What's new
Nirjonmela Desi Forum

Talk about the things that matter to you! Wanting to join the rest of our members? Feel free to sign up today and gain full access!

Collected লীলাবতী - উপন্যাস (1 Viewer)

স্বপ্নের শেষ অংশটা ভয়াবহ। আমি নৌকার গলুই-এ লীলাবতীর কোলে মাথা রেখে শুয়ে আছি। লীলাবতী রোদ থেকে আমাকে বাচানোর জন্যে আমার মুখের উপর শাড়ির আঁচল ধরে আছে। শাড়ির আঁচলের ভেতর থেকে লীলাবতীর হাসি হাসি মুখ আমি দেখতে পাচ্ছি।

এই ধরনের স্বপ্ন দেখার অর্থ একটাই— আমি সমস্যায় পড়েছি। ভয়াবহ সমস্যা। সমস্যায় পড়ার কোনো কারণ কিন্তু নেই। লীলাবতীর সঙ্গে আমার দেখা হয় না বললেই হয়। আর দেখা হলেও কথা হয় না। তবে এক সন্ধ্যায়। একটা ঘটনা ঘটেছিল। ঘটনাটা এরকম— আমি বসে অপেক্ষা করছি, আমার দুই ছাত্রী হারিকেন হাতে উপস্থিত হবে। তারা এলো না। চাঁদরে শরীর ঢেকে উপস্থিত হলো লীলাবতী। সহজ-স্বাভাবিক ভঙ্গিতে আমার সামনের চেয়ারে বসতে বসতে বলল, মাস্টার সাহেব, ভালো আছেন?

আমি বললাম, জি।

হাতে বেত নিয়ে বসে আছেন কেন?

আমি হাতের বেত নামিয়ে রাখলাম। একটু মনে হয় অপ্ৰস্তুত বোধ করলাম। লীলাবতী বলল, জাইতরী কইতরী দুজনই আপনাকে প্রচণ্ড ভয় পায়। এটা কি ভালো?

আমি বললাম, শিক্ষককে ভয় পাওয়া ভালো। শিক্ষক খেলার সাথি না। আমি তাদের সঙ্গে সাপ-লুড়ু খেলি না।

আপনি বেত দিয়ে তাদের মারেন?

মাঝে মাঝে শাসন করতে হয়। মানুষকে সবসময়ই কিছু অপ্রিয় প্রয়োজনীয় কাজ করতে হয়। শিক্ষকের শাসন সেরকম একটা বিষয়। অপ্রিয় কিন্তু প্রয়োজনীয়।

লীলাবতী শান্ত গলায় বলল, আপনি কিন্তু শাসন করার জন্যে তাদের মারেন না। আমি আড়াল থেকে কয়েকবার দেখেছি। আপনি তের ঘরের নামতা জিজ্ঞেস করেন। এরা দুইজনেই তের ঘরের নামতা জানে। আপনাকে ভয় পেয়ে তালগোল পাকিয়ে ফেলে। আপনি এই সুযোগটা গ্ৰহণ করেন।

আমি চুপ করে রইলাম। লীলাবতী তাকিয়ে আছে আমার দিকে। তার চোখে সামান্য উত্তেজনাও নেই। তার তাকানোর ভঙ্গি, কথা বলার ভঙ্গি বলে দিচ্ছে সে তৈরি হয়ে এসেছে।

মাস্টার সাহেব!

জি।

তের ঘরের নামতা আপনার একটা অজুহাত। আমি একবার শুনলাম জইতরী। ঠিকই বলল চার তের বাহান্ন। তারপরেও আপনি তাকে মারলেন। আপনার সমস্যাটা কী? আপনি নিজে কি তের ঘরের নামতা জানেন? আমার তো ধারণা। আপনি নিজেই জানেন না।

বলতে বলতেই লীলাবতী হাত বাড়িয়ে টেবিলের উপরে রাখা বেতটা টেনে নিল। এবং কঠিন গলায় বলল, বলুন সাত তের কত? এক্ষুনি বলুন। এক্ষুনি বলতে না পারলে কিন্তু আপনার সমস্যা আছে।

আমি হতভম্ব হয়ে গেলাম। কী করছে এই মেয়ে? তার হাতে বেত। সে বেতটা দোলাচ্ছে। জাইতরী-কইতরীকে পড়বার সময় আমি যেভাবে বেত দোলাতাম অবিকল সেইভাবে। লীলাবতী বলল, দেরি করবেন না এক্ষুনি বলুন।

একানব্বই। লীলাবতী হেসে ফেলে বলল, হয়েছে। আপনি কী ভেবেছিলেন? আপনাকে মারব?

লীলাবতী উঠে চলে গেল। আমার হতভম্ব ভাব কাটছে না। আমি বসেই আছি। কখন যে জাইতরী-কইতরী এসেছে, মাথা দুলিয়ে পড়তে শুরু করেছে। আমার খেয়াল নেই। আমি ওদের দিকে তাকিয়ে বললাম, কেমন আছ তোমরা?

দুই বোন অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। একবার নিজেদের মধ্যে মুখ চাওয়া-চাওয়ি করল। কইতরীর চোখে তীব্র আতঙ্ক। আমি বুঝতে পারছি সে টেবিলের নিচ দিয়ে হাত বাড়িয়ে জইতরীর হাঁটু ধরেছে। আমি বললাম, আজ আমার শরীরটা ভালো না। আজ পড়াব না।

জইতরী ক্ষীণ গলায় বলল, স্যার, চলে যাব?

আমি বললাম, হুঁ।

আমি আমার জায়গায় বসে আছি। শুনতে পাচ্ছি মেয়ে দুটি মঞ্জু। সাহেবের ঘরে ঢুকে বিরাট হৈচৈ শুরু করেছে। তিনজন মিলে কোনো একটা খেলা বোধহয় খেলছে। মঞ্জু সাহেব অদ্ভুত ভাষায় কিছু বলছেন, মেয়ে দুটিও অদ্ভুত ভাষায় তার কথার জবাব দিচ্ছে। কিছুক্ষণ কান পেতে থেকে আমি অদ্ভুত ভাষার রহস্য উদ্ধার করলাম।
 
মঞ্জু, সাহেব বললেন, তিটমরা কিটি কিটরো? যার অর্থ— তোমরা কী করো? জইতরী বলল, মিটজ কিটরি। অর্থ হলো, মজা করি। বাচ্চা দুটি কী সুখেই না আছে! মঞ্জু সাহেব যে আনন্দ নিয়ে এদের সঙ্গে খেলছেন আমি কোনোদিনও এত আনন্দ নিয়ে কারো সঙ্গে খেলতে পারব না। খেলতে পারলে ভালো হতো। লীলাবতীকে বলতাম, তিটুমি কিটেমন ইটাছ? (তুমি কেমন আছ?) সে বলত, ভিটালো (ভালো)। আমি বলতাম, বিটসো (বসো)। সে বলত, কিটি কিটরেন? (কী করেন?) আমি বলতাম..

