What's new
Nirjonmela Desi Forum

Talk about the things that matter to you! Wanting to join the rest of our members? Feel free to sign up today and gain full access!

Collected লীলাবতী - উপন্যাস (1 Viewer)

জোছনা প্রবল হয়েছে। বাড়ির পেছনের কামরাঙা গাছের ছায়া তার গায়ে পড়েছে। কামরাঙা গাছের চিড়ল-বিড়ল পাতার ছায়া জোছনায় সুন্দরভাবে এসেছে। বাতাসে গাছ কাঁপছে, ছায়াও কাঁপছে। সিদ্দিকুর রহমান নিজের গায়ের ছায়ার দিকে তাকিয়ে রইলেন। দৃশ্যটা তাঁর কাছে সুন্দর লাগছে, তবে মাস্টারের কথামতো এই সুন্দর দৃশ্য দেখে তার মনে কোনো ভাব তৈরি হচ্ছে না।

লোকমান!

জি?

মাসুদ এক-দুই দিনের মধ্যে ফিরে আসবে। যেদিন ফিরে আসবে সেদিনই কানে ধরে তাকে ট্রেনে তুলে দিবে। আমার হুকুমের অপেক্ষা করবে না।

জি আচ্ছা।

লোকমান হুক্কার নল তাঁর হাতে তুলে দিল। তিনি নল টানছেন। ভুড়ুক ভুড়ুক শব্দ হচ্ছে। শব্দ শুনতে তাঁর ভালো লাগছে।

কন্যার বাপ হুক্কা খায়
বুনকা বুনকা ধোঁয়া যায়।

সুন্দর সিমাসা। কে তাকে বলেছিল? রমিলা বলেছিল। একদিন তিনি বারান্দায় বসে হুক্কা টানছেন, হঠাৎ রমিলা ঘরের ভেতর থেকে বলে উঠল— কন্যার বাপে হুক্কা খায়, বুনকা বুনকা ধোঁয়া যায়। কী কারণে জানি রমিলার সিমাসা তার খুবই ভালো লাগল। তিনি সঙ্গে সঙ্গে রমিলাকে ডেকে পাঠিয়ে বললেন— ঘরের ভেতর থেকে কী বললা আরেকবার বলো। রমিলা ভয়ে অস্থির হয়ে বলল, আমার ভুল হইছে মাপ কইরা দেন। সিদ্দিক সাহেব অবাক হয়ে বললেন, ভুলের কী হইছে? সুন্দর সিমাসা বলেছি, আমার পছন্দ হয়েছে। রমিলা তার পরেও বলল, আর কোনোদিন বলব না। আমারে ক্ষমা দেন। তিনি দুঃখিত হয়ে বললেন, আচ্ছা ঠিক আছে যাও, ক্ষমা দিলাম।

অতি সুন্দর এই সিমাসাটা লীলাকে বললে কেমন হয়? হুক্কায় টান দিয়ে বুনকা বুনকা ধোয়া ছাড়তে ছাড়তে বলবেন। লীলা নিশ্চয় মজা পাবে। মেয়েটা নিজের মনে ঘুরে বেড়াচ্ছে। সে কী ভাবছে কে জানে! তাকে পাশে বসিয়ে কিছুক্ষণ গল্প করলে বোঝা যেত সে কী ভাবছে। কিন্তু তাকে ডেকে এনে আয়োজন করে কথা বলতে ইচ্ছা করছে না। যদি তার আসতে ইচ্ছা করে সে আসবে নিজের মতো। সে কবে চলে যাবে? যেরকম হুট করে এসেছিল— সেরকম হুট করেই কি চলে যাবে? যদি সে একবার ঠিক করে চলে যাবে তাহলে তাকে আটকানো যাবে না। তার মাকেও আটকানো যায় নি। এই মেয়েটা পুরোপুরি তার মা’র স্বভাব পেয়েছে। মাতৃ-স্বভাবের মেয়ে জীবনে সুখী হয় না। পিতৃ-স্বভাবের মেয়ে সুখী হয়। এই নিয়েও একটা সিমাসা আছে। সিমাসটা যেন কী? সিদ্দিকুর রহমান ভুড়ুক ভুড়ুক শব্দে হুক্কা টানছেন, চোখ বন্ধ করে সিমাসা ভাবার চেষ্টা করছেন। কিছুটা মাথায় আসছে, কিছুটা আসছে না—

মা-স্বভাবী দেখান হাসি
কন্যা থাকেন ভঙ্গে
বাপ-স্বভাবী সুখ-কপালি
কন্যা থাকেন রঙ্গে।

এই তো মনে পড়েছে। কন্যা থাকেন রঙ্গে। রঙ্গে থাকা অনেক বড় ব্যাপার। তিনি মনে-প্ৰাণে চাচ্ছেন তার কন্যা থাকবে রঙ্গে।



লীলা তার সৎমার খাওয়া দেখছে। রমিলা খুব গুছিয়ে ভাত খাচ্ছেন। পাটিতে বসেছেন— সামনে জলচৌকি, সেখানে ভাত-তরকারি। ঘোমটা দিয়ে বসেছেন। অসুস্থ মানুষের হুসাহাস খাওয়া না, ফেলে ছড়িয়ে একাকার করাও না। যেন তিনি এ-বাড়ির নতুন বউ। নতুন বউ বলেই ঘোমটা টেনে লাজুক-লাজুক ভঙ্গিতে খেতে হচ্ছে।
 
রমিলার ঘরে আলো নেই। ঘরের বাইরে জানালার পাশে হারিকেন রাখা হয়েছে। তার আলো ভেতরে পড়েছে। সেই আলো কাটা বেছে ছোটমাছ খাবার জন্যে যথেষ্ট না। অসুস্থ মহিলার ভাত খাওয়া দেখে লীলার রাগ লাগছে। কষ্টও লাগছে। সাৰ্ব্বক্ষণিক দেখাশোনার জন্য এই মহিলার একজন কাউকে দরকার। সেরকম কেউ নেই। লীলার বাবা সুস্থ-সবল একজন মানুষ। তার পেছনে ছায়ার মতো দুজন লোক আছে। যেন একজন মানুষের দুটা ছায়া। অথচ অসহায় এই মহিলাকে দেখার কেউ নেই। তার নিজের ছেলেমেয়েরাও একবার এসে খোঁজ নেয় না। খুশির মা বলে একজন মহিলা প্রতিদিন একবার আসেন। মনে হচ্ছে এই মহিলার উপরই দায়িত্ব। খুশির মা খুবই কাজের মেয়ে, তার পরেও সে তো এ-বাড়িতে থাকে না। লীলা লক্ষ করেছে, তার সৎমায়ের খাবারের সময়েরও কোনো ঠিক নেই। আজ তিনি সন্ধ্যাবেলায় খেতে বসেছেন। গতকাল দুপুরে তিনি কিছুই খান নি। এই ব্যাপারটা নিয়ে লীলা খুশির মার সঙ্গে কথা বলেছে। খুশির মা বলেছে–আম্মাজিগো, উনি যখন ভাত খাইতে চাইবেন তখন ভাত দিলে খাইবেন। না চাইলে ভাত দিলে উনি খুবই রাগ করেন।

