What's new
Nirjonmela Desi Forum

Talk about the things that matter to you! Wanting to join the rest of our members? Feel free to sign up today and gain full access!

Collected লীলাবতী - উপন্যাস (1 Viewer)

ডিমের তরকারি দিয়ে ভাত খেলাম। তিনি পাশে বসে খাওয়ালেন এবং সারাক্ষণই পিঠে হাত দিয়ে রাখলেন। এত মমতায় তিনি কি তার নিজের ছেলেমেয়েকে কোনোদিন খাইয়েছেন? এই সুযোগ তাঁর পাওয়ার কথা না।

লীলা।

জি?

মাগো, খেয়ে মজা পাইতেছ?

পাচ্ছি।

চালতা দিয়ে ছোট মাছের তরকারি। আমি খুব ভালো রাঁধতে পারি। তোমারে রাইন্ধা খাওয়াব। ইনশাল্লাহ।

আচ্ছা।

আমার আরেকটা শখ আছে মা। পাগল-মাইনষের শখ। শখটা তুমি পূরণ করবা?

অবশ্যই করব। আপনি বলুন কী শখ?

একটা রাইত আমার সঙ্গে থাকবা। দু’জনে বিছানায় শুইয়া সারারাত গফসাফ করব।

অবশ্যই। আপনি যদি বলেন আমি আজই আপনার সঙ্গে ঘুমুতে পারি।

ভয় লাগবে না?

ভয় লাগবে কেন?

আমি পাগল-মানুষ। ঘুমের মধ্যে আমি যদি তোমার গলা চাইপ্যা ধরি?

না, আমার ভয় লাগবে না।

মহিলা খিলখিল করে হাসতে শুরু করলেন। হাসি আর থামেই না।

এই মহিলা প্রায়ই সিমাসা বলেন। সিমাসা হলো ধাঁধা। যেমন–

ভোলা মিয়ার শয়তানি
বাইরে লোহা ভিতরে পানি।

এর অর্থ হলো নারিকেল। আমার মা হলেন সিমাসা রানি। তিনি অসংখ্য সিমাসা জানেন। আবার সিমাসা মুখে মুখে তৈরিও করতে পারেন।

যাই হোক, রাতে আমি আমার নিজের ঘরে ঘুমুতে এলাম। কিছুক্ষণের মধ্যেই বাবা এসে উপস্থিত হলেন। তার সঙ্গে ফিরে আসার পর আমার কোনো কথা হয় নি। তবে একটা ব্যাপার বুঝতে পেরেছি, তিনি আমাকে দেখে খুবই আনন্দিত হয়েছেন। তিনি হয়তো ভেবেছেন আমি নিজেই তার কাছে যাব। আমি যাই নি। তিনিও আমাকে ডাকেন নি। হয়তো আমাকে ডাকতে তাঁর অহঙ্কারে বেধেছে। এখন সমস্ত অহঙ্কার একপাশে ফেলে নিজেই এসেছেন। আমি বললাম, বাবা, কিছু বলবেন? তিনি বললেন, না। তিনি আমার ঘরে রাখা চেয়ারে বসলেন। আমি বললাম, বাবা আপনি খেয়েছেন? তিনি না-সূচক মাথা নাড়লেন। আমি বললাম, আমি তো জানি না যে আপনি এখনো খান নি। তিনি বললেন, জানলে কী করতে?

জানলে আপনাকেও সঙ্গে নিয়ে খেতে বসতাম।

তিনি বললেন, আমার একা একা খাওয়ার অভ্যাস।

আমি বললাম, আমি যে-কয়দিন আপনার সঙ্গে থাকব আপনি আমার সঙ্গে খাবেন। বাবা কিছু বললেন না। কিন্তু তাকে দেখে মনে হলো তিনি খুশি হয়েছেন। খুশির ভাবটা চাপতে চেষ্টা করছেন। চাপতে পারছেন না। আমি বললাম, রাত অনেক হয়েছে, খেতে চলুন। বলেই আমি উঠে দাঁড়ালাম। তিনি বিস্মিত হয়ে বললেন, তুমি ঘুমাও। আমি বললাম, আপনার খাওয়া হোক, তারপর ঘুমাব। আপনি যখন খাবেন আমি সামনে বসে থাকব।
 
বাবার খাবার সময় আমি পাশে বসে রইলাম এবং একটা কাণ্ড করে তাকে পুরোপুরি হকচাকিয়ে দিলাম। খাবার সময় মা যেভাবে আমার পিঠে হাত রেখেছিলেন। আমি ঠিক তা-ই করলাম। বাবার পিঠে হাত রাখলাম। আমি ভেবেছিলাম। তিনি খাওয়া বন্ধ করে আমার দিকে তাকাবেন। তিনি তা করলেন না। যেভাবে খাচ্ছিলেন সেইভাবেই খেয়ে গেলেন। খাওয়া শেষ করে মুখে পান। দিলেন। সুলেমান এসে তার হাতে হুক্কা ধরিয়ে দিল। তিনি হুঙ্কার নিলে টান দিচ্ছেন। গুড়ুক গুড়ুক শব্দ হচ্ছে। হুক্কার শব্দটা যে এত মজার তা আগে লক্ষ করি নি। শব্দটার মধ্যে ঘুমপাড়ানি ভাব আছে। আমার মনে হচ্ছে, বিশাল খটটার একপাশে শুয়ে ঘুমিয়ে পড়লে ভালো লাগত।

লীলা!

জি?

ঘুম পাচ্ছে মা?

জি।

তাহলে ঘুমাও। আরাম করে ঘুমাও। এই খাটে তোমার মা ঘুমাত।

বাবার এই কথা আগেও একবার শুনেছি। সেবার বিস্মিত হয়েছিলাম। আজ হঠাৎ বলে ফেললাম, শুধু মা ঘুমান নি। মার পরে আরো একজন ঘুমিয়েছেন। কথাটা বলেই আমার মনে হলো আমি কাজটা ঠিক করি নি। এই কথাটা না বললেও চলত। আমি লক্ষ করলাম। বাবার হুক্কা টানা বন্ধ হয়ে গেছে। তার মুখের চামড়া একটু যেন শক্ত হয়ে গেল। তিনি হুক্কার নল একপাশে রেখে শরীর ঘুরিয়ে আমার দিকে তাকালেন। বড় করে নিঃশ্বাস টেনে কথা বলা শুরু করলেন–লীলা শোনো। তোমার মা’র মৃত্যুর অনেক দিন পরে আমি বিবাহ করি। তোমার মা এবং আমি যে-খাটে ঘুমাতাম, সেই খাটটা খুলে রেখে দেয়া হয়েছিল। তুমি আসার পর খাটটা জোড়া লাগানো হয়েছে। তুমি বিষয়টা লক্ষ করো নাই। অতিরিক্ত বুদ্ধিমান মানুষদের সমস্যা কী জানো মা? তাদের প্রধান সমস্যা….

