What's new
Nirjonmela Desi Forum

Talk about the things that matter to you! Wanting to join the rest of our members? Feel free to sign up today and gain full access!

Collected লীলাবতী - উপন্যাস (1 Viewer)

আমি কন্যা লীলাবতী, ভাইয়ের বোন ভাগ্যবতী।

আমার কোনো ভাই নেই। একটা ভাই ছিল। সে মারা গেছে। এখনো কি আমি ভাগ্যবতী? মানুষ আলাদা আলাদা ভাগ্য নিয়ে আসে না। একজনের ভাগ্যের সঙ্গে আরেকজনের ভাগ্য জড়ানো থাকে। একজনের ভাগ্যে ধ্বস নামলে, পাশের জনের ভাগ্যেও লাগে। আচ্ছা, এইসব আমি কী লিখছি? আর কেনইবা লিখছি? কে পড়বে আমার এই লেখা!

কেউ না পড়ুক, আমি আমার ভাইয়ের বিষয়টা গুছিয়ে লিখতে চাই। আমার মন বলছে, খুব গুছিয়ে বিষয়টা লিখলেই আমার মন অনেক হালকা হয়ে যাবে। কিন্তু লিখবটা কী? আমি তো তাকে সেইভাবে জানি না। তার জানাজা পড়ানো হলো শহরবাড়ির সামনের মাঠে। জানাজায় মেয়েরা অংশ নিতে পারে না। জানাজার পুরো ব্যাপারটা আমি দেখলাম জানোলা দিয়ে। আমার পাশে পরীবানু ও দাঁড়িয়ে ছিল। একবার ভাবলাম তাকে বলি, তোমার দেখার দরকার নেই। তোমার মন খারাপ হবে। তারপরই মনে হলো, সে যে অবস্থায় আছে তারচে খারাপ হবার তো কিছু নেই।

তবে পরীবানু শক্ত মেয়ে। সে কাদছিল, কিন্তু চিৎকার করে বাড়ি মাথায় তুলছিল না। জানাজা প্রক্রিয়াটি সে দেখছিল যথেষ্ট আগ্রহ নিয়ে।

একটা নকশাদার খাটিয়ায় সাদা কাপড়ে মোড়ানো কফিন। তিনটা হ্যাজাক লাইট জ্বালানো হয়েছে। এর মধ্যে একটা নষ্ট। কিছুক্ষণ পর পর হ্যাজাকের সাদা আলো লাল হয়ে যাচ্ছে। খাটিয়ার চার মাথায় আগরবাতি জ্বলছে। আগরবাতির আলো জোনাকির মতো জ্বলছে নিভছে। বাতাস ছিল না বলে আগরবাতির ধোয়া সোজা উপরের দিকে উঠছে। চারদিকের গাঢ় অন্ধকারে সাদা ধোয়ার সুতা আকাশে মিশে যাচ্ছে, দেখতে খুবই সুন্দর লাগছে।

সারি বেঁধে সবাই দাঁড়িয়েছে। নামাজ শুরু হবার আগে বাবা বললেন, জানাজার নামাজের আগে মৃত ব্যক্তির সৎগুণ নিয়ে আলোচনা নবীর সুন্নত। নবীজি এই কাজটি করতেন। আপনারা আমার ছেলে সম্পর্কে ভালো কিছু যদি জানেন তাহলে কি একটু বলবেন?

সারি বেঁধে দাঁড়ানো লোকজন একে অন্যের দিকে তাকাচ্ছে। গুনগুন শব্দও হচ্ছে। কেউ এগিয়ে আসছে না। বাবা বললেন, মিথ্যা করে কিছু বলবেন না। অনেক সময় মৃত ব্যক্তির প্রতি সম্মান দেখানোর জন্যে মিথ্যা মিথ্যা ভালো ভালো কথা বলা হয়। দয়া করে কেউ মিথ্যাচার করবেন না।

কেউ এগিয়ে আসছে না। আমার খুবই রাগ লাগছে। আমি গুনে দেখেছি সর্বমোট একশ ষোলজন মানুষ আছে জানাজায়। এতজন মানুষের কেউ আমার ভাই সম্পর্কে একটা ভালো কথা বলবে না? কোনো সৎগুণই কি তার নাই? পরীবানু আমার কাঁধে হাত রেখেছে। সেই হাত থরথর করে কাঁপছে। পরীবানু। ভাঙা গলায় বলল, বুবু, কেউ কিছুই বলতেছে না কেন? কেন কেউ কিছু বলে না?

পরীবানুর ভাঙা গলা, তার শরীরের কাঁপুনি, আমার রাগ এবং দুঃখবোধ সব মিলিয়ে কিছু একটা হয়ে গেল— আমি জানালার পর্দা সরিয়ে উঁচু গলায় বললাম, আমি কিছু বলব। আমার গলার স্বর মনে হয় যথেষ্টই উঁচু ছিল। সবাই জানালার দিকে তাকাল। মওলানা সাহেবের ভুরু যে কুঁচকে উঠেছে তা আমি না দেখেও বুঝতে পারছিলাম। তিনি ফিসফিস করে বাবাকে কী যেন বললেন। খুব সম্ভবত তিনি বললেন– এইসব বিষয়ে মেয়েরা কিছু বলতে পারবে না। তারা থাকবে পর্দায়। মওলানা সাহেবের কথা না শোনা গেলেও বাবার কথা শোনা গেল। বাবা বললেন, মেয়েদের যদি কিছু বলার থাকে তারাও বলতে পারে। আমি তাতে কোনো দোষ দেখি না। মা তুমি বলো। পর্দার আড়াল থেকে বলো।

আমি কী বলব বুঝতে পারছি না। আমি তো মাসুদের বিষয়ে কিছুই জানি না। আমি তাকালাম পরীবানুর দিকে। পরীবানু বলল, বুবু বলেন— সে জীবনে কোনোদিন কোনো মিথ্যা কথা বলে নাই।

আমি নিচুগলায় পরীকে বললাম, কথাটা বোধহয় ঠিক না। তুমি ভেবে বলো, যেটা সত্যি সেটা বলো।

পরীবানু বলল, বুবু, আপনাকে ভুল বলেছি, সে মিথ্যা কথা বলতো। তার মতো নরম দিলের মানুষ তিন ভুবনে ছিল না, কোনোদিন হবেও না। আপনি এই কথাটা বলেন।

আমি বললাম, আমার ভাই ছিল অতি হৃদয়বান একজন মানুষ।

পরীবানু বলল, তার বিষয়ে আরো অনেক কিছু বলার আছে বুবু, এখন মনে আসতেছে না।

আমি বললাম, থাক আর দরকার নাই।
 
মাসুদের কবর হলো বাড়ির পেছনে জামগাছের তলায়। পাশাপাশি দুটা জামগাছ— একটা বড়, একটা ছোট। গাছতলায় কবর দেয়ার কারণ হলো— গাছপালা সবসময় আল্লাহর জিকির করে। সেই জিকিরের সোয়াব কবরবাসী পায়।

স্বামীর কবরের কাছে যাওয়া পরীবানুর জন্যে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হলো। সন্তানসম্ভবা স্ত্রীরা না-কি স্বামীর কবরের কাছে যেতে পারে না। এতে পেটের সন্তানের বিরাট ক্ষতি হয়।

আমি পরিবানুকে বললাম, তোমার যখন ইচ্ছা হবে তুমি কবরের কাছে যাবে। এত নিষেধ মানার কিছু নাই। তবে রাতে যদি কখনো যেতে ইচ্ছা করে একা যাবে না। আমাকে সঙ্গে নিয়ে যাবে।

পরী বানু বলল, একা যাব না কেন?

আমি বললাম, ভয় পেতে পারো।

পরীবানু বলল, ভয় পাব কেন? যে জীবিত অবস্থায় আমাকে ভালোবেসেছে। সে মৃত অবস্থায় আমাকে কেন ভয় দেখাবে?