লীলা বলল, খুবই রাগ করেন মানে কী? রাগ করলে কী করেন— ভাতের থালা-বাটি উল্টে ফেলেন?

সেইটা করলে তো ভালোই ছিল আম্মাজি। বেশি রাগলে পরনের কাপড় খুঁইল্যা দাঁত দিয়া ছিড়েন। বড়ই লইজার বিষয়। এইজন্যেই তো উনার দেখভালের জন্যে বাইরের লোক রাখা হয় না। উনার নিজের ছেলেমেয়েরা উনারে দেখতে আসে না। লইজ্জা পায়।

কথাগুলি লীলার কাছে যুক্তিযুক্ত বলে মনে হলো না। সব যুক্তি মন গ্ৰহণ করে না। এই যুক্তিও করছে না।

লীলাকে চমকে দিয়ে রমিলা হঠাৎ ক্ষীণ স্বরে বললেন, মাগো, কী দ্যাখো?

লীলা বলল, আপনার খাওয়া দেখি।

রমিলা চাপা হাসি-মাখানো গলায় বললেন, খাওয়ার মধ্যে কী আছে গো মা? খাওয়া তো রঙ্গিলা নাইচ না যে দেইখ্যা মজা পাইবা!

লীলা বলল, খাওয়া রঙ্গিলা নাচ না হলেও খাওয়া দেখার মধ্যে আনন্দ আছে। আপনার ছেলেমেয়েরা যখন খেতে বসত। তখন আপনি পাশে বসে তাদের খাওয়া দেখতেন না? দেখে আনন্দ পেতেন না?

তুমি তো দূর থাইক্যা দেখতেছ। কাছে বইসা খাওয়া দ্যাখো।

আসছি। বাবার কাছ থেকে চাবি নিয়ে এসে দরজা খুলে আসছি।

চাবি চাইলে তোমার বাবা চাবি দিব না। এক কাজ করো, তোমার বাপের ঘরে যাও। সেই ঘরে কাঠের দুইটা বড় আলমারি আছে। কালা রঙের আলমারির তিন নম্বর ড্রয়ারে চাবি আছে।

আপনি জানেন কীভাবে?

আমি অনেক কিছু জানি। কেউ আমারে কিছু না বললেও আমি জানি। মাসুদ চইল্যা গেছে— কেউ আমারে কিছু বলে নাই। কিন্তু আমি জানি।

কেউ আপনাকে কিছু না বললেও তারা নিজেদের মধ্যে আলোচনা করেছে, সেখান থেকে আপনি শুনেছেন।

এইটা ঠিক বলছ মা। আমার কান খুবই পরিষ্কার। যাও চাবি দিয়া দরজা খুঁইল্যা আমার সাথে বসো। আমি খাওয়া বন করলাম। তুমি সামনে বসলে খাওয়া শুরু করব।
 
লীলা চাবি আনতে বাবার ঘরে ঢুকল। চাবি যেখানে থাকার কথা সেখানেই আছে। সে চাবি হাতে নিয়ে ঘুরল আর তখন সিদ্দিকুর রহমান বললেন, চাবি নিয়া কই যাও? ঘটনাটা হঠাৎ ঘটায় চট করে লীলার মাথায় কোনো জবাব এলো না। সে বাবার দিকে তাকিয়ে রইল। সিদ্দিকুর রহমান বললেন, তালা খুলে তুমি তোমার সৎমারে আজাদ করতে চাও?

তা না। উনি ভাত খাচ্ছেন, আমি সামনে বসে থাকব।

সামনে বসে থাকার দরকার নাই।

আমি উনাকে কথা দিয়ে এসেছি। সামনে বসে খাওয়াব। উনি খাওয়া বন্ধ করে বসে আছেন।

যখন-তখন যে-কোনো মানুষরে কথা দিবা না। কথা অনেক দামি জিনিস।

লীলা শান্ত গলায় বলল, কথা দামি জিনিস বলেই তো আমি আমার কথা রাখব।

না।

का। একজন অসুস্থ মানুষকে আমি কথা দিয়ে এসেছি। উনি আমার কথা বিশ্বাস করে খাওয়া বন্ধ করে বসে আছেন। আমি যদি এখন তার কাছে না। যাই তাহলে উনি খাবেন না।

না খেলে না খাবে। পাগল-মানুষ এক-দুই বেলা না খেলে কিছু হয় না।

আপনি এমন একটা ছোট কথা কী করে বললেন?

সিদ্দিকুর রহমান ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, তাহলে একটা ঘটনা শোনো–মরিয়ম নামের একটা মেয়েকে রেখেছিলাম যে তোমার সৎমায়ের দেখভাল করবে। ভাটি অঞ্চলের গরিব ঘরের মেয়ে। রমিলা একদিন কী করল শোনো— মরিয়মরে ভুলিয়ে-ভালয়ে দরজা খুলাল। তারপর হুট করে ঘর থেকে বের হয়ে বঁটি দিয়ে তারে কোপ দিল। আমি মরিয়মকে প্রথমে নেত্রকোনা, তারপর ময়মনসিংহ সদর হাসপাতালে নিয়ে গেলাম। সেখানেই সে মারা যায়। মামলা-মোকদ্দমা যেন না হয়। সেজন্যে আমাকে অনেক টাকা-পয়সা খরচ করতে হয়েছে। মরিয়ম গরিব ঘরের মেয়ে বলে অল্পের উপর দিয়ে গিয়েছে। এখন নিশ্চয়ই বুঝতে পারছি কেন আমি এত সাবধান। আমার কথা শোনো— যেখানে চাবি ছিল সেখানে রাখো।

