছো তোমরা। লেখককে তার লেখার ঘরে যেতে দিতে চাইছো না, লেখককে বন্দি করেছো, যেভাবে কোনও ঘৃণ্য হত্যাকারীকে বন্দি করো। যেভাবে ফাঁসি দেওয়ার জন্য রেখে দাও দাগী আসামীকে, সেভাবে আমাকে রেখে দিয়েছে, কোথায় কোন গুহায় রেখেছো কাউকে জানতে দিচ্ছো না, পৃথিবীর কাউকে না, আমাকেও না।

লেখককে ভাবতে দিতে চাইছো না, লেখককে লিখতে দিতে চাইছো না, লেখককে বাঁচতে দিতে চাইছো না, তোমাদের না-চাওয়াগুলো স্পষ্ট দেখছে পৃথিবী। ভাবনা কী। তোমাদের বশীভূত লেখকেরা, পোষ্য ঐতিহাসিকেরা স্বর্ণাক্ষরে তো লিখেই রাখবে ইতিহাসে তোমাদের নাম!

.

ড়.

আমি এখন একটা ঘরে বাস করি, যে ঘরে বন্ধ একটা জানালা আছে, যে জানালা আমি ইচ্ছে করলেই খুলতে পারি না। ভারি পর্দায় জানালাটা ঢাকা, ইচ্ছে করলেই আমি সেটা সরাতে পারি না। এখন একটা ঘরে আমি বাস করি, ইচ্ছে করলেই যে ঘরের দরজা আমি খুলতে পারি না, চৌকাঠ ডিঙোতে পারি না। এমন একটা ঘরে বাস করি, যে ঘরে আমি ছাড়া প্রাণী বলতে দক্ষিণের দেয়ালে দুটো দুস্থ টিকটিকি। মানুষ বা মানুষের মতো দেখতে কোনও প্রাণীর এ ঘরে প্রবেশাধিকার নেই। একটা ঘরে আমি বাস করি, যে ঘরে শ্বাস নিতে খুব কষ্ট হয় আমার।

আর কোনও শব্দ নেই চারদিকে, শুধু মাথা ঠোকার শব্দ। জগতের কেউ দেখে না, শুধু টিকটিকিদুটো দেখে, বড় বড় চোখ করে দেখে, কী জানি কষ্ট পায় কিনা–মনে হয় পায়। ওরাও কি কাঁদে, যখন কাঁদি? একটা ঘরে আমি বাস করি, যে ঘরে বাস করতে আমি চাই না। একটা ঘরে আমি বাস করতে বাধ্য হই, একটা ঘরে আমাকে দিনের পর দিন বাস করতে বাধ্য করে গণতন্ত্র, একটা ঘরে, একটা অন্ধকারে, একটা অনিশ্চয়তায়, একটা আশংকায় একটা কষ্টে, শ্বাসকষ্টে আমাকে বাস করতে বাধ্য করে গণতন্ত্র। একটা ঘরে আমাকে তিলে তিলে হত্যা করছে ধর্মনিরপেক্ষতা।

একটা ঘরে আমাকে বাধ্য করছে প্রিয় ভারতবর্ষ…..

ভীষণ রকম ব্যস্তসমস্ত মানুষ এবং মানুষের মতো দেখতে প্রাণীদের সেদিন দু’সেকেন্ড জানি না সময় হবে কিনা দেখার, ঘর থেকে যেদিন জড়বস্তুটি বেরোবে, যেদিন পচা গলা একটা পিন্ড। যেদিন হাড়গোড়। মৃত্যুই কি মুক্তি দেবে শেষ অবধি? মৃত্যুই বোধহয় স্বাধীনতা দেয় অতপর চৌকাঠ ডিঙোনোর! টিকটিকিদুটো ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকবে সারাদিন, ওদেরও হয়তো দুঃখ হবে মনে। গণতন্ত্রের পতাকা পেঁচিয়ে প্রিয় ভারতবর্ষের মাটিতে আমাকে পুঁতে দেবে কেউ, কোনও সরকারি লোক সম্ভবত। সেখানেও ঘর পাবো, যে ঘরে চৌকাঠ নেই ডিঙোতে চাওয়ার, সেখানেও ঘর পাবো, যে ঘরে শ্বাসকষ্ট নেই।

.

ঢ়.

কখনও কোনওদিন যদি অন্তরিন হতে হয় তোমাকে, যদি শেকল পরায় কেউ পায়ে, আমাকে মনে কোরো। যদি কোনওদিন যে ঘরটিতে তুমি আছো সে ঘরের দরজা ভেতর থেকে নয়, বাইরে থেকে বন্ধ করে কেউ চলে যায়, মনে কোরো। সারা তল্লাটে কেউ নেই তোমার শব্দ শোনে, মুখ বাঁধা, ঠোঁটে শক্ত সেলাই। কথা বলতে চাইছো, কিন্তু পারছে না। অথবা কথা বলছো, কেউ শুনতে পাচ্ছে না, অথবা শুনছে, শুনেও গা করছে না, মনে কোরো। তুমি যেমন খুব চাইবে কেউ দরজাটা খুলে দিক, তোমার শেকল সেলাই সব খুলে দিক, আমিও তেমন চেয়েছিলাম, মাস পেরোলেও কেউ এ পথ মাড়ায়নি, দরজা খুলে দিলে আবার কী হয় না হয় ভেবে খোলেনি কেউ। মনে কোরো।