আমি বললাম, তোমার যদি একা যেতে ইচ্ছা করে তুমি একা যেও। অসুবিধা নেই।

পরীবানু প্রতি রাতেই মাসুদের কবরের কাছে যেত। বেশির ভাগ সময় আমি থাকতাম সঙ্গে। এক রাতে একটা ঘটনা ঘটল। শহরবাড়ি থেকে কবরে যেতে হলে বাঁশঝাড়ের ভেতর দিয়ে যেতে হয়। বাঁশঝাড়ে ঢুকেছি। সেখান থেকে হঠাৎ কবরের দিকে চোখ গেল। দেখি একটা ছায়ামূর্তি কবরে হাঁটাহাঁটি করছে। ছায়ামূর্তি দেখতে অবিকল মাসুদের মতো। মাসুদ যেমন মাথা ঢেকে চাদর পরত ছায়ামূর্তির গায়ে সেরকম চাদর। আমি থমকে দাঁড়িয়ে গেলাম। পরীবানু অস্ফুট শব্দ করে আমার হাত ধরে ফেলল। তারপরই চাপা গলায় বলল, বুবু, কিছু দেখেছেন?

আমি বললাম, চল ফেরত যাই। পরীবানু বলল, আপনি বাড়িতে চলে যান। আমি যাব না। আমি তার কাছে যাব। এই দেখেন আপনার ভাই হাত ইশারায় ডাকতেছে।

পরীবানুর গলার স্বর গম্ভীর। সে যে কবরের কাছে যাবে তা তার গলার স্বরেই বোঝা যাচ্ছে। শেষপর্যন্ত দুজনে মিলেই গেলাম। কবরের কাছাকাছি যাবার আগেই ছায়ামূর্তি মিলিয়ে গেল।

সেই রাতেই এই ঘটনা বাবার কানে পৌছল। তিনি আমাকে ডেকে পাঠালেন। বাবা খাটে পা তুলে বসেছিলেন। তার সামনে হুক্কা। তিনি নল হাতে বসে আছেন। হুক্কা টানছেন না। আমি তার সামনে দাঁড়াতেই তিনি ইশারা করলেন বসতে। আমি তার পাশে বসলাম। বাবা আমার দিকে না তাকিয়েই বললেন– এইটা কি মাস জানো?

আমি বললাম, আশ্বিন মাস।

বাবা বললেন, আশ্বিন মাসে চাঁদের দশ তারিখ থেকে বিশ তারিখ গ্রামের মানুষ ভূত-প্ৰেত বেশি দেখে, এইটা জানো?

আমি বললাম, জানি না।

পাতার ফাঁকে এই জোছনা যখন আসে তখন মনে হয়। ভূত-প্ৰেত।

আমি বাবার কথা বুঝতে পারছিলাম না। তিনি প্রস্তাবনা শুরু করেছেন। মূল বক্তব্যে এক্ষুনি যাবেন, তার জন্যে অপেক্ষা করাই ভালো।

লীলা শোনো। জামগাছের পাতার ফাঁক দিয়ে আশ্বিন মাসের ১৩ তারিখে জোছনা নেমেছে। সেই জোছনায় ছায়া তৈরি হয়েছে। ছায়াটা পড়েছে কবরে। তোমরা সেই ছায়াটাকে মনে করেছ মাসুদ। মৃত মানুষ ফিরে আসে না। কায়া ধরেও আসে না, ছায়া ধরেও আসে না।

বাবার যুক্তি আমি সঙ্গে সঙ্গে মানলাম। এত পরিষ্কার চিন্তা গ্রামের মানুষ সাধারণত করে না। কোনো বিষয় নিয়ে চিন্তা করার অভ্যাস না থাকলে চিন্তার মতো পরিশ্রমের কাজ গ্রামের মানুষজন করে না। এই মানুষটা করেন। ভালোমতোই করেন।

লীলা।

জি।

যদি একজন কেউ ভূত দেখে ফেলে তখন অন্যরাও দেখা শুরু করে। ভূত দেখা কলেরা রোগের মতো। একজনের হলে তার আশেপাশে দশজনের হয়। কাজেই তোমরা ভূত দেখাদেখি নিয়ে আলোচনা করবে না।

জি আচ্ছা।

কাল সকালে আমি জামগাছ দুটা কাটায়ে ফেলব। কবরের আশেপাশে গাছ থাকার প্রয়োজন নাই।

মনে হয় তার কথা বলা শেষ হয়েছে। তিনি তামাক টানা শুরু করেছেন। আমি চলে যাবার জন্যে উঠে দাঁড়ালাম না, বসেই রইলাম। অতি নিঃসঙ্গ এই মানুষটার জন্যে মায়া লাগছে। তাঁর সঙ্গে কিছুক্ষণ কথা বলতে ইচ্ছে করছে। এত বড় ঘটনা ঘটে যাবার পরেও মানুষটার মানসিক শক্তি আমি মুগ্ধ হয়ে দেখছি। বড় ধরনের ধাক্কা তিনি খেয়েছেন। তার ছাপ আমি দেখতে পাচ্ছি। তিনি আগের মতো হেঁটে জঙ্গলা ভিটায় যেতে পারেন না। তাকে এখন লোকমান-সুলেমানের কাধে ভর দিয়ে যেতে হয়।

লীলা, তুমি কিছু বলতে চাও?

আমি বললাম, আপনি ভূত-প্ৰেত বিশ্বাস করেন না?

বাবা তামাক টানা বন্ধ করে আমার দিকে ফিরলেন।

আগে আমরা পাশাপাশি বসেছিলাম, এখন বসেছি মুখোমুখি।

বাবা বললেন, মানুষ মরে ভূতপ্রেত হয়। এইসব বিশ্বাস করি না, তবে অন্য কিছু আছে।

অন্য কিছুটা কী?

ভূত-প্ৰেত জগতের জিনিস। আমি একবার দেখা পেয়েছিলাম। তুমি কি ঘটনাটা শুনতে চাও?

শুনতে চাই।

তোমার মাকে বিবাহের রাতেই ঘটনাটা বলেছিলাম। সে অত্যধিক ভয় পেয়েছিল।

আমি সহজে ভয় পাই না।

বাবা ছোট্ট করে নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, তুমি আমার মতো হয়েছ। আমার মধ্যে ভয়-ডর কম। সব মানুষের মৃত্যুভয় থাকে। আমার সেই ভয়ও নাই। মৃত্যু যখন হবার হবে। তার ভয়ে অস্থির হবার কিছু নাই।

আপনি ঘটনাটা বলেন।
 
আমার যৌবনকালের ঘটনা। বয়স কুড়ি-একুশ। তারচেয়ে কিছু কমও হতে পারে। তখন হলো টাইফয়েড। বাংলায় বলে সান্নিপাতিক জুর। তখন টাইফয়েড রোগের কোনো চিকিৎসা ছিল না। এই রোগ হওয়া মানেই মৃত্যু। আমার মৃত্যু হলো না, একত্রিশ দিনের মাথায় জ্বর ছাড়ল। শরীর অতি দুর্বল। দুই পা হাঁটলে মাথা ঘুরে। কিছু খেতে পারি না। হজম হয় না। দুইবেলা জাউ ভাত আর শিং মাছের ঝোল খাই। আমার দাদি তখন আমার স্বাস্থ্যু ঠিক করার দায়িত্ব নিলেন। তিনি হুকুম দিলেন, প্রতিদিন যেন আমাকে নদীর পাড়ে হাওয়া খেতে নিয়ে যাওয়া হয়। নদীর টাটকা হাওয়া রুচিবর্ধক। চারজন বেহাৱা পালকিতে করে আমাকে নদীর পাড়ে নিয়ে যায়। সেখানে পাটি পেতে দিয়ে দূরে গিয়ে গাজা ভাং খায়। সন্ধ্যা মিলাবার পর আমাকে নিয়ে ফিরে আসে। আমি নদীর দিকে তাকিয়ে শীতল পাটিতে শুয়ে থাকি।

জায়গাটা অতি নির্জন। আশেপাশে কোনো লোকবসতি নাই। নদীর ঐ পাশে ঘন বন। দিনের বেলায়ও শিয়াল ডাকে।