লীলা বলল, উনি আমাকে কিছু করবেন না। উনি আমাকে পছন্দ করেন।

সিদ্দিকুর রহমান বিরক্ত গলায় বললেন, মরিয়মকেও রমিলা খুব পছন্দ করত। তাকে রমিলা ডাকত— ময়না সোনা। এই নিয়া তোমার সাথে আর কথা বলতে ইচ্ছা করছে না। দাও, ঘরের চাবি আমার হাতে দাও।

লীলা বাবার হাতে চাবি দিয়ে শান্ত গলায় বলল, আমি আপনার এখানে দুদিন থাকব ভেবে এসেছিলাম, চারদিন থেকেছি। কাল সকালে চলে যাব।

সিদ্দিকুর রহমান বললেন, তোমাকে যদি চাবি দিয়ে দেই তাহলে কি আরো কয়েকদিন থাকবে?

না।

আচ্ছা ঠিক আছে। কাল যেতে চাও, কাল যাবে।

আমি যাকে সঙ্গে নিয়ে এসেছিলাম, মঞ্জুমামা, তিনি বাড়ি ফেরার জন্যে অস্থির হয়েছেন। আর আমার নিজেরও এখানে থাকতে ভালো লাগছে না।

কাল সকালেই তুমি যাবে?

জি।
 
সিদ্দিকুর রহমান বললেন, তোমাকে দেখে আমি খুব খুশি হয়েছি। নিজের খুশি আমি প্রকাশ করতে পারি না। রাগ প্রকাশ করতে পারি। পৃথিবীতে দুই ধরনের মানুষ আছে। এক ধরনের মানুষ রাগ প্রকাশ করতে পারে, খুশি প্রকাশ করতে পারে না। আরেক ধরনের মানুষ খুশি প্রকাশ করতে পারে, রাগ প্ৰকাশ করতে পারে কলা।

লীলা বিস্মিত হয়ে বলল, এই কথাগুলি কি আপনি নিজে চিন্তা করে বললেন?

সিদ্দিকুর রহমান বললেন, না, আমি এত সুন্দর সুন্দর কথা বলতে পারি না। এইগুলি মাস্টারের কথা। মাস্টারের সঙ্গে তোমার দেখা হয় নাই?

না, দেখা হয় নি। উনার কথা শুনেছি। সবাই উনাকে কুঁজা মাস্টার ডাকে।

হুঁ।

শুনেছি আপনি তাকে খুব পছন্দ করেন?

হুঁ, করি।

কেন?

জানি না। মানুষের পছন্দ-অপছন্দ হিসাব মেনে হয় না। পছন্দ-অপছন্দের কোনো ব্যায়াকরণ নাই।

এটাও কি কুঁজা মাস্টারের কথা?

এটা আমার কথা। মা শোনো, যাও চাবি নিয়ে রমিলার ঘরে যাও। তার সামনে বসে তাকে খাওয়াও। আমি সোলেমানকে বলে দিচ্ছি, সে আশেপাশে থাকবে। তেমন কিছু ঘটলে সামলাবে।

লীলা তাকিয়ে আছে। সে তার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটাকে বুঝতে চেষ্টা করছে। বুঝতে পারছে বলে মনে হচ্ছে না। সিদ্দিকুর রহমান মেয়ের দিকে তাকিয়ে অভয়দানের ভঙ্গিতে হাসলেন।

লীলা তার সৎমায়ের সামনে বসে আছে। তার মনে ক্ষীণ অস্বস্তি। অস্বস্তির কারণ, তার কেন জানি মনে হচ্ছে— এই অসুস্থ মহিলা হঠাৎ এক নলা ভাত তার মুখের সামনে ধরে আদুরে গলায় বলবেন, মা খাওগো। লীলা। এই মহিলার হাতের নলা কখনো মুখে নিতে পারবে না। অসুস্থ মানুষকে সে কিছু বুঝিয়েও বলতে পারবে না। অসুস্থ মানুষ যুক্তি মানে না। তারা একবার অপমানিত বোধ করলে সেই অপমানবোধ মনের গভীরে ঢুকে যায়। তাদের এলোমেলো জগৎ হঠাৎ করে আরো এলোমেলো হয়। তার ফল শুভ হয় না।

তোমার নামটা বড় সুন্দর, লীলা। নামটা কে রাখছে গো?

মা রেখেছেন।

তোমারে খুব আদর করত?

সব মা-ই তো ছেলেমেয়েদের আদর করে। এমন মা কি আছে যে ছেলেমেয়েদের অনাদর করে?

আমি করি। আমি যেমন করি তারাও করে। এই যে আমার ছেলেটা বাড়িঘর ছেড়ে পালায়ে গেল, আমারে মুখের দেখাও দেখল না।

লীলা কী বলবে ভেবে পেল না। অসুস্থ রমিলার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল।

তুমি কবে যাইবা গো মা?

আমি কাল সকালে যাব।

রমিলা এই কথা শুনে হেসে ফেললেন। মুখে ভাতের নলা তুলতে যাচ্ছিলেন, সেই নলা নামিয়ে রেখে হেসে কুটি-কুটি হলেন। লীলা বলল, হাসেন কেন?

তোমার কথা শুইন্যা হাসি।

আমার কথাটা কি খুব হাসির?

হুঁ হাসির। তুমি কোনোদিন যাইবা না। এইখানেই থাকবা।

ভবিষ্যদ্বাণী করছেন?

