আনিসের বুক শুকিয়ে আসছে। সে বিড়বিড় করে বলল, যূথি, পানি খাব। যূথি চামচে করে ঠোঁটে পানি দিচ্ছে। এত ঠাণ্ডা পানি সে কোথায় পেয়েছে কে জানে! মনে হচ্ছে সমস্ত মুখ ঠাণ্ডায় জমে যাচ্ছে। খুবই আশ্চর্যের ব্যাপার, যূথির সঙ্গে এইভাবে ট্রেনে দেখা হয়ে গেল! বেচারির ঘাড়ে এসে পড়ল রোগীর যত্ন। চামচে করে পানি খাওয়াতে হচ্ছে। আনিসের যখন টাইফয়েড হলো তখনো যূথি খুব সেবা করেছে। যূথি মেয়েটার জন্মই হয়েছে সেবা করার জন্যে। আনিসের হাত-পা কেমন যেন অবশ হয়ে আসছে। সে ক্লান্ত গলায় বলল, যূথি, তোমার চুলগুলি আমি খুব যত্ন করে রেখেছি। একটা হরলিক্সের কৌটায় ভরে সুটকেসে রেখে দিয়েছি। যূথি বলল, শুধু রেখে দিলে তো হবে না। মাঝে মাঝে বের করে রোদে দিতে হবে। সাজি মাটি দিয়ে ধুতে হবে।
কথাগুলি কি সত্যি যূথি বলছে, না অন্য কেউ বলছে? যূথি খুব নরম করে কথা বলে, এমন কঠিন করে কাটা কাটা ধরনের কথা বলে না। কে কথা বলছে চোখ মেলে দেখতে পারলে হতো। চোখ মেলা যাচ্ছে না। আনিস বুঝতে পারছে সে গভীর অতলে তলিয়ে যাচ্ছে। ট্রেনের ঝিকঝিক শব্দ হচ্ছে, কিন্তু সে ট্রেনে করে যাচ্ছে না। সে ভাসতে ভাসতে যাচ্ছে।
আরে এ তো দেখি আরেক ঘটনা। মালেকভাইকে দেখা যাচ্ছে। মালেক ভাইয়ের চোখে কালো চশমা। চাদর দিয়ে শরীর ঢাকা।
মালেক ভাই, ছাড়া পেলেন কবে?
আনিস!
জি মালেক ভাই।
মারা যাচ্ছ না-কি?
জি।
মৃত্যু খারাপ জিনিস না। মৃত্যু ভালো জিনিস।
জি।
সাহসী মানুষ মৃত্যুকে হাসিমুখে গ্ৰহণ করে।
জি।
আনিস, তুমি কি সাহসী?
জি না।
স্বদেশী আন্দোলনের সময় ছেলেগুলি যে ফাঁসিতে ঝুলেছে তারা সবাই যে ভয়ঙ্কর সাহসী ছিল তা-না। পরিস্থিতি তাদের সাহসী করেছে।
জি।
স্বদেশী আন্দোলন থেকে মুসলমান ছেলেরা পিছিয়ে গেল কেন আনিস?
আমি জানি না মালেক ভাই।
কেন জানবে না? অবশ্যই জানো। আমি তোমাকে ব্যাখ্যা করেছি।
এখন আমার কিছু মনে পড়ছে না মালেক ভাই। আমার শরীর খুব খারাপ। আমার জ্বর এসেছে। আমার মাথা এলোমেলো।
তাহলে আমি বলি, তুমি শোনো।
মালেক ভাই, আজ বাদ থাক।
বাদ থাকবে কেন? তুমি চোখ বন্ধ করে শোনো। তোমার পাশে যে রূপবতী বসে আছে সে কে?
তার নাম যূথি।
যূথি বলছি কেন? তার নাম তো লীলাবতী।
ও হ্যাঁ, লীলাবতী। জ্বরের কারণে আমার মাথার ঠিক নাই। কী বলতে কী বলছি।
মেয়েটার সঙ্গে তোমার প্রেম হয়ে যায় নাই তো?
জি না।
গুড। ভেরি গুড। প্রেম হচ্ছে হৃদয়ের দুর্বলতা। আমরা সর্বক্ষেত্রে হৃদয়ের দুর্বলতা পরিহার করব।
জি।
এখন শোনো, মুসলমান ছেলেরা কেন স্বদেশী আন্দোলন থেকে সরে গেল।
আজ থাক মালেকভাই। শোনো, মন দিয়ে শোনো–স্বদেশীরা বঙ্কিমচন্দ্রের ‘আনন্দমঠ’ বই থেকে প্রেরণা পেত। এই বইয়ের মূলমন্ত্র বন্দেমাতরম গান–
বাহুতে তুমি মা শক্তি
হৃদয়ে তুমি মা ভক্তি
তোমারই প্রতিমা গড়ি মন্দিরে মন্দিরে।
তুংহি দূৰ্গা দশপ্রহরণ ধারিণী…
কোনো মুসলমান ছেলে কি এই গানকে জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে নিতে পারে?