এই পর্যন্ত বলেই তিনি চুপ করে গেলেন। হুঙ্কার নলটা টানতে শুরু করলেন। আবারো ঘুম-পাড়ানি গুড়ুক গুড়ুক শব্দ হচ্ছে। আমি বললাম, আপনি আমার কথায় কিছু মনে করবেন না। তিনি বললেন, যাও, ঘুমাতে যাও। তিনি এখন আর মায়ের খাটে আমাকে ঘুমুতে বললেন না। প্রসঙ্গ সম্পূর্ণ পাল্টাবার জন্যেই হয়তো বললেন, আনিস ছেলেটাকে নিয়ে চিন্তিত আছি। ছেলেটাকে সঙ্গে করে নিয়ে এসে তুমি ভালো করেছ না মন্দ করেছ বুঝতে পারছি না। নিতান্তই পল্লীগ্রাম, চিকিৎসার সুব্যবস্থাও নাই।

আমি বললাম, উনাকে নিয়ে ঢাকা পর্যন্ত যাবার অবস্থা ছিল না।

মা যেমন আমার পিঠে হাত রেখে আমাকে হকচকিয়ে দিয়েছিলেন, বাবা এখন তা-ই করলেন, এমন একটা কথা বললেন যে আমি নিজে পুরোপুরি হ’কচাকিয়ে গেলাম। তিনি হঠাৎ হুক্কা টানা বন্ধ করে আমার দিকে তাকালেন— শান্ত গলায় বললেন, এই ছেলেটাকে কি তোমার পছন্দ?

আমি জবাব দিলাম না। বাবা বললেন, অনেক সময় মানুষ তার নিজের পছন্দের কথা নিজে বুঝতে পারে না। বোকাদের ক্ষেত্রে এই ঘটনা ঘটে না। বোকারা খুব ভালোমতো জানে কোনটা তার পছন্দ, কোনটা তার পছন্দ না। মাসুদের কথা ধরো। সে ভালোমতো জানে পরীবানু নামের মেয়েটাকে তার পছন্দ। এই মেয়েটার জন্যে যা-কিছু মানুষের পক্ষে করা সম্ভব তা সে করবে। মাসুদ যদি তোমার মতো অতি বুদ্ধিমান কেউ হতো তাহলে সে তার পছন্দের ব্যাপারটা ধরতে পারত না। তার মাথার মধ্যে নানান হিসাব-নিকাশ খেলা করত।

আপনার ধারণা আমার খুব বুদ্ধি?

হ্যাঁ, আমার তা-ই ধারণা।

আমি বললাম, অসুস্থ মানুষটাকে দেখে আমার খুব মায়া লেগেছে। পছন্দ বলতে এইটুকুই। আপনি যে-অর্থে পছন্দের কথা বলছেন— সেই অর্থে না।

বাবা বললেন, না হলেই ভালো।

না হলেই ভালো কেন?
 
অপদার্থ ধরনের ছেলে। অপদাৰ্থ মানুষরা তাদের আশেপাশের মানুষকেও অপদাৰ্থ বানিয়ে ফেলে। তাছাড়া তার মাথাও কিঞ্চিৎ খারাপ বলে আমার ধারণা।

আপনার এরকম ধারণার পেছনে কারণ কী?

চোখের চাউনি দেখে মনে হয়েছে। পাগলদের চোখের চাউনি সাধারণ মানুষের মতো না। পাগলদের দৃষ্টি আমার মতো ভালো কেউ জানে না। এই প্রসঙ্গে কথা বলার প্রয়োজন নেই। যাও, ঘুমাতে যাও। আমার মনটা আজ কিঞ্চিৎ খারাপ। কিঞ্চিৎ না, একটু বেশিই খারাপ। মন-খারাপ নিয়ে আমি কথা বলতে পারি না।

মন-খারাপ কেন?

বাবা চাপা গলায় বললেন, সুলেমান আমার সঙ্গে মিথ্যা কথা বলেছে। এটা জানতে পেরেছি বলেই মন-খারাপ। এরা আমার সঙ্গে মিথ্যা কথা বলবে— কথা গোপন করবে, এটা আমি কল্পনাও করি নি।

আমি বললাম, কী কথা গোপন করেছে?

বাবা শান্ত গলায় বললেন, মাসুদ পরীবানু মেয়েটিকে গোপনে বিবাহ করেছে। মৌলানা ডেকে বিবাহ। এই ঘটনা সুলেমান-লোকমান দুজনই জানে। কিন্তু কেউ আমাকে কিছু বলে নাই।

আমি অবাক হয়ে বললাম, আপনি কি নিশ্চিত মাসুদ বিয়ে করেছে?

হুঁ। ব্যাপারটা সবাই জানে। শুধু আমি জানি না। আনিস মাস্টারও জানে।

আপনি এখন কী করবেন?

আমার কী করা উচিত?

পরীবানুকে বাড়িতে নিয়ে আসা উচিত।

কথাটা চিন্তা-ভাবনা করে বলেছ?

আমি হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়লাম। বাবা তাকিয়ে আছেন আমার দিকে। তাঁর চোখে পলক পড়ছে না। নিম্পলক চোখে তাকিয়ে তিনি কী দেখার চেষ্টা করছেন? আমার চোখে উন্মাদের দৃষ্টি আছে কি না?

তুমি বলতে চোচ্ছ পরীবানু মেয়েটিকে এই বাড়িতে নিয়ে আসা উচিত?

জি।

আর মাসুদের ব্যাপারে কী করণীয়? আচ্ছা থাক, এই প্রশ্নের জবাব দিতে হবে না। তুমি ঘুমাও। ফি আমানিল্লাহ। দরজার খিল লাগায়ে শুয়ে পড়ে। একা ভয় পাবে না তো?

জি না।

রমিলা মাঝেমধ্যে খুব চিৎকার চ্যাঁচামেচি করে। ঘুমের মধ্যে হঠাৎ তার চিৎকার শুনলে ভয় পেতে পার।

আমি ভয় পাব না।

বাবা খাট থেকে উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বললেন, তোমার উপর দায়িত্ব দিলাম। এই বাড়িতে পরীবানুকে আনার। পরীবানুর দায়িত্ব তোমার। মাসুদের দায়িত্ব আমার।



বাবা চলে গেলেন। তখনো আমি জানি না যে আনিস সাহেবকে নিয়ে বাবা নিজেই ময়মনসিংহ রওনা হয়েছেন। এটা আমি জানলাম। পরদিন সকালে। আমার বিস্ময়ের সীমা রইল না।

এখন আমি আমার ভাই মাসুদ সম্পর্কে কিছু বলি। প্রথমে চেহারার বর্ণনা— সুপুরুষ। স্বাস্থ্য ভালো। চোখ বড় বড় (আমার বাবার চোখও বড় বড়, এটা মনে হয়। আমাদের পারিবারিক বিশেষত্ব। সবার চোখ বড় বড়)। মাথার চুল কোকড়ানো।