একদিনের ঘটনা। সন্ধ্যা হয়েছে। দিনের আলো সামান্য আছে। আমি শুয়ে আছি। বেহাৱা চারজন দূরে কোথাও গেছে। গাজ-টাজা খাচ্ছে হয়তো। আমার দৃষ্টি নদীর পানির দিকে। হঠাৎ দেখি পানিতে ঘূর্ণির মতো উঠেছে। এটা এমন কোনো বিশেষ ঘটনা না। নদীর পানিতে প্রায়ই ঘূর্ণি ওঠে।

হঠাৎ আমার গা ঝাড়া দিয়ে উঠল। আমি শোয়া থেকে উঠে বসলাম। দেখি নদীর ঘূর্ণি থেকে কে যেন মাথা ভাসায়ে দিয়েছে। প্রথমে চুল দেখলাম, তারপর মাথা। সেই মাথা পুরাপুরি মানুষের মাথা না। চোখ নাই। যাদের চোখ থাকে না তাদের চোখে কোটর থাকে। এর তাও নাই। চোখের জায়গায় মুখের চামড়ার মতো চামড়া। বাকি সব ঠিক আছে। নাক আছে, মুখ আছে, কান আছে। জিনিসটা বুক পর্যন্ত পানির উপর উঠল। তারপর কথা বলল। আমার দিকে আঙুল দেখিয়ে বলল— এই, মন দিয়ে শোন। পিতলের একটা ঘড়া মাটিতে পোতা আছে। তোকে দিলাম। তুই ভোগদখল কর। ঘড়াটা কই আছে নজর করে দেখ। তাকা আমার আঙুলের দিকে।

এই বলেই সে আমার দিক থেকে আঙুল সরিয়ে নদীর পাড়ের একটা অংশ আঙুল দিয়ে দেখাল। যেভাবে সে পানি থেকে আস্তে আস্তে উঠেছিল সেইভাবেই আস্তে আস্তে পানিতে ড়ুবে গেল। সারাক্ষণই আঙুল নদীর পাড়ের দিকে ধরে থাকল। আমি অজ্ঞান হয়ে পাটিতে পড়ে গেলাম। বেহারারা অজ্ঞান অবস্থাতেই আমাকে বাড়িতে নিয়ে গেল। আমার জ্ঞান ফিরে চার ঘণ্টা পরে। তখন আমার সারা শরীর দিয়ে বিজল বের হচ্ছে। বিজল চিন? বিজল হলো তৈলাক্ত জিনিস।

বাবা থামলেন। এখন তিনি আর আমার দিকে তাকাচ্ছেন না। তিনি আবারো মুখ ঘুরে বসেছেন। আমার সঙ্গে কথাবার্তা শেষ হয়েছে এরকম ভাব। আমি বললাম, আপনি তখন খুব অসুস্থ ছিলেন। শীতল পাটিতে শুয়ে থাকলেন। উঠে বসার মতো সামর্থ্যও ছিল না। আমার ধারণা। আপনি ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। ঘুমের মধ্যে স্বপ্ন দেখেছেন। স্বপ্নটা আপনার কাছে সত্যি মনে হয়েছে। মাঝে মাঝে অনেক স্বপ্ন আমাদের কাছে সত্যি মনে হয়।

বাবা বললেন, তোমার কথার মধ্যে যুক্তি আছে। যুক্তির কথা আমার পছন্দ।

আমি বললাম, অন্ধ মানুষটা আপনাকে যে জায়গাটা দেখিয়েছিল সেই জায়গাটার কি আপনি খোঁজ করেছিলেন?

বাবা শান্ত গলায় বললেন, হ্যাঁ। পরের দিনই সেখানে গিয়েছি।

কিছু পান নাই?

বাবা শান্ত গলায় বললেন, খুঁড়াখুড়ি করি নাই।

কেন করেন নাই? আপনার কৌতূহল হয় নাই?

কৌতূহল হয়েছে, কিন্তু ভূত-প্রেতের কাছ থেকে কিছু নিতে ইচ্ছা করে নাই। তবে সেই জায়গা আমি পরে কিনে নিয়েছি। আমি মাঝে মাঝেই সন্ধ্যার দিকে ঐ জায়গায় বসে থাকি।

অন্ধ লোকটার দেখা পাওয়ার জন্যে?

হ্যাঁ, তবে তাকে লোক বলবে না। সে মানুষ না, অন্য কিছু।

আবার তার দেখা পেতে চান কেন?

আমি তাকে জিজ্ঞেস করব, সে কে?

সে কে এটা জেনে আপনার লাভ কী?

কোনো লাভ নাই। কৌতূহল মিটানো। মানুষ কৌতূহল মিটানোর জন্যে অনেক কিছু করে। শুধু যে মানুষ করে তা-না। পশুপাখি কীটপতঙ্গ সবাই কৌতূহল মিটাতে চায়। তুমি যদি সন্ধ্যাবেলায় একটা কুপি জ্বালাও, দেখবে অনেক পোকা আগুনে এসে পড়ে। তাদের কৌতূহল হয় আগুন জিনিসটা কী জানার। জানতে এসে মারা পড়ে।

আপনি আমাকে একদিন আপনার সঙ্গে নিয়ে যাবেন? জায়গাটা দেখব।

অবশ্যই নিয়ে যাব। কবে যাবে বলো। কাল যেতে চাও?

হ্যাঁ যাব।
 
আমি এখন আমার বাবার প্রসঙ্গে কিছু কথা বলি। তিনি শুরুতে আমার কাছে ছিলেন অতি দুষ্ট্র একজন মানুষ। যে তাঁর স্ত্রী-কন্যাকে দূরে ঠেলে দেয়— আরেকটি বিবাহ করে। সুখে যে ঘর-সংসার করে তা-না। স্ত্রীকে তালা আটকে বন্দি করে রাখে। তাঁর সঙ্গে পরিচয় হবার পর মনে হলো— ভয়াবহ দুষ্ট্র মানুষদের একজন সম্ভবত তিনি না। ক্ষমতাধর মানুষদের দুর্বলতা তার মধ্যে আছে। বদরাগ, অহঙ্কার–এইসব বিষয় তাঁর কাছে চরিত্রের অহঙ্কার। দুর্বলতা না।

এখন মনে হচ্ছে মানুষটা ভাবুক প্রকৃতির। শুধু যে ভাবুক তা-না। তার মধ্যে চিন্তা করার দুর্লভ ক্ষমতা আছে। মানুষটির ভালোবাসার ক্ষমতাও প্রবল। তার ভালোবাসা আড়াল করার চেষ্টাটাও চোখে পড়ার মতো— আমি ভালোবাসব কিন্তু কেউ যেন তা বুঝতে না পারে।

এই মানুষটির মধ্যে যথেষ্ট পরিমাণ রহস্যময়তাও আছে। তাঁর মাথায় ঘুরছে। আশ্রম। সেই আশ্রমও তার কল্পনার আশ্রম। বিশাল একটা এলাকা থাকবে। সেই এলাকায় পশুপাখি নিজের মতো করে ঘুরবে কিন্তু কোনো মানুষ থাকবে না। মানুষ বলতে তিনি একা থাকবেন।

বাবা তার আশ্রম তৈরি করা শুরু করেছেন। আমি একদিন দেখে এসেছি। দুনিয়ার পাখি সেখানে। পাখি কেনইবা আসবে না? তাদেরকে ধান, কুড়া, সরিষাদানা আর কী কী যেন খেতে দেয়া হয়। অনেক গাছে দেখলাম মাটির কলসি উল্টা করে বাধা। যে সব পাখি বাসা বাধতে জানে না। তাদের জন্যেই এই ব্যবস্থা।

এই বিষয়টিকে কি আমি পাগলামি বলব? কিছু পাগলামি সব মানুষের মধ্যেই আছে। তবে বেশির ভাগ মানুষ এইসব পাগলামি প্রশ্ৰয় দেয় না। বাবা দেন। পাগলামি প্রশ্ৰয় দেয়ার ক্ষমতা আছে বলেই হয়তো দেন।

বাবার প্রসঙ্গে একটা অদ্ভুত গল্প এখন বলব। এই গল্পে আমার বিশেষ একটা ভূমিকা আছে। ঘটনাটা আমি কাছ থেকে দেখেছি।

নান্দিপুর থেকে একবার বাবার কাছে এক লোক এলো তার ছেলেকে নিয়ে। নান্দিপুর আমাদের এখান থেকে প্রায় ছয় ক্রোশ অর্থাৎ বার মাইল দূর। ছেলেটার বয়স দশ-এগারো। খুবই অসুস্থ। কয়েক বছর ধরে না-কি সে কিছুই খেতে পারে না। হজম হয় না। অতি সহজপাচ্য ভাতের মাড়, চিড়ার ক্যাথ এইসব তাকে খাওয়ানো হয়। এটাও সে হজম করতে পারে না। ছেলেটা রোগা কাঠি। দেখে মনে হয় পাঁচ-ছয় বছর বয়স। তার বাবা এই দীর্ঘ পথ তাকে ঘাড়ে করে এনেছে। ছেলের হাঁটারও ক্ষমতা নেই।

বাবা বললেন, আমার কাছে আসছ কী জন্যে? চিকিৎসার খরচা চাও?