যেটা ঘটব সেইটা বললাম। মিলাইয়া দেইখো।

আচ্ছা মিলিয়ে দেখব।

খাওয়া শেষ হইছে গো মা, এখন হাত ধুব।

আসুন আপনার হাত ধুইয়ে দিই।

রমিলা লীলার এই কথায় আবারো হেসে কুটি-কুটি হলেন। এইবার আর লীলা জিজ্ঞেস করল না, কেন হাসেন। রমিলা হঠাৎ হাসি থামিয়ে বললেন, আমার খুব ইচ্ছা ছিল তোমার মুখে একটা ভাতের নলা তুইল্যা দেই। তুমি ঘিন্না পাইবা বইলা দিলাম না। তোমারে দেইখা মনে হয় তোমার ঘিন্না বেশি।

লীলা তাকিয়ে আছে। রমিলা খুব হাসছেন।


আনিসের জ্বর খুব বেড়েছে। সে প্ৰলাপ বিকা শুরু করেছে। সে ক্রমাগত কথা বলে যাচ্ছে। কী বলছে সে নিজে জানে না। একটা ব্যাপার তার খুব ভালো লাগছে— সে যা বলতে চাচ্ছে বলতে পারছে। কোনো সমস্যা হচ্ছে না।

অসম্ভব রূপবতী একটি মেয়ে চিন্তিত মুখে তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। এই ব্যাপারটাও তার খুব ভালো লাগছে। মেয়েটি একা দাঁড়িয়ে নেই, তার সঙ্গে আরো অনেকে আছে। সিদ্দিক সাহেবও আছেন। কিন্তু অন্য কাউকেই আনিস স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে না। মেয়েটিকে দেখতে পাচ্ছে। আনিস মেয়েটির দিকে তাকিয়ে বলল, আপনি ভাববেন না যে আমি আপনাকে চিনি না। আপনাকে আমি খুব ভালোভাবে চিনি। আপনি সিদ্দিক সাহেবের বড় মেয়ে লীলাবতী। আপনার নাম উল্টো করলে কী হয় জানেন— তীবলালী। আমার নাম উল্টো করলে মেয়েদের নাম হয়ে যায় সনিআ। আমার মা আপনাকে দেখলে কী বলত জানেন? আপনাকে দেখলে বলত, আইত্যান্ত সুন্দরী কন্যা। আমার মা অত্যন্ত বলতে পারে না। মাঝখানে একটা ই লাগিয়ে আইত্যান্ত।

লীলাবতী নামের মেয়েটা আনিসকে কী যেন বলল। আনিস তার কথা শুনতে পেল না। সে এখন কারো কথাই শুনতে পাচ্ছে না, শুধু নিজের কথাগুলি পরিষ্কার শুনছে।
 
ট্রেন থেমে আছে
প্রায় আধঘণ্টার উপর ট্রেন থেমে আছে।

কোন থেমে আছে। কেউ বলতে পারছে না। কতক্ষণ থেমে থাকবে তাও কেউ বলতে পারছে না। ব্যাপারটা নিয়ে কাউকে চিন্তিত মনে হচ্ছে না। মনে হচ্ছে সবাই খুশি। জানালার পাশে একটা সিট নিয়ে লীলা বসেছে। বেঞ্চের সর্বশেষ সিট বলে দেয়ালে হেলান দিয়ে বসেছে। লীলার পাশেই মঞ্জু। তার হাতে ফ্লাস্ক ভর্তি গরম পানি। চা বানানোর সরঞ্জাম। ভদ্রলোকের প্রধান শখ চলন্ত ট্রেন বা বাসে নিজের হাতে বানিয়ে চা খাওয়া। মঞ্জুর মেজাজ খারাপ। তার আরো কিছুদিন থাকার ইচ্ছা ছিল। জায়গাটা সম্পর্কে ধারণা পাওয়ার আগেই চলে যেতে হচ্ছে এটা কেমন কথা? চলে আসার সময় কইতরী এমন কান্না শুরু করল যে তার নিজের চোখেও পানি এসে গেল। তিনি গম্ভীর গলায় ঘোষণা দিলেন– মা, কাঁদিস না। আমি লীলাকে পৌছে দিয়ে চলে আসব। তারপর যতদিন ইচ্ছা নিজের মতো থাকব। ভদ্রলোকের এককথা। আমি ভদ্রলোক।

লীলাদের উল্টোদিকের বেঞ্চে কান্ত হয়ে আনিসুর রহমান শুয়ে আছে। এই গরমেও তার গায়ে মোটা চাদর। শীত লাগছে–এই কথাটা সে কাউকে বলতেও পারছে না। আশেপাশে কেউ থাকলে সুটকেস খুলিয়ে সুটকেস থেকে সে আরেকটা চাদর বার করত। পায়ের তালুতে শীত বেশি লাগছে। একজোড়া মোজা পরলেও হতো। সে চোখ খোলা রাখতে পারছে না। চোখে রোদ লাগছে।

আনিসুর রহমান কলেজের চাকরি ছেড়ে দিয়েছে। এখন সে যাচ্ছে মায়ের কাছে। ডাক্তার দেখিয়ে প্রথমে শরীর সারাবে। পরেরটা পরে দেখা যাবে। তার যাত্ৰাসঙ্গী হয়েছে বড় সাহেবের মেয়ে লীলা। এটা অস্বস্তিকর। পরিচিত কেউ না থাকলে ভালো হতো। পরিচিত কেউ থাকা মানেই কিছু সৌজন্যমূলক কথাবার্তা। অসুস্থ অবস্থায় কোনো কথাবার্তা বলতে ইচ্ছা করে না। কথা শুনতেও ভালো লাগে না। তবে লীলা মেয়েটা ভালো। তার মধ্যে লোক দেখানো ব্যাপারটা নেই। শরীর কেমন? খারাপ লাগছে?— এই জাতীয় কোনো কথাই সে বলছে না। জানোলা দিয়ে মুখ বের করে সে আছে নিজের মতো। মঞ্জু আনিসের কাছে এসে বলল, আমার কাছে বালিশ আছে, নিজের বালিশ বিছানার চাদর ছাড়া আমি বের হই না। আপনাকে দেব?

আনিস বলল, না।

লাগলে বলবেন, লেজা করবেন না। আমার হলো উঠল বাই তো কটক যাই সিস্টেম। ব্যােগ গোছানোই থাকে। ব্যাগে লুঙ্গি, মশারি, দড়ি, টর্চলাইট, হাতুড়ি সব পাবেন। মেডিসিন বক্স একটা আছে, সেখানে যাবতীয় এসেনসিয়াল ড্রাগ পাবেন। পেট খারাপ হয়েছে— ফ্রাজিল আছে। মাথা ধরার ওষুধ আছে, জ্বর কমানোর ওষুধ আছে। থার্মোমিটার আছে। প্ৰেশার মাপার যন্ত্র আছে।

আনিস বলল, ভালো তো!