স্বভাব— কথা কম বলে। কারো চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বলে না। তাকে দেখলেই মনে হয় কোনো ভয়ে সে অস্থির হয়ে আছে। কথা বলার সময় সে ঘাড় ঘুরিয়ে পিছন দিকে তাকাবে। ভীতু প্রকৃতির ছেলে, তবে গলার স্বর ভারী এবং গম্ভীর। সে গান-বাজনা কেমন শিখেছে জানি না, তবে সে শিস বাজিয়ে পাখিদের শিসের নকল করতে পারে। তার শিস বাজানোর সুন্দর একটা ঘটনা বলি। আমি তাকে সঙ্গে নিয়ে শহরবাড়ি যাচ্ছি। একটা বাঁশঝাড়ের ভেতর দিয়ে পথ। হঠাৎ মাসুদ বলল, বুবু, একটা মজা দেখবে?

আমি বললাম, কী মজা?

মাসুদ হাত মুখের কাছে ধরে শিস দিতে লাগল। বুলবুলি পাখি যেরকম শিস দেয় সেরকম শিস। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই একটা বুলবুলি পাখি শিস দিতে লাগল। তারপর আরো কয়েকটা। আমি অবাক। মাসুদ বলল, বুবু, আমি ঘুঘু পাখির ডাক ডাকতে পারি। আমি যখন ঘুঘুর ডাক ডাকি, তখন বনের ঘুঘুও ডাকে।

বাবা বাড়িতে নেই, ময়মনসিংহ গিয়েছেন–এই খবর পেয়েই মনে হয়। মাসুদ বাড়িতে উপস্থিত। এমনভাবে সে হাঁটাহাঁটি করছে যেন সে-ই বাড়ির কর্তা। মুখভর্তি পান। পান চিবিয়ে বেশ কায়দা করে পানের পিক ফেলছে। আমি বললাম, মাসুদ, তুমি না-কি বিয়ে করেছ?

মাসুদ পানের পিক ফেলে বলল, করতেও পারি।

আমি বললাম, করতেও পারি। আবার কী? হয় বলো করেছি। অথবা বলো করি নাই।

মাসুদ বলল, আমি অধিক কথা বলি না।

আমি বললাম, বাবা খুব রাগ করেছেন।

মাসুদ বলল, আমি এইসব কেয়ার করি না।

সে যে সত্যিই কেয়ার করে না এটা বুঝাবার জন্যেই বোধহয় ছিপ নিয়ে মাছ মারতে গেল। সেই মাছ মারার আয়োজনও বড়। একজন গেল তার মাথায় ছাতি ধরার জন্যে। একজন গেল হারমোনিকা বাদক। একজন ঢোল নিয়ে গেল।

ঘটনা কী হচ্ছে দেখতে গেলাম। দেখি মচ্ছবি বসে গেছে। মাসুদের মাথার উপর চাঁদোয়া টানানো হয়েছে। কনসার্ট হচ্ছে, হারমোনিকা বাজছে, বাঁশি বাজছে, ঢোল-তবলা বাজছে। দলে মঞ্জুমামাও উপস্থিত। তার হাতে খঞ্জনি। তিনি মহানন্দে মাথা দুলিয়ে খঞ্জনি বাজাচ্ছেন।

মাসুদ ভালোই বাড়াবাড়ি করল, দুপুরে খাসি কিনে আনতে লোক পাঠাল। তার না-কি খিচুড়ি এবং খাসির মাংস খেতে ইচ্ছা করছে। এই মাংস সে নিজেই রাধবে।

রাধুক। তার যা ইচ্ছা সে করুক। আমাদের সবার জগৎ আলাদা। মাসুদের জগৎ মাসুদের। আমারটা আমার।
 
মাসুদ একটা কাঠবাদাম গাছের নিচে চিৎ হয়ে শুয়ে আছে। কাঠবাদাম গাছের পাতা বড় বড়— ছায়াময়। সে তার মাথা ছায়ায় রেখে শরীর রোদে মেলে। দিয়েছে। শীতকালের রোদের চিড়বিড়ানি সমস্যা থাকলেও রোদ আরামদায়ক। আরামে মাসুদের ঘুম এসে যাচ্ছে। সে ঠিক করেছে কিছুক্ষণ ঘুমাবে। দুপুরে চাপ খাওয়া হয়েছে, এখন দরকার ঘুম। অজগর সাপের মতো ঘুম। অজগর সাপ আস্ত ছাগল গিলে একনাগাড়ে সাতদিন ঘুমায়। সেও এখন অজগর।

ঘুমের আগে আগে নানান চিন্তা করতে তার ভালো লাগে। বেশির ভাগ চিন্তাই থাকে পরীবানুকে নিয়ে। যেমন সে তার নতুন কেনা হারকিউলিস্ সাইকেলে করে ধর্মপাশা যাচ্ছে। সাইকেলের পেছনে বসেছে পরীবানু। সাইকেল যাচ্ছে শা, শা করে। পরীবানু আতঙ্কে চিৎকার করছে— আস্তে চালাও, আস্তে। সে পরীবানুর কোনো কথাই শুনছে না। সাইকেলের গতি আরো বাড়াচ্ছে। একসময় সাইকেল থেকে মোটর গাড়ির মতো ভটভট শব্দ হতেও শুরু করেছে। সাইকেল হয়ে গেল মোটরসাইকেল।

চিত্তার মধ্যে যাত্ৰাদলের দৃশ্যও থাকে। যাত্ৰাদলের নাম নিউ অপেরা পার্টি। যাত্ৰাদলের অধিকারী এবং প্রধান অভিনেতা সে নিজে। পরী করে সামান্য সখির পার্ট। পরীর জীবনের প্রধান ইচ্ছা যাত্ৰাদলের মূল অভিনেতা মাসুদ সাহেবের সাথে একটা পাট করা। লজায় সে তার মনের গোপন কথা কাউকে বলতে পারে না। শুধু চোখের পানি ফেলে। একদিন এই দৃশ্য সে দেখে ফেলল। মেয়েটির কাছে গিয়ে বলল, কাদো কেন? তোমার অন্তরে কিসের যাতনা?

