What's new
Nirjonmela Desi Forum

Talk about the things that matter to you! Wanting to join the rest of our members? Feel free to sign up today and gain full access!

Collected গৌরীপুর জংশন - উপন্যাস (1 Viewer)

০৩.
কুয়াশা ভেঙে রোদ উঠেছে। মোহনগঞ্জের ট্রেন চলে এসেছে। আজ তুলনামূলকভাবে ভিড় কম। ছাদের উপর মানুষ নেই। দাঁড়িয়ে থাকা ট্রেন দেখার আনন্দই আলাদা। লোকজন উঠছে নামছে, হৈ চৈ হচ্ছে। পানওয়ালা, চা-ওয়ালা, নিম টুথ পাউডার, জামে মসজিদের চাঁদার খাতা হাতে মৌলানা, ফকির-মিসকিন কত ধরনের মানুষ এ কামরা থেকে ও কামরায় যাচ্ছে। কতগুলো মানুষের রুটি রোজগার এই ট্রেনের উপর নির্ভর করছে। কি বিরাট কর্মকাণ্ড। ভালো লাগে। দেখতে ভালো লাগে।

জয়নাল গাঢ় স্বরে ডাকল, ও বজলু?

জ্বি।

কোনহানে এই ট্রেন যাইব ক দেহি?

জানি না।

মোহনগঞ্জ। এইসব জানা দরকার বুঝলি। আমরা যারা ইস্টিশনে থাকিট্রেন হইল আমরার রুটি রোজগারের মালিক। হেই মালিকের খোঁজ-খবর না রাখলে জিনিসটা অন্যায় হয়। ঠিক কইলাম না?

বজলু হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ল।

জয়নাল গম্ভীর গলায় বলল, ট্রেইনের সাথে রুটি রোজগার বান্দা এমন মানুষ হইল দুই কিসিমের। চলন্তি মানুষ আর বসন্তি মানুষ। যারা ট্রেইনের লগে-লগে চলে তারা চলন্তি। আর যারা ট্রেইনের লগে চলে না তারা বসতি। ইজ্জত বেশি বসন্তি মানুষের।

অনেকক্ষণ পর স্টার সিগারেটের প্যাকেট খুলে জয়নাল সিগারেট ধরাল। আগে। কত সিগারেট খেয়েছে, এত ভালো লাগে নি, তখন সব সময় একটা আতংক ছিল এটা শেষ হলেই আরেকটা কখন জোগাড় হবে কীভাবে জোগাড় হবে? এখন এই অবস্থা না। নটা সিগারেট পকেটে আছে। একটা শেষ হবার সঙ্গে-সঙ্গে সে ইচ্ছা করলে আরেকটা ধরাতে পারে। কারোর কিছু বলার নেই।

জয়নাল মোহনগঞ্জ লাইনের গাডিটার মখোমখি হয়ে রোদে বসল। সারাদিনে গায়ে প্রচুর রোদ লাগিয়ে রাখলে রাতে শীত কম লাগে। এইসব জ্ঞানের কথা সে অনেক ভেবেচিন্তে বের করেছে। বজলুকে শিখিয়ে যাবে। এই ছেলে কাজে লাগবে। ছেলেটির প্রতি সে যথেষ্ট মমতা বোধ করছে।

ও বজলু?

জ্বি।

এই ইস্টিশনে আমি যখন পরথম আসি তখন আমি তার মতো আছিলাম। আমরা তিনজন আইস্যা উঠলাম। আমি, আমার বাপজান আর আমার ভইন শাহেদা। তিনজনের মধ্যে আমি টিকলাম। বাপজান পরথম বছরই শেষ। শাহেদারে ইস্টিশন মাস্টার বাসার কাম দিল। তারপর যখন বদলি হইল সাথে নিয়া গেল। এখন কই আছে জানে আল্লাহ মারুদ। তর দিা লাগছে?

না।

তুই থাক বইয়া। একটা মালাই চা খাইয়া আসি। শ‍ইলডা জুইত লাগছে না। কম্বল সাবধান। ধর এই টেকাড়া পকেটে রাখা বাদাম-টাদাম মনে চাইলে খাইবি। বাদামের বড় গুণ কি জানস?

না।

বাদাম হইল ক্ষিদার যম। এক ছটাক বাদাম আর দুই গেলাস পানি হইলে পুরা একটা দিন পার করন যায়। মানুষের রোজগার পাতি সবদিন সমান হয় না তখন এইসব বিদ্যা কাজে লাগে।

জয়নাল উঠে দাঁড়াল। পাটা আবার যন্ত্রণা দিচ্ছে। যন্ত্রণাকে সে আমল দিল না। শরীরের ব্যথা-বেদনা, পেটের ক্ষিধা এইসব জিনিসকে আমল দিলেই এরা পেয়ে বসে। এদের সবসময় তুচ্ছ জ্ঞান করতে হয়।
 
পরিমলের দোকানে ভিড় এখন কম। মোহনগঞ্জের ট্রেন ঘন্টি দিয়ে দিয়েছে। কাস্টমাররা উঠে চলে গেছে। পরিমলের ছোট শালা ট্রেনের কামরায়-কামরায় চা ফেরি করে। মোট পনেরো কাপ চা সে দিয়েছে, ফেরত এনেছে চৌদ্দটা কাপ। আরেকটা কাপের খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। নদশ বছরের ছেলেটা ভয়ে আতংকে নীল হয়ে আছে। তার দাদাবাবুর নিষ্ঠুরতা এবং নির্মমতার সঙ্গে সে পরিচিত। পরিমল বরফ শীতল গলায় ছেলেটাকে বলল, আমি ইতিং বিতিং কোনো কথা শুনতে চাই না। তুই যেখান থেইক্যা পারস কাপ আইন্যা দিবি। না আনলে খুন্তি আগুনে পুড়াইয়া ছাকা দিমু। তিনখান ছাকা আছে এইটা লইয়া হইব চাইর। বেজোড় সংখ্যা ছিল—জোড় সংখ্যা হইব। গিদরের বাচ্চা গিদর। খাওয়া ছাড়া আর কিছু শিখে নাই। বোয়াল মাছের মতো মুখ মেলতে শিখছে।

ছেলেটাভয়ে কাঁদতেও পারছে না। আরেকবার সে কাপ গুনতে বসল। হয়তো তার মনে ক্ষীণ আশা, কেনো অলৌকিক উপায়ে কাপের সংখ্যা বেড়ে যাবে।

জয়নালের মনটা খারাপ হয়ে গেল। শৈশবে ট্রেনে চা ফেরির কাজ সেও করেছে। তখন হিন্দু টি স্টলের মালিক ছিলেন শ্রীনিবাস। বড়ই ভালো লোক। সে কত কাপ হারিয়েছে। ভেঙে ফেলেছে। কাস্টমারের কাছ থেকে পয়সা নেয়ার আগেই ট্রেন ছেড়ে দিয়েছে। পেছনে পেছন দৌড়েও কোন লাভ হয় নি। একবার ট্রেন ছেড়ে দিলে কাস্টমারদের কি-যেন হয়, তারা কিছুতেই মানিব্যাগ খুঁজে পায় না। নানান পকেট হাতড়ায়। এক সময় পাওয়া যায় কিন্তু দেখা যায় ভাংতি নেই। তার ট্রেনের পেছনে ছোটাই সার হয়েছে। মুখ শুকনো করে সে দুঃসংবাদ দিয়েছে শ্রীনিবাসকে। শ্ৰীনিবাস উদাস গলায় বলেছেন, মন খারাপ করিস না। যার-যার পয়সা তার-তার কাছে। এই কথায় শ্রীনিবাস কি বুঝাতো কে জানে? তবে একটা জিনিস জয়নাল বুঝতো সেটা হচ্ছে শ্রীনিবাস বড় ভালো লোক ছিলেন। আফসোসের কথা, ঐ লোক ইন্ডিয়া চলে গেল। ভালো ভালো হিন্দু সব চলে গেছে, খারাপগুলো পড়ে আছে। এইটাই আফসোস।।

পরিমলের মতো হাড়-হারামজাদা থেকে গেল। সে চলে গেলে কী হত? বাচ্চা। ছেলেটাকে সত্যি-সত্যি গরম খুন্তির ছাকা দেয় কি-না কে জানে। দিতেও পারে। না দিলে এই ছেলে এত ভয় পাচ্ছে কেন?