আমি রাতে ভাত খেলাম না। রাগ করে খেলাম না তা না। ভাত না খাওয়ার পেছনে একটাই উদ্দেশ্য কাজ করছিল। কোনোভাবে লীলাবতীর কাছে খবর যাবে আমি ভাত খাই নি। সে আসবে আমার কাছে। আমাকে বলবে, আমার উপরে রাগ করে ভাত খাচ্ছেন না— এটা কেমন কথা? খেতে বসুন।

লীলাবতী এলো না। আমি তিনটা পৰ্যন্ত জেগে বসে রইলাম। সেই রাতে যথারীতি আবারো লীলাবতীকে স্বপ্নে দেখলাম। আমি ভাত খাচ্ছি। সে আমার সামনে বসে আছে। তার হাতে বেত, মুখে হাসি। আমি বললাম, তুমি বেত হাতে বসে আছ কেন?

সে বলল, তুমি খাওয়া নিয়ে গণ্ডগোল করবে। আর আমি তোমার মাথায় বেতের বাড়ি দেব। বেশি করে ভাত নাও।

আমি ভাত নিলাম। সে বলল, এখন আমাকে বলো যূথি মেয়েটা কে? তুমি যতবার অসুস্থ হও ততবার যূথিকে ডাকো।

যূথি আমার খালাতো বোন। ওর বিয়ে হয়ে গেছে।

বিয়ে হোক বা কুমারী থাক, খবরদার আর কখনো যূথির নাম মুখে আনবে না।

আচ্ছা।

যদি আবার কোনোদিন যূথির নাম মুখে আনো আমি কিন্তু বেত দিয়ে তোমাকে মারব।

আমার যে মাথা খারাপ হয়ে যাচ্ছে। আমি সেটা বুঝতে পারছি। সুস্থ মাথার মানুষ রোজ রাতে একই ধরনের স্বপ্ন দেখবে না। স্বপ্ন ছাড়াও আমার অসুস্থতার আরো একটা লক্ষণ প্ৰকাশ পেয়েছে। দস্তয়োভস্কির ক্রাইম এন্ড পানিশমেন্টের অনুবাদ এখন বন্ধ। এখন আমি খাতায় গুটিগুটি করে একটা শব্দই লিখি। শব্দটা— লীলাবতী। পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা এই জিনিস। আমার হাতে লেখা এক পৃষ্ঠায় থাকে। পঁচিশ লাইন। প্রতি লাইনে লীলাবতী লেখা হয়। আটবার। অর্থাৎ পৃষ্ঠায় দুইশবার করে এই নাম লেখা হচ্ছে। আমি তিনশ’ আঠারো পৃষ্ঠা লিখে ফেলেছি। তার মানে এখন পর্যন্ত আমি ছয়ত্ৰিশ হাজার ছয়শাবার লিখলাম–লীলাবতী। খারাপ কী!

মালেক ভাই যদি শুনেন আমার এই অবস্থা, তিনি কী করবেন? প্রথমে কিছুক্ষণ হাসবেন। তার বিখ্যাত ছাদ ফাটানো হাসি। তারপর বলবেন, তোমার নাম বদলে মজনু রাখলে কেমন হয়? শোনো আনিস, জায়গির মাস্টারের সঙ্গে জায়গির বাড়ির মেয়ের প্ৰেম প্ৰায় শাশ্বত বাংলার বিষয়। এই বাংলায় এমন কোনো জায়গির শিক্ষক ছিলেন না যার সঙ্গে সেই বাড়ির কোনো মেয়ের প্রেম হয় নাই। অন্য কিছু কি করা যায় না? নতুন কিছু করো। সবচে ভালো হয়, এই লাইনটা যদি ছেড়ে দাও। তোমার ক্ষমতা আছে। ক্ষমতা ব্যবহার করো।

একমাত্র মালেক ভাই বলেছেন আমার ক্ষমতা আছে। আমি জানি, যে ক্ষমতা আছে সেই ক্ষমতা নিম্নশ্রেণীর ক্ষমতা। এই ক্ষমতার সবচে’ বড় প্রকাশ, লীলাবতী লিখে পাতা ভরানোতে সীমাবদ্ধ। কোনো বানান ভুল হবে না। লাইন সোজা হবে। প্রতি পৃষ্ঠায় দুশবার করে লেখা হবে। অক্ষরগুলিও হবে সুন্দর। এর বেশি ক্ষমতা আমার নেই। তবে এই ক্ষমতাও অগ্রাহ্য করার মতো না।
 
ভিটাবাড়িতে লিচুগাছ লাগানো নিষেধ।

যে ভিটাতে ফলবান লিচুবৃক্ষ থাকে সেই ভিটা জনশূন্য হয়— এই প্রবাদ আছে। তারপরেও শহরবাড়ির সামনে সিদ্দিকুর রহমান দুটি লিচু গাছ লাগিয়েছেন। দশ বছরেই গাছ দুটি বিশাল আকৃতি নিয়েছে। গত তিন বছর থেকে ফল দিচ্ছে। বৈশাখে গাছ দুটি লাল টকটকে হয়ে যায়। দূর থেকে মনে হয়। গাছে আগুন ধরে গেছে। সিদ্দিকুর রহমান হুকুম দিয়েছেন, গাছের লিচু গাছেই থাকবে। কারোর লিচু খেতে ইচ্ছা হলে সে গাছ থেকে ছিড়ে নিয়ে খাবে।

গত বছর সিদ্দিকুর রহমান লিচুতলা বঁধিয়ে দিয়েছেন। হঠাৎ হঠাৎ তিনি এখানে এসে বসেন। তাঁর বসার সময়ের কোনো ঠিক-ঠিকানা নেই বলেই লিচুতলা সবসময় ঝকঝকে রাখা হয়। বাঁধানো অংশে একটা শুকনো পাতাও পড়ে থাকে না।

মঞ্জু, লিচুতলায় বসে আছেন। তার সামনে জইতরী। দু’জন গভীর মনোযোগে সাপলুড়ু খেলছে। কইতরী বসে আছে মঞ্জুর গায়ের সঙ্গে গা লাগিয়ে। সাপলুড়ু খেলা জটিল আকার ধারণ করেছে। দুটি গুটিই পাশাপাশি যাচ্ছে। জইতরী সাপের মুখে পড়ে পিছিয়ে পড়েছিল, কিছুক্ষণ আগে সিঁড়ি পেয়েছে।

বাজির খেলা হচ্ছে। বাজির পরিমাণ সামান্য না, এক টাকা। জাইতরীর কাছে টাকা নেই। সে বলেছে, সে যদি হারে তবে টাকাটা দেবে ঈদের পরে। ঈদে সে সালামি পায়। সালামির টাকা থেকে দেবে। মঞ্জু। এই শর্তে রাজি আছেন। কইতরী বোনের গুটি চালানো কঠিন চোখে লক্ষ করছে। জাইতরীর নাকি চোরামি করার স্বভাব আছে। চার উঠলে সে পাঁচ চেলে গুটিকে সিড়ির মুখে নিয়ে যায়। কইতরীর কঠিন চোখের সামনে জইতরী এই সুযোগ পাচ্ছে r।।