মঞ্জু বলল, ভালো-মন্দ জানি না। আমি সবসময় তৈরি থাকতে পছন্দ করি। দেখি, আপনার জ্বর কত মেপে দেই।

আনিস বলল, দরকার নেই।

মঞ্জু বলল, অবশ্যই দরকার আছে। আপনার চোখ-মুখ লাল হয়ে আছে। জ্বর একশ দুইয়ের উপরে। জ্বর একশ দুই ক্রস করলে চোখ-মুখ লাল হয়ে যায়।

প্লিজ, আমার কিছু লাগবে না।

শুনলাম আপনি চাকরি ছেড়ে দিয়ে ফর গুড চলে যাচ্ছেন? চির বিদায়।

হুঁ।

সঙ্গে ক্ল্যাশ হয়েছিল?

হুঁ।

কলেজের প্রফেসরের চাকরি তো ভালো চাকরি। ছাড়লেন কেন? কারো সঙ্গে কি ক্ল্যাশ হয়েছিল?

হুঁ।

কার সঙ্গে?

আপনার সঙ্গে কথা বলতে ভালো লাগছে না। কিছু মনে করবেন না।

মঞ্জু কিছু মনে করল বলে মনে হলো না। সে ব্যস্ত হয়ে পড়ল ফ্রাঙ্ক নিয়ে। ফ্লাস্কের মুখ খুলছে না। মনে হয় প্যাচ কেটে গেছে।
 
ট্রেন ছেড়ে দিয়েছে। এতক্ষণ কামরাভর্তি লোক ছিল, এখন প্রায় ফাকা। এই কামরায় যারা এসেছিল তারা লীলাকে উঠিয়ে দিতে এসেছিল। তাদেরকে বলা হয়েছিল, সিট দখল করে বসে থাকবে যাতে বাইরের কেউ উঠতে না পারে। ট্রেন ছেড়ে দেবার সময় নেমে যাবে।

আনিসের পায়ের কাছে দুই ভদ্রলোক বসেছেন। মনে হয় রাজনীতির লোক। ক্রমাগত বকবক করে যাচ্ছে—

যুক্তফ্রন্ট ভেঙে গেছে, উচিত শিক্ষা হয়েছে। এখন বুঝ কত ধানে কত চাল! ইস্কান্দর মীর্জা সাহেব উচিত কাজ করেছেন।

ইস্কান্দর মীর্জটা কে?

মেজর জেনারেল। কঠিন লোক। বাঙালির জন্যে দরকার কঠিন লোক।

রাজনীতির আলাপে উৎসাহিত হয়ে মঞ্জু। তাদের সঙ্গে যুক্ত হলো এবং অতি দ্রুত একমত হলো যে, পূর্ববাংলার গভর্নর জেনারেল গোলাম মোহাম্মদ কঠিন চীজ। সে পানি ছাড়াই চিড়া ভিজাতে পারে। আলোচকদের গলা উঁচু থেকে উঁচু হচ্ছে। আনিস একবার শুধু বলল, একটু আস্তে কথা বলবেন? কেউ তা শুনল না।

লীলা জানোলা দিয়ে তাকিয়ে আছে। কেন জানি তার খুব মজা লাগছে। নয়াপাড়া নামের জায়গাটায় সে বেশ কিছুদিন কাটিয়েছে। জায়গাটার জন্যে কিছুটা হলেও তার মনখারাপ লাগা উচিত। তা লাগছে না। ভাবটা এরকম যে সে একটা জরুরি কাজে গিয়েছিল। কাজ শেষ হয়েছে, এখন ফিরে যাচ্ছে। মন খারাপ করা বা বিষন্ন হবার মতো কিছুই ঘটে নি। যদিও লীলার সৎমা খুব কান্নাকাটি করলেন। মস্তিষ্কবিকৃত মানুষের কান্নাকাটিকে গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করার কিছু নেই। তারা কারণ ছাড়াই কাব্দে। রমিলা লীলার হাত ধরে বিস্মিত গলায় বললেন, চইল্যা যাবা? লীলা বলল, আমি সারাজীবন এখানে থাকার জন্যে আসি নাই। আপনাদের দেখার শখ ছিল। দেখেছি, শখ মিটেছে। এখন চলে যাচ্ছি।

থাকলে কী হয়?

থাকলে কিছু হয় না। কিন্তু আমি আরো পড়াশোনা করব। এখানে পড়াশোনা করব কোথায়?

পড়াশোনা না করলে কী হয়?

লীলা হেসে ফেলল। হাসি থামিয়ে বলল, আমার প্রসঙ্গে আপনি যে কথা বলেছিলেন তা কিন্তু হয় নি।

কী বলেছিলাম?

আপনি বলেছিলেন। আমি এইখানেই থাকব, কোথাও যাব না।

পাগল-মানুষের কথা।

লীলা বলল, আপনি ভালো থাকবেন। নিজের যত্ন নেবেন।

রমিলা তখন কাঁদতে শুরু করলেন। সৎমায়ের কাছ থেকে বিদায় নেয়া লীলার জন্যে কঠিন হয়ে দাঁড়াল। একসময় সিদ্দিকুর রহমান এসে বললেন, মেয়ের হাত ছাড়ো। তাকে যেতে দাও। রমিলা তৎক্ষণাৎ লীলার হাত ছেড়ে একপাশে গুটিয়ে গেলেন। ভীতচোখে তাকাতে লাগলেন। সিদ্দিকুর রহমান বললেন, যে যেতে চায় তাকে জাপটে ধরে রাখা যায় না। বুঝেছ? রমিলা ভীত গলায় ফিসফিস করে বললেন, বুঝেছি।
 
বিদায়মুহূর্তে সিদ্দিকুর রহমান মেয়েকে কিছু বললেন না। কিছুক্ষণ আগেই বাড়িতে একটা নাটক হয়েছে। পরিস্থিতি উত্তপ্ত। চুপচাপ থাকাই বাঞ্ছনীয়।

নাটক তৈরি হয়েছে মাসুদকে নিয়ে। সে ভোরবেলায় এসে উপস্থিত। চোখমুখ শুকনা। মাথার চুল উঠে গেছে। দেখে মনে হয়েছে কয়েক দিন না খেয়ে আছে। গালের চামড়া দেবে আছে। চোখের নিচে কালি। সিদ্দিকুর রহমান কিছুক্ষণ ছেলের দিকে তাকিয়ে থেকে বললেন, আছ কেমন?

মাসুদ অস্পষ্ট স্বরে বলল, ভালো।

দেশ-বিদেশ ঘুরলা?