পরিমলদা, পুলাডারে কিছু কইও না। পুলাপান মানুষ। বাদ দেও।

খামাখা কথা কইছ না তো জয়নাল। কাপের দাম কে দিব? তুই দিবি?

হ, দিমু।

তোর টেকা কি বেশি হইছে?

হইছে। দিন তো সমান যায় না। একটা মালাই চা দেও, আর কাপের দাম কত কও–দিছি। অসুবিধা নাই। চায়ের মইদ্যে চিনি বেশি দিবা।

জয়নাল পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট বের করল। উদার গলায় বলল, ধর একটা সিগারেট, ধরাও পরিমল দা।

জয়নালের পাশে বসে চা খাচ্ছে একজন অল্পবয়স্ক ক্যানভাসার। তাঁর পরনে চকচকে প্যান্ট, শার্ট। হাতে ট্যাচি কেস। প্রথম দর্শনে মনে হবে ভদ্রলোক। সেকেন্ড ক্লাসের যাত্রী। শুধু অভিজ্ঞ চোখই বলতে পারবে—এ আসলে একজন ক্যানভাসার। যে শূল-বেদনার ওষুধ, কিংবা কান পাকার ওষুধ বিক্রি করে।

জয়নাল লোকটির দিকে তাকিয়ে সহজ স্বরে বলল, ভাইজান কি…

লোকটা প্রথম একটু চমকে উঠল, তারপর নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, বাতের অষুধ।

নিজেই বানান?

হুঁ। স্বপ্নে পাওয়া অধ। বত্রিশ পদের গাছের শিকড় লাগে। সব গাছও এই দেশে নাই। আসাম থেকে আনাতে হয়। বড়ই যন্ত্ৰণা।



জয়নাল মনে-মনে দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলল। এই ছেলে নিতান্তই আনাড়ি। ক্যানভাসিং-এ নতুন নেমেছে। সুবিধা করতে পারবে না। ক্যানভাসিংয়ে বুদ্ধি লাগে। এই ছেলে বোকা কিসিমের। জয়নাল গলায় কৌতূহলের ভঙ্গি করে বলল, স্বপ্নটা কে দেখল?

আমার পিতাজী দেখেছেন।

সব মানুষ স্বপ্নে কেবল বাতের অষুধ পায়, বিষয়টা কি কন দেখি? এই লাইনে পাঁচজন স্বপ্নে পাওয়া বাতের অষুধ বেচে। আপনেরে নিয়া হইল ছয়।

আমি এই লাইনের না। আমি ময়মনসিংহ-জামালপুর লাইনের।

স্বপে এর চেয়ে ভালো কোনো অষুধ পান না?

আলো অষুধ মানে?

এই ধরেন ক্ষিধা নষ্ট হওনের অধ। তা হইলে গরিবের উপকার হইত।

লোকটি বিরক্ত চোখে তাকাচ্ছে।

জয়নাল বলল, আপনের পিতাজী যদি জীবিত থাকে তা হইলে তারে বলেন স্বপ্নে ক্ষিধার বড়ি জোগাড় করতে। খুব চলব। এক বড়িতে লাখপতি।

মশকরা করতেছেন?

না, মশকরা করব ক্যান? আপনে তো আমার দুলা ভাই না। নেন সিগারেট নেন। চা খাইবেন? খান আরেক কাপ। আমি দাম দিব। টেকা পয়সা হইল হাতের ময়লা। পরিমল দা ইনারে এক কাপ চা দেও, খরচ আমার।

হঠাৎ জয়নালের মন খারাপ হয়ে গেল। বাচ্চা দুটোর জন্যে খারাপ লাগছে। তবে এতক্ষণে তারা ময়মনসিংহ পৌঁছে গেছে। একটা কিছু ব্যবস্থা তারা নিশ্চয়ই করেছে। তবে সারা পথ ঐ লোক বোধ হয় তার বৌকে বকাঝকা করেছে। বৌটা চোখের পানি ফেলেছে। আহা বেচারি! আহা!

কুলি সর্দার হাশেম লম্বা-লম্বা পা ফেলে আসছে।

জয়নালের বুকটা ছাৎ করে উঠল। কিছু জানে না তো? ইস্টিশনের অনেক গোপন নিয়ম-কানুন আছে। মালামাল পাচার হলে প্রথম জানাতে হবে হাশেমকে। বিক্রির ব্যবস্থা হাশেমই করবে। দামের অর্ধেক হাশেমের বাকি অর্ধেক যে কাজটা করবে তার। তবে সোনাদানার বেলায় অন্য হিসাব।

জয়নাল বলল, হাশেম ভাই চা খাইয়া যান, খরচ আমার।জয়নাল বলল, হাশেম ভাই চা খাইয়া যান, খরচ আমার।

হাশেম আমল, তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে জয়নালকে এক পলক দেখেই এগিয়ে গেল। কোনো একটা বিষয় নিয়ে তাকে চিন্তিত মনে হচ্ছে। তার ব্যাপারে কিছু জেনে ফেলে নি তো? জানলে বিপদ আছে। মহা বিপদ।
 
০৪.
চায়ের দোকান থেকে বের হয়েই জয়নাল হুট করে এক হালি কমলা কিনে ফেলল। দশ টাকা করে হালি, দরদাম করলে আটে দিত। দরদান করতে ইচ্ছা করল না। কী। দরকার সামান্য দুটা টাকার জন্যে খেচামেচি করা। গরিব মানুষ না হয় দুটা টাকা বেশি পেল। মাঝে-মাঝে ফল-ফলান্তি খাওয়া দরকার। এতে শরীরে বল হয়। দুই হাতে চারটা কমলা দেখতেও ভালো লাগছে। এক্ষুনি খেয়ে ফেলতে হবে এমন তো কোনো কথা না। থাকুক কিছুক্ষণ হাতে। জয়নাল মালবাবুর ঘরের দিকে এগোল। মালবাবুকে বদলি করে দেবে এরকম গুজব শোনা যাচ্ছে। এটা একবার জিজ্ঞেস করা দরকার। বড় ভালো লোক। হাতির দিলের মতো বড় দিল। মালবাবুর ছেলেপুলে থাকলে কিছু কমলা কিনে দিয়ে আসত। বেচারার ছেলেপুলে নেই। ছেলেপুলে হওয়ানোটা কোনো ব্যাপার না। পীর সাহেবের লাল সুতা কোমরে বাঁধলেই হয়। তবে বিশ্বাস থাকতে হবে। মালবাবুর পীর ফকিরে বিশ্বাস নাই। জয়নাল একবার পীর সাহেবের কথা বলতে গিয়ে ধমক খেয়েছে। পীর সাহেবকে নিয়েও মুখ খারাপ করেছেন। খুবই অনুচিত কাজ হয়েছে। পীর ফকির নিয়ে ঠাট্টা মশকরা করার ফল শুভ হয় না। এই যে বদলির কথা শোনা যাচ্ছে এর কারণও হয়তো তাই।

মালবাবুকে পাওয়া গেল না। তার ঘর তালাবন্ধ। তবে জানালা খোলা। কিছুক্ষণের মধ্যেই হয়তো চলে আসবেন। জানালা দিয়ে কমলা চারটা টেবিলের উপর ছুঁড়ে দিলে কেমন হয়? দরজা খুলে কমলা দেখলে মনটা খুশি হবে। জনে-জনে জিজ্ঞেস করবেন। কমলা কে দিল? কেউ বলতে পারবে না। এটার মধ্যেও একটা মজা আছে। মালবাবু তার জন্যে অনেক করেছেন। সে কিছুই করতে পারে নি।

কোমরে চালের বস্তা পড়ে যাবার পর দুই সপ্তাহ হাসপাতালে ছিল। মালবাবু একদিন দেখতে গেল। দেখতে গেছেন এই যথেষ্ট তার উপর কুড়িটা টাকা দিলেন। হাতীর দিলের মত বড় দিল না হলে এটা সম্ভব না। সামান্য কমলা দিয়ে এই ঋণ শোধ হবার না। এরচে বেশি সে করবেই বা কী?