ছেলের বাবা বলল, না। চিকিৎসার খরচার জন্যে আপনার কাছে আসি নাই। আপনি তারে একটু উতার (পানি পড়া) দেন।

আমি তারে উত্তর দিব? আমি কি পীর-ফকির?

আপনের দেওয়া উতার খাইলে তার রোগ সারব।

তোমাকে কে বলেছে?

লোকটা জবাব দিল না। মাথা গোজ করে ছেলের হাত ধরে দাঁড়িয়ে রইল। বাবা লোকমান চাচাকে বললেন, এদেরকে যেন বাড়ির সীমানা থেকে বের করে দেয়া হয়।

তাই করা হলো। লোকটা কিন্তু গেল না। বাড়ির সীমানার বাইরে একটা আমগাছের নিচে ছেলেকে নিয়ে বসে রইল। শীতের রাত। তারা কাপড়চোপড় নিয়ে আসে নি। লোকটা শুকনো লতাপাতা জোগাড় করে আগুন ধরাল। আগুনের পাশে ছেলেকে নিয়ে জবুথবু হয়ে বসে রইল। অদ্ভুত এক দৃশ্য! রাত দশটার দিকে আমি বাবাকে গিয়ে বললাম, পানি পড়া চাচ্ছে, দিয়ে দেন। ছেলেকে নিয়ে চলে যাক।

বাবা বললেন, যে জিনিস আমি জানি না সেটা আমি কেন করব?

আমি বললাম, তাদের মনের শান্তির জন্যে করবেন।

বাবা আমার দিকে তাকিয়ে কঠিন গলায় বললেন, অন্যের শান্তি নিয়া আমি মাথা ঘামাই না। তুমি এই বিষয়ে আমার সঙ্গে দরবার করবা না।

এরা গাছতলায় বসে আছে।

থাকুক।
 
রাত এগারোটার দিকে বাবা বললেন, ঝাল মুরগির সালুন রান্না করো। পোলাও রান্না করো। ছেলেকে ডাক। এই ছেলে দিনের পর দিন বিস্বাদ জাউ ভাত খায়। পোলাউ দেখে মুখে রুচি আসবে। আরাম করে খাবে। তাতেই কাজ হবার কথা। দেখা যাক।

তাদেরকে যত্ন করে খাবার দেয়া হলো। বড় বড় জামবাটি ভর্তি মাংস। পোলাও-এর ডিসে ধোয়া উঠা কালিজিরা চালের সুগন্ধি পোলাও।

ছেলেটার নাম নসু। মিয়া। সে চোখ বড় বড় খাবারের দিকে তাকিয়ে থাকল। বাবা বললেন, একে এলাচি লেবু দাও। পিয়াজ, কাঁচামরিচ দাও।

নসু মিয়া ভয়ে ভয়ে তার বাবার দিকে তাকাল। তার বাবা আগ্রহের সঙ্গে বলল, খাও গো বাপাধন। উনি যখন খেতে বলেছেন খ্যাও। বমি যদি হয়— হইব। নিশ্চিন্ত মনে খাও।

নসু ভরপেট খেল। তার কোনো সমস্যাই হলো না। সকালবেলা ডিমভুনা দিয়ে খিচুড়ি খেয়ে বাবার হাত ধরে বাড়ি রওনা হয়ে গেল।

ঘটনাটার মধ্যে কোনো আধ্যাত্মিক বিষয় নেই। কিন্তু পিতা এবং পুত্ৰ বিষয়টিকে ফকিরি ঘটনা হিসেবে ধরেছে, এতে কোনো সন্দেহ নেই। এরকম মনে করাই স্বাভাবিক। মানুষ অলৌকিকত্বে বিশ্বাস করতে পছন্দ করে।

আমি নিজেও তো করি। আমার মা রমিলা যা বলেন বিশ্বাস করি। (সৎ মা না বলে মা বললাম। উনাকে আমার মা ভাবতেই ভালো লাগে) মাসুদের মৃত্যুর পর উনি খুবই চুপচাপ হয়ে গেছেন। সারাদিন বিছানার এক কোনায় গুটিসুটি মেরে বসে থাকেন। তবে সন্ধ্যার পর তার মধ্যে এক ধরনের ছটফটানি দেখা যায়। তিনি ঘরে বাতি দেবার জন্যে হৈচৈ শুরু করেন। চাপা গলায় তিনি বলতে থাকেন–বাতি দেও! সব ঘরে বাতি দেও। কোনো ঘর যেন বাকি না থাকে।

আমি তাঁকে একটা টর্চ লাইট কিনে দিয়েছি। পাঁচ ব্যাটারির টর্চ লাইট। টর্চ লাইটটা তিনি খুব পছন্দ করেছেন। চাপা গলায় বলেছেন, ভালো করেছ মা। অন্ধকারে ভয় লাগে।

কিসের ভয়?

আছে, বিষয় আছে। তোমার সব বিষয় জানার প্রয়োজন নাই। সব কিছু সবের জন্যে না।

আমার এই অপ্রকৃতস্ত মা পরীবানু বিষয়ে একটা ভবিষ্যতবাণী করেছেন। আমি মনেপ্ৰাণে তার কথা বিশ্বাস করছি। তিনি বলেছেন– এই মেয়েটার যমজ সন্তান হবে। একটা ছেলে একটা মেয়ে। দুই সন্তানসহ সে আবার এক স্বামীর সংসার করবে। সেই স্বামীর মতো ভালো মানুষ ত্রিভুবনে নাই। মেয়েটার জীবন অতি সুখে কাটবে।

আমি তাঁর কথা বিশ্বাস করি। মানুষের বিশ্বাস যুক্তি মানে না। আমার বিশ্বাসের পিছনেও কোনো যুক্তি নেই। যুক্তি দিয়ে হবেই বা কী? আমাদের চারপাশের যে জগৎ সেই জগৎ কতটা যুক্তিনির্ভর। এখন আমার ভাবতে ভালো লাগে, কেউ একজন আমাদের নিয়ন্ত্রণ করছে। কঠিন নিয়ন্ত্রণ। যিনি নিয়ন্ত্রণ করছেন তার কাছেই সবকিছু সমৰ্পণ করা ভালো না? কী হবে চিন্তা-ভাবনা করে?