আপনি তো মুসলমান না! আপনি আল্লাহই বিশ্বাস করেন না।
আমার কথা আসছে কেন? আমি তো স্বদেশী আন্দোলন করছি না। আমি একজন কমিউনিষ্ট। আমি সাম্যের কথা বলি–বিপ্লবের মাধ্যমে সাম্য।
মালেক ভাই, আমার মাথাটা একটু তুলে ধরবেন! আমি বমি করব।
মাগরিবের নামাজ শেষ করে সিদ্দিকুর রহমান মাঝউঠোনে ইজিচেয়ারে বসে আছেন। মাগরিবের ওয়াক্তে ঘরে আলো দিতে হয়, আজি আলো দেয়া হয় নি। শুধু উঠোনে একটা হারিকেন জ্বলিয়ে রাখা হয়েছে। ঘরের ভেতর আলো না জুলানোর একমাত্র কারণ রমিলা। লীলা চলে যাবার পর থেকে তার মাথা পুরোপুরি এলোমেলো হয়ে আছে। তার গায়ে কোনো কাপড় নেই। সে কিছুক্ষণ পরপর সাপের মতো ফোসফোস করে কী যেন বলছে। দেয়ালে মাথা ঠুকে রক্ত বের করে ফেলেছে। সিদ্দিকুর রহমান সব খবর পেয়েছেন। কিন্তু এখনো কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছেন না। তিনি যদি শুধু সামনে গিয়ে বলেন–রমিলা, কাপড় পরো। সে কাপড় পরবে। সিদ্দিকুর রহমানের চেয়ার ছেড়ে উঠতে ইচ্ছা করছে না। ক্লান্তি লাগছে।
তার মনে হচ্ছে শরীরও খারাপ করেছে। মাথায় কোনো যন্ত্রণা নেই, কিন্তু মাথা দপদপ করছে। এটা কি বড় ধরনের রোগ-ব্যাধি শুরু হবার পূর্বলক্ষণ? তার কোনো অসুখ-বিসুখ হয় না। কাজেই অসুখের পূর্বলক্ষণ সম্পর্কে তাঁর কোনো ধারণা নেই। রমিলার মাথা খারাপ হবার কিছুদিন পর এক গভীর রাত্রে তাহাজ্জুদের নামাজ পড়ে তিনি আল্লাহপাকের কাছে বলেছিলেন— ইয়া রহমানুর রহিম, তুমি আমাকে যে-কোনো রোগ-ব্যাধি দিতে চাইলে দিও, কিন্তু আমার মাথাটা যেন ঠিক থাকে। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত যেন আমি সুস্থ মাথায় সিদ্ধান্ত নিতে পারি। আমার যেন রমিলার মতো না হয়।
সিদ্দিকুর রহমানের ধারণা আল্লাহপাক তাঁর কথা শুনেছেন। সবরকম রোগব্যাধি থেকে তাকে মুক্ত রেখেছেন। আজ যদি রমিলার মতো অবস্থা তার হতো! একটা ঘরে তাকে তালাবদ্ধ করে রাখা হয়েছে। তার গায়ে কোনো কাপড় নেই। লোকজন আসছে, তাকে নগ্ন অবস্থায় দেখছে। তিনিও হাসিমুখে তাদের সঙ্গে গল্প করছেন। স্বাভাবিকভাবেই গল্প করছেন। যেসব পাগল সম্পূর্ণ নগ্ন থাকে তারা কথাবার্তা বলে খুবই স্বাভাবিকভাবে। এই ধরনের পাগলদের পাগলামি নগ্নতায় সীমাবদ্ধ।
চারদিক অন্ধকার হয়ে গেছে। সুলেমান হারিকেন জ্বলিয়ে তার ইজিচেয়ারের পেছনে এনে রাখল। সিদ্দিকুর রহমান বললেন— সুলেমান, মাসুদকে কি তুমি ট্রেনে তুলে দিয়েছিলে?
সুলেমান বলল, জি।
টিকিট কেটে দিয়েছ, না-কি বিনা টিকিটে তুলে দিয়েছ?
বিনা টিকিটে।
এটা ভালো করেছ। সে কি কান্নাকাটি করছিল?
জি না।
চোখের পানি ফেলে নাই?
জি না।
এটা খারাপ না। শুনে আনন্দ পেলাম। কিছুটা তেজ তাহলে এখনো আছে। বিষধর সাপের বিষ আর পুরুষের তেজ–দুটাই এক জিনিস। বিষধর সাপের বিষ শেষ হয়ে গেলে সাপের মৃত্যু হয়। পুরুষের তেজ শেষ হওয়া মানে পুরুষের মৃত্যু। বুঝেছ?
জি।
মেয়েদের তেজটা কী জানো?
জি না।
মেয়েদের তেজ তাদের চোখের পানিতে। যখন কোনো মেয়ের চোখের পানি শেষ হয়ে যায়— তখন সেই মেয়েরও মৃত্যু হয়। বুঝেছ?
জি।
তোমাকে কেন জানি চিন্তিত মনে হচ্ছে। সুলেমান, তুমি কি কোনো বিষয় নিয়া চিন্তিত?
সুলেমান জবাব দিল না। মাথা নিচু করে বসে রইল। তাকে দেখে এখন সত্যি সত্যি খুব চিন্তিত মনে হচ্ছে। সিদ্দিকুর রহমান বললেন, কোনো বিষয়ে নিয়া চিন্তা করার প্রয়োজন হলে সেটা আমারে বলো। আমি চিন্তা করব। চিন্তা করার ক্ষমতা আল্লাহপাক সব মানুষকে দেন নাই। অল্পকিছু মানুষ চিন্তা করতে পারে। জগতের বেশিরভাগ মানুষ তোমার মতো কাজ করতে পারে। চিন্তা করতে পারে না।
সুলেমান এখনো মাথা নিচু করে আছে। তার দৃষ্টি উঠানে নিবদ্ধ। সিদ্দিকুর রহমান ঠিকই ধরেছেন। সে খুবই চিন্তিত এবং ভীত। ভয়ে তার গলা শুকিয়ে গেছে। কারণ একটু আগে সে বড় ধরনের একটা মিথ্যা কথা বলেছে। তার ধারণা— মিথ্যা কথাটা ধরা পড়ে গেছে। এখনি সওয়াল-জবাব শুরু হবে। তার কঠিন শাস্তি হবে। সিদ্দিকুর রহমানের নিয়ম হলো, কঠিন শাস্তি দেবার আগে-আগে তিনি হালকা মেজাজে হাসিমুখে কথাবার্তা বলেন। অপরাধীর সঙ্গে ঠাট্টা-তামাশাও করেন। অপরাধীর ধারণা হয়ে যায় সে মাপ পেয়ে গেছে। সে যখন মোটামুটিভাবে নিশ্চিন্ত হতে শুরু করে তখনি শাস্তির হুকুম হয়। তার বেলাতেও কি এই ঘটনা ঘটতে যাচ্ছে! সেরকমই তো মনে হচ্ছে। সুলেমান গুটিয়ে গেল।
মিথ্যা কথা সে যা বলেছে তা হলো, মাসুদকে সে ট্রেনে তুলে দিয়ে আসে। নি। উত্তরপাড়ার সুরুজ মিয়ার বাড়িতে লুকিয়ে রেখেছে। এই কাজটা যে সে নিজ থেকে করেছে তা-ও না। এত সাহস তার নেই। কাজটা সে করেছে লীলাবতীর কথামতো। লীলাবতী বলে গিয়েছিল— মাসুদ ফিরে এলে তার বাবা তাকে আবার ট্রেনে করে পাঠিয়ে দিতে বলবেন। এই কাজটা তখন যেন না করা হয়। মাসুদকে যেন লুকিয়ে রাখা হয়। দু’একদিন পর তার বাবার রাগ খানিকটা পড়বে। ছেলের জন্যে মনখারাপ হবে। তখন যেন মাসুদকে নিয়ে আসা হয়। বুদ্ধিটা খুবই ভালো। সমস্যা একটাই— যার বুদ্ধি সে উপস্থিত নাই। বুদ্ধি দেয়া মানুষটা চলে গেছে। যন্ত্রণা এসে পড়েছে তার ঘাড়ে। অন্যের বুদ্ধিতে এত বড় যন্ত্রণা মাথায় নেয়া ঠিক হয় নাই।
সুলেমান!