মাসুদ কিছু বলল না। সিদ্দিকুর রহমান বললেন, ফিরে আসলা কেন?

মাসুদ চুপ করে রইল। সিদ্দিকুর রহমান বললেন, জবান বন্ধ কেন? কথা বলো। কার টানে ফিরলা? আমার টানে ফিরো নাই এইটা আমি জানি। আমার জন্যে এত টান কারোর নাই। তুমি তোমার ভাইবোনের জন্যেও ফিরো নাই। ঘরবাড়ির টানেও ফিরো নাই। তুমি কি পরীবানুর টানে ফিরেছ? দেখা হয়েছে তার সাথে?

মাসুদ জবাব দিচ্ছে না। সে আতঙ্কে অস্থির হয়ে আছে। সিদ্দিকুর রহমান আবারো বললেন, পরীবানুর সঙ্গে দেখা হয়েছে? হ্যাঁ কিংবা না একটা কিছু বলো।

মাসুদ বলল, জি দেখা হয়েছে।

পরীবানু তোমাকে দেখে খুশি হয়েছে?

মাসুদ চুপ করে আছে। সিদ্দিকুর রহমান হুক্কায় লম্বা টান দিয়ে সুলেমানকে ডেকে সহজ গলায় বললেন, তোমাকে বলছিলাম মাসুদ যে-ট্রেনে নামবে সেই ট্রেনেই তাকে কানে ধরে তুলে দিবে। এই কাজটা তুমি করো নাই। যা-ই হোক, সকাল দশটায় একটা ট্রেন আছে। ঐ ট্রেনে তুলে দাও।

সুলেমান হ্যাঁ-সূচক ঘাড় কাত করল। সিদ্দিকুর রহমান সহজ গলায় বললেন, কানে ধরে নিয়ে যাবে। ভুল হয় না যেন।

সুলেমান আবারো হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়ল।

লীলা বিচারপ্রক্রিয়া শুনল। কিছুই বলল না। সে এই বাড়িতে আর থাকছে। না। চলে যাচ্ছে। বাড়ির কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যোগ রাখার আর অর্থ হয় না। পৃথিবীর সবকিছু তার নিজের নিয়মে চলে। এই বাড়ি চলবে বাড়ির নিয়মে। এই বাড়ির নিয়ম যদি হয় কথায়-কথায় কানো ধরে ঘোরানো তাহলে তা-ই সই। লীলা যখন তার ব্যাগ গোছাচ্ছিল তখন মাসুদ এসে তার সামনে দাঁড়াল। লীলা বলল, কিছু বলবে? মাসুদ কথা বলে নি। লীলা একবার ভাবল কিছু উপদেশ দেয়। তেমন কোনো উপদেশ তার মাথায় আসে নি। লীলা বলল, তুমি কিছু বলতে চাইলে বলো। মাসুদ তখন বিড়বিড় করে বলল, আমাকে আপনার সঙ্গে নিবেন?

লীলা বলল, না।

মাসুদ বলল, আমি কী করব বলে দেন।

লীলা বলল, তুমি কী করবে সেটা তুমি চিন্তা করে বের করবে।

মাসুদ সামনে থেকে চলে গেল। তার কিছুক্ষণ পর সত্যি সত্যি তাকে কানে ধরে স্টেশনের দিকে নিয়ে গেল সুলেমান। সুলেমানের পেছনে আছে লাঠি হাতে লোকমান। তাদের পেছনে গ্রামের কিছু লোকজন, কিছু বাচ্চ-কাচ্চা। সিদ্দিকুর রহমান সাহেব বলে দিয়েছিলেন ছেলেকে যেন পরীবানুর বাড়ির সামনে কিছুক্ষণ রাখা হয়। সেই কাজটা করা হলো। পরীবানু বাড়ি থেকে বের হয়ে অবাক হয়ে কিছুক্ষণ এই দৃশ্য দেখে বাড়িতে ঢুকে গেল।
 
ট্রেন ছুটছে। আকাশ মেঘলা। বাইরের পৃথিবী অন্ধকার দেখাচ্ছে। দেখতে ভালো লাগছে। দূরের গাছপালাকে কুচকুচে কালো লাগছে।

বাবার কাছ থেকে বিদায়ের দৃশ্য কেমন হবে এটা নিয়ে লীলার মনে সামান্য দুশ্চিন্তা ছিল। তবে লীলা মোটামুটি নিশ্চিত ছিল যে আবেগঘন কিছু হবে না। বাবা স্বাভাবিক সৌজন্যের কিছু কথাবার্তা বলবেন। লীলা ঠিক করেছে, সে বিদায় নেবার সময় তীক্ষ্ণ চোখে বাবার দিকে তাকিয়ে থাকবে। তার দেখার ইচ্ছা এই অতি কঠিন মানুষটার চোখে পানি আসে কি-না। পানি না এলেও চোখ কি ছলছল করবে?

সিদ্দিকুর রহমান মেয়ের মাথায় হাত রেখে বললেন, ফি আমানিল্লাহ। যাও। তুমি এসেছিলে, মনে তৃপ্তি পেয়েছি, এর বেশি আমার কিছু বলার নাই। তোমার দাদির একটা গয়না আমার কাছে আছে। আমার খুব শখ গয়নাটা তোমাকে দেই। গয়নাটা নিবে?

লীলা বলল, না।

সিদ্দিকুর রহমান বললেন, তোমার মায়ের একটা খাতা আমার কাছে আছে। নানান সময়ে সে গুটুর গুটুর করে কী সব লিখত। এই বাড়ি ছেড়ে যাবার সময় সে খাতাটা ফেলে গেছে। মনে হয় ইচ্ছা করেই ফেলে গেছে। তুমি চাইলে খাতাটা তোমাকে দিতে পারি।

ইচ্ছা করে ফেলে যাবে কেন?