টেবিলে কমলা ছুঁড়ে দেবার পরিকল্পনা শেষ পর্যন্ত বাতিল করতে হল। মালবাবু রেগেও যেতে পারেন। তার মেজাজের কোনোই ঠিক-ঠিকানা নেই। মেজাজ ঠিক থাকলে ফেরেশতা, বেঠিক হলে শয়তানের বাদশা। মেজাজ ঠিক না থাকারই কথা। মালামাল মোটেই চলাচল হচ্ছে না। পরশু রাতেই হুঙ্কার দিয়ে বলেছিলেন, অফিসের সামনে শুয়ে থাকস ক্যানরে হারামজাদা? লাথি খাইতে মন চায়? পেট গলায়ে দিব। বদের হাড্ডি।

থাক কমলা চারটা বরং অনুফাকে দিয়ে আসা যাক। খুশি হবে। এর মধ্যে দোষের কিছু নেই। সে নিজে দোষের কিছু দেখছে না।
 
অনেকদিন অনুফাকে দেখতে যাওয়া হয় না। ছয় মাসের উপর তো হবেই অবশ্যি এর মধ্যে দুবার সে গিয়েছে। ঘরে লোক আছে শুনে চলে এসেছে। সকালবেলা লোজন থাকবে না, তখন যাওয়া যায়। তাকে দেখলে অনুফা খুশি হয়। মুখে কিছু বলে না তবে সে বুঝতে পারে। অবশ্যি কিছুটা লজ্জাও পায়। লজ্জা পাওয়ার তেমন কিছু নেই। যা হচ্ছে সব আল্লাহর হুকুমেই হচ্ছে এটা জানা থাকলে লজ্জা চলে যাবার কথা। জগৎ-সংসার তো এমনি এমনি চলছে না–তাঁর হুকুমে চলছে। এটা জানা থাকলে মনে আপনা-আপনি শান্তি চলে আসে। অনুফাকে এই কথাটা গুছিয়ে বলতে হবে। অনুফার সামনে সে অবশ্যি গুছিয়ে কিছু বলতে পারে না। তার নিজেররা কেন জানি লজ্জালজ্জা লাগে। কথা বলবার সময় বেশিরভাগ কথাই গলা পর্যন্ত এসে আটকে যায়। সবচে মুশকিল হল ইদানীং অনুফা তাকে আপনি-আপনি করে বলে। যেন সে একজন মান্যগণ্য লোক। বাইরের কেউ।

এখন বাইরের কেউ হলেও এক সময় তো ছিল না। রীতিমতো কাজি সাহেব ডেকে বিয়ে পড়ানো হল। সেই বিয়েতে নগদ খরচ হল সাড়ে তিন শ। তাও বিয়ের শাড়ি কিনতে হল না। মালবাবু শাড়ি কিনে দিলেন এবং মুখ বিকৃত করে বললেন, হারামজাদা বিয়ে যে করলি, বউকে খাওয়াবি কী? বাতাস খাওয়াবি? ছোট লোকের বুদ্ধি-শুদ্ধি হয় না, এটা একেবারে সত্যি কথা। বৎসর না ঘুরতেই বাচ্চা পয়দা করে ফেলবি। পরের বৎসর আরেকটা, তার পরের বৎসর আরেকটা। আবার হাসে। লাথি দিয়া হারামজাদা তোর দাঁত ভাঙব। হাসবি না।

তা হাসি আসলে সে কী করবে। হাসি-কান্না এগুলো একবার আসতে শুরু করলে ফট করে থামানো যায় না। তখন মনে খুব ফুর্তি ছিল। এতগুলো টাকা ঋণ হল। সবটাই জোগাড় হল সুদীতে। টাকায় টাকা সুদ। কুলি সর্দারের কাছ থেকে নেয়া। তাঁর কাছে সুদে টাকা নেয়া মানে সারাজীবনের জন্যে বান্ধা পড়া। সুদ দিয়েই কূল পাওয়া যাবে না আসল দিবে কখন। তবু জয়নাল সব তুচ্ছ জ্ঞান করল। তখন শরীরে শক্তি ছিল। দুই মণী বোঝ হাচকা টান দিয়ে তুলতে পারত। ইস্টিশনের কাজ ছাড়াও বাইরে কাজ ছিল। সড়ক তৈরির কাজ। দিনে করত সড়ক তৈরির কাজ। তখন গৌরীপুর-শম্ভুগঞ্জ সড়কে মাটি কাটা হচ্ছে। কাজের অভাব নেই, শরীরে শক্তি থাকলে কাজ আছে। সন্ধ্যার পর চলে আসত স্টেশনে, এখানেও মাল তোলার কাজ আছে। অবশ্যি রোজগারের সবটাই কুলি সর্দার নিয়ে নিত। টাকায় টাকা সুদ, দিতে গিয়েই শরীরের রক্ত ঠাণ্ডা হয়ে যায়। তার ওপর সে একটা ঘর নিয়েছে। গৌরীপুরের রাজবাড়ির কাছে একটা ছনের ঘর। ছমিরুদ্দিন রিকশাওয়ালার ঘরের একটা অংশ। স্টেশন থেকে খানিকটা দূর। তাতে কি? হেঁটে হেঁটে বাড়ি ফিরতে তার মজাই লাগতো।

হেঁটে বাড়ি ফিরতে সে নানান ধরনের স্বপ্ন দেখতে। সুদের টাকা সবটা ফেরত দেয়া হয়েছে। তার পর টাকা জমাচ্ছে। টাকা জমিয়ে একদিন একটা রিকশা কিনে ফেলল। সেই রিকশা সে নিজে চালায় না। ভাড়া খাটায়। তখন টাকা জমে দুদিক থেকে তার টাকা এবং রিকশার টাকা। জমতে জমতে অনেক হয়ে গেল। তখন তারা জমি কিনল। ব্ৰহ্মপুত্র নদীর তীরে প্রথমে ছোট্ট এক টুকরা জমি। তারপর আরেকটু, তারপর আরেকটু। একটা ঘর তুলল। টিনের ঘর। ঘরের চারপাশে ফল-ফলান্তির গাছ। পিছনে বাঁশঝাড়। বাঁশঝাড় ছাড়া ঘরবাড়ি ভালো হয় না। ঘরবাড়ির আব্রু থাকে না। কল্পনার এই পর্যায়ে সে বাড়ি পৌঁছে যায়। মনে হয় পথটা আরেকটু দীর্ঘ হল না কেন? আরেকটু দীর্ঘ হলে ভালো হত। আরো কিছুক্ষণ ভাবা যেত। পথে নামতেই পথ ফুরিয়ে যায়, এও এক আশ্চর্য কাণ্ড।

তার পায়ের শব্দে দরজার ঝাঁপ সরিয়ে অনুফা বের হয়ে আসে। নিচু গলায় বলে আইজ অত দেরি হইল ক্যান?