দুটি গুটিই এখন নিরানব্বই-এর ঘরে আটকে আছে। এক না উঠলে খেলা জেতা যাবে না। যার আগে উঠবে সে-ই জিতবে। মঞ্জু প্রতিবারই দোয়া-দরুদ পড়ে ফু দিয়ে দান দিচ্ছেন। লাভ হচ্ছে না।

খেলার এই পর্যায়ে মঞ্জু বললেন, আমি আর টেনশন নিতে পারছি না। একটা কাজ করলে কেমন হয়— এসো লটারি করি। একটা কাগজে তোমার নাম লেখা থাকবে। একটাতে থাকবে আমার নাম। কইতরী কাগজ টানবে। যার নাম উঠবে সে-ই জিতবে। জাইতরী, রাজি আছো?

জইতরী বলল, হুঁ।

যাও তাহলে কাগজ-কলম নিয়ে আসো। আমার লটারির ভাগ্য অবশ্যি খুবই ভালো। আমার জিতে যাওয়ার কথা। তার উপর আজ রবিবার।

রবিবারে কী হয়?

রবিবার হলো আমার জন্মবার। জন্মবারে মানুষের ভাগ্য থাকে সবচে ভালো। আমি যে জিতব এটা নিয়েও এখন বাজি রাখতে পারি।

লুড়ুর বাজিতে জইতরী জিতল। মঞ্জুর এমন মনখারাপ হলো যে জইতরীর মনখারাপ হয়ে গেল। এত বড় মানুষ কিন্তু কী ছেলেমানুষ! বাজিতে হেরে কাদো। কাদো মুখ হয়ে গেছে। জাইতরীর ইচ্ছা করছে, এক টাকার নোটটা ফেরত দিয়ে দেয়।

মঞ্জু বললেন, আরেক দান খেলবে? এইবার দুই টাকা বাজি। তুমি হারলে এখন দিবে এক টাকা, বাকি এক টাকা দিবে। ঈদের দিন।

ঈদ পর্যন্ত আপনি থাকবেন?

না থাকলেও ঈদের দিন টাকা নিতে আসব।

দ্বিতীয় দফায় খেলা শুরু করার আগেই বদু এসে খবর দিল, চাচাজি আপনারে ডাকে। জাইতরী এবং কইতরী দুই বোনের মুখ একসঙ্গে কালো হয়ে গেল। বাবার ভয়ে এরা সবসময় অস্থির হয়ে থাকে।
 
সিদ্দিকুর রহমান পুকুরঘাটে বসেছিলেন। তার পেছনে লোকমান ছাতা ধরে আছে। আকাশ মেঘলা। ছাতা ধরার প্রয়োজন নেই। এই সত্য লোকমানও জানে। তারপরেও সে ছাতা ধরে আছে। এমনভাবে ধরেছে যেন সত্যি সত্যি রোদ আটকাচ্ছে।

সিদ্দিকুর রহমান উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বললেন, মঞ্জু, তুমি সোনালু গাছ চেনো?

মঞ্জু বললেন, জি না।

চল তোমাকে গাছ দেখায়ে আনি।

সোনালু গাছ দেখার চেয়ে জইতরী-কইতরীর সঙ্গে লুড়ু খেলতে পারলে মঞ্জুর ভালো লাগত। তার মতে গাছপালা আয়োজন করে দেখার কিছু না। মানুষটা এমন যে মুখের উপর না করা যায় না। মেজাজি মানুষ। ছেলেকে তালাবন্ধ করে রেখে দিয়েছে। কারোর তাতে কিছু যাচ্ছে। আসছে এমনও মনে হচ্ছে না। সবাই এমন ভাব করছে যেন এটা কোনো বিষয়ই না। কারোর কাছে যখন বিষয় না। তখন মঞ্জুর কাছেও বিষয় না। সে এই কারণেই মহানন্দে লুড় খেলে বেড়াচ্ছে।

সিদ্দিকুর রহমান বললেন, হলুদ রঙের লতানো ফুল হয়। চৈত্রমাসে ফুল ফোটে। তখন মনে হয় হলুদ চুলের কোনো মেয়ে চুল ছেড়ে দাঁড়িয়ে আছে। আমার খুবই পছন্দের গাছ। তোমার কি কোনো পছন্দের গাছ আছে?

জি না। সব গাছ আমার কাছে একরকম মনে হয়। ডালপালা, পাতা।

বটগাছও আমার পছন্দ। তবে সব বট না— মহাবট।

মহাবট কোনটা?

বটগাছেরও নানান রকমফের আছে। মহাবট দেখার জিনিস। কালিগঞ্জে একটা মহাবট আছে। আমি যখন দেখতে গিয়েছিলাম তখন দেখেছি। একশ আঠারোটা ঝুড়ি

আপনি বসে বসে ঝুড়ি গুনেছেন?

বসে বসে গুনি নাই। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে গুনেছি। গাছভর্তি হরিয়াল পাখির আস্তানা। হরিয়াল পাখি চেনো?

জি না।

হরিয়াল পাখি বটের ফল ছাড়া কিছু খায় না। সব পাখি মাংসাশী, শুধু হরিয়াল নিরামিষ পাখি। এই পাখি ফল ছাড়া কিছু খায় না বলে এর মাংসও অতি স্বাদু। তুমি হরিয়ালের মাংস খেয়েছ?

জি না।

আচ্ছা তোমাকে হরিয়ালের মাংস খাবার ব্যবস্থা করব।

আপনার সোনালু গাছ আর কত দূরে?

এই তো এসে গেছি।

মঞ্জু প্রায় বলেই ফেলছিল, এতদূর এসে গাছ দেখে পোষায় না। কথা মুখে আটকে গেল। সোনালু গাছ দেখা যাচ্ছে। পাশাপাশি তিনটা গাছ। গাছের গা ঘেঁসে যাচ্ছে নদীর পানি।

নদীর নাম ভোমরা। শীতের সময় পানি থাকে না, বর্ষায় পানি হয়, সেই পানি থাকে। ভাদ্র পর্যন্ত।

মঞ্জু বৃক্ষপ্রেমিক কিংবা প্রকৃতি-প্রেমিক কোনোটাই না, তারপরেও মুখ দিয়ে বের হয়ে গেল— বাহ!

সিদ্দিকুর রহমান বললেন, জায়গাটা তোমার পছন্দ হয়েছে?

অবশ্যই। অবশ্যই পছন্দ হয়েছে।

সিদ্দিকুর রহমান বললেন, আমি বলেছিলাম তোমাকে সামান্য সম্মান করতে চাই, মনে আছে না?