জি চাচাজি?
আমার মেয়ে লীলাবতীকে যখন ট্রেনে তুলে দিলা তখন কি সে কাঁদতেছিল?
জি।
অল্প কেঁদেছে, না বেশি কেঁদেছে? বেশি কেঁদেছে। ঘনঘন শাড়ি দিয়ে চোখ মুছেছে। সিদ্দিকুর রহমান ইজিচেয়ারে সোজা হয়ে বসলেন। আগ্রহ নিয়ে বললেন— আমার এই মেয়ে যে পুরোপুরি তার মা’র মতো হয়েছে তা কিন্তু না। তার মাকেও আমি ট্রেনে তুলে দিয়েছিলাম। সে এক ফোটা চোখের পানি ফেলে নাই।
সুলেমান শঙ্কিত বোধ করছে। সে আবারো একটা মিথ্যা কথা বলে ফেলেছে। লীলাবতী কোনো চোখের পানি ফেলে নাই। সহজ স্বাভাবিকভাবে ট্রেনে উঠে বসেছে। বরং হাসিমুখে সবার দিকে তাকিয়েছে। তাহলে আগ বাড়িয়ে সুলেমান এই মিথ্যা কথাটা কেন বলল?
বাড়ির ভেতর থেকে রমিলার কান্নার শব্দ শোনা যাচ্ছে। রমিলা চাপা গলায় কাঁদছেন। কান্নার ফাঁকে ফাঁকে অস্পষ্ট স্বরে দুএকটা কথাও বলছে। সিদ্দিকুর রহমানের হঠাৎ ইচ্ছা করল— রমিলা কান্নার ফাঁকে ফাঁকে কী বলছে আড়াল থেকে সেটা শোনেন। খুবই অন্যায়। ইচ্ছা। তাঁর মতো মানুষের এ ধরনের ইচ্ছা হওয়া উচিত না। কিন্তু ইচ্ছাটা তিনি চাপা দিতে পারছেন না। তিনি ইজিচেয়ার থেকে নামলেন। ইজিচেয়ারের পেছনে রাখা হারিকেনটা হাতে নিলেন। আশ্চর্যের ব্যাপার হলো— হারিকেন-হাতে উঠে দাঁড়ানো মাত্র রমিলার কান্না থেমে গেল।
সন্ধ্যাবেলায় তিনি খবর পেয়েছিলেন রমিলার গায়ে কোনো কাপড় নেই। এখন দেখা গেল।রমিলা শাড়ি পরে জড়সড় হয়ে খাটে বসে আছে। নতুন বউদের মতো মাথায় ঘোমটা দিয়েছে।
সিদ্দিকুর রহমান ডাকলেন, রমিলা!
রমিলা জবাব দিল না। আরো যেন গুটিয়ে গেল। সিদ্দিকুর রহমান বললেন, শরীরটা কি এখন ভালো লাগছে?
রমিলা বলল, জি।
একটু আগে কাঁদতেছিলা কেন?
রমিলা বিড়বিড় করে বলল, আমি পাগল-মানুষ। আমার হাসন কান্দনের কোনো ঠিক নাই। ইচ্ছা হইলে হাসি। ইচ্ছা হইলে কান্দি।
সিদ্দিকুর রহমান বললেন, পাগল হওয়ার দেখি অনেক সুবিধা আছে। ইচ্ছামতো কাজকর্ম করা যায়। আমার অনেককিছু করতে ইচ্ছা হয়। করতে পারি না।
রমিলা সিদ্দিকুর রহমানকে বিস্মিত করে বলল, পাগলা হইয়া যান, তাইলে করতে পারবেন।
সিদ্দিকুর রহমান বললেন, পাগল হলো নিজের ইচ্ছামতো হাসা এবং কাদা ছাড়া আর কিছুই করতে পারব না। হাসি-কান্না এই দুটা কাজের মধ্যে পড়ে না। হাসি-কান্না কাজের ফল, কাজ না।
কথাগুলো বলে সিদ্দিকুর রহমান নিজের উপরই বিরক্ত হলেন। মস্তিষ্ক বিকৃত একজন মানুষের সঙ্গে এ-ধরনের জটিল কথাবার্তা চালানো অর্থহীন। সিদ্দিকুর রহমান বললেন, শুনেছি। দুপুরে তুমি কিছু খাও নাই। খিদা লেগেছে? এখন কিছু খাবে?
খিদা হয়েছে। কিন্তু এখন খাব না।
কখন খাবে?
আপনার মেয়ে লীলা আসতেছে। সে আসার পরে খাব। দুজন একসঙ্গে খাব।
লীলা ঢাকায় চলে গেছে। আজ দুপুরে তাকে ট্রেনে তুলে দিয়ে আসা হয়েছে। সে আসবে না।
রমিলা দৃঢ় গলায় বলল, সে ফিরত আসবে।
অসুস্থ মানুষের কাছে যুক্তিতর্ক উপস্থিত করার কোনো অর্থ হয় না। সিদ্দিকুর রহমান এই নিয়ে কোনো কথা বললেন না, তবে তার মধ্যে সামান্য সংশয় তৈরি হলো। আগেও একবার রমিলা হঠাৎ করে বলেছিল। লীলা আসবে। লীলা ঠিকই এসেছে। আজো সে-রকম কিছু ঘটবে না তো? সিদ্দিকুর রহমান বললেন, লীলা কখন আসবে?