জোছনা রাতে আমি প্রায়ই একা একা মাসুদের কবরের কাছে যাই। চুপচাপ বসে থাকি। আমার ভালো লাগে। আমাকে ঢাকায় ফিরে যেতে হবে। পড়াশোনা শেষ করতে হবে–এইসব নিয়ে এখন আর মাথা ঘামাই না।

একটা কথা বলতে ভুলে গেছি, আমার বিএ পরীক্ষার রেজাল্ট হয়েছে। রেজাল্টের খবরে বাবা আরো একবার বাঁশগাছের মাথায় হারিকেন টানিয়েছেন। দূর-দূরান্ত থেকে মানুষ হারিকেন দেখেছে। তারা জানতে এসেছে ঘটনা কী। তাদের প্রত্যেককেই বাবা বলেছেন–আমার মেয়ে পেতলের ঘাড়া ভর্তি সোনার মোহর পেয়েছে। বড় ভাগ্যবতী আমার এই মেয়ে।
 
শ্রাবণ মাস।

ভোমরা নদী ফুলে-ফোঁপে উঠেছে। শহরবাড়ির সামনের বিস্তৃত মাঠ জলমগ্ন। পানি যেভাবে বাড়ছে তাতে মনে হয় শহরবাড়ির উঠানে পানি চলে আসবে। পাঁচ-ছয় বছর পর পর এরকম হয়, শহরবাড়ির উঠানে পানি চলে আসে। পানিতে জোয়ার-ভাটার টান পর্যন্ত হয়।

মঞ্জু অত্যন্ত আনন্দিত। তাঁর প্রধান কাজ গামবুট পরে পানিতে হাঁটাহাঁটি। সে নিজে নেত্রকোনা শহর থেকে গামবুট কিনে এনেছে। রাতে সে শহরবাড়িতে ঘুমায় না। পানশি নৌকায় ঘুমায়। পানশি নৌকা উত্তরের ঘাটে বাধা থাকে। নৌকার ছাঁইয়ের ভেতর ডাবল তোষকের বিছানা। তোষকের উপর সুনামগঞ্জের শীতলপাটি। কোলবালিশ। এলাহি ব্যবস্থা। মঞ্জুর রান্নবান্না নৌকার ভেতরই হয়। রান্না করে নিরঞ্জন। বন্দুও উঠে এসেছে নৌকায়। তার কােজ নৌকার গলুইয়ে ছিপ ফেলে বসে থাকা। এই কাজটা সে গভীর আগ্রহ এবং আনন্দের সঙ্গে করে। তাকে দেখে মনে হয়, এতদিনে সে মনের মতো একটা কাজ পেয়েছে। ফাৎনার দিকে তাকিয়ে মঞ্জু নামের মানুষটার সঙ্গে গল্প করতে তার বড় ভালো লাগে। সব গল্পই সে সাধারণভাবে শুরু করে, শেষ করে ভূত-প্রেতে। মঞ্জুকে কিছুদিন হলো সে মামা ডাকা শুরু করেছে।

মামা, পানি কেমন বাড়তাছে দেখছেন?

হুঁ।

শহরবাড়ির ভিতরে যদি পানি না। ঢুকে, আমি আমার দুই কান কাঁইট্টা কুত্তরে খাওয়াইয়া দিব। এইটা আমার ওয়াদা। আপনেরে সাক্ষি মাইন্যা কথাটা বললাম। ইয়াদ রাইখেন।

ইয়াদ রাখব।

আপনের ঘটনাটা কী বলেন দেখি, নিজ দেশ গ্রামে আর ফিরবেন না?

ফিরব না কেন? অবশ্যই ফিরব। এদের একের পর এক ঝামেলা যাচ্ছে, এখন যাই কীভাবে? পরীবানুর সন্তান হোক তারপরে বিদায়।

আপনারে একটা কথা বলি মামা?

বলো।

আপনে যদি চইল্যা যান। আপনার সাথে আমিও যাব।

তুমি চলে গেলে এখানে চলবে কীভাবে?

না চললে নাই। আমি এই বাড়ির কিনা গোলাম না। আমার যেখানে ইচ্ছা আমি যাব। আমারে কিন্তু সাথে নিতে হবে।

আচ্ছা দেখা যাবে।

দেখা যাওয়া যাওয়ির কিছু নাই মামা। আমি যাবই।

মঞ্জু দেশের বাড়ি চলে গেলে তাঁর সঙ্গে বদু ছাড়াও আরো একজন যাবার আগ্রহ প্ৰকাশ করেছে। তার নাম জাইতরী। তবে সে মঞ্জুকে বড়পীর সাহেবের নামে কসম কাটিয়েছে কথাটা কাউকে বলা যাবে না। কথাটা গোপন রাখতে হবে।
 
আজ মঞ্জুর ব্যস্ততার সীমা নেই। সে মূল বাড়ির সামনে দুপুর থেকেই হাঁটাহাঁটি করছে। পরীবানুর প্রসব বেদনা উঠেছে আজ ভোরবেলায়। যে-কোনো সময় সন্তান হতে পারে। উল্লাপাড়া থেকে বিখ্যাত ধাই রুসামের মাকে আনা হয়েছে। সে ঘোষণা করেছে, কন্যার পেটে সন্তান দুইটা। অঘটন ঘটতে পারে। জোড়া মোরগ যেন ছদগা দেওয়া হয়। ছদগার মোরগ হতে হবে। ধবধবে সাদা। সাদা মোরাগের সন্ধানে লোক গেছে।

লীলা সতীশ ডাক্তাকে খবর দিয়ে আনিয়েছে। পুরুষ ডাক্তারের এখানে কিছুই করার নেই। আঁতুড়ঘরে কোনো পুরুষ মানুষই ঢুকতে পারে না। তারপরেও লীলা তাকে কেন আনিয়ে রেখেছে সে-ই জানে। সতীশ ডাক্তার বাংলাঘরে বসে পান-তামাক খাচ্ছেন।

সিদ্দিকুর রহমান আশেপাশে নেই। তিনি লোকমান-সুলেমানকে নিয়ে জঙ্গলে গেছেন। সেখানে পানি উঠেছে। বেশির ভাগ জায়গাই ড়ুবে গেছে। পানির উপর মাথা ভাসিয়েছে কচুগাছ। কচুগাছে ফুল ফুটেছে। সেই ফুলের গন্ধ নেশা ধরা। ফুলগুলি দেখতেও সুন্দর, ধবধবে সাদা। তিনি হাত ইশারায় লোকমানকে ডাকলেন। লোকমান-সুলেমান দুই ভাই-ই ছুটে এলো।

লোকমান!

জি চাচাজি।

একটা ব্যাপার লক্ষ করেছ? জংলি ফুলের গন্ধ আর বাগানের ফুলের গন্ধ আলাদা। সব জংলি, ফুলের গন্ধে নেশা নেশা ভাব হয়।

লোকমান কিছু বলল না। সিদ্দিকুর রহমান আগ্রহ নিয়ে বললেন, আমি আরেকটা জিনিস লক্ষ করেছি, জংলি ফুলের রঙ হয় সাদা।

এই বিষয়ে লোকমানের কিছু বলার ছিল। সে লাল-হলুদ অনেক রঙের ফুলাই জঙ্গলে ফুটতে দেখেছে। এই জঙ্গলেই কয়েকটা জবা গাছ আছে। হাতের থাবার মতো বড় টকটকে লাল রঙের ফুল ফোটে। এই বিষয় নিয়ে চাচাজির সঙ্গে বাহাস করা তার পক্ষে সম্ভব না।

লোকমান!

জি চাচাজি।

জঙ্গলে পানি ঢুকেছে। হাঁটাচলা করা মুশকিল। আমার বসার ব্যবস্থা করো। একটা চৌকি এনে কোথাও পাতো। চৌকিতে বসে থাকব।

জি আচ্ছা।

জি আচ্ছ না। এখনই নিয়ে আসো। দুই ভাই চলে যাও।

আপনি একা থাকবেন?

একা থাকব কী জন্যে? আমার চারদিকে গাছপালা। এরাও আমার সঙ্গে আছে। তোমরা দাড়ায়ে থেকে না, চলে যাও।

লোকমান কিছু বলছে না, মাথা চুলকাচ্ছে। সুলেমান সাহস করে বলল, চাচাজি, আপনের ঘরে যাওয়া দরকার।

কেন?

মাসুদ ভাইজানের স্ত্রীর সন্তান হবে। ধাই বলেছে অবস্থা ভালো না।

আমি সেখানে গিয়ে কি কিছু করতে পারব? পারব না। মেয়েদের সন্তান প্রসবের বিষয়ে পুরুষদের কিছু করার নাই। তাছাড়া আমার বড় মেয়ে আছে। যা ব্যবস্থা নেবার সে নিবে। নিবে না সুলেমান?