রোজ একই প্রশ্ন। একদিন সে সন্ধ্যায় চলে এসেছিল। সেদিনও বলল, আইজ অত দেরি হইল ক্যান? জয়নাল হেসে বলল, এরে যদি দেরি কও তা হইলে যে বউ ঘরেই বইস্যা থাকন লাগে।

থাক না ক্যান? একটা পুরা দিন ঘরে থাকলে কী হয়?

টেকা জমান দরকার, অনুফা টেকা জমান দরকার।

টাকা অবশ্যি কিছু জমতে শুরু করল। বাঁশে ফুটো করে আজ এক টাকা, কাল দুটাকা এমনি করে ফেলতে লাগল। একবার ফেলল বিশ টাকার একটা নোট। বড় সুখের সময় ছিল।

দুজনে একবার ছবিঘরে একটা বইও দেখে এল। অনেক শিক্ষণীয় জিনিস ছিল বইটাতে। দেবর ভাবীর সংসার। দেবর তার ভাবীকে মায়ের মতো শ্ৰদ্ধা করে। ভাবীও বড় স্নেহ করেন দেবরকে। ভাত মাখিয়ে মুখে তুলে দেন। এই দেখে স্বামীর মনে হল খারাপ সন্দেহ। তাঁর মনে হল দুইজনের মধ্যে ভালবাসা হয়ে গেছে। তিনি দুজনকেই বাড়ি থেকে বের করে দিলেন। তারা পথে-পথে ঘুরে গান গায়, ভিক্ষা করে। খুব করুণবই। কাঁদতে-কাঁদতে অনুফা অস্থির। জয়নাল নিজেও কাঁদছে। দেবর ভাবীর দুঃখ সেও সহ্য করতে পারছে না। তবে একটা দিক ভেবে তার ভালো লাগছে এ জাতীয় সমস্যা তার নেই।
 
বেশি সুখ কারো কপালে লেখা থাকে না। এটাও আল্লাহতালার বিধান। কাজেই অঘটন ঘটল। চালের বস্তা পড়ে গেল কোমরে। দুনিয়া অন্ধকার হয়ে গেল। কাউকেই সে দোষ দেয় না। সবই কপালের লিখন। কথায় বলে না, কপালের লিখন না যায় খণ্ডন।

তার কপালে লেখাই ছিল কোমরে পড়বে তিনমণী চালের বস্তা, তারপর অনুফা তাকে ছেড়ে চলে যাবে। অনুফার উপরও তার রাগ নেই। যে স্বামী খেতে পরতে দেয়। না, খামাখা তার গলায় ঝুলে থাকবে কেন? তাছাড়া গায়ের রঙ ময়লা হলেও চেহারা ছবি ভালো। কোনো পুরুষ মানুষ একবার তাকে দেখলে, দ্বিতীয়বার ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায়। সেই পুরুষের চোখ চকচক করে। এই মেয়ের কি দায় পড়েছে জয়নালের সঙ্গে লেপ্টে থাকার? জয়নালের তখন এখন মরে তখন মরে অবস্থা। হাসপাতালে থেকে। কিছু হয় নি বলে চলে এসেছে স্টেশনে। একটা পয়সা নেই হাতে। মাথার ভেতরে সবসময় ঝুমঝম করে ট্রেন চলে। কিছু মুখে দিলেই বমি করে ফেলে দিতে ইচ্ছা করে। মাঝে-মাঝে মনে হয় হঠাৎ যেন কেউ সারা গায়ে এক লক্ষ সুচ ফুটিয়ে দিল। সে তখন বিড়বিড় করে বলে—ভাই সকল আপনেরা ধরাধরি কইরা আমারে লাইনের উপরে শুয়াইয়া দেন। আমার জীবনটা শেষ হউক। কেউ তাকে লাইনের উপর শুইয়ে দেয় না বলে জীবন শেষ হয় না। মালবাবুর অফিসের সামনে ময়লা বস্তার উপর সে শুয়ে থাকে। আর ভাবে জীবন জিনিসটা এমন জটিল কেন?

সেবার সে মরেই যেত। বেঁচে গেল দুটা মানুষের জন্যে। মালবাবু আর রমজান। ভাই। মালবাবু কয়েকদিন পরপর ডাক্তার নিয়ে আসতেন। কঠিন গলায় বলতেন, একটা ইনজেকশন দিয়ে মেরে ফেলুন তো ডাক্তার সাহেব। মারতে পারলে এক শ টাকা দেব। এরকম কষ্ট ভোগ করার কোনো অর্থ নাই। আগাছা পরিষ্কার হওয়া দরকার। এগুলো হচ্ছে আগাছা। আপনি ইনজেকশন দিয়ে না মারলে আমি নিজেই লাঠি দিয়ে বাড়ি দিয়ে মাথা দুফাঁক করে দেব। মুখে এসব বলতেন আর ভেতরে টাকা দিয়ে অষুধ কিনতেন। দামী দামী ওষুধ। টাকা তাঁর কাছে ছিল হাতের ময়লা।।

আর পাগলা রমজান ভাই রোজই এটা সেটা এনে খাওয়াতেন। এককাপ দুধ। একটা কলা। সুজির হালুয়া। লবণ মরিচ দিয়ে মাখা ভাতের মাড়। পাশে বসে নানান কথাবার্তা বলতেন। সবই জ্ঞানের কথা। ভাবের কথা।

কষ্ট পাওয়া ভালো, বুঝলি জয়নাল। কষ্ট পাওয়া ভালো। কষ্ট হইল আগুন। আর মানুষ হইল খাদ মিশানো সানা। আগুনে পুড়লে খাদটা চলে যায়। থাকে মোনা। তোর খাদ সব চলে যাচ্ছে বুঝলি?

রমজান ভাইয়ের কথা ঠিক না। কষ্টে পড়ে সে চোর হয়েছে। আগে চোর ছিল না। বোধ হয় তার মধ্যে সোনা কিছুই ছিল না। সবটাই ছিল খাদ। হাতের পাঁচটা আঙুল যেমন সমান না সব মানুষও তেমন সমান না। কিছু-কিছু মানুষ আছে পুরোটাই সোনা আবার কিছু-কিছু মানুষের সবটাই খাদ।

যাক এসব নিয়ে তার মনে কোনোকষ্ট নাই। কারো উপর তার কোনোরাগও নাই। সে যখন শুনল অনুফা ছমিরুদ্দিন রিকশাওয়ালার কাছে বিয়ে বসেছে সে রাগ করে নি। বরং ভেবেছে ভালোই হয়েছে, মেয়েটার গতি হল। ছমিরুদ্দিন লোক খারাপ না। রোজগার ভালো। অনুফা খেতে-পরতে পারবে। তারপর শুনল আগের বউটার সঙ্গে ঝগড়ায় টিকতে না পেরে চলে গেছে, তখন কিছুদিন বড় অশান্তিতে কাটল। জোয়ান বয়স। কোথায় যাবে? কোথায় ঘুরবে? তারপর খবর পাওয়া গেল অনুফা একজন কাঠ মিস্ত্রীর কাছে বিয়ে বসেছে। কাঠ মিস্ত্রীর আগের বউ মারা গেছে। সেই পক্ষের তিন চারটা ছেলে মেয়ে ওদের মানুষ করতে হবে। বউ দরকার। এই খবরে বড় আরাম পেল জয়নাল। যাক একটা গতি হল। আগের পক্ষের বউ যখন নেই তখন বলতে গেলে সুখের সংসার। কাঠ মিস্ত্রী যখন, তখন রোজগার-পাতি খারাপ হওয়ার কথা না। মানুষের কপাল, এই বিয়েও টিকল না। নানান ঘাট ঘুরে ফিরে তার জায়গা হল পাড়ায়। তা কী আর করবে। কপালের লিখন। অবশ্যি একদিক থেকে ভালো হলস্বাধীনভাবে থাকবে। কারো মুখের দিকে তাকিয়ে থাকতে হবে না। এই তো ভালো। ভাগ্যের উপর তো কারো হাত নেই। হাসান-হোসেনের মত পেয়ারা নবীর দুই নাতীকেও কি কুৎসিত মৃত্যু বরণ করতে হল। ভাগ্যে ছিল বলেই তো।