জি মনে আছে।

এই জায়গাটা আমার। তিন বিঘার মতো জমি। জমিটা আমি তোমাকে লিখে দিতে চাই। যদি তোমার আপত্তি না থাকে।

মঞ্জু, হতভম্ব গলায় বললেন, কী বলেন এইসব!

সিদ্দিকুর রহমান বললেন, আমি এখন চলে যাব। তুমি একা কিছুক্ষণ থাকো। দেখ কেমন লাগে। দুপুর একটার সময় ভোমরা ব্রিজের উপর দিয়ে ট্রেন যাবে। অতি সুন্দর দৃশ্য।
 
মঞ্জুর চোখ থেকে হতভম্ব ভাব এখনো দূর হয় নি। সিদ্দিকুর রহমান মানুষটাই বিচিত্র প্রকৃতির— এটা ঠিক আছে। যত বিচিত্ৰই হোক কোনো মানুষই নিতান্ত অপরিচিত একজনকে তিন বিঘা জমি দিয়ে দেয় না।

সিদ্দিকুর রহমান ডাকলেন, নিরঞ্জন আছ?

সোনালু গাছের আড়াল থেকে নিরঞ্জন বের হয়ে এলো। ধুতি লুঙ্গির মতো করে পরা খালি গায়ের একজন বয়স্ক মানুষ। মাথার চুল সবই পাকা। সে বের হয়েই হাতজোড় করে আছে।

নিরঞ্জন!

জে আজ্ঞে!

মঞ্জুকে জায়গা দেখাও। সীমানা কোন পর্যন্ত বুঝায়ে বলো।

জে আজ্ঞে।

রান্নাবান্না করেছ না?

নিরঞ্জন হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়ল। সিদ্দিকুর রহমান বললেন, অতিথি রেখে গেলাম, যত্ন করে খাওয়াবে।

নিরঞ্জন আবারো হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়ল। সে এখনো জোড় হাত করে দাঁড়িয়ে আছে। তার দৃষ্টি মাটির দিকে।

সিদ্দিকুর রহমান নদীর পাড ঘেঁসে হাঁটছেন। তিনি কোথায় যাবেন সেটা লোকমান ধরার চেষ্টা করছে। হয়তো তিনি নদী পার হবেন। নদী পার হবার সাঁকো অনেক দূরে। কোনো কোনো দিন উনার হাঁটতে ভালো লাগে। আজ কি সেরকম একটা দিন? তিনি দ্রুত হাঁটছেন। এত দ্রুত যে লোকমান তাল মিলিয়ে আসতে পারছে না। মাঝে মাঝেই পিছিয়ে পড়ছে।

লোকমান!

জি।

মঞ্জু, মানুষটা কেমন বলো দেখি।

ভালো।

কী কারণে ভালো?

লোকমান জবাব দিতে পারল না। চাচাজি মাঝে-মধ্যেই এমন সব প্রশ্ন করেন যার জবাব দেয়া যায় না। অথচ তিনি জবাব শোনার জন্যে অপেক্ষা করেন।

কেন ভালো বলতে পারলা না?

জে না।

মানুষটার মধ্যে মায়া বেশি। সে জইতরী-কইতরীকে কেমন মায়া করে, দেখো নাই?

জি দেখেছি।

পশুপাখির মধ্যে কি মায়া আছে লোকমান?

জি দেখেছি।

সামান্য ভুল বলেছ। পশুর মধ্যে মায়া আছে। পাখির মধ্যে নাই। পাখি মায়ার বশ হয় না। পশু হয়। ঠিক বলেছি?

জি।

এইখানে একটা কথা কিন্তু আছে লোকমান। মানুষ মায়া দিয়ে পশু বশ করার চেষ্টা করেছে। পাখি বিশের চেষ্টা কখনো করে নাই। কেন করে নাই জানো?

জে না।

পশুর কাছ থেকে মানুষ উপকার পায়। পাখির কাছ থেকে পায় না। পাখির কাছ থেকে উপকার পাওয়া গেলে মানুষ পাখি বশ করার চেষ্টা নিত। এখন বুঝেছ?

জি।

এখন বলো মঞ্জু নামের লোকটাকে আমি জমি দিতেছি কেন?

জানি না।

আমি মায়া দিয়ে লোকটাকে বশ করার চেষ্টা নিতেছি। আমার নিজের মধ্যে কিন্তু মায়া নাই। তারপরেও আমি মায়ার খেলা খেলি। কেন খেলি জানো?

জি না।

মায়ার খেলা বড় মজার খেলা এইজন্যে খেলি। আরেকটা মজার খেলা হলো ঘৃণার খেলা। এই খেলাটা আমি আমার ছেলের সঙ্গে খেলতেছি।
 
নদী পারাপারের সাঁকো এসে গেছে। সিদ্দিকুর রহমান সাঁকোর গোড়ায় দাঁড়িয়ে আছেন। সাঁকো পার হবেন কি হবেন না। এই সিদ্ধান্ত নিতে পারছেন না। তার মাথার উপর চিল উড়াউড়ি করছে। তিনি এখন আগ্রহ নিয়ে চিলের উড়াউড়ি দেখছেন।

লোকমান!

জি।

আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি পাখি বশ করার চেষ্টা নিব। ভালো হবে না?

জি ভালো হবে।

গাইড়ার ভিটায় রোজ একবেলা ধান ছিটায়ে দিবা। যেন পাখি এসে ধান খেতে পারে। প্রতিদিন একটা বিশেষ সময়ে আধমণ ধান।

জি আচ্ছা।

আজ কি বার?

বুধবার।

শুক্রবার থেকে শুরু করব।

জি আচ্ছা।

ধান ছিটায়ে দিয়ে চলে আসবা। কেউ থাকবা না।

গরু-ছাগল ধান খাইয়া ফেলবে।

কাঁটাতারের বেড়া থাকবে। গরু-ছাগল ঢুকবে না।

জি আচ্ছা।

চল গাইড়ার ভিটার দিকে যাই।

সিদ্দিকুর রহমান হাঁটতে শুরু করেছেন। লোকমান চিন্তিত বোধ করছে। গাইড়ার ভিটার মতো এত বড় এলাকায় কাটাতার দিয়ে বেড়া দেয়া অতি কঠিন কাজ। এক-দুই দিনের কাজ না। কাঁটাতার আনতে ময়মনসিংহ যেতে হবে। খুঁটি পুততে হবে। বিরাট ঝামেলা।

গাইড়ার ভিটায় এসে লোকমান ধাক্কার মতো খেল। অনেক লোকজন সেখানে খুঁটি পোতার কাজ করছে। কাটাতার লাগাচ্ছে। সিদ্দিকুর রহমানকে দেখে হেড মিস্ত্রি রশিদ এগিয়ে এলো। সিদ্দিকুর রহমান বললেন, শুক্রবারের মধ্যে কাজ শেষ হবে না?