জি নিবেন।

তোমরা চলে যাও। বড় দেখে চৌকি আনবা। চৌকির পায়ার নিচে ইট দিয়া চৌকি উঁচু করবা।

লোকমান-সুলেমান চলে গেছে। আকাশে মেঘ করেছে। ফোটা ফোঁটা বৃষ্টি পড়তে শুরু করেছে। সিদ্দিকুর রহমান চাপা গলায় বললেন, এই তোমরা আছ কেমন?

প্রশ্নটা গাছপালার উদ্দেশে। প্রশ্নটা করেই তার মনে হলো, চারপাশের বৃক্ষরাজি তাঁর প্রশ্ন বুঝতে পারছে। তারা প্রশ্নের উত্তর দিতে চেষ্টা করছে। উত্তর দেবার কৌশল জানা নেই বলে উত্তর দিতে পারছে না।

সিদ্দিকুর রহমান চোখ বন্ধ করে আবারো বললেন— তোমরা কেমন আছ?



মাগরেবের আজানের পর পর দাই রুসামের মা লীলাবতীর হাত ধরে বলল, মা গো, সন্তান প্রসব হবে না। একটা সন্তান উল্টা হইয়া নিচে নামছে আরেকটা নামতে পারতেছে না। আমার করনের কিছু নাই। আমারে বিদায় দেও।

লীলা হতভম্ব হয়ে বলল, কিছুই করার নাই?

রুসমের মা বলল, কিছুই করার নাই। বিষয়টা এখন ডাক্তার কবিরাজের হাতে নাই–আল্লাহপাকের হাতে। সদর হাসপাতালে নিয়া দেখতে পারো। শুনেছি সেইখানে পেট কাইট্টা বাচ্চা বাইর করে।

লীলা বলল, সদর হাসপাতাল তো অনেক দূরে, নেত্রকোনা। এত দূর নেয়ার সময় কি আছে?

নেত্রকোনা যাইতে সারা রাইত নাও বাইতে হবে। অত সময় নাই।


সিদ্দিকুর রহমানের জন্যে জঙ্গলের মাঝামাঝি জায়গায় খাট পাতা হয়েছে। তিনি মাগরেবের নামাজ শেষ করে খাটে পাতা জায়নামাজে বসেছেন, তখন খবরটা শুনলেন। সিদ্দিকুর রহমান শান্ত গলায় বললেন, আমার মেয়ে কি কোনো ব্যবস্থা নিয়েছে?

লোকমান বলল, উনি নৌকা নিয়া এক্ষণ রওনা দিবেন বলে বলেছেন।

তোমরা দুই ভাই সঙ্গে যাও। ঝড়ের অগ্ৰে যেন নাও যায়।

আপনে বাড়িতে চলেন।

সিদ্দিকুর রহমান বললেন, আমি এইখানেই থাকব। আমার কথা মাথা থাইক্যা দূর করো— তোমাদের যা করতে বলছি করো।
 
প্ৰবল বর্ষণ শুরু হয়েছে। নৌকা পড়েছে হাওরে। বিখ্যাত শনির হাওর। সামান্য বাতাস দিলেই বিশাল ঢেউ উঠছে। নৌকা টালমাটাল করছে। মঞ্জু, নৌকার গলুইয়ে বসে ভিজছে। ছাঁইয়ের ভেতর থেকে একেকবার কাতরানির শব্দ আসছে আর মঞ্জুর শরীর কেঁপে উঠছে। পরীবানু নামের মেয়েটির সঙ্গে তার কোনোদিন কোনো কথাও হয় নাই–অথচ মেয়েটার কষ্টে তার বুক ভেঙে যাচ্ছে। সে কিছুক্ষণ পরপর আল্লাহর কাছে দোয়া করছে, হে আল্লাহপাক, একজনের জীবনের বিনিময়ে অন্য একজনের জীবন তুমি দিতে পারো। সম্রাট বাবর তার পুত্র হুমায়ুনের জন্যে নিজের জীবন দিয়েছিলেন। আমি পরীবানু মেয়েটার কেউ না। আমার জীবনের বিনিময়ে হলেও দুঃখী মেয়েটার জীবন তুমি রক্ষা করো আল্লাহপাক।

নৌকা নিয়ে সামনে এগুনো যাচ্ছে না। প্ৰবল বাতাস সামনের দিক থেকে আসছে। বৃষ্টি কমে এসেছে, কিন্তু বাতাসের প্রবল বেগ।

ছাইয়ের দুই মুখ শাড়ির পর্দা দিয়ে ঢাকা। বৃষ্টিতে শাড়ি ভিজে ভারী হয়ে আছে। তারপরেও বাতাসে দুলছে। ছই থেকে একটা হারিকেন ঝুলানো হয়েছে। বাতাসে হারিকেন দুলছে। পরীবানুর গা চাদর দিয়ে ঢাকা। তার ফর্সা রক্তশূন্য মুখ চাঁদরের ভেতর থেকে বের হয়ে আছে। লীলাবতী বসেছে পরীর মাথার কাছে। সে পরীর হাত ধরে আছে। সেই হাত থারথার করে কাঁপছে। পরীবানু। বলল, বুবু, আমার মৃত্যু ঘনাইছে ঠিক না?

লীলা কিছু বলল না। সে একমনে দোয়া ইউনুস পড়ছে— লাইলাহা ইল্লা আনতা সোবাহানাকা ইন্নি কুনতু মিনাজজুয়ালেমিনা। সে দোয়া ঠিকমতো পড়তেও পারছে না। তার কাছে মনে হচ্ছে, কোথাও কোনো গণ্ডগোল হচ্ছে।

বুবু। ও বুবু।

দুইটা সন্তানই কি মারা যাবে? কেউ বাঁচবে না?



শেষরাতে রমিলা খুব হৈচৈ করতে লাগলেন। তিনি তার হাতের টর্চ দিয়ে জানালার শিকে বাড়ি দিচ্ছেন। গোঙানির মতো শব্দ করছেন। সিদ্দিকুর রহমান রমিলার ঘরের জানালার কাছে এসে দাড়ালেন। রমিলা বললেন, আমারে গরম পানি দিতে বলেন, নতুন সাবান দিতে বলেন, নয়া শাড়ি দিতে বলেন। আমি সিনান করব। আল্লাহপাকের দরবারে শুকরানা নামাজ পাঠাব। আপনার পুত্ৰ মাসুদের দুইটা সন্তান হয়েছে। দুইটাই পুত্ৰ সন্তান। তারা ভালো আছে। সন্তানদের মাতাও ভালো আছেন। বলেন, আলহামদুলিল্লাহ।

সিদ্দিকুর রহমান বললেন, আলহামদুলিল্লাহ।

তিনি একবারও জিজ্ঞেস করলেন না, রমিলা, এই সংবাদ কোথায় পেয়েছে? কীভাবে পেয়েছে?



মঞ্জু বিরাট দুশ্চিন্তার মধ্যে পড়ে গেছে। দুটা পুত্ৰ সন্তান হয়েছে। এখন আযান কি একবার দেয়া হবে, না দুইবার? কেউ তাকে কিছু বলতেও পারছে না। তারা এখনো নৌকায়। হাসপাতালে পৌঁছাতে দেরি আছে। পরীবানুর সন্তান নৌকাতেই হয়েছে এবং ভালোমতোই হয়েছে। তার জ্ঞান আছে। সে জড়ানো গলায় কিছু কথাও বলছে। দুটি বাচ্চাকেই মায়ের বুকে শুইয়ে দেয়া হয়েছে। বাচ্চা দুটির গলায় বিপুল শক্তি। তারা ক্রমাগত চিৎকার করে যাচ্ছে।

মঞ্জুর পাশে সতীশ ডাক্তার বসে আছেন। শেষ মুহুর্তে সন্তান প্রসবের কাজ তিনিই করিয়েছেন। মঞ্জু বলল, ডাক্তার সাহেব, আযান একবার দিব না। দুইবার? কিছু একটা বলেন।

সতীশ ডাক্তার বললেন, আপনাদের ধর্মের বিষয়ে তো আমি কিছু জানি না।

আপনার বিবেচনায় কী বলে?