মেয়েটা গানের সুরে বলল—

আমার কথা আমি জানি না
জানে বনের পাখি
আমার কষ্ট হয় না পষ্ট
আমারে দেয় ফাঁকি।

বাবা সিদ্দিকুর রহমান সাহেব। চিন্তাটা চলে যাচ্ছে খারাপ দিকে। বাবাকে নিয়ে খারাপ চিন্তা করা ঠিক না। কিন্তু মাসুদ চিন্তাটাকে আটকাতে পারছে না। মাসুদ কল্পনায় দেখছে, তার বাবা ময়মনসিংহ সদর হাসপাতালে। কুঁজা মাস্টারকে হাসপাতালে ভর্তি করে তিনি হাসপাতালের বাইরে এসে সিগারেট ধরালেন। সতীশ ডাওগারকে পাঠালেন জর্দা দিয়ে পান নিয়ে আসতে। সতীশ ডাক্তার পান আনতে গেল। সিদ্দিকুর রহমান সিগারেটে টান দিলেন, এই সময় তার শুরু হলো বুকে ব্যথা। তিনি মাথা ঘুরে পড়ে গেলেন। তাকে ধরাধরি করে ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেল। তিনি বিড়বিড় করে বললেন, আমার সমস্ত বিষয়-সম্পত্তি দেখার দায়িত্ব এখন থেকে আমার একমাত্র পুত্র মাসুদের। তাকে খবর দিয়ে আনো। বিষয়-সম্পত্তির ব্যাপারে তাকে কিছু উপদেশ দিব। আমার সময় শেষ। বলতে বলতেই মৃত্যু। চারদিকে বিরাট হৈচৈ, কান্নাকাটি।

বাবার মৃত্যু নিয়ে চিন্তা করতে অস্বস্তি লাগায় মাসুদ তার চিন্তাটাকে সামান্য ঘুরিয়ে দিল। নতুন চিন্তায় তিনি মারা গেলেন না। তবে তাঁর পক্ষাঘাত হলো। সমস্ত শরীর অবশ। কথাও পরিষ্কার বলতে পারেন না। কিছু কথা বোঝা যায়, কিছু যায় না। তাকে খাটিয়াতে করে বাড়িতে নিয়ে আসা হয়েছে। তিনি নির্দেশ দিয়েছেন— এখন থেকে যাবতীয় কাজ-কর্ম দেখবে আমার একমাত্র পুত্র মাসুদুর রহমান। আমি যেহেতু বেশিদিন বাঁচব না, সেই কারণে ধুমধাম করে পুত্রের বিবাহ দিতে চাই। স্যাকরা খবর দিয়ে আনো। আমি আমার পুত্রবধু পরীবানুকে গয়না দিয়ে মুড়ে দিব। দাড়িপাল্লায় ওজন করে সোনা দিব। দাড়িপাল্লার একদিকে থাকবে পরীবানু আরেক দিকে সোনা।
 
মাসুদ সন্ধ্যা পর্যন্ত ঘুমাল। ঘুম থেকে উঠে খোঁজ নিল তার বাবা ফিরেছেন কি-না। জানা গেল। তিনি ফিরেন নাই। মাসুদ তখন বাজারের দোকান থেকে তার সাইকেল বের করল। এই সাইকেল সে গত বছর গোপনে কিনেছে। লুকিয়ে রেখেছে বাজারের দোকানে। আজ সাইকেল বের করার শুভ দিন। সাইকেলে ডায়নোমো বসানো লাইট আছে। ডায়নোমার একটা অংশ ঘুরন্ত চাকার সঙ্গে লাগিয়ে দিলেই বাতি জ্বলে। বাতির খুবই পাওয়ার। দিনের মতো আলো হয়ে যায়। সাইকেলের ঘণ্টাও সুন্দর। জলতরঙ্গের মতো শব্দ হয়।

পরীবানু তার সাইকেলের ব্যাপারটা জানে না। সাইকেল নিয়ে তার সঙ্গে দেখা করতে যাবে কি-না— এই বিষয়েও মাসুদ সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না। মনে হয় যাওয়াটা ঠিক হবে না। পরীবানুর অতিরিক্ত প্রশ্ন করা স্বভাব। সাইকেল দেখে একহাজার প্রশ্ন করবে। মেয়েছেলের প্রশ্নের জবাব দেওয়া এক দিগদারি।

সাইকেল কিনেছ টাকা পেয়েছ। কোথায়? টাকা কি চুরি করেছ? কী সর্বনাশ, তুমি চোর!

দিগদারি প্রশ্ন শুনতেও ভালো লাগে না, প্রশ্নের জবাব দিতেও ইচ্ছা করে না। মাসুদ পরীবানুর বাড়ির কাছাকাছি এসে সিদ্ধান্ত নিল, পরীবানুর সঙ্গে দেখা করবে না। বরং সাইকেল নিয়ে চলে যাবে ধর্মপাশা। ধর্মপাশা এখান থেকে দশবারো মাইল। কাঁচারাস্তা হলেও ডিসট্রিক বোর্ডের সুন্দর সড়ক। খানাখন্দ কম। সাইকেল নিয়ে একটানে চলে যাওয়া যাবে।

ধর্মপাশায় গুনীন সুরুজ মিয়া থাকেন। তন্ত্ৰ-মন্ত্রের সাগর। জানেন না হেন জিনিস নেই। কোনো মুসলমানের কালী সাধনা থাকে না। উনার কালী সাধনাও আছে। মাসুদ কয়েকবারই তার কাছ থেকে জিনিসপত্র নিয়েছে। ফল পাওয়া গেছে। উনার মন্ত্র পড়া সুরমার নাম-ডাক আছে। এই সুরমা চোখে মেখে কঠিন হাকিমের সামনে দাঁড়ালে ঘটনা ঘটে। হাকিম যখন সুরমা দেয়া চোখের দিকে তাকান তখনই একশান হয়, হাকিমের দিল নরম হয়। যতবার তাকাবেন। ততবার দিল নরম হবে। গুনিন সুরুজ মিয়ার সুরমা চোখে দিয়ে অনেক খুনের আসামি খালাস পেয়ে গেছে।

মাসুদ পড়া সুরমার জন্যে সুরুজ মিয়াকে দশ টাকা। গত মাসের সাত তারিখ দিয়ে গেছে। অমাবস্যা ছাড়া সুরমায় মন্ত্র দেয়া যায় না। মাঝখানে অমাবস্যা গেছে। এখন ধর্মপাশা গেলে সুরমা নিয়ে আসা যাবে। মাসুদ ঠিক করে রেখেছে, এখন থেকে বাবার সামনে পড়ার আগে চোখে সুরমা দিবে। তার বাবা তো হাকিমের মতোই।

ধর্মপাশায় যাবার আরেকটি কারণ আছে। ধর্মপাশার নূর হোসেনের কাছে হারমোনিয়াম কেনার জন্যে একশ’ টাকা দিয়ে রেখেছে। নূর হোসেন বাদ্য-বাজনার জিনিস ভালো চেনে। মাসুদের দরকার মেলডি কোম্পানির ডাবল রিড হারমোনিয়াম। নূর হোসেনের কলিকাতা থেকে হারমোনিযাম আনিয়ে রাখার কথা। কলিকাতার সাথে নূর হোসেনের যোগাযোগ আছে। সে যদি হারমোনিয়াম এনে থাকে তাহলে সাইকেলের কেরিয়ারে করে নিয়ে আসবে। নয়াবাজারের দোকানে লুকিয়ে রাখবে। মাসুদের বাবা নয়াবাজারে কখনোই যান না।