রশিদ বলল, অবশ্যই।

লোকমানের মনটা খারাপ হয়েছে। বেশ খারাপ। এমন বিশাল কর্মকাণ্ড অথচ সে কিছুই জানে না।



মঞ্জু দুপুরে খুব আরাম করে খেয়েছেন। সবই নিরামিষ— বেগুন, ভাজি, শাক, আলু ভর্তা, ডাল। প্রতিটি খাবারই অতি সুস্বাদু। মঞ্জু বললেন, নিরঞ্জন ভাই, আপনি কি দ্ৰৌপদী বলে কারোর নাম শুনেছেন?

নিরঞ্জন না-সূচক মাথা নাড়ল।

মঞ্জু বললেন, দ্ৰৌপদী ছিল এই পৃথিবীর সেরা রাধুনি। আপনার রান্না খেয়ে বুঝেছি সে আপনার দাসী হবার যোগ্যও না। বুঝেছেন আমার কথা?

হুঁ।

আপনি আমার কথা কিছুই বুঝেন নাই। যাই হোক, না বুঝলে নাই। আপনার কাছে আমি রান্না শিখব। বুঝেছেন?

হুঁ।

প্রতিদিন আমি আসব। একটা করে আইটেম আমাকে শিখাবেন। পারবেন না?

হুঁ।

প্রথম শিখাবেন আলুভর্তা। এইটাই মনে হয় সবচে সোজা। সোজাটা দিয়েই শুরু হোক। ঠিক আছে?

হুঁ।

আপনার কাছে সব রান্না শিখে আমি একটা ভাতের হোটেল দিব। হোটেলের নাম দিব।— নিরঞ্জনের ভাতের হোটেল। ঠিক আছে?

হুঁ।

আপনি কি মাছ-মাংস রাঁধতে পারেন?

পারি।

কাল মাছ খাওয়াবেন। পারবেন না?

হুঁ।

কাল আমি দুজন অতিথি নিয়ে আসব। জাইতরী কইতরী। ঠিক আছে?

হুঁ।

সকালবেলা এই দুইজনকে নিয়ে চলে আসব, সন্ধ্যাবেলা যাব। নদীর পাড়ে বসে লুড়ু খেলিব। জাইতরী-কইতরী এই দুইজনকে চিনেন?

না।

সিদ্দিক সাহেবের দুই মেয়ে। এমন লক্ষ্মী মেয়ে আমি আমার জীবনে দেখি নাই। দেখব বলেও মনে হয় না। আর না দেখাই ভালো। ভালো জিনিস কম দেখতে হয়। ভালো জিনিস বেশি দেখলে ভালোর মান থাকে না।

নিরঞ্জন বলল, হুঁ।

মঞ্জু বললেন, আপনি হুঁ ছাড়া আর কিছু বলতে পারেন?

নিরঞ্জন জবাব দিল না। মঞ্জু বলল, করেন কী আপনি? এইখানে একা থাকেন?

হুঁ।

বউ ছেলেমেয়ে নাই?

আছে।

তাহলে একা থাকেন কেন?

নিরঞ্জন ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে বলল, আমি পতিত হইছি, আমার জাইত গেছে। আমারে সমাজ থাইক্যা বাইর কইরা দিছে। এইজন্যে একলা থাকি। বড় সােব আমারে পালে।

পতিত হয়েছেন কেন?

বড় সাহেবের জন্যে একদিন গো-মাংস রান্না করছিলাম, এইজন্যে পতিত হইছি।

বলেন কী? শুধু রান্না করার জন্যে সমাজ থেকে বের করে দিয়েছে! খেয়ে দেখেন নি!

আমি নিরামিষ ছাড়া কিছু খাই না।

মঞ্জুর মন মায়ায় ভরে গেল। আহা বেচারা। তার জন্যে কিছু করা উচিত।
 
জইতরী। দুপুরে খায় নি। সে খুবই মন খারাপ করেছে। কারণ মঞ্জুমামা লুড়ু খেলা নিয়ে একটা অন্যায় করেছেন। ইচ্ছা করে বাজিতে হেরে জাইতরীকে জিতিয়ে দিয়েছেন। লটারির দুটা কাগজেই জইতরীর নাম লিখেছেন। সে কাগজ দেখে টের পেয়েছে। জাইতরী এভাবে বাজি জিততে চায় নি। জাইতরী ঠিক করেছে, সে আর কোনো দিনই মঞ্জুমামার সঙ্গে কথা বলবে না। বড় পীর সাহেবের কসম— কথা বন্ধ। জাইতরী জানে সবচে কঠিন কসম— বড় পীর সাহেবের কসম। এই কসম ভাঙা মানেই মৃত্যু। কিছুক্ষণ পরই জইতরীর মনে হলো, সে একটা ভুল করে ফেলেছে। বড় ভুল। মঞ্জুমামার সঙ্গে কথা না বলে সে থাকতে পারবে না। তাকে যা করতে হবে তা হলো কসম ভাঙানোর ব্যবস্থা। একেক কসম একেকভাবে ভাঙাতে হয়। শুধু আল্লাহর নামে যে কসম সেটা ভাঙতে কিছু করতে হয় না। আল্লাহপাক কসম ভাঙলে রাগ করেন না। নাপাক অবস্থায় আল্লাহর নাম নেয়া যায়। কিন্তু বড়পীর সাহেবের নাম নেয়া যায় না।

জইতরী মন খারাপ করে ঘুরছে। পীর সাহেবের নামের কসম ভাঙানোর উপায় বের করতে পারছে না। এইসব জিনিস সবচে ভালো জানেন মা। তাকে আজ কিছু জিজ্ঞেস করা যাবে না। তার মাথা আজ অতিরিক্ত গরম। যখন তার মাথা অতিরিক্ত গরম থাকে তখন তিনি কাউকে চিনতে পারেন না। আজ জইতরী কয়েকবার তাঁর ঘরের সামনে দিয়ে গিয়েছে। তিনি জইতরীকে চিনতে পারেন নি।

এই বিষয় নিয়ে সে নতুন বউকেও জিজ্ঞেস করতে পারে। পরীবানু নামের এই মেয়েটা নিশ্চয়ই কসম ভাঙার বিষয় জানে। সমস্যা একটাই, নতুন বউয়ের সঙ্গে তার এখনো কোনো কথা হয় নি। জাইতরী আগ বাড়িয়ে কারোর সঙ্গে কথা বলে না। পরীবানুও মনে হয় তার মতো। সেও আগ বাড়িয়ে কথা বলে না। বেশির ভাগ সময় নিজের ঘরে বসে থাকে। ঘরের ভেতর হাঁটাহাঁটি করে। জাইতরী দেখেছে। হাঁটাহাঁটির সময় এই মেয়ে নিজের মনে কথা বলে। বিড়বিড় করে কথা। জইতরীর সঙ্গে এখানেও তার মিল আছে। জাইতরীও নিজের মনে কথা বলে।

পরীবানু খাটে পা বুলিয়ে বসে ছিল। তার ঘরের দরজা খোলা। খোলা দরজা দিয়ে রোদ এসে পড়েছে পরীবানুর গায়ে। অন্ধকার ঘরে পরীবানুর গায়ে রোদ পড়ার কারণে ঝলমল করছে। বারান্দা থেকে এই দৃশ্য দেখে জইতরীর এতই ভালো লাগল যে সে ঘরে ঢুকে পড়ল। পরীবানু বলল, জাইতরী কিছু বলবে?