আমার বিবেচনা বলে দুইবার। সন্তান যখন দুইটা।

মঞ্জু বলল, আমি এই দুই ছেলের নাম রাখলাম। প্ৰথমজনের নাম ঝড়। দ্বিতীয় জনের নাম তুফান। দুই ভাই একত্রে ঝড়-তুফান। হা হা হা।

বদু নৌকার হাল ধরেছিল, সে আনন্দিত গলায় বলল, নাম অতি চমৎকার হয়েছে।

মঞ্জু, আযান দিচ্ছে।

পরীবানু লীলার দিকে তাকিয়ে ক্ষীণ স্বরে বলল, বুবু, আমার নাম দুইটা খুব পছন্দ হইছে— ঝড়-তুফান। বুবু, দুইজনের মধ্যে কে বেশি সুন্দর? ঝড় না তুফান?

লীলা জবাব দিতে পারছে না। সে কেঁদেই যাচ্ছে। তার কান্না থামবে এরকম মনে হচ্ছে না।
 
কী নাম?

আনিসুর রহমান।

আর কোনো নাম আছে?

জি না।

মালেক বলে কাউকে চেনো?

জি না।

মালেক নাম তো খুবই কমন, এই নামে কাউকে চেনো না?

জি না। কমিউনিষ্ট পাটির নেতা মোহাম্মাদ মালেক। উনাকে চেন না?

জি না।

শরিয়তুল্লাহ বলে কাউকে চেন? ঠিকানা তস্তুরীবাজার।

জি না।

সে তো তোমাকে তিনটা ডিকশনারি পাঠিয়েছিল, তাকে চেনো না?

জি না।

সফিকুর রহমান বলে কাউকে চেনো?

আমার বাবার নাম সফিকুর রহমান।

তাও ভালো, নিজের বাবাকে ইচনতে পারছ। আমি ভেবেছিলাম, তুমি কাউকেই চিনবে না। নিজের বাবাকেও না।

প্রশ্ন কর্তা হেসে ফেললেন। প্রশ্ন কর্তার সঙ্গে যে তিনজন আছেন তারাও হাসলেন। যে ঘরে কথাবার্তা হচ্ছে সেই ঘরের দরজা-জানালা বন্ধ। ছোট্ট ঘুপচি মতো ঘর। হলুদ রঙের দালান। ছাদ অনেক উঁচু। উঁচু ছাদ থেকে ঝুলন্ত লম্বা তারের মাথায় ইলেকট্রিক বান্ধ। ঘরে কোনো হাওয়া আসছে না। কিন্তু বান্ধটা পেন্ডুলামের মতো দুলছে। আনিসের দৃষ্টি বান্ধে আটকে যাচ্ছে। বাম্বের আলো উজ্জ্বল। মনে হয় একশ পাওয়ারের বাহু। উজ্জ্বল আলো চোখে পড়ায় সে তার সামনে বসা তিনজনকে ঠিকমতো দেখতে পারছে না। যিনি তাঁকে প্রশ্ন করছেন তিনি পুলিশের কোনো সিনিয়র অফিসার হবেন। কারণ তাঁর পাশের দুজন অত্যন্ত সমীহ করে তাঁর দিকে তাকাচ্ছেন। মূল প্রশ্নকর্তার গায়ে সার্ট-প্যান্ট। সাটের রঙ হালকা নীল। বাকি দুজনের গায়ে পুলিশের পোশাক। প্রশ্ন কর্তার সামনের টেবিলে ফুলতোলা একা রুমাল। রুমালে একটা পিস্তল।

তোমার নাম আনিসুর রহমান?

জি।

তোমার বাবা নাম সফিকুর রহমান?

জি।

এমএ পাশ করেছ?

জি।

তোমার বিষয়বস্তু হলো ইতিহাস।

জি।

টেবিলে রাখা পিস্তলটা তুমি চেনো? চেনো না? তোমাকে চিনতেই হবে, কারণ তোমাকে ধরা হয়েছে পিস্তলসহ। এখন বলো, পিস্তলটিা চেনো না?

জি চিনি।

এই পিস্তল কখনো ব্যবহার করেছ?

জি না।

ব্যবহার করো নাই কী জন্যে?

আমাকে পিস্তলটা লুকিয়ে রাখার জন্যে দেয়া হয়েছে। ব্যবহার করার জন্য দেয়া হয় নি।

কে তোমাকে দিয়েছে?

আমি তার নাম বলব না।

নাম তো অবশ্যই বলবে। আমরা এখনো জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করি নাই। যখন জিজ্ঞাসাবাদ সত্যি সত্যি শুরু করব, তখন প্রশ্ন জিজ্ঞাস করার আগেই উত্তর দিয়ে দিবে। তোমাকে তোমার নাম জিজ্ঞসা করব, তুমি নিজের নাম তো বলবেই, তোমার বাবার নাম বলবে, তোমার শ্বশুরের নামও বলবে। শ্বশুরের নাম কী?

স্যার, আমি এখনো বিয়ে করি নি।

বিয়ে করো নি কেন? পার্টির নিষেধ আছে? তুমি কমিউনিস্ট পাটির মেম্বার না?

জি মেম্বার।

তোমাকে মেম্বার কে বানিয়েছেন? মোহাম্মদ মালেক?

জি।

ভাষা আন্দোলনে জড়িত আছ?

জি না।

জড়িত না কী জন্যে— বাংলা ভাষা পছন্দ করো না? না-কি আরো বড় ধরনের আন্দোলনের জন্যে অপেক্ষা?

স্যার, একটু পানি খাব।

অবশ্যই পানি খাবে। পানি কেন খাবে না! তোমাকে যদি এখন পানি না। দেই, তাহলে রোজহাশরে আমি নিজে পানি পাব না। পানি দিচ্ছি। পানি খাও। তারপর গরম এক কাপ চা দিচ্ছি। চা খাও। ধূমপানের অভ্যাস আছে?

জি আছে।

গুড। সিগারেট দিচ্ছি। সিগারেট খাও। মন শান্ত করো এবং সুবোধ বালকের মতো প্রশ্নের উত্তর দাও। তুমি যে কী ভয়াবহ অবস্থায় আছ তুমি জানো না। তুমি ধরা পড়েছ অস্ত্রসহ। অস্ত্র মামলায় তোমার যাবজীবন সাজা হয়ে যাবে। আর আমরা যদি আরেকটু কায়দা-কানুন করি, তাহলে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে দিতে পারব। ঠিক আছে। এখন কিছু সময়ের জন্যে আমরা ব্ৰেক নেব। ভালো কথা, সারাদিনে তুমি কিছু খেয়েছ?

জি না।

তাহলে তো শুধু চা খাওয়া ঠিক হবে না। চায়ের সঙ্গে সামান্য কিছু হলেও খাওয়া। মাখন দেওয়া দুই পিস পাউরুটি দিতে বলি? বলব?

জি বলুন।

আমার নাম এবং তোমার বাবার নাম কিন্তু এক। আমার নামও সফিকুর রহমান। আইবি’র পুলিশ ইন্সপেক্টর সফিকুর রহমান। তোমার বাবা নিশ্চয়ই খুব ভালো মানুষ ছিলেন। ছিলেন না?

জি।

আমি কিন্তু ভালো মানুষ না। আমি খুব খারাপ মানুষ। কতটা খারাপ কিছুক্ষণের মধ্যেই টের পাবে।

স্যার, একটু পানি খাব।

অবশ্যই পানি খাবে। তোমাকে তো বলেছি পানি দেয়া হবে। পানি, চা, সিগারেট, মাখন লাগানো দুই স্নাইস পাউরুটি। আচ্ছা আনিস, গত দুই বছর তুমি কোথায় ছিলে?

ময়মনসিংহে, নয়াপাড়া। সিদ্দিকুর রহমান সাহেবের বাড়িতে।

এই রিভলবার কি তখনো তোমার সঙ্গে ছিল?