আকাশে পঞ্চমীর চাঁদ। ফাঁকা সড়ক। সড়কের ধুলায় চাঁদের আলো পড়েছে। চিকচিক করছে। সড়কটাকে মাসুদের মনে হচ্ছে নদীর মতো। কিছুদূর গিয়েই মাসুদের মনখারাপ হয়ে গেল। পরীবানুর জন্যে মন টানছে। এমনই মন টানছে যে পেটে ব্যথা শুরু হয়েছে। ধর্মপাশা আরেক দিন যাওয়া যাবে। আজ রাতটা না হয় পরীবানুর সঙ্গে কাটুক। পরীবানু তার বিবাহিতা স্ত্রী। সে যদি পরীবানুর সঙ্গে থাকে কারো কিছু বলার নাই। সে পরীবানুর বাড়ির উঠানে দাঁড়িয়ে সাইকেলের ঘণ্টা দিতে পারে। গলা উচিয়ে ডাকতেও পারে— পরী! পরীবানু!
 
মাসুদ সড়কের মাঝখানে ব্রেক কষে সাইকেল থামাল। সে অনেকদূর এসে পড়েছে। অর্ধেকের বেশি। এখন সে কী করবে? ধর্মপাশা যাবে না পরীবানুর কাছে ফেরত যাবে? লটারি করলে হয়। লটারিতে যেটা ওঠে। সেটা। লটারি করার বুদ্ধি কী? মাসুদ ঠিক করল, সে সাইকেল হাতে দাঁড়িয়ে থাকবে। তার চোখ থাকবে রাস্তার দুই দিকে। যদি সে দেখে ধর্মপাশার দিক থেকে কেউ আসছে তাহলে সে রওনা হবে ধর্মপাশা। যদি দেখা যায় নয়াপাড়ার দিক থেকে কেউ আসছে তাহলে যাবে নয়াপাড়া। রাত তেমন হয় নি। কিন্তু চারদিক নীরব। রাস্তায় কোনো লোক চলাচল নেই। মাসুদ অপেক্ষা করছে। অপেক্ষা করতে তার খুবই ভালো লাগছে।



সাইকেলের ঘণ্টা বাজাতে হলো না, তার আগেই পরীবানু দরজা খুলে বের হয়ে এলো। তার হাতে কুপি। কুপির লাল আলো পড়েছে তার মুখে। কী সুন্দর যে তাকে লাগছে! সাইকেল হাতে মাসুদকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে সে মোটেই অবাক হলো না। যেন সে জানত নিশিরাতে মাসুদ এসে উপস্থিত হবে।

মাসুদ গলা নিচু করে বলল, সবাই কি ঘুমে?

পরীবানু বলল, হুঁ।

তোমাদের খাওয়া-দাওয়া শেষ?

পরীবানু বলল, সাইকেল রেখে হাত-মুখ ধুয়ে ঘরে যাও। কল পাড়ে সাবানা-গামছা আছে।

মাসুদ বলল, কল চাপার শব্দে তোমাদের বাড়ির লোকজনের যদি ঘুম ভেঙে যায়?

পরীবানু বলল, ঘুম ভাঙলে ভাঙবে। তুমি কি পৃথিবীর সবাইকেই ভয় পাও?

মাসুদ বলল, আরে না। ভয় পাব কী জন্যে? ভাব দেখাই যে ভয় পাই। আসলে পাই না।

পরীবানু কাল চাপছে। মাসুদ চোখে-মুখে পানি দিচ্ছে। পানি গরম। মাসুদ বলল, একটা অদ্ভুত জিনিস লক্ষ করেছি। গরমের সময় টিউব কলের পানি থাকে ঠাণ্ডা। আর শীতের সময় গরম। ঘটনা চমৎকার না?

হুঁ।

তুমি এত গম্ভীর কেন? মন কি কোনো কারণে খারাপ?

না।

জব্বর ভুখ লাগছে। ঘরে কি চিড়-মুড়ি আছে?

পরীবানু জবাব দিল না। মাসুদ বলল, কিছু না থাকলে নাই। গল্প করে রাত পার করে দিব। খালি পেটে আলাপ ভালো জমে এটা জানো?

না।

খালি পেটে আলাপ ভালো জমে, ভরা পেটে জমে ঘুম। হা হা হা। ভালো বলেছি না?

হুঁ।

মাসুদ পরীবানুর ঘরের মেঝেতে পাতা পাটিতে বসে আছে। তার সামনে থালায় গরম ভাত। সঙ্গে বেগুন দিয়ে ডিমের সালুন। মাসুদের অতি পছন্দের জিনিস। ভাত কিছুক্ষণ আগে রান্না হয়েছে। ধোঁয়া উঠছে। ভাতের উপর গরম ঘি দুই চামচ ঢালা হয়েছে। ঘিয়ের সুঘাণে মাসুদ মোহিত হয়ে গেল।

মাসুদ বলল, কে রাঁধল? তুমি?

পরীবানু বলল, আমার বাড়িতে কি দশটা দাসী-বান্দি আছে?

অতি সুখাদ্য হয়েছে।

এখনো তো মুখে দেও নাই। বুঝলে কীভাবে?

দর্শনে বুঝা যায়। পহেলা দর্শনধারী।
 
পরীবানু হাতে পাখা নিয়ে বসেছে। গরম ভাত পাখা নেড়ে ঠাণ্ডা করছে। তার ঠোঁটে চাপা হাসি। সেই হাসি একটু বাড়ল। শব্দময় হলো। সে সঙ্গে সঙ্গেই হাসি বন্ধ করে বলল, দর্শনে সব বোঝা যায় না। তোমাকে দেখে বোঝার উপায় নাই যে তুমি বোকা।

আমি বোকা?

হুঁ।

মাসুদ হঠাৎ গম্ভীর হয়ে বলল, পরী শোনো, আমি বোকা হই। আর যাই হই এখন বিরাট এক দায়িত্ব আমার হাতে।

কী দায়িত্ব?

খাঁ বাড়ির সবকিছু এখন আমার দেখা লাগবে, উপায় নাই। বাবার অবস্থা খারাপ। পক্ষাঘাত হয়েছে, উনার নড়ার অবস্থা না।

তোমাকে বলেছে কে?

খবর আসছে। সাইকেল নিয়া এইজন্যে টেলিগ্রাফ অফিসে গেলাম। পোষ্টমাস্টার সাহেবের সঙ্গে কথা বললাম। টেলিগ্রাফ উনার কাছে এসেছে।

পরীবানু বলল, বাবার অবস্থা কি খুবই খারাপ?