তোমার যখন খুব কষ্ট হবে, মনে কোরো আমারও হয়েছিলো, খুব ভয়ে ভয়ে সাবধানে মেপে মেপে জীবন চললৈও আচমকা অন্তরিন হয়ে যেতে পারে যে কেউ, তুমিও। তখন তুমি আমি সব একাকার, দুজনে এক সুতো তফাৎ নেই, তুমিও আমার মতো, তুমিও অপেক্ষা করো মানুষের, অন্ধকার কেঁপে আসে, মানুষ আসে না।

.

য়.

এমনই অপরাধী, মানবতার এমনই শত্ৰু আমি, এমনই কি দেশদ্রোহী যে দেশ বলে কিছু থাকতে নেই আমার। দেশই তবে কেড়ে নেবে আমার বাকিটা জীবন থেকে আমার স্বদেশ। দেশ দেশ বলে অন্ধের মতো উত্তর থেকে দক্ষিণ গোলার্ধ পাহাড় সমুদ্র আর সারি সারি বৃক্ষ অন্ধের মতো আকাশ চাঁদ কুয়াশা রোদ্দুর, অন্ধের মতো ঘাস লতাগুল্ম মাটি আর মানুষ হাতড়ে হাতড়ে দেশ খুঁজেছি। পৃথিবী ফুরিয়ে অবশেষে জীবন ফুরোতে দেশের তীরে এসে বসা ক্লান্ত পিপাসার্ত মানুষের নিশ্চিন্তিকে তুমি যদি টেনে হিঁচড়ে তুলে নিয়ে যাও, আঁজলার জলটাও ছুঁড়ে দিয়ে আমাকে মৃত্যুদন্ড দাও, তবে কী নামে ডাকবো তোমাকে, দেশ?

বুকের ওপর মস্ত পর্বতের মতো দাঁড়িয়ে বুটজুতোর পা দিয়ে গলা পিষছো, খুঁচিয়ে তুলে নিয়েছো দুটো চোখ, মুখ থেকে টেনে বের করে নিয়েছে জিভ, টুকরো করেছে, চাবুক মেরে চামড়া তুলে নিয়েছে, গুঁড়ো করে দিয়েছে পা,পায়ের আঙুল, খুলি খুলে মস্তিষ্ক থেঁতলে দিচ্ছো, বন্দি করেছে, যেন মরি, যেন মরে যাই, আমি তবু দেশ বলেই তোমাকে ডাকি, বড় ভালোবেসে ডাকি। কিছু সত্য উচ্চারণ করেছি বলে আমি দেশদ্রোহী, মিথুকের মিছিলে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে তুমি চলবে বলে আজ আমি দেশদ্রোহী। মানবতাকে যেন মাটি দিয়ে দিই নয়তো সাত আসমানে উড়িয়ে দিই–তর্জনী তুলে বলে দিয়েছে। আর যা কিছুই থাক বা না থাক, দেশ বলে কিছু থাকতে নেই আমার। আমার জীবন থেকে, তুমি দেশ, হৃদয় খুঁড়ে নিয়ে গেলে আমারই স্বদেশ।

.

ৎ.

ওদেরই তাহলে স্বাধীনতা দেওয়া হোক, ওদের জন্যই খুলে দেওয়া হোক অতপর অস্ত্রাগার। তলোয়ারগুলো তুলে নিক, কোমরে গুঁজে নিক পিস্তল, হাতে হাত-বোমা, দারুল ইসলাম এর মন্ত্র মাথায় নিয়ে ওরা না হয় বেরিয়ে পড়ুক, যেদিকে যত মুরতাদ পাক মুণ্ডু কেটে নিক। মেয়েদের মারুক, মেরে ফেলুক। নতমস্তক নারীদের গায়ে বোরখা চাপিয়ে দিক, ঘরবন্দি করুক। ঘন ঘন পুত্র পয়দা করতে ঘরে ঘরে ধর্ষণ চলুক। পৃথিবীর যত পুরুষ আছে, এক যোগে সবাই না হয় তালিবান হয়ে যাক, আর্জেন্টিনা থেকে আইসল্যান্ড, মালদ্বীপ থেকে মরক্কো, বাংলাদেশ থেকে বাহরাইন ওদের দখলে চলে আসুক। ইসলামের পবিত্র জমিতে পরম শ্রদ্ধায় মাথা ঠেকাক আমাদের জননেতাগণ। মুকুট পরিয়ে দিক এক একটা জঙ্গির মাথায়। কৃতকর্মের জন্য করজোড়ে ক্ষমা প্রার্থনা করুক জননেতাগণ। ধর্মান্ধর পা-ধোয়া পানি পান করে পুণ্যবান হোক আমাদের জননেতাগণ।
 

Users who are viewing this thread

Back
Top