জি।

আর কেউ সেখানে তোমার সঙ্গে দেখা করার জন্যে গিয়েছিল?

জি না।

মনে করে দেখ, কেউ না?

জি না। স্যার পানি খাব।

ও হ্যাঁ পানি খাবে। পানি, চা-নাশতা দিতে বলছি। সিগারেট দিচ্ছি। সিগারেট টানতে থাকো এবং যে সব প্রশ্ন করব তার জবাবগুলি ঠিক করে রাখো। কাগজ দেয়া হবে। কাগজে গুছিয়ে লিখবো। তিনটা মাত্র প্রশ্ন। প্রশ্নগুলি মন দিয়ে শোনো— প্রশ্ন এক. এ জাতীয় অস্ত্ৰ তোমাদের কাছে কয়টি আছে? কার কার কাছে আছে? প্রশ্ন দুই. হিন্দুস্তানের সঙ্গে তোমাদের কি যোগাযোগ আছে? প্রশ্ন তিন. তোমাদের মূল আন্দোলনটি বৃহৎ বাংলা আন্দোলন, সর্বহারা আন্দোলন না-কি ভালো পাকিস্তান আন্দোলন। সহজ প্রশ্ন— সহজ উত্তর। ঠিক না আনিস?

জি স্যার।

পুলিশ ইন্সপেক্টর সাহেব উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বললেন, প্রশ্নের উত্তর ঠিকঠাক না পেলে আমি কী করব সেটাও একটু বলে রাখি, এতে সুবিধা হবে। আমি তোমার তিনটা আঙুলের নখের নিচে আলপিন ঢুকিয়ে দেব। কোন তিনটা আঙুল সেটা তুমিই ঠিক করবে। খুবই কষ্টকর প্রক্রিয়া, কিন্তু কী আর করা!

স্যার পানি খাব।

পুলিশ ইন্সপেক্টর সফিকুর রহমান পানি দিতে বললেন। চা-সিগারেট দিতে বললেন। তার মুখে হাসি।
 
আনিস কুণ্ডুলি পাকিয়ে শুয়ে আছে। তার নিচে দুটা কালো কম্বল। আরেকটা কম্বল তার গায়ে। যে সেলে তাকে রাখা হয়েছে সেটি ফাঁসির আসামিদের জন্যে আলাদা করা কনডেম সেল। সেলের ছাদের সঙ্গে আলো-বাতাস আসা-যাওয়ার জন্যে চারকোনা একটি ভেন্টিলেটার আছে। এই মুহুর্তে ভেন্টিলেটার দিয়ে রোদ এসেছে। সেই রোদ পড়েছে দেয়ালে। আনিস রোদের দিকে তাকিয়ে আছে। সেলের ভেতরে ভ্যাপসা গরম। আনিসের লাগছে ঠাণ্ডা। তার কাছে মনে হচ্ছে, মেঝের নিচ থেকে ঠাণ্ডা উঠে এসে তার গায়ে লাগছে। দুটা কম্বলে ঠাণ্ডা মানছে না। দিনের বেলাতেও তার মুখের কাছে এবং কানের কাছে মশা ভিনভন্ন করছে। হাত দিয়ে মশা তাড়ানোর উপায় নেই। দুটা হাতই ফুলে উঠেছে। নখের নিচে পিন ঢুকানোর ফল ফলেছে, হাত বিষিয়ে উঠেছে।

বেশির ভাগ সময় আনিস ঘোরের মধ্যে কাটাচ্ছে। ঘোরটা যখন আসে। তখন তার ভালো লাগে। আঙুলের যন্ত্রণা টের পাওয়া যায় না। ঘোরের সময় সে কাউকে না কাউকে সেলের ভেতর বসে থাকতে দেখে। বেশির ভাগ সময় দেখে মালেক ভাইকে। মালেক ভাই নিচু গলায় কথা বলেন। তাঁর কথাগুলি বেশির ভাগ সময়ই গানের মতো মনে হয়। মনে হয়। গানের সুরে কথা বলে এই মানুষটা তাকে ঘুম পাড়াতে চেষ্টা করছে।

কেমন আছ আনিস?

ভালো আছি। মনে হয় জ্বর আসছে কিন্তু আমি ভালো আছি।

তোমার কথা শুনে ভালো লাগল। আনিস শোনো, যেখানে থাকবে, যে অবস্থায় থাকবে ভালো থাকার চেষ্টা করবে। ভালো থাকার চেষ্টা করাটা খুব জরুরি।

জি।

আনিস শোনো, দেশের ভালোর জন্যে দেশের সব মানুষ কাজ করে না। অল্প কিছু মানুষ কাজ করে। তুমি অল্প কিছু মানুষের একজন। এটা ভেবে তোমার ভালো লাগছে না?

জি লাগছে।

যে কষ্ট তুমি ভোগ করছ, সেই কষ্ট তোমার পরের প্রজন্ম ভোগ করবে না। তারা বাস করবে স্বাধীন বাংলাদেশে।

মালেক ভাই, এইসব কথা অনেকবার বলেছেন। নতুন কিছু বলুন।

নতুন কথা শুনতে চাও? এইগুলাও নতুন কথা।

আনিস মাঝে মাঝে সিদ্দিকুর রহমান সাহেবকে তার পাশে বসে থাকতে দেখে। তিনি সবসময়ই অদ্ভুত অদ্ভুত কথা বলেন।

মাস্টার।

জি।

ফুলের পাপড়ি সবসময় বেজোড় সংখ্যায় হয়। একটা ফুলের পাপড়ি হয় জোড় সংখ্যায়। ফুলের নামটা বলো।

বলতে পারছি না।

চিন্তা করো। চিন্তা করে বলো।

চিন্তা করতে ভালো লাগছে না।

কেন ভালো লাগছে না?

গাছপালা বনজঙ্গল আমার ভালো লাগে না। তাদের নিয়ে চিন্তা করার কিছু নেই। চিন্তা করতে হবে মানুষ নিয়ে।

গাছপালা, বনজঙ্গল এরা কি মানুষের অংশ না?

এইসব আপনি কী বলেন, এরা মানুষের অংশ হবে কী জন্যে?

আমার তো মনে হয় মানুষই বরং গাছপালার অংশ। মানুষকে গাছের ফুল হিসেবে কল্পনা করো। ফুলের থাকে পাপড়ি, মানুষের আঙুল হলো পাপড়ি। ফুলের থাকে গন্ধ— মানুষের গুণ হচ্ছে গন্ধ। ফুল থেকে ফল হয়…

আপনি কি চুপ করবেন?

আচ্ছা যাও চুপ করলাম।

হঠাৎ হঠাৎ আনিস লীলাবতীকে দেখতে পায়। সে খুব ব্যস্ত ভঙ্গিতে বলে, আপনি আমার সঙ্গে চলুন তো।

কোথায় যাব?

আমাদের বাড়িতে যাবেন। আমি আপনাকে জঙ্গলের ভেতর লুকিয়ে রাখব, কেউ আপনাকে পাবে না।

এরা আমাকে ছাড়বে না।

তাহলে একটা কাজ করুন, এরা আপনার কাছে যা যা জানতে চায় সব বলে দিন। হড়হড় করে বলে দিন।

সম্ভব না।

অবশ্যই সম্ভব। পুলিশ ইন্সপেক্টর সাহেবকে ডাকুন, ডেকে সব বলে দিন।

পুলিশ ইন্সপেক্টর সাহেবকে বেশির ভাগ সময়ই আনিস তার আশেপাশে দেখতে পায়। তিনি হাতে একটা আলপিন নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন এবং একটা প্রশ্নই বারবার করতে থাকেন। আনিসও ক্লান্তিহীনভাবে সেই প্রশ্নের উত্তর দিতে থাকে।

তোমার নাম কী?

আনিস।

তোমার নাম কী?

আনিস।

তোমার নাম কী?

আনিস।

তোমার নাম কী?

আনিস।

তোমার নাম কী?

আনিস।
 

Users who are viewing this thread

Back
Top