রমিলা ফিসফিস করে বলল, এশার নামাজের ওয়াক্তে। ঘর-দুয়ার অন্ধকার করে রাখছেন কেন? বাতি জ্বালান। কাঁঠালের বিচি দিয়া মুরগির সালুন রান্দার ব্যবস্থা করেন। লীলা। এই সালুন বড় পছন্দ করে। আমার ইচ্ছা এই সালুনটা আমি রান্দি।
আগুনের কাছে তোমার যাওয়া নিষেধ।
তাইলে থাক। অন্য কাউকে দিয়া এই সালুন রান্দাইয়া রাখেন।
সিদ্দিকুর রহমান জবাব দিলেন না। তবে তিনি বিস্মিত হয়ে লক্ষ করলেন, রমিলার কথায় তিনি প্রভাবিত হচ্ছেন। কাঁঠালের বিচি দিয়ে মুরগির সালুন রোধে রাখার ব্যবস্থা করতে ইচ্ছা করছে।
এশার নামাজের আগে-আগে প্রবল বর্ষণ শুরু হলো। কার্তিক মাসে আষাঢ় মাসের বৃষ্টি। এই বৃষ্টির আলাদা নাম আছে। কাত্যাইয়ান না? দমকা বাতাস ঝোড়ো হাওয়া। আকাশ ভেঙে নেমেছে বৃষ্টি। সিদ্দিকুর রহমান উঠানে বসে বৃষ্টি দেখছেন। তিনি সামান্য চিন্তিত। যে-বিষয় নিয়ে তিনি চিন্তিত সেটা ভেবেও তাঁর মেজাজ খারাপ হচ্ছে। তিনি চিন্তিত লীলাবতীকে নিয়ে। কোনো বিস্ময়কর কারণে সত্যি সত্যি যদি তাঁর মেয়ে এই ঝড়বৃষ্টির মধ্যে ফিরে আসে তাহলে খুবই সমস্যায় পড়বে। পশ্চিম পাড়ায় ছোট খালের উপরে যে কাঠের পুলটা আছে সেটা নড়বড় করছে। পাশেও অত্যন্ত ছোট। পনের-বিশদিন আগে মহিষের একটা গাড়ি পুল থেকে খালে পড়ে গিয়েছিল। মানুষ মারা যায় নি, কিন্তু একটা মহিষ মারা গেছে। লোকমান বা সুলেমান এদের কোনো একজনকে টর্চ হাতে কাঠের পুলের কাছে পাঠিয়ে দিলে খারাপ হয় না। কিন্তু তিনি কী বলে লোকমানকে পাঠাবেন? তাঁর মেয়ে লীলা, যে দুপুরের ট্রেনে ঢাকা চলে গিয়েছিল, সে ফেরত আসছে— এই খবর তিনি পেয়েছেন কোথায়? তার পাগল স্ত্রীর কাছে। ব্যাপারটা হাস্যকর না?
সিদ্দিকুর রহমান এশার নামাজের ওয়াক্ত পর্যন্ত বারন্দায় বসে রইলেন। তার ইচ্ছা করছে সুলেমান এবং লোকমান এই দুই ভাইকে ডেকে বলেন যে, তারা যে মিথ্যাচার করেছে তা তিনি জানেন। মাসুদকে কোথায় লুকিয়ে রাখা হয়েছে তাও জানেন। তারা বিশ্বাস ভঙ্গ করেছে। যে একবার বিশ্বাস ভঙ্গ করে সে বারবারই করে। রমিলা বলেছিল। লীলা এশার নামাজের ওয়াক্তে ফিরে আসবে। এশার নামাজ অনেকক্ষণ হলো শেষ। লীলা ফিরে আসে নি। একজন পাগলমানুষের কথায় বিশ্বাস করা ঠিক হয় নি। মানুষের সমস্যা হলো, একবার কারো কোনো কথায় বিশ্বাস করে ফেললে বারবার বিশ্বাস করতে ইচ্ছা করে। খাওয়াদাওয়া শেষ করে তিনি ঘুমুতে গেলেন রাত এগারটায়। ততক্ষণে ঝড় থেমে গেছে, কিন্তু বৃষ্টি আগের মতোই মুষলধারে পড়ছে। সিদ্দিকুর রহমানের মন সামান্য খারাপ। তিনি মনে হয়। সত্যি সত্যি বিশ্বাস করে ফেলেছিলেন— লীলা ফিরে আসছে। তিনি কাঁঠালের বিচি দিয়ে মুরগির সালুনের ব্যবস্থাও করে রেখেছিলেন। শেষ মুহুর্তে সালুন রান্না হয় নি।
মধ্যরাতে হৈচৈ-এর শব্দে তাঁর ঘুম ভাঙল। বারান্দায় এসে দেখেন বারান্দায় পাশাপাশি তিনটা হারিকেন জুলছে। বৃষ্টির পানিতে কাকভেজা হয়ে চারজন লোক বারান্দায় উঁচু হয়ে বসে শীতে কাঁপছে। সিদ্দিকুর রহমানকে দেখে তারা লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়াল। সিদ্দিকুর রহমান বললেন, তোমরা কারা? তাদের একজন ভীত গলায় বলল, তারা গাড়োয়ান। গরুর গাড়ি নিয়ে এসেছে।
সিদ্দিকুর রহমান বললেন, কে এসেছে গরুর গাড়িতে?
গাড়োয়ান ভয়ে কুঁকড়ে গিয়ে বলল, আপনার মেয়ে আসছে।
সিদ্দিকুর রহমান স্বাভাবিক গলায় বললেন, ও আচ্ছা ঠিক আছে।
এতক্ষণ সুলেমান বা লোকমান এদের কাউকেই দেখা যাচ্ছিল না। এখন সুলেমানকে দেখা গেল। ছাতা-হাতে আসছে। সিদ্দিকুর রহমান বললেন, কোথায় গিয়েছিলা?
সিদ্দিকুর রহমান মেয়ের খোঁজ করলেন না। হারিকেন হাতে রমিলার ঘরে ঢুকলেন। সন্ধ্যাবেলা রমিলা যে-ভঙ্গিতে যেভাবে খাটে বসেছিল, এখনো সেইভাবেই বসে আছে। মাথার ঘোমটাও আগের মতোই দেয়া আছে। সিদ্দিকুর রহমান ডাকলেন, রমিলা!
রমিলা ক্ষীণ স্বরে বলল, জি।
লীলা ফিরে এসেছে, খবর পেয়েছো?