খাতায় আমার সম্পর্কে, আমার দাদিজান সম্পর্কে অনেক অন্দমন্দ কথা আছে। মনে হয় তোমার মা চেয়েছিল। আমি লেখা পড়ে মনে কষ্ট পাই।

খাতাটা আমি নিব।

সিদ্দিকুর রহমান বললেন, মা শোনো, তোমার পড়াশোনার খরচ, বিবাহের খরচ সব আমি দিতে চাই।

আপনাকে কিছু দিতে হবে না।

আচ্ছা ঠিক আছে।

বাবা, আমি এখন রওনা দেই।

তোমার জন্যে পালকি আনতে লোক গেছে। পালকি আসুক, তারপরে যাবে।

কথাবার্তার এই পর্যায়ে লীলা লক্ষ করল, তার বাবার চোখে পানি। তিনি চট করে মাথা সরিয়ে ফেললেন যেন লীলা চোখের পানি দেখতে না পায়।



মায়ের লেখা খাতা লীলা বেশ খানিকটা পড়ে ফেলেছে পালকিতে আসতে আসতে–

আজ শুক্রবার। জুম্মাবার। আমার মনে কোনো শান্তি নাই। আমি আজ ফজরের নামাজ পড়িয়া আল্লাহপাককে বলিয়াছি— ও আল্লাহগো, ও দয়াময়, তুমি দয়া করো। তুমি ডাইনির হাত হইতে আমাকে উদ্ধার কর। মানুষ কী প্রকারে এমন হইতে পারে?

আমি আমার দাদি শাশুড়িকে ডাইনি বলিতেছি। ইহা অতীব অন্যায়। কিন্তু কত দুঃখে বলিতেছি, তাহা কি কেউ বুঝিবে? গত বুধবারের ঘটনা। বুধবারে এই অঞ্চলে বিরাট হাট বসে। উনি লোকজন নিয়া হাটে গিয়াছেন। বাড়ি প্রায় খালি। আমার দাদিশাশুড়ি আমাকে ডাকিয়া পাঠাইলেন। আমি উনার সম্মুখে উপস্থিত হইতেই উনি বলিলেন, নাতবউ, তোমার বুনি দুইটা এত বড় কেন? বিবাহের পূর্বেই কেউ হাতাপিতা করিয়াছে? বিবাহের পূর্বে হাতাপিতা করলে বুনি বড় হয়।

আমি এতই অবাক হইলাম যে আমার জবান বন্ধ হইল। আমি চুপ করিয়া আছি, তখন ডাইনি বলিল, ব্লাউজ খোল, আমি তোমার বুনি দেখব।

আমি বলিলাম, আপনি যদি আমাকে কোনোদিন এই জাতীয় কথা বলেন। তাহলে আমি খেজুরের কাঁটা দিয়া আপনার চোখ গালাইয়া দিব। আল্লাহর কসাম।

এই হইল ঘটনা। এই ঘটনা আমি কাহাকে বলিব? কে আমার কথা শুনিবে? উনি তাহার দাদিজানের বিষয়ে অন্ধ। কেন অন্ধ তাহাও বুঝি না।

ও আল্লাহপাক, ও দয়াময়, তুমি এই খবিস ডাইনির হাত হইতে আমাকে উদ্ধার করো।
 
লীলা ট্রেনের জানালা থেকে মাথা ভেতরে নিয়ে এলো। হঠাৎ তার খানিকটা মন খারাপ লাগছে। কেন লাগছে তা বুঝতে পারছে না। সে মঞ্জুমামার দিকে তাকাল। বেচারার আরো কিছুদিন থাকার ইচ্ছা ছিল। লীলা জোর করেই তাকে নিয়ে এসেছে। ট্রেনে উঠার সময় তার বেশ মন খারাপ ছিল। এখন আর মন খারাপ নেই। মহাউৎসাহে তিনি রাজনীতির আলাপ জুড়েছেন।

শুনেন, পরিষ্কার হিসাব শুনেন–বাঙালি জাতি যুক্তভাবে কিছু করতে পারে না। বাঙালি বিযুক্ত জাতি। ভাইয়ে ভাইয়ে লড়াইয়ের জাতি। এখানে যুক্তফ্রন্ট চলে? চলে না। হক সাহেব বিরাট বোকামি করেছেন। আমাদের দরকার লাঠির শাসন। মিলিটারির শাসন। বাঙালি গরমের ভক্ত, নরমের যম। বুঝেছেন কিছু?

লীলা চোখ বন্ধ করে আছে। চলন্ত ট্রেনে তার সবসময় ঘুম পায়। ছাড়া ছাড়া ঘুম না, গাঢ় ঘুম। ঘুমের মধ্যে বিচিত্র সব স্বপ্ন। মঞ্জুমামার রাজনীতির গল্প শুনতে শুনতে সে ঘুমিয়ে পড়ল। ঘুমের মধ্যে স্বপ্নে দেখল— এক থুড়গুড়ি বুড়ি তার পাশে বসে আছে। বুড়ি ফোকলা দাতে পান খাচ্ছে। পানের লাল রস গড়িয়ে গড়িয়ে পড়ছে। বুড়ি বলল, এই মেয়ে তোর নাম লীলা না? তুই আয়নার মেয়ে না?

লীলা বলল, জি।

বুড়ি বলল, তোর মা কি জীবিত আছে না মারা গেছে?

মা মারা গেছেন।

কস কী! আমি তো যাইতেছি তোর মার সাথে সাক্ষাতের জন্যে। মারা গেলে সাক্ষাৎ ক্যামনে হইব?

আপনি কে?

আমি তোর মায়ের দাদি শাশুড়ি। তুই তো আমারে কদমবুসিও করলি না। কদমবুসি কর।

আমি আপনাকে কদমবুসি করব না।

অবশ্যই করবি। তোর বাপ করে, তুই করবি না। এইটা কেমন কথা?

বুড়ি কদমবুসি করানোর জন্যে লীলার হাত ধরে টানাটানি করতে লাগল। তখনি লীলার ঘুম ভাঙিল। হাত ধরে টানাটানি করছেন মঞ্জুমামা। তার মুখ আতঙ্কগ্ৰস্ত। লীলা বলল, কী হয়েছে মামা?

খুবই খারাপ অবস্থা। অবস্থা ফর্টি নাইন।

অবস্থা ফর্টি নাইন মানে কী?

ঐ লোক তো মারা যাচ্ছে।

আমাদের সঙ্গে যে যাচ্ছে। কলেজের টিচার।

আনিসুর রহমান সাহেব? জ্বর বেড়েছে?

জ্বর বাড়াবাড়ি না। উনি নিজেই এখন আগ্নেয়গিরি।

বলো কী!