জইতরী বলল, না।

পরীবানু বলল, তোমার সঙ্গে আমার আলাপ পরিচয় হয় নাই। মন এত খারাপ থাকে, কারো সাথে কথা বলতে ইচ্ছা করে না। তুমি মনে কিছু নিও না। আসো আমার পাশে বসে। দুইজনে কিছুক্ষণ গল্প করি।

জইতরী খাটে উঠে বসল। পরীবানু বলল, তোমার মতো সুন্দরী মেয়ে আমি আমার জীবনে দেখি নাই। তুমি যখন শাড়ি পরা ধরবে তখন তোমাকে নিয়া আমি একটা গীত বাধব।

জইতরী বলল, তুমি গীত বাধতে জানো?

পরীবানু ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে বলল, জানি। গীত বাধতে জানি, গাইতেও জানি। সবেরে অবশ্যি মিথ্যা কইরা বলি আমি কিছু জানি না।

মিথ্যা বলো কেন?

নিজেকে আড়ার রাখার জন্যে মিথ্যা বলি। মেয়েছেলেদের নিজেদের আড়াল করার জন্যে অনেক কিছু করতে হয়। তুমি নিজেও করো। করো না?

জইতরী হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়ল। পরীবানুকে তার সামান্য পছন্দ হতে শুরু করেছে। জাইতরী বলল, আমি বড় পীর সাহেবের নামে কসম কাটছি! এখন কসম ভাঙব। আমার কী করা লাগবে তুমি জানো?

জানি।

জানলে বলে।

বড়পীর সাহেবের উপরে যিনি তাঁর নামে কসম ভাঙতে হবে। বড়পীর সাহেবের উপরে আছেন আমাদের নবী-এ করিম। তার নামে কসম ভাঙবা। কী নিয়া কসম কাটছিলা?

জইতরী কসমের ব্যাপারটা ব্যাখ্যা করল। ব্যাখ্যা করতে গিয়ে লক্ষ করল, কথা বলতে তার ভালো লাগছে। শুধু যে ভালো লাগছে তা না, যতই কথা বলছে পরীবানু মেয়েটাকে তার ততই ভালো লাগছে। পরীবানু বলল, তুমি কি মঞ্জু নামের মানুষটারে খুব ভালো পাও?

হুঁ। খুব বেশি ভালো পাও?

হুঁ।

তোমারে একটা উপদেশ দেই, মন দিয়া শোনো। নিকট আত্মীয়ের বাইরে কোনো পুরুষমানুষরে মেয়েদের বেশি ভালো পাওয়া উচিত না।

জইতরী বলল, উচিত না কেন?

মেয়েছেলের মন অন্যরকম। মেয়েছেলে সবসময় ভালো যারে পায় তারে নিয়া সংসার করতে চায়। তুমি যখন আরেকটু বড় হইবা তখন বুঝবা। এখন বুঝবা না। তুমি বড়পীর সাহেবের নামে কসম কাটছ, মঞ্জু নামের মানুষটার সাথে কথা বলবা না। কসম না ভাঙাই ভালো। কসম ভাঙাইবা না।

পরীবানু পা দোলাচ্ছে। তার আচার-আচরণ স্বাভাবিক। সে কথা বলার সময় জাইতরীর দিকে তাকাচ্ছেও না। কথা বলছে সহজ-স্বাভাবিক গলায়। অথচ এমনভাবে কথা বলছে যেন সে সবই জানে।

জইতরী।

হুঁ।

আমার কথায় তুমি কিছু মনে নিও না। আমার মন মিজাজ ভালো না। কখন কী বলি তার নাই ঠিক।

পরীবানু চোখ মুছল। সহজ-স্বাভাবিকভাবে যে মেয়ে কথা বলছিল মুহুর্তেই তার চোখে পানি। জাইতরী অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। পরীবানু চোখ মুছে হোসে ফেলে বলল—

ক্ষণেকে চোখে পানি ক্ষণেকে হাসি
সেই কন্যা হয় রাক্ষস রাশি।
 
সিদ্দিকুর রহমান আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে আছেন।

নানান ধরনের পাখি খান খাচ্ছে। কাক, শালিক, কবুতর, টুনটুনি, সাতরা পাখি। গ্রামাঞ্চলে কাক থাকে না। এই দুই দাড়কাক কোত্থেকে এসেছে? তিনি আগ্রহ নিয়ে কাক দুটিকে দেখছেন। সাধারণ কাকের দ্বিগুণ আয়তন। চোখ টকটকে লাল। পাখিসমাজ এই দুজনকে সমীহের চোখে দেখছে। কাক দুটির উপর দিয়ে বিকট শব্দ করে অচেনা একটি পাখি উড়ে গেল। কাক দুটি নড়ল না। আবার ঘাড় কাত করে দেখারও চেষ্টা করল না। কী হচ্ছে।

পাখির সংখ্যা গুনতে পারলে ভালো হতো। দিন দিন পাখির সংখ্যা বাড়ে না কমে এটা দেখা যেত। একজন কাউকে কি রেখে দেবেন যার কাজ হবে দিনে তিনবার পাখি গোনা! সকালে একবার, দুপুরে একবার, সন্ধ্যায় আরেকবার।

লোকমান-সুলেমান দুই ভাইই তাঁর সঙ্গে আছে। তাদের চোখে মুখে কোনো পরিবর্তন নেই। বিশাল একটা জংলা কাঁটাতার দিয়ে ঘেরা হয়েছে, সেখানে ধান ছড়ানো হচ্ছে। পাখি এসে এই ধান খাচ্ছে। এই বিষয়গুলি তাদেরকে স্পর্শ করছে না। ধান ছড়ালে পাখি খাবে— এর মধ্যে আশ্চর্যের কিছু নাই। এই দৃশ্য আয়োজন করে দেখারও কিছু নাই।

সুলেমান!

জি চাচাজি?