জি।
তোমার সঙ্গে দেখা হয়েছে?
না।
সে যে ফিরত আসতেছে এটা তুমি কীভাবে বললা?
জানি না।
সিদ্দিকুর রহমান ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, কাঁঠালের বিচি জোগাড় করে রেখেছি। যাও, মুরগির সালুন রাধো।
রমিলা ঘোমটা সরিয়ে সিদ্দিকুর রহমানের দিকে তাকিয়ে হাসল। সিদ্দিকুর রহমান রমিলার ঘরের দরজা খুলে দিলেন।
এখনো ঝুপ ঝুপ করে বৃষ্টি পড়ছে। সিদ্দিকুর রহমান ভেতরের উঠোনে বসে আছেন। এখান থেকে দেখা যাচ্ছে রমিলা তোলা উনুনে রান্না বসিয়েছে। দৃশ্যটা দেখতে সিদ্দিকুর রহমানের খুব ভালো লাগছে।
সুলেমান বসেছে তার পায়ের কাছে। পায়ের আঙুলে রসুন দিয়ে গরম করা সরিষার তেল মাখিয়ে দিচ্ছে। [ র রহমান বললেন, সুলেমান শোনো, তোমরা দুই ভাই যে অপরাধ করেছ সেটা ক্ষমা করলাম। শেষবারের মতো করলাম। মাসুদকে বলবা সকালে যেন আমার সঙ্গে দেখা করে।
সুলেমান মাথা নিচু করে বিড়বিড় করে বলল, জি আচ্ছা।
ডাক্তার কি আসছে?
জি আসছে। প্রফেসর সাবরে দেইখা গেছে।
ডাক্তার কী বলল?
বলেছেন অবস্থা ভালো না। রোগী টিকিব না।
দুঃসংবাদে সিদ্দিকুর রহমান বিচলিত হলেন না। সারা শরীরে আরামদায়ক আলস্য নিয়ে তিনি বসে আছেন। বৃষ্টির শব্দ শুনছেন। তাঁর বড় ভালো লাগছে।
সুলেমান।
জি।
জগৎ যে রহস্যময় এটা জানো?
সুলেমান জবাব দিল না। জগতের রহস্য নিয়ে বিচলিত হবার মানসিকতা তার নেই। তার কাজ বড় সাহেবের হুকুম তামিল করা। সারাজীবন এই কাজটাই সে করবে। একটু আগে বিরাট একটা ফাড়া কেটেছে। ফাড়া কাটার আনন্দেই সে আনন্দিত।
সুলেমান শোনো, জগৎ বড়ই রহস্যময়। কেন জানো?
জি না।
কারণ খুব সোজা। যিনি জগৎ তৈরি করেছেন তিনি রহস্য পছন্দ করেন। তিনি নিজেও রহস্যময়। এখন বুঝেছ?
জি।
যেসব মানুষের ভেতর রহস্য আছে। তিনি তাদেরও পছন্দ করেন। যার ভেতর রহস্য নাই, তাকে তিনি পছন্দ করেন না। তার প্রতি কোনো আগ্রহ বোধ করেন না।
সুলেমান হুঙ্কা আনতে যাচ্ছে না। এদিক-ওদিক তাকাচ্ছে। বড় সাহেবকে একা রেখে সে যেতে পারে না। আশেপাশে কাউকে দেখা যাচ্ছে না। লোকমান গেল কোথায়? তার তো এখানে থাকার কথা।
যাত্ৰা ভঙ্গ করে ফিরে আসার সময় মঞ্জু যতটা বিরক্ত হয়েছিলেন এখন ততটাই আনন্দ পাচ্ছেন। বদু তার গায়ে তেল মালিশ করছে। আরামে তার ঘুম চলে এসেছে। তেল মাখানো পর্ব শেষ হলে বৃষ্টির পানিতে গোসল করবেন। জানিয়েছেন। বৃষ্টি-স্নানের দুজন সঙ্গীও তার জুটেছে। জাইতরী ও কইতরী দুই বোন। জাইতরী আগে আড়ালে আড়ালে থাকত, আজ সে প্রকাশ্য হয়েছে এবং মহাআনন্দে হাড়হড় করে কথা বলে যাচ্ছে। এই মেয়ের কথার স্রোতে কইতরী টিকতে পারছে না। জাইতরী মেয়েটা কথাও বলছে গুছিয়ে এবং বেশ রহস্য করে–
কইতরী আপনারে ভালো পায়। আমি পাই না।
তুমি পাও না কেন?
আপনারে বলব না।
কেন বলবে না?
বললে ভাববেন আমি মন্দ মেয়ে।
তুমি কি ভালো মেয়ে?
হুঁ।
যে ভালো সে নিজে জানে সে ভালো। যে মন্দ সে নিজে জানে না। সে মন্দ।
এই বাড়িতে মন্দ কে?
আপনেরে বলব না।
এই বাড়িতে মন্দ কতজন আছে?
একজন।
সে কে?
একবার তো বলেছি আপনেরে বলব না।
কইতরী এবং জইতরী এই দুই বোনের ভেতর ভালো কে?
আমি ভালো।
সুন্দর কে?
আমি।
সবই তুমি?
হুঁ।
তোমার আরেক বোন লীলা, সে তো তোমার চেয়েও সুন্দর।
হুঁ।
সে তোমার চেয়ে ভালো?
হুঁ। কিন্তুক সে আলাদা।
সে আলাদা কেন?
আপনেরে বলব না।
তোমরা দুই বোন যে বৃষ্টিতে আমার সঙ্গে ভিজবে তোমাদের বাবা বকবে না?
না।
বকবে না কেন?
বাপজানের মন এখন ভালো। উনার মন ভালো থাকলে কাউকে বকেন না।
মন ভালো কেন?
বড়বুবু ফিরা আসছে–এইজন্য মন ভালো।
বড়বুবু ফিরে আসায় তোমরা খুশি হয়েছ?
হুঁ। আইজ রাইতে আমরা বড়বুবুর সঙ্গে ঘুমাব।
লীলা মাঝখানে আর তোমরা দুই বোন দুই পাশে?
হুঁ।
আজ রাতে তোমাদের খুবই মজা হবে?
হুঁ।
বৃষ্টির পানিতে তিনি যখন দুই কন্যাকে নিয়ে নামলেন তখন জাইতরী ঘোষণা করল— আমি আপনেরে ভালো পাই।
মঞ্জু বললেন, কেন?