অনুফার কাছে যাবার আগে জয়নাল নাপিতের কাছে গিয়ে মাথার চুল কাটাল। খোঁচা খোঁচা দাড়ি গজিয়েছিল। শেভ করাল।



কেমন হালকা লাগছে নিজেকে। আয়নায় দেখাচ্ছেও অন্যরকম। গায়ের শার্টটা অতিরিক্ত ময়লা। একটা শার্ট কিনে ফেলবে নাকি? পুরানো কাপড়ে বাজার ভর্তি। পনেরো বিশ টাকায় ভালো শার্ট হয়। টাকা যখন আছে কিনে ফেললেই হয়। এক জোড়া স্যান্ডেলও দরকার। অনেক দিন ধরেই খালি পায়ে হাঁটছে। স্পঞ্জের একজোড়া স্যান্ডেলের কত দাম কে জানে? দশ টাকায় হবে না?

খালি হাতে যাওয়াটাও ঠিক হবে না। অনুফার জন্যে কিছু একটা নিতে হবে। কমলা চারটা তো আছেই, এ ছাড়াও অন্য কিছু একটা শীতের চাদর নিয়ে গেলে কেমন হয়? ফুল তোলা শীতের চাদরের খুব শখ ছিল বেচারীর। লাল রঙের চাদরে সাদা ফুল।

অনুফার কাছে কোনোবারেই সে খালি হাতে যায় নি। অতি তুচ্ছ কিছু হলেও নিয়ে গেছে। পান খেতে পছন্দ করত বলে একবার একটা পানের বাটা নিয়ে গেল। বড় খুশি হয়েছিল সেবার। খুশি হয় আবার লজ্জাও পায়। প্রথম বার যখন গেল লজ্জায় অনুফা কথা বলতে পারছিল না। সারাক্ষণ মাথা নিচু করে বসেছিল। কোনোক্রমে ক্ষীণ স্বরে বলল, আপনের শইল কেমন?
 
আপনি ডাক শুনে জয়নালের বুকের ভেতরটা হা-হা করে উঠল। তবে সে সহজ ভাবেই বলল, ভালো। তুমি কেমন আছ?

যেমন দেখছেন।

খুব ভালো আছে বলে জয়নালের মনে হল না। অনুফার চোখের নিচে কালি। মুখ শুকনা। মাথার চুলগুলোও কেমন লালচে-লালচে। তবু সুন্দর লাগছিল অনুফাকে।

অনুফা বসেছিল জলচৌকিতে। জয়নাল চৌকির ওপর। চৌকিতে পাটি বিছানো। এক কোণায় তেলচিটচিটে বালিশ। ঘরের পাশ দিয়েই বোধহয় নর্দমা গেছে। দুর্গন্ধে নাড়িতুড়ি উন্টে আসে। ঘরের এক কোণায় ভোলা উনুনের পাশে লম্বা-লম্বা সবুজ রঙের বোতল। বোতলগুলোর দিকে তাকিয়ে জয়নাল ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলতেই অনুফা বলল, অনেক কিসিমের মানুষ আসে। মদ খাইতে চায়। এরাই বোতল আনে। আমি শেষে বোতল বেইচা দেই।

তুমি খাও না তো?

না।

খুব ভালো। ভুলেও খাইবা না। মদ হইল গিয়া নিশার জিনিস। একবার নিশা হইলে আর ছাড়তে পারব না। শইল নষ্ট হইব।

আমি খাই না।

না খাওনই ভালো।

এরপর জয়নাল আর কথা খুঁজে পায় না। কথা খুঁজে পায় না অনুফাও। দুজনই অপরিচিত মানুষের মতো মুখোমুখি বসে থাকে। একসময় জয়নাল বলে, উঠি কেমুন?

অনুফা লাজুক স্বরে বলে, আর একটু বসেন।

আইচ্ছা বসি।

অনুফা উঠে গিয়ে কোত্থেকে যেন চা নিয়ে আসে। সঙ্গে ছোট্ট পিরিচে একটা নিমকি, একটা কালোজাম। নিমকি, কালোজাম এবং চা জয়নাল খায়। না খেলে মনে দুঃখ পাবে। এত কষ্টের পয়সার রোজগার।

ফেরবার সময় হেঁটে হেঁটে অনুফা তাকে অনেক দূর এগিয়ে দেয়। জয়নাল বলে, যাও গিয়া আর আস কেন? ঘর খোলা।

অনুফা উদাস স্বরে বলে, থাকুক খোলা। ঘরে আছেই কী, আর নিবই কী?

অনুফা একেবারে সদর রাস্তা পর্যন্ত আসে। দাঁড়িয়ে থাকে রাস্তার মোড়ে। জয়নাল যতবার ঘাড় ফিরিয়ে তাকায় ততবারই দেখে অনুফা দাঁড়িয়ে আছে। মাথায় ঘোমটা।। অনুফার চোখ বড় মায়াময় মনে হয়। তাকে গৃহস্থ ঘরের বৌয়ের মতোই লাগে। পাড়ার মেয়ে বলে মনে হয় না।

রাস্তার চেংড়া ছেলেপুলেরা অনুফাকে দেখিয়ে অশ্লীল ইঙ্গিত করে। সুর করে বলে, নডি বেডি। ন-ডি- বেডি। অনুফার তাতে কোনো ভাবান্তর হয় না।

জয়নাল অনেকগুলো টাকা খরচ করে ফেলল, নিজের জন্যে চেকচেক শার্ট কিনল। এক জোড়া স্যান্ডেল কিনল। অনুফার জন্যে লাল চাদর। একটা বড় আয়না, অনুফার ঘরে ছোট্ট একটা আয়না সে দেখেছে। বড় আয়না পেলে খুশি হবে। আয়নার সঙ্গে চিরুনি না কিনলে ভালো লাগে না। চিরুনিও কিনল। তার পরেও এক শ টাকার উপর হাত থেকে গেল। এই টাকাগুলো তো খুব বরকত দিচ্ছে। ফুরাচ্ছে না।

মাঝে-মাঝে কিছু টাকা হাতে আসে যেগুলো খুব বরকত দেয়। ফুরায় না। একবার ট্রেন থেকে একটা ছোট্ট মেয়ে হাত নেড়ে তাকে ডাকছিল, এই, এই, এই। সে অবাক হয়ে দ্রুত এগিয়ে গেল। মেয়েটা বলল, মা একে ভিক্ষা দাও।

জয়নাল হাসি মুখে বলল, আম্মাজী আমি ফকির না।

ফকির না হলেও ভিক্ষা নাও। মা একে ভিক্ষা দাও।

ট্রেন তখন ছেড়ে দিচ্ছে। মেয়েটির মা হ্যান্ডব্যাগ খুলে কোনো ভাংতি পাচ্ছেন না। মেয়ে ক্রমাগত মাকে দিল তাড়া। মা দাও না, দাও না? ভদ্রমহিলা শেষ পর্যন্ত অতি বিরক্ত মুখে একটা পঞ্চাশ টাকার নোট বাড়িয়ে দিলেন। ঐ টাকা খুব বরকত দিয়েছিল। কিছুতেই শেষ হয় না। এটা ওটা কত কী কিনল, তার পরেও দেখা গেল পকেটে কুড়ি টাকার একটা নোট রয়ে গেছে। ঠিক করল এই টাকাটা অনুফাকে দেবে। আহা বেচারি কত কষ্ট করছে থাকুক তার হাতের কুড়িটা টাকা।