একটা জিনিস কি লক্ষ করেছ, পাখি যখন ধান খায় সে কোনো শব্দ করে না? ডাকাডাকি নাই, ক্যাচক্যাচানি নাই।

সুলেমান কিছু লক্ষ করে নি, তারপরেও সে হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়ল।

আমি কিছুক্ষণ একা একা জঙ্গলে হাঁটাহাঁটি করব। তোমরা দুজন বাইরে অপেক্ষা করো।

দুই ভাই মুখ চাওয়া-চাওয়ি করছে। উনাকে একা রেখে তাদের ঘরে যাবার কোনো ইচ্ছা নেই। এই কথাটা বলার সাহসও পাচ্ছে না।

সিদ্দিকুর রহমান বললেন, দাঁড়িয়ে আছ কেন? যাও। কাঁটাতারের বাইরে থাকো। আমি না ডাকলে ভিতরে ঢুকবে না।

তিনি বনের ভেতরে ঢুকে গেলেন। সাপখোপের ব্যাপার এখন থাকবে না। শীতের সময় সাপ গর্তে ঢুকে এক ঘুমে সময় পার করে দেয়। একেক প্রাণীজগতের জন্যে একেক ব্যবস্থা। সব ব্যবস্থার পিছনে সূক্ষ্ম কোনো হিসাব আছে। এই হিসাব সবার বোঝার বিষয় না।

তিনি অন্যমনস্ক ভঙ্গিতে হাঁটছেন। নজর করে কিছু দেখছেন না। আবার সবকিছুই দেখছেন। জঙ্গলের মাঝখানে বড়-সড় ডোবার দেখা পেলেন। ডোবায় রোদ পড়েছে। ঝিলমিল করছে ডোবার পানি। পানিও পরিষ্কার। তার কাছে মনে হলো, এত পরিষ্কার পানি তিনি অনেকদিন দেখেন নি। ডোবাটাকে আরো বড় করলে কেমন হয়? দিঘি হবে না। বিলের মতো হবে। এই ঝিল বনের ভেতর দিয়ে সাপের মতো একেবেঁকে যাবে।

তার গরম লাগছে। বনের ভ্যাপসা গরম। তিনি গায়ের পাঞ্জাবি খুললেন। হঠাৎ মনে হলো, শুধু পাঞ্জাবি কেন খুলবেন? কেন সম্পূর্ণ নগ্ন হবেন না? আব্রুর জন্যেই তো পোশাক। এখন তাঁর আব্রু ঘন বন। এই বনে দ্বিতীয় কেউ ঢুকবে না। নগ্ন হবার চিন্তাটা বাদ দিলেন। সব চিন্তাকে প্রশ্ৰয় দিতে নাই। শুধুমাত্র মস্তিষ্ক বিকৃত মানুষই সকল চিন্তাকে প্রশ্ৰয় দেয়।

তার মাথার উপর দিয়ে ট্যা ট্যা করে এক ঝাক টিয়া পাখি উড়ে গেল। তিনি মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে আছেন। এই বনে নিশ্চয়ই প্রচুর টিয়া পাখি বাস করে। তার মনে হলো–বনের নাম টিয়া বন দিলে কেমন হয়? লীলাবতীকে একবার এনে বন দেখাতে হবে। সেটা কি আজই দেখাবেন? নাকি আরো কিছু পরে? লীলা চলে যাবার প্রস্তুতি নিয়ে নিয়েছে। যে-কোনো একদিন সে বলবে— আমি আজ দুপুরের গাড়িতে যাব। তখন তাকে যেতে দিতে হবে। পশুপাখি আটকে রাখা যায়। মানুষ আটকে রাখা যায় না।

শব্দ করে ঝোপ-ঝাড় নাড়িয়ে কোনো একটা জন্তু ছুটে গেল। বনবিড়াল হতে পারে। আবার খরগোশও হতে পারে। বনের পশু যা আছে কাঁটাতারের বেড়ায় আটকা পড়েছে। এটা মন্দ কী! এই বনে কী কী পশু আছে তার একটা হিসাব থাকলে ভালো হতো। তিনি ডোবার পানিতে নামলেন। পানি ঠাণ্ডা হবে ভেবেছিলেন। পানি ঠাণ্ডা না, যথেষ্টই গরম। পানিতে ছপছপ শব্দ তুলে হাঁটতে তার ভালো লাগছে।
 
লীলাবতী মঞ্জুর সামনে দাঁড়িয়ে আছে। লীলাবতীর চোখে কৌতূহল, ঠোঁটের ফাকে চাপা হাসি। মঞ্জুমামার কর্মকাণ্ডে না হেসে উপায় নেই। একদল মানুষ আছে যাদের বয়স বাড়ে না। মঞ্জুমামা সেই দলের।

মঞ্জু অতি আগ্রহে পাথরে ঝিনুক ঘষছেন। তাকে দেখে মনে হচ্ছে কাজটা করে তিনি খুব মজা পাচ্ছেন।

মামা, কী করছ?

মঞ্জু। চোখ না তুলেই বললেন, ঝিনুকের ছুরি বানাচ্ছি। ঝিনুকের ছুরি হচ্ছে পৃথিবীর সবচে’ ধারালো ছুরি। ব্লেডের চেয়ে ধার।

ধারালো ছুরি দিয়ে কী করা হবে?

ছুরি বানানো শেষ হোক – তারপর দেখবি কী করা হবে।

লীলাবতী পাশে বসতে বসতে বলল, তোমার সঙ্গে কিছু কথা ছিল মামা— এখন কি বলা যাবে?

খুবই জরুরি।

তাহলে বলে ফেল।

ঝিনুকের ঘষাঘষি বন্ধ রাখো, তারপর বলি?

তোর যা বলার এই ঘষাঘষি শব্দের মধ্যেই বলতে হবে। আমি কাজ বন্ধ করব না। তোর এমন কোনো জরুরি কথা আমার সঙ্গে নেই যে কাজ বন্ধ করে

শুনতে হবে।

তুমি এইখানেই থেকে যাবে এমন পরিকল্পনা কি নিয়েছ?

না।

বাবা তোমাকে না-কি জমি দিয়েছেন?

হুঁ।

রোজ না-কি তুমি তোমার জমিতে বসে থাকো?

না। আমি আমার নিজের জমির দেখভাল করব এটাই কি স্বাভাবিক না?

মামা, তুমি কি বুঝতে পারছ বাবা চেষ্টা করছেন তোমাকে এখানে আটকে ফেলতে?

আমাকে আটকে ফেলে তার লাভ কী?

লীলাবতী শীতল গলায় বলল, বাবার আসল চেষ্টা আমাকে আটকানো। তোমাকে দিয়ে শুরু।

মঞ্জু কাজ বন্ধ করে লীলাবতীর দিকে তাকালেন। তার কাছে মনে হলো, এখানে এসে মেয়েটা আরো সুন্দর হয়ে গেছে। সৌন্দৰ্যও জায়গা-নির্ভর। যে মেয়েকে মরুভূমিতে সুন্দর লাগে সেই মেয়েকে পানির দেশে সুন্দর লাগবে না।

লীলাবতী বলল, বাবা অতি বুদ্ধিমান মানুষদের একজন। তিনি আমাকে এই অঞ্চলে আটকাবার জন্যে সুন্দর সুন্দর বুদ্ধি বের করছেন। তিনি তাঁর ছেলের বিয়ে দিলেন। তারপর সেই ছেলেকে তালাবদ্ধ করে রাখলেন। যাতে বাড়িতে বড় ধরনের ঝামেলা তৈরি হয়। আমি যেন বাড়ি ছেড়ে চলে যাবার কথা ভাবতে না পারি।

কোনো বাবা যদি তার মেয়েকে নিজের কাছে রাখতে চায় তাতে দোষ কী?