বদনায় পানি ঢেলে এই জ্বর কমানো যাবে না। দমকলে খবর দিতে হবে। এরকম সিরিয়াস রোগী সঙ্গে আনাই ঠিক হয় নি। হুশ করে মারা যাবে। আমরা ডেড়বডি নিয়ে পড়ব বিপদে। শরীরে হাত রাখলে হাত গরমে পুড়ে যাচ্ছে, আবার পায়ের তলা বরফের মতো ঠাণ্ডা। এটা খারাপ লক্ষণ।

লীলা উঠে এলো। আনিসের মাথার কাছে বসতে বসতে বলল, আপনার জ্বর নাকি খুব বেড়েছে? আনিস জবাব দিল না। লীলা বলল, আপনি তো থারথার করে কাপছেন। শীত লাগছে?

জি।
 
লীলা আনিসের কপালে হাত রাখল। আনিস চমকে উঠল। হিম-শীতল হাত। লীলা বলল, আপনি যখন ট্রেনে উঠেছেন তখনো কি আপনার এত জ্বর ছিল?

জ্বর ছিল, এতটা ছিল কি-না জানি না।

আপনার মাথায় পানি ঢালা দরকার। ট্রেনের কামরায় পানি ঢালব কীভাবে বুঝতে পারছি না।

কিছু করতে হবে না। ধন্যবাদ।

লীলা বলল, আপনি তো আমাদের সঙ্গে ঢাকা যাচ্ছেন না, আপনি যাবেন আপনার মায়ের কাছে। ভৈরব স্টেশনে নামবেন তাই না?

হুঁ।

স্টেশন থেকে একা যাবেন?

আনিস বিড়বিড় করে বলল, জানি না।

জানি না মানে কী?

আনিস জবাব দিল না। তার শরীর কাঁপছে। থারথার করে কাঁপছে। মুখে ফেনা জমছে। মঞ্জু বলল— ভাবভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে উনার মৃগী বেরাম আছে। ভালো বিপদে পড়লাম দেখি!

লীলা বলল, বিপদ তো বটেই, কী করা যায় সেটা ভেবে বের করো।

আমার মাথায় তো কিছুই আসছে না।

লীলা বলল, সামনের স্টেশনে ট্রেন থামবে। সেখানে আমরা উনাকে নিয়ে নেমে পড়ব। সেখান থেকে রিটার্ন ট্রেন যদি পাওয়া যায় তাহলে ট্রেনে বাড়ি ফিরে যাব। আর যদি ট্রেন না পাওয়া যায় তাহলে মহিষের গাড়ি কিংবা গরুর গাড়িতে বাড়ি ফিরব। আমরা তো মাত্র একটা স্টেশন পার হয়েছি। বেশিদূর তো যাই নাই।

মঞ্জু বিরক্ত মুখে বলল, লীলা, তোর তো মাথা খারাপ হয়ে গেছে।

লীলা বলল, মামা, আমার মাথা খারাপ হয় নি। আমার চেয়ে ভালো বুদ্ধি যদি কিছু তোমার মাথায় আসে তুমি বলো, আমি শুনিব। উনার জ্বর যেভাবে বাড়ছে উনি তো কিছুক্ষণের মধ্যে কোমায় চলে যাবেন।

কোমায় যাক কিংবা সেমিকোলনে যাক, আমরা কি তাকে নিয়ে ফেরত যাব না-কি! এই লোকের দরকার চিকিৎসা। তাকে কোনো একটা হাসপাতালে ভর্তি করাতে হবে। বাড়িতে নিয়ে লাভ কী? বাড়িতে কি হাসপাতাল আছে?

হাসপাতাল না থাকলেও সেবাযত্ন আছে। বাজারে পাশ করা ডাক্তার আছে।

বাড়িতে ফেরত যাবি?

হুঁ।

ঘটনা। যদি তার আগেই ঘটে যায় তাহলে কী করবি?

লীলা জবাব দিল না। সে আনিসের কপালে আবারো হাত রাখল। আনিস চমকে উঠল। তার কাছে মনে হচ্ছে, বরফের একটা খণ্ড তার মাথায় কেউ রেখেছে। বরফের ভেতর থেকে শুকনা বকুল ফুলের গন্ধের মতো গন্ধ নাকে আসছে। বরফ যেমন ঠাণ্ডা, বকুল ফুলের গন্ধটাও ঠাণ্ডা। নাকের ভেতর দিয়ে গন্ধটা ঢুকছে, সবকিছু ঠাণ্ডা করে দিচ্ছে। আনিস বলল, পানি খাব। বলেই চোখ বন্ধ করে ফেলল। মেঘলা দিন, কামরার ভেতর তেমন আলো নেই, তবু সে চোখ মেলে রাখতে পারছে না। চোখের ভেতর কড়া আলো ঢুকে যাচ্ছে। চোখ কড়াকড়ি করছে।

কেউ-একজন চামচে করে তার ঠোটে পানি ধরছে। সেই কেউ-একজনটা কে? একটু আগে সে তাকে চিনতে পারছিল, এখন আর চিনতে পারছে না। তবে চেনা-চেনা লাগছে। ও আচ্ছা! মনে পড়ছে—যূথি। মা’র সঙ্গে রাগ করে সে কাঁচি দিয়ে খ্যাচ করে মাথার একগাদা চুল কেটে ফেলে, চুলের শোকে কেঁদে অস্থির। সে যূথিকে বলেছিল, এই যূথি, তুই তো তোর কাটা চুলগুলি ফেলেই দিবি— এক কাজ কর, আমাকে দিয়ে দে। যূথি বলল, তুমি চুল দিয়ে কী করবে? সে বলল, জমা করে রাখব। একটা কোটায় ভরে সুটকেসে রেখে দেবী। যূথি বলল, চুল রেখে কী হবে? আসল মানুষটাকে রেখে দাও। বলেই কী ভয়ঙ্কর লজ্জা যে পেল! পরের তিনদিন তার আর দেখা নাই। এত যার লজ্জা সে কীভাবে অবলীলায় বলল, চুল রেখে কী হবে? আসল মানুষটাকে রেখে দাও। যূথির বয়স তখন কত হবে, চোদ-পনেরোর বেশি হবে না। এই বয়সে মেয়েদের আবেগও বেশি থাকে, লজ্জাও বেশি থাকে। বয়স যত বাড়তে থাকে লজা-আবেগ দুটাই কমতে থাকে।
 

Users who are viewing this thread

Back
Top