অনুফা কী ভাবল কে জানে। মেয়ে মানুষের মন অন্যকিছু ভেবে বসেছিল হয়তে। কেঁদে কেটে অস্থির। কিছুতেই টাকা নেবে না। শেষ পর্যন্ত নিলই না। চোখ মুছতে-মুছতে আবার আগের মতো রাস্তার মোড় পর্যন্ত পৌঁছে দিতে এল। রাস্তার বদমায়েশ ছোকরাগুলো আগের মতো চেঁচাতে লাগল, নডি বেডি যায়। নডি বেডি যায়। ছোড়াগুলো বড় বজ্জাত। ইচ্ছা করে এদের চামড়া ছিলে গায়ে লবণ মাখিয়ে রোদে বসিয়ে রাখতে।

জয়নাল অনুফার ওখানে পৌঁছল দুপুরের কিছু আগে। পাড়ার মেয়েদের কাছে আসার জন্যে সময়টা খারাপ। ওরা এই সময় ঘরের কাজকর্ম সেরে ক্লান্ত হয়ে ঘুমায়। রাত জাগার প্রস্তুতি নেয়। অনুফাও হয়তো ঘুমুচ্ছে। কড়া নাড়লে ঘুম ঘুম চোখে দরজা খুলবে। দরজা খুলেই লজ্জিত ভঙ্গিতে বলবে, আপনের শইল এখন কেমুন? পায়ের বেদন কমছে।
 
অনেকক্ষণ কড়া নাড়ার পর যে দরজা খুলল তার নাম অনুফা নয়। এ অন্য একটা মেয়ে। খুবই অল্প বয়স ষোল-সতেরও হবে না। চোখে মুখে এখনো কিশোরীর লাবণ্য। মেয়েটি আদুরে গলায় বলল, এইটা আসবার সময়? তা আসছেন যখন আসেন?

জয়নাল বলল, অনুফা নাই?

ও আচ্ছা অনুফা আফা? না উনি এইখানে নাই। হে তো অনেকদিন হইল ঢাকায়তা ধরেন পাঁচ-ছয় মাস। আসেন না, ভিতরে আসেন। দরজা ধরা মাইনষের সাথে গল্প করতে ভাল লাগে না।

ঢাকায় গেছে কী জইনে?

রোজগারপাতি নাই। কী করব কন? পাঁচ-ছয়জন একলগে গেছে। আমরা ছয়ঘর আছি। আসেন না ভিতরে আসেন। টেকা না থাকলে নাই। চিন-পরিচয় হউক। যেদিন টেকা হইব–দিয়া যাইবেন।

জয়নাল ঘরে ঢুকল। আগের সাজসজ্জায় অনেক পরিবর্তন হয়েছে। এই মেয়েটা সম্ভবত শৌখিন। চৌকিতে ফুলতোলা চাদর। ঘরের মেঝে ঝকঝকে তকতকে। বড় একটা আয়নাও এই মেয়ের আছে।

বসেন। দাঁড়ায়ে আছেন ক্যান? চিয়ারে বসেন।

জয়নাল পুঁটলিটা বাড়িয়ে উদাস গলায় বলল, তুমি এইগুলো রাখ। চাদর আছে। একটা, আয়না চিরুনি আর চাইরটা কমলা।

মেয়েটা দ্বিতীয় প্রশ্ন করে না। জিনিসগুলো এক ঝলক দেখেই পুঁটলিটা চৌকির নিচে রেখে দেয়। সম্ভবত তার মনে ভয় লোকটা হঠাৎ মত বদল করে জিনিসপত্র নিয়ে চলে যেতে পারে।

আমার নাম ফুলি। এই পাড়ায় দুইজন ফুলি আছে। যখন আইবেন–জিগাইবেন ছোট ফুলি। খাড়াইয়া আছেন ক্যান? বসেন। দরজা লাগায়ে দিমু?

না ফুলি আইজ যাই।

এটা কেমুন কথা। যাইবেন ক্যান? আসছেন চিন-পরিচয় হউক।

জয়নাল কথা বাড়াল না। তার মনটা খুবই খারাপ হয়েছে। সে বেরিয়ে এল। এই মেয়েটাও অনুফার মতো সঙ্গে-সঙ্গে আসছে।

জয়নাল বলল, তুমি আসছে ক্যান? তুমি ঘরে যাও।

ফুলি আদুরে গলায় বলল, ভাংতি টেকা থাকলে দিয়ে যান। ঘরে কেরাচিন কিননের পয়সা নাই। হাত একেবারে খালি।

জয়নাল ভেবেই এসেছিল-চকচকে এক শ টাকার নোটটা অনুফাকে দিয়েআসবে। নিতে না চাইলেও জোর করে দেবে। এই মেয়ে নিজ থেকে চাইছে। অনুফার সঙ্গে তার তো তেমন কোন তফাৎ নেই। তাছাড়া এক অর্থে সব মানুষই তো এক। অনুফাকে দেয়া যে কথা এই মেয়েটিকে দেওয়াও তো তাই।।

আফনের কাছে কিছু আছে? চাইর পাঁচ টকা হইলেও হইব। না থাকলে কোনো কথা নাই। চিন-পরিচয় হইল এইটাও কম কথা না।

জয়নাল এক শ টাকার নোটটা বের করল। ছোঁ মেরে ফুলি তা নিয়ে নিল। সঙ্গে-সঙ্গে বেঁধে ফেলল আঁচলের গিটে। মেয়েটি ফিরে যাচ্ছে। জয়নালের সঙ্গে রাস্তার মোড় পর্যন্ত আসার প্রয়োজন তার নেই। এলে জয়নালের ভালো লাগতো। ঝিমধরা দুপুরে একটা মেয়ে মাথায় ঘোমটা দিয়ে রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে আছে। তাকাচ্ছে মায়া-মায়া চোখে, এই দৃশ্য বড়ই মধুর।

ভালো লাগছে না। জয়নালের কিছু ভালো লাগছে না। পায়ের পুরানো ব্যথা ফিরে এসেছে। পূর্ণিমা লেগে গেছে কি-না কে জানে। মনে হয় লেগেছে, নয়ত আচমকা এই ব্যথা শুরু হত না।

জয়নাল রিকশা ডাকল। বুড়ো রিকশাওয়ালা এগিয়ে এল। এই রিকশাওয়ালাকে জয়নাল চেনে, ছমিরুদ্দিন। দুইজনই ভান করল কেউ কাউকে চেনে না। শুধু রিকশা থেকে নেমে দুটাকা ভাড়া দেয়ার সময় জয়নাল বলল, ছমিরুদ্দিন ভাইয়ের শইলডা ভালা?

ছমিরুদ্দিন বলল, ভালা।

আমারে চিনছেন তো? আমি জয়নাল।

চিনছি।

অনুফার খোঁজে গেছিলাম। শুনলাম ঢাকা গেছে।

জানি।

জয়নাল দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলল, অনুফার এই খবর অনেকেই জানে। শুধু সেই জানে না। ঢাকা তো এই স্টেশন দিয়েই যেতে হয়েছে। একবার খোঁজ নেয় নি। সে তো বাধা দিত না। বাধা দেবে কীভাবে? সে বাধা দেয়ার কে? যাবার আগে পরিমলদার দোকান থেকে এককাপ গরম চা খাইয়ে দিত। মালপত্র তুলতে সাহায্য করত। বসার জায়গা করে দিত। ট্রেন যখন ছেড়ে দিত সে জানলা ধরে-ধরে এগিয়ে যেত। এর বেশি আর কী?