ডাক্তাররা বলেছে উনি টিকতে নাও পারেন।

তুমি তাহলে এখানে বসে আছ কেন? ময়মনসিংহ যাও।

যাব। কাল সকালে যাব। তোমারে খবরটা দিতে আসছি।

পরীবানু পাখা দিয়ে হাওয়া করা বন্ধ করে শান্ত গলায় বলল, সবসময় মিথ্যা বলা ঠিক না। সবসময় মিথ্যা বললে অভ্যাস হয়ে যাবে। সত্য কথা বলতে পারবা না।

মাসুদ খাওয়া বন্ধ করে আহত গলায় বলল, কোনটা মিথ্যা বললাম? যাও কোরান মজিদ আনো। কোরান মজিদে হাত দিয়া বলব— যা বলেছি। সত্য বলেছি। বসে আছ কেন? কোরান মজিদ নিয়ে আসো।

বামেলা করো না। ভাত খাও।

আমি যে সত্য বলতেছি— এটা ফয়সালা না হলে ভাত মুখে দিব না। ভাত এখন আমার কাছে শিয়ালের গু।

পরীবানু বলল, আচ্ছা ঠিক আছে, তুমি সত্য বলতেছ। আমার ভুল হয়েছে। মাফ চাই।

মাসুদ বলল, বাপজানের অসুখ নিয়া আমি মিথ্যা বলব না। এটা তোমার বোঝা উচিত।

পরীবানু বলল, একবার তো বলেছি। ভুল করেছি। সালুন ভালো হয়েছে?

হ্যাঁ ভালো হয়েছে। ডিমের সালুন আমার প্রিয়। অত্যধিক প্রিয়। একটা ডিম দিয়ে আমি দুই গামলা ভাত খেতে পারি।

মাসুদ খাওয়া শেষ করে উঠে দাঁড়াল। বারান্দায় গেল হাত ধুতে। পরীবানু। জগে করে পানি ঢালছে, মাসুদ হাত ধুচ্ছে। মাসুদের মন আনন্দে পূর্ণ। পরীবানু। আশপাশে থাকলেই তার ভালো লাগে। আজ অন্যদিনের চেয়েও বেশি ভালো লাগছে। পরীবানু বলল, তোমারে একটা খবর দেওয়া হয় নাই। তোমার বাবা সন্ধ্যার সময় ফিরে আসছেন। খবর পাঠায়েছেন, আগামীকাল সন্ধ্যার পর আমাকে তুলে নেবেন।

মাসুদের মুখ হা হয়ে গেল।

পরীবানু সহজ গলায় বলল, পান দিব?

মাসুদ জবাব দিতে পারল না। সে পরীবানুর দিকে তাকিয়ে আছে। পঞ্চমীর চাঁদ ড়ুবে যাচ্ছে। তার কিছু আলো এখনো অবশিষ্ট আছে। সেই আলোয় পরীবানুকে কী সুন্দর যে লাগছে!

পরীবানু বলল, তুমি এই বাড়িতে থাকবে, না চলে যাবে?

মাসুদ বলল, বুঝতেছি না। আমার কী করা উচিত?

পরীবানু বলল, তোমার নিজ বাড়িতে চলে যাওয়া উচিত।

কেন?

তোমার বাবা হঠাৎ খোঁজ করে যদি তোমাকে না পান তাহলে মিজাজ খারাপ করবেন।

মাসুদ বলল, আমার উপরে উনার মিজাজ আর খারাপ হবে না। আমি ব্যবস্থা নিয়েছি। ধর্মপাশার সুরুজ গুনীনের পড়া সুরমা চোখে দিয়া রাখব। সঙ্গে সঙ্গে একশান।

পরীবানু হাসছে। শব্দ করেই হাসছে।

মাসুদ আহত গলায় বলল, হাসো কেন?

পরীবানু বলল, তুমি পুলাপানের মতো কথা বলবা, আমি হাসব না!

মাসুদ বলল, পুলাপানের কথা কী বললাম?

পরীবানু বলল, যাও বাড়িতে যাও।

মাসুদ বলল, বাড়িতে যাব না। ধর্মপাশা যাব। সুরমা নিয়া আসব। সাইকেলে শ্যা শা করে চলে যাব।

নতুন সাইকেল কিনেছ?

হুঁ।

টাকা কই পেয়েছ?

মাসুদ বলল, টাকা-পয়সা মেয়েছেলের দেখার বিষয় না। টাকা-পয়সা নিয়া

কথা বলব না।

মেয়েছেলে কী করবে? ভাত সালুন রানবে?

হুঁ।

প্রতি বৎসর একটা করে সন্তান দিবে?

কী প্যাচাল শুরু করলা? পান দিবা বলছিলা পান কই? সামান্য জর্দা দিও। জর্দা বিহীন পান আর নুন বিহন সালুন একই।

পরীবানু বলল, তুমি যে আমাকে মিথ্যা বললা এই বিষয়ে কিছু বলব না?

মাসুদ কিছু বলল না। উদাস চোখে সাইকেলের দিকে তাকিয়ে রইল।
 
মাসুদ পান চিবাচ্ছে। আড়চোখে পরীবানুর দিকে তাকাচ্ছে। পরীবানুর মুখের ভাব দেখার চেষ্টা করছে। মাসুদ যখন মুখ ভর্তি করে পান খায় তখন যদি পরীবানু আশপাশে থাকে তাহলে একটা ঘটনা ঘটে। একপর্যায়ে পরীবানু তার হাত বাড়িয়ে দেয় মুখের চাবানো পানের জন্যে। এই ঘটনা আজ ঘটছে না। পরীবানু হাত বাড়াচ্ছে না। মাসুদের মনটা খারাপ হয়ে গেল। সে কি তার মিথ্যা কথায় রাগ করেছে? স্বামী স্ত্রীর সঙ্গে টুকটাক মিথ্যা বলবে, এতে দোষ হয় না।

পরী!

হুঁ।

পান খাবে?

না।

রাগ করেছ না-কি?

না, আমার শরীরে এত রাগ নাই। তাছাড়া মা কি ছেলের উপর রাগ করতে পারে?

মাসুদ হতভম্ব গলায় বলল, মা কে? আর ছেলে কে?

পরীবানু হাসতে হাসতে বলল, আমি মা, তুমি ছেলে। মনে নাই তুমি আমাকে মা ডাকলা? পা ছুঁয়ে কদমবুসি করলা?

রাগে মাসুদের গা জুলে যাচ্ছে। ইচ্ছা করছে পরীবানুর গালে ঠাশ করে একটা চড় লাগাতে। স্ত্রীকে শাসন করার জন্যে মাঝেমধ্যে তার গায়ে হাত তোলা জায়েজ আছে। জুম্মাঘরের ইমাম শুক্রবারে খুতবা পাঠের পর বলেছেন। উনি তো না জেনে বলেন নাই। জেনেশুনে বলেছেন।

পরীবানুর গালে সে যে একটা চড় বসাবে— এই বিষয়ে মাসুদ পুরোপুরি নিশ্চিত ছিল, কিন্তু তার রাগ সেরকমভাবে উঠছে না। সব দিন তার রাগ দ্রুত উঠে না।

পরী!