জইতরী বলল, জানি না। কী জন্যে। কিন্তু আমি আপনেরে ভালো পাই।
শুনে খুশি হলাম।
আমার একটা নিয়ম আছে।
কী নিয়ম?
আমি একবার যখন কাউকে ভালো পাই তারে সারা জীবনই ভালো পাই।
এই নিয়ম কি তুমি নিজে বানিয়েছ?
হুঁ।
জইতরী এসে মঞ্জুর হাত ধরল। তার দেখাদেখি কইতরীও হাত ধরল। বৃষ্টির পানি বরফের মতো ঠাণ্ডা। দুই বোনই শীতে কাঁপছে, তারপরও তাদের আনন্দের সীমা নেই।
মঞ্জুর মনে হলো, এই দুই কন্যাকে রেখে তার পক্ষে ফিরে যাওয়া অসম্ভব হবে। লীলা চলে যেতে চাইলে চলে যাবে, তিনি থাকবেন।
রমিলা বললেন, অবশ্যই ভালো। যে মেয়ে স্বামীর আদর বেশি পায় সে বাপের আদর কম পায়। আবার যে মেয়ে বাপের আদর বেশি পায় তার ভাগ্যে স্বামীর আদর নাই।
আমি বাবার আদর পাব না?
তুমি দুইটাই পাইবা।
কীভাবে জানেন? তোমার থুতনিতে লাল তিল। এই নিয়াও একটা সিমাসা আছে। বলব?
বলুন।
থুতনিতে লাল তিল
কালো তিল কানে
পিতার কোলে থাকবে নারী
সৰ্ব লোকে মানে।
তোমার থুতনিতে লাল তিল, আবার কানের লতিতেও কালো তিল।
লীলার খাওয়া শেষ হয়েছে। সে হাত ধুতে ধুতে বলল, আমার ধারণা আমাকে দেখে দেখে এইসব সিমাসা। আপনি বানাচ্ছেন। এই ধরনের সিমাসা আসলে নাই।
রমিলা হাসতে শুরু করলেন। হাসতে হাসতে তার চোখে পানি এসে গেল। তিনি শাড়ির আঁচলে চোখ মুছতে মুছতে বললেন, কথা সত্য বলেছ। এমন সিমাসা নাই। তোমার বেজায় বুদ্ধি। তয় তোমার বাপের মতো না।
আপনার ধারণা বাবার অনেক বুদ্ধি?
অবশ্যই। তোমার বাপ সবেরে পুতুলের মতো চালায়। কেউ বুঝতে পারে না।
আমার মাকে কিন্তু বাবা পুতুলের মতো চালাতে পারে নাই।
তোমার মায়ের দিকে তোমার বাবার ভালোবাসা ছিল অনেক বেশি। যার দিকে ভালোবাসা বেশি থাকে তার উপরে বুদ্ধি কাজ করে না। এই বিষয়ে একটা সিমাসা আছে, শুনবা?
আপনার বানানো সিমাসা আমি আর শুনব না।
রমিলা আবারো হাসি শুরু করেছেন। হাসতে হাসতে আবারো তার চোখে পানি এসে গেছে। তিনি হাসির ফাঁকে ফাঁকে বললেন, তুমি তোমার ব্যাপারে বলো আমারে যেন আটকায়ে রাখে। মাথা জানি কেমুন করতেছে— হাসিটা বেশি হইছে। হি হি হি। একদিনে বেশি হাসছি—হি হি হি। এখন কান্দন শুরু হইব— হি হি হি।
সিদ্দিকুর রহমান আনিসের বিছানার পাশে দাঁড়িয়ে আছেন। তাঁকে একটা অতি কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে হবে। আনিসকে তিনি বাড়িতে রেখে দেবেন না-কি ময়মনসিংহ সদর হাসপাতালে পাঠাবেন? সতীশ ডাক্তার জবাব দিয়ে দিয়েছেন। ডাক্তারের ধারণা রোগীর সময় শেষ। আত্মীয়স্বজনকে খবর দেয়া দরকার।
রোগীকে দেখেও সেরকমই মনে হচ্ছে। নিঃশ্বাস নিতে পারছে না। সারাক্ষণ হা করে আছে। বুক উঠানামা করছে।
হাসপাতালে পাঠানো সমস্যা না। গরুর গাড়ি তৈরি আছে। এখান থেকে গরুর গাড়িতে নান্দাইল রোড স্টেশন। সেখান থেকে ট্রেনে ময়মনসিংহ। মাঝখানে গৌরীপুরে ট্রেন বদল। ঝামেলা আছে। রোগীর যে অবস্থা পথেও কিছু ঘটে যেতে পারে।
সিদ্দিকুর রহমান বললেন, রোগীকে ময়মনসিংহ সদর হাসপাতালে নিয়ে গেলে কেমন হয়?
সতীশ ডাক্তার বলল, নিতে পারেন। কিন্তু লাভ হবে না।
যেখানে জীবন-মৃত্যু নিয়ে প্রশ্ন, সেখানে লাভ-লোকসানের বিচার করা কি উচিত?
সতীশ ডাক্তার চুপ করে গেল। সিদ্দিকুর রহমান বললেন, তৈরি হয়ে নাও। তুমি সঙ্গে যাবে।
সতীশ ডাক্তার হোড়বড় করে বলল, আমি তো যেতে পারব না। আমার বিরাট ঝামেলা আছে।
সিদ্দিকুর রহমান বললেন, মানুষ হয়ে জন্মগ্রহণ করেছ। বিরাট ঝামেলা তো থাকবেই। ঝামেলামুক্ত জীবনযাপন করে শুধু পশু। তুমি তো পশু না।
সতীশ ডাক্তার বলল, আমার সাথে আর কে যাবে?
সিদ্দিকুর রহমান বললেন, আমি যাব। এই রোগী ভরসা করে অন্য কারো হাতে ছাড়তে পারব না।
সতীশ ডাক্তার অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। সিদ্দিকুর রহমান সহজ গলায় বললেন, আই মাস্টারের প্রতি আমার বিরাট মমতা তৈরি হয়েছে, সেই কারণে তাকে নিয়া নিজেই রওনা হয়েছি তা না। এত মমতা মানুষের প্রতি আমার নাই। কী জন্যে তাকে নিয়া যাচ্ছি শুনতে চাও?