তাতে কোনো দোষ নেই, কিন্তু কৌশল খাটানোটা দোষ।

লীলা উঠে দাঁড়াল। মঞ্জু বললেন, আমার জন্যে চা পাঠিয়ে দে।

লীলা বলল, চা পাঠাচ্ছি। মামা তুমি তৈরি থেকে, আমি কিন্তু যেকোনোদিন একঘণ্টার নোটিশে রওনা হব।

মাসুদকে জেলখানা থেকে উদ্ধার করে তারপর তো যাবি?

উদ্ধারের ব্যবস্থা তার স্ত্রী করবে। পরী মেয়েটাও খুব বুদ্ধিমতী।। ও জানে কখন কী করতে হয়। তোমার দুই অ্যাসিসটেন্ট কোথায়? কই আর জই?

ওদের কাজে পাঠিয়েছি। বড় সাইজের ঝিনুক আনতে গেছে।

মামা, তুমি সুখে আছ।

আমি সুখে থাকলে তোর কোনো সমস্যা আছে?

না। সমস্যা নেই।

মঞ্জু বিরক্ত গলায় বললেন, সুখী মানুষ দেখতে তোর যদি খারাপ লাগে যা একজন অসুখী মানুষ দেখে যা। লিচুতলায় চলে যা, কুঁজা মাস্টার মুখ ভোঁতা করে বসে আছে। এখন মনে হয় মাথাও খারাপ হয়ে গেছে — বিড়বিড় করে নিজের সঙ্গে কথা বলে।
 
আনিস লিচু গাছে হেলান দিয়ে পা ছড়িয়ে বসেছিল। তার আবার জ্বর এসেছে। জুরের লক্ষণ সুবিধার না। হাত-পা অবশ হয়ে আসছে। মনের জোর দিয়ে নাকি অসুখ সারানো যায়— আনিস সেই চেষ্টা করছে। নিজেকে বোঝাচ্ছে— আমার কিছু হয় নি। আমি ভালো আছি। সামান্য গা ম্যাজম্যাজ করছে। এটা কোনো ব্যাপারই না। অসময়ে ঘুমানোর কারণেই এই গা ম্যাজম্যাজানি।

লীলা নিঃশব্দে আনিসের পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে। মঞ্জু মামার কথা সত্যি, মানুষটা নিজের মনে বিড়বিড় করছে। লীলা স্পষ্ট শুনেছে–লোকটা বলছে— অসময়ের ঘুম। অসময়ের ঘুম।

লীলা বলল, কেমন আছেন?

আনিস চমকে পিছনে ফিরল। তার সঙ্গে দুটি খাতা। সে দ্রুত চান্দরের নিচে খাতা দুটি টেনে নিল। পারলে নিজেও চাঁদরের নিচে ঢুকে যায় এমন অবস্থা। লীলার কাছে মনে হলো, এই মানুষটার কর্মকাণ্ড অস্বাভাবিক। তাকে দেখে সে এত চমকাবে কেন? শুধু মাত্র ভূতপ্ৰেত দেখলেই মানুষ এতটা চমকায়।

লীলা বলল, আমাকে চিনেছেন?

কেন চিনব না! আপনি লীলাবতী।

আপনার কি শরীর খারাপ? চোখ লাল হয়ে আছে। এইজন্যে জানতে চাইলাম।

জ্বর নিয়ে রোদে বসে আছেন কেন? ছায়ায় বসুন। বাঁ-দিকে ছায়া আছে।

আনিস সরে বসল। সঙ্গে সঙ্গেই তার শীত লাগতে লাগল। জ্বর মনে হয় ভালোই এসেছে।

লীলা বলল, গাছতলায় বসে না থেকে বিছানায় শুয়ে থাকুন। আমি ডাক্তার সাহেবকে খবর দেবার ব্যবস্থা করব। ডাক্তার এসে দেখে যাবে।

দরকার নেই।

দরকার নেই কেন?

লীলা একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। সে প্রশ্নের জবাব চাচ্ছে। আনিস কী জবাব দেবে বুঝতে পারছে না। মেয়েটার সঙ্গে যূথির কোনো মিল নেই। যূথি কখনো কোনো প্যাচ খেলানো প্রশ্ন করে না। প্রশ্ন করলেও জবাব শোনার অপেক্ষা করে না। তারপরেও এই মেয়েটাকে দেখলেই যূথির কথা মনে আসে। এই রহস্যের মানে কী!

লীলা বলল, আপনি তো বললেন না— কেন ডাক্তার দেখানোর দরকার নেই।

আনিস বলল, আমি নিজেই নিজের চিকিৎসা করছি। চিকিৎসার ফলাফল দেখতে চাই।

কী রকম চিকিৎসা?

মানসিক চিকিৎসা। অন্য একসময় আপনাকে বুঝিয়ে বলব।

অন্য সময় কেন? এখন বুঝিয়ে বলতে সমস্যা কী?

আনিস হতাশ গলায় বলল, এখন কথা বলতে ভালো লাগছে না।

লীলা বলল, আপনি আমাকে দেখেই চাঁদরের নিচে কী যেন লুকিয়েছেন। কী লুকিয়েছেন?

আনিস বলল, কিছু না।

লীলা বলল, আমি দেখলাম সবুজ মলাটের দুটা খাতা। খাতায় কী লেখা?

আনিস বলল, আপনাকে এখন বলব না। পরে কোনো একদিন বলব।

লীলা বলল, এখন বলতে সমস্যা কী?

আনিস বলল, এখন আমার কথা বলতে ভালো লাগছে না।

লীলা চলে যাচ্ছে। আনিসের মনে হলো, মেয়েটা রাগ করে চলে যাচ্ছে। এখন কথা বলতে ভালো লাগছে না–এ ধরনের কথা বলা ঠিক হয় নি। মেয়েরা এই ধরনের কথায় খুবই আহত হয়। সে একবার যূথিকে বলেছিল— যূথি, এখন আমি লিখছি। তুই পরে আয়। যূথি প্রায় দৌড়ে সামনে থেকে চলে গেল। ঘটনাটা ঘটেছিল। সকাল দশটার দিকে। সে সকাল দশটা থেকে রাত বারোটা পর্যন্ত দরজা বন্ধ করে কাদল। কাঁদতে কাঁদতে অসুখ বাঁধিয়ে ফেলল।
 

Users who are viewing this thread

Back
Top