হুঁ।

এই ধরনের কথা আর কোনোদিন বলব না।

আচ্ছা বলব না।

পরীবানু মাসুদের মুখের কাছে হাত বাড়িয়েছে। এখন সে পান খাবে। মাসুদের আবার মন খারাপ হয়ে গেল। মাসুদের মুখে কোনো পান নেই। রাগের কারণে পান গিলে ফেলেছে।

মাসুদ বলল, পরী, আমার একটা কথা রাখবা?

পরীবানু বলল, তোমার একটা কথা না, সব কথাই রাখব।

মাসুদ বলল, কথাটা কী শুনলে তুমি পিছাইয়া পড়বা। যদি রাখো তাহলে ভবিষ্যতে তোমার দশটা অপরাধ ক্ষমা করব।

কথাটা কী?

রাত অনেক হয়েছে। গ্রামের মানুষজন ঘুমে। আসমানে চাঁদও নাই। অন্ধকার।

কথাটা বলো।

তুমি আমার সাইকেলের পিছনে বসো। আমি তোমারে নিয়া ঘুরব। কেউ কিছু জানব না। রাজি আছ?

পরীবানু ক্ষীণস্বরে বলল, হুঁ।



মাসুদ গাছপালার ভেতর দিয়ে এঁকেবেঁকে সাইকেল চালাচ্ছে। একসময় সে নদীর দিকে চলল। নদীর পাড়ে চর পড়েছে। ফাঁকা চরে সাইকেল চালানোর মজাই অন্যরকম। পরীবানুর শুরুতে ভয় ভয় লাগছিল, এখন মজাই লাগছে। সে ক্ষণে ক্ষণে চাপা গলায় হাসছে।

কে? মাসুদ না? মাসুদ, এদিকে আসো।

নদীর চরে সিদ্দিকুর রহমান দাঁড়িয়ে আছেন। তাঁর একপাশে লোকমান একপাশে সুলেমান। সুলেমানের হাতে বন্দুক। তাঁর গলার স্বর শুনেই মাসুদ সাইকেল নিয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়েছে। সিদ্দিকুর রহমান আবার ডাকলেন, মাসুদ কাছে আসো।

মাসুদ বাবার কথার পর পরই সাইকেল নিয়ে ঝড়ের গতিতে বের হয়ে গেল। পরীবানুর কথা একবারও তার মনে হলো না। সিদ্দিকুর রহমান লোকমানের দিকে তাকিয়ে বললেন, লোকমান, তুমি মেয়েটাকে তার বাড়িতে পৌছে দিয়ে আসো।




নদীর পাড় ঘেঁসে সিদ্দিকুর রহমান হাঁটছেন। সুলেমান তার পিছু পিছু যাচ্ছে। সে চারদিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখছে। রাত-বিরাতে এইভাবে বের হওয়া ঠিক না। কখন কী ঘটে তার কি ঠিক আছে?

সুলেমান!

জি চাচাজি।

আমার গাধা ছেলে স্ত্রীকে সাইকেলের পিছনে নিয়া চক্কর দিতেছিল। দৃশ্যটা তোমার কাছে কেমন লাগল?

ভালো না চাচাজি। বিরাট অন্যায় হয়েছে।

সিদ্দিকুর রহমান বললেন, আমার কাছে ভালো লেগেছে। আমি আনন্দ পেয়েছি। গাধাটাকে আমি ডেকেছিলাম কী জন্যে জানো? গাধাটাকে ডেকেছিলাম একটা কথা বলার জন্যে। কথাটা হলো–যা তুই যতক্ষণ ইচ্ছা সাইকেলে করে চঞ্চর দে।

সুলেমান চাপা নিঃশ্বাস ফেলল। সে এতদিন ধরে মানুষটার সঙ্গে আছে, তারপরেও মানুষটার বিষয়ে সে কিছুই জানে না। এটা কেমন করে হয়?
 
বাড়ির উঠোনে ইজিচেয়ার। ইজিচেয়ারের হাতলে লাল ঠোঁটের হলুদ পাখি বসে আছে। লীলা অবাক হয়ে পাখির দিকে তাকিয়ে আছে। কাক, চড়ুই এবং কবুতর— এই তিন ধরনের পাখি মানুষের আশেপাশে থাকতে পছন্দ করে। অন্যসব পাখি দূরে দূরে থাকে। মানুষ দেখলেই উড়ে কোনো গোপন জায়গায় চলে যায়।

লীলা মুগ্ধ হয়ে বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে। নড়াচড়া করতেও ভয় পাচ্ছে— পাখিটা যদি উড়ে চলে যায়! থাকুক আরো কিছুক্ষণ বসে। ধান এনে উঠোনে ছড়িয়ে দিলে কি পাখিটা টুকটুক করে ধান খাবে? বাড়ির ভেতর থেকে জলচৌকি নিয়ে লোকমান বের হচ্ছে। লীলা ইশারায় তাকে থামতে বলল। লোকমান ইশারা বুঝতে পারল না। এগিয়ে এলো। দরজার চৌকাঠের সঙ্গে জলচৌকি লেগে শব্দ হলো। হলুদ পাখি উড়ে চলে গেল। লীলার মনটা খারাপ হয়ে গেল। লোকমান বলল, আমারে কিছু বলছেন?

না, কিছু বলছি না।

লোকমান বলল, জলচৌকি কী করব?

লীলা বলল, উঠানের ঠিক মাঝখানে রাখেন। ইজিচেয়ার সরিয়ে দিন।

লোকমান ইজিচেয়ার হাতে নিয়ে এগুচ্ছে। ঠিক তখন হলুদ পাখিকে আবার দেখা গেল। সে এসে কাপড় শুকানোর দড়িতে বসল। বসেই আবারো উড়ে চলে গেল।

লীলা বলল, হলুদ পাখিটাকে কি দেখেছেন?

লোকমান বলল, জি দেখেছি।

পাখিটার নাম কী?

হইলাদা পাখি।

এই পাখিটার আর কোনো নাম নেই?

জি না। আর কী নাম থাকব?

অবশ্যই এই পাখিটার কোনো-একটা নাম আছে। টিয়া পাখির গায়ের রঙ সবুজ। তাই বলে। টিয়া পাখিকে আমরা সবুজ পাখি বলি না। কোকিলকে কালো পাখি বলি না। জলচৌকিটা রেখে আপনি লোকজনদের জিজ্ঞেস করে পাখিটার নাম জেনে আসবেন।

জি আচ্ছা।

আপনি এক কেন? আর লোকজন কোথায়?