এই স্টেশনে কত প্রিয়জনের বিদায় দৃশ্য সে দেখেছে কত মধুর সেই সব দৃশ্য। বিয়ের পর মেয়ে স্বামীর সঙ্গে চলে যাচ্ছে। মেয়ের বাবা মা ভাই বোন এরা সবাই স্টেশনে এসেছে বিদায় দিতে। ট্রেন চলতে শুরু করা মাত্র এরা সবাই ট্রেনের সঙ্গে-সঙ্গে দৌড়াতে শুরু করল। যেন কিছুতেই এই ট্রেনকে তারা চোখের আড়াল করবে না। মেয়ের বৃদ্ধা দাদী তিনিও দৌড়াচ্ছেন। গার্ড সাহেব এই দৃশ্য দেখে বাঁশি বাজিয়ে ট্রেন থামিয়ে দিলেন। গম্ভীর মুখে বললেন, ব্রেকে গণ্ডগোল আছে। এই ট্রেন এক ঘন্টা লেট হবে। আহা এই গার্ড সাহেবের মতো লোক হয় না। এরা আসলে ফেরেশতা। মানুষের সাজ-পোশক পরে ঘুরে বেড়ায়। সবাই ভাবে সেও বুঝি আমাদের মতোই একজন মানুষ।

জয়নাল স্টেশনে গেল না। ওভারব্রিজের উপর চুপচাপ বসে রইল। যত দূরে চোখ যায় লম্বা রেল লাইন চলে গেছে। বড় ভালো লাগে দেখতে। ঐ তো যাচ্ছে ভৈরব লাইনের গাড়ি। কোথায় ভৈরব কে জানে? ভৈরবের পরে কী আছে? একেবারে শেষ মাথায় কোন স্টেশন? এমন যদি হত যে লাইনের কোনো শেষ নেই যেতেই থাকে, যেতেই থাকে তাহলে বেশ হত। শেষ স্টেশনটা কী জানার জন্যে সে উঠে বসতত। চলুক ট্ৰেন, চলতে থাকুক। ঝিক-ঝিক করে গন্তব্যহীন গন্তব্যে যাত্রা।
 
০৫.
জয়নালের মন খারাপ ভাবটা কিছুতেই যাচ্ছে না। ওভারব্রিজের উপর উঠে তা যেন আরো বাড়ল। ওপর থেকে অনেক দূরে চলে যাওয়া রেললাইন চোখে পড়ে। মন আপন থেকে উদাস হয়। তার ওপর অনেক দিন পর বেলায়েতকে দেখা যাচ্ছে। বেলায়েত গান গেয়ে ভিক্ষা করে। তার পাশে বসে থেকে তার মেয়ে আপন মনে খেলে। কখনো ইচ্ছা হলে আচমকা মিষ্টি নিরিনে গলায় বাপের গলার সঙ্গে সুর মেলায়। শুনতে বড় মিষ্টি লাগে। বেলায়েত বেসুরা গলায় মাথা নেড়ে নেড়ে গাইছে…

… দিনের নবী মোস্তফায়
রাস্তা দিয়া হাইট্টা যায়
একটা পাখি সেই সুময়ে
ডাকতে ছিল আপন মনে
গাছের পাতায় গো গাছের পাতায়…।

আজ বোধ হয় বেলায়েতের মেয়ের মনটা ভালো। বাপ থামার সঙ্গে-সঙ্গেই ছোট্ট মাথা দুলিয়ে গেয়ে উঠল…গাছের পাতায় রে গাছের পাতায়।

জয়নাল পাঁচ টাকার একটা নোট থালায় ফেলে দিল। বেলায়েত বিস্মিত হয়ে জয়নালকে এক পলক দেখেই নোট সরিয়ে ফেলল। পাঁচ টাকার নোট একটা পড়ে আছে দেখলে অন্যরা ভিক্ষা দেবে না।

বেলায়েত ভাইরে অনেকদিন পরে দেখলাম। গেছিলেন কই?

শম্ভুগঞ্জ।

শইল ভালা তো?

আল্লায় রাখছে।

শম্ভুগঞ্জে আয় রোজগার কিছু হইছে?

হইছে কিছু।

হইলে মেয়েটারে জামা টামা কিন্যা দেন। শীতের মইদ্যে খালি গাও।

বেলায়েত নিচু গলায় বলল, জামা আছে। সুয়েটারও আছে। খালিগাও থাকলে ভিক্ষার সুবিধা। বেলায়েতের মেয়েটা মুচকি-মুচকি হাসছে। হাতে চারটা কড়ি। কড়ি খেলছে—হিসেব করছে। এই মেয়েটাকে দেখলেই জয়নালের শাহেদার কথা মনে হয়। শাহেদাও বাপজানের পাশে বসে আপন মনে কড়ি খেলত। বেলায়েত এখন যে জায়গায় বসে ভিক্ষা করছে টিনের একটা থালা নিয়ে, ঠিক এই জায়গায় বসতেন বাপজান। ভিক্ষা করতে লজ্জায় তাঁর মাথা কাটা যেত—শুধু তোতাপাখির মত বলতেন,

বাপধন গরিবরে সাহায্য করেন।

বাপধন গরিবরে সাহায্য করেন।

মাঝে-মাঝে বাপজানকে ভেংচি কাটত শাহেদা। অবিকল তাঁর মতো গলায় বলতো—

বাপধন গরিবরে সাহায্য করেন।

বাপধন গরিবরে সাহায্য করেন।

জয়নালের বাবা রাগ করার বদলে হেসে ফেলতেন।

গরমের সময় তারা ঘুমুহতা ওভারব্রিজে। মশা কম, ফুরফুরা বাতাস। শাহেদা বলত, একটা কিচ্ছা কও, বাজান। এই কথাটার জন্যেই যেন অপেক্ষা। বলা মাত্র গল্প শুরু হত। শুরু হত–

কিচ্ছা যত…

মিচ্ছা তত—এই প্রস্তাবনা দিয়ে। মজার মজার সব গল্প। ওভারব্রিজে তাদের সেই জীবন খুব খারাপ ছিল না। বেলায়েত এবং তার কন্যার জীবনও বোধ হয় খারাপ না। আল্লাহতায়ালার বড় একটা গুণ হচ্ছে কাউকে দুঃখ দিলে সমপরিমাণ সুখ দিয়ে তা পূরণ করার চেষ্টা করেন।

জয়নাল বলল, বেলায়েত ভাই—যাই। সন্ধ্যার আগেই মেয়েটারে জামা পরাইয়েন। ঠাণ্ডা লাগলে মুশকিল। এই বচ্ছর শীত পড়ছে বেজায়।

বেলায়েত জবাব দিল না। গানে টান দিল। এইবার নূতন গান—মনে বড় আশা ছিল—যাব মদিনায়।
 
ইস্টিশনে পা দিয়ে জয়নাল হকচকিয়ে গেল। অনেক পুলিশ। রেলওয়ে পুলিশ না। রেলওয়ে পুলিশ আনসারেরও অধম, আসল পুলিশ। জয়নালের বুক ছাঁৎ করে উঠল। তবে প্রায় সঙ্গে-সঙ্গেই আশ্বস্ত হল। তার সামান্য চুরির ব্যাপারে এত পুলিশ আসবে না। অন্য কোন ব্যাপার। জানা গেল হিরণপুর স্টেশনের কাছে মালগাড়ি থেকে দশ বস্তা চিনি চুরির তদন্ত হচ্ছে। দারোগা সাহেব খোঁজ-খবর করতে এসেছেন। আসামীদের একজন ধরা পড়েছে, সে গৌরীপুর স্টেশনের নম্বরী কুলি। ওসি সাহেবের ধারণা অন্যদেরও যোগ থাকতে পারে। সবাইকেই জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে।

জয়নালকেও জিজ্ঞাসাবাদের জন্যে ডাকা হল। রেলওয়ে পুলিশের ছোট ঘরে এক-এক করে ডাকা হচ্ছে, এবং জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। এ কী যন্ত্রণায় পড়া গেল। পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদের নমুনা সে জানে। পুলিশ আদর করে কখনো কিছু জিজ্ঞেস করে না। প্রশ্ন করার আগে পেটে রুলের একটা গুঁতা দেয়। প্রশ্ন শেষ হলে আরেকটা দেয়। কে কী বলল, না বলল তাতে কিছু আসে যায় না। সত্যি বললেও গুঁতা মিথ্যা বললেও গুঁতা।

ওসি সাহেব বললেন, তোমার নাম জয়নাল না?