সতীশ ডাক্তার হ্যাঁ-না কিছুই বলল না। সিদ্দিকুর রহমান বললেন, আমার মেয়ে লীলা তাকে নিয়ে আমার কাছে এসেছে। এই ভরসায় এসেছে যে আমি মাস্টারের জন্যে যা করার করব। রোগীকে আমার কাছে নিয়ে আসার পরেই দেখলাম, আমার মেয়ে নিশ্চিন্ত মনে ঘুরাফিরা করতেছে। খাওয়া-দাওয়া করেছে। সে তার মাথা থেকে সব চিন্তা ঝেড়ে ফেলে দিয়েছে। যে মেয়ে আমার প্রতি এতটা ভরসা করেছে, তার সেই ভরসা কি আমি ছোট করতে পারি?
লীলাবতীর হাতের লেখা গোটা-গোটা। প্রতিটি অক্ষর স্পষ্ট। একটির সঙ্গে আরেকটি জড়িয়ে নেই। মনে হতে পারে, সে প্রতিটি অক্ষর আলাদা করে লেখে এবং লিখতে সময় লাগে। আসলে তা না। সে অত্যন্ত দ্রুত লেখে। কিছুদিন পর-পর হঠাৎ করে তার লিখতে ইচ্ছা করে। লেখার ইচ্ছােটা যেমন হঠাৎ আসে। সেরকম হঠাৎই চলে যায়। খাতা-কলম নিয়ে বসার পেছনে লীলার মায়ের বেশ বড় ভূমিকা আছে। মা’র মৃত্যুর অনেক পরে ট্রাঙ্ক ঘাটতে গিয়ে লীলা তার মার লেখা কিছু কাগজপত্র পেয়েছে। ছােট ছােট টুকরো কাগজ। মজার মজার সব লেখা। কোনোটা চার-পাঁচ লাইন, কোনোটা আবার দেড়-দুই পাতা। কিছু লেখার শুরু আছে, শেষ নেই। সাংকেতিক ভাষায় লেখা কিছু কাগজও আছে। সেখানে সংকেত উদ্ধার কীভাবে করতে হবে তাও লেখা। যেমন এক জায়গায় লেখা–
লীলা প্রতিটি লেখা পড়ে খুবই মজা পেয়েছে। লেখাগুলি সে যত্ন করে রেখে দিয়েছে। মাঝে মাঝে পড়ে। কিছু কিছু সাংকেতিক চিঠির অর্থ সে উদ্ধার করতে পারে নি। যেমন একটা লেখা এরকম—
মত ৪০ নত ২৭ যত ১১
পিতা ৯৩২ মাতা ০৭ ভগ্নি ১২
অতঃপর ০০১২০৩৪০০৯৯২১
পক্ষী ৫ স্বৰ্গ ৩ আকাশ
১১-৩১-৫১-৯১-১৮
…
সাংকেতিক লেখার অর্থ উদ্ধারের কোনো সূত্রও মহিলা রেখে যান নি। লীলার ধারণা কোনো একদিন সাংকেতিক লেখার অর্থ তাঁর মেয়ে উদ্ধার করবে। এমন আশা নিয়েই সংকেতগুলি তৈরি করা। সে যেমন আগ্রহ করে মার লেখা পড়েছে, একদিন তার মেয়েও সেরকম আগ্রহ করে লীলার লেখা পড়বে। যখন লীলা লিখতে বসে তখন এই ব্যাপারটা তার মাথায় থাকে। এমন কিছু লেখা যাবে না। যা পড়ে তার মেয়ে মন-খারাপ করে। একবার লেখা শুরু হয়ে যাবার পর আর মেয়ের কথা লীলার মনে থাকে না।
মেঘলা সকাল। জানালা দিয়ে সামান্য আলো আসছে। পর্দা সরিয়ে দিলে কিছু আলো পাওয়া যেত। লীলা পর্দা সরায় নি। আধো আলো আধো অন্ধকারেই তার লিখতে ভালো লাগে। সে লিখছে—
গতকাল রাতে আমার খুব ভালো ঘুম হয়েছে। অথচ ভালো ঘুম হবার কথা ছিল না। আমার ঢাকায় যাবার কথা ছিল। আমি ঢাকায় না গিয়ে আবারো বাবার বাড়িতে ফিরে এসেছি। সঙ্গে করে এক রোগীকে নিয়ে এসেছি। ভদ্রলোক স্থানীয় এক কলেজের শিক্ষক। তার নাম আনিস। ভদ্রলোক কুজো হয়ে হাঁটেন বলে তাঁর নাম কুঁজা মাস্টার। এই নামেই সবাই তাঁকে ডাকে।
বাড়িতে তাকে ফিরিয়ে আনা ঠিক হয় নি। কোনো হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া উচিত ছিল। তাঁর শরীর এখন ভয়ঙ্কর খারাপ। জ্বর একশ চার-একশ পাচের মধ্যে। মাথায় পানি ঢাললে জ্বর কিছু কমে। পানি ঢালা বন্ধ করলেই হুট করে বেড়ে যায়। রাতেই ডাক্তার ডেকে আনা হয়েছে। ডাক্তার রোগী দেখে বলেছেন, অবস্থা ভালো না। আজ রাতেই ঘটনা ঘটে যেতে পারে।
ডাক্তাররা এ ধরনের কথা বললে আতঙ্কগ্ৰস্ত হতে হয়। আমি অবাক হয়ে লক্ষ করলাম, ডাক্তারের ভয়ঙ্কর কথা শোনার পরও কেউ আতঙ্কগ্ৰস্ত হলো না। পরে আসল রহস্য জানলাম। এই ডাক্তার (সতীশ পাল) নাকি নিদান ডাক্তার। রোগীর অবস্থার সামান্য উনিশ-বিশ দেখলেই তিনি নিদান ডাকেন। অর্থাৎ গম্ভীর হয়ে বলেন, রোগী টিকবে না। যাদের সম্পর্কে তিনি এ-ধরনের কথা বলেছেন তারা কেউই না-কি মারা যায় নি। বরং যাদের সম্পর্কে নিদান ডাকা হয় নি তাদের কেউ-কেউ চলে গেছে। নিদান ডাক্তার সতীশবাবু যে-রোগী সম্পর্কে বলেন রোগী টিকবে না সেই রোগীর আত্মীয়স্বজনরা না-কি খুবই খুশি হন। হাস্যকর সব কাণ্ড! তবে সবার কথাবার্তায় আমি মজা পেয়েছি। ডাক্তার সাহেবের একটা ব্যাপার আমার ভালো লেগেছে— তিনি রোগীকে রেখে চলে যান নি। রোগীকে সঙ্গে নিয়ে ময়মনসিংহ সদর হাসপাতালে গেছেন। সবচে যেটা অদ্ভুত, আমার বাবাও সঙ্গে গেছেন। এই বিষয়ে পরে লিখব।