সুলেমান চাচাজির সাথে কই জানি গেছে।

সুলেমান ছাড়াও তো এ-বাড়িতে আরো লোকজন আছে। সবাইকে আসতে বলুন।

জি আচ্ছা।

আজ এ বাড়িতে একটা বিশেষ দিন। এটা কি জানেন?

লোকমান জবাব দিল না। আজ যে এ-বাড়িতে বিশেষ দিন তা সে জানে। এ-বাড়িতে বউ আসবে। পরীবানুকে আনা হবে। তবে এই আনা অন্যরকম আনা। আনন্দ-উল্লাসের আনা না। লোকমান ভেবেছিল অন্ধকারে বাঁশঝাড়ের ভেতর দিয়ে মেয়েটাকে হাঁটিয়ে নিয়ে আসা হবে। কেউ কিছু বুঝতে পারবে না। এখন মনে হচ্ছে তা না। মোটামুটি আয়োজন করেই আনার ব্যবস্থা হচ্ছে। লোকমান নিশ্চিত চাচাজি বিষয়টা পছন্দ করবেন না। তিনি খুবই রেগে যাবেন। তবে রেগে গেলেও কিছু বলবেন না। তিনি তার মেয়েকে অত্যন্ত স্নেহ করেন। এই বিষয়টা এখন বোঝা যাচ্ছে।

আপনাকে বলেছিলাম পালকির ব্যবস্থা করতে। করেছেন?

লোকমান বলল, জি-না। প্রয়োজনে সেনাবাড়ির পালকি আনা হইত। সেনবাড়ির পালকি এখন নাই।

পালকি ছাড়া নতুন বউ আসবে কীভাবে? আর কোথাও পালকি নেই?

জি না।

লীলা বলল, কাঠমিস্ত্রি খবর দিয়ে আনুন। কাঠ কিনে আনার ব্যবস্থা করুন। পালকি বানানো এমন কোনো জটিল ব্যাপার না।

লোকমান বলল, কী যে কন! পালকি বানান জটিল আছে।

লীলা বলল, জটিল না। সরল সেটা বুঝবে কাঠমিস্ত্রি। আপনি ডেকে নিয়ে আসুন। আমি কথা বলব।

জি-আচ্ছা।

লীলা বলল, এখানের দোকানে রঙিন কাগজ পাওয়া যায়? লাল-নীল কাগজ?

যাইতে পারে।

আমার রঙিন কাগজ লাগবে। খোঁজ নিয়ে দেখুন। রঙিন কাগজ পাওয়া যায় केि না।

জি আচ্ছা।

এখন বলুন আপনাকে কী কী কাজ করতে দেয়া হয়েছে?

কাঠমিস্ত্রি খবর দিয়ে আনব। রঙিন কাগজ আনব।

আরেকটা কাজ করতে বলেছিলাম। হলুদ পাখির নাম জেনে আসতে। আপনাকে তিনটা কাজ দিয়েছি, আপনি তিনটা কাজ শেষ করে যত দ্রুত পারেন চলে আসবেন।
 
বেলা বেশি হয় নি। নটা সাড়ে নটা বাজে। লীলার হাতে অনেক সময় আছে। পরীবানু আসবে সন্ধ্যায়, তার আগে সব কাজ গুছিয়ে ফেলা যাবে। সিদ্দিকুর রহমান তাঁর মেয়ের হাতে পরীবানুকে এ-বাড়িতে আনার সমস্ত ব্যবস্থা করার দায়িত্ব দিয়েছেন। লীলা কাজগুলি আগ্রহ নিয়ে করছে। সে রমিলার ঘরে ঢুকল।

রমিলা খাটে বসেছিলেন। মেয়েকে দেখে দ্রুত খাট ছেড়ে উঠে এলেন। আগ্রহ নিয়ে বললেন, মাগো, বাড়িতে কি কোনো ঘটনা আছে?

লীলা বলল, আজ মাসুদের বউকে এ-বাড়িতে আনা হবে।

পরীবানু?

হ্যাঁ, পরীবানু। আপনি নাম জানেন?

জানি।

বাড়িতে নতুন বউ এলে কী কী করতে হয় আমি জানি না। আপনি আমাকে বলে দিন।

রমিলা আনন্দে হেসে ফেললেন। লীলা বলল, ঘরে তালাবন্ধ থেকে আপনি আমাকে সাহায্য করতে পারবেন না। আমি তালা খুলে দিচ্ছি।

তোমার ব্যাপজান রাগ হইব।

আমি তাঁর রাগ সামলাব। আসুন আমরা দুজনে মিলে সব আয়োজন করি।

অনেক জোগাড়যন্ত্র লাগিব গো মা। কালা গাই-এর দুধ লাগব।

দুধ লাগবে কেন?

দুধ পায়ে ঢালতে হয়।

দুধ কে ঢালিবে?

নিয়ম হইল ছেলের মা ঢালবে। তবে আমারে দিয়ে হবে না। পাগল আর বিধবা এই দুই কিসিমের মেয়ে দুধ ঢালতে পারে না। অলক্ষণ হয়।

অলক্ষণ হোক আর সুলক্ষণ হোক–দুধ আপনি ঢালবেন।

তুমি বললে ঢালব।

আরেকটা কথা মা, আপনি সবসময় আমার সঙ্গে সঙ্গে থাকবেন। আপনার মাথা হঠাৎ গরম হয়ে গেলে যেন আমি বুঝতে পারি। ব্যবস্থা নিতে পারি।

রমিলা বললেন, আমার একটা নতুন লাল পাইড় শাড়ি লাগব গো মা। ছেলের মা’র লাল পাইড় নতুন শাড়ি পরতে হয়।

লীলা বলল, আমি আপনার শাড়ির ব্যবস্থা করছি।

রমিলা বললেন, তোমার বাপ কিন্তু রাগ হইব।

না, বাবা রাগ করবেন না। উনি অবাক হবেন কিন্তু রাগ করবেন না। উনার সব রাগ এখন মাসুদের উপর। আমাদের উপর উনার কোনো রাগ নাই।

রমিলা বললেন, মা, তোমার খুব বুদ্ধি।

লীলা বলল, আপনারও খুব বুদ্ধি।

লীলা রমিলার ঘরের তালা খুলে দিল। রমিলা ঘর থেকে বের হলেন। চাপা গলায় বললেন, মাগো আমার খুব ইচ্ছা করতেছে দিঘিতে সিনান করি।

লীলা বলল, বেশ তো, আমিও আপনার সঙ্গে দিঘিতে গোসল করব। আমি কিন্তু সাঁতার জানি না।

রমিলা মুখ টিপে হাসছেন। লীলা সাঁতার জানে না। এই খবরে তিনি মনে হলো খুব মজা পাচ্ছেন। তার হাসি থামেই না।
 

Users who are viewing this thread

Back
Top