জয়নাল ওসি সাহেবের স্মৃতিশক্তি দেখে মুগ্ধ হয়ে গেল। সেই কবেকার কথা এখনো মনে আছে। এই না হলে থানার ওসি।

জয়নাল নাতোমার নাম?

জ্বি, স্যার।

ওয়াগনে লুটের সময় তোমার সাথে আর কে কে ছিল?

জয়নাল বিনয়ে ভেঙে পড়ে বলল, হুজুরের যখন আমার নামটা স্মরণ আছে তখন আমার পাওডার অবস্থাও নিশ্চয়ই স্মরণ আছে। এই পাও নিয়া আমি ওয়াগন লুট। করতে পারলে তো কামই হইছিল। হুজুর পাওডার অবস্থা নিজের চোখে দেখেন।

জয়নাল লুঙ্গী সরিয়ে পা দেখাল। তাতেও ওসি সাহেবের বিশেষ ভাবান্তর হল না। তিনি কঠিন গলায় বললেন, লুটের মালের ভাগ তো ঠিকই পাইছস। নূতন শার্ট নূতন স্যান্ডেল।

এইগুলো হুজুর বকশিশের টেকায় কিনা। বকশিশের টাকা?

জ্বি, হুজুর। আপনে মা-বাপ, আপনের কাছে মিথ্যা বইল্যা লাভ নাই। এক প্যাসেঞ্জারের ছোড বাচ্চা কানতেছিল। তার দুধের জন্যে গরম পানি আইন্যা দিলাম। বাচ্চার মা খুশি হয়ে এক শ টেকা বকশিশ করল।

এক শ টাকা বকশিশ?

বড়লোকের কারবার। টেকা পয়সা এরার হাতের ময়লা। আমার কথা যদি হুজুরের বিশ্বাস না হয় কোরান শরীফ আনেন। মাথার উপরে কোরান শরীফ রাইখ্যা তারপর বলব।

আচ্ছা যা ভাগ।
 
স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে জয়নাল বের হল। বিরাট বড় একটা ফাঁড়া কেটেছে। আরেকটু হলে ফেঁসে গিয়েছিল।

ওসি সাহেব যদি বলতেন কার কাছ থেকে গরম পানি আনলে? তাহলেই সর্বনাশ হয়ে যেত। মিথ্যা কথা বেশিক্ষণ বলা যায় না। একের এর এক মিথ্যা বলতে থাকলে জিয়া ভারী হয়ে যায়। তোতলামি এসে যায়। একবার তোতলামি এসে গেলে আর দেখতে হত না। জয়নাল বজলুকে খুঁজে বের করল। কী অদ্ভুত ব্যাপার। সে তাকে যেখানে বসিয়ে রেখেছিল সেখানেই বসে আছে। গাধা না-কি ছেলেটা? এই ছেলে টিকবে কী করে? এর কপালে দুঃখ আছে।

কিছু খাইছ? ঐ বজলু।

না।

খাস নাই ক্যান?

বজলু মাথা নিচু করে আছে। তার বগলে ভাঁজ করা কম্বল। কম্বল সে হাতছাড়া করে নি। তাকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে জীবন দিয়ে দেবে তবু সে কম্বল দিবে না।

টেকা তো একটা তোরে দিছিলাম। বলছিলাম কী? এক ছটাক বাদাম কিন্যা দুই গেলাস পানি খাইলে ক্ষিধা শেষ। বাদাম কিনলি না ক্যান।।

বজলু কিছু বলল না। তবে এখন তার চোখ চকচক করছে। মনে হচ্ছে জয়নালকে আবার দেখতে পেয়ে তার বুকে হাতির বল ফিরে এসেছে। জয়নালকে সে দেখতে পাবে এই আশা সে প্রায় ছেড়েই দিয়েছিল। অনেকক্ষণ ফুপিয়ে কেঁদেছেও অজানা সব দুঃশ্চিন্তাতে সে অস্থির ছিল। ক্ষিধের কথা তার মনেই হয় নি। এখন ক্ষিধেয় চোখ অন্ধকার হয়ে আসছে।

চল যাই—ভাত খাই। আইজের দিন যত মন চায় খাইবি। কাইল থাইক্যা ঠনঠঠন।

বজলু ক্ষীণ স্বরে বলল, আফনেরে খুঁজতেছে।

কে খুঁজতেছে?

হাশেম। সর্দার হাশেম।

তুই চিনস তারে?

জ্বি।

আমারে খুঁজে ক্যান। বিষয় কি? কিছু কইছে?

না।

কিছুই কয় নাই?

না।

জয়নালের মন আবার অস্বস্তিতে ভরে গেল। কিছু কি টের পেয়েছে? ইস্টিশনে। থাকাও এক যন্ত্রণা। দুশ্চিন্তায় জয়নাল খালোমলত খেতে পারল না। বজলু খুব আরাম করে খাচ্ছে। অনেকদিন পর এই প্রথম বোধ হয় ভাত খাওয়া। কেমন চেটে পুটে খাচ্ছে।

আর চাইটা ভাত নিবি?

না।

শরম করিস না। ক্ষিধা থাকলে ক। দিব আর এক হাফ?

জ্বি।

আরে ব্যাটা, তুই জ্বি কোনখানে শিখলি? কথায় কথায় জ্বি। ইসকুলে পড়ছস? বজলু হা-সূচক মাথা নাড়ল।

কোন কেলাসে ছিলি?

ফোর।

ইসকুলে পড়তে মন চায়?

জ্বি।

মন চাইলেই তো আর হয় না ব্যাটা। ভাইগ্যের ব্যাপার। ভাইগ্যে থাকলে হয়। না থাকলে হয় না। এই সব নিয়া মন খারাপ করিস না। পেট ভইরা ভাত খা। এই পুলারে আর এক হাফ ভাত দেও। ডাইল দেও। বজলু কাঁচামরিচ দিয়া ডলা দে।

স্টেশনে ফিরে জয়নাল ভয়াবহ সংবাদ পেল। পুলিশ পাঁচজনকে ধরে নিয়ে গেছে তার মধ্যে একজন হচ্ছে মালবাবু। কী সর্বনাশের কথা। পুলিশ হাশেমকেও খুঁজছে। হাশেম পলাতক। পুলিশের এসপি এসেছেন ময়মনসিংহ থেকে। জেলা পুলিশের বড় কর্তা। এদের দেখতে পাওয়া ভাগ্যের কথা। স্টেশন মাস্টারের ঘরে তিনি বসে আছেন। জয়নাল এক ফাঁকে জানালার ফাঁক দিয়ে দেখে এল। দেখতে ভদ্রলোকের মতো—চুক চুক করে চা খাচ্ছেন।

জয়নাল বজলুকে উঁচু করে দেখাল। ছেলেমানুষ দেখতে না পেলে মনে একটা আফসোস থাকতে পারে। একজন কনস্টেবল ছুটে এসে বলল, ভিড় করবেন না খবৰ্দার। জানালার কাছ থেকে সরতে মন চাচ্ছে না। এসপি সাহেব এখন কি সুন্দর রুমাল দিয়ে ঠোঁট মুছছেন। এই দৃশ্য দেখার ভাগ্য কয়জনের হয়।
 

Users who are viewing this thread

Back
Top