খুব ক্লান্ত ছিলাম। ঘুমে চোখ জড়িয়ে আসছিল। ভেবে রেখেছিলাম গরম পানি দিয়ে গোসল করেই সরাসরি বিছানায় চলে যাব, তখন শুনলাম আমার মা আমার জন্যে রান্না করেছেন। কাজেই খিদে না থাকলেও খেতে বসতে হবে। আমি খুব সহজেই লিখলাম আমার মা, আসলে লেখা উচিত আমার সৎমা। সৎমা শুনতে ভালো লাগে না, লিখতেও ভালো লাগে না। এরচে সরাসরি মা লেখাই ভালো। এই মহিলা মানসিকভাবে অসুস্থ। কিন্তু আমি লক্ষ করেছি, বেশির ভাগ সময় তিনি আমার সঙ্গে খুব স্বাভাবিকভাবে কথা বলেন। আমাদের দুজনের যখন কথাবার্তা হয় তখন বাইরে থেকে শুনে কারোর বোঝার সাধ্য নেই যে তিনি অসুস্থ। এই মহিলার কিছু অতিপ্রাকৃত ক্ষমতা আছে বলেও আমার মনে হয়। মাঝে মাঝে ভবিষ্যতের কিছু কথা বলেন। সেগুলি ফলে যায়। কাকতালীয় হতে পারে। আবার নাও হতে পারে।
আমার এই মা গতরাতে কাঁঠালের বিচি দিয়ে মুরগির মাংস রান্না করেছেন। কাঁঠালের বিচি তরকারি হিসেবে আমার খুব অপছন্দ। মানুষ কাঁঠাল যখন খায় তখন কাঁঠালের বিচিটা মুখে থাকে। মুখ থেকে বের করে। যে-জিনিসটা একজনের মুখ থেকে এসেছে সেটা খেতে আমার ঘেন্না করে। আমি খেতে বসলাম। মা নিজেই ভাড় বেড়ে দিলেন। তরকারির বাটিতে চামচ ডুবিয়ে তিনি থমকে গেলেন এবং আমাকে অবাক করে দিয়ে বললেন, মা, তুমি কাঁঠালের বিচি খাও না। তাই না? আমি বললাম, আপনি কী করে বুঝলেন?
তিনি তার জবাব দিলেন না। চুপ করে রইলেন। আমি বললাম, আমি মাংস আর ঝোল দিয়ে খাব। তিনি বললেন, না। তুমি একটু বসো, আমি ডিমের সালুন রান্না করে দিব। আমার সময় লাগবে না।
এই মহিলাকে একটা ঘরে তালাবন্ধ করে রাখা হয়। আজ দেখি তিনি স্বাধীন মানুষের মতো চলাফেরা করছেন। তবে তাকে যে দূর থেকে লক্ষ করা হচ্ছে এটা আমি বুঝতে পারছি। বাবা লক্ষ করছেন। সুলেমান নামের বডিগার্ড ধরনের একজন কর্মচারী, সেও লক্ষ করছে।
রান্না করার সময় তিনি সহজ-স্বাভাবিক মানুষের মতো টুকটাক গল্প করতে লাগলেন। কী সুন্দর গল্প বলার ভঙ্গিা! হাত নাড়ছেন, শরীর দোলাচ্ছেন।
বুঝছে মা, আমার একটা ছোট ভাইন ছিল। তার নাম চঞ্চলি। চঞ্চল ছিল, এইজন্যে নাম চঞ্চলি। আমরা দুই ভাইন পুষকুনির পাড়ে গিয়েছি, তখন হঠাৎ আমার পা পিছল খাইল। আমি পড়ে গেলাম পানিতে। সাঁতার জানি না। ড়ুইবা যাইতেছি, তখন চঞ্চলি আমারে বাচানোর জন্যে লাফ দিয়া পানিতে পড়ল। আমি ঠিকই পানি থেকে উঠলাম, চঞ্চলি উঠল না। তবে তারে আমি প্রায়ই দেখি।
আমি অবাক হয়ে বললাম, কোথায় দেখেন?
আমার আশেপাশে দেখি। আমার বিছানায় বসে আমার সাথে গফসফ করে। হাসে। একবার সারা রাইত আমার সাথে শুইয়া আছিল।
এখন কি উনি আশেপাশে আছেন?
না এখন নাই। কেউ ধারে কাছে থাকলে আসে না। লজ্জা পায়।
আমি বললাম, মা, আপনি যা দেখেন সেটা চোখের ভুল। মৃত মানুষের ফিরে আসার ক্ষমতা থাকে না।
উনি আমার এই কথাটা খুব শান্ত ভঙ্গিতে শুনলেন। তারপর বললেন, হইতে পারে, আমি পাগল-মানুষ। পাগল-মানুষের তো কোনো দিশা থাকে না।
আমি আপনার চিকিৎসা করাতে চাই। ভালো চিকিৎসা। ঢাকায় নিয়ে আপনাকে বড় বড় ডাক্তার দেখাব। প্রয়োজনে দেশের বাইরে নিয়ে যাব। আপনার আপত্তি আছে?
আছে। আপত্তি আছে গো মা।
আপত্তি কেন?
ভালো হয়ে গেলে চঞ্চলিরে। আর দেখব না।
উনাকে হয়তো দেখবেন না। কিন্তু তার বদলে ভালো ভালো অনেক কিছু দেখবেন।
ভয়ঙ্কর খারাপ জিনিস দেখেছি গো মা। ভালো কিছু আমার দেখতে ইচ্ছা করে না।
ভয়ঙ্কর খারাপ কী দেখেছেন?
বলব। তোমারে একদিন বলব। কোনো-একজনরে বলতে ইচ্ছা করে।